ষষ্ঠ অধ্যায় – ১. ভাষার শ্রেণীবিভাগ
যেসব ভাষা এখন প্রচলিত আছে এবং যেসব ভাষা একদা প্রচলিত ছিল এখন নাই, এমন আধুনিক ও প্রাচীন অনবলুপ্ত ও লুপ্ত ভাষাগুলিকে ভাষাবিজ্ঞানে দুই পৃথক্ মানদণ্ডে বিচার করিয়া বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইয়াছে। প্রথম মানে, ভাষাগুলির পরস্পর সম্পর্ক ও প্রাচীন ইতিহাস ইত্যাদি না দেখিয়া শুধু ব্যাকরণের (অর্থাৎ বাক্য ও পদ বিশ্লেষণের) দিক্ দিয়া বিচার করিয়া কয়েকটি শ্রেণীতে সাজানো হইয়াছে। দ্বিতীয় মানে, ভাষাগুলির পরস্পর সম্পর্ক ও প্রাচীন ইতিহাস—যতদূর এবং যতটা পাওয়া যায়, তাহা বিচার করিয়া সেগুলিকে কয়েকটি বর্গে অথবা বংশক্রমে গোছানো হইয়াছে। প্রথমটিকে বলা হয় রূপতত্ত্বানুগত শ্রেণীবিভাগ (Morphological Classification) দ্বিতীয়টিকে বলা হয় বংশানুগত শ্রেণীবিভাগ (Genealogical Classification)।
প্রথম শ্রেণীবিভাগ অনুসারে ভাষাগুলিকে দুইটি প্রধান গুচ্ছে ভাগ করা যায়—(ক) অসমবায়ী (Isolating) ও (খ) সমবায়ী (Non-isolating)। অসমবায়ী গুচ্ছের অন্তর্গত হইল চীনীয় গোষ্ঠীর ভাষাগুলি। চীনীয় ও সম্পৃক্ত ভাষাগুলিতে শব্দরূপ ও ধাতুরূপ বলিয়া কিছু নাই, শব্দ ও পদের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। বাক্যের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে বসিলেই কতা কর্ম ইত্যাদি কারক বোঝা যায় এবং বাক্যের অর্থ হইতে অথবা উপসর্গ বা অনুসর্গের মতো বিশেষ করিয়া কোন শব্দের সহযোগে ক্রিয়ার পুরুষ বচন কাল ভাব বাচ্য ইত্যাদি উপলব্ধ হয়। তা ছাড়া শব্দের উচ্চারণে বিভিন্ন সুর (Tone) ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ভাষা-উপভাষায় সুরের সংখ্যা বিভিন্ন। সুরভেদে একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন শব্দের অর্থ প্রকাশ করে। ব্যবহারিক (উত্তর-অঞ্চলের) চীনীয় ভাষায় সুর এই চার রকম,
(১) ঊর্ধ্বস্থিত সমান (high level)। যেমন, [মা১] ‘মাতা’
(২) ঊর্ধ্ব হইতে ঊর্ধ্বগামী (high rising)। যেমন, [মা২] ‘শণ’
(৩) নিম্ন হইতে ঊর্ধ্বগামী (low rising)। যেমন, [মা৩] ‘ঘোড়া’
(৪) নিম্ন হইতে নিম্নগামী (low falling)। যেমন, [মা৪] ‘তিরস্কার’।
চীনীয় ভাষার বাক্যের উদাহরণ,
ঙ্গো ত নি
=আমি মারি তোমাকে
নি ত ঙ্গো
=তুমি মার আমাকে
সমবায়ী শ্রেণীর ভাষাগুলিকে তিনটি উপগুচ্ছে ফেলা হয়,—(১) সর্বসমবায়ী, (২) যৌগিক এবং (৩) সমন্বয়ী।
সর্বসমবায়ী (Polysynthetic, Holophrastic বা Incorporating) হইল আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের ভাষাগুলি। এ ভাষায় বাক্য ও শব্দ একাকার; বাক্য হইল শব্দখণ্ডের মালা এবং বাক্যের বাহিরে শব্দ ও শব্দখণ্ডের কোন পৃথক্ অস্তিত্ব নাই।
যৌগিক (Agglutinating) ভাষাগুলি মোটামুটি দুই রকমের—উপসর্গ-যৌগিক ও অনুসর্গ-যৌগিক।
উপসর্গ-যৌগিক (Prefix-agglutinating বা Juxtapositional) ভাষায় বাক্যমধ্যে পদের মূল্যসূচক চিহ্নগুলি (—শব্দ বা শব্দখণ্ড—) মূল শব্দের আগে আলগাভাবে যুক্ত থাকে। মধ্য আফ্রিকার বান্টু-গোষ্ঠীর ভাষা ইহার অন্তর্গত।
অনুসর্গ-যৌগিক (Suffix-agglutinating) ভাষায় বাক্যমধ্যে পদের মূল্যনির্দেশক চিহ্নগুলি মূল শব্দের শেষে জোড়া দেওয়ার মতো লাগানো থাকে। তুর্ক-তাতার গোষ্ঠীর ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা ইহার মধ্যে পড়ে।
তামিল হইতে উদাহরণ দেওয়া গেল।
প্রাতিপদিক [পেলন্], বহুচনের বিভক্তি [-গল], সম্বোধনের বিভক্তি [-এ] কর্মের বিভক্তি [-এই] সম্বন্ধ বিভক্তি [-উদেইয়]।
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তা | পলন্ | পলন্গল্ |
সম্বোধন | পলনে | পলন্গলে |
কর্ম | পলনেই | পলন্গলেই |
সম্বন্ধ | পলনুদেইয় | পলন্গলুদেইয়া |
সমন্বয়ী (Inflexional, Amalgamating বা Synthetic) ভাষার লক্ষণ হইল এই যে পদের সম্পর্কসূচক চিহ্নগুলি (সাধারণত ধ্বনি) মূল শব্দের পিছনে মধ্যে ও সামনে যে-কোন স্থানে বসিতে পারে এবং সে চিহ্ন প্রায় বেমালুমভাবে পদের মধ্যে মিশিয়া যায়।১ আরবী, হিব্রু, সংস্কৃত, লাটিন, ইংরেজী, বাঙ্গালা প্রভৃতি—ইউরোপের ও পূর্ব এবং মধ্য এশিয়ার ভাষা এই রকমের। উদাহরণ আরবী ও সংস্কৃত হইতে দিতেছি।
আরবী ভাষায়, ধাতু অধিকাংশই ত্রিব্যঞ্জন। ধাতুর ব্যঞ্জনগুলির আগে পিছে মধ্যে প্রধানত স্বরধ্বনি যোগ করিয়া বিভিন্ন পদ পাওয়া যায়। যেমন, ধাতু ‘ক্ত্ল্’ [qtl] হইতে পাই ‘কতল’ [qatala]=সে মারিল, ‘কুতিল’ [qutila]সে মারা পড়িল, ‘য়ক্তুলু’ [yaqtulu]সে হত্যা করে, ‘কিৎল্’ [qitl]=শত্রু, ‘কাতিল্’ [qatil]=হত্যা, ‘কিতাল্’ [qital]=আঘাত, ‘কাতল’ [qatala]হত্যা করিতে ইচ্ছা করা ইত্যাদি।
সংস্কৃতে, [ভূ]ধাতু+বর্তমান কালের প্রত্যয় [-অ]+প্রথম পুরুষ একবচন পরস্মৈপদের বিভক্তি [-তি]=[ভূঅতি] না হইয়া (যেমন প্রথম উপশ্রেণী হইলে হইত), হইয়াছে [ভবতি]; অর্থাৎ ধাতুর সহিত প্রত্যয় [-অ-] এমনভাবে মিলিয়া গিয়াছে যে সহসা পৃথক্ বলিয়া বোঝা যায় না।
যেসব ভাষা প্রথম ও দ্বিতীয় কোন শ্রেণীতেই পড়ে না সেগুলিকে বলা হয় অ-শ্রেণীভুক্ত (Unclassified) ভাষা। এ রকম ভাষার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জাপানী।
রূপতত্ত্বানুগত শ্রেণীবিভাগের ব্যবহারিক দিক্ দিয়া উপযোগিতা থাকিলেও বৈজ্ঞানিক বিচারে এই শ্রেণীবিভাগের কয়েকটি বিশেষ অন্তরায় আছে। প্রথমত, যেসব ভাষার ইতিহাস জানা গিয়াছে তাহাদের সকলগুলিতেই দেখা যায় যে কালক্রমে ভাষার গুচ্ছ-পরিবর্তন বা শ্রেণী-পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সংস্কৃত ভাষা দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত, কিন্তু এই ভাষা হইতে উদ্ভূত বাঙ্গালা ভাষায় অধিকাংশ প্রত্যয়বিভক্তি লুপ্ত হইবার ফলে এ ভাষা এখন প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হইতে চলিয়াছে। প্রত্যয় বিভক্তিহীন শ্রেণীতে পদের ব্যাকরণমূল্য জানা যায় বাক্যমধ্যে পদের সুনির্দিষ্ট অবস্থানে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীতে বাক্যমধ্যে পদের নির্দিষ্ট অবস্থান আবশ্যক নয়, সেখানে প্রত্যেক পদে যে বিভক্তি আছে তাহাই তাহার ব্যাকরণমূল্য নির্দেশ করে। যেমন, সংস্কৃতে ‘ব্যাঘ্রঃ মানুষং খাদতি’, ‘ব্যাঘ্রঃ খাদতি মানুষম্’, ‘মানুষং খাদতি ব্যাঘ্রঃ’, ‘মানুষং ব্যাঘ্রঃ খাদতি’, ‘খাদতি ব্যাঘ্রঃ মানুষম্’, ‘খাদতি মানুষং ব্যাঘ্রঃ’—যেমন ইচ্ছা বলিতে পারি। কিন্তু বাঙ্গালায় এই বাক্যের অর্থ একটিভাবেই প্রকাশ করা যায়, ‘বাঘ মানুষ খায়’। সংস্কৃতের সঙ্গে বাঙ্গালা বাক্যটির তুলনা করিলে দেখি যে কর্তা (‘বাঘ’) ও কর্ম (‘মানুষ’) যা সংস্কৃতে বিভক্তির দ্বারা নির্দিষ্ট তা বাঙ্গালায় বাক্যে অবস্থানের (position) দ্বারা সূচিত। অতএব সংস্কৃত দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অথচ সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন বাঙ্গালার অধিকাংশ লক্ষণ প্রথম শ্রেণীর অনুযায়ী।
দ্বিতীয় অন্তরায় হইল এই যে অনেক ভাষা আছে যাহাতে গোড়াগুড়িই একাধিক শ্রেণীর লক্ষণ সমমাত্রায় বিদ্যমান। এগুলির লক্ষণমাত্রা ধরিয়া বিচার করিলে অসংখ্য উপশ্রেণী ধরিতে হয়।
ভাষা-বিভাজনের সর্বাপেক্ষা সহজ উপায় হইতেছে মোটামুটি ভাবে ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে তালিকা করা। ইহাকে বলে ভৌগোলিক শ্রেণীবিভাগ (Geographical Classification)। তবে এ শ্রেণীবিভাগের কোনো অতিরিক্ত উপযোগিতা নাই, বিশেষ কিছু বৈজ্ঞানিক মূল্যও নাই, তবে ঐতিহাসিক মূল্য আছে। ভাষাশ্রেণীবিভাগ ব্যাপারে উপযোগিতা ও মূল্য শুধু বংশানুগত শ্রেণী-বিভাগের। কিন্তু অনেক ভাষারই পুরানো নিদর্শন না থাকায় তাহাদের ইতিহাস ও বংশানুক্রম জানা যায় না॥
২. বিবিধ ভাষাবংশ
বর্তমানে যে-সব ভাষা প্রচলিত আছে এবং যে-সব লুপ্ত ভাষার নিদর্শন মিলিয়াছে সেগুলির বিশ্লেষণ ও ইতিহাস মিলাইয়া কয়েকটি বংশধারায় ভাগ করা হইয়াছে। একই পর্যায়ের কিংবা স্তরের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে যদি শব্দকোষে যথেষ্ট সাম্য এবং ব্যাকরণে যথোপযুক্ত মিল দেখা যায়, অথবা একাধিক ভাষার পূর্বতন রূপ যদি একই প্রকাবের হয়, তবে সেই ভাষার মধ্যে মৌলিক সম্পর্ক থাকিবেই। ইহা ভাষাবিজ্ঞানের একটি স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তসূত্র। এই সূত্র অনুসারে সংস্কৃত, আবেস্তীয়, প্রাচীন পারসীক, আর্মানী, প্রাচীন স্লাবিক, প্রাচীন গ্রীক, লাটিন, প্রাচীন জার্মানিক, প্রাচীন কেল্টিক ইত্যাদি ভাষাগুলি একটি বিশেষ ভাষাবংশের শাখা-প্রশাখা। এই ভাষাবংশের নাম দেওয়া হইয়াছে ইন্দো-ইউরোপীয়, কেননা এগুলির বর্তমান বংশধর ভাষাসমূহ একসীমায় ভারতবর্ষে, অপরসীমায় ইউরোপে, এবং ভারতবর্ষ ও ইউরোপের মধ্যস্থানে—ইরানে ও পূর্ব-এশিয়ার অপর কোনো কোনো অঞ্চলে—বরাবর প্রচলিত আছে।
যথোপযুক্ত নিদর্শনের অভাবে, অথবা সম্পর্কিত ভাষাগুলি লুপ্ত হওয়ায় কোনো কোনো ভাষাকে নির্দিষ্ট বংশের অন্তর্ভুক্ত করা যায় নাই। এমন অধুনালুপ্ত ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইতেছে—মেসোপটেমিয়ার প্রাচীনতম ভাষা সুমেরীয় (Sumerian)১, পশ্চিম ইরানের সুশা অঞ্চলের ভাষা এলামীয় (Elamite)২, পূর্ব-মেসোপটেমিয়ার অঞ্চল বিশেষের ভাষা মিটান্নি (Mitanni)৩, ক্রীট দ্বীপের প্রাচীন ভাষা৪ ইটালীর প্রাচীন ভাষা এট্ৰস্কান (Etruscan)৫, ইত্যাদি। এমন আধুনিক ভাষার মধ্যে পড়ে ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যবর্তী পিরেনীজ পর্বতমালার পশ্চিমাংশে বাস্ক (Basque), দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় বুশ্মান (Bushman) ও হট্টেনটট্ (Hottentot), জাপানী, কোরিয়ান, এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাদীদের ভাষা ইত্যাদি। এই ভাষাগুলিকে কোনরূপ বংশবন্ধনে বাঁধিতে পারা যায় নাই। উপরি-উক্ত ভাষাগুলি বাদ দিয়া পৃথিবীর তাবৎ ভাষা বিচার ও বিশ্লেষণ করিয়া এই কয়টি বংশে বর্গে বা গোষ্ঠীতে ভাগ করা হইয়াছে,
(ক) ইন্দো-ইউরোপীয়, (খ) সেমীয়-হামীয়, (গ) বান্টু, (ঘ) ফিন্নো-উগ্ৰীয়, (ঙ) তুর্ক-মোঙ্গল-মাঞ্চু, (চ) ককেশীয়, (ছ) দ্রাবিড়, (জ) অস্ট্রিক, (ঝ) ভোট-চীনীয়, (ঞ) উত্তরপূর্ব-সীমান্ত, (ট) এস্কিমো, এবং (ঠ—দ) আমেরিকার আদিম ভাষাগুলি।
সেমীয়-হামীয় (Semitic-Hamitic) বংশের দুই প্রধান শাখা—সেমীয় (Semitic) এবং হামীয় (Hamitic)। অনেক ভাষাতত্ত্ববিদ্ এই দুই শাখাকে দুইটি স্বতন্ত্র বংশ ধরিয়া থাকেন। সেমীয় শাখার পূর্বী উপশাখার অন্তর্গত ছিল বহুকাল পূর্বে বিলুপ্ত আসীরীয় (Assyrian) এবং আক্কাদীয় (Akkadian) বা বাবিলোনীয় (Babylonian)। বাণমুখ (Cuneiform) লিপিতে পাথরের উপর খোদাই অথবা কাদার টালির উপর লেখা এই দুই ভাষার প্রত্নলেখ ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হইতে মিলিয়াছে। পশ্চিমা উপশাখার উত্তর গোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল কনানীয় (Canaanite), ফিনিসীয় (Phoenician) ও আরামীয় (Aramaic)। বাইবেলের ওল্ড্ টেস্টামেন্টের মূলভাষা হিব্রু (Hebrew) এই উপশাখায় পড়ে। ধর্মশাস্ত্রের ভাষা, বহুকাল পূর্বে লুপ্ত, হিব্রু এখন ইজরাএল রাষ্ট্রের কথ্যভাষারূপে পুনর্জীবিত ও সর্বগ্রাহ্য হইয়াছে। পশ্চিমা উপশাখার দক্ষিণ গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে প্রধানত আরবী এবং আবিসীনিয়ায় প্রচলিত ভাষাগুলি। সেমীয় শাখার মধ্যে আরবীই এখন শ্রেষ্ঠ ভাষা। ইসলাম ধর্মের বাহক হিসাবে আফ্রিকার ও পূর্ব-এশিয়ার বহু ভাষাকে লুপ্ত করিয়া দিয়া আরবী এখন লোকসংখ্যার দিক দিয়া বিশেষ শক্তিশালী হইয়াছে। অষ্টম খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লিখিত প্রত্নলেখে আরবী ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন রহিয়াছে।
হামীয় শাখার একমাত্র ভাষা হইতেছে প্রাচীন মিশরীয়। ৪০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের কিছু পরে হইতে এই ভাষার নিদর্শন পাই। প্রাচীন মিশরের ভাষা হইতে কপ্টিক (Coptic) উদ্ভূত হইয়াছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই ভাষার বিলোপ ঘটিয়াছে। তখন হইতে আরবী সমগ্র মিশরে কথ্যভাষার স্থান গ্রহণ করিয়াছে। সেমীয়-হামীয় বংশের আরো দুইটি শাখা আছে—বেরবের (Berber) এবং কুশীয় (Cushite)। প্রথমটিতে লিবিয়ার কয়েকটি ভাষা এবং দ্বিতীয়টিতে সোমালিল্যাণ্ডের কয়েকটি ভাষা পড়ে।
মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব ভাষাই বান্টু (Bantu) বংশের অন্তর্গত। যেমন, সোয়াহিলি (Swahili), কাফির (Kaffir), জুল (Zulu), ইত্যাদি।
ফিন্নো-উগ্ৰীয় (Finno-Ugric) বংশের অন্তর্গত ভাষাগুলির মধ্যে প্রধান হইতেছে ফিন্ল্যান্ডের ভাষা ফিন্নীয় (Finnish) ও লাপ্পীয় (Lapponic), এস্থেনিয়ার ভাষার এস্থোনীয় (Esthonian) এবং হাঙ্গেরীর ভাষা হাঙ্গেরীয় (Hungarian), নামান্তরে মাজ্যর (Magyar)।
তুর্ক-মোঙ্গল-মাঞ্চু (Turk-Mongol-Manchu) বংশের তিন প্রধানশাখা—তুর্ক-তাতার, মোঙ্গল এবং মাঞ্চু। অনেকে এই তিন শাখাকে তিন স্বতন্ত্র বংশ বলিয়া ধরেন। প্রথম শাখার প্রধান ভাষা হইতেছে তুর্ক (Turkish), তাতার (Tartar), কিরগিজ (Kirghiz), উজবেগ (Uzbeg) ইত্যাদি। মোঙ্গোল শাখার ভাষাগুলি শুধু মোঙ্গোলিয়ায় সীমাবদ্ধ নাই, এশিয়ার অন্যত্র এবং ইউরোপের মধ্যে রাশিয়ায় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তৃতীয় শাখার প্রধান ভাষা সাইবীরিয়ার তুঙ্গুস (Tunguse) এবং মাঞ্চুরিয়ায় মাঞ্চু (Manchu)।
ককেশীয় (Caucasian)বংশের ভাষাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইতেছে শুধু জর্জিয়ার ভাষা জর্জীয় (Georgian)।
দ্রাবিড় (Dravidian) বংশের ভাষা প্রধানত ভারতবর্ষের দক্ষিণাংশেই প্রচলিত। তবে দ্রাবিড় ভাষা এখন সিংহলে এবং উত্তরাপথে দুই এক স্থানে প্রচলিত হছে। দ্রাবিড় বংশের অন্তর্গত মুখ্য ভাষা হইতেছে—দক্ষিণ ভারতে তামিল (Tamil), তেলেগু (Telugu), কন্নড বা কানাড়ী (Canarese), মলয়ালম বা মলয়ালী (Malayalam), টুলু বা টুড়ু (Tulu) এবং বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে কথিত ব্রাহুই (Brahui)। উড়িষ্যায় ছোটনাগপুরে মধ্যপ্রদেশে অঞ্চলবিশেষে কথিত গোড়ঁ-খোঁড়-ওঁরাওদের ভাষাও দ্রাবিড় বংশের অন্তর্গত। মালদহ জেলায় রাজমহল অঞ্চলের মালতো বা মালপাহাড়ী উপভাষা কানাড়ীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলিয়া অনুমিত হয়।
অস্ট্রিক (Austric) বংশের দুই শাখা—অস্ট্রো-এশিয়াটিক (Austro-Asiatic) এবং অস্ট্রোনেশীয় (Austronesian)। প্রথম শাখার দুই উপশাখা—মোন্-খ্মের (Mon-Khmer) এবং কোল (Kol)। মোন্-খ্মের উপশাখার ভাষাগুলি বর্মা-মালয়ের স্থানে স্থানে এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বলা হয়। কোল উপশাখার ভাষাগুলি ভারতবর্ষের নানা স্থানে—পশ্চিমবঙ্গে, উড়িষ্যায়, বিহারে, মধ্যপ্রদেশে ও অন্ধ্র প্রদেশের পূর্বোত্তর অঞ্চলে বলা হয়। আসামের খাসী ভাষাও ইহার অন্তর্গত। দ্বিতীয় উপশাখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইতেছে—মালয় (Malay), যবদ্বীপীয় (Javanese), বলিদ্বীপীয় (Balinese) ইত্যাদি। মালয় দ্বীপপুঞ্জের অন্যত্র, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের সর্বত্র এবং নিউজীল্যাণ্ড সামোয়া টাহিটি হাওয়াই ফিজি প্রভৃতি প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে এই শাখার ভাষা প্রচলিত।
ভোট-চীনীয় (Tibeto-Chinese বা Sino-Tibetan) বংশের তিন শাখা—চীনীয় (Chinese), থাই (Thai) এবং ভোট-বর্মী (Tibeto-Burmese)। চীনা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভাষা। চীনের ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের কয়েকটি প্রত্নলেখে। দ্বিতীয় শাখার প্রধান ভাষা হইতেছে শ্যাম দেশের ভাষা শ্যামী বা সিয়ামী। তৃতীয় শাখার তিনটি প্রধান উপশাখা, ভোট বা তিব্বতী (Tibetan) বর্মী (Brumese) এবং বোডো (Bodo) বা ভোট। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব প্রত্যন্তে হিমালয়ের পূর্বাংশের পাদদেশে, বোডো, কাচিন, নাগা প্রভৃতি বোডো উপশাখার ভাষা প্রচলিত আছে।
উত্তর-পূর্ব-সীমান্ত (Hyperborean) বংশের ভাষা এশিয়ার উত্তরপূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের নিতান্ত অল্পসংখ্যক লোকে বলে। ইহার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইতেছে চুক্চী (Chukchee)।
উত্তরমেরুর সীমান্ত দেশগুলিতে গ্রীনল্যাণ্ড (Greenland) হইতে আলেউশিয়ান (Aleutian) দ্বীপপুঞ্জ অবধি ভূভাগে এস্কিমো (Esquimo) বংশের ভাষা বলা হয়।
আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের ভাষাও ইংরেজী, ফরাসী অথবা স্পেনীয় ভাষার দ্বারা দূরীকৃত হইয়াছে। তবে আমেরিকার স্থানে স্থানে কিছু কিছু আদিম অধিবাসী যাহারা এখনও কোনমতে টিকিয়া আছে, সেই আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের (American Indian) লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলি আটটি প্রধান বংশে পড়ে,—(১) আল্গঙ্কীয়ান্ (Algonquian), (২) আথাবাস্কান্ (Athabascan), (৩) ইরোকোয়ীয়ান্ (Iroquoian) () মুস্কোজীয়ান্ (Muskogean), (৫) সিওউয়ান্ (Siouan) (৬) পিমান্ (Piman), (৭) শোশোনীয়ান্ (Shoshonean)এবং (৮) নাহুয়াট্লান্ (Nahuatlan)। শেষোক্ত বংশের অন্তর্গত প্রাচীন আজটেক্ (Aztec) এক পুরাতন সংস্কৃতির বাহক ছিল॥
৩. ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ
যে বিলুপ্ত মূলভাষা হইতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলি উদ্ভূত হইয়াছিল তাহার কোন নিদর্শন অদ্যাপি পাওয়া যায় নাই। তবে এই বংশের প্রাচীন ভাষাগুলির তৌলন আলোচনা হইতে মূলভাষার মোটামুটির রূপ যে কেমন ছিল তাহা ধারণা করা হইয়াছে। অনুমান হয় ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে মূলভাষা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া এই বংশের প্রাচীন ভাষাগুলির জন্ম হইয়াছিল এবং অনতিদীর্ঘকাল পরে সেগুলি ইউরোপ-এশিয়ায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার নীড় যে কোথায় ছিল সে-বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্কের অবসান আজও হয় নাই, এবং কখনো হইবে কিনা সন্দেহ। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে পূর্ব ইউরোপই এই মূলভাষার শেষ পীঠস্থান ছিল। পরবর্তী কালে এই ভাষাবংশের অভিযানপথ এই অনুমানই সমর্থন করে।
ইন্দো-ইউরোপীয় (Indo-European) ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচীন শাখা এই নয়টি—১) কেল্টিক (Celtic); (২) ইটালিক (Italic), (৩) জার্মানিক (Germanic) বা টিউটনিক (Teutonic), গ্রীক (Greek), (৫) বাল্টো-স্লাবিক (Balto-Slavic), (৬) আল্বানীয় (Albanian), (৭) আর্মেনীয় (Armenian), (৮) তোখারীয় (Tokharian) এবং (৯) ইন্দো-ইরানীয় (Indo-Iranian), বা আর্য (Aryan)। এই শাখাগুলির মধ্যে তোখারীয় অনেক দিন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। অপর শাখাগুলির বংশধর ভাষা অদ্যাবধি জীবিত। আরও কিছু কিছু শাখা ছিল। যেমন ফ্রিজিয় (Phrygian), থ্রাকিয় (Thracian), ইত্যাদি। এসব ভাষার পরিচয় যৎসামান্যই পাওয়া গিয়াছে॥
৪. ধ্বনি-সংস্থান
ইন্দো-ইউরোপীয় প্রাচীন ভাষাগুলির ব্যাকরণ আলোচনা করিয়া সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে মূলভাষার নিম্নলিখিত ধ্বনিগুলি ছিল।
(ক) হ্রস্ব স্বর—অ (a), এ(e), ও(o), ই (i), উ (u); দীর্ঘম্বর—আ (ā), এ (ē), ও (o) ঈ (ī), ঊ (ū); অতিহ্রস্ব— (ǝ)।
(খ) অর্ধব্যঞ্জন—হ্রস্ব এবং দীর্ঘ ঋ (r)৯(l); হ্রস্ব এবং দীর্ঘ ন্ (n), হ্রস্ব এবং দীর্ঘ ম্ (m)।
(গ) অর্ধস্বর—য়্ (y), ব্ (w)।
(ঘ) স্পৃষ্ট ব্যঞ্জন—
[১] পুরঃকণ্ঠ্য১— র্ক্, র্খ্, র্গ্, র্ঘ, র্ঙ্ (k, kh, ĝ, ĝh, ṅ)
[২] কণ্ঠ্য বা পশ্চাৎকণ্ঠ্য২—ক্, খ্, গ্, ঘ্, ঙ্ (q, qh, g, gh, ṅ)
[৩] কণ্ঠৌষ্ঠ্য৩—ক্ক, খ্ব, গ্ব, ঘ্ব, ঙ্ (qw, qwh, gw, gwh, nw)
[৪] দন্ত্য ও দন্তমূলীয়৪—ত, থ্, দ্, ধ, ন্ (t, th, d, dh, n)
[৫] ওষ্ঠ্য৫—প্, ফ্, ব্, ভ, ম্ (p, ph, b, bh, m)
‘(ঙ)’ কম্পিত—র্(r)
(চ) পার্শ্বিক—ল্(l)
(ছ) উষ্ম—
[১] পুরঃকণ্ঠ্য, পশ্চাৎকণ্ঠ্য, কণ্ঠৌষ্ঠ্য—[ক্. (খ্.) গ্. (ঘ্.) (x,‘γ’)]৬
[২] দন্ত্য ও দন্তমূলীয়—স্ (s) [জ্, ত্, (থ্), দ্ (ধ) (z,θ, δ]৬ ২।
ইন্দো-ইরানীয় (বা আর্য) শাখার মূলভাষায় [অ, এ, (হ্রস্ব), ও (হ্রস্ব)] এই তিন ধ্বনি অ-কারে এবং [আ, এ (দীর্ঘ), ও দীর্ঘ)] এই তিন ধ্বনি আ-কারে পরিণত হইয়াছে। অন্য শাখায় এই স্বরধ্বনিগুলি যথাসম্ভব অপরিবর্তিত আছে। নিম্নে উদাহরণ দ্রষ্টব্য। মূল-ভাষার শব্দ পরিকল্পিত (reconstructed) বলিয়া তারকাচিহ্নিত।
*ago—সং অজামি, গ্রী অগো, লা অগো। *medhu > সং মধু, গ্রী মেথু, লিথুয়ানীয় মেধু। *dōnom >সং দানম্, লা দোনুম্। *bhrater সং ভ্রাতা, গ্রী ফ্রাতের্, লা ফ্রাতের, প্রাচীন আইরিশ ব্রাথির, ইং ব্রাদার্।
[ই, ঈ, উ, ঊ] ধ্বনিগুলি সব শাখাতেই মোটামুটি বর্তমান আছে। যেমন, *idhi > সং ইহি, গ্রী ইথি। *gwiwos > সং জীবস্, লা বীবুস্। *ebhūt সং অভূৎ, গ্রী এফু। *nu সং নু, গ্ৰী নু।
*
(অর্থাৎ অতিহ্রস্ব অ) কোনো ভাষাতেই রক্ষিত হয় নাই, কোথাও ই-কারে এবং কোথাও অ-কারে পরিণত হইয়াছে। যেমন * > সং পিতা, গ্রী পতের্, লা পতের্, গ ফদর্, ইং ফাদার, প্রাচীন আইরিশ অথির্।
ঋ এবং দীর্ঘ ৯ কোনো ভাষাতেই রক্ষিত হয় নাই। আর্য শাখার ঋ রক্ষিত হইয়াছে, এবং হ্রস্ব ৯ ঋ-কারে পরিণত হইয়াছে। আর্য শাখার বাহিরে ৠ ও দীর্ঘ ৯ হ্রস্ব ঋ-কার ও ৯-কারের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে। যেমন, * > গ্রী কোর্দিঅ, লা কোর্দিস্, ইং হার্ট। * সং কৃপ্, লা কর্পূস। > সং মৃষ্টস্, লা মূল্ক্তুস, ইং মিল্ক্।
অর্ধব্যঞ্জন (হ্রস্ব ও দীর্ঘ) [ন্, ম্,] কোন শাখাতেই রক্ষিত হয় নাই। আর্য এবং গ্রীক শাখায় এই হ্রস্ব ও দীর্ঘ অর্ধব্যঞ্জন যথাক্রমে অ-কার এবং আ-কার হইয়াছে। যেমন, * > সং ততস্ (তন্+ত), গ্ৰী ততোস্, লা তেন্তুস, ওয়েলশ্ তন্ত। * > সং দশ, গ্ৰী দেক, লা দেকেম্, গ তেখুন্, ইং টেন। * > সং অগাৎ, গ্রী এবা (উপভাষায়)। * > সং আতিস্।
অর্ধস্বর [য়্ ব্] অধিকাংশ শাখাতেই মোটামুটিভাবে বিদ্যমান। গ্রীকে ব-কার সম্পূর্ণভাবে এবং ষ-কার প্রায়ই লোপ পাইয়াছে। *yugom > যুগম্, গ্রী জুগোন্, লা য়ুগুম, গ য়ুক, ইং ইয়োক। *woikois> সং বেশস্, গ্রী ওইকোস, লা বীকুস। *treyes >সং ত্রয়স্ গ্ৰী ত্রেইস্।
পুরঃকণ্ঠ্য স্পৃষ্ট ধ্বনিগুলি গ্রীক লাটিন জার্মানিক কেল্টিক ও তোখারীয় শাখায় পশ্চাৎকণ্ঠ্য ধ্বনিগুলির সহিত একীভূত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আর্য, বাল্টো-স্লাবিক, আল্বানীয় ও আর্মেনীয় শাখায় মূলভাষার [ক] (k) ধ্বনি শ-কারে অথবা স-কারে পরিণত হইয়াছে। মূলভাষার পুরঃকণ্ঠ্য ধ্বনির এইরূপ পরিবর্তন ধরিয়া ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের ভাষাগুলিকে দুই গুচ্ছে ভাগ করা হইয়াছে। যে ভাষাগুলিতে ইহা কণ্ঠ্যধ্বনি রহিয়া গিয়াছে সেগুলিকে বলা হয় কেন্তুম্ (Centum) গুচ্ছ, এবং যেগুলিতে ইহা ‘শ’ বা ‘স’ ধ্বনিতে পরিণত সেগুলিকে বলা হয় সতম্ (Satem) গুচ্ছ। মূলভাষার ‘শত’-বাচক শব্দের লাটিন এবং আবেস্তীয় প্রতিরূপ দুইটি লইয়া এই নামকরণ। মূলভাষার *( =শতম্) শব্দ দুই গুচ্ছে এইরূপ হইয়াছে—[কেন্তুম্] গ্ৰী হে-কতোন লা কেন্তুম্, গ খুন্দ, ইং হন্ড্রেড্, ওয়েল্শ কন্ত্, আইরিশ কেত্, তুখারীর কত্; [সতম] সং শতম, আবেস্তীয় সতম্, লিথুয়ানীয় শিম্তাস, স্লাবিক সুতো।
মূলভাষার অপর পুরঃকণ্ঠ্য ধ্বনির উদাহরণ: * > সং জনস্, আ জনো, প্রা-পা দন, গ্র গোনোস্, লা গেনুস্, ওয়েলশ গেনি, ইং কিন্। *)>সং অহম্, আ অজম, প্রা-পা অদম্, গ্ৰী এগো, লা এগো, গ ইক্, ইং আই (I)।
পশ্চাৎকণ্ঠ্য ধ্বনি সব শাখাতেই মোটামুটি বজায় আছে। কন্ঠৌষ্ঠ্য ধ্বনি শুধু গ্রীক লাটিন জার্মানিক প্রভৃতি ইউরোপের কয়েকটি শাখায় স্বতন্ত্রতা রাখিয়াছে, অন্যত্র পশ্চাৎ কণ্ঠ্য ধ্বনির সহিত মিশিয়া গিয়াছে। তবে [ই, ঈ, এ১] —এই তালব্য স্বরধ্বনির অব্যবহিত পূর্বে থাকিলে মূলভাষার কণ্ঠ্য ও কন্ঠৌষ্ঠ্য ধ্বনি আর্য ভাষায় শাখার তালব্য ধ্বনিতে (নূতন সৃষ্ট চ-বর্গে) পরিণত হইয়াছে। এই ধ্বনিপরিবর্তন কোলিৎসের সূত্র (Collitz’ Law) নামে পরিচিত। যেমন, *qrews>সং ক্রবিস্, গ্ৰী ক্রেঅস্, লা ক্রুওর, প্রা-ই খ্র, ইং-র (কাঁচা)। *gwōus >সং গৌস্, গ্ৰী বোউস, লা বোস, ইং কাউ। *qwe> সং চ, আ চ, প্রাপা চা, গ্ৰী তে, লা কে। *gwhormos, gwhermos >সং ঘর্মস, আ গর্ম, গ্রী থোর্মোস্, লা ফোর্মুস্, ইং ওয়ার্ম (warm)। *৩>সং জীবস্, প্রা-পা জীব, গ্রী বিওস্, লা বীবুস্, ইং কুইক।
[র্, ল্] সব শাখাতেই পাওয়া যায়, কেবল আর্য শাখায় ল-কার র-কারে পরিণত। যেমন, *rudhros > সং রুধিরস, গ্রী এরুথ্রোস, লা রূবের্, ইং রেড্। *leuq- >সং রোচস্, প্রা-পা রউচ, গ্ৰী লেউকোস্, লা লুক্স্, ইং লাইট্।
দন্ত্য ও ওষ্ঠ্য ধ্বনি সব শাখাতেই মোটামুটি রক্ষিত হইয়াছে। পূর্বে উদ্ধৃত উদাহরণের মধ্যে এগুলিরও উদাহরণ মিলিবে।
উষ্ম ধ্বনির মধ্যে মুখ্য স-কার। অন্যগুলি দৈবাৎ যুক্তধ্বনিতে পাওয়া যায়। স-কার প্রায় সব শাখাতেই আছে। তবে স্বরমধ্যগত স-কার গ্রীক শাখায় এবং ইরানীয় উপশাখায় হ-কারে পরিণত হইয়াছে। যেমন, *esti >সং অস্তি, আ অস্তি, প্রা-পা অস্তী, গ্রী অস্তি, লা এস্ত, গ ইস্ৎ, ইং ইজ। *senos >সং সনঃ ( =সনস্), গ্রী হেনোস্, লা সেনেস্, আইরিশ সেন, ওয়েলেশ্ হেন॥
৫. অপশ্রুতি: গুণ-বৃদ্ধি-সম্প্রসারণ
মূলভাষার সব শাখারই প্রাচীন স্তরে স্বরধ্বনিগত একটি বিশেষত্ব অল্পবিস্তর রক্ষিত হইয়াছে। গ্রীকে মূলভাষার স্বরধ্বনি সর্বাধিক অপরিবর্তিত থাকায় এই বিশেষত্ব সেখানে সর্বাধিক পরিস্ফুট। ব্যাপারটি হইতেছে যে মূলভাষায় একই ধাতু বা শব্দ হইতে, অথবা একই প্রত্যয় বা বিভক্তি যোগে, নিষ্পন্ন পদে ধাতু শব্দ প্রত্যয় অথবা বিভক্তি অংশে নির্দিষ্ট ক্রম-অনুসারে স্বরধ্বনির রূপান্তর— অর্থাৎ এ-কার হইতে ও-কারে পরিবর্তন কিংবা এই দুইধ্বনির হ্রস্ব-দীর্ঘ-ক্ষীণতা (ও লোপ)—দেখা যায়। স্বরধ্বনির এইরূপ পরিবর্তনকে বলে অপশ্রুতি১ (Ablaut, Vowel Gradation বা Apophony)। স্বরধ্বনির মাত্রা অনুসারে অপশ্রুতিতে স্বরধ্বনির তিনটি ক্রম (Grade)। ধাতু-প্রাতিপদিকের অথবা প্রত্যয় বিভক্তির মূল স্বরধ্বনি প্রথম ক্ৰমে অবিকৃত থাকে, দ্বিতীয় ক্রমে দীর্ঘ হয়, তৃতীয় ক্রমে লুপ্ত অথবা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়। এই তিন ক্রমের নাম যথাক্রমে গুণ বা সাধারণ (Strong বা Normal), বৃদ্ধি (Lengthened), এবং ক্ষীণ (Weak বা Reduced)। সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা ধাতুস্বরের এইরকম হ্রস্বদীর্ঘ পরিবর্তন লক্ষ্য করিয়াই প্রথম দুই ক্রমের নামকরণ করিয়াছিলেন যথাক্রমে গুণ ও বৃদ্ধি। তৃতীয় ক্রমের কোনো সাধারণ নাম তাঁহারা দেন নাই। কেবল বিশেষ অবস্থায়, যেখানে স্বরধ্বনির লোপের ফলে [র, য়, ব] যথাক্রমে [ঋ, ই, উ] হইয়াছে শুধু সেইখানে, ইহাকে সম্প্রসারণ বলিয়াছেন। ‘স্বপ্’ ধাতু হইতে ‘স্বপ্ন’ (গুণ), ‘স্বাপ’ (বৃদ্ধি), ‘সুপ্তি’ ও ‘সুপ্ত’ (ক্ষীণ, সম্প্রসারিত); ‘যজ্’ ধাতু হইতে ‘যজ্ঞ’ (গুণ), ‘যাগ’ (বৃদ্ধি), ‘ইষ্টি’, ‘ইষ্ট’ (ক্ষীণ, সম্প্রসারিত)। প্রথম দুই ক্রমে আবার ক্রম-মধ্যেও স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটিত। অর্থাৎ সাধারণ ক্রমে স্বরধ্বনি ‘এ’ অথবা ‘ও’ এবং বর্ধিত ক্রমে দীর্ঘ ‘এ’ অথবা দীর্ঘ ‘ও’ হইত। অপশ্রুতির গুণ ও বৃদ্ধি ক্রমের মধ্যে এমন পরিবর্তনকে বলে স্বরূপপরিবর্তন (Qualitative Change)।
৬. পদ ও শব্দ গঠন
মূলভাষার ব্যাকরণ বেশ জটিল ছিল। শব্দরূপে এবং ধাতুরূপে ছিল অজস্র বৈচিত্র্য। সে বৈচিত্র্য সংস্কৃতে এবং গ্রীকে অনেকটা বজায় আছে। নামরূপে তিন লিঙ্গ (Gender), তিন বচন (Number), এবং সম্বোধন ও সম্বন্ধ পদ সমেত আট কারক (Case)। সর্বনামের রূপেও এইরকম ছিল। ধাতুরূপে তিন বচন, তিন পুরুষ (Person)। ক্রিয়ায় দুই বাচ্য (Voice)— আত্মনেপদ (Middle) ও পরস্মৈপদ (Active); তিন কাল (Tense)— (১) বর্তমান (Present) বা লট্ (অসম্পন্ন Imperfect বা লঙ্ সমেত); (২) সামান্য (Aorist বা লুঙ্) এবং (৩) সম্পন্ন (Perfect বা লিট্); পাঁচ ভাব (Mood)— নির্দেশক (Indicative) অনুজ্ঞা (Imperative) সম্ভাবক (Optative), অভিপ্রায় (Subjunctive) ও নির্বন্ধ (Injunctive)। বাচ্য ও কাল অনুযায়ী শতৃ-শানচ্ ও ক্কসু-কানচ্ ইত্যাদি ক্রিয়ার্থ-বিশেষণ (Participle) এবং বিস্তর অসমাপিকা (Gerund infinitive) ছিল। মূলভাষায় ক্রিয়ার কাল সময়-নির্দেশক ছিল না। ইহা শুধু ক্রিয়ার মূল প্রকৃতি বা ধরন (Aspect)-নির্দেশ করিত। বর্তমান কাল বুঝাইত—কাজটি বার বার ঘটে, প্রায় ঘটিয়া থাকে, অথবা ঘটা শেষ হয় নাই। অসম্পন্ন কাল বর্তমান কালেরই রূপভেদ ছিল। সামান্য কাল সদ্যোঘটিত কার্য (ইংরাজীতে যেমন প্রেজেন্ট পারফেক্ট ব্যবহৃত হয়) কিংবা সময়নিরপেক্ষ ক্রিয়ামাত্র বুঝাইত। মূলভাষায় সম্পন্ন কালের অর্থ ছিল অনেকটা বর্তমান কালের মতো। ইহাতে বুঝাইত যে বর্তমান ক্রিয়াপ্রকৃতি পূর্বঘটিত ক্রিয়ারই জের বা ফল। যেমন, *বোইদ (*woida) > গ্রীকে ওইদ (oida), সংস্কৃতে বেদ— ‘আমি জানি’ অর্থাৎ পূর্ববর্তী অনুশীলনের ফলে আমার বর্তমান জ্ঞান লব্ধ।’ মূলভাষা হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার অনেককাল পরে তবে বিভিন্ন ভাষায় কালের সময়নির্দেশক অর্থ আসিয়া গিয়াছে। কিন্তু গ্রীকে এবং বৈদিকে সামান্য ও সম্পন্ন কালের মৌলিক অর্থ কখনো সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নাই। মূলভাষায় অতীত কাল বুঝাইতে হইলে, *e (গ্রীক্ এ, প্রাচীন পারসীক অ, সংস্কৃত অ) এই অব্যয়টি উপসর্গরূপে (Augment) ক্রিয়াপদে যুক্ত হইত, নতুবা শুধু বাক্যার্থের উপর নির্ভর করিতে হইত। পরবর্তী কালে মূলভাষা হইতে আগত বিভিন্ন ভাষার মধ্যে কোথাও কোথাও এই উপসর্গের ব্যবহার মোটেই নাই (যেমন কেল্টিক লাটিন জার্মানিক ইত্যাদিতে), কোথাও কোথাও সর্বদাই আছে। (যেমন প্রাচীন পারসীকে ও সংস্কৃতে), আবার কোথাও কোথাও কখনো আছে কখনো নাই (যেমন গ্রীকে, আবেস্তায়, বৈদিকে)।
দুইটি পদ মিলিয়া একটি পদ অর্থাৎ সমাস (Compound) হওয়া মূলভাষার একটি বড় বিশেষত্ব। পরবর্তীকালে সংস্কৃতে বহু পদ লইয়া সমাস করা বিশিষ্ট রীতিতে পরিণত হইয়াছিল।
মূলভাষায় স্বরও বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। গ্রীকে এবং বিশেষভাবে বৈদিকে আদিম ইন্দো-ইউরোপীয় স্বর (Intonation) প্রায়ই নির্দিষ্ট অক্ষরে রহিয়া গিয়াছে। মূলভাষায় যখন ভাঙ্গন লাগিতেছিল তখন স্বরের সঙ্গে সঙ্গে বল বা শ্বাসাঘাত (Stress) দেখা দিয়াছিল। ইহার ভালো উদাহরণ মূলভাষায় *es ধাতুর বর্তমানে প্রথম পুরুষের বহুবচনে আদিস্বরলোপ,— (প্রথমে) *এসেন্তি, *এসোন্তি > (পরে) *সেন্তি, *সোন্তি > সং সন্তি, গ্রী এন্তি, লা সুন্ত্ ইত্যাদি॥
৭. আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রাচীন শাখা হিট্টীয়
বর্তমান শতাব্দের প্রারম্ভে এশিয়া মাইনরের কাপ্পাদোকিয়া প্রদেশে বাণমুখ অক্ষরে (এবং লিপিচিত্রে) উৎকীর্ণ বহু প্রত্নলেখ আবিষ্কৃত হয়। লেখগুলি মোটামুটি খ্রীস্টপূর্ব বিংশ হইতে নবম শতাব্দী মধ্যে প্রস্তুত হইয়াছিল। যেখানে এগুলি পাওয়া যায় সেখানে খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হিট্টীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। রাজদপ্তরের দলিলপত্রে এই প্রত্নলেখগুলির মধ্যে এক খুব প্রাচীন নূতন ভাষা হিট্টীয়ের সন্ধান মিলিল এবং এই ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের ভাষাগুলির অনেকটা মিল দেখা গেল। সেই সঙ্গে হিট্টীয় ভাষায় এমন কিছু কিছু বিশেষত্ব দেখা গেল যাহা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে নাই, অথবা অত্যন্ত পরিবর্তিত। এই লইয়া পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দাঁড়াইয়াছে। একদল বলেন হিট্টীয় ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের এক শাখা। অপর দল বলেন যে হিট্টীয় ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার সমগোত্রীয় এবং সমান স্তরের ভাষা। শেষোক্ত মতে মূল ভাষার নাম হইবে ইন্দো-হিট্টীয়। হিট্টীয় বা আনাতোলীয় ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত অন্য ভাষারও খোঁজ পাওয়া গিয়াছে।১ যেমন পালাইক, লুবীয়, লীসীয় ও লীডীয়।
ইন্দো-ইউরোপীয় অপর ভাষাগুলির তুলনায় হিট্টীয় ভাষায় ধ্বনিসংখ্যা কম। বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ (খ, থ, ফ) ও চতুর্থ বর্ণ নাই। অধিকন্তু ছিল দুইটি কণ্ঠনালীয় (Laryngeal) ধ্বনি। একটি অঘোষ অপরটি সঘোষ। হিট্টীয় ভাষায় বর্গের প্রথম বর্ণের (ক, ত, প) অব্যবহিত পরে কণ্ঠনালীয় ধ্বনি থাকিলে তাহা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ রূপে দেখা যায়।
হিট্টীয় শব্দরূপ ও ধাতুরূপ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির তুলনায় অনেক সরল, তবে সুমেরীয় ও আক্কাদীয় ভাষার শব্দ ও ধ্বনি-প্রভাব হিট্টীয়ে যথেষ্ট আছে। আক্কাদীয় বাণমুখ (অথবা চিত্র) লিপিতে ব্যবহৃত হওয়ায় হিট্টীয় ভাষায় ধ্বনিগুলি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হইতে পারে নাই। অনেকটা এই কারণেই হিট্টীয় ভাষায় মূল ইন্দো-ইউরোপীয় স্বরূপ ঢাকা পড়িয়াছে॥
—
১ সমম্বয়ী ভাষায় জোড়ালাগা প্রত্যয় ও বিভক্তি প্রচুর দেখা যায়। প্রত্যয় যাহা যোগ করিলে নূতন শব্দ গঠিত হয় অথবা শব্দটি রূপ করিবার যোগ্য হয়, বিভক্তি যাহা যোগ করিলে শব্দটি রূপ পায়, অর্থাৎ সরাসরি বাক্যে ব্যবহারযোগ্য হয়।
১ ৪০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ হইতে নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
২ ২০৭০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ হইতে নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
৩ ১৬০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ হইতে নিদর্শন মিলিয়াছে।
৪ ১৫০০ খ্রীস্টপূর্ব হইতে নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
৫ খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দ হইতে নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে।
১ Palatal।
২ Velar।
৩ Labio-velar।
৫ Labial।
৬ [ ] বন্ধনীর্ধৃত ধ্বনিগুলির ব্যবহারক্ষেত্র অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ছিল।
১ [এ] হ্রস্ব অথবা দীর্ঘ।
২ [o] হ্রস্ব অথবা দীর্ঘ।
৩. [ই] হ্রস্ব অথবা দীর্ঘ।
১ নামটি শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রদত্ত।
১ এগুলির যথেষ্ট আলোচনার পক্ষে উপাদান এখনো মিলে নাই।