৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
“আমেরিকার এ গান্ধী আবির্ভূত হয়েছিলেন এক শ্রান্ত মায়ের ক্লান্ত পা দুখানির দিকে তাকিয়ে।” ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আমেরিকার মন্টগোমারি শহরের সিটি লাইন্সের বাস চলেছে। বাসের সব আসন পূর্ণ। সামনের দিকে বারোজন শ্বেতাঙ্গ, পেছনে চব্বিশজন নিগ্রো। মার্কিন দেশের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসবার অধিকার নেই নিগ্রোদের। সমস্ত বাসই সংরক্ষিত থাকে শ্বেতাঙ্গদের জন্য। শ্বেতাঙ্গরা বসবার পর যদি কোন আসন খালি থাকে। তবেই সেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা বসতে পারবে।
বাস এক জায়গায় দাঁড়াতেই তিনজন শ্বেতাঙ্গ গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন দেবার জন্য আদেশ দিলেন। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন দেবার জন্য আদেশ দিলেন। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ উঠে দাঁড়াল। কিন্তু নিজের আসন ছেড়ে এতটুকু নড়ল না একটি নিগ্রো মেয়ে। নাম রোজা পার্ক। এক দরজির দোকানে কাজ করে। রোজা স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠল, আমি আসন ছাড়ব না।
এ স্পষ্টতই সরকারী আইন-লঙ্ঘন। রোজাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। তাকে দশ ডলার জরিমানা করা হল। নেহাতই সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল নিগ্রো ধর্মযাজক। তারা ডাক দিলেন আন্দোলনের। বিচিত্র সেই আন্দোলন। কোন নিগ্রো আর সরকারী বাসে চড়বে না।
পরের সোমবার থেকে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। মন্টগোমারির কোন নিগ্রো আর বাসে চড়লেন না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাইকেলে করে পরিচিত কারোর গাড়িতে ভাগাভাগি করে যাতায়াত করতে থাকে। রোজার কণ্ঠে সেদিন প্রথম যে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদের ভাষাকে হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন একটি মানুষ। অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র আমেরিকার লক্ষ লক্ষ নিগ্রো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হল সেই মানুষটির নাম মার্টিন লুথার কিং। যিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে আমেরিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্য এনেছিলেন মুক্তির আলো। তারই মূল্য দিতে শেষ পর্যন্ত গান্ধীর মতই নিজেকে আত্মহুতি দিতে হল।
১৯২৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি আমেরিকার দক্ষিণের মন্টগোমারি রাজ্যের আটলান্টা শহরে এক নিগ্রো যাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-পিতামহ দুজনেই ছিলেন ধর্মযাজক। পিতামহ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন। কিং এর পিতাও ছিলেন সংবেদনশীল প্রতিবাদী মানুষ। পিতা-পিতামহের আদর্শেই শিশুকাল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিং।
জন্মের পর বাবার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল মাইকেল কিং। ছ বছর বয়েসে পিতা মাইকেল ঠিক করলেন নাম পরিবর্তন করবেন। পুত্রের নতুন নাম রাখা হল মার্টিন লুথার কিং। একদিন খ্রিস্টান ধর্মের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সেই ধর্মযাজককে নিজের পুত্রের মধ্যে বোধহয় নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন পিতা। ছেলেবেলা থেকেই কিং ছিলেন শান্ত, ধীর, অনভূতিপ্রবণ। স্বাভাবিক চেতনা জন্ম নিতেই তিনি অনুভব করলেন চারপাশের জগতে রয়েছে বৈষম্য আর ঘৃণা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা তাদের ঘৃণা করে। ট্রামে-বাসে, স্কুলে, কলেজেপথে, ঘাটে, চাকরিতে সর্বত্র রয়েছে সারিতে বসবে শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা, পেছনের বেঞ্চে বসবে নিগ্রোরা। এই সব ঘটনা গভীরভাবে বিচলিত করত কিংকে। একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা আমাদের ঘৃণা করে কেন? মা বেদনাহত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, আমাদের চামড়ার রং যে কালো। তাই ওরা আমাদের ঘৃণা করে নিগার বলে। পরিণত বয়েসে কিং ছেলেবেলার স্মৃতি স্মরণ করে লিখেছেন, “যখনই আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম একই সমাজে কেন আমাদের আলাদা হয়ে থাকতে হবে, মা উত্তর দিতেন, একদিন এই বৈষম্য শেষ হবেই। আমিও বিশ্বাস করতাম এই অন্যায়ের প্রতিকার হবেই। কিন্তু কেমন করে হবে তাই শুধু ভাবতাম।”
ছাত্র হিসাবে কিং ছিলেন খুবই মেধাবী। আটলান্টা পাবলিক স্কুল থেকে পাশ করে মোরাহাউজ কলেজে ভর্তি হলেন। ছাত্র অবস্থায় কিং-এর ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হলে তিনি নিগ্রোদের সেবা করতে পারবেন। পিতা-পিতামহ ধর্মযাজক হলেও ধর্মের প্রতি তার তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু কলেজে পড়বার সময় দার্শনিক থেরোর লেখা “Civil Disobedience” বইটি তার মনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং তারপরেই তিনি মনস্থির করলেন ধর্মযাজকের জীবন গ্রহণ করবেন। ধর্মযাজক হিসাবেই নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন।
কলেজ থেকে পাশ করবার পর ১৯৪৮ সালে ১৯ বছর বয়সে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার ক্রোজার থিওলজিক্যাল সেমিনারিতে ভর্তি হলেন। এ এক ভিন্ন পরিবেশ। এখানে শ্বেতাঙ্গ ও নিগ্রো ছাত্ররা একই সাথে পড়াশুনা করত, কোন বর্ণবৈষম্য ছিল না। পড়াশুনায় বরাবরই মনোযোগী ছাত্র ছিলেন কিং। এখানে ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকের সাথে দেশ-বিদেশের দার্শনিকদের রচনাবলী পড়তে আরম্ভ করলেন। পড়লেন বিভিন্ন দেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। তবে যাঁর জীবন রচনা তাঁর মনকে অধিকার করে নিল তিনি ভারতের মহাত্মা গান্ধী। তিনি বলতেন, নাজারেথের যীশু আর ভারতের গান্ধী আমার জীবনসর্বস্ব। যীশু পথ দেখিয়েছেন, গান্ধী প্রমাণ করেছেন সেই পথ পাঠ আমি পেয়েছিলাম বাইবেল ও খ্রস্টের জীবন আর উপদেশের মধ্যে। আর এই প্রতিরোধের পদ্ধতিটি পেয়েছিলেন গান্ধীর কাছ থেকে।
ক্রোজার থিওলজিক্যাল সেমিনারি থেকে স্নাতক হওয়ার পথ তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ডিগ্রি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তার জীবনে আরো একটি প্রাপ্তি ঘটেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ছাত্রী ছিলেন কোরো স্কট নামে একটি তরুণী। কিং– এর সাথে প্রথম পরিচয়ে মুগ্ধ হন স্কট। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার আগেই ১৯৫৩ সালে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ডেক্সার গ্র্যাভিনিউয়ের ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক হিসাবে যোগদান করলেন।
ছাত্র অবস্থা থেকেই নিগ্রো আন্দোলনের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। ধর্মর্যাজুক হিসাবে যোগদান করবার পর থেকে তিনি সরাসরি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেন। সেই সময় নিগ্রোদের প্রধান সংগঠন ছিল National Association for the Advancement of Coloured People (N A A C P)। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিং-এর দাদু। সেই সূত্রে এবং নিজের ব্যক্তিত্বে অল্পদিনের মধ্যেই এই এ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন কিং।
১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে শুরু হল ঐতিহাসিক বাস ধর্মঘট। সমস্ত নিগ্রোদের তরফে দাবি তোলা হল (১) বাসে নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যে বৈষম্য আছে যে প্রত্যাহার করতে হবে, (২) বাসে যে আগে উঠবে সে আগে বসবে, (৩) নিগ্রোদের সাথে ন্দ্র ব্যবহার করতে হবে, (৪) নিগ্রো এলাকা দিয়ে যে সব বাস চলাচল করে সেই সব বাসের ক্ষেত্রে নিগ্রো ড্রাইভার নিযুক্ত করতে হবে।
নিগ্রোদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন নিগ্রো খ্রীস্টান ধর্মযাজকরা। প্রতিষ্ঠা হল মন্টগোমারি ইমপ্রুভমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন। মার্টিন লুথার কিংও এর সভাপতি নির্বাচিত হলেন। তিনি এক প্রকাশ্য সমাবেশে সমস্ত নিগ্রোদের উদ্দেশ্যে বললেন যতদিন না মন্টগোমারি বাস কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের দাবি না মেনে নেওয়া হচ্ছে ততদিন একটি নিগ্রোও বাসে উঠবে না।
প্রায় এক বছর নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিগ্রোরা সমস্ত সরকারী বাস বয়কট করে। কর্তৃপক্ষ বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত নিগ্রোদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হলেন। সুপ্রীম কোর্ট বাসের এই বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করল। অবশেষে M 1 A-এ সমস্ত দাবি মেনে নেওয়া হল। বাসে নিগ্রোদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল।
এই জয়ের পেছনে কিং-এর অবদান ছিল বিরাট। তিনি নিগ্রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তাদের সাহস দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাকে নানাভাবে ভয় দেখানো হতে থাকে। এমনকি একদিন তার বাড়িতে বোমা ফেলা হল। কিন্তু কোন কিছুর কাছেই মাথা নত করলেন না কিং। পুলিশ নানাভাবে তাকে বিব্রত করতে থাকে। এমনকি তিনি নিগ্রোদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন বলে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে আদালত থেকে ছেড়ে দেওয়া হল।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিগ্রোদের কাছে হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন শান্তি আর অহিংসায়। তিনি অন্তরে অনুভব করতেন ন্যায় ও সত্যের সপক্ষে যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন তা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই করছেন। শ্বেতাঙ্গরা। তাঁকে বিদ্রূপ করে বলত নিগ্রো ধর্মগুরু।
মন্টগোমারির বাস আন্দোলনে এই গৌরব-উজ্জ্বল ভূমিকায় কি-এর নাম ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আমেরিকায়। তাঁর এই অহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে এল বহু নিগ্রো নেতা। সমস্ত আমেরিকা জুড়েই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতবািদ জেগে উঠতে থাকে।
১৯৫৭ সালে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশের নিগ্রো নেতৃবৃন্দ এবং তাছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারের নিগ্রো মন্ত্রীরা মিলিত হলেই আটলান্টা শহরে। নিগ্রোদের সামাজিক ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরো জোরদার করবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হল Southern Christian Leadership Conferance. 77769 TETT S.C.L.C. 1 Tifua লুথার এর সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন, তখন তার বয়স মাত্র ২৮।
কৃষ্ণাঙ্গদের দাবির সপক্ষে ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। ঘানার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উৎসবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন মার্টিন লুথার ও আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এখানে দুই নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ হল। নিক্সন নিগ্রোদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এক বছর পর রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে মিলিত হলেন কিং ও অন্যসব নিগ্রো নেতারা। বেশ কয়েকবার আলোচনা বৈঠক বসবার পরেও কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভবপর হল না। সরকারের অধিকাংশ প্রস্তাবই তাদের সপক্ষে মনোমত হল না। কি-এর ভাষায় This is no real or meaningful settement..
দেশের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের আচরণে ক্রমশই বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, আইনগত ক্ষেত্রেও নানাভাবে নিগ্রোদের বঞ্চনা করা হত। বহু রাজ্যে নিগ্রোদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। সরকারী উচ্চপদে বসবার অধিকার ছিল না নিগ্রোদের। কিং আমেরিকার প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে প্রচার করতে লাগলেন, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অহিংসা আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য সমস্ত নিগ্রোদের কাছে আহ্বান জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে প্রায় প্রতিটি প্রদেশেই আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কিং হয়ে উঠলেন সমস্ত আমেরিকার নিগ্রো মানুষের অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জহরলালের আমন্ত্রণে ভারতবর্ষে এলেন কিং ও তার স্ত্রী। ভারতবর্ষ কিং-এর কাছে ছিল এক মহান দেশ। তিনি মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। কিং ভারত ভ্রমণ শেষ করে যখন আমেরিকায় ফিরে এলেন, আমেরিকা জুড়ে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নিয়েছে। নিগ্রোর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলেও শ্বেতাঙ্গরা হিংস্র হয়ে ওঠে। নিগ্রোদের মধ্যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। তারাও পালটা আক্রমণ শুরু করে। সর্বত্রই ভাঙচুর লুঠতরাজ গুলি লাঠি চলতে থাকে। কৃষ্ণাঙ্গদের উপর সমস্ত অভিযোগ এসে পড়ে।
কিছু কিছু কৃষ্ণাঙ্গ নেতা এই অহিংস আন্দোলনের পথ পরিত্যাগের জন্যে কিং-এর কাছে অনুরোধ জানায়। কিং জানতেন তাতে উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, শুধু রক্তপাতাই হবে। তিনি এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না। অল্প কিছুদিনের জন্যে ব্যাপটিস্ট মিশনের হয়ে ধর্মযাজকের কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তার কাছে ধর্ম ছিল মানবমুক্তির একটি পথ।
আমেরিকার ক্যারোলিনা, টেনিসি, ভার্জিনিয়া, আরো কয়েকটি প্রদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ক্যানটিনে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ালেন কিং। তাঁরই নির্দেশে অহিংস সত্যাগ্রহের পথ বেছে নিল ছাত্ররা। বহু শ্বেতাঙ্গ ছাত্রও এই দাবিকে সমর্থন জানাল। কয়েক মাস আন্দোলন চলবার পর প্রতিটি প্রদেশেই এই ঘৃণ্য প্রথাকে বিলুপ্ত করা হল। কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররা শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের সঙ্গে একই সাথে খাবার অধিকার পেল।
আটলান্টা প্রদেশের একটি বিখ্যাত দোকানে তখনো বর্ণবিদ্বেষী প্রথা চালু ছিল। সেখানকার ক্যানটিনে কৃষ্ণাঙ্গদের কোন খাবার অধিকার ছিল না। কিং পঁচাত্তরজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন। তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে খাবার চাইলেন। কিন্তু তাদের সে অনুরোধ রক্ষা করা হল না। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় কিং ও আরো কিছু ছাত্রকে বন্দী করা হল। সেই সময় কেনেডি নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর অনুরোধে কিংকে ছেড়ে দেওয়া হল।
ইতিমধ্যে সমস্ত দেশ জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের সামগ্রিক অধিকার লাভের আন্দোলন গড়ে তোলবার প্রয়োজনীয়তা দেখা গিয়েছিল। সমস্ত দল মিলিতভাবে গড়ে তুলল A Freedom Rird Co-ordinating Commitee। কিং হলেন তার চেয়ারম্যান।
বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ কিংকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াবার জন্যে আহ্বান করতে থাকেন। নির্ভীক কিং সর্বত্রই ছুটে গিয়েছেন। এক এক সময় তাঁর জীবন বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর শ্বেতাঙ্গরা হিংস্রভাবে আক্রমণ করে। সামান্যের জন্য রক্ষা পেয়েছেন কিং। তবুও একটি বারের জন্যেও তিনি হিংসার একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
১৯৬৩ সালে তিনি SCLC-র বার্ষিক অধিবেশনে দেশের সর্বত্র পিকেটিং এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করবার ডাক দিলেন। তিনি সহযোগী সাধারণ মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে অর্থ সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন। যাতে আন্দোলনে আহত, নিহত বন্দী মানুষদের পরিবারকে সাহায্য করা হয়।
কিংকে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেপিয়ে তোলবার অভিযোগে বন্দী করা হল। কিং এর ভাই একটি চার্চে প্রার্থনা শেষ করা হল এর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলো।
২ মে প্রায় ৬০০০ স্কুল ছাত্র স্কুলে বৈষম্যের প্রতিবাদে প্রতিবাদ মিছিল বার করল। প্রায় ১০০০ ছাত্রকে বন্দী করা হল। পরদিন আরো বহু স্কুলের ছেলেমেয়েরা জমায়েত হল একটি চার্চে। স্থানীয় পুলিশ হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছোট ছোট ছেলেমেয়ের উপর। শত শত ছাত্র আহত হল।
আন্দোলন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছল স্থানীয় গভর্নর কিং-এর সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হল। কিং-এর ডাকে সাময়িকভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। স্কুলে বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হল। এর প্রতিবাদে শ্বেতাঙ্গরা ফেডারেল স্কুলে বোমা ফেলল। বহু নিগ্রো শিশু আহত হল, চারজন মারা গেল। ভয়াবহ দাঙ্গা দেখা দিল। কিন্তু শান্তি আর সত্যের পথে অবিচলিত কিং ছুটে গিয়েছেন দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে। তিনি এইবার স্থির করলেন দেশ জুড়ে শুরু করবেন ফ্রিডম মার্চ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওয়াশিংটনে পদযাত্রা শুরু হল। ১৯৬৩ সালের ২৭শে আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালে সমবেত হল প্রায় আড়াই লক্ষের বেশি নিগ্রো। তাদের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন কিং, আমি স্বপ্ন দেখছি…।
সেই বছর টাইমস পত্রিকার তরফে কিংকে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পুরস্কার দেওয়া হল। কিং শুধু আমেরিকার নন, বিশ্বের মানবতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছেন। বার্লিনের মেয়র উইলি ব্রান্টির আমন্ত্রণে জামার্নীতে গেলেন। সেখানে তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান দেওয়া হল। তাকে সম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হল।
১৯৬৪ সালে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। গান্ধীর মতই তিনি জীবন কর্ম সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন শান্তির পূজারী। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৫ বছর। পুরস্কারের সমস্ত অর্থই তিনি নিগ্রোদের মুক্তি আন্দোলনে দান করলেন।
নিগ্রোদের মানবাধিকারের এই আন্দোলন বিশ্বের সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রেসিডেন্ট জনসন নিগ্রোদের বহু দাবি স্বীকার করে দিলেন। এর মধ্যে ছিল নিগ্রোদের ভোটাধিকার।
১৯৬৫ সালে আমেরিকা ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। শান্তির পূজারী কিং ছিলেন যুদ্ধের বিপক্ষে। ভিয়েনামের মত একটি ছোট দেশের উপর আমেরিকার এই আক্রমণকে মেনে নিতে পারলেন না কিং। দেশ জুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিগ্রোদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর শ্বেতাঙ্গরা হিংস্রভাবে আক্রমণ করছিল। নিগ্রোরাও এর বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণ শুরু করল। সর্বত্রই অহিংস সত্যাগ্রহ হিংসাত্মক আন্দোলনে পরিণত হল। এতে ব্যথিত হতেন কিং। তিনি বার বার সকলকে শান্ত সংযত থাকবার জন্য আহ্বান জানাতেন।
আমেরিকা ক্রমশই ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বের বহু বুদ্ধিজীবী মানুষের সাথে কিংও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে তিনি ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরোধী পদযাত্রা করবার আহ্বান জানালেন আমেরিকার সমস্ত শান্তিকামী মানুষকে। এরই সাথে তিনি ঘোষণা করলেন ২৭শে এপ্রিল দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করবার জন্য আর্থিক নিরাপত্তার দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত দরিদ্র মানুষদের সাথে নিয়ে তিনি ওয়াশিংটন অভিযান করবেন।
শান্তি অভিযানে সেদিন হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল শান্তির আহ্বান।
মেমপিস টেনেসি রাজ্যে নিগ্রো পৌরকর্মীরা শ্বেতাঙ্গদের সমান মাইনে ও কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়াবার জন্য আন্দোলন করছিল। কিং সেখানে গেলেন। কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের একটি দাবিও মেনে নিলেন না। কিছু অল্পবয়সী ছেলে এর প্রতিবাদে ভাঙচুর শুরু হয়ে গেল। পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন মারা পড়ল।
৩রা এপ্রিল কিংকে হত্যার হুমকি দেওয়া হল। তাঁর সহকর্মীরা তাকে অন্যত্র চলে যেতে বললেন। কিন্তু অকুতোভয় কিং বললেন তার যাই ঘটুক না কেন তিনি এখান থেকে যাবেন না। সকলকে হিংসা ত্যাগ করবার আহ্বান জানালেন।
পরদিন তিনি যখন হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আততীয়র বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। সন্ধ্যে সাতটায় চিরশান্তির প্রতীক মার্টিন লুথার কিং তার আদর্শ খ্রীস্ট, গান্ধীর মতই হিংস্র মানুষের হিংস্রতার কাছে আত্মাহুতি দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তখন তিনি ঊনচল্লিশ বছরের এক যুবক।