৬. চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল

৬. চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল 

কলাপোতা গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। এছাড়া চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল বিল পুকুর। সবুজ জংলা ঝোঁপের পাশে সন্ধ্যামণি ফুল। হেলেঞ্চার লতা। উঠোনের কোণ ঘেঁষে কাঠচাঁপা। পঞ্চমুখী জবা। সদরের মুখটায় শিউলি। সাদা আঁচলের মতো পড়ে থাকে ফুলগুলো। উঠোনের মাঝখানে বড় তুলসী মঞ্চ। অষ্টপ্রহরের সময় ঘুরে ঘুরে কীর্তন হয় সেখানে। বাড়ির পেছনে আছে নারকেল গাছ বেয়ে ওঠা চুইঝাল। রান্নায় এতটুকু ঝালের দরকার হলে মা টুক করে গিয়ে ছোট্ট ডাঁটি পেড়ে নিয়ে আসে। একটু ঘেঁচে ফেলে দেয় ঝোলের মধ্যে। নারকেল গাছটা সোজা রেখে এগিয়ে গেলে পুঁইয়ের মাচা। তার ডগাগুলো বর্ষার জল পেয়ে যেন আকাশের দিকে মুখ করে আছে আরও বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায়। পুঁই মাচাকে বাঁদিকে রেখে কয়েক পা হাঁটলেই কলকাতা থেকে আনা দাদুর ডালিম গাছ। তার পাশেই ঠাম্মার নিজের হাতে আদর করে বসানো গন্ধরাজ লেবু। কালনার আতা। যেন ছবির মতো আঁকা। এইরকম সাজানো গোছানো বাড়ি এই গ্রামের অনেকেরই আছে। সচ্ছল গেরস্থ হিন্দু বাড়ির ঘর দোর সাজানো এক রকমের। আবার মধ্যবিত্ত মুসলিম বাড়ির অন্দরের সাজ ভিন্ন ধরনের। হিন্দুবাড়ির চারিদিকের এমন খোলামেলা পরিবেশটা কিছুটা হলেও ঢাকা পড়তো মুসলিম বাড়িতে। ইন্দুবালার যে খুব একটা গ্রামের সেইসব বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হতো তেমনটা নয়। কিন্তু হাতে গোনা একজন দুজনের বাড়িতে নানা অছিলায় সে গিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেকেছে। ভালোলাগা কাছের মানুষদের হুট করে গিয়ে চমকে দিলে কেমন যেন একটা আনন্দ হয়। সেইরকম যে কতবার ইন্দুবালা মনিরুলের বাড়িতে গিয়ে তাকে চমকে দিয়েছে তার সংখ্যা গুনতে বসলে এই বয়সে ইন্দুবালার লজ্জা পাওয়ার কথা। দুজনের সেই নিঃশব্দ ভালোবাসার মধ্যে আর কারও না থাকুক প্রকৃতির তো সায় ছিল। না হলে কেন ইন্দুবালার এখনও মনে থাকবে মনিরুলের বাড়ির পেছনের বড় পুকুরটাকে। তার পেছনের বড় বাঁশ ঝাড়টা। তারপর আদিগন্ত ধানক্ষেত। ওখানে সন্ধ্যা নেমে আসতো। জোনাকিগুলো ঘুরে ঘুরে আলো ফোঁটাতো। যারা কোনোদিন দুজনে দুজনের সঙ্গে থাকলে না, সংসার করলো না, তাদের ভালোবাসার গল্প বয়ে বেড়ালো কত যুগ। 

মনিরুলদের পুকুরপাড়ে জমাট অন্ধকারে জোনাকি দেখতে ভালোবাসতো ইন্দুবালা। সে সাধ অবশ্য বেশিদিন টেকেনি তার কপালে। ধিঙ্গি মেয়ে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখ টাটাতো সবার। অচিরেই বন্ধ হলো সবকিছু। সমাজের চোখে যা যা নিষিদ্ধ, অক্ষরে অক্ষরে মানতে বাধ্য করা হলো মেয়েকে। রাতের আঁধার দেখা বন্ধ হয়ে গেল। তার মধ্যে থেকে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলোগুলোও দূরে চলে গেল। এই বয়সে মেয়েরা সংসারের জন্য একটু একটু করে তৈরী হতে থাকে। ঘরের কাজ কম্ম শেখে। স্বামীকে কীভাবে যত্ন নিতে হবে, কোনটার পরে কীসের উপাচার তা ভালোভাবে বুঝে নেয়। আর এই মেয়ে কিনা এক মুসলমান ছেলের সাথে রাতের আঁধারে পুকুর পাড়ে জোনাকি দেখবে? দাওয়ায় বসে বই পড়ার ধুম হবে? কানাকানি থেকে জানাজানি হয় গ্রামে। মুখ টেপাটিপি, হাসিও। কথাগুলো ইন্দুবালার বাড়ির লোকের কানে বেঁধে সঁচের মতো। সেই নিয়ে হুলুস্থুল কম হয় না বাড়িতে। মেয়ের জেদ পুকুর পাড়ে গিয়ে সে বসবেই। কেন বাড়ির কাজ কি সে করে না? নাকি বাবা, মা, ঠাম্মার কথা শোনে না? গ্রামের লোক যা বলবে তাই শুনতে হবে? প্রথম দিকে কঠোর শাসন চলতো। তারপর দেখা গেল মেয়ে মোটেই সুবিধের নয়। এই শাসনে আরও বেঁকে বসছে সে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে শরীরের অবস্থা কাহিল হবার যোগাড়। ঠাম্মার পরামর্শে মা আশেপাশের হিন্দু বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। যাদের বাড়িতে বড় পুকুর কিংবা ছোট্ট ডোবা কাটানো আছে। সেখানেও অন্ধকার গাঢ় হয়ে জমাট বাঁধে। জোনাকিরা মিটমিটে আলো জ্বালায়। কিন্তু সেইসব বাড়িতে তো আর মনিরুল ছিল না। তার বাঁশি ছিল না। জসীমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বা মীর মশাররফের ‘বিষাদ সিন্ধু’ কেউ দুলে দুলে পড়তো না। সবে কৈশোরকে পিছনে ফেলে যেতে থাকা কোনো সন্ধ্যে সজল দুটো চোখ তুলে জানতে চাইতো না, “বাড়ি যাবি না ইন্দু?” ইন্দুবালার বাড়ি যেতে এতটুকু ইচ্ছে না করলেও যেতে হতোই। হিন্দু পাড়ায় সন্ধ্যের শাঁখ বেজেছে। আর মুসলিম পাড়ায় তখন মাগরিবের নামাজ। ইন্দুবালার মন পড়ে থাকতো ওই পুকুরটার পাড়েই। অন্ধকারে জ্বলে ওঠা বিন্দু বিন্দু জোনাকির আলোয় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা মনিরুলের চোখের মাঝে। কেউ কেউ বলেছিল ঝাড়ফুঁক করো মেয়েকে। অমন ভাবে পুকুর পাড়ে কেউ বসে থাকে ভর সন্ধ্যেবেলা? তবুও ইন্দুবালা জেদ করে বেশ কিছুদিন একাই বসতেন। বাঁশ ঝাড়ে হাওয়া লেগে ঝিরঝিরে আওয়াজ হতো। দূরে বিশালাক্ষ্মী তলার মাঠ থেকে শেয়াল ডেকে উঠতো। ইন্দুবালার সেই প্রথম মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে তিনি বড্ড একা। চারপাশে কেউ নেই। হাত বাড়ালে অন্ধকারটুকু ছাড়া। সেই অন্ধকারে ইন্দুবালা প্রথম জ্ঞান হারালেন। তারপর থেকে বাড়ির বাইরে পা রাখা এক্কেবারে বন্ধ হলো। ঠাম্মা সত্যপীরের কাছে মানত করলেন। মেয়েকে সুযোগ্য পাত্রের হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত মা পালন করলেন ব্রত। বাবা মরিয়া হয়ে চিঠি লিখলেন কলকাতায়। 

যখন বাড়ি থেকে বেরোনো এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেল। তখন ইন্দুবালার বারবার মনে হতো গ্রামে সবার বাড়িতে থাকলেও তাদের বাড়িতে কেন কোনো পুকুর বা ডোবা নেই? তাহলে সে তো চুপটি করে জলের পাশে একটু বসে থাকতে পারতো। এত সব কাণ্ডের পরেও মনিরুলকে ঠিক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাতো জোনাকির আলো। কারবালার যুদ্ধমুখর প্রান্তরটা কি মনিরুল তাদের পুকুর পাড়েই নামিয়ে আনতো না তখন? সাজু কি তাদের পুকুর পাড়ে এসে রূপাইয়ের খোঁজ নিতো না? অভিমান আর কষ্ট জমে উঠতো দু চোখ উজিয়ে। যদিও বাড়িতে পুকুর কেন ছিল না সেটা নিয়ে একটা গল্প সে ছোট্ট থেকে শুনে আসছে। 

কিন্তু সেই গল্পে প্রবেশ করার আগে এই মুহূর্তে ইন্দুবালা কী করছেন সেটা জেনে নেওয়াটা আখ্যানের ক্ষেত্রে জরুরি। বর্ষা এবার শুধু দেরিতে নয় আষাঢ় পার করেও দেখা দিচ্ছে না। ভ্যাপসা গরমে সবার নাজেহাল দশা। সত্তর পার করা ইন্দুবালার অবস্থা আরও কষ্টের। দোতলার বারন্দায় ঠাণ্ডা মেঝের ওপরে চুপটি করে শুয়েছিলেন তিনি। অনেকক্ষণ হলো কারেন্ট নেই। হাত পাখাটাকে অভ্যাসবশত আস্তে আস্তে নাড়ছিলেন নিজের শরীরের ওপরে। তালপাতার স্নিগ্ধ হাওয়া ভালো লাগছিল তাঁর। কিছুক্ষণ আগে শেষ খদ্দের ভাত খেয়ে চলে গেছে। যা বাকি ছিল হাঁড়ি চেঁচে পুছে খাওয়ানো হয়েছে বাজারের ভিখারিদের। এমনকি কালু, ভুলু, নেলু বাজারের যে হরেক নামের বিড়াল এবং কুকুর আছে তাদেরও পাতের উচ্ছিষ্টাংশ এক জায়গায় জড়ো করে ধনঞ্জয়ের খাওয়ানো হয়ে গেছে। লছমী নিজে হাতে শুরু করেছিল এইসব। সেই প্রথা আজও দিব্য বহাল আছে। সবই ঠিক ছিল। এর সাথে যদি বাড়ির সঙ্গে একটা পুকুর থাকতো। তাহলে ঠাণ্ডা মিঠে জলের হাওয়া পাওয়া যেত এই ছেনু মিত্তির লেনেও। বেচারা ধনঞ্জয়কে তখন কর্পোরেশানের ছিরছিরে জল পড়া কলে ওই অতক্ষণ ধরে বাসন মাজতে হতো না। পুকুর ঘাটে গিয়ে মেজে ঘষে ঝকঝকে করে আনতে পারতো বাসনগুলো। পারলে দুটো ডুব দিয়ে আসতো না হয় তার সাথে। আজ অনেক ভোরে প্রচণ্ড গরমে ঘুম ভাঙার পরেই কেমন যেন বোসদের পুকুরটার কথা মনে পড়ছে তাঁর। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষকে। এমনকি শাশুড়ি যে পালা পার্বণে গঙ্গার স্নানে নিয়ে যেতেন তাও। সক্কাল হতে না হতে আজ নিজে থেকেই কেমন যেন ডুব দিয়ে স্নান করার বাসনা মনের মধ্যে জাগছিল ইন্দুবালার। কত দিন গভীর গহন জলে ডুব দেননি তিনি। এই সময় তো কপোতাক্ষের একূল-ওকূল ভাসে। গভীর রাতে জলের আওয়াজ যেন দোর পর্যন্ত এসে কলকল করে কত কথা শুনিয়ে যায়। বোসদের পুকুরের জল আরও ঘন সবুজ রঙ নিয়ে ভারী হয়ে ওঠে। পাশের ঝোঁপ থেকে অনবরত ডেকে চলে ঝিল্লি। ভিজে গায়ে বাড়ি ফিরতে স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে ওঠে গা। ইন্দুবালার হঠাৎ আজ কেমন যেন ইচ্ছে হলো অমন বৃষ্টিভেজা ঝোপে ঢাকা মাটির রাস্তা দিয়ে স্নান করে ফিরতে। কিন্তু সে পথ কোথায় পাবেন তিনি ছেনু মিত্তির লেনে? আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙে তাই নীচে চলে এসেছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমেছিলেন। যেন ঘাটে নামছেন। সঙ্গে রয়েছে জল ভরে নেওয়ার ঘড়া। 

“ধনঞ্জয়…ও ধনঞ্জয়…।” কোনো সাড়া পান না তিনি। মাথার ওপর দিয়ে চাদর চাপা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে সে সিঁড়ির নীচের ঘরে। আবার ডাকেন দরজার কাছটায় এসে। “ধনা, ও ধনা ওঠ না বাবা। আমাকে একটু গঙ্গা স্নান করিয়ে এনে দে।” ভোরের আধো ঘুমে ধনঞ্জয় চোখ কচলায়। ধড়মড় করে উঠে বসে। কানে ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারে না। বুড়ি বলে কিনা গঙ্গায় যাবে? “বলি তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে মা? রোজ রাতে ঘিষঘিষে গা গরম থাকে তোমার। ডাক্তারের ওষুধ খাচ্ছে। তার ওপর তোমাকে নিয়ে গঙ্গা স্নানে গিয়ে আমার নিজের গঙ্গাপ্রাপ্তি হোক তাই না? তোমার ছেলেরা এসে আমাকে দুরমুশ করুক। হবে নাই।” 

ধনঞ্জয় বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। যত বয়স বাড়ছে, চুল যত পাকা হচ্ছে তত মুখের বুলি ফুটছে। রেগে যান ইন্দুবালা। “ছেলেদের ভয় দেখাস তুই কোন সাহসে? তাদের আমি খাই না পরি? যেতে হবে না তোকে। আমি নিজেই যাবো।” বুড়ি এগোতে গেলে ধনঞ্জয় চিৎকার করে। “যাও না, যাও। ও বাড়ির চক্কোত্তির বউয়ের মতো শেষকালে হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকো। গুয়ে মুতে একাক্কার হও গে। সুস্থ আছে কপালে সইবে কেন?” থমকে যান ইন্দুবালা। সত্যি তো এই বয়সে একা যেতে গিয়ে একটা কাণ্ড বাধলে? ধিক ধিক করে মরা তার জীবনে সইবে না। তবু রাগ যায় না। নিজে দমে গেলেও ধনাকে ছাড়েন না তিনি। “তোকে আজ কোনো কাজ করতে হবে না ধনা। আমি নিজেই সব কিছু করবো। গায়ের কাছে একদম ঘুরঘুর করবি না। এই আমি বলে দিলাম”। ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয়। আপাতত নিশ্চিন্ত সে। বুড়ির গঙ্গা স্নান আটকাতে পেরেছে। বড় ফাড়াকেটেছে একটা। এইখানে নাকি গঙ্গার ঘাট? রিক্সা করে যাও। আবার হাঁটো। তারপর আবার রিক্সা। শুধু কি তাই? গঙ্গায় নামার আগে মায়ের একপ্রস্থ প্রণাম। “তোমর গায়ে পা দিচ্ছি মা, অপরাধ নিও না।” আবার ওঠার সময় আর এক প্রস্থ প্রণাম। তারপর ঘাটে কাপড় ছাড়ার জায়গা নেই। বুড়ি জেদ করে সেই ভিজে কাপড়ে আসবে। শুধু তাই নয় বাড়ি ফিরে আবার স্নান করবে। কিছু যদি একটা হয় তখন সামলাবে কে? এইসব বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে আবার ধনঞ্জয়। 

ওদিকে ইন্দুবালা বাসি কাপড় ছেড়ে ঠিক করেন বাজারে যাবেন। একবার যখন বাইরে বেরোনোর বাই উঠেছে সেটা কাটানো মুশকিল। তার চেয়ে বাজারে গেলে মনটা শান্ত হবে। নিজে হাতে জিনিসপত্র দেখে কেনাকাটা করা যাবে। দুটো লোকের সাথে কথা বললে ভালো লাগবে। সদর খুলতেই মনে পড়ে যায় অনেক দিন পরে তিনি আজ নিজে বাজারে যাচ্ছেন। বেশ কিছু দিন হলো ধনঞ্জয় এইসব করে। হাঁটুর ব্যথায় খুব একটা নড়তে পারেন না ইন্দুবালা। কিন্তু এই তো কয়েক বছর আগেও নিজে হাতে বেছে বেছে। সবজি কিনতেন। মশলা দেখে, বেছে দরদাম করে নিয়ে আসতেন। সেগুলো পেশাই করে বাড়ি দিয়ে যাওয়ার লোক ছিল। লছমী যতদিন ছিল, মাছের ব্যাপারে ইন্দুবালাকে ভাবতেই হতো না। কিন্তু লছমী যাওয়ার পর থেকে মাছ দেখে শুনে বেছে নিতে হতো। কোথাকার কোন মাছ। কোন পুকুর, দিঘি, বিল সব ইন্দুবালার জানা চাই। না হলে রাঁধবেন কী করে? জল অনুযায়ী মাছের স্বাদ আলাদা হয় সবাই জানে সেটা। কিন্তু রান্না, সেটাও তো আলাদা হয়! শুধু কি তাই? কোথাকার বেগুন। কোথাকার লঙ্কা? কোথাকার ঢেঁড়শ জানা না থাকলে তাঁর রান্নায় মন বসে না। কুটনো কুটতে বসলে কড়াইতে ফোড়ন দিয়ে সেই ক্ষেতটাকেই যদি চোখের সামনে না দেখতে পান তাহলে রান্নায় মজা আসে না। স্বাদটাও। এইভাবেই একটু একটু করে ইন্দুবালার সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল মেমারির কুমড়ো, বেলডাঙ্গার কাঁচা লঙ্কা, পুরশুড়ার আলু, বাঁকিপুরের মুসুরি, রিহান্দের রুই, লাল গোলার আড়, বাসন্তীর গলদার। বাজার করা তাঁর কাছে এক স্বপ্নের মতো। বাজার যদি ঠিক করে হয় রান্নায় তাহলে তরিজুত আসে। আর একবার হাত দিয়ে দেখে নেন ব্লাউজের ফাঁকে টাকার ব্যাগটা ঠিক নিয়েছেন কিনা। 

অনেক সকালে মেসের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংশুক হীনযান ও মহাযানের তার্কিক পয়েন্টগুলো মিলিয়ে দেখছিল। ইতিহাস বইতে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের মতো ‘ঊষাকালীন মেঘমালা’ দেখার জন্য সে বেশ কয়েকদিন চেষ্টা করেছে। কিন্তু মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে গেছে তার মতো করে আর কিংশুক নিজে পাশ ফিরে শুয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে ভাত খাওয়ার সময়ে উঠেছে। আজ কী কুক্ষণে যে এতটা গরম পড়েছে আর ঘুম ভেঙেছে সে বুঝতে পারছিল না। যাই হোক, উঠেই যখন পড়েছে তখন সে ইতিহাসের চ্যাপ্টার গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলো। সামনেই বি এ ফাইনাল। নালন্দা থেকে হস্তিনাপুর হয়ে তিব্বতে যাওয়ার আগে সে দেখলো ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের দরজা খুলে স্বয়ং ইন্দুবালা বেরিয়ে পড়লেন। হীনযান-মহাযান মধ্যপথে রইলো। কিংশুক চিৎকার করলো, “ও দিদা? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?” ইন্দুবালা হাতের ব্যাগখানা উঁচু করে দেখালেন। কিংশুক হুড়মুড় করে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে জামার বোতাম আটকাতে আটকাতে। “চলো আমিও যাবো”। ইন্দুবালা অবাক হয়ে তাকান কিংশুকের দিকে। “তুই যাবি কেন? ভোররাত থেকে তো দেখলাম পড়াশুনো করছিস। ঘরের আলো জ্বলছিল যে”। কিংশুক বলে “ধুর পড়ছিলাম কোথায়? বেজায় গরমে ঘুম আসে নাকি? তার চেয়ে বরং এটাই ভালো হলো তোমার সাথে বাজার করতে যাবো। দাও দেখি ব্যাগ দুটো”। ইন্দুবালার হাত থেকে কিংশুক ব্যাগ দুটো প্রায় ছিনিয়ে নেয়। ছেলেটাকে ভালো লাগে 

ইন্দুবালার। সময় নেই অসময় নেই মেসের বারান্দা থেকে দিদা বলে হাঁক দেয়। ওদের ঘরটা ইন্দুবালার ঘরের ঠিক সামনে। রাস্তার উলটো দিকে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম না এলে ইন্দুবালা সেলাই ফোঁড়াই করেন। কিংশুক চিৎকার করে ওপারের জানলা দিয়ে। “এবার তো ঘুমোও। তোমার চোখ খারাপ হলে আমাদের উপোস করে থাকতে হবে। ধনাদার যা রান্নার হাত। গলা দিয়ে নামবে না যে”। নীচ থেকে ধনঞ্জয় কাঁইমাই করে ওদের শাপশাপান্তর করে। তার যত অভিযোগ ইন্দুবালাকে। তার জন্যেই নাকি ওই গাল টিপলে দুধ বেরোনো ছেলেগুলো তাকে হতচ্ছেদা করে। “আরও মাথায় তোলো তুমি ওদের মা। ঝেটিয়ে সব বিদেয় করবো দেখো। হা-হাভাতের দল সব”। যদিও খেতে না এলে ধনঞ্জয়ই ওদের ডেকে নিয়ে আসে। আদর করে বসিয়ে খাওয়ায়। শরীর খারাপ হলে সাতবার গিয়ে খবর নেয়। ছেলেরাও ভালোবাসে তাকে খুব। তার জর্দাটা, বিড়িটা হয়ে যায় ওই ছেলেগুলোর কল্যাণেই। তবে ছোটোখাটো খিটিমিটি লেগেই থাকে। না হলে ভালোবাসা জমবে কী করে? 

“আজ কী বাজার করবে দিদা?” 

“কেন? হোটেলের বোর্ড দেখিসনি?” 

“দেখেছি তো। ভাত, সোনা মুগের ডাল, মোচার ঘন্ট, মাছ…। ওই দেখো…কোন মাছ লেখখানি কিন্তু”। 

ইন্দুবালার সামনে দিয়ে তখন মাথায় ঝুড়ি ভর্তি কলমি শাক নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। একটা বউ। ইন্দুবালা থমকে দাঁড়ান। “ও বউ শুনছো..”। বউটা ঘুরে তাকায়। “কলমী শাক কোথায় পেলে? তোমার বাড়ির? বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছো?” বউটা হাসে। “মেয়ের বাড়ি গেছিলাম মা…। আমার তো আর পুকুর নেই…। ওর শাউড়ির বড় একটা পুকুর ছেল। তা সেই পুকুরের…”। ইন্দুবালা বলেন, “ছিল কেন বলছো? এখন আর নেই?” বউটার মাথা থেকে কিংশুক শাকের ঝুড়িটা নামাতে সাহায্য করে। হাঁপ ছাড়ে বউটা। “ডোবা হয়ে গেছে মা। এবার হয়তো ফ্যালাট উঠবে। তা মেয়ে বললো নিয়ে যাও। যে কদিন আছে”। ইন্দুবালা কলমী শাকের আঁটি তোলেন। সবুজ কচি মাথাগুলো সবাই যেন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাকের কাছে নিয়ে এসে শোঁকেন। জলের তাজা আঁশটে বুনো গন্ধ এখনও মিশে আছে ওদের ডালপালায়। কিংশুক জানতে চায় “এইভাবে বুঝি শাক চেনে? গন্ধ শুঁকে?” হাসে বউটা। “না গো না। মা আমার পুকুর চিনছে গো..”। ইন্দুবালার সামনে ভেসে ওঠে বর্ষার জলে থইথই উঠোন। ভাই বোন মিলে নাচানাচি। “আমাদের কেন পুকুর নেই ঠাম্মা?” ততক্ষণে ঠাম্মার কলমি শাক বাছা শেষ। “নিষেধ ছিল যে বংশে। পুকুর রাখা চলবে না”। “কেন নিষেধ ছিল কেন?” ইন্দুবালার প্রশ্নে ঠাম্মা জবাব দেন না। ইন্দুবালা ততক্ষণে শাকের আঁটি বেছে বেছে তোলেন ঝুড়ি থেকে। কিংশুকের পছন্দ হয় না ব্যাপারটা। শাক, লতা পাতা সে দু চক্ষে দেখতে পারে না। ওসব খাওয়ার জন্য তো গরু ছাগলরা আছেই। মানুষ কী জন্যে খেতে যাবে চারিদিকে এতো মাছ, মাংস, ডিম থাকতে। একটু বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে সে “আজ কিন্তু কলমি শাক মেনুতে নেই দিদা।” ইন্দুবালা বিড়বিড় করেন, “নেই তো কী? হতে কতক্ষণ? দেখছিস না বাড়ির সামনে কেমন একটা আস্ত গোটা পুকুর ঝুড়ির মধ্যে করে চলে এসেছে।” কিংশুক জবাব দিতে পারে না দিদার কথায়। এই মহিলা যাই রান্না করে তাই যেন মুখে লেগে থাকে সারা জীবনের মতো। মনে মনে ঠিক করে নেয় কিংশুক কলমি শাকটা আজ না হয় সে একবার ট্রাই করে দেখবে। ইন্দুবালা প্রায় সব শাক কিনে নিয়ে খালি ঝুড়ি ফেরত দেন বউটাকে। বলে দেন “ওবেলা বাড়ি ফেরার পথে একবার ঘুরে যেও বউ। আমার বাজারে একটু সময় লাগবে”। বউটা মাথা নাড়ে। আর তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া ইন্দুবালাকে ধরতে প্রায় ম্যারাথন দৌড় দেয় কিংশুক। 

ইন্দুবালার দাদুকে পিতৃস্বত্ব রাখতে দেশ ভাগ হওয়ার পরেও যেমন এপারে থেকে যেতে হয়েছিল ঠিত তেমনি তাঁর দাদুর দাদুও বাবার কথা ফেলতে পারেননি। কলকাতার পাট চুকিয়ে খুলনার কলাপোতায় যখন তিনি থাকতে শুরু করলেন তখন বর্ষাকাল। চারিদিকে উপছাপা হয়ে আছে নদীগুলো। খাল গুলো। বিলগুলো। বাড়ির মধ্যে চারিদিকে থই থই করছে জল। কোনটা পুকুর আর কোনটা উঠোন তা ঠাহর করা বেশ মুশকিল হচ্ছে। হামেশাই শোনা যাচ্ছে গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর খবর। এদিকে যাকে বিয়ে করে এনেছেন বিশ্বম্ভর সে এক্কেবারে শহুরে মেয়ে। খাস নবদ্বীপের। সেই মেয়ে এই অজ গাঁয়ের চারিদিকে জল, সাপে কাটা এইসব দেখে প্রথম দিনই তো পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে। তার বাবা যে তার সাথে এই অবিচার করবেন কোনোদিন সে ভাবতে পারেনি। ভালো পাত্রের কি আকাল পড়েছিল জ্যোৎস্নাময়ীর জন্যে? কত কত সম্বন্ধ এসেছিল বর্ধমান, রাজশাহী, হাতিমপুর থেকে। ময়মনসিংহের এক জমিদারও এসেছিলেন। বাবা বুড়ো মানুষের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে সেই সম্বন্ধও নাকচ হলো। শেষকালে মেয়েকে গৌরীদান করবেন নাকি? যারা আসে তারা নাকচ হয়। এদিকে সম্মা রাগে শুধু ফুলে ফুলে ওঠে। তারই বয়সী এক মেয়ে বাড়িতে থাকবে ঘাড়ের ওপর? তাও কি কখনও সহ্য করা যায়? এখন চুপ করে আছে, পরে এই মেয়ে যে ফোঁস করবে না তা কে বলতে পারে? জ্যোৎস্নাময়ী থাকতো দোতলায় তার মায়ের দিকে। আর নতুন মা তার দাস-দাসী নিয়ে এক তলায়। ওপর নীচ করায় বাবার অসুবিধে হতো। হাঁপের টান ধরতো। হাঁপাতে হাঁপাতে জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা তার মেয়ের বয়সী নতুন বউকে বোঝাতেন “ওই তো বয়েস মেয়েটার। ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিই কী করে? আর দিলেও সুপাত্রের হাতে দিতে হবে তো?” বুড়ো স্বামীর এই দ্বিচারিতা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল নতুন মাকে। মুখঝামটা দিতো যখন তখন। “মেয়েকে বিয়ে দেবেন না দোজবুড়োর সাথে অথচ নিজে বিয়ে করে এনেছেন মেয়ের বয়সী একটাকে। তা আমাকে মানুষ হিসেবে ঠাওরান? নাকি জন্তু জানোয়ার জ্ঞান করেন? রাতের সোহাগ দেখলে তো আর বাঁচতেও ইচ্ছে করে না।” চিল চিৎকারে কাক বসে না বাড়িতে। হাঁপানির টান বাড়ে জ্যোৎস্নাময়ীর বাবার। বুকে কর্পূর তেল মালিশ করে দেয় দাসী। ওপর থেকে সবই লক্ষ্য রাখে জ্যোৎস্নাময়ী। কিন্তু রাটি কাটে না সে মুখে। এক দিকে চুপ করে থাকে নিজের মতো করে। তার মা বড় শান্ত ছিল। লক্ষ্মী প্রতিমা যেন। বাড়িতে জোরে কথা বলতে পারতো না কেউ। আর অপমান বা হিংসে করা ছিল ভাবনারও অতীত। বাড়ির দরজায় এসে কেউ খালি হাতে ফিরছে কল্পনাই করতে পারতো না। সাধু সন্ত থেকে গরীব দুঃখী ভিখারি সবাইকে নিজে থেকে বসিয়ে খাওয়াতেন। দান ধ্যানে তিনি ছিলেন দরাজ হস্ত। বাড়িতে সারাক্ষণ একটা সুশ্রী ভাব বিরাজ করতো। এমন মা দুদিনের জ্বরে সেই যে চোখ বুজলেন আর খুললেন না। জ্যোৎস্নাময়ীকে এক্কেবারে একা করে দিয়ে চলে গেলেন। শোকাতুর বাবা খুব ধুমধাম করে মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি মিটিয়ে এবার বিয়ে করে আনলেন এমন একটা মেয়েকে যার চিৎকারে বাড়িতে কাক পক্ষী পর্যন্ত বসে না। সৎ মা আর মেয়ের মুখ দেখাদেখিও হয় না। জ্যোৎস্নাময়ী এমন ছোটো মনের মানুষদের সাথে মুখোমুখি ঝগড়া দূরে থাক কথা পর্যন্ত বলেন না। তাঁর হয়ে চিৎকার করে দাসী। সৎ মা এবং মেয়ের এই বাক বিতণ্ডার খবর নবদ্বীপ অঞ্চলের কেউ জানে না তেমন নয়। “মেরেছ কলসীর কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না” গাইতে এসে বোষ্টমী পর্যন্ত দু পক্ষের মুখের ভাষা শুনে মূৰ্ছা যায়। বাবারই তখন অবস্থা হয় সঙ্গীন। এই অশান্তির আগুন কীভাবে তিনি নেভাবেন, তার হদিশ যেন আর পান না। এই ভাবেই শাঁখের করাতের মতো যখন দিন কাটছিলো তাঁর ঠিক সেই সময়ে শহরে কলেরার জন্য ভলেন্টিয়ার হয়ে এলো একদল যুবক কলকাতা থেকে। তারা গান্ধিজীর স্বদেশী ভাবনায় অনুপ্রাণিত। বিবেকানন্দের সেবা তাদের বুকে। রবীন্দ্রগানের কলি তাদের লজ। একদল উঠতি যুবকদের মধ্যে যে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তাকে হঠাৎই খুব পছন্দ হয়ে গেল জ্যোৎস্নাময়ীর বাবার। বেশ গোল গোল চোখ। চওড়া ছাতি। বুকের পাটা আছে বলেই না কলেরা রোগী দেখতে আসে। তিন কুলে একমাত্র খুলনায় পিতা ছাড়া আর কেউ নেই। ঝাড়া ঝাঁপটা হাত পা। কথায় বার্তায় নম্র, শান্ত, সদালাপী। সর্বোপরি কর্মঠ। এমন একটা ছেলেকেই যেন মনে মনে খুঁজছিলেন তিনি। দেরি করলেন না জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা। কথা চললো তাড়াতাড়ি খুলনা আর নবদ্বীপের মধ্যে। পাকা কথা হয়ে গেলে আশ্বাস দিলেন বাবা মেয়েকে। “ভয় পাস না মা। এই জামাই আমার সোনার জামাই হবে দেখে নিস। কলকাতায় কত বড় একটা মেসে থাকে। কালীঘাটের মায়ের মন্দির তো পায়ে হাঁটা। দেখবি তোকে নিয়ে গিয়ে কেমন ট্রাম লাইনের পাশের বাড়িতে রাখে”। 

জ্যোৎস্নাময়ী কোনোদিন ট্রাম দেখেনি। শুনেছে দুটো লিকলিকে লাইনের ওপর দিয়ে সেই ট্রাম কলকাতা শহরে চক্কর মারে। সাহেব সুবোরা সেই ট্রামে ওঠে। যে যার জায়গায় চলে যায়। ঠুং ঠুং করে কাঁচের চুড়ির মতো আওয়াজ হয় ট্রামে। জ্যোৎস্নাময়ী তো সেই ট্রাম লাইনের পাশের বাড়িতে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল। এদিকে তার বিয়ে হয়ে গেল বেশ ঘটা করে বোশেখের কোনো এক শুভ দিনে। ফুলশয্যার খাটে শুতে এসে জানতে পারল বিশ্বম্ভরের পরিকল্পনা। বিয়ে করে সে আপাতত বউকে রেখে যাচ্ছে বাপের বাড়ি। এই কদিন জ্যোৎস্নাময়ী একটু মানিয়ে গুছিয়ে এখানে থাকুক। কারণ মাত্র কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় যাওয়া মানে বিস্তর খরচ। একেই নতুন বউ তার ওপরে বাড়ি ভাড়া করা, সংসার নতুন করে পাতানো খুবই ঝামেলার হবে। আর তো এক মাসের মধ্যে কলকাতার পাট চুকিয়ে বিশ্বম্ভর চলে যাবে খুলনা। সেখানে তার বাবা মৃত্যু শয্যায়। ছেলেকে পাশে পেলে তিনি খুশি হবেন। ছেলের বউয়ের সেবা পাবেন। এগুলোর সাথে বাড়ির জমি জায়গাও দেখা শোনা করা যাবে। আর ডাক্তারি প্র্যাকটিসটা ঠিক ভাবে চালালে তো আর কথাই নেই, পিল পিল করে লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়াবে দরজার সামনে। যদিও কোনো দিন তেমন রোগীর ভিড় হয়নি বিশ্বম্ভরের। তবে স্বদেশী করা এক ডাক্তারকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি আশেপাশের গাঁয়ের মানুষদের। যতটা না আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ডাক্তারি করতেন বিশ্বম্ভর, তার থেকে বেশি সাহায্য হতো গরিবগুর্বো মানুষগুলোর। কিন্তু সেসব তো আরও পরের কথা। আপাতত তার সামনে যে নতুন বউটি বসে আছে। একবারের অনুরোধেই খুলে ফেলেছে মাথার ঘোমটা। সেই মেয়েটা কী ভাবছে বোঝার চেষ্টা করছে। বিশ্বম্ভর। যদিও সে দেখতে পাচ্ছে এই মুহূর্তে মেয়েটির টানা দুটো চোখ ভরে উঠেছে জলে। আর ভরবে নাই বা কেন? খুলনা জায়গাটা কেমন তার আগে ঠিক ধারণা ছিল না জ্যোৎস্নাময়ীর। ততদিনে তো সে একটা পাকাঁপোক্ত স্বপ্ন দেখে রেখেছে ট্রাম লাইনের পাশে বাসার। খোলা ছাদে রান্নাঘর। একটু দূরে কালীঘাটের মায়ের মন্দির। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের মুখ দর্শন। পালা পাব্বনে গঙ্গায় স্নান। রথের মেলা। চড়কে জেলে পাড়ার সঙ। মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে জ্যোৎস্নাময়ীর। কাজেই ফুলশয্যায় স্বামীর গায়ের ঘেমো গন্ধের সাথে খাটের রজনীগন্ধা কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে। মাঝরাতে দোর খুলে মেয়ে গিয়ে শোয় তার পুতুল খেলার ঘরে। নিজের মা থাকলে এমনটি কক্ষনও করতো না। দিতো অমন ছেলের মুখে নুড়ো জ্বেলে। বিয়ের আগে এক কথা। বিয়ের পরে অন্য? মা মরা মেয়ে বলে তার কোনো দাম নেই গো? কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল জ্যোৎস্নাময়ী। ভোর রাতে গা শিরশির করে উঠলে দেখেছিল ওই অত বড় পুরুষমানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে পুতুল ঘরে। কখন উঠে এসেছে খাট থেকে জানেও না সে। ভোরের আলো এসে পড়েছে বিশ্বম্ভরের মুখে। কী সুন্দর লাগছে! জ্যোৎস্নাময়ীর খুব ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ভালোবাসতে। হালকা আলোয় ঠোঁটের ওপর, চোখের পাতায় চুমু খেতে। জ্যোৎস্নাময়ী পারেনি। তখনও মনের মধ্যে কলকাতায় না থাকতে পারার শোক উথাল পাথাল করছিল। 

বিশ্বম্ভরের বাবা মারা গেলেন বিয়ের কিছু কালের মধ্যে। ছেলে শ্রাদ্ধ শান্তি করলো বউকে ছাড়াই। জেদ করে থাকলো জ্যোৎস্নাময়ী নবদ্বীপে। একটা চিঠি পাঠালেই তাকে যেতে হবে নাকি? স্বামী হয়েছে তাহলে কীসের জন্য? নিজে এসে নিয়ে যেতে পারে না? জ্যোৎস্নময়ী বাড়িতেই তার না দেখা শ্বশুরের জন্য অশৌচ পালন করলো। ঘাটের দিন নখ কাটলো বাড়ির মধ্যে পাঁচিল ঘেরা পুকুর পাড়ে বসে। পুরোহিত এসে জল দেওয়ালো শ্বশুরকে। ব্রাহ্মণ খেলো। নিয়মভঙ্গের দিন অশৌচ কাটাতে জলঙ্গীতে গেলো বাড়ির পালকি জ্যোৎস্নাময়ীকে স্নান করাতে। বর্ষার জলঙ্গী তখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। পালকি শুন্ধু জ্যোৎস্নময়ীকে জলে চোবানো হলো। এমন শীতল জলে এর আগে কোনোদিন সে স্নান করেনি। আর এইভাবে পালকির ঘেরাটোপের মধ্যেও না। তার যেন মনে হলো জলঙ্গীর জলরাশির প্রবল চাপে এক অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে পালকিটা। চোখ খোলার চেষ্টা করলো জ্যোৎস্নাময়ী। আর ঠিক তখনই যেন সে দেখতে পেল বিশ্বম্ভরের শান্ত মুখটা। শিরশির করে উঠলো গা জ্যোৎস্নাময়ীর। এমন শিরশির করেছিল সেই ভোর রাতেও। যখন দুটো শক্ত হাত তাকে পরম মমতায়, ভালোবাসায় জড়িয়ে শুয়েছিল পুতুল ঘরে। একটা দেহের ওম যেন আরও একটা দেহ স্পর্শ করছিল। ঘাড়ের কাছে ঘন নিশ্বাসের হলকা লাগছিল যেন জ্যোৎস্নাময়ীর। এইসব সাত পাঁচ ভাবছেন যখন তিনি ঠিক সেই সময়ে সারা গা বেয়ে যেন কীসব উঠতে থাকে। চিড়বিড় করতে থাকে তারা গোটা গা জুড়ে। মনে হয় কারা যেন আঙুল বোলাচ্ছে তার গায়ে। প্রচণ্ড ভয়ে পালকির ভেতরের অন্ধকারে জলের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে যেন তার। চিৎকার করে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। পালকির বেহারারা বুঝতে পারে পুণ্যস্নান হয়েছে বটে মেয়ের। তারা আবার ডাক ছাড়তে ছাড়তে ঘাট পেরোয়, মাঠ পেরোয়। আর এদিকে দিনের আলোতে জ্যোৎস্নাময়ী দেখে তার পালকির মেঝেতে, কাপড়ের কোঁচড়ে, শাড়ির আঁচলে জাপটে জড়িয়ে আছে চিংড়ি মাছের ঝাঁক। কোনোটা নড়ছে। কোনোটা অল্প জলেই পালকির কাঠের মেঝেতে খাবি খাচ্ছে। ভয়টা কেটে যাচ্ছে জ্যোৎস্নাময়ীর। তাহলে এরাই এতক্ষণ গায়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চিড়বিড় করছিল? কী যেন এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠছে তার। কুড়িয়ে বাড়িয়ে আঁচল ভর্তি করছে সে। একটাও চিংড়িও যেন নষ্ট না হয়। 

বাড়ি ফিরে দাসীর হাতে আঁচল ভরা চিংড়ি দিয়ে জ্যোৎস্নাময়ী হুকুম দেয়, “দোতলায় মায়ের আমিষের রান্নাঘরটার দোর খোল। পরিষ্কার কর। আমি রান্না করবো”। দাসী যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে কী মেয়েটা! আজ শ্বশুরের তেল ছোঁওয়ানি। বাইরে থেকে বামুনরা এসে বসে আছে। মেয়ে পায়ে তেল চুঁইয়ে গেছে জলঙ্গীতে ডুব দিতে। ফিরে এসে পাতে তুলে দেবে ইলিশ মাছ ভাপা। গরম ভাত। মাছের ডিমের বড়া। এই যে এত রান্না করলো ঠাকুর। বিরক্ত হয় জ্যোৎস্নাময়ী। “উনুনটা নিকো দেখি। আমি চট করে কাপড়টা ছেড়ে আসি”। দাসীর মুখে আর কথা সরে না। যে মেয়ে খায় না দায় না বাড়ির কারো সাথে কথাটি ঠিক করে বলে না সেই মেয়ে উনুন নিকানোর কথা বলছে কেন? আঁচল ভর্তি চিংড়ি মাছও বা কোথায় পেলো? দাসী সময় নষ্ট করে না। রান্নাঘর পরিষ্কার করে। উনুন ধরিয়ে বসে থাকে। জ্যোৎস্নাময়ী নতুন একটা তাঁতের শাড়ি ভেঙে, আলতা পরে, কপালে সিঁদুর দিয়ে রান্না ঘরে ঢোকে। দাসীর মনে হয় যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা এসে ঢুকলেন রান্নাঘরে। তার যেন গড় হয়ে পেন্নাম করতে ইচ্ছে হলো। 

এই রান্নাঘর ব্যবহার হয় না মোটেই। জ্যোৎস্নাময়ীর মায়ের রান্নাঘর। মা মারা যাবার পর এই রান্নাঘরের পাট উঠছে বাড়িতে নতুন মা আসার পর থেকে। তাও সেটা অনেক দিন তো হলোই। তাই জিনিসপত্র বাড়ন্ত। এই অবেলায় কোথায় বা আর কিছু খুঁজতে যাবে সে? চট করে তাকিয়ে নেয় চারপাশটা। কী আছে আর কী নেই এর হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে যায় নিজের কাছে। দাসী সেই কচি চিংড়িগুলোতে ততক্ষণে মাখিয়ে রেখেছে নুন, হলুদ। জ্যোৎস্নাময়ী লোহার কড়াই উনুনের আঁচে বসায়। অল্প তেলে চিংড়িগুলোকে ছেড়ে দেয়। একটু নেড়ে চেড়ে কাঁচা লঙ্কা আর কালো জিরের ফোড়ন দিয়ে জল ঢালে। জলঙ্গীর কচি চিংড়ির গা থেকে বেরোতে থাকে মিষ্টি জলের রস। গোটা বাড়ি কালো জিরের ফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা আর হলুদের সুবাসে ভরে যায়। জ্যোৎস্নাময়ীর বাবা ব্রাহ্মণ বিদায় দিয়ে সবে ছোটোপক্ষের রান্নাঘরের পিঁড়েতে বসতে যাচ্ছিলেন দুপুরের আহার সারতে। কিন্তু তা আর হলো না। পঞ্চ দেবতাকে স্মরণ করে প্রথম গ্রাস মুখে তোলার আগেই উঠে এলেন দোতলায় অনেক দিনের বন্ধ রান্নাঘরের সামনে। জ্যোৎস্নাময়ী আন্দাজ করেছিল এমনটাই হবে। আসন পেতে জলের গ্লাস নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেদিন তার বাবা, মায়ের রান্নাঘরে কতদিন পরে খেতে বসলো। মনে পড়লো বড় বউয়ের কথা। তার হাতে 

চিংড়ির হলুদ গালা ঝোলের সুবাস। হাপুস হুপুস করে বাবা ভাত খায়। ঝোলের কাঁচা লঙ্কা ডলে। চোখ দিয়ে জল পড়ে তার। সেটা বড় বউয়ের স্মৃতিতে নাকি অনেক দিন পরে পুরোনো রান্না খাওয়ার আনন্দে বোঝা যায় না ঠিক। খাওয়া শেষ হলে পান এগিয়ে দেয় জ্যোৎস্নাময়ী। বাবা মেয়েকে আশীর্বাদ করেন। “কী চাস মা? একবার মুখ ফুটে বল”। সারা বাড়ি কানাকানি হয়। এই বুঝি মেয়ে তার নিজের নামে সব সম্পত্তি চেয়ে নিল। খাওয়া ছেড়ে অন্দরের দোরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে ছোটো মা ভয়ে ভয়ে। জ্যোৎস্নাময়ী অস্কুটে তার বাবাকে বলে, “একবার চিঠি লিখুন কলাপোতায়। তিনি যেন আমাকে এসে নিয়ে যান”। কথাগুলো বলেই জ্যোৎস্নাময়ী লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় ঝোলের চিংড়িগুলোর মতোই। মেয়ে বাড়ি লিখিয়ে নিলো না। জমি জমা সম্পত্তি কিছুটা না। এমনকি শখের পুতুলগুলোও না। শুধু গরুর গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে গেলো মায়ের রান্নাঘর। ডেয়য়া, ঢাকনা, খুন্তি। আর সেই আমিষের বড় লোহার কড়াইটা। বিশ্বম্ভর বাধা দেয়নি। সে জানতো নতুন সংসার করতে তার সবটাই লাগবে। কোনো কিছুই ফেলা যাবে না। 

“এই এত কলমী শাক কী হবে দিদা?” সকালের চড়া রোদে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে কিংশুক। “কলমী ভাজা। কলমী শুক্ত। কলমী চাটনী?” ফিরে তাকান ইন্দুবালা। “একদম শাক তরি-তরকারি না খেয়ে তোদের বুদ্ধির এই অবস্থা হয়েছে। আর শরীরগুলো তো লিকলিকে ঢ্যাঙা গাছ। করে দেবোখন রান্না। একটু কাসুন্দি দিয়ে খাস। দুবারের বেশি চেয়ে খেতে হবে তখন”। ইন্দুবালা এগিয়ে যান তড়বড় করে মাছের বাজারটার দিকে। “এই যে ঘনা… ওই চিংড়ি গুলো কি তোর বিক্রি হয়ে গেছে?” ঘনা অনেক দিন পরে দেখলো ইন্দুবালাকে। “সেকি গো মা তুমি আজ বাজারে? ধনাদার কী হলো আজ?” ইন্দুবালা চিংড়িগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বলেন “কিচ্ছু হয়নি তার। কী আবার হবে? কেন আমি এসেছি ভালো লাগছে না তোর?” ঘনা চা আনতে পাঠায়। “নিয়ে যাও মা সবটা। ভেড়ির নয়কো”। ইন্দুবালা চেনে। কোনটা ভেড়ির চিংড়ি। আর কোনটা নদীর। সক্কাল বেলা একটা বড় গামছা নিয়ে ভাই বোনে চুপি চুপি চলে যেতেন কপোতাক্ষের ঘাটে। ততক্ষণে জড়ো হয়েছে গ্রামের অন্যসব ছেলে মেয়েরাও। ওদিকে আকাশ আসছে কালো হয়ে। ফুঁসে ফুঁসে উঠছে সেই কবেকার দাঁড়াও পথিকবরের নদ। গামছা জলে ফেললেই উঠছে ঝাঁকের চিংড়িগুলো। হাতে করে একটা জ্যান্ত চিংড়ি তুলে মুখের সামনে ধরেন কিংশুকের। “কেমন এখনও নড়ছে দেখেছিস?” কিংশুক ভয়ে দুপা পিছিয়ে আসে। এমনিতে সে বড় পেটুক। খাবার পেলে আর কিছু চায় না। কিন্তু এইসব শাক সবজি মাছ সে বরাবর দেখে এসেছে মরা। জ্যান্ত জিনিস যে এমন হতে পারে সেই অভিজ্ঞতা তার এই ছাত্র জীবনের বাইরে। “এই ছোটো চিংড়ি দিয়ে বুঝি মালাইকারি হবে?” ইন্দুবালা বলেন, “তোর মুণ্ডু। কেমন হলুদ গালা ঝোল করে দেবো দেখিস”। কিংশুক মাথা নাড়ে। “ঠিক হচ্ছে না কিন্তু দিদা। বোর্ডে এইসবের কথা লেখা ছিল না মোটেই”। ইন্দুবালা বলেন, “কেন মাছের কথা লেখা ছিল। এই তো হয়ে গেল। চিংড়ি মাছ নিলাম”। কিংশুক মাথা চুলকোয়। “চিংড়ি আবার মাছ কোথায়? বইতে লেখা আছে ওগুলো জলের পোকা”। অনেক দিন পরে যেন ইন্দুবালা একটু হা হা করে হাসেন। বাজারের লোজন পাশে জড়ো হয়। “কী হয়েছে মা হাসো কেন?” ইন্দুবালা মাথা নাড়েন। “কিচ্ছু না। তোমরা তাড়াতাড়ি খেতে এসো সবাই”। ফেরার পথে একবার ইন্দুবালা দাঁড়িয়েছিলেন কাশী মুদির দোকানে কালো জিরে কিনতে। বোর্ডটা কিংশুককে দিয়ে মুছিয়ে লেখালেন ভাত, কলমী শাক, চিংড়িমাছের হলুদ গালা ঝোল, বেগুনের টক। অনেক দিন পর বাজার করে এসে প্রসন্ন চিত্তে স্নান করতে গেলেন ইন্দুবালা কর্পোরেশানের তোলা জলে। গায়ে জল পড়তেই পুকুরের ভাবনাটা আবার মাথায় চাগাড় দিতে শুরু করলো। বাড়ির পেছনের বাগানটার সাথে এই বাড়িতেও যদি একটা পুকুর থাকতো? কী ভালো হতো, তাই না? এই একটা ব্যাপার শাশুড়িকে বলার পর মুখ ঝামটা খেতে হয়নি। বাড়ির সেই সময়কার আত্মীয়রা মশকরা করতে এলে শাশুড়ি মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, “ঠিকই তো বলেছে বউ পুকুর থাকলে কত সুবিধে হতো বল দেখি। নিজের জল বলেও তো কিছু একটা থাকতো। তা ও বউ তোমাদের গ্রামের বাড়িতে কি পুকুর আছে?” উত্তর দিতে পারতেন না ইন্দুবালা। তিনি জানেন নেই বললেই তার শাশুড়ি মস্করা করতে ছাড়বেন না। আর মিথ্যে কথাও এই বুড়ো মানুষটাকে বলা যায় না। সন্ধ্যে দেবার অছিলায় উঠে পড়তেন তিনি। কথা আর এগিয়ে যাওয়ার পথ পেতো না। 

জ্যোৎস্নাময়ীর কোনো ছবি ইন্দুবালা দেখেননি। একমাত্র ফ্রেমে বাঁধানো উঁইয়ে কাটা আলতা রাঙানো পায়ের দুটো ছাপ ছাড়া। ঠাম্মা সেখানেই চন্দন দিতো। সন্ধ্যে দেখাতো। তার শাশুড়ি শিখিয়ে দিয়েছিল নাকি এইসব। আর মাঝে মাঝে সেই লোহার কড়াই সিন্দুক থেকে বেরোলে গল্প হতো জ্যোৎস্নাময়ীর। “কই রে ইন্দু, নিয়ে আয় হলুদের কৌটোটা”। ঠাম্মা হাঁক পাড়ে। বেলা যে অনেক হলো। ভাইকে পাঠায় পাশে ভবেশদের বাড়িতে কাঁচা লঙ্কা আনতে। ইন্দুবালারা গামছা দিয়ে যে চিংড়ি ধরেছে সেগুলো দিয়ে আজ ঠাম্মা রান্না করছে চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল। “কিন্তু এই গল্পের সাথে বাড়িতে পুকুর না থাকার কী সম্পর্ক?” প্রশ্ন করেন ইন্দুবালা। “দাও দেখি আমি একটু নাড়ি ঝোলটাকে”। ইন্দুবালা ঠাম্মার হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে নাড়তে থাকে এদিক থেকে ওদিকে। চিংড়িগুলো সেই হলুদ ছোপা ঝোলে কেমন যেন ডুব সাঁতার দিতে দিতে ভেসে ওঠে। ওই দেখো না সন্ধ্যারা কী সুন্দর বাড়ির পুকুরেই জারিয়ে রাখে মশারির জালে চিংড়িগুলো। মনিরুল তো আরও বুদ্ধি করে পাটকাঠি দিয়ে সরজাল করে। অল্প অল্প করে পুকুরের মধ্যেই জমায় মাছগুলো। তারপর একদিন চিংড়ি খাওয়ার মোচ্ছব হয়। আর তুমি কিনা মাটির হাঁড়িতে জারিয়ে রাখতে বলো চিংড়িগুলোকে। ওইটুকু হাঁড়িতে আর কতটুকুই বা ধরে?” 

একদম ভালো লাগে না ইন্দুবালার। বোসদের মতো যদি তাদেরও একটা পুকুর থাকতো। নয়তো বুনুদের মতো অন্তত একটা ডোবা। কী মজাই হতো তাহলে! টগবগ করে ফুটতে থাকা ঝোলে আরও দুটো লংকা দিয়ে ঢাকনা দেয় ঠাম্মা। পুকুর নেই বলে তার নাতনির বড় দুঃখ। তারও যে ছিল না তেমনটা তো নয়। পুকুর হলো গেরস্থের লক্ষ্মী। মাছটা শাকটা জলটা তা থেকে যেমন পাওয়া যায় ঠিক তেমনি কাজে লাগে চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠালপাতায় সিন্নি ভাসাতে। ইতু পুজোয় ঘট বিসর্জন দিতে। বাস্তু পুজোয় জল পুজো করতে। বিয়েতে জল সইতে একটা নিজের পুকুর থাকবে না তাও কী হয়? কিন্তু ওই যে অদৃষ্ট। “যাও তোমার কাছে আর কোনো গল্প শুনবো না”। চিৎকার করে ইন্দুবালা। তার ভাইও ঠাম্মার আঁচল ধরে বলে, “দিদি কাঁদছে ঠাম্মা। বলো না পুকুরের গল্পটা”। 

জ্যোৎস্নাময়ীও কাঁদতো সারাক্ষণ। এই নদী নালার দেশে বর্ষাকালে সংসার পাততে এসে চোখের জলে নাকের জলে হচ্ছিল সে। নবদ্বীপে ছিল বাবার পাকা বাড়ি। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। আর খুলনার অজ গাঁ কলাপোতাতে শ্বশুরের মাটির বাড়ি। মাটির দাওয়া। উঠোন ভর্তি পাশের বাড়ির পুকুরের জল। সাপে কামড়ানোর সব ভয়ানক গল্প। লক্ষ জেলে কোনোরকমে রান্না করে জ্যোৎস্নাময়ী। সন্ধ্যে হতে না হতেই বেড়ার দিকে উঠোনের শেষভাগে কাদের যেন চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। “ওরা কি সব ভূত, প্রেত অশরীরী? পাশের বাড়ির বিধবা বউ রাধারানী এসে বলে যায়, “মোটেই না ওগুলো সব শেয়াল। সন্ধ্যে হতেই খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। সাবধানে থেকো বউ, ওরা পারলে মানুষ তুলে নিয়ে যায়”। আঁতকে ওঠেন জ্যোৎস্নাময়ী। বিশ্বম্ভর অনেক রাতে রোগী দেখে একা একা বাড়ি ফেরে। তার যদি কিছু হয়ে যায়? শেয়ালে যদি ধরে? সাপে যদি ছোবল মারে! চিন্তায় চিন্তায় কেমন যেন শুকিয়ে যেতে থাকে জ্যোৎস্নাময়ী। এইদিকে বর্ষা গিয়ে শরৎ আসে। শরৎ গিয়ে হেমন্ত। শরীর ঠিক হয় না তার। গাঁয়ের লোক বলে হাওয়া লেগেছে বউয়ের। পীরের কাছে যাও। বিশালাক্ষ্মী তলায় মাঝে মাঝে আসে কত পীর। কত সাধু সন্ন্যাসী। এদের একটুও বিশ্বাস করে না বিশ্বম্ভর। যত বুজরুকি। কিন্তু জ্যোৎস্নাময়ীর মন চায় একবার অন্তত যাক সে। এতদিনে পেটেও তো এলো না কোনো সন্তান। কেন? কোন কারণে? এর মধ্যে গ্রামে এলো এক জল বাবা। কতশত পাহাড় ডিঙিয়ে। অনেক মন্ত্র তন্ত্র পড়ে। সে নাকি জলে মুখের ছায়া দেখে সব বলে দিতে পারে। রাধারানীই দিলো খবরটা জ্যোৎস্নাময়ীকে। তাজ্জব সব কথা বলে নাকি লোকটা। দরকার পড়লে বাঘে গরুতেও এক ঘাটে জল খাওয়াতে পারে। একদিন বিশ্বম্ভর যখন সদরে গেছে ওষুধ কিনতে জ্যোৎস্নাময়ী পাশের বাড়ির রাধারানীর সাথে বেরিয়ে পড়লো। বিশালাক্ষ্মী তলায় সেদিন ভিড় ছিল কম। বেদীর ওপর বসে এক ভিন দেশের সাধু। তিনি অনেকক্ষণ ধরে জ্যোৎস্নাময়ীকে দেখলেন। পেতলের সরার মধ্যে জল নিয়ে এগিয়ে পিছিয়ে মুখাবয়ব দেখলেন। আর তাকে চমকে দিয়ে নানা রকমের কথা বলতে শুরু করলেন। যেমন তার মায়ের মৃত্যুর আগের দিন পুকুর পাড়ে নারকেল গাছে বাজ পড়েছিল। জ্বলে গিয়েছিল গাছটা। দিনটা ছিল সোমবার। এটা একমাত্র জ্যোৎস্নাময়ী ছাড়া এই গ্রামের কারও জানার কথা নয়। এমনকি রাধারানীকেও সে কোনোদিন গল্প করেনি। সাধু ভুরু নাচিয়ে বলে, “নদীতে স্নান করার সময় গায়ে উঠেছিল চিংড়ি”। আঁতকে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। সব সত্যি যে! সাধু জানতে চায়, “বল কী দিবি? নিদান বলে দেবো। সব বিপদ কেটে যাবে”। জ্যোৎস্নাময়ী হাতের বালা খুলে দিয়েছিল। সাধু খুশি হয়ে বলেছিল “তোর বাড়ির চারপাশে 

ঘুরে বেড়াচ্ছে উপছায়া। পাপ। বাড়িতে একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার কর যাতে অন্য নতুন প্রাণ আসতে পারে”। এই নতুন প্রাণটা কী হতে পারে সেটা বুঝতে পারে না জ্যোৎস্নাময়ী। স্বামীকে বলা যায় না। যদি শোনেন সাধু সন্তের কাছে যেতে শুরু করেছে তার বউ তাহলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। রাধারানী একদিন দুপুরে পান খেতে এসে বুদ্ধি দেয়। “যদি বউ বাড়িতে একটা নতুন ডোবা করিস। সেটাও তো একটা নতুন কিছু করা হয়। জল তো প্রাণ তাই না?” বুদ্ধিটা ফেলতে পারে না জ্যোৎস্নাময়ী। স্বামীকে বলে। অন্যের পুকুরে যেতে তার বড় সমস্যা। কেমন লজ্জা লজ্জা করে। নিজের বাড়িতে যদি একটা পুকুর থাকতো। নিদেনপক্ষে একটা ডোবা। বিশ্বম্ভর রাজি হয়ে যায়। তারও অনেক দিনের শখ নিজের বাড়িতে একটা পুকুরের। জলাশয় শুভর প্রতীক। কল্যাণকর। পুকুর কাটানোর দিনক্ষণ দেখা হয়। সে মহা ঝক্কির ব্যাপার। এতসব জানতো না জ্যোৎস্নাময়ী। ভূমিকে পুজো করে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ নিয়ে প্রথম মাটি কাটা হয়। এক দিনেই অনেকটা মাটি গোল করে কেটে ফেলে লোকজন। বাড়ির চারপাশটা যেন মেলার মতো মনে হয়। কত লোক দেখতে আসে পুকুর কাটা। সেদিন হঠাৎ রাতে বৃষ্টি নামে। কড়কড় করে বাজ পড়ে। আর সে কী ঝড়! অনেক ভোরে জ্যোৎস্নাময়ীর ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখে বিশ্বম্ভর অকাতরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ যেন তার মনে হয় জলের কল কল আওয়াজ। প্রথম দিনের পুকুর কাটাতেই জল ভর্তি হয়ে গেল নাকি? জল দেখতে উঠে পড়ে জ্যোৎস্নাময়ী। আধ খোঁড়া পুকুরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। কোথায় জল? শুকনো খটখটে মাটি। আর সেই হাঁ করা বিশাল মাটির গর্তে পড়ে আছে সাদা থান পড়া পাশের বাড়ির বিধবা বউ রাধারানী। যার মুখের এক দিকটা খুবলে নিয়ে গেছে শেয়াল। বাতাস ভারী হতে থাকে। ফিসফিস করে যেন কারা কথা বলে চারপাশে। পেছন ফিরতেই জ্যোৎস্নাময়ী দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কবেকার মরে যাওয়া তার মৃত মা। “জানতিস না খুকু মরার আগে যে একটুও জল পাইনি আমি” আঁতকে ওঠে জ্যোৎস্নাময়ী। চোখ মেলে দেখে ঘুমোচ্ছিল সে। পাশে বিশ্বম্ভর নেই। বীভৎস স্বপ্নের রেশ নিয়ে দালানে এসে বুঝতে পারে কাজ বন্ধ রেখেছে মাটি কাটাইয়ের লোকেরা। পাশের বাড়ি থেকে কান্নার সুর ভেসে আসছে। বিধবা রাধারানী হঠাৎই ভোরবেলায় মারা গেছে ভেদ বমিতে। পুকুর কাটানো বন্ধ করে দিল বিশ্বম্ভরের গাঁয়ের লোকজন। বাধা পড়েছে কাজে। মাটি কাটার লোকগুলোও ফিরে গেল। তারও অনেক পরে বাড়ির পুব দিকে বিশ্বম্ভর একটা 

কুয়ো খনন করেছিল। ততদিনে অবশ্য তার ছেলে মেয়েতে সংসার ভরে উঠেছে। এই গ্রামে সেই প্রথম কুয়ো। যে কুয়োতে ইন্দুবালার ভাই একটা কচ্ছপ পুষেছিল। নাম রেখেছিল কুমড়ো। ওপর থেকে মুড়ি দিলে কুমড়ো ভেসে উঠতো। ছোট্ট হাঁ করে জলে ভেজা মুড়িগুলো গিলে গিলে খেতো। ঠাম্মার কূর্ম অবতারের গল্প হয়তো মনে ছিল তার। সবাই আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আসে। বাবা, ইন্দু, ভাই। মাকেও খেতে বসে যেতে বলে ঠাম্মা। গরম ভাতের সাথে আজ যে শুধু চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল সেই কবেকার গল্প হয়ে যাওয়া জ্যোৎস্নাময়ীর লোহার কড়ায়।  লোহার কড়াই ইন্দুবালার হোটেলেও আছে। কিন্তু জ্যোৎস্নাময়ীর মায়ের কড়াইয়ের মতো নয়। তিনি যদি তার মায়ের সব বাসনগুলো নিয়ে আসতে পারেন তাহলে ইন্দুবালাই বা পারবেন না কেন? লছমী তার চোখ গোল্লা পাকিয়ে বলেছিল “হাঁ ঠিকই তো লিয়ে আসলি না কেন ওইগুলা?” ইন্দুবালা হাসেন। “তখন কী করে জানবো এই এত্ত বড় ভাতের হোটেল হবে আমার?” লছমী বলে “এক মাছওয়ালী বন্ধু হবে”। “তিন তিনটে ছেলে মেয়ে নিয়ে অকালে বিধবা হব? আর কখনও কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। এমনকি বাপের বাড়িও না”। থম মেরে বসে থাকেন ইন্দুবালা। কিন্তু আজ লছমীও বা কোথায়? তাঁর চারপাশে কেউ কোত্থাও নেই। আর যখনই মনে হয় কেউ নেই, তখন যেন আর শরীর চলে না ইন্দুবালার। কিন্তু ইন্দুবালার একজন ওপরওয়ালা আছেন। তিনি বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে বেড়ান। গরম তেলের ওপর কালো জিরের ফোড়ন পড়তেই চড়বড় করে ওঠেন। রান্নার নানা রকমের সুবাস পাঠিয়ে লোক জড়ো করেন। ইন্দুবালার তখন আর একা থাকা হয় না। কিংশুক হোস্টেল উজিয়ে ছেলে মেয়ের দলকে তো নিয়ে এসেছেই, চিংড়ি মাছের হলুদ গালা ঝোল খেতে সেই কতদূর থেকে ডাক্তার হোস্টেলের ছেলে-মেয়েগুলোও আজ এসেছে। তাদের মধ্যে কলমী শাক বিক্রি করা বউটাও আছে। কাসুন্দি দিয়ে কলমি শাক মাখার সময় ইন্দুবালা তার চোখে জল দেখেছেন। আহা ওরও পুকুরের শখ ছিল গো ঠিক ইন্দুবালার মতোই। ওর যেন একটা বড় পুকুর হয় এই মনস্কামনা করার সাথে সাথে মেঘ ডেকে উঠলো। মুষল ধারায় বৃষ্টি নামলো। রেডিওতে এক ছোকরা জকি দু কলি গান শুনিয়ে বললো অবশেষে বর্ষা নামলো শহরে। ইন্দুবালা বিকেলের উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজলেন। মনে হলো তাঁর সাথে যেন ভিজছে গ্রামের ভিটেখানাও। ভিজছে পুঁইয়ের মাচা, ডালিম গাছ, গন্ধরাজ লেবু, কালনার আতা, নারকেল গাছে জড়িয়ে ওঠা চুইঝাল। এখনও সেখানে জল থৈ থৈ করে কিনা কে জানে! গামছা দিয়ে কেউ কি আর চিংড়ি মাছ ধরে? তার হলুদ ঝোল হয়? বৃষ্টির জলে যেন ডুব দিতে থাকেন ইন্দুবালা অনবরত। মনে মনে প্রার্থনা করেন এই ডুবের যেন শেষ না হয় ঠাকুর, কোনো দিন শেষ না হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *