পাব থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে মারিও একটা টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করল। তারপর রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল, একটু আড়ালে অপেক্ষা করতে হবে। এখনই পুলিশ আসবে।
পুলিশ কেন? লুসি জিজ্ঞেস কল।
না হলে ওদের সরানো যেত না।
এই সময় সাইরেনের আওয়াজ হতেই ওরা দ্রুত একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। একসঙ্গে গোটা তিনেক গাড়ি দ্রুত ছুটে গিয়ে মেজরের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। ঝটপট পুলিশ অফিসাররা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। তৎক্ষণাৎ একটি গাড়ি তীব্রগতিতে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল। দুটো গুলির শব্দ হল। তারপর পুলিশের গাড়িগুলো ছুটল ওটার পেছনে। মারিও হাসল, কীরকম প্ল্যান করেছিলাম বলো, চলো।
এখন ব সুনসান। মেজরের বাড়ির সামনে কেউ নেই। অর্জুন মেজরের কাছ থেকে নেওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুলল, ভেতরে ঢুকল। তারপর ওরা তিনজনে লিফটে উঠে প্রথমে দশতলার বোতাম টিপল। দরজা খুলে ওরা ধীরে-ধীরে মেজরের ফ্লাটের সামনে পৌঁছল। দরজা বন্ধ থাকার কথা, আছেও। অর্জুন চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখল ভেতরে আলো জ্বলছে। ফ্ল্যাটে কেউ নেই, কিন্তু তাণ্ডব হয়ে গিয়েছে এখানে। জিনিসপত্র ভাঙা, ছড়ানো। ফ্ল্যাটটা তছনছ করে গিয়েছে কারা। মেজর সঙ্গে থাকলে চিৎকার করতেন এবং পৃথিবীর যাবতীয় গালাগালি উগরে দিতেন।
লুসি জিজ্ঞেস করলেন, এরকম হল কেন?
আমাদের না পেয়ে রাগ দেখিয়ে গিয়েছে ওরা।
কারা?
আটলান্টিক সিটির মাফিয়ারা।
তারা কেন রাগ দেখাবে?
সে অনেক বড় গল্প। মিস্টার আলাম্বা বেঁচে আছেন কিনা কে জানে?
মারিও বলল, ওঁকে একটা ফোন করতে পারো?
আমি ওঁর নাম্বার জানি না। মেজর জানেন। উনি থাকেন দশতলায়। নেমে গিয়ে দেখা যেতে পারে। অর্জুন বলল।
দরজা বন্ধ করে ওরা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসছিল। দশতলার করিডোরে পড়ার আগেই লিটের আওয়াজ হল। তিনজন লোক কথা বলতে বলতে লিট থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল। শেষ ধাপে পা দেওয়ার আগেই অর্জুন এবং বাকি দুজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সিঁড়িতেই। মিস্টার আলাদা দরজা খুলতে খুলতে বললেন, তোমরা আমার যে ক্ষতি করলে…উঃ। আমি সহ্য করতে পারছি না। গাড়িতে কে আছে কে চালাচ্ছে তা দেখার প্রয়োজন হল না?
লোকগুলো ঢুকে গেল, দরজা বন্ধ হল। লুসি বলল, ও তা হলে ওই ফ্ল্যাটে থাকে?
হ্যাঁ। মারিও, বাকি দুজনকে চেনা গেল?
হ্যাঁ। ওরা দুজনেই আটলান্টিক সিটির বোর্ডের মেম্বার।
অদ্ভুত ব্যাপার তো! অর্জুন বিড়বিড় করল।
মারিও বলল, ওদের দেখে তো মনে হল না মিস্টার আলাম্বার কোনও ক্ষতি করতে এসেছে। তাই না?
অর্জুন লুসির দিকে তাকাল, আপনি বেল টিপুন। দরজা খুলে বলবেন মিস্টার আলাম্বার সঙ্গে কথা বলতে চান। প্লিজ, মাথা গরম করবেন না। সময় নিয়ে যতক্ষণ পারেন ওঁর সঙ্গে কথা বলে যাবেন।
তোমরা?
আমরা একটু পরে আসছি।
বেল টেপার পর মিস্টার আলাদা দরজা খুলে খুব অবাক হয়ে বললেন, তুমি? এখানে? কী চাই তোমার?
লুসি বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
সরি। আমি এখন খুব ব্যস্ত।
কিন্তু কথা তো বলতেই হবে।
আমি বলেছি এখন ব্যস্ত। আমার একমাত্র মেয়ে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় আমি নেই। তা ছাড়া তুমি এখানে ঢুকলে কী করে? এ বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে নাকি! ডোন্ট ডিস্টার্ব মি লুসি।
সরি। আমাকে কথা বলতেই হবে। লুসির গলা চড়ল।
আমি যদি শুনতে না চাই?
তা হলে তোমার ঠিকানা ওদের হাতে পৌঁছে যাবে।
আচ্ছা। তা হলে তো তোমাকে ভেতরে আসতে বলতে হয়।
লুসি ভেতরে ঢুকে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
অর্জুন মারিওকে বলল, ভদ্রমহিলার জন্যে আমার ভয় হচ্ছে। কোনওভাবে পুলিশকে ফোন করা যায়?
ওপরের ফ্ল্যাটের চাবিটা আমাকে দাও।
চাবি নিয়ে মারিও চলে গেলে অর্জুন এক মুহূর্ত চিন্তা করল। মিস্টার আলাম্বাকে মোটেই ভীত বা সন্ত্রস্ত বলে মনে হচ্ছে না। অথচ মাফিয়া বাহিনী যদি তাঁর পেছনে লাগে তা হলে সেটাই ওঁর হওয়া উচিত ছিল।
সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল টিপল।
দরজা খুললেন মিস্টার আলাদা। অর্জুনকে দেখে প্রচণ্ড অবাক যে হয়েছেন তা বোঝা গেল। কিন্তু সামলে নিলেন ঝটপট, আরে! আপনি?
আমি খুব দুঃখিত, আপনার মেয়ে আমার নির্দেশ শুনে মারা গিয়েছে।
সঙ্গে-সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল আলাম্বার মুখ, ও একটা ইডিয়ট। নইলে আপনাদের আটলান্টিক সিটিতে নিয়ে যেত না। কী চান?
আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে আপনার জীবন বিপন্ন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মেজর বাধ্য হয়ে আপনার ফোন নম্বর মাফিয়াদের দিয়েছেন। ভেতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?
মাথা নাড়লেন আলাদা, আসুন।
ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল অর্জুন। ঘরের মাঝখানে একটি চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন লুসি। তাঁর ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। ঘরের একপাশে সোফায় বসে আছেন দুজন লোক।
আলাম্বা বললেন, আপনাদের ভাগ্য খুব ভাল ভদ্রমহোদয়রা। ইউনাইটেড স্টেটকে যে লোকটি সেই হারানো সাপ দিতে এসেছে সে এখন এই ঘরে আপনাদের সামনে।
লোক দুটি উঠে দাঁড়াল। আলাদা বললেন, অর্জুন, লকেটটা দেখি।
কোন লকেট?
যেটার ড়ুপ্লিকেট আপনি করিয়েছেন।
আপনি কী করে ভাবলেন ওটা নিয়ে আপনার কাছে আসব?
কেন এসেছেন?
আপনাকে সতর্ক করতে।
অনেক ধন্যবাদ। আলাম্বা ইশারা করতেই দুজন লোক এগিয়ে এল। একজন তার হাত পেছন মুড়ে ধরল। অন্যজন তার শরীরে খুঁজতে লাগল। লকেট পেতে দেরি হল না তার। আলাম্বার গলা থেকে যুদ্ধজয়ের আনন্দ ছিটকে বের হল। লকেটটা হাতে নিয়ে বললেন, দ্যাট ইট। এত সহজে যে এটা পাব, ভাবতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছে লুসি তুমি অর্জুনকে চেনো। তোমরা একই সঙ্গে এসেছ। তাই না?
তুমি মরো। তুমি মরলে আমি খুশি হব।
হা হা করে হাসলেন আলাদা। তারপর অর্জুনের সামনে এসে বললেন, তুমি ইন্ডিয়ান। এই সাপে তোমার দরকার নেই। কিন্তু তোমায় নিয়ে কী করি? আমার সন্দেহ হচ্ছে পুলিশ ডেকে আমার বন্ধুদের তুমি এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছ।
যারা নীচে ছিল তারা আপনার বন্ধু?
হ্যাঁ, বন্ধু। এই মহিলার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হল?
হয়েছে।
আলাম্বা তখন বাকি দুজনের দিকে তাকালেন, বন্ধুগণ, এই লোকটিকে নিয়ে কী করা যায়?
ওর জন্যে যা বরাদ্দ হয়েছে তাই হবে।
তবে তাই হোক।
এই সময় আবার বেল বাজল। আলাম্বা খুব বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে তাকালেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। অর্জুন মারিওর গলা পেল, অর্জুন এসেছেন এখানে?,
আপনি কে?
ওর বন্ধু।
না। নেই।
আপনি মিথ্যে বলছেন।
কী চান আপনি?
অর্জুনকে।
অর্জুন দেখল মারিওর শরীরটাকে মুঠোয় ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন আলাম্বা, এই তিনটেকে একই জায়গায় পাঠাও।
দুজনের একজন বলল, আরে! এ তো মারিও।
উঠে দাঁড়িয়ে মারিও বলল, তুমি! তুমি! তুমি আমার বউকে মেরেছ। আমার ছেলেকে মেরেছ! আই উইল কিল ইউ! ছুটে গেল মারিও। লোকটা অবলীলায় তাকে ধরে আছাড় মারল।
মারিওর শরীরটা মাটিতে পড়ে নিস্পন্দ হয়ে গেল।
আলাম্বা বললেন, এদের এমন জায়গায় ফেলে দাও যাতে পুলিশ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে না পায়।
দ্বিতীয় লোকটি বলল, ব্রঙ্কসের গারবেজ ড্রেনে ফেলে দেব।
আলাম্বা লকেটের সাপের মুখটা সামনে ধরলেন। পরীক্ষা করে চোখের পাথরে চাপ দিতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর মুখে হাসি ফুটল। আলাদা বললেন, ইয়েস। এটাই সেই সাপ।
আলাদা এগিয়ে এলেন, জিভ বের করো।
অর্জুন মাথা নাড়ল, আমার ইচ্ছে নেই।
দ্বিতীয় লোকটি ঝটপট এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে অর্জুনকে এমনভাবে ধরল যে, সে নড়তে পারল না। প্রথম লোকটি এবার অর্জুনের গাল এমনভাবে টিপে ধরল যে, অর্জুন জিভ বের না করে পারল না। এবার মিস্টার আলাদা সাপের চোখের গর্তের বিষ অর্জুনের জিভে ঘষতে গেলেন। অর্জুন প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত সে বাঁ পা শূন্যে তুলে আলাম্বার হাতে আঘাত করতে পারল। সঙ্গে-সঙ্গে সাপের লকেট ছিটকে আলাম্বার হাত থেকে দরজার সামনে গিয়ে পড়ল। আলাদা দৌড়ে সেটাকে তুলে নিতে যেতেই বেল বাজল। সাপটাকে তুলে দরজা খুলতেই দুজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন।
সুধামাসি মেয়ের কাছে আরও কিছুদিন থেকে যাবেন। তাঁর জামাই এখন সুস্থ। অর্জুন একাই জলপাইগুড়িতে ফিরে যাচ্ছিল। সুধামাসির মেয়ে অঞ্জনাদি তাকে হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢোকার আগেই অর্জুন দেখতে পেল মারিও এবং লুসি এগিয়ে আসছেন।
মারিও বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
অনেক ধন্যবাদ। অর্জুন বলল। আমাদের ভুলে যেয়ো না।
কখনও নয়।
এবার লুসি বললেন, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি? আমি খুব। সিরিয়াস।
বলুন।
আমি তোমার দিদি হতে পারি?
নিশ্চয়ই। যদি কখনও ভাইফোঁটায় দেখা হয় আপনি আমাকে ফোঁটা দেবেন। ব্যাপারটা আপনি বুঝবেন না কিন্তু সুযোগ পেলে বুঝিয়ে দেব।
লুসি বললেন, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
প্লেনে বসে দেশের পথে ফিরতে ফিরতে অর্জুনের মনে হল, কে ভেবেছিল, আলাম্বাই যত নষ্টের গোড়া। আসলে বদ মানুষ কখনওই ভাল হয় না।