৪. আম তেল

৪. আম তেল 

বিয়ের পর সবুজ রঙের একটা ট্রেনে করে ইন্দুবালা যখন শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেছিলেন তখন তাঁর কাছে ইণ্ডিয়া দেশটা নতুন। খুলনার কলাপোতা গ্রামের বাড়ির উঠোনে নিভু নিভু আঁচের সামনে ঠাম্মা, বাবার কাছে শোনা গল্পের সাথে তার ঢের অমিল। এত বড় স্টেশন আগে কোনোদিন দেখেননি ইন্দুবালা। দেখবেনটাই বা কী করে? এই যে প্রথম ট্রেনে উঠলেন তিনি। নামলেনও। মাথার ওপর রাজপ্রাসাদের মতো ছাদ দেখলেন। এতবড় বাড়ি দেখলেন। এত লোক! সবাই যেন মাথা নীচু করে সামনের দিকে ছুটছে। কেউ কারো সাথে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে একটুও কথা বলছে না। কুশল বিনিময় করছে না। যে যার খেয়ালে আছে। সামান্য অসতর্ক হলে, চলাফেরার একটু এদিক ওদিক হলে সবাই বুঝি সবার গায়ে হুড়মুড়িয়ে পড়বে। তখন ইন্দুবালার জিনিসপত্রের কী হবে? নেই নেই করেও তো সঙ্গের জিনিস কম নয়। মা বারবার বলে দিয়েছিল “চোখ ছাড়া করবি না ইন্দু”..। ঠাম্মা বলে দিয়েছিল “আগলে রাখবি সব কিছু”..। যদিও অদৃষ্ট বড় নির্মম খেলা খেলেছিল ইন্দুবালার জীবন নিয়ে। কোনো কিছুই তিনি আগলে রাখতে পারেননি, একমাত্র এই ভাতের হোটেলটা ছাড়া। তবুও সব কিছুর ওপর বড় মায়া তাঁর। ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা ক্ষয়ে যাওয়া নারকেলের ঝাঁটা থেকে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি। কিছুতেই মন চায় না কোনো কিছু ফেলতে। সব কিছু বুড়ি জমিয়ে রাখেন নিজের করে। তাঁর উপচে পড়া স্মৃতির মতোই। 

মাঝে মাঝে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে যে গোল বাধে না তেমনটা নয়। বেশ ভালোই চিৎকার চেঁচামেচি হয়। ধনঞ্জয় তখন তোক ডেকে নিয়ে এসে রেগেমেগে কিলো হিসেবে বিক্রি করে সব কিছু। বুড়ি ঘুরঘুর করে চারপাশ। “ওরে মূর্খ তুই কী করে জানবি .. ঠাম্মা বলতো বাড়ির আগাছাটাও তো দরকারি। নাহলে হরিমতি খাবে কী? আর দুধ দেবেই বা কী করে?” ধনঞ্জয় কাঁই মাই করে ওঠে। “বারবার তোমার খুলনার কলাপোতার গল্প শুনিও না তো মা। এখানে তোমার কোথায় হরিমতি? পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি তোমার কাছে আগাছা? এই এত এত ঘিয়ের খালি শিশি? রঙ চটে যাওয়া টিনের বাক্স?” টান মেরে উঠোনে ফেলেছিল ধনঞ্জয়। কেমন যেন আর্তনাদ করে উঠেছিল সেই কতদিন আগের ফুলছাপ তোরঙ্গটা। ডালাটা হাঁ করে খুলে পড়েছিল উঠোনে। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের মতো। তার মুখ দিয়ে কিলবিল করে বেরোচ্ছিল আরশোলা। তারাও যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুলনার কলাপোতার স্বপ্ন নিয়ে বংশ বিস্তার করে চলেছে। “এটা তুই কী করলি ধনঞ্জয়? আমার এত দিনের জিনিসটা তোর কাছে পুরোনো মনে হলো?” ইন্দুবালা এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে তোরঙ্গটার দিকে। ধূসর হয়ে যাওয়া সবুজ রঙের ওপর লাল লাল ফুল। সেগুলোও কেমন যেন ঝরে পড়ার আগে তাকিয়ে আছে ইন্দুবালার দিকে। “আমার বিয়ের সময় বাবা কিনেছিলেন ঢাকা থেকে। তারপর তিনটে নদী পার করে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনা। সেখান থেকে এই কলকাতা।” ধনঞ্জয় ক্ষয়ে যাওয়া নারকেল ঝাঁটায় আরশোলা মারতে মারতে বলে “তাহলেই বুঝে দেখো আর ওর জেবন প্ৰেদীপ থাকতে পারে? নিবে গেছে গিয়ে কবে।” ছ্যাঁৎ করে বুকে বাজে যেন ধনঞ্জয়ের কথা। তোরঙ্গের জীবন প্রদীপ নিভতে পারে তাহলে ইন্দুবালার নয় কেন? তাঁরও তো কম পথ অতিক্রম করা হলো না। এখনও কোন মায়ায় আটকে আছেন তিনি? কেনই। বা আছেন? কেমন যেন দম বন্ধ লাগে তাঁর। ঘাড় তুলে তাকান ইন্দুবালা এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য। কিন্তু এখানে আকাশ কোথায়? ওই তো চার কোণের চৌখুপ্পি। তার ওপরে বাড়ির পেছনের আম গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে এসে পড়েছে খানিকটা ভেতরে। কাঁচা আম গুলো পুরুষ্টু হয়েছে গ্রীষ্মের রোদের খর তাপে। মন খারাপটা যেন কোথাও ঝুপ করে গায়েব হয়ে যায় ইন্দুবালার। আম দেখার আনন্দে এগিয়ে যেতে গিয়ে পায়ে কিছু একটা ঠেকে। নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেন। সেই কবেকার প্রথম ট্রেনে চড়ার টিকিট! 

“বিলাতি আমড়া খাবে গো নতুন বউ? বিলাতি আমড়া?” ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায় ট্রেনের কামরায়। মুখের সামনে এনে দেখায় আমড়াগুলো। ততক্ষণে ইন্দুবালার কপালের চন্দন ফিকে হয়ে গেছে। গলায় রজনীগন্ধার মালা বাসি। চোখের কাজল কিছুটা ধেবড়ে গেছে। বাকিটা রাখা আছে বিস্ময়ে মাখামাখি হয়ে। মাথা নাড়েন ইন্দুবালা। না, তিনি খাবেন না। জানলার দিকে তাকিয়ে ভাবেন এই ফল আবার কিনে খেতে হয় নাকি? তাঁদের গ্রামে ফেলা-ছড়া যেত। কাঁচা কাঁচা পেঁসো আমড়া পেড়ে আনতো ভাই। মা চাটনি করতো। নুন দিয়ে কুটি কুটি করে কেটে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দিদি ভাইতে খেতো বোসদের পুকুর পাড়ে বসে। বৃষ্টির জল মেখে আমড়া পাকতো অম্বুবাচি পার করে। সেই সময় ঠাম্মার প্রায় সারাদিন উপোস। এক বেলা ফলাহার। কখনও ছাতু ভিজে। কিংবা সারাদিন মিছরির জল। বাবা এনে দিতেন সন্দেশ, কলা। সেইসব মুখে তুলতেন না তিনি বড় একটা। সব যেত নাতি নাতনির পেটে। অত বার চা খাওয়া যার অভ্যেস ছিল, সেও ওই কটা দিন চা না খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিত। ইন্দুবালা বিধবা হবার পর এতসব কিছু মানেননি। তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিল না। আর লছমী থাকতে তা করতেও দিত না। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাঁকে অনেক ছোটো বয়সে বিধবা করে কেটে পড়েছিলেন পরপারে। দায় ফুরিয়েছিল তাঁর। বড় ছেলেটাও এত ছোট তখন যে মালসায় ফুটিয়ে হবিষ্যির ভাত খাবে কী করে! মাঝরাতে মরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। সকাল গড়িয়ে গেলেও কোনো আত্মীয় কুটুম কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এমনকি যাদের সাথে নেশা করে ভাসিয়ে দিতেন সেই ইয়ারদোস্তরাও না। মাছ বিক্রি করতে এসে দরজা ধাক্কিয়ে ছিল লছমী। নীচে সাড়া শব্দ না পেয়ে সটান ওপরে উঠে এসেছিল সে। দেখেছিল মরা আগলে বসে আছে মল্লিক বাড়ির বাঙাল বউ ইন্দুবালা। দৃষ্টি স্থির। চুল এলোমেলো। চোখে জলের আভাসটুকু পর্যন্ত নেই। পাথরের মতো বসে আছে একটা মানুষ। মড়ার পাশেই ঘুমোচ্ছে তিন-তিনটে বাচ্চা। লছমী ডেকেছিল “মা..”। ইন্দুবালা ফিরে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। সেই চাহনি দেখে লছমী কী বুঝেছিল কে জানে? বাজার থেকে জড়ো করে নিয়ে এসেছিল লোক। তারাই খাট, ফুল, খই জোগাড় করেছিল। শ্মশানে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা তিন ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। নিজে হাতে স্বামীর মুখাগ্নি করেছিলেন। শ্রাদ্ধও।

নিয়মভঙ্গের দিন লছমীর এনে দেওয়া ট্যাঙরা মাছ আর বাড়িতে দেওয়া বড়ি দিয়ে একটা তরিজুতের ঝোল বেঁধেছিলেন। অনেক দিন পর ছোটো ছোটো ট্যাঙরার মাথাগুলো চুষে চিবিয়ে খাওয়ার সময় মনে পড়েছিল ঠাম্মার কথা। অম্বুবাচিতে সারাদিন উপোস করে থাকার পর ছাতু খেতে খেতে তাঁর যখন আর কিছু মুখে রুচতো না তখন খোসা ছাড়িয়ে পাকা আমড়া মুখের কাছে ধরতেন ইন্দুবালা। ঠাম্মা চুষে চুষে সেই বুনো ফলের সব রসটুকু খেয়ে নিতো। সারা ঘর ম ম করতো পাকা আমড়ার গন্ধে। এসব কথা কোনোদিন ইন্দুবালা কাউকে বলতে পারেননি। এমনকি ছেলে-মেয়েদেরকেও না। নাতি নাতনি তো অনেক দূরের কথা। কিছু কিছু জানতো মাছওয়ালী লছমী, কিন্তু সে তো আজ কোন সুদূরের অতিথি। 

সেদিনের সেই ট্রেনের কামড়ায় বিলাতি আমড়াই শুধু উঠেছিল তাই নয়। তার সাথে ছিল চিরুনি, পাতাবাহারে ফুল গাছ, সূঁচ, বশীকরণের ওষুধ, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, বসিরহাটের কাঁচাগোল্লা আরও কত কিছু। ভাই মাঝে মাঝে বাবার কাছে বায়না করে খাচ্ছিল। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের খেতে ইচ্ছে করেনি কিছু। এমনকি নতুন জরির চুল বাঁধার ফিতে দেখেও কিনতে ইচ্ছে হয়নি। জানলার পাশ দিয়ে তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট, নদী, নৌকা, গ্রাম। ইঞ্জিনের কয়লার কালো ধোঁয়া। চোখ বড় বড় করে দেখছিলেন তাঁর বয়সী মেয়েরা কাজে যাচ্ছে। কলেজে যাচ্ছে। ইন্দুবালা কলেজ যেতে চেয়েছিলেন। পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হলো! মনিরুলের সজল কালো চোখ দুটো বাঁধা থাকলো তাঁর অন্তরে। নক্সী কাঁথার মাঠের সাজুর মতো তাকে সব স্মৃতি উপড়ে নিয়ে চলে আসতে হলো এপারে। রূপাই থেকে গেল অনেক দিনের পুরোনো অতীত হয়ে। 

ট্রেনটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো কোন একটা স্টেশনে। কান ফাটানো আওয়াজ শোনা গেল বোমার। পুলিশের বন্দুকের। ঝুপ ঝুপ করে ট্রেনের জানলাগুলো পড়তে শুরু করলো। ইন্দুবালা তারই মধ্যে দেখলেন একদল ছেলে-মেয়েকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চালালো। কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লো। এইসব চেঁচামেচিতে পাশে বসে ঝিমোতে থাকা মাস্টার রতলনাল মল্লিকের ঘুম গেল ভেঙে। তিনিও বিরক্ত হয়ে ইন্দুবালার সামনের জানলা ফেলে দিলেন। গোটা কামরায় অসহ্য গুমোট গরম। বাইরে চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া। কানে এলো গর্জনের মতো স্লোগান “পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশো বারো।” আবার একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটলো। কামরার ভেতরের লোকগুলো কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তারই মধ্যে কয়েকটা ছেলে মেয়েকে হুড়মুড়িয়ে ট্রেনের কামরায় উঠতে দেখলেন ইন্দুবালা। ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো। এক নতুন দেশে বউ হয়ে আসার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বেশ মনে রাখার মতো হলো তাঁর। যে ছেলে-মেয়েগুলো হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠেছিল তাদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটেছে। কোনো রকমে সে হাত দিয়ে চেপে আছে ক্ষত জায়গাটা। রক্তে ভাসছে জামা কাপড়। তারই পাশ থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে বললো, “ভয় পাবেন না বন্ধুরা..যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিনে একবেলা করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজের ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদের পেট ভরাচ্ছেন সেই শাসনের অবসান চাই আমরা। যে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে সেটা আর যাই হোক এই সরকার সামলাতে অপারগ…তাও আমরা যারা দুবেলা দুমুঠো এখনও খেতে পাচ্ছি.. রেশনে গিয়ে পচা চাল আর গম কিনতে পারছি; তাঁরা যদি এগুলো যারা একদম পারছেন না তাদের সাহায্যে কিছু দান করেন তাহলে লোকগুলো না খেয়ে অন্তত মরবে না। দয়া করে ভুলে যাবেন না এখনও এই দেশে একবেলাও খাবার না-জোটা লোকের সংখ্যাটা অনেক।” একটা ছিপছিপে ছেলে এতক্ষণ পুলিশের সাথে লড়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বলে চলেছিল কথাগুলো। আর তারই বন্ধুরা ট্রেনের যাত্রীদের সামনে গিয়ে হাতে একটা টিনের কৌটো নাড়িয়ে অনুদান চাইছিলো। সবটাই ইন্দুবালার কাছে নতুন। ধনধান্য পুষ্প ভরা গ্রাম থেকে এ কোন দেশে এলেন তিনি, যেখানে সরকার বলছে একবেলা খাও! পাশ থেকে খবর কাগজ পড়া মধ্যবয়স্ক লোকটা মাস্টার রতনলাল মল্লিককে বললেন, “খাদ্য আন্দোলন চলছে বুঝলেন কিনা। আইন হবে নাকি একবেলা ভাত আর এক বেলা রুটি খাবার। সরকার চাকরিও দিতে পারছে না। খেতেও দিতে পারছে না। দেশটার কী অবস্থা হয়েছে বুঝুন তাহলে…।” মাস্টার রতলনাল মল্লিক লোকটাকে পাত্তা দিলেন না। দ্বিতীয় বিয়ের ধাক্কা সামলাতে তিনি বেশ ক্লান্ত। ট্রেনের দুলুনির সাথে আবার ঝিমোতে শুরু করলেন। একজন তারই বয়সী মেয়ে ইন্দুবালার সামনে এসে যখন অনুদানের কৌটো ধরলো তখন খুব ইচ্ছে করলো মেয়েটির সেই কৌটোতে দু আনা হলেও দিতে। কিন্তু সেই মুহূর্তে ইন্দুবালার কাছে কোনো নয়া পয়সাও ছিল না। অথচ গা ভর্তি ছিল সোনার গয়নায়। হকৌটো ধরা মেয়েটা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ইন্দুবালার দিকে। একটা বালা কিংবা হার খুলে যদি দিতে পারতেন তিনি। মানুষগুলো না খেয়ে আছে যে। 

তাঁর গ্রামে কপোতাক্ষের জল ঢুকে পড়লে বন্যা হতো। স্কুল বাড়ির পাকা দাওয়ায় গিয়ে উঠতো লোকজন। ঠাম্মা বাবাকে দিয়ে তার অনেক আগে থেকে চাল, ডাল পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে যা থাকতো। গ্রামের লোকেরাও মজুত করতো। সবাই এক সাথে রান্না খাওয়া হতো তখন। কত দূর দূর থেকে বুক পর্যন্ত জল ঠেলে মানুষগুলো খিচুড়ি নিতে আসতো। বড় যত্ন করে রাঁধতেন ইন্দুবালার ঠাকুমা। “অন্ন হচ্ছে লক্ষ্মী। মানুষের পাতে তুলে দিলে পুণ্যি হয়। যে দেশের সব মানুষ দুবেলা দুটো অন্ন পায় সে দেশের ভাণ্ডার ধন ধান্যে পূর্ণ হয়” বলেছিলেন ঠাকুমা। ইন্দুবালা সবেমাত্র তাঁর হাতের বালাটা খুলতে যাবেন বলে মনস্থির করছিলেন আর ঠিক সেই সময়ে তাঁর স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক খিঁচিয়ে উঠলে সরে গিয়েছিল অনুদান চাইতে আসা মেয়েটা। খারাপ লেগেছিল ইন্দুবালার। মানুষগুলোর পেটের ভাতের জন্য ওরা রাস্তায় নেমেছে। ভিক্ষে করছে। তারা যদি দুবেলা ভরপেট খেতে পারে তাহলে যে দোরগোড়ায় এসে অভুক্ত দাঁড়াচ্ছে, সে পাবে না কেন? সেই ইন্দুবালা তখনও জানতেন না তিনি একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবেন। দুবেলায় তাঁর হোটেলে পাত পড়বে অসংখ্য মানুষের। সেই হোটেল থেকে বিনা পয়সাতেও খাবার বিলির বন্দোবস্ত থাকবে। সেটা সত্তরের জ্বালাময়ী দিনগুলোতেই হোক কিংবা তারও অনেক পরে মানুষগুলোর কাজ হারানোর সময়, সবাই জেনে গিয়েছিল এই একটা জায়গায় এমন এক অন্নপূর্ণা আছেন যাঁর ভাতের হাঁড়ি কারও জন্যে কোনোদিন খালি হয় না। 

নতুন কনে ইন্দুবালার সঙ্গে মালপত্র হিসেবে এসেছিল বড় নক্সা করা একটি তোরঙ্গ। দানের বাসনের বড় ঘড়াটা। বাবার হাতে ছিল ওপারের বাজারের জোড়া ইলিশ। ভাইরের হাতে দইয়ের বড় হাঁড়ি। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাতে ছিল বিয়ের ছাতা নিপাট ভাঁজ করা। কাঁধে ফেলা ছিল দানের শাল। হাতে চকচক করছিল আশীর্বাদের দু ভরি সোনার আংটিটা। স্টেশনে ট্রেন থামলে বরের বাড়ি থেকে লোক আসা দস্তুর ছিল। নতুন কনেকে যেভাবে গল্প শুনিয়েছিল তার বাড়ির লোকেরা, সে আরও অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। ব্যাণ্ড পার্টি। রঙ মশাল। ফানুস। কলকাতার রাজপথে শোভাযাত্রার মতো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। “তুই শুনলাম বনেদি বাড়ির বউ হলি ইন্দু। পা পড়বে তো মাটিতে”। ফুট কেটেছিল গাঁয়ের হিন্দু বাড়ির মেয়েরা। বন্ধুরা কেউ কেউ বলেছিল “আতসবাজি ফাটাবে নিশ্চয়। ঘোড়ার গাড়ি আসবে। ফুল ছড়াবে। আতরদানি থেকে আতর।” কিন্তু এইসবের ছিটেফোঁটাও ইন্দুবালার আশেপাশে ছিল না। নতুন বউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কাউকে আসতে দেখেননি তিনি। বাবা একটু কুণ্ঠা নিয়েই জানতে চেয়েছিলেন “বাবা রতন… তোমার বাড়ির থেকে…?” কথা শেষ করতে দেয়নি মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তাঁর সযত্নে লালিত বাবরি চুলের গোছা নেড়ে বলেছিলেন “তাই তো…তাই তো…এখন যে কী করি? বউভাতের যোগাড় যত্নে লেগে গেল কিনা লোকজন…। পুরুষ বলতে বাড়িতে আমি তো একাই…।” বাবা বিচলিত হতে বারণ করেছিলেন জামাইকে। তিনি থাকতে চিন্তার তো কিছু নেই। “শুধু এত জিনিস বলে লোকজনের খোঁজ করা। তা একটা কুলি নিলেই হয়ে যায় আর কি।” বাবা কুলি ডেকে তার মাথায় তুলে দিয়েছিলেন প্রায় সবকিছু। আর যেটুকু ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে সবার হাতে হাতে ধরে গেল। কপোতাক্ষর গাঁয়ের মেয়ে যখন ভাগীরথীর পাড়ে এসে প্রথম পা দিলো তখন কেউ শাঁখ বাজালোনা। কালো পাথরের থালায় দুধে আলতা মিশিয়ে কেউ পা ছোঁয়াতে বললো না। ঈশ্বরী পাটনীর মতো কেউ আদর করে পার করে দিল না শ্বশুরবাড়ির দোরটা। কিন্তু সে গল্প আমাদের জানা। যতই মাস্টার রতনলাল মল্লিক বলুন না কেন বউভাতের আয়োজনে বাড়ির সবাই ব্যস্ত আছে। আমরা তো জানি ইন্দুবালার বউভাতই হয়নি। কাকপক্ষীটিও টের পায়নি ইন্দুবালার শাশুড়ি এক বংশ ঘটির মাঝে একটা বাঙালি মেয়ে বউ করে নিয়ে আসছেন। জানাজানি হলে মুশকিল হতো। আগের বউটা বাচ্চা হতে গিয়ে মরেছিল নাকি মাস্টার রতলনাল মল্লিক গলা টিপে খুন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর কানাঘুষো আছে। তাই বাড়তি কোনো আয়োজনের দিকে যাননি শাশুড়ি। নতুন বউয়ের সাথে তার বাবা আর ভাইকে দেখে মেজাজ তিরিক্ষে হয়েছিল তাঁর। আপদগুলোর আবার আসার দরকার কী ছিল! মেয়েটাকেই চেয়েছিলেন তিনি। পরিবারকে নয়। আর ইন্দুবালা দেখেছিলেন বাড়ির সামনে থেকে বাবা ছোট্ট ভাইয়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছেন অপমানিত হয়ে। তাদের কেউ একটু জল-মিষ্টি খাওয়ার কথা দূরে থাক বসার জন্য পর্যন্ত বলছে না। ছেনু মিত্তির লেনের গলিটা দিয়ে যেতে যেতে ভাইটা কাঁদছে। বাবা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনও জানেন না ইন্দুবালা এই তাঁর শেষ দেখা বাবার সাথে। এরপর আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না বাবাকে। ইন্দুবালার বাড়ি ছেড়ে আসার বছর কয়েকের মধ্যেই মারা যাবেন বাবা। ঠাম্মা নাতনির মুখটা দেখতে চেয়েও পাবেন না। শেষ কদিন ইন্দু ইন্দু করে ঢলে পড়বেন চিরঘুমে। আর মায়ের কথা? সেগুলো যত্ন করে ইন্দুবালা শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁওয়ায় তুলে রেখেছেন। যেমন পঞ্চ প্রদীপের তাপ আঁচলে পুইয়ে গিঁট বেঁধে রাখতেন মা ঠিক তেমন করেই। ভাইটা তারও অনেক পরে যোগ দিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। চিঠি পত্রের আদান প্রদান অল্প বিস্তর যা ছিল যুদ্ধ শুরু হলে সেসবের পাটও চুকলো। জন্মভূমির সাথে যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন হলো ইন্দুবালার। 

কলকাতা শহর তখন বেশ সরগরম। মিছিলের পর মিছিল চলেছে রাস্তা জুড়ে। মানুষের পাতে ভাত নেই। মনে সুখ নেই। খাবার নিয়ে যে আন্দোলন হতে পারে ইন্দুবালা জানতেন না এই শহরে না এলে। স্টেশনের বাইরে থেকে অনেক দরদাম করে বাবা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন। সেই ট্যাক্সির মধ্যে ইন্দুবালা, ভাই, বাবা আর মাস্টার রতলনাল মল্লিক ঠিক এঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল সেইসব জিনিসগুলো যা আজ ধনঞ্জয় কুড়িয়ে বাড়িয়ে ফেলে দিতে চাইছে। ও কতটুকু জানে এইগুলোর মাহাত্ম? গজগজ করতে করতে বুড়ি ভাঙা তোরঙ্গটার সামনে বসেন। ততক্ষণে ডালে ফোড়ন পড়েছে। নটা বাজতে চললো। কলেজের ছেলেগুলো খেতে এলো বলে। ইন্দুবালার কাজের তাড়া পড়ে যায়। 

ট্যাক্সির জানলার পাশ আর ট্রেনের জানলার ধার ঠিক এক জিনিস নয়। ট্রেনের জানলার ধারে কত গ্রাম, নদী, জলা, জঙ্গল আর ট্যাক্সির পাশে শুধুই শহর। খেতে না পাওয়া মানুষের মিছিল। তখনও প্রথম ট্রেনে ওঠার ঘোরটা যেন কাটেনি ইন্দুবালার। অল্প অল্প মাথাটাও কি টলছিল ট্রেনের দুলুনির সাথে? তার রেশ রয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। কলকাতায় এসেই লুকিয়ে মনিরুলকে একটা না পাঠানো চিঠি লিখেছিলেন ইন্দুবালা। “জানিস মনিরুল ট্রেন যে কী ভীষণ বস্তু তোকে না বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের সেই বাঁশ গাছে দোল খাওয়ার মতো। তুই নিশ্চয়ই এতদিনে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিস। অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে তোর। অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। আমার কথা মনে পড়ে আর? বোসদের পুকুর? খানার ধারের ল্যাঙড়া..? গাজনের মাঠ..? কপোতাক্ষের ঘাট? আমি কিছু ভুলিনি মনিরুল। এখনও কি নানি সন্ধ্যে হলে বিষাদসিন্ধু পড়েন? তুই কি এখনও রাতের আঁধারে বাঁশি বাজাস? লণ্ঠনের আলোয় পড়িস নক্সীকাঁথার মাঠ? ঢাকাতে কি তোর দেখা হলো আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের? আমার যে সব কথা…সব কিছু বড় জানতে ইচ্ছে করছে মনিরুল…। আমি যে তোকে…।” এরপর আর লেখা এগোতে পারেননি ইন্দুবালা। তিনি মনিরুলকে কী? ভালোবাসেন? পছন্দ করেন? একসাথে থাকতে চেয়েছিলেন? নিজের কাছে উত্তরগুলো স্পষ্ট নয়। যেমন ঠিক স্পষ্ট নয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা আদৌও হয় কিনা। কিংবা ভালোবাসার অপর নাম শুধু শরীর কিনা। যে শরীরটাকে মাস্টার রতনলাল মল্লিক তার কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনে তিন তিনটে বাচ্চার মা বানানোর ফ্যাক্টরি করে দিয়ে হঠাৎ উবে যাবেন কর্পূরের মতো হাওয়ায়। শরীরের সেই না পাওয়া কিংবা প্রচণ্ড পাওয়া কষ্টগুলো নিয়ে ইন্দুবালাকে বেঁচে থাকতে হবে দিনের পর দিন। তাও মলিন হবে না স্মৃতিগুলো। মানুষগুলো। 

টগবগ করে ভাত ফোটে। ডাল ফোটে। মাছের ঝোলে মাছগুলো যেন ফুটতে ফুটতে ফড়ফড় করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তিন তিনটে উনুন জ্বেলে সেই স্মৃতি সম্ভাষণের আসন সাজান ইন্দুবালা। 

নতুন যে দেশটায়, শহরটায় তিনি এসে পড়লেন, এই দেশ নিয়ে, শহর নিয়ে এর আগে তিনি কম গল্প শোনেননি। বাবার বাবা মানে ইন্দুবালার দাদু এক সময়ে নাকি কাজ করতেন কলকাতার বন্দরে। সেখানে সাহেব সুবোর খাতা লিখে তাঁর দিন গুজরান হতো। বড় বড় জাহাজে করে কত শত যে জিনিস আসতো তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। মেমসাহেবের ছোট্ট চিরুনি থেকে বেলজিয়াম কাঁচের আয়না। ইন্দুবালার গ্রামের বাড়িতে ঠাকুর দেবতার যা মূর্তি ছিল লক্ষ্মী থেকে শুরু করে শিব সব কিছু তার দাদুর আনা। চিনেমাটিতে বানানো সব হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। কলকাতার বড়লোক বাড়িতে ছেলে মেয়েদের খেলার জন্য বিদেশ থেকে আনা হতো। অনেক সময় বিয়ের তত্ত্ব যেত এইসব পুতুল সাজিয়ে। প্রত্যেকটা পুতুলের গায়ে লেখা থাকতো মেড ইন জার্মানি। বেশ নামডাক ছিল এই শিল্পের। এগুলো বাড়িতে রাখাও সম্মানের ব্যাপার ছিল তখন। ঠাম্মার খেলার জন্য দাদু এইসব পুতুল মাঝে মাঝে নিয়ে গেলেও ঠাম্মা সব কিছু সাজিয়ে রাখতেন পুজোর ঘরে। লক্ষ্মী, শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নিয়ে কেউ খেলে নাকি? শুক্রবার হলেই দাদু বাড়ি ফিরতেন শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে খুলনায়। একটা সবজেটে ট্রেন দাদুকে নামিয়ে দিত কপোতাক্ষের ওপারে। শনি রবি বাড়ি থেকে আবার সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায়। বাবাও দাদুকে অনুসরণ করেছিলেন। দাদুর কাছে কাজ শিখতে শিখতে কলকাতায় পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝখান থেকে দেশটা স্বাধীন হলো। শুধু স্বাধীন হলো তাই না দেশটা দু-টুকরো করে ভাগ করা হলো। দেশের নেতারা সেই দেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষদের কাছে অনুমতি নিল না, জানতে চাইলো না। এক মুহূর্তে ভিটে মাটি সব কিছু হয়ে গেল বিদেশ। রাতের আঁধারে, দিনের আলোয় মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। কে কোন অংশে যেতে পারবে তার যেন মারাত্মক মরিয়া প্রতিযোগিতা। তার সাথে বাধলো দাঙ্গা। রক্তক্ষয়ী। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি মারলো। মেয়ে লাঞ্ছিত হলো পড়শির কাছে। গোটা ভূখণ্ড জুড়ে চললো নরহত্যা। তিনশো বছরের ইংরেজ রাজত্বের পর স্বাধীনতা উদযাপনের সে কী ভয়ঙ্কর উৎসব। 

নীল আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে দাদু প্রশ্ন করেছিলেন “এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এই স্বাধীনতার স্বপ্নই কি দেখেছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভ্যুত্থানের বীর শহীদ মাস্টারদা সূর্য সেন?” ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে যাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল? তারপর দড়িতে ঝুলিয়ে দেহটাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বুড়িগঙ্গার গভীর জলে? অত ছোট্ট মেয়ে প্রীতিলতাকেই বা মরতে হলো কেন? এত এত শহীদ কেন দ্বীপান্তরে গেলেন? জাতীয় পতাকা যদি সেই উড়লো দেশের স্বাধীন ভূমিতে তাহলে তখন দেশ বলে গড় করতে পারলাম না কেন? মনে অনেক প্রশ্ন, কষ্ট আর হতাশা নিয়ে দাদু ফিরে এলেন খুলনার কলাপোতায়। স্টেশনে আসার পথে দেখেছিলেন একদল লোক চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে “ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়”। খাবার নেই, জল নেই, নিজেদের বলতে কিচ্ছুটি নেই। হাতের সামনে যে যা পেরেছে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে উঠে পড়েছে ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছে, এরপরে কীভাবে থাকবে তার কিচ্ছুটি জানা নেই কারও কাছেই। 

বাবা আসতে চাননি কলকাতা ছেড়ে। তাঁর কাছে তখন নতুন দুটো ভূখণ্ড ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান। বাবা থেকে যেতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে। আর দাদু চেয়েছিলেন যে গ্রামের মাটিতে তাঁর বাবা, মা পূর্বজরা পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে আছেন, যে নদীর জলে ডুব দিলে জীবনে শান্তি পাওয়া যায় সেই কলাপোতায়। তখনও হয়তো তিনি মনে মনে বিশ্বাস করতেন এটা মানুষের সাময়িক ভ্রম। দেশ নেতাদের অলীক কল্পনা। “দেশ কখনও ভাগ করা যায় নাকি? এটা কি তোমার লাউটা, মুলোটা কাটলেই ভাগ হয়ে গেল?” সামনের বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। “বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাবে দুই দেশের সীমানা। তখন দেখো আবার আমি কেমন করে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে স্টেশনে নামি। বাড়ির দোরে এসে ডাক দিই…কোথায় ব্রজের মা…? হাতের ব্যাগখানা ধরো দেখি। তোমার জন্য বড় বাজারের মশলা আর ভীম নাগের সন্দেশ আছে।” বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দাদুর চোখে ছানি পড়েছিল। কিন্তু দুটো দেশ জোড়া লাগেনি। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন দাদুকে একা রেখে এইভাবে তিনি ইণ্ডিয়া চলে যেতে পারবেন না। কাজেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাঁকে থেকে যেতে হয়েছিল। তার মধ্যে বুদ্ধি খরচ করে তিনি দাদুর জমানো টাকায় বেশ কিছু জমি কিনে নিলেন। চাষবাস দেখাশুনো করতে শুরু করলেন। আর দাদুর জন্য খুলে দিলেন একটা টোল। সেখানে দাদু পড়াতে শুরু করলেন গ্রামের বাচ্চাদের। না হলে মানুষটার সময় কাটবে কী করে? ভাবতে ভাবতে শেষকালে পাগল হয়ে যাবে না তো? টোল থেকে কোনো কোনো দিন দাদু বাড়ি ফিরতেন না। সবাই জানতো তিনি এখন চুপ করে বসে আছেন কপোতাক্ষের ধারে। ওপারের দিকে তাকিয়ে। মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেন ওদিকের ট্রেন চলতে শুরু করেছে কিনা। এইসব ইন্দুবালা দেখেননি। শুনেছিলেন সব সেই ছোট্ট থেকে। শ্রুতিমালার সেই গল্পগুলো রয়ে গিয়েছিল তাঁর মনে। দাদুকে তিনি যখন দেখেছিলেন তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে মানুষটা। তবুও তাঁর সেই টোলের বারান্দায় চুপ করে বসে থাকা, মাঝে মাঝে দিদিভাই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। এখন ভাবেন এত কষ্ট নিয়ে কী করে বেঁচে ছিলেন দাদু? বন্ধু বান্ধব যা ছিল সবই ওপারে। আর এপারে ছিল প্রতিশ্রুতির বন্ধন। দাদু তাঁর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন থাকবেন তিনি এই পিতৃপুরুষের ভিটেতেই। সেই কথার খেলাপ তিনি কোনোদিন করেননি। অসম্মান তো দূরের কথা। তার অবিচল সিদ্ধান্ত থেকে কেউ টলাতে পারেনি। তাহলে যেখানে সবাই রয়ে গেল ওই পারে, সেখানে একমাত্র ইন্দুবালা তাঁদের পিতৃপুরুষের স্মৃতি তর্পণের জন্য কেন রয়ে গেলেন এপারে? কেন বাবার মনে হয়েছিল একমাত্র ইন্দুবালাকেই ওপারে পাঠাতে হবে? অনেকের মতো কেন বাবা নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন না এপারে চলে আসার? ইন্দুবালা জানতেন বাবা শিকড় ছাড়া হতে পারতেন না। মাও না। ঠাম্মাও না। আর ভাই? তার কথা সোনার আখরে ইতিহাসে না লেখা থাকলেও ইন্দুবালা জানেন ওই যে মুক্তোর মতো বর্ণপরিচয়, সেখানেই লুকিয়ে আছে তাঁর ভাই। ভাষা শহীদ হওয়া কি মুখের কথা? সে তো জন্ম জন্মান্তরের পুণ্যের ফল। তাঁদের গোটা পরিবারের মাতৃভূমির কাছে ঋণ মোচন। 

ঝোড়ো হাওয়ায় বাড়ির সব জানলা দরজাগুলো হুটোপাটি করে পড়ার শব্দে ইন্দুবালার ঝিমুনি কাটে। দুপুরে হোটেলের কাজ কম্ম শেষ করে তাঁকে এখন একটু বিশ্রাম নিতে হয়। না হলে রাতের দিকে আর উনুনের সামনে দাঁড়াতে পারেন না। ভেতরে কীরকম যেন একটা কষ্ট হয়। এইসব যদি ঘুণাক্ষরেও ধনঞ্জয় জানতে পারে তাহলে ছেলেদের বলে দেবে। তারা তখন মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ডাক্তার বদ্যি নিয়ে অযথা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে। নিয়ম দিয়ে মাকে বেঁধে ফেলতে চাইবে ওরা সাত তাড়াতাড়ি। এইসব ভাবলেও বিরক্ত বোধ হয় ইন্দুবালার। ঝিম ধরা চোখে তাকান বাইরের দিকে। আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। কালবৈশাখী। কোনোরকমে গাঁটের ব্যথা সামলে উঠে পড়েন তিনি। ধনঞ্জয়কে ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বাজার করতে গেল নাকি? এখন এতগুলো জানলা বন্ধ করবেন কী করে? তাও কোনোরকমে ওপরের ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করতে পারেন তিনি। আর ঠিক তখনই নজর পড়ে উঠোনের দিকে। বাগানের গাছটা থেকে টুপ টুপ করে আম পড়ছে ঝড়ে। সেদিনও কি এমন ঝড়টাই হচ্ছিল না? তবে সেটা ছিল ভোর। আর আজ বিকেল। ইন্দুবালা ভুলে যান তাঁকে বন্ধ করতে হবে বাড়ির আরও জানলা দরজা। ভুলে যান তাঁর বয়েস ছুঁয়ে গেছে সত্তরের ওপার। ঝোড়ো হাওয়া আর টুপটুপ আম পড়ার শব্দ তখন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। ইন্দুবালা নামছেন সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে। কোথায় তাঁর পায়ের ব্যথা? গাঁটের বাত? যেন ছুটছেন তিনি এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে উঠোনের দিকে। ছুটছেন ইন্দুবালা। ছুটছেন তীর বেগে। ঝোড়ো হাওয়ায় কেঁপে উঠছে হাতের লণ্ঠনের শিখা। কড়কড় করে বাজের শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। ভোর হতে তখন অনেক দেরি। পেছনে ছুটছে ছোট্ট ভাইটা। তার পেছনে মা, তারও অনেক পেছনে ঠাম্মা। গোটা আমবাগান জুড়ে কলাপোতার লোকজন জড়ো হয়েছে ওই আঁধার ভোরে। প্রায় একশো গাছের বাগান যাদের তারাও এসেছে। গাঁয়ের লোকের আম কুড়োনোতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এমনিতেই নষ্ট হয় কত। শিলের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আম পড়ছে হাওয়ায়। কেউ মারামারি করছে না। রেষারেষি না। সবার কোঁচড় ভরে উঠছে কাঁচামিঠে, ল্যাঙরা, বোম্বাই আমে। ঝড়ের সাথে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কড়কড় করে বাজ পড়ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটা ঠকঠক করে কাঁপছে। বারণ করেছিলেন ইন্দুবালা। বাবার সাথে বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। শোনেনি ভাই। তাঁর সাথেই ছায়ার মতো থাকে যে। চলে এসেছে ছুটে ছুটে দিদির পেছন পেছন। এবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালেই হলো আর কি। তাড়াতাড়ি গিয়ে নিজের আঁচলে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালা ভাইকে। তাও কি বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? বিড়বিড় করেন, “লেবু পাতায় করম চা যা বৃষ্টি থেমে যা”। কিন্তু বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে যেন বরফ জলের ঠাণ্ডা। ভাই বোন ঠকঠক করে কাঁপে। দুজনে আগলে রাখে কোঁচড়ে জমানো আমগুলোকে। একটা সময়ে ইন্দুবালা ইঠাই বুঝতে পারেন চারপাশে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু তাঁদের মাথায় বৃষ্টি নেই কেন? ওপর দিকে তাকাতে ইন্দুবালা দেখলেন একটা বড় কচু পাতা। সেটা ধরে আছে মনিরুল। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন, ইন্দুবালা বলে বোঝাতে পারেননি কাউকে। বলার সুযোগ ছিল না। রুমালের ওপর সুতা দিয়ে একটা ছেলেকে এঁকেছিলেন তিনি। তার হাতে দিয়েছিলেন একটা কচু পাতা। আর মেয়েটাকে রেখেছিলেন দূরে। এলোচুলে। বৃষ্টির মধ্যে। ইচ্ছে ছিল মনিরুলকে নিজে হাতে করে দেবেন রুমালটা। সেটা আর দেওয়া হয়নি। কেন দিতে পারেননি মনিরুলকে? মা দেখতে পেয়ে গিয়েছিল কি? বকেছিল খুব? মনে করতে বসেন ইন্দুবালা। নাকি তিনি নিজেই মিথ্যে বলেছিলেন মাকে? ভাইয়ের জন্য রুমাল করেছেন। ভাই সেই রুমালে সারাদিন নাক ঝেড়ে ঝেড়ে ভর্তি করেছিল। আর ইন্দুবালা পড়েছিলেন জ্বরে। বেজায় শরীর খারাপ হয়েছিল সেবার। সারছিলো না মোটেই। সাতদিনের মাথায় পথ্যি পেয়ে তবে মেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল। গ্রীষ্মের রোদে ঘর থেকে বেরিয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল ইন্দুবালার। ঠাম্মা ততদিনে সেই ঝড়ে কুড়োনো আমগুলোকে কেটে, ধুয়ে হলুদ নুন মাখিয়ে কিছুটা আচার করে ছিলেন আর বেশ খানিকটা আমতেল বসিয়েছিলেন রোদে। সুয্যিদেব গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে রোদে তাতিয়ে তেলে মিশিয়ে কাঁচা আমগুলোকে জারিয়ে দেবেন। তারপর সেই তেল দিয়ে সারা বছর যা খাওয়া দাওয়া চলবে তার কোনো হিসেবের কুল কিনারা পাওয়া যাবে না। আম তেল মুড়ি দিয়ে মাখা হবে। গরমভাতে ঘিয়ের বদলে খাওয়া হবে। মাছের ঝোলে বিশেষ করে সরল পুঁটিতে আমের গন্ধ দেওয়ার জন্য আমতেল ব্যবহার হবে। আর গ্রামে পোয়াতির সংখ্যা নেহাৎ কম থাকে না সম্বৎসর। তারাও পাবে। পাতা কুড়োতে এসে খেন্তির মা পাবে। টিফিনে মনিরুল পাবে। ফকিরি গান গাইতে আসা অন্ধ কানাই পাবে। চুরি করে ঠাম্মার আম তেল আর আচার খেতে খেতে গরমের ছুটির দুপুরগুলো কেটে যাবে। 

বৃষ্টিটা সবে ধরেছে। তবে হাওয়ার বেগ এখনও বেশ ভালোই। ঝিরঝিরে জোলো বাতাস চারিদিকে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইদানিং হয়েছে কী, কলকাতার এই ধরনের হুট করে আসা বৃষ্টিতে সবাই কেমন যেন তালকানা হয়ে যায়। ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে শুরু করে অটো চালক- সবাই। ইন্দুবালার বড় ছেলে প্রদীপ হঠাৎ নিজেই ড্রাইভ করে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। অন্যান্য বার আগে ফোন করে জানিয়ে রাখে মাকে কিংবা ধনঞ্জয়কে। এবার সেসব কিছুই করেনি। ভেবেছিল মাকে একটু চমকে দেবে। সদর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, “আজ কিন্তু বাড়ি যাবো না মা। থাকবো তোমার কাছে।” এমন কথা শুনলে তার মা কী বলবে এই বুড়ো ছেলেকে সেটা জানার জন্য তার খুব ইচ্ছে করছিল। যদিও জানে প্রদীপ, মা তাকে কোনোদিনই বউ বাচ্চা ছেড়ে থাকতে দেয়নি। এমনকি অন্যান্য মায়েরা যেমন খুব আদিখ্যেতা করে বাচ্চাদের আদর করে, খাওয়ায়; ইন্দুবালা তাঁর ছেলেদের বা মেয়েকে কোনোদিনই তেমন করে বড় করেননি। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা ছিল চোরাস্রোতের মতো। সেটা তিন ছেলে মেয়েই খুব ভালো করে টের পেতো। শরীর খারাপ করলে, জ্বর হলে ঠায় মাথার কাছে বসে থাকতেন। সারা রাত জাগার পর আবার সারাদিন হোটেলে ওই গনগনে উনুনের সামনে রান্না করা। মায়ের কষ্ট তারা বুঝতো। তাই জীবনের প্রথম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই প্রদীপ মাকে হোটেল বন্ধ করতে বলেছিল। দিল্লিতে যে কোয়ার্টারটা সে পাবে তাতে সবাই মিলে থাকা যাবে। ইন্দুবালা হাসি মুখে শুধু বলেছিলেন “এবার তুই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া কাটিয়ে নতুন জীবন শুরু কর বড় খোকা”। 

চাকরি পাওয়ার পর যেদিন প্রথম সে বাড়ি থেকে বেরোলো বড় মন কেমন করেছিল। ভাই, বোন এমনকি ধনাদা পর্যন্ত গিয়েছিল তার দিল্লির কোয়ার্টার গুছিয়ে দিতে। মা একবারও যায়নি। বিয়ের আগেও না। পরেও না। কেউ নড়াতে পারেনি তাকে এই বাড়ি ছেড়ে। হোটেল বন্ধ থাকা মানে যেন মায়ের প্রাণ চলে যাওয়া। ভাই আর খুকি বুঝিয়েছিল দাদাকে। মা যেমন আছে থাক। মেনে নিয়েছিল প্রদীপ। কিন্তু এখন তার মাঝে মাঝেই ভয় হয় এই বয়সে অতটা আগুনের সামনে একটা বিপদ যদি হয়ে যায়। কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার পরে এমনও হয়েছে সপ্তাহে দুবারও এসেছে সে। কিন্তু লক্ষ্য করেছে তাতে মা বিরক্ত হয়। ভাবে বুঝি নজর রাখতে এসেছে ছেলে। মার পছন্দ হয় না এমন কোনো কাজ প্রদীপ করতে চায় না। কিন্তু না জানিয়ে এসে সেকি আজ ভুল করলো? ধনঞ্জয়কে অন্তত ফোন করে আসলে ঠিক সময় মতো ও দাঁড়িয়ে থাকতো। গাড়ি পার্ক করার অসুবিধে হতো না। আজ বেজায় ঝামেলা হচ্ছে। 

ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের সামনে একটু বৃষ্টিতেই গোড়ালি সমান জল। সেখানে আবার কোথায় গর্ত আছে, নর্দমা আছে সেইসব দেখে গাড়ি রাখতে প্রদীপের অনেকটা সময় লেগে যায়। এতক্ষণে বাড়িটার দিকে তাকানোর ফুরসৎ হয় তার। শহরের এক পুরোনো পাড়ায় বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা কেমন যেন একলা হয়ে। কোথাও আলোটুকু পর্যন্ত নেই। তার মন কেমন যেন কু গেয়ে ওঠে। গোটা বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। এমনকি সামনে যে দু তিনটে খদ্দের ঘোরাঘুরি করে তারাও আজ নেই। বোর্ডে লাগানো আলোটাও আজ জ্বলছে না। প্রদীপ অনেক দিন পর মায়ের সাথে দেখা করতে এলো। আসবো আসবো করে তার আসাই হয় না। আজ এইটা কাল ওইটা লেগেই থাকে। তার আজকে আসার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে এইবার পাসপোর্টটা ফারদার রিনিউ করার আগে সে একবার বাংলাদেশ ট্যুর করতে চায়। একটা প্যাকেজও পাচ্ছে প্রায় কিছু খরচ না করেই। ছেলে বুবাই বললো “যাও না ঠাম্মির দেশে! কীসব তোমাদের কলাপোতা…ফোতা।” আইডিয়াটা খারাপ লাগেনি প্রদীপের। বউ সম্পূর্ণাও রাজি হয়ে গিয়েছিল। কর্মসূত্রে স্বামীর সাথে তার বাইরের অনেক দেশ ঘোরা। কিন্তু বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি। নিজের চোখে হাতে করে একটু ঢাকাই মসলিন দেখে আসার ইচ্ছে আছে তার। সাথে কিছু কেনারও। এবার মা রাজি হলে তাহলে পাসপোর্টের একটা ঝামেলা থাকবে। মায়ের পুরোনো পাসপোর্টটা আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। প্রদীপ যদিও জানে পাসপোর্ট করাতে সময় লাগবে না। বুবাইয়ের বন্ধু কাজ করে পাসপোর্ট অফিসে। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সব। সম্পূর্ণই তাকে ঠেলে পাঠালো। একবার কথা তোলবার জন্য। মেজাজ যা মাঝে মাঝে থাকে বুড়ির! 

প্রদীপ বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল বৃষ্টি ছিল না। এই দিকেই হয়েছে তাহলে ভালো। গরমের বৃষ্টি কোথায় যে কখন হয় বোঝা যায় না। প্রদীপ এগিয়ে গেল ভেতরের দরজার দিকে। সিঁড়ির আলো জ্বালানো। বাইরের বারান্দার। না কোথাও কেউ নেই। দুবার ডাকলো “মা..মা” বলে। কোন সাড়া শব্দ পেলো না। প্রদীপ চিৎকার করে ডাকলো ধনঞ্জয়কে। “ধনাদা..”। উত্তর নেই। কেমন যেন ভয়ে পেয়ে গেলো প্রদীপ। যদি মা সত্যি না থাকে? এই কথাটা যেন প্রথম ভাবলো সবে সিনিয়র সিটিজেনের তালিকায় প্রবেশ করতে যাওয়া প্রদীপ। এমন ভাবে কোনোদিন এর আগে মনে হয়নি। মা থাকলে জগৎটা তার এক রকম। আর মা না থাকলে অন্য রকম। বাবাকে ঝাপসা মনে পড়ে। ঘুড়ি ওড়ালে বাবা লাটাই ধরা শেখাতো। ব্যস, ওইটুকুই। তার তো তাও এটা মনে আছে, ভাই আর বোনের সেটুকুও তো মনে নেই। সবটাই তো তিনজনের মাকে ঘিরে। একবার কি ফোন করবে তাহলে ভাইকে? খুকুকে? কিন্তু কী বলবে? ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে সে এসেছে অথচ ইন্দুবালাকে খুঁজে পাচ্ছে না? দোতলা ঘুরে এসে পিছনের দিকে কুয়োতলায় উঠোনের কাছে এসে আর একবার কাঁপা কাঁপা গলায় ডেকে উঠলো প্রদীপ “মা…”। এবার খুব শান্ত গলায় উত্তর ভেসে এলো “আয়..”। প্রদীপ তার মায়ের গলা শুনতে পেল কিন্তু মাকে সে দেখতে পেলো না তখনই। মোবাইলের টর্চ জ্বালালো। “কোথায় তুমি মা?” একটু এগিয়ে যেতেই সে তার মাকে খুঁজে পেলো। কাক ভিজে হয়ে সন্ধ্যের উঠোনে ঝাঁকড়া আমগাছের ডালটার নীচে বসে আছেন ইন্দুবালা। চারপাশে জড়ো করা ঝড়ে পড়া কাঁচা আম। প্রদীপ এগিয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে তার মাকে। “মা তুমি ঠিক আছে তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? পড়ে গিয়েছিলে নাকি? আমাকে ধরো মা..প্লিজ আমাকে ধরো…শক্ত করে ধরো…।” ইন্দুবালা ছেলের হাত ধরেন। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে, আধুনিক মোবাইলের এল ই ডি লাইটে ইন্দুবালা বলে ওঠেন “আমাকে একটু তেল কিনে দিবি বড় খোকা? আম তেল করবো…।” 

এমনটা নয় যে ইন্দুবালার তেল কেনার টাকা নেই। এমনটা নয় ইন্দুবালা এইভাবে ছেলেদের কাছে টাকা চান। কোনোদিন কারো কাছে একটা টাকাও হাত পেতে চাননি সেই প্রথম দিন লছমী টাকা দিয়ে ভাত খেয়ে যাওয়ার পর থেকে। তারপর মা লক্ষ্মীর দয়ায় ক্যাশবাক্স ভর্তি থেকেছে সবসময়। তাই প্রদীপ একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। তার মনে ভয় ছিল ছোটোখাটো কোনো সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে কিনা। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে মা। ততক্ষণে সারা রাজ্যের বাজার ঘুরে ধনঞ্জয় এসে পড়েছিল। প্রদীপ একটুও দেরি না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল। সোজা নিয়ে গিয়েছিল কাছের নার্সিংহোমে। এমার্জেন্সির ডাক্তার বরং উলটে কথা শোনালো প্রদীপকে “আমতেল করার জন্য টাকা চেয়েছেন বলে সোজা এখানে নিয়ে চলে এলেন মাকে? আচ্ছা ছেলে তো মশাই”। প্রদীপ ইচ্ছে করলে ডাক্তারকে বোঝাতে পারতো তার মা কোন ধাতে গড়া মানুষ। কিন্তু সেই পথে সে হাঁটলোই না। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলো। তারও যেন এক ঘোর লেগেছে চোখে। আমের স্কুপের মধ্যে বৃষ্টি ভেজা মাকে একা বসে থাকতে দেখে তার কি কান্না পেয়েছে? কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজেকে লুকোয় প্রদীপ। আর ওদিকে ডাক্তার অবাক হয়ে শোনেন দুবেলা এখনও তিনশো করে লোকের রান্না করা, কুটনো কাটা ইন্দুবালার দিনলিপি। আতিপাতি খোঁজ নিয়ে হোটেলের ঠিকানা চেয়ে দুটো এন্টাসিড লিখে ডাক্তার ছেড়ে দিলেন ইন্দুবালাকে। তার সাথে ইন্দুবালা তাঁকে বলে এলেন সকালে উঠে লেবুর জলের সাথে মধু খাওয়ার নিদান। তাও যে সে মধু নয়। সর্ষে ফুলের মধু। গরম জলের মধ্যে ঘুরবে তার ঝাঁঝ। চর্বি যাবে কমে। মন থাকবে ফুরফুরে। বাড়ি ফেরার পথে বড় খোকার গাড়ি থামিয়ে পাঁচ কিলো সর্ষের তেল কিনলেন। ততক্ষণে ছোট খোকা, খুকি বেসবাই ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। ইন্দুবালার মুখে হাসি। তিনি এক্ষুনি মরছেন। নাকি? বড় খোকার গাড়িতে এই প্রথম উঠে বেশ লাগলো তাঁর। চারপাশটা কেমন যেন ঠাণ্ডা। কী সুন্দর জুই ফুলের গন্ধ গাড়ির মধ্যে। হুশ হুশ করে কত জায়গায় বেড়াতে যায় ওরা। অথচ সবাই কত কষ্টে বড় হয়েছে। ঈশ্বর করুন যেন এমন থাকে সবাই। দুধে, ভাতে, সুখে, আনন্দে। ওদের এই শ্রী বৃদ্ধি দু চোখ ভরে দেখার আশায় ঈশ্বরের কাছে আরও কয়েকটা বছরের আয়ু চেয়ে নেন তিনি মনে মনে। 

ইন্দুবালার শরীর এখন বেশ ভালো। আদৌ কখনও খারাপ হয়েছিল কিনা বোঝা যায় না। তেলের মধ্যে আমগুলো যখন বেশ চুবো চুবো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রদীপ তার বউকে নিয়ে এলো একদিন। সেদিন যে কথাটা পাড়া হয়নি এবার বলেই ফেললো সাহস করে। “যাবে মা আমাদের সাথে বাংলাদেশ?” ইন্দুবালা খুব যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন তেমনটা নয়। এঁচোড় কাটছিলেন হাতে তেল মেখে আঠা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। কুটনো কাটা থেমে গেল তাঁর। বিয়ের পরে যখন দেশ থেকে এসেছিলেন তখন সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর আজ সেটা বাংলাদেশ। তাঁর ছেলে বলছে মাকে একবার বাংলাদেশ ঘোরাবে। সত্যি কানে ঠিক শুনছেন তো তিনি? কোনো ছলনায় এরা আবার এসে জোটেনি তো এই সাত সকালে? উঠে পড়েন ইন্দুবালা। পড়ে থাকে আধ কাটা এঁচোড়। ডালনার না কাটা আলু। মোচা। আরও অনেক তরিতরকারি। ছেলের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চান “হঠাৎ বাংলাদেশ যাওয়ার কথা বলছিস কেন? আমি না মরা পর্যন্ত এই বাড়ি তোমরা বিক্রি করতে পারবে না বড় খোকা”। প্রদীপ হো হো করে হাসে। “তুমি কী করে ভাবলে আমি বাড়ি বিক্রি করার জন্য তোমাকে বাংলাদেশের লোভ দেখাবো?” ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না বড় ছেলের কথা। “এই তো সামনের চক্কোত্তিবাড়ির মেয়ে দুটো বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট তুলে দিলো।” সম্পূর্ণা এবার এগিয়ে আসে। ইন্দুবলার বড়ছেলের বউ কম কথা বলে। কিন্তু যেটুকু বলে কাটা কাটা, তীক্ষ্ণ, নুন ছড়ানোর মতো। “আপনি ভুল বুঝছেন মা। চক্কোত্তি বাড়ির সাথে আপনার ছেলে-মেয়েদের গোলাবেন না। আমরা বাংলাদেশের ট্যুর প্ল্যান করছিলাম। আপনার ছেলে তাই ভেবেছিল আপনি গেলে আমাদের ভালো লাগবে। ও তো কোনোদিন দেখেনি…। কলকাতা স্টেশন থেকে এখন ট্রেনও ছাড়ছে। মৈত্রী এক্সপ্রেস। এর মধ্যে বাড়ি বিক্রির কথা আসছে কী করে? আর আমাদের সবার তো বাড়ি আছে মা…।” ট্রেন ছাড়ছে বাংলাদেশের জন্য এই বড় খবরটা ইন্দুবালার কাছে ছিল না এতদিন? “ট্রেনে করে যাওয়া যাবে খুলনা?” বড় ছেলে বলে যাবে। ইন্দুবালা প্রশ্ন করেন “জানলার ধারে সিট পাবো খোকা?” প্রদীপ জানিয়ে দেয় “পাবে। একটা কূপ রিজার্ভ করে নেবো মা। সেখানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না।” কেমন যেন ফুরফুরে মেজাজের হয়ে যান ইন্দুবালা। বাড়ির সামনের তুলসী মঞ্চটাকে স্পষ্ট দেখতে |||||||||| পান। মাকে…বাবাকে…ঠাম্মাকে…ভাইকে…মনিরুলকে…। 

