প্রেতিনী

প্রেতিনী

আমি বুঝতে পারছি না তুমি কেন ওখানে যেতে চাইছ না, বলল সোহানা রহমান। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।

আমরা ডিজনিওয়ার্ল্ডে যাব, বলল স্টিভ অস্টিন। ওখানে অনেক মজা আছে।

জাহান্নামে যাক ডিজনিওয়ার্ল্ড, মুখ ঝাঁপটে উঠল সোহানা। আমি ডিজনিওয়ার্ল্ডে বহুবার গেছি। আমি লেক দেখতে যাব।

না, সোহানা।

কেন নয়?

এখন ওখানে অনেক ঠাণ্ডা।

 গরমের সময় যেতে চাইলাম, বললে এখন ওখানে খুব গরম।

শ্রাগ করল স্টিভ। আমি ও বাড়ি বিক্রি করে দেব। দালালের সঙ্গে কথাও বলেছি।

তোমার বাবা ওই বাড়িতে মারা গেছেন, ডায়মণ্ড লেকের তীরে চমৎকার একটি বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। আর তুমি ওটা আমাকে দেখতে পর্যন্ত দিতে চাইছ না!

ওখানে দেখার আছেটা কী! একটা লেক। কিছু জঙ্গল। আর কুৎসিত চেহারার ছোট একটি কেবিন।

অ্যালবামে ওই বাড়ির ছবি তুমি আমাকে দেখিয়েছ। ছবিতে তোমাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। বোঝাই যায় কৈশোরের দিনগুলো চমৎকার কেটেছে তোমার ও বাড়িতে।

আমার কৈশোর খুব একটা ভালো কাটেনি ও বাড়িতে, অন্ধকার ঘনাল স্টিভের চেহারায়। আমি ওখানে যাব না।

ঠিক আছে, স্টিভ, বলল সোহানা। তুমি ডিজনিওয়ার্ল্ডে ছুটি কাটাতে যাওগে। আমি ডায়মণ্ড লেকে বেরিয়ে আসব।

সোহানার জন্ম বাংলাদেশে। তবে এইচ.এস.সি পাশের পরে তাকে ইউএসও পাঠিয়ে দেয়া হয়। পড়াশোনার জন্য। ওর বাবা আজাদ রহমান জাতীয় সংসদের একজন প্রভাবশালী সদস্য। মা সমাজকর্মী। স্টিভের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে সোহানা। পড়তে পড়তে ভালো লাগা। প্রেম থেকে পরিণয়। স্টিভ একটি ল ফার্মে চাকরি করে। সোহানা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুজনে মিলে দুহপ্তার ছুটি কাটাতে বেরিয়েছে।

তুমি মাঝে মাঝে এমন অযৌক্তিক সব দাবি করে বস। বিরক্ত হলো স্টিভ।

মোটেই না, বলল সোহানা। আমি যা করতে চাইছি তা অযৌক্তিক কিছু নয়। ডায়মণ্ড লেকে তোমার বাবার একটা কেবিন আছে। আমি সেখানে ছুটিটা কাটাতে চাইছি। কিন্তু আমি যখন বলেছি যাব। যাবই। তুমি গেলে যাবে না গেলে নাই।

ঠিক আছে। তুমিই জিতলে, চেহারা বাংলা পাঁচের মত হয়ে আছে স্টিভের তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ যাবে। আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

গুড, বলল সোহানা। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলছি। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব।

.

গন্তব্যে পৌঁছুতে প্রায় সারাটা দিন লেগে গেল ওদের। ইন্টারস্টেট ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পড়ল। মসৃণ, ঝকমকে রাস্তা। স্টিভ যখন ছোট ছিল ওই সময়ই চওড়া করা হয় হাইওয়ে। ওর বাবা যখন লেকের তীরে জমি কিনে কেবিন বানান, ওই সময় দুই লেনের রাস্তাটি ছিল আঁকাবাঁকা এবং বিপজ্জনক। কৈশোরে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু ক্রেস্ট লাইন পাহাড়কে মনে হত আকাশ ছুঁয়েছে। এখন নতুন কেনা ক্রাইসলার ইমপেরিয়াল সাবলীলগতিতে পাহাড় বেয়ে চুড়োয় উঠে যাচ্ছে।

এই প্রথম ডায়মণ্ড লেকে যাচ্ছি, বলল সোহানা, আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত। ঘন জঙ্গলে এলাকা দিয়ে ছুটছে গাড়ি। শ্যাম্পেন লাগবে আমার। লেকের আশপাশে শপিং সেন্টার নেই?

গ্রামে আছে, বলল স্টিভ, নার্ভাসভঙ্গিতে চেপে ধরে আছে হুইল। এ কদিন ভালোই কেটেছে দিন, কিন্তু এখানে আসার পরে… গায়ে একটি জেনারেল স্টোর আছে।

তোমার কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সোহানা, এরকম শুকনো দেখাচ্ছে কেন চেহারা? আমি গাড়ি চালাব?

আমার কিছু হয়নি, জবাব দিল স্টিভ।

কিন্তু মিথ্যা বলেছে ও। ও ঠিক নেই।

এখানে ফিরে আসা উচিত হয়নি। মোটেই উচিত হয়নি।

এক গভীর অন্ধকার অপেক্ষা করছে ডায়মণ্ড লেকে।

.

গ্রামটির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। শুধু বাক্স আকারের একটি মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল গড়ে উঠেছে, সঙ্গে স্পোর্টস ক্লদিং স্টোর এবং নতুন একটি গিফট শপ।

সোহানা ওয়েডস জেনারেল স্টোর থেকে এক কেজি গরুর মাংস আর এক বোতল শ্যাম্পেন কিনল। বুড়ো ওয়েড মারা গেছে বহুদিন, তার ছেলে এখন দোকান চালায়। বাপের সঙ্গে ছেলের চেহারায় অনেক মিল; এমন কী ছেলে বাপের মতই তারের চশমা পরে চোখে। আর চশমাটি ঝুলে থাকে নাকের ডগায়।

অনেকদিন পরে এলে, বলল সে স্টিভকে।

হু… অনেকদিন পর।

স্টিভ গাড়ি নিয়ে কেবিনের পথ ধরেছে, সোহানা বলল স্টিভ বুড়োর ছেলের সঙ্গে অমন শীতল ব্যবহার না করলেও পারত।

তাহলে কী করতে বলো আমাকে? ওর হাতে চুমু খাব?

অন্তত হাসিমুখে কথা বললেই পারতে। লোকটা তো তোমাকে হাসি মুখেই হ্যালো বলল।

আমার হাসি আসেনি।

এমন শক্ত হয়ে আছ কেন? একটু রিল্যাক্স করো না। বলল সোহানা। খোদা, কী সুন্দর!

ওদেরকে ঘিরে আছে ঘন পাইনের সারি, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে চমকাচ্ছে সবুজ তৃণভূমি, চকচকে গ্রানিট, যেন রঙের সাগরে কালো দাগ।

এখানে কী ধরনের ফুল জন্মায়, জানো?

বাবা এসব খবর রাখতেন, বলল স্টিভ। এদিকে আছে পূপিন, আইরিশ, বাগল ফ্লাওয়ার, কম্বাইন… বাবা ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বুনো প্রকৃতির রঙিন ছবি তুলতেন। বিশেষ করে পাখির ছবি। লাল ঝুঁটিঅলা কাঠঠোকরার ছবি তুলতে খুব ভালোবাসতেন তিনি।

তুমি তোমার বাবার সঙ্গে বেরুতে না?

মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ সময় মা-ই সঙ্গে যেত। শুধু বাবা আর মা। আমি তখন লেকে সাঁতার কাটতাম। বাবা জঙ্গল দারুণ পছন্দ করতেন। তবে মা মারা যাওয়ার পরে মাত্র দুবার এসেছি এখানে। চোদ্দ বছর বয়স যখন আমার, তারপর থেকে বাবার সঙ্গে আর আসা হয়নি। বাবাকে বাড়িটি বিক্রি করে দেয়ার জন্য। অনেকবার বলেছি। তিনি কানেই তোলেননি আমার কথা।

ভালোই করেছেন। তোমার কথা শুনলে আর এদিকে আসা হত না।

বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলে বেঁচে যাই। গম্ভীর গলায় বলল স্টিভ।

কেন? স্বামীর দিকে ফিরল সোহানা। এ জায়গাটির প্রতি তোমার এত বিতৃষ্ণা কেন?

জবাব দিল না স্টিভ। ওরা লারসনের পুরানো মিল হুইল পাশ কাটাল। পনেরো বছর পরে আবার ডায়মণ্ড লেক ভেসে উঠল স্টিভের চোখের সামনে-গাছের ফাঁকে ঝিলিক দিল যেন রোদে ঝলসানো ইস্পাত। স্টিভের শিরদাঁড়া বেয়ে নামল বরফ জল। চোখ পিটপিট করছে ও। শুনতে পাচ্ছে দিড়িম দিড়িম ঢাকের বাজনা বাজাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

ওর এখানে আসা মোটেই ঠিক হয়নি।

.

যেমন দেখে গেছে ঠিক তেমনই আছে কেবিন-লম্বা, ঢালু ছাদ, রেডউডের তৈরি কাঠের বাড়ি। নুড়ি বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেল ওরা।

বাড়িটা একদম নতুনের মত লাগছে! বাচ্চা মেয়ের মত কলকল করে উঠল সোহানা। আমি ভেবেছি ভাঙাচোরা একটা বাড়ি দেখব।

বাবা বাড়ির যত্ন নেয়ার জন্য কেয়ারটেকার রেখেছিলেন। যার প্রয়োজন হত এ বাড়িতে দুএক রাত্তির কাটিয়ে যেত।

সামনের দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে।

বাহ্, ভারী সুন্দর তো! বলল সোহানা।

ঘোঁত ঘোঁত করল স্টিভ। ড্যাম্প পড়ে গেছে। বেডরুমে কেরোসিন তেলের একটা স্টোভ ছিল। রাতে স্টোভ জ্বালাতাম। রাতেরবেলা এদিকে খুব ঠাণ্ঠা পড়ে।

কেবিনের ভেতরটা কালো ওক কাঠে তৈরি। আসবাবগুলোও একই কাঠের, পাথরের একটি চুল্লিও আছে। লেকের দিকে মুখ ফেরানো কাঁচের জানালা। লেকের তীরে, পাহাড়ের দিকে দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা পাইন। ভারী মনোহর দৃশ্য।

ভিউকার্ডের কোনও দৃশ্যের মধ্যে যেন চলে এসেছি আমি, বলল উদ্ভাসিত সোহানা। ঘুরল স্বামীর দিকে, হাত ধরল। কটা দিন এখানে সুন্দরভাবে থাকার চেষ্টা করা যায় না, স্টিভ?

চেষ্টা নিশ্চয় করা যায়, জবাব দিল স্টিভ।

.

রাতের বেলা চুল্লিতে আগুন জ্বালল স্টিভ। সোহানা রান্না করল। বাসমতি চালের ভাত, গরুর মাংসের রেজালা, ডাল আর সালাদ। ডেসার্ট হিসেবে থাকল ভ্যানিলা আইসক্রিম। চাল আর ডাল সে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। স্টিভ সোহানার হাতের গরুর মাংস আর ভাত খেতে বেশ পছন্দ করে।

খাওয়া শেষে শ্যাম্পনের গ্লাস টোস্ট করে সোহানা বলল, ডায়মণ্ড লেকের ছুটি সফল ও সার্থক হোক।

তবে স্টিভ কিছু বলল না। সে জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে চুপচাপ মদ গিলল।

কৈশোরে এখানে তোমার নিশ্চয় অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল, বলল সোহানা।

ডানে-বামে মাথা নাড়ল স্টিভ। না…আমি একাকী থাকতেই ভালোবাসতাম।

তোমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল না?

চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল স্টিভের। আমার বয়স তখন মাত্র চোদ্দ।

তো? তোমরা, আমেরিকানরা তো আরও আগেই মেয়েদের প্রেমে পড়ো। তোমার জীবনে বিশেষ কেউ ছিল না?

বললামই তো এখানে আমার জীবন খুব একটা ভালো কাটেনি। অন্য কথা বলো। এসব নিয়ে বলতে ভাল লাগছে না।

সিধে হলো সোহানা। বাসনগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, ঠিক আছে। তোমার ভালো না লাগলে এ প্রসঙ্গ থাক।

শোনো, শক্ত গলায় বলল স্টিভ। আমি এখানে আসতে চাইনি। তোমার চাপাচাপিতে আসতে হলো। এটুকুই যথেষ্ট নয় কী?

না। এটুকুই যথেষ্ট নয়, স্টিভের দিকে ফিরল সোহানা। তোমার হয়েছেটা কী? তখন থেকে দেখছি মুখটা রামগরুড়ের ছানা করে রেখেছে।

সোহানার কাছে হেঁটে এল স্টিভ, চুমু খেল গালে, ডান হাত আলতো ছুঁয়ে গেল স্ত্রীর ঘাড় এবং কাঁধ। দুঃখিত, সোহানা, বলল ও। এ জায়গাটা আমার ভালো লাগে না। আমি এখানে কোনও দিনই আসব না ভেবেছিলাম। এখানে এলে অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

সোহানা আয়ত চোখ রাখল স্টিভের চোখে। এ জায়গা নিয়ে তোমার জীবনের কোনও খারাপ ঘটনা ঘটেছে, না?

আমি জানি না, ধীরে ধীরে বলল স্টিভ। আমি সত্যি জানি না কী ঘটেছিল…

জানালা দিয়ে বাইরে, লেকের কাঁচের মত স্বচ্ছ, কালো, তেলতেলে জলে তাকাল স্টিভ।কালো জলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এল রাতজাগা পাখির ডাক।

ভয়ার্ত এবং ব্যথাতুর আর্তনাদ।

.

পরদিন জোরে জোরে বাতাস বইতে লাগল। সোহানা ধরে বসল সে লেক ঘুরে দেখবে। এটা কেমন জায়গা আমি দেখতে চাই। রাজি হতেই হলো স্টিভকে। ওর বাবার ইঞ্জিনচালিত একটা রোবোট আছে। ওটায় চড়ে দুজনে ভেসে পড়ল লেকে। ইঞ্জিনের শব্দ খালি কেবিনে যেন প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এল।

বিশাল লেকে শুধু ওরা দুজন। আর কেউ নেই।

এদিকে আর কাউকে দেখছি না কেন? জানতে চাইল সোহানা।

গরম শেষ হলে এদিকে আর কেউ পা মাড়ায় না। অক্টোবরে এদিকে এমন ঠাণ্ডা পড়ে, কেউ সাঁতার কাটা কিংবা বোট চালানোর কথা ভুলেও ভাবে না। আর আজ অক্টোবরের শেষ। ওর কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন বেড়ে গেল বাতাসের গতি, পাহাড় বেয়ে নেমে এল হাড় জমাট বাঁধা শীতল হাওয়া।

ফিরে যাই চলো, বলল সোহানা। পাতলা সোয়েটারে শীত মানছে না। জ্যাকেট নিয়ে আসা উচিত ছিল। স্ত্রীর কথা শুনছে না স্টিভ, স্থির দৃষ্টি পাথুরে তীরে। হাত তুলে দেখাল, ওখানে কে যেন বসে আছে,কাঁপা গলা ওর। পাথরের স্তূপের পাশে।

কই, আমি তো কাউকে দেখছি না।

ওই তো বসে আছে, ঢোক গিলল স্টিভ। আমাদেরকে দেখছে। নড়াচড়া করছে না।

স্টিভের কণ্ঠ কেমন ভৌতিক এবং অপার্থিব। অস্বস্তি লাগল সোহানার। কই আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কথাটা পুনরাবৃত্তি করল সে।

ঈশ্বর! স্টিভ ঝুঁকে এল সোহানার দিকে। তুমি কি কানা? ওই তো…পাথরের ওপরে। তীরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে স্টিভ।

আমি শুধু পাথর দেখতে পাচ্ছি। তবে, বাতাসে হয়তো কোনও কিছু উড়ে এসে পড়েছে

চলে গেছে, সোহানার কথা কানে যায়নি স্টিভের। এখন কেউ নেই ওখানে।

আউটবোর্ডের থ্রটল সামনের দিকে ঠেলে দিল স্টিভ, লেকের কাকচক্ষু জলের বুক চিরে তীরে অভিমুখে ছুটল বোট।

জলের ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটি বাজপাখি, শিকারের সন্ধানে।

গাঢ় ধূসর আকাশের কফিনে শুয়ে বিশ্রাম নিতে চলেছে ক্লান্ত সূর্য।

আজ রাত হবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার একটি রাত। রাত একটার দিকে, আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ, কেবিনে ঘুমাচ্ছে সোহানা, স্টিভ নিঃশব্দে দরজা খুলে চলে এল লেকের ধারে, বোল্ডারগুলোর পাশে। পরনের ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট ভেদ করে চামড়ায় ধারাল ছুরির পোচ বসাচ্ছে কনকনে উত্তুরে বাতাস।

তবে বাইরের ঠাণ্ডা কাবু করতে পারেনি স্টিভকে, ভেতরের হিমধরা ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে রেখেছে সাপের কুণ্ডলীর মত।

ভয় পাচ্ছে স্টিভ কারণ ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রনিট পাথরে নিশ্চল যে মূর্তিটি ও দেখেছিল, তার সঙ্গে ডায়মণ্ড লেককে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠার নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে।

মনে মনে যা ভেবেছিল স্টিভ, তাই ঘটল। আবার আবির্ভূত হলো সেই মূর্তি। পাইনের জঙ্গলের ঘন আঁধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারী, কুড়ি/একুশ হবে বয়স, লম্বা, কোমর ছাপানো চুল, শিকারের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার উন্মুখ ভঙ্গি দেহে, দীঘির অতল জলের মতই মিশমিশে কালো, জ্বলজ্বলে চোখ। তার পরনে লম্বা, সাদা গাউন। জোছনায় রুপোর মত ঝলমল করছে। সে এগিয়ে এল স্টিভের দিকে।

লেকের তীরে মুখোমুখি হলো দুজন।

জানতাম একদিন না একদিন তুমি ফিরে আসবেই, নারীমূর্তি হাসল স্টিভের দিকে তাকিয়ে। তার কণ্ঠ মার্জিত, হাসিমাখা, তাতে উষ্ণতা অনুপস্থিত।

স্থির চোখে মেয়েটিকে দেখছে স্টিভ। কে তুমি?

তোমার অতীতের একটা অংশ। হাত বাড়িয়ে দিল নারী। খুলল মুঠো। তালুতে ব্রোঞ্জের একটি চেইন, তাতে ছোট্ট মুক্তো বসানো। শেষ যেবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় তারপর থেকে আমি এটা গলায় পরে আছি। তখন আমি সবে তেরোতে পা দিয়েছি। আর তুমি চৌদ্দ।

ভেনেট, ফিসিফিস করে নামটা উচ্চারণ করল স্টিভ, নারীর গভীর কালো চোখের মাঝে যেন হারিয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। ভীত হয়ে উঠল পরক্ষণে। জানে না কেন তবে মেয়েটি তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

তুমি আমাকে চুমু খেয়েছিলে, স্টিভি, বলল সে। আমি তখন ছোট্ট লাজুক একটি গেঁয়ো মেয়ে। আর আমার জীবনে তুমিই প্রথম পুরুষ যে আমাকে চুমু। খেয়েছো।

মনে আছে আমার, বলল স্টিভ।

আর কী মনে আছে তোমার? জিজ্ঞেস করল তরুণী। মনে পড়ে এখানে, এই পাথরের ওপর বসে তুমি আমাকে চুম্বন করেছিলে? সেটা ছিল গ্রীষ্মের এক রাত। লাখ লাখ তারা জ্বলছিল আকাশে। লেক ছিল শান্ত এবং সুন্দর। মনে পড়ে, স্টিভি?

আ…আ আমার মনে পড়ছে না, তোতলাচ্ছে স্টিভ।

তুমি ওই স্মৃতি কবর দিয়ে রেখেছ, বলল মেয়েটি। তোমার মন সে রাতের। স্মৃতির ওপর পর্দা ফেলে রেখেছে তোমাকে রক্ষা করার জন্য। বেদনা থেকে দূরে রাখার জন্য।

আমি তোমাকে নেকলেস দেয়ার পরে, ধীরে ধীরে বলল স্টিভ, উপযুক্ত হাতড়ে বেড়াচ্ছে, মনে করার চেষ্টা করছে, আমি… তোমাকে স্পর্শ করি… তুমি তোমার শরীর আমাকে ছুঁতে দিতে চাওনি, কিন্তু আমি–

তুমি আমাকে ধর্ষণ করেছিলে, মেয়েটির কণ্ঠ যেন হিমশীতল সিল্ক। আমি কাঁদছিলাম, তারস্বরে চিৎকার করছিলাম, তোমাকে মিনতি করছিলাম থামার জন্য, কিন্তু তুমি আমার কথা শোনননি। তুমি আমার পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলে, আমাকে ব্যথা দিয়েছ। অনেক অনেক ব্যথা দিয়েছ।

সে রাতের প্রতিটি দৃশ্য পরিষ্কার ফুটল স্টিভের মনছবিতে। ভেনেটের অনাঘ্রাতা কুমারী শরীরে প্রবেশ করার পরে কিশোরী তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল… তবে এরপরে কী ঘটেছে মনে নেই ওর।

আমি চিৎকার করছিলাম বলে তুমি রেগে গিয়েছিলে, তরুণী মনে করিয়ে দিল স্টিভকে। কী রাগ সেদিন তোমার! আমি চিৎকার করছি আর তুমি আমার চিৎকার বন্ধ করার জন্য একের পর এক ঘুসি মেরে আমার মুখটাকে থেতলে দিয়েছ।

আমি দুঃখিত, বলল স্টিভ। খুবই দুঃখিত… আ-আমার মাথাটা বোধহয় সেদিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

এরপরে কী ঘটেছিল মনে আছে তোমার?

মাথা নাড়ল স্টিভ। না…কিছু মনে পড়ছে না।

আমি, বলব কী ঘটেছিল?

হ্যাঁ, নিচু গল্লায় বলল স্টিভ, মেয়েটি যা বলবে নিশ্চয় সুখকর কিছু নয়। তবু ও জানতে চায়।

তুমি একটি পাথর তুলে নিয়েছিলে। বড় একখণ্ড পাথর। বলল ভেনেট। তারপর পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে আমার মাথাটাকে প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর তুমি আমাকে তোমার বাবার বোটে তুলে নাও… ওই বোটটা, রো বোটটা হাত তুলে দেখাল সে। বোট নিয়ে চলে এসেছিলে লেকের ঠিক মাঝখানে। বোটে লোহার নোঙর এবং কিছু রশি ছিল। তুমি রশি দিয়ে আমাকে বেঁধে ফেললে যাতে সাঁতার কাটতে না পারি। তারপর

না! হাপরের মত ওঠানামা করছে স্টিভের বুক। বিস্ফারিত চোখ। আমি ওটা করিনি! গডড্যাম ইট, আমি ওই কাজ করিনি!

নিরুত্তাপ স্বরে বলে চলল তরুণী, তুমি আমাকে বোটের পাশ দিয়ে পানিতে ঠেলে ফেলে দিলে, পায়ে নোঙর বাঁধা। আমি তলিয়ে যাই পাতালে। আর উঠতে পারিনি। লেকে সলিল-সমাধি ঘটে আমার।

মিথ্যা কথা! তুমি বেঁচে আছ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ। জ্যান্ত!

আমি দাঁড়িয়ে আছি বটে তবে বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকতাম তাহলে এখন এতটাই বড় হতাম আমি। এরকমই চেহারা থাকত আমার।

এসব–স্টিভের গলা কাঁপছে। তুমি নিশ্চয় আশা করছ না যে আমি বিশ্বাস করব

-যে তেরো বছরের একটি কিশোরীকে তুমি খুন করতে পার? কিন্তু ঠিক এক কাজটাই তুমি করেছ। তুমি দেখবে ওরা যখন আমাকে লেক থেকে তুলল ওই সময় আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল…? রশির বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়ার পরে আমি পানির ওপরে ভেসে উঠি।

কদম বাড়াল তরুণী। কাছিয়ে এল। আরও কাছে।

কাছে এসো না। খবরদার! চেঁচিয়ে উঠল স্টিভ, ঝট করে এক কদম পিছাল। চলে যাও!

স্টিভের সামনে এখন একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। হাসছে। তার মাথার বামদিকের হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে, চাঁদের আলোয় বীভৎস সাদা দেখাচ্ছে, শরীরটা ফুলে ঢোল, কুচকুচে কালো। তার একটা চোখ অদৃশ্য, খেয়ে ফেলেছে। জলজ কোনও প্রাণী, পরনের পোশাক ভেজা, পচা, কাদামাখা।

.

হাই, স্টিভি, খনখনে গলায় ডাকল সে।

ভৌতিক দেহটার সামনে থেকে চরকির মত ঘুরেই দৌড় দিল স্টিভ। প্রচণ্ড আতঙ্কে উন্মাদের মত ছুটছে। সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে প্রাণপণে ছুটছে। পালিয়ে যাচ্ছে লেকের তীর এবং ভয়ঙ্কর ওই জিনিসটার কাছ থেকে। ছুটতে ছুটতে বেদম হাঁফিয়ে গেল স্টিভ, গলা আগুনের মত জ্বলছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, পা আর টানতে চাইছে না শরীর। দম নিতে দাঁড়িয়ে পড়ল স্টিভ। একহাতে জড়িয়ে ধরে থাকল পাইনের গুঁড়ি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত স্টিভ আস্তে আস্তে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। জোছনায় প্লাবিত এ নিবিড় অরণ্যে ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয়া এবং দম ফেরার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। তারপর, আস্তে আস্তে, যখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে দম, মাথা তুলে চাইল স্টিভ এবং…ওহ গড, ওহ ক্রাইস্ট…

ওই যে সে!

ভেনেটের বিকটভাবে ফুলে থাকা বিশ্রী মুখটা স্টিভের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। মাংস গলে গলে পড়া, সাদা হাড় বেরিয়ে থাকা হাতটা বাড়িয়ে দিল প্রেতিনী, স্পর্শ করল স্টিভের গাল….

.

দুই বছর পরে, সোহানা ডায়মণ্ড লেকের বাড়িটি বিক্রি করে চলে এল বাংলাদেশে। জাভেদ চৌধুরী নামে এক সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়ল সে। জাভেদ একদিন কথায় কথায় জানতে চাইল সোহানার প্রথম স্বামীর খবর। ভাবলেশশূন্য মুখে সোহানা বলল, ও ডুবে মরেছে। ফ্লোরিডার ডায়মণ্ড লেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *