৪.০৫ কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল

৪.৫

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিনয়ের মনে পড়ে না। সকালে যখন চোখ মেলল তখনও ভাল করে রোদ ওঠেনি। কাল রাতে কুয়াশাটা একটু বেশিই পড়েছিল। ডান পাশের জোড়া জানলা দিয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল বাইরে। সেসোস্ট্রেস বে, দূরের ছোটবড় দ্বীপগুলি কিংবা বাঁ দিকের মাউন্ট হ্যারিয়েট–কিছুই স্পষ্ট নয়। সব ঘন কুয়াশায় ঢাকা। অলীক কোনও ছবির মতো মনে হয়।

বিনয় তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু কিছুই যেন দেখছে না। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুক আর অবনীমোহন ফের তার মাথায় ফিরে এসেছেন। ক’দিন আগে সেলুলার সেলের হাসপাতালের বাইরে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিন্তু সে তাকে চিনতেই চায়নি। একরকম অস্বীকারই করেছে। যা দু-একটা কথা বলেছে, তাও বেশ রুক্ষ স্বরে। কী চরম উদাসীন সে। ঝিনুক খুব সম্ভব বিনয়ের সঙ্গে জড়ানো তার জীবনের কয়েকটা বছরকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে চায়। এদিকে বিনয়ের জীবনের এক মেরুতে ঝিনুক আর এক মেরুতে অবনীমোহন। আয়ুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি ঝিনুককে শেষবারের মতো দেখতে চান। লা-পোয়ের সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে ঠিকই, তবু দ্বিধাটা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। অবনীমোহনের সঙ্গে ঝিনুকের দেখা করানোটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কিনা, কাল রাতে ভেরে ভেবে তলকূল পায়নি বিনয়, আজও পেল না। অফুরান নৈরাশ্য এবং অবসাদ চাই চাই পাথরের মতো তার শরীর আর মনের ওপর চেপে বসতে থাকে।

একসময় আকাশ যেখানে সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, সেই দিগন্ত থেকে সূর্য মাথা তুলতে শুরু করল। কুয়াশার স্তরগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিনের প্রথম নরম সোনালি রোদ এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। বেলা আর একটু বাড়লেই কুয়াশার চিহ্নমাত্র থাকবে না।

বিনয় উঠে পড়ল। বাথরুমের কাজ সেরে ড্রইংরুমে আসতেই দেখা গেল, বিশ্বজিৎ একটা সোফায় বসে আছেন। এখানেই একটা উঁচু টুলের ওপর টেলিফোনটা থাকে। তার পাশে বসার জন্য বেতের মোড়া। মোড়ায় বসে ফোন করছেন শেখরনাথ। নিঃশব্দে বিশ্বজিতের কাছাকাছি বসে পড়ল বিনয়।

শেখরনাথ বলছিলেন, ‘আজই আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। আমায় একটু সময় দিতেই হবে।…না, কাল নয়, কাইন্ডলি আজই…ব্যস্ত? আপনার মতো মানুষকে, যাঁর মাথায় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পুরো দায়িত্ব, সারাক্ষণ তার ব্যস্ততা তো থাকবেই।… সাড়ে ন’টায়? আপনার বাংলোতে? কোনও অসুবিধে নেই।… ব্রেকফাস্ট? মেনি থ্যাংকস, না না, তার দরকার নেই। ব্রেকফাস্ট না করলে দেখা হবে না? ঠিক আছে, আই অ্যাকসেপ্ট…আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি। রিহ্যাবিলিটেশনের ব্যাপারে অনেক কথা আছে। মিস্টার আয়ার, আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি ফোন নামিয়ে রাখলেন।

এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, শুনতে শুনতে বোঝা গেছে। শেখরনাথ আগেই বলেছিলেন, চিফ কমিশনারের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবেন। সেটাই করে নিলেন। বিনয় জানে, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি বাসিন্দা চিফ কমিশনারকে স্যার বলে থাকে, একমাত্র শেখরনাথই বাদ। তিনি বলেন, মিস্টার আয়ার। আয়ারসাহেব তাঁকে সমীহ করে বলেন আঙ্কল।

শেখরনাথ উঠে এসে বিনয়দের পাশে বসলেন। বিশ্বজিতের দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, ‘তুই। আজ কখন অফিসে যাবি?’

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আগে কোর্টে যেতে হবে। সেখান থেকে অফিসে। নটায় বেরুব।’

‘ভালই হল। তোর গাড়িতে আমাকে চিফ কমিশনারের বাংলোর সামনে নামিয়ে দিয়ে যাস। ন’টায় বেরুলে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারব।’

‘কিন্তু আপনি ফিরবেন কী করে?’

‘তা নিয়ে ভাবতে হবে না। ফেরার ব্যবস্থা একটা কিছু আমি করে নিতে পারব।’

আজ ব্রেকফাস্টের জন্য ভুবন ডালপুরি, ছোলার ডাল আর আলুর দম করেছিল। সে তিনজনকে খাবার দিয়ে গেল। শেখরনাথ খেলেন না। তাঁর ব্রেকফাস্টটা চিফ কমিশনারের বাংলোস সারবেন।

এদিকে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে স্নান করে তৈরি হয়ে নিলেন বিশ্বজিৎ। ছুটির দিন ছাড়া দুপুরে লাঞ্চটা তিনি হয় আদালতে বা রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে তার চেম্বারে সেরে নেন। শেখরনাথ অবশ্য স্নান করলেন না, ঘরোয়া পোশাকটা শুধু বদলে নিলেন। তারা বিশ্বজিতের গাড়িতে যাবেন।

বেরুবার সময় শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ‘আমি ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরে আসছি। তখন তোমাকে কোম্পানি দিতে পারব।’

বিনয় একটু হাসল শুধু। খানিকটা সময় তাকে নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে। অবশ্য কাজের লোকেরা আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কী গল্পই বা করবে!

ওদিকে মোহনবাঁশি; তার স্ত্রী জ্যোৎস্না এবং ওদের ছেলেমেয়েরাও সকালের খাবার খেয়ে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মোহনবাঁশির চেক-আপের জন্য তারা কালীপদর জিপে হাসপাতালে ডাক্তার চট্টরাজের জুনিয়রদের কাছে যাবে।

প্রায় একই সঙ্গে সবাই বেরিয়ে পড়ল। বিনয় ধীরে ধীরে তার বেডরুমে ফিরে এসে ডান পাশের জোড়া জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে সেই চেনা ছবি। ছোট বড় নানা দ্বীপ, পাহাড়, জঙ্গল, ঝাঁকে ঝাকে সিগাল আর সেসোস্ট্রেস উপসাগর। কিন্তু কিছুই যেন তার চোখে পড়ছিল না। নির্জন কামরায় মাথায় আবার ঝিনুক আর অবনীমোহন ফিরে এলেন। কোনও অপ্রতিরোধ্য নিয়মে।

.

চিফ কমিশনারের বাংলোর সামনে শেখরনাথকে নামিয়ে দিয়ে বিশ্বজিৎ আদালতে চলে গেলেন। সেকেলে ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ কোম্পানির হাতঘড়িটা একবার দেখে নিলেন শেখরনাথ। ন’টা বেজে একুশ। তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট সাড়ে ন’টায়। তিনি আজীবন তার প্রতিটি কাজ, চলাফেরা, সব কাঁটায় কাটায় সময় মেনে চলেছেন। ক্কচিৎ কখনও তার হেরফের ঘটেছে।

বিশাল কমপাউন্ডের মাঝখানে ছবির মতো দোতলা বাংলো। পিকচার পোস্টকার্ডে এমনটা দেখা যায়।

গেটের সামনে চারজন অবাঙালি পাহারাদার। তাদের কাঁধে বন্দুক। চারজনই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, ‘নমস্তে চাচাজি। নমস্তে। অন্দর যাইয়ে–

একজন বলল, ‘কমিশনার সাহাব বলেছেন, আপনি এলেই যেন অন্দরে নিয়ে যাই।

ওরা বললেই কি যাওয়া যায়? এখনও ন’মিনিট সময় দেরি। হাত তুলে হাসিমুখে পাহারাদারদের থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ। সাড়ে ন’টা বাজতেই বললেন, ‘চল—’

একজন পাহারাদার তাকে সঙ্গে করে বাংলো পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল।

সাজানোগোছানো, বিশাল ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিলেন চিফ কমিশনার। শেখরনাথকে দরজার বাইরে দেখতে পেয়ে উঠে এলেন। সসম্ভ্রমে বললেন, ‘আসুন আঙ্কল–আসুন–’ বাঙালিদের তিনি যে কতটা পছন্দ করেন, সবসময় তা বুঝিয়ে দেন। কিন্তু এই ধুরন্ধর অফিসার বাকিটা গোপন রাখার কৌশল জানেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে, মনে বিষের থলি লুকিয়ে রেখে আন্দামানে বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের যে ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেটা নানা ফিকিরে কেটেছেটে যতটা ছোট করা যায় তার মতলব আঁটছেন, এমনটাই অনেকের ধারণা। অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপমালা আর একটা বাংলাদেশ হয়ে উঠুক, এটা তিনি চান না। তবে পরাধীন ভারতের বিপ্লবী শেখরনাথকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। সেটা যথেষ্ট আন্তরিক বলেই মনে হয়।

চিফ কমিশনার শেখরনাথকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে নিজে তার মুখোমুখি বসলেন। মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘শরীর ভাল আছে আঙ্কল?’

শেখরনাথ বললেন, ‘আছে মিস্টার আয়ার—’

সাধারণ কিছু কথাবার্তার পর চিফ কমিশনার বললেন, ‘কী একটা আর্জেন্ট আলোচনা আছে বলেছিলেন—’

একটা ধবধবে উর্দি-পরা বেয়ারা কফি, কাজুবাদাম, আখরোট এবং ব্রেকফাস্ট হিসেবে টোস্ট ওমলেট, নানা রকম ফলটল দিয়ে গেল। নিশ্চয়ই তাকে আগে থেকে বলা ছিল।

আস্তে মাথা নাড়লেন শেখরনাথ।–-‘হ্যাঁ। সেই জন্যই আপনার মতো ব্যস্ত একজন ভি আই পি’কে বিরক্ত করা—’

সামান্য বিব্রত হলেন চিফ কমিশনার।–-‘আপনি এলে আমি কখনও বিরক্ত হতে পারি? নিন, খেতে খেতে কথা বলুন—’ নিজের হাতে কফির কাপটা শেখরনাথের হাতে তুলে দিলেন তিনি।

‘কিন্তু আপনার কফিটফি কোথায়?’

‘আমার আটটার ভেতর ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে যায়। এরপর একেবারে লাঞ্চ। তার দেরি আছে।’

শেখরনাথ আলত একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আপনার অধীনস্থ একজন অফিসার বিশ্বজিৎ রাহার কাকা হিসাবে আজ আমি এখানে আসিনি। এসেছি স্বাধীন ভারতবর্ষের একজন নাগরিক হিসেবে। শোনা যাচ্ছে আমাদের দেশের কনস্টিটিউশনে লেখা থাকবে এই দেশ হবে ডেমোক্রাটিক কান্ট্রি এবং প্রতিটি নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা থাকবে। সে নির্ভয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারবে।

চিফ কমিশনার একটু অবাক হলেন।-–’আমিও তা-ই জানি। কিন্তু এসব কথা উঠছে কেন?’

‘আমি সাহস করে জেফ্রি পয়েন্টের রিহ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।’

চিফ কমিশনারের চোখেমুখে হালকা একটু হাসি ফুটল।-–‘আপনি ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে একসময় আমর্স হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কারওকে ভয়টয় পান বলে তো শুনিনি। জেফ্রি পয়েন্ট নিয়ে যা বলার বলুন না। আপনি আন্দামানের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ। আপনার মতামতকে এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।’

‘আপনি হয়তো শুনেছেন, আমি বেশ কিছুদিন জেফ্রি পয়েন্টে রয়েছি।’

‘জানি, আপনার ভাইপো বিশ্বজিৎ রাহা আমাকে বলেছেন।’

‘ওখানে ডি পি ফ্যামিলিগুলো (উদ্বাস্তু পরিবার) প্রচণ্ড অসুবিধে আর ভয়ের মধ্যে রয়েছে। চিকিৎসার কোনওরকম বন্দোবস্ত নেই। অসুখবিসুখ হলে কিংবা কানখাজুরায় (এক ধরনের বড় বড় চেলা বিছে, এক ফুটের মতো লম্বা হয়) কামড়ালে পোর্টব্লেয়ারে এনে ভর্তি করানো যে কী কষ্টকর, বলে বোঝানো যাবে না। কোনও দরকারে যদি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের মালপত্র নিয়ে ট্রাক সেখানে যায় তাতে চাপিয়ে রোগীদের পোর্টব্লেয়ারে আনা হয়, যেমন আমরা মোহনবাঁশিকে আনতে পেরেছিলাম। নইলে মৃত্যু অবধারিত। তা ছাড়া জেফ্রি পয়েন্টের আশপাশে আরও কয়েকটা রিফিউজি আর পেনাল কলোনি রয়েছে। আরও নতুন নতুন উদ্বাস্তু কলোনি বসানো হবে। মানুষজন অনেক বেড়ে যাবে। এই তো সেদিন এক উদ্বাস্তুর বাচ্চা হল, পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে আসার মতো ট্রাক ছিল না। পাঁচটা পাহাড় পেরিয়ে অন্য একটা কলোনি থেকে ধাই নিয়ে আসতে হয়েছিল। এভাবে তো চলতে পারে না। জেফ্রি পয়েন্টে একটা হাসপাতাল বসানো খুব জরুরি। তাতে ওই কলোনিরই শুধু নয়, চারপাশের অন্য উদ্বাস্তু আর পেনাল কলোনিগুলোরও যথেষ্ট উপকার হবে।’

‘আপনার সঙ্গে আমি একমত। সেরকম পরিকল্পনা গভর্নমেন্টের আছে।’

‘গভর্নমেন্টের বারো মাসে নয়, আটত্রিশ মাসে বছর। কোনও পরিকল্পনা করলে তা শুরু হতে যুগ-যুগান্তর কেটে যায়। জেফ্রি পয়েন্টের হাসপাতালটা কিন্তু ফেলে রাখা চলবে না।’

চিফ কমিশনার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সেটা হয়, আমি দেখব। তবে সব কিছু আমার ওপর নির্ভর করে না। ফান্ড আসবে দিল্লি থেকে। তাদের বার বার রিমাইন্ডার পাঠাতে হবে।’

কফি জুড়িয়ে আসছিল। কয়েক চুমুকে বাকিটা শেষ করে ফেললেন শেখরনাথ। কাপটা নামিয়ে রেখে টোস্টে কামড় দিয়ে শুরু করলেন।–-‘জারোয়াদের নিয়ে একটা মারাত্মক প্রবলেম শুরু হয়েছে, তা কি আপনি জানেন?’

‘কী প্রবলেম বলুন তো—’

‘ওরা ওই অঞ্চলের জঙ্গলের আদি বাসিন্দা। থাকে উত্তর আর পশ্চিম দিকের অনেকটা এলাকা জুড়ে। জঙ্গল কেটে রিফিউজি কলোনি বসানো হচ্ছে, এটা ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। একেবারে খেপে উঠেছে। বুশ পুলিশরা পাহারা দেয় ঠিকই, কিন্তু তাদের পরোয়া না করে কলোনিতে ঢুকে হামলা চালাচ্ছে।’

চিফ কমিশনারকে চিন্তিত দেখায়।–-‘হুঁ, এটা একটা বড় সমস্যাই।’

 ‘এই সমস্যাটা ফেলে রাখা যায় না।’

‘কিন্তু সমাধান হবে কিভাবে? আপনি কিছু ভেবেছেন আঙ্কল?’

‘ভেবেছি। ওখানে জাঙ্গল ফেলিং বন্ধ করতে হবে। অরণ্য হচ্ছে জারোয়াদের বাসস্থান। সেটা যত ছোট হতে থাকবে, ওদের ক্রোধ তত বাড়বে।’

‘কিন্তু আঙ্কল–’

শেখরনাথ তাঁর দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না।

চিফ কমিশনার একটু ভেবে বললেন, ‘জঙ্গল না কাটলে রিফিউজি সেটলমেন্ট হবে কী? ইস্ট পাকিস্তানের হাজার-হাজার ডিপি ফ্যামিলিকে ওয়েস্টবেঙ্গল থেকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের কিভাবে চাষের আর বাড়িঘর তৈরির জমি দেওয়া সম্ভব? বহু মানুষের স্বার্থে কিছু মানুষকে তো একটু আধটু স্যাক্রিফাইস করতেই হয়।’

‘মিস্টার আয়ার, জঙ্গলের অধিকার কিন্তু জারোয়াদের। কত কাল ধরে তারা সেখানে বাস করে আসছে। তাদের উৎখাত করাটা কিন্তু অন্যায়। অবশ্য রিফিউজি সেটলমেন্টের বিষয়টা উপেক্ষা করা যায় না। এই মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জমিজমা দিতে হবে।’ শেখরনাথ বলতে লাগলেন, ‘জেফ্রি পয়েন্টের ব্যাপারে আমি চিন্তাভাবনা করেছি। এই নিয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে কিছু কথাও হয়েছে। আপনাকে সে তা জানিয়েছে কি না জানি না।’

চিফ কমিশনার চোখ আধবোজা করে ভাবতে লাগলেন। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, ‘মনে পড়ছে না।’

‘ঠিক আছে, আমার মুখে শুনুন। জাবোয়ারা থাকে জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর আর পশ্চিমদিকের গভীর জঙ্গলে। পুব দিকে আসে না। আপনারা এ-ধারের জঙ্গলটায় ‘ফেলিং’ করুন। বহু একর জমি পুব দিকে পাওয়া যাবে। জারোয়ারাও আর উৎপাত করবে না।’

‘কিন্তু আঙ্কল, তা কী করে সম্ভব?’

‘কেন নয়?’

‘উত্তর পুব দিকেই তো সেটলমেন্টের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেইমতো কাজও শুরু হয়ে গেছে।’

‘এটা সামান্য বদলেও নেওয়া যায়। তাতে সেটলমেন্টের কাজ কিন্তু নির্বিঘ্নে চলতে পারে। কোনওরকম বাধা ছাড়াই।’

চিফ কমিশনারের চোখেমুখে চকিতের জন্য বিরক্তির ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। সামান্য গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আপনার কথা আমার মনে থাকবে। ভেবে দেখব—’

একটু চুপচাপ।

তারপর শেখরনাথ বললেন, ‘এবার একটা অত্যন্ত গুরুতর প্রসঙ্গে আসছি।‘

‘কী প্রসঙ্গ আঙ্কল?’

‘শুনতে পাচ্ছি, ইস্ট পাকিস্তানের রিফিউজিদের জন্যে যে সেটলমেন্ট বসানো হচ্ছে সেই জমির খানিকটা অংশ নিয়ে মালাবারীদের বসানোর একটা চেষ্টা চলছে খুব গোপনে।’

‘কে বললে?’ চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল চিফ কমিশনারের।

‘নাম শুনে কী হবে? অনেকেই বলেছে। তবে বিশ্বজিৎ এ নিয়ে আমাকে কিছু জানায়নি। সে একজন লয়্যাল অফিসার। তার মুখ দিয়ে অ্যাডমিনিস্টেশনের সিক্রেট কোনও ব্যাপার বেরুবে না। আমি এখানে সেই নাইনটিন টোয়েন্টি থেকে আছি। এই আইল্যান্ডের সবাই আমাকে চেনে, ভালবাসে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি।’

চিফ কমিশনারের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। মাত্র দু-চার লহমা। ব্রিটিশ আমলের ধুরন্ধর আইসিএস। বাইরে থেকে এঁদের মনের ভাবগতিক বোঝা যায় না। হাসি হাসি একটা মুখোশ ফিরে এল তার আসল মুখের ওপর। বললেন, ‘লোকে বানিয়ে বানিয়ে কত কী-ই তো বলে। সেসব কি বিশ্বাস করতে আছে?’

পলকহীন চিফ কমিশনারকে লক্ষ করছিলেন শেখরনাথ। উত্তর দিলেন না।

কী ভেবে চিফ কমিশনার এবার বললেন, ‘তবে একটা দুশ্চিন্তাও আছে।’

‘কিসের দুশ্চিন্তা?’ শেখরনাথের চোখেমুখে, কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।

‘জাঙ্গল ফেলিং করে সাউথ আর মিডল আন্দামানে হাজার হাজার একর জমি রিক্লেম করা হচ্ছে। এরপর নর্থ আন্দামানেও করা হবে। ওদিকে কলকাতায় প্রচণ্ড গোলমাল। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো, বিশেষ করে কমিউনিস্টরা রিফিউজিদের আসতে দিচ্ছে না। যদি আন্দামানে রিফিউজি মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, এত জমি গভর্নমেন্ট নিশ্চয়ই ফেলে রাখবে না। অন্য কোনও পরিকল্পনা নিতে পারে। দুর্ভাবনা সেই কারণে।’

শেখরনাথ ব্যগ্রভাবে হাত নাড়তে লাগলেন।–-‘না না, বাধাটা টেম্পোরারি। উদ্বাস্তুরা নিশ্চয়ই আসবে।’

‘আসাই তো উচিত। তাদের জন্যেই এত বড় একটা প্রোজেক্ট।’

‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি না আসা হয়?’

খুব সরলভাবেই কথাগুলো বললেন চিফ কমিশনার। কিন্তু এই আপাত সারল্যের আড়ালে অন্য কোনও ইঙ্গিত রয়েছে কি? সেটা বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন শেখরনাথ। চিফ কমিশনারের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘উদ্বাস্তুদের জন্যে এই প্রোজেক্টে অন্য কিছুই করতে দেওয়া হবে না।’ তার গলার স্বর শান্ত কিন্তু দৃঢ়।

চিফ কমিশনার তাকিয়েই রইলেন।

শেখরনাথ থামেন নি।–-‘যদি উদ্বাস্তুরা এখন না আসতে পারে কিংবা যত ডিপি ফ্যামিলি আসার কথা, তারা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তেমন হলে পাঁচ বছর, দশ বছরও। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই মানুষগুলো স্বাধীনতার জন্যে সর্বস্ব হারিয়েছে, সবচেয়ে বেশি দাম দিয়েছে। এদের কথা সবার আগে ভাবতে হবে।’

চিফ কমিশনার আঁচ করে নিলেন শেখরনাথ ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত এবং অসন্তুষ্ট। তাকে শান্ত করতে চাইলেন।–-‘গভর্নমেন্ট এখনও অন্য কিছুই ভাবেনি। আপনার টেনশন করার কারণ নেই। প্রোজেক্টের কাজ যেমন চলছে তেমনই চলবে।’

শেখরনাথ বললেন, ‘চললেই ভাল। কিন্তু উদ্বাস্তুদের স্বার্থে যদি আঘাত লাগে, আমাকে কিন্তু প্রতিবাদ করতেই হবে। সেটা কিভাবে করব ভেবে রেখেছি। আচ্ছা, আজ চলি–’

চিফ কমিশনার উত্তর দিলেন না। শেখরনাথকে বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

.

সূর্য মাথার ওপর আকাশের মাঝখানে উঠে আসার আগেই ফিরে এলেন শেখরনাথ। বিনয় উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। কিন্তু চিফ কমিশনারের সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছে তার বিন্দুবিসর্গও জানালেন না। বিনয় সাংবাদিক, যদি কিছু লিখে ফেলে, জটিলতা বাড়বে। চিফ কমিশনার খুশি হবেন না। তা ছাড়া উদ্বাস্তুদের জন্য নির্দিষ্ট জমিতে মেপলাদের যে বসানো হবে তার নিশ্চিত কোনও প্রমাণ নেই। শুধু অনুমান আর শোনা কথার ওপর মন্তব্য করা ঠিক নয়। অন্তত তার মতো দায়িত্ববান, শ্রদ্ধেয় একজন মানুষের পক্ষে।

শেখরনাথ চিফ কমিশনারকে সতর্ক করে দিয়ে এসেছেন। তারপর দেখা যাক।

.

৪.৬

পরদিন বিকেলে কালীপদর জিপে বিনয়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ। বললেন, ‘জেলখানার তলার রাস্তা ধরে সমুদ্রের ধার দিয়ে ডান দিকে এগিয়ে যাবি।’

কালীপদ ঘাড় কাত করল, ‘আচ্ছা—’

মিনিট দশেকও লাগল না, জিপ সেলুলার জেলের তলায় পৌঁছে গেল। এখানে সেসোস্ট্রেস বে আধখানা বৃত্তের আকারে পূর্ব দিকে চলে গেছে। তার, গা ঘেঁষে বিনয়ের চেনা মসৃণ রাস্তাটাও পাশাপাশি চলছে। ঠিক উলটোদিকে ‘রস’ আইল্যান্ড।

কালীপদ জিগ্যেস করল, ‘এবার কোথায় যাব?’

‘সোজা এগিয়ে যা—’

উপসাগর যেখানে ডাইনে বাঁক নিয়ে আরও এগিয়ে গভীর সমুদ্রে মিশেছে ঠিক সেই কোণটিতে একটা মাঝারি ধরনের ন্যাড়া টিলা, ওপর দিকটা ফ্ল্যাট, গাছপালা-বাড়িঘর কিছু নেই।

শেখরনাথ কালীপদকে বললেন, ‘গাড়ি থামা—’ জিপ থামলে বিনয়কে নিয়ে নেমে পড়লেন।

বিনয় অবাক।–-‘আমাদের তো বৈজুদের বাড়ি যাওয়ার কথা। এখানে নিয়ে এলেন যে?’

শেখরনাথ হাসলেন।–-‘বৈজুদের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানার জন্যে এখানে আসা দরকার।’

ধন্দটা কাটছে না বিনয়ের।–-‘সেলুলার জেলেই তো বৈজু থাকত। সেটাই—’

তাকে থামিয়ে দিয়ে শেখরনাথ বললেন, ‘আমার সঙ্গে এসো। তোমার মনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার জবাব পেয়ে যাবে। এসো—’

এই ন্যাড়া নির্জন টিলায় কী রহস্য থাকতে পারে বিনয়ের বোধগম্য হচ্ছে না। ওপরে ওঠার সরু আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা রয়েছে। শেখরনাথের পিছু পিছু বিনয় টিলার মাথায় উঠে এল। প্রায় সমতল জায়গাটা অনেকখানি এলাকা জুড়ে।

শেখরনাথ বললেন, ‘এখানে এক সময় কী ছিল, ভাবতে পার?’

ডাইনে-বাঁয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল বিনয়–তার জানা নেই।

‘এখানেই ছিল সাউথ পয়েন্ট জেল। সেলুলার জেলের মতো অতটা না হলেও এটাও কম ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল না।‘

সাউথ পয়েন্ট জেলের নামটা শোনা শোনা। একটু ভাবতেই চট করে মনে পড়ে গেল বিনয়ের। এটাই ছিল একসময় মেয়েদের কয়েদখানা। তার সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল।

শেখরনাথ লঘু সুরে বলতে লাগলেন, ‘বুঝলে বিনয়, মেয়েরাও কম যায় না। বৈজুদের মতো মহাপুরুষেরা দু-চারটে খুন করে সেলুলার জেলে চালান হয়ে আসত, তেমনি সেই নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স থেকে বার্মা পর্যন্ত আন-ডিভাইডেড ইন্ডিয়ার নানা অঞ্চল থেকে মহামানবীদের কালাপানির এই জেলাখানায় নিয়ে আসা হত। এদের লাইফ হিস্ট্রিও খুবই গ্লোরিয়াস। কেউ দু-তিন জনের মাথা না নামিয়ে এখানে আসেনি। বলে হাসতে থাকেন।

বিনয় শুনতে লাগল। কোনও প্রশ্ন করল না।

শেখরনাথ থামেননি।–’ইংরেজদের মহত্ত্ব আছে, তারা কোনও মহিলা বিপ্লবীকে সাউথ পয়েন্ট জেলে টেনে আনেনি। খুনি মেয়ে-কয়েদিদের নিয়েই এই জেলখানা নরক গুলজার হয়ে থাকত। ইংরেজরা খুব সম্ভব নাইনটিন থার্টিতে এই জেলখানা বন্ধ করে দেয়। পরে বিশাল বিল্ডিংটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আন্দামানের একটা ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুনছি গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া জায়গাটা ফাঁকা ফেলে রাখবে না। কী একটা অফিস বিল্ডিং টিল্ডিং তৈরির কথা ভাবছে।‘

বিনয় উত্তর দিল না। কেমন ছিল সাউথ পয়েন্ট জেলখানার অন্দরমহলটা? ভারতের নানা প্রান্ত থেকে কালাপানি খাটতে আসা অগুনতি হিংস্র খুনি মেয়ে-কয়েদিদের কাল্পনিক চেহারাগুলি ভাবার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু না, ছায়ামূর্তির মতো ঝাপসা কিছু ছবি স্পষ্ট আকার নিতে না নিতেই ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

শেখরনাথের গলার স্বর ফের শোনা গেল।–’তোমাকে সেদিন বলেছিলাম না, পুরুষ কয়েদিরা সেলুলার জেলে আড়াই বছর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলে, জেলের আইন না ভাঙলে, তাদের ম্যারেজ সার্টিফিকেট দিত জেল অথরিটি। মনে পড়ছে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ–’ বিনয় মাথা কাত করল।

‘আর মেয়ে-কয়েদিরা যদি একবছর ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট না বাধাত তারাও এলিজিবল ফর ম্যারেজ। তাদেরও ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেওয়া হত। পুরুষ কয়েদিদের মধ্যে বিয়ের অনুমতি যাদের দেওয়া হত তারা এই সাউথ পয়েন্ট জেলখানা থেকে স্ত্রী-রত্ন লাভ করত। কোনও খরচ-খরচা নেই, একেবারে মুফতে সারা জীবনের জন্য একটা রমণীকে পাওয়া যেত।’ বলে হাসতে লাগলেন শেখরনাথ।

বিনয় অবাক। ব্রিটিশ আমলের এই বিপ্লবীটিকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। সাদাসিধে, সহৃদয়, অকপট। তাকে ঘিরে প্রবল এক ব্যক্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু দেশ ছাড়া তার ভাবনায় আর কিছুই নেই। সদ্য তরুণ, শেখরনাথ একদিন ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুভয়কে গ্রাহ্য করেননি। স্বাধীনতা এল ঠিকই। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে যা পাওয়া গেল তার নাম কি স্বাধীনতা? সেই যে উনিশশো কুড়িতে ‘দ্বীপান্তরী’ সাজা নিয়ে সেলুলার জেলে এসেছিলেন তারপর আর দেশের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাননি। পুনর্বাসনের জন্যে যে ছিন্নমূল মানুষদের আন্দামানে পাঠানো হচ্ছে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। শুধু কি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী? এই দ্বীপপুঞ্জে যেখানে যত বিপন্ন মানুষ তাদের পাশেও শেখরনাথ। দেশ আর দেশের মানুষ ছাড়া অন্য কোনও দিকে তাকানোর সময় নেই। ইচ্ছাও নয়। সেই বিপ্লবীটিই যে আন্দামানের কয়েদিদের বিয়ে নিয়ে এমন মজা করতে পারেন, কল্পনাও করা যায় না।

বিনয়ও হেসে ফেলল।–-‘কিন্তু—’

‘কী?’

‘এদের বিয়েটা হত কিভাবে?’

‘সেটা বৈজু আর গিন্নি সোমবারীই বলতে পারবে। চল, আমাদের নেক্সট ডেস্টিনেশন শাদিপুর—’

বিনয়ের মনে পড়ল, শাদিপুরেই থাকে বৈজুরা। দু’জনে টিলার মাথা থেকে নেমে এসে জিপে বসল। শেখরনাথ কালীপদকে বললেন, ‘বৈজুদের ওখানে যাব।‘

পাহাড়ি রাস্তার ওপর দিয়ে চড়াই-উতরাই ভাঙতে ভাঙতে একসময় একটা পাহাড়ের ঢালে সারি সারি একতলা ক’টা কাঠের ব্যারাক চোখে পড়ল। অল্প কিছুদিন হল সেগুলোতে রং করা হয়েছে। টাটকা পেন্টের ঝাঝালো গন্ধ নাকে এল।

একটা ব্যারাকের মাঝামাঝি জায়গায় এসে জিপ থামাল কালীপদ। গাড়ির শব্দে সারা পাড়াটায় লোকজন কেউ বাইরে বেরিয়ে এল, কেউ জানলা বা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। শেখরনাথকে দেখে তারা ভীষণ খুশি। একসঙ্গে সবাই হইচই বাধিয়ে দিল।

‘আইয়ে চাচাজি, আমাদের ঘরে আসুন–’

‘নেহি, আমাদের ঘরে আগে আসতে হবে’

শেখরনাথকে পুরনো কয়েদিরা যে কত ভালবাসে, নিজেদের কতটা আপনজন মনে করে, মুহূর্তে বুঝে গেল বিনয়। অবশ্য এর আগেও শেখরনাথের সঙ্গে যেখানেই গেছে এমন আন্তরিকভাবেই সেইসব এলাকার মানুষজন তাকে ডাকাডাকি করেছে।

বৈজু তার ঘর থেকে শেখরনাথকে দেখতে পেয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে খুব সম্ভব তার স্ত্রী। ভারী চেহারা, চুল কাঁচাপাকা, লম্বাটে ভরাট মুখ এই বয়সেও, রং বেশ ফর্সা, হলুদের সঙ্গে দুধ মেশালে যেমনটা দেখায়। পরনে সালোয়ার আর ঢোলা কামিজ।

মহল্লার বাসিন্দারা টানাটানি করছিল শেখরনাথকে নিয়ে। কিন্তু বৈজু আর তার সঙ্গের মধ্যবয়সিনী একরকম ছোঁ মেরেই তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে গেল। বিনয়কে বলল, ‘আইয়ে–চাচাজির সঙ্গে এসেছেন, বহুৎ খুশি হয়েছি।‘

পাশাপাশি দুটো ঘর, রান্নাঘর, চান করার ঘেরা জায়গা–এটুকুই চোখে পড়ল বিনয়ের। আন্দাজ করে নিল অন্য সব বাসিন্দাদের জন্যও একইরকম বাসস্থানের ব্যবস্থা। প্রতিটি ব্যারাকে পাশাপাশি এরকম দু-কামরার পঁচিশ-তিরিশটা করে ইউনিট। একটা ইউনিট মানে একটা ফ্যামিলি। এখানে সাত-আটটা ব্যারাক। প্রতিটি ব্যারাকের পর অনেকটা ফাঁকা জায়গা রেখে আর-একটা ব্যারাক। এইভাবে সেগুলো তৈরি করা হয়েছে।

বৈজু একটা ঘরে এনে শেখরনাথ আর বিনয়কে বসাল। এখানে কাঠের ভারী ভারী আসবাব। চেয়ার, টেবিল, গদি-আঁটা ক’টা মোড়া, ধবধবে চাদরে-ঢাকা নিচু তক্তপোশ, ইত্যাদি। বোঝাই যায় এটা বাইরের ঘর। লোকজন এলে এখানে বসানো হয়।

বৈজু আর মাঝবয়সিনীটি মোড়া টেনে এনে শেখরনাথের কাছাকাছি বসল। মেয়েমানুষটি একেবারে ঝড় বইয়ে দিতে লাগল।–’চাচাজি, সেদিন এসে আমার ঘরবালা বলল, আপনার সাথ বড় কয়েদখানায় (সেলুলার জেল) তার দেখা হয়েছে, আপনি বলেছেন আমাদের এখানে আসবেন। হর রোজ ভাবি আপনাকে দেখতে পাব। আপনি আসেনই না। মনমে বহুৎ দুখ হুয়া, হোড়া গুসা ভি। আর দো-এক রোজ দেখে সিধা রাহাসাহাবের বাংলায় চলে যেতাম।’

‘রাগ করিস না সোমবারী। একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম, তাই আসা হচ্ছিল না। যেই ফুরসত পেলাম, তক্ষুনি চলে এসেছি—’ অবুঝ কিশোরীকে বোঝাবার মতো হেসে হেসে সোমবারীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন শেখরনাথ।

‘কত রোজ বাদ এলেন বলুন তো? পুরা এক সাল—’

‘কী যে বলিস, তিন মাস আগেই তোদের সঙ্গে দেখা করে গেছি। বলতে বলতে কী খেয়াল হল শেখরনাথের।’ওই দ্যাখ, তোর সঙ্গে তো আলাপই করিয়ে দেওয়া হয়নি।–এ হল বিনয়, কলকাতা থেকে এসেছে, খবরে কাগজে কাজ করে। আর ও হল বৈজুর স্ত্রী।’

সোমবারী হাতজোড় করে বলল, ‘নমস্তে, নমস্তে। আমরা বহুৎ খুশনসিব যে আপনি এসেছেন—’

বিনয় আগেই বৈজুর সঙ্গে মেয়েমানুষটির সম্পর্কটা অনুমান করে নিয়েছিল। সেও হাতজোড় করল।

সোমবারী উঠে পড়ল।–’চায়-পানি নিয়ে আসি। খেতে খেতে কথা হবে।‘

শেখরনাথ হাঁ হাঁ করে উঠলেন।–’চায়ের দরকার নেই। এইমাত্র আমরা খেয়ে এসেছি।‘

কে কার কথা শোনে। চঞ্চল পায়ে প্রায় উড়তে উড়তে সোমবারী বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর চা, ঘরে তৈরি লাড্ড, নিমকি, ভুজিয়া-টুজিয়া নিয়ে ফিরল।–’লিজিয়ে। চাচাজি, আজ আপনাদের ছাড়ছি না। দু’পহরের খানা খেয়ে যেতে হবে। ঘরে সুরমাই আর পমফ্রেট মছলি আছে। মোরগা ভি আছে। ও হো, আপনি তো মাংস খান না। ঠিক হ্যায়, সবজি টবজি বানিয়ে দেব। আপনারা গপসপ করুন। আমি ঝটাঝট রসুই করে ফেলি।‘

সোমবারী চলে যাচ্ছিল, তাকে হাত ধরে বসিয়ে দিলেন শেখরনাথ। ব্যস্তভাবে বললেন, ‘আজ হবে না রে, তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে।

‘নেহি নেহি—’ সোমবারী জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। না খাইয়ে সে ছাড়বে না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে শান্ত করা গেল। তবে কথা দিতে হল অন্য একদিন শেখরনাথ বিনয়কে নিয়ে এসে খেয়ে যাবেন।

চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ পুরনো দিনের স্মৃতিতে মশগুল হয়ে গেলেন শেখরনাথ, সোমবারী আর বৈজু। সেলুলার জেলে দিনগুলো কিভাবে কেটেছে তাই নিয়ে কত গল্পগাছা! কী প্রচণ্ড দাপট যে ছিল পেটি অফিসার, টিন্ডাল আর ওয়ার্ডারদের। আর ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের দেখলে হাড় হিম হয়ে যেত দুর্ধর্ষ কয়েদিদের। পান থেকে চুন খসলে পুরো একদিনের খানা বন্ধু কি ‘টিকটিকি’তে চড়িয়ে চাবুক মারার হুকুম। কয়েদিরা বড় রকমের গোলমাল করলে হাতে-পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে সলিটারি সেলে তালাবন্ধ করে রাখা হত। আরও কতরকমের নির্যাতন। সাধারণ কয়েদি হোক বা অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা–তাদের সবাইকে রোজ নারকেলের ছোবড়া পিটে দু’সের সরু তার বা হাত দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পনেরো সের নারকেল কি সরষের তেল বের করতে হত। এক ছটাক কম হলে একবেলার খাওয়া বন্ধ। ইত্যাদি ইত্যাদি। বৈজু অন্যের গলার স্বরটর হুবহু নকল করতে পারে। ব্রিটিশ অফিসার, টিন্ডাল বা ওয়ার্ডাররা কে কেমন করে কথা বলত, চলাফেরা করত, নোংরা নোংরা গালাগাল দিত, খেপে গেলে তাদের চোখমুখের চেহারা কিরকম হয়ে যেত–কখনও বসে, কখনও উঠে দাঁড়িয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে দেখাতে লাগল।

বৈজুর কাণ্ডকারখানা দেখে সবাই হাসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হাসছিল সোমবারী। হাসতে হাসতে তার সারা শরীর বেঁকেচুরে যাচ্ছিল। এমন যে রাশভারী শেখরনাথ, তার মুখেও হাসি। বললেন, ‘বৈজুটা একটা মহা বিচ্ছু—’

সেলুলার জেলের অন্দরমহলে কয়েদিদের জীবন কিভাবে কেটেছে আগেই জেনে গেছে বিনয়। শেখরনাথ তাঁকে খুঁটিনাটি সমস্ত বলেছেন। কিন্তু সাউথ পয়েন্ট জেলের অন্তঃপুরটা সম্বন্ধে তিনি কিছু জানাননি, বলেছিলেন, শাদিপুরে গেলে সব জানা যাবে। বিনয় বার বার সোমবারীর দিকে তাকাচ্ছিল।

শেখরনাথ বিনয়কে লক্ষ করেছিলেন। তার মনোভাব অনুমান করে সোমবারীকে বললেন, কলকাতার পত্রকার সাউথ পয়েন্ট ‘জেলের কথা শুনতে চাইছে। নে বল—’

সোমবারী হাসির তোড় কমে গিয়েছিল। একটু ভেবে যা বলল, মোটামুটি এইরকম। মরদদের ফাটক (সেলুলার জেল) আর জেনানা ফাটকের (সাউথ পয়েন্ট জেল) মধ্যে ফারাক নেই বললেই হয়। সেলুলার জেলের কয়েদিদের শুধু সেলুলার জেলেই আটকে রাখা হত না, অনেককে পুলিশ পাহারায় সকালে বাইরে নিয়ে যাওয়া হত। তাদের দিয়ে পোর্টব্লেয়ারের সড়ক বানানো, বনবিভাগ বা শিপিং ডিপার্টমেন্টের কাজ করিয়ে সূর্যাস্তের আগে আগে পাহারা দিয়ে ফের সেলুলার জেলে ফিরিয়ে আনত পুলিশের দল। কিন্তু জেনানা ফাটকের বন্দিনীদের কখনও বাইরে বেরুতে দেওয়া হত না। তফাত এটুকুই। নইলে আর সব একইরকম। তাদেরও নারকেল ছোবড়া পিটে তার এবং ঘানি টেনে তেল বের করতে হত। সাউথ পয়েন্ট জেলেও টিন্ডাল, পেটি অফিসার, ওয়ার্ডার এবং ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার মিলিয়ে বিভীষিকার রাজত্ব।

বিনয় যেখানেই যায়, সঙ্গে পেন এবং নোটবই থাকে। সোমবারীর কথাগুলো সে টুকে টুকে নিচ্ছিল।

একসময় সোমবারী চুপ করল।

একটু নীরবতা।

তারপর শেখরনাথ বললেন, ‘আমি হয়তো তোদের এখানে দু-একদিন পরে আসতাম। বিনয়ের জন্যে আজই আসতে হল। ও তোদের কাছে একটা ব্যাপার জানতে চায়। সেটা আমার ভাল জানা নেই। তাই বলতে পারিনি। তোরাই বল—’

বৈজু বলল, ‘হাঁ হাঁ চাচাজি, কী ব্যাপার বলুন—’

‘বিনয় জানতে চায় আন্দামানে ইংরেজ আমলে মেয়ে-কয়েদিদের সঙ্গে পুরুষ-কয়েদিদের কীভাবে শাদি হত।’

বৈজু কথা বলতে ভীষণ ভালবাসে। উৎসাহে তারা চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। বলল, ‘এ হি বাত! চাচাজি গরমিনের (গভর্নমেন্টের) যেসব কানুন মেনে সোমবারীকে আমি শাদি করেছি, অন্য কয়েদিদেরও সেইভাবেই হয়েছে।‘

শেখরনাথকে বেশ উৎসুক দেখাল। এই ধরনের বিয়ের ব্যাপারটা তার প্রায় অজানা। বললেন, ‘তোদের শাদির কথাটাই শোনা যাক—‘

বৈজু বিনয়ের দিকে তাকাল।-–’ভাইসাব, আপনি কি জানেন, কালাপানির মরদ-কয়েদিরা যদি ঢাই সাল (আড়াই বছর) ঝামেলা-ঝঞ্জাট না করত, জেলখানা থেকে তাদের ‘ম্যারিজ সাট্রিফিট’ (সার্টিফিকেট) দেওয়া হত, আর জেনানাদের বেলা টেইম (টাইম) আরও কম। সিরিফ (স্রেফ) এক সাল।‘

বিনয় বলল, ‘শুনেছি। কাকা বলেছেন—’

‘এই ‘ম্যারিজ সাট্টিফিট’ ছাড়া শাদি করা যেত না। আমি একদিন সেটা পেয়ে গেলাম। পুরা জিন্দেগির জন্যে ‘কালাপানি’ খাটতে এই জাজিরায় (দ্বীপে) এসেছি। আমাদের মতো কয়েদিদের দুলহন তো আসমান থেকে নেমে আসবে না। দেশ থেকেও জাহাজে চেপে কেউ এসে গলায় মালা চড়াবে না। তা হলে দুলহন মিলবে কোথায়? শুনলাম সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার কোনও জেনানাকে শাদি করতে হবে। আরও শুনলাম শাদির পর আর কয়েদখানাতে আমাকে ঢোকানো হবে না। আমাকে ঘর দেওয়া হবে, নৌকরিও পাব। তলব মিলবে। নিজের আওরতকে নিয়ে সেখানে থাকব। দিল তো বহুৎ খুশ হো গিয়া। লেকিন–’

অফুরান আগ্রহ নিয়ে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। জিগ্যেস করল, ‘লেকিন কী?’

‘গরমিন আমাকে সাট্টিফিট দিয়েছে। শাদি না করলে যদি আংরেজ অফসররা ‘টিকটিকি’তে চড়িয়ে চাবুক মারে কি ভাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কয়েদখানার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে রাখে? দো রাত ভেবে ভেবে আঁখে নিদ এল না। মনে হল যা হবার তাই হবে। শাদি করব। না করলে গরমিন আমাকে ছাড়বে না। ঝুট বলব না, আমার মনেও শাদির খোয়াব ছিল।’

বলতে বলতে দম নেবার জন্য একটু থামল বৈজু। জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাস টানল। ফের শুরু করল।-–’এতোয়ার এতোয়ার (রবিবার রবিবার) সাউথ পয়িন্ট কয়েদখানায় ‘ম্যারিজ প্যারিড’ (ম্যারেজ প্যারেড) হত।‘

বিনয় জিগ্যেস করল, ‘সেটা কী?’

‘বলছি বলছি, শুনুন না। ‘ম্যারিজ প্যারিড’-এর কথা আগে শুনেছি, লেকিন নিজের আঁখে তখনও দেখিনি, জেনানা ফাটকে মরদদের ঢুকতে দিলে তো দেখব। ঢোকা তো দূরের কথা, আধা মাইলের ভেতর কোনও মরদ-কয়েদিকে ঘেঁষতে দেওয়া হত না।–তা আমার মতো আরও বিশ-পঁচিশজন সেবার ‘ম্যারিজ সাট্টিফিট’ পেয়েছিল। ইন্ডিয়ার দূর দূর থেকে তারা কালাপানি এসেছে। বঙ্গালি, পাঠান, বর্মী, পাঞ্জাবি, বিহারি, মান্দ্রাজি–কে নেই? হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ভি। এক এতোয়ার দু’পহরে বন্দুকবালা পুলিশরা পাহারা দিয়ে আমাদের জেনানা ফাটকে নিয়ে গেল। পায়দল। ফাটকটা ঘিরে চারদিকে উঁচা উঁচা দিবার। অন্দরে কদম রাখলেই বড় ফাঁকা ময়দান। তারপর চার-পাঁচটা ইমারত। ওগুলোতে জেনানারা থাকে। লেকিন এক ভি জেনানা দেখতে পেলাম না।

‘ময়দানের চারপাশ ঘিরে বহুৎ বহুৎ নারিকেল (নারকেল) গাছ। মাঝখানে বড় ছাতার তলায় কুর্সিতে তিন আংরেজ পুলিশ অফসর বসে আছে। এখানেও কমসে কম বিশ জন পুলিশ। তাদের হাতেও বন্দুক।

‘এক অফসরের হুকুমে আমরা যে মরদ কয়েদিরা দুলহনের খোঁজে এসেছিলাম তাদের পর পর কাতার দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। বঙ্গালির পর পাঞ্জাবি, হিন্দুর পর মুসলমান–এইভাবে।

‘এতটা উচানিচা রাস্তা ভেঙে এসেছি। মাথার ওপর আসমানে সুরুষটা (সূর্য) চুলহার মতো জ্বলছে। আমরা চৌবিশ (চব্বিশ) কয়েদি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। কমরে (কোমর) দর্দ হচ্ছে। পাও দু’টো ছিঁড়ে পড়বে মনে হচ্ছে। পসিনায় ভিজে যাচ্ছে কুর্তা। দুলহন কখন আসবে, কে জানে। ‘কালাপানি’তে শাদি করাটা সোজা ব্যাপার নয়।

‘আমার সামনের দুই, কয়েদি আস্তে আস্তে কথা বলছিল।

‘শাদির জরুরত নেই। চল, ভেগে যাই—’

‘তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? ভাগতে গেলে পুলিশ সিধা গোলি চালিয়ে দেবে।’

‘তারপর দুজনেই চুপ।

‘লগভগ দো ঘণ্টা বাদ তিন জেনানা টিন্ডালান ফটকের একটা বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে কড়া নজরে তাকিয়ে রইল পুলিশ। লেড়কি দেখে মরদদের কেউ যদি গড়বড় করে ফেলে সিধা গোলি তার সিনায় ঘুষে যাবে।

‘জেনানা টিন্ডালানরা যে জেনানা কয়েদিকে নিয়ে এসেছিল সে মোটি, কালা, পুরা চার হাত লম্বা। বিলকুল রাক্ষসী (রাক্ষসী) য্যায়সা। টিল্ডালানরা আমাদের একেকজনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে করিয়ে, মরদ আওরত দু’জনকেই জিগ্যেস করছে, ‘পসন্দ হল?’ মরদ কয়েদিটি বহুৎ ডরে যাচ্ছে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে–পসন্দ হয়নি। এইরকম দুলহন নিয়ে কে আর ঘর করতে চায়? চব্বিশজন মরদ কয়েদিই তাকে খারিজ করে দিয়েছে। তাকে পসন্দ না করায় আওরতটা খেপে গিয়েছিল। সে আঁখ লাল করে গালি দিতে দিতে ফাটকের বিল্ডিংয়ে ফিরে গেল। ‘শালে, কুত্তা, জানবরের দল—’ ভাইসাব, একেই ‘ম্যারিজ প্যারিড’ বলা হত।’

চমকপ্রদ এক আখ্যান মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিলেন শেখরনাথ। বেশ মজাই লাগছিল তার। লঘু সুরে বললেন, ‘ব্রিটিশ জেলাররা দেখছি রামায়ণ-মহাভারতের মতো স্বয়ম্বর সভা বসিয়ে দিয়েছিল সাউথ পয়েন্ট জেলে!’

স্বয়ম্বর-সভা ব্যাপারটা কী, বৈজু ঠিক বুঝতে পারল কি না কে জানে। তবে শেখরনাথ মাজাক ওড়াচ্ছেন, সেটা আন্দাজ করে সব ক’টা ট্যারাবাঁকা দাঁত বের করে খুব একচোট হেসে বলল, ‘তারপর শুনুন– নতুন উদ্যমে সে শুরু করে দেয়।’কালী মোটি তো চলে গেল। এরপর টিন্ডালানরা এক হট্টাকট্টা আওরতকে এনে হাজির করল। গলা নেই, মুণ্ডুটা কান্ধার (কাঁধের) ওপর ঠেসে বসিয়ে দেওয়া। ওঠ দু’টো (ঠোঁট দুটো) পুড়ে পুড়ে কালচে। জরুর বিড়ি কি পিনিক যুঁকত। মনে হচ্ছিল তার গায়ে পহেলবানদের মতো তাকত। এমন লড়কিকে কে শাদি করবে? সেও নাকচ হয়ে গেল। পহেলবান এক মরদ পেল না, ইসি লিয়ে তাঁর শিরে খুন চড়ে গিয়েছিল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মরদ কয়েদিদের সেও বাপ-মা তুলে গালি দিতে দিতে ফিরে গেছে।

‘দুই নমুনার কথা তো শুনলেন। এরপর একে একে তিন বর্মী জেনানাকে নিয়ে আসা হল। মরদ কয়েদিদের মধ্যে পাঁচ ছে আদমি বর্মা মুল্লুকের। তারা আওরতগুলোকে পসন্দ করে ফেলল। চারদিকে উঁচা উঁচা দিবার। অন্দরে কদম রাখলেই বড় ফাঁকা ময়দান। তারপর চার-পাঁচটা ইমারত। ওগুলোতে জেনানারা থাকে। লেকিন এক ভি জেনানা দেখতে পেলাম না।‘

‘ময়দানের চারপাশ ঘিরে বহুৎ বহুৎ নারিকেল (নারকেল) গাছ। মাঝখানে বড় ছাতার তলায় কুর্সিতে তিন আংরেজ পুলিশ অফসর বসে আছে। এখানেও কমসে কম বিশ জন পুলিশ। তাদের হাতেও বন্দুক।

‘এক অফসরের হুকুমে আমরা যে মরদ কয়েদিরা দুলহনের খোঁজে এসেছিলাম তাদের পর পর কাতার দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। বঙ্গালির পর পাঞ্জাবি, হিন্দুর পর মুসলমান–এইভাবে।

‘এতটা উঁচানিচা রাস্তা ভেঙে এসেছি। মাথার ওপর আসমানে সুরুষটা (সূর্য) চুলহার মতো জ্বলছে। আমরা চৌবিশ (চব্বিশ) কয়েদি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। কমরে (কোমর) দর্দ হচ্ছে। পাও দু’টো ছিঁড়ে পড়বে মনে হচ্ছে। পসিনায় ভিজে যাচ্ছে কুর্তা। দুলহন কখন আসবে, কে জানে। ‘কালাপানি’তে শাদি করাটা সোজা ব্যাপার নয়।

‘আমার সামনের দুই, কয়েদি আস্তে আস্তে কথা বলছিল।‘

‘শাদির জরুরত নেই। চল, ভেগে যাই—’

‘তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? ভাগতে গেলে পুলিশ সিধা গোলি চালিয়ে দেবে।‘

‘তারপর দুজনেই চুপ।

‘লগভগ দো ঘণ্টা বাদ তিন জেনানা টিন্ডালান ফটকের একটা বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে কড়া নজরে তাকিয়ে রইল পুলিশ। লেড়কি দেখে মরদদের কেউ যদি গড়বড় করে ফেলে সিধা গোলি তার সিনায় ঘুষে যাবে।

‘জেনানা টিল্ডালানরা যে জেনানা কয়েদিকে নিয়ে এসেছিল সে মোটি, কালা, পুরা চার হাত লম্বা। বিলকুল রাক্ষসী (রাক্ষসী) য্যায়সা। টিন্ডালানরা আমাদের একেকজনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে করিয়ে, মরদ আওরত দু’জনকেই জিগ্যেস করছে, ‘পসন্দ হল?’ মরদ কয়েদিটি বহুৎ ডরে যাচ্ছে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে–পসন্দ হয়নি। এইরকম দুলহন নিয়ে কে আর ঘর করতে চায়? চব্বিশজন মরদ কয়েদিই তাকে খারিজ করে দিয়েছে। তাকে পসন্দ না করায় আওরতটা খেপে গিয়েছিল। সে আঁখ লাল করে গালি দিতে দিতে ফাটকের বিল্ডিংয়ে ফিরে গেল। ‘শালে, কুত্তা, জানবরের দল– ভাইসাব, একেই ‘ম্যারিজ প্যারিড’ বলা হত।‘

চমকপ্রদ এক আখ্যান মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিলেন শেখরনাথ। বেশ মজাই লাগছিল তার। লঘু সুরে বললেন, ‘ব্রিটিশ জেলাররা দেখছি রামায়ণ-মহাভারতের মতো স্বয়ম্বর সভা বসিয়ে দিয়েছিল সাউথ পয়েন্ট জেলে!’

স্বয়ম্বর-সভা ব্যাপারটা কী, বৈজু ঠিক বুঝতে পারল কি না কে জানে। তবে শেখরনাথ মাজাক ওড়াচ্ছেন, সেটা আন্দাজ করে সব ক’টা ট্যারাবাঁকা দাঁত বের করে খুব একচোট হেসে বলল, ‘তারপর শুনুন—’ নতুন উদ্যমে সে শুরু করে দেয়।–’কালী মোটি তো চলে গেল। এরপর টিন্ডালানরা এক হট্টাকট্টা আওরতকে এনে হাজির করল। গলা নেই, মুণ্ডুটা কান্ধার (কাঁধের) ওপর ঠেসে বসিয়ে দেওয়া। ওঠ দু’টো (ঠোঁট দুটো) পুড়ে পুড়ে কালচে। জরুর বিড়ি কি পিনিক যুঁকত। মনে হচ্ছিল তার গায়ে পহেলবানদের মতো তাকত। এমন লড়কিকে কে শাদি করবে? সেও নাকচ হয়ে গেল। পহেলবান এক মরদ পেল না, ইসি লিয়ে তার শিরে খুন চড়ে গিয়েছিল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মরদ কয়েদিদের সেও বাপ-মা তুলে গালি দিতে দিতে ফিরে গেছে।

‘দুই নমুনার কথা তো শুনলেন। এরপর একে একে তিন বর্মী জেনানাকে নিয়ে আসা হল। মরদ কয়েদিদের মধ্যে পাঁচ ছে আদমি বর্মা মুল্লুকের। তারা আওরতগুলোকে পসন্দ করে ফেলল। জেনানারাও ওদের শাদি করতে রাজি। এইভাবে পর পর লেড়কিদের নিয়ে আসা হচ্ছে, দু’পক্ষেরই জীওন-সাথী পসন্দ হলে অংরেজ পুলিশ অফসরদের হুকুমে আলাগ আলাপ জেনানাদের একদিকে আর মরদদের অন্য জায়গায় বসিয়ে রাখা হল।’

শেখরনাথ বললেন, ‘অন্য সবার কথা তো বলছিস। তোর আর সোমবারীর কী হল?’

বৈজু হাত নাড়ে।–’থোড়েসে সবুর ভাইসাব। এবার বলছি। আমরা সেবিশ মরদ ‘ম্যারিজ সাট্টিফিট’ পেয়েছিলাম। জেনানাদের মধ্যে পেয়েছিল ত্রিশ জন। আঠারো জোড়ির (জোড়ার) বন্দোবস্তু হয়ে গেল। আমার মনমে বহুৎ দুখ। কারওকে আমার পসন্দ হচ্ছে না। যাকে ভাল লাগছে সে আবার আমাকে চাইছে না। যখন ভাবছি আমার নসিবে ঘরবালী নেই, সেই সময় টিল্ডালানরা এক লেড়কিকে নিয়ে এল। আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক পাঠান আর এক দাড়িবালা শিখ। দু’জনেই জবরদস্ত জওয়ান। এতক্ষণ ঝামেলা-ঝাট করেনি। আচানক যেন বিলকুল পাগল বনে গেল তারা। দু’জনে দুদিক থেকে লেড়কির হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল। পাঠান বলে, ‘এ লড়কি আমার’, শিখ বলে, ‘এ লড়কি সিরিফ (স্রেফ) মেরাহি।‘ দু’জনের মধ্যে মারদাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হল্লাগুল্লা বাধিয়ে দিলাম।

‘আংরেজ অফসররা সবাই হিন্দুস্থানী বুলি জানত। একজন চার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে এল। সমানে গালি দিতে দিতে হাতের ডাণ্ডা চালাতে লাগল।–’মার মারকে হাড্ডি তোড় দুঙ্গা। মারের চোটে যখন শিখ আর পাঠানের নাকমুখ পিঠ সিনা ফেটে খুন বেরিয়ে এল তখন অফসর পুলিশ চারটেকে বলল, ‘এ দো কুত্তাকে বচ্চেকো সেলুলার জেলমে লে যাও। ডান্ডাবেড়ি চড়াকে কুঠুরিমে (সেল) বন্ধ কর, তালা ভি লাগাও। দো রোজ খানা বন্ধ।‘ হুকুম শুনে বন্দুকের কুন্দা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে জেনানা ফটক থেকে দুই জানবরকে (জানোয়ারকে) বের করে নিয়ে গেল পুলিশরা।

শেখরনাথ উৎসুক সুরে জিগ্যেস করলেন, ‘তারপর?’

বৈজু বলল, ‘ইলাকায় পুরা শান্তি। ফের টিন্ডালানরা সেই লড়কিকে নিয়ে এগিয়ে এল। শিখ পাঠান চলে যাবার পর আমি এখন লাইনে বিলকুল পয়লা নম্বরে। লড়কি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক নজর দেখেই ভাল লেগে গেল। বড়ো বড়ে আঁখে, গোরা রং, খুবসুরত–’

হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে সোমবারী নিচু গলায় বলে, ‘চুপ কর। ভাইসাবের সামনে এসব বলতে শরম লাগছে না?’

বোঝা গেল সাউথ পয়েন্ট জেলের সেই কয়েদি মেয়েটিই সোমবারী। বৈজু হাত নাচিয়ে বলল, ‘কিসের শরম? যা সচ অই তো বলছি।’ সে একেবারে অকপট।

শেখরনাথ বললেন, ‘তাই তো বলবি। কিসের লজ্জা সোমবারী!’

শেখরনাথ এখানে আসার পর বেশ হালকা মেজাজেই আছেন। ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন বিপ্লবীটি শুষ্ক, নীরস একজন মানুষ নন। দেশের মানুষজন, দেশের হাজার সমস্যা তাঁর ধ্যানজ্ঞান–এটাই জানত বিনয়। কিন্তু তিনিও যে রগড় করতে পারেন, রসিকতার জবাবে পালটা রসিকতা–দেখতে দেখতে অবাক বিনয়। গাম্ভীর্যের কঠিন খোলার নিচে কোথায় লুকনো ছিল এমন একটি ফধারা! সরস, সজীব, স্নিগ্ধ।

সোমবারী মুখ নামিয়ে বসে রইল।

বৈজু বলতে থাকে, ‘যে টিল্ডালানরা লড়কিকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল তাদের একজন তাকে পুছল, ‘পসন্দ হয়েছে? তারপর আমাকেও একই সওয়াল। জবাবে আমরা দু’জনেই শির হিলিয়ে দিলাম। আগে যেখানে মরদ কয়েদিদের বসিয়ে রাখা হয়েছিল, আমাকে সেখানে পাঠানো হল। লড়কি গেল জেনানা কয়েদিদের কাছে। নজদিগ আংরেজ অফসর বসে আছে। আমরা মরদরা চুপচাপ বসে আছি, ডরে কারও গলার নলিয়া দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। জেনানারা ভি বিলকুল খামোস। তিরছি নজরে সোমবারী দূর থেকে আমাকে দেখছে। আমিও তাকে দেখছি। আঁখে আঁখ মিললে সোমবারী অন্য দিকে আঁখ সরিয়ে নিচ্ছে। অ্যায়সাই চলছিল।’

একটানা বলে যাচ্ছিল বৈজু। দম নেবার জন্য কিছুক্ষণ থামল। তারপর ফের শুরু করল, ‘আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। ‘ম্যারিজ প্যারিড’ শেষ হল আরও ঘণ্টা, সোয়া ঘণ্টা পর। সব জেনানা কয়েদিরা মরদ কয়েদিদের পসন্দ করেনি, তাদের জেনানা ফাটকের ইমারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যে মরদরা বাতিল হয়েছিল তাদেরও সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবার আংরেজ অফসর আমাদের বলল, ‘যে মরদ যে জোনানাকে পসন্দ করেছে ওই নারিয়েল গাছগুলোর পাশে গিয়ে বাতচিত কর। সাউথ পয়েন্ট জেলখানায় তখন বহুৎ নারিয়েল গাছ ছিল। আমরা এক-এক জোড়া আলাগ আলাপ গাছের তলায় গিয়ে বসলাম। দূর থেকে আমাদের কথা শোনা যাবে না, লেকিন আমাদের ওপর নজর রাখা যাবে। সিপাহিরা আমাদের সবার দিকে বন্দুক নিশানা করে রেখেছিল। কেউ বেতমিজি বদমাশি করলে সিরিফ গোলি চালিয়ে দেবে। অনেক সাল পর মরদরা লেড়কি দেখছে তো, তাদের মাথায় শয়তান ভর করতে পারে, তাই এত নজরদারির বন্দোবস্ত। বলে সে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল।-–’ভাইসাব, আংরেজ আমলে কয়েদিদের শাদির ব্যাপারটা কেমন মজাদার ছিল, একবার আন্দাজ করুন। বলেই আবার সাউথ পয়েন্ট জেলের সেই দিনটির স্মৃতিতে ফিরে গেল। তো নারিয়েল গাছের নিচে বসে দু’জনেই খানিকক্ষণ গুংগা (বোবা)। তারপর আমিই শুরুয়াতটা করলাম। –’তোমার কী নাম?’

‘লড়কি বলল, ‘সোমবারী।‘

‘পুছলাম, ‘ঘর কঁহা থা?’

‘সোমবারী বলল, ‘পঞ্জাব। গুরগাঁওকা আশপাশ এক গাঁওমে—’

’ঘরে কে আছে?’

‘এক বুড়হা বাপ। আর কোঈ নেহি–’

‘হিন্দু?’

‘হাঁ। আমরা জাঠ।‘

‘তোমার মতো খুবসুরত লড়কিকে কালাপানি আসতে হল কেন?’

‘সোমবারী বলল, ‘বাপু খুব ভুগত। বহুৎ কিসিমকা বুখারে সারাদিন শুয়ে থাকত। আমাদের খেতি জমিন ছিল ষাট পঁয়ষ বিঘার মতো। বাপু জমিনে যেতে পারত না। এদিকে পড়োশিরা ছিল বহুৎ হারামি। মতলববাজ। মাঝে মাঝেই থোড়া থোড়া করে আমাদের জমিন দখল করে নিচ্ছিল। বাপু তো খাঁটিয়া থেকে উঠতে পারে না। আমি গিয়ে বলতাম, ‘অ্যায়সা মাত্ কর। পড়োশিরা আমার মতো এক লড়কিকে পাত্তাই দিত না। বলত, ‘যা, ভাগ–’ যতবার যাই আমাকে ভাগিয়ে দেয়। আমিও জাঠের মেয়ে। হর রোজ জমিন নিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদ বাধত। বুরা (খারাপ) জবান ছিল ওদের। খারাব খারাব গালি দিত। আমিও ছাড়তাম না। এইভাবেই চলছিল। হারামজাদেরা জমিনের দখলও নিচ্ছিল। পড়োশিরা মনে হয় পুলিশকে পাইসা (পয়সা) খাইয়ে হাত করেছে। ঠিক করলাম লড়াইটা আমাকেই করতে হবে। ওরা খুঁটি পুঁতে ওদের সীমানা বাড়াচ্ছিল রাত্তিরে। আমি রাতে জমির পাশে বসে লণ্ঠন জ্বেলে পাহারাদারি শুরু করলাম। জমিনে কেউ নামলেই হল্লা বাধিয়ে দিই। ওরা ভেগে যায়। আমি রুখে দাঁড়াচ্ছি, এতে ওরা খেপে গেল। একদিন রাত্তিরে ওরা আচানক আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিয়ে দৌড়তে লাগল, চিল্লাবো যে তার উপায় নেই। মুখে হাত দিয়ে ঠেসে ধরে রেখেছে। লেকিন আমিও জাঠের ঘরের লড়কি। গায়ে তাকত কম ছিল না, সিনাতেও সাহস ছিল। আচানক চার পাঁচটা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় শুরু করেছিলাম। ওদের মতলব ছিল আমার ইজ্জৎ লুটে বিলকুল খতম করে দেওয়া। শয়তানের বাচ্চারা আমার পিছু ছাড়েনি, তবে আমাকে ধরতে পারেনি, আমি আমাদের ছোট কোঠিতে ফিরে এসেছিলাম। বাপুকে কিছু জানাইনি। লেকিন যতই সাহস থাক, মনে হচ্ছিল ওরা আমাকে ছাড়বে না, ফির হামলা চালাবে। এতগুলো মরদের সাথে একা আওরতের লড়া সম্ভব নয়। মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। দুশমনগুলোকে আন্ধেরাতে চিনে ফেলেছিলাম। ঠিক করে ফেললাম ওরা ফির হামলা চালাবার আগেই ওদের খতম করব। আমাদের ঘরে একটা বড় কিরপান (কৃপাণ) ছিল, সেটা দোপাট্টার ভেতর লুকিয়ে পরদিন সুবেহ সুরুয (সূর্য) ওঠার পর বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কোঠি থেকে সবচেয়ে নজদিগ ছিল দুই দুশমনের কোঠি। জানতাম সুবেহ ঘুম থেকে উঠে তারা খাঁটিয়ায় বসে গপসপ করতে করতে চায়-পানি খায়। বাকি দুই দুশমন থাকে গাঁও-এর শেষ মাথায়, অনেকটা দূরে। আমি আগে যাব নজদিগবালাদের কাছে, পরে দূরের দুশমনদের হিসাব চুকাব। আমি কাছের দুই হারামির কোঠি পৌঁছে গেলাম। হর রোজের মতো ওরা চায়ের গিলাস নিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে দু’জনেই অবাক, ভাবতে পারেনি এত সুবেহ সুবেহ তাদের বাড়ি চলে আসব। আমার আঁখ থেকে তখন আগুন ছুটছে। তাই দেখে দু’জনে ডরে গেল। চৌপায়া থেকে নেমে পালাতে যাবে, পারল না, দোপাট্টার তলা থেকে কিরপান। বের করে দু’বার চালিয়ে দিলাম। দু’টো মুণ্ডি (মাথা) কান্ধা থেকে দশ হাত তফাতে ছিটকে পড়ল। খুনে ভেসে যেতে লাগল চারদিক। একটা কাম শেষ হয়েছে, আরও দুই দুশমন বাকি। আমি তাদের কোঠির দিকে দৌড়তে লাগলাম, লেকিন পৌঁছতে পারলাম না। তার আগেই গাঁওবালিরা খুনের খবর পেয়ে হল্লা করতে করতে আমাকে এসে ধরে ফেলল। তারপর পুলিশ এল, আমাকে নিয়ে গারখানায় ঢোকাল, পরে আদালতে তোলা হল মামলা। জজসাহিব রায় দিলে আমার ‘কালাপানি’ হয়েছে। পঁচিশ সাল আন্দামান জাজিরায় (দ্বীপে) কাটাতে হবে। এই হল আমার জিন্দেগি। এবার তোমার কথা শুনি। কোথায় ঘর ছিল তোমার?’

‘বৈজু বেশ তারিফের সুরে বলেছে, ‘বাহাদুর লড়কি তুমি, দুই মুণ্ডি নামিয়ে এসেছ। আমি ইউ পি-বালা। আমার ঘর বনারসসে পচাশ ‘মিল’ তফাতে। তোমার জিন্দেগি আর আমার জিন্দেগি মোটামুটি একরকম। আমার বোনের ইজ্জৎ নিয়েছিল তিন শুয়ারকা বাচ্চা। আমি তাদের খতম করে সিধা থানায় চলে গিয়েছিলাম। আদালতে মামলা উঠলে জজসাহিব আমাকে ‘কালাপানি’ পাঠাল। পুরা পঁচিশ সালের জন্যে কয়েদ খাটতে। ব্যস—’

‘সোমবারী বলেছে, তোমাকে আমার পসন্দ হয়েছে। লেকিন ইয়াদ রাখবে আমি দুই মুণ্ডি নামিয়ে ‘কালাপানি এসেছি। যখন তখন হাতিয়ার চালাতে পারি।’

‘বৈজুর পৌরুষে বোধ হয় খোঁচা লেগেছিল। নাক সিঁটকে বলেছে, ‘আরে ছোড়, অমন হাতিয়ার বালি অনেক দেখেছি। আমিও তিন মুণ্ডি নামিয়ে এখানে এসেছি। তোর থেকে একটা বেশি।’

.

নিজেদের প্রথম দর্শনের ইতিহাস জানিয়ে বিনয় আর শেখরনাথের দিকে তাকাল বৈজু। হেসে হেসে বলল, ‘এরপর পুলিশসাহিবরা আরও চার দফে আমাদের দেখা করিয়ে দিয়েছিল। তারপর পুছল, ‘শাদি করতে তোরা রাজি?’ সোমবারীর সাথ আমার সমঝোতা হয়ে গেছে। শির হেলিয়ে বললাম, ‘পুরা রাজিবাজি অফসরসাহিব।‘ তারপর রেজিস্টারি করে সরকারি কাগজে অঙ্গুঠার ছাপ মেরে মারিজ হয়ে গেল। শাদিকা বাদ আমাদের আর কয়েদখানায় থাকতে হয়নি। এই শাদিপুরে পাঠানো হয়েছিল। আমাকে সরকারি নৌকরি দেওয়া হয়েছিল পিডাব্লুড়ি’তে। যে কয়েদিরা পুটবেলারের (পোটব্লেয়ারের) সড়ক বানাত তাদের হাজিরা, তারা কামকাজ ঠিক করছে কি না, সব দেখতে হত। নজরদারির কাম। তার জন্যে তলব (মাইনে) পেতাম। ঘর সামলাত সোমবারী।‘

শেখরনাথ হাসতে লাগলেন, ‘বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে তোদর প্রথম দেখা, তারপর বিয়ে। এমন রোমাঞ্চকর বিয়ের কথা পৃথিবীর কেউ কোনওদিন শোনেনি। বিয়ে একটা করেছিলি বটে তোরা—’

বৈজু আর সোমবারীও হেসে ফেলল। বৈজু বলল, ‘কালাপানি এক আজব দুনিয়া। এখানে আংরেজরা কত কিছুই যে করেছে! ভাইসাব আপনি তো এই জিন্দেগিতে শাদি করলেন না। করলে বন্দুকের নালিয়ার (নলের) সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকেও করতে হত।

চিরকুমার স্বাধীনতা-সংগ্রামীটি লজ্জা পেলেন। হালকা ধমকের সুরে বললেন, ‘দূর হারামজাদা, তোর মুখে কিছুই আটকায় না।‘

আরও একচোট হাসাহাসির পর বিষণ্ণ বৈজু বলল, ‘ভাইসাব, কালাপানি এসে শাদি হল, ঘর-সংসার হল, লেকিন একটা দুখ রয়ে গেছে।‘

‘কিসের দুঃখ?’

‘সব শাদিশুধা বিয়াহী (বিবাহিত) পুরানা কয়েদির ঘরই লেড়কা-লেড়কিতে ভরে গেছে। লেকিন আমাদের ঘর পুরা ফাঁকা।‘ ছেলেমেয়ে হয়নি, সেজন্য বৈজুর বড় রকমের একটা আক্ষেপ রয়েছে।

ঘরের আবহাওয়া এতক্ষণ মজায় হাসিতে ফুরফুরে হয়ে ছিল। হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর ভারী গলায় বৈজু বলল, ‘ভগোয়ানের ইচ্ছা নয়, তাই হয়নি। বদনসিব। ছোড়িয়ে ও বাত—’ সে আবার তার লঘু মেজাজে ফিরে গেল।

এদিকে সন্ধে নেমে আসছিল। শাদিপুরের চারপাশ ঘিরে দৈত্যাকার সব প্যাডক আর চুগলুম গাছ হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো ঝাপসা হয়ে যেতে শুরু করেছে।

শেখরনাথ বললেন, ‘আজ উঠি রে বৈজু। অনেকটা সময় তোদের সঙ্গে বড় আনন্দে কাটল।‘

সোমবারী বলল, ‘আজ এখানে কাল সেখানে, এক জাজিরা (দ্বীপ) থেকে আরেক জাজিরায় ঘুরে বেড়ান। আবার কবে আসবেন তার কি কিছু ঠিক আছে? আউর থোড়া কুছ টেইম (টাইম)  থাকুন না। খানা পাকাই, রাত্তিরে খেয়ে যাবেন। আমরা খুব খুশ হব।‘

‘আজ আর হবে না রে সোমবারী। আগেই তো বলেছি, পরে একদিন তোর হাতের রান্না খেয়ে যাব।‘

সোমবারী কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিনয় শেখরনাথের ঘাড়ের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় বলল, কাকা, এখনই কি আমরা বিশ্বজিৎবাবুর বাংলোয় ফিরে যাব?

শেখরনাথ অবাক হলেন।–’হ্যাঁ। কেন বল তো?’

‘বৈজুদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে, এটুকুই শুধু জানা হয়েছে কিন্তু তাদের সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানার আছে। তা ছাড়া শাদিপুরের পেনাল কলোনিতে আরও বহু পুরনো দিনের কয়েদি ফ্যামিলি রয়েছে। তাদের সঙ্গেও কথা বলে আরও অনেক মেটিরিয়াল জোগাড় করতে হবে। ওদের ছবিও তুলতে হবে। তা না হলে আমাদের কাগজের জন্যে লেখা তৈরি করা যাবে না।‘

শেখরনাথ বুঝলেন।–’ঠিক আছে, মোহনবাঁশিকে ডাক্তার চট্টরাজ ফিট সার্টিফিকেট না দেওয়া অবধি আমরা তো পোর্টব্লেয়ারে আছিই। কাল থেকে দিন তিনেক রোজ পেনাল কলোনিতে আসব। আশা করি, এর মধ্যে তোমার মালমশলা জোগাড় হয়ে যাবে–কী বল?’

বিনয় মাথা নাড়ল। বুঝিয়ে দিল তিন দিন যথেষ্ট।

শেখরনাথ আবার সোমবারীর দিকে ফিরলেন।–’শোন, আমরা কাল সকালে তোদের মহল্লায় আসব। পর পর তিনদিন। কাল দুপুরে তোদের এখানে খাব। রান্না করিস।‘

সোমবারী আর বৈজু প্রায় লাফিয়ে উঠল।–’আমাদের সৌভাগ (সৌভাগ্য)!’ তাদের চোখমুখ থেকে খুশি উপচে পড়ছে।

সোমবারী বলল, ‘কালই না, তিন রোজই আমাদের কাছে খেতে হবে।‘

শেখরনাথ বললেন, ‘না রে, কালকের দিনটাই শুধু। অন্যেরা তো ছাড়বে না। বাকি দুদিন তাদের ঘরে খেয়ে নেব।’

সোমবারী শুনবে না, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে শান্ত করলেন শেখরনাথ।

বৈজু আর সোমবারীকে যত দেখছিল, বিস্ময়ে মন ভরে যাচ্ছিল বিনয়ের। কত আন্তরিক এরা। সহজ, সরল, অতিথিপরায়ণ। পরমাত্মীয়ের মতো ব্যবহার, ভাবাই যায় না। এরাই একদিন দুতিনটে খুন করে ‘কালাপানি’র সাজা খাটতে আন্দামানে এসেছিল, ভাবা যায়!

একসময় বৈজুদের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শেখরনাথরা। শাদিপুর কলোনির অন্য বাসিন্দারা তক্কে তক্কে ছিল। তারা এসে ছেকে ধরল। সকলেরই এক আবদার।

‘চাচাজি, বৈজুর ঘরে তো এতক্ষণ কাটিয়ে এলেন। এবার আমাদের ঘরে চলুন–’

‘না, আগে আমাদের ঘরে আগে—’

‘না, আমাদের ঘরে—’

হইচই শুরু হয়ে গেল। এদিকে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল। কলোনির ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। শেখরনাথ হয়তো ক্লান্তিবোধ করছিলেন। বললেন, ‘আজ আমাদের তোরা ছেড়ে দে। কাল পরশু তরশু–তিনদিন এখানে আসছি। তখন সবার ঘরে একবার করে যাব।‘

ফের চেঁচামেচি শুরু হল।

‘পুরা রোজ শাদিপুরে থাকবেন। আমাদের ঘরে দু’পহরে খেতে হবে।‘

‘নেহি নেহি, আমার ঘরে—’

‘চাচাজি, আমি কিন্তু ছাড়ব না।‘

দেখা গেল কেউ ছাড়তে চাইছে না। সবার ইচ্ছা তাদের ঘরে শেখরনাথরা খান। তিনি দু’হাত ওপরে তুলে নাড়তে নাড়তে ওদের থামালেন।-–’দ্যাখ, তিন দিনে যদি এতগুলো বাড়িতে খেতে হয়, স্রেফ ভেদবমি করে শ্মশানঘাটে চলে যেতে হবে। বৈজুকে কথা দিয়েছি, কাল দুপুরে তাদের কাছে খাব। জনতার দিকে তাকাতে তাকাতে তাঁর আঙুল দু’জনের ওপর স্থির হল। বললেন, ‘পরশু মুস্তাক আর তরশু রাজপালের ঘরে খাব।‘

আবার হল্লা শুরু হয়ে গেল।

‘বৈজু, মুস্তাক আউর রাজপাল আপনার বহুত প্যারা, আমরা আপনার না-পসন্দ, ক্যা?’

শেখরনাথ বিব্রতভাবে বললেন, ‘তোদের সবাইকে আমি সমান ভালবাসি। পরে এসে তোদের ঘরে একদিন একদিন করে খেয়ে যাব। রাগ করিস না।‘

অগ্নিযুগের প্রাচীন এই বিপ্লবীটি যে বঙ্গোপসাগরের বিশাল দ্বীপপুঞ্জের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন, আগেই জেনেছিল। বিনয় আজ আবার নতুন করে দেখল।

শেখরনাথ বললেন, ‘কাল আবার আসছি। তোরা কিন্তু কোথাও যাস না। এসে যেন তোদের পাই।‘

.

৪.৭

বিশ্বজিৎ একজন ফোটোগ্রাফার ঠিক করে দিয়েছেন। এবারডিন মার্কেটে তার ফোটোগ্রাফির দোকান আছে। নাম নকুল বিশ্বাস। রোগা, পাকানো চেহারা। লম্বা ধাঁচের মুখে ব্রণ শুকিয়ে কালচে কালচে দাগ, গাল তুবড়ে বসে গেছে। চোখে নিকেলের গোল চশমা। কাঁচাপাকা চুলের মাঝবরাবর সিঁথি। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর গলায় বোতাম-আঁটা ফুলশার্ট, কব্জির কাছে সেটার দুই হাতাতেও বোম লাগানো। বয়স পঞ্চাশের আশপাশে।

কাল রাত্তিরে বিশ্বজিৎকে বলে দু’টো গাড়ির বন্দোবস্ত করিয়ে রেখেছিলেন শেখরনাথ। একটা গাড়ি মোহনবাঁশিকে নিয়ে হাসপাতালে চেক-আপ করাতে যাবে। বিনয় আর নকুলকে নিয়ে কালীপদর গাড়িতে শেখরনাথ যাবেন শাদিপুরে।

সকালবেলায় স্নান সেরে চা এবং খাবার খেয়ে তৈরি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। ততক্ষণে নকুল বিশ্বাস একটা ঢাউস চামড়ার ব্যাগে ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির হল।

বাংলোর সামনে অনেকটা এলাকা জুড়ে সবুজ ঘাসের জমি। সেখানে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসে ছিল কালীপদ। বিনয়রা তিনজন নিচে নেমে গাড়িতে উঠল। ফ্রন্ট সিটে কালীপদর পাশে নকুল। বিনয় আর শেখরনাথ ব্যাক সিটে।

গন্তব্য জানাই ছিল কালীপদর। সে স্টার্ট দিয়ে গাড়িটাকে ঢালু রাস্তায় নামিয়ে ডানদিকে ছুটিয়ে দিল।

খানিকটা যাওয়ার পর বিনয় জিগ্যেস করল, ‘কাকা, শাদিপুরে সব সুন্ধু কতগুলো ফ্যামিলি আছে?’

একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, ‘পঞ্চাশ-একান্নটা তো হবেই।‘

মনে মনে অঙ্ক কষে নিল বিনয়।–’রোজ মিনিমাম, সতেরো আঠারোটা ফ্যামিলির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারলে তিনদিনে পুরো শাদিপুর কভার করা যাবে। কাজটা বেশ ডিফিকাল্ট।‘

শেখরনাথ সামান্য হাসলেন শুধু।

মিনিট পঁচিশেকের মধ্যে গাড়ি শাদিপুর পৌঁছে গেল।

আগের দিনের মতোই দুই ব্যারাকের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাগুলোতে এলাকার বাসিন্দাদের জটলা। কাল শেখরনাথ তাদের বলে গিয়েছিলেন, তাই আজ আর কেউ মহল্লা ছেড়ে দূরে কোথাও যায়নি।

সবাই এসে শেখরনাথদের ঘিরে ধরল। কালকের মতোই তারা সবাই তাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেতে চায়।

শেখরনাথ বললেন, ‘যে যার ঘরে যা। আমরা সবার কাছেই যাবো। এসো নকুল, এসো বিনয়– তিনি শুরুটা করলেন ডানধারের ব্যারাকটা দিয়ে। ভিড়ের ভেতর লম্বাচওড়া তাগড়াই চেহারার একটা লোক, বয়স ষাটের কাছাকাছি, আর একজন মাঝবয়সি মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের বললেন, ‘চল, তোদের ঘরে আগে যাই—’

লোকটা এবং মেয়েমানুষটি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল। বলল, ‘আইয়ে আইয়ে চাচাজি। বিনয়দেরও খুব সমাদরের সুরে ডাকল, ‘চলিয়ে চলিয়ে—’

বিনয় লক্ষ করেছে, মেয়েমানুষটির মুখে মোঙ্গলিয় আদল। সে নিশ্চয় বর্মীই হবে।

ওরা দু’জনে শেখরনাথদের নিয়ে ডানপাশের ব্যারাকের উত্তর দিকের একটা ঘরে খুব খাতির করে বসাল।

মেয়েমানুষটি বলল, ‘চাচাজি, আপনারা বসুন। আমি চায়-পানি আর নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসি।‘

‘তোকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা সে সব চুকিয়েই এসেছি।’ শেখরনাথ মেয়েমানুষটি এবং লোকটির হাত ধরে দু’টো মোড়ায় বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আগে তোদের পরিচয় করিয়ে দিই। এর নাম বিনয়, কলকাতা থেকে এসেছে। আর নকুলকে তোরা নিশ্চয়ই দেখেছিস?’

‘হাঁ, হাঁ—’ পুরুষ এবং মেয়েমানুষটি একসঙ্গে বলে উঠল, ‘উনি ফোটো খিচেন। হাবরাডিন (এবারডিন) মার্কিটে দুকান আছে।‘

শেখরনাথ এবার বিয়ের দিকে ফিরলেন।–এরা হল বজরঙ্গী আর মা-লিন। স্বামী-স্ত্রী। তাঁর চোখ ফের বজরঙ্গীদের দিকে।’ইনি পত্রকার, কলকাতার একটা খবরের কাগজে কাজ করেন। তোদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন। যা যা জিগ্যেস করবেন তার জবাব দিবি।

বজরঙ্গী বলল, ‘হাঁ হাঁ, জরুর। আপনি যখন বলছেন, জবাব দেব না? কী জানতে চান ইনি?’

‘ওর কাছ থেকেই শোন। শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ‘শুরু কর–’

বিনয় পকেটে থেকে একটা নোটবই আর পেন বের করে মা-লিনকে দিয়ে আরম্ভটা করল, ‘আপনি কত বছর আগে ‘কালাপানি’ এসেছিলেন?

মা-লিন বলল, ‘কবে এসেছিলাম তা কি আর মনে আছে? হোগা লগভগ তিশ পয়তিশ সাল।‘

‘কালাপানি আসতে হল কেন?’

‘দা দিয়ে এক হারামখোরের মুণ্ডি নামিয়ে দিয়েছিলাম, তাই। বর্মা মুল্লুকের দা কেমন হয় জানেন। কি বাবুজি? দুদিকেই ধার। সিরিফ (স্রেফ) একবারই চালিয়ে ছিলাম। ব্যস, জানবরটার মুণ্ডি উড়ে গেল।‘

‘খুন করতে গেলেন কেন?’

‘করব না? মা-লিনের মঙ্গোলিয় চোখ দুটো থেকে এক ঝলক আগুন যেন ঠিকরে বেরিয়ে এল। সে এক নিঃশ্বাসে তার জীবনের পুরনো ইতিহাস বলে গেল। আন্দামান আসার আগে তার একটা বিয়ে হয়েছিল, তার ঘরবালা লোকটা খারাপ ছিল না। দিল আচ্ছাই থা। লেকিন ছিল নেশাখোর। চণ্ডু খেত, চরস খেত। নেশা তো সবাই করে। লেকিন একটা বড় দোষ ছিল জুয়া। জুয়া খেলতে বসলে আর হোঁশ থাকত না। এই জুয়ার আড্ডাতেই তার এক ভারী দুশমন ছিল। কোনও দিনই তার ঘরবালার সঙ্গে পেরে উঠত না। হেরে ফতুর হয়ে যেত। অনেকদিন গুত্সা পুষে রেখেছিল হারামির ছৌয়াটা (বাচ্চাটা)। এক রোজ তারা রাত্তিরে ঘুমোচ্ছে, দুশমনটা তাদের কাঠের বাড়িতে আগ (আগুন) লাগিয়ে দিল। সেই আগে ঘরবালা পুড়ে পুড়ে মরে যায়। মা-লিন কোনও রকমে বেঁচে যায়। কিন্তু স্বামীর দুশমনকে সে ছাড়েনি, দিনের বেলায় তাদের গাঁও-এর শ’খানেক মানুষের সামনে দা চালিয়ে লোকটাকে শেষ করে দেয়। জনতা তাকে ধরে পুলিশ চৌকিতে নিয়ে যায়। তারপর আদালত, ফাঁসির ফান্দাতেই ঝুলতে হত, জেনানা বলে হয়তো জজসাহিব মেহেরবানি করে কালাপানি পাঠিয়ে দেয়। জিন্দেগির বাকি পাঁচিশ সাল তাকে এই জাজিরাতেই (দ্বীপেই) কাটাতে হবে। এক সাল সাউথ পয়িন্ট জেনানা ফাটকে কাটানোর পর বজরঙ্গীর সাথ শাদি হল। নয়া ঘর-গিরস্থি হল।

একটানা বলার পর থামল মা-লিন। বিনয় জিগ্যেস করল, ‘বর্মায় কোথায় আপনাদের দেশ ছিল?’

‘পোগো টোনের (টাউনের) নাম শুনেছেন?’

‘শুনেছি।‘

‘ওহি টৌন থেকে লগভগ’ বিশ ‘মিল’ (মাইল) দূরে এক গাঁওয়ে।‘

‘গাঁওটার কথা মনে আছে?’

‘থোড়া গোড়া। পুরা ইয়াদ নেহি। কত সাল আগে চলে এসেছি! কতটুকু আর মনে থাকবে!’

‘আপনার পুরনো শ্বশুরবাড়িতে কেউ নেই?’

‘ছিল এক বুড়া শ্বশুর আর সাস (শাশুড়ি)। তারা এতদিনে কি আর বেঁচে আছে।‘

‘আপনার বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি থেকে কত দুরে?’

‘বেশি দূরে নয়। নজদিগ। পাশের গাঁওয়ে!’

‘সেখানে কে কে আছে?’

‘যখন কালাপানি হয় বাপ-মা বেঁচে ছিল। তারা এতদিনে মরে টরে গেছে। তিন ভাই আর এক বহিন আমার। তারা হয়তো বেঁচে আছে। ঠিক জানি না।‘

‘তারা আপনার খোঁজখবর নেয়নি?’

‘হত্যারা (খুনি) লড়কির কে আর খবর নেয় বাবুজি?’

‘দেশে যেতে ইচ্ছে করে না?’

‘আগে আগে দেশের জন্যে মন খারাপ হয়ে যেত। পঁয়তিশ সাল আন্দামানে কাটিয়ে দিলাম। বাকি জিন্দেগিও কাটবে। এই জাজিরাই (দ্বীপই) এখন আমার দেশ, আমার মুল্লুক। এর বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারি না।‘

একটু চুপ করে কী ভেবে নিল বিনয়। তারপর জিগ্যেস করল, ‘বর্মার লোকজনদের বেশির ভাগই শুনেছি বৌদ্ধ। আপনিও কি তাই?’

‘হাঁ–’ মাথা সামান্য হেলিয়ে দিল মা-লিন। ‘আমি ভগেয়ান বুদ্ধের পূজা করি।‘

‘আর বজরঙ্গীজি?’

‘ও হিন্দু।‘

‘আপনি বৌদ্ধ, বজরঙ্গীজি হিন্দু–দু’জনের ধর্ম আলাদা আলাদা। এতে সমস্যা হয় না?’

‘কিসের সমস্যা! ধরম তো যার যার আপনা ব্যাপার। আমার ঘরবালা কালীমন্দিরে যায়, হনুমান। মন্দিরে যায়। আমি যাই ফুঙ্গি চাউঙে (বৌদ্ধ মন্দিরে)। শাদিপুরে ফিরে এসে আমি ওর ঘরবালী, ও আমার ঘরবালা। কোই মুশকিল নেহি—’

‘আপনার ছেলেমেয়েদের তো দেখছি না?’

‘তারা ইস্কুলে গেছে। ফিরতে ফিরতে বিকেল।

হঠাৎ একটা প্রশ্ন ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিনয়ের।–’আপনি বৌদ্ধ, বজরঙ্গীজি হিন্দু। আপনার ছেলেমেয়েরা তা হলে কী?’

মা-লিন বলল, ‘ওরা এখনও ছোট। একজনের উমর পন্দ্র, আরেক জনের সাড়ে তেরো। বড় হয়ে ওরা কোন মন্দিরে যাবে সেটা ওদের পসন্দ। চাই কি মসজিদ কি গির্জাতেও যেতে পারে। আমাদের আপত্তি নেই। ওই যে বললাম, ধরম আপনা আপনা–’

নকুল বিশ্বাসকে বলা ছিল, সেই মতো শাদিপুরে আসার পর থেকে সমানে ছবি তুলে চলেছে। মা-লিন আর বজরঙ্গীর ঘরে ঢুকেও ক্যামেরা থামেনি, সমানে ক্লিক করে যাচ্ছে।

এবার বজরঙ্গীর দিকে তাকাল বিনয়।–’আপনি ইন্ডিয়ার কোন এলাকা থেকে এসেছেন?’

বজরঙ্গী বলল, ‘বিহার। জিলা গয়া, গাঁও ভোগবানি।‘ বিনয়ের নানা প্রশ্নের উত্তরে বজরঙ্গী অকপটে জানাল, সে ছিল গয়া জেলার এক দুর্ধর্ষ ডাকাতদলের সর্দার। তার নামে সমস্ত অঞ্চল ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত। কত পয়সাওলা লোকের বাড়িতে মধ্যরাতে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হানা দিয়ে সোনাদানা, হিরে-জহরত, নগদ টাকা লুটেছে, লুটে বাধা দিলে ধারালো দায়ের কোপে কতজনের মাথা নামিয়ে রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছে তার লেখাজোখা নেই।

বজরঙ্গীদের আস্তানা ছিল এক গভীর জঙ্গলে। লুটপাটের পর দলবল নিয়ে সে সেখানে ঢুকে যেত। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও তাদের হদিশ পায়নি। এই নিয়ে সরকারের উঁচু মইলে হইচই শুরু হয়ে গেল। যেমন করে হোক, জিন্দা বা মুর্দা-বজরঙ্গীকে পাকড়াও করতেই হবে। একটা হত্যারা (খুনি) ডাকু তার দল নিয়ে অবাধে লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এটা আংরেজ সরকারের পক্ষে বিরাট বদনাম। মুখে চুনকালি লাগিয়ে দেবার মতো ব্যাপার। নিরুপায় হয়ে সরকার হাজারে হাজারে ইস্তাহার ছাপিয়ে গয়া জেলায় বিলি করল। যে বা যারা বজরঙ্গীকে ধরে দিতে বা তার সন্ধান দিতে পারবে, নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনাম দেওয়া হবে।

চারপাশের গাঁওবালাদের কেউ কেউ দুর্ভেদ্য জঙ্গলে বজরঙ্গীদের ঘাঁটি গাড়ার ব্যাপারটা জানত। কিন্তু কার ঘাড়ে ক’টা মুন্ডি আছে যে পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভে খবরটা সরকারকে জানায়।

শেষ পর্যন্ত পাটনা থেকে এক জবরদস্ত আংরেজ অফিসার এবং বিশাল পুলিশবাহিনী পাঠানো হল। অফিসারের নাম লিপটন সাহেব। তিনি মাসখানেকের ভেতর বজরঙ্গীদের গোপন আস্তানার হদিশ পেয়ে গেলেন। তার হুকুমে পুলিশের দঙ্গল জঙ্গল ঘিরে গাছপালায় ‘মিটি তেল’ (পেট্রল) ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল, সেই সঙ্গে চলল বেপরোয়া গুলি।

বজরঙ্গীদের হাতেও দশ-পনেরোটা বন্দুক ছিল; সেগুলো মুঙ্গেরে তৈরি বে-আইনি গাদা বন্দুক। সরকারি বন্দুকের পাল্লা অনেক দূর পর্যন্ত, মুঙ্গেরি বন্দুক সেগুলোর কাছে কিছুই নয়।

একদিকে দাউ দাউ আগুন, অন্যদিকে একটানা গুলি! বজরঙ্গীদের পক্ষে কতক্ষণ আর লড়া সম্ভব? তার দলের বেশ কয়েকজন ডাকু গুলিতে শেষ হয়ে গেল, জখম হল তার চেয়ে বেশি। বাকি সবাই হাতিয়ার ফেলে হাত তুলে ধরা দিল। এদের মধ্যে বজরঙ্গীও ছিল।

এরপর হাজত। হাজত থেকে আদালত। এক বছর পর জজ সাহেবের রায়ে পঁচিশ বছরের ‘কালাপানি’ হয়ে গেল বজরঙ্গীর। সেলুলার জেলে ঢুকে প্রথম প্রথম মনে হত, পুরা জিন্দেগিটাই বরবাদ হয়ে গেছে।

আড়াই সাল মোটামুটি কয়েদখানার আইন-কানুন মেনে চলার পর সে ‘ম্যারিজ সাট্রিফিট’ পায়। মা-লিনের সঙ্গে শাদি হল। গয়া জেলার দুর্দান্ত ডাকু, হত্যারা (খুনি) এখন শান্তশিষ্ট, পোষমানা, দায়িত্বশীল ভারতীয় নাগরিক। বর্মী মা-লিন জাদু জানে। সে গয়া জেলার সেই খুনিকে বশে এনে একেবারে নিরীহ, গৃহপালিত জীবে পরিণত করেছে।

বজরঙ্গীর জীবনের লম্বা ইতিহাস শেষ হল। হাসিমুখে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে সে জিগ্যেস করে, ‘আর কিছু জানতে চান?’

বিনয়ও হাসল।–’না। আপনাদের অনেকক্ষণ কষ্ট দিয়ে গেলাম।‘

‘কিসের কষ্ট! আপনি যে মেহেরবানি করে চাচাজির সঙ্গে আমাদের গরিবখানায় এসেছেন, সেজন্যে বহুৎ খুশ হয়েছি।‘

‘আচ্ছা, আজ তা হলে চলি—’

‘আবার আসবেন।‘

.

বজরঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরও ছ’টা কোয়ার্টারে গেল বিনয়রা। সেখানে যারা থাকে তাদের জীবনের ইতিহাসও প্রায় একই। খুনটুন করে ‘কালাপানি’ আসা, ম্যারেজ সার্টিফিকেট পেয়ে জেনানা ফাটকের বিচিত্র স্বয়ম্বর সভায় গিয়ে শাদি; তারপর শাদিপুরে এসে ঘর-সংসার পাতা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুপুরে সূর্য যখন আকাশের ঢালু পাড় বেয়ে মাথার ওপর উঠে এল, সেই সময় বৈজুদের কোয়ার্টারে চলে এলেন শেখরনাথরা। তাঁদের জন্য বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিল বৈজু আর সোমবারী।

সোমবারী হালকা গলায় বলল, ‘ভাইসাব, মহল্লার ঘরে ঘরে ঘুরে বহুৎ বাতচিত করে আপনারা হয়রান হয়ে পড়েছেন। থোড়া জিরিয়ে নিন। গোসলখানায় পানি আছে। তারপর হাত-মুহ ধুয়ে খেতে বসবেন। আমার রসুই হয়ে গেছে।

মিনিট পনেরো পর বাইরের ঘরের মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হল।

জাঠের মেয়ে সোমবারী শুধু তলোয়ার বা হাতিয়ার ধরতে শেখেনি, হাতা-খুন্তিও নিপুণভাবে চালাতে পারে। তার রান্নার হাতটি চমৎকার। পদও বেঁধেছে বেশ কয়েকটি। সরু চালের ভাত, ঘি-মাখানো চাপাটি, ঘন অড়র ডাল, সুরমাই মাছ ভাজা, আলুভাজা, সরষে দিয়ে লাল ভেটকি, পুদিনার চাটনি, ঘরে-পাতা দই, ক্ষীরের বরফি।

শেখরনাথ বললেন, ‘এত সব কী করেছিস! কখন করলি?’

লাজুক হাসে সোমবারী।–’কোনওদিন আপনাকে চায়-পানি ছাড়া কিছুই খাওয়াতে পারিনি। আজ ভগোয়ান শিউশঙ্করজি মেহেরবানি করেছেন; তাই আপনি এসেছেন, ভাইসাবরা এসেছেন। আমার দিল খুশ হয়ে গেছে।‘

অবাক বিস্ময়ে সোমবারীর দিকে তাকিয়ে আছে বিনয়। পলকহীন। এই মেয়েটিই একদিন ধারালো হাতিয়ারের কোপে দুজনের মাথা নামিয়ে আন্দামানে এসেছিল, ভাবাই যায় না। চিরকালের ভারতীয় নারীর মতো সোমবারী এক পরমাশ্চর্য সুগৃহিণী। শান্ত, স্নিগ্ধ, অতিথিপরায়ণ। তার অতীত জীবন সম্পর্কে কাল বিনয় যা শুনে গিয়েছিল তার সঙ্গে আজ তাকে যেভাবে দেখল তা মেলানো যাচ্ছে না।

খাওয়া-দাওয়ার পর আবার বেরিয়ে পড়ল বিনয়রা। তিনদিনের মধ্যে শাদিপুরের কাজটা শেষ করতে হবে। রোজ যোলা-সতেরোটা ফ্যামিলির কাছে যেতে না পারলে তা সম্ভব নয়।

সন্ধে পর্যন্ত একের পর এক কোয়ার্টারে ঘুরে এই বিচিত্র পরিবারগুলি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করল বিনয়। নকুল বিশ্বাস প্রতিটি পরিবারের বেশ কয়েকটা করে ছবি তুলল। তারপর সবাই বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় ফিরে গেল।

.

তিনটে দিন কেটে গেল।

এর মধ্যে শাদিপুরের প্রায় পঞ্চাশটা ফ্যামিলির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিনয়। তার মনে হয় পোর্টব্লেয়ারের এই ছোট্ট মহল্লাটায় না এলে ভারতবর্ষের এক বিস্ময়কর এলাকা এবং তার বাসিন্দারা তার অজানা থেকে যেত।

শাদিপুর নানা দিক থেকে বিনয়ের ভাবনাচিন্তাকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন, সৃষ্টিছাড়া দ্বীপপুঞ্জে অখণ্ড ভারতের পেশোয়ার থেকে বর্মা মুল্লুক পর্যন্ত সুবিশাল অঞ্চলের যে সব পুরুষ এবং নারী কয়েদিরা ‘কালাপানি’র সাজা খাটতে এসেছে তারা ধরেই নিয়েছিল বাকি জীবনটা তাদের এখানেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে বরবাদ হয়ে যাবে।

পালিয়ে যে যাবে তার কোনও উপায় নেই। জঙ্গলের দিকে গেলে জারোয়াদের তীরে অবধারিত মৃত্যু। জলে নামারও উপায় নেই। সেখানে ঝাঁকে ঝাকে হাঙর ঘুরছে।

কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যখন তাদের শাদির ব্যবস্থা করে শাদিপুরে পাঠাল, জেনানা এবং পুরুষ কয়েদিরা যেন হাতের মুঠোয় বেহেস্ত পেয়ে গেল। নারীসঙ্গহীন এই দ্বীপের পুরুষ কয়েদি পেল একটি ঘরণী। আর মেয়েরা পেল একটি করে নিজস্ব পুরুষ। ঘরগৃহস্থি’ বসানোর পর এই দুর্ধর্ষ খুনি এবং দস্যুদের জান্তব হিংস্র প্রকৃতির উগ্রতা ধীরে ধীরে জুড়িয়ে আসতে লাগল। নিভৃত ঘর-সংসার তাদের আমূল বদলে দিল। এদের ছেলেমেয়ে হতে লাগল, ইংরেজরা যাদের নামকরণ করে গেছে–’লোকাল। বর্ন্য’। এখন বিবাহিত পুরুষ-কয়েদিরা দায়িত্বশীল বাবা আর মেয়ে-কয়েদিরা মমতাময়ী জননী।

অন্যদিকে জাতি-গোত্র-বংশ মিলিয়ে, যোটক বিচার করে এদের বিয়ে হয়নি। একজন পাঠানের ঘরণী হয়েছে একজন বিহারি, একজন রাজস্থানির ঘরবালা শিখ, কোনও বর্মী কারেনের জীবনসঙ্গিনী সেন্ট্রাল প্রভিন্সের রাজপুত্র ক্ষত্রিয়। হিন্দুর ঘর করতে এসেছে মুসলমান, বৌদ্ধের ঘরে এসেছে খ্রিস্টান বা শিখ। আন্দামানে জাতপাতের যাবতীয় সওয়াল ধুয়েমুছে সাফ। সবচেয়ে যা বিনয়কে বেশি নাড়া দিয়েছে তা হল এখানকার ধর্মের দিক। ধর্ম নিয়ে লেশমাত্র মাতামাতি বা অন্ধ গোঁড়ামি নেই। সেই ছেচল্লিশ সাল থেকে কমিউনাল রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা ভারতীয় উপমহাদেশে রক্তস্রোত বয়ে গেছে এবং এখনও বয়ে চলেছে। কিন্তু আট-ন’শো মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে এক ফোঁটা রক্তপাতও হয়নি। জীবন এখানে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন, দাঙ্গার উন্মাদনা এখানে এসে পৌঁছয়নি।

শাদিপুরে ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। স্বামীটি হয়তো যাচ্ছে মসজিদে, তার স্ত্রী মন্দিরে। কারও ঘরবালী নিষ্ঠাবতী খ্রিস্টান, সে যায় গির্জায়; তার স্বামী গুরদোয়ারায় বা ফুঙ্গি চাউঙে (বৌদ্ধ মন্দিরে)। এ নিয়ে কোনও বিরোধ বা সংঘাত নেই, তিক্ততা নেই। ধর্মবিশ্বাসটা যার যার নিজের অধিকারে। কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্বামী-স্ত্রী মন্দির, মসজিদ, ফুঙ্গি চাউঙ বা গুরুদোয়ারা থেকে ফিরে এসে নিজের নিজের সংসারের ঘরণী বা গৃহকর্তা। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে কোন ধর্ম পালন করবে, কোন ধর্মবিশ্বাস তাদের পছন্দ হবে সেটা তারাই ঠিক করে নেবে। বাপ-মা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে না।

বিনয় ভাবে, এই শাদিপুরের খবর কি ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডের কেউ জানে? ভারত এবং পাকিস্তানের ধর্মান্ধ মানুষজন এবং জননেতাদের গোঁড়ামিমুক্ত এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি এনে দেখালে কেমন হয়?

.

এই তিনদিন রোজ শাদিপুর থেকে ফিরে রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে কয়েদি দম্পতিদের ইতিহাস এবং জীবনযাপনের কাহিনি লিখেছে সে। নকুল বিশ্বাস সেখানকার যে সব ফোটো তুলেছে সেগুলো ডেভলাপ করে দুই-একদিনের মধ্যে দিয়ে যাবে।

মনে হয়, তার লেখাটা ভালই হয়েছে। ‘নতুন ভারত’-এর পাঠকেরা একটা নতুন অজানা জগতের কথা পড়ে খুশিই হবে।

নকুল বিশ্বাস ফোটোর কপিগুলো দিয়ে গেলে লেখাসুদ্ধ ফোটোগুলো একটা পুরু কাগজের প্যাকেটে পুরে, সেটার মুখ আটকে, বিশ্বজিৎ রাহাকে দেবে। তিনি কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।

.

৪.৮

ডাক্তার চট্টরাজ মোহনবাঁশি কর্মকারকে ‘ফিটনেস’ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ভিটামিন ছাড়া তাকে অন্য কোনও ওষুধ খেতে হবে না। সে তার বউবাচ্চাদের নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজি সেটলমেন্টে ফিরে যেতে পারে। তবে ভারী কোনও কাজ আপাতত বেশ কিছুদিন বন্ধ। যেমন জঙ্গল কাটাই, চাষবাস ইত্যাদি।

শেখরনাথ বললেন, ‘আমরা তা হলে মোহনবাঁশিদের নিয়ে কালপরশুর মধ্যে চলেই যাই। এর ভেতর সেটলমেন্টের কাজ কতটা এগিয়েছে, কে জানে। তিনি সরকারি কর্মী নন, সেদিক থেকে কোনওরকম দায়িত্বই তাঁকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষদের নতুন বসতি গড়ে তোলার অনেকখানি দায় যেন তারই। ব্রিটিশ আমলের এই পুরনো শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নিজের কাঁধে সেটা নিজেই তুলে নিয়েছেন।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এতদিন যখন আপনারা রইলেনই, আরও চারটে দিন থেকে যান কাকা—’

‘কেন রে?’ শেখরনাথ উৎসুক হলেন।

‘সেদিন বলেছিলাম না, নিরঞ্জন আর বিভাস রিফিউজি আনতে কলকাতায় গেছে। তাদের জাহাজ এর মধ্যে চলে আসবে।‘

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে।‘

বিশ্বজিৎ বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলেন। উদ্বাস্তুরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামানে সহজে আসতে চায়; তাদের খিদিরপুরে এনে জাহাজে তোলা খুবই কষ্টকর। যদিও বা তাদের চোখের সামনে আন্দামান সম্পর্কে স্বপ্নের একটা ছবি টাঙিয়ে তোলা হল, ছিন্নমূল মানুষগুলি জাহাজের খোলে আতঙ্কগ্রস্তের মতো দলা পাকিয়ে বসে থাকে। স্বপ্নের ছবিটা কতটা সত্যি তারা জানে না। বঙ্গোপসাগরের অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের জন্য কী নিদারুণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে, কে জানে। ভয়, অনিশ্চয়তা, সংশয়–সব মিলিয়ে তারা সারাক্ষণ সিঁটিয়ে থাকে। তার ওপর রয়েছে চারদিনের সমুদ্রযাত্রার ধকল। ‘রোলিং’ এবং ‘পিচিং’-এ আছাড় খেতে খেতে হাড়গোড় চুরমার হয়ে যায় উদ্বাস্তুদের। খাওয়ামাত্র হড় হড় করে তারা বমি করে ফেলে। ক্ষুধার্ত, আধমরা, সন্ত্রস্ত মানুষগুলো আন্দামানে এসে যদি এখানকার বাঙালিদের, বিশেষ করে শেখরনাথের মতো লোকজনদের দেখে অনেক ভরসা পাবে।

এসব শেখরনাথের অজানা নয়। বিশ্বজিৎ যখন একটানা বলে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দেননি। এবার বললেন, ‘ঠিক আছে, থেকে যাব।’

.

হাতে সময় আছে। পোর্টব্লেয়ার শহরটা সেভাবে দেখা হয়নি বিনয়ের। কালীপদের জিপে দু’দিন সারা শহর ঘুরে বেড়াল সে।

একদিন সন্ধেবেলায় বিশ্বজিৎ তাকে বাঙালিদের একমাত্র ক্লাব ‘অতুল স্মৃতি সমিতি’তে নিয়ে গেলেন।

অনেক উঁচু স্তরের অফিসারদের নাক-উঁচু, ভারিক্কি একটা ভাব থাকে। নিজেদের চারপাশে দুর্ভেদ্য পাথরের দেওয়াল তুলে এঁরা দূরত্ব বজায় রাখেন। কিন্তু আন্দামানের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ‘অতুল স্মৃতি সমিতি’তে ভেদাভেদটা খুব বেশি নয়, মনে হল বিনয়ের। ভারী পদমর্যাদার অফিসারদের কেরানি, সুপারভাইজার, বড়বাবু ধরনের কর্মীরা সমীহ করে ঠিকই; তবে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে না। সম্পর্কটা খোলামেলা, অনেকখানিই সহজ এবং আন্তরিক।

বিনয় যেদিন আন্দামানে আসে সেদিনই ‘রস’ আইল্যান্ডে চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার প্রণবেশ চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন। এমন কয়েকজন বড়কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আজ ডাক্তার চট্টরাজকে দেখা গেল না। তবে অ্যানথ্রোপোলজিকাল সার্ভের ডক্টর শ্যামচৌধুরি, পিডব্লুউডি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার পরমেশ দত্ত, বিরাট স’মিলের মালিক জনার্দন পাল, একটা প্রাইভেট শিপিং কোম্পানির ডিরেক্টর চন্দ্রনাথ চৌধুরি–এমন কয়েকজন এবং সরকারি বেসরকারি আট দশজন ছোট মাপের অফিসার ক্লার্কার্কদের সঙ্গে পরিচয়। করিয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ।

হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একদিনই দেখা হয়েছিল। তারপর শুনলাম আপনি রিফিউজিদের সঙ্গে জেফ্রি পয়েন্টে চলে গেছেন। ভাল করে আলাপই হয়নি। রাহাসাহেব বলেছেন, আপনি ইস্ট পাকিস্তান থেকে মাত্র কিছুদিন আগে এসেছেন। সেখানকার পরিস্থিতি এখন কিরকম?

পিডব্লুডি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার পরমেশ দত্ত বললেন, ‘রেডিওতে খবর শুনি, কিংবা দু’তিন দিন পর পর কলকাতা থেকে যে নিউজ পেপারগুলো আসে তাতে যা বেরোয়, খুবই দুশ্চিন্তার কারণ। তবে মনে হয়, এই সব মিডিয়ায় সবটা বেরোয় না। মাইনোরিটি কমিউনিটির লোকজনের পক্ষে সেখানে থাকা কি আর সম্ভব হবে?’

বিনয় লক্ষ করল, তার চারপাশে যাঁরা বসে আছেন, সবার চোখেমুখে প্রবল আগ্রহ। সেই সঙ্গে তীব্র উৎকণ্ঠাও। পূর্বপাকিস্তানের অভ্যন্তরে কী ঘটে চলেছে, কলকাতা থেকে এতদূরের দ্বীপে রেডিও আর খবরের কাগজ মারফত কতটুকুই বা জানা যায়। ইন্ডিয়ায় যাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা বিদ্বেষ না বাড়ে সেজন্য অনেক ভয়ঙ্কর খবর চেপে রাখা হয় কিংবা অনেকটা হালকা করে কাগজে ছাপা হয় কিংবা রেডিওতে প্রচার করা হয়। বিনয় তা জানে। বলল, আমি যখন সীমান্তের ওপার থেকে আসি পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভাল ছিল না। সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হত। বিহারি মুসলিমরা এপার থেকে ওপারে গিয়ে পরিবেশ আরও মারাত্মক করে তুলেছে। একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘আমি যে কতটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ডারের এপারে এসেছি, সে শুধু আমিই জানি। যে কোনও মুহূর্তে আমি খুন হয়ে যেতে পারতাম। ঝিনুকের প্রসঙ্গটা বাদ দিয়ে বিশ্বস্ত, সৎ, সাহসী দুই মুসলমান মাঝির ভরসায় কিভাবে আকণ্ঠ উদ্বেগ নিয়ে দীর্ঘ নদী পেরিয়ে স্টিমার ঘাটায় এসেছিল, সেখান থেকে গোয়ালন্দে রিফিউজি স্পেশালে চেপে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছেছিল তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে গেল।

অনেকক্ষণ নীরবতা।

তারপর বিনয়ই ফের বলতে লাগল, আমার দাদু, মানে মায়ের মামা, দিদা-পাকিস্তানে থেকে গেছেন। দাদু একজন আদর্শবাদী মানুষ। যাই ঘটুক তিনি দেশ ছেড়ে আসবেন না। কয়েকদিন আগে তার একটা চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি দিন দিন আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণ হুমকি দেওয়া হচ্ছে; দাদু বেনামা বেশ কিছু চিঠি পেয়েছেন–দেশ ছেড়ে চলে যাও। যুবতী মেয়েরা নিরাপদ নয়, রাতের অন্ধকারে তাদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘরে আগুন, খুনখারাপি–এসব তো আছেই। সব সময় প্যানিকের মধ্যে বাস করা যায় না। দলে দলে মানুষ সর্বস্ব ফেলে চলে আসছে। তবে মাইনোরিটি কমিউনিটির লোকজন এখনও অনেকেই সেদেশে রয়েছে। যদি গভর্নমেন্ট তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কতদিন থাকতে পারবে, জানি না।

পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেল।

একসময় প্রসঙ্গটা পালটে যায়। এবার বিষয় কলকাতা এবং আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন।

চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল বললেন, ‘কলকাতার অবস্থা তো শুনছি সাংঘাতিক। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তো রিফিউজিদের নিয়ে রোজ আন্দোলন করে চলেছে। বিশেষ করে কমিউনিস্টরা তাদের আন্দামানে আসতে দিতে চায় না। যতভাবে পারে রিফিউজিদের আটকে রাখতে চাইছে ওয়েস্ট বেঙ্গলেই।‘

বিনয় আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।–’হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন।‘

‘এর জন্যে পরে পস্তাতে হবে।‘

সমিলের মালিক জনার্দন পাল বললেন, ‘বাঙালির মতো আত্মঘাতী জাতি খুব কমই আছে। পলিটিক্যাল গেইনের জন্যে যারা বাধা দিচ্ছে তারা কি জানে না, কত বড় একটা সুযোগ ওয়েস্ট বেঙ্গলের হাতে এসে গেছে? এখানে রিহ্যাবিলিটেশনটা যদি সুদলি হয়ে যেত, আমরা ইন্ডিয়াতেই সেকেন্ড একটা বেঙ্গল পেয়ে যেতাম।‘

প্রাইভেট শিপিং কোম্পানির চন্দ্রনাথ চৌধুরি বললেন, ‘এই ধরনের পলিটিকস আমাদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে।‘

জনার্দন পাল বললেন, ‘আমার মনে হয়, কমিউনিস্টরা রিফিউজিদের উসকে দিয়ে নিজেদের সাপোর্ট বেসটা বাড়াতে চাইছে। এত মানুষকে পাশে পেলে তাদের স্ট্রেন্থ অনেক বাড়বে।‘

রাজনীতি নিয়ে ক্লাবঘরের আবহাওয়া ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ডক্টর শ্যামচৌধুরি আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।–’আন্দামানকে আপনারা সবাই সেকেন্ড বেঙ্গল বানাতে চান। আমিও তাই চাই কিন্তু অন্য একটা দিক ভেবে দেখেছেন কী?’

সবার চোখ তার ওপর স্থির হল। চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল জিগ্যেস করলেন, ‘কোন দিকের কথা বলছেন?’

‘সাউথ আর মিডল আন্দামানের ফরেস্ট যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে এই আর্কিপেলাগোর সবচেয়ে বড় দুটো দ্বীপে গাছপালা বলতে কিছু থাকবে না। তাতে এই দ্বীপপুঞ্জে মারাত্মক এনভায়রনমেন্টাল প্রবলেম দেখা দেবে। ক্রমাগত জঙ্গল কেটে কেটে রিফিউজিদের জন্য জমি বের করতে থাকলে দশ-বারো বছরে এখানকার পরিবেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। গভর্নমেন্টের এই বিষয়টা বিশেষ করে ভাবা উচিত, নইলে পরে আফসোস করতে হবে।‘

জনার্দন পালকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখাল। বললেন, ‘এতসব উদ্বাস্তুর রিহ্যাবিলিটেশন তা হলে হবে কী করে? জঙ্গলের চেয়ে মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি। বিশেষ করে যারা ইস্ট পাকিস্তান থেকে সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছে।‘

ব্রজদুলাল মণ্ডল মানুষটি শান্ত ধরনের। কালো রং, ভারী চেহারা। চোখে গোলাকার চশমা। পরনে ঢলঢলে ফুলপ্যান্ট আর ঢোলা শার্ট, যেটার গলা অবধি সব ক’টা বোতাম আটকানো। নিরুত্তেজ, ঠান্ডা গলায় বললেন, তা হলে বলছেন গাছপালার দাম নেই? জঙ্গল কেটে আন্দামানকে যদি মরুভূমি করে ফেলা হয়, যারা এখানে বাস করবে, তাদের হাল কী হবে, ভেবে দেখেছেন?

জনার্দন পালের স্নায়ুগুলো খুব সম্ভব চড়া তারে বাঁধা থাকে। ফের তিনি কণ্ঠস্বর চড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, পিডব্লডি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মানুষের জন্যে গাছপালা, বনজঙ্গল খুবই জরুরি। মিস্টার মণ্ডল ঠিকই বলেছেন, নির্বিচারে গাছটাছ কেটে ফেললে আল্টিমেটলি মানুষেরই ক্ষতি।‘

জনার্দন পালের মাথায় হয়তো গাছপালার গুরুত্ব কিছুটা ঢুকল। এবার শান্তভাবেই জিগ্যেস করলেন, জাঙ্গল ফেলিং না করলে রিহ্যাবিলিটেশন হবে কিভাবে?’

‘গাছপালা, জঙ্গল–এসব যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে সেটা করতে হবে। সেইমতো প্ল্যানিং করা দরকার। আমার মনে হয় সেটা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। এখনই এদিকে নজর দিতে হবে।‘

অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর ডক্টর শ্যামচৌধুরি বললেন, ‘আরও একটা সমস্যা এই রিহ্যাবিলিটেশন প্রসেস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে। নিশ্চয়ই সেটা আপনারা লক্ষ করেছেন।‘

হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন বললেন, ‘সেটা কী বলুন তো?’

শ্যামচৌধুরি বললেন, ‘ব্যাপারটা এলাবোরেটলি বলা দরকার। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও আন্দামানে তেরো রকমের ট্রাইব ছিল। ন’টা ট্রাইব এর মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে চারটে–লিটল আন্দামানের ওঙ্গে, নর্থ আর সাউথ সেন্টিনেল দ্বীপের সেন্টিনালিজ আর সাউথ আর মিডল আন্দামানের জারোয়া। আর আছে গ্রেট আন্দামানিজরা, তাদের সংখ্যা ওনলি সেভেনটি ফাইভ। ট্রাইব হিসেবে পিওর নয়, নানা রক্তের মিশ্রণ ঘটে তাদের চেহারা টেহারা পালটে গেছে। এই পঁচাত্তর জনও কতদিন টিকে থাকবে, কে জানে। সে যাক, ওঙ্গে আর সেন্টিনালিজরা অনেক দূরে থাকে। সেখানে আপাতত গভর্নমেন্টের রিহ্যাবিলিটেশনের কোনও পরিকল্পনা নেই। ওরা বেঁচে গেছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদ জারোয়াদের। সাউথ আর নর্থ আন্দামানের জঙ্গলে এতকাল নিজেদের মতো করেই থাকত। কিন্তু রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন শুরু হওয়ার পর থেকে রোজ জঙ্গল কাটা হচ্ছে, জারোয়াদের সীমানা তাতে দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রিফিউজিদের ওপর রেগুলারলি তারা চড়াও হচ্ছে। দু’একজন মারা গেছে, কয়েকজন জখম হয়েছে। এদের সংরক্ষণের দিকটা ভাবা উচিত।‘

বিনয় এতক্ষণ নীরবে শুনে যাচ্ছিল। এবার বলল, ‘কাকা কয়েকদিন আগে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে জারোয়াদের সমস্যার কথা জানিয়ে বলেছিলেন রিফিউজিদের জন্যে অনেকটা এলাকার জঙ্গল কাটার ফলে তাদের চলাফেরার জায়গা কমে যাচ্ছে। এতে এই ট্রাইবের লোকজন ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠেছে।‘

শেখরনাথকে যে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি মানুষ–পুরনো কয়েদি থেকে সরকারি আমলা, ব্যবসাদার, দোকানদার, বেসরকারি অফিসের সাধারণ কর্মী ‘কাকা’ বলে সেটা সবাই জানে।

আগ্রহে ক্লাবঘরের প্রতিটি মেম্বার বিনয়ের দিকে তাকাল। নৃতাত্ত্বিক শ্যামচৌধুরি জিগ্যেস করলেন, ‘চিফ কমিশনার কাকাকে এ ব্যাপারে কোনওরকম অ্যাসিওরেন্স দিয়েছেন?’

বিনয় বলল, ‘খুব সম্ভব না। জাঙ্গল ফেলিং বন্ধ করে দেবেন, এমন কথা বলেননি, শুধু নাকি বলেছেন, ব্যাপারটি তিনি ভেবে দেখবেন।‘

বিশ্বজিৎ রাহাও বিনয়ের কথায় সায় দিলেন।–’কাকা সেদিন যখন বিনয়বাবুকে বলছিলেন, আমিও ওঁদের সামনে ছিলাম। তিনি চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে এসে এসব জানিয়েছেন।‘

ডক্টর শ্যামচৌধুরি ডাইনে-বাঁয়ে অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন, ‘এটা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না, কোনওভাবেই এটা মেনে নেওয়া যায় না।‘

জনার্দন পাল জোরে জোরে হাত ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করে বিরক্ত মুখে বলতে লাগলেন, ‘ক’টা আধ-ন্যাংটা জংলির জন্যে আপনার দরদ একেবারে উথলে উঠছে দেখছি। রিফিউজিগুলোর কথা ভাবুন—’

ডক্টর শ্যামচৌধুরির মতো নিরীহ, শান্ত মানুষও এইবার ভীষণ রেগে গেলেন। জনার্দন পালের দিকে আঙুল তুলে গলার স্বর অনেকটা উঁচুতে তুলে বললেন, ‘কাদের জংলি বলছেন আপনি–অ্যাঁ? দে আর সন্স অফ দিস সয়েল। দে আর—’

ডক্টর শ্যামচৌধুরি এমন খেপে যাবেন হয়তো ভাবতে পারেননি জনার্দন পাল। মিনমিন করে কী যেন বলার চেষ্টা করলেন।

ডক্টর শ্যামচৌধুরির গলার শিরা উত্তেজনায় ফুলে উঠেছে। তিনি এবার চিৎকার করে উঠলেন।–’শাট আপ’–

বাকি সবাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে ডক্টর শ্যামচৌধুরিকে শান্ত করলেন।

যে মেজাজে কথাবার্তা চলছিল তার সুরটা কেটে গেছে। হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে বললেন, ‘ওহ, অনেক রাত হয়ে গেছে। ন’টা বেজে আঠারো। আজ ওঠা যাক, কাল সকালে কলকাতা থেকে রিফিউজি নিয়ে জাহাজ আসছে। তাদের রিসিভ করতে যেতে হবে। চলুন–চলুন—’

সবাই উঠে পড়লেন। সোমনাথ সেন, পরমেশ দত্তরা বিনয়কে বললেন, একদিন তাদের বাংলোয় শেখরনাথ, বিশ্বজিৎ এবং বিনয়কে লাঞ্চ বা ডিনার খেতে হবে। তখন প্রচুর গল্পটল্প করা যাবে।

বিনয় লক্ষ করল দশজন তাদের নিমন্ত্রণ জানালেন। বিশ্বজিৎ এবং শেখরনাথ আন্দামানেই থাকেন। তাদের যে কোনওদিন খাওয়ানো যায়। আসল উপলক্ষটা বিনয়ই। ভদ্রতা এবং সৌজন্যের কারণে বিশ্বজিৎদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দু-একদিনে তো এতজনের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া যায় না। এতগুলো নেমন্তন্ন রাখতে হলে দশদিন পোর্টব্লেয়ারে থাকতে হয়। সেটা অসম্ভব। বিনয় বলল, কাকা আর আমি দু-তিনদিনের মধ্যে জেফ্রি পয়েন্ট ফিরে যাব। ক্ষমা করবেন, এবার আর সম্ভব হচ্ছে না। পরে যখন আসব তখন না হয়—’

সবাই জানালেন, বেশ, তাই হবে।

.

৪.৯

কলকাতা থেকে জাহাজ-বোঝাই উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসনের জন্য যেদিন এসে ‘রস’ আইল্যান্ডে নামে সেদিন ভোরবেলায় পোর্টব্লেয়ার থেকে ছোট বড় সরকারি বাঙালি অফিসার থেকে সাধারণ লোকজনও সেখানে চলে যায়।

আন্দামানের ছোটবড় সবক’টি বন্দর এবং জেটিঘাটই শুধু নয়; জাহাজ থেকে স্টিমার, লঞ্চ, স্টিম বোট, মোটর বোট ইত্যাদি যাবতীয় জলযান হারবার মাস্টার সোমনাথ সেনের নিয়ন্ত্রণে। কলকাতা থেকে উদ্বাস্তু এলে পোর্টব্লেয়ারের অনেক বাঙালি, উদ্বাস্তুদের খাওয়ানোর জন্য চাল, ডাল, মাছ, সবজি, তেল, মশলা, মস্ত মস্ত উনুন, হাঁড়ি, কড়া, রান্নার লোক ইত্যাদি ‘রস’ আইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’টো লঞ্চ, চার-পাঁচটা মোটর বোটের ব্যবস্থা করে দেন তিনি।

আজ উদ্বাস্তু আসবে। তাই আজও লঞ্চ টঞ্চের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

ভোরবেলায়, সূর্য সবে উঠতে শুরু করেছে, মালপত্র এবং মানুষজন বোঝাই করে দুটো লঞ্চ, সেলুলার জেলের নিচের দিকের জেটি থেকে কোনাকুনি সেসোট্রেস উপসাগর পেরিয়ে ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে পৌঁছে গেল।

লঞ্চে শেখরনাথ, বিশ্বজিৎ, সোমনাথ সেন, ডক্টর শ্যামচৌধুরি, ডাক্তার চট্টরাজ, ব্রজদুলাল মণ্ডল, জনার্দন পালদের সঙ্গে বিনয়ও এসেছে। তারা একে একে দ্বীপে নেমে পড়ল। দশ পনেরোটি লোক ঝপাঝপ সব লটবহর নামিয়ে ফেলল। চালডাল ইত্যাদি জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রঙিন ছাতা আর অনেক লোহার ফোল্ডিং চেয়ারও এসেছিল। চার-পাঁচটা আর্দালি জাতীয় লোক সেগুলো নামিয়ে ছাতাগুলোর ভঁটি মাটিতে পুঁতে প্রতিটির তলায় ছ’সাতটা করে চেয়ার পেতে দিল। ছাতার তলায় মস্ত মস্ত অফিসার আর পোর্টব্লেয়ারের অন্য সব মান্যগণ্যদের বসার বন্দোবস্ত। কিছুদিন আগে বিনয় যখন উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এখানে এসে নামে, এইরকম ছাতাটাতা দেখেছিল।

অন্যদিনের মতো আজও এই ভোরবেলার গাঢ় কুয়াশায় সমুদ্র এবং দূরের দ্বীপগুলো ঢেকে আছে। ওইসব দ্বীপের গায়ে হাজার বছর ধরে যেসব মহাবৃক্ষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, এখন সেগুলো কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা। ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখলে যেমন মনে হয়, অনেকটা সেইরকম। এমনকি মাউন্ট হ্যারিয়েটের যে চূড়াটা কাঠের সাদা ক্রস নিয়ে আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে সেটাও স্পষ্ট নয়। কুয়াশার স্তর ভেদ করে এই দ্বীপপুঞ্জে রোদ এসে পৌঁছতে এখনও অনেক দেরি। যে বিশিষ্ট দামি মানুষগুলির জন্য ছাতা এবং চেয়ারের বন্দোবস্ত তারা কিন্তু কেউ বসেননি, চারিদিকে থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। অনেকে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ঘাসের জমির ওপর এলোমেলো হাঁটছেন।

সারা ‘রস’ আইল্যান্ডটার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই। তারই কয়েকটার আড়ালে তেরপলের চাদোয়া খাঁটিয়ে সেগুলোর তলায় পুরোদমে রান্নার আয়োজন চলছে। ছটা বিরাট বিরাট উনুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে শ’খানেক মানুষ এসেছেন। তাদের কেউ এত ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে আসার সময় পাননি। এঁদের জন্য একটা উনুনে। লুচি ভাজা হচ্ছে, আরেকটা উনুনে লুচির সঙ্গে খাওয়ার জন্য আলুর তরকারি। যেদিন উদ্বাস্তুরা ‘রস’ আইল্যান্ডে এসে নামে সেদিন হারবার মাস্টার, চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্টের সঙ্গে সামান্য কেরানির মধ্যে ভেদাভেদ থাকে না। সবারই খাবার এক–লুচি-তরকারি। তার সঙ্গে চা।

অন্য চারটে উনুনে বিরাট বিরাট ডেকচি আর কড়াইতে ভাত-ডাল বসানো হয়েছে। একটা দল আনাজ কাটছে, আরেকটা দল বড় বড় সুরমাই আর লাল ভেটকি কাটছে, চারজন বাটনা বেটে চলেছে।

কলকাতা থেকে এবার একশো কুড়িটা ডি পি ফ্যামিলি অর্থাৎ উদ্বাস্তু পরিবার আসার কথা। পরিবার পিছু চারজন ধরলেও বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে পাঁচশোর কাছাকাছি মানুষ। তার সঙ্গে পোর্টব্লেয়ারের শ’খানেক। প্রায় ছ’শো লোকের জন্য রান্না কি মুখের কথা! লুচি-তরকারি হয়ে গেলে এই দুটো উনুনে মাছ আর ভাতের সঙ্গে খাওয়ার জন্য পাঁচমেশালি তরকারি বসানো হবে। কতবার যে ভাত, ডাল, মাছটাছ রাঁধতে হবে তার লেখাজোখা নেই। এ এক এলাহি কাণ্ড।

শেখরনাথ বিনয়কে সঙ্গে করে রান্নার জায়গায় চলে এলেন। বললেন, ‘কী রে রাধানাথ, রিফিউজিদের জন্যে কী কী পদ রাঁধা হচ্ছে?’

একটা মাঝারি হাইটের, টাকমাথা, নিরেট চেহারার লোক, পরনে খাটো ধুতি আর হাফশার্ট, গায়ের রং ময়লা, একটা উনুনের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আইজ্ঞা কাকা, ভাত, মুসোরির ডাইল, আলু ভাজা, নানা আনাজপাতি দিয়া ব্যন্নন (ব্যঞ্জন), মাছের ঝোল আর হের (তার) লগে (সঙ্গে) দুধ তো আছেই।‘

বোঝা গেল, রাধানাথ হেড কুক এবং পূর্ববাংলার মানুষ। শেখরনাথ এবং রাধানাথ পরস্পরকে চেনেন। হয়তো পূর্বপাকিস্তান থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে এসে রান্নাবান্নার কাজ করছে রাধানাথ।

শেখরনাথ বললেন, ‘দেখিস, মাছ আর তরকারিতে যেন বেশি ঝাল টাল দিয়ে বসিস না। রিফিউজিদের ফ্যামিলিগুলোতে ছোট ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই থাকবে। ঝাল দিলে তারা খেতে পারবে না।

রাধানাথ একটু হাসল।–’হেই (সেই) খেয়াল আমার আছে। আইজ তো নয়া ‘রিফুজ’ আইতে আছে না। বছর দ্যাডেক (দেড়েক) ধইরা তাগো লেইগা (তাদের জন্য) রানতে (রাঁধতে) আছি। আপনে নিশ্চিন্ত থাইকেন কাকা।

রাধানাথ বেশ চালাক চতুর। একবার কিছু বললে সেটা তার মাথায় থেকে যায়। প্রথম যেবার রিফিউজিরা এল তখন এই ঝাল সম্পর্কে রাধানাথকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন শেখরনাথ। সেটা সে ভোলেনি।

শেখরনাথ খুশি হলেন। প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এবার আসল কথাটা বল—’

রাধানাথ উন্মুখ হল।–’কী কথা কাকা’

‘জাহাজ কিন্তু এগারোটায় পৌঁছে যাবার কথা। তার আগে তোর রান্নাবান্না হয়ে যাবে তো?’

‘এইর (এর আগে চাইর বার (চার বার) রিফুজ আইছে আন্ধারমান দ্বীপি। হেরা (তারা) তো প্যাটে দুনিয়ার খিদা লইয়া জাহাজ থিকা নামে। নাইমা কুনোবার ভাতের লেইগা (জন্য) এক দণ্ডও বইয়া (বসে) থাকতে অইচে (হয়েছে)? যদি এগারোটার জাগায় (জায়গায়) দশটায়ও আইয়া পড়ে, ফেল করুম না।‘ আত্মবিশ্বাস জোরদার করার জন্য একটা ইংরাজি শব্দও পূর্ব বাংলার ডায়ালেক্টের মধ্যে গুঁজে দিল সে।

শেখরনাথ মৃদু হাসলেন।

কত আদমলেন। কিছুক্ষণ রাধানাথদের সঙ্গে কাটিয়ে শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ‘চল, ওই দিকটায় যাই—’

যেধারে ছাতাগুলোর তলায় চেয়ার পাতা রয়েছে সেদিকে পা বাড়ালেন শেখরনাথ। তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল বিনয়।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, ‘রাধানাথ লোকটা বেশ উদ্যোগী। পূর্ব বাংলার ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের মানিকগঞ্জ সাব-ডিভিশনে ছিল আদি বাড়ি। দাঙ্গার বছর, মানে ফর্টি সিক্সে ওদের ওই অঞ্চলৈ বহু মানুষ খুন হয়। আতঙ্কে রাধানাথরা কলকাতায় পালিয়ে আসে। স্বাধীনতা আর দেশভাগের তখনও একবছর বাকি। সেই অর্থে ওরা রিফিউজি নয়। দেশে রাধানাথের একটা ছোট ভাতের হোটেল ছিল; ওর রান্নার হাত চমৎকার। কলকাতায় হোটেল খোলার মতো পয়সার জোর ছিল না। কলকাতায় পাইস হোটেলগুলোর রমরমা। এই ধরনের দু-তিনটে হোটেলে সামান্য মাইনের রাঁধুনির কাজ করেছে সে। কিন্তু লোকটা অ্যাম্বিশাস এবং দূরদর্শী। পার্টিশানের পর লাখ-লাখ মানুষ ইস্ট পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে বর্ডারের এপারে চলে এল। পুনর্বাসনের জন্যে আন্দামানে তাদের পাঠানো শুরু হলে সেইসময় পোর্টব্লেয়ার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। এখানে বেশ কিছু বাঙালি আছে; ভবিষ্যতে চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যে আরও অনেক বাঙালি আসবে। রাধানাথ ভাবল, আন্দামানে এলে তার কপাল খুলে যেতে পারে। বিরাট ঝুঁকি নিয়ে পোর্টব্লেয়ারের জাহাজে উঠে পড়ল। তারপর কিভাবে যেন বিশু (বিশ্বজিৎ রাহা) আর রিহ্যাবিলিটেশনের অন্য দু-তিনজন টপ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে-পায়ে ধরে বোঝাল, ঠিক রিফিউজি না হলেও একরকম রিফিউজিই তো। দাঙ্গায় উৎখাত হওয়া একজন মানুষ। কেঁদেকেটে রিফিউজি কোটায় একটা লোন বের করে এভারডিন মার্কেটের কাছে একটা ভাতের হোটেল খুলে ফেলল। বছর দুয়েকের মধ্যে সেই ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে তার। বাঙালিদের খুব পেট্রোনেজ পায় সে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

.

একসময় বেলা বাড়লে কুয়াশার স্তরগুলি ছিন্নভিন্ন করে রোদ উঠে এল। এখন চারিদিক ঝকঝকে, পরিষ্কার। চোখের সামনে প্রতিদিনের সেই পরিচিত দৃশ্য। সমুদ্রের পাহাড়প্রমাণ ঢেউগুলি বিপুল আক্রোশে পোর্টব্লেয়ারের দিকে ধেয়ে গিয়ে পাড়ের ওপর আছড়ে পড়ছে। কাছে বা দূরে যেদিকে যতদূর চোখ যায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে সিগাল।

সাড়ে আটটায় রাধানাথ তার টিমের চারজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শালপাতার থালায় সবাইকে লুচি-তরকারি আর চা দিয়ে গেল।

সকালের জলখাবার শেষ হতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল। তারপর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। এগারোটায় ‘এস এস মহারাজা’ জাহাজের ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছবার কথা। তার অনেক আগেই অনেক দূরে দু’পাশে দুই দ্বীপের মাঝখান দিয়ে একটা চলমান বিন্দু দেখা গেল। ছোট্ট বিন্দুটা ক্রমশ বড় হতে হতে দশ হাজার টনের বিশাল জলযান হয়ে ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে এসে ভিড়ল। কিছুদিন আগেই এই এস এস অর্থাৎ স্টিমশিপ ‘মহারাজা’তেই বিনয় এসে নেমেছিল।

জাহাজ ভিড়তেই তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেল। পোর্টব্লেয়ার থেকে যারা এসেছেন রাধানাথের টিম ছাড়া বাকি সবাই জেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিনয়ও তাঁদের সঙ্গেই আছে। ওদিকে জাহাজের উঁচু ডেকের ধারে ক্যাপ্টেন ছাড়াও অন্য সব কর্মীকে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিভাস আর নিরঞ্জনও রয়েছে।

খালাসিরা হাঁকডাক করে ওপর থেকে কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দিল জেটিতে। বিভাসরা জাহাজের খোল থেকে রিফিউজিদের তাড়া দিয়ে দিয়ে তুলে এনে সিঁড়ি দিয়ে একে একে সবাইকে নামিয়ে আনল।–’নামেন হগলে (সকলে)। নামেন, নামেন—’

বিনয়ের মনে পড়ল, আগের বারও এইভাবেই উদ্বাস্তুদের নামিয়েছিল বিভাসরা। সে লক্ষ করল, ছিন্নমূল মানুষগুলি শীর্ণ, ভয়ার্ত। বিহ্বলের মতো তারা এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে।

সোমনাথ সেন, বিশ্বজিৎ রাহা, ব্রজদুলাল মণ্ডলরা, বিশেষ করে শেখরনাথ প্রতিটি উদ্বাস্তুর পিঠে হাত রেখে সদয় গলায় বলতে লাগলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। আমরা এত জন বাঙালি তোমাদের নিতে এসেছি। আন্দামানে সবসময় তোমাদের পাশে থাকব।

আরও কয়েকজন তাঁর কথায় সায় দিলেন।

ব্রজদুলাল মণ্ডল শেখরনাথের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘উনি একজন মস্ত মানুষ। ইংরেজ আমলের বিপ্লবী। দেশের স্বাধীনতার জন্যে অনেক লড়াই করেছেন। ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার পর ওঁকে ‘কালাপানি’র সাজা দিয়ে আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল, সাতাশ আটাশ বছর আগে। তিনি আর দেশে ফিরে যাননি, এখানেই থেকে গেছেন। যেখানে তোমাদের জমিজমা দিয়ে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে সবসময় ওঁকে পাবে।

উদ্বাস্তুরা শেখরনাথের ব্যাপারটা কতটা বুঝতে পারল, বোঝা গেল না, তবে এতজন গণ্যমান্য বিশিষ্ট মানুষের আশ্বাসে তারা বেশ ভরসা পেল। অন্তত তাদের মুখচোখ দেখে তেমনই মনে হল। বিনয়ের।

পুনর্বাসন দপ্তরের অনেক কর্মী পোর্টব্লেয়ার থেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন মুখে চোঙা লাগিয়ে হেঁকে হেঁকে উদ্বাস্তুদের ডাকছিল, ‘আপনাদের জন্যে রান্না হয়ে এসেছে। কেউ সমুদ্রে নামবেন না, ঝাঁকে ঝাঁকে হাঙর ঘুরছে। এধারে জল তোলা আছে; হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যান। সকালে এসেই দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় সারি সারি বিশাল বিশাল ড্রামে জল তুলে রাখা হয়েছিল। কর্মীরা সেগুলো দেখিয়ে দিল।

খাওয়ার ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নমূল মানুষগুলোর মধ্যে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দিল।–’জবর ক্ষুদা (খিদে) পাইছে। সমুন্দুরের আলিসান ঢেউয়ে জাহাজে কয়ডা দিন আছাড়ি-পিছাড়ি খাইছি। প্যাটে ভাত রুটি গ্যালে (গেলে) বমি অইয়া (হয়ে) গ্যাছে। অহন (এখন) ক্ষুদায় প্যাট জ্বইলা যায়। তারা জলের ড্রামগুলোর দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল। তাদের পিছুপিছু লম্বা লম্বা পা ফেলে শেখরনাথও এগিয়ে গেলেন। নিশ্চয়ই উদ্বাস্তুদের খাওয়া-দাওয়া তদারক করবেন।

এদিকে নিরঞ্জন আর বিভাস জেটিঘাটের কাছে সোমনাথ সেন, বিশ্বজিৎ রাহা, ব্রজদুলাল মণ্ডলদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বিভাস নিচু গলায় তাদের বলল, ‘এইবার কইলকাতায় রিফিউজি আনতে গিয়া নিরঞ্জন আর আমার কী ফ্যাসাদ যে অইছে (হয়েছে), কইয়া বুঝাইতে পারুম না।

বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, ‘কিসের ফ্যাসাদ?’

‘কুনোহানে (কোথাও) বইয়া (বসে) কইতে পারলে ভালা হয়। মেলা (অনেক) কথা—’

মস্ত মস্ত ছাতার তলায় দশ বারোটা করে ফোল্ডিং চেয়ার আর টেবিল পাতা রয়েছে। একটা ছাতার দিকে হাত বাড়িয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘চল, ওখানে বাস যাক।‘

কিন্তু একটা মাত্র ছাতার নিচে এতজন নামিদামি বিশিষ্ট মানুষের পক্ষে বসা সম্ভব নয়। ক্ষিপ্র হাতে বিভাসরা অন্য ছাতাগুলো থেকে বেশ কয়েকটা চেয়ার নিয়ে এল। সবাই বসে পড়নে কিন্তু ওরা পঁড়িয়ে রইল। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের এই সব হর্তাকর্তাদের অনেক নিচের স্তরের কর্মী তারা। কী করে বসে?

সোমনাথ সেন হেসে হেসে বললেন, ‘আরে বোসো বোসো। এটা অফিস টফিস নয়। কাছে বসলে আমাদের সম্মানহানি হবে না।‘

বিভাস আর নিরঞ্জন সসঙ্কোচে বসল। বিনয় আগেই গিয়ে বিশ্বজিতের পাশে বসে পড়েছিল। ওদিকে উদ্বাস্তুদের নামিয়ে দিয়ে, সিঁড়ি টিড়ি তুলে ‘এস এস মহারাজা’ সেলুলার জেলের পাশ দিয়ে ঘুরে চ্যাথাম জেটিতে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। কিছুদিন আগে বিনয় যখন আন্দামানে এল, এই জাহাজটাকে এভাবেই যেতে দেখেছিল।

বিশ্বজিৎ নিরঞ্জনদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, ‘এবার বল—’

নিরঞ্জন বলল, এইবার একশো বিশডা ডি পি (ডিসপ্লেসড পার্সনস) ফেমিলি আননের কথা আছিল। কিন্তু, ‘কোটা’ পূরণ করতে পারি নাই।

চারিদিক থেকে প্রশ্নটা ধেয়ে এল।–’কেন? কেন?’

নিরঞ্জন বলল, ‘পার্টির লোকেরা ঝামেলা পাকাইছে।‘

‘সে তো যতবার আন্দামানে রিফিউজিদের আনা হয়, ততবারই এটা হয়। নতুন তো নয়—’

নিরঞ্জন যা বলল তা এইরকম। অন্যবার পার্টির লোকেরা রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে আর শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে উদ্বাস্তুদের তাতায়, কোনওমতেই তারা যেন আন্দামানে না যায়। পুনর্বাসন পশ্চিমবঙ্গেই দিতে হবে। খিদিরপুর ডকে রিফিউজি আনার পর জাহাজ টাহাজ দেখে ভয়ে মাঝে মাঝে দু-চারটে ফ্যামিলি রাতারাতি পালিয়ে গেছে। কিন্তু এবার খিদিরপুর ডকের দিকে কয়েকটা লরিতে একশো বিশটা ফ্যামিলি নিয়েই রওনা হয়েছিল নিরঞ্জনরা। একদল পুলিশ তাদের পাহারা দিয়ে আনছিল। কিন্তু রাস্তায় পার্টির লোকেরা তাদের আটকে দেয়। ‘উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নিয়ে যাওয়া চলবে না, চলবে না।’ ‘এই রাজ্যেই তাদের পুনর্বাসন–দিতে হবে, দিতে হবে।’

পুলিশ লাঠি চালিয়ে পার্টির লোকদের হটিয়ে দিলেও তিরিশটা ডি পি ফ্যামিলিকে শেষ পর্যন্ত তারা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বছরখানেক ধরে তারা আন্দামানে উদ্বাস্তু আনছে কিন্তু এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি। যাই হোক, আন্দামানের জাহাজ ছাড়বে পরদিন ভোরে। তখন নিরঞ্জন আর বিভাসের হাতে এমন সময় ছিল না যাতে ত্রাণশিবির কি শিয়ালদা স্টেশনের চত্বর থেকে তিরিশটা ফ্যামিলি জোগাড় করে এনে ‘কোটা’ পূরণ করতে পারে।

নিরঞ্জনের বয়ান শেষ হওয়ার পর ছাতার তলার পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ।

স’মিলের মালিক জনার্দন পাল বললেন, ‘তিরিশটা উদ্বাস্তু ফ্যামিলি না আসা মানে পাঁচ তিরিশে দেড়শো একর জমি বাঙালিদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। পঞ্চাশ একর অর্থাৎ সাড়ে চারশো বিঘা। এতটা জমি কি সোজা কথা! এখানে একটা ষড়যন্ত্র চলছে, এমনটা শোনা যাচ্ছে। রিক্রেম-করা জমি গভর্নমেন্ট ফেলে রাখবে না। মোপালারা তো পা বাড়িয়েই আছে। কিছুদিন ওয়েট করার পর তাদের এনে এখানে বসিয়ে দেবে।

বিভাস বলল, ‘গভর্নমেন্ট হেইডা (সেটা) পারব না। আগের বারে কী হইছিল আপনেরা বুঝিন ভুইলা গ্যাছেন!’ পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে ফেলল।–‘জাহাজে আইতে আইতে (আসতে আসতে) আমি একহান (একখানা) লিস্টি বানাইয়া ফালাইছি।‘

ডক্টর শ্যামচৌধুরি জিগ্যেস করলেন, ‘কিসের লিস্ট?’

‘যে নব্বইডা’ ফেমিলি এইবার আইছে হেগো (তাদের) মইদ্যে পনরোডা অবিয়াত (অবিবাহিত) বষ্যের পোলা (যুবক) আর পনরোডা অবিয়াত মাইয়া আছে। এয়াগো (এদের) আলদা কুনো ফেমিলি নাই। আগের বারের মতো এই ‘রস’ দ্বীপেই হেগো (তাদের) বিয়া দিয়া সেপারেট ফেমিলি বানাইয়া (তৈরি করে) কোটা’র পুরাটা না অইলেও (হলেও) আধাআধি পূরণ কইরা ফেলান (ফেলা) যাইব।’

অর্থাৎ গতবারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্যাটার অর্ধেকটা সমাধান ভেবে রেখেছে বিভাস। যতটা জমি বাঙালিদের আসে, সেটুকুই লাভ। সেবার ‘কোটা’র চেয়ে ছ’টা ফ্যামিলি কম ছিল, ‘রস’ আইল্যান্ডেই ছ’জোড়া যুবক-যুবতীর বিয়ে দিয়ে কোটা’ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। এবারও সেই একই পদ্ধতি।

পকেট থেকে বিভাস যে কাগজটা বের করেছিল, সেটার ভাঁজ খুলে বিভাস বলতে লাগল, ‘অবিয়াত (অবিবাহিত) পোলা-মাইয়াগো নামগুলান এইবার শুনাই। বংশী পরামানিক, গৌর পাল, নিতাই পাল, যদু কর্মকার, যোগেন আচার্য, গণেশ সাহারায়, গোপাল বারুই, শ্রীহরি ঘোষ, অনন্ত রুদ্রপাল এই রকম পনরো জন। মাইয়ারা (মেয়েরা) হইল তারামণি, দুর্গা, হরিমতি, পদ্ম, টগরী, ময়না, কাজল, সাগরী এই রকম আর কি। গেল বারে ছ’টা বিয়া সারতে ঘণ্টাখানেক লাগছিল, এইবার সোময় এটু বেশি লাগব। রিফিউজিগো খাওন দাওন (খাওয়া দাওয়া) হউক, আমরাও খাইয়া লই। বিকালের মইদ্যে বিয়াগুলান সাইরা ফালামু (ফেলব)। সন্ধ্যার আগে আগে যহন (যখন) পোর্টব্লেয়ারে রওনা হমু (হব), পুরাটা অইব (হবে) না, কিন্তুক অনেকখানিই অইব (হবে)।’

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন বিশ্বজিৎ।–’লিস্ট তৈরি করে কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছিলে ঠিকই। কিন্তু এই রাস্তায় সমস্যার সলিউশন এবার আর হবে না।‘

বিভাস হতভম্ব।–’ক্যান?’

‘বিয়ে দিয়ে ফ্যামিলি বাড়াবার চাতুরিটা চিফ কমিশনার ধরে ফেলেছেন। ব্যাপারটা ভীষণ রিস্কি। হয়ে যাবে। নব্বইটা ডি পি ফ্যামিলি নিয়ে এসেছ; ওই নব্বইই দেখাতে হবে।‘

‘কিন্তু বাকি তিরিশড়া ফেমিলির জমিনের কী অইব (হবে)?’

‘পরে সেসব ভাবা যাবে।‘

বিভাসকে হতাশ দেখাল।–’গেলবার ছয়ডা বিয়া দিয়া আমরা যে ‘কোটা’ পুরা করছিলাম, চিফ কমিশনার হেইটা (সেটা) জানলেন কেমনে?’

তিক্ত একটু হাসি ফুটে ওঠে বিশ্বজিতের মুখে। বললেন, ‘পোর্টব্লেয়ারের বাঙালিদের মধ্যে দু-চারটে বিভীষণ নেই? তাদের কেউ চিফ কমিশনারের কাছে গিয়ে লাগিয়েছে।‘

.

শুধু উদ্বাস্তুদেরই নয়, পোর্টব্লেয়ার থেকে যাঁরা তাদের এই দ্বীপে স্বাগত জানাতে এসেছেন তাদের সবার খাওয়া হয়ে গেছে। সূর্য আকাশের ঢাল বেয়ে পশ্চিম দিকে অনেকটা নেমে গেছে। কিন্তু রোদে এখনও ছুরির ধার। আকাশ বা সমুদ্রের দিকে তাকানো যায় না। সেসোস্ট্রেস বে’র নোনা জলের পাহাড়প্রমাণ উত্তাল ঢেউগুলো থেকে তীব্র ঝঝ উঠে আসছে। যে সাগরপাখিগুলো দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, মাছ নজরে পড়লেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদেরও এখন দেখা যাচ্ছে না। রোদের মারাত্মক তাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে তারা পাড়ের বিরাট বিরাট গাছগুলোর ঘন পাতার আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। বেলা পড়লে রোদ যখন জুড়িয়ে আসবে, ফের তারা সমুদ্রের ওপর চক্কর দিতে বেরুবে।

এদিকে যে জাহাজটায় উদ্বাস্তুরা কলকাতা থেকে এসেছিল সেই স্টিমশিপ ‘মহারাজা গম্ভীর ভো বাজিয়ে সেলুলার জেল পেরিয়ে মাউন্ট হ্যারিয়েট ডাইনে রেখে চ্যাথাম জেটির দিকে চলে গেছে। বেলা পড়লে ইন্টার-আইল্যান্ড শিপ সারভিসের স্টিমশিপ ‘চলুঙ্গা’ জাহাজটি এসে পড়বে। আজ যে উদ্বাস্তুদের আনা হয়েছে তাদের দু’ভাগ করে বড় অংশটাকে মিডল আন্দামানের নতুন রিফিউজি সেটলমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাদবাকি যাবে জেফ্রি পয়েন্টের নয়া উপনিবেশে।

খাওয়াদাওয়ার পর উদ্বাস্তুরা ‘রস’ আইল্যান্ডের চারপাশে যে বিরাট বিরাট সব পাথরের চাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেগুলোর ছায়ায় শুয়ে পড়েছে। উদ্বাস্তুরা টানা চারদিন উথালপাতাল সমুদ্রে জাহাজের অবিরল ঝকানি খেতে খেতে আসার কারণে এখন তাদের সারা শরীর জুড়ে অনন্ত ক্লান্তি। শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখ জুড়ে এসেছে।

বিনয়রাও খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে বড় বড় ছাতাগুলোর তলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল। সেই কোন ভোরে উঠে তারা ‘রস’-এ চলে এসেছিল। পেটে ভাত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ঘুম পাচ্ছিল।

হঠাৎ একনাগাড়ে ভটভট আওয়াজ শুনে সবাই চকিত হয়ে উঠল। বিনয়দের যে ঢুলুনি এসেছিল, লহমায় কেটে গেল। চোখে পড়ল পোর্টব্লেয়ারের দিক থেকে একটা বড় স্টিম লঞ্চ সেসোস্ট্রেস বের ঢেউ কেটে কেটে ‘রস’ আইল্যান্ডের দিকে আসছে।

লঞ্চটা আন্দামানের সবারই চেনা। ওটা আন্দামান অ্যান্ড নিকোবরের চিফ কমিশনারের নিজস্ব জলযান। যদিও সোমনাথ সেন হারবার মাস্টার, এই অঞ্চলের সব বন্দর, জেটি, জাহাজ, স্টিমবোট তাঁর নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু চিফ কমিশনার হলেন আন্দামান-নিকোবর দুই দ্বীপপুঞ্জের সর্বেসর্বা। তার লঞ্চটার ওপর সোমনাথ সেনের এতটুকু কর্তৃত্ব নেই। চিফ কমিশনার ইচ্ছা করলে তার জলযানে যখন যেখানে খুশি যেতে পারেন। পদমর্যাদায় তিনি এখানে সবার চেয়ে উঁচুতে।

ব্রজদুলাল মণ্ডল বলেন, ‘আন্দামানে রিফিউজিদের আনা হলে কোনও দিন চিফ কমিশনার ‘রস’ আইল্যান্ডে আসেন না। রিফিউজিদের মনোবল বাড়ানোর জন্য বাঙালিরাই শুধু আসে। সন্ধেবেলা রিফিউজিদের এবারডিন মার্কেটের সামনের মাঠে নিয়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার নিশ্চয়ই চিফ কমিশনারের সন্দেহ হয়েছে ‘কোটা’য় যদি ঘাটতি থাকে, বিয়েটিয়ে দিয়ে সেপারেট ফ্যামিওি বানিয়ে তা পূরণ করা হতে পারে। তাই নিজেই দেখতে চলে এসেছেন।‘

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, ‘অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক।‘

সবাই মাথা নাড়লেন। এ বিষয়ে তারা একমত।

বিভাস আর নিরঞ্জন কাছাকাছিই রয়েছে। বিশ্বজিৎ তাদের বললেন, ‘বিয়ে দেওয়ার ছকটা তো করে এসেছিলে। সত্যি সত্যিই তার অ্যারেঞ্জমেন্ট যদি করা হত, কী অবস্থায় সবাই পড়তাম, ভেবে দেখ—’

বিভাস এবং নিরঞ্জন মাথা নিচু করে রইল। কোনও উত্তর দিল না।

স্টিম লঞ্চটা ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে এসে ভিড়তেই সব অফিসার এবং অন্য মান্যগণ্য লোজন ব্যস্ত পায়ে সেখানে গিয়ে ভিড় জমালেন। আন্দামান-নিকোবরের সর্বময় কর্তাকে অভ্যর্থনা জানানোটা রীতি।

খালাসিরা রেলিং-লাগানো কাঠের পাটাতন পেতে লঞ্চের সঙ্গে জেটিটা জুড়ে দিয়েছিল। চিফ কমিশনার নেমে আসতেই সবাই হাতজোড় করে বললেন, ‘আসুন স্যার, আসুন—’

চিফ কমিশনার মানুষটি সবসময় হাসিমুখ। কখনও উঁচু গলায় কথা বলেন না। তাঁরা এই ভদ্র, শান্ত মুখটির আড়ালে যে একটি চতুর মুখ লুকনো রয়েছে সেটা বাঙালি অফিসাররা এতদিনে জেনে গেছেন। তিনিও হাতজোড় করে বললেন, ‘দেড় বছর ধরে মেনল্যান্ড থেকে রিফিউজিরা আন্দামানে আসছে কিন্তু কখনও আমি ‘রস’-এ আসিনি। আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, চলে এলাম।‘ জেটি থেকে ঢালু, এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ বেয়ে দ্বীপে উঠতে হয়। কারওকে গিয়ে তার হাত ধরতে হল না। তিনি নিজেই উঠে এলেন।

তাঁকে এনে একটা ছাতার তলায় বসানো হল। চিফ কমিশনার বললেন, ‘আজ আর এবারডিন মার্কেটের সামনে নয়, এখানেই রিফিউজিদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তারা কোথায়?’

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘খাওয়া দাওয়া করে ওখানে জিরোচ্ছে। তিনি বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইগুলো দেখিয়ে দিলেন।‘

চিফ কমিশনার লক্ষ করলেন, চাঁইগুলোর ছায়ায় সারি সারি অগুনতি মানুষ।

বিশ্বজিৎ বিভাস আর নিরঞ্জনকে বললেন, ‘যাও, রিফিউজিদের ডেকে নিয়ে এসো।‘

শেখরনাথ এবং অন্য অফিসাররা দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিফ কমিশনার শেখরনাথকে বেশ সসম্ভ্রমে বললেন, ‘বসুন আঙ্কল, বসুন–’ অন্য অফিসারদেরও বসতে বললেন।

বিভাস আর নিরঞ্জন কয়েকজন পুনর্বাসন দফতরের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে হাঁকডাক করে রিফিউজিদের ঘুম ভাঙিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এল। তাদের বলল, ‘আন্দামানের সব থিকা বড় কত্তা চিফ কমিশনার সাহেব আইছেন (এসেছেন); তোমাগো লগে (তোমাদের সঙ্গে) আলাপ করবেন। ক্যাচামেচি (চেঁচামেচি) কইরো না। হাতজোড় কইরা তেনার সামনে খাড়াইবা (দাঁড়াবে)।‘

বিভাসরা যেমন বলে দিয়েছিল সেইভাবে এসে চিফ কমিশনারের সামনে রিফিউজিরা কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আন্দামানের হর্তাকর্তাবিধাতাটি কেন তাদের মতো সর্বস্ব খুইয়ে আসা তুচ্ছ মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করতে চান, ভেবে ভেবে তারা তলকূল পাচ্ছিল না। সকলে ত্রস্ত, হতচকিত, জড়সড়।

চিফ কমিশনার বাংলা বলতে পারেন না, একটু আধটু বুঝতে পারেন। বিনয় লক্ষ করেছে, এর আগেও উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলতে তার দোভাষীর দরকার হয়েছে। এই কাজটা বিশ্বজিত্ব করে থাকেন। আজও দায়িত্বটা তাকেই নিতে হল।

চিফ কমিশনার বয়স্ক উদ্বাস্তুদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জিগ্যেস করছেন, তাদের বাড়ি কোথায় ছিল, ইস্ট পাকিস্তানের কোন কোন ডিস্ট্রিক্টে, কবে দেশ ছেড়ে তারা ইন্ডিয়ায় এসেছে, তাদের পরিবারে কতজন করে মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বিশ্বজিতের মারফত। তিনি উদ্বাস্তুদের কাছে উত্তর জেনে নিয়ে চিফ কমিশনারকে জানিয়ে দিচ্ছেন।

একসময় একটি বছর চল্লিশের উদ্বাস্তুর ওপর চিফ কমিশনারের নজর গিয়ে পড়ল। জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার কী নাম?’

লোকটার শুকনো, পাকানো চেহারা। ভাঙাচোরা মুখ, গাল বসে গেছে, চুলদাড়ি খাড়া খাড়া।। কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, হাতের শিরাগুলো প্রকট। পরনে আধময়লা খাটো ধুতি আর ফতুয়া, পায়ে টায়ার কাটা স্যান্ডেল। চাউনিতে, হাবভাবে কেমন একটা খ্যাপাটে ব্যাপার রয়েছে।

লোকটা বলল, ‘আইজ্ঞা, সনাতন দাস। ‘দেশ কোথায় ছিল?’

‘আইজ্ঞা, ঢাকায়।‘

‘ফ্যামিলিতে কতজন মেম্বার?’

‘পিরথিমীতে আমার আর কেও (কেউ) নাই। আমি এক্কেরে (একেবারে) একলা। আমারে লইয়াই আমার ফেমিলি।‘ সনাতনের কথাগুলো হাহাকারের মতো শোনাল।

আন্দামানে স্বজন-পরিজন নিয়ে পুনর্বাসনের জন্য শত শত ফ্যামিলি এসেছে। কিন্তু এই মানুষটা ব্যতিক্রম। সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। এই দ্বীপপুঞ্জে এমন উদ্বাস্তু আগে আর একজনও আসেনি।

শুধু চিফ কমিশনারই নন, অন্য সবাই অবাক দৃষ্টিতে সনাতনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিফ কমিশনার সনাতনকে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। ঘণ্টাদেড়েক ‘রস’ আইল্যান্ডে উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাটিয়ে, তাদের প্রচুর ভরসা দিয়ে, বিভাস নিরঞ্জন এবং অন্য সব বাঙালি অফিসারদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ‘কোটা’ পূরণের আধাআধি ছকটা ভেস্তে দিয়ে নিজের স্টিম বোটে পোর্টব্লেয়ারে ফিরে গেলেন।

এদিকে ইন্টার-আইল্যন্ড স্টিমশিপের ‘চলুঙ্গা’ জাহাজ জেটিতে এসে ভিড়েছে। যেসব লঞ্চে করে বিনয়রা সকালে ‘রস’ আইল্যান্ডে এসেছিল সেগুলো একধারে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।

আগে থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, নতুন যে উদ্বাস্তুরা আন্দামানে আসবে তাদের শতকরা ষাট ভাগকে পাঠানো হবে মিডল আন্দামানের নতুন কলোনিগুলোতে। বাকি চল্লিশ ভাগ যাবে জেফ্রি পয়েন্টে। সেই মতো প্রচুর হাঁকডাক করে চুয়ান্নটা ডি পি ফ্যামিলিকে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে তোলা হল। কিছুক্ষণ পর জাহাজটা চলতে শুরু করল।

বিনয়ের মনে পড়ল সেদিন এই ‘চলুঙ্গা’ জাহাজেই তার চোখের সামনে দিয়ে মিডল আন্দামানে চলে গিয়েছিল ঝিনুক। যখন তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া গেল, সে তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সন্ধে নেমে যাবে খানিক পরেই। তেজি, উগ্র রোদের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। সমস্ত চরাচর ঝাপসা হতে শুরু করেছে।

যে লঞ্চ ক’টা দাঁড় করানো রয়েছে তাতে একবারে শ’দুয়েক লোককে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উদ্বাস্তুদের নিয়ে বার দুই সেসোস্ট্রেস বে পারাপার করতে হল জলযানগুলোকে। তাদের সঙ্গে গেছে নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। বাকি সবাইকে নিয়ে লঞ্চ ক’টা যখন ওপারে গেল কুয়াশা আর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারিদিক।

রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের যে তিনটে বড় বিল্ডিং আছে এবারডিন মার্কেটের পিছন দিকটায়, সেখানে আজকের নতুন উদ্বাস্তুদের পাঠিয়ে দেওয়া হল। ওখান থেকে তাদের জেফ্রি পয়েন্টে পাঠানো হবে।

শেষবার লঞ্চগুলো এসে বাকি সবাইকে তুলে নিয়ে পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *