বাংলোর সামনে গাড়ি থেকে নামতেই সেই রোগা লোকটাকে দেখতে পাওয়া গেল। কাছাকাছি যেতে অর্জুন দেখল, লোকটি সনাতনকে দেখে খুব অবাক হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, একে চেনো?
না বলতে গিয়েও, হ্যাঁ বলল লোকটা।
আমি যেখান থেকে হাড়িয়া কিনি, কাল ও সেখান থেকে হাড়িয়া কিনে এনেছে। ঠিক আছে দাদা, আপনারা যান, আমি ওর সঙ্গে গল্প করি। কিন্তু জোর করে এত দূরে নিয়ে এলেন, বারোটার মধ্যে ফিরব কী করে ভাবছি, সনাতন কথাগুলো বলতে বলতে এগোচ্ছিল।
অর্জুন বলল, চিন্তা কোরো না। যেখানেই যাও, এগারোটার মধ্যে ফিরে এসো। তোমাকে পৌঁছোবার দায়িত্ব আমি তো নিয়েছি।
সনাতন বিড়বিড় করল, এই অন্ধকারে কোথায় যাব! তারপর রোগা লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, লছমন কোথায় রে? ধাবায় যখন সে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন ওর কথা জড়ানো ছিল। এখন পরিষ্কার।
কী জানি, লোকটা উদাস গলায় বলল।
চলো, খুঁজে বের করি!
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে অর্জুনের ঘরে ঢুকে মেজর অনেকক্ষণ পরে কথা বললেন, কী বুঝছ? চেয়ার টেনে ধপ করে শরীর ছেড়ে দিলেন তিনি।
কিছু বুঝতে পেরেছি বলা এই মুহূর্তে ভুল হবে।
কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি। নিউ ইয়র্কের মাফিয়াদের এত ক্ষমতা যে, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-জলদাপাড়াতেও স্বচ্ছন্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! মেজর বললেন।
এদের নেটওয়ার্ক খুব ভাল। কিন্তু লুসিকে মেরে ফেলাই যদি ওদের উদ্দেশ্য, তা হলে গত কালই তো মেরে ফেলতে পারত। আজও প্রচুর সুযোগ পেয়েছে। মারছে না কেন?
আমরা সব সময় ওর পাশে থাকছি, তাই সাহস পাচ্ছে না! মেজর বললেন।
দুর! আজ সকালে যখন আপনারা হাতির পিঠে চেপে ঘুরতে গিয়েছিলেন, তখনই জঙ্গলের ভিতর ওকে শেষ করে দিতে পারত।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ, লুসি ওদের টার্গেট নয়?
না।
তা হলে কি…!
না, আপনিও নন।
যাচ্চলে! তা হলে?
শুয়ে পড়ুন। একটু পরেই তো বেরোতে হবে।
আমি একবার শুলে আর উঠতে পারব না ভাই। তা ছাড়া কোথায় শোব? মাঝখানের ঘরে অবশ্য শোওয়া যায়। আজ লুসি নেই, মেজর উঠে দাঁড়ালেন।
চলুন, লুসির ঘরে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
নো, নো। তুমি আমার ফর্ম ভুলে যাচ্ছ। একা-একা সাহারা পেরিয়ে গিয়েছি, এ তো এ ঘর থেকে ও ঘর, বলতে বলতে পাশের ঘরে চলে এলেন তিনি। ভেজানো দরজা ঠেলে আলো জ্বেলে চট করে ঘরটা দেখে নিয়ে সোজা বাথরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন জেমস বন্ডের মতো। তারপর খাটের তলা, আলমারি দেখে নিয়ে বললেন, ওকে। কিন্তু মেয়েটা যে খাটের উপর পোশাক ছড়িয়ে গিয়েছে।
অর্জুন সেগুলোকে টেবিলে তুলে দিল, এমন কিছু গরম নেই, জানলা খুলবেন না।
পাগল!
অর্জুন ঘর থেকে বেরোতে যাবে, হঠাৎ মোবাইলের রিং শুনতে পেল। সে পকেট থেকে নিজের সেট বের করে দেখল সেটি অন্ধকার।
আপনার মোবাইল বাজছে?
নো, আমি ওই যন্ত্রটি ব্যবহার করি না।
ইতিমধ্যে শব্দটি থেমে গেল। অর্জুন চারপাশে লক্ষ করছিল। যেদিক থেকে শব্দটি ভেসে এসেছিল, সেদিকে লুসির ঢাউস সুটকেস পড়ে আছে। তবে কি মোবাইলটা লুসির? সুটকেসে রেখে গিয়েছে? সে বলল, মনে হচ্ছে লুসির মোবাইলে কল এসেছিল। ওটা সুটকেসের ভিতর রয়েছে।
থেমে গিয়েছে যখন, তখন ওটার কথা ভুলে যাও। মহিলাদের সুটকেস খোলা অভদ্রতা, খাটের উপর বসলেন মেজর।
ঠিক তখনই জলতরঙ্গ বাজল সুটকেসের মোবাইলে। ভারতবর্ষের কেউ নিশ্চয়ই লুসিকে কোনও খবর পাঠাতে চাইছে না। জলতরঙ্গ একবার বেজে থেমে যাওয়ার অর্থ হল মেসেজ এসেছে।
বিদেশের কেউ নিশ্চয়ই কিছু জানাতে চায় লুসিকে। সেটা খুব জরুরিও হতে পারে।
অর্জুন বলল কথাটা। মেজর মাথা নাড়লেন, হতে পারে। তা হলে বের করো ওটা।
সুটকেস খুলতেই মোবাইল সেটটাকে দেখতে পেল। বেশ দামি সেট। সঙ্গে ক্যামেরা তো আছেই, আরও অন্যান্য আধুনিক সুবিধেতে ঠাসা। পরদায় ফুটে উঠেছে, একটি মেসেজ এসেছে। বোতাম টিপে লক খুলে মেসেজ ইনবক্সে গেল অর্জুন। বোতাম টিপতে ফুটে উঠল ইংরেজি অক্ষরগুলো, এক্সলেন্ট ওয়ার্ক। ডোন্ট ক্যারি ক্যাসেটস, ট্রাই টু ফাইন্ড এ কুরিয়ার সার্ভিস। কিপ ডিসট্যান্স উইথ দ্য টার্গেট নম্বর ওয়ান। কাম ব্যাক সুন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ব্যক্তিগত ব্যাপার?
হয়তো। শুধু একটা কথা বুঝতে পারছি না, মোবাইলটা মেজরকে দিল অর্জুন। মেজর চেঁচিয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, বেশ রহস্যময় মেসেজ। লুসিকে বলা হয়েছে, ক্যাসেটগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাতে এবং টার্গেট নম্বর ওয়ানের থেকে দূরত্বে থাকতে। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতেও বলেছে। জানা দরকার, মেসেজটা কে পাঠিয়েছে?
অর্জুন মোবাইল সেট হাতে নিয়ে বোতাম টিপে বলল, প্রাইভেট নম্বর। যে পাঠিয়েছে তাকে শুধু লুসিই জানেন। বলতে বলতে মনে পড়ে গেল, তার মস্তিষ্কে যখন খবর আসে, তখন মোবাইলে ফুটে ওঠে প্রাইভেট নম্বর। পরে জানা গিয়েছে বিষ্টুসাহেব কথা বলেছেন। তা হলে কি এই মেসেজ বিষ্টুসাহেবই পাঠিয়েছেন?
কিন্তু তা হলে কাকে টার্গেট নম্বর ওয়ান বলেছেন? দূরত্ব রাখতে বলেছেন যখন, তখন সেই টার্গেট নম্বর ওয়ান ওঁর সঙ্গেই আছে? সঙ্গী বলতে তো মেজর এবং সে! অর্জুন ফাঁপরে পড়ল।
টার্গেট নম্বর ওয়ান! কার টার্গেট? হঠাৎ মনে হল গত রাতে যারা সাপটাকে ছুঁড়েছিল জানলা দিয়ে, তাদের টার্গেট কি মেজরই ছিলেন? ওরা ভুল ভেবেছিল? লুসি নন, মেজরই টার্গেট নম্বর ওয়ান? সেই কারণে লুসিকে একা পেয়েও মেরে ফেলেনি ওরা!
অথচ সনাতনের কাছে খবর, লুসিকে মেরে ফেললে দশ, ধরে নিয়ে গেলে পঁচিশ পাওয়া যাবে। এটা যদি সত্যি হয়, তা হলে লুসিরই টার্গেট হওয়া উচিত। কিন্তু এই মেসেজ লুসিকে সতর্ক করে বলছে, টার্গেট থেকে দূরে থাকতে! অর্জুনের মনে হল, লুসির সঙ্গে কথা বললে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। সে সন্তর্পণে মোবাইল সেটটাকে সুটকেসের যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই রেখে দিল। রাখার আগে বোতাম টিপে আগের অবস্থায় মোবাইলটাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। অর্জুন মেজরকে বলল, লুসির যে মেসেজ এসেছে তা বলবার দরকার নেই।
কেন?
দেখুন না, উনি নিজে থেকে কিছু বলেন কিনা!
অর্জুন নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুতেই তার মোবাইল বেজে উঠল, একটা মেসেজ এসেছে। রোমানে লেখা, হাবুর কি মোবাইল আছে? থাকলে তার নম্বর এখনই এস এম এস করো। বিট্সাহেব।
অবাক হল অর্জুন। হাবু কথা বলতে পারে না। মোবাইলের প্রয়োজন ওর নেই। তা ছাড়া একটা মোবাইল কেনার ক্ষমতা বাড়ির কাজের লোক হাবুর থাকার কথা নয়। তা সত্ত্বেও বিষ্ট্রসাহেব হাবুর মোবাইল নম্বর জানাতে বললেন? ওঁর তো অজানা নয় যে, হাবু মূক-বধির। তারপরই প্রশ্নটা মাথায় এল। যদি হাবুর মোবাইল থাকত, তা হলে সে কোনও নম্বরে এস এম এস পাঠালে, বিষ্টুসাহেব সেটা পেতেন? বিষ্টসাহেবের এস এম এস এসেছে। একটা প্রাইভেট নম্বর থেকে। কোনও নম্বর লেখা নেই। শুধু লেখা রয়েছে। প্রাইভেট নম্বর। তবু মেসেজের ইনবক্সে গিয়ে বোতাম টিপে সে রিপ্লাই-এ চলে এল। তারপর লিখল, হাবুর মোবাইল নেই। বোতাম টিপতেই সেন্ড ফুটে উঠল। সেন্ড টিপলে জানতে চাইল কোন নম্বরে মেসেজ পাঠাতে হবে? অর্জুন নম্বরের জায়গায় লিখল, প্রাইভেট নম্বর। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে লেখা ফুটে উঠল, মেসেজ ফেলড।
বিষ্টুসাহেব নিশ্চয়ই জানেন, তিনি প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন করছেন। তা হলে কী করে তাকে এস এম এস করতে বললেন?
হঠাৎ অর্জুনের খেয়াল হল। জলপাইগুড়ি থেকে আসার পর আর মা’র খবর নেওয়া হয়নি। সে নিজের বাড়ির নম্বর টিপল। মায়ের ঘুমোনোর সময় এখনও হয়নি। রিং হচ্ছিল। শেষে মা’র গলা পাওয়া গেল, হ্যালো।
কেমন আছ তুমি?
তুই? কী ছেলে রে বাবা। সেই যে গেলি, একটাও খবর নিলি না!
সরি মা। এত ঝামেলায় আছি, তুমিও তো মোবাইলে ফোন করোনি?
করিনি? করে করে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। লাইনই পাইনি। তুই কবে আসছিস? ওরা কেমন আছে?
ওঁরা ভাল আছেন। কবে আসছি এখনই বলতে পারছি না।
এদিকে একটা খারাপ খবর আছে।
কী খবর?
কাল শেষ রাতে হাবুকে পাড়ার লোকজন হাসপাতালে ভরতি করেছে।
হাবুকে? কেন? কী হয়েছে ওর?
ও বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। হাবুর হাত-পা বেঁধে ডাকাতরা তার দিয়ে কীসব করছিল। সেই অবস্থায় হাবু লড়াই করায় ওরা ওকে গুলি করে। গুলির শব্দে পাড়ার লোক উঠে পড়ার সময় ডাকাতরা পালিয়ে যায়।
হাবু কেমন আছে এখন?
আমি বিকেলে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। আই সি ইউ-তে রেখেছে। অপারেশন করে গুলি বের করেছে। কী হবে তা এখনই ডাক্তাররা বলতে পারছেন না।
ঠিক কখন ডাকাতি হয়েছে?
তা জানি না। গুলির শব্দ শোনা গিয়েছে ভোর চারটের সময়। ওরা নাকি একটা জিপে চেপে এসেছিল।
মা, তুমি ডাক্তারদের বলো, চিকিৎসার যেন ত্রুটি না হয়। টাকাপয়সার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাবুকে বাঁচাতেই হবে। অর্জুন বলল।
তুই এটা বলবি তা জানা থাকায় আজই আমি ডাক্তারদের বলে এসেছি। ওরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। যদি দরকার মনে করেন, তা হলে হাবুকে ওঁরা নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাবেন। তুই চিন্তা করিস না।
ঠিক আছে মা, রাখছি, মোবাইল বন্ধ করল অর্জুন।
অমল সোম হাবুর উপর বাড়ির দায়িত্ব ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন হাবুর নামে, যাতে সে নিজের খরচ এবং বাড়ির দেখাশোনা করতে পারে। কিন্তু ওই বাড়িতে যে ডাকাতি করে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু নেই, এ খবর জলপাইগুড়ির অধিকাংশ মানুষ জানে। তা হলে ডাকাতি করতে কারা গিয়েছিল? লোকগুলো যে নির্বোধ, তা ভাবা যাচ্ছে না। ওরা হাবুকে বেঁধে তার দিয়ে কী করছিল?
মাথায় ঢুকছিল না অর্জুনের। এইসময় নীচে বেশ গোলমাল হচ্ছে বলে সে বুঝতে পেরে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সনাতনের সঙ্গে যে লোকটা ঝগড়া করতে করতে শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পৌঁছোল, তার মুখ অন্ধকারে দ্যাখা যাচ্ছে না। তৃতীয় লোকটি, যে কিনা দর্শক, তাকে চিনতে অসুবিধে হল না।
অর্জুন ধমক দিল, অ্যাই! কী করছ তোমরা?
সাব, এই লোকটা আমার টাকা মেরে দিচ্ছে। মুখ তুলে যে বলল তাকে চিনতে পারল অর্জুন, লছমন। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। আজ ওকে জঙ্গলে দেখেছে।
না, দাদা। আমি বলেছি বাকি থাকবে। কাল দিয়ে দেব।
আমি আগেই বলেছি হাঁড়িয়া আমি বাকিতে দিই না। তারপর খেলি কেন? কাল টাকা আদায় করতে কোথায় ছুটব আমি? টাকা দে, নইলে তোকে এই জঙ্গল থেকে বেরোতে দেব না।
বেরোতে দিবি না? কেন, কী করবি তুই?
মরে যাবি সনাতন। গন্ডার লেলিয়ে দেব পিছনে।
গন্ডার? গন্ডাররা তোর চাকর নাকি? হা হা হা!
সাব, আমাকে দোষ দেবেন না পরে। লোকটা মুখ তুলল।
কত টাকা পাওনা হয়েছে তোমার? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
তিরিশ টাকা।
তুমি একজন সরকারি কর্মী হয়েও ওসব বিক্রি করছ কোন সাহসে? সাব, আমি বিক্রি না করলে বড়সাহেবরা এখানে এলে অসুবিধেয় পড়তেন। সত্যি বলছি সাব, আমি বেশি দাম নিই না। কাল টুরিস্ট সাহেবের জন্য ও হাঁড়িয়া কিনতে গিয়েছিল আমার কাছে। আমি এক নম্বর জিনিস দিয়েছি, মাত্র পাঁচ টাকা প্রফিট করে। একে আমি ছাড়ব না!
কী করে গন্ডার লেলিয়ে দেবে?
আমি ডাকলে গন্ডার ছুটে আসবে, ওকে ছাতু করে ফেলবে।
তুমি উপরে এসো।
সনাতনকে শাসাতে শাসাতে লছমন উপরে উঠে এল। লোকটাও যে নেশা করেছে, বোঝা যাচ্ছিল। সে দরজায় দাঁড়াতে অর্জুন বলল, দ্যাখো, তোমার যে ক্ষমতা আছে তা আমার নেই। তোমার ডাক গন্ডার শোনে, আমি হাজার ডাকলেও তারা কান দেবে না। ভগবান তোমাকে এত ক্ষমতা দিয়েছেন যখন, তখন তুমি এদের সঙ্গে ঝগড়া করছ কেন? আমার কাছে। থেকে টাকাটা নিয়ে নিয়ো।
ও ব্যাটা বদমাশ। এখানে কেন এসেছে জানেন? ধান্দায়। ও তো জানে না যে, মেমসাহেব এখন বাংলোয় নেই। ওরা জানে তাকে ধরে দিতে পারলেই পঁচিশ হাজার পেয়ে যাবে। আরে, এতই যদি সোজা হত, তা হলে আমি কি মরে গিয়েছি? এটা আমার এলাকা। আমি কামাই না করে তোদের কামাই করতে দেব? সাব, শুধু গন্ডার কেন, হাতিও আমার কথা শোনে। মাহুতকে জিজ্ঞেস করুন। কথা বলতে বলতে টলছিল লছমন।
শুনেছি এই জঙ্গলে বিষধর সাপ অনেক আছে।
সাপ? সাপ আমাকে ভয় পায়। একবার একটা কেউটে ভয় পেয়েই ছোবল মেরেছিল আমাকে। আমি মরলাম না, সাপটাই মরে গেল, সোজা হওয়ার চেষ্টা করল লছমন, তা হলে আপনিই টাকাটা দিয়ে দেবেন? এখনই দিন না।
কেন? আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?
জিভ বের করে নিজের কান স্পর্শ করল লছমন, ছি, ছি। কী বলেন? তবে সাব, মানুষের জীবন তো, কিছুই বলা যায় না। রাতে যার সঙ্গে কথা বললাম, সকালে তাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে হল শ্মশানে।
আমি অত সহজে মরব না লছমন। কাল যে সাপটাকে ট্রানজিট থেকে চুরি করে নিয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ফেলা হয়েছিল, সেটাও তো কাউকে মারতে পারেনি। লছমন, সময়টা বলল, ঠিক কোন সময়ে সাপটাকে ছুঁড়েছিলে! অর্জুন তাকাল।
লছমন পিটপিট করে তাকাল। অর্জুন লোকটাকে ভাল করে দেখছিল। দেখতে পেল সেই ভরদুপুরে কানের পাশে গুঁজে রাখা সিগারেটটা এখনও স্থানচ্যুত হয়নি। হয়তো ওটার কথা ভুলেই গিয়েছে লোকটা। সে এগিয়ে গিয়ে হতভম্ব লছমনের কানের পাশ থেকে সিগারেটটা টেনে বের করে আলোর সামনে ধরল, ডানহিল। তারপর হেসে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিশ্চয়ই প্যাকেট খুলে নিজের জন্য একটা সিগারেট বের করে কানে খুঁজে রাখোনি? এর প্যাকেট কত দামে বিক্রি করো?
একশো টাকা।
কত করে কেনো?
সাপ্লাই বেশি এলে দাম কমে যায়। সব সময় ঠিক থাকে না।
ওই একটা সিগারেট কে দিয়েছে তোমাকে?
আপনি কী জানতে চাইছেন? হঠাৎ লছমনের গলার স্বর নরম হয়ে গেল।
সাপটা কি তুমি ছুঁড়েছিলে?
না, আমি ছুড়লে ওটা কাজে লাগত।
কী কাজ? মেজর না লুসিকে মেরে ফেলা? আমি কিছু জানি না। মাইকেলসাহেবের লোক এসেছিল। আমার কাছে একটা মই চাইল, দিলাম। ওরা অন্ধকারে কী করেছে দেখতে পাইনি। পরে শুনেছিলাম, ওরা সাপ ছুঁড়েছিল মারতে। জানে না কায়দা। ছোঁড়ার সময় যদি লেজটা মুচড়ে দিত, তা হলে বিছানায় পড়েই ফণা তুলে ছোবল মারত। তা করেনি বলে ভয়ে লুকোতে চেষ্টা করেছে।
মাইকেলসাহেব কে?
ওরে বাবা। শিলিগুড়ির অর্ধেক এলাকার মালিক। দু’শো জন ওর আন্ডারে কাজ করে। পুলিশ আজ পর্যন্ত মাইকেলকে ধরতে পারেনি। যখন তখন হিলকার্ট রোডে, চার-পাঁচজনের বডি ফেলে দিতে পারে। কাল রাতে মই না দিলে আমিই খতম হয়ে যেতাম, লছমন বলল, গুডনাইট সাব।
দাঁড়াও। আজ দুপুরে মাদারিহাট থেকে চোরাপথে খুব খুশিমনে ফিরে এসেছ। ভাল কামাই হয়েছে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আ-আপনি জানলেন কী করে?
যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও।
হ্যাঁ। সাহেব বলেছে দশ বোতল স্কচ আমাকে দেবে, দাম দিতে হবে না। দশ বোতলের দাম এখানে অন্তত কুড়ি হাজার টাকা হবে। তাই…।
কোন সাহেব?
নাম জানি না। মাইকেলের লোক দুটো আমাকে সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা। তোমাকে দশটা স্কচ সাহেব উপহার দেবে, এমনি এমনি?
তা বলতে পারেন। জঙ্গলের নিয়ম হল, রাতে কোনও গাড়ি বের হবে। না, ঢুকবে না। এমার্জেন্সি হলে আলাদা কথা। রাতে জঙ্গলের পথে হাঁটাও বেআইনি। সাহেবের ইচ্ছে, রাত একটা নাগাদ জঙ্গলে ঢুকে গন্ডারদের ছবি তুলবেন। আমি ডাকলে গন্ডাররা আসবে। সেই সুযোগ করে দিলে, সাহেবের ছবি তুলতে সুবিধে হবে। তার জন্যই উনি আমাকে উপহার দিচ্ছেন, লছমন কপালে হাত ছোঁয়াল, জঙ্গলে ঢোকা আটকাতে গার্ড আছে। ওটা আমার কাজ না। তাদের ম্যানেজ করে যদি সাহেব ভিতরে আসতে পারে, তা হলে আমি ওই উপকারটা করেই দিতে পারি। এতে তো কারও ক্ষতি হবে না।
কিন্তু সনাতন বলল, সাহেব ওর কাছ থেকে লরি নিয়ে ফুন্টশোলিং চলে যাবেন বারোটার সময়। অর্জুন মনে করিয়ে দিল।
আমি জানি না। সাহেব এসে মাল দেবে, আমি কাজ করে দেব। আচ্ছা, লছমন চলে গেল।
বারোটার কিছু আগে অর্জুন নীচে নামল। পদমবাহাদুর গাড়িতেই ঘুমোচ্ছে। চারধার পাতলা অন্ধকারে ঢাকা। জোনাকি উড়ল জঙ্গলের গায়ে। ওপাশের বাংলোর স্টাফ কোয়ার্টাসে আলো জ্বলছে না। একটা দরজায় শব্দ করল অর্জুন। অনেকক্ষণ পরে হারিকেন হাতে রোগা লোকটা বেরিয়ে এল।
সনাতন কোথায়?
ও তো চলে গিয়েছে।
চলে গিয়েছে? হেঁটে হেঁটে?
তা জানি না। লছমন যখন উপরে আপনার সঙ্গে কথা বলছিল, তখনই চুপচাপ চলে গেল।
ঠিক আছে, শুয়ে পড়ো।
উপরে উঠে এল অর্জুন। সনাতন বোধহয় তার উপর ভরসা করতে পারেনি। কিন্তু এত রাতে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যে বিপজ্জনক, তা নিশ্চয়ই ও জানে। তবু ঝুঁকি নিল!
হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, আর নয়, অনেক হয়েছে। লুসি প্রচুর পাখির। ডাক রেকর্ড করেছেন। কাল সকালে জলপাইগুড়ি যাওয়া দরকার। হাবুকে। সুস্থ করে তোলাই তার এখন একমাত্র কাজ।
হাবুকে মারতে চাইল কেন? কারা মারতে চেয়েছিল? আর আজই বিষ্টুসাহেব জানতে চাইলেন হাবুর মোবাইল নম্বর কত। হাবু কি ওদের টার্গেট ছিল? কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে লুসি তো হাবুর ধারেকাছে কখনও ছিলেন না। হঠাৎ মনে হল, লুসিকে যে মেসেজ পাঠিয়েছে, সে টার্গেট বলতে তাকে বোঝায়নি তো! আর এটা লুসির জানা। অথচ লুসির কথাবার্তা বা ব্যবহারে সেটা একদম বোঝা যায়নি।
অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। অর্জুন বুঝতে পারছিল, এই বাংলোয় থাকা আর নিরাপদ নয়। দ্রুত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে সে মেজরের ঘরে গেল। দরজা না বন্ধ করে শুয়েছেন মেজর। ঘরে ঢুকে তাঁকে ডাকতেই তিনি উঠে বসলেন।
একী! আপনি ঘুমোননি?
ঘুমিয়েছিলাম। একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল।
তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র প্যাক করে নিন।
কেন?
আমাদের এখনই বাংলো ছেড়ে চলে যেতে হবে।
চলে যেতে হবে? মাঝরাতে চলে যেতে বললেই হল? মামদোবাজি? ডাকো রেঞ্জারকে, ওর বাবার নাম আমি ভুলিয়ে দেব! মেজর খেপে গেলেন।
কেউ আমাদের চলে যেতে বলেনি। আত্মরক্ষার জন্য আমরা চলে যাব।
ও, তাই বলো। এটা রণকৌশল।
ঝটপট রেডি হয়ে নিয়ে মেজর নীচে নামলেন। অর্জুন গাড়ির কাছে গিয়ে জানলায় শব্দ করতে পদমবাহাদুর জিজ্ঞেস করল, কৌন?
অর্জুন বলল, চুপচাপ বেরিয়ে এসো।
বিস্মিত পদমবাহাদুর দরজা খুলে বলল, সাব?
গাড়িটাকে ভালভাবে লক করে আমাদের সঙ্গে চলো।
পদমবাহাদুর কথা বাড়াল না।
নিঃশব্দে রেঞ্জারের অফিস ছাড়িয়ে ওরা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। মেজর বললেন, গাড়িটাকে নিয়ে এলে না কেন? অন্ধকারে হাঁটা যাচ্ছে না।
দুপুরের সেই কাঁচা রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে উপরের দিকে মুখ তুলে অর্জুন দেখল, আকাশ অনেকটাই ঢেকে গিয়েছে বড় বড় গাছের পাতায়। নিচু গলায় বলল, গাড়িটাকে ওখান থেকে সরালে ওরা সন্দেহ করত।
কারা?
যারা আমাকে মারতে চায়!
তোমাকে? কী বলছ? কারা মারতে চায়?
যারা চাইছে না প্রোফেসর মুলেনের গবেষণা সফল হোক। আসুন, আমরা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাই। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানি না।
জঙ্গলের মধ্যে একটা চমৎকার বসার জায়গা পেয়ে গেল ওরা। বেশ বড় বড় বোল্ডার পড়ে ছিল ওখানে। এখানে আকাশ অনেকটাই দৃশ্যমান বলে ফিনফিনে আলো অন্ধকারকে পাতলা করেছে।
লছমনের কথা যদি ঠিক হয়, তা হলে ওদের এই পথ দিয়েই আসতে হবে। এত রাতে মূল গেট কখনওই খুলবে না। হঠাৎ মাথার ভিতরে অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল অর্জুনের। তারপরই বিপ বিপ শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের আলো জ্বলে উঠল। ফুটে উঠল, প্রাইভেট নম্বর।
পরিষ্কার ইংরেজিতে বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক গ্রহণ করল, অর্জুন, ডু ইউ হিয়ার মি? লুসি কি তোমার কাছে আছে? আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই, আমি প্রোফেসর মুলেন। যদি থাকে, তা হলে তোমাকে যে কথাগুলো বলব, তা ওকে বলে দিয়ে! যদি না থাকে, তা হলে তোমার মোবাইল সেট অফ করে দিয়ো।
অফ করে দেওয়াই উচিত। কিন্তু অর্জুন সেটা করল না।
তা হলে লুসি তোমার পাশেই আছে। লুসিকে জিজ্ঞেস করো, ও কি মোবাইল নিয়ে যায়নি? উত্তরটা হ্যাঁ হলে তোমার মোবাইল অফ কোরো না। কয়েক সেকেন্ড গেল, প্রোফেসর মুলেন আবার কথা বললেন, আশ্চর্য। এই কারণে আমি ওর কাছে পৌঁছোতে পারছি না। যা হোক, লুসিকে বলো, বিপ বিপ করে যে-পাখি ডাকে, তার দ্যাখা পেলে যেন অবশ্যই একটা ছবি তুলে নিয়ে আসে। আর আসার সময়টা আমাকে যেন আগেই জানিয়ে দেয়।
তারপর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে উঠল অর্জুনের, মোবাইলের আলো নিভে গেল। আজ মাথার অস্বস্তি দূর হয়ে গেল বেশ তাড়াতাড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা কী? লুসি তো মোবাইল নিয়ে এসেছেন। সেই মোবাইলে মেসেজও আসছে। অথচ ওঁর বস প্রোফেসর মুলেন মনে করছেন, লুসি মোবাইল নিয়ে আসেননি। তা হলে এটা কি অন্য মোবাইল, যার নম্বর প্রোফেসরকে দিয়ে আসেননি লুসি! তা হলে তো…!
হঠাৎ একটা চাপা যান্ত্রিক শব্দ কানে এল। মেজর ফিসফিস করে বললেন, মনে হচ্ছে, একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ।
মিনিটতিনেকের মধ্যে ওরা জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে জিপটাকে দেখতে পেল। নাচতে নাচতে এগোচ্ছে। কোনও আলো জ্বালা হয়নি। জিপে তিনজন মানুষ বসে আছে। জিপ ওদের পেরিয়ে চলে যাওয়ার পর, ওরা পিছু নিল বেশ দুরত্ব রেখে। ফরেস্ট অফিসের কাছাকাছি গিয়ে জিপ থামল। তিনটে ছায়ামূর্তিকে জিপ থেকে নামতে দেখল অর্জুন। এই সময় একটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছিল ফরেস্ট অফিসের দিক থেকে। চারটে লোক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল।
অর্জুন নিচু গলায় মেজরকে বলল, আপনি আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে এখানে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করুন। প্রয়োজনে আপনাকে ডাকব।
হোয়াই? আমাকে বসিয়ে দিতে চাইছ কেন? আমি কি মরে গিয়েছি?
ছি ছি! আপনি ফোর্ট আগলান। সেটা তো খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
.
নিঃশব্দে পদমবাহাদুরকে নিয়ে অর্জুন জিপের কাছাকাছি পৌঁছে গেল জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে। টর্চ হাতের লোকটা লছমন। বাকি দু’জনকে বুঝতে পারল অর্জুন। এদেরই সে দেখেছিল ময়নাগুড়ির ধাবায়, খুঁটিমারি বাংলোয়। চতুর্থজন বিদেশি। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স।
লছমন বলছে, আমি কথা দিয়েছি, আমি গন্ডারদের ডাকব। কিন্তু তার আগে গিভ মি স্কচ!
সাহেব বলল, নো প্রব্লেম। বাট কল রাইনো নাউ।
নো স্কচ, নো কল। লছমন মাথা নাড়ল।
বাঙালি লোক দুটোর একজন সাহেবকে চাপা গলায় কিছু বলতে সাহেব ইশারা করল। দ্বিতীয় লোকটা জিপের পিছনে গিয়ে একটা পিসবোর্ডের বাক্স বের করে মাটিতে রাখল, এই নাও।
লছমন এগিয়ে গিয়ে বাক্সের মুখ খুলে একটা বোতল বের করে মুখের সামনে তুলে ভাল করে দেখল। তারপর বোতলটাকে আবার বাক্সের মধ্যে রেখে সেটাকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
সাহেব বলল, কল দেম।
লছমন বলল, ওরা এখন বাংলোর ওপাশে নুন খেতে এসেছে। ওদিকে চলুন।
চারজন লোক একটু ঘুরে বাংলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাহেব ইশারা করল ডাকার জন্য। লছমন রেলিং-এর উপর উঠে মুখের দু’পাশে হাত রেখে অদ্ভুত আওয়াজ তুলল। অর্জুন আর পদমবাহাদুর ততক্ষণে চলে এসেছে। ওদের গাড়ির আড়ালে। অদ্ভুত গলায় আওয়াজ তুলে যাচ্ছে লছমন। হঠাৎ নীচের জঙ্গলে গাছ ভাঙার শব্দ শুরু হল। যেন দুদ্দাড় করে ছুটে আসছে কিছু প্রাণী।
ঠিক তখনই শিলিগুড়ি থেকে আসা মাইকেলের দুটো লোক চুপচাপ সরে এসে সিঁড়ি বেয়ে বাংলোর উপরে চলে গেল।
হঠাৎ লছমন চেঁচিয়ে উঠল, দেখুন সাহেব, দেখুন।
অর্জুন কিছু বোঝার আগেই একরাশ বুনো অন্ধকার যেন ছুটে গেল ওপাশে। ওগুলো যে গন্ডার, তা বুঝতে অসুবিধে হল না। তারপরই বেশ জোরে ভাঙচুরের শব্দ কানে এল। তখনই উপরের বারান্দায় চলে এসে লোক দুটোর একজন ইংরেজিতে ঘোষণা করল, কেউ নেই সাহেব। ওরা পালিয়েছে।
কী করে পালাবে? ওরা তো সন্ধের পরে এখানে ফিরে এসেছে। ওই তো ওদের গাড়ি এখানেই পড়ে আছে। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। সাহেব বলল।
এইসময় সেই পায়ের আওয়াজ আবার ফিরে আসছিল। লছমনকে দৌড়োতে দেখে সাহেবও দৌড়ে বাংলোর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। অর্জুন পদমবাহাদুরকে বলল, দৌড়োও। তরতর করে ওরা নেমে গেল নীচে। তারপর একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল, গন্ডারগুলো যেন আছড়ে পড়ল বাংলোর উপর।
ওদিকে তখন রেঞ্জার অফিসের চৌকিদাররা পটকা ফাটাচ্ছে। গন্ডারদের ধাক্কায় বাংলোটা দুলছে। সাহেবের চিৎকার শোনা গেল, ওদের চলে যেতে বলো, নইলে আমাদের মেরে ফেলবে।
লছমনের ভয়ার্ত কণ্ঠ শোনা গেল, আমি ডাকতে জানি, থামাতে জানি । বাংলোর সিঁড়ি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার পর গন্ডারগুলো শান্ত হল, কিন্তু জায়গা ছেড়ে গেল না। ঠিক তখনই বাংলোর বারান্দা থেকে মাইকেলের দু’জন লোক গুলি চালাল গন্ডারদের উদ্দেশে। সেটা দেখে খেপে গেল লছমন, গুলি করছেন কেন? খবরদার, গুলি করবেন না। ওদের গুলি করার কোনও কথা ছিল না।
অ্যাই চোপ। তুই নিশ্চয়ই তোক দুটোকে খবর দিয়েছিস, নইলে ওরা পালাবে কেন? বল, কোথায় রেখেছিস ওদের?
আমি কাউকে খবর দিইনি। আমি কথা দিয়েছিলাম গন্ডার দ্যাখাব, দেখিয়ে দিয়েছি। লছমন প্রতিবাদ করল।
দ্বিতীয় লোকটা বলল, এই ব্যাটা সাহেবটার কী দরকার ছিল গন্ডার দেখতে চাওয়ার। যে কাজে এসেছি তাই চুপচাপ করে চলে যাওয়া উচিত ছিল। যাক, গন্ডারগুলো চলে যাচ্ছে।
লছমন সেটা দেখে মাথা নাড়ল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, পালান, পালান এখান থেকে। হাতির দল আসছে।
দোতলার বারান্দা থেকে লাফিয়ে নামল সে। তারপর চোঁ-চোঁ দৌড়ল রেঞ্জারের অফিসের দিকে।
প্রথম লোকটা চেঁচাল, নামুন, গেটডাউন।
দ্বিতীয় লোকটা উপর থেকে লাফ দিয়েই আর্তনাদ করে উঠল, মরে গেছি, আমার পা… ওরে বাবা রে।
প্রথম লোকটা এবং সাহেব লাফিয়ে নীচে নেমে লোকটার কাছে গেল। প্রথম লোকটা তখন যন্ত্রণায় কাতর দ্বিতীয়কে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, হাঁটতে পারবি?
না, আমার ডান পা একদম গিয়েছে, উঃ, কেঁদে উঠল দ্বিতীয়জন।
প্রথম লোকটা ইতস্তত করছিল। ইংরেজিতে বলল, হাতি আসছে। এখানে ওকে পেলে মেরে ফেলবে।
সাহেব বলল, কোথায় হাতি? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ওই লোকটা আমাদের ভয় দেখিয়ে পালিয়ে গেল। তুমি যাও, গাড়িটাকে এখানে নিয়ে এসো। না হলে একে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
লোকটা মাথা নাড়ল। তারপর বেশ ভয়ে ভয়ে পা বাড়াল।
পদমবাহাদুরকে ইশারা করে অর্জুন উপরে উঠে এল। মাটিতে পড়ে থাকা লোকটা সমানে ককিয়ে যাচ্ছে। সাহেব তাকে চুপ করতে বললেও সে থামছে না। হঠাৎ রেগে গিয়ে সাহেব তাকে লাথি কষাল, তাতে চিৎকার আরও বেড়ে গেল।
অর্জুন সোজা সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, আমার নাম অর্জুন। তোমার নামটা জানতে পারি?
চমকে গেল সাহেব, তুমি কে?
অর্জুন হাসল, নামটা শোনবার পরও জিজ্ঞেস করছ? আমি তোমার টার্গেট নম্বর ওয়ান। তোমার নাম কী?
কার্ল।
বাঃ! কিন্তু কার্ল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। চলো, ওখানে আমাদের গাড়ি আছে, চলো গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসি। অর্জুন বলল।
হঠাৎ পকেটে হাত দিল কার্ল, চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। মাথার উপর হাত তুলে পিছন ফিরে দাঁড়াও। কার্ল পিস্তল বের করল।
অর্জুন বাধ্য হল আদেশ মান্য করতে। পদমবাহাদুর এগিয়ে আসছিল মাটিতে পড়ে থাকা লোকটির পাশ দিয়ে। যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতেও লোকটা পদমবাহাদুরের পা ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দিল যে, সে মুখ থুবড়ে পড়ল সামনে। এইসময় জিপের আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রথম লোকটা জিপ নিয়ে চলে এল সামনে। অর্জুনকে বেঁধে ফেলতে বেশি দেরি করল না সাহেব। পদমবাহাদুরকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হল বাংলোর ওপাশে। আহত লোকটিকে ওরা
সযত্নে তুলে নিল জিপে। কার্ল বলল, একটু দাঁড়াও। তারপর ভাঙা সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে বাংলোর দোতলায় শরীরটা নিয়ে গেল জিমন্যাস্টের মতো। মিনিটদুয়েকের মধ্যে ফিরে এল লোকটা লুসির ব্যাগ নিয়ে।
অর্জুনকে পিছনে বসিয়ে ওরা জিপে উঠল। কার্ল বলল, চালাকি আমি পছন্দ করি না। দু’দিন ধরে খুব ভুগিয়েছ আমাদের। প্রাণে বাঁচতে চাও তো চুপচাপ বসে থাকো। আর এই যে, তুমি কি মনে করছ পৃথিবীতে এর আগে কারও পা ভাঙেনি? দয়া করে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করো।
জিপ চলছিল সেই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ প্রথম লোকটা চাপা গলায় বলে উঠল, সর্বনাশ। ওটা কী?
অন্ধকারে সামনের পথ স্পষ্ট না হলেও বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা পড়ে আছে রাস্তা জুড়ে। অত লম্বা কোনও প্রাণী হতে পারে না। প্রাণ থাকলে নড়াচড়া করত। একবার লাইট জ্বালিয়েই নিভিয়ে দিল প্রথমজন। একটা বিশাল গাছ রাস্তা আটকে রেখেছে। প্রথমজন বলল, ওরকম উদ্ভট শখ, কারও হয়? রাতের বেলায় গন্ডারদের ডাকো, দেখব। আর-একটু হলেই ওখানে প্রাণ যেত। আর এখানে ওদের ছুটন্ত শরীরের ধাক্কায় গাছ পড়েছে। এখন যাব কী করে?
কার্ল লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে। পকেট থেকে টর্চ বের করে রাস্তাটা দেখে এসে বলল, হয়তো গন্ডাররাই গাছ ফেলেছে। কিন্তু গাছটাকে ওইভাবে রেখে যায়নি।
তার মানে? প্রথমজন খিঁচিয়ে উঠল।
কোনও মানুষ টেনে নিয়ে গিয়েছে। মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট।
এখানে মানুষ আসবে? এত রাতে?
সেই মোটকা পিপেটা কোথায় গেল, তা কি একবারও ভেবেছ?
প্রথমজন বলল, তাই তো।
অতএব দয়া করে নেমে এসো।
অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। যেভাবে ওরা ওর হাত-পা বেঁধে রেখেছে, তাতে শোনা ছাড়া কিছু করবার নেই। কিন্তু মেজর অত বড় গাছটাকে টেনে রাস্তা বন্ধ করেছেন, এটা ভাবাই যাচ্ছে না। তা হলে নিশ্চয়ই তিনি আশপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন।
গাছটাকে সামান্য সরিয়ে গাড়ি চলার উপযোগী করে ওরা ফিরে এল। মিনিটকুড়ির মধ্যে নৌকোর মতো দুলতে দুলতে জিপ শেষ পর্যন্ত হাইওয়েতে উঠে পড়ল।
প্রথম লোকটা জিজ্ঞেস করল, ওকে নিয়ে কোন হাসপাতালে যাব?
সেটা আমার চেয়ে তুমিই ভাল জানেনা। কার্ল জবাব দিল।
মাদারিহাটের মধ্যে দিয়ে জিপ ছুটল। এখন এই মিনি শহরটা গভীর ঘুমে। একটা আলোও জ্বলছে না কোথাও।
ঠিক তখনই অর্জুনের মাথার অস্বস্তি শুরু হল। পকেটে রাখা মোবাইলে আলো দপদপ করছে। ঠিক তারপরেই প্রোফেসর মুলেনের গলা কানে এল, এখন ইন্ডিয়া টাইম অনুযায়ী তোমার ঘুমোবার কথা। তবু বাধ্য হয়েই তোমাকে জাগাচ্ছি। তুমি মেজরকে বলবে, আগামীকালই কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্কে তোমাদের নিয়ে চলে আসতে। কথাটা লক্ষ করো, তোমাদের বলছি। অর্থাৎ তুমি আর লুসি। ওকে।
অর্জুন শ্বাস ফেলল। সে এখন কী অবস্থায় আছে, তা জানানো সম্ভব হচ্ছে। না। অতএব প্রোফেসর বুঝবেন কী করে, কেন ফেরা যাবে না।
আমি একটু নীচে নামব। অর্জুন চলন্ত জিপে বসে বলল।
কার্ল জিজ্ঞেস করল, কেন?
প্রকৃতি ডাক দিয়েছে।
অ। ওহে, গাড়িটা একটু থামাও।
গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে প্রথমজন বলল, ওকে সার্চ করা হয়নি। দেখুন পকেটে কোনও অস্ত্র আছে কি না।
অর্জুনকে জিপ থেকে নামিয়ে কার্ল অর্জুনের পকেটগুলো হাতড়াতে গিয়ে মোবাইল সেট পেয়ে গেল। অর্জুন বলল, আমার হাত খুলে না দিলে…
কার্ল প্রথম লোকটিকে বলল, ওকে হেল্প করো। আমি এই যন্ত্রটি দেখছি।
বোতাম টিপে টিপে কার্ল রিসিভড কলাম বের করে চেঁচিয়ে উঠল, মাই গড। ইট মাস্ট বি ওভারসিজ কল, মিনিটদুয়েক আগে এসেছে।
অর্জুন তখন জলবিয়োগ করছিল প্রথমজন হাত খুলে দেওয়ায়।
কে ফোন করেছিল?
কেউ ফোন করলে তো শুনতেই পেতেন। রিং হত। কাজ শেষ হতেই অর্জুনের হাত বেঁধে দেওয়া হল।
সঙ্গে সঙ্গে সজোরে চড় মারল কার্ল। পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিল অর্জুন। কার্ল গজরাল, আমাকে নির্বোধ ভাবো তুমি? তোমার সন্ধানে কেন এদেশে এসেছি? অ্যাঁ!
প্রথম লোকটা বলল, ঠিক আছে। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। এটা হাইওয়ে। পুলিশ এসে পড়তে পারে, উঠুন।অর্জুনকে উঠিয়ে দিল লোকটা। চোয়াল কনকন করছিল। জিপ চলতেই অর্জুন বলল, তোমার নাম বলছে তুমি জার্মান। প্রোফেসর মুলেনও তাই। এই একটা জায়গায় মিল দেখছি।
মুলেন তোমাকে গিনিপিগ করেছে, তা তুমি জানো?
না।
ও যে এক্সপেরিমেন্ট করছে, তা শতকরা দু’জন লোকের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। ওই টু পার্সেন্টের মধ্যে তুমি আছ।
তা হলে হাবুকে খুন করতে গিয়েছিলে কেন?
লোকটা বেআদব। ওর মাথার পাশে মোবাইল ফোন রেখে সেই নম্বর ব্যবহার করে দেখতে চেয়েছিলাম ওর মস্তিষ্কে খবর পৌঁছে দেওয়া যায় কিনা! কিন্তু বুদ্বুটা এমন শক্তি দ্যাখাতে চাইল যে, মেরে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। আশা করি, তুমি ওই ভুল করবে না। কার্ল বলল।
অর্জুন স্বস্তি পেল। যাক, হাবু বেঁচে গিয়েছে, এই তথ্য এদের জানা নেই!
কিন্তু প্রোফেসর মুলেনের গোপন খবর কার্ল জানল কী করে? বিট্সাহেব প্রোফেসরের হয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। মেজর নর্থ বেঙ্গলে আসার সময় বলেছেন, লুসি পাখির ডাক রেকর্ড করতে এসেছেন। সে নিজে মোবাইল নিয়েছে মেজররা এদেশে আসার কয়েকদিন আগে। তার নম্বর পাঠিয়েছে, ব্রেন স্ক্যান এবং পি ই টি রিপোর্ট পাঠিয়েছে। আর আর সেই রিপোর্ট যে প্রোফেসর মুলেনকে মোবাইলের মাধ্যমে তার মস্তিষ্ক কোষে শব্দ পাঠাতে সাহায্য করেছে, এ-কথা কার্ল জানতে পারল কী করে?
হঠাৎ কোমরের কাছে ভিজে ভিজে অনুভূতি হওয়ায় মুখ ফেরাতেই আহত লোকটাকে দেখতে পেল অর্জুন। ওর আহত পা তার কোমরে ঠেকছে। সে চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলল। প্রথম লোকটা গাড়ির গতি কমিয়ে জিজ্ঞেস করল, আবার কী হল?
এই লোকটার শরীর থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। আমার জামা ভিজে গিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাল প্রথম লোকটা। দৌড়ে পিছনে এসে ডাকল, কী রে? ঠিক আছিস তো? এই সামু…। যাচ্চলে, এ তো কথা বলছে না! শরীর থেকে সব রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে নাকি? এখন কী করা যায়?
কার্ল বলল, ফুন্টশোলিং চলো। ওখানে ভাল ডাক্তার নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
এখনও অনেকটা পথ। তার আগেই তো ও ছবি হয়ে যাবে।
গেলে যাবে। টাকা নিয়ে প্রোফেশনাল হয়েছে, অথচ ঠিক মত লাফাতে জানে না!
অ্যাই, ও আমার জিগরি দোস্ত। এসব কথা বলবে না।
অর্জুন বলল, কাছেই একটা চা-বাগানের হাসপাতাল আছে। ওখানে নিয়ে গেলে বেঁচে যেতে পারে।
আপনি চেনেন?
হ্যাঁ।
চলুন, লোকটা আবার ড্রাইভিং সিটে ফিরে গেল। অর্জুনের নির্দেশমতো সুভাষিণী চা-বাগানে যখন জিপ ঢুকল তখন অর্জুন বলল, আমাকে এভাবে দেখলে ওরা আপনাদের প্রশ্ন করবে। কী উত্তর দেবেন?
লোকটা আবার গাড়ি থামিয়ে পিছনে এসে অর্জুনকে বন্ধনমুক্ত করতে যাচ্ছিল। কিন্তু কার্ল তাকে বাধা দিল, নো, নেভার। ওকে খুলে দিলে আমাদের বিপদে ফেলবেই। ওর ব্রেন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
কিন্তু আমার বন্ধুর চিকিৎসার জন্য ওর সাহায্য দরকার, প্রথম লোকটি চেঁচিয়ে বলল।
হাসপাতালের সামনে আলো জ্বলল। ছোট্ট হাসপাতাল। এখন ডাক্তারদের থাকার কথা নয়। নার্স ছিলেন। তাঁকে বলে একটি চৌকিদারকে পাঠানো হল ডাক্তারকে তাঁর কোয়ার্টার্স থেকে ডেকে আনতে। ভদ্রলোক বিছানা ছেড়ে চলেও এলেন খুব তাড়াতাড়ি। এসে সব দেখে বললেন, এই হাসপাতালে শুধু বাগানের কর্মীদের চিকিৎসা হয়। কিন্তু অর্জুনবাবু, আপনাকে আমি চিনি। আগেও এখানে দেখেছি। তা ছাড়া কেসটা খারাপ দিকে যাচ্ছে, ভরতি করে নিচ্ছি। তবে কাল জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়িতে নিয়ে যাবেন। দ্বিতীয় লোকটিকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, কমপাউন্ড ফ্র্যাকচার। হাড় বেরিয়ে এসেছে। ফলে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। অপারেশন করতে হবে। আমি কয়েকটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলাম, যাতে ইনফেকশন না হয়। স্যালাইন আর অক্সিজেন চলছে। আপনাদের মধ্যে কারও ‘ও’ গ্রুপের রক্ত আছে?
প্রথম লোকটা বলল, আমার ‘ও’ গ্রুপ।
তাড়াতাড়ি ভিতরে আসুন।
ওরা ভিতরে চলে গেলে অর্জুন কার্লকে জিজ্ঞেস করল, কী চাও তুমি?
কার্ল কাঁধ ঝাঁকাল। উত্তর দিল না।
এইসময় গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা গেল। গাড়িটা অনেকটা কাছে এসে থেমে গেল। তারপর দু’জন লোকের অস্পষ্ট মূর্তি গাড়ি থেকে নামল।
অর্জুন চিৎকার করল, মেজর, এদিকে আসুন।
মিনিটখানেকের মধ্যেই পদমবাহাদুরকে নিয়ে মেজর চলে এলেন সামনে, এই উল্লুকটা, এই উল্লুকটাকে কী করে কঞ্জা করলে?
একে আপনি চেনেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
কস্মিনকালেও নয়। কিন্তু ও তোমাকে বেঁধে এনেছে, তাই তো?
কী করে জানলেন?
আমি জঙ্গলের আড়াল থেকে দেখলাম। আজ আমি গন্ডারের পায়ের তলায় আর-একটু হলে পড়ে গিয়েছিলাম। পুলিশকে খবর দিয়েছ? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বের করল কার্ল, পুলিশ? পুলিশের কথা ভুলে যাও। অর্জুন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে।
কোথায়?
থিম্পু। ক্যাপিটাল অফ ভুটান। কাল দুপুরের ফ্লাইটে দিল্লি থেকে প্রোফেসর মুলেনের প্রধান সহকারী থিম্পু আসছেন।
প্রধান সহকারী? তাকে তো দু’মাস আগে তাড়িয়ে দিয়েছেন প্রোফেসর মুলেন? লোকটা ফর্মুলা চুরি করছিল। মেজর বললেন।
এইসময় বাইরে বেরিয়ে এল প্রথম লোকটা, সঙ্গে ডাক্তার, এঁর জন্যই ওই ভদ্রলোক বেঁচে যাবেন। এত রাতে আপনারা আর কোথায় যাবেন। আমার অফিসঘরে বিশ্রাম করুন। ম্যানেজার এখন বাগানে নেই। অর্জুনবাবু, ঘটনাটা আপনি আগামীকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে বলে যাবেন। আর হ্যাঁ, কালই ওকে অপারেশনের জন্য নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু…।
কোনও সমস্যা? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
এরকম কেস হাসপাতালে এলে পুলিশকে জানানো নিয়ম।
আমরা কোনও পুলিশ চাই না ডাক্তার। ভোর হলেই যদি সমস্যা হয়, তা হলে এখনই ওকে শহরে নিয়ে যেতে পারি। প্রথমজন বলল।
অসম্ভব। এখন ওকে মুভ করানো যাবে না। সেটল হতে সময় দিতে হবে। তা ছাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স চাই। বীরপাড়া থেকে আনাতে হবে। এই ভদ্রলোকের হাতে পিস্তল কেন? ডাক্তার অবাক হলেন।
প্রথমজন বলল, ওটা পকেটে রেখে দিন সাহেব।
কার্ল যন্ত্রটা পকেটে রাখল। প্রথমজন বলল, বিদেশি তো, সব সময় বন্য জন্তুর ভয় পায়। ঠিক আছে, আপনি যান, বিশ্রাম নিন।
ডাক্তার চলে গেলে কার্ল জিজ্ঞেস করল, তুমি কাল চলে যাবে?
হ্যাঁ।
মাইকেল কথা দিয়েছিল কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আমার সঙ্গে থাকবে।
ঠিক। কিন্তু আমার বন্ধুর প্রাণ বাঁচানো অনেক জরুরি।
এটা কিন্তু চুক্তিভঙ্গ হচ্ছে।
আই অ্যাম সরি সাহেব।
বেশ। অর্জুনকে বেঁধে জিপে তুলে দাও। আমিই ওকে ফুন্টশোলিং-এ নিয়ে যাব। ওখান থেকে লোক জোগাড় করে থিম্পু যেতে অসুবিধে হবে না।
অর্জুন হাসল, তোমার বুদ্ধি দেখে হাসি পাচ্ছে আমার। উনি আমাকে বাঁধতে আসবেন আর আমি এখন এখানে সেটা করতে দেব? তখন আমি প্রায় একা ছিলাম। তুমি পিস্তল দেখিয়েছিলে, তাই মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন ওই চেষ্টা করতে গেলে ওকেও বন্ধুর পাশের বেড়ে গিয়ে শুতে হবে।
তুমি ভুলে যাচ্ছ আমার পকেটে পিস্তল আছে।
জানি। একটা গুলির আওয়াজ হলে শ’য়ে-শ’য়ে শ্রমিক ছুটে আসবে। তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। ছুঁড়ে দ্যাখো, অর্জুন হাসল।
হঠাৎ অসহায়ের মতো দু’হাতে পিস্তল তুলে মুঠোয় ধরল কার্ল, ওঃ! আই অ্যাম সো হেলপলেস। তারপর চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল লোকটা। শেষে চোখ খুলল, অর্জুন, আমার নাম কার্ল। আমি দিল্লিতে থাকি। আমি গুন্ডা-বদমাশ নই। এই মোটকুরা যেদিন বাগডোগরায় নেমেছে, তার আগের দিন ওই একই ফ্লাইটে আমি এসেছি। দিল্লি থেকেই মাইকেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল একজন। মাইকেল এই দুটো লোককে দিয়েছিল আমাকে সাহায্য করার জন্য। প্রোফেসর মুলেন যেমন মানুষের ব্রেন নিয়ে রিসার্চ করছেন, তেমনই ওঁর প্রধান সহকারী প্রোফেসর বেকারও একই কাজ করছেন। আমি ব্যবসার কাজে দিল্লিতে আছি। প্রোফেসর বেকার আমার আত্মীয়। উনি জানতে পেরেছেন প্রোফেসর মুলেন তোমার ব্রেন সেলে কথা পোঁছোতে পেরেছেন। অথচ সবার ব্রেনে এটা করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং গবেষকদের কাছে তোমার চাহিদা আছে। তুমি যদি কাল আমার সঙ্গে থিম্পুতে গিয়ে প্রোফেসর বেকারকে তোমাকে নিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ। দাও, তা হলে খুশি হব।
অসম্ভব, মেজর খেপে গেলেন, এক কোটি ডলার দিলেও তোমরা অর্জুনকে কিনতে পারবে না। প্রোফেসর মুলেন বিষ্টসাহেবের বন্ধু। তাই আমি বা অৰ্জুন তার সঙ্গেই থাকব। অর্জুন, এই হনুমানটাকে পুলিশের হাতে তুলে দাও।
ওঃ, আবার পুলিশ! অর্জুন, তুমি যাবে না?
অর্জুন হাসল। কথা বলল না।
কত টাকা পেলে তুমি যেতে পারবে?
আপাতত আমার টাকার খুব বেশি দরকার নেই কার্ল!
অ, থিতিয়ে গেল কার্ল। তারপর বলল, বেশ যেতে হবে না, কিন্তু তুমি আমাকে আধঘণ্টা সময় দেবে?
বেশ।
তা হলে চলো। শুধু তুমি আমার সঙ্গে যাবে।
তা হয় না। মেজর আমার সঙ্গে যাবেন।
এখানকার গেস্টহাউজটা কোথায়?
অর্জুন অবাক হয়ে গেল। কার্ল এই বাগানের গেস্টহাউজের কথা জানল কী করে? সে জিজ্ঞেস করল, আজ সন্ধের পর তুমি কি গেস্টহাউজে এসেছ?
না। এলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না, কার্ল হাসল, আমি জানি লুসি আছে ওখানে। চলো।
লুসিকে খুন করলে বা জ্যান্ত ধরে দিলে টাকা দেবে, একথা প্রচার করেছিলে?
হ্যাঁ।
কেউ যদি খুন করে ফেলত?
পারত না।
তোমরাই তো লুসির ঘর ভুল করে সাপ ফেলেছিলে।
না, আমরা জানতাম লুসি ও ঘরে নেই, ওই মোটকুটা আছে। ও মুলেনের চামচে। তাই একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম।
কী? মেজর চেঁচালেন, আমাকে শিক্ষা দেবে? সাপটা যদি আমাকে কামড়াত তা হলে? তা হলে কী হত?
অর্জুন ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথম লোকটাকে বলল, আপনি এখনই বীরপাড়ায় চলে যান জিপ নিয়ে। ভোর হতে দেরি নেই। ওখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসুন। চলুন মেজর।
গেস্টহাউজের গেট খুলতেই বাধা পেল ওরা। প্রহরীরা বলল, ভিতরে যাওয়ার হুকুম নেই। কিন্তু তাদের একজন অর্জুনকে চিনতে পারল। লোকটা বলল, মেমসাহেব বাংলো থেকে বেরোতে চেয়েছিলেন, আমরা যেতে দিইনি।
ভাল করেছ। ওর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি।
উপরে উঠে গেস্টরুমে ওরা বসতেই মেজর গিয়ে দরজায় শব্দ করলেন, লুসি, মাই লিটল সিস্টার, তুমি কি জেগে আছ?
দরজা খুললেন লুসি। বোঝা গেল তিনি ঘুমোননি। সবাইকে ভাল করে দেখলেন। কার্ল এগিয়ে গেল, আমি কার্ল।
আমি লুসি।
এভাবে কথা হচ্ছে বলে খারাপ লাগছে।
ঠিক আছে, এরা কি সব জেনে গিয়েছে?
হ্যাঁ। না জানিয়ে উপায় ছিল না। আমার লোক দুটোর জন্য সব বিগড়ে গেল। আমি তোমার সঙ্গে ভিতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?
নিশ্চয়ই।
কার্ল ভিতরে চলে গেল দরজা ভেজিয়ে। মেজর হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, এ কী! লুসি যে ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছে। বেচারা জানে না, এই লোকটা প্রোফেসর মুলেনের শত্রু।
আমার মনে হয় উনি জানেন। অর্জুন বলল।
জানে? আমরা একসঙ্গে প্লেনে এলাম। ও তো প্রোফেসর বলতে অজ্ঞান।
অপেক্ষা করে দেখুন।
খানিক বাদে কার্ল দরজা খুলে অর্জুনের সামনে এল, আমাদের কাছে কোনও যন্ত্রপাতি নেই। তবু একটা এক্সপেরিমেন্ট করবে লুসি। তোমার মোবাইল অন আছে কি?
হ্যাঁ।
ওটা কানের উপর রাখো।
অর্জুন মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতেই রিং হল সশব্দে। কার্ল বলল, এবার কানে চেপে ধরো। হ্যাঁ, আগে রিসিভ করো।
অর্জুন বোম টিপে কানের কাছে মোবাইল নিয়ে গেল। কোনও শব্দ নেই। তারপর হঠাৎ বিপবিপ বিপ শব্দ এবং তারপর হুইসলের আওয়াজ হয়ে মিলিয়ে গিয়ে পুনরাবৃত্তি হতে লাগল। হঠাৎ মাথার ভিতর প্রবল অস্বস্তি। অস্বস্তিটা বাড়ছে কিন্তু কোনও গলা শুনতে পাচ্ছে না অর্জুন। ঠিক সেই প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন এলে এই বিপ বিপ শব্দে এইরকম অস্বস্তি হয়ে থাকে। সে মোবাইল সরিয়ে নিতে কার্ল প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথায় কি কোনও অনুভূতি হচ্ছে?
হ্যাঁ। অস্বস্তি হতে হতে ফাঁকা হয়ে গেল মাথার ভিতরটা।
অর্জুন বলামাত্র কার্ল চিৎকার করে উঠল, লুসি, ট্রলি ইটস ওয়ার্কিং।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী হচ্ছে?
লুসি বেরিয়ে এলেন বাইরে, প্রোফেসর মুলেনের থিয়োরি হল পাখিদের শ্রবণশক্তি খুব বেশি। বিশেষ করে বিপবিপ বিপ ডাকটা যে-পাখি ডাকে, ওদের কানে শব্দটা পৌঁছে দিলেই ওরা ডেকে উঠবে। আর এই সিগনালটা ছড়িয়ে যাবে অনেক দূরে। নাউ, অর্জুন, অন বিহাফ অফ প্রোফেসর বেকার, তোমাকে এক লক্ষ ডলার অফার করছি। তোমার ব্রেনের স্ক্যান রিপোর্টের কপি আমার কাছে আছে। কিন্তু পিইটি রিপোর্ট পাইনি। তা ছাড়া তোমার ব্রেন কেন সিগনাল অ্যাকসেপ্ট করছে, এটা জানা দরকার। তুমি কি আগামীকাল থিম্পু যাবে?
সরি লুসি, অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আমার মগজ আমি আপনাদের গবেষণার জন্যে দিতে রাজি নই। চলুন মেজর।
ওরা নীচে নেমে আসতেই দেখল দুটো পুলিশের জিপ বাংলোয় ঢুকছে। ডাক্তারবাবু ছুটে এলেন, কিছু হয়নি তো আপনার? লোকটার হাতে পিস্তল দেখে আমি থানায় খবর দিলাম। ইনি ওসি, মিস্টার সেন, ইনি অর্জুন।
মিস্টার সেন জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম, একজন বিদেশি পিস্তল দেখিয়েছেন?
হ্যাঁ। গত রাতে জলপাইগুড়ির একটি নিরীহ মানুষকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। আজ হলং বাংলো ওর জন্যই প্রায় চুরমার হয়েছে। দুটো পেশাদার লোককে ভাড়া করে এনেছিল আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্জুন বলল।
আর লুসি, লুসির কথা বলো।
না মেজর, লুসির বিরুদ্ধে কোনও চার্জ আনা যাবে না, অর্জুন বলল, হ্যাঁ, ওই লোকটি এখানকার ট্রানজিট থেকে সাপ চুরি করে এই ভদ্রলোককে মারবার চেষ্টা করেছিল। অর্জুনের কথা শেষ হতেই পুলিশবাহিনী উপরে উঠে গেল।
কী মনে হতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে অর্জুন বলল, এটা সহ্য হচ্ছে না আমার। কী করা যায় এটাকে নিয়ে?
পদমবাহাদুর এগিয়ে এল সামনে, আমাকে দেবেন সাব?
অর্জুন হেসে ওর হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। তুমি জানো না, আমার কী উপকার করলে?