একাদশ অধ্যায় – কেন খারাপ কিছু ঘটে?
খারাপ কিছু কেন ঘটে? ভূমিকম্প কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর, আপনি হয়তো মানুষকে বলতে শুনবেন এমনকিছু : ‘খুবই অন্যায়, ওইসব গরিব মানুষগুলো কী এমন করেছিল যে, তাদের কপালে এ রকম দুর্ভোগ লেখা ছিল?’ যদি সত্যি ভালো একজন মানুষ যন্ত্রণাদায়ক কোনো অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, যখন কিনা খারাপ একজন মানুষ তার চমৎকার স্বাস্থ্য বজায় রাখে, আমরা আবারো একবার আক্ষেপ করে বলি, ‘কী অবিচার!’ অথবা আমরা বলি, এখানে সুবিচারের কী আছে?’
কোনো-না-কোনোভাবে, প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মতো কিছু-একটা থাকা উচিত, এই অনুভূতিটাকে প্রতিরোধ করা খুব কঠিন। ভালো মানুষগুলোর সাথে ভালো কিছু হওয়া উচিত, খারাপ কোনোকিছু যদি আদৌ হতেই হয়, সেটি হওয়া উচিত শুধু খারাপ মানুষগুলোর সাথেই। অস্কার ওয়াইল্ডের চমৎকার ‘দ্য ইম্পর্ট্যান্স অব বিইং আর্নেস্ট’ নাটকে মিস প্রিজম, একজন বয়স্ক গভর্নেস, ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিভাবে, বহুদিন আগে, তিনি একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল উপন্যাসটি আনন্দের সাথে শেষ হয়েছিল কিনা, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ভালো কিছু শেষ হয় আনন্দের সাথে আর খারাপ কিছু শেষ হয় দুঃখের সাথে। আর সেটাই মূলত কাহিনি বলতে বোঝায়।’ বাস্তব জীবন ভিন্ন। খারাপ কিছুও ঘটে এবং সেটি ঘটে ভালো আর খারাপ সবার সাথে। কেন? কেন বাস্তব জীবন মিস প্রিজমের উপন্যাসের মতো নয়? কেন খারাপ জিনিসগুলো ঘটে?
বহু মানুষই বিশ্বাস করেন যে, ত্রুটিহীন একটি জগৎ তৈরি করারই তাঁদের উপাস্য সব দেবতাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পরিকল্পনা সেভাবে অগ্রসর হয়নি, কিছু গোলমাল ঘটেছিল। আর কী ঘটেছিল তার সংখ্যা, সেটি সম্বন্ধে যত ধারণা প্রায় তার সমানই। পশ্চিম আফ্রিকার ডোগোন গোত্রের সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর শুরুতে একটি মহাজাগতিক ডিম ছিল, যেখান থেকে যমজ দুইজনের জন্ম হয়েছিল। সবকিছুই ভালো হত যদি যমজদের জন্ম একই সময় হত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজনের জন্ম হয়েছিল বেশি আগে, আর সেটাই দেবতাদের নিখুঁত পৃথিবীর পরিকল্পনাটিকে ভেস্তে দিয়েছিল। সেটাই, ডোগনদের মতে, পৃথিবীতে খারাপ যা-কিছু ঘটে তার কারণ।
অসংখ্য কিংবদন্তি আছে কিভাবে পৃথিবীতে মৃত্যুর আগমন ঘটেছিল। পুরো আফ্রিকা জুড়ে, বিভিন্ন গোত্রের সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, ক্যামেলিয়ন বা রঙ পাল্টাতে সক্ষম গিরগিটিকে অনন্ত জীবনের বার্তা দেয়া হয়েছিল ও মানুষের কাছে বার্তাটি বহন করে নিয়ে যাবার জন্যে তাকে বলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্যামেলিয়ন এত ধীরে হেঁটেছিল [তারা ধীরে হাঁটে, আমি জানি, আফ্রিকায় আমার শৈশবে, আমার একটি পোষা ক্যামেলিয়ন ছিল, যার নাম ছিল হুকারিয়া] যে, মৃত্যুর খবর, যা বহন করে নিয়ে এসেছিল ‘নিপিয়ার’ গিরগিটি [অথবা কিংবদন্তি-ভেদে অন্য দ্রুত গতির কোনো প্রাণী] এবং সেই সংবাদটি আগে পৌঁছেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার একটি পুরাণে জীবনের খবর বহন করে এনেছিল ধীর গতির একটি ব্যাঙ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাকে অতিক্রম করেছিল একটি দ্রুতগামী কুকুর, যে মৃত্যুর খবর বহন করে এনেছিল। অবশ্যই বলতে হবে যে আমি খানিকটা বিভ্রান্ত, কোন খবরটি আগে এসে পৌঁছেছিল সেই ধারাক্রমটার এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত কেন। খারাপ খবর খারাপ খবরই, যখনই সেটা আসুক-না কেন।
অসুখ হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের খারাপ ঘটনা এবং বহু নিজস্ব পুরাণ-কাহিনির জন্ম দিয়েছে এটি। একটি কারণ হচ্ছে, বহুদিন ধরে অসুখ মূলত রহস্যময় একটি বিষয় ছিল। আমাদের পূর্বসূরিদের নানা ধরনের বিপদের মোকাবেলা করতে হত, যেমন—সিংহ বা কুমিরের আক্রমণ অথবা শত্রু গোত্রের আক্রমণ, অভুক্ত থাকার ভয়, কিন্তু এ সবকিছু আগে থেকে দেখা বা জানা সম্ভব ছিল যে সেটি আসছে, আর সেগুলো বোঝাও সম্ভব ছিল, কিন্তু গুটিবসন্ত অথবা প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ অথবা ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগগুলোকে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে যে সেগুলো যেন কোনো সতর্কসংকেত ছাড়াই তাদের অতর্কিতে আক্রমণ করছে এবং এদের আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষা করার কোনো স্পষ্ট উপায়ও তাদের জানা ছিল না। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি রহস্য ছিল এইসব রোগব্যাধি। কোথা থেকে এই অসুখগুলো আসে? আমরা কী করেছি এই কষ্টকর মৃত্যু, যন্ত্রণাদায়ক দাঁতের ব্যাখ্যা অথবা ভয়ঙ্কর কুৎসিত সব গায়ের মধ্যে ওঠা পুঁজভরা গুটিগুলোর শাস্তি পাবার জন্যে? অবাক হবার কোনো কারণ নেই যে সে-কারণেই মানুষ কুসংস্কারের আশ্রয় নিয়েছে যখন মরিয়া হয়ে তারা অসুখগুলোকে বোঝার চেষ্টা করেছে, এমনকি আরো মরিয়া হয়ে সেই অসুখগুলো থেকে নিজেদের সুরক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আফ্রিকার বহু গোত্রে, খুব সাম্প্রতিক সময় অবধি, যারাই অসুস্থ হত অথবা কোনো অসুস্থ শিশুর জন্ম দিত, তারা প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দোষী সাব্যস্ত করার জন্য অশুভ কোনো জাদুকর বা ডাইনিকে খুঁজত।
আমার শিশুর যদি খুব বেশি জ্বর হয়, অবশ্যই আমার কোনো শত্ৰু কোনো এক ডাইনিকে পয়সা দিয়েছে আমার সন্তানের ওপর জাদুমন্ত্রের কোনো প্রভাব ফেলতে। অথবা হয়তো এর কারণ আমি কোনো ছাগল বিসর্জন দিতে পারিনি যখন তার জন্ম হয়েছিল। অথবা হয়তো এর কারণ একটি সবুজ শুঁয়োপোকা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, আর আমি সেই অশুভ আত্মাটাকে শরীর থেকে থুতু দিয়ে বের করে দিতে পারিনি।
প্রাচীন গ্রিসে, চিকিৎসা আর নিরাময়ের দেবতা আসক্লিপিয়াসকে উৎসর্গ করা কোনো মন্দিরে অসুস্থ তীর্থযাত্রীরা রাত কাটাত। তারা বিশ্বাস করত দেবতা হয়তো নিজেই তাদের অসুখ নিরাময় করবেন কিংবা স্বপ্নে তাদের চিকিৎসা বলে দেবেন। এমনকি আজও, বিস্ময়করভাবে বিশাল সংখ্যক অসুস্থ মানুষ লুর্ডের মতো জায়গায় তীর্থে যান, যেখানে তাঁরা কোনো পবিত্ৰ পানির জলাশয়ে ঝাঁপ দেন, পবিত্র পানি তাঁদের নিরাময় করবে এমন আশা নিয়ে [আসলেই কেউ হয়তো সন্দেহ করতে পারেন যে তাঁদের অসুখ বাধাবার সম্ভাবনা আরো বাড়তে পারে কারণ সেই একই পানি নানা অসুখে অসুস্থরাও ব্যবহার করছেন]। নিরাময়ের আশায় গত ১৪০ বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ লুর্ডে তীর্থযাত্রা করেছেন। বহু ক্ষেত্রে আসলেই তাঁদের খুব বেশি কোনো সমস্যা ছিল না এবং সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের বেশিরভাগই নিরাময় লাভ করেছিলেন—তাঁদের এমনিতেই হবার কথা ছিল, তাঁদের নিরাময়ে তীর্থযাত্রার কোনো ভূমিকা ছিল না।
হিপোক্রাটিস, ‘চিকিৎসাবিদ্যার জনক’ সেই প্রাচীন গ্রিক, যিনি তাঁর নাম সেই বিখ্যাত শপথের সাথে যুক্ত করে গেছেন যা সব ডাক্তারদের মেনে চলার কথা, ভেবেছিলেন অসুখের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হচ্ছে ভূমিকম্প। মধ্যযুগে, বহু মানুষই বিশ্বাস করতেন নক্ষত্রের প্রেক্ষাপটে গ্রহদের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে অসুখ হয়। এটাই বিশ্বাসের সেই পদ্ধতির অংশ, জ্যোতিষবিদ্যা বলা হয় যাকে, যা, যতই হাস্যকর মনে হোক-না কেন এখনো বহু মানুষ সেটি অনুসরণ করেন।
স্বাস্থ্য এবং অসুখ নিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পুরাণটি, যা টিকে ছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি—সেটি হচ্ছে চারটি ‘হিউমরের’ পুরাণ। যখন আমরা বলি, আজ সে ভালো হিউমরে আছে, এই হিউমর থেকে শব্দটি এসেছে সেখান থেকে, যদিও এর পেছনের ধারণাগুলো মানুষ আর বিশ্বাস করে না। চারটি ‘হিউমর’ হচ্ছে, কালো পিত্ত, হলুদ পিত্ত, রক্ত আর শ্লেষ্মা। ভাবা হত সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে এই চারটি জিনিসের পারস্পরিক ভারসাম্যের ওপর, আপনি কিছু হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে এখনো শুনবেন, যারা আপনার মাথার উপর দিয়ে হাত বুলাবে আপনার ‘শক্তি’ বা ‘চক্রে’র ‘ভারসাম্য’ ঠিক করার জন্য।
রোগীদের নিরাময় করার জন্য চার হিউমরের তত্ত্বটি অবশ্যই ডাক্তারদের সাহায্য করতে পারেনি, কিন্তু এটি হয়তো খুব বেশি ক্ষতি করেনি শুধুমাত্র রোগীদের রক্তপাত করানোর আচারটি ছাড়া–ব্লিডিং। এই প্রক্রিয়ায় একটি শিরাকে ধারালো একটি যন্ত্র, যাকে বলে ল্যান্সেট, দিয়ে ছিদ্র করা হয়, একটি বিশেষ পাত্রে কিছু পরিমাণ রক্ত জমা করা হয়। এটি অবশ্যই অসহায় রোগীকে আরো অসুস্থ করে ফেলত [এটি জর্জ ওয়াশিংটনের মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছিল], কিন্তু ডাক্তাররা এই প্রাচীন হিউমরের পুরাণটি এত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তাঁরা সেটির পুনরাবৃত্তি করে যেতেন। উপরন্তু রোগীরা যখন অসুস্থ তাঁদের শুধু রক্তপাতই করানো হত না, মাঝে মাঝে অসুস্থ হবার আগেই তাঁরা ডাক্তারদের কাছে যেতেন সেটি করানোর জন্য, অসুখকে যেন তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন এই আশায়।
একবার, যখন আমি স্কুলে, আমাদের শিক্ষক, অসুখ কেন হয় সেটি ভাবতে বলেছিলেন। একটি ছেলে তার হাত তুলেছিল ও প্রস্তাব করেছিল যে অসুখ হয় তার কারণ হচ্ছে ‘পাপ’! বহু মানুষ, এমনকি আজও, যারা ভাবেন এমনকিছুই সাধারণভাবে খারাপ কিছু ঘটার কারণ। কিছু পুরাণ প্রস্তাব করছে যে খারাপ কিছু পৃথিবীতে ঘটে কারণ আমাদের পূর্বপূরুষেরা বহুদিন আগে খুব খারাপ কিছু করেছিল। আমি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠাতা পূর্বসূরি আদম ও হাওয়াকে নিয়ে ইহুদিদের পুরাণ-কাহিনিটি বলেছি। আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন, আদম ও হাওয়া শুধুমাত্র একটি খারাপ কাজ করেছিল : নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার জন্যে তারা নিজেদের সাপ দ্বারা প্ররোচিত হতে দিয়েছিল। এই পৌরাণিক অপরাধ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে আর এখনো কিছু মানুষের দ্বারা আজও পৃথিবীতে খারাপ যা-কিছু হয়েছে তার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বহু পুরাণ ভালো আর খারাপ দেবতাদের [বা শয়তান] মধ্যে সংঘর্ষের কথা বলেছে, পৃথিবীতে ঘটা সব খারাপ কাজের জন্য খারাপ দেবতারা দায়ী। অথবা, শুধুমাত্র একটি আত্মা থাকতে পারে যা অশুভ, যাকে বলা হয় ‘ডেভিল’ বা শয়তান বা সে-রকম কিছু, যে ভালো ঈশ্বর অথবা ভালো দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করে। যদি শয়তান আর দেবতাদের মধ্যে বা ভালো আর খারাপ দেবতাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ না থাকত, খারাপ কিছু ঘটত না।
‘আসলেই’ খারাপ জিনিস কেন ঘটে?
কেনই-বা ‘যে-কোনো কিছু’ ঘটে? উত্তর দেয়ার জন্যে এটি খুবই জটিল একটি প্রশ্ন, কিন্তু এটি ‘কেন খারাপ কিছু ঘটে?’ এমন প্রশ্ন থেকে আরো যুক্তিসঙ্গত একটি প্রশ্ন। এর কারণ, শুধুমাত্র খারাপ জিনিসগুলোকে পৃথক করে দেখা কোনো কারণ নেই, যদি-না আমরা যা প্রত্যাশা করি, খারাপ কিছু তার চেয়ে বেশি হারে ঘটে, দৈবাৎ ঘটা অপেক্ষা যার পরিমাণ বেশি; অথবা যদি-না আমরা ভাবি, প্রাকৃতিক ন্যায়বিচার বলে কিছু একটা আছে, যার মানে খারাপ জিনিস শুধুমাত্র খারাপ মানুষদের সাথে হওয়া উচিত।
শুধুমাত্র দৈবক্রমে যতটা ঘটে বলে আমরা প্রত্যাশা করি, খারাপ জিনিসগুলো কি তারচেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটছে? যদি তাই হয় তাহলে আমাদের আসলেই কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করতে হবে। আপনি হয়তো শুনেছেন অনেকেই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে ‘মার্ফি’স ল’ বা সূত্রের দোহাই দেয়, কখনো যাকে ‘সড’স ল’ ও বলা হয়ে থাকে। যা বলছে, ‘যদি আপনি একটুকরো মার্মালেড [কমলার জেলি] জেলিমাখা টোস্ট পাউরুটি মাটিতে ফেলে দেন, সবসময় মার্মালেড লাগানো দিকটা আগে মাটিতে পড়বে।’ অথবা, আরো সাধারণভাবে, ‘যদি কোনোকিছু গোলমাল হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেটি হবে।’ মানুষ প্রায়শই এটি নিয়ে কৌতুক করে, কিন্তু কখনো আপনি হয়তো অনুভব করতে পারবেন যে তারা আসলে এটিকে কৌতুকের চেয়েও বেশি কিছু ভাবে। তারা আসলেই যেন বিশ্বাস করে, পুরো পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বেশ কিছুসংখ্যক টেলিভিশন প্রামাণ্যচিত্রে আমি অংশ নিয়েছিলাম, আর ‘লোকেশনে’ থাকার সময় যে বিষয়গুলো সমস্যা করতে পারে তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ। যখন দূরে কোনো উড়োজাহাজ শব্দ করে আসতে থাকে, আপনাকে প্রামাণ্যচিত্রের চিত্রগ্রহণ থামিয়ে দিতে হবে, সেটি চলে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে, আর এটি খুবই বিরক্তিকর হতে পারে। আগের কোনো শতাব্দীর কাহিনি নিয়ে নির্মিত দৃশ্যের চিত্রগ্রহণে সামান্যতম উড়োজাহাজের আওয়াজ সবকিছু ভেস্তে দিতে পারে। চিত্রগ্রাহক আর ছবিনির্মাতাদের মধ্যে একটি কুসংস্কার আছে যে, উড়োজাহাজ ইচ্ছা করেই সেই মুহূর্তটিকে বেছে নেয়, যখন একটি মাছির শব্দের চেয়েও নীরবতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা তখন ‘সড’স ল’-এর কথা উল্লেখ করে।
সম্প্রতি, চলচ্চিত্র-কুশলীদের একটি দল, যাঁদের সাথে আমি কাজ করছিলাম, তাঁরা এমন একটি লোকেশন বেছে নিয়েছিলেন, বেশ নিশ্চয়তার সাথে আমরা অনুভব করেছিলাম, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের পরিমাণ একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে থাকা উচিত। কারণ সেটি ছিল অক্সফোর্ডের কাছে বিশাল নির্জন একটি মাঠ। আমরা খুব সকালে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম, দ্বিগুণ পরিমাণে নিশ্চিত হতে যেন চিত্রগ্রহণের সময় সবকিছু নীরব ও শান্তিপূর্ণ থাকে, কিন্তু যখনই আমরা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম, তখনই আমরা আবিষ্কার করেছিলাম, একাকী একজন স্কটসম্যান সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর ব্যাগপাইপ অনুশীলন করছেন [হয়তো তাঁর স্ত্রী কর্তৃক বাড়ি থেকে নির্বাসিত হবার পর]। ‘সড’স ল, আমরা সবাই ঘোষণা করলাম। অবশ্যই সত্যটা হচ্ছে শব্দ আর কোলাহল সেখানে চলছে অধিকাংশ সময় জুড়েই, কিন্তু আমরা তখনই শুধুমাত্র সেটি ‘খেয়াল’ করি যখন সেটি আমাদের বিরক্ত করে, যেমন—যখন সেটি শুটিং- এ ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের বিরক্তিকর বিষয়গুলো লক্ষ করার ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনাটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং সেটাই আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, পৃথিবী ইচ্ছা করেই যেন আমাদের বিরক্ত করছে।
টোস্টের ক্ষেত্রে, অবাক হবার মতো কোনো বিষয় হবে না যদি আসলেই লক্ষ করা সম্ভব হয় যে মার্মালেড লাগানো দিকটি বেশিরভাগ সময় আগে মাটির দিকে মুখ করে নিচে পড়ে, কারণ, টেবিল বেশি উঁচু নয় এবং টোস্টের নিচে পড়ার সময় প্রথমে মারমালেড লাগানো দিকে উপরে দিয়ে শুরু করে এবং এটি মাটিতে পড়ার আগে সাধারণত যথেষ্ট সময় থাকে একটি অর্ধ-চক্র ঘোরার জন্য, কিন্তু টোস্টের উদাহরণটি বর্ণিল বিষণ্ন একটি ধারণাকে প্রকাশ করার একটি উপায় মাত্র, আর সেটি হচ্ছে : ‘সমস্যা যদি কিছু হতে পারে, সেটি হবে।’
হয়তো ‘সড’স ল’-এর আরো ভালো একটি উদাহরণ হতে পারে এটি : ‘যখন আপনি কোনো কয়েন টস করেন, যতই তীব্রভাবে আপনি চাইবেন হেড পড়ুক, সাধারণত টেল পড়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। সেটি, অন্ততপক্ষে নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আশাবাদীরাও আছেন যাঁরা মনে করেন যত বেশি আপনি হেড আশা করবেন, ততই সম্ভাবনা থাকবে টসে হেডই পড়বে। হয়তো আমরা একে বলতে পারি ‘পলিয়ানা’স ল’–সেই আশাবাদী বিশ্বাস, যা-কিছু হয় সেসব কিছুর পরিণতি সাধারণত ভালোই হয়। অথবা এটিকে বলা যেতে পারে ‘প্যানগ্লস ল’, সেই চরিত্রের নামানুসারে যাকে সৃষ্টি করেছিলেন মহান ফরাসি লেখক ভলতেয়ার। তাঁর ‘ড. প্যানগ্লস’ ভাবতেন, ‘সবকিছু সবচেয়ে ভালোর জন্যে, এই সম্ভাব্য সব জগতের সেরা জগতের জন্যে।’
যখন আপনি বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করবেন, খুব দ্রুত আপনি দেখতে পাবেন যে ‘সড’স ল’ আর ‘পলিয়ানা’স ল’ দুটোই অর্থহীন। পয়সা, টোস্টের টুকরো, কোনোটারই আমাদের মনের ইচ্ছার জোর কতটুকু সেটি জানার কোনো উপায় ও ক্ষমতা নেই, আর এদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছাও নেই যে, তারা আপনার ইচ্ছায় বাধা দেবে কিংবা পূর্ণ করবে। এছাড়াও, কারো জন্য যা খারাপ অন্য কারো জন্যে সেটি ভালো কিছু হতেও পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী টেনিস খেলোয়াড়রা দুজনেই হয়তো জেতার জন্যেই উৎসাহের সাথে খেলে থাকেন, কিন্তু তাঁদের একজনকে হারতেই হবে। জিজ্ঞাসা করার বিশেষ কোনো কারণ নেই, ‘কেন খারাপ কিছু ঘটে?’ অথবা, একইভাবে, ‘কেন ভালো কিছু ঘটে?’ কিন্তু আসল যে প্রশ্নটি দুটি ক্ষেত্রেই মূল, সেটি আরো বেশি সাধারণ একটি প্রশ্ন : কেন ‘যে-কোনো কিছু’ ঘটে?
ভাগ্য, দৈব ঘটনা ও কারণ
মানুষ মাঝে মাঝে বলে, ‘সবকিছু ঘটার কোনো-না-কোনো কারণ আছে। একটি অর্থে এটি সত্য। সবকিছুই ঘটে কোনো-না-কোনো একটি কারণে—তার মানে বলা যে প্রতিটি ঘটনার ‘কারণ’ আছে এবং কারণটি সবসময় ঘটনার আগেই আসে। সুনামি হয় সমুদ্রের তলদেশে ঘটা কোনো ভূমিকম্পের কারণে আর ভূমিকম্প হয় পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে, দশম অধ্যায়ে যেমন আমরা দেখেছিলাম। সত্যিকার অর্থে এটি সেটাই যেখানে ‘সবকিছুই ঘটার কোনো-না-কোনো একটি কারণ আছে।’ যে অর্থে ‘কারণ’ মানে ‘অতীতে সংঘটিত’ কোনো একটি ঘটনা, কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝে ‘কারণ” শব্দটি ব্যবহার করে খুব ভিন্ন একটি অর্থে, যার মানে এমনকিছু, যেমন – ‘পারপাস’ বা ‘উদ্দেশ্য’। তারা হয়তো এমনকিছু বলবে, যেমন—সুনামি হচ্ছে আমাদের পাপের জন্যে শাস্তি অথবা সুনামির কারণ হচ্ছে স্ট্রিপ ক্লাব [যেখানে নগ্নবক্ষা নারীরা নাচেন], ডিস্কো আর পানশালা অথবা অন্য পাপপূর্ণ এলাকাগুলো ধ্বংস করার জন্যে। খুবই বিস্ময়কর, কত প্রায়শই মানুষ এই ধরনের আজগুবি ভাবনার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
এটি হয়তো শৈশবের একটি মানসিকতার ধারাবাহিকতা মাত্র। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা প্রদর্শন করেছেন যে, খুব অল্পবয়সী শিশু, যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় কেন বিশেষ কিছু পাথর সুচালো, তারা এর ব্যাখ্যা হিসেবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং উত্তর দেয় : ‘প্রাণীদের গা চুলকালে যেন তারা সেখানে ঘষে গা চুলকিয়ে নিতে পারে।’ অধিকাংশ শিশু সুচালো পাথরের সেই ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারে প্রাপ্তবয়স্ক হবার সাথে সাথে, কিন্তু বহু প্রাপ্তবয়স্ক আপাতদৃষ্টিতে সেই একই ধরনের ব্যাখ্যা কোনোদিন মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, যখন তাঁরা কোনো বড় দুর্ঘটনা আর বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দেন; যেমন—ভূমিকম্প অথবা সৌভাগ্য, যেমন—এ ধরনের কোনো ভূমিকম্প থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া।
কিন্তু দুর্ভাগ্য তাহলে কী? আসলেই কি খারাপ অথবা,ভালো ভাগ্য বলে কিছু আছে? কিছু মানুষ কি অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি ভাগ্যবান? কিছু মানুষ ধারাবাহিক দুর্ভাগ্য বা দুঃসময়ের কথা বলেন, অথবা তাঁরা বলেন, ‘বেশ, অনেক খারাপ কিছু ঘটেছে আমার জীবনে কিছুদিন ধরে, আমার ভাগ্য ভালো হবার সময় এবার হয়েছে।’ অথবা তাঁরা হয়তো বলতে পারেন, অমুক কোনো ব্যক্তি খুবই দুর্ভাগা, সারাক্ষণই যেন তার সাথে খারাপ কিছু-না কিছু ঘটছে।’
‘আমার জীবনে সৌভাগ্যপূর্ণ কিছু ঘটার মতো সময় হয়েছে’, হচ্ছে একটি উদাহরণ যা ‘ল অব এভারেজ’ [গড়পড়তার সূত্র] নিয়ে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝির উদাহরণ। ক্রিকেট খেলায়, প্রায়শই কোন দল আগে ব্যাট করবে সেটি খেলার ফলাফলের ওপর বেশ বড় একটি প্রভাব ফেলতে পারে। দুজন ক্যাপ্টেন কয়েন টস করে সিদ্ধান্ত নেয় কে সেই সুবিধাটা পাবে এবং প্রতিটি টিমের সমর্থকরা খুব আশা করেন যে তাঁদের ক্যাপ্টেন টসে জিতবেন। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সাম্প্রতিক একটি খেলার আগে একটি ইয়াহু ওয়েব পেজ প্রশ্ন করেছিল : ‘ধোনি [ভারতীয় ক্যাপ্টেন] আরো একবার কি ভাগ্যবান হবে টসে জয় লাভ করে?’ কিছু উত্তর যা তারা পেয়েছিল, তাদের মধ্যে এগুলোকে বাছাই করা হয়েছিল সেরা উত্তর হিসেবে : ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ‘ল অব এভারেজে’, সুতরাং আমি বাজি রাখব সাঙ্গাকারার [শ্রীলঙ্কার ক্যাপ্টেন] ওপর, সে ভাগ্যবান হবে এই বহুল আলোচিত টসে জয় লাভ করে।’ আপনারা কি বিষয়টির অর্থহীনতা অনুধাবন করতে পারছেন? ধারাবাহিকভাবে প্রাক্তন ম্যাচগুলোয়, ধোনি প্রতিবারই টসে জিতেছে। টসের কয়েনটি নিরপেক্ষ হবারই কথা। সুতরাং ভ্রান্ত বোঝা ‘ল অব এভারেজ’-এর উচিত দেখা যে ধোনি এতদূর অবধি ভাগ্যবান হবার কারণে এখন টসে হারা উচিত, ভারসাম্যটি সংশোধন করার জন্য। আরেকটি উপায়ে এটি বলা যেতে পারে, এবার সাঙ্গাকারার টসে জেতার সময়। অথবা ন্যায়বিচারের বিষয় হবে না যদি ধোনি আবারো টসে জয় লাভ করে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ধোনি যতবারই এর আগে টসে জিতুক-না কেন, তার আবার জেতার সম্ভাবনা সবসময়ই ৫০ :৫০; এবার আমার ‘পালা’ বা ‘ন্যায়বিচার’ কোনোভাবেই এর অংশ না। আমরা সুবিচার আর অবিচার নিয়ে মাথা ঘামাতে পারি, কিন্তু টস করার সেই কয়েনটি এ বিষয়ে আদৌ কিছু ভাবে না, মহাবিশ্বও কিছু ভাবে না।
সত্যি যদি আপনি একটি পয়সা ১০০০ বার উপরে ছুড়ে মারেন, আপনি হয়তো আশা করতে পারেন ৫০০ বার হেড আর ৫০০ বার টেইল পড়বে, কিন্তু ধরুন আপনি যদি কোনো পেনি ৯৯৯ বার উপরে ছুড়ে মারলেন, প্রতিবার মাথাটাই পড়েছে, তাহলে শেষ বারে কী পড়তে পারে বলে আপনি বাজি রাখবেন? ‘ল অব এভারেজ’-এর একটি ব্যাপক ভ্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি অনুযায়ী আপনি বাজি রাখবেন এবার টেল পড়বে, কারণ এবার টেল পড়ার পালা, না হলে সুবিচার হবে না যদি আবার হেডই পড়ে, কিন্তু আমি আমার বাজি রাখব মাথার ওপর, আর যদি আপনি বুদ্ধিমান হন আপনিও তাই করবেন। টসে ৯৯৯টি বার মাথা পড়ার ধারাক্রম প্রস্তাব করছে যে নিশ্চয়ই কেউ পেনিটা নিয়ে কিছু করেছে অথবা এটা ছুড়ে মারার পদ্ধতির সাথে কিছু আছে যা হেড পড়ার সম্ভাবনাটি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘ল অব এভারেজ’ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা বহু জুয়াড়ির সর্বনাশের কারণ হয়েছে।
স্বীকার করতে হবে যে, ঘটনা ঘটে যাবার পর বিষয়টির দিকে পেছন ফিরে দেখলে, আপনি হয়তো বলতে পারেন, এই টসটি হারার কারণে সাঙ্গাকারার ভাগ্য খুবই খারাপ, কারণ এর মানে ভারত চমৎকার একটি পিচের উপর ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছে ও একটি বিশাল মাপের রানসংগ্রহ করেছে। কোনো সমস্যা নেই এই ভাবনায়। আপনি শুধু যা বলছেন তা হল এইবার এই টসে জেতা আসলেই খেলার ফলাফলের ওপর নির্ধারণী একটি প্রভাব ফেলেছে। সুতরাং যারাই এই বিশেষ ক্ষেত্রে টসে জিতবে তারা খুবই ভাগ্যবান সেটি ঘটবার জন্য। আপনার যা বলা উচিত হবে না সেটি হচ্ছে যেহেতু ধোনি এর আগে বহুবার টসে জিতেছে, এবার সাঙ্গাকারার জেতার পালা, কিংবা আপনার বলা উচিত হবে না, যেহেতু ধোনি ঘটনাচক্রে ভালো ক্রিকেটার, কিন্তু সত্যিকার যে কারণে আমাদের তাকে ক্যাপ্টেন বানানো উচিত সেটি হচ্ছে টস জেতার ক্ষেত্রে সে খুবই ভাগ্যবান। টস জেতার ভাগ্য এমনকিছু নয় যা কেউ ধারণ করতে পারেন। আপনি কোনো ক্রিকেটার সম্বন্ধে হয়তো বলতে পারেন, সে ভালো ব্যাটসম্যান বা খারাপ বোওলার। আপনি বলতে পারেন না যে সে টস জেতার জন্য ভালো বা খারাপ।
এবং ঠিক একই কারণে, পুরোপুরি অর্থহীন এমনকিছু ভাবা যে আপনি আপনার ভাগ্যকে উন্নত করতে পারবেন কোনো তাবিজ বা লাকি চার্ম গলায় বেঁধে। অথবা আপনার পেছনে আঙুল ক্রস করে ধরে রেখে। আপনার সাথে কী হচ্ছে এই জিনিসগুলোর সেটি প্রভাবিত করার কোনো উপায় নেই, যদি-না আপনি কেমন অনুভব করছেন এটি সেটির ওপর প্রভাব খাটিয়ে কিছু করে : আপনাকে এটি হয়তো বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে যা আপনার স্নায়ুকে ঠাণ্ডা করবে, যেমন—কোনো টেনিস ম্যাচে বল সার্ভ করার আগে, কিন্তু এর সাথে ভাগ্যের কোনো যোগাযোগ নেই। এটি মনোবিজ্ঞান।
সত্যি, কিছু মানুষকে বর্ণিত করা হয় ‘দুর্ঘটনার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে। এটি ঠিক আছে, যদি শুধুমাত্র এটি বোঝায় এমনকিছু যেমন — ‘আনাড়ি’, ‘অসাবধানী’, অথবা, পড়ে যাওয়া অথবা দুর্ভাগ্যের শিকার হবার যাদের বিশেষ প্রবণতা থাকে। আপনি যদি সত্যি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ বলতে কী বোঝায় তার একটি কৌতুকময় উদাহরণ চান, তাহলে মজার সিনেমা ‘দ্য পিঙ্ক প্যানথার’ দেখুন, যেখানে ইন্সপেক্টর জ্যাক ব্লুজোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পিটার সেলার্স। ইন্সপেক্টর ব্লুজো সারাক্ষণই বিব্রতকর আর মজার সব দুর্ঘটনা ঘটান ও শিকার হন, কিন্তু তার কারণ তিনি স্বভাবগতভাবেই একজন গোলমাল পাকানোর মানুষ, এমন নয় যে সারাক্ষণই তাঁর ভাগ্য খারাপ, আর সেভাবেই অনেকেই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে [প্রসঙ্গক্রমে, মূল ‘পিঙ্ক প্যানথার’ সিনেমাটি দেখার চেষ্টা করেন, পরবর্তীতে নির্মিত অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের একই ধরনের শিরোনামসহ ছবিগুলো নয়, যেমন—সন অব পিঙ্ক প্যানথার, দ্য পিঙ্ক প্যানথার রিভেঞ্জ ইত্যাদি, যার থেকে এদের জন্ম]।
অতি বিশ্বাসপ্রবণতা ও অতি সন্দেহবাদিতা
বেশ, আমরা দেখেছি খারাপ জিনিসগুলো, ভালো জিনিসগুলোর মতো, তাদের যতটা প্রায়শ ঘটা উচিত শুধুমাত্র দৈবাৎ কারণে তার চেয়ে বেশি মাত্রায় ঘটে না। মহাবিশ্বের কোনো মন নেই, কোনো অনুভূতি বা ব্যক্তিত্ব নেই, সুতরাং আপনাকে আঘাত করতে বা তৃপ্তি দেয়ার জন্যে এটি কিছু করে না। খারাপ কিছু ঘটে কারণ কোনোকিছু ঘটে। ঘটনাটি ভালো কিংবা খারাপ যাই হোক-না কেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেটি ঘটার সম্ভাবনাকে কোনো দিকেই প্রভাবিত করবে না। কিছু মানুষ এটিকে মেনে নেয়ার জন্যে বেশ কষ্টকর একটি বিষয় মনে করেন। তাঁরা মনে করেন পাপীরা তাদের যা প্রাপ্য সেটি পায় এবং সদগুণ পুরস্কৃত হয়। মানুষ কী শ্রেয়তর মনে করে, সেই বিষয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মহাবিশ্ব আদৌ তোয়াক্কা করে না।
কিন্তু এখন, এইসব বলার পর, চিন্তার জন্যে খানিকটা বিরতি নেয়া আমাদের উচিত হবে। যথেষ্ট হাস্যকরভাবেই, আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ‘সড’স ল’-এর মতো কিছু খানিকটা সত্য। যদিও অবশ্যই এটি সত্য নয় যে আবহাওয়া অথবা একটি ভূমিকম্প, এসব আপনারই ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ঘটছে [কারণ, কোনোভাবেই আপনার ব্যাপারে তাদের আদৌ কোনো মাথাব্যথা নেই]; আমরা যখন বিবর্তনের দিকে তাকাব পরিস্থিতি সেখানে খানিকটা ভিন্ন অনুভূত হয়। আপনি যদি একটি খরগোশ হন, কোনো শিয়াল অবশ্যই আপনাকে শিকার করার জন্য খুঁজছে। আপনি যদি ছোট কোনো মাছ হন তাহলে বড় কোনো মাছ আপনাকে খাবার জন্য খুঁজছে। আমি বোঝাতে চাইছি না যে শিয়াল কিংবা বড় কোনো শিকারি মাছ এভাবেই বিষয়টি নিয়ে ভাবে। যদিও তারা সেটি হয়তো করতেও পারে। আমি একইভাবে খুশি হব বলতে পারলে যে, একটি ভাইরাস আপনাকে আক্রমণ করার জন্য খুঁজছে এবং কেউই বিশ্বাস করে না যে ভাইরাস কোনোকিছু নিয়ে ভাবতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন লক্ষ রেখেছে যেন ভাইরাস, শিয়াল এবং শিকারি মাছ, এমনভাবে আচরণ করে যেন তারা সক্রিয়ভাবে তাদের শিকারদের জন্যে খারাপ, তারা এমনভাবে আচরণ করে যেন পরিকল্পিতভাবে তারা তাদের আক্রমণ করার জন্যে খুঁজছে—আর সেটি এমন একটি উপায়ে যা আমি কোনো ভূমিকম্প, হারিকেন বা তুষারধসের সম্পর্কে বলতে পারব না। ভূমিকম্প আর হারিকেনগুলো তাদের শিকারদের জন্য খুবই বড় বিপর্যয়, কিন্তু সেগুলো খারাপ কিছু করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেয় না। কোনোকিছু করার জন্যেই তারা সক্রিয় পদক্ষেপ নেয় না, শুধুমাত্র সেগুলো ঘটে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, ডারউইন যেমন বলেছিলেন, এর মানে হচ্ছে প্রতিটি জীবিত প্রাণীর শত্রু আছে এবং এর বিপর্যয় আর পতনের জন্যে তারা কঠোরভাবে পরিশ্রম করছে এবং কখনো প্রাকৃতিক শত্রুরা যে কৌশলগুলো ব্যবহার করে তা আপাতদৃষ্টিতে এমন একটি বিভ্রম উপস্থাপন করে যে তাদের তৈরি করা হয়েছে খুব বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পরিকল্পনা দ্বারা। যেমন—মাকড়শার জাল, বিস্ময়কর উদ্ভাবনী একটি ফাঁদ, যা তৈরি করে বিছিয়ে রাখা হয় অসতর্ক কীটপতঙ্গদের ধরতে। একটি ভয়ঙ্কর ছোট কীট যার নাম ‘অ্যান্ট লায়ন’, এটি এর শিকারের জন্য মাটিতে গর্ত করে নানা ধরনের গোপন ফাঁদ পেতে রাখে। অ্যান্ট লায়ন বালির মধ্যে একটি কৌণিক গর্ত করে তার নিচে বসে থাকে, আর সেই গর্তে যখনই কোনো পিঁপড়া পড়ে যায় তাকে সে আক্রমণ করে। কেউই এমন কোনো প্রস্তাব করছে না যে, মাকড়শা অথবা অ্যান্ট লায়ন খুব উদ্ভাবনী ক্ষমতাপূর্ণ—এবং ধূর্ত ফাঁদগুলো তারা চিন্তা করেই আবিষ্কার করেছে, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদের যে মস্তিষ্ক বিবর্তন করেছে এবং সেটি যেভাবে আচরণ করে তা আমাদের চোখে ‘দেখতে’ উদ্ভাবনপটু মনে হয়। একইভাবে একটি সিংহের শরীর দেখলে মনে হয় সেটি এত বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিকল্পিত যা জেব্রা আর অ্যান্টিলোপদের জন্যে অনিবার্যভাবে মৃত্যু ঢেকে আনে, আপনি যদি একটি অ্যান্টিলোপ হন, ওঁৎ পেতে থাকা, অনুসরণ করা, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করা সিংহকে দেখলে মনে হতে পারে এটি হয়তো ক্ষতি করার জন্যে আপনাকেই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেছে।
খুবই সহজ এভাবে দেখা যে, শিকারি প্রাণীরা [যে প্রাণীরা অন্য প্রাণীদের হত্যা করে ও তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে] তাদের শিকারদের সর্বনাশ করার সব চেষ্টাই করছে, কিন্তু এটিও সত্য যে শিকার হওয়া সেই প্রাণীরাও তাদের শিকার করা প্রাণীরা যেন তাদের আক্রমণ করতে সফল না হতে পারে সেই লক্ষ্যেও চেষ্টা করছে। শিকারি প্রাণীরা খাদ্য হওয়া থেকে নিজেদের বাঁচাতে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এবং যদি তারা সেটি করতে সক্ষম হয় তাহলে শিকারি প্রাণীকে অভুক্ত থেকে মারা যেতে হয়। একইভাবে বিষয়টি সত্য পরজীবী ও তাদের পোষকদের ক্ষেত্রেও এবং এটি সত্য একই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যেও, যারা সবাই সত্যিকারভাবে অথবা সম্ভাব্য পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি বেঁচে থাকা সহজ হয়, প্রাকৃতিক নির্বাচন শত্রুদের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি করার বিবর্তনে সহায়তা করে, সেটি শিকারি প্রাণী, শিকার, পরজীবী, পোষক অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী যাই হোক-না কেন : যে উন্নতিগুলো জীবনকে আবার আরো কঠোর করে তুলবে। ভূমিকম্প, টর্নেডো কোনোটাই সুখকর কিছু নয়, এমনকি শত্রু বলা যেতে পারে, কিন্তু তারা ‘আপনাকেই ঠিক নির্দিষ্ট করে আক্রমণ করছে এমন নয় সেই একই ‘সড’স ল’-এর নিয়মানুযায়ী, শিকারি প্রাণী আর পরজীবীরা যেমন।
আর এটি, যে-কোনো প্রাণী যেমন—অ্যান্টিলোপদের যে ধরনের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা করা যেতে পারে, তার ওপর প্রভাব ফেলে। আপনি যদি একটি অ্যান্টিলোপ হন আর লক্ষ করেন যে দূরের লম্বা ঘাসগুলো নড়ছে, এটি শুধুমাত্র বাতাস হতে পারে। কোনোকিছু চিন্তা করার নেই, কারণ বাতাস আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসছে না : এটি অ্যান্টিলোপ ও তাদের ভালো-মন্দের ব্যাপারে পুরোপুরি নির্বিকার, কিন্তু লম্বা ঘাসের মধ্যে খসখস শব্দ লুকিয়ে অনুসরণ করা কোনো চিতাবাঘেরও হতে পারে এবং চিতাবাঘ সুনির্দিষ্টভাবে আপনাকে ক্ষতি করার জন্য অপেক্ষা করছে : কোনো চিতাবাঘের কাছে আপনার মাংসের স্বাদ বেশ লোভনীয় এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন পূর্বসূরি চিতাবাঘদের অ্যান্টিলোপদের শিকার করার জন্য দক্ষভাবে বিবর্তিত করেছে। সুতরাং অ্যান্টিলোপ, খরগোশ আর ছোট পোনামাছেরা এবং প্রায় সব প্রাণীরা সারাক্ষণই সতর্ক অবস্থায় থাকে। ভয়ঙ্কর শিকারি প্রাণী দিয়ে সারা পৃথিবী পূর্ণ এবং ‘সড’স ল’য়ের মতো কোনোকিছু আসলে সত্য মনে করাই সবচেয়ে নিরাপদ হবে। আসুন এটাকে আমরা চার্লস ডারউইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করি, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভাষায় : সেইসব একক প্রাণী-সদস্যরা যারা এমনভাবে আচরণ করে যেন ‘সড’স ল’ সত্য, তাদের বেঁচে থাকা ও প্রজনন করার সম্ভাবনাও বেশি থাকে সেই প্রাণীদের তুলনায় যারা অতিবিশ্বাসপ্রবণ ‘পলিয়ানা’র ল’ অনুসরণ করে।
আমাদের পূর্বসূরিরা তাদের সময়ের একটি বড় অংশ কাটিয়েছে সিংহ, কুমির, পাইথন আর চিতাবাঘদের আক্রমণের ভয়ঙ্কর বিপদের ঝুঁকির মুখে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের জন্য পৃথিবীর প্রতি একটি সংশয়পূর্ণ— কেউ হয়তো বলতে পারেন সন্দেহবাতিক-দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত অর্থবহ, ঘাসের মধ্যে প্রতিটি খসখস শব্দ, ডালের প্রতিটি ভাঙন শোনা এবং সতর্কতার সাথে ধারণা করে নেয়া যে কিছু-না কিছু আছে যা কিনা আপনার ক্ষতি করবে, কোনো পরিকল্পনাকারী সচেতন সত্তা পরিকল্পনা করছে আপনাকে হত্যা করবে। ‘ফন্দি’ আঁটা বললে বিষয়টি ভুলভাবে দেখা হবে, যদি আপনি বিষয়টি ভাবেন একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা হিসেবে, কিন্তু বিষয়টি খুব সহজ যদি ধারণাটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয় : অনেক শত্রু আছে চারিদিকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তারা আচরণ করবে যেন তারা ‘ফন্দি আটছে আমাকে কিভাবে হত্যা করবে। আমার কল্যাণের বিষয়ে পৃথিবী আদৌ নিরপেক্ষ আর নির্বিকার নয়। পৃথিবী উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমার কল্যাণ- বিরোধী, ‘সড’স ল’ সত্যি হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে, কিন্তু ‘পলিয়ানা’স ল’ সত্য ভেবে আচরণ করার চেয়ে বরং ‘সড’স ল’ সত্য ভেবে সতর্ক আচরণ করা আসলেই অনেক নিরাপদ।
হয়তো এটি একটি কারণ কেন, আজ অবধি, বহু মানুষেরই কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস আছে যে, সারা পৃথিবী তাদের ক্ষতি করবে এমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কিন্তু যখন এই ভাবনাগুলো সীমানা অতিক্রম করে, তখন আমরা বলি তারা ‘প্যারানয়েড’ বা ভ্ৰমগ্ৰস্ত।
অসুখ ও বিবর্তন—এখনো অসমাপ্ত?
যেমন আমি বলেছি আগে, শিকারি প্রাণীরাই শুধুমাত্র একমাত্র এজেন্ট নয়, যারা কিনা আমাদের ক্ষতি করার ফন্দি আটছে। পরজীবীরা আরো কৌশলী গোপন হুমকি, কিন্তু তারা একই মাত্রায় বিপজ্জনক। পরজীবীদের মধ্যে আছে ফিতাকৃমি এবং ফ্লুক, ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস, যারা জীবন কাটায় আমাদের শরীর থেকে খাদ্যসংগ্রহ করে। শিকারি প্রাণী, যেমন—সিংহরা শরীরদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে; কিন্তু একটি শিকারি প্রাণী ও একটি পরজীবীর মধ্যে পার্থক্য সাধারণত খুব সুস্পষ্ট। পরজীবীরা বেঁচে থাকে জীবিত শিকারদের শরীর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে [যদিও তারা একসময় তাদের হত্যা করে] এবং সাধারণত তারা আকারে ক্ষুদ্রতর তাদের শিকারদের তুলনায়। শিকারি প্রাণীরা হয় তাদের শিকার থেকে আকারে বড় [যেমন করে একটি বিড়াল ইঁদুরের চেয়ে আকারে বড়], অথবা যদি আকারে ছোট হয় [সিংহ আকারে কোনো জেব্রা থেকে ছোট], তবে খুব বেশি ক্ষুদ্রতর নয়। শিকারি প্রাণীরা তাদের শিকারকে হত্যা করে প্রথমে তারপর তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। পরজীবীরা তাদের শিকারদের আরো ধীরে ধীরে ব্যবহার করে এবং শিকার হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য বেঁচে থাকে যখন পরজীবীরা ভিতর থেকে তাদের কুরে কুরে খায়।
প্রায়শই বহুসংখ্যক পরজীবী একসাথে আক্রমণ করে তার পোষককে, যেমন—যখন আমাদের শরীর আক্রান্ত হয় কোনো ফ্লু বা সর্দিজ্বরের ভাইরাস দ্বারা। যে পরজীবীর আকারে এতই ক্ষুদ্র যে তাদের খালি চোখে তাদের দেখা যায় না, সাধারণত জার্মস বা রোগজীবাণু বলা হয় তাদের, কিন্তু এটি নির্ভুল শব্দ নয়। তাদের মধ্যে আছে ভাইরাসরা, যারা আসলেই আকারে অতি ক্ষুদ্র, ব্যাকটেরিয়া, যারা ভাইরাসের চেয়ে আকারে বড় কিন্তু তারপরও খুব ক্ষুদ্র তাদের আকারে [এমন ভাইরাসও আছে যারা ব্যাকটেরিয়াদের শরীরে পরজীবীর মতো আচরণ করে], অন্য এককোষী জীব যেমন—ম্যালেরিয়ার পরজীবী, যারা আকারে ব্যাকটেরিয়াদের চেয়ে অনেক বড় কিন্তু তারপরও অনেক ক্ষুদ্র যে তাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। প্রচলিত ভাষায় এই এককোষী পরজীবীদের চিহ্নিত করার জন্য কোনো একটি সাধারণ নাম নেই। তাদের কাউকে বলা যেতে পারে প্রোটোজোয়া, কিন্তু এখন শব্দটি বেশি পুরনো হয়ে গেছে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পরজীবী, ছত্রাক, যেমন—রিং ওয়ার্ম আর অ্যাথলেট ফুটের কারণ [বেশিরভাগ ছত্রাক কেমন দেখতে সেই সম্বন্ধে মাশরুম আর টোডস্টুলের মতো বড় ছত্রাকগুলো ভুল ধারণা দিতে পারে ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুখের উদাহরণ : টিউবারকুলোসিস বা যক্ষ্মা, কিছু ধরনের নিউমোনিয়া, হুপিং কফ, কলেরা, ডিপথেরিয়া, লেপরোসি, স্কারলেট ফিভার, ফোড়া আর টাইফাস ইত্যাদি। ভাইরাসজনিত অসুখের মধ্যে যেমন আছে হাম, চিকেনপক্স, মাম্পস, গুটিবসন্ত, হারপিস, র্যাবিস, পোলিও, রুবেলা, নানা ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সেই একগুচ্ছ অসুখ যাদের বলা হয় কমন কোল্ড বা সর্দিজ্বর। ম্যালেরিয়া, অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি বা আমাশয়, স্লিপিং সিকনেস হচ্ছে সেই অসুখগুলো যাদের কারণ কোনো প্রোটোজোয়া। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পরজীবীরা, আরো বড় আকারের, খালি চোখে দেখার মতোই যথেষ্ট বড়, যেমন—নানা ধরনের কৃমি, যেমন— ফ্ল্যাটওয়ার্ম, রাউন্ডওয়ার্ম আর ফ্লুক। শৈশবে যখন আমি একটি খামারের কাছে থাকতাম, প্রায়ই আমি মৃত প্রাণীদের খুঁজে পেতাম, যেমন কোনো বেজি অথবা একটি মোল। আমি তখন স্কুলে জীববিজ্ঞান শিখছি, আমি যথেষ্ট কৌতূহলী ছিলাম, মাঝে মাঝে এই মৃত প্রাণীগুলো ব্যবচ্ছেদও করতাম। যে মূল বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করতে সেটি ছিল তাদের অন্ত্রনালী ভর্তি থাকত মোচড় দিতে থাকা জীবন্ত কৃমি দিয়ে [রাউন্ডওয়ার্ম, বৈজ্ঞানিক ভাষা যাদের বলা হয় নেমাটোড], কিন্তু এমন কোনোকিছুই চোখে পড়ত না সেইসব গৃহপালিত ইঁদুর বা খরগোশদের ক্ষেত্রে, যে প্রাণীগুলো আমাদের স্কুলে দেয়া হত ব্যবচ্ছেদ করার জন্য।
শরীরের খুবই উদ্ভাবনী ও সাধারণত কার্যকরী উপায় আছে পরজীবীদের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য, যাকে বলা হয় ইমিউন সিস্টেম [রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র]। ইমিউন সিস্টেম এত বেশি জটিল যে সেটি ব্যাখ্যা করতে পুরো একটি বই লাগবে। সংক্ষেপে, যখনই ভয়ঙ্কর কোনো পরজীবীর উপস্থিতি এটি টের পায়, শরীরকে এই তন্ত্রটি সক্রিয় করে তোলে বিশেষ কিছু কোষ তৈরি করতে, রক্ত যাদের বহন করে নিয়ে যায় যুদ্ধে, এক ধরনের সেনাবাহিনীর মতো, যাদের বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে সেই বিশেষ পরজীবীটিকে মোকাবেলা করার জন্য। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম জয়লাভ করে এবং শরীর আরোগ্যলাভ করে। এরপর, ইমিউন সিস্টেম ‘মনে রাখে’ সেই আণবিক যন্ত্রাংশগুলো যা এটি তৈরি করেছিল এই বিশেষ যুদ্ধটি জেতার জন্য এবং পরবর্তীতে একই পরজীবীর আক্রমণ এটি এত সহজেই মোকাবেলা করে যে আমরা লক্ষই করতে পারি না। সে-কারণেই, একবার যখন আপনি হাম অথবা মাম্পস বা জলবসন্তের মতো কোনো রোগে আক্রান্ত হন, রোগটি আবার হতে পারার খুবই কম সম্ভাবনা থাকে। মানুষ সাধারণত ভাবে খুব ভালো একটি ধারণা যদি শিশুদের মাম্পস হয়, কারণ ইমিউন সিস্টেমের ‘স্মৃতি’ যখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবে তাদের সেই রোগ থেকে সুরক্ষা করবে—এবং শিশুদের জন্য যতটা, মাম্পস প্রাপ্তবয়স্ক কারো জন্য আরো বেশি কষ্টকর [বিশেষ করে পুরুষদের, কারণ এটি তাদের অণ্ডকোষকে আক্রমণ করে]। ভ্যাক্সিনেশন হচ্ছে দারুণ উদ্ভাবনী একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে একই কাজ করা হয়। আপনাকে মূল অসুখটি না দিয়ে ডাক্তার আপনাকে সেই একই অসুখের একটি দুর্বল সংস্করণ দেয়, অথবা, সম্ভবত মৃত জীবাণুদের একটি ইনজেকশন, যা ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে আপনাকে আসল অসুখ না দিয়ে, প্রায়শই আপনি কোনো প্রভাবই অনুভব করেন না, কিন্তু ইমিউন সিস্টেম মৃত জীবাণুদের ‘মনে রাখে’ অথবা অসুখটির একটি মৃদু সংস্করণ এবং সেভাবে এটি আগেই সশস্ত্র হয়ে ওঠে সত্যিকার জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে যদি কখনো সেটি আক্রমণ করে।
ইমিউন সিস্টেমের একটি কঠিন কাজ হচ্ছে ‘সিদ্ধান্ত’ নেয়া, কোনটি ফরেন বা বহিরাগত বা শরীরের বাইরে থেকে প্রবেশ করেছে এবং সে- কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে [যেমন, একটি সন্দেহজনক পরজীবী এবং কোনটি শরীরের নিজেরই অংশ হিসেবে মনে করা উচিত হবে। এটি বিশেষভাবে জটিল, যেমন—যখন কোনো একটি নারী গর্ভবতী হয়। তার গর্ভের শিশুটি তার শরীরে ‘বহিরাগত’ [শিশুরা তাদের মায়ের জিনগত হুবহু প্রতিলিপি নয়, কারণ তাদের অর্ধেক জিন আসে তাদের বাবার কাছ থেকে]। ইমিউন সিস্টেমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিশুর সাথে যেন সে যুদ্ধ না করে। এটি একটি কঠিন সমস্যা যার সমাধান করতে হয়েছে যখন গর্ভধারণে করার মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেয়ার পদ্ধতিটি স্তন্যপায়ীদের পূর্বসূরিদের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছিল। এটির সমাধান করা হয়েছিল—বহুসংখ্যক শিশু মাতৃগর্ভে যথেষ্ট পরিমাণ দীর্ঘসময় ধরে বেঁচে থাকে জন্ম নেবার জন্যে, কিন্তু অনেক সংখ্যক ভ্রূণও গর্ভপাতে শেষ হয়ে যায়। সেটি হয়তো প্রস্তাব করে যে বিবর্তনের বেশ কঠিন সময় অতিক্রম করতে হয়েছে এটি সমাধান করার জন্য এবং সমাধানটিও সম্পূর্ণ নয়। আজও, বহু শিশু বাঁচতে পারে শুধুমাত্র হাতের কাছে ডাক্তার থাকার কারণে, যেমন—ইমিউন সিস্টেমের অতি- প্রতিক্রিয়ার কিছু চূড়ান্ত ক্ষেত্রে জন্মের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব পুরোপুরিভাবে তাদের শরীরের রক্ত পরিবর্তন করার মাধ্যমে।
আরেকটি যে উপায়ে ইমিউন সিস্টেম ভুল করতে পারে সেটি হচ্ছে তথাকথিত আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে খুব বেশি শক্তিশালীভাবে যুদ্ধ করে। আর সেটাই হচ্ছে অ্যালার্জি : অপ্রয়োজনীয়, অপরিমিত ও ক্ষতিকরভাবে নিরীহ জিনিসের সাথে যুদ্ধ করে ইমিউন সিস্টেম। যেমন—বাতাসের পরাগরেণু সাধারণত কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ইমিউন সিস্টেম মাত্রাহীনভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে—এবং তখনই আপনি অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়ার শিকার হন, যাকে বলা হয় ‘হে ফিভার’ : আপনি হাঁচি দেবেন, আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়বে, জ্বলবে, খুবই অস্বস্তিকর আর অপ্রীতিকর একটি অভিজ্ঞতা। কিছু মানুষ, বিড়াল, কুকুরদের প্রতিও অ্যালার্জি প্রদর্শন করে : তাদের ইমিউন সিস্টেম এইসব প্রাণীদের চুলের মধ্যে অথবা এর উপরে থাকা নিরীহ অণুর প্রতি অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। অ্যালার্জি কখনও খুবই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে। কিছু মানুষ চীনাবাদামের প্রতি এত বেশি মাত্রায় অ্যালার্জি প্রদর্শন করে যে, একটিমাত্র বাদাম তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে [যাকে বলে অ্যানাফাইল্যাকটিক শক]।
কখনও অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনকারী একটি ইমিউন সিস্টেম এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে-কোনো মানুষ তার নিজের প্রতি অ্যালার্জি প্রদর্শন করে! এটাই পরিচিত অটোইমিউন [অটোস হচ্ছে গ্রিক শব্দ যার অর্থ সেলফ বা ‘নিজে’] রোগগুলোর কারণ। কিছু অটোইমিউন রোগের উদাহরণ, যেমন—অ্যালোপেসিয়া [আপনার চুল গোছা গোছা পড়ে যায় কারণ আপনার শরীর আপনার নিজের চুলের কোষ বা হেয়ার ফলিকলের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে] এবং সোরিয়াসিস [অতিপ্রতিক্রিয়াশীল একটি ইমিউন সিস্টেম চামড়ায় গোলাপি শুষ্ক এলাকা তৈরি করে]।
খুব বিস্ময়কর নয় যে ইমিউন সিস্টেম মাঝে মাঝেই অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে, কারণ যখন আক্রমণ করা উচিত তখন আক্রমণ করতে ব্যর্থ হওয়া আর যখন উচিত নয় তখন আক্রমণ করা, এই দুটি পরিস্থিতির মধ্যবর্তী সীমারেখায় তাকে খুব সন্তর্পণে অগ্রসর হতে হয়। এটি সেই একই সমস্যা, যেমন—আমরা অ্যান্টিলোপের ক্ষেত্রে দেখেছি, যখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় লম্বা ঘাসের মধ্যে শব্দ কি শুধুমাত্র পাতা নড়ার খসখস শব্দ, নাকি সেটি লুকিয়ে থাকা কোনো চিতাবাঘ? নাকি ঘাসের মধ্যে বাতাসের নিরাপদ ফুঁ? এটি কি কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া, নাকি ক্ষতি করে না এমন কোনো পরাগরেণু? আমি না ভেবে পারছি না, অতিপ্রতিক্রিয়াশীল ইমিউন সিস্টেমসহ মানুষগুলো, যাদের অ্যালার্জি বা অটোইমিউন রোগ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে হয়, তাদের হয়তো কিছু সুনির্দিষ্ট ধরনের ভাইরাস আর অন্য পরজীবীদের আক্রমণে অপেক্ষাকৃত কম কষ্টভোগ করার সম্ভাবনা থাকে।
এই ধরনের ‘ভারসাম্য’ সমস্যাগুলো খুবই সাধারণ ঘটনা। সম্ভাবনা আছে অতিমাত্রায় ‘ঝুঁকি এড়ানোয় ইচ্ছুক’ হওয়া—খুব বেশি সতর্ক, ঘাসের ঝোপে প্রতিটি শব্দকে বিপদ হিসেবে মনে করা অথবা নিরীহ চীনাবাদাম কিংবা নিজের শরীরের কোষের বিরুদ্ধে ব্যাপক রোগপ্রতিরোধী আক্রমণ সূচনা করা। আবার সম্ভাবনাও আছে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে ঝুঁকি তোয়াক্কা না করা, যখন আসলেই বিপদ সেই পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হওয়া অথবা যখন কিনা আসলেই বিপজ্জনক পরজীবী শরীর আক্রমণ করে, তখন তার বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়া। এই সীমারেখাটি মেনে চলা খুব কঠিন, যে-কোনো দিকে অসতর্কতার পরিণতি হতে পারে ভয়ানক।
ক্যান্সার হচ্ছে বিশেষ একটি খারাপ পরিস্থিতি যা ঘটতে পারে : অদ্ভুত একটি কেস, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিস্থিতি। ক্যান্সার হচ্ছে আমাদের নিজেদের শরীরের একগুচ্ছ কোষ, শরীরে তাদের যা কাজ করা দরকার সেই বাধ্যবাধ্যকতা থেকে বের হয়ে আসে এবং পরজীবীর মতোই আচরণ করতে শুরু করে। ক্যান্সার কোষগুলো যারা সাধারণত একসাথে গুচ্ছাকারে থাকে একটি ‘টিউমর’ হিসেবে, যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, শরীরের কোনো অংশকে পরজীবীর মতো ব্যবহার করে। সবচেয়ে খারাপ ক্যান্সারগুলো শরীরে অন্য অংশেও ছড়িয়ে পরে [তাদের বলা হয় মেটাস্টাসিস] এবং একপর্যায়ে এটি সেই শরীরে মৃত্যুর কারণ হয়। যে টিউমরগুলো এটি করে তাদের বলে ম্যালিগন্যান্ট।
যে কারণে ক্যান্সার এত বেশি ভয়ঙ্কর, সেটি হচ্ছে তাদের কোষগুলো খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে সরাসরিভাবে শরীরের নিজের কোষগুলো থেকেই উদ্ভব হয়। এর মানে শরীরে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ-প্রতিরোধ তন্ত্রের জন্যে তাদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া এর মানে এটি নিরাময়ের জন্যে চিকিৎসা খোঁজাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ আপনি চিন্তা করতে পারেন এমন যে-কোনো চিকিৎসা এক্ষেত্রে বিষের মতো, অর্থাৎ এটি ক্যান্সার কোষগুলোর সাথে সাথে শরীরের নিজস্ব সুস্থ কোষগুলোকেও নির্বিচারে হত্যা করে। ব্যাকটেরিয়া মারা এর চেয়ে অনেক সহজ, কারণ ব্যাকটেরিয়ার কোষ আমাদের চেয়ে ভিন্ন। যে বিষটি ব্যাকটেরিয়াদের কোষ হত্যা করে, কিন্তু আমাদের শরীরের কোষের কোনো ক্ষতি করে না তাদের বলে অ্যান্টিবায়োটিক। কেমোথেরাপি ক্যান্সার কোষকে হত্যা করে, কিন্তু এটি আমাদের শরীরের সুস্থ কোষের জন্যেও বিষাক্ত কারণ দুটি কোষের মধ্যে সদৃশ্যতা অনেক বেশি। আপনি যদি কোনো বিষের ডোজ বেশি মাত্রায় ব্যবহার করেন, আপনি হয়তো ক্যান্সার কোষগুলোকে সব হত্যা করতে পারেন, কিন্তু পরিণতিতে অসহায় রোগীকেও আপনার হত্যা করতে হবে আগে।
আমরা আবার সেই সমস্যায় ফিরে এসেছি, সত্যিকারের শত্রুকে [ক্যান্সার কোষ] আক্রমণ আর, বন্ধুকে [আমাদের নিজেদের শরীরের কোষ] আক্রমণ না করার মধ্যে একটি ভারসাম্যে পৌঁছানো : সেই চিতাবাঘ আর লম্বা ঘাসের মধ্যে খসখস শব্দের সমস্যায় আবার ফিরে আসা।
একটি ধারণা দিয়ে আমাকে এই অধ্যায়টি শেষ করতে দেয়া হোক। সম্ভব হতে পারে কি যে, বহু পূর্বসূরি প্রজন্মের পরে অটোইমিউন রোগগুলো ক্যান্সারের বিরুদ্ধে বিবর্তনীয় যুদ্ধের একটি উপজাত উৎপাদন? প্রাক- ক্যান্সার কোষদের সাথে বহু যুদ্ধে ইমিউন সিস্টেম জয় লাভ করেছে, পুরোপুরিভাবে ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যাবার আগেই তাদের প্রতিরোধ করেছে তারা। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, প্রাক-ক্যান্সার কোষগুলো শনাক্ত করার জন্যে এর নিরন্তর তদারকিতে, ইমিউন সিস্টেম কখনো খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে এবং নিরীহ কোষগুলো আক্রমণ করে, শরীরের নিজের কোষগুলোকে এবং আমরা এটি বলি অটো-ইমিউন ডিজিজ। অটোইমিউন রোগগুলোর ব্যাখ্যা কি হতে পারে যে এগুলো আসলে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো অস্ত্র গড়ে তোলার জন্যে বিবর্তনের কোনো চলমান প্রক্রিয়ার প্রমাণ?
আপনারা কী মনে করেন?