০৩. পরম পরমাণু বা সমুদ্রপাখির ডাক

পরম পরমাণু বা সমুদ্রপাখির ডাক

প্রশ্ন : এই তাহলে ছিল তোমার বিবাহিত জীবন?

উত্তর : কোয়ার্ক!

প্রঃ : তবু তোমরা একসঙ্গে?

উঃ : কোয়ার্ক! কোয়ার্ক!

 

পৃথিবীর সব দম্পতিই এমন, আমি তা বলি না। আমাদের চেয়েও ঢের অমানুষিক সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত আছে।

এখন, আদালতের পরিভাষায়, আমি দু-একটি এক্সিবিট পেশ করব। দৃষ্টান্তগুলি কাল্পনিক নয়। নামটাম পাল্টে দিলেও ঘটনা অদলবদল করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমি লেখক নই এবং আমার কল্পনাশক্তি শূন্য (অবশ্য, লেখক না হলেও আমি এটা জানি যে, কল্পনাশক্তি যাদের থাকে তারা অতি হেঁদো লেখক)। অতএব, যে বা যাঁরা উদাহরণগুলির মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাবেন, তারা ভুলেও যেন না ভাবেন, আমি তাদের কথা হয়ত বলছি না। আমি ঠিক তাদেরই সাক্ষ্য দিতে ডাকছি। আত্মপক্ষ সমর্থনের খাতিরেই আমাকে এ কাজ করতে হচ্ছে, যা খুনিরও আছে। আমি নাচার।

দৃষ্টান্ত–১

—আপনার নাম বলুন।

–নীহার মজুমদার।

—পেশা?

—শিল্পী।

—পেইন্টার না স্কাল্পটর?

—পেইন্টার।

—স্ত্রীর নাম?

–হিমানী।

—মজুমদার?

–মজুমদার।

—আপনারা সুখী দম্পতি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আচ্ছা, গত ১৭ জানুয়ারি সকালবেলা। আপনি সদ্য ঘুম থেকে উঠে, রেডিওয় হারানো দিনের গান শুনছিলেন : গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি…। আপনার বিধবা, পরে মৃতা, ছোটবোন গাইতেন। তখন আপনার পরনে আন্ডারউইয়ার ছাড়া কিছু ছিল না, বিছানায় বসে চাদর মুড়ি দিয়ে আপনি গানটি শুনছিলেন। ওই সময় আপনার স্ত্রী ঠিকে-ঝি নন্দর মা আগের দিন আসেনি বলে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গজগজ করছেন। আপনি আন্ডারউইয়ার পরে পরিচারিকার সামনে গিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলেন, এমন একটা সুন্দর গান হচ্ছে, বকুল গাইত… একটা পাখি উড়ে গেলে ভাগাড়েও ছায়া পড়ে তোমার ক্ষেত্রে কি সেটুকুও প্রযোজ্য হয় না!, প্রযোজ্যশব্দটি আপনি ইউজ করেছিলেন, যার আর্বান এফেক্টের দরুন, স্বীকার করি, এটাকে ঠিক খিস্তি বলা যায় না। কিন্তু, কনটেন্ট-ওয়াইজ, এ তো স্ত্রীকে তবে রে মাগী বলার প্রকারান্তর। নয় কি?

—আমি আগের দিন খুব মদ খেয়েছিলাম। হ্যাংওভারে ছিলাম।

—সত্যি কি না। হ্যাঁ, না, না?

–হ্যাঁ।

—তবে রে মাগী?

—হ্যাঁ। বিচারপতির প্রতি : প্লিজ নোট। ইওর অনার।

—আর একটু পিছিয়ে যাচ্ছি। আগের বছর। ৩ জুলাই। রবিবার। বেলা সওয়া ১২টা। আপনি তখন দোতলায় দক্ষিণের ঘরে। আপনার স্টুডিওয়। বিখ্যাত স্বপ্ন ও সাধনা ছবিটি শেষ করছিলেন যা বাইশ হাজার টাকায় সম্প্রতি বোম্বাইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারি থেকে বিক্রি হয়েছে। আপনার স্ত্রী আপনাদের ড্রইংলবি থেকে ওগো শুনছ এই শুনছ বলে ডাকছিলেন। আপনি তৃতীয়বারে শুনতে পেয়ে উত্তর দেন, কী ব্যাপার? একবার এসো নাগো, উনি ডাকেন।

—হ্যাঁ, এমনটা তো হতেই পারে। কী ব্যাপার!

—আরও দু-একবার ডাকাডাকির পর আপনি চেঁচিয়ে উত্তর দেন, এখন কী করে যাব? এখন আমি ছবিটা শেষ করছি। হেগোপোঁদে যাব?তখন অবশ্য আপনাদের পরিচারিকা ছিলেন না। কিন্তু জাহাঙ্গির থেকে ওই ছবিটাই বুক করতে এসেছিলেন কোটিপতি কালেক্টর শ্রীশ্যাম ক্যাশপ ও, ওখানে আপনার তৃতীয় এগজিবিশনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে। যদিও বাংলা তিনি একদম জানেন না। এবং, যেহেতু আপনি তখন ওই মূল্যবান ছবিটি তৈরি করছিলেন–তখন লেফট হ্যান্ডার বলে আপনার বাঁ হাতে ব্রাশ ও ডানহাতে প্যালেট–আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, আপনার স্বপ্ন ও সাধনার মধ্যে স্ত্রীর প্রতি ওই উক্তি বিশেষত হেগোপোঁদ শব্দটি অননুমেয়ভাবে মিশ্রিত হয়ে আছে?

—প্লিজ স্টিক টু দ্য পয়েন্ট লার্নেড ফ্রেন্ড। আদালত শিল্প সমালোচনার স্থান নয় : বিচারপতি।

—এক্সকিউজ মি মিলর্ড। (নীহারের প্রতি) বলুন!

—তখন আমার মাথায় একটা জেনারেটর পুড়ে যাচ্ছিল।

—হ্যাঁ অথবা না বলুন।

—হ্যাঁ। (দুশ্চিন্তিতভাবে) তা তো কিছুটা থাকবেই।

(বিচারপতির প্রতি ইঙ্গিত)

—আপনি পায়েলকে চেনেন?

—হ্যাঁ। আমার মডেল হিসেবে ছিল কিছুদিন।

—আপনাদের মাল্টি-স্টোরিডের পার্কিং জোনে গাড়ির মধ্যে আপনি তার সঙ্গে উপগত হন।

—আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম।

—কিন্তু ড্রাইভার তেওয়ারি ছিল না। সে গাড়ি থেকে নেমে সোজা আপনার বারো তলার ফ্ল্যাটে উঠে যায় এবং আপনার স্ত্রীকে যা বলার বলে সে-ই, মধ্যরাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। সে রাতেই স্ত্রী ওই প্রসঙ্গ তুললে, আপনি ছি ছি ছি, ড্রাইভারকে তুমি স্পাই হিসেবে লাগিয়েছ—ছি ছি-ছিঃ ছিঃছিঃবলতে বলতে তার কপালে ডাইনিং টেবিল থেকে ডিশ ছুঁড়ে মারেন। তারপর প্রহার করেন।

কিন্তু, তারপর, সারারাত আমি তার শুশ্রুষা করি। তাছাড়া ওসব আগে হত। এখন আর হয় না।

—এখন আর পরনারী করেন না?

–করি। কিন্তু এখন আমার স্ত্রী ওসব মেনে নিয়েছেন।

—এখন আপনারা সুখী?

—আমরা চিরকাল সুখী ছিলাম।

দৃষ্টান্ত–২

—আপনার নাম?

–ডাঃ ব্যোমকেশ বর্মন।

—আপনার স্ত্রীর নাম?

—শুভলক্ষ্মী বর্মন।

—পেশা ডাক্তারি?

—হ্যাঁ।

—আপনি একজন বিশেষজ্ঞ?

—হ্যাঁ।

–কীসে আপনার বিশেষজ্ঞতা?

—ব্রেস্ট ক্যানসারে। আমি হাত দিয়ে টিপে ব্রেস্ট টিউমার বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট বলে দিতে পারি।

-আপনি রোগ নির্ণয়ের জন্য কত নমর্দন করেছেন?

—দেশে না বিদেশে?

—বিদেশের কথাই আগে বলুন।

—হ্যাঁ, বিশেষ করে সুইডেন আর জাপান আমাকে কয়েকবার ডিমনস্ট্রেশন দিতে নিয়ে গেছে। ওখানে তো পেসেন্টরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের কম্পিউটারে সমস্ত ডাটা আছে। তবে এদেশে

—এ-দেশে?

—এ-দেশে হিসেব রাখা হয় না।

—আপনি মারা যান কত সালে?

—১৯৮৬-র ২৯ সেপ্টেম্বর, ভোর পাঁচটা পাঁচ মিনিটে আই ব্রিড মাই ল্যাস্ট হ্যাফ।

—হোয়াইলাস্টহাফ?

—শেষ নিঃশ্বাসটা আমি আধখানার বেশি নিতে পারিনি।

—আই সি। আপনার কী হয়েছিল?

—মাল্টিপ হার্ট ব্লক।–আচ্ছা, অপারেশন করাবার আগে আপনি দশ লক্ষ টাকার একটা ইনসিওরেন্স করাবার চেষ্টা করেছিলেন। কেন?

—হ্যাঁ, অসুখটা কী আমি ৬ মাস আগেই বুঝতে পারি। তাই তাড়াতাড়ি যদি লক্ষ্মী কিছু পেয়ে যায়!

—অসুখটা ইনসিওরেন্স চেক-আপেই ধরা পড়ল?

–হ্যাঁ।

—ডাঃ জর্জ লুমিস আপনাকে স্টেটসে আসতে বলেছিলেন?

—হ্যাঁ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেলভিউতেই হল। বোম্বে থেকে এলেন ডাঃ ভরোসে। ভাবলাম, কলকাতায় হলে লক্ষ্মী পাশে থাকবে, ছেলেমেয়ে থাকবে—মনে জোর পাব। তাই এখানে করালাম। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল। সেই শুভদৃষ্টির দিন থেকে। রোজ ঘুম থেকে উঠে আমরা বিছানায় দুজনে-দুজনকে জড়িয়ে, দুজনে-দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এক মিনিট–চোখের পলক না ফেলে। পরে এটা তিন মিনিট পর্যন্ত বাড়ানো গিয়েছিল। এক ধরনের যোগা বলতে পারেন। ভাবলাম, মরে যাবার সম্ভাবনাই তো বেশি। ভেবেছিলাম, শেষবারের মতন ওর চোখে-চোখ রেখে……তাই বেলভিউ-এ।

—পেরেছিলেন?

–এন্‌-না। (হেসে) পারার কথাও নয়। তখন যা হয় আর কী। শেষ মুহূর্তে। সবাই যা করে। আরও আধখানা নিঃশ্বাস নিতে পারি কিনা সেই চেষ্টাই করেছিলাম।

-আচ্ছা, নার্সিংহোমে ভর্তির ডেট পিছিয়ে দিলেন কেন?

—শেষ কদিন তো উকিল, ইনকাম ট্যাক্স আর ব্যাঙ্কের লোকদের নিয়েই কাটল। তারা ছাড়বে, তবেনা যাব? যেখানে যা গোলমাল আছে সব ঠিকঠাক করাতে হল।সমস্ত অ্যাকাউন্ট লক্ষ্মীর নামে ও তার বেনামে ট্রান্সফার করাতে হল। কালো টাকা যা, যথাসম্ভব সাদা করতে হল। ট্রাস্ট, ডিড অফ গিফট এসব করাতে কটা দিন দেরি হয়ে গেল আর কী। আমি আর উইল-টুইলের ঝামেলায় যাইনি। প্রবেট করানো এক ঝামেলা। সে-সব লক্ষ্মী একা পেরে উঠবে না।

—আচ্ছা, বছর ঘোরার আগেই আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করলেন। কেন?

—ও, দ্যাট শি হ্যাড টু ডু। দেয়ার রিমেনড নো আদার অপশন ফর হার। হল কী, যার নাকি সহমৃতা হওয়ার কথা—অন্তত আমাকে তাই বলেই শাসিয়েছে বারবার, যে, যদি আমি আগে মরি তাহলে… বিধবা হওয়ার পর সে-ইদ্যাখ-দ্যাখ করে মোটাতে শুরু করল। বিশেষত, পাছায় ওর মাংস লাগল প্রচুর। গায়ের ফর্সা রং লাল হয়ে একদম যাকে বলে ফেটে বেদানা। একজন পতিগতপ্রাণা সদ্যবিধবার পক্ষে খুবই লজ্জার কথা বৈকি! সত্যি কথা বলতে কি, লক্ষ্মী আমার পুত্রবধূর চেয়েও সুন্দরী আর অ্যাট্রাকটিভ হয়ে উঠল, মাত্র মাস-ছয়েকও যেতে না যেতেই।

–তারপর?

–কথা হল, শরীর তো মিথ্যে বলে না! বৌ ঊর্মির প্ররোচনায় ছেলে একদিন মাকে বলে বসল, লজ্জা করে না! বিধবা মাগী মাছ-মাংস খাস! বন্ধুবান্ধবদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। সেই দিনই পাখায় শাড়ি বেঁধে… আসলে, আমারই ভুল। আমার ছেলের নামেও কিছু টাকাকড়ি রেখে আসা উচিত ছিল। আমার ছেলেটা লুম্পেন।

—ভিনা শীতলবলকে আপনি চেনেন?

–-হ্যাঁ, আমার অ্যানাসথেসিওলজিস্ট।

–ভিনাকে উনি সেদিন বাড়িতে আসতে দেননি। শ্মশানেও যেতে দেননি।

—হ্যাঁ। ভিনা কাঁদতে কাঁদতে ফোন করলে, লক্ষ্মীও কাঁদতে কাঁদতে বিচহোর এই সব বলে বিশ্রী গালাগালি দিয়েছিল ওকে।

—আপনার অ্যাকাউন্ট্যান্ট আপনার বারো লক্ষ টাকা খরচের হদিশ করতে পারেননি।

—আ-হ্যাঁ। ওটা, ওটা আমি গলফ গ্রিনে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ভিনাকে দিই। আই আম গ্রেটফুল টু হার। লাভ-মেকিং-এর আগে ওই আমাকে বাথরুমে গিয়ে টু দা লাস্ট ড্রপ ব্লাডার খালি করে আসতে শেখায়। ডিউরেশন এতে সত্যিই বাড়ে। শি ইউজড টু হ্যাভ টু অর্গাজম অ্যাট ইচ অ্যান্ড এভরি অকেজন। আ, আই হ্যাভ টু এনডিওর টুয়েন্টি-টু ইয়ার্স অফ ম্যারেড লাইভ টু নো হাউ ইট ইজ টু গেট সাড বায় আ উওম্যান। মাই-মাই!

—আপনাদের এরকম দাম্পত্যকে কি সুখকর বলা যায়?

—হ্যাঁ। আমরা ছিলাম সুখী দম্পতি। প্রতিদিন লক্ষ্মী নিজের হাতে আমার গেঞ্জি ও ব্রিফ কেচে দিয়েছে। স্নান করে উঠে কোনওদিন ভোলেনি লোহা আর সিঁথিতে রাঙ্গাজবা লাগাতে।

—চুল উঠে যায় শোনার পর থেকে চীনে সিঁদুর ব্যবহার শুরু করলেন, শেষের দিকে।

—হ্যাঁ, মেটে-মেটে রং। বিশ্রী। কুৎসিত।

—আপনার অসুখটাও তার পরেই ধরা পড়ল।

—হ্যাঁ। যতদিন রাঙ্গাজবা সিঁদুর ইউজ করত—

—আপনারা সুখী দম্পতি?

—আমরা সুখী দম্পতি।

দৃষ্টান্ত–৩

—আপনার নাম কী? —–অনাদিপ্রসাদ।

–পুরো নাম?

—অনাদিপ্রসাদ।

–পদবি বলুন।

—আমি পদবি ব্যবহার করি না।

—এটা আদালত। বাবার পদবি বলুন। নইলে আদালতের অবমাননা করা হবে।

—আমার মা ব্রাহ্মণকন্যা। এবং বাবা জেলে। তাদের বিবাহ হয়নি।

–বাপের পদবি-সহ নাম জানা আছে?

—আছে।

—মা বলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ–।

–বাপের এবং মার পদবি জুড়ে আপনার পুরো নাম বলুন।

—ডক্টর অনাদিপ্রসাদ সাঁতরামুখার্জি।

—আপনি কীসে ডক্টরেট?

—বাংলা সাহিত্যের মলমূত্র নামে আমার থিসিসের জন্য।

—স্ত্রীর নাম কী?

–সারদাময়ী।

–সাঁতরামুখার্জি?

–সাঁতরামুখার্জি।

—আপনি স্ত্রীকে ভালবাসেন?-

-অ্যাঁ-ম্যা…

—উত্তর দিন।

—এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

-আদালতে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু নেই। হাঅথবা নাবলতে হবে। দুটোর একটা বলুন।

—এবং চলবে না?

–এবং বলতে?

–হ্যাঁ এবং না?

–না।

—শুধু অথবা?

—শুধু অথবা। হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে।

–মনে হয় চলবে না?

—আপনার যা মনে হয় সেটা আপনার থিসিসে চলতে পারে। এখানে শুধু সাক্ষ্য অথবা প্রমাণ। হ্যাঁ, কিংবা না।

—আচ্ছা, হ্যাঁ।

—আচ্ছা-ফাচ্ছা চলবেনা।বলুন, হঁ্যা।নইলে আপনাকে এই মুহূর্তে হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করব।

—হ্যাঁ।

—স্ত্রীর সঙ্গে আপনার যৌন সম্পর্ক নেই কতদিন?

—পনেরো বছর।

–এখন বয়স কত?

—পঁয়তাল্লিশ।

–তিরিশ থেকে?

—বিয়োগফল তাই।

—সম্পর্ক নেই কেন?

—হিস্টেরেকটমি, মানে ওই ওর ইউটেরাস রিমুভড হবার পর, ও যন্ত্রণার কথা বলত। কিছুতেই নিতে পারত না। উঃ, আঃ মাগো, মরে গেলাম এইরকম বলত। মাসখানেক চেষ্টা করলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ছিঃ, আমি না মানুষ। হাল ছেড়ে দিলাম।

—ডাক্তারের কাছে গেলেন না?

–না, তখন আমার ধারণা ছিল, হিস্টেরেকটমির পর বোধহয় আর সেক্স করা যায় না। লজ্জায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে জানতে চাইনি যাদের স্ত্রীদের অমন হয়েছিল। তাছাড়া ওই সময় রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পাের যৌন ব্যাপারটার ভার পুরোটা আমার ওপর এসে পড়ল। সাহিত্য অকাদমির গ্রান্টে চলে গেলাম আর্জেন্টিনা। অনেককাল বাদে, একদিন রোববার দুপুরে রোয়িং ক্লাবে বিয়ার খেতে খেতে ব্যোমকেশ আমাকে বলল, সে কীরে। খুব প্রেমসে করা যায়, ব্যোমকেশ তখনও বেঁচে, আগের চেয়ে ঢের ভাল করা যায়। আমার শালা কাতুর বৌ এর তো হয়েছে। ফকিং-টকিং দিব্যি চলছে। তাছাড়া কনসিভ করার ভয়ও আর থাকে না। ফ্রি লাভ বলতে যা বোঝায় আর কি। একদম তাই। বলে ও খুব একচোট হাসল। কিন্তু, ততদিনে বছর চারেক পেরিয়ে গেছে। ততদিনে সারদা কেঠো, কড়ে বিধবা।

—সেক্স লাইফ কীভাবে কাটালেন। এতগুলো বছর?

–মাস্টারবেট করে। (রিমলেস গ্লাস নাকের ডগায় নামিয়ে) হ্যাঁ!

—আপনারা পাশাপাশি শোন না।

–নাঃ। ও পাশের ঘরে শোয়।

—অথচ, সবাই আপনাদের সুখী দম্পতি বলে জানে?

–অথচ, সবাই আমাদের সুখী দম্পতি বলে জানে।

—ইউ ডিডন্ট গো ফর এনি আদার উওম্যান, ডিড ইউ?

—এন-নো। আই ডিড নট।

বিচারপতি : স্টিল ইউ আর ইন বেস্ট অফ টার্মস?

—ইয়েস মি লর্ড।

—অ্যাজ হ্যাজবন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ?

—ইয়েস মি লর্ড। সুখী দম্পতি বলতে তো তাদেরই বোঝায় যখন সবাই তাদের সেভাবে দ্যাখে, তাই না? ইন পয়েন্ট অফ ফ্যাক্ট, মি লর্ড, আমার শ্বশুরবাড়ির তরফ থেকে আমাদের ২৫তম বিবাহবার্ষিকীর জন্যে ইল্লববারেট প্রিপারেশন হচ্ছে।

–আচ্ছা। এখন বলুন! আপনারা সুখী দম্পতি?

—দাম্পত্য জীবনের সুখ-অসুখের কথা আদালতকে বলা নিরর্থক ধর্মাবতার।

—কেন?

–কারণ, আদালত ক্লীবলিঙ্গ। আদালতের বিবাহ হয় না।

—ইফ দিস ইজ নট, দেন হোয়াট এলস্ ইজ কনটেম্পট অফ দ্য কোর্ট, মিলর্ড?

—হুজুর! মিলর্ড! ধর্মাবতার! দাম্পত্য জীবনের সুখ-অসুখ আমি আদালতকে বোঝাব কী করে? দাম্পত্য মানে তো শেকলে বাঁধা দুজন মানুষ একজন স্ত্রী আর আর-একজন পুরুষ যে যার নিজের শেকল চাটছে। কী করে আমি আদালতকে এটা বোঝাব, এতেও একটা সুখ আছে। (ক্রন্দন)

কৌঁসুলি : আপনি ইতিমধ্যেই কঠিন শাস্তিযোগ্য একটি উক্তি করেছেন আদালতকে ক্লীবলিঙ্গ বলে–

—(বিচারপতির প্রতি, কাঠ-গড়া চেপে ধরে, ঝুঁকে) সার, আপনি ব্যাকরণ দেখুন। বিচারপতি (হাতুড়ি ঠুকে) : আদালত ব্যাকরণ মানে না। বলুন, আপনি সুখী না অসুখী? অনাদিপ্রসাদ (শিকল ও অশ্রু একত্রে ঝেড়ে) : সুখী ধর্মাবতার।

দৃষ্টান্ত–৪

—আপনার নাম কী?

–কুবের হালদার।

—স্ত্রীর নাম?

—স্ত্রীর নাম মন্দিরা হালদার।

—আপনি কী করেন?

—শিয়ালদহর কাছে নুর মহম্মদ লেনে আমার হারমোনিয়ামের দোকান আছে। নাম : সুর-লক্ষ্মী।

—টেবিলের ওপর রাখা একটি উজ্জ্বল হারমোনিয়াম দেখিয়ে) এই হারমোনিয়ামটা চিনতে পারছেন?

—হ্যাঁ। ওটা মন্দিরার হারমোনিয়াম। একদিন ওটা সারাতে ভাই-এর সঙ্গে মন্দিরা আমার দোকানে নিয়ে এল। দেখলাম, কারিগরির দিক থেকে যন্ত্রটি খুবই ভাল। তবে, কালক্রমে এর উইন্ড চেম্বার, ভয়েসিং, টিউনিং সব নষ্ট হয়ে গেছে। খুব বেসুরে বাজছিল।

–বলে যান।

—রিডগুলো ঘষে ঘষে আমি সুর মেলালাম। জার্মান টিউনিং ফর্ক দিয়ে অনেক খেটেখুটে সা-টু-সা মেলালাম। সিঙ্গল রিডকে স্কেলচেঞ্জিং-এ পরিণত করলাম। পালিস-টালিসের পর কালক্রমে খুবই সুন্দর দেখাল। মন্দিরা এতটা আশা করেনি আমার কাছে। আমাদের বয়সেরও অনেক তফাত।

—সেই আপনাদের পরিচয়ের শুরু। তারপর?

–তারপর কালক্রমে আমার আর মন্দিরার বিয়ে হল। কালক্রমে আমাদের সন্তানাদিও হল।

—উনি গান গাইতেন?

—হ্যাঁ। তবে শেষ ছমাস আর গাইতে পারত না। সেই ছোটবেলা থেকে তানপুরা ধরত মালবিকা কাননের সঙ্গে। গান ওঁর কাছেই শেখে। তারপর কালক্রমে ওর গলায় ক্যানসার হল।

—কিন্তু এখন এই হারমোনিয়ামটা পাওয়া গেছে শেওড়াফুলির নিরাপদ মল্লিকের বাড়ি থেকে।

—হ্যাঁ। আমি ওকে বিক্রি করি। প্রথমটা করতে চাইনি। স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব ভেবেছিলাম। কালক্রমে করলাম।

—এটা কি সত্যি যে এই হারমোনিয়ামের সুরে গান গেয়ে গায়িকার গলায় ক্যানসার হয় বলে অনেকেই এটা কিনতে চাননি?

–কেউ না। কিন্তু মল্লিক বেপরোয়া লোক। ভজন ছাড়া ও কিছু গায় না।

—কত দাম পান?

—চার হাজার।

—স্ত্রীর মৃত্যুর কত দিন পরে বিক্রি করেন?

–ছমাসের মধ্যে।

–টিউনিং ইত্যাদির জন্যে আপনি নিরাপদবাবুর কাছে আরও পাঁচশোর জন্য খুব চাপাচাপি করেছিলেন?

–কালক্রমে সাড়ে চার হাজার পাই।

—আর স্ত্রীর তানপুরাটা। যা মালবিকা কাননের সঙ্গে বাজাতেন?

–কালক্রমে ওটাও বিক্রি হয়।

–কালক্রম বলতে কি পরে?

—ওটা হারমোনিয়ামের আগেই বিক্রি হয়ে যায়। এতে তো ক্যানসারের ব্যাপার ছিল না।

—ভাল দাম পেয়েছিলেন?

—ভাল দাম পেয়েছিলাম।

—আচ্ছা কুবেরবাবু, স্ত্রীর মৃত্যুর পর, ওষুধের আন-ইউজ ফয়েলগুলো–যা বেঁচেছিল…

—হ্যাঁ। ওগুলো আমি সব স্থানীয় প্যানাসিয়া ড্রাগ স্টোর্স-কে বিক্রি করে দিই।

—ভাল দাম পেয়েছিলেন?

—ভাল দাম পেয়েছিলাম। সবই দামি ওষুধ।

বিচারপতি : (কৌঁসুলির প্রতি) কুয়ো ভাদিস, মাই লার্নেড ফ্রেন্ড?

কৌঁসুলি : লিডিং টু দা পয়েন্ট, ইওর অনার।

বিচারপতি : (বিরক্ত মুখে): এ মামলার আসামি কে বা কারা? উইটনেসের পর উইটনেস বক্সে দাঁড়াচ্ছে–আসামিরা কই?

কৌঁসুলি : দে শ্যাল অ্যাপিয়ার অ্যাট দা রাইট মোমেন্ট, ইওর অনার। (সাক্ষীর প্রতি) আচ্ছা, আমার শেষ প্রশ্ন। হলদিয়া থেকে আপনারা বাসে ফিরছিলেন একবার। মনে আছে?

-হ্যাঁ। শালির ছেলের অন্নপ্রাশনে যাই।

—দুজনে বসার সিটে পাশাপাশি বসেছিলেন। বাসে আপনারা একটাও কথা বলেননি। সেদিন কি ঝগড়া হয়েছিল?

–না-না। ঝগড়া, মনোমালিন্য এসব আমাদের একদিনের জন্যেও হয়নি। এ জন্যে বন্ধুবান্ধব সবাই আমাদের হিংসে করত।

বিচারপতি : তাহলে? তিন ঘণ্টার পথ… বাসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটাও কথা হবে না?

–স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কী কথা হবে, ইওর অনার, বাজারে মাছ কাটিয়ে এনেছ, তবু গায়ে আঁশ লেগে কেন–এ-ছাড়া?

আদালতে হাস্যরোল।

বিচারপতি : চোপ! আদালত চলছে।

কৌঁসুলি : (বিচারপতির প্রতি) মিলর্ড। এবার আমি আসামিদের ডাকছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *