অষ্টম অধ্যায় – কখন আর কোথায় কিভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিল?
আফ্রিকার কঙ্গোর বোসোঙ্গোর একটি বান্টু গোত্রের পুরাণ-কাহিনি দিয়ে শুরু করা যাক। একেবারে শুরুতে কোনো স্থলভূমি ছিল না, শুধু ছিল জলজ অন্ধকার এবং এছাড়াও, আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে, ছিলেন দেবতা বুম্বা। বুম্বার পেটে একবার ব্যথা হয়, তিনি বমি করে সূর্যের জন্ম দেন। সূর্যের আলো সব অন্ধকার দূর করে দিয়েছিল, সূর্যের তাপ কিছু পানিকে শুকিয়েও ফেলেছিল, স্থলভূমির জন্ম হয়। বুম্বার পেটব্যথা তা-ও কমেনি যদিও, এরপর আবার বমি করে বুম্বা চাঁদ, নক্ষত্র, প্রাণী এবং মানুষ জন্ম দিয়েছিলেন।
সৃষ্টি-পুরাণসংক্রান্ত বহু চীনা গল্পের একটি চরিত্রের নাম, পান গু, কখনো তাকে দেখানো হয় দানবাকৃতির লোমশ একজন ব্যক্তি রূপে, যাঁর মাথাটা কুকুরের মতো। পান গু’র পুরাণ-কাহিনিগুলো একটি হচ্ছে এ রকম : একেবারে শুরুতে পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো বিভাজন ছিল না; সবকিছুই ছিল একটি বড় কালো ডিমের চারপাশে আঠালো জমাটবাঁধা পদার্থ। ডিমের মধ্যে বাঁকা হয়ে শুয়ে ছিলেন পান গু। পান গু ডিমের মধ্যে ঘুমিয়েছিলেন ১৮,০০০ বছর ধরে। যখন অবশেষে তাঁর ঘুম ভেঙেছিল, তিনি পালাতে চেয়েছিলেন, সুতরাং একটি কুড়াল যোগাড় করে তিনি ডিমের খোলস কেটে তাঁর পথ বের করে নেন। ডিমের কিছু উপাদান ছিল ভারী সেগুলো নিচে নিমজ্জিত হয়ে তৈরি করে পৃথিবী, আর কিছু ছিল আলো, যেগুলো ভেসে উড়ে উপরে আকাশ তৈরি করে। তারপর আরো ১৮,০০০ বছর ধরে পৃথিবী আর আকাশ স্ফীত হয়েছিল প্রতিদিন ৩ মিটার করে [বা তার সমতুল্য]।
এই গল্পের কোনো সংস্করণে আমরা পান গু’কে পৃথিবী আর আকাশকে পৃথক করার চেষ্টা করতে দেখি। স্পষ্টতই পরিশ্রমসাধ্য এই কাজটির পরে তিনি এতই ক্লান্ত নিঃশেষ হয়ে পড়েন যে তিনি মারা যান। তাঁর শরীরের নানা টুকরোই পরে সেই মহাবিশ্ব তৈরি করেছিল যার সাথে আমরা পরিচিত। তাঁর শ্বাস হয়েছিল বাতাস, কণ্ঠস্বর হয়েছিল বজ্রপাত, তাঁর দুই চোখ চাঁদ আর সূর্যের রূপ নিয়েছিল, তাঁর মাংস থেকে চাষাবাদের জমি, শিরা থেকে রাস্তার জন্ম হয়েছিল। তাঁর ঘাম থেকে আসে বৃষ্টি, তাঁর চুল রূপান্তরিত হয় নক্ষত্রে এবং মানুষ বিবর্তিত হয়েছিল ফ্লি আর উকুন থেকে, যারা একসময় পান গু’র শরীরে বাস করত।
প্রসঙ্গক্রমে, পান গু’র পৃথিবী আর আকাশকে পৃথক রাখার প্রচেষ্টা সেই গ্রিক পুরাণের [সম্ভবত সম্পর্কযুক্ত নয়] অ্যাটলাসের কাহিনির মতো, সে-ও আকাশটাকে উপরে ধরে রেখেছিল [যদিও, অদ্ভুত ব্যাপার হল, ছবি ও ভাস্কর্যে আমরা তাকে তার কাঁধের উপর পুরো পৃথিবীটাকে বহন করতে দেখি]।
এবার ভারতের বহু সৃষ্টিপুরাণের একটি : সময়ের সূচনা হবার আগে ছিল একটি বিশাল শূন্যতার সাগর, যার উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকত একটি দানবাকৃতির সাপ। আর সাপের কুণ্ডলীর উপর ঘুমিয়ে ছিলেন দেবতা বিষ্ণু। একসময় গম্ভীর একটি শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙেছিল, যা শূন্যতার গভীর সমুদ্রের নিচ থেকে ভেসে আসছিল এবং তাঁর নাভি থেকে একটি পদ্মফুলের জন্ম হয়। সেই পদ্মফুলের মধ্যে বসে ছিলেন ব্ৰহ্মা, বিষ্ণুর সেবক। তিনি ব্রহ্মাকে নির্দেশ দেন পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য, ব্রহ্মা তাঁর নির্দেশ পালন করে সেটাই করলেন। কোনো সমস্যা নেই, সেটি করার সময় সব জীবদেরও তিনি খুব সহজে সৃষ্টি করে ফেললেন।
এইসব সৃষ্টিপুরাণগুলো বিষয়ে আমরা কাছে যা হতাশাজনক মনে হয় তা হল সেগুলোর প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো এক ধরনের জীবিত সত্তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ধরে নেবার মাধ্যমে শুরু হয়েছে : বুম্বা বা ব্ৰহ্মা বা পান গু বা উনকুলুকুলু [জুলু সৃষ্টিকর্তা] অথবা আবাসি [নাইজেরিয়া] বা আকাশবাসী বৃদ্ধ [সালিশ, কানাডার আদিবাসীদের একটি গোত্র]। আপনার কি মনে হয় না, কোনো এক ধরনের মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আগে আসতে হবে, যা কিনা সৃজনশীল কোনো সৃষ্টিকর্তা সত্তার কাজ করার জায়গা করে দেবে? এইসব পুরাণগুলোর কোনোটাই ব্যাখ্যা দেয় না, কিভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার নিজেরই জন্ম হয়েছিল [সাধারণত তিনি পুরুষ], প্রথমে তিনি কিভাবে তাঁর অস্তিত্ব লাভ করেছিলেন।
সুতরাং, আসলেই এই কাহিনিগুলো বেশি কিছু আমাদের জন্যে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বেশ তাহলে দেখা যাক আসলেই মহাবিশ্ব কেমন করে সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সত্য কাহিনিটির কতটুকু আমরা জানি।
আসলেই, কিভাবে শুরু হয়েছিল সবকিছু?
প্রথম অধ্যায়ের কথা কি আপনার মনে আছে, যেখানে আমি বলেছিলাম, বিজ্ঞানীরা কাজ করেন প্রথমে একটি মডেল প্রস্তাব করার মাধ্যমে, যা বোঝাতে চেষ্টা করে আসল পৃথিবী কেমন করে কাজ করতে পারে? এরপর সেই প্রতিটি মডেলকে তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেন, সেটিকে ব্যবহার করে কোনোকিছু আমাদের কেমন দেখা উচিত সেই বিষয় ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে অথবা কোনোকিছু পরিমাপ করে, যা আমাদের পরিমাপ করতে পারার কথা—যদি মডেলটি সঠিক হয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হল সেই বিষয়ে দুটি প্রতিযোগী মডেল ছিল, একটিকে বলা হত ‘স্টিডি স্টেট’ [Steady State] মডেল আরেকটি হচ্ছে ‘বিগ ব্যাং’ [BIg Bang] মডেল। ‘স্টিডি স্টেট’ মডেল ছিল খুবই চমৎকার, তবে পরে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। বা তার মানে হচ্ছে এটির ওপর ভিত্তি করে করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল। স্টিডি স্টেট মডেল অনুযায়ী, কখনোই একটি শুরুর মুহূর্ত ছিল না : এবং মহাবিশ্ব সবসময়ই এর বর্তমান রূপটি যেমন—তেমনই ছিল। বিগ ব্যাং মডেলটি, অন্যদিকে প্রস্তাব করেছিল যে, মহাবিশ্ব একটি সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে তার যাত্রা শুরু করেছিল, একটি অদ্ভুত বিস্ফোরণের মাধ্যমে। আর বিগ ব্যাং মডেলের ওপর ভিত্তি করে করা সব ভবিষ্যদ্বাণীও সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হয়, আর সে-কারণে এটি সাধারণভাবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীদের জন্য গ্রহণযোগ্যও হয়ে উঠেছিল।
বিগ ব্যাং মডেলের আধুনিক সংস্করণ অনুযায়ী, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের পুরোটাই ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব লাভ করেছিল। ‘পর্যবেক্ষণযোগ্য কেন বলছি আমরা, ‘পর্যবেক্ষণযোগ্য’ মহাবিশ্ব মানে সবকিছু, যার জন্যে আমাদের কাছে কোনো-না-কোনো প্রমাণ আছে। সম্ভব হতে পারে যে আরো অনেক মহাবিশ্ব আছে যা আমাদের ইন্দ্রিয় আর যন্ত্রের কাছে অদৃশ্য। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেন, হয়তো বেশি কল্পনাপ্রবণতার সাথে, বহু মহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্স আছে : বদ্বুদের মতো মহাবিশ্বদের ফেনা যার মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব শুধুমাত্র একটি বুদ্বুদ। অথবা, হতে পারে যে পর্যবেক্ষণক্ষম মহাবিশ্ব, যে মহাবিশ্বে আমাদের বাস, সেটি একটিমাত্র মহাবিশ্ব যার জন্যে আমাদের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে যে এটি শুধু একটিমাত্র মহাবিশ্ব। যাই হোক-না কেন, এই অধ্যায়ে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব পর্যবেক্ষণক্ষম মহাবিশ্ব সম্বন্ধে। প্রমাণ জানাচ্ছে যে পর্যবেক্ষণক্ষম মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল ‘বিগ ব্যাং’ মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, আর এই অসাধারণ ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে।
বিজ্ঞানীদের কেউ হয়তো আপনাকে বলবেন, ‘সময়’ নিজেই শুরু হয়েছিল এই বিগ ব্যাং থেকে, উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে যেমন জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই, তেমনি দরকার নেই সেই বিগ ব্যাং-এর আগে কী ঘটেছিল। আপনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন না তো? আমিও পারি না, কিন্তু সেই প্রমাণগুলো আমি খানিকটা বুঝি যে, বিগ ব্যাং ঘটেছিল ও কখন ঘটেছিল। আর এই অধ্যায়টি সেই বিষয় নিয়ে।
প্রথমে গ্যালাক্সি [ছায়াপথ] কী সেটি আমার ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। অধ্যায় ছয়ের সেই ফুটবলের উদাহরণটির সাথে আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছিলাম যে, নক্ষত্রগুলো পরস্পরের থেকে আসলে অবিশ্বাস্য রকম দূরত্বে অবস্থান করে, যদি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা গ্রহগুলোর মধ্যবর্তী
দূরত্বের সাথে সেটির তুলনা করা হয়, কিন্তু যতই বিশাল দূরত্বে তারা থাকুক-না কেন, নক্ষত্ররা আসলে একসাথে জড়ো হয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে, এই গ্রুপগুলোকে বলে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। একটি গ্যালাক্সি, কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাদের শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যা ঘুরপাক খাওয়া একটি বিশাল সজ্জার মতো দেখতে পান, সেগুলো আসলে তৈরি হাজার কোটি নক্ষত্র দিয়ে, এছাড়াও সেখানে আছে ধুলা আর গ্যাসের মেঘ।
আমাদের সূর্য হচ্ছে সেই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটি নক্ষত্র, যারা একত্রে ‘মিল্কি ওয়ে’ নামে একটি নির্দিষ্ট গ্যালাক্সি তৈরি করেছে। আর মিল্কি ওয়ে [আকাশগঙ্গা] নামে এটিকে ডাকা হয়, কারণ অন্ধকার রাতে আমরা এটিকে ঠিক আমাদের মুখোমুখি দেখতে পাই, আমরা এটিকে দেখতে পাই রহস্যময় দুধের সাদা দাগের মতো যা আকাশ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে, হয়তো আপনি ভুল করে সেটিকে হালকা ধোঁয়ার মতো কোনো মেঘ মনে করতে পারেন প্রথমে, যতক্ষণ-না এটি আসলে কী সেটি ভালোভাবে লক্ষ করবেন। আর আপনি যখন সেটি করবেন, সেই চিন্তাটি আপনাকে বিস্ময়ে হতবাক করবে, যেহেতু আমরাই মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি, আমরা কখনোই এটিকে সম্পর্ণভাবে দেখতে পারব না। আর মহাবিশ্ব, যে মহাবিশ্ব আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি সেটি আসলেই বিশাল একটি জায়গা।
পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে এটি : প্রতিটি গ্যালাক্সি কত দূরে অবস্থিত সেটি কি পরিমাপ করা সম্ভব? কিভাবে? আমরা কিভাবে আসলে জানতে পারি জানি মহাবিশ্বে কোনোকিছু কত দূরে অবস্থিত? নিকটবর্তী নক্ষত্রদের দূরত্ব পরিমাপের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ‘প্যারালাক্স’। আপনার মুখের সামনে একটা আঙুল তুলে ধরুন এবং আপনার বাম চোখটা বন্ধ করে এটিকে দেখুন, এবার আপনি আপনার বাম চোখ খুলুন, আর ডান চোখটা বন্ধ করুন, এভাবে চোখ পরিবর্তন করুন,
আপনি লক্ষ করবেন যে আপনার আঙুলটি একপাশ থেকে অন্যপাশে লাফ দিয়ে সরে গিয়ে এর আপাত অবস্থান পরিবর্তন করছে। আপনার দুটি চোখের পৃথক দৃষ্টিকোণ হচ্ছে এর কারণ। আঙুলটি আরো কাছে নিয়ে আসুন, আগের চেয়ে এই জায়গা পরিবর্তনের পরিমাণ আরো বেশি হবে। আর যতদূরে আঙুল সরাবেন ততই সেটি কম হবে। আপনার শুধু যা জানা দরকার সেটি হল আপনার চোখ দুটি পরস্পর থেকে কতটা দূরত্বে অবস্থান করছে, তাহলেই এই অবস্থান পরিবর্তনের পরিমাণ থেকে আপনি চোখ থেকে আঙুলের দূরত্ব পরিমাপ করতে পারবেন। দূরত্ব পরিমাপের জন্যে এটাই হচ্ছে ‘প্যারালাক্স’ পদ্ধতি ।
এখন, আপনার আঙুলের দিকে তাকানোর পরিবর্তে, রাতের আকাশে কোনো একটি নক্ষত্রের দিকে তাকান, দুটি চোখ পালাক্রমে পরিবর্তন করে। মনে হবে তারাটি আদৌ তার জায়গা পরিবর্তন করছে না, আর তার কারণ এটি আসলেই বহু দূরে অবস্থান করছে। আঙুলের মতো কোনো একটি নক্ষত্রকে লাফিয়ে পাশাপাশি তার জায়গা পরিবর্তন করাতে হলে আপনার চোখদুটির মধ্যে দূরত্ব বহু মিলিয়ন মাইল হতে হবে। কিভাবে আমরা সেই একই ধরনের পরিস্থিতি অর্জন করতে পারি যেন চোখদুটি বহু মিলিয়ন মাইল দূরত্বে অবস্থান করছে? আমরা সেই বাস্তব তথ্যটি ব্যবহার করতে পারি যে, সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস ১৮৬ মিলিয়ন মাইল। আমরা কোনো একটি নিকটবর্তী তারার অবস্থান পরিমাপ করতে পারি, অন্য তারাদের সাপেক্ষে তার অবস্থানের প্রেক্ষাপটে। তারপর ছয় মাস পর, যখন পৃথিবী কক্ষপথের বিপরীত দিকে ১৮৬ মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থান করে, আমরা সেই তারাটির আপাত অবস্থান আবার পরিমাপ করি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদিও, প্যারালাক্স পদ্ধতি কাজ করে শুধুমাত্র নিকটবর্তী তারাদের ক্ষেত্রে। দূরবর্তী তারাদের জন্যে এবং অবশ্যই অন্য সব গাল্যাক্সির জন্য, পর্যায়ক্রমে দেখা দুটি ‘চোখকে’ ১৮৬ মিলিয়ন মাইলের চেয়ে আরো বেশি দূরে অবস্থান করার দরকার হবে। সে- কারণেই আমাদের অন্য একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা এটি করতে পারি কোনো একটি গ্যালাক্সি কত উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে সেটি পরিমাপ করে : নিশ্চয়ই আরো দূরের গ্যালাক্সি অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বলতর হবে, নিকটবর্তী কোনো গ্যালাক্সির চেয়ে? সমস্যা হচ্ছে দুটি গ্যালাক্সির ‘আসলেই’ ভিন্ন ভিন্ন উজ্জ্বলতা হতে পারে। এটি অনেকটা কত দূরে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি আছে সেটি পরিমাপ করার মতো। যদি কিছু মোমবাতি অন্য মোমবাতিগুলোর তুলনায় বেশি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে, তাহলে আপনি কিভাবে বুঝতে পারবেন যে আপনি বহুদূরের কোনো উজ্জ্বল মোমবাতির দিকে তাকাচ্ছেন নাকি কাছের কোনো অনুজ্জ্বল মোমবাতি দেখছেন?
সৌভাগ্যজনকভাবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে প্রমাণ হিসেবে কিছু বিশেষ ধরনের তারা আছে, যাদের তারা বলেন ‘স্টান্ডার্ড ক্যান্ডেল’। তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণ ভালো করে জানেন যে এই তারাদের মধ্যে আসলে কী ঘটছে এবং কতটা উজ্জ্বল তারা, আমরা যেমন দেখছি সেভাবে নয়, বরং তাদের সত্যিকারের উজ্জ্বলতা, আলোর তীব্রতা [অথবা এটি হতে পারে এক্স-রে বা অন্য কোনো ধরনের রেডিয়েশন যা আমরা পরিমাপ করতে পারি], আমাদের দূরবীক্ষণ যন্ত্র অবধি তাদের দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার আগে। তাঁরা এটাও জানেন কিভাবে এই বিশেষ ‘ক্যান্ডেলগুলোকে’ আমরা শনাক্ত করতে পারি এবং এভাবে, কোনো একটি গ্যালাক্সিতে যতক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কমপক্ষে এমন একটি নক্ষত্র খুঁজে পাবেন, সুপ্রতিষ্ঠিত গাণিতিক গণনার মাধ্যমে সেই গ্যালাক্সিটি ঠিক কত দূরে আছে সেটি পরিমাপ করার জন্য তাঁরা সেটি ব্যবহার করতে পারবেন।
তাহলে খুব অল্প দূরত্বে নক্ষত্রদের দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য আমাদের ‘প্যরালাক্স’ পদ্ধতি আছে এবং নানা ধরনের স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেলদের, বলা যায়, পর্যায়ক্রমিক একটি ধাপ বা ‘সিঁড়ি’ আছে, যা দিয়ে আমরা ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব মাপতে পারি, যা বিস্তৃত বহু দূরের গ্যালাক্সি অবধি।
রংধনু ও লাল শিফট
বেশ, এখন আমরা জানি গ্যালাক্সি আসলে কী, আর কিভাবে আমাদের থেকে এর দূরত্ব আমরা পরিমাপ করতে পারি। এই আলোচনার পরবর্তী ধাপের জন্যে আমাদের আলোর বর্ণালি ব্যবহার করতে হবে, অধ্যায় সাতে যে বিষয়টির সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে। আমাকে একবার একটি বইয়ের অধ্যায় লিখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যে বইটিতে নানা ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীদের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কোনটি, সেই বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মনোনয়ন দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বেশ মজার একটি ব্যাপার ছিল, কিন্তু সেই পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য আমি বেশ দেরি করে ফেলেছিলাম, আর সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারই ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়ে গিয়েছিল : ঢাকা, প্রিন্টিং প্রেস, টেলিফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি। সুতরাং আমি বেছে নিয়েছিলাম এমন একটি যন্ত্র আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আর কেউই সেটা পছন্দ করবে না এবং অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ যদিও বেশিরভাগ মানুষ সেটি কখনোই ব্যবহার করে না [আমিও নিজেই স্বীকার করছি, আমিও কখনো ব্যবহার করিনি। মানবজাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হিসেবে আমি ‘স্পেকট্রোস্কোপ’ বা বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্রটিকে বেছে নিয়েছিলাম।
একটি স্পেকট্রোস্কোপ হচ্ছে ‘রংধনু’ যন্ত্র। যদি এটিকে কোনো একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়, সেটি কোনো একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে আসা আলো বিচ্ছুরিত করে, ঠিক যেমন নিউটন তাঁর প্রিজম ব্যবহার করে করেছিলেন, কিন্তু এটি নিউটনের সাধারণ প্রিজমের তুলনায় আরো বেশি উন্নত, কারণ এর মাধ্যমে আমরা নক্ষত্রের বিচ্ছুরিত আলোর বর্ণালি সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারি। বেশ, কিসের পরিমাপ? পরিমাপ করার মতো রংধনুতে আসলেই কী আছে? বেশ, এখানেই বিষয়টি আসলে খুব আগ্রহোদ্দীপক হয়ে ওঠে। ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্ৰ থেকে আসা আলো ‘রংধনু’ তৈরি করে, যে রংধনুগুলোর প্রত্যেকটি পরস্পর থেকে সুনির্দিষ্টভাবেই ভিন্ন। সুতরাং সেটি আমাদের সেই নক্ষত্ৰ সম্বন্ধে অনেক তথ্য দিতে পারে।
এর মানে নক্ষত্রের আলোয় কি অদ্ভুত সব বিচিত্র রঙ আছে, যে রঙ আমরা পৃথিবীতে কখনো দেখি না? না, অবশ্যই না। পৃথিবীতে, আপনার চোখের পক্ষে যতটা রঙ দেখার ক্ষমতা আছে, আপনি সেই ধরনের রঙই দেখেছেন। আপনার কি এটি শুনে হতাশ হলেন? আমি হতাশ হয়েছিলাম, যখন আমি প্রথম বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলাম। যখন আমি শিশু ছিলাম, আমরা খুব প্রিয় ছিল হিউ লফটিঙ-এর ডক্টর ডুলিটল সিরিজের বইগুলো। তাঁর সেই বইগুলোর একটিতে ডক্টর চাঁদে গিয়েছিলেন এবং তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন সম্পূর্ণ নতুন সব রঙ দেখে, যা মানব-চোখ কখনোই দেখেনি। আমার সেই ভাবনাটা খুব ভালো লেগেছিল। আমার জন্য এটি ছিল সেই রোমাঞ্চকর ধারণা যে, আমাদের পরিচিত পৃথিবী মহাবিশ্বের সবকিছুর বৈশিষ্ট্যসূচক না-ও হতে পারে। যদিও ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাহিনিটি সত্য ছিল না, আর সেটি সত্য হতেও পারে না। এটি আমরা জানি নিউটনের আবিষ্কার থেকে; যে রঙ আমরা দেখছি সেগুলো সবই আছে সাদা রঙের মধ্যে আর একটি প্রিজম ব্যবহার করে বিচ্ছুরিত করে আমরা তাদের পরস্পর থেকে পৃথকও করতে পারি। এই সীমানার বাইরে আর কোনো রঙ নেই যার সাথে আমরা পরিচিত। শিল্পীরা বিভিন্ন টিন্ট আর শেড-এর রঙ বানাতে পারেন, কিন্তু এ সবকিছুই সাদা রঙের সেই মৌলিক উপাদানগুলোর সংমিশ্রণ। যে রঙগুলো আমরা আমাদের মস্তিষ্কে দেখতে পাই সেগুলো আসলে শুধু লেবেল বা শনাক্তকারী, যা মস্তিষ্ক তৈরি করে, সেগুলো আসলে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সংমিশ্রণ। না চাঁদ বা নক্ষত্র, রঙের ক্ষেত্রে কোনো চমক দেয় না, হায়!
বেশ, তাহলে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি, যখন বলেছি যে, ভিন্ন ভিন্ন তারা ভিন্ন ভিন্ন ‘রংধনু’ সৃষ্টি করে, আর কোনো স্পেকট্রোস্কোপ দিয়ে আমরা সেই পার্থক্যটা পরিমাপ করতে পারি? বেশ, দেখা গেছে যখন তারার আলো স্পেকট্রোস্কোপের মাধ্যমে বিচ্ছুরিত করা হয়, বর্ণালির খুব সুনির্দিষ্ট জায়গায় সরু কালো লাইনের অদ্ভুত প্যাটার্ন আমরা লক্ষ করতে পারি। অথবা কখনো এই রেখাগুলো কালো নয় বরং রঙিন এবং ব্যাকগ্রাউন্ড বা পেছনের ক্ষেত্রটি কালো। রেখাদের এই বিশেষ প্যাটার্নটি বারকোডের মতো দেখতে, যে ধরনের বারকোড আপনি দেখেন দোকানে কোনোকিছু কেনার সময়, ক্যাশ টিলের বিশেষ মেশিনের সাহায্যে যে লাইনগুলোকে পড়া হয়, যখন আপনি তার মূল্য পরিশোধ করেন। ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্রগুলো একই রংধনু তৈরি করে, তবে এই লাইনের প্যাটার্নগুলো সেখানে ভিন্ন। আর এই প্যাটার্ন আসলেই এক ধরনের বারকোড, কারণ এটি আমাদের সেই নক্ষত্রটি সম্বন্ধে এবং এটি কী দিয়ে তৈরি সেই বিষয়ে বেশকিছু তথ্য দেয়।
শুধুমাত্র নক্ষত্রের আলোরই বারকোড লাইন থাকে না, পৃথিবীর আলোরও থাকে, সুতরাং ল্যাবরেটরিতে আমরা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারি, সেই দাগগুলো কী তৈরি করেছে। বারকোডগুলো তৈরি করেছে কী? দেখা গেছে এই দাগগুলো তৈরি করছে বিশেষ কিছু মৌল। সোডিয়াম, যেমন—বর্ণালির হলুদ অংশে সুস্পষ্ট লাইনের একটি প্যাটার্ন সৃষ্টি করে। সোডিয়াম লাইট তাই হলুদ রঙের আলো তৈরি করে [সোডিয়াম বাষ্পের মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে যে আলো]। এর কারণ পদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, অবশ্যই আমি নই, কারণ আমি হচ্ছি একজন জীববিজ্ঞানী যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বোঝে না।
দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সালিসবুরিতে আমি যখন স্কুলে পড়ছিলাম, মনে আছে রাস্তার হলুদ ল্যাম্পের নিচে আমার উজ্জ্বল লাল রঙের স্কুলক্যাপটির অদ্ভুত চেহারা দেখে আমি পুরোপুরিভাবে বিস্মিত হয়েছিলাম। সেটি দেখতে আদৌ লাল মনে হয়নি, বরং হলদে বাদামি একটি রঙ ধারণ করেছিল। উজ্জ্বল লাল রঙের ডাবল ডেকার বাসগুলোও তেমনই রঙ ধারণ করত। এ রকম হবার কারণ হচ্ছে এটি : সেই সময়ে অনেক ইংলিশ শহরের মতো, সালিসবুরিও রাস্তার আলোর জন্য সোডিয়াম লাইটের প্রচলন শুরু করে এবং তারা যে আলো তৈরি করে সেটি বর্ণালির একটি সংকীর্ণ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে সোডিয়ামের বৈশিষ্ট্যসূচক দাগগুলো আমরা দেখতে পাই আর সবচেয়ে উজ্জ্বল সোডিয়ামের দাগগুলো থাকে হলুদের মধ্যে। সুতরাং বলা যেতে পারে সোডিয়াম লাইটগুলো বিশুদ্ধ হলুদ আলোয় জ্বলে, সূর্যের সাদার আলোর চেয়ে, অথবা কোনো সাধারণ ইলেকট্রিক বাল্বের অস্পষ্ট হলুদ আলোর তুলনায় যা খুবই আলাদা। যেহেতু সোডিয়াম লাইট থেকে কোনো লাল আলো আসে না, সুতরাং কোনো লাল আলো আমার ক্যাপ থেকে প্রতিফলিত হতে পারে না। আর যদি আপনি ভাবেন যে কোন জিনিসটা আসলে একটা ক্যাপ অথবা একটি বাসকে লাল করে প্রথমত, এর উত্তর হচ্ছে এই রঙের অণু অথবা পেইন্ট, প্রায় সব রঙই শোষণ করে নেয় শুধুমাত্র লাল রঙ ছাড়া। সুতরাং সাদা আলোর নিচে, যা সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ধারণ করছে, সেখানে মূলত সেটি লাল রঙকেই প্রতিফলিত করে। সোডিয়াম বাষ্পের রাস্তার লাইটের নিচে, কোনো লাল রঙ নেই যা প্রতিফলিত হতে পারে, আর সে-কারণে এই হলদে বাদামি রঙ।
সোডিয়াম হচ্ছে শুধু একটিমাত্র উদাহরণ। অধ্যায় চারের আলোচনা থেকে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে প্রতিটি মৌলের একটি নিজস্ব অনন্য পারমাণবিক [অ্যাটোমিক] সংখ্যা আছে, যা এর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা [একই সাথে এর চারপাশে প্রদক্ষিণরত ইলেকট্রনের সংখ্যাও]। আর, এর প্রদক্ষিণরত ইলেকট্রনের কক্ষপথের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কারণে আলোর উপর প্রতিটি মৌলের নিজস্ব একটি অনন্য প্রভাব আছে। কোনো বারকোডের মতো অনন্য, বাস্তবিকভাবে, কোনো একটি বারকোড হচ্ছে কোনো নক্ষত্রের আলোর বর্ণালিতে লাইনগুলোর প্যাটার্ন যেমন—তেমন। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় এমন ৯২টি মৌলগুলোর কোনগুলো নক্ষত্রে উপস্থিত আছে, সেটি আপনি স্পেকট্রোস্কোপ দিয়ে সেখান থেকে আসা আলো বিচ্ছুরিত করে, সেই বর্ণালির মধ্যে বারকোড লাইনগুলো পরীক্ষা করে দেখার মাধ্যমে বলতে পারবেন।
যেহেতু প্রতিটি মৌলের ভিন্ন ভিন্ন বারকোড প্যাটার্ন আছে, আমরা নক্ষত্র থেকে আসা আলো লক্ষ করে বলতে পারি কোন কোন মৌল সেই নক্ষত্রে উপস্থিত। স্বীকার করতেই হবে, বিষয়টি খুব সহজ নয় কারণ বেশকিছু ভিন্ন ভিন্ন মৌলের বারকোডগুলো মাঝে মাঝে পরস্পরের সাথে মিশে যেতে পারে, অবশ্যই সেগুলোকে সঠিকভাবে বাছাই করার উপায় আছে। স্পেকট্রোস্কোপ আসলেই অসাধারণ একটি যন্ত্র।
আরো অসাধারণ কিছু ব্যবহার আছে এর। স্যালিসবুরির রাস্তার ল্যাম্পের আলো থেকে পরিমাপ করা সোডিয়াম বর্ণালি আর বেশি দূরবর্তী নয় এমন কোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলোর সোডিয়াম বর্ণালিও একই। বেশিরভাগ যে নক্ষত্রদের আমরা দেখি, যেমন রাশিচক্রের সেই সুপরিচিত নক্ষত্রপুঞ্জের নক্ষত্রগুলো, সেগুলো আমাদের গ্যালাক্সিতে অবস্থিত, কিন্তু যদি আপনি ভিন্ন কোনো গ্যালাক্সির নক্ষত্র থেকে আসা আলোর সোডিয়াম বর্ণালি লক্ষ করেন, আপনি বিস্ময়করভাবে ভিন্ন একটি ছবি পাবেন। বহু দূরের কোনো গ্যালাক্সি থেকে আসা সোডিয়ামের আলোর বর্ণালিতে একই প্যাটার্নের দাগ থাকবে, পরস্পরের থেকে একই দূরত্বে, কিন্তু পুরো প্যাটার্নটি বর্ণালির লাল প্রান্তের দিকে সরে যাবে, কিন্তু কিভাবে তাহলে আমরা জানব এটি আসলেই সোডিয়াম? কারণ লাইনগুলোর মধ্যবর্তী শূন্যস্থানের প্যাটার্নটি একই থাকে। এটি হয়তো তেমন বিশ্বাসযোগ্য হত না যদি শুধু এটি সোডিয়ামের সাথে ঘটত, কিন্তু একই জিনিস ঘটে সব মৌলের সাথেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই স্পেসিং প্যাটার্ন, সেই মৌলের জন্য যা বৈশিষ্ট্যসূচক, কিন্তু সেটি পুরোপুরিভাবেই সরে যায় বর্ণালির লাল প্রান্তের দিকে। উপরন্তু, কোনো একটি গ্যালাক্সির জন্য, পুরো বারকোডটি বর্ণালিতে একই দূরত্বে সরে যায়।
আপনি যদি নিকটবর্তী কোনো একটি গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর সোডিয়াম বারকোড লক্ষ করেন—কোনো খুব দূরের গ্যালাক্সি থেকে আলোর সোডিয়াম বারকোডের তুলনায়, যা আমি আগের অনুচ্ছেদে আলোচনা করেছি, কিন্তু যা আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির তারাদের তুলনায় দূরবর্তী, আপনি তাহলে মাঝামাঝি একটি শিফট বা অবস্থান পরিবর্তন দেখতে পাবেন, কিন্তু আপনি সেই একই স্পেসিং প্যাটার্ন দেখতে পাবেন, যা সোডিয়ামের বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন, কিন্তু অনেক দূরে যা সরে যায়নি। প্রথম লাইনটি বর্ণালিতে গাঢ় নীল থেকে সরে গিয়েছে, কিন্তু সবুজ অবধি নয়, শুধুমাত্র হালকা নীল অবধি। আর হলুদ লাইন যা সালিসবুরির রাস্তার ল্যাম্পের হলুদ রঙের জন্য দায়ী সরে গেছে একই দিকে, বর্ণালির লাল প্রান্তের দিকে, কিন্তু পুরোপুরি লাল অবধি নয়, যেমনটি ঘটে বহু দূরের কোনো গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর সাথে, শুধুমাত্র কমলা রঙের দিকে কিছুটা।
সোডিয়াম হচ্ছে শুধুমাত্র একটি উদাহরণ। অন্য যে-কোনো মৌল লাল দিক বরাবর একটি পরিবর্তন প্রদর্শন করবে। যত দূরে হবে গ্যালাক্সি, লাল দিক বরাবর ততই পরিবর্তন দেখা যাবে। এটাকেই বলে ‘হাবল শিফট’, কারণ এটি আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল; তাঁর মৃত্যুর পর, হাবল টেলিস্কোপের নামও তাঁর নাম থেকে এসেছে। এটাকে একটি ‘রেড শিফট’ বলে, কারণ শিফট হচ্ছে বর্ণালির লাল রঙের দিক বরাবর।
বিগ ব্যাং অভিমুখে পেছন দিকে
এই রেড শিফট বলতে আসলে কী বোঝায়? সৌভাগ্যক্রমে, বিজ্ঞানীরা বিষয়টি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছেন। এটা হচ্ছে ‘ডপলার শিফট – এর একটি উদাহরণ। ডপলার শিফট হতে পারে যখনই আমরা কোনো ঢেউ বা তরঙ্গ পাব, আর আগের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখেছি আলো ঢেউ দিয়ে তৈরি। এটিকে কখনো বলা হয় ‘ডপলার ইফেক্ট’ এবং শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রে এটি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। যখন আপনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খুব দ্রুতবেগে কোনো গাড়ির চলে যাওয়া দেখবেন, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের তীব্রতা মনে হবে কমে যাচ্ছে যখন এটি আপনাকে অতিক্রম করবে, কিন্তু আপনি জানেন গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের তীব্রতা আসলে সবসময় একই থাকে, তাহলে শব্দের তীব্রতা কেন কমে যায় বলে মনে হয়? এর উত্তর হচ্ছে ‘ডপলার শিফট’, আর এর ব্যাখ্যাটি আমি নিচে দেয়ার চেষ্টা করছি।
শব্দ বাতাসে বিস্তার করে পরিবর্তনশীল বায়ুচাপের ঢেউ হিসেবে। আপনি যখন কোনো গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনবেন, অথবা ধরুন কোনো ট্রাম্পেটের আওয়াজ, কারণ কোনো ইঞ্জিনের আওয়াজের যা শ্রুতিমধুর, শব্দের উৎস থেকে শব্দতরঙ্গ বাতাসে মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনার কান সেই দিকগুলোর কোনো একটি দিকে অবস্থান করে শুধু। সেটি বাতাসে চাপের তারতম্যটিকে শনাক্ত করে যা ট্রাম্পেটটি তৈরি করছে, আর আপনার মস্তিষ্ক সেটি শুনতে পায় শব্দ হিসেবে। এমনকিছু কল্পনা করবেন না যে অণুরা ট্রাম্পেট থেকে বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের কান অবধি ভেসে আসে। আদৌ সেরকম কিছু ঘটে না : সেটি হচ্ছে বাতাস, বাতাস একদিক বরাবর চলে কিন্তু শব্দতরঙ্গ চলে সবদিকে বহির্মুখী, কোনো পুকুরে ঢিল ছুড়ে মারলে পানির ঢেউগুলো যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যে ঢেউটাকে আমরা সবচেয়ে সহজ বুঝতে পারি সেটি হচ্ছে মেক্সিকান ওয়েভ, খুব বড় কোনো খেলার স্টেডিয়ামে যেখানে মানুষ পালাক্রমে উঠে দাঁড়ায় আর বসে পড়ে, প্রতিটি ব্যক্তি সেই কাজটি করে তার যে-কোনো এক পাশের মানুষটি সেটি করার পর পরই [মনে করুন তাদের বাম পাশের কেউ]। দাঁড়ানো ও তারপর বসে পড়ার একটি ঢেউ খুব দ্রুত সারা স্টেডিয়াম ছড়িয়ে পড়ে, কেউ কিন্তু তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে নড়ছে না, কিন্তু তারপরও ঢেউটি ছড়িয়ে পড়ে। আসলে কারো পক্ষে যত দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব তারচেয়েও বেশি দ্রুততায় এটি ছড়িয়ে পড়ে।
পুকুরে যা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেটি হচ্ছে পানির উপরিপৃষ্ঠের উচ্চতার পরিবর্তনের ঢেউটি। যে জিনিসটা এটিকে ঢেউ বানাচ্ছে সেই পানির অণুগুলো কিন্তু পাথরের টুকরোর আঘাতে চারপাশে ছিটকে বাইরের দিকে বের হচ্ছে না, পানির অণুগুলো শুধু উপর-নিচ করছে, স্টেডিয়ামের সেই মানুষগুলোর মতো। কোনোকিছু সেই পাথরের টুকরো থেকে বাইরের দিকে বের হয় আসে না। শুধু তেমন দেখতে লাগে কারণ পানির উচ্চ বিন্দু আর নিচু বিন্দু বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শব্দতরঙ্গগুলো খানিকটা আলাদা। শব্দের ক্ষেত্রে যা ছড়িয়ে পড়ে সেটি হচ্ছে পরিবর্তিত বায়ুর চাপ। বাতাসের অণু খানিকটা নড়াচড়া করে, এদিক সেদিক, ট্রাম্পেট থেকে দূরে অথবা শব্দের যে উৎসই হোক-না কেন, আবার ফিরে আসে। এভাবে যখন অণুগুলো নাড়াচাড়া করে, তারা তাদের প্রতিবেশী বায়ুর অণুর সাথে ধাক্কা খায়, তাদেরকে সামনে-পেছনে নাড়িয়ে দেয়, তারা আবার তাদের প্রতিবেশীদের নাড়িয়ে দেয়, এর ফলাফল অণুদের ধাক্কাধাক্কির ঢেউ—যার মানে বাতাসের চাপের পরিবর্তন, যা ট্রাম্পেট থেকে বাইরে সব দিকে ছড়িয়ে যায় এবং এই ঢেউই ট্রাম্পেট থেকে আপনার কান অবধি আসে, বাতাসের অণুগুলো নয়। তরঙ্গ বিস্তার করে একটি সুনির্দিষ্ট গতিতে, শব্দের উৎস যাই হোক-না কেন, ট্রাম্পেট, গাড়ির শব্দ কিংবা কারো কণ্ঠ : এই বেগটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৭৬৮ মাইল [পানির নিচে শব্দের গতিবেগ এর চেয়ে আরো চারগুণ বেশি দ্রুত, আরো দ্রুত কিছু কঠিন পদার্থে]। আপনি যদি উচ্চ-স্বরগ্রামের কোনো নোট বা ধ্বনি ট্রাম্পেট দিয়ে তৈরি করেন, যে গতিতে সেটি ঢেউটি বিস্তার লাভ করবে সেটি কিন্তু একই থাকবে, কিন্তু তরঙ্গের চূড়ার মধ্যে দূরত্ব [তরঙ্গদৈর্ঘ্য] আরো ছোট হয়ে আসে। নিচু কোনো স্বর বাজান, ঢেউ-এর চূড়া আরো ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু ঢেউ তারপরও একই গতিতে যাবে। সুতরাং নিচু স্বরের আওয়াজের তুলনায় উচ্চ নোটের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত ছোট।
আর এটাই হচ্ছে শব্দতরঙ্গ। এখন যদি ডপলার শিফটের কথা ভাবেন, তাহলে কল্পনা করি যে-কোনো ট্রাম্পেটবাদক কোনো বরফে ঢাকা পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী একটি শব্দ তৈরি করল, আপনি একটি টোবোগানে উঠলেন এবং দ্রুত সেই ট্রাম্পেটবাদকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন [আমি গাড়ির বদলে টোবোগান নির্বাচন করলাম, কারণ এটি কোনো শব্দ করে না, আর আপনি ট্রাম্পেটের আওয়াজ শুনতে পাবেন]। আপনি কী শুনবেন? ধারাবাহিক তরঙ্গচূড়াগুলো যা ট্রাম্পেট থেকে বের হয়ে আসে পরস্পর থেকে একটি সুনির্দিষ্ট দূরত্বে, সেটি নির্দিষ্ট করে দেয় বাদক কোন ধরনের নোট বাজাবেন তার ওপর। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে যে হারে তরঙ্গগুলো গ্রহণ করত, আপনার কান একের পর এক আসতে থাকা এই তরঙ্গচূড়াগুলো আরো উচ্চ-হারে গ্রহণ করতে শুরু করবে যখন আপনি ট্রাম্পেটবাদকের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবেন, সুতরাং আওয়াজটি যতটা তীব্র নয় তার চেয়ে বেশি জোরে শোনা যাবে। তারপর যখন আপনি তার পাশ কেটে বের হয়ে যাবেন, আপনার কানে তরঙ্গগুলো কম হারে পৌঁছাবে [মনে হবে তাদের মধ্যে আরো বেশি ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, কারণ আপনি যেদিকে যাচ্ছেন শব্দতরঙ্গগুলোও সেদিকেই যাচ্ছে] এবং আওয়াজটির যতটা নিচু কপাঙ্কের তারচেয়ে কম তীব্র শোনাবে এবং একই ঘটনা ঘটবে যদি আপনার কান স্থির থাকে, কিন্তু শব্দের উৎসের অবস্থান পরিবর্তিত হয়। বলা হয়ে থাকে [আমি জানি না এটি সত্যি কিনা, কিন্তু সুন্দর গল্প এটি] যে ক্রিশ্চিয়ান ডপলার, অস্ট্রীয় যে বিজ্ঞানী এই প্রভাবটি আবিষ্কার করছিলেন, উন্মুক্ত রেলগাড়ির ট্রাকে বাজনা বাজানোর জন্যে একটি ব্যান্ড ভাড়া করেছিলেন, যেন তিনি ডপলার ইফেক্টটি দেখাতে পারেন। বাদ্যদলটির বাজনার আওয়াজ কমে যায় যখন রেলগাড়ির সেই বগিটি বিস্মিত দর্শকদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।
আলোর তরঙ্গ আবার ভিন্ন, ঠিক একেবারে মেক্সিকান ওয়েভ-এর মতো নয় আবার ঠিক শব্দতরঙ্গের মতো নয়, কিন্তু তাদেরও নিজস্ব সংস্করণের ‘ডপলার ইফেক্ট’ আছে। মনে করে দেখুন যে বর্ণালির লাল প্রান্তের তরঙ্গদৈর্ঘ্য লম্বা এর নীল প্রান্তের তুলনায়, আর সবুজ হচ্ছে এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্যের। মনে করুন ক্রিশ্চিয়ান ডপলারের সেই রেলগাড়ির খোলা বগিতে ব্যান্ডবাজিয়েরা সবাই হলুদ কাপড় পরে আছেন। ট্রেনটি যখন আপনার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসবে, আপনার চোখ তরঙ্গ অনেক বেশি দ্রুত শোষণ করবে, যদি ট্রেনটি দাঁড়ানো থাকত তখন যেভাবে হত সেই তুলনায়। সুতরাং এখানে রঙের একটি একক পরিবর্তন ঘটছে বর্ণালি সবুজ দিক বরাবর। এখন, যখন ট্রেনটি আপনাকে অতিক্রম করে যাবে, এটি আপনার থেকে দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছে, ঠিক বিপরীতটাই ঘটে এখানে। ব্যান্ডবাজিয়েদের পরনের কাপড়টিকে মনে হবে খানিকটা বেশি লালচে।
এই উদাহরণে শুধুমাত্র যে জিনিসটা ভুল সেটি হচ্ছে, নীল রঙের দিকে পরিবর্তন বা লাল রঙের দিকে পরিবর্তন, অর্থাৎ ব্লু শিফট বা রেড শিফট লক্ষ করতে হলে, ট্রেনকে প্রতি ঘণ্টায় বহু মিলিয়ন মাইল গতিতে চলতে হবে, আর কোনো ট্রেনই রঙের ডপলার ইফেক্ট লক্ষ করার মতো গতির ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারে না, কিন্তু গ্যালাক্সিরা সেটাই করে। বর্ণালির লাল প্রান্তের দিকে কোনো শিফট প্রদর্শন করে যে বহু দূরের গ্যালাক্সিরা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ঘণ্টায় বহু শত মিলিয়ন মাইল গতিবেগে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে গ্যালাক্সিরা যত দূরে অবস্থান করবে [যেটি পরিমাপ করা হয় স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল ব্যবহার করে, ইতোপূর্বে উল্লেখিত] ততই দ্রুত এটি আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে [আরো বেশি রেড শিফট]।
মহাবিশ্বের সব গালাক্সিগুলোই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এর মানে তারা আমাদের কাছ থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। আপনি কোন দিক বরাবর আপনার টেলিস্কোপ রাখছেন, সে বিষয়ে কোনোকিছু আসে- যায় না, ক্রমবর্ধিষ্ণু গতিতে গাল্যাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে [তাদের পরস্পরের কাছ থেকেও]। পুরো মহাবিশ্ব মহাশূন্যটাই, অবিশ্বাস্য সুবিশাল মাত্রায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সেই ক্ষেত্রে আপনি হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারেন কেন শুধুমাত্র গ্যালাক্সি স্তরেই মহাশূন্য সম্প্রসারিত হচ্ছে বলে মনে হয়? কেন গ্যালাক্সির মধ্যে বিদ্যমান তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না? কেন আমি আর আপনি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি না? এর উত্তর হচ্ছে পাশাপাশি বা নিকটে অবস্থান করা জিনিসগুলো, গ্যালাক্সির অন্য সবকিছুর মতোই, তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সবচেয়ে তীব্রভাবে মহাকর্ষীয় টান অনুভব করে, এটাই তাদের একসাথে ধরে রাখে, যখন দূরবর্তী বস্তুগুলো, অন্য গ্যালাক্সি, দূরে সরে যায় মহাশূন্য সম্প্রসারণের সাথে।
এখন বিস্ময়কর একটি বিষয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রসারণের বিষয়টি লক্ষ করেছেন এবং বিষয়টি সময়ের পশ্চাৎমুখী হিসাবনিকাশ করে দেখেছেন। তাঁরা যেন সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, যেখানে গ্যালাক্সিগুলো দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে, এরপর সেই ছবিটি বিপরীতমুখে চালানো হল। এবার তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার বদলে, এই বিপরীত দিকে চলা চলচ্চিত্রে আমরা দেখব গ্যালাক্সিগুলো একদিকে এক বিন্দুতে মিলিত হচ্ছে। আর সেখান থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিসাব করে সেই মুহূর্তটি শনাক্ত করেছেন, যে মুহূর্তে পুরো মহাবিশ্ব অবশ্যই শুরু হয়েছিল। এমনকি তাঁরা সেই মুহূর্তটি হিসাব করে বের করেছিলেন, এভাবেই তাঁরা জানেন ১৩ বিলিয়ন থেকে ১৪ বিলিয়ন বছরের মাঝামাঝি কোনো সময়ে, সেটাই সেই মুহূর্ত ছিল, যেখান থেকে মহাবিশ্ব নিজেই তার যাত্রা শুরু করেছিল, আর এই মুহূর্তটির নাম ‘বিগ ব্যাং’।
আজকের মহাবিশ্বের ‘মডেল’ পূর্বধারণা করে যে বিং ব্যাঙের সাথে শুধু একটিমাত্র মহাবিশ্বের শুরু হয়নি : সময় নিজেই এবং মহাশূন্য বা স্পেস বিগ ব্যাঙের সাথে যুক্ত। আমাকে এটি ব্যাখ্যা করার জন্যে অনুরোধ জানাবেন না, কারণ যেহেতু আমি কসমোলজিস্ট না, সুতরাং আমি নিজেই সেটি বুঝতে পারি না, কিন্তু আপনি হয়তো এখন বুঝতে পারবেন কেন আমি স্পেকট্রোস্কোপকে সর্বকালের জন্য সেরা আবিষ্কার হিসেবে মনোনীত করেছিলাম। রংধনুরা শুধুমাত্র দেখতেই সুন্দর নয়। একটি উপায়ে তারা সময় এবং মহাশূন্যসহ কখন সবকিছুর সূচনা হয়েছিল সেটি আমাদের জানায়। আমি মনে করি এটি রংধনুদের আরো সুন্দর করেছে।