০৪. ময়দান-ই-কলকাতা

ময়দান-ই-কলকাতা

“বুঝলি তো, নেক্সট সিজনে বাবুদা বলেছে এরিয়ানে সাইন করিয়ে দেবে। তিরিশ হাজার অ্যাডভান্স… থোক হাতে হাতে। পেলেই নাইকের সি আর সেভেন বুটটা কিনে ফেলব। ওই তোর ময়দান মার্কেটের আলি জালি মাল নয়। এ্যাক্কেবারে অরিজিনাল। গ্র্যান্ডের তলায় কাচের শোকেসে সাজানো রয়েছে। সাত হাজার মতো পড়বে। আসতে যেতে রোজ দেখি একবার করে। অনেক দিনের ইচ্ছে মাইরি… শুধু একবার সাইনটা হয়ে গেলেই…।” “হবে হবে গুরু, চিন্তা করবি না একদম। চোখের সামনে মেহতাবকে দ্যাখ। বাসুদেবকে দ্যাখ… বাসুদেব, কালীঘাটের ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান ছিল ওর বাবার। সেখান থেকে উঠে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান হয়ে ইন্ডিয়া ক্যাপটেন। ভাবা যায়! ওদের যদি হয় তা হলে আমাদের হবে না কেন?… চ চ, তাড়াতাড়ি পা চালা… ওদিকে আবার প্র্যাকটিসে দেরি হয়ে যাবে।”

ভোরবেলা। কুয়াশাঘেরা ময়দান। কথা বলতে বলতে মেয়ো রোডের মোড় পার হচ্ছিল ছেলে দুটো, রোগা, কালোকালো চেহারা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ময়দান মার্কেটের সস্তা জার্সি, মোজা, অ্যাংক্লেট, বুট, নিক্যাপ…। চোখ-ভরতি স্বপ্ন। বাসুদেব মণ্ডল, মেহতাব হোসেন হয়ে ওঠার। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো সাত হাজারি বুট পরে মাঠে নামার… তারপর ব্যাঙ্ক বা মেট্রোরেলে একটা চাকরি। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, চার্চিল, ডেম্পো, ইন্ডিয়ার জার্সি, হালিশহর বা চাকদায় পুরনো ধচাপচা টালির বাড়িটা ভেঙে দোতলা বাড়ি একটা। ই এম আইয়ে কেনা বাইক, স্মার্ট ফোন… জন্মে ইস্তক দেখে আসা খাটতে খাটতে কোলকুঁজো মেরে যাওয়া দোকান কর্মচারী বাবার একটু অবসর। সাত সকালে উঠে কয়লার উনুনে ফুঁ দিতে দিতে গলার শিরা নীল হয়ে যাওয়া মা’র জন্য একটা গ্যাসওভেন। দিদিটার বিয়ে… তাবৎ স্বপ্ন চোখে পুরে ওই দুটো ছেলের মতো আরও হাজার হাজার ছেলে লোকাল ট্রেন আর কলকাতা-মফস্সল বাসে চেপে ভোরের ময়দানে পাড়ি জমায় রোজ। শুধু কি ছেলেরা? ঠিক একইরকম সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা মেয়ের দল, পরনে রং চটে যাওয়া মলিন ট্রাকসুট, তার চেয়েও মলিন চোখমুখের চেহারা, দৌড়োচ্ছে রেড রোডের ধারে ঘাসজমিতে, মোহনবাগান ক্লাবের গায়ে ফুটপাত ধরে। প্রাণ আর ইজ্জত হারানোর ভয়কে নিত্যসঙ্গী করে। এই তো কয়েক বছর আগে কিছু ধনীর দুলাল চলন্ত গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে ওদের মতো একজনকে ধরে ফেলেছিল খপ করে। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেছিল দুশো মিটারখানেক। তারপর আহত অবস্থায় ফেলে দিয়ে খ্যা খ্যা হায়না হাসি হাসতে হাসতে চলে গেছিল গাড়ি চালিয়ে। তবু মেয়েগুলো আসে। কারণ ওই যে স্বপ্ন। বুট-জার্সি কাঁধে রাস্তা পেরোনো ওই ছেলেদুটোর মতো। শুধু স্বপ্নের নামগুলো বদলে গেছে। বাসুদেব, মেহতাবদের জায়গায় জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সোমা বিশ্বাস, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার… বাকিটা হুবহু এক।

কলকাতা ময়দান। সেই ব্রিটিশ আমলেরও আগে থেকে শহরের বুকে বড় একটুকরো সবুজ। কলকাতার ফুসফুস। সারা দেশে আর কোনও শহরে একলপ্তে এতটা ফাঁকা সবুজভূমি রয়েছে বলে এই প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় এই ময়দান। একে ঘিরে গড়ে ওঠা কত মিথ, কত রহস্য, কত স্বপ্ন গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার কাহিনি। কাকভোর থেকে গভীর রাত— পরতে পরতে রং বদলায় এর। বদলে যায় চরিত্র। সকালের প্র্যাকটিস সেরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের গায়ে গায়ে লেগে দুপুর নেমে আসে ময়দানে। সি এ বি ক্লাব হাউসের উলটোদিকে বিখ্যাত বটতলা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান আর মহামেডান মাঠের ফাঁকা গ্যালারি আর আশপাশের ফাঁকা জমিতে, রেড রোডের পাঁচিলে, কার্জন পার্কের আনাচেকানাচে, ইডেনে প্যাগোডার ছায়ায় ছোট ছোট জটলা। কতরকম আড্ডা। কতরকম মানুষ। ভবঘুরে, চিটিংবাজ, বেকার, নিত্যরোজ অফিসের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া চাকরি খোয়ানো মানুষ, গেঁজেল, তাসের জুয়াড়ি, ক্লাব টেন্টের ধারে বসে সেই কবে হাবিব, পরিমল দে, সুধীর কর্মকার, আর ফুটবলের স্বর্ণযুগ চর্চায় ব্যস্ত ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারার লোকজন, চোলাই মদ, ড্রাগ আর রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ফোলা ফোলা ফ্যাকাসে চোখমুখের পেশাদার রক্তদাতা। ফোর্ট উইলিয়ামের দেয়াল ঘেঁষা ঝোপঝাড়ে ভর দুপুরবেলায় খদ্দেরকে হাতছানি দেয়া সস্তা বেশ্যা, আধময়লা ফাটাফুটো শাড়ি, ময়দানের পুকুরে কঞ্চির ছিপে কেঁচো গেঁথে ত্যালাপিয়া ধরা কাঙালি, ছাগল ভেড়া চরানো হাটুরে, উনুনের ওপর কেটলি বসিয়ে এ আড্ডা থেকে ও আড্ডায় ঘোরাফেরা করা চাওয়ালা… বেমতলব গরিব মানুষজন সব। নবারুণের ভাষায় ফ্যাতাড়ু। সারপ্লাস পিপল, অলস দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে ময়দানে। দুপুরের নিঝুম অলস ভাবটা একঝটকায় মুছে যায় ময়দানের মুখ থেকে। বিশেষত ফুটবলের মরশুমে। হাওড়া, তালতলা, বাগবাজার, দমদম, বেলঘরিয়া, যাদবপুর, চিৎপুর, কলুটোলা, রাজাবাজার থেকে দলে দলে ময়দানমুখো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান সমর্থক আর তাদের জঙ্গিপনাকে সামাল দিতে ঘোড়সওয়ার পুলিশ। যদিও আই পি এল, আই এস এল আর ফি শনি-রোববার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দাপটে কলকাতা ফুটবলের সে রমরমা আর নেই, একইসঙ্গে সমর্থকদের মধ্যে ষাট-সত্তরের সেই উগ্র জঙ্গিপনার ভাবটা অনেকটাই অন্তর্হিত এখন, তবুও রোজ সকাল বিকেল দু’বেলা ময়দানে মাউন্টেড পুলিশের উপস্থিতি ইংরিজিতে যাকে বলে— ‘মাস্ট,’ ময়দানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আজও অনেকখানি ওদেরই হাতে। এ ছাড়া ফুটবলের পাশাপাশি ময়দানের সর্বত্র বিরাজমান বাঁধাকপি, টমাটো বা ধনেপাতার মতো বারোমেসে হয়ে যাওয়া ক্লাব ক্রিকেট, ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং ক্যাম্প আর বাঁশের খুঁটিতে জাল টাঙিয়ে নেট প্র্যাকটিস। নেটে অনুশীলনরত কচি কচি মুখ। গ্রীষ্মের তপ্ত অপরাহ্ণে ঘেমে পুড়ে লাল। মাঠের একধারে রাখা ইয়া ঢাউস কিটসব্যাগ আর হাতে হেল্থ ড্রিংকসের বোতল, উদ্বিগ্ন মায়ের দল। সবাই ছেলেকে সৌরভ বানাতে চান, এই সর্বগ্রাসী ক্রিকেট ম্যানিয়ার দাপটে পিছু হটতে হটতে প্রায় দেয়ালে পিঠ ঠেকার জোগাড় গরিবগুর্বো ময়দানি ফুটবলের। অতীতে ফুটবলের আঁতুড়-ঘর একাধিক বিখ্যাত সব ক্লাব এরিয়ান, রাজস্থান, খিদিরপুর, উয়াড়ির তাঁবুগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত চেহারা দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। কংকালসার কাঠামো জীর্ণ তেরপলের ছাদ, ফুটো দিয়ে জল পড়ে বর্ষাকালে। অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও ময়দানের বুকে। ক’দিন থাকবে জানা নেই, ভাবলেই ভারী হয়ে যায় মনটা। যাকগে, আপাতত এই মনখারাপের এলাকা থেকে বেরিয়ে চলুন একটু অন্যদিকে নজর ঘোরানো যাক। সারাবছর প্রায় নিয়মিত খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলোর পাতা ওলটালেই বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ দোকান এমনকী ফুটপাতের খাবার নিয়েও প্রচুর লেখা দেখতে পাওয়া যায়। কেন জানি না ময়দান সেই তালিকায় ব্রাত্য অদ্ভুতভাবে। অথচ সকাল থেকে রাত অবধি কতরকম খাবারের যে আনাগোনা উপস্থিতি গোটা ময়দান জুড়ে। যার মধ্যে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ— ‘ডান্ডাপানি’ এ রাজ্য তো বটেই, সারা দেশে তথা বিশ্বের আর কোথাও এ বস্তুটি পাওয়া যায় বলে জানা নেই। একমাত্র এই ময়দান চত্বর ছাড়া। দু’চাকার ঠেলাগাড়িতে বসানো একটা বড় টিনের ড্রামে ভরতি জল। এটা ডান্ডা-লাগানো পাত্রে তুলে চোঙার মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করা হয় গেলাসে গেলাসে। প্রয়োজন মতো লেবুর রস, বরফ, জলজিরা, বিটনুন বা স্যাকারিন সিরাপ মিশিয়ে। স্বাদে লা-জবাব, অত্যন্ত সস্তা, সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত। দীর্ঘদিন ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতা ময়দান চত্বরে। ডান্ডাপানি খেয়ে কারও পেট খারাপ হয়েছে বলে শুনিনি কোনওদিন। তবে সবকিছুর ওপরে থাকবে বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুতে ক্যান্টিনের খাবার। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ভেজিটেবল চপ আর ঘুগনি, হাওড়া ইউনিয়ন টেন্টের ফ্রিশফ্রাই। ছাঁকা তেলে ভাজা সোনালি কুইজিন! এককথায় দেবভোগ্য। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু সেরার সেরা অবশ্যই কাস্টমস বা সেন্ট্রাল এক্সাইজ টেন্টে বাটার টোস্ট, চিকেন অথবা ভেজিটেবল স্টু। দুধসাদা পিরিচে পেঁপে, গাজর, আলু আর আর তাজা মুরগির মাংস, ফ্রেশ ক্রিমের মাধুরী মিশিয়ে, গরম গরম। সাহেবি কেতায় যাকে বলে ‘পাইপিং হট’। এককথায় অলৌকিক এক পাকপ্রণালী। সঙ্গে কড়া লিকারের চা, সঠিক পরিমাণে দুধ মিশিয়ে। জাস্ট কোনও কথা হবে না।

এই চত্বরে যাদের বহুদিনের আনাগোনা তাদের অবশ্যই মনে থাকবে আনন্দবাজার তাঁবু ক্যান্টিনে গরম ঝরঝরে সরু চালের ভাত আর কাটাপোনার ঝোল। ধোঁয়া ওঠা থালার একপাশে আধ টুকরো পাতিলেবু আর পেঁয়াজ। মনে পড়তেই অ্যাতোদিন বাদেও স্যালাইভার নিঃসরণ জিভের ডগায়। আসলে সময় তখন অনেক অলস, সহজ সরল আর নিরুপদ্রব ছিল। সেই পুরনো ইডেন গার্ডেন। পাঁচ দিনের টেস্টম্যাচ। চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েসলি হলের বাম্পার বল (বাউন্সার নয়), চন্দ্রশেখরের বিষ মেশানো স্পিন আর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের লেটকাট দেখে লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে অনেকেরই ঠিকানা সোজা আনন্দবাজার ক্যান্টিন। টেস্ট ক্রিকেট থেকে পুরনো ইডেন গার্ডেন— সময়ের করাল গ্রাস অনেক কিছুই খেয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী সময়ের থাবা এড়িয়ে আনন্দবাজার ক্যান্টিনের মাছের ঝোল ভাত আজও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা জানা নেই। আপাতত স্মৃতিসরণি থেকে বেরিয়ে একটু অন্য পথে হাঁটা যাক। ময়দানের এ অঞ্চলটা ছেড়ে রেড রোড টপকে শহিদ মিনারের তলায় পড়ন্ত বিকেলে রচিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্যপট। মিনার লাগোয়া ময়দান জুড়ে বসে গেছে বিকিকিনির হাট। শেকড়বাকড় আর হেকিমি তেলের পশরা সাজিয়ে বসা বেদে-বেদেনি, ঢোলক বাজিয়ে খনখনে যৌন আবেদন মাখা গলায় আদি রসাত্মক গান গাওয়া যাযাবরী মহিলারা, দড়ির ওপর দিয়ে বাঁশের পোল হাতে ব্যালান্স করে হেঁটে যাওয়া বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে। অ্যালুমিনিয়ামের ত্যাড়াব্যাঁকা থালা নিয়ে দর্শকদের কাছে পয়সা চাওয়া ছোট ভাইটা, একটু আগে টায়ারের রিঙের ফাঁক দিয়ে গলে যাবার খেলা দেখিয়েছে, জটপাকানো চুল, চোখে তিনদিনের পিচুটি… দড়ি বেয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। শতচ্ছিন্ন নোংরা ফ্রক, মুখে চাপ চাপ ময়লা, জটপড়া চুল, চোখে অপার ক্লান্তি। দড়ি টাঙানোর বাঁশের এক কোণে অপেক্ষারত সতর্ক বাবা মা। এ প্রান্তে এসে বাঁশটা ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পড়া মাত্র লুফে নেবে মেয়েকে। একটা গোটা সার্কাস পরিবার। এর থেকে হাত দশকে দূরে ছোট টুল পেতে বসে সান্ডার তেল আর শিলাজিৎ বেচছেন জাঁদরেল চেহারার খান সাহেব। পরনে পাঠান স্যুট। মাথায় বিশাল পুশতুনি পাগড়ি। পাশে দাঁড়ানো তাগড়াই চেহারার তিন ছেলে। সহকারী। বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার ছাড়ছেন খান সাহেব, “ইয়ে বাঙালি! মুড়ি খাকে বাড়ি বনাতা হায়। লেকিন জওয়ানি কে উপ্পর ধ্যান নহি দেতা… মেরি বাত মানো, ইয়ে খান কা শিলাজিৎ লো। রাত কো অ্যায়সা খেল খেলোগে কি বিবি পুছেগি— ‘ওয় মেরি জান, তুমনে আজ ক্যা খায়া?’ তব তুম বিবিকো বতানা— ‘হাম খান কা শিলাজিৎ খায়া’…” গলা চড়ছে খান সাহেবের। ভিড় বাড়ছে খান সাহেবকে ঘিরে। দুর্বল বাঙালি জাতিকে পুরুষ বানানোর ইজারা নিয়েছেন খান সাহেব। বরাবর খেয়াল করেছি যারা খান সাহেবের আসল খদ্দের, তারা কখনওই বক্তৃতা চলাকালীন কেনাকাটা করবেন না। ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকবেন ভিড়ের পিছনে। ভাষণ শেষ হবার পর আনকা পাবলিকের ভিড় হালকা হয়ে গেলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে খানসাহেবের সামনে ঝুঁকে পড়ে মিনিট দুয়েক গুজগুজ ফুস ফুস। জেনে নেওয়া ব্যবহারের নিয়মকানুন। মানিব্যাগ থেকে দ্রুত বের করে আনা কয়েকটা দশ বিশ টাকার নোট। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতে পাওয়া মাত্র টুক করে কেটে পড়া অকুস্থল থেকে। কোনওদিক না তাকিয়ে। খান সাহেবের প্রায় গা ঘেঁষে ইয়াসিন। মেটিয়াবুরুজে বাড়ি। সঙ্গে ভুল্লু। হাড় জিরজিরে নেড়ি কুকুরছানা। ইয়াসিনের নির্দেশে একটা ডালডার কৌটোর ওপর উঠে দাঁড়াবে ভুল্লু। ফের নেমে আসবে। আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট আরেকটা কৌটো চড়ানো হবে ডালডার কৌটোর ওপর। ফের চড়ে বসবে ভুল্লু। এভাবে ক্রমাগত কৌটোর আকার ছোট হতে হতে একটা জর্দার কৌটো। ভুল্লুর দাঁড়াবার শেষ আশ্রয়স্থল। চারপাশে ফটাফট হাততালি আর ছুঁড়ে দেয়া একটাকা। দু’টাকা… ইয়াসিন আর ভুল্লুর পেটের ভাত। সেই ছোটবেলায় দেখা রাশিয়ান সার্কাস থেকে নিয়ে জেমিনি সার্কাস, কমলা সার্কাস… বাঘ, সিংহ, হাতি, শিম্পাঞ্জি, কুকুর… এক সে না মানুষি খেলোয়াড়ের কসরৎ আর কেরামতি দেখেছি। ভুল্লুর তুল্য খিলাড়ি চোখে পড়েনি আজ অবধি। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কথাটা।

আসুন এবার খানসাহেব, ইয়াসিন আর ভুল্লুর থেকে নজর সরিয়ে আরেকটু সামনে এগোনো যাক। স্পোর্টিং ইউনিয়ন আর কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের তাঁবুর মাঝখানে একটুকরো ঘাসজমিতে একটা জলচৌকির ওপর রামচরিত মানস রেখে দুলে দুলে পড়ে চলেছেন কথকঠাকুর— “বন মে চলে রামচন্দ্রজী/পিছে সীতা, লছমন ভাই…” পরনে শ্বেতশুভ্র ধুতি-ফতুয়া, কপালে চাল-চন্দন আর সিঁদুরের টিকা, গানের গলাটি ভারী মিঠে। সামনে বসা নিম্নমধ্যবত্তি অবাঙালি ভক্তের দল। সপরিবারে। প্রতিটি দোঁহা শেষ হবার পর হেঁকে উঠছেন কথকঠাকুর— “জয় সিয়া বোলো রামচন্দ্রকি…” “জয়!” সমবেত গলায় সাড়া দিচ্ছে ভক্তরা। পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাঠিতে টাঙানো বেলুনওয়ালা, চিনেবাদাম, ঝালমুড়ি, কাটা শাঁখালু, বাচ্চাদের জন্য সস্তা ছিটের ফ্রক-জামা বিক্রেতার দল। প্রবচনসুধা পানের পাশাপাশি কেনাকাটাও চলছে টুকটাক। কথকতা শেষ। রামচরিতমানস বন্ধ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন কথকঠাকুর। মিষ্টি হেসে নমস্কার করছেন। ভক্তরা যে যার সাধ্যমতো পাঁচ টাকা, দশ টাকা নামিয়ে রাখছেন সামনে। প্রণাম করছেন সাষ্টাঙ্গে। কথকঠাকুর তাতেই খুশি। যতবার দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে— ‘আরে, এটাই তো আমার দেশ। ভারতবর্ষ ছড়িয়ে রয়েছে এই একফালি ময়দানে।’

ছায়ামূর্তিরা আসে জীবিকার সন্ধানে

অতঃপর সন্ধে নামে ময়দানে। নিঝুম হয়ে আসা ক্লাবতাঁবু। টিম হারার দুঃখে ম্লানমুখ সমর্থক, যাযাবরি মেয়েরা, মাদারি পরিবার, খানসাহেব, ইয়াসিন, ভুল্লু, কথকঠাকুর, ক্লান্ত খেলোয়াড় আর রেফারির দল… সবাই ঘরমুখো আজকের মতো। ময়দান মার্কেটে জামাকাপড় আর খেলার সরঞ্জামের দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়তে থাকে। একটু দূরে বাসগুমটি থেকে ভেসে আসা ‘মালদা, রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ি…’ হাঁক। দিনের বেলা ময়দানের চরিত্ররা প্রায় সবাই চলে গেলেও থেকে যান ঝালমুড়ি, বাদামওয়ালার দল। এদের সঙ্গে এসে যোগ দেন আরও কিছু বিক্রেতা যাদের দিনের বেলা কখনওই দেখা যাবে না ময়দানে। যেমন বিমলদা। গামছার বিড়ে বাঁধা মাথার ওপর গরম ঘুগনির ডেকচি। শালপাতার বাটিতে করে ধরিয়ে দেন খদ্দেরদের হাতে হাতে। বিমলদা একসময় ডানলপে চাকরি করতেন। সব খুইয়ে ডেকচি মাথায় এই রাতের ময়দানে। বন্ধ কারখানার দরজা কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। শুধু কাড়তে পারেনি ঠোঁটের কোণে কখনওই হার না মানা জেদি নাছোড় হাসিটা। সেলাম বিমলদা। বিমলদা ছাড়াও রাতের ময়দানে অবশ্যই দেখা মিলবে নরহরিদার। নরহরি বেহড়া। আদি নিবাস ওড়িশার জগত্সিংহপুর। গলায় ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে কুলফি মালাই। ভারী মিঠে গলায় ‘কুলফিইই… কুলফি মালাইইই…’ ডাকটা শুনলে খাওয়ার আগেই প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। নরহরিদার মূল আকর্ষণ গাঢ় সবুজ রঙের সিদ্ধিমেশানো কুলফি। রসিকজনেরা তেমনভাবে চাইলে কুলফির সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাওয়া যায় খানিকটা কাঁচা সিদ্ধিবাটা। অলৌকিক এক দুনিয়ায় পৌঁছে যাবার চাবিকাঠি।

রাত বাড়ে ময়দানে। অন্ধকারে হাতে ছোট ছোট তেলের শিশি ঝুলিয়ে তেলমালিশওয়ালার চাপা কণ্ঠস্বর— ‘তেলমালিশ…’। মোটামুটিভাবে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে কার্জন পার্ক থেকে নিয়ে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড— এই পুরো ময়দান চত্বরটা চলে যায় ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের দখলে। এদের মধ্যে একটা অংশের সঙ্গে রাতের বেলা ময়দান পাহারাদার পুলিশদের একাংশের নিবিড় ব্যবসায়িক সম্পর্ক। সিক্সটি-ফর্টি পার্সেন্টেজ। অনভিজ্ঞ খদ্দেরকে ফুসলে ফাসলে নিয়ে ময়দানের অন্ধকারে বসা মাত্র চুপিসারে যমদূতের মতো মাটি ফুঁড়ে উদয় হয় নগরকোটালের দল। এর পরের অঙ্কটা অত্যন্ত সোজা। পুলিশরা ঘিরে ফেলা মাত্র নিপাট নিরীহ মুখে উঠে চলে যাবে মেয়েটি। অতঃপর কড়া ধমকধামক, গালাগালি, প্রয়োজনে হালকা দুয়েকটা চড়চাপড়… পকেটের শেষ কড়িটুকু খুইয়ে ভয়ে, লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে খদ্দেরের ময়দান থেকে বেরিয়ে আসা। এই একই ছকে খেলাটা চলে আসছে বহুদিন ধরে। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার সেটা হল এই ময়দান এলাকায় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যৌনকর্মীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পুরুষ। এরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। ছোট ছোট তিন চারজনের দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়ায় খদ্দেরের সন্ধানে। মূলত রেড রোড আর কার্জন পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে এদের অবাধ বিচরণ। অনেকেরই শাড়ি অথবা সালোয়ার কুর্তার ভাঁজে লুকোনো থাকে ক্ষুর। বেগতিক বুঝলে ধাঁ করে চালিয়ে দিতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না। অতএব রাতের ময়দানে সাধু সাবধান! তবে সর্বত্রই যে ছবিটা একইরকম সেটা বলা যাবে না কিছুতেই। ময়দানের ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা অধিকাংশই আসেন একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত গরিবগুরবো ঘর থেকে। সন্ধে থেকে শুরু করে ভাগ্য ভাল থাকলে আর কোনওমতে দেড় দুশো টাকা রোজগার হয়ে গেলেই দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে ময়দান ছেড়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেন প্রত্যেকে। কারণ রাতের ময়দানে ওদের ভাষায় ‘কাজ’ করাটা প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরাফেরার সামিল। এই ত্রাসের অন্যতম কারণ আশপাশে হেস্টিংস, রিপন স্ট্রিট, কলিন লেন, মার্কুইস স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলের লুম্পেন বাহিনী। যখন তখন এরা হানা দেয় রাতের ময়দানে। একবার কাউকে ধরতে পারলে যৌন কর্মীদের নিজস্ব ভাষায় পাঁচ সাতজন মিলে ‘বসে’ (পড়ুন ধর্ষণ করে) চলে যাবে। একটি পয়সাও ঠেকাবে না। চাইতে গেলে কপালে জুটবে চড়থাপ্পড়, লাথি ঘুষি এমনকী গালে ক্ষুরের দাগ। তাই সেধে কে আর বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়। একদিকে রাতপাহারাদার পুলিশের একাংশ অন্যদিকে দলবদ্ধ নেকড়ের মতো হিংস্র লুম্পেনবাহিনী— এই দুয়ের মাঝখানে পড়ে শাঁখের করাতের মতো খণ্ডিত হতে থাকেন রাতের ময়দানে যৌনকর্মীরা। পিষে যান জুলুমের জাঁতায়। ময়দান অঞ্চলে যে-কোনও যৌনকর্মীকে জিজ্ঞেস করলে একথার সমর্থন মিলবে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম একবার। আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগেকার কথা। সময়টা শীতকাল। রাত আটটা মতো হবে, এই অধম প্রতিবেদক ও তার এক অনুজপ্রতিম সিনেমা সমালোচক ও ডকু-ফিল্মমেকার বন্ধু (ইদানীং কিঞ্চিৎ স্বনামধন্য হওয়ায় নামটা আর এখানে উল্লেখ করলাম না), সদর স্ট্রিটে কাইয়ুমের ঠেক থেকে কেনা বাবা ভূতনাথের প্রসাদে ঝিমঝিম নেশায় বুনুয়েল, ঋত্বিক, আইজেনস্টাইন নিয়ে গুরুগম্ভীর তর্ক চালাচ্ছি গ্র্যান্ডের উলটোদিকে মনোহরদাস তরাগের রেলিঙে বসে। সামনে প্রেসক্লাবের গায়ে লাগা ময়দান। সেসময় এখনকার মতো ঘেরা ছিল না জায়গাটা। অন্ধকার মাঠে ইতিউতি ঘোরাফেরা করা যৌনকর্মীরা। মাঝেমাঝে সামনে এগিয়ে আসা খদ্দের। দরদামে পটলেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মিলিয়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে। হঠাৎই তীব্র হেডলাইটের আলোয় রাতকে দিন করে দিয়ে ময়দানে ঢুকে পড়ল মিলিটারি পুলিশের জোঙ্গা জিপ। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামা জওয়ানের দল। ভারী বুটের দাপাদাপি ময়দান জুড়ে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও এক হতভাগিনী ধরা পড়ে গেল। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসা হল জিপের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে, গাল লক্ষ্য করে বিরাশি সিক্কার চড়টা নেমে আসার আগের মুহূর্তে কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা— “মারবেন না বাবুগো! পেটে বাচ্চা আছে,” বনেটে হেলান দেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখে জান্তব হাসি। হিসহিসে গলায় আদেশ উচ্চারিত হল— “শালিকা সিনা দাবাকে দেখ, দুধ হায় কি নেহি,” মুহূর্তের মধ্যে হুকুম তামিল অক্ষরে অক্ষরে। অন্ধকারে ব্লাউজ ছেঁড়ার পড়পড় শব্দ। হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বালিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটার ওপর নজর চালিয়ে তবে নিশ্চিন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। “ছোড় দে শালিকো,” অতঃপর রেহাই হতভাগিনীর। পুকুরের ধারে রেলিঙের ওপর বসা ঝিমঝিমে নেশা ফেটে চৌচির এক মুহূর্তে! খালি মনে হয়েছিল ঠান্ডা ঘরে নারীমুক্তির সেমিনার, গুরুগম্ভীর বক্তৃতা, পাতার পর পাতা ভারী ভারী প্রবন্ধ উওমেনস লিব-এর ওপর… এ সবের আওতা থেকেই ময়দান এলাকাটা কতদূর?

রাতের ময়দান। বিপদসংকুল, রহস্যময় আর একইসঙ্গে তীব্র আকর্ষণীয়। একবার যাকে ধরেছে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো বারবার সে ফিরে যাবে ময়দানে। মনে পড়ছে ফোর্ট উইলিয়ামের একদম শেষপ্রান্তে প্রিন্সেপ ঘাটের ঠিক উলটোদিকে জোকারের ব্ল্যাক মদের ঠেক। বিয়ার থেকে শুরু করে রাম, হুইস্কি, ভোদকা, জিন… যা চাও সব মিলবে এখানে। রাতের বেলা বিশেষ করে ন’টার পর শহরের আইনি মধুশালাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ভিড় বাড়ত জোকারের ঠেকে। জোকার কালো, বেঁটে খাটো, পেটা চেহারা। টিপটপ, ফ্লামবয়েন্ট। মুখে সর্বদা লেগে থাকা দুর্দান্ত স্মার্ট একটা হাসি। যে-কোনও চাহিদা অথবা প্রশ্নের জবাবে একটাই উত্তর— “নো প্রবলেম,” পুলিশের সঙ্গে মাসোহারার পাকা বন্দোবস্ত আর যেখানেই যা কিছু হোক না কেন জোকারের ঠেকে রেইড হবে না কিছুতেই। ঠেকের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করত বোম্বাইয়া। দু’হাতে আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো তিন চারটে করে জালি থামস আপ, কোকাকোলার বোতল, পৈলান, বজবজ আর মেটেবুরুজের কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি। মোটামুটি সকাল দশটা থেকে নিয়ে সন্ধে সাতটা, সাড়েসাতটা অবধি ঘোরাঘুরি করত গঙ্গার ঘাট, ময়দান আর ইডেন গার্ডেন চত্বরে। গাছের ছায়ায় বসা প্রেমিক-প্রেমিকা আর তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত উপভোগকারী ঝোপঝাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা ‘পিপিং টম-’দের কাছে বিক্রি করত খানিকটা জোরজুলুম করেই। বোম্বাইয়া। মুখে সবসময় মহম্মদ রফি। রাত সাড়ে আটটা বাজলেই চলে আসত জোকারের ঠেকে। আকাশে চকচকে চাঁদ। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া। ঘাসের ওপর পলিথিন বিছিয়ে বসে দু’নম্বরি কোল্ড ড্রিংকস সহযোগে জোকার মদিরা। সঙ্গে ফেরিওয়ালাদের থেকে টকঝাল আলুকাবলি-চুড়মুড়, মশলা আর পাতিলেবুর রসে মাখা চানাচ্যাপটা-ঘটিগরম, বিটনুনের টাকনা দিয়ে খোসাভাঙা চিনেবাদাম আর প্রচুর কাঁচা লঙ্কার কুচি মেশানো ঝালমুড়ির চাট। সে এক অলৌকিক, অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। যার হয়নি তাকে বলে বোঝানো যাবে না। তবে এই অভিজ্ঞতা চূড়ান্ত স্বর্গীয় রূপ নিয়েছিল একবারই। গঙ্গার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাদাবোটগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জোকারের নিয়মিত খদ্দের। ওদের দু’-একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বাড়বার পর বৃদ্ধসাধুর পেটমোটা দুটো বোতল সমেত পৌঁছে যাওয়া গেছিল গাদাবোটে। ওদের ডিঙিনৌকোয় চড়ে, গঙ্গার একদম মাঝখানে। ওদেরই মধ্যে একজনের রাঁধা গরম গরম কষা শুয়োরের মাংস, লাল টকটকে রং। সঙ্গে জোকার ম্যাজিক! নিস্তব্ধ নিশুতি সারারাত, গাদাবোটের খোলা ডেক। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে মাথার ওপর দিয়ে ‘ট্রি ই ই ই’ শব্দে উড়ে চলে যাওয়া রাতচরা পাখি, চাঁদের আলোয় গঙ্গার জলে ঘাই মেরে ওঠা শুশুক… কোথায় লাগে শ্যামল গাঙ্গুলি, নবারুণ বা মার্কেজের ম্যাজিক রিয়্যালিজম।

শম্ভুভাই, ময়দানে শুকনো নেশার কারবারি। বয়স আশির কোঠায়। সর্বক্ষণ গাঁজার নেশায় রক্তলাল দুটো চোখ। গুঁড়িগুঁড়ি করে ছাঁটা চুল। হাতে মোটা তামার বালা। পেশিবহুল চেহারা বয়সের কারণে একটু ভারীর দিকে। তবে দেখলেই বোঝা যায় একসময় প্রচণ্ড তাগদ রাখত শরীরে। শম্ভুভাই। লুঙ্গির গেঁজে সবসময় দশ বারোটা গাঁজার পুরিয়া। লোকাল আর মণিপুরি। মণিপুরির দাম বেশি। ময়দানে ফিসফাস জনশ্রুতি ছিল লোকটা আসলে নাকি একসময়ের উত্তরপ্রদেশের কুখ্যাত ডাকাত। বহু খুন আর ডাকাতির কেসে ফেরার হয়ে পালিয়ে এসেছে এখানে। অতঃপর অগতির গতি এই গাঁজার কারবার। সত্যিমিথ্যে যাচাই করে দেখা হয়নি কোনওদিন। এই অধম প্রতিবেদক আর তার কয়েকজন বন্ধুকে খুব ভালবাসত শম্ভুভাই। মাঝেমধ্যেই তুরীয় আনন্দের সন্ধানে ঢুঁ মারতাম ওর কাছে। মনে আছে তীব্র গরমকালের এক রাতে শম্ভুপ্রসাদ প্রাপ্ত হয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম মোহনবাগান মাঠের পিছনে র‍্যামপার্ট ঘেঁষা রাস্তাটা ধরে। গা ছমছমে পরিবেশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ চারপাশ। মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে মৃদু শাড়ির খসখস। হালকা চুড়ির আওয়াজ। ফিসফিসে গলার আহ্বান— ‘বসবে?’ ইতিউতি ঘোরাফেরা করা সন্দেহজনক চেহারার সব ছায়ামানুষ। এবড়ো খেবড়ো মেঠো অসমান রাস্তা। টাল খেতে খেতে রেড রোডের মোড় টপকে ঢুকে পড়েছিলাম ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের গা ঘেঁষে। লোহার ব্যারিকেডে ঘেরা জীর্ণ প্যাটন ট্যাঙ্ক। ঘাসে ঝিঁঝির ডাক। কয়েকদিন আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির আঙুলডোবা জলে কুনো ব্যাঙের কটকট। গাছের আড়াল থেকে রোজগারের ধান্দায় রাত জাগা বৃহন্নলাদের খোনাখোনা গলার ডাক, ফটাফট হাততালি… অনেকটা দূরে মায়াবী আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল… ঘোরলাগা চোখে দেখতে দেখতে অনেকটা হেঁটে এসে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম বিশাল বিশাল বট, অশথ আর পাকুড় গাছে ঘেরা ঘাসজমিটার সামনে। ধক্ করে উঠেছিল বুকটা! যে ময়দান নিরাশ্রয়, বেকার, বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষজনের মাথার ওপর ছায়া জোগায়… রুটিরুজির ব্যবস্থা করে কতজনের… সেই ভোর থাকতে উঠে ময়দানে চলে আসা হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে স্বপ্ন দেখায় রোজ… সেই ময়দানেই আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে… সেই সত্তরের দশকে এক কাকভোরে এক কবির স্বপ্নদর্শী চোখদুটোকে বরাবরের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল ঘাতকেরা। ঠিক এই গাছগুলোর নীচে। সেই স্বপ্ন হননের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এইসব আদিম মহাবৃক্ষরাজি। বহু প্রেম, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের আবাসভূমি হয়ে শহরের বুকে জেগে রয়েছে কলকাতা ময়দান। আজও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *