১১২. ইন্দ্র কর্ত্তৃক বানরগণের জীবন দান

হইল রাক্ষস ক্ষয় হৃষ্ট পুরন্দর।
বলিলেন রামচন্দ্রে তুমি মাগ বর।।
দেবে রক্ষা করিলে মারিয়া দশানন।
বর মাগ ব্যর্থ রাম না হবে বচন।।
শ্রীরাম বলেন ইন্দ্র যদি দিবে বর।
তব বরে জীয়ে উঠুক মৃত যে বানর।।
ধন জন না দিলাম নহে ভূমি গাঁথি।
এড়িয়া স্ত্রী-পুত্র এল আমার সংহতি।।
হৃতা সীতা পাইলাম হইলাম সুখী।
বানরের ভার্য্যা পুত্র কেন হবে দুঃখী।।
এত যদি ইন্দ্রেরে বলেন রঘুনাথ।
বলিছেন পুরন্দর যোড় করি হাত।।
ভুবনের নাথ তুমি স্বয়ং নারায়ণ।
মারিয়া জীয়াতে পার এ তিন ভুবন।।
তুমি জান আপনা তোমারে জানে কে।
মরিয়া না মরে তব নাম জপে যে।।
আপনি চাহিলে বর কে করিবে আন।
রূপে বেশে সবে হউক দেবতা সমান।।
ইন্দ্রের আজ্ঞায় মেঘ অমৃত-সঞ্চারে।
সুধাবৃষ্টি হয় মৃত বানর উপরে।।
কাটা হাত কাটা পা সব লাগে জোড়া।
চারি দ্বারে উঠে সৈন্য দিয়া গাত্র মোড়া।।
যে বানর পড়িয়াছে রাক্ষসের বাণে।
মার মার করি উঠে যুদ্ধ করি মনে।।
কুম্ভকর্ণে মার বলি কেহ ডাক ছাড়ে।
ইন্দ্রজিতা মার বলি কেহ ডাক পাড়ে।।
দেবান্তক নরান্তক আর যে ত্রিশিরা।
রাবণেরে মার ঝাট পরনারী-চোরা।।
উন্মত্ত পাগল সবে হয়ে রণস্থলে।
ইষ্ট মিত্র বুঝায় চাপিয়া ধরে কোলে।।
কারে মার কারে কাট কিসের সংগ্রাম।
হইল রাক্ষস নাশ শত্রুজয়ী রাম।।
শ্রীরামের বামে দেখ জানকী সুন্দরী।
দেবগণ দেখ হেথা, এই স্বর্গপুরী।।
হরিষের কথা যদি শুনিল বানর।
মাথা নোঙাইল গিয়া রামের গোচর।।
ত্রিভুবনে নাহি দেখি তোমার সমান।
মরিয়া প্রসাদে তব পাই প্রাণদান।।
তোমা হেন প্রভু যেন পাই যুগে যুগে।
সেবা করি থাকি যেন রাখি আগে আগে।।
মরিল বানর যত পেল প্রাণদান।
জিজ্ঞাসা করেন রাম দেব-বিদ্যমান।।
রাম বলে দেবরাজ জিজ্ঞাসি তোমারে।
এক কথা সন্দ বড় আমার অন্তরে।।
উভয় দলেতে যুদ্ধ হইল বিস্তর।
পড়িল উভয় সেনা রাক্ষস বানর।।
সুধাবৃষ্টি কৈলে তুমি সবার উপর।
প্রাণদান পেয়ে উঠে অসংখ্য বানর।।
উভয় সৈন্যেতে হৈল সুধা বরিষণ।
বানরের মৃতদেহ পাইল জীভন।।
অতএব জিজ্ঞাসা করি যে তব স্থানে।
প্রাণদান রাক্ষসে না পেলে কি কারণে।।
ইন্দ্র বলে রাক্ষসে না পাইল জীবন।
ইহার বৃত্তান্ত শুন কমল-লোচন।।
রাবণেরে মার বলি কপিগণ মরে।
উদ্ধার হইবে বল কি নামের জোরে।।
রামে মার শব্দ করি মরেছে রাক্ষস।
রামনাম করে মরি গেছে স্বর্গবাস।।
শ্রীরাম বলিয়া প্রাণ বাহিরায় যার।
অনায়াসে বৈকুণ্ঠে যায় হইয়া উদ্ধার।।
মুক্তিপদ পাইয়াছে রামনাম-গুণে।
উদ্ধার হইয়া গেছে বাঁচিবে কেমনে।।
ইন্দ্র বলিলেন যাহ সবে নিজ বাস।
এতদিনে সবাকার পূর্ণ অভিলাষ।।
চৌদ্দবর্ষ বনে দশমাস উপবাস।
শ্রীরাম জানকী দোঁহে হউক সম্ভাষ।।
অবিশ্রাম সংগ্রামেতে না ছিল বিশ্রাম।
বিশ্রাম করহ রাম যাই স্বর্গধাম।।
শ্রীরামকে সীতারে করিয়া সমর্পণ।
দেবগণ চলিলেন আপন ভবন।।
যখন যে কর্ম্ম বভীষণ তাহা জানে।
এগারশত বৃহন্দে নেতের কাপড় টানে।।
কাঞ্চন-নির্ম্মিত ঘর অপূর্ব্ব গঠন।
রত্নসিংহাসনে পাতে নেতের বসন।।
উপরে চাঁদোয়া দোলে খাটে শোভে তুলি।
ঘর শোভা করে যেন পড়িছে বিজলী।।
স্বর্ণময় প্রদীপ জ্বলিছে চারিভিত।
পারিজাত-পুষ্প করে গন্ধে আমোদিত।।
বিশ্বব্যপ্ত করে গন্ধে এক পারিজাতে।
এক লক্ষ পারিজাত সিংহাসনে পাতে।।
বিভীষণ আপনি যে রহিল প্রহরী।
আওয়াসের বাহিরে বানর সারি সারি।।
বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া লক্ষ্মী হৈল অবতার।
সীতা সহ রাম প্রবেশের সে আগার।।
শ্রীরামের পাশে বসিলেন ঠাকুরাণী।
শ্রীপতির পাশে লক্ষ্মী যেমন তেমনি।।
রাম সীতা দুই জনে বসি সিংহাসনে।
পূর্ব্ব দুঃখ স্মরিয়া বিষণ্ণ দুই জনে।।
শ্রীরাম বলেন প্রিয়ে তোমার বিচ্ছেদে।
যে দুঃখ পেয়েছি সে কহিতে মরি খেদে।।
তুমি প্রাণ তুমি ধন তুমি সে জীবন।
তোমার বিহনে দেখি শূন্য ত্রিভুবন।।
দশ মাস তোমার বদন অদর্শনে।
অন্ধকারে ডুবিয়াছিলাম মানি মনে।।
সুধাকরে জ্ঞান করিতাম দিবাকর।
তাপ ভয়ে না হইতাম তাহার গোচর।।
ভ্রমর ঝঙ্কার আর কোকিলের ধ্বনি।
শুনিলে হইত জ্ঞান দংশে যেন ফণী।।
সাগর বন্ধন করি পাইব জানকী।
এ আশায় প্রাণ আছে নতুবা থাকে কি।।
পূর্ব্বে যত দুঃখ পাইলেন দেবী সীতা।
রামেরে কহেন সীতা হয়ে হর্ষান্বিতা।।
উভয়ের মনেতে বেদনা যত ছিল।
পরস্পর আলাপে সকল দুঃখ গেল।।
প্রভাত হইল নিশা উদিত ভাস্কর।
একে একে সবে গেল রামের গোচর।।
চতুর্দ্দিকে দাঁড়াইল শাখামৃগগণ।
যোড়হাত করি বলে রাজা বিভীষণ।।
বহুকাল অনাহার বহু পর্য্যটন।
করিয়া হয়েছ শ্রান্ত শ্রীরঘুনন্দন।।
করুক তোমার পরিচর্য্য দাসীগণ।
আনুক কস্তূরী আর সুগন্ধি চন্দন।।
দূর্ব্বাদল-শ্যাম-তনু হয়েছে সমল।
সে মল করিয়া দূর করুক নির্ম্মল।।
সহস্র যুবতী কন্যা আছে মম পাশ।
করিয়া তোমার সেবা পূরাউক আশ।।
শ্রীরাম বলেন, ওহে রাক্ষসাধিপতি।
আমার বচন তুমি কর অবগতি।।
লোকে বলে বিভীষণ তুমি ধর্ম্মময়।
পরনারী চোর তুমি মম মনে লয়।।
পরপত্নী নাহি দেখি নয়নের কোণে।
স্পর্শসুখ দূরে থাক না চাই নয়নে।।
কোটি কোটি দেবকন্যা এক ঠাঁই করি।
সীতা তুল্য তারা কেহ না হয় সুন্দরী।।
রাজকূলে জন্মিয়া ভরত ভাই সুখী।
কেবল আমার দুঃখে হয়ে আছে দুঃখী।।
হেন ভরতেরে যদি করি আলিঙ্গন।
তবে স পরিব বস্ত্র সুগন্ধি চন্দন।।
চৌদ্দবর্ষ ভ্রমিলাম বনে বহুতর।
তরিলাম বহু নদ নদী ও সাগর।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ ভ্রমিলাম বহু ক্লেশে।
হেন যুক্তি কর, যেন ঝাট যাই দেশে।।
বিভীষণ বলে প্রভু পাইলা বড় ক্লেশ।
একদিন মধ্যে তুমি যাবে নিজদেশ।।
কুবেরের রথ যে পুষ্পক তার নাম।
একদিনে তোমারে লইবে নিজ ধাম।।
এক দান চাহি আমি বিতর সম্প্রতি।
কিছুদিন লঙ্কাপুরে করহ বসতি।।
সকল সৈন্যের প্রভু করিব সেবন।
লঙ্কামধ্যে ভোগ ভুঞ্জি করহ গমন।।
শ্রীরাম বলেন প্রীত হইনু তোমারে।
বিলম্ব না কর তুমি আমা রাখিবারে।।
আহার না করে যারা মরণ না গণে।
হেন বানরের প্রীতি ভালবাসি মনে।।
সুগন্ধি চন্দন বানরে দেহ দান।
ভুঞ্জাইয়া নানা ভোগ করহ সম্মান।।
বানর-প্রসাদে তুমি লঙ্কাপুরে রাজা।
ভালমতে কর তুমি বানরের পূজা।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা রাজা বিভীষণে।
নানা সুখে স্নান করাইল কপিগণে।।
স্বর্ণখাটে বানর বসিলা সারি সারি।
স্নানদ্রব্য লইয়া আইল বিদ্যাধরী।।
দেব দানবের কন্যা গন্ধর্ব্ব রূপসী।
দেখিয়া সবার মুখে নাহি ধরে হাসি।।
কঙ্কন ঝঙ্কার আর গায়ের সুগন্ধ।
পাইয়া বানরগণ সকলে সানন্দ।।
দিব্য নারায়ণ তৈল সুগন্ধি চন্দন।
হাতাহাতি মাখে সবে আনন্দে মগন।।
স্নান করি পরে সবে বিচিত্র বসন।
গলায় পুষ্পের মালা নানা আভরণ।।
লঙ্কার সামগ্রী যত ভুবনের সার।
রাজার আজ্ঞায় দ্রব্য আনে ভারে ভার।।
অপূর্ব্ব সে ভক্ষ্য-দ্রব্য দিব্যনারী তায়।
স্বর্ণথালে পরিবেষে বানরেরা খায়।।
পাকা কাঁঠালের কোষ সবে খায় চুষি।
ক্ষীর-লাড়ু পাঁপড় মোদক রাশি রাশি।।
মধু পিয়ে কপিগণ ভরি স্বর্ণ-গাড়ু।
গাল ভরি কপিগণ খায় ঝাললাড়ু।।
ঝাললাড়ু খাইতে চক্ষেতে পড়ে লোহ।
বাপ না মরিলে যেন পাইলেক মোহ।।
গলা আঁচড়ায় কেহ কেহ করে থো থো।
বুড়া বুড়া কপি বলে হাত বাড়িয়ে থো।।
সোণার ডাবরে তারা করে আচমন।
রতন বাটায় করে তাম্বুল ভক্ষণ।।
রত্নাসিংহাসনে তারা করিল শয়ন।
পদসেবা করিতে আইল-কন্যাগণ।।
স্বর্ণখাটে শুইল বানর শয্যা মেলে।
দশ দশ দিব্য নারী প্রত্যেকের কোলে।।
রাবণ হরিয়াছিল যতেক নাগরী।
কালবশে তারা শেষে বানরের নারী।।
সুখেতে বঞ্চিল নিশা নিশাচর পুরে।
নিশা না প্রভাত হয় ভাবিছে অন্তরে।।
সে আশায় নিরাশ হইল কপিগণ।
পূর্ব্বদিকে চেয়ে দেখে উদিত তপন।।
আইল বানরগণ রামের গোচর।
প্রণাম করিয়া কহে শুন রঘুবর।।
তুমি হেন ঠাকুর হইও যুগে যুগে।
সদা সেবা করি যেন তব পদযুগে।।
যে সুখে ছিলাম কল্য করি নিবেদন।
বড় প্রীত করাইল রাজা বিভীষণ।।
কন্যাগুলা লয়ে করি দেশেতে গমন।
এই আজ্ঞা কর প্রভু কমললোচন।।
আজ্ঞা কর লঙ্কায় আর থাকি দুই মাস।
বানরের কৌতুকেতে শ্রীরামের হাস।।
শ্রীরাম বলেন শুন মিত্র বিভীষণ।
কন্যাদান দিয়া তুমি তোষ কপিগণ।।
বানরের প্রসাদে লঙ্কায় হলে রাজা।
ভালমতে কর তুমি বানরের পূজা।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা রাজা বিভীষণ।
নানা রত্ন দিল আর গজমুক্তাগণ।।
বসন ভূষণ কত দিলেক মাণিক।
কুবেরের ধন বুঝি না হবে অধিক।।
নানা দ্রব্যে করাইল বানরে সম্মান।
সমান বয়স বেশ কন্যা করে দান।।
অন্য দানে নাহি মানে আনন্দ তেমন।
কন্যাদানে যেমন হরিষ কপিগণ।।
একেক বানরে পাইল দশ দশ নারী।
নিবেদন করে প্রভু দেশে যাত্রা করি।।