১. অদ্ভুত পার্টি চলছিল

প্লেয়িং উইথ দ্য কার্ডস (পোয়ারো)

মিঃ শেটানের অদ্ভুত পার্টি চলছিল : ডিনার টেবিলে আলোচনা চলছে এখন?

বিষ-ই হল মহিলাদের প্রধান হাতিয়ার। মন্তব্য করে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন মিঃ শেটান, আপনারা কি বলেন? অবশ্য বলবারই বা কি আছে। কত মহিলা তো খুন করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

শেটানের কথায় সায় দিয়ে মিসে অলিভার বলেন, যা বলেছেন।

পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শেটানের দিকে তাকালেন। ডিনার টেবিলে প্রথম দিককার একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন শেটান। ঘরের নীলাভ আলোয় তার দু-চোখের ধূর্ত চাহনী যেন আরও ক্র হয়ে উঠেছে। শেটান কি উদ্দেশ্যে একের পর এক এ ধরনের মন্তব্য করে চলেছেন? পোয়ারো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পোয়ারো সহ আজ শেটানের নিমন্ত্রিতের সংখ্যা আটজন। পুলিশ সুপার ব্যাটেল, গোয়েন্দা গল্পের লেখিকা মিসেস অলিভার, সিক্রেট সার্ভিসের কর্নেল রেস এই তিনজনকে-ই পোয়ারো ভালভাবে চেনেন। কিন্তু বাকি চারজন? ডাঃ রবার্টস, মিসেস লরিমার, মিস মেরিডিথ এবং মেজর ডেসপার্ড এদের পরিচয় পোয়ারোর অজ্ঞাত।

পোয়ারোর মনে পড়ল, শেটান তাঁকে জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী দেখতে আজকের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিসের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন তিনি? ডিনারের শেষে হঠাৎ খুনের বিভিন্ন পদ্ধতির কথা আলোচনার অর্থ-ই বা কি?

চারপাশে তাকিয়ে নিলেন শেটান। তার মুখে সূক্ষ্ম শয়তানী হাসি, তবে আমি বলব–কাউকে খুন করতে ডাক্তারদের জুড়ি নেই। সুযোগ সুবিধাও বেশি

শেটানের কথা শেষ হবার আগেই ডাঃ রবার্টস প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ আপনার ভুল ধারণা মিঃ শেটান। কখনো সখনো মানুষের মৃত্যুর কারণ আমরা ডাক্তাররা হই বটে তবে সে নিছক দুর্ঘটনা। মানুষ খুন? না না কক্ষনো না।

শেটানের পরবর্তী মতামতের অপেক্ষায় আগ্রহে বসে রইলেন পোয়ারো।

একটু পরেই–

আমি যদি ভাবি কাউকে খুন করব– থমথমে গলায় শেটান বললেন, তবে খুব সোজা পথেই এগোব। এই ধরুন শিকার করতে গিয়ে কাউকে মেরে বসা লোকে জানবে নিছক দুর্ঘটনা। অথবা কোন রুগীকে ভুল করে ওষুধের বদলে বিষাক্ত কিছু খাইয়ে দেওয়া- একটু চুপ করে আবার সকলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিলেন শেটান, তবে কথা হল এত অভিজ্ঞ লোক বর্তমান থাকতে আমি এসবে মতামত দেবার কে?

সমস্ত ঘর নিস্তব্ধ। পোয়ারো লক্ষ্য করলেন শেটানের মুখে সেই মৃদু শয়তানী হাসি।

.

ডিনারের পর ড্রয়িংরুমে জমায়েত হলেন সকলে। সেখানে ব্রীজ খেলার টেবিল পাতা। মিঃ শেটানের অনুরোধে চারজন তাস টেনে পার্টনার নির্বাচন করে ব্রীজ খেলতে বসলেন। এদের মধ্যে তাস খেলার সব থেকে দক্ষ মিসেস লরিমার–তার উৎসাহও বেশি। একদিকে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। টেবিলের অন্য দিকে মিসেস লরিমার এবং সুন্দরী মিস মেরিডিথ।

অন্য চারজনকে নিয়ে শেটান এলেন পাশের ঘরে। এ ঘরেও ব্রীজ খেলার বন্দোবস্ত হয়েছে। মিঃ শেটানের একান্ত অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলতে বসলেন সকলে। শোন নিজে খেলবেন না।

একটু বাদেই পাশের ঘরে পা বাড়ালেন তিনি। খেলা পুরোমাত্রায় জমে উঠেছে। ওয়ান হার্ট, পাস, থ্রি ক্লাবস, স্পেডস, ফোর ডায়মন্ডস, ডবল। ফোর হার্টস বিভিন্ন ডাকগুলো ভেসে এল শেটানের কানে। টেবিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, চারজনকে দেখছিলেন শেটান। ডাক্তার, মিসেস লরিমার, সুন্দরী মেরিডিথ, মেজর গভীর মনোযোগে খেলে চলেছেন। টেবিলের ঠিক ওপরে একটা শেড দেওয়া আলো জ্বলছে। ঘরের সবটা আলোকিত হয়নি। ছায়া ছায়া আলো আঁধারীর কারুকাজ। ফায়ার প্লেসের কাছাকাছি একটা ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন শেটান। মুখে মৃদু হাসি। আজ অফুরন্ত হাসির খোরাক পেয়েছেন তিনি।

মাত্র বারোটা দশ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস অলিভার। এ ঘরের ব্রীজ খেলা শেষ। তাস খেলতে আর কেউ-ই উৎসাহী নন। সবথেকে বেশি হেরেছেন মিসেস অলিভার।

চলুন মিঃ শেটানকে বলে আমরা বিদায় নিই। মিসেস অলিভার বললেন। পাশের ঘরে পা বাড়ালেন সবাই।

শেটানকে দেখা গেল ফায়ার প্লেসের পাশে চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন। এ ঘরের চারজন কিন্তু দারুণ উৎসাহে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন তখনও। মিসেস অলিভার আর সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল খেলার টেবিলের দিকে পা বাড়ালেন। ফায়ার প্লেসের দিকে এগোলেন কর্নেল রেস।

আমরা এবার বিদায় নেব মিঃ শেটান। কোন জবাব এল না। কর্নেল রেস অবাক হলেন–শেটান যেন কেমন অদ্ভুত ভঙ্গীমায় ঘুমিয়ে আছেন–মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে সামনে। পোয়ারোর দিকে তাকালেন কর্নেল রেস। একটু এগিয়ে শেটানের কাছাকাছি হতে-ই একটা অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেল কর্নেলের মুখে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পোয়ারো চমকে উঠলেন শেটানের কোটের ফাঁকে একটা শক্ত জিনিস চকচক করছে।

শেটানের একটা হাত তুলে নিলেন পোয়ারো। আপন মনে মাথা নাড়লেন। ধীরে ধীরে শেটানের হাতটা নামিয়ে দিলেন তিনি।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল একবার এদিকে আসুন।

কি ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো? ব্যাটেল ফায়ার প্লেসের কাছাকাছি এগিয়ে এলেন।

শেটানকে ইশারায় দেখালেন কর্নেল রেস। চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়লেন ব্যাটেল। একটু পরেই ব্যাটেল গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দয়া করে সকলে এদিকে মনোযোগ দিন।

ব্রীজ টেবিলের সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালেন।

খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, গৃহস্বামী মিঃ শেটান মারা গেছেন।

ঘরের মধ্যে প্রবল গুঞ্জন। হুড়মুড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মিসেস লরিমার এবং ডাঃ রবার্টস। মেজর ডেসপার্ডের চোখে জিজ্ঞাসা। ফ্যাকাশে মুখে অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠলেন অ্যানা মেরিডিথ।

আপনি নিশ্চিত, মিঃ শেটান মারা গেছেন? প্রশ্ন করে এগোতে যাচ্ছিলেন রবার্টস, বাধা দিলেন ব্যাটেল, দাঁড়ান। আমার প্রশ্নের জবাব দিন–খেলার সময় এ ঘর ছেড়ে বাইরে কে কে গেছিলেন। আর ভেতরে কে এসেছিলেন?

মানে? রবার্টস ঘাবড়ে গেলেন, বাইরে যাওয়া, ভেতরে আসা–এরকম কিছুই হয়নি।

মিসেস বলছেন রবার্টস। মিসেস লরিমার সায় দিলেন। এমনকি খেলার আগেই খানসামা পানীয়ের ট্রে রেখে চলে গেছেন। আর আসেনি।

মেজর এবং মিস মেরিডথ ও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

বেশ। তবে ডিভিশানাল সার্জন না আসা অবধি শেটানের দেহ কেউ ছোঁবেন না। ডাক্তার রবার্টসের দিকে তাকিয়ে ব্যাটেল বললেন, ডাঃ রবার্টস আপনিও না। কারণ শেটান খুন হয়েছেন।

আতঙ্কে যেন শিউরে উঠলেন ঘরের সবাই। ব্যাটেল এ ঘরে উপস্থিত চারজন ব্রীজ খেলোয়াড়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিলেন। তাঁকে খুন করা হয়েছে–বুকে ছুরি বসিয়ে! একটু থেমে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, খেলার সময় টেবিল ছেড়ে আপনাদের ভেতর কে কে উঠেছিলেন? কয়েকমুহূর্ত সবাই চুপ করে রইলেন। একটু পরে খানিক ইতস্তত করে মেজর ডেসপার্ড বলেন, দেখুন আমার মনে হয় ঘরের প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় টেবিল ছেড়ে উঠেছেন। আমি নিজেই দু-বার উঠেছি। শেষবার আগুনটা উস্কে দেবার জন্য যখন ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি গেলাম মনে হল শেটান যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন।

হতে পারে– ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, হয়তো ততক্ষণে মিঃ শেটান মারা গেছেন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। তবে এখন আপাতত আপনারা পাশের ঘরে যান। কর্নেল রেস সহ বাকি চারজন পাশের ঘরে চলে গেলেন। ব্যাটেল স্থানীয় পুলিশকে ফোন করলেন।

একটু পরেই ফোন নামিয়ে রাখলেন ব্যাটেল, ডিভিশনাল সার্জন, স্থানীয় পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। পোয়ারোর দিকে তাকলেন ব্যাটেল, খুনী কি সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে ভাবুন মঁসিয়ে পোয়ারো। শোন তো চেঁচিয়ে উঠতে পারতেন? আরো আশ্চর্য ঘরের এতগুলো লোক টের পেল না একটা খুন হচ্ছে?

খুব মরীয়া না হলে এতটা ঝুঁকি নিয়ে খুন করা সম্ভব হত না। পোয়ারো বিড়বিড় করলেন, আজকের পার্টির উদ্দেশ্য ………ঠিক তক্ষুনি বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। সম্ভবতঃ লোক্যাল পুলিশ এসেছে। এক মিনিট মঁসিয়ে পোয়ারো–ব্যাটেল দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

ডাইনিং টেবিলের চারদিকে চারজন বসে রয়েছেন। পোয়ারো মিসেস অলিভার, কর্নেল রেস এবং সুপারিনটেন্টে ব্যাটেল। এর মধ্যে এক ঘণ্টা কেটে গেছে। বিভিন্ন ছবি নেওয়া হয়েছে মৃতদেহের, ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞও এসে তার কাজ করে চলে গেছেন। ব্যাটেল তাকালেন পোয়ারোর দিকে, ওঘরের চারজনকে ডেকে জেরা করব। তার আগে আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে। আজকের ডিনার পার্টির সম্বন্ধে কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। পার্টির আসল উদ্দেশ্যটা– শান্তকণ্ঠে বললেন পোয়ারো আমাকে মিঃ শেটান যা বলেছিলেন, পার্টিটা নাকি জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী!

তার মানে! ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেন নি তো!

না। যতদূর মনে পড়ছে মিঃ শোন বলেছিলেন তার শখ খুন এবং খুন! তার মতে খুন হল একটা আর্ট–যে কাজে সফল হতে পারলে খুনীকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। ভদ্রলোকের সখ ছিল সফল খুনীরা অর্থাৎ যারা খুন করেও সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে পার পেয়ে গেছে এরকম খুনীদের সঙ্গে পরিচয় করা–

তাহলে তাদের নিয়েই এই জীবন্ত অপরাধ প্রদর্শনী? এদের দেখাতেই পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি? ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন।

সম্ভবত তাই। ভদ্রলোক চিরকাল সকলকে ভয় পাইয়ে মজা পেতেন। ফলটা কি হল–তিনি নিজে মারা পড়লেন।

তাহলে দাঁড়াচ্ছে নিমন্ত্রিত আটজন। তার মধ্যে চারজন দর্শক, বাকি চারজন হত্যাকারী। অন্ততঃ মিঃ শেটান এই ভাবতেন। প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল।

না, না, এরা সকলেই ভদ্রলোক। এর মধ্যে কেউই খুন করতে পারেন না। মিসেস অলিভার প্রতিবাদ করে ওঠেন।

তাই যদি হয়, তবে আমার সন্দেহ হয় ডাঃ রবার্টসকে! ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হবার সময়ই, মনে হয়েছিল কি একটা গলদ আছে। আমার অনুভূতি কখনো মিথ্যা হয় না। মিসেস অলিভারের কথায় বিশেষ মনোযোগ দিলেন না ব্যাটেল। পুরনো কথার খেই ধরেই আলোচনা চলতে লাগল।

হয়তো শোন আজকের পার্টিতে কয়েকজন খুনীকে নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন। মানে আমরা চারজন ছাড়া বাকি চারজনকে শেটান অন্ততঃ খুনী বলেই জানতেন। হয়তো সবক্ষেত্রে তাঁর অনুমান ঠিক নয়। কিন্তু শেটানের মৃত্যুই প্রমাণ করেছে অন্ততঃ একটা ক্ষেত্রে তার আন্দাজ সঠিক কি বলেন মিঃ পোয়ারো।

সেরকমই মনে হচ্ছে। খুনীর ভয় ছিল শেটানের হাতেই হয়তো তার অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ জমা আছে। সে ভেবেছিল তাকে নিয়ে খানিক মজা করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে শেটান। আসলে যে কি ঘটেছিল আমরা তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না। মাথা দোলালেন পোয়ারো।

এবার তাহলে শুরু করি– সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল উঠে পড়লেন।

তাহলে আমরা বাইরে অপেক্ষা করি। কর্নেল রেস উঠে দাঁড়াতেই একটু ইতস্তত করে ব্যাটেল বাধা দিলেন, না, দরকার নেই। আপনারা সকলেই এ ঘরে থাকতে পারেন। কিন্তু কাজের মাঝখানে কেউ বাধা দেবেন না। আর এতক্ষণ যে বিষয়ে আলোচনা করলাম সে সম্বন্ধেও কোন কথা বলবেন না কেউ–ঠিক আছে?

মিসেস অলিভার মাথা নাড়লেন। পাশের ঘর থেকে ডাঃ রবার্টসকে ডেকে পাঠালেন ব্যাটেল।

একটু পরেই ডাঃ রবার্টস ঘরে এসে ঢুকলেন।

সত্যি কি সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি তো ভাবতেই পারছি না–মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে তিন জন তাস খেলছে। এর মধ্যে খুন করে আসা–বাপরে, আমার অতো সাহস নেই বলুন সুপারিনটেন্ডেন্ট কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করব। ডাক্তার রবার্টস ক্ষীণ হাসলেন।

মোটিভ। মোটিভই হল আসল কথা–

তবে তো কোন কথাই নেই। মিঃ শেটানকে আমি ভাল করে চিনি না পর্যন্ত। একটু আধটু পরিচয় আছে। আমি তাকে খুন করতে যাব কেন? অবশ্য আপনারা তদন্ত করবেন নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, আইনমাফিক কাজ তো করতেই হবে। আচ্ছা,.ডাঃ রবার্টস! ও ঘরের বাকি তিনজন সম্বন্ধে আপনার মতামত কি?

দুঃখিত। কিছুই বলতে পারব না। আজই তো আলাপ হল এদের সঙ্গে। একমাত্র মিসেস লরিমারকে আগে থাকতে চিনতাম। অবশ্য মেজর ডেসপার্ডের লেখা ভ্রমণ কাহিনী আগে পড়েছি।

আপনি জানতেন ডেসপার্ড-এর সঙ্গে শেটানের আলাপ আছে?

 না। আজই প্রথম মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে পরিচয় হল আমার।

মিসেস লরিমারকে তো চিনতেন আপনি। তাঁর সম্পর্কে কি কিছু জানেন?

তেমন কিছু না। যতটুকু জানি, তিনি একজন বিধবা ভদ্রমহিলা। টাকাকড়ি ভালই আছে। বুদ্ধিমতী এবং ব্রীজ খেলায় এক্সপার্ট। তার সঙ্গে ব্রীজ খেলা উপলক্ষেই এক বন্ধুর বাড়িতে আমার আলাপ।

মিঃ শেটানের কাছে কখনো মিসেস লরিমারের নাম শোনেন নি।

না।

আচ্ছা। খুব ভাল করে ভেবে বলুন ডাক্তার রবার্টস, কবার আপনি খেলার টেবিল ছেড়ে উঠেছিলেন? বাকি তিনজন কবার উঠেছিল?

ডাক্তার রবার্টস কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন।

আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। অন্যদের কথা সঠিক বলতে পারব না। আমারটা বলতে পারি –যতদূর মনে পড়ছে মোট তিনবার উঠেছিলাম। সেই তিনবারই ডামি ছিলাম আমি। প্রথমবার উঠে ফায়ার প্লেসের আগুন উস্কে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার একজন মহিলার জন্য জল আনতে। আর শেষবার আমার নিজের জন্য পানীয় আনতে উঠেছিলাম।

সময়ের একটা আন্দাজ দিন

মোটামুটি সময়টা বলতে পারি। প্রায় সাড়ে-নটার সময় আমরা খেলতে বসি। ঘণ্টাখানেক বাদে আমি ফায়ার প্লেসের কাছে যাই। মিনিট দুই-তিন বাদে জল আনতে উঠি, শেষবার উঠি তখন রাত সাড়ে এগারোটা হবে। ঘড়ি তো দেখিনি, ভুলও হতে পারে।

পানীয়র ট্রে তো মিঃ শেটানের চেয়ারের পাশের টেবিলে ছিল।

হ্যাঁ। মোট তিনবারই আমি তার চেয়ারের পাশ দিয়ে গেছি।

 প্রত্যেকবারই কি তাকে আপনার ঘুমন্ত মনে হয়েছিল?

প্রথমবার সেইরকমই মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার তাসের কথা ভাবছিলাম ততটা খেয়াল করিনি। শেষবার তার পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাবলাম ভদ্রলোক এত ঘুমুতেও পারেন। কোনবারই খুব একটা লক্ষ্য করিনি।

অন্যান্যরা কবার উঠেছিলেন? একটু চিন্তা করুন

বেশ কঠিন প্রশ্ন- খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন ডাক্তার রবার্টস।মেজর ডেসপার্ডকে দুবার উঠতে দেখেছিলাম, মনে পড়ছে। একবার বোধহয় অ্যাসট্রে আনতে আর দ্বিতীয়বার পানীয় জল আনতে গিয়েছিলেন।

আর মহিলারা? ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন।

মিসেস লরিমার একবার ফায়ারপ্লেসের কাছে বোধহয় আগুনটা উস্কাতে গিয়েছিলেন, কি যেন কথাও বললেন শেটানের সঙ্গে। আর মিস মেরিডিথ যখন আমার পার্টনার ছিলেন তখন একবার উঠেছিলেন তাস দেখতে। প্রথমটায় আমার তাস উঁকি মেরে দেখলেন। তারপর অন্যদের তাস দেখবার পর বোধহয় পায়চারী করছিলেন ঘরের মধ্যে। আসলে তখন তাস নিয়ে এত ব্যস্ত ওদিকে মাথা ঘামাতে পারিনি।

ব্যাটেল একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাস খেলার সময় আপনাদের কেউ কি ফায়ারপ্লেসের দিকে মুখ করে বসেছিলেন?

না, সবার চেয়ারই একটু কোনাকুনিভাবে ঘোরানো ছিল। তাছাড়া মাঝখানে একটা মেহগনী কাঠের আলমারী থাকায় আড়াল পড়ে যায়। খুন একটা কঠিন হয় নি। কারণ খেলাটা যখন ব্রীজ তখন সকলের মনোযোগ ওইদিকেই থাকতে বাধ্য, একমাত্র ডামিই খুনটা করতে পারে–

ডামিই খুন করেছে কোন সন্দেহ নেই। যেই খুন করুক, মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে। অন্যদের দিকে একঝলক তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, ডাঃ রবার্টস, এই তিনজনের মধ্যে আপনার কাকে খুনী বলে সন্দেহ হয়?

আমার মতামত চাইছেন? একটু থতমত খেয়ে যান ডাঃ রবার্টস, দেখুন আমার তো মনে হয় খুনী মেজর ডেসপার্ড। আজীবন বিপজ্জনক পরিবেশে কাটানোয় ভদ্রলোকের নার্ভ বেশ স্ট্রং, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতেও পারেন। এরকম ঝুঁকি নেওয়া তার পক্ষেই সম্ভব। মেয়েদের এরকম খুন করার দৈহিক বা মানসিক শক্তি কোনটাই নেই।

নাঃ, এ ব্যাপারে বিশেষ গায়ের জোর লাগেনি, দেখুন না এটা একটা পাতলা লম্বা ছোরা বের করে ধরলেন ব্যাটেল। যেটার হাতলে চুনিপান্না বসানো। ফলাটা আলোয় ঝকঝক করে উঠল।

আলগাভাবে ছোরার ডগায় একবার হাত ঠেকালেন ডাঃ রবার্টস, কি সাংঘাতিক! একটু ঠেকালেই একেবারে মাখনের মত ঢুকে যাবে বুকে। খুনী এটা তাহলে সঙ্গে করেই। নিয়ে এসেছিল, কি বলেন?

না। এটা মিঃ শেটানের, দরজার পাশেই টেবিলের ওপর অনেক পুরানো জিনিসপত্রের সঙ্গে ছিল।

খুনীই তাহলে খুঁজে বার করেছে এটা—

এমন তো হতে পারে খুনী এটা দেখার পরই মতলব এঁটেছে?

 অসম্ভব নয়, হতে পারে।

যাকগে, আপনাকে আর আটকাব না। যাবার আগে ঠিকানাটা বলে যান। দু-চার দিনের মধ্যে হয়তো যেতে হবে

নিশ্চয়ই যাবেন, তবে দেখবেন এ নিয়ে যেন কাগজে বেশি লেখালেখি না হয়। বুঝতেই পারছেন, রুগীরা নার্ভাস হয়ে পড়বে

ব্যাটেল ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কোন প্রশ্ন করবেন?

হ্যাঁ, পোয়ারো মাথা দুলালেন, আমি খেলাটা সম্বন্ধেই কিছু জিজ্ঞাসা করব। আপনারা কটা রাবার খেলেছিলেন ডাঃ রবার্টস?

তিনটে। চতুর্থটা শেষ হবার আগেই আপনারা এসেছিলেন।

খেলাটার বিবরণ দিতে পারেন?

হ্যাঁ, প্রথম রবারে আমি আর মেজর ডেসপার্ড জুটি ছিলাম। মেয়েদের কাছে হারলাম আমরা। দ্বিতীয়বার মিস মেরিডিথ আর আমি খেলেছিলাম, মিসেস লরিমার আর মেজর ডেসপার্ডের বিপক্ষে। তৃতীয়বার আমার পার্টনার ছিলেন মিসেস লরিমার, চতুর্থবার মিস মেরিডিথ। প্রত্যেকবারেই তাস টেনে পার্টনার বেছে নেওয়া হয়েছে।

হার-জিৎ?

 প্রত্যেকবারই মিসেস লরিমার জিতেছেন। মিস মেরিডিথ জিতেছেন কেবল প্রথমবার। সবমিলিয়ে আমার কিছু জিত হয়েছে। মিস মেরিডিথ আর ডেসপার্ডই বেশি হেরেছেন।

ডাঃ রবার্টস, আপনাকে একটা অন্য প্রশ্ন করছি। পোয়ারো মৃদু হাসলেন, আপনি ছাড়া বাকি তিনজন কেমন ব্রীজ খেলেন?

মিসেস লরিমার ব্রীজ খেলায় এক্সপার্ট। ব্রীজ খেলে ভালই পয়সা রোজগার করেন মনে হয়। ডেসপার্ড খুব একটা ঝুঁকি নেন না, তবে খেলেন ভালই। মিস মেরিডিথ খুবই সাদামাটা খেলেন, তবে ভুল করেন কম।

আর আপনি?

হাসলেন ডাঃ রবার্টস। অনেকেই ভাবে আমি হাতের তাসের তুলনায় বেশি বেশি ডাক দিই, হয়তো তাই। কিন্তু তাতে আমার খুব একটা ক্ষতি হয় না বরং লাভই হয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রবার্টস, আর কিছু জিজ্ঞাসার নেই তো?

মাথা নাড়লেন পোয়ারো। শুভরাত্রি জানিয়ে ডাঃ রবার্টস বিদায় নিলেন।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। এর মধ্যে বাকি সকলের জেরা শেষ। মিসেস লারিমার, মিস মেরিডিথ ও মেজর ডেসপার্ড বিদায় নিয়েছেন। সকলকেই মোটামুটি একই ধরনের প্রশ্ন করছিলনে ব্যাটেল। উত্তরে যা জানা গেল?

মিসেস লরিমার : ব্রীজ খেলতে ভালবাসেন। মিঃ শেটানের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয় মিশরের এক হোটেলে। শেটানের সম্পর্কে তার ধারণা খুব উঁচু ধরনের নয়, ভালভাবে তাকে চেনেনও না। শেটানের মৃত্যুতে তার কোন লাভ বা ক্ষতি নেই, যদিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে তিনি খুব একটা উৎসাহী নন। মেজর ডেসপার্ড ও মিস মেরিডিথের সঙ্গে আজকের পার্টিতেই তার প্রথম আলাপ। ডাঃ রবার্টসকে তিনি একজন নামকরা ডাক্তার হিসাবে চেনেন, কিন্তু রবার্টসের পেশেন্ট নন। ব্রীজ খেলা চলাকালীন তিনি একবার উঠে ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়েছিলেন, শেটানের সঙ্গে তাঁর কিছু কথাও হয়েছিল। ব্রীজ টেবিলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের গতিবিধি সম্পর্কে তিনি নতুন কিছু বলতে পারলেন না। যে ছোরা দিয়ে খুন করা হয়েছে সেটা তিনি আগে কখনও দেখেন নি। কাউকে খুনী হিসাবে মতামত দিতে নারাজ। এসময় তিনি একটু রেগে গিয়েছিলেন। অবশ্য ব্রীজ খেলোয়াড় হিসাবে অন্যান্যরা কেমন এ প্রশ্নে তিনি কোন আপত্তি করেন নি। তাঁর মতে, ডেসপার্ড বেশ হিসেব করে খেলেন, ডাক্তার রবার্টস একটু বেশি বেশি ডাক দেন। মিস মেরিডিথ খুব সাবধানী।

মিস মেরিডিথ : সুন্দরী, অল্পবয়সী তরুণী মিস মেরিডিথ থাকেন ওয়ালিংফোর্ডে। এমনিতেই অতিরিক্ত নার্ভাস, মিঃ শেটানের মৃত্যুতে খুব ভয় পেয়েছেন। শেটানের সঙ্গে তার আলাপ সুইজারল্যান্ডে। মাঝে মধ্যে শেটানের পার্টিতে এসেছেন। ভদ্রলোককে দেখে তাঁর সবসময়ই ভয় করত যদিও সেরকম কোন কারণ নেই। আজকের পার্টির কাউকেই তিনি চিনতেন না, আজই আলাপ হয়েছে সবার সাথে। ব্রীজ টেবিল ছেড়ে তিনি কবার উঠেছিলেন, কি করেছিলেন কিছুই সঠিকভাবে বলতে পারলেন না। মিসেস লরিমারকে তার খুনের ব্যাপারে সন্দেহ হয়। ছোরাটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা বকতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত এটুকুই বলতে পারলেন যে শেটানের মৃত্যুতে তার কোন স্বার্থ নেই। অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে পড়বার জন্য তাকে বিশেষ প্রশ্ন না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

মেজর ডেসপার্ড : বনে জঙ্গলে বহুদিন কাটিয়েছেন। পার্টির জাঁকজমক, সামাজিকতা ভালবাসেন না বরঞ্চ বনে জঙ্গলের উন্মুক্ত পরিবেশ তাকে বেশি মুগ্ধ করে। শেটানের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ এক বন্ধুর পার্টিতে। মেজর ডেসপার্ড খুব অপছন্দ করতেন শেটানকে। ভদ্রলোকের আচার, আচরণ, পোষাক সবই তার অসহ্য বলে মনে হত। খুন করা হয়েছে যে ছোরা দিয়ে সেটা আগে কখনো দেখেন নি। ব্রীজ টেবিল ছেড়ে তিনি দুবার উঠেছিলেন, প্রথমবার একটা অ্যাশট্রের জন্য, দ্বিতীয়বার পানীয় আনতে। ডাক্তার রবার্টসকে তিনি খুনী বলে সন্দেহ করেন। ব্রীজ খেলোয়াড় হিসাবে অন্যান্য সকলের সম্পর্কে তার মত–মিস মেরিডিথ ভাল খেলেন, ডাক্তার রবার্টস অতিরিক্ত ডাক দেন, মিসেস লরিমার সব থেকে দক্ষ। মেজর ডেসপার্ড প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরই সাবলীলভাবে দিয়েছেন।

প্রত্যেকেই তাদের ঠিকানা দিয়ে বিদায় নেন।

আচ্ছা মিঃ পোয়ারো, আপনি তখন থেকে ওই স্কোরশীটগুলোতে কি দেখছেন? ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তখন দেখলাম মিসেস লরিমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন স্কোরটা কার লেখা?

দেখছিলাম এদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যগুলো। প্রথমটা দেখুন, স্কোর লেখেন মিস মেরিডিথ। প্রথম রাবারে মিসেস লরিমারের পার্টনার ছিলেন মেরিডিথ। ভালো তাস তুলেছিলেন মিসেস লরিমার, তাই জিত তাদেরই হয়েছে। কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে খেলা। ক্ষুদে ক্ষুদে অথচ স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, যোগবিয়োগগুলো খুব সতর্কভাবে করা হয়েছে।

দ্বিতীয়টা কার?

মেজর ডেসপার্ডের লেখা,–খেলা অবশ্য ঠিক কিরকম হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে না তবুও এ থেকে মেজর ডেসপার্ডের চরিত্রের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে ভদ্রলোক একনজরে নিজের চারপাশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে চান, ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরগুলোও একটা বৈশিষ্ট্য আছে।

আর তৃতীয়টা বোধহয় মিসেস লরিমারের!

হ্যাঁ, তিনি তখন ডাক্তার রবার্টসের পার্টনার। খেলাটা বেশ জমেছিল। বোঝা যাচ্ছে, দুদিকের লম্বা যোগবিয়োগের সারি। মিসেস লরিমারের হাতের লেখারও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সুন্দর দৃঢ়।

এই অসমাপ্ত স্কোরশীটটা?

এটা ডাক্তার রবার্টসের লেখা। পার্টনার ছিলেন মিসেস মেরিডিথ একটু ভীতু স্বভাবের, কম কম ডাক দেন। খেলাটাও খুব একটা জমেনি। রবার্টসের হাতের লেখা সুন্দর না হলেও পড়া যায়। সমস্ত স্কোরটায় কেমন একঘেয়ে একটা ভাব রয়েছে।

কিছু বুঝতে পারলেন এর থেকে?

একটা ধোঁয়াটে ছায়া, বিশেষ কিছু না।

সম্ভাবনার দিক থেকে দেখতে গেলে, আমার যা মনে হয়, প্রথম সন্দেহ হবে ডাঃ রবার্টসের ওপর। ভদ্রলোক ডাক্তার, বুকের ঠিক কোথায় ছোরা বসালে সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত মৃত্যু, খুব ভালভাবেই তা জানেন। অবশ্য এছাড়া আর কোন কারণ দেখা যাচ্ছে না। তারপর, আসছেন মেজর ডেসপার্ড। বিপজ্জনক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ। নার্ভ খুব শক্ত, চটপট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একেও সন্দেহ হয়। অবশ্য মেয়েদের সন্দেহ না করার কোন কারণ নেই।

মিসেস লরিমারকেই ধরুন না, বেশ শক্ত নার্ভের মহিলা, তার হাবভাব। দেখলে বোঝা যায় কোন মানসিক অশান্তি আছে, গোপন রহস্যও থাকতে পারে। আবার অন্যদিক থেকে ভাবতে গেলে তিনি খুন করতেই পারেন না। একজন আদর্শবাদী হেডমিস্ট্রেসের মতই মনে হয় তাকে। সুতরাং কারো বুকে ছোরা বসাচ্ছেন ভাবাও যায় না। বাকি থাকল মিস মেরিডিথ, সুন্দরী তরুনী, একটু লাজুক লাজুক ভাব, ভীতু। তার সম্বন্ধে কিছুই আমরা জানি না–

কিন্তু মি. শেটানের বিশ্বাস ছিল মেয়েটি কাউকে খুন করেছে। পোয়ারো শান্ত কণ্ঠস্বরে বললেন।

আমার বিশ্বাস ঐ মেয়েটাই খুনী। ভাগ্যিস এটা কোন গল্প নয়। পাঠকেরা আবার সুন্দরী মেয়েদের খুনী বানালে অসন্তুষ্ট হয়। এক্ষেত্রে আমার স্থির বিশ্বাস হয় ঐ ডাক্তার নয় ঐ মিস মেরিডিথ। কোন সন্দেহ নেই। মিসেস অলিভার মতামত দেন।

এদের চারজনের একজন তো খুনী নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা কে? ব্যাটেল চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো বললাম তার তো কোন মূল্যই দিচ্ছেন না আপনারা। মি. পোয়ারো আপনি কি বলেন? মিসেস অলিভার তাকালেন পোয়ারোর দিকে।

আমি? আমি এইমাত্র একটা নতুন সূত্র আবিষ্কার করলাম।

 নিশ্চয়ই আপনার ঐ স্কোরশিটটা থেকে, কি যে অত দেখছেন–

ঠিকই ধরেছেন, মিস মেরিডিথের স্কোরশিট থেকে। স্কোরশিটের পেছনে হারজিতের হিসেব করেছেন মিস মেরিডিথ।

এর থেকে কি প্রমাণ হয়?

 প্রমাণ কিছুই নয়, একটা বৈশিষ্ট্য বোঝা যাচ্ছে, মিস মেরিডিথ গরিব ঘরের মেয়ে অথবা বেশ হিসেবী।

সাজপোষাকের ঘটা দেখলে তো মনে হয় না সেকথা। মিসেস অলিভার বললেন।

আমরা কিন্তু মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি। কর্নেল রেস একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। এর চাইতে সন্দেহজনকদের অতীত সম্বন্ধে খোঁজখবর করলে লাভ হত।

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, নিশ্চয়ই, সে বিষয়ে তো খোঁজখবর করা হবে–আমরাই করব, তবে আপনারও সাহায্য চাই–ডেসপার্ডের ব্যাপারে খবর দরকার।

আমার মাথায় একটা দারুণ মতলব এসেছে। মিসেস অলিভার খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলেন এখানে আমরা চারজন উপস্থিত আছি। সবাই গোয়েন্দা বিভাগের কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত। আর ওঁরাও সংখ্যায় চারজন। আমরা প্রত্যেকেই যদি এক একজনের ওপর নজর রাখি কেমন হয়? ধরুন কর্নেল রেস, খবরাখবর নিলেন মেজর ডেসপার্ডের। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল নেবেন ডাক্তার রবার্টসের। মিসেস লরিমারের খোঁজখবর নিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি না হয় মেরিডিথকে দেখবো। আমরা আমাদের নিজেদের পদ্ধতিতেই কাজ চালাব।

ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, না, তা হয় না। এসব হল সরকারি ব্যাপার, আইনের প্রশ্ন থেকে যায়। আমার ওপর এখন দায়িত্ব দেওয়া আছে তদন্ত চালাতে হবে আমাকেই। তাছাড়া কর্নেল রেস হয়ত ডেসপার্ডকে খুনী মনে করেন না। পোয়ারো হয়ত মনে করেন মিসেস লরিমার নির্দোষ। এ নিয়ে একটা মিথ্যে গোলমালের সৃষ্টি করার দরকার কি?

হয় না, তাই না, কিন্তু প্ল্যানটা অলিভার হতাশ হয়ে পড়লেন, আচ্ছা আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে কোন অনুসন্ধান চালাই আপনার আপত্তি আছে?

না। আপনি পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন, আপনার কৌতূহল মেটাতে যেভাবে খুশি অনুসন্ধান চালাতে পারেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার আপত্তির কি আছে? তবে এইসব খুনের মামলায় মাথা না ঘামানোই ভাল।

আপনাকে এমন একজনের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে, যে এরমধ্যেই দুটো খুন করেছে। প্রয়োজন হলে তৃতীয় খুন করতেও তার হাত কাঁপবে না। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

আমাকে সাবধান করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এ রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না। আমরা যে সমস্ত খবর জোগাড় করব সবই সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলকে জানিয়ে দেব। অবশ্য সমস্ত ঘটনা থেকে আমার সিদ্ধান্ত কাউকে জানাব না।

কর্নেল রেস উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক আছে। ফের ডেসপার্ড-এর খবর দু চারদিনের মধ্যে এনে দেব।

আমি ঠিক কি ধরনের খবর চাইছি বুঝতে পারছেন তো?

বুঝতে পেরেছি। কোন শিকার দুর্ঘটনা বা ওই জাতীয় কিছুর সঙ্গে ভদ্রলোক জড়িত ছিলেন কিনা, এই তো?

মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কর্নেল রেস সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

মিসেস অলিভার জিজ্ঞাসা করলেন, ভদ্রলোক কে বলুন তো?

সেনা বিভাগের একজন বড় অফিসার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘুরে এসেছেন।

তাহলে ঠিকই ভেবেছিলাম। ভদ্রলোক সিক্রেট সার্ভিসের অফিসার। মিসেস অলিভার মৃদু হাসলেন তাই তো, তা না হলে মিঃ শেটানই বা কেন ওকে ডিনারে ডাকবেন। চারজন খুনি, চারজন গোয়েন্দা। একজন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের, একজন সিক্রেট সার্ভিসের, একজন বেসরকারী আর বাকি রইলাম আমি–কাল্পনিক রহস্য উপন্যাসের–বাঃ! প্ল্যানটা ভালই করেছিলেন শেটান।

ব্যাটেল হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনার কি মনে হয় মিঃ পোয়ারো, কোন পথে এগোলে রহস্যের হদিশ মিলবে?

মনস্তত্বই হচ্ছে আসল। আজ রাতের ডিনার পার্টির অতিথিদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছু কিছু জানি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, লক্ষ্য করেছি এদের প্রত্যেকের ব্রীজ খেলার ধরন, হাতের লেখা, স্কোর রাখার ধরন–এ সমস্ত থেকেই এদের মনস্তত্ব কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তবে এই খুনের একটা ব্যাপার আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, খুনির মনের জোর অসাধারণ। অহঙ্কার খুব বেশি।

আপনি তো এদের চারজনের ব্রীজ খেলার ধরন নিয়ে খুব ভাবনা চিন্তা করছিলেন।

হ্যাঁ, কিন্তু সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। সুতরাং ওদিকে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা আছে–অতীত। অতীতের গোপন আবরণ খসে গেলেই পাব সত্যের সন্ধান। মিঃ শেটানের বিশ্বাস ছিল এরা প্রত্যেকেই খুনি। তিনি কি কোন প্রমাণ পেয়েছিলেন, না সবটাই তার কল্পনা? আজ এসব কিছুই জানা যাবে না।

চারজনই খুনি আর তার প্রমাণ শেটানের হাত মজুত ছিল, এ আমার বিশ্বাস হয় না। ব্যাটেল মাথা নাড়লেন।

হতে পারে। হয়ত কাউকে তিনি খুনি বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু প্রমাণ ছিল না। তখন গল্প করতে করতে অতিথিদের কাছে বিশেষ ধরণের সেই খুনের পদ্ধতির কথা বললেন। কেউ হয়ত গম্ভীর হয়ে উঠল, কারোর চোখের পলক পড়ল না বা কেউ কথা ঘোরাতে চেষ্টা করল–সবই তিনি লক্ষ্য করলেন। এ ভাবে উদ্দেশ্য বিহীনভাবে ছুঁড়ে দেওয়া কথাতে আসল অপরাধী মনে মনে অস্থির হয়ে পড়বে। একটা বা দুটো ক্ষেত্রে শেটানকে এরকম চালাকি করতে হয়েছিল। অন্য ক্ষেত্রে হয়ত তার হাতে প্রমাণ ছিল। তবে পুলিসে ধরিয়ে দেবার মত অত জোরালো প্রমাণ হয়তো ছিল না।

খুবই গোলমেলে ব্যাপার। একটাই মাত্র পথ–এদের চারজনের অতীত জীবনের খোঁজখবর চালান। অতীত হাতড়ে বার করা-এদের কেউ কোন অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত কিনা। ডিনার টেবিলে মিঃ শেটান বলেছিলেন মনে আছে মিঃ পোয়ারো।

হ্যাঁ। বলেছিলেন ডাক্তারদের পক্ষে খুন করার সুযোগ সুবিধা বেশি, আবার শিকার করতে গিয়ে ভুল করেও কেউ খুন করতে পারে–দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই কেউ ভাবত না। কিন্তু এসব বলে নিজের বিপদকেই ডেকে এনেছিলেন শেটান।

তবে কেবলমাত্র এসব কথার ওপর ভিত্তি করে চারজনের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা–

একজন হয়তো নির্দোষ হতে পারে। শেটানের ভুলও হতে পারে।

একজন নির্দোষ? চিন্তিত হয়ে পড়লেন ব্যাটেল। ব্যাপার দেখছি আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে। ধরুন, জানালাম কেউ ছোটবেলায় ঠাকুমাকে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে খুন করেছে–তাতে কি লাভ হবে আমাদের?

কিছু যে লাভ নেই একথা আপনি বলতে পারবেন না। এক্ষেত্রে খুনি হয়ত তার পুরোন পদ্ধতিকেই কাজে লাগিয়েছে। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

তা অবশ্য ঠিক। হয়ত একইভাবে দ্বিতীয় খুনটা করেনি, কিন্তু কোথাও একটা যোগাযোগ দুটো খুনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

ধরুন মি. শেটানকে কেউই খুন করেনি। তিনি প্ল্যান করে ঐ চারজনকে ডেকে এনে মজা দেখবার জন্য আত্মহত্যা করলেন। হতেও তো পারে।

মিসেস অলিভার বলে উঠলেন–আপনার কল্পনা শক্তি আছে। কিন্তু মি. শেটান আত্মহত্যা করার লোক ছিলেন না। মৃদু হাসলেন পেয়ারো, মিঃ শোন মোটেই ভাল লোক ছিলেন না, এটা মানতেই হবে। মিসেস অলিভার মাথা নাড়লেন।

ঠিক কথা। কিন্তু এ রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না। এর জন্যে বাঘের খাঁচার মধ্যে যেতেও আমি রাজি। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমি যাবোই।

ব্যাপারটা নিয়ে কাগজে যে বেশি লেখালেখি হয়নি, এটাই বাঁচোয়া, ডাঃ রবার্টস বললেন।

হ্যাঁ, মিঃ শেটান হঠাৎ মারা গেছেন। এটুকুই লেখা হয়েছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একটু আগেই ব্যাটেল এসেছেন ডাঃ রবার্টসের চেম্বারে। ডাঃ রবার্টসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার।

ভদ্রলোকের সলিসিটরের সঙ্গে তাঁর উইল নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। দানপত্রে এক ভদ্রলোকের নাম আছে–সিরিয়ায় থাকেন। মনে হয় শেটানের আত্মীয়। এছাড়া শেটানের ব্যক্তিগত কাগজপত্রও ঘাঁটাঘাঁটি করেছি।

চকিতে ডাক্তার রবার্টসের মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়ল। ব্যাটেলের নজর এড়ায়নি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ব্যাটেল। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

ডাক্তার রবার্টস সহজ হয়ে উঠলেন আমার কাগজপত্রও নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবেন? সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন?

না।

তবুও বাধা দেব না। আপনি সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমাকে এক্ষুনি কলে বেরোতে হবে। আলমারি, ড্রয়ারের সব চাবি রেখে যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আমার সেক্রেটারিও আপনাকে সাহায্য করবে।

যাবার আগে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব আপনাকে। আপনার জন্ম, বিবাহ এইসব।

রবার্টস সোজা হয়ে বসলেন। ছোটবেলায় মোভিউ হোটেলে থেকে পড়াশোনা করতাম। বাবা ছিলেন একটা ছোট মফস্বল শহরের ডাক্তার। আমার যখন পনের বছর বয়স, প্রথমে বাবা মারা যান, তার দু বছর বাদে মা গেলেন। বাবার দেখাদেখি মেডিক্যাল লাইনই বেছে নিলাম।

অন্যান্য ভাইবোন?

কেউ নেই। আমিই একমাত্র সন্তান। এখনও অবিবাহিত। পাশ করার পর এখানে ডাক্তার এমারির সঙ্গে পার্টনারশিপে চেম্বারে রুগী দেখতাম। বছর পনের আগে এমারি অবসর নিয়ে আয়ার্ল্যান্ডে চলে যান। ডায়রীতে তার ঠিকানা পাবেন। চাকরবাকরেরা আমার কোয়ার্টারেই থাকে–একজন বেয়ারা একজন বাবুর্চি আর এক বুড়ি ঝি। চেম্বারে আমার সেক্রেটারী মিস বার্জেস আমাকে সাহায্য করেন, সকাল আটটার মধ্যে চলে আসেন। ডাক্তারীতে আমার আয় বেশ ভালোই। রুগীরা বেশ অবস্থাপন্ন। খুব একটা গোলমেলে রোগ না হলে তারা কেউই সাধারণতঃ মারা যায় না। এই হলো আমার ইতিহাস।

ঠিক আছে। আপনাকে চেনেন এমন চারজন ভদ্রলোকের ঠিকানা দিন, এ শহরের বাসিন্দা হলেই ভাল হয়।

ডাক্তার রবার্টস প্যাডের উপর চারজনের নাম ঠিকানা লিখে দিলেন, প্রত্যেকেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের।

তাহলে আমি চলি। আমার চাবির গোছা রইল। সব কিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি মিস বার্জেসকে বলে যাচ্ছি তিনি যেন আপনাকে সাহায্য করেন। পাশের ঘরেই আছেন–প্রয়োজন হলে ডেকে নেবেন মিস বার্জেসকে।

ডাক্তার রবার্টস পাশের ঘরে সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ব্যাটেল কাজে লেগে পড়লেন। এখানে তেমন কিছু খুঁজে পাবেন বলে মনে হয় না। রবার্টস তাকে সব কিছু পরীক্ষা করবার অনুমতি দিয়ে গেলেন। তিনি নিশ্চয়ই বোকা নন। আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন পুলিশ আসবে, তাই যা ব্যবস্থা করার করে রেখেছেন। তবু ব্যাটেলের মনে হল কিছু পেলেও পেতে পারেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল প্রথমে ড্রয়ারগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, ব্যাঙ্কের পাশবইটাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, রুগীর নাম ধাম লেখা খাতাটা পরীক্ষা করলেন। বিষের আলমারীটা পরীক্ষা করেও নিরাশ হলেন। চিঠিপত্রের ফাইলেও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না। যা খুঁজছিলেন তা পেলেন না ব্যাটেল। একটু হতাশা হয়ে পড়লেন। বেল টিপে ডাকলেন মিস বার্জেসকে।

মিস বার্জেস এসে দাঁড়াতে ব্যাটেল একটা চেয়ারে বসতে বললেন। স্পষ্টই বোঝ যাচ্ছে মিস বার্জেস একটু রেগে গেছেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল, সমস্ত শুনেছেন নিশ্চয়ই। কি সাংঘাতিক নোংরা ব্যাপার দেখুন দেখি। আমাদের সন্দেহ চারজনের ওপর, এর মধ্যে কেউ একজন খুনটা করেছে। মিঃ শেটানকে আপনি চিনতেন? কাগজে তো প্রায় তার সম্পর্কে কত মজার মজার কথা লেখা হত–সেগুলো নিশ্চয়ই পড়েছেন?

মিঃ শেটানকে আমি চিনতাম না, আর বাজে খবর পড়ে নষ্ট করার মত আমার সময় নেই।

তা ঠিক। ব্যাটেল মাথা দোলালেন, একটা কথা কি জানেন, এই চারজনই বলছে মি. শেটানকে তারা খুব ঘনিষ্টভাবে চেনে না। তা তো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কেউ মিথ্যে বলছে, আর সেটাই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।

মিস বার্জের্স নির্বিকারভাবে বসে রইলেন। ব্যাটেল বুঝতে পারলেন কোনভাবেই মিস বার্জেসের কাছ থেকে কিছু কথা আদায় করা যাবে না। তবুও হাল ছাড়লেন না ব্যাটেল।

আমাদের কত দিকে কত ঝামেলায় মাথা ঘামাতে হয় কি বলব। ধরুন, কোন মেয়ের কাছ থেকে কোন স্ক্যান্ডাল শোনা গেল। কারো সম্পর্কে গুজবে কান দেওয়া উচিত নয়, তবু আমরা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারি না, নজর রাখতে হয়–অবশ্য মেয়েরাই গুজব ছড়াতে ওস্তাদ।

আপনি কি বলতে চান, কেউ ডাক্তার রবার্টসের নামে কুৎসা রটাচ্ছে।

না, ঠিক তা নয়, ব্যাটেল সতর্কভাবে এগোলেন, ধরুন কোন রুগী হঠাৎ মারা গেলেন, সাধারণলোকের কাছে মৃত্যুটা সন্দেহজনক। পাঁচজন বলতে লাগল। অবশ্য এসব ব্যাপারে ডাক্তারকে সন্দেহ করা খুবই অনুচিত।

কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে মিসেস গ্রেওসের কথা বলেছে। ঐ সব বুড়িদের ধারণা সবাই বুঝি তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চায়। এমনকি নিজের ডাক্তারকে তার অবিশ্বাস। ডাক্তার রবার্টসের আগে আর তিনজন ডাক্তারের রুগী ছিলেন মিসেস গ্রেস। রবার্টসকেও তাঁর সন্দেহ হত। এরপর তিন চারজন ডাক্তারের কাছে ঘোরার পর শেষ অবধি ডা. ফার্মারের কাছে গেলেন। তার চিকিৎসাধীনে থাকার সময়ই মারা যান। সবাইকেই তার সন্দেহ।

ব্যাটেল আবার কথা শুরু করলেন, কত তুচ্ছ জিনিস থেকে গুজবের জন্ম। ধরুন, কোন রুগী মৃত্যুর আগে ডাক্তারকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেল কৃতজ্ঞতাবশতঃ। সেটা যদি বেশিই হয় ক্ষতি কি? তাও দেখবেন কত কথা উঠবে–

ডাঃ রবার্টস রুগীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তেমন কোনদিন পাননি–একজন পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়েছিলেন, আর একজন একটা সোনার রিস্টওয়াচ।

এই ধরনের পেশায় কত যে বিপদ ধীরে ধীরে বলে চলেন ব্যাটেল হয়তো নির্দোষ ঘটনা, অথচ কেউ ব্ল্যাকমেল করতে চায়। কতরকমের স্ক্যান্ডেল রটে, একজন ডাক্তারের পক্ষে কত মারাত্মক

আর বলবেন না, বিশেষ করে ঝামেলা বাধায় হিস্টিরিয়ার মহিলা রোগী।

ভদ্রমহিলার কথা শোনার পর আমারও তাই মনে হয়েছিল।

কার কথা বলছেন–মিসেস ক্যাডাক? খুবই সাংঘাতিক মহিলা!

মিসেস ক্র্যাডাক? ব্যাটেল এমন ভাব করলেন যেন ঠিক মনে পড়ছে না। বোধহয় বছর তিনেক আগেকার ঘটনা, ঠিক মনে নেই।

না, বছর পাঁচেক আগের ব্যাপার। ভদ্রমহিলা বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্বামীর কাছে ডাক্তার রবার্টসের নামে বানিয়ে বানিয়ে কত কি বলছিলেন। স্বামী বেচারাও তাই সত্যি ভেবে অশান্তিতে বাকি জীবনটা কাটালেন। সকালে দাড়ি কামাবার সময় তার গলাটা কেটে গেছিল, নীচুমানের সেভিং ব্রাশ দূষিত ছিল বোধহয়, জীবানু রক্তে সংক্রামিত হয়ে তিনি মারা যান। ভদ্রমহিলা তারপর লণ্ডন ছেড়ে চলে যান। মারা যান বিদেশে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা, মিথ্যে কথা বলে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠলেন ব্যাটেল, কোথায় যেন মারা গেছিলেন ভদ্রমহিলা?

খুব সম্ভবত মিশরে।

ডাক্তারদের আর একটা সমস্যা হল, ধরুন কোন রুগীর আত্মীয় রুগীকে স্লো পয়জন করছে, ডাক্তারকে কোন কারণে চুপচাপ থাকতে হচ্ছে, কিন্তু রুগী মারা গেলে আত্মীয়রা হয়ত ডাক্তারের ঘাড়েই দোষ চাপাল–কি ঝামেলা ভাবুন।

ডাক্তার রবার্টসের এ ধরনের কোন বিপদ হয়নি।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর বিদায় নিলেন ব্যাটেল। মোটামুটি সব খবরই জানা হয়ে গেছে তার। মিস বার্জেস সাত বছর ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারে আছেন। এ পর্যন্ত রবার্টসের হাতে জনা-তিরিশ রুগী মারা গেছে। রবার্টসের পশার খুব ভালো। শেটানের ছবি মিস বার্জেসকে দেখিয়েছিলেন ব্যাটেল। কিন্তু মিস বার্জেস চেনেন না শোনকে। নোটবইয়ে কয়েকটা কথা নোট করে নিলেন ব্যাটেল। মিসেস গ্রেওস? খুব সম্ভব নয়।

মিসেস ক্রাডাক? কোন উত্তরাধিকারী নেই।

 বিয়ে করেননি।

 রুগীদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তদন্ত চালাতে হবে।

নোটবই বন্ধ করে ওয়েসেক্স ব্যাঙ্কের দিকে পা বাড়ালেন ব্যাটেল। রবার্টসের ব্যাঙ্ক একাউন্ট সেখানেই।

.

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল বিষণ্ণ মুখে বসে ছিলেন। পোয়ারোর সঙ্গে একই টেবিলে লাঞ্চ করেছেন তিনি একটু আগে। পোয়ারো ফিরে তাকালেন ব্যাটেলের দিকে, আপনার পরিশ্রমটা তাহলে মাঠে মারা গেল?

গোলমেলে ব্যাপার। ব্যাঙ্কের পাসবই-এ এ-পর্যন্ত সেরকম সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।

ডাঃ রবার্টসকে কি রকম মনে হল?

আমার মনে হয় না রবার্টস খুন করেছেন শেটানকে। তাকে খুন করা যে কত বড় ঝুঁকি–রবার্টস সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। শেটান ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠতে পারতেন।

পাসবই পরীক্ষা করে কি বুঝলেন?

রবার্টস কোন পেশেন্টের সম্পত্তি পাননি। তাই সম্পত্তি লাভের জন্য যে কাউকে খুন করেছেন এ কথাও বলা যাচ্ছে না। তার নিজের অবস্থা খুবই ভালো, অবিবাহিত। এক যদি স্ত্রীকে খুন করে থাকেন, তবে মিসেস ক্র্যাডক নামে এক পেশেন্টকে নিয়ে কিছু একটা গোলমাল বেধেছিল শোনা যায়। এ ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ভাবছি গোয়েন্দা দপ্তরের কোন চালু ছোকরাকে এ ব্যাপারটার ভার দেব।

ভদ্রমহিলার স্বামীর কি খবর?

সে ভদ্রলোক অ্যানথ্রাক্স রোগে মারা যান। সে সময় বাজারে এক ধরনের কম দামী সেভিং ব্রাশ বেরিয়েছিল, সে গুলোর কয়েকটাতে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ছিল। এ নিয়ে কোম্পানির নামে বোধহয় কি একটা মামলাও হয়েছিল কোর্টে।

খুনীর পক্ষে এটাও কিন্তু মস্ত বড় সুযোগ। গম্ভীরভাবে বললেন পোয়ারো।

আমিও এ-ব্যাপারে ভেবেছি। যদি মিসেস ক্র্যাডাকের স্বামীর সঙ্গে রবার্টসের কোন কারণে গণ্ডগোল বেধে থাকে–তবে এইসব হল অনুমাণ, কোন ভিত্তি নেই। সে থাক, আপনি কি ভাবে এগোবেন ভাবছেন? অবশ্য আমাকে বলতে যদি কোন আপত্তি না থাকে

না, না। আপত্তির কিছুই নেই। আমিও ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে দেখা করব।

 একই দিনে দুজন। ভদ্রলোক তো ঘাবড়ে যাবেন খুবই।

আমি আপনার মত অতীত সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করব না। ভদ্রলোক যাতে সন্দেহ করতে না পারেন সেইভাবেই এগোব। আমার প্রশ্ন হবে ব্রীজ নিয়ে।

আবারও ব্রীজ? যাক আপনি যেভাবে খুশি আপনার কাজ করবেন। মনে হয় কর্নেল রেস কয়েকদিনের মধ্যেই ডেসপার্ডের খবরাখবর এনে দিতে পারবেন। আর মিসেস অলিভারের পক্ষেও অনেক খবর আনার সুবিধা আছে। মেয়েরাই মেয়েদের খবর যোগাড় করতে ওস্তাদ।

একটু পরেই ব্যাটেল পা বাড়ালেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দিকে। আর ডাঃ রবার্টসের চেম্বারের দিকে এগোলেন পোয়ারো।

পোয়ারোকে দেখে রবার্টসের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। ঠাট্টার সুরে বলে উঠলেন, একদিনে দুই টিকটিকি! হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে সন্ধ্যের মধ্যেই ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যাবে আমার নামে।

পোয়ারো মৃদু হাসলেন, না না, চিন্তার কোন কারণ নেই, এখন অবধি আমার নজর সমানভাবে আপনাদের চারজনের ওপরে।

বলছেন। তবু ভাল। বলুন কিভাবে আপনার সেবায় লাগতে পারি। রবার্টস বললেন।

তক্ষুনি কোন উত্তর দিলেন না পোয়ারো, কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। তারপর রবার্টসকে প্রশ্ন করলেন পোয়ারো, আমি যে কাজের জন্য এসেছি, আমার মনে হয় সে ব্যাপারে একমাত্র আপনিই সাহায্য করতে পারেন। আপনি নিশ্চয়ই মানুষের চরিত্র স্টাডি করেন ডাঃ রবার্টস? অন্তত আপনার পেশেন্টদের খুঁটিনাটি তো একজন ডাক্তার হিসাবে লক্ষ্য রাখতেই হয়।

হ্যাঁ, সেটা যে কোন ডাক্তারকেই রাখতে হয়। কিন্তু আপনি কোন বিষয়টার ওপর জোর দিচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।

পোয়ারো কোটের পকেট থেকে ভাঁজ করা তিনটে ব্রীজ খেলার স্কোরশিট বার করে রাখলেন টেবিলের ওপরে। এগুলো হল যেদিন সন্ধ্যার প্রথম তিনটে রাবারের ফলাফল। প্রথমটা মিস মেরিডিথের লেখা। এটা দেখে আপনার সেদিনের তাস সম্পর্কে কিছু মনে পড়ছে কি? ধরুন, খেলাটা কিভাবে এগিয়েছিল, ডাকগুলো কি হয়েছিল।

আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন মঁসিয়ে পোয়ারো! অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ রবার্টস এতদিন বাদে এসব আমি মনে করব কিভাবে?

একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। ভাল করে ভেবে দেখুন, প্রথম হাতটা নিশ্চয়ই হার্ট বা স্পেডে ডাকা হয়েছিল। তবে খেলা হয়নি। একটা শর্ট গিয়েছিল।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। মনে পড়েছে এবার। স্পেডের খেলা ছিল। একটা শর্ট দিলেন ওঁরা।

পরেরটা?

যতদূর মনে পড়ছে আমি বা আমার পার্টনার দুটো ডায়মন্ডে খেলেছিলাম। তবে এবারও খেলা হয়নি। পঞ্চাশ ডাউন দিলাম। কিন্তু এতদিন পরে সবকিছু ঠিকঠাক মনে করা কি করে সম্ভব! তবে একটা গ্ল্যান্ডস্লামের কথা মনে পড়েছে। সেটা ছিল আমারই খেলা। আর একবার তিনটে নোট্রাম্প ডেকে অনেকগুলো সর্ট দিলাম–বিশ্রী ব্যাপার। প্রতিটি রঙের ডিস্ট্রিবিউশন এত খারাপ ছিল কি বলব। কোন পিটই আমরা পাইনি। তবে এটা শেষ দিকের তাস। আমার পার্টনার মিসেস লরিমার বোধহয় আমার ওভার কলিংটা ঠিক পছন্দ করছিলেন না।

অন্য কোন ডিল? পোয়ারো প্রশ্ন করলেন।

আচ্ছা মিঃ পোয়ারো, আপনি কি করে ভাবছেন যে সেদিনের সমস্ত কিছুই আমার মনে থাকবে? মিঃ শেটানের নৃশংস মৃত্যুই তো সব কিছু ভুলিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তাছাড়া এ পর্যন্ত আরও সাত-আটটা রাবার খেলেছি। সেদিনের খেলার কথা আমার বিশেষ কিছুই মনে পড়ছে না।

মানলাম আপনার কথা। কিন্তু চেষ্টা করলে দু একটা ডিলের কথা মনে পড়বে না, এই কথাটা ভাবা যায় না। বিশেষ করে ডিলগুলো যখন অন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

অন্য ঘটনা বলতে?

ধরুন আপনার পার্টনার একটা সহজ খেলা ভুল করে বসল। কিংবা অন্যপক্ষের কেউ অন্ধের মত ডিফেন্স করে বসল যাতে হারা খেলা আপনারা জিতে নিলেন–

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকেছে। আপনি বলতে চাইছেন যে মিঃ শেটানকে সদ্য সদ্য খুন করে এসেছে তার হাবভাব খেলার ধরণ কিছুটা অন্যরকম হবে, তার অপরাধবোধ তাকে উত্তেজিত করে তুলবে।

ঠিক এ-কথাটাই আমি বলতে চাই। মাথা নাড়লেন পোয়ারো একটু ভাল করে ভেবে দেখুন ডাঃ রবার্টস। কারো খেলার মধ্যে এরকম চোখে পড়ার মত কোন ঘটনা ঘটেছে কি?

ডাক্তার রবার্টস মিনিট দুই মনে মনে ভাবলেন, তারপর মাথা নাড়লেন, না। নতুন কিছু তো মনে পড়ছে না। মিসেস লরিমার আর মেজর ডেসপার্ড ঠিকঠাকই খেলছিলেন। তবে মিস মেরিডিথ প্রায়ই ভুল করছিলেন, অন্যমনস্কতার জন্য হতে পারে। তাছাড়া মনে হয় অভিজ্ঞতাও কম। খেলতে খেলতে হাত কাঁপছিল।

ঠিক কখন থেকে মিস মেরিডিথের হাত কাঁপছিল?

অতসব আমার মনে নেই।

আর একটা ব্যাপার জিজ্ঞেসা করব। সেদিন যে ঘরে আপনারা ব্রীজ খেলছিলেন সে ঘরের জিনিসপত্রগুলোর একটা বিবরণ দিতে পারবেন?

বিবরণ? সে তো অনেক কিছু ছিল–যেমন দামী দামী ফার্নিচার–

না, না, ওভাবে নয়, পোয়ারো বাধা দিলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করবেন।

বেশ। হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বড় সেট। চার-পাঁচটা বড় বড় চেয়ার, আটটা কি নটা পার্সিয়ান কম্বল। বারোটা ছোট ছোট চেয়ারের একটা সুন্দর সেট। খুব সুন্দর একটা তিন-

চাইনিজ আলমারী। বড় পিয়ানো একটা। আরো অনেক ফার্নিচার ছিল কিন্তু অত লক্ষ্য করিনি, ছটা ভালো জাপানি ছবি। আয়নার দুপাশের ছবি দুটো চাইনিজ। পাঁচ-ছটা নস্যির কৌটো, বেশ দেখতে। টেবিলের ওপর হাতির দাঁতের কাজ করা কয়েকটা ছোট ছোট মূর্তি। প্রথম চালর্সের শীলমোহর করা কিছু মুদ্রা–

হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে বলে যান। উৎসাহ দিলেন পোয়ারো।

প্রাচ্যদেশীয় কিছু জিনিসপত্র ছিল। সুক্ষ্ম রূপোর কাজ করা কয়েকটা শিল্পসামগ্রী, কিছু গয়নাগাটি। একটা সুন্দর কাঁচের বাক্সে ছোট ছোট কয়েকটা সৌখিন জিনিস সাজানো ছিল। আর তো মনে পড়ছে না।

আপনার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়, সত্যি চমৎকার।

আপনি যে জিনিসটার কথা জানতে চান, যা বর্ণনা দিলাম এর মধ্যে পেলেন সেটা?

না, আমি জানতাম আপনি সেটার উল্লেখ করবেন না কারণ জিনিসটা হয়ত আদৌ তখনো সেখানে ছিল না।

তার মানে আপনার কথা কেমন হেঁয়ালীর মত মনে হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না।

সেটাই তো আমি চাই। কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। তবে আজ আপনি যা বললেন তা আমার খুব কাজে লাগবে।

ডাক্তার রবার্টসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পোয়ারো একটা ট্যাক্সি ধরলেন। এবার তিনি দেখা করবেন মিস লরিমারের সঙ্গে।

আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ পোয়ারো। সেদিনের ঘরের ফার্নিচারের বিবরণ–সে আবার আপনার কি কাজে লাগবে? মিসেস লরিমার বেশ অবাক হলেন।

ম্যাডাম, ব্যাপারটা হয়ত বোঝাতে পারব না। ধরুন আপনাকে ব্রীজ টেবিলে যদি কেউ বলে আপনি টেক্কাটা অত তাড়াতাড়ি খেলে বসলেন কেন, অথবা সাহেব না মেরে গোলাম মারলেন কেন? আপনার তখন বিরক্ত লাগবে কোন আনাড়িকে বোঝাতে, সেখানে বললেও বুঝবে কিনা সন্দেহ।

মিসেস লরিমার হাসলেন, ও, তার মানে আপনি বলতে চান গোয়েন্দাগিরিতে আপনি। যেমন দক্ষ, ঠিক ততখানি আনাড়ি হলাম আমি। ঠিক আছে, বলছি–সেদিনের যে যে জিনিসগুলোর কথা আমার মনে আছে। মনে মনে একটু চিন্তা করে নিলেন মিসেস লরিমার, ঘরটা বেশ বড়, প্রচুর জিনিসপত্র ছিল–

কি কি জিনিস ছিল?

গোটাকতক কাঁচের আধুনিক ডিজাইনের ফুলদানী, সুন্দর দেখতে। যতদূর মনে পড়ে চিনা বা জাপানি ঢঙের কতকগুলো ছবিও দেওয়ালে টাঙানো ছিল। একগোছা ছোট ছোট রক্তিম টিউলিপ। টিউলিপের সময় কিন্তু এখন নয় কিন্তু ভদ্রলোক যে কোথা থেকে। জোগাড় করলেন–

আর কিছু? ফার্নিচারগুলোর রঙ কিরকম ছিল মনে পড়ছে?

হ্যাঁ। ধূসর সিল্ক রঙের কয়েকটা ফার্নিচার ছিল।

 ছোটখাট কোন জিনিস নজরে পড়েনি আপনার?

নাঃ, একদম মনে পড়ছে না। মাপ করবেন, হয়ত কোন কাজে লাগলাম না–

আর একটা প্রশ্ন বাকী আছে। পোয়ারো পকেট থেকে স্কোরশিটগুলো বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। এগুলো সেদিনের প্রথম রাবার তিনটের হিসেব। দেখুন তো, এগুলো দেখে সেদিনের ডিলগুলোর কথা আপনার মনে পড়ে কিনা।

পোয়ারোর হাত থেকে স্কোরশিটগুলো নিয়ে মিসেস লরিমার ঝুঁকে পড়লেন তার উপর। হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। এটা প্রথম রাবার। তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিস মেরিডিথ। অন্যদিকে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। প্রথম ডিলে আমরা চারটে স্পেড ডেকেছিলাম। পাঁচের খেলা হয়। পরের তাস দুটো ক্লাব ডাক হয়েছিল। ডাঃ রবার্টস খেলতে পারেননি। একটা ডাউন দেন। তৃতীয় ডিলে খুব বেশি ডাকাডাকি চলে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। মিস মেরিডিথ পাস দিলে একটা হার্ট দিয়ে মেজর ডেসপার্ড ডাক শুরু করেন। আমি পাস দিলাম। ডাক্তার রবার্টস লাফিয়ে বীড দেন, তিনটে ক্লাব। মিস মেরিডিথ ডাকেন তিনটে স্পেড। মেজর ডেসপার্ড বলেন চারটে ডায়মণ্ড। আমি ডবল দিই। ডাক্তার রবার্টস গোড়ায় হার্ট রঙে ফিরে চান। কিন্তু চারটে হার্টসে একটা ডাউন দেন।