বড় ছেলে, বউকে এঁচোড়ের ডালনা, মোচার ঘন্ট, পাবদার ঝোল আর কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে বাড়ি পাঠান ইন্দুবালা। সঙ্গে দিয়ে দেন এক শিশি আম তেল। ভাত খেতে আসা কালেক্টর অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে সামনের মেসের ছেলেগুলো এমনকি পাগলা পাঁচুও জেনে যায় ট্রেনে করে ইন্দুবালা বাংলাদেশ যাবেন। সারা রাত ওপরের ঘরে খটর মটর করে কীসের যেন আওয়াজ হয়। ধনঞ্জয় যতক্ষণ জেগেছিল শুনেছে। অনেক ভোরে ইন্দুবালার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায় তার। “কী হয়েছে মা? এত ভোরে?” চোখ কচলায় ধনঞ্জয়। দেখে ইন্দুবালার পরিপাটি করে চুল বাঁধা। নতুন কাপড় পরা। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। “কী হলো কি মা তোমার? নাতি পাসপোর্টের ফটো তোলার জন্য তোমাকে নিয়ে যাবে বেলা নটায়। এখন থেকে কাপড় পরে বসে আছো কেন?” ইন্দুবালা হুকুমের সুরে বলে “একটা ট্যাক্সি ডাক। আমি কলকাতা স্টেশন যাবো।” ধনঞ্জয় বলে “এ্যাঁ? এতো সকালে কলকাতা স্টেশনে? দেশে যাওয়ার নামে তোমার মাথা কি সত্যিই খারাপ হলো?” ইন্দুবালা কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগোলে কোনোরকমে উঠে জামা পরে দৌড় লাগায় ধনঞ্জয়। এই মুড তার অনেক দিনের চেনা। বেশি কথা বললে জেদ আরও বাড়বে। নিজেও চলে যেতে পারে। তখন হিতে বিপরীত হবে। দাদাবাবুদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে জান কাবার হবার জোগাড়। তাই কথা না বাড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিজেও চেপে বসে ধনঞ্জয়। 

দুটো প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটা হয়। ইন্দুবালা বলেন “জিজ্ঞেস কর মৈত্রী এক্সপ্রেস কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে?” একজন টিটি দেখিয়ে দেয়। “ওই তো… দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদিকে তো যেতে পারবেন না। সময় হয়নি এখনও। টিকিট আছে তো? পাসপোর্ট, ভিসা? সব চেক হবে কিন্তু।” ইন্দুবালার ওইসব কিছু নেই। তিনি দূর থেকে দেখেন মৈত্রী এক্সপ্রেসকে। ট্রেনের গায়ে বড় বড় করে বোর্ডে লেখা কলকাতা-খুলনা। কিন্তু সেই আগের ট্রেনটার মতো সবজেটে নয়তো। কেমন যেন ধূসর নীল। ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না। এবার নিজেই এগিয়ে যান টিটির কাছে, “আচ্ছা আপনি ঠিক বলছেন তো ভাই? এই ট্রেনটাই যাবে খুলনা?” বিরক্ত হয় টিটি। একে ইন্টারন্যাশানাল ট্রেন। তার ওপরে ঝক্কি আছে অনেক। সিকিউরিটির দিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। তার মাঝে কিছু লোক এসে দেশ দেশ করে এমন ন্যাকামো করে না। ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, “দেখতেই তো পাচ্ছেন লেখা আছে সব কিছু”। ইন্দুবালা অবাক হন নাতির বয়সী ছেলেটার বিরক্তি দেখে। “ওকি রেগে যাচ্ছো কেন বাবা? ধনা, ওনাকে দুটো নাড়ু দে। ট্রেন দেখতে আসলে কেউ এরম করে বকে?” কী বলবে বুঝতে পারে না বছর সাতাশের অখিলেশ। নতুন চাকরির প্রথম পোস্টিং তার। হাতে নাড় নিয়ে দিদার মতো এক মহিলাকে একটু দূর থেকে ট্রেনটা দেখতে বলে এগিয়ে যায় সে নিজের কাজে। ইন্দুবালা অবাক হয়ে দেখেন ট্রেনটাকে। এর কত ভাগ্য। কতবার ছুঁয়ে আসছে দেশটাকে। আর তিনি? সেই যে চলে এসেছিলেন আর একটি বারের জন্যেও যাওয়া হয়নি। বলা যেতে পারে যাননি। ধনঞ্জয় তাড়া দেয় “হলো মা তোমার? হোটেলের দেরি হয়ে যাবে যে। রান্না বসাবে কখন?”। ইন্দুবালা ধমকান, “তুই থাম। কিচ্ছু দেরি হবে না। সব আমি সামলে নেবো। কী জানিস তুই এই ট্রেনের?” ধনঞ্জয় মনে মনে ভাবে জানার আর কী আছে? সেও তো দেশের বাড়িতে ট্রেনে করেই যায়। আর মা এখন আদেখলার মতো ট্রেন ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেন কোনোকালে ট্রেন দেখেনি। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল একবার ট্রেনটার গায়ে স্পর্শ করতে। দুই দেশের মধ্যে যখন সব যোগাযোগ বন্ধ তখন সেই সবজেটে ট্রেনটাই কি একটা থমকে থাকা সময়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো না শিয়ালদার স্টেশনে? মাঝে মাঝে লছমীর সাথে শুধু সেই ট্রেনটাকে দেখবেন বলে চলে আসতেন ইন্দুবালা। সেই ট্রেনের গায়ে হাত দিলে তিনি তার দেশকে দেখতে পেতেন। গ্রামটাকে দেখতে পেতেন। গন্ধ পেতেন মায়ের আঁচলের। প্ল্যাটফর্ম এখনও ফাঁকা। ছোকরা টিটিকেও দেখা যাচ্ছে না আর। ইন্দুবালা আরও এগিয়ে যান ট্রেনটার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করেন তার গা। কিন্তু কোথায়? ভেসে আসছে না তো তার দেশের গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। বোসদের পুকুর। কপোতাক্ষ নদ। ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির মিটমিট করে জ্বলে থাকা। না না না এই ট্রেন তাঁর সেই সবুজ কাঁচা আমতেল রঙের ট্রেন নয়। এই ট্রেনে করে তিনি দেশ ছেড়ে আসেননি। এই ট্রেন তাঁর দাদুকে শেষবারের মতো নামিয়ে দেয়নি কপোতাক্ষের ধারে। এই ট্রেন তো এখন বেড়াতে যাওয়ার। দেশে ফেরার নয়। উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করা নয় সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে দেখার জন্য। চোখ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে জল। অনেক দিন আগে একাত্তরে তাঁদের কলাপোতার বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল খানসেনারা। বাড়ির সাথে পুড়েছিল মা, ভাই আরও অনেকে। সেই চিতাভস্ম আর হাজার হাজার শহীদের রক্তে যে দেশটা গড়ে উঠেছে নতুন করে সেখানে আজ গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ইন্দুবালা নিশ্চিত জানেন। এবার যদি গিয়ে গ্রামটাকেই না খুঁজে পান? যদি বোস পুকুরটাই আর না থাকে? কপোতাক্ষের ঘাট? মনিরুলের বাড়ির উঠোন? বড় মাঠের ফলসা গাছ? তাহলে কার কাছে ফিরে যাবেন ইন্দুবালা? কার আঁচলে মুখ লুকোতে? যারা ছিল অথচ আজ নেই? নাকি যারা মরেও বেঁচে আছেন ইন্দুবালার মধ্যে? নীরবে কাঁদেন ইন্দুবালা। কোনো সদুত্তর পান না অন্তর থেকে। শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভিড় বাড়ে। পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে মানুষ। এক সময়ে যে দেশটা নিজের দেশ ছিল সেটারই বেড়া টপকায়। প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যায় না সেই জলে। ওটা ইন্দুবালার দাদুর স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়। 

কলকাতা স্টেশনে যাত্রীদের আনন্দের আতিশয্যের ফাঁকে সেদিন ট্রেনে ওঠার আগে কেউ কেউ লক্ষ্য করলেন এক সত্তর পেরোনো মহিলাকে। যার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে করুণাধারা। যিনি চুপ করে বসে আছেন দেশ নামের এমন এক স্বপ্ন নিয়ে, যে দেশে তাঁর জন্যে আজ আর অপেক্ষা করে থাকবার কেউ নেই। মনে মনে আরও একবার প্রতিজ্ঞা করলেন ইন্দুবালা। ভাতের হোটেল ছেড়ে তিনি কোত্থাও কোনোদিন যাননি। আজও যাবেন না। শত প্রলোভনেও না। হনহন করে হাঁটতে থাকেন তিনি ওভার ব্রিজ দিয়ে। এক্ষুনি তাঁর মনে পড়ে গেছে আজকের মেনুতে আম-কই এর কথাটা বোর্ডে লিখতে ভুলে গেছেন। ধনঞ্জয় শুধু জানে এই একটা পদ খেতেই আজ ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে লাইন পড়বে। কই মাছের মাখো মাখো ঝোল থেকে সুবাস উঠবে আম তেলের। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *