৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
ফ্রান্সের বার্গাভী প্রদেশের একটি ছোট শহর ক্লামেসি। ১৮৬৬ সালের ২৯শে জানুয়ারি এই শহরেই জন্ম হয়েছিল সমান ফরাসী সাহিত্যিক মানবতার পূজারী রম্যাঁ রোলাঁর। জনা থেকেই ছিলেন রুগ্ন অসুস্থ। জীবনের কোন আশা ছিল না। কিন্তু মায়ের স্নেহ ভালবাসা যত্নে মৃত্যুকে জয় করলেন রোলাঁ। কিন্তু মা রক্ষা করতে পারলেন না তার কোলের মেয়েটিকে। দু বছর বয়েসে মারা গেল একমাত্র কন্যা। রোলাঁর বয়স তখন পাঁচ। প্রথম মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করলেন।
নিজের জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “আমার শৈশব যেন মৃত্যুর ছায়াঘেরা এক বন্দীশালা।” এই বন্দীশালার জগৎ থেকে যিনি রোলাঁকে মুক্তির জগতে নিয়ে এলেন তিনি রোলাঁর মা। রোলাঁর জীবনে মা বাবা দুজনেরই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। তবে মায়ের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। মা ছিলেন ধর্মপরায়ণ, সৎ পরিশ্রমী আর ছিল সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগ। বাবা ছিলেন স্বাধীনচেতা আদর্শবাদী, ধর্ম সম্বন্ধে কোন মোহ ছিল না তার। পিতা-মাতার এই পরস্পর বিরোধী মনোভাবের কারণেই সুদীর্ঘকাল রোলাঁকে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়েছে।
রোলাঁ ছিলেন রুগ্নদেহ। ঘরের বাইরে বড় একটা যেতেন না। চার-দেওয়ালের নিঃসঙ্গতারকে ভোলবার জন্য মা তাঁকে সঙ্গীতের জগত নিয়ে গেলেন। রোলাঁর মা পিয়ানোতে ছিলেন দক্ষ শিল্পী। মায়ের পিয়ানো শুনতে শুনতে সঙ্গীতের মধ্যে তার এক সহজাত দক্ষতা ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই মোৎসার্ট বিঠোফেনের সঙ্গীতের মধ্যে তিনি আত্মস্থ হলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “তাদের তাছে আমি ঈ। যখনই আমার মন সংশয় আর ব্যর্থতার ভারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, বিঠোফোনের সঙ্গীত আমার অন্তরে নবজীবনের দীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছে।…শুষ্ক জমিতে বৃষ্টিধারার মত জার্মান সঙ্গীত আমার হৃদয়ের শুষ্কতার বুকে বারিধারা এনে দিয়েছে…মোৎসার্ট বিঠোফেন আমার জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে আছে। যখন শিশু ছিলাম, প্রতিমুহূর্তে মনে হত মৃত্যু এসে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। মোৎসার্টের একটি সুর আমাকে যেন পাহারা দিত।”
রোলাঁ শৈশবে পা দিলেন। ক্লামেসি শহরে ভাল কোন স্কুল ছিল না। প্রথমে বাবা ঠিক করলেন রোলাঁকে প্যারিসে পাঠাবেন, কিন্তু একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকতে চাইল না।
রোলাঁর বাবা ছিলেন শহরের নামকরা নোটারী। আর্থিক উর্পাজন ভালই হত। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নোটারীর কাজে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে একটা ব্যাঙ্কে সাধারণ চাকরি নিয়ে বাস করলেন।
রোলাঁ ভর্তি হলেন প্যারিসের সবচেয়ে নামকরা স্কুল লিসেতে। কিন্তু স্কুলের নিয়মবাধা জীবন ভাল লাগত না তাঁর। মাঝে মাঝে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত। এই স্কুলেই। পরিচয় হল পল ক্লডেলের সাথে। উত্তরকালে দুজনেই হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের চিন্তাজগতে খ্যাতিমান পুরুষ।
রোলাঁ ছাত্র অবস্থাতেই আকৃষ্ট হলেন সঙ্গীতশিল্পী ভাগনারের প্রতি। তাঁর মনে হয়েছিল তিনিও ভাগনারের মত শিল্পী হবেন। কিন্তু মা-বাবা চাইলেন ছেলে যেন নিজের পায়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। তার জন্যে এমন কিছু শিক্ষার প্রয়োজন যা অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবে।
লিসের স্কুলের পাঠ করে রোলাঁ ভর্তি হলেন নর্মাল স্কুলে। এই স্কুল ছিল ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল। এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা পড়াশুনার মনোযোগের প্রতি জোর দেওয়া হত। এখানে সাহিত্য দর্শন ইতিহাসের মধ্যে প্রথম রোলাঁ খুঁজে পেলেন কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং আদর্শ শিক্ষক। এই শিক্ষকদের কাছ থেকে রোলাঁ পেয়েছিলেন এক উদার সংস্কারমুক্ত মানসিকতা। তার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে হয়েছিলেন ফ্রান্সের মুক্তিদের মুক্তিপথের দিশারী।
নর্মাল স্কুলে পড়বার সময় রোল ছিলেন গভীর মনোযোগী ছাত্র। ক্লাসের পাঠ্য পুস্তকের বাইরে পড়তেন তলস্তয়, শেকস্পীয়র, হোমার, শুনতে জাগনারের সঙ্গীত। সঙ্গীত আর সাহিত্য ধীরে ধীরে তার মধ্যে সৃষ্টি করছিল এক নতুন জগৎ। সঙ্গীতের সাথে সাহিত্যের প্রতিও ছিল তার আজন্ম আকর্ষণ। যখনই সময় পেতেন কবিতা লিখতেন। সাহিত্য, সঙ্গীতের উপর প্রবন্ধ লিখতেন।
এই সময় রোলাঁর মানস জগতে ঘটল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রোলাঁর আদর্শ ছিলেন মহান রুশ লেখক তলস্তয়। তাঁর রচনা সমস্ত তরুণদের উদ্দীপিত করত। প্রতিটি লেখা রোলাঁ মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়তেন। হঠাৎ প্রকাশিত হল তলস্তয়ের একটি প্রবন্ধ ‘কি করতে হবে? (What is to be done)। এতে তলস্তয় সমস্ত শিল্প সাহিত্যকে তীব্রভাষায় আক্রমণ করলেন, বললেন, বিঠোফেনের সঙ্গীত ইন্দ্রিয়ের কামনা সৃষ্টি করে। শেকস্পীয়র একজন নিকৃষ্ট কবি, অকেজো ব্যক্তি। সঙ্গীত এক চূড়ান্ত বিলাসিতা যা মানুষকে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করে।
তলস্তয়ের এ মন্তব্যে বিচলিত হয়ে পড়লেন রোলাঁ। তার চিন্তামানসলোকে এতখানি ঝড় তুলল শেষ পর্যন্ত তিনি তলস্তয়কে একটি চিঠি লিখলেন। উত্তর পাবেন এমন আশা ছিল না। কিন্তু কয়েক মাস পর অপ্রত্যাশিতভাবে চিঠি এল। ১৪ অক্টোবর ১৮৮৭…প্রিয় ভ্রাতা, তোমার চিঠি পেলাম…প্রকৃত শিল্পীর প্রেরণা শিল্পের প্রতি ভালবাসা থেকে জন্মায় না, জন্মায় মানবজাতির প্রতি ভালবাসা থেকে। একজন প্রকৃত মানবপ্রেমিকই পারে মহৎ সৃষ্টি করতে।
এই চিঠি রোলাঁর ভবিষ্যৎ জীবনে এক নতুন আলো দিয়েছিলেন–তিনি সমস্ত জীবন এই আদর্শকেই শিল্পীর ধর্ম বলে মনে করেছেন। তাই পৃথিবীর যে দেশে মানবতা নিষ্পেষিত হয়েছে…মানুষ বিপন্ন হয়েছে, তিনি নির্ভীক চিত্তে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
নর্মাল স্কুলের জীবন শেষ হল। প্রতি বছর এই স্কুলের কয়েকজন ছাত্রকে গবেষণার জন্য বৃত্তি দেওয়া হত। রোলাঁ সেই বৃত্তি পেলেন। তাঁকে প্রাচীন ইতিহাসের গবেষণার জন্য যেতে হল রোমে। পুঁথি-পত্র ঘেঁষে গবেষণায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না রোলাঁর। তিনি ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করতেন সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেখলেন ইতালির বিখ্যাত শিল্পকলা। ধীরে ধীরে তার মানসলোক এক পরিপূর্ণতার পথে এগিয়ে চলে। রোমে শেকস্পীয়রের নাটকের অভিনয় দেখে তার মনের মধ্যে নাটক লেখবার অনুপ্রেরণা জেগে ওঠে। বেশ কয়েকটি নাটক লেখেন। এগুলোর সাহিত্যিক মূল্য ছিল নিতান্তই কম। তাই পরবর্তীকালে নিজেই এই নাটকগুলোকে বর্জন করেন রোলাঁ।
ইতালিতে থাকার সময় রোলাঁর সাথে পরিচয় হয় মালভিদাভন মাইসেনবুর্গের সাথে। বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার জন্য এই মহিলাকে জার্মানী থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাকে সে যুগের সব বিখ্যাত মানুষেরাই শ্রদ্ধা করতেন। এই বৃদ্ধার সাথে পরিচয় রোলাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো ব্যাপ্ত করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বৃদ্ধা মালভিদা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন রোলাঁর মধ্যেকার প্রতিভা। তিনি লিখেছেন,”আমি এই তরুণের মধ্যে এমন এক উচ্চ আদৰ্শ ও মেধা দেখেছি, যার প্রকাশ দেখেছি শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কদের মধ্যে।”
দু বছর ইতালিতে কাটিয়ে তিনি ফিরে এলেন প্যারিসে। নর্মাল স্কুলে সঙ্গীত শিক্ষকের চাকরি পেলেন। এখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করবার পর ১৯০৩ সালে তিনি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও ইতিহাসের অধ্যাপকের পদ পেলেন।
শিক্ষকতার সাথে সাথে সঙ্গীতের উপর বেশ কয়েকটি বই লিখলেন–Oid musi cians, Haended, History of opera, Musicians of today. এই বইগুলো মূলত ছাত্রদের জন্য লিখলেও তিনি এরই মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করলেন সঙ্গীদের মর্মবাণী। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে মানুষ দেশকাল সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে এক মহামানবের স্তরে।
অধ্যাপনার সাথে সাথে রোল অনুভব করতে চেষ্টা করতেন ফরাসী সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য শিল্পের মূল স্রোতধারা। কিন্তু যেদিকেই তাকাতেন, দেখতেন, সমস্ত সমাজ জুড়ে শুধু নিরাশা, হতাশা আর অবক্ষয়। ফরাসী সাহিত্যের সব দিকপাল স্রষ্টারাই চলে গিয়েছেন। যারা আছে তারা চটুল সাহিত্যের নেশায় ডুবে গিয়েছে। সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি আর অনাচার। ফরাসী বিপ্লবের মহান আদর্শ বিলীন হয়ে গিয়েছে। সমাজের বুকে যে সব শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিক রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছেন হতাশার অন্ধকারে।
এরই মধ্যে আবির্ভাব হল কয়েকজন তরুণের যারা এই অন্ধকারের বুকে জ্বালাতে চান নতুন আলো।
তাদের প্রধান হলেন রোলাঁ, তাঁর সঙ্গী হলেন পেগী স্যুয়ারে। এরা সকলেই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, কারোরই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তবুও সকলের মিলিত চেষ্টায় প্রকাশিত হল একটি পত্রিকা Cabiers de la guinzaine-রোলাঁ তার সম্পাদক। এই পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন দেওয়া হত না, বাজারে ফেরি করা হত না। আগ্রহশীল কিছু পাঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বিতরণ। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকটি রচনা–জা ক্রিস্তফ, বিঠোফেন, মিকেলেঞ্জলো–এই পত্রিকায় লেখার জন্য কখনো একটি পয়সাও নেননি। দীর্ঘ পনেরো বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
রোলাঁ ছেলেবেলায় সঙ্গীতের সাথে ভালবেসেছিলেন শেকস্পীয়রকে। পরিণত বয়েসে এসে অনুভব করতে পারছিলেন নাটকের গুরুত্ব। সমাজকে নাটক কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে তারই ভাবনায় ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ এই পাঁচ বছরে তিনি লিখলেন তিনটি নাটক– Saint Louis, Aert, Triomphe de la Raison। এই নাটকগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সমাজ, জাতি ও মানুষদের উপর বিশ্বাস। এর উৎস ছিল ফরাসী বিপ্লব। এর পরে আরো কয়েকটি নাটক লিখলেন। এই নাকটগুলোর নাম ট্রাজেডিস অব ফেথ (Tragedies of Faith)।
কিন্তু ক্রমশই তিনি অনুভব করতে পারছিলেন তাঁর নাটকে যেন জনগণের প্রাণের স্পর্শ নেই। এ নাটক যেন শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের জন্যে লেখা হয়েছে। তিনি স্থির করলেন এবার নাটক লিখবেন সাধারণ মানুষের জন্য, জনগণের জন্য। এক নতুন আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করলেন তাঁর নাটক লেখা। তিনি এই পর্যায়ের নাটকের নাম দিলেন গণনাট্য (People’s Theatre)। লিখলেন, Les Loups (১৮৯৮), Lc0uatarze Jullet.এই পর্যায়ে তার শ্রেষ্ঠ নাটক ১৪ই জুলাই। এই নাটকে নায়ক ডাক দিয়েছে বাস্তিল দুর্গ ভেঙে ফেলবার। এ যেন ফরাসী বিপ্লবের ডাক নয়, এ যেন তৎকালীন সমাজের সমস্ত অবক্ষয়কে ভেঙে ফেলবার ডাক।
কিন্তু ফরাসী সমাজ তখন আফিমের নেশার মত এক আত্মতৃপ্তিতে ডুবে আছে। রোলাঁর উদাত্ত আহ্বান কারো কানে পৌঁছাল না। কোন নাটকই মঞ্চে সফল হল না। অল্প কয়েকদিন চলবার পরেই তা বন্ধ হয়ে গেল। এরই সাথে সমালোচকদের তীব্র সমালোচনা…রোলাঁর সমস্ত পরিশ্রম যেন ব্যর্থ হয় গেল। আসলে রোলাঁর নাটক এক একটি ভাব আদর্শের প্রতীক। সমাজের সাধারণ মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ তাতে স্থান পায়নি। তার দৃষ্টি ছিল আকাশের দিকে। মাটি সেখান থেকে অনেক দূর। তাই তার নাটক মাটির মানুষেরা গ্রহণ করতে পারেনি।
এই পরাজয়ে সাময়িক ভেঙে পড়লেও হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাবার মানুষ ছিলেন না রোলাঁ। অল্পদিনের মধ্যেই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আসলে নিজের আদর্শের প্রতি রোলাঁর ছিল গভীর বিশ্বাস। কোন কারণেই সেই আদর্শ থেকে কখনো বঞ্চিত হননি।
এই সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নেমে এল অশান্তির কালো মেঘ। বিবাহ করেছিলেন কিন্তু বিবাহ সুখের হয়নি। ১৯০৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ক্রমশই সমাজ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন রোলাঁ। আসলে মনের মধ্যে তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল নতুন সৃষ্টির প্রেরণা। কিন্তু সমস্যা হল কি লিখবেন! হঠাৎ মনে হল তিনি লিখবেন সেই সব মানুষদের কথা যারা সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বিশ্বাস হারাননি। যার ছিলেন অটল ধৈর্য আর সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। শুরু করলেন বিঠোফেন। এর ভূমিকায় লিখেছেন চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কর্ম আর নোংরা আবহাওয়ার মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সব জানলা খুলে দাও! স্বর্গীয় বাতাস এসে ভরে যাক ঘর-দুয়ার। মহান মানুষদের স্বর্গীয় বাতাসের স্পর্শে আমাদের বুক ভরে উঠুক।
রোলাঁ তাঁর এই জীবনী রচনায় এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দিলেন। শুধু সাল তারিখ আর তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। লেখকের ভাব ভাবনা অনুভূতিই এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার কাছে বিঠোফেন শুধু একজন মহান সঙ্গীতকার নন, তার চেয়েও অনেক বড়। যিনি সমস্ত জীবন দুঃখের মধ্যে, যন্ত্রণার মধ্যে অতিবাহিত করেও সব দুঃখ-যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। বিঠোফেন প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে।
এরপর রচনা করলেন মিকেলেঞ্জলো (১৯০৬)। সেই সময়ের যুগকে ছবির মত করেই ফুটিয়ে তুলেছেন রোলাঁ। মিকেলেঞ্জলোর সৃষ্টি তার কাছে এক অতিমানবীয় শক্তির প্রকাশ। কিন্তু তার মধ্যে কোন সংগ্রামী চরিত্র খুঁজে পাননি রোলাঁ। তিনি শুধুই একজন মহৎ শিল্পী। তাই তাঁর বিঠোফেনের তুলনায় মিকেলেঞ্জলোর উত্তৰ্ষতা অনেক কম।
এর কয়েক বছর পর রোলাঁ আর একটি জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন–তলস্তয় (১৯১১)। এই সময়ে রোলাঁর মধ্যে অনেক পরিণতি এসে গিয়েছে। তাই তাঁর তলস্তয় অনেক পরিণত। যদিও তলস্তয়কে তিনি আদর্শ বলে গ্রহণ করেননি।
এই সব জীবনী গ্রন্থ রচনার আগে থেকেই তাঁর মন অন্বেষণ করছিল এক আদর্শ মানুষের, যে চিরসগ্রামী দুঃখের ভারে ভেঙে পড়ে কিন্তু নত হয় না। তাঁর মনের ভাবনা আদর্শের প্রকাশ ঘটল তার জগৎবিখ্যাত উপন্যাস জা ক্রিসফ-এ।
এই বইখানি লিখতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল রোলাঁর দশ বছর ধরে তিনি রচনা করেছেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস। প্রথম খণ্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে এবং শেষ খও বার হয় ১৯১২ সালে। এই সুদীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হলেও তার প্রতি জনগণের দৃষ্টি পড়েনি। এই বইয়ের মধ্যে ইউরোপের সমস্ত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীদের আত্মা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
জা ক্রিসফ সঙ্গীতশিল্পী পরিবারের সন্তান। তাদের কুটিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর কলতান…পিয়ানোর সুর তাকে মুগ্ধ করে। সঙ্গীত যেন মেশায় রক্তের মধ্যে, সঙ্গীতচর্চার মধ্যেই ধীরে ধীরে। বড় হয়ে জাঁ ক্রিসফ কুড়ি বছর বয়সে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করল। কিন্তু বিপ্লব ব্যর্থ হল। ক্রিসফ এল ফ্রান্সে। এখানে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল লেখক অলিভিয়ের সাথে। ক্রিসফ চায় শিল্পের মধ্যে বেঁচে থাকতে। অলিভিয়ের মনে হয় শিল্প জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের আশ্রয়স্থল। এক অন্তর্দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে ক্রিসতফের মনে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব রোলাঁর মনোজগতেরই প্রতিচ্ছবি।
ক্রিসতফ সরল উদাসীন, সঙ্গীতই তার কাছে একমাত্র অস্তিত্ব। সব কিছুর মধ্যেই সে যেন সঙ্গীতকে খুঁজে বেড়ায়। আশাহত হয় কিন্তু বিশ্বাস হারার না।
বৃদ্ধ হয়ে পড়ে ক্রিসফ। অসুস্থ দেহ। সব শক্তি হারিয়ে ফেলে। তবু তার মনে হয় একদিন সে আবার ফিরে আসবে নতুন সংগ্রামের জন্য। জা ক্রিসতফের মধ্যে রোলাঁর আত্মাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে।
১৯১২ সাল অবধি রোল ছিলেন প্রায় অজ্ঞাত। নাটক জীবনী প্রবন্ধ কোন কিছুই তাকে খ্যাতি পারেনি। কিন্তু জা ক্রিসফ প্রকাশিত হতে না হতেই তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে ক্রিসতফের মধ্যে আবিষ্কার করল তাদেরই জীবনের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা।
ইউরোপের বুকে তখন নেমে এসেছে যুদ্ধের ঘনঘটা। ১৯১৪…শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এই সময় ব্যক্তি রোলাঁর পরিচয় মুছে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন সমগ্র ইউরোপ তথা মানবজাতির বিবেকের প্রতিরূপ।
সমস্ত ইউরোপ জুড়ে যখন শুরু হয়েছে হানাহানি, হত্যা আর রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত আদর্শ, রোলাঁ তখন সুইজারল্যান্ডে। তখন তিনি আর কোন দেশের নন, সব দেশের সব মানুষের। রোলাঁ যোগ দিলেন আন্তজার্তিক রেডক্রসে। সৈনিকদের বাড়ি থেকে অসংখ্য চিঠি আসত সৈনিকদের সংবাদের জন্য। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংগ্রহ করতেন সৈনিকদের সংবাদ। প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা ধরে চিঠি লিখতেন।
রোলাঁর মনে হল এই মুহূর্তে শুধু সেবা নয়, সকলের আগে প্রয়োজন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হাওয়া। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি প্রকাশ করলেন “যুদ্ধের ঊর্ধ্বে। এই বই মুহূর্তে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি সৈনিকরাও এই বই পড়তে আরম্ভ করল। সাথে সাথে প্রথমে ফরাসী সরকার তারপর জার্মান সরকার এই বই নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু রোলাঁর কলম বন্ধ হল না। অবিশ্রান্তভাবে তিনি লিখে চললেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
ফ্রান্সের যুদ্ধবাজ মানুষেরা রোলাঁর এই মনোভাবের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠল। নিষিদ্ধ করা হল তার সমস্ত রচনা, তাকে বলা হল বিশ্বাসঘাতক, দেশের শত্রু জার্মানীর গুপ্তচর। তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করল। রোলাঁ জানতেন সত্যের সপক্ষে লড়াই করতে গেলে তাকে আরো নির্যাতন সইতে হবে। তিনি এবার দেশে-বিদেশের মনীষীদের কাছে আবেদন জানালেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্যে। কিন্তু একমাত্র আইনস্টাইন ছাড়া কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। এই সময়কার দিনলিপিতে রোলাঁ লিখেছেন, “আমার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। আমি যদি মরে যেতাম তাহলে ভাল হত। মানুষ যখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তখন বাঁচার প্রয়োজন কি?”
আবার তারই নিজের আদর্শবাদে চিরবিশ্বাসী রোল লিখেছেন–”এক বছর ধরে আমি অনেক শত্রু সৃষ্টি করেছি। তারা আমাকে ঘৃণা করতে পারে কিন্তু কেউ আমার মনের মধ্যে অন্যের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারবে না। আমার কাজ যা কিছু শুভ মানবিক, তারই প্রচার করা। তা অন্যের ভাল লাগুক বা না লাগুক তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।”
এমনকি রোলাঁ জার্মান লেখক বুদ্ধিজীবীদেরও চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু কেউ তাঁর সপক্ষে দাঁড়ায়নি। শুধু সৃষ্টি হল অসংখ্য শত্রু।
এরই মধ্যে ১৯১৫ সালে রোলাঁকে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। রেডক্রসের কাজ করবার সময় অনুভব করেছিলেন তাদের অর্থের প্রয়োজন। নিজের প্রয়োজনের জন্য একটি কপর্দকও নেননি রোলাঁ। সমস্ত অর্থই তুলে দিলেন রেডক্রসের হাতে।
অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। বিজয়ীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। তাদের মত্ততা অহঙ্কার গর্বকে ভাল চোখে দেখেনি রোলাঁ। তাঁর মনে হয়েছিল এ ভবিষ্যৎ আরেক যুদ্ধের ইঙ্গিত।
যুদ্ধের শেষে রোলাঁ রচনা করলেন Declaration of Indipendence of the Mind (মানবাত্মার স্বাধীনতার ঘোষণা)। এতে ইউরোপের বহু মনীষী স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন রোলাঁ যদিও তখনো তাঁদের মধ্যে পরিচয় হয়নি।
ভারতবর্ষ থেকে স্বাক্ষর করলেন রবীন্দ্রনাথ ও আনন্দকুমার স্বামী।
যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন রোলাঁ। তার মনে হয় এর থেকে মুক্তির পথ কোথায়? গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন প্রাচ্যের মহান আদর্শে।
যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যখন চারদিক থেকে ঘৃণিত নিন্দিত তখনই প্রথম ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। অজস্র বই পড়েন ভারতীয় দর্শন ধর্ম সংস্কৃতি সম্বন্ধে। যুদ্ধের পরবর্তীকালে রোলাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করলেন ভারত-আত্মার মূর্ত বাণীকে। দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। যা আমৃত্যু বজায় ছিল।
তবে যিনি ভারতবর্ষের এক পূর্ণাঙ্গ ছবি রোলাঁর কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি দিলীপকুমার রায়। দিলীপ রায়ের কাছেই রোলাঁ প্রথম গান্ধীর কথা শোনেন। তারপর লিখলেন গান্ধীর জীবনী। তিনি লিখলেন, “আমি অনুভব করছিলাম ইউরোপের বুকে ঝড়ের পূর্বাভাস। নিজের জন্য আমি চিন্তিত নই। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে আশ্রয় খুঁজেছি আমার প্রিয়জনদের জন্যে, ইউরোপের মানুষের জন্যে। এই সময় দেখতে পেলাম ভারতের বুকে জীর্ণ শীর্ণ দেহ একটি মানুষ আত্মিক বলের ঝড় তুলেছেন…যে আদর্শ সেই সময় আমার মনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল তা গান্ধীর।” ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হল গান্ধীচরিত।
রোলাঁ গান্ধীর প্রতি এতখানি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার কারণ গান্ধী যা চেয়েছিলেন তাই তিনি করতে পেরেছিলেন। তাই রোলাঁ বলেছেন তলস্তয় যেখানে ব্যর্থ গান্ধী সেখানে সফল।
এর পরবর্তীকালে তিনি আকৃষ্ট হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনী। রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন অধ্যাত্ম সাধনা আর মানব প্রেমের এক সম্মিলিত রূপ। বিবেকানন্দের মধ্যে পেয়েছিলেন তার কর্মের বাণী।
একদিন যখন রোলাঁ প্রাচ্যের ধ্যানে মগ্ন, অন্যদিকে তখন তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন যুদ্ধরোত্তর ইউরোপের এক জীবন্ত চিত্র ‘বিমুগ্ধ আত্মা’ উপন্যাসে। এর প্রথম দুই খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, তৃতীয় খণ্ড ১৯২৬, চতুর্থ ১৯৩৩।
‘বিমুগ্ধ আত্মা’ রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা জা ক্রিসতফে রোলাঁ পূর্ণতা পাননি কিন্তু বিমুগ্ধ আত্মাতে এসে পেলেন পূর্ণতা। এই উপন্যাস জঁ ক্রিসতফের চেয়ে অনেক পরিণত।
এই কাহিনীর নায়িকা আনেৎ। সে এক শিল্পীর কন্যা। সুন্দরী, ধনী পরিবারে তার বিয়ে স্থির হল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্বে তার প্রেমিক বিয়ের মানসিকতার সাথে একমত হতে পারল না। আসলে সে চেয়েছিল স্বাধীনতা। পূর্ণ নারীতু। স্ত্রী হিসাবে দাসত্ব নয়। তখন সে সন্তানসম্ভবা। সন্তানের কথা ভেবেও সে বিয়ে করল না। নিজের সন্তান মার্ককে নিয়ে শুরু হল তার জীবন সংগ্রাম। আনেৎ যেন চিরন্তন নারী সংগ্রামের প্রতীক। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। তারই মধ্যে আনেৎ দেখেছে মানুষের কদর্য রূপ। অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। আনেৎ নতুন যুগের স্বপ্ন দেখে। তার বিশ্বাস একদিন এই অন্ধকার পৃথিবী থেকে মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই উত্তরণ ঘটবে। এই উপন্যাস শেষ হয়েছে সেই সংগ্রামের ডাক দিয়ে। “ন্যায়পরায়ণ হওয়া তো ভাল কিন্তু প্রকৃত ন্যায়বিচার কি শুধু দাঁড়িপাল্লার কাছে বসে থাকে, আর দেখেই সন্তুষ্ট হয়? তাকে বিচার করতে দাও, সে হানুক আঘাত। স্বপ্ন তো যথেষ্ট দেখেছি আমরা, এবার আসুক জাগার পালা।”
১৯১৯ থেকে ১৯২৯ রোলাঁর জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণ। একদিকে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা অন্যদিকে বাস্তব পৃথিবীর হাজার সমস্যা। ইউরোপের বুকে নতুন চিন্তা ভাবনার উন্মেষ। তিনি উপলব্ধি করলেন গান্ধীবাদের আদর্শ যাকে একদিন তার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীকে পথ দেখাবে, ক্রমশই তার রং যেন ফিকে হয়ে আসছে।
ইউরোপের বুকে তখন ঘটে গিয়েছে রুশ বিপ্লব। এই নতুন আদর্শকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও তাকে মেনে নিতে পারেনি তিনি। তার অন্তরে তখন গান্ধী আর তলস্তয়।
রুশ সাহিত্যিক গোর্কির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল রোলাঁর। গোর্কিই তাঁকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সাথে পরিচিত করালেন। প্রথমে সোভিয়েত সরকারকে মেনে নিতে না পারলেও ক্রমশই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯২৯ সালে যখন ফ্রান্সে কমিউনিস্টদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল, তাদের বন্দী করা হল, শ্রমিক শ্ৰেণীর উপর শুরু হল নির্যাতন, সেই সময় ফ্রান্সের বিখ্যাত কয়েকজন কবি দার্শনিক লেখক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন।
রোলাঁ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কোন পথে তিনি যাবেন! প্রথমে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি লেখক সাহিত্যিক, রাজনীতি তার ধর্ম নয়। কিন্তু শেষে অনুভব করলেন যখন মানব জাতি বিপন্ন তখন সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে নেমে এলেন রাজনীতির আঙিনায়, অনুভব করলেন মার্কসবাদের মধ্যেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিহিত। রচনা করলেন তাঁর “শিল্পীর নবজন্ম”। রোলাঁ লিখেছেন, “সমস্ত জীবন ধরে আমি যে পথের সন্ধান করেছি, সমাজতন্ত্রের মধ্যেই তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি।”
রোলাঁ যখন এই মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন তখন তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধা। শুরু হল চারদিকে প্রচার-রোলাঁ কমিউনিস্ট…দেশদ্রোহী।
কিন্তু নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত রোলাঁ শুধু ইউরোপ নয়, সমস্ত মানবের মুক্তির কামনায় মুখর হয়ে উঠলেন। “ভারতবর্ষ, চীন ইন্দোচীন প্রভৃতি শোষিত নিপীড়িত জাতির পাশে দাঁড়িয়ে আমি যুদ্ধ করব।”
১৯৩৬ সালে রোলাঁর ৭০তম জন্মদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আড়ম্বর করে পালন করা হল। তাকে বলা হল ফ্রান্সের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, মানব কল্যাণের এক অক্লান্ত যোদ্ধা।
জার্মাণির বুকে তখন শুরু হয়েছে হিটলারের তাণ্ডব। রোলাঁ অনুভব করতে পারছিলেন আগামী দিন ইউরোপের বুকে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় নেমে আসছে।
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করল। শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪০ সালে জার্মানরা ফ্রান্স দখল করল। রোলাঁ রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, সেটাই তাঁর শেষ চিঠি।
“আমি সংবাদপত্রে লিখতে পারছি না…তাই যৌবনের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোকে আমি পুনরায় জীবন্ত করে তুলছি, স্মৃতিকথা লিখছি।
অন্ধ হিংসা ও মিথ্যায় উন্মত্ত এই পৃথিবীতে আমাদের সত্য ও শান্তিকে রক্ষা করতেই হবে।”
রোলাঁ জীবনের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও নিজের গৃহ ছেড়ে কোথাও যাননি। তার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হত। তাঁর প্রতিটি চিঠি পরীক্ষা করা হত, এমনকি তাঁকে খুনের হুমকি অবধি দেওয়া হত।
নিজের জন্যে কখনো চিন্তিত ছিলেন না রোলাঁ। মানুষের এই হত্যা নির্যাতন তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করত। তাঁর মনে হত গ্যেটে বিঠোফেনের মহান দেশের এ অধঃপতন। একি সভ্যতার আসন্ন মৃত্যু!
এক বেদনার্ত হৃদয়ে নিঃসঙ্গভাবে সারাদিন নিজের ঘরে বসে থাকতেন। নিজেকে প্রকাশ করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। চারদিকে অনাহার অভাব। জার্মান দূতাবাস তাঁকে সব কিছু দিতে চেয়েছিল, খাদ্য, কয়লা, পোশাক। কিন্তু হত্যাকারীর হাত থেকে কিছু গ্রহণ করতে তাঁর বিবেক বাধা দিয়েছিল। তাই জার্মানদের সমস্ত দানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
অবশেষে ১৯৪৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তেও বিশ্বাস হারাননি। নতুন যুগের মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছেন–
“নতুন দিনের মানুষ, হে তরুণের দল, আমাদের পদদলিত করে তোমরা এগিয়ে চল। আমাদের চেয়েও বড় ও সুখী হও।”