সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ

সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ

সৃষ্টিতত্ত্ব জানার কৌতূহলটি মানব মনে বহুদিনের পুরাতন। এই কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য মানুষ বহু মতবাদের জন্ম দিয়াছে। তবে সেই সমস্ত মতবাদকে সাধারণত চারিটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা –আদিম মত, ধর্মীয় মত, দার্শনিক মত ও বৈজ্ঞানিক মত। এই কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাহার মধ্যে আদিম জাতিদের মত, ধর্মীয় মত ও দার্শনিক মতবাদের কিছু কিছু আলোচনা এযাবত করা হইয়াছে। উহাতে দেখা গিয়াছে যে, আদিম ও ধর্মীয় মতবাদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক এক জন সৃষ্টিকর্তা ছিলেন এবং তাঁহারা ছিলেন কোথায়ও ঈশ্বর, কোথায়ও দেবতা, কোথায়ও পশু-পাখি, এমনকি কোথায়ওবা পতঙ্গ। সেই সকল সৃষ্টিকর্তাদের স্বরূপ যাহাই হউক না কেন, সকল মতবাদের আসল রূপ একটিই। বর্তমান জগতটিকে আমরা যেরূপ দেখিতে পাইতেছি, ইহা সেই রূপেই সৃষ্টি করা হইয়াছিল এবং যত রকম গাছপালা ও জীব-জানোয়ার দেখিতেছি, সৃষ্টিকর্তা উহার প্রত্যেকটিকে এই রূপেই সৃষ্টি করিয়া পৃথিবীতে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে কাহারও ‘জাতিগত রূপ’-এ কোনো পরিবর্তন বা নূতনত্ব নাই। ইহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জাতিগত রূপ ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট বজায় রাখিয়া বংশবৃদ্ধি করিতেছে মাত্র। সাধারণত এইরূপ একটি ধারণা সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। আর এই রকম ধারণাকে বলা হয় সৃষ্টিবাদ। জড় কিংবা জীবজগতে এক-এর রূপান্তরে বহু’র উৎপত্তি– এইরূপ ধারণাকে বলা হয় অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ।

পূর্বে আলোচিত আদিম জাতিসমূহের ও বেদ-বাইবেলাদির সৃষ্টিতত্ত্বসমূহ সৃষ্টিবাদ-এর অন্তর্ভুক্ত এবং সামান্য মতানৈক্য থাকিলেও জগতের যাবতীয় ধর্মীয় মতবাদই সৃষ্টিবাদের আওতাভুক্ত। জগত ও জীবন সৃষ্টি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের সর্বস্বীকৃত যে মত, তাহাই অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ। দার্শনিকগণ সকলে না হইলেও বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বিবর্তনবাদী। এই বিষয়ে একজন আধুনিক দার্শনিকের মতবাদের উল্লেখ করিতেছি। তিনি বলেন —

“সৃষ্টিবাদ অনুসারে জগতের একজন স্রষ্টা আছে। সাধারণত ঈশ্বরকেই জগতের স্রষ্টা বলা হয়; কিন্তু যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী নন, এমন লেখকেরা প্রকৃতিকে জগতের উৎস বলে মনে করেন। যেমন, মিল (Mill)-এর মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই।“

“প্রকৃতি থেকেই জগতের সৃষ্টি। এমন এক সময় ছিল যখন জগতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর বা প্রকৃতি কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে জগত সৃষ্টি করেছিল। যাবতীয় বস্তু এবং জীব জগতসৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সৃষ্ট হয়েছে। গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে পূর্ণ এই জগত প্রথমে যেভাবে সৃষ্ট হয়েছিল, আজও ঠিক একইভাবে বর্তমান। মূলত এর রূপ বিন্দুমাত্রও পরিবর্তিত হয়নি।

“ঈশ্বরবিশ্বাসী সৃষ্টিবাদের দুইটি রূপ আছে। যথা –ক. নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ (Theory of Absolute Creation) 978 3. 129Tapa lama (Theory of Dependent or Conditional Creation)।

“ক. নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ –এ মতবাদ অনুসারে নিছক শূন্য (nothing) থেকে ঈশ্বরের দ্বারা এই জগত সৃষ্ট হয়েছিল। এমন এক সময় ছিল, যখন এই জগতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী এক শাশ্বত সনাতন পুরুষ। তিনি হলেন পূর্ণ; সেই কারণে এই জগতের কোনো প্রয়োজন তার ছিল না। কিন্তু তবু তার ইচ্ছা হলো, এক জগতের সৃষ্টি হোক। অমনি সঙ্গে সঙ্গেই জগতের সৃষ্টি হলো। জগত সৃষ্ট হবার পর ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টি প্রাকৃতিক শক্তির উপরই জগতকে ছেড়ে দিলেন। এই প্রাকৃতিক শক্তিই জগতকে নিয়ন্ত্রিত ও চালিত করতে লাগল। ঈশ্বর এই জগতের প্রথম বা মুখ্য কারণ (first cause)। এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলি হলো দ্বিতীয় বা গৌণ কারণ (second cause)। জগত সৃষ্ট হবার পর ঈশ্বর জগতের বাইরে অবস্থান করেন এবং প্রয়োজন হলে জগতের পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করেন। এই মতবাদ অনুসারে জগতকে আমরা বর্তমানে যেভাবে বা যে রূপে দেখছি, জগত সেইভাবে সৃষ্ট হয়েছিল। জগত কোনোরূপ ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ফলে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়নি।

“খ. সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ –এই মতানুযায়ী ঈশ্বর নিছক শূন্য থেকেই এই জগত সৃষ্টি করেন নি, জড়ের (matter) থেকে তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের মতো জড় নিত্য ও অবিনাশী; জগত সৃষ্ট হবার পূর্বেই জড়ের অস্তিত্ব ছিল। এই জড়ের কোনো আকার ছিল না, এই জড় এলোমেলো এবং বিশৃঙখল অবস্থায় ছিল। ঈশ্বর এই জড়োপাদানকে একটা নির্দিষ্ট আকার দিলেন এবং এই বিশৃঙ্খল এলোমেলো উপাদানের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে এই সুন্দর জগত সৃষ্টি করলেন। ভারতীয় দর্শনেও আমরা এই জাতীয় সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের দেখা পাই। বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, ঈশ্বর ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের নিত্য পরমাণুগুলির সাহায্যে এই জগত সৃষ্টি করেছেন। যে কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে দুটি কারণ থাকে –একটি নিমিত্ত কারণ, আর একটি উপাদান। কারণ। জগতসৃষ্টির মূলেও এই দু’প্রকার কারণ ছিল। ঈশ্বর হলেন নিমিত্ত কারণ, জড় হলো উপাদান কারণ।

“পূর্বোক্ত উভয় প্রকার সৃষ্টিবাদে নিম্নলিখিত বৈশিষ্টগুলি পাওয়া যায় —

“অনন্তকাল ধরে ঈশ্বর এই জগত ছাড়া একাকীই ছিলেন। যেহেতু তিনি পূর্ণ, সেহেতু জগতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। হয় নিছক শূন্য থেকেই, নতুবা পূর্বস্থিত জড়কেই উপাদানরূপে গ্রহণ করে তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে খেয়ালবশত ঈশ্বর এই জগত সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পর এই জগত ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকে। কেবলমাত্র প্রয়োজনবোধে অর্থাৎ জাগতিক ব্যাপারে যখন কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়, তখনই ঈশ্বর জগতের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। ঈশ্বর জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন না, জগতের বাহিরেই অবস্থান করেন। ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বাহ্য সম্পর্ক (external relation), আন্তর সম্পর্ক (internal relation) নয়।”

উপরোক্ত মতবাদের সমালোচনায় তিনি বলেন —

“পূর্বোক্ত সৃষ্টিবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। এই মতবাদ বিজ্ঞানের দ্বারাও সমর্থিত নয়। এই মতবাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি আনা যেতে পারে —

“প্রথমত এই মতবাদ অনুসারে ঈশ্বর পূর্ণপুরুষ— তার জগতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবে তিনি এই জগত সৃষ্টি করলেন কেন? কোনো অভাববোধ থেকে এই জগত সৃষ্ট হতে পারে না, কারণ পূর্ণপুরুষের কোনো অভাবের প্রশ্ন ওঠে না। যদি বলা যায়, জীবের উপর করুণাবশত তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন– তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এরই বা কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সৃষ্টিবাদীরা এর কোনো সদুত্তর দেন না।

“দ্বিতীয়ত ঈশ্বর অন্য জগত সৃষ্টি না করে এই জগত সৃষ্টি করলেন কেন? ঈশ্বরের জগতের প্রয়োজন ছিল না –একথা বলাও যুক্তিযুক্ত নয়, কেননা জগতসৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত না হলে। জীবনের পক্ষে ঈশ্বরের সত্তাকে অনুভব করা সম্ভব নয়।

“তৃতীয়ত নিছক শূন্য (nothing) থেকে জগত সৃষ্টি করা ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব নয়, কেননা শূন্য থেকে শূন্যই পাওয়া যায়। অসৎ থেকে সৎ-এর সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব? যদি ধরে নেওয়া যায়। যে, ঈশ্বর নিছক শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন, তাহলে জগতও নিছক শূন্য হবে; যেহেতু কার্য কারণেরই পরিণাম। কারণে যা থাকে, তাই কার্যে পরিণত হয়। আবার যদি বলা যায় যে, ঈশ্বর পূর্বস্থিত জড় থেকেই এই জগত সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এই জড়ের অস্তিত্ব ঈশ্বরকে সীমিত করবে, কিন্তু ঈশ্বরকে বলা হয়েছে অসীম ও অনন্ত, তার কোনো সীমা থাকতে পারে না।

“চতুর্থত ঈশ্বর কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে জগত সৃষ্টি করলেন কেন? তার পূর্বে বা পরে কেন জগত সৃষ্টি করলেন না? সৃষ্টিবাদীরা এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন নি। তা ছাড়া অনন্তকালের কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন –এ যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে জগত সৃষ্টির পূর্বেও কালের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু জগত ছাড়া অর্থাৎ কোনো ঘটনা ছাড়া শূন্যগর্ভ কালের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না।

“পঞ্চমত জগত সৃষ্টির পর ঈশ্বর যদি জগতের বাইরে অবস্থান করেন অর্থাৎ কিনা এই জগত যদি ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কবিযুক্ত হয়ে অবস্থান করে, তাহলে এই স্বতন্ত্র জগতের সত্তা ঈশ্বরকে সীমিত করবে এবং সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে সসীম বলা যাবে।

“যষ্ঠত জগতের মধ্যে যদি বিপর্যয় দেখা দেয় বা জগত যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পথে না চলে, তাহলে প্রয়োজনবোধে ঈশ্বর জগতের কার্যে হস্তক্ষেপ করেন— এ মতবাদও গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তাহলে ধারণা করতে হয় যে, ঈশ্বর নিখুঁত শিল্পী নন এবং ঈশ্বরের জগতসৃষ্টির মধ্যে নৈপুণ্যের অভাব ছিল। তা ছাড়া জগতের অমজননক বিষয় ও ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে : যদি জগতের উপাদান এড়ই অমওঃ লর কারণ হয়, তাহলে ধারণা করতে হবে যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপাদানের দোয়ত্রুটি দূর করার সামর্থ নেই; কিন্তু এ জাতীয় ধারণা ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

“সপ্তমত সৃষ্টিবাদ অনুসারে ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বাহ্য সম্পর্ক (external relation), কিন্তু এ মত স্বীকার করা যায়না। ঈশ্বর জগতের কারণ বলার অর্থ, জগতের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রকাশ বা ঈশ্বরের সত্তা জগতের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। অর্থাৎ ঈশ্বরের সঙ্গে, জগতের সম্পর্ক আন্তর সম্পর্ক (internal relation)।

 “সবশেষে, এই মতবাদে ঈশ্বরকে মানুষ বা সাধারণ কারিগরের মতো কল্পনা করা হয়েছে। কোনোমতেই যুক্তিসঙ্গত নয়।

“সুতরাং, সৃষ্টিবাদ গ্রহণযোগ্য মতবাদ নয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই জগতের গঠন ও ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একটি সহজ সরল অবস্থা থেকে ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে জগত আজকের এই জটিল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সুতরাং বিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থিত এই অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদই গ্রহণযোগ্য মতবাদ।”

এখন আমরা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদ-এর কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব, প্রথম পদার্থ ও পরে জীব বিষয়ে।