অকাল তমসা

অকাল তমসা (THE SHADOW OUT OF TIME)

 [লাভক্র্যাফটের শেষ জীবনের এই গল্পটির সঙ্গে একমাত্র অ্যাট দ্য মাউন্টেইনস অব ম্যাডনেস গল্পটিরই তুলনা করা যায়। এখানেও এসেছে লাভক্র্যাফটের প্রিয় থিম, মানুষের মনের অদল-বদল। কিন্তু তার সঙ্গে এই গল্পে এসেছে কথক পিসলির জীবন কাহিনি, আশা নিরাশায় দুলতে থাকা মানুষটি বোঝার চেষ্টা করছিল তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলির অর্থ। গল্পের শেষ চমকে লাভক্র্যাফট বুঝিয়ে দিয়েছেন এই বিশাল মহাবিশ্বে মানুষের স্থান কতই না নগণ্য।]  

আমার নাম ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি। ছ-সাত বছর আগে যদি কেউ খবরের কাগজ বা বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল জার্নাল নিয়মিত ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকেন তাহলে তাঁদের কাছে আমার নামটা চেনা-চেনা ঠেকতেও পারে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৩ সাল অবধি আমার স্মৃতিবিলোপ তথা স্মৃতিবিভ্রাট নিয়ে ওই সময় কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছিল। এ ছাড়া ম্যাসাচুসেটস শহরে ক্রমাগত ঘটতে-থাকা ভৌতিক, অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে ডাকিনীবিদ্যার যোগসাজশ নিয়েও লেখা হয়। যার সূত্রপাত ঘটে আমার বাড়িতে। আমি জানি, আমার এই উন্মাদনা আমার মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে আসেনি। বাইরের সমান্তরাল কোনও জগৎ থেকে হঠাৎ করে অন্ধকার কেন নেমে এল এই পৃথিবীর বুকে! আমার এই লেখা পড়তে পড়তে আপনিও যখন সেই উৎস সন্ধান করবেন, তখন এই তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখার প্রথমদিকের অংশগুলো বাড়ি ফেরার পথে জাহাজের কেবিনে বসে লেখা। এইসব লেখাই আমি আমার মেজ ছেলে উইনগেট পিসলিকে দেব। উইনগেট এখন মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসার। ও-ই আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যে আমার ওই স্মৃতিবিভ্রাটের সময় থেকে সবসময় আমার পাশে ছিল। শুধু তা-ই নয়, উইনগেট আমার সমস্ত কথা বিশ্বাস করেছিল, এবং আমার এই বিচিত্র কেসের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করেছিল। আমি উইনগেটকে মুখেও বলতে পারতাম, কিন্তু আমার এলোমেলো কথা দিয়ে সবটা হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়। এই লেখা পড়ে আসল সত্যিটা কী, সেটা ও ঠিক খুঁজে বের করবে। দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কের মধ্যে বাইশ বছর কাটানোর পর ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসের ১৭-১৮ তারিখ নাগাদ একরাতে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় অবশেষে আমি খুঁজে পাই বহু যুগ ধরে সংরক্ষিত সেই প্রাচীন ভয়ংকর সূত্র। এই সূত্রের আসল সত্যি এতটাই ভয়ানক যে, আমার নিজেরই মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য মনে হয়। যদি সত্যিই এটা ঘটতে থাকে, তাহলে পৃথিবীর আসন্ন বিপদ প্রতিরোধের জন্য গোটা মনুষ্যজাতিকে প্রস্তুত থাকতে হবে। হয়তো সেই কারণেই আমি সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন খুঁজে বেরিয়েছি সেই আদিম অজানা অপার্থিব শক্তির কারিগরকে। আমার ধারণা, সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবার আমার যে নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা আর কোনও জীবিত মানুষের হয়নি। সেই আতঙ্কের সময় আমি একা ছিলাম। আমার মানসিক সুস্থতা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তি আমার কাছে ছিল না। আর এখন আমি শুধু নিজের মানসিক সুস্থতা প্রমাণ করতেই নয়, সমস্ত মানুষকে সতর্ক করার জন্যই এটা লিখছি।

আমি আগেই বলেছি, আমার এই উন্মাদনা বংশানুক্রমিকভাবে আমার মধ্যে আসেনি। আমার বাবা জোনাথন আর মা হানা দুজনেই ছিলেন হ্যাঁভারহিল শহরের একেবারে আদ্যিকালের মানুষ। আমার জন্ম, লেখাপড়া সব কিছুই হ্যাঁভারহিলের গোল্ডেন হিলের কাছে বোর্ডম্যান স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে। ১৮৯৫ নাগাদ আমি মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ঢুকি। তার আগে আর্কহ্যামের সঙ্গে আমার কস্মিনকালেও কোনও যোগাযোগ ছিল না। ১৮৯৬ সালে অ্যালিস সিজার বলে হ্যাঁভারহিলেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করি। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাদের জীবন বছর তেরো বেশ ভালোভাবেই কাটছিল। প্রথমে ইউনিভার্সিটির সহকারী ও পরে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলাম। এই সময়গুলো আমার কাজের চাপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, এইসব গুপ্তবিদ্যা, পরা-মনোবিজ্ঞান বা অপ-মনোবিজ্ঞান– কোনও কিছু নিয়েই মাথা ঘামাবার মতো অবস্থা আমার ছিল না।

তারপর এল সেই ভয়ংকর দিনটা। দিনটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে আছে। দিনটা ছিল, ১৪ মে, ১৯০৮–বৃহস্পতিবার। এই দিন থেকেই শুরু হল আমার মগজের যাবতীয় স্মৃতির ওলটপালট। ব্যাপারটা প্রথমে তেমনভাবে টের না পেলেও, পরে যখন হঠাৎ করে মৃদু আলোয় ঝড়ের গতিতে শেষ কয়েক ঘণ্টার সব দৃশ্য দেখতে লাগলাম, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এলোমেলো ওই দৃশ্যগুলো আমার মাথা পুরোপুরি ঘেঁটে দিল। হঠাৎ করেই যেন কোনও অশুভ ইঙ্গিত টের পেলাম। মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি পিটতে লাগল। আর একটা জিনিস টের পেলাম, কেউ যেন আমার মগজের যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে দখল করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বেলা দশটা কুড়ি নাগাদ যখন আমি ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ করেই চোখের সামনে বিদঘুটে কিছু অপরিচিত জ্যামিতিক আকার ভেসে উঠল। ক্লাসরুমটা মনে হল যেন অন্য কোনও একটা অদ্ভুত আকারের ঘর। এরপর অর্থনীতির ছ নম্বর অধ্যায় থেকে সরে গিয়ে ছাত্রদের খুব গুরুত্ব সহকারে কী বলেছিলাম, এখন মনে নেই। তবে ছাত্রদের চাউনি দেখে টের পেয়েছিলাম, তারা ভয়ে হতবাক হয়ে গেছে। এরপর আমি প্রায় অচেতনভাবে চেয়ারে বসে পড়ি। আমি নাকি এমন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম যে, কেউ আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলতে পারেনি। যেমন তারা পারেনি পাঁচ বছর চার মাস তেরো দিনে, দিনের আলোয় এই দুনিয়ার বিপর্যয় ঠেকাতে। এর পরের ঘটনাগুলো লোকের মুখে শুনেছিলাম। ২৭ নং ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসা শুরু হলেও প্রায় সাড়ে ষোলো ঘণ্টা আমার কোনও হুঁশ ছিল না।

১৫ মে ভোর ৩টে নাগাদ আমি চোখ খুলে কথা বলতে শুরু করি। কিন্তু আমার সেই বিচিত্র ভাষা আর চাউনি দেখে বাড়ির লোকজন আর ডাক্তার রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। আমি যে স্মৃতিশক্তি লোপাট হবার ফলে নিজের পরিচিতি পুরোপুরি ভুলে গেছি– এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়। যদিও আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম স্মৃতিবিভ্রাটের ব্যাপারটা গোপন করার। ওই সময় আমি আমার আশপাশের লোকজনদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মুখের পেশির নড়াচড়ার সঙ্গে সেই চাউনির কোনও মিল ছিল না। এমনকী আমার কথাবার্তাও কেমন অদ্ভুত হয়ে গিয়েছিল। গলা দিয়ে যে আওয়াজগুলো বের হত, সেগুলো শুনলে হয়তো কারও মনে হবে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ক-টা ইংরেজি শব্দ আমি আয়ত্ত করতে পেরেছি।

প্রায় বছর কুড়ি বাদে ১৯০৮ সালে আর্কহ্যামের সেই বিচিত্র পেশেন্টের রহস্যময় কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে আমেরিকায়। আর্কহ্যামের ডাক্তারবাবুরাও নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন। আমার শারীরিক শক্তি ফিরে এলেও হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালানোর জন্য আমাকে বিশেষভাবে তালিম দেওয়া হত ডাক্তারবাবুদের কড়া তত্ত্বাবধানে। যখন আমি দেখলাম, আমার স্মৃতিবিভ্রাটকে লুকোবার যাবতীয় প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেল, তখন বাধ্য হয়ে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। ডাক্তারবাবুরা ভাবলেন, ওই স্মৃতিবিভ্রাটকে আমি মেনে নিয়েছি স্বাভাবিক হবার বদলে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভাষা, শিল্প, উপকথা ইত্যাদি বিষয়ে আমার তুমুল আগ্রহ তাঁদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল। আবার কিছু আচরণ নেহাতই খোকাগিরি মনে হল তাঁদের। বলাই বাহুল্য, এই পরস্পরবিরোধী ব্যাপারগুলো শুধুই জটিলতা বাড়ায়, আর কিছু নয়। এই সময় আমি লক্ষ করলাম, কোনও অদ্ভুত ভাষায় কে যেন আমার মাথার ভেতর থেকে আমাকে ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে চলেছে। এই ভাষাটাকে পার্থিব কোনও কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করি। অতীত বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা আমার কাছে ছেলেখেলার মতো হয়ে যায়। অবশ্য এই ভবিষ্যৎ বলাটা দু-তিনবার মিলে যাওয়ায় রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি হয় চারপাশে। একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম, এই ভবিষ্যৎগুলো যখন বলতাম, একটা ভূতুড়ে বিদ্যুতের ঝলক এসেই গায়েব হয়ে যেত। এই ব্যাপারটা আমি ছাড়া আর কেউ লক্ষ করেনি। এদিকে আমি চেষ্টা চালাতে লাগলাম, যত জলদি পারিপার্শ্বিক সব কিছু শিখে নেওয়া যায়। দূর দেশ থেকে কোনও পর্যটক নতুন জায়গায় এলে যেমন করে আর কী। ডাক্তারবাবুদের অনুমতি পাবার পর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটাতে লাগলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে জোগাড় করা, তথ্য আর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে যেসব গুপ্তবিদ্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেইসব বিষয়ের ওপর লাগাতার গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। যেগুলো পরবর্তীকালে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে।

ইতিমধ্যে সমসাময়িক মনোবিদদের কাছে আমি তখন রীতিমতো এক সেলেব্রিটি। দ্বৈত সত্তার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে আমাকে পেশ করে নানা জায়গায় বক্তৃতাও দেওয়া হয়। যদিও বক্তারা আমার আচরণ নিয়ে বক্তৃতায় যা যা বলেছিলেন, সেগুলো আদৌ গুরুত্ব সহকারে বলেছিলেন, নাকি মজা করে তা আমার কাছে আজও রহস্য। এই সময় কারও কাছ থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পাইনি। আমার হাবভাব সবার মনেই ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। আমি যেন সুস্থ স্বাভাবিক সব কিছু ছেড়ে ধীরে ধীরে এক আদিম অন্ধকার ও গোপন আতঙ্কের জগতে প্রবেশ করছিলাম। আমার নিজের পরিবারও কোনও ব্যতিক্রমী আচরণ করেনি। আমার স্ত্রী আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠত। যেন আমি কোনও ভিন গ্রহের বাসিন্দা। ১৯১০ সালে তার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়। এমনকী ১৯১৩ সালে আমি স্বাভাবিক হবার পরেও সে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি। এরপর আমার বড় ছেলে আর ছোট মেয়ে কারও সঙ্গেই আমার আর কোনও দিন দেখা হয়নি।

একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার মেজ ছেলে উইনগেট, যার কথা এই লেখার গোড়াতেই আমি বলেছি। আমার আচরণ অচেনা লোকের মতো হলেও উইনগেট সেই ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। হয়তো ওর কচি মাথা ওকে ভরসা জুগিয়েছিল যে, একদিন ওর বাবা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। পরে যখন আমি আদালতের নির্দেশে রেহাই পেলাম, আমি উইনগেটের কাছেই ছিলাম। উইনগেট আমাকে সমস্তরকম সাহায্য করত। অনেক পড়াশোনা, গবেষণা সে চালায় আমার ওই পরিস্থিতির ওপর। এখন ও মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, সে কথা তো আগেই বলেছি।

আমি যদিও এগুলো নিয়ে আর ভাবছিলাম না। কারণ সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবারে আমার যা যা পরিবর্তন হয়েছিল, সেটা আমার এই স্বাভাবিক সত্তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯০৮ থেকে ১৯১৩- এই পাঁচ বছরে আমার জীবনে ঠিক কী কী ঘটেছিল, হাজার চেষ্টা করলেও আমি আর মনে করতে পারব না। যদি পাঠকরা বিশেষ কৌতূহলী হন তাহলে পুরোনো খবরের কাগজ বা সায়েন্স জার্নালের সাহায্য নিতে পারেন। আমি নিজেও তা-ই নিয়েছি। আমার যা কিছু পুঁজি ছিল, খুব বুঝেসুঝে খরচা করতে হত। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা করতে হত। যদিও আমি একাই যেতাম, কিন্তু জায়গাগুলো এমন পাণ্ডববর্জিত যে, যেতে প্রচুর সময় লাগত, তাই খরচাও যেত বেড়ে।

১৯০৯ সালে হিমালয়ে প্রায় এক মাস কাটাই। ১৯১১ নাগাদ আবার আরবের এক অচেনা মরুভূমিতে উটের পিঠে চেপে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য ওই অভিযানগুলো একেবারে ব্যর্থ হয়নি। কিছু জিনিস আমি শিখতে পেরেছিলাম। ১৯১২-র গ্রীষ্মে একটা চার্টার্ড জাহাজে করে উত্তর মেরু রওনা হলাম। গন্তব্য স্পিঞ্জ বার্গেনের উত্তরদিক১৮৯। এবারেও হতাশ হলাম। ওই বছরেরই মাঝামাঝি পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় একটা পেল্লায় চুনাপাথরের গুহার সন্ধান পেলাম। গুহা তো নয় যেন গোলকধাঁধা! আমার নিজের পায়ের ছাপ খুঁজতেই অসুবিধে হচ্ছিল রীতিমতো। এদিকে আমার নিজের আচরণ দেখে আমি নিজেই ঘাবড়ে যেতাম। ইউনিভার্সিটির লাগোয়া যেখানে থাকতাম, সেখানে সব জায়গায় আমার উন্মাদনার ছাপ ছড়িয়ে ছিল। সব থেকে ঘাবড়ে দেবার মতো ব্যাপার ছিল, সবসময় যেন কোনও দ্বিতীয় সত্তা আমাকে গ্রাস করতে চাইত। যে-কোনও বই আমি একঝলক দেখেই মুখস্থ করে ফেলতাম। যে-কোনও জটিল ধাঁধা যেভাবে মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করে ফেলতাম, তা সত্যিই তারিফ করার মতো। এই সময় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে আমার পড়ানো ও অন্যান্য আচরণ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আসতে লাগল। যদিও এই চাকরি নিয়ে আমার তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এদিকে আর একটা রিপোর্ট এল, যার বক্তব্য ছিল, আমার সঙ্গে বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যার চক্রের নেতাদের যোগাযোগ আছে। ছাত্ররা সন্দেহ করতে লাগল সমান্তরাল জগতের কোনও বাসিন্দাই এই গুপ্তবিদ্যার উপাসক। যদিও এগুলো গুজব হিসেবেই থেকে যায়। কিছুই প্রমাণ হয়নি। আমার ধারণা, আমি লাইব্রেরি থেকে যেসব প্রাচীন আর নিষিদ্ধ বই নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেছিলাম, সেগুলোই এই গুজবের উৎস। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি বলে কথা! গোপন করা যায়নি। অবশ্য যে বইগুলো থেকে আমি নোটস নিতে শুরু করি, সেগুলো দেখে যে-কোনও কারওই সন্দেহ করার কথা। ডি এরলেটসের কাল্টস ডি গাউলস, লুডউইগ প্রিনের ডি ভারমিন মিস্ট্রিজ, ভন জানৎসের আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন বা সেই উন্মাদ আরব আবদুল আলহাজ্রেডের লেখা কুখ্যাত নেক্রোনমিকন। নিঃসন্দেহে কোনও সক্রিয় অশুভশক্তিই ওই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমার ভেতর এক অন্য সত্তার সৃষ্টি করেছিল।

১৯১৩-র গ্রীষ্মকালে আমি গতানুগতিক কিছু বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করলাম। সবাই ভাবল, খুব শিগগির হয়তো আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠব। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ শুরু করলাম। যদিও মনোবিদদের কাছে এগুলো নিছক মেকি বলেই মনে হতে লাগল। হয়তো তারা ভেবেছিল, আমি নিজের পুরোনো লেখালেখি থেকেই এগুলো আয়ত্ত করেছি।

আগস্টের মাঝামাঝি আমি আর্কহ্যাম থেকে ফিরে এসে আস্তানা গাড়লাম বহু দিন ধরে খালি পড়ে-থাকা ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে। ইউরোপ আর আমেরিকায় নতুন যত কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, খুব সাবধানে আনাতে লাগলাম। অবশ্যই একেবারে নয়, বারে বারে। কারণ একটাই, যদি কোনও অতিচালাক জিনিসটা বুঝতে পেরে যায় তাহলে মহাসমস্যার সৃষ্টি হবে। যদিও একজন মজুর, কাজের লোক আর হাউসকিপার ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ জানত না। আর তারা এ ব্যাপারে কী-ই বা বুঝত? কাঁড়িখানেক রড, হুইল আর আয়নাসমৃদ্ধ খুড়োর কল। এই খুড়োর কল লম্বায় ছিল দু-ফুট, চওড়ায় এক ফুট আর এর ঘনত্ব ছিল এক ফুট। এর কেন্দ্রের আয়নাটা ছিল উত্তল গোলাকার।

২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধেবেলায় আমি হাউসকিপারকে তার হিসাবপত্র বুঝিয়ে বিদায় করলাম। আর কাজের লোককে বললাম পরের দিন দুপুরের আগে না আসতে। সে দিন অনেক রাত অবধি আমার ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে আলো জ্বলেছিল। আর কথামতোই এক রোগা, শ্যামলা ভিনদেশি গাড়ি চড়ে এসে হাজির হয়েছিল ক্রেন স্ট্রিটের বাড়ির সামনে। রাত একটা নাগাদ বাড়ির সব আলো জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। রাত দুটো পনেরো নাগাদ একজন টহলদারি পুলিশ নাকি দেখেছিল গোটা বাড়িই অন্ধকার, কিন্তু বাড়ির সামনে সেই ভিনদেশির গাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে। ভোর চারটে নাগাদ হঠাৎ করেই গাড়িটা যেন গায়েব হয়ে যায়। সকাল ছটা নাগাদ খসখসে, ভাঙা গলায় বিদেশি উচ্চারণে কেউ ড. উইলসনকে ফোন করে জানায় আমার অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা। পরে ওই ফোন কলের হদিশ পাওয়া যায়। ফোনটা করা হয়েছিল বোস্টনের নর্থ স্টেশনের এক পাবলিক বুথ থেকে। দূরপাল্লার ওই কলের হদিশ পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি ওই রহস্যময় ভিনদেশির কোনও হদিশ।

ড. উইলসন যখন আমার বাড়ি এলেন, তখন আমি আরামকেদারায় বেহুশ অবস্থায় পড়ে আছি। সামনে একটা টেবিল। ড. উইলসন টেবিলের ওপর অনেক আঁচড়ের দাগ দেখতে পান, যেন কোনও ভারী জিনিস ওপরে আছড়ে পড়েছে। বিদঘুটে সেই খুড়োর কলমার্কা যন্ত্রটাও গায়েব। নিঃসন্দেহে সেই রোগা, শ্যামলা ভিনদেশিই ওটা নিয়ে গিয়েছে। স্মৃতিবিভ্রাটের পর আমি টুকরো কাগজে যা যা লিখেছিলাম, তার সব কিছু পোড়ানো হয়েছে নিপুণভাবে। লাইব্রেরির ঝাঁজরি সেই কাগজ-পোড়া ছাইয়ে ভরতি। ড. উইলসন লক্ষ করেন, আমি খুব অস্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিচ্ছি। তিনি একটা হাইপোডারমিক ইনজেকশন দেবার পর সেটা স্বাভাবিক হয়।

২৭ সেপ্টেম্বর বেলা এগারোটা পনেরো নাগাদ জোরে ঝটকা মেরে নড়ে উঠি; এবং আমার সেই পাথুরে মুখে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ফিরতে থাকে। ড. উইলসনের মতে, আমার ওই অভিব্যক্তিগুলো কোনও দ্বৈত সত্তার অভিব্যক্তি ছিল না। একেবারেই আমার নিজস্ব ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। ১১.৩০টা নাগাদ আমি বিড়বিড় করে কিছু বলতে আরম্ভ করি। ড. উইলসনের মতে সেগুলো কোনও পার্থিব ভাষা ছিল না। আমাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোনও কিছুর বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে বাড়ির কাজের লোক এসে দেখে আমি স্বাভাবিক ভাষায় বিড়বিড় করছি, ওই সময়ের অর্থনীতি ছিল নিতান্তই একমুখী। জেভনস ব্যাখ্যা করেন, ওই সময় অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণকারী যে কোনও বাণিজ্যই বিজ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওঁর মূল প্রচেষ্টা ছিল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির চক্রের সঙ্গে সৌরকলঙ্কের ক্রমবৃদ্ধির মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন…।

ন্যাথানিয়েল উইনগেট প্রিসলি হিসেবে আমি ফিরে এলাম নিজের মধ্যে। যদিও আমার কাছে দিনটা ছিল সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবার। ১৪ মে ১৯০৮৷ আমি অর্থনীতির ক্লাস নিচ্ছি।

এই অবধি পড়ার পর কেউ হয়তো ভাবছেন, ১৯১৩ সালে আমার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসার পর সব কিছু হয়তো খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আদপেই তা হয়নি। জীবন থেকে যে পাঁচ-পাঁচটা বছর বেমালুম গায়েব হয়ে গেল, সেই ঘাটতি পোষাতে যে আমাকে কী পরিমাণ নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা কেউ ধারণাও করতে পারবেন না। ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে বসে বসে এই পাঁচ বছর আমার আচরণ (অন্যদের থেকে শোনা) নিয়ে অনেক দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ধোপে টেকেনি। ভাবতে ভাবতে নিজেই অবাক হয়েছি, আবার বিরক্তও হয়েছি। এই সময় আমার মেজ ছেলে আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯১৪-র ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউনিভার্সিটির চাকরিটায় আবার যোগ দিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলাম, যাতে সব ভন্ডুল না হয়ে যায়। কোনওমতে যাতে চাকরিটা টিকে যায়। এই পাঁচটা বছর যে আমাকে কীভাবে ঘেঁটে দিয়েছে, পদে পদে টের পেতে লাগলাম। আমার আগের মতো মনের জোর আর না থাকলেও নিজের হাবভাব যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু নানারকম অদ্ভুত চিন্তা আর দুঃস্বপ্ন আমাকে নাজেহাল করে রেখেছিল। এদিকে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আমিও ইতিহাসের বিভিন্ন কালান্তক ঘটনা নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম (অবশ্যই একটু অন্যরকমভাবে)। সময় সম্পর্কে আমার ধারণা পুরো পালটে গিয়েছিল। সময়ের বিবর্তন, ধারাবাহিকতা সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। সময় নিয়ে নিজেই এক নয়া কাল্পনিক ধারণা বানিয়ে বসলাম। যুগের ঘেরাটোপে আটকে না থেকে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে ছড়িয়ে-থাকা সেই অনন্তব্যাপী জ্ঞানের সমুদ্রে নিজেকে সঁপে দিলাম। এই বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি কী হতে চলেছে তা যেন আমার সামনে ছবির মতো ভেসে উঠল ভবিষ্যতের আলোয়। যুদ্ধের সব ভয়াবহ স্মৃতি মগজে জমা রইল, এবং কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ কীরকম কৃত্রিমভাবে এই যুদ্ধের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার ভোল পালটে দিচ্ছে, সেটাও টের পেলাম। আমি অনেককেই আমার এই ধারণার কথা বলেছিলাম। কেউ কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত যেন আমিই পৃথিবীর সেই অষ্টম আশ্চর্য! গণিত বিভাগের কয়েকজন অবশ্য কিছুটা মন দিয়ে আমার এই ব্যাখ্যা শুনলেন এবং আপেক্ষিকতার ওপর নয়া নয়া আবিষ্কারের ওপর কিছু জ্ঞানও দিলেন আমাকে। ওঁরা যে নিজেদের চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে চান না, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সময়কালের ওপর আইনস্টাইনের মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও দু-চার কথা শুনতে হল। বিশেষ করে ওই অতিমাত্রিক মতবাদের সমালোচনা।

যা-ই হোক, আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। ওইসব দুঃস্বপ্নের ভয়ানক অনুভূতির প্রভাব আমার ওপর এতটাই পড়েছিল যে, ১৯১৫ নাগাদ চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হলাম। যদিও ওই দুঃস্বপ্ন আমার রোজকার রুটিনে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু যেটা বলার ব্যাপার, সেটা হল, এই সময় ওই দুঃস্বপ্ন একটা নির্দিষ্ট আকার নিতে শুরু করল। টের পেলাম, আমার স্মৃতিবিভ্রাট কোনও সাধারণ ব্যাপার ছিল না। একটা অশুভ ইঙ্গিতের পূর্বাভাস ছিল মাত্র। আমার মনের ঘরে সেই দ্বিতীয় সত্তা অনধিকার প্রবেশ শুরু করে দিল রীতিমতো। উদ্দেশ্য একটাই, আমার প্রাথমিক সত্তাকে হটিয়ে দিয়ে সে-ই থাকবে আমার মগজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, একজন চালাতে লাগল আমার শরীর, আর একজন আমার মগজ। এই সময় আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে আমার এই আচরণ সম্পর্কে খোঁজ লাগালাম এবং আরও ভয় পেয়ে গেলাম। আমার আচরণ হয়তো অন্যদের পিলে চমকে দিয়েছিল, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেটা হল, আমার সচেতন আর অবচেতন মনের গণ্ডি গেল ঘুচে। বিভিন্ন অশুভ জ্ঞান আমার মাথায় কিলবিল করে ঘুরত। ওই অভিশপ্ত পাঁচ বছরে বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে আর নানা জায়গায় ঘুরে আমি যা যা তথ্য পেয়েছিলাম, তার ওপর শুরু করলাম আরও পড়াশোনা আর গবেষণা। যদিও আমার আসন্ন সব বিপদ একই রকম অদ্ভুত ছিল না। এমন কিছু কিছু স্বপ্ন দেখতাম, যেগুলো সেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে ধারণা আরও মজবুত করে তুলত। আমার মেজ ছেলে উইনগেট আর কিছু পরিচিত মনোবিদ ছাড়া কাউকেই কিছু বলিনি। পাশাপাশি স্মৃতিবিভ্রাটের বিভিন্ন কেস নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিলাম নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য। আগেই বলেছি, সেই সময়কার মনোবিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমি একজন সেলেব্রিটি হয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমার এই দ্বৈত সত্তার কেস নিয়ে যে যে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, পরা-মনোবিজ্ঞানী, এমনকী প্রেততত্ত্ববিদরাও যা যা লিখেছিলেন বা বলেছিলেন, সেগুলো পড়ে ফেললাম। প্রথমে একটু ভয়ের উদ্রেক হলেও, সত্যি বলতে কী, পরের দিকে কিছুটা সান্ত্বনাও পাই। কারণ আমি বুঝেছিলাম যে, আমার ওইসব স্বপ্ন বা আচরণ কোনও সাধারণ স্মৃতিবিভ্রাটের কেস ছিল না। কারণ যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছি, তার কাছে এগুলো শিশু। কিছু চিকিৎসা হয়েছিল মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে, আর কিছুটা ছিল সাংবাদিকদের রং-চড়ানো আষাঢ়ে গল্প। আরও বুঝলাম যে, মানুষের বিবর্তনের বহু যুগ বাদে এই বিরল ঘটনা ঘটেছে, যার শিকার ও সাক্ষী শুধু আমি। হয়তো বিগত কয়েক শতকের ইতিহাস ঘাঁটলে আরও এরকম একটা দুটো কেস পাওয়া যেতে পারে, আবার না-ও পারে। এত ঘাঁটাঘাঁটি করে যেটা সারমর্ম বুঝলাম যে, এই ঘটনার শিকার হয়েছে সবসময় কোনও ভাবুক বা কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তি যেমন এক্ষেত্রে আমি। এবং সৃষ্টি হয় এক দ্বিতীয় সত্তার, যা সচেতন ও অবচেতন মনকে শুরু করে দেয় নিয়ন্ত্রণ। এই অপার্থিব সত্তার প্রভাবে কণ্ঠস্বর, আচার-আচরণ সবই যায় পালটে। আগ্রহ জন্মায় ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব ও শিল্পকলা সম্পর্কে। এবং শুধু আগ্রহই জন্মায় না, তার সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে জ্ঞান আহরণ। এবং ফলস্বরূপ দেখা দেয় ভয়ংকর সব স্বপ্ন, যার প্রভাবে স্বাভাবিক জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। এই অবধি জানার পর আমার সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নগুলোর প্রকৃতি যে ঠিক কীরকম তা বুঝলাম। দু-একটা কেস দেখলাম, যেখানে মহাজাগতিক যোগাযোগের কথাও বলা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেগুলোর সঙ্গে নিজের ঘটনার মিল পেয়ে আমি আরও আগ্রহী হয়ে উঠলাম। তিনটে কেসে স্পষ্টভাবে কোনও অজানা যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। আমার মনে পড়ে গেল আমার স্মৃতি ফিরে আসার আগের ঘটনা, এইরকম একটা যন্ত্র তো আমিও বানিয়েছিলাম! যে মহাজাগতিক সংযোগের কথা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও অপার্থিব যন্ত্রণার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। আরও কয়েকটা জিনিস লক্ষ করলাম। এইসব কেসেই আক্রান্ত ব্যক্তি মাঝারি মানের বুদ্ধিবিশিষ্ট, ওই ধরনের যন্ত্র তৈরির কথা ভাবাও তাদের সাধ্যের বাইরে। দ্বিতীয়ত, এরা প্রত্যেকেই চালিত হয়েছে কোনও অশুভ ভিনগ্রহী শক্তির দ্বারা। তারপরেই সেই স্মৃতিবিভ্রাট ও মগজে থেকে যাওয়া সেই অপার্থিব আতঙ্কের ক্ষীণ স্মৃতি।

এতক্ষণ যা যা লিখেছি তা থেকে নিশ্চয়ই আমার স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নগুলো কতখানি ভয়ানক ছিল তা বোঝা গেছে। ইতিমধ্যে আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে, বদ্ধপাগল হবার প্রাথমিক ধাপে আমি প্রবেশ করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমার আগে যারা এই ঘটনার শিকার হয়েছে, তারাও কি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল? কে জানে! একদিকে এই সচেতন আর অবচেতন মন যুদ্ধ চালাত, আর অন্যদিকে আমার মগজে এইসব বিদঘুটে ভাবনা পাকাপাকি জায়গা দখল করে বসেছিল। ওহ্ একটা কথা বলাই হয়নি। আমার ওই উপকথার থিয়োরিগুলো কিন্তু ইতিমধ্যে স্বীকৃতির তকমা পেয়েছিল। এমনকী ভিনগ্রহীদের মতবাদে বিশ্বাসীরাও আগে ঘটে-যাওয়া অনেক কেসের হদিশ দিয়ে আমাকে বিস্তর সাহায্য করেছিলেন। সব থেকে আনন্দদায়ক বিষয় হল, তাঁরা আমাকে পাগল তো বলেনইনি, বরং এটাকে সাময়িকভাবে স্নায়ুবৈকল্যের উপসর্গই বলেছিলেন। আমার কাজ ছিল শুধু তথ্যসংগ্রহ আর বিশ্লেষণ আর ওঁদের কাজ ছিল মনোবিজ্ঞানের আলোকে সেগুলোর ভুল সংশোধন। এমনকী কিছু ডাক্তার তো আমার আর আমার ওই দ্বৈত সত্তার ওপর রীতিমতো পড়াশোনা আরম্ভ করে ফেলেছিলেন।

যখন আমার প্রথম স্মৃতিবিভ্রাট ঘটে, তখন কিন্তু এগুলো টের পাইনি। সত্যি বলতে কী, ওইসব উদ্ভট ব্যাপারস্যাপার তখন আমাকে পুরোপুরি ঘেঁটে দিয়েছিল। একটা অজানা আদিম অপার্থিব আতঙ্ক আমাকে সবসময় কুরে কুরে খেত। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, যাতে নিজের চেহারা দেখতে না হয় তাই আয়না দেখার পাটই দিয়েছিলাম চুকিয়ে। দাড়িও কাটতাম নাপিতের কাছে গিয়ে। আমার চোখ সবরকম রং সহ্য করতে পারত না তাই নীল বা ছাইরঙা পোশাক-পরা কোনও লোককে দেখলে একটা অদ্ভুত স্বস্তি পেতাম। বাদবাকি সময় চাউনি নীচের দিকেই রাখতাম; সরাসরি কোনওদিকে তাকাতাম না। অবশ্য এগুলো আমার ওই উদ্ভট কল্পনার কায়িক আকার নেওয়ার অনেক আগের ঘটনা। ইতিমধ্যে আমি কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, কেউ যেন ইচ্ছে করে ওইসব দৃশ্যের ঝলকগুলো আমার সামনে হাজির করছে, যাতে আমি যোগসূত্রগুলো খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কী, মানেগুলোও আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম। কালের চক্রের সঙ্গে সঙ্গে ওই অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার, পৈশাচিক দৃশ্য– অন্যদিকে আমি আর মাঝখানে সেই যোগসূত্র। এটাও বুঝলাম, কেউ ওগুলোর সঙ্গে আমার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করতে চাইছে।

এবার আসা যাক আমি যে ঝলকগুলো দেখতাম, সেগুলো প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলি, ওগুলো যতটা না ভয়ানক ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল উদ্ভট। যেটা আপনা আপনিই একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করত। ঘোরের মধ্যে দেখতাম, আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি পেল্লায় পেল্লায় পাথুরে খিলানওয়ালা একটা কুঠুরির মধ্যে। অনেকটা রোমান কায়দায় তৈরি ওই খিলানগুলো এমনই সোজা খাড়া উঠে গিয়েছে যে, যতই মাথা উঁচিয়ে দেখি-না কেন ওগুলোর চূড়া দৃষ্টিগোচর হত না! খিলানগুলো আশপাশে কেবল তৈরি করেছে আলো আঁধারি কিছু ছায়া। রোমান কায়দায় তৈরি বিরাট বিরাট গোলাকার জানলা, খিলানওয়ালা দরজা, মাঝে মাঝেই গোলাকার বেদির মতো টেবিল, দেওয়ালে আলো-আঁধারি ঢাকা কাঠের তাক– যেগুলো ঠাসা থাকত আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিকের মতো ভাষা খোদাই করা বইয়ে– এই হল ওই কুঠুরির বর্ণনা। এখন বলার বিষয় হচ্ছে, সব কিছুই ছিল সাধারণ ঘরের থেকে অনেক অনেক বড়। পাথুরে কুঠুরিতে অদ্ভুত সব প্রাগৈতিহাসিক জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা থাকত। গোটা কুঠুরিটাই ছিল যেন পেল্লায় আকারের এক গম্বুজ। আর-একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ওখানে কোনও চেয়ার ছিল না। কাঠের তাকে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা বইয়ের সঙ্গে থাকত কিছু কাগজের তাড়া যেন লেখার কাজে কেউ ওগুলো ব্যবহার করে। আর থাকত চকচকে ধাতুর তৈরি কিছু বয়াম, যার ছুঁচোলো ছিপিগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। কুঠুরিতে একটা উঁচু পাদানি ছিল, তাই মাঝে মাঝে আমি ওই পাদানিতে উঠে ওপর থেকে গোটা ঘরটাই দেখতে পেতাম। আলোর কাজ করত ওই কুঠুরিতে রাখা কিছু গোলাকার স্ফটিক। ওই আলোতে বেশ অদ্ভুত ধরনের কিছু যন্ত্রও দেখতে পেতাম। যন্ত্রগুলো অনেকটা আমার সেই অভিশপ্ত দিনে তৈরি করা বিটকেল রড আর নলওয়ালা খুড়োর কলের মতোই দেখতে ছিল। কিছু মোটা গরাদওয়ালা জানলাও ছিল, যদিও আমি কখনওই ওগুলোর ধারেকাছে যাওয়ার সাহস দেখাইনি! এরপর স্বপ্নে আরও কিছু জিনিস যোগ হল। আমি দেখতাম, ওপরে-নীচে দানবীয় নকশাওয়ালা এক পাথুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। কোনও রাস্তাই তিরিশ ফুটের কম চওড়া ছিল না এবং কোথাও ছিল না কোনও সিঁড়ি। রাক্ষুসে মূর্তিগুলো কম করে হাজার ফুট লম্বা ছিল, কারণ ওগুলো দেখলে মনে হত, ওগুলো যেন আকাশে মিলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও ছিল কালোলা রঙের নানা আকারের খিলান আর মুখ আটকে রাখা কিছু দরজা। হয়তো ওগুলোর আড়ালে কোনও ফাঁদ পাতা ছিল, দেখলেই মনে হত, ওগুলো কখনও ভোলা হয়নি। একটা আবছা, ভয়ংকর বিপদের আভাস পেয়ে আমি শিউরে উঠতাম। আমার নিজেকে ওই আতঙ্কপুরীতে এক বন্দি মনে হত। দেওয়ালে আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক নকশাগুলো যেন আমাকে দেখে ঠাট্টা করে বলত, এ যাত্রায় বেঁচে গেলে হে!

এরপর আমার স্বপ্নে যোগ হল বেশ সুন্দর দেখতে গোল গোল কিছু জানলা আর ওই আতঙ্কপুরীর ছাদ। বিরাট ওই ছাদ থেকে আমি একটা বাগান দেখতে পেতাম। বাগানের বেশির ভাগটাই ছিল পাথুরে আর ঢালু। বাগানের চারদিকে আরও অনেক বিরাট বিরাট বাড়ি দেখতাম। ওই বাড়িগুলোতেও এরকম বাগান ছিল। বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে কম করে দু-শো ফুট চওড়া রাস্তা থাকত। বাড়িগুলোর এক-একটার আকার ছিল এক একরকম। কিন্তু কোনওটাই চওড়ায় পাঁচশো ফুট আর লম্বায় হাজার ফুটের কম ছিল বলে মনে হয় না। এক-একটা এতই উঁচু ছিল যে মনে হত, কোনও পাহাড়ি টিলার ওপর রয়েছে। আর মিশে গেছে কোনও ধূসর জগতে, হয়তো যেটাকে আমরা স্বর্গ বলে থাকি। বাড়িগুলো দেখলে মনে হত পাথর আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। এবং ওই বাড়িগুলোর গায়েও আমার আতঙ্কপুরীর মতো হায়ারোগ্লিফিক নকশা আঁকা থাকত। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ওই বাড়িগুলোর কোনও কোনওটার সমান ছাদেই বাগান থাকত। আর যে বাড়িগুলো আমার নজরের আওতার বাইরে থাকত, সেগুলোতে কোনও বাগান দেখতে না পেলেও মনে হত, ভেতরে বাগান রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় নলের মতো দেখতে কিছু উঁচু টাওয়ার দেখতাম। সব কিছু ছাপিয়ে-যাওয়া এই টাওয়ারগুলোর গায়ে খোদাই করা বিটকেল কারিগরিওয়ালা নকশাগুলো দেখে আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেতাম।

টাওয়ারগুলোর ওপরটা ছিল গোলাকার আর তাতে মোমবাতির মতো একটা ক্ষীণ আলো দেখা যেত৷ টাওয়ারগুলোতে কোনও দরজা বা জানলা দেখতে পেতাম না। এ ছাড়াও কিছু ছোট ছোট ভাঙাচোরা বাড়ি দেখতে পেতাম। দেখলে মনে হত, অগুনতি বছর ধরে ওগুলো একইভাবে রয়েছে। অবশ্য দেখতে ছোটখাটো হলেও, ওগুলো দেখে ওই বন্ধ দরজাগুলোর মতোই ভয় পেতাম।

আবার আসি ওই বাগানের কথায়, যেগুলো দেখলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত নেমে যেত। বারবার বাগান বলছি, কারণ ওখানে নানারকম অদ্ভুত ফুলবিহীন ছত্রাকের মতো ফ্যাকাশে গাছপালা দেখতাম। আর ছিল সব কিছুকে টেক্কা-দেওয়া পাম গাছের মতোই দেখতে একটা ভূতুড়ে গাছ। ক্যালামাইটের পেল্লায় ওই গাছ থেকে নেমে-আসা শুড়গুলো দেখলে আবার মনে হত বাঁশ গাছ। এ ছাড়াও ছিল পাহাড়ি এলাকার মতো কিছু ঝোপঝাড় আর গাছপালা। কিছু কিছু বাড়ির ছাদের বাগান থেকে আবার কিছু দানবীয় ছত্রাক বাড়ির গা বেয়েই নেমে আসত। দেখলে মনে হবে যেন গিলে খেতে আসছে। তবে কোথাও কোথাও আবার শৌখিন টপিয়ারি ধাঁচের গাছও দেখা যেত। বাগান, বাড়ি, রাস্তা যেমনই হোক, আকাশ সবসময় মেঘলা থাকত। কোনও কোনও সময় প্রবল বৃষ্টি হতেও দেখেছি। শুধু একবার বোধহয় সূর্যের মতো কোনও কিছুর একটা ঝলকানি দেখেছিলাম। সূর্যের মতো বললাম, কারণ সূর্যের থেকে আকারে ওটা ছিল অনেক অনেক বড়। রাতের আকাশ খুব কমই বুঝতে পারতাম। একবার কিছু তারা দেখতে পেলেও ভালো করে বুঝতে পারিনি। মনে হত, আমি যেন পৃথিবীর এক অজানা গোলার্ধে রয়েছি।

১৯১৪-র অক্টোবর মাসের পর থেকে কিছু খাপছাড়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমি দেখতাম, আমি যেন একটা শহরের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। সেই শহর, যেখানে আমার ওই আতঙ্কপুরীও ছিল। ওপর থেকে নানা রঙের জঙ্গল দেখতে পেতাম। ওই জঙ্গলগুলোর এক-একটা গাছ এতটাই বড় ছিল যে, দেখলে শিউরে উঠতাম। আমার বন্দিনিবাস আতঙ্কপুরী যে শহরে ছিল, তার আশপাশেও আরও অদ্ভুত দেখতে কিছু শহর দেখতাম। একবার তো মাইলের পর মাইল জোড়া ব্যাসাল্ট পাথরের ধ্বংসাবশেষও দেখেছিলাম। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, ওই ব্যাসাল্টগুলোর গায়েও নকশা আর কারিগরির মতো দেখেছিলাম, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম আতঙ্কপুরীর দেওয়ালে! আর একবার ওই গম্বুজের ধারেই ধীরস্থির, স্রোতহীন এক সমুদ্র দেখেছিলাম।

আমি আগেও বলেছি, যেসব দৃশ্যের ঝলক আমি দেখতাম, তার থেকে ঢের বেশি ভয়ের স্বপ্ন অনেকে দেখে থাকেন। এবং একটা সময় আমি এগুলোকে স্বাভাবিক বলে মেনেও নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, ওই ঘটনার আগে কস্মিনকালেও আমি স্বপ্নবিলাসিতা করিনি। বরং স্বপ্ন নিয়ে এযাবৎ যা যা তর্ক চালিয়েছি, সবই ছিল কিছু মান্ধাতার আমলের পুঁথিগত বিদ্যার প্রতিফলন। কয়েক মাস পর থেকেই কিন্তু গল্প আর এক রইল না। যা যা স্বপ্ন দেখতাম, তার প্রায় সবটাই স্মৃতির মধ্যে থেকে যেত; ফলে আমার মনের ভেতর জমে-থাকা ভয় এক নারকীয় আকার ধারণ করল। শুধু তা-ই নয়, আমার মগজ ওই দুঃস্বপ্নের সঙ্গে আমার সচেতন অবস্থায় থেকে দেখা ঝলকগুলোকে মেলাতে শুরু করল। আমি পরিষ্কার বুঝলাম, ১৯০৮ থেকে ১৯১৩– এই সময়ের মধ্যে আমার যে দ্বিতীয় সত্তার সৃষ্টি হয়েছে, তার কাছে আমার ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি নামক সত্তাটা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে।

ইতিমধ্যে আমার দুঃস্বপ্নে অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আসতে শুরু করেছে, ফলে ভয়াবহতা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকশো গুণ। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমার কিছু করা উচিত, কিন্তু আদপে আমার কিছুই করার ছিল না। ১৯১৫-র অক্টোবর মাসের আগে পর্যন্ত এই স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নের জাল বিছোনোর পর্ব চলল বেশ ভালোভাবেই। এরপরেই আমি বিস্মৃতি আর দৃষ্টিবিভ্রমের ওপর বিভিন্ন কেস ঘাঁটতে শুরু করলাম। গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই, যদি ওই দ্বিতীয় সত্তাকে হারিয়ে ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলিকে জেতানো যায়! আগেই বলেছি, এতে ফল হয়েছিল বিপরীত! আমার মনে এমন ধারণাও আসতে শুরু করেছিল যে, এইসব গবেষণার ফলেই হয়তো আমার অবচেতন মনে তার ছাপ পড়ছে এবং ফলস্বরূপ ওই দুঃস্বপ্ন। কারণ ওইসব কেস ঘেঁটে দেখলাম, আগের অধিকাংশ ব্যক্তিরই ভূতত্ত্ব সম্পর্কে না ছিল কোনও জ্ঞান আর ওই কেসগুলোতে তারা ঠিক কী ধরনের দৃশ্য দেখত, সে সম্পর্কেও ছিল না কোনওরকম উল্লেখ। যেটুকু ছিল তা থেকে বুঝলাম, এরা বিভিন্ন অতিকায় বাড়ি, জংলা বাগান ইত্যাদি দেখত। আর একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো ছিল, এদের সবাই ধর্মবিরোধিতা করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেছিল। সব থেকে জঘন্য ব্যাপার, ইতিমধ্যে আমার ওই দ্বিতীয় সত্তা ক্রমাগত আমাকে ওইসব ভয়ংকর স্বপ্ন আর বিভিন্ন ঘটনার পূর্বাভাস দেখিয়ে চলেছিল। আর এদিকে বিভিন্ন ডাক্তারবাবু আমার কেসটাকে দ্বৈত সত্তার আদর্শ কেস হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে আমি আমার মেজ ছেলে উইনগেটের ব্যাপক উৎসাহে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। উইনগেটও অবশ্য অধ্যাপনার পাশাপাশি একই কাজ করছিল। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ আমি মিসকাটনিকে স্পেশাল কোর্সও করেছিলাম। ইতিমধ্যে আমার চিকিৎসাবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাসের হরেকরকম নথি ঘাঁটার রোজনামচায় আরও একটা ব্যাপার যোগ হল, সেটা হচ্ছে আমার ওই দ্বিতীয় সত্তার যেসব বিষয়ে প্রবল উৎসাহ যেমন গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত যতরকম বই আছে, দূরদূরান্তের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেগুলো নিয়ে চর্চা করা। এক-একটা বই এতই বীভৎস ছিল যে, আমি নিজেও শিউরে উঠেছিলাম। শুধু এটুকুই বলছি, আমি আমার দ্বিতীয় সত্তার প্রভাবে যেসব বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েছিলাম, এগুলোর বীভৎসতা ছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি। কিছু কিছু বইয়ের আধুনিক সংস্করণে আমি কিছু শব্দ আর বাগধারার পরিবর্তন দেখলাম, কারণ মূল শব্দগুলো এতটাই বীভৎস ছিল যে, কোনও আধুনিক সভ্যতা ওগুলোকে মেনে নেবে না। বইগুলো নানা ভাষায় লেখা হলেও কিছু কিছু চিহ্ন সব বইয়েই দেখেছিলাম। আর আমার ধারণা, যাঁরা এই সংশোধনের কাজ করেছিলেন, মূল শব্দগুলোর অর্থ তাঁদের অজানা ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ভন জানৎসের লেখা আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন বইটার কথা। এতে যে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলো ছিল, সেগুলোর সঙ্গে কোনও পার্থিব চিহ্নের কোনওরকম মিল নেই। কিন্তু সব থেকে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, ওই চিহ্নগুলো যে কালিতে আঁকা ছিল, সংশোধনও করা হয়েছে একই কালিতে!! তাহলে লেখক আর সংশোধক কি একই লোক? তিনি কি জানতেন, এই বই সঠিক হাতে না পড়লে কী কী বিপর্যয় হতে পারে? এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে কোনও আসন্ন অপার্থিব বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার জন্যই কি এই সংশোধন করা হয়েছে? বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আর সব থেকে পিলে চমকে দেবার মতো বিষয় হল, হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলোকে যখন আমি চিনতে পারলাম না, ওগুলোর মানে বুঝতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ওই চিহ্নগুলোই যে আমার স্বপ্নে ঘুরে-ফিরে আসত, সে বিষয়ে আমার আর সন্দেহ ছিল না।

যেহেতু আমার দ্বৈত সত্তা তখন খবরের কাগজে একটা আলোচিত বিষয় তাই অনেক লাইব্রেরিয়ান আমার ধোঁয়াশা কাটাতে এটাও বলল যে, ওই চিহ্নগুলো আমি নিজেই অচেতনভাবে আমার দ্বৈত সত্তার প্রভাবে ঘোরের মধ্যে এঁকে ফেলেছি। তাদের ধোঁয়াশা কাটাবার ঠ্যালায় আমার ঘিলু আরও ঘেঁটে গেল। এইসব নথিপত্র ঘেঁটে একটা কথা সার বুঝলাম, এইসব গুপ্তবিদ্যায় ব্যবহৃত তিনটে ভাষা সম্পর্কে আমার কোনওরকম ধারণা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান আর নৃতত্ত্বের পুরোনো আর নতুন সমস্ত নথি থেকে বিভিন্ন ছড়ানো ছিটোনো তথ্য এক জায়গায় করে দেখলাম, এগুলো অধিকাংশই অলীক আর প্রচলিত কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্যালেওজোইক, মেসোওজোইক, জুরাসিক, ট্রায়াসিক যুগের কিছু ছবি তুলে ধরেছে। আমি এটা ভেবে স্বস্তি পেলাম যে, ১৭ থেকে ২৫০ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীর কিছু উপকথামার্কা থিয়োরি নিয়ে হয়তো সত্যিই তেমনভাবে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু এগুলোর বীভৎসতা আমার মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করতে লাগল। এত পুরোনো দিনের ঘটনা শুধু ধোঁয়াশাই বাড়ায়। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই, আর সবার মতো আমিও ওই অজানা আদিম আতঙ্ককে ভয় পেতে লাগলাম। যুগে যুগে এইসব উপকথায় একটু একটু করে রং চড়েছে, আর সেটা আমার মতো স্মৃতিবিভ্রাটের রুগির চিন্তনের জগতে একটা কাল্পনিক দুনিয়া তৈরি করে তালুক গেড়ে বসেছে। আমি নিজেই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

আবার কিছু কিছু উপকথা, বিশেষ করে কিছু হিন্দু পুরাণে মানবসভ্যতার সৃষ্টির আগে থেকে কালচক্রে কী করে আধুনিক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে, তার উল্লেখ আছে। এসব পড়লে যে কোনও লোক শিউরে উঠবে বা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যাবে, কিন্তু আমি ক্রমশ এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। পুরাণ আর বিভ্রান্তি সব কিছুর সারসংক্ষেপ থেকে এটা প্রমাণিত যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে যতই রহস্য থাকুক, মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে সব ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে শুধু টিকেই থাকেনি, সারা দুনিয়ায় তার আধিপত্য কায়েম করেছে। কিন্তু ওইসব পুরাণে এ কথাও উল্লেখ আছে, মানুষ সৃষ্টির তিনশো কোটি বছর আগেই এক প্রজাতি মেঘলোক থেকে হাজির হয়ে আয়ত্ত করেছিল এই প্রকৃতির সমস্ত রহস্য। তাদের আকার, প্রকৃতি কোনও কিছু নিয়েই ওইসব বইয়ে কোনও উল্লেখ ছিল না। তাদের কেউ কেউ হয়তো এসেছিল আমাদের এই মহাবিশ্ব বা তার থেকেও প্রাচীন কোনও নক্ষত্রলোক থেকে। আর খুব দ্রুতভাবে সৃষ্টি করেছিল জীবনচক্রের সেই প্রথম জীবাণু। সৃষ্টির হাজার-লক্ষ বছরের বিবর্তনে আমরা যে জিনিসটাকে সময় বলে মেনে নিয়েছি, আদপে নাকি তার কোনও অস্তিত্বই নেই!!

কিন্তু এ ছাড়াও ওইসব পুরাণে অপেক্ষাকৃত নবীন এক প্রজাতির কথা বলা হয়েছে। জটিল আর বীভৎস আকৃতির ওই প্রজাতির তথাকথিত বিজ্ঞানের আলোকে পরিচিত কোনও আকার ছিল না। এরা মানুষ সৃষ্টির পঞ্চাশ কোটি বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেই এরা আয়ত্ত আর জয় করে ফ্যালে সময়ের সেই গোপন রহস্য। আর সেই জন্যই এদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ওইসব পুরাণে উল্লেখ করা আছে। এই পৃথিবীর ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের যাবতীয় জ্ঞান এদের আয়ত্তে চলে আসে। নিজেদের তীব্র মানসিক ক্ষমতা দিয়ে তারা অনায়াসে চলে যেত অতীত কিংবা বর্তমানে। এবং সেই সময়ের সমস্ত জ্ঞান পুরোপুরি আয়ত্তে নিয়ে আসে। এমনকী মানবসভ্যতার যাবতীয় পুরাণও ছিল তাদের নখদর্পণে!! এদের একটা কেতাবি নামও অবশ্য উল্লেখ আছে ওইসব বইয়ে–ইথ! ইথদের বিশালাকার লাইব্রেরিতে এই পৃথিবীর বছরের পর বছরের সমস্ত প্রজাতির শিল্প, ভাষা, মনোবিজ্ঞান, কৃতিত্ব– সব কিছুর সচিত্র বিবরণ ঠাসা থাকত। ইথরা প্রত্যেক যুগ থেকেই নিজেদের স্বভাব আর পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই কাউকে বেছে নিত। ভূত ভবিষ্যৎ-বর্তমানের এই জ্ঞান তাদের আয়ত্তে থাকার ফলে তাদের কোনও সমস্যাই হত না। পরবর্তীকালে উপযুক্ত যন্ত্র এসে যাওয়ার ফলে এদের কাছে এই কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। তখন ইথরা অনায়াসে তাদের সময়-ভ্রমণে ইচ্ছেমতো যুগে নিজেদের সশরীরে হাজির করতে পারত। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবার পর এরা সেই যুগের সেরা প্রজাতিকে বেছে নিত। তারপর তাদের কাজ ছিল চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে সেই জীবের মস্তিষ্কে নিজেদের ভাবনাকে চালান করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে জীবের মগজে ওই ভাবনাপ্রবাহের আমদানি হত, সময়চক্রের এক বিপরীত প্রবাহের সৃষ্টি হত তার শরীরে। সে তখন সেই ইথদের উত্তরসূরি ছাড়া কিছুই নয়। তার কাজ হত বেছে নেওয়া যুগের যাবতীয় তথ্য আর কারিগরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নেওয়া। ব্যাপারটা এমনি ভাবলে হয়তো বেশ মজা লাগবে, যেন চাহিদা আর জোগানের খেলা। কিন্তু এরপর যেটা হত, সেটা আরও ভয়ংকর। ইথরা তাদের পরীক্ষার গিনিপিগের চিন্তন আর মননকে ফিরিয়ে আন্ত নিজেদের যুগে এবং নিজেদের শরীরে। তারপর যত্ন নিয়ে সেগুলো রক্ষা করত। এইভাবেই ছোট প্রজাতির সঙ্গে ভরের আদানপ্রদান ঘটিয়ে ইথরা নিজেদের অস্তিত্ব লোপকে ঠেকিয়ে রাখত আর হয়ে উঠত সর্বজ্ঞ। কোনও প্রজাতির ভাষা তাদের অজানা থাকলেও, তাদের কাছে এমন যন্ত্র ছিল, যা দিয়ে তারা অনায়াসে ওই ভাষার অনুবাদ করে ফেলতে পারত। ইথদের চেহারার বর্ণনাও দেওয়া ছিল কিছু বইয়ে। ইথরা আকারে ছিল প্রায় দশ ফুট লম্বা। দেখলে মনে হবে ঠিক যেন শঙ্কু আকৃতির কিছু কুঁজো হয়ে রয়েছে। ওই শঙ্কু আকৃতির ধড়ের ওপর থাকত মাথা। সেই মাথা থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ছড়িয়ে থাকত। তারা কথা বলত তাদের বিশাল আকারের গুঁড় দিয়ে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে। চলাফেরার দরকার হলে স্যাঁতস্যাঁতে জেলির মতো ওই দশ ফুটের অবয়বকে হড়কে হড়কে নিয়ে যেত এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায়।

যেসব প্রাণীর চিন্তাভাবনা ইথরা বন্দি করত, তারা প্রথমে খুব ভয় পেত বা আশ্চর্য হয়ে যেত, কিন্তু পরে অভ্যস্ত হয়ে যেত ইথদের দুনিয়ায়। যেমন হয়েছিলাম আমি যা-ই হোক, সে কথায় পরে আসছি। যদিও তাদের এই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণভাবে ইথদের ইচ্ছা অনুযায়ীই হত। বন্দিরা এরপর রাক্ষুসে উড়োজাহাজ বা পারমাণবিক ইঞ্জিনওয়ালা বোটে করে যেত ইথদের লাইব্রেরিতে। সেখানে তাদের বিভিন্ন গ্রহের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা করতে দেওয়া হত। এরপর অনেক বন্দি একজোট হয়ে লেগে পড়ত পৃথিবীর গোপন সব রহস্যভেদে। অতীতের বহু হারানো অধ্যায় আর সুদূর ভবিষ্যতের অগ্রগতি দেখে তারা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেত।

অনেক সময় হয়তো ভবিষ্যৎ থেকে বন্দি হয়ে আসা কারও সঙ্গে জ্ঞানের আদানপ্রদান হত। তারপর তাদের কাজ হত নিজেদের ভাষায় বিভিন্ন যুগের ওইসব নথি ইথদের লাইব্রেরিতে জমা করা। কোনও কোনও বন্দি অবশ্য কিছু বাড়তি সুবিধা পেত। তবে তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। মুমূর্ষ এইসব বন্দিকে পাঠানো হত চিরনির্বাসনে। তার অবশ্য কারণও ছিল। ভবিষ্যতে এদের কায়িক অবয়ব হয়তো কোনও ইথের হাতে বন্দি৷ ইথরা খুব সম্ভবত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তাই মানসিক অবলুপ্তির হাত থেকে মুক্তির জন্যই তাদের এই ফন্দি। তবে এই ঘটনার সংখ্যা ছিল খুবই কম। বন্দি মন যখন তার ভবিষ্যতের ইচ্ছা জানতে পারত, তখন একটা যন্ত্রের সাহায্যে সে এই গোটা পদ্ধতিটাই উলটোদিকে চালাত। ফলে ভবিষ্যতে সঠিক শরীরে সে ফিরে যেতে পারত। অবশ্য শরীর নষ্ট হয়ে গেলে এটা সম্ভব ছিল না। তখন ওই মন হয় কোনও ভিনগ্রহীর আকার ধারণ করত, আর না-হয় চিরকালের মতো বন্দি হয়ে থাকত ইথিয়ান জগতে। অবশ্য বন্দি-হওয়া মন যদি কোনও ইথের হত তাহলে ব্যাপারটা এতটা ভয়ানক হত না। নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ইথরা যথেষ্ট সচেতন ছিল। যখন কোনও ভিনগ্রহী প্রজাতির বন্দি মন তার নিজের শরীরে ফিরে যেত, তখন যান্ত্রিকভাবে হিপনোসিসের মাধ্যমে ইথিয়ান দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান ও স্মৃতি মুছে ফেলা হত। এর কারণ অবশ্যই ভবিষ্যতের ঝামেলা এড়ানো। পৃথিবীতে বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে এগুলোই ওইসব পুঁথিতে উল্লেখ করা আছে। অবশ্য এই সব কিছুই যুগযুগান্ত দূরের ঘটনা, যার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে সমুদ্রের গভীরে। কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে ভয়ানক প্লাকোটিক পাণ্ডুলিপিতে। ইথিয়ান দুনিয়া থেকে যেসব মন চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে নিজের শরীরে ফিরে আসত, ওই জগতের ছিটেফোঁটা স্মৃতিও তার থাকত না। সব পুরোপুরি মুছে দেওয়া হত।

যেসব সংগঠন গুপ্তবিদ্যাচর্চার সঙ্গে জড়িত, তারা অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবে জানত। নেক্রোনমিকন-এ তো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির কথা, যারা কালসমুদ্রে ইথিয়ান দুনিয়ায় পাড়ি জমাত। ইথরা শুধু পৃথিবীই নয়, আরও বিভিন্ন গ্রহে চিন্তন আর মনন আদানপ্রদানের কাজ শুরু করেছিল। খুব সম্ভবত ইথরা নিজেদের সেই উৎসের সঙ্গে কালচক্রকে মেলাতে পেরেছিল, যার শুরু হয়েছিল সেই বিগ ব্যাং-এর আমলে। ইথদের শরীরের থেকেও তাদের মানসিক বয়স ছিল বহু প্রাচীন। শরীরী অবয়ব তারা অনেক পরে লাভ করে। নিজেদের বিলুপ্তির কথা জানতে পেরেই তারা তাদের চিন্তনকে ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিল কয়েক লক্ষ-কোটি বছর আগে, এবং সফলও হয়েছিল।

১৯২০ সাল নাগাদ আমি আমার জট-পাকানো চিন্তাভাবনাগুলোকে একটা ঠিকঠাক জায়গায় আনতে পেরেছিলাম। আমার ওই উদ্‌বেগ আর উত্তেজনাও অনেক কমে গিয়েছিল। আমি আস্তে আস্তে আমার স্মৃতিবিভ্রাটের সময়ের ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছিলাম। ওই সময় আমি যে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতাম বা ওই হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নগুলো স্বপ্নে দেখতাম, নিঃসন্দেহে ওইসব পুঁথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার ফল। আমার অবচেতন মনে ব্যাপক ছাপ পড়ার ফলেই ওগুলো ঘটত। আমি এই সময় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম এইসব বিষয় নিয়ে কিন্তু কোনও কূলকিনারাই পাইনি।

নানা সময়ে আমি যে কেসগুলো ঘেঁটেছিলাম, প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে রুগিদের মিল দেখে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, ওইসব পুঁথিতে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা নেহাত উপকথারই শামিল, কারণ এখনকার সময়ের থেকে অতীতের সঙ্গেই ওগুলোর মিল বেশি। আমার আগে যাদের এরকম ঘটেছিল, খুব সম্ভবত স্মৃতিবিভ্রাটের পর তারা তাদের পারিপার্শ্বিক কিছু চালু ধারণার সঙ্গেই নিজেদের জড়িয়ে ফ্যালে, তারপর সেখান থেকে বেরোতে না পেরে নিজেদের কল্পনাতেই এক অমানবিক জগৎ বানিয়ে সেখানে পাড়ি জমায়। আমার ক্ষেত্রে এগুলো হয়নি, কারণ আমি এগুলো নিয়ে চর্চা আরম্ভ করি প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পরে। আমার আগের রুগিদের স্মৃতিশক্তি ফিরে এলেও ওই কাল্পনিক দুনিয়া থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি। আমি আমার মনে কখনওই এইসব চিন্তাভাবনাকে গেড়ে বসতে দিইনি। সবসময় যুক্তি-পালটা যুক্তি দিয়ে ভাবতাম। পরে বিভিন্ন নামকরা মনোবিদ আর নৃতত্ত্ববিদও আমার সঙ্গে একমত হন।

যা-ই হোক, আমি কিন্তু ওইসব ভূতুড়ে স্বপ্ন আর চিন্তাভাবনার থেকে আত্মরক্ষার বেশ ভালো একটা উপায় ঠাওরেছিলাম। রাতে যদি কোনও অদ্ভুত স্বপ্নও দেখতাম, বুঝতাম, ওইসব পুঁথিপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ফলেই আমার অবচেতন মনে ওগুলোর ছাপ পড়েছে। এই থিয়োরিটা বেশ কাজে দিয়েছিল। আমার স্নায়ুতন্ত্রেও একটা স্থিতিশীলতা আসে। ১৯২২ সাল নাগাদ আমি বুঝতে পারলাম, আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারব। এবং নতুন যা যা কিছু শিখেছি, সেগুলো হাতেকলমে প্রয়োগের এটাই সেরা উপায়। এই সময় আমি তাই ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। এদিকে অধ্যাপনার পাশাপাশি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আমার মেজ ছেলে উইনগেটও এই সময় ইউনিভার্সিটিতে এল। আমাদের দুজনের জুটিতে আরও অনেক দূর এগোতে পারব ভেবে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল।

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, আমি যে স্বপ্নগুলো দেখতাম, সেগুলো নরকযন্ত্রণার থেকে কিছু কম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার স্বপ্নের একটা ধারাবাহিক রেকর্ড রাখতে শুরু করি। বড়াই করব না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ওই রেকর্ড যে-কোনও মনোবিদ লুফে নিতেন অনায়াসে। খুব ধীরে ধীরে হলেও আমি আমার এই নরকযন্ত্রণা থেকে একটু হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। ১৯১৪ সালের পর থেকে আমার স্বপ্নের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এখন আমি স্বপ্নের মধ্যেই নানা জায়গায় অবাধে ভেসে বেড়াতে পারতাম। বেড়াতে বেড়াতে কোথাও দেখতে পেতাম অদ্ভুত পাথুরে বাড়ি, যেগুলোর ভেতরের চোরাপথ দিয়ে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যাতায়াত করা যেত। আবার কোথাও দেখতে পেতাম ওইরকমই গা-ছমছমে বন্ধ-হওয়া চোরা দরজা। এ ছাড়াও বিভিন্ন খোপ-খোপ আঁকা দরজা, নানারকম অদ্ভুত আকারের বাসনপত্র, জটিল কারিগরিতে ভরা বিভিন্ন গুহা (যেগুলোর উদ্দেশ্য বুঝতাম না) দেখতে পেতাম।

কিন্তু সত্যিকারের ভয় কাকে বলে, সেটা টের পেলাম ১৯১৫ নাগাদ। এই সময় আমি আমার স্বপ্নে বিভিন্ন জ্যান্ত জিনিস দেখতে শুরু করলাম। শুধু দেখা বললে ভুল হবে, তাদের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আমার চিন্তায় গেঁথে গেল। হ্যাঁ, ঠিকই আমি ইথদের কথাই বলছি। যদিও তখনও আমার মগজে ওইসব রাক্ষুসে বিল্ডিং আর রাস্তার স্মৃতি ভালোভাবেই ছিল। ওই পুরোনো পুঁথিগুলোতে ইথদের চেহারার বর্ণনা পড়ার পর যখন নিজের চোখের সামনে ওদের দেখলাম, আমার ভয় বহুগুণে বেড়ে গেল। ইথরা আমার চোখের সামনে যখন ভেসে উঠত, এক-একসময় মনে হত পুরো গায়েব, আবার ঠিক তার পরের মুহূর্তেই জেলির মতো থকথকে দশ ফুট লম্বা শরীর নিয়ে চলে যেত আর-এক জায়গায়। এদের শরীর থেকে তিন-চারখানা অংশ বেরিয়ে থাকত, যাদের মধ্যে দুটোকে দেখে আন্দাজ করতে পারতাম ওগুলো ওদের থাবা। তিন নম্বর অংশ থেকে আবার চারটে লাল শুড়ের মতো অংশ বেরিয়ে থাকত। চার নম্বর অংশের ব্যাস ছিল প্রায় দু-ফুট। আর এটা দেখতে অনেকটা হলদে গ্লোবের মতো। এটা থাকত ইথদের দেহের ঠিক মাঝখানে। সেখানে আবার তিনটে কালো কালো চোখ ছিল। তখন বুঝলাম ওই হলদে গ্লোবটা হল ওদের মাথা। মাথা থেকে আবার ছাইরঙা ফুলের মতো চারটে অংশ বেরিয়ে থাকত। এর দু-দিকেই আবার সবুজ রঙের অ্যান্টেনার মতো শুড় দেখা যেত।

এমনিতে দেখলে মনে হত এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু এদের কাজকর্ম দেখে আমি সত্যিই ভয় পেতাম। ওই পাথুরে কুঠুরির তাকে যেসব বই থাকত, সেগুলো এরা শুড় দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে আসত বেদির মতো টেবিলে। কখনও আবার ওই সবুজরঙা অ্যান্টেনার মতো শুড় দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে কী সব লিখত। আর কথা বলত ওই শুড়গুলো দিয়ে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ করে। ইথদের পিঠে একটা ঝোলার মতো অংশ থাকত। যেভাবে এরা ঝড়ের গতিতে নিজেদের লেখাপড়ার কাজ চালাত, তাতে এদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। আমি নিজেকে স্বপ্নে যে আতঙ্কপুরীতে দেখতাম, তার সর্বত্র এরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত। কখনও-বা মাটির নীচের ঘরে রাখা কিছু অতিকায় মেশিনে বিভিন্ন তথ্য জমা করত। এরা কী কী লিখত, সেগুলোও আস্তে আস্তে আমার চোখে ধরা পড়তে শুরু করে। অধিকাংশই ছিল ওই আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক লেখা, কখনও-বা একটু অন্যরকম সমাসবদ্ধ কিছু। খুব সম্ভবত ওরা নিজেরা নিজেদের জন্যই কোনও বিশেষ বর্ণমালা তৈরি করেছিল। তবে হ্যাঁ, যারা লিখত, বাকি ইথদের থেকে তাদের গতি ছিল একটু হলেও কম।

১৯১৫ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এই ইথিয়ান কার্যকলাপ আমাকে রীতিমতো ভোগাতে শুরু করল। কারণ এত দিন আমি যা যা দেখেছি, সেগুলো ছিল কিছু স্বপ্ন, কিছু আমার কল্পনা। কিন্তু এখন আমি নিজেকে ইথিয়ান দুনিয়ারই অংশ হিসেবে অনুভব করতে লাগলাম। এর আগে হয়তো আমি আমার নীচের দিকে তাকিয়ে চলা বা আয়না থেকে দূরে থাকার কথা উল্লেখ করেছি। এই ইথিয়ান দুনিয়াতেও নিজেকে খুব স্বচ্ছন্দ লাগত, কারণ এখানে কোনও আয়না ছিল না।

কিন্তু এরপর এল সেই কালরাত্রি, যখন আমি টের পেলাম, আমার মুন্ডুও একটা বিরাট থকথকে ঘাড়ের মতো অংশের সঙ্গে আটকানো। আর তার ঠিক নীচেই রয়েছে দশ ফুট লম্বা, কুঁজো হয়ে-যাওয়া শঙ্কুর মতো একটা ধড়। যেটা থেকে বেরিয়ে এসেছে রংবেরঙের আঁশওয়ালা কিছু শুঁড়। সে দিন আমার চিৎকারে বোধহয় আর্কহ্যামের অর্ধেক লোক জেগে উঠেছিল।

এক সপ্তাহ পর থেকে এই দৃশ্যগুলো ঘন ঘন দেখতে শুরু করলাম আমার স্বপ্নে। এখন অবশ্য আমিও ওই রাক্ষুসে ইথদের মতোই আকারওয়ালা একজন। আমিও বাকি ইথদের মতোই সহজভাবে চলাফেরা করতাম। শুড় দিয়ে টেনে নিতাম বই, আবার বেদির মতো টেবিলে সবুজ গঁড় দিয়ে অনেক কিছু লিখে চলতাম। ঠিক কী কী লিখতাম আর পড়তাম, প্রথম প্রথম আমার খেয়াল থাকত না, তবে বারবার একই জিনিস দেখার ফলে বুঝেছিলাম, ভয়ংকর নানা বিষয়ের সঙ্গেও গোটা ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন জীবজগতের বিষয়ই আমার লেখাপড়ার মূল বিষয় ছিল। তবে একটা ভয়ংকর বিষয় আমার আলাদাভাবে মনে আছে। সেটা হল মানব-প্রজাতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তির লক্ষ লক্ষ বছর পর এক অদ্ভুত আকারের বুদ্ধিমান প্রাণীর গোটা দুনিয়া শাসনের বর্ণনা।

মানবসভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা যা পড়লাম, এখনকার যে-কোনও তথাকথিত পণ্ডিতের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। বেশির ভাগই হায়ারোগ্লিফিকে লেখা থাকলেও আমি সেগুলো বুঝতে পেরেছিলাম ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে। তবে অন্যান্য বেশ কিছু খণ্ড এমন বিটকেল ভাষায় লেখা ছিল, হাজার চেষ্টা করেও প্রথমে সেগুলো উদ্ধার করতে পারিনি। পরে এগুলো পড়তেও কাজে লাগাই ড্রোনিং মেশিন। তবে জেগে ওঠার পর খুব ঝাপসাভাবে এই স্মৃতিগুলো আমার মনে থাকত। এই উন্নত জাতি কীভাবে সময়কে জয় করেছে, সেটা ভেবে খুব অবাক লাগত। তার থেকেও বেশি অবাক হতাম এটা ভেবে, বর্তমান সময় থেকে আমার চেতনাকে সরিয়ে আনার পাশাপাশি ঠিক একই সময়ে কেউ ব্যবহার করে চলেছে আমার শরীর। শুধু তা-ই নয়, বৃহস্পতি, শুক্রর মতো গ্রহ থেকেও ইথরা চেতনা সংগ্রহ করেছিল। আমাদের এই পৃথিবীর চেতনাশক্তির মধ্যে ছিল অ্যান্টার্কটিকার ডানাওয়ালা তারার মতো মুওয়ালা আধা উদ্ভিদ প্যালিওজিয়ন প্রজাতি, ভ্যালুসিয়ার সরীসৃপ প্রজাতি, এমনকী প্রাক-মানবসভ্যতার সাতগুয়ার রোমশ জাতির গোটা চারেক নমুনা, বিবর্তনের শেষ পর্যায়ের মাকড়সা প্রজাতি আর ভয়ানক চো চো প্রজাতির নমুনাও ছিল।

এই সময় পাঁচ হাজার খ্রিস্টাব্দের এক দার্শনিক ইয়াং লি-র চেতনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দেখা হয়েছিল লেমুরের সম্রাটের সঙ্গেও, যিনি লক্ষ বছর আগে মেরুদেশে সাম্রাজ্য করতেন, হলুদ চামড়ার ইয়টদের আক্রমণের আগে। কথা বলেছিলাম ষোলো হাজার খ্রিস্টাব্দের এক জাদুকর নাগসোথের সঙ্গেও। এবং এদের সঙ্গে কথা বলে আমি অতীতের বহু সমাধান না-হওয়া রহস্যের আর ভবিষ্যতের বহু আসন্ন বিপর্যয় ও ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলাম।

এইসব স্বপ্নচারণের পর প্রত্যেকদিন সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙত, দেখতাম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বপ্ন থেকে পাওয়া ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়ে এইসব নানারকম তথ্য নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করে দিতাম এবং আরও অনেক নতুন নতুন তথ্য পেতাম। এখনকার বহু বিষয়, মানে যেগুলো নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে, স্বপ্নের মাধ্যমে তা অনায়াসে সমাধান করে দিতাম। টের পেতাম, অতীতের এমন অনেক সত্য গোপন ছিল, যা প্রকাশ পেলে সমগ্র মানবজাতি এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। মানবসভ্যতার পরে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হবে কীট-সভ্যতার, যারা শাসন করবে গোটা দুনিয়া। এবং অবশ্যই ইথরা শাসন করবে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে। চেতনা আদানপ্রদানের খেলা অবশ্য চলতেই থাকবে। ইথিয়ান লাইব্রেরির যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করা হত শক্ত সেলুলোজজাতীয় কাপড়ে। হাতে লেখা আর ছাপানো দু-রকমই থাকত বই আকারে বাঁধাই অবস্থায়। বলা বাহুল্য, এই স্বপ্নগুলো কখনওই আমাকে দৈনন্দিন জীবনের ছবি দেখায়নি। ইথিয়ান দুনিয়ায় আমি এতরকম প্রাণী আর প্রজাতি দেখেছিলাম, যে সবার কথা বলতে গেলে খণ্ডের পর খণ্ড লেখা হয়ে যাবে। খুব সম্ভবত আমি স্বপ্নে যে যুগের কার্যাবলি দেখতাম তা ছিল ১৫ কোটি বছরেরও আগেকার সময়ের– যখন পেলোজোয়িক যুগ শেষ হয়ে মেসোজোয়িক যুগ শুরু হতে যাচ্ছে।

এই সময় ইথরা প্রায় মানুষের মতোই দেখতে এক ধরনের প্রাণীর শরীর দখল করেছিল। এই প্রাণীগুলো ঠিক কী পর্যায়ের বলতে পারব না, কারণ প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে এদের সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। ইথদের কোষের গঠন ছিল অদ্ভুত আর অভিনব। এবং এই কোষের গঠনের জন্যই তারা কখনও ক্লান্ত হত না। তাই ঘুমেরও দরকার হত । যাবতীয় পৌষ্টিক কার্যাবলি চালাত ওই শুড়ের মতো উপাঙ্গ দিয়েই। আমাদের পরিচিত অনুভূতির মধ্যে মাত্র দুটি এদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল– দেখা আর শোনা। শোনার কাজ চালাত মাথার ওপরে থাকা ফুলের মতো ধূসর রঙের অংশ দিয়ে আর দেখার কাজ চালাত কুতকুতে তিনখানা চোখ দিয়ে। এদের রক্ত ছিল থকথকে সবুজ রঙের। ইথদের মধ্যে কোনওরকম যৌনক্রিয়া না থাকলেও প্রজননের কাজ তারা চালাত বীজ বা দেহের নীচের দিকে থাকা এককোষী যৌন জননাঙ্গ দিয়ে। অগভীর জলাশয়ে চলত সদ্যোজাতদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ইথরা ছিল যথেষ্ট দীর্ঘায়ু। কম করে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর ছিল এদের আয়ু। যেহেতু ইথদের স্পর্শক্ষমতা বা যন্ত্রণাবোধ ছিল না, তাই সদ্যোজাতদের মধ্যে কারও কোনও খুঁত থাকলে তা ইথরা চোখে দেখলেই বুঝে যেত আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলা হত। মৃত্যুর পর মৃতদের শরীর পুড়িয়ে ফেলা হত। ইথদের হাতে বন্দি হওয়া কেউ কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার ফলেই কখনও কখনও আসন্ন মৃত্যুকে এড়াবার জন্য পালাতে সক্ষম হলেও এই ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটত না বললেই চলে। ইথরা মিলিত হয়ে যে সমাজ গড়ে তুলেছিল, তাতে একনায়কতন্ত্রের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে যে উচ্চতায় তারা নিয়ে গিয়েছিল তা ধারণার বাইরে।

স্বপ্নচারণ আর জেগে উঠে যেটুকু মাথায় থাকত, সেগুলো নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবা এইভাবেই চলছিল। আমার দুঃস্বপ্নের শেষ হত আমার চিৎকার দিয়ে। এগুলো আমার রোজনামচা হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে একই রকম বিভিন্ন কেস নিয়ে অনুসন্ধান চালাতাম। ১৯২২ সালে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও ওই অপার্থিব আতঙ্ককে অতিক্রম করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। হয়তো এইভাবেই চলত, তারপর একদিন সমস্ত হিসেব গেল গুলিয়ে।

১৯৩৪ সালের ১০ জুলাই আমার হাতে এল সুদূর অস্ট্রেলিয়ার পিলবারা থেকে পাঠানো একটা চিঠি আর তার সঙ্গে কিছু ফোটোগ্রাফ আর কাগজপত্র। আর এই চিঠিটাই আমার সামনে তুলে ধরল সেই নারকীয় রহস্য উন্মোচনের এক অভাবনীয় সুযোগ। বেশি কিছু না বলে সরাসরি সেই চিঠির বয়ান হুবহু তুলে দিলাম:

অধ্যাপক ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি,
৪৯, ডাম্পিয়ের স্ট্রিট,
 প্রযত্নে, মনোবিজ্ঞান বিভাগ।
 পিলবারা, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া,

৩০ই. ৪১ স্ট্রিট,
১৮ মে, ১৯৩৪
নিউ ইয়র্ক সিটি, ইউএসএ

মাননীয়েষু,
প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো যে, আপনার সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও পরিচয় নেই। কিছু দিন আগে পার্থ নিবাসী ড. ই এম বয়েলের সঙ্গে আমার বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথাপ্রসঙ্গে তিনি আপনার কথা অর্থাৎ আপনার ওই দ্বৈত সত্তা নিয়ে কাগজে বিভিন্ন লেখালেখির কথা আমাকে বলেন। তিনি আমাকে এ-ও জানান যে, আপনি আপনার স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখেছেন। এই বিষয়ে আমি আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি আমাকে বলেন যে, ডাকযোগে তিনি আমাকে সেগুলো পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন। ক-দিন আগে তিনি আপনার লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ, কিছু কাগজ ও ছবি আমাকে ডাকযোগে পাঠান। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার আর সরকারি খনি বিভাগের সঙ্গে জড়িত। আপনি হয়তো শুনলে অবাক ও আশ্বস্ত হবেন যে, আপনার স্বপ্নে দেখা বিভিন্ন জ্যামিতিক আঁকিবুকি আর অদ্ভুত ওইসব বিরাট পাথরের চাঁইয়ের কিছু নমুনা আমিও দেখেছি।

কীভাবে দেখলাম, এবার সেই কথা বলি। বছর দুয়েক আগে সোনার খনির কাজে আমাকে যেতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে। কাজের জন্য সেখানকার আদিবাসীদের সাহায্য নিতেই হয়। এই আদিবাসীদের মুখেই প্রথম শুনি নানারকম অদ্ভুত প্রচলিত কিংবদন্তির কথা, যার মধ্যে একটা ছিল এক অজানা প্রাচীন শহরের কথা, যেখানে নাকি ওইরকম পেল্লায় পাথরের চাঁই দেখা যায়, যেগুলোর গায়ে থাকে অদ্ভুত নকশা আর আপনার বর্ণনার সেইসব হায়ারোগ্লিফ। স্থানীয় এইসব আদিবাসী যে কুসংস্কারগ্রস্ত হবে তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু যেটা দেখলাম, এই কিংবদন্তি নিয়ে তাদের মধ্যে এক অজানা চাপা আতঙ্ক। তারা আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে এর সঙ্গে নিজেদের কিছু চালু উপকথাকেও মিলিয়ে নিয়েছে। যেমন বুদ্দাই নামে এক বিশালাকার বৃদ্ধ, যে কিনা যুগ যুগ ধরে নিজের হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। যে দিন সে জেগে উঠবে, তার আগ্রাসী খিদে নিয়ে খেয়ে ফেলবে গোটা দুনিয়াকে। আর যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, তার আশপাশেই দেখা যায় ওইসব রাক্ষুসে পাথরের চাঁই।

এই পাথরগুলো নাকি যেখানে আছে, তার নীচেই আছে এক ভয়ংকর দুনিয়া, যার বিস্তার কত দূর তা কেউ জানে না। এই দুনিয়া কতটা ভয়াবহ তা এই আদিবাসীদের কাছে অজানা হলেও এর প্রসঙ্গ উঠলেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কারণ তারা নাকি শুনেছে, বহু যুগ আগে কিছু সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এইরকমই এক সুড়ঙ্গের ভেতর, আর এরপর তারা কেউই আর ফিরে আসেনি। কিন্তু তাদের আশ্রয় নেবার পর থেকেই ওই জায়গা দিয়ে বইতে শুরু করে ভয়ানক ঝোড়ো বাতাস। আমি এদের এইসব আষাঢ়ে গল্পে তেমন পাত্তা না দিলেও, আমার মনে গেঁথে আছে বছর দুয়েক আগের সেই স্মৃতি।

বছর দুয়েক আগে এই মরুভূমিরই ৫০০ মাইল পূর্বে আমি এরকমই কিছু রাক্ষুসে পাথরের চাঁই দেখেছিলাম। প্রায় ১২ ফুট লম্বা এই চাঁইগুলো মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রথমে কিন্তু আমি এগুলোর গায়ে কোনও চিহ্ন দেখতে পাইনি, কিন্তু একটু কাছে গিয়ে ভালোভাবে দেখার পর এর গায়ে গভীরভাবে খোদাই-করা অদ্ভুত কিছু আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পাই, ঠিক যেমনটি ওই আদিবাসীরা তাদের আষাঢ়ে গপ্পে বলেছিল। কেন জানি না আমার মনে হল, মাইলখানেকের মধ্যে এরকম আরও ৩০-৪০টা পাথরের চাঁই পোঁতা থাকলেও থাকতে পারে। আমার যন্ত্রপাতির সাহায্যে একটু খোঁজার পর দেখলাম ঠিক তা ই। খুঁজে পেলাম এরকম আরও কয়েকটা চাঁই, এবং সেগুলোর কাছে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করলাম। এবং আশ্বস্ত হবার পর দশ-বারোটা ছবিও তুললাম। ছবিগুলো এই চিঠির সঙ্গেই আপনাকে পাঠিয়েছি। এর আগে অবশ্য আমি এই চিঠি আর তথ্যগুলো পারথের সরকারি বিভাগেও পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা এগুলোতে কোনও পাত্তাই দেয়নি। এরপর আমার সঙ্গে আলাপ হয় ড. বয়েলের। এই ড, বয়েল আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে আপনার নিবন্ধগুলো পড়েছিলেন। আমি তাঁকে এই পাথরের চাঁইগুলোর কথা বলতেই তিনি প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমি তাঁকে এ-ও জানাই যে, এই পাথর আর এর গায়ে আঁকা নকশাগুলোর সঙ্গে আপনার স্বপ্নে দেখা নকশাগুলোর যথেষ্ট মিল আছে। সঙ্গে আমি তাঁকে আমার তোলা ছবিগুলোও দেখাই। এরপরেই তিনি আমাকে বলেন অবিলম্বে আপনার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করার জন্য। আমার এই চিঠিটা পাঠাতে একটু দেরি হল, কারণ ইতিমধ্যে ড. বয়েল আমাকে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার প্রায় সব প্রবন্ধ নিবন্ধ আমাকে পাঠান, আমি আরও একবার সমস্ত আঁকা আর বর্ণনাগুলো ভালোভাবে মিলিয়ে নিলাম এবং দেখলাম, ঠিক যেমনটি আপনি বলেছেন, আমার এই ছবিগুলোও সেইরকমই। এবং ওই পত্রপত্রিকার কপি আর যাবতীয় তথ্য ইত্যাদিও চিঠির সঙ্গে পাঠালাম। বাকিটা না-হয় ড. বয়েলের থেকে সরাসরি সাক্ষাতেই শুনে নেবেন। সত্যি কথা বলতে কী, এগুলো দেখার পর আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো আপনার কাছে ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগেই বলেছি, একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুন ভূতত্ত্ব সম্পর্কে অল্পবিস্তর পড়াশোনা আমার আছে। সেই নিরিখেই বলতে পারি, এই পাথরের চাঁইগুলো এতটাই প্রাচীন যে, সাধারণ ভূতত্ত্বের জ্ঞান দিয়ে এগুলোর আনুমানিক বয়স বলা অসম্ভব। তবে এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর গঠনের সময়ও এই পাথরগুলোর অস্তিত্ব ছিল। এই পাথরগুলোর উপাদান হিসেবে থাকা কংক্রিট আর সিমেন্টের উপাদান রীতিমতো বিস্ময়কর। এবং আরও বুঝতে পারি, বহু দিন, হয়তো সহস্র-লক্ষাধিক বছর কিংবা তারও বেশি দিন এগুলো জলের তলায় ডুবে ছিল। এবং বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী এই পাথরের চাঁইগুলো। আর এগুলো বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে। ঠিক কত দিন, আমি বলতে পারব না। সত্যি বলতে কী, ভাবতেও চাই না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, আমরা দুজনেই মুখোমুখি হয়েছিলাম বহু প্রাচীন এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের।

একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এগুলো হাতে পাবার পর আপনি অবশ্যই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমিতে অভিযান করতে চাইবেন। এ ব্যাপারে আমার আর ড. বয়েলের তরফ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা আপনি পাবেন। আপনি চাইলে আপনার পরিচিত কোনও সংস্থার সঙ্গেও অভিযানের আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে কথা বলতে পারেন। আমি অভিযানের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালাবার জন্য কিছু মজুরের ব্যবস্থা করতে পারি। কারণ স্থানীয় ওইসব আদিবাসীকে দিয়ে এসব কাজ আর করানো যাবে না। ব্যাটারা ভয়েই কুঁকড়ে আছে। তবে এই অভিযানের ব্যাপারে আপনি, আমি ও ড. বয়েল ছাড়া আর কেউ জানবে না। আর একটা ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, যদি কিছু আবিষ্কারও করতে পারি, সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব হবে আপনার।

এবার আসি জায়গাটার প্রসঙ্গে। পিলবারা থেকে মোটর ট্র্যাক্টরে করে ওখানে পৌঁছোতে দিন চারেক লাগবে। ওই মোটর ট্রাক্টরে আমাদের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও নিয়ে নেওয়া যাবে। ওয়ারবার্টন পারথের দক্ষিণ-পশ্চিমে আর জোয়ানা প্রপাতের ১০০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে শেষ হবে ট্র্যাক্টর-যাত্রা। তারপর ডি গ্রে নদীপথেই আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হবে। ওই পাথরের চাঁইগুলোর সঠিক অবস্থান হল ২২ ডিগ্রি ৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ড দক্ষিণ অক্ষাংশ আর ১২৫ ডিগ্রি ৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমা। ওখানকার আবহাওয়া কিন্তু খুবই গরম আর ক্রান্তীয় প্রকৃতির। তাই জুন থেকে আগস্টের মধ্যেই যাওয়া ভালো। যদি আপনারও কোনও পরিকল্পনা থাকে, সেটাও জানাবেন। সে যা-ই হোক, অত চিন্তা করার কিছু নেই। বাকি কথাবার্তা না-হয় সামনাসামনিই হবে। ড. বয়েলও আপনাকে পরে চিঠি লিখবেন। আর জরুরি কিছু বলার হলে না-হয় পাথ থেকে তার করে দেওয়া যাবে।

আপনার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।
নমস্কারান্তে
রবার্ট বি এফ ম্যাকেঞ্জি

চিঠিটা পড়বার পর কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই চিঠিটা আরও বার দুয়েক পড়লাম। আনন্দে আর উত্তেজনায় আমার বুকের ভেতর

ধুকপুকুনিটা যেন স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। এরপর আর খুব বেশি দেরি করিনি। আমার জবাব ম্যাকেঞ্জি আর ড. বয়েলকে জানিয়ে দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে মিসকাটনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহচর্য আর পৃষ্ঠপোষকতা পেতে আমার খুব বেশি অসুবিধে হয়নি। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ম্যাকেঞ্জি আর ড. বয়েলও যাবতীয় আয়োজন সেরে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমরা বিষয়টা যতটা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত সেটা আর হল না। সর্বত্র কাগজওয়ালারা ফেউয়ের মতো লেগে গেল আমাদের পেছনে। শুরু হল আমাদের এই আসন্ন অভিযান নিয়ে নানারকম আষাঢ়ে গল্প আর টিটকিরির বন্যা। যদিও আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য তাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তাই গুজব আর টিটকিরিতেই এগুলো সীমিত থাকল।

এবার এই অভিযানে আমার সহযাত্রীদের নিয়ে বলা যাক। প্রথমেই বলব মিসকাটনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অধ্যাপকের কথা। এঁরা হলেন ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম ডায়ার (যিনি ১৯৩০-৩১ নাগাদ অ্যান্টার্কটিকা অভিযান করেছিলেন), প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ফার্ডিনান্দ সি অ্যাশলে আর নৃতত্ত্ব বিভাগের টাইলার এম ফ্রিবরন। এবং এঁদের সঙ্গে অবশ্যই ছিল আমার মেজ ছেলে উইনগেট। ১৯৩৫ নাগাদ ম্যাকেঞ্জি আর্কহ্যামে আসে এবং আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে যারপরনাই সাহায্য করে। আমি এই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ভদ্রলোকের উৎসাহ আর অস্ট্রেলিয়ার হালহকিকত নিয়ে জ্ঞান যত দেখছিলাম, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।

চিঠিতে যেমন বলা ছিল, ঠিক সেইভাবেই পিলবারাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মোটর ট্র্যাক্টর। আর এরপর আমরা ভাড়া করে নিই একটা টহলদারি স্টিমার। আমরা একেবারে আধুনিক আর বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাতে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো যায়, তার জন্য সবরকম যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিলাম। ১৯৩৫-এর ২৮ মার্চ আমরা বোস্টন থেকে এসে পৌঁছোলাম লেক্সিংটনে। সুয়েজ খাল বরাবর আটলান্টিক সাগর, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছোলাম লোহিত সাগরে এবং ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আমরা চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। যাত্রাপথের ক্লান্তিকর আর দীর্ঘ বর্ণনায় আর গেলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছেন ড. বয়েল। মনোবিজ্ঞানের ওপর তাঁর দখল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এবং বাকি যাত্রাপথ আমি আর উইনগেট তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করে কাটিয়ে দিলাম।

যাত্রাপথের শেষে যখন আমাদের অভিযানের দল সেই বালি আর পাথরের দুনিয়ায় প্রবেশ করল, তখন ক্লান্তিতে আমাদের যা হাল হয়েছিল তা হয়ত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অবশেষে ৩১ মে এক শুক্রবার ডি গ্রে নদীর শাখা বেয়ে আমরা এসে পৌঁছোলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই অজানা আর অদ্ভুত জগতে। যে অপার্থিব বস্তুগুলো এত দিন আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেগুলোকে সামনে দেখলে ঠিক কী মনে হতে পারে, এ কথা ভাবতেই এক অজানা আর নারকীয় আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করল।

৩ জুন, সোমবার আমরা এসে পৌঁছোলাম সেই জায়গায়, যেখানে ওই রাক্ষুসে পাথরের চাঁইগুলো রয়েছে। প্রথমে অর্ধেক পোঁতা পাথরটা দেখে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলাম। তারপর যখন সেটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, তখন যে আমার ঠিক কী অনুভূতি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ওই পাথরের চাঁইটা ছিল আমার স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নে দেখা দৈত্যাকার স্থাপত্যে তৈরি বাড়িগুলোর দেওয়ালের এক টুকরো ভগ্ন নিদর্শন। ওই পাথরের গায়ে খোদাইয়ের চিহ্ন ছিল। এবং যখন হাত দিয়ে একটা নকশাকে দেখে চিনতে পারলাম, উত্তেজনায় আমার হাত কাঁপতে লাগল। কারণ বহু দিন ধরে নিয়মিতভাবে যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্ন আর গবেষণার ফলে ওই নকশাটা ছিল আমার কাছে ভীষণভাবে পরিচিত।

এক মাস ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চালাবার পর নানারকম আকৃতির প্রায় ১২৫০টা পাথরের চাঁই আমরা খুঁজে পেলাম। বেশির ভাগই ছিল ওপর-নীচে ঢেউ-খেলানো মান্ধাতার আমলের খোদাই-করা স্মৃতিস্তম্ভের মতো। কিছু ছিল আমার স্বপ্নে দেখা ওই পাষাণপুরীর মেঝে আর রাস্তার ধারের ফুটপাথের মতোই চৌকোনা বা আটকোনা চ্যাটালো ছোট পাথর। কয়েকটা আবার দানবীয় আকারের পাথরও ছিল। আমরা উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর যত খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে লাগলাম, ক্রমাগত এরকম পাথরের নমুনা আরও চোখে পড়তে লাগল। যদিও এযাবৎ আবিষ্কৃত সব কটা পাথরের মধ্যে কোনওরকম যোগসূত্র আছে কি না, সেটা আমরা বের করতে পারিনি। অধ্যাপক ডায়ার এই পাথরগুলোর প্রাচীনত্ব দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তবে অধ্যাপক ফিবরন অবশ্য কিছু চিহ্নের সঙ্গে পাপুয়ান আর পলিনেশীয় ভয়ানক কিছু প্রচলিত কিংবদন্তির মিল খুঁজে পেলেন। তবে পাথরগুলোর অবস্থা দেখে আমরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত ছিলাম, এগুলো বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী।

আমাদের সঙ্গে যে এরোপ্লেন ছিল, আমার মেজ ছেলে উইনগেট তাতে চেপে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন উচ্চতা থেকে জরিপ করে মরুভূমির বালি আর পাথরগুলোর মধ্যে নতুন কোনও চিহ্ন বা সূত্র খুঁজে দেখার চেষ্টা চালাত। অবশ্য তার এই চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সে সাফল্যের মুখ দেখল। ঝোড়ো হাওয়ার ফলে বেশ কিছু বালি এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। আর তার ফলেই তার চোখে পড়ল নতুন এক পাথরের ছাঁদ। আর এইগুলোর মধ্যে দু-একটা দেখার পরই আমি চিনতে পারলাম এই ছাঁদগুলোকে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, হুবহু। কোথায় এগুলোকে আমি দেখেছিলাম। হতে পারে, আমার সেই নারকীয় দুঃস্বপ্ন অথবা দিনরাত পড়াশোনা আর গবেষণার ফলেই হয়তো অবচেতন মনে এর ছাপ রয়ে গেছে।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ আমি প্রথম সেই অজানা উত্তুরে ভয়ানক বাসিন্দাদের সম্পর্কে ভয় আর কৌতূহল মেশানো একটা অদ্ভুত গা-শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম। হয়তো এর জন্য কিছুটা দায়ী ছিল আমার আগের ভয়ানক অভিজ্ঞতার স্মৃতি। আমি মাথা থেকে এইসব চিন্তা হটাবার জন্য নিজেকে নানারকম মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলাম। কিন্তু সবই বিফল হল। এই সময় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হল অনিদ্রা। তবে এটা আমার কাছে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি, কারণ ঘুমোলেই তো আবার ওইসব স্বপ্ন দেখতে হবে! সে যা-ই হোক, এই সময় আমার একটা নতুন অভ্যাস তৈরি হল। সেটা হল গভীর রাতে উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর মরুভূমিতে হাঁটা। কেন জানি না মনে হত, হয়তো আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্ন নগরীর বা তার বাসিন্দাদের দেখা পেলেও পেতে পারি। নিজের ইচ্ছা থাক বা না-থাক, কেউ যেন জোর করে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ওই নৈশভ্রমণে। ঘুরতে ঘুরতেই কখনও কখনও হোঁচট খেতাম মাটি থেকে সামান্য উঁকি-মারা সেই আদ্যিকালের স্থাপত্যের কিছু পাথরের টুকরোয়। কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। যদিও আমার বিশ্বাস ছিল, মাটির নীচে এই স্থাপত্যের সিংহভাগই বহু যুগ ধরে লুকিয়ে রয়েছে। তার কারণও ছিল অবশ্য। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল ওই পাথুরে টুকরোগুলোর থেকে উঁচু জায়গায়। বালির ঝড়ের দৌলতে একটা সাময়িক টিলার সৃষ্টি হয়েছিল। আর টিলার জন্যই অপেক্ষাকৃত নতুন পাথরের টুকরোগুলো কিছুটা মাথা বের করেছিল।

এই গোটা এলাকার খোঁড়াখুঁড়ি চালালে ঠিক কী কী আবিষ্কার হতে পারে, তার জন্য আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। এই নৈশভ্রমণের ফলেই আমি একদিন আবিষ্কার করলাম এক ভয়ানক জিনিস। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১১ তারিখ। জ্যোৎস্নায় ঝলমলে হয়ে ছিল গোটা এলাকাটা। আমিও নিজের নৈশভ্রমণের এক্তিয়ার পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম আরও খানিকটা। এবং ঘুরতে ঘুরতেই আমার চোখে পড়েছিল একখানা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই। পাথরটা প্রায় পুরোটাই বালিতে ঢেকে গিয়েছিল। আমি ভালোভাবে দেখার জন্য দু-হাত দিয়ে সব বালি পরিষ্কার করলাম। তারপর চাঁদের আলো আর আমার ইলেকট্রিক টর্চের যুগলবন্দিতে ভালোভাবে দেখতে লাগলাম পাথরটা। একেবারে নিখুঁত বর্গাকার এই পাথরটা ছিল আমাদের অভিযানে আগে দেখা সব কটা পাথরের থেকে এক্কেবারে আলাদা। ব্যাসাল্টজাতীয় শিলা দিয়ে তৈরি এই পাথরের চাঁইটায় কোনও উত্তল বা অবতল অংশ ছিল না। আর তখনই আমার মাথায় একটা ঝলক দিল! ঠিক এইরকম পাথরগুলোকেই আমি আমার স্বপ্নে দেখতাম। ইথদের দুনিয়ায় আমি যে জানলাহীন পেল্লায় পাথুরে বাড়িগুলো দেখতাম, এই পাথরটা সেই বাড়িগুলোরই একটা অংশ। এই বাড়ির মধ্যেই পাতাল-কুঠুরিতে চিরকালের জন্য দরজার মুখ বন্ধ করে রেখে দেওয়া হত কোনও অপার্থিব শক্তিকে। আর দেরি নয়, দৌড় লাগালাম আমাদের ক্যাম্পের দিকে। সে রাতে আর ঘুম এল না আমার। ভোরবেলা বুঝতে পারলাম, কী বোকামিটাই না করেছি! একটা মান্ধাতার আমলের উপকথা আর আমার দুঃস্বপ্নের ভিত্তিতে ওভাবে ভয় পাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। একটু বেলা হলে আমি সবাইকে আমার আবিষ্কারের কথা বললাম। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে রওনা দিলাম পাথরটাকে দেখার জন্য। কিন্তু আমার কপালটাই বোধহয় খারাপ ছিল। গত রাতে বালির ঝড়ে গোটা এলাকাটা ঢাকা পড়ে গেছে, ফলে আমি ঠিক কোন জায়গাটায় ওই পাথরটাকে দেখেছিলাম, খুঁজে বের করতে পারলাম না।

এইবার আমি আমার এই লেখার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পর্কে বলতে চলেছি। কারণ একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এগুলো কখনওই আমার কল্পনা বা স্বপ্ন নয়, ভয়ংকর রকমের সত্যি। কারণ আমার মেজ ছেলের মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল, আর ও কখনওই এই বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নেয়নি। আর আমার এই কেসের গোড়া থেকেই উইনগেট সাক্ষী ছিল। যা-ই হোক, এবার আসি আসল ঘটনায়। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১৭-১৮ তারিখের একরাতের ঘটনা। বাইরে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। আমি ক্যাম্পে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও ঘুম আসছিল না। তখন বোধহয় এগারোটা বেজেছিল, দেখলাম, আর শুয়ে কাজ নেই। যথারীতি সেই নৈশভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাম্প থেকে যখন বেরোচ্ছি, ট্যাপার বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান খনি মজুর আমাকে দেখে অভিবাদন জানাল। আকাশে তখন ঝলমলে চাঁদ তার নিজস্ব শোভা নিয়ে বিরাজমান। জ্যোৎস্নায় চারদিক উজ্জ্বল। আমি নিশ্চিত কারও কবিতা লেখার শখ থাকলে তিনি বেশ কয়েক ছত্র কবিতা লিখে ফেলতেন। কিন্তু আমি তো ঘরপোড়া গোরু, তাই কী একটা অশুভ আমাকে যেন ক্রমাগত ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল করলাম, সেই ঝোড়ো বাতাসটা আর তেমন জোরে বইছে না। বুঝলাম, আগামী চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আর ঝোড়ো বাতাস বইবে না। আসলে ট্যাপারদের সঙ্গে কথা বলে এইসব ব্যাপারস্যাপার আমিও বেশ জেনে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ হেঁটেছিলাম খেয়াল নেই, তখন বোধহয় সাড়ে তিনটে মতো বেজেছিল। হঠাৎ সেই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। বাতাসের এমনই দাপট ছিল, যে আমাদের ক্যাম্পের সকলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙে যেতে সবাই দেখল আমি গায়েব। কিন্তু যেহেতু আমি রোজই নৈশভ্রমণে বেরুতাম, কেউ গা করেনি। এদিকে তখনও বাইরে জ্যোৎস্না ঝলমল করছে, আকাশে ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। আমাদের ক্যাম্পের কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান মজুর আবার বেশ কুসংস্কারগ্রস্ত ছিল। তারা মনেপ্রাণে এইসব প্রচলিত উপকথায় বিশ্বাস করত। তাদের ধারণা ছিল, মেঘহীন ঝকঝকে আকাশ থাকা সত্ত্বেও যখন অনেকদিন বাদে এই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করবে, সেটা নিশ্চিতভাবে অশুভ। এই বাতাসে কান পাতলে নাকি অনেক অপার্থিব ফিশফিশানি শুনতে পাওয়া যায়। আর এই বাতাসের ফলেই বালির ভেতর থেকে জেগে ওঠে বহু যুগ ধরে মাটির নীচে সুপ্ত থাকা সেইসব রাক্ষুসে আঁকিবুকি-কাটা পাথরের চাঁই। এই সময় তারা ভুলেও ওই এলাকা কখনও মাড়ায় না। তখন আন্দাজ চারটে বাজে, দুম করে ঝোড়ো বাতাস বওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই বালি খুঁড়ে তখন অনেক নতুন আকারের পাথর মাথা তুলেছে।

যখন পাঁচটা নাগাদ চাঁদ পশ্চিমদিকে বিদায় নিল, আমিও টলতে টলতে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আমার মাথায় না-ছিল কোনও টুপি, আর ইলেকট্রিক টর্চটাও গিয়েছিল হারিয়ে। আর আমার চেহারা অবিকল লাশকাটা ঘরের কোনও কাটাছেঁড়া করা লাশের মতোই ফুটিফাটা, শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়লেও অধ্যাপক ডায়ার ক্যাম্পের সামনে বসে জুত করে পাইপ টানছিলেন। আমার চেহারার হাল দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ড. বয়েলকে ডেকে আনলেন। তারপর দুজনে মিলে আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন আমার বিছানায়। এরপর ড. বয়েল, অধ্যাপক ডায়ার আর উইনগেট মিলে আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু আমার তখন যা মানসিক অবস্থা, ওসব ঘুম-টুম তখন বিশ বাঁও জল। হয়তো এযাবৎ আমার মানসিক অবস্থা যতবার বিগড়েছে, এবারেরটা ছিল সব থেকে ভয়াবহ। কিছুক্ষণ বাদে আমি এলোমেলোভাবে আমার হাল কী করে এরকম হল, বর্ণনা দিতে শুরু করলাম। আমি ওদের বললাম যে, আমি ক্লান্ত হয়ে বালির ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি যেসব ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিলাম তা এযাবৎকাল যত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, সব কটাকে টেক্কা দিয়েছিল। অবশেষে যখন আমার স্নায়ু আর দুঃস্বপ্নের ভার বইতে পারেনি, তখন আমি জেগে উঠি। এবং প্রচণ্ড ভয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার সময় ওই হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা পাথরগুলোয়ে ধাক্কা খেয়েই হয়তো আমার শরীর এভাবে কেটে-ছড়ে গেছে। হয়তো আমি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে একটা কথা মানতেই হবে যে, ওই বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েও আমি নিজেকে খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছিলাম। এরপর আমি জানাই, আমাদের অভিযানের কর্মসূচি একটু পালটে যাবতীয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ উত্তর-পূর্বদিক বরাবর করলে ভালো হয়। যদিও আমার কথায় কোনও যুক্তি ছিল না। শুধু কিছু দুঃস্বপ্ন আর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কেউই কর্মসূচি পালটাতে রাজি হয়নি। এদিকে আমাদের অভিযানের পুঁজিও ফুরিয়ে আসছে, আর আমার যা শরীর ও মনের অবস্থা, তাতে কোনও নতুন ঝুঁকি নিতে কেউ রাজি হয়নি, এমনকী উইনগেটও নয়।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ক্যাম্পের চারদিকে একটু টহল দিলেও ওদের খোঁড়াখুঁড়ির কোনও কাজে কোনও অংশ নিলাম না। দেখলাম, এদের সঙ্গে থাকলে আমার কাজ তেমন এগোবে না। কিন্তু আমাকে কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। তাই ঠিক করলাম, আমাকে দেশে ফিরতে হবে। আমার মেজ ছেলে উইনগেটকে বললাম আমার সঙ্গে বিমানে প্রায় হাজার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম পারুথে যাবার জন্য। সঙ্গে এ-ও বললাম, সেখানে পৌঁছোনোর পর যাবতীয় যা কাজ, সব আমি একাই করব। জুলাই মাসের ২০ তারিখ নাগাদ উইনগেট আমার সঙ্গে পারুথে রওনা দিল। ২৫ তারিখ লিভারপুল থেকে স্টিমার ছাড়া অবধি ও আমার সঙ্গে ছিল। এবং স্টিমারের কেবিনে বসে বসেই আমি এই লেখা লিখছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, উইনগেটের গোটা ব্যাপারটাই জানা দরকার। বিশেষ করে সেই রাতের ঘটনাটা, যেটা আমি কাউকে বলিনি। আমার দুঃস্বপ্নের প্রতীক সেই নারকীয় হায়ারোগ্লিফিক লেখাওয়ালা সাইক্লোপিয়ান পাথরগুলো যখন পাতাল ফুড়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল, আমার যাবতীয় দুঃস্বপ্ন আর তাদের কেন্দ্র করে আমার গবেষণা সব কিছু নিছকই শিশুসুলভ মনে হয়েছিল। হয়তো আকাশ থেকে জরিপ করার সময় উইনগেট এই পাথরগুলোই দেখেছিল, আর এদের মধ্যে মিল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আমি যখন এগুলো তেমনভাবে খেয়াল করিনি, কোনও এক অজানা, অশুভশক্তি প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল এগুলো আমার দৃষ্টিগোচরে আনতে। আমি আগেই বলেছি, জুলাই মাসের ১৮ তারিখের সেই চাঁদনি রাতে ঝোড়ো বাতাস হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমি আচমকাই সমুদ্রের মতো শান্ত আর স্থির হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আমার এই অভিযানে তেমন কোনও কাজ ছিল না, তাই উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতাম। উদ্দেশ্য একটাই, যদি কপালফেরে সেই দুঃস্বপ্নের নগরীর কোনও নিশান খুঁজে পাই! আমরা জানি, আমরা সব থেকে বেশি ভয় পাই অজানা-অচেনাকে। কিন্তু সেই অজানা-অচেনা জিনিস যদি আমাদের চোখের সামনে বারে বারে উঠে আসে, আমাদের ভয় অনেকটাই কমে যায়। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু আদৌ তা হয়নি, বরং উলটোটাই হয়েছিল। স্বপ্নের জগতের সেইসব করাল বিভীষিকা যখন স্বপ্নের গণ্ডি পেরিয়ে আমার রোজকার জীবনে হানা দিয়েছিল, আমার জীবন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। আমার চোখের সামনে প্রাক-মানবসভ্যতার সেইসব ভয়াবহ পাথুরে আতঙ্কপুরীর বালি-আবৃত বারান্দা, খিলান, কুঠুরি বারে বারে ফিরে ফিরে আসত। সঙ্গে অবশ্যই সেইসব হায়ারোগ্লিফিক নকশা। এখানেও কিন্তু আমি ঠিক ওই আতঙ্কপুরীর মতোই বিভিন্ন বালি দিয়ে ঢাকা পাথরের চাঁই দেখতাম। সে দিন ঠিক কতক্ষণ ধরে কোন দিক বরাবর আমি হেঁটেছিলাম, আমার কোনও খেয়ালই ছিল না। তাই যখন আমি হাঁটতে হাঁটতে ওই পাথরের চাঁইগুলোর কাছে সে দিন পৌঁছোলাম, আমার বুকের ভেতর দামামা বাজতে লাগল। কারণ একসঙ্গে এতগুলো পাথরের চাঁই আমি এখনও পর্যন্ত দেখিনি। আকাশের চাঁদ আর মরুভূমিকে এখন আর সৌন্দর্যের প্রতীক মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল অগণিত বছর ধরে কোনও অন্ধ অতীতের সাক্ষী এরা।

আমি এবার একটু কাছে এগিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর আমার ইলেকট্রিক টর্চের আলো ফেললাম। প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে একটা টিলা দেখতে পেলাম। আমার কেন জানি না মনে হল, এই পাথরের চাঁইগুলো কোনওভাবেই সাধারণ হতে পারে না। এযাবৎ আমরা যে ক টা নমুনা দেখেছি, এগুলো তার থেকে অনেক গভীর অর্থপূর্ণ ছিল। এগুলোর ওপর যে আঁকাবাঁকা রেখাগুলো ছিল, সেগুলো আমি দেখেই চিনতে পারলাম। গবেষণা করে করে এই রেখাগুলো আমার খুবই পরিচিত। অনেক কসরত করে আমি একটু নিচু জায়গা দেখে নামলাম। তারপর এখানে-ওখানে যে বালি লেগেছিল, সেগুলো আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলাম। তারপর ক্রমাগত এগুলোর আকার, আকৃতিগত সামঞ্জস্য খুঁজতে লাগলাম। প্রথমে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঠিক তারপরেই টের পেলাম, এই ধ্বংসস্তূপকে কোথায় দেখেছি! এগুলো হল আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই রাক্ষুসে তিরিশ ফুট লম্বা ইমারতেরই ভগ্নাংশ! কিন্তু এগুলো ঠিক কত দিন ধরে মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল, কোনও কূলকিনারা পেলাম না। আমি এই পেল্লায় ইমারতের লাইব্রেরি, বারান্দা, সেইসব ঘর এবং সর্বোপরি সেই দানবীয় ইথদের অনেক আগেই দেখেছিলাম। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল।

হঠাৎ টের পেলাম, সেই পাথরের গাদা থেকে আবার ঠান্ডা, দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঠিক যেন গভীর পাতাল থেকে কোনও ঘূর্ণাবর্ত জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। বাইরের এই ধ্বংসস্তূপগুলো যার খোলস। আমার প্রথমেই মনে পড়ল স্থানীয় আদিবাসীদের সেইসব উপকথার কথা। কিন্তু তারপরেই আমার মনে পড়ে গেল আমার সেই দুঃস্বপ্নের কথাগুলো। টের পেলাম, আমার বহু আতঙ্কিত রাতের সেইসব দুঃস্বপ্ন এবার সত্যি হতে চলেছে। এই সময় হয়তো আমার পালিয়ে আসাই উচিত ছিল, কিন্তু একটা কৌতূহল আর বৈজ্ঞানিক মানসিকতা যা-ই হোক-না কেন, আমাকে সাহায্য করল সেই ভয়কে জয় করতে। কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই আমি তরতরিয়ে এগোতে লাগলাম সেই ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার উৎসের সন্ধানে। কোনও অলৌকিক বল যেন আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। কী করে জানি না, প্রথমেই আমি এক ঝটকায় একটা পেল্লায় পাথরের চাঁইকে সরিয়ে ফেললাম। আমার শরীরে তখন অমানুষিক শক্তি ভর করেছে। তারপর একের পর এক পাথরকে অনায়াসে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম। একটা জিনিস টের পেলাম, এই মরুভূমির দেশে থাকলেও পাথরগুলো কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই অলৌকিক বল আমাকে টেনে নিয়ে গেল অতল গহ্বরে। তলিয়ে যাবার সময় আমি আবার সেই বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পেলাম। যখন হুঁশ ফিরল, দেখি, সেই গহ্বরের মধ্যে আমি পড়ে আছি। আমার আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপের নানা নিদর্শন। পাশেই পড়ে আছে আমার ইলেকট্রিক টর্চ। আমি টর্চটা জ্বালালাম। কিন্তু সেই অন্ধকার ঘোচাবার পক্ষে ওই টর্চ নিছক খেলনা ছাড়া কিছুই নয়। এই মরুভূমির অতলে কত যুগ ধরে এই প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ রক্ষিত হয়েছে, কে জানে? খুব সম্ভবত পৃথিবীর সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। আমি ব্যাটারির আয়ু বাঁচাবার জন্য টর্চটা নেবালাম। আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট বুঝলাম, খুব ভয়ানক অশুভ কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যা-ই হোক, আমি হাত ও পা একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে এগোতে লাগলাম।

আমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল, সেই দানবীয় আঁকিবুকি-কাটা বিশাল দেওয়াল আর সীমাহীন অন্ধকার। আমি প্রথমটাই বেছে নিলাম। আমি ঠিক কোন পথে নীচে এলাম, সেটা কোনওভাবেই আঁচ করতে পারলাম না। অতঃপর এলোমেলো কিছু স্মৃতির ওপর ভরসা করেই এগোতে লাগলাম। আমার শরীর তখন পুরোপুরি অসাড়। তার ওপর ভয়ও কাজ করছিল। এগোতে এগোতে এতক্ষণে একটা ঘরের মেঝেমতো পেলাম। মেঝের এদিক-ওদিক বিভিন্ন পাথরের টুকরো পড়ে আছে। সঙ্গে ধুলো ও জঞ্জাল। ঘরের অন্যদিকে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু একটা দেওয়াল উঁচু হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। ওই দেওয়ালেও আঁকিবুকি থাকলেও সেগুলো ঠিক কীরকম এত দূর থেকে আমি ঠাহর করতে পারলাম না। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে আমি সব থেকে ঘাবড়ে গেলাম, সেটা হল এই ঘরের ধনুকের মতো বাঁকানো ছাদ। যদিও টর্চের আলোয় সবটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু ওই ছাদের নীচের অংশটা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এগুলো আমার সেই দুঃস্বপ্নের পাতালপুরীর মতোই! এই অতল গহ্বর থেকে আমি কী করে ফিরব, কোনওভাবেই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি এবার আমার বাঁদিকের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম। এই দেওয়ালটা অন্যগুলোর থেকে কিছুটা কম এবড়োখেবড়ো ছিল। অনেক কষ্টে আমি এগোতে লাগলাম। এগোনোর সময় আমি কয়েকটা পাথরের টুকরোকে জঞ্জালের গাদায় ঠেলে দিতেই টের পেলাম এই ঘরের শান-বাঁধানো মেঝেও হুবহু আমার আতঙ্কপুরীর মতোই।

এবার আমি টর্চটা আবার জ্বেলে ভালোভাবে দেখলাম। বেলেপাথরের ওপর কোনও জলপ্রবাহের ক্রিয়ায় কিছু কিছু জায়গা আলগা আর নরম হয়ে ভেঙেচুরে গেছে। কিন্তু যেটা দেখে আমি সব থেকে বেশি অবাক হলাম, সেটা হচ্ছে পাথরের ওপর আঁকিবুকি নকশাগুলো দেখে। এগুলো হচ্ছে সেই নকশা, যা বহু যুগের আতঙ্ককে একসঙ্গে আমার অবচেতন মন দেখতে পেয়েছিল। রাতের পর রাত আমি দেখেছিলাম দুঃস্বপ্ন। যে দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এত দূর। এই ধ্বংসস্তূপের প্রত্যেক টুকরোর সঙ্গে আমি পরিচিত, ঠিক আর্কহ্যামে আমার ক্রেন স্ট্রিটের বাড়ির মতোই। কিন্তু স্বপ্নে আমি যা দেখেছি, তার থেকে অনেক অনেক বেশি ভয়াবহ বাস্তবে এই দুঃস্বপ্নের নগরীতে হাজির হওয়া। এই আতঙ্ককে হুবহু ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দুঃস্বপ্নে আমি যেসব জলজ্যান্ত বিভীষিকাকে দেখেছিলাম, যদি তাদের মুখোমুখি হই, তাহলে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করব এবং আদৌ পারব কি না, সেটা ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আমি যেন আমার চারপাশে সেইসব বিভীষিকার অস্তিত্ব টের পেতে লাগলাম। অন্ধকারের কোথাও যেন তারা ঘাপটি মেরে আমাকে লক্ষ করছে। দুঃস্বপ্নের সেইসব দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। এখনও কি সেই লাইব্রেরিতে ইথরা ঘুরে বেড়ায়? এখনও কি সেই আতঙ্কপুরীর বারান্দা আর বন্ধ কুঠুরিগুলোর অস্তিত্ব আছে? যদিও আমার স্বপ্নে দেখা আর ওইসব কিংবদন্তির অনেক কিছুই ভবিষ্যতের ইতিহাসের খোলনলচে পালটে দিয়েছিল। অবশ্যই এক ভয়ানক উন্মাদনা আমাকে গ্রাস করেছিল, কিন্তু যে ভয়াবহতার সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে তার কাছে সেগুলো কিছুই নয়। এই সময় আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ল ইথদের সেই লাইব্রেরির কথা, যেখানে আমিও তাদের মতো একজন হয়ে গিয়ে ঝড়ের গতিতে লিখে চলতাম পাতার পর পাতা। যদি সত্যিই ওরকম কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমি নিমেষেই সেখানে পৌঁছোতে পারব।

আমার মাথার মধ্যে এবার যেন ঝড় বইতে লাগল। সমস্ত স্মৃতি থমকে থমকে ভিড় জমাল মগজে। আমার ইলেকট্রিক টর্চের কমজোরি আলো দেখে যেন ওই অনন্ত অন্ধকার বিদ্রুপের হাসি হাসতে লাগল। সত্যি বলতে কী, টর্চের ওই আলোয় জায়গাটা আরও ভূতুড়ে লাগছিল। এক জায়গায় দেখলাম, আলশেটা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, তাই ঠিক করলাম, ওইদিকেই যাওয়া যাক। আলশে থেকে পাথরের চাঁই পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গাদা হয়ে জমে আছে। অনেক কষ্টে সেগুলোর ওপর ওঠা গেল। এই দানবীয় গুহায় আমার আকৃতি ছাড়া সব কিছুই বেশ মিলে যাচ্ছিল আমার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে। নিজেকে মনে হচ্ছিল দানবের দেশে গ্যালিভার। যা-ই হোক, টলতে টলতে, লাফ দিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে আমি কোনওমতে এগিয়ে চললাম আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। একবার তো কোনওমতে টাল সামলালাম, আর-একটু হলে আমার টর্চটাই ভেঙে যাচ্ছিল। তবে আমার এখন আর কোনও কিছু মনে হচ্ছিল না, কারণ এই পাতাল গহ্বরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি এখন আমার কাছে পরিচিত মনে হল। মনে হচ্ছিল, এরা যেন আমাকে বলছে, ক্ষণিকের অতিথি হয়ে কেন এলে আমাদের কাছে? আমরা যে যুগ যুগ ধরে তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। এসো, আমাদের কাছে এসো।

এখানকার বেশির ভাগ ঘরই হয় ভেঙেচুরে গেছে, নয়তো আবর্জনায় ভরতি। কয়েক জায়গায় দেখলাম, কিছু ধাতব পাত পড়ে আছে। কয়েকটা অক্ষত থাকলেও অধিকাংশই ভেঙেচুরে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো হচ্ছে আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই টেবিলের অংশ, যেগুলোর ওপর রেখে আমি পাতার পর পাতা লিখে চলতাম। এবার একটু নীচের দিকে নামলাম। দেখলাম নীচের দিকটা বেশ ঢালু। এগোতে এগোতে এবার থামলাম। দেখলাম, ফাটলের জন্য সামনে প্রায় ফুট চারেক ফাঁকের সৃষ্টি করেছে। ওই অন্ধকারের জন্য ফাঁকের ভেতরে কী আছে তা আন্দাজ করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানতাম, এই ইমারতের মাটির নীচে আরও দুটো তলা আছে। আর একদম শেষ তলায় আছে ধাতুর তৈরি সেই চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া দরজা। এদিকে এই ফাটল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আমার পক্ষে এগোনো রীতিমতো কষ্টকর হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কেন জানি না, হয়তো নিজের পাগলামির ভরসাতেই আমি এগোতে থাকলাম বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে। এইভাবে পৌঁছোলাম একেবারে শেষের ধাপে। আমার ক্ষীণ স্মৃতি আমাকে বলল, এই পথে গেলেই আমি আমার বহু-আকাঙ্ক্ষিত সেই মেশিন ঘরে পৌঁছোতে পারব। কালের প্রকোপে যেগুলো হয়তো আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে, কিংবা হয়নি! কোথায় কী ছিল, আমার একদম মুখস্থ। তাই বেশ মনের জোর নিয়েই আমি সেই ধ্বংসস্তূপের গাদা পেরিয়ে এগোতে লাগলাম। আমি জানতাম, একসময় এই ত্যারচা বারান্দা পেরিয়েই আমি পৌঁছোতাম সেই দুঃস্বপ্নের লাইব্রেরিতে। তাই আমার আশা ছিল, এবারেও সেখানে পৌঁছে যাব।

যত এগোতে লাগলাম, আমার মনে হল, বহু যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা গোপন রহস্য এবার আমার সামনে উন্মোচিত হতে চলেছে। দেওয়াল, বারান্দার ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে কিছু কিছু মিল খুঁজে পেলাম, কিছু আবার নতুন জিনিসও দেখলাম, যেগুলো আগে দেখিনি। আমি জানতাম, মাটির নীচের কোনও রাস্তা এই আতঙ্কপুরীকে মূল রাস্তার সঙ্গে যোগ করেছে। শুধু এই বাড়িই নয়, আশপাশের সেই রাক্ষুসে বাড়িগুলোকেও। তবে এখনও অবধি আমি আমার স্বপ্নের থেকে খুব বেশি কিছু ফারাক খুঁজে পাইনি। খুব আবছাভাবে হলেও, কিছু কিছু রাস্তা আমার এখনও মনে ছিল। তবুও আমি আরও ভাবতে লাগলাম। মাথায় বেশি জোর দেবার ফলে আমার অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ল। তবুও আমি মনে করতে পারলাম, মাটির নীচের সেই গোলাকার গম্বুজঅলা ঘর কম করে দু-শো ফুট জুড়ে ছিল। মেঝেটা এতই চকচকে ছিল যে, আমি নিজের ছায়াও দেখতে পেতাম। ইথদের দরকার না-থাকায় এখানে কোনও সিঁড়িও ছিল না। স্বপ্নের সেই দানবীয় মিনারগুলো ইথরা কড়া পাহারায় রক্ষণাবেক্ষণ করত, কিন্তু এখন তো আর সেখানে কোনও পাহারা নেই! ভেবেই আমার মাথা ঘুরতে লাগল।

এবার সেই বারান্দায় এক জায়গায় গিয়ে থামতে বাধ্য হলাম। এখানে পাথরের স্তূপ প্রায় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে। আর দেখলাম একটা বিশাল বড় গহ্বর, যেটা দেখে বুঝলাম, আমার ইলেকট্রিক টর্চ এখন দেওয়াল বা গহ্বর কোনও কিছু দেখার জন্যই আর কাজে আসবে না। আমার কেন জানি না মনে হল, এটা মাটির নীচের সেই চোরাকুঠুরির কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি সীমারেখা। আমি বুঝতে পারলাম, ইথদের সেই তথ্যভাণ্ডারের খুব কাছাকাছি এসে গেছি। কিন্তু তিন নম্বর ধাপে উঠে যা দেখলাম, সেটা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা ছিল না। মনে হল, এতক্ষণ যা করলাম, সব পণ্ডশ্রম! এত কাঠখড় পুড়িয়ে আবার আমি এসে হাজির হয়েছি নতুন এক প্রকাণ্ড বারান্দায়। এখানে ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো প্রায় ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। এরপর পুরোপুরি হয়তো আমার পাগলামির ওপর ভর করেই হ্যাঁচকা দিয়ে ওই পাথরের স্তূপগুলোকে সরাবার জন্য উদ্যোগী হলাম। স্বপ্ন নাকি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন জানি না, কিন্তু অনেক কসরত করে একফালি এগোবার রাস্তা বানাতে সক্ষম হলাম। আমার ইলেকট্রিক টর্চ ক্রমাগত জ্বালাতে ও নেবাতে (অবশ্যই ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য) লাগলাম পাথর সরাবার কাজে। একবুক তেষ্টা নিয়ে কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করলাম, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে গেলে হয়তো আরও একটি অধ্যায় লিখে ফেলতে হবে।

বারে বারে পিছলে যেতে যেতেও দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরেছিলাম পাথরের চাঁইগুলোকে। যুদ্ধশেষে একটা মোটামুটি দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম। এবং অবশেষে টের পেলাম, আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তু সেই লাইব্রেরির খুব কাছাকাছি এসে গেছি। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমি এসে পৌঁছেছি চারদিক বন্ধ খিলানওয়ালা একটা নিচু গোলাকার সমাধিগৃহে। এই সমাধিগৃহের অবস্থা কিন্তু অতটা তথৈবচ নয়। বরং দেখলে মনে হবে, দীর্ঘ দিন ধরে এর রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে। এর দেওয়ালগুলো আমার টর্চের নাগালের মধ্যেই ছিল। তাই টর্চের আলোয় ভালো করে দেখলাম। এবং দেখে চমকে উঠলাম! আরে! এগুলোতে তো হায়ারোগ্লিফিক লেখা ও আঁকিবুকিতে ভরতি! কিছু কিছু আঁকিবুকি তো হুবহু আমার স্বপ্নের মতো। বুঝলাম, আমার নিয়তি আজ আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সেই আলো-আঁধারির দেশে। আমার বাঁদিকের একটা ধনুক আকারের খিলানওয়ালা পথ গেছে দেখলাম, তাই সেদিকেই পা বাড়ালাম। এই পথে এগোতে এগোতে দেখলাম, ওপরে আর নীচে যে অংশগুলো এখনও টিকে আছে, এখান থেকে নাগাল পাওয়া যেতে পারে। একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়ে গেলাম সমস্ত পৃথিবী থেকে সুরক্ষিত, সৌরজগতের যুগান্তরের নিখুঁত বর্ণনাসমৃদ্ধ এই তথ্যভাণ্ডার নির্মাণে কী অমানবিক দক্ষতা প্রয়োগ হয়েছে। এই গোটা স্থাপত্যটা নিজেই যেন এক স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম! নিখুঁত গাণিতিক পদ্ধতিতে সিমেন্টের সাহায্যে এই বিরাট পাথরগুলোকে বিস্ময়করভাবে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্য। পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলের মতোই মজবুত এর ভর। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এই নতুন রাস্তা বানিয়ে নেওয়ার পর তুলনামূলকভাবে হাঁটতে আমার সুবিধে হচ্ছে, বরং একরকম দৌড়েই এগোতে লাগলাম। এই ব্যাপারটা আমাকে একটু হলেও অবাক করল আর ভাবিয়ে তুলল। এযাবৎ ওই দুঃস্বপ্নে আমি যা যা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমি আমার গতিপথের অস্বাভাবিক মিল দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দু-দিকে হায়ারোগ্লিফিক নকশা-আঁকা ধাতুর দরজা থাকে থাকে তাদের স্বকীয় মহিমায় বিরাজমান। কালচক্রে এই স্থাপত্যের অনেক কিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও, এগুলোতে তেমনভাবে সময় তার থাবা বসাতে পারেনি। ওই দরজার থাকের সারির মাঝে মাঝে ধুলোর পাহাড় তৈরি হয়েছে। বুঝতে পারলাম, ভূমিকম্পের ফলে এই ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে আবার বিভিন্ন লেখাওয়ালা গম্বুজ রয়েছে, যেগুলো দেখে বোঝা যায়, কোন তাকে কী কী খণ্ড রয়েছে, তার বিবরণ রয়েছে ওতে। হঠাৎ দেখি সমাধিঘরের মতো দেখতে একটা ঘরের দরজা খোলা! আমিও থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি, এখানে কয়েকটা ধাতব তাকওয়ালা আলমারি দিব্যি মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, এবং এগুলোতে একটুও ধুলো জমেনি। আমারও এবার গোয়েন্দাগিরির শখ চাগিয়ে উঠল। কসরত করে ওই পেল্লায় আলমারি বেয়ে উঠতে লাগলাম। ওপরের তাকে কয়েকটা রোগাপাতলা নমুনা দেখতে পেলাম। ঠিক করলাম, ওগুলো মাটিতে নামিয়ে একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে, ওগুলোতে ঠিক কী লেখা আছে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। মাটিতে নামালাম কয়েকটা পাতলা নমুনা।

এবার উলটে-পালটে দেখতে লাগলাম। ধাতব মলাটওয়ালা বইগুলো লম্বায় ছিল কুড়ি ইঞ্চি আর চওড়ায় পনেরো ইঞ্চি। আর বইগুলোর ঘনত্ব ছিল ইঞ্চি দুয়েক। এগুলোর পাতায় পাতায় হায়ারোগ্লিফিক লেখায় ভরতি! এগুলোর কিছু কিছু আমার দুঃস্বপ্নে দেখা হায়ারোগ্লিফিকের মতো। এবার আমি আর-একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এবার আমার মাথায় বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে উঠল। এগুলোর লেখার পদ্ধতি আমার খুব ভালোভাবে পরিচিত। যখন আমি গবেষণা চালাতাম, এই ধরনের লেখা আমি অনেক দেখেছি। ডি এরলেটসের কাল্টস ডি গাউলস, লুডউইগ প্রিনের ডি ভারমিন মিস্ট্রিজ, ভন জানৎসের আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন, আবদুল আলহাজ্রেডের নেক্রোনমিকন আর সেগুলোর সূত্র ধরে যে যে জিনিস নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়েছিলাম, সেটা থেকে এই বইয়ের হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তাতে এর বিষয়বস্তু পুরোপুরি না বুঝলেও এর সম্ভাব্য সারমর্ম কিছুটা হলেও আন্দাজ করলাম। সেলুলোজ দিয়ে তৈরি পাতায় অদ্ভুত রঙিন কালি দিয়ে হায়ারোগ্লিফিকে অনেক কিছু লেখা। কত কালচক্রের ইতিহাস যে লেখা রয়েছে, আন্দাজ করতে পারলাম। এই হায়ারোগ্লিফিক কোনও পরিচিত পার্থিব হায়ারোগ্লিফিক নয়, এ হল সম্পূর্ণ অশুভ অপার্থিব কোনও লিপিমালা। আমার শরীরে আশ্রয় নিয়েছিল যে দূর মেঘলোক থেকে আসা কোনও প্রাণীর চিন্তন, এ হল তার ভাষায় লেখা বিবরণ! কোনও অজানা গ্রহের সৃষ্টির সময়ের বিবরণ হয়তো বন্দি আছে এখানে, তারপর সেটা জায়গা পেয়েছিল ইথদের সংগ্রহশালায়। তবে আমি নিশ্চিত, এ আমাদের পরিচিত সৌরজগতের কোনও গ্রহ২১৬ নয়। এদিকে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমার খেয়াল ছিল না যে, আমার টর্চের ব্যাটারির হাল খারাপ। যখন দেখলাম, ব্যাটারির দৌলতে টর্চ দপদপ করতে শুরু করেছে, চটজলদি ব্যাটারি পালটে নিলাম। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাটারি সবসময়ই থাকে, তাই কোনও অসুবিধে হল না। আমার দুঃস্বপ্নের জন্য আমি এই গোলকধাঁধা আর অলিগলির অনেকটাই চিনতে পেরেছিলাম, তাই জানতাম বলেই সঙ্গে অতিরিক্ত সরঞ্জাম রেখেছিলাম। এদিকে আমার পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে নিজেরই কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। কতকাল এই পাণ্ডববর্জিত ধ্বংসাবশেষে কোনও জীবিত প্রাণীর পায়ের শব্দ শোনা যায়নি, কে জানে? বহু যুগ ধরে জমে-থাকা ধুলোর পরতের ওপর নিজের পায়ের ছাপ দেখে নিজেরই বুকটা কেঁপে উঠল। আমার অবচেতন মন ক্রমাগত জানান দিচ্ছিল, কোনও অশুভশক্তি হয়তো কোথাও ওঁত পেতে রয়েছে। এবার আমি আর-একটু গভীরে যাবার জন্য নীচের দিকে দৌড় লাগালাম। আমার সামনে শুধু টর্চের আলো। দৌড়োনার সময় টর্চের আলোয় অনেক অদ্ভুত জিনিসের নিদর্শন দেখতে পেলেও, একবারের জন্যও থামলাম না। দৌড়ের গতির সঙ্গে কেন জানি না, হয়তো আমার অবচেতন মনের নির্দেশেই বারে বারে ডান হাত ঝাঁকাতে লাগলাম! যেন আমি আধুনিক প্রযুক্তির কোনও বিশেষ কম্বিনেশনের তালা খুলতে চাইছিলাম। স্বপ্নে দেখেছিলাম, নাকি সত্যি জানি না, কিন্তু ওই তালাটার ব্যাপারে যেন আমার অবচেতন মন একশো ভাগ নিশ্চিত ছিল। স্বপ্ন না হলেও হয়তো সেই দুঃস্বপ্ন-ভ্রমণের সময় কোনও প্রাচীন অপার্থিব শক্তি নিখুঁতভাবে আমাকে ওই তালার গঠনপ্রণালী শিখিয়েছিল। এইসব ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে দুঃস্বপ্নের ক্রমাগত মিল খুঁজে পেয়ে আমার মন বারে বারে শিউরে উঠেছিল। এই গোটা ধ্বংসাবশেষ যেন কোনও অলীক অপার্থিব আতঙ্কের ভগ্নাংশমাত্র।

ইতিমধ্যে আমি সব থেকে নীচের ধাপে চলে এসেছিলাম। কিন্তু কথায় বলে না, যেখানে বাঘের ভয়…! ওই অন্ধকারের নাগপাশের জন্যই হয়তো আমার দৌড়ের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। আর যে জায়গায় এসে গতিটা কমল, আমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠল। কারণ আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম, এই জায়গাটা পার করা

সব থেকে কঠিন। কারণ এখানেই রয়েছে সব থেকে নিরাপত্তাযুক্ত ধাতুর গরাদওয়ালা দরজা। এবং এই দরজা অনধিকার প্রবেশকারীদের জন্য একটা ফাঁদও বটে। এই দরজার পাহারায় থাকত অনেক রক্ষী। যদিও এখন কোনও রক্ষী সেখানে থাকার কথা নয়, কিন্তু তাহলেও ভয়ে আমার হাত-পা কেঁপে উঠল। কারণ কোনওক্রমে এই ব্যাসাল্টের গুহা পার করলেও ঠিক একই রকম আরেকটা দরজার ফাঁদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা কনকনে, ভ্যাপসা হাওয়া আমাকে ওই দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। আমার ইচ্ছে না থাকলেও ওই হাওয়ার প্রকোপে আমি ওইদিকে যেতে বাধ্য হলাম। যখন ওই হাওয়ার দমক থামল, আমি দেখলাম ওই ধাতুর গরাদগুলো হাঁ করে খোলা! কী করে ওটা খুলে গেল, আমার মাথায় এল না। ওই দমকা হাওয়ার জন্যই হবে হয়তো। যা-ই হোক, আমি আর-একটু এগোলাম। সামনে আবার সেই সারি সারি ধাতুর তাকওয়ালা আলমারি। এবার মেঝের দিকে তাকালাম। এক জায়গায় ধুলোর পাহাড় জমেছে, এবং গোটাকতক আলমারি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঠিক এই সময়েই এক অজানা আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠল। কারণ যে আলমারিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সেগুলো আমার কাছে অপরিচিত ছিল না। সেই বিগ ব্যাং-এর সময় থেকে পৃথিবী সৃষ্টির সমস্ত রহস্য লিপিবদ্ধ হয়ে জায়গা নিয়েছিল ওই তাকে। আর অগুনতি বছর ধরে যখন মাঝে মাঝে কিছু বিরতিতে পৃথিবীর বিবর্তন ঘটেছে, এই আলোহীন গোলকধাঁধাও বিধ্বস্ত হয়েছে। বারেবারে। আর সেই জন্যই এইসব দানবীয় আলমারি যখন নিজেদের জায়গা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, সেই শব্দের প্রতিধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে এই পাতালপুরী।

যখন আর-একটু কাছে এগোলাম, বুঝতে পারলাম, ঠিক কী কারণে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। না, ওই ধুলোর পাহাড় নয়। বরং ওই ধুলোর গাদার মধ্যে বিশেষ কিছু আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি এবার টর্চের আলোয় ভালোভাবে জায়গাটা দেখলাম। এখানে ঠিক যতটা ধুলো জমে থাকার কথা, ততটা নেই। ঠিক যেন মাসখানেক আগে এখান থেকে কিছু সরানো হয়েছে, কারণ বাকি জায়গার ধুলোর আস্তরণ এর তুলনায় যথেষ্ট পুরু। আরও ভালোভাবে টর্চের আলো ফেলে যা দেখলাম, সেটা আমার কাছে খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। কারণ ধুলোর ওপর যে তিনটে ছাপ পড়েছিল, সেগুলো ছিল আমার খুব পরিচিত। মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার সময় আমার চোখের সামনে যে বিদঘুটে অপরিচিত জ্যামিতিক আকার ভেসে উঠেছিল, এগুলো ছিল তারই একটা। ঠিক ওই সময়ই আমার ক্লাসরুমের আকারও গিয়েছিল পালটে। ধুলোর ওপর এই ছাপগুলো ছিল কোনও কিছুর বর্গাকার চারটে পায়ার। আর ছাপগুলো ছিল প্রায় গোলাকার আর পাঁচ ইঞ্চি মতো পুরু। চারটে পায়ার একটা বাকি তিনটের তুলনায় দেখলাম একটু বড়। ঠিক যেন এগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়েও কোনও কারণে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু কী কারণ? হয়তো যে কারণে এই দানবীয় ধাতব তাকওয়ালা আলমারি মুখ থুবড়ে পড়েছে বা ঠান্ডা, ভ্যাপসা হাওয়ার প্রকোপে ধাতুর গরাদওয়ালা এই দরজা খুলে গেছে এক নিমেষেই।

হঠাৎ আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হল, ঠিক কীরকম তা ভাষায় ব্যাখ্যা হয়তো করতে পারব না, কিন্তু এ কথা ঠিক যে, এখন আমার আর আগের মতো ভয় করছিল না। আর ওই পায়ার ছাপগুলো দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার স্বপ্নের কিছু প্রভাব এখনও আমার অবচেতন মনে রয়ে গেছে। এদিকে আমার ডান হাত তখনও সেই বিশেষ কম্বিনেশন তালা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমি ওই উলটে পড়া আলমারি আর ধুলোর গাদা পেরিয়ে নিজের অজান্তেই ছুট লাগালাম একটা বিশেষ দিকে, যেন এই রাস্তা আমার কত দিনের পরিচিত! আমার নিজের এই আচরণের কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেলাম না। শুধু আমার শরীরের কার্যকলাপের সঙ্গে তাল মেলাতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম, কোন প্রাণীর চেতনা এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কোনও মানুষ কি আদৌ সেই বিশেষ প্রযুক্তির তালার নাগাল পেতে পারে? যে প্রাণীর চিন্তন এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে কি আদৌ এর কম্বিনেশন জানে? আর জানলেও এত যুগ বাদে সেই তালা কি আদৌ টিকে আছে? মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বইতে লাগল। ওই তালাবন্ধ কুঠুরির ওপারে এমন কী রয়েছে, যার মুখোমুখি হবার আগে আমার মন এভাবে ভয়ে কেঁপে উঠছে? আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু এইটুকু মনে ছিল যে, আমার দৌড় সাময়িকভাবে থামিয়ে আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম একসারি হায়ারোগ্লিফিক লিপি-আঁকা বিরাট দরজাওয়ালা আলমারির দিকে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম ছিল। এগুলো দেখলে মনে হচ্ছিল, এগুলোর কিন্তু যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটের দরজা আবার হাট করে খোলা। এগুলো দেখে আমার ঠিক কী মনে হচ্ছিল, ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না, শুধু এটুকু বলতে পারি, এগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, এরা বহু যুগ ধরে আমার পরিচিত। আমি তাকগুলোকে একবার মেপে নিলাম। নাঃ, সহজে এগুলোর নাগাল পাওয়া যাবে না। কোনও ফন্দি আঁটতে হবে। খানিকক্ষণ ভেবে একটা উপায় বের করলাম। একটা আলমারির নীচের দিকের খোলা দরজা আর অন্য বন্ধ দরজাগুলোর সাহায্য নিলে হাত পায়ের সাহায্যে বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে। সেইভাবেই কোনওরকম শব্দ না করে টর্চটাকে কামড়ে ধরে উঠতে লাগলাম। আমার ডান হাত যেভাবে কাজ করছিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, ওই কম্বিনেশন তালা আমি খুলতে পারব। এখন তালাটা কাজ করলে হয়। এদিকে বন্ধ দরজাগুলোর খাঁজে পা লাগিয়ে আমার উঠতে তেমন কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। হঠাৎ তাক বেয়ে উঠতে উঠতে ডানদিকে চোখ গেল, আর আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই তালাটাকে দেখতে পেলাম।

ওপরে চড়তে চড়তে আমার আঙুলগুলো প্রায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেই না আমি তালাটাকে দেখতে পেলাম, অমনি আমার আঙুলে সাড় ফিরে এল। কিন্তু চমকের তখনও শেষ হয়নি। আমাকে হতভম্ব করে ওই ধাতব দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল!! যেন আমার আসার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে গেলাম ওইদিকে। আমার ডান হাতের কাছেই একটা হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা বইয়ের তাকে একটা বাক্স ছিল। সেটা দেখে আমার ডান হাত এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল যে, যন্ত্রণায় প্রায় কুঁকড়ে গেলাম। শুধু মনের জোরে আমি ওই ব্যথাটা ভুলে ছিলাম, নয়তো আর-একটু হলেই হাতটা ফসকে যেত আর কী! বাকি তাকগুলোর থেকে এটা একটু বেশিই বড় ছিল, আর এর বেধ ছিল ইঞ্চি তিনেক। আর এই বাক্সটাতে ছিল অনেকরকম গাণিতিক নকশা। আমি অনেক কসরত করে বাক্সটার নাগাল পেলাম। তারপর কোটের কলারের সঙ্গে আটকে সেটাকে নিয়ে নিলাম পিঠে। আর চিন্তা নেই, এখন আমার হাত খালি। এবার আমি তরতরিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। আমার মনে তখন তীব্র কৌতূহল, আমার এত যন্ত্রণা সহ্য করার পর পুরস্কার হিসেবে যে বাক্সটা পেলাম, কী আছে তার ভেতরে? নীচে নেমে ধুলোর ওপরেই হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর পিঠ থেকে বাক্সটাকে নিয়ে এলাম সামনে। আমার হাত রীতিমতো কাঁপছিল। বাক্সটা খুলে আমি একটা বই বের করলাম। যেন আমার ভেতর থেকে অন্য কারও অদম্য ইচ্ছাশক্তি বইটাকে বের করে আনল। এই বইটার মলাটেও আমার পরিচিত হায়ারোগ্লিফিক নকশা আছে। এবার যেন আমি একটু হলেও আমি বুঝতে পারলাম, ঠিক কী জিনিস খোঁজার জন্য এত দিন আমি অপেক্ষা করেছি আর এত দূর ছুটে এসেছি৷ যদি আমি সত্যিই স্বপ্ন না দেখে থাকি, আর যেটা ভাবছি, সেটা হয়, তাহলে সমগ্র মানবসভ্যতা যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে চলেছে, তা সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। সব থেকে ভয়ানক ব্যাপার হল যে, আমি চেষ্টা করেও এই ঘটনাগুলোকে স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। এমনকী এটা লিখতে লিখতেই যতবার ঘটনাগুলো মনে পড়ছে, আমার হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে।

যা-ই হোক, ঘটনায় ফিরে আসি। বইটার হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা ধাতব মলাটের দিকে তাকিয়ে আমি চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সত্যি বলতে কী, বইটার মলাট উলটে ভেতরে কী আছে, সেটা দেখার জন্য আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না। আমার সেই দুঃস্বপ্নে ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে এটার সারমর্মের অনুবাদ করেছিলাম কি না, সেটাও মনে পড়ছিল না। যা হবে, দেখা যাবে ভেবে কপাল ঠুকে আমি মলাট উলটোলাম। ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য মুখ থেকে টর্চটা বের করে বন্ধ করলাম। অন্ধকারে বসে বসে খানিকক্ষণ সাহস সঞ্চয় করলাম। তারপর অবশেষে টর্চ জ্বালিয়ে সেই আলোয় তাকালাম খোলা পাতার দিকে।

যা ভেবেছিলাম তা-ই। পাতায় যা লেখা ছিল, সেটা দেখে আমার দাঁতে কাঁপুনি লেগে গেল। হয় আমি স্বপ্ন দেখছি, নয়তো সময় আর স্থান নিয়ে যা যা থিয়োরি আছে, সব ভাঁওতা। আমি ঠিক করলাম, যে করেই হোক, এই বইটা নিয়ে গিয়ে আমার ছেলে উইনগেটকে এটা দেখাতে হবে। যদিও আশপাশের অন্ধকারে আমি অন্য কিছুর অস্তিত্ব টের পাইনি, কিন্তু অতীতের সেই ভয়াবহ স্মৃতির ঝলক আমার চারদিকে ভিড় জমাতে লাগল। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। আমি বইটা বন্ধ করে আবার কোটের কলারের সঙ্গে আটকে পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম। সত্যিই যে, এই পাতালপুরীর অস্তিত্ব আছে তা সবার জানা দরকার। অবশ্য বাইরের জগতের এমনকী আমারও আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু নীচে নামার সময় আমার যে ভয়টা করেনি, সেটা এবার হতে লাগল। মনের জোরে তো এই অবধি আমি নেমে এসেছি। কিন্তু ওই পরিমাণ প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবার ফিরে যাবই বা কী করে? আর-একটা ভয় হল, ইথরাও ভয় পেয়েছিল যাদের, তারা হয়তো এখনও এই পাতালপুরীর অন্ধকারে কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। মনের মধ্যে আরও নানারকম ভয় ঘুরতে লাগল। স্থানীয় আদিবাসীদের ঝোড়ো হাওয়ার গল্প, ধ্বংসাবশেষ, শিসের মতো শব্দ, ধুলোর ওপর পায়ার ছাপ, দুঃস্বপ্নে ভেসে আসা জ্যামিতিক আকার– সব মিলেমিশে একেবারে সাড়ে বত্রিশভাজা হয়ে গেল।

ঠিক কী ধরনের অজানা আতঙ্ক আমার জন্য অপেক্ষা করছে, তা যদিও আমার ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু তার কিছু কিছু নমুনা আমি আগে দেখেছিলাম। একটা দেখেছিলাম এখানে ঢোকার আগে একটা খাঁজকাটা দেওয়ালের গায়ে আঁকা একটা চিহ্নে। আর-একটা দেখেছিলাম, প্রথম যে বইটা নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, তার আগে ধনুকের মতো খিলানওয়ালা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গোলাকার গম্বুজওয়ালা হলে। ডানদিকের খিলানটার দিকে তাকালাম। নাঃ, এবার ফিরতে হবে। এটা বেয়ে নেমে এখানে এসে পৌঁছেলেও ফিরতে আমার যে কী অবস্থা হবে, ভেবেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। পিঠে এই ধাতব মলাটওয়ালা বইয়ের ভার নিয়ে এই ধ্বংসস্তূপ পেরোনো যে খুব সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য! এবং হলও ঠিক তা-ই। এই ধ্বংসস্তূপের এক-একটা টুকরো আমার কাছে হয়ে দাঁড়াল পাহাড়প্রমাণ বাধা। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে করে আমার এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না-পৌঁছোনো অবধি আমি হাল ছাড়তাম না। এক্ষেত্রেও তা-ই হল। আমি দেখলাম, অবশেষে আমি এসে পৌঁছেছি সেই পাহাড়ের মতো ধ্বংসস্তূপের ঢিপির সামনে, যেটা পেরিয়ে আমি প্রথম একটু যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মনে একটা ভয় কাজ করছিল। প্রথমবার এখানে ঢোকার সময় কিঞ্চিৎ শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা যেন আর না হয়। কারণ ধুলোর ওপর ওইসব ছাপ দেখে আর এই পাতালপুরীর ভেতর হাড় হিম করে দেওয়া নানারকম শব্দ শুনে আমার আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি আগের মতো ছিল না। আর ওই বাক্সবন্দি বইটা পিঠের ওপর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কিন্তু আমি ওসব তোয়াক্কা না করে এগোতে লাগলাম বেয়ে বেয়ে। টর্চটা কামড়ে ধরলাম মুখে আর বইয়ের বাক্সটাকে ওঠার পথে যা যা ফাঁকফোকর পাচ্ছিলাম, সাময়িক বোঝা লাঘব করার জন্য ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওই সাময়িকই! তার পরের মুহূর্তেই পিঠের বোঝার জন্য বেয়ে উঠতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল।

এদিকে এই কসরত করতে করতেই ঘটল আসল বিপত্তি! যেই না পরের ধাপে একটা পাথরের ফাঁকে বইয়ের বাক্সটাকে চালান করতে যাব, আমার হাত ফসকে বাক্সটা ঢাল বেয়ে গিয়ে পড়ল ধ্বংসস্তূপের গাদায়। আর শুধু যে পড়ল তা-ই নয়, পড়ে এমন একটা শব্দের সৃষ্টি করল, যে তার প্রতিধ্বনিতে এই পাণ্ডববর্জিত পাতালপুরীর প্রত্যেকটা দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল! আর আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বেয়ে গেল। আমি ঠিক যে জিনিসটা মনেপ্রাণে চাইনি, সেটাই হল। আর এই সময়ই বহু দূর থেকে যেন একটা খনখনে, তীব্র শিসের মতো শব্দ ভেসে এল আমার কানে। শব্দটা যে ঠিক কীরকম, ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সত্যি কথা বলতে, কোনও পার্থিব শব্দের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই, তাই কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা দিয়ে এটা বোঝাতে পারব না। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বোঝাতে লাগলাম, ওই শব্দ সম্পূর্ণ আমার কল্পনা। কিন্তু আমার সচেতন আর অবচেতন মন এর বিরোধিতা করতে লাগল। যদিও আমার আতঙ্কের শেষ এতেই ঘটেনি, কারণ এরপর যেটা ঘটল, সেটা এতটাই ভয়ানক ছিল যে, ভাবলেও এখন আমি শিউরে উঠছি। আমি বইয়ের বাক্সটাকে হস্তগত করার জন্য দৃঢ়ভাবে টর্চটা ধরে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এলাম। আমি তো তখন বাইরের দুনিয়ায় চাঁদের আলো আর মরুভূমিতে পৌঁছোবার আনন্দে মশগুল! তাই আমার ধারণা ছিল না, বইটাকে হস্তগত করার পরও এই পৈশাচিক ঘটনাক্রমে কোনও ইতি ঘটবে না। জিনিসটা ঘটল ওই ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ের ঢিপির ওপর ওঠার পর। হঠাৎ করেই আমার পা গেল পিছলে, আর আমি শুধু দেখলাম, কিছু গাঁথনি আর পাথরের টুকরোর ধসের সঙ্গে আমিও গড়িয়ে পড়ছি। আর সেই ধসের কী আওয়াজ! মনে হবে, একশোটা কামান যেন একসঙ্গে দাগা হয়েছে। এই বিপর্যয়ের ঠিক পরেই কী ঘটেছিল, আমার মনে ছিল না। যখন আমার হুশ এল, দেখলাম, চাতালের ওপর পড়ে আছি। আমার পাশেই পড়ে রয়েছে আমার টর্চটা আর সেই বইয়ের বাক্সটা। শুধু এইটুকু মনে করতে পারলাম, ওই সশব্দ ধ্বসের সঙ্গে প্রবল গতিতে আমিও নিমজ্জিত হতে চলেছি কোথাও। আর ওই ধসের শব্দে আমার চিৎকারও ঢেকে গিয়েছিল। এদিকে ওই ধসের বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি তখনও যেন ফিরে ফিরে আসছে পাতালপুরীর দেওয়াল থেকে। আর ঠিক সময়ই আবার সেই অপার্থিব খনখনে শিসের মতো শব্দটা ভেসে এল খুব স্পষ্টভাবে। নাঃ, এবার আর কোনও ভুল হবার কথা নয়। কারণ এবার শব্দটা আর আমার পিছনদিক থেকে নয়, আসছে সামনের দিক থেকে! সামনের সেই খোলা দরজার ওপারে থাকা সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে থেকে। আর শুধু শব্দই নয়, তার সঙ্গে বইছে এক ভয়ংকর দমকা হাওয়া। আর হাওয়াটা কোনও ঠান্ডা, সোঁদা বা ভ্যাপসা হাওয়া নয়। যেন ওই নরকের অন্ধকারের মধ্যে থেকে কোনও অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই এর আগমন। আর এই হাওয়াটা আমাকে কেন্দ্র করেই যেন কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বইতে লাগল। আর প্রত্যেক মুহূর্তে এই হাওয়ার দমক বেড়ে চলল। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল সেই খনখনে শিসের শব্দ। হাওয়ার ধরনটা দেখে মনে হল যেন এটা কোনও ফাঁস বা কাউবয়দের ল্যাসোর মতো আমাকে বেঁধে ফেলতে চাইছে। এবং এই হাওয়ার দমকের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। শুধু খেয়াল ছিল, একটা ভয়ানক চক্রবর্তের সঙ্গে আমিও ঘুরছি৷

কতক্ষণ ঘুরেছিলাম খেয়াল নেই, কারণ এরপরেই আমি টর্চ আর বইয়ের বাক্স সহযোগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম, কম করে দু-ধাপ নীচের একটা চাতালের ওপর পড়ে আছি, যেখানে ওই গুপ্ত দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে। আমার রীতিমতো কান্না পেল। কিন্তু দেখলাম, কান্নার বদলে আমি বিড়বিড় করছি নিজের মনে হয়তো এটা গোটাটাই একটা স্বপ্ন, হয়তো আমার ঘুম ভাঙবে আর্কহ্যামের পাগলাগারদে কিংবা মরুভূমিতে আমাদের ক্যাম্পে। যদিও আমি জানতাম, ওই ফুট চারেক ফাঁকটা আরেকবার পেরোতে হবে। কিন্তু হয়তো এবার আমার জন্য নতুন কোনও অজানা আতঙ্ক অপেক্ষা করছে। আমি ভেবে দেখলাম, লাফ দিয়ে দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে পারব, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার সঙ্গী সেই অপার্থিব খনখনে শিসওয়ালা বিভীষিকা। এদিকে আমার টর্চের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাকে আমার স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করেই এগোতে হবে। আর ভেবে দেখলাম, এগিয়ে যেতে গেলে আমাকে এই ভয় কাটাতেই হবে। আর তার জন্য আমাকে এই নারকীয় আতঙ্কের মুখোমুখি হতে হবে। এইসব বাধাবিপত্তির কথা ভাবলে যেটুকু সাহস সঞ্চয় করেছি, সেটুকুও গায়েব হয়ে যাবে। তাই আমি আবার এগোতে লাগলাম। আর ওই ফাটলের কিনারা দেখতে পেলাম। সাহসে ভর করে যেই না এগোতে যাব, ওই ঝোড়ো দমকা হাওয়া, নারকীয় অন্ধকার, অপার্থিব শব্দ– সব কিছুর মিলিত একটা ঘূর্ণি আমাকে গ্রাস করল। শুধু ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে মনে আছে, আমি ওই নারকীয় চক্ৰাবর্তে হারিয়ে যাচ্ছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও ওই চক্ৰাবর্তের মিলিত শব্দের সামনে তা হারিয়ে গেল অচিরেই।

ব্যাস, এই ছিল আমার অভিজ্ঞতা। মানে আমার যতটুকু মনে ছিল, আমি লিপিবদ্ধ করলাম। এর বেশি কিছু বলতে গেলে হয়তো আমাকে আশ্রয় নিতে হবে আমার উন্মাদনা কিংবা অলৌকিক তত্ত্বের। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, স্মৃতি, পাগলামি– সব কিছুর মিলিত যোগফলে হয়তো জন্ম হয়েছিল কোনও অপার্থিব বিভ্রমের, যার সঙ্গে এই পার্থিব জগতের কোনও কিছুরই মিল নেই। এর বেশি আর কী-ই বা বলতে পারি? যুগ যুগ ধরে এই মহাজাগতিক বিবর্তন, বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশোনা, রাতের পর রাত দুঃস্বপ্নের মোকাবিলার যোগফলই ঘটেছিল হয়তো-বা। তবে এরপরেও কিন্তু ওই ভয়ানক শহর আমার স্বপ্নে হানা দিয়েছিল। আমিও তখন ইথদের একজন হয়ে গিয়ে শঙ্কু-আকৃতির দেহ নিয়ে চলাফেরা করতাম। শুড়ের সাহায্যে তাক থেকে বই নামিয়ে নিতাম, আবার রেখেও দিতাম। তারপর এই পাতালপুরীর ভয়ানক স্মৃতি (সে সত্যি-মিথ্যে যা-ই হোক না কেন) আর সবশেষে নারকীয় চক্রবর্তে হারিয়ে-যাওয়া সব মিলিয়ে কোনটা কোনটা সত্যিই ঘটেছিল আর কোনটা নিছকই আমার কল্পনা, তা এই মুহূর্তে হয়তো আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কারণ এই সব কিছুই ঘটেছিল উলটোক্রমে। নিজেকে ইথরূপে দেখা, চক্ৰাবর্তে হারিয়ে যাওয়া, দমকা হাওয়া আর খনখনে শিসের শব্দ, ধ্বংসস্তূপ বেয়ে ওঠা, বইয়ের বাক্সটা খুঁজে পাওয়া, হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা বইয়ের তাক, আঁকাবাঁকা খিলানওয়ালা পথ, অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে মাথা কুঁড়ে-ওঠা নকশাওয়ালা পাথরের চাঁই, চাঁদনই রাত সব কিছু।

এই দৃশ্যায়নের উলটো ক্রমপর্যায় যখন শেষ হল, দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমিতে বালি খামচে পড়ে আছি। আমার চারদিকে এক অদ্ভুত হাওয়া বইছে শনশন করে, এই হাওয়া কোনও পার্থিব হাওয়া নয়। আমার জামাকাপড়ের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। পুরো ফর্দাফাঁই! দেখলে মনে হবে, কোনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছি। সারা শরীর কেটে ছড়ে গেছে। সচেতন অবস্থায় আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। স্বপ্ন, অভিযান– সব কিছুই ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল! কোথা থেকে আমার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল আর কোথায়ই বা অভিযানের শেষ হয়েছিল, আমার কিছুই মনে নেই। আমার আশপাশে কয়েকটা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই যেন দুঃস্বপ্নের অভিযানের সাক্ষী হয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। যা-ই হোক, একটা দুঃস্বপ্নের অভিযান, একটা নারকীয় আতঙ্কের প্রহরের সমাপ্তি ঘটল অবশেষে। এর মধ্যে কতটা সত্যি আর কতটা আমার কল্পনা বা স্বপ্ন, সেটা অজানাই রয়ে গেল। আমার টর্চ, আমার সংগ্রহ-করা বইয়ের বাক্স কিছুই আমার আশপাশে খুঁজে পেলাম না। ওগুলো থাকলে হয়তো সাক্ষী হিসেবে কাজ করত। ওই বইয়ের বাক্সটা দুটো দুনিয়ার মধ্যে মিসিং লিংকের কাজ করতে পারত। কিন্তু সত্যিই কি কোনও পাতালপুরী ছিল? বা ওই বইয়ের বাক্সটা, অথবা সেই প্রাচীনতম সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ? নাকি সবই আমার কল্পনা? কিন্তু আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য আমার আশপাশে মরুভূমির রুক্ষ বালি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেই অশুভ হাওয়াটা আর বইছিল না। রাঙাভাঙা চাঁদও পশ্চিমে ঢলে গিয়েছিল। আমিও কোনওরকমে আমার ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর রওনা দিলাম ক্যাম্পের দিকে। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। যদি আমি জ্ঞান হারিয়ে গোটাটাই স্বপ্ন দেখে থাকি, তাহলে আমি এতক্ষণ বেঁচে রইলাম কী করে? আরও একবার সেই উপকথার গল্পগুলো আমার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। যদি ওই পাতালপুরীর অস্তিত্ব সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ইথরাও সত্যি! আর বিশ্বব্যাপী কালচক্রের সেই চক্রবর্তও একটা হৃদয়বিদারক সত্যি ছাড়া কিছু নয়। সত্যিই হয়তো আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকশো কোটি বছর আগের প্রাক্-মানবসভ্যতার যুগে আমার সেই অন্ধকারের দিনগুলোয়। হয়তো সত্যিই প্যালিওজিয়ন যুগের কোনও ভিন গ্রহের ভয়ংকরের মনন আমার এই শরীরটাকে ব্যবহার করেছিল সময় অভিযানের বাহন হিসেবে। কিন্তু এর কিছু অংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে তো মানবসভ্যতার জন্য অপেক্ষা করছে সেই ভয়াবহ অকাল তমসা! পাশাপাশি এ কথাও ঠিক, এগুলোকে সত্যি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। যা-ও-বা ওই বইয়ের বাক্সটা ছিল, সেটাও হারালাম! অবশ্য সত্যি না হলে সেটা গোটা মানবসভ্যতার জন্যই আশীর্বাদ।

যা-ই হোক উইনগেটের জন্য সবই খুঁটিনাটি আমি লিখে রাখলাম। একজন মনস্তাত্ত্বিক আর আমার বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসেবে ও-ই না-হয় এগুলোর বিচার করুক। আর শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ওই পাতালপুরীর নরকে টর্চের আলোয় যখন আমি বাক্স থেকে বইটা বের করে দেখেছিলাম, তখন ঠিক কেন শিউরে উঠেছিলাম। ওই বইয়ের সেলুলোজের পাতায় কোনও প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা ছিল না। যা ছিল, সেটা সত্যি হলে সময় আর স্থানের শিশুসুলভ সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা মানবসভ্যতা যে কোনও দিন ডুবে যাবে সেই ভয়াবহ অকাল তমসায়। ইথরাও যাদের ভয় পেয়েছিল, তারা শাসন করবে এই গোটা মহাবিশ্ব! হ্যাঁ, ওই বইয়ের সেলুলোজ পাতায় হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালার বদলে আমি দেখেছিলাম নিজের হাতের লেখায় রোজকার খুঁটিনাটি বিবরণ! যে ভাষায় আমি কথা বলতাম মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে, সেই চালু ইংরেজিতে!

[প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৬ সালে অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরিজ পত্রিকার জুন সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর: সৌমেন চ্যাটার্জী]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *