১১. অন্য খাবার: কেয়ার অফ কলকাতা

অন্য খাবার: কেয়ার অফ কলকাতা

অন্য খাবার। সত্যিই অন্যরকম। সবসময় নামী পরিচিত দোকান বা হোটেল রেস্তোরাঁ নয়, এরকম কত যে চেনা অচেনা খাবারের ঠিকানা মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে রয়েছে এ শহরের ফুটপাতে, ছোট ছোট হোটেলে, দোকানে, রাস্তার ধারে স্টলগুলোয়, তার ইয়ত্তা নেই। তাদের সবাইকে যে হাতের মুঠোয় ধরতে পেরেছি এরকম অসম্ভব দাবি করব না কখনওই। তবু যেটুকু পেরেছি তাই বা কম কী? সেইসব জানা অজানা রত্নভাণ্ডারগুলো থেকে খানিকটা নয় আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগই করে নিলাম। ক্ষতি কী?

‘ঝাল চানাচুর টাটকা হলে মুখের কথা বলা বন্ধ হয়…।’ সেই নব্বইয়ের দশকে লেখা অমোঘ এই গানের লাইনটা। একশো শতাংশ সত্যি। আজও। মুখের কথা বন্ধ করে দেবার মতো কয়েকটা চানাচুরের ঠিকানা আজও রয়েছে এই তিনশো টপকানো শহরে। মানিকতলার মোড়ে ছায়া সিনেমার গায়ে মোহন সাউয়ের দোকান। ঝাল, মাঝারি ঝাল, কম ঝাল, টকমিষ্টি …অজস্র ধরনের চানাচুর, চিপস, কচুভাজা, গাঁঠিয়া, ঝুরিভাজা আর ভুজিয়া পাওয়া যায় এ দোকানে। তবে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ডালমুট। চিপস, গাঁঠিয়া, বাদামের অনধিকার প্রবেশ নেই। স্রেফ ঝালঝাল মশলায় চান করা, ছাঁকা তেলে ভাজা, সোনার বরন মুচমুচে কুড়মুড়ে ছোলার ডাল। অপেক্ষা করে রয়েছে আপনার জন্য কাচের বয়ামে। ওপরে সামান্য পাতিলেবুর রস দু’-চার ফোঁটা, একচিমটে বিটনুন, ঠোঙাটা একবার ঝাঁকিয়ে নেওয়া ভাল করে… ব্যস! শুরু হয়ে গেল ঠাকুমার ঝুলি কিংবা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড! স্ন্যাকস আর টিটবিটস্ সর্বস্ব শহরে মোহন সাউ অ্যান্ড সন্স আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রায় বিলুপ্ত হতে বসা এই ডালমুট নামক সভ্যতা ও তার দলিল-দস্তাবেজকে। কতদিন পারবেন জানা নেই। তাই আজ যাচ্ছি, কাল যাব করলে শেষমেশ হয়তো হতাশ হতে পারেন। সুতরাং চটজলদি পৌঁছে যান মানিকতলার মোড়ে। এক ঠোঙা রূপকথা কিনে আবেশে আধবোজা চোখে চিবোতে চিবোতে হাঁটা লাগান শেয়ালদামুখো। পরের স্টপেজ শ্রীমানি বাজার। শ-দেড়েক বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়া এই বাজারের নীচে, সুকিয়া স্ট্রিটের ওপর তেলেভাজার দোকান। আলুর চপের মধ্যে পুরটা যদি ঠিকঠাক না হয় তা হলে চপের মজাটাই মাটি। কলকাতার বহু দোকানেই এই পুরটা ঠিকঠাক বানাতে জানে না। শ্রীমানি মার্কেটের আলুর চপ খেলে বুঝতে পারবেন আলুর সঙ্গে সঠিক মশলার মিশেল এই স্বাদকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আলুর চপের পাশাপাশি একই আসনে বসার যোগ্য এদের ধোঁকা আর বেগুনি। ওপরে পোস্ত ছেটানো মুচমুচে বেসনের আস্তরণ। ভেতরে ঢাকাই মসলিনের চাইতেও পাতলা করে কাটা লম্বা বেগুনের ফালি, যে শিল্পকর্ম অনেক নামী পাঁচতারা হোটেলের শেফদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে। একমুঠো মুড়ির সঙ্গে বর্ষাকালে… নাঃ থাক। লেখা গুলিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর বাকি রইল ধোঁকা। আধবাটা আর ফেটিয়ে ফেটিয়ে পেঁজা তুলোর মতো করে ফেলা ছোলার ডালে তৈরি হবে এই অসামান্য পদটি। ভাজা মৌরির মনোরম সুগন্ধ। ওপরটা অমসৃণ। দাঁতের চাপে ভেঙে কুচিকুচি মুড়মুড়ে ডালের কণা… বাকিটা পল সাইমনের ‘সঙ অফ সাইলেন্স!’ সন্ধের মুখে গেলে দেখবেন রামমোহন রায় রোড, দিনেন্দ্র স্ট্রিট, গলি গড়পার, হরিনাথ দে রোড, পীতাম্বর ভটচাজ লেন, বাদুড়বাগান, যুগিপাড়া, বৃন্দাবন মল্লিক লেন, ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন স্ট্রিট, কালু ঘোষ লেন, বলদেপাড়া… পাড়ার গিন্নিরা এসে ঠোঙায় করে ধোঁকা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। রাতে ডালনা হবে। ঘি, গরম মশলা আর সামান্য হিং দিয়ে। বেটার হাফের যদি রান্নার তাগবাগ থাকে তা হলে একঠোঙা কিনে নিয়ে সোজা পৌঁছে যান বাড়ি। ছুটিছাটার দিনে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের নেমন্তন্ন করে সত্যি সত্যিই ধোঁকা খাইয়ে দেওয়া যাবে।

তেলেভাজার দোকানের ঠিক উলটোফুটেই নন্দলাল ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স। নামজাদা সব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশে নামটা একটু মলিন হয়ে গেছে ঠিকই তবে উত্কৃষ্টতা আর গুণমানে কখনওই নয়। সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন। এখানে আপনার পছন্দের আইটেম হোক হিংয়ের কচুরি, সঙ্গে পাঁচফোড়নের সুগন্ধি মেশা নিরামিষ আলু কুমড়োর লাবড়া। শেষ পাতে রাজভোগ অথবা কমলাভোগ। ভেতরে ছোট্ট এতটুকু একটা তুলতুলে নরম ক্ষীরের পুর। আর কোনও বিশেষণের প্রয়োজন নেই। তবে সেরা মিষ্টির দোকানগুলোর তালিকায় মুহূর্তের মধ্যে আর একটা নাম যে যোগ হয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত। হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

এই দেখুন চানাচুর দিয়ে শুরু করে এ কোথায় চলে এলাম। তবে এরকম বারবারই হবে। প্রতিবেদনের শিরোনাম যেহেতু ‘অন্য খাবার’, তাই অন্যরকম একটা ছকভাঙা কায়দাই চলবে। ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাবে, চেনা রুট বদলে যাবে বারবার। কিচ্ছু করার নেই। সুকিয়া স্ট্রিট থেকে ফের শেয়ালদামুখো এগোলে শ্রীমানি বাজারটা যেখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার গা ঘেঁষে বাদুড়বাগান লেন। এখানেই একদম গলির মুখেই ছিল তিনকড়ি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ছিল মানে এখন আর নেই। তিনকড়ি মানে শুধুই কড়াপাকের সন্দেশ। আর কিচ্ছু না। বেশি নয় মাত্র আট দশ রকমের মিষ্টান্ন পদ। সব কড়াপাক। তার মধ্যে গোল মন্ডা, বরফি, গুঁজিয়া, আতা আর আম সন্দেশের স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে। বিজয়া দশমী, লক্ষ্মী পুজো আর ভাইফোঁটার দিন তৈরি হত চন্দ্রপুলি আর রাতাবি সন্দেশ। তিনকড়ি স্পেশাল। প্রতিদিন সন্ধে ছ’টা-সাড়ে ছটার মধ্যে শোকেস খালি। এলাকায় এতটাই চাহিদা ছিল তিনকড়ির মিষ্টির। শুধুমাত্র কড়াপাক সন্দেশের দোকান। শুধু কলকাতা নয় গোটা রাজ্যে আর কোথাও আছে অথবা ছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই। ষাটের দশকের শেষভাগে বন্ধ হয়ে যায় তিনকড়ি। এখানেও কারণ বাঙালির সেই চিরন্তন ব্যাধি: শরিকি বিবাদ।আজও যদি ওই এলাকায় প্রবীণ মানুষদের এ ব্যাপারে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেন তা হলেই তিনকড়ি উঠে যাওয়ার হা-হুতাশটা ভালরকম অনুভব করবেন। নিশ্চিত এ ব্যাপারে।

তিনকড়ির প্রায় গা ঘেঁষেই হিন্দুস্থানি চানাচুর ভুজিয়ার দোকানটা। নামগোত্রহীন। দাঁড়িয়ে পড়ুন দোকানের সামনে। লম্বাটে একটা টিনের একদিক খোলা পাত্রে থরে থরে সাজিয়ে রাখা জুঁইফুল রঙা সাদা ছাঁকা তেলের চিঁড়েভাজা। ওপর থেকে ফোকাস মারছে তিনশো ওয়াটের একটা সি এফ এল লাইট (আগে বাল্‌ব জ্বলত)। চিঁড়েভাজার রঙটা জুঁইফুলের মতো লিখলাম বটে, আসলে ওটা হবে কুমোরটুলি থেকে সদ্য নিয়ে এসে মণ্ডপে অথবা বাড়িতে বসিয়ে দেওয়া বীণাপাণি ঠাকরুনের গাত্রবর্ণের মতো। সঙ্গে কারিপাতা, কড়া ভাজা বাদাম, ঝুরিভাজা আর একচিমটে বিটনুনের সঠিক মিশেল। চাইলে দোকান থেকে সেলোফেনের প্যাকেটে ভরে মোমবাতির আগুনে প্যাক করে দেবে কিন্তু আপনি ঠোঙাতেই নিন। তখনই খাওয়া শুরু করবেন না, প্লিজ। ঠোঙা হাতে ট্রামলাইন পেরিয়ে এপারে আসুন। সামনেই বিন্তুদের বাড়ির রোয়াক। পাড়ার বাকিগুলো সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে কবেই হারিয়ে গেছে। বিন্তুদেরটা কিন্তু টিকে আছে আজও। এই ছোট্ট একফালি রোয়াক জুড়ে কত স্মৃতি। বাড়ির সামনে হারিয়ে যাওয়া পাড়ার ছোট্ট পার্ক। কুমিরডাঙ্গা, চোর চোর… একটু বড় হয়ে চার দশ হাইটের ফুটবল। বিন্তু দুরন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ড। কাইজার স্ট্রিটের রেলমাঠে দ্রোণাচার্য বাঘা সোমের প্রিয় ছাত্র। পাড়ায় সবাই বলত বড় হয়ে ইন্ডিয়া খেলবে। একদিন মাঝরাত্তিরে গলায় দড়ি বেঁধে সিলিংয়ে ঝুলে গেল। বিন্তুদের দোতলায় ছোনুদা, পিন্টুদা, তপুদি… ছোনুদা স্কটিশ চার্চ স্কুল থেকে ন্যাশনাল স্কলার হয়েছিল। এখন ঘোর অপ্রকৃতিস্থ। একগাল সাদা দাড়ি। সারাদিন উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় আর ফিজিক্সের থিয়োরি আওড়ায়। মেজ ভাই পিন্টুদা। সত্তরের দশকে পিন্টুদার খোঁজে এলাকার পর এলাকা তোলপাড় করে ফেলেছিল গোটা উত্তর কলকাতার ছ’-সাতটা থানার পুলিশ। বীরভূমের কোনও একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ধরা পড়ে বছর সাতেকের কারাবাস। ঘেঁটে যাওয়া জীবনটা আর ঠিকঠাক হয়নি কখনওই। ছোট বোন তপুদি। বাগবাজারে ডাকের সাজের দুগ্গাঠাকুর দেখেছেন কখনও? তপুদিকে দেখতে হুবহু ওইরকম। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড দাপট আর প্রখর ব্যক্তিত্ব। লাল স্কার্ট আর সাদা শার্ট পড়ে দুটো কলাবিনুনি দুলিয়ে যখন ব্রাহ্ম গার্লসে যেত, পাড়ার সব লক্কার দল রক থেকে বেমালুম হাওয়া। পাড়ায় সমবয়সি বন্ধুদের রক্ষাকবচ ছিল তপুদি। এই অধমকে খুব ভালবাসত। মণিমেলার পিকনিকে চূড়ান্ত অবাধ্য আর ভয়ংকর রকম ব্যাদড়া এই এতটুকু একটা ছেলেকে ধমকে ধামকে জোর করে খাইয়ে দেবার দায়িত্বটা সর্বদাই বর্তাত তপুদির কাঁধে। সেই তপুদি শেষমেশ কিনা সাধিকা হয়ে গেল। পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ইয়া লম্বা সিঁদুরের টিকা কপালে। প্রতিদিন প্রচুর ভক্তসমাগম হয় বাড়িতে। কী একটা মা নামে যেন তপুদিকে ডাকে ভক্তরা। অবাক হয়ে মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে তপুদিকেই ডেস্টিনি এরকম একটা অবস্থানের জন্য নির্বাচিত করল!

যাকগে, হটান এসব পুরনো কথা। ফুটপাত পেরিয়ে সোজা হয়ে এসে বসে পড়ুন বিন্তুদের রোয়াকে। ভয় নেই, উত্তর কলকাতার রোয়াকে এখনও অচেনা কেউ এসে বসলে বাড়ির লোকেরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় না। তাই জুত করে বসুন। ঠোঙা খুলে তারিয়ে তারিয়ে খান দুনিয়ার সেরা চিঁড়েভাজা। কোনও নামী ব্র্যান্ডের ঝলমলে প্যাকেজিং বা অমুক তমুক ভুজিয়াওয়ালার দোকান এর ঠিকানা দিতে পারবে না। রোয়াকে বসেই খান, কারণ আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে একটা বাচ্চা ছেলে এই রোয়াকে বসেই তার বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খেত দুনিয়াসেরা এই চিঁড়েভাজা। বিন্তুদের রোয়াকে বসে খেলে স্বাদটা যে আরও কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

একটু এগিয়েই রাজাবাজার। রাস্তার ওপর দাঁড়ানো সার সার ঘোড়ার গাড়ি। মোড়ের ওপর সস্তা মুসলমান হোটেল। সামনে লম্বাটে মাটির উনুনে কুচো কয়লার গনগনে আঁচে ঝলসানো হচ্ছে শিককাবাব। মশলা মাখানো আধপোড়া মাংসের সুবাসে ম ম করছে চারপাশ। দাম মাত্র সাত পয়সা। সেটা সত্তর কি একাত্তর সাল। মনে আছে প্রথম নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণের জিভেখড়ি এখানেই। তখন নিয়মভঙ্গের পর্ব চলছে চারদিকে। এতদিনে অনেককিছু পালটেছে। সেই টালি খোলার দোকানের সামনে আজ ঝকঝকে গ্লো-সাইনবোর্ড। কাবাবের দাম সাত পয়সা থেকে বেড়ে আট টাকা। তবু সেই নিয়মভঙ্গের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে হোটেলটা।

উত্তরের মায়া কাটিয়ে চলুন এবার যাওয়া যাক মধ্য কলকাতায়। লেনিন সরণি ধরে সোজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের মোড়। হাতের বাঁদিকে মোড়ের মাথায় ছোট্ট দোকান। তাকে সাজানো রকমারি ছোলাভাজা, বাদাম আর চানাচুরের বয়াম। তবে প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট পট্যাটো চিপস। দোকানের সামনে বিশাল লোহার কড়াইয়ে ফিনফিনে পাতলা করে কাটা আলুর চাকা, গনগনে আঁচে, ডুবো তেলে ভাজা হয়ে চলেছে অনবরত। ভেজে তোলার পর প্রত্যেকটা চাকা দেখতে ঠিক হলুদ ডানা ছোট ছোট প্রজাপতির মতো। বহুকাল আগে পুজোর মুখে মুখে আসত আমাদের শহরে। প্রত্যেকবার দোকানটার সামনে দিয়ে গেলেই পুরীর ঢেউয়ের মতো লাফ দিয়ে ফিরে আসা কৈশোর যৌবন। সে এক অলৌকিক সময়। পঁচাত্তর কিংবা নব্বই পয়সায় ‘ফাইভ মেন আর্মি’, ‘ড: জিভাগো’ বা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’। মেট্রো, গ্লোব, লাইট হাউস, নিউ এম্পায়ারে। ষাট পয়সায় ময়দানের সবুজ গ্যালারিতে ফুটবল। পিন্টু, শ্যাম, সুরজিৎ, হাবিব, মজিদ বাসকারের সোনা বাঁধানো বুটের জাদু। দেখে ফেরার পথে অবধারিত স্টপেজ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। কাগজের ঠোঙায় চিপস। ওপরে ছড়ানো বিটনুন আর লঙ্কাগুঁড়োর ছিটে। চার-পাঁচজনের চাঁদা মেলানো পয়সায়। ভাগযোগ করে খেতে খেতে বাড়ি ফেরা। তখন কলকাতার দোকানগুলোর সামনে অমুক কুড়কুড়ে, তমুক মুড়মুড়ের ঝাঁ চকচকে লাল-নীল-সবুজ প্যাকেটগুলো ঝোলানো থাকত না। সুতরাং পটাটো চিপস মানেই সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। সমার্থক দুটো শব্দ। বিশ্বায়নের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সটান দাঁড়িয়ে আছে আজও। টম্যাটো, তন্দুরি বা চিলিসস মার্কা নকল স্বাদগন্ধের প্রলোভন বা হাতছানি নেই। নেই বিজ্ঞাপনের চমক বা জাগলারি। উপকরণ বলতে খাঁটি তেল আর টাটকা আলু। ‘যে চিনবে সে কিনবে’—শুধুমাত্র এই আপ্তবাক্যটিকে সম্বল করে আজও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পুরনো ক্রেতার দল। সেটাই বা কম কিসে।

হাজরা মোড় থেকে রাসবিহারীমুখো এগোলে পরের স্টপেজ উজ্জ্বলা সিনেমা। সিনেমা হল উঠে গেছে কবেই, রয়ে গেছে উজ্জ্বলার চানাচুর। ছোট্ট এতটুকু পায়রার খোপের মতো দোকান। যখনই যাওয়া যাক না কেন নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে পঁচিশজনের লাইন দোকানের সামনে। ওজন করে বাদামি রঙের ঠোঙায় পুরে তুলে দেওয়া হচ্ছে হাতে হাতে। নো পলিপ্যাক বিজনেস। পিয়োর বাদাম তেলে ভাজা। মোটা সেঁউভাজা, চিনেবাদাম আর ডালের সঠিক মেলবন্ধন। খাওয়ার পরমুহূর্তে পোয়াপাত্তি দুধের চা বা এক গ্লাস জল যে-কোনও একটা খেয়ে ফেলুন ঢকঢক করে। একফোঁটা অম্বল হবে না। আর ঠিক এই কারণেই আমার সোমরসিক কিছু বন্ধুর কাছে আজও উজ্জ্বলার চানাচুরের কোনও বিকল্প নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই মহার্ঘ খাদ্যপদটির আকর্ষণ কিছুটা কম। ঝালমশলাহীনতার কারণে। অবশ্য তাতে উজ্জ্বলার মাহাত্ম্য এতটুকুও কম হচ্ছে না। অতএব শুভস্য শীঘ্রম। ডেস্টিনেশন উজ্জ্বলা।

চানাচুর তো অনেক হল। এবার ‘একটু ভাল চা পাওয়া যায় কোন দোকানে।’ চা মানে লাল চা। কালীঘাট পার্কের গায়ে যোগেশ মাইমের সামনে ফুটপাতে ছোট্ট চায়ের দোকান। চা-পাতা, গরম জল আর চিনির পারফেক্ট ব্লেন্ড। চাহিদা অনুযায়ী লেবু আর মশলা মিশিয়ে দেওয়া হয়। তবে খেতে হলে প্লেন লিকারের বিকল্প নেই। যদিও এটা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত মতামত। এবার আপনার মর্জি। কালীঘাট ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা লাল চায়ের ঠেক রয়েছে পাশাপাশি ভবানীপুর আর লেক মার্কেট অঞ্চলে। এর মধ্যে সামথিং স্পেশাল দেশপ্রিয় পার্কের গায়ে দাদাবউদির লাল অথবা লেবু চা। না খেলে সত্যিই মিস করবেন।

বালিগঞ্জ বিজন সেতু ধরে সটান নেমে এসে গড়িয়াহাটের দিকে এগোতে না এগোতেই হাতের বাঁ পাশে একটা হাতে ঠেলা গাড়ির ওপর বিশাল ঝুড়ি। ওপরে আধখোলা প্লাস্টিকের চাদরের আড়াল থেকে উঁকি মারছে গোল গোল ফুচকার ঘিয়ে-রঙা মাথা। পাশে চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের হাঁড়িতে গোলা তেঁতুল জল (আগে স্টিলের জায়গায় থাকত মেটে হাঁড়ি)। একপাশে ডাঁই করে রাখা সেদ্ধ মটর আর আলু। কুচোনো কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা আর অন্তত পাঁচ-সাত রকম মশলার বাটি। গাড়ি ঘিরে ভিড়। বেশিরভাগই মহিলা। আট থেকে আশি। সবার হাতে ছোট ছোট শালপাতার বাটি। দোকানি, মাঝবয়েসি। আলু-মটর, বিটনুন, মশলা, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা সবকিছু নিপুণ হাতে মেখে হাঁড়ির তেঁতুলগোলা জলটা ঘুলিয়ে নিচ্ছেন ফের একবার। কে বেশি ঝাল, কার ঝাল কম, জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন ওর মধ্যেই। অতঃপর ঝুড়িতে হাত গলিয়ে বের করে আনা ফুচকার পেটে আঙুলের চাপে ছোট্ট একটা ফুটো। ভেতরে পুরে দেওয়া মশলামাখা আলুমটরের পুর। অবিশ্বাস্য দ্রুত হাতে তুলে দিচ্ছেন পাতে থুড়ি শালপাতার বাটিতে। কিমাশ্চর্যম! ক্রেতারা সবাই আলাদা আলাদাভাবে তাদের পছন্দের স্বাদটা পাচ্ছেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের চূড়ান্ত নমুনা। অভিযোগের কোনও জায়গাই নেই। ক্রেতাদের চোখমুখের চেহারাই বলে দিচ্ছে অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলেছেন প্রত্যেকে। শেষপাতে একটা পুরঠাসা ফুচকা, তেঁতুলজল ছাড়া, ফাউ হিসাবে। চিবিয়ে শেষ করামাত্র শালপাতায় ঢেলে দেওয়া একটু তেঁতুলজল, ওপরে বিটনুন মশলার ছিটে (রিকোয়েস্টে রিপিটও করা হয়)। ‘সুরুৎ’—পরম পরিতৃপ্তির চুমুক একটা। অম্লায়েন সমাপয়েৎ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই পেট্রল পাম্প ছাড়াও আরও অন্তত কুড়ি থেকে পঁচিশটি সেরা ফুচকার ঠিকানা রয়েছে এ শহরে। গোলপার্ক, গড়িয়াহাট, রবীন্দ্র সরোবর, যাদবপুর, মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, থিয়েটার রোড আর বড়বাজার অঞ্চলে। সাধারণ ফুচকা ছাড়া দই-ফুচকা, বুঁদিয়া ফুচকা বা দহিবড়া ফুচকাও বানিয়ে থাকেন অনেক বিক্রেতা। সঙ্গে আরেক অমোঘ আকর্ষণ—চুরমুর। আধচটকানো ঝাল ঝাল মশলাদার আলুর সঙ্গে শুকনো ফুচকার পাপড়ির যুগলবন্দি। প্রতিটি মহিলার হার্টথ্রব। কোথায় লাগে উত্তমকুমার বা শাহরুখ খান। তবে সেরার সেরা ফুচকা আর চাট তথা চুরমুরের সেরা ঠিকানাটি কিন্তু উত্তর কলকাতায়, হেদোর মোড়ে। বৃথা বাক্যব্যয়ে অযথা সময় নষ্ট। সন্ধের মুখে মুখে পৌঁছে যান একদিন। শ্রবণ আর জিহ্বার বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাবে।

ঝালমুড়ি আর আলুকাবলি। অমর হয়ে আছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার গল্পে। এক সময় পাওয়া যেত পাড়ায় পাড়ায় বিশেষ করে উত্তর কলকাতায়। সন্ধেবেলায়, গলির মোড়ে মোড়ে। আজ বিলুপ্তপ্রায়। দু’-একটা ভাল ঠেকের কথা জিজ্ঞেস করলে অনেকেই মাথা চুলকোবেন। সে আলুকাবলি খেতাম বটে তিন-চার যুগ আগে হৃষিকেশ পার্কের গায়ে। লম্বাটে বেতের মোড়া ধরনের স্ট্যান্ডের ওপর চ্যাটালো ডালায় উঁচু করে সাজানো চাক চাক করে কাটা আলু আর সেদ্ধ মটর। গোল গোল, নিটোল। পাকা তেঁতুলের রস আর মশলায় জড়ানো, সামান্য একচিমটে বিটনুন আর লঙ্কাকুচি ছিটিয়ে, ‘চেরি অন কেক’-এর মতো আলুর মাথায় গোঁজা একটা ছোট কাঠি। শালপাতা আর তেঁতুল-মশলার গন্ধ মিলেমিশে একাকার… যেন স্বপ্ন। তারপর ‘সময় গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার’… পার্কের মাঠে কেষ্টিদার ফুটবল কোচিং ক্যাম্প, বুকসমান হাইটের লোহার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝালমুড়ি আর আলুকাবলিওয়ালা… সবকিছু মিলিয়ে গেছে ভোরবেলার অলীক স্বপ্নের মতো। কেষ্টিদার স্বপ্নের এবং মিনিমাগনার কোচিং ক্যাম্পে এখন ছেলেকে শচীন-সৌরভ বানানোর স্বপ্ন ফিরি করা হয়। চড়া দামে। গেটের সামনে আলুকাবলি আর ঝালমুড়িওয়ালার জায়গায় দাঁড়ানো গাড়িঠেলা ফুচকাওয়ালা। ক্রেতারা চাইলে তিনিই আলুকাবলি বানিয়ে দেন। কিন্তু ওই যে কথায় বলে—‘যার যেটা কাজ।’ ফুচকাওয়ালার বানানো আলুমটর মাখা কখনওই আলুকাবলির হাজার আলোকবর্ষের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারে না। তবে আমি হাল ছাড়িনি। গোটা কলকাতা তিল তিল করে ঢুঁড়ে বের করে ফেলেছি এক্সক্লুসিভ আলুকাবলি আর ঝালমুড়ির ঠিকানা। আর প্রদোষ সি মিটারের মতোই লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠেছি সোল্লাসে—“আছে! আছে!”

শেয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিটের আগের স্টপেজ কলেজ স্কোয়ার। বঙ্কিম চাটুয্যে স্ট্রিট ধরে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের মোড়ে রোজ বিকেলে এসে দাঁড়ান একজন। সেই লম্বাটে ধরনের মোড়া আর চওড়া গোল ঝাঁকা। চাক চাক সেদ্ধ আলু আর মটর… কোনও এক্সট্রা কায়দাবাজি নেই। সিম্পল, ওল্ড ফ্যাশনড, এথনিক অ্যান্ড এক্সক্লুসিভ আলুকাবলি। ঠিক সেই ছেলেবেলার মতো। আর কী চাই? তা হলে একদিন বেরিয়ে পড়ুন সেই ছেলেবেলা থুড়ি আলুকাবলির সন্ধানে।

এখনও পাওয়া যায়। চৌকোনা টিনের ঘেরাটোপে খোপে খোপে সাজানো সেদ্ধ আলু, সেদ্ধ ছোলা, কাঁচা ছোলা, কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ-শশা-টম্যাটো কুচি, সেঁউভাজা, বাদামভাজা আর চানাচুর, শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো আর দু’-চার রকম মশলা। ঘেরাটোপের মাঝখানে ফুঁড়ে ওঠা টিনের ড্রামভর্তি মুড়ি। পাশে দুটো শিশিতে তেঁতুলগোলা জল আর সরষের তেল। চাওয়া মাত্র মিলিয়ে মিশিয়ে, নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে তৈরি হবে সেই পুরনো ঝালমুড়ি। ঝাঁকানোমাত্র নাকে মশলা মাখা মুড়ির প্রাণকাড়া সুবাস! গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন যেখানটায় রবীন্দ্র সরোবরের গায়ে শেষ হচ্ছে, তারপর থেকে পুরো লেক চত্বরের রেলিং ঘেঁষে এরকম দু’-চারজন আছেন যারা বাপ-পিতেমোর ছেড়ে যাওয়া রিলে রেসের ব্যাটনটাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন আজও। অনেকটা সেই লাস্ট অফ দ্য টাইটানসের মতো। হালফ্যাশনের কায়দায় চাট-ভেলপুরির সঙ্গে ঝালমুড়ি নয়। শুধু শুধু এবং শুধুমাত্র ঝালমুড়ি। আদি এবং অকৃত্রিম। অভিযোগ শুধু একটাই। ঠোঙার বদলে যদি সেই সাবেকি কায়দায় কাগজের মোড়কে মুড়িয়ে দিতেন। বিক্রেতারা একটু ভেবে দেখবেন কথাটা।

ঝালমুড়ি নয়। মুড়িমাখা। ঝালমুড়ি গোত্রের হলেও স্বাদে অনেকটাই স্বতন্ত্র। মূলত বাদাম, সেঁউ, ছোলাভাজা আর দুর্দান্ত সুগন্ধি একটা চাটমশলা মিশিয়ে বানানো হয় এই মুড়িমাখা। একমাত্র অল্পস্বল্প সেদ্ধ আলুর টুকরো সরষের তেল ছাড়া পেঁয়াজ-শসা-টম্যাটো বা তেঁতুলজল কিছুই মেশানো হয় না। ফলে অনেকটা বেশি শুকনো আর ঝরঝরে থাকে। প্রত্যেকটা পদের স্বাদ আলাদা আলাদাভাবে অনুভূত হয় মুখে, বানানোর কায়দাটাই এরকম। মুড়িমাখার সেরা ঠিকানা এ শহরে মাত্র কয়েকটি। লর্ড সিনহা রোড আর এজেসি বোস রোডের মোড়ে ক্যাথলিনের গায়ে, লাইটহাউস-নিউমার্কেটের মাঝখানে গলির মোড়ে আর পার্কস্ট্রিট, বিবাদী বাগের খাবার পাড়ায়। বিক্রেতারা সবাই অবাঙালি। তবে বারবার খেয়ে একটা কথাই মনে হয়েছে মুড়িমাখার আসল ম্যাজিকটা লুকিয়ে রয়েছে ওই চাট মশলায় (বিক্রেতারা বলেন ‘কুটা মশালা’)। প্যাকেটে আলাদা করেও বিক্রি হয়। বাড়িতে কিনে নিয়ে গিয়ে বানিয়ে দেখেছি। ফুটপাতের সেই সু’তারটা পাইনি কখনও। হাতের গুণে কি? কে জানে?

চানাচুর আর ঘটিগরমের কথাই যখন উঠল তখন ঘটিগরম আর চানাচ্যাপটাই বা বাদ থাকে কেন? প্রথমে ঘটিগরম দিয়েই শুরু করা যাক। মোটামুটি পড়ন্ত বিকেলের মুখে মুখে উত্তর চব্বিশ পরগনার গুমা, বিড়া, চাঁদপাড়া, মছলন্দপুর, ঠাকুরনগর, বনগাঁ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতায় নেমে পড়েন এই ঘটিগরম বিক্রেতার দল। ছড়িয়ে পড়েন শহরের এদিক ওদিক। গলায় ঝোলানো অ্যালুমিনিয়ামের বালতি ভর্তি চানাচুর। মাঝখানে জ্বলন্ত কাঠকয়লার আঙড়া ভর্তি একটা ছোট ঘটি। চানাচুরকে টাটকা, মুচমুচে, গরম রাখার জন্য। চানাচুরের জুড়িদার হিসেবে পিঁয়াজের বদলে ফিনফিনে কাটা কাঁচা আম বা বিলিতি আমড়ার কুচি। সিজন অনুযায়ী। যখন যেটা পাওয়া যায়। অতঃপর হালকা করে ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া সামান্য বিটনুন আর মশলা। ব্যস, তাতেই অসামান্য হয়ে ওঠে কম ঝালমশলার সস্তা চানাচুর। শহরের অনেক জায়গাতেই সন্ধের মুখে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলেও দেখা পাওয়ার শিয়োর শট কলকাতা ময়দান। কমপক্ষে দশ-পনেরো জনের দেখা তো মিলবেই। ভীষণ সরল, দরিদ্র আর দলিত মতুয়া সম্প্রদায়ের এই মানুষরা, মুখে সর্বদা একটা মিঠে হাসি নিয়ে আজও ঘটিগরম বিক্রি করে যাচ্ছেন বাবুদের এ শহরে।

চানাচ্যাপটা, চালু ভাষায় মিক্সচারওয়ালা। কলকাতার ফুটপাতে দেখা মিলবে এদেরও। এরা সবাই উত্তরপ্রদেশ নিবাসী। প্রত্যেকের কমন ইউনিফর্ম সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, মাথায় গান্ধিটুপি। কাঁচাছোলাকে খলনোড়া কিংবা হামানদিস্তেয় পিটে পিটে চ্যাপটা করে খোলার আঁচে ভাজা হয়। তেল ছাড়া। হলদে কালো ছোপ ছোপ, গা-টা অমসৃণ, এবড়ো খেবড়ো। ঘটি গরমের মতো এদের ঝুড়ির মাঝখানেও বসানো থাকে একটা কাঙড়ার পাত্র। তবে ঘটিগরমের মতো ধাতুর নয়, মাটির। উদ্দেশ্য একই। খাবার গরম রাখা। দু’-চার ফোঁটা লেবুর রস। সামান্য মশলা আর বিটনুন। তাতেই পুরো ব্যাপারটা টেনিদার বয়ানে—‘ডিলা গ্রান্ডি মেফিস্টোফেলিস!’ শুধুমাত্র এই কারণেই মুড়িমাখা-চাট-চুরমুর-ঝালমুড়ির চেয়ে চানাচ্যাপটা আর ঘটিগরমকে অনেকটা এগিয়ে রাখব আমি। হাজার রকম মশলার কারিকুরি নেই। নেই নানা ধরনের আনাজপাতির ঝক্কি। বেসিক প্রোডাক্ট একটা। সামান্য দু’-একটা উপকরণের যোগ্য সংগত। ব্যস তাতেই কেল্লাফতে। অনেকটা ঠিক সেই উনিশশো ছিয়াশির বিশ্বজয়ী আর্জেন্তিনা টিমের মতো। সেরকম তারকা কোনও খেলোয়াড় নেই। কিন্তু একা সেই ফুটবলের ঈশ্বর! পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির লোকটা। দশনম্বর সাদা-নীল জার্সি। দলের মূল গায়েন। এক থেকে এগারো নম্বর—সব ক’জনই দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। আর তাতেই গোটা ফুটবল দুনিয়া পদানত। ঘটিগরম আর চানাচ্যাপটাও হুবহু ওই একরকম। মূল পদটা জিনিয়াস। সঙ্গে মামুলি কিছু উপকরণের ক্ষুদ্র কিন্তু আন্তরিক সহযোগিতা। ঠিক এখানেই বাকিদের দশ যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে এই দুই ফুটপাত ডেলিকেসি। এই প্রতিবেদকের অন্তত মত তাই।

মনে আছে আগের প্রতিবেদন ‘মোগলাই কলকাতা’-য় লিখেছিলাম আরবি হালিম পাওয়া যায় একমাত্র রমজানের মাসে, শহরের বেশ কয়েকটা নামজাদা মুসলিম হোটেলে। কথাটা আংশিক সত্যি হলেও পুরোটা নয়। অনেকটাই ওই ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’-র মতো। আসলে হালিম সম্বত্সরই পাওয়া যায় কলকাতায়। তবে হোটেলে নয়, ফুটপাতে। চাকা লাগানো গাড়িতে ধোঁয়া ওঠা ফুটন্ত হালিমের হাঁড়ি। নীচের পাটাতনে বসানো জ্বলন্ত উনুন। বাটিতে বাটিতে ঢেলে কড়া লাল পেঁয়াজ ভাজা, রোগন তেল, পাতিলেবুর রস আর লঙ্কাকুচি ছড়িয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে খদ্দেরের হাতে, এরকম ঠেক শহরে বেশ কয়েকটা রয়েছে খিদিরপুর মোড়, পার্ক সার্কাস ময়দানের গায়ে আর ধর্মতলার মোড়ে স্টেটসম্যান বিল্ডিংয়ের উলটোদিকে। কিন্তু সবার সেরা ঠেকটি বেকবাগান মোড়ে কোয়স্ট মল ঘেঁষা সামসুল হুদা রোড ধরে এগিয়ে ব্রাইট স্ট্রিটের মোড়ে। সামুভাইয়ের ফুটপাত স্টল। গাড়ির সামনে সবসময় খদ্দেরের ভিড়। ঘন ডালের সমুদ্রে সাবমেরিনের মতো আত্মগোপন করে থাকা পাতলা মাংসের সর আর দু-চারটে টুকরো। সে কী সুগন্ধ। অহো! স্বাদে আর খাদ্যগুণে যে-কোনও একনম্বরি মোগলাই রেস্তোরাঁর সঙ্গে পাল্লা দেবে একমুহূর্তে ক্লান্তি অপহরণকারী এই হালিম। দীর্ঘ সময় আমেরিকা প্রবাসী, বর্তমানে সেক্টর ফাইভে এক বহুজাতিক সফটওয়ার সংস্থায় উচ্চপদে আসীন আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সৌমিত্র বসু ওরফে ক্ষ্যাপা (চেহারাটা অনেক ডব্লু ডব্লু ই অথবা সুমো পালোয়ানকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে) যখনই এ ঠেকে হানা দেয়, অন্তত পাঁচ থেকে ছ’ বাটি পরপর না খেয়ে থামে না। তবে আপনারা ভুল করেও সে চেষ্টা করবেন না। হালিম স্বাস্থ্যকর এবং একই সঙ্গে প্রচণ্ড সুস্বাদু হলেও খানিকটা গুরুপাক তো বটেই। একবাটি দু’বাটিতে যা ‘রিফ্রেশিং’, চার-পাঁচ বাটিতে সেটাই সমস্যায় ফেলতে পারে। ক্ষ্যাপার পক্ষে যা সম্ভব অন্যদের পক্ষে সেটা কখনওই নয়। রাতবিরেতে ঝামেলা হলে হ্যাপা কে সামলাবে? আর অসামান্য কোনও সৃষ্টি পরিমিত পরিমাণে চাখলেই রসনার সঠিক তৃপ্তি হয়। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত অবশ্যই ক্ষ্যাপা। তবে ব্যতিক্রমটা ব্যতিক্রমই। নিয়ম নয় কখনওই। স্টলের মালিক সামুভাই। ফরসা ছিপছিপে হ্যান্ডসাম চেহারা। দুর্দান্ত স্মার্ট। ঠোঁটের কোণে সর্বদা লেগে থাকা আন্তরিক একটা হাসি। নিজে অসামান্য পাচক। এখন নিজে হাতে আর না রাঁধলেও দাঁড়িয়ে থেকে পুরো প্রক্রিয়াটার ওপর কড়া তদারকি চালান রোজ। বহু ফ্র্যাঞ্চাইজি আর নামী হোটেলে রাঁধুনির চাকরির অফার পায়ে ঠেলে দিয়ে এই আরবি হালিম ভাণ্ডার আজও চালিয়ে যাচ্ছেন সামুভাই। সামসুল হুদা রোড আর ব্রাইট স্ট্রিট মোড়ের ফুটপাতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, রমজানের একমাস বিফের পাশাপাশি চিকেন হালিমও বানিয়ে থাকেন সামুভাই অ্যান্ড কোং। গোমাংসে আপত্তি থাকলে রমজানের মাসে যে-কোনও একদিন সন্ধের পর আপনার অবশ্য গন্তব্য হোক সামুভাইয়ের স্পেশাল আরবি হালিম। তবে দোকানে প্রচণ্ড ভিড় হয় এ সময়টায়। টালা টু টালিগঞ্জ, বাবুরা গাড়ি হাঁকিয়ে এসে ঘটিবাটি ভর্তি করে কিনে নিয়ে যান। মোটামুটি সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে পেল্লায় চেহারার চার-পাঁচটি হাঁড়ি চেঁচেপুছে সাফ একেবারে। দেরি করলে হতাশ হবার সম্ভাবনা প্রবল।

শুধু কি হালিম? আরও কত ধরনের সুস্বাদু খাবার যে ছড়িয়ে রয়েছে সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলো জুড়ে তার লেখাজোখা নেই। কলকাতার আর কোথাও এসব খাবারের দেখা মেলে না। তার মধ্যে অন্যতম পানতারাস। ছোট ছোট মুসলমান হোটেলে বা খাবারের দোকানগুলোয় পাওয়া যায়। এনভেলাপ বা খামের মতো করে চারপাশটা মোড়া। চৌকোনা আকারের। ময়দার পাতলা আস্তরণের মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আলুর টুকরো (মাখা বা চটকানো নয়), পেঁয়াজ-রসুনকুচি আর মশলা মাখানো মাংসের কিমার পুর। ডুবো তেলে ভেজে তোলা হয়। স্বাদ আর কুড়মুড়ে ক্রিসপি ভাবটা আচ্ছা আচ্ছা নামী কনফেকশনারির প্যাটিসকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যে-কোনও দিন। সামান্য সসের সঙ্গে… ইরশাদ! ইরশাদ! আর দাম? শুনলে মনে হবে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরে গেলুম নাকি? মাত্র আড়াই টাকা পার পিস। ভাবা যায়! আশ্চর্যজনক যেটা প্রতিদিন বেলা এগারোটা, বারোটা নাগাদ বানানো শুরু হয় এই অনন্য খাদ্যবস্তুটি। একটা দেড়টার মধ্যে খতম। ফলে খেতে চাইলে ভরদুপুর ছাড়া গতি নেই। এরকম একটা বেখাপ্পা সময়েই কেন? বহুবার জিজ্ঞেস করেছি একাধিক হোটেলওয়ালা বা দোকান মালিককে। “অ্যায়সা হি হোতা হায়”—নিস্পৃহ আর নির্লিপ্ত উত্তর পেয়েছি প্রতিবারই। মাইক্রোওভেনে ফের গরম করে নিলে স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকবে কি? জানা নেই কারণ সে চেষ্টা করিনি কোনওদিন।

সামোসার বাংলা মানে তো সিঙ্গারা। কিন্তু সংখ্যালঘু মহল্লায় সামোসা মোটেই সেরকম নয়। বরং অনেকটা সেই মা-ঠাকুমার বানানো পুলিপিঠের মতো আকারে। ভেতরের পুরটা অবিকল পানতারাসের মতো। স্বাদও প্রায় একইরকম। এখানে উল্লেখ্য যেটা, যে দোকানে সামোসা তৈরি হবে সেখানে পানতারাস বানানো হবে না কখনওই। উলটোদিকে পানতারাস নির্মাতাদের ক্ষেত্রেও ওই একই কানুন প্রযোজ্য। কারণটা কী? আগের প্রশ্নের মতো এ প্রশ্নেরও উত্তর পাইনি কখনও।

পওয়া বা পোয়া। এ নামেই ডাকা হয় মুসলিম মহল্লায়। খেতে অবিকল মালপোয়ার মতো। এলাকার ফুটপাত স্টলগুলোয় পাওয়া যায়। মৌরির বদলে গোলাপজলের সুগন্ধ। আর মিষ্টির পরিমাণটা মালপোয়ার তুলনায় খানিকটা কম। যারা কম মিষ্টি পছন্দ করেন তাদের জন্য আদর্শ এই ‘পওয়া’। পড়ন্ত বিকেলে গরম গরম ভেজে তোলা হয়। এর দামও মাত্র তিন টাকা। সত্যিই অকল্পনীয়।

নানখাটাই। এর আদি উৎপত্তিস্থল নাকি আফগানিস্তান। সুজি, ডালডা আর ঘিয়ের তৈরি এ বিস্কুট সত্যিই অমৃত সমান। তৈরি হয় পার্ক সার্কাস, রিপন স্ট্রিট, মল্লিকবাজার অঞ্চলের ছোট ছোট বেকারিগুলোয়। বহু নামী বেকারির নামী দামি কুকিজ তো খেয়েছেন। একবার নানখাটাই ট্রাই করুন। মুখে ফেলামাত্র ঝুরঝুর করে ভেঙে মিলিয়ে যাবে। সঙ্গে মিলিয়ে যাবে অন্য কোনও কুকিজ খাওয়ার ইচ্ছেটাও। চ্যালেঞ্জ। সম্বত্সর পাওয়া যায় মল্লিকবাজারের দোকানগুলোয়। তবে সেরা নানখাটাই পাওয়া যায় মহরমের দিন। হালকা ঝুরঝুরে, হাতেগরম। ঘি-ডালডার যুগলবন্দি। ভেবে দেখুন মহরম অবধি অপেক্ষা করবেন না কি আজই রওয়ানা দেবেন মল্লিকবাজারের দিকে।

শিককাবাবের গল্প তো আগেই করেছি। কিন্তু কাবাব ফ্রাইয়ের কথা বলা হয়নি। সন্ধের মুখে বানিয়ে শিকসুদ্ধু নামিয়ে একআধটু তুতিয়ে পাতিয়ে অনুরোধ করলে চাঁপের তাওয়ার একপাশে এক-আধ চামচে ডালডা আর চাড্ডি পেঁয়াজ ফেলে ভেজে দেয় যে-কোনও চুলিয়া হোটেলে (সংখ্যালঘু এলাকায় সস্তার হোটেলগুলোকে এ নামেই ডাকা হয়)। দাম টাকা দুয়েক বেশি পড়ে। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে কাবাব ফ্রাইয়ের সেরা ঠিকানা ছিল যমুনা সিনেমার গায়ে নুরি হোটেল। দোকানের বাইরে বিশাল লোহার তাওয়ায় চাঁপের পাশাপাশি সবসময় ভাজা হত কাবাব। ডিমান্ডও ছিল প্রচুর। সে সময় কাবাবপ্রেমীদের কাছে পরিচিত ছিল ‘যম্‌নাফ্রাই’ নামে। যমুনায় ইন্টারভেলের সময় অথবা গ্লোব, লাইটহাউসে ম্যাটিনি শো সেরে ফেরার পথে থামতেই হবে নুরি হোটেল। আজ যমুনা নেই, লাইট হাউস নেই, নেই সেভেন্টি এম এম পর্দার সেই গ্লোব। সব সিনেমা এখন মাল্টিপ্লেক্সে নয়তো পেনড্রাইভের সুড়ঙ্গ বেয়ে ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল আর এল ই ডি-র পর্দায়। এদিকে বয়সও বেড়েছে। অনেকদিন যাইনি ওদিকটায়। জানি না ‘যমনাফ্রাই’ আজও বহমান কিনা?

নুরি হোটেলের মতো আরেক অমৃতলোকের ঠিকানা পেয়ে গেছিলাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের পিছনে তালতলা লেনের একটা সরুস্য সরু গলিতে। টালির চালের নামগোত্রহীন চুলিয়া হোটেল। ভাঙাচোরা কাঠের বেঞ্চি আর টেবিল। আধো অন্ধকার ভেতরটা। কম পাওয়ারের বাল্‌ব জ্বলছে কয়েকটা। প্রচুর লোক খাচ্ছে। মলিন জামা আর লুঙ্গি পরিহিত বেয়ারাদের ব্যস্ত পদচারণা। হাঁকডাক। একদম সাদামাটা চেহারা। কিন্তু রান্নার মান— এককথায় অসামান্য! কবি বীরেন চাটুজ্জের ভাষায়— ‘কোন উপমাটুপমা চলবে না।’ তো খেয়েছিলাম বটে সেই হোটেলে। খুস্কা পোলাও। বিরিয়ানি নয় মোটেই। গাত্রবর্ণ অনেকটা হলুদ পোলাও-এর মতো। জাফরানের ঝাঁঝটা প্রায় নেই বললেই চলে। বড় একখণ্ড মাংসের বদলে ছোট ছোট সুপক্ব মাংসের টুকরো। আলু বা ডিমের কোনও গল্প নেই। ‘একবার খা কে তো দেখিয়ে’—পরিবেশনকারীর এহেন অনুরোধে সঙ্গে নিতে হয়েছিল হাফপ্লেট ‘পাগলা ভুনা।’ ওই হোটেলের ‘ইসপেশাল’ নাকি। এক টুকরো দাঁতে কাটামাত্র বুঝতে পেরেছিলাম না নিলে কি ভুলটাই না করতাম। এমনিতেই যে-কোনও ছোটখাটো চুলিয়া হোটেলের ভুনা গোস্ত (কষা মাংস) যে-কোনও নামী দামি রসাকষাদের বলে বলে ইনিংস ডিফিট দেবে তায় আবার ‘পাগলা ভুনা’। তা খেয়েছিলাম বটে কবজি ডুবিয়ে। খাওয়া তো নয় যেন একটা প্লেটনিক জার্নি থ্রু দ্য স্টমাক। খাওয়া সেরে ময়লা বেসিনে হাত ধুয়ে কাউন্টারের ওপর রাখা জর্দার কৌটো থেকে মৌরি তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বিল মেটাচ্ছি, সামনে এসে দাঁড়ালেন পরিবেশনকারী বৃদ্ধ চাচা। বৃদ্ধ মানুষ। একগাল সাদা দাড়ি। মলিন লুঙ্গি আর গেঞ্জি। কিন্তু হাসিটা ভারী সরল আর তরতাজা। কাঁধে একটা আধময়লা তোয়ালে (নিশ্চয়ই অনেকে মুখ মুছে গেছে ওই একই তোয়ালেতে)। এগিয়ে দিয়েছিলেন মুখ মোছার জন্য। না করতে পারিনি স্রেফ ওই ভনিতার লেশমাত্র না থাকা হাসিটার জন্য। খাবারের দামের সঙ্গে এগিয়ে দিয়েছিলাম সামান্য দু’-পাঁচটা অতিরিক্ত টাকা। কতটুকুই বা মানে রাখে? মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠে সারা মুখ জুড়ে আরও চওড়া হয়েছিল হাসিটা। আর তাতেই আলোয় আলোময় সংখ্যালঘু মহল্লার ঘুপচি আধো অন্ধকার গরিব হোটেল। পরবর্তীতে বহুবার ওই এলাকার অলিতে গলিতে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি হোটেলটাকে। পাইনি। উঠে গেল? নাকি প্রোমোটারের থাবায় পড়ল? নাকি আদৌ কখনও ছিলই না বাস্তবে? অনেকটা সেই জন লেননের ‘নো হোয়ার ল্যান্ড’-এর মতো। ভোরবেলার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া সুখস্বপ্নের মতো মিনিট পনেরো-কুড়ি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেছে। উত্তরটা পাইনি বাস্তবে।

একটা কথা ভেবে দেখেছেন কখনও? কলকাতা শহরে রান্না করা শুয়োরের মাংস বা পর্ক পাওয়া যায় কি না? পাঁচতারা হোটেলের ব্যাপারস্যাপার জানি না। তবে আমরা মানে সাধারণ শহরবাসীরা কুকড পর্ক বলতে বুঝি চিনে রেস্তোরাঁর খাবার আর বাড়িতে খেতে হলে দোকানের মাংস বা শপিং মল থেকে কিনে আনা হ্যাম-সালামি-সসেজ-বেকন ইত্যাদি ইত্যাদি। অবগতির জন্য জানাই তার বাইরেও দু’-চারটে কুকড পর্কের ঠিকানা রয়েছে কলকাতায়। যেখানে তৈরি হয় আদি অকৃত্রিম পর্ক কারি। লাল ঝাল, ধনেপাতার সুবাস ছড়ানো শুয়োরের মাংসের ঝোল। পাওয়া যায় গড়িয়া রেল স্টেশনের গায়ে ছোট্ট দোকানে। মাংসের এই পদটি রাঁধার জন্য সবিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। কখন ঠিক তাক করে কড়াইয়ে ছাড়তে হবে যাতে মাংসের ওপরে চর্বির অংশটা গলে না যায়, তীক্ষ্ন নজর রাখতে হবে সেদিকে। আর সেই কৌশলটাই জানেন দোকান মালিক হরিদা। দোকানে মাংসের পাশাপাশি হাতে গড়া রুটিও পাওয়া যায়। লাল লাল ঝোলে চুবিয়ে মাংসসুদ্ধ একটা কামড়। মোটা চর্বিওয়ালা বাদিতে দাঁত কেটে বসার ‘কচ’ মৃদু শব্দ। বাকিটা— পুরো শিল্প।

এরকম আরও বেশ কয়েকটা পর্ক কারির ঠেক রয়েছে ট্যাংরায় বৈশালি সিনেমা হলের আশেপাশে। এছাড়া দক্ষিণ কলকাতার গরচা রোডে বাংলা মদের দোকানের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে করে নিয়ে বসতেন একজন। টকটকে লাল ঝোলে মাথা উঁচু করে থাকা আধ ইঞ্চি পুরু বাদিওয়ালা চর্বিদার মাংসের টুকরো। প্রতিটি টুকরো চৌকোনা আর নিখুঁত সমান মাপে কাটা। ঝোলের ওপর ভাসমান তেলে ইতিউতি সন্তরণরত কুচোনো ধনেপাতা। স্বাদে মারকাটারি। অনেককাল ঢুঁ মারা হয়নি ওদিকটায়। ফলে আজও পাওয়া যায় কিনা জানা নেই।

সত্তরের শেষভাগ। পার্ক লেন। পার্ক স্ট্রিটের গায়ে সরু ত্যারচা গলিটা তখন গোটা কলকাতায় বিখ্যাত মূলত দুটো কারণে। বব ডিকস্টার শুকনো নেশার ঠেক— ‘ববস্ প্লেস’ আর লিন্ডা গোমস মানে লিন্ডা আন্টির পর্ক কারি জয়েন্ট। গোটা সত্তর-আশির দশক জুড়ে রাজত্ব চালিয়েছিল শহরে। দুটো আড্ডা। কত স্মৃতি, অনভ্যস্ত কানে শুনে ফেলা কত-শত গান। জিম মরিসন, ন্যাট কিংকোল, বিটলস্, ন্যানসি সিনাত্রা, বব ডিলান, জোন বায়েজ, পিঙ্ক ফ্লয়েড, জন লেনন, ব্রুস স্প্রিং স্টিন, নীল ডায়মন্ড, বব মার্লে, জিমি হেনড্রিক্স, রোলিং স্টোন… গিটারে উথালপাথাল ঝোড়ো স্ট্রোক… ‘আই মিস ইউ বেবি’… বব ডিকস্টা, বহুদিন হল এ শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে বউবাচ্চা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া… লিন্ডা আন্টি, বছর বিশেক আগে চলে গেছেন তারাদের পথে। সঙ্গে চলে গেছে ভুবনমোহিনী পর্ক কারির সেই জাদু ফর্মুলা। আর ঠিক সেই কারণেই ওরকম পর্ক কারি আর কোনওদিন রাঁধা হবে না তিনশো পেরোনো এই তিলোত্তমায়।

স্মৃতিমেদুর ভারাক্রান্ত মন। একটু চাঙ্গা হতে চলুন ফের একবার ফিরে যাওয়া যাক সেই গড়িয়ায়। তবে স্টেশনের দিকটায় নয়, গড়িয়া মোড়ে। মোড়ের মাথায় মহুয়া সিনেমা হল। মহুয়া-বান্টি-মালঞ্চ-মধুবন। একসময় শহরতলির গর্ব। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সেভেন্টি এম এম স্ক্রিন। বান্টি, মধুবন বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন হল। মালঞ্চ আর মহুয়া, টিমটিম করে টিকে আছে কোনওমতে। নোংরা পর্দা, জায়গায় জায়গায় তাপ্পি মারা… অস্পষ্ট আওয়াজের সাউন্ডবক্স, গদি ছিঁড়ে গিয়ে চেয়ারের কাঠ বেরিয়ে পড়েছে অনেকদিন। দর্শক হয় না হলে, হতাশ মুখ সিনেমা হল কর্মচারী। হালকা হতে চাওয়া মন ভারী হয়ে আসছে ফের। এই ভীষণ মনখারাপের রেশটা কাটাতে ঢুকে পড়ুন মহুয়ার উলটোফুটের গলিটায়। সোজা গিয়ে যেখানে গড়িয়া মেট্রো স্টেশনের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে রাস্তাটা, তার দু’-চার পা আগেই তেলেভাজার দোকানটা। জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার মতো এ দোকান ভ্রমণের সেরা সময় শীতকাল। কারণ বাজার-সেরা ঠাসবুনোটের ফুলকপি আর পেঁজা তুলোর মতো হালকা নরম তুলতুলে জাম্বো সাইজের বেগুন একমাত্র এ সময়টাতেই পাওয়া যায়। যার মানে ফুলকপির বড়া আর আধ হাত লম্বা বেগুনি। এ দোকানের ডেলিকেসি। এত ভাল ফুলকপির বড়া কলকাতার আর কোনও দোকানে পাওয়া যায় না। বেসনের উষ্ণ আবরণে ভেবে ওঠা তাজা ফুলকপির সুবাস। মুখের মধ্যে থেকে থেকেই ফুটফুট করে ফুটতে থাকা ভাজা ডালের কুচি আর বিটনুনের সোঁদাটে গন্ধ। আবেশটা ধরে রাখতে খেতে খেতেই বেরিয়ে আসুন গলি থেকে। উলটোফুটে মহুয়ার প্রায় গা ঘেঁষেই ছোট চায়ের দোকানটা। গম্ভীরমুখো দোকানি। লাল বা দুধ, দু’ধরনের চায়ের ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ। দ্রুত চামচ চালাচ্ছেন গ্লাসে। মাটির ভাঁড় বা কাগজের কাপেও দেওয়া হয়। দোকানের আয়তন ছোট কিন্তু দুধ বা লাল, শহরে ভাল চায়ের অন্যতম সেরা ঠিকানা এটি। চুমুকে পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

গড়িয়া থেকে গোটা পাঁচেক স্টপেজ। বাঘাযতীন মোড়। বাস থেকে নেমেই ভাঙা টিনের বেড়ার দোকান। লাল আর দুধ—দু’রকম চা-ই পাওয়া যায়। লালটাই বেশি ভাল। দোকানি। দুর্দান্ত রসিক। অসম্ভব হিউমার সেন্স। দু’-চারটে টুকটাক রসিকতার মধ্যেই বেছে নিন প্লেন লিকার অথবা লেবু, মশলা—যে-কোনও একটা। প্রতিটি উপকরণ একদম সঠিক পরিমাপে। অজস্রবার খেয়েছি। মানের উঠতি পড়তি দেখিনি কখনও।

উলটোফুটে বাঘাযতীন স্টেশন রোডে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে পরানদার চায়ের দোকান। পরানদা। সর্বদা হাসিমুখ। কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির লড়াকু ইউনিয়ন কর্মী ছিলেন। লক আউট হতে হতে একদিন বন্ধই হয়ে গেল কারখানা। গ্লাস কিন্তু পিছু ছাড়ল না পরানদার। উলটে কেটলি-চামচ-উনুন-ছাঁকনি-চা পাতা আর মিল্ক পাউডারকে সঙ্গে নিয়ে উঠে এল ফুটপাতের ধারে একফালি দোকানে। পরানদা। প্রায় সত্তর। একদা একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী। অফিসিয়াল বামপন্থীদের রকমসকম দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন বছর কুড়ি আগেই। নাটকের পোকা। এখনও মুখে মুখে বলে যেতে পারেন টিনের তলোয়ার, কল্লোল, ব্যারিকেড, ফেরারি ফৌজ, সেতু, মারীচ সংবাদ, দেবীগর্জন… এরকম বহু নাটকের সংলাপ। ওর নিজের বয়ানে—“কমিউনিস্ট পার্টিটা যেরকম সততার লগে করতাম, চা-ডাও ঠিক হেইভাবেই বানাইয়া থাকি। আসলে হেই দুইডাই তো আবেগ।” কথাটা যে কদ্দুর সত্যি সেটা পরানদার চা খেলেই প্রমাণিত হবে। শুধুমাত্র তীব্র প্যাশনের কারণে সস্তার চা পাতা আর গুঁড়ো দুধের মিশেল যে কোন উচ্চতায় উঠতে পারে তার একমেবঅদ্বিতীয়ম দৃষ্টান্ত বোধহয় পরাণদা। আশার কথা গোটা শহরটা এখনও ‘ক্যাপুচিনো’ সভ্যতার মেঘে ঢাকা পড়ে যায়নি। কারণ পরাণদা আজও রয়েছেন কলকাতায়।

বাঘাযতীন থেকে ছোট ছোট তিনটে স্টপেজ। চাইলে হেঁটেও মেরে দিতে পারেন। এইট-বি বাসডিপোর উলটোদিকে যাদবপুর বাজার লাগোয়া গলিতে বউদির চায়ের দোকান। সবসময় থিকথিক করছে ভিড়। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে ঘোড়েল বাজারু হয়ে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সুজয় বসু, কে নেই সেই ভিড়ে? আর চায়ের কথা? লিকার, লেবু বা দুধ, বিজ্ঞাপনের ভাষায়—‘চুমুকেই চমক!’ সঙ্গে কম মিষ্টির খাস্তা ‘টোস্ট’ লেড়ো বা ‘এস’ বিস্কুট। অহো, ‘এই তো জীবন কালীদা!’

একটা জরুরি তথ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গ্লাসে চা পাওয়া যায় এখানে। বোধহয় এই দোকানের জন্যই স্পেশালি অর্ডার দিয়ে বানানো। দাম মাত্র তিন টাকা। গ্লাসের নয়, চায়ের।

‘উদ্‌ভ্রান্ত একঝাঁক যুবক মিলে রাখত ফুটপাত সরগরম/অযথা জ্ঞান দিলে গালিগালাজ গিলে চায়ের দাম দেওয়া শাস্তি চরম…।’ গান বাজছে ছোট সাউন্ডবক্সে। চার দেয়াল ভর্তি নচিকেতার ছবি। ওপরে সাইনবোর্ডে সাদার ওপর নীল লেটারহেডে বড় বড় করে লেখা দোকানের নাম—‘চা ও নচিকেতা। Just for today।’ দুই ভাই পালা করে দোকানটা চালায়, যাদবপুর বাসস্টপেজের গায়ে ফুটপাতের ওপর। বয়স মেরে-কেটে আঠাশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে। আর কী অবাক কাণ্ড! পরানদার থেকে প্রায় প্রজন্ম দুয়েকের ছোট এরাও নাকি সেই চা-টা বানায় প্রচণ্ড আবেগ দিয়ে। দুনিয়ার যত নচিকেতাপ্রেমীদের ফেভারিট জয়েন্ট এই— ‘চা ও নচিকেতা।’ দোকানের দুটি বিশেষত্ব। ১. কড়া লিকারের দুধ-চা ছাড়া আর কোনও ধরনের চা পাওয়া যায় না এখানে। ২. সকাল এগারোটা থেকে রাত দশটা— যতক্ষণ দোকান চলবে, নচিকেতা থামবে না এক সেকেন্ডের জন্য। গান আর কড়া দুধ চায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় উত্সাহী হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের নচিকেতাপ্রেমীরা নাকি ব্রাঞ্চ খোলার প্রস্তাব দিয়েছে বলে শুনেছি। দু’ ভাইয়ের গা নেই তেমন। ওদের মতে ‘এই বেশ ভালো আছি।’

কথায় বলে কলম অশরীরী। সত্যিই তো দেখছি কেবল চায়ের চক্রপথে ঘুরে চলেছে চক্রাকারে। যত অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছি ফের টেনে এনে ফেলে দিচ্ছে সেই চায়ের গাড্ডায়। এভাবে তো চলতে পারে না। শুধু কলকাতার চা আর চায়ের ঠেক নিয়ে লিখতে গেলেই একটা হাজারখানেক পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। তারপরেও লক্ষ লক্ষ চা-তক (আদৌ যদি তারা লেখাটা পড়েন) চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবেন—‘কই মশাই, আমাদের পাড়ার দোকানটার কথা তো লিখলেন না?’ তাই এই মুহূর্তে চা-পর্বে ইতি টানলাম। কত দোকান আর ঠেকের কথা যে বলা হল না। বাদ পড়ে গেল শ্যামবাজার, শোভাবাজার, গড়পার, মানিকতলা, কলেজস্ট্রিট, ভবানীপুর, কালীঘাট। লেক আর অকাদেমি চত্বরের অলৌকিক সব চা-বিপণি। অক্ষমতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আশাকরি সেটা পাব।

‘দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা’—বাংলার প্রবাদে আছে। সাপ আদৌ পোষ মানে কি? আর পোষ মানলেও দুধকলা খায় কি? সাপ সত্যিই দুধ কলা খায় কি না জানা নেই। তবে মানুষ যে দুধ-কোলা খায়, এক পরিচিতের কাছে এহেন অদ্ভুত এবং বিচিত্র তথ্য জানার পর চোয়াল ঝুলে গেছিল মিনিট খানেকের জন্য। বলে কী রে লোকটা। পাগল না পেট খারাপ? কোলা মানে সোডাভিত্তিক একটা ঝাঁঝালো পানীয়ের সঙ্গে দুধের মতো স্নেহজাতীয় পানীয়ের মিশেল? এ তো আদা-কাঁচকলা বা তেল আর জলের মিশ খাওয়ার চাইতেও জটিল ব্যাপার যাকে বলে। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম ইয়েতি বা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের চেয়েও রহস্যময় সেই পানীয়ের ঠিকানা। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন অগ্রজপ্রতিম বন্ধু সত্যবান মিত্রের সঙ্গে পৌঁছে গেছিলাম হরিশ মুখার্জি রোডে পিজি হসপিটাল সংলগ্ন গুরদোয়ারার গায়ে বলবন্ত সিংস ইটিং হাউজ বা বলবন্ত সিং ধাবায়। আর পান করেছিলাম সেই আশ্চর্য তরল। প্রাণ ভরে। দুধ আর কোলার সংমিশ্রণে যে এরকম সুস্বাদু পানীয় তৈরি হতে পারে নিজের চোখে অথবা নিজে চেখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না। এতটাই সুমধুর। দুধ-কোলা ছাড়া দুধ-সোডাও বানিয়ে থাকেন এরা। সেটিও সমান সুস্বাদু। দুধ কোলা বা সোডার পাশাপাশি এখানকার চিকেন তড়কা ফ্রাই আর বাটার নান, সঙ্গে মিক্সড সালাড—জাস্ট অ্যামেজিং! খাবারদাবার ছাড়া ঐতিহাসিক কারণেও এ হোটেল বিখ্যাত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এটি ছিল পাঞ্জাবের গদর পার্টির বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল। বর্তমান মালিকদের পূর্বপুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আশ্রয় দিতেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের। টেবিলে বসে খেতে খেতে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলাম খুব। হয়তো এই টেবিলে বসেই ভবিষ্যৎ বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন ভগৎ সিং, আসফাকুল্লা খান, রাজগুরু, বটুকেশ্বর দত্তরা। পিকরিক বোমার মশলা আবিষ্কার করেছিলেন শুকদেব, যতীন দাস, চন্দ্রশেখর আজাদ। শুধু ভাল খাওয়া নয়, একইসঙ্গে ইতিহাসকে ছুঁয়ে ফেলার তৃপ্তিটা মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে আজও।

ধাবা বা পাঞ্জাবি হোটেলের কথা যখন উঠলই তখন বলি এরকম আরও কয়েকটা ধাবা রয়েছে এই শহরে যারা নিজগুণেই স্বনামধন্য। শংসাপত্র বা স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই তেমন একটা। যার মধ্যে অন্যতম বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ধাবা আর তাদের অজস্র ধরনের পাঞ্জাবি ঘরানার খাদ্যসম্ভার। এই তালিকায় প্রথমেই থাকবে মক্কি (মকাই/ভুট্টা) দি রোটি আর সর্ষোঁ দা শাক। শহরের খুব বেশি পাঞ্জাবি হোটেলে সবসময় এই পদ দুটো পাওয়া যায় না। গরমাগরম মকাইয়ের রুটির সঙ্গে ওপরে ‘মাঠ্‌ঠা’ (তাজা ক্রিম) ছড়ানো ঘন সবুজ সরষে শাকের যুগলবন্দি। আহা! মুখের মধ্যে যেন রবিশঙ্কর আর আলি আকবরের ডুয়েট কনসার্ট। পাশে একপ্লেট সালাড আর একটুখানি পাঁচমিশেলি আচার। যোগ্য সংগত আল্লারাখা বা জাকিরের মতোই। বুঁদ হয়ে যান মূর্ছনায়! কথা না বাড়িয়ে।

দ্বিতীয় ঠিকানাটা রাসবিহারী মোড়ে আজাদ হিন্দ হোটেল। এলাকায় বেশি পরিচিত বচন সিংয়ের ধাবা নামে। কালীঘাট শ্মশানের দিকে যাবার রাস্তাটায় হাতের বাঁদিকে। এখানে আপনার পছন্দের তালিকায় অবশই থাকুক দাল মাখানি, চিকেন বাটার মশালা আর ফিশ অমৃতসরি। সঙ্গে রুমালি রুটি অথবা বাটার নান, যে-কোনও একটা। এমনিতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে এখানে। ফলে খাবার দিতে একটু দেরি হয়। তাই টেবিলে এসে নামামাত্র আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে চালু হয়ে যান। এক এক মুহূর্ত দেরি করা মানে এক-এক ফোঁটা অসম্ভব ভাললাগা স্বাদু উষ্ণতা আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়া। মনে রাখবেন কথাটা।

একটা ছোট্ট ফুডি কুইজ। বলুন তো কলকাতা শহরে কোন খাবার হোটেল সবচাইতে বেশি রাত অবধি খোলা থাকে? চোখ বুজে উত্তর— বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এএইআই ক্লাবের পাশে শের-ই-পাঞ্জাব ধাবা (কালীঘাট বা নিমতলা শ্মশানের পাশে দোকানগুলো এর মধ্যে ধর্তব্য নয়)। রাত তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ বন্ধ হয়ে ফের খুলে যায় ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। দু’ শিফটে হোটেল চলে। কর্মচারী বদলে যায়। রাতবিরেতে কোথাও খাবার না পেলে আপনার অবশ্যগন্তব্য হোক শের-ই-পাঞ্জাব। বিশ্ববরেণ্য চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনের প্রিয় খাবারের ঠিকানা ছিল এই ধাবাটি। কলকাতায় এলে নামীদামি পাঁচতারা হোটেলের লাঞ্চ-ডিনার ফেলে খেতে চলে আসতেন এখানে প্রায়ই। হুসেনের নামে এদের একটা পদের নামই হয়ে গেছে ‘হুসেনস্ স্পেশাল চিকেন।’ দুয়েকবার খেয়ে দেখেছি। আহামরি কিছু লাগেনি। খেতে যদি হয় সেটা এদের চিকেন ভর্তা আর এগ তড়কা ফ্রাই। ফুলকো ফুলকো চাপাটির সঙ্গে জমাট, হালকা আঠালো, মাসকালাই-কসৌরি মেথি-ডিমের মেলানো মেশানো ফাটাফাটি সুগন্ধি তড়কা। পাশাপাশি অফুরন্ত মাখনে সাঁতলানো ছিলেকাটা মুরগির টুকরোর ভর্তা। শেষে একগ্লাস লস্যি। ওপরে মোটা ননীর পরত। তলানিটা আর প্রায় চুমুক দেওয়া যায় না। চামচে করে তুলে খেতে হয়, এতটাই ঘন। আজ থেকে বছর বিশ-পঁচিশ আগেও হোটেলের বাইরে বসেই খাওয়া চলত। সঙ্গে ফ্রি—মুক্ত বাতাস। অবিকল হাইওয়ের ওপর এথনিক ধাবা বা লাইন হোটেলের স্টাইলে। শোনা কথা, এখানে এলে হোটেলের মধ্যে ভিড়ভারাক্কার চেয়ে বাইরে খাটিয়ায় বসে খেতেই বেশি পছন্দ করতেন হুসেন সাহেব। হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কটা এতটাই নিবিড় আর আন্তরিক জায়গায় এসে পৌঁছেছিল যে এঁকে উপহার দিয়েছিলেন প্রমাণ সাইজ গজগামিনীর একটি ছবি। ধর্মের ষাঁড়ের গুঁতোয় বিধ্বস্ত, অপমানিত হয়ে প্রথমে চলে গেলেন প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে। পরবর্তীতে এমন কোথাও যেখানে ধম্মো, জাতপাত এসব নিয়ে বেকার, বেফালতু, বেমতলব কোনও লড়াই নেই। হুসেন চলে গেছেন। ফুটপাতের খাটিয়াপত্তর কবেই তুলে দিয়েছেন মালিকরা। গজগামিনীর ছবিটা কিন্তু আজও টাঙানো রয়েছে হোটেলের দেয়ালে। ক্যাশ কাউন্টারের মাথার ঠিক ওপরে। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে গিয়ে দেখে আসতে পারেন একদিন।

এবার কলকাতার শেষ দুটি ধাবার কথা বলেই এই ধাবা প্রসঙ্গে ইতি টানব। রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে কর্তার সিংয়ের ধাবা। কনক বিল্ডিংয়ের ঠিক পিছনে। চিকেন, মাটন অথবা এগ, যে-কোনও তড়কাই এখানে যেন অনেকটা সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জামাইকার শর্ট ডিসট্যান্স অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান দৌড়বাজদের মতো। ফটো-ফিনিশে একচুল এগিয়ে পিছিয়ে থাকবে। এখানে আপনার মর্জিমাফিক অর্ডার করা তড়কার সঙ্গে থাকুক প্লেন চাপাটি। সিংজির ধাবায় নান বা তন্দুরি রুটির সঙ্গে কম্পিটিশনে এটাই সেরা। শীতকালে শসা-পেঁয়াজ-টম্যাটোর সঙ্গে মুলোও দেওয়া হয় সালাডে। এত মিষ্টি আর ঝাঁঝহীন মুলো যে কোন স্বর্গীয় আবাদভূমিতে উৎপন্ন হয় কে জানে? কথার সত্যমিথ্যে যাচাই করতে একদিন না হয় চলেই যান রাসেল স্ট্রিটে সিংজির ধাবায়।

ভি আই পি রোড এয়ারপোর্ট হোটেল থেকে ঠিক যেখানটায় উত্তর চব্বিশ পরগণার দিকে বাঁক নিয়েছে, সেই মোড়ের মাথার ধাবাটায় খেয়েছেন কখনও? অনবদ্য সব পঞ্চনদের দেশের পঞ্চব্যঞ্জনের পর নিতেই হবে মোষের দুধে ফোটানো বড় এক গেলাস সরভাসা পোয়াপাত্তি চা। সঙ্গে এলাচের মাতচমাত সুগন্ধ। দাম দশটি টাকা মাত্র। খাওয়ার পর মনে হবে আরও টাকা দশেক বেশি নিলেও কোনও সমস্যা ছিল না। এতটাই স্বাদু আর তরতাজা করে দেওয়া অনুভূতি। এর বেশি আর কিছু বলার নেই।

আরেকটি প্রশ্ন। কলকাতার সেরা জিলিপি কোথায় পাওয়া যায়? এককথায় উত্তর: ফুটপাতে। ফুটপাত বলতে অফিসপাড়ার ফুটপাত। সেই ক্যামাক স্ট্রিট থেকে শুরু করে বিবাদি বাগ চত্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত হয়ে এর বিস্তৃতি। অফিস পাড়ার খাবার— বিষয়টা নিয়ে এতবার লেখা হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর ম্যাগাজিনে যে এ নিয়ে নতুন করে আর কিছু লেখার অবকাশ থাকে না। ডাল ভাত থেকে শুরু করে বিরিয়ানি হয়ে রুটি-লুচি-তরকারি মায় খিচুড়ি-পাপড়-চাটনি এমনকী দই চিঁড়ের ফলার, কী না পাওয়া যায় এখানে। এককথায় একটা ওপেন এয়ার কমপ্লিট ফুড হাব। তবু দুটো পদের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। এক) জিলিপি। পাওয়া যায় কিরণশঙ্কর রায় রোডে হাইকোর্টের ঠিক উলটোফুটে। দ্বিতীয় ঠিকানাটি জওহরলাল নেহরু রোডের ওপর মেট্রো রেল অফিসের সামনে। উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরের কোনও ময়রার দোকানের জিলিপি স্বাদে-গন্ধে এর ধারেকাছেও আসবে না। অনেকটা মারকাটারি সেই গানটার মতো। ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না…।’ যখনই যাবেন তখনই হাতে গরম, রসালো মুচমুচে। কামড় বসানো মাত্র অফিসপাড়ার ভিড়, হই-হল্লা, বাস আর ট্যাক্সির প্যাঁ পোঁ… সব কর্পূরের মতো উবে গিয়ে একটা ঘোরলাগা ভাব গোটা শরীরে। এবার পাঠকের করণীয় বলতে বাকি রইল ঘটনাস্থলে গিয়ে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করা। দুই) ঘুগনি। চায়ের দোকান বা চাটওয়ালার হড়হড়ে আর পেঁয়াজ রসুনের ঘ্যাঁট নয়। তেঁতুল জল বা লেবুর রসের কোনও গপ্পো নেই। ট্রেসিং পেপারের মতো পাতলা ছিলেকাটা নারকোলের টুকরো দেওয়া। জমাট এবং খাঁটি নিরামিষ ঘুগনি। শালপাতা বেয়ে একটুও গড়িয়ে পড়বে না। ওপরে ছিটিয়ে দেওয়া এক চিমটে জিরে ভাজার গুঁড়ো আর বিটনুন। ব্যস! তাতেই কিস্তিমাত। মনে আছে ঠিক এইরকম ঘুগনি পাওয়া যেত ছেলেবেলায়, গড়পারে। একটু রাতের দিকে। এই সাড়ে আটটা নাগাদ চাকা লাগানো টিনের গাড়ি ঠেলে আসত সনাতনকাকা। আদতে ওড়িশার বারিপদা নিবাসী। ছোটখাট সৌম্য চেহারা। গলায় কণ্ঠির মালা আর টানা সুরেলা একটা ডাক। ঈষৎ নাকিসুরে—‘ঘুঁ উ উ উ নি।’ শোনামাত্র পাড়ায় একটা হুলুস্থূল পড়ে যেত যেন। পাড়ার ছেলেবুড়ো, মেয়েবউ, সবাই রোয়াক, ঝুলবারান্দা অথবা জানলায়। গাড়ির মধ্যে চৌকোনা একটা পাত্রে চাপ বেঁধে থাকা ঘুগনি। শালপাতার বাটিতে করে। সঙ্গে আইসক্রিমের কাঠ চামচ। ঘুগনির সঙ্গে আরও একটা জিনিস বিক্রি করত সনাতন কাকা। নকুলদানা। খই মুড়ির দোকানে চিনির তৈরি ছোট ছোট অমসৃণ গোলাকার যে বস্তুটিকে আমরা সাধারণত নকুলদানা বলে জানি সেরকমটা নয় মোটেই। ফুরফুরে চিনির আঁশে মাখানো টাটকা খোলাভাজা বাদাম। ঘুগনির পর সেই নকুলদানা। রসনা, স্বাদ এবং স্মৃতি, তিনটেকেই আলোড়িত করে রেখেছে আজও। হুবহু সেই একরকম ঘুগনি আজও পাওয়া যায় অফিসপাড়ায়। লালবাজারের উলটোদিকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ে। ভরাপেটেও ওদিকটা দিয়ে গেলেই একপাতা ঘুগনি মাস্ট। একদিনের জন্যও সে নিয়মের অন্যথা হয়নি অদ্যাবধি।

বাখরখানি। বাখরখণ্ডি নামেও ডাকা হয় পুববাংলা অধুনা বাংলাদেশের কোথাও কোথাও। সনাতন কাকার ঘুগনির মতো এটিও পাওয়া যেত ছেলেবেলায়। সেই উত্তর কলকাতাতেই। ময়দার বানানো অপার্থিব এক খাস্তাভাজা। নুন মিষ্টি দুটোই কম। বেকিং সোডার হালকা গন্ধ। মুখে দিলেই বাক্যহারা, মানে হতে বাধ্য। এতটাই অপ্রতিরোধ্য এর টান। এখন প্রায় অবলুপ্ত। সুন্দরবন, সরিষ্কা বা বান্ধবগড়ের বাঘের মতোই। শুনেছি খিদিরপুর, মার্ক্যুইস স্ট্রিট আর রিপন লেনের দুয়েকটি বেকারিতে এখনও তৈরি হয়। কালেভদ্রে রাস্তাঘাটে দেখা পেয়েছি দুয়েকজন বিক্রেতার। চারদিকে কাচ লাগানো টিনের বাক্স কাঁধে নিয়ে হাঁক পাড়ছেন গলির মোড়ে—“বাখরখানি আছে, বাখরখানি-ই-ই…”। চোখে পড়ামাত্র কিনে ফেলেছি। নিদেনপক্ষে আড়াইশো গ্রাম। ভোরবেলা ভাল ফ্লেভার আর পাতলা লিকারের লাল চায়ের সঙ্গে দু’-চার পিস বাখরখানি মানে বাকি দিনটা ভাল কাটতে বাধ্য। হাতে পেলে মিলিয়ে নেবেন।

দরবেশ বা লাড্ডু তো অনেক খেয়েছেন। বলি আলাউদ্দিনের লাড্ডু চেখেছেন কখনও? ভীম নাগ, নকুড় বা বলরামের মতোই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ডেলিকেসি। প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে চিৎপুর রোডে নাখোদা মসজিদের নীচে প্রাচীন এই দোকান। নামে লাড্ডু হলেও মিল কিন্তু অনেকটা সেই দরবেশের সঙ্গেই। আপাদমস্তক জমাট ক্ষীরের গোল্লার মধ্যে বোঁদের টুকরো। দরবেশের মতো শুধুমাত্র ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া খোয়া ক্ষীরের গুঁড়ো নয়, আলাউদ্দিনের লাড্ডুর মূল উপকরণই খোয়াক্ষীর। লাড্ডু বা দরবেশের তুলনায় মিষ্টি খানিকটা কম। ফারাক শুধু এতটুকুই। এদের আরেকটি অসামান্য মিষ্টান্ন পদের নাম আফলাতুন। দুধ মেরে মেরে কালচে বাদামি হয়ে যাওয়া ক্ষীরের বরফির মধ্যে কাজু, পিস্তা, কিশমিশ আর কাঠবাদামের (আলমন্ড) টুকরো। দিল্লি কা লাড্ডু না খেলে পস্তাতে হয় কিনা জানা নেই তবে আলাউদ্দিনের লাড্ডু আর আফলাতুন না খেলে যে সত্যিই পস্তাবেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

কলকাতার বুকে আজ যারা নিদেনপক্ষে পঞ্চাশ-ষাটের হার্ডল টপকে গেছেন তাদের মনে থাকার কথা ছেলেবেলায় বাড়ির দরজায় দরজায় কালো ট্রাঙ্ক মাথায় ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালাদের। বেশি হাঁকডাক নেই। শুধু ‘কেক চাই’—মৃদু একটা আহ্বান। তাতেই কাজ হয়ে যেত। ‘কেকওয়ালা, এদিকে এসো’… দরজার সামনে গুছিয়ে উবুর হয়ে বসে মাথা থেকে ট্রাঙ্কটা নামাতেন বিক্রেতা। ঢাকনাটা খোলা মাত্র চকলেট-স্ট্রবেরি-অরেঞ্জ-বাটারস্কচ-ভ্যানিলার সে কী দুর্দান্ত মিশ্র সুগন্ধ। থরে থরে সাজানো রঙবেরঙের ছোট ছোট পেস্ট্রি। প্রত্যেকটার তলায় ট্রেসিংপেপারের মোনক। ট্রাঙ্কের ওপর লেখা বেকারির নাম—‘মিসেস সালদানাস কেক’, ‘রেইনবো বেকারি’… ইত্যাদি ইত্যাদি। অনির্বচনীয় সেইসব পেস্ট্রির স্বাদ। মুখে দিতে না দিতেই কোঁত করে গিয়ে সোজা পেটের মধ্যে। পেস্ট্রির ডালাটা সরালে তলায় আরেকটা কম্পার্টমেন্ট। দুভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখা প্যাটিস। চিকেন আর ভেজিটেবল। ওপরের পরতটা সোনালি-বাদামি। মুচমুচে, খাস্তা। ভেতরে আলু-পিঁয়াজ-গাজর আর মুরগির মাংসের সুগন্ধি পুর। ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী তুলে দেওয়া হত হাতে হাতে। যে সময়ের কথা বলছি তখন বাড়ির নীচে পাড়ার মোড়ে মোড়ে কেক পেস্ট্রির দোকানের গাদা লেগে যায়নি। নিউ মার্কেট, গ্রেট ইস্টার্ন আর ফ্লুরিজের বাইরে আর কোথাও এসব জিনিস পাওয়া যেত না। একমাত্র বড়দিনের সময় স্টেশনারি দোকানে সাজানো বড়ুয়ার কেক ছাড়া। ফলে রেইনবো বেকারি আর মিসেস সালদানারাই ছিলেন সেসময় মধ্যবিত্ত বাঙালির পেস্ট্রি ভরসা। বহুদিন হল হারিয়ে গেছেন শহর থেকে। সঙ্গে হারিয়ে গেছে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো সেই সুরেলা ডাক— ‘কেক চাই।’

কেক-পেস্ট্রি-প্যাটিসের কথা যখন উঠল তখন তো একবার যেতেই হবে নিউমার্কেটে। মানে কেক গলিতে। সরু গলিটা জুড়ে রঙবেরঙের কেক, পেস্ট্রি আর ক্যান্ডির মেলা। ম ম করছে সুগন্ধে। ছুটিছাটায় বাবার সঙ্গে ওদিকটায় গেলেই বায়না করতাম ‘জুজুপ’ কিনে দেবার জন্য। না লজেন্স, না চকলেট। থরে থরে সাজানো থাকত দোকানের সামনে কাঠের ডালায়। চিনির আবরণের তলায় স্ট্রবেরি-গোয়াভা-অরেঞ্জ জেলির ছোট ছোট তুলতুলে টুকরো। কোন বেহেস্তের বেকারিতে তৈরি হয় কে জানে? আজও ওদিকটা দিয়ে গেলে টুক করে কিনে ফেলি এক ঠোঙা। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে টুপ করে একটা মুখে ফেলে দিয়ে চারপাশটা ভাল করে দেখে নিই একবার। চেনাশোনা কেউ দেখে ফেলল না তো? বাড়িতে কমপ্লেন করে দিলেই চিত্তির। ‘ছি ছি… বুড়ো বয়সে… লজ্জা করে না? তোমার না সুগার?…” হোম ফ্রন্টের বাক-মিসাইলের আঘাতে আঘাতে জেরবার হয়ে যেতে হবে একেবারে।

কেক গলি ধরে মিটার পঁচিশেক এগোলেই আর এক কেক কিংবদন্তী নাহুমের গা ঘেঁষেই ম্যাক্স-ডি-গামা। হালফিলে নামীদামি দেশি বিদেশি সব বেকারির ভিড়ে হারিয়ে গেছে নামটা। পুরনো কলকাতায় কেক-পেস্ট্রির সমার্থক পাঁচটি নাম। নাহুম-গ্রেট ইস্টার্ন-ফিরপো-ফ্লুরিজ আর অতি অবশ্যই ম্যাক্স-ডি-গামা। কনফেকশনারির পঞ্চপাণ্ডব। ম্যাক্স-ডি-গামা। সময়ের কালগ্রাসে তার অতীত জৌলুস হারিয়েছে অনেকদিন। তবু একবার যান। (যদি বন্ধ না হয়ে গিয়ে থাকে এখনও)। পুরনো কাঠের দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়ুন ভেতরে। অরেঞ্জ, চকলেট, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি… কলকাতা সেরা অ্যাসর্টেড পেস্ট্রি এখানেই পাওয়া যায়।

কেকের কথা যখন উঠলই তা হলে তো একবার যেতেই হবে বো-ব্যারাকে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউর গায়ে বউবাজার থানার পাশে। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের থাকার প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল এই ব্যারাক। দু’পাশে লম্বা লাল ইটের দুটো ব্যারাকবাড়ি। মাঝখানে প্রশস্ত রাস্তা। কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের একটা উল্লেখযোগ্যঅংশের বাস এখানে। এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা। তবু যারা রয়ে গেছেন তাদের মধ্যে বিশেষ করে প্রবীণাদের হাতে আজও রয়ে গেছে এক জাদু-রসুইঘরের চাবিকাঠি। কেক আর ওয়াইন। আমাদের পৌষপরবের পুলিপিঠের মতো। বানানো হয় শীতকালে, বিশেষত বড়দিন আর নববর্ষের সময়। তা ছাড়া শীতকালটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিয়ের মরশুমও বটে। এই সময় চাহিদা তুঙ্গে ওঠে কেক আর ওয়াইনের। মদিরা রন্ধন-পটীয়সী ঠাকুমা-দিদিমাদের দরজার সামনে ভিড় বাড়ে। সঙ্গে উইন্টার থুড়ি ক্রিসমাস স্পেশাল কেক। আপনিও যান। কিনে ফেলুন প্লাম, ফ্রুট অথবা প্লেন কেকের মধ্যে যেটা খুশি। নামীদামি বেকারির কেক তো সবসময়ই খাচ্ছেন। বো-ব্যারাকের কেক একবার ট্রাই করুন। চেনা রুট বদলে ফেলবেন। একদম সিয়োর। অতঃপর মদিরা পর্ব। গ্রেপস, জিঞ্জার, বানানা আর লিচি— এই চার ধরনের ওয়াইন বানানো হয় এখানে। আমি চিরকেলে অম্বুলে রুগি। সাধারণত টক স্বাদের ওয়াইন খেলে গ্যাস অ্যাসিডিটির সমস্যা হয় একটা। ব্যতিক্রম বো-ব্যারাক আর এদের টকমিষ্টি ঝাঁঝালো স্বাদের ওয়াইন। মদিরা জাদুকরীদের অন্যতম দু’জন, জর্জিনা আর সুজানা আন্টি। বহু বছর ধরে উত্কৃষ্ট হোম মেড ওয়াইন বানিয়ে চলেছেন এই শহরে। এরপর আর একটাও কথা নয়।

ফের সেই ছেলেবেলা। আর ছেলেবেলা মানেই টিফিনের সময় আর ছুটির পর ইস্কুলের গেট। মাস্টারমশাইদের প্রবল চোখরাঙানি আর ‘পেটখারাপ হবে!’ ধরনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছোট ছোট লাল পুঁতির মতো মশলা মাখানো বুনোকুল, হজমি, কাঠির আগায় লাল নীল বরফগুঁড়ো আর সরবতের তীব্র আকর্ষণ। সেটা যে কত তীব্র হতে পারে যারা ইস্কুলে গিয়েছেন তাদের কাউকে নতুন করে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। মনে মনে ভাবতাম ওসব বোধহয় আমাদের মতো বুড়ো হাবড়াদের নস্টালজিয়ার কচকচানি। এতদিনে নিশ্চয় চুকেবুকে গেছে ওসব। এহেন ধারণাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত করে সেদিন চোখ গেল মধ্য কলকাতার নামী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গেটে। ইস্কুল ছুটির পর গেটের সামনে নামীদামি ব্র্যান্ডের আইসক্রিম আর চিপসের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফেরিওয়ালারা। সেসবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেটের একপাশে রঙিন শরবতের ঠেলাগাড়ি আর হজমির ডালার সামনে ভিড় জমিয়েছে সম্পন্ন ঘরের খুদে পড়ুয়াদের দল। জোগান দিতে দিতে হাঁফিয়ে উঠেছেন বিক্রেতা। হাতের কাঠিতে গোঁজা রামধনু রঙা জমাট বরফের কুচি। ঠোঁটে, গালে, ইউনিফর্মে লেগে যাওয়া লাল, নীল, সবুজের ছোপ। কচি মুখে গোটা একটা পৃথিবী জিতে ফেলার হাসি। দেখামাত্র মনে হল সবকিছুকে এক ছাঁচে মুড়ে ফেলতে চাওয়া বিশাল এই বিশ্বায়নের বাজার কোথায় যেন গো-হারা হেরে গেছে ছোট্ট ওই একটুকরো হাসির সামনে। অন্য খাবারের শেষপর্বে পৌঁছে এটুকুই তো পাওনা এই অধম প্রতিবেদকের।

* লেখাটা শেষ করার কিছুদিন পর জানতে পারলাম কোনও অজ্ঞাত কারণে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ধাবা বন্ধ হয়ে গেছে। কলকাতার সেরা খাদ্য নক্ষত্রমণ্ডলীর একটি তারকার পতন ঘটে গেল। এছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *