০৫. আসামি হাজির

আসামি হাজির

দীপ্তি আমাকে বলেছিল, কোনও ট্রাভেল এজেন্ট ঠিক করতে।

আমাদের অফিসে একটা হিমালয় লবি আছে। নেতা অ্যাকাউন্টসের দ্বিজেনবাবু। ছোটখাট গাঁট্টাগোট্টা টাইপের দ্বিজেনবাবুকে, সবাই বলে, অনেকটা নাকি যতীন চক্রবর্তীর মতো দেখতে। সামান্য বাকিটুকুকে সম্পূর্ণতা দিতে উনি হাফ-পাঞ্জাবি পরলে পারতেন, পকেটে মোটা কলম কি মুখে লম্বা চুরোট রাখা যেত–আর-এস-পি করলে তো কথাই ছিল না। তা না, উনি ভালবাসলেন হিমালয়কে।

দ্বিজেনবাবু শুনেটুনে বললেন, হ্যাঁ, চলে যান। কে কে যাচ্ছেন?

উইথ ফ্যামিলি।

ক জন?

স্ত্রী, মেয়ে–আর আমি।

একটা নোট শেষ করে নিচে সাবমিটেড লিখে তার ওপর মিয়ার ইনিসিয়ালের বদলে জবরদস্ত ডি কে মুখার্জি পুরোটা দস্তখৎ করে, জের মাথার ফুটকির বদলে এক আউট সাইজ শূন্য বসিয়ে, স্বাক্ষরের নিচে একটা আনুভূমিক ইংরেজি এস টানলেন দ্বিজেনবাবু। তারপর মুখ তুলে কালো লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা খুলে রাখলেন টেবিলে।

তারপর, দীপ্তির স্টাইলে, যেন যাওয়া হয়েই গেছে এমনভাবে বললেন, তা চলে যান।

না, মানে দেখুন, আমার স্ত্রী বলছিলেন, কোনও ট্রাভেল এজেন্ট-টেজেন্ট ঠিক করতে। যেমন ধরুন, পাল স্পেশাল।

এন্‌না-না-না-না। ছোট ছোট দুবাহু বাড়িয়ে ঘোর আপত্তি করলেন দ্বিজেনবাবু, নেভার। ট্রাভেল এজেন্সি তো ঘণ্টা নেড়ে আর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে বলে যাবে, কেদার দেখো। বদ্রী। দেখো। তারপর ঝপ করে দেবে ঢাকনাটা বন্ধ করে। প্রশস্ত টেবিলের ওপর দিয়ে মুণ্ডুটা যথাসাধ্য এগিয়ে এনে, গলা নামিয়ে, যেন গোপন খবর, দ্বিজেনবাবু বললেন, আপনার যদি বদ্রিবিশালে দুদিন বেশি থাকতে ইচ্ছে করে, আপনি থাকবেন না? যদি অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমে দশ মিনিট বসতে ইচ্ছে করে, রুদ্রপ্রয়াগে, ব্রিজের ঠিক নিচেই– আহা, সে কী দৃশ্য—আপনি কি বসবেন না? দেখবেন, সেদিনটা হয়ত রুদ্রপ্রয়াগেই থেকে গেলেন। সঙ্গমেই জগদম্বার মন্দির। পাহাড়ের মাথায় রুদ্রনাথ।এত বলে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন তিনি। ধ্যানস্থ ক মুহূর্ত!

কিরণদাকে তুমি দ্যাখোনি, না?হঠাৎ তুমি-তে নেমে পড়লেন দ্বিজেনবাবু, তোমাদের সেন্ট্রাল সেকশানেই তো ছিলেন। রুপোর গোল চশমা পরতেন–

কিরণদা…

ডায়েড নাইন্টিন সিক্সটি ফাইভ। টোয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স ব্যাক। দ্যাখোনি?

আমি তখনও জয়েন করিনি…

সিক্সটি টু থেকে হিমালয় যাচ্ছি। ছাব্বিশ বছর। প্রথমবার নিয়ে গিয়েছিলেন কিরণদা। পরপর তিন বছর উনি ছিলেন আমাদের লিডার। ওঁর একটা পা-ই ছিল না, জানো তো? প্রথম বছর রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে বসে রইলেন। পরের বছর থেকে তো ক্রাচ-বগলে আমাদের সঙ্গে কেদার-বদ্রী-মদমহেশ্বর-ত্রিউগিনন্দনকানন-তপোবন, যেবার যা, সব ঘুরেছেন। এমন। কত কিরণদাকে যেতে দেখবে কেদারের পথে। কত অন্ধ চলেছে, চক্ষুম্মানের হাত ধরে।… তখন যোশিমঠ থেকে হাঁটতে হত বদ্রী ওখান থেকে ৪০ কিলোমিটার বেশি তো কম। নয়। পৌঁছতেই তিন দিন লাগত। শুধু বদ্রীতে। রুদ্রপ্রয়াগে ফের নেমে এসে কেদার। কেদার যেতে চার দিন। এখন তো– দ্বিজেনবাবুর চশমার উঁটির জয়েন্টে স্কু খুলে গেছে। এতক্ষণ চেষ্টার পর একটা আলপিন ঢুকিয়ে সেটা নিজেই মেরামত করার তৃপ্তি ফুটে উঠল তাঁর মুখে, বদ্রী অব্দি সোওজা বাস যাচ্ছে। ওই কেদারেই যা গৌরীকুণ্ড থেকে পনেরো কিলোমিটার হাঁটা।ও কিসসুনা!বলতে বলতে হঠাৎ আমাদের কথা মনে পড়ল তার,বেশ তো, ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছেন। না হয়, কেদার এবার বাদ দিলেন।

দেখুন দ্বিজেনদা, আমি তাড়াতাড়ি বলি. সে হবার নয়। কেদারে ও যাবেই।

বেশ তো। উনি ডান্ডি করবেন একটা। চেয়ার-পাল্কির মতো। ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, এখন এই মে-জুনে ফুল সিজন। তা, যাতায়াত হাজারের মধ্যে ওঁর হয়ে যাবে। চার বেহারার কাঁধে চেপে দুলতে-দুলতে যাবার এক্সপিরিয়েন্সটাও আগে থেকেই হয়ে যাবে। হ্যা-হ্যাঁ।

পথে অসুখ-বিসুখ–অ্যাকোমডেশন–অ্যাটাচড বাথ ছাড়া ওর চলবে না বলেছে…

ধূর মশায়।তুমি থেকে রাগ করে ফের আপনিতে উঠে গেলেন দ্বিজেনবাবু, আপনারা কেদার যাবার লোক না যাচ্ছেন বাবার কাছে, চাইছেন অ্যাটাচড বাথ। সে তো তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। আপনি ট্রাভেল এজেন্টই দেখুন। আপনাদের পক্ষে সেটাই ভাল হবে।

তাড়া থেকে ও বাবা, এ আবার কখন এল বলে ক্র্যাশ প্রায়োরিটি ছাপ মারা একটা ফাইল টেনে নিলেন দ্বিজেনদা।

দ্বিজেনদার কাছে তাড়া খেয়ে বেজায় চটে গেলাম দীপ্তির ওপর। আজ বাড়ি ফিরে আচ্ছাসে ঝাড়তে হবে। মহাপ্রস্থানের পথে একি কুকুর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ নাকি যুধিষ্ঠির! অ্যাটাচড বাথ চাও তো সঙ্গে যেতে বাথরুমকে ডাক। হোয়ায় মি, অ্যাঁ, আমাকে কেন!

এখানে-ওখানে গিয়ে আমি টুকটাক কেদারবদ্রীর খবর জোগাড় করতে লাগলাম। যেখানেই যাই, বিশেষত কেদার প্রসঙ্গ একবার তুলি। কেদারই টাফ। গৌরীকুণ্ড ৬০০০ মিটার। কেদার সাড়ে ১১। গৌরী টু কেদার একটানা বিরতিহীন চড়াই। পথ ১৫ কিলোমিটার। সরু, ঘোড়ার গু আর শ্যাওলায় পিচ্ছিল পাকদণ্ডীর হাঁটা পথ। পথের পাশে ডানদিক জুড়ে পাতাল।

যদি ডান্ডি না পাওয়া যায় ভাল।দীপ্তি ঘোড়ায় মরে গেলেও চাপবেনা জানিয়েছে। তাহলে গৌরীকুণ্ড থেকে ফিরে আসবে। এক আমি যদি কান্ধা দিয়ে নিয়ে যাই, সেকথা স্বতন্ত্র।

বুলবুল! বুল ছাড়া কী, আমি যেদিন টেলিফোন ভবনে গেলাম, তরফদার তখন সহকর্মী কাঞ্জিলালকে চিৎকার করে বোঝাচ্ছে, ওয়ার্ল্ড কাপে মারাদোনার ওই সেকেন্ড গোলটা! পাঁচজনকে গুতিয়ে যেভাবে গোলটা দিল, শিং না থাকলে, দু-পেয়ে মানুষের পক্ষে ও-গোল দেওয়া সম্ভব? হঠাৎ আমাকে দেখে বলে উঠল, কী ব্যাপার। বিলটা এনেছ?

গত মাসে ভুতুড়ে টেলিফোন-বিল এসেছে। তিন হাজার তিনশো তিরিশ টাকা। তদন্ত সাপেক্ষে অ্যাভারেজ বিল দেবার অর্ডার কদিন আগে তরফদার করিয়ে দিয়েছে।

আরে,না-না। বিল নয়।আমি বললাম, তা, তোমাদের কী নিয়ে ফাইট? ট্যাকটিক্স ভার্সাস পাওয়ার ফুটবল?

না-না। প্রাক্তন নকশাল নেতা সিরিয়াসলি জানাল, আমাদের কথাটা শুরু হয়েছিল হাউ টু শেক-অফ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, দিস ব্লাডি বামফ্রন্ট। এই নিয়ে। আবার বলল, বিলটা আনলে না কেন?

আমি বিল আনিনি। এসেছি, ও রিসেন্টলি গেছে শুনে, কেদার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। জেনে, ওর মুখচোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কোথা কেদার আর কোথায় বিল হাতে স্পেশাল কমপ্লেন সেলের নায়ারকে তেল-মারা।

কেদার যাচ্ছ? বলে ড্রয়ার থেকে একতাড়া ছবি বের করে সে টেবিলে রাখল, এই দ্যাখো। লাস্ট অক্টোবরের কেদার। কেদার, বদ্রিনারায়ণ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী–চারো ধামের ছবি! বাট কেদার ইজ কেদার। সিম্পলি আনবিটেবল! আহা–হ্যাঁ। তুষার রায়ের শেষ কবিতাটা মনে আছে তোমার–

ঘণ্টার শব্দ শুধু ভেসে আছে তিব্ৰতী গোস্ফার।
ব্যস আর কেউ নয়, কিছু নয়, শুধুই তুষার,
ফার ও পাইনবনে তুষার ঝরছে শুধু, শুধুই তুষার..

বোধহয় একটু মিসকোট করলাম। কিন্তু, একজন কবির শেষ কবিতার শেষ লাইনের শেষ শব্দ নিজের নাম দিয়ে… পৃথিবীর সাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত দুটো দেখাতে পারবে? লিখছে কখন? না, যখন হেভি হেমোপটিসিস হচ্ছে–মুনলাইট গ্রোভের সাদা বেসিন লালে-লাল করে দিচ্ছে দার্জিলিঙে–

তরফদার সাহিত্য ভালবাসে, নিজেও লেখেটেখে। তুষার রায় ছিল ওর বন্ধু।

লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল ডান হাতের রোঁয়া বাঁ-হাতের তালু দিয়ে সস্নেহে শোয়াতে শোয়াতে ও প্রসঙ্গে ফিরে এল, আর পথের সৌন্দর্য… কী করে বোঝাব তোমাকে। তুলনা হয় না। পাহাড়ের গায়ে যে কত রকমের সবুজ। পরপর দশটা হয়ত শেড দেখতে পাবে সবুজের…

তবে বিউটির শুরু তোমার রামবাড়া চটির পর থেকেই। তারপর তো শুধুই তুষার… শুধু তুষার রায়ের শেষ কবিতা।

বুঝলাম, ভুল জায়গায় এসেছি। আর যাই হোক, তরফদারের কাছে কোনও ইনফর্মেশান নেই। অন্তত এখন। লাঞ্চের সঙ্গে, গোটা দুই বিয়ার আজ সে নির্ঘাত পেঁদিয়েছে।

তবে তরফদারও ট্রাভেল এজেন্টের বকলস গলায় বাঁধতে বারণ করল। সে একটা চিঠি করে দিয়ে বলল বিড়লার হেড অফিসে যেতে ওই যেনীলাট হাউসের পাশে। ডালহৌসিতে। কেদার ও বদ্রীতে বিড়লার গেস্ট হাউসে যথাক্রমে দুটি ঘর সে বুক করতে বলল।

অ্যাটাচড বাথ আছে নাকি? আমি ভয়ে ভয়ে বলি।

আছে মানে? উইথ গিজার অ্যান্ড এভরিথিং। বিয়ারের ফেনার চেয়েও উচ্ছ্বসিতভাবে তরফদার টেবিলে ঘুসি মারল। বলল,

বাংলো মন্দিরের একদম গায়ে। নিচে মন্দাকিনী। মন্দিরের একেবারে পিছন থেকে উঠে গেছে চিরতুষার–কেদার পাহাড়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *