উপন্যাস
গল্প

১৬. কাহিনির পর

১৬। কাহিনির পর

একটু থেমে আবার বললেন তিনি, ভাবছেন, মস্ত বড় একটা আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা আপনাদের বলার জন্যে যে ফিরে এসেছি তা-ও তো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না আমি। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস করুন, এতটা আশা করা সত্যিই উচিত হয়নি আমার। ধরে নিন, সবটাই ডাহা মিথ্যে, নিছক একটা ভবিষ্যদ্বাণী। ধরে নিন, কারখানায় বসে একটা আজগুবী স্বপ্ন দেখেছি। না-হয় ভাবতে পারেন, মানুষজাতির ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত এই গাঁজাখুরি উপন্যাসটাই ফেঁদে বসেছি। নিছক গল্প হিসাবে ধরেই বলুন তো কেমন লাগল আপনাদের?

পাইপটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঠুকতে লাগলেন তিনি। ক্ষণকালের জন্য গভীর নৈঃশব্দ্য নেমে এল ঘরে। তারপরেই শুরু হল চেয়ার টানার জুতোর মসমস শব্দ। অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে দেখি, পলকহীন চোখে ডাক্তার লক্ষ করছেন সময়-পর্যটককে। সম্পাদক তাঁর ছনম্বর সিগারেটটার ডগায় চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। সাংবাদিক ঘড়ি হাতড়াচ্ছেন। বাকি সবাই একেবারে নিশ্চল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন সম্পাদক। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আপনি গল্প-লেখক হতে পারলেন না!

আপনি তাহলে বিশ্বাস করেননি?

আরে মশাই–।

তাহলে করেননি। আমার দিকে ফিরলেন সময়-পর্যটক। দেশলাইটা দিন তো… বিশ্বাস কি আমিও করেছি… কিন্তু…

হঠাৎ ওঁর চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা শুকনো সাদা ফুল দুটোর ওপর। তারপরেই আঙুলের গাঁটের প্রায় শুকনো কাটাছেঁড়াগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। ল্যাম্পের কাছে এসে ফল দুটো নেড়েচেড়ে দেখলেন ডাক্তার। বিড়বিড় করে ওঠেন তিনি।

সাংবাদিক বলেন, একটা বাজতে চলল, এবার তাহলে বাড়ি যাওয়া যাক, কী বলেন?

মনোবিজ্ঞানী বললেন, অনেক ট্যাক্সি মিলবে এখন।

 ডাক্তার বললেন, ফুলগুলো দেখতে কিন্তু অদ্ভুত। এগুলো নিয়ে যেতে পারি কি?

 ইতস্তত করেন সময়-পর্যটক, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে স্পষ্ট বলেন, নিশ্চয় না।

 সত্যি করে বলুন তো কোত্থেকে জোগাড় করলেন ওগুলো? শুধালেন ডাক্তার। দুহাতে মাথা চেপে ধরেন সময়-পর্যটক। একটু চুপ করে থেকে মৃদু কণ্ঠে বললেন, উইনা রেখেছিল আমার পকেটে। কিন্তু… কিন্তু এসব কি সত্যি না কল্পনা? সত্যিই কি আমি কোনওদিন টাইম মেশিন বা তার মডেল তৈরি করেছিলাম? স্বপ্ন, না পাগল হলাম আমি? নাঃ, মেশিনটা দেখতেই হবে আমাকে!

চট করে ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে করিডরের দিকে এগিয়ে গেলেন উনি, পিছুপিছু আমরাও গেলাম। ল্যাম্পের কাঁপা আলোয় দেখলাম দেওয়ালের গায়ে খাড়া মেশিনটা, বিদঘুটে স্কুল তার গড়ন, তামা আবলুশ, হাতির দাঁত আর স্বচ্ছ কোয়ার্টজে চিকমিকে তার শ্রীহীন অঙ্গ। স্বপ্ন যে নয়, তা কঠিন ধাতুর রেলিং স্পর্শ করেই বুঝলাম, হাতির দাঁতের ওপর লেগেছে বাদামি ছোপ, এখানে-সেখানে কাদার দাগ, নিচের অংশে ঘাস আর শেওলার কুচি, একটা রেলিং বেঁকে গেছে। ল্যাম্পটা বেঞ্চির ওপর রেখে বেঁকা রেলিং-এ হাত বুলিয়ে বললেন সময়-পর্যটক, স্বপ্ন নয় তাহলে। যে কাহিনি আপনাদের বললাম, তার প্রতিটি অক্ষর সত্য। বলে ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিঃশব্দে ফিরে এলেন স্মোকিং রুমে।

বিদায় নেওয়ার সময় একটু ইতস্তত করে ডাক্তার বললেন, আপনি দিনকতক বিশ্রাম নিন, অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন আজকাল। উত্তরে হা হা করে হেসে উঠলেন সময় পর্যটক।

সম্পাদকের সঙ্গে একই ট্যাক্সিতে ফিরলাম আমি। ভদ্রলোক তো ডাহা মিথ্যে বলে সবকিছু উড়িয়ে দিলেন। আমার পক্ষে কিন্তু অত চট করে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হল না। গল্পটা যেমন আজগুবি আর অবিশ্বাস্য, বলার ভঙ্গিও তেমনি বিশ্বাস্য যুক্তিসংগত। ঠিক করলাম, আবার দেখা করতে হবে সময়-পর্যটকের সঙ্গে। এইসব কথা ভেবে সারারাত ভালো করে ঘুমাতেই পারলাম না আমি।

পরের দিন সকালে গিয়ে শুনলাম, ল্যাবরেটরিতে রয়েছেন উনি। ল্যাবরেটরিতে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। টাইম মেশিনটা একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে, হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁলাম লিভারটা। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে দুলে ওঠার মতো সামান্য দুলে উঠল বিদঘুটে মেশিনটা। চমকে হাত সরিয়ে নিলাম আমি। করিডর দিয়ে স্মোকিং রুমে আসতে আসতে সময়-পর্যটকের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ভেতর বাড়ি থেকে আসছিলেন উনি। এক কাঁধে ছোট্ট একটা ক্যামেরা, অপর কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। আমাকে দেখে হেসে উঠলেন, মেশিনটা নিয়ে খুব ব্যস্ত এখন, কী খবর আপনার?

শুধালাম, কাল রাতে বিলকুল ধাপ্পা মারলেন কি সত্যি বললেন, তা-ই জানতে এলাম। সত্যিই কি আপনি সময়ের পথে বেড়াতে পারেন?

পারি। আমার চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার বললেন উনি। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, আধ ঘণ্টা সময় দিন আমাকে। ম্যাগাজিনগুলো রইল, পড়ন। লাঞ্চ পর্যন্ত যদি সবুর করতে পারেন, সময়পথে সত্যিই ভ্রমণ করতে পারি কি না, তার প্রমাণ আপনাকে আমি দেব। এখন তাহলে আসি।

বলে চলে গেলেন উনি। ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনলাম। যে কথাগুলো বলে গেলেন, তার অর্থ তখন অত খেয়াল করিনি। দৈনিক কাগজটা কিছুক্ষণ পড়ার পর হঠাৎ মনে পড়ল, একটু পরেই একজন প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। ঘড়ি দেখলাম, সময় আর বেশি নেই। ভাবলাম, সময়-পর্যটককে বলে ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে দেখা করে আসি।

ল্যাবরেটরির দরজার হাতলটা ধরামাত্র একটা বিস্ময়-চকিত চিৎকার শুনলাম, শেষের দিকে অদ্ভুতভাবে ক্ষীণ হয়ে এল শব্দটা আর শুনলাম, ক্লিক শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘটাং করে একটা আওয়াজ। দরজা খুলতেই এক ঝলক হাওয়া আমার পাশ দিয়ে বেগে বেরিয়ে গেল বাইরে, আর ভেতরে মেঝের ওপর ভাঙা কাঁচ পড়ার ঝনঝন শব্দ ভেসে এল। সময় পর্যটককে ভেতরে দেখলাম না। মুহূর্তের জন্যে বেগে ঘুরপাক খাওয়া তামা আর আবলুশের মাঝে যেন খুব আবছা প্রেতচ্ছায়ার মতো একটা মূর্তিকে বসে থাকতে দেখলাম, সে মূর্তি এত স্বচ্ছ যে, তার মধ্যে দিয়ে পাশে বেঞ্চের ওপর রাখা ড্রয়িং-এর সরঞ্জামগুলোও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু চোখ রগড়েই দেখি, ভৌতিক ছায়া অদৃশ্য হয়ে গেছে। টাইম মেশিনও উধাও হয়ে গেছে। দেওয়ালের পাশে ছোট্ট একটা ধুলোর ঘূর্ণিপাক ছাড়া ল্যাবরেটরি একেবারে শূন্য। জানলার একটা কাঁচও দেখলাম ভেঙে এসে পড়েছে ঘরের ভেতর।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আশ্চর্য একটা কাণ্ড ঘটল চোখের সামনেই, তবুও কিন্তু নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না। এমন সময়ে বাগানের দিকের দরজা খুলে মালি ঢুকল ভেতরে।

শুধালাম, উনি কি এদিক দিয়ে বাইরে গেলেন?

 না স্যার, এদিকে কেউ আসেনি।

বুঝলাম সব। প্রকাশকের কথা ভুলে গিয়ে সময়-পর্যটকের জন্য বসে রইলাম আমি। প্রতীক্ষায় রইলাম আরও বিচিত্র কাহিনি শোনার, বিচিত্রতর নিদর্শন আর ফোটোগ্রাফ দেখার আশায়। কিন্তু মনে হচ্ছে, সারাজীবনেও আমার এ প্রতীক্ষা আর ফুরাবে না। সময় পর্যটক উধাও হয়েছেন তিন বছর আগে–আর সবাই জানেন, আজও তিনি ফেরেননি।

.

উপসংহার

সন্দেহ জাগে, সত্যিই কি আর ফিরবেন উনি? হয়তো অতীতে ফিরে গিয়ে আদিম প্রস্তরযুগের রক্তপিপাসু বুনো বর্বরদের হাতে পড়েছেন; না-হয় তলিয়ে গেছেন খড়িগোলা ক্রিটেশাশ সমুদ্রের পাতালগুহায়; নয়তো জুরাসিক আমলের অতিকায় সরীসৃপ আর কিম্ভুতকিমাকার সরিয়ানদের রাক্ষুসে খিদে মিটিয়েছেন নিজেকে দিয়ে। এমনও হতে পারে, উনি এখন প্লিসিওসরাসে ভরা কোনও ওসাইটিক প্রবাল দ্বীপে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অথবা ট্রায়াসিক যুগের নির্জন লবণ সমুদ্রের ধারে পথ ভুলেছেন। কিংবা আরও সামনের দিকে এগিয়ে এমন এক কাছাকাছি যুগে পৌঁছেছেন, যেখানে মানুষ এখনও মানুষ, কিন্তু আমাদের যুগের সব সমস্যা, সব প্রশ্নের সমাধান করে রামরাজ্য সৃষ্টি করেছে। তারা। মানুষ তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে যে সমাজের উন্নতি করতে, হয়তো একদিন সেই সমাজই হবে তার কবরস্থান। কিন্তু আমার কাছে ভবিষ্যৎ এখনও অজ্ঞানের গভীর অন্ধকারে ভরা–তাঁর কাহিনিই শুধু সামান্য আলো ফেলেছে এখানে-সেখানে। হয়তো সে কাহিনি নিছক অলীক, কিন্তু তবুও আমার কাছে এখনও রয়েছে দুটি শুকনো ফুল–যে ফুল পৃথিবীতে এর আগে বা এখনও কোথাও জন্মায়নি।…

————

[১ অধুনালুপ্ত দানবাকার সামুদ্রিক সর্পবিশেষকে ইকথিওসরাস বলে।

 ২ গ্রিফিন একটা কাল্পনিক জন্তুর নাম। এর দেহ সিংহের মতো, চঞ্চু আর ডানা শকুনির মতো।

 ৩ কল্পনার রামরাজ্যকে বলে ইউটোপিয়া। এ-রাজ্যে অঢেল সুখ ছাড়া দুঃখের বালাই নেই।

 ৪ ম্যাডাগাস্কার দ্বীপপুঞ্জের নিশাচর বানরদের লিমার বলে।]