হাওয়াযিন বা হুনায়নের যুদ্ধ
আল্লাহর বাণী :
অর্থ : আল্লাহ্ তোমাদের তো সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং হুনায়নের যুদ্ধের দিনে যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিল তোমাদের সংখ্যাধিক্য। কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্যে সংকুচিত হয়েছিল ও পরে তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। এরপর আল্লাহ্ তাঁর নিকট হতে তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী অবতীর্ণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করেন; এটাই কাফিরদের কর্মফল । এরপরও যার প্রতি ইচ্ছা আল্লাহ্ ক্ষমা পরায়ণ হবেন; আল্লাহ্ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (৯-তাওবা ও ২৫– ২৭)।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ইবন ইয়াসার তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর ৫ই শাওয়াল রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, মক্কা বিজয় হয়েছিল রমযানের দশ দিন বাকী থাকতে এবং হাওয়াযিনের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হওয়ার পনের দিন পূর্বে। ইবন মাসউদ থেকেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে। উরওয়া ইবন যুবায়রও এ মত পোষণ করেন। ইমাম আহমদ এবং ইবন জারীর তার ইতিহাস গ্রন্থে এ মতই সমর্থন করেছেন। ওয়াকিদী লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) শাওয়াল মাসের ছয় তারিখের পর হাওয়াযিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং দশ তারিখে হুনায়ন পৌঁছেন। আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, ঐ দিন আমরা সংখ্যায় স্বল্পতার দরুন পরাজিত হইনি। সংখ্যায় অধিক হওয়া সত্ত্বেও তারা পলায়ন করে। সর্ব প্রথম পলায়ন করে বনূ সুলায়ম, তারপরে মক্কাবাসীগণ, তারপরে অন্যান্য সবাই।
ইবন ইসহাক বলেন : হাওয়াযিন গোত্রের লোকজন যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আগমন ও মক্কা বিজয়ের সংবাদ জানতে পারলো, তখন তাদের নেতা মালিক ইব্ন আওফ নাসরী তার গোত্রের লোকদের একত্রিত করলো। হাওয়াযিনদের সাথে ছাকীফ গোত্রের সকলেই এসে তার কাছে সমবেত হল। নাসর ও জুশাম গোত্রদ্বয়েরও সবাই এসে হাযির হয়। আরও উপস্থিত হয়। সা’দ ইবন বকর গোত্র এবং বনূ হিলাল গোত্রের অল্প সংখ্যক লোক, এরা ছিল সংখ্যায় নগণ্য। মোটকথা, কায়েস আয়লানের উপরোক্ত লোকজন ব্যতীত আর কেউ আসেনি। হাওয়াযিন গোত্রের কা’ব ও কিলাব শাখাদ্বয় এ গণজমায়েতে অনুপস্থিত থাকে। তাদের মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য কেউ সেখানে আসেনি। বনূ জুশাম গোত্রের দুরায়দ ইবন সাম্মা [আর রাহীকুল মাখতূমে’ (উর্দু সংস্করণ ১৯৯৮ লাহোর) নামটি দুরায়দ ইবন সাম্মা এবং মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ আকরম যিয়া উমরীর আস্সীরতুন নববীর আস-সাহীছা (আরবী) গ্রন্থে দুরায়দ ইবন সিম্মা বলে উল্লিখিত হয়েছে।–সম্পাদক] ছিল অতিশয় বৃদ্ধ । তার দৈহিক শক্তি ছিল না বটে, তবে তার মতামত যুদ্ধের কলা-কৌশল ও অভিজ্ঞতা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো। সে ছিল যুদ্ধের ময়দানের এক প্রবীন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ‘ছাকীফ গোত্রের সর্দার ছিল দু’জন। আহলাফ গোত্রের নেতা ছিল কারিব ইবন আসওদ ইবন মাসউদ ইবন মুআত্তাব । আর বনূ মালিক গোত্রের সর্দার ছিল যুল খিমার সুবায় ইবন হারিছ এবং তার ভাই আহমদ ইবন হারিছ । তবে সামগ্রিকভাবে সবার উপরে নেতৃত্ব ছিল মালিক ইবন আওফ নাসরীর হাতে। এরপর যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, তখন সে সকলকে নিজেদের ধন-সম্পদ ও স্ত্রী-পুত্র সাথে নিয়ে গমন করার নির্দেশ দিল । যখন তারা আওতাস নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হল, তখন লোকজন তার কাছে এসে সমবেত হল। তাদের মাঝে ছিল দুরায়দ ইবন সাম্মা। একটি হাওদার মধ্যে বসিয়ে তাকে সেখানে টেনে নেয়া হয়। হাওদা থেকে অবতরণ করে সে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা এখন কোন প্রান্তরে রয়েছ? জবাবে তারা বললো : আওতাস প্রান্তরে। সে বললো :
نعم مجال الخيل = لا حزن ضرس” ولا سهل دهس = مسالي اسمع رغاء
البعير = ونهاق الحمير = وبكاء الصغير = ويعار الشاء =
বাহ ও ঘোড়ার চক্কর কাটার কতই না সুন্দর জায়গা। এমন উঁচা ও কঠিন মাটি নয় যে, চলাচলে কষ্ট হবে; আবার এমন নীচু ও নরম মাটি নয় যে, পা দেবে যাবে ।
সে আবার বললো :
কি ব্যাপার? এ যে শুনতে পাচ্ছি উটের গোংগানী? গাধার বিকট আওয়ায? শিশুদের কান্না? ছাগলের ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দ?
লোকজন জবাবে বললো, মালিক ইবন আওফ তো লোকজনের সাথে তাদের ধন-সম্পদ ও তাদের স্ত্রী-পুত্রদেরও সংগে নিয়ে এসেছে। তখন দুরায় বললো, মালিক কোথায়? লোকেরা তাকে ডেকে এনে বললো– এই যে মালিক। তখন সে তাকে বললো : হে মালিক! তুমি তোমার গোত্রের নেতা হয়েছে। আজকের এ দিনটি এমন যে, এর প্রভাব পড়বে আগামী দিনগুলোর উপর। বল, আমি উটের গোংগানী, গাধার বিকট আওয়ায, শিশুদের কান্নাকাটি এবং ছাগলের ভ্যা ভ্যা শব্দ কেন শুনতে পাচ্ছি? সে উত্তর দিল, আমি তো লোকজনের সাথে তাদের স্ত্রী-পুত্র ও ধন-সম্পদ নিয়ে এসেছি। সে বললো, ওগুলো কেন নিয়ে এসেছো? সে জবাব দিল, আমি মনে করেছি যে, এদের প্রতিটি যোদ্ধার পশ্চাতে তার সম্পদ ও পরিবার রেখে দেব। যাতে সে ওগুলো রক্ষার্থে প্রাণপণে যুদ্ধ করে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে দুরায় মালিককে ধমক দেয়। সে তাকে আরও বলে, ওহে মেষপালক! আল্লাহর কসম, যারা পরাজিত হয়, তাদেরকে কিছু ফেরত দেওয়া হয় বলে কখনও শুনেছ কি? যুদ্ধ যদি তোমার অনুকূলে আসে, তা হলে তলোয়ার ও বল্লমধারী পুরুষ লোকই তোমার কাজে আসবে, অন্য কেউ নয় । আর যদি যুদ্ধ তোমার বিপক্ষে যায়, তবে তুমি তোমার পরিবার ও ধন-সম্পদসহ লাঞ্ছিত হবে। তারপর সে জিজ্ঞেস করলো? আচ্ছা কা’ব ও কিলাব গোত্রের ভূমিকা কি? মালিক বললো, তাদের থেকে কেউই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি। দুরায়দ বললো : তা হলে তো ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বই অনুপস্থিত। আজকের এ দিনটা যদি মর্যাদা ও সুখ্যাতি বয়ে আনতো তা হলে কা’ব ও কিলাব এ থেকে দূরে থাকতো না। আমার মনে হয়, তোমরাও যদি কা’ব ও কিলাবের পথ ধরত, তবে কতই না ভাল হতো। বল তো, তা হলে কারা তোমরা যুদ্ধ করতে এসেছো? লোকজন বললো, আমর ইবন আমির ও আওফ ইবুন আমির গোত্রদ্বয় এসেছে। সে বললো, হায় এতো আমির গোত্রের দুটো যুদ্ধ-অনভিজ্ঞ শাখা! এরা না কোন উপকার করতে পারবে, আর না কোন ক্ষতি করতে পারবে। তারপরে সে বললো, শুন হে মালিক! তুমি হাওয়াযিনের দলকে ঘোড়ার সামনে আদৌ পেশ করো না। এরপর দুরায়দ মালিক ইবন আওফকে বললো? নিজের দেশের হিফাযতে ও নিজ গোত্রের সম্মান রক্ষার্থে এদেরকে এ অবস্থান থেকে উঠিয়ে আন এবং ধর্মত্যাগীদের (অর্থাৎ মুসলমানদের)-কে অশ্বারোহী বাহিনীর সম্মুখে করে দাও। যদি যুদ্ধ তোমার অনুকূলে এসে যায়, তবে পিছনের লোকজনও এসে তোমাদের সাথে মিলিত হবে। আর যদি যুদ্ধ তোমার প্রতিকূলে যায়, তাহলে এরা বাকী থাকবে এবং তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ নিরাপদে থাকবে। জবাবে মালিক বললো : আল্লাহর কসম! আমি তা করবো না। তুমি বুড়ো হয়েছে। সেই সাথে তোমার জ্ঞান-বুদ্ধিও বুড়ো হয়ে গিয়েছে। এরপর মালিক তার দলবলকে সম্বোধন করে বললো : হে হাওয়াযিন গোত্রের লোকেরা! আল্লাহর কসম! হয় তোমরা আমার আনুগত্য করবে; না হয় আমি এই তলোয়ারের উপর উপুড় হয়ে পড়বো, যাতে আমার পেট চিরে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। যুদ্ধের ব্যাপারে সে দুরায়দের কথাবার্তা ও মতামতকে আদৌ আমল দিল না। জবাবে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, আমরা তোমারই আনুগত্য করবো। তখন দুরায়দ বললো :–এটা এমন একটা দিন যাতে আমি অন্তর্ভুক্ত হলাম না এবং এ থেকে দূরেও থাকলাম না।
أخب فيها واضع كانها شاة صدع
يا ليتني فيها جذع اقود وطفاء الزمع
“হায়, যদি আমি আজ যুবক হতাম, তাহলে এতে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিতাম। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতাম। আর এদেরকে মেষের পাল বলেই মনে হতো।”
তারপর মালিক সমবেত লোকজনের উদ্দেশ্যে বললো : তোমরা যখন মুসলমানদের দেখতে পাবে, তখন তোমরা তোমাদের তরবারির কোষসমূহ ভেংগে ফেলবে এবং একযোগে তাদের উপর হামলা করবে ।
ইবন ইসহাক বলেন : উমাইয়া ইবন আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন উছমান আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, মালিক ইবন আওফ কয়েকজন গুপ্তচর প্রেরণ করে। তারা বিপর্যস্ত অবস্থায় তার কাছে প্রত্যাবর্তন করে। সে বললো, তোমাদের সর্বনাশ হোক! তোমাদের এ দুর্দশা কেন? জবাবে তারা বললো, আমরা বিচিত্র রং এর ঘোড়ার উপর কিছু সংখ্যক শুভ্র লোক দেখতে পাই। আল্লাহর কসম! তারপরে আমাদের যে অবস্থায় দেখতে পাচ্ছেন তা ঠেকাবার সাধ্য আমাদের ছিল না। আল্লাহর কসম! এ বিস্ময়কর ঘটনা তাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারলো না।
ইবন ইসহাক বলেন : নবী করীম (সা) হাওয়াযীনদের এ যুদ্ধ উন্মাদনার কথা শুনতে পেয়ে আবদুল্লাহ ইবন আবূ হাদরাদ আসলামীকে প্রেরণ করেন এবং শক্রদের মধ্যে ঢুকে অবস্থান করে তাদের গোপন সংবাদ সগ্রহ করে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন। ইবন আবু হাদরাদ চলে গেলেন। তিনি তাদের মধ্যে ঢুকে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে ভালরূপে অবগত হলেন। তিনি মালিক ইবন আওফ ও বনু হাওয়াযিনের সমস্ত পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ফিরে এসে তাকে যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন হাওয়াযিন গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁকে জানান হয় যে, সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার কাছে তার নিজস্ব অনেক বর্ম ও অস্ত্র আছে । রাসূলুল্লাহ (সা) সাফওয়ানকে ডেকে পাঠালেন। সে তখনও মুশরিক ছিল । রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে বললেন : হে আবু উমাইয়া! তোমার অস্ত্রগুলো আমাদেরকে ধার দাও! আমরা তা দিয়ে আগামী কাল আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বো। সাফওয়ান বললো, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি তা জোরপূর্বক নেবেন? তিনি বললেন : না, বরং ধার হিসেবে নিতে চাই এবং তোমাকে ফেরত দেওয়ার শর্তে। সাফওয়ান বললো, তাহলে আপত্তি নেই। সুতরাং সে একশ’ বর্ম এবং সে অনুপাতে অস্ত্রশস্ত্র দিল । লোকজন বলে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাফওয়ানের কাছে সৈন্যদের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অস্ত্র চেয়েছিলেন, আর সে তাই দিয়েছিল। ইবন ইসহাক সনদবিহীনভাবে এ ঘটনা এরূপই বর্ণনা করেছেন।
ইউনুস ইবন বুকায়র ইবন ইসহাক– জাবির থেকে; এবং আমর ইবন শুআয়ব, যুহরী, আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর ইবন আমর ইবন হাযম প্রমুখ, হুনায়নের ঘটনা পূর্বোল্লিখিত ঘটনার অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে উক্ত বর্ণনায় শত্রু হাওয়াযিনদের মধ্যে প্রবেশ করা ও সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে এ কথা অতিরিক্ত বলা হয়েছে যে, আবু হাদরাদ সেখান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট হাওয়াযিনদের সংবাদ বলেন। তখন উমর ইবন খাত্তাব তাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। ইবন আবু হাদরাদ তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ওহে উমর! আজ যদি তুমি আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করো- তবে তাতে আর আশ্চর্যের কি! ইতিপূর্বে তুমি তো দীনে হককেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলে । তখন উমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে কী বলছে তা কি আপনি শুনছেন না? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : “তুমি বিভ্রান্ত বিপথগামী ছিলে, তারপরে আল্লাহ্ তোমাকে সঠিক সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন।” (এ তো সত্য কথাই।)
ইমাম আহমদ বলেন : ইয়াযীদ ইবন হারূন– সাফওয়ান (রা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমাইয়ার নিকট কতকগুলো বর্ম ধার চেয়েছিলেন । উমাইয়া জিজ্ঞেস করেছিল, হে মুহাম্মাদ! এগুলো কি আপনি কেড়ে নেবেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : না, ধার হিসেবে নেব এবং কাজ শেষে ফেরত দেব। রাবী সাফওয়ান বলেন, যুদ্ধে কিছু বর্ম খোয়া যায়। তাই ফেরত দেওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সা) খোয়া যাওয়া বর্মগুলোর ক্ষতিপূরণ পেশ করেন। তখন উমাইয়া বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আজ আমি ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত (সুতরাং ক্ষতি পূরণ লাগবে না)। আবু দাউদ ও নাসাঈ– ইয়াযীদ ইবন হারূন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম নাসাঈ ইসরাঈল সূত্রে— সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার পুত্র আবদুর রহমান থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাফওয়ানের নিকট থেকে বর্মধার নিয়েছিলেন । বাকী ঘটনা উপরের অনুরূপ। এ ছাড়া ইমাম নাসাঈ– হুশায়ম– হাজ্জাজ– আতা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাফওয়ানের নিকট থেকে অনেকগুলো বর্ম ও অশ্ব ধার নিয়েছিলেন । এর পরের কথা উপরের অনুরূপ।
ইমাম আবু দাঊদ বলেন : আমার কাছে বর্ণনা করেছেন আবু বকর ইব্ন আবূ শায়বা— আবদুল্লাহ্ ইবন সাফওয়ানের পরিবারের লোকদের থেকে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সাফওয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কি অস্ত্র-শস্ত্র আছে? সাফওয়ান বললো : ধার স্বরূপ নিবেন, না জোর করে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : না, ধার স্বরূপ। এরপর সাফওয়ান রাসূলুল্লাহ (সা) কে ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বর্ম ধার স্বরূপ প্রদান করেন। এগুলো নিয়ে তিনি হুনায়নের যুদ্ধে ব্যবহার করেন। যুদ্ধে মুশরিক বাহিনী পরাজিত হলে সাফওয়ানের বর্মগুলো একত্রিত করা হয় । তখন দেখা গেল কয়েকটি হারিয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাফওয়ানকে বললেন :তোমার দেওয়া বর্ম থেকে কয়েকটি বর্ম হারিয়ে গিয়েছে– এগুলোর ক্ষতিপূরণ দিব কি? সাফওয়ান বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সে দিন আমার হৃদয়ের যে অবস্থা ছিল। আজ আর সে অবস্থা নেই । এ বর্ণনাটিও মুরসাল।
ইবন ইসহাক বলেন এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর সাথে ছিলেন মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে আগত দশ হাজার সাহাবী এবং মক্কা থেকে নতুন যোগদানকারী দুই হাজারসহ মোট বার হাজার সৈন্য।
আমি বলি, উরওয়া, যুহরী ও মূসা ইবন উকবার মতে হাওয়াযিন অভিযানে সর্বমোট সৈন্য সংখ্যা ছিল চৌদ্দ হাজার। তাঁদের মতে মদীনা থেকে মক্কা অভিযানে এসেছিলেন বার হাজার । আর এদের সাথে যোগ দেন মক্কার দু’ হাজার নও মুসলিম। ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিনের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হন শাওয়াল মাসের পাঁচ তারিখে । মক্কা দেখা-শুনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্তাব ইবন উসায়দ ইবন আবুল ‘ঈস ইবন উমাইয়া ইবন আবদে শামস উমাবীর উপর। তখন তার বয়স ছিল বিশ বছরের কাছাকাছি। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিন গোত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।
আব্বাস ইবন মিরদাস সুলামী এ সম্পর্কে তাঁর কাসীদায় বলেন :
مني رسالة نصح فيه تبيان
ابلغ هوازن أعلاها و اسفلها
جيشا له في فضاء الارض اركان
والمسلمون عباد الله غسان والاجر بان بنو عبس و ذبیان وفي مقدمه اوس وعثمان
اني اظن رسول الله صابحكم فيهم سلیم اخوكم غير تارككم وفي عضادته اليمنى بنو اسد تكاد ترجف منه الارض رهبته
অর্থঃ হে পথিক! আমার পক্ষ থেকে হাওয়াযিন গোত্রের উচ্চ-নিম্ন সকল পর্যায়ের লোকের কাছে এ উপদেশ বাণীটি পৌঁছিয়ে দাও, এতে রয়েছে বিস্তারিত বর্ণনা।
আমার ধারণা, আল্লাহর রাসূল (সা) প্রত্যুষকালে তোমাদের উপর তার এমন এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে হামলা করবেন- যারা এ ভূ-পৃষ্ঠের উপর অত্যন্ত শক্তিশালী।
এদের মধ্যে আছে তোমাদের ভাই সুলায়ম গোত্র:- যারা তোমাদেরকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে । আর মুসলমানগণ হল আল্লাহর অনুগত ক্ষিপ্র সৈনিক।
তাদের সমর্থনে দক্ষিণ বাহিনীতে আছে বনূ আসাদ গোত্র। আর নাংগা তলোয়ারধারী বন্দু আব্বাস ও যিবয়ান গোত্রদ্বয়।
এ বাহিনীর ভয়ে যমীন কেঁপে উঠে। আর এ বাহিনীর অগ্রভাবে আছে আওস ও উছমান গোত্রদ্বয়।
ইন ইসহাক বলেন : আওস ও উছমান হলো মুযায়না গোত্রের দুটি শাখাগোত্র। ইবন ইসহাক বলেন : যুহরী হারিছ ইবন মালিক সূত্রে বলেন, যে তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হুনায়নের উদ্দেশ্যে বের হলাম। তখন আমরা সবেমাত্র জাহিলী জীবন ত্যাগ করে ইসলামে এসেছি। তিনি বলেন, আমরা তার সাথে হুনায়ন অভিমুখে যাত্রা করলাম। তিনি বলেন : ঐ যুগে কুরায়শ কাফির ও অন্যান্য আরব গোত্রের লোকেরা একটি প্রকাও সবুজ বৃক্ষের ভক্ত ছিল। সে বৃক্ষটিকে যাতু আনওয়াত” বা ঝুলন্ত বৃক্ষ বলা হত। প্রতি বছর তারা একবার ঐ বৃক্ষের কাছে আসতো, তাদের অস্ত্রপাতিগুলো বৃক্ষের উপর লটকিয়ে রাখতে, বৃক্ষের কাছে পশু বলি দিত এবং সেখানে একদিন অবস্থান করতো। তিনি বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে পথ অতিক্রম করছি, তখন পথে একটি বিশাল সবুজ কুল বৃক্ষ দেখতে পাই। আমরা তখন পথের পার্শ্ব থেকে জোর আওয়াজে ডেকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের জন্যে একটি যাতু আনওয়াত’ এর ব্যবস্থা করুন, যেমন ওদের যাতু আনওয়াত’ আছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : আল্লাহু আকবার! সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন, তোমরা আজ এমন একটি কথা বললে, যেমন কথা বলেছিল মূসা (আ) এর সম্প্রদায় মূসা (আ) কে। তারা বলেছিল, আমাদের জন্যে একটি ইলাহর ব্যবস্থা করুন। যেমন ওদের রয়েছে অনেক ইলাহ। মূসা (আ) জবাবে তাদেরকে বলেছিলেন, তোমর একটি অজ্ঞ সম্প্রদায়। এটা তো নিছক একটি গতানু গতিক ভ্রান্ত প্রথা। এরূপ করা হলে তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ভ্রান্ত প্রথারই অনুকরণ করবে। ইমাম তিরমিযী এ হাদীছটি সাঈদ ইব্ন আবদুর রহমান সূত্রে সুফিয়ান থেকে এবং ইমাম নাসাঈ মুহাম্মাদ ইবন রাফি- আবদুর রায্যাক মামার সূত্রে, এরপর উভয়েই যুহরী থেকে বর্ণনা করেন। যেমন ইবন ইসহাক যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী এ হাদীছকে হাসান-সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। ইব্ন আবু হাতিম তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এ হাদীছটি কাছীর ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইবন আওফ তার পিতা, তার দাদা থেকে মারফুরূপে বর্ণনা করেছেন।
বু দাউদ বলেন : আমার নিকট আবু তাওবা–… সাহল ইবন হানজালিয়া সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মুসলিম বাহিনী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হুনায়ন যুদ্ধে যাত্রা করে। তারা দ্রুত গতিতে যাত্রা করে সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছে। যোহর নামাযের সময় হলে একজন অশ্বারোহী এসে বললো ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাদের আগেভাগে গিয়ে অমুক অমুক পাহাড়ে আরোহণ করে দেখলাম, হাওয়াযিন গোত্রের ছোট-বড়, নারী-পুরুষ তাদের উট, মেষ ও অন্যান্য গবাদি পশু নিয়ে হুনায়ন প্রান্তরে সমবেত হয়েছে। তার বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হেসে বললেন, আগামীকাল এ সবই গনীমত হিসেবে মুসলমানদের করায়ত্ব হবে ইনশাআল্লাহ্। এরপর তিনি আহ্বান জানালেন, আজ রাত্রে আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্যে কে প্রস্তুত আছ? জবাবে আনাস ইব্ন আবু মারছাদ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এ কাজের জন্যে আমি প্রস্তুত আছি। তিনি বললেন, তাহলে তুমি একটি বাহনে আরোহণ কর। তিনি তখন গিয়ে তার ঘোড়ায় আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বললেন, এই গিরিপথ ধরে অগ্রসর হও এবং তার উপরে আরোহণ কর। আমরা তোমার পক্ষ থেকে রাত্রে কোন দুশ্চিন্তা বোধ করবো না। রাবী বলেন, ভোর হলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নির্ধারিত নামাযের স্থানে গিয়ে দু’ রাকআত (সুন্নাত) নামায আদায় করেন। তারপরে আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তোমাদের অশ্বারোহী ভাইয়ের প্রত্যাগমন সম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পারলে? জবাবে সকলেই বললেন, আমরা কিছুই আঁচ করতে পারিনি ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরপর ফজরের নামায জামায়াতে পড়ার জন্যে ঘোষণা দেওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নামায পড়াচ্ছিলেন এবং গিরিপথের দিকে তাকাচ্ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি সুসংবাদ দিলেন যে, তোমাদের অশ্বারোহী ভাই তোমাদের মাঝে এসে গেছে। এ কথা বলে তিনি পাহাড়ের ঢালে গাছ-গাছালির দিকে তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি ঐ পথ দিয়ে বের হয়ে রাসূলুপ্লাহ (সা)-এর নিকট এসে থামলেন। এরপর বলতে লাগলেন। আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশিত এই পাহাড়ের উপর আরোহণ করি। ভোর হলে আমি দু’টি পাহাড়ের উপরেই উঠি এবং সেখান থেকে সম্মুখে লক্ষ্য করি, কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলাম না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রাত্রে নীচে অবতরণ করেছিলে? তিনি বললেন, জ্বী না। নামায আদায় কিংবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া আমি পাহাড়ের উপর থেকে নীচে অবতরণ করিনি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বললেন তুমি তো জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে। এরপর আর কোন আমল না করলেও তোমার কোন ক্ষতি হবে না। ইমাম নাসাঈও এ হাদীছ মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহূয়া সূত্রে–.-. আবু তাওবা রাবী ইবন নাফি’ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
হুনায়ন যুদ্ধে প্রথম দিকে মুসলিম বাহিনীর পলায়ন এবং শেষে বিজয় লাভ
ইউনুস ইবন বুকায়র প্রমুখ মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আমার নিকট আসিম ইবন উমার জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মালিক ইবন আওফ তার গোটা বাহিনী নিয়ে হুনায়ন অভিমুখে যাত্রা করে। এ সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানে গমন করেন। শত্রু সৈন্যরা পাহাড়ের গিরিপথ ও উপত্যকার আশ পাশের সংকীর্ণ স্থানসমূহে ওঁৎপেতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ অগ্রসর হয়ে ভোরের আঁধারে উপত্যকার ঢালু এলাকায় অবতরণ করেন। মুসলিম বাহিনী যখন সে প্রান্তরে অবতরণ করে, তখন শত্রুগণ তাদের গোপন স্থান থেকে অতর্কিতে অশ্বারোহী দল নিয়ে এক সংগে হামলা চালায়। ফলে মুসলিমগণ হতবুদ্ধি হয়ে ছুটে পলায়ন করতে থাকে, কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাতেও পারছিল না। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) ডান দিকে একটু সরে গিয়ে বলতে লাগলেন : হে লোক সকল! তোমরা যাচ্ছে কোথায়? আমার দিকে ফিরে এসো, আমি আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহর রাসূল, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ।”
این ایها الناس ، هلموا الى ، انا رسول الله ، انا رسول الله ، انا
রাবী জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ডাকে কোন কাজ হলো না। বরং পলায়নকালে তাদের উটগুলো একটার উপর অপরটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মানুষের এ অবস্থা দেখেন, তখন তিনি তার সাদা খচ্চরের উপর বসা ছিলেন- যা সেখানে রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে তখন মাত্র কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিলেন। আহলে বায়তের মধ্যে যারা ছিলেন, তারা হলেন- আলী ইবন আবু তালিব, আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ ইব্ন আবদুল মুত্তালিব, তার ভাই রাবীআ ইবন হারিছ ইব্ন আবদুল মুত্তালিব, ফযল ইবন আব্বাস, কারও মতে ফুযায়ল ইব্ন আবু সুফিয়ান, আয়মান ইব্ন উম্মে আয়মান এবং উসামা ইবন যায়দ (রা)। কেউ কেউ এ তালিকায় কুদাম ইবন আব্বাসের কথাও উল্লেখ করেছেন। আর মুহাজিরদের মধ্যে যারা সেখানে ছিলেন, তারা হলেন, আবু বকর, উমার ও আব্বাস। আব্বাস রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খচ্চরের লাগাম ধারণ করে ছিলেন।
ইন ইসহাক বলেন : হাওয়াযিন গোত্রের এক লোক তার লাল উটে আরোহণ করে একটি লম্বা বর্শার মাথায় কাল পতাকা বেঁধে হাতে নিয়ে আগে আগে চলছিল। আর অন্যান্য হাওয়াযিনরা তার পিছে পিছে ছুটছিলো। কোন মুসলমান সামনে পড়লে সে তার ঐ বর্শা দ্বারা তাকে আঘাত করতো। এতে পতাকা নীচে নেমে যাওয়ায় লোকেরা তাকে হারিয়ে ফেলতো। তখন সে পশ্চাতের লোকদের উদ্দেশ্যে আবার বর্শাটি উপরে তুলে ধরতো। তখন পশ্চাত্যের লোকজন তাকে অনুসরণ করে চলতো। রাবী জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) বলেন, পতাকাবাহী লোকটি যখন এ ধরনের হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন আলী ইবন আবু তালিব (রা) ও জনৈক আনসার সাহাবী তাকে বধ করার জন্যে তার দিকে অগ্রসর হন। আলী (রা) পিছন দিক থেকে গিয়ে তার উটের পশ্চাতের পা দুটি তলোয়ারের আঘাতে কেটে ফেলেন। ফলে উটটি নিতম্বের উপর বসে পড়ে। তখন আনসার সাহাবী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তলোয়ারের প্রচণ্ড আঘাতে তার পায়ের নলা মাঝখান থেকে কেটে পা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। রাবী বলেন, এরপর মুসলিম বাহিনী শত্রুদের উপর তলোয়ার দ্বারা আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। আল্লাহর কসম! তলোয়ারের প্রচণ্ড আঘাতে তারা দিগবিদিক ছুটে পালায়। আর যে পালিয়েছে সে আর যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসার সাহস পায়নি। শেষ পর্যন্ত শত্রু পক্ষের বিরাট সংখ্যক লোক বন্দী হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট নীত হয়। ইমাম আহমদ ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম যুহরী থেকে। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইবুন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিবের দিকে তাকালেন। সে দিন যারা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খচ্চরের জিনের এক অংশ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে? জবাবে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার দুধ-মায়ের পুত্র। ইবন ইসহাক বলেন : যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলমানদের বিপর্যয় দেখে মূৰ্থ বেদুঈনরা এমন সব মন্তব্য করতে লাগলো- যার দ্বারা তাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা বিদ্বেষ প্রকাশ পেল। আবু সুফিয়ান সাখর ইবন হারব বলে উঠলো, তাদের পরাজয় সমুদ্রের তীর পর্যন্ত পৌঁছার আগে শেষ হবে না। এই আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ তখনও দুর্বল ছিল। ঐদিন তার কাছে ভাগ্য গণনার পর্যাপ্ত তীর মওজুদ ছিল। কালদা ইবৃন হাম্বল সে দিন তার ভাই সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার সাথে এক জায়গায় ছিল। সাফওয়ান তখনও মুশরিক ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে যে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন, এটা ছিল সেই সময়ের কথা। কালদা তখন চিৎকার দিয়ে বললো : দেখলেতো! যাদুর কারসাজি আজ ততুল গেছে। তখন সাফওয়ান তাকে বললো : চুপ কর! আল্লাহ তোমার মুখ বন্ধ করে দিন। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোন কুরায়শের নেতৃত্ব যে কোন হাওয়াযিনের নেতৃত্ব অপেক্ষা অধিকতর পসন্দনীয়। ইমাম আহমদ আফান ইবন মুসলিমের সূত্রে– আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণনা করেন যে, হুনায়ন যুদ্ধে হাওয়াযিন গোত্র নারী, শিশু, উট ও মেষপালসহ রণাঙ্গনে উপস্থিত হয় এবং তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। এভাবে তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপর দল ভারী করে। এরপর যুদ্ধ আরম্ভ হলে মুসলমানগণ পরাজিত হয়ে পশ্চাতের দিকে পলায়ন করেন। যেমনটি কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা’আলা এ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন আওয়ায দিয়ে বললেন : “ওহে আল্লাহর বান্দাগণ! আমি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল।” তারপরে বললেন, “হে আসার সম্প্রদায় । আমি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। রাবী বলেন, অবশেষে আল্লাহ তাআলা মুশরিক বাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে তার তলোয়ারও চালাতে হয়নি এবং বর্শাও নিক্ষেপ করার প্রয়োজন হয়নি।
রাবী আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, হুনায়নের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন : যে ব্যক্তি কোন কাফিরকে হত্যা করবে, সে ঐ কাফিরের সাথে থাকা দ্রব্য-সামগ্রীর মালিক হবে।
রাবী বলেন : সে দিন আবু তালহা (রা) বিশজন কাফিরকে হত্যা করে এবং তাদের দ্রব্য-সামগ্রীর অধিকারী হন। যুদ্ধের ময়দানে আবূ কাতাদা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) কে জানান, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এক ব্যক্তির কাঁধের শিরায় তলোয়ারের আঘাত মেরে চলে যাই। তার গায়ে একটি বর্ম ছিল। একটু সন্ধান নিয়ে দেখুন, বর্মটি কে নিয়েছে? এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! বর্মটি আমি নিয়েছি। এখন তাকে রাযী করিয়ে বর্মটি আমাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট কেউ কিছু চাইলে হয় তিনি তাকে তা দিয়ে দিতেন নয়ত নীরব থাকতেন। এ সময় তিনি নীরব থাকলেন। তখন উমর (রা) বললেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহর সিংহদের মধ্যকার একটি সিংহের উপর প্রাধান্য দিয়ে তিনি কিছুতেই তোমাকে তা দিবেন না। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলে উঠলেন : উমর যথার্থই বলেছে। রাবী বলেন, রণাংগনে আবু তালহা (রা) এর সাথে (তার স্ত্রী) উম্মু সুলায়মের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তখন তার কাছে একটি খঞ্জর দেখতে পেয়ে আবূ তালহা (রা) জিজ্ঞেস করলেন, এটা আবার কি? জবাবে উম্মু সুলায়ম (রা) বললেন, কোন মুশরিক যদি আমার কাছ দিয়ে যায়, তবে এটা আমি তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিব। আবূ তালহা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! উম্মু সুলায়ম কি বলছে, তা কি শুনতে পাচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন একটু হেসে দিলেন। উম্মু সুলায়ম (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরপর আমি সেই সব নও মুসলিমকে হত্যা করবো, যারা আপনাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : ওহে উম্মু সুলায়ম! আল্লাহই তাদের জন্যে যথেষ্ট ও উত্তম। ইমাম মুসলিম আবূ তালহা (রা) থেকে উম্মু সুলায়মের খঞ্জরের ঘটনা এবং ইমাম আবূ দাউদ ‘নিহতের দ্রব্য-সামগ্রী হত্যাকারীর প্রাপ্য’ রাসূলুল্লাহর (সা) এ উক্তি উল্লেখ করেছেন। তারা উভয়েই হাম্মাদ ইব্ন সালমার সূত্রে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে উমরের কথিত বলে উল্লিখিত উক্তিটি নির্ভরযোগ্য নয়। বরং প্রসিদ্ধ মতে ঐ উক্তিটি ছিল আবু বকর সিদ্দীকের।
ইমাম আহমদ বলেন : আবদুস সামাদ ইবন আবদুল ওয়ারিছ– থেকে বর্ণনা করেন যে, নাফি আবু গালিবের উপস্থিতিতে ‘আলা ইবন যিয়াদ ‘আদাবী আনাস ইবন মলিক (রা)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আবু হামযা! নুবুওয়াত প্রাপ্তিকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বয়স কত ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এরপরের হিসেব কি? তিনি জবাব দিলেন, এরপর তিনি মক্কায় থাকেন দশ বছর। তারপরে মদীনায় থাকেন আরও দশ বছর। এই মোট ষাট বছর পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর নিকট উঠিয়ে নেন। আলা ইবন যিয়াদ জিজ্ঞেস করেন, ইনতিকালের সময় তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল? আবু হামযা বলেন, তখনও তিনি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট যুবক। সবার চেয়ে সুন্দর ও উত্তম দৈহিক গঠন বিশিষ্ট এবং সবচেয়ে অধিক শৌর্য-বীর্যের অধিকারী। প্রশ্নকারী আবার জিজ্ঞেস করলো, হে আবু হামযা! আপনি কি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন : তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি হুনায়নের যুদ্ধে তার সাথে অংশ গ্রহণ করেছি। সে যুদ্ধে মুশরিক বাহিনী অতি প্রত্যুষে আমাদের উপর হামলা চালায়। তখন দেখলাম, আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী আমাদের পশ্চাতে রয়েছে। আরও দেখলাম, মুশরিকদের মধ্যে এক ব্যক্তি প্রবল বেগে আমাদের উপর আক্রমণ করে আমাদেরকে দলিত মথিত করে চলছে। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বাহন থেকে অবতরণ করলেন। এরপর আল্লাহ্ তাদেরকে পরাজিত করলেন এবং তারা রণে-ভংগ দিয়ে পলায়ন করলো। মুসলমানদের বিজয় দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) এক জায়গায় দাঁড়ালেন। এরপর একের পর এক মুসলমানরা শক্রদে বন্দী করে তার কাছে নিয়ে আসতে থাকেন। আর তিনি তাদেবকে ইসলামের উপর বায়আত করতে থাকেন। এ সময় নবী (সা)-এর জনৈক সাহাবী বিনীতভাবে জানাল ‘আমি মানত করেছি, যে মুশরিক লোকটি যুদ্ধের সময় আমাদেরকে দলিত মথিত করেছিল, সে যদি বন্দী হয়ে আসে তবে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) নীরব থাকেন। এ সময় সে লোকটিকে বন্দী করে নিয়ে আসা হল। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখেই সে বলে উঠলো, হে আল্লাহর নবী! আমি আল্লাহর নিকট তওবা করেছি। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার কথা শুনার পরে নীরব থাকলেন এবং তাকে বায়আত করা হতে বিরত থাকলেন। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যাতে অপর লোকটি এ সুযোগে তার মানত পূরণ করতে পারে। কিন্তু সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দিকে তাকিয়ে তাঁর নির্দেশের অপেক্ষা করছিলো। বিনা অনুমতিতে হত্যা করতে সে ভয় পাচ্ছিলো। নবী (সা) যখন দেখলেন, সে কিছুই করছে না। তখন তিনি তাকে বায়আত করেন। তখন সে বললো, হে আল্লাহর নবী! আমার মানতের কি হলো? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমি তো দীর্ঘক্ষণ বায়আত করা থেকে বিরত ছিলাম যাতে তুমি তোমার মানত পূরণ করতে পার। সে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে একটু ইংগিত দিলেন না কেন? তিনি বললেন, হত্যার জন্যে ইংগিত করা নবীর জন্যে শোভা পায় না। এ ঘটনা ইমাম আহমদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : আমার নিকট ইয়াযীদ– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুনায়নের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) এ দু’আ করেছিলেন : “হে আল্লাহ্! আপনি যদি চান আজকের দিনের পর এ পৃথিবীতে আর আপনার ইবাদত করার প্রয়োজন নেই….”। এ হাদীছের সনদে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা মাত্র তিনজন এবং এটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী বর্ণিত। ভবে অন্য কোন হাদীছ সংকলনকারী এই সনদে এ হাদীছ বর্ণনা করেননি।
ইমাম বুখারী মুহাম্মাদ ইবন বাশশারের সূত্রে– আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বারা ইবন আযিব (রা) থেকে শুনেছেন, যখন কায়েস গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, হুনায়ন যুদ্ধে আপনারা কি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন?” তিনি বললেন, তবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিন্তু পালিয়ে যাননি। হাওয়াযিন গোত্রের লোকেরা ছিল সুদক্ষ তীরন্দাজ। কিন্তু আমরা যখন তাদের উপর আক্রমণ করলাম তখন তারা ছত্রভংগ হয়ে যায়। এরপর আমরা গনীমত সংগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করলাম। ঠিক তখনি আমরা তাদের তীরন্দাজ বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হই। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর সাদা রংয়ের খচ্চরের উপর আরোহী অবস্থায় দেখেছি। আর আবু সুফিয়ান (ইবনুল হারিছ) তার খচ্চরের লাগাম ধরে ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন : “আমি আল্লাহর নবী, এতে কোন মিথ্যা নেই।” এ হাদীছ ইমাম বুখারী আবুল ওয়ালীদের সূত্রে শু’বা থেকেও বর্ণনা করেছেন। এতে আছে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন : “আমি নবী, এতে কোন মিথ্যা নেই; আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান”।
বুখারী বলেন, ইসরাঈল ও যুহায়র আবু ইসহাকের সূত্রে বার (রা) থেকে বলেছেন যে, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর খচ্চরের উপর থেকে নীচে অবতরণ করেছিলেন। মুসলিম ও নাসাঈ বুনদার থেকে এবং মুসলিম ও আবু মূসা উভয়ে গুনদুর থেকে এ হাদীছ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া ইমাম মুসলিম– যাকারিয়া ইব্ন আবু যায়িদা- আবু ইসহাক সূত্রে বারা (রা) থেকে এ হাদীছ বর্ণনা করেন। এর শেষে আছে “এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) খচ্চর থেকে অবতরণ পূর্বক আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে বলেন : “আমি সত্য নবী। এতে কোন মিথ্যা নেই, আমি আবদুল মুত্তালিবের সন্তান; হে আল্লাহ! আপনি আপনার সাহায্য নাযিল করুন।” বারা (রা) বলেন, যুদ্ধের উত্তেজনা যখন চরমে উঠলো, তখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আড়ালে আশ্রয় খুঁজছিলাম। আর বীর পুরুষরাই তার কাছাকাছি থাকতে পারত। বায়হাকী বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সে দিন বলেছিলেন : আমি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্তান। তাবারানী আব্বাস ইবন ফল সূত্রে– ইবন আসিম সুলামী থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুনায়ন যুদ্ধের দিন বলেছিলেন : আমি কুরায়শ বংশীয় সন্ত্রান্ত লোকের সন্তান।
ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ্ ইবন ইউসুফ সূত্রে–… আবু কাতাদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়নের বছর আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে যুদ্ধে গমন করি। যখন আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হই, তখন মুসলমানরা কিছুটা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। এ সময় আমি দেখলাম, মুশরিকদের এক ব্যক্তি মুসলমানদের এক ব্যক্তির উপর চড়াও হয়ে প্রায় কাবু করে ফেলছে। তখন আমি পিছন দিক থেকে গিয়ে ঐ মুশরিকের কাঁধের শিরার উপর তলোয়ার দ্বারা সজোরে আঘাত হানি। এতে তার লৌহ বর্ম কেটে যায়। লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে এমন জোরে চাপ দিল, যে আমি মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম। এরপর লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো এবং আমাকে ছেড়ে দিল। এরপর আমি উমর (রা)–এর কাছে গিয়ে বললাম, লোকজনের কি হয়েছে : তিনি বললেন, আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকরী হয়। এরপর মুসলমানরা নিজনিজ স্থানে ফিরে আসলো। বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক জায়গায় বসে ঘোষণা করলেন : কেউ যদি কোন শত্রুকে হত্যা করে থাকে এবং তার পক্ষে প্রমাণ থাকে তবে সেই হবে নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত দ্রব্য-সামগ্রীর অধিকারী। এ কথা শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললাম, “আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার কেউ আছে কি?” কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে আমি বসে পড়লাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) পুনরায় অনুরূপ ঘোষণা দিলে আমি আবার দাঁড়িয়ে বললাম, “আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার কেউ আছে কি?” এবারও কোন সাড়া না পেয়ে আমি বসে পড়লাম। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবারও অনুরূপ ঘোষণা দিলে আমি পুনরায় দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললাম, “কে আছে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবার?” কিন্তু কেউ সাক্ষ্য না দেওয়ায় আমি বসে পড়লাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) চতুর্থবার অনুরূপ ঘোষণা দিলে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন, “আবু কাতাদা! তোমার কি হয়েছে :” তখন আমি তাকে বিষয়টি জানালাম। এ সময় এক ব্যক্তি উঠে বললো, আবু কাতাদা ঠিকই বলেছেন। তাঁর দ্রব্য-সামগ্রী আমার কাছে আছে। তবে সেগুলো আমাকে দিয়ে দেওয়ার জন্যে তাঁকে সম্মত করে দিন।” তখন আবু বকর (রা) বললেন, “না, আল্লাহর কসম! তা হতে পারে না। আল্লাহর সিংহদের মধ্যে এক সিংহ যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে যুদ্ধ করেছে, তার যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদি রাসূলুল্লাহ্ (সা) তোমাকে দিয়ে দিবেন। এ হতে পারে না।” নবী (সা) বললেন : আবু বকর ঠিকই বলেছেন। সুতরাং দ্রব্যগুলি তুমি তাকে দিয়ে দাও। আবু কাতাদা বলেন, তখন সে নিহতের দ্রব্যগুলো আমাকে ফেরত দিয়ে দিল। পরবর্তীতে এ দ্রব্যসামগ্রীর বিনিময়ে আমি বনূ সালিমার একটি বড় খেজুর বাগিচা খরিদ করি। আর এটাই ছিল ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার প্রথম উপার্জিত সম্পদ। নাসাঈ ব্যতীত অন্যান্য হাদীছবেত্তাগণ এ হাদীছটি ইয়াহয়া ইবন সাঈদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ভিন্ন সনদে ইমাম বুখারী বলেন : লায়ছ ইবন সা’দ সূত্রে–আবু কাতাদা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়ন যুদ্ধের দিন আমি দেখতে পেলাম, একজন মুসলমান ও একজন মুশরিক লড়াই করছে। অপর একজন মুশরিক যুদ্ধরত মুশরিকের পক্ষ অবলম্বন করে পিছনের দিক থেকে চুপিসারে মুসলমান লোকটিকে হত্যা করতে চাইছে। আমি দ্রুত গতিতে ঐ লোকটির কাছে গেলাম। সে আমাকে আঘাত করার জন্যে তার হাত উত্তোলন করলো। কিন্তু তার পূর্বেই আমি পাল্টা আঘাত হেনে তার হাত কেটে ফেললাম। সে তার অপর হাত দিয়ে আমাকে ভীষণভাবে জাপটে ধরলো- এতে আমি মৃত্যুর আশংকা করলাম। তারপরে সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ধড়াস করে মাটিতে পড়ে যায়। আমি আর একটি আঘাত করে তাকে হত্যা করে ফেলি। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলমানরা রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। তাদের সাথে আমিও পলায়ন করি। পথে উমর ইবন খাত্তাব (রা)-কে লোকজনের সাথে দেখে জিজ্ঞেস করলাম : “ব্যাপার কি? মানুষের এ অবস্থা কেন?” তিনি বললেন, “সবকিছু আল্লাহর হুকুমেই হয়। এরপর সমস্ত লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে সমবেত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা করলেন : “যে ব্যক্তি প্রমাণ দিতে পারবে যে, সে কোন মুশরিককে হত্যা করেছে তা হলে ঐ নিহত ব্যক্তির সংগে থাকা দ্রব্য-সামগ্রী সে-ই পাবে।” তখন আমি দাঁড়িয়ে আমার হাতে নিহত হওয়া ব্যক্তি সম্পর্কে প্রমাণের সন্ধান করলাম। কিন্তু আমার পক্ষে কোন সাক্ষ্য না পেয়ে আমি বসে পড়লাম। এরপর এক সুযোগে আমি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উল্লেখ করলাম। তখন সেই মজিলেসের এক ব্যক্তি বললো, “উল্লিখিত নিহত ব্যক্তির অস্ত্রপাতি আমার কাছে আছে। এখন এ বস্তুগুলো আমার কাছে থাকার ব্যাপারে তাকে রাযী করে দিন।” তখন আবু বকর (রা) বললেন, “তা কখনও হতে পারে না। আল্লাহর সিংহদের মধ্য থেকে এক সিংহ যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাকে বাদ দিয়ে কুরায়শের এক নগণ্য ব্যক্তিকে তিনি এটা কিছুতেই দিবেন না।” আৰূ কাতাদা বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিহতের দ্রব্য-সামগ্রীগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে আমাকে দিয়ে দেন। পরে এ সব দ্রব্য দ্বারা আমি একটা খেজুরের বাগান খরিদ করি। আর এটাই ছিল আমার প্রথম উপার্জিত সম্পদ। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়েই এ হাদীছ লায়ছ ইবন সা’দের সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নাফি আবু গালিব– আনাসের সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, উপরে উল্লিখিত বক্তব্যটি উমর ইবন খাত্তাবের । সম্ভবতঃ উমর (রা) আবু বকর (রা)-এর বক্তব্য সমর্থন করায় বর্ণনাকারী উমর (রা)-এর বক্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন। অথবা হতে পারে বর্ণনাকারী বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে এরূপ বলেছেন। আল্লাহ্-ই সমধিক জ্ঞাত।
হাফিয বায়হাকী হাকিমের সূত্রে– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুনায়ন যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলমানদের ছত্রভংগ অবস্থা দেখে আব্বাস (রা) কে ডেকে বললেন, তুমি আনসার ও হুদায়বিয়ার সাথীদের ফিরে আসার জন্যে আহ্বান কর এবং বল, –হে আনসার সম্প্রদায়! –হে বৃক্ষের নীচে বায়’আত গ্রহণকারী হুদায়বিয়ার সাথীরা! আহ্বান শুনে তারা . L বলে সাড়া দিলেন। সকলেই নিজ নিজ উট থামাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনক্রমেই তাতে সক্ষম হলেন না। তখন তাঁরা নিজেদের কাঁধের উপর থেকে বর্ম ছুঁড়ে ফেলে শুধু ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আমার ধ্বনি অনুসরণ করে অগ্রসর হতে থাকেন। এভাবে আসতে আসতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট একশত লোক পৌঁছে গেলেন। তখন তারা শত্রুর মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ শুরু করে দেন। প্রথম দিকে আহ্বান ছিল আনসারদের প্রতি আর শেষের দিকে ছিল খাযরাজদের প্রতি। যুদ্ধের ময়দানে এরা চরম ধৈর্য-শৈর্যের পরিচয় দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বাহনের রিকাবদ্বয়ে পা রেখে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেন। মুসলিম সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ অবলোকন করে বলে উঠলেন : এটাই যুদ্ধের চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম! পলায়নকারী লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে আসার অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে গেল। দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট শব্ৰু-পক্ষের বহু বন্দীকে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অবশিষ্টদের মধ্যে এক অংশ আল্লাহর ইচ্ছামত যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয়; এবং আর এক অংশ রণাংগন থেকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে গনীতম হিসেবে শত্রুদের প্রচুর সম্পদ ও তাদের সন্তান-সন্ততি বন্দীরূপে দান করেন।
ইবন লাহয়া’ আবুল আসওয়াদের সূত্রে উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন এবং মূসা ইবন উকবা তাঁর মাগাযী গ্রন্থে যুহরী থেকে উল্লেখ করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে মক্কা বিজয় দান করলে তিনি সেখানে তার প্রতিনিধি নিয়োগ করে হাওয়াযিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। মক্কার সাধারণ নাগরিকরাও এ সময় তার সহযাত্রী হয়, কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ যায় বাহনে চড়ে, কেউ যায় পায়ে হেঁটে। এমন কি তাদের স্ত্রীরা পর্যন্ত অভিযানে শরীক হয়। এ সব লোক তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেনি। এরা যায় দর্শক হিসেবে এবং গনীমতের আশা নিয়ে। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবাগণের উপর কোন বিপর্যয় আপতিত হলে তাতে তাদের কোন প্রকার আপত্তি ও মনঃপীড়া ছিল না। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিল আবু সুফিয়ান ইবন হারব এবং সাফওয়ান ইবন উমাইয়া। সাফওয়ানের সংগে ছিল তার মুসলমান স্ত্রী। সাফওয়ান তখনও ছিল মুশরিক। কিন্তু ধর্মের বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেনি। বর্ণনাকারিগণ বলেন, এ যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল মালিক ইবন আওফ নাসরী। তার সংগে ছিল দুরায়দ ইবন সাম্মা। বয়সের ভারে তার শরীর কাঁপছিল। মুশরিক বাহিনীর সাথে ছিল নারী, শিশু ও জীব-জন্তু। রাসূলুল্লাহ (সা) শত্রু বাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্যে আবদুল্লাহ্ ইবন আবু হাদরাদকে গোয়েন্দা হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি শত্রুদের মধ্যে মিশে গিয়ে রাত্রি যাপন করেন। তখন তিনি শুনতে পেলেন– মালিক ইবন আওফ তার বাহিনীকে সম্বোধন করে বলছে। “ভোর বেলা তোমরা মুসলিম বাহিনীর উপর একযোগে অতর্কিতে হামলা করবে। তরবারিগুলোর খাপসমূহ ভেঙ্গে ফেলবে। তোমাদের পশুগুলোকে এক লাইনে রাখবে এবং মহিলাদেরকে আলাদা লাইনে কাতারবন্দী করে রাখবে।” সকাল হলে আবু সুফিয়ান, সাফওয়ান ও হাকীম ইবন হিযাম আলাদা হয়ে মুসলিম বাহিনীর পিছনে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে থেকে তারা লক্ষ্য করছিলো যে, দেখা যাক বিপদ কাদের ঘাড়ে চাপে। মুসলিম বাহিনীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করান হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সাদা খচ্চরে আরোহণ করে মুসলিম সৈন্যদের লাইনের সম্মুখে আসেন এবং যুদ্ধ করার নির্দেশ দান করেন। যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন এবং ধৈর্য ধারণ করলে বিজয়ের সুসংবাদ দেন। এমতাবস্থায় মুশরিক বাহিনী মুসলিম বাহিনীর উপর একযোগে অতর্কিতে হামলা চালায়। ফলে মুসলিম বাহিনী সহসা ছত্র-ভংগ হয়ে পড়ে। তারপরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুত পলায়ন করে। হারিছা ইবন নুমান বলেন, মুসলিম বাহিনী পলায়ন করে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের সংখ্যা হবে আনুমানিক একশ’। বর্ণনাকারিগণ বলেন : কুরায়শদের এক ব্যক্তি সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার পাশে গিয়ে বললো, সুসংবাদ শুনুন- মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীরা পরাজিত হয়েছে। আল্লাহর কসম! তারা আর ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তখন সাফওয়ান তাকে বললো, তুমি আমাকে আরব বেদুঈনদের বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছ? আল্লাহর কসম! কোন কুরায়শীর নেতৃত্ব বেদুঈনের নেতৃত্ব অপেক্ষা আমার কাছে অধিক পসন্দনীয়, এ কথা বলার জন্যে সাফওয়ান ঐ ব্যক্তির উপর ক্রোধান্বিত হয়।
উরওয়া বলেন : সাফওয়ান তার এক গোলামকে যুদ্ধের সংকেত জানার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। সে ফিরে এসে জানালো যে, আমি শুনতে পেলাম মুসলমানরা এই বলে ডাকাডাকি করছে- হে বনূ আবদুর রহমান! হে বনূ আবদুল্লাহ্! হে বনূ উবায়দুল্লাহ্! তার বক্তব্য শুনে সাফওয়ান বললো, মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন। যুদ্ধে তারা এই সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে।
বর্ণনাকারিগণ বলেন : যুদ্ধের প্রচণ্ডতা যখন রাসূলুল্লাহ (সা) কে ভাবিয়ে তোলে তখন তিনি তাঁর বাহন খচ্চরের রিকাবদ্বয়ের উপর দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে আল্লাহর নিকট দু’আ করেন এবং বলেন : “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করুন। হে আল্লাহ্! ওরা যেন আমাদের উপর জয়লাভ করতে না পারে।” দু’আ শেষে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে যুদ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে আহ্বান করেন- হে হুদায়বিয়ার বায়আত গ্রহণকারী সাহাবীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা তোমাদের নবীর কাছে ফিরে এসো। তিনি তাদেরকে আরও উদ্বুদ্ধ করে বলেন : হে আল্লাহর সাহায্যকারিগণ! হে আল্লাহর রাসূলের সাহায্যকারিগণ! হে খাযরাজ গোত্রের লোকজন! হে সূরা বাকারার সাথীগণ! এভাবে নিজে আহ্বান করার পর তিনি কোন কোন সাহাবীকে অনুরূপভাবে আহ্বান করার জন্যে আদেশ করেন।
বর্ণনাকারিগণ বলেন : এ সময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজের হাতে এক মুঠো কংকর নিয়ে মুশরিকদের চোখ-মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারেন এবং মুখে উচ্চারণ করেন– ওদের চেহারা বিবর্ণ হোক। তখন তাঁর সাহাবীগণ অতি দ্রুত তার কাছে ফিরে আসেন। রাবীগণ বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ সময় বলেছিলেন : “এখন যুদ্ধের চরম মুহূর্ত।” তারপর আল্লাহ্ তার দুশমনদের সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত করেন। শত্রুদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে নিক্ষিপ্ত কংকর লেগে যায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা পলায়ন করে। মুসলমানরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে অকাতরে হত্যা করেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ্ তা’আলা ওদের নারী ও শিশুদেরকে গনীমত হিসেবে মুসলমানদেরকে প্রদান করেন। এ দিকে সেনাপতি মালিক ইব্ন আওফ ও তার গোত্রের সর্দারগণ পালিয়ে তায়েফের দুর্গে প্রবেশ করে। এ সময় রাসূলের প্রতি আল্লাহর সাহায্য ও দীন ইসলামের অপ্রতিরোধ্য শক্তি প্রত্যক্ষ করে মক্কার বহু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করে। ইমাম বায়হাকী এটি বর্ণনা করেছেন।
ইব্ন ওয়াহ বলেন, ইউনুস– কাছীর ইবন আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেন । আব্বাস (রা) বলেছেন : হুনায়ন যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে অংশ গ্রহণ করি। আমি ও আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে থাকি। কখনও তার থেকে পৃথক হইনি। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাদা রং-এর খচ্চরের উপর থাকেন। এ খচ্চরটি তাঁকে ফারওয়া ইবন নুফাছা আল-জুযামী উপঢৌকন স্বরূপ দান করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে মুসলমানরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার খচ্চরটিকে কাফিরদের দিকে এগিয়ে নেন। আব্বাস (রা) বলেন, খচ্চরটি যাতে দ্রুত না চলে সে জন্যে আমি তার লাগাম ধরে টেনে রাখি। আর আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রিকাব ধরে রাখেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন আব্বাসকে বললেন : তুমি হুদায়বিয়ার বাবলা বৃক্ষের নীচে বায়আত গ্রহণকারীদেরকে আহ্বান কর। আব্বাস (রা) বলেন, গাভী যেমন তার বাছুরকে সোহাগের জন্য ছুটে যায়, তেমনি আমার আওয়ায শুনার পর তারা ছুটে আসে যেন আমি তাদের প্রতি অনুরূপ সোহাগ প্রকাশ করেছি। তারা জবাবে বললো- আমরা হাযির, আমরা হাযির। তারা এসে কাফিরদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। আনসারদের আহ্বান করে বলা হয়- Le। LL হে আনসার সম্প্রদায়! এরপর নির্দিষ্টভাবে বনুল হারিছ ইব্ন খাযরাজকে হে বনুল হারিছ বলে আহ্বান করা হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) খচ্চরের উপর থেকে মাথা উঁচু করে রণক্ষেত্রের দিকে তাকান এবং যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। তখন তিনি বলেন, এখন হচ্ছে যুদ্ধের সব চাইতে উত্তেজনাকর অবস্থা। এরপর তিনি কিছু কংকর হাতে নিয়ে সেগুলো কাফিরদের প্রতি নিক্ষেপ করেন। তারপরে বললেন, মুহাম্মাদের প্রতিপালকের কসম! ওরা পরাজিত হয়েছে। আব্বাস বলেন, তখন আমি স্বচক্ষে দেখার জন্যে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, যুদ্ধ তার আপন অবস্থায় আছে। আব্বাস বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সা) যখন কাফিরদের দিকে কংকর নিক্ষেপ করেন, তখন থেকে দেখলাম, তাদের যুদ্ধের গতিতে ভাটা পড়েছে, তলোয়ারের ধার ভোঁতা হয়ে গিয়েছে এবং ময়দান ছেড়ে পেছনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইমাম মুসলিম এ হাদীছ আবু তাহিরের সূত্রে ইবন ওহব থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি মুহাম্মাদ ইবন রাফি আবদুর রাযযাক– মামার সূত্রে যুহরী থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মুসলিম ইকরামা ইব্ন আম্মার– সালামা ইবন আকওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হুনায়নের যুদ্ধ করেছি। শক্রদের সম্মুখীন হলে আমি একটু অগ্রসর হয়ে একটি টিলার উপর আরোহণ করি। তখন মুশরিক পক্ষের এক লোক আমার মুকাবিলায় আসে। আমি তাকে লক্ষ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করি। কিন্তু সে আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় । আমি বুঝতে পারলাম না যে, তীর নিক্ষেপের ফলাফল কি হয়েছে। তারপর শত্ৰুদলের প্রতি লক্ষ্য করে দেখলাম যে, তারা অপর একটি টিলার উপর আরোহণ করেছে। এ সময় তারা ও রাসূল (সা)-এর সাহাবীগণ পরস্পর মুখোমুখি হন। তখন নবীর সাহাবীগণ পিছন দিকে সরে যেতে লাগলেন। আমি পরাজিত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করলাম। আমার পরিধানে ছিল দুটি চাদর। একটি ছিল লুঙ্গিরূপে, অপরটি চাদররূপে ব্যবহৃত এক পর্যায়ে আমার পরিধেয় লুঙ্গি খুলে যায় । আমি সেটি ভালরূপে বেঁধে নিলাম এবং পরাজিত মন নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছ দিয়ে গমন করলাম। তখন তিনি তাঁর সাদা রংএর খচ্চরের উপর আরোহণ করেছিলেন। তিনি বললেন, ইবনুল আকওয়া ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। এরপর শত্রুরা যখন চারদিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ঘিরে ফেলে, তখন তিনি তাঁর খচ্চরের উপর থেকে নিচে অবতরণ করেন। তারপর এক মুঠো মাটি হাতে নিলেন এবং ৯৯ ৩৯ (তাদের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হোক) বলে তাদের মুখমণ্ডলে নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেলা ঐ এক মুঠো মাটিতে তাদের সকলের দু’চোখ ভরে গেল। আল্লাহর ইচ্ছায় একজনও এ থেকে বাদ থাকল না। ফলে তারা পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলো। এভাবে আল্লাহ্ তাদেরকে পরাজিত করে দেন। শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসলমানদের মধ্যে গনীমতের মাল বণ্টন করে দেন।
আবু দাউদ তায়ালিসী তার মুসনাদ গ্রন্থে হাম্মাদ ইবন সালমার সূত্রে– আবু আবদুর রহমান ফিহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন যুদ্ধ অভিযানে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিলাম। প্রচণ্ড গরমের সময় আমাদের এ সফর হয়েছিল। তাই সফরে বিরতি দিয়ে আমরা একটি বাবলা গাছের ছায়ায় অবতরণ করি। সূর্য পশ্চিমে গড়িয়ে যাওয়ার পর আমি বর্ম পরিধান করে ও ঘোড়ায় আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যাই। এ সময় তিনি তার তাবুতে অবস্থান করছিলেন। আমি সেখানে পৌঁছে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললাম : [ ] তারপরে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুনরায় যাত্রা শুরু করার সময় হয়েছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ তাই। তখন তিনি বিলালকে ডাক দেন। তার ডাক শুনে বিলাল বাবলা গাছের নিচ থেকে ঠিক যেন পাখির ন্যায় উড়ে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি আপনার খিদমতে হাযির! আপনার জন্যে আমি উৎসর্গ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : আমার জন্যে আমার ঘোড়াকে জিন লাগিয়ে প্রস্তুত কর। বিলাল চটের একটি আসন নিয়ে আসলেন। যার মধ্যে খেজুর গাছের ছাল ভরা ছিল। নরম ও কোমল জাতীয় কিছুই তাতে ছিল না। এরপর তিনি তাঁর ঘোড়র উপর আরোহণ করলেন। এক দিন চলার পর আমরা শত্রুর সম্মুখীন হই। ঘোড়সওয়ার বাহিনী তাদের ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে মাঠে নিয়ে যায় । আমরা শত্রুদের মুকাবিলা করি। কিন্তু মুসলমানরা এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। যার বর্ণনা আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনে দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দারা! আমি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল।” এ কথা বলে তিনি ঘোড়া থেকে অবতরণ করেন। রাবী বলেন, আমার চাইতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অধিক নিকটে থাকা এক ব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে ০১৭৩৯ বলে শত্রুদের মুখমন্ডলের দিকে নিক্ষেপ করেন। ইয়া’লা ইবন আতা বলেন, ঐ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী যোদ্ধাদের সন্তানরা তাদের পিতাদের বরাত দিয়ে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, শত্রুপক্ষের এমন কেউ অবশিষ্ট ছিল না যার চোখ-মুখ ঐ মাটি দ্বারা পরিপূর্ণ না হয়েছিল। তারা বলেছেন, আমরা আকাশ থেকে একটি ঝনঝন আওয়ায শুনতে পাই। লোহার থালার উপর দিয়ে এক খণ্ড লোহা গড়িয়ে দিলে যে রকম আওয়ায হয়- ঐ আওয়াযটি ছিল ঠিক এ আওয়াযের মতই। অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে পরাজিত করেন। আবু দাউদ সিজিসতানী তার সুনান গ্রন্থে মূসা ইবন ইসমাঈলের সূত্রে হাম্মাদ ইবন সালামা থেকে এ ঘটনা অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ আফফান সূত্রে– আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন দিবসে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিলাম । এক পর্যায়ে মুসলিম মুজাহিদরা তাকে রেখে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। তবে মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে মাত্র আশি জন লোক তার কাছে থেকে যান। আর আমরা কিছু সংখ্যক লোক আশি কদম পিছিয়ে গিয়ে অবস্থান করি। তবে আমরা পিট ফিরিয়ে চলে যাইনি। উক্ত আশি জনের উপর আল্লাহ প্রশান্তি নাযিল করেন। ইবন মাসউদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তার খচ্চরে আরোহণ করে কয়েক কদম অগ্রসর হন। কিন্তু খচ্চরটি তাঁকে নিয়ে আকাবাকা হয়ে চলে। ফলে তিনি জিন থেকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। আমি তখন বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি সোজা হয়ে মাথা উঁচু করুন। আল্লাহ আপনাকে উপরে উঠাবেন।” তিনি বললেন : “আমার কাছে এক মুঠো মাটি দাও।” এরপর তার হাতে এক মুঠো মাটি দেওয়ার পর তিনি তা শত্রুদের মুখের দিকে ছুঁড়ে মারেন। ফলে দেখা গেল তাদের সকলের চোখ সে মাটিতে ভরে গিয়েছে। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন : “মুহাজির ও আনসাররা কোথায়?” আমি বললাম, “ঐ তো তারা ওখানে আছেন।” তিনি বললেন, “তাদেরকে এখানে আসার জন্যে আওয়ায দাও।” আমি আওয়ায় দিলাম। আওয়ায শুনে তারা চলে আসলেন। তাদের ডান হাতে ছিল তলোয়ার। তলোয়ারগুলো ছিল সাদা-কাল মিশ্রিত উজ্জ্বল চকচকে। এ সময় মুশরিকরা পশ্চাৎ দিকে পলায়ন করে ময়দান ত্যাগ করে। ইমাম আহমদ উক্ত সনদে একাই এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বায়হাকী আবু আবদুল্লাহ হাফিয এর সূত্রে–ইয়ায ইবন হারিছ আনসারী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিনদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে বার হাজার মুসলিম সৈন্যসহ আগমন করেন। হুনায়নের এ যুদ্ধে তায়েফের অধিবাসীদের মধ্য হতে যারা নিহত হয়, তাদের সংখ্যা ছিল বদর যুদ্ধে নিহত মুশরিকদের সংখ্যার অনুরূপ। রাবী ইয়ায বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক মুঠো কংকর হাতে নিয়ে তা আমাদের মুখমণ্ডলের দিকে নিক্ষেপ করেন। এর ফলে আমাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ইমাম বুখারী তার ইতিহাস গ্রন্থে এ হাদীছ উল্লেখ করেছেন; কিন্তু সেখানে ইয়াযের নাম নেই।
মুসাদ্দাদ বলেন, আমাদের কাছে জাফর ইবন সুলায়মান, হুনায়ন যুদ্ধে কাফিরদের পক্ষে অংশগ্রহণকারী জনৈক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, “আমরা ও রাসূলুল্লাহর বাহিনী যখন পরস্পর মুখোমুখী হই, তখন তারা আমাদের মুকাবিলায় বকরী দোহন করার সময় পর্যন্ত টিকতে পারেনি। এরপর আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে গিয়ে আমাদের তলোয়ার প্রদর্শন করতে থাকি। এক পর্যায়ে আমরা তাকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলি। হঠাৎ দেখি, আমাদের ও তার মাঝে কয়েকজন উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তারা বললো : [ ] -ওদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাক। তোমরা ফিরে যাও। তাদের এ কথায় আমাদের পরাজয় ঘটে। বায়হাকী এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান বলেন, আবু সুফিয়ান–… হারিছ ইবন বদল নাসরীর সূত্রে তার গোত্রের এমন এক ব্যক্তির থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি হুনায়নের এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল এবং আমর ইব্ন সুফিয়ান ছাকাফী থেকে বর্ণনা করেন। উভয়ে বলেন : হুনায়ন যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হয়ে যায় এবং রাসূলুল্লাহর সাথে আব্বাস ও আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ ব্যতীত আর কেউ ছিল না। এ সময় তিনি এক মুঠো কংকর নিয়ে শত্রুদের মুখের দিকে নিক্ষেপ করেন। এরপর আমরা পরাজয় বরণ করি। এরপর মুসলিম অশ্বারোহিগণ প্রতিটি পাথর ও বৃক্ষের আড়ালে আমাদেরকে খুঁজতে থাকে। আমর ইবন সুফিয়ান ছাকাফী বলেন, আমি আমার ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে তায়েফে চলে যাই।
ইউনুস ইবন বুকায়র তার মাগাযী গ্রন্থে ইউসুফ ইবনূ সুহায়ব ইবন আবদুল্লাহর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুনায়ন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে একজন মাত্র লোক ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট ছিল না। সে ব্যক্তির নাম ছিল যায়।
ইমাম বায়হাকী কাদীমীর সূত্রে– ইয়াযীদ ইব্ন আমির সুওয়াইর থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন : হুনায়ন যুদ্ধে মুসলমানরা যখন ময়দান খালি করে পলায়ন করছিল তখন কাফিররা তাদের পশ্চাদ্বাবন করেছিল। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) যমীন থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মুশরিকদের সম্মুখে গিয়ে তাদের মুখমণ্ডলের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং বলেন “তোমরা ফিরে যাও। তোমাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাক।” এরপর তাদের একজনের সাথে অন্য জনের সাক্ষাৎ হলেই তারা চোখে ধুলাবালি যাওয়ার অভিযোগ জানিয়েছে। এরপর বায়হাকী দুটি পৃথক সূত্রে আবু হুযায়ফা থেকে যুদ্ধের কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেন। তার একটি সূত্রে আবু হুযায়ফা– সাইব ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি ইয়াযীদ ইবন আমির সুওয়ায়ী থেকে শুনেছি, আর সে হুনায়ন যুদ্ধে মুশরিক দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে। রাবী বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করতাম যে, হুনায়ন যুদ্ধে আল্লাহ্ মুশরিকদের অন্তরে যে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন তা কেমন ছিল? এর জবাবটা বাস্তবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে ইয়াযীদ ইবন আমির কিছু কংকর হাতে নিয়ে তামার থালার উপর নিক্ষেপ করতেন। এতে থালা ঝনঝন করে উঠলে তিনি বলতেন, ভয়ের কারণে আমরা অন্তরে এরকম ঝনঝন শব্দ অনুভব করতাম।
বায়হাকী বলেন : আবু আবদুল্লাহ হাফিয ও মুহাম্মাদ ইবন মূসা ইব্ন ফযল– দুজনেই শায়বা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে হুনায়ন যুদ্ধে যাই । তবে আল্লাহর কসম! আমি মুসলমান হয়েও যাইনি কিংবা ইসলামের অনুরক্ত হয়েও যাইনি। বরং আমি গিয়েছিলাম এ জন্যে যে, আমি চাচ্ছিলাম না হাওয়াযিনরা কুরায়শদের উপর জয়লাভ করুক। যুদ্ধের কোন এক মুহূর্তে আমি রাসূলুল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন আমি তাকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটি সাদা কাল মিশ্র বর্ণের ঘোড়া দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন : হে শায়বা! এ ঘোড়া তো কাফির ছাড়া অন্যরা দেখতে পায় না। এরপর তিনি তাঁর পবিত্র হাত আমার বুকের উপর রেখে বললেন : — হে আল্লাহ্! শায়বাকে সঠিক পথ দেখাও। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার হাত রেখে ঐ দু’আ করলেন– হে আল্লাহ্! শায়বাকে হিদায়াত কর। তারপরে তৃতীয়বার তিনি আমার বুকে হাত রেখে একই দু’আ করলেন–হে আল্লাহ্! শায়বাকে সত্য পথের সন্ধান দাও। শায়বা বলেন, আল্লাহর কসম! তৃতীয়বার হাত উঠিয়ে নেয়ার পর আমার মনে হল, আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে তার থেকে অধিক প্রিয় আমার কাছে অন্য কেউ নেই। এরপর তিনি একে একে উভয় পক্ষের মুখোমুখী হওয়া, মুসলমানদের পলায়ন, আব্বাসের আহ্বান এবং রাসূলুল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার কথা উল্লেখ করে বলেন, অবশেষে আল্লাহ্ মুশরিকদের পরাজিত করে দেন।
বায়হাকী বলেন, আমার নিকট আবু আবদুল্লাহ হাফিয— শায়বা ইব্ন উছমান থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আমি একাকী নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দেখতে পাই। এ সময় আলী ও হামযার হাতে আমার পিতা ও চাচার নিহত হওয়ার কথা স্মরণ পড়ে যায়। আজকের এ সুযোগে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে আমার অন্তর উতলা হয়ে ওঠে। শায়বা বলেন, এ উদ্দেশ্যে ডান দিক থেকে আমি তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখলাম সেখানে আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা) সাদা রংয়ের বর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন। বর্মটি এমন সাদা যে, দেখতে মনে হয় তা রৌপ্য নির্মিত- কোন ধুলাবালি তাতে জমতে পারছে না। মনে মনে ভাবলাম, আব্বাসতো তার চাচা। তিনি তো তার কোন ক্ষতি হতে দিবেন না। শায়বা বলেন, এরপর আমি বাম দিক থেকে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ ইব্ন আবদুল মুত্তালিবকে দেখতে পাই। এবারও মনে মনে ভাবলাম, ইনিও তো তাঁর আর এক চাচাতো ভাই। তার কোন অনিষ্ট করতে সুযোগ দিবেন না। এরপর আমি পশ্চাৎ দিক থেকে তার কাছে চলে যাই। এখানে কোন বাধা না থাকায় আমি তলোয়ার দ্বারা আঘাত করার প্রস্তুতি নেই। এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি- আমার ও তার মাঝে আগুনের এক লেলিহান শিখা উঁচু হয়ে আছে। মনে হল এ এক বিদ্যুতের ঝলক। আমার ভয় হল যে, এ শিখা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে। ভয়ে আমি হাত দ্বারা চোখ ঢেকে ফেলি এবং পিছু হটে চলে আসি। এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন : “হে শায়ব! আমার কাছ এসো। হে আল্লাহ্! তার থেকে শয়তানকে দূর করে দাও!” শায়বা বলেন, তখন আমি তার পানে চোখ উঠাতেই মনে হলো তিনি আমার কাছে আমার চোখ কান অপেক্ষাও অধিক প্রিয়। তারপর তিনি বললেন : “হে শায়বা! এখন কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই কর।”
ইবন ইসহাক বলেন : আবদার গোত্রের শায়বা ইবন উছমান ইবন আবূ তালহা বলেন, “হুনায়ন যুদ্ধের দিন আমি ভাবলাম, রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের আজ সুবর্ণ সুযোগ।” উহুদ যুদ্ধে তার পিতা নিহত হয়েছিল। তিনি বলেন, “তার প্রতিশোধে আজ আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করবো। এ উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহকে হত্যা করার জন্যে আমি সম্মুখে এগিয়ে যাই। হঠাৎ দেখি কি একটা জিনিস আমার সামনে এসে বাধা দিল এবং আমার অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ফলে আমি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারলাম না। এতে আমি বুঝলাম যে, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে এ কাজ করতে বাধা দিচ্ছে।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, তাঁর পিতা ইসহাক– জুবায়র ইবন মুতইম সূত্রে বর্ণনা করেন যে, জুবায়র বলেছেন, হুনায়ন দিবসে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিলাম। মুসলিম বাহিনী ও মুশরিকদের মধ্যে লড়াই চলছিল। তখন আমি লক্ষ্য করে দেখি, আসমান থেকে কাল চাদরের মত কিছু একটা নিচে নেমে আসছে। অবশেষে তা আমাদের ও শক্রদের মধ্যখানে পতিত হলো। আমি চেয়ে দেখি, অসংখ্য পিপিলীকা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা উপত্যকা ছেয়ে গেছে। শক্রদের বিপর্যয় না হওয়া পর্যন্ত তারা স্থান ত্যাগ করেনি। এরা যে মূলতঃ ফেরেশতা– তাতে আমাদের আর কোন সন্দেহ ছিল না। ইমাম বায়হাকী হাকিমের সূত্রে– ইবন ইসহাক থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। বায়হাকীর বর্ণনায় অতিরিক্ত খাদীজ ইবন আওজা নাসরীর নিম্নোক্ত কবিতা উল্লেখ করা হয়েছে :
رأيناسوادا منكر اللون اخصفا شماريخ من روى اذا عاد صفصفا اذا مالقينا العارض المتکشفا ثمانين الفاو استمدوا بخندفا
ولما دنونا من حنين ومائه بملمومة شهباء لوقذفوا بها ولو ان قومی طاوعتنی سراتهم اذا ما لقيناجند أل محمد
“আমরা যখন হুনায়ন ও তার পানির নিকটবর্তী হলাম, তখন সাদা-কাল নানা প্রকার কুশ্রী বর্ণের মানব দেহ দেখতে পেলাম।
তারা ছিল সাদা ঝলমলে অস্ত্রধারীদের সাথে। যদি তারা ওদেরকে আরওয়া পর্বতের শীর্ষে নিক্ষেপ করতো তবে তা সমতল স্থানে পরিণত হয়ে যেত।
আমার সম্প্রদায়ের সর্দারগণ যদি আমার কথা মেনে নিত। তাহলে আমাদের এ দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না।
আর মুহাম্মাদ পরিবারের আশি হাজার লক্ষরের মুকাবিলা আমাদের করতে হতো না। যারা সাহায্য পেয়েছিল খিদিফ গোত্রেরও।”
ইন ইসহাক বলেন : হুনায়ন যুদ্ধ তীব্রভাবে চলাকালে হাওয়াযিন নেতা মালিক ইবন আওফ নিম্নোল্লিখিত উদ্দীপক কবিতা বলেন :
مثلي على مثلك يحمی ویکر
اقدم مجاج انه يوم نكر
ثم احزالت زمر بعد زمر
اذا أضيع الصف يوما والدبر
قد اطعن الطعن تقذى بالسبر
كتائب يكل فيهن البصر
واطعن النجلاء تعوی وتهر
حين يذم المستكن المنجحر
نفق تارات وحياتنفجر
لها من الجوف رشاش منهمر وثعلب العامل فيها منکسر بازبن با این همهم این نفر
قد علم البيض الطويلات المر
قد أنفذ الضرس وقد طال العمر
غمر اذ تخرج الحاصن من تحت السر
ای فی امثالها في
“হে আমার ঘোড়া মুহাজ! এগিয়ে যাও, আজ বড়ই বিভীষিকাময় দিন। এমন দিনেই আমার মত লোক তোমার মত ঘোড়ায় চড়ে আত্মরক্ষা করছে এবং একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের দিন যখন সৈন্য ব্যুহ ভেংগে যায় ও পশ্চাদপদ হয়, তখন দলের পর দল ধ্বংস হয়ে যায় ।
সে বিশাল সৈন্য বাহিনী যা দেখে চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি বল্লম নিক্ষেপ করে এমনভাবে ক্ষত করি, যা সুন্দর চেহারাকে বিকৃত করে দেয়।
গৃহ কোণে অবস্থানকারীকে যখন নিন্দাবাদ করা হয়, তখন আমি বর্শা দ্বারা এমনভাবে বিরাটকায় যখম করে দিই যা অত্যন্ত গম্ভীর হয় ও সেখান থেকে আওয়ায বের হয়।
সে ক্ষত স্থান থেকে রক্তের ধারা বের হয়ে আসে। কখনও তা ক্ষত স্থানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবার কখনও প্রবাহিত হতে থাকে।
বল্লমের ফলা ভেংগে ক্ষতের মধ্যে রয়ে যায়।
তখন আমরা ডেকে ডেকে বলি, “হে যায়ন! “হে ইবন হামহাম! কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে?” “মাড়ির দাঁত বিদায় নিয়েছে। বয়স ও অনেক বেড়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে দীর্ঘ কাপড় পরিধানকারী সুন্দরী নেকাবধারী রমণীরা ভালভাবে অবগত আছে।
আমি অনুরূপ ঘায়েল করার কাজে ভুল করি না। যখন পর্দানশীল নারীরা তাদের পর্দা থেকে বের হয়ে আসে তখনও।
ইমাম বায়হাকী ইউনুস ইবন বুকায়র সূত্রে আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, মালিক ইবন আওফের দলবল পরাজিত হয়ে পলায়ন করলে সে ইসলাম গ্রহণের পর নিম্নের কবিতাটি বলেছিল। তবে কেউ কেউ বলেছেন, কবিতাটি মালিকের নয়, অন্য কারও হবে।
ومالك فوقه الرايات تختفق
اذكر مسيرهم والناس كلهم ومالك مالك مافوقه احد يوم حنين عليه الناج يأتلق
عليهم البيض و الابدان والدرق
حتى لقوا الناس حين البأس يقدمهم
حول النبي وحتى جنه الغسق
فضاربوا الناس حتى لم يروااحدا
فالقوم منهزم منا و معلق
حتى تنزل جبريل بنصرهم
لمنعتنا انا اسيافنا الفلق
منا ولو غير جبريل يقاتلنا
بطعنة كان منها سرجه العلق
وقد و في عمر الفاروق ان هزموا
“তাদের সফরের কথা স্মরণ কর, যখন লোকজন সবাই উপস্থিত ছিল। আর মালিকের উপর তখন পতাকা পতপত করে উড়ছিল।
মালিক– সে তো মালিকই। হুনায়নের দিন তার উপরে আর কেউ ছিল না। তার মস্তকে মুকুট শোভা পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধের সময় তারা প্রতিপক্ষের মুকাবিলায় অগ্রসর হল। তাদের সাথে ছিল শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও কাঠ বিহীন চামড়ার ঢাল।
এ অবস্থায় তারা প্রতিপক্ষের উপর আঘাত হানলো। এক পর্যায়ে তারা নবীর পাশে কাউকে দেখতে পেল না। এমন কি ধুলোর আঁধারে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান।
এরপর জিবরীল ফেরেশতা তাদের সাহায্যার্থে অবতরণ করেন। অবশেষে আমরা পরাজিত হয়ে বন্দী হই, আর কতক পলায়ন করি।
যদি জিবরীল ব্যতীত অন্য কেউ আমাদের সাথে যুদ্ধ করতো, তা হলে অবশ্যই আমাদেরকে হিফাযত করতো আমাদের উন্নত তরবারিগুলো।
তারা যখন পরাজিত হয়ে পলায়ন করছিল, তখন উমর ফারূক বর্শার আঘাতে যখম হয়ে যান। সে যখমের রক্তে তার বাহনের জিন রঞ্জিত হয়ে যায়।”
ইন ইসহাক বলেন, মুশরিক বাহিনী যখন পরাজিত হয় এবং আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে বিজয় দান করেন, তখন জনৈক মুসলিম রমণী কবিতায় বলেন :
والله احق بالثبات
قد غلبت خيل الله خيل اللات
“আল্লাহর অশ্বারোহী বাহিনী জয়লাভ করেছে সাত দেবতার অশ্বারোহী বাহিনীর উপর । আল্লাহই চিরস্থায়ী”।
ইবন হিশাম বলেন, কোন কোন বর্ণনাকারী আমার নিকট উক্ত পংক্তিটি নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছেন :
وخيله أحق بالثبات
قد غلبت خيل الله خيل اللات
“আল্লাহর অশ্বারোহী দল লাত দেবতার অশ্বারোহী দলের উপর বিজয় লাভ করেছে। আর আল্লাহর অশ্বারোহী বাহিনীই টিকে থাকার অধিক যোগ্য।”
ইন ইসহাক বলেন : হাওয়াযিন বাহিনীর পরাজয়ের পর বনূ মালিকের শাখা ছাকীফ গোত্রে হত্যাকান্ড চালানো হয়। তাদের সত্তরজন সৈন্য পতাকা তলেই নিহত হয়। তাদের পতাকা ছিল যুল-খিমারের হাতে। যুল-খিমার নিহত হলে উছমান ইব্ন আবদুল্লাহ ইবন রাবীআ ইবন হারিছ ইবন হাবিব পতাকা ধারণ করে। পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতে করতেই সে নিহত হয়। ইবন ইসহাক বলেন : আমির ইবন ওহব ইব্ন আসওয়াদ আমাকে জানিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উছমানের নিহত হওয়ার সংবাদ পৌঁছলে তিনি বলেছিলেন :
ابعده الله فانه كان يبغض قريشا ۔
“আল্লাহ্ তাকে রহমত বঞ্চিত করে দিন। সে কুরায়শদের প্রতি অতিশয় বিদ্বেষ পোষণ করতো।” ইবন ইসহাক ইয়াকূব ইবন উবার বরাতে উল্লেখ করেন যে, আলোচ্য উছমানের সাথে তার এক খৃষ্টান গোলামও নিহত হয়। জনৈক আনসারী এসে তার পরিধেয় জিনিসপত্র খুলে নেয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান যে, গোলামটি খাতুনাহীন। এ দেখেই তিনি চিৎকার করে আওয়ায দিলেন, হে আরব– সমাজ! ছাকীফ গোত্রের লোকেরা খানা করায় না। মুগীরা ইব্ন শু’বা ছাকাফী বলেন, আমার আশংকা হলো- আরব সমাজ থেকে আমাদের মান-সম্মান সবই বিলীন হয়ে যাবে– তাই আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, দেখ! এমন কথা আর প্রচার করো না। আমার পিতা-মাতা তোমার প্রতি উৎসর্গ হোন। ও তো আমাদের খৃষ্টান গোলাম। এরপর আমি (মুগীরা) অন্যান্য নিহতদের কাপড় উঠিয়ে তাকে বললাম? এদেরকে দেখ, এরা সবাই খানাকৃত। ইবন ইসহাক বলেন : এ যুদ্ধে মিত্র গোত্রসমূহের পতাকা ছিল কারিব ইবন আসওয়াদের হাতে। পরাজয়ের পরই সে তার পতাকাটি একটি গাছের সাথে ঠেস দিয়ে রেখে তার চাচাত ভাই ও গোত্রের লোকজন নিয়ে পালিয়ে যায়। এ কারণে মিত্র গোত্রসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র দু’জন লোক ছাড়া অন্য কেউ নিহত হয়নি। তাদের একজন হল গায়রা গোত্রের ওহব, আর অপরজন বনূ কুব্বাহ গোত্রের জালাহ। জালাহের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, হাকীফ গোত্রের যুবক নেতা আজ শেষ হলো। কিন্তু ইবন হামীদা- অর্থাৎ হারিছ ইবন উওয়ায়েস এখনও রয়ে গেল। ইবন ইসহাক বলেন : কারিব ইবন আসওয়াদের ভাইদের রেখে পলায়নপূর্বক আত্মরক্ষা করা এবং যুল-খিমার ও তার গোত্রের লোকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে আব্বাস ইবন মিরদাস নিম্নোক্ত কবিতা বলেন :
وسوف اخال يأتيه الخبير وقولا غير قولكما يسير الرب لا يضل ولا يجور فكل فتی بخایره مخیر بوج اذا تقسمست الامور امیر والدوائر قد تدور جنود الله ضاحية تسير علی حنق نكاد له نطير اليهم بالجنود ولم يغوروا ابجناها و اسلمت النصور فاقلع والدماء به تمور ولم يسمع به قوم ذكور على راياتها والخيل زور لهم عقل يعاقب او نكير
الا من مبلغ غيلان عنی وعروة انما اهدي جوابا بان محمدا عبد رسول وجدناه نبيا مثل موسی وبئس الامر امر بنی قسى اضاعوا أمرهم ولكل قسوم فجئنا اسد غابات اليهم نوم الجمع جمع بني قسی واقسم لو هموا مكثوا لسرنا فكنا اسد لية ثسم حتی ويوم كان قبل لدى حنين من الايام لم تسمع كيوم قتلنا في الغبار بني حطيط ولم يك ذو الخمار رئیس قوم
وقد بانت لمبصرها الأمور
اقام بهم على سنن المنايا نافلت من نجا منهم حريضا وقتل منهم
بشر کثیر
ولا الغلق الصريرة الحصور
ولا يغني الامور اخو التواني
امورهم وافلتت الصقور
احانهم وحان وملكوه
اهين لها الفما فص والشعير
بنو عوف يميح بهم جياد
تقسمت المزارع والقصور
فلولا قارب و بنو ابيه
على يسمن اشار به المشير
ولكن الرياسة معمموها
واحلام الي عز تصي
اطاعسوا قاربا و لهم جدود
انوف الناس ماسمر السمير
فان يهدوا الى الاسلام يلفوا
بحرب الله ليس لهم
نصير
فان لم يسلموا فهموا اذان
برهط بنى غزبة عنقفیر
كما حکمت بنی سعد وجرت كان بني معاوية بن بكر الى الاسلام ضائنة تخور
وقد برأت من الأحن الصدور
فقلنا اسلموا انا اخوكم
من البغضاء بعد السلم عور
كأن القوم اذ جاوا الينا
ر
“ওহে কে আছে আমার পক্ষ থেকে গায়লানকে পয়গাম পৌঁছে দিতে? তবে আমার ধারণা, খুব শীঘ্রই কোন ভাল জানাশোনা লোক তার কাছে এসে পৌঁছবে।
একই সাথে উরওয়াকেও পৌঁছিয়ে দেবে। আর আমি এমন একটা জবাব ও বক্তব্য উপঢৌকন দিব- যা তোমাদের দুজনের বক্তব্য থেকে ভিন্ন।
তা হলো মুহাম্মাদ (সা) প্রতিপালকের বান্দা ও রাসূল। তিনি বিপথগামী হন না এবং কারও প্রতি যুলুমও করেন না।
আমরা তাকে মূসা (আ)-এর মতো নবী হিসেবে পেয়েছি। যে কেউ তার সাথে শ্রেষ্ঠত্বের মুকাবিলা করবে সে পরাজিত হবে।
ও প্রান্তরে বনূ কাসী (ছাকীফ) সম্প্রদায়ের অবস্থা ছিল খুবই শোচণীয়- যখন তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
তাদের বিষয়াদি ও ক্ষমতা তারা নিজেরাই নষ্ট করে দেয়। প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই একজন আমীর থাকে। আর বিপদ আপদ ঘুরে ফিরে আবর্তিত হতে থাকে।
আমরা বনের সিংহের ন্যায় তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আর ওদিকে আল্লাহর বাহিনীগুলো প্রকাশ্যভাবে অগ্রসর হচ্ছিল।
আমরা বান্ কাসী বা হাওয়াযিন বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম ক্রোধের সাথে । আমাদের চলার গতি ছিল এত তীব্র মনে হচ্ছিল যেন পাখীর ন্যায় উড়ে চলছিলাম।
আমি কসম করে বলছি, তারা যদি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করতো, তা হলে আমরা সৈন্যদল নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতাম সে দল বিজয় না নিয়ে ফিরে আসতো না।
তারপর আমরা লিয়্যা এলাকায় যেয়ে তথাকার সিংহের মত হয়ে যাই এবং সেখানে রক্তপাত বৈধ করে নিই। আর নসূর গোত্র আত্মসমর্পণ করে।
ইতিপূর্বে হুনায়নের নিকট এমন একটা দিন অতিবাহিত হয়েছে যে দিন তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং সেখানে রক্ত প্রবাহিত হয়েছে।
সে দিনটি ছিল এমন ভয়াবহ যে, তোমরা অমন একটি দিনের কথা কখনও শুনতে পাওনি। আর না শুনতে পেয়েছে কোন স্মরণীয় জাতি।
আমরা বনূ হুতায়তকে উড়ন্ত ধুলোবালির মধ্যে তাদের পতাকার কাছে গিয়ে হত্যা করি। আর তাদের প্রশস্ত বক্ষ বিশিষ্ট অশ্বগুলো ছিল রশি দিয়ে বাঁধা।
সে সময় যুল-খিমার তাদের গোত্রের সর্দার ছিল না। তাদের বিবেক বুদ্ধির পরিণতি তারা ভোগ করছিল।
সে তাদেরকে মৃত্যুর পথসমূহে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে পথসমূহ দর্শনকারীদের নিকট বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
তাদের মধ্যে যারা রক্ষা পেয়েছিল তারা দৃষ্টির আড়ালে নিচে পড়েছিল। সেখান থেকে উঠার শক্তি তাদের ছিল না। আর তাদের বিপুল সংখ্যক লোককে হত্যা করা হয়।
অলস ও ধীর গতির লোকেরা কোন কাজেই ফলপ্রসূ হয় না। আর যারা দুর্বলচেতা বিবাহ-শাদী করে না বা রমণী স্পর্শ করে না, তাদের দ্বারাও কোন কাজ হয় না।
সে তাদেরকে হত্যা করলো এবং নিজেও নিহত হল। লোকজন তাকে নিজেদের কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে নেতা বানিয়ে নেয় এমন অবস্থায় যখন বীরযোদ্ধারা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
বনূ আওফ, তাদের সাথে উত্তম ঘোড়াসমূহ উদ্দীপনার ঢংগে চলতে থাকে। এগুলোর জন্যে প্রস্তুত থাকে তাজা ঘাস ও যব।
কারিব ও তার ভাইয়েরা যদি বিদ্যমান না থাকতো, তা হলে তাদের জমি-ক্ষেত ও প্রাসাদগুলো ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যেত।
কিন্তু শাসন ক্ষমতা সাধারণত তাদের কাছেই অর্পণ করা হয় আশির্বাদ হিসেবে। ইংগিত দানকারী (অর্থাৎ রাসূল সা) এ দিকেই ইংগিত করেছেন।
তারা কারিবের আনুগত্য করেছে। অথচ তাদের রয়েছে এমন সব উত্তর পুরুষ ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি যারা তাদেরকে মর্যাদার স্থানে পৌঁছে দিত।
যদি তারা ইসলামের দিকে আসার হিদায়াত পেয়ে যায়, তা হলে তারা লোক সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে- যত দিন রাত্রির গল্পকারীরা গল্প করতে থাকবে।
কিন্তু যদি তারা ইসলামের দিকে না আসে। তা হলে ধরে নেওয়া হবে, তারা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে এ অবস্থায় তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।
যেমনটি আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় বনূ সা’দকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে এবং গাযায়্যা গোত্রের লোকদেরকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বনূ মুআবিয়া ইবন বকরকে ইসলামের সামনে মনে হয় একটি বাছুর- যেগুলো হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে।
তাই আমরা তাদেরকে বললাম, তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর, আমরা তোমাদের ভাই। আমাদের হৃদয় হিংসা-দ্বেষ থেকে মুক্ত পবিত্র।
যখন তারা আমাদের নিকট এসেছিল, তখন সন্ধি-চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাদের অন্তর বিদ্বেষে অন্ধ ছিল।”
হুনায়ন যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা
হাওয়াযিন বাহিনীর পরাজয়ের পর তাদের নেতা মালিক ইবন আওফ নাসরী কিছু সংগী সাথী নিয়ে একটি গিরিপথের উপর দাঁড়ায়। তারপর সকলকে সম্বোধন করে ঘোষণা দেয়, তোমরা এখানে থাম, যারা দুর্বল তারা আগে চলে যাক। আর যারা পিছনে রয়ে গেছে তারা এসে তোমাদের সাথে মিলিত হোক। ইবন ইসহাক বলেন : আমার কাছে এ রকম বর্ণনা পৌঁছেছে যে, ঐ সময় একদল অশ্বারোহী বাহিনীকে আসতে দেখা যায়। মালিক ও তার সংগীরা গিরিপথের উপর ছিল। মালিক তার সাথীদেরকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ?” তারা বল্লো, “আমরা দেখছি একদল লোক এ দিকে আসছে, তাদের বর্শাগুলো ঘোড়ার কানের কাছে রাখা এবং তাদের পার্শ্বদেশ লম্বা।” তখন মালিক বললো, এরা বনূ সুলায়মের লোক। তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর হামলা হওয়ার কোন আশংকা নেই। দেখা গেল, তারা এসে উপত্যকার নিম্ন ভূমির দিকে নেমে গেল। এরপর তাদের পিছনে পিছনে আর একটি অশ্ব বাহিনীকে আসতে দেখা গেল। মালিক তার সংগীদের কাছে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কী দেখতে পাচ্ছে। তারা বললো, “আমরা দেখছি, একদল লোক তাদের বর্শাগুলো ঘোড়ার উপরে আড়াআড়িভাবে এলোমেলো করে রেখে দিয়েছে।” মালিক বললো, “এরা আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ের লোক। এদের পক্ষ থেকেও তোমাদের উপর বিপদ আসার কোন আশংকা নেই।” তারপর এরা যখন ঐ গিরিপথের কাছে এলো, তখন তারাও বনূ সুলায়মের পথ ধরে চলে গেল। এরপর একজন অশ্বারোহীকে আসতে দেখা গেল। তখন মালিক বললো, “এবার তোমরা কী দেখতে পাচ্ছো?” তারা জবাব দিল, “আমরা একজন অশ্বরোহীকে দেখছি। তার পার্শ্বদেশ বেশ লম্বা। বর্শা কাঁধে ঝুলান এবং একটি লাল কাপড় দ্বারা তার মাথা বাঁধা।” মালিক বললো, এ হচ্ছে যুবায়র ইবন আওয়াম। লাত দেবীর কসম! সে তোমাদেরকে হেস্তনেস্ত করবে, সুতরাং তোমরা দৃঢ়ভাবে অবস্থান কর। যুবায়র গিরিপথের সন্নিকটে এসে হাওয়াযিনদের দেখতে পেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যান এবং বর্শা দ্বারা অব্যাহতভাবে আঘাত হেনে তাদেরকে সেখান থেকে দূরে হটিয়ে দেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশক্রমে গনীমতের মাল হিসেবে উট, মেষ ও দাসদেরকে একত্রিত করা হয়। তিনি এগুলোকে জি-ইরানায় নিয়ে আটকে রাখার আদেশ দেন। ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) গনীমতের মাল সংরক্ষণের জন্যে মাসউদ ইবন আমর গিফারীকে দায়িত্ব প্রদান করেন।
ইবন ইসহাক বলেন : আমার কোন এক সাথী আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে দিন চলার পথে দেখেন, এক মহিলার লাশ পড়ে আছে। খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা) তাকে হত্যা করেছেন। লোকজন লাশটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন তিনি তাঁর এক সাহাবীকে বললেন : “তুমি যাও, খালিদকে বল- রাসূলুল্লাহ (সা) শিশু, নারী ও দিন মজুর তোক হত্যা করতে তোমাকে নিষেধ করেছেন।” এটা ইবন ইসহাকের বিচ্ছিন্ন (মুনকাতি’) সনদে বর্ণিত ।
ইমাম আহমদ আবু আমিরের সূত্রে–… রাবাহ্ ইবন রাবী থেকে বর্ণনা করেন। একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। দলের অগ্রভাগে ছিলেন খালিদ ইবন ওয়ালিদ। চলার পথে রাবাহ ও অন্যান্য সাহাবী এক মহিলার লাশ দেখতে পান। অগ্রভাগে যারা ছিলেন তারাই একে হত্যা করেছিলেন। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে লাশটি দেখতে লাগলেন এবং মহিলার অবয়ব দেখে বিস্মিত হলেন। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সা) বাহনে চড়ে সেখানে উপস্থিত হন। লোকজন লাশের পাশ থেকে সরে যায়। তখন নিহতের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “এ মহিলা তো যুদ্ধ করেনি।” এরপর তিনি জনৈক সাহাবীকে বললেন : তুমি গিয়ে খালিদকে বল? সে যেন কোন শিশুকে কিংবা মজদুরকে হত্যা না করে। আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা এ ঘটনাটি অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আওতাস যুদ্ধ
আওতাস যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণ ছিল এই যে, হাওয়াযিন সম্প্রদায় পরাজয় বরণ করার পর তাদের এক দল তায়েফে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে দলপতি মালিক ইবন আওফ নাসরীও ছিল। তায়েফের দুর্গের অভ্যন্তরে তারা অবস্থান নেয়। আর এক দল লোক আওতাস নামক স্থানে গিয়ে সমবেত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবূ আমির আশআরী (রা)-এর নেতৃত্বে এক দল সাহাবীর একটি বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করেন। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং তায়িফের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তায়িফ অবরোধ করেন। এ বিষয়ে আলোচনা পরে করা হবে।
ইবন ইসহাক বলেন : হুনায়ন যুদ্ধে মুশরিক বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর পালিয়ে তায়েফে চলে আসে । মালিক ইবন আওফও তাদের সাথে ছিল। তবে তাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক আওতাসে যায়। আর কিছু সংখ্যক যায় নাখলায়। অবশ্য ছাকীফ গোত্রের ওয়াগীরা উপগোত্রের লোক ব্যতীত আর কেউ নাখলায় যায়নি। যে সব লোক পার্বত্য পথ ধরে তায়েফ যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অশ্বারোহী বাহিনী তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। এ প্রচেষ্টায় রাবীআ ইবন রাফী ইবন ইহান সুলামী দুরায়দ ইবন সিমমাকে ধরে ফেলেন। রাবীআ ইবন দাগিন্না নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। দাগিন্না ছিল তার মায়ের নাম। রাবীআ দুরায়দের উটের লাগাম টেনে ধরেন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, উটের আরোহী হবে একজন মহিলা। কেননা, সে কাপড় দিয়ে ঘেরা হাওদার মধ্যে অবস্থান করছিল। কিন্তু ঘের খুলে ফেলার পর তিনি দেখলেন সে একজন পুরুষ মানুষ। তিনি উটটিকে বসিয়ে দিলেন। দেখলেন লোকটি জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ, দুরায়দ ইবন সিমমা। তরুণ রাবীআ দুরায়দকে চিনতেন না। দুরায়দ জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাকে কি করতে চাও? তিনি বললেন, তোমাকে আমি হত্যা করবো। দুরায় জানতে চাইল, কে তুমি? তিনি জবাবে বললেন, আমি রাবীআ ইবন রাফী সুলামী। এরপর তিনি তলোয়ার দ্বারা দুরায়দকে আঘাত করলেন। কিন্তু তাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেন। তখন দুরায় বললো, “কত নিকৃষ্ট অস্ত্র দিয়ে তোমার মা তোমাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে? আমার বাহনে হাওদার পিছনে রাখা ঘেরের ভেতর থেকে আমার তলোয়ারটা বের করে আন এবং তা দিয়ে আমাকে আঘাত কর। তবে তুমি অস্থির উপরে এবং মগজের নিচে আঘাত করবে। কেননা, আমি এভাবেই লোক হত্যা করতাম। তারপর তুমি যখন তোমার মায়ের কাছে ফিরে যাবে তখন তাকে বলবে, আমি দুরায়দ ইবন সিমমাকে হত্যা করেছি। আল্লাহর কসম! বহুবার আমি তোমাদের মহিলাদেরকে রক্ষা করেছি।” পরবর্তীতে বন্দু সুলায়মের লোকজন বলেছে যে, রাবীআ’ জানিয়েছেন, দুরায়দকে আঘাত করার পর সে উলংগ হয়ে নিচে পড়ে যায়। তখন দেখা যায় তার নিতম্ব ও উরুদ্বয় অধিক অশ্বারোহণ করার ফলে কাগজের ন্যায় সাদা হয়ে গেছে। এরপর যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে রাবীআ তাঁর মায়ের নিকট গিয়ে দুরায়দকে হত্যা করার বিবরণ শুনায়। বর্ণনা শুনে তার মা বললেন। “আল্লাহর কসম! সে তো তোমার মা-দেরকে তিন তিনবার মুক্ত করেছিল।”
দুরায় নিহত হওয়ার পর তার কন্যা উমারা বিন্ত দুরায় যে শোক গাঁথা রচনা করেছিল, ইবন ইসহাক তা উল্লেখ করেছেন। তার কিছু অংশ নিম্নে দেওয়া হলঃ
فظل دمعي على السر بال ينحدر
قالوا قتلنا دريدا قلت قد صدقوا لولا الذي قهر الأقوام كلهم رأت سليم وكعب كيف يأتمر اذن لصبحهم با وظاهرة حيث استقرت نواهم جحفل ذفر
“তারা বলেছে, আমরা দুরায়দকে হত্যা করেছি। আমি বলেছি, তারা সত্য কথাই বলেছে। ফলে আমার অশ্রু অবিরতভাবে আমার জামার উপর ঝরে পড়ছে।
যদি ঐ শক্তি বিদ্যমান না থাকতো- যা সমুদয় জাতিকে গ্রাস করে নিয়েছে, তা হলে বন্দু সুলায়ম ও বনূ কা’ব দেখতো, কিভাবে হুকুম মান্য করা হয় ও আনুগত্য করতে হয়।
তখন প্রাতঃকালে তাদেরকে আঘাত হানতো প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এক বিরাট বিশাল বাহিনী। তখন বিপদ মুসীবত স্থায়ীভাবে তাদের ঘাড়ে চেপে বসতো।”
ইন ইসহাক বলেন : মুশরিক বাহিনীর মধ্য হতে যারা আওতাসের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল তাদের পশ্চাদ্ভাবন করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবূ আমির আশআরীকে প্রেরণ করেন। তিনি পরাজিতদের মধ্যেকার কিছু লোকের নাগাল পেয়ে যান। দূর থেকে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। একটি তীর এসে আবু আমির (রা)-এর গায়ে পতিত হয় এবং তাতেই তিনি শহীদ হন। তারপর তার চাচাত ভাই আবু মূসা আশআরী (রা) পতাকা ধারণ পূর্বক তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। আল্লাহ্ তাকে এ লড়াইয়ে বিজয় দান করেন এবং শত্রুদেরকে পরাজিত করেন। লোকমুখে জানা যায় যে, যে ব্যক্তি আবু আমির আশআরী (রা) কে তীরবিদ্ধ করেছিল সে হল দুরায়দের পুত্র সালামা। তার নিক্ষিপ্ত তীর আবৃ আমিরের হাঁটুতে লাগে এবং এতেই তিনি নিহত হন। এ প্রসংগে সালামা কবিতায় বলে?
ابن سمادير لمن توسمه
وان تسألوا عنی فانی سلمة
اضرب بالسيف رؤس المسلمة
“আমার সম্পর্কে যদি জানতে চাও, তা হলে শুনে নাও- আমার নাম সালামা। আমি সামাদীরের পুত্র। এ পরিচয় তার জন্যে দেওয়া যে তাকে ভালরূপে জানতে চায়। আমি মুসলমানদের মাথায় তলোয়ারের আঘাত হানি।”
ইবন ইসহাক বলেন : কবিতা ও ঘটনা বর্ণনায় পারদর্শী জনৈক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, আওতাসের দিন দশজন মুশরিকের সাথে আবু আমির (রা)-এর মুকাবিলা হয়। এ দশজনই ছিল পরস্পরের ভাই। তাদের মধ্যে একজন আৰূ আমিরের উপর হামলা করে। ফলে আৰু আমির (রা) ও তার উপর হামলা করেন। তিনি তাকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে দাওয়াত দেন এবং বলেন, “হে আল্লাহ! আপনি তার উপর সাক্ষী থাকুন।” তারপর আবু আমির (রা) তাকে হত্যা করেন। এরপর দ্বিতীয় আর একজন তাকে আক্রমণ করে। ফলে আবু আমির (রা) তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করে বলেন, “হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।” তারপর প্রতি-আক্রমণ করে আবু আমির (রা) তাকে হত্যা করেন। এরপর তারা প্রত্যেকেই একে একে আবু আমির (রা)-এর উপর হামলা করতে থাকে। আর প্রত্যেক বারেই তিনি অনুরূপ দাওয়াত দিয়ে ও আল্লাহূকে সাক্ষী রেখে প্রতি-হামলা করে হত্যা করতে থাকেন। এভাবে তাদের নয়জন নিহত হয়ে যায়। বাকী থাকে দশম ব্যক্তি এবার সেও আবু আমির (রা)–এর উপর হামলা করে বসে। ফলে তিনিও তার উপর হামলা করেন। তিনি তাকে প্রথমে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন এবং বলেন “হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন।” তখন আক্রমণকারী দশম লোকটি বললো- হে আল্লাহ! আপনি আমার উপরে সাক্ষী থাকবেন না। এ কথা শুনে আবু আমির (রা) তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে সে প্রাণে রক্ষা পায়। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং অতি নিষ্ঠার সাথে ইসলামের আনুগত্য করে। নবী করীম (সা) যখনই তাকে দেখতেন তখনই বলতেন, এ হচ্ছে আবু আমিরকে ফাঁকি দেওয়া পলাতক ব্যক্তি। বর্ণনাকারী বলেন, অল্পক্ষণ পর বনু জুশাম ইবন মুআবিয়া গোত্রের হারিছের দুই পুত্র- আলা ও আওফা (দুই ভাই) একযোগে আবু আমির (রা)-এর প্রতি তীর নিক্ষেপ করে। একটি তীর তার হৃৎপিণ্ডে লাগে এবং অপরটি তার হাঁটুতে বিদ্ধ হয়। এভাবে তারা দুজনে মিলে তাকে শহীদ করে। এ সময় লোকজন আবু মূসা আশআরীকে তার স্থানে আমীররূপে গ্রহণ করে। তিনি আক্রমণকারী ভ্রাতৃদ্বয়ের উপর পালটা আক্রমণ চালিয়ে তাদের দু’জনকেই হত্যা করেন। বনূ জুশাম গোত্রের এক ব্যক্তি উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের মৃত্যুতে নিম্নরূপ মর্সিয়া রচনা করেন :
ء واوفي جميعا ولم يسنذا وقد كان داهية اربدا كأن علی عطفه مجسدا اقل عثارا وارمی دا
ان الرزية
قتل العلا
هما القاتلان ابا عامر هما تركاه ل دى معرك فلم يرفي الناس مثليهما
“আলা ও আওফার হত্যাকাণ্ড একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। তারা এক সাথেই মারা গেল, অথচ কোন আশ্রয়ই তাদের ছিল না।
তারা দু’জনেই আবৃ আমিরের হত্যাকারী। আর আবৃ আমির ছিল এক ভয়ংকর ব্যক্তি।
তারা দুজনে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে এমন অবস্থায় পরিত্যাগ করে, যেন তার পাশে রয়েছে মসজিদ।
মানব সমাজে তাদের দু’ভাইয়ের ন্যায় লোক কোথাও দেখা যায়না। প্রতিযোগিতায় তারা কমই হোঁচট খায়। আর তীর নিক্ষেপে তারা খুবই সিদ্ধহস্ত।”
ইমাম বুখারী মুহাম্মাদ ইবন আলা–… আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন যুদ্ধ শেষ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা) আবূ আমির (রা)-এর নেতৃত্বে একটি সৈন্য দল আওতাস গোত্রের দিকে পাঠান। দুরায়দ ইবন সিমমার সাথে তার মুকাবিলা হয়। লড়াইয়ে দুরায় নিহত হয় এবং তার বাহিনী আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছায় পরাজিত হয়। আবু মূসা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবূ আমির (রা)-এর সাথে আমাকেও প্রেরণ করেন। এ মুকাবিলায় আবূ আমির (রা)-এর হাঁটুতে একটি তীর নিক্ষিপ্ত হয়। জুশাম গোত্রের এক লোক তীর নিক্ষেপ করে তার হাঁটু তীরবিদ্ধ করে। আমি তখন তার কাছে গিয়ে বললাম, “চাচা! কে আপনাকে তীর মেরেছে?” তিনি আবু মূসাকে ইংগিতে জানালেন, ঐ যে লোকটি- সে আমার হত্যাকারী এবং সেই আমাকে তীর মেরেছে। আমি তার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম এবং তার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। সে আমাকে দেখা মাত্রই পালাতে শুরু করলো। আমিও তার পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং বললাম, “কি হে, লজ্জা করে না? দাঁড়াও না কেন?” এ কথা শুনে সে থেমে গেল। তখন আমরা দুজনে পরস্পরকে তলোয়ার দ্বারা আঘাত করি। অবশেষে আমি তাকে হত্যা করে ফেলি। এরপর আমি এগিয়ে নিয়ে আবূ আমির (রা)-কে বললাম, “আল্লাহ্ আপনার ঘাতককে হত্যা করেছেন।” আবু আমির (রা) বললেন, “এখন তুমি আমার হাঁটু থেকে এ তীর বের করে দাও।” আমি তীরটি টেনে বের করে দিলাম। তখন ক্ষত স্থান থেকে কিছু পানি বেরিয়ে আসলো। আবু আমির (রা) তখন বললেন, ভাতিজা! তুমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিও এবং আমার মাগফিরাতের জন্যে দুআ করতে বলবে।” এ কথা বলে আবু আমির (রা) আমাকে দলের নেতা নিযুক্ত করেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ইনতিকাল করেন। আমি অভিযান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাড়িতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করি। দেখতে পাই, তিনি পাকান রশি দিয়ে তৈরি একটি খাঁটিয়ার উপর বিছানায় শুয়ে আছেন। খাঁটিয়ার রশি তার পিঠে ও পার্শ্বদেশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে আমাদের অবস্থা ও আবূ আমির (রা)-এর ঘটনা জানালাম এবং তার জন্যে মাগফিরাতের দু’আর আবেদন করার কথাও জানালাম। তখন তিনি একটু পানি আনতে বললেন। এরপর উযূ করে দু’হাত তুলে বললেন : “হে আল্লাহ! তোমার প্রিয় বান্দা আৰূ আমিরকে ক্ষমা করে দাও।” দু’আ করার সময় তিনি হাত এতদূর উপরে উঠান যে, আমি তাঁর বগলদ্বয়ের সাদা অংশ দেখতে পাই। তিনি আরও বললেন, “হে আল্লাহ্! কিয়ামতের দিন তোমার অনেক বান্দার উপর তাকে মর্যাদা দিও।” অথবা বলেছেন, “তোমার অনেক সৃষ্টির উপর তাকে সম্মান দিও।” তখন আমি বললাম, “আমার জন্যেও একটু মাগফিরাতের দুআ করুন।” তিনি বললেন, হে আল্লাহ্! আবদুল্লাহ্ ইবন কায়সের গুনাহগুলোও মাফ করে দিও এবং কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশের সুযোগ দিও।” আবু বুরদা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি দুআ ছিল আবু আমির (রা)-এর জন্যে। আর একটি ছিল আবু মূসা (রা)-এর জন্যে।
ইমাম মুসলিম এ ঘটনা আৰূ কুরায়ব মুহাম্মাদ ইব্ন আলা ও আবদুল্লাহ্ ইবন আবী বারাদের সূত্রে আবু উসামা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ আবদুর রাযযাকের সূত্রে– আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আওতাস যুদ্ধে অনেক নারী বন্দী হিসেবে আমাদের হস্তগত হয়। এ সব নারীর স্বামীরা জীবিত ছিল। তাই স্বামী থাকার কারণে তাদের সাথে মিলিত হতে আমাদের মনে খটকা লাগে। তখন এ বিষয়ে পরিষ্কার জানার জন্যে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞেস করি। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় :
والمحصنات من النساء الأ ما ملكت أيمانكم +
“এবং নারীর মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত সকল সধবা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ” (৪- নিসা : ২৪)।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, এ আয়াতের কারণে আমরা তাদের সাথে মিলিত হওয়া বৈধ মনে করি। তিরমিযী এবং নাসাঈও এ হাদীছ উছমান বাত্তী থেকে বর্ণনা করেছেন। মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে শুবা– আবু সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসাঈ এ হাদীছ সাঈদ ইবন আবূ আরূবা থেকে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া মুসলিম, শু’বা ও তিরমিযী– হুমাম আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আওতাস যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবীগণ অনেক বন্দী দাসী প্রাপ্ত হন। এসব দাসীর মুশরিক স্বামী বর্তমান ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কিছু সংখ্যক সাহাবী এ সব দাসীদের ভোগ সম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন এবং এ কাজকে তারা পাপ মনে করেন। তখন এ প্রসংগে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় :
:
والمحصنات من النساء الأ ما ملكت أيمانكم +
“এবং নারীর মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত সকল সধবা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ” (৪- নিসা : ২৪)।
হাদীছের উপরোক্ত বর্ণনাটি আহমদ ইবন হাম্বলের পাঠ থেকে গৃহীত। বর্ণিত হাদীছের এ সূত্রে আলকামা হাশিমীর নামটি তিনি অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য (ছিকা) রাবী এবং হাদীছটি মাহফুয শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
উপরোক্ত আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করে প্রাথমিক যুগের একদল আলিম বলেন যে, দাসী বিক্রী করলে তালাক হয়ে যায়। ইবন মাসউদ, উবাই ইবন কাব, জাবির ইবন আবদুল্লাহ্, ইবন আব্বাস (রা), সাঈদ ইবন মুসায়্যিব ও হাসান বসরী (র) থেকে এরূপ মত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ আলিম এ মতের বিরোধী। তাঁরা বারীরার ঘটনাকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। কেননা, বারীরাকে বিক্রী করে দেওয়ার পর তার বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে তাকে ইখতিয়ার দেওয়া হয়- ইচ্ছে করলে সে তার বিবাহ রেখে দিতে পারে অথবা ইচ্ছে করলে ভেংগে দিতে পারে। যদি কেবল বিক্রী করার দ্বারাই তালাক হয়ে যেত, তা হলে তাকে এখতিয়ার দেওয়া হতো না। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমি তাফসীর গ্রন্থে করেছি। অবশ্য “আহকামুল কাবীর” অধ্যায়ে আমি এ সম্পর্কে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। এ ছাড়া আওতাস যুদ্ধের বন্দী দাসীদের ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণ পূর্বক প্রাথমিক যুগের আলিমদের একটি দল এ মত পোষণ করেন যে, মুশরিক বাদীর সাথে মিলন-ক্রিয়া বৈধ। কিন্তু জমহুর উলামা এ মতের বিরোধী। তারা বলেন, এ ঘটনা একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। হতে পারে তারা হয়তো বা ইসলাম গ্রহণ করেছিল; কিংবা তারা ছিল আহলে কিতাব। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার স্থান “আহকামুল কাবীর” অধ্যায়। হুনায়ন ও আওতাস যুদ্ধে যারা শহীদ হন।
১. রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুক্তদাস আয়মান ইবন উবায়দ। যিনি আয়মান ইবন উম্মে আয়মান নামে খ্যাত।
২. যায়দ ইবন যামআ ইবন আসওয়াদ ইবন মুত্তালিব ইবন আসাদ। তার জানাহ্ নামক ঘোড়া তাকে পিঠ থেকে ফেলে দিলে তিনি ইনতিকাল করেন।
৩. বনূ আজলান গোত্রের সুরাকা ইবন মালিক ইবন হারিছ ইবন আদী আনসারী। ৪. আবূ আমির আশআরী। ইনি ছিলেন আওতাস যুদ্ধের সেনাপতি।
এ চারজনই উক্ত যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। হুনায়ন যুদ্ধ সম্পর্কে রচিত কবিতা।
এ প্রসংগে বুজায়র ইবন যুহায়র ইবন আবূ সুলামী বলেন :
حين استخف الرعب كل جبان
لولا الا له وعبده وليتم
وسوابح یکبون للاذقان
بالجزع يوم حبالنا اقراننا من بين ساع ثوبه في كفه ومقطر بسنابك ولبان
واعزنا بعبادة الرحمن
والله اكرمنا واظهر ديننا
واذ لهم بعبادة الشيطان
والله اهلكهم وفرق جمعهم
মর্মার্থ : “যদি আল্লাহ ও তাঁর বান্দাহ না থাকতো তা হলে তোমরা অবশ্যই পালিয়ে যেতে, যখন ভীতি সকল কাপুরুষকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
উপত্যকার মোড়ে আমাদের সমকক্ষ দল যখন আমাদের মুকাবিলা করে । তখন ক্ষীপ্রগতি সম্পন্ন ঘোড়াগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল।
তখন কেউ কেউ দৌড়ে যাচ্ছিল কাপড় হাতে নিয়ে। আর ঘোড়াগুলো খুর ও বুক উল্টিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
আল্লাহ্ আমাদেরকে মর্যাদায় ভূষিত করলেন, আমাদের দীনকে বিজয়ী করলেন এবং রাহমানের আনুগত্য করায় তিনি আমাদেরকে সম্মান দান করলেন।
আর আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করে দিলেন, তাদের দলকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন এবং শয়তানের গোলামী করার কারণে তাদেরকে লাঞ্ছিত করলেন।”
ইবন হিশাম বলেন : কোন কোন বর্ণনাকারী এ কবিতার সাথে আরও কিছু উল্লেখ করেন যথাঃ
اذ قام عم نبيكم و وليه بدعون يالكتيبة الايمان
يوم العريض و بيعة الرضوان
این الذين هم أجابوا ربهم
“যখন তোমাদের নবীর চাচা ও তার অভিভাবক দাঁড়িয়ে আহ্বান করে বললেন, হে ঈমানের সৈন্যদল। কোথায় সে সব লোক! যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়েছিল বদর প্রান্তরে ও বায়আতুর রিযওয়ানে?”
হুনায়নের যুদ্ধ প্রসংগে আব্বাস ইবন মিরদাস সুলামীর কবিতা :
وما يتلو الرسول من الكتاب
فانی والسوابح يوم جمع
بجنب الشعب امس من العذاب
لقد احببت ما لقيت ثقيف هم رأس العدو من اهل نجد فقتلهم المسن الشراب
وجلسست برگها ببنی رئاب
هزمنا الجمع بني قسي
باوطاس تعفر بالتراب
وصرما من هلال غادرتهم
لقام نسائهم والنقع كابی
ولو لاقين جمع بنی کلاب
الي الاورال تنحط بالتهاب
ركضنا الخيل فيهم بين بس بذی لجب رسول الله فيهم كتيبته تعرض للضراب
“যুদ্ধের দিনের তেজি ঘোড়ার কসম এবং রাসূল (সা) কিতাব থেকে যা পাঠ করেন তার কসম! নিশ্চয়ই আমি।
আনন্দ পেয়েছি। গতকাল গিরিপথ প্রান্তে ছাকীফ গোত্র যে শাস্তি ভোগ করেছে- তা দেখে ।
নজদবাসীদের মধ্যে তারাই মূল শত্রু। তাই তাদের নিধন হওয়া মদ পান করার চাইতেও
আমরা বনূ কাসিয়্যের সৈন্য দলকে পরাজিত করেছি এবং বনূ রিয়াবের উপরেও তার চাপ
আওতাস যুদ্ধ থেকে পরিত্যক্ত হিলাল গোত্রের একটি মহল্লা মাটির ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
তাদের নারী সমাজ যদি বনূ কিলাবের সৈন্যদের দেখতো এবং উড়ন্ত ধুলোবালি লক্ষ্য করতো, তবে তারা অবশ্যই উঠে যেতো।
বাস হতে আওরাল পর্যন্ত সমগ্র এলাকায় তাদের মাঝে আমরা অশ্ব হাঁকিয়েছি এবং গনীমতের মাল কুড়িয়েছি।
সর্বদা শোরগোলে মুখরিত এ এলাকায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আঘাত হানতে এগিয়ে যান।
আব্বাস ইবন মিরদাস কবিতায় আরও বলেন :
بالحق كل هدي السبيل هداكا
ياخاتم النباء انك مرسل ان الاله بني عليك محبة في خلقه ومحمداسماك
جندبعثت عليهم الضحاكا
ثم الذين وفوا بما عاهدتهم رجلا به ذرب السلاح كانه لما تكنفه العدو براکا يفشی ذوي النسب القريب وانما يبغى رضا الرحمن ثم رضاکا
تحت العجاجة يدمغ الاشراكا
انبئك اني قد رأيت مكره
بفري الجماجم صار مافتاکا
طورا يعانق باليدين وتارة
منه الذي عاينت كان شغاكا
يغشی به هام الكماة ولوتري
يفرى الجماجم صار ما فتاكا
طورا يعانق باليدين وتارة وبنو سليم معنقون امامه ضربا وطعنا في العدو در اكا يمشون تحت لوائه وكانهم اسد العرين اردن ثم عراكا مایرتجون من القريب قرابة الا لطاعة ربهم وهواكا هذي مشاهدنا التي كانت لنا معروفة
و ولينامرلاكا
“হে সর্বশেষ নবী! আপনি সত্য সহকারে প্রেরিত! সকল সঠিক পথ আপনারই প্রদর্শিত।
আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকুলের অন্তরে আপনার প্রতি ভালবাসা প্রোথিত করেছেন এবং আপনার নাম তিনি রেখেছেন মুহাম্মাদ (প্রশংসিত)।
এরপর আপনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি যারা পূর্ণ করেছে, তারা এমন এক সেনাদল যাদের প্রতি আপনি পাঠিয়েছেন দাহ্হাককে।
সে এমন লোক- যার কাছে রয়েছে তীক্ষ্ণ যুদ্ধাস্ত্র। তাকে যখন শত্রুরা ঘিরে ফেলে, তখন সে যেন আপনাকে দেখতে পায়।
তখন সে নিজের নিকট-আত্মীয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে চায় শুধু রাহমান- আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং এরপর আপনার সন্তুষ্টি।
আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে, আমি তাকে দেখেছি রণাংগনে ধুলোবালির মধ্যে সে চক্কর দিচ্ছে ও মুশরিকদের নিধন করছে।
কখনও সে দু’হাত দিয়ে তাদের কাঁধ জাপটে ধরছে। কখনও ধারাল তলোয়ার দিয়ে আঘাত হেনে তাদের দলকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
এবং তলোয়ারের আঘাতে বীর যোদ্ধার মাথার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে। আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা যদি তুমি দেখতে। তা হলে তোমার হৃদয় জুড়িয়ে যেত।
তার সম্মুখে বনূ সুলায়ম ছিল অগ্রসরমান। শক্রর প্রতি তীর বল্লমের আঘাত হানতে হানতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল।
এরা চলছিলো তার পতাকাতলে। তারা যেন বনের সিংহ- আক্রমণ করতে উদ্যত।
তারা আপন আত্মীয়দের কাছে আত্মীয়তার আশা করে না। তারা চায় আপন প্রতিপালকের আনুগত্য ও আপনার ভালবাসা।
এই হচ্ছে আমাদের রণাংগনের দৃশ্য। এগুলোই আমাদের ঐতিহ্য। আর আমাদের অভিভাবক তো আপনারই বন্ধু ও প্রভু।
আব্বাস ইবন মিরদাস আরও বলেন :
عفا مجدل من اهله فمتالع فمطلا اريك قد خلا فالمصانع دیار لناباجمل اذ ج عيشنا رحى وصرف الدهر للحي جامع حبيبة الوت بها غربة النوى لبين فهل ماض من العيش راجع فان تبتغي الكفار غير ملومة فانی وزیر للنبی و تابع دعانا اليه خير وقد علمتهم خزيمة والمرار منهم و واسع فجئنا بالف من سليم عليهم لبوس لهم من نسبح داود رائع نبايعه بالاخشبين وانما يد الله بين الاخشبين نبایع فجسنا مع المهدي مكة عنوة باسيافنا والنقع كاب وساطع علانية والخيل يغشی متونها حميم وأن من دم الجوف ناقع ويوم حنين حين سارت هوازن البنا وضاقت بالنفوس الاضالع صبرنا مع الضحاك لايستفزنا قراع الأعادي منهم والوقائع امام رسول الله يخفق فوقنا لواء كخذروف السحابة لامع عشبة ضحاك بن سفيان معتص بسيف رسول الله الموت كانع نذود اخانا عن اخينا ولو ترى مصالا لكنا الاقربین نتابع ولكن دين الله دین محمد رضينا به فيه الهدى والشرائع اقام به بعد الضلالة أمرنا وليس لامر حمه الله دافع
“মাজদাল ও মাতালি’ জনশূন্য হয়ে গেছে। অনুরূপ মাতলা আরীক এবং মাসানি সবই বসতি শূন্য উজাড় ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
হে জামলু! আমাদের তো বাড়িঘর ছিল। স্মরণ কর, যখন আমাদের জীবন যাপন ছিল খুবই আনন্দময়। আর কালের প্রবাহ জনপদে ঐক্য গড়ে তোলে।
স্মরণ কর, হাবীব গোত্রের কথা। বিচ্ছিন্নতার জন্যে প্রবাস জীবন সেখানকার সৌন্দর্য মলিন করে দিয়েছে। অতীতের সে সুখের জীবন কি আর কখনও ফিরে আসবে?
তুমি যদি কাফিরদের দলভুক্ত হতে চাও, তাহলে তোমাকে কোন তিরস্কার করা হবে না। কিন্তু জেনে রেখ আমি নবীর সাহায্যকারী এবং তাঁর অনুসারী ।
উত্তম প্রতিনিধি দল আমাদেরকে তাদের দিকে আহ্বান করেছে, আমি তাদেরকে চিনি। তারা হল খুযায়মা, মুরারা ও ওয়াসি’।
আমরা তাদের বিরুদ্ধে বনূ সুলায়মের এক হাজার সৈন্যসহ আসলাম। তাদের পরিধানে ছিল দাউদ (আ)-এর পদ্ধতিতে তৈরি উৎকৃষ্ট বর্ম।
আমরা দুই পাহাড়ের মাঝখানে তাঁর কাছে আনুগত্যের বায়আত গ্রহণ করি। বস্তুতঃ পাহাড়দ্বয়ের মাঝে আমরা আল্লাহর হাতেই বায়আত করেছিলাম।
আমরা আমাদের তরবারি দিয়ে সহসা পিষে ফেললাম মক্কা নগরী হিদয়েত দানকারীর সাথে থেকে। আর ধুলাবালি চতুর্দিকে উৎক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হচ্ছিল।
এসব চলছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। আমাদের ঘোড়াগুলোর পিঠ ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর তাদের দেহাভ্যন্তরের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল।
হুনায়নের দিন হাওয়ানিরা যখন আমাদের দিকে ধেয়ে আসে, তখন ভয়ে আমাদের লোকদের অংগ-প্রত্যংগসমূহ শিথিল হয়ে পড়ে।
সে সময় আমরা দাহহাকের সাথে ধৈর্যের পরিচয় দিই। ফলে শত্রুর আক্রমণ ও যুদ্ধের ঘটনাবলী আমাদেরকে বিচলিত করতে পারেনি।
রাসূলুল্লাহর সামনে আমরা অটল হয়ে থাকি। আর আমাদের মাথার উপরে উজ্জ্বল পতাকা দ্রুতগামী মেঘের ন্যায় পতপত করে উড়ছিল।
পড়ন্ত বেলায় দাহ্হাক ইবন সুফিয়ান যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তলোয়ার শক্ত হাতে ধরে এগিয়ে চলছিল, তখন মৃত্যু ছিল অতি নিকটবর্তী।
এভাবে আমরা বাঁচালাম আমাদের ভাইদেরকে ভাইদের হাত থেকে। যদি আমরা সুযোগের সন্ধানী হতাম তা হলে আত্মীয়দের সাথেই থেকে যেতাম।
কিন্তু, আল্লাহর দ্বীনই তো মুহাম্মাদ (সা)-এর দীন। এ দ্বীন পেয়েই আমরা সন্তুষ্ট। এতে আছে সঠিক পথের সন্ধান ও জীবনের বিধি-বিধান।
বিভ্রান্তির পর তিনি এ দীনের সাহায্যে আমাদেরকে সঠিক পথগামী করে দিয়েছেন। আর যে বিষয়টি আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দেন তা কেউ প্রতিহত করতে পারে না।
আব্বাস নিম্নের কবিতায় আরও বলেন :
بعاقبة واستبدلت نية خلفا
تقطع باقي وصل ام مؤمل
فما صدقت فيه ولا برت الحلفا
وقد حلفت بالله لا تقطع القوى
وتحتل في البادين وجرة فالعرفا
خفافية بطن العقيق مصيفها
فقد زودت قلبي على نأيها شغقا
فان تتبع الكفار غير مؤمل
ابينا ولم نطلب سوى ربنا حلفا
وسوف ينبئها الخبير بأننا
وفينا ولم يستوفها معشر الفا
وانا مع الهادي النبي محمد
اطاعوا فما يعصون من امره حرفا
يفتيان صدق من سلیم اعزة
مصاعب زانت في طروقتها كلفا
خفاف وذكوان و عوف تخالهم
اسودا تلاقت في مراصدها غضفا
كان نسيح الشهب والبيض ملبس
وزدنا على الحي الذي معه ضعفا
بنا عز دين الله غير تنحل
عقاب ارادت بعد تحليقها خطفا
بمكة اذ جئنا كان لواءنا على شخص الابصار تحسب بينها اذا هي جالت في مراودها عزفا
لأمر رسول الله عدلا ولا صرفا
غداة وطئنا المشركين ولم نجد
لنازحمة الا التذ امر والنقفا
بمعترك لا يسمع القوم وسطه
وتقطف أعناق الكماة بها قطفا
ببيض تطير الهام عن مستقرها
وار ملة تدعو على بعسلها لهفا
فكائن تركنا من قتيل ملحب
ولله ما يبدو جميعا وما يخفي
رضا الله ننوى لارضا الناس نبتغي
“শেষ পর্যন্ত উম্মু মুআম্মালের সাথে অবশিষ্ট সম্পৰ্কটুকুও ছিন্ন হয়ে গেল। পরে সে তার ইচ্ছাও পরিবর্তন করে ফেলেছে।
অথচ সে আল্লাহর নামে শপথ করেছিল যে, সে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। সে শপথে সতোর পরিচয় দেয়নি এবং অংগীকার রক্ষা করেনি।
সে তো বনূ খুফাফের লোক। যারা গ্রীষ্মকাল কাটায় বানুল আকীকে। আর অবতরণ করে যাযাবরদের মাঝে ওজরা কুয়ো ও আরাফায়।
উম্মু মুআম্মল যদিও কাফিরদের অনুসরণ করে থাকে, তবু সে আমার হৃদয়ে সহানুভূতির আবেগ সৃষ্টি করেছে– দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও।
অচিরেই সংবাদ বাহক তাকে জানাবে যে, আমরা কুফর অস্বীকার করেছি এবং আমাদের প্রতিপালক ছাড়া কারও সাহায্য চাই না!
আমরা আছি পথ প্রদর্শক নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর সাথে। আমাদের মধ্যে আছে হাজার সৈন্য । অন্য কেউ তা পূরণ করতে পারেনি।
সাথে ছিল বনূ সুলায়মের সত্যনিষ্ঠ শক্তিশালী যুবকরা। তারা তাঁর আনুগত্য করেছে তাঁর নির্দেশের এক অক্ষরও অমান্য করেনি।
খুফাফ, যাকওয়ান ও আওফ গোত্রের লোকদের মনে হচ্ছিল যে, কঠিন দুর্যোগ তাদেরকে পযুদস্ত করে দিয়েছে। কাল মলিন হয়ে গেছে তাদের অবয়ব।
যেন রক্তিম ও শ্বেত বর্ণের পোশাক রয়েছে তাদের পরিধানে। তারা সিংহের ন্যায়। তারা তাদের ঘাটিতে সমবেত হয়েছে।
আমাদের দ্বারা আল্লাহর দীন শক্তিশালী হয়েছে- দুর্বল হয়নি। তাঁর সংগে যারা চলে আমরা তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছি।
আমরা যখন মক্কায় আসলাম, তখন আমাদের পতাকা যেন বাজপাখী । যে তার লক্ষ্য স্থির করার পর হেঁ মারার জন্যে উদ্যত।
তাকিয়ে দেখলে তোমার মনে হবে যখন তা চারপাশে ঘুরতে থাকে যেন বায়ুর শনশন শব্দ।
যে দিন প্রভাত বেলা আমরা মুশরিকদের পদতলে দলিত করি, সে দিন আমরা আল্লাহর রাসূলের নির্দেশের সামান্য ব্যতিক্রম করিনি।
সে দিন রণক্ষেত্রের মাঝে মানুষ আমাদের হাঁকডাক ও তলোয়ারের ঝনঝনানী শব্দ ব্যতীত আর কোন শব্দ শুনতে পাইনি।
শুভ্র তরবারির আঘাতে মাথার খুলি তার স্থান থেকে উড়ে যেত এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত বীর যোদ্ধার ঘাড়।
কত যে নিহতের লাশ আমরা ফেলে রেখেছি ছিন্ন ভিন্ন করে । আর কত বিধবা যে তাদের স্বামীদের জন্যে বিলাপ শুরু করেছে।
আমরা চাই আল্লাহর সন্তুষ্টি। মানুষের সন্তুষ্টি চাই না। যা প্রকাশ পায় ও যা গোপন থাকে সবই তো আল্লাহর জন্যে।
আব্বাস (রা) আরও বলেন :
ما بال عينك، فيها عائر سهر مثل الحماطة اغضی فوقها الشفر عين تاوبها من شجوها ارق فالماء يغمرهاطورا وينحدر كانه نظم در عندناظمه تقطع السلك منه فهو منتشر يابعد منزل من ترجو مودته ومن اني دونه الصمان فالحفر دع ما تقدم من عهد الشباب فقد ولى الشباب وزار الشيب والزعر واذكر بلاء سليم في مواطنها وفی سلیم لاهل الفخر مفتخسر قوم هموا نصروا الرحمن واتبعوا دين الرسول وامر الناس مشتجر لا يغرسون فسيل النخل وسطهم ولا تخاور في مشتاهم البقر الا سوابح كالعقبان مقربة في دارة حولها الاخطار والعكسر ندی خفاف و عوف في جوانبها وحی ذکوان لاميل ولا ضجر الضاربون جنود الشرك ضاحية ببطن مكة والارواح تبتسدر حتی رفعنا وقتلاهم كانهسم نخل بظاهرة البطحاء منقعر ونحن يوم حنين كان مشهدنا للدين عزا و عند الله مدخر اذ نركب الموت مخضرا بطائنة والخيل ينجاب عنها ساطع كدر تحت اللواء مع الضحاك يقدمنا كما مشى الليث في غاباته الخدر في مأزق من مجر الحرب كلكلها تكاد تأقل منه الشمس والقمر
لله ننصر من شئناو ننتصر
وقد صبرنا باوطاس اسنتنا حتى تأوب اقوام منازلهم لولا المليك ولولا نحن ماصدروا فما ترى معشرا قلوا ولا كثروا الا وقد أصبح منا فيهم اثر
“কি হলো তোমার চোখের যে যন্ত্রণা ও অনিদ্রা লেগে আছে, উপরে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আছে, গলার ব্যথার মত বিচলিত মনে হয়।
দুশ্চিন্তায় এ চোখের নানারূপ পরিবর্তন ঘটে। কখনও চোখের পানি শুকিয়ে যায়, কখনও পানিতে ভরে ওঠে, আবার কখনও পানি গড়িয়ে পড়ে।
চোখ দিয়ে পানির ফোঁটা যখন গড়িয়ে পড়ে তখন দেখলে মনে হয় এ যেন মুক্তার দানা। যে মালা গেথেছে তার হাতে সুতা ছিঁড়ে যেয়ে একের পর এক দানাগুলো ঝড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে।
ওহে দূর-দূরান্তরের বসতবাটি-তুমি যার ভালবাসা কামনা করছে এবং যে সেখানে এসেছে তার। কিন্তু সে পথের বাধা হচ্ছে সুদৃঢ় পাথর ও খানা-খন্দ।
অতীত যৌবনের কথা ভুলে যাও। সে যৌবন তো পালিয়ে গেছে আর আগমন করেছে বৃদ্ধকাল ও টাকমাথা।
তুমি বরং স্মরণ কর বিভিন্ন রণক্ষেত্রে বনূ সুলায়মের ত্যাগ-তিতীক্ষার কথা। বস্তুত বনূ-সুলায়মের সে ত্যাগের মধ্যে রয়েছে গৌরবকারীদের জন্যে গৌরবের অনেক কিছু।
তারা সেই সম্প্রদায়, যারা রাহমানের দীনের সাহায্য করেছে এবং রাসূলের দীনের অনুসরণ করেছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য লোক ছিল পরস্পর দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে লিপ্ত। তারা তাদের বাগানের মধ্যে লাগায় না খেজুরের চারা এবং তাদের আংগিনার সামনে গাভী হাম্বা রবেও ডাকে না। তবে তাদের বাড়িতে আছে বাজের ন্যায় দ্রুতগামী অশ্ব আর তার চারপাশে আছে বিপুল সংখ্যক উট ও তলোয়ার।
তাদের পাশে থাকতে আহ্বান করা হয়েছিল খুফাফ, আওফ ও নিরপেক্ষ দুর্বলচিত্ত যাকওয়ান গোত্রকে।
তারা মুশরিক বাহিনীর উপর দিবসের পূর্বাহ্নে আঘাত হানে- এই মক্কা উপত্যাকায়। তখন তাদের প্রাণগুলো দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে আমরা যুদ্ধে ক্ষান্ত হই। তাদের লাশগুলো তখন পড়েছিল উন্মুক্ত উপত্যকায় কর্তিত খেজুর গাছের ন্যায়।
হুনায়নের যুদ্ধে আমরা অংশ গ্রহণ করি। আমাদের উপস্থিতি যেন দীনের জন্যে শক্তির কারণ ছিল। আর আল্লাহর কাছে তা সঞ্চিত হয়ে আছে।
যখন আমরা মৃত্যুকে মুকাবিলা করি এক সবুজ ও কঠিন স্থানে। তখন অশ্বগুলো খুরের আঘাত করছিল, যার ফলে ধুলোবালি উৎক্ষিপ্ত হয়ে উড়ছিল ।
আমরা যুদ্ধ করছিলাম দাহ্হাকের পতাকা তলে। তিনি আমাদের সম্মুখে থেকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। যেভাবে এগিয়ে চলে সিংহ বনের মধ্যে তার আবাসস্থলের দিকে।
যুদ্ধ করছিলাম এক সংকীর্ণ ও কঠিন বিপদ সংকুল ঘাটিতে। যার প্রচণ্ডতায় মনে হচ্ছিল যেন চন্দ্র-সূর্য অস্তমিত হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আওতাসের যুদ্ধে ধৈর্য প্রদর্শন করি। আমরা বর্শা নিক্ষেপ করি আল্লাহর জন্যে। আমরা যাকে ইচ্ছা সাহায্য করি ও প্রতিশোধ নেই। অবশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোক আপন আপন বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। যদি আল্লাহ্ মালিক সাহায্যকারী না হতেন এবং আমরা যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী না হতাম, তাহলে তারা কখনও ফিরে যেত না।
এমন কোন জনগোষ্ঠী তুমি দেখবে না– সংখ্যায় তারা কম হোক বা বেশী– যাদের মধ্যে আমাদের কিছু না কিছু নিদর্শন নেই।”
আব্বাস ইবন মিরদাস আরও বলেন :
وجناء مجمرة المناسم عرمس
يايها الرجل الذى تهوي به
حقا عليك اذا اطمأن المجلس
اما اتيت على النبي فقل له
فوق التراب اذا تعد الانفس
يا خير من ركب المطی و من مش
والخيل تقدع بالكمأة وتضرس
انا وفينا بالذي عاهدتنا
جمع تظل به المخارم ترجس
از سال من افناء بهثة كلها
شهباء يقدمها الهمام الاشوس
حتی صبحنا أهل مكة فيلقا من كل اغلب من سليم فوقه بيضاء محكمة الدخال وقونس
ونخاله
اسد اذا ما يعبس
يروي القناة اذا تجاسر في الوغي
عضب يقدبه ولدن مدعس
يغشي الكتيبة معلما وبكفه
الف امد به الرسول عرندس
وعلى حنين قد وفي من جمعنا
والشمس يومئذ عليهم اشمس
كانوا امام المؤمنين دريئة
والله ليس بضائع من يحرس
نمضي ويحرسنا الاله بحفظه
رضی الاله به فنعم المحبس
ولقد حبسنا بالمناقب محبسا
كفت العدو وقيل منها يا احبسوا
وغداة اوطاس شددناشدة تدعو هوازن ب الاخوة بيننا ثدي تمد به هوازن ایبس حتی ترکنا جمعهم وكانه غير تعاقبه السباع مفرس
“হে যাত্রী! যাকে নিয়ে চলছে—সবল স্বাস্থ্যবতী শক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট উটনী।
তোমার কাছে আমার এটুকু দাবী যে, যখন তুমি নবীর কাছে পৌঁছবে, তখন মজলিস থেমে যাওয়ার পর তাকে বলবে।
“যারা উষ্ট্রে আরোহণ করে কিংবা যারা মাটির উপর দিয়ে হেঁটে চলে- {স সব মানুষের যখন হিসেব নেওয়া হয়, তখন আপনিই তাদের মধ্যে সেরা মানব।
আপনি আমাদের থেকে যে অংগীকার নিয়েছেন আমরা তা পূরণ করেছি। আর অশ্বারোহী বাহিনী বীরত্বের সাথে প্রতিহত করে ও হতাহত করে।
বুহছা গোত্রের চারদিক থেকে যখন সৈন্যগণ এসে গেল, তখন পাহাড়ের সমস্ত পথ-ঘাট ছেয়ে ফেললো এবং কাঁপিয়ে তুলোে।
যখন আমরা উষালগ্নে মক্কায় পৌঁছলাম তখন বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত এক বিশাল দলের সাথে সাক্ষাৎ হল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক নির্ভীক বীর। এ দলে ছিল সুলায়ম গোত্রের সকল বীর যোদ্ধা। তাদের পরিধানে ছিল মজবুত শ্বেত বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ।
রক্তে রঞ্জিত করে ফেললো বর্শাগুলোকে যখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো রণক্ষেত্রে। দেখলে তোমার মনে হবে- এ যেন ক্ষ্যাপা সিংহ।
গোটা বাহিনী ছিল বিশেষ চিহ্নে চিহ্নিত। তাদের হাতে ছিল তীরের ফলক ও তীক্ষ্ণ বর্শা- যা তারা ব্যবহার করতো।
হুনায়নে আমাদের সমবেত হওয়ায় হাজার সংখ্যা পূর্ণ হয়। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিরাট সাহায্য লাভ করেন।
তারা মুমিনদের সম্মুখভাগে ছিল নিরাপত্তা বিধায়ক হিসেবে। সে দিন তাদের উপরে এক সূর্য পরিণত হয় বহু সূর্যে (অস্ত্রের আভায়)।
আমরা অতিক্রম করে চলোম, আল্লাহ্ তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে আমাদের হিফাযত করেন। আল্লাহর কসম, তিনি যাকে হিফাযত করেন, সে কখনও ধ্বংস হয় না।
আমরা মানাকিবে আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করি। এতে ‘আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। কত উত্তম সে ঘাঁটি।
আওতাস যুদ্ধে প্রাতঃকালেই আমরা প্রচণ্ড আঘাত হানলাম। সে আঘাতেই শত্রুরা কাবু হয়ে গেল এবং তাদের পক্ষ থেকে বলা হল– যুদ্ধ বন্ধ কর, ক্ষান্ত হও।
হওয়াযিনগণ আমাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের দোহাই দিল। বস্তুত দুরে শুকিয়ে যাওয়া ওলান ধরেই হাওয়াযিনরা টানাটানি করছে।
অবশেষে আমরা তাদের দলবলকে পরিত্যাগ করলা । তখন তাদের অবস্থা এমন মনে হল যেন, তারা এমন একটা কাফিলা যাদেরকে হিংস্র বুনো জানোয়ার তাড়া করে ফিরছে।”
আব্বাস ইবন মিরদাস কবিতায় আরও বলেন :
رسول الا له راشد حيث يمما فاصبح قد وفي اليه وانعما
من مباغ الاقوام ان محه مدا دعا ربه و استنصر الله ود ده
يؤم بنا امرا من الله محكما
سرینا و واعدنا قديدا محمدا
مع الفجر فتيانا وغابا مقوما
تمار وا بنا في الفجر حتى تبينوا
ورجلا
كدفاع الاتی عرمرما
على الخيل مشدودا علينا در و عنا
سليم وفيهم منهم من تسلما
فان سراة الحمي ان كنت سائلا
اطاعوا فما يعصونه ما تكلما
وجند من الأنصار لا يخذلونه
وقدمته فانه قد تقدما
فان تلك قدامرت في القوم خالدا
تصيب به في الحق من کان اظلما
بجند هداه الله انت أميره حلفت يمينابرة لمحمد فاكملتها الفا من الخيل ملجما
وحب الينا ان نكون المقدما
وقال نبي المؤمنين نقدموا
بنا الخوف الا رغبة وتحزما
وبتنابنهي المستدير ولم يكن
وحتى صبحنا الجمع اهل يلملما
اطعناك حتى أسلم الناس كلهم
ولا يطمئن الشيح حتى يسوما
يضل الحصان الابلق الورد وسطه
وكل تراه عن اخيه قد احجما
سمونا لهم ورد القطا زفة ضحى
حنينا وقد سالت دوامعه دما
الدن غدوة حتى تركنا عشية
وفارسها يهوی ور محا محطما
اذا شئت من كل رأيت طمرة
وحب اليها ان نخيب ونحرما
وقد احرزت منا هوازن سربها
“এমন কে আছে, যে সকল সম্প্রদায়কে এ সংবাদটা পৌঁছে দিবে যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল। তিনি যে দিকে যেতে চান সে দিকেই সঠিক পথে থাকেন।
তিনি তার প্রতিপালককে আহ্বান করেন এবং এক আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ্ তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে দেন ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন।
আমরা যাত্রা শুরু করলাম এবং পূর্ব নির্ধারিত কুদায়দ নামক স্থানে গিয়ে মুহাম্মাদ (সা)-এর সাথে মিলিত হলাম। তিনি আমাদেরকে নিয়ে আল্লাহর নির্দেশক্রমে এক দৃঢ় সংকল্প করেন।
ভোর বেলা আমাদেরকে দেখে প্রথমে তারা সন্দেহে পড়ে। পরিশেষে ভোর থাকতেই তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ হচ্ছে একদল যুবক ও প্রচুর লম্বা বর্শার সমারোহ।
এরা অশ্বের উপর সাওয়ার । আমাদের দেহের উপর বর্ম বাধা। আর একদল ছিল পদাতিক। সে বিশাল বাহিনী দেখতে ছিল প্রবল বন্যার ন্যায়।
তুমি যদি জিজ্ঞেস কর, তবে বলব- শ্রেষ্ঠ গোত্র হলো সুলায়ম। আর তাদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক লোকও আছে যারা নিজেদেরকে সুলায়ম বলে দাবি করে।
আনসারদের মধ্য হতে একটি বাহিনী আছে যারা তাকে বাধা দেয়নি; বরং আনুগত্য করেছে। তিনি যা বলেছেন, তারা তার অবাধ্য হয়নি কখনও।
আপনি যদি কওমের মধ্যে খালিদকে নেতা বানিয়ে থাকেন ও অগ্রগামী করে থাকেন। তা হলে সে কারণেই সে এগিয়ে গিয়েছে একটি বাহিনী নিয়ে। আল্লাহ্ তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। আপনি তার মূল পরিচালক। আপনি শাস্তি দিয়ে থাকেন তার দ্বারা ঐসব লোকদের যারা যুলুমের পথ অবলম্বন করে ।
আমি শপথ করে যে উত্তম অংগীকার করেছিলাম মুহাম্মাদ (সা)-এর কাছে, আমি তা পূর্ণ করেছি এক হাজার লাগাম বিশিষ্ট ঘোড়া দিয়ে।
মুমিনদের নবী নির্দেশ দিলেন : অগ্রসর হও! বস্তুতঃ আমাদের কালই ছিল যে, আমরা অগ্রসর হই।
আমরা রাত কাটালাম মসতাদীর কুয়োর কাছে। আমাদের ছিল না কোন ভয়-ভীতি । কিন্তু ছিল তীব্র আগ্রহ ও দৃঢ় সংকল্প।
আমরা আপনার আনুগত্য করে চলোম। অবশেষে সমুদয় লোক আত্মসমর্পণ করলো এবং প্রত্যুষে ইয়ালামলামবাসীদের উপর আমরা আক্রমণ করলাম।
দিনের বেলা বলিষ্ঠ ও সাদা-কাল গোলাপী রং এর ঘোড়াটি হারিয়ে যায় লোকের ভীড়ে।
তারপর তাকে চিহ্নিত না করা পর্যন্ত দলপতি স্বস্তিতে থাকতে পারেননি।
আমরা তাদের উপর হামলা করলাম সকালে তাড়িয়ে দেওয়া বন্য হাঁসের মত । তুমি তাদের প্রত্যেককে দেখবে যে নিজের ভাই থেকে আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছে ।
সকাল থেকে এভাবে আমরা লড়াই করতে থাকি। অবশেষে সন্ধ্যাকালে আমরা হুনায়ন ত্যাগ করি। তখন দেখা গেল সেখানকার নালাগুলো দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ।
ইচ্ছা করলে তুমি দেখতে পাবে সেখানকার সর্বত্রই পড়ে আছে লম্বা লম্বা ঘোড়া, আরও দেখবে সওয়ারীরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এবং ভাংগা বাসমূহ।
হাওয়াযিন আমাদের আক্রমণ থেকে তাদের সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। তারা চাচ্ছিল যে, আমরা ব্যর্থ হই এবং বঞ্চিত হই”।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক আব্বাস ইবন মিরদাস সুলামীর এসব কাসীদা তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার ও বিরক্তি উদ্রেক হওয়ার আশংকায় আরও কিছু কাসীদা উল্লেখ করা থেকে আমি বিরত থাকলাম। ইবন মিরদাস ছাড়া অন্যের কবিতাও তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রয়োজন পরিমাণ আমরা এখানে উল্লেখ করেছি।
তায়েফ যুদ্ধ
উরওয়া ও মূসা ইব্ন উকবা যুহরী থেকে বর্ণনা করেন : অষ্টম হিজরীর শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুনায়নের যুদ্ধ ও তায়েফ অবরোধ করেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন : ছাকীফের পলাতক সৈন্যরা তায়েফে এসে শহরের প্রবেশ দ্বারগুলো বন্ধ করে দেয় এবং যুদ্ধের জন্যে বিভিন্ন রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করে। উরওয়া ইবন মাসউদ এবং গায়লান ইব্ন সালামা হুনায়ন যুদ্ধে ও তায়েফ অবরোধে উপস্থিত ছিলেন না। তারা তখন জারাশ নগরীতে অবস্থান করছিলেন এবং দাববাবাত। মানজানীক ও দাববূর (সমরাস্ত্র বিশেষ) তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হুনায়নের যুদ্ধ শেষে তায়েফ অভিমুখে যাত্রা করেন। এ প্রসংগে কা’ব ইব্ন মালিক কবিতায় বলেন :
قضينا من تهامة كل ريب وخيبر ثم اجمعنا السيوفا نخبرها ولو نطقت لقالت قواطعهن دوسا او ثقيفا فلست لحاضن ان لم تروها بساحة دار کم منا الوفا وننتزع العروش ببطن وج وتصبح دور کم منکم خلوفا ويأتيكم لنا سرعان خيل يغادر خلفه جمعا كثيفا اذا نزلوا بساحتكم سمعتم لها مما أناخ بها رجیسفا بايديهم قواضب مرهفات يزرن المصطلين بها الحنوقا كأمثال العقائق أخلصتها قيون الهندلم تضرب كتيفا تخال جدية الابطال فيها غ داة الزحف جاديامدوفا أجدهم اليس لهم نصيح من الأقوام كان بناعریفا يخبرهم بانا قد جمعنا عتاق الخيل والنجب الطروفا وانا
قد اتيناهم بزحف يحيط بسور حصنهم صفوفا رئيسهم النبي وكان صلبا نقى القلب مصطبرا عزوفا رشيد الأمر ذا حكم وعلم وحلم لم يكن نزقا خفيفا نطيع نبينا ونطيع ربا هو الرحمن كان بنا رؤفا
الا
ونجعلكم لنا عضدا وريفا
فان تلقوا الينا السلام نقبل
ولا يك امرنا رعشا ضعيفا
وان تابوا نجاهدكم ونصبر نجالد مابقينا او تنيبوا الى الاسلام اذعانا مضيفا
أأهلكنا التلاد ام الطريفا
نجاهد لا نبالي ما لقينا
صميم الجزم منهم والحليفا
وكم من معشر البسوا علينا اتونا لا ي رون لهم كفاء فجدعنا المسامع والانوفا بكل مهند ثین صقيل نسوقهم بها سوقا عنيفا
يقوم الدین معتدلا حنيفا
الامر
الله والاسلام حتى وتنسي الات والعزى وود ونسلبها القلائد والشنوفا فامسوا قد اقروا واطمأنوا ومن لا يمتنع يقبل خصوفا
“আমরা তিহামা ও খায়বর থেকে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে আমাদের তলোয়ারগুলো সগ্রহ করে একত্রিত করলাম।
আমরা তলোয়ারগুলোকে এখতিয়ার দিই। যদি সেগুলো কথা বলতে সক্ষম হতো, তবে অবশ্যই এ কথা বলতো যে, ওরা এখন দাওস হাকীফ গোত্রকে নিধন করবে।
আমাদের মধ্য থেকে হাজার হাজার সৈন্য যদি তোমাদের বাড়ির আংগিনায় না দেখ, তবে বলছি আমি কোন মায়ের সন্তান নই।
বানে ওয়াজ্জের ঘরসমূহের ছাদ আমরা খুলে ফেলবো। ফলে তোমাদের বাড়িগুলো হয়ে যাবে মানবশূন্য।
তোমাদের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাবে আমাদের অশ্বারোহী দল। তারা তাদের পশ্চাতে ছেড়ে আসবে এক বিশাল বাহিনী।
তারা যখন অবতরণ করবে তোমাদের আংগিনায়। তখন তোমরা শুনতে পাবে সেখানে উট বসানোর শোরগোল।
তাদের হাতে রয়েছে তীক্ষ্ণ ধারাল তরবারি। সে তরবারির আঘাতপ্রাপ্ত আহত ব্যক্তিরা সাক্ষাৎ করবে মৃত্যুর সাথে, সেগুলো এমন স্বচ্ছ তলোয়ার যা তৈরী করেছে ভারতের কর্মকাররা খাঁটি ধাতব দিয়ে যার সাথে কোন তলোয়ারের তুলনা হয় না।
বীর যোদ্ধাদের বসার গদিগুলোকে যুদ্ধের দিনে মনে হবে জাফরান রং এ রঞ্জিত ।
তাদের রক্ষার জন্যে কি কেউ চেষ্টা করছে? মানুষের মধ্যে কেউ কি তাদেরকে সৎ উপদেশ দেওয়ার মত নেই? যে আমাদের সম্পর্কে ভালরূপে জানে। যে ব্যক্তি তাদেরকে এ সংবাদ দিবে যে, আমরা সমবেত করেছি অভিজাত অশ্বারোহী ও তাজি ঘোড়া।
আমরা তাদের কাছে এসেছি এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যারা তাদের দুর্গের প্রাচীর অবরোধ করবে সারিবদ্ধ হয়ে।
তাদের সেনাপতি স্বয়ং নবী করীম (সা)। তিনি অতি দৃঢ়পদ। পবিত্র-চিত্ত। ধৈর্যশীল ও সংযমী।
সঠিক সিদ্ধান্তদাতা, প্রজ্ঞাশীল, জ্ঞানী ও সহিষ্ণু। চঞ্চল ও আবেগপ্রবণ নন।
আমরা আনুগত্য করি আমাদের নবীর । আমরা আনুগত্য করি এমন প্রতিপালকের যিনি অতি দয়ালু ও আমাদের প্রতি করুণাময়।
তোমরা যদি আমাদের কাছে শান্তির প্রস্তাব দাও, তবে আমরা তা গ্রহণ করবো। আর তোমাদেরকে বানাবো আমাদের জন্যে শক্তি ও শান্তির বাহক।
আর যদি তোমরা অস্বীকার কর, তা হলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো ধৈর্যের সাথে আমাদের তৎপরতা কখনও দ্বিধাযুক্ত ও দুর্বল হবে না।
আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব যতক্ষণ বেঁচে থাকবো; অথবা তোমরা ফিরে আসবে ইসলামের দিকে আনুগত্যের সাথে ও দ্রভাবে।
আমরা যুদ্ধ করবো, কারও কোন পরোয়া করবো না, যার সাথেই মুকাবিলা হোক না কেন। স্থায়ী বাসিন্দা ও অস্থায়ী বাসিন্দা সকলকেই আমরা সমানে ধ্বংস করবো ।
কত গোত্রই তো আমাদের বিরুদ্ধে এলো– যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল দৃঢ় সংকল্পকারী। আরও এসেছিল তাদের মিত্ররা।
তারা এসেছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। তারা ধারণা করেছিল তাদের সমকক্ষ কেউ নেই। আমরা তাদের নাক-কান কেটে দিয়েছিলাম।
কেটেছিলাম ভারতীয় হালকা শানিত তরবারি দ্বারা। এর সাহায্যে আমরা তাদেরকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে নিয়ে আসি
আল্লাহর নির্দেশ পালন ও ইসলামের দিকে যাতে দীন প্রতিষ্ঠিত হয়– ভারসাম্যপূর্ণ ও একনিষ্ঠভাবে ।
আর যাতে লোকে ভুলে যায় লাত, উযযা ও উদকে এবং আমরা ছিনিয়ে নিব ওদের গলার হার ও কানের দুল।
এর ফলে মানুষ স্থিতি ফিরে পায় ও শান্তি লাভ করে। আর যারা বিরত হবে না তারা হবে অপমানিত।”
ইবন ইসহাক বলেন : কিনানা ইবন আবদ ইয়ালীল ইবন আমর ইবন উমায়র ছাকাফী উক্ত কবিতার জবাব দেয়।
আমি বলি, এ ঘটনার পর কিনানা ইব্ন আবদ ইয়ালীল ছাকীফ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করে। মূসা ইবন উকবা, আবু ইসহাক, আবু উমার ইবন আবদুল বার, ইবনুল আছীর প্রমুখ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু মাদায়িনী বলেছেন যে, কিনানা ইসলাম গ্রহণ করেনি; বরং সে রোমে চলে যায় এবং খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। তার মৃত্যুও সেখানে হয়।
فانابدار معلم لانريمها
من كان يبغينايريد قتالنا
و كانت لنا اطواؤها وكرومها فاخبرها ذو رأيها وحليمها اذا ما اتت صعر الخدود نقيمها ويعرف للحق المبين ظلومها كلون اسماء زينتها نجومها اذا جردت في غمرة لا نشيمها
وجدنا بها الآباء من قبل ماتري وقد جربتنا قبل عمرو بن عامر وقد علمت ان قالت الحق أننا نقومها حتى يلين
شريسها علينا دلاص مسن تراث محرق
ص وارم
نرفعها عن ابيض
“যে আমাদেরকে সন্ধান করে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে, তাকে বল, আমরা এমন একটি চিহ্নিত দেশে আছি- যা আমরা ত্যাগ করবো না।
আমরা এখানে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি তোমাদের দেখার পূর্বে । এখানকার পানির কুয়ো ও আংগুরের বাগানগুলো আমাদের দখলে আছে।
ইতোপূর্বে আমাদের পরীক্ষা করেছে আমর ইবন আমির গোত্র। তাদের বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোকেরা এ সংবাদ তাদেরকে জানিয়েছে।
তারা ভাল করেই জানে, যদি তারা সত্য কথা বলে- যে কোন অহংকারী দাম্ভিক লোক সামনে আসলে আমরা তাকে উচিৎ শিক্ষা দেই।
তাকে আমরা সোজা করে দেই। ফলে তার চরিত্রের মন্দ দিকগুলো নরম হয়ে যায় এবং তাদের যালিম প্রকৃতির লোকগুলো স্পষ্ট সত্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করে।
আমাদের পরিধানে আছে নরম বর্ম। এগুলো আমাদের আয়ত্তে এসেছে অগ্নি দগ্ধ মানুষের থেকে। [এখানে আমর ইবন আমিরের কথা বলা হয়েছে। সে-ই সর্ব প্রথম মানুষকে অগ্নি দগ্ধ করে। তাদের বর্ম আমাদের হস্তগত হয়।] বর্মগুলোর রং আকাশী- যে আকাশ সুশোভিত হয়েছে নক্ষত্ররাজি দ্বারা ।
এগুলো আমরা উঠিয়ে রাখি সেই সব ধারাল তরবারির সাথে যেগুলো যুদ্ধের প্রাক্কালে একবার খাপমুক্ত করা হলে আর তা খাপে ঢুকাইনা।”
ইবন ইসহাক বলেন : শাদ্দাদ ইবন আরিয় জুশামী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর তায়েফ যাত্রাকালে কবিতায় বলেন :
وكيف ينصر من هو ليس ينتصر ولم تقاتل لدى احجار ها هدر يظعن وليس بها من اهلها بشر
لا تنصروا الات ان الله مهلكها ان التي حرقت بالسد فاشتعلت أن الرسول متى ينزل بلادكم
“তোমরা লাতের সাহায্য করো না, কেননা, আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করবেন। যে নিজেকে বাঁচাতে পারে না, তাকে সাহায্য করা যায় কিভাবে?
যাকে পোড়ান হয় পাহাড়ের পাদদেশে এবং সেখান থেকে অগ্নি-শিখা উঠতে থাকে। আর তার পাথরের কাছে অনর্থক যুদ্ধও করা হয় না।
রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তোমাদের এলাকায় পৌঁছবেন, তখন লোকজন এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবে। সেখানকার কোন অধিবাসী অবশিষ্ট থাকবে না।”
ইবন ইসহাক বলেন : তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) হুনায়ন থেকে তায়েফ গমন করেন। যাওয়ার পথে তিনি নাখলাতুল ইয়ামানিয়া, কারূণ ও মালিহ্ অতিক্রম করে লিয়্যার অন্তর্গত বুহ্রাতুর রুগায় উপনীত হন। তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ও তাতে সালাত আদায় করেন।
ইবন ইসহাক বলেন : আমর ইবন শুআয়ব আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, বুহরাতুর রুগায় অবতরণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি খুনের কিসাস গ্রহণ (খুনের বদলে খুন) করেন। এটাই ছিল ইসলামের সর্ব প্রথম কিসাস। বনূ লায়ছের এক ব্যক্তি হুযায়লের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর কিসাস হিসেবে তিনি ঘাতককে হত্যা করেন। লিয়ায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে মালিক ইবন আওফের দুর্গ বিধ্বস্ত করা হয়।
ইবন ইসহাক বলেন : এরপর তিনি যীকা নামক একটি পথ দিয়ে সামনে অগ্রসর হন। এ পথে যাত্রা শুরু করে তিনি পথটির নাম জিজ্ঞেস করেন। তাঁকে জানান হয় যে, পথটির নাম যীকা। তিনি বললেন, যীকা (সংকীর্ণ) বলো না; একে বরং ইউসরা (প্রশস্ত) বলো। এরপর তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে নাখাব পৌঁছেন। সেখানে একটি কুল গাছের ছায়ায় অবতরণ করেন। গাছটিকে সাদিরা বলা হতো। এর পাশেই ছিল ছাকীফ গোত্রের জনৈক ব্যক্তির সম্পদ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐ ব্যক্তির কাছে সংবাদ পাঠান যে, হয় তুমি আমাদের কাছে চলে এসো, না হয় তোমার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলব। সে ব্যক্তি আসতে অস্বীকার করলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন।
ইবন ইসহাক বলেন : ইসমাঈল ইবন উমাইয়ার সূত্রে– আবদুল্লাহ্ ইবন আমর থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে তায়েফের দিকে যাই, তখন পথে একটি কবরের কাছ দিয়ে আমরা অতিক্রম করছিলাম। কবরটির দিকে ইংগিত করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন এটি ছাকীফ গোত্রের পূর্ব পুরুষ আবু রিগালের কবর। সে ছিল কওমে ছামূদের লোক। সে হারম শরীফে অবস্থান করে আত্মরক্ষা করতো। যখন সে হারম থেকে রেব হয় তখন ঐ শাস্তি তার উপর পতিত হয়, যে শান্তিতে আক্রান্ত হয়েছিল তার কাওমের লোকেরা এই স্থানে। তাকে এখানেই দাফন করা হয়। এর নিদর্শন হলো- তার সাথে স্বর্ণের একটি ডালও দাফন করা হয়। কবর খুঁড়লে স্বর্ণের ডালটি পেয়ে যাবে। এ কথা শুনে সবাই এগিয়ে গেল এবং কবর থেকে পুঁতে রাখা স্বর্ণের ডালটি বের করে আনলো। আবু দাউদ এ ঘটনা ইয়াহইয়া ইবন মাঈন এর সূত্রে– মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম বায়হাকী ইয়াযীদ ইবন যুরায়’ সূত্রে– ইসমাঈল ইব্ন উমাইয়া থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) পথ অতিক্রম করে তায়েফের নিকটবর্তী এক স্থানে সৈন্যদের শিবির স্থাপন করেন। এখানে তার কয়েকজন সাথী তীরের আঘাতে নিহত হয়। কারণ, সৈন্য শিবিরটি স্থাপন করা হয়েছিল তায়েফের প্রাচীরের অতি সন্নিকটে। তাই তিনি এখান থেকে শিবির উঠিয়ে পশ্চাতে নিয়ে যান এবং তায়েফের বর্তমান মসজিদের নিকটে স্থাপন করেন। বনূ ছাকীফ ইসলাম গ্রহণের পর এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিল। আমর ইবন উমাইয়া ইবন ওহবের তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হয়। ঐতিহাসিকগণ লিখেন যে, এ মসজিদে এমন একটি স্তম্ভ ছিল যে, প্রতি দিন সকালে সূর্য উদয়ের সময় এর থেকে একটি আওয়ায় শোনা যেত। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফবাসীকে বিশ দিনের অধিক অবরোধ করে রাখেন। ইবন হিশাম বলেন, অবরোধকাল ছিল সতের দিন।
উরওয়া ও মূসা ইবন উকবা ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বন্দীদেরকে জিইররানায় রেখে যান। তাদের সংখ্যা এতো অধিক ছিল যে, মক্কার তাবু পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তায়েফের দুর্গের কাছাকাছি গিয়ে তিনি শিবির স্থাপন করেন। তের দিনেরও বেশি সময় সেখানে অবস্থান করেন। এখানে থেকেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তারাও দুর্গের ভিতর থেকে যুদ্ধ করে। দুর্গের ভিতর থেকে এক ব্যক্তি ব্যতীত কেউ বাইরে বেরিয়ে আসেনি। সে ব্যক্তি হলো যিয়াদের বৈপিত্রেয় ভাই আবূ বাকরা ইবন মাসরূহ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে মুক্ত করে দেন। দুর্গের অভ্যন্তরে অনেকেই আহত হয়। মুসলমানগণ তায়েফবাসীদের অনেক আংগুর গাছ কেটে ফেলেন- যাতে তারা ক্রোধে জ্বলতে থাকে। তখন ছাকীফ গোত্রের লোকজন এ কাজে বাধা দিয়ে বলে, সম্পদের ক্ষতি সাধন করো না। কেননা, এগুলো হয় তোমাদের অধিকারে আসবে না হয় আমাদের দখলে থাকবে। উরওয়া বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলিম বাহিনীকে নির্দেশ দেন, যেন প্রত্যেকে পাঁচটি করে খেজুর গাছ ও পাঁচটি করে আংগুর গাছ কেটে ফেলে। তিনি একজন ঘোষণাকারীকে পাঠিয়ে এই ঘোষণা জারী করেন যে, যে কেউ দুর্গ থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে আসবে- সে মুক্ত। এ ঘোষণার পর শত্রু পক্ষের কয়েক ব্যক্তি অতি কষ্টে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে পৌঁছে। তাদের মধ্যে যিয়াদ ইব্ন আবু সুফিয়ানের বৈপিত্রেয় ভাই আৰু বাকরা ইবন মাসরূহও ছিলেন । তিনি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন এবং তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখাশুনার জন্যে এক একজনকে এক একজন মুসলমানের দায়িত্বে দিয়ে দেন।
ইমাম আহমদ ইয়াযীদের সূত্রে— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেনকোন গোলাম তার মুনিবের নিকট থেকে পালিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি তাকে মুক্ত করে দিতেন। তায়েফ যুদ্ধের সময় তিনি এরূপ দুজনকে মুক্ত করেন। ইমাম আহমদ আবদুল কুদদূস ইবন বকর ইব্ন খুনায়সের সূত্রে– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফবাসীকে চার দিক থেকে অবরোধ করেন। সে সময় দু’জন গোলাম রেব হয়ে তার কাছে চলে আসে। তিনি দু’জনকেই আযাদ করে দেন। তাদের একজন হচ্ছেন আবু বকর (রা)। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নীতি ছিল যে, কোন গোলাম তার কাছে চলে আসলে তাকে আযাদ করে দিতেন। ইমাম আহমদ আরও বলেন : নাসর ইবন রিআব— ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, তায়েফ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘোষণা দেন যে, কোন গোলাম আমাদের কাছে বেরিয়ে আসলে সে মুক্ত। এ ঘোষণার পর কতিপয় গোলাম তার কাছে বেরিয়ে আসে। এদের একজন আবু বকরা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন। এ হাদীছ উপরোক্ত সনদে ইমাম আহমদ একাই বর্ণনা করেছেন।
সনদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হাজ্জাজ ইবন আরতাত একজন দুর্বল রাবী। কিন্তু ইমাম আহমদ এ মতই গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে কোন গোলাম যদি যুদ্ধরত শক্রদেশ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রে। ১) চলে আসে, তবে সে মুক্ত হয়ে যাবে। বিনা শর্তে, স্বাভাবিকভাবে- এটাই শরীআতের বিধান। কিন্তু অন্যরা বলেন, এটা শর্তসাপেক্ষে ছিল, সাধারণ নির্দেশ ছিল না। তবে হাদীছটি সহীহ হলে সাধারণ নির্দেশ হওয়াই যুক্তি সংগত। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন :– যে ব্যক্তি কোন শত্রুকে হত্যা করবে সে তার ব্যবহৃত সম্পদ পাবে। ইউনুস ইবন বুকায়র মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুকাররাম ছাকাফী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফ অবরোধ করলে তাদের কতিপয় গোলাম বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট চলে আসে। তাদের একজন হলেন হারিছ ইব্ন কিলদার গোলাম আবু বকর (রা)। আর একজনের নাম মুনবায়েছ। এর পূর্ব নাম ছিল মুযতাজে (১৯১০) রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন মুনয়েছ (৭ )। বাকী দু’জনের নাম ইয়াহ্নাস ও ওয়ারদান। এরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে যখন তায়েফের একদল প্রতিনিধি এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করে, তখন তারা আবেদন জানায় যে, আমাদের যে সব গোলাম আপনার নিকট চলে এসেছে তাদেরকে ফিরিয়ে দিন। জবাবে তিনি জানান। ওদেরকে ফেরত দেওয়া যাবে না- ওরা আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাদ। তবে যে গোলামের কাছে তার মুনিবের মিরাছ পাওনা ছিল, তিনি তাকে তা ফেরত দেন।
ইমাম বুখারী বলেন : আমাদের নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবন বাশশার– আবূ উছমান থেকে যে তিনি বলেছেন, আমি সা’দ (রা) থেকে শুনেছি- যিনি আল্লাহর রাস্তায় প্রথম তীর নিক্ষেপকারী, আরও শুনেছি আবু বকর (রা) থেকে- যিনি কতিপয় লোকসহ তায়েফের প্রাচীর টপকিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসেছিলেন। তাঁরা দুজনেই বর্ণনা করেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি জেনেশুনে অন্য লোককে নিজের পিতা বলে দাবি করবে, তার উপর জান্নাত হারাম। ইমাম মুসলিম ও আসিমের সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। বুখারী বলেন : মামার আসিম আবুল আলিয়া কিংবা আবু উছমান হিশাম নাহদী থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি সা’দ (রা) ও আবু বকরা (রা)-কে নবী (সা) থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি। আসিম বলেন, আমি আবুল আলিয়া কিংবা আবু উছমান নাহদীকে বললাম, এমন দু’ব্যক্তি আপনাকে শুনিয়েছেন, যাদের উপর আপনার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ । কেননা, তাদের একজন হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে সর্ব প্রথম তীর নিক্ষেপ করেন আর অপরজন এমন, যে তায়েফ যুদ্ধে বেষ্টন-প্রাচীর ডিংগিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমনকারী তেইশজনের একজন।
ইন ইসহাক বলেন : সে সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে দুজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের একজন হলেন উম্মু সালামা। তাঁদের জন্যে তিনি দুটি তাঁবু স্থাপন করেন এবং ঐ তাঁবুদ্বয়ের মাঝখানে তিনি সালাত আদায় করতে থাকেন। তিনি তাদেরকে (তায়েফবাসীদের) অবরোধ করে রাখেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে যুদ্ধ করেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের উপর তীর নিক্ষেপ করতে থাকে । ইবন হিশাম বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের প্রতি মিনজানীক দ্বারা পাথর নিক্ষেপ করেন। আমার কাছে বিশ্বস্ত এমন এক ব্যক্তি আমাকে জানিয়েছেন যে, নবী (সা) সর্ব প্রথম ইসলামে মিনজানীক ব্যবহার করেন। এর দ্বারা তিনি তায়েফবাসীদের প্রতি পাথর বর্ষণ করেছিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন : এ দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কতিপয় সাহাবী একটি দাব্বাবায় (ট্যাংক এর ন্যায় সমরাস্ত্র) প্রবেশ করেন। তারপর তা আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে যান তায়েফের প্রাচীর বিধ্বস্ত করার জন্যে। তখন তাদের উপর গরম লৌহ শলাকা ফেলে দেওয়া হয়। ফলে তারা দাব্বাবা থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন বনূ ছাকীফ তাঁদের উপর তীর নিক্ষেপ করে। এতে কিছু সংখ্যক লোক নিহত হন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বনূ ছাকীফের আংগুরের বাগান কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। সাথে সাথে লোকজন বাগান কাটার কাজে লেগে যায়।
ইবন ইসহাক বলেন : আবু সুফিয়ান ইবন হারব ও মুগীরা ইবন শু’ব গিয়ে ছাকীফ গোত্রের সাথে আলাপ আলোচনা করার জন্যে নিরাপত্তা চাইলেন। তারা তাদেরকে নিরাপত্তা দিল। তখন এরা কুরায়শ ও বনূ কিনানার মহিলাদেরকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানায়। তারা আশংকা করছিল দুর্গ বিজয়ের পর এদেরকে বন্দী করা হবে। কিন্তু মহিলারা তাদের কাছে আসতে অস্বীকার করে। তখন আবুল আসওয়াদ ইবন মাসউদ আবু সুফিয়ান ও মুগীরাকে বললো– তোমরা যে উদ্দেশ্যে এসেছে তার চেয়ে কোন উত্তম প্রস্তাব কি আমি রাখতে পারি? শুননা, আবুল আসওয়াদের সম্পদ কোথায় আছে তোমরা জান । আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আকীক নামক যে উপত্যকায় অবতরণ করেছেন সে উপত্যকাটি বনূ আসওয়াদের সম্পদ ও তায়েফের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সমগ্র তায়িফে বনূ আসওয়াদের সম্পদের চাইতে অধিক লাভজনক বেশী জীবনোপকরণ ও অধিক বসবাস উপযোগী সম্পদ আর নেই। মুহাম্মাদ যদি তা ধ্বংস করে দেন তবে আর কখনও তা আবাদ হবে না। সুতরাং তোমরা দুজনে গিয়ে তার সাথে আলাপ কর। হয় তিনি তা নিজের জন্যে রেখে দিন; না হয় আল্লাহ ও আত্মীয়বর্গের জন্যে ছেড়ে দিন। বর্ণনাকারিগণ বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে সম্পত্তি তাদের জন্যে রেখে দেন। ওয়াকিদী তার উস্তাদগণ থেকে এরূপই বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, মিনজানীক ব্যবহারের জন্যে সালমান ফারসী পরামর্শ দেন এবং নিজ হাতে তা তৈরী করেন। কেউ বলেছেন, তিনি তা (পারস্য থেকে) সাথে করে নিয়ে আসেন এবং সেই সাথে দু’টি দাব্বাবাও আনেন।
ইমাম বায়হাকী ইবন লাহীআ সূত্রে আবুল আসওয়াদ, উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, উয়ায়না ইবন হিসৃন তায়েফ গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি তাকে এ কাজের অনুমতি দেন। কিন্তু সে তাদের কাছে এসে তাদেরকে দুর্গ অভ্যন্তরে অবিচল থাকার পরামর্শ দেয়। দীর্ঘ আলোচনা করে সে জানায় যে, তোমাদের বাগান বৃক্ষ কর্তনের সংবাদ যেন তোমাদের ঘাবড়িয়ে না দেয়। সে প্রত্যাবর্তন করার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওদেরকে কি বলেছো? উত্তরে সে বললো, “আমি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে আহ্বান করেছি, জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করেছি এবং জান্নাতের পথ অবলম্বনের জন্যে উৎসাহ দিয়েছি।” তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো তাদেরকে এই এই কথা বলেছে। তখন সে বলে উঠলো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি সত্য বলেছেন। আমি আমার কাজের জন্যে আল্লাহর কাছে ও আপনার কাছে তাওবা করছি।”
বায়হাকী বর্ণনা করেন : হাকিম– ইবন আবু নাজীহ সুলামী– আমর ইব্ন আবাসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তায়েফের দুর্গ অবরোধ করি। তখন আমি শুনতে পেলাম, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলছেন : যে ব্যক্তি একটি তীর নিয়ে পৌঁছবে সে জান্নাতে একটা মর্যাদা লাভ করবে। সে দিন আমি ষোলটি তীর নিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছলাম। আমি আরও শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি তীর নিক্ষেপ করবে সে একটি দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব পাবে। যে বৃদ্ধ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে। কিয়ামতের দিন সে বিশেষ ধরনের নূর লাভ করবে। যে ব্যক্তি কোন মুসলমান পুরুষ দাসকে আযাদ করবে, আল্লাহ্ ঐ দাসের প্রতিটি অস্থির পরিবর্তে আযাদকারীর প্রতিটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। যে মুসলিম নারী কোন মুসলিম দাসীকে মুক্ত করবে। আল্লাহ তার প্রতিটি অস্থির বিনিময়ে আযাদকারীর প্রতিটি অস্থিকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রাখবেন। আবূ দাউদ ও তিরমিযী এ হাদীছ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। নাসাঈ কাতাদা বর্ণিত এ হাদীছকে সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন।
ইমাম বুখারী হুমায়দীর সূত্রে– উম্মু সালামা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : এক সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার কাছে আসেন। তখন একজন হিজড়া আমার নিকট বসা ছিল। আমি শুনতে পেলাম, হিজড়া লোকটি আবদুল্লাহ ইব্ন আবূ উমাইয়াকে বলছে- আগামী কাল যদি আলাহ্ তোমাদেরকে তায়েফ জয় করার সামর্থ্য দেন, তা হলে তুমি অবশ্যই গায়লানের কন্যাকে তুলে নিবে। কেননা, সে (পেটে) চার ভাজসহ সামনে আসে এবং (পিঠে) আট ভাঁজসহ ফিরে যায়। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ঐসব হিজড়ারা যেন তোমাদের কাছে আর না আসে। ইব্ন উয়ায়না বলেন, ইবন জুরায়জ বলেছেন, সেই হিজড়া লোকটির নাম ছিল হীত এ ছাড়া ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিম বিভিন্ন সূত্রে হিশাম ইবন উরওয়ার পিতা থেকে অনুরূণ বর্ণনা করেছেন। তবে এর ভাষ্য এরূপ তারা মনে করতেন যে, হিজড়া ব্যক্তি যৌন বাসনা রহিত পুরুষ।’ (JJ ১০ us, ১ ) আবার কোন কোন বর্ণনায় এ কথা এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : কি ব্যাপার! ওখানে যা কিছু আছে সবই তো এ জানে। এরা যেন আর তোমাদের কাছে না আসে।” অর্থাৎ যৌন কামনা সম্পর্কে যারা জ্ঞাত হবে তারা এ আয়াতের মধ্যে শামিল হবে। যথা .
أو الطفل الذين لم يظهروا على عورات النساء *
“এবং নারীদের গোপন অংগ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত” (২৪- নূর : ৩১)।
প্রাথমিক যুগের আলেমদের পরিভাষায় ‘হিজড়া’ বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা নারীদের সাথে সঙ্গমের সামর্থ্য রাখে না। যার পুংমৈথুনে জড়িত তারা এখানে উদ্দেশ্য নয়। কেননা সে রকম হলে তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব। হাদীছ থেকে এটা প্রমাণিত। আবু বকর সিদ্দীক (আ) এরূপ হিজড়াদের হত্যা করেছেন। হিজড়ার উক্তি চারসহ আসে এবং আটসহ যায় এর অর্থ হল তার পেটের ভাজ। যখন সে সম্মুখে আসে তখন পেটের চার ভাজ দেখা যায়, আর যখন পিছনের দিকে যায় তখন পিঠের দিকে ঐ চার ভাজ প্রত্যেকটি দ্বিগুণ হয়ে আট ভাজ দেখা যায়। উল্লিখিত মহিলার নাম ছিল বাদিয়া বিন্ত গায়লান ইবন সালমা। সে ছিল ছাফি গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ইমাম বুখারী ইব্ন জুরায়জের বরাতে এই হিজড়ার নাম বলেছেন হীত। এ নামটাই সকলের নিকট প্রসিদ্ধ। কিন্তু ইউনুস ইবন ইসহাক থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তার খালা বিন্ত আমর ইবন আয়িদ এর এক গোলাম ছিল । সে ছিল হিজড়া। নাম তার মাতি’। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর গৃহে মহিলাদের কাছে সে আসা যাওয়া করতো । তার ব্যাপারে আমাদের ধারণা ছিল যে, পুরুষরা মহিলাদের যে সব (অঙ্গের) দিকে তাকায় সে সব ব্যাপারে এর কোন বুঝ ছিল না। মনে হতো এগুলোর প্রতি তার কোনই আকর্ষণ নেই। কিন্তু এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) শুনতে পেলেন যে, সে খালিদ বিন ওয়ালিদকে বলছে? হে খালিদ! রাসূলুল্লাহ্ (সা) যদি তায়েফ জয় করতে পারেন তাহলে বাদিয়া বিনত গয়লান যেন তোমাদের হাতছাড়া না হয়। কেননা, সে চার ভাজে আসে আর আট ভজে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার মুখ থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে বললেন : আরে এ দেখি এসব বুঝে। তারপরে তিনি স্বীয় সহধর্মিণীগণকে ডেকে বলে দেন- সে যেন আর তোমাদের কাছে না আসে। এরপর তার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর গৃহে আসা বন্ধ হয়ে যায়।
ইমাম বুখারী বলেন : আলী ইবন আবদুল্লাহ্– আবদুল্লাহ্ ইবন আমর সূত্রে বর্ণিত যে তিনি বলেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফ অবরোধ করেন; কিন্তু তাদের থেকে কিছুই অর্জন করতে পারেননি। তখন তিনি বললেন, আমরা ইনশাআল্লাহ্ আগামী কাল ফিরে যাব। সাহাবীগণের কাছে ফিরে যাওয়াটা খুব বেদনাদায়ক মনে হল। তারা বলে ফেললেন আমরা এভাবে ফিরে চলে যাব, তায়েফ জয় করবো না? তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “ঠিক আছে আগামী কাল সকালে তোমরা যুদ্ধ করবে।” পরের দিন সকালে যুদ্ধ করলে মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু লোক আহত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) পুনরায় বললেন : “আগামী কাল ইনশাআল্লাহ্ আমরা এখান থেকে ফিরে যাব।” এবার কথাটি সাহাবীদের কাছে খুবই মনঃপূত হলো। তাদের অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হেসে দিলেন। সুফিয়ানের কোন কোন বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হাসলেন। ইমাম মুসলিম এ হাদীছ সুফিয়ান ইবন উয়ায়না থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন । মুসলিমের আর এক বর্ণনায় আবদুল্লাহ্ ইবন উমার ইবন খাত্তাব (রা)-এর সূত্রের উল্লেখ আছে। বুখারীর বিভিন্ন সংস্করণে সূত্রের বিভিন্নতা আছে। এক মুদ্রণে আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইবন আস (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে।
ওয়াকিদী বলেন : আমার নিকট কাছির ইব্ন যায়দ ইবন ওয়ালিদ ইবন রাবাহ আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, তায়েফের অবরোধ কাল যখন পনের দিন অতিক্রম করে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) নওফল ইব্ন মুআবিয়া দুয়ালীর নিকট পরামর্শ চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে নওফল! এখানে অবস্থান আরও বৃদ্ধির ব্যাপারে তোমার মত কি? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! শৃগাল গর্তের মধ্যে আছে। আপনি অবস্থান দীর্ঘ করলে ধরা পড়বে। আর যদি পরিত্যাগ করেন, আপনার কোন ক্ষতি নেই।
ইবন ইসহাক বলেন : আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, ছাকীফ গোত্রকে অবরোধ কালে রাসূলুল্লাহ (সা) আবু বকর (রা)-কে বলেছিলেন : হে আবু বকর! আমি স্বপ্নে দেখি, মাখন ভর্তি একটি পেয়ালা আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। কিন্তু একটি মোরগ তাতে ঠোকর দেওয়ায় সবটুকু মাখন নীচে পড়ে গেছে। আবু বকর (রা) বললেন : আমার ধারণা, এদের থেকে আপনি যা পেতে আশা করেন, এ যাত্রায় তা আপনি পাবেন না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমারও তাই মনে হয়। রাবী বলেন, উছমান ইব্ন মাযউন (রা)-এর স্ত্রী খাওলা বিন্ত হাকীম সালামিয়া (রা) রাসূল (সা)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহ যদি আপনাকে বিজয় দান করেন, তা হলে আপনি আমাকে বাদিয়া বিন্ত গায়লন ইবন সালমার অলংকারগুলো কিংবা ফারিআ বিত আকীলের অলংকারগুলো প্রদান করবেন। এরা ছিল ছাকীফ গোত্রের সমস্ত মহিলাদের মধ্যে অধিক অলংকারের অধিকারিণী। জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন : হে খাওলা! ছাকীফ গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি যদি আমাকে দেওয়া না হয়? এ কথা শুনে খাওলা বের হয়ে উমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর কাছে কথাটা প্রকাশ করলেন। উমর (রা) তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! খাওলা আমার কাছে এরূপ কিছু কথা বলেছে এবং সে জানিয়েছে যে, আপনি তাকে তা বলেছেন : তিনি বললেন, আমি তা বলেছি। উমর (রা) বললেন, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি? তিনি বললেন, না । উমর (রা) বললেন, তবে কি আমি চলে যাওয়ার ঘোষণা দিব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন উমর (রা) সেখান থেকে সবকিছু গুটিয়ে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। লোকজন যখন যাত্রা শুরু করলো তখন সাঈদ ইবন উবায়দ ইবন উসায়দ ইবন আবু আমর ইবন ইলাজ উচ্চস্বরে বলে উঠলো, শুনো। এ গোত্রটি স্থায়িত্ব পেল । তখন উয়ায়না ইবন হিসন বললো, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! এরা সম্ভ্রান্ত মর্যাদাশীল সম্প্রদায়। তখন জনৈক মুসলমান উয়ায়নাকে বললো, হে উয়ায়না! আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে রক্ষা পেয়ে তুমি মুশরিকদের প্রশংসা করছো? অথচ তুমি এসেছিলে তাকে সাহায্য করতে? উয়ায়না বললো, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সাথে থেকে ছাকীফ গোত্রের বিরুদ্ধে লড়তে আসেনি; বরং আমি এ উদ্দেশ্যে এসেছিলাম যে, মুহাম্মাদ যদি তায়েফ জয় করতে পারেন তবে আমি ছাকীফ গোত্রের একটি মেয়েকে নিয়ে গিয়ে তার সাথে মিলিত হবো । হয়তো তার গর্ভে আমার একটা পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করবে। কেননা, ছাকীফ গোত্রের সন্তানরা প্রখর মেধা সম্পন্ন হয়ে থাকে।
ইন লাহী ‘আ আবুল আসওয়াদের সূত্রে উরওয়া থেকে খাওলা বিনত হাকীমের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বক্তব্য ও উমর (রা)-এর যাত্রা অনুমতি সম্পর্কিত বর্ণনার পর বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোকজনকে তাদের বাহন ঘাস খাওয়ানোর জন্যে ছেড়ে না দেওয়ার আদেশ প্রদান করেন। সকাল হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদেরকে সংগে নিয়ে যাত্রা করেন। যাত্রাকালে তিনি দুআ করেন : “হে আল্লাহ্! তুমি ওদেরকে সঠিক পথ দেখাও এবং তাদের দায় দায়িত্ব থেকে আমাদেরকে মুক্ত কর।” ইমাম তিরমিযী আবদুল্লাহ্ ইবন উছমান ইবন খায়ছামের সূত্রে আবুয যুবায়র জাবির থেকে বর্ণনা করেন যে, সাহাবীগণ আরয করেন “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ছাকীফ গোত্রের তীর আমাদেরকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে, আপনি তাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : হে আল্লাহ্! ছাকীফ গোত্রকে আপনি হিদায়ত করুন। তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান গরীব পর্যায়ের। ইউনুস, ইবন ইসহাক থেকে– আলিমদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, তায়েফবাসীদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) ত্রিশ দিন কিংবা প্রায় তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত অবরোধ করে রাখেন। তারপর অবরোধ উঠিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি যথা সময়ে মদীনা চলে আসেন। পরবর্তী রমযান মাসে তায়েফ থেকে একদল প্রতিনিধি এসে তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করে। নবম হিজরীর রমযান মাসের আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্।
তায়েফ যুদ্ধে যারা শহীদ হন
ইবন ইসহাকের বর্ণনা মতে তায়েফ যুদ্ধে যে সব মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন, নিম্নে তাদের নাম উল্লেখ করা হলঃ
০ কুরায়শ গোত্রের সাঈদ ইবন সাঈদ ইব্ন আস ইবন উমাইয়া । ০ বনূ উমায়া ইবন আসাদ ইবন গাওছের মিত্র উরফা ইবন হুবাব।
০ আবদুল্লাহ ইব্ন আবু বকর সিদ্দীক (রা) । তিনি একটি তীরবিদ্ধ হন। তারই প্রতিক্রিয়ায় মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতের পর তিনি ইনতিকাল করেন।
০ মাখযুম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবন আবূ উমাইয়া ইব্ন মুগীরা আল-মাখযুমী। এ যুদ্ধে তিনিও তীরবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
০ বনূ আদীর মিত্র আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমির ইবন রাবীআ ।
০ সাহম গোত্রের সাইব ইবন হারিছ ইবন কায়স ইবন আদী আস-সাহমী এবং তার ভাই আবদুল্লাহ্।
০ বনূ সা’দ ইব্ন লায়ছ গোত্রের জুলায়হা ইবন আবদুল্লাহ। আনসারদের মধ্য থেকে শহীদ
০ খাযরাজ গোত্রের ছাবিত ইবন জাযা’ আসলামী। ০ মাযিন গোত্রের হারিছ ইবন সাহল ইব্ন আবু সাঈসা আল-মাযিনী । ০ বনূ সাঈদার মুনযির ইবন আবদুল্লাহ্।
০ আওস গোত্রের শুধুমাত্র কায়ম ইবন ছাবিত ইবন ছা’লাবা ইবন যায়দ ইবন লাওযান ইবন মুআবিয়া।
সুতরাং তায়েফ যুদ্ধে মোট বারজন মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। তাদের মধ্যে সাতজন কুরায়শ গোত্রের চারজন আনসার সম্প্রদায়ের এবং একজন বনূ লায়ছ গোত্রের। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
ইবন ইসহাক বলেন, তায়েফের যুদ্ধ ও অবরোধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন বুজায়র ইব্ন যুহায়র ইবন আবু সুলমা হুনায়ন ও তায়েফ স্মরণে নিম্নোক্ত কবিতা বলেন :
وغداة اوطاس و يوم الأبرق
كانت علالة يوم بطن حنين
فتبددوا كالطائر المتمزق
جمعت باغواء شوازن جمعها
الا جدارهم وبطن الخندق
لم يمنعوا منا مقاماواحدا
فاستحصنوا منا بباب مغلق
ولقد تعرضنا لكيما يخرجوا ترتد جسرانا الى رجراجة شهباء تلمع بالمنايا فبلق
حصنا لظل كانه لم يخلق
ملسومة خضراء لوقذفوا بها
قدر تفرق في القياد ويلتقي
مشى الضراء على الهراس كاننا
كالنهي هبت ريحه المترقرق
في كل سابغة اذا ما استحصنت جدل تمس فضولهن نعالنا من نسج داود و آل محرق
“হুনায়ন উপত্যকায় আওতাসের সকালে ও বিদ্যুৎ চমকানোর দিনে (তায়েফ) যুদ্ধগুলো একটার পর একটা আসতে থাকে।
ভ্রষ্টতাবশতঃ হাওয়াযিন এক বিশাল বাহিনী সগ্রহ করে। কিন্তু তারা ছত্রভংগ হয়ে যায়, যেমন নীড়ভ্রষ্ট পাখীরা ছত্রভংগ হয়ে থাকে।
তারা আমাদের হাত থেকে একটা স্থানও রক্ষা করতে পারেনি, তাদের প্রাচীর ও গর্তের গহ্বর ব্যতীত।
আমরা তাদের সম্মুখে উপস্থিত হই, যাতে তারা বের হয়ে আসে। কিন্তু তারা দরজা বন্ধ করে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নেয়।
পরে তারা অনুতপ্ত হয়ে ফিরে এলো এক বিরাট বাহিনীর দিকে যারা যুদ্ধে অতি পারদর্শী, যারা অনিবার্য মৃত্যুর সাথে সাক্ষাতের ইংগিত দেয়।
সবুজ বর্ণের পোশাকে আচ্ছাদিত সে বাহিনী। তাদেরকে যদি নিক্ষেপ করা হয় কোন দুর্গের উপর, তবে দুর্গের অবস্থা এমন হয়ে যায় যেন তার অস্তিত্বই ছিল না।
তাদের চলার সতর্কতা ছিল যেমন হিংস্র বাঘের পিঠে পিপীলিকা হেঁটে চলে। দূরত্বের পরিমাণ সমান রেখে যেন তারা অগ্রসর হয় ও মিলিত হয়।
তারা ছিল মযবুত বর্মে সজ্জিত। যখন তা সুদৃঢ়ভাবে বিন্যস্ত করা হয় তখন দেখতে জলাধারের মত মনে হয়। যার উপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হলে ঢেউ খেলতে থাকে।
বর্মগুলো ভূমি পর্যন্ত ঝুলান। তার বাড়তি অংশ আমাদের জুতা স্পর্শ করে। আর এগুলো দাউদ ও মুহাররিক পরিবারের হাতে নির্মিত।
আবূ দাউদ উমার ইবন খাত্তাব আবু হাফস— আহমাস গোত্রের সাখর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাকীফ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সাখর এ সংবাদ দ শুনতে পেয়ে একদল অশ্বারোহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং তা জয় করতে পারেননি। তখন তিনি কঠিন প্রতিজ্ঞা করলেন যে, এরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ফায়সালা মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি এ দুর্গ ছেড়ে যাব না। প্রতিজ্ঞা মতে তিনি তাদের থেকে পৃথক হননি। যতক্ষণ না তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ফায়সালা মেনে নেয়। এরপর সাখর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এক পত্র লিখে জানান : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ছাকীফ গোত্রের লোকজন আপনার ফায়সালা মেনে নিয়েছে। আমি তাদেরকে নিয়ে আসছি। তারা আমার অশ্ববাহিনীতে আছে। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালাতের জামায়াতের জন্যে আদেশ দেন। সালাত শেষ করে তিনি আমাসের জন্যে দশটি দু’আ করেন। যেমন তিনি বলেন : “হে আল্লাহ্! আহমাস গোত্রের অশ্ববাহিনী ও পদাতিক বাহিনীর উপর আপনি বরকত নাযিল করুন। এরপর তিনি জনগণের সামনে আসেন এবং মুগীরা ইবন শু’বা (রা)-এর সাথে কথা বলেন। মুগীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সাখার আমার ফুফীকে বন্দী করেছে। অথচ তিনি অন্যান্য মুসলমানগণের মত ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাখারকে ডেকে বললেন : কোন সম্প্রদায় যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপত্তায় এসে যায়। সুতরাং মুগীরার ফুফীকে তার কাছে দিয়ে দাও”। তখন সাখার তাকে মুগীরার কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ সুলায়মের জলাশয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং জলাশয় থেকে পালিয়ে যায়। সাখার বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এ জলাশয়ের দায়িত্ব আমাকে ও আমার গোত্রকে দিবেন কি?” তিনি বললেন, হ্যাঁ দিলাম’। এরপর সাখার সেখানে যান। এদিকে সুলায়ম গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে। তখন তারা সাখারের কাছে এসে তাদের জলাশয় ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানায়। কিন্তু সাখার তা দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে আরয করে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা ইসলাম গ্রহণ করে সাখারের কাছে এসে আমাদের জলাশয় ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করি। কিন্তু সাখার তা দিতে অস্বীকার করে”। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “হে সাখার! কোন সম্প্রদায় যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপত্তা লাভ করে। সুতরাং তুমি তাদের জলাশয় ফিরিয়ে দাও”। সাখার বললেন : “জ্বী হ্য, হে আল্লাহর নবী! আমি তাই করবো”। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম সাখার একজন মহিলাকে ধরে আনায় ও জলাশয় আটকে রাখার কারণে লজ্জায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চেহারা মুবারকের রঙ পরিবর্তিত হয়ে লাল হয়ে গেছে। আবু দাঊদ একাই এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদে মতভেদ আছে।
আমি বলি, আল্লাহর রহস্যময় কুদরাতের দাবী ছিল । ঐ বছর তায়েফ বিজয় না হওয়া। কেননা, এ সময় তায়েফ বিজিত হলে সেখানকার অধিবাসীরা হত্যার ব্যাপকতায় বিনাশ হয়ে যেত। কারণ, ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর তায়েফে গমন করেছিলেন, তাদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং রিসালাতের দায়িত্ব পালনের পক্ষে তাঁকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।ফলে অতি ভগ্ন হৃদয়ে তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এবং কারনুছ ছায়ালিব না পৌঁছা পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেননি। এখানে পৌঁছে তিনি একখণ্ড মেঘ দেখতে পান। মেঘের মধ্যে ছিলেন জিবরাঈল (সা)। তিনি শুনতে পান, পাহাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা তাকে ডেকে বলছেন : “হে মুহাম্মাদ! আপনার প্রতিপালক আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনার কওমের লোকেরা যা কিছু বলেছে এবং যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সবই তিনি শুনেছেন। এখন আপনি যদি চান তবে আমি তাদের উপর দুটি পাহাড় দু দিক থেকে চেপে দিয়ে পিষে ফেলি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “বরং তাদের জন্য আমাকে আরও কিছু অবকাশ দিন। হতে পারে তাদের বংশে এমন লোক জন্ম নিবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে অন্য কিছুই শরীক করবে না। সুতরাং তিনি যে অবকাশ চেয়েছিলেন সেই অবকাশের দাবী ছিলো ঐ বছর তায়েফ দুর্গ বিজিত না হওয়া। কেননা, বিজিত হলে হত্যার মাধ্যমে তারা নির্মূল হয়ে যেত। বরং বিজয় বিলম্বিত হওয়াই ছিল বাঞ্ছনীয়, যাতে পরের বছর রমযান মাসে ইসলাম গ্রহণের জন্যে তারা মদীনায় আসতে পারে। কিছু পরেই এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন ও হাওয়াযিনের গনীমত বণ্টন
ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পথ অতিক্রম করতে থাকেন এবং দাহনা হয়ে জিইরানায় উপনীত হন। তার সাথে ছিলেন সাহাবীগণ ও হাওয়াযিন থেকে প্রাপ্ত বহু সংখ্যক বন্দী। ছাকীফ গোত্র থেকে ফিরে আসার সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জনৈক সাহাবী তাঁকে বললেন : “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওদের উপর অভিসম্পাত করুন” । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “হে আল্লাহ্! ছাকীফ গোত্রকে হিদায়াত করুন এবং তাদেরকে আমার নিকট এনে দিন”। রাবী বলেন, এরপর হাওয়াযিনের প্রতিনিধিদল জিইানায় এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে। তখন তাঁর নিকট হাওয়াযিনের ছয় হাজার নারী ও শিশু বন্দী ছিল এবং উট ও মেষ ছিল অসংখ্য। ইবন ইসহাক বলেন : আমার নিকট বর্ণনা করেছেন আমর ইবন শুআয়ব। অন্য রিওয়ায়তে ইউনুস ইবন বুকায়র। আমর ইবন শুআয়ব তার পিতা হতে তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুনায়ন যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিলাম। হাওয়াযিন গোত্র হতে প্রচুর সম্পদ ও বন্দী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হস্তগত হয়। তারপর হাওয়াযিনের একটি প্রতিনিধি দল জিইরূরানায় এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপরে বলে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো একই মূলের এবং একই জ্ঞাতিগোত্রের লোক। আমাদের উপর যে বিপর্যয় এসেছে তা আপনার অজানা নয়। সুতরাং আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, আল্লাহ্ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করবেন। এ সময় তাদের এক মুখপাত্র আবু সারদ যুহায়র ইবন সাদ উঠে বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই বন্দীশালায় রয়েছে আপনার ফুফু ও দুধমাতা যারা আপনাকে লালন পালন করেছে। আমরা যদি ইবন আবূ শিমার কিংবা নু’মান ইবন মুনযিরের উপর নুন নেমকের অনুগ্রহ করতাম, তারপর তাদের পক্ষ থেকে আমাদের উপর আঘাত আসতো যেমনটি আপনার পক্ষ থেকে এসেছে। তবে আমরা তাদের দয়া ও করুণার আশা করতাম। আর আপনি তো আল্লাহর রাসূল, লালিত-পালিতদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি। তারপর সে কবিতায় বললো :
فانك المرء نرجوه وننتظر ممزق شملها في دهرها غير على قلوبهم الغماء و الغمر
امنن علينا رسول الله في كرم امنن على بيضة قد عاقها قدر أبقت لنا الدهر هتافا على حزن
في العالمين اذا ما حصل البشرد
ياخير طفل و مولود ومنتجب
يا ارجح الناس حلما حين يختبر
ان لم تداركها نعماء لتنشرها
ان فوك تملؤه من محضها الدرر
امنن على نسوة قد كنت ترضعها
وان يزنيك ما تأتي و ماتذر
امنن على نسوه قد كنت ترضعها لا تجعلنا من شمالت نعامته واستبق منافانا معشر زهر انا لنشكر الاء وان كفرت وعندنا بعد هذا اليوم مدخر
“হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের উপর করুণা ও অনুগ্রহ করুন। কারণ, আপনি এমন মহান ব্যক্তি যার নিকট আমরা অনুগ্রহ পাওয়ার আশা রাখি ও তার প্রতীক্ষায় থাকি।
সেই কবিলার উপর আপনি অনুগ্রহ বর্ষণ করুন, ভাগ্য যাদেরকে বঞ্চিত করে দিয়েছে। আর কালের বিবর্তন যাদের আচ্ছাদন ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে।
কালের গতি আমাদেরকে হতাশায় চিৎকার করার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের অন্তরে দুঃখ-দুর্দশা ও হিংসা ছড়িয়ে রয়েছে।
হে বিশ্ব জাহানের সর্বোত্তম সন্তান ও মহোত্তম ব্যক্তি! কোন মানুষ আপনার ন্যায় গুণান্বিত নয়।
আপনি যদি অনুগ্রহ দ্বারা তাদের তদারকী না করেন তবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। হে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি! পরীক্ষার ক্ষেত্রে যিনি অধিক ধৈর্যশীল হিসেবে উত্তীর্ণ।
সে সব মহিলার প্রতি আপনি অনুগ্রহ করুন, যাদের দুধ আপনি পান করেছেন। তাদের খাঁটি দুধ আপনি মুখভরে তৃপ্তিসহ পান করতেন।
ঐ সূব নারীদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করুন, যাদের বুকের দুধ আপনি পান করেছিলেন। আর যখন আপনার কাছে সংকীর্ণ হয়ে আসতো যা আসতো ও যা ফিরে যেতো।
আমাদেরকে তাদের মত করে দিবেন না যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আপনার অনুগ্রহ আমাদের প্রতি অব্যাহত রাখুন। আমরা অভিজাত ও কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়।
আমরা দয়া ও অনুগ্রহ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি এবং আজকের দিনের পরেও এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের মধ্যে অব্যাহত থাকবে।”
জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : তোমাদের নিকট তোমাদের নারী ও সন্তানগণ অধিক প্রিয়,
তোমাদের সম্পদ? তারা বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সন্তান-নারী ও সম্পদের মধ্যে কোন্টি অধিক প্রিয় তা বাছাই করার ইখতিয়ার দিচ্ছেন? এর জবাবে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, “আমাদের সন্তান ও নারীরাই আমাদের নিকট অধিকতর প্রিয়”। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আমার ও বনূ আবদুল মুত্তালিবের অধিকারে যারা আছে তাদেরকে তোমাদের দিয়ে দিলাম। আর আমি যখন সবাইকে নিয়ে সালাত শেষ করবো তখন তোমরা দাঁড়িয়ে বলবে–আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাধ্যমে সকল মুসলমানের নিকট এবং সকল মুসলমানের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আমাদের নারী ও সন্তানদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার সুপারিশের আবেদন জানাচ্ছি। ঐ সময় আমি আমার অধিকারভুক্তদেরকে তোমাদের দিয়ে দিব এবং অন্যদেরকেও দেয়ার জন্যে সুপারিশ করবো”। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন যুহরের সালাত আদায় করলেন, তখন তারা দাঁড়িয়ে সেই আবেদন করলে যা তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আমার ও বনূ আবদুল মুত্তালিবের অধিকারে যারা আছে তাদেরকে তোমাদের দেওয়া হলো”। তখন মুহাজিরগণ বললেন, “আমাদের অধিকারে যারা আছে তারা তো রাসূলুল্লাহরই”। এরপর আনসারগণ জানালেন, আমাদের করায়ত্তে যারা আছে তারাও রাসূলুল্লাহর জন্যে। আক্রা ইবন হাবিস উঠে বললোঃ “আমি ও বনূ তামিম এতে একমত নই”। উয়ায়না বললো, “আমি ও বনূ ফাযারা এতে রাজি নই”। আব্বাস ইব্ন মিরদাস সুলামী বললো, আমার ও বনূ সুলায়মেরও সেই কথা। তখন বনূ সুলায়ম প্রতিবাদ করে বললো, “না, বরং আমাদের ভাগে যারা আছে তারাও রাসূলুল্লাহর জন্যে”। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আব্বাস ইবন মিরদাস বনূ সুলায়মকে বললো, “তোমরা আমাকে দুর্বল করে দিলে।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা এই বন্দীদের অংশ রেখে দিতে চাও, তাদেরকে প্রতিটি বন্দীর পরিবর্তে আগামী প্রথম যুদ্ধলব্ধ গনীমত থেকে ছয়গুণ বেশী দেওয়া হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের এসব বন্দী নারী ও শিশুদেরকে ওদের কাছে ফিরিয়ে দাও”। এরপর তিনি সাওয়ারীতে আরোহণ করে সেখান থেকে যাত্রা করেন। অন্যান্য সাথীরা তাঁর অনুসরণ করে চলেন। পিছন থেকে তারা দাবী জানাতে থাকে- ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মালগুলো আমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিন। এ কথার চাপ দিতে দিতে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে একটি বৃক্ষের কাছে নিয়ে গেল। এক পর্যায়ে তার গায়ের চাদর পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে গেল। তিনি বললেন, “ লোকেরা! তোমরা আমার চাদর ফিরিয়ে দাও। যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম! গোটা তিহামা অঞ্চলে যত বৃক্ষ আছে, সেই পরিমাণ গনীমতের মাল যদি আমার হাতে থাকে, তবে তার সবগুলোই তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিব। এ ব্যাপারে আমাকে কৃপণ, ভীত ও মিথ্যাবাদী পাবে না। এরপর তিনি একটি উটের কাছে যান এবং তার কুঁজ থেকে একটি পশম নিয়ে হাতের দু’আংগুলের মধ্যে রেখে উপরে হাত উঠিয়ে বলেন : লোকসকল! তোমাদের গনীমতের মালের মধ্যে, এমন কি এই সামান্য পশমের মধ্যেও এক পঞ্চামংশ (খুমুস) ব্যতীত আমার কোন অধিকার নেই। আর সেই খুমুসও পরে তোমাদের মধ্যেই বণ্টন হয়ে যায়। সুতরাং তোমাদের কাছে সুই-সুতা থাকলে তাও জমা দিয়ে দাও। কেননা, গনীমতের মাল খিয়ানতকারী কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনা আগুন ও কলংকের সম্মুখীন হবে”। এ কথা শুনে জনৈক আনসারী এক তোড়া পশমের সুতা হাযির করে বললো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার উটের পিঠে জখম ঢাকার গদি সেলাই করার জন্যে এটি নিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : এগুলোর মধ্যে আমার প্রাপ্য অংশ তোমাকে দিয়ে দিলাম। তখন আনসারী লোকটি বললেন, এ সামান্য বিষয়টি যখন এতই জটিল স্তরে পৌঁছে গেছে তখন এর কোন প্রয়োজন আমার নেই। এ কথা বলে তিনি হাত থেকে সুতার তোড়াটি ফেলে দিলেন। বর্ণনার এ ধারা থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) গনীমতের মাল বণ্টনের পূর্বেই হাওয়াযিনদের কাছে। তাদের বন্দীদের ফেরত দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের মতও তাই। কিন্তু মূসা ইবন উকবা ও অন্যান্যরা ভিন্ন মত পোষণ করেন।
সহীহ বুখারীতে লায়ছ এর সূত্রে– মিসওয়ার ইবন মাখরামা (রা) ও মারওয়ান ইবন হাকাম থেকে বর্ণিত যে, হাওয়াযিনের প্রতিনিধি দল ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে যখন তাদের লুণ্ঠিত মালামাল ও নারীদের ফেরত দেয়ার প্রার্থনা করে, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে যান এবং তাদেরকে বলেন : “আমার সাথে যে সব লোক আছে তাদেরকে তোমরা দেখছো। আর সত্য কথাই আমার কাছে অধিক প্রিয়। সুতরাং তোমরা দু’টির মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণ কর- হয় বন্দী, না হয় মাল। আমি তো তোমাদের জন্যে দেরী করছিলাম”। বর্ণনাকারী বলেন, তায়েফ থেকে ফিরার পথে রাসূলুল্লাহ (সা) হাওয়াযিনদের কেউ আসে কিনা, সে জন্যে দশ দিনেরও অধিক কাল অপেক্ষা করেন। অবশেষে তাদের কাছে যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের মাল ও বন্দীর যে কোন একটির বেশি ফেরত দেবেন, তখন তারা বললো, আমরা বন্দীদের ফেরত নিতে চাই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন মুসলমানদের সম্মুখে দাঁড়ালেন। প্রথমে আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “দেখ, তোমাদের ঐ সব হাওয়াযিন ভায়েরা তাওবা করে এসেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাদের বন্দীদেরকে তাদের কাছে ফেরত দিব । যার নিকট এ সিদ্ধান্ত মনঃপূত হবে সে যেন তাই করে। আর যে চাইবে আগামীতে আল্লাহ্ আমাকে প্রথম যে গনীমত দিবেন তা থেকে তাকে এর বিনিময় দেওয়া হবে, তবে সে যেন তাই করে”। উপস্থিত লোকজন বললো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা খুশীমতে আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “আমি স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারছি না কে এ সিদ্ধান্ত মেনে নিল, আর কে মেনে নিল না। তোমরা বরং তোমাদের বিজ্ঞজনদের সাথে আলোচনা করে মতামত ব্যক্ত কর। তারা আমার কাছে তোমাদের মতামত জানাবে”। তখন তারা গিয়ে তাদের বিজ্ঞজনদের সাথে বসে আলোচনা করে মতামত দিল। পরে বিজ্ঞজনেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে জানাল যে, তারা খুশীমনে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে এবং বন্দী ফেরত দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। এই হলো হাওয়াযিনদের বন্দী সম্পর্কে কথা- যা আমাদের নিকট পৌঁছেছে। ইমাম বুখারী আকরা’ ও উয়ায়নার বাধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেননি। এ বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন। কিন্তু হাদীছের নীতিমালা অনুযায়ী কোন কিছুর প্রমাণকারী হাদীছ ঐ বিষয়ে নেতিবাচক হাদীছের উপর যখন প্রাধান্য পায়, তখন যে হাদীছ প্রমাণ বা অস্বীকার কোনটিই নেই বরং নীরব, তার তো প্রশ্নই উঠে না।
ইমাম বুখারী যুহরীর সূত্রে– জুবায়র ইবন মুতইম থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিলাম। তখন লোকজন তার সাথে হুনায়ন থেকে ফিরে আসছিল। এ সময় মূর্খ বেদুঈনরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গনীমত বণ্টনের জন্যে ভীষণভাবে চাপ দিচ্ছিল। এমনকি তারা তাকে ঠেলতে ঠেলতে একটি গাছের কাছে নিয়ে যায় এবং তার চাদর টেনে নেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা আমার চাদর ফিরিয়ে দাও। আমার কাছে যদি এ কাঁটা গাছের কাঁটার সমসংখ্যক গনীমত থাকে, তবে তার সবই তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিব। এ ব্যাপারে আমাকে কৃপণ, মিথ্যুক ও ভীত কোনটাই পাবে না। এটি বুখারীর একক বর্ণনা।
ইবন ইসহাক বলেন : আবূ ওয়াজরা ইয়াযীদ ইবন উবায়দ সা’দী আমাকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আলী ইব্ন আবূ তালিব (রা)-কে একটি বাঁদী দিয়েছিলেন। তার নাম ছিল রীতা বিনত হিলাল ইবন হাইয়ান ইবন উমায়রা। তিনি উছমান ইবন আফফান (রা)-কেও একটি বাদী দেন। তার নাম যায়নাব বিন্ত হাইয়ান ইব্ন আমর ইবন হাইয়ান। এ ছাড়া তিনি হযরত উমর (রা)-কেও একটি বাদী দেন। উমর (রা) তার সে বাদীটিকে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে দান করেন। ইবন ইসহাক বলেন : নাফি আমাকে আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) থেকে জানিয়েছেন যে, তিনি বলেছেন, বাদীটিকে আমি আমার মাতুলালয় বনূ জুমাহ্ গোত্রে পাঠিয়ে দিই। উদ্দেশ্য তারা তাকে পরিপাটি ও প্রস্তুত করে রাখবে । আমি বায়তুল্লাহ্ তওয়াফ করে সেখানে যাব। আমার ইচ্ছা, যখন সেখানে যাব তখন তার সাথে মিলিত হবো। মসজিদের কাজ শেষ করে যখন আসলাম, তখন দেখি লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কি হয়েছে : তারা জানালো, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নারী ও শিশুদের ফেরত দিয়েছেন। আমি বললাম, তোমাদের সেই মেয়েটি তো জুমাহ গোত্রে রয়েছে। তোমরা গিয়ে তাকে নিয়ে নাও। তখন তারা সেখানে গিয়ে তাকে নিয়ে নেয়।
ইবন ইসহাক বলেন : উয়ায়না ইবন হিসনের ঘটনা হল, সে হাওয়াযিন গোত্রের এক বৃদ্ধা মহিলাকে করায়ত্ব করে। যখন সে তাকে করায়ত্ব করে তখন বলে, আমি তো এক বৃদ্ধাকে পেয়েছি। তবে আমার ধারণা, গোত্রের মধ্যে তার বিশেষ বংশীয় মর্যাদা রয়েছে। আশা করি তার মুক্তিপণের পরিমাণ অধিক হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন ছয়গুণ বেশি অংশ দেয়ার অংগীকারের বিনিময়ে বন্দী ফেরত দিচ্ছিলেন, তখন সে তাকে ছয়গুণের বিনিময়ে দিতে অস্বীকার করে। যুহায়র ইবন সারদ তাকে বললো, ছয়গুণ নিয়েই তাকে দিয়ে দাও। আল্লাহর কসম! এর মুখমণ্ডল কমনীয় নয়। স্তন উন্নত নয়, পেট সন্তান ধারণের যোগ্য নয়, তার স্বামী দুঃখিত নয়, দুধও পর্যাপ্ত নয়। ‘আল্লাহর কসম! তুমি এমন কোন সুন্দরী রূপসীকে পাওনি বা মধ্য বয়সী কোমল দেহের যুবতাঁকে লাভ করনি। তখন সে ছয়গুণের বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দিল।
ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিইানায় গনীমতের মাল বণ্টন করেন । তাতে প্রত্যেকে চারটি করে উট ও চল্লিশটি করে বকরী ভাগে পায়। সালমা মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুনায়ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল এমন এক ব্যক্তি আমার নিকট বলেছে যে, আল্লাহর কসম! আমি একটি উষ্ট্ৰীতে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পাশে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার পায়ে ছিল এক জোড়া মোটা জুতা। পাশে যাওয়ার সময় আমার উটনী রাসূলুল্লাহ (সা)-এব উটনীকে ধাক্কা দেয়। ফলে আমার জুতার এক পাশ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পায়ের গোছায় লেগে যায়। এতে তিনি ব্যথা পান এবং আমার পায়ে ছড়ি দিয়ে আঘাত করেন এবং বলেন, তুমি আমাকে ব্যথা দিয়েছে, আমার থেকে পেছনে সরে দাঁড়াও। তখন আমি সেখান থেকে ফিরে চলে আসি। পরের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে খোঁজ করেন। আমি ভাবলাম, গতকাল আমি তার পায়ে যে ব্যথা দিয়েছিলাম, সে জন্যেই আজ আমাকে খুঁজছেন। তাই আমি মনে আশা নিয়ে তার কাছে আসলাম। তিনি বললেন, গতকাল তুমি আমার পায়ে ব্যথা দেওয়ায় তোমার পায়ে আমি ছড়ি দিয়ে আঘাত করেছিলাম। তার বদলা দেয়ার জন্যে তোমাকে আজ ডেকে এনেছি। একটি কোড়া মারার বদলা স্বরূপ তিনি আমাকে আশিটি উট প্রদান করলেন। এ ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিনদের বন্দী ছেড়ে দিয়েছিলেন গনীমতের বণ্টন করার পর। ঘটনার আগপাছ বিবেচনা
করলে তাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক তার পিতা থেকে তার দাদার সূত্রে আমর ইবন শুআয়বের যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তার প্রেক্ষাপট থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, গনীমত বন্টনের পূর্বেই তিনি হাওয়াযিনদের নিকট বন্দী ফিরিয়ে দেন। আর সে কারণেই যখন তিনি বন্দী ফেরত দিলেন এবং সাওয়ারীতে আরোহণ করলেন তখন বেদুঈনরা তার পিছনে লেগে গেল এবং বলতে থাকলো আমাদেরকে গনীমতের মাল বণ্টন করে দিন। তারা তাকে এক বাবলা গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরলো এমন কি তার গায়ের চাদরও টেনে নেওয়া হলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : “লোকেরা, তোমরা আমার চাদরটি ফিরিয়ে দাও”। যার হাতে আমার জীবন তার কসম! তোমাদের গনীমতের পরিমাণ যদি এই কাঁটা গাছের কাঁটার সম সংখ্যকও হয় তবু সবগুলোই তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দিব। এ ব্যাপারে তোমরা আমাকে কৃপণ, ভীত বা মিথ্যুক পাবে না”। ইমাম বুখারী জুবায়র ইবন মুতইম থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অবস্থা দৃষ্টে তাদের মনে যেন এই সন্দেহ জাগছিলো যে, হাওয়াযিনদের বন্দীগুলোকে যেভাবে ছেড়ে দেওয়া হল, সেভাবে মালামালও তাদেরকে ফেরত দিয়ে দিবেন। সে কারণেই তারা গনীমত বণ্টন করার দাবী জানাচ্ছিল।
অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিইরানা নামক জায়গায় আল্লাহর নির্দেশমত গনীমতের মাল বণ্টন করেন। তবে গনীমত বণ্টনে তিনি কতিপয় লোককে কিছুটা অগ্রাধিকার দেন। বিভিন্ন গোত্রের সর্দার ও নেতৃস্থানীয় লোককে কিছু বেশী প্রদান করেন। এভাবে বণ্টন করায় কিছু সংখ্যক আনসারী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথে কথা বলেন এবং এরূপ করার মধ্যে তাঁর কি গূঢ় উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তা ব্যক্ত করেন। মূলতঃ ঐসব সর্দারদের অন্তর আকৃষ্ট করার জন্যেই তিনি এরূপ করেছিলেন। কিছু সংখ্যক মূর্খ লোক এবং যুল-খুওয়ায়সারা সহ কতিপয় অভিশপ্ত খাওয়ারিজ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এ কাজের কঠোর সমালোচনা করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে আসবে। হাদীছের মধ্যেও এর বিশদ বিবরণ রয়েছে।
ইমাম আহমদ বলেন : আরিম-মু’তামির ইবন সুলায়মান– তার পিতা– সুমায়ত সাদূসী সূত্রে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমরা মক্কা বিজয় করি, তারপর হুনায়নের যুদ্ধে যাই। সেখানে মুশরিকরা অতি উত্তম ব্যুহ রচনা করে। দেখলাম, তারা প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যুহ দাঁড় করিয়েছে, তার পিছনে রেখেছে পদাতিক বাহিনী, তারপরে রেখেছে মহিলাদের বহ। এরপরে মেষ ও সবশেষে রেখেছে উটের পাল। আনাস (রা) বলেন, আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক, ছয় হাজার সৈন্য। আমাদের দক্ষিণ বাহুতে ছিল খালিদ ইবন ওয়ালিদের অশ্ব বাহিনী। এক পর্যায়ে আমাদের অশ্ব বাহিনী আমাদের পশ্চাতে এসে আশ্রয় নিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অশ্ব বাহিনী স্থান ত্যাগ করলো এবং অনেক পরিচিত লোকসহ বেদুঈনরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) উচ্চ আওয়াজে আহ্বান করলেন, “হে মুহাজিরগণ! হে মুহাজিরগণ! হে আনসার সম্প্রদায়! আনাস (রা) বলেন, এটা তার চাচা কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ। তিনি বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা উপস্থিত! তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্মুখ পানে অগ্রসর হলেন। আল্লাহর কসম! আমরা শত্রুদের সম্মুখে না আসতেই আল্লাহ্ তাদেরকে পরাজিত করেন। আনাস (রা) বলেন, আমরা তখন গনীমতের এ মাল হস্তগত করি। এরপর আমরা তায়েফ যাই। চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবরোধ করে রাখি। তারপরে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করি। সেখানে অবতরণের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) গনীমত বণ্টন করেন। কাউকে একশ উট দেন, কাউকে দেন দুইশ। এ দেখে আনসারগণ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন যে, যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদেরকে তিনি দিচ্ছেন। আর যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি তাদেরকে দিচ্ছেন না। এ কথা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন তিনি মুহাজির ও আনসারদের নেতৃস্থানীয় লোকদের তাঁর কাছে আসার জন্যে হুকুম দেন। তারপরে বলেন, এখন আমার কাছে আমার আনসারগণ (অথবা বলেছেন আনসারগণ) ব্যতীত কেউ যেন না আসে। আনাস (রা) বলেন : আমরা একটি তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করি। আমাদের দ্বারা তাঁবু পরিপূর্ণ হয়ে যায় । নবী করীম (সা) তখন বললেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! (কিংবা যে শব্দে তিনি বলেছেন) আমার কাছে কী সংবাদ এলো”। আনসারগণ জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কাছে কী সংবাদ এসেছে? তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাছে এ কী সংবাদ এলো? তারা বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কী সংবাদ এসেছে আপনার কাছে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যান্য লোকেরা মাল সম্পদ নিয়ে যাবে, আর তোমরা যাবে আল্লাহর রাসূলকে সাথে নিয়ে এবং তাকে তোমাদের গৃহে প্রবেশ করাবে? আনসারগণ বললো, “আমরা তাতেই রাযী আছি- ইয়া রাসূলাল্লাহ্!” আনাস (রা) বলেন, রাসূলের কথায় তারা সন্তুষ্ট হয়ে যান। কিংবা তিনি যে রকম বলেছেন)। ইমাম মুসলিমও এ হাদীছ মু’তামির ইবন সুলায়মান থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে এ হাদীছের মধ্যে কিছু অপরিচিত ( 2) দিক আছে। যেমন এ হাদীছে বলা হয়েছে যে, হাওয়াযিনের যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছয় হাজার ছিল। অথচ সে দিন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বার হাজার। এ হাদীছে তায়িফের অবরোধকাল চল্লিশ দিনের বলা হয়েছে। অথচ তায়িফের অবরোধ কাল ছিল প্রায় এক মাস বরং বিশ দিনের কম।
ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ হিশাম– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হাওয়াযিন যুদ্ধে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যে পরিমাণ গনীমত দিতে ইচ্ছা করেছিলেন তা প্রদান করেন। তিনি তা থেকে কতিপয় লোককে একশ’ করে উট দিতে লাগলেন। এ অবস্থায় আনসারদের কতিপয় লোক বলছিলেন, আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে ক্ষমা করুন। তিনি কুরায়শদেরকে গনীমত দিচ্ছেন এবং আমাদের বাদ দিচ্ছেন; অথচ আমাদের তরবারি থেকে এখনও ওদের রক্ত ঝরছে। আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, আনসারদের এ আলোচনার বিষয়টা রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে জানান হয়। তিনি তখন আনসারদের কাছে খবর পাঠিয়ে তাদেরকে একটি চামড়ার তাঁবুতে সমবেত করলেন। তাঁদের সাথে অন্য কাউকে ডাকেননি। সবাই জমায়েত হলে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্য থেকে এ কী কথা আমার কাছে এসে পৌঁছেছে?” জবাবে আনসারদের বিজ্ঞজনেরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কেউ কিছু বলেনি। তবে আমাদের মধ্যে অল্প বয়সী কিছু লোক বলেছে”। আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে ক্ষমা করুন। তিনি কুরায়শদের দিচ্ছেন আর আমাদের বাদ রাখছেন। অথচ তাদের রক্ত এখনও আমাদের তলোয়ার থেকে ঝরছে”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “সদ্য কুফরী ত্যাগ করে আসা কিছু লোককে আমি অবশ্যই দিয়েছি। এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য, তাদের অন্তরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে রাখা। তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যান্য লোকজন যেখানে ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরে যাবে। সেখানে তোমরা তোমাদের বাড়িতে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে যাবে? আল্লাহর কসম! তোমরা যে জিনিস সংগে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে তা ঐ জিনিস অপেক্ষা অধিক উত্তম, যা সংগে নিয়ে এরা প্রত্যাবর্তন করবে”। আনসারগণ বলে উঠলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা সন্তুষ্ট আছি”। নবী করীম (সা) তাদেরকে বললেন, “অচিরেই তোমরা দেখতে পাবে, লোকজন স্বজনপ্রীতিকে প্রাধান্য দিবে। তখন তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে। শেষ পর্যন্ত তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সংগে মিলিত হবে। আমি সে দিন হাওজে কাওছারের পাশে থাকবো”। আনাস (রা) বলেন, কিন্তু আনসারগণ সে বিপর্যয়কালে ধৈর্য রক্ষা করতে পারেননি। এই সূত্রে বুখারী একাই এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম, ইব্ন আওফ– হিশাম ইবুন যায়দ– তার দাদা আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন যুদ্ধে হাওয়াযিন গোত্রের সাথে মুকাবিলা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাহিনীতে ছিল দশ হাজার মুসলমান এবং মক্কা বিজয়ের সময় সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত ‘তুলাকাগণ’ (মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ)। যুদ্ধের প্রচণ্ডতার সময় ‘তুলাকা’রা পিছটান দিয়ে ভেগে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) হে আনসার সম্প্রদায়’ বলে আহ্বান করেন। আনসারগণ জবাব দিলেন, হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা হাযির আছি এবং আপনার সামনেই আছি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সওয়ারী থেকে অবতরণ করে বলতে থাকেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। অবশেষে মুশরিকদের পরাজয় ঘটে। যুদ্ধ অবসানের পর তিনি মুহাজির ও তুলাকাদের মধ্যে গনীমতের সমস্ত মাল বণ্টন করে দেন। আনসারদের কিছুই দিলেন না। আনসাররা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে বলাবলি করতে থাকেন। তখন তিনি তাদেরকে একটি তাঁবুতে জমায়েত করে বলেন : তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যান্য লোকেরা উট ও বকরী নিয়ে ফিরে যাবে, আর তোমরা ফিরবে আল্লাহর রাসূলকে সংগে নিয়ে? তারা বললেন, জ্বী হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই এতে সন্তুষ্ট। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : সমস্ত লোক যদি একটা উপত্যকা দিয়ে যায়। আর আনসাররা যায় একটি গিরিপথ দিয়ে, তাহলে আমি অবশ্যই আনসারদের গিরিপথ দিয়ে যাব।
বুখারীর বর্ণনায় এ সূত্রে আর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, হুনায়ন যুদ্ধের দিন হওয়াযিন, গাতফান ইত্যাদি গোত্রসমূহ তাদের চতুষ্পদ গৃহপালিত জীব-জন্তু ও স্ত্রী-সন্তানসহ হাযির হয়। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সংগে ছিল দশ হাজার সৈন্য ও তুলাকা’-নও মুসলিমগণ। যুদ্ধ শুরু হলে তুলাকারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছ থেকে পালিয়ে যায়। তিনি একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন। সে দিন তিনি পরপর দুবার আহ্বান জানান। প্রথমে ডান দিকে ফিরে আহ্বান করেন, হে মুহাজির সম্পদ্রায়! তারা জবাব দিলেন, “আমরা হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ! সুসংবাদ নিন আমরা আপনার সাথেই আছি”। তারপরে তিনি বাম দিকে ফিরে আহ্বান করেন, “হে আনসার সম্প্রদায় । তারা জবাবে বললো, আমরা হাযির, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সুসংবাদ নিন, আমরা আপনার সাথে হাযির আছি”। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাদা রং এর খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন। তিনি সওয়ারী থেকে অবতরণ করে বলতে লাগলেন, “আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল” । অবশেষে মুশরিকরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে প্রচুর গনীমত সংগৃহীত হয়। তিনি সমুদয় গনীমত মুহাজির ও ‘তুলকা’দের মধ্যে বণ্টন করে দেন। আনসারগণকে এর থেকে কিছুই প্রদান করেননি। তা দেখে কতিপয় আনসারী বলাবলি করলেন, যখন সংকট দেখা দেয় তখন তো আমাদের ডাকা হয়; আর গনীমতের ভাগ দেওয়া হয়। এ কথাটি রাসূলুল্লাহ্ (সা) পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি তখন আনসারদেরকে একটি তাবুতে সমবেত করে বললেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! এ কী কথা আমার কাছে পৌঁছলো?” কথা শুনে আনসারগণ সবাই নীরব থাকেন। এরপর তিনি বললেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্য লোকেরা পার্থিব সামগ্রী সাথে নিয়ে চলে যাবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে সংগে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাবে”? তারা বললেন, “জ্বী, হ্যাঁ আমরা তাতেই সন্তুষ্ট”। তিনি আরও বললেন : “অন্যান্য সব লোক যদি একটি উপত্যকা দিয়ে যায়, আর আনসারগণ একটি গিরিপথ দিয়ে যায়, তবে আমি আনসারদের গিরিপথ দিয়েই যাব”। রাবী হিশাম বলেন, আমি আবূ হামযাকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি ঐ সময় তথায় উপস্থিত ছিলেন”? আবু হামযা বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে দূরে কোথায় থাকতাম”? বুখারী ও মুসলিম উভয়েই শু’বা কাতাদা আনাস সূত্রে আরও বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আনসারদেরকে একত্রিত করে বলেছিলেন : কুরায়শরা অতি সম্প্রতি জাহিলী ধর্ম ত্যাগ করে এসেছে এবং তারা বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্থ। আমি চেয়েছি এ দুর্দশা লাঘব করতে ও তাদের মন জয় করতে। তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যরা দুনিয়া নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে আর তোমরা তোমাদের বাড়িতে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে”? তারা বললেন, “জ্বী, হ্যাঁ, আমর সন্তুষ্ট আছি “। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “অন্য সব লোক যদি একটা উপত্যকা দিয়ে যায়, আর আনসাররা যদি কোন গিরিপথ দিয়ে চলে, তবে আমি আনসারদের গিরিপথ দিয়েই যাব”। বুখারী ও মুসলিম এ হাদীছ শু’বা- আবুত তায়াহ্ ইয়াযীদ ইবন হুমায়দ- আনাস সূত্রেও বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনায় আছে গনীমত বন্টনের পর আনসাররা বলাবলি করছিলো যে, আল্লাহর কসম! এটা অতি বিস্ময়কর বিষয় যে, আমাদের তরবারি এখনও যাদের রক্তে রঞ্জিত, তাদেরকেই দেয়া হচ্ছে গনীমত? এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সাথে কথা বলেন- যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আহমদ বলেন : আফফান— আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আবু সুফিয়ান, উয়ায়না, আকরা, সুহায়ল ইবন আমরকে হুনায়ন দিবসে অন্যান্যদের সাথে গনীমত প্রদান করেন। এ দেখে আনসারগণ বলাবলি করছিলো- হে আল্লাহর রাসূল! ওদের রক্ত এখনও আমাদের তরবারি থেকে ঝরে পড়ছে, অথচ তারাই দেখছি গনীমত নিয়ে যাচ্ছে? এ কথা নবী (সা) পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন তিনি আনসারদেরকে একটি তাঁবুতে একত্রিত করেন। তাদের উপস্থিতিতে তাঁবু কানায় কানায় ভরে যায়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কি তোমরা ব্যতীত অন্য কেউ আছে? তারা জানালেন, অন্য কেউ নেই, তবে আমাদের ভাগ্নেরা আছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “কোন কাওমের ভাগ্নেরা সে কওমেরই অন্তর্ভুক্ত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি এই এই কথা বলেছে”? তারা বললেন “জ্বী হ্যাঁ বলেছি”। তিনি বললেন : “ তোমরা হচ্ছে আমার সেই প্রতীকতুল্য পোশাক যা দেহের সাথে সরাসরি মিশে থাকে। আর অন্যান্য লোক হচ্ছে সেই পোশাকের ন্যায়, যা আলগাভাবে দেহের উপরে ঝুলান থাকে ll Lil ull} : তোমরা কি সন্তুষ্ট নও যে, অন্যান্য লোকজন উট বকরী সাথে নিয়ে যাবে। আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে সাথে নিয়ে তোমাদের বাড়ীতে যাবে?” তারা বললেন, “জ্বী হাঁ, অবশ্যই আমরা সন্তুষ্ট” । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “তোমরা আমার পরিবারভুক্ত ও নিরাপদ স্থান। সব লোক যদি উপত্যকা দিয়ে চলে, আর আনসাররা যদি গিরিপথ দিয়ে যায়, তা হলে আমি আনসারদের গিরিপথ দিয়েই যাব। “হিজরত না হলে আমি একজন আনসারীই হতাম”। রাবী বলেন, হাম্মাদ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একশটি করে উট প্রদান করেন। যাদেরকে দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। উল্লিখিত সূত্রে এ হাদীছ ইমাম আহমদ একাই বর্ণনা করেছেন। তবে এটা মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী উত্তীর্ণ। ইমাম আহমদ বলেন : ইব্ন আবূ আদী হুমায়দ- আনাস সূত্রে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদের নিকট এমন অবস্থায় আসিনি, যখন তোমরা ছিলে পথভ্রষ্ট । তারপরে আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, আমি কি তোমাদের নিকট এমন অবস্থায় আসিনি, যখন তোমরা ছিলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এরপর আল্লাহ্ আমার দ্বারা তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন : আমি কি তোমাদের নিকট এমন অবস্থায় আসিনি, যখন তোমরা ছিলে একে অপরের শত্রু। এরপর আল্লাহ তোমাদের মধ্যে আন্তরিক সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি ঠিকই বলেছেন”। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেন এ কথা বলছে না যে, আপনি ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় আমাদের কাছে এসেছিলেন, আমরা আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। আপনি বিতাড়িত হয়ে এসেছেন, আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। আপনি অসহায় অবস্থায় এসেছিলেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি”? জবাবে তারা বললেন, “বরং আমাদের উপরই রয়েছে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুকম্পা ও অনুগ্রহ। এ হাদীছের সনদ ছুলাহ (মাত্র তিনজন বর্ণনাকারী) এবং বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। সুতরাং আনাস ইবন মালিক (রা) বর্ণিত এ হাদীছটি মুতাওয়াতির হাদীছের মর্যাদার সমতুল্য। অন্যান্য সাহাবী থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী বলেন : মূসা ইব্ন ইসমাঈল– আবদুল্লাহ্ ইবন যায়দ ইবন আসিম সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, হুনায়ন দিবসে আল্লাহ যখন তাঁর রাসূল (সা)-কে গনীমত দান করেন, তখন তিনি ইসলামের দিকে মন আকৃষ্ট করার জন্যে মানুষের মধ্যে তা বণ্টন করে দেন। এ মাল থেকে আনসারদের কিছুই দেননি। অন্য লোকদের যা দিয়েছেন আনসারদের তা না দেয়ায় যেন তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট পাইনি? যারপরে আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা কি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলে না? যারপরে আল্লাহ আমার সাহায্যে তোমাদের মধ্যে ঐক্য দান করেছেন। তোমরা কি আর্থিক সংকটে ছিলে না? যারপরে আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে স্বচ্ছলতা প্রদান করেছেন। তারা জবাবে বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক ইহসানকারী”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “ইচ্ছা করলে তোমরা বলতে পারো আপনি আমাদের কাছে এই এই অবস্থায় এসেছিলেন। তবে তোমরা কি সন্তুষ্ট নও যে, অন্য লোকেরা বকরী ও উট সাথে নিয়ে যাবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে সাথে করে তোমাদের বাড়িতে যাবে?
যদি হিজরাত অবধারিত না থাকতো, তা হলে আমি অবশ্যই একজন আনসারী লোক হয়ে থাকতাম। অন্যান্য লোকজন যদি কোন উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়ে যায়, তবে আমি আনসারদের উপত্যকায় ও গিরিপথ দিয়েই যাবো। আনসার হচ্ছে প্রতীকতুল্য ভিতরের পোশাক; আর অন্যরা বাইরের পোশাক। আমার পরে তোমরা শীঘ্রই স্বজনপ্রীতির প্রাধান্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে। এরপর হাওজে কাওছারে আমার সাথে সাক্ষাৎ হবে”। ইমাম মুসলিম এ হাদীছ আমর ইবন ইয়াহয়া মাযিনীর সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইউনুস ইবন বুকায়র বলেন : মুহাম্মাদ– ইবন ইসহাক— আবূ সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হুনায়নের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রচুর গনীমত লাভ করেন। কুরায়শ ও অন্যান্য আরব গোত্রের লোকদের মধ্যে তিনি তা বণ্টন করে দেন। তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে। আনসারদেরকে এর থেকে কিছুই দেননি- কমও না বেশীও না। এতে আনসার সম্প্রদায় মনে মনে দুঃখিত হয়। এমন কি তাদের একজন বলে ফেললেন, “আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন”। সাদ ইবন উবাদা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আনসার সম্প্রদায় আপনার উপর মনক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি কারণে তারা দুঃখ পেয়েছে। সা’দ (রা) বললেন, “গনীমত বণ্টনে, আপনি আপনার কওম ও সকল আরব গোত্রকে দিয়েছেন; কিছু তা থেকে আনসারদের কিছুই দেননি”। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এ ব্যাপারে তোমার অবস্থা কি, হে সা’দ? সা’দ বললেন, আমি তো আমার কাওমেরই একজন।” তিনি বললেন, “তোমার কওমকে এই বেষ্টনীর মধ্যে একত্রিত কর এবং সবাই আসার পর আমাকে সংবাদ দিও” । সা’দ (রা) বেরিয়ে গিয়ে আনসারদের মধ্যে আওয়াজ দিলেন, এবং সেই ঘেরের মধ্যে তাদেরকে একত্রিত করলো । একজন মুহাজির এসে অনুমতি চাইলে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। এরপর অন্যান্য আরও কিছু লোক আসলে সা’দ (রা) তাদেরকে ফেরত দেন। যখন আনসারদের সমস্ত লোক এসে গেলেন- কেউ অবশিষ্ট থাকলেন না, তখন সা’দ (রা) এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আনসার সম্প্রদায়ের সবাই এই স্থানে এসে জমায়েত হয়েছে, যে স্থানের কথা আপনি বলেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বের হলেন এবং তাঁদের মধ্যে এসে ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালেন । প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং তার উপযুক্ত গুণগান করলেন। তারপর বললেন : “হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসিনি, যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? তারপর আল্লাহ্ তোমাদেরকে সঠিক পথ দান করেন। তোমরা কি অভাব অনটনে ছিলে না? পরে আল্লাহ্ তোমাদেরকে সচ্ছল করেছেন। তোমরা কি পরস্পর শত্রু ছিলে? আল্লাহ তোমাদের অন্তরে মমতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাঁরা বললেন, “জ্বী হ্যাঁ অবশ্যই তাই”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে আনসারগণ! তোমরা জবাব দিচ্ছ না কেন? আনসারগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি বলবো? কি জবাব দিব? সমস্ত ইহসান ও অনুগ্রহ তো আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের”! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “আল্লাহর কসম! তোমরা ইচ্ছা করলে বলতে পার, আর যদি তা বলো তবে সত্যই বলা হবে এবং যুক্তিগ্রাহ্য হবে। সে কথা এই যে, আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন বিতাড়িত হয়ে। আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। আপনি এসেছিলেন গরীব অবস্থায়। আমরা আপনাকে আর্থিক সহযোগিতা করেছি। আপনি ছিলেন ভীতিগ্রস্ত। আমরা আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। আপনি ছিলেন অসহায়। আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি”। জবাবে আনারগণ বললেন, “সব ইহসান ও অনুগ্রহ ও তাঁর রাসূলেরই”। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “হে আনসারগণ! তোমরা দুনিয়ার সামান্য জিনিসের জন্যে মনে দুঃখ পেয়েছে, যে জিনিস দিয়ে আমি এমন কিছু লোকের মন আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি। যারা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে। আর তোমাদেরকে ইসলামের সেই মহা অংশের উপর রেখে দিয়েছি যা আল্লাহ তোমাদের জন্যে বণ্টন করেছেন। হে আনসারগণ! তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যান্য লোকেরা তাদের বাড়িতে যাবে বকরী এবং উট নিয়ে, আর তোমরা তোমাদের বাড়িতে যাবে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে। যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার কসম! সমস্ত লোক যদি একটা গিরিপথ দিয়ে চলে, আর আনসাররা ভিন্ন আর এক গিরিপিথ দিয়ে যায়, তবে আমি আনসারদের গিরিপথ দিয়েই যাবো। যদি হিজরত করা অবধারিত না হতো, তাহলে আমি অবশ্যই আনসারদের একজন হয়ে থাকতাম। হে আল্লাহ্! আনসারদের প্রতি আপনি রহম করুন! তাদের সন্তান এবং সন্তানের সন্তানদের প্রতিও আপনি দয়া করুন”। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কথা শুনার পর আনসারগণ এমনভাবে কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে যায়। এ অবস্থায় তারা বলতে থাকলেন, “আমাদের প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহর উপর আমরা সন্তুষ্ট। রাসূলুল্লাহ্ (সা) গনীমত যেভাবে বণ্টন করেছেন তাতে আমরা রাযী-খুশী” । এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেখান থেকে চলে আসেন, আনসাররাও ছড়িয়ে পড়ে। ইমাম আহমাদও এ হাদীছ ইবন ইসহাক থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীছ গ্রন্থকারগণের কেউই উক্ত সূত্রে এটা বর্ণনা করেননি। অবশ্য এটির সনদ সহীহ । ইমাম আহমদ এ হাদীছ ইয়াহইয়া ইবন বুকায়র– আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আনসারদের এক ব্যক্তি তার সাথীদেরকে বললেন : “শুনো, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের নিকট জানাচ্ছি যে, সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে, তবে জেনে রেখো, তিনি তোমাদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দিয়েছেন। রাবী বলেন, সাথীরা তার কথাকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু এ কথা রাসূলুল্লাহ্ (সা) পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি তখন তাঁদের কাছে আসেন এবং এমন কিছু কথা বলেন যা আমার স্মরণ নেই। তারা জবাবে বললেন, “হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমরা ঘোড়ার উপর সওয়ার হতে পারতে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে যে কথাই বলতেন, তারা জবাবে বলতেন, “জ্বী হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এরপর গ্রন্থকার হাদীছের অবশিষ্ট অংশ উল্লেখ করেছেন। যেভাবে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। এই সনদেও ইমাম আহমদ একাই বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ এ হাদীছ আমাশ আবু সালিহ্ আবু সাঈদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি মূসা ইবন উকবা ইবন লাহীয়া আবুয যুবায়র জাবির (রা) সূত্রে এ হাদীছ সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন।
সুফিয়ান ইবন উয়ায়না– রাফি’ ইবন খাদীজ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুনায়নের বন্দীদের মধ্য হতে যাদের মন আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে উট দান করেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে দেন একশ’ উট। সাফওয়ান ইবন উমাইয়াকে দেন একশ’ উট। উয়ায়না ইবন হিসূনকে দেন একশ’টি । আকরা’ ইবন হাবিসকে দেন একশ’টি। আলকামা ইবন ‘আলাছাকে দেন একশ’টি। মালিক ইব্ন আওফকে দেন একশ’টি। কিন্তু, আব্বাস ইবন মিরদাসকে দেন একশ’র কম। পাওয়ার ক্ষেত্রে সে উপরোক্তদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তাই সে কবিতায় বললো :
اتجعل نهبی و تهب العب يد بين عيينة والاقرع
ولا حابس يغو قان مرداس في المجمع
فما كان حصن وما كنت دون امرء منها ومن تخفض اليوم لا يرجع
فلم اعط شيئا ولم امنع
وقد كنت في الحرب ذاتدرا
আমার অংশ ও উবায়দ (কবির অশ্বের নাম)-এর অংশ কি আপনি উয়ায়না ও আকরাকে দিচ্ছেন।
কিন্তু জেনে রাখুন, তাদের পিতা হিসন ও হাবিস কোন মজলিসে আমার পিতা মিরদাসের উপরে সম্মান পেত না।
আমি নিজেও ওদের দু’জনের নীচের লোক নই। কিন্তু আজ যাকে নীচে নামানো হচ্ছে সে আর উপরে উঠতে পারবে না।
যুদ্ধক্ষেত্রে তো আমিই ছিলাম হিফাযতকারী। কিন্তু আমাকে তেমন কিছুই দেওয়া হলো না, আবার বঞ্চিতও রাখা হলো না।”
বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে একশ’টি পূর্ণ করে দেন। ইমাম মুসলিম এ হাদীছ ইবন উয়ায়নার সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত কবিতা বায়হাকী থেকে নেওয়া। হয়েছে । কিন্তু মূসা ইব্ন উকবা, উরওয়া ইবন যুবায়র ও ইবন ইসহাক এর বর্ণনায় নিম্নোক্ত কবিতা উল্লেখ করা হয়েছে :
بكري على المهر في الاجرع
كانت
نها باتلافيتها وايقاظي الحي ان يرقدوا اذا هجع الناس لم اهجع فاصبح نهبی ونهب العب يد بين عيينة والاقرع
فلم أعظ شيئا ولم أمنع
وقد كنت في الحرب ذا تدری الا أفایل اعطيتها عديد قوائمها الاربع وما كان حصن ولا حابس يفوقان مرداس في المجمع وما كنت دون امرء منها ومن تضع اليوم لا يرفع
“এই লুণ্ঠিত গনীমত তো উপার্জন করেছি আমি মরুভূমিতে ঘোড়ায় চড়ে আক্রমণ করে।
আমি জাগ্রত থাকার কারণে কবিলার লোক ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। অন্যান্য লোক যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখনও আমি ঘুমাই না।
এই ত্যাগের বদলায় বুঝি আমার হিস্যা ও আমার অশ্ব উবায়দের হিস্যা উয়ায়না ও আকরা’র মাঝে ভাগ হয়ে গেল?
আমি ছিলাম যুদ্ধের ময়দানে হিফাযতকারী সে কারণে আমাকে তেমন কিছু দেওয়াও হয়নি। আবার বঞ্চিত ও রাখা হয়নি।
আমি পেয়েছি কতগুলো দুর্বল জন্তু যেগুলোর পা চতুষ্টয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র।
অথচ উয়ায়নার পিতা হিসৃন এবং আকরার পিতা হাবিস কোন মজলিসেই আমার পিতা মিরদাসের উপর অধিক মর্যাদা পেত না।
আর আমি নিজেও ওদের দুজনের থেকে নীচে নই। তবে আজ; যাকে নীচে নামিয়ে দেওয়া হবে সে আর কখনও উপরে উঠবে না।
উরওয়া ও মূসা ইবন উকবা যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এ কবিতার কথা পৌঁছলে তিনি আব্বাস ইবন মিরদাসকে বললেন : তুমিই কি বলেছো?
اصبح نهبی ونهب العبيد بین الاقرع و عيينة
“আমার হিস্যসা ও উবায়দের হিস্যসা বণ্টন হয়ে গেছে আকরা’ ও উয়ায়নার মাঝে”?
আবু বকর (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সে কবিতাটা এভাবে বলেনি। কিন্তু আল্লাহর কসম! আপনি তো আর কবি নন। আর কবি হওয়া আপনার জন্যে শোভনীয়ও নয়”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে সে কিভাবে বলেছে”? তখন আবু বকর (রা) কবিতাটি যথাযথ ভাবে পড়লেন (অর্থাৎ? ) । ৭ ৫ ) রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : উভয়টি তো একই। দুজনের যার নামই আগে বলা হোক তাতে ক্ষতি কি? তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা দিলেন, “আমার পক্ষ থেকে তোমরা ওর জিহ্বা কেটে দাও”। এতে কিছু লোক ঘাবড়ে গেল যে, তাকে না বিকলাঙ্গ (মুছলা) করা হয়। বস্তুতঃ নবী করীম (সা) তাকে আরও কিছু দান করে কবিতা বন্ধ রাখার উদ্দেশ্যেই এ কথা বলেছিলেন। আর উবায়দ হচ্ছে কবির ঘোড়ার নাম।
ইমাম বুখারী মুহাম্মাদ ইবন আলা– আবূ মূসা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি নবী করীম (সা)-এর কাছে ছিলাম। তিনি মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে জিইরানা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তার সাথে ছিলেন বিলাল (রা)। এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট দিয়ে এক বেদুঈন এসে বললো, “আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণ করবেন না”? তিনি তাকে বললেন, “সুসংবাদ গ্রহণ কর”। সে বললো, “এরূপ সুসংবাদ গ্রহণের কথা তো আপনি আমাকে অনেক বারই শুনিয়েছেন। নবী করীম (সা) তখন রাগতভাবে আবু মূসা ও বিলালের দিকে ফিরে বললেন, “সে তো সুসংবাদ প্রত্যাখ্যান করলো, এখন তোমরা দুজনে তা গ্রহণ কর”। এরপর তিনি পানি ভর্তি একটি পেয়ালা আনতে বলেন। পেয়ালা আনা হলে তিনি তাতে হাত-মুখ ধৌত করেন ও কুলি করে তাতে ফেলেন। তারপর বললেন, “তোমরা এ থেকে পান কর ও বুকে-মুখে ছিটিয়ে দাও এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর”। তাঁরা পেয়ালা হাতে নিয়ে নির্দেশ মত কাজ সম্পন্ন করলেন। এ সময় পর্দার আড়ালে থেকে উম্মে সালামা (রা) বললেন : “তোমাদের মায়ের জন্যে কিছু রেখে দিও”। তখন তারা তার জন্যে কিছু রেখে দিলেন।
ইমাম বুখারী বলেন : ইয়াহয়া ইবন বুকায়র– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হেঁটে চলছিলাম। তার গায়ে ছিল শক্ত পাড় বিশিষ্ট একটা নাজরানী চাদর। এ সময় এক বেদুঈন তাঁর কাছে এলো। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাদর ধরে জোরে টানতে লাগলো। এক পর্যায়ে আমি দেখি, জোরে টেনে নেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাঁধের চামড়ায় চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে গেছে। বেদুঈন বলছিলো, “আপনার কাছে আল্লাহর দেওয়া যে মাল আছে তা থেকে আমাকে কিছু দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দিন”। রাসূলুল্লাহ (সা) বেদুঈনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন এবং তাকে কিছু দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দিলেন।
হুনায়ন যুদ্ধের গনীমত থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যাদেরকে একশ’ করে উট দিয়েছিলেন, ইবন ইসহাক তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হলো : আবু সুফিয়ান সাখার ইবন হারব, তার পুত্র মুআবিয়া, হাকীম ইবন হিযাম, বনূ আবদুদ দার গোত্রের হারিছ ইবন কালদা, বনূ যোহরার মিত্র আলকামা ইবন আলাছা ছাকাফী, হারিছ ইবন হিশাম, জুবায়র ইবন মুঈম, মালিক ইব্ন আওফ নাসরী, সুহায়ল ইব্ন আমর, হুআয়তাব ইবন আবদুল উয্যা, উয়াযনা ইবন হিসন, সাফওয়ান ইব্ন উমাইয়া ও আকরা ইব্ন হাবিস।
ইবন ইসহাক বলেন : আমার কাছে মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন হারিছ তায়মী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জনৈক সাহাবী তাঁকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উয়ায়না ও আকরা’কে একশ’ একশ’ করে দিয়েছেন। অথচ জুআয়ল ইবন সুরাকা জামরীকে কিছুই তো দেননি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “দেখ, যার হাতে মুহাম্মদের জীবন তার কসস! জুআয়ল ইবুন সুরাকা ভূ-পৃষ্ঠের উপর বসবাসকারী সকলের চাইতে একজন উত্তম লোক। উয়ায়না ও আকরার মতই। কিন্তু আমি এ দু’জনের মন আকৃষ্ট করতে চেয়েছি- যাতে এরা ইসলাম কবুল করে। আর জুআয়ল ইবন সুরাকার ইসলাম গ্রহণের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এরপর ইবন ইসহাক সেসব লোকের নামও উল্লেখ করেছেন যাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) একশ’ থেকে কম দিয়েছেন। কিন্তু সে তালিকা অনেক দীর্ঘ।
সহীহ হাদীছে সাফওয়ান ইবন উমাইয়া থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেছেন, “হুনায়নের গনীমত থেকে আমাকে কিছু দান করার পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছিলেন আমার নিকট সবচাইতে ঘৃণ্য। কিন্তু দান গ্রহণের পর থেকে আল্লাহর সৃষ্টি জগতে তার চাইতে অধিকতর প্রিয় আমার কাছে আর কেউ নেই”।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট মালিক ইবন আওফ নাসরীর আগমন
ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) হাওয়াযিন প্রতিনিধিদের নিকট জিজ্ঞেস করেন যে, মালিক ইবন আওফ কি করছে? তারা জানায় যে, সে তায়েফে ছাকীফ গোত্রের সাথে আছে । তিনি বললেন : তাকে সংবাদ দাও। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে আমার কাছে আসে তবে তার পরিবারবর্গ ও সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দিব এবং অতিরিক্ত একশত উটও দিব। এ সংবাদ পেয়ে সে ছাকীফ গোত্র থেকে দ্রুত বের হয়ে জিইররানায় বা মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে তার পরিবারবর্গ ও সম্পদ ফিরিয়ে দেন। এরপর যখন তাঁকে একশটি উট দেওয়া হয় তখন তিনি কবিতায় বলেন :
ما ان رأيت ولا سمعت بمثله في الناس كلهم بمثل محمد
ومتى تشأ يخبرك عما في غد
او في واعطى لجزيل اذا اجتدی واذا الكتيبة عردت انيابها بالسمهري وضرب كل مهند فكانه ليث على اشباله وسط الهباءة خادر في مرصد
“আমি তার মত কাউকে দেখিওনি শুনিওনি সমগ্র মানবের মাঝে মুহাম্মদের সদৃশ অন্য কেউ নেই।
কেউ যখন অনুগ্রহ প্রার্থনা করে তখন তিনি তাকে পরিপূর্ণভাবে বিরাট অংকের সামগ্রী দান করে থাকেন। তুমি যখন চাইবে তিনি তখন তোমাকে আগামীতে যা ঘটবে তা বলে দিবেন।
যখন সৈন্যদল দাপটের সাথে প্রদর্শন করে তেজি উটের উপর থেকে তাদের বর্শা এবং হিন্দুস্তানের লোহার তৈরি তরবারি।
তখন তিনি সিংহের ভূমিকায় চলে আসেন, যে তার শাবকদের রক্ষার্থে গর্তের মুখে ঘাঁটিতে অবিচলিত থেকে অবস্থান করে।”
ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে তার কওম থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের উপর শাসক বানিয়ে দেন। সেই সাথে ছুমালা সালমা ও ফাহম গোত্রকেও তার অধীন করে দেন। এদেরকে সাথে নিয়ে তিনি ছাকীফ গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। তাদের কোন কাফেলা বের হলেই তাদের উপর হামলা করতেন। এতে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠে।
ইমাম বুখারী বলেন : মূসা ইবন ইসমাঈল– আমর ইবন তাগলিব থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এক দলকে গনীমত দেন, আর এক দলকে দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এতে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। তখন তিনি বললেন, “আমি এমন এক দলকে দিয়েছি যাদের ক্ষুধা ও বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে আমি আশংকা বোধ করেছি। আর এমন এক কওমের উপর আমি আস্থা স্থাপন করেছি যাদের অন্তরে আল্লাহ্ কল্যাণ রেখেছেন এবং যারা মহানুভব । এ কওমেরই একজন আমর ইবন তাগলিব”। আমর বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার জন্যে যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তার বিনিময়ে বিপুল প্রাচুর্যও আমার কাছে প্রিয় নয়। আবু আসিম জাবির হাসান- আমর ইবন তাগলিব সূত্রে অতিরিক্ত বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাল অথবা বন্দী নিয়ে আসেন। তারপর তিনি এভাবে তা বণ্টন করে দেন। বুখারীর এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মালামাল নিয়ে আসেন; কিংবা জিনিসপত্র নিয়ে আসেন। এরপর কিছু লোককে তা দিলেন এবং কিছু লোককে বাদ রাখলেন। যাদেরকে বাদ রাখলেন, তাদের সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন যে, তাঁরা তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান প্রকাশ করেন। তারপর উপরোক্ত বর্ণনার মত কথা বলেন। বুখারী একাই এ হাদীস উক্ত সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
ইবন হিশাম বলেন, আনসারদেরকে গনীমত থেকে বঞ্চিত করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কবি হাস্সান ইবন ছাবিত বলেন :
(در الهموم فما العين منحدر کسحا اذا حفلته غبرة درر) وجدابشماء أن أسماء بهكنة هيفاء لا ذنن فيها ولا خور
نزرا وشر وصال الواصل النزر
دع عنك شماء إذ كانت مودتها
للمؤمنين ان ماعدد البشر
وانت الرسول وقل ياخد مؤتمن علام تدعی سلیسم و هی نازحة قدام قوم هموا أووا وهم نصروا
دين الهدی و عوان الحرب تستعر
سماهم الله انصارا بنصرهم وسار عوا في سبيل الله واعترضوا للنائبات وما خانوا وما ضجروا
الا السيوف واطراف القناوزر
والناس إلب علينا فيك ليس لنا نجالد الناس لا نبقى على احد ولا نضيع ما توحي به السور ولا تهز جناة الحرب نادينا ونحن حين تلظى نار ها سعر
اهل النفاق وفينا ينزل الظفر
كما رددناببدر دون ما طلبوا
ان حزبست بطرا احزابها مضر
ونحن جندك يوم النعف من احد
منا عثارا وكل الناس قد عثروا
فما ونينا وما خمنا وما خبروا
“দুঃখ বেড়ে গেছে, চোখের পানি অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে। সে পানি একত্রিত করছে অশ্রু নির্গমনের পথ” ।
আমার এ দুঃখ শাম্মার জন্যে। শাম্মা তো সুঠাম দেহের অধিকারী, সরু কোমর বিশিষ্ট। তার মধ্যে নেই কোন নোংরামি, নেই কোন দুর্বলতা।
শাম্মার কথা এখন ছেড়ে দাও। কেননা, তার ভালবাসা ছিল ক্ষণিকের জন্যে। আর মিলন প্রত্যাশীর কাছে নিকৃষ্ট মিলন তো সেটাই- যা হয় ক্ষণিকের তরে।
তুমি বরং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে যাও এবং বল : হে মু’মিনদের বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল! যখন লোক গণনা করা হয়, তখন বনূ সুলায়মকে ডাকা হয় কিসের ভিত্তিতে, সেই সম্প্রদায়ের মুকাবিলায় যারা এবং একমাত্র যারাই আশ্রয় দিল ও সাহায্য করলো?
আল্লাহই তাদের নাম দিয়েছেন আনসার (সাহায্যকারী) কারণ, তারা সত্য দীনের সাহায্য করেছে এমন সময় যখন যুদ্ধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল ।
আল্লাহর পথে তারা অগ্রগামী। মুসীবত ও দুর্যোগের মুকাবিলা করেছে তারা। কখনও তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, অস্থিরতাও দেখায়নি।
আপনার ব্যাপার নিয়ে মানুষ আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন আমাদের আর কোন উপায় থাকে না তলোয়ার ও বর্শার হাতল ছাড়া।
ঝাঁপিয়ে পড়া লোকদের সাথে আমরা যুদ্ধ করি । এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দিই না। আর ওহীলব্ধ সূরা সমূহে যা আদেশ করা হয়েছে তার আমরা ব্যর্থ হতে দিই না।
যুদ্ধের অপরাধীরা আমাদের সমাবেশকে করেনা অপসন্দ। আমরা তখনই জ্বলে উঠি, যখন যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে।
যে রকম আমরা প্রতিহত করে দিয়েছিলাম বদর যুদ্ধে মুনাফিকরা যা চেয়েছিলো তা। ফলে আমাদের মধ্যেই নেমে আসে জয়ের মালা ।
আমরাই তো ছিলাম আপনার সৈনিক সেই যুদ্ধে যা সংঘটিত হয় উহুদ পর্বতের টিলার পাশে, যে দিন মুযার গোত্র গর্বভরে সগ্রহ করেছিলো সে যুদ্ধের সৈন্যগণকে।
আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়িনি, দুর্বলও হয়ে যাইনি। আমাদের থেকে কোন পদস্খলন কেউ পায়নি, যখন অন্য সব লোকের পদস্খলন ঘটেছিলো ।
ইমাম বুখারী বলেন : কুবায়সা সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন হুনায়নের গনীমত বণ্টন করে দেন, তখন আনসারদের এক ব্যক্তি বলে উঠলো, “এ বণ্টনে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখেননি”। এ কথা শুনার পর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে তাঁকে কথাটি জানালাম। তখন তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, “আল্লাহ্ মূসা (আ)-এর প্রতি রহমত করুন। তাঁকে এ থেকেও বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তিনি সবর করেছিলেন। ইমাম মুসলিমও এ হাদীছ আ’মাশ সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী আরও বলেন : কুতায়বা ইবন সাঈদ আবু ওয়াইল সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, যখন হুনায়নের দিন গনীমত বণ্টনের সময় হলো, তখন নবী (সা) কতিপয় ব্যক্তিকে কিছু বেশী দিলেন। আকরা’ ইব্ন হাবিসকে দিলেন একশ’ উট। উয়ায়নাকেও দিলেন অনুরূপ (একশ’ উট)। এভাবে আরও কিছু লোককে বেশি বেশি করে দিলেন। তখন এক ব্যক্তি বলে ফেললো, এ বণ্টনের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য করা হয়নি। রাবী বলেন, আমি বললাম, নবী করীম (সা)-কে অবশ্যই আমি এ কথা জানিয়ে দিব। (তারপর আমি তাঁকে কথাটি জানিয়ে দিলাম)। কথাটি শুনার পরে তিনি বললেন, “আল্লাহ্ মূসা (আ)-এর প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। তাঁকে এর চেয়েও অধিক কষ্ট দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন”। বুখারীর এক বর্ণনায় কথাটি এভাবে আছে যে, এক ব্যক্তি বললো, “এ বণ্টনে ন্যায়-নীতি রক্ষিত হয়নি এবং এতে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়নি”। রাবী বলেন, আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবশ্যই জানিয়ে দিব। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসলাম এবং তাঁকে সে বিষয়ে অবহিত করলাম । কথা শুনে তিনি বললেন, “আর কে ন্যায়-নীতি রক্ষা করবে। যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ন্যায়-নীতি রক্ষা না করেন : আল্লাহ্ মূসা (আ)-এর উপর সদয় হোন। তাকে এর চেয়েও অধিক কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেন।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন : আবু উবায়দা ইবন মুহাম্মাদ ইব্ন আম্মার ইবন ইয়াসির আবদুল্লাহ্ ইবন হারিছ ইবন নওফলের আযাদকৃত গোলাম মিকসাম আবুল কাসেম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি ও তালীদ ইবন কিলাব বেরিয়ে পড়লাম এবং আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রা)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি তখন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করছিলেন। তাঁর হাতে ঝুলানো ছিল তার জুতা। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হুনায়নের দিন তামীমী যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কথা বলছিলো, তখন কি আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ। বনূ তামীমের যুল খুওয়ায়সিরা নামক এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পাশে দাঁড়ায়। তিনি তখন মানুষের মধ্যে গনীমত বণ্টন করছিলেন। লোকটি বললো, “হে মুহাম্মাদ! আজ যা আপনি করেছেন, আমি তা দেখেছি।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “আচ্ছা! তা তুমি কি দেখেছো”? সে বললো, “দেখলাম, আপনি ইনসাফ মত কাজ করেননি। এ কথা শুনে তিনি ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি বললেন, “ধিক্কার তোমাকে; আমার কাছে যদি ইনসাফ না থাকে, তবে আর কার কাছে ইনসাফ থাকবে”? তখন উমর ইবন খাত্তাব (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি কি তাকে হত্যা করবো না”? তিনি বললেন, ‘ছেড়ে দাও ওকে। ভবিষ্যতে তার একটি দল হবে। যারা দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করবে। শেষ পর্যন্ত তারা দীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। যার ফলকে লক্ষ্য করলে কিছুই পাওয়া যায়না। তারপরে দণ্ডের দিকে দৃষ্টি দিলেও কিছু পাওয়া যায় না। এরপরে গোড়ার দিকে তাকালেও কিছু পাওয়া যায় না। অথচ তা গোবর ও রক্ত ভেদ করে বেরিয়ে গেছে”।
লায়ছ ইবন সা’দ ইয়াহয়া ইবন সাঈদ– জাবির ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন : একজন লোক জিইররানায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আসে। তিনি হুনায়ন থেকে সেখানে এসেছিলেন। বিলালের কাপড়ের মধ্যে ছিল রৌপ্য। রাসূলুল্লাহ (সা) সেখান থেকে তুলে নিয়ে লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছিলেন। তখন লোকটি বললো, “হে মুহাম্মাদ! ইনসাফ মত কাজ করুন”। তিনি বললেন, “তোমাকে ধিক্কার! আমি যদি ইনসাফ মত কাজ না করি তবে আর কে ইনসাফ করবে? যদি আমি ইনসাফ না করি তাহলে তো আমি ক্ষতি ও ধ্বংসের মধ্যে পতিত হবো”। তখন উমর ইবন খাত্তাব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, এ মুনাফিককে হত্যা করে দিই”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, একে হত্যা করলে লোকে বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করি। এই লোক ও তার অনুগামীরা কুরআন পাঠ করে; কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নীচে যায় না । তারা কুরআন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যায়, যেমনভাবে তীর রেব হয়ে যায় শিকার ভেদ করে”।
ইমাম মুসলিম এ হাদীছটি মুহাম্মাদ ইবন রুম থেকে লায়ছ এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন । ইমাম আহমদ বলেন : আবু আমির কুরা- আমর ইবন দীনার সূত্রে জাবির থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন হুনায়নের গনীমত বণ্টন করছিলেন, তখন এক ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ইনসাফ করুন। তিনি বললেন, ইনসাফ না করলে তো আমি দুর্ভাগা হয়ে যাবো। ইমাম বুখরী এ হাদীছ মুসলিম ইবন ইবরাহীমের সূত্রে কুররা ইব্ন খালিদ সাদুসী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ।
বুখারী ও মুসলিমে ইমাম যুহরী আবু সালমার সূত্রে আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। এ সময় বনূ তামীমের যুল-খুঅয়ায়সিরা নামক স্থানে এসে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ন্যায় বিচার করুন”। তিনি বললেন, “ওহে দুর্ভাগা! আমি যদি ন্যায় বিচার না করি, তা হলে ন্যায় বিচার করার আর কে আছে? আমি তো তখন ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব। আমি ন্যায় বিচার না করলে আর কে ন্যায় বিচার করবে?” তখন উমর ইবন খাত্তাব (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! অনুমতি দিন, আমি এর গর্দান উড়িয়ে দিই”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : “ওর ব্যাপারটি ছেড়ে দাও। ওর কিছু অনুসারী আছে। তাদের সালাত ও সিয়ামের তুলনায় তোমরা নিজেদের সালাত ও সিয়ামকে নিম্ন মানের মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করে; কিন্তু তা তাদের কণ্ঠ নালীর নীচে পৌঁছায় না। তারা ইসলামের মধ্য থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমনভাবে বের হয়ে যায় তীর শিকার ভেদ করে । কিন্তু তীরের ফলার দিকে লক্ষ্য করলে কিছুই দেখা যায় না। ফলার গোড়ার দিকে লক্ষ্য করলেও কিছু পাওয়া যায় না। কাঠির দিকে তাকালেও কিছু পাওয়া যায় না। ফলার বক্র অংশের দিকে লক্ষ্য করলেও কোন আলামত দেখা যায় না । অথচ তা শিকারের দেহের রক্ত ও গোবর ভেদ করে চলে গেছে”। এই দলের একটি লক্ষণ হলো, “তাদের এমন এক লোকের আবির্ভাব হবে যার গায়ের রং কৃষ্ণ বর্ণের। তার একটা বাহু হবে নারীর স্তনের মত কিংবা উঁচু মাংস খন্ডের মত । মাংস খণ্ডটি কাঁপতে থাকবে। আমার উম্মতের মধ্যে যখন দলাদলির সৃষ্টি হবে তখন এদের আবির্ভাব ঘটবে”। আবু সাঈদ (রা) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে আমি নিজে এ কথা শুনেছি। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আলী ইব্ন আবু তালিব (তাঁর খিলাফত কালে) এদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। সে লড়াইয়ে আমিও শরীক ছিলাম। তিনি ঐ লোকটিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। লোকজন তাকে পাওয়ার জন্যে অনুসন্ধান চালায়। পরে সে ধৃত হয়ে তার কাছে আনীত হয়। আমি ঐ ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করে দেখেছি, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে সব আলামতের কথা বলেছিলেন, সে সবই তার মধ্যে বিদ্যমান আছে। ইমাম মুসলিমও এ হাদীছটি কাসিম ইবন ফযল– আবু নাদরার সূত্রে আবু সাঈদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধ বোনের জিইররানায় আগমন
ইবন ইসহাক বলেন : সা’দ ইব্ন বকর গোত্রের এক ব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হাওয়াযিন যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা যদি সা’দ ইবন বকর গোত্রের নাজাদ নামক লোকটিকে পাও তবে সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে। এই ব্যক্তি কোন একটি ঘটনা ঘটিয়েছিল। মুসলমানগণ তাকে ধরতে সক্ষম হন। তারা তাকে তার পরিবারবর্গসহ ধরে আনেন। সেই সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুধ বোন শায়মা বিনত হারিছ ইব্ন আবদুল উযযাকেও ধরে আনেন। আনার পথে শায়মার প্রতি কিছু কঠোরতা করা হয়। শায়মা তখন মুসলমানদেরকে বলেন, “আল্লাহর কসম! জেনে রেখ, আমি কিন্তু তোমাদের সাথী (সা)-এর দুধ বোন”। তারা তার কথা বিশ্বাস করলেন না এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত করলেন। ইবন ইসহাক বলেন : আমার কাছে ইয়াযীদ ইবন উবায়দ সা’দী –অর্থাৎ আবু ওয়াজরা বর্ণনা করেছেন যে, শায়মাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট হাযির করা হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি আপনার দুধ বোন” । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার দাবির প্রমাণ কি”? শায়মা বললেন, “শিশুকালে আপনাকে কোলে রেখেছিলাম, তখন আপনি আমার পিঠে কামড় দিয়েছিলেন,সেই কামড়ের দাগ এখনও আছে”। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে আলামত দেখে শনাক্ত করলেন এবং নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দিলেন ও মুবারকবাদ জানালেন। এরপর তিনি তাকে প্রস্তাব দিলেন, “ইচ্ছা করলে তুমি আমার কাছে থাকতে পার । আমি ভালবাসা ও সোহাগ দিয়ে তোমাকে রাখবো। আর যদি নিজ গোত্রে ফিরে যেতে ইচ্ছা কর, তা হলে মাল-সামগ্রীসহ সেখানে পাঠিয়ে দিব। যেটা ইচ্ছা করতে পার”। শায়মা বললেন, “আমাকে মাল-সামগ্রীসহ আমার গোত্রে পাঠিয়ে দিন” । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রচুর মাল- সামগ্রীসহ তাকে তার গোত্রের নিকট পাঠিয়ে দেন। বনূ সা’দের লোকেরা বলে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) শায়মাকে মাকহুল নামক একজন দাস ও একজন দাসী দিয়েছিলেন। শায়মা তাদের দু’জনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দেন। ঐ গোত্রের মধ্যে এ দু’জনের বংশধারা অব্যাহতভাবে চলে আসছে। ইমাম বায়হাকী হাকাম ইবন আবদুল মালিকের সূত্রে কাতাদা থেকে বর্ণনা করেন। যেদিন হাওয়াযিন বিজয় হয়, সে দিন একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার দুধ বোন। আমি শায়মা বিনত হারিছ”। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন, “তোমার কথা যদি সত্য হয়, তা হলে তোমার সাথে আমার এমন একটা চিহ্ন আছে যা মুছে যায়নি”। এ কথা শুনার পর মহিলাটি তার বাহু উন্মুক্ত করে বললেন, “হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! শিশুকালে আপনি আমার এ বাহুতে কামড় দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন তাঁকে চাদর বিছিয়ে দেন এবং বলেন : “তুমি আবেদন জানাও । তোমাকে আবেদন অনুযায়ী দেওয়া হবে। তুমি সুপারিশ কর, যা সুপারিশ করবে তাই রক্ষা করা হবে। বায়হাকী বলেন : আবু নাসর ইবন কাতাদা– আবুত তুফায়ল থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমি ছোট ছিলাম- উটের গোশতের খন্ডিত টুকরা বহন করতাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখলাম, জিইররানায় গনীমতের উট বণ্টন করছেন। সে সময় তাঁর কাছ একজন মহিলা আসেন। তিনি তাঁর জন্যে নিজের চাদর বিছিয়ে দেন। এ অবস্থা দেখে আমি লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “এ মহিলাটি কে?” তারা বললো, ইনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুধ মা। এ হাদীছটি গরীব পর্যায়ের। হতে পারে বর্ণনাকারী মা বলে বোনকে বুঝাতে চেয়েছেন। কেননা, তিনি তার মা হালীমা সাদিয়া (রা)-এর সাথে থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে লালন পালনে সহযোগিতা করতেন। আর যদি হাদীছটি মাহফ্য (সুরক্ষিত নির্ভুল) পর্যায়ের হয়ে থাকে। অর্থাৎ মহিলাটি দুধ মা-ই হয়ে থাকেন। তবে বুঝতে হবে যে, হালীমা সাদিয়া (রা) দীর্ঘ দিন জীবিত ছিলেন। কেননা, দুধ পান করান সময় থেকে জিইরানার ঘটনা পর্যন্ত ষাট বছরের অধিক ব্যবধান রয়েছে। আর যখন তিনি দুধ পান করান তখন তার বয়স কমপক্ষে ত্রিশ বছর হয়েছিল। আল্লাহই ভাল জানেন। এরপর তিনি কত বছর জীবিত ছিলেন। এ সম্পর্কে একটি মুরসাল হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, সে দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুধ মা ও দুধ পিতা দু’জনেই তার কাছে এসেছিলেন। এটা কতটুকু সত্য আল্লাহই ভাল জানেন। আবু দাউদ তার মুরসাল বর্ণনায় আহমদ ইব্ন সাঈদ হামদানী– উমার ইবন সাইব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় তার দুধ পিতা তাঁর কাছে আসেন। তিনি তাকে নিজের কাপড়ের এক অংশ বিছিয়ে দেন। তার উপর তিনি বসলেন। এরপর তার দুধ মা-ও সেখানে এসে হাযির হন। এবার তিনি ঐ কাপড়ের অপর অংশ তার জন্যে বিছিয়ে দেন। তিনি তার উপর বসে পড়েন। এরপর আসে তার দুধ ভাই । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে তাকে সম্মুখে বসতে দেন। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাওয়াযিনের গোটা সম্প্রদায়ই বনূ সাদ ইবন বকরের দুধ পান করানোর ফলে উপকৃত হয়। বন সা’দ হাওয়াযিনেরই একটি ক্ষুদ্র দল। এ জন্যেই তাদের বক্তা যুহায়র ইবন সাদ বলেছিল, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এই ঘেরের মধ্যে যারা আছে তারা তো আপনারই (দুধ) মা, খালা ও লালন-পালনকারী । তাই আপনি আমাদের প্রতি সদয় হন, আল্লাহ্ আপনার প্রতি সদয় হবেন”। এরপর তিনি কবিতায় বলেন :
اذ فوك يملؤه من محضها درد
وان يزينك ما تأتي وما تذر
امنن علی ندوة قد كنت ترضعها
امنن على نسوة قد كنت ترضعها
“আপনি অনুগ্রহ করুন সেই সব রমণীদের প্রতি যাদের দুধ আপনি পান করেছিলেন। যাদের বিশুদ্ধ দুধ সর্বদা আপনার পেট পরিপূর্ণ করে রাখতো।
অনুগ্রহ দান করুন ঐসব মহিলাদের প্রতি যাদের দুধ সেবন করে আপনি লালিত পালিত হয়েছেন। যা সংরক্ষণ করে ও যা পরিত্যাগ করে তা আপনার মর্যাদাকে সুশোভিত করে”।
গোটা হাওয়াযিন সম্প্রদায়ের মুক্তিলাভের এটাই ছিল প্রকৃত কারণ। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অনুগ্রহ তাদের প্রবীণ, নবীন, ব্যক্তি বিশেষ ও সর্ব সাধারণের উপর পতিত হয়। ওয়াকিদী ইব্রাহীম ইবন মুহাম্মাদ ইবন শুরাহবীল সূত্রে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নাদীর ইবন হারিছ ইবন কলদাহ ছিলেন একজন সুদর্শন পুরুষ। তিনি বলতেন : “যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দিয়ে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। আর মুহাম্মাদ (সা)-এর মাধ্যমে আমাদের উপর ইহসান করেছেন। ফলে আমাদের মৃত্যু সেই ভ্রান্তির উপর হচ্ছেনা, যে ভ্রান্তির উপর আমাদের ভ্রাতাগণ ও পিতৃব্য পুত্রগণ নিহত হয়েছে। এরপর নাদীর ইবন হারিছ নবী (সা)-এর সাথে শত্রুতার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে “কুরায়শদের মধ্য হতে তাদের সম্প্রদায়ের সাথে তিনিও হুনায়ন গমন করেন। কুরায়শদের এ অংশটি পরবর্তীকালে তাদের দীনের উপরই থেকে যায়। নাদীর বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যদি মুহাম্মাদের বিপর্যয় ঘটে তা হলে আমরা তার উপর হামলা করবো। কিন্তু আমরা তাতে সক্ষম হলাম না। এরপর যখন তিনি জিইররানায় আসেন, তখনও আমি আমার পূর্বের পরিকল্পনার উপরই ছিলাম। তখন আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (সা) ব্যতীত আমার অন্য কোন চিন্তা ছিল না। এমন সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি, নাদীর না কি? আমি বললাম, জি হ্যাঁ, আমি হাযির । তিনি বললেন, হুনায়নের দিন তুমি যে পরিকল্পনা করেছিলে- যার মাঝে আল্লাহ্ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দিয়েছিলেন, তার চেয়ে উত্তম জিনিস কি তুমি পেতে চাও? এ কথা শুনে আমি দ্রুত তার কাছে ছুটে যাই। তিনি বললেন : “যার মধ্যে তুমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলে সে বিষয়ে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে”। আমি বললাম, “এখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি যে, আল্লাহর সাথে যদি আর কেউ শরীক থাকতো, তা হলে সে আমার কোন না কোন উপকারে আসতো। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তার কোন শরীক নেই”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন : “হে আল্লাহ্! তাকে তুমি দৃঢ়-পদ রাখ”। নাদীর বলেন, কসম সেই সত্তার! যিনি তাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমার অন্তর তখন থেকে দীনের উপর পাথরের ন্যায় অনড় মযবুত হয়ে যায় এবং সত্যকে সূক্ষ্মভাবে বুঝতে সক্ষম হই। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বললেন, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তাকে সঠিক পথ দান করেছেন ।
যিলকদ মাসে উমরাতুল জিইররানা
ইমাম আহমদ বলেন : বাহ্য ও আবদুস সামাদ মুনী আমার কাছে হাম্মাম ইবন ইয়াহয়ার সূত্রে কাতাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি আনাস ইবন মালিক (রা) কে জিজ্ঞেস করি যে, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) কয়টি হজ্জ সম্পাদন করেন”? তিনি বলেন, “একটি হজ্জ ও চারটি উমরা সম্পাদন করেন। তার মধ্যে একটি হুদায়বিয়ার সময়। একটি মদীনা থেকে যিলকাদ মাসে। একটি জিইরান থেকে যিলকদ মাসে। যেখানে তিনি হুনায়নের গনীমত বণ্টন করেছিলেন। আর একটি উমরা যা তিনি হজ্জের সাথে আদায় করেন”। ইমাম বুখারী মুসলিম, আবূ দাউদ ও তিরমিযী এ হাদীছ বিভিন্ন সূত্রে হাম্মাম ইবন ইয়াহূয়া থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে হাসান সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন।
ইমাম আহমদ বলেন : আবুন নাযর– ইকরিমা সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) চারটি উমরা আদায় করেছেন। উমরাতুল হুদায়বিয়া, উমরাতুল কাযা। তৃতীয় উমরা জিইরান থেকে এবং চতুর্থ উমরা হজ্জের সাথে আদায় করেন। আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাজা। ও হাদীছটি দাউদ ইবন আবদুর রহমান আত্তার আল-মক্কীর সূত্রে আমর ইবন দীনার থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : ইয়াহয়া ইবন যাকারিয়া ইব্ন আবু যায়িদা– আমর ইবুন আস থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তিনটি উমরা পালন করেছেন। প্রতিটি উমরাই যিলকদ মাসে হয়েছে। তিনি তালবিয়া পড়েছেন এবং শেষে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেছেন। এ সূত্রে হাদীছটি গরীব পর্যায়ের। এ তিনটি সেই উমরা যেগুলো যিলকদ মাসে সম্পাদিত হয়েছে। এ ছাড়া আরও একটি উমরা আছে যা তিনি তাঁর হজ্জের সাথে আদায় করেন। কেননা, এ উমরাটি হয়েছিল যিলহাজ্জ মাসে, হজ্জের সাথে। আর যদি ঐ তিনটি উমরার ইহরামের সূচনা ধরা হয় যিলকদ মাসে। তা হলে মনে করতে হবে যে, তিনি হুদায়বিয়ার উমরাকে গণনা থেকে বাদ দিয়েছেন। কেননা, এ উমরায় কাফিররা বাধা দেয়। ফলে তা আদায় করা সম্ভব হয়নি।
গ্রন্থকার বলেন : নাফি ও তার মনিব ইবন উমর (রা) জিইররানা থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উমরা পালনের কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। তাদের এ অস্বীকারের কারণ আছে। যেমন ইমাম বুখারী বলেন, ইবন নু’মান হাম্মাদ ইবন যায়দ– ইবন উমার (রা) সূত্রে বর্ণিত যে, উমর ইবন খাত্তাব (রা) বলেছিলেন : “ইয়া রাসূলাল্লাহ! জাহিলী যুগে আমি বায়তুল্লায় ইতিকাফ করার মানত করেছিলাম। সে কাজটি আমার উপর এখনও বাকী রয়ে গেছে”। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমর ইবন খাত্তাব (রা)-কে তা আদায় করার নির্দেশ দেন। ইবন উমর বলেন, (“আমার পিতা) উমর হুনায়ন থেকে দুটি দাসী লাভ করেন। দাসী দুটিকে তিনি মক্কায় এক বাড়িতে রাখেন। বর্ণনাকারী বলেন, ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) হুনায়নের বন্দীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন। এ ঘোষণা শুনার পর লোকজন পথে-ঘাটে ছুটাছুটি করতে থাকে। তখন পিতা উমর (রা) আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ্! দেখোতো বাইরে এ কি হয়েছে : ইবন উমর (রা) জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বন্দীদের প্রতি অনুকম্পা করেছেন তাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। উমর (রা) বললেন, “তা হলে তুমি যাও, আমার বন্দী দাসী দুটিকে ছেড়ে দিয়ে আস”। নাফি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিইরুরানা থেকে উমরা আদায় করেননি। কেননা, তিনি যদি উমরা আদায় করতেন তাহলে আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা)-এর নিকট তা গোপন থাকতো না। এ হাদীছটি ইমাম মুসলিম আইউব সখতিয়ানী নাফি সূত্রে ইবন উমর (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম আহমদ ইব্ন আবদা দাবই– নাফি’ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, একদা ইবন উমর (রা)-এর নিকট “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জিইরনা থেকে উমরা করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) জিইরানা থেকে উমরা আদায় করেননি। উমরাতুল জিইরানা অস্বীকার করা প্রসংগে ইবন উমর (রা) ও তাঁর মুক্ত গোলাম নাফির বর্ণনা অতিশয় গরীব পর্যায়ের। তবে নাফি ও ইবন উমর (রা) ব্যতীত অন্যান্য সকল বর্ণনাকারী উমরাতুল জিইরানার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন । সহীহ্ সুনান ও মুসনাদ গ্রন্থসমূহে সে সব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সকল মাগাযী ও সুনান গ্রন্থকারগণ তা উল্লেখ করেছেন। তারা এ ব্যাপারেও একমত, যেমন বুখারী ও মুসলিমে আতা ইবন আবু রাবাহ– উরওয়া সূত্রে আইশা (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি ইবন উমর (রা)-এর এই বক্তব্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) রজব মাসে উমরা পালন করেছেন, অস্বীকার করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “আল্লাহ্ আবু আবদুর রাহমান (ইবন উমর)-কে ক্ষমা করুন। রাসূলুল্লাহ (সা) এমন কোন উমরা করেননি যাতে তিনি সংগী ছিলেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সা) রজব মাসে কোন উমরা পালন করেননি”। ইমাম আহমদ বলেন : ইবন নুমায়র আ’মাশ মুজাহিদ সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন : উরওয়া ইবন যুবায়র একদা ইবন উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কোন মাসে উমরা করেছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, রজব মাসে। পরে আইশা (রা) আমাদেরকে শুনান যে, তার কাছে ইবন যুবায়র জিজ্ঞেস করেছিল এবং ইবন উমরের মতামতের কথা জানিয়েছিল । উত্তরে আইশা (রা) বলেছিলেন, “আল্লাহ্ আবু আবদুর রহমানকে ক্ষমা করুন। রাসূলুল্লাহ (সা) এমন কোন উমরা করেননি যাতে তিনি সংগী থাকেননি, অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) যিলকাদ মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে কখনও উমরা আদায় করেননি”। বুখারী ও মুসলিম এ হাদীছ জারীর মানসূর মুজাহিদ সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ এবং নাসাঈ ও এ হাদীছ যুহায়র- আবু ইসহাক মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ইবন উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কতবার উমরা আদায় করেছেন : জবাবে তিনি বললেন, দু’বার। আইশা (রা) বললেন, ইবন উমর (রা) জানেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সাথে মিলিত উমরাটি বাদে আরও তিনটি উমরা পালন করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন : ইয়াহইয়া ইবন আদম মুফাঁদদাল মানসূর মুজাহিদ সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, একদা আমি উরওয়া ইবন যুবায়রের সাথে মসজিদে (নববীতে) প্রবেশ করি । সেখানে দেখি ইবন উমর (রা) হযরত আইশা (রা)-এর কক্ষের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন । আর কতিপয় লোক সেখানে চাশতের সালাত আদায় করছেন। উরওয়া জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু আবদুর রহমান! এটা কিসের সালাত? তিনি বললেন, এটা বিদআত। এরপর উরওয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ আবদুর রহমান! রাসূলুল্লাহ (সা) কতটি উমরা পালন করেছেন : তিনি বললেন, চারটি উমরা পালন করেছেন। তার মধ্যে একটি ছিল রজব মাসে। মুজাহিদ বলেন, কক্ষের মধ্যে হযরত আইশা (রা)-এর আওয়াজ আমরা শুনতে পাই। তাই উরওয়া তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আবু আবদুর রহমান বলছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) চারটি উমরা পালন করেছেন, যার একটি ছিল রজব মাসে। আইশা (রা) বললেন, “আল্লাহ্ আবু আবদুর রহমানের প্রতি রহম করুন! নবী করীম (সা) এমন কোন উমরা পালন করেননি যাতে তিনি তার সাথী হননি। কিন্তু তিনি কখনও রজব মাসে উমরা পালন করেননি”। তিরমিযী এ হাদীছ আহমদ ইবন মানবা’– মানসূর সূত্রে বর্ণনা করে একে হাসান সহীহ গরীব বলে মন্তব্য করেছেন।
ইমাম আহমদ বলেন : রাওহ– মুখাররাশ কাবী সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমরা পালনের উদ্দেশ্যে জিইরানা থেকে রাত্রিবেলা বের হন। ঐ রাত্রেই মক্কা পৌঁছে উমরা পালন শেষে রাত থাকতেই প্রত্যাবর্তন করেন। সকাল বেলা জিইরানায় পৌঁছেন। ঘটনাটি ঘটে এমনভাবে যেন জিইররানাতেই তিনি রাত কাটিয়েছেন। এরপর সূর্য পশ্চিমে গড়িয়ে গেলে তিনি জিইরূরানা থেকে বের হয়ে বানে সারিফের পথে উঠেন। বানে সারিফের এই পথই মদীনার পথের সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি সে পথ ধরে চলতে থাকেন। মুখাররাশ বলেন, এ কারণেই অনেকের কাছে তাঁর এ উমরার বিষয়টি গোপন থেকে যায়। এ হাদীছ ইমাম আহমদ ইয়াহয়া ইবন সাঈদ সূত্রে ইবন জুরায়জ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। যা হোক উমরাতুল জিইরানা সহীহ্ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত- যা অস্বীকার কিংবা প্রত্যাখ্যান করার কোন উপায় নেই। যারা এ উমরার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করেছেন তাদের মুকাবিলায় যারা একে অস্বীকার করেছে তাদের কাছে মূলতঃ কোন প্রমান নেই। এরপর তারা এ ব্যাপারে প্রায় একমত যে, এ উমরা যিলকদ মাসে হয়েছিল এবং তা হয়েছিল তায়েফের যুদ্ধ ও হুনায়নের গনীমত বণ্টনের পর। হাফিয আবুল কাসিম তাবারানী তাঁর মু’জামুল কাবীর গ্রন্থে বলেন : হাসান ইবন ইসহাক তুসতারী— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন করে জিইররানায় আসেন এবং সেখানে গনীমতের মালামাল বণ্টন করেন। তারপর সেখান থেকে উমরা পালন করেন। তখন শাওয়াল মাস শেষ হতে দুই দিন বাকী ছিল। এ বর্ণনাটি অত্যন্ত গরীব এবং এর সনদ সন্দেহমুক্ত নয়।
ইমাম বুখারী বলেন : ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম– সাফওয়ান ইবন ইয়া’লা ইবন উমায়য়া থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, ইয়ালা প্রায়ই বলতেন, হায়! রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয় সেই মুহূর্তে যদি আমি তাঁকে দেখতে পেতাম! সাফওয়ান বলেন, এরই মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিইানায় অবস্থান করছিলেন। তার মাথার উপর একটি কাপড় টাংগানো ছিল। তিনি তার ছায়ার নীচে ছিলেন। সে কাপড়ের ছায়ায় তাঁর কতিপয় সাহাবীও তাঁর সাথে ছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন তাঁর কাছে আসে। তার পরিধানে ছিল একটি জুব্বা ও শরীরে খোশবু মাখানো। (সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার ফায়সালা কি, যে খোশবু মেখে, জুব্বা পরে উমরার জন্যে ইহরাম বাঁধে”? তখন উমর ইবন খাত্তাব (রা) হাত দিয়ে ইশারা করে ইয়ালাকে আসতে বললেন। ইয়ালা আসলেন। উমর (রা) তাকে ঐ টাংগানো কাপড়ের নিচে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি দেখলেন, নবী করীম (সা)-এর চেহারা লাল হয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বইছে। এ অবস্থা কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। তিনি বললেন, “সেই লোকটি কোথায়, যে এইমাত্র আমাকে উমরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলো”? লোকটিকে খুঁজে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হলো। তিনি তাকে বললেন, তোমার শরীরে যে খোশবু মাখানো আছে তা তিনবার ধুয়ে ফেল। তারপর জুব্বাটি খুলে ফেলো। পরে হজ্জে যেসব কাজ করে থাকো উমরাতেও সেসব কাজ করো”। ইমাম মুসলিম এ হাদীছটি ইবন জুরায়জের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও মুসলিম অন্য সূত্রে এ হাদীছ আতা থেকে তার পর আতা ও ইবন জুরায়জ সাফওয়ান ইবন ইয়া’লা ইবন উমাইয়া থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ বলেন : আবু উসামা হিশাম তার পিতার সূত্রে আইশা থেকে বর্ণিত যে, আয়িশা (রা) বলেছেন, মক্কা বিজয়ের বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কার উচ্চভূমি কুদার দিক থেকে প্রবেশ করেন এবং উমরা পালনের জন্যেও তিনি কুদা হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। আবু দাউদ বলেন : মূসা আৰূ সালমা— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ জিইররানা থেকে উমরা পালন করেন। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ কালে তিনবার রমল করেন ও চারবার হেঁটে চলেন। এ সময় তাঁরা তাঁদের চাদর বগলের নীচ থেকে উঠিয়ে বাম কাঁধের উপর ছেড়ে দেন। এ ছাড়াও আবু দাউদ ও ইবন মাজা এ হাদীছ ইবন খায়ছাম- আবুত তুফায়ল ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেন।
ইমাম আহমদ বলেন : ইয়াহয়া ইবন সাঈদ– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, মুআবিয়া তাকে জানিয়েছেন যে, আমি (মুআবিয়া) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চুল চ্যাপ্টা ছুরি (কাঁচি) দিয়ে কেটে ছোট করে দিয়েছিলাম । অথবা তিনি বলেন, (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) আমি দেখেছি, মারওয়া পাহাড়ের কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চুল চওড়া ফলাযুক্ত কাঁচি দিয়ে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে । সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ইবন জুরায়জের সূত্রে এ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া ইমাম মুসলিম সুফিয়ান ইবন উয়ায়নার সূত্রে– মুআবিয়া থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন । আবু দাউদ ও নাসাঈ আবদুর রাযযাকের সূত্রে— তাঊস থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন । আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমাদ বলেন : আমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাকিদ– ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে মুআবিয়া থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, মারওয়া পাহাড়ের কাছে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাথার চুল ছেটে দিয়েছিলাম। এ সব উদ্ধৃতির উদ্দেশ্য হল, চুল ছোট করার কাজটি উমরাতুল জিইানায় হয়েছিল । কেননা, উমরাতুল হুদায়বিয়ায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মক্কায় প্রবেশ করেননি; বরং মক্কায় যেতে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছিল যেমনটি পূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর উমরাতুল কাযায় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেনি (সুতরাং মুআবিয়ার চুল ছাঁটার প্রশ্নই ওঠে না)। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন মক্কার কোন বাসিন্দা সেখানে ছিল না; বরং মক্কা থেকে বের হয়ে তারা বাইরে অবস্থান করে। উমরার তিন দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মক্কায় অবস্থানকালে সেখানকার অধিবাসিরা আত্মগোপন করে থাকে। আর যে উমরা তিনি হজ্জের সাথে আদায় করেন, সে উমরা পালন শেষে তিনি হালাল হননি। এ ব্যাপারে কারোর কোন মতবিরোধ নেই। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, মারওয়া পাহাড়ের সন্নিকটে মুআবিয়া ইব্ন আবু সুফিয়ান কর্তৃক রাসূলুল্লাহর মাথার চুল ছাঁটা হয় যে উমরায় তা হলো উমরাতুল জিইররানা। ইবন ইসহাক বলেন । এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিইরানা হতে উমরার উদ্দেশ্যে বের হলেন এবং গনীমতের অবশিষ্ট মালামাল মারু-যাহরানের পাশে মাজান্নায় সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিলেন।
আমি বলি : এটা সহজেই বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) গনীমতের কিছু মাল অবশিষ্ট রেখে দেন, যাতে মক্কা-মদীনার মাঝে কোন বেদুঈনের সাথে সাক্ষাৎ হলে তাদের মন আকৃষ্ট করার জন্যে প্রদান করতে পারেন।
ইবন ইসহাক বলেন : উমরা শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি আত্তাব ইবন আসীদ (রা)-কে মক্কার প্রশাসক নিযুক্ত করে যান এবং লোকজনকে দীনের জ্ঞান ও কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্যে মুআয ইবন জাবাল (রা)-কে তাঁর সাথে রেখে যান। উরওয়া ও মূসা ইবন উকবা বলেন : হাওয়াযিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) আত্তাব (রা)-এর সংগে মুআয (রা)-কে মক্কার দায়িত্বে রেখে যান। এরপর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার সময় তিনি তাঁদেরকে মক্কার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
ইবন হিশাম বলেন : যায়দ ইবন আসলাম হতে আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আত্তাব ইব্ন আসীদ (রা)-কে মক্কার শাসক নিযুক্ত করার সময় তার জন্যে দৈনিক এক দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করে যান। পরে তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “হে জনমণ্ডলী! আল্লাহ সেই ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করে দিয়েছেন যার এক দিরহামের ক্ষুধা ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার জন্যে দৈনিক এক দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং কারও কাছে আমার আর কোন প্রয়োজন নেই”। ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উমরা পালিত হয় যিল-কাদ মাসে। তিনি যিল-কাদার শেষে কিংবা যিল-হাজ্জ মাসের প্রথম দিকে মদীনায় প্রবেশ করেন।
ইবন হিশাম বলেন : আবু আমর মাদানীর ধারণা মতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুল-কাদার ছয় দিন বাকী থাকতে মদীনায় পৌঁছেন। ইবন ইসহাক বলেন : সে বছর লোকেরা আরবদের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী হজ্জ পালন করে। আত্তাব ইবন আসীদ (রা) মুসলমানদের সাথে নিয়ে ঐ বছর হজ্জ আদায় করেন। এটা ছিল হিজরী অষ্টম সাল। বর্ণনাকারী বলেন, তায়েফবাসী তাদের শিরকের উপর অবিচল হয়ে থাকে। তারা অষ্টম হিজরীর যিল-কাদ মাস থেকে নবম হিজরীর রমযান মাস পর্যন্ত তাদের তায়েফ দুর্গে অবস্থান করে।
কা’ব ইবন যুহায়র ইবন আবূ সুলমার ইসলাম গ্রহণ ও তাঁর বিখ্যাত কাসীদা- বানাত সু’আদ
ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তায়েফ থেকে ফিরে আসলে বুজায়র ইবন যুহায়র ইব্ন আবূ সুলমা তার সহোদর কা’ব ইব্ন যুহায়রকে পত্র লিখে জানান যে, মক্কার যে সব লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিন্দা করতে ও তাঁকে কষ্ট দিতো। তাদের কতিপয়কে তিনি হত্যা করেছেন। কুরায়শদের যে সব কবি এখনও বেঁচে আছে যেমন ইবনুয যুবা’রী ও হুবায়রা ইবন আবু ওহব- তারা চারিদিকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তুমি যদি বেঁচে থাকা প্রয়োজন মনে কর তবে দ্রুত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে চলে এসো। কেননা, যে লোক তাওবা করে তাঁর কাছে আসে তাকে তিনি হত্যা করেন না। আর যদি তুমি তা না কর। তবে পৃথিবীর কোন নিরাপদ স্থানে গিয়ে আত্মরক্ষা কর। কা’ব ইবন যুহায়র বলেছিলেন :
فويحك فيما قلت ويحك هل لكا
الا بلغا عنسی بجی۔سرا رسالة
علی ای شئ غير
ذالك دلكا
فبين لنا ان كنت لست بفاعل
عليه وما تلفی عليه ابا لكا
على خلق لم الف يوما ابا له
ولا قائل إما عثرت لمما لکا
فان انت لم تفعل فلست بأسف سقاك بها المامون كأسا روية فأنهلك المأمون منها وعملكا
“ওহে! বুজায়রের কাছে আমার পক্ষ থেকে এ বার্তা পৌঁছিয়ে দাও যে, তুমি যে কথা বলেছে সে জন্যে তোমাকে ধিক্কার জানাই। ধিক তোমাকে, এ কি তোমার নিজের কথা?
তুমি যদি না মান, তবে আমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দাও যে, এটা ছাড়া আর কোন জিনিসের দিকে সে তোমাকে পথ দেখিয়েছে?
এমন আদর্শের দিকে কি, যার উপরে তার পিতাকে এক দিনের জন্যে আমি পাইনি? আর তুমি তোমার পিতাকেও তার উপর কখনও পাবে না।
যদি তুমি না মান তাহলে আমি আফসোসও করবো না। কোন কথাও বলবো না। তোমার পদস্খলন হয়ে থাকলে তা তোমার জন্যে অভিশাপ বটে।
মামুন (বিশ্বস্ত’ মুহাম্মাদ) তোমাকে এর পেয়ালা ভাল করে পান করিয়েছেন এবং বারবার পান করিয়েছেন। এর দ্বারা মামুন’ নিজেকে শংকার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন ।
ইবন হিশাম বলেন, কবিতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ জনৈক ব্যক্তি উক্ত কবিতাটি আমাকে নিম্নোক্তভাবে আবৃত্তি করে শুনিয়েছে?
فهل لك فيما قلت بالخيف هل لكا
من مبلغ عني بجيرا رسالة شربت مع المامون كأسا روية فانهلك المامون منها وملكا
علی ای شئ ويب غيرك دلكا
وخالفت اسباب الهدی واتبعته
عليه ولا تدرك عليه اخالکا
علی خلق لم تلف اما ولا ابا
ولا قائل اما عثرت لالك
فان انت لم تفعل فلست بأسف
“কে পৌঁছাবে বুজায়রকে আমার বার্তা? খায়ফে তুমি যা বলেছিলে তা কি আসলে তোমার কথা? বল, তা কি তোমার কথা?
তুমি মামুনের (মুহাম্মাদ (সা) বা আবু বকর) সাথে এক পেয়ালায় পান করেছো তৃপ্তি সহকারে। সে পেয়ালা থেকে প্রথমে মামুন পান করেছেন। এরপর দ্বিতীয়বার পান করিয়েছেন তোমাকে।
সঠিক পথের সকল উপকরণই তুমি পরিত্যাগ করেছো ও তার অনুসরণ করেছো। কিসের ভিত্তিতে তুমি অন্যের ধ্বংস নিজের উপর টেনে নিলে?
সে তোমাকে এমন এক আদর্শের উপর উঠিয়েছেন যার উপরে চলতে তুমি মাতা ও পিতাকে দেখনি আর তার উপর তোমার ভাইকেও থাকতে দেখনি।
তুমি যদি কথা না মান, তবে আমি আফসোস করবো না, কোন কথাও বলবো না। যদি তুমি পদস্খলিত হয়ে থাক, তবে তোমর জন্যে অভিশাপ”।
ইবন ইসহাক বলেন : কবি কা’ব এ চিঠি তার ভাই বুজায়রের কাছে পাঠিয়ে দেয়। চিঠিটি হাতে পাওয়ার পর বুজায়র রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে বিষয়টি গোপন রাখা পসন্দ করলেন না। তাই তিনি তাঁকে কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনালো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) [ ] বাক্যটি শুনে বললেন : “সত্য কথা বলেছে, যদিও সে একজন ডাহা মিথ্যুক। আর আমিই তো মামুন (বিশ্বস্ত)। এরপর যখন তিনি এ [ ] বাক্য শুনলেন, তখন বললেন, হ্যাঁ –সে তার মা ও বাপকে এ আদর্শের উপর পায়নি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর বুজায়র কা’বের উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত কবিতা লিখে পাঠান
تلوم عليها باطلا
وهي احزم
من مبلغ كعبا فهل لك في التي
فتنجو اذا كان النجاء وتسلم
الى الله لا العزی ولا اللات وحده
من الناس الا طاهر القلب مسلم
لدى يوم لا ينجو وليس بمغلت فدين زهير وهو لا شئ دينه ودين ابی سلمی علی محرم
“কে পৌঁছে দিকে কা’বকে আমার এ বার্তা যে, তুমি যে আদর্শের জন্যে অন্যায়ভাবে তিরস্কার করছো, অথচ সেটাই উত্তম আদর্শ।
উষ্যা নয়, লাতও নয় এক আল্লাহর দিকে ফিরে এসো। যদি মুক্তির আশা কর তবে এ পথেই আছে মুক্তি ও নিরাপত্তা।
সেদিন, যেদিন পবিত্র মুসলিম হৃদয় ছাড়া আর কোন মানুষের মুক্তি ও ছাড়া হবে না। যুহায়রের ধর্ম, সে তো কোন ধর্মই না। আর আবু সুলমার ধর্ম আমার উপর হারাম ।
ইবন ইসহাক বলেন : কাবের কাছে বুজায়রের পত্র যখন পৌঁছলো। তখন দুনিয়া তার কাছে সংকীর্ণ হয়ে উঠলো। নিজ জীবনের উপর আশংকা বোধ করলো। এমন কি, এতে আশপাশের শত্রুরা পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে উঠলো। তারা বলতে লাগলো, ও তো নিহত হবেই। আর কোন উপায়ান্তর না দেখে তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত কাসীদাটি রচনা করলো, যাতে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রশংসা করেছেন, তাঁর আশংকার কথা ও নিন্দাকারী শত্রুদের কেঁপে উঠারও বর্ণনা দিয়েছেন। এরপর তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। সেখানে জুহায়না গোত্রের পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আমার কাছে কথাটি এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। তার সে বন্ধু লোকটি তাঁকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায়কালে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সে সালাত আদায় করলো। তারপর সে কা’বকে ইংগিত করে দেখালো যে, ঐ তো রাসূলুল্লাহ্ (সা) । তুমি তার কাছে চলে যাও এবং আশ্রয় প্রার্থনা কর। আমার কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কা’ব উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে গিয়ে বসলেন। তিনি রাসূলের হাতের মধ্যে তাঁর নিজের হাত রেখে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) কা’বকে চিনতেন না। তিনি তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কা’ব ইবন যুহায়র তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ করে আপনার নিকট আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে চলে এসেছে। আমি যদি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসি, তাহলে আপনি কি তাকে মাফ করে দিবেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিই সেই কাব ইবন যুহায়র”। ইবন ইসহাক বলেন : আমার নিকট আসিম ইবন উমার ইব্ন কাতাদা বর্ণনা করেছেন যে, জনৈক আনসারী লাফ দিয়ে উঠে বললেন– “ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর এ দুশমনকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই”। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, সে তাওবা করে তার পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে এসেছে”। বর্ণনাকারী বলেন, আনসারী ঐ ব্যক্তির আচরণে কা’ব ইবন যুহায়র গোটা আনসার কবিলার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। কেননা, মুহাজিরদের মধ্যে কেউ তাঁর প্রতি কোন অশুভ উক্তি করেননি। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে কা’ব তার বিখ্যাত এ কবিতায় বলেছিলেন :
“সু’আদ আমার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাই আমার হৃদয় তার বিরহে আহত, তার প্রেমে বন্দী, তবে তা আমার কোন কাজে আসেনি।
বিদায় বেলা সু’আদকে যখন তার লোকজন নিয়ে চলে যায়, তখন তার কণ্ঠে ছিল গুনগুন আওয়াজ, কাজল লাগানো চোখ দুটি অবনমিত।
সামনে আসলে দেখা যায় তার সরু কোমর ও হালকা পেট; আর পেছনে গেলে দেখা যায় ভারী ও চওড়া নিতম্ব। লম্বা বা বেঁটে হওয়ার দোষে সে নিন্দনীয় নয়।
যখন সে হেসে দেয় তখন তার সরস দাঁতগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যেন তা গন্ধযুক্ত মদিরায় বারবার স্নাত হয়েছে।
আর সে মদিরায় মিশ্রণ করা হয়েছে সুশীতল পরিষ্কার পানি- যা উষাকালে আনা হয় উপত্যকা থেকে- যার উপর দিয়ে বয়ে যায় উত্তরা বায়ু।
তার উপর থেকে বাতাস দূর করে দেয় সব আবর্জনা, প্রভাত বেলায় বর্ষণে ভরে উঠা পানির উপর ভেসে উঠে শুভ্র বুদ্বুদ।
হায় আফসোস তার প্রেমের জন্যে! যদি সে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতো কিংবা আমার উপদেশ যদি তার কাছে গৃহীত হতো।
কিন্তু সে প্রেম তো এমনই, যার রক্তে মিশ্রিত আছে আঘাত। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও পরিবর্তন।
তার এ প্রেম এক অবস্থায় স্থায়ী থাকে না, এ যেন এক জীন যে বারবার তার পোশাকের রং পরিবর্তন করে ।
সে যে ওয়াদা করে তা রক্ষা করতে পারে না, যেমন চালুনি পানি ধরে রাখতে পারে না।
সুতরাং তার দেওয়া আশায় তুমি ধোকায় পড়ো না, সে যে ওয়াদা করে তা শুধু ভ্রান্ত আশা ও স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না।
তার দেওয়া ওয়াদা উরকূবের [আরবের বিখ্যাত ওয়াদা ভংগকারী, যা প্রবাদে পরিণত হয়েছে] ওয়াদার সাথে তুলনীয়। তার সকল ওয়াদা মিথ্যায় পরিপূর্ণ।
আমি আশা করি ও আকাক্ষা রাখি যে, তার প্রেম তাকে কাছে নিয়ে আসবে। তাদের ব্যাপারে আমি এ ধারণা পোষণ করি না যে, সে সময়টা খুব শীঘ্রই আসবে।
সু’আদ এমন দেশে চলে গেছে, যেখানে অভিজাত ও দ্রুতগামী বাহন ছাড়া পৌঁছা সম্ভব নয়।
সেখানে কিছুতেই পৌঁছতে পারবে না শক্ত ও কষ্ট-সহিষ্ণু উট ছাড়া যেমন শক্ত হয়ে থাকে মারাকীল ও বিগাল জাতীয় উট।
এমন সব উট যা অধিক চলার কারণে ঘেমে গেলে কানের পিছনের হাড় ভিজে যায়, আর তার সামনে আসতে থাকে অজানা চিহ্ন–বিলুপ্ত পথ।
সে উট তার সাদা বুনো গরুর চোখের মত তীক্ষ্ণ চোখ মারতে থাকে সম্মুখের অজানা পথ পানে, যখন রৌদ্রের খরতাপে জ্বলতে থাকে পাথুরে মাটি ও দূরত্ব নির্ণয়ের চিহ্ন, পাথর।
সে উটের ঘাড় পুরু ও মোটা, পাগুলো মাংসে ভরা। ষাড়ের কন্যাদের মধ্য হতে তার সৃষ্টি বৈশিষ্ট্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব।
এমন অভিজাত বংশীয় উট সে –যে, তার ভাই তার পিতা এবং তার চাচা তার মামাও, দীর্ঘ-গ্রীবা ও অত্যন্ত দ্রুতগামী।
কুরাদ নামক কীট তার গায়ের উপর দিয়ে হাটে। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে বুক ও কোলের মসৃণতা গড়িয়ে নীচে ফেলে দেয়।
সে বুনো গাধার ন্যায় দ্রুত গতিসম্পন্ন এবং তার কোল মাংসে ভরা। তার কনুই বুকের উপরের অংশ থেকে বেশ দূরে (অর্থাৎ চওড়া বুক)।
উঁচু তার নাক। কান দুটিতে রয়েছে সুস্পষ্ট আভিজাত্য চক্ষুষ্মনের জন্যে। আর অধর দুটি বিনম্র কোমল।
তার নাক ও চোয়াল হতে চোখ ও গাল পর্যন্ত বিস্তৃত চেহারাটি দীর্ঘ এক পাথরের ন্যায় ।
খেজুর গাছের শাখার মত তার চুলের গোছা বিশিষ্ট লেজ মাছি তাড়াবার জন্যে দুধের বাটের উপর মারে। এতে সে উটনীর বাট থেকে দুধ বেরোবার ছিদ্রে কোনরূপ ক্ষতি হয় না।
সে হালকা পদক্ষেপে দ্রুত চলে। পা মাটি স্পর্শ করে নরম ভাবে। আর এভাবেই সে সম্মুখের উটগুলোকে পশ্চাতে ফেলে যায়।
দিবাভাগে এমন রৌদ্রের মধ্যে চলে যখন সূর্যের তেজ অত্যন্ত প্রখর হয়। তার দেহের উপরিভাগ তপ্ত বালুর ন্যায় হয়ে যায়।
প্রচন্ড গরমের কারণে কাফেলার হুদী সংগীতের গায়করা পর্যন্ত বলে উঠৈ- তোমরা দুপুরের বিশ্রাম গ্রহণ কর। তাপ থেকে বাঁচার জন্যে সবুজ পাতার টিল্ডী পোকারাও নুড়ি পাথর উল্টিয়ে আশ্রয় খুঁজছে।
দিন ব্যাপী সফরে তার বাহুগুলো চলে সেই হতভাগ্য রমণীর বাহুদ্বয়ের মত যে তার সন্তান হারিয়ে এলোকেশে চিৎকার করে কাঁদছে। সে রমণী দাঁড়িয়ে বিলাপ করছে, আর তার পাশে জমায়েত হয়েছে আরও সন্তান হারা বঞ্চিতরা।
সে রমণী উচ্চস্বরে বিলাপ করছে, এতে তার দু বাহু অসাড় হয়ে গেছে। তার জ্ঞান উধাও হয়ে গেছে তখন, যখন মৃত্যু সংবাদ ঘোষণাকারীরা তার প্রথম সন্তান মৃত্যুর ঘোষণা দিল।
সে তার দুহাত দিয়ে বুক ও জামার উপর আঘাত করছে। ফলে তার সীনার উপরের কাপড় ফেটে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
আমার সে উটনীর চারপাশে নির্বোধ লোকেরা ছুটাছুটি করছে আর বলছে, হে আবু সুলমার পুত্র! তুমি যে খুন হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সে সব বন্ধু, যাদের সাহায্যের আমি আশা করছিলাম, তারা প্রত্যেকেই বললো– তোমাকে আমি বৃথা আশা দিব না। তোমার ব্যাপারে আমি উদাসীন।
তাদেরকে আমি বললাম, তোমরা আমার পথ ছেড়ে দাও। তোমরা পিতার সন্তান নও। এখন রহমান-দয়াময় আমার জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তাই হবে ।
প্রত্যেক নারীর সন্তান, তা সে যতই দীর্ঘজীবী হোক না কেন! একদিন তাকে মৃত বহনকারী খাঁটিয়ায় উঠতেই হবে।
আমাকে সংবাদ জানানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আল্লাহর রাসূলের কাছে ক্ষমার আশা করা যায়।
একটু অপেক্ষা করুন, আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সেই সত্তা, যিনি আপনাকে কুরআন উপহার দিয়েছেন, যাতে রয়েছে বহু উপদেশ ও সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা।
আমাকে পাকড়াও করবেন না চোগলখোরদের কথা শুনে। আমি কোন অপরাধ করিনি; যদিও আমার সম্পর্কে বহু রটনা ছড়ানো হয়েছে।
এখন আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছি, এবং এমন কিছু দেখছি ও শুনছি, যদি হাতিও এ স্থানে দাঁড়াতে ও শুনতো।
তবে সেও ভয়ে কম্পমান হতো যদি আল্লাহর নির্দেশে রাসূলের পক্ষ হতে ক্ষমা প্রাপ্ত না হতো।
অবশেষে আমি আমার ডান হাত রাখলাম, যা আর গুটিয়ে নিব না, সেই প্রতিশোধ গ্রহণকারীর হাতে যার মুখের কথাই চূড়ান্ত কথা।
তাঁর প্রতি আমি অতিশয় ভীত হয়ে পড়ি, যখন আমি তার সাথে কথা বলি। আর আমাকে তখন বলা হচিছল যে, তুমি অভিযুক্ত এবং তোমার কাছে জবাব চাওয়া হবে ।
এ ভীতি ঐ সিংহের ভীতির চেয়েও অধিক, যে সিংহের গুহা ছদুর বনের গহীনে বিপদ শংকুল স্থানে অবস্থিত, যা নিবিড় ঘন বনে ঘেরা।
সে তার দুই শাবকের জন্যে ঊষাকালে মাংসের খোঁজে বের হয়। যাদের খোরাক হলো মানব মাংসের টুকরা, যাতে থাকে ধূলা-মাটি মাখান।
সে যখন তার প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালায়, তখন তার জন্যে বৈধ হয় না প্রতিপক্ষকে ঘায়েল না করে ছেড়ে দেয়া।
বনের অন্যান্য হিংস্র প্রাণীরা পর্যন্ত তার ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কোন শিকারী দলও তার উপত্যকা দিয়ে হাটে না।
যখনই তার উপত্যকায় কোন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সাহসী লোক যাক না কেন, সে তার খোরাকে পরিণত হবেই। আর তার কাপড় ও অস্ত্র রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানেই পড়ে থাকবে ।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো এক জ্যোতি। তার থেকেই আলো সংগ্রহ করা হয়। তিনি আল্লাহর তরবারির মধ্য হতে এক তীক্ষ্ণ তরবারি– যা হিন্দুস্তানী লোহা দ্বারা প্রস্তুত।
তিনি ছিলেন কুরায়শদের একটি দলের অন্তর্ভুক্ত। ঐ দলটি যখন মক্কা উপত্যকায় ইসলাম গ্রহণ করলো তখন তাদের একজন বললো, তোমরা দেশ ত্যাগ করো ।
ফলে তারা দেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন, তবে যুদ্ধে তারা ছিলেন না দুর্বল ভীত, ঢাল বিহীন বা তলোয়ার ও অস্ত্র শূন্য।
তারা হেঁটে চলে শুভ্র উটের মত গাম্ভীর্যের সাথে, যখন বেঁটে, কালো লোকগুলো পলায়ন করে তখন নিজেদের তরবারি তাদেরকে রক্ষা করে।
তারা উন্নত নাসিকা বিশিষ্ট বীর । যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পোশাক হয় দাউদ নির্মিত বর্ম ।
বর্মগুলো শুভ্র ও পরিপূর্ণ। তাতে রয়েছে মজবুত আংটা লাগানো, যেনো তা কাফআ বৃক্ষের তৈরি আংটা।
তারা আনন্দে আত্মহারা হয় না, যদি তাদের বর্শাগুলো শত্রুদের আঘাত করে। আবার তারা ভীত হয়েও পড়েনা। যদি তারা আক্রান্ত হয়।
নিক্ষিপ্ত বর্শা এসে তাদের বুক ব্যতীত অন্য কোথাও লাগে না। আর মৃত্যুর হাউজে অবগাহন করতেও তারা কখনও পিছপা হয় না”।
ইবন হিশাম বলেন : মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এ কাসীদাটি উপরোল্লিখিতভাবে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু তিনি এর কোন সূত্র উল্লেখ করেননি। তবে হাফিয বায়হাকী দালাইলুন নবুওয়াত গ্রন্থে অবিচ্ছিন্ন (মুত্তাসিল) সনদে তা বর্ণনা করেছেন। তিনি সনদ পরম্পরা এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি শুনেছি আবূ আবদুল্লাহ হাফিয থেকে তিনি আবুল কাসিম আবদুর রাহমান ইবনুল হাসান ইবন আহমাদ আসাদী বাহজান থেকে তিনি ইবরাহীম ইবনুল হুসায়ন থেকে তিনি ইবরাহীম ইবনুল মুনযির হাযামী থেকে তিনি হাজ্জাজ ইবন যিররুকায়বা ইবন আবদুর রহমান ইবন কা’ব ইবন যুহায়র ইবন আবু সুলমা থেকে তিনি (হাজ্জাজ) তার পিতা (যুররু-বায়বা) থেকে তিনি তার (হাজ্জাজের) দাদা (আবদুর রহমান) থেকে। তিনি বলেন, যুহায়রের দুই পুত্র কাব ও বুজায়র একদা বেরিয়ে পড়েন। তারা যখন আবরাকুল উযাফ নামক স্থানে পৌঁছে তখন বুজায়র কাবিকে বললেন, তুমি এখানে অবস্থান কর। আমি ওই লোকটির কাছে যাই। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে। তিনি কি বলেন তা আমি শুনে আসি। কা’ব সেখানেই অবস্থান করলো । বুজায়র বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে পৌঁছলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার নিকট ইসলামের মর্ম তুলে ধরেন। বুজায়র তখন ইসলাম গ্রহণ করেন। কা’ব এ সংবাদ শুনতে পেয়ে কবিতায় বলেন :
الا ابلغا عني بجيرا رسالة علی ای شئ ويب غيرك دلكا
عليه ولم تدرك عليه اخالكا
علی خلق لم تلف اما ولا ابا
سقاك ابو بكر
بكأس روية وأنهلك المأمون منها و علکا
“ওহে’ বুজায়রের নিকট আমার এ বার্তা পৌঁছিয়ে দাও যে, অন্যের ধ্বংস নিজের গায়ে টেনে নিতে কিসে তোমাকে প্রলুব্ধ করলো?
এমন এক আদর্শই তুমি গ্রহণ করেছে যার উপর তোমার পিতা-মাতাকে দেখতে পাওনি এমন কি তোমার ভাইকেও পাবে না ।
আবু বকর তোমাকে পূর্ণ পেয়ালা পান করিয়েছে তৃপ্তি সহকারে। আর ‘মামূন’ (বিশ্বস্ত) তোমাকে তা পান করিয়েছেন বারবার।
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যখন এ কবিতা পৌঁছে তখন তিনি তার রক্তপাত বৈধ ঘোষণা করেন এবং জানিয়ে দেন যে, কাবকে যে দেখবে সেই যেন হত্যা করে। তখন বুজায়র পত্রের মাধ্যমে তাঁর ভাইকে লিখে পাঠান যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তোমার রক্তপাত বৈধ ঘোষণা করেছেন । এর থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা কর, বেঁচে যাওয়ার কোন পথ আমি দেখছি না। এরপর বুজায়র কা’বকে লিখে জানান যে, দেখ, যে কেউ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর একত্বের ও মুহাম্মাদ (সা)কে তাঁর রাসূল হিসেবে মেনে নেয়ার সাক্ষ্য দেয়, তিনি তা গ্রহণ করেন ও পূর্বের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেন। অতএব, তোমার কাছে আমার এ পত্র পৌঁছামাত্র তুমি ইসলাম গ্রহণ করে এখানে চলে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, কাব পত্র পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন ও সেই কাসীদা রচনা করেন যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রশংসা করা হয়েছে। এরপর তিনি মদীনায় চলে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মসজিদের দরজায় এসে বাহন থামিয়ে দেন। তারপর তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। সেখানে দেখেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণের সাথে বসে আছেন। তাঁরা চারিদিক থেকে তাঁকে বেষ্টন করে আছেন। ঠিক খাবার মজলিসের ন্যায় দেখা যাচ্ছে। সাহাবীরা এক লাইনের পিছনে আর এক লাইন করে বসে আছেন। তিনি একবার এ দিকে ফিরে কথা বলছেন, আর একবার ওদিকে ফিরে আলোচনা করছেন। কা’ব বলেন, মসজিদের দরজায় বাহন থেকে নেমেই আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে তার বৈশিষ্ট্য দেখে চিনে ফেলি। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম, ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলাম এবং মুখে বললাম।–“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা)। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে নিরাপত্তা দিন” । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কা’ব বললেন, আমি বললাম, আমি কা’ব ইবন যুহায়র। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সেই কা’ব- যে বলে থাকে ….। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু বকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আবু বকর! সে যেন কি বলেছে? আবু বকর তখন পড়ে শুনান :
وانهلك المامون منها و علکا
سقاك بها المامون كأسا روية
“মামুন” তোমাকে এক নতুন মতাদর্শের পেয়ালা তৃপ্তি সহকারে পান করিয়েছে এবং বারবার তা পান করিয়েছে। আর এতে “মামুন” নিজেকে শংকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
কা’ব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবিতাটি এভাবে বলি নাই। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তাহলে কিভাবে বলেছো? তিনি বললো, আমি এভাবে বলেছি?
وانهلك المأمون منها و علکا
سقاك بها المامون كأس روية
“মামুন এর দ্বারা তোমাকে তৃপ্তির পেয়ালা পান করিয়েছে। এবং এর থেকে তোমাকে পান করিয়েছে বারবার।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন, আল্লাহর কসম, আমি “মামুন”? এরপর কা’ব তার পুরা কাসীদা শেষ পর্যন্ত আবৃত্তি করলেন– যার শুরুতে বলা হয়েছে :
متيم عندها لم يفد مكبول
بانت سعاد قلبي اليوم متبول
“আদ আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তার বিরহ বেদনায় আমার হৃদয় পীড়িত, লাঞ্ছিত। তার প্রেমে বন্দী, যা হতে সে মুক্ত হতে পারেনি।
এ কাসীদা আবৃত্তিতে ইবন ইসহাক ও বায়হাকীর বর্ণনায় যে পার্থক্য আছে সে বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। আবু উমার ইব্ন আবদুল বার তার ইসতিআব গ্রন্থে বলেছেন, কা’ব যখন কাসীদা আবৃত্তি করতে করতে এ পর্যন্ত আসলেন–
مهند من سيوف الله مسلول والعفو عند رسول الله مأمول
ان الرسول لنور يستضاء به نبئت ان رسول الله او عدني
“নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সা) একটি জ্যোতি- যার থেকে আলো লাভ করা হয়। তিনি আল্লাহর সুতীক্ষ্ণ ধারাল তরবারি।
আমাকে সংবাদ জানান হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের নিকট তো ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যায়”।
বর্ণনাকারী বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর কাছের লোকদের ইংগিত দিয়ে বলেন– শুনো, কি বলছে। এ কথাটি অবশ্য ইবন আবদুল বার এর পূর্বে মূসা ইবন উবা তার মাগাযী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
আমি বলি : কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কাব ইবন যুহায়র এ কাসীদা আবৃত্তি করলে রাসূলুল্লাহ (সা) তার চাদর কবিকে উপহার দেন। বস্তুতঃ কবি বিভিন্ন প্রশংসামূলক কবিতা থেকে এক জায়গায় এনে এ কাসীদা তৈরি করেছেন। হাফিয আবুল হাসান ইনুল আছীর তার উদুল গাবা গ্রন্থে এ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এই চাদরটি পরবর্তীকালে খলীফাঁদের কাছে থাকতো।
আমি বলি : এটা একটি অতি প্রসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু আমি কোন নির্ভরযোগ্য সনদে কোন প্রসিদ্ধ গ্রন্থে এটা পাইনি। আল্লাহই ভাল জানেন। বর্ণিত আছে, কবি যখন এ কথা বলেছিলেন, যে, সুদ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে (১aw–L), তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, suLw–সুআদ আবার কে? কবি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সুআদ আমার স্ত্রী। তিনি বললেন, না, সে বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু এটা সঠিক নয়। সম্ভবতঃ সে ধারণা করেছিলো যে, কবি ইসলাম গ্রহণ করায় বুঝি তার স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় যে, তিনি দৈহিক বিচ্ছিন্ন হওয়া বুঝেছেন, নৈতিক বিচ্ছিন্ন নয়।
ইবন ইসহাক বলেন : আসিম ইবন উমার ইব্ন কাতাদা বলেন, কাব যখন তার কাসীদায় এ কথা বললো– (-যখন বেঁটে কালো লোকগুলো কাপুরুষতা প্রদর্শন করলো)। এর দ্বারা তিনি আমাদের আনসার সম্প্রদায়কে বুঝাচ্ছেন। এর কারণ, আমাদের মধ্যেকার একজন কবির সাথে খারাপ আচরণ করেছিলো। তাই তিনি তাঁর কাসীদায় কেবল কুরায়শ মুহাজিরদের প্রশংসা করছিলেন। এ কারণে আনসারগণ কবির উপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। সে জন্যে ইসলাম গ্রহণের পর কবি আনসারদের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন। এতে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তাদের ত্যাগ কুরবানী ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কথা উল্লেখ করে কবিতায় বলেন :
من سره کرم الحياة فلايزل في مقنب من صالحی الانصار
ان الخيار هموابنو الاخيار
ورثوا المكارم كابرا عن كابر
کسوالف الهندي غير قصار
المكرهين السمهری بأذرع
كالجمر ، غير كليلة الابصار
والناظرين باعين
محمرة والبائعين نفوسهم لنبيهم للموت ، يوم تعانق وكرار
بالمشرقی و بالقنا الخطار )
والقائدين الناس عن أديانهم يتطهرون ، يرونه نسكا لهم بدماء من علقوا من الكفار دربوا كما دربت بطون خفية غلب الرقاب من الاسود ضواری و اذا حللت ليمنعوك اليهم اصبحت عند معاقل
الاعفار ضربوا عليا يوم بدر ضربة دانت لو قعتها جميع نزار
فيهم لصدقنى الذين أماری
لو يعلم الاقوام علمی کله
للطارقين النازلين مقاری
قوم اذا خسرت النجوم فانهم
اعيت محافرها على المانقار )
في السفر من غسان من جرثومة
“যে ব্যক্তি সম্মানজনক জীবন পেতে আগ্রহী, সে যেন সর্বদা নেককার আনসার সম্প্রদায়ের অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
তারা সম্মানের উত্তরাধিকারী হয়েছেন পুরুষানুক্রমে, আসলে উত্তম লোকদের সন্তানরাই উত্তম হয়ে থাকে।
তাঁরা লম্বা মাপের শক্ত বর্শা চালাতে উত্তেজনা বোধ করেন। বর্শার কাঠগুলো ভারতীয় তরবারির বাঁটের ন্যায় শক্ত কঠিন।
তারা শত্রুর পানে তাকান আগুনের আংগারার ন্যায় রক্তিম চোখে। এ তাকানোর মধ্যে নেই কোন দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা।
তারা ঘোরতর যুদ্ধের দিনে নবীর জন্যে মৃত্যুর বিনিময়ে নিজেদের জীবন বিক্রী করে দেন। তারা মানুষকে তাদের মিথ্যা ধর্ম থেকে ফিরিয়ে আনেন তীক্ষ্ণ তলোয়ার ও ভয়াল বর্শা দ্বারা।
কাফিরদের মধ্যে যারা নিহত হয়, তাদের রক্তে স্নাত হয়ে তারা পবিত্রতা অর্জন করেন এবং এটাকে তারা পুণ্যের কাজ মনে করেন।
তারা শত্রু নির্মূলে অভ্যস্ত, যেমন খাফিয়া জংগলে মাংসল পাঞ্জা বিশিষ্ট সিংহ শিকার ধরে চিরে ফেড়ে খেতে অভ্যস্ত।
তুমি যখন তাদের কাছে আশ্রয় নিবে, তারা তোমাকে রক্ষা করবেন এই উদ্দেশ্যে, তখন মনে হবে যেন তুমি পাহাড়িয়া বকরীর নিরাপদ খোয়াড়ে আশ্রয় নিয়েছে।
তাঁরা বদর যুদ্ধে (বনূ কিনানার) আলী (ইবন মাসউদ)-এর উপর তরবারির আঘাত হানেন। এ ভয়ে নিযার গোত্রের সমুদয় লোক বিনয়ের সাথে এগিয়ে আসে।
তাঁদের সম্পর্কে আমি যা জানি, তা যদি অন্যান্য লোক জানতো, তবে আমাকে সে সব লোক সমর্থন জানাতো, যারা আজ আমার সাথে বিতর্ক করছে।
তারা এমন সম্প্রদায় যে, অভাব অনটন দেখা দিলেও রাত্রের অসহায় আগন্তুককে সমাদরে মেহমানদারী করেন।
(তাওরাতের লেখা মতে তারা জ্বরহুম মানব গোষ্ঠীর গাসসান গোত্রের মূলের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের শিকড় উপড়ে ফেলা কোদালের পক্ষে সম্ভব নয়।)
ইবন হিশাম বলেন : বলা হয়ে থাকে যে, কাব যখন তাঁর [ ], কাসীদাটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামনে আবৃত্তি করেন, তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি আনসারদের গুণাবলীও উল্লেখ করলে না কেন? কেননা, তারা এর যোগ্য”। তখন কা’ব এ কবিতাটি রচনা করেন। মূলতঃ এটা তার অন্য একটি কাসীদার অংশ বিশেষ। ইবন হিশাম বলেন : আলী ইবন যায়দ ইবন জাদআন সূত্রে আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, কা’ব ইব্ন যুহায়র মসজিদে নববীর মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে তার [ ] কাসীদা আবৃত্তি করেছিলেন।
হাফিয বায়হাকী তার পূর্বের সনদে ইবরাহীম ইবন মুনযির হাযামী– ইবন জাদআন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এটা অবশ্য মুরসাল বর্ণনা । শায়খ আবু উমার ইবন আবদুল বার তাঁর “কিতাবুল ইসতিআব ফী মারিফাতিল আসহাব” গ্রন্থে কাব ইবন যুহায়রের জীবনের কিছু অংশ বর্ণনা করার পর বলেন, কা’ব ইবন যুহায়র ছিলেন একজন উচ্চ মানের কবি। তাঁর কবিতার সংখ্যা অনেক। তার যুগের তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কবি। তাঁর ভাই বুজায়রও একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তবে দু’ভায়ের মধ্যে কা’বই শ্রেষ্ঠতর । তাদের পিতা ছিল তাদের চেয়েও উচ্চাংগের কবি। কাবের শ্রেষ্ঠ কবিতার কিছু অংশ নিম্নে দেওয়া হল ।
سعى الفتى وهو مخبوء له القدر
لوكنت اعجب من شئ لاعجبني يسعى الفتی لامور ليس يدر کها والمرء ما عاش ممدود له امل
للنقی
لا تنتهي العين حتى ينتهی الاثر
“কোন কিছু যদি আমাকে বিস্মিত করেই, তবে ঐ যুবকের প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখলে বিস্মিত হই যার ভাগ্য রয়েছে গোপন লুক্কায়িত, অথচ সে তারই জন্যে চেষ্টা করে ফিরছে।
ঐ যুবক এমন অনেক কিছু লাভের জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছে যার নাগাল সে পাবে না কখনও। কেননা, লোক তো একজন, আর উদ্দেশ্য অনেক।
মানুষের জীবনকাল সীমিত। কিন্তু আশা-আকাক্ষা সীমাহীন। চক্ষু তার দৃষ্টিপাত থেকে ক্ষান্ত হয় না। যতক্ষণ না আলামত শেষ হয়ে যায়।
এরপর ইবন আবদুল বার কাবের বহু কবিতা উল্লেখ করেছেন। এখানে তা উদ্ধৃত করলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে । ইবন আবদুল বার তাঁর গ্রন্থে কা’বের মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করেননি। অনুরূপ আবুল হাসান ইবনুল আছীর তাঁর রচিত “কিতাবুল (উসদুল) গাবা ফী মা’রিফাতিস সাহাবা” গ্রন্থেও কবি কাবের মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করেননি। অবশ্য তিনি এটা বলেছেন যে, কবির পিতা যুহায়র রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্মের এক বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন। সুহায়লী বলেন : কাব ইবন যুহায়রের উত্তম কবিতা হলো সেগুলো যার মাধ্যমে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রশংসা করেছেন, যেমন :
بالبرد کالبدر جلى ليلة الظلم ما يعلم الله من دين ومن كرم
تجرى به الناقة الادماء معتجرا فقفي عطا فيه، او اثناء بردته
“ধূসর বর্ণের উটনী তাঁকে বহন করে নিয়ে যায়। তাঁর মাথায় রয়েছে সাদা চাদরের পাগড়ী বাধা। যেন এক পূর্ণিমার চাঁদ, যা অন্ধকার রাতকে আলোকিত করছে।
এরপর তাঁর চাদর কিংবা কম্বলের মধ্য থেকে এমন দীন ও সদাচরণ প্রকাশ পেল যা কেবল আল্লাহই জানতেন ।
হিজরী অষ্টম সালের প্রসিদ্ধ ঘটনা ও কার্যাবলী
হিজরী অষ্টম সালের জুমাদা মাসে মুতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ বছর রমযান মাসে মক্কা বিজয়ের অভিযান হয়। মক্কা বিজয়ের পর শাওয়াল মাসে হাওয়াযিনদের বিরুদ্ধে হুনায়ন ময়দানে যুদ্ধ হয়। এরপর তায়েফ অবরোধের ঘটনা ঘটে। তায়েফ অবরোধের পর যিলকদ মাসে উমরাতুল জিইানা পালিত হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং বছরের অবশিষ্ট সময় সেখানেই কাটান। ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ সফর থেকে যখন মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন তখন যিলহাজ্জ মাস শেষ হতে কয়েক দিন বাকী ছিল । ওয়াকিদী আরও বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ বছর আমর ইবন আস (রা)-কে আযদ গোত্রের শাসক জুলান্দীর দুই পুত্র জায়ফার ও আমরকে প্রেরণ করেন। এ দুই ভাইয়ের মাধ্যমে উক্ত দু এলাকার অগ্নিপূজকদের এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বেদুঈনদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায় করা হয়। ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ বছর যিল-কাদ মাসে ফাতিমা বিন্ত দাহহাক ইবন সুফিয়ান কিলাবীকে বিবাহ করেন। কিন্তু ফাতিমা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। কেউ কেউ বলেছেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে ইখতিয়ার প্রদান করেন। ফাতিমা দুনিয়ার জীবনকে পসন্দ করলে তিনি তাকে বিচ্ছিন্ন করেন। ওয়াকিদী আরও বলেন : এ বছর যিলহাজ্জ মাসে মারিয়া কিবতীর গর্ভে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পুত্র ইবরাহীমের জন্ম হয়। এ দিকে মারিয়ার পুত্র সন্তান জন্ম হওয়ায় অন্যান্য উম্মাহাতুল মু’মিনীন দারুনভাবে ঈর্ষা বোধ করতে থাকেন। মারিয়ার এ সন্তান হওয়ার সময় ধাত্রী ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দাসী সালমা। তিনি আবু রাফির কাছে এ সন্তান হওয়ার সংবাদ জানান। আবু রাফি’ এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ইবরাহীমের জন্মের সুসংবাদ শুনান। রাসূলুল্লাহ (সা) খুশী হয়ে তাকে একটি দাস প্রদান করেন । ইবরাহীমকে লালন-পালনের জন্য উম্মে বা বিন্ত মুনযির ইবন উসায়দ ইবন খিদাশ ইবন আমির ইবন গানাম ইবন আদী ইবুন নাজ্জার ও তার স্বামী বারা ইবন আওস ইবন খালিদ ইবন জা’দ ইবন আওফ ইবন মাবযুল এর নিকট অর্পণ করেন।
এ বছর যারা শাহাদাত বরণ করেন তাঁদের নাম আমরা ইতোপূর্বে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় বর্ণনা করেছি। এ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে খালিদ ইব্ন ওয়ালিদ (রা)-এর হাতে মক্কা ও তায়িফের মাঝে নাখলায় মুশরিকদের সেই বুতখানা ধ্বংসের বর্ণনা ও আমরা করে এসেছি যার মধ্যে আরবের মুশরিকদের উযযা দেবতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সালের রমযান মাসের পাঁচ দিন বাকী থাকতে খালিদ (রা) এটা ধ্বংস করেন। ওয়াকিদীর বর্ণনামতে এ বছরেই রিহাতে অবস্থিত হুযায়ল গোত্রের দেবতা সুওয়া’কে ধ্বংস করা হয়। আমর ইবন আস (রা) এটা ধ্বংস করেন, তবে তিনি এখানে কোন ধন-রত্ন পাননি। এছাড়া মুশালালে অবস্থিত মানাত দেবীর ইবাদতখানাও বিধ্বস্ত করা হয়। আনসারদের আওস ও খাযরাজ গোত্র মানাতের আরাধনা করতো। সা’দ ইবন যায়দ আশহালী (রা) এটা বিধ্বস্ত করেন। মুশরিকদের এই তিন দেব-দেবী সম্পর্কে সূরা নাজম’-এর আয়াত [ ] (“তোমরা কি ভেবে দেখেছে লাত ও উযযা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্বন্ধে? (নাজম : ১৯)-এর তাফসীরে একটি অনুচ্ছেদে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমি বলি : ইমাম বুখারী মক্কা বিজয়ের বর্ণনা শেষে খাছআম গোত্রের ইবাদতখানা ভাংগার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তারা এটাকে ইয়ামানী কাবা বলতো এবং মক্কার কা’বা গৃহের শাখা মনে করতো। তারা মক্কার কাবাকে আল-কা’বাতুল শামিয়া (সিরিয়ার কা’বা) এবং তাদের ওটাকে আল-কা’বাতুল ইয়ামানিয়া (ইয়ামানী কা’বা) বলতো। ইমাম বুখারী বলেন : ইউসুফ ইবন মূসা– জারীর (রা) সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে বললেন, “তুমি কি আমাকে যুল-খালাসার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করবে না”? আমি বললাম “জ্বী, হ্যাঁ”। তখন আমি আহমাস গোত্রের একশ পঞ্চাশজন অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ছুটে চলোম। এরা সবাই ছিল ঘোড়-সাওয়ারে পারদর্শী। কিন্তু আমি ঘোড়ার পিঠে স্থির থাকতে পারতাম না। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আমার এ বিষয়টি ব্যক্ত করলে তিনি তার মুবারক হাত দ্বারা আমার বুকে একটি মৃদু আঘাত করলেন। আমি আমার বুকে তার হাতের স্পর্শের প্রভাব অনুভব করলাম। আঘাতের সাথে তিনি দু’আ করলেন : “হে আল্লাহ্! তাকে স্থির হয়ে থাকতে দিন এবং তাকে হিদায়াত লাভকারী ও হিদায়াত দানকারী হিসেবে কবুল করুন। জারীর (রা) বলেন, এরপর আর কখনও আমি ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে যাইনি। তিনি বলেন, যুল-খালাসা ছিল ইয়ামানের অন্তর্গত খাছআম ও বুজায়লা গোত্রের ইবাদত গৃহ। সেখানে কিছু মূর্তি স্থাপিত ছিল। লোকেরা এর পূজা করতো। এ ঘরটিকে বলা হতো ইয়ামানী কাবা। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি সেখানে এসে ঘরটিকে ভেংগে দিলেন এবং আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। বর্ণনাকারী আরও বলেন, জারীর (রা) যখন ইয়ামানে পৌঁছেন তখন সেখানে এক ব্যক্তি থাকতো এবং সে তীরের সাহায্যে ভাগ্য গণনা করতো। তাকে বলা হলো, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দূত এখানে আছেন, তোমাকে ধরতে পারলে গর্দান উড়িয়ে দিবেন। একদিন সে তীর দিয়ে ভাগ্য গণনা কাজে রত ছিল। এমন সময় জারীর (রা) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি তাকে বললেন, “তীরগুলো ভেংগে ফেলো ও আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এ কথার সাক্ষ্য দাও; অন্যথায় তোমার গর্দান উড়িয়ে দিব”। লোকটি তখন তীরগুলো ভেংগে ফেললো এবং এক আল্লাহর সাক্ষ্য দিল । এরপর জারীর (রা) আহমাস গোত্রের আরতাত নামক এক ব্যক্তিকে এ সংবাদ জানাবার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পাঠিয়ে দেন। লোকটি নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, সে ইবাদত খানাটিকে ঠিক পাঁচড়া আক্রান্ত উটের মত করে রেখে আমি এসেছি । বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনার পর নবী করীম (সা) আহমাস গোত্রের অশ্বারোহী ও পদাতির বাহিনীর কল্যাণের জন্যে পাঁচবার দু’আ করলেন। এ হাদীছটি ইমাম মুসলিম বিভিন্ন সূত্রে ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ কায়স ইবন আবূ হাযিম- জারীর ইবন আবদুল্লাহ বাজালী (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আলহামদু লিল্লাহ, ইব্ন কাছীরের তারীখুল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার চতুর্থ খণ্ড শেষ হলো । এরপর পঞ্চম খণ্ড শুরু হয়েছে তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে। এ যুদ্ধ হয়েছিল সে বছর রজব মাসে।
[ইসলামের ইতিহাস : আদি-অন্ত – চতুর্থ খণ্ড সমাপ্ত]
very good islamic article