তৃতীয় অধ্যায় – কেন এত বেশি বিচিত্র ধরনের জীব?
কোনো প্রাণী যেমন দেখতে, কেন তারা তেমন দেখতে হয় সেটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে নানা ধরনের পুরাণ-কাহিনি—কিংবদন্তির সেই গল্পগুলো ‘ব্যাখ্যা’ করেছে, যেমন—কেন চিতাবাঘের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে, কেন খরগোশের সাদা লেজ থাকে, কিন্তু খুব বেশি পুরাণ- কাহিনি নেই যা কিনা পৃথিবীতে এই অসংখ্য বিচিত্র জীবদের অস্তিত্বের কারণ কী সে ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। ‘টাওয়ার অব বাবেলের’ সেই ইহুদি পুরাণ-কাহিনির সমতুল্য আমি কোনোকিছু পাইনি, যা পৃথিবীর বহু বিচিত্র ভাষার উপস্থিতি ‘ব্যাখ্যা’ করেছিল। বহুদিন আগে, এই কাহিনি অনুযায়ী, সারা পৃথিবীর মানুষ একই ভাষায় কথা বলত। সুতরাং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে তারা অনেক উঁচু একটি স্তম্ভ নির্মাণ করতে শুরু করেছিল, তারা আশা করেছিল সেই স্তম্ভটি যেন আকাশ স্পর্শ করে, কিন্তু ঈশ্বর ব্যাপারটি লক্ষ করেছিলেন এবং মানব জাতির সদস্যরা সবাই যে পরস্পরের ভাষা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে বিষয়টি তাঁর আদৌ পছন্দ হয়নি। কারণ মানুষেরা সবাই যদি সবার ভাষা বোঝে আর একসাথে কাজ করে, এরপরে তাহলে তারা কী-না করতে পারে? সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের ভাষাগুলোকে ‘বিশৃঙ্খল আর তালগোল পাকিয়ে’ দেবেন, যেন তারা পরস্পরের ভাষা বুঝতে না পারে। সুতরাং এই পুরাণ-কাহিনিটি বলছে, কেন পৃথিবীতে এত ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আমরা দেখতে পাই এবং কেন, যখন মানুষ অন্য গোত্র বা দেশের মানুষের সাথে কথা বলতে চায়, তাদের কথা শুনলে পরস্পরের কাছে অর্থহীন বকবকানি মনে হয়। যথেষ্ট অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ইংরেজি ‘ব্যবল’ শব্দটি [যার অর্থ অসংলগ্ন বা অর্থহীন কথা বলা বা বকবক করা] আর টাওয়ার অব বাবেল-এর মধ্যে শব্দের উৎপত্তিগত কোনো যোগসূত্রতা নেই।
আমি একই ধরনের পুরাণ খুঁজে পাব বলে আশা করেছিলাম, যা কিনা পৃথিবীতে নানা ধরনের বিচিত্র জীবদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করবে, কারণ প্রাণী ও ভাষা-বিবর্তনের মধ্যে খানিকটা সদৃশ্যতা আছে, যেমনটি আমরা পরে দেখব, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এমন কোনো পুরাণ নেই, যা সুনির্দিষ্টভাবে বহু ‘বিচিত্র প্রাণীদের অতি বিশাল সংখ্যাটি’ ব্যাখ্যা করেছে। এটি বেশ বিস্ময়কর, কারণ পরোক্ষ প্রমাণ আছে, বহু ধরনের যে প্ৰাণী আছে আদিবাসী মানুষেরা সেই বাস্তব সত্যটি সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। ১৯২০-এর দশকে, এখন অত্যন্ত বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী, আর্নস্ট মায়ার পাপুয়া নিউ গিনির হাইল্যান্ডে পাখিদের নিয়ে যুগান্তকারী একটি গবেষণা করেছিলেন। তিনি প্রায় ১৩৭টি পাখি প্রজাতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন এবং এরপর তিনি আবিষ্কার করেন, অবশ্যই বিস্ময়ের সাথে, স্থানীয় পাপুয়া আদিবাসীদের কাছে এদের মধ্যে ১৩৬ পাখির জন্যেই আলাদা আলাদা নাম আছে।
আবার পুরাণে ফিরে যাই। উত্তর আমেরিকার হপি গোত্রের আদিবাসীদের এক দেবী ছিলেন, যাঁর নাম ‘স্পাইডার উওম্যান’। তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের পুরাণে, এই দেবী সূর্যদেবতা ‘তাওয়া’র সাথে জোট বেঁধেছিলেন এবং দ্বৈতভাবে তাঁদের ‘প্রথম জাদুকরী গান’ গেয়েছিলেন। এই গানটি পৃথিবী এবং জীবন সৃষ্টি করেছিল। ‘স্পাইডার উওম্যান’ এরপর ‘তাওয়া’র চিন্তার সূত্রগুলো সুতোর মতো বুনন করে মাছ, পাখি এবং অন্য সব প্রাণীদের বর্তমান রূপ দিয়েছিলেন।
উত্তর আমেরিকার অন্য গোত্রগুলো, যেমন—পুয়েবলো আর নাভাহো আদিবাসীদের একটি পুরাণ-কাহিনি আছে, যার সাথে বিবর্তনের খুব সামান্য কিছু মিল আছে : পৃথিবী থেকে জীবন বেরিয়ে এসেছিল, যেমন করে কোনো বিকাশমান উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে ধারাবাহিক কিছু ধাপের অনুক্রমে। পোকামাকড়েরা তাদের জগৎ, প্রথম বা লাল বিশ্ব থেকে, উপরে উঠে আসে দ্বিতীয় বিশ্বে, নীল বিশ্বে, যেখানে পাখিদের বাস। দ্বিতীয় বিশ্ব এরপর আরো বেশি জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে, সে-কারণে পাখিরা আর কীটপতঙ্গরা উড়ে যায় তৃতীয় জগতে বা হলুদ বিশ্বে, যেখানে মানুষ আর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বাস। এর পর হলুদ বিশ্বও ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে, খাদ্যের ঘাটতি দেখা যায় এবং সবাই চতুর্থ বিশ্বে উঠে আসে, সাদা আর কালো বিশ্বে, দিন ও রাতের বিশ্ব। এখানে দেবতারা ইতোমধ্যেই বুদ্ধিমান মানুষদের সৃষ্টি করে রেখেছিলেন, যারা জানত কিভাবে চতুর্থ বিশ্বে চাষাবাদ করা যায় এবং তারা নবাগতদের শিখিয়েছিলেন কিভাবে শস্য উৎপাদন করতে চাষাবাদ করতে হয়। ইহুদিদের সৃষ্টি পুরাণ জীববৈচিত্র্যের ব্যাপারে খানিকটা সুবিচার করেছে বলা যেতে পারে, তবে এটি ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা করেনি। আসলেই, ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থে দুটি ভিন্ন সৃষ্টিতত্ত্ববাদের পুরাণ আছে, যেমনটি আমরা এর আগের অধ্যায়ে দেখেছিলাম। প্রথমটিতে, ঈশ্বর মাত্র ছয়দিনে সবকিছুই সৃষ্টি করেছিলেন। পঞ্চম দিনে তিনি মাছ, তিমি ও অন্য সামুদ্রিক প্রাণীদের সৃষ্টি করেন, এছাড়াও আকাশে ওড়া পাখি। ষষ্ঠ দিনে মানুষসহ তিনি বাকি সব স্থলবাসী প্রাণীদের সৃষ্টি করেন। পুরাণের ভাষা কিছুটা নজর দিয়েছিল জীবিত প্রাণীদের সংখ্যা ও তাদের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করার জন্য। যেমন—’ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন বিশাল তিমিদের এবং প্রতিটি জীবিত প্রাণী যারা নড়াচড়া করে, পানি যা জন্ম দিয়েছিল প্রচুর পরিমাণে তাদের সেই নানা প্রকারের এবং প্রতিটি ডানাওয়ালা পাখিদের আলাদা করে এবং তিনি সৃষ্টি করেছিলেন’, ‘পৃথিবীর প্রতিটি জন্তু’ এবং ‘সবকিছু যা পৃথিবীর উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে’, কিন্তু কেন এত বিচিত্র প্রাণী? আমাদের সেটি বলা হয়নি।
দ্বিতীয় পুরাণে আমরা কিছুটা আভাস পাই, ঈশ্বর হয়তো ভেবেছিলেন প্রথম মানুষের বিচিত্র ধরনের সঙ্গীর দরকার আছে। অ্যাডাম, প্ৰথম মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল একা এবং তাঁকে সুন্দর স্বর্গোদ্যানেও রাখা হয়েছিল, কিন্তু তারপর ঈশ্বর অনুধাবন করেছিলেন, মানুষের একা থাকা উচিত না। ‘সুতরাং তিনি স্থলে প্রতিটি প্রাণী আর আকাশে প্রতিটি পাখি সৃষ্টি করলেন এবং তাদের দেখাতে অ্যাডামের কাছে নিয়ে আসেন, কী নামে সে তাদের ডাকে।’
কিন্তু সত্যি, আসলেই পৃথিবীতে এত বিচিত্র ধরনের প্রাণী কেন?
সব প্রাণীদের নাম দেয়ার কাজটি অ্যাডামের জন্যে স্পষ্টতই বেশ কঠিন ছিল, প্রাচীন হিব্রুদের পক্ষে যতটুকু বোঝা সম্ভব হয়েছিল তার চেয়েও বেশি। অনুমান করা হয় প্রায় ২ মিলিয়ন প্রজাতিকে আপাতত আমরা বৈজ্ঞানিক নাম দিতে পেরেছি এবং যে প্রজাতিদের এখনো বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া সম্ভব হয়নি তার খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ এটি।
কিভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, দুটি জীব একই প্রজাতির সদস্য, নাকি তারা দুটি ভিন্ন প্রজাতির? যে জীবরা যৌনপ্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে, তাদের ক্ষেত্রে একটি সংজ্ঞা প্রস্তাব করতে পারি। জীবরা ভিন্ন প্রজাতির সদস্য যদি তারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে না পারে। কিছু ব্যতিক্রম আছে যেমন—ঘোড়া আর গাধা, যারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারে এবং সন্তানও জন্ম দিতে পারে [যাদের বলা হয় মিউল বা হিনিস, খচ্চর] তবে তারা অনুর্বর, তার মানে এরা নিজেরা কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। আমরা সে-কারণে ঘোড়া আর গাধাকে ভিন্ন প্রজাতিতে শ্রেণিভুক্ত করেছি। আরো সুস্পষ্ট উদাহরণ যেমন—ঘোড়া আর কুকুরেরা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্য, কারণ তারা চেষ্টাও করে না নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে এবং যদি তারা সেটি করেও তারা কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারবে না, এমনকি অনুর্বর কোনো সন্তানও, কিন্তু স্প্যানিয়েল আর পুডলস জাতের কুকুরেরা একই প্রজাতির সদস্য কারণ এরা নিজের মধ্যে সহজেই প্রজনন করতে পারে এবং তারা যে সন্তান উৎপাদন করে তারাও উর্বর, অর্থাৎ তারাও সন্তানের জন্ম দিতে পারবে।
প্রতিটি প্রাণী আর উদ্ভিদদের বৈজ্ঞানিক নামে দুটি ল্যাটিন শব্দ আছে, সাধারণত ‘ইটালিক’ [বা একপাশে কাত করে] রূপে লেখা হয়। প্রথম শব্দটি ‘জিনাস’ বা গণ বা প্রজাতিদের গ্রুপের প্রতি ইঙ্গিত করে এবং দ্বিতীয় শব্দটি সেই জিনাসের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট স্পিসিস বা প্রজাতিকে নির্দেশ করে। হোমো সেপিয়েন্স [Homo sapIens, জ্ঞানী মানুষ] আর এলিফাস ম্যাক্সিমাস [Elephas maxImus, খুব বড় হাতি] যেমন দুটি উদাহরণ। প্রতিটি প্রজাতি একটি জিনাসের [গণ] সদস্য। হোমো হচ্ছে একটি জিনাস, তেমনি এলিফাসও। সিংহ হচ্ছে প্যানথেরা লিও [Panthera leo] এবং জিনাস প্যানথেরার মধ্যে আছে প্যানথেরা টাইগ্রিস [ Panthera tIgrIs] [বাঘ], প্যানথেরা পারদুস [Panthera pardus] [চিতাবাঘ বা প্যানথার] এবং প্যানথেরা ওনকা [Panthera onca] [জাগুয়ার]। আমাদের হোমো জিনাসে কেবলমাত্র একটি প্রজাতি এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু জীবাশ্মদের যেমন নাম দেয়া হয়েছে হোমো ইরেকটাস [Homo erectus] এবং হোমো হ্যাবিলিস [Homo habIlIs]। অন্য মানব-সদৃশ্য জীবাশ্মগুলো হোমো থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ভিন্ন যে তাদের পৃথক জিনাসে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, যেমন— অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস [AustralopIthecus AfrIcanas], অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস [ AustralopIthecus AfarensIs ] [ না… অস্ট্রেলিয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, অস্ট্রালো মানে দক্ষিণের, অস্ট্রেলিয়া নামটাও সেখান থেকেই এসেছে]।
প্রতিটি জিনাস একটি ফ্যামিলি বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, সাধারণত রোমান হরফে বড় হাতের প্রথম অক্ষরসহ এটি লেখা হয়। ক্যাটস বা বিড়ালরা [যার মধ্যে আছে সিংহ, চিতাবাঘ, লিঙ্কস এবং আরো অনেক ছোট আকারের বিড়াল] মিলে ফেলিডি [FelIdae] পরিবার তৈরি করে। প্রতিটি পরিবার আবার একটি অর্ডার বা বর্গের সদস্য। বিড়াল, কুকুর, ভালুক, উইজেল, হায়েনা এরা ভিন্ন পরিবারের সদস্য হলেও তারা সবাই কার্নিভোরা [CarnIvora] অর্ডারের সদস্য।
বানর, নরবানর বা এইপ [আমরাসহ] এবং লেমুররা সবাই পৃথক পরিবারের সদস্য, তবে প্রাইমেট [PrImate] অর্ডারের এবং প্রতিটি অর্ডার আবার একটি ক্লাস বা শ্রেণির সদস্য, সব স্তন্যপায়ীরা ম্যামালিয়া [MammalIa] শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
আপনি কি দেখতে পারছেন, একটি গাছের ধারণা আপনার মনের মধ্যে গড়ে উঠছে যখন আপনি শ্রেণিবিন্যাসের বিবরণটি পড়ছিলেন? এটাই একটি পারিবারিক বৃক্ষ, একটি গাছ যার বহু শাখা আছে, প্রতিটি শাখার আছে প্রশাখা, প্রতিটি প্রশাখাও আবার বিভক্ত বেশ কয়েকটি ধাপে। প্রতিটি ডালের শেষ প্রান্তগুলো হচ্ছে এক-একটি প্রজাতি। অন্য শ্রেণিগুলো, শ্রেণি, বর্গ, পরিবার, গণ হচ্ছে শাখা, প্রশাখা। পুরো বৃক্ষটাই পৃথিবীর সমস্ত জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে।
চিন্তা করে দেখুন গাছে কেন এত বেশি ডালপালা থাকে? শাখাগুলো আবার উপশাখায় বিভাজিত হয়। যখন আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ শাখার শাখার শাখা হবে, গাছের ছোট ডালের সংখ্যাও অনেক বেশি হবে। বিবর্তনে সেটাই ঘটে। চার্লস ডারউইন নিজে তাঁর বিখ্যাত অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বইয়ে একটিমাত্র ছবি হিসেবে একটি শাখা বিভাজিত হওয়া গাছ এঁকেছিলেন। এর একটি প্রাথমিক সংস্করণ তিনি এঁকেছিলেন কয়েক বছর আগে তাঁর নোটবুকে। সেখানে পৃষ্ঠার উপর রহস্যময় একটি ছোট বার্তা লিখেছিলেন তাঁর নিজের জন্য : ‘আই থিঙ্ক’ আপনি কি মনে করেন, তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন ওই দুটি শব্দ দিয়ে? তিনি হয়তো কোনো একটি বাক্য লিখতে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের কেউ এসে বিরক্ত করায় বাক্যটি লিখে শেষ করতে পারেননি। হয়তো তিনি যা ভাবছিলেন, সেটিকে প্রকাশ করার জন্যে শব্দের চেয়ে এই ড্রায়াগ্রামটিকে সহজতর মনে করেছিলেন। হয়তো আমরা কখনোই তা জানতে পারব না। সেই পৃষ্ঠায় আরো একটি হাতের লেখা আছে, কিন্তু সেটি মর্মোদ্ধার করা বেশ কঠিন। মহান বিজ্ঞানীদের সত্যিকারের নোটগুলো পড়া খুব লোভনীয়, যা হয়তো কোনো বিশেষ দিনে তিনি লিখে রেখেছিলেন নিজের জন্যে, প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে নয়।
পরের অংশটি, জীবদের এই গাছটি কিভাবে শাখা-প্রশাখায় বিভাজিত হয় সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আলোচনা করবে না, কিন্তু আপনাকে একটি মূলনীতি সম্বন্ধে ধারণা দেবে। কল্পনা করুন একটি আদি পূর্বসূরি প্রজাতি দুটি পৃথক প্রজাতিতে বিভাজিত হয়েছে। এরপর যদি সেই প্রজাতি দুটি আবারো দ্বি-বিভাজিত হয় তাহলে প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়াবে চার তাদের প্রত্যেকটি যদি আবার দ্বিবিভাজিত হয় তাহলে প্রজাতি হবে আটটি, এভাবে ১৬, ৩২, ৬৪, ১২৮, ২৫৬, ৫১২…; আপনি দেখতে পারছেন, যদি এই দ্বিগুণ হওয়া আপনি অব্যাহত রাখেন, খুব বেশি সময় লাগবে না মিলিয়ন সংখ্যক প্রজাতিতে পৌঁছাতে। হয়তো বিষয়টি আপনি বুঝতে পারছেন, কিন্তু আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন একটি প্রজাতি বিভাজিত হবে। বেশ, এটি অনেকটাই মানব ভাষা যেকারণে বিভাজিত হয়েছে সেই একই কারণে, তাহলে আসুন একটি বিরতি নেই সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য।
পৃথকীকরণ : কিভাবে ভাষা এবং প্রজাতি বিভাজিত হয়
যদিও টাওয়ার অব বাবেলের পুরাণ-কাহিনিটি আসলে সত্যি নয়, কিন্তু এটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে, কেনই-বা পৃথিবীতে এত বেশি বিচিত্র ধরনের ভাষার অস্তিত্ব আছে? ঠিক যেমন কিছু প্রজাতি অন্যদের চেয়ে বেশি পরস্পর-সদৃশ এবং তাদের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে একই পরিবারে, ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক এ ধরনের পরিবার আছে, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ, ফরাসি এবং বহু ইউরোপীয় ভাষা এবং ভাষাভঙ্গি যেমন—রোমান্স, গ্যালিসিয়ান, অক্টিয়ান এবং কাটালান প্রত্যেকটি ভাষাই পরস্পর-সদৃশ। বর্তমানে এর একত্রে রোমান্স ভাষা পরিবার হিসেবে পরিচিত। এই নামটি আসলে এসেছে ল্যাটিন থেকে, তাদের সাধারণ উৎপত্তির কারণে, রোমের যা ভাষা ছিল। না, সেই রোমান্সের সাথে এর কোনো যোগসূত্রতা নেই, কিন্তু আসুন উদাহরণ হিসেবে ভালোবাসার একটি অভিব্যক্তিকে আমরা ব্যবহার করি। আপনি কোন দেশে বাস করেন তার ওপর নির্ভর করবে উল্লেখিত এই উপায়গুলোর কোনটি আপনি ব্যবহার করতে পারেন আপনার একান্ত সেই অনুভূতিটি ঘোষণা করার জন্য : TI amo, Amote, T’aImI বা je t’aIme। ল্যাটিন ভাষায় এটি হবে Te amo—ঠিক আধুনিক স্প্যানিশ ভাষার মতোই।
কেনিয়া, তানজানিয়া বা উগান্ডায় কেউ যদি ভালোবাসার অঙ্গীকার করতে চান, তিনি বলতে পারেন, সোয়াহিলি ভাষায় নাকুপে ভা [Nakupenda] আরো দক্ষিণে মোজাম্বিক, জাম্বিয়ায় বা মালাওয়ি, যেখানে আমার নিজের শৈশব কেটেছে, আপনাকে হয়তো চিনইয়ানযা ভাষায় কথা বলতে হবে, এনডিমাকুকোন্ডা [NdImakukonda]। আফ্রিকার দক্ষিণে অন্য বান্টু ভাষাগুলোয় আপনি হয়তো বলবেন এনডিনোকুডা [NdInokuda], এনদিয়াকুথান্ডা [NdIakuthanda] অথবা কোনো জুলুকে এনগিয়াকুথান্ডা [NgIakuthanda] বলতে হবে। এই বান্টু পরিবারে ভাষাগুলো রোমান্স পরিবারের ভাষাগুলো থেকে খুবই আলাদা, আবার এই দুই পরিবার খুব আলাদা জার্মানিক পরিবারের ভাষাগুলো থেকে, যেমন- ডাচ, জার্মান এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভাষাগুলো। দেখুন কিভাবে আমরা পরিবার শব্দটি ব্যবহার করছি, ঠিক যেভাবে প্রজাতির জন্যে ব্যবহার করেছি [বিড়াল বা ক্যাট পরিবার, কুকুর পরিবার] এবং অবশ্যই আমাদের নিজেদের পরিবারগুলো [যেমন—জোনস পরিবার, রবিনসন পরিবার, ডকিন্স পরিবার]।
কিভাবে একই পরিবারের কাছাকাছি ভাষাগুলো উদ্ভব হয়েছে কয়েক শতাব্দী সময় ধরে, সেটি সমাধান করা খুব কঠিন কিন্তু নয়। ভালো করে শুনুন কিভাবে আপনি ও আপনার বন্ধু কথা বলেন এবং এটি তুলনা করুন কিভাবে আপনার দাদা-দাদি কথা বলতেন, তাঁদের ভাষা সামান্য খানিকটা আলাদা এবং আপনি খুব সহজে তাঁদের বুঝতে পারতেন, কারণ তাঁরা মাত্র দুটি প্রজন্ম দূরে। কল্পনা করুন, আপনার দাদা-দাদি নয়, আপনার ২৫তম-প্র-পিতামহ/মহীর সাথে। আপনি যদি ইংরেজ হন, তাহলে সেটি আপনাকে নিয়ে যাবে চতুর্দশ শতকের শেষে, জিওফ্রে চসারের জীবদ্দশায়, যিনি এমনকিছু লিখেছিলেন—
He was a lord ful fat and In good poynt;
HIs eyen stepe, and rollynge In hIs heed,
That stemed as a forneys of a leed;
HIs bootes souple, hIs hors In greet estaat.
Now certeInly he was a faIr prelaat;
He was nat pale as a forpyned goost.
A fat swan loved he best of any roost.
HIs palfrey was as broun as Is a berye.
বেশ, এটি যে ইংরেজি ভাষা সেটি শনাক্ত করা যাচ্ছে, তাই-না? তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারব, আপনার এটি বুঝতে বেশ কষ্টই হবে, যদি কাউকে এটি বলতে শোনেন এবং যদি এটি আরেকটু বেশি ভিন্ন হত তাহলে আপনি হয়তো এটিকে ভিন্ন একটি ভাষা মনে করতেন; ইতালীয় ভাষা থেকে যেমন স্প্যানিশ ভাষা ভিন্ন।
সুতরাং, শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে কোনো একটি এলাকার ভাষা পরিবর্তিত হয়; আমরা বলতে পারি এটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয় ভিন্ন কোনো ভাষায়। এবার বাস্তব সেই সত্যটি যোগ করুন, যে মানুষগুলো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসবাস করে আর একই ভাষায় কথা বলে, প্রায়শই তাদের সুযোগ থাকে পরস্পরের কথা শোনার [অথবা নিদেনপক্ষে তারা সেই সুযোগ পায়নি টেলিফোন বা রেডিও আবিষ্কারের আগে]; এবং আরো একটি বাস্তব সত্য হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভাষা ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়। শব্দগুলো যেমন পরিবর্তিত হয়, সেগুলো কেমনভাবে উচ্চারিত হবে, এই পরিবর্তন সেটির ওপর একইভাবে প্রভাব ফেলে। চিন্তা করে দেখুন ইংরেজি কত ভিন্ন স্কটল্যান্ড, ওয়েলশ, জিওরর্ডি, কর্নিশ, অস্ট্রেলিয়া অথবা আমেরিকার স্থানীয় উচ্চারণভঙ্গিতে এবং স্কটল্যান্ডের যে কেউই অনায়াসে এডিনবরা, গ্লাসগো অথবা হেরিডিয়ান উচ্চারণভঙ্গিগুলো পৃথক করতে পারবেন। সময়ের সাথে, কিভাবে ভাষাটি বলা ও শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি কোনো একটি অঞ্চলের জন্যে বৈশিষ্ট্যসূচক হয়ে ওঠে। যখনই একই ভাষা দুইভাবে বলার উপায়টি যথেষ্ট পরিমাণ দূরে সরে যায়, সেগুলো আমরা ভিন্ন ধরনের ডায়ালেক্ট বা উপভাষা [ভাষার আঞ্চলিক রূপ] হিসেবে চিহ্নিত করি।
যথেষ্ট পরিমাণ শতাব্দী পৃথকীকরণের পরে, বিভিন্ন এলাকার উপভাষাগুলো অবশেষে ধীরে ধীরে এত বেশি আলাদা হয়ে যায়, কোনো একটি এলাকার মানুষ অন্য এলাকার মানুষের ভাষা আর বুঝতে পারে না। এই পর্যায়ে আমরা তাদের পৃথক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করি। এটাই ঘটেছিল, বিলুপ্ত কোনো পূর্বসূরি ভাষা থেকে যখন জার্মান আর ডাচ ভাষা আলাদা হয়েছিল পৃথক পৃথক দিকে এবং এটাই ঘটেছিল ফরাসি, ইতালীয় ও পর্তুগিজ ভাষার সাথে স্বতন্ত্রভাবে, যখন তারা ল্যাটিন থেকে ক্রমশ সরে গিয়েছিল ইউরোপের পৃথক পৃথক এলাকার স্থানীয় ভাষায়। ভাষার কোনো পারিবারিক বৃক্ষ যদি আপনি আঁকেন, ফরাসি, পর্তুগিজ আর ইতালীয় সম্পর্কিত ভাষাগুলো কাছাকাছি শাখায় অবস্থান করবে এবং ল্যাটিনের মতো পূর্বসূরিরা থাকবে গাছের আরো ভিতরের দিকে, ঠিক যেমন ডারউইন প্রজাতিদের সাথে করেছিলেন 1
ভাষার মতোই প্রজাতিও সময় এবং দূরত্বের সাথে পরিবর্তিত হয়। আর কেন এমন ঘটে সেটি দেখার আগে, আমাদের দেখতে হবে কিভাবে তারা কাজটি করে। প্রজাতির ক্ষেত্রে ‘শব্দের’ সমতুল্য হচ্ছে ডিএনএ, সেই জিনগত তথ্য, যা প্রতিটি জীব তাদের কোষে বহন করে যেখানে এটি নির্ধারণ করে, কিভাবে জীবটিকে তৈরি করা হবে, আমরা যেমন দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি। যখন কোনো সদস্য যৌনপ্রজনন করে, তারা তাদের ডিএনএগুলো মিশ্রণ করে। আর যখন স্থানীয় কোনো একটি জনগোষ্ঠীর সদস্যরা অন্য একটি এলাকার স্থানীয় আরেকটি জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাসের জন্যে গমন করে, সেই গোষ্ঠীর কোনো সদস্যের সাথে প্রজননের মাধ্যমে তাদের জিনগুলো সদ্য যোগ দেয়া নতুন সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। আমরা একে বলি ‘জিন ফ্লো’ বা জিন প্রবাহ।
যেমন ধরুন, ইতালীয় ও ফরাসি ভাষা পৃথক হবার সমতুল্য, এমনকিছু বলা যে তারা এত দূরে সরে গেছে যে, সময়ের সাথে দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ডিএনএ ক্রমেই সদৃশ্যতা হারিয়েছে। তাদের ডিএনএ সন্তান তৈরির করার লক্ষ্যে কাজ করতে ক্রমশ পরস্পরের অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঘোড়া ও গাধারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারে, কিন্তু ঘোড়ার ডিএনএ গাধার ডিএনএ থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে তারা আর নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করতে পারে না বা বরং বলা উচিত যথেষ্ট ভালোভাবে মিশ্রিত হতে পারে না, এক্ষেত্রে তুলনামূলক উদাহরণের রূপক ব্যবহার করে আমরা বলতে পারি, ডিএনএ-এর দুটি ‘ডায়ালেক্ট’ মোটামুটি মিশ্রিত হতে পারে ঠিকই পরিণতিতে একটি জীবিত প্রাণীরও সৃষ্টি হয় : মিউল [খচ্চর], কিন্তু পরবর্তীতে এমন কোনো প্রজন্ম সৃষ্টি করতে তারা যথেষ্ট ভালোভাবে মিশ্রিত হতে পারে না, যারা কিনা পরবর্তীতে সফল প্ৰজনন [অর্থাৎ উর্বর প্রজন্ম সৃষ্টি] করতে পারে; সুতরাং, যেমনটি আমরা দেখি, এরা অনুর্বর।
প্রজাতি আর ভাষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য হচ্ছে, পুরোপুরিভাবে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার বহু পরেও, একটি ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করতে পারে, রোমান্স, জার্মানিক এবং কেল্টিক ভাষা থেকে যেমন আলাদা হবার বহুদিন পরও ইংরেজি ভাষা বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দসংগ্রহ করেছে। ইংলিশ ভাষা হিন্দি থেকে Shampoo শব্দটি, নরওয়েজীয় ভাষা থেকে Iceberg, বাংলা থেকে Bungalo, ইন্যুইট থেকে Anorak ইত্যাদি সংগ্রহ করেছে। প্রাণী প্রজাতিরা এর ব্যতিক্রম কখনোই আর ডিএনএ বিনিময় করে না, একবার যখন তারা যথেষ্ট পরিমাণ দূরে চলে যায়, তারা পরস্পরের সাথে প্রজননও বন্ধ করে দেয়। ব্যাকটেরিয়াদের কাহিনি অবশ্য ভিন্ন, তারা জিন বিনিময় করে, কিন্তু এই বইয়ে সেটি নিয়ে আলোচনা করার মতো যথেষ্ট জায়গা নেই, অধ্যায়ের বাকি অংশে মনে করুন আমরা শুধু প্রাণীদের নিয়ে কথা বলছি।
দ্বীপ এবং বিচ্ছিন্নতা : পৃথকীকরণের শক্তি
সুতরাং প্রজাতির ডিএনএ, ভাষার শব্দগুলোর মতো, যখন পৃথক হয়ে পড়ে তারা ক্রমেই পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। কেন এমনকিছু ঘটতে পারে? পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াটিই-বা কিভাবে শুরু হতে পারে? একটি সুস্পষ্ট সম্ভাবনা হচ্ছে সমুদ্র। সমুদ্র দ্বারা পৃথক দ্বীপগুলোর প্রাণী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পরস্পরের সাথে দেখা হয় না অন্তত সচরাচর বিষয়টি ঘটে না, সুতরাং দুই সেট জিনের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যাবার সুযোগ থাকবে। এই বিষয়টি দ্বীপগুলোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে নতুন প্রজাতির উৎপত্তির [প্রজাত্যায়ন বা স্পিসিয়েশনের] জন্য, কিন্তু আমরা কোনো দ্বীপকে চারিদিকে পানি দিয়ে ঘেরা একটুকরো ভূখণ্ড ছাড়াও আরো বেশি কিছু বা অন্যভাবেও ভাবতে পারি। যেমন—কোনো ব্যাঙের জন্য একটি মরুদ্যানই হচ্ছে দ্বীপ, কোনো মাছের জন্য হ্রদ হচ্ছে একটি দ্বীপ। দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ, প্রজাতি কিংবা ভাষার জন্য, কারণ কোনো একটি দ্বীপের জনগোষ্ঠী অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন [প্রজাতির ক্ষেত্রে যা জিন ফ্লো বা জিন প্রবাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, ঠিক যেভাবে এটি ভাষার ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ঠেকায়], সুতরাং একটি নিজস্ব দিকে বিবর্তিত হবার জন্য এটি মুক্ত।
এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, চিরকালের জন্য কোনো একটি দ্বীপে জনগোষ্ঠীকে আবশ্যিকভাবে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে না : কখনো কখনো জিন এটিকে ঘিরে থাকা সীমারেখাটি অতিক্রমও করে, হতে পারে সেটি পানি কিংবা বসবাসের অযোগ্য কোনো ভূমি।
১৯৯৫ সালের ৪ অক্টোবর, কিছু উপড়ে পড়া গাছ আর গাছের গুঁড়ির একটি ভেলা আনগুইলা নামের একটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপের বেলাভূমিতে এসে পৌঁছেছিল। এই ভেলায় ছিল পনেরোটি সবুজ ইগুয়ানা; আরেকটি দ্বীপ, ১৬০ কিলোমিটার দূরের, সম্ভবত গুয়াদেলুপ থেকে বিপদসংকুল একটি যাত্রাশেষে তারা জীবিতও ছিল। দুটি ঘূর্ণিঝড়, লুইস আর মেরিলিন, এর আগের মাসেই প্রচুর গাছ উপড়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দুটি ঘূর্ণিঝড় ক্যারিবীয় সাগরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ঝড় দুটির কোনো একটি এমনকিছু গাছ ভেঙে ফেলেছিল, যে গাছে এই ইগুয়ানারা বসে ছিল [তারা গাছে চড়তে খুব ভালোবাসে, আমি পানামায় দেখেছিলাম] এবং সেই গাছগুলোই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রে। অবশেষে তারা আনগুইলায় এসে পৌঁছায়, তাদের সেই অপ্রচলিত বাহন থেকে ইগুয়ানারা হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল নতুন দ্বীপের বেলাভূমিতে এবং খাদ্যসংগ্রহ, প্রজনন এবং তাদের ডিএনএকে দ্বীপের নতুন বাসভূমিতে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে এরা নতুন জীবন শুরু করেছিল।
আমরা জানি এটি ঘটেছিল কারণ আনগুইলাতে এই ইগুয়ানাদের আসার ব্যাপারটি দেখেছিল স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। বহু শতাব্দী আগে, যদিও সেই ঘটনার সাক্ষ্য দেয়ার মতো কেউ তখন ছিল না, প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় এ রকমই কোনো ঘটনা ঘটেছিল, ইগুয়ানার পূর্বসূরিরা গুয়াদেলুপে এসে যখন তাদের প্রথম বসতি গড়েছিল এবং এ রকমই কোনো ঘটনা গালাপাগোস দ্বীপের ইগুয়ানাদের উপস্থিতিকেও প্রায় নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারে। আমাদের গল্পের পরের ধাপে আমরা তাদের কথাই আলোচনা করব।
গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সম্ভবত এই দ্বীপগুলোই ডারউইনকে প্রথম বিবর্তন নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল, যখন ১৮৩৫ সালে এইচএমএস বিগলের একজন অভিযাত্রী হিসেবে তিনি সেখানে পা রেখেছিলেন। এটি মূলত একগুচ্ছ আগ্নেয় দ্বীপ, দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল থেকে ৬০০ মাইল পশ্চিমে বিষুবরেখার কাছে প্ৰশান্ত মহাসাগরে এর অবস্থান। সাগর তলদেশের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বেশ নবীন [মাত্র অল্প কয়েক মিলিয়ন বছর প্রাচীন] এই দ্বীপগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল হয়েছিল। এর মানে হচ্ছে এখানকার সব জীব, প্রাণী ও উদ্ভিদ, এই দ্বীপগুলোয় বসতি গড়েছে অন্য কোনো জায়গা থেকে এখানে এসে, খুব সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে, বিবর্তনের সময়ের মানদণ্ডে, বেশ সাম্প্রতিক একটি সময়ে। একবার এখানে এসে বসতি গড়ার পর, প্রজাতিগুলো এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছিল, আর সেটি ঘটেছিল যথেষ্ট প্রায়শই [হয়তো প্রতি শতাব্দীতে অথবা তেমন কোনো সময়ের ব্যাপ্তিতে একবার বা দুইবার] কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে কম একটি হারে, সুতরাং, তারা পৃথকভাবে বিবর্তিত হতে পেরেছিল। যেমন আমি বলেছিলাম, এই কদাচিৎ এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাবার মধ্যবর্তী সময়ে বিরতিতে তারা ক্রমশ ‘পৃথক হতে পেরেছিল।
কেউ জানে না প্রথম কখন ইগুয়ানারা গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এসেছিল। সম্ভবত মূল ভূখণ্ড থেকে তারা কোনোকিছুর উপর ভেসে এসেছিল, ঠিক যেমন করে ১৯৯৫ সালে একদল ইগুয়ানা আনগুইলাতে ভেসে এসেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে নিকটবর্তী দ্বীপটির বর্তমান নাম হচ্ছে ‘সান ক্রিস্টোবাল’ [ডারউইনের সময় এটি পরিচিত ছিল এর ইংরেজি নাম ‘চ্যাটহাম’ নামে], কিন্তু বহু মিলিয়ন বছর আগে এই মধ্যবর্তী দূরত্বে আরো অনেক দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল, যারা এখন সাগরের পানির নিচে ডুবে গেছে। ইগুয়ানারা হয়তো বর্তমানে নিমজ্জিত কোনো দ্বীপে প্রথম এসেছিল, এরপর মধ্যবর্তী দূরত্ব অতিক্রম করে তারা অন্য দ্বীপগুলোয় পৌঁছেছিল, যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সেই দ্বীপগুলো যেগুলো এখনো পানির উপর ভেসে আছে।
একবার সেখানে পৌঁছানোর পর, নতুন একটি জায়গায় পূর্ণ বিকশিত হতে তারা সুযোগ পেয়েছিল, ঠিক যেমন ১৯৯৫ সালে আনগুইলাতে পৌঁছানো ইগুয়ানাগুলো করেছিল। গালাপাগোসের প্রথম ইগুয়ানারা বিবর্তিত হয়ে মূল ভূখণ্ডের তাদের আত্মীয় প্রজাতি থেকে ভিন্ন হয়েছে। আংশিকভাবে শুধু দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমে [ভাষার মতো] আর আংশিকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে, যা তাদের সেখানে টিকে থাকার নতুন কৌশলকে ‘সহায়তা’ করেছিল : দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে তুলনামূলকভাবে অনুর্বর এই আগ্নেয় দ্বীপগুলোর ভূ-প্রকৃতি খুব ভিন্ন।
মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপপুঞ্জটির যে-কোনো দ্বীপের যে পরিমাণ দূরত্ব, দ্বীপগুলোর পরস্পরের মধ্যবর্তী দূরত্ব তার চেয়ে অনেক কম। সুতরাং দ্বীপপুঞ্জটির এই দ্বীপগুলোয় দুর্ঘটনাবশত কোনো প্রজাতির সমুদ্র অতিক্রম করার ঘটনা অপেক্ষাকৃতভাবে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল : হয়তো হাজার বছরে একবার হবার চেয়ে প্রতি শতাব্দীতে একবার সেটি ঘটেছিল এবং ইগুয়ানারা একসময় অধিকাংশ অথবা সব দ্বীপেই তাদের বসতি গড়েছিল। তারপরও এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া যথেষ্ট দুর্লভ ঘটনা ছিল। আর সেটাই পরবর্তীতে অন্য দ্বীপ থেকে আসা ইগুয়ানাদের জিন দ্বারা ‘দূষিত’ হবার মধ্যবর্তী পর্বে পৃথক দ্বীপগুলোয় প্রজাতিগুলোকে পরস্পর থেকে বিবর্তনীয়ভাবে পৃথক হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল এবং পরে যখন অবশেষে তারা মিলিত হয়েছিল তখন তারা আর পরস্পরের মধ্যে প্রজনন করতে সক্ষম ছিল না। ফলাফল হচ্ছে তিনটি ভিন্ন প্রজাতির স্থলবাসী বা ল্যান্ড ইগুয়ানা এখন গালাপাগোসে আছে, যারা আর পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারে না। কনোলোফাস প্যালিডাস [Conolophus pallIdus] প্রজাতিটিকে পাওয়া যায় শুধুমাত্র ‘সান্তা ফে’ দ্বীপে। কনোলোফাস সাবক্রিস্টাটাস [Conolophus subcrIstatus] বেশ কয়েকটি দ্বীপে বাস করে : ‘ফার্নান্দিনা’, ‘ইসাবেলা’ ও ‘সান্তা ক্রুজ’ [প্রতিটি দ্বীপের ইগুয়ানা জনগোষ্ঠী সম্ভবত পৃথক পৃথক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবার পথে আছে]। কনোলোফাস মার্থি [Conolophus marthae] ‘ইসাবেলা’ নামে বড় দ্বীপের সবচেয়ে উত্তরের পাঁচটি আগ্নেয়গিরির শৃঙ্খলে সীমাবদ্ধ।
প্রসঙ্গক্রমে এটি আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের উদ্রেক করে। আপনি মনে করতে পারবেন যে, আমি আগে বলেছিলাম একটি হ্রদ অথবা একটি মরুদ্যানকেও দ্বীপ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, যদিও সেগুলো কোনোটাই দ্বীপের মতো পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত কোনো ভূখণ্ড নয়। বেশ, এইভাবে এটি প্রযোজ্য ‘ইসাবেলা’ দ্বীপের পাঁচটি আগ্নেয়গিরির ক্ষেত্রে। এই শৃঙ্খলের প্রতিটি আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে রেখেছে বেশ উর্বর আর সমৃদ্ধ জঙ্গল, যেগুলো এক ধরনের মরুদ্যানের মতো, পরের আগ্নেয়গিরি থেকে মধ্যবর্তী মরুভূমি দ্বারা এটি পৃথক। বেশির ভাগ গালাপাগোস দ্বীপে একটিমাত্র বড় আগ্নেয়গিরি আমরা দেখি, কিন্তু ইসাবেলায় আছে পাঁচটি। যদি কখনো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে [হয়তো বিশ্ব-উষ্ণায়নের জন্য ইসাবেলা সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন পাঁচটি দ্বীপ হতে পারে। এখন যেমন আছে, আপনি ভাবতে পারবেন যে প্রতিটি আগ্নেয়গিরি এক ধরনের দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ। আর এভাবেই মনে হয় ল্যান্ড ইগুয়ানার [অথবা জায়ান্ট টরটয়েস] মতো কোনো প্রাণীরা, যাদের বাঁচার জন্যে যে উদ্ভিদ খাওয়া প্রয়োজন সেগুলো শুধু এই আগ্নেয়গিরি আশেপাশের ঢালেই খুঁজে পাওয়া যায়।
ভৌগোলিক কোনো প্রতিবন্ধকতা দ্বারা সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা, যা মাঝে মাঝে অতিক্রম করা যায় ঠিকই তবে খুব হরহামেশা যা ঘটে না, প্রায়শই বিবর্তনীয় বিভাজনের সৃষ্টি করে [আসলেই এটাকে ভৌগোলিক কোনো বাধা হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আরো কিছু সম্ভাবনা আছে, বিশেষ করে কীটপতঙ্গদের ক্ষেত্রে, কিন্তু সরলতার কারণে আমি সেই বিষয়ে আলোচনা করব না এখানে] এবং একবার যখন বিভাজিত জনগোষ্ঠী যথেষ্ট দূরে সরে যাবে তারা আর পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারবে না। তখন ভৌগোলিক সীমারেখার আর দরকার পড়ে না। দুটি প্রজাতি তাদের স্বতন্ত্র বিবর্তনীয় পথে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, পরস্পরের ডিএনএকে কখনো দূষিত না করে। মূলত এই গ্রহে উদ্ভব হওয়া প্রতিটি প্রজাতির জন্যে এই ধরনের বিচ্ছিন্নতা দায়ী : যেমন পরে আমরা দেখব, ধরুন, আমরা সহ সব মেরুদণ্ডী প্রাণীদের পূর্বসূরিদের শামুকদের পূর্বসূরি থেকে মূল পৃথকীকরণ।
ইগুয়ানাদের ইতিহাসের কোনো একটি পর্যায়ে গালাপাগোসে একটি বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, যা একটি অদ্ভুত নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করেছিল। দ্বীপগুলোর একটিতে, আমরা জানি না কোনটিতে, একটি ল্যান্ড ইগুয়ানাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী পুরোপুরিভাবে তাদের জীবনযাত্রা বদলে ফেলেছিল। আগ্নেয়গিরির ঢালে স্থলজ উদ্ভিদ খাবার বদলে, তারা সমুদ্রতীরে এসে খাদ্য হিসেবে সমুদ্র-শৈবাল বেছে নিয়েছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচন সহায়তা করেছে সেই সদস্যদের, যারা দক্ষ সাঁতারু, আজকের দিন অবধি তাদের উত্তরসূরিরা সমুদ্রের পানিতে ডুব দিয়ে পানির নিচে সমুদ্র-শৈবাল খেতে অভ্যস্ত। তারা পরিচিত মেরিন ইগুয়ানা নামে এবং ল্যান্ড ইগুয়ানার ব্যতিক্রম, গালাপাগোস ছাড়া তাদের আর কোথাও দেখা যায় না।
তাদের বহু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে যা তাদের সামুদ্রিক জীবনে অভ্যস্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছিল, আর এগুলোই তাদের আসলেই পৃথক করেছে গালাপাগোস ও পৃথিবী অন্য জায়গার সব ধরনের ল্যান্ড ইগুয়ানাদের থেকে। তারা অবশ্যই ল্যান্ড ইগুয়ানা থেকে বিবর্তিত হয়েছিল কিন্তু তারা বিশেষভাবে গালাপাগোসের আজকের ল্যান্ড ইগুয়ানাদের নিকটাত্মীয় নয়। সুতরাং সম্ভাবনা আছে তারা হয়তো বিবর্তিত হয়েছিল আরো আগের, বর্তমানে বিলুপ্ত কোনো ইগুয়ানা জিনাস থেকে, যারা মূল ভূখন্ড থেকে এই দ্বীপগুলোতে বসতি গড়েছিল বর্তমানের কনোলোফাসদের চেয়েও বহুদিন আগে। বিভিন্ন জাতের মেরিন ইগুয়ানা আছে, কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির নয়, ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে তাদের বাস। এই ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপবাসী জাতের ইগুয়ানাগুলো সম্ভবত কোনো একদিন নিজেদেরকে এত দূরে সরে যাওয়া ‘পৃথক’ হিসেবে আবিষ্কার করবে, মেরিন ইগুয়ানা জিনাসের নতুন প্রজাতি হিসেবে তাদের তখন চিহ্নিত করতে হবে।
জায়ান্ট টরটয়েসদের [কচ্ছপ], লাভা লিজার্ড, সেই অদ্ভুত উড্ডয়ন – অক্ষম করমোরান্ট, মকিংবার্ড, ফিঞ্চ এবং গালাপাগোসের বহু প্রাণী আর উদ্ভিদের ক্ষেত্রে কাহিনিটাও প্রায় একই এবং একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। গালাপাগোস শুধুমাত্র সুনির্দিষ্টভাবে সুস্পষ্ট একটি উদাহরণ মাত্র। দ্বীপ [হ্রদ, মরুদ্যান এবং পর্বতসহ] নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে। একটি নদীও তা করতে পারে। যদি কোনো প্রাণীর পক্ষে নদী অতিক্রম করা কঠিন হয়, নদীর দুই পারের জনগোষ্ঠীর জিন পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে পারে, ঠিক যেভাবে একটা ভাষা দুটি উপভাষায় বিচ্ছিন্ন হয়, যেটি পরে আরো দূরে সরে গিয়ে দুটি পৃথক ভাষার সৃষ্টি করে। একই দায়িত্ব পালন করে কোনো পর্বতমালাও প্রজাতির দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি শুধুমাত্র দূরত্বও সেটি করতে পারে। স্পেনের ইঁদুরগুলো পুরো এশিয়া মহাদেশ অতিক্রম করে চীন অবধি পরস্পর প্রজনন করেছে এমন ইঁদুরদের শৃঙ্খল দিয়ে সংযুক্ত, কিন্তু অনেক সময় লাগে কোনো একটি জিন একটি ইঁদুর থেকে আরেকটি ইঁদুরের শরীরের মধ্যে দিয়ে এতটা দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য, এই দূরত্ব পৃথক দ্বীপের মতোই মনে করা যেতে পারে এবং স্পেন ও চীনে ইঁদুরের বিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন দিকে সরে যায়।
গালাপাগোসের ল্যান্ড ইগুয়ানাদের তিনটি প্রজাতি বিবর্তনের ধারায় পরস্পর থেকে পৃথক হবার জন্য মাত্র কয়েক হাজার বছর পেয়েছে। যথেষ্ট বেশি, কয়েক শত মিলিয়ন বছর অতিক্রান্ত হবার পর, কোনো একটি পূর্বসূরি প্রজাতির উত্তরসূরিরা যথেষ্ট পরিমাণ পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়, যেমন—একটি তেলাপোকা থেকে কুমির যতটা ভিন্ন। বাস্তবিকভাবেই এটি আক্ষরিকভাবে সত্যি যে অনেকদিন আগে তেলাপোকার একটি প্র-প্র-প্র- প্র-[…]-পিতামহ [অনেকগুলো প্র] [এবং শামুক আর কাঁকড়ারা সহ আরো অনেক প্রাণীদেরও যেমন ছিল] যে কিনা কুমিরদেরও মহা-পূর্বসূরি [গ্রানসেস্টর শব্দটা যদি ব্যবহার করি] [বলাবাহুল্য অন্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদেরও], কিন্তু এ রকম কোনো গ্রানসেস্টর বা মহাপূর্বসূরি, যে কিনা অনেক প্রাচীন, খুঁজে বের করতে হলে আপনাকে অনেক বেশি অতীতে যেতে হবে, হয়তো এক বিলিয়ন বছরেরও বেশি আগের কোনো সময়ে। আর এটি অনেক বেশি অতীত হয়ে যাবে আমাদের জন্যে, এমনকি সেই মূল বাধাটি কী ছিল সেটি অনুমান করা শুরু করতে, যা তাদের সেই শুরুতেই বিচ্ছিন্ন করেছিল। সেটি যাই হোক-না কেন, এটি অবশ্যই সমুদ্রে ঘটেছিল, কারণ সেই প্রাচীন সময়ে স্থলে কোনো প্রাণীরই বাস ছিল না। হয়তো আমাদের সেই মহাপূর্বসূরি বা গ্রানসেস্টর শুধুমাত্র বাস করতে পারত প্রবালপ্রাচীরে এবং দুটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের আবিষ্কার করেছিল একজোড়া প্রবালপ্রাচীরে, যার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল বসবাসের অযোগ্য গভীর সমুদ্র।
যেমন আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছিলাম, মানুষ আর শিম্পাঞ্জির সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম সাধারণ গ্রানসেস্টর বা মহাপূর্বসূরিকে খুঁজে বের করার জন্য আপনাকে শুধুমাত্র ছয় মিলিয়ন বছর আগে যেতে হবে। এটি যথেষ্ট সাম্প্রতিক, আমরা অনুমান করতে পারি একটি সম্ভাব্য ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো এই মূল বিভাজনের কারণ হয়েছিল। প্রস্তাব করা হয়েছে এটি আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি, যেখানে মানব-পূর্বসূরিরা বিবর্তিত হয়েছে পূর্বদিকে এবং শিম্পাঞ্জিরা ডান দিকে, পরে শিম্পাঞ্জিদের পূর্বসূরিদের বংশধারা বিভাজিত হয়েছে সাধারণ শিম্পাঞ্জি ও পিগমি শিম্পাঞ্জি বা বনোব শাখায়। কঙ্গো নদীকেও প্রতিবন্ধক সীমা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমনটি আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি, জীবিত সব স্তন্যপায়ীদের ভাগ করে নেয়া মহাপূর্বসূরি প্রজাতি বাস করত প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন বছর আগে। তারপর, এর উত্তরসূরিরা বিভাজিত এবং বিভাজিত এবং বিভাজিত হয়েছে বারবার, সৃষ্টি করেছে বহু হাজার স্তন্যপায়ী প্রজাতি, যাদের আমরা বর্তমানে দেখি। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ২৩১টি মাংসাশী [কুকুর, বেজি, ভালুক ইত্যাদি], ২০০০ প্রজাতির রোডেন্ট, ৮৮ প্রজাতি তিমি ও ডলফিন, ১৯৬টি ক্লোভেন-হুফ বা বিভক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণী [গরু, অ্যান্টেলোপ, শূকর, হরিণ, ভেড়া], ঘোড়া পরিবারের ১৬ প্রজাতি [ঘোড়া, জেব্রা, টাপির, গণ্ডার], ৮৭ প্রজাতির খরগোশ, ৯৭৭ প্রজাতির বাদুড়, ৬৮ প্রজাতির ক্যাঙ্গারু, ১৮ প্রজাতির এইপ [মানুষ সহ] এবং আরো বহুসংখ্যক প্রজাতি, যারা ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে [যার মধ্যে আছে বেশকিছু বিলুপ্ত মানব প্রজাতি, যাদের আমরা কেবল জীবাশ্ম নমুনা থেকে চিনি]।
মিশ্রণ, নির্বাচন এবং টিকে থাকা
আমি এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই সেই একই গল্পটি খানিকটা ভিন্ন ভাষায় বলে। আমি সংক্ষিপ্তভাবে ‘জিন ফ্লো’ বা জিন প্রবাহের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বিজ্ঞানীরা আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলেন, সেটি হচ্ছে ‘জিন পুল’ এবং এর মানে কী সেটি আমি বিস্তারিত বলব এখন। অবশ্যই আক্ষরিকভাবে জিনদের কোনো ‘পুল’ নেই। এই ‘পুল’ শব্দটি প্রস্তাব করছে যেন কোনো তরল কিছু, যেখানে জিনরা হয়তো মিশ্ৰিত হয় নাড়াচাড়ার মাধ্যমে, কিন্তু শুধুমাত্র জীবিত শরীরের কোষে জিনরা থাকে। তাহলে ‘জিন পুল’ বলে আসলে কী বোঝায়? প্রতিটি প্রজন্মে, যৌনপ্রজনন নিশ্চিত করে জিনগুলো যেন ভালোভাবে মিশ্রিত বা ‘শাফল’ হয়। আপনার জন্ম হয়েছে আপনার বাবা ও মায়ের জিনের অদলবদলের একটি মিশ্রণ নিয়ে, এর মানে চারজন, দাদা/দাদি ও নানা/নানীর জিনের অদলবদলকৃত একটি মিশ্রণ। বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য জনগোষ্ঠীর সব সদস্যের জন্য বিবর্তনের সুদীর্ঘ সময় ধরে : বহু হাজার বছর, বহু লক্ষ বছর। এই সময়ে যৌনপ্রজননের এই প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করে অদলবদল হয়ে যাওয়া জিনগুলো পুরো জনগোষ্ঠীতে খুব ভালোভাবে যেন অদলবদল হয়, যেন কোনোকিছু ভালো করে মেশানোর উদ্দেশ্যে নাড়ানোর মাধ্যমে এবং বিশাল ‘ঘূর্ণায়মান তরলপূর্ণ একটি কুণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করলে, সেটাই জিন পুলের ধারণাটিকে অর্থবহ করে তোলে।
আমাদের দেয়া প্রজাতির সংজ্ঞাটি আপনার মনে আছে, এক গ্রুপ প্ৰাণী অথবা উদ্ভিদ যারা কেবল নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কেন এই সংজ্ঞাটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি দুটি প্রাণী একই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই প্রজাতির হয়ে থাকে, তার মানে তাদের জিনগুলো একই জিন পুলে মিশ্রিত হচ্ছে। যদি দুটি প্রাণী ভিন্ন প্রজাতির সদস্য হয়, তারা একই জিন পুলের সদস্য হতে পারে না, কারণ তাদের ডিএনএ যৌনপ্রজননের সময় মিশ্রিত হতে পারে না, যদিও তারা একই দেশে বাস করে এবং প্রায়শই তাদের দেখা হয়েও থাকে। যদি একই প্রজাতির একাধিক জনগোষ্ঠী ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে, তাদের জিন পুলেরও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সুযোগ থাকবে—এতই দূরে, যে একসময় তাদের যদি দেখাও হয়, তারা আর নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারবে না। এখন তাদের জিনপুল মিশ্রণের সব সম্ভাবনার স্তর অতিক্রম করেছে এবং তারা ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয় এবং আরো দূরে তারা সরে যেতে পারে এমন একটি পর্যায় অবধি, তারা একে অপরের থেকে অনেক আলাদা হবে, যেমন—মানুষ তেলাপোকা থেকে ভিন্ন। বিবর্তন মানে কোনো একটি জিন পুলে পরিবর্তন। জিন পুলে পরিবর্তন মানে কিছু জিনের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়, অন্য জিনগুলো সংখ্যায় কমে যায়। যে জিনগুলো খুবই সাধারণ ছিল জিন পুলে তারা দুর্লভ হয়ে পড়ে অথবা পুরোপুরিভাবে অপসারিত হয়। আর যে জিনগুলো একসময় দুর্লভ ছিল তারাই সাধারণ হয়ে পড়ে এবং ফলাফল হচ্ছে কোনো প্রজাতির একজন বৈশিষ্ট্যসূচক সদস্যের যে আকার, আকৃতি অথবা রঙ আছে তা পরিবর্তিত হয়। এটি বিবর্তিত হয়, জিন পুলে জিনদের সংখ্যার পরিবর্তনের কারণে। সেটাই হচ্ছে বিবর্তন
কেনই-বা বিভিন্ন জিনের সংখ্যা পরিবর্তিত হয় প্রজন্মান্তরে? আপনি হয়তো বলতে পারেন। বেশ, যদি তারা পরিবর্তিত না হয় সেটাই বিস্ময়কর হবে, বিশেষ করে সময়ের এই অকল্পনীয় বিশালতায়। বহু শতাব্দী ধরে কিভাবে ভাষা পরিবর্তিত হয় সেটি ভাবুন। ইংরেজি ভাষার কিছু শব্দ যেমন—Thee বা Thou, yound আর Avast এবং stap আর vItals-এর মতো অভিব্যক্তিগুলো কম-বেশি ইংরেজি ভাষা থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে। অন্যদিকে I was lIke [অর্থ আমি বলেছিলাম বা ও saId] বাক্যটি এমনকি ২০ বছর আগের মতো সাম্প্রতিক সময়েও অবোধ্য মনে হত, যেমন—Cool, কোনোকিছু স্বীকৃতিসূচক একটি শব্দ হিসেবে যা এখন হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে।
আপাতত এই অধ্যায়ে, বেশি গভীরে প্রবেশ করা আমার দরকার হয়নি, শুধুমাত্র সেই ধারণাটি ছাড়া যে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের ‘জিন পুল’ বিচ্ছিন্ন হতে পারে, ভাষার মতো, কিন্তু আসলে, প্রজাতির ক্ষেত্রে, এখানে দূরে সরে যাওয়া ছাড়াও আরো কিছু ঘটে। এই আরো কিছু হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন, চূড়ান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া যা চার্লস ডারউইনের শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন। প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াও, আমরা আশা করতে পারি, ‘জিন পুল’ যা ঘটনাচক্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা ক্রমেই দূরে যায়, কিন্তু তারা দূরে সরে যায় বরং উদ্দেশ্যহীন একটি উপায়ে। প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবর্তনকে একটি উদ্দেশ্যমূলক দিকে পরিচালিত করে : মূলত টিকে থাকা ও জিন হস্তান্তরের সফলতার দিকে। যে জিনগুলো ‘জিন পুলে’ টিকে থাকে সেগুলো হচ্ছে সেই জিনগুলো যেগুলো টিকে থাকা ও প্রজনন-সফল হবার জন্যে উপযোগী। আর কোন জিনিসটি একটি জিনকে টিকে থাকতে সফল করে? এটি শরীর নির্মাণ করার জন্য অন্য সেইসব জিনগুলোকে সহায়তা করে, যারা টিকে থাকা ও প্রজনন-সফল হবার ক্ষেত্রে দক্ষ : শরীর যা যথেষ্ট দীর্ঘ সময় টিকে থাকে সেই জিনগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে, যে জিনগুলোই দীর্ঘ সময় তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
এবং ঠিক কিভাবে তারা সেটি করে, সেটি প্রজাতি-ভেদে ভিন্ন। জিন যেগুলো পাখি অথবা কোনো বাদুড়ের শরীরে বাস করে, সেগুলো তার ডানা তৈরিতে সহায়তা করে। জিন যা মোলদের শরীরে বাস করে তা তাদের সাহায্য করে কোদালের মতো শক্তিশালী সামনের হাত বানানোর জন্য। জিন যা টিকে থাকে সিংহের শরীরে, সেটি তাদের দ্রুত দৌড়ানোর পা এবং ধারালো নখ আর দাঁত বানাতে সহায়তা করে। জিন যা টিকে থাকে অ্যান্টেলোপদের শরীরে, সেগুলো তাদের দ্রুত দৌড়ানোর উপযোগী পা, তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। লিফ- ইনস্কেটদের শরীরে যে জিনগুলো টিকে থাকে, সেগুলো পাতা থেকে আলাদা করা কঠিন এমন শরীর তৈরি করতে তাদের সহায়তা করে। খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যতই ভিন্ন হোক-না কেন, প্রতিটি প্রজাতিতে এই খেলার নাম হচ্ছে ‘জিন পুলে জিনের টিকে থাকা’। এরপরে যখনই আপনি কোনো প্রাণীকে লক্ষ করবেন, যে-কোনো প্রাণী, অথবা কোনো উদ্ভিদ, ভালো করে লক্ষ করবেন এবং নিজেকে বলবেন, আমি তাকিয়ে আছে জটিল একটি যন্ত্রের দিকে, এটি তৈরি করা জিনগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করাই যার কাজ। আমি তাকিয়ে আছি জিনদের সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্রের দিকে।
এরপরে যখন আপনি আয়নার দিকে তাকাবেন, শুধু ভাববেন যে, আপনিও ঠিক তাই।