৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক চার্লসডিকেন্স নামেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ১৮১২ খ্রি: ৭ ফেব্রুয়ারী পোর্টসমাউথের ল্যান্ডপোর্টে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জন ডিকেন্স নৌ-বিভাগের সামান্য কেরানীর কাজ করতেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ বা ডিকেন্স পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
জন ডিকেন্স স্বভাবতঃ দয়ালু এবং হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। কিন্তু কাজে ছিলেন অলস এবং দায়িত্ব জ্ঞানহীন।
ফলে সংসারের অবস্থা এক সময়ে স্বচ্ছল থাকলেও পরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয় তাঁকে। ঋণের দায়ে কারাগারেও যেতে হয়েছিল।
চার্লসের ভাইবোনেররা ছিলেন আটজন। ডিকেন্স ছিলেন দ্বিতীয়। তার মা এলিজাবেথ সন্তানদের সামলে উড়নচনন্ডী স্বামীকে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন।
যথারীতি বাল্যবয়সেই চার্লসের স্কুলের পড়া শুরু হয়েছিল। লেখাপড়ায় আগ্রহেরও অভাব ছিল না।
প্রকৃতির পাঠশালায়ই তার শিশুমম পরিপুষ্টি লাভ করে এবং কল্পনার বিকাশ ঘটে। তাঁর মেধাও ছিল অসাধারণ।
সংসারে চরম আর্থিক সঙ্কট দেখা দিলে ডিকেন্স পরিবার চলে আসেন উত্তর লন্ডনের ক্যামডেন টাউনের বেহ্যাম স্ট্রিটে। এই এলাকাটা ছিল দরিদ্র পরিবারের বস্তি। চার্লসের কাছে ছিল একেবারেই অপ্রিয়।
তবে লন্ডন শহরের বিস্তৃতি প্রাণময়তা ছিল তাঁর কাছে একটা অভূতপূর্ব আবিষ্কারের মত।
স্কুলের আনন্দময় দিনগুলোর অবসান ঘটেছিল বাবার জেলে যাবার পরে পরেই। ফলে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনার ইতি পড়েছিল। তার মা এক আত্মীয়কে ধরে চার্লসকে পাঠালেন এক কালির কারখানার চাকরিতে। প্রতিদিন ১ শিলিং মাইনেতে শ্রমিকের কাজ করতে লাগলেন তিনি।
কালির কারখানা চার্লসের কাছে ছিল আতঙ্কের মত। এই আতঙ্ক তাঁকে সারা জীবন তাড়া করে ফিরেছে।
দুটো বছর কাটল খুবই দুর্ভোগ দুর্দশার মধ্যে। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহের ফলে এই দুরবস্থার মধ্যেও চার্লস সময় সুযোগ পেলেই প্রিয় বই খুলে নিয়ে বসতেন।
বারো বছর বয়সে আবার স্কুলে যাবার সুযোগ পেলেন। ইতিমধ্যে বাবা ফিরে এসেছিলেন জেল থেকে। পারিবারিক ঋণও শোধ হয়েছে। প্রধানতঃ মায়ের চেষ্টাতেই তা হয়েছিল আর চার্লসকে তার জন্য তাড়না ভোগ করতে হয়েছিল যথেষ্ট। এর জন্য মায়ের প্রতি একটা অবুঝ অভিযোগ কোনদিনই ভুলতে পারেনি চার্লস।
ছেলের মেধা এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জন চার্লসের নজর এড়ায়নি। তিনি একরকম স্ত্রীর অমতেই ডিকেন্সকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মেধাবী চার্লস নষ্ট হওয়া দিনগুলো মেধা ও পরিশ্রমের সাহায্যে ফিরিয়ে নিলেন।
মর্নিংটন প্লেসের ওয়েলিংটন হাউস অ্যাকাডেমিতে পড়ার সময়ে গল্প লিখতে শুরু করলেন চার্লস। ভিড়ে গেলেন স্কুলের নাটক দলের সঙ্গে।
১৮২৭ খ্রি: পনের বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে এক সলিসিটার ফার্মে চাকরি নিলেন। অফিস বয় হিসেবে। ক্রমে উন্নীত হলেন কেরানীর পদে। বাড়িতে বাবার কাছেও এই সময় নিতে লাগলেন সর্টহ্যান্ডের পাঠ। তারই ফলে কয়েক মাস পরে পেলেন কোর্ট রিপোর্টারের পদ।
স্বপ্ন ছিল অতি সম্মানিত পার্লামেন্ট রিপোর্টারের পদ। একদিন তাই হল করায়ত্ত।
আদালতে যাবার ফলে বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে। জীবনকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পান। এই অভিজ্ঞতাই তাঁর সাহিত্য জীবনের উপকরণ জুগিয়েছিল।
পার্লামেন্ট রিপোর্টার হিসেবে চার্লসের সমালোচনা খুবই সমাদৃত হয়েছিল। প্রথম দ্য টু সান, পরে দ্য মির অব পার্লামেন্ট এবং সবশেষে দ্য মর্নিং ক্রনিকল ম্যাগাজিন তাকে পার্লামেন্ট রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ করে। পরে ওল্ড মান্থলি ম্যাগাজিনের লেখক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন।
এই কাজের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও জায়গা সম্পর্কে নিয়মিত নোট রাখতেন চার্লস। এই সব নোটের সাহায্যেই ১৮৩৩ খ্রি: থেকে ওল্ড মান্থলি ম্যাগাজিনে নিয়মিত স্কেচধর্মী লেখা লিখতে আরম্ভ করলেন। ছদ্মনাম নিলেন Boz।
১৮৩৪ খ্রি: এরকম নটি রচনা Sketches by Boz নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
এভাবেই সাহিত্যজগতে পদার্পণ করলেন চার্লস। এবারে এল এক অভূতপূর্ভ সুযোগ। প্রখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ড্রাপম্যান অ্যান্ড হল, মাসিক কিস্তিতে তার লেখা প্রকাশ করবার চুক্তি করল। স্থির হল এই লেখাগুলো হবে সচিত্র। ছবি আঁকবেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রবার্ট সিমূর।
১৮৩৬ খ্রি: এক সতীর্থ জর্জ হগার্থ-এর কন্যা ক্যাথেরিন হগার্থকে বিয়ে করলেন চার্লস। কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখময় ছিল না তার।
এ বছরেই সূচনা হল তাঁর বিখ্যাত Posthumous Papers of the Pickwick Club রচনার। বই আকারে প্রকাশিত হল ১৮৩৭ খ্রি:।
এই চিত্রোপন্যাস চার্লসকে ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের শিরোপা এনে দিল। এরপর থেকে একাদিক্রমে ত্রিশবছর অব্যাহত থাকল তার সাহিত্য-সাধনা।
১৮৩৮ খ্রি: প্রকাশিত হল অলিভার টুইস্ট। এরই পরিণতরূপ হল ডেভিড কপারফিল্ড (১৮৪৮-৫০ খ্রি:)। মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন নিকোলাস নিকলবি (১৮৩৯ খ্রি:), বারনরি রাজ (১৮৪০ খ্রি:)। চার্লসের অন্যান্য সাহিত্যকীর্তি হল–ব্ৰীক হাউস (১৮৫২-৫৩ খ্রি:), এ টেল অব টু সিটিজ (১৮৫৯ খ্রি:), গ্রেট এক্সপেক্টেশনস (১৮৬১ খ্রি:) প্রভৃতি।
ডিকেন্স ছিলেন একজন সৎ ভ্রমণকারী। ইংলন্ডের অভিজাত সম্প্রদায়ের নাক উঁচু ভাব তার ভাল লাগেনি। তাই ভ্রমণে বের হয়ে আমেরিকায় গেলেন। সেখানে রাজকীয় সম্মান লাভ করেন তিনি।
আমেরিকার পরে জেনোয়া, লুসন, প্যারিস, বুলোন– সর্বত্রই তিনি সমানভাবে সমাদৃত হন। যেখানে যখন গেছেন প্রায় সব জায়গাতেই প্রকাশ্যে স্বরচিত গ্রন্থপাঠ করে শ্রোতাদের শোনাতে হয়েছে তাঁকে। ফলে অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল।
১৮৬৯ খ্রি: অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরের বছরই মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১৮৭০ খ্রি: ৯ই জুন তাঁর মৃত্যু হয়।
চার্লস ডিকেন্সের প্রিয় বই ছিল ডেভিড কপারফিল্ড। তিনি নিজেই বলেছেন ‘of all books I like this the best’.
সমাজের কুশ্রীতা, কদর্যতা, নীচতার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নির্মম কশাঘাত করেছেন। দ্য মিস্ট্রি অব এডুইন ডুড হল চার্লসের সর্বশেষ রচনা। কিন্তু সম্পূর্ণ করবার মত আয়ু পাননি। তাই যে রহস্য নিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন তার সমাধান বা শেষ কথা আর বলে যেতে পারেননি। তার আগেই প্রিয় পৃথিবীর মায়াকাটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। একসময় চার্লস ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর শৈশবের স্বপ্নভূমি কেন্টের গির্জা সংলগ্ন সমাধি ক্ষেত্রে তাকে যেন সমহিত করা হয়।
চ্যাথাম আর রচেস্টারের মাঝে কেন্টের গ্যাডস হিল প্লেসই ছিল তাঁর শেষ আবাসস্থল। এখানে তাঁর সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই কন্যা মেমি ও কেটি। তাঁর শেষ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে সমাহিত করা হয়েছিল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের পোয়েটনে কর্নারে।