কাপালিকরা এখনও আছে

কাপালিকরা এখনও আছে

এক

কত বিচিত্র ঘটনাই না জগতে ঘটে যায়। তারাপদর জীবনে যেমন ঘটল আজ।

সকালে খুব বিরস মুখে তারাপদ ঘুম থেকে উঠেছিল। ঘুম ভাঙার মুখে মুখে যদি মনে পড়ে যায়, মেসের বটুকবাবুকে গোটা তিরিশেক টাকা অন্তত দিতেই হবে আজ, নিচের জগন্নাথ চা-অলাকেও পাঁচ-সাত টাকা, তা হলে কারই বা ভাল লাগে! লোকের কাছে ধার-দেনার কথা, নিজের অভাবের কথা মনে হলে ভাবনা-চিন্তা বেড়েই যায়, আরও কত রকম ধারটারের কথা মনে পড়ে, কত রকম অভাব এসে দেখা দেয়। তারাপদরও সেই রকম হল মনে পড়ল–আজ লন্ড্রি থেকে জামাটামা আনতে হবে, তা তাতেও দেড় দু টাকা; নীলুর মনিহারী দোকান থেকে একটা সাবান, নিদেন পক্ষে একটা কি দুটো ব্লেড আনতে গেলে সেও বাকি সতেরো টাকার জন্যে হাত পেতে বসবে। এই রকম আরও কত টুকটাক। না, এ আর ভাল লাগে না! এইভাবে কি বাঁচা যায়, দিনের পর দিন! মাঝে মাঝে তারাপদর মনে হয়, এ জীবন রেখে লাভ নেই; তার চেয়ে একদিন ‘জয় মা বলে ডবল ডেকারের তলায় ঝাঁপ দেওয়াই ভাল।

বিরক্ত বিরস মুখ করে তারাপদ উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। তার ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা খোলা। শীতের দিন বলেই যে জানলা বন্ধ তা নয়, এখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে, জানলা খুলে দেওয়া যেত। কিন্তু তার রুমমেট বঙ্কিমদা কখনো সকালে জানলা খুলবেন না। কেননা, জানলাটা খোলা এবং বন্ধ করার মধ্যে কলা-কৌশল আছে। জানলার দুটো পাটই আলগা, প্রায় কৰ্জাবিহীন, হিসেব করে না খুললেই একটা পাট সোজা নিচে বটুকবাবুর মাথায় গিয়ে পড়তে পারে, আর-একটা হয়ত মাঝপথে কোথাও ঝুলতে থাকবে। নারকোল দড়ি, লোহার ছোট শিক–এইসব মালমশলা দিয়ে তারাপদ কোনো রকমে ঘরের জানলা দুটোকে ধরে রেখেছে, যদি না রাখত–এই ঘরে জানলা বলে কিছু থাকত না। তারাপদ খুব বিবেচক। বাড়ির দোষ সে দেয় না। একশো সোওয়াশো বছরের পুরনো বাড়ির হাল এর চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে! গলির গলি তার মধ্যে বাড়িটা নড়বড়ে চেহারা নিয়ে, কপোরেশনের ময়লাফেলা গাড়ির মতন ইটকাঠের আবর্জনা হয়ে যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাই যথেষ্ট। যদি গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনের ওই বাড়ি না থাকত-কোথায় যেত তারাপদ? আজকের দিনে মাথা গোঁজার জন্যে তার মাত্র ন’ টাকা খরচ হয় মাসে মাসে। বটুকবাবু এবাড়ির জন্যে সিট রেন্ট বাবদ মাথা পিছু ন টাকা নেন। তাতেও তাঁর লাভ থাকে। আটান্ন টাকা মাসিক ভাড়ার বাড়ি। অবশ্য পুরনো ভাড়াই চলছে। জনা দশেক মেম্বারের মেসের।

তারাপদ ঘরের এক কোণ থেকে তার টুথব্রাশ তুলে নিয়ে আবার বিরক্ত হল। পেস্ট নেই। পরশুই ফুরিয়ে গিয়েছিল। গতকাল কোনো রকমে পেস্টের মুণ্ডু টিপে একটু পাওয়া গিয়েছিল, দাঁত মাজার কাজটা তাতেই সেরেছে। কাল। সারাদিন আর টুথপেস্টের কথা মনে হয়নি।

এক চিলতে সাবানের ওপর ব্রাশ ঘষে নিয়ে মুখ ধুতে যাবার সময় তারাপদর মনে পড়ল, আজ শনিবার। একুশ তারিখ। শনিবার দিনটা এমনিতেই ভাল যায় না তারাপদর, তার ওপর একুশ তারিখ। একুশ তারিখটা তার পক্ষে ভাল নয়। তিন সংখ্যাটাই তার ভাগ্যে সয় না। একুশ, মানে দুই আর এক–সংখ্যা দুটো পাশাপশি রাখলে তাই হয়। দুই আর এক যোগ করো, তিন। খারাপ। ওদিকে আবার একুশকে শুধু তিন আর সাত দিয়ে ভাগ করা যায়, করলে মিলে যায়। তিন দিয়ে মেলানো অশুভ। আবার সাত দিয়ে ভাগ করলে সেই তিন। মানে, যোগ আর ভাগ দু দিকেই একুশ সংখ্যাটা এত খারাপ তারাপদর পক্ষে যে তাকে ডবল খারাপ বলা যায়।

দিনটা যে আজ খুবই খারাপ যাবে সকাল থেকে তারাপদ তার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে । ঘুম থেকে উঠেই টাকার চিন্তা, কোথায় বটুকবাবু, কোথায় নীলু, কোথায় লন্ড্রি। মুখ ধোবার গেস্ট পর্যন্ত জুটল না।

.

মাত্র ক’ঘণ্টা পরেই কিন্তু সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেল ।

বেলা সাড়ে বারোটা বাজেনি। তারাপদ হন্তদন্ত হয়ে চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে গিয়ে হাজির। চন্দন ঘরেই ছিল। দাবা খেলছিল বন্ধুর সঙ্গে। সবে এম-বি পাশ করেছে চন্দন, পাশ করে পি আর সি-তে আছে।

তারাপদকে এমন অসময়ে আসতে দেখে চন্দন, “কী রে? হঠাৎ?” বলতে বলতে সে তারাপদর খানিকটা উত্তেজিত, খানিকটা বা বিমূ মুখ দেখতে লাগল ।

তারাপদ হাঁপাচ্ছিল। শীতের দিন হলেও তার মুখে যেন সামান্য ঘাম ফুটেছে। চুলটুল রুক্ষ শুকনো শুকনো চেহারা।

তারাপদ দম টেনে বলল, “চাঁদু, তোর সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে।”

“বল”, বলে চন্দন তার দাবার বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল।

তারাপদ বলব কি বলব না মুখ করে বসে থাকল। তৃতীয়জনের সামনে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

চন্দন তার দাবা খেলার বন্ধুকে চোখের ইশারায় আপাতত উঠে যেতে বলল। বন্ধুটি স্নান করতে যাচ্ছিল, তার কাঁধে তোয়ালে ঝোলানো, সে চলে গেল।

বিছানার মাথার দিক থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই উঠিয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাল চন্দন; বলল, “কী তোর সিরিআস কথা, বল?”

তারাপদ নিজের উত্তেজনা সামান্য সামলে নিয়ে বলল, “চাঁদু, সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। আমি একটা চিঠি পেয়েছি, আজ, খানিকটা আগে; রেজিস্ট্রি করে এসেছে।“

“কিসের চিঠি? চাকরির?”

“আরে না না–চাকরির নয়,” বলতে বলতে তারাপদ পকেট থেকে খামে মোড়া একটা চিঠি বের করল। “চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। কিছু বুঝতে পারছি না…।” বলে তারাপদ খামসমেত চিঠিটা চন্দনের হাতে দিল।

চিঠি নিল চন্দন। রেজিস্ট্রি করা চিঠি, উইথ এ ডি। খামের মুখ ছেঁড়া। চন্দন চিঠিটা বের করে নিল। ছাপানো প্যাডে ইংরেজিতে লেখা চিঠি। যেন খানিকটা পোশকি ব্যাপার।

প্রথমটায় চন্দন তেমন মন দিতে পারেনি। চিঠির মাঝামাঝি এসে তার কেমন চমক লাগল। তারাপদর দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার মন। দিয়ে প্রথম থেকে চিঠিটা পড়তে লাগল।

চিঠি পড়া শেষ করে চন্দন অবাক হয়ে বলল, “এ তো কোনো সলিসিটারের চিঠি বলে মনে হচ্ছে রে।”

তারাপদ মাথা নেড়ে বলল, “মনে হবার কী আছে, লেটার প্যাডের মাথায় তো লেখাই আছে, ভদ্রলোক সলিসিটার।”

“কিন্তু সলিসিটাররা অফিস থেকে চিঠি দেয় বলে শুনেছি। এটাতে বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। “

“চিঠিটা খানিকটা পাসসান্যাল বলে বোধ হয়।”

চন্দন আরও একবার চিঠিটা পড়তে পড়তে সিগারেট খেতে লাগল।

তারাপদ বলল, “কিচ্ছু বুঝলি?”

চন্দন বলল, “খানিকটা বুঝলাম। ভদ্রলোক তোকে পত্রপাঠ দেখা করতে বলেছেন। বিষয়সম্পত্তির একটা বড় ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সলিসিটার ভদ্রলোক যাঁর কথা লিখেছেন, ওই ভুজঙ্গভূষণ হাজরা; উনি কে?”

তারাপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি ভাই এরকম নাম কখনো শুনিনি। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। তবে মা বেঁচে থাকতে শুনেছিলুম–সাঁওতাল পরগনার দিকে আমার এক পিসিমা থাকতেন, তাঁরা হাজরা ছিলেন। পিসিমার নাম বোধ হয় ছিল সুবর্ণলতা। পিসেমশাই নাকি অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। আমার মনে হচ্ছে, ভুজঙ্গভূষণ আমার সেই পিসেমশাই। চিঠিতে তো আর কিছু লেখা নেই তেমন।”

চন্দন চিঠিটা মুড়ে খামের মধ্যে ঢোকাল। অন্যমনস্ক। পরে বলল, “বোধ হয় ভুজঙ্গভূষণ তোকে বিরাট কোনো সম্পত্তিটম্পত্তি দিয়ে গেছেন…” বলে হাসল চন্দন, “দেখ, রাজত্বটাজত্ব পেয়ে যেতে পারিস।”

তারাপদ বলল, “আমার তিন কুলে কেউ নেই। টিউশানি করে আর বটুকবাবুর মেসে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। একটা চাকরি পর্যন্ত জোটাতে পারলাম না। যাও বা একটা জুটেছিল হাতাহাতি করে ছেড়ে এলাম। আমার কপালে ভাই রাজত্ব বর্তাবে ।”

চন্দন হেসে বলল, “বর্তে যাবে রে, তার হিন্টস্ রয়েছে চিঠিতে। তুই বড়লোক হয়ে যাবি। নে লেগে পড়।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে, তুই লক্ষ করেছিস?”

“কী?”

“প্রথমত ধর, আমার ঠিকানা এরা পেল কেমন করে? যদি ধরেই নি ভুজঙ্গভূষণের বিষয়সম্পত্তি আমার জন্যে বসে বসে কাঁদছে, তবু ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতন নয় কি? আমার ঠিকানা সলিসিটার মশাই জানলেন কী করে? কেমন করে বুঝলেন আমি ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়? যদি আমার ঠিকানা জানাই থাকবে তবে সেই ভুজঙ্গভূষণ কেন আমায় নিজে চিঠি লিখলেন না?

চন্দন আচমকা বলল, “ভুজঙ্গভূষণ হয়ত মারা গিয়েছেন।”

“মারা গিয়েছেন?”

“মারা গেলেই এ-সব বিষয়সম্পত্তির ওয়ারিশানের কথা ওঠে।“

“তা আমায় কেন?”

“তুই-ই বোধ হয় একমাত্র মানুষ যে কিনা ভুজঙ্গভূষণের জীবিত আত্মীয়।”

তারাপদ চুপ করে থাকল, অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করতে লাগল, ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দমকা বাতাসে নড়ে নড়ে যাচ্ছে ।

চন্দন বলল, “তুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?”

“ব্যাপারটা আমার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে।”

“গোলমালের কী আছে, তুই আজ সোজা ওই সলিসিটার ভদ্রলোক কী যেন নাম–মৃণালকান্তি দত্ত, তাই না–, তাঁর কাছে চলে যা। গিয়ে দেখা কর।”

“তারপর?”

“দেখা করে দেখ, কী বলেন ভদ্রলোক। কেন তোকে যেতে বলেছেন।”

“কিন্তু আমি যে ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়, তার প্রমাণ কী? নামে মিললেই মানুষ এক হয় না। আমি তো জাল হতে পারি।”

মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “জাল ভেজাল প্রমাণ হয়ে যাবে । ভদ্রলোকের। কাছে নিশ্চয়ই কোনো প্রমাণ আছে। তা ছাড়া যদি তোর সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর ও-পক্ষ না রাখত তবে তোর ঠিকানায় চিঠি আসত না।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। চন্দন যা বলছে এসব চিন্তা যে তার মাথায়। আসেনি এমন নয়। চিঠি পাবার পর থেকে সে অনবরত ভেবেই যাচ্ছে, ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য। তারাপদ ভাবতেই পারছে না, যে ভুজঙ্গভূষণকে সে জীবনে চোখে দেখেনি, যার নাম শোনেনি, সেই লোক সত্যি সত্যি তারাপদর জন্যে বড়সড় কোনো বিষয়সম্পত্তি রেখে যেতে পারে! বরং এ-সব ব্যাপারে এমন একটা রহস্য রয়েছে যে, না জেনে না বুঝে এগুতে পেলে বিপদে পড়ে যাবে । গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে গেলেই বিপদ।

খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “তুই যেতে বলছিস?”

“আলবত্ যাবি।”

“আমার কেমন নার্ভাস লাগছে।”

“কিসের নার্ভাস! তোকে কি সলিসিটার খেয়ে ফেলবে? তুই কি নিজে যাচ্ছিস? তোকে দয়া করে যেতে বলেছে বলে তুই যাচ্ছিস।”

“তুই আমার সঙ্গে যাবি?”

“আমি?”

“উকিল অ্যাটর্নি শুনলেই আমার ভয় করে। তা ছাড়া ওই যে কী ঠিকানা–কত নম্বর ওল্ড আলিপুর–ও সব ভাই আমি চিনি না। চল তুই…।”

‘বিকেলে আমার যে অন্য দরকার ছিল রে!”

“ক্যানসেল করে দে।…তোর এমন কোনো কাজ নেই। হাসপাতালের চাকরিরও যা বাহার।”

একটু কি ভাবল চন্দন, তারপর বলল, “বেশ, তা হলে বিকেল বিকেল চল । শীতের দিন। পাঁচটা বাজতেই সন্ধে হয়ে যাবে।”

তারাপদ যেন আশ্বস্ত হল খানিকটা। হঠাৎ আবার চোখে পড়ে গেল ক্যালেন্ডারটা। তারাপদ বলল, “চাঁদু, আজ কিন্তু আমার দিনটা ভাল নয়।”

“মানে?”

“একে শনিবার তায় একুশ তারিখ। তিন হল আমার আনলাকি নাম্বার। চন্দন হেসে উঠল। গালাগাল দিয়ে বলল, “তোর যত কুসংস্কার। এসব মাথায় কে ঢোকায় রে? আমি তো দেখছি আজ তোর সাঙ্ঘাতিকু দিন, এ ডে। অফ ফরচুন।”

তারাপদ তখনো খুঁতখুঁত করতে লাগল।

শেষে চন্দন বলল, “আমার এখনো নাওয়া-খাওয়া হয়নি। তুই মেসে যা। ঠিক চারটের সময় ওয়েলিংটনের মোড়ে থাকবে। আমি আসব ।”

তারাপদ উঠল । অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে।

.

আলিপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। ডিসেম্বর মাসের এই সময়টা এই রকমই, বিকেল ফুরোবার আগেই সব ঝাপসা, ঝপ করে যেন অন্ধকার নেমে আসে আকাশ থেকে। জায়গাটাও কেমন নিরিবিলি। পুরনো আলিপুরের সেই প্রাচীন, বনেদি বাড়ি-ঘর এদিকে রাজারাজড়ার এলাকা যেন, উঁচু উঁচু দেওয়াল ঘেরা বাড়ি, মস্ত মস্ত গাছ, ফটকে দরোয়ান, ভেতরে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের গর্জন, ঝকঝকে গাড়ি বেরুচ্ছে, ঢুকছে, রাস্তাটাস্তা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। তারাপদর কেমন গা ছমছম করছিল। সে বেচারি বউবাজারের দিকে থাকে, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে, যেখানে আলো-বাতাসও ঢুকতে ভয় পায়, গাছটাছ তো দূরের কথা, কোথাও একটা সবুজ পাতা পর্যন্ত দেখা যায় না–সেই তারাপদ এরকম একটা জায়গায় এসে ঘাবড়ে যাবে না তো কী হবে!

তারাপদ বলল, “চাঁদু, এ-দিকে এলে মনেই হয় না এটা কলকাতা, কী বল?”

চন্দন দু পাশের বাড়ি, বাগান, গাছপালা দেখতে দেখতে হাঁটছিল ধীরে ধীরে সলিসিটার দত্ত-র বাড়ির নম্বর খুঁজছিল। ততক্ষণে রাস্তার বাতি জ্বলে উঠেছে, মাথার ওপর আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল।

বাড়িটা পাওয়া গেল। আশেপাশের বাড়ির তুলনায় ছোট। পুরনো আমলের বাড়ি। সামনে বাগান ছোটমতন।

ফটকের সামনে কেউ ছিল না। তারাপদ ঢুকতে চাইছিল না, যদি অ্যালসেশিয়ান তেড়ে আসে।

চন্দন বলল, “কুকুর নেই, থাকলে বাঁধা আছে; চলে আয়–।”

ফটক খুলে দুজনে ভেতরে ঢুকল। তারাপদর ভয় করছিল। তার ওপর শীতটাও যেন বেচারিকে জাপটে ধরেছে, কাঁপতে লাগল তারাপদ।

অল্প এগিয়ে গাড়ি বারান্দা।

গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে উঠে একজনকে দেখতে পাওয়া গেল। বুড়ো মতন একটি লোক। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে মোটা চাদর।

তারাপদদের দেখতে পেয়ে লোকটি কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর কাছে এল। তার চোখে দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে জিজ্ঞেস করছে, কাকে চাই আপনাদের?

চন্দন বলল, “আমরা বউবাজার থেকে আসছি। মিস্টার দত্ত আমাদের দেখা করতে বলেছেন।” বলে চন্দন তারাপদকে দেখিয়ে দিল। “বাবু এঁকে চিঠি লিখেছেন দেখা করার জন্যে। এঁর নামটা বলে গিয়ে বাবুকে।” চন্দন তারাপদর নাম ঠিকানা বলল।

তারাপদদের অপেক্ষা করতে বলে লোকটি চলে গেল। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। এক সময় নিশ্চয় বিস্তর পয়সা ছিল বাড়ির মালিকের, সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়ি করেছিল, এখনো তার প্রমাণ চোখে পড়ে। মাথার ওপর শেকল দিয়ে ঝোলানো সাদা শেড় পরানো বড় বাতি জ্বলছে, আলোর রঙ বাদামী; এই ঢাকা জায়গা–অনেকটা যেন লবির মতন, দু পাশেই বড় বড় সেটি পাতা রয়েছে বসার জন্যে, এক কোণে হ্যাট স্ট্যান্ড, আয়না, দেওয়ালে গোটা দুয়েক বিশাল বিশাল ছবি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের, একটা চমৎকার হরিণের মাথা।

সমস্ত বাড়ি কিন্তু কী চুপচাপ। দোতলা থেকে পাতলা স্বর ভেসে আসছিল সামান্য।

লোকটি ফিরে এল। এসে বলল, “আসুন আপনারা।”

খুবই আশ্চর্য, ডান বা বাঁ দিকের মুখোমুখি দুটো বাইরের ঘরের কোনোটাতেই ওদের নিয়ে গিয়ে বসাল না লোকটি। একটু ভেতর দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারাপদদের আর-একবার ভাল করে দেখে চলে গেল। .

সেকেলে কাঠের গদি-আঁটা চেয়ারে বসল তারাপদরা। এই ঘরটা সামান্য ছোট। ঘরের বারোআনা শুধু বইয়ে ভরতি। মোটা মোটা বই। বোধ হয় আইনের বই। একদিকে দেওয়ালে-গাঁথা সিন্দুক। লোহার একটা আলমারি অন্যদিকে। জানলা বরাবর বোধহয় দত্ত-মশাইয়ের বসার জায়গা, সিংহাসনের মতন চেয়ার, সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল।

এই ঘরের গন্ধই যেন কেমন আলাদা। বইপত্রের জন্যেই বোধ হয় ধুলোধুলো গন্ধ লাগে নাকে। পায়ের তলায় জুট কার্পেট। দেওয়ালের দু-এক জায়গায় ছোপ লেগেছে। ঘরে মস্ত বড় একটা পোর্ট্রেট ঝোলানো, কোনো বৃদ্ধের, দত্ত-মশাইয়ের বাবা কিংবা ঠাকুরদার। এক দিকে নিচু টেবিলের ওপর একটা বেড়াল। জ্যান্ত নয়, মরা। কেমন করে তৈরি করেছে কে জানে! একেবারে জ্যান্ত বলে মনে হয়। গায়ের লোেম, চোখের মণি, কান, পায়ের থাবা সব যেন জীবন্ত। বেড়ালের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। চোখে খুব যে ভাল লাগে তা কিন্তু নয়।

তারাপদ আর চন্দন নিচু গলায় কথা বলছিল, পায়ের শব্দ শুনে চুপ করে গেল।

ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে এলেন। টকটকে গায়ের রঙ, মাথায় বেশ লম্বা, পরিষ্কার করে কামানো মুখ, মাথার চুল একেবারে সাদা ধবধবে, পরনে ধুতি, গায়ে পুরো হাতা পশমী গেঞ্জির ওপর দামি শাল। চোখে চশমা।

তারাপদরা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে জড়সড়ভাবে নমস্কার করত হাত তুলে।

ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করলেন। চশমার আড়াল থেকে দুজনকে লক্ষ করতে করতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন শেষে ।

চন্দন ইশারায় তারাপদকে চিঠিটা বের করতে বলল।

তারাপদ চিঠি বের করল।

চিঠি বের করে তারাপদ দু পা এগিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আজ সকালে আমি এই চিঠিটা পেয়েছি । আপনিই কি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন?”

ভদ্রলোক চিঠির জন্যে হাত বাড়ালেন। দেখলেন। বললেন, “হ্যাঁ, আমারই নাম মৃণালকান্তি দত্ত। বসুন আপনি।”

তারাপদ আবার দু পা পিছিয়ে এসে চন্দনের পাশে বসল।

মৃণাল দত্ত কিছুক্ষণ সরাসরি তারাপদদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “আপনার নামই তারাপদ?”

তারাপদ একটু কেমন ধাঁধায় পড়ে গেল। এ আবার কেমন প্রশ্ন? সামান্য যেন রাগই হল। ভাবল, বলে–আজ্ঞে আমি তো তাই জানি।…

কিন্তু মৃণাল দত্তের সামনে দাঁড়িয়ে সে-কথা বলতে তার সাহস হল না। ভদ্রলোকের চেহারায় শুধু ব্যক্তিত্বই নেই, দেখলেই বোঝা যায়, অসম্ভব সাবধানী, চালাক এবং বুদ্ধিমান উনি।

তারাপদ নিজের নাম বলল, আবার, পদবী সমেত। বটুকবাবুর মেসের ঠিকানাও।

“আপনার পিতার নাম?”

তারাপদ তার বাবার নাম বলল। তাতেও রেহাই নেই, মার নামও বলতে হল। বাবার নাম, মার নামের পর তাদের পৈতৃক দেশবাড়ি ভিটেমাটির কথাও।

তারাপদ বলল, “আমি এ-সব চোখে দেখিনি। ছেলেবেলায় একবার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়েস, আমার কিচ্ছু মনে নেই। শুধু একটা তেঁতুল গাছের কথা মনে আছে, খুব বড় তেঁতুল গাছ, গাছটায় নাকি ভূত থাকত…..” তারাপদ একটু হাসল।

এমন সময় বাহারি ট্রের ওপর সুন্দর কাপে করে চা আনল সেই বুড়ো লোকটি। তারাপদদের দিল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “চা খাও–”, বলেই তাঁর কী খেয়াল হল, সামান্য হালকা গলায় বললেন, “তোমাদের তুমি বলছি, কিছু মনে করো না, বয়েস তোমাদের অনেক কম।”

চা পেয়ে তারাপদরা বেঁচে গেল । একে এই বিশ্রী অবস্থা, তার ওপর শীত, হাত-পা রীতিমত ঠাণ্ডা হয়ে আসার জোগাড়।

“ওই ছেলেটি তোমার বন্ধু?” মৃণাল দত্ত চন্দনকে দেখিয়ে তারাপদকে জিজ্ঞেস করলেন।

“আমার পুরনো বন্ধু । ওর নাম চন্দন। ডাক্তারি পাশ করেছে সবে।”

মৃণাল দত্ত চন্দনকে দু চারটে কথা জিজ্ঞেস করলেন, পুরো নাম কী চন্দনের, কোথায় থাকে, বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন, কোথায় থাকেন–এই সব ।

শেষে মৃণাল দত্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমায় এবার কটা কথা জিজ্ঞেস করব। ঠিকঠিক জবাব দিও। তোমার বন্ধু এখন এখানে থাকতে পারে–পরে তাকে একটু উঠে যেতে হবে।”

তারাপদ একবার চন্দনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মৃণালবাবুর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “চাঁদু আমার পুরনো বন্ধু। ওর কাছে আমার কিছু গোপন করার নেই। ও আমার সবই জানে।”

“আচ্ছা, সে আমি পরে ভেবে দেখব। এখন তোমার বন্ধু থাকুক।” বলে মৃণাল দত্ত যেন সামান্য কি ভেবে নিলেন।

খুবই আচমকা মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখেছ?”

“আজ্ঞে, না।”

“তাঁর নাম শুনেছ?”

“আমার মনে পড়ছে না।“ মার কাছে আমার এক পিসিমার কথা শুনেছি। পিসিমার শ্বশুরবাড়ির পদবী ছিল হাজরা। সাঁওতাল পরগনার কোথায় যেন থাকতেন জায়গাটার নাম আমি জানি না । মা যদি বলেও থাকে–আমি ভুলে গিয়েছি।”

মৃণাল দত্ত খুব শান্তভাবে বসে, তারাপদর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার বাবা কবে মারা যান?”

“বাবা–! বাবা মারা গেছেন অনেক দিন। আমি তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট-এ।”

“অসুখ করেছিল? কী অসুখ?”

“কী অসুখ আমি বলতে পারব না।…বাবা কলকাতার বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। কয়েক দিনের মধ্যে মারা যান।”

“কোথায় গিয়েছিলেন জানো না?”

“না।”

“মা-র কাছে কিছু শুনেছ?”

“না।…বাবা যখন ফিরে আসেন তিনি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন, অনেকটা পাগলের মতন। অথচ একটা কথাও বলতেন না। বলতে পারতেন না। একেবারে বোবা। মাথায়ও কিছু হয়েছিল, মনে হত আমাদের চিনতেও পারছেন না।” বলতে বলতে তারাপদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। এতকাল পূরে বাবার কথা মনে হওয়ায় হঠাৎ যেন সেই পুরনো স্মৃতি তাকে কেমন বিষণ্ণ করে তুলল।

মৃণাল দত্ত নীরব। চন্দন আড় চোখে একবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তার চোখের মণিতে আলো পড়েছে যেন।

“তোমার মা কবে মারা যান?” মৃণাল শুধোলেন।

“আমি কলেজ থেকে বেরুবার পর মা মারা যায়। বাবা মারা যাবার পর মা অনেক কষ্টে স্কুলে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। আমরা বরাবরই খুব গরিবভাবে থেকেছি। কোনো রকমে চলত দুজনের। মার বুকের অসুখ করেছিল। তাতেই মারা যায়।”

মৃণাল দত্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর রাখা চুরুটের বাক্স থেকে একটা চুরুট বেছে নিলেন। “তোমরা আগে কোথায় থাকতে, ঠিকানা কী?”

তারাপদ মদন দত্ত লেনের ঠিকানা বলল।

“তারপর?”

তারাপদ বটুকবাবুর মেসে এসে ওঠার আগে যেখানে যেখানে ছিল তার কথা বলল ।

চুরুট ধরিয়ে নিয়ে মৃণাল দত্ত এবার বললেন, “তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণ তোমায় তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর-সবই দিয়ে যেতে চান। ভূজঙ্গবাবুর প্রপার্টি যা যা আছে তার সঠিক ভ্যালুয়েশান আমি এখনই দিতে পারব না। ধরো মোটামুটি দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকার। এ-সমস্তই তোমার হবে। কিন্তু…”

তারাপদর মাথা প্রায় ঘুরে উঠল। দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি! আজ সকালে দাঁত মাজার স্টে পর্যন্ত যার ছিল না, বটুকবাবুর তিরিশটা টাকার জন্যে যারা আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করছিল, সেই লোক সন্ধেবেলায় দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি পাচ্ছে। তারাপদর ইচ্ছে করছিল থিয়েটারের লোকদের মতন হাহা করে হেসে ওঠে।

মৃণাল দত্ত বললেন, “কিন্তু এই সম্পত্তি পাবার আগে তোমায় দুটো শর্ত পালন করতে হবে।”

তারাপদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমিই যে ভুজঙ্গবাবুর আত্মীয় তারাপদ তা প্রমাণ করতে হবে।”

“কী করে করব?”।

“তোমার যা করার করেছ, বাকিটা আমি করব। আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমি মিলিয়ে দেখব। তার আগে তোমার বন্ধুকে এ-ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্যে উঠে যেতে হবে।”

তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন উঠে দাঁড়াল। সেও রীতিমত উত্তেজনা বোধ করছিল।

তারাপদ বলল, “আর-একটা শর্ত কী?”

মৃণাল দত্ত শান্ত গলায়, “প্রথমটা যদি মেলে তবে না দ্বিতীয়টা!”

চন্দন আর-একবার বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

.

দুই

চন্দন চলে যাবার পর তারাপদর বড় ভয় করতে লাগল। ঘরে সে এখন একলা; মৃণাল দত্ত মুখোমুখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন তো দেখেই যাচ্ছেন, চুরুটটা তাঁর দাঁতের সঙ্গে ছোঁয়ানো, কেমন একটা কড়া তামাকের গন্ধ নাকে লাগছে। তারাপদ বুঝতে পারছিল না, অন্ধকারের আলো ফেলার মতন চোখ করে মৃণাল দত্ত এত কী দেখছেন তাকে! তার মাথায় ঢুকছিল না, ওই ভদ্রলোকের কাছে এমন কী প্রমাণ রয়েছে যাতে তিনি আসল আর জাল তারাপদ ধরে ফেলবেন? খানিকটা যেন রাগও হচ্ছিল তারাপদর, তার, পরিচয় এই নিয়ে সন্দেহ করার কী আছে? সে কি মুদির দোকানের বনস্পতি ঘি যে খাঁটি আর ভেজাল পরীক্ষা করে দেখতে হবে? বাস্তবিক পক্ষে এটা কিন্তু অপমান;. তারাপদ যেচে এখানে আসেনি, সে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দু লাখ টাকার সম্পত্তি পাবার আশায় কাঙাল নয়, তবু তাকে নিয়ে এটা কি বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে? এভাবে তাকে বসিয়ে রাখার কোনো অধিকার মৃণাল দত্তর নেই।

তারাপদ মনে মনে যাই ভাবুক সে কিছু বলতে পারল না; বোবার মতন বসে থাকল।

শেষে মৃণাল দত্ত উঠলেন। ওঠার আগে টেবিলের ড্রয়ার খুললেন চাবি দিয়ে, ড্রয়ারের মধ্যে থেকে আরও একটা বড় মতন চাবির গোছা বার করলেন, দুটো কি তিনটে চাবি একসঙ্গে বাঁধা।

তারাপদর সামনে দিয়ে মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে দেওয়াল-সিন্দুকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমার চেহারার সঙ্গে কার মিল বেশি বলে মনে হয়, তোমার বাবার না মা-র?”

তারাপদ খানিকটা অবাক হল। বাবা এতকাল হল মারা গিয়েছেন যে, তাঁর মুখ আর ভাল করে মনেই পড়ে না। তা ছাড়া বাবা মারা যাবার সময় সে ছেলেমানুষ ছিল, এখন কত বড় হয়ে গিয়েছে, চব্বিশ পঁচিশ বয়েস হতে চলল–কেমন করে সে বলবে তার চেহারা বাবার মতন’ হয়ে আসছে কি না! মা অবশ্য বলত, তারাপদর চেহারার আড় তার বাবার মতন হয়েছে, মুখের খানিকটা বাবার ছাঁদে, বাকিটা মার।

শুকনো শুকনো গলায় তারাপদ বলল, “আমি বলতে পারব না। মা বলত, মেশানো মুখ ।”

মৃণাল দত্ত বড়সড় দেওয়াল-সিন্দুকটা খুলে ফেলে কী যেন বের করতে লাগলেন। তারপর বাঁধানো অ্যালবামের মতন একটা মোটা খাতা বের করলেন যত্ন করে রাখা কিছু কাগজপত্রও নিলেন; নিয়ে সিন্দুকের ডালা বন্ধ করলেন।

নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন মৃণাল দত্ত। বললেন, “তুমি আমার সামনে এগিয়ে এসে বসো।” বলে আঙুল দিয়ে টেবিলের অন্য প্রান্তটা দেখালেন।

তারাপদ চেয়ারটা টেনে এনে টেবিল ঘেঁষে বসল, মুখোমুখি ।

মৃণাল দত্ত বাঁধানো খাতার মতন জিনিসটা এগিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, ওটা অ্যালবামই, তবে বাজারে যেমন কিনতে পাওয়া যায় সেই রকম নয়। মোটা মোটা কাগজ, বেশিরভাগ পাতায় একটা করে মাত্র ছবি, কখনো কখনো দুটো; প্রতিটি পাতা নিখুঁত করে রাখা, গোটা খাতাটাই চামড়ায় বাঁধানো, ছবির পাশে লাল পেনসিলে পুরু করে শুধু নম্বর লেখা আছে বাংলায় ।

তারাপদ অ্যালবাম হাতে করে বসে থাকল।

মৃণাল দত্ত কাগজপত্রের মধ্যে থেকে একটা পাতলা চামড়ার খাপ–চুরুট রাখার খাপ যেমন হয় অনেকটা সেই রকম খাপ-খুঁজে নিয়ে তার ভেতর থেকে একটা মোটা কাগজ বের করে নিলেন।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ওই ছবিগুলো দেখে যাও একটা একটা করে; যে ছবিটা তোমার চেনাচেনা লাগবে সেই ছবিটা কার আমায় বলবে। বুঝলে?”

তারাপদ মাথা হেলিয়ে বলল, সে বুঝেছে।

“নাও বলো”, বলে মৃণাল দত্ত চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে বসে মুখের সামনে মোটা কাগজটা মেলে রাখলেন। তারাপদ বুঝতে পারল, উনি খুব সাবধানী, কাগজের কোনো আঁচড়ও যাতে তারাপদর চোখে না পড়ে সেজন্য দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। এর কোনো প্রকার ছিল না, কেন না তারাপদ কাগজের সাদা পিঠ ছাড়া অন্য কিছু এমনিতেই দেখতে পাচ্ছিল না।

তারাপদ অ্যালবামের দিকে চোখ দিল। প্রথম ছবিটা যে কার কে জানে! অনেক পুরনো ছবি, কেমন হলদেটে হয়ে গেছে, ছোপ ছোপ ধরেছে, কোথাও কোথাও একেবারেই ধূসর। বিশাল দাড়িঅলা এই বৃদ্ধ মানুষটিকে সেকেলে কোনো গুরুদেব-টুরুদেবের মতন দেখতে লাগে, পরনের খুট গায়ে জড়ানো, পদ্মাসন না কী বলে যেন সেই ভাবে বসা, হাত দুটি হাঁটুর ওপর।

তারাপদ মাথা নাড়ল বলল, “এই এক নম্বরের ফটো যে কার আমি জানি না। জীবনেও দেখিনি।”

মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার দেখার কথাও নয়। তারপর বলে যাও…।”

তারাপদ দুই তিন চার পাঁচ নম্বর ছবি পর্যন্ত কাউকে চিনতে পারল না। বুঝতে পারল, ছবিগুলো সবই পারিবারিক, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, প্রবীণের । এই পরিবারের সঙ্গে তারাপদর সম্পর্ক কী? সে তো কাউকে চেনে না দেখেনি। তবে? তবে কি তারাপদ এই পরিবারেরই কেউ, এদেরই বংশধর, এদেরই রক্ত গায়ে নিয়ে বেঁচে আছে? এইসব স্বর্গত পুরুষরা কি আজ অদৃশ্য হয়ে তাকে দেখছে? তারাপদর ঘাড় এবং মাথার কাছে যেন কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এরকম একটা অস্বস্তি বোধ করল সে।’

সাত নম্বর ছবির দিকে চোখ রেখে তারাপদ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । কী যেন মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। ওই ছবির সঙ্গে একটা কিছুর যোগ রয়েছে কোথাও। অথচ ছবিটা কোনো মানুষের নয়। সেকেলে একটা বাড়ির ছবি। পাকা বাড়ি, তার চেহারাই কেমন আলাদা–একালের শহুরে বাড়ির সঙ্গে মেলে না। বাড়ির ঢঙে, আশপাশের চেহারায়, গ্রাম-গাম লাগে। দোতলা বাড়ি, একটানা ঘর, বাঁ দিকে একটা চালার মতন, ডান দিকে ক’টা গাছপালা, তার পাশে মস্ত একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে, গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে না।

তারাপদ গভীর মনোযোগে গাছটার অস্পষ্ট ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “এই বাড়িটা বোধ হয় আমাদের দেশের বাড়ি। আমার ঠিক মনে নেই, তবে সেই তেঁতুলগাছটা, যার মাথায় ভূত থাকত, সেই গাছটা যেন এইটে–” বলে তারাপদ আঙুল দিয়ে গাছটা দেখাল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “হ্যাঁ, তোমাদের দেশের বাড়ি। তোমার কি মনে আছে ওই বাড়ির পেছনে কী ছিল?”

তারাপদ মনে করার বৃথা চেষ্টা করল, তারপর হঠাৎ কেমন একটু হেসে বলল, “আমার মনে নেই। তবে মার মুখে শুনেছি পুকুর ছিল।”

মৃণাল দত্ত শান্ত গলায় বললেন, “তেঁতুলগাছটার কথাও মা-বাবার মুখে শুনতে পার।…যাক, অন্য ছবি দেখো।”

তারাপদ বেশ ক্ষুব্ধ হল। তার বাল্যস্মৃতির মধ্যে তেঁতুলগাছটা কেমন করে যেন থেকে গেছে অথচ মৃণাল দত্ত তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আশ্চর্য! এত সন্দেহ কেন?

পর পর তিনটে ছবি উলটে গিয়ে তারাপদ হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ উজ্জ্বল দেখাল । সামান্য গলায় বলল, “আমার বাবার ছবি ।” বলে তারাপদ ঝুঁকে পড়ে তার বাবার ছবি দেখতে লাগল । কতকাল পরে বাবাকে দেখছে। যেন। এই মুখ চোখ মাথার চুল সব বুঝি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ ফিরে পেল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তোমার কাছে তোমার বাবার ছবি নেই?”

“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।

“তোমার মার কাছে নিশ্চয়ই ছিল।”

তারাপদ এবার রেগে গিয়ে বলল, “আপনি আগাগোড়া আমায় অবিশ্বাস করছেন কেন? আপনি ভাবছেন, মা বাবা বেঁচে থাকার সময় আমি যা শুনেছি দেখেছি সেগুলো চালাবার চেষ্টা করছি।”

মৃণাল দত্ত বললেন, “আমি আমার কাজ করছি। তোমার কথার জবাব পরে দেব। এখন তুমি ছবিগুলো দেখে যাও।”

বিরক্ত অসন্তুষ্ট মনে তারাপদ অন্য ছবিগুলো দেখতে লাগল। মার ছবি দেখল, বলল। একটা মন্দিরের পাশে মা বাবা এবং আরও যেন দুজনকে দেখল। বলল, “মা বাবাকে চিনতে পারছি, আর কাউকে পারছি না।”

“তোমাকে পারছ না?”

“আমাকে? আমিও আছি নাকি? কোথায়?” তারাপদ বেশ কৌতূহল বোধ করে নিজেকে খুঁজতে লাগল। দুটো বাচ্চার একটা নিশ্চয় সে। কিন্তু কোটা? ছেলেবেলার তারাপদ কি তালপাতার সেপাই ছিল? কাঠির মতন হাত পা, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট, একটা শার্ট গায়ে, খোঁচা খোঁচা চুল মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ছেলেটাই কি তারাপদ নিজে? অন্যটা কে তা হলে?

তারাপদ ছবির ওপর আঙুল দিয়ে বলল, “আমি বোধ হয় এইটে…।”

মৃণাল দত্ত একটু যেন হাসলেন। বললেন, “ঠিক আছে, পরের ছবিগুলো দেখো।”

তারাপদ পরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবি দেখে কেমন থমকে গিয়ে বলল, “এ আমার বোন পরী…।”

“ওটা কত নম্বরের ছবি?”

“উনিশ।”

“তোমার বোনের কথা মনে পড়ে?”

“হ্যাঁ । দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ঝাঁকড়া চুল, ফরসা রঙ, একটু একটু কথা বলতে শিখেছিল, দা—দ–দা, মা—ম‌–মা বলতে পারত জলকে বলত দল…। বছর দুই বয়সও হয়নি, পরী মারা যায়।”

“কেমন করে?”

“সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মাথায় লেগেছিল। তাতেই মারা গেল।”

মৃণাল দত্ত কিছু বললেন না। নিবন্ত চুরুটটা ছাইদান থেকে আবার উঠিয়ে নিলেন।

তারাপদ অন্যমনস্ক বিষণ্ণ মুখে বসে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর আবার পাতা ওলটাতে লাগল। ওলটাতে ওলটাতে দেখল কী আশ্চর্য, তার স্কুলে পড়ার সময়কার ছবি, মা-র সঙ্গে আরও একটা ছবি, তার কৈশোর ও যৌবনকালের ছবিও এই অ্যালবামে রয়েছে। কেমন করে থাকল? বি এ পাশ করার পর সে কনভোকেশনে গিয়েছিল–একটা ছবিও তুলিয়েছিল অন্যদের মতন জোব্বা পরে, সেই ছবিও রয়েছে। অদ্ভুত তো!…একেবারে শেষের দিকে তারাপদ সাধুমামার ছবি দেখতে পেল। দেখে অবাক হয়ে গেল। সাধুমামা তাদের একেবারে নিজের কেউ নয়, মার কোন দুর সম্পর্কের আত্মীয়, আবার বাবারও যেন কেমন একটা ভাইটাই হত । তবু মার সম্পর্কেই তাঁকে মামা বলা হত। একটু খেপাগোছের লোক। হঠাৎ কলকাতায় তাদের বাড়িতে আসত, আবার চলে যেত, কোথায় যে থাকত সাধুমামা, কেউ জোর করে বলতে পারবে না। কখনো বর্ধমানে কখনো রানীগঞ্জে, কখনো দেওঘরে। সাধুসন্ন্যাসী আশ্রম-টাশ্রম করে বেড়াত খুব। মা মারা যাবর পরও সাধুমামা দু-এক বছর তারাপদর খোঁজখবর করেছে, থেকেছে এক-আধ রাত। বটুকবাবুর মেসে তারাপদ আস্তানা গাড়ার পরও সাধুমামা দেখা দিয়ে গিয়েছে। আজ বছর দেড় দুই অবশ্য আর আসেনি। তারাপদ ভাবত, সাধুমামা মারা গেছে।

সাধুমামার কথা ভাবতে গিয়েই তারাপদর আচমকা খেয়াল হল, আরেসাধুমামাই তো তার কনভোকেশনের একটা ছবি জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। ওই ছবি কি সেইটে? নিশ্চয়ই তাই।

তারাপদ চোখ তুলে বলল, “আমি এখন বুঝতে পারছি।”

“কী বুঝছ?”

“সাধুমামা আমাদের অনেক ছবি জোগাড় করে এই অ্যালবামে রেখেছে।”

“না”, মৃণাল দত্ত মাথা নাড়লেন। “সাধুমামার অ্যালবাম এটা নয়। এটা ভুজঙ্গবাবুর। তোমাদের সাধুমামা অনেক ছবি ভুজঙ্গবাবুকে দিয়েছে, তঅমাদের ছবি–বিশেষ করে তোমার বাবা মারা যাবার পর তোমাদের সমস্ত ছবিই সাধুমামা ভুজঙ্গবাবুকে জোগাড় করে দিয়েছে।”

“শুধু ছবি কেন, আমাদের সমস্ত খবরই বোধ হয় সাধুমামা দিত?”

“হ্যাঁ ।”

“আমার ঠিকানাও সাধুমামা দিয়েছিল!”

“না দিলে ভুজঙ্গবাবু কোথায় পাবেন?”

“আমি যদি বটুকবাবুর মেসে না থাকতাম–তা হলে কী হত?”

“তোমার খোঁজ করার চেষ্টা করতাম, কাগজে নোটিশ দিতাম। তাতেও যদি তোমার খোঁজ না পাওয়া যেত–আমায় এই বোঝা মাথায় নিয়ে বসে থাকতে। হত তোমার অপেক্ষায়।”

তারাপদ অ্যালবামটা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণে তার যেন স্বস্তি লাগছে। বড় করে নিশ্বাস ফেলল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “এবার আমায় দু-একটা ছোটখাট কথা বলো! তোমার শরীরে কোনো আইডেন্টিফিকেশান মার্ক আছে? কোনো কাটাকুটি, জড়ল, তিল–?”

তারাপদ নিজের হাত দেখতে দেখতে বলল, “তিল তো অনেক আছে, বাঁ পায়ে হাঁটুর তলায় কাটা আছে।”

“আর কিছু?”

“জানি না, লক্ষ করিনি।”

মৃণাল দত্ত হাতের কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, “তোমার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের কাছটা জোড়া নয়? আরও আঙুলের মতন আছে। পাঁচের জায়গায় ছয় বলতে পারো। ঠিক কি না? দেখি?”

তারাপদ স্বীকার করল, হ্যাঁ, তার বাঁ পায়ের আঙুল ওই রকমই। মৃণাল দত্তকে দেখাল।

মৃণাল দত্ত এবার যেন নিশ্চিন্ত। চুরুট নিবে গিয়েছিল। আবার ধরালেন। বললেন, “আর একটু চা খাবে?”

তারাপদ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। মাথা নেড়ে বলল, “খাব।”

মৃণাল দত্ত টেবিলের পাশে লাগানো কলিং বেলের বোতামে হাত দিলেন। একটু পরেই সেই বুড়োমতন লোকটি ঘরে এল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “দু কাপ চাপ নিয়ে এসো, আর বাবুর বন্ধুকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও।”

লোকটি চলে গেল।

মৃণাল দত্ত এবার মোলায়েম গলায় বললেন, “প্রথম শর্তটা মিটল। তুমি যে আসল তারাপদ সবার আগে আমার সেটা দেখা দরকার ছিল। তোমার শরীরের চিহ্ন ছাড়াও–ওই ছবিগুলো যা তুমি চিনতে পেরেছ–তাতেও প্রমাণ হয় তুমি তারাপদই। আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।”

“তোমার এই বন্ধুটি কি সত্যিই পুরনো বন্ধু?” মৃণাল দত্ত জিজ্ঞেস করলেন।

“আজ্ঞে হ্যাঁ।“

“বিশ্বাস করার মতন?”

“আজ্ঞে, ও আমার সবচেয়ে ইনটিমেট ।”

“ভাল। খুবই ভাল।” মৃণাল দত্ত আস্তে আস্তে চুরুটে টান দিলেন। খানিকটা যেন চিন্তিত।

চন্দন ঘরে এল। তারাপদর পাশে বসতে পারল না, নিজের পুরনো জায়গায় বসল। এখানে বসলে চোখ যেন নিজের থেকেই বেড়ালটার দিকে চলে যায়। চন্দন তাকাল। তাকিয়েই তার কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল। সামান্য যেন চমকেও উঠল। চন্দন যখন এ-ঘর ছেড়ে চলে যায় তখন ওই বেড়ালটার মুখ যে অবস্থায় ছিল-এখন যেন তার চেয়ে খানিকটা ঘুরে গিয়েছে। তখন, মানে তারাপদ আর সে যখন এই ঘরে এসে প্রথমে বসে, তখন বেড়ালটার মুখ তাদের দিকে ফেরানো ছিল, এখন ঘড়ির কাঁটার মতন ডানদিকে সরে গিয়েছে, বেড়ালটার মুখ বা চোখের সঙ্গে চন্দনের চোখাচুখি হচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার তো! চন্দন কি চোখে ভুল দেখছে? নাকি তারাপদ বেড়ালটা হাতে করে তুলে দেখেছিল, আবার নামিয়ে রাখার সময় ওই ভাবে বসিয়েছে? চন্দন কিছু বুঝতে পারল না। সে বেড়ালটার দিকে নজর রেখে বসে থাকল।

ততক্ষণে তারাপদ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুকে দেখে নিয়েছে।

মৃণাল দত্ত তারাপদকে বললেন, “আমি তোমায় গোড়ার কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। তোমার শুনে রাখা ভাল। তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। আমি একবার পুজোর ছুটিতে ফ্যামিলি নিয়ে মধুপুরে চেঞ্জে গিয়েছিলাম। ভুজঙ্গবাবুও গিয়েছিলেন কয়েক দিনের জন্যে। পাশাপাশি বাড়ি। আলাপ হয়েছিল সে-সময়। তারপর আমি কলকাতায় ফিরে আসি। ভুজঙ্গবাবু মাঝে মাঝে আমায় চিঠি লিখতেন। আমিও জবাব দিতাম। তারপর তিনি আমায় তাঁর সলিসিটার হবার অনুরোধ জানান। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হব না। পরে তাঁর চিঠির তাগাদায় রাজি হয়ে যাই। এবার পুজোর সময়, লক্ষ্মী পূর্ণিমার পর ভুজঙ্গবাবু একদিনের জন্যে কলকাতায় আসেন, আর এই সমস্ত কাগজপত্র ছবি দিয়ে যান। কিছু সই-সাবুদের ব্যাপার ছিল–ছুটির আগেই আমি তা সেরে রেখেছিলাম, তিনি সেগুলো সইটই করে দেন। তখন আমায় বলেছিলেন, তাঁর চিঠি পাবার পর আমি যেন তোমার খোঁজখবরের চেষ্টা করি। আজ দিন সাতেক হল আমি তাঁর দুটো চিঠি পেয়েছি। দুটো চিঠিতেই তিনি তোমার কথা লিখেছেন; লিখেছেন তোমায় তাড়াতাড়ি একবার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে।”

তারাপদ মন দিয়ে কথা শুনছিল। বলল, “তিনি কোথায় থাকেন আমি তো । জানি না!”

“তোমার জানবার কথাও নয়, মৃণালবাবু বললেন। “তুমি কোনোদিন মধুপুর দেওঘরের দিকে গিয়েছ?”

“আজ্ঞে না ।”

“মধুপুর আর যশিডির মধ্যে একটা স্টেশন আছে, স্টেশনটার নাম শংকরপুর। সেখানে নেমে মাইল তিন-চার ভেতরে গেলে ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি পাবে। জায়গাটাকে মাঠমোকাম বলে।”

বুড়োমতন লোকটি আবার চা নিয়ে এল ট্রে-তে করে। তারাপদ আর । চন্দনকে দিল। চন্দন যত না মৃণাল দত্তর কথা শুনছে তার চেয়ে বেশি। মনোযোগ দিয়ে কালো বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে। আপাতত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এত রকম ঝঞ্ঝাটের পর গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারাপদর আরাম লাগছিল।

মৃণাল দত্ত সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “তুমি তো ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখোনি, তাঁর বিষয়ে কিছু জানো না।”

“না,” তারাপদ মাথা নাড়ল।

মৃণাল দত্ত কী যেন ভাবছিলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, “আমি দেখেছি—ওঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখলেও তোমার ভয় করত। আর এখন, কী অবস্থায় তুমি তাঁকে দেখবে আমি বলতে পারছি না।”

তারাপদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। “ভয় করবে? কেন?”

“এক একজন মানুষের চেহারা দেখলে কেমন একটা লাগে না? তেমার কখনো লাগেনি?”

তারাপদ মনে করবার চেষ্টা করল। প্রথমেই তার মনে পড়ল, মদন দত্ত লেনের সেই মুদিঅলাকে; বীভৎস চেহারা, পাড়ার ছেলেরা তাকে ফ্র্যাংকেস্টাইন বলত; মনে পড়ল ছেলেবেলায় একবার সে সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে একটা বাবরি চুলঅলা, কালো কুচকুচে চেহারার ষণ্ডা লোক দেখেছিল, তার চোখ দুটো লাল টকটকে। কে যেন বলেছিল, লোকটা জল্লাদ, জেলে জেলে ফাঁসি দিয়ে বেড়ায়। সেই লোকটাকে দেখে তারাপদর ভীষণ ভয় হয়েছিল। তারপর আরও কাউকে কাউকে দেখেছে যাদের চেহারার কোনো না কোনো অস্বাভাবিকতা, কোনো অঙ্গহানির জন্যে সত্যিই বড় বিশ্রী দেখতে লাগে ।

তারাপদ বলল, “হ্যাঁ, তা লাগে।”

“ভুজঙ্গবাবুকেও দেখতে তোমার ভাল লাগবে না–” মৃণাল দত্ত বললেন, “অনেকটা যেন কাপালিকের মতন দেখতে। আমি নিজে অবশ্য কোনো কাপালিক কখনো দেখিনি–বঙ্কিমবাবুর কপালকুণ্ডলা’ সিনেমায় একবার কাপালিক দেখেছি, সে তো সিনেমার কাপালিক। ভুজঙ্গবাবুকে আরও ভয়ঙ্কর দেখতে। তাঁর একটা ছবি আমার কাছে আছে তিনিই দিয়েছেন, তোমায় দেখাচ্ছি।” বলে মৃণালবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাগজপত্র থেকে একটা খাম বের করলেন। ফটো রাখার হলুদ খাম। ভুজঙ্গবাবুর ছবি বের করে তারাপদর দিকে এগিয়ে দিলেন।

চন্দনের কান তখন মৃণাল দত্তর কথায়। সে কালো বেড়ালটার দিকে তাকাতে ভুলে গেল। তারাপদ ছবিটা হাতে নিল। মাঝারি ছবি। ভুজঙ্গবাবুর বুক পর্যন্ত দেখা যায়। ছবি দেখে তারাপদ স্তম্ভিত। বিশাল মুখ, খড়ের মতন লম্বা নাক, বড় বড় চোখ, চওড়া কান। চোখ দুটো এত তীব্র, এমন অস্বাভাবিক রুক্ষ যে তাকালেই মনে হয়, মানুষটা তোমার সব কিছু দেখে নিচ্ছে। চোখের মধ্যে কেমন এক নিষ্ঠুরতা। মানুষের ভুরু যে কত চওড়া হতে পারে ভুজঙ্গভূষণের মুখ না দেখলে বোঝা মুশকিল। পুরু ঠোঁট, সামান্য দাঁত দেখা যাচ্ছে, ধারালো শক্ত ঝকঝকে দাঁত। ভুজঙ্গবাবুর উঁচু চওড়া কপাল, নাক, চোখ আর ঠোঁটের সামান্য অংশ ছাড়া বাস্তবিক মুখের আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মুখে ঘন দাড়ি, সন্ন্যাসীদের মতন, মাথার চুল পিঠ পর্যন্ত বাবরি করা। দাড়ি আর চুল কোনোটাই পরিপাটি নয়, উস্কোখুস্কো, ঝড়ে-ওড়া চুলের মতন এলোমেলো।

তারাপদ ভাবতে পারছিল না, এই লোকটা কী করে তার পিসেমশাই হয়? এ তো কোনো ভয়ংকর তান্ত্রিক হতে পারে। কাপালিক হওয়াও সম্ভব। ১

মৃণাল দত্ত বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর কাছে তোমায় যেতে হবে। তিনি তোমায় নিজের চোখে দেখতে চান।”

“কেন?”

“তিনি লিখেছেন, আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন না। কীভাবে আগুন লেগে তাঁর মুখ পুড়ে গেছে। ওষুধপত্র লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। মারা যাবার আগে একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এ হয়ত তাঁর দুর্বলতা। তা ছাড়া, তুমি ছাড়া তাঁর আর কোনো জীবিত আত্মীয় নেই, হয়ত সেই জন্যেই নিজের ওয়ারিসানকে একবার স্বচক্ষে দেখতে চান।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। ভুজঙ্গভূষণের কাছে যেতে তার ইচ্ছে করছিল না, আবার যখনই দেড় দু’লাখ টাকার সম্পত্তির মনে আসছিল–তখন সেটা হারাবার কথাও ভাবতে পারছিল না।

মৃণাল দত্ত যেন তারাপদর মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, “ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে যদি তোমার দেখা না হয় তা হলে দ্বিতীয় শর্ত মতন তুমি তাঁর সম্পত্তির কানাকড়িও পাবে না।”

তারাপদর মনে হল, সে যেন মনে মনে কিসের স্বপ্ন দেখছিল, হঠাৎ তা ভেঙে গেল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃণালবাবু আবার বললেন, “তোমায় আমার আপাতত আর কিছু বলার নেই। যদি ভুজঙ্গবাবুর কাছে যেতে চাও, আমি তোমায় দু-একটা জিনিস দেব। সেটা তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি জিনিসগুলো পেয়ে আমায় জানাবেন–তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।”

“কিন্তু আমি গিয়ে যদি দেখি তিনি মারা গেছেন?”

“মারা যাবেন বলে মনে হয় না। দু-চার দিনের মধ্যে বোধ হয় নয়। নিজের মৃত্যুর দিন নাকি তাঁর জানা। সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন লিখেছেন। মানে আরও দিন আষ্টেক । আজ সপ্তমী-টপ্তমী হবে।”

তারাপদ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল।

“যদি যেতে চাও কাল সকালে একবার তোমায় এখানে আসতে হবে। আমি সব তৈরি করে রাখব।”

তারাপদর মুখে কথা ফুটল না।

ঘর ছেড়ে চলে আসার মুখে চন্দন আবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তাকিয়ে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। বেড়ালের মুখ মৃণাল দত্তর দিকে ঘুরে গিয়েছে প্রায়। চন্দন তারাপদর হাতের কাছটা জোরে চেপে ধরল।

.

তিন

টাইম টেল-এ গাড়ি ছাড়ার সময় রাত প্রায় দশটা; ন’টার আগেই তারাপদরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেল। হাতে খানিকটা সময় থাকা ভাল, টিকিট কাটা, আগেভাগে বসবার জায়গা দখল করা । সারা রাত এই শীতে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাবে না, ঘুমোতে না পারুক–অন্তত ভাল করে বসার জায়গা দরকার।

তারাপদ নিজে টিকিট কাটতে গেল না। চন্দনকে পাঠিয়ে দিল। সারাটা দিন আজ তারাপদর বড় ছুটোছুটি গিয়েছে। কাল সারা রাত তেমন একটা ঘুমোতেই পারল না, মাথার মধ্যে মৃণাল দত্ত আর ভুজঙ্গভূষণ। ওরই মধ্যে সাধুমামার মুখ মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, মা বাবার কথা মনে পড়েছে, পরীর কথাও মনে পড়ল। পরীর মুখ তো মনেই ছিল না তারাপদর, ছবি দেখে মনে পড়ল। ওই একটিমাত্র বোন, আর তো কেউ ছিল না তার, আহা সে বেচারিও থাকল না। হাজার চিন্তায় ঘুম হল না। তার ওপর ওই ব্যাপারটাও তাকে বেশ অবাক করে তুলেছিল। মৃণালবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়েই চন্দন সেই কালো বেড়ালটার কথা বলল। বেড়ালটা নাকি ঘড়ির কাঁটার মতন ঘুরে যায়। চন্দন স্বচক্ষে দেখেছে, তারাপদরা যখন মৃণালবাবুর ঘরে গিয়ে বসে তখন তার মুখ ছিল তাদের দিকে, আর যখন চলে আসে তখন বেড়ালটার মুখ মৃণাল দত্তর দিকে। এ কি করে সম্ভব? একটা ভুয়ো, নির্জীব, পুতুল ধরনের বেড়াল কেমন করে মুখ ঘোরাবে? চন্দন নিশ্চয় ভুল দেখেছে।

চন্দন জোর দিয়ে বলল, না, সে ভুল দেখেনি। ঠিকই দেখেছে।

কেমন করে এটা হয় তারাপদ বুঝতে পারল না। ভূতের ব্যাপার নাকি? ম্যাজিক?

ভুজঙ্গভূষণের পুরো ব্যাপাটাই ভূতুড়ে মনে হচ্ছে, ভাবতে গেলে সেরকমই মনে হয় নাকি? কোথায় তারাপদ আর কোথায় ভুজঙ্গভূষণ–চেনা না জানা না–কস্মিনকালেও যারা পরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখল না, তারা কেমন করে। আজ একজন অন্যজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! ভুজঙ্গভূষণ খুঁজছে তারাপদকে, আর তারাপদ খুঁজে বেড়াচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দুলাখ টাকার সম্পত্তি! সত্যিই ব্যাপারটা ভুতুড়ে।

ব্যাপার ভুতুড়ে হোক আর যাই হোক, সকালে ঘুম ভেকে উঠে তারাপদকে মৃণালবাবুর কাছে ছুটতেই হল। দেড় দু’লাখ টাকার লোভে কি? হতে পারে। আবার টাকার লোভ ছাড়াও কেমন একটা রহস্যের টানও রয়েছে। সত্যি সত্যি ওই ভুজঙ্গভূষণ কে? কেনই বা তাঁর ওই রকম কাপালিক-মাকা চেহারা? কী করতেন তিনি এতকাল? কেন কোনদিন তারাপদদের খোঁজখবর নেনি, অথচ সাধুমামাকে দিয়ে তাদের পরিবারের–মানে তারাপদর মা, বাবা, পরী সকলের ছবি জোগাড় করে নিয়েছেন! কী তাঁর উদ্দেশ্য ছিল?

হাজার রকম ‘কেন’র কোনো জবাব যেমন পাওয়া যাচ্ছে না–সেইরকম। বোঝা যাচ্ছে না ভুজঙ্গভূষণ কী করে জানতে পারলেন যে সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন? ভদ্রলোকের কি ইচ্ছামৃত্যু? কে জানে বাবা! এত রকম অবাক হবার ব্যাপার যখন রয়েছে তখন বেড়ালটার মুখ ঘোরানোও আর এমন কি আশ্চর্যের! তবে, ওই কালো বেড়ালটা তো ছিল, মৃণাল দত্তর ঘরে। তা হলে? মৃণাল দত্তও কি ভুজঙ্গভূষণের ছোঁয়া পেয়েছেন?

সকালে মৃণাল দত্তকে একবার কালো বেড়ালটার কথা জিজ্ঞেস করলে হত। এসব কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জাও তত করে। কিন্তু সে সুযোগই হল না। পুরনো ঘরে মৃণাল দত্ত তারাপদকে আর বসাননি। বাইরের বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে তাঁর দরকারি কাগজপত্র এনে দিলেন। যেন তিনি জানতেন তারাপদ ঠিকই আসবে, রাত পোহালেই এসে হাজির হবে। সমস্ত তৈরি করে রেখেছিলেন। সিলমোহর করা একটা চিঠি, সামান্য ভারী মতন একটা প্যাকেট, রেজিস্ট্রি করা পার্শেলের মতন চেহারা সেটার চারপাশে গালা দিয়ে করা, মোহরের ছাপ।

সেইসব জিনিস নিয়ে তারাপদ এল চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে। চন্দনকে বলল, “চাঁদু তোকে সঙ্গে যেতে হবে ।”

চন্দন প্রথমটায় রাজি হচ্ছিল না; তার হাসপাতাল। আবার পুরো ব্যাপারটাই এমন গোলমেলে যে একলা তারাপদকে ছেড়ে দিতে তার ভাল লাগছিল না। তারাপদ কোনো কালেই সাহসী নয়, বরং ভিতু ধরনের; তার শরীর স্বাস্থ্য ততটা মজবুত নয়; নিরীহ ভালোমানুষ গোছের ছেলে ও, ভিড়ের ভয়ে কোনোদিন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের লিগ বা শিন্ডের খেলা পর্যন্ত দেখতে গেল না। চন্দন কতবার বলেছে, চল্ না-আমি তো রয়েছি। তারাপদ মাথা নেড়েছে আর বলেছে, থাক ভাই, আমার মাঠে গিয়ে দরকার নেই, রিলে শুনলেই আমার খেলা দেখা হয়ে যাবে।

সেই তারাপদকে একলা একলা কী করে ছেড়ে দেয় চন্দন! তারাপদর মা যখন মারা যায় চন্দন শ্মশানে গিয়েছিল, তার মনে আছে সেদিন বারবার তারাপদ শুধু চন্দনকেই আঁকড়ে ধরেছিল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ।

অনেক রকম গবেষণার পর ঠিক হল, চন্দন হাসপাতাল থেকে কয়েক দিনের ছুটি নেবে, বললবাবার অসুখ। কথাটা মিথ্যে হলেও করার কিছু নেই, ছুটির যখন দরকার তখন বড় কিছু একটা না বললে ছুটি দেবে কেন?

চন্দন রাজি হয়ে যাবার পর তারাপদ বটুকবাবুর মেসে ফিরল। স্নান খাওয়া সেরে বেরুলো কিছু টাকা পয়সা জোগাড়ের ধান্ধায়। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যা পায় জুটিয়ে অন্তত একশো সোয়া শো টাকা তো হাতে রাখতেই হবে।

দুপুরের পর তারাপদ মেসে ফিরল। বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপর গোছগাছ শুরু করল।

সন্ধের গোড়ায় গেল চন্দনের হোস্টেলে। চন্দন প্রায় তৈরি। তারপর দুই বন্ধু মিলে জয় মা বলে বেরিয়ে পড়েছে। দেখা যাক কপালে কী আছে!

চন্দন টিকিট কেটে ফিরে এসে বলল, “নে, চল…। ননম্বরে গাড়ি দেবে।

জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই তাদের, দুজনের দুটো কিট ব্যাগ, চন্দন একটা কম্বল নিয়েছে হাতে ঝুলিয়ে, রাত্রে শীতের হাত থেকে বাঁচতে হবে। তারাপদর কম্বল নেই, সে একটা তুষের পুরনো চাদর আর বঙ্কিমদার হনুমান টুপিটা নিয়ে নিয়েছে সঙ্গে করে। মেসে কেউ জানে না–তারাপদ কোথায় যাচ্ছে।

তারাপদ শুধু বলেছে, একটু বাইরে যাচ্ছি এক বন্ধুর সঙ্গে, দরকার আছে।

প্লাটফর্মে ঢুকে তারাপদরা দেখল, ভিড় ভীষণ একটা কিছু নয়, মোটামুটি। প্যাসেঞ্জার ট্রেন; তায় আবার শীতকাল, হয়ত তাই ভিড়টা কমই।

একটু পরেই প্লাটফর্মে গাড়ি দিয়ে দিল। চন্দন বাহাদুর ছেলে। গাড়ি প্লাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই কী-এক বিচিত্র কায়দায় সে চলন্ত ট্রেনের হ্যাঁন্ডেল ধরে ঝুলে পড়ল ।

গাড়ি দাঁড়াবার পর তারাপদ খুঁজে খুঁজে চন্দনকে বের করে নিল। চমৎকার জায়গা জুটিয়ে কম্বল বিছিয়ে ফেলেছে।

গাড়িতে উঠে তারাপদ বলল, “তোর দৌড়বার কী ছিল? ভিড় তেমন নেই।”

চন্দন বলল, “দেখতেই পাবি। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসুক। নে বসে পড়। এদিকে আয়-জায়গা নিয়ে বস্–চাদরটা বিছিয়ে দে; শোবার জায়গা ছাড়বি না।”

কি ব্যাগ মাথার কাছে রেখে একেবারে কোণের দিকে মুখোমুখি দুই বন্ধু কম্বল আর চাদর পেতে ফেলল। কামরায় লোক উঠছে, কুলি উঠছে, আবার নেমেও যাচ্ছে, মালপত্র রাখার হইচই।

চন্দন নিজের জায়গায় বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। “তোর এই মালগাড়ি কাল নটা দশটার সময় শংকরপুর পৌঁছবে।”

গাড়িটা অবশ্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন, মালগাড়িরই যমজ-ভাই। ঢিকির ঢিকির করে যাবে, হাজারবার দাঁড়াবে। অন্য কোনো গাড়িতে যাওয়া চলত, কিন্তু সারাদিন এত ছুটোছুটি করতে হয়েছে তারাপদকে যে সে-সুযোগ তার হয়নি। একটা এক্সপ্রেস গাড়ি ছিল, সেটা শংকরপুরে দাঁড়াত না।

ততক্ষণে দু বন্ধু মিলে সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছে। কামরায় তোক বাড়ছে, দেখতে দেখতে বেশ ভিড় হয়ে গেল। প্লাটফর্মে আরও যাত্রী এসে পৌঁছচ্ছে। তারাপদদের কামরায় এক দঙ্গল বেহারি উঠেছে, দু পাঁচজন বাঙালিও।

এমন সময় এক অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক এসে কামরায় উঠলেন। টিয়াপখির মতন নাক, তোবড়ানো গাল, গর্তে বসা চোখ। চেহারাটি রোগাসোগা, গায়ে সেই আদ্যিকালের অলেস্টার, মাথায় কাশ্মীরি টুপি ডান হাতে একটা সুটকেস ঝুলছে, বাঁ হাতে খয়েরি বালাপোশ । ভদ্রলোক এতই রোগা যে গায়ে অলেস্টার চাপিয়েও তাঁকে মোটা দেখাচ্ছে না। গলায় মোটা মাফলার জড়ানো।

চন্দন ভদ্রলোককে দেখে নিচু গলায় বলল, “ডিসপেপসিয়ার কেস রে তারা, টিপিক্যাল ডিসপেপটিক পেশেন্ট।”

ভদ্রলোক তারাপদদের দিকেই এগিয়ে এলেন। কাছে এসে এমন মুখ করে হাসলেন যেন কতই না চেনা তারাপদর, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে রোজই দেখা হয়।

“কত দূর?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন হাসিমুখে। হাসবার সময় তাঁর। দাঁত দেখা গেল। এবড়োখেবড়ো কালচে দাঁত, পান-খাওয়া দাঁত যেন।

তারাপদ ভদ্রলোককে কোনোদিন দেখেনি। জবাবও দিল না কথার।

ভদ্রলোক কিন্তু নির্বিকার, সুটকেসটা বেঞ্চির তলায় রেখে বালাপোশটা বিছিয়ে নিলেন, তারাপদর চাদর সামান্য গুটিয়ে গেল। তাঁর চেনাচেনা হসি আর কথা : “এই ট্রেনটায় যত ছিঁচকে চোরের উপদ্রব, বুঝলেন মশাই, চোখে পাতা দু দণ্ড বুজেছেন কি পুঁটলি-পাটলা সুটকেস ব্যাগ হাওয়া। ওই দরজার দিকটায় তাই গেলাম না।…ওদিকটায় একটু পরেই দেখবেন কী হয়-ছিলিম চলবে। সে কী দৃর্গন্ধ।! গোয়ালাগুলো ব্যোম ভেলার জাত। গাঁজাই ওদের সর্বনাশ করল। দেখি স্যার, আপনার পা-টা একটু সরান–সুটকেসটাকে প্লেস করে দি আরও একটু সেফ সাইডে।“

চন্দন হেসে ফেলেছিল। সামলে নিল। ভদ্রলোক এবার গোছগাছ সেরে তারাপদর পাশে বসলেন।

গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে আসছিল। প্লাটফরমের কলরব কমে আসছে যেন। তারাপদদের কামরা থেকে কিছু বেহারি লোকজন নেমে গেল।

ভদ্রলোক ততক্ষণে পান-জরদা মুখে পুরেছেন। “আপনারা কদুর যাবেন স্যার?” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন। তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন বলল, “মধুপুর-টধুপুরের দিকে।”

“মধুপুর? কোথায়? কোন দিকটায়?”

“আপনি মধুপুরে থাকেন?”

“না স্যার, আমি অরিজিন্যালি ভাগলপুরের, তারপর থেকেছি জামসেদপুরে, শেষে ইছাপুরেও কিছুদিন ছিলাম, এখন আর কোনো পুরে থাকি না, টুরে টুরে দিন কেটে যায়।”

তারাপদ হেসে ফেলল। চন্দনও।

“আমার স্যার কতকগুলো বদ দোষ আছে,” পান চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক বললেন, “আমি হাসিঠাট্টা করতে ভালবাসি। আমার আপন-পর নেই। ভেরি ফ্র্যাংক…। একটা কথা স্যার আগেই বলে নি, আমার মুখ থেকে হরদম ইংলিশ বেরোয়, নো গ্রামার, কিছু মনে করবেন না। আমার বাবাকে একজন অ্যাংলো ঘুষি মেরে নাক ভেঙে দিয়েছিল, তখন থেকেই আমার ওই ভাষাটার ওপর রাগ। অ্যাংলোরা হাফ ইংলিশ বলে, তাতেই আমার বাবার নাক চলে গেল, ফুল ইংলিশ যারা বলে তাদের ঘুষি খেলে তো আমার বাবার ফেসই পালটে যেত। বলুন ঠিক কি না! আমি তখন থেকে রিভেজ নিতে শুরু করেছি ভাষাটার ওপর, যা মুখে আসে বলব–তুই আমার কাঁচকলা করবি। তোর ভাষা কি আমার মার না বাবার ভাষা!”

তারাপদরা এবার জোরে হেসে উঠল।

গাড়ি ছাড়ল। গাড়ি ছাড়ার সময় যেমন হয়, দু-একজন নেমে পড়ল, ছুটতে ছুটতে কে এজন পা-দানিতে উঠে পড়ল, প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হাত নাড়ছে, একদল দেহাতী গোছের মানুষ ‘গঙ্গা মাই কি জয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।

ধীরে ধীরে গাড়িটা প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই শীতের হাওয়া এসে ঢুকল জানলা দিয়ে।

চন্দন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, এবার ভেতরে মুখ ফেরাল।

চন্দন বলল, “আপনার নামটা কী স্যার?”

“কিঙ্করকিশোর রায়, দেড়গজী নাম স্যার, ছোট করে লোকে বলে কিকিরা দি গ্রেট।“

জোরে হেসে উঠে চন্দন বলল, “আলেকজান্ডার দি গ্রেট-এর পর আর কোনো গ্রেট দেখিনি স্যার, আপনাকে দেখলাম।”

কিকিরা খকখক শব্দ করে হেসে উঠলেন। অদ্ভুত সে শব্দ। তারাপদও হেসে উঠল। ঠাট্টা করে চন্দনকে বলল, “তুই তা হলে আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে দেখেছিস।”

“ছবি দেখেছি”, চন্দন রসিকতা করে বলল।

কিকিরা হাসতে হাসতে বললেন, “এবার জ্যাস্ত দেখুন, লিভিং গ্রেট।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কী করেন?”

কিকিরা অলেস্টারের গলার দিকে বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, “আমার করার কিছু ঠিক নেই, স্যার। কখনো ছুরি-কাঁচির এজেন্ট, কখনো খোস পাঁচড়ার মলমের, কখনো অম্লশূলের ওষুধ বেচে আসি, কখনো আবার অন্য কিছু–যা হাতের কাছে জুটে যায়। আমার নেচারটা অস্থির গোছের। মেজাজে না বলে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। লাস্ট মাস্থে আমি একটা নতুন কোম্পানির স্নো ক্রিম পাউডারের রিপ্রেজেনন্টেটিভ ছিলাম । মালিক বেটা ছ্যাঁচড়া, আমার সঙ্গে বনলো না, ছেড়ে দিলাম। দিয়ে এখন একটা কোম্পানির কাঁচি, খুর, ক্লিপের এজেন্ট হয়ে গিয়েছি। হাওড়ায় কারখানা খুলেছেন ভদ্রলোক বেশ ভাল খুর তৈরি করছে স্যার । আমার সুটকেসে স্যাম্পল আছে। কাল সকালে দেখাব।”

চন্দন হাত নেড়ে বলল, “থাক্ স্যার, খুব আর দেখাবেন না, খুর দেখলেই আমার ভয় করে।”

“ভয়ের কিছু নেই, স্যার। ঠিক মতন টানতে পারলে মাখনের মতন গাল নরম থাকবে। বেকায়দায় টানলে অবশ্য গলা যাবে…” বলে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকিয়ে খখক্ শব্দ করে হাসলেন। তারপর নিজেই বললেন, “সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আমি আসলে ম্যাজিশিয়ান ছিলাম। গণপতিবাবু আমার গুরুর গুরু। আমার সাক্ষাৎ গুরু বড় একটা কলকাতায় আসতেন না। তাঁর ফিল্ড ছিল পাটনা, মজঃফরপুর, জামালপুর; ওদিকে বেনারস, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা–এইসব। আমার গুরু অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা জানতেন। ইন্ডিয়ান ট্রিক বলে তাঁর একটা খেলা ছিল–তাতে তিনি স্টেজের ওপর একটা মেয়ের হাত-পা, মুখ সব আস্তে আস্তে অদৃশ্য করে দিতেন। তারপর আবার একে একে সব জোড়া লাগিয়ে দিতেন।”

চন্দন কৌতূহল বোধ করছিল, “বলেন কী!”

“মিথ্যে বলব না স্যার, গুরুর নামে কেউ মিথ্যে বলে না।” বলে কিকিরা হাত জোড় করে গুরুর উদ্দেশে প্রণাম জানালেন। উঁচুদূরের লোক ছিলেন তিনি। একবার নাইট্রিক অ্যাসিড খাবার খেলা দেখাতে গিয়ে কী একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি মারা গেলেন। আমি পনেরো বছর বয়েস থেকে তাঁর চেলাগিরি করেছি। সাত আট বছর লেগে ছিলাম। আরও পাঁচ সাতটা বছর সঙ্গে থাকতে পারলে দেখতেন–কিকিরা কী না করত! জাপান, আমেরিকা, লন্ডন করে বেড়াতাম । কপাল স্যার, কপাল, ব্যাড লাক…।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “আপনি নিজেও কি ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন?”

“আমরা ম্যাজিকের বংশ স্যার। আমার ফাদারের অলটারনেট ফাদার বিরাট ম্যাজিশিয়ান ছিলেন।”

চন্দন অবাক হয়ে বলল, “ফাদারের অলটারনেট ফাদার কী জিনিস মশাই?”

কিকিরা মজার মুখ করে হেসে বললেন, “বাবার বাবাকে ছেড়ে তাঁর বাবা–-মানে প্রপিতামহ।”

তারাপদ আর চন্দন হেসে গড়িয়ে গেল।

কিকিরা বললেন, “ওটাই তো আমার অরিজিন্যাল ব্যবসা ছিল স্যার, বছর আট দশ কিকিরা ম্যাজিক মাস্টার হয়েছিল; তারপর আমার বাঁ হাতটায় কী যে হল–প্রথমে ব্যথা-ব্যথা করত, দেখতে দেখতে হাত শুকোতে লাগল, জোর একেবারে কমে গেল, সব সময় কাঁপত। হাত না থাকলে ম্যাজিশিয়ান হওয়া। যায় না। ম্যাজিশিয়ানের হাত, চোখ আর মুখ এই তিনটেই হল আসল। “

চন্দন কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কিকিরা তার বাঁ হাতটা দেখালেন। সত্যিই শুকনো মতন দেখতে। আঙুলগুলো বেঁকা বেঁকা, চামড়া কেমন পোড়া পোড়া রঙের। হাতটা কাঁপছিল। কোট থাকার জন্যে কব্জির ওপর দেখা গেল না ।

চন্দন বলল, “আপনি ডাক্তার-টাক্তার দেখাননি?”

“দেখিয়েছি, কত ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি, ইনজেকশান নিয়েছি, কিছু হয়নি। ডাক্তাররা ধরতে পারছে না। কেউ বলছে, নার্ভের রোগ;কেউ বলছে কোনো বিষাক্ত জিনিস থেকে হয়েছে, কেউ আবার অন্য কিছু বলছে–।”

তারাপদ চন্দনকে দেখিয়ে কিকিরাকে বলল, “ও হল ডাক্তার।“

চন্দন যেন সামান্য লজ্জা পেল। বলল, “না না, এখনো পুরো ডাক্তার হইনি, সবে পাশ করেছি।”

তারাপদ রগড় করে বলল, “চন্দন এখনও দশ বিশটা কেন, একটাও মানুষ মারেনি। কাঁচা হাত। দু-চার বছর আরও যাক তারপর ডাক্তার হবে।”

তিনজনেই হেসে উঠল।

হাসি-ঠাট্টার কথা বলতে বলতে রাত বাড়তে লাগল। গাড়ি মাঝে মাঝে থামছে, আবার চলছে। শীতের জন্যে জানলা সব বন্ধ। কামরার লোকজন কথাবার্তা বলতে বলতে ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। দু-একজন ঘুমিয়েও পড়েছে। কিকিরা ততক্ষণে তারাপদদের নামধাম জেনে গিয়েছেন। শুধু জানতে পারেননি তারাপদরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। ওরা সেই যে বলেছিল মধুপুর-ধুপুর, তার বেশি আর কিছু বলেনি।

বর্ধমানের পর গোটা কামরাটাই যেন ঘুমিয়ে পড়ল।

তারাপদর ঘুম পাচ্ছিল। হাই উঠছিল তার।

হাই তুলতে তুলতে চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি তো একজন এক্স-ম্যাজিশিয়ান আচ্ছা এই যে লোকে মন্ত্রটন্ত্রর কথা বলে, আপনি ওসব বিশ্বাস করেন?

মাথা নাড়লেন কিকিরা, “না, ম্যাজিক হল খেলা, তার সঙ্গে মন্ত্রটন্ত্রর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমি হিপ্নোটিজম, মেসম্যারিজম্ এ-সব বিশ্বাস করি । নিজে করেছি একসময়। আমাদের দেশে অনেকে যোগ অভ্যাস করে অনেকে কিছু করতে পারেন। আমার গুরু মাটির তলায় চাপা দেওয়া অবস্থায় দু-তিন ঘণ্টা থাকতে পারতেন।”

তারাপদ আর বসে থাকতে পারছিল না, বড় ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হতে হতে বলল, “আপনার দু-চারটে ম্যাজিক কাল সকালে উঠে দেখব।”

কিকিরা তারাপদকে দেখতে দেখতে হেসে বললেন, “কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, না এখনই দেখবেন?”

“এখন?”

কিকিরা যেন মজা করছেন এমন চোখমুখ করে বললেন, “একটা স্যাম্পল দেখিয়ে দিই, কী বলেন?” বলে কয়েক পলকের জন্যে চোখ বুজলেন, তারপর বললেন, “আপনি আপনারা মধুপুর যাচ্ছেন না। কোথায় যাচ্ছেন জানি না–তবে মধুপুর নয়, এমন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন যার নামের প্রথমে ‘এস্‌’ অক্ষর আছে। রাইট? যার কাছে যাচ্ছেন তার নামের প্রথমে ‘বি’ অক্ষর থাকবে। রাইট?”

তারাপদ যেন চমকে উঠল। চন্দনও। দুজনেই হতভম্ব; অপলকে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল, নিশ্বাস নিতেই যেন ভুলে গেছে ।

শেষে তারাপদ বলল, “আপনি–আপনি কে?”

কিকিরা খক খক্ করে বিচিত্র হাসি হেসে বললেন, “আমি কিকিরা দি গ্রেট, কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান।”

তারাপদ মাথায় পাশে তার কিট ব্যাগের দিকে তাকাল। ওই ব্যাগের মধ্যে ভুজঙ্গভূষণকে দেবার জন্যে সিলমোহর করা চিঠি আর প্যাকেট আছে একটা। খুব দরকারি জিনিস। মৃণাল দত্ত বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। ও দুটো যদি খোয়া যায় সর্বনাশ হবে। তারাপদ যেজন্য শংকরপুর যাচ্ছে তা ব্যর্থ হবে। এই কিকিরা লোকটা কি সেটা জানে? সে কি সমস্ত জেনেশুনে তারাপদদের পিছু ধরেছে? লোকটার উদ্দেশ্য কী? কোন মতলব নিয়ে সে তাদের সঙ্গী হয়েছে?

তারাপদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চন্দনও বিচলিত, বিমূঢ়।

.

চার

অনেকক্ষণ আর কেউ কোনো কথা বলল না। তারাপদ ভাল করে আর কিকিরার দিকে তাকাচ্ছিল না, তার সাহস নেই তাকাবার। ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে। লোকটাকে। মুখে যতই হাসি থাক, মজার মজার কথা বলুক–তবু কিকিরা যে বড় রকমের ঘুঘু তাতে সন্দেহ কী।

আড়চোখে তাকিয়ে তারাপদ চন্দনকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। তার মুখের ভাব, চোখের সাবধানী দৃষ্টি বলছিল : চাঁদু, বি কেয়ারফুল; লোকটা ঘুঘু ।

চন্দন নিজেও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। কিকিরা যত বড় ম্যাজিশিয়ানই হোক, ওরা কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে–এটা মুখ দেখে ঠাহর করতে কিছুতেই পারে না। অসম্ভব। থট রিডিং না কী যেন বলে একটা–কিকিরা কি সেই মনের কথা জানতে পারার খেলা দেখাল? বোগা। চন্দন ওসব বিশ্বাস করে না। তবে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, কিকিরা প্রচণ্ড ধূর্ত। সে কেমন কায়দা করে পুরো শংকরপুর, কিংবা সোজাসুজি ভুজঙ্গভূষণ না বলে রহস্যময় ভাবে বলল, প্রথমটা অক্ষর ‘এস’ আর ‘বি’। ও যে সবই জানে তাতে চন্দনের সন্দেহ হচ্ছিল না। অন্তত, কিকিরা নিশ্চয় জানে চন্দনরা শংকরপুরে যাচ্ছে, ভুজঙ্গভূষণের কাছে।

চন্দন চোখে চোখে তারাপদকে বোঝাবার চেষ্টা করল : সবই বুঝতে পারছি। সাবধান হতে হবে।

কিকিরা কিন্তু একই রকম হাসিমুখে তারাপদদের দেখছিলেন। বরং তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, কিকিরা এরকম একটা খেলা দেখাবার পর যেন তারাপদদের হাততালি আশা করেছিলেন, না পেয়ে একটু দুঃখবোধ করছেন।

চন্দন মনে মনে ভেবে দেখল, আর বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকা উচিত নয়। ওরা ভয় পেয়েছে কিকিরা সেটা বুঝে ফেলবে। বার দুই শুকনো কাশি কেশে তারাপদকে বলল, “অনেক রাত হয়ে গেল: তুই শুয়ে পড়। আমি জেগে আছি। ট্রেনে আমার ঘুম হয় না। “

তারাপদ ঘুমোবে কি, ঘুম তার মাথায় উঠে গেছে।

কিকিরাই যেন কী মনে করে বললেন, “বাস্তবিক স্যার, রাত হয়ে গেছে অনেক, বারোটায় বর্ধমান পেরিয়ে পেরিয়ে এসেছি। তা ধরুন এখন সাড়ে বাররা। শীতটাও জব্বর। এবার শোবার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে একজনের জেগে থাকা উচিত, নয়ত এ-গাড়িতে যা চোরের উৎপাত, গা থেকে জামাকাপড়ও খুলে নিয়ে যায়।”

চন্দন একটু ঠাট্টার ছলেই বলল, “আপনার নিশ্চয় অম্বলের রোগ আছে, বয়েসও হয়েছে, আপনি শুয়ে পড়ন–আমি জেগে আছি।”

কিকিরা বললেন, “ঠিক ধরেছেন স্যার, আমার জুস বেশি হয়, রাত জাগলে বোতলের সোডার মতন হয়ে যায় পেট বুক। সে কী কষ্ট! যাকগে, আমি একবার বাথরুম ঘুরে এসে শুয়ে পড়ি, কী বলেন?”

বালাপোশটা হাত দিয়ে আবার একটু ঝেড়েঝুড়ে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন, বাথরুমে যাবেন।

তারাপদ যেন এই সুযোগের অপেক্ষা করছিল।

কিকিরা ওপাশে বাথরুমের দিকে যেতেই নিচু গলায় তারাপদ বলল, “চাঁদু, লোকটা ঘোড়েল। ওর কোনো মতলব আছে।”

চন্দন বলল, “আমিও তাই ভাবছি। ম্যাজিক-ফ্যাজিক বাজে কথা।”

“কিকিরা কি আমাদের ফলো করছে?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।”

“তাই তো মনে হয়। কিন্তু কেন?”

তারাপদ দূরে বাথরুমের দিকে তাকাল। কিকিরা দরজা খুলে ঢুকে গেলেন।

তারাপদ বলল, “আমার ভুজঙ্গভূষণের নামে একটা সিল করা প্যাকেট, চিঠিঠি আছে, মৃণাল দত্ত দিয়েছেন। ওগুলো যতক্ষণ না ভুজঙ্গভূষণের হাতে দিতে পারছি ততক্ষণ আমার কোনো ক্লেম হচ্ছে না সম্পত্তির ওপর। “

“তা জানি,” চন্দন মাথা নাড়ল।” কিকিরা কি ওটা হাতাবার জন্যে এসেছে? তাতে ওর লাভ কী হবে? কিকিরা তো তারাপদ নয় যে, ওগুলো হাতিয়ে ভুজঙ্গভূষণের কাছে হাজির হলেই দেড় দুই লাখ টাকার সম্পত্তি পেয়ে যাবে। তা ছাড়া ওর মধ্যে কী আছে তাও তো আমরা জানি না।”

তারাপদ চিন্তায় পড়ে কেমন বিমর্ষ হয়ে আসছিল। বলল, “আমিও তো তাই ভাবছি।..আচ্ছা, তোর কি মনে হয়, কিকিরা মৃণাল দত্তর লোকর?”

“মানে?”

“মৃণাল দত্ত ওকে পাঠাননি তো? উনি ছাড়া আর তো কেউ জানে না আমরা শংকরপুরে ভুজঙ্গভূষণের কাছে যাচ্ছি।”

চন্দন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবল। বলল, “তা ঠিক। তুই যখন সকালে মৃণাল দত্তর বাড়ি গিয়েছিলি তখন কাউকে দেখেছিস?”

“না”, মাথা নাড়ল তারাপদ।

“ঘরে কেউ ছিল না?”

“কালকের সেই বুড়োমতন লোকটি দু একবার এসেছিল।”

“তার চোখের সামনেই মৃণাল দত্ত তোকে এই এই সব দিয়েছেন?”

“হ্যাঁ।”

“গাড়ির কথা কিছু বলেছেন?”

“বলেছেন, রাত্রে দুটো গাড়ি আছে, একত্সপ্রেস শংকরপুরে থামে না।”

চন্দন কিছুই বুঝতে পারল না। মৃণাল দত্ত নিজেই তাঁর মক্কেলের জন্যে তারাপদর খোঁজ করছিলেন, তিনি যেচে তারাপদকে ভুজঙ্গভূষণের কাছে। পাঠাচ্ছেন, এটা তাঁর কর্তব্য। তবে কেন তিনি পেছনে লোক লাগাবেন? তা হলে কি ওই বুড়ো লোকটা, মৃণাল দত্তর বাড়ির কাজের লোকটা, আসলে অন্য কারও হাতের পুতুল। তাই যদি হয়, তবে ধরে নিতে হবে, ভুজঙ্গভূষণের সম্পত্তি যাতে তারাপদর হাতে না যায় সেজন্যে ফন্দি আঁটার লোক আছে। তারাই কিকিরাকে লাগিয়েছে। কিন্তু এ-সব ভাবনা কি বাড়াবাড়ি নয়। কার গরজ তারাপদকে বঞ্চিত করার। তেমন কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না ।

চন্দন বলল, “আমি ভাই কিছু বুঝতে পারছি না। এভরিথিং ইজ মিস্টিরিয়াস। ভুজঙ্গভূষণ, মৃণাল দত্ত, কালো বেড়াল, কিকিরা–সবই কেমন গোলমেলে।”

তারাপদ ম্লান মুখ করে বলল, “আমারও মাথায় কিছু ঢুকছে না। লাভের মধ্যে ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে গেল। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি ব্যাপারটাই ঝাটের। বেশ ছিলুম, এখন কী প্যাঁচেই পড়লাম।”

কিকিরাকে আবার দেখা গেল।

চন্দন নিচু গলায় বলল, “যাই হোক–তুই ঘাবড়াবি না, তারা। ওই লোকটার কাছে একেবারেই নার্ভাসনেস দেখাবি না। ওর সামনে তুইও শুয়ে পড়।”

“আমার ঘুম হবে না।”

“না হোক, তবু তুই শুয়ে পড়বি। ঘুমোবার ভান করবি। আমি জেগে থাকব। হাসপাতালের ডিউটিতে আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে।”

“তুই একলা কতক্ষণ জাগবি?”.

“সারা রাত। কিকিরাকে আমি নজর রাখব।”

তারাপদর হঠাৎ মনে পড়ল, কিকিরা বলেছে, তার সুটকেসে নাকি খুরটুর আছে। স্যাম্পল দেখাবে বলেছিল। লোকটা কত বড় শয়তান। সুটকেসে করে খুর এনেছে। গলা কাটবে নাকি? খুন?

তারাপদ ভয়ে ভয়ে বেঞ্চির তলার দিকে তাকাল, কিকিরার সুটকেস দেখবার চেষ্টা করল। তারপর অস্ফুটভাবে চন্দনকে বলল, “কিকিরার কাছে খুর আছে–।”

কিকিরা ততক্ষণে একেবারে কাছে এসে পড়েছেন।

চন্দন আবার একটা সিগারেট ধরাল। যেন কিছুই হয়নি।

তারাপদ তখনও বসে।

কিকিরা বললেন, “জমজম করে শীত পড়ছে। পানাগড় দুর্গাপুর কাছেই বোধ হয়। আরও জব্বর ঠাণ্ডা পড়বে স্যার, একেবারে আর্লি মর্নিংয়ে আসানসোল, তারপর শীতের বহরটা দেখবেন, লাইক্ ক্যাটস অ্যান্ড ডগস্।”

চন্দন ব্যঙ্গ করে বলল, “ওটা বৃষ্টির বেলায় স্যার, শীতের বেলায় নয়।”

কিকিরা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খখকে হাসি হেসে বললেন, “একই হল স্যার, বৃষ্টির বেলায় যদি বেড়াল কুকুর পড়তে পারে শীতের বেলায় কেন পড়বে না। ইংরিজি ভাষার কোনো নিয়ম নেই, যা পড়াবেন তাই পড়বে।”

কথা বলতে বলতে কিকিরা তাঁর সেই বেখাপ্পা অলেস্টার খুলে পাট করে বালিশের মতন করে নিলেন। টুপি আগেই খুলেছিলেন, মাফলারটা পাগড়ির মতন করে কানে বাঁধলেন, জুতো খুললেন।

চন্দন ইশারায় তারাপদকেও শুয়ে পড়তে বলল।

কিকিরা পাট করা অলেস্টারের ওপর মাথা রেখে বালাপোশ গায়ে টেনে শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন, “স্যার, একটু সাবধানে থাকবেন। চোখের পাতাটি বুজেছেন কি সর্বনাশ হয়ে যাবে।…আচ্ছা, শুয়ে পড়ি। আসানসোলে আমায় ডেকে দেবেন। চা খাব।”

কিকিরা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন। তারাপদও যেন বাধ্য হয়ে শুয়ে পড়ল।

কামরার মধ্যেটা একেবারেই চুপচাপ। কেউ কেউ বেঞ্চের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, কেউ কেউ বাংকের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে, পুঁটলি পাকানো চেহারা করে বসে বসেই ঘুমোচ্ছে দু-চার জন। মাঝে মাঝে কাশির শব্দ, এক-আধটা ঘুম-জড়ানো কথা, ট্রেনের একঘেয়ে শব্দ–সব মিলিয়ে কেমন একটা নিঝুম আবহাওয়া।

একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি থেমে আবার চলতে শুরু করল চন্দন বড় বড় হাই তুলছিল।

কিকিরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তারাপদ অনেকক্ষণ মটকা মেরে পড়েছিল। সারাদিনের ক্লান্তি যেন কখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

চন্দন নানারকম কথা ভাবছিল। কিকিরা লোকটা কি সত্যিই চালাক? তার ভাঁড়ামির খানিকটা হয়ত অভিনয়, কিন্তু চালাকির ব্যাপারটা অভিনয় করে দেখানো যায় না। কিকিরা যদি চালাকই হবে তাহলে সে কেন অযথা প্রথমেই চন্দনদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে গেল? যে-লোক জানে চন্দনরা শংকরপুরে ভুজঙ্গভূষণের কাছে যাচ্ছে সেই লোক কেন আগেভাগে তা প্রকাশ করে দেবে? বরং সে চুপচাপ থাকবে, ঘুণাক্ষরেও জানতে দেবে না তারাপদদের ব্যাপারটা সে ছিটেফোঁটাও জানে। তারপর সবাই যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে, কিকিরা তারাপদর কিট ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়বে যে কোনো স্টেশনে। এই গাড়িটা এমনই যে, যখন তখন নেমে পড়া যায়, অনরবত থামছে, চলছে, আবার থামছে।

কিকিরা বোকামি করেছে। হয় বোকামি করেছে, না হয় জেনেশুনে ইচ্ছে করেই সতর্ক করে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, তারাপদদের ব্যাপার সে জানে । কিন্তু কেন কিকিরা সতর্ক করে দেবে? চোর কি বাড়ির লোককে সাবধান করে দিয়ে চুরি করে? তবে?

চন্দন যতই ভাবছিল ততই তার মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল । শুরু থেকেই যার মধ্যে এত রহস্য আর ঝামেলা–শেষে গিয়ে তার মধ্যে যে আরও কত গভীর রহস্য দেখা যাবে কে জানে।

.

গায়ে হাত পড়তেই চন্দন ধড়মড় করে উঠে বসল ।

মুখের সামনে কিকিরা। চন্দন তারাপদকে দেখে নিল। ঘুমোচ্ছে। তারাপদ।

“আপনি স্যার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন”, কিকিরা বললেন, এমনভাবে বললেন। যেন কতই না সহানুভূতি দেখাচ্ছেন।”

চন্দন বলল, “হ্যাঁ, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে তার লজ্জা এবং রাগ হচ্ছিল।

“অনেকক্ষণ থেকেই ঘুমোচ্ছেন,” কিকিরা হাসি হাসি মুখ করলেন। চন্দন তাড়াতাড়ি হাতের ঘড়ি দেখল। সর্বনাশ, সাড়ে তিনটে বাজে। সে যখন শেষবার ঘড়ি দেখে তখন দুটো বাজছিল। টানা দেড় ঘণ্টা সে ঘুমিয়ে থাকল। আশ্চর্য। হাসপাতালে কখনও এ-রকম হয় না। রাত্রের গাড়িটাড়ির এই দোষ, যাত্রীদের ঘুম, ঢুলুনি, গাড়ির দোলানি, একঘেয়ে শব্দ, ট্রেন থামা আর যাওয়া, হলুদ হলুদ আলো, সব মিলেমিশে কেমন ঘুম এনে দেয়। ছোঁয়াচে রোগের মতন ব্যাপারটা।

চন্দন কিকিরাকে সন্দেহের চোখে দেখল। “আপনি কি জেগেছিলেন?”

“আমার ঘুম স্যার খুব পাতলা, একটু খুসখস শব্দ হলেই জেগে উঠি। রাতের গাড়িতে চলাফেরা করতে করতে এই অভ্যেস হয়ে গেছে ।”

চন্দন হাই তুলল। চোখ যেন এখনও জুড়ে রয়েছে।

“আপনি অনেকক্ষণ থেকে জেগে বসে আছেন?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“অনেকক্ষণ। বসে নয়, শুয়ে ছিলাম।”

হঠাৎ চন্দনের কেমন যেন মনে হল, মনে হতেই চমকে উঠল। আরে–কিকিরা এর মধ্যে কোনো হাত সাফাই করেনি তো? তারাপদর কিটু ব্যাগে মৃণাল দত্তর দেওয়া সেই কাগজপত্তর ঠিকঠাক আছে? না কিকিরা চুরি করে নিয়েছে?

কথাটা মনে হতেই চন্দনের বুক ধকধক করে উঠল, ভয় যেন লাফ মেরে। গলার কাছে এসে বসল। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে সে তারাপদকে ঠেলা দিল।“তারা, এই তারা–”

বলিহারি ঘুম তারাপদর। মরার মতন ঘুমোচ্ছে ।

“ওঁকে আবার কেন অযথা জাগাচ্ছেন, স্যার?” কিকিরা বলল।

“দরকার আছে,” চন্দন রুক্ষভাবে জবাব দিল।

বার কয়েক ঠেলা খেয়ে তারাপদ উঠে বসল। উঠে বসে চোখ রগড়াতে লাগল। যেন তার খেয়ালই নেই সে বাড়িতে বিছানায়, না রেলগাড়িতে। কয়েক মুহূর্ত পরে তারাপদ হুঁশ ফিরে পেল।

চন্দন রেগে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য ঘুম তোর!”

তারাপদ লজ্জিত হয়ে বলল, “কাল সারাদিন যা ধকল গেছে–পারছিলাম না।”

“এদিকে যে—” বলতে গিয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল চন্দন, আড়চোখে কিকিরাকে দেখে নিল। তারপর ইঙ্গিতে বলল, ‘আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলে কিকিরাকে দেখাল, “উনি জেগে ছিলেন।”

তারাপদ হয় ইঙ্গিতটা বুঝল না, না হয় তার মাথা মোটা। সে তখনো হাই তুলছে।

বিরক্ত হয়ে চন্দন আবার বলল, “এই ট্রেনে ছিঁচকে চোরের যা উপদ্রব । দেখে নে আমাদের জিনিসপত্র ঠিক আছে কিনা?”

তারাপদ এবার বুঝতে পারল। তার মুখের অদ্ভুত এক চেহারা হল ।

কিকিরা বললেন, “না না, এদিকে কেউ আসেনি। আমার ঘুম ভেরি ভেরি ভেরি থিন, গায়ের পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই ঘুম ভেঙে যায়।”

চন্দন তারাপদকে হুকুমের ভঙ্গিতে বলল, “তা হলেও একবার দেখে নে।“

তারাপদ কিব্যাগ-টিটব্যাগ দেখল।

“তোর ব্যাগের মধ্যে আমার একটা সিগারেটের প্যাকেট রেখেছিলাম–দেখ তো আছে কি না?” একবারে ডাহা মিথ্যে কথা চন্দনের! সে চাইছিল, ব্যাগ খুলে তারাপদ একবার আসল জিনিসটা আছে কিনা দেখে নিক।

তারাপদ কোলের ওপর ব্যাগ তুলে চেন খুলল। দেখল। হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঘাঁটল। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মৃণাল দত্তর দেওয়া জিনিসগুলো ঠিকই রয়েছে।

তারাপদ কায়দা করে বলল, “আছে।…তুই এখন আমার সিগারেট নে। নতুন প্যাকেট পড়ে ভাঙবি।”

চন্দন নিশ্চিন্ত হল। বাব্বা, যা ভয় ধরে গিয়েছিল তার।

কিকিরা সমস্ত ব্যাপারটাই স্বাভাবিকভাবে দেখছিলেন। এবার বললেন, “আমায় একটা সিগারেট খাওয়ান, স্যার; যা শীত…।”

চন্দন তারাপদর প্যাকেট থেকে কিকিরাকে সিগারেট দিল। নিজেও ধরাল।

বালাপোশ গায়ে জড়িয়ে বসে সিগারেট খেতে খেতে কিকিরা খখক্ করে কাশছিলেন। বললেন, “সিগারেটের নেশা আমার নেই, একটা দুটো খাই কখনো।”

গাড়িটা যেন কোনো ইয়ার্ডে ঢুকল । লাইন বদলের শব্দ হচ্ছে। এক একবার বাঁয়ে টাল খাচ্ছে, আবার যেন ডাইনে টাল খেল।

কিকিরা বললেন, “অন্ডাল এসে গেল । আর খানিকটা পরে আসানসোল। সোয়া চারটে নাগাদ আসানসোল পৌঁছোয়।”

“আপনি এদিকে খুব যাতায়াত করেন?” চন্দন জিজ্ঞেস করল ।

“প্রায়ই।”

“সবই আপনার চেনা।”

“তা বলতে পারেন।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “যশিডিতে থাকবেন এখন?”

“যশিডিতে নয়, দেওঘরে যাচ্ছি…। ওখানে আমার ফিল্ড আছে।”

“কী?”

“ফিল্ড স্যার, মানে চেনাজানা আছে, কাস্টমার রয়েছে।”

চন্দন মনে মনে একটা প্যাঁচ ভাবছিল। দাবা খেলার চালের মতন একটা মোক্ষম চাল দিলে কেমন হয়? কিকিরা কি সামলাতে পারবে? হয়ত কিকিরা আরও পাকা খেলোয়াড়, চন্দনকে বসিয়ে দেবে। তবু একটা ঝুঁকি নিতে আপত্তি কী? এখনও যাত্রা শেষ হয়নি চন্দনদের, আরও পাঁচ ছ ঘণ্টার বেশি ট্রেনে থাকতে হবে। কিকিরার যদি কোনো মতলব থাকে, এর মধ্যে হাসিল করবে কি না কেউ বলতে পারে না। তবে এখন পর্যন্ত করেনি। সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে। যদি তারাপদর ব্যাগ নিয়ে কিকিরা কোথাও নেমে যেত মাঝপথে, চন্দনরা জানতেও পারত না। লোকটাকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করার চেয়ে একটু বিশ্বাস করা যাক না, ক্ষতি কী!

চন্দন আরও খানিকক্ষণ ভেবে শেষে বলল, “স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“নিশ্চয় নিশ্চয়, একশোটা কথা জিজ্ঞেস করুন।”

“আপনি যে বললেন, আমরা মধুপুরে যাচ্ছি না–এটা কী করে বললেন?”

কিকিরা অদ্ভুত মুখ করে হাসলেন, “ম্যাজিক।”

“ম্যাজিক দেখতে আমাদের ভাল লাগে, কিন্তু তা বিশ্বাস করি না।”

“ভাল ম্যাজিক আপনারা দেখেননি স্যার, তাই বলছেন–” কিকিরা বললেন। একটু চুপ করে থেকে আবর বললেন, “আপনারা ছেলেমানুষ, অনেক কিছুই জানেন না, দেখেননি। যখন দেখবেন, জানবেন,–তখন বিশ্বাস করবেন।”

“তা বলে এই থট রিডিং না কী যেন বলে, তাও বিশ্বাস করতে হবে? আপনি নিজেই তখন বলছিলেন, ম্যাজিক হল খেলা, মন্ত্রট বাজে–।”

“বলেছি,” কিকিরা ঘাড় হেলালেন, “এখনও বলছি, মন্ত্রটন্ত্র বাজে। তবে যোগীদের আমি বিশ্বাস করি। তাঁরা আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারেন। মাটি চাপা হয়ে তিন ঘণ্টা কী করে মানুষ থাকতে পারে স্যার, আপনি তো ডাক্তার, বলুন না?”

চন্দন কোনো জবাব দিল না। কিকিরাকে এখন আর ভাঁড় মনে হচ্ছে না। তার গলার স্বরও যেন পালটে গিয়েছে।

তারাপদ লল, “আপনি কি যোগী?”

“না, না”, কিকিরা মাথা নেড়ে জিব কাটল, “যোগের য পর্যন্ত আমি জানি না। ওসব মহাপুরুষরা পারেন, আমরা কত তুচ্ছ।”

“তা হলে আপনি কী করে জানলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি?”

কিকিরা খুব বিনয় করেই যেন বললেন, “একথাটা ঠিক হল না স্যার, আমি শুধু বলেছি, আপনারা যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গাটার নামের প্রথমে ‘এস’ অক্ষর আছে। যার কাছে যাচ্ছেন তাঁর নামের প্রথমে ‘বি’ অক্ষর আছে তা আপনারা তো ‘এন’ অক্ষর দিয়ে নামের কত জায়গাতেই যেতে পারেন, সীতারামপুর, সালানপুর, শিমুলতলা আর যার কাছে যাচ্ছেন তাঁর নাম বিহারীপ্রসাদ, বিজনকুমার, বটুকচন্দ্রও হতে পারে…”

চন্দন বুঝতে পারল, কিকিরা পাকা লোক, সহজে মচকাবে না। বলল, “হতে সবই পারে, কিন্তু আপনি জানেন আমরা কোথায় যাচ্ছি। জানেন না?”

কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে চেয়ে থাকলেন।

চন্দন আর তারাপদ তাকিয়ে থাকল, অপেক্ষা করতে লাগল।

কিকিরা কোনো কথাই বলছিলেন না।

“কিছু বলছেন না?”

“কী বলব স্যার!”

“আপনি সত্যি সত্যিই কিছু জানেন না?”

কিকিরা এবার একবার তারাপদর দিকে তাকালেন। চোখ বন্ধ করলেন। আবার খুললেন। তাঁর হাসি-হাসি মুখ মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর, করুণ হয়ে উঠল, গলার স্বর ভারী শোনাল। বললেন, “একটা কথা আপনাদের আমি বলে দিই। আপনারা ছেলেমানুষ। যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গা কিন্তু ভয়ংকর। আপনারা ভয় পেয়ে যাবেন, বিপদেও পড়তে পারেন। চোখ কান খোলা রাখবেন। কোনো ভেলকি বিশ্বাস করবেন না। ওই লোকটা যোগী নয়–শয়তান, পিশাচ। তার চেহারা দেখলে আপনাদের বুক কাঁপবে। অনেক মানুষের জীবন সে নষ্ট করেছে। ও একটা কাপালিক। কী নিষ্ঠুর জানেন না। এত বড় শয়তান কেমন করে বেঁচে আছে–আমি জানি না। ভগবান এত লোককে নেন, ওই পিশাচকে কেন নেন না?” বলতে বলতে কিকিরার মুখ কেমন রক্তজমার মতন নীলচে হয়ে এল। তিনি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন।

তারাপদ আর চন্দন যেন স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকল। কোনো কথা বলতে পারল না।

কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায়, জড়ানো স্বরে তারাপদ বলল, “সামনের অমাবস্যায় নাকি তিনি মারা যাবেন?”

কিকিরা বললেন, “তাই যেন যায়।…এত পাপ করেও মানুষ যদি বেঁচে থাকে তবে ভগবান বলে কিছু নেই।”

চন্দনরা অবাক হয়ে দেখল, কিকিরার গলা ফুলে উঠেছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।

.

পাঁচ

শংকরপুর গাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সামান্য বেলা হয়ে গেল। মধুপুরে মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেন, কিসের একটা গণ্ডগোল হয়েছিল ইঞ্জিনে। শংকরপুরে পৌঁছতে হরেদরে আধ ঘণ্টা লেট।

কিটব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে তারাপদরা প্লাটফর্মে নেমে পড়ল। ছোটখাট স্টেশন, তেমন একটা লোকজন ওঠানামা করল না। যারা নামল বা গাড়িতে উঠল, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই দেহাতী মানুষজন।

প্লাটফর্মে নেমে তারাপদরা কিকিরার জানলার দিকে সরে এল । চন্দন বলল, “আপনিও নেমে গেলে পারতেন।”

কিকিরা মাথা নেড়ে বললেন, “না স্যার, এখন আমার নামা চলবে না। এখানে আমাকে দু-চারজন চেনে। আপনাদের সঙ্গে নামলে চোখে পড়ে যেতে পারি।”

তারাপদ বলল, “চোখে পড়লে কী হবে?”

“কী হবে তা কেমন করে বলব। সাবধানের মার নেই। আপনারা ভাববেন না; আমি যশিডির কাজকর্ম সেরে বিকেলের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এখানে ফিরে আসব। যা বলে দিয়েছি মনে রাখবেন, স্টেশনের পুব দিকে বালিয়াড়ির মতন জায়গাটার কাছে হরিরামের আস্তানা। ওখানে আমায় পাবেন। কাল দেখা করার চেষ্টা করবেন। যান স্যার, আর দাঁড়াবেন না। খুব সাবধানে থাকবেন, চোখ কান খোলা রেখে। ভয় পাবেন না। “

তারাপদরা দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ দেখল না আর। গাড়িও ছাড়ল ছাড়ব করছে। হুইল বেজে গেছে। ইঞ্জিনের দিকেও স্টিম ছাড়ার শব্দ উঠছে।

চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন আমরা ভুল বুঝেছিলাম। বুঝতেই তো পারছেন–”

কিকিরা চন্দনের কথায় বাধা দিয়ে বললেন, “কিছু না, কিচ্ছু না স্যার, ক্ষমা-টমার দরকার নেই। আমি আপনাদের পেছনে আছি। আমার যতটা সাধ্য করব।”

ট্রেন ছেড়ে দিল। কিকিরা কেমন হাসি-হাসি অথচ মায়া-মাখানো মুখ করে তারাপদর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

তারাপদ একটু হাত ওঠাল, যেন বিদায় জানাল কিকিরাকে ।

প্লাটফর্ম ততক্ষণে ফাঁকাই হয়ে এসেছে । দুই বন্ধু মিলে হাঁটতে লাগল।

টিকিট কালেক্টারকে টিকিট দিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। পাঁচ-সাতটা ছোট ছোট দোকান, এক ফালি রেল কোয়াটার, মস্ত মস্ত ক’টা শিমুলগাছ ছাড়া আশেপাশে আর কিছু চোখে পড়ে না। পানের দোকান, দেহাতী মিঠাইয়ের দোকান। একপাশে কয়েকটা বুড়বুড়ি গোছের লোক ছোট-ছোট ঝুড়ি করে বেগুন, কাঁচা টমাটো, অল্প ক’টা ফুলকপি বিক্রি করছে। খদ্দের বলতে রেলের বাবু আর খালাসি গোছের লোক। একদিকে ছোট এক হনুমান-মন্দির, বাঁশের আগায় পতাকা উড়ছে।

তারাপদ বলল, “চাঁদু, নো রিকশা? নাথিং?”

চন্দন বলল, “কিকিরা তো বলেই দিয়েছিলেন হাঁটতে হবে।“

“তা হলে নে, হাঁট।”

চারদিক তাকিয়ে চন্দন বলল, “ওদিকে একটা মারোয়াড়ি দোকান দেখছি। চল, আগে সিগারেট-ফিগারেট কিনে নিই। ভুজঙ্গভূষণের মাঠ-মোকামের কথাও জেনে নেব।”

জায়গাটা এই রকম যে, তারাপদ আর চন্দনের মতন দুটি বাঙালি ছেলে কাঁধে কিট ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমেছে, হাতে কম্বল ঝোলানো–এই দৃশ্যটাই যেন অনেকের কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সকলেই তাদের নজর করছিল। কালো জোয়ান গোছের একটা লোক সাইকেল কোমরের কাছে হেলিয়ে দেহাতী মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ময়লা কাঁচের গ্লাসে চা খাচ্ছিল। লোকটার চেহারা ষণ্ডার মতন, মাথা নেড়া, পরনে নীল একটা প্যান্ট, গায়ে কালো রঙের সোয়েটার।

চন্দন এবং তারাপদ দুজনেই তাকে দেখল।

তারাপদ ইশারা করে চন্দনকে বলল, “ভুজঙ্গভূষণের লোক নাকি রে?”

চন্দন বলল, “ড্রেস থেকে রেলের লোক মনে হচ্ছে। মালগাড়ির ড্রাইভার হতে পারে।”

“বেটা আমাদের অমন করে দেখছে কেন?”

“দেখুক। তাকাস না। ইগনোর করে যা।”

সামান্য এগিয়ে চন্দনরা মারোয়াড়ির দোকানটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।

দোকানটা দেখতে বড় নয়, কিন্তু হরেক রকম জিনিস রয়েছে। মুদির দোকান খানিকটা, খানিকটা মনিহারী। কবিরাজী তেল আর ভাস্কর লবণ ধরনের করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

সস্তা সিগারেট পাওয়া গেল। কয়েক প্যাকেট কিনে নিল চন্দন।

তারাপদ মাঠ-মোকামের কথাটা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল । কিকিরা যদিও বলে দিয়েছিলেন রাস্তাটা, তবু তারাপদ জিজ্ঞেস করল । নতুন জায়গায় কিছু খুঁজে বের করতে হলে একজনের জায়গায় দুজন কি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

দোকানের ছোকরামতন লোকটি মাঠ-মোকামের যাবার রাস্তাটা বলে দিলেও দোকানের বাইরে যে বুড়োমতন লোকটি টিনের চেয়ারে বসে ছিল, সে কেমন কৌতূহলের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাঙলায় হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করল, “কাঁহা যাবেন?

তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি।“

লোকটা অবাক হলেও নিজেকে যেন সামলে নিতে নিতে বলল, “ভুজঅংগ মহারাজজি? আচ্ছা আচ্ছা । যাইয়ে…।”

দোকানের বাইরে এসে তারাপদরা একটা নিমগাছের পাশ দিয়ে পাথরফেলা রাস্তাটা ধরল। সামান্য এগিয়ে চড়াই। চড়াইয়ের কাছে পৌঁছতেই ডান দিকে গ্রাম চোখে পড়ল। ছোট গ্রাম। কয়েকটা মাত্র ঘর। হরিরামের আস্তানা দেখা গেল না, টিলাটা চোখে পড়ল গ্রামের কাছাকাছি। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আস্তানাটা বোধ হয় আড়াল পড়েছে। বাঁ দিকেও দু-একটা পাকা বাড়ি, বাঁধানো কুয়ো ।

চড়াই ফুরিয়ে গেলেই বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরতে হল।

জায়গাটা যে সুন্দর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খটখটে শুকনো শক্ত মাটি, বিশাল বিশাল মাঠ, ঢেউ-খেলানো; মাঝে-মাঝে বড় বড় পাথর পড়ে আছে, জংলা গাছ নানা রকমের, মাথার ওপর দিয়ে দু-চারটে বক উড়ে যাচ্ছে, রোদ টকটক করছে, শীতের বাতাস দিচ্ছে শনশন করে।

হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “জায়গাটা কিন্তু চমৎকার, কী বলিস?”

তারাপদ বলল, “খুব ভাল। কিন্তু জায়গার কথা এখন ভাবতে পারছি না চাঁদু।”

“কেন? জেনেশুনেও চন্দন বলল।

“ভুজঙ্গ যেরকম ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে–,” তারাপদ হাজার দুভাবনার মধ্যেও তামাশা করবার চেষ্টা করল।

চন্দন হেসে বলল, “যা বলেছিস। ভুজঙ্গ যে কোন্ ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কিকিরা যা বললেন তাতে লোকটাকে একটা আস্ত শয়তান বলেই মনে হচ্ছে।”

তারাপদ বলল, “কিকিরা কিন্তু সত্যিই বড় ভাল লোক।”

“আমরা ভাই ওঁকেই অবিশ্বাস করছিলাম। সত্যি, মানুষ চেনা বড় কঠিন।”

“সবই কঠিন। এই সংসার চেনাই কি সহজ। ধর না ভুজঙ্গভূষণের কথা লোকটা এত শয়তান কিন্তু সেই লোক মরার আগে আমায় সম্পত্তি দেবার জন্যে ডেকে পাঠায়?”

চন্দন একটা কুলঝোঁপের পাশে বিশাল এক গিরগিটির মতন জীবন দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “তারা, দেখ।“ চন্দন আঙুল দিয়ে জীবটাকে দেখাল।

তারাপদ বলল, “কী রে ওটা? তক্ষক নাকি?”

চন্দন পায়ের শব্দ করতেই জন্তুটা ঝোঁপের আড়ালে পালাল।

 তারাপদ বলল, “ডেনজারাস্ জিনিস। বিষটিষ আছে বোধ হয়।

চন্দন বলল, “তুই এক আচ্ছা জায়গায় এলি, কী বল? চারপাশেই ডেনজার।”

“সত্যি! এখন ভাবছি, টাকার লোভে মানুষ কী না করে!”

“আমার কিন্তু ভালই লাগছে।”

“ভালই লাগছে?”

“অ্যাভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। সেই যকের ধনের মতন ব্যাপার। তোর পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের গুপ্তধন উদ্ধারের থ্রিলটা মন্দ কী রে?”

তারাপদ দুঃখের শব্দ করে বলল, “গুপ্তধন উদ্ধার! বলেছিস বেশ। ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার।”

“কেন কেন? নিধিরাম কেন?”

“কিকিরার মুখে শুনলি না ভুজঙ্গ কেমন ভয়ংকর। তার সঙ্গে লড়ব আমরা? আমাদের কী আছে রে? নাথিং। একটা লাঠি পর্যন্ত হাতে নেই।”

চন্দন এবার মুচকি হেসে বলল, “আছে, আছে।”

“কী আছে?”

“বলব?”

“বল।”

“প্রথমে আছে কিকিরার হেল্প। কিকিরা আমাদের সব রকম সাহায্য করবেন বলেছেন।”

“তুই বড় বাজে কথা বলিস, চাঁদু। কিকিরা একটা রুগ্ন লোক, তাঁর একটা হাত একরকম অসাড়। ওই মানুষ তোকে মুখের কথায় ছাড়া আর কিসে সাহায্য করতে পারেন?”

চন্দন একটা ছোট পাথর লাফ মেরে টপকে গেল। যেন তার হাত-পায়ের সাবলীল ভাবটা দেখাল। বলল, “শোন তারা, কিকিরা আমাদের কাছে চোদ্দ আনা কথাই ভাঙেননি। আমি তোকে বলছি, কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর রাখেন। কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের শত্রু। কাজেই শত্রু যদি ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর দেন তা হলে আমরা সেটা জানতে পেরে যাচ্ছি। ওটা কম কাজে লাগবে না। দু নম্বর হল, কিকিরার অ্যাডভাইস। সেটা খুব কাজের হবে। আর তিন নম্বর হল, আমার দুটো অস্ত্র।”

“অস্ত্র?” তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

চন্দন মিটমিট করে হেসে বলল, “ভাই, যখন থেকে আমি ভুজঙ্গভূষণের কথা শুনেছি তখন থেকেই আমি তাঁকে সাসপেক্ট করেছি। ভুজঙ্গভূষণের দুর্গে ঢুকব অথচ একেবারে খালি হাতে, তা কি হয়! আমি দুটো জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ইনজেকসানের সিরিঞ্জ, আর একটা পাতলা ছিপছিপে ছুরি।”

তারাপদ বন্ধুর এই ব্যাপারটাকে তামাশা মনে করে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “এই তোর অস্ত্র? আমি ভেবেছিলাম রিভলবার-টিভলবার নিয়ে এসেছিস।

“ওটা আমি চালাতে জানি না। এ দুটো জানি।”

“তুই ভুজঙ্গকে ওই দিয়ে ভয় দেখাবি? সত্যি চাঁদু তোর যা বুদ্ধি!”

“ভয় দেখাব কেন? ভদ্রলোকের মতন সব যদি মিটমাট হয়ে যায়–তোর ভুজঙ্গভূষণকে ভগবানের হাতে দিয়ে আমরা কলকাতায় ফিরে যাব।”

তারাপদ যেন কি ভেবে বলল, “কিন্তু চাঁদু, যদি ভুজঙ্গ আগেই তোর চালাকি ধরতে পারে?”

চন্দন বলল, “ধরা পড়লেই বা কী হবে! আমরা কলকাতাতেই শুনেছি, ভুজঙ্গভূষণের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমি তোর ডাক্তারবন্ধু; ইমার্জেন্সিতে কাজে লাগতে পারে ভেবে জিনিস দুটো এনেছি।”

যুক্তিটা তারাপদর পছন্দ হল। তবু বলল, “তুই স্টেথোকোপটা এনেছিস?”

“না।”

“বাঃ, তা হলে? স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তার হয়?

“ভুলে গিয়েছি। তাড়াহুড়োর মধ্যে জরুরি জিনিস নিতে লোকে ভুল করে না? সেই রকম ভুল।”

তারাপদ কী যেন ভাবল, বলল, “শুধু ইজেকসানের সিরিঞ্জ নিয়ে কী হবে? ওষুধপত্র?”

চন্দন বলল, “মাথা ধরা, পেট ব্যথার দু-চারটে খুচরো ওষুধ ছাড়া ইনজেকসানের জন্যে মরফিয়ার দুটো অ্যাম্পুল এনেছি, আর-একটা অ্যাম্পুল আছে হার্টের গোলমালের ওষুধ। সবই ইমার্জেন্সির জন্যে।”

তারাপদ এক ফোঁটাও ডাক্তারি বোঝে না। কিন্তু চন্দনের এই উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে ওকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করছিল । সত্যিই তো, একজন ডাক্তার বন্ধু নিয়ে সে মুখ ঝলসানো ভুজঙ্গভূষণের কাছে আসছে, এরকম অবস্থায় একেবারে খালি হাতে কি আসা যায়?

চুপচাপ কয়েক পা এগিয়ে এসে তারাপদ বলল, “দেখ চাঁদু, ভুজঙ্গকে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি–এতটা ভয়ের কারণ আমাদের বেলায় নাও থাকতে পারে । কাল রাত্রেও ঠিক এতটা ভয় আমাদের ছিল না। আজ সকালে কিকিরাই আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা যতটা ভাবছি তা হয়ত কিছুই হবে না। তা ছাড়া আমি কি যেচে এসেছি? ভুজঙ্গভূষণই আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।”

তারাপদ তার কথা শেষ করেনি, চন্দন অনেকটা দূরে গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “তারা, ওই তোর মাঠ-মোকাম, ভুজঙ্গভূষণের বাড়ি।”

চন্দন তাকাল। জায়গাটা দেখার মতন। মাঠের ঢল নেমে গেছে অনেকটা, চারদিকে জঙ্গলের ঝোঁপঝাড় গাছপালা, মনে হয় জঙ্গল বুঝি এখান থেকেই শুরু হয়েছে। ওরই এক পাশে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আড়ালের জন্যে বোঝা যাচ্ছে না বাড়িটা কেমন।

আরও আধ মাইলটাক হেঁটে তারাপদরা ভুজঙ্গভূষণকে বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এটা বাড়ি না দুর্গ বোঝা যায় না। জেলখানার মতন উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারদিক ঘেরা। গাছপালার অভাব নেই, আম জাম নিম কাঁঠাল থেকে শুরু। করে শিমুল পর্যন্ত। জল বৃষ্টি রোদ সয়ে সয়ে পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলার রঙ ধরেছে। কোথাও কোথাও কালো হয়ে গেছে। পাঁচিলের এ-পাশ থেকে বাড়ির সামান্যই চোখে পড়ে। অনেকটা ভেতর দিকে বাড়িটা। দোতলাই হবে। দোতলরা রেলিং-দেওয়া বারান্দা চোখে পড়ছিল। কেমন একটা ফটফট শব্দ হচ্ছে, যেন একটা মেশিন গোছের কিছু চলছে।

তারাপদ বলল, “কিসের শব্দ রে?”

চন্দন বলল, “ডায়নামো বলে মনে হচ্ছে।”

“কী করে ডায়নামো দিয়ে?”

“বোধ হয় বাতিটাতি জ্বালায়।”

“অবাক হয়ে তারাপদ বলল, “বাব্বা! বিশাল কারবার তা হলে?”

একটা জিনিস চন্দন লক্ষ করল। তারা বাড়ির হয় পেছনে না হয় পাশে কোথাও এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের দিকটা নজরে আসছে না।

পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “আয়, সামনের দিকে যাই।”

শুকনো পাতা, গাছের সরু সরু ভাঙা ডালপালা, ছড়ানো পাথরের ভূপ টপকে তারাপদরা বাড়ির সামনের দিকে এসে পড়ল। প্রথমেই চোখে পড়ল, লোহার ফটক। বিশাল ফটক। কারখানার গেটে যেমন দেখা যায়, অনেকটা সেই রকম। ফটকের একপাশে পাঁচিল জুড়ে ছোট একটা ঘর মতন। বোঝাই যায় পাহারা দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। খুবই আশ্চর্য, ফটকের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা মাঠের দিকে চলে গেছে–সেটা কাঁচা হলেও গাড়ি চলার দাগ আছে। মরা ঘাস, কাঁকর-মেশানো মাটির ওপর চাকার দাগ। গরুর গাড়ি চললে যেমন দাগ ধরে যায় মাটিতে। কিন্তু দাগের গর্ত গভীর নয়।

তারাপদ ফটকের সামনে এসে বলল, “এবার?”

চন্দন আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। ফটক বন্ধ। পাহারা ঘরের গায়ে একটা ছোট ফটক রয়েছে, কিন্তু তালা দেওয়া। ফটকটা টপকানো যেত, যদি না মাথায় বশার ফলার মতন শিক থাকত।

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকা ছাড়া চন্দন অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না।

হঠাৎ তারাপদ বলল, “চাঁদু, এদিকে একবার দেখ।”

চন্দন তারাপদর কাছে গেল। বাঁ ফটকের পাশে থামের গায়ে একটা কী যেন লেখা আছে। লোকে সাদা পাথরের ওপরেই বরাবর কালো দিয়ে বাড়ির নামটাম লিখে এসেছে। এ একেবারে উলটো। কালো পাথরের ওপর সোনালি দিয়ে কিছু লেখা ছিল। সোনালি রঙ এখন প্রায় কালচে হয়ে এসেছে, অক্ষরগুলো বোঝা কষ্টকর, অর্ধেক নষ্ট হয়ে গিয়েছে, গিয়ে পাথরের খোদাইটুকু কোনো রকমে টিকে আছে। দেবনাগরী অক্ষরে কিছু লেখা। চন্দন দেবনাগরী বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে, তারাপদ হয়ত বুঝতে পারত, কিন্তু ভাঙা অস্পষ্ট অক্ষর সে পড়তে পারছিল না।

খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারাপদ বলল, “সংস্কৃত মনে হচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছি না, তবে আত্মাটাত্মা কিছু লেখা আছে।”

“আত্মা?”

“তাই তো দেখছি।”

চন্দন কী যেন ভাবল, “আত্মা পরে হবে। জোর খিদে পেয়ে গিয়েছে। নিজেদের আত্মা আগে বাঁচাই। আয় আগে তোর পিসেমশাইয়ের সঙ্গে মোলাকাত করি।“

তারাপদকে টেনে নিয়ে চন্দন পাহারা-ঘরটার কাছে এল। “টপকাতে পারবি?”।

“পাগল, বর্শায় গিঁথে যাব।”

“তা হলে?…আচ্ছা, দাঁড়া, আমার কম্বলটা পাট করা রয়েছে। এটা বশার মাথায় দিচ্ছি। তুই ওই সেট্রি পোস্টের গা ধরে ওঠ, উঠে টপকে যা।”

চন্দন যাকে সেট্রি পোস্টের গা বলল সেটা পাহারা-ঘরের দেওয়ালই বলা যায়।

তারাপদ ইতস্তত করল। এই ফটকটা ছোট, ফুট চারেকেরও কম উঁচু মাটি থেকে। হাই জাম্প করেও পেরিয়ে যাওয়া যেত যদি জায়গা থাকত দু পাশে । অবশ্য তারাপদ স্পোর্টসম্যান নয়, চন্দন খানিকটা লাফঝাঁপ করতে পারে।

চন্দনের তাড়া খেয়ে তারাপদ মনে-মনে ভগবানকে ডেকে গেটের ওপর চেপে পড়ল।

কপাল ভাল, কোনো অঘটন ঘটল না। দুজনেই গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ভেতরে ঢুকে তারাপদরা দেখল, বাড়িটা ফটক থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে হবে। গড়নটা সেকেলে জমিদারবাড়ির মতন, অবশ্য সামনের দিকে গোলাকার ভাব আছে। মজবুত বাড়ি মস্ত মস্ত থাম, পাকাঁপোক্ত বারান্দা বাইরে। দূর থেকে মনে হয়, যেন বড় বড় পাথরে গাঁথা বাড়ি। বাইরে রঙরঙ কিছু নেই, কালচে হয়ে আছে, মানে ভুজঙ্গভূষণ বাইরের দিকে আর নজর দেন না। দেখতে বাড়িটা ছোট নয়। ভুজঙ্গভূষণ একলা মানুষ, এই বাড়ি নিয়ে কী করেন কে জানে!

ফটক থেকে যে রাস্তাটা সোজা বাড়ির সদর সিঁড়িতে গিয়ে পড়েছে, তার দু পাশে বাগান। এক সময় নিশ্চয় ফুলের বাগান ছিল, এখন ফুলটুল তেমন কিছু নেই, নানা ধরনের পাতাবাহার, জবা, গাঁদা আর এলোমেলো কিছু ফুলগাছ। চোখে পড়ে। বাগানে বেদী আছে বসার । ঘাসগুলো মরে যাচ্ছে শীতে। কিছু লতাপাতা নিজের মতন বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচিলের গা ধরে অবশ্য বড় বড় গাছ–নিম, কাঁঠাল, আম, হরীতকী ।

তারাপদ আর চন্দন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই ডায়নামোর শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মানুষের গলা পাওয়া যাচ্ছে না, কারও কোনো রকম টিকি দেখা যাচ্ছে না। ক’টা প্রজাপতি উড়ছে বাগানে। রোদ আরও গাঢ়, রীতিমত তাপ লাগছে গায়ে। শীত যেন এই রোদের কাছে। হার মেনে গেছে।

চন্দন বলল, “তারা, একটাও লোক নেই, কোনো সাড়াশব্দ নেই, তোর ভুজঙ্গভূষণ বেঁচে আছে তো?”

কথাটা শোনামাত্র তারাপদ যেন চমকে উঠল। সত্যিই তো, ভুজঙ্গভূষণ যদি মারা গিয়ে থাকে? ভুজঙ্গ নিজে অমাবস্যা পর্যন্ত বাঁচব বলেছে–কিন্তু মরা বাঁচা কি মানুষের নিজের হাতে? ওটা ভগবানের হাত । যদি ভুজঙ্গভূষণ মারা গিয়ে থাকে তবে তো হয়েই গেল! তারাপদর এই ছুটে আশা বৃথা হল । বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার যে আশা দেখা গিয়েছিল তাও গেল।

তারাপদ বেশ বুঝতে পারল, সে ভুজঙ্গভূষণকে জীবিত দেখতে চায় টাকার লোভে, সম্পত্তির লোভে? অথচ এই ভুজঙ্গকে নিয়ে তাদের ভয় দুশ্চিন্তা কি কম!

পাথরকুচি-ছড়ানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির একেবারে সামনের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল তারাপদরা। তবু কোনো শব্দ নেই, কারও সাড়া নেই। একেবারে চুপচাপ সব।

চন্দন বন্ধুর দিকে তাকাল। “কী ব্যাপার রে?”

“কী জানি, বুঝতে পারছি না।”

“চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকব?”

“কাকে?”

“কেন, ভুজঙ্গভূষণকে?”

তারাপদ বুঝতে পারল না, কী বলবে।

পাঁচ-সাত ধাপ সিঁড়ি উঠে গেল ওরা। বারান্দায় উঠে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা বড়-মতন ঘর। দরজা খোলা। বারান্দার একদিকে গোটা দুই চেয়ার পাতা রয়েছে।

চন্দন ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে উঁকি মারতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের ঘর থেকে কে বাইরে এসে দাঁড়াল। চন্দন তাকাল।

তারাপদ একদৃষ্টে লোকটিকে দেখছিল। তারপর অবাক হয়ে বলল, “সাধুমামা!”

সাধুমামা যেন তারপদকে চিনতে পারছিলেন না। তাকিয়ে থাকলেন।

তারাপদ আবার বলল, “সাধুমামা, আমি তারাপদ । তোমার এ কী চেহারা হয়েছে? তুমি ওভাবে আমায় দেখছ কেন? আমায় চিনতে পারছ না?”

সাধুমামার শরীর কঙ্কালের মতন, মাথার চুল একেবরে সাদা, ঘাড় পর্যন্ত ছড়ানো, মুখের মাংস কুঁচকে বিশ্রী হয়ে গেছে। বীভৎস দেখাচ্ছে। কিছু যেন হয়েছিল মুখে। কাটাকুটি, ঘা, নাকি সাধুমামারও মুখ পুড়ে গিয়েছিল ঝোঝা যাচ্ছে না। সাধুমামা এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলেন যেন সত্যিই তারাপদকে চিনতে পারছেন না।

তারাপদ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সাধুমামা তাকে চিনতেও পারছেন না। বছর দেড় দুই আগেও সাধুমামা তার কাছে গিয়েছিলেন,

এমন সময় একেবারে আচমকা ভয়ংকর গম্ভীর গলায় কে যেন বলল, “ওদের হলঘরে বসাও। বসিয়ে তুমি ওপরে আমার কাছে এসো।”

তারাপদরা চমকে উঠল।

কে যে কথাটা বলল দেখবার জন্যে তারাপদরা তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না কোথাও। গলার স্বরটা কী গম্ভীর, কী কঠিন। গমগম করে উঠল যেন বারান্দাটা। কিন্তু কে কথা বলল? কে?

সাধুমামা ওই গলা শোনামাত্র বাড়ির চাকরবাকরের মতন হাত দেখিয়ে তারাপদদেরর মাঝের ঘরটার দিকে যেতে ইশারা করলেন। কথা বললেন না।

.

ছয়

হলঘরে বসে থাকার সময়েই তারাপদরা বুঝতে পারল, তারা এক অদ্ভুত জায়গায় এসে পড়েছে। এই বিশাল বাড়ি এত ফাঁকায়–এমনিতেই নিঝুম থাকার কথা তার ওপর যদি এই বিরাট পুরীতে মানুষের সাড়াশব্দ, হাঁকডাক, চলাফেরা না থাকে–তবে কেমন লাগে? তারা কলকাতার মানুষ, মানে হইহই রইরইয়ের মধ্যে মানুষ। কোন্ ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সেখানে শুধু শব্দ আর শব্দ, মানুষজন থেকে গাড়ি-ঘোড়া, রাস্তার খেকি কুকুরগুলোও কানের পরদা ফাটিয়ে দেয় অনবরত। আর এখানে এই অদ্ভুত চুপচাপ। শুধু ডায়নামো চলার সেই ফটফট শব্দ; মাঝে মাঝে বাইরে দু-চারটে পাখির ডাক।

হলঘরটাও কেমন জাদুঘরের মতন দেখাচ্ছে। রীতিমত বড় ঘর, কবেকার কোন্ মান্ধাতা আমলের আসবাবপত্র, কারিকুরি করা লোহার ফ্রেমের সোফা সেট, বড় বড় আর্ম চেয়ার, মোগলাই নকশার একটা বড় সেন্টার টেবিল, মোটা মোটা বেটপ আলমারি গোটা দুই, দেওয়াল জুড়ে নানা ধরনের সামগ্রী ঝুলছে, বাঘের মাথা, বুনো মোষের সিং, বড় বড় তীর-ধনুক, এক জোড়া খঙ্গ, মা কালীর বিরাট পট, আর ওই সবের মধ্যে একটিমাত্র মানুষের ছবি। ফটো নয়, তেলরঙে আঁকা ছবি । ও ছবি যে ভুজঙ্গভূষণের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই মুখের দিকে তাকালে সমস্ত শরীর যেন থরথর করে কাঁপে, গায়ের লোমকূপে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বেশ লম্বা, খাঁড়ার মতন নাক, ভীষণ চওড়া কপাল; চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, কী তীব্র, তীক্ষ্ণ। খুবই আশ্চর্য, ঘরের মাঝখানে যেখানেই তুমি বসো, মনে হবে ভুজঙ্গভূষণ তোমায় দেখছে। ঘাড় পর্যন্ত ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল, মুখভরতি দাড়ি। দাঁত যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় মানুষটি বড় ভয়ংকর।

তারাপদরা বসে থাকল তো বসেই থাকল। চুপচাপ। ঘরের মধ্যে একটা বড় দেওয়াল-ঘড়ি টিকটিক করে বেজে যাচ্ছিল। আর তারাপদর বুকের মধ্যে ধকধক করছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল।

এমন সময় একজন ঘরে এল। ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ কালো, অন্তত বছর চল্লিশ বয়েস, লালচে রঙের গেরুয়া পরনে, মাথায় রুক্ষ একরাশ কোঁকড়ানো চুল, দাড়ি নেই। লোকটার মুখের দিকে তাকালেই প্রচণ্ড ধূর্ত মনে হয়।

লোকটা দু মুহূর্ত তারাপদদের দেখল। তারপর বলল, “তোমাদের জন্যে ঘর ঠিক করা হয়েছে, এসো।”

তারাপদ বলল, “আমরা ভুজঙ্গবাবুর সঙ্গে দেখা করব।”

“এখন নয়। গুরুজির অসুখ। তিনি বিকেলের পর দেখা করবেন।”

তারাপদ কী ভেবে বলল, “একবার একটুর জন্যে দেখা করা যায় না?”

“না; এখন নয়। দেখা করার সময় তিনি নিজেই দেখা করবেন।”

তারাপদ ঢোক গিলল। চন্দন একটাও কথা বলছিল না। লোকটাকে দেখছিল। তার মনে হল, লোকটা মোটামুটি টেরা, গলার কাছে একটা জায়গা ফোলা, থায়রয়েড় গ্ল্যান্ডের গোলমাল আছে বোধ হয়, চোখ দুটোও যেন সামান্য ঠেলে বেরিয়ে আসার মতন লাগছে।

তারাপদরা ঝোলাঝুলি নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

আবার বারান্দায়। লোকটার পিছু পিছু হেঁটে বাড়ির একেবারে শেষ দিকে একটা ঘরে তারা এসে দাঁড়াল।

তারাপদ কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা বলল, “আমার নাম মৃত্যুঞ্জয়। এখানে আমায় সকলে ছোট মহারাজ বলে।” বলেই তারাপদর দিকে তাকাল, “গুরুজি আদেশ দিয়েছেন, তোমার কাছে কাগজপত্র যা আছে, আমার হাতে দিতে। গুরুজি দেখবেন।”

তারাপদ ভাবল আপত্তি করে। কাগজপত্রগুলো নিজের হাতে ভুজঙ্গভূষণকে দেবার কথা। অবশ্য মৃণাল দত্ত বলে দেননি যে, হাতে-হাতেই দিতে হবে। পৌঁছে দেবার কথাই তিনি বলেছিলেন। এই মৃত্যুঞ্জয়কে কাগজপত্র দিলে কি কোনো ক্ষতি হবে? তারাপদ বুঝতে পারল না। লোকটা যখন এই বাড়িরই লোক, বোধ হয় ভুজঙ্গভূষণের ডান হাত–তখন একে দিতে আপত্তি কি? তা ছাড়া ভুজঙ্গভূষণ তো বিকেলের আগে দেখাই করবেন না। কাগজপত্রের কথা ভুজঙ্গভূষণ বলে না দিলে এই লোকটা জানবেই বা কোথা থেকে?

তারাপদ একবার চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন চোখের ইশারায় দিয়ে দিতে বলল।

কিট ব্যাগ খুলে যা কিছু দেবার বের করে তারাপদ মৃত্যুঞ্জয়কে দিয়ে দিল।

চন্দন এতক্ষণ পরে কথা বলল। বলল, “কিছু মনে করবেন না, আমরা সারারাত ট্রেন জার্নি করেছি। খিদে-তেষ্টা পেয়েছে। একটু চা পেলে অন্তত ভাল হয়।”

মৃত্যুঞ্জয় বলল, “ও হ্যাঁ, আমি দেখছি। ব্যবস্থা হয়ে গেছে।” বলে চলে যেতে গিয়ে আবার বলল, “এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। কিছু দরকার হলে আমাদের জানিও। নাও, বিশ্রাম করো। কলঘরটা ডানদিকে।” বলে হাত দিয়ে বাথরুমের দিকটা দেখাল।

মৃত্যুঞ্জয় চলে যাবার পর তারাপদ নিচু গলায় বলল, “চাঁদু, এ কোথায় এলাম । আমার ভাল লাগছে না। সাধুমামা আমায় চিনতে পারল না। কেমন শরীর হয়ে গেছে! একটাও কথা বলল না। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না।”

চন্দন বলল, “তোর লোক চিনতে ভুল হয়নি তো?”

“কী বলিস! সাধুমামাকে চিনব না?”

চন্দন কোনো জবাব দিল না। ঘরটা দেখতে লাগল। বড়ঘর। দু পাশে দুই বিছানা। একটা দেরাজ একপাশে। গোটা দুয়েক চেয়ার। মাথার ওপর পাখা। ইলেকট্রিক বাতি ঝুলছে। শীতকাল বলে পাখা চালানোর প্রয়োজন নেই। আর দিনের বেলায় বাতি জ্বালানোর প্রশ্নই ওঠে না। পুবের মস্ত জানলা দিয়ে আলো আসছে, রোদ অবশ্য নেই, সরে গেছে।

চন্দন বলল, “দাঁড়া, আগে মুখ ধুই, চা খাই, তারপর ভাবব। এখন আর মাথা খুলছে না।”

চন্দন কিট ব্যাগ খুলে টুথব্রাশ, পেস্ট, তোয়ালে বার করল। এক টুকরো সাবানও।

তারাপদ তার কিট ব্যাগ খুলতে লাগল। তার মুখ দেখলেই মনে হয় সে বেশ উদ্বেগ এবং হতাশা বোধ করছে।

ঘরের ভেতর দিকের দরজা খুলে চন্দন একটা প্যাসেজ দেখল, তার গায়েই বাথরুম।

তারাপদ জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরটা একেবারে শেষের দিকের। জানলার গা ঘেঁষে বাগান, পেছনের দিকে আস্তাবল। একটা বাদামী রঙের ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে ফাঁকা জমিতে। তারাপদ বুঝতে পারল, ভুজঙ্গভূষণের বাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি আছে।

সেই ফটফট শব্দটা হঠাৎ কখন থেমে গেছে তারাপদ বুঝতে পারেনি। আচমকা খেয়াল হল। কান পেতে থাকল সামান্য, না, কোনো শব্দ নেই। সাধুমামার মুখ আবার তার মনে পড়ল। মানুষ না কঙ্কাল? কী হয়েছিল সাধুমামার? সাধুমামা কেন তাকে চিনতে পারল না? কেন কথা বলল না? সাধুমামা কি অসুখবিসুখে বোবা হয়ে গেছে? আশ্চর্য!

চন্দন ফিরে এসে বলল, “যা তারা, মুখটুখ ধুয়ে আয়। ফাইন জল এখানকার রিফ্রেশিং…।”

তারাপদ নিশ্বাস ফেলে মুখ ধুতে চলে গেল।

চা জলখাবার এসেছিল। বাড়িতে তৈরি জলখাবার । মিষ্টিও। চা-টাও মন্দ নয়।

দুই বন্ধু চা খেতে খেতে নিচু গলায় কথা বলছিল।

চন্দন বলল, “শোন তারা, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদূর এসে আর ফিরে যাওয়া যায় না।”

“এমন জানলে আমি আসতাম না, চাঁদু।”

“না এলে সম্পত্তি ফসকে যেত।” চন্দন যেন ঠাট্টাই করল।

তারাপদ মুখ কালো করে বলল, “যেত তো যেত। আমি গরিব ছিলাম, গরিবই থাকতাম; বটুকবাবুর মেসে আমার জীবন কেটে যেত। কিন্তু এ-কোথায় এলাম? মৃণাল দত্ত আমায় এত কথা বলে দেননি।’

চন্দন বলল, “এসে যখন পড়েছিস, দুটো দিন দেখে যা না কী হয়? আমাদের কী করবে ভুজঙ্গভূষণ? খুনও করবে না, জেলেও পাঠাবে না। যদি অবস্থা খারাপ দেখি, পালাব।”

“কেমন করে পালাবি এই দুর্গ থেকে?”

“পালাব। সে-ভার আমার।…এই বাড়িতে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, তারা; অ-নেক। এই রহস্যগুলো কী?”

তারাপদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই শার্লক হোমস্ নাকি?”

চন্দন বলল, “শোন, তুই এ-বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখেছিস?”

“মেয়ে? না।” তারাপদ অবাক।

“আমি দেখেছি,” চন্দন বলল, “দোতলার দিকে ভেতর বারান্দায় একটা মেয়েকে দেখলাম। একটুর জন্যে। মনে হল, খুব রোগা, ফরসা, বয়স কম।”

তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গভূষণ বা তার চেলার কেউ হবে।“

“হতে পারে,” চন্দন একটা সিগারেট ধরাল, “কাপালিকের বাড়িতে অতটুকু মেয়ে কেন?”

তারাপদর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার কপালকুণ্ডলার কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধুর মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল তারাপদ।

ভুজঙ্গভূষণ যে অতিথিদের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল সেটা বোঝা গেল। শীতের বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল, স্নান খাওয়া শেষ করল তারাপদরা। দোতলায় গিয়ে তাদের খেতে হল আসনে বসে। খেতে বসে মনে হল, এতরকম সুখাদ্য তারাপদ জীবনে খায়নি। মৃত্যুঞ্জয় তাদের তদারক করছিল। ঠাকুরগোছের একটা লোক খেতে দিচ্ছিল ওদের। সমস্ত কিছু পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন।

নিজেদের ঘরে ফিরে এসে চন্দন বলল, “তারা, তোর পিসেমশাই যে দারুণ খাতির করছে রে? এই রেটে যদি সাত দিন খাই আর ঘুমোই–এই শীতে একটা ফার্স্ট ক্লাস চেঞ্জ হয়ে যাবে।”

তারাপদ ঢেকুর তুলে বলল, “খাতিরের শেষটায় কি হয়, দেখ।”

“কেন, তুই সম্পত্তি পাবি, আর আমরা বগল বাজাতে বাজাতে কলকাতা ফিরব। “

“সাধুমামাকে আর একবারও দেখছি না কেন বল তো?”

“কী জানি! হয়ত তাঁর অন্য কাজ।”

“মৃত্যুঞ্জয়কে তোর কেমন লাগছে?”

“একটা ক্যারেকটার।”

“লোকটা শয়তান বলে মনে হচ্ছে আমার।”

“পাকা শয়তান। …নে এবার একচোট ঘুমিয়ে নে। ট্রেনে ভাই ভাল ঘুম হয়নি।” বলতে বলতে চন্দন বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতের সিগারেটটা টিল করে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল।

তারাপদও প্রচুর খাবার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল। বলল, “চাঁদু, আজ একবার কিকিরার সঙ্গে দেখা করা যায় না? উনি তো বলেছেন বিকেলেই যশিডি থেকে ফিরবেন।”

চন্দন বলল, “আজ আর কী করে হবে? সন্ধের দিকে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা হবে তোর। তারপর আর সময় কোথায়? স্টেশন কম দূর নয়।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। চন্দন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

তারাপদরও আলস্য লাগছিল। শীতের দুপুরে চন্দন ঘুমোচ্ছে। বিছানায় গা গড়িয়ে নানারকম ভাবতে ভাবতে তারাপদও ঘুমিয়ে পড়ল।

.

তারাপদর ঘুম ভাঙল শেষ বেলায়। শীতের দিন। হুহু করে রোদ পালিয়ে আলো মরে আসছে। ঘরের মধ্যে ছায়াছায়া ভাব। কেমন যেন বিষণ্ণ রঙ ধরে গিয়েছে বাগানে।

চন্দন ঘুমোচ্ছিল। তারাপদ হাই তুলতে তুলতে উঠল। জানলার কাছে দাঁড়াল। হাওয়া দিয়েছে শীতের, গাছপালায় সেই হাওয়া লেগেছে। দূরে যেন কোথায় একটা কাক ডাকছে। শব্দটা কানে খারাপ লাগছে না। গাছের পাতা উড়ে গেল বাতাসে, বোধ হয় ওই ইউক্যালিপটাস গাছটার শুকনো পাতা।

তারাপদ চোখেমুখে জল দিয়ে আসতে কলঘরের দিকে চলে গেল।

ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখল জানলার কাছে সাধুমামার মুখ ।

তারাপদ প্রথমটায় কেমন বিশ্বাস করতে পারেনি। যখন তার বিশ্বাস হল, তখন আর সাধুমামা নেই। কী যেন একটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই সাধুমামা চলে গেছেন।

তারাপদ তাড়াতাড়ি এসে জানলার কাছে দাঁড়াল। জানলায় গরাদ, মুখ বাড়ানো যায় না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তারাপদ–সাধুমামাকে দেখতে পেল না। ডেলাটা তুলে নিল তারাপদ। ধীরে ধীরে খুলল। এক টুকরো কাগজে কী যেন লেখা সিস-পেনসিলে; পড়তে কষ্ট হয় ।

তারাপদ পড়ল : “তুমি শেষ পর্যন্ত যমপুরীতে পা দিয়েছ। এসে ভাল করেছ। খুব সাবধানে থাকবে। আমি আছি । তোমায় পরে সব বলব। আমি বোবা সেজে আছি। এই যন্ত্রণা থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করবে বাবা? একাগজ রেখো না। নষ্ট করে ফেলো।”

অরাপদর সর্বাঙ্গ পাথর হয়ে গেল। সাধুমামা বোবা সেজে রয়েছে। কেন? তারাপদ তাদের উদ্ধার করতে পারে, মানে? কাদের? কারা এখানে বন্দী? কেন?

তারাপদ ভয়ে কেমন যেন হয়ে গিয়ে চন্দনকে ঠেলা মেরে জাগিয়ে তুলতে লাগল ।

“চাঁদু, এই চাঁদু; ওঠ..।”

চন্দন ধড়মড় করে উঠে বসল। ভেবেছিল, না জানি কী ঘটেছে; উঠে বসে দেখল ঘরটা ছায়ায় ভরা, তারাপদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

তারাপদ বলল, “আচ্ছা ঘুম ঘুমোচ্ছিস? সন্ধে হয়ে গেল। ওঠ। …এইটে পড়ে দেখ।”

ঘুম জড়ানো ছলছলে চোখে চন্দন বলল, “কী ওটা?”

“সাধুমামার চিঠি।“

চন্দন চিঠিটা নিল। চোখ ঝাপসা, কোনো রকমে পড়ল। বার দুই তিন। তারপর বলল, “এখানকার সবই মিস্টিরিয়াস ।”

.

এবাড়ির আরও বড় রহস্য তারাপদরা সন্ধের দিকে জানতে পারল।

শীতের দিন; বিকেল ফুরোতেই সন্ধে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল । কলকাতার মানুষ তারাপদরা, অন্ধকার দেখার সুযোগ কমই জোটে; জুটলেও এমন চারপাশ জুড়ে থমথমে অন্ধকার দেখার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তার ওপর শীত। কুয়াশা জমছে মাঠঘাটে। কোনো দিকেই তাকানো যায় না।

মৃত্যুঞ্জয় এসে জানিয়ে গিয়েছে, সামান্য পরে এসে তারাপদদের ভুজঙ্গভূষণের কাছে নিয়ে যাবে। তারাপদরা জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে বসে আছে। সেই ফটফট শব্দটা আবার বিকেলের পর থেকে শোনা যাচ্ছিল । ডায়নামো চলছে আর কি। ঘরে বাতি জ্বলছি।

তারপর বুকের মধ্যেও ধকধক করছিল। ভুজঙ্গভূষণের কাছে যেতে হবে। জীবনে যাকে কোনোদিন দেখেনি, যার নামও তিন দিন আগে পর্যন্ত তার জানা ছিল না, সেই লোকটার কাছে। অথচ এই লোকই তারাপদকে দেড় দুই লাখ টাকার সম্পত্তি দিয়ে যেতে ডেকে পাঠিয়েছে। এমন মানুষকে দেখার আগে এমনিতেই বুক কাঁপার কথা। তার ওপর সেই মানুষ যদি এত রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর হয় তবে কেমন লাগে? তারাপদর মুখ গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, বলে যেন অনবরত কেউ হাতুড়ি পিটছে।

চন্দন তারাপদর চেয়ে সাহসী । তবু তারও ভয় হচ্ছিল।

তারাপদর কাঠের মতন শুকনো গলা করে বলল, “চাঁদু, কী হবে?”

চন্দন বলল, “কিছু ভাই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আমাদের নিশ্চয় মেরে ফেলবে না। কাপালিকই হোক আর শয়তানই হোক–আজকের দিনে মানুষকে বাড়িতে ডেকে এনে মেরে ফেলা মুশকিল। পুলিসে ধরবে। আমরা দুজন যে এবাড়িতে এসেছি তার প্রমাণ কলকাতার মৃণাল দত্ত থেকে শুরু করে এখানে সাধুমামা পর্যন্ত সবাই দিতে পারবেন।”

তারাপদ ভয় সামলাবার জন্যে ঘন ঘন সিগারেট খেতে লাগল।

শেষে মৃত্যুঞ্জয় এল। বলল, “এসো।”

তারাপদরা উঠল।

ফাঁকা ফাঁকা ঘর, বারান্দা, সিঁড়ি দিয়ে তারাপদরা দোতলায় এল। দোতলার ভেতর বারান্দা দিয়ে হেঁটে একটা ছোট ঘরের কাছে এসে মৃত্যুঞ্জয় বলল, “ওই ঘরে যাও। ঘরে থোয়ানো ধুতি, ফতুয়া, গরম চাদর আছে। তোমাদের এই জামা-প্যান্ট পালটে নেবে, জুতো-মোজা খুলে রাখবে । জানলার দিকে জল আছে। হাত ধুয়ে নেবে। নোংরা, বাইরের জামা কাপড়ে গুরুজির কাছে যাওয়া যায় না।”

চন্দন প্রতিবাদ করে বলল, “আমরা লড্রির প্যান্ট জামা পরেছি।”

“তা হোক; এখানের এই নিয়ম। বাইরের কোনো পোশাকেই কাউকেই গুরুজির কাজে যেতে দেওয়া হয় না।”

“আমি ধুতি পরতে পারি না,” চন্দন বলল।

“তা হলে তুমি থাকো।”

তারাপদ চন্দনের হাত ধরে টানল। “ঠিক আছে–আমি তোকে ধুতি পরিয়ে দেব।”

ওরা দুজনে পোশাক পালটাতে পাশের ঘরে চলে গেল।

ঘরে ঢুকে চন্দন রাগের গলায় বলল, “যত্ত বাজে নিয়ম। কোনো মানে। হয়? কোন মহারাজ তোর পিসেমশাই যে তাকে দেখতে হলে ধুতি পরতে হবে। কেমন শীত দেখছিস। ধুতির ভেতর দিয়ে ঢুকে হাড় কাঁপাবে।”

তারাপদ বলল, “কপাল ভাই। কিছু করার উপায় নেই।”

চন্দন একেবারেই ধুতি পরতে পারে না তা নয়, বছরে এক-আধ দিন পরে, রীতিমত যুদ্ধ করে।

ওরা জামা-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি ফতুয়া পরতে লাগল।

পোশাক পালটে তারাপদরা বাইরে এল। মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “এসো ।”

বারান্দার গা-লাগানো একটা প্যাসেজ ঘুরে সামনের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল মৃত্যুঞ্জয়। বলল, “ভেতরে যাও, বসবার জায়গা আছে, গিয়ে বসে থাকো। কথাবার্তা বলো না।”

দরজা ভেজানো ছিল, মৃত্যুঞ্জয় খুলে দিল।

তারাপদরা ঘরে পা বাড়াল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

সামনেই মোটা ভারী পরদা। পরদা সরিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাতেই চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেল। কিছু দেখা যায় না। মনে হল, সিনেমা আরম্ভ হয়ে যাবার পর হলে ঢুকলে চোখে কিছু দেখা যায় না, অনেকটা সেই রকম। কিন্তু সিনেমার হলে তবু এদিকে ওদিকে চোরা আলোর ব্যবস্থা থাকে, ছবি দেখানোর আলোও এক এক সময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখানে ওসব কিছু না। মিটমিট করে দুপাশে দুই চোরা দেওয়াল-আলো জ্বলছে যদিও, তবু সেই আলোয় কিছু দেখা যায় না।

দুই বন্ধু পাশাপাশি থমকে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে খুব অস্পষ্টভাবে ঘরটা চোখে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দুটো চেয়ার। দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বসে থাকা ভাল ভেবে দুজনে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে চলল। পায়ের তলায় যে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। মনেই হয় না মাটিতে পা; যেন কোনো তুলোর মধ্যে পা ডুবে যাচ্ছে, এত নরম! কোনো সন্দেহ নেই, খুব দামি কার্পেট পাতা রয়েছে ঘর জুড়ে, কার্পেটের রঙটাও। হয় কালো, না হয় ঘন লাল–কালচে দেখাচ্ছে, অবশ্য এই অন্ধকারে সবই কালচে দেখাচ্ছে।

তারাপদরা কোনো রকমে চেয়ারে এসে বসল। বসামাত্র মনে হল, যেন নরম গদির মধ্যে সমস্ত শরীরটা ডুবে গেছে।

ভয় দু’জনেরই বুকের ওপর চেপে বসেছে। তবু চোখ আরও খানিকটা সয়ে আসায় তারা ঘরের চারপাশ দেখছিল। ঘর নিশ্চয় ছোট নয়। দেওয়ালগুলো দেখা যায় না। সারা ঘরে কেমন এক সুন্দর গন্ধ। দামি ধূপের, নাকি কোনো আতর ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে বোঝা যায় না। গন্ধটা বাতাসে ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছিল। তাদের চেয়ারের সামনে–খানিকটা তফাতে আরও একটা চেয়ার চোখে পড়ল। তারাপদদের দিকে মুখ করা। সিংহাসনের মতনই যেন। উঁচু, বড়। মনে হল–বেশ যেন বাহারি। চেয়ারের দু’পাশে পরদা। ভেলভেটের পরদা বুঝি। কোঁচানো হয়ে ঝুলছে। ঠিক একেবারে ছোট স্টেজের দুটো উইং। মাথার ওপর দিকটা এত অন্ধকার যে, কোথায় ছাদ বোঝা যাচ্ছে না।

হঠাৎ চন্দন তারাপদর হাত আঁকড়ে ধরল। ধরে ফিসফিস করে বলল, “তারা, সেই বেড়াল।

তারাপদ তাকায়। ভেলভেটের পরদার একপাশে, ছোট্ট একটা গোল টেবিলের ওপর সেই কালো বেড়াল, মৃণাল দত্তের বাড়িতে যেমন দেখেছিল তারা। অন্ধকারে তার গা দেখা যাচ্ছে না, চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল। করছে। নিশ্চয় কালো বেড়াল। মৃণাল দত্তের বাড়ির বেড়ালের মতনই মরা, সাজানো বেড়াল। নয়ত একই জায়গায় বসে থাকবে কেন?

চন্দনের হাত ঘামছিল। সে বেড়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিশ্চয় ঘুরবে, মুখ ফেরাবে।

এমন সময় ভেলভেটের পরদার পরদার দিকে আর-একটা চোরা আলো জ্বলে উঠল। লাল আলো। মৃদু তার আভা।

আর তারাপদরা দেখল এক ভৌতিক আকৃতি ডানদিকের পরদা সরিয়ে এসে দু মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর সেই সিংহাসনের মতন চেয়ারে বসল ধীরে ধীরে।

ভয় দুজনেরই গলায় এসে জমা হয়েছে। জিব শুকনো। বুক যেন আর সইতে পারছে না এত জোরে ধকধক করছে হৃদপিণ্ড । শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। অসাড় লাগছে। কাঁপছে হাত-পা ।

মানুষটি যে কী পরেছে বোঝা যাচ্ছিল না। হয়ত আলখাল্লা। রক্ত-গৈরিক রঙের। তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত একটা ঢাকা পরানো, শুধু নাক মুখ আর চোখের জায়গাটা ভোলা। তারাপদরা প্রচুর ইংরেজি ছবি দেখেছে। তাদের মনে হল, এককালে এই রকম মুখোশ পরে রাজারাজড়ারা গোপন জায়গায়। যেত, এইরকম মুখোশ পরেই কেউ কেউ অনাচার অত্যাচার করতে বেরিয়ে পড়ত; দুশমন দমন করতেও যেত।

এই কি ভুজঙ্গভূষণ?

হঠাৎ সেই মানুষটি গম্ভীর চাপা গলায় বলল, “তারাপদ, আমি তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণ।”

উঠে গিয়ে প্রণাম করার কথা তারাপদ ভুলে গেল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমার মুখ পুড়ে গিয়েছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা। তোমাদের দেখতে ভাল লাগবে না। তাই এটা পরেছি। তুমি আমার মুখ দেখতে পাচ্ছ না বলে আমারই কষ্ট হচ্ছে। আমার শরীর ভাল নয়। তোমায় শুধু দেখতে এসেছি। তুমি এসেছ, আমি খুশি হয়েছি।”

তারাপদ সাহস করে বলল, “মৃণালবাবু আমার হাত দিয়ে কিছু কাগজপত্র আর চিঠি দিয়েছিলেন আপনাকে দেবার জন্যে। আপনি পেয়েছেন?”

“পেয়েছি। ..ওই ছেলেটি তোমার বন্ধু, ডাক্তার?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। মৃণালবাবুর মুখে শুনলাম, আপনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে–তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। কী হয়েছিল আপনার?”

“কী হয়েছিল তুমি ঠিক বুঝবে না। অগ্নিচক্রের মধ্যে মুখ ছিল, মনটা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। একাগ্রতা নষ্ট হয়ে গেলে পাপ হয় সেই পাপের ফল।”

“অগ্নিচক্র কী?”

“তোমরা বুঝবে না। না দেখলে বুঝতে পারবে না। এই যে ঘরে তোমরা বসে আছ, এই ঘরে পরলোক থেকে আত্মারা আসেন। আমি তাঁদের ডেকে আনি। তাঁরা আসেন, দেখা দিয়ে যান, কত লোক তাদের হারানো প্রিয়জনকে এখানে একটু দেখতে আসে। আত্মা অদৃশ্য। তাকে দেখা যায় না। তবে সদয় হলে তাঁরা আমাদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান। অনেক সময় স্পর্শও করে যান। চিহ্নও রেখে যান কোনো কোনো সময়ে।…ওই দেখো, একজন এসেছেন…এই মুহূর্তে এসে গেছেন।” বলতে বলতে যেন ভুজঙ্গভূষণ কেমন হয়ে গেলেন, মাটি থেকে একটা বড় পুজোর ঘণ্টা উঠিয়ে নিয়ে বাজালেন সামান্য। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ঘর ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

সেই নিকষ কালো অন্ধকারে মাথার ওপর ক্ষীণ একটু আলো জ্বলে উঠল । আর কোথা থেকে একটা লাল বল, সোনালি ডোরা দেওয়া, ঘরের মাঝখানে এসে হাজির হল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আপনি কে আমি জানি না। যদি আমার পরিচিত হন আপনার আসার প্রমাণ দিন।”

বলার পর বলটা কাঁপতে লাগল, নড়তে লাগল, তারপর ধীরে ধীরে শূন্যে উঠতে লাগল, ভাসতে ভাসতে ওপরে ছাদের দিকে উঠে গেল, ওপরের আলোয় সেই লাল আর সোনালি রঙের বলটা ঝকঝক করে উঠল। বলটা আবার সামান্য নেমে এল। নেমে এসে লাফাতে লাফাতে ঘরের ডান দিক থেকে বাঁ দিক পর্যন্ত চলে গেল। আবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আসতে লাগল।

তারাপদ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন।

চন্দন দু চোখ বন্ধ করে ফেলল।

.

সাত

পরের দিন সকালেও তারাপদ নিজেকে সামলে নিতে পারল না। চোখমুখ বসে গিয়েছে, শুকনো চেহারা। পর পর দু’ রাত্রিই ঘুম হল না বেচারির; আগের দিন কেটেছে ট্রেনে; আর কাল সারা রাত বিছানায় শুয়ে ভয়ে আতঙ্কে মরেছে । চন্দন ডাক্তার-মানুষ, তার অনেক সাহস, মড়া কাটা থেকে শুরু করে সে কত কী করেছে, সহজে ঘাবড়ে যাবার ছেলে চন্দন নয়; তবু চন্দনও কেমন বোকা হয়ে গেছে। ভয়ও পেয়েছে খানিকটা। দুজনে আলোচনা করেও বুঝতে পারছে না–এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটে? ছোট ফুটবল সাইজের, একটা বল কেমন করে হাওয়ার মধ্যে নেচে বেড়ায়? ভৌতিক ব্যাপার? না ম্যাজিক?

যদি বিশ্বাস করে নেওয়া যায় ম্যাজিক, তবে ভয়-ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু ম্যাজিক বলে ঠিক বিশ্বাস করতেও মন চাইছে না।

সকাল বেলায় মুখটুক ধুয়ে কোনো রকমে চা খেয়ে দুজনে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল। বাগানে।

তারাপদ বলল, “চাঁদু, কিকিরার কাছে যেতেই হবে।”

চন্দন বলল, “আমিও তাই ভাবছি। কখন যাবি।”

‘বিকেলে যাওয়া যাবে না। ভুজঙ্গ আবার আজ বিকেলের পর আমাদের সঙ্গে দেখা করবে বলেছে। যেতে হলে এখনই যাওয়া দরকার।”

চন্দন বলল, “চল, আমরা ঘুরে আসি।”

“কাউকে কিছু বলতে হবে না?”

“কী দরকার । নতুন জায়গা, কেমন সুন্দর দেখতে, আমরা একটু বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি–এইভাবে যেতে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, বেড়াচ্ছি। তারপরও যদি খোঁচায়, বলব–স্টেশনে যাচ্ছি ব্লেড কিনতে কিংবা সিগারেট কিনতে। “

তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, চল।”

বাগানের মধ্যে সামান্য সময় দুজনে বেড়ানোর ভাব করে ঘুরে বেড়াল। বাড়ির চার পাশ না হলেও অন্তত তিনটে পাশ দেখে নিল । ভুজঙ্গভূষণের এই পুরী যতই দুর্গ হোক, কেউ যদি পালাতে চায় নিশ্চয় পালাতে পারে । সব দিক সর্বক্ষণ আটকে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ জেলখানা থেকেও পালায়–এখান থেকে পালানো নিশ্চয়ই তার চেয়ে কঠিন নয়।

বাগানে বেড়াতে বেড়াতেই মৃত্যুঞ্জয়কে দেখা গেল।

চন্দন বলল, “তারা, তোকে এবার একটু খেলতে হবে।”

তারাপদ অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল।

চন্দন বলল,”তুই ওই মৃত্যুঞ্জয়টাকে ডাক। ডেকে বল, ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে। বলবি, আমরা বেড়াতে যাব। শোন, মিনমিন করে কথা বলবি না ওর সঙ্গে, হুকুমের গলায় বলবি।”

“এখানকার ছোট মহারাজাকে হুকুম? তুই বলছিস কী?” তারাপদ ঘাবড়ে গিয়ে বলল।

চন্দন বলল, “আমি ঠিকই বলছি। তুই ভুজঙ্গভূষণের সম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছিস। ও বেটার কোনো রাইট নেই এখানে; তোর আছে। তুই এখন থেকেই এটা দেখিয়ে যা।”

“তারপর যদি–”

“যদি-টদি বাদ দে; নো রিস্ক নো গেই।…তুই চালা না–তারপর আমি আছি।” বলে চন্দন মাতব্বরের মতন মৃত্যুঞ্জয়কে ডাকল।

মৃত্যুঞ্জয় কাছে এলে তারাপদ ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে বলল। ঠিক হুকুমের গলায় অবশ্য বলতে পারল না।

“খুবই আশ্চর্য যে, মৃত্যুঞ্জয় সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করল, তারাপদরা কোথায় যাবে? তারপর চাকরকে ডেকে তালা খুলে দিতে বলল।

ফটকের বাইরে এসে তারাপদরা হাঁটতে লাগল। মাঠ ময়দান, গাছপালা, দূরের জঙ্গল–যেদিকে চোখ যায়–সব যেন রোদে ভেসে যাচ্ছে। শীতের রোদ, তবু কী গাঢ়, কত উষ্ণ। আকাশ নীল, রোদ যেন উপচে পড়ছে আকাশ থেকে; মাঠঘাটের ভেজা ভাব শুকিয়ে এসেছ, শিশির আর চোখে পড়ছে না। এখনো শীতের সেই শনশন হাওয়া দেয়নি, অল্পস্বল্প যা আছে তাতে ভালই লাগে।

কাল রাত্রের সেই অন্ধকার রহস্যময় ঘর, সেই আত্মার ব্যাপার-স্যাপার, বলের নাচ যেন অন্য একটা জগৎ। আর এখানকার এই রোদ, মাঠ, কুলঝোঁপ, আতাগাছের ডালে বসে পাখির ডাক–এ আর-এক জগৎ। এই জগৎ তারাপদরা বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে, কিন্তু কালকের ওই রহস্যময় ঘটনার কিছুই বুঝতে পারে না। মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন।

হেঁটে আসতে আসতে দুজনেই গল্প করছিল।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “চাঁদু, তুই তো ডাক্তার । আত্মা-টাত্মা কখনো দেখেছিস?”

“না ভাই, আমি মর্গও দেখেছি, বাট নো আত্মা।”

“আমি প্ল্যানচেট দেখেছি,” তারাপদ বলল, “পরলোক-টরলোক নিয়ে একবার একটা বইও পড়েছিলাম। কিছু বুঝিনি।”

“এ-সব গাঁজাখুরি…।”

“কিন্তু কাল আমরা নিজের চোখে যা দেখলাম–?”

“তাই তো ভাবছি। পি সি সরকারের ম্যাজিক যেন!”

এমন সময় একটা দেহাতী গোছের লোককে সাইকেলে করে আসতে দেখা গেল দূরে। ভুজঙ্গভবনের দিক থেকে আসছে। চন্দনের চোখে পড়েছিল।

চন্দন বলল, “তারা, ওই লোকটা এদিকে কেন আসছে?”

তারাপদ দেখল। বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি দেখতে আসছে বোধ হয়।”

“তার মানে ভুজঙ্গ আমাদের ওপর চোখ রাখতে চায়? না, মৃত্যুঞ্জয়?”

“বুঝতে পারছি না।”

দুজনেই হাঁটতে লাগল, দাঁড়াল না। চন্দন হঠাৎ বেয়াড়া গলায় গান গাইতে শুরু করল, যেন খুব খুশ মেজাজে রয়েছে।

লোকটা কাছাকাছি এল। পুরোনো সাইকেল, মাঝ বয়েসী লোক; বাঙালি বলে মনে হয় না। তারাপদদের কাছাকাছি এসেও দাঁড়াল না। একবার শুধু দেখল, খাতিরের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো, তারপর চলে গেল।

সাইকেল খানিকটা এগিয়ে যেতে চন্দন বলল, “তারা, আমার মনে হচ্ছে লোকটা নজর রাখার জন্যে এসেছে। কিন্তু কেন? ভুজঙ্গ না মৃত্যুঞ্জয়, কার হুকুমে ও নজর রাখছে? আমরা পালিয়ে যাব ভাবছে নাকি?”

তারাপদ বলল, “চাঁদু, সম্পত্তির নিকুচি করেছে, চল, আমরা এই ভূতের বাড়ি থেকে পালাই।”

মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “এত সহজে পালাব কেন রে? আরও দু-একটা দিন দেখি । অন্তত তোর পিসেমশাইয়ের অরিজিন্যাল মুখটা একটু দেখি। পালাবার জন্যে তুই ভাবিস না। ওটা আমার হাতে ছেড়ে দে। সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। পালাবার জায়গা দেখে রেখেছি ভাই।

আরও একটু এগিয়ে আসতেই আচমকা পাখির ডাকের মতন শোনা গেল । ডাকটার একটা আলাদা সুর ছিল, কানে লাগে। চন্দন দাঁড়িয়ে পড়ল, তার দেখাদেখি তারাপদও দু-চার পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চন্দন আশেপাশে তাকাল । ডানদিকে খানিকটা উঁচু জমি, মস্ত মস্ত দুই পাথর, আশেপাশে ছোট ছোট পাথর-টুকরো পড়ে আছে। রুক্ষ জায়গা, কাঁকরভরা মাটি। কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। কাঁটা গাছের ছোট্ট একটু ঝোঁপ পাথরের পাশে। কোথাও কোনো পাখির চিহ্ন নেই।

চন্দন কিছু বোঝবার আগেই একটা ছোট ঢিল এসে পায়ের কাছে পড়ল । তারপরেই পাথরের আড়াল থেকে কিকিরার মুখ উঁকি মারল।

“আরে, আপনি?” চন্দন অবাক । তারাপদকে বলল, “কিকিরা।”

হাতছানি দিয়ে কিকিরা ডাকলেন।

তারাপদরা এগিয়ে গেল ।

কিকিরা বললেন, “এখানে আসুন স্যার, গুঁড়ি মেরে চলে আসুন।”

তারাপদরা পাথরের আড়ালে গেল। কিকিরা বললেন, “একটু আগেই এক চেলা গেল, দেখেছি। দেখেই শেলটার নিয়েছি।”

“আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছিলুম।”

“আমিও আপনাদের খোঁজে আসছিলাম। মনে হচ্ছিল, দেখা হয়ে যেতেও পারে।”

“ওই লোকটাকে আপনি চেনেন?”

“না। তবে আন্দাজ করতে পারি।”

“ও কি আমাদের ওপর নজর রাখছে?”

“মনে তো হয়, স্যার। তবে ও বেটা অনেকটা চলে গেছে। দেখতে পাবে আর। যদি দেখি ফিরে আসছে, আপনাদের বলব। আপনারা সোজা ভুজঙ্গ ভয়ালের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করবেন।”

চন্দনরাও একবার দেখে নিল। লোকটা বেশ দূরে চলে গেছে। সেখান থেকে পাথরের আড়ালে তাদের দেখতে পাবে না। না গেলে কী ভাববে বলা মুশকিল। মাঠের মধ্যে দুটো লোক নিশ্চয় ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অন্য সন্দেহই বা কী করবে? ভাববে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিকিরা বলল, “খবর বলুন, স্যার।”

তারাপদ বলল, “খবর অনেক। কিন্তু এখানে বলব?”

“এখানেই স্যার নিরাপদ। যদি লোকটা এখনি না ফিরে আসে,তা হলে এই হল বেস্ট জায়গা।”

“যদি আসে?”

“সামনে গিয়ে মনের সুখে নিজেরা গল্প করবেন, লাফাবেন, নাচানাচি করবেন, যেন ওর মনে হয় আপনারা কলকাতার লোক, ছেলেমানুষ, বাইরে বেড়াতে এসে বেজায় খুশি হয়েছেন। “

“আপনাকে যদি দেখতে পায়?”

“পাবে না স্যার, পাবে না। আমি মিলিটারির পজিসন নিয়েছি।”

চন্দন একটা সিগারেট ধরাল।

কিকিরা বললেন, “দিন স্যার, একটা ধোঁয়া দিন। টানি।”

কিকিরা সিগারেট নিয়ে ধরালেন।

তারাপদ খুব সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা বলল। বলে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটা দিল। তার গলার স্বর থেকে বোঝা যাচ্ছিল, তারাপদ উত্তেজনা, ভয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধার মধ্যে রয়েছে।

কিকিরা মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। আজ তাঁর বেশবাস খানিকটা অন্যরকম। পরনে পাজামা, গায়ে কেমন এক আলখাল্লা ধরনের জামা। মাথায় গরম হনুমান-টুপি। টুপির তলার দিকটা গুটোনো। পায়ে খাকি কেডস্ জুতো।

চন্দন বলল, “মশাই, ভুজঙ্গ আত্মা নামায়; আপনি জানেন?”

কিকিরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। “জানি।”

“ব্যাপারটা কী?”

“ব্যাপারটা আপনারা এমনিতে বুঝবেন না। একে বিদেশিরা পেঁয়াস। বলে।”

“সেঁয়াস? সেটা আবার কী?”

“সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, আত্মাটাত্মা নামানো হয়, আত্মাদের দিয়ে নানারকম ভেলকি দেখানো হয়।”

“আপনি আত্মা মানেন?”

“আমার মানামানির কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আত্মা মানি কিনা আমি জানি না। তবে ভুজঙ্গর আত্মাটাত্মা মানি না।”

তারাপদ বলল, “তা হলে ও কেমন করে ওই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটাল?

কিকিরা চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন, “কেমন করে ঘটল তা আমি বলতে পারব না। নিজের চোখে দেখলে বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু স্যার, আমি বলছি, এ হল ভেলকি। বড় রকমের ম্যাজিক। বিশ্বাস করবেন না। ভুজঙ্গ এই ভেলকি দেখিয়েই তার প্রতিপত্তি করেছে, বহু লোকের সর্বনাশও করেছে সেই সঙ্গে। কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত পাগলের মতন হয়ে গেছে, কারও কারও যথাসর্বস্ব গিয়েছে। আপনারা ওই পিশাচের ধোঁকায় ভুলবেন না।”

চন্দন বলল, “আপনি আমাদের কী করতে বলছেন তা হলে?”

“আমি বলছি, আপনারা রয়ে সয়ে থাকুন। ভয় পাবেন না। চোখ খুলে ভুজঙ্গর বাড়ির সবকিছু লক্ষ করার চেষ্টা করুন। আপনাদের ও প্রাণে মারার সাহস করবে না।…শুনুন স্যার, এই মানুষটা–কিকিরা দি গ্রেট–একেবারে অপদার্থ নয়, যশিডিতে আমার অনেক মক্কেল আছে,তার মধ্যে একজন রয়েছে পুলিসের লোক–তেওয়ারিসাহেব। আমি তাঁকে বলে এসেছি। ভুজঙ্গ যদি বেশি চালাকি করার চেষ্টা করে, এবার আমি ওকে ছাড়ব না।”

তারাপদ কিকিরার মুখ দেখতে লাগল। মানুষটির চোখ দেখলে বোঝা যায়–কিসের যেন এক জ্বালা তার চোখে ঝকঝক করে উঠেছে।

মাথার টুপিটা খুলে নিলেন কিকিরা, রোদে মাথা তেতে উঠেছে। বললেন, “ভুজঙ্গ এখনো তার আসল চাল চালেনি, স্যার। কাল সে আপনাদের ভেলকি দেখিয়ে ঘাবড়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ধরুন আজ কিংবা আগামী কাল সে আসল চাল চালবে।”

“কী চাল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল ।

কিকিরা বললেন, “আমার মনে হচ্ছে–চালটা আপনাকে নিয়ে। ভুজঙ্গ হয়ত আপনাকেই সব দিয়ে যেতে চায়, কিন্তু দিয়ে যাবার আগে সে আপনার সঙ্গে শর্ত করতে চাইবে। কিসের শর্ত আমি বুঝতে পারছি না! ভুজঙ্গ এত শঠ আর শয়তান যে তার চাল আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই বলছি–আপনারা ধৈর্য ধরে থাকুন। দেখুন। ভয় পাবেন না। আমি এখানেই থাকব। আপনাদের খোঁজখবর করব। যদি কোনো বিপদে পড়েন ভুজঙ্গর আস্তাবলে রামবিলাস বলে যে কোচোয়ান আছে তাকে বলবেন। রামবিলাস আমার লোক। বুঝলেন? আমি কোথায় থাকব সে জানে?”

তারাপদরা অবাক হয়ে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। চন্দন বলল, “ভুজঙ্গের বাড়িতে আপনার লোক কে কে আছে?”

কিকিরা যেন কতই লজ্জা পেয়েছেন, এমনভাবে হাসলেন। বললেন, “স্যার, আমার ধাতটাই হল ম্যাজিশিয়ানের, সব খেলাই ধীরেসুস্থে দেখাতে হয়, ঝট করে দেখাতে নেই। যথাসময়ে সবইদেখতে পাবেন।”

তারাপদ বলল, “কিকিরাবাবু, আপনি সাধুমামাকে চেনেন?

কিকিরা কেমন একটু হেসে বললেন, “চিনি।”

“কেমন চেনেন?”

“ভাল করেই চিনি। দয়া করে আমায় এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনারাও আর দেরি করবেন না। এবার ফিরতে শুরু করুন। ওই লোকটার ফেরার সময় হয়ে গেছে।…শুনুন, আর-একটা কথা বলে দিই। বাড়িতে এমনভাবে থাকবেন যেন ভুজঙ্গর ভেলকি দেখে আপনারা একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন। কাউকে বুঝতে দেবেন না, আপনারা ব্যাপারটা সন্দেহ করেছেন।…আর হ্যাঁ, কাল আমি আপনাদের জন্যে একটা জিনিস নিয়ে আসব। আজকের রাত্রের খেলাটা আগে দেখে নিন, দেখুন ভুজঙ্গ কী করে।”

তারাপদরা উঠতে লাগল। “কাল কোথায় দেখা হবে?”

“কাল আপনারা ওই জঙ্গলের দিকে বেড়াতে যাবেন। আমি থাকব । একটা ভাঙা সাঁকো আছে, নালার মতো নদী, শুকনো; ওখানে থাকব।”

উঠে দাঁড়িয়ে চন্দন হেসে বলল, “স্যার, আজ আপনার একটা ইংলিশ শুনলাম না।”

কিকিরা হেসে বললেন, “শুনবেন, ঠিক সময়ে শুনবেন। এখন ভুজঙ্গ আমার ইংলিশ স্টিম করে দিচ্ছে। পেটে কিছু থাকছে না, স্যার। পেটে না থাকলে কি করে ইংলিশ হবে? ইংলিশ হল পেট্যারন্যাল ব্যাপার, পেট প্লাস ইন্টারন্যাল সন্ধি করুন…”

চন্দন হো হো করে হেসে উঠল।

পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে দুজনেই রাস্তায় নেমে এল। হাত নাড়ল। কিকিরাও হাত তুললেন।

ফিরতে লাগল দুজনেই।

তারাপদ বলল, “চাঁদু, আমার মনে হচ্ছে–ভুজঙ্গর বেশ কিছু শত্রু আছে। তারা একটা দল করেছে। সেই দলে সাধুমামা, কিকিরা, রামবিলাস না কি নাম বললেন কিকিরা–ওরা আছে। আর ভুজঙ্গর দলে আছে তার চেলারা।”

চন্দন বলল, “তাই মনে হয়।”

আরও খানিকটা এগিয়ে চন্দন ঘাড় ঘোরাল পিছনে। সাইকেলে-চড়া লোকটিকে দেখতে পেল না; কিকিরাকেও চোখে পড়ল না।

দুপুরটা ভালই কাটল। ভুজঙ্গভূষণের লোকজন আতিথ্যের ব্যাপারে কোনো কৃপণতা করল না। খাওয়া, শোওয়া, বাগানে ঘুরে বেড়ানো–কোনো দিকেই কারও কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারাপদদের কেমন মনে হচ্ছিল, তারা যেন কাদের নজরে নজরে রয়েছে। সাধুমামার সঙ্গে বার দুই চোখাচুখি হয়েছে, হওয়া মাত্র সাধুমামা সরে গেছেন।

বিকেল পড়তে না পড়তে ফুরিয়ে গেল। তারপর সন্ধে। ৪ ।

তারাপদর তৈরি । আজ আবার সেই রহস্যময় ঘরেগিয়ে বসতে হবে। ভুজঙ্গ গতকালই জানিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার কী দেখতে হবে কে জানে?

তারাপদ বরাবরই ভিতু ধরনের। বড় বেশি নিরীহ। কিকিরা যতই সাহস দিন, ভূত, প্রেত, আত্মা বিশ্বাস করুক আর না করুক তারাপদ, তবু বিকেল থেকেই বেশ বিচলিত বোধ করতে লাগল। সন্ধের মুখে তার মুখ কেমন শুকিয়ে এল। তারাপদ চন্দনকে বলল, “চাঁদু, আমার এ-সব ভাল লাগে না। মিস্ট্রিই বল আর অলৌকিক ব্যাপারই বল–কোনোটাই আমি সহ্য করতে পারি না। “ চন্দন বলল, “উপায় নেই ভাই, ভুজঙ্গর সব রকম খেলা দেখতেই হবে। লোকটার মনে কী আছে এখনো বোঝা যায়নি।”

তারাপদ বলল, “আজ আমি স্পষ্টই বলব, ভুজঙ্গকে বলে দেব–আত্মাটাত্মা। আমি দেখতে চাই না। আপনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে চাই। আপনার মুখ দেখতে চাই। হয় সাফসুফ কথা বলুন মশাই, না হয় ছেড়ে দিন, বাড়ি চলে যাই–আপনার সম্পত্তি আমি চাই না।”

দুই বন্ধুর কথাবার্তার মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় এসে তাদের ডাকল। “এসো।”

.

সেই একই ঘর । কালকের মতনই অন্ধকার । বাতি যেটুকু জ্বলছে তাতে পাশের মানুষকেও আবছা দেখায়। ধূপধুনো গুগগুলের সেই রকম গন্ধ । তফাতের মধ্যে আজ একটা ছোট টেবিল রয়েছে গোল ধরনের, তার তিন দিকে চেয়ার।

তারাপদরা বসল।

ওরা বসার পর আচমকা কোথা থেকে ভারী গলায় স্তোত্র পাঠের মতন গানের সুর ভেসে এল । তারপর সেটা স্পষ্ট হল, যাকে বলে। জলদগম্ভীর–সেই স্বরে কে যেন স্তোত্র পাঠ করতে লাগল। সংস্কৃত স্তোত্র । কে কোথায় গান করছে বোঝবার আগেই সেই গম্ভীর স্বর যেন কেমন অন্যমনস্ক করে ফেলল তারাপদকে ।

স্তোত্রের মধ্যেই ভুজঙ্গভূষণ এলেন। কখন এলেন বোঝা গেল না। তাঁর বসার আসনেই বসলেন। মাথার ওপর সেই লাল আলো জ্বলে উঠল। ভুজঙ্গভূষণের পরনে রক্ত-গৈরিক বসন। একটা বড় রুদ্রাক্ষ ঝুলছে গলায় । মুখের ওপর সেই আবরণ।

স্তোত্র পাঠ বন্ধ হয়ে গেল।

ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন প্রথমে। বললেন, “তারাপদ, কাল তুমি ভয়, পেয়ে গিয়েছিলে। তোমার বন্ধুও ভয় পেয়েছিল। আজ ভয় পেয়ো না যাঁরা তোমার আত্মীয়–মা, বাবা, বোন–”

“মা, বাবা, বোন-” তারাপদ চমকে উঠে বলল, গলার স্বর যেন বুজে আসছে।

“হ্যাঁ, তোমারই নিজের লোক। এঁদের আত্মা যখন আসেন তখন তোমার ভয় কী? এঁরা কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। অনেক দূর থেকে তারা আসেন, আসতে তাঁদের কষ্টও হয়। এই মর্ত্যলোকে তাঁরা আসতে চান না, তবুও আমরা যখন ডাকি, না এসে পারেন না। আজ আমি তোমার মাকে প্রথমে তাকব।”

“মা?”

“তোমার মা আমার আত্মীয়া। আমরা তাকে ছেলেবেলায় বেণু বলে ডাকতাম। বলতে গেলে আমার বোনেরই মতো। আমি বেণুকে ডাকব।”

তারাপদর গায়ে কাঁটা দিল। মা! মা আসবে? কোন্ ছেলেবেলায় বাবাকে সে হারিয়েছে, স্কুলে পড়ার সময়, তারপর মা-ই ছিল তার সব । কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছে, সেই মা আজ আসবে? তার কাছে? মা তা হলে আজও আছে, এ-জগতে নয়, অন্য জগতে, হয়ত স্বর্গে। মা কি তাকে দেখতে পায়?

তারাপদর বুকের মধ্যে কত দুঃখ যেন টনটন করে উঠল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার মা আসবে। এই ঘরেই আসবে। কিন্তু তুমি তাকে দেখতে পাবে না। আত্মা অদৃশ্য। ছায়ারূপে তাঁরা আসেন, চলে যান। মানুষের চোখ তাঁদের দেখতে পায় না। কোনো কোনো চিহ্ন তাঁরা রেখে যান, স্পর্শও দিয়ে যান–কিন্তু সব সময় নয়, কখনো কখনো, এসব কাজ করতে তাঁদের কষ্ট হয়।”

কথা শেষ করে ভুজঙ্গভূষণ পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজালেন।

ঘণ্টা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভুজঙ্গভূষণের পিঠের দিক থেকে ভেলভেটের পরদা সরিয়ে একটি মেয়ে এল। ভাল করে দেখা যায় না মেয়েটিকে। তবু যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল, কিশোরী মেয়ে, বছর পনেরো হয়ত হবে বয়স, রোগা দেখতে, ধবধবে ফরসা রঙ, লম্বাটে মুখ, মাথার চুল এলো করা, পুনে ঘন কালো শাড়ি জামা। মেয়েটি এল। কিন্তু কিছুই দেখল না । কোনো দিকেই তাকাচ্ছিল না। ভুজঙ্গভূষণের পায়ের দিকে রাখা ঘণ্টাটা তুলে লি। নিয়ে তারাপদদের কাছে এসে বসল। ঘণ্টাটা নিচে টেবিলের তলায় নামিয়ে রাখল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, এই মেয়েটির মধ্যে দিয়ে তোমার মা হনবেন। ও হল আধার, ওর মধ্যে দিয়ে তোমার মাকে আসতে হবে। তোমরা দুজনে ওর হাতে হাত ছুঁয়ে বসো। পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখবে। ও তোমাদের দেখিয়ে দেবে।”

তারাপদ কিছু ভাবতে পারছিল না। বিহ্বল বোধ করছিল।

চন্দনের মনে হল, এই হয়ত সেই মেয়ে–গতকাল যাকে সে এক লহমার জন্যে দোতলায় দেখেছিল।

ছোট গোল টেবিলের তিন দিকে চেয়ার। মেয়েটি একটি চেয়ারে বসল। ইশারায় তারাপদদের চেয়ার সামান্য সরিয়ে নিতে বলল। চেয়ার সাজিয়ে নেবার পর দেখা গেল, টেবিলের ওপর হাত ছড়ালে তারাপদর একটা হাত মেয়েটির হাত ছোঁয়, অন্য হাত চন্দনের হাত ছোঁয়। চন্দনেরও সেই একই অবস্থা, তার বাঁ হাত তারাপদর হাত ছুঁয়ে রয়েছে, ডান হাত মেয়েটির হাত ছুঁয়েছে। এ যেন বাচ্চা বয়েসে সেই গোল হয়ে হাতে হাত ধরে খেলার মতন।

মেয়েটি তার পা দু পাশে বাড়িয়ে দিল। ইশারায় তারাপদদের বলল, ওদের এক একটা পা দিয়ে তার পা ছুঁয়ে থাকতে।

সামান্য বিব্রত বোধ করলেও তারাপদরা পা বাড়াল ।

মেয়েটির পা বড় শক্ত শক্ত লাগল তারাপদর। অবশ্য বুড়ো আঙুলের কাছটায় আলগা করে ছুঁয়ে থাকল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি এবার মনে মনে তোমার মাকে ডাকো, তারাপদ। চোখ বন্ধ করে। একমনে। আমিও তাকে ডাকছি।” বলে ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় কিসের যেন একটা মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন।

ঘরের সমস্ত আলো নিবে গেল। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার।

তারাপদ চোখ বন্ধ করে মার কথা ভাবতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল; তবু সে মা-র কথা না ভেবে থাকতে পারল না। চন্দন প্রথমটায় চোখের পাতা খুলে রেখেছিল। কিন্তু চোখ খুলে রাখা না রাখা সমান; দু চোখই যেন অন্ধ । কিছু দেখা যায় না; শুধু কালো আর কালো। চন্দনও চোখের পাতা বুজে ফেলল। তারাপদর মাকে সে দেখেছে, ভালো করেই জানত তাঁকে। চন্দনও তারাপদর মার কথা ভাবতে লাগল। আর মাঝে মাঝে অনুভব করছিল, তার একটা হাতের আঙুল মেয়েটির হাতের ওপর রাখা, অন্য হাতটি তারাপদর হাতের ওপর রয়েছে।

কতক্ষণ সময় যেন চলে গেল। কোনো শব্দ নেই। শেষে ভুজঙ্গভূষণ চাপা গলায় বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? তুমি কি এসেছ?”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার চুপচাপ। আরও কিছু সময় গেল।

ভুজঙ্গভূষণ এবার আবার বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? আমরা তোমায় ডাকছি, তুমি এসেছ?”

হঠাৎ টেবিলের তলার দিকে মৃদু করে ঘণ্টা বেজে উঠল ।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তুমি যদি সত্যি সত্যি নিজে এসে থাকো—ঘণ্টাটা একবার বাজাও, বাজিয়ে থামিয়ে দাও, আবার বাজাও।”

ঘণ্টা সেইভাবেই বাজল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছ? যদি পাও অন্যভাবে ঘণ্টা বাজাও। একটানা।”

এবারও সেই রকম বাজল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে আমি এখানে এনেছি। তুমি তাকে বলল আমার ইচ্ছা মতন সে যেন চলে। আমি তার ভাল চাই।”

ঘন্টাটা আস্তে আস্তে বাজল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে আর কেউ এসেছে বেণু? কে এসেছে?”

ঘণ্টা বাজল না।

ভুজঙ্গভূষণ কেমন আকুল স্বরে বললেন, “কে এসেছে বেণু? তোমার স্বামী?”

ঘণ্টা এবার জোরে বেজে উঠল। তারাপদ সমস্ত কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠল, বাবা!”

বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত টেনে নিয়েছিল। মেয়েটি কেমন শব্দ করে উঠল । যেন ঘুমের ঘোর থেকে চমকে উঠে শব্দ করেছে।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কী হল? কী হল?”

বাতি জ্বলে উঠল। সেই মৃদু আলো। মেয়েটি টেবিলের ওপর মুখ রেখে। পড়ে আছে। হাত ছড়ানো। থরথর করে কাঁপছে।

ভুজঙ্গভূষণ তারাপদকে বললেন, “কী করেছিলে তোমরা? বেণু চলে গেছে।”

তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “কিছু করিনি । হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম।”

কঠিন গলায় ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “মূর্খ!…সমস্ত বৃথা গেল।..যাও, তোমরা চলে যাও। ওকে ছুঁয়ো না। ধীরে ধীরে ও সুস্থ হয়ে উঠবে।”

তারাপদরা অপরাধীর মতন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

.

আট

সকালে তারাপদর চেহারা দেখে চন্দন বেশ ঘাবড়ে গেল। মুখ কেমন থমথম করছে তারাপদর, উদাস চোখ, বার বার নিশ্বাস ফেলছে শব্দ করে, কিসের এক দুঃখ যেন তার সমস্ত মুখ ম্লান করে রেখেছে। কথাবার্তা বলতেও তার তেমন ইচ্ছে করছি না। আপন মনে কত কী যে ভাবছে তারাপদ, কে জানে!

চন্দন বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলল, “তুই এত মুষড়ে পড়লে চলবে কেন? কী হয়েছে তোর?”

তারাপদ চুপচাপ, কথার জবাবই দেয় না, শেষে বলল, “কাল আমার মা এসেছিল। একবার যদি দেখতে পেতাম…।”

চন্দন বলল, “তুই সত্যিই বিশ্বাস করিস মাসিমা এসেছিলেন?”

“তুই করিস না?”

চন্দন বুঝতে পারছিল না, বিশ্বাস করা উচিত কি উচিত নয়। সে বিশ্বাস করতেও চাইছে না, আবার অবিশ্বাস করারও জোর পাচ্ছে না।

তারাপদ ধরা-ধরা গলায় বলল, “মার সঙ্গে বাবাও এসেছিল, চাঁদু। আমার বাবা। স্কুলে যখন ক্লাস এইটে পড়ি, সেই সময় বাবা মারা গেছে; এত বছর পরে বাবা এসেছিল…; ইস্ আমি যে কী করলাম!”

তারাপদর চোখ ছলছল করে উঠল; ঠোঁট কাঁপতে লাগল । চন্দন বুঝতে পারল না কী বলবে। তার খারাপ লাগছিল। মাবাবার জন্যে বন্ধুর এই দুঃখ সে বুঝতে পারে, কিন্তু কেমন করে সান্ত্বনা দেবে জানে না। মাথা চুলকে চন্দন বলল, “তারা, এমন তো হতে পারে এ সবই মিথ্যে।”

তারাপদর ভাল লাগল না কথাটা। বন্ধুর দিকে ক্ষোভের চোখে তাকাল। বলল, “মিথ্যে?”

“কিকিরা তো তাই বলেছেন।”

“কিকিরা যা বলবেন তাই সত্যি হবে? বেশ, তুই বল–এটা কেমন করে সম্ভব হল? আমি ওই মেয়েটার একটা হাত আর একটা পা ছুঁয়ে রেখেছিলাম। একবারও ছাড়িনি। তুইও ছুঁয়ে ছিলি। ঠিক কি না?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে ঘন্টাটা কেমন করে বাজল? কে বাজাল?”

চন্দন জবাব দিতে পারল না। সে এই ব্যাপারটা নিয়ে কাল রাত থেকেই। ভেবেছে, ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায়নি। এক যদি এমন হয় যে, ওই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘরে কেউ লুকিয়ে এসে ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিয়ে যায়! কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? লোকটা আসবে, বাজাবে, চলে যাবে–আর তারা দুজনে কিছুই বুঝতে পারবে না?

চন্দন বলল, “আমিও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা তারা, ঘণ্টা যেটা বেজেছিল সেটা আমাদের টেবিলের তলায় ছিল সেটা ঠিক তো?”

“নিশ্চয়। কেন, তোর সন্দেহ হচ্ছে?”

“না, আমারও হচ্ছে না। তবু তোকে কাল যা বলছিলাম রাত্রে, কেউ যদি লুকিয়ে এসে বাজিয়ে দিয়ে যায়?”

“বাজে কথা বলিস না। অত অন্ধকারে এসে ঘণ্টা খুঁজে বাজিয়ে দিয়ে যাবে–আর আমাদের গায়ে পায়ে কোথাও তার ছোঁয়া লাগবে না–তা কি হয়? তুই একটা জিনিস ঠিক জানবি, যতই অন্ধকার থাকুক, তোর গায়ের পাশে কেউ যদি এসে দাঁড়ায় তুই নিশ্চয় বুঝতে পারবি। বাই ইনটিংক্ট।”

চন্দন অস্বীকার করতে পারল না।

তারাপদ বলল, “তারপর আমরা হাত ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বাতি জ্বলে উঠেছিল। যদি কেউ এসে থাকে–অত তাড়াতাড়ি পালাবে কোথায়?”

স্বীকার করে নিল চন্দন। এমন সব রহস্যময় কাণ্ড পর পর দু’ দিন তারা দেখল যে, কোনো রকমেই তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তা হলে কি সত্যিই আত্মা আছে? মানুষ মারা যাবার পর এই জীবলোকে না-থাকলেও অন্য কোনো জায়গায় থাকে? মানে তাদের আত্মা থেকে যায়? হাজার হাজার বছর ধরে কত। মানুষ এই জগতে এসেছে, চলে গেছে। সবাই কি তা হলে অন্য কোনো জগতে–অন্য কোনো লোকে আছে? কোটি কোটি আত্মা সেখানে কেমন করে আছে?

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না চন্দনের। সে ডাক্তার । মানুষ একটা বিচিত্র যন্ত্রের মতন, কে জানে ভগবান কেমন করে এই যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, কিন্তু এই যে যন্ত্র, এর কোনো তুলনা নেই, চাঁদে যাওয়ার চেয়েও এ অনেক রহস্যময়। সেই যন্ত্র যখন অচল হয়ে যায় কোনো কারণে, তখনই মৃত্যু। তারপর আর কিছু থাকতে পারে না।

থাকতে পারে না; কিন্তু এ-সব কেমন করে হচ্ছে? চন্দন অতশত আর ভাবতে পারল না। বলল, “নে ওঠ, কিকিরার সঙ্গে দেখা করার সময় হয়ে গেছে।”

তারাপদ এতই মুষড়ে পড়েছিল যে, কিকিরার কাছে যাবার জন্যে গা করল না। বলল, “আমার আর ভাল লাগছে না। তুই যা।”

চন্দন অবাক বন্ধুকে দেখতে লাগল। “তুই যাবি না মানে?”

“আমার ইচ্ছে করছে না।”

“কিন্তু কিকিরা এই ব্যাপারটা আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারেন।”

“মুখে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যায়, চাঁদু-” তারাপদ বলল, “মন তা মানতে চায় না।”

চন্দন বন্ধুর এই ভেঙে পড়া ভাব পছন্দ করল না। বলল, “তুই এখানে বসে থেকে কী করবি একলা একলা। তার চেয়ে কিকিরার কাছে চল । কিকিরাকে সব বলি। আমার তো মনে হয় কিকিরার পরামর্শ খুব দরকার এখন।”

তারাপদ বলল, “তুই যা। আমি একবার সাধুমামাকে ধরবার চেষ্টা করি । সাধুমামা আমার মা-বাবার কথা সবই জানে। দেখি, সাধুমামাকে দিয়ে যদি কোনো কথা বলাতে পারি ।”

চন্দন কী ভেবে তারাপদর কথায় রাজি হয়ে গেল। তারাপদ যদি সাধুমামাকে দিয়ে দু-চারটে কথা বলাতে পারে, ভালই হবে। চন্দন বলল, “ঠিক আছে তুই এই বাড়ির দিকটায় নজর রাখ, সাধুমামাকে যদি ধরতে পারিস ধর; আমি কিকিরার সঙ্গে দেখা করে আসি। এবাড়িতে সাইকেল আছে। একটা সাইকেল বাগিয়ে এক চক্কর ঘুরে আসতে আসতে পারলে ভাল হয়। চল, দেখি কী করা যায়।”

দুই বন্ধু বাগানের রোদে পায়চারি করতে করতে মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজতে লাগল।

চন্দন একটা সাইকেল জুটিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। তারাপদ সে বাগানেই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে শেষ পর্যন্ত পেয়ারা গাছের ছায়ায় এসে বসে। ছিল। মৃত্যুঞ্জয় আজ তারাপদর সঙ্গ ছাড়তে চাইছিল না। গায়ে যেন লেপটে ছিল অনেকক্ষণ। বোধ হয় চন্দনকে একটা সাইকেল তাড়াতাড়ি জুটিয়ে দিয়ে সে তারাপদকে একলাই পেতে চাইছিল ।

তারাপদ নিরীহ, সরল মানুষ। হয়ত অনেক সময় বোকামি করে ফেলে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় লোকটাকে দেখা পর্যন্ত তার মন যেরকম বিগড়ে আছে, তাতে লোকটার সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইছিল না। তা ছাড়া মানুষ যাকে সন্দেহ করে, তার কাছে মনখোলা হয় না, হতে পারে না। তারাপদ একেবারে বোক নয়, সে মৃত্যুঞ্জয়ের উদ্দেশ্য জানে না যদিও, তবু খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে লাগল। কথাবার্তা বলতে বলতে বুঝল, লোকটা যতই ধূর্ত শয়তান হোক, তার মনের ইচ্ছেটা একেবারে গোপন রাখতে শেখেনি। মৃত্যুঞ্জয় চায় না, তারাপদ এবাড়িতে বেশিদিন থাকে। হ্যাঁ, কথাবার্তা থেকে সেই রকমই আঁচ করল তারাপদ।

বেলা আরও বেড়ে উঠল। শীতের রোদ মাথা-গা তাতিয়ে যখন কপালে ঘাম ফোঁটাতে লাগল, তারাপদ তখন পেয়ারাতলায় একা-একা বসে একটা সিগারেট শেষ করল। এদিক ওদিক তাকিয়েও সে সাধুমামাকে কোথাও দেখতে পেল না। বাগান ফাঁকা। একটা দেহাতী মালী কিছু কাজকর্ম করছিল বাগানের একপাশে সবজি বাগানে; সেও চলে গেছে। ডায়নামোটা আর চলছে না। শব্দ নেই। আকাশ একেবারে নীল। চিলটিল উড়ছে অনেক উঁচুতে।

তারাপদ বারবার তার মা বাবার কথা ভাবছে। বেচারি বাবা, দুঃখী মা। মা যে কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছিল, তারাপদই জানে। মা বাবা বেঁচে থাকলে আজ কি তারাপদর এমন অবস্থা হত?

পেয়ারাতলা ছেড়ে তারাপদ উঠে পড়ল। ভাল লাগছে না। কেন সে এখানে এল? না এলে এমন করে তাকে দুঃখ পেতে হত না। মা বাবাকে তো। সে ভুলেই গিয়েছিল, ভুজঙ্গ নতুন করে সেই দুঃখ জাগিয়ে তুলল। শুধু জাগিয়ে তুলল না, তারাপদর এখন থেকে বারবার মনে পড়বে–তার বাবা, মা বোন–সকলেই যেন আকাশে বাতাসে কোথাও আছে, কোনো ছায়ালোকে, অদৃশ্য আত্মা হয়ে।

অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে তারাপদ আস্তাবলের কাছে আসতেই হঠাৎ তার নজরে পড়ল, খানিকটা তফাতে টালির একটা ভাঙাচোরা ঘরের একপাশে আতা-ঝোঁপের দিকে সাধুমামা দাঁড়িয়ে। কী যেন করছিল সাধুমামা।

তারাপদ একবার চারপাশে তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না। আস্তাবলে ঘোড়া নেই। সহিস বোধ হয় ঘোড়া নিয়ে মাঠে গিয়েছে।

প্রায় চোরের মতন তারাপদ সাধুমামার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে সাধুমামা তারাপদকে দেখতে পেয়ে গেছেন।

সাধুমামা তারাপদকে দেখে ভয়ের চোখে চারপাশে তাকালেন, যেন কেউ তাঁকে দেখে ফেলবে।

তারাপদ বলল, “সাধুমামা!”

আতা-ঝোঁপের আড়ালে মাটিতে বসে পড়লেন সাধুমামা, চোখে ভয়, সারা মুখে উদ্বেগ । ইশারায় তারাপদকে বসে পড়তে বললেন।

তারাপদ বসল। বসে একদৃষ্টে সাধুমামার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “সাধুমামা, তুমি বোবা সেজে বসে রয়েছ কেন?”

সাধুমামা জবাব দিতে পারলেন না। তাঁর গলার শিরা ফুলে উঠল, মুখ কেমন কালচে হয়ে এল, জল এসে পড়ল চোখে । তারপর চাপা গলায়, ভাঙা ভাঙা স্বরে, জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, “প্রাণের ভয়ে।” বলতে বলতে সাধুমামা তাঁর রোগা হাত কপালে তুললেন। তাঁর হাত কাঁপছিল থরথর করে । শিরাগুলোই চোখে পড়ে, বিন্দুমাত্র মেদ-মাংস যেন হাতে নেই, হাড় ফুটে আছে। সাধুমামার গলার স্বর থেকেই বোঝা যায়, তাঁর গলা কি বিশ্রী খসখসে হয়ে গেছে, জিবের কোনো দোষ হয়েছে তাঁর, কথা জড়িয়ে যায়।

তারাপদর কান্না পাচ্ছিল। বেচারি সাধুমামা। যেভাবে সাধুমামা বেঁচে আছেন, তা প্রায় মরে যাবারই সামিল। তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ তোমায় মেরে ফেলবে?”

“মারতে চেয়েছিল। পারেনি।” টেনে-টেনে জড়িয়ে-জড়িয়ে সাধুমামা বললেন।

“কেন?”

“আমি ওর বাধা হয়ে পড়েছিলাম।”

“কিন্তু তুমি আমাদের সব খবরাখবর ওকে দিয়েছ। আমাদের ছবি দিয়েছ।”

“দিয়েছি, বাবা। তখন ওকে বুঝিনি। ও আমায় বশ করে রেখেছিল। আমি তোমাদের ভালই চেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম, ও একটা পাপী, নরকেও ওর জায়গা নেই। পশু…পশু..একেবারে পশু।” সাধুমামা অনেক কষ্ট করে কথাগুলো বললেন। বলতে তাঁর কী পরিশ্রম যে হচ্ছিল, তারাপদ বুঝতে পারল।

“কথা বলতে তোমার বড় কষ্ট হয়, না?”

“হ্যাঁ। বড় কষ্ট।“

তুমি আমায় একটা কথা বলো সাধুমামা। ভুজঙ্গ কি আত্মা নামাতে পারে?”

সাধুমামা কিছু বলার আগেই মৃত্যুঞ্জয়কে তারাপদ দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ধক করে লাফিয়ে উঠল যেন। সর্বনাশ! মৃত্যুঞ্জয় যদি তাদের দেখতে পায়, সাধুমামার ভীষণ অবস্থা হবে। তারাপদ ভয়ে কাঠ হয়ে বলল, “সাধুমামা, মৃত্যুঞ্জয়।”

মৃত্যুঞ্জয়ের নাম শোনামাত্র সাধুমামা আতা-ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়ে হাত-পা গুটিয়ে কুণ্ডলী হয়ে গড়াতে গড়াতে আরও হাত কয়েক দূরে সরে গেলেন। জায়গাটা আরও ঝোপেঝাড়ে ভরা, বুনো তুলসীর ঝোঁপ, কাঁটা-ঝোঁপ, তারই মধ্যে এক ধরনের বুনো লতা গাছপালার গা জড়িয়ে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে। সাধুমামা ইশারায় তারাপদকে চলে যেতে বললেন।

তারাপদ আড়াল থেকে মৃত্যুঞ্জয়কে লক্ষ করতে লাগল। সামান্য সময় লক্ষ করার পর দেখল, মৃত্যুঞ্জয় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে । বাড়ির ভেতরেই যাচ্ছে।

তারাপদ বসে বসেই বলল, “সাধুমামা, কাল ভুজঙ্গ আমার মা-র আত্মাকে এনেছিল। বাবাও এসেছিল। আমি গোলমাল করে ফেলায় সব নষ্ট হয়ে গেল ভুজঙ্গ কেন আমার মা-বাবাকে এনেছিল? সত্যিই কি তারা এসেছিল?”

সাধুমামা হাত বেড়ে তারাপদকে চলে যেতে ইশারা করছিলেন। বললেন, “ভুজঙ্গ তোমায় এইখানে এবাড়িতে আটকে রাখতে চায়। সারা জীবনের মতন। তোমাকেও সে ভুজঙ্গ করতে চাইছে। খবরদার, তুমি থেকো না। এই সম্পত্তির জন্যে নিজের সর্বনাশ তুমি করো না, বাবা। তুমি পাপী হয়ো না। এ বড় পাপের জিনিস।..যাও, আর এখানে থেকো না। উঠে যাও। পরে কথা বলব।”

তারাপদ কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে সাধুমামাকে দেখল। অবশ্য সাধুমামাকে দেখা যাচ্ছে না আর, আড়ালে মাটিতে শুয়ে আছেন, এমনভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছেন যে, মুমূর্ষ জন্তুর মতন দেখাচ্ছে।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তারাপদ উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে চলল।

.

আরও খানিকটা বেলায় চন্দন ফিরল।

তারাপদ তার বিছানায় শুয়ে ছিল ছাদের দিকে তাকিয়ে। খোলা জানলা দিয়ে রোদ আসছে না, কিন্তু আলো আসছিল। উজ্জ্বল আলো। এক জোড়া ভোমরা ঘরের মধ্যে উড়ছে, জানলা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে, আবার কখন এসে ঘরে ঢুকে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত তারা উড়ে গেল বাইরে। তারাপদও নিশ্চিন্ত বোধ করল ।

চন্দন এসে বলল, “তারা, তুই না-যাওয়ায় কিকিরা খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন।”

“কেন?”

“কিকিরা ভয় পাচ্ছেন, তুই না শেষ পর্যন্ত ভুজঙ্গর খপ্পরে পড়ে যাস।”

তারাপদ তেমন খুশি হল না; বলল, “খপ্পরে পড়ে যাবার কী দেখলেন উনি?”

চন্দন বলল, “তুই আত্মা-নামানোর ব্যাপারে বিশ্বাস করে ফেলেছিস। ভুজঙ্গ এই চাল দিয়ে তোকে বাগিয়ে ফেলবে।”

“মানে?”

“মানে এর পর ভুজঙ্গ যা বলবে–তুই তাই করবি।”

তারাপদ হঠাৎ যেন কেমন রেগে উঠল। বলল, “কিকিরা যা বলবেন তাই মেনে নিতে হবে? উনি মুখেই বলছেন, কাজে কিছু দেখাতে পারছেন? বোঝাতে পারছেন? কালকের ব্যাপারটা কেমন করে হল–কিকিরা আমায় বোঝান, তারপর অন্য কথা।”

চন্দন বলল, “কিকিরা বললেন, ঘরে কোনো আত্মাটাত্মা নামেনি। এটা ওই মেয়েটিরই কাজ।”

তারাপদ এত অবাক হয়ে গেল যে, কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর বলল, “কী বাজে কথা বলছিস তুই? মেয়েটা কেমন করে ঘণ্টা বাজাবে! আমরা তার হাতে হাত রেখে বসে ছিলাম, আমাদের পা তার পা ছুঁয়ে ছিল। তুই কি বলতে চাস মেয়েটার আরও একটা লুকোনো হাত ছিল? বাজে বকিস না চাঁদু।”

চন্দন বলল, “কিকিরাকে আমি সে-কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, হাতে হাত রাখা, পায়ে পা ছোঁয়ানো সবই ঠিক কিন্তু ওরই মধ্যে একটা ভেলকি আছে।”

“ভেলকি আছে বললেই তো চলবে না, তার প্রমাণ কী?”

“কোনো প্রমাণ নেই, মানে আমরা কাল ধরতে পারিনি। ওইভাবে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বসিয়ে আত্মা নামালে লোকে সমস্ত ব্যাপারটায় এত অবাক হয়ে যায় যে, ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে খেয়াল করে না। মেয়েটা যদি কোনো চালাকি করে থাকে আমরা ধরতে পারিনি।”

“কোনো চালাকি করেনি,” তারাপদ বলল।

চন্দন একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে। আজ যদি আবার ওই মেয়েটা আসে আমিও তক্কে তক্কে থাকব।”

“থাকিস।”

চন্দন বেশ বুঝতে পারল, তারাপদ তার মা-বাবার আত্মা আসার ব্যাপারটা বিশ্বাস করে নিয়েছে প্রায়। না, বন্ধুর সে দোষ ধরছে না। মানুষের এই দুর্বলতায় দোষ ধরা যায় না। কিকিরাও বলেছেন, ভুজঙ্গ তারাপদর দুর্বল জায়গায় ঘা মারছে, এই ঘা দিয়েই সে তারাপদকে বশ করবে, তাকে নিজের মুঠোয় এনে ফেলবে। চন্দন যে কেমন করে বন্ধুকে ভুজঙ্গর হাত থেকে বাঁচাবে বুঝতে পারছে না। কিকিরা বলেছেন, আপনি স্যার এখন থেকে আরও সজাগ থাকবেন, আরও নজর রাখবেন সব ব্যাপারে।

.

চন্দন আজ খুব সতর্ক থাকবে। আজ সে দেখবার চেষ্টা করবে কেমন করে আত্মা আসে, কেমন করে ঘন্টা বাজে। কিকিরা তাকে একটা জিনিস দিয়েছেন। ছোট্ট জিনিস, লুকিয়ে রাখা যায়। চন্দন আজ যখন ওপরের ওই ভুতুড়ে ঘরে যাবে–তখন জিনিসটা লুকিয়ে নিয়ে যাবে কাপড়ের মধ্যে। চন্দনের ইচ্ছে ছিল, ইনজেকশনের উঁচটা লুকিয়ে নিয়ে যাবার। যদি সে দেখত, বা তার সন্দেহ হত, আত্মার নাম করে আশেপাশে কেউ ঘোরাঘুরি করছে, তবে একবার উঁচটা ফুটিয়ে দিত গায়ে। আত্মা হলে নিশ্চয় ছুঁচ ফুটত না, বাতাসে কি আর ছুঁচ ফোটে? কিন্তু কোনো মানুষ হলে, সে যেমনই মানুষ হোক, আচমকা উঁচ ফুটলে উঃ করে উঠত। আর তখনই ব্যাপারটা জানা যেত। বোঝা যেত, ভুজঙ্গ আত্মা নামায় না মানুষ নামায়।

চন্দন বিছানায় শুয়ে এইসব ভাবতে লাগল, আর তারাপদ বসল দাড়ি কামাতে।

দাড়ি কামাতে কামাতে তারাপদ বলল, “চাঁদু, সাধুমামার সঙ্গে আজ আমার কথা হয়েছে।”

চন্দন তাকাল।

তারাপদ বলল, “সাধুমামাকে আমি দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করেছি–এমন সময় মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেলাম। বেশি কথা হল না। সাধুমামা কথা বলতে পারে–কিন্তু কেমন জড়িয়ে-জড়িয়ে। খুব কষ্ট হয়। সাধুমামা আমায় বলল, ভুজঙ্গ আমায় এইখানে আটকে রাখতে চায়। কেন বল তো?”

চন্দন বলল, “কিকিরাও তাই বললেন।”

“কিন্তু কেন?”

“ভুজঙ্গ মারা যাবার পর তুই আর-এক ভুজঙ্গ হয়ে থাকবি বলে।”

“আমি কেন ভুজঙ্গ হয়ে থাকব?”

“ভুজঙ্গই তোকে সে কথা বলবে। আমি কেমন করে জানব!”

.

সন্ধেবেলায় আবার সেই আত্মা-নামানোর ঘরে তারাপদরা এসে বসল। তেমনই অন্ধকার ঘর, মিটমিটে আলো জ্বলছে গুটি দুই, সেই একই ভাবে টেবিল-চেয়ার সাজানো, বাড়তির মধ্যে একটা নিচু ধরনের টেবিল ভুজঙ্গর কাছাকাছি রাখা, তার ওপর দু-একটা জিনিস; গোল বয়ামের মতন দেখতে।

তারাপদরা বসে থাকল তো বসেই থাকল। ঘরের সেই অন্ধকারে চোখ যেন নরম হয়ে আসছিল। গন্ধও আজ চমৎকার লাগছিল, কেমন একটা আবেশ আসছিল। হঠাৎ চন্দন উঠে পড়ে তারাপদকে তার চেয়ারে আসতে বলল । তারাপদ কিছু বুঝল না। কিন্তু চেয়ার বদল করল।

চন্দন ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করতে লগল । পর পর তিন দিন এই ঘরে এল তারা। এখন খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রথম দিনের মতন অতটা গা ছমছম করে না। চন্দন দেখল, এই ঘরের বাইরে মন একরকম থাকে কিন্তু ঘরটায় ঢুকলেই ধীরে ধীরে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায় । সেই বেড়ালটাকেও চন্দন দেখল। চোখের মণি দুটো জ্বলছে।

আরও খানিকটা পরে ভুজঙ্গভূষণ এলেন। তাঁর মাথার ওপরকার চোরা লাল আলো জ্বলে উঠল। ঘরের অন্য বাতি দুটো নিবে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। ভুজঙ্গভূষণের একই বেশ : রক্তগৈরিক বসন, মুখের ওপর সেই মুখোশ, গলায় বিশাল রুদ্রাক্ষমালা। তিনি এসে বসার পর সেই কালকের মতন স্তোত্র পাঠ হল। গ্রামোফোন রেকর্ডে যে-ভাবে গান হয়, সেইভাবেই । এই ঘরের কোথাও এই গান-বাজাবার ব্যবস্থা আছে। ভেতর থেকে কেউ বাজায়, বন্ধ করে। যে বাজায় সে-ই বোধ হয় ঘরের আলো জ্বালায় । চন্দন আজ সমস্ত কিছু লক্ষ করতে লাগল।

স্তোত্রপাঠ শেষ হবার পর একেবারে স্তব্ধ সব। সেই স্তব্ধতা ভেঙে ভুজঙ্গভূষণ গম্ভীর স্বরে সংস্কৃতে কী-যে মন্ত্রপাঠ করলেন। তারপর তারাপদকে বললেন, “তারাপদ, তুমি কি তোমার মা বাবাকে আজ আবার ডাকতে চাও?”

তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”

একটু থেমে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কাল তুমি–” তোমরা যা করেছ তাতে বড় ক্ষতি হয়েছে। ওই মেয়েটি–যার মধ্যে তোমার মা-বাবার আত্মা এসেছিলেন–আচমকা তোমরা তার হাত থেকে হাত উঠিয়ে নেবার পর সে এক রকম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পরে তার জ্ঞান আসে। খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মিডিয়ামদের স্নায়ু হল সূক্ষ্ম তারের মতন–একটুতেই গোলমাল হয়ে যায়।”

তারাপদ লজ্জা পেল। বলল, “আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।”

“তোমার মা বাবার আত্মাও কষ্ট পেয়েছেন। তোমরা এখনকার মানুষ, তোমাদের বোঝার সাধ্য নেই এইভাবে আত্মাদের আসতে-যেতে কত কষ্ট হয়। ডাকলেই কি তাঁরা আসেন? না–না। অনেক সময় হাজার বার ডাকলেও আসেন না। আবার যখন আসেন, তখন তাঁরা নিজেরা না চলে যাওয়া পর্যন্ত বিদায় দিতে নেই, এতে তাঁদের আরও কষ্ট হয়। কাল তোমরা তাঁদের কষ্ট দিয়েছ। আজ তাঁরা আবার আসবেন কিনা আমি বলতে পারছি না।”

“আসবেন না?” তারাপদ ব্যাকুল হয়ে বলল।

“কেমন করে বলব?”

“আপনি ডেকে দিতে পারেন না?”

“চেষ্টা করি। দেখি।”

ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা বাজালেন।

কয়েক মুহূর্ত পরেই সেই মেয়েটিকে দেখা গেল। ঘন কালো শাড়ি, কালকের মতনই, সিল্কের শাড়িই হবে; পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে না, শাড়ি লুটোচ্ছে কার্পেটে। মাথায় এলো চুল, পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো। মুখ বড় সাদা, অবশ্য লাল আলোয় কেমন লালচে দেখাল।

মেয়েটি ঘণ্টা উঠিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছে চলে এল। একবার শুধু তারাপদ আর চন্দনকে দেখল। ওর দুই চোখ কেমন টানা টানা ছোট দেখাল, যেন ঘুম জড়িয়ে আছে।

কালকের মতন করেই বসল তিনজনে গোল টেবিল ঘিরে। মেয়েটির একটা ছড়ানো হাতের ওপর তারাপদর হাত, আঙুলে আঙুলে ছোঁয়ানো, অন্য হাতটি চন্দনের দিকে বাড়ানো। চন্দন তার হাত এমন করে মেয়েটির আঙুলে ছুঁইয়ে রাখল যেন একটু হাত কাঁপলেই সে বুঝতে পারে। পায়ে পা ছোঁয়ানো থাকল। চন্দন বুঝতে পারল না, মেয়েটির পায়ের আঙুল এত শক্ত কেন? হাড়-হাড় বলেই হয়ত।

ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

ভুজঙ্গ বললেন, “তারাপদ, একমনে নিবিষ্টচিত্তে ওঁদের ডাকো।”

তারাপদ চোখ বুজে মা-বাবাকে ডাকতে লাগল। চন্দন চোখের পাতা বন্ধ করল না । তাকিয়ে থাকল। এই অন্ধকার যেন পাহাড়ের কোনো গুহার মধ্যের অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না, চোখের সাধ্য নেই এক বিঘত দূরের জিনিসও অনুমান করতে পারে।

ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।

সময় কেটে যেতে লাগল। চন্দনও যেন আর না-পেরে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল ।

তারাপদ অধীর হয়ে উঠছিল। মা-বাবা আজ কি আর আসবে না? কাতর হয়ে তারাপদ তার মা বাবাকে ডাকতে লাগল।

সময় কেটে গেল আরও কতক্ষণ যেন। মনে হল, আজ আর কেউ আসবে না।

তারাপদ প্রায় যখন হতাশ হয়ে পড়েছে, তখন ঠিক তখন ঘণ্টার মৃদু শব্দ হল।

ভুজঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “কে, বেণু?”

ঘণ্টা বাজল না।

“বেণু, তুমি কি আসোনি?”

কোনো শব্দ হল না।

ভুজঙ্গ এবার বললেন, “কে তুমি? বিষ্ণু নাকি?”

বিষ্ণু তারাপদর বাবার নাম, বিষ্ণুপদ নাম থেকে বিষ্ণু।

এবারও কোনো শব্দ হল না। ঘণ্টা বাজল না।

ভুজঙ্গ নিজেই যেন বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বললেন, “তুমি কে? তারাপদ যদি কেউ না হও, সাড়া দাও।”

ঘণ্টা বাজল না।

ভুজঙ্গ কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, “তুমি কি তাহলে বেণুর মেয়ে?”

এবার খুব আস্তে করে ঘণ্টা বাজল।

তারাপদ কল্পনাই করেনি, তার সেই ছোট্ট বোন পরী আসবে। সেই পরী! কত ছোট্ট ছিল! কী সুন্দর ছিল! তার মাথার ঝাঁকড়া চুল আর ফুটফুটে গায়ের রঙ ছাড়া কিছুই আর মনে নেই তারাপদর। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মাথায় চোট লেগেছিল পরীর। মারা গেল। আহা রে!

তারাপদর সেই ছোট্ট বোন পরী আজ এসেছে। কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারল না তারাপদ, ছেলেমানুষের মতন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

.

নয়

তারাপদ কান্নার আবেগে হাত ছেড়ে দিচ্ছিল প্রায়, আচমকা তার খেয়াল হল, হাত ছেড়ে দিলেই পরী চলে যাবে। কালকের মতন অবস্থা হবে তা হলে, পরীর আত্মা আর এই ঘরে থাকবে না। ওই মেয়েটি–যার মধ্যে দিয়ে পরীর আত্মা এসেছে-টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়বে, অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি জ্বলে উঠবে। ভুজঙ্গভূষণ আজ আর ক্ষমা করবে না। ভীষণ রেগে যাবে।

কথাটা খেয়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে তারাপদ মেয়েটির হাত আরও জোরে চেপে ধরল। চন্দনের হাতও ছাড়ল না।

ভুজঙ্গভূষণ সামান্য অপেক্ষা করলেন। তারাপদর কান্না শুনতে-শুনতে তাকে যেন সময় দিলেন সামলে নেবার।

তারাপদ নিজেকে খানিকটা সামলে নিল।

ভুজঙ্গভূষণ পরীকে উদ্দেশ করেই বললেন, “তোমার নামটা আমার মনে পড়ছে না। বেণুর মেয়ে বলেই তোমায় আমি জানি।”

তারাপদ জড়ানো গলায় বলল, যেন ভুজঙ্গভূষণের ওপর রাগ করেই, “ওর নাম পরী । পরী আমার বোন। একটি মাত্র বোন।”

ভূজঙ্গভূষণ কান দিলেন না তারাপদর কথায়। পরীকেই বললেন, “তুমি একলা এসেছ? যদি একা এসে থাকো, চুপ করে থেকো যদি সঙ্গে কেউ এসে থাকে–ঘণ্টা বাজিয়ে। একবার ।…তুমি একলা এসেছ?”

ক’ মুহূর্ত কোনো শব্দ হল না। তারপর ঘণ্টা বাজল। একবার ।

ভূজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু, না বিষ্ণু? শোনো, মন দিয়ে শোনো, আমার কথার জবাবে যদি হ্যাঁ হয়–তবেই একবার ঘণ্টা বাজাবে; যদি না হয় তবে চুপ করে থাকবে–ঘণ্টা বাজাবে না। বুঝলে? এখন বলল, তোমার সঙ্গে কে এসেছে? বেণু?”

একবার ঘণ্টা বাজল।

তারাপদ বুঝতে পারল, মা এসেছে।

চন্দন অন্ধকারে চোখের পাতা খুলল। তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না। এত অন্ধকার চন্দন আর কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না, অন্ধ হয়ে গেলে কি মানুষ চোখে এই রকম অন্ধকার দেখে সর্বক্ষণ? চন্দনের মনে হচ্ছিল খুব ঘন কালো কোনো কালিতে ব্লটিং পেপার চুবিয়ে কেউ যেন তার চোখে চাপা দিয়ে কাপড়ে চোখ বেঁধে দিয়েছে। না, তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করা বৃথা তাতে চোখের মণি টনটন করে ওঠে। চোখ বন্ধ করল চন্দন। মেয়েটির হাত ঠিক আছে, নড়েনি। পায়ের আঙুলও ঠিক রয়েছে, আঙুলে-আঙুলে ছোঁয়ানো আছে। চন্দন ঠিক বুঝতে পারল না, মেয়েটির আঙুল এরকম শক্ত শক্ত লাগছে কেন? হাড় ছাড়া আঙুলে কিছু নেই নাকি?

ভুজঙ্গভূষণের গম্ভীর গলা শোনা গেল। স্পষ্ট করে টেনে টেনে কথা বললেন, “বেণু, তুমি আজ আবার এসেছ, আমরা খুশি হয়েছি। কাল তোমার ছেলে একটু ভুল করে ফেলেছিল। ও ছেলেমানুষ, অত বোঝেনি। তা ছাড়া তারাপদ ভয় পেয়েছিল। ওর কোনো দোষ নেই। ও কেমন করে জানলে তোমরা আত্মা হয়ে সূক্ষ্ম শরীরে অন্য লোকে বাস করছ? ওকে তুমি ক্ষমা করো।”

তারাপদও মনে মনে মা-র কাছে ক্ষমা চাইল । মা, আমায় ক্ষমা করো। “বেণু, তুমি জানো কেন আমি তোমার ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছি?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।

সঙ্গে-সঙ্গে না হলেও ঘণ্টা বাজল।

“তুমি তা হলে জানো!…আমারই ভুল। তোমায় কেন বোকার মতন কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। তোমাদের কিছুই অজানা থাকে না । ভূত-ভবিষ্যৎ সবই তোমরা জানো। তবু, দু-একটা কথা বলি। তোমার ছেলেও শুনুক।” বলে ভুজঙ্গভূষণ একটু চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন, “বেণু, তুমি জানো আমার তিনকুলে কেউ নেই। আমার এই ঘরবাড়ি ছাড়াও অনেক সম্পদ আছে। আমার যা কিছু আছে–স্থাবর অস্থাবর সব আমি তোমার ছেলেকে দিয়ে যাব স্থির করেই তাকে ডেকে আনিয়েছি। কিন্তু আমার দুটি শর্ত আছে। এই শর্ত তাকে পালন করতে হবে। যদি শর্ত মানে, এ-সবই তার যদি না মানে, সে একটা পাই পয়সাও পাবে না। যেমন এসেছে সেই ভাবে তাকে ফিরে যেতে হবে।”

আচমকা ঘণ্টাটা বেয়াড়া ভাবে বেজে উঠল, না থেমে, কোনো রকম ছন্দ না মেনে। শব্দটা এমনই যে কানে লাগে। মনে হয়, কেউ বুঝি প্রবল কোনো আপত্তি জানাচ্ছে।

ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টার শব্দটা শুনে কী বুঝলেন কে জানে, বললেন, “বেণু, তুমি অমন করছ কেন? কী হয়েছে?”

আবার সেই একইভাবে একটানা ঘণ্টা বেজে গেল। তারপর থামল।

ভুজঙ্গভূষণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “বেণু, তোমার সঙ্গে কি অন্য কেউ এসেছে? কে এসেছে? বিষ্ণু?”

এবার আর ঘণ্টা বেয়াড়াভাবে বাজল না। একবার মাত্র বাজল।

তারাপদ বুঝতে পারল, তার বাবাও এসেছে। বাবা, মা, পরী–সবাই এসে হাজির হয়েছে। চোখ বুজেই ছিল তারাপদ। তার মনে হল, যদি এমন হত–চোখ খুললেই তিনজনকে দেখতে পেত,তা হলে তার কী আনন্দই না হত, কিন্তু তা তো দেখতে পাবে না। তা ছাড়া সে-সাহসই বা তার কোথায়? তবু সকলে এসেছে জেনে তারাপদর মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।

“বিষ্ণু, তুমি এসে ভাল করেছ,” ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমরা যে সবাই আসবে আজ–আমি ভাবতেও পারিনি। এসে ভাল করেছ। তোমাদের ছেলেকে আমি আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে যেতে চাই। আমার যাবার দিন হয়ে এসেছে। আগামী অমাবস্যার পর ইহজগতে আমি আর থাকব না। তোমাদের কাছে চলে যাব ।..যাক, কাজের কথাটা আগে বলে নিই। তারাপদকে আমি সব দিয়ে যাব–কিন্তু দুটো শর্ত রয়েছে। আমার প্রথম শর্ত হল তারাপদকে তার আগের জীবনের কথা ভুলতে হবে। আমি জানি, মানুষ তার অতীত ভুলতে পারে না। সে-ভাবে আমি তাকে কিছুই ভুলতে বলছি না। আমি বলছি–সে আর কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে না। পুরনো কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। এই বাড়িতে এখানে তাকে থাকতে হবে, বরাবরের মতন।”

তারাপদ চমকে উঠল তাই কি সম্ভব নাকি? কী বলছে ভুজঙ্গভূষণ? তারাপদ কলকাতায় ফিরে যাবে না? কলকাতার কথা, বন্ধুবান্ধবের কথা, চন্দনের কথা–সব ভুলে যাবে? অসম্ভব। তারাপদ বাঁচবে কী করে?

“আমার দ্বিতীয় শর্ত, ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমার মৃত্যুর পর তারাপদকে আমার জায়গায় বসতে হবে। আমি জানি তার কোনো সাধনা নেই, শিক্ষা নেই, আমাদের তন্ত্র-মন্ত্র সে জানে না। তবে সবই ধীরে ধীরে সে জেনে নেবে। তার মন যদি বশ করতে পারে, এই সাধনার কিছু কিছু সে জেনে নিতে পারবে। তারপর ধ্যান আর সাধনার মধ্যে দিয়ে একদিন সবই তার আয়ত্ত হবে।…এই আমার শর্ত।”

তারাপদ স্তব্ধ। তার বুকের অস্বস্তি হচ্ছিল। উত্তেজনা, ভয়, প্রতিবাদ, অসম্মতি সব যেন একসঙ্গে তার বুকের মধ্যে জমে যাচ্ছিল, গলায় এসে উঠছিল। তারাপদ বলতে যাচ্ছিল–না না,–সে এ-সব শর্ত মানতে রাজি নয়। তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের মতন কাপালিক হতে চায় না। বটুকবাবুর মেস তার পক্ষে অনেক ভাল। সেখানে সে স্বাধীন। এই পরাধীনতা সে চায় না।

তারাপদ কিছু বলতে যাচ্ছি, তার আগেই ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন। “বিষ্ণু, তুমি কি চাও না, তোমার ছেলে আমার শর্তে রাজি হয়? যদি তোমার আপত্তি থাকে তুমি ঘণ্টাটা একবার বাজাও, যদি তুমি রাজি থাকো দু’বার বাজাবে। মনে রেখো, তুমি রাজি থাকলে দু’বার বাজাবে।”

তারাপদ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বুক এত জোরে ধকধক করছে যে, নিজের কানেই সে শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল।

সেই অন্ধকার স্তব্ধ ঘরে দু’বার ঘণ্টা বেজে উঠল। তার মানে তারাপদর বাবা বিষ্ণুপদ রাজি।

তারাপদ কিছুই বুঝল না, চেঁচিয়ে উঠে বলল, “না, না।”

ভুজঙ্গভূষণ গম্ভীর গলায় বললেন, “চুপ করো, তুমি এখন কথা বলো না। তোমার মা বাবা কী বলছেন আগে সেটা শোনো। তারপর তোমার যা বলার বলো।” বলে ভুজঙ্গভূষণ গলার স্বর পালটে তারাপদর মাকে যেন জিজ্ঞেস করছেন, বললেন, “বেণু, তোমার কী ইচ্ছে বলো? তুমি কী চাও–তোমার ছেলে এই ঘরবাড়ি, সম্পত্তি, সুখ সমস্ত ফেলে দিয়ে কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াক? কোনো মানুষ যা স্বপ্নেও ভাবে না-তোমার ছেলেকে আমি নিজের হাতে তা দিয়ে যেতে চাই। বলো, তুমি কী চাও? কী তোমার ইচ্ছে?”

ঘর একেবারে স্তব্ধ। তারাপদ ঘেমে উঠছিল। মা-ও কি সম্মতি জানাবে?

খুবই আশ্চর্য, সামান্য পরে ধীরে ধীরে ঘন্টাটা বেজে উঠল। একবার নয়, দু’বার ।

তারাপদ নির্বাক। তার সমস্ত কথা হারিয়ে গেছে। চন্দনের হাতটা জোরে চেপে রাখল তারাপদ। তার হাত ভিজে গিয়েছে।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বিষ্ণু, বেণু–তোমরা বাবা-মা হিসেব তোমাদের ছেলেকে যা ভাল, যাতে তার ভাল হবে–তাই করতে বলেছ। তোমাদের ওপর আমি খুশি হয়েছি। তবু তোমরা আর-একটু কি থাকতে পারো না? আমি তোমাদের সামনে তোমাদের ছেলের সঙ্গে দুটো কথা বলে নিতে চাই।”

ঘণ্টা বাজল না। তারাপদ বুঝতে পারল না, বাবা-মা আছে না চলে গেল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ তোমার মা বাবার ইচ্ছে তুমি শুনলে। এখন বলো, কী তুমি বলতে চাও।”

তারাপদ ভাবছিল কী জবাব দেবে। সে এখানে থাকবে না। কিছুতেই নয়। কিন্তু মা বাবা যদি চান তারাপদ এখানে থাকুক, তা হলে সে কী করবে? ঠিক এই মুহূর্তে তার মাথায় যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ ঘণ্টাটা আস্তে আস্তে বেজে উঠল, বেজে বেজে যেন দুরে কোথাও মিলিয়ে গেল।

ভুজঙ্গভূষণ কথা বললেন, “তোমার মা বাবা-বোন চলে গেল তারাপদ। ওরা চলে গেল।” বলার পর গম্ভীর মৃদুস্বরে তিনি একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, মনে হল, আত্মাদের বিদায় জানালেন।

ঘরের বাতি জ্বলল। মাথার ওপরকার ফিকে আলো ।

তারাপদ চোখ খুলল । চন্দনও তাকাল। চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা। ধীরে ধীরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল সামান্য।

মেয়েটি হাত টেনে নিল, পা সরিয়ে নিল। কোনো দিকে তাকাল না। মুখ মাথা নিচু করে থাকল। তবু তার ফরসা মুখ আরও সাদা ভিজে ভিজে দেখাচ্ছিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারাপদ একবার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। কেমন যেন ঘুম-জড়ানো চোখ, আচ্ছন্নের মতন লাগছে।

ঘুমের মধ্যে যেন হেঁটে যাচ্ছে এইভাবে চলে গেল মেয়েটি।

মেয়েটি চলে যাবার পর ভুজঙ্গভূষণ আবার কথা বললেন। তাঁর দিকের সেই লাল আলো এখন আর জ্বলছে না। ঝাপসা অন্ধকারে ভৌতিক চেহারা নিয়ে তিনি বসে আছেন। ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, তোমার যা বলার আছে বলো।”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনকে খানিকটা অন্যমনস্ক দেখাল। চোখাচোখি হওয়া সত্ত্বেও সে কোনো রকম ইশারা করল না।

তারাপদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আমি এখানে কেমন করে থাকব?”

“কেন?”

“কলকাতা ছেড়ে আমি কখনো থাকিনি। আমার বন্ধুবান্ধব, চেনা-জানা যারা, তারা সবাই কলকাতায় থাকে। তাদের ছেড়ে আমি এখানে একা একা কেমন করে থাকব?”

“একা একা কেন থাকবে, এই বাড়িতে লোকজন কম নেই, এরা থাকবে।” তারাপদ শুকনো গলায় ঢোক গিলল। “আমার মন টিকবে না।”

“প্রথম প্রথম টিকবে না, তারপর টিকে যাবে। আমার কেমন করে টেকে?”

“আপনি কতকাল ধরে এখানে আছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা রয়েছে–আপনি সাধনা করেন, কত বছর ধরে তন্ত্র-টন্ত্রর সাধনা করে আসছেন। আমি কিছু জানি না। আমার ওসব জিনিস পছন্দও হয় না। আমি কেমন করে আপনার মতন সাধক হব?”

ভুজঙ্গভূষণ শান্ত গলায় বললেন, “সে-চিন্তা আমার। তোমায় যে অনেক কিছু শেখাতে হবে–তা আমি জানি। তার ব্যবস্থাও আমি করেছি।”

তারাপদ আবার চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না তারাপদ; পরে বলল, ধরুন যদি এমন হয়, আজ আমি আপনার শর্তে রাজি হলাম, তারপর আপনি যখন থাকবেন না–তখন শর্ত ভাঙলাম–তখন কী হবে?”

ভুজঙ্গভূষণ স্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি তোমার মা বাবার মনের ইচ্ছে জেনেছ। কাল আবার আমি ওদের ডাকব। ওই আত্মাদের কাছে তোমায় শপথ করতে হবে।…তারাপদ, মৃত পিতা-মাতার আত্মার সামনে শপথ করে সেই শপথ যদি তুমি ভাঙো, তার পরিণতি যে কী হবে–তুমি কল্পনাও করতে পারছ না। তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।..তা ছাড়া, আমার নির্দেশ আছে, অন্তত তিন বছর তুমি পুরনো সমস্ত সংসর্গ থেকে দূরে থাকবে। এই বাড়িতে তোমায় থাকতে হবে। কোথাও যাবে না। এখানে সাধনা করবে। যদি তিন বছর তুমি আমার নির্দেশ-মতন থাকতে পারো, তবেই তুমি আমার সমস্ত কিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারী হবে। নয়ত নয়। আর এই তিন বছর তোমার থাকা, খাওয়া-পরার কোনো কষ্ট হবে না, দরকার পড়লে কিছু কিছু টাকা তুমি খরচ করতে পারবে। তিন বছর পরে তুমি বিষয়সম্পত্তি পেয়ে যা খুশি করতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, তোমার মাথার ওপর আত্মারা থাকবে–তোমার মা-র, বাবার, আমার ।…তিন বছর পরে আমার বিশ্বাস, তুমি আজ যা ভাবছ তা আর ভাবতে পারবে না।”

তারাপদ কোনো কালেই অঙ্ক জিনিসটা বোঝে না; তার মাথায় ফন্দি ফিকিরও খেলে না। তবু ভুজঙ্গভূষণের কথা থেকে বুঝতে পারল, লোকটি ভীষণ চতুর, সবদিক দিয়েই পথ আগলে রেখেছে।

তারাপদ চুপ। কী বলবে? সরাসরি না করে দেবে? কী দরকার তার এত সম্পত্তিতে? কোন দুঃখে সে তান্ত্রিক-টান্ত্রিক হতে যাবে? কেনই বা সে ভুজঙ্গভূষণের মতন আত্মা-টাত্মা নামাতে যাবে? সে যা আছে–এই কি যথেষ্ট নয়? সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল সাধুমামার কথা, কিকিরার কথা। সবাই তাকে বলেছেন, ভুজঙ্গ শয়তান, ভুজঙ্গ পাপী। সাধুমামা মিনতি করে বলেছেন, বাবা

তুমি আমাদের এই নরক থেকে উদ্ধার করো। কেমন করে উদ্ধার করবে। তারাপদ? তিন বছর এই পুরীতে নিজে বন্দী থেকে সমস্ত কিছু নিজের আওতায় আনার পর? কিন্তু আত্মা? মা-বাবার মৃত আত্মার সামনে শপথ নেবার পর সে কি অমন কাজ করতে পারবে? . তারাপদ কথা বলছে না দেখে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি মন স্থির করতে পারছ না?”

বিড়বিড় করে তারাপদ বলল, “আমায় ভাববার একটু সময় দিন।”

“বেশি সময় তোমায় কেমন করে দেব। আমার সামনেও যে সময় নেই। তুমি কি কোনো সন্দেহ করছ তারাপদ? তোমার মা-বাবার আত্মার ইচ্ছে কি পূরণ করতে মন চাইছে না?”

তারাপদ কিছু খেয়াল না করেই বলল, “আত্মা কি কথা বলে না?”

“না। কখনো-সখনো এক-আধটা কথা কেউ বলেছেন। আমি কাউকে কথা বলতে দিতে চাই না।”

“আমার মা-বাবা যদি একটা কথা বলতেন।”

‘তারাপদ, আত্মারা তোমারা আমার মতন স্কুল দেহ নিয়ে থাকেন না। সূক্ষ্ম আত্মা, সে প্রায় বাতাসের মতন। তাঁদের দিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা না করাই উচিত। যিনি বাতাসের আকার নিয়ে থাকেন, তাঁকে সবাক করা উচিত নয়। তাতে তাঁদের বড় কষ্ট হয়।…তবে আমি একটা কাজ করতে পারি। আত্মারা

যে কখনো কখনো নিজেদের আসা-যাওয়ার চিহ্ন রেখে যান, সে-প্রমাণ আমি তোমায় দেখাতে পারি? দেখবে?”

তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দনের চোখে কৌতূহল।

তারাপদ বলল, “দেখব। “

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। তুমি দেখতে চেয়েছ যখন আমি দেখাব। ওই ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”

তারাপদ উঠল। ঘন্টাটা চন্দনের পায়ের দিকে, যেদিকে চন্দন আর মেয়েটি পায়ে পা ছুঁইয়ে বসেছিল। চন্দন মাটিতে হাত নামিয়ে ঘণ্টাটা তুলে দিল। তারাপদ ঘন্টা হাতে করে ভুজঙ্গর সামনে গিয়ে হাত বাড়াল ।

ভুজঙ্গভূষণ ইশারা করে ঘন্টাটা নিচে নামিয়ে রাখতে বললেন।

তারাপদ ঘণ্টা নামিয়ে রাখল। রেখে নিজের জায়গায় ফিরে আসার সময় শুনল ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজালেন। তাঁর মাথার দিকে টকটকে লাল আলো জ্বলে উঠল আবার। তারাপদদের ওপরকার আলো নিবে গেল। আর কী আশ্চর্য, ভুজঙ্গভূষণের পেছন দিক থেকেই পরদার আড়াল সরিয়ে সাধুমামা এলেন। তারাপদদের দিকে তাকালেন না সাধুমামা, বাধ্য অনুগত চাকরের মতন ভুজঙ্গর সামনে মাথা নিচু করে আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ভুজঙ্গভূষণ হাতের ইশারায় তাঁর সামনের নিচু টেবিলটার দিকে দেখালেন। নিচু গলায় কী যেন বললেন, শুধু ‘মোম’ শব্দটা কানে গেল তারাপদর। সাধুমামা টেবিলের ওপর থেকে সামান্য লম্বা গোল মতন অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রটা নিয়ে চলে গেলেন। কাঁচের গোল বয়ামটা পড়ে থাকল। তার মধ্যে যেন জল, অর্ধেকের বেশি বয়ামটা ভরতি।

ভুজঙ্গভূষণ তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি কতটা সাহসী?” কথার মধ্যে যেন একটু ঠাট্টার ভাব ছিল।

তারাপদ কথার জবাব দিল না। সে সাহসী নয়। ঘরের মধ্যে যা ঘটছে, তা সহ্য করার মতন মনের জোরও তার থাকার কথা নয়। তবু, দু দিনের পর–আজ তৃতীয় দিনে কেমন করে সে সাহস দেখাতে পারছে–সে নিজেই জানে না।

“তোমার বন্ধুর সাহস বোধ হয় বেশি।”–ভুজঙ্গ চন্দনকে লক্ষ করে বললেন। “ডাক্তার লোক..আমার এখানে ভয় পাবার মতন কিছু নেই, তবু লোকে ভয় পায়। ভয় পায় কেন জানো? যারা ইহলোকের মানুষ, তারা পরলোকের কথা বোঝে না। পরলোক থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদেরও বুঝতে পারে না। যা অজ্ঞেয়, তাকে মানুষ ভয় করে। তবে আত্মারা সচরাচর কারও ক্ষতি করেন না, যদি না আমরা তাঁদের বিরক্ত করি, অশ্রদ্ধা করি। কখনো কখনো কোনো দুষ্ট আত্মা হঠাৎ এসে যান। তাঁরাই বড় ভয়ংকর। তাঁরা কাউকে ভর করলে বিপদে পড়তে হয়। যাক, আবার একবার আমি চেষ্টা। করে দেখি তারাপদ–যদি কাউকে আনতে পারি। একটা কথা মনে রেখো, আত্মারা আমাদের ইচ্ছাধীন নন, আমরাই তাঁদের ইচ্ছাধীন। তোমার মা বাবাকে আজ অনেকক্ষণ আমরা ডেকে এনে কাছে রেখেছিলাম। এভাবে থাকতে ওদের বড় কষ্ট হয় । জানি না ওরা আর আসবে কিনা! তুমি কাকে আনাতে চাও আমি জানি না। “

তারাপদর মনে হল, মা-বাবার হয়ত কষ্ট হবে আসবে। হতেও তো পারে।

তারাপদ আচমকা বলল, “পরী আসবে না?”

“পরী?”

“পরীকে দেখতে আমার বড় ইচ্ছে করে। সে যদি একবার আসত.” বলতে বলতে আবেগে গলা ধরে গেল তারাপদর।

ভুজঙ্গভূষণ অল্প নীরব থেকে বললেন, “তুমি যে-পরীকে দেখেছ সেই পরী–তোমার সেই ছোট্ট পরী কি এখনও অতটুকু আছে! আত্মা অমর, তার কোনো পরিবর্তন থাকে না–তবু নিজেদের মতন করে তারা কিছুটা বদলে যায়।…ঠিক আছে, আমরা পরীকেই ডাকব। যদি সে আসে–এই ঘরে তার আসার চিহ্ন রেখে যাবে। তোমাদের আমি সাবধান করে দি, এবার যে আসবে–সে সরাসরি আসবে, মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে নয়, তোমরা কোনো রকম নড়াচড়া করবে না, কথা বলবে না, কিছু ধরবার চেষ্টা করবে না–আত্মাকে ধরার চেষ্টা করা মুখ । শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে বসে থাকবে–। দেখো কী। হয়! পরী আসে কি আসে না।”

সাধুমামা আবার ফিরে এলেন। সেই পাত্রটা ভুজঙ্গভূষণের টেবিলের সামনে নামিয়ে রাখলেন। ভুজঙ্গ ঘরে আরও কিছুটা ধুনো-গুগগুল দিয়ে দিতে বললেন। ঘরের কোণে কোণে ধূপের বাটি ছিল ঢাকা, ধূপ দিতে বললেন।

সবাই যেন তৈরি ছিল। সাধুমামা চলে যেতেই মৃত্যুঞ্জয় এল। তার দু হাতে ধোঁয়া-ওঠা ধুনোর পাত্র। গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ঘরে ধোঁয়া দিয়ে সে পাত্র দুটো আড়ালে রেখে দিল। একটুও আগুন বা আভা দেখা গেল না। বাটিতে ধূপ এনে সাধুমামা ঘরের কোণে আড়াল করা জায়গায় রেখে গেলেন। ধূপের আগুনও চোখে পড়ল না।

ঘরের সমস্ত বাতি নিভে গেল। ঘোর অন্ধকার । কোথাও এক বিন্দু আলো নেই। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর জলদগম্ভীর গলায় আশ্চর্য সুরে দীর্ঘ এক সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন। গানের সুরের মতন লাগছিল। ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ধুনোর গন্ধ, গুগগুলের গন্ধ, ধূপের তীব্র এক গন্ধেও ঘর ভরে উঠল।

ভুজঙ্গভূষণ মন্ত্রের মতন করে সেই শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে শেষ পর্যন্ত থেমে গেলেন কিছুক্ষণ পরে বললেন, “যাকে আনতে চাইছ, তাকে চোখ বন্ধ করে একমনে ডাকো, তারাপদ। কোনো কথা বলো না। তোমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করো না।”

তারাপদ পরীকে মনে মনে ভাবতে লাগল। ডাকতে লাগল। পরী-পরী সেই ছোট্ট পরী।

চন্দন চোখ খোলার চেষ্টা করল বার কয়েক। পারল না। যেন পাতালের তলায় তারা কোথাও নেমে গেছে, ঘটুঘুট করছে অন্ধকার।

কোনো শব্দ নেই, আলোর একটি ফোঁটাও কোথাও নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে। এর যেন শেষ নেই। তারাপদ কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পরীকে ভাবতে লাগল।

কতক্ষণ যে কেটে গেল খেয়াল নেই। হঠাৎ ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “আমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। কে একজন এসেছে! কে?”

তারাপদ সচেতন হল। চন্দনও।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যদি এসে থাকো, তোমার দাদার কাছে যাও। তাকে ওই গন্ধ, তোমার বয়ে আনা গন্ধ তাকে জানতে দাও মা।”

তারাপদ একেবারে ধীরস্থির হয়ে বসে থাকল। বুক কাঁপছে। তবু সে অধৈর্য।

পরী আসছে না। কেন আসছে না? তার দাদা তাকে ডাকছে–তবু কেন আসছে না?

একেবারে আচমকা তারাপদর নাকে এক গন্ধ ভেসে এল। কোন ফুলের গন্ধ সে বুঝতে পারল না। চাঁপা ফুলের মতনই অনেকটা।

পরী এসেছে। তারাপদ থরথর করে কাঁপতে লাগল। পরী এসেছে। পরী, পরী, সোনা বোন আমার।

আবেগে তারাপদ যখন কেঁদে ফেলেছে, হঠাৎ তার গালের পাশে পরীর চুলের ছোঁয়া পেল। তারপর আর নয়। ছোঁয়া নয়। গন্ধটাও ফিকে হয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “পরী, তুমি যে এই ঘরে এসেছিলে তার কিছু চিহ্ন রেখে যাও। তোমার দাদা সামান্য কিছু চিহ্ন চায়। আমার সামনে মোমের পাত্র আছে। তোমার হাতের কিছু চিহ্ন রেখে যাও মা। অন্তত একটা-দুটো আঙুলের।”

আবার সব নিস্তব্ধ।

অনেকক্ষণ পরে জঙ্গভূষণ বললেন, “পরী চলে গেছে। আমি আর কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”

আরও সামান্য সময় গেল । ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা নাড়লেন। তারাপদদের মাথার ওপরকার বাতি জ্বলে উঠল।

তারাপদ আর চন্দন অন্ধের মতন বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে তাদের চোখ ফুটল।

ভুজঙ্গভূষণ সামনের টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “তারাপদ, তোমার বোন পরী এসেছিল। ওই দেখো সে তোমার জন্যে তার আঙুলের ওই চিহ্ন রেখে গেছে।”

তারাপদ প্রায় পাগলের মতন সামনে ছুটে গেল। ভুজঙ্গভূষণের সামনের টেবিলে মোমের একটা আঙুল পড়ে আছে।

আঙুলটা নেবার জন্যে তারাপদ হাত বাড়াল।

.

দশ

সকালে তারাপদর আর বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুম ভেঙে যাবার পরেও সে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। শরীর যেন ভেঙে যাচ্ছে, হাত-পা ভার, চোখ জ্বালা করছিল। সারা রাত জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকার পর সকালে ঘুম ভাঙলে যেমন লাগে, সেই রকম লাগছিল। শরীরের দোষ নেই, আজ ক’দিনই একটা-না-একটা এমন কিছু ঘটে যাচ্ছে যাতে মাথার ঠিক থাকে না, একের পর এক ভাবনা সারাক্ষণ জট পাকিয়ে থাকে মাথায় । রাত্রে ঘুম হয় না ভাল করে। তার ওপর কালকের ঘটনার পর তারাপদ একেবারেই ঘুমোত পারেনি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে, মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠেছে বাবা-মা-পরীর কথা ভেবে। তবু বাবা কিংবা মা তাকে এমন করে বিহ্বল করে যায়নি। পরীই যেন সব উলটে-পালটে দিয়ে গেল। তার আত্মা তারাপদর গায়ের কাছে, সামনেই এসে দাঁড়াল, গন্ধ শুকিয়ে দিল, চুলের ছোঁয়া দিল মুহূর্তের জন্যে, একটা মোমের আঙুলও রেখে গেল চিহ্ন হিসেবে। এরপর তারাপদ কেমন করে স্থির থাকবে! সে কাকে বোঝাবে, এই ছোট্ট বোনটিকে সে কতদিন কোলে করে একটু বসে থাকার জন্যে মায়ের কাছে আবদার করত!পরী তখন চার ছ’মাসের বাচ্চা! ওইটুকু বাচ্চা কিছুই তো বোঝে না, তবু তারাপদ বিকেলে খেলাধুলো ছেড়ে বোনের পাশে শুয়ে-শুয়ে কাগজের ফুল দেখিয়েছে, ঝুমঝুমি নেড়েছে, প্রাণপণে ছড়া কেটেছে। পরী আরও যখন বড় হল একটু, তারাপদ বোনকে বসতে, পা-পা করে হাঁটতে, একটা দুটো আধো-আধো কথা বলতে শিখিয়েছিল। সেই বোন যখন থাকল না–তখন তারাপদর বুক ভেঙে গিয়েছিল। সমস্ত বাড়ি অসাড় থাকত তখন; মা আড়ালে বসে কাঁদত, বাবা কেমন পাথরের মতন হয়ে গিয়েছিল, আর তারাপদ বেড়াল-ছানার মতন সারা বাড়ি কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াত।

সেই পরী কাল এসেছিল। তারাপদ তাকে চোখে দেখতে পেল না বটে, তবে আসার প্রমাণ তো পেল। পরী আজও কোথাও-না-কোথাও রয়েছে এটা জানার পর বুকের মধ্যে কেমন হয় এ-কথা শুধু তারাপদই বুঝতে পারে। আর কেউ বুঝবে না।

মাঝরাত পর্যন্ত চন্দনকে জ্বালিয়ে শেষরাতে তারাপদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এখন উঠল বেশ খানিকটা বেলায়, ঘরে রোদ ঢুকে পড়ার পর ।

চন্দন বিছানায় নেই । অনেক আগেই বোধ হয় উঠে পড়েছে ।

শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে উঠল তারাপদ, অনেকটা জ্বোরো রোগীর মতন বেখেয়ালে মুখটা ধুয়ে এল। একজনকে দেখতে পেয়ে চা দিতে বলল রুক্ষ গলায়। কেন যে রুক্ষ হল নিজেও বুঝল না।

ঘরে বসে যখন চা খাচ্ছে তারাপদ, চন্দন এল।

“ঘুম ভাঙল তোর?” চন্দন বলল।

“হ্যাঁ। তুই কোথায় গিয়েছিলি?”

চন্দন হাত বাড়িয়ে নিজের জন্যে এক পেয়ালা চা ঢেলে নিল; কথা বলল প্রথমটায়, তারপর বলল, “রোগী দেখতে!”

অবাক হয়ে তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

চন্দন বলল, “সাধুমামার বুকে ব্যথা উঠেছিল।”

“সাধুমামার?”

“ভোর রাতে আমায় মৃত্যুঞ্জয় ডাকতে এসেছিল। তোকে আর আমি জাগাইনি। একটু আগে আর একবার দেখতে গিয়েছিলাম সাধুমামাকে।”

তারাপদ উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “কী হয়েছে সাধুমামার? কেমন আছে?”

“ভালই আছেন এখন!”

“বুকে ব্যথা কেন? হার্টের গোলমাল?” চন্দন পর পর দু’ চুমুক চা খেল। সিগারেটও ধরাল। শেষে হেঁয়ালি করেই যেন বলল, “হতে পারে।”

“হতে পারে মানে?”

“বলতে পারছি না। হার্টের গোলমাল ধরা কঠিন। আমার কাছে স্টেথোও নেই। তবে ব্যথাটা হার্টের দিকটাতেই।”

“তোর কাছে তো ওষুধও নেই কিছু?”

“না। দু-চারটে যা এনেছি, তাতেই আপাতত কাজ চালিয়ে দিচ্ছি।”

তারাপদ কিছুই বুঝতে পারছিল না। সাধুমামার বুকের ব্যথা যদি এতই বেশি তাহলে চন্দন তেমন গা করছে না কেন? আশ্চর্য! যে ডাক্তারের না আছে স্টেথোসকোপ না কোনো ওষুধপত্র, সে-ডাক্তার কেন রোগীর ভার নেবে! তারাপদ বলল, “তুই সবে পাশ করেছিস, তোর কাছে ওষুধপত্র নেই–কেন তুই এই দায়িত্ব মাথায় নিচ্ছিস? সাধুমামা বুড়োমানুষ, একটা-কিছু হয়ে গেলে তখন সামলাতে পারবি না। তার চেয়ে ভুজঙ্গদের বল–কোনো ডাক্তার-টাক্তার ডেকে আনবে।”

চন্দন কথাগুলো কানে শুনেও গা করল না, বলল, “বোকার মতন কথা বলিস না। আমি যেমন ডাক্তারই হই বিপদে পড়ে কেউ যদি আমায় ডাকতে আসে আমি না বলতে পারি না। তা ছাড়া এখানে ধারেকাছে কোনো ডাক্তার নেই । হয় মধুপুর না হয় দেওঘর থেকে ডাক্তার আনতে হবে। তার মানে গোটা একটা দিনের ব্যাপার । তোকে বলেছি না–কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি দু-একটা ইনজেকশানের ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। তার মধ্যে একটা হার্টের ওষুধ ছিল। ভেবেছিলাম ভুজঙ্গ অক্কা পাবার আগে কাজে লাগবে। সাধুমামার দরকারে লেগে গেল ।…যাক গে, সাধুমামা এখন ঘুমোচ্ছে; ইনজেকশান দিয়ে দিয়েছি ভোর রাতেই। মনে হচ্ছে, কোনো গণ্ডগোল হবে না। এর পর ভুজঙ্গ কী করবে না-করবে সেটা তার ব্যাপার। আমার যা করার করেছি, যা বলার মৃত্যুঞ্জয়কে বলেছি।”

তারাপদ চা শেষ করে ফেলল। হাই তুলল আবার। চা খাওয়ার পর সামান্য আরাম লাগছিল।

চন্দন বলল, “একবার কিকিরার কাছে যেতে হবে।”

“কেন?”

“চল না; গেলেই বুঝতে পারবি।”

মাথা নাড়ল তারাপদ। “আমার ভাল লাগছে না।”

“এই বাড়িতে বসে বসেই বা তোর কী ভাল লাগবে?”

কথার জবাব দিল না তারাপদ।

অপেক্ষা করে চন্দন হঠাৎ বলল, “তুই যদি আমার সঙ্গে না যাস, তারা–আমি কিন্তু আর এ-বাড়িতে ফিরব না; কিকিরার কাছে দুপুরটা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাব।”

তারাপদ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন চন্দনের হঠাৎ এই মত পালটে ফেলার ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে তাকে লক্ষ করতে লাগল।

চন্দনও চা শেষ করে ফেলল। তারাপদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল্।” ।

তারাপদ বলল, “কী হবে কিকিরার কাছে গিয়ে?”

“কী হবে না-হবে, তোর কাছে আমি এখন বলব না। যদি তুই না যাস, আমি বুঝব তুই ভুজঙ্গর ফাঁদে ধরা পড়ে গিয়েছিস। আমি আর এখানে থাকব না।“

চন্দনের মুখ দেখেই তারাপদ বুঝতে পারল, ও বাজে কথা বলছে না। সত্যিই-সত্যিই তারাপদকে রেখে চন্দন চলে যাবে। ও বরাবরই জেদী, একবার যা ঠিক করে নেয় তার নড়ানো যায় না। তবু তারাপদ বলল, “কী হল ব্যাপারটা? হঠাৎ তুই এরকম করছিস?”।

চন্দন চাপা গলায় বলল, “এখানে বসে সব কথা বলা যাবে না। তুই হয় আমার সঙ্গে চলনা হয় তুই এই লাখটাকার সম্পত্তির জন্যে ভুজঙ্গর কাছে বসে থাক–আমি থাকব না।”

তারাপদর কানে কথাটা বড় লাগল। আহত হয়ে বলল, “তুই আমায় এত লোভী ভাবলি?”

চন্দন বলল, “এই বাড়িতে বসে আমি আর একটা কথাও বলব না। যদি তোর ইচ্ছে না থাকে, তুই যাস না। আমি যাচ্ছি।”

তারাপদর সাধ্য হল, না চন্দনকে ছেড়ে দেয়। সে স্পষ্টই বুঝল, চন্দন তাকে। মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছে না–সত্যিই ও চলে যাবে, যা একগুঁয়ে ছেলে। তা। ছাড়া তারাপদর সন্দেহ হল, চন্দনের যেন কিছু বলার আছে, গোপনে বলবে। অগত্যা তারাপদ বলল, “বেশ। আমি যাব। “

তারাপদ আর চন্দন বেরিয়ে পড়ল । মৃত্যুঞ্জয় তাদের দেখেছিল, কিছু বলল না। কেউ যে নজর রাখছে, তাও মনে হল না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “তোকে একটা কথা বলি তারা, কিছু মনে করিস না। ভুজঙ্গ তোকে জব্বর প্যাঁচ মেরে কবজা করে ফেলেছে।”

তারাপদ রেগে গেল। বলল, “কেন? কী করে বুঝলি?”

“বুঝেছি। তোকে আমি বুঝব না? তুই বরাবর নরম ধাতের । একটুতেই কেঁদে ফেলিস, বুক চাপড়াস, ছটফট করিস। তোর মতন সেন্টিমেন্টাল ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। তোর মনে কোনো জোর নেই।”

চন্দন আরও কী বলতে যাচ্ছিল, তারাপদ বাধা দিয়ে রাগের গলায় বলল, “লেকচার মারিস না, চাঁদু । আমি অনেক লেকচার শুনেছি।”

“তুই চটে যাচ্ছিস কেন?”

“আলবাত চটব। তুই আমায় লোভী বলবি, সেন্টিমেন্টাল বলবি–আর আমি চটব না!”

চন্দন বন্ধুর রাগ দেখে হেসে ফেলল। তারাপদর রাগ ভাঙাবার জন্যে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই মিছিমিছি চটছিস। সকলের মন কি একরকম হয়? কারুর মন শক্ত হয়, কারুর নরম; কেউ নিষ্ঠুর হয় তোর ভুজঙ্গ-পিসেমশায়ের মতন, কেউ বা সাধুমামার মতন দুর্বল হয়। তোর মন নরম বললে তুই চটবি কেন?”

“তুই আমায় লোভী বলেছিস।”

“লোভ সব মানুষেরই অল্পস্বল্প থাকে, তারা। পড়ে-পাওয়া সম্পত্তির লোভ ভাই আমারও থাকত। যাকগে, তুই লোভী নোস, যা বলেছি–ভুল করে বলেছি। এবার হল তো?”

তারাপদ কোনো কথা বলল না। চন্দন বন্ধুর গলা জড়িয়েই হাঁটতে লাগল। খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “ভুজঙ্গ তোকে বশ করে ফেলছে, তারা। ধীরে ধীরে তোকে মুঠোয় পুরে ফেলছে। এরপর তুই আর পালাতে পারবি না, সে-ক্ষমতা তোর থাকবে না। আমিও তোকে সাবধান করে দিচ্ছি।”

তারাপদ বলল, “যা মনে করিস বল, আমি কিছু বলব না।”

“তুই সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করিস তোর মা-বাবার আত্মা আসে? তুই কি বাস্তবিকই মনে করেছিস–কাল তোর কাছে পরী এসেছিল?”

“হ্যাঁ, পরী এসেছিল।”

“আমি বিশ্বাস করি না। এ অসম্ভব।”

“তুই বিশ্বাস না করতে পারিস, কিন্তু আমি করি। যদি পরী না আসবে তবে কে আমার নাকের কাছে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, কার মাথার চুল আমার মুখে লাগবে? কার আঙুলের ছাঁচ পড়ে থাকবে?”

চন্দন বন্ধুর গলা থেকে হাত সরাল। মুখোমুখি তাকাল। বলল, “তুই পাগলের মতন কথা বলছিস। পরী মারা গিয়েছিল ছোট্ট বয়সে, তুই বলিস বছর দুই-তিন বয়েসে । শোন তারা, যা বলছি ভেবে দেখ । পরী যখন মারা যায় তখন তুই নিজেই ছেলেমানুষ; পরীর ঠিক-ঠিক বয়েস কত হতে পারে তুই জানিস না। দু-তিন বছর হতে পারে, আবার চারও হতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু ছোট্ট পরী কি মরে গিয়েও পরলোকে বাড়ছে?”।

তারাপদ কথাটা বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

চন্দন বলল, “এটা তো সোজা ব্যাপার। আমরা চেয়ারে বসেছিলাম–ঠিক কিনা বল? একটা তিন-চার বছরের মেয়ে মাথায় কত লম্বা হবে রে যে তোকে গন্ধ শুকিয়ে যাবে, মুখে চুলে ছোঁয়া দিয়ে যাবে? যদি মেয়েটা কম করেও ফুট চারেকের মতন লম্বা না হয়, কখনোই আমরা চেয়ারে বসে থাকার সময় মুখে মাথার চুল ছোঁয়াতে পারে না। এটা সোজা অঙ্কের ব্যাপার। চেয়ারে বসে থাকার সময় আমাদের মুখ মাটি থেকে অন্তত সোয়া তিন সাড়ে তিনি ফুট উঁচুতে থাকে, ওই হাইটের কোনে মেয়ে পাশে না দাঁড়ালে তার চুলের ছোঁয়া তোর মুখে লাগতে পারে না। অবশ্য যে-মেয়ে মাথায় আরও লম্বা সে কিন্তু ঘাড় নামিয়ে হেঁট হয়ে তোর মুখে চুলের ছোঁয়া লাগাতে পারে। এবার তুই বল, মারা যাবার পর স্বর্গে গিয়ে পরী কি তোর-আমার মতন বছরে বছরে বাড়ছে? তা যদি বাড়ে–তবে তার বয়েস আজ ষোলো সতেরো হতে পারে।”

তারাপদ বোকার মতন বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কথা বলতে পারল না। পরীর মুখ কিংবা স্মৃতি যেটুকু মনে আছে তারাপদর, তাতে সেই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে কখনোই মাথায় অত লম্বা হতে পারে না। বড় জোর বছর তিনেকের ছিল পরী। সে কতই বা লম্বা হবে? তা ছাড়া তার মাথার চুল ছিল ঝাঁকড়া, কিন্তু বল্‌ করে ছাঁটা। সেই চুলই বা কেমন করে মুহূর্তের জন্যে পালকের ছোঁয়ার মতন তারাপদর গালে লেগে সরে যাবে? মোমের আঙুলের যে ছাঁচ তারাপদ দেখেছে–সেটাও তো কচি মেয়ের নয়। তা হলে? আত্মারা কি মানুষের মতন পরলোকে গিয়ে বয়েসেও বাড়ে? যদি তা বাড়ত–তবে হাজার-হাজার আত্মার বয়েস শ, দুশ, পাঁচশ বছর হয়ে গেছে।

তারাপদ এরকম একটা হেঁয়ালির কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না। বলল, “কী জানি, আমি কিছু জানি না। তবে ভুজঙ্গ তো আগেই বলেছে–পরী আর অত ছোট্টটি নেই। আত্মাদের অন্য কোনো ব্যাপার আছে।”

“কোনো ব্যাপার নেই”, চন্দন ঘাড় নেড়ে বলল, “আমি তোকে বলছি–যে-মেয়েটি আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে, আত্মা নামাবার মিডিয়াম হয়–সেই মেয়েটাই কাল পরী সেজে তোর কাছে এসেছিল।”

তারাপদ প্রবলভাবে বাধা দিতে গেল, চন্দন শুনল না। বলল, “মেয়েটার মাথায় অনেক চুল, সব সময় চুল এলো করে থাকে, মাথায় লম্বা, গায়ে রোগা–তারা, এই মেয়েই কাল পরী সেজে এসেছিল।”

চন্দন আরও কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। পরে বলল, “কিকিরার কাছে চল । কিকিরা তোকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন ভুজঙ্গ কেমন করে আত্মা নামায়।”

.

মাঠেঘাটে নয়, কিকিরা বাড়িতে চন্দনদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ি মানে সেই হরিরামের আস্তানা। বালিয়াড়ির আড়ালে মাঠকোঠা ধরনের বাড়ি, দোতলা, কাঠের সিঁড়ি, মাথায় খাপরার চাল। চারদিকেই কিছু-না-কিছু গাছপালা। বাড়ির একপাশে বাঁধানো কুয়ো।

হরিরাম খেতখামার নিয়ে পড়ে থাকত একসময়, ছেলে গোরখপুরে বড়সড় ব্যবসা ফাঁদার পর বাবার কাছে বড় একটা আসতে পারে না। হরিরামের স্ত্রী মারা গিয়েছে বছর কয়েক আগে। সংসারে একলা মানুষই এখন হরিরাম। খেতখামারের ওপর তার আর টান নেই, ধর্মকর্ম নিয়েই দিন কাটায়। বাড়িতে জোয়ান বয়েসের কাজের লোক আছে একটা, আর আছে পাঁড়েজি, বুড়ো বামুন।

কিকিরা দোতলার ঘরে ডেকে নিলেন চন্দনদের। ঘরটা কাঠের, শীতের রোদ খেয়ে মোটামুটি গরমই লাগছিল, সরাসরি রোদ পড়েছে পেছন দিকটায়, সামনে সরু বারান্দা।

কিকিরার ঘরে একটা তক্তপোশ, টিনের চেয়ার আর কাঁঠালকাঠের টেবিল ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। দড়ির আলনায় জামাটামা ঝুলছে কিকিরার।

চন্দনরা বসার পর কিকিরা তারাপদর মুখ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “রাত্তিরে ঘুম হয়নি, স্যার?” বলে একটু হাসলেন।

চন্দন বলল, “ওর ঘুম তো গেছেই, সঙ্গে-সঙ্গে আমারও। কাল সারারাত তারা যা করেছে–ভাবছিলাম ওকেই একটা ইঞ্জেকশান ঠুকে দিই।”

“কেন কেন?” কিকিরা কৌতূহল বোধ করে বললেন।

চন্দন বলল, “বলছি। তার আগে আর-একটা খবর আছে। সাধুমামার আজ শেষরাত থেকে শরীর খারাপ। বুকে ব্যথা। মৃত্যুঞ্জয় আমায় ডাকতে এসেছিল শেষরাতে।”

কিকিরা কেমন ব্যস্ত হয়ে বললেন, “বুকে ব্যথা? কী হয়েছে?”

“আমার মনে হল, অনেকদিন ধরেই উনি কোনো দুঃখ-দুভাবনার মধ্যে রয়েছেন, শরীরটাও দুর্বল। হার্টের কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। আমার কাছে স্টেথেসকোপও নেই। নাড়ি ধরে কতটুকু আর বুঝব! প্রেশার, হার্টসই দেখানো দরকার। তবে এই ব্যথাটা বোধ হয় মনের ভীষণ দুভাবনা থেকে হয়েছে।” বলে চন্দন অল্প সময় করে থেকে তারাপদকে দেখল দু পলক, শেষে কিকিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যখন সাধুমামাকে দেখছিলাম, মৃত্যুঞ্জয় আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন নিচে এসে ইনঞ্জেকশান নিয়ে আবার ওপরে গেলাম তখন আমি মৃত্যুঞ্জয়কে ঘর থেকে সরিয়ে দিলাম কায়দা করে।”

“কেমন করে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“ব্যাপারটা সহজ। বললাম, আমার কাছে ইথার-টিথার নেই, ইনজেকশানের সিরিঞ্জ আর ছুঁচ স্টেরিলাইজ করতে হবে। গরম জলে এগুলো ফুটিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন তাড়াতাড়ি।”

কিকিরার মুখ দেখে মনে হল তিনি চন্দনের উপস্থিত বুদ্ধিতে খুশি হয়েছেন।

চন্দন বলল, “সাধুমামার মুখ চোখ দেখে আমি আগেই বুঝেছিলাম তিনি আমায় কিছু বলতে চান। তাই কায়দা করে মৃত্যুঞ্জয়কে সরালাম। ঘরে যখন আমি আর সাধুমামা ছাড়া অন্য কেউ নেই, তখন সাধুমামা বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা চিরকুট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, আপনার কাছে চিরকুটটা দিতে।” বলে চন্দন প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল।

তারাপদ বোকার মতন বসে থাকল । অবাক চোখ করে, সে একবার চন্দনকে দেখছে, একবার কিকিরাকে। কী যে হয়ে যাচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না। বেশ বোঝা যাচ্ছে সাধুমামা কিকিরাকে জানেন। এটাও জানেন যে কিকিরা এখন এখানে। তারাপদদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সাধুমামাও যেন এক রহস্য।

কিকিরা চিরকুটটা নিয়ে পড়লেন। বার দুই মনে হল, চঞ্চল হয়ে পড়েছেন; প্রকাশ করতে চাইলেন না। কী মনে করে একটা সিগারেট চাইলেন চন্দনের কাছে, তারপর সিগারেটটা ধরিয়ে হঠাৎ উঠে গেলেন।

ঘরে তারাপদ আর চন্দন।

তারাপদ বলল, “কিসের চিরকুট?”

চন্দন বলল, “কিকিরা বলবেন।”

“তুই দেখিসনি?”

“দেখেছি। বুঝতে পারিনি।” চন্দন এ কথা এড়িয়ে গেল ।

তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “সাধুমামা তোকে চিরকুট দিল কেন?”

চন্দন বলল, “তোকে দিয়ে লাভ হত না বলে। কিংবা তোকে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না বলে।”

তারাপদর সন্দেহ হল। কিছু যেন ভাবল তারাপদ; বলল, “তুই কী বলতে চাসবুকের ব্যথার নাম করে সাধুমামা তোকে ডেকে ওই চিরকুটটা দিয়েছে?”

“আমার তাই মনে হয়,” চন্দন ছোট করে জবাব দিল।

“সাধুমামাও তাহলে কিকিরাকে চেনে?” তারাপদ বলল।

চন্দন চুপ করে থাকল।

কিকিরা ফিরে এলেন। ফিরে এসে বসলেন না, ঘরের মধ্যে বার দুই পায়চারি করলেন, তারাপদকে দেখলেন বারবার। তারপর বললেন, “একটু দেহাতী চা খেয়ে নিন স্যার, তারপর কথা বলা যাবে।”

তারাপদর ধৈর্য থাকছিল না। সাধুমামা কেন চিরকুট পাঠিয়েছে কিকিরাকে? কী লিখেছে চিরকুটে? অসহিষ্ণু হয়ে তারাপদ বলল, “সাধুমামা আপনাকে কী লিখেছে?”

কিকিরা প্রথমটায় জবাব দিলেন না। পরে বললেন, “সবই বলব স্যার, রয়েসয়ে শুনতে হবে। তার আগে বলুন, ভুজঙ্গ কাল আপনাকে কোন্ খেলা দেখিয়েছে?”

তারাপদর রাগ হল। খেলা? কিকিরা সব জিনিসকেই খেলা মনে করেন? রাগ করে তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ যা যা দেখায়, সবই আপনি খেলা মনে করেন?

কিকিরা তারাপদর রাগ বুঝে যেন মনে-মনে হাসলেন। চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনিই বলুন স্যার।”

সাধুমামার চিরকুটে কালকের কথার একটু-আধটু উল্লেখ ছিল । কিকিরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কাল ভুজঙ্গ কোন্ খেলা দেখিয়েছে। তবু, সবটাই শুনতে চান তিনি। কাল যা যা ঘটেছে চন্দন বলতে লাগল ।

ওরই মধ্যে কাঁচের বড় বড় গ্লাসে চা এল। দেহাতী চা না দুধ-চা বলা মুশকিল, দুধে সাদা হয়ে রয়েছে, সর ভাসছে ওপরে।

চন্দন কথা শেষ করে থামল।

কিকিরা সব শুনে তারাপদর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি ঠিক জানেন আপনার বোনের আত্মা এসেছিল?”

তারাপদ জেদীর মতন বলল, “আসেনি তার প্রমাণ কোথায়?”

চন্দন চা খেতে খেতে বলল, “তারা, তোর মতন মুখ্য আমি আর দেখিনি। তোকে আমি অত করে বোঝালাম সাধারণ নিয়মে এটা হতে পারে না, অসম্ভব ব্যাপার।”

তারাপদ বলল, “জগতে অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়। ভুজঙ্গ আমার পিসেমশাই হয়ে ডেকে পাঠাবে এটাই কি সম্ভব?” চন্দন ভীষণ বিরক্ত বোধ করে চুপ করে গেল ।

সামান্য চুপচাপ। কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি তা হলে বিশ্বাস করেন, আত্মা আছে, আর পরলোক থেকে সেই আত্মারা ভুজঙ্গর ডাকে মাটিতে। নেমে আসে?”

তারাপদ একগুঁয়ের মতন বলল, “হ্যাঁ করি। আমি যা দেখেছি তা অবিশ্বাস করব কেমন করে?”

কিকিরা কয়েক মুহূর্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে থেকে মজার গলায় বললেন, “আপনি যা যা দেখেছেন আমি যদি আপনাকে সেগুলো দেখাতে পারি তাহলে কি আপনি স্বীকার করবেন ভুজঙ্গ আপনাদের ধোঁকা দিয়েছে?”

তারাপদ প্রথমে অবাক হল, তারপর অবিশ্বাসের চোখে কিকিরার দিকে তাকাল।

কিকিরা তাঁর আলখাল্লার মতন জামাটা খুলে ফেললেন। মাথার সেই টুপিটাও খুললেন। বড় রোগা দেখাচ্ছিল তাঁকে; রোগা আর রুগ্ন। মাথার চুলও কিছু কিছু সাদা, লম্বা লম্বা চুল, ঘাড় পর্যন্ত নামানো ।

কিকিরা বললেন, “চলুন আমরা নিচে যাই। নিচের তলায় হরিরামের একটা গুদোমঘর আছে। পুরনো, পোড়ো, ঘর। ঘরটা বেশ অন্ধকার। সেখানে আমরা এই সাত-সকালেই আত্মা নামাব ।” বলে কিকিরা যেন হাসলেন; বললেন, “ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরে অনেক ব্যবস্থা আছে। সেটা স্যার মডার্ন । আমাদের পোড়ো গুদোমঘরে কিছু নেই। তবু দেখা যাক সেখানে আত্মা নামে কি না?”

তারাপদ এবার কেমন বিব্রত বোধ করল । ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ব্যপারটা পুরো ধোঁকা এ-কথা এখন প্রমাণ হয়ে গেলেও তার যেন ভাল লাগবে না। অথচ এটা যে মিথ্যে তাও জানা দরকার।

কিকিরা বললেন, “চলুন স্যার, দিনের বেলায় আত্মারা বড় একটা আসতে চায় না, তবু একবার চেষ্টা করা যাক। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান অনেকদিন পরে তার খেলা দেখাবে।” বলে ঠাট্টার গলায় হাসলেন কিকিরা। তারপর জাদুকরের ভঙ্গিতে পিঠ নুইয়ে মাথা নিচু করে অভ্যর্থনার ভঙ্গি করে ডাকলেন তারাপদদের, “আসুন।”

চন্দন প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর তারাপদ। তারাপদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, একটা কথা আপনাকে বলে দি। ভুজঙ্গ যতবড় শয়তান তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু বুদ্ধিমানও ভুল করে। ভুজঙ্গ মস্ত বড় ভুল করেছে। বারবার একই ফন্দি কাজে লাগে না। পরীর আত্মা নামিয়ে সে আপনার বাবাকে পাগল করেছিল। তাঁকে মেরেছিল বলা যায়। ওই একই কায়দা করে সে আপনাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলেছে। কিন্তু ও জানে না–একই ফাঁদে দু’বার শিকার ধরা যায় না।”

বাবার কথায় তারাপদ সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

কিকিরা কিন্তু দাঁড়ালেন না। রোগা, রুগ্ন, হাড় জিরজিরে মানুষটির মুখে ঘৃণা এবং প্রতিহিংসা যেন জ্বলে উঠেছিল।

তারাপদ কিকিরার এমন মুখ কখনো দেখেনি। তার কেমন যেন ভয় হল।

কিকিরা নিচে নেমে গেলেন।

.

এগারো

হরিরামে গুদোমঘরটা বেশ অন্ধকার। তবু ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরটার মতন ঘুটঘুঁটে নয়। এখন আবার দিনের বেলা, বাইরের আলো ছোটখাট ফাঁকফোকর দিয়ে একটু না একটু ঢুকে পড়ছে। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখতে গেলে হলের মধ্যে যেমন লাগে–অনেকটা সেই রকম অন্ধকার লাগছিল এখানে।

কিকিরা বড় বড় ফাঁক-ফোকরগুলো ছেঁড়া চট, কাগজ, আরও যা যা পেয়েছেন হাতের কাছে, তাই দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন আগেই; ছোটগুলো ঢাকতে পারেননি। তার জন্যে তিনি ব্যস্তও হলেন না।

ঘরের মাঝমধ্যিখানে একটা ছোট টেবিল ছিল চৌকো ধরনের; আর দুটো চেয়ার, মুখোমুখি।

গুদোমঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন কিকিরা। বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি আর আমি চেয়ারে গিয়ে বসব। মুখোমুখি। টেবিলের ওপরে আমাদের হাত থাকবে, আমরা দুজনে দুজনের হাত ধরে থাকব। আর টেবিলের নিচে আমাদের পা থাকবে, আমরা পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখব। চন্দনবাবু যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।..আসুন।”

তারাপদ কিকিরার মতিগতি বুঝতে পারছিল না। ওই খেপা মানুষটি কী পাগলামি শুরু করলেন? তা ছাড়া তারাপদর মাথায় বাবার কথা বারবার এসে পড়ছিল। কিকিরা কেন বললেন, ভুজঙ্গই একরকম তার বাবাকে মেরেছে? কেন বললেন, পরীর আত্মা নামিয়ে ভুজঙ্গ বাবাকে পাগল করেছিল? কিকিরা কি তার বাবার কথা জানেন? আশ্চর্য! যদি জানেন তবে আগে কেন বলেননি?

তারাপদর মন বড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল।

কিকিরা ততণে চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারাপদকে আবার ডাকলেন তিনি, “আসুন।”

ঝাপসা অন্ধকারে তারাপদ ধীরে ধীরে এগিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“বসুন,” কিকিরা বসতে বললেন।

কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে তারাপদ বলল, “জুতো রয়েছে পায়ে।”

কিকিরা বললেন, “আগেই দেখেছি। শু। চামড়ার। বেশ শক্ত জুতো। ওতে কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পায়েও রয়েছে।” বলে চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ঠাট্টার গলায় বললেন, “ধূপ ধোঁয়া স্তোত্রপাঠ গানটান কিছুই তো এ-ঘরে দেখছেন না । ভুজঙ্গর তাক-লাগানো ব্যাপার কোনোটাই নেই স্যার। তবু দেখবেন আপনার পছন্দসই আত্মারা সবাই একে-একে চলে আসবে।…নিন, বসে পড়ন।”

তারাপদ চেয়ার টেনে বসল। কিকিরাও বসে পড়েছেন। চৌকো ধরনের ছোটখাট অথচ সামান্য উঁচু টেবিলের দু ধারে মুখোমুখি দুজনে বসে। কিকিরা তাঁর দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। টেবিলের ওপরই ফেলে রাখলেন হাত দুটো। বললেন, “নিন, আপনার হাত দুটো এগিয়ে দিন; আমার হাত ধরুন।”

তারাপদ হাত ধরল । কিকিরা টেবিলের তলায় জুতোসমেত পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারাপদও তার পা বাড়াল। কিকিরা বললেন, “না না, আপনি অত লজ্জা পাবেন না স্যার, জুতোর মুখে মুখে ছুঁইয়ে রাখছেন কেন–ডগাটার ওপর একটু চাপ দিয়ে থাকুন।”

সঙ্কোচ হচ্ছিল তারাপদর। কিকিরার পায়ের ওপর নিজের জুতোসমেত পা কেমন করে চাপানো যায়? তার ভদ্রতায় বাধছিল। ভুজঙ্গর ওখানে তারা শুধু মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আঙুল ছুঁইয়ে রাখে। আর এখানে কিকিরা জুতোর মুখের ওপর পা চাপিয়ে দিতে বলছেন। এ

তারাপদ তার জুতোর ডগা দিয়ে কিকিরার জুতোর ডগা চেপে থাকল।

কিকিরা বললেন, “বাঃ বাঃ, চমৎকার হয়েছে। এবার আমরা চোখ বন্ধ করব । বন্ধ করে আত্মার কথা ভাবব । চন্দনবাবু, আপনি চোখ খুলে সবই দেখতে পারেন, যদি অবশ্য এই অন্ধকারে দেখা যায়। রেডি,…তা হলে এবার আমরা আত্মা ডাকতে বসতে পারি। নিন তারাপদবাবু, চোখ বুজে ধ্যান করুন। কাকে ডাকতে চান?”

“বাবাকে।”

“বেশ, বেশ।”

তারাপদ চোখের পাতা বুজে ফেলল। কিকিরাও চোখ বন্ধ করার ভান করলেন–কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করলেন না। চন্দন সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে কিকিরাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই অন্ধকারে দুজনকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মাত্র।

তারাপদ তার বাবাকে ডাকবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু একমনে ডাকতে পারছিল না। নানা ধরনের চিন্তা এসে যাচ্ছিল। কখনো ভুজঙ্গ এসে পড়ছিল, কখনো। সেই মেয়েটি। বাবার কথা ভাবতে গিয়েও কিকিরার কথাটা মনে আসছিল। কিকিরা কেন বললেন ভুজঙ্গই তার বাবাকে মেরেছে?

সমস্ত মন এলোমেলো হয়ে থাকায় তারাপদ কিছুতেই তার বাবাকে তেমন করে ভাবতে পারছিল না।

এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে । কতক্ষণ যে কেটে গেল তাও বোঝা গেল না। সবই চুপচাপ। এক-আধবার বাইরে থেকে কোনো কাকের ডাক কিংবা দূরে কাঠ কাটার শব্দ খুব ফিকেভাবে ভেসে আসছিল।

হঠাৎ যেন কিকিরা সামান্য কেঁপে উঠলেন। তারপর বললেন, “তারাপদবাবু, উনি এসেছেন।”

তারাপদ বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত ছিল। বলল, “কে?”

“আপনার বাবা।”

“বাবা?” তারাপদ বিশ্বাস করতে পারল না। কিকিরা কি তার সঙ্গে তামাশা করছেন! কোথায় বাবা?

কিকিরা বললেন, “আপনার বাবার আত্মা আমায় ভর করে নেই, কিন্তু তিনি আমার কাছেই রয়েছেন। প্রমাণ চান?”

তারাপদ মুখ ফুটে বলতে পারল না–হ্যাঁ চাই। তার মন বলছিল–চাই, নিশ্চয়ই চাই।

কিকিরা যেন তারাপদর মন বুঝেই বললেন, “আপনার বাবার আত্মা এসেছেন কিনা সেটা আপনিই যাচাই করে নিন। ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করুন। জবাব হ্যাঁ হলে ঘন্টার শব্দ শুনবেন; না হলে ঘণ্টা বাজবে না।”

তারাপদ এবার খানিকটা অবাক হল। কিকিরা ঘণ্টার ব্যবস্থাও রেখেছেন? আগে তো বলেননি! কেমন একটা থতমত ভাব হল তারাপদর সত্যি সত্যিই কি কিকিরা আত্মা নামিয়েছেন না মজা করছেন তার সঙ্গে?

কিকিরা বললেন, “কই, জিজ্ঞেস করুন?”

তারাপদ ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,”বাবা! বাবা আপনি এসেছেন?”

প্রথমটায় চুপচাপ। তারপর সত্যি সত্যিই ঘণ্টা বেজে উঠল ।

তারাপদ চমকে গেল। সে স্বপ্নেও ভাবেনি কিকিরা এইভাবে তাকে অবাক করে দেবেন। হতবুদ্ধি হয়ে গেল তারাপদ। আর ওই অবস্থায় আবার জিজ্ঞেস করল, “বাবা, সত্যিই আপনি এসেছেন?”

আবার ঘণ্টা বাজল। তারাপদ কান পেতে শব্দটা শুনল। ভুজঙ্গর ঘরে ঘণ্টার শব্দ আরও সুন্দর শোনায়, এখানে শব্দটা একটু অন্যরকম। ঠাকুরঘরে ঘণ্টা বাজার মতনই অনেকটা। হঠাৎ তারাপদর ঝোঁক চাপল, কিকিরা কোনো চালাকি করছেন কিনা জানতে হবে। চোখ সামান্য খুলে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকাল । কিকিরাও তাকিয়ে আছেন।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “বাবা, আপনার সঙ্গে আর কেউ এসেছে?”

ঘণ্টা এবার বাজল না।

“কাল ভুজঙ্গর ঘরে পরী এসেছিল?”

ঘণ্টা বাজল।

“পরী কি কিছু রেখে গিয়েছে?”

এবারও ঘণ্টা বাজল।

তারাপদ বিচলিত হয়ে পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন হেরে যাচ্ছে । কিকিরা তাকে জব্দ করছেন। খানিকটা রাগও হচ্ছিল তার, কেন রাগ হচ্ছিল বুঝতে পারছিল না। কিকিরা তার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন বলে কি?

আচমকা তারাপদ কতকগুলো উলটো-পালটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল। “আপনার নাম বিষ্ণুপদ না বিষ্ণুব্রত?…আপনি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান না অসুখে ভুগে?…পরী বাড়িতে মারা গিয়েছিল না হাসপাতালে?”

হেরেই গেল তারাপদ। কিকিরার নামানো আত্মা ঠিক-ঠিক জবাবে ঘণ্টা বাজাল।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল তারাপদ।

এবার কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এ এক এমন আত্মা যে আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে, যদি অবশ্য তার জানা থাকে। যাকগে, এবার আর লুকোচুরির দরকার নেই, আসল ব্যাপারটা আপনাকে দেখাই।” বলে কিকিরা তাঁর হাত টেনে নিলেন। চন্দনকে বললেন, “চন্দনবাবু, আপনাকে একটু হাত লাগাতে হবে। এখানে তো আলো নেই, না দেখলে ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পারবেন না। দয়া করে ওই ভেতর দিকের জানলাটা খুলে দেবেন? দরজাও খুলে দিন। ওপাশের উঁচু ঘুলঘুলি থেকে চটটা নামিয়ে নিন স্যার।

চন্দন ঝাপসা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে জানলা-টানলা খুলল। এবার খানিকটা আলো আসছিল। মোটামুটি সবই চোখে পড়ে।

কিকিরা চন্দনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকিয়ে হাসি-হাসি গলায় বললেন, “স্যার, এই আত্মা নামানোর ব্যাপারটা স্রেফ জোচ্চুরি। লোক ঠকানোর খেলা।…আপনারা স্যার লেখাপড়া-শেখা ছেলে–নিজেরাই জানেন মানুষ মনে-মনে কত দুর্বল। আমরা কেউই তো চাই না আমাদের মা বাবা ভাই বোন আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অনেক বয়েস হল, মানুষ বুড়ো হল, অসুখবিসুখে ভুগে মারা গেল, সেটা অন্য কথা; কিন্তু সময় হল না, অথচ মা বাবা ছেলে মেয়ে ভাই বোন যদি চলে যায় তবে কে তা সহ্য করতে পারে বলুন। মানুষের এই দুর্বলতাকে কিছু লোক মাথা খাঁটিয়ে কাজে লাগায়। এরই নাম সেয়াঁস, বা আত্মা-নামানোর চক্র। আমাদের দেশ বলে নয়, সব দেশেই এটা বেশ ভাল ব্যবসা হিসেবে চলে। য়ুরোপ আমেরিকাতেও চলে, আবার হংকং-টংকংয়েও চলে। লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চলছে স্যার এইভাবে। যাকগে, সে পরের কথা, এখন কাজের কথায় আসি।” বলে কিকিরা একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, “এইবার দেখুন, স্যার ঘন্টাটা কেমন করে বাজে।”

তারাপদ আর চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে ঘণ্টাটা বাজাতে লাগলেন। তারাপদরা মাটির দিকে তাকাল, কিছু দেখতে পেল না। অথচ বেশ বুঝতে পারল টেবিলের তলায় ঘন্টা বাজছে।

কিকিরা বললেন, “আপনারা মাটিতে বসে পড়ন, উবু হয়ে বসুন, তা হলেই দেখতে পাবেন।”

চন্দন ঝপ করে বসে পড়ল। বসে পড়ে টেবিলের তলার দিকে তাকাল। দেখল, টেবিলের মাঝ-মধ্যিখানে একটা আঙটার ফাঁকে ছোট মতন এক পুজোর ঘণ্টা ঝোলানো। দেখে চন্দন বোবা হয়ে গেল।

তারাপদও চেয়ারে বসে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের তলাটা দেখতে লাগল ।

কিকিরা হেসে হেসে বললেন, “ভেরি ইজি স্যার, শুধু একটু প্র্যাকটিস দরকার। এই দেখুন, আমি আমার ডান পায়ের বুড়ো আর মাঝখানের আঙুল দিয়ে কেমন করে ঘন্টা বাজাচ্ছি।” কিকিরা ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন।

কিকিরার জুতো জোড়ার একটাতে তাঁর পা নেই। জুতো পড়ে আছে।

তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “আপনার ডান পায়ের জুতো পড়ে আছে, পা নেই।”

চন্দন আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

কিকিরা বললেন, “পা যদি জুতোর মধ্যেই থাকবে স্যার, তবে ঘণ্টাটা বাজাব কেমন করে!”

তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চান জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজানো হয়?”

“এক্কেবারে ঠিক কথা। যদি ঘন্টাটা এ-দেশি হয় তবে ওইভাবে বাজাতে হবে।”

“কিন্তু আপনি জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করলেন কেমন করে? আমি তো বুঝতে পারলাম না। আপনার জুতোর ডগার ওপর আমার পা চাপানো ছিল।“

“আমি বোকা বানিয়েছি। অবশ্য স্যার, এইভাবেই আমরা আপনাদের বোকা বানাই। ব্যাপারটা কী জানেন, আমার যে জুতো জোড়া দেখছেন এটা ঠিক আমার নয়, চেয়েচিন্তে বেছে জোগাড় করেছি। এটা হল খাদে পরে যাবার মালকাট্টাদের জুতো। হরিরামের কাছে পড়ে ছিল। এই জুতোর মুখটা খুব শক্ত, লোহার মতন। এরকম জুতো পাওয়া যায় বাজারে। এই ধরনের শক্ত মুখের আরও পাঁচ রকম জুতো আছে। কলকারখানায় যারা কাজ করে তারা

অনেকেই এই ধরনের জুতো পরে। আঙুলগুলো বাঁচে আর কি-ঠোক্কর, খান, হোঁচট খান, কিসসু হবে না।…সত্যি বলতে কী স্যার, আপনাকে আমি ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, জুতোর ডগার ওপর আপনার জুতোসুদ্ধ পা চাপিয়ে রাখতে। আপনি পা ঠিকই চাপিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারেননি আমি আলগা জুতো থেকে পা বের করে নিয়েছি। কেমন করে বুঝবেন? খুব শক্ত মুখের জুতোর ওপর যদি আপনার জুতোর মুখটা চেপে থাকেন–আপনার মনে হবে, আপনি অন্যের জুতো ঠিকই চেপে ধরে আছেন।”

চন্দন বলল, “আপনার জুতোর ফিতে বাঁধা রয়েছে।”

কিকিরা হেসে উঠে বললেন, “সেটা ওপরে-ওপরে। প্রথমত ফিতে আমি আলগা করে বেঁধেছি, তা ছাড়া–ফিতের তলার দিকে কাটা আছে স্যার। জুতোটা একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন।”

তারাপদ বলল, “এ-সব আপনি কখন করলেন?”

“কেন, সেই যে একবার আপনাদের ঘরে বসিয়ে রেখে বাইরে গেলাম, তখন এই স্পেশ্যাল জুতো পরে এলাম। “

চন্দন কেমন কৌতূহলের সঙ্গে বলল, “আত্মারা তা হলে এইভাবে ঘণ্টা বাজায়?

কিকিরা মুচকি হাসলেন।

তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “কিন্তু ওই মেয়েটি কেমন করে ঘণ্টা বাজাবে? সে আপনার মতন জুতো পায়ে এসে বসত না। খালি পায়ে বসত। আমরাও খালি পায়ে থাকতাম।”

কিকিরা সহজভাবেই বললেন, “স্যার, যে নিয়মে নৌকো জলে ভাসে, সেই একই নিয়মে জাহাজও জলে ভাসে। একই মাটি, একই খড়গড়ার বেলায় কখনো আমরা গড়ি মা দুর্গা, কখনও মা কালী ।” বলে জিবে একটা শব্দ করলেন কিকিরা। তারপর বললেন, “আপনি যদি ম্যাজিকের লাইনে থাকতেন স্যার, বুঝতে পারতেন, খেলাটা একই, তবে এক একজন এক একভাবে দেখায়, সামান্য অদলবদল করে। ভুজঙ্গ খেলাটাকে একটু অন্যভাবে দেখাত।”

চন্দন বলল, “কেমন করে?”

কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা খুব কঠিন নয়। আপনারা হাতে পরার দস্তানা দেখেছেন তো? নরম শক্ত অনেক রকম দস্তানা থাকে। যদি বলি মেয়েটি পায়ের দস্তানা পরত–তা হলে?”

অবিশ্বাসের সুরে তারাপদ বলল, “কী বলছেন?”

“ঠিকই বলছি স্যার, তবে বলায় একটু ভুল হয়েছে। দস্তানা না বলে বলা উচিত পায়ের ঢাকনা, অবিকল পায়ের পাতার সামনের দিকটার মতন।” বলতে বলতে কিক্রি নিজের ডান পা তুলে ধরে দেখালেন। বললেন, “এই যে আঙুল দেখছেন–ঠিক এইরকম আঙুল-অলা একটা কাঠের কিংবা খুব শব্দ রবারের, বা মেটালের ফলস্ পায়ের পাতা দরকার । পুরো পাতা না হলেও চলে, আধখানা হলেই যথেষ্ট। মেয়েটা এই রকম ফলস্ আঙুল-অলা পায়ের পাতা পরে থাকত। দরকারের সময় সে এই খোপের মধ্যে থেকে পা বার করে নিত, আপনারা বুঝতে পারতেন না।”

তারাপদ বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। বলল, “আমাদের পায়ের আঙুল তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়ানো থাকত।”

“না, কখনোই নয়, কিকিরা বললেন, “আপনারা ভাবতেন মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আপনাদের পায়ের আঙুল ছোঁয়ানো আছে। কিন্তু তা থাকত না। আপনারা তার নকল পায়ের পাতার নকল আঙুলে নিজেদের আঙুল ছুঁইয়ে রাখতেন। আর সেই মেয়েটি দরকারের সময় ঢিলেঢালা ওই নকল পায়ের পাতা থেকে নিজের পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজাত।”

চন্দন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “মাই গড়। ওই জন্যেই মেয়েটির পায়ের আঙুল আমার একদিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল।”

তারাপদরও খেয়াল হল, তারও প্রথম দিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল। চন্দন বলল, “তারা, তোর মনে আছে–আমি তোর সঙ্গে একদিন জায়গা বদল করে নিয়েছিলাম। যেদিকে মেয়েটা ঘণ্টা এনে রাখত সেদিকের চেয়ারে বসেছিলাম। আমার সেদিন কেমন মনে হয়েছিল মেয়েটির পায়ের আঙুল বেশ শক্ত।”

তারাপদ অস্বীকার করতে পারল না। চুপ করে থাকল। চন্দন খানিকটা উত্তেজনার গলায় বলল, “কিকিরা স্যার, মেয়েটা তা হলে একটা মাত্র পায়ে ফলস ফুট পরত?”

“খুব সম্ভব তাই পরত। যেদিকে ঘণ্টা থাকত–সেই দিকের পায়ে পরত।“

“ওই পায়ে ঘন্টা বাজাত?”

“কোনো সন্দেহ নেই।”

“অত বড় ঘণ্টা পায়ের আঙুলে ধরে কেমন করে বাজাত?”

“ওটা অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসে মানুষ সবই শেখে। সাকাসের খেলা দেখেছেন তো! আপনি আমি পারব না। কিন্তু যে শিখেছে সে পারবে। অত কথায় দরকার কী স্যার, সামান্য একটা শাঁখ যদি আপনাকে বাজাতে বলি আপনি পারবেন না–অথচ কত ছোট-ছোট মেয়েরা কেমন চমৎকার শাঁখ বাজায়!”

তারাপদ আর. যেন কথা বলতে পারছিল না। এখন তার বিশ্বাস হচ্ছিল ভুজঙ্গ আগাগোড়া তাদের সঙ্গে ধাপ্পা মারছে! কিন্তু তাই কি?, সবই ধাপ্পা? মোমের আঙুলটাও ধাপ্পা?”

কিকিরা বললেন, “একটা কথা কিন্তু বলে রাখি। যে-ঘণ্টাটা পায়ের সামনে এনে রাখা হত–সেটা হয়ত আপনাদের ধোঁকা দেবার জন্যে। দেখানো হত–আত্মা কেমনভাবে এসে ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজায়। আসলে টেবিলের তলার দিকে লুকোনো একটা ঘণ্টা ঝুলানো থাকত। কিংবা এমনও হতে পারে–মেয়েটি পায়ের আঙুলে ঘণ্টার মুণ্ডুটা আঁকড়ে ধরে বাজাত। এতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না। মোদ্দা কথা পা দিয়েই ঘণ্টা বাজানো হত?”

কেউ কোনো কথা বলল না কিছুক্ষণ। তারাপদর দীর্ঘ নিশ্বাস শোনা গেল।

সামান্য পরে ভারী গলায় তারাপদ বলল, “আপনি বাবার কথা তখন কী বলছিলেন? ভুজঙ্গই বাবাকে মেরেছে?”

কিকিরা বললেন, “সেকথাও বলব। তবে এখানে আর নয়–বাইরে চলুন।”

নিজের ঘরে এনে কিকিরা তারাপদদের বসালেন। আবার একবার দেহাতী চা খাওয়া হল। চন্দনের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন কিকিরা । জোরে-জোরে টান মারলেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকালেন।

কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এবার আপনার বাবার কথা শুনুন। আপনার বাবাকে আমি কখনো চোখে দেখিনি। তবে তাঁর কথা শুনেছি। মানুষটি বড় ভাল ছিলেন, সরল সাদাসিধে। তাঁর মন খুব নরম ছিল, সামান্যতেই ছটফট করতেন, কেঁদেকেটে মরতেন। আপনার ছোট বোন পরী যখন ওইভাবে আচমকা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেল, তিনি একেবারে পাগলের মতন হয়ে গেলেন।”

তারাপদ তখনকার কথা মনে করবার চেষ্টা করল। ওই বয়েসের কথা স্পষ্ট করে কিছুই মনে পড়ে না, অস্পষ্ট করেও বা কতটুকু মনে পড়তে পারে । পরী মারা যাবার পর সমস্ত বাড়িটাই কেমন ফাঁকা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাবা, মা, সে নিজে–সকলেই যে যার মতন কেঁদে মরত।

কিকিরা বললেন, “মন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল আপনার বাবার। এই সময়ে মানুষ বড় দুর্বল হয়ে পড়ে। তার মতি নষ্ট হয়। আপনার বাবা সেই সময় পরলোক, আত্মা–এইসব ব্যাপার নিয়ে লেখা বইটই পড়তেন, নানা লোকের কাছে গল্প শুনতেন, লুকিয়ে লুকিয়ে প্ল্যানচেট করতে বসতেন। আপনার মা এ-সব একেবারেই পছন্দ করতেন না।…যাই হোক, এই সময় একবার আপনাদের সাধুমামা কলকাতার বাড়িতে এলেন। আপনার বাবা তাঁকে ধরলেন। সাধুমামাও আপনার বাবার অবস্থা দেখে তাঁকে ভুজঙ্গভূষণের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। লুকিয়ে। সেই যাওয়াই কাল হল।”

তারাপদর বুকটা কেমন যেন করে উঠল। দুঃখে না রাগে বোঝা গেল না। উত্তেজনাতেও হতে পারে। কিকিরার দিকে সে তাকিয়ে থাকল।

“সাধুমামা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দু-দিন দিন পরে আপনার বাবা চুরি করে লুকিয়ে ভুজঙ্গভূষণের কাছে হাজির। ভুজঙ্গকে হাতে পায়ে ধরলেন–আমার মেয়েকে একবার দেখান। ভুজঙ্গ তো মেয়ে দেখাল না, কিন্তু মেয়ের আত্মাকে দেখাল, যেমন করে আপনাদের দেখিয়েছে। মেয়ের পুরো হাতের একটা মোমের ছাঁচও দেখাল। সেই ছাঁচ বুকে করে আগলে আপনার বাবা কলকাতায় ফিরে এলেন। কিন্তু আসবার পথেই তাঁর মাথায় কী যে হল, একেবারে অন্য মানুষ। কথাবার্তা বলতেন না, কাজকর্মে যেতেন না, বোবা হয়ে থাকতেন, পাগলের মতন তাকাতেন। আপনার মা কিছুই জানলেন না। আপনার বাবার অসুখ করল–মাথার গোলমালের দরুনই হবে। অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। সেই মোমের ছাঁচটার কী হল আমি জানি না। হয় আপনার বাবা নিজেই নষ্ট করে ফেলেছিলেন, না হয় আপনার মা কিছু না-জেনেই ফেলে দিয়েছিলেন।”

তারাপদর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুক ধকধক করছিল। চন্দনও যেন। বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরাও অনেকক্ষণ কথা বললেন না ।

চন্দন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “মোমের ছাঁচ–মানে হাতের ওই ছাঁচ তৈরি করা যায়?”

কিকিরা বললেন, “যায়। পৃথিবীতে যেখানেই সেয়াঁসের আড্ডা বসে–সেখানেই এটা চালু আছে। আত্মা যে এসেছে তার প্রমাণ দেবার জন্যে ছাঁচ দেখানো হয়।”

“কেমন করে হয়?”

“সেটা আপনি এখানে আপনাদের দেখাতে পারব না। কারণ খানিকটা মোম আমি এ-জায়গায় জোগাড় করতে পারলেও রবারের একটা দুস্তানা জোগাড় করতে পারব না। তবে নিয়মটা বলে দিই । রবারের একটা দস্তানার মধ্যে জল ভরে দস্তানাটা ইচ্ছেমতন ফুলিয়ে নিতে হয়। তারপর সেটা ভাল প্যারাফিন বা মোমের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে হয়। দস্তানার গায়ে মোম জমে গেলেই সেটা উঠিয়ে নিয়ে জলের পাত্রে ডুবিয়ে দিতে হয়। তারপদ দস্তানার ভেতরের জল ফেলে দিলেই রবারের দস্তানা কুঁচকে যাবে। সেটা বেরিয়ে আসবে । ছাঁচটা ঠিক থাকবে। এইভাবে আঙুল করা যায়, হাতের মুঠো করা যায়..। অনেক সময় এগুলো আগে থেকেই করা থাকে। সেয়াঁসের সময় লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেওয়া হয়।”

তারাপদ আর সহ্য করতে পারল না। রাগে, ক্ষোভে সে কাঁপতে লাগল। চিৎকার করে বলল, “এ সমস্তই তা হলে ধোঁকাবাজি? ব্লাফ?”

“সমস্তই।”

“আমার বাবাকে ভুজঙ্গ ভাঁওতা দিয়েছিল? আর বেচারি বাবা সেই ধোঁকাবাজিতে বিশ্বাস করে পাগল হয়ে গেল?”

“আমি তাই মনে করি। শুধু আমি কেন, আপনাদের সাধুমামা–মানে সাধনদাও তা জানে। সে এর সাক্ষী ।”

তারাপদ কেমন এক শব্দ করে উঠল। তারপর মুখ নিচু করে যেন মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল নিজেরই। সে কেঁদে ফেলেছিল।

চন্দন চুপ। কিকিরাও চুপ। তারাপদকে সান্ত্বনা দিতেও পারছিলেন না।

কিছু পরে চন্দন চাপা গলায় বলল, “আপনি যা বললেন তা কি সবই সত্যি?”

কিকিরা বললেন, “সমস্তই সত্যিই। ঘণ্টা বাজানোই বলুন আর মোমের ছাঁচের কথাই বলুন, এর কোনোটাই আত্মা এসে করে দিয়ে যায় না। সবটাই ধোঁকা, চালাকি, হাত সাফাই । জাদুর রাজা হুডিনির নাম শুনেছেন? তিনি নিজে এইসব লোক-ঠকানো খেলা ধরে দিয়ে গেছেন। তাঁর বইয়ে যেমন-যেমন আছে, আমি ঠিক সেই-সেইভাবে ঘণ্টা বাজিয়েছি, রবারের দস্তানা থাকলে হাতের ছাঁচও গড়ে দেখিয়ে দিতাম।”

তারাপদ মুখ তুলল। তার মুখ কেমন যেন খেপার মতন দেখাচ্ছে, চোখের জলে গাল ভেজা। তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, ভুজঙ্গকে আমি দেখছি। “

কিকিরা হাত তুলে বললেন, “না না, ওভাবে দেখা নয়। আমি বলে দেব কী ভাবে আপনারা তাকে দেখবেন। ভুজঙ্গ বড় চালাক, ভীষণ শয়তান। তা ছাড়া এটা কলকাতা নয়। এখানে ভুজঙ্গর অনেক শক্তি। তার সঙ্গে সোজাসুজি লড়া চলবে না। অন্য পথ আছে। চলুন–আপনাদের একটু এগিয়ে দিই। এগিয়ে দিতে দিতে বলব।“ কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।

.

বারো

সন্ধের পর পর তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের আত্মা-নামানোর সেই রহস্যময় ঘরে এসে বসল। আজ সে একা, চন্দন নেই। চন্দন আসবে না।

দুপুরটা যে কেমন করে কেটেছে, তারাপদ নিজেই শুধু জানে, আর জানে চন্দন। উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়েছিল মাঝে মাঝে; দুঃখে ঘৃণায় এক এক সময় সে খেপার মতন কাণ্ড করছিল। চন্দন তাকে অনেক কষ্টে সামলেছে। বলেছে, “ওরকম করিস না তারা, ভুজঙ্গর কোনো চেলা যদি একবার বুঝতে পারে আমরা ভুজঙ্গর সিক্রেট জানতে পেরেছি তা হলে তুইও গেলি, আমিও গেলাম। নিজেকে কন্ট্রোল কর। তোকে এখন অ্যাক্টিং করতে হবে, কিকিরা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন।”

চন্দন অনেক বুদ্ধিমান। তারাপদর ওই ছটফটে ভাবটাকে সে বুদ্ধি করে কাজে লাগাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলল বন্ধুকে। তারপর মৃত্যুঞ্জয়কে ডেকে পাঠাল। তারাপদকে বলল, “ভুজঙ্গর সঙ্গে আর একবার দেখা করতে চাস তুই; একলা। শেষবারের মতন তোর মা-বাবার কাছে দুটো কথা জানতে চাস। বুঝলি?”

তারাপদ সবই বুঝল। ভুজঙ্গর ওই ঘরে বসে আজ তাকে সত্যিই অনেক কিছু করতে হবে। কিকিরা বলে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন।

মৃত্যুঞ্জয় এল, চন্দনই কথা বলল বেশি, তারাপদ কেমন ভেঙে পড়েছে, কী ভীষণ কান্নাকাটি করছে–এই সব বুঝিয়ে বলল, আজ আর-একবার সে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

তারাপদ প্রায় কিছুই বলল না, বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল। তার চোখমুখ দেখে মৃত্যুঞ্জয় কী ভাবল কে জানে, ভুজঙ্গভূষণকে তারাপদর কথা বলতে গেল। খানিকটা পরেই আবার ফিরে এল, বলল, “হ্যাঁদেখা হবে।”

সেই দেখা করতেই তারাপদ এখন সন্ধেবেলায় ভুজঙ্গভূষণের রহস্যময় ঘরে এসে বসেছে। একলা।

তারাপদ চুপচাপ বসেই থাকল। আজ ক’দিন আসা-যাওয়া করতে করতে এই ঘর তারাপদর চেনা হয়ে গেছে। অভ্যেসও হয়ে এসেছে অনেকটা। আগের মতন অতটা গা-ছমছম করে না। তবু এই ঘরের একটা ভৌতিক পরিবেশ রয়েছে, মন যেন অন্যরকম হয়ে যায়, বুকের মধ্যে শিরশিরে ভাব হয়।

তারাপদ এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল। এত অস্পষ্ট, প্রায়-ঘুটঘুঁটে ঘরে কোনো কিছুই ভাল করে দেখা যায় না। এই ঘর যেমন ছিল সেই রকমই রয়েছে। সেই একই মিটমিটে আলো, সেই ধূপধুনোর গন্ধ, সেই ভুজঙ্গভূষণের সিংহাসন, সেই বেড়াল ।

ছোট টেবিলের ওপর বসানো কালো বেড়ালটাকে দেখল তারাপদ। এই বেড়াল তাদের খুব অবাক করেছিল, ভয়ও পাইয়ে দিয়েছিল। আজ তারাপদ কালো বেড়ালটাকে দেখল। তার ভয় হল না। কেনই বা হবে? এটাও তো চালাকি, কিংবা মানুষকে বোকা বানিয়ে দেবার ফন্দি। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন করে বেড়ালটা ঘুরে যায়?

কিকিরা হেসে হেসে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা যেভাবে ঘোরে। ঘড়িতে দুটো কাঁটা থাকে, ছোট কাঁটা আর বড় কাঁটা, যদি একটা থাকত কী হত? একটাই ঘুরত। খুব পুরনো আমলের বড় বড় দেওয়াল-ঘড়ি কিংবা দেরাজের ওপর রাখা ঘড়ি দেখেছেন স্যার? এক একটা ঘড়ি থাকত যার মধ্যে ঘণ্টার কাঁটার ওপর ছোট্ট রঙিন পাখি বসানো থাকত মেটালের। ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও ঘুরত। এটাও সেই রকম, তফাতের মধ্যে কী জানেন, ঘড়ির যন্ত্রপাতিগুলো নিচে আছে, আর ওপরে–কাঁটার বদলে একটা ফুঁকো বেড়াল, পেপার পাল্পের কিংবা হালকা কিছুর। ঠিক যেভাবে গ্রামোফোনের রেকর্ড ঘোরে–সেইভাবে বেড়ালটা ঘুরছে, তবে খুব ধীরে ধীরে–বোঝা যায় না। যদি একটা ওয়াল-ক্লক মাটিতে শুইয়ে রাখেন চিত করে তার কাঁটাও এইভাবে ঘুরবে।

তারাপদ কালো বেড়ালটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেবার আগেই স্তোত্রপাঠ শুরু হল। যেমন রোজই হয়–সেইরকম। দামি লাউডস্পিকারটা যে কোথায়, বোঝা যায় না, কিন্তু বড় নিখুঁত। এই নিঃশব্দ ঘরে চমৎকার শোনায়, মন ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যায়।

স্তোত্রপাঠ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সেই ক্ষীণ আলো নিবে গেল। নিবে গিয়ে ভুজঙ্গভূষণের বসবার দিকটায় লাল আলো জ্বলে উঠল । ভেলভেটের পরদা সরিয়ে ভুজঙ্গভূষণ এলেন, সেই একই রক্ত-গৈরিক বসন, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা, মুখ মুখোশে ঢাকা।

নিজের আসনে বসলেন ভুজঙ্গভূষণ। তাঁর পায়ের দিকে একপাশে ঘণ্টা।

তারাপদ এইবার ভয় পেতে শুরু করল। উত্তেজনা আর ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। আজ যে কী হবে শেষ পর্যন্ত সে জানে না। হয়ত ভীষণ কোনো বিপদে পড়বে, তেমন কিছু ঘটলে বাঁচবে না মরবে–কে বলতে পারে । মনের এই ভয়ের ভাবটাও কাটাবার জন্যে প্রাণপণে তারাপদ বাবার কথা ভাবতে লাগল। এই লোকটা–ওই ভুজঙ্গভূষণ তার সরল, ভালোমানুষ, সাদাসিধে স্বভাবের বাবাকে কী ভীষণ প্রবঞ্চনা করেছে। শুধু প্রবঞ্চনা নয়, সেই প্রবঞ্চনার দরুন তার বাবা-বেচারি মিথ্যেকে সত্য বলে জেনেছে। বাবা-বেচারির হয় মানসিক আঘাত লেগেছিল, না হয় বাবা মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে পাগলের মতন হয়ে পড়েছিল। তাতেই বাবার অসুখ, আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু।

এই সমস্তর জন্যে ওই ভুজঙ্গই দায়ী। বাবাকে ওই লোকটাই মেরেছে। তারাপদদের সংসার, তাদের জীবন, এত দুঃখকষ্ট, মার অত কষ্ট সওয়াসবই ওই শয়তানটার জন্যে। তারাপদ কেমন করে লোকটাকে ক্ষমা করবে?

তারাপদকে চমকে দিয়ে ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন, “তারাপদ, তুমি আজ আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছ কেন? আমার শরীর ভাল নেই, ভাবছিলাম বিশ্রাম করব।”

প্রথমে কথা বলতে পারল না তারাপদ, গলা কাঠ হয়ে থাকল। বার দুই গলা পরিষ্কার করে শেষে কাঁপা কাঁপা গলায় তারাপদ বলল, “আপনার সঙ্গে আমার ক’টা কথা ছিল।”

“বলো।”

একটু থেমে নিজেকে সামলে নিতে নিতে তারাপদ বলল, “কাল সারারাত আমি ঘুমোত পারিনি, শুধু ভেবেছি। আজও সারাদিন ভেবেছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি।” বলে আবার একটু থামল তারাপদ, তারপর গলায় যতটা সম্ভব আবেগ দিয়ে বলল, “পিসেমশাই, আপনি রাগ করবেন না, আপনার। কথামতন আমি চলতে রাজি। কিন্তু আর একবার, একটিবার মাত্র আমি মা-বাবার কাছে তাঁদের আদেশ জানতে চাই। মনে কোনো খুঁত রাখতে চাই না। আপনি দয়া করে আজ একবার ওঁদের ডাকুন।”

“আবার?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।

“শুধু আজকের মতন-” তারাপদ মিনতি জানাল।

“তোমার মনে কি এখনো সন্দেহ আছে, তারাপদ? তোমার মা বাবার যা ইচ্ছে সে তো আগেই জেনেছ।”

“আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবু সব ছেড়েছুঁড়ে যখন আপনার এখানে চলে আসব ভাবছি–তখন আসবার আগে আর একবার মা বাবার আদেশ নিতে চাই।”

দু মুহূর্ত অপেক্ষা করে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। আজই তোমায় মনঃস্থির করতে হবে, আর সময় পাবে না।”

ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা বাজালেন। মৃত্যুঞ্জয় এল ।

কিছু যেন বললেন ভুজঙ্গভূষণ, তারাপদ কিছুই শুনতে পেল না, বুঝতেও পারল না। মৃত্যুঞ্জয় চলে গেল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার বন্ধু কবে ফিরবে?”

“ফিরবে। শীঘ্রি।”

তারাপদ বেশি কথা বলল না। কিছু না বলে চুপ করে থাকাই ভাল। কথা ঘুরোবার জন্যেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, তারাপদ আচমকা বলল, “পিসেমশাই, একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“আপনার এই ঘরবাড়ি সম্পত্তি আপনি কেন আমায় দিয়ে যেতে চাইছেন?”

“কেন চাইছি তোমায় বলেছি। আমার নিজের বলতে কেউ নেই, তুমি ছাড়া। আমি যা করেছি ও রেখেছি, তা তোমার হাতে থাকলেই খুশি হব। “

মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে আবার ফিরে এল। ভুজঙ্গভূষণকে কিছু বলল মুখটা নামিয়ে । ভুজঙ্গ ইশারায় ঘরের দিকে আঙুল দিয়ে কী দেখালেন। চলে গেল মৃত্যুঞ্জয়। একটু পরেই আর-একজন এল, ঘরের মধ্যে আবার ধুনো দিয়ে গেল, লুকোনো জায়গায় ধূপ বসিয়ে গেল।

ঘরটা আবার ধোঁয়ায় আরও অস্পষ্ট হল। ধুনো-গুগগুলের গন্ধে চাপা বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

আর-একটু পরেই সেই মেয়েটি এল। কালো শাড়ি জামা পরা, মাথায় এলো চুল। এল, ভুজঙ্গর সামনে দাঁড়াল, তারপর ঘণ্টাটা তুলে নিয়ে গোল টেবিলের অন্যদিকে বসল। আজ চন্দন নেই, সে থাকলে যেমনভাবে তিনজনে গোল হয়ে বসা যায়, কানামাছি খেলার মতন হাত ছড়িয়ে-তেমনভাবে বসা গেল না। মুখোমুখি বসতে হল; সকালে কিকিরার সামনে যেমনভাবে বসেছিল তারাপদ।

নতুন করে শেখাবার কিছু নেই। তারাপদ টেবিলের ওপর হাত ছড়িয়ে দিল, পা বাড়িয়ে দিল টেবিলের তলা দিয়ে। মেয়েটিকে একবার ভাল করে দেখল। অন্য দিনের চেয়ে আজ যেন মেয়েটিকে শুকনো দেখাচ্ছে। রোগা মুখ আরও শুকনো।

এরপর রোজই যেমন হয়–সেই রকম। ঘরের বাতি নিবে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। টেবিলের ওপর তারাপদ হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরে রেখেছে। তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে মেয়েটির পায়ের আঙুল ছোঁয়াননা। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় বললেন, “তারাপদ, তুমি তোমার মার কথা ভাব। তাকে ডাকো। মন যেন চঞ্চল না হয়!”

তারাপদ মা বাবার কথা ভাবল না। কোনো প্রয়োজন নেই।

খুব সতর্ক ছিল তারাপদ। সমস্ত কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছিল। চোখ খুলছিল মাঝে মাঝেই। যদিও চোখ খোলার কোনো অর্থ হয় না। এই জমাট অন্ধকারে এক বিঘত দূরের জিনিসও বিন্দুমাত্র চোখে পড়ে না।

প্রথমেই একটা জিনিস অনুভব করতে পারল তারাপদ। মেয়েটির ডান পায়ের আঙুল শক্ত শক্ত লাগলেও বাঁ পায়ের আঙুল অত শক্ত লাগছে না। তার মানে, আগের কদিন মেয়েটির দুটি পায়ের একটি চন্দন ছুঁয়ে থাকত, অন্য পা ছুঁয়ে থাকত তারাপদ। একই লোকের পক্ষে এই তফাত বোঝার উপায় ছিল না, মেয়েটির এক পায়ের আঙুল কেন কাঠের মতন শক্ত, অন্য পায়ের আঙুল স্বাভাবিক? এই তফাতটুকু কেন?

তারাপদ খুব সহজেই এই ধাঁধা ধরে ফেলতে পারল। মেয়েটি তার ডান পায়ে নকল পাতা পরে। সেই পা কাঠ কিংবা শক্ত রবারের পায়ের ফাঁপা পাতা থেকে বের করে নিয়ে ঘণ্টা বাজায়। কিকিরা ঠিকই বলেছেন।

আজও মেয়েটি ঘণ্টা বাজাতে পারবে। সে সুযোগ তারাপদ তাকে দেবে।

নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে সত্যিই এক সময় ঘণ্টা বেজে উঠল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কে, বেণু? তুমি এসেছ?”

ঘণ্টা বাজল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তোমার ছেলে তোমায় ডেকেছে। সে তোমার আদেশ চায়। তোমাদের মনের ইচ্ছে তাকে জানাও…”

তারাপদ আত্মা আবিভাব, ঘণ্টা বাজানোর দিকে মন দিল না, ভুজঙ্গর কথাতেও নয়। খুব সাবধানে নিজের বাঁ পা দিয়ে মেয়েটির ডান পায়ের ফেলে রাখা নকল ফাঁপা পাতা আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগল। যে কোনো সময়ে এই চালাকি মেয়েটি বুঝে ফেলতে পারে। ভয় করছিল তারাপদর, শুধু সাবধানে সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। এর আগে চন্দনও একদিন ঘণ্টা বাজানোর রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল, কিকিরার কথা মতন। মাফলার থেকে ছিঁড়ে আনা সাদা উলের টুকরো ঘণ্টার পাশে ফেলে রেখেছিল। ধরবার চেষ্টা করছিল ঘন্টাটা কেউ তুলে নিয়ে বাজায় কিনা? মানুষেই হোক অথবা ভূতেই হোক, ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজানোর পর আবার যখন রাখবে–তখন একটুও নড়চড় হবে না, উলের টুকরোর ঠিক পাশেই থাকবে–এটা হতে পারে না। চন্দন দেখেছিল, ঘন্টা আর উলের টুকরো ঠিক জায়গাতেই আছে। তখন থেকেই চন্দনের সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই তুচ্ছ একটা প্রমাণ প্রমাণই নয়, আরও বড় প্রমাণ চাই।

ভুজঙ্গ আত্মা নামিয়ে যাচ্ছেন। বেণু গেল, বিষ্ণু এল। কথা বলছেন ভুজঙ্গ। তারাপদ ততক্ষণে তার কাজ সেরে ফেলেছে। বাজাক-টেবিলের তলায় গোপনে ঝুলিয়ে রাখা ঘণ্টা যত খুশি বাজাক মেয়েটি কিছু আসে যায় না তারাপদর।

আত্মারা শেষ পর্যন্ত বিদায় নিল। তারাপদ নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল, এবার মেয়েটি পা নামাবে, নামিয়ে তার নকল পায়ের পাতা খুঁজবে।

তারাপদ বুঝতে পারছিল মেয়েটি পা নামিয়েছে, পায়ের পাতা খুঁজছে। তার পা নড়ছে, শাড়িও নড়ছে। ঠিক জায়গায় নকল জিনিসটি না পেয়ে পা দিয়েই যেন চারদিক খুঁজছে, অন্ধকারে আমরা যেভাবে পায়ের চটি খুঁজি।

মেয়েটির হাতের আঙুলের ওপর সামান্য চাপ দেবার চেষ্টা করল তারাপদ, বোঝাতে চাইল-তুমি ধরা পড়ে গেছ। চলে যাও।

এইবার সেই ক্ষীণ বাতি জ্বলল। আত্মারা চলে যাবার সামান্য পরে যেমন রোজই বাতি জ্বলে ওঠে। মেয়েটি তারাপদর মুখের দিকে তাকাল। তার ফরসা মুখে ভয় ও বিস্ময়। চোখের পাতা পড়ল না মেয়েটির। কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে তাকিয়ে থেকে মেয়েটি উঠে পড়ল। তারাপদর মনে হল, ভুজঙ্গকে বলে দেবে।

মেয়েটি কিছু বলল না। মুখ নিচু করে অন্য দিনের মতন ভুজঙ্গর পাশ দিয়ে চলে গেল।

তারাপদর এবার সত্যি সত্যিই বুক কাঁপছিল।

ভুজঙ্গ বললেন, “তোমার আর কিছু বলার আছে, তারাপদ?”

কথার জবাব দেবার আগে তারাপদ প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল। শেষে বলল, “না। আর কিছু নেই।” একটু থেমে আবার বলল, “পিসেমশাই, পরীকে আজ আর-একবার দেখতে পাব না?”

ভুজঙ্গ যেন বিরক্তই হলেন; বললেন, “তোমায় আমি বারবার বলেছি–আত্মাদের যখন-তখন খেয়াল-খুশি মতন ডাকতে নেই। তাতে তাঁদের কষ্ট হয়।”

তারাপদ মনে মনে বুঝতে পারল, ভুজঙ্গ কেন বারবার পরীকে আনতে চান না। ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। যতই চালাকি করে শিখিয়ে পড়িয়ে, কায়দা কানুন করে পরীর নাম দেখিয়ে ওই মেয়েটিকে আনা হোক না কেন–তবু ঘণ্টা বাজানোর চেয়ে এই ব্যাপারটা কঠিন। সামান্য ভুলচুক হলেই ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে যে-কোনো মানুষের পক্ষে আসা, আর ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো মুশকিল। তার চেয়েও মুশকিল হল, একেবারে গায়ের সামনে এসে দাঁড়ানো রুমালে মাখানো সেন্টের গন্ধ নাকের কাছে ধরা, খুব আলগা করে মাথার ছড়ানো চুলের ছোঁয়া দিয়ে যাওয়া। কাল। তারাপদকে এইভাবে ঠকানো হয়েছে। যদি ওই মেয়েটি সামান্য ভুলচুক করত–তারাপদর গায়ে এসে পড়ত । হয়ত তারাপদ তখন উত্তেজনার মাথায় হাত বাড়িয়ে পরীকে ধরতে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে ফেলত।

ভুজঙ্গ চতুর লোক। ঝুঁকি নিতে বারবার রাজি হবে না। কিন্তু তেমন একটা বড় ঝুঁকি কি ভুজঙ্গ নেয়? কিকিরা বলেছেন, এই সশরীরে আত্মা আসার ব্যাপারটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতন। এখানে একটু অন্যরকম চালাকি করতে হয়। অন্ধকারে দেখা যাবার একরকম দূরবীন আছে। যুদ্ধের সময় রাত্রে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে শত্রুরা গুলি ছুঁড়তে পারে ভেবে অন্ধকার দেখার জন্যে সৈনিকেরা এই দূরবীন ব্যবহার করে। একে বলে স্নাইপারস্কোপ। পরীর বেশে যখন মেয়েটি এসেছিল–তখন তার হাতে ওই দূরবীন ছিল, ছোট ধরনের। কাজেই এই অন্ধকারে সে সবই দেখতে পাচ্ছিল। কোনো অসুবিধে তার হয়নি।

তবু কখনো কখনো এ-সব কাজে ভুল হয়ে যায়। ভুজঙ্গ খুব সাবধানী।

তারাপদ বলল, “আমি তা হলে উঠি?”

ভুজঙ্গ বললেন, “তুমি মনঃস্থির করেছ?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি রাজি?”

“রাজি।”

“আমার সমস্ত শর্ত মানছ?”

“মানছি।”

“খুশি হলাম, তারাপদ। তোমায় আমি আমার আশীর্বাদ জানাচ্ছি।” বলে ভুজঙ্গ একটু চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, “ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”

তারাপদ ঘণ্টা তুলে নিল। তার চেয়ারের পেছন দিকে পায়ের নকল পাতা পড়ে আছে। ভুজঙ্গর দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ভুজঙ্গভূষণের পায়ের কাছে ঘণ্টাটা নামিয়ে তারাপদ দাঁড়িয়ে থাকল।

ভূজঙ্গভূষণ হাত নেড়ে ইশারায় তারাপদকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে বললেন। ফিরে এল তারাপদ ।

ঘণ্টাটা বাজালেন ভুজঙ্গ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তারাপদ, আমাদের পালনীয় কিছু আচার আছে, নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে। আজ তোমায় তার জন্যে ব্যস্ত হবে না। কাল সকালে মৃত্যুঞ্জয় তোমাকে যেমন-যেমন বলবে তুমি সেইভাবে কাজ করবে। আজ আর তোমায় আমি বসিয়ে রাখব না। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমার সমস্ত শর্ত মেনে কাজ করলে এই আসনের তুমি হবে একমাত্র উত্তরাধিকারী। যদি প্রবঞ্চনা করো, ছলনা করো–তবে তার। শাস্তি কত ভয়ংকর হবে তুমি জানো না।”

তারাপদকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল । নিকষ কালো অন্ধকার।

সেই অন্ধকার যেন এবার পাতালের অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল। থমথম করছে সব, স্তব্ধ। আচমকা ভুজঙ্গভূষণের গলা শোনা গেল, বজ্রগম্ভীর। “আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করলৈ তোমার কী হবে তুমি জানো না। সামনে তাকাও। দেখো।”

ভুজঙ্গর কথা শেষ হবার আগেই ঘরের মাথার দিকে ক্ষীণ একটা আলো জ্বলে উঠল । তারাপদ মাথা তুলে আলোটা দেখবার চেষ্টা করে মুখ নামাতেই ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

ঘরের মাঝখানে একটা রক্তাক্ত মুণ্ডু ঝুলছে। শরীর হিম হয়ে গেল তারাপদর। মাথা ঘুরতে লাগল। দু হাতে চোখ ঢাকল।

সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য হেসে উঠলেন ভুজঙ্গ। সেই হাসি যেন ঘরের বাতাসে ঘূর্ণির মতন পাক খেতে লাগল। অসহ্য। একেবারেই অসহ্য। চোখ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে কান চেপে ধরল তারাপদ। আবার তাকাল। দেখল মুণ্ড নয়, একটা মাথার খুলি, টকটকে লাল রক্তে যেন চোবানো। তার চোখের গর্ত, মুখের হাঁ–বীভৎস। মাথার খুলিটা ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত শূন্যে লাফাতে লাফাতে আসা-যাওয়া করছিল।

ভুজঙ্গভূষণ তখনো হাসছেন। তারাপদ টেবিলের ওপর মাথা থেকে বেহুঁশের মতন পড়ে থাকল।

.

রাত অনেক হয়েছে। বারোটা বাজতে চলল।

তারাপদদের ঘর অন্ধকার। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। বাইরে প্রচণ্ড শীত।

চন্দন আর-একটা সিগারেট শেষ করে নিচু গলায় বলল, “আর দেরি করে লাভ নেই।”

চন্দনের বিছানার একপাশে কিকিরা সেই অলেস্টার পরে, মাথায় টুপি এঁটে বসে আছেন। গলায় মাফলার। অন্ধকারে তিনজনে বসে আছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।

তারাপদ তার বিছানায়। শীতের সবরকম সাজ তার পরনে। কিকিরা চাপা গলায় বললেন, “আরও পনেরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করা যাক।”

তারাপদ বলল, “সাধুমামার দায়িত্ব আপনার।”

কিকিরা বললেন, “সাধনদার দায়িত্ব আমি ঠিক লোককে দিয়েছি। আপনি স্যার নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চন্দন বলল, “আপনি আর আমাদের সম্মান করে আজ্ঞে-আপনি করবেন না কিকিরাবাবু, বড় লজ্জা লাগে।”

কিকিরা একটু হাসলেন, “তা হলে বলব না।”

তারাপদ বলল, “ওই মেয়েটির জন্যে আমার বড় ভয় হচ্ছে।”

“ভয়ের কিছু নেই,” কিকিরা ফিসফিস করে বললেন, “সাধনদা যদি বেঁচে থাকে–ওই মেয়েটিও বেঁচে থাকবে । ও হল সাধনদার ভাইঝি। ইন্দু। ছেলেবেলায় মা বাপ হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েছিল ও সাধনদা ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন অনাথ মেয়েকে মানুষ করবেন বলে। কিন্তু ও ভুজঙ্গর চোখে পড়ল । ভুজঙ্গ ওকে হাতে পেয়ে নিজের আত্মা নামানোর কাজে লাগাচ্ছিল।“

তারাপদ বুঝতে পারছিল, মেয়েটি আজ তাকে বাঁচিয়েছে। মেয়েটি তার নকল পায়ের পাতা খোয়া যাবার কথা ভুজঙ্গকে বলে দিতে পারত। বলেনি। বলেনি, কারণ মেয়েটি সাধুমামার কাছে সব শুনেছে।

তারাপদ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেঁপে উঠল। কেমন শব্দ করল, বিড়বিড় করে কিছু বলল।

চন্দন বলল, “কী হল তোর?” তারাপদ বলল, “মাঝে মাঝেই সেই মড়ার মাথা-খুলিটা আমার চোখে ভেসে উঠছে। হরি। এখনো বমি আসছে।”

কিকিরা বললেন, “আপনার–তোমার নার্ভ বড় দুর্বল তারাপদ। তুমি কখনো ম্যাজিকে মেয়েদের পেট কাটা, স্টেজের ওপর কংকাল নেচে বেড়ানো দেখোনি? আশ্চর্য! আমি তো তোমায় বললাম, ওটা কিছু নয়। প্রথম দিন যেভাবে তোমরা রঙিন বল নাচতে দেখেছিলে, এটাও সেইভাবে নাচানো হয়েছে। সবই চালাকি। ওই খেলাটা হবার সময় মাথার ওপরে যে বাতিটা জ্বলে ওঠে–সেটা ব্ল্যাক ল্যাম্প। আর যে বস্তুটা নাচে তার গায়ে লাগানো থাকে লুমিনাস পেন্ট। পাশের ঘর থেকে কেউ একজন ওটা নাচায়। কেমন করে নাচায় তাও বলছি। তোমরা ভাল করে কিছু লক্ষ করোনি। করার মনও তোমাদের ছিল না। ওই ঘরের মাথায় কালো রঙ করা লম্বা তার ঝোলানো আছে। এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত। সেই তারের সঙ্গে আবার কালো রঙ করা অন্য তারে রঙিন বলই বলো আর মাথার খুলিই বলো ঝোলানো আছে। পুলি জানো? কিংবা গোল গোল চাকা! চাকার গায়ে তার জড়িয়ে এই খেলা দেখানো হয়। একটা স্ট্রেট লাইনে একদিক থেকে অন্যদিকে টেনে নেওয়া কিংবা ঢিলে করা কিছুই নয়। ঢিলে করলে ঝুলবে, টানলে উঠবে। নাথিং বাট পুলি সিস্টেম। পুতুল নাচের মতন ব্যাপার, তবে পুলিটাই হচ্ছে এখানে আসল। আর ওই ব্ল্যাক ল্যাম্প। দুটো পুলি দিয়ে এ কাজ করতে হয়। পাশের ঘরে বসে ভুজঙ্গর কোনো চেলা এই ভূতের নাচ দেখায়।”

তারাপদ অত বুঝল না। তবে বুঝতে পারল, ঘণ্টা বাজানোর মতন এও একটা ধাপ্পা, ধোঁকা ।

চন্দন দেশলাই জ্বেলে ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে দু মিনিট। ঘড়িটা দেখাল কিকিরাকে ।

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “ডায়নামো দশটার পর বন্ধ হয়ে গেছে। আর চলবে না?”

“না”, চন্দন বলল, “সে ব্যবস্থা আমি করেছি। খারাপ হয়ে গেছে।”

“বেশ। তা হলে তারাপদ থাকবে আস্তাবলে, গাড়িতে ঘোড়া জোতা থাকবে। রামবিলাস থাকবে। সাধনদা, ইন্দু, আর তারাপদ গাড়ি করে পালাবে।” বলতে বলতে কিকিরা তাঁর লুকোনো ছোট টর্চটা বার করে নিয়ে জ্বালালেন একবার । নিবিয়ে দিলেন আবার।

“ফটক?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“খোলা আছে,” কিকিরা মুচকি হাসলেন। “এই বাড়িতে যারা থাকে তারা সকলেই ভুজঙ্গ নয়। দায়ে পড়ে থাকে। ভয়ে। দু-চারজন ভাল লোকও আছে যারা এই পাপের রাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তারাপদ সাধনদার মতনই তারা একদিন এসে পড়েছিল, হয় কিছু পাবার আশায়, না হয় পেটের দায়ে। তারপর আর ফিরে যেতে পারেনি। মৃত্যু ছাড়া তাদের মুক্তি ছিল না। ওরাই আজ আমাদের সহায় সম্বল বন্ধু। নয়ত আমি কেমন করে এখানে এলাম বলো?”

তারাপদ কিছু বলল না। কিকিরা বিচিত্র মানুষ। এই লোকটির আসল পরিচয় আজও জানা গেল না।

বারোটা বাজতেই চন্দন উঠে দাঁড়াল।

কিকিরাও ধীরে-সুস্থে উঠলেন। টর্চ জ্বালালেন। বললেন, “আমার পকেটে দু বোতল পেট্রল আছে। ভুজঙ্গ শয়তানের আত্মার ঘর তাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।…তুমি একটা কিছু নাও চন্দন। কিছু নেই?”

চন্দন পকেট থেকে পাতলা সরু ছুরিটা বার করল। বলল, “আপনি চলুন।”

তিনজনেই দাঁড়াল। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

তারাপদ চন্দনকে বলল, “তোরা আগুন লাগিয়েই পালিয়ে আসবি। আমরা বাইরে থাকব।”

কিকিরা বললেন, “ভয় পেয়ো না, আমরা আসব। তোমরা সাবধানে থেকো।”

.

ফটকের বাইরে সামান্য তফাত থেকে তারাপদ দেখল, ভুজঙ্গভূষণের দোতলায় আগুন জ্বলে উঠেছে। শীতের বাতাসে দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে আগুনটা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। দমকা হাওয়ায় আগুনের শিখা যেন ঝাঁপটা মারছে, আকাশের দিকে লকলক করে উঠে যাচ্ছে, তারপর ধোঁয়া হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকের জমাট অন্ধকার আলো হয়ে উঠল। ভীত, ত্রস্ত মানুষের কলরব। ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের বাড়ির চারদিক।

তারাপদ হঠাৎ কেমন আনন্দ অনুভব করল। প্রতিহিংসার আনন্দ। একজন শয়তানের সর্বনাশ হবার আনন্দ। তারপরই সে ব্যাকুল হয়ে উঠল । চন্দনের জন্যে, কিকিরার জন্যে। ওরা কোথায়?

একটু পরেই চন্দনকে দেখতে পেল। বাগান দিয়ে প্রাণপণে ছুটে আসছে।

কিকিরা! কিকিরা কোথায়?

চন্দন ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যাবার পর তারাপদ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। পরনে লাল গেরুয়ার বস্ত্র, গায়ে চাদর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে ব্যান্ডেজ এক উন্মাদ ছুটে আসছে। হাতে তার খঙ্গ। চোখে বুঝি দেখতে পাচ্ছে না। তবু ছুটে আসছে । গায়ের চাদরে আগুন জ্বলছে। চাদরটা ফেলে দিল ও নগ্ন গা।

তারাপদ চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “চাঁদু–চাঁদু–চাঁদু, আমরা এখানে।”

চন্দন মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। দেখল। তারপর ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে পড়ল।

চন্দন হাঁপাচ্ছিল।

“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

চন্দন আগুনের দিকে তাকাল। সমস্ত বাড়িতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কী ভীষণ কোলাহল হচ্ছে ওদিকে।

“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ আবার বলল।

“আমরা একসঙ্গে ঘরে আগুন দিই। তারপর আর তাঁকে দেখিনি। কোথায় যে ছুটে চলে গেলেন!”

তারাপদ বিহ্বল হয়ে পড়ল। এখন কী করা যাবে? সেই উন্মাদ ততক্ষণে ফটকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের খড়গ উঁচু হয়ে আছে। আগুনের আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। চারিদিকে পাগলের মতন তাকাচ্ছে। ও যে ভুজঙ্গ বুঝতে কষ্ট হয় না। তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ আমাদের খুঁজছে। কী করব?”

কম্বল মুড়ি দিয়ে সাধুমামা ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন। তাঁর পাশে ইন্দু। কালো চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। সে থরথর করে কাঁপছিল।

সাধুমামা বললেন, “গাড়িটাকে আরও একটু আড়ালে নিয়ে যেতে বলি।”

গাড়ির কোচোয়ানকে সাধুমামা কী যেন বললেন। কোচোয়ান হাতের লাগাম টেনে ঘোড়ার গাড়িটাকে আরও আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গেল।

ভুজঙ্গর লোকেরা দু একজন প্রাণ বাঁচাতে বাগানে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কিকিরা কোথায়?

সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্ত যেন কত দীর্ঘ! তারাপদ অস্থির হয়ে পড়ছিল, চন্দন বুঝতে পারছিল না তার কী করার আছে।

তারাপদ ব্যাকুল হয়ে বলল, “সাধুমামা, আমরা কী করব?” সাধুমামা বললেন, “ভুজঙ্গর বাড়িতে বন্দুক আছে। মৃত্যুঞ্জয় বন্দুক চালাতে পারে। সেও যদি এসে পড়ে আমরা বিপদে পড়ব।”

“কিন্তু কিকিরা?”

সাধুমামাও কিছু বলতে পারলেন না।

ভুজঙ্গ যেন কিছু অনুমান করে আরও কয়েক পা এগিয়ে এলেন। হঠাৎ চন্দন বলল, “কিকিরা!”

কিকিরাকে বাগানের কাছে দেখা গেল। প্রাণপণে ছুটে আসার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বাগানের লোকগুলো চিৎকার করে উঠল। কিকিরার ওভারকোটটা গায়ে নেই। হাতে। আগুন জ্বলছে কোটটায় দাউ দাউ করে। কিকিরা সেই কোটটাকেই আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লাঠি ঘোরানোর মতন চারপাশে ঘোরাচ্ছেন ।

ভুজঙ্গ কিন্তু দেখতে পেয়ে গিয়েছেন কিকিরাকে। ছুটে গেলেন । মাথার ওপর খাঁড়া তুলে।

তারাপদ ভয়ে চোখ বুজে ফেলল । চন্দন কেমন আর্তনাদ করে উঠল।

আবার যখন চোখ খুলল তারাপদ, দেখল, ভুজঙ্গর খাঁড়া কিকিরার মাথার ওপর। কিকিরা কোটটা ঘোরাচ্ছেন। আগুনের হলকায় খাঁড়া ঝকঝক করে উঠল। ভুজঙ্গর খাঁড়া পড়ল। কিকিরার মাথাতেই পড়ার কথা কিন্তু কেমন করে যেন সরে গেলেন কিকিরা, খাঁড়ার কোপ থেকে নিজেকে বাঁচালেন। ভুজঙ্গ ক্ষিপ্ত হয়ে আবার কিকিরার শরীর লক্ষ করে খাঁড়া তুললেন। তারাপদ বুঝতে পারছিল, কিকিরার হাত দুর্বল। এতক্ষণ তিনি নিজেকে ভাগ্যের জোরে, সামলেছেন–আর পারবেন না। চোখের সামনে মানুষটা মরবে।

পারলেন না কিকিরা, জ্বলন্ত কোটটা খাঁড়ায় জড়িয়ে গেল। ভুজঙ্গ প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন কোটটা ফেলে দেবার । কিকিরাও সেই ফাঁকে ছুটতে শুরু করেছেন।

কোচোয়ান রামবিলাস বলল, “সামালকে বসুন বাবুরা। জান বাঁচান।” বলতে বলতে রামবিলাস তার ঘোড়াকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিল ফটকের দিকে। তারপর চাবুক কষাল।

আচমকা চাবুক খেয়ে ঘোড়া লাফ মেরে উঠল। তারপরই সামনের দিকে ছুটল।

কিকিরার কোটের আগুন ভুজঙ্গর কাপড়ে লেগে গিয়েছিল। তিনি এই অবস্থাতেই ছুটে আসছিলেন, হাতের খাঁড়া থেকে কোটটা মাটিতে পড়ে গেছে।

রামবিলাস কোনো দিকে তাকাল না, সোজা ভুজঙ্গর দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

তারাপদ পলকের জন্যে দেখল ভুজঙ্গ খাঁড়া তুললেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তাঁর সামনে লাফ মেরে, ভুজঙ্গকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ফটক পর্যন্ত ছুটে গেল ।

রামবিলাস ফটকের কাছ থেকে আবার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। ফেরার সময় দেখল ভুজঙ্গ মাটিতে পড়ে আছেন। উপুড় হয়ে। তার খাঁড়া একদিকে, তিনি অন্যদিকে। কাপড়ে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।

কিকিরাকে গাড়িতে তুলে নিল রামবিলাস।

তারাপদ বলল, “আপনি এত দেরি করলেন কেন?”

কিকিরার কথা বলার শক্তি ছিল না। হাঁপাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজছিলাম। ভুজঙ্গর ঘরে সিন্দুক খুলে সে পাগলের মত টাকা-পয়সা সোনাদানা হাতড়াচ্ছিল। তাকে ঘরের মধ্যেই বন্ধ করে রেখে এলাম। জানলা দিয়ে লাফানো ছাড়া তার আর উপায় নেই।”

ভুজঙ্গর বাড়ি ছেড়ে গাড়িটা অনেক দূর চলে এল। এখনো দূরে তাকালে আকাশের একটা দিক লাল দেখায়। অথচ আশপাশে মাঠ আর ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। শীতের বাতাস বইছে শনশন করে, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ আর খুরের আওয়াজ উঠছে খটখট।

সাধুমামা বসে থাকতে থাকতে কেঁদে উঠলেন।

কিকিরা প্রথমে কিছু বললেন না, পরে বললেন, “সাধনদা, তুমি কাঁদছ কেন? আজ এতকাল পরে তোমার মুক্তি হল।”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সাধুমামা কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল। তারাপদর বাবাকে আমিই এনেছিলাম।”

কিকিরা বললেন, “তারাপদকেও তুমি এনেছ। ভুজঙ্গকে শেষ করবে বলে তুমি ধীরে ধীরে ধৈর্য কতকাল ধরে জাল ছড়িয়েছে সাধনদা। সেই জালে একে একে সবাই জড়িয়ে পড়েছে।”

সাধুমামা কাঁদতে কাঁদতে বললেন “না না, আমার কিসের সাধ্য। তুমিই তো করলে সব। তোমার ও কত ক্ষতি করেছিল আমি জানি।”

চন্দন জিজ্ঞেস করল, “কিকিরাবাবু, আপনি কে? আপনার সত্যিকারের পরিচয়টা জানতে পারি?”

কিকিরা তাঁর আগুনে ঝলসানো হাত সামলাচ্ছিলেন মনের জোরে। যন্ত্রণার শব্দও করছিলেন মাঝে মাঝে। বললেন, “আমি সাধনদার বন্ধু। কিঙ্করও বলতে পার । সাধনদা আমায় কলকাতায় খবর দিয়েছিল তোমরা শংকরপুরে আসছ।” বলে একটু থেমে কিকিরা আবার বললেন, “সলিসিটার মৃণাল দত্তর বাড়িতে যে বুড়ো মতন লোকটিকে তোমরা দেখেছ, সে আমাদের লোক। আমরা তাকে মধুপুর থেকেই সলিসিটার দত্তর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কাজে লাগাব বলে।”

তারাপদ চুপ করে ছিল। খানিক পরে বলল, “আপনি সত্যি সত্যি কে–আমরা জানি না। কিন্তু আপনার দয়াতেই আমরা বাঁচলাম।”

কিকিরা বললেন, “অতশত জানি না বাবা, তবে এটুকু জানি–তুমি যদি একবার ভুজঙ্গর ফাঁদে পা দিতে তুমিও ভুজঙ্গ হয়ে যেতে। পাপের পথ, লোভের পথ–মানুষ যদি একবার ধরে, সে আর সহজে ছেড়ে আসতে পারে না। দেড় দু লক্ষ টাকার সম্পত্তির লোভ থেকে তুমি বেঁচেছ।”

তারাপদ মনে মনে বলল, “হ্যাঁ, সে বেঁচেছে।” বেঁচে গিয়েছে।

Leave a Reply to SRIKANTA PAL Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *