সভ্যতার বিকাশ

সভ্যতার বিকাশ

# হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি

মানব জাতির ক্রমোন্নতির মূলে রহিয়াছে হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি। আদিম মানবের জীবনে একটিমাত্র সমস্যা ছিল, তাহা হইল আত্মরক্ষা। সুখেই হউক আর দুঃখেই হউক, বাঁচিয়া থাকাই ছিল তাহাদের প্রধান সমস্যা। বাঁচিয়া থাকিতে হইলে প্রথমত চাই খাদ্য ও শত্রুর কবল হইতে মুক্তি। খাদ্যসংস্থানে ঝামেলা থাকিলেও উহা তত মারাত্মক নহে। কেননা, বনে বনে ঘুরিয়া ফলমূল সংগ্রহ বা ছোট ছোট জানোয়ার হত্যা করিয়া তাহার কাঁচা মাংস ভক্ষণ করা একেবারে অসাধ্য ছিল না। হয়তো দুই-এক বেলা অনাহারে থাকিলেও তাহাতে মৃত্যুভয় নাই। শীতাতপ হইতে রক্ষা পাইতে হইলে কোনো রকমে কায়ক্লেশে গাছের কোটরে বা পাহাড়ের গুহায়। প্রবেশ করিতে পারিলেই ব্যাস। কিন্তু বাঘ-ভালুকাদি হিংস্র জানোয়ারের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাওয়াই ছিল কঠিন কাজ। শত্রুর কবল হইতে আত্মরক্ষার উপযোগী কোনো ব্যবস্থাই ছিল না মানুষের গায়ে, যেরূপ ছিল পশু-পাখিদের। বাঘের মতো বিরাট দেহ বা দাঁত-নখরও ছিল না, আর গরু-মহিষের মতো শিংও ছিল না। সম্বল ছিল মাত্র দুইখানা হাত। তাহাও বেশি বড় নহে এবং উহাতে শক্তিই বা কতটুকু! তাই আদিম মানব সাহায্য লইল হাতিয়ারের। সেই হাতিয়ার আর কিছুই নহে –গাছের ডাল ও পাথরের টুকরা।

বন্য জানোয়ারের আক্রমণ সাধারণত আঁচড়ানো ও কামড়ানো। কিন্তু একেবারে গায়ে পড়া শত্রু না হইলে এ ধরণের আক্রমণ চলে না। আদিম মানবেরা যখন দৃঢ় মুষ্টিতে গাছের ডাল ধরিয়া দলবদ্ধভাবে আক্রমণ চালাইত, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জানোয়ার মারা পড়িয়া উহাদের খাবার তো জোগাড় হইতই, বরং অনেক হিংস্র জন্তু লড়াইয়ে হার মানিত। কেননা, ইহাতে আক্রমণকারীরা থাকিয়া যাইত হিংস্র জন্তুদের নাগালের বাহিরে।

আদিম মানব শিকার ও আত্মরক্ষার কাজে প্রধানত গাছের ডাল বা লাঠিই ব্যবহার করিত। অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন বুঝা গেল যে, কঠিন কোনো কিছু খুঁড়িয়া মারিলে আরও দূর হইতে আক্রমণ চালানো যায়, তখন উহারা ঐ কাজে ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল পাথরের টুকরা –যে রূপে পাওয়া যাইত সেই রূপেই। যখন দেখা গেল যে, পাথরের টুকরাগুলি ধারালো সূঁচালো হইলে শত্রুকে ঘায়েল করা যায় আরও সহজে, তখন উহারই চেষ্টা চলিতে লাগিল। এইভাবে কালক্রমে সৃষ্টি হইল আদিম মানবদের নানা ধরণের পাথরের হাতিয়ারের।

ক্রমে দেখা গেল যে, ঘুড়িয়া মারা হাতিয়ার সব সময়ে লক্ষ্যস্থলে পড়ে না। তাই অনেক সময়েই শিকার ফসকাইয়া যায়। চেষ্টা চলিল অব্যর্থ আঘাত হানিবার হাতিয়ার তৈয়ারের। একখণ্ড কাঠের দণ্ডে পাথরের ফলা যুক্ত করিয়া তৈয়ার করা হইল বর্শা, বল্লম, ক্রমে উড়ন্ত বর্শা।

উড়ন্ত বর্শাও হাতে ছোঁড়া হইত। কাজেই উহার গতিবেগ ও পাল্লা তত বেশি নহে। উড়ন্ত বর্শাই ক্রমে রূপ পাইল তীর-ধনুকের। মানব সভ্যতার এক বিরাট সাফল্য এই তীর-ধনুকের আবিষ্কার। আদিতে ইহার ব্যবহার ছিল পশু-পাখি শিকার ও আত্মরক্ষামূলক কাজেই এবং উহার ব্যবহার চলিয়াছিল হাজার হাজার বৎসর। সভ্যতাবৃদ্ধির সাথে সাথে তাম্র ও লৌহ আবিষ্কারের পর তীর-ধনুকের উন্নতি হইয়াছিল অসাধারণ। কিন্তু উন্নতি হইলে কি হইবে, উহা দ্বারা পশু পাখি হত্যার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল নরহত্যা এবং পশু-পাখির স্থলাভিষিক্ত হইয়াছিল রামানুজ লক্ষ্মণ, লঙ্কেশ্বর রাবণ ও নূরনবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনও।

আধুনিক যুগে আবার তীর-ধনুকের চেহারা বদল হইয়া উহার তীরটি হইয়াছে গোল এবং ধনুটি হইয়াছে সোজা –সৃষ্টি হইয়াছে বন্দুক, কামান ইত্যাদি মারণাস্ত্রের। শেষমেশ পারমাণবিক বোমা।

হাতিয়ার শুধু মারণাস্ত্রই নহে। যাহা হাতের বদলে ব্যবহৃত হয় বা হাতের শক্তি বাড়াইয়া দেয়, তাহাই হাতিয়ার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের সমাজ জীবনে, বিশেষত শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদিতে রকমারি হাতিয়ার বনাম কল কারখানার অন্ত নাই। অধুনা মানব সভ্যতার মাপকাঠিই হইল হাতিয়ার। যে জাতির হাতিয়ার যত উন্নত, সেই জাতি সভ্যতায় তত অগ্রগামী।

.

# জাতিগত জীবন ও ব্যক্তিজীবনে সাদৃশ্য

বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, ক্রমবিবর্তনের নিয়ম মতে মানুষ তাহার জাতিগত জীবনে যে যে অবস্থাপ্রাপ্ত হইয়া বর্তমান অবস্থায় পৌঁছিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি অবস্থা মূর্ত হইয়া উঠে তাহার ব্যক্তিজীবনে। মনুষ্য জাতির বিবর্তনের প্রধান প্রধান স্তর বা অবস্থা হইল –১. মৎস্য, ২. সরীসৃপ, ৩. পশু, ৪. অর্ধমানব, ৫. অসভ্য মানব ও ৬. সভ্য মানব ইত্যাদি। মানব সভ্যতার আবার কয়েকটি সুস্পষ্ট ধাপ আছে। যথা –পুরাতন পাথর যুগ, নূতন পাথর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদি। ইহাকে আমরা বলিতে পারি মানব সভ্যতার –শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবন অবস্থা। এই সমস্ত অবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কি রকম প্রতিফলিত হইতেছে, এইখানে আমরা তাহার কিছু আলোচনা করিব।

মৎস্য অবস্থা

মানুষের দৈহিক রূপের বিকাশ শুরু হয় এই মৎস্য অবস্থায়। মাছের মতো জলজীবন, মাছের মতো চেহারা এবং বহির্জগতের আলো-বাতাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে না মাছের মতোই। ইহা ব্যক্তিজীবনের প্রাথমিক অবস্থা, ইহার নাম শুক্রকীট।

সরীসৃপ অবস্থা

পশুদের মতো সরীসৃপরাও চারি পায়ের অধিকারী বটে, কিন্তু উহারা পায়ের দ্বারা পেট শূন্যে তুলিয়া রাখিতে পারে না, মাটিতে টানিয়া চলে। মানবশিশুরাও ৫-৬ মাস বয়স্ক হইলে উপুড় হইতে শুরু করে এবং ক্রমে কুমিরাদি সরীসৃপদের ন্যায় মাটিতে বুক টানিয়া চলিতে থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় শিশুর বুকে চলা বা বুকে হাঁটা।

পশু অবস্থা

 পশুরা চারি পায়ে হাঁটে। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষও কোনো এক সময়ে পশু পর্যায়ে ছিল এবং চারি পায়ে হাঁটিত। ঐ অবস্থাটি ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত হয় শৈশবে। ন্যূনাধিক ৯-১০ মাস বয়স্ক শিশুরা হামাগুড়ি দিয়া চলিতে আরম্ভ করে। ইহাতে শিশুরা চলিবার জন্য হাত ও পা সমানে ব্যবহার করে পশুদের মতোই।

অর্ধমানব অবস্থা

মানুষের পূর্বপুরুষেরা পুরাপুরি দ্বিপদ হইবার আগে গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও বানরাদির ন্যায় কখনও দুই পায়ে এবং কখনও চারি পায়ে হাঁটিত এবং চলিবার সময় দেহ সামনের দিকে ঝুঁকিয়া থাকিত। সদ্য হাঁটিতে শেখা শিশুরাও ঐরূপ কখনও হাঁটে, আবার কখনও হামাগুড়ি দেয় এবং ঐ অবস্থায় কোনো শিশুই সোজা হইয়া হুঁটিতে পারে না।

অসভ্য অবস্থা

মানুষ যখন পুরাপুরি দ্বিপদ জীব অর্থাৎ মানুষ নামের অধিকারী হইয়াছিল, তখন তাহারা ছিল বুনো বা অসভ্য মানুষ। তখন তাহারা খাইবার মতো যাহা পাইত, তাহা দিয়াই উদর পুরাইত; ক্ষুধানিবৃত্তিই ছিল খাইবার উদ্দেশ্য। তাহারা উলঙ্গ থাকিত, বনে বনে ঘুরিয়া পশু-পাখি মারিত ও উহা কাঁচা ভক্ষণ করিত। বৃক্ষকোটরে বা পর্বতগুহায় বাস করিত। তুচ্ছ বিষয় লইয়া কলহ করিত, আবার পরমুহূর্তে উহা ভুলিয়া যাইত। তাহারা ছিল অকপট, নিরলস, স্বেচ্ছাচারী ও নোংরা। বলা। বাহুল্য, ঐরূপ অসভ্য বা অনুন্নত মানবগোষ্ঠী আজিও দুনিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে দেখিতে পাওয়া যায়।

মানবশিশুদের মধ্যে উক্তরূপে এমন একটি অবস্থা আসিয়া থাকে, যখন তাহারা সাধারণত খাদ্যাখাদ্য যাহা হাতের কাছে পায়, তাহাই তুলিয়া মুখে দেয়, মাতা-পিতার সঙ্গেও ‘তুই’ শব্দটি ব্যবহার করে, ধুলা-বালি লইয়া খেলিতে ও ময়লা গায়ে থাকিতে চায়, উলঙ্গ থাকিতে লজ্জাবোধ করে না ইত্যাদি অসভ্যজনোচিত আচরণ করিয়া থাকে। অসভ্যদের মতোই শিশুরা অকপট, সত্যবাদী, নিরলস, নোংরা এবং স্বেচ্ছাচারী হইয়া থাকে। শিশুদের তুচ্ছ বিষয় লইয়া সাথীদের সাথে বকাবকি, মারামারি, আবার নিমেষে মিলিয়া-মিশিয়া খেলা করা, ঢিল ছোঁড়া, পাখি ধরা, গাছে উঠা ইত্যাদির প্রবণতা সেই আদিম অসভ্য মানবদের চরিত্রেরই ছায়া।

সভ্য অবস্থা

মানব সভ্যতার প্রধানত চারিটি ধাপ। যথা –শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবনাবস্থা।

সভ্যতার শৈশবাবস্থা –সভ্য জগত ও অসভ্য জগতের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নাই। সভ্যতা আসিয়াছে যুগ যুগ ধরিয়া, হাজার হাজার বৎসরে, ক্রমে ক্রমে। কিন্তু আজিও কি আমাদের সমাজে পূর্ণ সভ্যতা আসিয়াছে? আজিও সভ্যতার দাবিদারদের সমাজে রমণীদের অগচ্ছেদনপূর্বক অলকার পরানো, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, মহামারী ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিবারণের জন্য দেবতাদের কাছে ধর্ণা দেওয়া ইত্যাদি যে সকল রীতি-নীতি প্রচলিত আছে, (প্রিয় পাঠক রাগ করিবেন না) ঐগুলি সবই অসভ্য যুগের প্রথা। পক্ষান্তরে সভ্যজনোচিত কোনো কোনো প্রথা অসভ্য যুগেও ছিল। যেমন –মাতা-পিতা বা বংশপ্রধানকে মান্য করা ইত্যাদি।

শেষোক্ত নীতিটির উপর ভিত্তি করিয়াই অসভ্য মানব যুগে যুগে পা বাড়াইয়াছিল সভ্যতার দিকে। পিতৃপ্রধান হইতে উদ্ভব হইয়াছে গোষ্ঠীপ্রধানের যুগ, অতঃপর সমাজপতি বা মোড়ল প্রধানের যুগ ও পরে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজা-বাদশাহের যুগ। সে যাহা হউক, মানব সভ্যতার শৈশবে পিতৃপ্রধান যুগই ছিল। সন্তানেরা মাতা-পিতার আহার-বিহার, চাল-চলন অনুসরণ করিত; তাহাদের যে কোনো বাক্য অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করিত। বস্তুত পিতা-মাতাই ছিল সেকালের মানুষের শিক্ষাগুরু।

মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ অবস্থাটি প্রতিফলিত হয় তিন-চারি বৎসর বয়সে। অধিকাংশ শিশুরই এই বয়সের সকল কথা বা ঘটনা স্মরণ থাকে না, কিন্তু নিজ্ঞান মনে (Unconscious Mind) উহার দাগ থাকে। মনোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, শিশুদের ভাবী জীবনে চরিত্র গঠনের ভিত্তিপত্তন বা উপাদান সংগ্রহ হয় এই সময় হইতেই। এই অবস্থার প্রথম দিক দিয়া শিশুরা হয় গতানুগতিকপন্থী, অনুকরণপ্রিয় এবং সরল বিশ্বাসী। মাতা-পিতা, গুরুজন বা সহগামীদের চাল চলন, আহার-বিহার ইত্যাদি অনুসরণ করিয়া চলে এবং উহাদের যে কোনো বচন অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করে।

হয়তো কোনো শিশুর মা-বাবা জলডুবি হইবার বা পোকা-মাকড় ও সাপে কামড়াইবার ভয়ে শিশুকে বলিল, পুকুরে কুমির বা বাগানে বাঘ আছে। হয়তো শিয়াল-কুকুরে কামড়াইবার ভয়ে কোনো শিশুকে বলা হইল, “শ্মশানে ভূত ও গোরস্থানে শয়তান থাকে, উহারা শিশুদের পাইলে ঘাড় মটকায়, ঐসব জায়গায় কখনও যাইবে না” ইত্যাদি। যদিও এই জাতীয় উপদেশগুলির উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু কুমির, বাঘ, ভূত ও শয়তান সবই মিথ্যা। তথাপি সরলমতি শিশু উহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিল এবং উপদেশগুলি পালনের সুফলও লাভ করিল। এই কথা সত্য যে, তখন ঐ উপদেশগুলি বিশ্বাসপূর্বক পালন না করিলে হয়তো শিশুরা মহাবিপদে পতিত হইত।

সভ্যতার বাল্যাবস্থা –এই অবস্থায় সমাজের অধিনায়ক ছিলেন মুনি-ঋষি, নবী-আম্বিয়া বা আঞ্চলিক জ্ঞানী ব্যক্তিরা। জীবনের মানোন্নয়নের জন্য জনসাধারণকে তাঁহারা নানারূপ উপদেশ দিতেন। উপদেশকের আসল উদ্দেশ্য ছিল মানব জীবনের উৎকর্ষ সাধন। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তাহারা কখনও নানাবিধ কাল্পনিক কাহিনী বা উপাখ্যান রচনা করিয়া সাধারণকে শুনাইতেন, যাহার মধ্যে নিহিত থাকিত চরিত্র গঠন ও জাতীয় উন্নতির প্রেরণা। শুধু নিজেরাই বলিতেন না, বলাইতেন– জীব-জন্তু, দেব-দেবী বা ঈশ্বরকে দিয়াও। তাহারা মন্দ কাজের জন্য ভয় দেখাইতেন এবং ভালো কাজের জন্য অভয় দান করিতেন। তবে ভীতিকরগুলি পুকুরের কুমির ও বাগানের বাঘের মতো বসতবাড়ির কাছাকাছি থাকিত না, থাকিত বহুদূরে, মানুষের দৃষ্টিসীমার বাহিরে (পরকালে)।

মানুষের ব্যক্তিজীবনে এই অবস্থাটি প্রতিফলিত হয় ৫-৬ হইতে ১০-১১ বৎসর বয়সের মধ্যে এবং সমাজপতি বা উপদেশকের ভূমিকা গ্রহণ করেন পাঠশালা, মক্তব ও টোলের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাগণ এবং শিক্ষকবৃন্দ।

সভ্যতার কৈশোরাবস্থা –এই অবস্থায় সমাজপতিরা বনিয়াছেন রাজ্যপতি। মানবতাবিরোধী বা নীতিগর্হিত কাজের জন্য নানাবিধ হিতোপদেশ দান ও নরকবাসের ভয় দেখাইয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না রাজ্যপতিরা সমাজপতিদের মতো, তাহারা ব্যবস্থা করিতেন কারাবাস, বেত্ৰদণ্ড ইত্যাদির। সমাজপতিদের আয়ত্তে ছিল শুধু ভাষণ ও তোষণ, কিন্তু রাষ্ট্রপতিরা করিতেন শাসন ও পোষণ।

সমাজপতি বা মান্ধাতার আমলের অতিপ্রাকৃতিক বা অলৌকিক কাহিনীগুলি এই সময়ে আর সকলে বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। কার্য-কারণ সম্পর্ককে ভিত্তি করিয়া গড়িয়া উঠিল দার্শনিক মতবাদ। ফলে দ্বন্দ্ব বাধিল বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী –এই দুই দলে।

সভ্যতা বিকাশের উপরোক্ত অবস্থাটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব বিস্তার করে ১২-১৩ বৎসর বয়স হইতেই। উহার প্রকট রূপ দেখিতে পাওয়া যায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক শিক্ষায়তনগুলিতে এবং অনেকটা বাহিরেও।

সভ্যতার যৌবনাবস্থা —এই অবস্থাটি হইল মানব সভ্যতার বর্তমান অবস্থা। ইহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কেননা, জনসাধারণ ইহার প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে উহার বিবৃতি দেওয়া নিরর্থক।

এই সময়টিকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান হইল মানবীয় জ্ঞানের পরিপক্ক অবস্থা এবং মানব সভ্যতার যৌবনাবস্থাও বটে। এই যুগে যুগমানবের আসনে সমাসীন বিজ্ঞানীরা, সমাজপতিরা নহেন। বিজ্ঞানীরা হইলেন নীরব সাধক। কোনো মতবাদ অটুট রাখিবার বা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বিজ্ঞানীরা কখনও কোনোরূপ হৈ-চৈ করেন না। বিশেষত কোনো মতবাদকে সামান্য আঘাতে ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ভয়ে মুরগির ডিমের মতো পাখার নিচে পুঁজিয়া রাখেন না, উহা ছাড়িয়া দেন বিশ্বের দরবারে –সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের জন্য।

এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট হইল –১. গতানুগতিকতা বর্জন করা, অর্থাৎ স্বয়ং কিছুই না বুঝিয়া অন্যের দেখাদেখি কোনো কাজ না করা; ২. কোনোরূপ আপ্তবাক্য গ্রহণ না করা, অর্থাৎ কোনো কথা সত্য কি মিথ্যা তাহা যাচাই না করিয়া শুধু গুরুবাক্য বলিয়া বা বক্তার নামের জোরেই বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।

সভ্যতা বিকাশের উপরোক্ত অবস্থাটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রস্ফুটিত হয় যৌবনে। কেননা, এই সময়টিই মানুষের ব্যক্তিগত জ্ঞানের পরিপক্ক অবস্থা। কিন্তু কেহ যদি ৬০ বৎসর বয়সেও তাহার মুরুব্বিদের সেই শৈশবকালের উপদেশ মানিয়া চলেন, অর্থাৎ পুকুরে কুমির, বাগানে বাঘ, শ্মশানে ভূত ও গোরস্থানে শয়তান থাকে –ইহা বিশ্বাস করিয়া ঐসকল জায়গায় না যান, তবে তাহাকে কি বলা যায়? তাহাকে বলা যায়– ৬০ বৎসর বয়সের শিশু!