০১. প্রথম খেলা

১. প্রথম খেলা

দুটি স্কুলের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ। খেলা এইবার শুরু হবে। আগন্তুক স্কুল দলের ফাস্ট বোলার উইকেট থেকে পা মেপে অনেক দূরে গিয়ে দাগ কাটল। জবরদস্ত বোলার, তাতে আর সন্দেহ নেই। ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর ছুটতে ছুটতে এসে বল করল। বিদ্যুৎগতি বল। ব্যাটসম্যান পলক ফেলার আগেই একটা স্টাম্প সামারসল্ট নিয়ে হাঁফ ছাড়ল।

পরের ছেলেটি এল ব্যাট করতে। ছেলেটি গার্ড নিচ্ছে, বোলার অধৈর্য হয়ে বলটা লোফালুফি করছে এ-হাত ও-হাতে। তারপর আবার সেছুটে এল বল হাতে, আর একবার আম্পায়ারের আঙুল আকাশমুখো হল আউটের সংকেত জানিয়ে।

ছাত্র-দর্শকদের মুখ আমশি হয়ে এল। হ্যাটট্রিক করবে নাকি? পরের ছেলেটি ব্যাট করতে নামছে। তাকে দেখে কারুর সন্দেহ রইল না আর—হ্যাটট্রিক হবেই। অ্যাত্তোটুকু এগারো বছরের টিংটিঙে, এখানকারই এক ছুতোরের ছেলে। বাওরাল ইন্টারমিডিয়েট হাই স্কুলের এই ছাত্রটি যে আগে কখনো ক্রিকেট ম্যাচ খেলেনি, একথা স্কুলের সব ছেলেই জানে। সুতরাং হ্যাটট্রিক অবধারিত। তাই নয়, বড়ো বড়ো ছেলেদের ব্যাট বহন করা ছাড়া ছেলেটি জীবনে কখনো ব্যাটও ধরেনি। খেলার অভিজ্ঞতা বলতে গাছের ডালের ব্যাট নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছু নেই।

ছেলেটির নাম ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।

বস্তুত অন্য ছেলেদের খেলা দূর থেকে দেখে সেযতটুকু বুঝেছে, তার বেশি আর কিছু ধারণা ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে তার ছিল না। যে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে, সেখানে কোনো খেলার পাট ছিল না। এখন যে আপার স্কুলে পড়ছে, সেখানেও প্র্যাকটিসের জন্য ব্যাট, স্টাম্প মেলে না, ক্রিকেট পিচও নেই। এসব ১৯১৯ সালের অস্ট্রেলিয়ার কথা। ওই বছরই প্রথম মহাযুদ্ধ থামল, ওই বছরই এরোপ্লেনে সরাসরি প্রথম আটলান্টিক পার হয় অ্যালকক এবং ব্রাউন।

ডনকে খেলতে নেওয়া হয়েছে তার কারণ আট মাইল দূরে স্কুলটার সঙ্গে এই ম্যাচের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। সেটা অবশ্য বোঝাই যাচ্ছে। কেননা, বাওরালে একমাত্র যে ভালো পিচটা আছে, খেলাটা সেখানে না হয়ে হচ্ছে ফুটবল মাঠে। মাঠে ঘাসের একটা শিষও নেই; শুধুই ধুলো।

ডন গার্ড নিল। বোলার ছুটতে শুরু করল। বল করল। সেই একই বল যা আগের দুজনকে আউট করেছে। স্থির চোখে ডন বলটাকে লক্ষ করে এক পা পিছিয়ে এসে ব্যাট পাতল। বল ব্যাটে লেগে পায়ের কাছে মাটিতে ঢলে পড়ল।

হ্যাটট্রিক হয়নি। দর্শকরা চোখ কচলে মাঠের দিকে তাকাল। বোলারের চোখ-মুখে হতাশা, বিরক্তি, রাগ। হ্যাটট্রিকটা হল না এই হতচ্ছাড়ার জন্য। রাগে গরগর করে এবার সেআরও জোরে বল দিল। ডন এবার ক্রিজ থেকে বেরিয়ে হাঁকড়ে ব্যাট চালাল। মারটা অবশ্য কেতাবে মিলবে না, কিন্তু কাজের মার। চারটে রান এর থেকে ডন পেয়ে গেল।

বোলারটি যতভাবে সম্ভব চেষ্টা করেও পেরে উঠল না। নতুন ছেলেটি মাঠের সর্বদিকে ঠেঙিয়ে বল পাঠাচ্ছে। ওর ব্যাট ধরা গ্রিপটি একটি অদ্ভুত রকমের, খেলার স্টাইলও ভালো, কোচেরা যেরকমটি শেখান সেরকম নয়। কিন্তু তাতে কী যায় আসে! ছেলেটি নিজের ওপর যেরকম আস্থা নিয়ে আর নিশ্চিত ভঙ্গিতে খেলে যাচ্ছে, তাতে ওকে ক্রিকেটারের মতোই দেখাচ্ছে; এবং রানও পেয়ে যাচ্ছে।

এবার বোলার বদল করা হল। প্রথম বোলার যে ভগ্নহৃদয় হল ডন ব্র্যাডম্যান দ্বারা। ডনের স্কোর বাড়ছে। অন্য প্রান্তে ব্যাটসম্যানরা আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। ডন রয়ে গেল। যখন খেলা শেষ হল তখন সে৫৫ নট আউট।

ডনের ক্রিকেট জীবন শুরু এই খেলা থেকে। ডি জি ব্র্যাডম্যান (‘জি’ হচ্ছে জর্জ) নামটা এই প্রথম স্কোর বুকে লেখা হল। সেদিন যারা মাঠে ছিল তাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না এই ধুলো-ভরতি ফুটবল মাঠটা একদিন তকতকে সবুজ ক্রিকেট মাঠে রূপান্তরিত হয়ে নাম নেবে ব্র্যাডম্যান ওভাল।

কারুর পক্ষে সেদিন ভবিষদবাণী করাও সম্ভব ছিল না একদিন ডন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটের প্রতিভারূপে স্বীকৃত হবে; এক দশকেরও বেশিকাল অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব এবং তার দ্বিগুণ সময়কাল ধরে ক্রিকেটের ওপর আধিপত্য করবে; সংগ্রহ করে জড়ো করবে ব্যাটিং রেকর্ড, যা বিশ্লেষিত ও আলোচিত হবে যতদিন পৃথিবীতে ক্রিকেট খেলা হবে।

সেদিন যারা মাঠে ছিল তারা কী করেই-বা বুঝবে, ব্র্যাডম্যান নামটা একদিন পৃথিবীতে বিখ্যাত ও সম্মানিতদের অন্যতমরূপে গণ্য হবে; গ্রাম্য ছুতোরের ছেলেটি রাজরাজড়া, প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবে; নাইট হয়ে স্যার খেতাব পাবে এবং টুরিস্টরা অ্যাডিলেডের অন্যতম দ্রষ্টব্যরূপে তার বাড়িটিকে গণ্য করবে।

এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই হয়েছে। অসুস্থতা তার খেলার জীবনকে পঙ্গু করলেও, অত্যধিকরূপে সফল লোকেদের বিরুদ্ধে যেরকম ঈর্ষাকাতর বিষাক্ত সমালোচনা হয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে সেরকম হওয়া সত্ত্বেও, ব্র্যাডম্যান টেস্ট ক্রিকেটে প্রতি তিন বার ক্রিজে গিয়ে একটি করে সেঞ্চুরি করেছে। চার রানের জন্য তার টেস্ট গড় ১০০ হতে পারেনি, কিন্তু তাতে কীই-বা আসে যায়! ডন যখনই ব্যাট করে তখন হুড়হুড় করে লোক টিকিট কেটে মাঠে ঢুকেছে। যে ম্যাচে খেলেনি, লোকেও সে-খেলা দেখতে আসেনি। ক্রিকেটে খুব বেশি আগ্রহ নেই এমন লোকেদের কাছেও নায়কের শ্রদ্ধা পেয়েছে। ক্রিকেট দুনিয়াকে সেবেঁধেছিল একই বঁাধনে— তার খেলার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলে। ভারতে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজে, নিউজিল্যাণ্ডে, ইংল্যাণ্ডে এবং অস্ট্রেলিয়াতে সর্বত্রই ডন ছিল খবর।

বিরাট বিরাট রান করে সেক্রিকেটের প্রকৃতিটাই বদলে দেয়। ব্র্যাডম্যান-পূর্ব আমলে ক্যাপ্টেনরা ফিল্ড সাজাতেন এবং বোলাররা বল করতেন উইকেট লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্র্যাডম্যান আসার পর তাঁরা মনোনিবেশ করলেন রান ওঠা কমাবার চেষ্টার দিকে, আউট করার দিকে নয়। এই পরিবর্তনে খেলা মন্থর হয়ে পড়ে। অন্যদের মতো ডনও এতে ব্যথিত হয়।

এগারো বছর বয়সে ক্রিকেটে ডনের নাটকীয়ভাবে প্রবেশের পিছনে যে-জিনিসটি কাজ করেছে, সেটি হল তার নি:সঙ্গতা।

নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনির প্রায় দুশো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুটামুন্ড্রা নামে একটা গ্রামে ১৯০৮-এর ২৭ আগস্ট ডনের জন্ম। যখন তার বয়স তিন, তাদের পরিবারটি চলে আসে সিডনির ৮০ মাইল দক্ষিণে, প্রায় তিন হাজার লোকের বাস বাওরাল নামে এক গ্রামে। কুটামুন্ড্রা ও বাওরাল কৃষি অঞ্চলের গ্রাম।

ডন তার পরিবারে কনিষ্ঠতম সন্তান। বাবা জর্জ ব্র্যাডম্যান, মা এমিলি, তিন দিদি আইলেট, লিলি এবং মে; দাদা ভিক্টর ডনের ঠিক উপরে, চার বছরের বড়ো। ওদের বাড়ির কাছাকাছি ডনের সমবয়সি কোনো ছেলে ছিল না, ফলে স্কুলের সময় ছাড়া ডনকে বাকি সময় একাই কাটাতে হত।

তার বাবা, দাদা এবং দুই মামা ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন। ক্রিকেটের প্রতি আসক্তিটা ডন এঁদের কাছ থেকেই পায়। কিন্তু তাঁদের এমন সামর্থ্য ছিল না যে, ডনকে ক্রিকেটের সরঞ্জাম বা খেলা শেখার বই কিনে দিতে পারেন।

তাই ডনের সময় কাটানোর উপায় ছিল একা একা ক্রিকেট খেলা। খেলাটা নিজেই বার করেছিল।

বাড়ির পিছনে ইটের দুটো ছোটো থামের ওপর একটা ৮০০ গ্যালনের বড়ো জলের ট্যাঙ্ক ছিল, তার তিন দিকে গোলাঘরের দেওয়াল। উপরে ছাদ, বর্ষা হলেও খেলা যেত। একটা পুরোনো গলফ বল দেওয়ালে ছুড়ত, দেওয়াল থেকে ফেরার সময় ডন বলটাকে একটা ছোটো ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মারার চেষ্টা করত। ইটের দেওয়ালে ছোড়া গলফ বল খুব জোরেই ফিরে আসে। সুতরাং ডন যা করার চেষ্টা করত, সেটা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু দিনের পর দিন চেষ্টা করে নি:সঙ্গ ডন এই খেলায় সড়োগড়ো হয়ে ওঠে।

তিন দিকে দেওয়াল এক দিকে খোলা, তাই লেগের দিকে ঘুরিয়ে যতদূর সম্ভব ততদূরে বল মারতে পারত। একা একাই ডন ম্যাচ খেলত আর দলের এগারো জনের প্রত্যেকের হয়ে ব্যাট করত। দলে থাকত তার হিরোরা, অস্ট্রেলিয়ার সেই আমলের ক্রিকেট তারকারা : চার্লি ম্যাকার্টনি, জনি টেলর, জ্যাক গ্রেগরি, কলিন্স প্রভৃতিরা।

দেওয়ালে বল মেরে খেলায় পোক্ত হয়ে যাওয়ার পর ডন খেলাটাকে আরও কঠিন করার একটা উপায় বার করে। বাড়ির কাছে লোহার রেলিং-ঘেরা একটা ছোটো গোচারণ ভূমি ছিল। গলফ বলটাকে সেতিরিশ বা চল্লিশ ফুট দূরে থেকে রেলিংয়ে ছুড়ত আর ফিরতি বলটাকে লোফার বা মারার চেষ্টা করত। এজন্য প্রচন্ড নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে তাকে ছুড়তে হত, যাতে বলটা তার দিকেই আসে; বলটা যখন আচমকা সামনের দিক থেকে আসে, তখন সেটা লোফার জন্য তীক্ষ্ণ আন্দাজ করতে ও শরীরটাতে লহমায় গতিসঞ্চার করতে হত।

ডন নিছকই পরিবেশের চাপে, চোখ ও কবজিকে প্রশিক্ষিত করার, সময়বোধ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংযুক্ত চালনা নিখুঁত করে তোলার অদ্ভুত এক পদ্ধতি বার করে ফেলে। সন্দেহ নেই, বাওরালে বাড়ির পিছনে ডন যে-দক্ষতা অর্জন করে, তার সঙ্গে তার মেধা এবং একাগ্রতা যুক্ত হয়ে তাকে ক্রিকেটের সবথেকে ওস্তাদ ব্যাটসম্যানে, নিরাপদতম ফিল্ডারদের একজনে পরিণত করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *