০৬.
মাটির নীচ থেকে উপরে উঠে এসে প্রথমে মনে হল, নিউ ইয়র্ক শহরের প্রান্ত এলাকার সঙ্গে কোনও ফারাক নেই। লোকজন দ্রুতগতিতে হাঁটছে। কিছুটা চলার পর অর্জুন লক্ষ করল, ক্রমশ কালো মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দূরে বিকট শব্দ হতেই জো অর্জুনকে নিয়ে একটা দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দোকানদার কিছু বলতে চাইলে জো বলল, ভাই, তিন মিনিটের বেশি থাকব না। ও কে!
তখনই দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্জুন। পাশাপাশি ছ’টা মোটরবাইক, পিছনে অন্তত আঠারোটা মাঝারি গতিতে এগিয়ে আসছে। সাদা-কালো মিশিয়ে স্বাস্থ্যবান চালকদের পরনে চামড়ার প্যান্ট, হাতকাটা জ্যাকেট। হাতে নানানরকম উল্কি আঁকা। প্রত্যেকের চুলে বেণি, কাঁধের উপর লুটোনো। চোখগুলো রোদচশমায় ঢাকা, মুখে দাড়ির জঙ্গল। ওদের আসতে দেখে রাস্তা ফাঁকা করে সবাই ফুটপাতের ওধারে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যটি দেখলেই ভয় জাগবেই। ওরা ওপাশের রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যেতেই জো বলল, চলুন।
এরা কারা? হাঁটতে হাঁটতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠাবার সময় ওদের বুকে দয়ামায়া, ভালবাসা বোধগুলো দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। জো বলল।
এরাই তা হলে সেই কুখ্যাত অপরাধী? পুলিশ ধরছে না কেন?
অপরাধ করলেই ওরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এখন যাদের দেখলেন, তাদের বিরুদ্ধে কেউ পুলিশের কাছে কোনও নালিশ করেনি।
দুটো সাদা ছেলে একটা ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখেই বোঝা যায় অনেকদিন স্নান করেনি। চুলে নানারকমের রং। হাতকাটা গেঞ্জি আর জিনস পরনে। কিছু একটা চিবুচ্ছিল ওরা। ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজন পা সামনে তুলে দিয়ে পথ আটকাল। দ্বিতীয়জন জিজ্ঞেস করল, ইউ স্টে হিয়ার?
জো মাথা নাড়ল, নো।
ছেলেটা খ্যাকখ্যাক করে হাসল, তোমার পকেটে যা আছে তা বের করো? কুইক।
বের তো করতেই পারি ব্রাদার, কিন্তু তুমি মুশকিলে পড়বে। জো বলল।
মুশকিলে পড়ব? হা হা হা। আমি কথা বলি কিন্তু ও ছুরি চালাতে ভালবাসে।
বেশ নাও। পকেটে হাত ঢোকাল জো, কিন্তু একটু পরেই মিস্টার ডি সিলভার কাছে তোমাদের যেতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ছেলেটা পা নামিয়ে দিল, ইউ নো হিম?
হি ইজ মাই ক্লায়েন্ট।
সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দুটো যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে উলটো দিকে তাকিয়ে থাকল।
আবার হাঁটা শুরু করতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ডি সিলভা কে?
এই পাড়ার গড ফাদার। জো জবাব দিল।
একটা ছোট্ট আধা অন্ধকার বারে ঢুকল জো। সেখানে চার-পাঁচজন ছড়িয়েছিটিয়ে বসে। বারম্যানকে জো ডি সিলভার কথা জিজ্ঞেস করতে সে মুখের ইশারায় পাশের দরজা দিয়ে ভিতরে যেতে বলল। দরজাটা ভেজানো।
জোর সঙ্গে ভিতরে ঢুকে অর্জুন দেখল, বিশাল চেহারার একটা লোক টেবিলে বসে দাবা খেলছে। তার সামনে কেউ নেই। লোকটার ঊধ্বাঙ্গের অনেকটা জ্যাকেটে ঢাকা পড়েছে। সেখানে প্রচুর উল্কি আঁকা।
জো বলল, হাই! কেমন আছ?
মরে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত আমি খারাপ থাকব না। অনেক দিন পর এলে? লোকটি দাবার বোর্ড থেকে চোখ না সরিয়ে কথাগুলো বলল।
আমার কর্মচারী অসুস্থ বলে আসতে হল। মিস্টার কার্ভালার নামে একটা পার্সেল এসেছে টেক্সাস থেকে। জো বলল।
কাভার্লো এখন মাটির নীচে। মাসখানেকের মধ্যে উপরে উঠবে না।
ও।
ফালতু খুন করে ঝামেলায় পড়েছে। উপরে উঠলেই পুলিশ ওকে ধরবে।
ডি সিলভা বলল, তুমি যদি চাও তা হলে কাউকে সঙ্গে দিয়ে তোমাকে নীচে পাঠাতে পারি। না হলে আমাকে দিয়ে যেতে পারো।
তুমিই নাও। দয়া করে ওকে দিয়ে দেবে।
এটি কে? ডি সিলভা বোর্ডের চাল দিল।
আজ থেকে আমার কাজ করছে। ওকে চেনানোর জন্যে সঙ্গে এসেছি।
একটা নাম নিশ্চয়ই আছে।
অর। জো বলল।
অর? অবাক হয়ে তাকাল ডি সিলভা। তারপর অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল। শেষে হাসি থামতে বলল, আমি বাবার জন্মে এমন নাম শুনিনি। সুতরাং তুমি হলে অলটারনেটিভ। কোন দেশ থেকে এসেছ?
ইন্ডিয়া। অর্জুন বলল।
ইন্ডি! মাথা নাড়ল ডি সিলভা, এখানে এসে যদি কোনও প্রবলেমে পড়ো তা হলে আমার নাম বলবে। কিন্তু মনে রেখো, এই তিনটে ব্লকে। তার বাইরে নয়।
বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল অর্জুন।
পার্সেলটা ডি সিলভাকে দিয়ে দিল জো। সেটা তুলে কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ঝাঁকাল ডি সিলভা। তারপর গন্ধ শুকল। এবার হাসি ফুটল তার মুখে। তারপর সেলফোনের বোতাম টিপল। সেটা কানে লাগিয়ে ধরতেই ওপারের সাড়া পেয়ে হাসতে হাসতে যে ভাষায় কথা বলে গেল, সেটা সম্ভবত স্প্যানিশ। বিন্দুবিসর্গ বুঝল না অর্জুন। লোকটি ফোনে কথা বলছে চেঁচিয়ে। মোটা শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। শেষে সেলফোন বন্ধ করে ডি সিলভা বলল, কার্ভালো খুব এক্সাইটেড। ও তোমাকে কিছু দেবে কুরিয়ার করার জন্যে।
কীভাবে দেবে?
ও তো উপরে উঠবে না। তুমি নীচে গিয়ে দেখা করে এসো।
আমাকে নীচে যেতে হবে? জো-এর মুখ শুকিয়ে গেল।
তুমি তো এর আগে নীচে নেমেছ?
হ্যাঁ। কিন্তু মিস্টার ডি সিলভা, ওখানে না গেলেই খুশি হব।
এই সময় একটা বাইকের আওয়াজ বাইরের রাস্তায় থামল। তারপর দরজায় শব্দ হল। একটা লোক মাথা গলিয়ে বলল, বেন দেখা করতে চাইছে।
পাঠিয়ে দাও। কিন্তু তুমি ওর পিছনে থেকো। ডি সিলভা বলল।
তারপরই যে ছেলেটি ঢুকল তাকে পাঙ্ক ছাড়া কিছু মনে হয় না। চুল রঙিন এবং মাথার উপরে খাড়া হয়ে আছে। হাতে-গলায় উল্কি। পরনে বারমুডা আর হাতকাটা জ্যাকেট। মুখের চেহারা নির্বিকার। উল্কিগুলো সাপের।
বেন বলল, কার্ভালো ফোনে বলল আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
আমি শুনছি তুমি নাকি প্রায়ই ব্রঙ্কসের বাইরে যাচ্ছ?
প্রায়ই না, গত কাল গিয়েছিলাম।
আই ডোন্ট লাইক দ্যাট।
আমার মনে থাকবে। কিন্তু শুধু আমার বেলায় এই নির্দেশ কেন?
তুমি কি তোমার বন্ধুর কথা বলছ? ওকে আমি যেতে দিই। কারণ, ওর যাওয়ার পিছনে সেন্টিমেন্টাল কারণ আছে। যাকগে, তুমি এই ভদ্রলোককে কার্ভালোর কাছে নিয়ে যাও। জো, ফলো হিম। ডি সিলভা বলল।
আমি কি আপনার প্রাইভেট প্যাসেজ ব্যবহার করতে পারি?
যদিও আমি পছন্দ করি না, তবু, জো-এর জন্যে। হাত নাড়ল ডি সিলভা।
জো অর্জুনকে অপেক্ষা করতে বলে বেনকে অনুসরণ করে ভিতরে চলে গেল।
ডি সিলভা তার কর্মচারীকে বলল, অ্যাসকে বলবে বেনের উপর নজর রাখতে। ওর চালচলন আমার ভাল লাগছে না।
লোকটি বেরিয়ে গেলে অর্জুন বলল, আমি কি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারি?
নিশ্চয়ই। কিন্তু বেশি দূরে যাবেন না। ডি সিলভা আবার দাবার বোর্ডের সামনে গেল।
অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশে হঠাৎই মেঘ জমছে। ছায়াছায়া হয়ে আছে সামনের পথ। হঠাৎ চিৎকার কানে এল। একটা লোক প্রাণভয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর তার পিছনে ছুটছে তিনটে ছেলে। বীভৎস চিৎকার করছে ছেলেগুলো। একটা পুলিশের গাড়ি দ্রুত সেদিকে যেতে আচমকা চিৎকার থেমে গেল। ছেলে তিনটে পাশের বাড়িগুলোর খাঁজে উধাও। পুলিশ লোকটিকে জিজ্ঞেস করে গাড়িতে তুলে চলে গেল।
অর্থাৎ জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়। দু’পাশের ফুটপাতে যে সমস্ত মানুষ চলাফেরা করছে তাদের দেখে কিন্তু অপরাধী বলে মনে হল না। নিতান্তই সাংসারিক মানুষ। এই সব কাণ্ডের মধ্যেও এরা এখানে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার!
হঠাৎ ফুটপাতের গায়ে দাঁড় করানো মোটরবাইকের উপর নজর পড়ল অর্জুনের। ঝকঝকে বাইক। দেখতে বেশ সুন্দর। সে সামনে গিয়ে চাকার দিকে তাকাতেই কীরকম অস্বস্তি এল মনে। টায়ারের উপরে যে ডিজাইনটা রয়েছে তা যেন সে আগেও দেখেছে। বাইকের পিছনের রাস্তায় কাদার উপরে যে ছাপটা পড়েছে তা দেখামাত্র অর্জুন বুঝতে পারল, মিস্টার ব্রাউনের বাড়ির গায়ে এই রকম চাকার ছাপ সে দেখেছিল। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, ওখানেও একই বাইক গিয়েছিল। একই কোম্পানির চাকা অনেক বাইকে থাকাই স্বাভাবিক। অর্জুন দেখল, আর-একটা মোটরবাইক তার সামনে এসে দাঁড়াল। এই ছেলেটির পরনে ফ্যাকাশে জিন্স আর টি শার্ট। বেশ শক্তপোক্ত চেহারায় বাইক থেকে নেমে ছেলেটি আগের বাইককে দেখল। ঠিক তখনই ডি সিলভা এসে দাঁড়াল দরজায়।
এখানে কী দরকার? ডি সিলভার কোমরে হাত।
পুলিশ আমাকে খুঁজছে। ওরা আমার বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ এনেছে। ছেলেটি নার্ভাস।
কেন?
আমি জানি না। আমার মা নাকি হাসপাতালে। ওরা মনে করছে, আমি নাকি তাঁকে ছুরি মেরেছি। ঈশ্বরের দিব্যি, আমি আমার মাকে কখনওই তা করতে পারি না।
কে বলল তোমাকে?
থানা থেকে খবরটা এসেছে। আমি আমাদের এলাকার হাসপাতালে ফোন করে জেনেছি, মাকে কাল রাতে ভরতি করা হয়েছে। মিস্টার ডি সিলভা, আপনি আমাকে বাঁচান। প্লিজ। আমি আমার মাকে স্পর্শ পর্যন্ত
করিনি। ছেলেটি বলল।
তুমি তো কাল বাড়িতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। কেউ সাড়া দেয়নি। দরজা খোলেনি। আমি চলে এসেছিলাম।
তা হলে কে ছুরি মেরেছে?
আমি জানি না।
ঠিক আছে। তুমি ড্যানিয়েলের কাছে চলে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।
থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। বলে ছেলেটি বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। ডি সিলভা অর্জুনের দিকে তাকিয়ে হাসল, খুব সুন্দর জায়গা, না? বেশ পিসফুল!
এই সময় বেন আর জো বেরিয়ে এল। বেন বলল, আমি কি যেতে পারি?
শিয়োর। ডি সিলভা বলল।
সে বাইক নিয়ে চলে যেতে জো বলল, আমার কাজ হয়ে গিয়েছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিস্টার ডি সিলভা।
ডি সিলভা বলল, নেক্সট টাইম তোমার আসার দরকার নেই। অরকে পাঠিয়ে দিয়ো। হ্যাভ এ নাইস ডে। বলে ভিতরে চলে গেল লোকটি।
দ্রুত হেঁটে ওরা টিউব স্টেশনে পৌঁছে গেল। ট্রেনে উঠে জো জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলেন? দেখার ইচ্ছে নিশ্চয়ই পূর্ণ হয়েছে?
কিছুটা। কিন্তু আপনি অত দূর থেকে এখানে ডেলিভারি দিতে কেন আসেন? ওরা তো এখানকার কোনও কুরিয়ার কোম্পানিকে পাঠাতে পারে। আপনাকেও এখানে আসার ঝুঁকি নিতে হয় না। অর্জুন বলল।
ওদের পক্ষে এখানকার কুরিয়ার ব্যবহার করা সম্ভব নয়। যে-কোনও মুহূর্তে পুলিশের হাতে চলে যেতে পারে বলে এত দূরে আমার কাছে পাঠায়। আর আমি আসি, কারণ, ওরা অনেক গুণ বেশি অর্থ দেয়। হাসল জো।
.
০৭.
খুব উত্তেজিত হয়ে মেজরের বাড়িতে ফিরে এল অর্জুন। টিউব থেকে নেমে রাস্তা নিয়ে একটু ধন্দে পড়েছিল সে। জো তাকে সাহায্য করল। বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। বেল না বাজিয়ে মেজরের দেওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুলে উপরে উঠতে উঠতে ঘড়ি দেখল সে। সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছে।
দোতলার ঘরে কেউ নেই। টেবিলে একটা চিরকুট পেপারওয়েটের নীচে রয়েছে। তাতে মেজর লিখেছেন যে, তিনি মিসেস ব্রাউনকে দেখতে যাচ্ছেন। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসবেন। কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে মাইক্রোওভেন চালু করে নিতে পারে।
অতএব এই ফাঁকা বাড়িতে স্নান সেরে মাইক্রোওভেন অন করে গরম খাবার নিয়ে টেবিলে বসল অর্জুন। বোনলেস মাংসের সঙ্গে নানান সবজি দিয়ে রান্না উপাদেয় ঝোল খেতে বেশ ভালই লাগল।
খেয়েদেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসল সে। এখনও বাইরেটা বেশ ঝকঝকে, রোদ্র সরতে অনেক দেরি। এখানে সন্ধে হয় রাত আটটার পরে। কাঠবিড়ালিগুলো একইভাবে লাফালাফি করে চলেছে।
জিম ব্রাউনের ছেলের সঙ্গে ওইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি অর্জুন। আচ্ছা, এটাকে কি কাকতালীয় বলে? তা কেন? ছেলেটি যে ব্রঙ্কসে থাকে তা তো সে আগেই শুনেছিল। হ্যাঁ, জো-এর সঙ্গে ডি সিলভার কাছে না গেলে নিশ্চয়ই ওর দেখা পাওয়া যেত না। ছেলেটির পোশাক, চালচলনে রুক্ষ ভাব থাকলেও কথা বলার সময় বোঝা যাচ্ছিল, ওর মধ্যে নরম ভাবও রয়েছে। মুখের গড়ন অবশ্য মিস্টার ব্রাউনের মতো নয়। পুলিশ ওকে আততায়ী বলে ভাবছে। মিস্টার ব্রাউন যদি স্টেটমেন্ট দেন, তা হলে সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিসেস ব্রাউন কথা বলতে পারলে পুলিশের ধারণা অবশ্যই বদলাবে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল, ডি সিলভাকে ধরলে ওই ছেলেটির কাছে পৌঁছোনো যাবে।
একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল রাস্তা ছেড়ে বাড়ির সামনে। ন্যাড়ামাথা গোলগাল এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে উপরের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারা করলেন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কার খোঁজ করছেন? এখন বাড়িতে আমি একা।
চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছি, দয়া করে দরজাটা খোলো। মেজরের গলা শুনে চমকে উঠল অর্জুন। ইনিই এতকালের চেনা মেজর? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। দৌড়ে নীচে নেমে সে চিৎকার করল, এ কী করেছেন?
কেন? শ্রাদ্ধ করলে মাথার চুল আর দাড়ি কামাতে হয়। হয় না?
আপনি সত্যি সত্যি নিজের শ্রাদ্ধ করে এলেন?
সেটা দুপুরে। এখন আমি ফ্রিম্যান, মুক্তপুরুষ। মেজর হাসলেন, এখন আমি নো-ম্যানস ল্যান্ডে রয়েছি বলে ভাবতে পারো।
নো-ম্যানস ল্যান্ড মানে?
দুটো দেশের সীমানা যেখানে শেষ হয় সেখানে কিছুটা খালি জায়গা রাখা হয়। সেই জায়গাটাকে নো-ম্যানস ল্যান্ড বলা হয়। আমি সংসার জীবন থেকে ছুটি নিয়েছি আবার পরলোকে যেতে দেরি হচ্ছে বলে এই নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?
অতিরিক্ত সুস্থ আছে। এখন এই বাড়ি, আসবাব, এমনকী এই শরীর দেখে মনে হচ্ছে এসব আমার নয়। কোনও পিছুটান নেই। আহা, কী যে আনন্দ হচ্ছে!
তা হলে শহরে আছেন কেন? পাহাড়ের নির্জনে চলে যাওয়াই তো ভাল ছিল।
পাহাড়ে নির্জনতা আছে একথা তোমাকে কে বলল? শহরে থেকেই আমি আমার চারপাশে নির্জনতা তৈরি করতে পারি। মেজর মাথা নাড়লেন।
তা হলে মিস্টার ব্রাউনের স্ত্রীকে দেখতে গেলেন কেন?
ও! তুমি এটা বুঝলে না? জিম আমাকে দেখে চমকে উঠল। প্রথমে চিনতেই পারেনি। এতে আমি আনন্দিত হলাম।
মিসেস ব্রাউনের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ইয়েস। হয়েছে। ওঁর জ্ঞান ফিরেছে। আমাকে চিনতে পারেননি, তাই কথাও হয়নি। জিমের কাছে শুনলাম উনি পুলিশকে বলেছেন, ছেলের ব্যাপারে কথা বলবে বলে একটি ছেলে তাঁর কাছে এসেছিল। সে এসে সরাসরি এক লক্ষ ডলার চায়। না দিলে ছেলেটিকে খুন করা হবে। তিনি চিৎকার করে উঠতে ছেলেটি তাঁকে ছুরি মারতে থাকে। এর পর তার কিছু মনে নেই।
তার মানে এই দাঁড়াল, আমার ধারণা সত্যি। অর্জুন হাসল।
জিমের ধারণা ভুল হওয়ায় তোমার উপর তার আস্থা বেড়ে গিয়েছে।
মেজর বললেন, ফ্রিজে কিছু খাবার ছিল। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করেছ?
হ্যাঁ।
তোমার দিনটা নিশ্চয়ই ভাল কাটেনি?
উঁহু। দারুণ কেটেছে।
কীরকম?
আমি আজ ব্রঙ্কসে গিয়েছিলাম। অর্জুন বলল।
অ্যাঁ? চোখ বড় হয়ে গেল মেজরের, তুমি একা গিয়েছ?
না। অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর জো-এর সঙ্গে আলাপ হওয়া, তার সঙ্গে ব্রঙ্কসে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে জো-কে রাজি করানো ইত্যাদি ঘটনা মেজরকে জানাল।
মেজর খুবই উত্তেজিত। বললেন, এক্ষুনি জিমকে জানানো দরকার যে, তোমার সঙ্গে ওর ছেলের দেখা হয়েছে।
দেখা হয়েছে কিন্তু পরিচয় হয়নি। তা ছাড়া উনি চাইলেই ছেলের কাছে পৌঁছোতে পারবেন না। অর্জুন বলল।
না পারুক। খবরটা দেওয়া উচিত।
মিস্টার ব্রাউন এখনও হাসপাতালে?
না। ও বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। ওর মা অসুস্থ। তাকে দেখাশোনা করতে হয়। বাড়িতে ফোন করলে পাওয়া যাবে ওকে।
মেজর চলে গেলেন ল্যান্ডলাইনে ফোন করতে। অর্জুন তাকিয়ে ছিল। মেজরের চেহারা একদম বদলে গিয়েছে। কিন্তু চেহারাই বদল হয়েছে, কথাবার্তা, উৎসাহ সব আগের মতো রয়েছে। নো-ম্যানস ল্যান্ডে থাকার কথা বলছেন। কিন্তু সেটা স্বভূমি থেকে কীসে আলাদা তা বোঝা যাচ্ছে না।
মেজর রিসিভার হাতে নিয়ে গলা তুললেন, অৰ্জুন, জিম তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। ও খুব এক্সাইটেড।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে রিসিভার নিয়ে বলল, গুড ইভনিং মিস্টার ব্রাউন!
গুড ইভনিং অ-র-জুন। আমি, আমি খুব দুঃখিত। আমি তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। এখনও চব্বিশ ঘণ্টা কাটেনি, অথচ তুমি এর মধ্যে মিরাকেল করেছ।
আমি কিছুই করিনি। আচমকাই হয়ে গিয়েছে।
আমার ছেলেকে কেমন দেখলে?
ভাল।
তুমি কথা বলার সুযোগ পাওনি?
প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝলাম, তখন সুযোগ ছিল না।
অ-র-জুন। ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা দরকার। আমার স্ত্রী ওকে ছেড়ে থাকতে পারছে না। আমার মা-ও ওকে দেখতে চাইছেন। এখন আমার মন বলছে তুমি পারবে ওকে ফিরিয়ে আনতে। তোমার পারিশ্রমিক বাবদ আমি পাঁচ হাজার ডলার কালই পাঠিয়ে দেব। এটা অগ্রিম। কাজে সফল হলে বাকি পাঁচ হাজার দেব। রাখছি। ফোন রেখে দিলেন জিম ব্রাউন।
পাঁচ হাজার ডলারে কত টাকা হয়? হিসেবটা মনে-মনে করতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, পাগল! একদম পাগল!
মেজর তাঁর কামানো গালে হাত বোলাচ্ছিলেন, একদম পাগল বলছ? অর্ধেক নয়?
আপনি ভাবতে পারেন, ভদ্রলোক কাল দু’লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দেবেন অ্যাডভান্স হিসেবে। যদি কাজ শেষ করতে পারি তা হলে আরও দু’লক্ষ দেবেন। এত টাকা পাওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এবং এই কাজের জন্যে এত পাওয়ার কোনও কারণই নেই। অর্জুন বলল।
মাথা নাড়লেন মেজর, আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গলে মুটুম্বু জাতের আদিবাসী শিশুরা যে পাথর ঘষে ঘষে মার্বেল বানিয়ে খেলত, তা একদল আমেরিকান অভিযাত্রী কৌতূহলবশে কুড়িয়ে নিয়ে এসে জানল, ওগুলো মহামূল্য হিরে। অতএব তোমার কাজের মূল্য তুমি যা নির্ধারণ করবে সেটা সঠিক না-ও হতে পারে। যাই, স্নান করে আসি। মেজর চলে গেলেন। হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন।
.
সকালে মেজরের ঘরে গিয়ে অর্জুন দেখল, তিনি গম্ভীর মুখে বসে আছেন। সে গুড মর্নিং বলতে মেজর মাথা নাড়লেন একবার।
কী হয়েছে?
বাংলায় যাকে অম্বল বলে, তাই।
অ্যান্টাসিড খেয়েছেন?
না। এই শরীর যেমন অম্বল তৈরি করেছে তেমনই তার দায়িত্ব সেটা দূর করা। বাইরে থেকে ওষুধ পাঠিয়ে তাকে সাহায্য করব না।
কেন?
শ্রাদ্ধের পর এই শরীর সম্পর্কে কোনও মোহ না থাকাই উচিত।
জল খান। তিন-চার গ্লাস। জল ওষুধ নয়।
মাথা নাড়লেন মেজর, সেটা খাওয়া যেতে পারে।
আমি ভাবছি, মিসেস ব্রাউনকে দেখতে যাব। কীভাবে যাব?
মার্টিনকে বলো। ও গাড়ি ড্রাইভ করবে।
টিউবের রুটটা কী?
আহা, গাড়িটা তো পড়েই আছে। ওটা নিয়ে যাও।
মার্টিন এককথায় রাজি। অতএব চা খেয়ে রওনা হল ওরা।
.
০৮.
হাসপাতালের পার্কিং-এ গাড়ি পার্ক করে মার্টিন বলল, আমি এখানেই থাকি। ভিতরে গিয়ে তো কিছুই করার নেই। এখানে দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।
অতএব একাই রিসেপশনে গিয়ে মিসেস ব্রাউনের খোঁজ নিল অর্জুন। সুন্দরী বললেন, আপনার নাম আর আই ডি দেখান। মাত্র তিনজন গেস্টকে ওঁর কাছে যেতে অ্যালাউ করা হচ্ছে।
অর্জুন তার পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল। সুন্দরী সেটা দেখেকম্পিউটারের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বললেন, লিটে তিনতলায় চলে যান।
তিনতলায় লিট থেকে বের হতেই এক সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, অ-র-জু-ন?
অর্জুন মাথা নাড়তে লোকটি দু’হাত দিয়ে ওর পোশাক, শরীর সার্চ করল। কিছু না পেয়ে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
একটা কেবিনে প্রৌঢ়া শুয়ে আছেন। তার কাঁধে-হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সিকিউরিটির লোকটি বলল, আপনার গেস্ট। অ-র-জুন।
ও। আপনার কথা জিম বলছিল! ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে কথা বলছেন। বোঝা গেল তিনি এখনও অসুস্থ।
মিস্টার ব্রাউন আসেননি?
মাথা নাড়লেন মহিলা, আমার শাশুড়ি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
উনি কি আপনাকে বলেছেন যে, আমি আপনার ছেলেকে দেখেছি?
হ্যাঁ। কী বলে ধন্যবাদ জানাব আপনাকে? আপনি ওকে যেমন করে হোক আমার কাছে নিয়ে আসুন। কাতর চোখে তাকালেন ভদ্রমহিলা।
চেষ্টা করব, কথা দিচ্ছি। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি সব কথা পুলিশকে বলেছেন? পুলিশ নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে?
হ্যাঁ। বলেছি। জিম বোধহয় আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।
যে ছেলেটি আপনাকে ছুরি মেরেছিল তাকে মনে আছে?
মাথায় খাড়া হয়ে থাকা রঙিন চুল। হাত কাটা জ্যাকেট। হাতে সাপের উল্কি আঁকা। বেশি বয়স নয়। চোখ বন্ধ করলেন মহিলা।
সঙ্গে সঙ্গে ডি সিলভার সঙ্গে দেখা করতে আসা বেনের মুখ মনে পড়ে গেল অর্জুনের। মিসেস ব্রাউনের বর্ণনার সঙ্গে বেনের যথেষ্ট মিল।
দূরে দাঁড়ানো সিকিউরিটির লোক এগিয়ে এসে বলল, এবার ওঁকে বিশ্রাম নিতে দিন, প্লিজ।
লিফটে উঠল অর্জুন। সেটা দোতলায় এসে থেমে গেল। দরজা খুলল। দু’জন মানুষ লিফটে ঢুকলেন। অর্জুন অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেল, আপনি?
লিফ্ট ততক্ষণে একতলায় নেমে এসেছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়েই হেসে ফেলল, আরে! আপনি!
আপনি এখানে কী করছেন? লিজা ক্লিন্টন অর্জুনের হাত ধরে বেরিয়ে এল, এভাবে আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি।
আমি আমার এক পরিচিত ভদ্রমহিলাকে দেখতে এসেছিলাম। আপনি?
আপনাকে যে বৃদ্ধার কথা বলেছিলাম তাঁকে দেখতে এসেছিলাম। আপনি শুনলে খুশি হবেন, উনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। লিজা বলল।
বাঃ। বেশ ভাল খবর। অর্জুন বলল, আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে?
হ্যাঁ। আমি ওঁকে সব কথা বলেছি।
শুনে ওঁর কী প্রতিক্রিয়া হল?
আমাকে খুব বকলেন। বললেন, কাজটা খুব অন্যায় হয়েছে। ওঁর ভাইপো যদি বুদ্ধিমান হত তা হলে উনি খুন হয়ে যেতেন। তা নয় বলে এখন শুধু তার পা ভেঙেছে। আমি বললাম, উনি পুলিশকে ডেকে সব কথা জানিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বৃদ্ধা রাজি হলেন না। বললেন, যেহেতু আমি তাকে নিজে থেকে সব জানিয়েছি তাই তিনি ক্ষমা করে দিচ্ছেন। লিজা হাসলেন, এখন
অনেক হালকা লাগছে।
ওঁর ভাইপো, যিনি আপনাকে বিয়ে করতে চান, তাঁর খবর কী?
তার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। লিজা কাঁধ নাচালেন।
কথা বলতে বলতে ওঁরা হাসপাতালের বাইরে চলে এসেছিলেন। লিজা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় উঠেছেন?
কুইন্সের ইউনিয়ন টার্নপাইকে।
আত্মীয়ের বাড়িতে?
না। তার চেয়েও বেশি, একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের বাড়িতে।
লিজা অবাক হয়ে তাকালেন, কোনও ফোন নাম্বার?
এই রে। ওটা তো জানতে চাইনি। হাতব্যাগ খুলে একটা চিরকুটে নিজের নাম্বার লিখে এগিয়ে ধরলেন লিজা, এটা রাখুন। আশা করি আমাকে ফোন করবেন। আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?
লং আইল্যান্ডে। কোনও কাজ করার না থাকলে যেতে পারেন।
একটু ভাবলেন লিজা। তারপর বললেন, বেশ। কিন্তু আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে?
হ্যাঁ।
তা হলে আমাকে ফেরার সময় একটা টিউব স্টেশনে নামিয়ে দেবেন যেখান থেকে আমি ব্রুকলিনে যেতে পারি। আমি ওখানেই থাকি।
লং আইল্যান্ড থেকে ব্রুকলিন কতটা দূর?
টিউবে বেশি সময় লাগে না।
মার্টিনের সঙ্গে লিজার আলাপ করিয়ে দিয়ে অর্জুন বলল, সে মিস্টার ব্রাউনের বাড়িতে যেতে চায়। সে কি বাড়িটা চেনে?
মার্টিন বলল, সে এর আগে মিস্টার মেজরকে নিয়ে দু’বার ওই বাড়িতে গিয়েছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে মার্টিন বলল, অ-র-জুন, ওই ছেলেটি আজও এসেছিল। তবে একা নয়, সঙ্গে একটা কালো ছেলে ছিল।
কোন ছেলেটি?
যে কাল সিকিউরিটির তাড়া খেয়ে বাইকে চড়ে পালিয়েছিল।
ওরা কি ভিতরে ঢুকেছিল?
ছেলেটি ঢোকেনি। ও যাকে এনেছিল সে ঢুকেছিল। কিন্তু মিনিট চারেকের মধ্যে বেরিয়ে এসে ছেলেটির সঙ্গে চলে গেল।
তুমি সিকিউরিটিকে জানালে না কেন?
কালকের সিকিউরিটির লোকরা আজ ডিউটিতে ছিল না। আমি তাদের বলতে গেলে ওরা কিছুই বুঝত না। গাড়ি চালাতে চালাতে মার্টিন বলল।
লিজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
আমরা যে ভদ্রলোকের বাড়িতে যাচ্ছি তার স্ত্রীকে একটি ছেলে ছুরিতে আহত করেছিল। সেই ছেলেটিকে গত দু’দিন হাসপাতালে আসতে দেখা যাচ্ছে। অর্জুন বলল।
সর্বনাশ! আপনারা পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?
হ্যাঁ। এটা জানানো দরকার।
ছেলেটি কি ভদ্রমহিলার চেনা?
না। ও এসেছিল ব্রঙ্কস থেকে।
মাই গড। চোখ বন্ধ করলেন লিজা।
কী হল? অর্জুন তাকাল।
ওখানকার ছেলেরা ডেঞ্জারাস হয়। পুলিশ ওদের নিয়ে নাজেহাল!
.
জিম ব্রাউন লিজাকে দেখে অবাক হলেন। অর্জুন লিজার পরিচয় দিল, আমার সঙ্গে প্লেনে আলাপ। আজ আবার দেখা হয়ে গেল হাসপাতালে। মিসেস ব্রাউন বললেন, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন?
হ্যাঁ। আমি একটু আগে তোমাকে ফোন করেছিলাম। মেজর বললেন, তুমি হাসপাতালে গিয়েছ। অ-র-জুন, আমার মা খুব অসুস্থ। উনি নাতিকে দেখতে চান। নাতির কথা ভেবে ভেবেই ওঁর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বলে মিস্টার ব্রাউন একটা টেবিলের ড্রয়ার খুলে খাম বের করলেন। সেটা অর্জুনের দিকে এগিয়ে ধরলেন, নাও।
কী?
তোমাকে বলেছিলাম, আজ অগ্রিমবাবদ এটা দেব।
মাথা নাড়ল অর্জুন, মিস্টার ব্রাউন। ওটা আপাতত রেখে দিন। আমি এই শহরে নতুন। আমার কোনও ক্ষমতাও এখানে নেই। এদেশে এসেছি টুরিস্ট হিসেবে। তাই আমার প্রফেশনাল কাজ এদেশে করে আমি পারিশ্রমিক নিতে পারি না।
কিন্তু!
এদেশের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে সতর্ক করে বলা হয়েছে যেন কোনও সমস্যা হলে পুলিশকে জানাই, নিজে কিছু না করি। অর্জুন হাসল, আজ আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সিকিউরিটি অফিসারের জন্যে বেশি কথা বলতে পারিনি। আততায়ী ছুরি মারার আগে ওঁকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছিল?
খামটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিয়ে মিস্টার ব্রাউন বললেন, হ্যাঁ। ও আমার ছেলের নাম করে পাঁচ হাজার ডলার চেয়েছিল। না দিলে নাকি আমার ছেলে খুব বিপদে পড়বে। আমার স্ত্রী তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চেয়েছিল। তখন তর্ক শুরু হয়। সেই সময় ছেলেটি ছুরি মারে। মাথা ঠান্ডা রেখে আমার স্ত্রী আহত অবস্থাতেই মেঝেয় পড়ে গিয়ে এমন ভান করে, যাতে ছেলেটি ভেবে নেয় যে, ও মারা গিয়েছে। ভয় পেয়ে সে পালায়।
লিজা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, ওই ছেলেটির ব্যাপারে কিছু করা উচিত।
অর্জুন তখন ব্রঙ্কসের ছেলেটির পরপর দু’দিন হাসপাতালে আসার কথা মিস্টার ব্রাউনকে জানিয়ে বলল, আপনি পুলিশকে জানান, যাতে মিসেস ব্রাউনের আর কোনও বিপদ না হয়।
মিস্টার ব্রাউন তড়িঘড়ি টেলিফোনে পুলিশকে ব্যাপারটা জানালেন। পুলিশ তাকে আশ্বস্ত করল, তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ফোন রেখে মিস্টার ব্রাউন বললেন, এই ছেলেটি আমাদের ক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেল! অথচ আমি জানিই না এই বাড়িতে সে নিয়মিত আসত। রাতে আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতাম তখন আমার স্ত্রী তাকে দরজা খুলে দিত। আমার মাও তাঁর নাতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তার জন্যেই আমার স্ত্রী ছেলেটিকে বাড়িতে ঢুকতে দিত। অথচ এসবের বিন্দুবিসর্গ আমি জানতাম না।
ওঁরা, মানে আপনার স্ত্রী এবং মা ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনেননি কেন?
নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি। সব প্রাণী কি পোষ মানে? মিস্টার ব্রাউন বললেন, কিন্তু পুলিশ যেই জেনেছে যে, আমার ছেলে আততায়ী নয়, অমনই তার সম্পর্কে ওদের আর কৌতূহল নেই। ওরা খুঁজে বের করবে কে আততায়ী?
আততায়ী যে ব্রঙ্কসের ছেলে তা কি ওরা জানে?
না। আমি বলতে পারিনি তুমি ওকে ব্রঙ্কসে দেখেছ। তা হলে পুলিশ জানতে চাইবে তুমি কে এবং কেন ব্রঙ্কসে গিয়েছিলে? তোমাকে নিয়ে পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করত। সেটা শুরু হলে তোমার কাছ থেকে আমি কোনও সাহায্য পেতাম না। আততায়ীর চেহারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, মোটরবাইক ব্যবহার করে সে। এবার পুলিশ তাকে খুঁজে বের করুক। মিস্টার ব্রাউন বললেন।
মাথা নাড়ল অর্জুন, আপনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারি?
ওঁর শরীর খুব খারাপ। কথা বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।
তবু!
এসো।
মার্টিন বাড়ির ভিতর ঢোকেনি। বাইরে গাড়িতে রয়েছে। অর্জুন এবং লিজা মিস্টার ব্রাউনকে অনুসরণ করলেন। দোতলায় উঠে অর্জুনের জানা ঘরটিতে ঢুকলেন মিস্টার ব্রাউন। ভিতরে ঢুকে ওঁরা দেখলেন, বৃদ্ধা চিত হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর গলা পর্যন্ত একটা চাদরে ঢাকা।
মম। ফিসফিস করে ডাকলেন মিস্টার ব্রাউন।
একটু ফুঁপিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। মিস্টার ব্রাউন বললেন, আমরা খুব চেষ্টা করছি। ও ভাল আছে। অর্জুন ওকে দেখেছে। অর্জুনকে ইশারা করলেন মিস্টার ব্রাউন।
অর্জুন বলল, আপনি বিশ্বাস করুন, আপনার নাতিকে কাল দেখেছি। বৃদ্ধা নড়লেন না। তিনি দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলেন। জিম ব্রাউন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মম, হি ইজ হেলপিং আস। তুমি কিছু বলো।
বৃদ্ধা ফুঁপিয়ে উঠলেন, ব্রিং হিম ব্যাক। প্লিজ!
.
নীচে নেমে এসে অর্জুন মিস্টার ব্রাউনকে বলল, ব্রঙ্কসের পুলিশকে বলুন ছেলেটি ওখানেই আছে। ওকে ‘বেন’ বলে সবাই ডাকে।
কী করে বলব? বললেই তো জানতে চাইবে খবরটার সোর্স কী?
অর্জুন হাসল, বলবেন, একটা উড়ো ফোন এসেছিল। সেই ফোনে আপনি জেনেছেন।
জিম ব্রাউন মাথা নাড়লেন, কিন্তু তুমি কি কোনও প্ল্যান করেছ?
ভাবছি। দেখুন, গতকাল ওখানে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, আমার মতো বাইরের লোককে কেউ ঢুকতেই দেবে না। আমার কথা ওরা ভাল বোঝে না, ওদের কথা আমি আন্দাজে বুঝি। উচ্চারণই দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। দেখি, আর একটু ভাবি। অর্জুন বলল।
.
ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডের সামনে মার্টিন লিজার কথামতো গাড়ি থামাল। লিজা বললেন, আমি কি আপনাকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসতে বলতে পারি?
নিশ্চয়ই। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই। এখান থেকে কুইন্স নিশ্চয়ই বেশ দূর।
অর্জুন বলতেই মার্টিন মাথা নাড়ল, এক ঘণ্টার বেশি লাগবে।
লিজা বললেন, আপনার ফোন নাম্বারটা জানা থাকলে ভাল হত।
অর্জুন মার্টিনের দিকে তাকালে সে মেজরের নাম্বারটা বলে দিল। সেলফোনে নোট করে নিলেন লিজা।