০৪.
জিম ব্রাউনের গাড়িটি বেশ আরামদায়ক। জিম গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে মেজর। পিছনে বসে অর্জুন ভাবল, এত দামি গাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জিম ড্রাইভার রাখেননি। গতবারই শুনেছিল অতিরিক্ত বিত্তবান না হলে এদেশে কেউ ড্রাইভারের খরচ মেটাতে পারে না। ভারতবর্ষ হলে জিম কখনও ড্রাইভারের সিটে বসতেন না।
এখন সন্ধে নামব নামব করছে। এই সময় ডিনারের কথা জলপাইগুড়িতে অতি নিয়মনিষ্ঠ মানুষও ভাবেন না। সাহেবদের ব্যাপারই আলাদা। মাঝরাতে খিদে নিশ্চয়ই ঘুম ভাঙাবে। আমেরিকায় গাড়ি চালানো কোনও কঠিন কর্ম নয়। ক্ল্যাচ নেই। ব্রেক আর অ্যাক্সিলেটারের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেই হল। সেইসঙ্গে রাস্তার নিয়মটা জানতে হবে। জিম বোধহয় ম্যানহাটনের উলটো দিকে ওঁদের নিয়ে যাচ্ছেন। প্রচুর গাড়ি সামান্য ব্যবধান রেখে ছুটছে, লাল আলো দেখলেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এর আগেরবার সে পাতালরেলে বেশি ঘুরেছিল। তাতে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছোনো যায় বটে, কিন্তু মাটির উপরের শহরটাকে চেনা যায় না।
বড় রাস্তা থেকে গাড়ি চলে এল সরু পথ ধরে যেখানে একটা বিশাল লেক, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নামতেই নিয়ন সাইন চোখে পড়ল, ওয়াটার ফ্রন্ট রেস্টুরেন্ট।
জিম বললেন, চলো, এটা আমার প্রিয় জায়গা।
ওয়েটাররা জিমকে চেনে। পরম সমাদরে কাঁচের দেওয়ালের পাশে সাজানো টেবিলে একজন নিয়ে গেল ওঁদের। কাঁচের ওপাশেই জল। বেশ চওড়া এই জলাশয়ের উপরে আলো জ্বলছে পরপর। তার আলো পড়েছে। জলে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। অর্জুন বলল, বিউটিফুল!
খুব খুশি হলেন জিম। জানলার ধারের দুটো চেয়ার মেজর এবং অর্জুনকে ছেড়ে দিয়ে বসে বললেন, আমি এখানে প্রায়ই ডিনার খেতে আসি। ওই জলের বুকে ভাসতে থাকা আলোগুলো দেখতে-দেখতে দিব্যি সময় কেটে যায়।
ওয়েটার এগিয়ে এলে জিম বললেন, তুমি কী নেবে? স্কচ অর বিয়ার? মেজর তো এখন এসব খায় না, আমরাই একটু খাই। কী বলো?
অর্জুন চমকে গেল। সে মেজরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। যে মেজর পান না করে থাকতেন না, পকেটে চ্যাপটা ছোট বোতল সব সময় রাখতেন, তিনি অভ্যেসটা ছেড়ে দিয়েছেন? কী করে সম্ভব হল?
অর্জুনকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেজর বললেন, বুদ্ধিমান মানুষরা অবাক হয় না, প্রয়োজনে অবাক হওয়ার ভান করেন। কী খাবে বলে দাও।
কৌতূহল দমন করে অর্জুন জিমকে বলল, আমাকে একটা লেমন স্কোয়াশ দিতে বলুন। খুব বেশি ঠান্ডা যেন না হয়।
মাথা নেড়ে জিম ওয়েটারকে পানীয় এবং ডিনারের মেনু জানিয়ে বিদায় করে মেজরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি এখনই কাজের কথা শুরু করব?
মেজর বললেন, দেরি করার কি কোনও কারণ আছে?
জিম একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, না। আগে ডিনারটাই আরাম করে খাওয়া যাক। আমি কাল সকালে ওর সঙ্গে কথা বলব। তুমি কি আমার অফিসে আসতে পারবে? পকেট থেকে পার্স বের করে কার্ড এগিয়ে দিলেন জিম।
নিশ্চয়ই। অর্জুন বলল।
বাঃ। তা হলে সকাল এগারোটায় চলে এসো।
কার্ডে চোখ বুলিয়ে পকেটে রেখে দিল অর্জুন। ব্রুকলিনের ঠিকানা। জায়গাটা মেজরের বাড়ি থেকে কীভাবে যেতে হয় জেনে নিতে হবে।
ডিনার যখন মাঝামাঝি অবস্থায় তখন সেলফোন শব্দ করতে লাগল। বেশ বিরক্ত হয়ে সেটটাকে অন করে ওদিকের কথা না শুনে জিম বললেন, আমি এখন ডিনার টেবিলে। খুব দরকার হলে ঘণ্টাখানেক পর কল করবেন। লাইনটা কেটে দিলেন জিম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার ওটা বেজে উঠল। জিম ফোনটা অন করলেন না। বেজেই চলেছে দেখে মেজর হাত বাড়িতে ওটা তুলে নিতে জিম বললেন, প্লিজ, আমাকে কথা বলতে বলবে না। লোকটি অভদ্র, এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারল না?
মেজর লাইনটা অন করে বললেন, হ্যালো! কে বলছেন?
জবাবটা তিনি শোনামাত্র লাউডস্পিকার অন করে দিলেন, সরি, কে বলছেন বললেন?
এবার গলা শোনা গেল, আমি সার্জেন্ট গোল্ডস্মিথ বলছি। আপনি এখনই আপনার বাড়িতে চলে আসুন। আপনার বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
শোনামাত্র মেজরের হাত থেকে সেলফোন ছিনিয়ে নিয়ে জিম ব্রাউন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কী দুর্ঘটনা ঘটেছে?
আপনি মিস্টার ব্রাউন?
অফকোর্স, আমি জিম ব্রাউন।
আপনার স্ত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে।
আমি আসছি, এখনই আসছি। অফিসার, ও বেঁচে আছে তো?
এখন পর্যন্ত আমরা কোনও খারাপ খবর পাইনি।
সেলফোন অফ করে অর্জুনের দিকে তাকালেন জিম। খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল তাকে। ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছতে গিয়ে হাত কাপল। বললেন, আমাকে এখনই যেতে হবে। তোমাদের ডিনারটা নষ্ট করার জন্যে দুঃখিত। তোমরা খাওয়া শেষ করো। ওয়েটার! গলা তুলে ওয়েটারকে ডাকতে সে কাছে। এলে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফর্মালিটিস শেষ করো। আমাকে যেতে হবে।
ওয়েটার কার্ড নিয়ে চলে গেলে মেজর বললেন, তোমার এই বিপদের সময় আমরা তোমার দেওয়া ডিনার খেতে পারি না জিম। কিন্তু তোমার স্ত্রীকে কে আহত করল? কেনই বা করল?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ এখানে ডিনার খাওয়ার প্ল্যান তো আগে ছিল না, থাকলে ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতাম। ওর যদি… উঃ, আমি পাগল হয়ে যাব। আমি কল্পনা করতে পারছি না মেজর! উঠে দাঁড়ালেন জিম ব্রাউন।
অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। এবার সে মেজরকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওঁর বাড়িতে যাবেন? আমার মনে হচ্ছে যাওয়া দরকার।
মেজর আপত্তি করলেন না। জিমের একটু কুণ্ঠা ছিল। তার মনে হচ্ছিল, একে তো রাতের খাওয়া নষ্ট হল, তার উপর অত দূরে নিয়ে যাওয়া মানে কষ্ট দেওয়া। কিন্তু অর্জুনের কথা শুনে না বলতে পারলেন না।
মেজরের অনুরোধে স্পিড বাড়াতে গিয়েও বাড়ালেন না জিম। তার মনে হচ্ছিল, যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছোতে পারবেন তত মঙ্গল। কিন্তু মেজর মনে করিয়ে দিলেন, এখন জিমের আস্তে গাড়ি চালানো উচিত। মনের উপর যে চাপ পড়েছে তা সামলে জোরে চালালে বিপদ ঘটতে পারে।
অর্জুন দেখল, নিউ ইয়র্কে এখন রাত নেমেছে। নানান ধরনের গাড়ি ছুটছে। কিন্তু রাস্তা শব্দহীন। কোনও গাড়ি থেকেই হর্নের আওয়াজ বের হচ্ছে না। দেশের ড্রাইভাররা যে কেন এটা শেখে না? হঠাৎ তার চোখ বড় হল। অন্ধকারেও সে বুঝতে পারল, তারা একটা সমুদ্রের ধার দিয়ে যাচ্ছে। এই শহরের বুকের কাছে সমুদ্র আছে তা জানা ছিল না তার। সে মেজরকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী সমুদ্র?
অতলান্তিক। মেজর সামনের সিটে বসে জবাব দিলেন।
অর্জুনের মনে পড়ল। কোথায় যেন পড়েছিল, পৃথিবীর সব সমুদ্রের মধ্যে অতলান্তিক হল সবচেয়ে ভয়ংকর। একটু পরে সমুদ্র থেকে সরে এল গাড়ি। অর্জুন ভেবে রাখল, একদিন দিনের বেলায় ওই সমুদ্র দেখতে হবে।
কিছুটা যাওয়ার পর মেজর মুখ ঘুরিয়ে বললেন, নিউ ইয়র্কের এই অঞ্চলটার নাম লং আইল্যান্ড। বড়লোকদের পাড়া বলতে পার।
কথাগুলো বাংলায় বললেন বলে জিম মানে বুঝতে পারলেন না। অবশ্য তিনি এখন অভ্যেসে গাড়িটা চালাচ্ছেন, মন পড়ে আছে পুলিশের দেওয়া খবরে।
এগজিট দিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে ভিলেজ রোডে চলে এল গাড়ি। কিছুদূর যেতেই গাড়ির গতি কমে এলে অর্জুন দেখল, একটা বিরাট একতলা বাড়ির লনের পাশে দুটো পুলিশের গাড়ির ছাদে আলো জ্বলছে নিভছে। হাট করে খোলা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পুলিশের গাড়িগুলোর পাশে গাড়ি পার্ক করলেন জিম! তারপর গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত বাড়ির দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। মেজর এবং অর্জুন গাড়ি থেকে নেমে ওঁকে অনুসরণ করতে গিয়েও পিছিয়ে পড়লেন। অর্জুন দেখল, বিশাল লনে জোরালো আলো ছড়িয়ে আছে। লনের চারপাশে ফুলের গাছ, জিম সত্যি ধনী ব্যক্তি।
ওঁরা দরজায় গিয়ে দেখলেন, দু’জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বেশ উত্তেজিত হয়ে জিম কথা বলছেন। মোটামুটি লম্বা চেহারার অফিসার বলছেন, আপনি শান্ত হন। এখন হাসপাতালে গেলে কোনও লাভ হবে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ওরা দেখা করতে দেবে না। আমি লাইনটা ধরে দিচ্ছি, আপনি কথা বলে দেখুন।
সেলফোনে লাইন ধরে জিমকে দিলেন অফিসার। জিম বললেন, আমি জিম ব্রাউন। একটু আগে আমার স্ত্রীকে আহত অবস্থায় পুলিশ আপনাদের হাসপাতালে ভরতি করেছে। আমি তাকে দেখতে এখনই আসতে পারি কি?
ওপাশের কথা শুনে মাথা নাড়লেন জিম, ও হো! ও কেমন আছে?
সেটা শোনার পর জিম ভেঙে পড়লেন, আই সি ইউ-তে আছে। ও বাঁচবে তো? প্লিজ, আমাকে মিথ্যে বলবেন না।
উত্তরটা শুনে মাথা নাড়লেন। ঠোঁট টিপে কান্না সামলে টেলিফোন রেখে দিয়ে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন।
মোটাসোটা অফিসার এবার মেজরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওয়েল, জেন্টলম্যান, আপনাদের পরিচয় জানতে পারি?
মেজর আমেরিকান উচ্চারণে বললেন, আমি জিমের বন্ধু। এই ছেলেটি আমার গেস্ট। আমরা যখন ওয়াটার ফ্রন্টে ডিনার করছিলাম তখন ওর কাছে খবরটা পৌঁছেছিল। ওর এই বিপদে ওকে একলা ছেড়ে দিতে চাইনি।
ও কে। আমি সার্জেন্ট গোল্ড স্মিথ। চল্লিশ মিনিট আগে আমি এই রাস্তায় ডিউটিতে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, এই বাড়ি থেকে একটা বাইক তীব্র গতিতে বেরিয়ে উলটো দিকে চলে গেল। আমি বাইকটাকে চেজ করতে পারতাম অত জোরে চালানোর জন্যে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এই বাড়ির ভিতরে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। ভাগ্যিস সেটা মনে হয়েছিল, না হলে আমরা মিসেস ব্রাউনকে অত তাড়াতাড়ি হসপিটালাইজ করতে পারতাম না। ওঁর পিঠে, কোমরে, কাঁধে ছুরি মারা হয়েছে। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছিল এবং ওঁর জ্ঞান ছিল না। যে ছুরি দিয়ে ওঁকে মারা হয়েছে, ছুরিটাকে আততায়ী এখানে ফেলে যায়নি। এই বাড়িতে আর-একজন বৃদ্ধা থাকেন। তার কত বয়স হয়েছে জানি না, কিন্তু ভাল করে কথা বলতে পারেন না। তাকে জিজ্ঞেস করে একমাত্র ওঁর সেলফোন নাম্বার ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। নাম্বারটা বৃদ্ধার সেলফোনেই ছিল। তিনি কোনও চিৎকার, চেঁচামেচি শুনতে পাননি।
মাথা নাড়লেন জিম, আমার মা, এখন একদম শুনতে পান না।
মিস্টার ব্রাউন, আপনি আজ কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?
লাঞ্চের পরে। কয়েকটা কাজ শেষ করতে বিকেল হয়ে গেল। তখন মেজরের কাছে গিয়েছিলাম। স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলাম, ফিরতে রাত হতে পারে। জিম বললেন।
আপনার বা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল?
ওর মতো নিরীহ মানুষের কোনও শত্রু থাকতে পারে না।
আপনি এই কাজটা কার হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন?
অফিসার, বিশ্বাস করুন, আমি ভাবতে পারছি না।
আপনার ছেলেমেয়ে?
মেয়ে ওয়াহিও ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। ওর স্বামীও ওখানকার প্রোফেসর। ছেলে কোথায় আছে তা আমি জানি না। জিম মাথা নাড়লেন।
ছেলের সঙ্গে আপনার এখন সম্পর্ক নেই?
হ্যাঁ। ও বাজে সংস্পর্শে পড়েছিল। স্কুলের পর পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিল। আমি ওসব পছন্দ না করায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ও আমাদের বেশি বয়সের সন্তান। দিদি এবং ভাই-এর বয়সের পার্থক্য অনেক।
ইদানীং কি ও আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে?
আমি জানি না। ওর মা আমাকে কিছু বলেনি।
ওর একটা ফোটো আমাদের চাই। না, না, এখনই দিতে হবে না। কাল সকালে দিলেই হবে। বুঝতেই পারছেন, ওকেও কিছু প্রশ্ন করা দরকার।
সার্জেন্টের কথা শুনে জিম মাথা নাড়লেন, কিন্তু ওর এখনকার ফোটো তো এই বাড়িতে নেই। স্কুল থেকে বেরোবার সময় ওর মায়ের সঙ্গে ফোটো তুলেছিল। সেই চেহারা নিশ্চয়ই বদলে গিয়েছে এতদিনে। সেটা যদি কাজে লাগে তা হলে দিতে পারি।
সেটাই নেবেন জানিয়ে সার্জেন্ট তার সঙ্গী অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পুলিশের দুটো গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, মনে হল, তুমি ওদের সত্যি কথা বললে না জিম!
জিম চুপ করে থাকলেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, হাসপাতাল কী বলল?
একটু পরে ওর জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করছে। জ্ঞান ফিরলে, কন্ডিশন স্টেবল হলে কাল সকালে অপারেশন করবে। আমাকে সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যে যেতে হবে। উঃ, আমি ভাবতেই পারছি না। জিম উঠে দাঁড়ালেন।
অর্জুন এতক্ষণে কথা বলল, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ছেলে কী কথা বলত তা সত্যি আপনি জানতেন না?
জিম অর্জুনের দিকে তাকালেন, হা, জানতাম। আমি ওকে নিষেধ করেছিলাম ছেলের ফোন এলে কথা বলতে।
কেন? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
টম চাইত আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। দীর্ঘকাল দেখা না হওয়ায় আমার স্ত্রী ওর প্রস্তাবে দুর্বল হয়ে পড়ত। আমার জন্যে কিছু বলতে পারত না।
কেন দেখা করতে চাইত? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
কেন আবার? মায়ের কাছ থেকে যদি পাঁচ-দশ হাজার ডলার পাওয়া যায় তা হলে কিছুদিন মজায় কাটাতে পারবে।
ও কি মায়ের কাছে টাকা চাইত?
আমি সন্দেহ করি, যদিও আমার স্ত্রী কখনও সেরকম কথা বলেনি?
তা হলে আপনি কী মনে করেন, ছেলেই তার মাকে ছুরি মেরেছে?
আমি কী করে বলব? তখন তো আমি সামনে ছিলাম না।
মেজর চেয়ারে বসলেন, কিন্তু জিম, এসব কথা তুমি পুলিশকে বললে না কেন? কাকে সন্দেহ হয় জিজ্ঞেস করেছিলেন অফিসার। তুমি ছেলের নাম বলোনি। যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা তুমি আমাকে বললে, তা পুলিশকে জানানো তোমার কি কর্তব্য ছিল না?
মেজর আমার সন্দেহের কথা পুলিশকে জানালে ওরা আজ না হয় কাল ঠিক ওকে ধরে ফেলত। যদি এই কাজটা ও না করে থাকে তা হলে আমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে ফিরে এসে যখন শুনত, আমার সন্দেহের কারণে ছেলে জেলে ঝুলছে, তা হলে খুব ধাক্কা খেত। আমাকে দায়ী করত। জিম বললেন।
ও যদি খুনের চেষ্টা করে থাকে তা হলে নিশ্চয়ই ধাক্কা খেতেন না। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, সেক্ষেত্রে ছেলের শাস্তি চাইতেন তিনি।
আমি জানি না, আমাকে আগে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কাল সকালে যদি ওর সেন্স ফিরে আসে, ডাক্তার যদি কথা বলার অনুমতি দেয়! জিম ক্লান্ত গলায় বললেন।
মেজর চলে গেলেন ল্যান্ডলাইনের টেলিফোনের কাছে। রিসিভার তুলে নাম্বার ডায়াল করে জিমের বাড়ির ঠিকানা বলে ট্যাক্সি পাঠাতে বললেন।
জিম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
ও! আমি তোমাদের পৌঁছে দিতে পারছি না। আমি সত্যি দুঃখিত। আবার এই রাতে বাড়িতে একা থাকতেও স্বস্তি বোধ করছি না। আই ডোন্ট নো, যে খুন করতে চেয়েছিল সে যদি আবার ফিরে আসে? জিম নিচু গলায় বললেন।
মেজর এগিয়ে গিয়ে ওঁর কাঁধে হাত রাখলেন, তুমি পুলিশকে বলো…!
নাঃ। হয়তো আমি ভুল ভাবছি! ও কে!
মিস্টার ব্রাউন, অর্জুন এগিয়ে এল, আমি যদি আজকের রাতটা এই বাড়িতে থাকি তাতে কি আপনার আপত্তি আছে?
প্রস্তাবটা শোনামাত্র মুখে হঠাৎ আলো ফুটল জিমের, তুমি থাকবে? ওঃ, আই উইল বি হাইলি অবলাইজড।
এই সময় গাড়ির হেডলাইট এসে পড়ল বাড়ির উপর। মেজর বললেন, ঠিক আছে। অর্জুন, তুমি এখানেই থেকে যাও। কাল সকালে একটা ট্যাক্সি নিয়ে না-হয় কুইন্সে চলে এসো। মেজর এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। তার ট্যাক্সি এসে গিয়েছে।
আমেরিকার বাড়িগুলোর দেওয়াল ইটের নয়। পাতলা কাঠের। বাড়ির দরজাও পলকা। ঠেললে খুলবে না, কিন্তু একটু বেশি শক্তি প্রয়োগ করলে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ধরেই নেওয়া হয় দরজা বন্ধ দেখেও যারা বেশি শক্তি প্রয়োগ করে তারা অপরাধী। এই কারণে দরজায়, জানলায় অ্যালার্ম লাগানো হয়। শক্তি প্রয়োগ করলেই যন্ত্র এমন জানান দেয় যে, প্রতিবেশীরা
তো বটেই, পুলিশও ছুটে আসে। এদেশে বাড়ি তৈরি হয় বড়জোর ষাট বছরের জন্যে। একজন তিরিশ বছর বয়সি মানুষ সেই বাড়ি কিনলে গোটা জীবন চমৎকার কাটিয়ে দিতে পারে। কখনও ছেলেমেয়ে, নাতির কথা ভেবে শক্তপোক্ত বাড়ি তৈরির কথা ভাবা হয় না।
দরজা বন্ধের পর অ্যালার্ম চালু করে দিয়ে জিম জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রিজে কিছু খাবার আছে, তাই গরম করে দিই। তোমার তো ডিনার অর্ধেকও করা। হয়নি।
অর্জুন মাথা নাড়ল, এখনই দরকার নেই।
বেশ। এই বাড়িতে বেডরুম চারটে। নীচে গেস্টরুম, লিভিংরুম; হল, কিচেন। এসো আমার সঙ্গে। জিম একটা ছোট সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন, পিছনে অর্জুন।
মাঝখানে সুন্দর কার্পেট মোড়া ফাঁকা ঘর। দু’পাশে চারটে বেডরুম।
বাঁ দিকের শেষ দরজাটা খুললেন জিম। ভিতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে অর্জুন দেখল, জিম গিয়ে বসেছেন বিছানার একপাশে। আর তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক বৃদ্ধা কেঁদে কেঁদে কিছু বলছেন! জিম বললেন, ঠিক আছে মা, আমি তো এসে গিয়েছি, তোমার কোনও ভয় নেই।
বৃদ্ধা ততক্ষণে অর্জুনকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে বললেন, হু-হুঁ-ইজ-দেয়ার?
জিম হাসলেন, হি ইজ গোয়িং টু হেলপ আস মম। হিজ নেম ইজ অ-র জুন।
অর্জুন ঘরের ভিতরে ঢুকে বৃদ্ধার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকাল। বৃদ্ধা তার দিকে ভাল করে দেখে ছেলের দিকে তাকালেন, হি-হি-গুড!
গুড। এখন তুমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। তুমি কি একটু দুধ খাবে?
বৃদ্ধা মাথা নেড়ে না বললেন।
চাদরটা বৃদ্ধার বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে একটা মৃদু আলো জ্বেলে দিয়ে, গুড নাইট মম! বলে বেরিয়ে এলেন জিম। অর্জুন তাকে অনুসরণ করল।
বাইরে বেরিয়ে জিম বললেন, এপাশের দুটো বেডরুম আমরা স্বামী-স্ত্রী ব্যবহার করি। নীচে গেস্টরুম আছে, আর উপরের চার নাম্বার বেডরুমটায় কেউ থাকে না। তুমি কোন ঘরে থাকতে পছন্দ করছ?
আমার বোধহয় নীচের ঘরে থাকা উচিত।
বেশ, তুমি নীচে যাও, আমি আসছি। জিম বললেন।
নীচে নেমে এল অর্জুন। গেস্টরুমে ঢুকে দেখল, দামি হোটেলের সঙ্গে কোনও তফাত নেই। দেওয়াল-আলমারির পাল্লা খুলে দেখল, এক কাপড়ের সুন্দর স্লিপিংসুট ভাঁজ করা রয়েছে। যাক, রাত্রে শার্ট-প্যান্ট পরে শুতে হবে না। এগুলো নিশ্চয়ই এই ঘরে যে অতিথি থাকবেন তার জন্যে রেখে দেওয়া। হয়েছে।
পোশাক পরিবর্তন করে অর্জুন খুশি হল। যেন তার শরীরের মাপ নিয়ে এগুলো বানানো হয়েছে। সে দরজা খুলে বাইরে আসতেই জিমকে দেখতে পেল। নিজের পরনে এখন শোওয়ার পোশাক। কিন্তু তার সামনের টেবিলে গ্লাসের ভিতর সোনালি রঙের পানীয়ে কয়েক টুকরো বরফ ভাসছে। জিম বললেন, বোসো। জিমকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
অর্জুন বসল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলে কোথায় থাকে? ওর প্রফেশন কী?
আমি কিছুই জানি না। তবে ব্রঙ্কসে ওকে অনেকে দেখেছে।
ব্রঙ্কস?
ম্যানহাটন, কুইন্স, ব্রঙ্কস, স্যাটার্ন আইল্যান্ড আর লং আইল্যান্ড নিয়ে নিউ ইয়র্ক। ম্যানহাটনের পাশে হার্লেম আর ব্রঙ্কস হল কালোদের জায়গা। বেশিরভাগ ক্রিমিনাল ওখানেই আস্তানা গাড়ে। কারণ, ওখানকার কয়েকটা এলাকায় বড় দলে না গেলে পুলিশও ঢুকতে সাহস পায় না। আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই ও কোথায় থাকে তা জানার। আর ওর প্রফেশন সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। ক্রাইমওয়ার্ল্ডে ঢুকে গিয়ে কোনও শক্তিশালী দলের সঙ্গে হাত মেলালে রোজগারের ভাবনা ভাবতে হয় না।
তা হলে আপনার ছেলে তার মায়ের কাছে টাকা চাইতে কেন এসেছিল? ওর তো অন্য পথে রোজগার থাকার কথা।
হয়তো সেখানে কোনও সমস্যা হয়েছে।
মিস্টার ব্রাউন, আপনার ছেলে এরকম হল কেন?
একটা বড় চুমুকে গ্লাস অর্ধেক করে জিম বললেন, আমাদের দুর্ভাগ্য। ওর দিদি অত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিল বলে আমরা ভেবেছিলাম ও সেরকম হবে। ওর মা চাইত, দিদির কথা বলে ওকে ইন্সপায়ার করতে। আমরা বুঝিনি, খুব। সাধারণ মানের ছাত্র বলে ও দিদিকে ঈর্ষা করত। স্কুলের বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে দিয়েছিল অল্প বয়সেই। তাদের কাছ থেকে ড্রাগ খাওয়া শিখেছিল সে। পনেরো বছর বয়সে প্রথম স্কুল থেকে ওর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এল। ওকে স্কুল থেকে বের করে দিত কিন্তু ওর মা হাতে পায়ে ধরায় প্রিন্সিপাল সেবার ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করল ও। তারপর থেকেই আমাদের অবাধ্য হতে ওর খুব ভাল লাগত। রাত দুটো বা তিনটের সময় বাড়ি ফিরত। এইভাবে চলছিল। আঠারো বছরের পর ও বাড়িতে আসা বন্ধ করল। এখন মাঝে মাঝে মোটরবাইকে ওকে দেখা যায় ওই ব্রঙ্কস এলাকায়।
এখন ওর বয়স কত?
পঁচিশ পেরিয়েছে।
আপনার কি মনে হয় ও নিজের মাকে খুন করতে পারে?
কোনও কিছুই অসম্ভব বলে এখন মনে হচ্ছে না।
অর্জুন জিমের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল। তার মনে হচ্ছিল, জিমের এখন শুয়ে পড়া উচিত। তবু জিম গ্লাস শেষ করতে যাচ্ছেন দেখে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি বোধহয় জেমস বন্ডের মতো একজনকে খুঁজছিলেন। মেজর আপনাকে আমার কথা বলেছিলেন? আমাকে দেখে আপনি খুব হতাশ হন। আপনি আমাদের ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু মনস্থির করতে পারেননি। আপনি কেন একজন সত্যসন্ধানীকে খুঁজছিলেন?
জিম হাসলেন, আমি ভয় পাচ্ছিলাম আমার কোনও ক্ষতি হবে। আমি একবারও ভাবিনি আঘাতটা আমার স্ত্রীর উপর আসবে। ভাবলে আরও বেশি তৎপর হতাম।
আপনি কেন ভয় পাচ্ছিলেন?
আমার ছেলে এই শহরে আছে কিন্তু কোথায় আছে তা জানি না। আমাকে এড়িয়ে সে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তার সঙ্গীরা হল ভয়ংকর ক্রিমিনাল। ভয় হচ্ছিল সেই কারণে। আমি ওর ঠিকানাটা জানতে চাইছিলাম। ঠিকানা জানলে ওর গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারতাম। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এজেন্সিগুলোর উপর আমার একটুও ভরসা নেই। আবার পুলিশের কাছে যেতে চাইনি। আমি কোনও কারণ ছাড়াই ছেলেকে ভয় পাচ্ছি এটা শুনলে ওরা কোনও গুরুত্ব দিত না। জিম বললেন।
অর্জুন বলল, আপনি এবার শুয়ে পড়ুন।
জিম উঠলেন। ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কথাটা মনে আসতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়েকে খবরটা দিয়েছেন।
মাথা নাড়লেন জিম, না। কাল সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখব ও কেমন আছে, দেখে ফোন করব। গুড নাইট।
অর্জুন বলল, গুড নাইট।
এখন এই বাড়ি শান্ত। কোথাও কোনও শব্দ নেই। আলো নেভাতে গিয়ে টেবিলে পড়ে থাকা গ্লাসটার উপর চোখ পড়ল। সেটাকে তুলে নিয়ে কিচেনের বেসিনের পাশে রেখে এল অর্জুন। এত বৈভব, এত বিলাসিতা, কিন্তু বাড়িতে কোনও কাজের লোক নেই। অতিরিক্ত বিত্তশালী না হলে ড্রাইভার তো বটেই, কাজের লোকও রাখা সম্ভব নয়। ভারতীয় টাকায় মাসে যে আট লাখ টাকা রোজগার করে, তাকেও নিজের হাতে বাসন মাজতে হয়, রান্না থেকে ঘর পরিষ্কার না করে উপায় থাকে না। বাড়ির লনে ঘাস বড় হলে সেগুলো ছাঁটাও তার কর্তব্য।
আলো নিভিয়ে গেস্টরুমে চলে এল অর্জুন। জিম ব্রাউন না হয় এ দেশের মানুষ, অনেক ভারতীয়র হাজার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে যেতে চায় না। মানুষের টাকা রোজগার করতে গিয়ে দুঃখ কেন?
ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল অর্জুন। এখন চারধার চুপচাপ। দূরের রাস্তায় মাঝে মাঝে কোনও গাড়ি ছুটে গেলে তার আওয়াজ ভেসে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সারা দুপুর ঘুমোনোর জন্যে এখন অর্জুনের ঘুম আসছিল না।
ঘণ্টাখানেক পর সে উঠে বসল। ঘুম না আসার একটা কারণ, তার খিদে পেয়েছে। ওয়াটার ফ্রন্ট রেস্টুরেন্টে খাওয়া শুরু করামাত্র ফোনটা এসেছিল। সময়টা ছিল সন্ধেবেলা। এখন গভীর রাত। জিম নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর অর্জুন উঠল। কিচেনের রেফ্রিজারেটরে কি কোনও খাবার নেই? মিসেস ব্রাউন কি আজ সকালে কিছু তৈরি করে রেখে দেননি ওখানে? যদিও ওখান থেকে জিমকে না জানিয়ে খাবার নেওয়া অনুচিত, কিন্তু নিশ্চয়ই চুরি বলে মনে করবেন না জিম?
দরজা খুলে নিঃশব্দে বড় ঘরে পা রাখল অর্জুন। ঘরে বাতি না জ্বললেও কাঁচের দেওয়ালের আড়াল ভেদ করে আকাশের আলো চুঁইয়ে ঢুকছে ভিতরে। তাতে অবশ্য কোনও কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের চেয়ে একটু স্বস্তি এনে দিয়েছে। অর্জুন কিচেনের দিকে পা বাড়াল। মেঝের উপর কার্পেট থাকায় শব্দ হওয়ার কারণ নেই।
রেফ্রিজেটরের দরজা খুলতেই আলো জ্বলে উঠল ভিতরে। অনেক পাত্র রাখা আছে। প্রথমটি তুলতেই অর্জুন খুশি হল। পুডিং। এখনও ছুরির স্পর্শ পায়নি যখন, তখন আজ-কালের মধ্যেই বানিয়েছিলেন মিসেস ব্রাউন।
একটা প্লেটে খানিকটা পুডিং চামচ দিয়ে তুলে নিয়ে পাত্র যথাস্থানে রেখে দরজা বন্ধ করতেই আলো নিভে গেল। কিচেনে দাঁড়িয়েই এক চামচ পুডিং মুখে দিল অর্জুন। আঃ, দারুণ স্বাদ। খিদের কারণে দ্রুত পুডিং শেষ করে সে গ্লাস খুঁজে না পেয়ে জিমের ব্যবহার করা গ্লাস কলের জলে ধুয়ে আবার ভরে নিয়ে চুমুক দিল। ঠিক তখনই কোথাও কট করে একটা শব্দ হল। তারপর আবার সব চুপচাপ।
খালি বাড়িতে রাতের বেলায় শব্দ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অর্জুন নিশ্চিত যে, সে ভুল শোনেনি। গ্লাস হাতে নিয়েই সে কিচেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে গোটানো পরদা, তাই বাইরের লন ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। এই সময় দ্বিতীয়বার কট শব্দটা হল।
অর্জুন দরজার দিকে তাকাল। শব্দটা হচ্ছে দরজার ওপাশে। এটা হাওয়ার ধাক্কা নয়। সে পা টিপে টিপে দরজার এপাশে চলে আসামাত্র তৃতীয়বার শব্দটা হল। দরজার গায়ে তালায় চাবি বা ওই জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে, কেউ খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু জিম এদিকের লকটা নামিয়ে দেওয়ায় চাবি কাজ করছে না।
কী করা যায়? লক তুলে দরজা চটপট খুললেই আগন্তুককে দেখা যাবে। লোকটি নিশ্চয়ই সেটা পছন্দ করবে না। সঙ্গে অস্ত্র থাকলে অর্জুনকে আঘাত করবেই। বোকামি করার কোনও মানে হয় না। অর্জুন ধীরে ধীরে কাঁচের দেওয়ালের পাশে ঝুলে থাকা পরদার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকতেই বারান্দায় দাঁড়ানো লোকটির ঝাপসা মূর্তি দেখতে পেল সে। লোকটি তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু লোকটি যে বেশ লম্বা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবার দরজায় আলতো টোকা দিল লোকটি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে আবার টোকা দিল। এবার একটু জোরে। তারপর অর্জুনকে অবাক করে চাপা গলায় ডাকল, মম, মম।
এতক্ষণ অর্জুন লোকটিকে জিম ব্রাউনের ছেলে বলে ধারণা করেছিল। মাকে খুন করার চেষ্টা করেও নিশ্চয়ই অন্য কোনও মতলবে ফিরে এসেছে। কিন্তু মম ডাক শুনে অর্জুনের মনে হল, এতক্ষণ তারা পুরোটাই ভুল ভেবে নিয়েছিল। লোকটি যখন এ বাড়ির দরজায় এসে মা বলে ডাকছে, তখন মিসেস ব্রাউনের হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনাটা ওর জানা নেই। ও যদি ছুরি মেরে থাকে, তা হলে কখনওই এই সময়ে এসে ‘মা’ বলে ডাকবে না। ছেলের বদলে অন্য কেউ যদি হয় তা হলে সে ‘মা’ বলবে কেন? অর্জুনের মনে হল, লোকটির সঙ্গে কথা বলা দরকার। সে দেওয়ালের কাঁচে শব্দ করে লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। কিন্তু শব্দ হওয়ামাত্র লোকটি হকচকিয়ে এদিকে তাকাল এবং এক লাফে নীচে নেমে দ্রুত গেটের দিকে চলে গেল। তারপরেই বাইকের শব্দ হল রাস্তায়। মুহূর্তেই শব্দ মিলিয়ে গেল।
.
০৫.
ঘুম ভাঙল সাড়ে সাতটার সময়। তাড়াতাড়ি বাথরুমের কাজ সেরে বাইরে আসতেই অর্জুন দেখতে পেল, টেবিলের উপর একটা কাগজ পেপারওয়েট চাপা রয়েছে। সেটা তুলেই পড়ল, মিস্টার ব্রাউন হাসপাতালে চলে গিয়েছেন। অর্জুন ঘুমোচ্ছিল বলে তিনি আর ডাকেননি। ওঁর সেলফোনের নম্বর লিখে গিয়েছেন।
একটু খারাপ লাগল অর্জুনের। আরও ভোরে ওঠা উচিত ছিল তার। তা হলে ভদ্রলোকের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে পারত। হাসপাতালটা কোথায় তা অবশ্য ওঁকে ফোন করে জেনে নেওয়া যায়। মাঝরাতে লোকটি চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ সে এই ঘরে বসে ছিল অপেক্ষায়, যদি আবার ফিরে আসে।
একটা ব্যাপারে ধন্দ লাগছে তার। পুলিশ অফিসার বলেছেন যে, এই বাড়ি থেকে দ্রুতবেগে একটা মোটরবাইককে বেরিয়ে যেতে দেখে তার সন্দেহ হওয়ায় তিনি খোঁজ করতে ভিতরে ঢুকেছিলেন। অর্থাৎ আততায়ীর মোটরবাইক ছিল। আবার গত রাতে যে এসেছিল সেও মোটরবাইকে ফিরে গিয়েছে। লক্ষণীয় যে, লোকটি মোটরবাইক ভিতরে নিয়ে আসেনি। যে আসছে সে বাড়ির লোকদের জানাতে চায়নি বলে মোটরবাইক বাইরে রেখে এসেছিল। এই দুটো লোককে একই মানুষ বলে ভাবতে অসুবিধে নেই। কিন্তু তা হলে দরজায় নক করে ‘মা’ বলে ডাকবে কেন?
দ্বিতীয়ত, প্রথমে চাবি দিয়ে দরজা খুলতে চেষ্টা করেছিল লোকটি। তার মানে এ বাড়ির সদর দরজার চাবি তার কাছে আছে। পেল কী করে? জিম নিশ্চয়ই সেটা দেবেন না। অবশ্য এক ফাঁকে এসে বন্ধ দরজায় চাবির গর্তের ছাঁচ নিয়ে নতুন চাবি তৈরি করে নেওয়া যায়। কিন্তু লোকটি দরজায় নক করেছিল। সাড়া না পেয়ে ‘মা’ বলে ডেকেছিল। অত রাতে দরজায় নক করলে নিশ্চয়ই মিসেস ব্রাউন সাড়া দিয়েছেন এর আগে। ‘মা’ ডাক শুনে নিশ্চয়ই দরজা খুলে দিয়েছেন। সেই কারণেই লোকটি নক করেছিল, ‘মা’ বলে ডেকেছিল।
হিসেব মিলছে না। কিচেনে ঢুকল সে। ইলেকট্রিক কেটলিতে চায়ের জল বসিয়ে দিয়ে দুধ-চিনি-চায়ের সন্ধান করতে লাগল। সেগুলো পাওয়ার পর খেয়াল হল জিম ব্রাউনের মায়ের কথা। ভদ্রমহিলা কি এখনও ঘুমোচ্ছেন? নাকি বেরোবার আগে জিম ওঁকে চা খাইয়ে গিয়েছেন! তবু দু’কাপ চা তৈরি করে দুধ-চিনি একটা ট্রে-তে তুলে সে দোতলায় চলে এল। জিমের মায়ের ঘরের দরজা ঈষৎ খোলা। সেখানে দাঁড়িয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ভিতরে আসতে পারি?
ভিতর থেকে জড়ানো শব্দ বাইরে এল। একটু অপেক্ষা করে অর্জুন ভিতরে ঢুকল। জিমের মা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় রয়েছেন। তার পিঠের নীচে তিনটে বালিশ রাখা। একটা চাদর কোমর পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে।
গুড মর্নিং। আমি অর্জুন। পাশের টেবিলে ট্রে রাখল সে।
সেদিকে তাকালেন বৃদ্ধা। ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটল।
আসুন, আমরা চা পান করি। আপনি চিনি খান?
বৃদ্ধা মাথা নেড়ে না বললেন।
শুধু লিকার?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালেন বৃদ্ধা। তারপর ইশারায় যে বস্তুটিকে দেখালেন তা দেখে অর্জুন চমৎকৃত। বিছানার পাশ থেকে টেনে সামনে নিয়ে আসতেই বৃদ্ধার সামনে একটা বেশ চওড়া প্লাইউডের হাতল এগিয়ে এল। অর্জুন সেই হাতলের উপর বৃদ্ধার চায়ের কাপ রাখল।
বৃদ্ধা জড়ানো যে শব্দটা উচ্চারণ করলেন সেটা যে থ্যাঙ্ক ইউ’ তা এবার বুঝতে পারল অর্জুন। একটা চেয়ারে চায়ের কাপ নিয়ে বসে অর্জুন বৃদ্ধাকে ভাল করে দেখল। সমস্ত মুখ জুড়ে বার্ধক্যের ছাপ, হাতদুটো সরু এবং তা থেকে চামড়া ঝুলছে। মাথায় সাদা চুল ছেলেদের মতো ছটা।
হঠাৎ অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন আপনার ছেলের বউ এখন কোথায়?,
বৃদ্ধা অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর ডান হাত নীচের দিকে নাড়ালেন। কাপটাকে দুহাতে ধরে উপরে তুলে মুখ নামিয়ে আলতো চুমুক দিলেন তিনি।
অর্থাৎ এই বাড়ির কোনও খবর ওঁর কাছে পৌঁছোয়নি।
আপনার নাতির সঙ্গে দেখা হয়? বেশ জোরে প্রশ্নটা করল অর্জুন।
কাপটা নামিয়ে রেখে অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন বৃদ্ধা। শব্দগুলোর মানে বুঝতে পারছিল না অর্জুন। কিন্তু তাতে যে যথেষ্ট অভিমান জড়ানো আছে, তা স্পষ্ট। অর্জুনের মনে হল, এই বৃদ্ধার সঙ্গে ওঁর নাতির যোগাযোগ ছিল। অর্থাৎ জিমকে এড়িয়ে জিমের স্ত্রী এবং মা ছেলেটির জন্যে অপেক্ষা করতেন। জিম যাতে না জানতে পারেন তাই সে আসত মধ্যরাতে। হয়তো দরজায় টোকা দিলে মিসেস ব্রাউন সেটা খুলে দিতেন নিঃশব্দে।
আপনার নাতির কাল আসার কথা ছিল? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
কিছু বলতে গিয়েও যেন নিজেকে সামলে নিলেন বৃদ্ধা। তারপর চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিতে লাগলেন। অর্জুন যে এই ঘরে বসে আছে তা একেবারে উপেক্ষা করলেন।
অর্জুন বুঝল ভদ্রমহিলা এখন মুখ খুলবেন না। হয়তো ওঁর মনে পড়েছে নাতির ব্যাপারে মুখ খোলা নিষেধ।
বৃদ্ধার চা খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কাপ তুলে হাতল সরিয়ে নীচে নেমে এল অর্জুন। তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। অর্জুন ট্রে-টা কিচেনে নামিয়ে রেখে রিসিভার তুলল, হ্যালো।
অ-র-জুন। দিস ইজ জিম। তুমি কি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হতে .পারবে?
নিশ্চয়ই।
মেজর আসছেন। তোমাকে তৈরি থাকতে বলেছেন। উনি তোমাকে তুলে নেবেন। লাইন কেটে দিলেন জিম।
পোশাক বদলে দরজার বাইরে এসে সেটা চেপে দিতেই লক আটকে গেল। এখন এই বিরাট বাড়িটায় একজন লোলচর্ম প্রায় বাশক্তিরহিত বৃদ্ধা ছাড়া আর কেউ নেই। আমেরিকানরা এই সব বৃদ্ধবৃদ্ধাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেয় বলে শুনেছিল অর্জুন। জিম কেন ব্যতিক্রম হল? কিন্তু বৃদ্ধা সারাদিন ওইভাবে পড়ে থাকেন, ওটাও তো ভাল নয়।
লনের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল অর্জুন। ঘাসের উপর চাকার দাগ এখনও রয়ে গিয়েছে। এই চাকা অবশ্যই মোটরবাইকের। গাড়ির চাকার চেয়ে অনেক সরু। লন এবং বাঁধানো চাতালের মাঝখানে এক বিঘত পরিমাণ মাটির উপর দাগটা বেশ স্পষ্ট। খাঁজগুলো বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রথম রাতে যে লোকটি এসে খুনের চেষ্টা করেছিল এটা তার বাইকের চাকার দাগ। একটু উত্তেজিত হয়ে গেটের বাইরে চলে এল অর্জুন। সেখানকার মাটির উপর বেশ কয়েকটা চাকার দাগ। দুটো দাগ আগের চাকার দাগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টির চাকার দাগ একটু আলাদা। খাঁজগুলো একটু বড় বড়। অর্থাৎ দ্বিতীয় মোটরবাইক ভিতরে ঢোকেনি। জিমের ছেলে এটাকে গেটের বাইরে রেখে ভিতরে ঢুকেছিল।
এই সময় মেজরের গাড়ি পাশে এসে দাঁড়াল। অর্জুন দেখল, মার্টিন গাড়িটা চালাচ্ছে। পাশে বসে আছেন মেজর। পিছনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসতেই মেজর এবং মার্টিন একসঙ্গে বলে উঠলেন, গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং! অর্জুন হাসল। মেজর বললেন, একটা ভাল খবর আছে। মিসেস ব্রাউনের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
বাঃ। খুব ভাল কথা। অর্জুন বলল।
এখন ওঁর কাছ থেকে স্টেটমেন্ট পেলেই পুলিশ ছেলেটিকে খুঁজবে।
কোন ছেলেটিকে?
আঃ। যে খুন করতে চেষ্টা করেছিল। ছেলের উপর জিমের সন্দেহ ছিল।
কিন্তু মিস্টার ব্রাউনের ছেলে তো তার মাকে খুন করতে আসেনি। অর্জুন খুব শান্ত গলায় বলতে মেজর চমকে তাকালেন, কী বলছ?
আমি ভুল বলছি না।
তোমার কী থেকে মনে হচ্ছে ঠিক বলছ? একটু আগে জিম ফোনে আফশোস করছিল, ছেলের ব্যাপারে কেন আরও সতর্ক হয়নি!
উনি ভুল করছেন। দেখবেন ওঁর স্ত্রীও আমাকে সমর্থন করবেন।
দ্যাখো অর্জুন, তুমি অতীতে অনেক সত্যি উদ্ধার করেছ বটে, কিন্তু একটা রাত ওই বাড়িতে কাটিয়েই ঠিকঠাক সত্যি জেনে যাবে এটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? মেজর মাথা নাড়লেন, শুনেছি, জিমের মা কথা বলতে পারেন না। জিম নিশ্চয়ই তোমাকে এই তথ্য দেয়নি। তা হলে তোমার জানা সোর্স কোথায়?
অর্জুন গত রাতের ঘটনা এবং আজ বৃদ্ধার সঙ্গে কথাবার্তা মেজরকে জানিয়ে হাসল, আমার সন্দেহ হয়েছিল কেউ মাকে ছুরি মেরে আবার রাত দুপুরে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। তাই যে খুন করতে চেয়েছিল সে আলাদা লোক। কিন্তু সন্দেহ তো তথ্য নয়। আজ লনের উপর এবং গেটের বাইরের মাটিতে দু’-দুটো মোটরবাইকের চাকার দাগ আমার সন্দেহকে সত্যি করে দিল।
আশ্চর্য! পুলিশ তো মোটরবাইকের চাকার কথা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
কারণ, ওঁরা জানেন একটাই মোটরবাইক ভিতরে ঢুকেছিল। মাঝরাতের আগন্তুকের খবর ওঁদের কাছে নেই। অর্জুন বলল।
তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি হয় তা হলে জিমের ছেলেটি বদলেছে বলতে পারছি না। কিন্তু সে চোরের মতো মাঝরাতে বাড়িতে যায় কেন? জিমের ভয়ে?
হ্যাঁ। বাবা এবং ছেলের সম্পর্ক ভাল নয়। হয়তো মিস্টার ব্রাউন নির্দেশ দিয়েছেন ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে। অর্জুন বলল।
তা হলে জিমের বউকে কে খুন করতে এসেছিল?
পুলিশ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে।
কেন ছুরি মেরেছিল?
এর উত্তর মিসেস ব্রাউন দিতে পারবেন।
হাসপাতালের পার্কিংলটে গাড়ি পার্ক করল মার্টিন। করে বলল, আমি এখানেই অপেক্ষা করছি, আপনারা কাজ শেষ করে আসুন।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে মেজর বললেন, তুমি একা গাড়িতে বসে কী করবে? চলো, আমাদের সঙ্গে ভিতরে চলো।
থ্যাঙ্ক ইউ মেজর। কিন্তু কোনও কোনও সময় দূরে থাকলে অনেকটা দেখা যায়।
কথা না বাড়িয়ে মেজর হাঁটতে লাগলেন, সঙ্গী হল অর্জুন।
.
হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট জানালেন মিসেস ব্রাউনের জ্ঞান ফিরে এসেছে কিন্তু তাকে কথা বলতে দেওয়া হবে না। বিকেলের দিকে কন্ডিশন নর্মাল হলে উনি কথা বলতে পারবেন। মিস্টার ব্রাউন যেহেতু বয়স্ক মানুষ, তাই তাকে অ্যালাউ করা হয়েছে স্ত্রীর পাশে যেতে। কিন্তু তিনি কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। একটু পরেই মিসেস ব্রাউনকে ও টি-তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অপারেশনের জন্যে। এ ব্যাপারে ভয়ের কিছু নেই।
মিস্টার ব্রাউনের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। মেজর বললেন, চলো, কফি খেয়ে আসি।
যদি সেই সময় মিস্টার ব্রাউন বেরিয়ে যান?
ও জানে আমি আসছি, তাই অপেক্ষা করবে।
তা হলে চলুন। কিন্তু শুধু কফি নয়, খুব খিদে পেয়েছে। হসপিটাল ক্যান্টিনে ঢুকে অর্জুনের মনে হল, জলপাইগুড়িতে এর কাছাকাছি মানের কোনও খাবার দোকান নেই। ছোট ছোট রঙিন টেবিল চেয়ার, কাউন্টারের ওপাশে সুন্দরী সেলসগার্ল, তাদের পিছনে ইলেকট্রনিক বোর্ডে কী কী খাবার পাওয়া যাবে এবং তাদের দাম লেখা রয়েছে।
সেদিকে তাকিয়ে মেজর বললেন, এখনও কুড়ি মিনিট বাকি আছে। এরা একটা স্পেশ্যাল ব্রেকফাস্ট দেয় যার দাম কুড়ি মিনিট পরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তুমি ওই টেবিলে গিয়ে বসো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আপনি নেবেন কেন?
আঃ। অর্জুন। এটা তোমার ভারতবর্ষ নয়। এখানে পরিশ্রম করলে বৃদ্ধরাও নিজেকে যুবক ভেবে খুশি হয়। যাও! মেজর অর্ডার দিলেন, ওয়ান জাম্বো ব্রেকফাস্ট, টু কাপ্স অফ কফি।
একটু পরে ট্রে-র উপর কফির মুখ বন্ধ কাগজের গ্লাস আর প্লেট ভরতি যে জাম্বো ব্রেকফাস্ট নিয়ে মেজর এলেন, তা দেখে অর্জুনের চোখ বড় হয়ে গেল, এ কী!
সস্তায় পাচ্ছ, খেয়ে নাও।
কী এটা?
তিনতলা বিগম্যাক।
নষ্ট হবে। আপনি একটু নিন, প্লিজ!
আমি এখন দিনেরাতে দু’বার খাই। দিনেরবেলায় সেদ্ধ, রাতে যা পাই।
অতএব শুরু করল অর্জুন। মনমাতানো স্বাদ। ভিতরে যে সস দেওয়া হয়েছে তার গন্ধও চমৎকার। ক্যান্টিনটায় এখন বেশ লোক হয়েছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ হয়ে গেল। কফির কাপের ঢাকনা খুলে চুমুক দিল অর্জুন।
মেজর বললেন, জিমের সঙ্গে দেখা করেই বাড়ি ফিরে যাব।
দরকারি কাজ আছে?
তোমাকে খাওয়াব বলে একটা আড়াই কেজির ইলিশ কিনেছিলাম। সেটা জমিয়ে রাঁধতে হবে। মেজর হাসলেন।
মানে? আপনি তো সেদ্ধ খাবেন!
ইয়েস। তা ছাড়া নিজের শ্রাদ্ধ করব আজ।
ওরে বাব্বা। তা হলে ইলিশটা মুলতুবি থাক। এখন যা খেলাম তাতে বিকেলের আগে খিদে পাওয়ার কোনও চান্স নেই।
বলছ?
হ্যাঁ। এই সময় মিস্টার ব্রাউনকে দেখা গেল। মুখ ঘুরিয়ে ওঁদের খুঁজছেন। দেখতে পেয়ে এসে বসলেন তৃতীয় চেয়ারে। উনি মুখ খোলার আগেই মেজর বললেন, দাঁড়াও। ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসি তোমার জন্যে।
না। জাস্ট এ কাপ অফ কফি!
ছাড়ো তো। কাল থেকে তো না খেয়ে আছ। মেজর, উঠে গেলেন। অর্জুনের ভাল লাগল। মানুষকে খাইয়ে ভদ্রলোক বেশ তৃপ্ত হন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলেন?
আমাকে চিনতে পেরেছে। মাথা নাড়লেন জিম।
ডাক্তার কী বলছেন?
একটা মাইনর অপারেশন হবে এখন। তারপরে আর কোনও ভয় নেই। মিস্টার ব্রাউন দু’হাতে কপাল চেপে ধরলেন, একটু পরেই পুলিশ আসবে। আবার জিজ্ঞেস করবে। আমি কী জবাব দেব? উঃ।
আপনি যা জানেন তাই বলবেন।
আমি যে অনেক কিছু জানি, কিন্তু সেসব কথা পুলিশকে বলতে চাইনি। চাইনি বলেই মেজরের কাছে তোমার কথা শুনে উৎসাহী হয়েছিলাম।
অর্জুন হাসল, তা হলে বলছেন আপনার স্ত্রীর আততায়ীকে আপনি জানেন?
এই সময় মেজর ট্রে-তে খাবার নিয়ে এলেন। মিস্টার ব্রাউন বললেন, আমি ওর নাম উচ্চারণ করতে চাই না।
তুমি যা ভাবছ তা সত্যি নয় জিম। খাও। মেজর বললেন।
তার মানে? অবাক হয়ে তাকালেন মিস্টার ব্রাউন।
অর্জুন বলল, দাঁড়ান, মিস্টার ব্রাউন! সমস্ত ব্যাপারটা আপনি আপনার স্ত্রীর মুখে শুনতে পারবেন। ততক্ষণ মনটাকে একটু নরম রাখুন। আপনার ছেলে তার মাকে ছুরি মারেনি।
তুমি আমাকে স্তোক দিচ্ছ? পুলিশ তাকে দেখেছে আমার বাড়ি থেকে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার ব্রাউন।
পুলিশ তোমাকে বলেছে যে, তারা তোমার ছেলেকে দেখেছে?
ওই হতভাগাই বাইক চড়ে। আমারই টাকায় কিনেছে। ইদানীং ও আমাকে ফোনে ভয় দেখাত। বিশ হাজার ডলার না দিলে আমার ব্যাবসার গোপন। তথ্য ফাঁস করে দেবে। সেই টাকা চাইতে এসে না পেয়ে ছুরি মেরেছে। এখন আর আমার কোনও সংকোচ নেই। পুলিশকে আমি সব বলব। মিস্টার ব্রাউনের হাত কঁপতে লাগল।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ফোনে যে কথা বলেছে সে যে তোমার ছেলে তা বুঝলে কী করে? অন্য কেউ তো হতে পারে?
মেজর! আমি বাপ হয়ে ছেলের গলা চিনব না? তা ছাড়া ওরকম অশ্লীল শব্দ, বস্তি এলাকার মস্তানরা যা বলে তাতে তো ও অভ্যস্ত।
মেজর বললেন, তোমাদের তো অনেকদিন দেখা হয়নি। আর কেউ ওর পরিচিত, তোমাকে ফোন করেছিল। তুমি তাকে ছেলে ভেবে নিয়েছ?
তোমরা কী বলতে চাইছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না?
আগে খেয়ে নাও, তারপর বোঝার চেষ্টা করবে।
মিস্টার ব্রাউন খাবারের ট্রে-র দিকে তাকালেন। তারপর কফির কাপ তুলে নিলেন।
একটা চুমুক দিয়ে অর্জুনের দিকে তাকালেন তিনি, পুলিশ যাকে আমার বাড়ি থেকে মোটরবাইকে বেরোতে দেখেছিল সে টম নয়?
টম?
আমার ছেলে।
না। অর্জুন সহজ গলায় বলল।
.
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে রিসেপশনে আসতেই সুন্দরী রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করলেন, মিস্টার ব্রাউন?
ইয়েস। মিস্টার ব্রাউন এগিয়ে গেলেন।
আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনাদের কোনও পরিচিত ছেলে এখানে এসে অসভ্যতা করে গিয়েছে। আমি পুলিশকে ইনফর্ম করতে যাচ্ছিলাম। সুন্দরী বললেন।
আমাদের পরিচিত? কী নাম?
নাম বলেনি। কানে দুল, লেদার জ্যাকেট, চুলে রং। স্বাস্থ্য ভাল, হোয়াইট। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মিস্টার ব্রাউন, না। এরকম কাউকে আমি চিনি না।
আশ্চর্য ব্যাপার! ছেলেটি এসে বলল, কাল রাতে মিসেস ব্রাউন ভরতি হয়েছিলেন, তাকে কি মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? আমি অবাক হয়ে জানালাম, তিনি মর্গে যাবেন কেন? তার অপারেশন চলছে। ও একটা বিশ্রী গালি দিয়ে চলে গেল।
বিশ্বাস করুন, এরকম কেউ আমার পরিচিত নেই।
আপনার স্ত্রী বেঁচে আছে শুনে ও যেন দুঃখিত হয়েছিল।
আপনি পুলিশকে বললেন না কেন? হয়তো এই ছেলেটিই আততায়ী?
আমি সিকিউরিটিকে বলেছিলাম ওকে আটকাতে। কিন্তু ও ততক্ষণে বাইকে চেপে বেরিয়ে গিয়েছে। আপনি অপেক্ষা করুন, পুলিশের সাহায্য আপনার দরকার হবে।
মিসেস ব্রাউনের অপারেশন শেষ হওয়ার পর জানা গেল আর উদ্বেগের কারণ নেই। মেজর বিকেলবেলায় আবার আসবেন বলে অর্জুনকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের দেখে মার্টিন প্রায় দৌড়ে এল, কী হয়েছিল?
কী হয়েছিল মানে? জিমের স্ত্রীর অপারেশন হয়েছে। মেজর বললেন।
ও নো! ব্রঙ্কসে যে ছেলেদের দেখা যায় তাদের মতো দেখতে একজন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসতেই সিকিউরিটির দুটো লোক দৌড়ে এল ওকে ধরতে। ছেলেটি বাইকে উঠে যেভাবে বেরিয়ে গেল তা শুধু সিনেমায় দেখা যায়। আমি সিকিউরিটির লোক দুটোকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? ওরা উত্তর দিল না। এই ছেলেগুলো খুব ভয়ংকর। মার্টিন বলল।
ওকে আবার দেখলে চিনতে পারবেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই। বেশ জোরের সঙ্গে বলল মার্টিন।
ব্রঙ্কসের ছেলেদের আপনি চেনেন?
না। আমি চিনতে চাই না। ওদের মানুষ বলে মনে করি না আমি।
ওরা আপনার মতে কী?
নরকের কীট। মার্টিন বলল।
মেজর হাসলেন, চলো, বাড়ি যাওয়া যাক। আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
.
বাড়ি ফিরে স্নান সেরে মার্টিনকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মেজর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি তোমার লাঞ্চ খাওয়ার ইচ্ছে নেই?
একদম সত্যি। যা খাইয়েছেন তার ভার এখনও বইছি।
বেশ। তবু যদি খিদে পায় ফ্রিজে টুকটাক পেয়ে যাবে। আমি চারটের মধ্যে ফিরে আসব। আর এই নাও নীচের দরজার ডুপ্লিকেট চাবি। বিশ্রাম নিতে না চাইলে আশপাশে ঘুরে এসো। মেজররা চলে গেলেন।
মেজর কোথায় যাচ্ছেন তা জিজ্ঞেস করেনি অর্জুন। নিশ্চয়ই কোনও ব্যক্তিগত কাজে যাচ্ছেন। তার মনে পড়ল, মেজর বলেছিলেন, আজ শ্রাদ্ধ করব নিজের, দাড়ি কামাব। নিশ্চয়ই কথাগুলো রসিকতা করে বলেছেন।
ব্যালকনিতে গেল অর্জুন। কাঠবিড়ালিরা ফুটপাতে, গাছে নিজেদের খেলা খেলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে প্রাইভেট কার ছুটে যাচ্ছে সামনের রাস্তা দিয়ে। তারপরেই শব্দহীন হয়ে যাচ্ছে এই পাড়া। আশপাশের বাড়িগুলোর জানলা-দরজা বন্ধ। একজন প্রৌঢ়া মহিলা চেনে বাঁধা কুকুরকে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটছেন অলসভাবে।
আকাশের দিকে তাকাল অর্জুন। জলপাইগুড়ির আকাশের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের আকাশের কোনও পার্থক্য নেই। যত পার্থক্য মাটিতেই। হঠাৎ খেয়াল হল, এখানে আসার পর মাকে পৌঁছোনোর খবরটা দেওয়া হয়নি। মেজরের অনুমতি না নিয়ে ফোন করাটা উচিত কাজ হবে না।
আধঘণ্টা শুয়ে-বসে কাটিয়ে অর্জুন ঠিক করল আশপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখতে। দরজা টেনে দিতেই বন্ধ হয়ে গেল। চাবি পকেটে নিয়ে সে হাঁটতে লাগল। ছবির মতো বাড়ি। কিন্তু এই দুপুরে সেগুলোকে জনশূন্য বলে মনে হচ্ছে। রাস্তাটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। বাঁক নিতেই বেশ কিছু দোকান এবং অফিস দেখতে পেল। মানুষজন দরকারে এসেছে এখানে। কেনাকাটা করছে, কাজ সারছে।
একটা কফির দোকান চোখে পড়ল। পকেটে ডলারগুলো আছে। এখানে কফির দাম নিশ্চয়ই খুব বেশি হবে না। কফি নিয়ে গোলটেবিলে বসল অর্জুন। এক ডলার নিল। দেশে চল্লিশ টাকা দিয়ে সে নিশ্চয়ই এক কাপ কফি খেত না। না, চল্লিশ টাকাকে এখন থেকে এক টাকা বলে ভাবতে হবে।
কফির দোকানে জনাপাঁচেক লোক বসে কফি খাচ্ছে। ঠিক পাশের টেবিলে একটা গোঁফওয়ালা শক্তপোক্ত মানুষ একটি তরুণকে খুব বোঝাচ্ছে, কিন্তু তরুণটি সমানে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গুফো লোকটি বিরক্ত হয়ে ছেলেটিকে হাত নেড়ে কিছু বলতে ছেলেটি যেন পালিয়ে বেঁচে গেল। যেহেতু ওরা ইংরেজিতে কথা বলছিল না, তাই অর্জুন কিছুই বুঝতে পারেনি।
গুঁফো লোকটি এবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইংরেজিতে বলল, বেকার হয়ে থাকবে তবু কাজ করবে না। মাথা গরম হয়ে যায়।
অর্জুন মাথা নাড়ল, এরকম ছেলে সব দেশেই আছে।
হুম। আমাকে এখন আর-একটা ছেলেকে খুঁজে বের করতে হবে।
মনে হচ্ছে আপনার হাতে কাজ আছে? আছে।
কিন্তু কাজ করবে এমন লোক কম।
কী ধরনের কাজ জানতে পারি?
আমার একটা কুরিয়ার সার্ভিস আছে। চিঠি বা প্যাকেট ডেলিভারি দেওয়ার জন্যে তোক চাই। পার অ্যাসাইনমেন্ট পেমেন্ট করি, নো মাইনে।
ও।
আপনি কি আমেরিকান?
না। আমি ইন্ডিয়ান।
অনেক ইন্ডিয়ান এখানকার সিটিজেনশিপ নিয়ে আমেরিকান হয়ে গিয়েছে। তা আপনি এদেশে কবে এসেছেন?
গত কাল।
মাই গড! কতদিন থাকবেন?
বড়জোর দিনদশেক।
তা হলে আপনি টুরিস্ট?
লোকটি মুখ ফিরিয়ে নিল। কফি খেতে খুব ভাল লেগেছিল অর্জুনের। আর-এক কাপ খাওয়ার কথা চিন্তা করল সে। লোকটি টেবিলে আঙুল দিয়ে কিছু আঁকছে। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি আর-একটু কফি খাবেন?
লোকটা হাসল, হাফ কাপ খেতে পারি।
ওরা হাফ কাপ দেবে?
লোকটি বলল, আপনি বসুন, আমি নিয়ে আসছি।
লোকটি উঠে কাউন্টারে চলে গেল। তারপর দুটো কাপ নিয়ে ফিরে এল, একটা কাপ দু’ভাগ করে নিলাম।
আপনি দাম দিলেন কেন? আমিই তো খাওয়াতে চেয়েছিলাম?
এই যে চেয়েছিলেন তার দাম কফির দামের চেয়ে অনেক বেশি। নিন। লোকটি অর্জুনের টেবিলে বসল, আমার নাম জোসেফ। সবাই ‘জো’ বলে ডাকে।
আমার নাম অর্জুন।
একটু খটোমটো। অর ইজ ওকে। এই কফি খেয়ে আমাকে ব্রঙ্কসে যেতে হবে। ছোকরা কিছুতেই যেতে রাজি হল না। নোকটা কফিতে চুমুক দিল।
অর্জুন সোজা হল, ব্রঙ্কস! কেন?
একটা পার্সেল ডেলিভারি দেওয়ার আছে। আজই দিতে হবে। কুরিয়ার বিজনেসে দেরি করা মানে ক্লায়েন্ট হারানো। যে ছেলেটি রেগুলার কাজ করে সে আজ অসুস্থ হয়ে পড়ায় নতুন ছেলে খুঁজছিলাম। অগত্যা আমাকেই যেতে হবে। গুফো লোকটা, যার নাম জো, কফি শেষ করল।
অর্জুন তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কখন যাবেন?
এখনই। পাশেই আমার অফিস। সেখান থেকে পার্সেল নিয়ে টিউব ধরব।
কতক্ষণ লাগবে যেতে-আসতে?
ঘণ্টাতিনেক।
আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই তা হলে আপত্তি আছে?
আপনি যাবেন? কেন?
আমি কখনও ব্রঙ্কস দেখিনি।
ওটা মোটেই দেখার জায়গা নয়।
তবু, অনেক কথা শুনেছি।
গুঁফো জো একটু ভাবল। তারপর বলল, আপনাকে আমি কোনও পারিশ্রমিক দিতে পারব না, টিউবের টিকিটও আপনাকে কাটতে হবে।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছে।
জো-এর অফিসটা খুবই ছোট। কোনও কর্মচারী নেই। তালা খুলে পার্সেলটা নিয়ে আবার তালা বন্ধ করে মাথা নাড়ল জো।
মিনিট সাতেক হেঁটে টিউবস্টেশনে পৌঁছে গেল ওরা। জো-র কাছে কার্ড ছিল, বোধহয় টিউবে যাতায়াতের মাসিক কার্ড। অর্জুনকে টিকিট কাটতে হল আসা-যাওয়ার। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই হুড়মুড়িয়ে ট্রেন এসে গেল। নিউ ইয়র্কের সবক’টা দ্বীপকে মাটির নীচ দিয়ে বেঁধে ফেলেছে পাতাল রেল। মাটির নীচের সেই রেললাইনের ম্যাপ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
ট্রেনে উঠে বেশ মজা লাগল। দুটো কালো ছেলে যন্ত্র চালিয়ে গান গাইছে আর নাচছে। গান গাইতে গাইতে যাত্রীদের সামনে টুপি পেতে ধরছে। তাতে খুচরো বা এক দুই ডলার দিচ্ছেন কেউ কেউ। ছেলে দুটোর পোশাক এবং ভঙ্গি দেখলে হিন্দি সিনেমার অভিনেতা বলে মনে হবে। অর্জুনের মজা লাগছিল। পশ্চিমবাংলার গ্রামগঞ্জের বাসে ‘ভোলা মন’ বলে চিৎকার করে যারা একতারা বাজিয়ে গান গায় তাদের সঙ্গে এদের মূলত কোনও পার্থক্য নেই। শুধু এই কালোসাহেব গাইয়ে ভিখিরিদের স্মার্টনেস দেশের ভিক্ষুকরা কোনওদিন রপ্ত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
পাশাপাশি বসে ছিল জো আর অর্জুন। স্টেশনে ট্রেন থামছে আবার ছুটছে। একসময় গাইয়েরা নেমে গেল। হঠাৎ জো জিজ্ঞেস করল, আপনি দেশে কী করেন?
অর্জুন একটু ভাবল। তারপর এমন ভান করল যেন ট্রেনের চাকার শব্দে শুনতে পায়নি। জো এবার একটু গলা তুলে প্রশ্নটা করল। অতএব উত্তরটা দিতেই হল। শুনে চোখ বড় হয়ে গেল জো-এর, মাই গড! আপনি ডিটেকটিভ?
অর্জুন হাসল, না। আমি সত্যসন্ধানী। মিথ্যের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা সত্যিটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
এটা আপনার প্রফেশন?
মাথা নাড়ল অর্জুন, হ্যাঁ।
ডিটেকটিভ হন বা না হন, এইসব মানুষ অকারণে সময় নষ্ট করেন । আপনি ওই কফির দোকানে নিশ্চয়ই কিছুর খোঁজে এসেছিলেন? জো জিজ্ঞেস করল।
বিশ্বাস করুন, সময় কাটাতে ওখানে ঢুকেছিলাম। আমার পরিচিত এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে নিউ ইয়র্কে এসেছি। এখানে আমি শুধু টুরিস্ট। অর্জুন হাসল।
কিন্তু আপনার তো বেশি বয়স নয়?
বোধহয় সেটাই আমার সুবিধে।
ও। কিন্তু আমি ব্রঙ্কস যাচ্ছি শুনে আপনি সঙ্গে যেতে চাইলেন কেন? যদি আমাকে কুইন্সে যেতে হত তা হলেও কি উৎসাহ দেখাতেন?
না।
তার মানে ব্রঙ্কসের ব্যাপারে আপনার বিশেষ আগ্রহ আছে। কেন?
শুনেছি ওখানে কুখ্যাত অপরাধীরা ঘোরাফেরা করে। পুলিশের সঙ্গে প্রায়ই তাদের মারপিট হয়। জায়গাটা দেখার ইচ্ছে হল। অর্জুন বলল।
আপনাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। ভুলেও ওখানে গিয়ে নিজের পরিচয় দেবেন না। তা হলে আপনি আর ফিরে আসতে পারবেন না। জো বলল।
মনে থাকবে। অর্জুন মাথা নাড়ল।