উপন্যাস
গল্প

২. মেশিন

২। মেশিন

 চকচকে ধাতুর তৈরি একটা যন্ত্র দেখলাম সময়-পর্যটকের হাতে। টাইমপিসের চেয়ে সামান্য বড় যন্ত্রটা, কিন্তু নিখুঁতভাবে তৈরি। হাতির দাঁত আর কয়েকটা স্বচ্ছ ক্রিস্টালের কারুকাজও দেখলাম তার মাঝে। যন্ত্রটার বিচিত্র গঠন দেখে কৌতূহল না জেগে পারে না।

এরপরে যা ঘটল তা সত্যই অবর্ণনীয়। আটকোনা একটি টেবিল এনে রাখা হল আগুনের সামনে। ওপরে মেশিনটাকে বসিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনে বসলেন ভদ্রলোক। মেশিন ছাড়াও টেবিলের ওপর ছিল একটা শেড-দেওয়া ল্যাম্প-চিকমিক করছিল মডেলটা তার আলোয়। ঘরের মধ্যে এদিকে-সেদিকে আরও প্রায় ডজনখানেক মোমবাতি থাকায় আলোর অভাব ছিল না মোটেই। আগুনের একেবারে কাছেই বসেছিলাম আমি। সময়-পর্যটকের পেছনে বসল ফিল্বি। বাঁদিকে বসলেন ডাক্তার আর প্রাদেশিক মেয়র –ডানদিকে মনোবিজ্ঞানী, অল্পবয়েসি ছেলেটা রইল আমার ঠিক পেছনেই। প্রত্যেকেই চোখ-কান খুলে বেশ সজাগ হয়ে বসে–কাজেই এরকম পরিস্থিতিতে হাতসাফাই যে একেবারেই অসম্ভব, তা বুঝলাম সবাই।

আমাদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন সময়-পর্যটক। তারপর টেবিলের ওপর কনুই রেখে দু-হাতের তালুতে আলতোভাবে ধরলেন মেশিনটাকে।

বললেন, ছোট্ট একটা মডেল–আর কিছু না। সময়ের মাঝে খেয়ালখুশিমতো ঘুরে বেড়ানোর অভিনব এক পরিকল্পনা। মেশিনটার নিখুঁত কারুকাজ, এদিকের এই সূক্ষ্ম রডটা, ওপাশের ওই লিভার–প্রতিটিই লক্ষ করার মতো, মনে রাখার মতো। খুবই খুদে এই মেশিন। কিন্তু একেই তৈরি করতে আমার পুরো দুটি বছর গেছে। লিভারটা টিপলে মেশিন উধাও হয়ে যাবে ভবিষ্যতের গর্ভে আর এটা টিপলে যাবে ঠিক উলটোদিকে– অতীতের হারানো পাতায়। এই আসনটা হল চালকের বসবার জায়গা। ভালো করে দেখে রাখুন মডেলটা–টেবিলের ওপর নজর রাখুন সবাই। পরে যেন বলে বসবেন না যে, ধাপ্পাবাজের মতো হাতসাফাইয়ের ভেলকি দেখিয়ে বোকা বানিয়েছি সবাইকে।

পুরো এক মিনিট সব চুপচাপ। মনোবিজ্ঞানীর বোধহয় কিছু বলার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কী ভেবে তিনিও বোবা হয়ে গেলেন।

সরু একটা লিভারের ওপর হাত রাখলেন সময়-পর্যটক। তারপরেই চট করে বললেন, না, আপনিই আসুন। এগিয়ে দিন আপনার আঙুল।

ভয়ে ভয়ে তর্জনী এগিয়ে দেন মনোবিজ্ঞানী। সময়-পর্যটক আঙুলটা দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন লিভারটা।

চোখের সামনে দেখলাম, লিভারটা ঘুরে গেল। কোনও হাতসাফাই নেই, চোখের ধাঁধা নেই। কোনওরকম চালাকি থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু পরক্ষণেই এক ঝলক বাতাসে লাফিয়ে উঠল ল্যাম্পের আকাঁপা শিখাটা। দপ করে নিবে গেল ম্যান্টেলের ওপর রাখা একটা মোমবাতি।

আর, টেবিলের ওপর ছোট্ট মেশিনটা দুলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অস্পষ্ট হয়ে গেল তার নিখুঁত ধাতব অঙ্গ। সেকেন্ডখানেকের জন্য চিকমিকে তামা আর হাতির দাঁতের একটা ফিকে ভৌতিক ছায়া দুলে উঠল ছায়া-মায়ার মাঝে। আর তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেটুকুও। ল্যাম্প ছাড়া টেবিলের ওপর আর রইল না কিছুই।

ঠিক পুরো একটা মিনিট কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে প্রথমে মনোবিজ্ঞানীই হেঁট হয়ে টেবিলের তলাটা দেখলেন।

 আর প্রসন্ন মুখে হাসতে লাগলেন সময়-পর্যটক। ধীর-পায়ে এগিয়ে গেলেন ম্যান্টলপিসের সামনে–পাইপটা বার করে তামাক ঠাসতে লাগলেন আপন মনে।

হতভম্বের মতো আমরা এর-ওর মুখের দিকে তাকালাম। ডাক্তার ফস করে বলে ওঠেন, আরে মশাই, আপনি কি সত্যই ভেবেছেন যে, ওই বিদঘুটে মেশিনটা সময়ের পথে হাওয়া খেতে গেল?

কোনও সন্দেহই নেই সে-বিষয়ে। পাইপে আগুন লাগিয়ে মনোবিজ্ঞানীর দিকে ফিরে দাঁড়ান সময়-পর্যটক। মোটেই ঘাবড়ে যাননি, এমনি ভাব দেখিয়ে মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি কাঁপা হতে একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। মুচকি হেসে বলে চললেন সময়-পর্যটক, ল্যাবরেটরিতে বেশ বড় সাইজের একটা মেশিন শেষ হয়ে এল প্রায়। তারপর তো ইচ্ছে আছে, নিজেই একদিন বেরোব।

এরপর আমরা কেউ আর কোনও কথা বললাম না। অথবা বলবার চেষ্টা করেও পারলাম না। সকৌতুকে আমাদের বিস্ময়-আঁকা মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন উনি, তারপর বললেন, আসুন, আসল টাইম মেশিনটা দেখাই আপনাদের।

বলে, একটা মোমবাতি নিয়ে পা বাড়ালেন বারান্দার পথে। পিছুপিছু চুম্বকে টানা লোহার মতো আমরাও এগিয়ে গেলাম। লম্বা টানা বারান্দার দেওয়ালে আমাদের লম্বা ছায়াগুলো মোমবাতির কাঁপা শিখায় কেঁপে কেঁপে উঠে কেমন জানি শিরশিরে ভাবে ভরিয়ে দিল আমার অন্তর।

ল্যাবরেটরিতে এসে যা দেখলাম, তা ড্রয়িং রুমে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া খুদে মেশিনটারই বিরাট সংস্করণ। কতকগুলো অংশ চকচকে নিকেলের তৈরি, সাদা হাতির দাঁতের কাজও দেখলাম কয়েক জায়গায়। পাথরে ক্রিস্টালও বসানো আছে এখানে সেখানে। মেশিনটা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এলেও কতকগুলো কোনো ক্রিস্টালের ডান্ডা তখনও পড়ে ছিল পাশের বেঞ্চে। একটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম–মনে হল কোয়ার্টজের তৈরি।

ডাক্তার বললেন, আপনি কি মশাই তামাশা জুড়েছেন, না সত্যিই সময়ের পথে ঘুরে বেড়ানোর মতলব আঁটছেন?

মাথার ওপর বাতিটা তুলে ধরে বললেন সময়-পর্যটক, এই মেশিনে বসেই আমি। আমার অভিযান চালাব সময়ের বুকে–এই আমার প্রতিজ্ঞা। জীবনে এর চাইতে বেশি সিরিয়াস যে আর আমি হইনি–তা আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন।