২৫. কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুনের সহিত রাবণের যুদ্ধ

কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুনের সহিত রাবণের যুদ্ধ

শ্রীরাম বলেন বৃদ্ধ ছিলেন দুর্ব্বল।
তেকারণে হয়েছিল রাবণ প্রবল।।
বীরশূন্যা পৃথিবী ছিলেন সে সময়।
তেঁই রাবণের বৃদ্ধি ছিল অতিশয়।।
সেকালের রাজা ব্রহ্ম অস্ত্র নাহি জানে।
রাবণের পরাজয় নহে তেকারণে।।
মুনি বলেন, দশানন নানা মায়া ধরে।
রাক্ষস করিলে মায়া কোন্ জন তরে।।
মায়া-রণ দেখা-রণে অনেক অন্তর।
তেকারণে পরাজিত নহে লঙ্কেশ্বর।।
মানুষ হইয়া যিনি বিষ্ণু অধিষ্ঠান।
তাঁর ঠাঁই রাবণ যে পায় অপমান।।
কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন রাজা ছিল চন্দ্রবংশে।
সে সহস্র হাত ধরে জন্ম বিষ্ণু অংশে।।
নানা মূর্ত্তি ধরিয়া সে রাজ্য রাজ্য রাখে।
যাঁর নামে হারাধন আসিত সম্মুখে।।
শত শত কামিনী লইয়া কুতূহলে।
অর্জ্জুন করিত কেলি নর্ম্মদার জলে।।
মাহিষ্মতী-নগরে তাঁহার ছিল ঘর।
তথা গিয়া বার্ত্তা পুছে রাজা লঙ্কেশ্বর।।
লঙ্কার রাবণ আমি চাহি আজি রণ।
কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন কি করিল পলায়ণ।।
রাক্ষস-কটক চাপ অতি ভয়ঙ্কর।
অর্জ্জুন রাজার কাছে কার নাহি ডর।।
লোক বলে কিবা চাহ তুমি এই স্থলে।
করেন ভূপতি ক্রীড়া নর্ম্মদার জলে।।
নর্ম্মদায় যায় বীর অর্জ্জুন উদ্দেশে।
পথে যেতে বিন্ধ্যাগিরি দেখিল হরিষে।।
নানা ফল ফুল দেখে অতি মনোহর।
নানা পক্ষী কেলি করে শোভে সরোবর।।
নৃত্য করে ময়ূর, ঝঙ্কারে মধুকর।
নানা হংস কেলি করে দেখিতে সুন্দর।।
দানব গন্ধর্ব্ব দেব যক্ষ বিদ্যাধর।
কামিনী লইয়া ক্রীড়া করে নিরন্তর।।
রাবণেরে দেখিয়া দেবতা কাঁপে ডরে।
পলায় ছাড়িয়া কেলি পর্ব্বত উপরে।।
উভরড়ে দেবগণ পলাইল ত্রাসে।
দেবতা পলায় দেখি দশানন হাসে।।
নির্ম্মল নদীর জল পর্ব্বতেতে বয়।
নানাবিধ লোক তথা করয়ে আলয়।।
বিন্ধ্যগিরি এড়ি গেল নর্ম্মদার কূলে।
জলকেলি করে তথা কেশরী শার্দ্দুলে।।
সহ শুক সারণ প্রভৃতি পরিজন।
রথ হৈতে সেইখানে উলিল রাবণ।।
মধ্যাহ্নকালের রৌদ্র তাপিতা পৃথিবী।
রাবণে দেখিয়া মন্দতেজ হৈল রবি।।
দুই কূলে বাল সে স্ফটিক হেন দেখি।
বহু জন্তু কেলি করে নানাবিধ পাখী।।
নর্ম্মদার জল সেই অতি সুশীতল।
ধীরে ধীরে বায়ু বহে অতি সুকোমল।।
সৈন্য সঙ্গে নামিয়া রাবণ যায় জলে।
ধুইল গায়ের রক্ত লগ্ন রণস্থলে।।
সাঁতারে রাবণ রাজা নর্ম্মদার জলে।
আপনি করিয়া স্নান উঠিলেক কূলে।।
দেবদেব মহাদেব জগতের রাজা।
নানা উপচারে রাবণ করে তাঁর পূজা।।
স্বর্ণ-শিবলিঙ্গ তাহে কাঞ্চন-মেখলা।
ভক্তিতে রাবণ পূজে দেবার্চ্চন-বেলা।।
শত সুবর্ণের পাত্র লাগে পূজা-সাজে।
শঙ্খ ঘণ্টা দুন্দুভি যে চারিদিকে বাজে।।
করাইল শিবলিঙ্গে স্নান সেই জলে।
কলস করিয়া গন্ধ তদুপরি ঢালে।।
মন্ত্র জপ করিল লইয়া জপমালা।
মৌন নাহি ভাঙ্গে তার দেবার্চ্চন-বেলা।।
কুড়ি হাত পসারিয়া নাচে রঙ্গ ভঙ্গে।
রাবণ প্রণাম করে সেই শিবলিঙ্গে।।
এদিকে অর্জ্জুন রাজা হয়ে হৃষ্টমতি।
জলক্রীড়া করে সঙ্গে শতেক যুবতী।।
প্রসারে নদীর মাঝে হস্ত সে দীঘল।
হাতেতে জাঙ্গাল বান্ধি রাখে তার জল।।
ছিল যে কাঁকালি জল হইল পাথার।
শত শত কন্যা দিতে লাগিল সাঁতার।।
হাত সম্বরিয়া রাজা এড়ি দিল পানি।
আকুল হইয়া ডাকে যতেক রমণী।।
হাতেতে জাঙ্গাল বান্ধি রাণী সব ভাসে।
দেখিয়া অর্জ্জুন রাজা কৌতুকেতে হাসে।।
তাহার উপর হাত দেয় কাতে কাতে।
সে জল উজান বহে কূল ভাঙ্গে স্রোতে।।
শিবপূজা করিছে রাবণ সেই কূলে।
স্রোতে তার ফল ফুল ভাসাইল জলে।।
রাবণ আপনি গায় আপনি সে নাচে।
বার্ত্তা জানিবারে শুক সারণেরে পুছে।।
না ভাঙ্গে রাবণ মৌন, হাতে তুড়ি দিল।
বৃত্তান্ত জানিতে শুক সারণ চলিল।।
নিষ্ঠা বার্ত্তা জানিয়া যে তাহারা জানায়।
তোমারে ভেটিতে কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন চায়।।
সুন্দর অর্জ্জুন রাজা যেন দেবপতি।
জলক্রীড়া করে সব লইয়া যুবতী।।
নদীতে সহস্র হস্ত প্রসারে দীঘল।
সহস্র হস্তেতে তার বদ্ধ করে জল।।
সহস্র হস্তেতে সেতু বান্ধি রাখে জল।
ভাঁটা জল উজান বয় সে অপূর্ব্ব কল।।
জাঙ্গাল সহস্র হাতে বান্ধি রাখে নদী।
তেকারণে ভাসিতেছে ফল ফুল আদি।।
যে কার্ত্তবীর্য্যের হেতু হেথা আগমন।
নর্ম্মদার জলে তারে কর দরশন।।
অর্জ্জুনের বার্ত্তা পেয়ে চলে দশানন।
দুই ক্রোশ পথ গিয়া করে নিরীক্ষণ।।
অর্জ্জুন সহস্র করে করে জলখেলা।
সহস্র সহস্র তার বেষ্টিত মহিলা।।
তাহার পাত্রের স্থানে কহিছে রাবণ।
অর্জ্জুনেরে কহ গিয়া মম আগমন।।
স্ত্রী লইয়া তোর রাজা সুখে করে স্নান।
বল গিয়া রাজারে রাবণ রণ চান।।
এত যদি রাবণ পাত্রের প্রতি বলে।
কুপিল সে রাজপাত্র রাবণের বোলে।।
স্ত্রী লইয়া মহারাজ সুখে কেলি করে।
এ সময় কোন্ জন বলে যুঝিবারে।।
রনের সময় না জানিস নিশাচর।
অর্জ্জুনের হাতে আজি যাবি যমঘর।।
স্ত্রী লইয়া করে রাজা হাস্য পরিহাস।
তোর বাক্যে কেন আমি যাব তাঁর পাশ।।
কুড়িখান হাতে তোর এত অহঙ্কার।
সহস্র হস্তেতে কার্ত্তবীর্য্য-অবতার।।
বীর হেন দেখিস কি তুই আপনারে।
করিতে আইলি যুদ্ধ বিধাতার বরে।।
অর্জ্জুন পাইলে তোরে মারিবে আছাড়।
দশমুণ্ড ভাঙ্গিয়া করিবে চূর্ণ হাড়।।
দেব দৈত্য জিনিয়া বেড়াইস যেন সর্প।
তেঁই সে কারণে তোর বাড়িয়াছে দর্প।।
অর্জ্জুন রাজার কাছে কর অহঙ্কার।
মানুষ হইয়া তিনি দেব-অবতার।।
জন্মিলি রাক্ষসকুলে নানা মায়া ধর।
হের দেখ রাজা মোর মায়ার সাগর।।
আকাশে থাকিয়া যুঝে কভু নাহি দেখি।
মেঘরূপে বর্ষে জল, উড়িলে সে পাখী।।
সরলের সোজা তিনি বাঁকা প্রতি বাঁকা।
পড়িলে তাঁহার ঠাঁই তবে যায় দেখা।।
অর্জ্জুনেরে না পারিবি এরি মারিবারে।
প্রাণ রক্ষা কর গিয়া ঝাট যাহ ঘরে।।
আমার সমরে যদি পাস অব্যাহতি।
তবে গিয়া ঘাটাইস্ অর্জ্জুন নৃপতি।।
কুপিল রাবণ রাজা মহা ভয়ঙ্কর।
রাক্ষস মানুষে যুদ্ধ বাধিল বিস্তর।।
শুক সারণ মারীচ রাক্ষস মহাবীর।
রাক্ষসের মায়ারণে নর নহে স্থির।।
রাক্ষসের সংগ্রামে মানুষ-সৈন্য পড়ে।
অর্জ্জুনের কাছে গিয়া দূত কহে রড়ে।।
মারিয়া তোমার সৈন্য ফেলিল রাবণ।
অগ্নি হেন কোপে জ্বলে শুনিয়া অর্জ্জুন।।
যুঝিবারে অর্জ্জুন চলিল মহাবীর।
ভয়ে রাজ-নিতম্বিনী কেহ নহে স্থির।।
স্ত্রীলোকের কলরব উঠিল গভীর।
সবারে অভয় দানি রাজা করে স্থির।।
পাত্র সহ অন্তঃপুরে পাঠায় স্ত্রীগণ।
স্বর্ণ-গদা হাতে করি ধাইল অর্জ্জুন।।
গভীর গর্জ্জনে আসে পর্ব্বত-আকার।
গদা হাতে রাক্ষসেরে বলে মার মার।।
দুর্জ্জয় শরীর রাজা অতি ভয়ঙ্কর।
তিনশত যোজন যুড়িয়া পরিসর।।
ছয়শত যোজন শরীর দীর্ঘতর।
সহস্র হস্তেতে ধরে সহস্র ভূধর।।
দেখিয়া কুপিল সে প্রহস্ত মহাবল।
অর্জ্জুনের শিরে মারে লোহার মুদগর।।
পড়িল মুষল যেন ঝঞ্ঝনা চিকুর।
অর্জ্জুনের গদায় ঠেকিয়া হৈল চূর।।
অর্জ্জুন সহস্র হাতে গদা এক চাপে।
প্রহস্তের মাথায় মারিল মহাকোপে।।
মোহ গেল প্রহস্ত সে অত্যন্ত কাতর।
দেখিয়া কাতর তারে রোষে লঙ্কেশ্বর।।
কুড়ি হাতে অস্ত্র অস্ত্র ফেলে রাক্ষস রাবণ।
সহস্র হস্তেতে লোফে অর্জ্জুন রাজন্।।
দুই গিরি ঠেকাঠেকি শুনি ঠনঠনি।
ত্রিভুবন জল স্থল কম্পিতা মেদিনী।।
উভয় হস্তীর যুদ্ধ দন্ত হানাহানি।
দুই সূর্য্য যুদ্ধ করে মনে হেন মানি।।
দুই সিংহ রণে যেন ছাড়ে সিংহনাদ।
দুই বীর রণ করে নাহি অবসাদ।।
উভয়ে বরিষে বাণ দোঁহে ধনুর্দ্ধর।
দোঁহে দোঁহা বিন্ধিয়া করিল জর্জ্জর।।
কেহ কারে নাহি পারে তুল্য দুইজন।
দেবতা অসুরে যেন পূর্ব্বে হৈল রণ।।
রাবণ মুষলাঘাত করিল নিষ্ঠুর।
অর্জ্জুনের বুকেতে ঠেকিয়া হৈল চূর।।
ধরিল দুর্জ্জয় গদা অর্জ্জুন নৃপতি।
রাবণের বুকেতে মারিল শীঘ্রগতি।।
মোহ গেল রাবণ সে গদার আঘাতে।
এড়িয়া ধনুক বাণ লাগিল কাঁপিতে।।
লাফ দিয়া অর্জ্জুন ধরিল লঙ্কেশ্বরে।
গরুড় ধরিয়া যেন নিল অজগরে।।
ধরিয়া সহস্রহাতে রাখে কক্ষতলি।
পাতালে যেমন হরি বান্ধিলেন বলি।।
বান্ধিল সহস্র হাতে তার কুড়ি হাত।
রাবণ ভাবিছে একি হইল উৎপাত।।
সাধু সাধু আকাশে ডাকিছে দেবগণ।
অর্জ্জুন উপরে করে পুষ্প বরিষণ।।
হস্তী মারি সিংহ যেন ছাড়ে সিংহনাদ।
মৃগ মারি ব্যাধ যেন পাসরে বিষাদ।।
নানা অস্ত্র রাক্ষস ফেলায় চারিভিতে।
রাক্ষসের অস্ত্র সব রাজা লোফে হাতে।।
কত হাতে ধরিয়া রহিছে দশাননে।
কত হাতে খেদাড়ে সে নিশাচরগণে।।
মারীচ খর দূষণ প্রহস্ত মহাবল।
অর্জ্জুনেরে স্তুতি করে রাক্ষস সকল।।
রাক্ষসের স্তবেতে অর্জ্জুন রাজা হাসে।
কক্ষে রাবনেরে চাপি চলিল আবাসে।।
রাবণে লইয়া রাজা পদব্রজে যায়।
রাবণের লইয়া রাজা পদব্রজে যায়।
রাবণের দুর্দ্দশা দেখিতে সবে পায়।।
অর্জ্জুনেরে ডাক দিয়া বলে দেবগণে।
চিরকাল বন্দী করি রাখহ রাবণে।।
অর্জ্জুনেরে দেবগণ করেন বাখান।
তোমার প্রসাদে আজি পাইলাম ত্রাণ।।
কুতূহলে দেবগণ করে হুলাহুলি।
রাবণেরে লয়ে পুরে সান্ধাইল বলী।।
বন্দীশালে নিয়ে ফেলে মরার আকার।
রাবণের টুটিল সে সব অহঙ্কার।।
কুড়ি হাত ফুঁড়িলেক আর দশ গলা।
দৃঢ় বান্ধিলেক দিয়া লোহার শৃঙ্খলা।।
বন্ধনের টানে দুষ্ট হইল কাতর।
বুকেতে তুলিয়া দিল দারুণ পাথর।।
পাথর তুলিয়া দিল সত্তর যোজন।
পাশ উলটিতে নারে দুরন্ত রাবণ।।
রাবণেরে বদ্ধ করি রাখি কারাগারে।
অর্জ্জুন করিতে কেলি গেল অন্তঃপুরে।।
ধরিল সহস্র হাতে সহস্র যুবতী।
মনোসুখে কেলি করে অর্জ্জুন-নৃপতি।।
অর্জ্জুনের নামে হয় পাপ বিমোচন।
অর্জ্জুনের নামে পাই হারাইলে ধন।।
বিষ্ণু-অবতার রাজা বলে মহাবলী।
কৃত্তিবাস রচে অর্জ্জুনের জলকেলি।।