৮. ভারতীয়-আর্য

অষ্টম অধ্যায় – ভারতীয়-আর্য

১. বৈদিক-ভাষা

ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন হয় আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ হইতে। একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত আর্যেরা প্রথমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। পরে ক্রমশঃ পূর্বদিকে ঠেলিয়া পূর্ব পাঞ্জাবে ও মধ্যদেশে এবং আরো পরে কাশী-কোশল-মগধ-বিদেহ-অঙ্গ-রাঢ়-বারেন্দ্র-কামরূপ প্রভৃতি উত্তরাপথের প্রাচ্য অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মসাৎ করিয়া আর্য ভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে। দক্ষিণ দেশেও আর্যদের ভাষার ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়াছিল। কিন্তু দ্রবিড় ও কণার্ট প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত প্রদেশগুলিতে আর্য ভাষা স্থানীয় কথ্যভাষাকে কখনই দূরীভূত করিতে পারে নাই। পশ্চিমে সিন্ধু-সৌবীর প্রদেশে আর্যপূর্ব সংস্কৃতি বিশেষ প্রবল ছিল বলিয়া এই অঞ্চলে আর্য ভাষার ও সংস্কৃতির প্রসার বাধাগ্রস্ত হইয়াছিল।

আর্যেরা যে-সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল লইয়া ভারতে আসিয়াছিলেন তাহাদের কথ্য ভাষার মধ্যে অল্পস্বল্প স্বাতন্ত্র্য থাকিলেও মোটামুটি বেশ মিল ছিল। খুব উন্নত বাহ্য সংস্কৃতি বলিতে যাহা বোঝায় এমন কিছু নবাগত আর্যদের বেশিরকম ছিল না। কিন্তু আর্যদের ভাষা ও সাহিত্য ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তাহাৱা ছিল প্রধানত পশুপালক যাযাবর জাতি। কিছু কিছু চাষবাসও শিখিয়াছিল। ভারতবর্ষে আসিয়া তাহারা অনতিবিলম্বে যাযাবরত্ব ত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণরূপে কৃষিজীবী হইয়া যায়। তবে আর্যদের অনন্যসাধারণ সম্বল ছিল অশ্বসাধন, গোপালন ও শক্তিশালী ভাষা এবং সে ভাষায় উচ্চশ্রেণীর দেবগীতিমূলক সাহিত্য। ভারতীয় আর্যদের নিকট-সম্পর্কিত উপভাষাগুলির এক সাহিত্যিক রূপ অর্থাৎ “সাধুভাষা” ছিল। ইহাতেই তাহারা দেবতাদের উদ্দেশে এবং বহিঃপ্রকৃতিতে দেবমহিমার আবেশ অনুভব করিয়া স্তব রচনা করিত। বৈদিক (অর্থাৎ ঋগ্‌বেদের) ভাষাই হইতেছে ভারতীয়-আর্য ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক রূপ অর্থাৎ প্রথম সাধুভাষা। ঋগ্‌বেদের মধ্যে আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্যরচনা সঙ্কলিত আছে। ঋগ্‌বেদের সর্বাপেক্ষা পুরানো কবিতাগুলির রচনাকাল খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের কাছাকাছি বলিয়া অনুমান করা হয়। এইগুলিই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের সর্বাপেক্ষা পুরানো সাহিত্যিক রচনা! ঋগ্‌বেদের কবিতাগুলি যত পুরানো, ঋগ্‌বেদ-সংহিতার অর্থাৎ গ্রস্থকারে সঙ্কলনের কাল তত প্রাচীন নয়। সম্ভবত ১০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে কবিতা বা সূক্তগুলি “বেদ” রূপে সঙ্কলিত হইয়াছিল। তখনই সূক্তগুলির ভাষা প্রাচীন হইয়া পড়িয়াছিল।

বৈদিক সাহিত্য (খ্রীস্টপূর্ব ১২৫০-৬০০) কালানুক্রমিকভাবে তিন স্তরে বা পর্যায়ে বিভক্ত— (১) বেদ বা সংহিতা, (২) ব্রাহ্মণ এবং (৩) আরণ্যক-উপনিষদ্‌। বেদ বলিতে বোঝায় ‘ত্রয়ী’ অর্থাৎ তিন যজ্ঞীয় বেদ (ঋক্ সামন্‌, যজুঃ) এবং অযজ্ঞীয় অথর্ববেদ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে আছে বিবিধ যজ্ঞকার্যের বিবরণ ও ব্যাখ্যা আর কিছু কিছু প্রাচীন উপাখ্যান ও উপাখ্যানের টুকরা। ব্রাহ্মণেরই পরিশিষ্ট আরণ্যক-উপনিষদ্‌। ইহাতে সে-যুগের উদাসীন মনীষীদের আধ্যাত্মিক চিন্তা অনুভূতির অপূর্ব সরল এবং অননুকরণীয় সহজ কবিত্বময় প্রকাশ আছে। ঋক্‌ ও সাম বেদ পদ্যে, অন্য বেদ পদ্যে ও গদ্যে আর ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক-উপনিষদ্‌ প্রধানত গদ্যে লেখা।

প্রত্যেক বেদের একাধিক “ব্রাহ্মণ” ও আরণ্যক-উপনিষদ্‌ আছে। ঋক্‌-সংহিতার বা ঋগ্‌বেদের প্রধান “ব্রাহ্মণ” হইতেছে ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ। ইহাই ব্রাহ্মণ-গ্রন্থের মধ্যে সর্বপ্রাচীন (রচনাকাল আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৮০০)। সাম-সংহিতায় অর্থাৎ সামবেদে ঋগ্‌বেদের কবিতাগুলিই এমনিভাবে সাজানো হইয়াছে যাহাতে যজ্ঞে গান করিবার পক্ষে সুবিধা হয়। অল্প কয়েকটি মাত্র নূতন। সামবেদের ব্রাহ্মণগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হইতেছে তাণ্ড্য (বা পঞ্চবিংশ) ব্রাহ্মণ। সুবিখ্যাত ছান্দোগ্য-উপনিষদ্‌ সামবেদের অন্তর্ভুক্ত। যজুর্বেদের দুইটি প্রধান শাখা,—শুক্ল ও কৃষ্ণ। শুক্ল যজুর্বেদে পদ্য ও গদ্য অংশ পৃথকভাবে বিন্যস্ত বলিয়া ইহার নাম “শুক্ল” অর্থাৎ পরিষ্কৃত। আর কৃষ্ণ যজুর্বেদে গদ্য ও পদ্য মেশানো আছে বলিয়া ইহার নাম “কৃষ্ণ” অর্থাৎ মিশ্রিত। শুক্ল যজুর্বেদের এক বড় শাখার “বেদ” অর্থাৎ পদ্যাংশ হইতেছে বাজসনেয়ি-সংহিতা, এবং “ব্রাহ্মণ’ হইতেছে শতপথ-ব্রাহ্মণ। সুবিখ্যাত বৃহদারণ্যক-উপনিষদ্‌ শতপথ-ব্রাহ্মণেরই পরিশিষ্ট। কৃষ্ণ যজুর্বেদের “বেদ” পাওয়া যায় একাধিক শাখায় একাধিক সংহিতায়। যেমন তৈত্তিরীয়-সংহিতা, মৈত্রায়ণি-সংহিতা, কাঠক-সংহিতা। যদিও কৃষ্ণ যজুর্বেদের পৃথক ব্রাহ্মণ আছে, তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণ ইত্যাদি, কিন্তু আসলে কৃষ্ণ যজুর্বেদের সংহিতাগুলি ব্রাহ্মণ ছাড়া কিছু নয়। যজুর্বেদের পদ্যাংশেও ঋগ্‌বেদের মন্ত্রই বেশির ভাগ উদ্ধৃত। তবে তাহার সঙ্গে নূতন শ্লোক অল্পস্বল্প এবং যজ্ঞীয় মন্ত্র (“নিবিদ্‌”) কতকগুলি আছে।

অথর্ববেদের প্রয়োগ সম্ভ্রান্ত যজ্ঞকার্যে ছিল না তবে গৃহস্থালি ধর্মকর্মে ছিল। ইহাতে সে যুগের তুকতাক ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি তান্ত্রিক মন্ত্র ও স্তব অনেকগুলি সঙ্কলিত আছে। অথর্ববেদের প্রাচীন অংশ ঋগ্‌বেদের অনেক সূক্তের সমকালীন রচনা। কয়েকটি সূক্ত বা কবিতা উভয় গ্রন্থেই উদ্ধৃত আছে। সাধারণ লোকের বা জনগণের সম্পত্তি এবং পরে সঙ্কলিত বলিয়া ইহার ভাষা ঋগ্‌বেদের ভাষা হইতে কিছু পৃথক্ ও অর্বাচীন। অথর্ববেদকে বৈদিক যুগে বলিত অর্থবাঙ্গিরসঃ অর্থাৎ অথর্বন্‌-অঙ্গিরস্‌দের মন্ত্রতন্ত্র। ইহাকে “বেদ” মযার্দা দিবার পর অন্যান্য বেদের অনুকরণে ইহারও ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদ রচিত হইয়াছিল। কিন্তু এগুলি বেশ অর্বাচীন। এমন কি অথর্ববেদের নবীনতম পরিশিষ্ট, আল্লোপনিষদ্‌, যাহাতে আরবী আল্লাহ্‌-এর সহিত ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদন হইয়াছে, তাহার রচনাকাল সপ্তদশ শতাব্দ।

আর্যেরা যখন এদেশে পদার্পণ করেন তখনই তাঁহাদের মুখের ভাষা তাঁহাদের দেবস্তুতির ভাষা হইতে বেশ কিছু পরিমাণে পৃথক্‌ হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার পর তাঁহারা এদেশের লোকের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা করিতে থাকেন তাঁহাদের ভাষাও তেমনি পরিবর্তন লাভ করিতে থাকে। তা ছাড়া তাঁহাদের মধ্যে একাধিক উপভাষার ব্যবহার ছিল। তাহার উপর আরও একটা ব্যাপার ঘটিয়াছিল। প্রথম দফায় আর্যদের আসিবার বেশ কিছুকাল পরে আর একদল আর্য আসিয়া প্রথম দলের সঙ্গে বিরোধে পড়ে। ইহারা অশ্বমেধ যজ্ঞ আমদানি করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় দল প্রথম দলকে পূর্ব দিকে ঠেলিয়া আনিয়া অবশেষে গ্রাস করিয়া ফেলিয়া ছিলেন। এই দুই দল আর্য আমাদের ভাষার ইতিহাসে একটা স্পষ্ট দাগ টানিয়া দিয়াছেন। সে দাগ হইল ভারতবর্ষের পূর্ব-অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে অপর অঞ্চলের ভাষার পার্থক্য। একটা সরল উদাহরণ দিই। প্রথম দলের আর্যরা পূর্বদেশে বেশি দিন ছিলেন তাই পূর্বদেশের প্রাকৃতে পরিবর্তন হইয়াছিল বেশি পরিমাণে। এইসব কারণে বৈদিক সাহিত্য— যাহা এদেশে রচিত হইয়াছিল তাহার ভাষায় দুটি ভিন্ন ছাঁদ লক্ষ্য করা যায়। সূক্ষ্ম বিচারে এই ভিন্নতা উপভাষার।

বৈদিক ভাষার এই দুই স্তরের ভিন্নতা প্রধানত ব্যাকরণ ও শব্দব্যবহারেই বেশি বোঝা যায়। ঋগ্‌বেদে এমন অনেক শব্দ আছে যা অন্য বেদে একেবারেই দেখা যায় না।

প্রাচীন ও অর্বাচীন ছাড়া বৈদিক ভাষায় আরও একটা স্তর দেখা যায়। সে হইল অথর্ব সংহিতার ভাষা। এ ভাষাকে প্রাচীন ও অর্বাচীন স্তরের মাঝামাঝি বলা চলে না, অর্বাচীন স্তরের পরবর্তীও বলা চলে না। কিন্তু কোন কোন বিষয়ে প্রাকৃত অর্থাৎ মধ্য ভারতীয় ভাষার সঙ্গে অথর্ব সংহিতার ভাষার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর; যেমন অর্বাচীন বৈদিকের সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হইবে।

অকারান্ত পুংলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ শব্দের রূপে তৃতীয়ার বহুবচনে দুটি বিভক্তি আছে বৈদিক ভাষায়— [-ঐস্‌] আর [-ভিস্‌]। তিনটি বৈদিক উপভাষায় এই দুটি বিভক্তির প্রয়োগ হইল এইরকম,—

ঋগ্‌বেদে (প্রথমস্তর) দুই আছে প্রায় সমান ভাবে। যেমন দেবৈঃ, দেবেভিঃ। যজুর্বেদে (দ্বিতীয়স্তর) [-ঐস্‌) বিভক্তিরই ব্যবহার বেশি, [-ভিস্‌] খুব কম। অথর্বসংহিতায় [-ভিস্‌] বিভক্তির ব্যবহার [-ঐস্‌) বিভক্তির ব্যবহারের অপেক্ষা পাঁচগুণ বেশি।

সংস্কৃতে [-ভিস্‌] বিভক্তির ব্যবহার একবারে নাই। প্রাকৃতে [-ঐস্‌] বিভক্তির ব্যবহার একবারেই নাই।

ঋগ্‌বেদ ও যজুর্বেদ ছিল মান্যব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সম্পত্তি আর অথর্ববেদ ছিল জনসাধারণের প্রথম পুরোহিতের বা রাজার সম্পত্তি। সুতরাং ঐস্তরের বৈদিক ভাষাকে বলিতে পারি Hieratic আর অথর্ব সংহিতার ভাষাকে বলিতে পারি Demotic। এই ভাবে দেখিলে প্রধান ভারতীয় আর্যভাষার এইরকম শ্রেণী বিভাগ করা যায়॥

২. সংস্কৃত

প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষার সাহিত্যিক বা সাধু ছাঁদ ছিল দুইটি। একটি প্রাচীনতর— যেটিতে ধর্মসাহিত্য রচিত হইয়াছিল— ঋগ্‌বেদের এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের ভাষা, আর অপরটি নবীনতর, সেকালের শিষ্ট অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তির ব্যবহারের এবং লৌকিক আখ্যান-উপাখ্যানের ভাষা। এই শেষোক্ত ছাঁদে লেখা কোন প্রাচীন রচনা এ-যুগ অবধি পৌঁছায় নাই, তবে পরবর্তী কালের প্রাচীন কাব্য ও পুরাণের মধ্যে এই ভাষার ছাঁদ আভাষে রহিয়া গিয়াছে। এই শেষোক্ত ভাষার ভদ্র এবং পাণিনি-অনুশাসিত রূপই আমাদের পরিচিত সংস্কৃত। আমরা যে অর্থে সাধারণত সংস্কৃত শব্দটি ব্যবহার করি সে অর্থে “সংস্কৃত” নাম হইতে পারে না। শব্দটির এ মানে নয় যে কোন প্রাচীনতর ভাষাকে ঘসিয়া মাজিয়া কাটছাট করিয়া সুন্দর রূপ ও স্পষ্ট প্রকাশ ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে। এ দেশে উপনিবিষ্ট বৈদিক আর্যদের ভাষা সাধারণের সঙ্গে ব্যবহারে ব্যাকরণের বহর কমাইয়া যথাসম্ভব শব্দার্থের উপর নির্ভর করিয়া প্রাত্যহিক কাজ চালানোর উপযুক্ত রূপ লইয়াছিল। অবশ্যই ইচ্ছা করিয়া নয়, প্রাকৃতিক কারণে। শিষ্ট ব্যক্তিরা—যাঁহারা বৈদিক ভাষা উত্তমরূপে জানিতেন তাঁহারা নিজেদের প্রয়োজনে এই কথ্যভাষার উপরে ব্যাকরণের সাজ চড়াইয়া ও উচ্চারণে বিশুদ্ধি আনিয়া “সংস্কৃত” ছাঁদে লিখিতেন অথবা কথা কহিতেন। অর্থাৎ “সংস্কৃত” হইল বৈদিক যুগের অন্তে কথ্য ভাষা হইতে লেখ্য ভাষায় প্রত্যাবর্তন। স্বভাবতই এ প্রত্যাবর্তন অন্ত্য বৈদিক স্তরের শেষ রচনা উপনিষদের ভাষার কাছাকাছি পৌঁছিয়াছে। মোট কথা এই যে সেকালে “সংস্কৃত” বলিয়া, বৈদিক হইতে ভিন্নতর ভাষা বুঝাইত না। বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃতের আওতার বাহিরে ছিল না।

আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দে বা তাহার অল্প কিছুকাল পরে অদ্বিতীয় বৈয়াকরণ পাণিনি তক্ষশিলার নিকটে শালাতুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার মাতার নাম ছিল দাক্ষী। কৈশোরেই পাণিনি মেধার পরিচয় দিয়াছিলেন। ইহা ছাড়া তাঁহার সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য আর কিছুই পাওয়া যায় নাই। পাণিনির ব্যাকরণসূত্রগুলি আট অধ্যায় বিভক্ত বলিয়া ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামে পরিচিত। উদীচী বা উত্তরপশ্চিমা তখন শিষ্টসম্মত মুখ্য ভাষা ছিল, আর পাণিনি এই অঞ্চলেরই অধিবাসী। সুতরাং তাঁহার ব্যাকরণে এই অঞ্চলের ভাষাই আদর্শরূপে গৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু তাই বলিয়া পাণিনি অন্যান্য অঞ্চলের শিষ্ট প্রয়োগ উপেক্ষা করেন নাই। “প্রাচাম্‌” “উদীচাম্‌” ইত্যাদি বলিয়া অঞ্চল-বিশেষে সীমাবদ্ধ ভাষারীতিকে এবং আপিশলি, কাশকৃৎস্ন, শাকল্য প্রভৃতি পূর্ববর্তী বৈয়াকরণদের উল্লেখ করিয়া বিভিন্ন মতকেও তিনি স্বীকার করিয়াছেন॥

৩. অপাণিনীয় সংস্কৃত

পাণিনির ব্যাকরণ মানব-মনীষার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ইহাতে সংস্কৃতের মতো বিরাট ভাষার জটিল ব্যাকরণের যে নিপুণ বিবরণ ও দক্ষ বিশ্লেষণ আছে তাহা অতুলনীয়। অল্পকাল মধ্যেই পাণিনির ব্যাকরণ পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক ব্যাকরণগুলিকে অনাদরে ও বিস্মৃতির গর্ভে নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের অধিকাংশের বিলোপসাধন করিয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে অবৈদিক শিষ্টভাষার রূপও পরবর্তী কালের জন্য নির্দিষ্ট হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতাব্দ হইতে প্রায় সে-দিন অবধি রচিত অপর সংস্কৃত সাহিত্যের প্রায় সকল লেখাই মোটামুটি পাণিনির ব্যাকরণসম্মত। তবে অল্পশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত জনসাধারণ পাণিনির ব্যাকরণের ধার ধারে নাই। তাহারা অপাণিনীয় সাধুভাষায় পুরাণকথা কবিতা ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি পড়িত শুনিত। এইরূপ অবৈদিক অ-সংস্কৃত প্রাচীন ভারতীয়-আর্য “চলিত সাধু” অর্থাৎ শিষ্টের ব্যবহৃত ভাষায় পুরাণ-কাহিনীগুলি প্রথমে লেখা হইয়াছিল। প্রাচীন পুরাণগুলির যে অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ রূপ এখন প্রচলিত আছে তাহার মধ্যে এই অ-সংস্কৃত ভাষার চিহ্ন অবলুপ্ত নয়। ভারতীয়-আর্য যখন মধ্যস্তরে পৌঁছিয়াছে তখনো কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অসংস্কৃত লৌকিক প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষার ব্যবহার ছিল। উত্তরাপথের বৌদ্ধেরা তাঁহাদের শাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন এই ধরনের সংস্কৃত-প্রাকৃত মিশ্রভাষায়। সাধারণত তাঁহাদের ব্যবহৃত এই ভাষা এখন গাথা ভাষা, বৌদ্ধ-সংস্কৃত অথবা বৌদ্ধ মিশ্র-সংস্কৃত নামে পরিচিত। এই ভাষার নিদর্শন যেমন

অপ্রিয় যে দুখি তেহি নিবাসো

যে পি প্রিয়া দুখু তেহি বিয়োগো

অন্ত উভে অপি তেহি জহিত্বা

তে সুখিতা নয় যে রত ধর্ম্মে॥

‘যাহারা অপ্রিয় তাদের সংসর্গ দুঃখকর। যাহারা প্রিয় তাহাদের বিয়োগ বেদনাদায়ক। প্রিয় অপ্রিয় দুই প্রান্ত পরিত্যাগ করিয়া সেই সকল নর সুখপ্রাপ্ত যাহারা ধর্মে রত॥

৪. প্রাচীন ভারতীয়-আর্যের বিশেষত্ব

প্রাচীন ইরানীয় ভাষার সহিত তুলনা করিলে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষায় যে অভিনবত্ব দেখা যায় তাহা সংক্ষেপে নির্দেশ করিতেছি। ইন্দো-ইরানীয় [অই, অউ] এই দুই দ্বিস্বর-ধ্বনি যথাক্রমে এ-কারে এবং ও-কারে পরিণত হইল, উষ্ম [z, zh, ź, źh] ধ্বনিগুলি লুপ্ত হইল অথবা র-কারে কিংবা বিসর্গে পরিণত হইল; [ট্‌, ঠ্‌, ড্‌, ঢ্‌, ণ্‌, ষ্‌] এই কয়টি ধ্বনির (অর্থাৎ মূর্ধন্যবর্গের) সৃষ্টি হইল; র-কার কখনো কখনো (বিশেষ করিয়া পূর্ব অঞ্চলে) ল-কারে পরিবর্তিত হইল [-য়] এবং [-স্য-] বিকরণ যোগ করিয়া যথাক্রমে ভাবকর্ম-বাচ্যের ও ভবিষ্যৎ-কালের রূপ নির্দিষ্ট হইল। মোটামুটি এইগুলি প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষার প্রধান বিশেষত্ব।

প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা বলিতে বোঝায় সেই পুরাতন ভাষা যাহার সাধু রূপ দুইটি—বৈদিক ও সংস্কৃত। (এখানে মনে রাখিতে হইবে যে বৈদিক ও সংস্কৃত কোনটিই ঠিক কথ্য অর্থাৎ মুখের ভাষা ছিল না, দুইই ছিল সাহিত্যের ভাষা অর্থাৎ পোষাকি ভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্য বলিলে বৈদিক ও সংস্কৃতের পিছনে যে কথ্য ভাষা ছিল তাহাই বুঝিতে হইবে।) বৈদিক ও সংস্কৃত মোটামুটি অভিন্ন হইলেও দুইটির মধ্যে কিছু মৌলিক এবং প্রচুর কালপরিমাণগত পার্থক্য আছে। সংস্কৃতের মধ্যে ভারতীয়-আর্য ভাষার পরবর্তী (অর্থাৎ মধ্য বা “প্রাকৃত”) স্তরের অনেক শব্দ ও বাক্‌রীতি প্রবেশ করিয়াছে। এগুলিকে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষার নিজস্ব বলিয়া গ্রহণ করা চলে না। সুতরাং সংস্কৃত এবং প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা সর্বদা সমার্থক নয়। তেমনি প্রাচীন ভারতীয়-আর্য ভাষা বলিতে শুধু বৈদিকই বোঝায় না। কেননা এমন অনেক পুরানো পদ ও প্রয়োগ সংস্কৃতে আছে যাহার মূল বৈদিক ভাষায় মিলে না। যেমন, সং নট্‌- < *নৃত্‌, সং খেলতি < *ক্রেড়তি। আর, বৈদিক এবং সংস্কৃত উভয় ভাষাতেই আর্যেতর ভাষা হইতে গৃহীত শব্দের অপ্রতুলতা নাই। সুতরাং বৈদিক-সংস্কৃতে আর্য ভাষার যে ছাঁদটি রক্ষিত হইয়াছে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য বলিতে তাহাই বোঝায়। তবে মোটামুটিভাবে প্রাচীন ভারতীয়-আর্য বলিতে বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষা দুই-ই বুঝিব।

বৈদিক বলিতে প্রধানত বোঝায় ঋগ্‌বেদের ভাষা। অন্যান্য বেদের এবং বৈদিক গদ্যগ্রন্থ ব্রাহ্মণ-উপনিষদ্‌গুলির ভাষা কাল-বিচারে অর্বাচীন এবং ব্যাকরণ-রীতিতে সরলতর। এমন কি ঋগ্‌বেদের মধ্যে যে অংশ অর্বাচীন (যেমন দশম এবং প্রথম মণ্ডলের কতক অংশ) তাহাতেও দেখা যায় যে, ভাষা সংস্কৃতের দিকে আগাইয়াছে। বৈদিক সাহিত্যের শেষ সময়ে প্রাচীন উপনিষদ্‌গুলি লেখা হইয়াছিল। এগুলির ভাষা বৈদিকত্ব অনেকটা পরিহার করিয়া সংস্কৃতের খুব কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এক হিসাবে উপনিষদের ভাষাকে সংস্কৃতের পূর্বরূপ বলা যায়।

ঋগ্‌বেদের পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থগুলি যে-সময়ে রচিত অথবা সঙ্কলিত হয় সে-সময়ে আর্যেরা ব্রহ্মাবর্তে, এমন কি প্রাচ্যে কাশী-কোশল-বিদেহ অবধি আসিয়া পৌঁছিয়াছে, এবং আর্য-সংস্কৃতির কেন্দ্র পঞ্চনদের তীর ছাড়িয়া আসিয়া গঙ্গাযমুনার অন্তর্বেদীতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই কারণে ঋগ্‌বেদের ভাষা সর্বাংশে ঋগ্‌বেদেতর বৈদিকের পূর্বরূপ নয়। অর্বাচীন বৈদিকের মূলে ছিল অন্য একটি উপভাষা যে উপভাষা ঋগ্‌বেদের ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠসম্পর্কযুক্ত কিন্তু যাহার মধ্যে আর্যেতর প্রভাব বেশি প্রকট। ধ্বনিতত্ত্বে প্রাচীন বৈদিকের এক প্রধান বিশেষত্ব র-কার বাহুল্য। কিন্তু অর্বাচীন বৈদিকে র-কার স্থলে ল-কার দেখা দিতেছে। যেমন প্রা বৈ—রম্বতে, কৃপ্ত, শ্রীর, রোচন: অ বৈ লম্বতে, ক্প্ত, শ্লীল, লোচন। রূপতত্ত্বের বিচারেও প্রাচীন ও অর্বাচীন বৈদিকের স্বতন্ত্রতা ধরা পড়ে। একটি উদাহরণ দিই। অকারান্ত শব্দের তৃতীয়ার বহুবচনে ঋগ্‌বেদে প্রধানত পাই [-ভিস্‌] বিভক্তি (যেমন দেবেভিঃ) আর অথর্ববেদে পাই প্রধানত [-ঐস্‌-] বিভক্তি (যেমন দেবৈঃ)। তেমনি প্ৰা বৈ কৃণোতি, অ বৈ করোতি॥

৫. বৈদিক ও সংস্কৃতের তুলনা

বৈদিকের ও সংস্কৃতের মধ্যে মোটামুটি ধ্বনিগত ঐক্য আছে। কিন্তু ব্যাকরণে অনেক ব্যবধান। সংস্কৃতে স্বরের অস্তিত্ব নাই। কিন্তু বৈদিকে, ঋগ্‌বেদে বিশেষ করিয়া, স্বর (accent) একটি প্রধান বিশেষত্ব। স্বরের স্থানপরিবর্তনে অর্থের পরিবর্তন হয়। বৈদিকে শব্দরূপ ও ধাতুরূপ বিপুল এবং বিচিত্র। শব্দরূপে বৈদিকে কতকগুলি অতিরিক্ত পদ আছে। যেমন, ‘নর’ শব্দের প্রথমা-দ্বিতীয়ার দ্বিবচনে [নরা], তৃতীয়ার বহুবচনে [নরেভিঃ]। নতুবা উভয় শব্দরূপ মোটামুটি একই। ধাতুরূপে বাহুল্য ও বৈচিত্র্য অনেক বেশি। সংস্কৃতে পাই নির্দেশক ছাড়া দুইটিমাত্র ভাব বা মুড (Mood)—অনুজ্ঞা (লোট্‌), এবং সম্ভাবক বা বিধি (লিঙ্‌)। বৈদিকে দুইটি অতিরিক্ত ভাব ছিল— অভিপ্রায় (লেট্‌), এবং নির্বন্ধ (Injunctive)। অভিপ্রায় ভাবের প্রয়োগ সংস্কৃতে একেবারেই নাই, কেবল উত্তম-পুরুষের পদগুলি অনুজ্ঞার উত্তম-পুরুষের রূপ লইয়া আত্মগোপন করিয়া আছে। (বৈদিকে এবং মূলভাষায় অনুজ্ঞায় উত্তম-পুরুষ ছিল না, কেন না যথার্থত উত্তম-পুরুষের অনুজ্ঞা হইতে পারে না।) নির্বন্ধ ভাবের প্রয়োগ সংস্কৃতে শুধু [মা] এই নিষেধাৰ্থক অব্যয়ের যোগেই সীমাবদ্ধ (“মাঙি লুঙ্‌”)। বৈদিকে ‘অসম্পন্ন’ (লঙ্‌), ‘সামান্য’ (লুঙ্‌) এবং ‘সম্পন্ন’ (লিট্‌)—এই তিনরকম অতীত-কালের প্রয়োগ সুনির্দিষ্ট ছিল। সংস্কৃতে যেমন শুধু বর্তমান কালের এবং ক্কচিৎ সামান্য অতীত কালেরই ভাবান্তর হয়(—বর্তমান কালের অনুজ্ঞা = আশীর্লিঙ্‌—), বৈদিকে তেমন নয়। বৈদিকে বর্তমান, সামান্য অতীত সম্পন্ন অতীত এবং ভবিষ্যৎ—এই চার কালেই যথাসম্ভব বিভিন্ন ভাবের রূপ হইত। নিন্মে বিভিন্ন কালঘটিত ভাবের উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে।

‘কৃ’, ‘মুচ্‌’ ও ‘গম্’ ধাতুর বিভিন্ন কালে বিধি বা সম্ভাবক (লিঙ্‌) এবং অনুজ্ঞা (লোট্‌) ভাবে পরস্মৈপদ মধ্যম-পুরুষের একবচনে নিম্নলিখিত রূপ হয়,— [১] লটের লিঙ্‌—কৃণুয়াঃ (বা কুৰ্য্যাঃ), মুঞ্চেঃ, গচ্ছেঃ। লটের লোট্‌—কৃণু (বা কুরু), মুঞ্চ, গচ্ছ। [] লুঙের লিঙ্‌—ক্রিয়াঃ, *মুচ্যাঃ।গম্যাঃ। লুঙের লোট্‌—কৃধি, মুচ, গহি। [৩] লিটের লিঙ্—চক্রিয়াঃ, *মুমুচ্যাঃ, জগম্যাঃ। লিটের লোট্‌— *চকর্ধি, মুমুগ্ধি, *জগন্ধি। [৪] লৃটের লেট্‌—করিষ্যাঃ। [৫] লৃটের লিঙ্‌—দ্রক্ষ্যেত (রামায়ণ)। [৬] লৃটের লোট্‌—বৈদিকে ইহার প্রয়োগ মিলে না বটে, রামায়ণে (যেমন, দ্রক্ষ্যন্তু, অপনেষ্যন্তু, গমিষ্যধ্বম্‌ ও মধ্য-এসিয়ার নিয়া প্রাকৃতে আছে (যেমন করিষ্যতু অগছিশতু < *আগচ্ছিষ্যতু)।

সংস্কৃতে শুধু লটেরই লিঙ্‌ (=বিধিলিঙ্‌) এবং লোট্‌ আছে, আর আছে আশীর্লিঙ্‌ নামে কয়েকটি লুঙের বিশিষ্ট ও বিকৃত লিঙ্‌ পদ।

বৈদিক শতৃ-শানচ্‌ ক্কসু-কানচ্‌, স্যতৃ-স্যমান প্রভৃতি ক্রিয়াজাত বিশেষণের এবং ক্ত্বাচ্‌-ল্যপ, তুম্‌-তবৈ ইত্যাদি অসমাপিকা পদের প্রাচুর্য ছিল। সংস্কৃতে তাহা হ্রাস পাইয়া অল্প কয়েকটিতে দাঁড়াইল। ‘প্র, পরা, অপ’ ইত্যাদি কোন কোন উপসর্গ বৈদিকে সাধারণ ক্রিয়াবিশেষণের মতো স্বতন্ত্র পদরূপেও ব্যবহৃত হইত। সংস্কৃতে এগুলি ক্রিয়াপদের আগে আবদ্ধ হইল। কেবল ‘আ, প্রতি, পরি, অনু’, প্রভৃতি কর্মপ্রবচনীয় হইলেই তবে স্বতন্ত্র রহিল। বৈদিকে সমাসের ব্যবহার সংস্কৃতের তুলনায় অল্পই হইত। আর দুইটির বেশি পদের সমাস প্রায় একেবারেই ছিল না। সংস্কৃতে সমাসবহুলতা ক্রমশ বাড়িয়া গিয়া শেষে বাণভট্টের মতো কবির লেখায় শতাধিক শব্দের দৈর্ঘ্য পাইল। এমন প্রয়োগ আর কোনো অনুরূপ ভাষার সাহিত্যে দেখা যায় নাই।

সংস্কৃত ব্যাকরণের নূতনত্বের মধ্যে দেখা গেল—অতীত-কালে সমাপিকা ক্রিয়ার অর্থে [-তবৎ) প্রত্যয়ের প্রয়োগ এবং ধাতুপাঠের মধ্যে বহু অবাচীন ধাতুর প্রবেশ।

অবৈদিক কথ্যভাষায় দ্বিবচনের এবং লিটের প্রয়োগ লোপ পাইয়াছিল, কিন্তু সংস্কৃতে, ব্যাকরণের ব্যবস্থায়, এই দুইটির প্রচুর প্রয়োগ দেখা যায়॥

৬. ভারতীয়-আর্যের স্তরবিভাগ

ভারতীয়-আর্য ভাষার ধারাবাহিক ইতিহাস বিবেচনা করিলে তিনটি পৃথক্‌ স্তর বা অবস্থা লক্ষিত হয়।

(ক) প্রাচীন ভারতীয়-আর্য (বৈদিক-সংস্কৃত) খ্রীস্টপূর্ব দ্বাদশ হইতে ষষ্ঠ শতাব্দ পর্যন্ত। এই কালনির্দেশ অত্যন্ত আনুমানিক।

(খ) মধ্য ভারতীয়-আর্য (অশোক ও অন্যান্য প্রত্নলিপির ভাষা, পালি, বিভিন্ন প্রাকৃত এবং (অপভ্রংশ-অপভ্রষ্ট), খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দ হইতে খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দ পর্যন্ত। এই কালনির্দেশ অত্যন্ত আনুমানিক নয়।

(গ) নব্য ভারতীয়-আর্য (বাঙ্গালা, হিন্দী, সিন্ধী, মারাঠী ইত্যাদি ভাষা ও অনেক উপভাষা), খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দ হইতে আধুনিক কাল পর্যন্ত॥

৭. প্রাচীন ভারতীয়-আর্যের (সংস্কৃতের) লক্ষণ

প্রাচীন ভারতীয়-আর্যের প্রধান লক্ষণ এই নয়টি:

১. [হ্রস্ব ও দীর্ঘ ঋ, (৯), এ, ঐ] সমেত স্বরবর্ণ এবং তিন স-কার সমেত ব্যঞ্জনবর্ণগুলির যথাযথ ব্যবহার। স্বরবর্ণের গুণ-বৃদ্ধি-সম্প্রসারণ। সন্ধি। বৈদিকে স্বর।

২. বিবিধ যুক্তব্যঞ্জনের ব্যবহার। যেমন [ক্র, ক্ন, ক্ত্ব, ক্ষ্ম, র্দ্ধ, স্থ্য, ষ্ট্র, র্ত্র্য, ৎস্ন, ষ্ট, ত্ন, স্ন্য] ইত্যাদি।

৩. শব্দরূপে বৈচিত্র্য। তিন বচন, সম্বোধন ছাড়া সাত কারক, তিন লিঙ্গ। লিঙ্গ ও অন্ত্যধ্বনি অনুসারে শব্দের রূপভেদ।

৪. ধাতুরূপে বিপুল বৈচিত্র্য। তিন পুরুষ, দুই পদ (পরস্মৈপদ ও আত্মনেপদ), দুই বাচ্য (কর্তা, কর্ম-ভাব), পাঁচ কাল, পাঁচ ভাব, বহু বিশেষণ ও অসমাপিকা।

৫. উপসর্গের স্বাধীন ব্যবহার।

৬. সমাসের বিচিত্র ও বহুল প্রয়োগ।

৭. বাক্যের পদবিন্যাসে নির্দিষ্ট নিয়মের অনাবশ্যকতা।

৮. ধাতুতে ও শব্দে বিবিধ কৃৎ ও তদ্ধিত প্রত্যয়ের যোগে যথেচ্ছ শব্দগঠন ক্ষমতা।

৯. অক্ষরমূলক ছন্দঃপদ্ধতি॥

৮. মধ্য ভারতীয়-আর্যের লক্ষণ

মধ্য ভারতীয়-আর্যের বিশিষ্ট লক্ষণ এই নয়টি:

১. স্বরধ্বনির সংখ্যাহ্রাস: [হ্রস্ব ও দীর্ঘ ঋ (ঌ)] স্বরধ্বনিতে পরিবর্তন; [ঐ, ঔ] ধ্বনির [এ, ও] ধ্বনিতে পরিণতি; যুগ্ম ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী [এ, ও] ধ্বনির হ্রস্বতা; সংবৃত অক্ষরে দীর্ঘস্বরের হ্রস্বতা।

২: পদান্তে, প্রধানত ম-কার (ক্কচিৎ ন-কার) জাত অনুস্বার ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ।

৩. যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে একটির লোপ (কেবল পদের আদিতে), অথবা বিশ্লেষ (স্বরভক্তির সাহায্যে), অথবা যুগ্মধ্বনিতে পরিণতি (সমীভবনের ফলে)।

৪. তিন স-কারের স্থানে সাধারণত একটি— [স] অথবা [শ]—ধ্বনির ব্যবহার।

৫. স্বরমধ্যগত একক ব্যঞ্জনের, অল্পপ্রাণ হইলে লোপপ্রবণতা, অথবা মহাপ্রাণ হইলে হ-কারে পরিণতি। এ লক্ষণ প্রথম স্তরে ছিল না।

৬. শব্দরূপের সরলতা। ব্যঞ্জনান্ত শব্দের স্বরান্ততা, দ্বিবচনের লোপ, ঋ-কারান্ত শব্দরূপের স্বরান্তে পরিবর্তন। নামরূপে কোথাও কোথাও সর্বনাম বিভক্তির ব্যবহার। ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত পুংলিঙ্গ ক্লীবলিঙ্গ পদে অ-কারান্ত শব্দরূপের প্রভাব। বহুবচনে প্রায়ই প্রথমা-দ্বিতীয়ায় ভেদলোপ। চতুর্থী বিভক্তির লোপ (—একবচনে ক্রমশ)। পঞ্চমীর অর্থে তৃতীয়ার ব্যবহার।

৭. ধাতুরূপে আত্মনেপদের ও দ্বিবচনের লোপ; অভিপ্রায় ও নির্বন্ধ ভাবের লোপ; লিটের লোপ; লঙ্‌-লুঙের সমাহার ও ক্রমশ লোপ। অসমাপিকার বৈচিত্র্য হ্রাস। নিষ্ঠা [-ত, -তবৎ] প্রত্যয়ান্ত শব্দের অতীত কালের অর্থে সমাপিকা ক্রিয়ার স্থানে ব্যাপক ব্যবহার।

৮. বিভক্তিলোপের ফলে বাক্যে পদসংস্থানের গুরুত্ববৃদ্ধি। কতা-কর্ম ব্যতিরিক্ত কারকে বিভক্তির অর্থে বিশিষ্ট শব্দের এবং/অথবা প্রত্যয়ের ব্যবহার।

৯. ছন্দঃপদ্ধতি প্রধানত মাত্ৰামূলক এবং গোড়ার দিকে ছন্দ প্রায়ই বিষমমাত্রিক, শেষের দিকে বিষমমাত্রিক ও সমমাত্রিক। সর্বশেষে দেখা দিয়াছিল অন্ত্যানুপ্রাস বা মিল॥

৯. নব্য ভারতীয়-আর্যের লক্ষণ

নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলির বিশিষ্ট সাধারণ লক্ষণ এই ছয়টি:

১. যুগ্মধ্বনির সরলতার অর্থাৎ একটি ধ্বনি হওয়ার দিকে অনিবার্য ঝোঁক এবং তাহার ফলে, অক্ষরে মাত্রাসমতা রাখিবার জন্য, পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরের দীর্ঘতাপ্রাপ্তি।

২. পদমধ্যে, শ্রুতিধ্বনির ব্যবধান না থাকিলে, সন্নিকৃষ্ট স্বরধ্বনির সন্ধিপ্রবণতা বা সংশ্লেষ (contraction)।

৩. লুপ্ত প্রাচীন বিভক্তির স্থানে নূতন বিভক্তির প্রচলন এবং বিভক্তিস্থানীয় বিভিন্ন শব্দের (‘অনুসর্গ’) ব্যবহার। নূতন করিয়া “স্ত্রীলিঙ্গ” সৃষ্টি। ক্লীবলিঙ্গের ব্যবহার হ্রাস ও লোপপ্রবণতা।

৪. নিষ্ঠাপ্রত্যয় ও শতৃপ্রত্যয় জাত বিশেষণ পদ হইতে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়াপদ সৃষ্টি। যৌগিক কালের ব্যবহার। প্রাচীন কাল-ভাবের মধ্যে শুধু বর্তমান (দৈবাৎ ভবিষ্যৎ) এবং অনুজ্ঞা রহিল।

৫. বাক্যরীতি সিদ্ধপ্রয়োগ-অনুযায়ী; পদপ্রয়োগ সংস্থানগত। যেমন ছেলেটি ভালো (বাক্য): ভালো ছেলেটি (বিশেষণ-বিশেষ্যময় বাক্যাংশ)। প্রথম উদাহরণে ‘ভালো’ শেষে বসিয়া বিধেয় বিশেষণরূপে বাক্য সম্পূর্ণ করিয়াছে। দ্বিতীয় উদাহরণে ‘ভালো’ বিশেষ্যের পূর্বে বসিয়াছে বলিয়া সাধারণ বিশেষণ।

৬. ছন্দের পদ্ধতি সমমাত্রিক ও মাত্রামূলক এবং পরে কোথাও কোথাও অক্ষরমূলক॥

১০. ভাষা ব্যবহারে ধর্মমত

সংস্কৃত ব্রাহ্মণ্যধর্মের একমাত্র বাহক ভাষা ছিল। জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মমত জনসাধারণের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করিতে চাহিত, সুতরাং সেগুলির বাহক ভাষা দীর্ঘকাল ধরিয়া ছিল মধ্য ভারতীয়-আর্য। অশোকের অনুশাসন ভূমিদান-বিক্রয়ের দলিল নয়, ধর্মানুশাসন। দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ হীনযান মতাবলম্বীরা পালি ভাষা গ্রহণ করিয়াছিলেন। উত্তর ভারতে বৌদ্ধ মহাযান-মতাবলম্বীরা আশ্রয় করিয়াছিলেন সংস্কৃত-প্রাকৃত-মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃত বা গাথা ভাষা এবং সংস্কৃত। জৈনেরা অবলম্বন করিলেন প্রথমে অর্ধমাগধী পরে অপভ্রংশ এবং সংস্কৃত॥

সম্প্রতি ক্রীটদ্বীপে প্রাপ্ত প্রত্নলেখ কিছু কিছু পড়া গিয়াছে। তাহাতে গ্রীক-ভাষার (Mycenacan) নিদর্শন ১৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ হইতে মিলিতেছে। হিট্টীয়ের বাহিরে ইহাই, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার অসন্দিগ্ধ প্রাচীনতম নিদর্শন।

আসলে তাই ‘সংস্কৃত বলিতে উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিত যোগে উচ্চারিত এবং অবিকৃত বিভক্তিযুক্ত বৈদিক ভাষাই বুঝাইত। এই অর্থেই কালিদাস ‘সংস্কৃত’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছিলেন।

মহাভাষ্যে পতঞ্জলি লিখিয়াছেন, “আকুমারং যশঃ পাণিনেঃ”।

সমাপিকা ক্রিয়াপদে ধাতু ও বিভক্তির মাঝখানে যে প্রত্যয় আসে সেগুলিকে বিকরণ (Stem-affix) বলা হয়। যেমন, ‘আপ্‌-নো-তি’, ‘আ-প্‌-নু-তে’, ‘দা-স্য-তি’, ‘দা-স্য-তে’, ‘বুধ-য-তি’, ‘যুধ্‌-ষ-তে’—এইসব উদাহরণে -‘নো’-,‘-স্য’-, ‘-ষ’—এইগুলি বিকরণ।

কাল ও ভাবের সংজ্ঞা পরে দ্রষ্টব্য।

সংস্কৃত ভাষায়— পাণিনির সময়ে এবং পরেও— ক্রিয়াপদের “কাল”, আধুনিক অর্থে (Tense) বুঝাইতে স্বীকৃত ছিল না। ভারতীয় চিন্তায় তখনও পর্যন্ত কাল ছিল খণ্ড। যাহাকে আমরা এখন কাল (Tense) বলি তাই ইন্দো-ইউরোপীয়-মূলভাষায় যেমন সংস্কৃতেও তেমনি ক্রিয়ার প্রকৃতি (aspect) বুঝাইত। সুতরাং পানির মতে বর্তমান (Present) মানে যে ক্রিয়া অবসিত নয়। পাণিনি অতীত (Past) বলিয়া কোন “কাল” বা সময়খণ্ড ধরেন নাই। তিনি ধরিয়াছেন ভূত অর্থাৎ সমাপ্ত, অনদ্যতন অর্থাৎ যাহা এখন হইতেছে না, এবং পরোক্ষ যাহা অগোচরে ঘটিয়াছে কিন্তু যাহার এখন ফল গোচর,—এমন ক্রিয়া।

তারকা-চিহ্নিত পদগুলির প্রয়োগ নাই।

রামায়ণের উদাহরণগুলি শ্রীযুক্ত নীলমাধব সেন সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেন। মহাভারতেও ভবিষ্যৎ কালের অনুজ্ঞা পদ পাওয়া যায়।

উপসর্গ কোনো কারকের অর্থে এবং কোনো কারকের সহিত ব্যবহৃত হইলে তাহাকে সংস্কৃত ব্যাকরণে কর্মপ্রবচনীয় বলে। যেমন, ‘তস্মাদ গচ্ছের্‌ অনু কনখলম্‌’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *