হাদীস নং ২৫৪৭
আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ রহ……….মিসওয়াব ইবনে মাখরামা রা. ও মারওয়ান রা. থেকে বর্ণিত, তাদের উভয়ের একজনের বর্ণনা অপরজনের বর্ণনার সমর্থন করে তাঁরা বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার সময় বের হলেন। যখন সাহাবীগণ রাস্তার এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন, তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কুরাইশদের অশ্বারোহী অগ্রগামী বাহিনী নিয়ে গোমায়ম নামক স্থানে অবস্থান করছে। তোমরা ডান দিকে চল। আল্লাহর কসম! খালিদ মুসলমানদের উপস্থিতি টেরও পেল না, এমনকি যখন তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর পশ্চাতে ধূলিরাশি দেখতে পেল, তখন সে কুরাইশাদের সংবাদ দেওয়ার জন্য ঘোড়া দৌঁড়িয়ে চলে গেল। এদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগ্রসর হয়ে বসে পড়ল। লোকজন হাল-হাল বলল, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কাসওয়া ক্লান্ত হয়নি এবং তা তার স্বভাবও নয় বরং তাকে তিনিই আটকিয়েছেন যিনি হাতি বাহিনীকে আটকিয়েছিলেন। তারপর তিনি বললেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, কুরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয় সমূহের মধ্যে যে কোন বিষয়ের সম্মান প্রদর্শনার্থে কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব। এরপর তিনি তাঁর উষ্ট্রীকে ধমক দিলে সে উঠে দাঁড়াল। রাবী বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পথ ত্যাগ করে হুদায়বিয়ার শেষপ্রান্তে অল্প পানি বিশিষ্ট কূপের কাছে অবতরণ করেন। লোকজন তা থেকে অল্প অল্প পানি নিচ্ছিল । এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন পানি শেষ করে ফেলল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পিপাসার অভিযোগ করা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোষ থেকে একটি তীর বের করলেন এবং সে তীরটি সেই কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহর কসম, তখন পানি উপচে উঠতে লাগল, এমনকি সকালেই তৃপ্তি সহকারে তা থেকে পানি পান করলেন। এমন সময় বুদায়ল ইবনে ওয়ারকা খুযাঈ তার খুযাআ গোত্রের কিছু লোক নিয়ে এল। তারা তিহামাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আন্তরিক হিতাকাঙ্ক্ষী ছিল। বুদাইল বলল, আমি কাব ইবনে লুওয়াই ও আমির ইবনে লুওয়াইকে রেখে এসেছি। তারা হুদায়বিয়ার প্রচুর পানির নিকট অবস্থান করছে। তাদের সঙ্গে আছে শাবক সহ দুগ্ধবতী অনেক উষ্ট্রী। তারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও বায়তুল্লাহর যিয়ারতে বাধা প্রদান করতে প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আম তো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসেনি ; বরং উমরা করতে এসেছি। যুদ্ধ নিঃসন্দেহে কুরাইশদের দুর্বল করে ফেলেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা যদি চায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারি আর তারা আমার ও কাফিরদের মধ্যকার বাঁধা তুলে নিবে। যদি আমি তাদের উপর জয়ী হই তাহলে অন্যান্য লোক ইসলামে যেভাবে প্রবেশ করেছে, তারাও চাইলে তা করতে পারবে। আর না হয়, তারা এ সময়টুকুতে শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি আমার প্রস্তাব অস্বীকার করে, তাহলে সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমার গর্দান বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাব। আর নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তাঁর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। বুদায়ল বলল, আমি আপনার বক্তব্য তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিব। এরপর বুদায়ল কুরাইশদের কাছে এসে বলল, আমি সেই লোকটির নিকট থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছে কিছু কথা শুনে এসেছি। তোমরা যদি চাও, তাহলে তোমাদের তা শোনাতে পারি। তাদের মধ্যে নির্বোধ লোকেরা বলল, তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু তাদের বিবেকবান লোকেরা বলল, তুমি তাকে যা বলতে শুনেছ, আমাদের তা বল। তারপর বুদায়ল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছিলেন, সব তাদের শুনাল। তারপর উরওয়া ইবনে মাসউদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হে লোকেরা ! আমি কি তোমাদের পিতৃতুল্য নই? তারা বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। উরওয়া বলল, তোমরা কি আমার সন্তান তুল্য নও? তারা বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই। উরওয়া বলল, আমার সম্বন্ধে তোমাদের কি কোন অভিযোগ আছে ? তারা বলল, উরওয়া বলল, তোমরা কি জান না যে, আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য উকাযবাসীদের কাছে আবেদন করেছিলেন এবং তারা আমাদের আহবানে সাড়া দিতে অস্বীকার করলে আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্তুতি ও আমার অনুগতদের নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছিলাম? তারা বলল, হ্যাঁ। জানি। উরওয়া বলল, এই লোকটি তোমাদের কাছে একটি ভাল প্রস্তাব পেশ করেছেন। তোমরা তা মেনে নাও এবং আমাকে তার কাছে যেতে দাও। তারা বলল, আপনি তাঁর কাছে যান। তারপর উরওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এল এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গে কথা বললেন, যেমনিভাবে বুদায়লের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। উরওয়া তখন বলল, হে মুহাম্মদ, আপনি কি চান যে, আপনার কওমকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন, আপনি কি আপনার পূর্বে আরববাসীদের এমন কারো কথা শুনেছেন যে, সে নিজ কওমের মূলোৎপাটন করতে উদ্যত হয়েছিল? আর যদি অন্য রকম হয়, (তখন আপনার কি অবস্থা হবে?) আল্লাহর কসম ! আমি কিছু চেহারা দেখছি এবং বিভিন্ন ধরনের লোক দেখতে পাচ্ছি যারা পালিয়ে যাবে এবং আপনাকে পরিত্যাগ করবে। তখন আবু বকর রা. তাকে বললেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাকে ছেড়ে পালিয়ে যাব। উরওয়া বলল, সে কে ? লোকজন বললেন, আবু বকর । উরওয়া বলল, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি তাঁর কসম করে বলছি, আমার উপর যদি আপনার ইহসান না থাকত, যার প্রতিদিন আমি দিতে পারিনি, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার কথার জবাব দিতাম। রাবী বলেন, উরওয়া পুনরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। কথা বলার ফাকে ফাকে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁর সাথে ছিল একটি তরবারী ও মাথার ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। উরওয়া যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁড়ির দিকে তার হাত বাড়াতো মুগীরা রা. তাঁর তরবারীর হাতল দিয়ে তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁড়ি থেকে তোমার হাত হটাও। উরওয়া মাথা তুলে বলল, এ কে? লোকজন বললেন, মুগীরা ইবনে শুবা। উরওয়া বলল, হে গাদ্দার । আমি কি তোমার গাদ্দারীর পরিণতি থেকে তোমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করিনি? মুগীরা রা. জাহেলী যুগে কিছু লোকদের সাথে ছিলেন। একদিন তাদের হত্যা করে তাদের সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেণ, আমি তোমার ইসলাম মেনে নিলাম, কিন্তু যে মাল তুমি নিয়েছ, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তারপর উরওয়া চোখের কোণ দিয়ে সাহাবীদের দিকে তাকাতে লাগল। সে বলল, আল্লাহর কসম ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো থুথু ফেললে তা সাহাবীদের হাতে পড়ত এবং তা গায়ে মুখে মেখে ফেলতেন। তিনি তাদের কোন আদেশ দিলে তা তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পালন করতেন। তিনি উযূ করলে তাঁর উযূর পানির জন্য তাঁর সম্মানার্থে সাহাবীগণ তাঁর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাতেন না। তারপর উরওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেল এবং বলল, হে আমার কওম, আল্লাহর কসম ! আমি অনেক রাজ-বাদশাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজ্জালী সম্রাটের দরবারে দূত হিসেবে গিয়েছি, কিন্তু আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পানি যে, কোন রাজা বাদশাহকেই তার অনুসারীদের ন্যায় এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মদের অনুসারীরা তাকে করে থাকে। আল্লাহর কসম ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোন সাহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন; তিনি উযূ করলে তাঁর উযূর পানি নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তিনি কথা বললে, সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমন কি তাঁর সম্মানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। তিনি তোমাদের কাছে একটি ভালো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তোমরা তা মেনে নাও। তা শুনে কিনানা গোত্রের এক ব্যক্তি বলল, আমাকে তাঁর নিকট যেতে যাও। লোকেরা বলল, যাও। সে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের কাছে এল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ হল অমুক ব্যক্তি এবং এমন গোত্রের লোক, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে থাকে। তোমরা তার কাছে কুরবানীর পশু নিয়ে আস। তারপর তার কাছে তা নিয়ে আসা হল এবং লোকজন তালবিয়া পাঠ করতে করতে তার সামনে এলেন। তা দেখে লোকটি বলল, সুবহানাল্লাহ ! এমন সব লোকদেরকে কাবা যিয়ারত থেকে বাধা দেওয়া সঙ্গত নয়। তারপর সে তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, আমি কুরবানীর পশু দেখে এসেছি, সেগুলোকে কিলাদা পরানো হয়েছে ও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই তাদের কাবা যিয়ারত বাধা প্রদান সঙ্গত মনে করি না। তখন তাদের মধ্য থেকে মিকরায ইবনে হাফস নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে তাঁর কাছে যেতে দাও। তারা বলল, তাঁর কাছে যাও। তারপর সে যখন মুসলিমদের নিকটবর্তী হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ হল মিকরায আর সে দুষ্টু লোক। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় সুহাইল ইবনে আমর এল। মামার বলেন, ইকরিমা রহ. সূত্রে আইয়্যুব রহ. আমাকে বলেছেন যে, যখন সুহাইল এল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল। মামার রহ. বলেন, যুহরী রহ. তাঁর বর্ণিত হাদীসে বলেছেন যে, সুহাইল ইবনে আমর এসে বলল, আসুন আমাদের ও আপনাদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র লিখি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন লেখককে ডাকলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (লিখ) بسم الله الرحمن الرحيم এতে সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম ! রাহমান কে-? আমরা তা জানি না, বরং পূর্বে আপনি যেমন লিখতেন, লিখুন باسمك اللهم মুসলিমগণ বললেন, আল্লাহর কসম ! আমরা بسم الله الرحمن الرحيم ছাড়া আর কিছু লিখব না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লিখ, باسمك اللهم তারপর বললেন, এটা যার উপর চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)। তখন সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম ! আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনাকে কাবা যিয়ারত থেকে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হতাম না। বরং আপনি লিখুন আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (এর তরফ থেকে)। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসূল ; কিন্তু তোমরা যদি আমাকে অস্বীকার কর তবে লিখ, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। যুহরী রহ. বলেন এটি এজন্য যে, তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আল্লাহর পবিত্র বস্তুগুলোর সম্মান করার কোন কথা দাবী করে তাহলে আমি তাদের সে দাবী মেনে নিব। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ চুক্তি কর যে, তারা আমাদের ও কাবা শরীফের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, যাতে আমরা তাওয়াফ করতে পারি। সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম ! আরববাসীরা যেন একথা বলার সুযোগ না পায় যে, এ প্রস্তাব গ্রহণে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। বরং আগামী বছর তা হতে পারে। তারপর লেখা হলো। সুহাইল বলল, এ-ও লিখা হউক যে, আমাদের কোন লোক যদি আপনার কাছে চলে আসে এবং সে যদিও আপনার দীন গ্রহণ করে থাকে, তবুও তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন। মুসলিমগণ বললেন, সুবহানাল্লাহ ! যে ইসলাম গ্রহণ করে আমাদের কাছে এসেছে, তাকে কেমন করে মুশরিকদের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে? এমন সময় আবু জানদাল ইবনে সুহাইল ইবনে আমর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বেড়ী পরিহিত অবস্থায় ধীরে ধীরে চলছিলেন। তিনি মক্কার নিম্নাঞ্চল থেকে বের হয়ে এসে মুসলিমদের সামনে নিজেকে পেশ করলেন। সুহাইল বলল, হে মুহাম্মদ ! আপনার সাথে আমার চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রথম কাজ হল তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখনো তো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। সুহাইল বলল, আল্লাহর কসম ! তাহলে আমি আপনাদের সঙ্গে আর কখনো সন্ধি করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেবল এ লোকটিকে আমার কাছে থাকার অনুমতি দাও। সে বলল, না এ অনুমতি আমি দেব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি এটা কর। সে বলল, আমি তা কবর না। মিকরায বলল, আমরা তাকে আপনার কাছে থাকার অনুমতি দিলাম। আবু জানদাল রহ বলেন, হে মুসলিম সমাজ! আমাকে মুশরিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, অথচ আমি মুসলিম হয়ে এসেছি। আপনারা কি দেখছেন না, আমি কত কষ্ট পাচ্ছি। আল্লাহর রাস্তায় তাকে অনেক নির্যাতিত করা হয়েছে। উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলাম এবং বললাম, আপনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, আমরা কি হকের উপর নই আর আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তাহলে দীনের ব্যাপারে কেন আমরা এত হেয় হবো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি অবশ্যই রাসূল; অতএব আমি তাঁর অবাধ্য হতে পারি না, অথচ তিনিই আমার সাহায্যকারী। আমি বললাম আপনি কি আমাদের বলেন নাই যে, আমরা শীঘ্রই বায়তুল্লাহ যাব এবং তাওয়াফ করব। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি কি এ বছরই আসার কথা বলেছি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই কাবা গৃহে যাবে এবং তাওয়াফ করবে। উমর রা. বলেন, তারপর আমি আবু বকর রা.-এর কাছে গিয়ে বললাম, হে আবু বকর ! তিনি কি আল্লাহর সত্য নবী নন? আবু বকর রা. বললেন, অবশ্যই। আমি বললাম, আমরা কি সত্যের উপর নই এবং আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? আবু বকর রা. বললেন, ওহে ! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি তাঁর রবের নাফরমানী করতে পারেন না। তিনিই তাহার সাহায্যকারী। তুমি তাঁর অনুসরণকে আকড়ে ধর। আল্লাহর কসম ! তিনি সত্যের উপর আছেন। আমি বললাম, তিনি কি বলেননি যে, আমরা অচিরেই বায়তুল্লাহ যাব এবং তার তাওয়াফ করব? আবু বকর রা. বললেন, অবশ্যই। কিন্তু তুমি এবারই যে যাবে একথা কি তিনি বলেছিলেন ? আমি বললাম, না । আবু বকর রা. বললেন, তবে নিশ্চয়ই তুমি সেখানে যাবে এবং তার তাওয়াফ করবে । যুহরী রহ. বলেন যে, উমর রা. বলেছেন, আমি এর জন্য অনেক নেক আমল করেছি। বর্ণনাকারী বলেন, সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা উঠ এবং কুরবানী কর ও মাথা কামিয়ে ফেল। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম ! রাসূলুল্লাহ তিনবার তা বলার পরও কেউ উঠলেন না। তাদের কাউকে উঠতে না দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালামা রা-এর কাছে এসে লোকদের এই আচরণের কথা বলেন। উম্মে সালামা রা. বললেন, হে আল্লাহর নবী ! আপনি যদি চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সাথে কোন কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরধার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন। সেই অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সাথে কোন কথা না বলে নিজে পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়াইলেন। তা দেখে সাহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। অবস্থা এমন হল যে, ভীড়ের কারণে একে অপরের উপর পড়তে লাগলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কয়েকজন মুসলিম মহিলা এলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন : “হে মুমিনগণ ! মহিলার তোমাদের কাছে হিজরত করে আসলে………………….. কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না” (৬০ : ১০)। সেদিন উমর র. দুজন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন, তারা ছিল মুশরিক থাকাকালে তাঁর স্ত্রী। তাদের একজনকে মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এবং অপরজনকে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বিয়ে করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে আসলেন। তখন আবু বাশীর রা. নামক কুরাইশ গোত্রের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁর তালাশে দুজন লোক পাঠাল। তারা বলল, আপনি আমাদের সাথে যে চুক্তি করেছেন (তা পূর্ণ করুন) । তিনি তাকে ঐ দুই ব্যক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তারা তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যুল-হুলায়ফায় পৌছে অবতরণ করল আর তাদের সাথে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল। আবু বাশীর রা. তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম ! হে অমুক, তোমার তরবারীটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে লোকটি তরবারীটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম ! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারী। আমি একাধিকবার তা পরীক্ষা করেছি। আবু বাশীর রা. বললেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই আমাকে তা দেখাও। তারপর লোকটি আবু বাশীরকে তলোয়ারটি দিল। আবু বাশীর রা. সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করলেন যে, তাঁতে সে মরে গেল। তার অপর সঙ্গী পালিয়ে মদীনায় এসে পৌঁছল এবং দৌড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন, এই লোকটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে। ইতিমধ্যে লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌছে বলল, আল্লাহর কসম ! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, আমিও নিহত হতাম। এমন সময় আবু বাশীর রা.-ও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আল্লাহর কসম ! আল্লাহ আপনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে তার কাছে ফেরত দিয়েছেন ; এ ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সর্বনাশ ! এত যুদ্ধের আগুন প্রজ্ব্বলিত, কেউ যদি তাকে বিরত রাখত। আবু বাশীর রা. যখন একথা শুনলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, তাকে আবার তিনি কাফিরদে কাছে ফেরত পাঠাবেন। তাই তিনি বেরিয়ে নদীর তীরে এসে পড়লেন। রাবী বলেন, এ দিকে আবু জানদাল ইবনে সুহাইল কাফিরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবু বাশীরের সঙ্গে এসে মিলিত হত। এভাবে তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম ! তাঁরা যখনই শুনতেন যে, কুরাইশদের কোন বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যাবে, তখনই তাঁরা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন আর তাদের হত্যা করতেন ও তাদের মাল সামান কেড়ে নিতেন। তখন কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরনিকট লোক পাঠাল। আল্লাহ ও আত্মীয়তার ওয়াসীলা দিয়ে আবেদন করল যে, আপনি আবু বাশীরের কাছে এর থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কেউ এলে সে নিরাপদ থাকবে । তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে নির্দেশ পাঠালেন। এ সময় আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন : “তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে বিরত রেখেছেন………..জাহেলী যুগের অহমিকা পর্যন্ত” (৮৪ : ২৬)। তাদের অহমিকা এই ছিল যে, তারা মুহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহর নবী বলে স্বীকার করেনি এবং “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” মেনে নেইনি ; বরং বায়তুল্লাহ ও মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। উকাইল রহ. যুহরী রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া রহ. বলেন যে, আমার কাছে আয়িশা রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম মহিলাদের পরীক্ষা করতেন এবং আমাদের কাছে বর্ণনা পৌছেছে যে, যখন আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন, মুসলমানগণ যেন মুশরিক স্বামীদের সে সব খরচ আদায় করে দেয়, যা তারা তাদের হিজরতকারী স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করেছে এবং মুসলিমদের নির্দেশ দেন যেন তারা কাফির স্ত্রীদের আটকিয়ে না রাখে। তখন উমর রা. তাঁর দুই স্ত্রী কুরায়বা বিনতে আবু উমায়্যা ও বিনতে জারওয়াল খুযায়ীকে তালাক দিয়ে দেন। এরপর কুরায়বাকে মুআবিয়া ও অপর জনকে আবু জাহাম বিয়ে করে নেয়। তারপর কাফিররা যখন মুসলমানদের তাদের স্ত্রীদের জন্য খরচকৃত অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকার করল, তখন নাযিল হল : “তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাত ছাড়া হয়ে কাফিরদের কাছে চলে যায়, তবে তোমরা তার বদলা নিবে”(৬০: ১১) বদলা হল : কাফিরদে স্ত্রী যারা হিজরত করে চলে আসে, তাদের কাফির স্বামীকে মাহর মুসলিমদের যা দিতে হয়, এ সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন যে, তারা যেন মুসলিমদের যে সব স্ত্রী চলে গেছে ঐ অর্থ তাদের মুসলিম স্বামীদেরকে দিয়ে দেয়। (যুহরী রহ. আরো বলেন) এমন কোন মুহাজির রমণীর কথা আমাদের জনা নেই, যে ঈমান আনার পর মুরতাদ হয়ে চলে গেছে। আমাদের কাছে এ বর্ণনা পৌছেছে যে, আবু বাশীর ইবনে আসীদ সাকাফী রা. ঈমান এনে চুক্তির মেয়াদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হিজরত করে চলে আসলেন। তখন আখনাস ইবনে শারীক আবু বাশীর রা.-কে ফেরত চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পত্র লিখল। তারপর তিনি হাদীসের অবশিষ্ট অংশ বর্ণনা করেছেন।