১৪. ওগো, তোমরা কে কে চা খাবে…

ওগো, তোমরা কে কে চা খাবে…

আমি তখন সঞ্জয়কে বললাম, গলাটা কেটে দে। কট্‌ট্ররর।

ঘরে একটা টেপ চলছিল ফুল ভলুমে। আমাকে দেখেই সত্যবান রেকর্ডারটা বন্ধ করলেন।

চিনতে পারছেন!

কৌশিক, তুই?

যা অবিশ্বাস্য, তার মুখোমুখি হতে হলে, আমার প্রবণতা হল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেনে নেওয়া। কিন্তু এজন্যে আমাকে যে কী দাম দিতে হয়, সে শুধু আমি জানি আর জানে আমার ক্রীতদাস স্নায়ুমণ্ডল, যারা অ্যাজবেস্টস দিয়ে তৈরি। আগুন যাদের পোড়াতে পারে না।

হাতে-হাতকড়া, কৌশিককে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে দীপ্তির কাটা গলা দেখেও যা হয়নি এই প্রথম তারা শরীর ছেড়ে পালাতে থাকে। আমার হুকুম তারা আর শোনে না। ভাঙতে ভাঙতে আমি একটি স্কুপে পরিণত হচ্ছি, আমি দেখি। প্রশ্নটা আমি করতে চেয়েছিলাম ডান হাতের তর্জনী তুলে। দেখলাম, সেটুকু ক্ষমতাও অন্তর্হিত হয়েছে। কোনও মতে চেয়ার ধরে তবু, আমি দাঁড়িয়ে।

আ-হ্যাঁ। কৌশিক।সত্যবান বললেন, চেনেন তো আপনি। পাড়ার ছেলে! প্রসেনজিৎ আর রাকেশ ভিকটিমকে ধরে রাখে। বুকের ওপর বসে কৌশিক মুখে টেবিল ক্লথ খুঁজে দেয়। তারপর সঞ্জয় গলা কাটে। যেন বাহাদুর ছেলে, কৌশিকের পিঠে হাত রাখলেন সত্যবান, মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে দ্য চ্যাপ হ্যাজ কাম আউট উইথ দা এনটায়ার স্টোরি। উইথ এভূরি বিট অফ ডিটেলস্। কোনও বেগ দেয়নি। একটুও টর্চার করতে হয়নি। গলাটা কাটলি কেন রে কৌশিক? সত্যবান স্নেহ ভরে জানতে চাইলেন, তার আগেই তো মরে গিয়েছিল।

কৌশিক কিছু বলল না।

ওরা ভেবেছিল, হয়ত পুরোটা মরেনি। সত্যবান আমাকে জানালেন, আগে খুন করেনি তো। আগে দ্যাখেনি। তাই, টু বি সিওর, কৌশিক সঞ্জয়কে গলাটা কেটে দিতে বলে। ওই আপনার কেনা ছুরিটা দিয়েই। খোলে কাঠি নেই দেখে বাক্সটা টুক করে লিটার ক্যানে ফেলে দিয়ে সত্যবান হেঁকে বললেন, দারওয়াজা, এক ম্যাচিস ল্যাও! গলা নামিয়ে, ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে ছিল।

কৌশিকের পরনে জিন্স। গায়ে ব্যাগি জামা। চুলে ক্রু ছাঁট। সানগ্লাস টেবিলের ওপর পড়ে আছে। পাপপূণ্যের বাইরে কী শুদ্ধ, শান্ত, শূন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে এই মুক্ত বন্দী!

তুই কাকিমাকে খুন করলি কেন রে কৌশিক, দীপ্তির মৃতদেহ দেখেও যা হয়নি, কৌশিককে দু-চোখ ভরে দেখতে দেখতে আমার তাই হল। চোখ জলে ভরে এল। টপ করে একফোটা, আমার হাতের ওপর পড়ল যেন আকাশ থেকে, কেন রে।

সে জবাব দিল না।

ওই যে আপনার মেয়ে চৈতি। তার কাছেই কৌশিক প্রথম শোনে আপনারা কেদার বদ্রী যাচ্ছেন। চৈতি ওদের ভ্রমণ সাথী বইটাও পড়তে দেয়। তাতেই হেমকুণ্ড আর ব্রহ্মকমলের কথা ছিল। কৌশিক বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে। যে, ওরা যাবে। ব্রহ্মকমল আনবে। উইদাউট রিজার্ভেশন ওরা ফার্স্ট ক্লাসে উঠে পড়ে। ওদের সঙ্গে ছিল, আমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে, এক লক্ষ টাকা। আপনার বুক র‍্যাকের পিছন থেকে ওরা হঠাৎই টাকাটা পেয়ে যায়। দা গ্রিনিং গোরিলা বইটা দেখতে গিয়ে রাকেশই প্যাকেটটা দ্যাখে। আলমারি টালমারি খুলতেই হয়নি। তবে ওরা হাজার দশের বেশি নেয়নি।

এই যে ব্ৰহ্মকমল, প্রথম ড্রয়ার খুলে উঁটিসুদ্ধ একটা প্রকাণ্ড পদ্মকুঁড়ি বের করলেন সত্যবান, ড্রয়ারে আপহোলস্টারের মধ্যে রিভলভার, বললেন, পাঁচ-ছদিন পরেও দেখুন কত ফ্রেশ রয়েছে। অ্যান অলমোস্টএক্সটিঙুট স্পিসিজ অ্যামংস্টদা ইন্ডিয়ান ফ্লোরা। টাটকা অবস্থায় একটা লাল আভা বেরোয় এর গা থেকে। যদিও দেখুন, কোনও গন্ধ নেই। বলে উনি নিজে এঁকে দেখলেন।

বরফের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে কৌশিক এটা নিজে তুলে এনেছে।

 

আমি চুপ করে আছি দেখে সত্যবান বলে চললেন, এরা সবাই সাউথ স্টার আর বীরেন্দ্রপুরের ছেলে। শুধু রাকেশ কনভেন্ট স্কুলের। স্কুল ফাইনালে প্রত্যেকে হাই ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেছিল। কৌশিক তো লেটারই পেয়েছিল চিারটে। আপনার মেয়ের বন্ধু। জানেন নিশ্চয়ই।

ম্যাচেস এসে গেছে। হুস-হুস করে বার তিনেক ধোঁয়া ছেড়ে সত্যবান বললেন, আপনি এর বাবাকেও চেনেন। কী নাম তোমার বাবার, কৌশিক।

কৌশিক উত্তর দিল না।

আর একবার বলবে না? ঠিক আছে। ঠিক আছে। এর বাবার নাম বন্ধুবিহারী মুখার্জি। আলিপুর বয়েজ-এর হেড মাস্টার। খবর দেওয়া হয়েছে।এসে পড়বেন। নাচিয়ে সত্যবান জানালেন, বাকি তিনটে লকআপে। এক-এক করে ডাকছি আর কী। সোমবার কোর্টে প্রোডিউস করব।

 

আমার সঙ্গে সুদীর্ঘ বারো দিনের সেমিনারে সত্যবান মণ্ডলের একদিনের বিষয় ছিল খুন। উনি সেদিন বলেছিলেন—

পৃথিবীর যে-কোনও খুনকে আমি জীবনবিরোধী বলে মনে করি। টু মার্ডার ইজ ইনহিউম্যান। অ্যান্ড স্টুপিড।

অথচ দেখুন, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে কোথাও না কোথাও একটা করে খুন হয়ে যাচ্ছে। এটা পরিসংখ্যান। বছরে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ৬০০। কেন এত খুন! কারণ একটাই। আমি চুরি করব না, আমি বলাৎকার করব না, এগুলো বলা যায়। কিন্তু আমি পাগল হব না, আমি খুন করব না–এগুলো বলা যায় না। এ দুটো ব্যাপারে মানুষ বড় অসহায়, জানেন।

পৃথিবীর শতকরা ৯৮টা খুন হয় চূড়ান্ত উত্তেজনার মাথায়। যে কোনও আমি বাবা-ওসবে নেই মানুষই তো ওগুলো করে ফেলে? পাগল হয় সুস্থ মানুষেই, তাই নয় কি? ছেড়ে দিলে এরা কেউ আর-একবার খুন করবে না।

এগুলোকে আধুনিক অপরাধ-বিজ্ঞানে বলা হয় নিরপরাধীর অপরাধ।৩৪ উপধারা-সহ পঠিতব্য ৩০২ ধারায় এদের যারা ফঁসি দেয় সেই সব বেতনভূক বিচারককে আমি ফাঁসুড়ে ছাড়া কিছু মনে করি না। ইন্ডিয়ান পিনাল কোর্টের বকলস বাঁধা পুলিসের কুকুর-মরালিটিকে আমি ঘৃণা করি।

তাহলে তো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, জুলিয়স সিজর—এরা সবাই খুনি।বা, রাসকলনিকভ! তাই নয় কি?

সেদিন মাত্র একবার ওঁকে বাধা দিয়ে আমি বাকিটু পার্সেন্টের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম।

হ্যাঁ। শূ-শূ করে সিগারেটে টান মেরে সত্যবান বলেছিলেন, বাস্তবের সেই টু পার্সেন্ট খুনি–যারা প্রিমেডিটেটেড মার্ডার করে। যেখানে মোটিভ থাকে। যেমন, খোকা গুন্ডা। তার প্রেমিকা রামবাগানের মলিনা ভালবাসত তার তবলচি রোগা, তিংখাডু পাগলাকে। থোকা পাগলাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেল। বলল, পাগলা, যা স্নান করে আয়। শীতকাল। তখন শেষ রাত। পাগলা জানতে চাইল, দাদা, তুমি কি আমাকে সত্যিই খুন করবে? খোকা বলল, পাগলা, যা, স্নান করে আয়।

ইউরোপের মর্ডান ক্লাসিকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। জ্যাক দ্য রিপার, মনস্টার অফ ডুসেলডর্ফ, পিটার কার্টেন ব্লু বিয়ার্ড ল্যানডু পৃথিবীর সবচেয়ে অমানুষিক মার্ডার যেগুলো—এদেরও তো মানুষ হিসেবে একটা সহানুভূতি প্রাপ্য ছিল। যে, খুন না করে এরা পারেনি। পাগল না হয়ে পারেনি। পাগলের যদি বেঁচে থাকার অধিকার থাকে, খুনির থাকবে না কেন? আমার প্রতি চূড়ান্ত অবিচার করলে, হে ঈশ্বর, এই ধারণায় বিশ্বাস রেখেই কি এরা প্রত্যেকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়নি? এরা কি অভিসম্পাত দিয়ে যায়নি খুনিদের খুনি প্রতিটি বিচারপতিকে। বিশ্বাসঘাতক ঈশ্বরকে!

কিন্তু আমার ভাবনা এদের নিয়েও নয়। আমি ভাবি তাদের কথা, যারা এই টু পার্সেন্টের মধ্যেও আসে না। সত্যবান পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, আমি ভাবি, মারসোর মতো খুনিকে নিয়ে। আপনি তো আউটসাইডার পড়েছে, আমাকে বলেছিলেন? আচ্ছা বলুন তো, মারসো কেন খুন করল। কী অপরাধ ছিল আরব ছেলে দুটোর। সে তো তাদের চিনতই না। ডস্টয়েভস্কির খুনিদের তবু একটা সাফারিং ছিল। মারসোর তাও নেই। এর প্রেম নেই, দুঃখ নেই, জিজ্ঞাসা নেই—জিঘাংসা তো ছিলইনা। প্রতীতি নেই, কাজেই ভাল-মন্দ নেই। হৃদয়ের ঝড় আর বাইরের ঝড় মিলেমিশে তার মধ্যে কবেই একাকার হয়ে গিয়েছে। এই যদি তার অবস্থা হয়, তাহলে এখান থেকে তো এভরিথিং ইজ পারমিটেড। তাই নয় কি? কেননা, জীবনই তাকে জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। আর, এজন্য সে দায়ী নয়! আরব ছেলে দুটোকে খুন করে, সে তো তার জীবনের ভেতরে থাকার সার্বভৌম অধিকারকেই প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছে তাই না বাবু? একে শাস্তি দেবে কোন আহাম্মক।

আমাদের একজন বিদ্বান সেক্রেটারি, আই এ এস পার্থসারথি চৌধুরি, বোধহয় ঠাট্টা করেই আমাকে বলেছিলেন, মারসো ওয়াজ সিম্পলি স্ট্রাক বাই দা ডেজার্ট সান। বোধহয় আমারই বোঝার ভুল। তার পার্সোনাল লাইব্রেরির ১৫০০০বই-এর মধ্যে বসে আমি তাকে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, না, সার। রাসকোলনিকভ খুন করেছিল অন্ধকার ঘরে। সূর্য ছিল না।

 

কৌশিক তুই আমাকে বললি না কেন রে! আমি তোকে নিয়ে যেতাম।

কৌশিকের মুখময় একটা হাসির আভা জেগে উঠে কোথাও মিলিয়ে গেল, আমি দেখতে পেলাম। যদিও জন্মমুহূর্তেই তার মৃত্যু।

সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

আচ্ছা, একে এবার ছেড়ে দিই? সত্যবান অনুমতি চাইলেন। হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন ধুতি-শার্ট পরা দুজন পালোয়ানকে। নিয়ে যাও।

গম্ভীর ইরেক্ট ভঙ্গিতে কৌশিক উঠে দাঁড়াল। একবার স্ট্রেচ করে নিল শরীরটা। তারপর ওদের সঙ্গে মার্চ করে কিছুটা গেল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে, হাতলে দুই থাবায় ভর রেখে, সত্যবান চেয়ার থেকে ঊধ্বাঙ্গ কিছুটা তুলে, স্থির।

চশমাটা। কৌশিক বলল।

ভঙ্গিটা দেখুন।ওর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে সত্যবান বললেন, যেন কোনও অন্যায়ই করেনি। চারটে ছেলে। অ্যাটিচিউড কিন্তু একটা। যে, উই হ্যাভ মেড ইট। আমরা পারি। এবং পেরেছি। আমরা ব্ৰহ্মকমল এনেছি। কী আর বলব। মাথা নেড়ে কিছুটা হতাশভাবে, কিছু বা দুঃখিত, বললেন, সচ্ছল, শিক্ষিত পরিবারের কৃতী ছাত্র সব। খুন করলেও এরা ভাবে, তা ঠিক আর পাঁচটা খুনের মত নয়। কিছুটা রেসপেক্টেবল!

 

ওরা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুইং ডোরের দুলুনি থেমে আসে। টেবিলের ওপর আমার অশৃঙ্খলিত হাতদুটি রেখে, সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম–

দেখুন, সত্যবানবাবু–

বলুন।

দেখুন, মানে আমি … যাক গে, থাক।

না-না। বলুন না। একটা লিমকা খান। দারওয়াজা, এক লিমকা ল্যাও। নিন, বলুন–

দেখুন, সত্যবাবু। দীপ্তিকে তো আমিও খুন করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু পারেননি।

না। কেদারে হোক, বদ্রীতে হোক, এবার আমি দীপ্তিকে খুন করতাম।আমি ধীরে ধীরে বলি, দীপ্তি ফিরে আসত না।

 

ওগো তোমরা কে কে চা খাবে, উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…

 

হ্যাঁ। এটা, ইন বিটুয়িন লাইনস, আপনার ডায়েরিতে আমি লক্ষ্য করেছি। আইভি সোম আসার পর থেকেই কমবেশি এই লাইনে আপনি ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু, সত্যবান হাসতে লাগলেন, করেননি। বা, করতে পারেননি। বা, দেরি করে ফেলেছেন। তার আগেই যে করার, সে কাজ করে দিয়ে গেছে। প্রেমিক বলুন, বিশ্বাসঘাতক বলুন, খুনি বলুন–সকলকেই ইন লাইফ, ওয়ান হ্যাজ টু অ্যাক্ট। তাই না — বাবু?

বহুদিন আমি আইভিকে ফ্ল্যাটে এনেছি, যখন ওরা নেই। দীপ্তির নিজের হাতে পেতে যাওয়া বিছানা ইউজ করেছি।

আমি সব জানি। শি হ্যাজ কনফেসড এভরিথিং। টানা দশটি বছর ধরে আপনি মিস সোমের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চালিয়ে গেলেন, অথচ, স্ত্রী তা টেরও পেলেননা এত বিশ্বাস করতেন আপনাকে…

যে এটা পারে, এতটা ক্ললেস রাখতে পারে গোটা ব্যাপারটা–আই এগ্রি, হি ইজ আ পোটেনশিয়াল মার্ডারার। হি ইজ ওয়ান, ইনডিড। হি কুড হ্যাভ, অলমোস্ট সার্টেনলি, মেড আ ক্ললেস পারফেক্ট মার্ডার।

তাহলে আমাদের লাইন অফ ডিফারেন্সটা কোথায়? প্রায় তো নেই-ই। আমি কেন শাস্তি পাব না?

নেই মানে? সত্যবান হাসতে হাসতে বললেন, হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স। বললাম তো। আপনি ভেবেছিলেন, কিন্তু, করেননি। বা, পারেননি। আরে মশায়, আপনার মতো লোকরা, আগেই তো বলেছি আপনাকে, শুধু ভাবে। শুধু ভেবে যায়। কিছু করে না। ইউ পিপল সিম্পলি রিড নিউজপেপার্স অ্যান্ড ফরনিকেট। অ্যান্ড টক। অ্যান্ড দ্যাট ইজ অ্যাবাউট অল। আপনারা কিছু করেন না। …অথচ, এদের দেখুন। এরা খুন করল। বসে বসে এক প্যাকেট ফান মাঞ্চ খেল। চতুর্দিকে ক্লু ছড়াতে ছড়াতে এরা কেদার আর বদ্রীনাথের দিকে গেল। হেমকুণ্ডসাহেব থেকে ব্রহ্মকমল আনল। এটাও তো একটা আদর্শ হতে পারে, দিগন্ত পেরিয়ে একটু বেশি দূরে যাওয়ার এই ইচ্ছা। অন্তত, এখনও যাদের গোঁফ ওঠেনি ভাল করে, সেই কিশোরদের কাছে? একটা স্বপ্ন হতে পারে। একটা মূল্যবোধ হতে পারে। আর আদর্শ যোগ হলেই তো সে শহিদ, তাই না –- বাবু?

এদের কীরকম শাস্তি হবে? বেনাবনে মুক্ত ছড়াবার হতাশা ফুটে উঠল সত্যবানের মুখে। সাত কাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা? বিরক্তমুখে বললেন, ওরা জুভেনাইল কোর্টে প্রোডিউসড হবে। এই তিন, চার কি পাঁচ বছর করে, আর কত। গলা কেটেছেসঞ্জয়। কিন্তু কৌশিকের হাতে সাফোকেশানে মিসেস বসুরায়ের আগেই মৃত্যু হয়। ওর একটু বেশি হতে পারে। মেরে কেটে ছয় ম্যাক্সিমাম? কারেকশান হোমে খুব একটা খারাপ থাকবে না।

কারেকশান হোম! মাত্র ছবছর!আমি আর্তনাদ করে উঠি, কী বলছেন আপনি? এদের ফাঁসি হবে না?

অপ্রত্যাশিত। তবু অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। অন্তত আমার কাছে। ওঁর গল-অস্থির ওঠা-নামা দেখতে দেখতে এর আগে আমি তিনবার চেষ্টা করেছি। পারিনি।

হঠাৎ, সত্যবানের টেবিলের ওপর আমি জ্বলন্ত চিতার লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ি। খোলা ড্রয়ারে ব্ৰহ্মকমলের পাশে রাখা রিভলভারটা তুলে নিতে চেষ্টা করি।

বজ্রমুঠিতে আমার হাত চেপে ধরে আছেন সত্যবান। আমি হাত খুলে নেবার চেষ্টা ছাড়ি না। ক্রমে বুঝতে পারি, আমার সর্বশক্তির চেয়ে উনি কিছু বেশি শক্তিমান। তাছাড়া, ধুতি শার্ট পরা অনেকগুলো লোক আমাদের ঘিরে ধরেছে।

সত্যবান হাত ছেড়ে দেবার পরেও আমি চিৎকার করতে থাকি, ছেড়ে দিন। আমাকে ছেড়ে দিন। দীপ্তির মতো ইনোসেন্টকে যারা খুন করল, যারা এ-ভাবে সর্বনাশ করল আমার, চৈতি মাতৃহারা হল, তাদের কারও ফাঁসি হবে না? মাত্র ছবছর? ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমি টেবিলে মাথা ঠুকতে থাকি, গেট মি দ্য রিভলভার, প্লিজ। প্লিজ, ডু মি দিস ওয়ান অ্যাক্ট অফ ফেবার। আই শ্যাল শ্যুট দেম। শ্যুট ইচ ওয়ান অফ দেম। শ্যুট ওয়ান বাই ওয়ান।

 

টেবিলে মুণ্ডু রেখে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম আমি জানি না। খেয়াল হল তখন, যখন পিঠে হাত রেখে নৃপেন আমাকে বলছে, যে গেছে, তাকে যেতে দাও -–। যারা আছে তারা থাকুক।

. অনেকক্ষণ পরে আমি আবার বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম। সেই ৯০ কিলোমিটার বেগে সাইক্লোন, আমার অজান্তে, কলকাতার ওপর দিয়ে কখন বহে গেছে। এখন হাওয়া নেই। এখন শুধু অনর্গল বৃষ্টি। আকাশের স্টপকল খুলে গেছে।

***

 

———–

উল্লেখ থাকে যে এই রচনায় অধ্যায়ক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, আলোক সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত ও শেষ অধ্যায়ে শঙ্খ ঘোষের কাব্যপঙক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

উপন্যাস মানেই যা কল্পনাপ্রসূত। তবু যদি কোনও পাঠক এই কাহিনী ও/বা এর কোনও চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান, তা হবে, তার নিজস্ব বিনির্মাণ। কৃতিত্বও একান্তভাবে তারই। –লেখক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *