৯. মধ্য ভারতীয়-আর্য

নবম অধ্যায় – মধ্য ভারতীয়-আর্য

১. প্রাচীন প্রাকৃতের সাধারণ লক্ষণ

বৈদিক ভাষা উচ্চারণে এবং ব্যাকরণে ক্রমশ সরল হইয়া সংস্কৃতে পরিবর্তিত হইল, কিন্তু প্রাচীন ভারতীয়-আর্য কাঠামোটি অটুট রহিল। তাহার পরে অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দ হইতে, ভারতীয়-আর্য ভাষার যে পরিবর্তন ঘটিতে লাগিল তাহাতে পুরানো কাঠামো অনেকটা বদলাইয়া গেল। ভারতীয়-আর্য ভাষা এখন যেন প্রাচীন বেশ অর্থাৎ ‘সংস্কৃত’ রূপ ছাড়িয়া মধ্যকালীন বেশ ধরিল, সাধারণ ভাষায় ‘প্রাকৃতে’ পরিণত হইল। প্রাকৃত বা প্রাকৃত ভাষা কথাটির আসল তাৎপর্য হইতেছে ‘প্রকৃতি’র অর্থাৎ জনগণের ব্যবহৃত ভাষা। শিষ্ট ব্রাহ্মণ্য সমাজের “শুদ্ধ” ভাষা সংস্কৃত—এই নামটির প্রতিরূপ হিসাবে প্রাকৃত নামটি কল্পিত। কালিদাসের কথায় ইহার উদ্দেশ পাই।

বৈদিক সময়ে যে কথ্য ভাষা দাঁড়াইয়া ছিল তাহাতে ব্যাকরণের খুব ছাঁট কাট ছিল এবং ধ্বনি উচ্চারণেও বিকৃতি আসিয়াছিল। এই বৈদিক কথ্য রূপ থেকেই মূল মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার উৎপত্তি। এই ভাষা গোড়ার দিকে কিছু কালের জন্য সাহিত্যে ব্যবহৃত হইয়াছিল। তখন এ ভাষা সংস্কৃতের স্থান খানিকটা গ্রহণ করিয়াছিল। অপাণিনীয় সংস্কৃতের মধ্যে এ ভাষার—বৌদ্ধ সংস্কৃতের আলোচনা করিয়াছি।

আসলে এই ভাষা লোক মুখে বরাবর চলিয়া আসিয়া আধুনিক নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলিতে পরিণত হইয়াছে। এই ভাষার শব্দাবলীকে পতঞ্জলি (খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দ) ‘অপভ্রংশ’ বা ‘অপভ্রষ্ট’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছিলেন।

এই ‘অপভ্রংশ’ অর্থাৎ মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষাই গোড়ার ও শেষের দিকে সাহিত্যে ব্যবহৃত হইয়াছিল। প্রথম দিকের অবস্থায়, যখন বৌদ্ধদের দ্বারা ব্যবহৃত ছিল তখন তাহার যে রূপ তাহা পরে পালি নাম পাইয়াছে। আর একেবারে শেষের দিকে আধুনিক বা নব্য স্তরে পরিণত হইবার ঠিক আগেও এই মূল মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষা সাহিত্যে প্রচুরভাবে ব্যবহৃত হইয়াছিল, বিশেষ করিয়া পূর্ব ও মধ্য অঞ্চলে। তখন এই সাহিত্য ভাষার নাম হইয়াছিল অপভ্রষ্ট। নামটি হইতে বোঝা যায় যে পতঞ্জলি এ ভাষাকে যা বলিয়া নির্দেশ করিয়াছিলেন সেই নামই লোকের মুখে মুখে চলিয়া আসিয়াছিল।

সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন প্রাকৃত বলিয়া যাহা পরিচিত তাহা বৈদিক আমলের মুখের ভাষা হইতে সরাসরি আগত নহে। ইহা আসিয়াছে তাহারই শিষ্টজন ব্যবহৃত এবং কিছু সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুযায়ী সাজসজ্জা দিয়া সাহিত্যের জন্য গঠিত কিঞ্চিৎ কৃত্রিম রূপ হইতে। সেইজন্য এই প্রাকৃতের রূপ একটি নয়। অবশ্য প্রধান একটি রূপ আছে, মাহারাষ্ট্ৰী তবে তাহার প্রাধান্য প্রাচীনত্বের ও অনুশীলনের জন্য। অন্য প্রাকৃতগুলিতে স্থানীয় পরিবর্তন আসিয়াছে। যে প্রাকৃত স্টাইলে সংস্কৃত ভাষার বিশেষ অনুকরণ ছিল—এবং সেই সূত্রে—অপভ্রষ্টের বেশি কাছাকাছি ছিল, সে প্রকৃত নাম পায় শৌরসেনী, অর্থাৎ শূরসেন বা মথুরা অঞ্চলের ভাষা। যখন সংস্কৃত ভাষার বিশেষ সমৃদ্ধি হইয়াছিল তখন মথুরা অঞ্চল পাণ্ডিত্যে ও বৈদগ্ধে বিশেষভাবে যশস্বী ছিল।

তাহা হইলে মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার বংশের ছক এই রকম হয়,

সংস্কৃত প্রাকৃতে পরিণত হইলে পর প্রধানত তিন বিষয়ে পরিবর্তন দেখা গেল,— (১) ধ্বনিতে, (২) শব্দরূপে ও ধাতুরূপে, এবং (৩) পদব্যবহারে। প্রথমে ধ্বনিগত পরিবর্তন বিচার করা যাক। গোড়াতেই দেখি যে, ঋ-কারের উচ্চারণ লোপ পাইয়াছে। (আর ৯-কারের তো কথাই নাই, কেননা এই ধ্বনি সংস্কৃতে ছিল না, এক ‘ক্৯প্‌’ ধাতুর দুই তিনটি পদ ছাড়া।) মধ্য স্তরে ঋ-কারের স্থলে পাই শুধু স্বরধ্বনি (অ-কার, ই-কার, উ-কার, ক্কচিৎ এ-কার) অথবা [র, রি, রু] ইত্যাদি র-কার যুক্ত স্বরধ্বনি। যেমন মৃগ > (ক)মগ, মিগ, মুগ, ম্রুগ, ম্রিগ, (খ) মুঅ, মিঅ; বৃদ্ধ > বুড্‌ঢ; বৃক্ষ > (ক) রুক্‌খ, লুকখ, রুচ্ছ, ব্ৰচ্ছ, ব্রুচ্ছ; ঋষি—ইসি, রিসি; কৃষি > কসি। ঐ-কার, ঔ-কার স্থলে এ-কার, ‘ও-কার। যেমন ধর্মানুশস্ত্যৈ > (ক) ধর্ম্মানুসত্থিয়ে; ঔষধানি > (ক) ওসধানি। দ্ব্যক্ষর [অয়, অব] স্থলে প্রায়ই একাক্ষর [এ, ও]। যেমন ভবতি > (ক) ভোতি, হোতি, (খ) হোদি, ভোদি, হোই; পূজয়তি > (ক) পূজেতি, (খ) পূজেদি, পূজেই, (গ) পূজই। দক্ষিণ পশ্চিমা উপভাষায় এইরূপ একাক্ষরীভবন কিছু বিলম্বিত হইয়াছিল। কেননা অশোকের গির্নার অনুশাসনে দেখি যে, অন্যত্র ‘ভোতি (হোতি), পূজেতি’ হইলেও এখানে ‘ভবতি, পূজয়তি’ রহিয়া গিয়াছে। যুক্তব্যঞ্জনধ্বনির এবং পদান্ত অনুস্বারের পূর্বে সংস্কৃতের দীর্ঘ স্বর হ্রস্ব হইতেছে। যেমন কান্তাম্‌ > কন্তং; দীর্ঘ > দিগ্‌ঘ অথবা (দীঘ)। ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিবর্তন বেশি হইয়াছিল। প্রথমেই দেখি যে, অনুস্বার ছাড়া সমস্ত পদান্ত ব্যঞ্জনধ্বনির লোপ হইয়াছে। যেমন তৎ, কল্পাৎ, তস্মিন্ > ত, কপ্‌পা, তম্‌হি। পদান্তে অ-কারের পর বিসর্গ থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ও-কার বা এ-কারে পরিণত অথবা লুপ্ত; অন্য স্বরবর্ণের পর সর্বদা বিসর্গের লোপ। যেমন জনঃ > জনো, জনে জন; পুত্রাঃ > পুত্তা; মুনিঃ > মুনি (মুনী)। ষ-কারের লোপ। (কেবল উত্তর-পশ্চিম উপভাষায় এবং ক্কচিৎ প্রাচ্যমধ্যা উপভাষায় ধ্বনিটি কিছুকাল রহিয়া গিয়াছিল।) যেমন শুশ্রূষা > সুসূষা, সুসূসা (=সুস্‌সূসা) সুশ্রষ। [ঋ, র, শ, ষ] ধ্বনির কোনোটির যোগে (অথবা স্বতই) অনেক সময় দন্ত্য ব্যঞ্জনধ্বনি মূর্ধন্য হইয়া গেল। যেমন কৃত- > (ক) কত, কট-, (খ) কদ-, কঅ-, কট-। ব্যাপৃত- > (ক) বাপুত-, বিয়াপত, বপট; বপুট। দ্বাদশ > (ক) দ্‌বাদাস, দুবাদস, দুবাডস। পদের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকিলে হয় তাহার একটি, সাধারণত— [র, ব, স] লুপ্ত, নয় স্বরভক্তির যোগে ব্যঞ্জন দুইটি বিশ্লিষ্ট হয়। যেমন ত্রী, ত্রীণি > তী, তিন্নি; দ্বাদশ (ক) দুবাদাস; স্বামিকেন > (ক) সুবামিকেন। উত্তরপশ্চিমা উপভাষায় এবং ক্কচিৎ দক্ষিণপশ্চিমা উপভাষায় পদের আদিতে কোনো কোনো বিশেষ যুক্তব্যঞ্জন কিছুকাল রহিয়া গিয়াছিল। যেমন প্রিয়স্য > (ক) প্রিয়স্‌স; স্বামিকেন > (ক) স্পামিকেন, স্বামিকেন; স্ত্রী-> (ক) স্ত্রিয়ক- (কিন্তু প্রাচ্যা উপভাষায় ‘ইত্থী’।) পদমধ্যস্থিত যুক্তব্যঞ্জন হয় সমীভূত নয় স্বরভক্তির যোগে বিশ্লিষ্ট। সমীভূত যেমন অস্তি > অত্থি; সর্বত্র > সব্‌বত্ত; কল্যাণম্‌ > কল্লাণং; নিষ্‌ক্রমন্তু > নিক্‌খমন্তু; অদ্য > অজ্জ; চিকিৎসা > চিকিস্‌সা, চিকিচ্ছা; ব্রাহ্মণ > ব্রম্মণ, বম্ভন; ক্ষুদ্র > খুদ্দ, ছুদ্দ। পদাদিস্থিত অথবা পদমধ্যস্থিত [ক্ষ] হইয়াছে [ছ, চ্ছ) কিংবা [খ, ক্‌খ]। যেমন ক্ষণতি > ছনতি, বৃক্ষ > ব্ৰচ্ছ লুক্‌খ-। (উত্তরপশ্চিমা ও দক্ষিণপশ্চিমা উপভাষায় আদি স্তরে পদমধ্যগত অ-সমীভূত যুক্তব্যঞ্জন কিছু কিছু রহিয়া গিয়াছিল। যেমন তস্মিন্ > তম্‌হি; তিষ্ঠন্তঃ > তিস্‌টন্তো; ব্রূমি; *বিনীতস্মিন্ > বিনিতস্‌পি; দর্শয়িত্বা > দস্‌সয়িৎপা। য-ফলা থাকিলে উত্তরপশ্চিমায় সর্বদা এবং দক্ষিণপশ্চিমায় প্রায়ই সমীভবন, আর প্রাচ্যমধ্যায় ও প্রাচ্যায় সম্প্রসারণ হইয়াছে। যেমন কর্তব্য-> কটুব্ব, কট্টবিয়।

শব্দরূপে দেখি যে, পদান্ত ব্যঞ্জনের লোপের ফলে ব্যঞ্জনান্ত শব্দ স্বরান্তে পরিণত হইয়াছে। তবে কদাচিৎ পুরাতন ব্যঞ্জনান্ত শব্দের পদ দুই একটি রহিয়া গিয়াছে। যেমন রাজা (প্রথমার একবচন) > রয় (রায়া), লাজা; রাজ্ঞঃ (ষষ্ঠীর একবচন) > রঞ্‌ঞো, রাজিনে; লাজিনে; রাজানঃ (প্রথমার বহুবচন) > রাজানো, লাজানো। অধিকাংশ ব্যঞ্জনান্ত শব্দের রূপ অ-কারান্তের মতো হইত। যেমন ‘কর্মণে’ স্থলে *কর্মায় > (ক) কম্মায়; ‘অশ্লতঃ’ স্থলে * অশ্লতস্য > (ক) অশতস্ (= অশ্‌শতস্‌স)। আ-কারান্ত; ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত শব্দের রূপ বজায় ছিল। যেমন মহিলাঃ > (ক) মহিডায়ো; অম্বকজন্যঃ > (ক) অম্বকজনিয়ো; গণনায়াম্ > গণনায়ং; বৃদ্ধয়ে, বৃদ্ধ্যৈ > (ক) বড্‌ঢ়িয়ে, বড্‌ঢিয়া। দ্বিবচনের স্থান বহুবচন অধিকার করিল। যেমন দ্বৌ ময়ূরৌ > (ক) দ্বো মোরা, দুবে মজুলা; দ্বে চিকিৎসে > (ক) দ্বে চিকীছ (= চিকিচ্ছা), দুবে চিকিস (=চিকিৎসা)। পঞ্চমীর একবচনে [-তস্‌) প্রত্যয় যোগ হইতে লাগিল। যেমন উজ্জয়িনীতঃ > (ক) উজেনিতে। সপ্তমীর একবচনে সর্বত্র সর্বনামের [-স্মিন্] বিভক্তির ব্যবহার হইত, তবে কোনো কোনো উপভাষায় প্রাচীন [-ই] বিভক্তিও ছিল। যেমন বিজিতে, *বিজিতস্মিন্ > (ক) বিজিতে, বিজিতম্‌হি। অন্ত্য ব্যঞ্জনধ্বনি লোপের ফলে বহুবচনে প্রথম ও দ্বিতীয়া বিভক্তিতে পুংলিঙ্গ-ক্লীবলিঙ্গের প্রভেদ লুপ্ত হইল বলিয়া (—অর্থাৎ, নরাঃ > নরা, নরান্‌ >নরা, এবং ফলা = ফলানি—) পুংলিঙ্গে দ্বিতীয়ার বহুবচনে প্রায়ই ক্লীবলিঙ্গের প্রথমা-দ্বিতীয়ার বহুবচন অথবা পুংলিঙ্গের প্রথমবার বহুবচন ব্যবহৃত হইত। যেমন প্রাণাঃ > (ক) পাণানি, প্রণনি (= প্রাণানি বা প্রাণাঃ); বৃক্ষাঃ > লুখানি (=লুক্‌খানি) বা ব্ৰছা (ব্ৰচ্ছা); রাজানঃ > রজনি (=রাজানি), রাজানো, লাজানে। সর্বনামের প্রথমার বহুবচনে [-এ] বিভক্তি (যেমন ‘যে’, ‘তে’, ‘কে’) দ্বিতীয়ার বহুবচনে ব্যবহৃত হইত। যেমন, ‘জীবান্‌’ স্থলে ‘জীবে’। [-ভিস্‌] হইতে উৎপন্ন [-হি] বিভক্তি তৃতীয়া ছাড়া চতুর্থী পঞ্চমীতেও চলিত। যেমন (ক) আজীবিকেহি < আজীবিকেভ্যঃ।

প্রাকৃতের ধাতুরূপে সংস্কৃতের বৈচিত্র্য একেবারেই নাই। ধাতুর সঙ্গে বিকরণ মিশিয়া গিয়াছে। যেমন যুধ্‌ + -য়- > জুজ্‌ঝ- জি+না- >জিন-। এইভাবে কখনো কখনো এক মূলধাতু হইতে একাধিক নূতন ধাতু উৎপন্ন হইয়াছে। যেমন বাএই <বাদয়তি, বাজ্জই < বাদ্যতে। সকল ধাতুরই রূপ ভ্বাদিগণীয়ের মতো। তবে দৈবাৎ অন্যান্য গণের চিহ্নাবশেষযুক্ত পদ দুইচারটি আছে। যেমন অস্তি > অত্থি; *প্রাপ্‌ণাতি > (ক) পাপুণাতি; করোতি > (ক) করোতি, কলেতি, (খ) করোদি, কলেদি, (গ) করই; কৃণোতি > (গ) কুণই; মন্যতে > (ক) মঞ্‌ঞতে মঞ্‌ঞতি, মন্নতি; সংস্কৃতে শুধু একাক্ষর আ-কারান্ত ধাতুর ণিজন্ত রূপে [-পয়] বিকরণ যুক্ত হইত (যেমন দাপয়তি, মাপয়তি), প্রাকৃতে কিন্তু সব ধাতুরই ণিজন্তে (এমন কি নামধাতুতেও) এই বিকরণ দেখা যায়। যেমন লেখয়িষ্যামি > (ক) লেখাপেশামি (=লেখাপেশ্‌শামি); হারিতানি > (ক) হারাপিতানি; হারয়তি > (খ) হারাবেদি, হারাবেই। অতীতকালের ক্রিয়ার রূপে লিট্‌ লুপ্ত হইলে পর লঙ্‌ আর লুঙ্‌ মিশিয়া গেল। অসমাপিকায় সর্বত্র (উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও) ধাতুতে ক্ত্বাচ্ প্রত্যয় হইত। যেমন *আলোচয়িত্বা > (ক) অ(া)লোচেৎপা।

পদপ্রয়োগে দেখা যায় যে, দ্বিবচন সম্পূর্ণ লুপ্ত হইয়াছে। চতুর্থীর ও পঞ্চমীর একবচনও লুপ্তপ্রায়। কেবল তাদ্যৰ্থ-চতুর্থীর, এবং দক্ষিণপশ্চিমায় দৈবাৎ পঞ্চমীর, একবচন কিছুকাল ধরিয়া টিকিয়া ছিল। দ্বিতীয়া ও ষষ্ঠী বিভক্তির দ্বারা চতুর্থীর, এবং তৃতীয়ার ও সপ্তমীর দ্বারা পঞ্চমীর অর্থ প্রকাশিত হইত। যেমন নাস্তি হি কর্মতরং সর্বলোকহিতত্বাৎ > (ক) “নাস্তি হি কম্মতরং সর্বলোকহিতৎপা,” “নথি (=নত্থি) হি কম্মতলা সব (=সব্ব) লোকহিতেন”; তেভ্যঃ বক্তব্যম্‌ > “তেষং বতবো (=বত্তব্বো)”, “তেহি বতবিয়ে (=বত্তব্বিয়ে”)। ক্রিয়াপদেও দ্বিবচন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত এবং দক্ষিণপশ্চিমা উপভাষা ছাড়া অন্যত্র আত্মনেপদও বিলুপ্ত। বিধিলিঙ্‌ এবং লোট্‌ ভিন্ন অপর ভাবটি (অর্থাৎ লেট্‌) লোপ পাইয়াছে॥

২. প্রথম মধ্য ভারতীয়-আর্য

প্রাকৃত অর্থাৎ মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষা তিনটি সুস্পষ্ট স্তরের ভিতর দিয়া আসিয়া পরিণতি লাভ করিয়াছে। এই তিন স্তর হইল—প্রাচীন মধ্য ও অন্ত্য। এগুলির আনুমানিক স্থিতিকাল হইতেছে যথাক্রমে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ হইতে খ্রীস্টীয় প্রথম শতাব্দ, খ্রীস্টীয় প্রথম হইতে ষষ্ঠ শতাব্দ, এবং খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ হইতে দশম শতাব্দ। প্রথম স্তরের প্রধান নিদর্শন পাইতেছি অশোকের অনুশাসনে, খ্রীস্টপূর্ব শতাব্দের অন্যান্য প্রত্নলিপিতে এবং হীনযান-মতাবলম্বী বৌদ্ধদিগের পালি শাস্ত্রের প্রাচীনতম গ্রন্থগুলিতে। দ্বিতীয় স্তরের নিদর্শন মিলে খ্রীস্টপর প্রথম তিন শতাব্দের প্রত্নলিপিতে, সাহিত্যিক প্রাকৃতে (মহারাষ্ট্রী-শৌরসেনী-অর্ধমাগধী-মাগধী-পৈশাচী ইত্যাদিতে) এবং বৌদ্ধ-সংস্কৃতে। তৃতীয় স্তরের নিদর্শন পাই অপভ্রংশে ও অপভ্রষ্টে॥

৩. অশোক-অনুশাসনের ভাষা

অশোক-অনুশাসনের ভাষা পালি নয়, প্রাকৃতও নয়। এ ভাষার মধ্যে (খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দে) সেকালের, মধ্য ভারতীয়-আর্যের, মূল স্তরের উপভাষা চারটির পরিচয় পাইতেছি—১) উত্তরপশ্চিমা (শাহ্‌বাজগঢ়ী এবং মান্‌সেহ্‌রা অনুশাসন), (২) দক্ষিণপশ্চিমা (গির্নার অনুশাসন), (৩) প্রাচ্য-মধ্যা (কালসী ও ছোট অনুশাসনগুলি), এবং (৪) প্রাচ্যা (ধৌলী ও জৌগড় অনুশাসন)। প্রথম দুই অনুশাসন খরোষ্ঠী লিপিতে উৎকীর্ণ। এই বিদেশি লিপি লেখা হইত ডান দিক হইতে বাঁ দিকে। এই লিপিতে স্বরধ্বনির হ্রস্ব-দীর্ঘের ভেদাভেদ ছিল না। অপর অনুশাসনগুলি আধুনিক ভারতীয় সমুদয় লিপির আকর ব্রাহ্মীতে—বাঁ দিক হইতে ডান দিকে উৎকীর্ণ।

উত্তরপশ্চিমার প্রধান বিশেষত্ব হইতেছে পাঁচটি। (১) র-কার এবং স-কারযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির স্থিতি। যেমন প্রি-, স্ত্রিয়ক-, অস্তি। (২) য-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির সমীভবন। যেমন কর্তব্যঃ > কটবো = কট্টব্বো; কল্যাণম্ > কলণং = কল্লাণং। (৩) [স্ম স্ব] স্থলে [ম্প]। যেমন *বিনীতস্মিন্ > বিনিতস্‌পি, স্বামিকেন > স্পামিকেন। (৪) শ-কারের এবং কচিৎ ষ-কারের স্থিতি। (৫) [-ত্ব] প্রত্যয়ের অর্থে [*ত্বী] প্রত্যয়ের ব্যবহার। যেমন দ্রশেতি, তিস্তিতি, ইত্যাদি।

শাহ্‌বাজগঢ়ী লিপির নবম অনুশাসনের প্রথম অংশ উত্তরপশ্চিমার নিদর্শনরূপে উদ্ধৃত করিতেছি। লিপি খরোষ্ঠী, তাই দীর্ঘস্বরের চিহ্ন নাই। প্রাকৃত প্রত্নলিপিতে প্রায়ই যুক্ত বা যুগ্ম ব্যঞ্জন একক রূপে লেখা হইত।

দেবনং প্রিয়ো প্রিয়দশি রয় এবং অহতি জনো উচবুচং মংগলং করোতি অবধে অবহে বিবহে পজুপদনে প্রবসে। এতয়ে অঞয়ে চ এদিশিয়ে জনো বহু মংগলং করোতি। এত তু স্ত্রিয়ক বহু চ বহুবিধং চ পুতিকং চ নিরঠ্রিয়ং চ মংগলং করোতি। সে কটবো চ ব খো মংগলং। অপফলং তু খো এতং। ইং তু খো মহফল যে ধ্রুমমংগলং২।

দক্ষিণপশ্চিমা বৈদিক-সংস্কৃতের সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি। এখানে [শ, য] হইয়াছে ‘স’। র-কার ও স-কারযুক্ত ব্যঞ্জন ক্কচিৎ রহিয়া গিয়াছ । যেমন, অস্তি, সর্বত্র; য-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জন সমীভূত হইয়াছে। [ত্ব, ত্ম] স্থলে হইয়াছে [ৎপ]; অন্তঃস্থ ব-ফলা অনেক সময় বর্গীয় ব-ফলায় পরিণত হইয়াছে। যেমন আত্ম > আৎপ-, চত্বারঃ > চৎপারো, দ্বাদশ > দ্‌বাদস। ‘দৃ’ স্থানে পাই ‘রি’। যেমন এতাদৃশ- >এতারিস, যাদৃশ- > যারিস। ‘অয়, অব’ অনেক সময় ‘এ, ও’ হয় নাই। যেমন পূজয়তি, ভবতি। আত্মনেপদ ক্কচিৎ রহিয়া গিয়াছে। যেমন মঞ্‌তে আরভরে, অনুবতরে। ‘অস্’ ধাতুর অ-কারের অলোপ। যেমন অস=অস্‌সা < *অস্যাৎ; অসু=অস্‌সু < *অস্যুঃ। সপ্তমী ‘-স্মিন্’ বিভক্তি অন্য উপভাষার ‘-সি (=স্‌সি) অথবা ‘-স্পি’ হইয়াছে, কিন্তু দক্ষিণপশ্চিমায় হইয়াছে ‘-ম্‌হি’। যেমন তস্মিন্‌ > তম্‌হি, *ধর্মস্মিন্ > ধম্মম্‌হি।

দক্ষিণপশ্চিমার নিদর্শনরূপে গির্নার লিপির নবম অনুশাসনের প্রথম অংশ উদ্ধৃত করা গেল।

দেবানং পিয়ো পিয়োদসি রাজা এবং আহ অস্তি জনা উচাবচং মংগলং করোতে আবাধেসু বা আবাহবিবাহেসু বা পুত্রলাভেসু বা প্রবাসম্‌হি বা। এতম্‌হি অঞম্‌হি চ জনো উচাবচং মংগলং করোতে। এত তু মহিডায়ো বহুকং চ বহু্‌বিধং চ ছুদং চ নিরথং চ মংগলং করোতে। ত কতব্যমেব তু মংগলং। অপফলং তু খো এতারিসং মংগলং। অয়ং তু মহাফলে মংগলে য ধংমমংগলে।

‘দেবতাদের প্রিয়, প্রিয়দর্শী রাজা এই কথা বলিতেছেন: লোকে নানাবিধ মঙ্গল-অনুষ্ঠান করে—পুত্ৰবিবাহে, কন্যাবিবাহে, সন্তানলাভে, প্রবাসগমনে। এইসব এবং এইরকম অন্য উপলক্ষ্যে লোকে অনেক মঙ্গল-অনুষ্ঠান করে। এই ভাবে মহিলারা অনেক এবং নানারকম ছোটখাট নিরর্থক মঙ্গল-অনুষ্ঠান করে। অতএব মঙ্গগল-অনুষ্ঠান করিতে হয়ই। তবে এইসব মঙ্গল-অনুষ্ঠান অল্পফলপ্রদ। এই ধর্মমঙ্গল-অনুষ্ঠানই মহাফলপ্রদ মঙ্গল-অনুষ্ঠান।

প্রাচ্যমধ্যার বিশিষ্ট লক্ষণ এইগুলি,—র > ল। ক্কচিৎ [শ, ষ]-এর স্থিতি। পদান্তে বিসর্গযুক্ত অ-কারের এ-কারে পরিণতি। কদাচিৎ পদমধ্যবর্তী-ও- >-এ-; যেমন করোতি > কলেতি। পদান্তে অ-কারের আ-কারপ্রবণতা। র-কার ও স-কার যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি সমীভবন; যেমন অস্তি > অত্থি, সর্বত্র > সব্বত্ত। -ত্য- > -তিয়-, -ব্য- > -বিয়-, -দ্য- > -জ্জ- (-য্য-), -ল্য >- য্য (যেমন অপত্য- > অপতিয়-, কর্তব্য, > কট্টবিয়-, অদ্য > অজ্জ, উদ্যান- > = উয্যান-, কল্যাণ- > কয্যাণ-)। -ত্য > -চ্চ- (যেমন সত্য- > সচ্চ)। [ত্ব-] ছাড়া সর্বত্র ব-ফলার সম্প্রসারণ (যেমন দ্বাদশ > দুবাদশ, শ্বঃ শ্বঃ > সুবে, সুবে; কিন্তু চত্বারি > চত্তালি)। -ষ্ম, -স্ম- > প্‌ফ- (যেমন তস্মাৎ > তপ্‌ফা, *তুষ্মে (=যুষ্মে) > তুপ্‌ফে)। -ক্ষ-> -ক্‌খ (যেমন *দৃক্ষতি > দখতি =দক্‌খতি)। ভূ- > হু- (যেমন ভবতি > হোতি)। আত্মনেপদ (শানচ্‌) প্রত্যয়ের অ-লোপ।

প্রাচ্যমধ্যার প্রাচীনতম নিদর্শন বলিয়া দিল্লী-তোপ্‌রা স্তম্ভলিপির সপ্তম অনুশাসনের মধ্য হইতে একটু অংশ দিতেছি।

দেবানাং পিয়ো পিয়দসি লাজা হেবং আহ মগেসু পি মে নিগোহানি লোপাপিতানি ছায়োপগানি হোসংতি পসূমুনিসানং অংবাবডিক্যা লোপাপিতা অটকোসিক্যানি পি মে উদুপানানি খানাপিতানি নিংসিধিয়া চ কালাপিতা আপানামি মে বহুকানি তত তত কালাপিতানি পটীভোগায়ে পসুমুনিসানং।

‘দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা এই কথা বলিতেছেম— পশুর ও মানুষের ছায়াপ্রদ হইবে বলিয়া আমি পথে ন্যগ্রোধ রোপণ করিয়াছি, আমবাড়ী বসাইয়াছি, আধক্রোশ অন্তরে আমি ইদারা কাটাইয়াছি, সিঁড়ি বাঁধাইয়াছি—যেখানে সেখানে আমি জলছত্র বসাইয়াছি পশুর ও মানুষের প্রয়োজনের জন্য।’

বাংলাদেশে মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শিলাখণ্ড লেখটি অশোকের সমসাময়িক। লেখটির ভাষাও অশোকের সময়ের প্রাচ্যা।

প্রাচ্যার লক্ষণ মোটামুটি প্রাচ্যমধ্যার অনুগামী। বিশেষ লক্ষণ এইগুলি, —পদান্ত অ-কারযুক্ত বিসর্গের এ-কারে পরিণতি। পদমধ্যে -ও- > এ-। শ, ষ > স। র > ল। উত্তমপুরুষ সর্বনামে প্রথমার একবচনে ‘হকং’।

ধৌলী লিপির অতিরিক্ত প্রথম অনুশাসন হইতে প্রাচ্যার নিদর্শন দিতেছি।

সবে মুনিসে পজা মমা। অথা পজায়ে ইছামি হকং কিংতি সবেন হিতসুখেন হিদলোকিকপাললোকিকেন যুজেবু তি। তথা সমুনিসেসু পি ইচ্ছামি হকং।

‘সব মানুষ আমার সন্তান। যেমন আমি সন্তানের বিষয়ে চাই—তাহারা যেন ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সকল হিতসুখ পায়, সেইরূপ সব মানুষের পক্ষেও আমি ইচ্ছা করি।’

মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার এবং ভারতীয় লিপিমালার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন পাই অশোক-অনুশাসনে। বিষয়বস্তুর হিসাবে অশোক-অনুশাসনগুলিকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (১) গিরি-অনুশাসন, (২) ক্ষুদ্র গিরি অনুশাসন এবং (৩) স্তম্ভ-লিপি ও নিতান্ত ক্ষুদ্র উৎসর্গ-লিপি। ছয়টি গিরি-অনুশাসনের মধ্যে দুইটি আছে পূর্বতন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে। (এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত)। তাহার মধ্যে একটি আছে আটক ও পেশাওরের মধ্যবর্তী মর্দান স্টেশন হইতে প্রায় সাত মাইল উত্তর-পশ্চিমে শাহ্‌বাজগঢ়ী গ্রামে গিরিগাত্রে। এবটাবাদ হইতে যে কাশ্মীরগামী পথ বাহির হইয়াছে তাহার উপর অবস্থিত মান্‌সেহ্‌রা শহরের এক মাইল পশ্চিমে একটি পাহাড়ের গায়ে অপর অনুশাসনটি খোদাই রহিয়াছে। গুজরাটে জুনাগঢ় শহরের আধ মাইল পূর্বে প্রাচীন সুদর্শন হ্রদের তীরের পৌরাণিক রৈবতক, আধুনিক গির্নার, পাহাড়ের গায়ে তৃতীয় অনুশাসনটি উৎকীর্ণ আছে। মসুরী হইতে চক্রাতার পথে ষোল মাইল দূরে কাল্‌সী গ্রাম, সেই গ্রাম হইতে দক্ষিণদিকে প্রায় দেড় মাইল দূরে যমুনা ও তমসা নদীর সঙ্গমস্থলের নিকটে এক সুবৃহৎ শ্বেত স্ফটিক শৈলখণ্ডের গায়ে চতুর্থ অনুশাসনটি লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। বাকি দুইটি অনুশাসন আছে সেকালের কলিঙ্গ প্রদেশ, আধুনিক উড়িষ্যায়। একটি আছে ভুবনেশ্বর হইতে চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ধৌলী গ্রামে, দ্বিতীয়টি আছে গঞ্জাম হইতে উত্তর-পশ্চিম দিকে আঠার মাইল দূরে জৌগড়ে। গুজরাটে আর একটি গিরি-অনুশাসনের সামান্য কিছু অংশ পাওয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র গিরি-অনুশাসনগুলির মধ্যে একটি আছে জব্বলপুর জেলার প্রাচীন রূপনাথ তীর্থে, দ্বিতীয়টি বিহারে শাহাবাদ জেলার অন্তর্গত সাসারামে, তৃতীয়টি জয়পুর রাজ্যে বৈরাট শহরে, চতুর্থটিও বৈরাটে ছিল, এখন রহিয়াছে কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি ভবনে। তিনটি আছে কর্ণাটক রাজ্যে—সিদ্ধপুর, ব্রহ্মগিরি এবং জটিঙ্গারামেশ্বরে। একটি আছে অন্ধ্র প্রদেশে, মস্‌কি গ্রামে, এবং আর একটি আছে তামিলনাড়ুর কুর্নুল জেলায়। স্তম্ভ-লিপিগুলির মধ্যে দুইটি রহিয়াছে এখন দিল্লীতে। আসলে এ-দুটির মধ্যে একটি ছিল আম্বালা জেলায় তোপ্‌রা গ্রামে, আর অপরটি ছিল মীরাটে। তৃতীয় স্তম্ভটি প্রথমে প্রাচীন কালের কৌশাম্বীতে ছিল, এখন আছে এলাহাবাদ দুর্গের মধ্যে। তিনটি স্তম্ভ আছে বিহারে চম্পারণ জেলায়—লৌড়িয়া গ্রামের কাছে দুইটি এবং রামপুরওয়া গ্রামে একটি। কাশীর অদূরে সারনাথে এবং ভোপাল রাজ্যের অন্তর্গত সাঁচীতে দুইটি স্তম্ভলিপির অংশ পাওয়া গিয়াছে। বুদ্ধের জন্মভূমিতে, নেপাল রাজ্যের অন্তর্গত রুম্মিনদেঈ নামক স্থানে প্রাপ্ত একটি স্তম্ভে সামান্য কিছু লিপি আছে। ইহার কিছু দূরে নিগ্‌লীব নামক স্থানে আর একটি স্তম্ভের অংশ পাওয়া গিয়াছে। ইহা ছাড়া বরাবর পাহাড়ের গুহার দ্বারদেশে দুইচার ছত্র করিয়া গুহালিপি (অশোকের এবং তাঁর নাতি দশরথের) দেখা যায়॥

৪. “সুতনুকা” প্রত্নলেখ

অশোক-অনুশাসনের সমসাময়িক একটি লেখ নিতান্ত ক্ষুদ্র হইলেও ভাষার ইতিহাসে সবিশেষ মূল্যবান্। পূর্বতন ছোটনাগপুর প্রদেশের অন্তর্গত সরগুজা রাজ্যের, অধুনা উত্তর প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত রামগড় পাহাড়ের উপরে যোগীমারা গুহায় খোদিত তিনছত্র প্রত্নলিপিটি প্রথম শব্দ ‘শুতনুকা’ হইতে সুতনুকা প্রত্নলেখ নামে নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। এই অনুশাসনের ভাষা প্রাচ্য, কিন্তু ইহার এমন একটি বর্ণগত বিশেষত্ব আছে, অর্থাৎ [স, ষ] স্থানে [শ] অক্ষর, যাহা অশোক অনুশাসনের প্রাচ্যায় পাই না। পরবর্তী কালের সাহিত্যের “মাগধী” প্রাকৃতের প্রধান লক্ষণ তিনটিই এখানে পাওয়া যাইতেছে—স, ষ > শ; র > ল; এবং পুংলিঙ্গ প্রথমার একবচনে ‘-এ’ বিভক্তি। প্রত্নলিপিটি এই

শুতনুক নম দেবদশিক্যি

তং কময়িথ বলনশেয়ে

দেবদিনে নম লুপদখে।

‘সুতনুকা নামে দেবদাসী। তাহাকে কামনা করিয়াছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন নামে রূপদক্ষ।’

৫. খারবেল অনুশাসন

উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছে উদয়গিরি পাহাড়ের হাথিগুম্ফার ছাদের তলদেশে কলিঙ্গরাজ খারবেলের যে অনুশাসন (খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দ) উৎকীর্ণ আছে তাহা এক হিসাবে বিশেষ মূল্যবান্‌। ইহার ভাষা ঠিক প্রাচ্যা নয়, কতকটা দক্ষিণ-পশ্চিমার মতো। অশোকের গির্নার অনুশাসনের, এবং বিশেষ করিয়া পালি ভাষার সহিত খারবেল-অনুশাসনের ভাষার খুব মিল আছে। তবে অশোক-অনুশাসনের মতো ইহা কথ্যভাষা ঘেঁষা নয়, বিশুদ্ধ সাধুভাষা। সমাস-বহুল সংস্কৃত গদ্যরীতির অনুকরণ ইহাতে আছে। প্রাকৃতের উপর সংস্কৃতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পুরানো এবং ভালো নিদর্শন এখানে পাই। খারবেল-অনুশাসনের আরম্ভ এই ভাবে।

নমো অরহন্তানং নমো সবসিধানং। অইরেন মহারাজেন মহামেঘবাহনেন চেতিরাজবংসবধনেন পথসুভলখণেন চতুরন্তলুণ্ঠনগুণউপিতেন কলিঙ্গাধিপতিনা সিরিখারবেলেন পন্দরস বসনি সিরিকডারসরীরবতা কীড়িত কুমারকীড়িকা। ততো লেখরূপগণনাববহারবিধিবিসারদেন সববিজাবদাতেন নব বসানি যোবরজং পসাসিতং।

‘অর্হৎদিগকে নমস্কার, সর্বসিদ্ধকে নমস্কার। ঐর মহারাজ গজপতি চেদিরাজ বংশবর্ধন প্রশস্তশুভলক্ষ্মণসম্পন্ন চতুর্দিগাহৃতগুণসমূহযুক্ত কলিঙ্গাধিপতি শ্রীখারবেল পনের বৎসর যাবৎ শ্রীকড়ার (সৌন্দর্যময়?) শরীর ধারণ করিয়া বাল্যক্রীড়া করিলেন। তাহার পর লেখ-রূপ-গণনা-ব্যবহারবিধি-বিশারদ এবং সর্ববিদ্যাভূষিত হইয়া নয় বৎসর ধরিয়া যৌবরাজ্য শাসন করিলেন।’

খ্রীস্টপূর্বাব্দের প্রাপ্ত প্রত্নলেখ কোনটিই সংস্কৃতে নয়, সবই মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষায় লেখা। তাহার কারণ এই যে, সাধারণ ব্যবহারে, অর্থাৎ শিষ্ট-জন-ভাষার প্রাদেশিক রূপে তখন এতটা পার্থক্য দেখা দেয় নাই যাহাতে এক অঞ্চলের লোকের কথা অপর অঞ্চলের লোকের সম্পূর্ণ অবোধ্য হইতে পারে। কিন্তু কালক্রমে যখন মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার প্রাদেশিক রূপান্তর পরিস্ফুটতর হইতে লাগিল তখন সকলের বোধগম্য রাখিবার জন্য সাধারণ ভাষাভাণ্ডার সংস্কৃতের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় রহিল না। তাহার কারণ আবহমান কাল হইতে সংস্কৃত ভারতবর্ষে আর্যভূমির প্রথমে একমাত্র পরে প্রধান সাধুভাষা রূপে ব্যবহৃত ছিল। সেইজন্যই খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দ হইতে যতগুলি প্রত্নলেখ পাওয়া যাইতেছে তাহার মধ্যে দুইচারটি ছাড়া সবই সংস্কৃতে লেখা, এবং এই দুইচারটি প্রাকৃত প্রত্নলেখেও সংস্কৃতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিদ্যমান। খ্রীস্টপর কালে দক্ষিণ-ভারতে অন্ধ্র ও পল্লব রাজাদের অনুশাসন এবং কয়েকটি বৌদ্ধ গুহালিপি এবং উত্তরাপথে কুষাণ-রাজাদের সময়ে কয়েকটি ছোট ছোট লেখ ছাড়া খাস ভারতবর্ষে বিশুদ্ধ অথবা সংস্কৃত-মিশ্র প্রাকৃতে লেখা আর কোন উল্লেখযোগ্য প্রাচীন প্রত্নলেখের সন্ধান মিলিতেছে না॥

৬. হেলিওদোরের গরুড়স্তম্ভ লিপি

খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতাব্দের একটি বিশিষ্ট প্রাকৃত প্রত্নলেখ হইতেছে বেসনগরে (প্রাচীন বিদিশায়) যবন-রাজ অন্তলিখিতের (Antialkidas) দূত তক্ষশিলাবাসী যবন (অর্থাৎ গ্রীক) দিওনের পুত্র হেলিওদোরের (Heliodoros) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গরুড়স্তম্ভ-লেখ। সেটি এই

দেবদেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজে অয়ং কারিতে ইঅ হেলিওদোরেণ ভাগবতেন দিয়স পুত্রেণ তক্ষশিলাকেন যোন-দূতেন আগতেন মহারাজস অংতলিকিতস উপংতা সকাসং রঞো কোসীপূত্ৰস ভাগভদ্রস ত্রাতারস বসেন চতুদসেন রাজেন বধমানস।

ত্রিনি অমুত-পদানি ইঅ সু অনুঠিতানি নেয়ংতি স্বগং দম চাগ অপ্রমাদ॥

‘দেবদেব বাসুদেবের এই গরুড়স্তম্ভ নির্মিত হইল দিয়সের পুত্র তক্ষশিলাবাসী যবনদূত বৈষ্ণব হেলিওদোর কর্তৃক যিনি মহারাজ অন্তলিখিতের নিকট হইতে আসিয়াছিলেন কৌৎসীপুত্র রাজা ভাগভদ্রের কাছে, মহারাজের বর্ধমান রাজ্যশাসনের চতুর্দশ বৎসরে।

এই তিনটি অমৃতপদ সু-অনুষ্ঠিত হইলে স্বর্গে লইয়া যায়—দম ত্যাগ অপ্রমাদ।

৭. পালি

দক্ষিণপশ্চিমা ও প্রাচ্যমধ্যার মিশ্রণে— সম্ভবত প্রথমে কেন্দ্রীয় উজ্জয়িনী অঞ্চলে—উদ্ভূত দেশিবিদেশি সর্বসাধারণের ব্যবহার্য যে মধ্য ভারতীয় সাধুভাষা—যাহাকে সেকালের lingua franca বলিতে পারি— তাহা হইতে পালি উৎপন্ন। একদিকে অশোকের গির্নার অনুশাসনের ও অপরদিকে খারবেল অনুশাসনের ভাষার সঙ্গে পালির গভীর ঐক্য এই অনুমানের প্রবল সমর্থক। পালি পুরাপুরি ধর্ম-সাহিত্যের ভাষা। প্রাচ্যমধ্যার সঙ্গে বিশেষ মিল দেখি র-কারের ল-কারে পরিণতিতে এবং বিসর্গযুক্ত অ-কারান্ত পদের এ-কারান্ত হওয়ায়। অশোকের অনুশাসনের দক্ষিণপশ্চিমার মতো পালিতেও অ-সমীভূত যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি কিছু আছে এবং আত্মনেপদ পদও কিছু কিছু রহিয়া গিয়াছে। এই পদগুলির কোন কোনটি প্রাচীন ভারতীয়-আর্যে নাই। অর্থাৎ এগুলির মূলে সংস্কৃতের পূর্ববর্তী স্তরের চিহ্নাবশেষ রহিয়াছে। যেমন দিস্‌সরে < *দৃশ্যরে (=দৃশ্যন্তে)।

পালি ভাষার নিদর্শন

ন তাব সুপিতুং হোতি রত্তি নক্‌খত্তমালিনী।

পটিজগ্‌গিতুমেবেসা রত্তি হোতি বিজানতা॥

‘নক্ষত্রমালিনী রাত্রি কিছুতেই ঘুমাইয়া কাটাইবার নহে।

যিনি জ্ঞানবান্ এই রাত্রি তাঁহার জাগিয়া থাকিবার।’

পালি ভাষা দক্ষিণভারতেই অনুশীলিত হইতে থাকে। এই অঞ্চলে পালি ব্যবহারকারী হীনযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায় বাস করিতেন। এখান হইতে পালির চর্চা উঠিয়া গিয়া বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষ ছাড়িয়া সিংহলে চলিয়া যায়॥

৮. বৌদ্ধ সংস্কৃত

উত্তর ভারতের বৌদ্ধসম্প্রদায়গুলি পালি ব্যবহার করিতেন না। ইহারা গ্রন্থরচনা করিতেন সংস্কৃত-প্রাকৃত মিশ্র ভাষায়। এ ভাষার উৎপত্তি কথ্য সংস্কৃত ভাষা হইতে। তাঁহাদের ভাষাকে এখন বলা হয়, বৌদ্ধ (মিশ্র) সংস্কৃত। কিন্তু এই মিশ্র ভাষার ব্যবহার বৌদ্ধ শাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কুষাণ সম্রাটদের কোন কোন অনুশাসনেও এই ভাষা দেখা যায়।

বৌদ্ধ সংস্কৃতের নিদর্শন

সর্বাভিভু সর্ববিদু হমম্মি

সর্বেষু ধর্মেষু অনোপলিপ্তঃ।

সর্বং জহে তৃষ্ণক্ষয়া বিমুক্তো

ন মাদৃশো সংপ্রজনেতি বেদনা॥

‘আমি সর্বদমন্ সর্ববিদ্‌, সকল ধর্মে অনুপলিপ্ত।

তৃষ্ণাক্ষয়ের ফলে বিমুক্ত আমি সব ত্যাগ করিয়াছি।

আমার মতো সদত (সুখদুঃখ) বেদনা অনুভব করে না॥’

৯. দ্বিতীয় মধ্য ভারতীয়-আর্য

একটি গুরুতর ধ্বনিপরিবর্তন প্রাকৃতকে মধ্যস্তরে পৌঁছাইয়া দিল। ইহা হইল স্পৃষ্ট ব্যঞ্জনের প্রথমে স্পর্শক্ষীণতা পরে স্পর্শহীনতা। ধ্বনিপরিবর্তন সূত্রটি এই : মধ্য ভারতীয়-আর্যের দ্বিতীয় স্তরে স্বরমধ্যস্থিত স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন উষ্ম হইয়া অল্পপ্রাণ হইলে লুপ্ত আর মহাপ্রাণ হইলে হ-কারে পরিণত হইয়াছিল। মহাপ্রাণ ধ্বনির হ-কারে পরিণতি প্রাচীন ভারতীয়-আর্যেই কিঞ্চিৎ দেখা দিয়াছিল। যেমন ধিত- > হিত- (‘ধা’ ধাতু + -‘ত’); *ইধি (তুলনীয় ‘শাধি’, ‘এধি’) > ইহি (‘ই’ ধাতু লোট্‌ ‘হি’)। অশোকের অনুশাসনে -ধ > -হ-তো পাইই উপরন্তু -ভ- > -হ- পাই, এবং ক্বচিৎ -ক- > -গ- এবং -ট- > -ড-, -প- > -ব পাই। যেমন বিদহামি < বিদধামি, তেহি < তেভিঃ, পরলোগ-< পরলোক, অংববাডিকা < আম্রবাটিকাঃ, থুবে < স্তূপঃ। প্রাকৃতের আদি স্তরের শেষের দিকে -ত- > -দ- এবং -থ- > -ধ- —এই পরিবর্তনের উদাহরণ মোটেই অসুলভ নয়। যেমন অশ্বঘোষের নাটকে সুরদ- < সুরত; খারবেল অনুশাসনে পধম < প্রথম, রধ- < রথ-।

দ্বিতীয় মধ্য ভারতীয়-আর্যের যে তিন উপস্তরভেদ কল্পিত হয় তাহা এই ধ্বনিপরিবর্তনের তিনটি ধাপ ধরিয়া। আদি উপস্তরে স্বরমধ্যগত স্পৃষ্ট অঘোষ ব্যঞ্জন ঘোষবৎ হইল। যেমন ভোদি, হোদি < ভবতি; জধা < যথা; রূব < রূপ; সিভা < শিফা। মধ্য উপস্তরে স্বরমধ্যগত ঘোষবৎ ব্যঞ্জন উষ্ম হইল। যেমন খরোষ্ঠী প্রত্নলিপিতে—নগ·রগ·স< নগরকস্য ভগ.বতো < ভগবতঃ, প্রতিষ্ঠবিদ. < প্রতিস্থাপিত। নিয়া প্রাকৃতে—অনেগ. < অনেক, পাহুড. < প্রাকৃত। অন্ত্য উপস্তরে স্বরমধ্যগত উষ্মীভূত ব্যঞ্জন অল্পপ্রাণ হইলে লুপ্ত হইল, মহাপ্রাণ হইলে হ-কারে পরিণত হইল। যেমন মঅ < *মগ, < মগ < মৃগ; কঅ < *কদ· < কদ < কৃত; রূঅ < রূব < রূপ; সঅল < *সগ·ল < *সকল; লহু < লঘু. লঘু; < জহা < জধ.া < জধা < যথা।

দ্বিতীয় উপস্তরে শব্দরূপ ও ধাতুরূপ আরো সরল হইল। কর্মভাববাচ্যে ‘-ত-’ প্রত্যয়ান্ত কৃদন্ত পদ কর্তৃবাচ্যে অতীতকালে সমাপিকা ক্রিয়ার স্থান গ্রহণ করিল। কর্তা ছাড়া বিভিন্ন কারকের অর্থে বিবিধ পদ অনুসর্গরূপে যুক্ত হইতে লাগিল॥

১০. প্রথম উপস্তর

মধ্য ভারতীয়-আর্যের প্রথম উপস্তরের স্থিতিকাল মোটামুটি ৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ হইতে ১০০ খ্রীস্টাব্দ। ইহার অ-সাহিত্যিক নিদর্শন প্রত্নলিপিতে, সাহিত্যিক নিদর্শন অশ্বঘোষের নাটকে ও খরোষ্ঠী অক্ষরে লেখা ধম্মপদে। এই পুথির ভাষা গান্ধারী অর্থাৎ উত্তরপশ্চিমা প্রাকৃত, [যাহার প্রাচীনতর রূপ অশোকের শাহ্‌বাজগঢ়ী অনুশাসনে পাই। অশ্বঘোষের নাটকের প্রাকৃত টুকরাগুলিতে তিন প্রধান উপভাষার নমুনা আছে। এগুলির মধ্যে পরবর্তী কালের সাহিত্যের মাগধী-শৌরসেনী-অর্ধমাগধীর পূর্বতন রূপটি নিহিত।] খরোষ্ঠী ধম্মপদ উত্তর-পশ্চিমায় লেখা, তবে ভারতবর্ষের বাহিরে, মধ্য এশিয়ার খোটানে। খরোষ্ঠী ধম্মপদ হইতে গান্ধারী প্রাকৃতের নিদর্শন দিই।

সিজ ভিখু ইম নম সিত দি লহ ভেষিদি।

ছেত্ব রক জি দেষ জি তদো নিবন এষিদি।

‘হে ভিক্ষু এই (দেহ) নৌকায় জল সেচ। সেচা হইলে তোমার ভার লঘু হইবে। তখন রাগদ্বেষ ছিন্ন হইলে নির্বাণ আসিবে।’

মধ্য উপস্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক ১০০-৩০০ খ্রীস্টাব্দ। শক-কুষাণদের খরোষ্ঠী প্রত্নলেখে এবং চীনীয় তুর্কিস্তানে প্রাপ্ত নিয়া লেখমালায় ইহার নিদর্শন রহিয়াছে। এগুলি সবই উত্তরপশ্চিমা উপভাষায় লেখা॥

১১. নিয়া প্রাকৃত

চীনীয় তুর্কিস্তানের অন্তর্গত প্রাচীন শান্‌শান্‌ রাজ্যের সীমান্তে নিয়া নামক স্থানের বালুকাস্তূপ হইতে প্রাপ্ত প্রধানত খরোষ্ঠীতে এবং কিছু কিছু ব্রাহ্মীতে লেখা প্রত্নলেখগুলির ভাষা এখন নিয়া (Niya) প্রাকৃত নামে পরিচিত। এগুলি শাসনকার্য বিচার ও ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কীয় পত্রাবলী ও রিপোর্ট।

নিয়া প্রাকৃতে স্বরমধ্যগত ব্যঞ্জনধ্বনির উষ্মীভবন ব্যাপকভাবে হইয়াছে। যেমন অবগ·জ· < অবকাশ-, দঝ < দাস-, গোয়রি < গোচরে। ‘ত’- প্রত্যয়ান্ত কৃদন্ত পদে উত্তম ও মধ্যম পুরুষে ‘অস্‌’ ধাতুর বর্তমানের পদ অনুপ্ৰয়োগ করিয়া, এবং প্রথম পুরুষের বহুবচনে ‘অন্তি’ বিভক্তি দিয়া অতীত কাল সৃষ্ট হইয়াছে। যেমন শ্রুতোমি < শ্রুতোহম্মি = আমি শুনিলাম, শুনিয়াছি। দিতেসি < দত্তোহসি = তুমি দিলে, দিয়াছ। গতংতি < গত + -অন্তি = তাহারা গেল, গিয়াছে। প্রথম পুরুষের একবচনে কিছুই যোগ হইত না। যেমন গদ· = সে গেল, গিয়াছে।

প্রাদেশিক শাসনকর্তার কাছে লেখা একটি রাজানুজ্ঞাপত্রের কিছু অংশ নিয়া প্রাকৃতের নিদর্শনরূপে উদ্ধৃত হইল।

ল্যিপেয় বিন্নবেতি যধ অত্র খখোর্নি স্ত্রি ৩ নিখলিতন্তি তহ সূধ এদস স্ত্রি মরিতন্তি অবশিঠি স্ত্রিয় ব মুতন্তি। এদ প্রচে তু অপ্‌গেয়দে অনদি গিড়েসি ল্যিপেয়স স্ত্রি পতেন স্তবিদব হোঅতি। যহি এদ কিলমুদ্র অত্র এশতি প্রঠ। অত্র অনদ প্রোছিদবো।

‘ল্যিপেয় জানাইতেছে যে ওখানে ডাইনীতে তিনজন স্ত্রীলোককে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে শুধু তাহার স্ত্রীকে মারিয়া ফেলিয়াছে, অবশিষ্ট স্ত্রীলোকদের ছাড়িয়া দিয়াছে। এ সম্বন্ধে তুমি অপ্‌গেয়ের কাছে উপদেশ পাইয়াছ— ল্যিপেয়কে স্ত্রীর বদলে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। যখন এই কীলমুদ্রা ওখানে পৌঁছিবে তখন তৎক্ষণাৎ ভালো করিয়া অনুসন্ধান করিবে॥

১২. সাহিত্যের প্রাকৃত

ব্যাপক অর্থে ‘প্রাকৃত’ দ্বিতীয় মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলি বুঝাইতে এখন অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয় বটে, কিন্তু আসলে নামটি কেবল সংস্কৃত সাহিত্যে নাটকের মধ্যে এবং সংস্কৃত অনুগত সাহিত্যের অথবা জৈনধর্মের কাজে অনুশীলিত মধ্য উপস্তরের দ্বিতীয় ভারতীয়-আর্য সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। সংস্কৃত নাটকে নারী ও নিম্নশ্রেণীর পুরুষ ভূমিকার ভাষা, গাথাসপ্তশতী-সেতুবন্ধ-গৌড়বধ প্রভৃতি পদ্যগ্রন্থের ভাষা এবং জৈন শাস্ত্র ও সাহিত্যের ভাষা— এইগুলিকে সেকালের বৈয়াকরণেরা প্রাকৃত নাম দিয়া বিচার করিয়াছিলেন। এই প্রাচীন বৈয়াকরণেরা সংস্কৃত ব্যাকরণের আদর্শেই এই সাহিত্যিক প্রাকৃতের ব্যাকরণ রচনা করিয়াছিলেন। আসলে কিন্তু এই সাহিত্যিক প্রাকৃত কখনই কথ্য ভাষা ছিল না। এগুলি ছিল প্রধানত মধ্য ভারতীয়-আর্যকে মূল করিয়া সংস্কৃতের আদর্শে গড়া, অনেক সময় সংস্কৃত ভাঙ্গা, অন্ত্য উপস্তরে সাহিত্যের ‘সাধুভাষা’ বা ‘সাধুভাষা-ছাঁদ’, যাহা মোটামুটি খ্রীস্টীয় পঞ্চম শতাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দ পর্যন্ত উত্তম সংস্কৃতজ্ঞ নাটক-রচয়িতারা অপরিবর্তিত ভাবে ব্যবহার করিয়া আসিয়াছেন। অথচ এই প্রায় দেড় হাজার বৎসরের মধ্যে ভারতীয়-আর্য ভাষার পরিবর্তনের প্রবল ঢেউ পরপর বহিয়া গিয়াছে, এবং তাহাতে ভাষা মধ্য স্তর হইতে নব্য স্তরে উন্নীত হইয়াছে।

বিভিন্ন কালে রচিত প্রাকৃত ব্যাকরণগুলিতে যে প্রধান প্রাকৃত ভাষাগুলির নাম ও লক্ষণ নির্দেশ করা হইয়াছে, তাহা হইল মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধমাগধী, মাগধী, পৈশাচী এবং অপভ্রংশ। মাহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী, অর্ধমাগধী, মাগধী ও পৈশাচীর মূলে হয়ত একদা ছিল যথাক্রমে দক্ষিণপশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তরপশ্চিমা। কিন্তু সমসাময়িক কথ্যভাষার সঙ্গে এগুলির বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না। এগুলি সংস্কৃতের মতোই পুরাপুরি সভা-সাহিত্যের ভাষা। তবে অপভ্রংশ সম্বন্ধে এ মন্তব্য সম্পূর্ণ খাটে না। জৈন কবিদের হাতে অপভ্রংশ সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যিক প্রাকৃতে পরিণত হইলেও, সাধারণ সাহিত্যে তাহা সজীব ভাষা ছিল। সাধারণ সাহিত্যে ব্যবহৃত অপভ্রংশেও মুখের ভাষা অল্পবিস্তর প্রতিধ্বনিত ছিল। তাই সাহিত্যের ভাষা হইলেও অপভ্রংশ খানিকটা সংস্কৃতের প্রভাববর্জিত। অপভ্রংশ অন্ত্য উপস্তরের প্রতিনিধিস্থানীয় ভাষা বলিয়া পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন, কিন্তু ইহা মধ্য উপস্তরেরও ভাষা বটে॥

১৩. মাহারাষ্ট্রী

প্রাকৃত-বৈয়াকরণেরা মাহারাষ্ট্রীকে মূল প্রাকৃত ধরিয়া তাহার তুলনায় অন্য প্রাকৃতের লক্ষণ বিচার করিয়াছেন। মাহারাষ্ট্ৰীতে স্বরমধ্যগত ব্যঞ্জনধ্বনি-পরিবর্তন পুরাপুরিই হইয়াছে, এবং শব্দরূপে ও ধাতুরূপে প্রাচীনত্বের চিহ্ন কিছু রহিয়াছে। সংস্কৃত নাটকে যে প্রাকৃত কবিতা আছে তা প্রায় সবই মাহারাষ্ট্ৰীতে লেখা। গাথাসপ্তশতী, সেতুবন্ধ (নামান্তর রাবণবধ), গৌড়বধ প্রভৃতি প্রাকৃতকাব্যের ভাষাও মাহারাষ্ট্ৰী।

মাহারাষ্ট্রীর নিদর্শন, গাথাসপ্তশতী হইতে

কইঅব-রহিঅং পেম্ম ণহি হোই মামি মাণুসে লোএ।

জই হোই ণ তস্‌স বিরহো বিরহে হোন্তম্মি কো জীঅই।

‘ছলনাহীন প্রেম, সখি, মানুষের সংসারে হয় না। যদি হয় তবে তাহার বিরহ নাই।

তবুও যদি বিরহ ঘটে তবে কে বাঁচে?’

১৪. শৌরসেনী

সংস্কৃত নাটকে শৌরসেনী নারীর এবং অশিক্ষিত পুরুষের ভাষা। ‘শৌরসেনী’ নাম হইতে পণ্ডিতেরা অনুমান করিয়াছেন যে এই প্রাকৃতের মূলে আছে শূরসেন (অর্থাৎ মথুরা) অঞ্চলের কথ্যভাষা। কিন্তু মহারাষ্ট্রীর সঙ্গে শৌরসেনীর একটি ছাড়া কোন বিষয়ে মূলগত পার্থক্য নাই। সেটি হইল—স্বর-মধ্যগত দ-কার ও ধ-কারের অবস্থিতি। যেমন শৌ গচ্ছদি, মা গচ্ছই < গচ্ছতি; শৌ কধেদি, মা কহেই < কথয়তি; শৌ মধু, মা মহু < মধু; শেী রধ, মা [রহ<রথ]। শৌরসেনীর এই লক্ষণটি আসলে দ্বিতীয় মধ্য ভারতীয়-আর্যের আদি (—অথবা মধ্য, দ-কারের ও ধ-কারের উচ্চারণ উষ্ম হইলে—) উপস্তরের জের। এই লক্ষণে মাহারাষ্ট্রী শৌরসেনীর তুলনায় অর্বাচীন।

শৌরসেনীর দ্বিতীয় বিশিষ্ট লক্ষণ হইল সপ্তমীর একবচনে সং ‘-স্মিন্‌’ > ‘-ম্‌হি’ বিভক্তি (মহারাষ্ট্ৰীতে ‘-স্মি’, অর্ধমাগধীতে ‘-সি’)।

শৌরসেনীর আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হইল সংস্কৃত ভাষার অত্যধিক অনুগতি। এই অনুগতির ইঙ্গিত নামটির মধ্যেই রহিয়াছে। শূরসেন উত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চল। মথুরা যাঁহাদের রাজধানী ছিল সেই শক ও কুষাণ রাজারা সংস্কৃতপ্রভাববহুল বৌদ্ধ সংস্কৃত ভাষা শাসনকার্যে ব্যবহার করিতেন। সেই বৌদ্ধ সংস্কৃতের রেশ শৌরসেনী ভাষার নামে ও বৈশিষ্ট্যে ছাপ রাখিয়া গিয়াছে।

শৌরসেনীর নমুনা, কালিদাসের নাটক হইতে

পোরব জুত্তং ণাম তুহ পুরা অস্‌সমপদে সভাবুত্তাণহিদ অং ইমং জণং তথা সমঅপুব্বং

সংভাবিঅ সংপদং ইদিসেহিং অক্‌খরেহি পচ্ছাচক্‌খিদুং।

‘পৌরব, একদা আশ্রমপদে স্বভাবসরলহৃদয় এই ব্যক্তির কাছে সেইভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়া ও আশ্বাস দিয়া এখন এই রকম ভাষায় প্রত্যাখ্যান করা তোমার উপযুক্ত বটে!’

১৫. আবন্তী

কোন কোন প্রাকৃত বৈয়াকরণ মাহারাষ্ট্রী-শৌরসেনীর মাঝামাঝি এক বিভাষা ‘আবন্তী’ প্রাকৃতের উল্লেখ করিয়াছেন। ইহাদের মতে আবন্তীতে আংশিকভাবে দুইটি প্রাকৃতেরই লক্ষণ বিদ্যমান॥

১৬. মাগধী

সংস্কৃত নাটকে মাগধী নিতান্ত অশিক্ষিত দুর্গত লোকের ভাষা। ‘মাগধী’ নামের মধ্যে মগধের (অর্থাৎ দক্ষিণ বিহারের) কথ্যভাষার স্মৃতি রহিয়া গিয়াছে বলিয়া পণ্ডিতেরা মনে করেন। অশোক নিজেকে মাগধ বলিয়াছেন, কালিদাস ‘মাগধী’ ব্যবহার করিয়াছেন মগধের গৌরবিনী রাজকন্যা বলিয়া ‘মাগধ’ শব্দটির অর্থ স্তুতিপাঠক, গায়ক। এই সব হইতে অনুমান হয় যে, ‘মগধ’ সংস্কৃতিবান্ এবং গর্বিত জাতি ছিল। প্রাচ্যের এই বিভাষার খাঁটি এবং সবচেয়ে পুরানো নমুনা রহিয়াছে সুতনুকা প্রত্নলিপিতে। কিন্তু মাগধীকে প্রাচ্যের প্রতিনিধি ভাষা মনে করিলে ভুল হইবে। মাগধী প্রাকৃত একেবারে কৃত্রিম সাহিত্য-ভাষা যাহার ব্যবহার সংস্কৃত নাটকে ছিল হাস্যকৌতুকের জন্যই। মাগধীর কয়েকটি বিভাষা ও প্রাকৃত-বৈয়াকরণেরা ধরিয়াছেন। যেমন শাকারী, চাণ্ডালী, শাবরী ইত্যাদি। শাকারী ব্যক্তিবিশেষের ভাষা, যেন সাহিত্যিক নিভাষা (idiolect)। চাণ্ডালী চণ্ডাল জাতির ভাষা, শাবরী শবর জাতির ভাষা।

মাগধীর প্রধান লক্ষণ এইগুলি: র > ল; স, ষ > শ; বিসর্গযুক্ত পদান্ত -অ > -এ; ক্ষ > স্ক (শ্‌ক); চ্ছ > শ্ছ; ল্য > য্য; স্বরমধ্যগত -দ-,-ধ- (এবং ক্বচিৎ-গ-) অবিকৃত।

মাগধীর নিদর্শন, কালিদাসের নাটক হইতে

অধ এক্কশ্‌শিং দিঅশে মএ লোহিদমশ্চকে খণ্ডশো কপপিদে। যাব তশ্‌শ উদলব্‌ভন্তলে এদং মহালদণভাশুলং অংগুলীঅঅং পেশ্‌কামি। পশ্চা ইধ বিক্কঅস্তং ণং দংশঅন্তেষ্যেব গদীদে ভাবমিশ্‌শেহিং। এত্তিকে দাব এদশ্‌শ আগমে। অধুনা মালেধ কুট্টেধ বা।

‘এখন একদিন রুই মাছ খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিতেছিলাম। তাহার উদরাভ্যন্তরে এই · মহারত্নোজ্জ্বল অঙ্গুরীয়কটি দেখি। পরে বিক্রয়ের জন্য দেখাইবার সময়ে আপনারা আমাকে ধরিয়াছেন। এইটুকু ইহার ব্যাপার। এখন আপনারা মারুন বা কাটুন।’

১৭. শাকারী

মৃচ্ছকটিক নাটকের রাজশ্যালক শকারের ভাষা ‘শাকারী’। এই বিভাষার প্রধান বিশেষত্ব হইতেছে সম্বন্ধের একবচনে ‘-(আ)হ’ বিভক্তি। যেমন পুলিশাহ = পুরুষষ্য। এই বিশেষত্ব অপভ্রংশেও আছে॥

১৮. অর্ধমাগধী

অর্ধমাগধীর ব্যবহার শুধু জৈনদের রচনায় দেখা যায়। ইহারা মাহারাষ্ট্রী এবং শৌরসেনীও ব্যবহার করিতেন। জৈনদের যেসব রচনায় অর্ধমাগধীর স্পষ্ট মিশ্রণ আছে তাহাতে ব্যবহৃত মাহারাষ্ট্রী ও শৌরসেনীকে যথাক্রমে জৈন মাহারাষ্ট্রী ও জৈন শৌরসেনী বলা হয়। অশ্বঘোষের নাটকের তালপাতা পুথির টুকরায় প্রাচীন অর্ধমাগধীর ব্যবহার আছে, কিন্তু পরবর্তী কালের সংস্কৃত নাটকে প্রায় একেবারেই নাই। জৈনমতাবলম্বী প্রাকৃত-বৈয়াকরণেরা অর্ধমাগধীকে তাঁহাদের শাস্ত্রকারের (ঋষির) ভাষা ধরিয়া আর্য বা আর্য প্রাকৃত নাম দিয়াছিলেন।

অর্ধমাগধীতে শৌরসেনী ও মাগধী দুইয়েরই লক্ষণ কিছু কিছু আছে— অর্থাৎ ‘র’, ‘ল’ দুইই আছে, বিসর্গযুক্ত পদান্ত অ-কার ‘এ’, ‘ও’ দুইই হইয়াছে, এবং ‘ষ শ’ নাই। স্বরমধ্যগত লুপ্ত ব্যঞ্জনের স্থানে প্রায়ই য়-শ্রুতির ব্যবহার অর্ধমাগধীর আর একটি বিশেষত্ব, যাহা মাহারাষ্ট্ৰীতেও আছে। যেমন শত- > সয়-। স্বরমধ্যগত ‘-গ’ ক্বচিৎ রহিয়া গিয়াছে। বিবিধ অসমাপিকা পদের এবং শানচ্‌ [-মান] প্রত্যয়ের ব্যবহারেও মাহারাষ্ট্রীর, সঙ্গে অর্ধমাগধীর বিশেষ মিল দেখা যায়।

অর্ধমাগধীর নিদর্শন

তেন কালেণং তেণং সমএণং সিন্ধুসোবীরেসু জনবএষু বীয়ভএ নামং নয়রে হোত্থা উদায়ণে নামং রায়া পভাবঈ দেবী। তীসে জেট্‌ঠে পুত্তে অভিঈ নামং জুব্বরায়া হোত্থা । জিয়এ ভাইণেজ্জে কেসী নামং হোথা॥

‘সেইকালে সেই সময়ে সিন্ধু-সৌবীর জনপদে বীতভয় নামক নগর ছিল, (সেখানে) উদায়ন নামে রাজা, প্রভাবতী রানী। তাঁহার (অর্থাৎ রানীর গর্ভজাত) জ্যেষ্ঠ পুত্র, নাম অভিজিৎ, যুবরাজ ছিলেন। নিজ ভাগিনেয় ছিল, নাম কেশী।

১৯. পৈশাচী

প্রাকৃত বৈয়াকরণেরা যাহাকে ‘পৈশাচী’ বলিয়াছেন সাধারণ সাহিত্যে সে প্রাকৃতের স্থান হয় নাই, লোক-সাহিত্যে তাহার সমাদর ছিল। বিবিধ ও বিচিত্র কাহিনী সংকলন জড়ো করিয়া গুণাঢ্য পৈশাচীতে বৃহৎকথা (‘বড্ডকহা’) রচনা করিয়াছিলেন। পৈশাচীতে লেখা মূল বইটি লুপ্ত হইয়াছে কিন্তু একাধিক সংস্কৃত অনুবাদের মধ্য দিয়া কাহিনীবস্তু রহিয়া গিয়াছে। পৈশাচীর আলোচনায় প্রাকৃত বৈয়াকরণদের উক্তি এবং ইতস্তত উদ্ধৃত ও কৃত্রিম দুই-একটি শ্লোকই একমাত্র অবলম্বন। পৈশাচীর সঙ্গে প্রত্নলিপিতে প্রাপ্ত উত্তরপশ্চিমার বা গান্ধারীর বেশ মিল আছে। একদা গান্ধারী হইতে উদ্ভূত হইলেও পৈশাচী অ-সংস্কৃত সাহিত্যের সর্বভূমিক রূপটি লইয়াই দেখা দিয়াছিল। এই হিসাবে ইহাকে অপভ্রংশের পূর্বতন রূপের মধ্যে ধরা যায়। পৈশাচীর বিশিষ্টতম লক্ষণ হইতেছে স্বরমধ্যগত ঘোষবৎ ব্যঞ্জনের ঘোষহীনতা এবং স্বরমধ্যগত স্পৃষ্ট ব্যঞ্জনের অলোপ। যেমন নকর- < নগর-, রাচা < রাজা। প্রাকৃত-ব্যাকরণে পৈশাচীর কতিপয় বিভাষারও উল্লেখ আছে। তাহার মধ্যে একটিতে মাগধীর কোন কোন লক্ষণ মিলে। পৈশাচীর কৃত্রিম নিদর্শন (দ্বাদশ শতাব্দর রচনা)।

পত্তুন কিং ফটচনো নিচতেহতানা

অত্থাসনং ফচতি চম্‌ফনিসূতনস্‌স।

ভোত্তুন ঘোরতরতুক্‌খ-সত্যই পাপা

মোহান্ধকারগহনং লপ কিং লফন্তি॥

‘যোদ্ধা ব্যক্তি নিজদেহ দানের ফল পাইয়া কি জম্ভনিসূদনের (অর্থাৎ ইন্দ্রের) অর্ধাসনভাগী হয় না? পাপীরা কি শত শত ঘোর দুঃখ ভোগ করিয়া (নরকের) মোহান্ধকারে পতিত হয় না? —বল॥’

(আসলে পৈশাচী হইতেছে পালির ব্রাহ্মণ্য রূপ। হেমচন্দ্র তাঁহার প্রাকৃত ব্যাকরণে পৈশাচীর যে সব লক্ষণ দিয়াছেন তাহা পালির সঙ্গে মিলিয়া যায়, নামটির মধ্যেও এই অনুমানের সপক্ষে বেশ ইঙ্গিত রহিয়াছে। মুণ্ডিত মস্তক পীতবসনধারী বৌদ্ধ ভিক্ষু গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যপন্থীর কাছে পিশাচ গণ্য হওয়া আশ্চর্যের বিষয় নয়।

পালি আসিয়াছিল অপভ্রষ্ট হইতে। গুণঢ্যের রচনাও তাই অপভ্রংশে লেখা বলিয়া গণ্য হইয়াছিল।)

২০. অপভ্রংশ ও অপভ্রষ্ট

অপভ্রংশ নামটি অধুনা একাধিক মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার অন্ত্য স্তর বুঝাইতে প্রচলিত হইয়াছে। কিন্তু প্রাকৃত বৈয়াকরণেরা এটিকে একটি স্বতন্ত্র প্রাকৃত ভাষা অর্থেই ব্যবহার করিয়াছিলেন। গ্ৰীয়র্সন-প্রমুখ ভাষাতত্ত্ববিদ্‌ মধ্য-প্রাকৃতের শেষ উপস্তরকে অপভ্রংশ নাম দিয়াছেন। অর্থাৎ কোন কোন প্রাকৃত বৈয়াকরণ যাহাকে লৌকিক বলিয়াছেন এবং সাধারণ ব্যবহারে যাহার অর্বাচীন রূপান্তর অপভ্রষ্ট বা অবহট্‌ঠ (অবিহটঠ) নামে উল্লিখিত তাহাকেই গ্ৰীয়র্সন কোন কোন বৈয়াকরণ-নির্দিষ্ট অপভ্রংশের সহিত মিলাইয়া অপভ্রংশ বলিয়াছেন। প্রাকৃত-ব্যাকরণে যাহা অপভ্রংশ বলিয়া উল্লিখিত তাহা একটি বিশিষ্ট প্রাকৃত ভাষা বলিয়া অনুমিত ছিল এবং বিবিধ স্থানীয় (?) অপভ্রংশের নাম করিলেও বৈয়াকরণেরা একটিমাত্র অপভ্রংশেরই বিচার বিবেচনা করিয়াছেন। তাহা নাগরক অপভ্রংশ, অর্থাৎ শীলিত অপভ্রংশ। গ্রীয়র্সন প্রত্যেক প্রাদেশিক প্রাকৃত ও আধুনিক কথ্যভাষার মধ্যবর্তী একটি করিয়া ‘অপভ্রংশ’ মধ্যাবস্থা কল্পনা করিয়া ভারতীয় আর্য ভাষার ইতিহাস রচনা করিয়াছিলেন। যেমন শৌরসেনী প্রাকৃত > শৌরসেনী অপভ্রংশ > ব্রজভাষা ইত্যাদি, অর্ধমাগধী প্রাকৃত > অর্ধমাগধী অপভ্রংশ (কল্পিত) > অবধী ইত্যাদি, মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ (কল্পিত) > বাঙ্গালা ইত্যাদি। অপভ্রংশ নামটি কিন্তু সর্বপ্রথম মধ্য ভারতীয়-আর্য সাধারণ লোকের কথ্যভাষার শব্দ ও পদ বুঝাইতেই ব্যবহার করিয়াছিলেন বৈয়াকরণ পতঞ্জলি (খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতাব্দ)। পতঞ্জলির মতে সংস্কৃত শাস্ত্রবানের শুদ্ধ ভাষা, অপভ্রংশ শাস্ত্রহীনের অশুদ্ধ ভাষা। তাই পতঞ্জলির কাছে ‘দেবদত্ত’ শুদ্ধ— ‘দেবদিন্ন’ অশুদ্ধ, ‘বর্ধতে’ শুদ্ধ— ‘বড্‌ঢ়তি’ অশুদ্ধ। প্রাকৃত বৈয়াকরণদের অপভ্রংশও পতঞ্জলির সংজ্ঞা অনুসরণ করে। মধ্য ভারতীয়-আর্যের যে সর্বজনীন রূপটি অ-শিষ্ট লোকসাহিত্যের বাহক হইয়া উঠিয়াছিল তাহাই অপভ্রংশ অর্থাৎ প্রাচীন অপভ্রংশ, এবং এই প্রাচীন অপভ্রংশের যে অর্বাচীন রূপটি আধুনিক কথ্য ভারতীয় আর্যের (vernacular) জনক অর্থাৎ অব্যবহিত পূর্ব অবস্থা, তাহাকেই বলি অপভ্রষ্ট (বা অবহট্‌ঠ) অর্থাৎ অর্বাচীন অপভ্রংশ।

প্রাকৃত-ব্যাকরণের উল্লিখিত অপভ্রংশ কতক অংশে প্রাচীন এবং কতক অংশে অর্বাচীন অপভ্রংশ। কালিদাসের বিক্রমোর্বশী নাটকে কয়েকটি অপভ্রংশ গান আছে। এগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলা চলে না। সুতরাং ধরিতে হইবে যে বৈয়াকরণদের উল্লিখিত অপভ্রংশ কালিদাসের কালেও লোকসাহিত্যে বেশ অনুশীলিত ছিল। বৌদ্ধ সংস্কৃতের ও নিয়া প্রাকৃতের সহিত ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য ও অপভ্রংশের আপেক্ষিক প্রাচীনতার সমর্থক।

প্রাচীন বৈয়াকরণেরা নাগরক অপভ্রংশকে মুখ্য ধরিয়া অপভ্রংশের আলোচনা করিয়াছেন। এবং অপভ্রংশের আঞ্চলিক বিভাষাগুলির শুধু নামই করিয়াছেন যেমন, ব্রাচড়ক, উপনাগরক, বৈদর্ভী, লাটী, গৌড়ী, পাঞ্চালী, ঢক্কী, সিংহলী ইত্যাদি। যৎকিঞ্চিৎ উদাহরণ যাহা মিলিয়াছে তাহাতে এগুলিকে প্রত্ন-নব্য-আর্যের মধ্যেই ফেলিতে হয়।

অষ্টম শতাব্দ হইতে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দ পর্যন্ত অবহট্‌ঠ সমগ্র উত্তরাপথে—গুজরাট হইতে আসাম-উড়িষ্যা পর্যন্ত ভূখণ্ডে—সংস্কৃতের প্রতিদ্বন্দ্বী সাধুভাষা রূপে লৌকিক সাহিত্যে সমাদৃত ছিল। এ সাধুভাষার ব্যবহার সকলেই করিতেন, কিন্তু নমুনা যাহা আমাদের কালে পৌঁছিয়াছে তাহা ধর্মের কৌটায় আঁটা হইয়াই। ইহার অনুশীলন প্রধানত করিতেন জৈন-বৌদ্ধ-যোগপন্থী (অর্থাৎ তাবৎ অব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী) সাধকেরা এবং সংস্কৃত না-জানা শিষ্ট জনগণ। অর্বাচীন অপভ্রংশে গান-কবিতা ছড়াময় যে লোকসাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছিল নব্য ভারতীয়-আর্য সাহিত্যের শুভারম্ভ তাহারই পথ বাহিয়া।

অর্বাচীন অপভ্রংশের নিদর্শন হিসাবে একটি সমস্যা ও সমাধানময় চউপঈ উদ্ধৃত করি।

রসিঅহ কেণ উচ্চাডণু কিজ্জই

জুবইহ মাণসু কেশ উবিজ্জই।

তিসিঅ লোউ খণি কেণ সুহিজ্জই

এই পণ্‌হ মহ ভুবনে গিজ্জই।

‘রসিকের কিসে উচাটন হয়। যুবতীর মন কিসে ভারি হয়? তৃষিত লোক কিসে ক্ষণমধ্যে তৃপ্ত হয়। আমার এই প্রশ্ন ভুবনে গাওয়া হইল॥

২১. মধ্য ভারতীয়-আর্যে শব্দরূপের আদর্শ

পালি-প্রাকৃত-অপভ্রংশ-অবহট্‌ঠের শব্দ ও ধাতু রূপের তৌলন উদাহরণ নিম্নে দ্রষ্টব্য। ইহা হইতে মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষার ক্রমবিকাশের ধারা পরিস্ফুট হইবে এবং নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষার পদের পূর্ব ইতিহাস জানা যাইবে।

(ক) অ-কারান্ত, পুংলিঙ্গ

(খ) অ-কারান্ত, ক্লীবলিঙ্গ

(গ) ঈ-কারান্ত, স্ত্রীলিঙ্গ

ঈ-কারান্ত, স্ত্রীলিঙ্গ

(ঘ) সর্বনাম, উত্তমপুরুষ

(ঙ) সর্বনাম, মধ্যম পুরুষ

(চ) সর্বনাম, প্রথম পুরুষ, পুংলিঙ্গ

একবচন

বহুবচন

(ছ) সর্বনাম, প্রথম পুরুষ, ক্লীবলিঙ্গ

(জ) সর্বনাম, প্রথম পুরুষ, স্ত্রীলিঙ্গ

(ঝ) সংখ্যা-শব্দ

২২· মধ্য ভারতীয়-আর্যে ধাতু-রূপের আদর্শ

(ক) বর্তমান কাল, কর্তৃবাচ্য

(খ) বর্তমান কাল, কর্ম ও ভাব-বাচ্য

(গ) ভবিষ্যৎ কাল, কর্তৃবাচ্য

(ঘ) অতীতকাল (লুঙ্‌), কর্তৃবাচ্য

(ঙ) বর্তমান কালে অনুজ্ঞা—কর্তৃবাচ্য

(চ) বর্তমান কালে অনুজ্ঞা—কর্ম ও ভাববাচ্য

(ছ) বর্তমান কালে বিধি—কর্তৃবাচ্য

১. তুলনীয় কুমারসম্ভব ৭.৯০।

অতঃপর প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ও মধ্য ভারতীয়-আর্য যথাক্রমে ‘সংস্কৃত’ ও ‘প্রাকৃত’ নামে উল্লিখিত।

(ক), (খ) ও (গ) যথাক্রমে প্রাকৃতের আদি, মধ্য ও অন্ত্য স্তর নির্দেশ করিতেছে।

সর্বনাম বিভক্তির এইরকম প্রয়োগ গ্রীকে এবং প্রাচীন পারসীকেও দেখা যায়।

প্রাকৃতের দ্বিতীয় স্তরে প্রায়ই সংস্কৃতের তৃতীয়ান্ত (বা পঞ্চম্যন্ত) পদে আবার [-তস্‌] প্রত্যয় যোগ হইত। ‘ঘরাদো > ঘরাও’ আসিয়াছে হয় তৃতীয়ার একবচন (বৈদিক) ‘গৃহা’ + ‘তস্’ নতুবা পঞ্চমীর একবচন ‘গৃহাৎ’ > প্রাচীন প্রাকৃত ‘ঘরা’ + সংস্কৃত প্রত্যয় ‘তস্‌’ যোগ করিয়া।

এ ভাষা লেখ্য। ইহাতে প্রাচীন ভারতীয়-আর্যের অর্থাৎ বৈদিক ও সংস্কৃতের এবং অপভ্রষ্টের প্রভাব আছে।

২ অনুবাদ পরে দ্রষ্টব্য।

‘মনসি, বেধসি’ ইত্যাদি পদ হইতে ‘-সি’ বিভক্তি নিষ্কাশিত হইতে পারে।

প্রাচ্যায় ও মধ্যপ্রাচ্যায় অপভ্রষ্টের প্রভাব কিছু বেশি আছে।

কিছুকাল আগে মধ্যভারতে দুইটি এবং মীর্জাপুরের কাছে একটি নূতন ক্ষুদ্র গিরি-অনুশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। একটিতে অশোকের নাম উল্লিখিত আছে।

সংস্কৃতে অনুবাদ করিলে এই রকম হয়,

সুতনুকা নাম *দেবদাসিকী তাম্ *কাময়িত্থ বারাণসেয় দেবদিন্নঃ নাম রূপদক্ষঃ।

নামটি আধুনিককালের রূপে অবধী ও ভোজপুরিয়া ভাষায় হুইবে ‘দেওদীন’।

এই সব উদাহরণে [গ·] ইত্যাদি উষ্ম ধ্বনি বুঝাইতেছে।

তালপাতার পুথির বিচ্ছিন্ন টুকরো হইতে ল্যুডর্স (H. Lueders) কর্তৃক আবিষ্কৃত ও সম্পাদিত। দুইটি ভগ্নাংশ নাটকের মধ্যে একটির নাম ‘শারীপূত্র-প্রকরণ’।

অধ্যাপক বেলি (H. W. Bailey) এই নামটির স্রষ্টা।

সংস্কৃতে অনুবাদ করিলে এইরকম হয়

সিঞ্চ ভিক্ষো ইমাং নাবং সিক্তা তে লঘুঃ ভবিষ্যতি।

ছিত্ত্বা রাগং-চিৎ দ্বেষং-চিৎ ততো নির্বাণম্‌ এষ্যতি॥

সর্বাপেক্ষা পুরানো প্রাকৃত-ব্যাকরণ ‘প্রাকৃত-প্রকাশ’। রচয়িতা বররুচি সম্ভবত পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দের লোক। এই ব্যাকরণে অপভ্রংশ নামে কোন ভাষার উল্লেখ নাই।

মহারাষ্ট্র দেশের নামের সহিত মাহারাষ্ট্রির বিশেষ সম্পর্ক নাই, আছে ‘মহরট্‌ঠ’ বা ‘মরহ্‌টঠ’ জাতিনামের সঙ্গে।

যেমন ঊনবিংশ শতাব্দের কোন কোন বাঙ্গালা নাটকে ঝি-চাকর-বামুনের মুখে বঙ্গালীর অথবা ঝাড়খণ্ডীর বিকৃত রূপ দেওয়া হইত।

নামটির অর্থ অনুমান করা হয়—অর্ধেক মাগধী ও অর্ধেক মাহারাষ্ট্রী। এ অর্থ সঙ্গত নয়। অন্য প্রাকৃতের মধ্যে মাহারাষ্ট্রীর সঙ্গেই মিল বেশি। অনুমান করি, আসল অর্থ ছিল— মাগধীর পার্শ্ববর্তী, অর্থাৎ মাগধীর প্রতিবেশী ভাষা। এখানে ‘অর্ধ’ শব্দের প্রাচীনতর অর্থ গ্রহীতব্য।

নানা কারণে, বিশেষ করিয়া বৈয়াকরণ হেমচন্দ্রের প্রদত্ত লক্ষণ অনুসারে বলিতে হয় পৈশাচী পালির রূপান্তর। প্রাকৃত ব্যাকরণে অন্যথা পালির ইঙ্গিত নাই ২ সংস্কৃতে অনুবাদ

*প্রাপ্তা (=প্রাপ্য) ন কিং ভটজনো নিজদেহদানাদ্‌ অর্ধাসনং ভজতি জম্ভনিসূদনস্য।

*ভোক্ত্বা (=ভুত্ত্বা ন ঘোরতরদূঃখশতানি পাপা মোহান্ধকারগহনং লপ কিং লভন্তে॥

যখন সাধারণ লোকের কথ্য ভাষা প্রত্ন নব্য-আর্য স্তরে নামিয়া আসিয়াছে তখনও শিষ্ট লোকে তাহার যে পূর্বতন লেখা সাধুরূপ—যাহাতে পূর্বতন ভাষার অর্থাৎ অর্বাচীন অপভ্রংশের রঙ মুছিয়া যায় নাই—তাহাই সমসাময়িক লেখকের উক্তি অনুসারে অপভ্রষ্ট, অবহট্‌ঠ অথবা অবিহট্‌ঠ (পরবর্তীকালে লৌকিক বলিয়াও উল্লিখিত)। ‘অবহট্‌ঠ’ আসিয়াছে সং ‘অপভ্রষ্ট’ ও ‘বিভ্রষ্ট’ শব্দ দুইটির জোড়কলম হইতে। নামটি সংস্কৃতায়িত অপিভ্রষ্ট রূপে পাওয়া গিয়াছে।

আধুনিক কথ্যভাষাগুলির প্রতিষ্ঠার পরেও সাহিত্যের বাহকরূপে অর্বাচীন অপভ্রংশ প্রচলিত ছিল। সেই কারণে তাহাতে নব্য ভারতীয়-আর্যের প্রভাবচিহ্ন অসুলভ নয়।

বিভাষা বলিতে বিমিশ্র ভাষা, একাধিক ভাষার লক্ষণযুক্ত ভাষা বুঝাইবে।

অবহট্‌ঠের শেষ উল্লেখযোগ্য রচনা বিদ্যাপতির কীর্তিলতা।

ত্রয়োদশ শতাব্দের দিকে পশ্চিম পঞ্জাবের মুসলমান অধিবাসী আব্‌দর রহমান অপভ্রংশে একটি বড় “দূত” কাব্য লিখিয়াছিলেন সংনেহয়ারাসয় (=সংস্নেহকরাসক) বা ‘সন্দেশরাসক’ নামে।

সম্প্রদান ‘দেব্যৈ’ হইতে উৎপন্ন।

অপাদানেও ব্যবহৃত। ২ অস্‌ ধাতুর বর্তমানকালে উত্তমপুরুষ একবচনের পদ। ৩ সম্প্রদান ও সম্বন্ধপদ।

৪ সম্প্রদান পদ। ৫ বৈদিকে সম্প্রদান ও অধিকরণের বহুবচনের পদ।

১ বৈদিকে চতুর্থী-সপ্তমীর বহুবচনের পদ। ২ সম্বন্ধ বহুবচনের পদ ৩ সম্প্রদান ও সম্বন্ধ বহুবচনের পদ ৪ অপাদান বহুবচনের পদ ৫ বৈদিকে বিকল্প রূপ ৬ সম্প্রদান একবচন ৭ সম্প্রদান ও অধিকরণ বহুবচনের পদ (‘যুষ্মে’ স্থানে)।

১ বৈদিক। ২ অব্যয়। ৩ পুংলিঙ্গ কর্তা। ৪ করণের বহুবচন।

৫ স্ত্রীলিঙ্গ পদ। ৬ পুংলিঙ্গ কত। ৭ বৈদিক ক্লীবলিঙ্গ। ৮ ‘ঈম’ বৈদিকে সর্বনাম অব্যয় পদ।

১ সম্বন্ধ পদ। ২ সম্প্রদান পদ।

৩. সম্বন্ধ পদ। ৪ অথবা তাৎ+-স। ৫ সম্প্রদান পদ।

১ পুংলিঙ্গ। ২ ক্লীব ও স্ত্রীলিঙ্গ। ৩ বৈদিক উচ্চারণ। ৪ অবহট্‌ঠ। ৫ ব্যাকরণে উদাহৃত।

৬ পুংলিঙ্গ। ৭ স্ত্রীলিঙ্গ। ৮ ক্লীবলিঙ্গ।

১ স্ত্রীলিঙ্গ। ২ অভিপ্রায় ভাবের পদ। ৩ দ্বিবচন পদ।

৪ ‘পূচ্ছী য়ামি’ ইত্যাদিও হয়।

১ আত্মনেপদ

২ বর্তমান কালের পদ। ৩ বর্তমান কালের দ্বিবচন। ৪ একবচনেও ব্যবহৃত।

৫ একবচনে ব্যবহৃত। ৫ মধ্যম ও প্রথম পুরুষ হইতে আগত।

১ লৃঙের পদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *