আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া – চতুর্থ খণ্ড
তৃতীয় হিজরী
এই হিজরীর শুরুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল “নাজদ”-এর যুদ্ধ। এটিকে “যূ-আমর”-এর যুদ্ধও বলা হয়।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ছাতুর যুদ্ধ (সাবীক) শেষে মদীনায় ফিরে এলেন। যুলহাজ্জ মাসের বাকী সময়টুকু তিনি মদীনাতে কিংবা মদীনার নিকটবর্তী কোন স্থানে কাটান। তার পর “নাজদের যুদ্ধের জন্যে বের হলেন। এই যুদ্ধ ছিল গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে। এটি “-আমর”-এর যুদ্ধ নামেও প্রসিদ্ধ।
ইন হিশাম বলেন, এ অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত উছমান ইবন আফফান (রা)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রায় পুরো সফর মাস নাজদ অঞ্চলে অবস্থান করেন। এরপর তিনি ফিরে আসেন। সেখানে কোন শত্রুর সাথে মুকাবিলা হয়নি। ওয়াকিদী বলেন, বান্ ছা’লাবা ইবন মুহরিব গোত্রের কতক গাতফানী লোক মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সমবেত হয়েছে বলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সংবাদ পান। তাদেরকে দমন করার জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনা থেকে যাত্রা করেন। তৃতীয় হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার তিনি মদীনা থেকে বের হন। মদীনায় শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন হযরত উছমান ইবন আফফান (রা)-কে। এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ১১ দিন মদীনার বাইরে ছিলেন। ৪৫০ জন মুজাহিদ তার সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের ভয়ে শত্রুপক্ষের বেদুঈনরা পাহাড়ে পালিয়ে যায়। মুসলমানগণ এগিয়ে গিয়ে “যূ-আমর” নামক জলাশয়ের নিকট পৌঁছেন। তারা ওখানে তাঁবু ফেললেন। ওইদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জামা–কাপড় ভিজে গিয়েছিল। একটি গাছের নীচে অবস্থান করে তিনি জামা-কাপড় শুকাতে দিয়েছিলেন। মুশরিকগণ দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করছিল। ওরা নিজ নিজ কাজে মশগুল ছিল। ওদের জনৈক সাহসী লোককে তারা গোপনে মুসলিম তাবুতে পাঠিয়ে দেয়। লোকটির নাম গাওরাছ ইবন হারিছ, মতান্তরে দাছুর ইবন হারিছ। ওরা বলেছিল, মুহাম্মাদকে হত্যা করার মহা-সুযোগ আল্লাহ্ তোমাকে দিয়েছেন। সে সুতীক্ষ্ণ তরবারি হাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পৌঁছে। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমার হাত থেকে তোমাকে আজ কে রক্ষা করবে। তিনি বললেন, রক্ষা করবেন আল্লাহ্ তা’আলা। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আ) এসে ওর বুকে সজোরে আঘাত করেন। তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা হাতে তুলে নিলেন এবং বললেন, “এখন আমার হাত থেকে তোমাকে কে রক্ষা করবে? সে বলল, “কেউই তো এখন আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। এখন আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল। সে আরো বলল, জীবনে আর আমি আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না।” তিনি তার তরবারি ফেরত দিলেন। সে নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিকট ফিরে গেল। তারা বলল, ব্যাপার কী? তোমার কী হয়েছিল? সে বলল, আমি দেখতে পেলাম এক দীর্ঘকায় মানুষ। সে আমার বুকে ঘুষি মারে। তাতে আমি বে-সামাল হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যাই। আমি বুঝতে পেরেছি যে, তিনি ছিলেন ফেরেশতা। তাই আমি সাক্ষ্য দিয়েছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কসম, আমি কোন দিন তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না। সে তার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয় আল্লাহ তাআলার বাণীঃ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের বিরুদ্ধে হাত উঠাতে চেয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের হাত সংযত করেছিলেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, আর আল্লাহরই প্রতি মুমিনগণ নির্ভর করুক। (৫ – মায়িদা : ১১)।
বায়হাকী (র) বলেন, এ ঘটনার মত একটি ঘটনা যাতুর রিকা যুদ্ধের আলোচনায় উল্লেখ করা হবে। এগুলো সম্ভবত দুটো পৃথক পৃথক ঘটনা। আমি বলি, বর্ণনা যদি সত্য হয়, তবে এগুলো যে দুটো পৃথক পৃথক ঘটনা তা সুনিশ্চিত। কারণ, ওই ব্যক্তির নাম গাওরাছ ইবন হারিছ। সে ঈমান আনয়ন করেনি, বরং তার পূর্ব ধর্মে অবিচল ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে হত্যা করবে না তেমন কোন প্রতিশ্রুতি সে তাঁকে দেয়নি। আল্লাহই সর্বজ্ঞাত। বুহরান অঞ্চলে ফুরা-এর যুদ্ধ
ইন ইসহাক বলেন, সে সময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) পুরা রবিউল আউয়াল মাস কিংবা তার কিছু কম সময় মদীনায় অবস্থান করেন। তারপর কুরায়শদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়েন। ইবন হিশাম বলেন, তখনকার জন্যে মদীনার শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন ইবন উম্মে মাকতূমের উপর। ইবন ইসহাক বলেন, ওই অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সা) বুহরানে এসে পৌঁছেন। বুহরান হল আরবে ফুরা অঞ্চলের নিকটবর্তী একটি খনি। ওয়াকিদী বলেন, এই যাত্রায় ১০ দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় অনুপস্থিত ছিলেন। মদীনার ইয়াহুদী গোত্র বা কায়নুকা প্ৰসংগ
ওয়াকিদীর ধারণা বানু কায়নুকা অভিযান সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ২য় সনের ১৫ই শাওয়াল শনিবারে। নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ওদের কথাই উল্লেখ করেছেন :
এদের তুলনা হল এদের অব্যবহিত পূর্বে যারা ছিল তারা। তারা নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছে। তাদের জন্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (৫৯-হাশর : ১৫)।
ইবন ইসহাক বলেন, ‘বানূ কায়নুকা’ গোত্রের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অভিযান পরিচালনার পটভূমি হলো, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাদেরকে এক বাজারে সমবেত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে ইয়াহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহর আযাবের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক হও। বদর যুদ্ধে কুরায়শদের উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল তোমাদের উপরও তেমন আযাব আসতে পারে। তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। তোমরা তো বুঝতে পেরেছ যে, আমি আল্লাহর সেই প্রেরিত রাসূল যার কথা তোমাদের কিতাবে তোমরা পেয়েছ এবং যার সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের অঙ্গীকারও নিয়েছেন। ওরা বলে, হে মুহাম্মাদ! আপনার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন তা যেন আমাদের সম্পর্কে আপনাকে প্রতারিত না করে। আপনিতো মুখোমুখি হয়েছিলেন এমন আরব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিদ্যায় যাদের কোন জ্ঞানই নেই। তাই আপনি ঐ সুযোগে বিজয় অর্জন করেছেন। আল্লাহর কসম, আমরা যদি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হই, তবে আপনি বুঝবেন আমরাই আসল যোদ্ধা জাতি।
ইবন ইসহাক বলেন– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, নিম্নের আয়াতগুলো ওদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে :
যারা কুফরী করে তাদেরকে বলে দিন, তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করা হবে। আর সেটি কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল। দু’দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিল আর অন্যদল কাফির ছিল । ওরা তাদেরকে বাহ্যদৃষ্টিতে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্যে শিক্ষা রয়েছে। (৩-আলে-ইমরান : ১২-১৩)।
আয়াতে দু’ দল অর্থ বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সাহাবীগণ আর তাদের প্রতিপক্ষ কুরায়শগণ।
ইন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা বলেছেন, বান্ কায়নুকা গোত্র হল মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গকারী প্রথম ইয়াহুদী গোত্র। বদর ও উহুদ যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়। ইবন হিশাম বলেন, আবু আওন সুত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন জাফর বলেছেন, বান্ কায়নুকা যুদ্ধের পটভূমি এই ছিল যে, একজন আরব মহিলা তার স্বর্ণালংকার নিয়ে তা বিক্রয় করার জন্যে বাজারে এসেছিল। ঐ বাজারে সে তা বিক্রিও করেছিল। এরপর কায়নুকা গোত্রীয় এক ইয়াহুদী স্বর্ণকারের দোকানে সে বসেছিল। তারা বোরকা পরা মহিলাটির চেহারা উন্মোচন করতে প্রয়াস পায়। সে তা হতে দেয়নি। স্বর্ণকার কৌশলে তার পরনের কাপড়টি তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। ফলে বসা থেকে দাঁড়ানোর সাথে সাথে মহিলাটি বিবস্ত্র হয়ে যায়। এ নিয়ে উপস্থিত ইয়াহুদিগণ হাসাহাসি করে। লজ্জায় ক্ষোভে মহিলা চীঙ্কার জুড়ে দেয়। একজন মুসলমান তা প্রত্যক্ষ করে স্বর্ণকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং তাকে হত্যা করেন। ইয়াহূদীরা ওই মুসলমানের উপর আক্রমণ করে তাকেও হত্যা করে। মুসলমানগণ ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অন্য মুসলমানদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। উভয় পক্ষে যুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়। উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
ইবন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। শেষে তারা তাঁর ফায়সালা মেনে নিতে রাজী হয়। তখন আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সাল্ল তাদের পক্ষ হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কথা বলল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ (সা)! আমার মিত্রদের প্রতি অনুগ্রহ করুন! ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বলল, হে মুহাম্মাদ (সা)! আমার মিত্রদের প্রতি অনুগ্রহ করুন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জামার ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিল।
ইবন হিশাম বলেন, এই যুদ্ধকে “যাত-আলফুযুল” যুদ্ধও বলা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদুল্লাহ ইবন উবাইকে বললেন, আমার জামা ছেড়ে দাও। তিনি তখন ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। চোখে মুখে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠে। তিনি আবার বললেন, ধ্যেৎ, আমার জামা ছেড়ে দাও। আবদুল্লাহ্ বলল, না, আমার মিত্রদের প্রতি যতক্ষণ উদার ও সহজ সিদ্ধান্ত না দেবেন ততক্ষণ জামা ছাড়ব না। ওরা ছিল ৭০০ জন। চারশ’ জন নিরস্ত্র আর তিন শ’ জন বর্ম পরিহিত। সাদা-কালো সকল মানুষদের আক্রমণ থেকে ওরা আমাকে রক্ষা করেছে। আপনি কি এক ভোরেই ওদের সকলকে নির্মূল করে দিতে চান? আল্লাহর কসম, আমি কিন্তু তাতে বড় বিপদের আশংকা করছি। এবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তবে তাদের ব্যাপার তোমার উপরই ছেড়ে দিলাম।
ইবন হিশাম বলেন, বানু কায়নুকা গোত্রকে অবরোধ করে রাখার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার শাসনভার দিয়ে এসেছিলেন আবু লুবাবা বাশীর ইবন আবদুল মুনযির এর হাতে। এই অবরোধ ১৫দিন ব্যাপী কার্যকর ছিল। ইবন ইসহাক বলেন, আমার পিতা আমাকে জানিয়েছেন, উবাদা ইবন ওয়ালীদ ইবন উবাদা ইবন সামিত সূত্রে। তিনি বলেছেন, বানু কায়নুকা গোত্র যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই তাদের পক্ষে কথা বলার দায়িত্ব নিল। এবং সে তাদের পক্ষ অবলম্বন করল। উবাদা ইবন সামিত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গেলেন। আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই এর সাথে যেমন ইয়াহুদী গোত্র বা কায়নুকা এর মৈত্রীচুক্তি ছিল, বানূ আওফ গোত্রের উবাদা ইব্ন সামিত (রা)-এর সাথেও তাদের মৈত্রী চুক্তি ছিল। উবাদা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ওই চুক্তি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন, এবং ওদের সাথে সম্পর্ক বর্জন করে আল্লাহ্ তা’আলা ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ অবলম্বন করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আল্লাহ্ তা’আলা, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের সাথে রয়েছি। সাথে সাথে এসব ইয়াহুদী কাফিরদের সম্পাদিত চুক্তি ও বন্ধুত্ব আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। বর্ণনাকারী বলেন, উবাদা ইবন সামিত এবং আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই দুজনকে উপল্য করে সূরা মায়িদার এ আয়াত নাযিল হয়েছে :
হে মুমিনগণ! ইয়াহুদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ ওদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তুমি তাদের সত্বর ওদের সাথে মিলিত হতে দেখবে এই বলে “আমাদের আশংকা হয় আমাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে।” হয়ত আল্লাহ বিজয় অথবা তার নিকট হতে এমন কিছু দিবেন যাতে তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছিল তার জন্যে অনুতপ্ত হবে। এবং মু’মিনগণ বলবে, এরাই কী তারা যারা আল্লাহর নামে দৃঢ়ভাবে শপথ করেছিল যে, তারা তোমাদের সংগেই আছে? তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়েছে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হে মু’মিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দীন হতে ফিরে গেলে আল্লাহ্ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন ও যারা তাকে ভাল বাসবে, তারা মু’মিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ্ প্রাচুর্যময় ও প্রজ্ঞাময়। তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ্ তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে। (৫-মায়িদা : ৫১-৫৬)। আয়াতে “যাদের মনে ব্যাধি আছে” দ্বারা আবদুল্লাহ্ ইবন উবাইকে এবং “যারা আল্লাহকে তাঁর রাসূলকে এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে” দ্বারা উবাদা ইবন সামিতকে বুঝানো হয়েছে। আমাদের তাফসীর গ্রন্থে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
যায়দ ইবন হারিছার নেতৃত্বে সেনা-অভিযান (যু-কারদা অভিমুখে)
এই অভিযান ছিল আবু সুফিয়ানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কুরায়শের ব্যবসায়ী কাফেলার উদ্দেশ্যে। কেউ বলেছেন, ওই কাফেলা যাত্রা করেছিল সাফওয়ানের তত্ত্বাবধানে। ইউনুস ইবন বুকায়র (র) ইবন ইসহাক সূত্রে বলেছেন যে, এই অভিযানটি পরিচালিত হয় বদর যুদ্ধের ছয় মাস। পর। ইবন ইসহাক বলেন, ঘটনাটি ছিল এই : বদর যুদ্ধের পূর্বে কুরায়শগণ যে পথে সিরিয়া যেত বদর যুদ্ধের পর ওই পথে সিরিয়া যেতে তারা ভয় পেতো। তাই এবার তারা ইরাকের পথে রওনা করে। ওই কাফেলায় কুরায়শের বহু ব্যবসায়ী শামিল ছিল। নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। তার সাথে প্রচুর রৌপ্য ছিল। ঐগুলোই ছিল এই কাফেলার বড় মূলধন। পথ চিনিয়ে দেয়ার জন্যে তারা বকর ইব্ন ওয়ায়েল গোত্রের একজন লোক ভাড়ায় নিযুক্ত করে। তার নাম ছিল ফুরাত ইবন হায়্যান আজালী। সে ছিল বানূ সাহম গোত্রের মিত্র।
ইন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা)-এর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করলেন। কারাদা নামক জলাশয়ের নিকট তারা কুরায়শী কাফেলার সাক্ষাত পান। কাফেলার সকল মালামাল ও ধন-সম্পদ তারা অধিকার করেন। কাফেলার লোকজন অবশ্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। যায়দ ইবন হারিছা (রা) ওই মালামাল নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট জমা দেন। এ প্রসংগে হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন :
সিরিয়ার ঝর্ণাধারাগুলো ছেড়ে তারা অন্য পথে যাত্রা করেছে। কারণ, ওই ঝর্ণাধারাগুলো দখল করে রেখেছে বিশাল বিশাল উটবহর। সেগুলোর অগ্রবর্তী দল গর্ভবতী উটনীর মুখের ন্যায় ।
ওই উটগুলো রয়েছে এমন লোকদের হাতে যারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছেন (মুহাজির) এবং যারা তাঁর সত্য সাহায্যকারী (আনসার)। আর এগুলো রয়েছে ফেরেশতাদের হাতে।
ওগুলো আলিজ উপত্যকা থেকে যখন শুষ্ক জলাশয়ের দিকে যাত্রা করবে, তখন তোমরা ওগুলোকে বলে দিও যে, রাস্তা সেদিকে নয়।
ইবন হিশাম বলেন, এ পংক্তিগুলো হাসানের কবিতাসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিছ অবশ্য হাস্সান (রা)-এর এই চরণগুলোর প্রত্যুত্তর দিয়েছিল।
ওয়াকিদী বলেন, যায়দ ইবন হারিছা এই সেনা অভিযানে বেরিয়েছিলেন হিজরতের ২৮ মাসের মাথায় জুমাদাল উলা মাসের প্রথম দিকে। কুরায়শী কাফেলা সম্পর্কে তার অভিমত হল সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তার নেতৃত্ব দিয়েছে। যায়দ ইবন হারিছা (রা)-এর সেনাপতিত্বে এই অভিযান প্রেরণের পটভূমি হল নু’আয়ম ইবন মাসউদ তখন মদীনায় আগমন করেছিল। সে তখন–ও তার পিতৃ ধর্মে বিশ্বাসী। কুরায়শী ব্যবসায়ী কাফেলা ইরাকের পথে যাত্রা করেছে তা সে জানত। মদীনায় বা নাযীর গোত্রে এসে সে কিনানা ইবন আবুল হুঁকায়ক এর সাথে বৈঠকে মিলিত হয়। তাদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সালীত ইব্ন নুমান আসলামী। তারা সকলে মদপান করল । এ ঘটনা মদপান নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বেকার। কুরায়শী কাফেলার যাত্রা, তাতে সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার নেতৃত্বদান এবং তাদের সাথে থাকা বিপুল মালামালের কথা নু’আয়ম ইবন মাসঊদ ওই বৈঠকে আলোচনা করেছিল। এসব শুনে সালীত ইবন নু’মান (রা) কালবিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। তিনি সব কিছু রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানালেন। তখনই রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে প্রেরণ করলেন। তারা কাফেলাকে ধরে ফেলেন এবং মালামাল হস্তগত করেন। কাফেলার লোকজন অবশ্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা একজন কিংবা দু’জনকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। সব কিছু এনে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট জমা দেন। বিধি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার তত্ত্বাবধানে ব্যয় করার জন্যে মোট সম্পদের ১, অংশ সংরক্ষিত রাখেন। তার মূল্যমান ছিল ২০ হাজার দিরহাম। অবশিষ্ট ৪, অংশ তিনি অভিযানে অংশ গ্রহণকারী মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করে দেন । বন্দীদের একজন হলেন ফুরাত ইবন হাইয়ান। তারপরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবন জারীর বলেন, ওয়াকিদীর ধারণা- এই হিজরী বছরের (৩য় হিজরী) রাবীউল মওসুমে হযরত উছমান (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কন্যা উম্মে কুলছুম (রা)-কে বিয়ে করেন। ওই বছর জুমাদাল আখির মাসে তাদের বাসর হয়।
কা’ব ইবন আশরাফের হত্যার ঘটনা
কা’ব ইব্ন আশরাফ বানু তায় গোত্রের লোক । আর তায় গোত্র, বানূ নাবহান গোত্রের শাখা গোত্র। কিন্তু তার মা ছিল বানূ নাযীর গোত্রের । ইবন ইসহাক এটি উল্লেখ করেছেন বানূ নাযীর গোত্রের দেশান্তরিত করার ঘটনা বর্ণনার পূর্বে। তবে ইমাম বুখারী (র) কা’ব ইবন আশরাফের হত্যার ঘটনা উল্লেখ করেছেন বা নাযীর গোত্রের দেশান্তরিত করার ঘটনা বর্ণনার পরে। তবে ইবন ইসহাকের বর্ণনাই সঠিক। কারণ, বান্ নাযীর গোত্রের ঘটনাটি ঘটেছিল উহুদের যুদ্ধের পর । ওদের অবরোধ কালেই মদ নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান নাযিল হয়। এসব বিষয় আমরা অবিলম্বে বর্ণনা করব ইনশা আল্লাহ্।
ইমাম বুখারী (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থে বলেছেন, “কাব ইবন আশরাফ হত্যাকাণ্ড বিষয়ক অধ্যায়” আলী ইবন আবদুল্লাহ্– জারির ইবন আবদুল্লাহ্ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, কা’ব ইবন আশরাফকে শায়েস্তা করার জন্যে কে আছো? সে তো মহান আল্লাহকে এবং তার রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে। তাঁর কথা শুনে মুহাম্মাদ ইব্ন মালামা (রা) উঠে দাঁড়ালেন, তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি তাকে হত্যা করি তা কি আপনি পছন্দ করবেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হাঁ করব । মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা (রা) বললেন, তাহলে আমাকে এ অনুমতি দিন যে, আমি তার সাথে কিছু কৌশলপূর্ণ কথা বলব। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হাঁ, তুমি যেমন বলতে চাও তা বলবে। সে মতে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা কা’ব ইবন আশরাফের নিকট গেলেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ওই লোকটি (মুহাম্মাদ) আমাদের নিকট সাদকা দাবী করেছে। লোকটি আমাদেরকে খুব কষ্ট দিচ্ছে । আমি আপনার কাছে এসেছি কিছু ঋণ নেয়ার জন্যে। সে বলল, তাহলে তুমিও পাল্টা তাকে কষ্ট দাও। তিনি বললেন, অবশ্য আমরা তাঁর আনুগত্য অবলম্বন করেছি। শেষ পরিণতি না দেখে তাকে ছেড়ে যাওয়া ভাল মনে করছি না। এখন আমি আপনার নিকট কিছু ঋণ চাচ্ছি। সে বলল, হাঁ ঋণ দিব তবে কিছু একটা বন্ধক রাখতে হবে। আমি বললাম, কী বন্ধক রাখতে চান? সে বলল, তোমাদের স্ত্রীলোকদেরকে আমার নিকট বন্ধক রাখবে। মাসলামা (রা) ও তাঁর সাথীগণ বললেন, আপনি তো আরবের অন্যতম রূপবান পুরুষ। আপনার নিকট আমাদের ঘরের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখি কেমন করে? সে বলল, তাহলে তোমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখ। তাঁরা বললেন, সন্তানই বা বন্ধক রাখি কেমন করে? তাহলে লোকজন আমাদেরকে গালি দিবে আর বলবে “দেখ দেখ, এক ওসক কিংবা দুই ওসক শস্যের জন্যে ছেলেদের বন্ধক দিয়েছে। এটি হবে আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। আমরা কিছু অস্ত্রশস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি । তাতে কা’ব রাজী হল এবং রাতে দেখা করতে বলল। মুহাম্মদ ইবন মাসলামা রাতের বেলা তার নিকট হাযির হলেন। তার সাথে কাব-এর দুধ-ভাই আবু নাইলা ছিল । সে তাদেরকে সুরক্ষিত দূর্গে আহ্বান জানাল । তারা যথাস্থানে উপস্থিত হলেন। সেও দুর্গ থেকে নেমে আসলো। এ সময় তার স্ত্রী বলল, এ অসময়ে কোথায় যাচ্ছেন? এক বর্ণনায় আছে যে, তার স্ত্রী এও বলেছিল যে, আমি এমন শব্দ শুনছি তা থেকে যেন রক্ত ঝরছে। কা’ব বলল, তা হবে কেন? ওরা তো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা এবং আমার দুধ ভাই আবু নাইলা। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে রাতের বেলা ছুরিকাঘাত করার জন্যে ডাকলেও ডাকে সাড়া দিতে হয়। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা তার সাথে দুজন লোক নিয়ে গেলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, কা’ব ইবন আশরাফ ঘরে প্রবেশ করলে আমি তার চুল ধরে তার ঘ্রাণ নেব । তোমরা যখন দেখবে যে, আমি মযবুতভাবে তার মাথা ধরে ফেলেছি তখন তোমরা তার উপর আক্রমণ করবে, তরবারির আঘাত করবে। কাব সুসজ্জিত হয়ে তাঁদের নিকট নেমে এল । দেহ থেকে তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছিল। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা বললেন, আজকের ন্যায় সৌরভ আমি কোনদিনই পাইনি, সে বলল, আমার স্ত্রী তো আরবের সর্বাধিক সৌরভময় ও শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা । মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে অনুমতি দেবেন, আমি আপনার মাথা থেকে ঘ্রাণ নেব? সে বলল, হাঁ, তা হবে। তিনি নিজে ঘ্রাণ নিলেন এবং তার সাথীদেরকে ঘ্রাণ নিতে বললেন। তিনি পুনরায় বললেন, পুনরায় আমাকে ঘ্রাণ নেবার অনুমতি দেবেন? সে বলন, হাঁ। এবার তিনি মযবুতভাবে তার মাথা চেপে ধরলেন এবং তার সাথীদেরকে বললেন, কাজ সেরে নাও। তারা তাকে হত্যা করে ফেললেন। এরপর তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে এসে তাঁকে তা অবহিত করলেন ।
ইবন ইসহাক বলেন, কা’ব ইবন আশরাফের পরিচয় এই, সে তায় গোত্রের লোক ছিল যা প্রকৃতপক্ষে বানূ নাহবান গোত্রের শাখা গোত্র ছিল। তার মা ছিল বানূ নাযীর গোত্রের। যায়দ ইবন হারিছা ও আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা বদর ময়দান থেকে ফিরে এসে সেখানে নিহত কাফিরদের অবস্থা যখন জানাল তখন সে বলেছিল, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ যদি সত্যিই ওদেরকে হত্যা করে থাকে তবে মাটির উপরের অংশের চেয়ে মাটির নীচে চলে যাওয়াই আমাদের জন্যে উত্তম। শেষ পর্যন্ত বদরের যুদ্ধে কাফিরদের বিপর্যয় সম্পর্কে সে যখন নিশ্চিত হল তখন সে মক্কায় চলে গেল । সেখানে গিয়ে উঠল মুত্তালিব ইব্ন আবূ ওয়াদা’আর বাড়ীতে। মুত্তালিবের স্ত্রী ছিল উসায়দ ইবন আকূল ঈসের কন্যা আতিকা । সে সসম্মানে তাকে বরণ করল । আদর আপ্যায়ন করল। মক্কায় গিয়ে সে মক্কাবাসীদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রচণ্ডভাবে প্ররোচনা দান করল, এ বিষয়ে সে তার স্বরচিত বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল । বদর যুদ্ধে নিহত কাফিরদের স্মরণে সে শোকগাথা রচনা ও প্রচার করতে লাগল। ইবন ইসহাক তার একটি কাসীদা উল্লেখ করেছেন। সেটির প্রথম পংক্তিটি ছিল এরূপ :
বদর যুদ্ধের যাতা বদরবাসীদের পিষে ফেলেছে। বদরের মত একটি দুঃখজনক ঘটনার জন্যে ক্রন্দন করা ও মাথা পিটানো উচিত।
হাসান ইবন ছাবিত (রা) প্রমুখ তার কবিতার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। ইবন ইসহাক সেগুলোও উল্লেখ করেছেন। এরপর কা’ব ইবন আশরাফ মদীনায় ফিরে আসে। মুসলিম মহিলাদের সম্মুখে প্রেম নিবেদনমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও সাহাবীগণ সম্পর্কে নিন্দামূলক কবিতা রচনা করতে থাকে।
মূসা ইবন উবা বলেন, কাব ইব্ন আশরাফ বানূ নাযীর গোত্রভুক্ত ছিল। অথবা বানূ নাযীর গোত্রে অবস্থানকারী ছিল। নিন্দাগীত রচনা ও আবৃত্তির মাধ্যমে সে নবী করীম (সা)-কে খুব কষ্ট দিত। সে কুরায়শদের নিকট গিয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল। মক্কায় অবস্থানকালে আবু সুফিয়ান তাকে বলেছিল, আমাদের ধর্ম আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর সাহাবীদের ধর্ম? তোমার ধারণায় আমাদের মধ্যে কে অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত ও সত্যের নিকটবর্তী? আমরাতো বড়বড় উঁচু উঁচু উট যবাই করি। তীর্থযাত্রীদেরকে পানি এবং দুধ পান করাই। উত্তরা বায়ু যা উড়িয়ে নিয়ে আসে আমরা তা খাদ্যরূপে দান করি। উত্তরে কাবি বলেছিল মুহাম্মাদ (সা) ও তার সাহাবীদের চেয়ে আপনারাই বরং অধিক হিদায়াত প্রাপ্ত। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা তার রাসূলের (সা) প্রতি নাযিল করলেন :
তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল তারা জিবত ও তাগূতে বিশ্বাস করে? তারা কাফিরদের সম্বন্ধে বলে- এদেরই পথ মু’মিনদের অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর। এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ্ লানত করেছেন। আল্লাহ্ যাকে লা’নত করেন তুমি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবে না। (৪-নিসা : ৫১-৫২)।
মূসা ও মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, কা’ব ইব্ন আশরাফ মদীনায় ফিরে এসে প্রকাশ্যে শত্রুতা করতে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্যে লোকজনকে প্ররোচিত করতে লাগল। বস্তুতঃ সবাই মিলে যুদ্ধ শুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই সে মক্কা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। উম্মুল ফযল প্রমুখ মহিলাকে উপলক্ষ করে সে প্রেম নিবেদনমূলক গীত রচনা ও আবৃত্তি করতে লাগল।
ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুগীছ ইবন আবু বুরদা আমাকে জানিয়েছেন যে, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, কা’ব ইবন আশরাফকে শায়েস্তা করার জন্যে কে আছো।? বানূ আবদুল আশহাল গোত্রের মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! তাকে শায়েস্তা করার জন্যে আমি আপনার জন্যে রয়েছি। আমি তাকে হত্যা করব। তিনি বললেন, তবে পারলে তাই কর। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা (রা) বাড়ী ফিরে গেলেন । তিন দিন তিন রাত প্রাণে বাঁচার মত পরিমাণ ছাড়া কিছুই খেলেন না । এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পৌঁছে গেল। তিনি তাঁকে ডেকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমি তো আপনাকে একটি কথা দিয়েছিলাম। সেটি পূর্ণ করতে পারব কি পারব না সে চিন্তায় আমার দিন কাটছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমার কাজ হল চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া । ইবন মাসলামা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার তো কিছু কথা বলতে হতে পারে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা যেমন চাও তেমন কথা বলতে পার। ওই অনুমতি তোমাদেরকে দেয়া হল, বস্তুতঃ কা’ব ইবন আশরাফকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা, সালকান ইবন সালামা ইবন ওয়াক্স (আবু নায়েলা) আব্বাদ ইবন বিশর ও হারিছ ইবন আওস ইবন মু’আয একত্রিত হলেন। আবু নাইলা ছিলেন আব্দ আশহাল গোত্রের লোক এবং কা’ব ইব্ন আশরাফের দুধ ভাই। আব্বাদ ইবন বিশর এবং হারিছ ইবন তাওস ছিলেন আব্দ আশহাল গোত্রের লোক। আল্লাহর দুশমন কা’ব এর নিকট তারা তার দুধ ভাই আবু নাইলা সালকান ইবন সালামাকে প্রেরণ করলেন। তিনি তার নিকট কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন এবং কবিতা আবৃত্তি করলেন। এক একটি কবিতা আবৃত্তির পর আবু নাইলা বলতে লাগলো, হে আশরাফ পুত্র! আমি একটি বিশেষ কাজে তোমার নিকট এসেছি। আমি তা তোমাকে বলব কিন্তু তুমি তা অবশ্যই গোপন রাখবে। সে বলল, তাই হবে। আবু নাইলা বললেন, আমাদের সমাজে ওই (রাসূল দাবীকারী) লোকটির আগমন এক ভীষণ বিপদ বটে । তার কারণেই আরবের লোকেরা আজ আমাদের শত্রু। ওরা একযোগে আমাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে। তারা আমাদের ব্যবসায়ী কাফেলার যাত্রাপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অভাব-অনটনে আমাদের পরিবার-পরিজন মরতে বসেছে। আমরা এবং আমাদের পোষ্যগণ ভীষণ কষ্টে আছি। কাবি বলল, আমি আশরাফের পুত্র। হে সালামার পুত্র! আমি তোমাদেরকে আগেই তা বলেছিলাম। আমি যা বলেছি শেষ পর্যন্ত হুবহু তা হবেই। সালকান বললেন, এখন আমি চাই যে, তুমি বাকীতে আমাদের নিকট কিছু খাদ্য বিক্রি কর! আমরা কিছু বস্তু বন্ধক রাখব। আশা করি এ বিষয়ে তুমি মহানুভবতা দেখাবে। সে বলল, তবে তোমরা তোমাদের পুত্র সন্তানগুলোকে আমার নিকট বন্ধক রাখবে, আবু নাইলা বললেন, হায়, তুমি কি আমাদেরকে বেইজ্জত করতে চাও? আমার সাথে আমার কতক সাথী আছেন, তারাও আমার মত অভিমত পোষণ করেন। আমি চাই তাদেরকে তোমার নিকট নিয়ে আসি। তুমি উদারভাবে তাদের নিকট বাকীতে কিছু খাদ্য বিক্রয় করবে। আমরা কিছু অস্ত্রশস্ত্র বন্ধক রাখব এবং তোমাকে অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে। সালকান বুঝে নিয়েছিলেন বন্ধক রাখার জন্যে অস্ত্র নিয়ে আসা হলে সে ফিরিয়ে দেবে না। সে বলেছিল অস্ত্র শস্ত্রের ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করা হবে। বস্তুত সালকান (রা) তাঁর সাথীদের নিকট ফিরে এসে পুরো ঘটনা তাদেরকে জানালেন। এবং অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়ার কথা বললেন। তারপর তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট সমবেত হলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, ছাওর ইবন যায়দ বর্ণনা করেছেন, ইকরামা সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁদেরকে বিদায় দিতে বাকী আল গারকাদ নামক স্থান পর্যন্ত এসেছিলেন। তারপর তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর নাম নিয়ে এগিয়ে যাও। হে আল্লাহ্! আপনি এদেরকে সাহায্য করুন!
রাসূলুল্লাহ (সা) তার গৃহে ফিরে এলেন। রাতটি ছিল জ্যোক্সময়। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ও তার সাথিগণ কা’ব এর দুর্গ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন। আবু নাইলা তার নাম ধরে ডাক দিলেন । কা’ব তখন নব বিবাহিত। ডাক শুনে রাত্রিকালীন পোশাকে সে বেরিয়ে আসে। তার স্ত্রী জামা টেনে ধরে এবং বলে, আপনি একজন যোদ্ধা ব্যক্তি। যোদ্ধাগণ তো এ সময়ে ঘর থেকে বের হয়না! সে বলল, এ তো আৰূ নাইলা, আমি ঘুমিয়ে থাকলে সে আমাকে জাগাত না। তার স্ত্রী বলল, আল্লাহর কসম, ওই লোকটির কণ্ঠস্বরে আমি অকল্যাণের আভাস পাচ্ছি। কা’ব বলল, বীর ও সাহসী ব্যক্তিদেরকে যদি খুন করার জন্যেও ডাকা হয় তবু তারা ওই ডাকে সাড়া দেয়। সে নীচে নেমে এল। কিছুক্ষণ সে এবং আগন্তুকদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলল। এরপর তারা বললেন, হে আশরাফ-পুত্র! চলুন না হাঁটতে হাঁটতে আমরা আল আজ গিরি সঙ্কট পর্যন্ত যাই এবং বাকী রাত গল্প করে কাটিয়ে দেই। সে বলল, তোমরা চাইলে তা হবে। সকলে বেরিয়ে পড়লেন। তারা কিছুদুর হেঁটে গেলেন। তারপর আবু নাইলা তাঁর হাত ঢুকিয়ে দিলেন কা’বের মাথার চুলের মধ্যে। হাত টেনে এনে ঘ্রাণ নিয়ে তিনি বললেন, এ রাতের ন্যায় অধিক সুঘ্রাণ আমি কখনো পাইনি। আরো কিছু পথ এগিয়ে আবৃনাইলা পুর্নবার ঘ্রাণ নিলেন। আবার কিছুটা এগিয়ে গেলেন, এবার তিনি কাবের চুলের বেণী দুটো মযবূতভাবে ধরে নিলেন এবং তাঁর সাথীদেরকে বললেন, এবার আল্লাহর শত্রুকে দফা-রফা করে দাও। তাঁরা একযোগে একের পর এক তরবারির আঘাত হানলেন। কিন্তু তাতে ফল হলো না।
মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা (রা) বলেন, আমার তরবারিতে থাকা একটি বল্লমের কথা আমার স্মরণ হল। আমি সেটি খুলে নিলাম। তখন আল্লাহর দুশমন কা’ব সজোরে চীৎকার দিয়ে উঠে। তাতে আশপাশের সকল দুর্গের লোকেরা সতর্কতা স্বরূপ আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা তাঁর বল্লম তলপেটে চেপে ধরেন। প্রচণ্ড চাপ দেয়ায় সেটি তার মুত্র দ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে। তাতে তার মৃত্যু হয়, আমাদেরই কারো ছুরিকাঘাতে আমাদের সঙ্গী হারিছ ইবন আওস তাঁর পায়ে কিংবা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন।
বর্ণনাকারী বলেন, আমরা পথে বেরিয়ে পড়ি। দ্রুতবেগে পথ অতিক্রম করতে থাকি। বান্ উমাইয়া ইব্ন যায়দ গোত্রের এলাকা, বান্ কুরায়যা গোত্রের এলাকা এবং বু’আছ অঞ্চল ছেড়ে আমরা বিস্তৃত পাথুরে ভূমিতে এসে পড়ি। হারিছ ইবন আওসের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল । তিনি পেছনে পড়ে গেলেন। আমরা তাঁর জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আমাদের পদচিহ্ন দেখে দেখে তিনি আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমরা তাঁকে কাঁধে তুলে নিলাম। রাতের শেষ ভাগে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন নামায আদায় করছিলেন। আমরা তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমরা তাঁকে আল্লাহর দুশমন কাবের খুন হওয়ার সংবাদ জানালাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের সাথী হারিছ এর ক্ষতস্থানে লালা লাগিয়ে দিলেন। আমরা নিজ নিজ পরিবারে ফিরে গেলাম। যথা নিয়মে ভোর হল । আল্লাহর দুশমন কাবের হত্যাকাণ্ডের সংবাদে ইয়াহুদিগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। প্রত্যেক ইয়াহূদী তার নিজের জীবন বিপন্ন মনে করল। ইবন জারীর বলেন, ওয়াকিদীর ধারণা মাসলামা ও তাঁর সাথীগণ কা’ব ইবন আশরাফের কর্তিত মাথা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এনে হাযির করেছিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, এ প্রসংগে কবি কা’ব ইবন মালিক কবিতায় বলেন :
এরপর তাদের মধ্য থেকে কা’ব নিহত হল। তার নিহত হওয়ার পর বানূ নাযীর গোত্র লাঞ্ছিত ও অপমানিত হল ।
দু’হাতের আঘাতে সে নিহত হয়েছে। আমাদের সাহসী ও প্রসিদ্ধ হাতগুলো তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
তাকে হত্যা করা হয়েছে মুহাম্মাদ (সা)-এর নির্দেশে। তিনি রাতের বেলা কাবের প্রতি প্রেরণ করেছিলেন তার ভাইকে। তিনি (আবূ নাইলা) রাতেই রওয়ানা করেছিলেন।
নিজের ভাই হওয়াতে কা’ব তাঁকে বিরূপ ভাবেনি। কৌশলে তিনি তাকে নীচে নামিয়ে আনেন। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ছিলেন প্রশংসাযযাগ্য, আস্থাভাজন ও সাহসী ব্যক্তিত্ব।
ইবন হিশাম বলেন, কা’ব ইবন মালিকের এই পংক্তিগুলো। বাণী নাযীর এর যুদ্ধকালে আবৃত্তিকৃত কাসীদার অন্তর্ভুক্ত যা পরে উল্লেখ করা হবে।
আমি বলি, কাব ইবন আশরাফের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল আওস গোত্রীয় লোকদের হাতে। এবং তা হয়েছিল বদরের যুদ্ধের পর। এরপর উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে খায়রাজ গোত্রের লোকেরা আবু রাফি’ ইবন আবুল হুঁকায়ককে হত্যা করেছিলেন। ইনশা আল্লাহ্ অচিরেই তার বর্ণনা আসবে। এ প্রসংগে ইবন ইসহাক হাসান ইবন ছাবিত (রা)-এর নিম্নোক্ত কবিতা উল্লেখ করেছেন :
সকল প্রশংসা আল্লাহর । হে ইব্ন হুঁকায়ক এবং হে ইব্ন আশরাফ, তোমরা তো মুখোমুখি হয়েছ একদল সাহসী মানুষের।
তীক্ষ্ণধার হাল্কা তরবারি নিয়ে রাত্রিবেলা তারা তোমাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তাঁরা ছুটেছিলেন বীর দর্পে যেন বিস্তৃত বনভূমিতে পশুরাজ সিংহ।
তারা এসেছিলেন তোমাদের মহল্লায়। তারপর তীক্ষ্ণধার হাল্কা তরবারির সাহায্যে তোমাদেরকে মৃত্যুর মদিরা পান করিয়েছেন।
তারা তা করেছেন জেনে শুনে। তাদের নবীর দীনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। আর সকল অন্যায় কর্মকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার উদ্দেশ্যে।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, যে কোন ইয়াহূদীকে তোমরা বাগে পেলে তাকে হত্যা করবে। এ ঘোষণা শুনে মাহীসা ইবন মাসউদ ইবন সানীনা এর উপর আক্রমণ করলেন। সে ছিল অন্যতম ইয়াহুদী ব্যবসায়ী। সে মুসলমানদের মধ্যে আসা যাওয়া করত এবং তাদের সাথে বেচাকেনা করত। মাহীসা তাকে হত্যা করলেন। মাহীসার বড় ভাই হুয়াইসা তখনো অমুসলিম। ইব্ন সানীনাকে খুন করার অপরাধে সে মাহীসাকে খুব প্রহার করল । সে বলছিল, হে আল্লাহর দুশমন, তুই ওকে খুন করলি, অথচ তোর পেটের অধিকাংশ চর্বি জমেছে তার ধন-সম্পদ খেয়ে। মাহীসা বলেন, তখন আমি বললাম, ওকে হত্যা করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন এমন এক মহান সত্তা যিনি তোমাকে খুন করার নির্দেশ দিলে আমি নির্দিধায় তোমাকেও খুন করতাম। এই ছিল হুয়াইসার ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক অবস্থা। তিনি বলেছিলেন, হায়, মুহাম্মাদ (সা) যদি তোমাকে নির্দেশ দেন আমাকে হত্যা করার জন্যে তবে তুমি আমাকে হত্যা করবে? মাহীসা বললেন, হাঁ, তা বটে; তিনি আমাকে যদি নির্দেশ দেন তোমাকে খুন করতে তবে আমি তোমাকেও খুন করব। এবার হুয়াইসা বলল, তোমার নিকট যে দীন এসেছে তা তো অত্যন্ত আশ্চর্যজনক দেখছি। এরপর হুয়াইসা ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইন ইসহাক বলেন, বানূ হারিছা গোত্রের আযাদকৃত এক ক্রীতদাস মাহীসার কন্যার বরাতে আমার নিকট এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছে। এ প্রসংগে মাহীসা নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন :
আমার সহোদর ভাই আমাকে গাল-মন্দ করে। অথচ আমি যদি তাকে হত্যা করার জন্যে আদিষ্ট হতাম তবে তীক্ষ্ণধার তরবারির আঘাতে তার ঘাড়ের রগ দুটো তার কানের পেছনের হাড়ের সাথে একাকার করে দিতাম।
সেটি প্রচণ্ড কর্তন শক্তিসম্পন্ন এবং তার রং লবণের মত। আমি তাকে শানিত করে রাখি। যখন আমি তা দ্বারা লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করি তখন তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।
আপোসে ও স্বাভাবিক অবস্থায় তোমাকে আমি খুন করব তা আমার পসন্দ নয়। বস্তুতঃ আমার ও তোমার মাঝে রয়েছে বুসরা ও মাআরিবের মধ্যকার ব্যবধান।
আবূ উবায়দা সূত্রে আবু আমর মাদানী থেকে ইবন হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বানূ কুরায়যা যুদ্ধের পর, এ সময়ে নিহত ব্যক্তির নাম ছিল কা’ব ইবন ইয়াহুয়া। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশে বান্ কুরায়যা যুদ্ধের দিনে মাহীসা (রা) তাকে হত্যা করেছিলেন। তখন তার ভাই হুয়াইসা তাঁকে গালমন্দ করেছিল এবং মাহীসা (রা) প্রত্যুত্তরে উপরোক্ত কথা বলেছিলেন। ওই দিনই হুয়াইসা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
জ্ঞাতব্য : বায়হাকী ও ইমাম বুখারী (র) কা’ব ইবন আশরাফ হত্যার ঘটনার পূর্বে বানূ নাযীর গোত্রের যুদ্ধের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। এবং তা তারা বর্ণনা করেছেন উহুদ যুদ্ধের বিবরণের পূর্বে। তবে বানূ নাযীর যুদ্ধের বিবরণ উহুদ যুদ্ধের বিবরণের পর উল্লেখ করাই সঠিক ও সমীচীন। ইবন ইসহাক প্রমুখ ইতিহাসবিদগণ তাই করেছেন। এর প্রমাণ এই যে, বান্ নাযীর গোত্রকে অবরোধ করে রাখার সময়ে মদ হারাম হওয়ার বিধান নাযিল হয়। অন্যদিকে সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত যে, কতক মুজাহিদ মদ পান করা অবস্থায় উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাতে বুঝা যায়, উহুদ যুদ্ধের সময় মদ পান হালাল ছিল। সেটি হারাম হয়েছে পরে। অতএব, সাব্যস্ত হল যে, বান্ নাযীর গোত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে উহুদ যুদ্ধের পর। আল্লাহই ভাল জানেন।
আরেকটি জ্ঞাতব্যঃ
বান্ কায়নুকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বদর যুদ্ধের পর। উপরে তা আলোচিত হয়েছে। কা’ব ইবন আশরাফ ইয়াহূদী আওস গোত্রের হাতে নিহত হয়েছিল বদর যুদ্ধের পর। বানূ নাযীর গোত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল উহুদ যুদ্ধের পর। এই বিবরণ অচিরেই আসছে। ইয়াহুদী ব্যবসায়ী আবু রাফি এর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল খাযরাজ গোত্রের হাতে উহুদ যুদ্ধের পর। ইয়াহূদী গোত্র বান্ কুরায়যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আহযাব তথা খন্দকের যুদ্ধের পর। পরে সেই বিবরণ আসবে।
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত উহুদ যুদ্ধ
উহুদ নামকরণ প্রসংগে গ্রন্থকার বলেছেন যে, অন্যান্য পাহাড় থেকে এটি পৃথক ও একাকী অবস্থিত বলে এটি উহুদ নামে পরিচিত। সহীহ হাদীস গ্রন্থে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, উহুদ এমন এক পাহাড় যেটি আমাদেরকে ভালবাসে এবং আমরাও সেটিকে ভালবাসি। কেউ কেউ বলেছেন যে, এর অর্থ হল আমরা উহুদ পাহাড়ের আশ-পাশের অধিবাসীদেরকে ভালবাসি আর তারা আমাদেরকে ভালবাসে। আবার কেউ বলেছেন, এর ব্যাখ্যা হল, সফর থেকে ফেরার পথে উহুদ পাহাড় দৃষ্টিগোচর হলে বুঝা যায় যে, বাড়ীর কাছে এসে পৌঁছেছে। উহুদ পাহাড় যেন মুসলিম মুসাফিরদেরকে তাদের বাড়ী-ঘরের নিকটবর্তী পৌঁছার সুসংবাদ দেয় যেমন প্রিয়জন তার প্রিয়জনকে সুসংবাদ প্রদান করে। কেউ কেউ বলেন যে, হাদীস তার প্রকৃত ও প্রকাশ্য মর্মই প্রকাশ করছে । (অর্থাৎ প্রকৃতই উহুদ পর্বত মুমিনদেরকে ভালবাসে তার নিজস্ব চেতনা ও অনুভুতি দিয়ে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলার বাণী- এবং কতক পাথর এমন যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে। (২-বাকারা : ৭৪)। হাদীছে আছে, আবু ‘আবাস ইবন জাবার থেকে বর্ণিত- উহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে। আমরাও তাকে ভালবাসি। সেটি জান্নাতের দরজায় অবস্থিত। আর পাহাড় আমাদের প্রতি বৈরিতা পোষণ করে। আমরাও তাকে ঘৃণা করি। সেটি অবস্থিত জাহান্নামের দরজাসমূহের একটির উপর ।
এই হাদীছের সমর্থনে সুহায়লী বলেন, বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : মানুষ তার সাথেই থাকবে যার সাথে তার বন্ধুত্ব রয়েছে। এটি সুহায়লী এর একটি বিরল উপস্থাপনা। কারণ, এই হাদীছ দ্বারা মানুষের অবস্থান বুঝানো হয়েছে। পাহাড়তো মানুষের অন্তর্ভুক্ত নয়।
এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে। ইমাম যুহরী, কাতাদা, মূসা ইবুন উা এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ও ইমাম মালিক প্রমুখ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবন ইসহাক বলেন, এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি সময়ে, কাতাদা বলেন, শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবারে তা সংঘটিত হয় । ইমাম মালিক বলেন, দিনের প্রথম ভাগে তা সংঘটিত হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন :
“স্মরণ করুন, যখন আপনি আপনার পরিজনবর্গের নিকট হতে প্রত্যুষে বের হয়ে যুদ্ধের জন্যে মু’মিনদেরকে ঘাঁটিতে স্থাপন করছিলেন।” আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যখন তোমাদের মধ্যে দু’ গোত্রের সাহস হারানোর উপক্রম হয়েছিল এবং আল্লাহ্ উভয়ের সহায়ক ছিলেন । আল্লাহর প্রতিই যেন মু’মিনগণ নির্ভর করে। এবং বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে আল্লাহ্ তো তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। স্মরণ করুন, যখন আপনি মু’মিনদেরকে বলছিলেন এটা কি তোমাদের জন্যে যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন হাজার ফেরেশতা দ্বারা তোমাদেরকে সহায়তা করবেন? হাঁ, নিশ্চয় যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল তবে তারা দ্রুত গতিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করলে আল্লাহ্ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। এটি তো কেবল তোমাদের জন্যে সুসংবাদ ও তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি হেতু আল্লাহ্ করেছেন। এবং সাহায্য শুধু পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতেই হয়। কাফিরদের এক অংশকে নিশ্চিহ্ন করার অথবা লাঞ্ছিত করার জন্যে। ফলে তারা যেন নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তিনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদেরকে শাস্তি দেবেন এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ, তারা যালিম। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সমস্ত আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দান করেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৩-আলে ইমরান : ১২১-১২৯)
অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ আল্লাহ মুমিনগণকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে অবহিত করার নন, তবে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনবে। তোমরা ঈমান আনলে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চললে তোমাদের জন্যে মহাপুরস্কার রয়েছে। (৩-আলে ইমরান : ১৭৯)। এ সকল আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা আমরা আমাদের তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার। এখানে আমরা উক্ত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করব। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক প্রমুখ আলিমগণ যা বর্ণনা করেছেন তার আলোকেই আমরা বিবরণ পেশ করব। এ বিষয়ে হাদীছে বর্ণিত আছে মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম যুহরী, মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহয়া ইবন হিব্বান, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা, হুসায়ন ইব্ন আবদুর রহমান ইবন আমর ইবন সা’দ ইবন মু’আয (র) প্রমুখ থেকে। তারা প্রত্যেকে উহুদ দিবসের কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সকলের বর্ণনার সমন্বিত রূপ এই : তারা সকলে কিংবা তাদের কেউ কেউ বলেছেন, বদরের যুদ্ধে কুরায়শী কাফিরদের নেতৃস্থানীয় লোকজন নিহত হয়েছিল এবং তাদের মৃতদেহগুলোকে কুয়েতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তাদের পরাজিত সৈনিকগণ মক্কায় ফিরে গিয়েছিল। অন্যদিকে ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে আবু সুফিয়ানও মক্কায় এসে পৌঁছেছিল। তখন আবদুল্লাহ্ ইবন আবু রবী’আ, ইকরামা ইবন আবু জাহ্নল, সাফওয়ান ইবন উমাইয়াসহ কুরায়শী নেতাগণ যাদের পিতৃবর্গ সন্তানাদি ভাইয়েরা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তারা আবু সুফিয়ানের নিকট উপস্থিত হয়। তারা আবু সুফিয়ানের সাথে এবং ওই ব্যবসায়ী কাফেলায় যাদের মালামাল ছিল তাদের সাথে কথা বলে। তারা বলেছিল, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! মুহাম্মাদ তো তোমাদের আপনজনদেরকে হত্যা করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ লোকদেরকে খুন করেছে এখন এই ব্যবসায়ী কাফেলার ধন-সম্পদ দ্বারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তোমরা আমাদেরকে সাহায্য কর। আমরা আশা করছি যে, তাহলে আমরা তার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারব। ওরা তাই করল ।
ইবন ইসহাক বলেন, কারো কারো মতে নিম্নোক্ত আয়াত ওদেরকে উপলক্ষ্য করে নাযিল হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
আল্লাহর পথ থেকে লোককে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে কাফিররা তাদের ধন সম্পদ ব্যয় করে, তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর সেটি তাদের অনুতাপের কারণ হবে, এরপর তারা পরাভূত হবে এবং যারা কুফরী করে তাদেরকে জাহান্নামে একত্র করা হবে ।) (৮ আনফাল : ৩৬)
ঐতিহাসিকগণ বলেন, আবু সুফিয়ান ও কাফেলার সদস্যগণ কিনানা গোত্র ও তিহামাহ্ বাসীদেরকে নিয়ে এরূপ পরামর্শ করার পর কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও একমত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন ছিল আবু ইজ্জাহ্ আমর ইবন আবদুল্লাহ্ জুমাহী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার প্রতি দয়া করেছিলেন বদর দিবসে। সে ছিল একজন ছাপোষা দরিদ্র লোক। বদর দিবসে মুসলমানদের হাতে সে বন্দী হয়েছিল। যুদ্ধ প্রস্তুতির এই ক্রান্তিকালে সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তাকে বলেছিল, তুমি তো কবি মানুষ। তুমি আমাদের সাথে চল, আমাদেরকে কবিতা শুনিয়ে সাহায্য করবে। সে বলল, মুহাম্মাদ (সা) আমার প্রতি দয়া দেখিয়েছেন আমাকে অনুগ্রহ করেছেন তার বিরুদ্ধে যেতে আমি রাষী নই। সাফওয়ান বলল, তা ঠিক বটে। তবে তুমি শুধু আমাদের সাথে থাকবে, আমাদের সংখ্যা বাড়াবে। আল্লাহকে সাক্ষ্য
রেখে বলছি যদি তুমি যুদ্ধ শেষে বাড়ী ফিরে আস তবে তোমাকে বিত্তবান করে দেবো। আর তুমি যদি যুদ্ধে নিহত হও তাহলে তোমার কন্যাদেরকে আমি আমার কন্যাদের সাথে যুক্ত করে নেবো। সুখে দুঃখে আমার মেয়েদের যে অবস্থা হবে তাদেরও সে অবস্থা হবে। শেষ পর্যন্ত আবু ইজ্জাহ কাফিরদের সাথী হয়ে যুদ্ধে যেতে রাজী হল। সে তিহামা অধিবাসীদের সাথে বের হয়ে বা কিনানা গোত্রকে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলল :
হে আব্দ মানাতের বংশধরগণ! তোমরা তো প্রচণ্ড শক্তিশালী ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবিচল । তোমরা নিজেরা রক্ষক এবং তোমাদের পিতৃপুরুষ ও রক্ষক ছিল।
তোমাদের সাহায্য যেন এ বছরের পর আমার জন্যে প্রয়োজন না হয়। তোমরা আমাকে এ অবস্থায় ঠেলে দিওনা যে, ইসলাম আমার মধ্যে প্রবেশের সুযোগ পায় ।
বর্ণনাকারী বলেন, অন্য দিকে বানূ মালিক গোত্রের নিকট গেল নাফি’ ইব্ন আবদ মানাফ ইব্ন ওয়াহ্ব ইবন হুযাফা ইবন জুমাহ্। সে বানূ মালিক গোত্রকে যুদ্ধের জন্যে নিম্নের কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে প্ররোচিত করে :
হে মালিক গোত্রের লোকজন! তোমরা তো সুপ্রাচীনকাল থেকে আভিজাত্য ও মর্যাদার অধিকারী। আমি এখানে তোমাদের আত্মীয়দের এবং দায়িত্বশীলদের দোহাই দিচ্ছি।
যারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আর যারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নয় তাদের সকলের দোহাই দিয়ে আমি তোমাদেরকে ওই চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যা সম্মানিত নগরী- হারাম শরীফের মধ্যবর্তীস্থানে সম্পাদিত হয়েছিল। যা সম্পাদিত হয়েছিল কাবাগৃহের হাতীমের নিকট।
এদিকে জুবায়র ইবন মুতইম তার এক হাবশী ক্রীতদাসকে ডেকে আনল। তার নাম ছিল ওয়াহ্শী। হাবশী কৌশলে যে বর্শা নিক্ষেপ করত, সেটি খুব কম লক্ষ্যভ্রষ্ট হত। জুবায়র ইবন মুতইম তার হাবশী ক্রীতদাস ওয়াহ্শীকে নির্দেশ দিয়ে বলল, তুমি লোকজনের সাথে যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়। বদর যুদ্ধে নিহত আমার চাচা তু’আয়মা ইবন আদীর প্রতিশোধ হিসেবে তুমি যদি মুহাম্মাদ (সা)-এর চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তবে তুমি স্বাধীন হয়ে যাবে। যুদ্ধ উন্মাদনা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং তাদের অনুসারী বানূ কিনানা ও তিহামা অঞ্চলের লোকজন সহ কুরায়শের সম্মিলিত বাহিনী যুদ্ধ অভিযানে যাত্রা করে। তাদের সাথে ছিল কতক মহিলা। উদ্দেশ্য পুরুষদের মনোবল চাঙ্গা রাখা, তাদেরকে যুদ্ধ উন্মাদনায় সজীব রাখা এবং পলায়ন থেকে রক্ষা করা। সেনাবাহিনীর মূল নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান সাখর ইবন হারব। সে তার স্ত্রী হিন্দ বিনত উতবা ইবন রাবীআকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছিল। ইকরামা ইবন আবু জাহলও তার স্ত্রী ও চাচাত বোন উম্মু হাকীম বিন্ত হারিছ ইবন হিশাম ইবন মুগীরাকে নিয়ে বের হয়েছিল। ইকরামার চাচা হারিছ ইবন হিশাম-এর সাথে ছিল তার স্ত্রী ফাতিমা বিন্ত ওলীদ ইবন মুগীরা। সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার সাথে ছিল বারযা বিন্ত মাসউদ ইবন আমর ইবন উমায়র ছাকাফিয়্যাহ। আমর ইব্ন আস-এর সাথে ছিল রীতা বিন্ত মুনাবৃবিহ ইবন হাজ্জাজ। রীতা হল আমরের পুত্র আবদুল্লাহ্-এর মা। আরো যারা নিজ নিজ স্ত্রীদেরকে সাথে নিয়ে বেরিয়েছিল কেউ কেউ তাদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন। যাত্রাপথে ওয়াশী এবং হিব্দ কাছাকাছি এলে ওয়াহশীকে লক্ষ্য করে হিন্দ বলত, ওহ্ আবু দামামা। তুমি আমাদেরকে মুক্তি দাও তুমি নিজেও মুক্তি লাভ কর । এ কথ দ্বারা সে ওয়াহশীকে উত্তেজিত করছিল হামযা (রা)-কে হত্যা করার জন্যে। বস্তুত তারা মদীনার নিকটবর্তী হল । মদীনার উপকণ্ঠে খালের তীরে বাতনু সাবাখা’ পাহাড়ের কাছাকাছি আইনায়ন নামক স্থানে তারা তাঁবু ফেলল। তাদের আগমন সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা) ও মুসলমানদের নিকট পৌঁছে যায়। তিনি মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখেছি যে, একটি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আমি আরো দেখলাম যে, আমার তরবারির ধারের মধ্যে ভাঙ্গার চিহ্ন। আমি এও দেখলাম যে, একটি মজবুত লৌহ বর্মে আমি আমার হাত ঢুকিয়েছি। আমি মনে করি, ওই মজবুত লৌহ বর্ম হল মদীনা নগরী। এই হাদীছটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম দুজনেই আবৃ কুরায়ব– আবূ মূসা আশআরী (রা)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন :
আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে, আমি মক্কা থেকে হিজরত করে একটি খেজুর বাগান বিশিষ্ট স্থানে যাচ্ছি। আমি মনে করেছিলাম ওই স্থানটি ইয়ামামা কিংবা হাজর। পরে দেখলাম যে, সেটি ইয়াছরিব–মদীনা। আমার এই স্বপ্নে আমি দেখলাম যে, আমি আমার তরবারি নাড়া দিলাম সেটি মাঝখান থেকে ভেঙ্গে গেল। এটি হল উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের উপর আপতিত বিপদের ইঙ্গিত। আমি পুনরায় তরবারি নাড়া দিলাম। সেটি পূর্বের চেয়েও অধিক সুন্দর রূপ নিল। এটি হল ওই যুদ্ধে পুনরায় মুসলমানদের একত্রিত হওয়া এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত বিজয়ের ইঙ্গিত। আমি স্বপ্নে দেখলাম, কতকগুলো গরু জবাই করা হচ্ছে। কলাণ আল্লাহর নিকটই। তা ছিল উহুদ যুদ্ধের শহীদদের প্রতি ইঙ্গিত। আর কল্যাণ হল বদরের যুদ্ধের পর থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে সকল বিজয় ও বিনিময় দান করেছেন সে গুলো।
বায়হাকী বলেন, আবু আবদুল্লাহ হাফিয– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, বদরের যুদ্ধের গনীমত হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর যুলফিকার তরবারিটি পেয়েছিলেন। ওই তরবারিটিই তিনি উহুদ যুদ্ধের দিনে স্বপ্নে দেখেছিলেন। বস্তুত যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মুশরিকগণ যখন মদীনার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছল তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইচ্ছা ছিল মদীনায় অবস্থান করেই ওদের মুকাবিলা করা। বদরের যুদ্ধে ছিলেন না এমন কতক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা মদীনা থেকে বের হব এবং উহুদ প্রান্তরে গিয়ে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব । বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুজাহিদগণ যে ফযীলত ও সম্মান লাভ করেছেন তা লাভ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্যে। এ বিষয়ে তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পীড়াপীড়ি করছিলেন। শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ পোশাকে সজ্জিত হলেন। এবার ওই সাহাবীগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলেন। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মদীনাতেই অবস্থান করুন। আপনার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। তিনি বললেন, কোন নবী যদি যুদ্ধ পোশাক পরিধান করেন তবে শত্রুর বিরুদ্ধে ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ পোশাক খুলে ফেলা তার জন্যে শোভনীয় নয়। বর্ণনাকারী বলেন, সেদিন যুদ্ধ পোশাক পরিধান করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণকে বলেছিলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি একটি মযবুত লৌহবর্মে আমার হাত ঢুকিয়েছি। আমি তার ব্যাখ্যা করেছি যে, সেটি হল সুরক্ষিত মদীনা নগরী। আমি দেখেছি যে, আমি একটি বকরী পাল তাড়া করছি। বস্তুতঃ এর ব্যাখ্যা হচ্ছে শত্রু সেনাবাহিনী । আমি দেখেছি, আমার তরবারি যুলফিকারের ধারের মধ্যে ভাঙ্গা-চিহ্ন। আমি এর ব্যাখ্যা করেছি যে, তোমরা আঘাত প্রাপ্ত হবে। আমি দেখেছি, একটি গরু জবাই করা হচ্ছে। বস্তুতঃ সকল কল্যাণ আল্লাহ্ই হাতে। ইমাম তিরমিযী ও ইবন মাজা উক্ত হাদীছটি আবদুর রহমান ইবন আবু যিনাদ সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন।
বায়হাকী (র) হাম্মাদ ইবন সালামা–আনাস (রা) থেকে মার রূপে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার পেছনে কতকগুলো মেষ। আমার তরবারির ধার অংশে ভাঙ্গার চিহ্ন। আমি স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা করেছি যে, আমি শত্রু পক্ষের সৈন্যদেরকে হত্যা করব। আর আমার তরবারির ধার ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাখ্যা হল, আমার বংশের কারো নিহত হওয়া। ওই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা হামযা (রা) শহীদ হন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) শত্রু পক্ষের পতাকাবাহী তালহাকে হত্যা করেন।
মূসা ইবন উকবা (র) বলেন, কুরায়শরা পুনরায় প্রস্তুতি গ্রহণ করল। তাদের অনুগত আরবের মুশরিকদেরকেও সাথে নিল। আবূ সুফিয়ান কুরায়শের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যাত্রা করল। এটি ছিল বদরের যুদ্ধের পরের বছর শাওয়াল মাসের ঘটনা, উহুদ পাহাড়ের মুখোমুখি বতনওয়াদীতে এসে তারা অবস্থান নিল। কতক মুসলমান বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে সম্মান মর্যাদা ও ছাওয়াব অর্জনে বঞ্চিত হয়ে তাঁরা অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তাই শত্রুর মুখোমুখি হবার জন্যে তাঁদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ ছিল। যাতে বদরী সাহাবীগণের ন্যায় তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারেন। আবু সুফিয়ান ও মুশরিকগণ উহুদ প্রান্তরে এসেছে শুনে ওই সাহাবীগণ আনন্দিত হলেন। তারা বলেন, শত্রুর মুকাবিলা করার আমাদের আগ্রহ পূর্ণ করার জন্যে মহান আল্লাহ্ এ সুযোগ এনে দিয়েছেন।
জুমুআর রাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি স্বপ্ন দেখলেন। সকালে সাহাবীদেরকে ডেকে তিনি বললেন, গতরাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, একটি গরু জবাই করা হচ্ছে । কল্যাণ আল্লাহর নিকট। আমি আরো দেখলাম আমার তরবারি যুলফিকার ধারের স্থানে ভেঙ্গে গিয়েছে। অন্য বর্ণনায় আছে তাতে ভাঙ্গার চিহ্ন দেখা গিয়েছে। এই স্বপ্ন দেখে আমি দুঃখ পেয়েছি, মূলতঃ এ দুটো বিপদের পূর্বাভাস, আমি আরো দেখেছি যে, একটি সুরক্ষিত লৌহ বর্মে আমি আমার হাত ঢুকিয়েছি এবং আমি একটি মেষ তাড়া করছি। স্বপ্নের কথা শোনার পর সাহাবা-ই কিরাম (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি নিজে ওই স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা করেছেন : তিনি বললেন, গরু যবাইয়ের যে স্বপ্ন দেখেছি তা হল আমাদের পক্ষের এবং শত্রু পক্ষের কিছু লোক নিহত হবে । আর তরবারি ভাঙ্গার বিষয়টি আমার নিকট খুবই কষ্টদায়ক। কারো কারো মন্তব্য এই যে, তরবারি ভাঙ্গা বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা দেখেছেন তা হল উহুদ দিবসে তার মুখমণ্ডলে আপতিত আঘাত। সেদিন তার চেহারা মুবারকে আঘাত করেছিল। তারা তাঁর পঁাত শহীদ করে দিয়েছিল। তার ঠোঁট যখম করেছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা, উতবা ইব্ন আবু ওয়াক্কাস তাঁর প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করেছিল, স্বপ্নে দেখা গরু যবাই এর ব্যাখ্যা হলো সেই দিনে শাহাদাত বরণকারী মুসলিমগণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন যে, মেষ এর ব্যাখ্যা আমার মতে শত্রু পক্ষের সৈন্য। মুসলিমগণ তাদেরকে হত্যা করবেন। মযবূত লৌহ বর্মের ব্যাখ্যা হল মদীনা নগরী। মুজাহিদদেরকে নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা মদীনাতেই অবস্থান কর এবং নারী ও শিশুদেরকে দুর্গের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দাও। শত্রুরা যদি আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে তবে আমরা ওদের মুকাবিলা করব- যুদ্ধ করব আর দুর্গের মধ্যে থাকা লোকজন ওদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করবে। মদীনাবাসীগণ মদীনার গলিপথ ও রাস্তা গুলোকে ঘর বাড়ী বানিয়ে আরো সংকীর্ণ করে তুলেছিল। ফলে পুরো মদীনা নগরী দুর্গের ন্যায় হয়ে উঠেছিল । যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রস্তাব শুনে তারা বললেন, আমরা এমন একটি দিনের আকাংখায় ছিলাম । মুখোমুখি জিহাদের একটি দিন আমাদেরকে দেয়ার জন্যে আমরা আল্লাহর নিকট দু’আ করতাম। আল্লাহ্ তা’আলা আজ আমাদেরকে তেমন দিন দিয়েছেন এবং এর দূরত্বও কম । জনৈক আনসারী বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমাদের বাড়ীর কাছে ওরা এসে পড়েছে। এখন যদি আমরা ওদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ না করি তবে আর কবে করব? কতক লোক বলল, ওদের পশু-প্রাণীগুলো তো আমাদের ফসল খেয়ে দলিত মথিত করে দিচ্ছে। আমরা যদি ওই ফসল রক্ষা করতে না পারি তবে কি আর রক্ষা করব? অন্য কতক লোক পূর্ববর্তীদের সমর্থনে কথা বললেন। তাঁদের একজন হযরত হামযা (রা)। তিনি বললেন, যে মহান আল্লাহ্ আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন তার কসম করে বলছি আমরা ওদের মুকাবিলা করবই। বান্ সালিম গোত্রের নু’আয়ম ইবন মালিক ইবন ছালাবা বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাদেরকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করবেন না, যার হাতে আমার প্রাণ! সেই মহান সত্তার কসম, আমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করব। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি কেমন করে জান্নাতে যাবে? তিনি বললেন, কারণ আমি আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি এবং জিহাদের দিনে আমি ময়দান ছেড়ে পালাবনা, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। সত্যি সত্যি সেদিন নুআয়ম (রা) শাহাদাত বরণ করেন। বহুলোক সেদিন বাইরে এসে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রস্তাবে তারা সন্তুষ্ট হননি। তাঁর প্রস্তাব যদি তারা মেনে নিতেন তবে তা তাদের জন্য অনেক ভাল হত। কিন্তু আল্লাহর নির্ধারিত ফায়সালা-ই- প্রাধান্য পেল। বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তাব যারা দিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন, বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে তারা জ্ঞাত ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) জুমু’আর নামায আদায় করছিলেন। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিলেন। নসীহত করলেন। এবং সাধ্য মত জিহাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। যথা নিয়মে খুতবা ও নামায শেষ করলেন। তারপর যুদ্ধ পোশাক আনয়নের নির্দেশ নিলেন। তিনি যুদ্ধ পোশাক পরিধান করলেন। তারপর লোকজনকে যুদ্ধ অভিযানে বের হবার নির্দেশ দিলেন। এ অবস্থা দেখে বিচক্ষণ সাহাবিগণ বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো আমাদেরকে মদীনায় অবস্থান করতে বলে ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে তিনিই তো ভাল জানেন। ঊর্ধ্বাকাশ থেকে তাঁর নিকট ওহী আসে। শেষে তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যেমনটি নির্দেশ দিয়েছিলেন আপনি মদীনাতেই থাকুন, আমরাও তাই করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, যুদ্ধ পোশাক পরিধান করা এবং যুদ্ধ অভিযানে বের হবার ঘোষণা দেয়ার পর যুদ্ধ না করে ফিরে আসা কোন নবীর জন্যে শোভনীয় নয়। আমি তো তোমাদেরকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম; কিন্তু তোমরা অভিযানে বের হওয়া ব্যতীত কিছুতে রাজী হলে না। এখন তোমাদের দায়িত্ব হল তাকওয়া অবলম্বন করা ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণ করা। আর তোমরা অপেক্ষায় থাক, আল্লাহ্ কী নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেলে তা পালন করবে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং মুসলমানগণ অভিযানে বের হলেন। বাদাই-এর পথে তারা অগ্রসর হলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আর মুশরিকদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর অনুসারীগণকে নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু ফেললেন। কিছুদূর গিয়ে আবদুল্লাহ্ ইবন উবায় ইবন সাল তার তিন শ অনুসারীকে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসে। অবশিষ্ট সাত শ’ জন নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) অগ্রসর হলেন। বায়হাকী (র) বলেন, যুদ্ধ ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে এটিই প্রসিদ্ধ কথা যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সাত শ’ জন মুজাহিদ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে যুহরী বলেন, প্রসিদ্ধ কথা হল শেষ পর্যন্ত চার শ’ জন সাহাবী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিলেন। এটি বর্ণনা করেছেন ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান যুহরী থেকে। কেউ কেউ বলেছেন যে, সাত শ’ জন মুজাহিদ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে অবশিষ্ট ছিলেন ইমাম যুহরী থেকে এমন একটি বর্ণনাও রয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
মূসা ইবন উকবা বলেন, মুশরিকদের অশ্ববাহিনীর নেতৃত্ব ছিল খালিদ ইবন ওয়ালীদের হাতে। তাদের সাথে ছিল একশ’টি অশ্ব। তাদের পতাকা ছিল উছমান ইবন তালহার হাতে। বর্ণনাকারী বলেন, মুসলমানদের নিকট একটি অশ্বও ছিলনা। তারপর তিনি বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করেছেন যার বিবরণ অচিরেই আসবে ইনশাআল্লাহ।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার স্বপ্নের কথা সাহাবিগণের নিকট প্রকাশ করলেন, তারপর তিনি বললেন, তোমরা যদি এ অভিমত দাও যে, তোমরা মদীনায় অবস্থান করবে এবং ওদেরকে ওদের স্থানে ছেড়ে দেবে। ওরা যদি ওদের স্থানে অবস্থান করে তাতে তারা একটি মন্দ স্থানে অবস্থান করবে। আর যদি তারা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে তবে মদীনার ভেতরেই আমরা ওদের মুকাবিলা করব। মদীনা থেকে বেরিয়ে ওদের মুখোমুখি না হওয়ার প্রস্তাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে একমত পোষণ করেছিল আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সাল্ল; কিন্তু কতক মুসলমান যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি এবং পরে ওই দিনই উহুদ ময়দানে শাহাদাঁতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদেরকে শত্রুপক্ষের নিকট নিয়ে চলুন! তারা যেন এটা মনে না করে যে, আমরা সাহসহারা এবং দুর্বল হয়ে পড়েছি। আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! শত্রু পক্ষের নিকট যাবেন না, আল্লাহর কসম, ইতিপূর্বে আমরা যখনই মদীনা থেকে বেরিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছি ততবারই পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আর যখনই শত্রুপক্ষ মদীনায় প্রবেশ করেছে তখনই আমরা বিজয় লাভ করেছি। সবাই এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করছিল।এক সময় তিনি হুজরায় প্রবেশ করলেন। তাঁর যুদ্ধ পোশাক পরিধান করলেন। সেদিন ছিল জুম’আর দিন জুম’আর নামায শেষে তিনি এসব করলেন। সেদিন বান্ নাহার গোত্রের জনৈক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। তার নাম ছিল মালিক ইবন আমর । যুদ্ধ পোশাকে তিনি ওই ব্যক্তির জানাযা আদায় করলেন তারপর মুসলমানদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে লোকজন লজ্জিত হল। তারা বলল হায়, আমরা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে বের করে এনেছি এটিতো আমাদের মোটেই উচিত হয়নি। তিনি যখন তাদের সম্মুখে এলেন, তখন তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি চাইলে মদীনাতেই থাকুন। তিনি বললেন, যুদ্ধ পোশাক পরিধান করার পর যুদ্ধ না করে ওই পোশাক খোলা কোন নবীর শান নয়। এক হাজার সাহাবী নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন। ইবন হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখনকার জন্যে মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবন উম্মু মাকতূম (রা)-কে।
ইবন ইসহাক বলেন, মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শাওত নামক স্থানে আসার পর এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়ে আবদুল্লাহ ইবন উবাই দল ত্যাগ করল। সে বলল, হে লোক সকল! রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওদের কথা শুনেছেন আর আমাদের কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাহলে কিসের জন্যে আমরা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেব তা বুঝে আসছে না। তার সম্প্রদায়ের মুনাফিকগণ তাকে অনুসরণ করে ফিরে যায়। হযরত জাবির (রা)-এর পিতা আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইবন হারাম সুলামী ওদের পিছু পিছু গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে থাকার জন্যে ওদেরকে ডেকে ডেকে বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি । শত্রুর মুখোমুখি হওয়া অবস্থায় তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়কে এবং তোমাদের নবীকে ছেড়ে যেয়োনা। মুনাফিকগণ বলল, আমরা যদি মনে করতাম যে, তোমরা সত্যিই জিহাদে যাচ্ছ তবে আমরা তোমাদের কথা মানতাম; কিন্তু জিহাদ সংঘটিত হবার কোন আলামতই আমরা দেখছি না। তার অনুরোধ উপরোধে তারা যখন সাড়া দিলনা তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর শত্রুরা, আল্লাহ্ তোমাদেরকে তার রহমত থেকে সরিয়ে দিন! অতি সত্বর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নবীকে তোমাদের সাহায্য প্রার্থী হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। আমি বলি আল্লাহ্ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণীতে ওই মুনাফিকদের কথাই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :
এবং মুনাফিকদেরকে জানবার জন্যে। এবং তাদেরকে বলা হয়েছিল- আস, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর। তারা বলেছিল “যদি একে যুদ্ধ বলে জানতাম তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীর নিকটতর ছিল ।
যা তাদের অন্তরে নেই তারা তা মুখে বলে, তারা যা গোপন রাখে আল্লাহ্ তা বিশেষভাবে অবহিত”। (৩-আলে ইমরান : ১৬৭)। অর্থাৎ তারা যে বলেছে “যদি যুদ্ধ হবে জানতাম তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম” এই বক্তব্যে তারা মিথ্যাবাদী। কারণ, যুদ্ধ যে সে সময়ে সংঘটিত হবে তা ছিল নিশ্চিত। তাতে কোন অস্পষ্টতা ও সন্দেহ ছিলনা। এই সকল মুনাফিক লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন :
তোমাদের হল কী যে, তোমরা মুনাফিকদের সম্বন্ধে দু’ দলে বিভক্ত হয়ে গেলে? তাদেরকে আল্লাহ্ তাদের কৃতকর্মের জন্যে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। (৪-নিসা : ৮৮)। এ মুনাফিকদের সম্বন্ধে সাহাবাগণ দু ধরণের অভিমত পাওয়া যায়। একদল বলে যে, আমরা এই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি । অপর দল বলেন আমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। সহীহ হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ে হাদীস বর্ণিত আছে।
যুহরী বলেন, উহুদের যুদ্ধের প্রাক্কালে আনসারগণ মদীনায় অবস্থান কারী মিত্রশক্তি ইয়াহুদীদের সাহায্য নেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি চেয়েছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ওদের সাহায্যে আমাদের প্রয়োজন নেই। উরওয়া ইব্ন মূসা ইবন উবা বলেছেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই মুনাফিক ও তার সাথীগণ দলত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর বানূ সালিমা ও বানূ হারিছা গোত্রদ্বয় ও ভগ্ন হৃদয় হয়ে দলত্যাগ করার কথা ভেবেছিল । কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে অবিচল রেখেছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন ।
যখন তোমাদের মধ্যে দু’ গোত্রের সাহস হারানোর উপক্রম হয়েছিল এবং আল্লাহ্ উভয়ের সহায়ক ছিলেন, আল্লাহর প্রতিই যেন মু’মিনগণ নির্ভর করে। (৩-আলে ইমরান : ১২২)। জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) বলেন, এই আয়াত নাযিল হওয়াটাই ছিল আমাদের কাম্য। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন : আল্লাহ্ ওই দু’ দলের সাহায্যকারী। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির (রা) থেকে এরূপ বর্ণিত আছে।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন, বানূ হারিছা গোত্রের পাথুরে অঞ্চল অতিক্রম করার সময় একটি ঘোড়া তার লেজ নাড়ল তা’ জনৈক মুজাহিদের তরবারির বাঁটের সাথে লাগায় তরবারি খাপ থেকে খসে পড়ে। তরবারিধারী সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তরবারি আপাততঃ কোষবদ্ধ করে রাখ, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আজ অচিরেই তরবারিগুলো খোলা হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, এমন কেউ আছে কি যে, আমাদেরকে সংক্ষিপ্ত পথে শত্রুদের নিকট নিয়ে যাবে তবে একেবারে শত্রুদের মুখোমুখি নয়। বানূ হারিছা গোত্রের আবু খায়ছামা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি প্রস্তুত রয়েছি। এরপর তিনি সূলুল্লাহ্ (সা)-কে পথ দেখিয়ে বানূ হারিছা গোত্রের শিলাভূমি ও ধন-সম্পদ ক্ষেত-ফসলের মধ্য দিয়ে নিয়ে চলল । যেতে যেতে তারা মিরবা ইবন কায়যী নামের জনৈক ব্যক্তির বাগানে গিয়ে পৌঁছলেন। ওই লোকটি ছিল মুনাফিক এবং দৃষ্টিশক্তিহীন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও মুসলমানদের আগমন আঁচ করতে পেরে সে উঠে দাঁড়াল এবং মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে ধুলো নিক্ষেপ করতে লাগল। সে বলছিল, তুমি যদি আল্লাহর রাসূল হও তবে আমার বাগানে প্রবেশে তোমার জন্যে অনুমতি নেই। ইবন ইসহাক বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, সে এক মুষ্টি ধুলো হাতে নিয়ে বলেছিল, আল্লাহর কসম, হে মুহাম্মাদ! আমি যদি নিশ্চিত হতে পারতাম যে, আমার নিক্ষিপ্ত মাটি আমি ছাড়া অন্য কারো গায়ে পড়বে না তবে আমি শুধু তোমার মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে এ ধুলো নিক্ষেপ করতাম। তার এ উদ্ধত্য দেখে লোকজন দ্রুত তাকে হত্যা করার জন্যে এগিয়ে চললেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বললেন, না, ওকে মেরোনা। এই ব্যক্তিটি চোখ এবং অন্তর উভয় দিক থেকেই অন্ধ। রসূলুল্লাহ্ (সা) বারণ করার পূর্বেই বানূ আবদুল আশহাল গোত্রের সা’দ ইবন ?য়দ মুনাফিকটির নিকট পৌঁছে যান এবং ধনুক দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন। তাতে তার মাথা যখম হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) অগ্রসর হয়ে অবস্থান নিলো। উহুদ প্রান্তরের উপত্যকায় সমতল ভূমিতে। রাসূলুল্লাহ (সা) উহুদ পাহাড়কে পেছনে রেখে অবস্থান নিলেন। তার সেনাবাহিনী ও তাঁর পেছনের দিকে ছিল। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, তাঁর আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করেন। কুরায়শগণ তাদের সশস্ত্র বাহন জন্তু গুলো ঘাস খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিয়েছিল খালের ধারে শ্যামল শস্যক্ষেত্রে। ওই শস্যক্ষেত্রটি ছিল মুসলমানদের। রাসূলুল্লাহ (সা) আপাততঃ যুদ্ধ থেকে বারণ করার পর জনৈক আনসারী বলে উঠলেন, এ কেমন কথা বানূ কীলা গোত্রের ক্ষেত খামারে পশু চরানো হচ্ছে অথচ আমরা তা তাড়াব না।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তখন তাঁর সাথে মুজাহিদের সংখ্যা ছিল সাত শ’ ?ন। তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান রূপে বানূ আমার ইবন আওফ গোত্রের হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন ?বায়র (রা)-কে মনোনীত করেন । তিনি ছিলেন সাদা পোশাক পরিহিত। তীরন্দাজ বাহিনী সংখ্যায় ছিলেন পঞ্চাশ জন। তিনি বললেন, তীর নিক্ষেপ করে তোমরা শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে প্রতিরোধ করবে। তারা যেন আমাদের পেছনের দিক থেকে আসতে না পারে। যুদ্ধের ফলাফল আমাদের পক্ষে হোক কিংবা বিপক্ষে তোমরা ওই গিরিপথে অবিচল থাকবে। কোন অবস্থাতেই যেন আমরা পেছনের দিক থেকে ওদের দ্বারা আক্রান্ত না হই। সহীহ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীছ রয়েছে। সে গুলোর উদ্ধৃতি অচিরেই আসবে ইনশাআল্লাহ্।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) দুটো যুদ্ধ-বর্ম পরিধান করে মাঠে নেমেছিলেন। অর্থাৎ একটির উপর আরেকটি বর্ম তিনি পরেছিলেন। পতাকা দিয়েছিলেন মুসআব ইবন উমায়রের হাতে। তিনি ছিলেন বানূ আবদিদ দার গোত্রের লোক।
আমি বলি, সেদিন রাসূলুল্লাহ (সা) কতক অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালককে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তাদের এ নাবালকত্বের কারণে তারা উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবন উমার (রা)। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম গ্রন্থে আছে যে, আবদুল্লাহ্ ইবন উমার (রা) বলেছেন, উহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার অভিপ্রায়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা) -এর সম্মুখে উপস্থিত হই। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন না। পরবর্তীতে খন্দকের যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হই। তখন আমার বয়স ১৫ বছর। এবার তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। আরো যারা উহুদ যুদ্ধে অংশ নেয়ার অনুমতি পাননি তাঁদের মধ্যে ছিলেন উসামা ইবন যায়, যায়দ ইবন ছাবিত, বারা ইবন আযিব, উসায়দ ইবন যুহায়র, আরাবা ইবন আওস ইবন কীষী। ইবন কুতায়বা ও সুহায়লী আরাবার নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে কবি শামমাখ বলেন :
মর্যাদার ঝাণ্ডা যখনই উত্তোলিত হয়েছে, তখনই আরাবা সেটিকে তার দক্ষিণ হাতে ধারণ করেছে।
অনুমতি-বঞ্চিতদের মধ্যে ছিলেন ইবন সাঈদ ইবন খায়ছামাহ। তাঁর কথাও উল্লেখ করেছেন সুহায়লী। খন্দক যুদ্ধের সময় তারা সকলেই তাতে অংশ নেয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা) সামুরা ইবন জুনদুব এবং রাফি’ ইবন খাদীজকেও ফেরত পাঠিয়ে দিলেন, তখন তাদের বয়স ছিল পনের বছর। বলা হল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! রাফি তো ভাল তীরন্দার্য । ফলে তিনি রাফি’কে অনুমতি দিলেন। আবার বলা হল সামুরা তো কুস্তিতে রাফিকে পরাস্ত করতে পারে। তিনি তখন সামুরাকেও যুদ্ধে অংশ নেয়ার অনুমতি দিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, অন্যদিকে কুরায়শরা যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হল। তারা সংখ্যায় ছিল তিন হাজার। তাদের অশ্ব সংখ্যা ছিল দুই শ’ । অশ্ব গুলোকে তারা দুপাশে সারিবদ্ধ করল। তারা তাদের অশ্বারোহী বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্ব খালিদ ইবন ওলীদকে এবং বাম বাহুর নেতৃত্ব ইকরামা ইবন আবূ জাহূলকে অর্পণ করে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা; একটি তরবারি উঁচিয়ে ঘোষণা দিলেন, প্রকৃত হক আদায় করার সংকল্প নিয়ে এ তরবারিটি কে নিবে? অনেক মুজাহিদ তা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তিনি তাদের কাউকেই তা দিলেন না । এবার এলেন বানূ সাইদাহ্ গোত্রের আবু দুজানা সিমাক ইবন খারাশা। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই তরবারির হক কী! রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তা হল এটি বেঁকে না যাওয়া পর্যন্ত শত্রুর উপর অনবরত আঘাত হেনে যাওয়া । আবু দুজানা (রা) বললেন, ওই হক আদায়ের সংকল্প নিয়ে আমি সেটি গ্রহণ করব ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তিনি তরবারি খানা তার হাতে তুলে দিলেন । ইবন ইসহাক বিচ্ছিন্ন সনদে এরূপ বর্ণনা করেছেন । ইবন আহমদ (র) বলেন, ইয়াযীদ– ছাবিত থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি তরবারি উঁচিয়ে বললেন, এই তরবারি নেয়ার মত কে আছে? কতক লোক তা নিতে আগ্রহী হল। তিনি তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, এটির হক আদায় করে গ্রহণ করার মত কে আছে? এবার সবাই চুপ হয়ে গেলেন। আবু দুজানা সিমাক বললেন, আমি সেটির হক আদায়ের সংকল্প নিয়ে গ্রহণ করব। আবু দুজানা তা হাতে নিলেন এবং সেটির আঘাতে বহু মুশরিকের মাথার খুলি উড়িয়ে দিলেন। ইমাম মুসলিম (র) এই হাদীছ আবূ বকর সূত্রে আফফান থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন, আবূ দুজানা ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। যুদ্ধকালে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তার একটি লাল পাগড়ী ছিল । যুদ্ধের সময় তিনি তা মাথায় বাঁধতেন । এটি ছিল তার পরিচিতি চিহ্ন। এই পাগড়ী পরিধান করলেই বুঝা যেত যে, তিনি অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাত থেকে তরবারিটি নিয়ে আবূ দুজানা তাঁর লাল পাগড়ি মাথায় বাঁধলেন। তারপর উভয় পক্ষের সারির মাঝখানে গিয়ে প্রচণ্ড বীরত্বের সাথে গর্ব প্রকাশ করতে লাগলেন। বর্ণনাকারী বলেন, জাফর ইবন আবদুল্লাহ– বান্ সালামার গোত্রের জনৈক আনসারী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবূ দুজানার ওই গর্ব প্রদর্শনের মহড়া দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এটি এমন এক চলার ভঙ্গি সাধারণত যা আল্লাহ্ পসন্দ করেন না। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থাৎ যুদ্ধের ময়দানে তা আল্লাহ্ তা’আলা পসন্দ করেন।
ইবন ইসহাক বলেন, বানূ আবদুদ দার গোত্রের পতাকাবাহী লোকদের মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শত্রু সেনাপতি আবু সুফিয়ান বলেছিল, হে আবদুদ দার গোত্রের লোকজন! বদর দিবসে আমাদের পতাকা তোমাদের দায়িত্বে ছিল। সেদিন আমরা যে গ্লানি ভোগ করেছি তা তোমরা দেখেছ । পতাকার উপর সৈনিকদের মনোবল ও সাহস নির্ভর করে । পতাকার পতন হলে সৈন্যদলের পতন হয়। এই যুদ্ধে তোমরা যদি পতাকা সমুন্নত রাখতে পার তবে ভাল । আর যদি তা না পার, তবে পতাকা আমাদের নিকট হস্তান্তর কর, আমরা ওই দায়িত্ব থেকে তোমাদেরকে অব্যাহতি দেবো। এ কথা শুনে প্রতিশ্রুতি প্রদানের আঙ্গিকে তারা বলল, আমরা আমাদের পতাকা আপনার হাতে সোপর্দ করব? আগামীকাল যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম সৈন্যদের মুখোমুখি হলে আপনি দেখবেন আমরা কেমনতর ভূমিকা পালনকারী। আবু সুফিয়ানের ইচ্ছাও ছিল ওদের পক্ষ থেকে এরূপ সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর শ্রবণ করা।
উহুদ দিবসে উভয় পক্ষের সৈনিকগণ মুখোমুখি হলে, হিন্দ বিন্ত উতবা তার সঙ্গিনীদেরকে নিয়ে মুশরিক পুরুষদের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল এবং সকল মহিলা মিলে দফ বাজাতে লাগল । কুরায়শ যোদ্ধাদেরকে উৎসাহিত করে হিন্দ বাদ্যের তালে তালে আবৃত্তি করছিল :
ওহে বানূ আবদুদ দার গোত্র! ওহে দেশ রক্ষাকারী সৈনিকগণ! প্রচণ্ডভাবে তরবারি চালিয়ে যাও।
তোমরা যদি এগিয়ে যাও সম্মুখপানে তবে আমরা তোমাদেরকে আলিঙ্গন করব এবং তোমাদের জন্যে ভালবাসার বিছানা পেতে দেব।
আর তোমরা যদি পশ্চাতে ফিরে আস পালিয়ে আস তবে আমরা তোমাদেরকে চিরদিনের জন্যে পরিত্যাগ করব । কোন দিন আর তোমাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করব না।
ইন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা বলেছেন, আবৃ আমির ছিল আমর ইবন সায়ফী ইবন মালিক ইবন নু’মানের ক্রীতদাস । আমর ইবন সায়ফী বান্ যাবীআ গোত্রের লোক। আবু আমির রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গ ত্যাগ করে ৫০ জন ক্রীতদাসসহ মক্কার পালিয়ে যায়। কারো কারো মতে মক্কাগামী ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল পনের। কুরায়শদেরকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সে তার আপন সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হলে সকলে তার দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেউই তার বিরোধিতা করবে না। উহুদ দিবসে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মুখোমুখি হয় ওই দেশত্যাগী ক্রীতদাস আবৃ আমির। তার সাথে ছিল তার দলবল ও মক্কার কতক ক্রীতদাস। মদীনাবাসীদেরকে ডেকে ডেকে সে বলছিল! হে আওস সম্প্রদায়! আমি আবূ আমির। মুসলমানগণ বললেন, হে ফাঁসিক (পাপাচারী)। আল্লাহ্ তোর অকল্যাণ করুন! জাহেলী যুগে সে রাহিব বা যাজক নামে প্রসিদ্ধ ছিল। শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার নাম দিয়েছিলেন ফাঁসিক পাপিষ্ঠ। মুসলমানদের উত্তর শুনে সে বলল হায়, আমার দেশ ত্যাগের পর আমার সম্প্রদায় এতটা মন্দ ও অকল্যাণে নিমজ্জিত হয়েছে। তারপর সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই শুরু করে। সে তাদের প্রতি পাথর ছুঁড়তে থাকে ।
ইবন ইসহাক বলেন, এর সাথে সাথেই উভয়পক্ষ মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যুদ্ধ উম্মাদনা শুরু হয়। আবু দুজানা তরবারি চালাতে থাকেন। শত্রুপক্ষের ব্যুহ ভেদ করে তিনি তাদের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়েন।
ইবন হিশাম বলেন, একাধিক আলিম আমাকে জানিয়েছেন যে, যুবায়র ইবন আওয়াম বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট তরবারিটি চেয়েছিলাম । তিনি আমাকে না দিয়ে সেটি দিলেন আবু দুজানাকে। তাতে আমার মনে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে মনে বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ফুফাত ভাই । আমি তার ফুফু সাফিয়্যার পুত্র । আমি একজন কুরায়শী। আমি আবূ দুজানার পূর্বে তাঁর নিকট তরবারি চেয়ে আবেদন করি। অথচ তিনি আমাকে বাদ দিয়ে তাকেই তরবারি দিলেন। আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই দেখব আবু দুজানা কী ভূমিকা পালন করে? অতঃপর আমি তাঁর পেছনে পেছনে গেলাম। তিনি একটি লাল পাগড়ী বের করলেন। সেটি মাথায় বাঁধলেন। তা দেখে আনসারীগণ বলে উঠলেন- এই যে, আবু দুজানা, তিনি মৃত্যু পরওয়ানা পাগড়ী বের করেছেন। তাঁরা এরূপ বলছিলেন। ইতোমধ্যে আবু দুজানা পাগড়ী মাথায় বাঁধলেন এবং এই কবিতা আবৃত্তি করতে করতে বেরিয়ে পড়লেন :
আমি সেই ব্যক্তি আমার বন্ধু মুহাম্মাদ (সা) যাকে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ করেছেন। খেজুর বীথিকার নিকট আমরা এখন রক্তের বন্যা বইয়ে দেব।
তিনি আমার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, আমি যেন কখনো পেছনের সারিতে না থাকি। আর আল্লাহ্ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে থাকি। আর আল্লাহ্ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে থাকি।
উমাভী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীস বর্ণনা প্রসংগে আবু উবায়দ আমাকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এরবারি হাতে যুদ্ধ করছিলেন। তখন একজন লোক তার নিকট উপস্থিত হয় এবং তরবারি খানা চায়। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি যদি তোমাকে তরবারি দিই তাহলে তুমি কি পেছনের সারিতে অবস্থান করে যুদ্ধ করবে? সে ব্যক্তি বলল, জ্বী না, তা নয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে একটি তরবারি দিলেন। সে ব্যক্তি তখন এ রণসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে এগিয়ে গেল ।
আমি এমন এক ব্যক্তি যে, আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (সা) আমার অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আমি যেন জীবনে কোনদিন পেছনের সারিতে থেকে যুদ্ধ না করি ।
এই হাদীছটি শু’বা থেকেও বর্ণিত আছে। ইসরাঈলও এটি বর্ণনা করেছেন। তাঁরা দু’জনে আবু ইসহাক সূত্রে হিন্দু বিন্ত খালিদ থেকে কিংবা অন্য কারো সূত্রে মারফু পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেন।
?? শব্দের অর্থ সারিগুলোর পেছনে। একাধিক বিজ্ঞজনের নিকট আমি এ ব্যাখ্যা শুনেছি। এই হাদীছ ব্যতীত অন্য কোন হাদীছে আমি এ শব্দটি পাইনি।
ইবন হিশাম বলেন, এরপর অগ্রসরমান আবু দুজানা যাকেই সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই হত্যা করছিলেন। মুশরিকদের দলে একজন লোক ছিল আহত ব্যক্তি পেলেই সে তার সেবা করছিল ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করছিল। ইতোমধ্যে আবু দুজানা এবং ওই ব্যক্তি কাছাকাছি হয়ে গেল। যুবায়র (র) বললেন, আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছিলাম যেন এরা দুজনে সংঘর্ষ লেগে যায়। অবিলম্বে তারা দুজন মুখোমুখি হয়ে গেল এবং উভয়ে তরবারি পরিচালনা করল । মুশরিক লোকটি আবূ দুজানার উপর তরবারির আঘাত হানল। ঢাল দিয়ে আবু দুজানা তা প্রতিহত করলেন। মুশরিক লোকটির তরবারি ভোতা হয়ে গেল। এবার আবু দুজানা তার উপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেললেন।
এরপর আমি দেখলাম আবু দুজানা তরবারি উঠালেন হিন্দ বিনত উতবার মাথা বরাবর। কিন্তু অবিলম্বে তরবারি সরিয়ে নিলেন। আমি বললাম, এর রহস্য কি তা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। বায়হাকী (র) আদ দালাইল’ গ্রন্থে হিশাম ইবন উরওয়া সূত্রে তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি যুবায়র ইব্ন আওয়াম থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইবন ইসহাক বলেন, আবূ দুজানা বলেছেন যে, আমি একটি লোক দেখলাম যে মুশরিক সৈন্যদেরকে খুব সাহস দিচ্ছে এবং উত্তেজিত করছে। আমি তার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। আমি যখন তার মাথার উপর তরবারি উঠালাম তখন সে অনুনয় বিনয় শুরু করল। তখন আমি দেখতে পেলাম যে সে একজন মহিলা। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তরবারির সম্মানার্থে ওই মহিলাটির উপর তরবারির আঘাত করিনি।
মূসা ইবন উবা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন এই তরবারিটি হস্তান্তরের প্রস্তাব করেছিলেন তখন উমর (রা)-ও তরবারি পাওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে তরবারি দেননি। এরপর যুবায়র (রা)-তরবারিটি পাওয়ার আবেদন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকেও তরবারিটি দেননি। এতে তাঁরা মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, তিনি তৃতীয়বার প্রস্তাব করলেন।
এবার তরবারি পাওয়ার আবেদন জানালেন আবু দুজানা। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-তরবারিটি তাঁকেই দিলেন । আবু দুজানা শেষ পর্যন্ত তরবারির হক আদায় করেছিলেন। সীরাত-অভিজ্ঞদের ধারণা যে, কা’ব ইবন মালিক বলেছেন, আমি যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুসলমানদের মধ্যে ছিলাম। আমি যখন দেখলাম যে মুশরিকদের সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণ তখন আমি এক পাশে সরে দাঁড়ালাম। আমি দেখলাম জনৈক মুশরিক সৈন্য পূর্ণভাবে অস্ত্র সজ্জিত। সে দ্রুতবেগে মুসলমানদের ব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। সে বলছিল, পালাও! পালাও!! যেমন যবেহ করার ভয়ে বকরী দল পালায়। বর্ণনাকারী বলেন, আমি আরো দেখতে পেলাম, একজন মুসলিম সৈনিক ওই মুশরিকের অপেক্ষায় আছে। সেও পূর্ণভাবে অস্ত্র সজ্জিত। আমি গিয়ে মুসলিম সৈনিকের পেছনে দাঁড়ালাম। আমি উভয় সৈনিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমি বুঝে নিলাম যে, শারিরীক ও অস্ত্র-শস্ত্রের দিক থেকে মুশরিকটি অধিকতর শক্তিশালী। আমি অপলক নেত্রে তাদের দুজনকে দেখছিলাম। এক সময় তারা দুজন মুখোমুখি হল। মুসলিম সৈনিকটি তরবারির আঘাত হানল মুশরিকের ঘাড় বরাবর। প্রচণ্ড আঘাতে তার তরবারি মুশরিকের ঘাড় ভেদ করে সোজা নিতম্ব অতিক্রম করে গেল। লোকটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ল । এবার মুসলিম সৈনিকটি তার মুখের পর্দা সরাল এবং বলল, হে কাব! কেমন দেখলেন? আমি আবূ দুজানা!
হযরত হামযা (রা)-এর শাহাদাতবরণ
ইবন ইসহাক বলেন, হযরত হামযা লড়াই করে যাচ্ছিলেন। এক সময় তিনি আরতাত ইবন শুরাহবীল ইবন হাশিম ইবন আব্দ মনাফ ইবন আবদুৰ্দার কে হত্যা করলেন। আরতাত ছিল। শত্রুপক্ষের অন্যতম পতাকাধারী। তিনি ওদের পতাকাবাহী উছমান ইব্ন আবু তালহাকেও হত্যা করলেন। তখন উছমান ইবন তালহা বলছিল :
পতাকাবাহীর কর্তব্য হল বল্লমকে রক্তে রঞ্জিত করা অথবা নিজে টুকরা হয়ে যাওয়া। ইত্যবসরে হযরত হামযা (রা) তার উপর আক্রমণ চালালেন। এবং তাকে হত্যা করলেন। তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল সিবা ইবন আবদুল উযযা গুবশানী। তার উপনাম ছিল আবু নাইয়ার। তার উদ্দেশ্যে হযরত হামযা (রা) বললেন, হে খতনাকারিণী মহিলার ছেলে, এদিকে আয়। তার মা হল উম্মু আনসার। শুরায়ক ইবন আমর ইবন ওয়াহব ছাকাফীর আযাদকৃত ক্রীতদাসী। মক্কায় সে খাতনা পেশায় নিয়োজিত ছিল । দুজনে মুখোমুখি হল। হযরত হামযা তাকে আক্রমণ করে হত্যা করলেন। জুবায়র ইবন মুতইমের ক্রীতদাস ওয়াশী বলে, আল্লাহর কসম, আমি দেখছিলাম হামযাকে তিনি তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষের লোকজনকে কেটেই যাচ্ছিলেন। তাঁকে ধুসর রঙের উটের ন্যায় দেখাচ্ছিল। আমার আগে সিবা গিয়ে হামযার নিকট পৌঁছল। হামযা বললেন, হে খতনাকারিণীর ছেলে এদিকে আয়। হামযা তার উপর আক্রমণ করলেন। তবে সম্ভবত: তার মাথায় আঘাত করতে পারেননি। আমি আমার বর্শা তাক করলাম। সুনিশ্চিতভাবে লক্ষ্যস্থির করে আমি হামযার দিকে বর্শা ছুড়লাম। বর্শা গিয়ে পড়ল তার নাভিমূলে। নাভি ভেদ করে দুপায়ের মাঝখান দিয়ে সেটি বেরিয়ে এল । আমাকে আক্রমণ করার জন্যে তিনি আমার দিকে আসতে উদ্যত হলেন, কিন্তু তার পূর্বেই নিস্তেজ হয়ে গেলেন, এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আমি একটু অপেক্ষা করলাম, তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর আমি তার নিকট এলাম। আমার বর্শা খুলে নিলাম। তারপর স্বগোত্রীয় সৈনিকদের নিকট ফিরে গেলাম । আমার এর অতিরিক্ত কিছুর দরকার ছিল না।
ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন ফযল ইবন আইয়াশ ইবন রাবী’আ ইবন হারিছ বর্ণনা করেছেন, সুলায়মান ইবন ইয়াসার সূত্রে জাফর ইবন আমর ইবন উমাইয়া দিমারী থেকে। তিনি বলেছেন, আমি নিজে এবং উবায়দুল্লাহ্ ইবন আদী ইবন খিয়ার একবার এক সফরে বের হয়ে ছিলাম। উবায়দুল্লাহ্ ছিল বানূ নাওফল ইবন আব্দ মানাফ গোত্রের লোক। তখন মুআবিয়া (রা) এর শাসনকাল যেতে যেতে আমরা হিমস অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছলাম। জুবায়রের ক্রীতদাস ওয়াশী ওখানেই অবস্থান করছিল। আমরা ওখানে পৌঁছার পর উবায়দুল্লাহ ইবন আদী আমাকে বলল, আমরা যদি ওয়াশীর নিকট গিয়ে হযরত হামযার (রা) হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করি তাতে তোমার কি কোন আপত্তি আছে? আমি বললাম, তুমি যদি যাও, তবে আমিও যাব এবং তার কাছে ওই বিষয়ে জানতে চাইব। বস্তুতঃ ওয়াহ্শীর খোঁজে আমরা বের হলাম। লোকজনকে তার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলাম। একজন লোক আমাদেরকে বলল, তোমরা তাঁকে তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় পাবে। এমনও হতে পারে যে, মদের নেশা তাকে পুঁদ করে রেখেছে। যদি তোমরা তাঁকে এ অবস্থায় পাও যে তিনি চীৎকার করছেন তবে তোমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে। অর্থাৎ তাঁর নিকট থেকে কাংখিত উত্তর পেতে পার। আর যদি এ অবস্থায় পাও যে, মদের সামান্য নেশা তাঁর মধ্যে রয়েছে তবে কিছু জিজ্ঞেস না করে তাঁকে ছেড়ে চলে আসবে।
বর্ণনাকারী বলেন, আমরা যাত্রা করে তার নিকট এসে পৌঁছলাম। তিনি তার বাড়ীর আঙ্গিনায় এক বিছানায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি তখন বয়োবৃদ্ধ। বুগাছ পাখীর ন্যায় সাদা কালো মিশ্রিত গায়ের রং। তিনি ডেকে ডেকে বলছিলেন যে, তাঁর কোন অসুবিধা নেই। আমরা তাঁর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি ওবায়দুল্লাহ্ ইবন আদীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি আদী ইবন খিয়ার এর পুত্র? ওবায়দুল্লাহ্ বলল, জ্বী হাঁ, তাই । ওয়াহ্শী বললেন, আল্লাহর কসম, তোমার দুধ মা সাদিয়া তোমকে ঘূ-তুওয়া নামক স্থানে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি আর তোমাকে দেখিনি। আমি সেদিন তোমাকে তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তখন সে ছিল উটের উপর। আমি তোমার দু পাজর চেপে ধরে তোমাকে উটের পিঠে তুলে দিয়েছিলাম। তোমার পা দুটো তখন আমার নজরে পড়ে এরপরে আজ তুমি আমার নিকট এসেছ। আমি তোমার পা দুটো দেখেই তোমাকে সনাক্ত করেছি । বর্ণনাকারী বলেন, আমরা দুজনে তাঁর নিকট বসলাম। আমরা বললাম, আপনি হযরত হামযা (রা) কে কীভাবে হত্যা করেছিলেন তা জানতে এবং সে বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা আপনার নিকট এসেছি। ওয়াশী বললেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন । ঘটনাটি আমি তাকে যেভাবে জানিয়েছি তোমাদেরকেও সেভাবে জানাব। আমি জুবায়র ইবন মুতইম-এর গোলাম ছিলাম । তার চাচা তুআয়মা ইবন আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়। কুরায়শরা পরবর্তী বছর উহুদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তখন আমার মালিক জুবায়র আমাকে বলেছিলেন যে, তুমি যদি আমার নিহত চাচার প্রতিশোধ হিসেবে মুহাম্মদের (সা) চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার তবে তুমি মুক্তি পাবে। কুরায়শী সৈন্যদের সাথে আমি যাত্রা করি। আমি মূলতঃ হাবশী বংশোদ্ভুত লোক। হাবশী কৌশলে আমি বর্শা নিক্ষেপ করতে পারি যা খুব কমই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় । উহুদ ময়দানে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়। আমি হামযার খোঁজে বের হলাম। হঠাৎ আমি তাঁকে লোকজনের মাঝে দেখতে পেলাম। তিনি যেন একটি ধুসর বর্ণের উট। তরবারির আঘাতে শত্রুপক্ষের লোকজনকে কেটে কেটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। কেউই তাকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। আল্লাহর কসম, আমি তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম । আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিলেন তিনি। একটি পাথর কিংবা বৃক্ষের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম আমি। অপেক্ষা করছিলাম যাতে তিনি আমার নাগালের মধ্যে আসেন। ইতোমধ্যে সিবা ইব্ন আবদুল উযযা তাঁর সম্মুখে গিয়ে পৌঁছলেন। তাঁকে দেখে হুংকার ছেড়ে হামযা বললেন, ওহে খতনাকারিণীর ছেলে। এদিকে আয় । অবিলম্বে হামযা তাকে আক্রমণ করলেন; কিন্তু তার মাথায় আঘাত করতে সক্ষম হলেন না।
ওয়াহ্শী বলেন, আমি আমার বর্শা তাক করলাম। নিশ্চিতভাবে লক্ষ্য স্থির করে আমি বর্শা ছুঁড়লাম। বর্শা তাঁর নাভিমুলে গিয়ে পড়ল। নাভি ভেদ করে সেটি তার দুপায়ের মাঝখান ভেদ করে বেরিয়ে পড়ে। তিনি আমাকে আক্রমণ করার জন্যে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে সক্ষম হননি। কিছুক্ষণ আমি অপেক্ষা করি। বর্শাবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে থাকতে দিই। অবশেষে তিনি মারা যান। এরপর আমি তার নিকট আসি এবং আমার বর্শাটি খুলে নেই। পরে আমি স্বগোত্রীয় সৈন্যদের সাথে মিলিত হই। সেখানে বিশ্রাম গ্রহণ করি। আমার অন্য কোন দায় দায়িত্ব ছিল না। আমি তাঁকে হত্যা করেছিলাম যাতে আমি দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি । যুদ্ধ শেষে মক্কায় আসার পর আমি মুক্তি লাভ করি, এবং সেখানে অবস্থান করতে থাকি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মক্কা জয় করেন তখন আমি তায়েফে পালিয়ে যাই। সেখানেই আমি অবস্থান করছিলাম। তায়েফের লোকজন যখন ইসলাম গ্রহণের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল তখন আমি সংকটাপন্ন হয়ে পড়লাম। আমার বসবাসের স্থান সংকুচিত হয়ে এল । আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সিরিয়া কিংবা ইয়ামান কিংবা অন্য কোন দেশে চলে যাওয়ার । আমি এমন চিন্তাভাবনায় ছিলাম এমন সময় একজন লোক আমাকে বলল, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ (সা) তো তাঁর দীন গ্রহণকারী এবং সত্যের সাক্ষ্যদানকারী কাউকে হত্যা করেন না। এ সংবাদ অবগত হয়ে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্যে যাত্রা করি। আমি মদীনায় তার নিকট পৌঁছি। তাঁর নিকট দাঁড়িয়ে আমি সত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছি এটা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হতচকিত হয়ে পড়লেন। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি কি ওয়াশী?” আমি বললাম জী হাঁ, তাই, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তবে আমার নিকট বস এবং হামযা (রা)-কে তুমি কীভাবে হত্যা করেছ তা আমার নিকট খুলে বল! আমি এখন তোমাদের নিকট যা বললাম রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকটও ঠিক তাই বলেছিলাম। আমার বর্ণনা শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে বলেছিলেন, তোমার মুখমণ্ডল তুমি আমার দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখবে। আমি যেন তোমার মুখমণ্ডল দেখতে না পাই। তখন থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যেখানেই থাকতেন সেখানে আমি মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম যাতে আমার চেহারা তাঁর নজরে না পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতি কাল পর্যন্ত আমি এরূপ করেছি। হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে ভণ্ড নবী-মিথ্যাবাদী মুসায়লামা–র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে মুসলমানগণ যখন ইয়ামামার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তখন আমিও তাদের সাথে যাত্রা করি। যে বর্শা দ্বারা আমি হযরত হামযা (রা)-কে হত্যা করেছিলাম ওই বর্শাটি আমি সঙ্গে নিই। উভয় পক্ষ মুখোমুখি হওয়ার পর আমি মুসায়লামাকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেতে পাই। তার হাতে ছিল তরবারি। আরো কিছু চিহ্ন ছিল যা দ্বারা আমি তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হই। তাকে আক্রমণ করার জন্যে আমি প্রস্তুত হই । অন্য দিক থেকে একজন আনসারী লোকও তার উপর আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত হয়। আমাদের উভয়ের লক্ষ্য ছিল সে-ই। আমি আমার বর্শা তাক করলাম। নিশ্চিতভাবে লক্ষ্যস্থির করে আমি বর্শা নিক্ষেপ করলাম । বর্শা গিয়ে তাকে আঘাত করে। আনসারী লোকটিও তার উপর তরবারির আক্রমণ চালায় । আমাদের দুজনের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছে তা আল্লাহই ভাল জানেন। বস্তুত আমিই যদি তাকে হত্যা করে থাকি তবে একদিকে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পর সর্বোত্তম ব্যক্তি অর্থাৎ হযরত হামযা (রা)-কে হত্যা করেছি আর জগতের নিকৃষ্ট ব্যক্তি অর্থাৎ মুসায়লামাকে হত্যা করেছি।
আমি মনে করি, আনসারী লোকটি ছিলেন আবু দুজানা সিমাক ইব্ন খারাশা। ইয়ামামার যুদ্ধে ওই বিবরণ আসবে। মুরতাদ ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পর্বে ওয়াকিদী উল্লেখ করেছেন যে, আনসারী লোকটি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন যায়দ ইবন আসিম মাযানী। সায়ফ ইবন আমর বলেন, ওই আনসারী লোক হলেন আদী ইবন সাহল । বস্তুত: আদী ইবন সাহল নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছিল?
তুমি কি জানো যে, আমি এবং ওয়াহশী হত্যা করেছি অভিশাপগ্রস্ত মুসায়লামাকে।
লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমি কিভাবে তাকে হত্যা করেছি। তখন আমি বলি যে, আমি তাকে আঘাত করেছি। আর এটি হল সেই বর্শা।
প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, ওয়াশীই প্রথম মুসায়লামাকে আঘাত করেন এবং আবৃ দুজানা তার উপর চুড়ান্ত আঘাত হানেন। এ বিষয়ে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবদুল্লাহ ইবন ফল– আবদুল্লাহ্ ইবন উমার (রা) থেকে। তিনি বলেছেন, ইয়ামামার যুদ্ধের দিন আমি জনৈক চীৎকারকারীকে শুনেছি সে চীৎকার করে বলছিল যে, এক কালো ক্রীতদাস তাকে হত্যা করেছে। ইমাম বুখারী (র) হযরত হামযা (রা)-এর শাহাদাঁতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন আবদুল আযীয ইবন আবদুল্লাহ্– জা’ফর ইবন উমাইয়া দিসারী থেকে। তিনি বলেছেন, আবদুল্লাহ্ ইব্ন আদী ইবন খিয়ারের সাথে আমি সফরে বের হয়েছিলাম। এরপর পূর্বোল্লিখিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন । ওই বর্ণনায় আছে যে, উবায়দুল্লাহ ইবন আদী ইবন খিয়ার যখন ওয়াহ্শীর নিকট উপস্থিত হন তখন তাঁর সমগ্র মুখমণ্ডল পাগড়ীতে ঢাকা ছিল তাঁর দুটো চক্ষু আর দুখানা পা ব্যতীত অন্য কিছুই ওয়াহ্শীর দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। এরপর ওয়াশী তাকে যেভাবে চিনলেন তার বর্ণনা রয়েছে। এটি একটি গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিচক্ষণতা বটে। অনুরূপ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন মুজায্যায মুদলিজী। হযরত যায়দ ও তার পুত্র উসামার (রা) দেহের রং ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও মুজায্যায মুদলিজী উসামার (রা) পা দেখে বলেছিলেন যে, এ হচ্ছে যায়দের পুত্র।
ইমাম বুখারীর উদ্ধৃত বর্ণনায় আছে যে, ওয়াশী বলেছেন, লোকজন যখন যুদ্ধের জন্যে সারিবদ্ধ হল তখন সিবা ময়দানে বেরিয়ে আসে। সে বলল, আমার বিরুদ্ধে লড়াই করার কেউ আছ কি? তখন হান্য ইবন আবদুল মুত্তালিব বেরিয়ে এলেন। হুংকার ছেড়ে তিনি বললেন, ওহে সিবা’, ওহে খৎনাকারীর পুত্র, তুই কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে চ্যালেঞ্জ করছিস? একথা বলেই তিনি সিবাকে আচমণ করলেন। সাথে সাথে সে অতীতের ইতিহাসে পরিণত হল। ওয়াহশী বলেন, হামযাকে তাক করে একটি পাথরের আড়ালে আমি লুকিয়ে রয়েছিলাম। তিনি আমার নিকটবর্তী হলেন। আমি তাকে লক্ষ্য করে, বর্শা হুঁড়ি। বর্শাটি ঠিক তার নাভিতে গিয়ে পড়ে । তারপর তা তার দু’ নিতম্বের মাঝখান দিয়ে বের হয়ে আসে। এই ছিল তাঁর অন্তিম অবস্থা। ওয়াহশী এও বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওফাতের পর যখন ভণ্ড নবী মুসায়লামার আবির্ভাব ঘটল তখন আমি বললাম, সম্ভবত আমিই তাকে হত্যা করতে পারব যাতে করে হযরত হামযা (রা)-কে শহীদ করার দায় থেকে আমি মুক্ত হতে পারি । মুসায়লামার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে যারা যাচ্ছিল আমি তাদের সাথী হলাম। এরপর যা হবার হল। আমি দেখতে পেলাম যে, এক ব্যক্তি একটি ভগ্ন প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার চুল এলোমেলো । দেখতে ধূসর উটের মত। তাকে লক্ষ্য করে আমি আমার বর্শা নিক্ষেপ করলাম। সেটি গিয়ে তার বুকভেদ করে তার দু’ কাদের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে গেল। একজন আনসারীও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন, নিজের তরবারি দিয়ে তিনি মুসায়লামার মাথায় আঘাত করেছিলেন ।
আবদুল্লাহ্ ইবন ফযল বলেন, সুলায়মান ইবন ইয়াসার বলেছেন যে, তিনি আবদুল্লাহ্ ইবন উমার (রা)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলছিলেন তখন জনৈকা ক্রীতদাসী ঘরের ছাদে উঠে বলছিল, হায় আমীরুল মু’মিনীন! তার জন্যে দুঃখ হয়। একজন কালো ক্রীতদাস তাঁকে হত্যা করেছে।
ইবন হিশাম বলেন, আমার নিকট বর্ণনা পৌঁছেছে যে, ওয়াহশী মদপানে অভ্যস্ত ছিলো। এ জন্যে তাকে সরকারী চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয় । হযরত উমার ইবন খাত্তাব (রা) বলতেন যে, হযরত হামযার (রা) হত্যাকারীকে আল্লাহ্ ছাড়বেন না ।
ওয়াশী ইবন হারব আবু দাসামা মতান্তরে আবু হারব এর ওফাত হয় হিসে। তিনিই সর্বপ্রথম ইস্ত্রি করা পোশাক পরিধান করেন।
ইন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আড়াল করে মুসআব ইবন উমায়র যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি শহীদ হলেন। ইব্ন কামিয়া লায়ছী তাকে হত্যা করেছিল। সে মুসআব (রা)-কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলে ধারণা করেছিল। ফলে সে কুরায়শদের নিকট গিয়ে বলল, আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।
মূসা ইবন উবা তাঁর মাগাযী গ্রন্থে সাঈদ ইবন মুসায়্যির থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উবাই ইবন খালফ-ই হযরত মুসআব (রা)-কে হত্যা করেছিল। আল্লাহই ভাল জানেন। ১. বিশুদ্ধ উচ্চারণ হচ্ছে মুসায়লিমা।
ইবন ইসহাক বলেন, মুসআব ইবন উমায়র (রা) নিহত হবার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত আলী ইবন আবী তালিবের হাতে পতাকা অর্পণ করেন। তবে ইব্ন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে ইউনুস ইবন বুকায়র বলেছেন। প্রথম থেকেই পতাকা ছিল হযরত আলীর হাতে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন দেখলেন যে, মুশরিকদের পতাকা বহন করছে আবদুদ্দার গোত্রের লোকেরা। তখন তিনি বললেন, প্রতিশ্রুতি পূরণের আমরাই ওদের চেয়ে অধিক তর হকদার। তখন তিনি আলী (রা)-এর হাত থেকে নিয়ে পতাকা মুসআব ইবন উমায়রের হাতে অর্পণ করলেন । হযরত মুসআব শহীদ হওয়ার পর আবার পতাকা আলী (রা)-এর হাতে তুলে দেন।
ইবন ইসহাক বলেন, হযরত আলী (রা) এবং অপর কতক মুসলিম যোদ্ধা বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
ইব্ন হিশাম বলেন, মাসলামা ইবন আল কামা আল-মুমিনী আমাকে বলেছেন যে, উহুদ প্রান্তরে যখন যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আনসারীদের পতাকার নীচে বসলেন। হযরত আলী (রা) বলে পাঠালেন যে, পতাকা এগিয়ে নিয়ে যাও। হযরত আলী পতাকা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি বলছিলেন আমি আকূল কাসাম কর্তনকারীর পিতা। তার ঘোষণার উত্তরে মুশরিকদের পতাকা বহনকারী আবু সা’দ ইবন আবূ তালহা বলল, হে আকূল কাসাম! দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। হযরত আলী (রা) বললেন, অবশ্যই । দুজন উভয় পক্ষের মধ্যখানে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। হযরত আলী (রা) তার উপর আক্রমণ করলেন। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাকে দ্বিখণ্ডিত না করেই তিনি ফিরে এলেন। কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি ওকে হত্যা না করে ফিরে এলেন কেন? তিনি জবাবে বলেন সে বিবস্ত্র হয়ে পড়ায় তার প্রতি আমার করুণার উদ্রেক হয়। তবে বুঝে নিয়েছি যে তার এত্যু অবধারিত। এরকম একটি ঘটনা ঘটিয়েছিলেন হযরত আলী (রা) সিফফীনের যুদ্ধেও। সেটি ছিল বুসর ইবন আবু আরতাতের সঙ্গে। তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হযরত আলী (রা) তার উপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন। সে তখন তাঁর সম্মুখে নিজের লজ্জাস্থান উন্মুক্ত করে দেয় । হযরত আলী (রা) তাঁকে ছেড়ে চলে আসেন। আমর ইবন আস ও সিফফীনের যুদ্ধে একবার তেমনটি করেছিলেন। একদিন হযরত আলী (রা) আমরের উপর আক্রমণ করেছিলেন। তখন আমর নিজের লজ্জাস্থান উন্মুক্ত করে দেন। হযরত আলী (রা) তাকে ছেড়ে ফিরে যান। এ সম্পর্কে হারিছ ইবন নযর বলেন :
তিনি প্রতিদিন এমন সব অশ্বারোহীর মুখোমুখি হন যারা নিজেদের সতর উন্মুক্ত করে রাখে।
তা দেখে হযরত আলী তার উপর থেকে নিজের তরবারি ফিরিয়ে আনেন। আর তা দেখে নির্জনে হাসতে থাকেন মুআবিয়া (রা)।
ইউনুস উল্লেখ করেছেন ইবন ইসহাক থেকে যে মুশরিকদের পতাকা বহনকারী তালহা ইবন আবূ তালহা আবদারী সেদিন যুদ্ধ করার জন্যে ময়দানে হাযির হয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানাচ্ছিল। মুসলিম সৈন্যগণ তার নিকট থেকে সরে থাকছিলেন। তখন যুবায়র ইবন আওয়াম তার মুকাবিলায় এগিয়ে গেলেন। তিনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এক সময় তিনি তার উটের উপর চড়ে বসেন। তিনি তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন এবং নিজ তরবারি দিয়ে তাকে জবাই করে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত যুবায়র (রা)-এর এ বীরত্বের প্রশংসা করে বললেন, প্রত্যেক নবীর হাওয়ারী ও সাহায্যকারী থাকে, আমার হাওয়ারী হল যুবায়র (রা)। তিনি আরো বললেন, আমি যখন দেখলাম মুসলিম সৈন্যগণ তালহা থেকে সরে থাকছে তখন যুবায়র যদি বেরিয়ে না আসত তবে আমি নিজেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতাম।
ইবন ইসহাক বলেন, সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রা) সেদিন আবু সা’দ ইবন আবূ তালহাকে হত্যা করেছিলেন। দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নেমেছিলেন আসিম ইবন ছাবিত ইবন আবূ আফলাহ । তিনি নাফি ইবন আবু তালহা ও তার ভাই জিলাসকে হত্যা করেন। তাদের উভয়েই তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করছিল । সে তার মায়ের নিকট আসত এবং তার কোলে মাথা রাখত। তার মা বলত, বৎস! তোমাকে কে আঘাত করলো? সে বলত মা, আমার প্রতি তীর নিক্ষেপ করার সময় আমি এক ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, সে বলছিল, এটি গ্রহণ কর, আমি আবূ আফলাহ্ এর পুত্র। তখন তার মা মানত করেছিল যে, যদি কোনদিন সে আসিম (রা)-এর মাথা হাতে নিতে পারে তবে ওই মাথার খুলিতে শরাব পান করবে। হযরত আসিম (রা) ও আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছিলেন যেন তিনি কোনদিন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন এবং কোন মুশরিক ও তাকে স্পর্শ করতে না পারে । এজন্যে “রাজী দিবসের ঘটনায় কোন মুশরিকের স্পর্শ থেকে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর লাশকে রক্ষা করেছিলেন। রাজী দিবসের ঘটনা অবিলম্বে বর্ণনা করা হবে ।
ইবন ইসহাক বলেন, হানযালা ইবন আবূ আমির মুখোমুখি হলেন আবু সুফিয়ানের। হানযালার পিতা আবু আমিরের নাম ছিল আমর। তাকে আব্দ আমর ইবন সায়ফীও বলা হত। জাহেলী যুগে সে রাহিব অর্থাৎ ধর্ম যাজক উপাধি পেয়েছিল । এটি হয়েছিল তার প্রচুর ইবাদত বন্দেগীর প্রেক্ষিতে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে ফাঁসিক তথা পাপাচারী নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। কারণ ইসলামী যুগে সে সত্য ও সত্যপন্থীদের অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরোধিতা করতে গিয়ে এবং ইসলাম গ্রহণ থেকে দূরে থাকার উদ্দেশ্যে মদীনা ছেড়ে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য হানযালা হলেন ফেরেশতাদের গোসল প্রাপ্ত হানযালা । ফেরেশতাগণ তাঁকে গোসল দিয়েছিলেন। ওই ঘটনা পরে উল্লেখ করা হবে। বস্তুতঃ হানযালা এবং আবু সুফিয়ান সাখর ইবন হারব পরস্পর মুখোমুখি হলেন। হানযালা যখন আবু সুফিয়ানকে পরাস্ত করছিলেন এবং তার বুকের উপর উঠে বসেন তখন শাদ্দাদ ইবন আওস ওরফে ইবন শাঊব তাঁকে দেখে ফেলে এবং তার উপর আক্রমণ করে তাকে হত্যা করে। তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন “তোমাদের সাথী হানযালাকে এখন ফেরেশতাগণ গোসল দিচ্ছে, তার পরিবারকে জিজ্ঞেস করে দেখ তো ব্যাপার কী? তার স্ত্রীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। ওয়াকিদী বলেন, তাঁর স্ত্রী হলেন জামীলা বিনত উবাই ইবন সালুল । মাত্র ওই রাতেই তিনি নববধুরূপে হানালার গৃহে আগমন করেছিলেন। তিনি জানালেন, হানযালার গোসল ফরয হয়েছিল। যুদ্ধের অহ্বান শুনে গোসল না করেই তিনি জিহাদে বেরিয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এজন্যেই ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দিয়েছেন ।
মূসা ইবন উকবা উল্লেখ করেছেন যে; হানযালা (রা)-এর পিতা তার বুকে পদাঘাত করেছিল এবং বলেছিল, তুই দুটো অপরাধ করেছিস। এখানে আসতে আমি তোকে নিষেধ করেছিলাম । আল্লাহর কসম, তুইতো আত্মীয় বৎসল এবং পিতৃভক্ত ছিলি ।
ইবন ইসহাক বলেন, এ সম্পর্কে ইবন শাউব বলেছিল–
আমি অবশ্যই রক্ষা করব আমার সাথীকে এবং আমার নিজেকে সূর্য কিরণ তুল্য একটি বর্শা দ্বারা । ইবন শাঊব বলেন :
হে ইবন হারব, আমি যদি প্রতিরোধ না করতাম এবং উপস্থিত না থাকতাম তবে তুমি যুদ্ধের দিন কাউকে তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্যে পেতেন।
এ প্রসংগে আবু সুফিয়ান ও একটি দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করেছিল । আর হাস্সান ইবন ছাবিত প্রত্যুত্তরে আরেকটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
উহুদ যুদ্ধের শেষ পর্যায় ও ফলাফল
ইবন ইসহাক বলেন, এরপর আল্লাহ্ তা’আলা মুসলমানদের প্রতি তাঁর সাহায্য অবতীর্ণ করেন । তিনি তার ওয়াদা পূরণ করেন। মুসলমানগণ শত্রুপক্ষকে অবিরত হত্যা করতে থাকেন এবং ওদেরকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলেন। কাফিরদের পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে উঠে। ইয়াহয়া ইবন আব্বাদ তাঁর পিতা আব্বাদ ইবন আবদুল্লাহ ইব্ন যুবায়র থেকে এবং তিনি যুবায়র (রা) থেকে। বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ওই সময় হিন্দ্ বিনত উতবার নুপুরের দিকে আমার নজর পড়ে। সে এবং তার সঙ্গিনী কুরায়শী মহিলারা পায়ের কাপড় গুটিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল । শত্রুপক্ষ তাদের মালপত্র ছেড়ে ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী ওদের মাল পত্র সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের পশ্চাতের গিরিপথ তারা শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর জন্যে অবারিত করে দেয়। ফলে ওরা পেছনের দিক থেকে এসে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তখন জনৈক ঘোষক ঘোষণা দেয় যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন। এ অবস্থায় আমরা আবার পাল্টা আক্রমণ করলাম। ওরাও আক্রমণ করল। ওদের পতাকাবাহী নিহত হল। কিন্তু ওদের পক্ষের কেউই পতাকাটি তুলে নিতে এগিয়ে আসছিল না। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তির বরাতে ইবন ইসহাক যে, পতাকাটি দীর্ঘক্ষণ মাটিতে পড়েই ছিল। শেষে বনূ হারিছ গোত্রীয় উমরা বিত আলকামা এসে তা তুলে নিল । সে পতাকাটি কুরায়শদের নিকট নিয়ে গেল। তারা পুনরায় সেটি দৃঢ়ভাবে উত্তোলন করল । ওদের ওই পতাকাটি ছিল বানু আবূ তালহা গোত্রের হাবশী বালক সাওয়াবের হাতে। সে ছিল ওদের শেষ পতাকাবাহী! পতাকা নিয়েই সে যুদ্ধ করছিল এক সময় তার হাত দুটি কাটা গেল। তারপর সে উপুড় হয়ে বসে তার বুক ঘাড় দিয়ে পতাকাটি ধরে রাখে । শেষ পর্যন্ত পতাকা রক্ষার প্রচেষ্টারত অবস্থায়ই নিহত হয়। সে তখন বলছিল, হে আল্লাহ! আপনি কি আমার ওযর ও অক্ষমতা গ্রহণ করেছেন? এ প্রেক্ষিতে হযরত হাসসান ইবন ছাবিত বলেছেন :
পতাকা নিয়ে তোমরা গৌরব করে থাক । পতাকা বিষয়ে সবচেয়ে বেশী নিন্দনীয় ঘটনা ঘটল যখন সেটি সাওয়াব ক্রীতদাসের হাতে দেয়া হল।
পতাকা বিষয়ক গৌরব তোমরা রেখে দিয়েছিলে একজন গোলাম ও একজন বাদীর জন্যে। সে মাটি মাড়িয়ে যায় ।
তোমরা ধারণা করেছিলে আর মুখ লোকেরা তো অনেক কিছুই অনুমান করে থাকে। কিন্তু তা তো যথার্থ ছিল ।
আমাদের যোদ্ধারা যেদিন মক্কায় তোমাদের মুখোমুখি হবে সেদিন তোমাদেরকে তারা রক্তরঞ্জিত করবে না এ ধারণাটি ছিল ভ্রান্ত।
তার দুহাত রক্তাক্ত হওয়ার দৃশ্যে আমি চোখ জুড়িয়েছি! রক্তের খিযাব তো তাকে লাগাতেই হবে।
‘আমরা বিন্ত আলকামা ভুলুণ্ঠিত পতাকা তুলে নিয়েছিল সে বিষয়েও হযরত হাসান (রা) একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। তাঁদের কতক শত্রুর আক্রমণে জখম হন। সে দিনটি ছিল মুসলমানদের জন্যে বিপদ ও পরীক্ষার দিন। কতক মুসলমানকে আল্লাহ তা’আলা শহীদের মর্যাদা দান করেন। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একেবারে কাছাকাছি এসে পড়ে। তার প্রতি তারা পাথর নিক্ষেপ করে। সেটি তার মুখের এক পাশে আঘাত করে। তার সম্মুখের একটি দাঁত শহীদ হয়। মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়। তার ঠোঁট ফেটে যায়। আঘাতকারী হতভাগাটি ছিল উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাস। হুমায়দ আত-তাবীল হযরত আনাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখের দাঁত ভেঙ্গে যায়। তার মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়ে যায়। তিনি রক্ত মুছতে মুছতে বলছিলেন- “যে জাতি তাদের নবীর চেহারা রক্তাক্ত করে দেয় এ অপরাধে যে, তাদেরকে তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন ওই জাতি কী করে সফলতা লাভ করবে? এই প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
আল্লাহ্ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন নাকি তাদেরকে শাস্তি দিবেন এই বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ, তারা যালিম। (৩-আলে ইমরান : ১২৮)
ইবন জারীর তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, মুহাম্মাদ ইবন হুসায়ন– সুদ্দী সূত্রে বর্ণনা করেন, ইব্ন কাসিয়া হারেছী ময়দানে উপস্থিত হল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে লক্ষ্য করে একটি পাথর নিক্ষেপ করল । ফলে তার একটি সম্মুখের দাঁত শহীদ হল তাঁর নাক ফেটে গেল এবং পবিত্র মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। তিনি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন। তাঁর সাহাবীগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। কেউ কেউ মদীনায় ফিরে গেলেন। কেউ কেউ পাহাড়ের উপর পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের ডেকে ডেকে বলছিলেন–আল্লাহর বান্দাগণ, এদিকে আমার নিকটে এসো। আল্লাহর বান্দাগণ, এদিকে আমার নিকট এসো! ৩০ জন মুজাহিদ তার নিকট জমায়েত হলেন । তারা রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর আগে আগে চলছিলেন। ইতিপূর্বে তালহা ও সাহল ইবন হানীফ ছাড়া কেউই তার পাশে ছিলনা। হযরত তালহা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে নিজ দেহদ্বারা আড়াল করে রেখেছিলেন। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটি তীর এসে তার হাতে বিদ্ধ হয়। ওই হাত অসাড় হয়ে যায়। উবাই ইবন খালাফ জুমাহী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দিকে অগ্রসর হয়। সে শপথ করেছিল যে, অবশ্যই সে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে হত্যা করবে । রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন না, আমিই বরং তাকে হত্যা করব। তিনি বললেন, ওহে মিথ্যুক! তুই যাবি কোথায়? রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে আক্রমণ করলেন এবং লৌহ বর্মের ফাঁকে আঘাত করলেন। সে সামান্য যখমী হল। কিন্তু তার ব্যথায় জর্জরিত হয়ে সে ষাঁড়ের মত চীৎকার করতে লাগল! তার সাথীরা তাকে তুলে নিয়ে গেল। তারা বলল, তোমার দেহে তো তেমন কোন যখম নেই, তাহলে তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন? সে বলল, মুহাম্মাদ (সা) তো বলেছেন যে, তিনি আমাকে অবশ্যই হত্যা করবেন। এক্ষণে যদি রাবীআ ও মুদার উভয় গোত্রও একত্রিত হত তবে মুহাম্মাদ (সা) তাদের সকলকে হত্যা করতেন। ওই সামান্য ক্ষতের পরিণতিতে একদিন কিংবা তার ও কম সময়ের ব্যবধানে তার মৃত্যু হয়। লোকজনের মধ্যে গুজব রটে যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) শহীদ হয়ে গিয়েছেন। তখন পাহাড়ের উপরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সাহাবীগণ বললেন যে, আমরা যদি একজন দূত পেতাম তাহলে আবদুল্লাহ্ ইবন উবাইর মাধ্যমে আবৃ সুফিয়ানের নিকট নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন পাঠাতাম। সে আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিত। তাঁরা আরো বললেন, হে লোকজন! মুহাম্মাদ (সা) তো শহীদ হয়েছেন। মুশরিকরা তোমাদের নিকট এসে তোমাদেরকে হত্যা করার পূর্বে তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যাও। আনাস ইবন নযর বললেন, হে লোকজন! মুহাম্মাদ (সা) যদি শহীদ হয়েও থাকেন তবে মুহাম্মাদের (সা) প্রতিপালক তো নিহত হননি। সুতরাং মুহাম্মাদ (সা) যে উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেছেন তোমরাও সে উদ্দেশ্য যুদ্ধ করে যাও। আনাস (রা) আরো বললেন, হে আল্লাহ! ওরা যা বলেছে সে বিষয়ে আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তারা যা করেছে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এরপর তিনি তরবারি হাতে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে আহ্বান করতে করতে পাথরের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণকারীদের নিকট পৌঁছে গেলেন। তাকে চিনতে না পেরে জনৈক সাহাবী তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপের জন্যে ধনুকে তীর তাক করেন । তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পেয়ে তারা সকলে পরম আনন্দিত হন। তিনি যখন দেখলেন যে, তাঁর সাহাবীদের মধ্যে এখনও অনেক লোক আছেন যারা তার নিরাপত্তা রক্ষা করতে সচেষ্ট রয়েছেন, তখন তিনি আনন্দিত হলেন। তারা সবাই একত্রিত হলেন। নিজেদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ফিরে পেয়ে তাদের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে গেল। এবার তারা জয়-পরাজয় ও পাওয়া না পাওয়া সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল হলেন, কারা শহীদ হয়েছেন তা নির্ণয় ও আলোচনা করতে লাগলেন । যারা বলেছিল যে “মুহাম্মাদ (সা) নিহত হয়েছে সুতরাং তোমরা নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের নিকট ফিরে যাও।” তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন :
মুহাম্মাদ একজন রাসূলমাত্র। তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। (৩-আলে ইমরান : ১৪৪)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাথীদেরকে আক্রমণ করার জন্যে আবু সুফিয়ান পাহাড়ে আরোহণ করল। তাকে দেখে মুসলমানগণ পূর্বেকার সকল দুঃখ বেদনা ভুলে প্রত্যাঘাতের জন্যে প্রস্তুত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ওরা আমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। তিনি এই দু’আ পাঠ করলেন —
হে আল্লাহ! মুসলমানদের এই দল যদি নিহত হয় তবে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার কেউ থাকবে না। এবার তিনি সাহাবীগণকে যুদ্ধের জন্যে আহ্বান জানালেন। তারা শত্রুপক্ষকে পাথর নিক্ষেপ করে পাহাড় থেকে নেমে যেতে বাধ্য করলেন। আবু সুফিয়ান বলল, “হুবল দেবতার জয় হোক! হানযালার প্রতিশোধে হান্যলাকে খুন করেছি, বদর দিবসের প্রতিশোধ উহুদ দিবসে নিয়েছি। এভাবে ইবন জারীর পূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এটি একটি গরীর পর্যায়ের (একক) বর্ণনা এতে অনেক অগ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
ইবন হিশাম বলেন, রুবায়হ্ ইবন আবদুর রহমান তাঁর পিতা, তাঁর দাদা আবু সাঈদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাস রাসূলুল্লাহ (সা)-কে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়েছিল এবং তাতে তাঁর সামনে নীচের সারির ডান দিকের দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং তাঁর নীচের ঠোঁট জখম হয়েছিল। আর আবদুল্লাহ ইবন শিহাব (যুহরী) তাঁর কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবন কামিয়া তার মুখমণ্ডল যখম করে দিয়েছিল। তাঁর শিরস্ত্রাণের দুটো কড়া তাঁর কপালের পাশে ঢুকে গিয়েছিল, তিনি একটি গর্তে পড়ে যান। মুসলমানগণ যেন যুদ্ধ করার সময় গর্তে পড়ে যায় সেজন্যে আবূ আমির পূর্বেই ওইসব গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল। তখন হযরত আলী (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাত ধরলেন। আবূ তালহা (রা) তাঁকে টেনে তুললেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, আবু সাঈদের পিতা মালিক ইবন সিনান রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চেহারা মুবারক থেকে রক্ত চুষে নিয়ে গিলে ফেললেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, যার রক্তের সাথে আমার রক্ত মিশেছে জাহান্নামের আগুন কোন দিন তাকে স্পর্শ করবে না।
কাতাদা উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আবু হুযায়ফার আযাদকৃত দাস সালিম সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে তুলে বসালেন এবং মুখমণ্ডলের রক্ত মুছে দিলেন। চেতনা ফিরে আসলে তিনি বলছিলেন, নিজেদের নবী যাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকেন আর এ অবস্থায় তারা নবীর প্রতি এ আচরণ করে সে সম্প্রদায় সফলতা অর্জন করবে কেমন করে? এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন :
(৩-আলে-ইমরান : ১২৮)। ইবন জারীর এরূপ বর্ণনা করেছেন। এটি একটি মুরসাল বর্ণনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা একটি আলাদা অধ্যায়ে আসবে।
বর্ণনাকারী বলেন, আমার মতে ওই দিবসের প্রথমভাগে মুসলমানদের বিজয় হচ্ছিল । ঐ সময়ে তারা কাফিরদেরকে পরাস্ত করেই যাচ্ছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :
“আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকে দেখাবার পর তোমরা অবাধ্য হলে । তোমাদের কতক ইহকাল চাচ্ছিলে এবং কতক পরকাল চাচ্ছিলে। এরপর তিনি পরীক্ষা করার জন্যে তোমাদেরকে তাদের থেকে ফিরিয়ে দিলেন। অবশ্য তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ্ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল । স্মরণ কর, যখন তোমরা উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পেছনে ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলে না। আর রাসূল তোমাদেরকে পেছন দিক থেকে আহ্বান করছিলেন। ফলে তিনি তোমাদেরকে বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছ অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছে তার জন্যে দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা বিশেষভাবে অবহিত । ( ৩- আলে-ইমরান : ১৫২-১৫৩)
ইমাম আহমদ (র) বলেন, আব্দুল্লাহ্— ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা উহুদ দিবসে আমাদেরকে যেমন সাহায্য করেছিলেন অন্য কোন সময় তেমনটি করেননি। বর্ণনাকারী বলেন, তাতে আপত্তি উঠলে তিনি বললেন, যারা আমার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের ও আমার মাঝে মীমাংসাকারী হল আল্লাহর কিতাব। উহুদ দিবস সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই বলেছেন : ৬৫ । ১, ২uki,
আল্লাহ তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন যখন তোমরা তাঁর অনুমতিক্রমে ওদেরকে বিনাশ করছিলে । ‘ শব্দের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (রা) বলেন, ‘ অর্থ হত্যা করা । (৩-আলে ইমরান : ১৫২) এটি দ্বারা গিরিপথে নিয়োজিত তীরন্দাজ বাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) গিরিপথে তীরন্দাজদের নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমরা আমাদের পশ্চাৎদিক রক্ষা করবে। তোমরা যদি আমাদেরকে দেখ যে, আমরা সবাই নিহত হচ্ছি তবু তোমরা ঐ পথ ছেড়ে আমাদের সাহায্যের জন্যে আসবে না। আর যদি দেখ যে, আমরা বিজয়ী হয়ে গনীমতের মাল সংগ্রহ করছি তবু তোমরা আমাদের সাথে যোগ দিবে না। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন গনীমতের মাল সংগ্রহ করছিলেন এবং মুশরিকদের জান মাল দখলকে যখন বৈধ ঘোষণা করলেন তখন গিরিপথে প্রহরারত তীরন্দাজগণ হুমড়ি খেয়ে নীচে নেমে এলেন । তারপর তারা শত্রু সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে গিয়ে গনীমত সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । সাহাবীগণের সারিগুলো পরস্পর মিলে মিশে যায়। বর্ণনাকারী তাঁর দুহাতের আঙ্গুলগুলো একটির ফাঁকে আরেকটি ঢুকিয়ে দেখান যে, তাদের সারি এমনিভাবে সংলগ্ন হয়ে গিয়েছিল ।
তীরন্দাজগণ গিরিপথ খালি করে দেয়ায় শত্রু বাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যরা ঐ পথে এসে সে পশ্চাৎদিক থেকে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে। অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে সাহাবিগণ একে অন্যকে চিনতে না পেয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করতে যাবেন। এভাবেই বহু মুসলমান নিহত হন। ঐ দিবসের প্রথম ভাগ রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার সাহাবীগণের পক্ষে ছিল। ফলে তখন মুশরিকদের সাত মতান্তরে নয় জন পতাকাবাহী সৈন্য মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। পরবর্তীতে শত্রুদের আক্রমণে হতভম্ব হয়ে মুসলমানগণ পাহাড়ের দিকে ছুটতে থাকেন। কিন্তু যেখানে গুহা আছে। বলে ধারণা ছিল সেখান পর্যন্ত তাঁরা পৌঁছতে পারেননি। এসময়ে শয়তান চীৎকার দিয়ে বলেছিল, “মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন।” এই ঘোষণার সত্যতার কেউ সন্দেহ করেননি। বর্ণনাকারী বলেন, ঐ ঘোষণা সত্য বলে আমরা তাই বিশ্বাস করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাসূলুল্লাহ্ (সা) দুই সা’দের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাথা তুলেছেন। হাঁটার সময়ে তিনি একটু ঝুঁকে হাঁটতেন তা দেখে আমরা তাঁকে চিনে ফেলি । তাঁকে দেখে আমরা এত খুশী হলাম যে, আমরা আমাদের নিহত আহতদের কথা ভুলেই গোলাম। আমরা এমন হয়ে যাই যেন আমাদের কিছুই হয়নি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের দিকে উঠে এলেন। তিনি বলছিলেন “ঐ সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহর প্রবল গযব ও অসন্তুষ্টি কঠিনভাবে নেমে আসুক, যারা আল্লাহর রাসূলের মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত করেছে। আবার তিনি বললেন :
“হে আল্লাহ! ওরা যেন আমাদের উপর বিজয়ী হতে না পারে।’ এসব বলতে বলতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নিকট এসে পৌঁছলেন। তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তখন শোনা গেল যে, পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আবু সুফিয়ান চীৎকার করে বলছে “হুবলের জয় হোক। হুবল দেবতার জয় হোক। আবু কাবাশার পুত্র (রাসূলুল্লাহ্) কোথায়? আবু কুহাফার পুত্র (আবূ বকর ছিদ্দীক (রা) কোথায়? খাত্তাবের পুত্র (উমর [রা] কোথায়? উমর (রা) বললেন, আমরা কি ওর কথার জবাব দেবো না? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হাঁ। আবু সুফিয়ান বলল, হুবল দেবতার জয় হোক। জবাবে উমর (রা) বললেন, আল্লাহ্ সর্বোচ্চ ও সুমহান । আবু সুফিয়ান বলল, হে খাত্তাবের পুত্র! আজকের কর্মকান্ডে হুবলের চোখ জুড়িয়েছে। এখন তুমি পারলে তাকে অতিক্রম করে যাও। আবু সুফিয়ান বলল, আবূ কাবাশার পুত্র কোথায়? আবূ কুহাফার পুত্র কোথায় এবং খাত্তাবের পুত্র কোথায়? উমর (রা) বললেন, এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা), এই আবু বকর (রা) এবং এই যে, এখানে আমি উমর। আবু সুফিয়ান বলল, আজকের দিন হল বদর দিবসের প্রতিশোধের দিন। যুগ আবর্তনশীল । যুদ্ধ বালতির ন্যায় পালাক্রমে হাতবদল হয়। উমর (রা) বললেন, উভয় পক্ষে সমান সমান নয়। আমাদের নিহত ব্যক্তিগণ থাকবে জান্নাতে আর তোমাদের নিহতরা থাকবে জাহান্নামে। আবু সুফিয়ান বলল, তোমরা কি তাই বিশ্বাস কর, তবে তো আমরা ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত । এরপর আবু সুফিয়ান বলল, তোমরা তোমাদের পক্ষে নিহত লোকদের মধ্যে কতক লোককে কর্তিত অঙ্গ পাবে । আমরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কিন্তু ঐ রকম কাজ করার সিদ্ধান্ত দেইনি। এ সময় তার মধ্যে জাহিলিয়্যাতের অহমিকা জেগে উঠল । সে বলল, ঐ অঙ্গ কর্তনের যে ঘটনা ঘটেছে তাতে অবশ্য। আমরা অসন্তুষ্টও নই। এই বর্ণনা করেন ইব্ন আবু হাতিম । আরো মুসতাদরাক হাকিম এবং বায়হাকী (র)-এর আদ দালাইল গ্রন্থের। তারা বর্ণনা করেছেন, সুলায়মান ইবন দাউদের বরাতে । এটি একটি গরীব পর্যায়ের বর্ণনা। এটি ইবন আব্বাস (রা)-এর মুরসাল বর্ণনাগুলোর একটি। এটির সমর্থনে অন্যান্য বর্ণনা রয়েছে। সাধ্যমত আমরা সেগুলো উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ । ইমাম বুখারী (র) বলেন, উবায়দুল্লাহ্ ইবন মূসা –বারা (রা)-এর বরাতে বলেন যে, বরাতে উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত বলেছেন, উহুদের দিন আমরা সেনাপতি আব্দুল্লাহ তাঁর তীরন্দাজদের ঘাটি ত্যাগ করতে দেখে বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো আমাদের অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আমরা যেন এই স্থান ত্যাগ না করি। কিন্তু তাঁরা তাঁর কথা মানেননি ফলে যুদ্ধের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী তাতে নিহত হন। আবু সুফিয়ান তখন বেরিয়ে আসে এবং বলে, তোমাদের মধ্যে কি মুহাম্মাদ (সা) আছেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমরা তার কথার কোন উত্তর দিও না । সে বলল, তোমাদের মধ্যে কি আবু কুহাফার পুত্র আছে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, কোন উত্তর দিবে না। সে বলল, তোমাদের মধ্যে কি খাত্তাবের পুত্র আছে? কোন উত্তর না পেয়ে সে বলল, ওরা সবাই নিশ্চয়ই নিহত হয়েছে। জীবিত থাকলে অবশ্যই উত্তর দিত। হযরত উমর (রা) নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন, হে আল্লাহর দুশমন! তোর কথা মিথ্যা, যাতে তুই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকিস এজন্যে আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে বহাল তবিয়তে রেখেছেন। আবু সুফিয়ান বলল, হুবল দেবতার জয় হোক। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওর কথার জবাব দাও! সাহাবিগণ বললেন, কী জবাব দিব? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমরা বল, “আল্লাহ্ সর্বোচ্চ আল্লাহ্ সুমহান”। আবু সুফিয়ান বলল, আমাদের উযযা আছে, তোমাদের উয্যা নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ওর কথার জবাব দাও। সাহাবাগণ (রা) বললেন, কী জবাব দিব? তিনি বললেন যে, তোমরা বল “আল্লাহ্ আমাদের মাওলা ও প্রভু তোমাদের প্রভু নেই। আবু সুফিয়ান বলল, আজকের এই দিবস বদর দিবসের বদলা ও প্রতিশোধ, আর যুদ্ধ হল বালতির ন্যায় হাত বদলের ব্যাপার। তোমাদের নিহতদের মধ্যে তোমরা অঙ্গ-কর্তিত লোক খুঁজে পাবে । আমি কিন্তু তা করার নির্দেশ দিইনি। তবে আমি তাতে অখুশীও নই। এই হাদীছ ইমাম বুখারী (র)-এর একক বর্ণনা।
ইমাম আহমদ ও মূসা– বারা ইবন আযিব (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তাতে একথাও আছে : আব্দুল্লাহ্ ইবন জুবায়র (রা)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন সৈন্যগণ বললেন : হে সাথিগণ! গনীমতের মাল । তোমাদের সাথিগণ তো যুদ্ধের ময়দানে বিজয়ী। আর অপেক্ষা কিসের? আব্দুল্লাহ্ ইবন জুবায়র (রা) বললেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তোমাদেরকে কী বলে দিয়েছিলেন তা কি তোমরা ভুলে গিয়েছ? তারা বললেন, “আল্লাহর কসম, আমরা ওদের নিকট যাব এবং গনীমতের অংশ নিব । ওরা যখন গিরিপথ ছেড়ে ময়দানে নেমে এলেন তখন তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটল । যুদ্ধের মোড় পাল্টে গেল। তারা বিজয়ের পর এবার পরাজিত হলেন । এটি হচ্ছে (কুরআন বর্ণিত) রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে পেছন থেকে ডাকা মাত্র ১২ জন ছাড়া কেউ সেখানে ছিলেন । সেদিন আমাদের ৭০ জন লোক শহীদ হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাথিগণ বদর দিবসে মুশরিকদের ১৪০ জন লোককে নিহত ও বন্দী করেছিলেন। তন্মধ্যে ৭০ জন নিহত হয়েছিল আর ৭০ জন বন্দী হয়েছিল ।
তারপর এ রিওয়ায়াতেও পূর্বোল্লিখিত আবু সুফিয়ান ও উমর (রা)-এর মধ্যকার বাক্য বিনিময়ের বর্ণনা রয়েছে। এ বর্ণনাটি ইমাম বুখারী (র) যুহায়র ইবন মুআবিয়া থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে উদ্ধৃত করেছেন। ইসরাঈল সূত্রে আবু ইসহাক থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ বর্ণনা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ বলেন, আফফান– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। এক পর্যায়ে তাঁর সাথে মাত্র ৭ জন আনসারী সাহাবী এবং একজন কুরায়শী সাহাবী ছিলেন। তিনি বললেন, কেউ যদি কাফির শত্রুদেরকে আমার নিকট থেকে সরিয়ে দিতে পারে তবে সে জান্নাতে আমার সাথী হতে পারবে। একথা শুনে একজন আনসারী সাহাবী এগিয়ে এলেন এবং কাফিরদেরকে সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত শহীদ হলেন । শত্রুগণ দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ঘিরে ফেলল। তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি ওদেরকে সরিয়ে দিবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে। এ ঘোষণা শুনে অন্য একজন সাহাবী এগিয়ে এলেন এবং যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। এভাবে ৭ জন সাহাবীই শহীদ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমার এ সাহাবীগণের প্রতি সুবিচার করা হয়নি।
মুসলিম (র) এই হাদীছ হুদবা ইবন খালিদ সূত্রে হাম্মাদ ইবন সালামা থেকে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল’ গ্রন্থে তাঁর সনদে উমারা ইব্ন শুরা সূত্রে আবু যুবায়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, জাবির (রা) বলেছেন, উহুদ দিবসে মুসলিম সৈন্যগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মাত্র ১১জন আনসারী সাহাবী এবং তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ তাঁর সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন পাহাড়ে আরোহণ করছিলেন। ইতোমধ্যে মুশরিকগণ তাঁদের কাছাকাছি এসে পৌঁছে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, ওদেরকে প্রতিরোধ করার কি কেউ নেই? হযরত তালহা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আছি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে তালহা! তুমি যেমন আছ তেমন থাক। তখন একজন আনসারী সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আছি । এ কথা বলে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতিরক্ষার্থে যুদ্ধ শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার অন্য সাথিগণ উপরের দিকে উঠে গেলেন। ইতোমধ্যে উক্ত আনসারী সাহাবী শহীদ হলেন এবং শত্রুগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেল। তিনি বললেন, ওদেরকে প্রতিরোধ করার কি কেউ নেই? হযরত তালহা (রা) পূর্বের ন্যায় বললেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে পূর্বের ন্যায় উত্তর দিলেন, তখন একজন আনসারী সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আছি। এ বলে তিনি যুদ্ধ শুরু করলেন। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তার অবশিষ্ট সাহাবীগণ আরো উপরে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আনসারী সাহাবী শহীদ হয়ে গেলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) একাধিকবার পূর্বের মত আহ্বান করলেন। হযরত তালহা (রা) তাঁর প্রস্তুতির কথা জানালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বিরত রাখলেন। অন্য একজন আনসারী সাহাবী অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) অনুমতি দিলেন। তাঁরা একের পর এক যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে তালহা (রা) ব্যতীত কেউই রইলেন না। শত্রুগণ এসে তাঁদের দুজনকে ঘিরে ফেলল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওদেরকে প্রতিরোধ করবে কে? তালহা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমি প্রতিরোধ করব । তাঁর পূর্বের সাহাবীগণের ন্যায় তিনি যুদ্ধ শুরু করলেন। তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে গেল। তিনি বললেন আহ্! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি যদি আহ না বলে বিমিল্লাহ বলতে তবে ফেরেশতাগণ তোমাকে আকাশে তুলে নিতেন। লোকজন তোমার দিকে তাকিয়ে দেখত। ওঁরা তোমাকে নিয়ে আসমান উঠে যেতেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) পাহাড়ের উপরে অবস্থানরত তাঁর অন্যান্য সাহাবীদের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন ।
ইমাম বুখারী (র) আব্দুল্লাহ্ ইবন আবূ শায়বা– কায়স ইবন আবু হাযিম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, আমি দেখেছি আবূ তালহা (রা)-এর হাত অবশ হয়ে রয়েছে। সে হাত দ্বারা তিনি উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে রক্ষা করেছিলেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থে মূসা ইবন ইসমাঈল ।
— আবু উছমান নান্দী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যে দিবস গুলোতে যুদ্ধ হয়েছে সেগুলোর একটিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তালহা ও সা’দ (রা) ব্যতীত কেউ ছিলেন না। তাঁরা নিজেরা এটি বর্ণনা করেছেন।
হাসান ইব্ন আরাফা বলেন,– সা’দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদ দিবসে তাঁর তীরের থলি থেকে আমাকে তীর বের করে দিয়েছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন আমার পিতা-মাতা তোমার জন্যে কুরবানী হোক! তুমি তীর ছুঁড়তে থাক। ইমাম বুখারী (র) আব্দুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মাদ সূত্রে মারওয়ান থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন।
সহীহ বুখারী গ্রন্থে আব্দুল্লাহ্ ইবন শাদ্দাদ সুত্রে আলী ইবন আবু তালিব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সা’দ ইবন মালিক (আবু ওয়াক্কাস) ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর পিতা-মাতা দু’জন কুরবান হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বলে আমি শুনিনি। উহুদ দিবসে আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলছিলেন, হে সাদ! তুমি তীর ছুঁড়তে থাকো। আমার পিতা-মাতা তোমার জন্যে কুরবানী হোন।
মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক বলেন, সালিহ ইবন কায়সন সা’দ (রা)-এর পরিবারের জনৈক সদস্যের সূত্রে সাদ (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে রক্ষায় তীর নিক্ষেপ করেছেন। সা’দ (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখেছি যে, তিনি আমাকে তীরের যোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, আমার পিতা-মাতা তোমার জন্যে কুরবানী হোক! তুমি তীর ছুঁড়তে থাকো। কখনো কখনো তিনি আমাকে ফলকবিহীন তীর দিয়েছেন আমি তা নিক্ষেপ করছিলাম।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ইবরাহীম ইবন সা’দ– সা’দ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস (রা)-এর বরাতে বলেছেন, আমি উহুদের দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ডানে ও বামে দু’জন লোক দেখেছিলাম তাদের পরিধানে ছিল সাদা পোশাক। তারা দুজনে এত প্রচন্ড যুদ্ধ করেছেন যে, এমন যুদ্ধ আমি তার আগেও দেখিনি পরেও দেখিনি। তিনি তাতে জিব্রাঈল ও মীকাঈল (আ)-কে বুঝিয়েছেন ।
ইমাম আহমদ বলেন, আফফান আমাকে জানিয়েছেন আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে যে, উহুদ দিবসে আবূ তালহা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে অবস্থান নিয়ে তীর নিক্ষেপ করছিলেন। নবী করীম (সা) তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করছিলেন। আবূ তালহা (রা) দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। তিনি যখন তীর নিক্ষেপ করতেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাথা তুলে দেখতেন যে, তীরটি কোথায় গিয়ে পড়ছে। আর আবু তালহা তখন তাঁর ঘড়ি উঁচু করে দিতেন এবং বলতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে কুরবানী হোন, শত্রুর নিক্ষিপ্ত কোন তীর যেন আপনার শরীরে না লাগে। আমার বক্ষ আপনার বক্ষের জন্য ঢাল স্বরূপ রইল । আবু তালহা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমি শক্ত সামর্থ লোক বটে, যে কোন প্রয়োজনে আপনি আমাকে যে কোন স্থানে পাঠাতে পারেন এবং যে কোন কাজের নির্দেশ দিতে পারেন।
ইমাম বুখারী (রা) বলেন, আবু আমার— আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ (সা)কে রেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান; কিন্তু আবূ তালহা (রা) তাঁর ঢাল নিয়ে প্রাচীর রূপে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি দ্রুত ও দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। সেদিন তার হাতে ২ থেকে ৩টি ধনুক ভেঙ্গে যায়। কোন সৈনিক তৃণীর নিয়ে সেখান দিয়ে যেতে থাকলে রাসূলুল্লাহ (সা) বলতেন, তোমার তীরগুলো আবু তালহা (রা)-কে দিয়ে দাও। মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাথা উচিয়ে তাকাতেন এবং ময়দানের লোকজনের অবস্থা দেখতেন। তখন আবু তালহা বলতেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে কুরবানী হোন, আপনি মাথা তুলবেন না নতুন শত্রুপক্ষের তীর আপনার গায়ে লাগতে পারে। আমার বক্ষ, আপনার বক্ষের জন্য ঢালরূপে রইল, আমি আইশা (রা) ও উম্মু সুলায়মকে দেখেছিলাম সেদিন যে, তাঁরা পায়ের গোছার উপর কাপড় গুটিয়ে ছুটোছুটি করছেন যে, আমি তাদের পায়ের গোছা দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁরা পিঠে করে পানির মশক বহন করছিলেন এবং আহতদেরকে পানি পান করাচ্ছিলেন। তারপর ফিরে যেতেন এবং পানি ভরে এনে পুনরায় পান করাতেন।
ওই দিন আবূ তালহা (রা)-এর হাত থেকে দুবার কিংবা তিনবার তরবারি পড়ে গিয়েছিল । বুখারী (রা) আবূ তালহা (রা)-এর বরাতে বলেছেন, উহুদ দিবসে যারা তন্দ্রামগ্ন হয়েছিলেন আমি ছিলাম তাদের একজন। আমার হাত থেকে কয়েকবার তরবারি পড়ে গিয়েছিল । আমি সেটি উঠাই আবার সেটি পড়ে যায়। আবার উঠাই আবার পড়ে যায়। বুখারী (র) এভাবে সনদ বিহীনভাবে নিশ্চয়তা জ্ঞাপক ভাষায় এটি বর্ণনা করেছেন। কুরআন মজীদের আয়াত তাঁর বর্ণনা সমর্থন করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :
-এরপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে প্রদান করলেন প্রশান্তি তন্দ্রারূপে, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল। এবং একদল জাহেলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ্ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, আমাদের কি কোন অধিকার আছে? বলুন, সমস্ত বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে । যা তারা আপনার নিকট প্রকাশ করে না তারা তাদের অন্তরে তা গোপন করে রাখে। আর বলে, এই ব্যাপারে আমাদের কোন ইখতিয়ার থাকলে আমরা এই স্থানে নিহত হতাম না। বলুন, যদি তোমরা তোমাদের নিজ বাড়ীতে অবস্থান করতে তবু নিহত হওয়া যাদের অবধারিত ছিল তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হত; তা এজন্যে যে, আল্লাহ্ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরিশোধ করেন। অন্ত্যরে যা আছে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে বিশেষ অবহিত।
যে দিন দুদল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল সেদিন তোমাদের মধ্য হতে যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল তাদের কোন কৃতকর্মের কারণেই শয়তান তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল । অবশ্য আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। আল্লাহ ক্ষমা পরায়ণ ও পরম সহনশীল। (৩- আলে ইমরান : ১৫৪-১৫৫)।
বুখারী বলেন, আবদান–… উছমান ইবন মাওহিব সূত্রে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি হজ্জের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ্ শরীফে এসেছিল। সে দেখতে পেল যে, কতক লোক বসে আছে। সে বলল, বসে থাকা লোকদের পরিচয় কী? একজন উত্তর দিল, এরা কুরায়শ বংশের লোক। সে বলল, ওদের শায়খ কে? উত্তর এল, ইবন উমার (রা)। সে ইবন উমর (রা)-এর নিকট এসে বলল, আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব, আপনি উত্তর দিবেন তো? এরপর প্রশ্ন আকারে সে বলল, আল্লাহর ঘরের কসম, আপনি কি জানেন যে, উহুদ দিবসে উছমান (রা) যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। এবার সে বলল, তাহলে আপনি এও জানেন যে, তিনি বদর দিবসে অনুপস্থিত ছিলেন, যুদ্ধে অংশ নেননি? ইবন উমার (রা) বললেন, হাঁ জানি। সে বলল, তিনি যে, বায়আত-ই-রিযওয়ান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না তা কি আপনি জানেন? ইবন উমার (রা) বললেন, হাঁ, জানি বটে। ইবন উমার (রা)-এর উত্তর শুনে সে আনন্দে তকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠল । ইবন উমার (রা) তাকে বললেন, এদিকে আস! তুমি আমাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছ সেগুলো সম্পর্কে আমি তোমাকে ব্যাখ্যা শুনাই। বস্তুতঃ হযরত উছমান (রা) উহুদের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আমি আল্লাহকে সাক্ষ্য রেখে বলছি যে, আল্লাহ্ তা’আলা নিজে ওই দোষ ক্ষমা করে দিয়েছেন। বদর যুদ্ধে তিনি এজন্যে অনুপস্থিত ছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কন্যা ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনি ছিলেন অসুস্থ। স্ত্রীর সেবার জন্যে ঘরে থাকার অনুমতি দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বলেছিলেন একজন লোক বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে যে ছাওয়াব পাবে তুমি ঘরে থেকেও সে ছাওয়াব এবং গনীমতের অংশও পাবে। আর বায়আত-ই–রিযওয়ানে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন এজন্যে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন তাঁর নিজের প্রতিনিধিরূপে। মক্কা নগরীতে দ্বিতীয় কেউ যদি হযরত উছমান অপেক্ষা অধিক সন্তানযোগ্য হত তবে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে না পাঠিয়ে সেই লোকটিকেই পাঠাতেন। বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকেই পাঠিয়েছিলেন। হযরত উছমান (রা) মক্কায় যাওয়ার পর বায়আত-ই–রিযওয়ান অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর ডান হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এটি উছমানের হাত। এরপর বাম হাতে ডান হাত রেখে বলেছিলেন এটি উছমানের (রা) পক্ষে শপথ! হে আগন্তুক, এ ব্যাখ্যা নিয়ে তুমি দেশে ফিরে যাও। ইমাম বুখারী (র) এই হাদীছটি অন্য জায়গায় ও উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তিরমিযী এটি উদ্ধৃত করেছেন আবু আওয়ানা সূত্রে উছমান ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন মাওহিব সূত্রে ।
উমাবী বর্ণনা করেছেন, তাঁর মাগাযী গ্রন্থে ইবন ইসহাক থেকে। তিনি বলেছেন যে, ইয়াহয়া ইবন আব্বাদ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে। তিনি বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, উহুদ দিবসে লোকজন তাঁকে ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ আওয়াস পাহাড়ের বিপরীতে অবস্থিত সুবাক্কায় গিয়ে উঠেছিল। উছমান ইব্ন আফফান এবং সা’দ ইবন উছমান আনসারী-গিয়ে উঠেছিলেন মদীনার নিকটবর্তী আওয়াস পাহাড়ের লাগোয়া জালআবে। তাঁরা সেখানে তিনদিন ছিলেন। তারপর ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)এদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “তোমরা তো পাহাড় অতিক্রম করে মদীনার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছে ছিলে ।”
মোদ্দা কথা, বদর যুদ্ধে যা যা ঘটেছিল তার কিছু কিছু উহুদ যুদ্ধেও ঘটেছিল। যেমন যুদ্ধ চলাকালে তন্দ্রাভাব সৃষ্টি হওয়া। এটি হল আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তার প্রেক্ষিতে অন্তরের প্রশান্তির নিদর্শন । এবং এই তন্দ্রাভাব দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এই কলগুলো ছিল তাঁর সৃষ্টিকর্তার প্রতিপূর্ণ নির্ভরশীল ও তাওয়াক্কুলকারী । বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে নাযিলকৃত আল্লাহ তা’আলার বাণী ।
(৮- আনফাল : ১১)-এর ব্যাখ্যায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি । উহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন, এরপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে প্রদান করলেন প্রশান্তি তন্দ্রারূপে যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল। (৩- আলে-ইমরান ১৫৪)। অর্থাৎ ঈমানদারদের ওই তন্দ্রা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। ইবন মাসউদ (রা) প্রমুখ জ্ঞান বিশারদগণ তা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, যুদ্ধের সময় তন্দ্রাভাব সৃষ্টি হওয়া ছিল ঈমানের নিদর্শন আর নামাযে তন্দ্রা সৃষ্টি হওয়া মুনাফিকীর পরিচায়ক। এজন্যেই উক্ত আয়াতে তন্দ্রা বিষয়ক আলোচনার পর বলা হয়েছে ( 5। ai aath’, আর একদল জাহেলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ্ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল।)।
উহুদের যুদ্ধের সাথে বদরের যুদ্ধের আরেকটি সামঞ্জস্য এই ছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদরের যুদ্ধে যেমন আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছিলেন উহুদের যুদ্ধেও তিনি আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছিলেন! বদরের যুদ্ধে তিনি বলেছিলেন–
-হে আল্লাহ্! আপনি যদি ইচ্ছা করেন যে, দুনিয়াতে আপনার ইবাদত আর না হোক,তবে আর আপনার ইবাদত করা হবে না)। উহুদের যুদ্ধে তাঁর সাহায্য কামনা সম্পর্কে ইমাম আহমদ বলেছেন যে, আবদুস সামাদ– আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) উহুদ দিবসে বলছিলেন :
হে আল্লাহ! আপনি যদি চান যে, দুনিয়াতে আপনার ইবাদত না হোক তবে তাই হবে)। ইমাম মুসলিম (র) হাজ্জাজ– হাম্মাদ ইবন সালামা (রা) সূত্রে এটি উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী (রা) বলেন, আব্দুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মাদ— জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রা) সূত্রে বলেছেন যে, এক ব্যক্তি উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলেছিল যে, আমি যদি যুদ্ধে নিহত হই তবে আমার স্থান কোথায় হবে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমার স্থান হবে জান্নাতে। একথা শুনে সেই ব্যক্তি তার হাতে থাকা খেজুরগুলো ফেলে দিয়ে যুদ্ধে শরীক হন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। মুসলিম (র) এবং নাসাঈ (র) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন সুফিয়ান ইবন উয়ায়না থেকে। বদরের যুদ্ধ বিষয়ক আলোচনায় উল্লিখিত উমায়র ইবন হাম্মামের ঘটনার সাথে এই ঘটনার মিল রয়েছে।
উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আহত হওয়া প্রসঙ্গ
বুখারী (র) “উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যখম হওয়া প্রসঙ্গে লিখেন- ইসহাক ইবন নাসর– আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাতে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন :
সেই জন সমষ্টির উপর আল্লাহর গযব কঠিনতর হোক যারা আল্লাহর নবীর সাথে এ আচরণ করেছে। একথা বলার সময় তিনি তাঁর সম্মুখে শহীদ হওয়া দাঁতের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহর গযব কঠিনতর হোক সেই ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর পথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) স্বহস্তে যাকে হত্যা করেছেন। মুসলিম (র) আব্দুর রাযযাক সূত্রে এই মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন ।
তবে তার শেষাংশে রয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পবিত্র মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করেছে তাদের প্রতি আল্লাহর গযব তীব্রতর হোক।
ইমাম আহমদ বলেন, আফফান— আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদ দিবসে তার পবিত্র মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বলছিলেন সেই সম্প্রদায় কেমন করে সফলকাম হবে যারা তাদের নবীর মুখ যখম করে দিয়েছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। একথা বলার সময় তিনি আল্লাহর দরবারে দু’আ করছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
(৩- আলে-ইমরান ও ১২৮)। মুসলিম (র) কানবী সূত্রে হাম্মাদ ইবন সালামা থেকে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (র) হুশায়ম— আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখের একটি দাঁত শহীদ করে দেয়া হয় এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল যখম করে দেয়া হয়, তাঁর মুখণ্ডল বেয়ে রক্ত পড়ছিল। এ অবস্থায় তিনি বলছিলেন, যে নবী তাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকছেন যারা সে নবীর প্রতি এ অমানবিক আচরণ করে তারা কেমন করে সফলকাম হবে? তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রতি নাযিল করলেন ( ১০২।-০ ১ )
ইমাম বুখারী বলেন, কুতায়বা– আবু হাযিম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি সাহ্ল ইবন সা’দকে বলতে শুনেছেন যখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আঘাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল। উত্তরে তিনি বলছিলেন যে, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ক্ষতস্থান কে ধুয়ে দিচ্ছিলেন, কে পানি ঢেলেছিলেন এবং তাঁকে কী চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল তাও আমি জানি। নবী কন্যা ফাতিমা ক্ষতস্থান ধুয়ে দিচ্ছিলেন। ঢালে করে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন হযরত আলী (রা) । হযরত ফাতিমা যখন দেখলেন যে, পানিতে রক্ত ঝরা বন্ধ হচ্ছে না বরং তা বেড়েই চলেছে তখন তিনি এক টুকরা চাটাই পুড়িয়ে ক্ষতস্থানে ছাই লাগিয়ে দেন। তাতে রক্ত বন্ধ হল। সেদিন তাঁর সম্মুখের নীচের একটি দাঁত শহীদ হয়ে যায়। পবিত্র মুখমণ্ডল যখম হয়। শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে মাথায় ঢুকে যায়।
আবু দাউদ তায়ালিসী তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইবনুল মুবারক– হযরত আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আবু বকর (রা)-এর নিকট উহুদ দিবসের কথা আলোচনা করা হলে তিনি বলতেন, সেদিনের যতটুকু কল্যাণ ও ইতিবাচক দিক রয়েছে তার সবটাই তাহার প্রাপ্য। তারপর তিনি বলতেন, বিপর্যয়ের পর পুনরায় আমিই সর্বপ্রথম উহুদ ময়দানে ফিরে আসি। আমি দেখলাম, তখনও জনৈক লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আড়ালে রেখে প্রচন্ড যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে মনে বললাম, ওই লোকটি যেন তালহা-ই-হয়। তাহলে আমি যা থেকে বঞ্চিত হলাম ওই দুঃখ কিছুটা মোচন হবে। আমি মনে মনে বললাম, লোকটা যদি আমার স্বগোত্রের হয় তবে কতটা না ভাল হয়। তখন আমি আমার ও মুশরিকদের মধ্যখানে একজন লোককে দেখতে পেলাম যাকে আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার অবস্থান তখন তার তুলনায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছাকাছি। ওই লোকটি খুব দ্রুত হাটছিল যা আমি পারছিলাম না । হঠাৎ দেখি, তিনি আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ্। আমরা দুজনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পৌঁছি। তখন তার সামনের দাঁত শহীদ হয়ে গেছে মুখমণ্ডল ক্ষত বিক্ষত । শিরস্ত্রাণের দুটো কড়া তাঁর কপালের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তালহা (রা)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, তোমরা দুজনে তোমাদের এই সাথীকে বাঁচাও। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে তখন তালহা (রা) ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সে দিকে তত খেয়াল না করে আমি তাঁর মুখমন্ডল থেকে শিরস্ত্রাণের কড়া খুলতে গেলাম।
আবু উবায়দা আমাকে বললেন “দোহাই আল্লাহর, আপনি আমাকে ওই কড়া দুটি খোলার সুযোগ দিন। আমি সরে গিয়ে তাকে সুযোগ দিলাম। হাতে খুলতে গেলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যথা পাবেন এ আশংকায় আবু উবায়দা দাঁত দিয়ে তা খোলার চেষ্টা করলেন । দাঁতে কামড়ে তিনি কড়া খুলে আনলেন। সাথে সাথে তার ও সম্মুখের একটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেল। আবু বকর (রা) বলেন, তিনি যা করেছেন আমিও তা করে অপর কড়াটি খুলতে গেলাম, তিনি আমাকে পূর্বের মত কসম দিলেন। এরপর তিনি প্রথম বারের মত দ্বিতীয় কড়াটিও খুলে আনলেন । এক সাথে তার সম্মুখের আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে গেল। বস্তুতঃ ভাঙ্গা দাঁতের লোকদের মধ্যে আবু উবায়দা ছিলেন সর্বাধিক সুদর্শন পুরুষ। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সেবাযত্ন করে তাঁকে সুস্থ করে তুললাম। এরপর আমরা তালহা (রা)-এর নিকট এলাম। তখনও তিনি দুর্বল নিঃসঙ্গ। আমরা দেখলাম তীর, তরবারি ও বর্শার আঘাত মিলিয়ে তার দেহে ৭০-এর অধিক ক্ষতচিহ্ন। তার আঙ্গুলও কর্তিত। আমরা তাঁকেও সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তুললাম।
ওয়াকিদী বলেন, ইবন আবু সাবুরা– নাফি ইবন জুবায়র (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জনৈক মুহাজির ব্যক্তিকে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, “আমি উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম । সেদিন আমি দেখলাম, চারিদিক থেকে তীর ছুটে আসছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই ছিলেন তীরগুলোর লক্ষ্যস্থল। তবে তীরগুলো প্রতিহত করা হচ্ছিল। সেদিন আমি আব্দুল্লাহ্ ইবন শিহাব (যুহরীকে) বলতে শুনেছিলাম। “মুহাম্মাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও! মুহাম্মাদ জীবিত থাকলে আমার স্বস্তি নেই।” রাসূলুল্লাহ (সা) কিন্তু তার নিকটেই একাকী ছিলেন। তাঁর সাথে কেউ ছিল না। কিন্তু সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অতিক্রম করে যায়। এজন্যে সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তাকে তিরস্কার করেছিল । আবদুল্লাহ্ বলেছিল, আল্লাহর কসম, আমি তাঁকে দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ছিলেন। আমরা চারজন তাঁকে হত্যা করবার জন্যে প্রতিজ্ঞা করে ময়দানে এসেছিলাম। কিন্তু আমরা তাঁর নিকটে ঘেঁষতে পারেনি। ওই সুযোগ পাইনি।
ওয়াকিদী বলেন, আমার নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কপালে পাথর মেরেছিল ইবন কামিয়া। তাঁর ঠোঁটে পাথর মেরে তাঁর দাঁত শহীদ করেছিল উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাস। ইতিপূর্বে ইবন ইসহাক থেকেও অনুরূপ মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে দাঁতটি ভেঙ্গে ছিল সেটি হল নীচের সারির মধ্যখানের ডান দিকের দাঁত।
ইবন ইসহাক বলেন, সালিহ ইবন কায়সান– সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, (আমার ভাই) উতবা ইবন আবূ ওয়াক্কাসকে হত্যা করার জন্যে আমি যত উৎসাহী ছিলাম অন্য কারো ব্যাপারে ততটা ছিলাম না। তার দুশ্চরিত্রের কারণে আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে সে ঘৃণ্য ছিল তা নয়; বরং তাকে হত্যার জন্যে আমার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করেছে তার উপর আল্লাহর ক্রোধ তীব্রতর হোক।”
আব্দুর রাযযাক বলেন, মামার– মিকসাম সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) উতবা ইবন আবু ওয়াক্কাসের জন্যে বদ দু’আ করেছিলেন যখন সে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিল এবং মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। তিনি সে বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যেন কাফির হিসেবে তার মৃত্যু হয় তা কামনা করেছিলেন এবং বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। আবূ সুলায়মান জুযাযানী বলেন, মুহাম্মাদ ইবন হাসান– আবু উমামা ইবন সাহল ইবন হুনায়ফ থেকে বর্ণনা করেন যে, উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা) পুরনো হাড় দিয়ে তাঁর মুখমণ্ডলের চিকিৎসা করেছিলেন। এটি একটি একক বর্ণনা! উমামী রচিত আল-মাগাযী গ্রন্থের “উহুদ যুদ্ধ” শিরোনামের মধ্যে আমি তা পেয়েছি। আবদুল্লাহ্ ইবন কামিয়া রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আহত করে ফিরে যায় এবং চীকার করে বলে, আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি। সেদিন আকাবার আযুব নামক শয়তান চীৎকার করে বলে উঠে, শুনে রেখো, মুহাম্মাদ নিহত। এতে মুসলমানগণ হত বিহ্বল হয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই একথা সত্য বলে বিশ্বাস করে ফেলেন এবং ইসলাম রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এবং দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যেপথে জীবন দিয়েছেন তাঁরাও সে পথে জীবন উৎসর্গ করবেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আনাস ইবন নাযর (রা) প্রমুখ । তাঁদের আলোচনা অবিলম্বে আসবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যদি নিহতও হতেন তবু তা মুসলমানদের জন্যে সাহস হারাবার কারণ হতে পারে না বলে আশ্বস্ত করে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
(মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ নন। তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেউ যদি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেও তবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করবে না। বরং আল্লাহ্ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না। তার মেয়াদ সুনির্ধারিত। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমি তাকে তার কিছু দিই এবং যে পরকালের পুরস্কার চাইবে তাকে তা থেকে দান করি এবং শীঘ্রই আমি কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করব। এবং কত নবী যুদ্ধ করেছেন তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি দুর্বল হয়নি এবং নত হয়নি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন। এ কথা ব্যতীত তাদের আর কোন কথা ছিল না- “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ এবং আমাদের কার্যে সীমালংঘন আপনি ক্ষমা করুন এবং আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। এরপর আল্লাহ্ তাদেরকে পার্থিব পুরস্কার এবং উত্তম পারলৌকিক পুরস্কার দান করেন। আল্লাহ্ সৎকর্ম পরায়ণদেরকে ভালবাসেন । হে মুমিনগণ! যদি তোমরা কাফিরদের আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদেরকে বিপরীত দিকে ফিরিয়ে দেবে এবং তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আল্লাহই তো তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী । আমি অবিলম্বে কাফিরদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর শরীক করেছে যার সপক্ষে আল্লাহ্ কোন সনদ পাঠাননি। জাহান্নাম তাদের আবাস। কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল যালিমদের। (৩- আলে-ইমরান : ১৪৪-১৫১)। আমাদের তাফসীর গ্রন্থে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহর ।
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতিকালের পর হযরত ছিদ্দিক-ই-আকবর (রা) প্রথম যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেছিলেন : হে লোক সকল! যারা মুহাম্মদের (সা) ইবাদত করতে মুহাম্মাদ (সা) তো ইনতিকাল করেছেনই, আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তবে আল্লাহ্ চিরঞ্জীব তাঁর মৃত্যু নেই, এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন :
বর্ণনাকারী বলেন, এতে লোকজন সম্বিৎ ফিরে পেল । তারা যেন এ আয়াত ইতিপূর্বে কোন দিন শুনেনি। এবার সবাই আয়াতটি তিলাওয়াত করতে লাগলেন।
বায়হাকী (র) তাঁর “দালাইল আন নুবুওয়াহ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইবন আবু নাজীহ্ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উহুদ দিবসে জনৈক মুহাজির ব্যক্তি একজন আনসারী ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আনসারী লোকটি ছিলেন রক্তাক্ত অবস্থায় । মুহাজির সহসা বললেন, তুমি কি জান যে, মুহাম্মাদ (সা) নিহত হয়েছেন? আনসারী বললেন : মুহাম্মাদ (সা) যদি নিহত হন-ই তবে তিনি রিসালাতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এখন তোমরা তাঁর দীন রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাও। এ প্রসংগে নাযিল হল — আনসারী লোকটি সম্ভবত ছিলেন আনাস ইবন নাযর (রা)। তিনি আনাস ইবন মালিকের চাচা ।
ইমাম আহমদ বলেন, ইয়াযীদ– আনাস (রা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, চাচা বদরের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। তাই বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মুশরিকদের বিরুদ্ধে প্রথম যে যুদ্ধ করলেন আমি তাতে অনুপস্থিত ছিলাম। আল্লাহ্ তা’আলা যদি আমাকে অন্য কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেন তবে আমি দেখিয়ে দেব যে আমি কী করতে পারি। এরপর উহুদ দিবসে এক সময় মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এরা যা করেছে অর্থাৎ সাথীরা যা করেছে তার ব্যাপারে আমি আপনার দরবারে ওযর খাহী করছি। আর মুশরিক যা করেছে তার সাথে আমি আমার সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি। তারপর তিনি এগিয়ে গেলেন। উহুদের পাদদেশে (তাঁর) সা’দ (রা)-এর ইবন মুআয-এর সাথে দেখা হল ‘দ (রা) বললেন, আমি তোমার সাথে আছি। সাদ (রা) আরো বলেছেন, সে আনাস ইবন নাযর যা করেছেন আমি তা করতে পারিনি। তার শরীরে ৮০-এর উপর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো ছিল তরবারি, বর্শা ও তীরের আঘাত। তার সম্পর্কে এবং তাঁর সাথীদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে বলে আমরা বলাবলি করতাম : “তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। (৩৩, আহযাব ও ২৩)। এই হাদীস তিরমিযী (র) থেকে এবং ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী মন্তব্য করেছেন যে, এটি হাসান। আমি বলি, যে এর সনদ ও মুসলিম (র)-এর শর্তে উত্তীর্ণ ।
ইমাম আহমদ বলেন, বাহস ও হাশিম– আনাস (রা)-এর বরাতে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, তাতে অতিরিক্ত আছে । এক পর্যায়ে তিনি সা’দ ইবন মুআয (রা)-এর মুখোমুখি হলেন । আনাস (রা) তাঁকে বললেন, হে আবু আমর! কোথায় যাচ্ছেন? বাহ্ চমৎকার আমি উহুদ পাহাড়ের দিক থেকে জান্নাতের সুবাস পাচ্ছি। এরপর তিনি লড়াই শুরু করলেন। অবশেষে শহীদ হলেন। তাঁর দেহে তরবারি, বর্শা ও তীরের আঘাত মিলিয়ে ৮০-এর উপরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল । বর্ণনাকারী আনাস ইবন মালিক বলেন, তাঁর বোন আমার ফুফু রাবী বিত নাযর বলেছেন “একমাত্র আঙ্গুলের অগ্রভাগ দেখেই আমি আমার ভাইয়ের লাশ সনাক্ত করেছি। আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, ওদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অংগীকারে কোন পরিবর্তন করেনি। (৩৩, আহযাব : ২৩)। সাহাবা-ই-কিরাম মনে করতেন যে, এই আয়াত আনাস ইবন নাযর ও তাঁর সাথীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।
মুসলিম (র) তিরমিযী ও নাসাঈ ও আবু দাউদ ভিন্ন ভিন্ন সনদে এটি বর্ণনা করেছেন । তিরমিযী এটি হাসান ও সহীহ্ হাদীছ বলে মন্তব্য করেছেন।
আবুল আসওয়াদ বর্ণনা করেছেন, উরওয়া ইবন যুবায়র থেকে। তিনি বলেছেন, উবায় ইবন খালফ জুমাহী মক্কায় অবস্থানকালে শপথ করে বলেছিল যে, সে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা)-কে হত্যা করবে। তার শপথের সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা) অবহিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, বরং আমিই তাকে হত্যা করব ইনশাআল্লাহ্। উহুদ দিবসে উবাই লৌহ বর্মে আবৃত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়। সে বলছিল যে, “মুহাম্মাদ বেঁচে থাকলে আমার রক্ষা নেই।” রাসূলুল্লাহ (সা)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে সে তাঁর উপর আক্রমণ চালায়। সামনে এগিয়ে আসেন হযরত মুসআব ইবন উমায়র (রা)। তিনি ছিলেন আবদুদদার গোত্রের লোক। তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু শত্রুর আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। উবাইর বর্মের ফাঁক দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) তার বক্ষদেশ দেখতে গেলেন। বর্ম ও শিরস্ত্রাণের ফাঁক লক্ষ্য করে তিনি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। সে ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ওই আঘাতে তার রক্ত ক্ষরণ হয়নি। তার সঙ্গীরা এসে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তখন সে ষাঁড়ের মত চীৎকার করছিল। তারা বলল, তোমার হল কী? এতো সামান্য ক্ষত মাত্র । সে তখন তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উক্তি “আমি উবাইকে হত্যা করব” ওদেরকে স্মরণ করিয়ে দিল। তারপর সে বলল, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, আমি যতটুকু আঘাত পেয়েছি যুল মাজায অঞ্চলের সকলে মিলে যদি ততটুকু আঘাত পেত তবে তাদের সকলেরই মৃত্যু হত । তারপর উবাই মারা যায় । “ধ্বংস জাহান্নামীদের জন্যে।” মূসা ইবন উবা তাঁর মাগাযী গ্রন্থে যুহরীর বরাতে সাঈদ ইবন মুসায়্যিব থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন পাহাড়ী পথে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন উবাই ইবন খালাফ তাঁকে দেখতে পায়। সে তখন বলছিল, মুহাম্মাদ বেঁচে থাকলে আমার রক্ষা নেই । সাহাবিগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমাদের কেউ কি তাকে প্রতিহত করবে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, না তাকে বরং আসতে দাও। সে কাছাকাছি আসার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হারিছ ইবন সাম্মাহ থেকে বশী চেয়ে নেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, তখন আমরা উট গা ঝাড়া দিলে যেমন লোম উড়তে থাকে আমরা তেমনি তা থেকে দূরে সরে পড়লাম । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সম্মুখে গেলেন এবং বর্শা দ্বারা তার ঘাড়ে আঘাত করলেন । এক আঘাতে সে ঘোড়া থেকে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ওয়াকিনী অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ওয়াকিদী বলেন, যে ইবন উমার (রা) বলতেন, উবাই ইবন খালাফ-এর মৃত্যু হয় বাতন-ই-রাবিগ অঞ্চলে। তিনি আরো বলেছেন যে, রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন আমি বাতন-ই-রাবিগ এলাকায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ আমি দেখতে পাই যে, এক জায়গায় ভীষণভাবে আগুন জ্বলছে। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। তখন দেখি, ওই আগুন থেকে একটি লোক বের হচ্ছে । সে শিকলে বাঁধা। পিপাসায় সে হাঁপাচ্ছে। তখন একজন লোক বলছিল যে, একে পানি দেবেন না কারণ, সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে নিহত হয়েছে। সে উবাই ইব্ন খালাফ ।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবদুর রাযযাক– আবু হুরায়রা সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যে লোককে আল্লাহর পথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) স্বহস্তে হত্যা করেছেন তার প্রতি আল্লাহর ক্রোধ তীব্রতর হোক! বুখারী ভিন্ন সনদেও এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
বুখারী বলেন, আকূল ওয়ালীদ— জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমার পিতা যখন শহীদ হন তখন আমি কাঁদতে থাকি। তাঁর চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে তাঁর মুখ দেখতে থাকি। সাহাবীগণ (রা) আমাকে তা থেকে বারণ করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বারণ করেননি। তিনি বললেন, তার জন্যে কেঁদোনা অথবা তিনি বলেছেন যে, তার জন্যে কাঁদার কী আছে? ফেরেশতাগণ তো সব সময় তাকে ডানা দ্বারা ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে তাকে উর্ধ্বাকাশে তুলে নেয়া হয়েছে। এখানে এই হাদীছটি সনদহীনভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তবে জানাযা অধ্যায়ে সনদসহ তা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম এবং নাসাঈ ও শুবা থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন।
বুখারী বলেন, আবদান– ইবরাহীম থেকে বর্ণিত যে, আবদুর রহমান ইবন আওফের (রা) নিকট কিছু খাদ্য উপস্থিত করা হয়েছিল। তিনি তখন রোযা অবস্থায় ছিলেন। তিনি বললেন, মুসআব ইবন উমায়র শহীদ হয়েছেন। তিনি আমার চাইতে উত্তম ছিলেন। তাঁকে একটি মাত্র চাদরে কাফন দেয়া হয়েছিল। চাদরটি খাটো ছিল । চাদর দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকলে পা দুটো বেরিয়ে যেত । আর পা ঢাকতে গেলে মাথা বের হয়ে যেত। বর্ণনাকারী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি এও বলেছিলেন যে, হামযা (রা) শহীদ হয়েছেন, তিনি আমার চাইতে উত্তম ছিলেন। তারপর দুনিয়ার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বচ্ছলতা আমাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তাতে আমাদের আশংকা হচ্ছে আমাদের সৎকর্মের প্রতিদান দুনিয়াতেই নগদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না! তারপর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এই হাদীছ বুখারী একা উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী আহমদ ইবন ইউনুস– খাব্বার ইবন আরত সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হিজরত করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন । আল্লাহর নিকট আমাদের প্রতিদান মঞ্জুর হয়েছে। এরপর আমাদের কেউ কেউ চলে গিয়েছে ওই প্রতিদানের কিছুই দুনিয়াতে ভোগ করেনি। তাদের মধ্যে আছেন মুসআব ইবন উমায়র । তিনি উহুদ দিবসে শহীদ হন। একটি চাদর ব্যতীত কিছু রেখে যাননি। কাফন হিসেবে ওই চাদরে পা ঢাকতে গেলে তাঁর মাথা বের হয়ে যেত আর মাথা ঢাকতে গেলে পা বের হয়ে যেত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে বললেন, চাদর দ্বারা তার মাথা ঢেকে দাও আর ইযখির ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দাও। বর্ণনাকারী খাব্বার (রা) আরো বলেন যে, আমাদের কতকের ফল পেকে গিয়েছে এখন সে তা ভোগ করছে। ইবন মাজাহ ব্যতীত অন্য সকলে এই হাদীছ আমাশ থেকে বিভিন্ন সনদে উদ্ধৃত করেছেন।
বুখারী বলেন, উবায়দুল্লাহ্ ইবন সাঈদ— আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে প্রথম দিকে মুশরিকরা পরাজিত হয়েছিল। তখন অভিশপ্ত ইবলীস চীৎকার দিয়ে বলে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমাদেরকে তো পেছন থেকে আক্রমণ করা হচ্ছে। ফলে মুসলমানদের সম্মুখ সারির লোকজন পেছনের দিকে ফিরে যায় এবং নিজেদেরই সম্মুখ সারি ও পেছনের সারি পরস্পরের উপর তরবারি চালাতে থাকে। হঠাৎ হুযায়ফ দেখতে পেলেন তাঁর পিতা ইয়ামানকে আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি চীকার করে বললেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তিনি তো আমার পিতা, তিনি আমার পিতা, কিন্তু তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের আঘাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। হুযায়ফা বললেন, আল্লাহ্ আপনাদেরকে ক্ষমা করুন। উরওয়া বলেন, আল্লাহর কসম! মৃত্যু পর্যন্ত হুযায়ফা ওই দুঃখ ভুলতে পারেননি।
আমি বলি, হযরত হুযায়ফার পিতা ইয়ামান নিহত হওয়ার পটভুমি এই যে, ইয়ামান এবং ছাবিত ইবন ওয়াশ দুজনে মহিলাদের সাথে টিলার উপর অবস্থান করছিলেন। বার্ধক্য ও দুর্বলতার প্রেক্ষিতে তাঁরা ওখানে ছিলেন। তাঁরা বললেন, গাধার তৃষ্ণা (স্বল্প সময়) ব্যতীত আমাদের জীবনেরতো কিছু অবশিষ্ট নেই। একথা বলে তাঁরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। ঘটনাক্রমে তারা বেরিয়েছিলেন মুশরিকদের নিকটস্থ পথে। ফলে মুশরিকরা ছাবিত (রা)-কে হত্যা করে। আর ভুলবশত মুসলমানগণ ইয়ামান (রা)-কে শহীদ করে ফেলেন। হযরত হুযায়ফা (রা) মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাঁর পিতার রক্তপণের দাবী ক্ষমা করে দেন! গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণে ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে তিনি দোষারূপ করেননি।
কাতাদা ইবন নু’মানের চোখ পুনঃস্থাপন
ইবন ইসহাক বলেন, সেদিন কাতাদা ইবুন নু’মানের একটি চোখে আঘাত লেগেছিল । চোখটি স্থানচ্যুত হয়ে তাঁর মুখমণ্ডলে ঝুলে পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজ হাতে চোখটি যথাস্থানে বসিয়ে দেন। পরে দুই চোখের মধ্যে এটিই বেশী সুন্দর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে উঠে। হযরত জাবির (রা) থেকে হাদীছে বর্ণিত আছে যে, উহুদ দিবসে কাতাদা ইবন নু’মানের চোখে আঘাত লাগে। চোখটি তাঁর মুখের উপর ঝুলে পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেটি যথাস্থানে বসিয়ে দেন। পরে দুচোখের মধ্যে সেটিই সুন্দর ও প্রখর দৃষ্টির অধিকারী হয়। অন্য চোখ মাঝে মাঝে রোগগ্রস্ত হত; কিন্তু এটি কোন দিন রোগাক্রান্ত হত না।
দারাকুতনী স্বয়ং কাতাদার বরাতে এ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে আমার দুচোখেই আঘাত লাগে । দুচোখ আমার গালের উপর ঝুলে পড়ে। এ অবস্থায় আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসি। তিনি চোখ দুটো যথাস্থানে বসিয়ে দেন এবং একটু লালা লাগিয়ে দেন। ফলে দুটোই প্রখর দৃষ্টির অধিকারী হয়।
তবে তাঁর একটি চোখে আঘাত লাগার প্রথম বর্ণনাটি বিশুদ্ধতর। এজন্যেই উমার ইবন আবদুল আযিযের শাসনামলে কাতাদার পুত্র যখন তাঁর নিকট উপস্থিত হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, আপনি কে? উত্তরে ছন্দাকারে তিনি বলেছিলেন:
আমি সেই ব্যক্তির পুত্র যার চোখ ঝুলে তার গালের উপর পড়েছিল। এরপর মুস্তাফা (সা) স্বহস্তে সুন্দরভাবে সেটি যথাস্থানে তা পুনঃস্থাপন করেছিলেন।
এরপর সেটি হয়ে গেল তেমন যেমনটি ছিল ইতিপূর্বে। বাহ্! কী চমৎকার ওই চোখ! বাহ! কী চমৎকার ওই গন্ডদেশ।
তখন উমর ইবন আবদুল আযীয নিজেও কবিতার ছন্দে ঐ ঘটনার প্রশংসা করে সাদর অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁকে মূল্যবান উপঢৌকন প্রদান করেন।
উহুদ যুদ্ধে উম্মে আমার প্রমুখের বীরত্ব প্রদর্শন
ইবন হিশাম বলেন, উম্মু আমারা নাসীবা বিন্ত কা’ব মাযিনী (রা) উহুদ দিবসে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এ প্রসংগে সাঈদ ইব্ন আবু যায়দ আনসারী বলেন যে, উম্মু সা’দ বিন্ত সা’দ ইবন রাবী বলতেন, আমি একদিন উম্মু আমারার নিকট গিয়ে বললাম, খালা! আপনার যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন, ওই দিন আমি সকালের দিকে বের হয়ে পড়ি। লোকজন কী করছে আমি তা দেখছিলাম। আমার সাথে একটি পানি ভর্তি মশক ছিল । আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যাই। সেখানে তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন। তখন মুসলমানদের বিজয়ের পালা চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন মুসলমানগণ পরাজিত হলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে আশ্রয় নিলাম । আমি তাকে রক্ষার জন্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হই। তরবারি পরিচালনা করে এবং তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদেরকে দূরে তাড়িয়ে দিই। এতে আমি যখম হই। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তার কাঁধে যখমের চিহ্ন দেখেছি। সেটি ছিল বৃত্তাকার গভীর গর্ত। কে এই আঘাত করেছিল তা আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, ওই আঘাত করেছিল অভিশপ্ত ইবন কামিয়া । সাথিগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর সে এসে বলল, মুহাম্মাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও। সে বেঁচে থাকলে আমার রক্ষা নেই। আমি নিজে, মুসআব ইবন উমায়র এবং অন্য কতক লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে রক্ষার জন্যে দাঁড়িয়ে গেলাম । তখন সে আমার উপর এই আক্রমণ চালায়, আমি তাকে পাল্টা কয়েকবার আক্রমণ করি; কিন্তু আল্লাহর সেই দুশমন দুটো লৌহবর্ম পরিহিত ছিল যার ফলে তার গায়ে আঘাত লাগেনি।
ইবন ইসহাক বলেন, আবু দুজানা নিজে ঢাল স্বরূপ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে যান। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দিকে মুখ করে একটুখানি ঝুঁকে অবস্থান নেন। শত্রুর তীরগুলো তার পিঠে এসে বিঁধতে থাকে। তাতে করে বহু তীর তার পিঠে বিদ্ধ হয়। ইবন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তার ধনুক দিয়ে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। এক পর্যায়ে ধনুকের মাথা দু’টি ভেঙ্গে যায়। কাতাদা ইবন নুমান ওই ধনুক নিয়ে যান। সেটি তাঁর নিকটই থাকত।
ইন ইসহাক বলেন, বান্ আদী ইব্ন নাজ্জার গোত্রের লোক কাসিম ইব্ন আবদুর রহমান বলেছেন, আনাস ইবন মালিকের চাচা আনাস ইবুন নাযর গিয়ে পৌঁছলেন উমর ইবন খাত্তাব ও তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ্ সহ কতক মুহাজির ও আনসার সাহাবীর নিকট । তারা সকলে তখন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছিলেন। তিনি বললেন, আপনারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? তারা বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অবর্তমানে আপনাদের বেঁচে থাকার কী অর্থ? বরং উঠুন, যুদ্ধ করুন যে জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রাণ দিয়েছেন আপনারাও সে উদ্দেশ্যে প্রাণ বিসর্জন দিন। এরপর তিনি শত্রুদের মুখোমুখি হলেন। এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলেন। তাঁর নাম অনুসারেই আনাস ইবন মালিকের নাম রাখা হয়। হুমায়দ আততাবীল আমাকে জানিয়েছেন যে, আনাস ইবন মালিক বলেছেন, উহুদের দিবসে আমরা আনাস ইবুন নাযরের দেহে ৭০টি আঘাত দেখেছি। একমাত্র তাঁর বোন ব্যতীত অন্য কেউ তার লাশ সনাক্ত করতে পারেনি। তার হাতের আঙ্গুল দেখে তিনি তাঁকে সনাক্ত করেছিলেন। ইবন হিশাম বলেন, কেউ কেউ আমাকে জানিয়েছেন যে, আবদুর রহমান ইব্ন আউফ সেদিন মুখে আঘাত পেয়েছিলেন। তাতে তার দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাঁর দেহে কুড়িটির ও বেশী আঘাত লেগেছিল। তার কতক ছিল পায়ে। ফলে তিনি খুঁড়িয়ে চলতেন।
অধ্যায় : ইবন ইসহাক বলেন, মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ হওয়া এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিহত হয়েছেন এই গুজব রটনার পর রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সর্বপ্রথম সনাক্ত করেন কা’ব ইবন মালিক (রা)। যুহরী বলেছেন যে, এ প্রসংগে কা’ব ইবন মালিক বলেছেন, আমি দেখতে পেলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শিরস্ত্রাণের নীচ দিয়ে তার চোখ দু’টি থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে । আমি উচ্চস্বরে চীৎকার করে বলে উঠলাম, হে মুসলমানগণ! সুসংবাদ নিন, এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এখানে আছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললেন।
ইবন ইসহাক বলেন, মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে চিনতে পেরে তাকে ধরে উঠালেন। তিনি তাঁদের সাথে গিরিপথের দিকে রওয়ানা হলেন। আবু বকর সিদ্দীক (রা) উমার ইবন খাত্তাব (রা), আলী ইবন আবু তালিব (রা), তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ্ (রা), যুবায়র ইবন আওয়াম (রা), হারিছ ইবন সাম্মাহ (রা) ও একজন মুসলমান তখন তাঁর সাথে ছিলেন। তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় উবাই ইবন খালাফ সেখানে হাযির হয়। ইবন ইসহাক বলেন, সালিহ ইবন কায়সান ইব্ন আবদুর রহমান ইবন আওফ আমাকে জানিয়েছেন যে, মক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে উবাই ইবন খালাফের দেখা হলে সে বলত হে মুহাম্মাদ! আমার একটি তেজী ঘোড়া আছে। প্রতিদিন আমি সেটিকে প্রায় ৮ সের তাজা ঘাস খেতে দেই। ওই ঘোড়ায় চড়ে আমি তোমাকে হত্যা করব। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বলতেন, বরং ইনশা-আল্লাহ্ আমি তোকে হত্যা করব। উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে সে কুরায়শদের নিকট ফিরে যায়। তার ঘাড়ে আঘাত লেগেছিল। সেটি খুব বড় ক্ষত ছিল না। সেখানে রক্ত জমাট বেঁধেছিল । তা প্রবাহিত হয়নি। সে তখন বলছিল, আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ (সা) তো আমাকে খুন করে ফেলেছে। তার সাথীরা বলল, আসলে এটি তোমার মনের ভয়। আল্লাহর কসম, তোমার আঘাত তো সামান্য মাত্র। সে বলেছিল, মক্কাতে মুহাম্মাদ আমাকে বলেছিল যে, সে আমাকে হত্যা করবে। এখন সে যদি আমার প্রতি থুথুও নিক্ষেপ করত তবু আমি মারা যেতাম । মক্কা ফেরার পথে সারিক নামক স্থানে আল্লাহ্ এ দুশমনের মৃত্যু হয়। ইবন ইসহাক বলেন, এ প্রসংগে হাস্সান ইবন ছাবিত নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন:
সে তো তার পিতা উবাই থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ ভ্রষ্টতা পেয়েছে। সেদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার বিরুদ্ধে লড়াই করলেন।
একটি পুরনো হাড় হাতে নিয়ে তুমি তার নিকট এসেছে। তুমি তাকে ভয় দেখাচ্ছিলে। অথচ তার অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে তুমি নিতান্তই অজ্ঞ।
বানু নাজ্জার গোত্র তোমাদের থেকে উমাইয়াকে হত্যা করেছে। যখন সে ফরিয়াদ জানাচ্ছিল আর বলছিল, হে আকীল!
রাবী’আ এর দুপুত্রই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যখন তারা আবৃ জাহলের আনুগত্য করেছে। ওদের মা তো ধ্বংসশীলা বটে ।
হে হারিছ! তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে যে, আমাদের সকলকে তোমরা যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছিলে। বস্তুত তার সম্প্রদায়ের লোকজন কমই।
হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) আরো বলেছেন :
কে আছ, আমার পক্ষ থেকে উবাইকে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে দেবে যে, হে উবাই, তুমি তো জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
তুমি তো সত্য থেকে বহু দূরের ভ্রান্তি কামনা কর। তুমি যদি সক্ষম হও তবে এই সতকর্তকারীর মুকাবিলায় টিকে থাক।
তোমার সকল কামনা বাসনা তো মিথ্যা ও অসত্যকে ঘিরে আবর্তিত। কুফরী কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত প্রতারণায় পর্যবসিত হয় ।
প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধের অধিকারী নবী (সা)-এর বর্শা তোমাকে আঘাত করেছে। তিনি সম্ভ্রান্ত বংশীয়। অশ্লীলতা তাকে স্পর্শ করেনি।
সৎ গুণাবলী বিবেচনায় প্রশংসনীয় বিষয়গুলোর মূল্যায়নে তিনি সকল মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ।
ইবন ইসহাক বলেন, গিরিপথের প্রবেশ মুখে যাবার পর আলী (রা) তাঁর ঢাল ভর্তি করে পানি নিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা পান করতে গেলেন। কিন্তু তাতে দুর্গন্ধ পেলেন। ফলে ওই পানি পান করলেন না। সেটি দিয়ে রক্ত ধুয়ে নিলেন এবং মাথায় ঢাললেন । তিনি তখন বলছিলেন, “যারা নবীর মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করেছে তাদের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি কঠোর হোক!” এ বিষয়ে ইতিপূর্বে পর্যাপ্ত সংখ্যক সহীহ হাদীছ আমরা উল্লেখ করেছি।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) গিরি সংকটে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে উল্লিখিত সাহাবীগণ ছিলেন। কুরায়শের একটি দল তাদেরকে লক্ষ্য করে উপরে উঠতে লাগল। ইবন হিশাম বলেন, ওই দলে খালিদ ইবন ওলীদও ছিল। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বললেন- হে আল্লাহ্! ওরা আমাদের নিকট পর্যন্তও যেন না আসতে পারে ।
হযরত উমার (রা) ও কতক মুহাজির মুসলমান ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ওদেরকে পাহাড় থেকে নামিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) একটি পাথরে উঠতে প্রয়াস পেলেন। কিন্তু তাঁর পরিধানে দুটো লৌহবর্ম ছিল। ফলে তিনি পাথরের উপর উঠতে পারলেন না। এ অবস্থায় তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ্ বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর পিঠে উঠলেন। তালহা তাঁকে নিয়ে পাথরের উপরে উঠে এলেন । ইয়াহয়া ইবন আব্বাদ– যুবায়র (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সেদিন আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যে তালহা যা করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে তিনি বলছিলেন “তালহার জন্যে জান্নাত অবধারিত হয়ে গিয়েছে”।
ইন হিশাম বলেন, আফরার আযাদকৃত গোলাম উমর বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) শরীরে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ায় ওই দিন যুহরের নামায় বসে বসে আদায় করেন। মুসলমানগণও বসে বসে নামায আদায় করেছিলেন । ইবন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা বলেছেন, আমাদের মধ্যে জনৈক আগন্তুকের আগমন ঘটেছিল তার পরিচয় কারো নিকট জানা ছিল না। তাকে কুযমান নামে ডাকা হচ্ছিল। তার সম্পর্কে আলোচনা হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলতেন “ সে অবশ্যই জাহান্নামী”। উহুদ দিবসে মুসলমানদের সপক্ষে সে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। ৭/৮ জন মুশরিককে সে একাই হত্যা করে। সে খুব শক্তিশালী ছিল। এক পর্যায়ে শত্রু পক্ষের আঘাতে আঘাতে সে অচল হয়ে পড়ে। বানূ যফর গোত্রের এলাকায় তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সম্পর্কে মুসলমানগণ বলতে থাকেন যে, হে কুযমান, তুমি আজকে ভীষণ কষ্ট ভোগ করেছ। এর বিনিময়ে পুরস্কারের সুসংবাদ গ্রহণ কর! সে বলল, কেমন সুসংবাদ নেব, আমি তো লড়াই করেছি আমার সম্প্রদায়ের ইজ্জত রক্ষার্থে, তা নাহলে আমি আদৌ লড়াই করতাম না। এক পর্যায়ে তার ক্ষতস্থানে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়। নিজের তূণ থেকে সে একটি তীর বের করে সেটি দ্বারা আত্মহত্যা করে। এ রকম একটি ঘটনা খায়বারের যুদ্ধেও ঘটেছিল, তার বিবরণ অবিলম্বে আসবে ইনশাআল্লাহ্।
ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবদুর রাযযাক– আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে খায়বারের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলাম । ইসলাম গ্রহণের দাবীদার এক লোকের দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘এই লোকটি জাহান্নামী। যুদ্ধ শুরু হল, লোকটি প্রচণ্ড লড়াই করছিল। এক পর্যায়ে সে আহত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানানো হল যে, যে ব্যক্তিকে আপনি জাহান্নামী বলেছিলেন সে তো প্রচণ্ড যুদ্ধ করেছে আজ এবং আহত হয়ে মারা গেছে। তিনি বললেন, সে জাহান্নামীই বটে। তাঁর এ কথায় কারো কারো সংশয় সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় খবর পাওয়া গেল যে ওই লোক মারা যায়নি । বরং ভীষণভাবে আহত অবস্থায় রয়েছে। ওই রাতে ক্ষত ও আঘাতের যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে সে আত্মহত্যা করে। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তা জানানো হলে তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবর, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশক্রমে তিনি ঘোষণা দিলেন যে, মুসলমান ব্যতীত কেউ জান্নাতে যাবে না এবং পাপাচারী ব্যক্তি দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা এই দীনকে সাহায্য করবেন । ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) তাদের সহীহ্ গ্রন্থে আবদুর রাযযাক সূত্রে এই হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন।
ইবন ইসহাক বলেন, উহুদ যুদ্ধে নিহতদের একজন ছিলেন মুখায়রীক। সে বান্ ছা’লাবা ইবন গীত্ন গোত্রের লোক ছিল। উহুদ দিবসে সে তার সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, হে ইয়াহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম, তোমরা তো জান যে, মুহাম্মাদ (সা)-কে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তারা বলল, আজ তো শনিবার। সে বলল, তোমাদের কোন শনিবার নেই। সে তার যুদ্ধ সরঞ্জাম ও তরবারি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং বলল, আমি যুদ্ধে নিহত হলে আমার সকল ধন-সম্পদ মুহাম্মাদ (সা)-এর জন্যে হয়ে যাবে। তিনি ওই সম্পদে যা চান তাই করবেন। ভোরে সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হয়, আমরা যা জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, মুখায়রীক হল শ্রেষ্ঠ ইয়াহুদী। সুহায়লী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুখায়রীকের সম্পদগুলো ৭টি বাগান মদীনায় আল্লাহর পথে ওয়াকফ করে দেন। মুহাম্মাদ ইবন কা’ব বলেন, এটি ছিল মদীনায় প্রথম ওয়াকফ সম্পত্তি। আবদুর আবদুর ।
ইবন ইসহাক বলেন, হুসায়ন ইবন আবদুর রহমান– আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলতেন যে, আপনারা আমাকে এমন একজন লোকের নাম বলুন, যে জান্নাতে প্রবেশ করেছে অথচ এক ওয়াক্ত নামাযও পড়েনি। লোকজন উত্তর প্রদানে অপারগ হয়ে বলত যে, আপনি বরং তার পরিচয় বলে দিন । তিনি বলতেন, সে হল আব্দ আশহাল গোত্রের আমর ইবন ছাবিত ইবন ওয়াকশ ওরফে উসায়রিম। হুসায়ন বলেন, আমি বলেছিলাম মাহমূদকে যে, উসায়রিম কেমন লোক ছিল। তিনি বললেন, তার সম্প্রদায়ের সাথে সেও ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাত। কিন্তু উহুদ দিবসে তার সুমতি হয়। সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর তরবারি হাতে যুদ্ধ ময়দানে উপস্থিত হয় । প্রচণ্ড যুদ্ধ চালিয়ে যায় সে। এক পর্যায়ে সে আহত হয়। বানূ আবদুল আশহাল গোত্রের লোকেরা তাদের যুদ্ধের ময়দানে নিহত ব্যক্তিদের লাশ খুঁজছিল । হঠাৎ তারা উসায়রিমকে দেখতে পায়। তারা বলে এ যে, উসায়রিম । সে এখানে কেন এল? আমরা তো তাকে বাড়ীতে রেখে এসেছি যে, সে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতিও জ্ঞাপন করেছিল। তারা বলল, হে আমর! তুমি যুদ্ধের ময়দানে কেন এসেছে? আপন সম্প্রদায়ের প্রতি বিরক্ত হেতু, না ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে? তিনি বললেন বরং আমি এসেছি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তারপর তরবারি হাতে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে মিলিত হয়েছি। এরপর আমি এমনকি আহত ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি যা এখনও আমার দেহে বিদ্যমান আছে। এর অল্প কিছুক্ষণ পরই তাদের চোখের সামনে তিনি শহীদ হন। তাঁর কথা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানানো হলে তিনি বললেন, সে জান্নাতী ।
ইবন ইসহাক বলেন, বানূ সালামা গোত্রের কতক শায়খ থেকে আমার পিতা বর্ণনা করেছেন যে, আমর ইব্ন জামূহ ছিলেন একান্ত খোঁড়া এক লোক । তাঁর ৪ পুত্র ছিলেন। তাঁরা সিংহের মত সাহসী। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথী হয়ে তাঁরা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করতেন। উহুদ দিবসে তাঁরা তাদের পিতা আমর ইবন জামূহকে ঘরে বসিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা তো আপনাকে ওযরগ্রস্ত করেছেন। তখন আমর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে বললেন, আমার ছেলেরা এই যুক্তিতে আমাকে যুদ্ধ থেকে বারণ করতে চায়। অথচ আমি চাই আমার এই খোঁড়া পায়ে ভয় করে জান্নাতে প্রবেশ করি । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে ওযরগ্রস্ত করেছেন, আপনার উপর জিহাদ বাধ্যতামূলক নয়। তাঁর পুত্রদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন যে, তোমরা তাঁকে জিহালে যেতে বাধা দিওনা। কারণ, এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে শাহাদতের মর্যাদা দান করবেন। আমর ইবন জামূহ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে জিহাদে বের হলেন এবং ওই উহুদ দিবসে যুদ্ধে শহীদ হলেন। ইবন ইসহাক বলেন, হিন্দ বিন্ত উতবা এবং তার সাথী মহিলারা সেদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবীগণের অঙ্গচ্ছেদ করতে শুরু করে। তারা তাদের নাক কান কাটতে লাগল। এক পর্যায়ে হিন্দ তার পায়ের মল নাকের দুল এবং গলার হার খুলে ওয়াহ্শীকে দিয়ে দেয় এবং মুসলমানদের নাক কান কেটে মালা ও মল বানিয়ে গলায় ও পায়ে পরিধান করে । হযরত হামযা (রা)-এর কলিজা কেটে এনে সে চিবাতে থাকে। কিন্তু গিলতে পারলো না। অগত্যা সে তা ফেলে দিল। মূসা ইবন উবা বলেন, হযরত হামযা (রা)-এর কলিজা কেটে এনেছিল ওয়াহশী। সেটি এনে সে হিন্দর হাতে তুলে দেয়। হিন্দে সেটি চিবাতে থাকে। কিন্তু গিলতে পারেনি। আল্লাহই ভাল জানেন।
ইবন ইসহাক বলেন, এরপর হিদ একটি উঁচু পাথরে উঠে এবং উচ্চস্বরে চীৎকার করে নিম্নের কবিতাগুলো আবৃত্তি করে?
আজ আমরা তোমাদের উপর বদর দিবসের প্রতিশোধ নিয়েছি। এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধ আরো তীব্র হয়।
উতবা নিহত হবার পর আমার ধৈর্য ধারণ করার অবস্থা ছিল না। দ্রুপ আমার ভাই, তার চাচা এবং বকরের হত্যাকাণ্ড আমাকে ভীষণ বিচলিত করেছিল।
এখন আমি শান্তি পেয়েছি। আমি আমার মানত পূর্ণ করেছি। হে ওয়াহশী! তুমি আমার মনের বেদনার উপশম করে দিয়েছ।
ওয়াহশীর প্রতি আমার জীবনভর কৃতজ্ঞ থাকতে হবে । যতক্ষণ না কবরের মধ্যে আমার হাড় নিশ্চিহ্ন হয় ।
ইবন ইসহাক বলেন, হিনদ বিনতে উতবার উপরোক্ত কবিতার প্রত্যুত্তরে হিন্দু বিন্ত উছাছা ইবন আব্বাছ ইবন মুত্তালিব নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন?
হে জঘন্য কাফিরের কন্যা, তুমি বদর দিবসেও অপমানিত হয়েছ বদর দিবসের পরেও অপমানিত হয়েছ।
উজ্জ্বল ভোর বেলায় আল্লাহ্ তা’আলা হাশিম বংশীয়দের পক্ষ থেকে তোমার জন্যে যেন প্রস্তুত করে দেন–
প্রতিটি তরবারি যা সুতীক্ষ্ণ ধার সম্পন্ন ও কর্তনশীল। মনে রেখ, হামযা (রা) আমার সিংহ এবং আলী (রা) আমার ঈগল ।
তোমার পিতা আমার নিকট একজন বিশ্বাসঘাতক মাত্র । যুবক আলী হামযা (রা) যখন তাকে আক্রমণ করলেন তখন তারা তার বক্ষে রক্তের কলপ লাগিয়ে দিলেন, তার বক্ষ রক্তে রঞ্জিত করে দিলেন।
তোমার এই কদর্য মানত অত্যন্ত মন্দ ও অকল্যাণকর মানত। ইবন ইসহাক বলেন, তখন হুলায়স ইবন যিয়ান ছিল সম্মিলিত বাহিনীর নেতা। সে বানূ হারিছ ইবন আবদ মানাত গোত্রের লোক। সে আবু সুফিয়ানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আবু সুফিয়ান তখন তার বর্শার ফলা দিয়ে হযরত হামযা (রা)-এর চোয়ালে খোঁচা মারছিল, পুঁতো দিচ্ছিল, আর বলছিল, হে আত্মীয়তা ছিন্নকারী এখন মজা বুঝ। এ অবস্থা দেখে হুলায়স বলল, হে কিনানা গোত্র! দেখ দেখ এই কুরায়শী নেতা তার চাচাত ভাইয়ের লাশের সাথে কেমন আচরণ করছে! আবু সুফিয়ান বলল, ধুতুরী এ ঘটনা প্রকাশ করোনা, কারণ, তা একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল । ইবন ইসহাক বলেন, আবু সুফিয়ান যখন উহুদ প্রান্তরে ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল তখন সে পাহাড়ে উঠে চীৎকার করে বলল, আমি খুশী। যুদ্ধ হল বালতির ন্যায়। আজকের দিবস বদর দিবসের প্রতিশোধ। হুবল দেবতার জয় হোক। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমর (রা)-কে বললেন, উঠে দাঁড়াও এবং ওর উত্তর দাও। এবং বল, আল্লাহ্ই সর্বোচ্চ সুমহান । আমাদের শহীদগণ জান্নাতে যাবে। তোমাদের নিহতগণ জাহান্নামে যাবে। আবু সুফিয়ান বলল, হে উমর এদিকে আসো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমর (রা)-কে বললেন, যান তার অবস্থা দেখে আসুন। উমর (রা) এগিয়ে এলেন, আবু সুফিয়ান তাকে বলল, আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, হে উমর! আমরা কি মুহাম্মাদ (সা)-কে মেরে ফেলেছি? উমর (রা) বললেন, তা তো নয়ই তিনি বরং এখন তোমার বক্তব্য শুনছেন। সে বলল, আপনি আমার নিকট ইবন কামিয়া অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী ও পুণ্যবান।
ইন ইসহাক বলেন, এরপর আবু সুফিয়ান ডেকে ডেকে বলল, তোমাদের নিহতদের অঙ্গহানি করা হয়েছে। আল্লাহর কসম, তাতে আমি খুশীও নই, দুঃখিতও নই। আমরা অঙ্গ কর্তনের নির্দেশও দেইনি, তা নিষেধও করিনি। যাওয়ার প্রাক্কালে আবু সুফিয়ান বলল, আগামী বছর আবার বদর প্রান্তরে শক্তি পরীক্ষার প্রতিশ্রুতি রইল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) জনৈক সাহাবীকে বললেন, তুমি বলে দাও, হাঁ আমাদের আর তোমাদের মাঝে ওই প্রতিশ্রুতি রইল ।
ইবন ইসহাক বলেন, এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত আলী (রা)-কে পাঠালেন এবং বললেন, তুমি গিয়ে দেখ, কাফিরগণ কী করে এবং কী চায়। তারা যদি ঘোড়া বাদ দিয়ে উটে আরোহণ করে তাহলে বুঝবে যে, তারা মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আর যদি দেখ যে, তারা উট বাদ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়েছে আর উটকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তবে তারা বুঝবে যে, তারা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছে। যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তার কসম, তারা যদি মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তবে আমরা তাদেরকে ধাওয়া করব এবং তাদেরকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাব।
হযরত আলী (রা) বললেন, আমি ওদের পেছন পেছন গেলাম। আমি দেখছিলাম ওরা কী করছে। আমি দেখতে পেলাম যে, তারা ঘোড়া ছেড়ে উটের পিঠে আরোহণ করেছে এবং মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।
উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দু’আ
ইমাম আহমদ (র) বলেন, মারওয়ান ইবন মু’আবিয়াহ ফাযারী– ইবন রিফা’আ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে মুসলমানদের আক্রমণের মুখে মুশরিকরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বললেন, সকলে প্রস্তত হও! আমি আমার প্রতিপালকের গুণ গান করব। সকলে তার পেছনে সারিবদ্ধ হলেন, তিনি বলতে লাগলেন:
“হে আল্লাহ্! সকল প্রশংসা আপনার। হে আল্লাহ্! আপনি যা প্রসারিত করেন তা কেউ সংকুচিত করতে পারে না। আপনি যা সংকুচিত করেন, কেউ তা প্রসারিত করতে পারে না। আপনি যাকে গুমরাহ করেন, কেউ তাকে সৎপথ দেখাতে পারে না। আপনি যাকে সৎপথ দেখান, কেউ তাকে গুমরাহ করতে পারে না। আপনি যা দান করেন, কেউ তা রুখতে পারে না। আপনি যা আটক করে রাখেন কেউ তা দান করতে পারেনা। আপনি যা নিকটবর্তী করে দেন কেউ তা দুরে সরাতে পারে না। আপনি যা দুরে সরিয়ে দেন, কেউ তা কাছে আনতে পারেনা। হে আল্লাহ্! আপনার বরকত, রহমত, অনুগ্রহ ও রিযুক আমাদের জন্যে সম্প্রসারিত করে দিন! হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট চিরস্থায়ী নে’মত কামনা করছি যা পরিবর্তন ও বিনাশ হয়না। হে আল্লাহ্! আমি ওই অভাবের দিবসের জন্যে আপনার নি’আমত কামনা করছি। ভয়ের দিবসের জন্যে কামনা করছি নিরাপত্তা । হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা দান করেছেন তার অকল্যাণ থেকে এবং যা দান করে নি তার অকল্যাণ থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ্ । ঈমানকে আমাদের নিকট প্রিয় করে দিন এবং আমাদের অন্তরে সেটিকে আকর্ষণীয় করে দিন; কুফরী পাপাচার ও অবাধ্যতাকে আমাদের নিকট ঘৃণ্য করে দিন; আমাদেরকে হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন।
হে আল্লাহ্! আমাদেরকে মৃত্যু দিবেন মুসলমান অবস্থায়, জীবিত রাখবেন মুসলমান অবস্থায়। এবং আমাদেরকে সৎ কর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন। আমাদের লাঞ্ছিত ও বিপদগ্রস্ত করবেন না। হে আল্লাহ! কাফিরদেরকে ধ্বংস করুন ‘যারা আপনার রাসূলদেরকে অস্বীকার করে এবং আপনার পথ থেকে লোকদেরকে বাধা দেয়। আপনার আযাব ও শাস্তি তাদের জন্যে অবধারিত করে দিন। হে আল্লাহ্! সত্য মা’বূদ! কিতাব প্রাপ্ত লোকদের মধ্যে যারা কুফরী করে আপনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিন। ইমাম নাসাঈ (র) এই হাদী যিয়াদ ইবন আইয়ুব— রিফাআ সূত্রে ‘আল ইয়াওম ওয়াল লায়লাহ’ অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন।
সা’দ ইবন রবী’র শাহাদত ও হযরত হামযার অঙ্গচ্ছেদ
ইবন ইসহাক বলেন,এক পর্যায়ে লোকজন নিজেদের নিহত ব্যক্তিদেরকে খুঁজতে শুরু করে। বানূ নাজ্জার গোত্রের মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন আবদুর রহমান মাযিনী আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমার পক্ষে কে গিয়ে সা’দ ইবন রাবী’ এর খোঁজ নেবে সে কি জীবিত আছে নাকি মারা গেছে? জনৈক আনসারী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যাব তার খোঁজ নিতে। তিনি খুঁজতে খুঁজতে সা’দ ইবন রাবী’কে নিহত ব্যক্তিদের মাঝে মুমূর্ষ অবস্থায় পেলেন। ঐ আনসারটি সা’দকে বললেন, আপনি জীবিত আছেন নাকি মারা গেছেন তা জানার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে পাঠিয়েছেন। স’দ বললেন, আমি এখন বলতে গেলে মৃতদের দলে । আপনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আমার সালাম বলবেন এবং বলবেন যে, সা’দ ইবন রাবী আপনার উদ্দেশ্যে বলেছেন “উম্মতের পক্ষ থেকে নবীকে যে প্রতিদান প্রদান করা হয় আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদের পক্ষ থেকে তার সর্বোত্তম প্রতিদান প্রদান করেন। আর আপনার সম্প্রদায়ের লোকজনকে আমার সালাম বলবেন, আর তাদেরকে বলবেন যে, সা’দ ইবন রাবী তোমাদের উদ্দেশ্যে বলেছে- তোমাদের চক্ষু দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ও সচল থাকা অবস্থায় কাফিরেরা যদি তোমাদের নবীর কাছে ঘেঁষতে পারে তাকে আক্রমণ করতে পারে, তবে আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন ওযর-আপত্তি চলবে না। আনসারী বলেন, একথা বলতে বলতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন । আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এসে তাকে এই সংবাদ জানাই।
আমি বলি, নিহত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে যিনি সা’দ (রা)-কে খুঁজে বের করেছিলেন তিনি হলেন মুহাম্মাদ ইবন সালামা। মুহাম্মাদ ইবন সালামা । মুহাম্মাদ ইবন উমর আল-ওয়াকিদী তাই বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, আনসারী লোকটি হযরত সা’দ (রা)-কে প্রথমে দু’বার ডেকেছিলেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি। শেষে তিনি যখন বললেন যে, আপনার খবর নেয়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে পাঠিয়েছেন তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলেন এবং উপরোক্ত কথাগুলো বললেন।
আল-ইসতী’আব গ্রন্থে শায়খ আবূ উমর বলেছেন যে, উবাই ইবন কা’ব (রা)-ই হযরত সা’দ (রা)-এর খোঁজ নিয়েছিলেন । আল্লাহই ভাল জানেন।
সা’দ ইবন রাবী ছিলেন, আকাবার শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ (সা) সা’দ (রা) ও আবদুর রহমান ইব্ন আওফের (রা) মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে হযরত হামযা (রা)-এর খোঁজে বের হয়েছিলেন। বাতন আল ওয়াদী’তে তিনি তাঁর লাশ খুঁজে পান। তাঁর পেট চিরে কলিজা বের করে নেয়া হয়েছিল। তাঁর অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছিল, নাক ও কান দুটো কেটে ফেলা হয়েছিল। মুহাম্মাদ ইবন জাফর ইবন যুবায়র আমাকে জানিয়েছেন যে, হযরত হামযা (রা)-এর এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, সাফিয়্যা দুঃখ পাবেন আর আমার পরবর্তীকালের জন্যে এটি যদি রেওয়াজে পরিণত হতে পারে এ আশঙ্কা না থাকলে আমি হামযা (রা)-এর লাশ এভাবেই ফেলে রাখতাম তিনি পশু পাখীর খোরাক হতেন। কোন স্থানে আল্লাহ যদি আমাকে কুরায়শদের বিরুদ্ধে বিজয় দেন তবে ওদের ৩০ জনের আমি অঙ্গচ্ছেদ করে দেব, নাক-কান কেটে দেব । হযরত হামযা (রা)-এর প্রতি এই অমানবিক আচরণের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুঃখ ও ক্রোধ লক্ষ্য করে উপস্থিত মুসলমানগণ বললেন, আল্লাহর কসম, কোনদিন যদি আল্লাহ্ তা’আলা ওদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে বিজয়ী করেন তবে আমরা ওদের এমন অঙ্গহানি-অঙ্গকর্তন করব যা কোন আরব কখনো করেনি। ইবন ইসহাক বলেন, বুরায়দা ইবন সুফিয়ান ইবন ফারওয়া আসলামী– ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এই প্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন ও
যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঠিক ততখানি করবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্যে তা-ই উত্তম (১৬- নাহল ও ১২৬)।
আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওদেরকে ক্ষমা করে দেন, ধৈর্য অবলম্বন করেন এবং শত্রুপক্ষের অঙ্গকর্তন নিষেধ করে দেন।
আমি বলি, এ আয়াত মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে আর উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে মদীনায় হিজরতের তিন বছর পর। তাহলে উপরোক্ত মন্তব্য যুক্তিসঙ্গত হয় কীভাবে? আল্লাহই ভাল জানেন।
ইবন ইসহাক বলেন, হুমায়দ আততাবীল বর্ণনা করেছেন হাসান সূত্রে সামূরা থেকে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে স্থানেই অবস্থান করে তা ত্যাগ করেছেন। সেখানেই সাদকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অঙ্গকর্তন থেকে লোকজনকে বারণ করেছেন। ইবন হিশাম বলেন, হামযা (রা)-এর লাশের নিকট দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, আপনার মত আঘাত কোনদিন কেউ করেনি এবং এর চাইতে অধিক দুঃখজনক কোন স্থানে আমি কোনদিন দাঁড়াইনি। তারপর তিনি বললেন, জিবরাঈল (আ) এসে আমাকে বলে গেলেন, সাত আসমানে হামযা (রা)-এর পরিচয় এভাবে লেখা হয়েছে যে, আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হামযা, আল্লাহর সিংহ এবং তাঁর রাসূলের সিংহ। ইবন হিশাম বলেন, হামযা (রা) এবং আবু সালামা ইবন আবদুল আসাদ দুজন ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধভাই। আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবা তাদের তিনজনকে দুধ পান করিয়েছিলেন।
হযরত হামযা ও উহুদ যুদ্ধের শহীদগণের জানাযার নামায
ইবন ইসহাক বলেন, আস্থাভাজন জনৈক ব্যক্তি মিকসাম সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে হযরত হামযা (রা)-কে একটি চাদর দ্বারা কাফন পরানো হল, তিনি তার জানাযা পড়ালেন। তাতে তিনি সাতবার তাকবীর বললেন। তারপর এক একজন শহীদ এনে তাঁর পাশে রাখা হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই শহীদের নামায আদায় করছিলেন সাথে হযরত হামযা (রা)-এর নামাযও হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত হযরত হামযা (রা)-এর জানাযার নামাযের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭২-এ, এটি একটি একক বর্ণনা এটির সনদ দুর্বল। সুহায়লী বলেন, দেশ বিদেশের কোন উল্লেখযোগ্য আলিম এই বক্তব্য সমর্থন করেননি। ইমাম আহমদ বলেন, আফফান– ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করলেন। তিনি বলেছেন, মুসলিম মহিলাগণ উহুদ দিবসে মুসলিম পুরুষদের পেছনে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা মুশরিকদের আক্রমণে আহত মুজাহিদদের সেবা শুশ্রূষা করছিলেন। আমি যদি তখন আল্লাহর কসম করে বলতাম যে, আমাদের কেউই পার্থিব লাভের প্রত্যাশী নয় তবে আমার মনে হয় আমার শপথ মিথ্যা হতো না। যতক্ষণ না আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
তোমাদের কেউ ইহকাল কামনা করছিল আর কতক পরকাল কামনা করছিল। এরপর তিনি পরীক্ষা করার জন্যে তোমাদেরকে তাদের থেকে ফিরিয়ে দিলো। (৩-আলে-ইমরান : ১৫২)। যখন কতিপয় সাহাবী নির্দেশ অমান্য করে স্থানত্যাগ করেন তখন মাত্র নয়জন লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ময়দানে অবস্থান করছিলেন। নয়জনের মধ্যে ৭ জন আনসারী এবং ২ জন কুরায়শী, তিনিসহ ছিলেন ১০ জন। শত্রুপক্ষ যখন তার খুব নিকটবর্তী হয়ে গেল তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ওদেরকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে আল্লাহ্ তা’আলা তার প্রতি সদয় হবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এভাবে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন আর সাথিগণ একের পর এক প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হচ্ছিলেন। এভাবে নয়জনের মধ্যে সাতজনই শহীদ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সাথীদ্বয়কে বললেন, আমাদের সাথিগণের প্রতি ইনসাফ করা হয়নি। এ অবস্থায় আবু সুফিয়ান এসে বলল হুল দেবতার জয় হোক। রাসূলুল্লাহ্ সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন উত্তর দিতে এবং বলতে যে, আল্লাহ্ই সর্বোচ্চ-সুমহান। মুসলমানগণ বললেন, আল্লাহ্ সর্বোচ্চ সুমহান । আবু সুফিয়ান বলন, আমাদের উযযা আছে, তোমাদের উয্যা নেই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা উত্তর দাও যে, আল্লাহ আমাদের প্রভু, তোমাদের কোন প্রভু নেই; আবু সুফিয়ান বলল, আজকের দিন বদরের দিনের প্রতিশোধ । একদিন তোমাদের একদিন আমাদের, একদিন আমরা দুঃখ পাই আর একদিন খুশী হই । তোমাদের হানযালা আমাদের হানযালার বদলা স্বরূপ। অমুক অমুকের বদলা । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, উভয় দল সমান নয়। আমাদের নিহত লোকজন মূলতঃ জীবিত তারা জীবিকা পাচ্ছে। আর তোমাদের নিহতরা জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করছে। আবু সুফিয়ান বলল, লোকজনের মধ্যে কতক অঙ্গ কর্তিত আছে। তবে সেটা আমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাজ নয়। আমি অঙ্গ কর্তনের নির্দেশও দিইনি তা থেকে বারণও করিনি। আমি তা পছন্দও করিনি অপছন্দও করিনি। তাতে আমি দুঃখিতও নই খুশীও নই।
বর্ণনাকারী বলেন, লোকজন নিজেদের নিহতদের খোঁজে বের হল। হযরত হামযা (রা)-কে পাওয়া গেল যে, তাঁর পেট চিরে ফেলা হয়েছে। হিন্দ তার কলিজা বের করে চিবিয়েছে । কিন্তু তা গিলতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সেকি তার কলিজার কিছুটা খেতে পেরেছে? লোকজন বলল, না খেতে পারেনি। তিনি বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত হামযা (রা)-এর সামান্য অংশও জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) হামযা (রা)-কে সামনে রেখে জানাযা আদায় করলেন। এরপর একজন আনসারী শহীদকে উপস্থিত করা হল, তার রাখা হল হামযা (রা)-এর পাশে। রাসূলুল্লাহ (সা) তার জানাযার নামায আদায় করলেন। ওই আনসারীকে সরিয়ে নিয়ে অন্য এক আনসারী আনা হল। হামযা (রা)-এর লাশ ওখানেই থাকলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই আনসারী এবং হামযার (রা) জানাযা আদায় করলেন। ওই অনিসারীকে সরিয়ে নেয়া হল। হামযা (রা)-কে ওখানে রাখা হল। সেদিন এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ৭০ বার হযরত হামযা (রা)-এর জানাযার নামায পড়েছেন, এটি ইমাম আহমদের একক বর্ণনা। এই জনৈক বর্ণনাকারী আতা ইবন সাইব সনদে থাকায় বর্ণনার সনদটি দুর্বল সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ্ ভাল জানেন। ইমাম বুখারীর বর্ণনাটি অধিকতর প্রামাণ্য। তিনি বর্ণনা করেছেন, কুতায়বা— জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ সূত্রে তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদের শহীদগণের মধ্যে দুজন দুজন করে, এক কাপড়ের মধ্যে একত্রিত করছিলেন আর বলছিলেন, দুজনের মধ্যে কুরআন চর্চায় কে অগ্রগামী ছিলেন? কোন একজন স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হলে তিনি তাঁকেই কবরে সম্মুখে রাখছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, আমি কিয়ামতের দিনে এদের পক্ষে সাক্ষ্য দেব। রক্তসহ তিনি ওদেরকে দাফন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের জানাযাও পড়া হয়নি। তাদেরকে গোসলও দেয়া হয়নি। এটি ইমাম বুখারীর একক বর্ণনা! সুনান সংকলনকারিগণ লায়ছ ইবন সা’দের বরাতে এটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবন জাফর– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে যে, তিনি উহুদের শহীদগণ স্পষ্ট বলেছেন, কিয়ামতের দিন তাদের প্রত্যেক ক্ষতস্থান থেকে অথবা তাদের রক্ত থেকে মিশক এর ঘ্রাণ বের হতে থাকবে। তিনি শহীদদের জানাযার নামায পড়েননি। বর্ণিত আছে যে, পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতের কিছু দিন পূর্বে তিনি ওই শহীদদের জন্যে নামায আদায় করেছিলেন। এ প্রসংগে ইমাম বুখারী (রা) বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবন আবদুর রহীম– উকবা ইবন আমির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আট বছর পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদের শহীদদের জন্য নামায আদায় করেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন জীবিত ও মৃত লোকদের থেকে বিদায় গ্রহণকারীর ন্যায়। তারপর তিনি মিম্বরে আরোহণ করলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের আগে যাত্রা করব। আমি তোমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেব। তোমাদের সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুত স্থান হল হাওয-ই-কাওছার। আমি এখান থেকে তা দেখতে পাচ্ছি। তোমরা সকলে একযোগে শিরকে লিপ্ত হবে সে আশংকা আমি করি না। তবে আমার আশংকা এই যে, তোমরা দুনিয়াদারীতে আকৃষ্ট হয়ে যাবে। বর্ণনাকারী বলেন, এই দেখা ছিল আমার রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে শেষ দেখা।
ইমাম বুখারী অন্য একস্থানে, ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসাঈ (রা) এরূপ হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন ইয়াযীদ ইবন আবূ হাবীব থেকে। উমাভী বলেন, আমার পিতা– হযরত আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদেব যুদ্ধে যাবার পর সংবাদ সগ্রহের উদ্দেশ্যে আমরা সাহরীর সময় পথে বের হয়ে পড়ি। ইতোমধ্যে ফজরের সময় হয়ে যায়। আমরা জনৈক পাথর বহনকারী লোককে দেখলাম সে দৌড়াচ্ছে আর বলছে:
হে হামল ইবন সা’দানা! তুমি একটু অপেক্ষা কর, তারপর প্রচণ্ড যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হও। পরে আমরা ভালভাবে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি হলেন উসায়দ ইবন হুযায়। এরপর আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। হঠাৎ দেখলাম একটি উট এল! উটের পিঠে একজন মহিলা। দুপাশে দুটো বোঝা। হযরত আইশা (রা) বলেন, আমরা মহিলাটির নিকট গেলাম। তখন দেখতে পাই যে, তিনি আম্র ইবন জামূহ এর স্ত্রী। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সংবাদ কী? তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে রক্ষা করেছেন। কতক মুমিন ব্যক্তিকে শহীদরূপে কবুল করেছেন। এবং কাফিরদেরকে মনের জ্বালাসহ বিফল মনোরোথে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন । যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী। মহিলাটি তার উটকে বসার নির্দেশ দিয়ে নিজে উট থেকে নেমে পড়লেন। আমরা তাঁর বোঝা দুটোর দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, এগুলো কী? তিনি বললেন, একটি আমার স্বামীর লাশ আর একটি আমার ভাইয়ের লাশ।
ইবন ইসহাক বলেন, সাফিয়্যা বিনত আবদুল মুত্তালিব হযরত হামযার (রা) লাশ দেখতে আসেন। হযরত হামযা (রা) ছিলেন তার সহোদর ভাই। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর পুত্র যুবায়র ইবন আওয়ামকে বললেন, তুমি তোমার মায়ের নিকট যাও। তাকে থামাও, যেন তার ভাইয়ের হৃদয়বিদারক এই লাশের দৃশ্য তাঁকে দেখতে না হয়। যুবায়র তার মাকে বললেন, আম্মা! রাসূলুল্লাহ্ (সা) আপনাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বললেন, কেন? আমি তো জেনেছি যে, আমার ভাইয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে, তাতে কী? তাতো হয়েছে আল্লাহর পথে! আমার জন্য অধিকতর খুশীর ব্যাপার আর কী হতে পারে । আমি অবশ্যই ধৈর্যধারণ করব এবং ছওয়াবের আশায় থাকব ইনশা-আল্লাহ। যুবায়র (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে এই সংবাদ জানালেন। তখন তিনি তাকে বললেন :তাকে আসতে দাও! সাফিয়্যা (রা) এলেন। হামযা (রা)-কে দেখলেন। তার জন্যে দুআ করলেন, শোক প্রকাশ করলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত হামযা (রা)-কে দাফনের নির্দেশ দিলেন। তাঁকে এবং তার সাথে তার ভাগ্নে আবদুল্লাহ্ ইবন জাহশ ও তার মা উসায়মা বিন আবদুল মুত্তালিবকে দাফন করা হল। আবদুল্লাহ্ ইবন জাহশের অঙ্গহানি করা হয়েছিল; কিন্তু বুক চিরে কলিজা বের করা হয়নি। আবদুল্লাহ ইবন জাহ্শকে বলা হত আল্লাহর পথে নাক কান কৰ্তিত ব্যক্তি।
সা’দ (রা) বলেছেন, তিনি এবং আবদুল্লাহ ইব্ন জাহ্শ দুজনে দু’আ করেছিলেন, তাঁদের দুজনের দু’আ-ই কবুল হয়েছিল। সা’দ (রা) দু’আ করেছিলেন যে, তিনি যেন কোন মুশরিক অশ্বারোহী সৈনিকের মুখোমুখি হন এবং তাকে হত্যা করে তার অস্ত্রশস্ত্র কবজা করতে পারেন। বস্তুত তিনি তাই করতে পেরেছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবন জাহ্শ (রা) দুআ করেছিলেন যে, কোন অশ্বারোহী মুশরিক সৈন্য যেন তার সম্মুখে এসে পড়ে এবং আল্লাহর পথে ওই সৈন্য যেন তাকে হত্যা করে তার নাক কেটে নেয়। তার ক্ষেত্রে এরূপই ঘটেছিল।
যুবায়র ইবন বাক্কার উল্লেখ করেছেন যে, উহুদ যুদ্ধে আবদুল্লাহ্ ইবন জাহশের তরবারি ভেঙ্গে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে একটি খেজুরের ডাল দিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ (রা)-এর হাতে সেটি তরবারিতে পরিণত হয়েছিল। সেটি দ্বারা তিনি লড়াই করেছেন। পরে তার কোন এক ওয়ারিশের ভাগে পড়া ওই তরবারি দু শ দিরহাম মূল্যে বিক্রি হয়। বদর দিবসে আক্কাশা (রা)-এর ক্ষেত্রেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল।
সহীহ্ বুখারীতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) দু’জন দু’জন-তিনজন তিনজন শহীদকে একই কবরে দাফন করেছেন! বরং একই কাফনে একত্রিত করেছেন দু’-তিনজন শহীদকে। জীবিত মুসলিম সৈনিকগণ প্রচণ্ড আহত হওয়ার কারণে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা কবর খনন করা কষ্টকর ছিল বিধায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ অনুমতি দিয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে যাঁর কুরআন জানা ছিল বেশী তাকে সম্মুখে রেখে অন্যজনকে পেছনে রেখেছেন। সাধারণতঃ পরস্পর সহচর ও সাথী ছিলেন এমন দুজন দুজন করে এক কবরে দাফন করেছিলেন। যেমন হযরত জাবিরের পিতা আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইবন হারাম এবং আমর ইবন জামূহ এই দু’জনকে এক কবরে রাখেন। কারণ, তারা দুজনে পরস্পর বন্ধু ছিলেন। শহীদদেরকে গোসল দেয়া হয়নি। বরং তাদের জখমও রক্তসহ তাদেরকে দাফন করা হয়। এ প্রসংগে ইবন ইসহাক যুহরী সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন ছালাবা ইব্ন শু’আয়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) শহীদদেরকে দাফন করে ফিরে এসে বললেন, আমি ওদের পক্ষে সাক্ষী রইলাম। যারাই আল্লাহর পথে আহত হয় আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত দিবসে তাদেরকে উপস্থিত করবেন এ অবস্থায় যে, তাদের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে । ওই রক্তের রং হবে রক্তের ন্যায়; কিন্তু ঘ্রাণ হবে মিশকের ন্যায় । মূসা ইবন ইয়াসার শুনেছেন হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে তিনি বলছিলেন যে, আবুল কাসিম (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে এমন অবস্থার পুনরুজ্জীতি করবেন যে, তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে । রক্তের রং হবে রক্তের ন্যায় কিন্তু তার ঘ্রাণ হবে মিশকের ন্যায়। এই হাদীছ অন্য সনদেও সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে।
ইমাম আহমদ (র) বলেন, আলী ইবন আসিম— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) উহুদ দিবসে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন শহীদদের দেহ থেকে লোহা ও চামড়া জাতীয় সব বস্তু খুলে নেয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, ওদেরকে রক্ত ও পরনের জামা কাপড় সহ দাফন করে দাও! আবু দাউদ ও ইবন মাজা (র) এটি আলী ইবন আসিম থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আবু দাউদ তার সুনান-ই-আবু দাউদ গ্রন্থে বলেছেন, কানবী– হিশাম ইবন আমির থেকে সূত্রে বলেন, উহুদ দিবসে আনসারগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, আমরা তো এখন আহত এবং ক্লান্ত, এখন আমাদেরকে কী নির্দেশ দেবেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, সবাই মিলে কবর খনন কর! কবর খনন করবে বড়বড় ও প্রশস্ত করে। তারপর দু-তিনজন করে এক কবরে দাফন করে দাও! তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কাকে সামনে রাখব? তিনি বললেন, যার কুরআন বেশী জানা আছে। ইমাম আবু দাঊদ এই হাদীছ ছাদরী– হিশাম ইবন আমির সূত্রেও উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন, তোমরা কবর খনন করবে গভীর করে। ইবন ইসহাক বলেন, কতক মুসলমান তাদের আত্মীয় শহীদদের লাশ মদীনায় নিয়ে গিয়ে ওখানে দাফন করেছিলেন। পরে রাসূলুল্লাহ (সা) তা থেকে বারণ করেছেন এবং বলেছেন, ওরা যেখানে শহীদ হয়েছে সেখানেই তাদেরকে দাফন কর। ইমাম আহমদ (র) বলেন, আলী ইবন ইসহাক–… জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) সূত্রে বলেছেন, আমার আব্বা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন । আমার বোনেরা আমাকে পাঠিয়েছিল একটি উট সহকারে এবং বলেছিল এই উট নিয়ে পিতার লাশের নিকট যাও এবং তাঁকে উঠিয়ে এনে মদীনায় বান্ সালিমা গোত্রের কবরস্থানে দাফন কর। হযরত জাবির বলেন, আমার কয়েকজন সাথী নিয়ে আমি আমার পিতার লাশের নিকট আসি। এই সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা) অবগত হলেন। তিনি তখন উহুদ প্রান্তরে বসা ছিলেন। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম! তোমার পিতাকে তার ভাইদের সাথেই দাফন করা হবে। এরপর তাঁকে তাঁর শহীদ সাথীদের সাথেই উহুদ প্রান্তরে দাফন করা হল। ইমাম আহমদ একা এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (র) বলেন, মুহাম্মাদ ইবন জাফর– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, উহুদ যুদ্ধের কতক শহীদ ব্যক্তিকে ওখান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে এক ঘোষক ঘোষণা দিল যে, শহীদদেরকে তাদের শাহাদাত বরণের স্থানে ফিরিয়ে আন। ইমাম আবু দাঊদ এবং নাসাঈ (রা) এই হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন ছাওরী সূত্রে। ইমাম তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবন মাজায় জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে মদীনা থেকে বের হলেন। আমার পিতা আবদুল্লাহ আমাকে বললেন, হে জাবির! তুমি মদীনায় অবস্থানকারীদের পর্যবেক্ষক রূপে মদীনায় থেকে গেলে তোমার অপরাধ হবেনা। সেখান থেকে তুমি জানতে পারবে আমাদের যুদ্ধের ফলাফল কী হবে । আমি যদি আমার মেয়েগুলোকে রেখে না যেতাম । তাহলে আমি এটাই চাইতাম যে, তুমি যুদ্ধ করে আমার সম্মুখে শহীদ হয়ে যাও। জাবির (রা) বলেন, আমি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ আমার ফুফু আমার বাবা ও মামার লাশ নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে তিনি উটের পিঠে করে মদীনায় নিয়ে এলেন আমাদের কবরস্থানে দাফন করার উদ্দেশ্যে। এমন সময় জনৈক ঘোষক আমাদের নিকট এলেন এই ঘোষণা নিয়ে যে, নবী করীম (সা) শহীদদেরকে উহুদ প্রান্তরে ফিরিয়ে নিতে এবং যেখানে তাঁরা শহীদ হয়েছেন সেখানে দাফন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমরা তাদেরকে ফিরিয়ে নিলাম এবং যেখানে শহীদ হয়েছেন সেখানেই তাদেরকে দাফন করলাম। মু’আবিয়া ইবন আবৃ সুফিয়ানের শাসনামলে একজন লোক আমার নিকট এসে বলল, হে জাবির ইবন আবদুল্লাহ্! মুআবিয়া (রা)-এর কর্মচারীরা আপনার পিতার কবরের কাছে মাটি খননের ফলে তাঁর দেহের কিছু অংশ বেরিয়ে পড়েছে। সংবাদ পেয়ে আমি সেখানে গেলাম। আমি আমার পিতাকে অবিকল তেমনটিই পেলাম যেমনটি তাকে দাফন করেছিলাম। তার দেহে কোন রূপ পরিবর্তন আসেনি। শুধুমাত্র আঘাতজনিত চিহ্ন ছাড়া। এরপর জাবির (রা) তাঁর পিতার ঋণ পরিশোধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ওই ঘটনা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে।
বায়হাকী . . . . জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, উহুদের শহীদদের দাফন করার দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ওই কবরস্থানের পাশ দিয়ে খাল খনন শুরু করা হয়। তখন আমাদেরকে ওখানে ডাকা হয়। আমরা সেখানে আমি । আমরা লাশগুলো বের করে আনি। ঘটনাক্রমে হযরত হামযা (রা)-এর পায়ে কোদালের আঘাত লাগে তাতে তার পা থেকে রক্ত বের হতে থাকে। ইবন ইসহাক হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, আমরা তাদেরকে কবর থেকে বের করে আনি এ অবস্থায় যে, যেন মাত্র গতকালই তাদেরকে দাফন করা হয়েছিল। ওয়াকিদী বলেন, হযরত মুআবিয়া (রা) যখন খাল খননের সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন তিনি একজন ঘোষক পাঠিয়ে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, উহুদ প্রান্তরে যাদের শহীদ আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তারা যেন সেখানে হাযির থাকেন। জাবির (রা) বলেন, আমরা তাদের কবর খুলে ফেলি। আমি আমার পিতাকে পেলাম যেন তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন। তাঁরই করে পেলাম তার সাথী আমর ইব্ন জামুহকে। তার হাত ছিল তার ক্ষতস্থানের উপর। ক্ষত স্থান থেকে তার হাত সরিয়ে দেয়া হলে সেখান থেকে রক্ত বের হতে শুরু করে। কথিত আছে যে, তাঁদের কবর থেকে মিশকের ঘ্রাণ বের হচ্ছিল। (আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন)। এ ঘটনা ঘটেছিল তাদেরকে দাফন করার ছেচল্লিশ বছর পার ।
ইমাম বুখারী (র) বলেন মুসাদ্দাদ– জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, উহুদের যুদ্ধ যখন অত্যাসন্ন তখন রাতের বেলা আমার পিতা আমাকে ডেকেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমার মনে হচ্ছে যে সকল সাহাবী প্রথম ধাপে শহীদ হবেন আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত থাকব। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যতীত তোমার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাউকে রেখে যাচ্ছি না, আমার কিছু ঋণ আছে, তুমি সেগুলো শোধ করে দিও এবং তোমার বোনদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। পরদিন ভোরে তিনিই হলেন প্রথম শহীদ। তার কবরে তার সাথে অন্য একজনকে দাফন করি। তিনি অন্যের সাথে একই কবরে থাকবেন তাতে আমি স্বস্থি বোধ করছিলাম না। তাই ছয় মাস পর আমি তাকে ওই কবর থেকে বের করে ফেলি । তখনও আমি তাকে দেখতে পাই যে, আজই যেন তাকে দাফন করেছি। অবশ্য তার কানে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে শুবা– জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন তার পিতা শহীদ হন তখন তিনি বার বার পিতার মুখের কাপড় সরিয়ে কাঁদছিলেন। অন্যেরা তাকে বারণ করছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি তার জন্যে কাঁদ আর নাইবা কাদ ফেরেশতাগণ কিন্তু তাকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন। তাকে তোমরা ওখান থেকে না উঠানো পর্যন্ত ফেরেশতাগণ ছায়া দিয়ে যাবে। অন্য বর্ণনায় আছে যে, হযরত জাবির (রা)-এর ফুফু কান্নাকাটি করছিলেন।
বায়হাকী (র) বলেন, আবু আবদুল্লাহ আল হাফিয ও আবু বকর আহমদ— আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত জাবির (রা)-কে বলেছিলেন, হে জাবির! আমি কি তোমাকে একটি সুসংবাদ দেবো না? জাবির (রা) বললেন, জী হাঁ, দিন, আল্লাহ্ ও আপনার সুসংবাদ প্রদান করুন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি কি জান, আল্লাহ্ তা’আলা তোমার পিতাকে জীবিত করে বলেছিলেন, হে আমার বান্দা, তুমি আমার নিকট যা ইচ্ছ। চাও আমি তোমাকে তা দেব। তখন তোমার পিতা বলেছিলেন, হে মালিক! আমি আপনার পূর্ণ বন্দেগী করেছি, এখন আমার কামনা হল আপনি আমাকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠিয়ে দিন যাতে করে আমি আপনার নবীর সাথী হয়ে জিহাদ করতে পারি এবং পুনরায় আপনার পথে শহীদ হতে পারি । আল্লাহ তা’আলা বললেন, আগে থেকেই আমার সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, এ অবস্থা থেকে কেউই পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে যেতে পারবে না।
বায়হাকী বলেন, আবুল হাসান মুহাম্মাদ ইবন আবুল মা’রূফ— জাবির (রা) সূত্রে বলেছেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একদিন আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ব্যাপার কি তোমাকে যে এত পেরেশান দেখা যাচ্ছে? আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমার আব্বা শহীদ হলেন আর রেখে গেলেন অনেক ঋণ ও বহু সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবার। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা পর্দার অন্তরাল ব্যতীত কারো সাথে কথা বলেননি। কিন্তু তোমার পিতার সাথে কথা বলেছেন সরাসরি । আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলেছেন, হে আমার বান্দা! তুমি আমার নিকট যা চাইবার চেয়ে নাও! আমি তোমাকে তাই দেব। তোমার পিতা উত্তরে বললেন, হে প্রভু! আমি চাই, আপনি আমাকে পুনরায় দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেন যাতে আমি আবার আপনার পথে শহীদ হতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, আমার পক্ষ থেকে তো আগেই বলে দেয়া হয়েছে যে, কাউকেই পুনরায় দুনিয়াতে পাঠানো হবে না। এরপর তোমার পিতা বললেন, হে প্রভু! তাহলে আমাদের এই অবস্থার কথা আপনি দুনিয়াবাসীদেরকে জানিয়ে দিন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে কখনো মৃত মনে করোনা; বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তারা জীবিকা পেয়ে থাকে। (৩- আলে-ইমরানঃ ১৬৯)।
ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন। তাতে এতটুকু অতিরিক্ত আছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেছিলেন, আমি তো চুড়ান্ত করেছি যে, ওদেরকে পুনরায় দুনিয়াতে ফেরত পাঠানো হবে না ।
ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইয়াকূব–… জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে শুনেছি তার সাহাবীদের কথা আলোচনা কালে তিনি বলতেন, আল্লাহর কসম, আমার সাহাবীদের সাথে পাহাড়ের পাদদেশে থেকে যাওয়াটা আমার নিকট বেশী পসন্দনীয় ছিল। এ হাদীছ ইমাম আহমদ একাই উদ্ধৃত করেছেন।
বায়হাকী আবদুল আ’লা– আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন যে, উহুদ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত মুসআব ইবন উমায়র (রা)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই পথেই শহীদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন হযরত মুসআব ইবন উমায়র (রা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেখানে থামলেন এবং তাঁর জন্যে দু’আ করলেন। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন,
মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, ওদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। ওরা ওদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি, (৩৩-আহযাব : ২৩)। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সাক্ষী হবে। তোমরা তাদের নিকট যাবে এবং তাদের যিয়ারত করেন । যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ তাদেরকে সালাম দেবে তারা তার সালামের উত্তর দেবে। সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গরীব বা একক বর্ণনা । উবায়দ ইবন উমায়র থেকে এটি মুরসাল ভাবে বর্ণিত হয়েছে ।
বায়হাকী (র) মূসা ইবন ইয়াকূব– আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) শহীদদের কবরের নিকট আসতেন। পার্বত্য পথের পাদদেশে পৌঁছে তিনি বলতেন–
–তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ, পরকালীন বাসস্থান কতইনা উত্তম!) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরে আবু বকর (রা) তাই করতেন। তার শাসনামলের পর হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে তিনিও তাই করতেন। হযরত উছমান (রা) তার শাসনামলে তাই করতেন ।
ওয়াকিদী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রতি বছরই শহীদদের কবর যিয়ারত করতে ৫তেন। গিরিপথের মুখে এসে তিনি বলতেন, —
পরে আবু বকর (রা) প্রতি বছর তাই করতেন। পরে হযরত উমর এবং উছমান (রা) ও প্রতি বছর এরূপ করতেন। হযরত ফাতিমা যাহরা (রা) উহুদের শহীদদের নিকট আসতেন তিনি। সেখানে কান্নাকাটি করতেন এবং তাদের জন্যে দু’আ করতেন। হযরত সাদ (রা) তার বন্ধুদের নিকট আসতেন এবং তাদেরকে বলতেন, তোমরা ওই লোকদেরকে সালাম দাওনা কেন যারা তোমাদের সালামের উত্তর দেয়? বর্ণিত আছে যে, আবু সাঈদ (রা), আবু হুরায়রা (রা), আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) এবং উম্মু সালামা (রা) শহীদদের কবর যিয়ারত করতেন।
ইবন আবু দুনিয়া বলেছেন; ইবরাহীম– আত্তাফ ইবন খালিদ বলেছেন যে, আমার খালা আমাকে বলেছেন যে, একদিন আমি সওয়ারীতে চড়ে শহীদদের কবরের নিকট উপস্থিত হই। অবশ্য তিনি নিয়মিত যিয়ারতে যেতেন। বস্তুত: ওই যাত্রায় তিনি হযরত হামযা (রা)-এর কবরের নিকট গেলেন। তিনি বলেন, আল্লাহ্ যা চাইলেন আমি সেই পরিমাণ দু’আ দরূদ পাঠ। করলাম। ওই ময়দানে আমার ঘোড়ার লাগাম ধারণকারী বালকটি ছাড়া কোন লোক ছিলনা। দু’আ শেষে আমি হাত তুলে বললাম <ls L.) বর্ণনাকারী বললেন, আমি সালামের উত্তর শুনলাম। মাটির নীচ থেকে ওই উত্তর আসছে। আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে সৃষ্টি করেছেন তা যেমন আমার নিকট সুস্পষ্ট, ওই সালামটিও আমার নিকট তেমনি সুপরিচিত। ওই সালাম আমার নিকট রাত-দিনের ন্যায় সুস্পষ্ট। ওই সালাম শুনে আমার শরীরের লোমগুলো শিহরিত হয়ে উঠে।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক— ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, উহুদ দিবসে তোমাদের ভাইগণ যখন শহীদ হয় তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের রূহগুলোকে সবুজ পাখীর পেটে স্থান করে দেন। ওই রূহগুলো ইচ্ছামত বেহেশতের ঝর্ণাগুলোতে অবতরণ করে, বেহেশতের ফল আহার করে এবং আরশের ছায়ায় স্থাপিত স্বর্ণের ঝুলন্ত ফানুসে ফিরে আসে। পবিত্র ও উন্নত খাদ্য-পানীয় ও বিশ্রামস্থল দেখে তারা বলেছিল, আমাদের এই শান-শওকত ও নি’আমত প্রাপ্তির কথা আমাদের ভাইদেরকে জানিয়ে দিবে কে? কে ওদেরকে বলে দেবে যে, আমরা জীবিত আছি এবং জান্নাতে রিযক প্রাপ্ত হচ্ছি? যাতে তারা যুদ্ধ থেকে না পালায় এবং জিহাদে অলসতা না করে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, আমিই তোমাদের পক্ষ থেকে এই বার্তা ওদের নিকট পৌঁছিয়ে দেব। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :
— যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনই মৃত মনে করোনা। বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত। (৩-আলে-ইমরান : ১৬৯)।
ইমাম মুসলিম ও বায়হাকী (র) উভয়ে আব মু’আবিয়া— মারূক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে আমি-
আয়াত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, আমি এই বিষয়ে নিজে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন তিনি বলেছেন, ওদের রূহ থাকবে সবুজ পাখীর পেটে, জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা তারা সেখানে ভ্রমণ করতে পারবে তারপর আরশের সাথে ঝুলানো ফানুসে এসে আশ্রয় নেবে। এমনি এক অবস্থায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা ওদের দিকে মনোনিবেশ করবেন। তিনি বলবেন, তোমাদের যা কামনা বাসনা তা আমার নিকট চাও। ওরা বলবেন, হে প্রভু! আমাদের চাওয়ার তো কিছু নেই । আপনার দয়ায় আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা যেতে পারছি। আল্লাহ্ তা’আলা তিনবার তাদেরকে এরূপ বলবেন। তারা যখন দেখবে যে, আল্লাহ্ তা’আলা বার বার বলছেন, তখন তারা বলবে, হে প্রভু! আমরা চাই যে, আপনি আমাদের দেহে রূহ পুনস্থাপন করে আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমরা পুনরায় আপনার পথে শহীদ হতে পারি, আল্লাহ্ তা’আলা যখন দেখবেন
যে, তারা শুধু এটাই চাচ্ছে তখন তিনি তাদেরকে তাদের অবস্থায় রেখে দেবেন। উহুদ যুদ্ধে শহীদগণের সংখ্যা
মূসা ইব্ন উকবা বলেন, উহুদ যুদ্ধে মুহাজির ও আনসার মিলিয়ে মোট ৪৯ জন শহীদ হন। সহীহ্ বুখারীতে হযরত বারা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীছে আছে যে, সেদিন ৭০ জন সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
হযরত আনাস (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কাতাদা (র) বলেন যে, উহুদ যুদ্ধে আনসারগণের সত্তর জন, বি’র-ই-মাঊনার ঘটনায় আনসারগণের সত্তর জন এবং ইয়ামামার যুদ্ধে আনসারগণের সত্তর জন শহীদ হয়েছিলেন। হাম্মাদ ইবন সালামা আনাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলতেন উহুদ যুদ্ধে, বির-ই-মাঊনার ঘটনায়, মাওতার যুদ্ধে এবং ইয়ামামার যুদ্ধে প্রতিবেশী প্রায় সত্তরজন করে আনসার সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন।
মালিক— সাঈদ ইবন মুসায়্যিব থেকে বর্ণনা করেন যে, উহুদ যুদ্ধে এবং ইয়ামামার যুদ্ধে সত্তর জন করে আনসারী শহীদ হয়েছেন। আবু উবায়দ এর নেতৃত্বে পরিচালিত সেতুর যুদ্ধের দিনেও সত্তর জন আনসারী শহীদ হয়েছিলেন। ইকরিমা, উরওয়া, যুহরী এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক উহুদের শহীদগণের সংখ্যা সম্পর্কে এরূপই বলেছেন। আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণী তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করে?
কী ব্যাপার! যখন তোমাদের উপর মুসিবত এল তখন তোমরা বললে, এটি কোত্থেকে এল? অথচ তোমরা তো ওদের উপর দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। (৩- আলে-ইমরান ও ১৬৫)।
এখানে বদরের যুদ্ধে কাফিরদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে ।
ইবন ইসহাক থেকে বর্ণিত যে, উহুদ দিবসে আনসারগণের মধ্য থেকে ৬৫ জন শহীদ হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ এখানে আনসারগণের মধ্য থেকে ‘শব্দ না হয়ে’ মুসলমানদের মধ্য থেকে হবে। কারণ, পরবর্তীতে তিনি বলেছেন যে, ৬৫ জনের মধ্যে ৪ জন মুহাজির আর অবশিষ্টগুণ আনসার ছিলেন। মুহাজির চারজন হলেন- হামযা (রা), আবদুল্লাহ্ ইবন জাহাশ (রা), মুসআব ইবন উমায়র (রা) এবং শাম্মাস ইবন উছমান (রা)। গোত্রপরিচয়সহ তিনি আনসারী শহীদগণের নামও উল্লেখ করেছেন।
ইবন হিশাম শহীদগণের সংখ্যা আরো ৫ জন বাড়িয়ে বলেছেন। ফলে তাঁর বক্তব্যানুসারে শহীদ সংখ্যা মোট ৭০! ওই যুদ্ধে যে সকল মুশরিক নিহত হয়েছিল ইবন ইসহাক তাদের নামও উল্লেখ করেছেন। ওদের সংখ্যা ছিল বাইশ। উরওয়া বলেন, উহুদ যুদ্ধের শহীদের সংখ্যা ৪৪ কিংবা ৪৭! মূসা ইবন উকবা বলেন, মুসলমান শহীদের সংখ্যা ৪৯ জন আর কাফির নিহত হয়েছিল ১৬ জন। উরওয়া (র)-এর মতে নিহত কাফিরের সংখ্যা ১৯।
ইবন ইসহাক বলেছেন, সেদিন কাফিরদের বাইশ জন নিহত হয়েছিল : শাফিঈ (র)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনাকারী রবী’ (র) বলেন যে, সেদিন শুধু একজন মুশরিক মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিল। তার নাম আবূ আযযা জুমাহী। সে বদর যুদ্ধেও মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিল । তখন দয়া পরবশ হয়ে কোন মুক্তিপণ ছাড়াই রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে শর্ত ছিল যে, সে কোনদিন, আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। শর্তভঙ্গ করে সে উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। এদিন বন্দী হবার পর সে বলেছিল, হে মুহাম্মাদ! আমার কন্যা সন্তানদের খাতিরে আমার প্রতি দয়া করুন। আমি অঙ্গীকার করছি যে, আর কোনদিন আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমাকে আর ছাড়ব না। তোমাকে এই সুযোগ দেবনা যে, তুমি মক্কায় গিয়ে দু পাঁজরে হাত বুলাবে আর বলবে “আমি দু’ দুবার মুহাম্মদকে ঠকিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আদেশে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল । কেউ কেউ বলেন যে, ওই দিনই রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, ঈমানদার মানুষ এক গর্ত থেকে দুবার দংশিত হয় না।
ইবন ইসহাক বলেন, উহুদ যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার পথে ফিরতি যাত্রা করলেন। পথে তার সাথে সাক্ষাত হয় হামনা বিন্ত জাহাশের! লোকজন তাঁকে তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবন জাহুশের শহীদ হওয়ার সংবাদ জানায়। তিনি ইন্না লিল্লাহ্— পাঠ করেন। এবং আপন ভাইয়ের জন্যে মাগফিরাত কামনা করে দুআ করেন। এরপর তার মামা হামযা (রা)-এর শহীদ হওয়ার সংবাদ তাঁকে জানানো হয়। তিনি “ইন্না লিল্লাহ্– .– পাঠ করে তার জন্যেও মাগফিরাতের দুআ করলেন । এরপর তাকে তার স্বামী মুসআব ইবন উমায়রের (রা) শাহাদাত সংবাদ জানানো হল। এটি শুনে তিনি চীৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন । এবং আহাজারি করতে থাকেন। ভাই ও মামার মৃত্যু সংবাদে মোটামুটি স্থিরতা এবং স্বামীর মৃত্যু সংবাদে তার চীৎকার ও আহাজারি দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : স্ত্রীর নিকট আপন স্বামীর গুরুত্ব অবশ্যই অত্যধিক।
ইবন মাজা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহয়া–… হামনা বিন্ত জাহাশ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাঁকে বলা হয়েছিল তোমার ভাই শহীদ হয়েছেন, তিনি বলেছেন– অর্থাৎ আল্লাহ্ তাঁকে দয়া করুন, আমরা আল্লাহরই মালিকানাধীন এবং তাঁরই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন। এর পর লোকজন তাকে বলেছিল
“তোমার স্বামী শহীদ হয়েছেন।” তখন তিনি আহাজারি করে বলেছিলেন, হায় কপাল! এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, স্ত্রীর নিকট আপন স্বামীর এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে যা অন্য কিছুর জন্যেই নেই!
ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল ওয়াহিদ– সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বান্ দীনার গোত্রের এক মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মহিলার স্বামী, ভাই ও পিতা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে উহুদ ময়দানে শহীদ হয়েছিলেন। ওদের মৃত্যু সংবাদ তাকে শোনানোর পর তিনি বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কেমন আছেন? লোকজন বলল, হে অমুকের মা! আপনি যেমন কামনা করেছেন, আলহামদু লিল্লাহ্ তিনি ভাল আছেন। তিনি বললেন, তাঁকে একটু দেখান, আমি তাকে এক নজর দেখে নিই! রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ইশারা করে তাকে দেখানো হল । রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখে তিনি বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! 19 Ja, i w০০ US আপনাকে সুস্থ দেখার পর সকল বিপদ আমার নিকট তুচ্ছ । ইবন হিশাম বলেন, ‘ শব্দটি কম এবং বেশী উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়, এখানে শব্দটি কম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কবি ইমরাউল কায়স বলেছেন :
বানূ আসাদ গোত্র তাদের রাজাকে হত্যা করেছে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। ওই রাজা ব্যতীত সব কিছুই গৌণ ও তুচ্ছ। এখানে যা, শব্দটি তুচ্ছ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় পৌঁছে তাঁর তরবারিটি ফাতেমা (রা)-এর হাতে সমর্পণ করলেন। তিনি বললেন, মা রে! তরবারির রক্তগুলো ধুয়ে ফেল, এটি আজ আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। হযরত আলী (রা) তার তরবারিটি ফাতিমা (রা)-কে দিয়ে বললেন, রক্ত ধুয়ে ফেল, এটি আজ সত্যিই আমাকে সহযোগিতা করেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে আলী! আজ তুমি পূর্ণ যুদ্ধ করেছ বটে; তবে তোমার সাথী হয়ে সাহল ইবন হুনায়ফ এবং আৰু দুজানাও পুরো মাত্রায় যুদ্ধ করেছেন।
মূসা ইব্ন উকবা অন্যত্র বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত আলী (রা)-এর রক্ত মাখা তরবারি দেখে বলেছিলেন, “আজ তুমি যুদ্ধের মত যুদ্ধ করেছ বটে, তবে আসিম ইব্ন ছাবিত ইবন আবুল আফলাহ্, হারিছ ইবন সাম্মাহ্ ও সাহ্ল ইবন হুনায়ফও খুব ভাল যুদ্ধ করেছে।
বায়হাকী (রা) বলেন, সুফিয়ান ইবন উয়ায়না–… ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, উহুদ দিবসে হযরত আলী (রা) তাঁর তরবারি নিয়ে ফিরে এলেন, তরবারিটি বেঁকে গিয়েছিল । তিনি হযরত ফাতিমা (রা)-কে বললেন, প্রশংসা যোগ্য এই তরবারিটি নাও, এটি আমাকে পরিতুষ্ট করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আজ তুমি তোমার তরবারি দ্বারা খুবই ভাল আঘাত করেছ বটে, তবে সাহল ইবন হুনায়ফ, আবু দুজানা, আসিম ইবন ছাবিত এবং হারিছ ইবন সাম্মাহ্ প্রমুখও ভাল লড়েছেন ।
ইবন হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এই তরবারিটির নাম ছিল যুলফিকার। তিনি আরো বলেন, কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন, ইবন আবু নাজীহ সূত্রে যে, সেদিন জনৈক ঘোষক উহুদ ময়দানে ঘোষণা দিয়েছিল যে, যুলফিকার ব্যতীত উল্লেখযোগ্য কোন তরবারি নেই। ইবন ইসহাক বলেন, কেউ কেউ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত আলী (রা)-কে বলেছিলেন “আল্লাহ্ আমাদেরকে পূর্ণ বিজয় দানের পূর্বে মুশরিকগণ আমাদের আর এরূপ ক্ষতি করতে পারবে না।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বানূ আবদ আশহাল গোত্রের পাশ দিয়ে গেলেন। উক্ত গোত্রের নিহত লোকদের শোকে অন্দর মহলে কান্নাকাটির শব্দ পেলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো, তিনি বললেন, “তবে হামযা (রা)-এর জন্যে কান্নাকাটি করার কেউ নেই। তার জন্যে শোক প্রকাশ করার, কান্নাকাটি করার কেউ নেই। সা’দ ইবন মু’আয ও উসায়দ ইবন হুজায়র বানূ আবৃদে আশহাল গোত্রের নিকট গিয়ে ওদের মহিলাদেরকে হযরত হামযা (রা)-এর জন্যে শোক প্রকাশ করার নির্দেশ দিলেন। হাকীম ইবন হাকীম– বান্ আবদুল আশহাল গোত্রের জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, হযরত হামযা (রা)-এর শোকে ওই মহিলাদের আহাজারি ও কান্নাকাটি শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁরা ছিলেন মসজিদ-ই-নববীর সম্মুখে। তিনি বলেন, এবার তোমরা ফিরে যাও! মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি সদয় হোন! তোমরা তো নিজেরা এসে সহানুভূতি প্রকাশ করলে।
ইন ইসহাক বলেন, সেদিন থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) মৃত ব্যক্তির জন্যে বিলাপ ও চীৎকার করে কান্নাকাটি নিষিদ্ধ করেছেন, ইবন হিশামও এরূপ বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার এই অংশটুকু বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত, তবে এটি মুরসাল পদ্ধতিতেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমদ (র) এই হাদীছটি পূর্ণ সনদসহ উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, যায়দ ইবন হুবাব– ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদ প্রান্তর থেকে মদীনার দিকে এলেন। তখন নিজ নিজ স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনে শহীদগণের স্ত্রীগণ কান্নাকাটি ও শোক প্রকাশ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হায়! হামযার (রা) জন্যে কান্নার কেউ নেই। এক সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘুমিয়ে পড়লেন। পরে তাকে সজাগ করা হল। তখনও মহিলাগণ কাঁদছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) শুনে বললেন, এখন তো দেখছি ওরা হামযা (রা)-এর জন্যে কাঁদছে। এই বর্ণনাটি ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। এ প্রসংগে ইবন মাজা (র) হারূন ইবন সাঈদ– ইবন উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বানূ আবদুল আশহাল গোত্রের মহিলাদের নিকট গেলেন। তখন তারা উহুদ যুদ্ধে নিহত তাদের আত্মীয়দের শোকে কান্নাকাটি করছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হায়! হামযার (রা) জন্যে কান্নাকাটি করার কেউ নেই। এরপর আনসারী মহিলাগণ এসে হযরত হামযার জন্যে শোক প্রকাশ করে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। এবার তিনি বললেন, দুঃখ এই মহিলাদের জন্যে যাওয়ার পর এরা এখন ফিরে এল কেন? ওরা যেন চলে যায় এবং আজ থেকে কোন মৃত ব্যক্তির জন্যে কান্নাকাটি না করে।
মূসা ইবন উকবা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার গলিপথে প্রবেশের পর শুনতে পেলেন যে, ঘরে ঘরে মহল্লায় মহল্লায় কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? লোকজন বলল, এঁরা আনসারী মহিলা। তাঁদের ঘনিষ্ঠ লোকদের শহীদ হওয়ার কারণে তারা কান্নাকাটি করছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : কিন্তু হামযার জন্যে কোন ক্রন্দনকারী নেই। তিনি হামযা (রা)-এর জন্যে ইসতিগফারও করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এই বক্তব্য শুনেছিলেন হযরত সা’দ ইবন মুআয, সা’দ ইবন উবাদা, মুআয ইবন জাবাল এবং আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা । রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একথা শুনে তাঁরা নিজেদের মহল্লায় যান এবং মদীনার সকল ক্রন্দনকারী মহিলাকে একত্রিত করেন। তারা মহিলাদেরকে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা হামযা (রা)-এর জন্যে না কেঁদে তোমরা কোন শহীদের জন্যে কাঁদবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে, মদীনায় হামযার জন্যে কাঁদার কেউ নেই। ঐতিহাসিকদের ধারণা যে, ক্রন্দনকারী মহিলাদেরকে একত্রিত করেছিলেন আবদুল্লাহ্ ইব্ন রাওয়াহা । হযরত হামযা (রা)-এর জন্যে যখন মহিলাগণ কান্নাকাটি করছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ব্যপার কী? আনসারগণ তাদের মহিলাদেরকে একত্রিত করেছেন বলে তাঁকে জানানো হল । তিনি আনসারদের জন্যে ইসতিগফার করলেন এবং তাঁদের প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি বললেন, আমি মূলত কথাটি এ উদ্দেশ্যে বলিনি, আর আমি এরূপ কান্নাকাটি পসন্দ করি না। বস্তুত তিনি এরূপ কান্নাকাটি নিষিদ্ধ করে দিলেন। ইব্ন লাহইয়াহ্ আবুল আসওয়াদ সূত্রে উরওয়াহ্ ইবন যুবায়র থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
মূসা ইবন উকবা বলেন, মুসলমানদের কান্নাকাটি ও শোক প্রকাশের এ সময়ে মুনাফিকরা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা মুসলমানদের দুঃখ ও হতাশা বৃদ্ধি এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে জোর প্রচেষ্টা চালায়। এ সময়ে ইয়াহূদীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুতা প্রকাশ্য রূপ নেয়। মুনাফিকদের অপপ্রচার ও উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে মদীনা ফুটন্ত কড়াইয়ের ন্যায় টগবগ করতে থাকে। ইয়াহূদীরা বলছিল যে, মুহাম্মাদ যদি নবী হতেন তবে শত্রুপক্ষ তার উপর জয়ী হতে পারতনা এবং তিনি এভাবে যখমপ্রাপ্ত ও বিপদগ্রস্ত হতেন না। বরং তিনি ক্ষমতালোভী (নাঊযুবিল্লাহ্)। সকল ক্ষমতা করায়ত্ত করাই তাঁর উদ্দেশ্য। মুনাফিকরা ইয়াহূদীদের মত উস্কানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছিল। তারা মুসলমানদেরকে বলতে লাগল যে, তোমরা যদি আমাদের অনুসরণ করে ফিরে আসতে তবে এই বিপদের সম্মুখীন হতেনা। এ প্রেক্ষাপটে অনুগত মুসলমানদের আনুগত্যের প্রশংসা, মুনাফিকদের অপকর্মের বিবরণ এবং শহীদ মুসলমানদের প্রতি সান্তনা স্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন :
স্মরণ করুন! যখন আপনি আপনার পরিজনবর্গের নিকট থেকে প্রত্যুষে বের হয়ে যুদ্ধের জন্যে মু’মিনদেরকে ঘাঁটিতে স্থাপন করছিলেন । এবং আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ (৩- আলে-ইমরান : ১২১)। তাফসীর গ্রন্থে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আহত হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবাগণের আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবন
উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা এবং সেখান থেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের বিবরণ দেয়ার পর মূসা ইবন উকবা বলেন যে, মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে আবু সুফিয়ান ও তার সাথীদের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সে বলল, আমি তো ওদের নিকট যাত্রা বিরতি করেছিলাম। আমি ওদেরকে শুনেছি যে, তারা একে অন্যকে দোষারোপ করছে এবং বলছে যে, তোমরা কিছুই করতে পারলে না। শত্রু পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নাগালে পেয়েও তোমরা তাদেরকে ছেড়ে দিলে ওদেরকে নির্মূল করলে নাওদের নেতারা তো জীবিত রয়েছে। ওরা আবার তোমাদের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ ঘটাবে। এ সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণকে শক্রর খোঁজে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তখনও সাহাবীগণ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। তিনি আরো বললেন যে, যারা উহুদ ময়দানে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই ওই অভিযানে অংশ নিতে পারবে। মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই বলল, আমি আপনার সাথে যাব। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, না, তা হবে না। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশ পেয়ে যখম ও আঘাত নিয়েই শত্রু অভিমুখে যাত্রা করলেন, এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন : “যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার, (৩-আলে-ইমরান ১৭২)।
বর্ণনাকারী বলেন, হযরত জাবির (রা)-এর পিতা তার কন্যাদের দেখা শোনার জন্যে জাবির (রা)-কে মদীনায় থাকতে বলেছিলেন শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে যুদ্ধে না গিয়ে মদীনায় থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে শত্রুর পিছু ধাওয়া করে হামরা উল আসাদ নামকস্থান পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। ইবন লাহয়া আ আবু আসওয়াদ সূত্রে উরওয়া ইবন যুবায়র (র) থেকে এরকমই বর্ণনা করেছেন।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক তার মাগাযী গ্রন্থে বলেছেন যে, উহুদ যুদ্ধের দিনটি ছিল শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ শনিবার। পরের দিন, শাওয়ালের ১৬ তারিখ রবিবার রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে এক ঘোষক শত্রুপক্ষের পিছু ধাওয়া করার ঘোষণা দিল। এবং ষিক এই ঘোষণাও দিল যে, যারা গতকালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আজ শুধু তারাই এ অভিযানে অংশ নিতে পারবেন। হযরত জাবির (রা) তার ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবহিত করায় তিনি তাকে যাত্রার অনুমতি দিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এই অভিযানে বের হয়েছিলেন মূলতঃ শত্রুদের মনে ভীতি সঞ্চার করার জন্যে এবং এটা বুঝানোর জন্যে যে, এত আঘাতের পরও মুসলমানগণ দুর্বল ও হতোদ্যম হননি। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন খারিজা ইবন যায়দ ইবন ছাবিত বর্ণনা করেছেন, আইশা বিন্ত উছমান এর আযাদকৃত দাস আবু ছাইব থেকে যে, বনী আবদ আশহাল গোত্রের জনৈক ব্যক্তি বলেছেন, আমি এবং আমার এক ভাই দু’জনে উহুদ যুদ্ধে উপস্থিত ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আহত অবস্থায় আমরা ফিরে আসি। এরপর শত্রুর পিছু ধাওয়ার জন্যে যখন রাসলুল্লাহ (সা) পুনরায় আহ্বান জানালেন তখন আমি আমার ভাইকে বললাম, সেও আমাকে বলল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথী হয়ে আরেকটি যুদ্ধ করা থেকে আমরা কি বঞ্চিত হব? আল্লাহর কসম! আমাদের নিকট কোন সওয়ারী নেই যাতে চড়ে যুদ্ধে যাব, তদুপরি আমরা দুজনেই এখন আহত। তবু আমরা দু’জন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে অভিযানে বের হলাম। ভাইয়ের চেয়ে আমার আঘাত কিছুটা কম ছিল। হেঁটে হেঁটে ভাইটি একেবারেই অচল হয়ে গেলে আমি কিছুক্ষণ তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতাম। আবার কিছুক্ষণ সে পায়ে হেঁটে যেত। এভাবে মুসলমানগণ যেখানে গিয়ে থামলেন, আমরাও সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম।
ইন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) অভিযানে বের হলেন এবং হামরাউল আসাদ নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন। সেটি ছিল মদীনা থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী একটি স্থান। তিনি সোম, মঙ্গল ও বুধবার সেখানে অবস্থান করলেন। এরপর মদীনায় ফিরে এলেন।
ইবন হিশাম বলেন, ওই অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন ইবন উম্মি মাকতুমের হাতে। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর বলেছেন, যে, তিহামা অঞ্চলের খুযায়মা গোত্রের লোকজন তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চুক্তিবদ্ধ মিত্র ছিল। তিহামার কোন কিছুই তারা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে গোপন রাখত না, খুযাআ গোত্রের মা’বাদ ইবন আৰু মা’বাদ জুহানী নামক এক ব্যক্তি তখনও মুশরিক ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) হামরা-উল আসাদ এ অবস্থান করার সময় সে ওখানে গিয়েছিল। সে সহানুভূতি প্রকাশ করে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার সাথিগণ সহ আপনারা যেভাবে আহত ও বিপদগ্রস্ত হয়েছেন তাতে আমরা মর্মাহত। আল্লাহ্ আপনাদেরকে নিরাপদ রাখুন আমরা তা কামনা করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে আলাপ শেষ করে সে পথে বের হল হামরা উল আসাদ ছেড়ে যাবার উদ্দেশ্যে। রাওহা নামক স্থানে তার সাথে আবু সুফিয়ান এবং তার সেনাবাহিনীর সাক্ষাত হয়। তারা তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও তার সাহাবীগণকে পুনঃ আক্রমণ করার জন্যেও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিল যে, মুহাম্মাদের গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় সাথীদেরকে আমরা নাগালের মধ্যে পেয়ে সমূলে উৎখাত করলাম না। তাদেরকে রেখে ফিরে এলাম এ কেমন হল? ওদের মধ্যে যারা অবশিষ্ট আছে আমরা পুনরায় তাদেরকে আক্রমণ করব এবং সকলকে নিশ্চিহ্ন করে এ আপন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করব। মা’বাদকে দেখে আবু সুফিয়ান বলল, হে মাবাদ, তোমার ছেরে আসা পথের অবস্থা কেমন? সে বলল, আমি দেখে এলাম মুহাম্মদকে। তিনি বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আপনাদেরকে ধাওয়া করার জন্যে এগিয়ে আসছেন। তাঁর সাথে এত বিশাল বাহিনী ইতিপূর্বে আমি কখনো দেখিনি। অগ্নি রূপ ধারণ করে এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় টান টান উত্তেজনা নিয়ে তারা আপনাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। উহুদ ময়দানে আসার পথে যারা ফিরে গিয়েছিল তারাও কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত হয়ে এই অভিযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে যোগ দিয়েছে। আপনাদের প্রতি তার এত ক্ষ্যাপা ও ক্ষুদ্ধ যা আমি কোন দিন দেখিনি। আবু সুফিয়ান বলল, হায়, এ তুমি কী বলছ? মা’বাদ বলল, আল্লাহর কসম, আমি একথা বলছি যে, আপনি যদি সম্মুখে অগ্রসর হন তবে অসংখ্য তাদের ঘোড়র উঁচু উঁচু মাথা দেখতে পাবেন। আবু সুফিয়ান বলল, আমরা প্রস্তুত হয়েছিলাম তাদেরকে নির্মল করার জন্যে তাদের উপর পুনঃআক্রমণ করার জন্যে। মা’বাদ বলল, আমি আপনাকে ওই কাজ থেকে বারণ করছি। সে আরো বলল যে, মুসলমানদের সমবেত বাহিনী দেখে আমি কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেছি। আবু সুফিয়ান বলল, ওই পংক্তিগুলোতে তুমি কী বলেছ? মা’বাদ বলল, তা এই :
ওদের প্রচণ্ড শব্দে আমার সওয়ারী ধরাশায়ী হবার উপক্রম হয়েছিল। যখন দেখা গেল যে, ওদের অসংখ্য অশ্বের পদচারণায় ভূমিতে অশ্বের বন্যা প্রবাহিত হচ্ছে।
ওরা হামলা করে সাহসী সিংহের ন্যায়। শত্রুর মুখোমুখি হলে দুর্বলও হয় না কোন দিকে পাশ কাটিয়েও যায় না ।
আমি তো দৌড়ে পালিয়ে এলাম। মনে হল পৃথিবীটা কাত হয়ে গিয়েছে। যখন তারা বরেণ্য এক নেতার পেছন পেছন চলছিল।
আমি বললাম, তোমাদের মুখোমুখি হলে সুফিয়ান ইবন হারবের ধ্বংস অনিবার্য । যখন সাহসী সন্তানদের পদভাবে, পৃথিবী টালমাটাল।
আজকের এই পূর্বাহ্নে আমি আরবের সাহসী লোকদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন তাদেরকে।
আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আহমদ (সা)-এর সেনাদল সম্পর্কে, যার অস্ত্র শস্ত্র ভেঁতা নয়। আমি যে বিষয়ে সতর্ক করেছি তা কোন গাল গল্প বলা চলে না।
বর্ণনাকারী বলেন, মাবাদের এই বর্ণনা আৰু সুফিয়ান ও তার সাথীদেরকে অগ্রসর হওয়া থেকে নিবৃত্ত করে দিল। তার পাশ দিয়ে আবদুল কায়স গোত্রের কতক পথিক যাচ্ছিল। সে বলল, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? ওরা বলল, মদীনায় যাচ্ছি। সে জিজ্ঞেস করল কী উদ্দেশ্যে? তারা বলল, খাদ্য সগ্রহের উদ্দেশ্যে। সে বলল, তোমরা কি আমাদের একটি সংবাদ মুহাম্মাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতে পারবে? বিনিময়ে আমরা পরের দিন উকয মেলায় তোমাদের উটদেরকে প্রচুর শুকনা আঙ্গুর খেতে দেব। ওরা বলল, হাঁ, পারব । সে বলল, তবে এই সংবাদটি মুহাম্মদ (সা)-কে পৌঁছাবে যে, আমরা তাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি। তাদের যে কয়জন অবশিষ্ট আছে সকলকে আমরা সমূলে ধ্বংস করবো।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) হামরা-উল আসাদে অবস্থান করছিলেন। পথিকগণ তার নিকট আসে এবং আবু সুফিয়ানের বার্তাটি তাঁকে পৌঁছিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন,
–আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক।” হাসান বসরী (র) এরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেন আহমদ ইবন ইউনুস– ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করে যে,
কথাটি হযরত ইবরাহীম (আ) বলেছিলেন যখন তাঁকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর মুহাম্মাদ (সা) এ কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন যখন তাকে বলা হয়েছিল যে, শত্রুপক্ষ আপনাদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছে ওদেরকে ভয় করুন! বস্তুতঃ এই বক্তব্য সাহাবীগণের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছিল। তারা বলেছিলেন । ii … এই বর্ণনা ইমাম বুখারী একাই উদ্ধৃত করেছেন।
ইমাম বুখারী (রা) বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবন সালাম– আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন।
”যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্যে মহাপুরস্কার রয়েছে। (৩- আলে-ইমরান : ১৭২)। আয়াত প্রসংগে তিনি উরওয়া (র)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ভাগ্নে! তোমার পূর্ব পুরুষদের মধ্য থেকে দু’জন উল্লিখিত দলে ছিলেন। সে দু’জন হলেন যুবায়র (রা) ও আবূ বকর (রা)। উহুদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা) আহত হলেন। মুশরিকগণ যুদ্ধস্থল ত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করল। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আশংকা করলেন যে, ওরা হয়ত ফিরে এসে পুনরায় আক্রমণ করতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে তিনি ঘোষণা দিলেন : মুশরিকদের পিছু ধাওয়া করার জন্যে অভিযানে কে কে বের হবে? ৭০ জন সাহাবী তার সে আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আবু বকর (রা) এবং হযরত যুবায়র (রা) ও ছিলেন। বুখারী হাদীছটি এভাবেই উদ্ধৃত করেছেন। মুসলিম (র) হিশাম (র) থেকে বর্ণনা করেছেন সংক্ষিপ্ত আকারে। সাঈদ ইব্ন মনসূর এবং আবু বকর হুমায়দী প্রমুখ সুফিয়ান ইবন উয়ায়না থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন। ইব্ন মাজা (র) ও হাকিম (র) হিশাম ইবন উরওয়া থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম এ বর্ণনা সম্পর্কে স্পষ্ট মন্তব্য করেছেন যে, এটি সহীহ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম এটি উদ্ধৃত করেননি। এ সনদটি একান্তই বিরল। মাগাযী বিশেষজ্ঞগণের প্রসিদ্ধ বর্ণনা আছে যে, “হামরা-উল আসাদ” অভিযানে উহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সকলেই শরীক ছিলেন। সংখ্যায় তারা ছিলেন ৭০০ জন। ইতিপূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ জন যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং অবশিষ্ট লোকজন হামরা-উল আসাদ অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন ।
ইবন জারীর (র) আওফী সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, উহুদ যুদ্ধের দিবসে আবু সুফিয়ান যা করেছিল বার তারপরই আল্লাহ তা’আলা তার অন্তরে তীতির সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। ফলে সে মক্কায় ফিরে যায়। উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শাওয়াল মাসে। আরব ব্যবসায়িগণ প্রতি বছর যিলকদ মাসে মদীনায় যেত এবং পথে বদর আস-সুগরা নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করত। এবারও তারা উহল যুদ্ধের পর্ব এ পথে আগমন করল। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ ভীষণ বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে পুনরায় নতুন অভিযানে বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, এখনি তোমরা সম্মুখে অগ্রসর হবে এবং শত্রুদেরকে পরাজিত করে হজ্জ সম্পাদন করবে। অন্যথায় আগামী বছর ব্যতীত হজ্জ করা যাবে
, ইতোমধ্যে সেখানে শয়তান উপস্থিত হয় তার অনুসারীদেরকে সে নিহত হবার ভয় দেখাতে থাকে। সে বলে যে, শপক্ষ তোমাদের বিরুদ্ধে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করেছে। ফলে কতক লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সম্মুখে অগ্রসর হতে অনীহা প্রকাশ করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমার সাথে যদি একজনও না যায়, তবু আমি একাই অগ্রসর হও ‘ এরপর আবু বকর (রা), উমর (রা), উছমান (রা), আলী (রা), তালহা (রা), যুবায়র (রা), সাদ (রা), আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা), আবু উবায়দা (রা), ইবন মাসউদ (রা) ও হুযায়ফা (রা) সহ ৭০ জন লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে বের হল। তারা আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবন করে। তারা সাফরা নামক স্থানে এসে পৌঁছেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন–
এই আয়াতটি নাযিল হয়। এই বর্ণনাটি নিতান্ত গরীব পর্যায়ের।
ইবন হিশাম বলেন, আবু উবায়দা বলেছেন যে, উহুদ দিবসে আবু সুফিয়ান যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়েছিল। তখনি পুনরায় মদীনায় আসার পরিকল্পনা করে সাফওয়ান ইব্ন উমাইয়া তাকে বলেছিল যে, তেমনটি করোনা। কারণ, মুসলমানগণ এখন ক্ষেপে আছে। আমার ভয় হচ্ছে যদি এ যাত্রায় তারা না পূর্বের চাইতে অধিক কার্যকর যুদ্ধ পরিচালনা করে, তোমরা বরং মক্কায় ফিরে যাও! ফলে তারা মক্কায় ফিরে গেল। হামরা-উল আসাদ গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন তাদের পুনঃ আক্রমণ প্রস্তুতির সংবাদ পেলেন তখন তিনি বললেন, একটি প্রকাণ্ড পাথর ওদের জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল। ওরা যদি সে পথে অগ্রসর হত তবে ঐ পাথর চাপা পড়ে সকলেই ধ্বংস হয়ে যেত।
এই অভিযানে মদীনায় ফিরে আসার পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মু’আবিয়া ইবন মুগীরা ইবন আবুল আস ইবন উমাইয়া ইবন আব্দ শামস-কে পাকড়াও করেন। সে ছিল আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের নানা। আবদুল মালিকের মা ছিলেন মুআবিয়ার কন্যা আইশা। একই অভিযানে তিনি আবৃ আয্যা জুমাহীকেও পাকড়াও করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আবূ আযযা জুমাহীকে বদর যুদ্ধে বন্দী করেছিলেন। তারপর দয়াবশত বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। উহুদ যুদ্ধে সে পুনরায় কাফিরদের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসে। এবার বন্দী হবার পর সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমায় ক্ষমা করে দিন। তিনি বললেন, না, তা হবে না। মক্কায় ফিরে গিয়ে তুমি গালে হাত বুলিয়ে বলবে, আমি মুহাম্মাদ (সা)-কে দু দুবার ঠকিয়েছি, তোমাকে সে সুযোগ দেয়া হবে না। তিনি নির্দেশ দিয়ে বললেন, হে যুবায়র! ওর গর্দান উড়িয়ে দাও। যুবায়র (রা) তা কার্যকর করেন।
ইবন হিশাম ইবন মুসায়্যিব সূত্রে উদ্ধৃত বর্ণনায় যুবায়ারের স্থলে আসিম ইবন ছাবিতের নাম রয়েছে।
ইবন হিশাম বলেন, হযরত উছমান (রা) মুআবিয়া ইবন মুগীরার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এই শর্তে যে, সে তিন দিনের বেশী মদীনায় থাকবে না। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে সে মদীনায় থেকে যায়। তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়দ ইব্ন হারিছাকে এবং আম্মার ইবন ইয়াসিরকে পাঠিয়ে বললেন, তোমরা অমুক স্থানে গিয়ে তাকে দেখতে পাবে। সেখানে তোমরা তাকে হত্যা করবে। তারা দুজনে তাই করেছিলেন।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) অভিযান শেষে মদীনায় ফিরে গেলেন। যুহরী আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, মদীনায় আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই এর একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল। প্রতি জুমাবার সে ওখানে দাঁড়াত। তার ব্যক্তিত্ব এবং বংশ মর্যাদার দরুন সকলে তাকে সম্মান করত। রাসূলুল্লাহ (সা) জুমাবারে খুতবা দেয়ার জন্যে বসলে আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই তার নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াত এবং বলত, হে লোক সকল! এই যে, আপনাদের সম্মুখে রাসূলুলাহ (সা)। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছেন। আপনারা তাকে সাহায্য ও সম্মান করবেন। তার নির্দেশ পালন করবেন। এবং তার আনুগত্য করবেন। এরপর সে বসে যেত। উহুদ দিবসে তার অপকর্মটি লোকজন ফেরার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সাহাবীগণকে নিয়ে যখন মদীনায় ফিরে এলেন, তখন আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই জুমাবারে পূর্বের মত তার নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে গিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানগণ চারিদিক থেকে তার জামা কাপড় টেনে ধরেন এবং বললেন, হে আল্লাহর দুশমন! তুমি বসে পড়, তুমি এই কাজের যোগ্য নও! তুমি যে অপকর্ম করেছ তা তো করেছই। সে মানুষের ঘাড় টপকিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল এবং বলতে লাগল, আহির কসম, আমি যেন খারাপ কথা বলেছি, আমি তো দাঁড়িয়েছিলাম তার কাজ-কর্ম সমর্থন করতে, তাকে শক্তিশালী করতে। বেরিয়ে যাওয়ার পথে মসজিদের দরজায় কতক আনসারী সাহাবীর সাথে তার দেখা হয়। তারা বললেন, ব্যাপার কী? কী হয়েছে : সে বলল, আমি মুহাম্মাদের কাজ-কর্ম সমর্থনও তা শক্তিশালী করার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম। তার কতক সাহাবী এসে আমাকে টেনে নামিয়ে দিল এবং আমার সাথে কঠোর আচরণ করল। আমি যেন মন্দ কথা বলেছি, মূলত আমি দাঁড়িয়েছিলাম তাকে সমর্থন করতে, তাকে শক্তিশালী করতে। আনসারী সাহাবীগণ বললেন, সর্বনাশ, ফিরে চলো, রাসূলুল্লাহ (সা) তোমার জন্যে দু’আ করবেন। সে বলল, না, আমার জন্যে তিনি দুআ করুন আমি তা চাইনা।
এরপর ইবন ইসহাক সূরা আলে ইমরানে উহুদ যুদ্ধ সম্পর্কিত যে সব আয়াত রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ –থেকে ৬০টি আয়াত উল্লেখ করেছেন (৩- আলে-ইমরান : ১২১-১৮০)।
ইবন ইসহাক এ আয়াতগুলো সম্পর্কে কিছু বক্তব্য রেখেছেন। এ বিষয়ে আমরা তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আগ্রহীদের জন্যে তাই যথেষ্ট। এরপর ইবন ইসহাক তার নীতি অনুযায়ী উহুদের শহীদগণের নাম, পিতার নাম ও গোত্রের উল্লেখসহ পরিচয় ও সংখ্যা বর্ণনা করেছেন। এ প্রসংগে তিনি ৪ জন মুহাজির শহীদের নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন- হযরত হামযা (রা), মুসআব ইবন উমায়র (রা), আবদুল্লাহ ই জাহশ (র) ও শাশ্বাস ইবন উসমান (র!)। তিনি এ প্রসংগে ৬১ জন আনসারী সাহাবীর নাম উল্লেখ করে শহীদের সংখ্যা ৬৫ জন পর্যন্ত পৌঁছান। ইবন হিশাম আরো ৫ জনের নাম যোগ করেছেন। ফলে ইবন হিশামের মতে শহীদ সাহাবীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। এরপর ইবন ইসহাক মুশরিকদের নিহতদের নাম উল্লেখ করেছেন। সংখ্যায় তারা ছিল বাইশ জন । তিনি ওদেরও গোত্র পরিচয় উল্লেখ করেছেন, আমি বলি, সেদিন আবূ আযযা জুমাহী ছাড়া কোন মুশরিক বন্দী হয়নি। ইমাম শাফিঈ প্রমুখ তাই বলেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত যুবায়রকে মতান্তরে আসিম ইবন ছাবিতকে নির্দেশ দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানগণ এবং কাফিরদের উচ্চারিত পংক্তিমালা
এ প্রসংগে আমরা কাফিরদের কবিতাগুলোও উল্লেখ করব এজন্যে যে, তার প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের দেয়া প্রত্যুত্তরমূলত কবিতাগুলো শুনতে ভাল লাগবে এবং বুঝতে সহজ হবে। উপরন্তু ওদের কবিতায় বর্ণিত অভিযোগসমূহের খণ্ডন নিশ্চিত হবে।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, উহুদ দিবসে যে সকল কাফির কবিতা আবৃত্তি করেছে তাদের একজন হল হুবায়রা ইবন আৰূ ওয়াহব মাখযুমী। সে তখনো তার পিতৃবংশ কুরায়শী কাফিরদের ধর্মের অনুসারী। সে বলেছিল ।
গোত্রপতির কী হল যে, তিনি আমাকে রাতভর গাল-মন্দ করেছেন। হিন্দের সাথে আমার ভালবাসার কারণে।
অন্যদিকে হিন্দ ও আমাকে গালমন্দ করে রাত কাটিয়েছে। এবং সে আমাকে রাতভর ভর্ৎসনা করেছে। আর যুদ্ধ সে তো আমাকে সকল বন্ধুত্ব ও ভালবাসার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে।
থাম, থাম হে হিনদ! তুমি আমাকে ভসনা করোনা। আমার চরিত্রের কথা তো তুমি জানই। আর আমার চরিত্রের কিছুই আমি গোপন রাখিনা।
আমি তো সহায়তাকারী পুরুষ বান্ কা’ব গোত্রের। তারা যে সমস্ত দায় ও বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছে সেগুলো পরিশোধ ও উত্তরণে আমি তো ওদেরকে সহযোগিতা করি।
আমার অস্ত্রশস্ত্র আমি বোঝাই করেছি একটি বৃহদাকার ঘোড়ার পিঠে। আমার ঘোড়াটি দীর্ঘ পদক্ষেপকারী দ্রুতগামী, যখন সে চলতে শুরু করে তখন সেটি যেন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ঘোড়া।
সেটি যখন চলতে শুরু করে তখন সেটিকে মনে হয় দুর্গম পথ অতিক্রমকারী কাফেলা। সেটি যেন প্রচণ্ড বেগে ধাবমান ঘোড়া, যেটি তার সাহায্যকারী কাফেলার সাথে মিলিত হবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।
এটি উৎকৃষ্ট প্রজাতি আওয়াজ প্রজাতির ঘোড়া, এটি যখন হনহন করে ছুটতে থাকে তখন তার কণ্ঠ থেকে মিষ্টি মধুর শব্দ বের হয়। এটি ঘন পত্র-পল্লব বিশিষ্ট শা’রা বৃক্ষের ডালের ন্যায়। কেশরগুলো উঁচু উঁচু ও ঝরঝরে।
আমি প্রস্তুত রেখেছি এই ঘোড়া, সুতীক্ষ দুধারী তলোয়ার এবং শক্ত-মজবুত বর্শা বিপদ মুকাবিলার জন্যে যদি আমি কোন বিপদের সম্মুখীন হই।
এটি এবং সংরক্ষিত কঠিন মাটির ন্যায় মযবুত সফেদ তরবারি এগুলো আমাকে সাহস যুগিয়েছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল। এগুলোর সমকক্ষ আমি কিছুই দেখিনি।
আমরা ইয়ামানের প্রান্ত থেকে বনু কিনানা শহর অতিক্রম করছিলাম
কিনানা গোত্রের লোকজন বলল, আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমরা বললাম, তোমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছি খেজুর বীথির দেশে। সুতরাং তোমরা ওই দেশ ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা কর।
আমরা অশ্বারোহী যোদ্ধা, আজকের উহুদ যুদ্ধের দিনে। যুদ্ধের জন্যে সাদ গোত্র উড়ে এসেছে। আমরা বললাম আমরাও আসছি।
ওরা দ্রুতবেগে ছুটে এসেছে। ওদের মধ্যে আছে তরবারি পরিচালনায় দক্ষ যোদ্ধা, প্রতিপক্ষকে কেটে টুকরো টুকরো করতে পারে এমন বর্শা নিক্ষেপকারী, ওদের পথের দূরত্ব যেন হ্রাস করে দেয়া হয়েছে।
এরপর আমরা যাত্রা করলাম। তখন আমরা যেন প্রচণ্ড ঠান্ডা মুকাবিলা করে যাচ্ছি। অন্য দিকে বনূ নাজ্জার গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ প্রস্তুত হল, কান্নার রোল সৃষ্টি করে ।
যুদ্ধের সময় ওদের শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধাগণ এমন হয়ে যায় যে, তাদের অশ্বদলের ক্ষুরের আঘাতে উড়তে থাকা ধুলি ঝড় তাদের আবাসস্থল থেকে ওদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়।
অথবা তারা পুরানো বৃক্ষ ডালে তিক্ত মাকাল ফল বায়ুপ্রবাহে সেটি আন্দোলিত হয়। পাখীর সেগুলো কুড়িয়ে খায় ।
আমরা মাল-সম্পদ ব্যয় করি দেদারসে অবিরত, বে-হিসাব। দ্রুতগতি সৃষ্টির লগে, আমরা ক্রোধান্বিত হয়ে অশ্ব পরিচালনা করি তার চোখে গুতো দিয়ে।
বহু রাত আমাদের এমন কেটেছে যে, উট জবাইকারী ব্যক্তি শুষ্ক গোবর তথা ঘটে জ্বালিয়ে দিয়েছে আলো দেখানোর জন্যে। আর মুসাফিরদেরকে এদিকে আহ্বান করার জন্যে আহবানকারী ব্যক্তি ঢাক-ঢোল পিটিয়েছে।
প্রচন্ড কুয়াশাময় জুমাদার বহু রাত্রি আমার এমন কেটেছে যে, আমি আমার অশ্ব নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছি।
এত ঠান্ডা ও শৈত্য প্রবাহের রাত ছিল যে, ঠান্ডার কারণে কোন কুকুর একবারের বেশী দু’বার ডাক ছাড়ত না, বড় বড় সাপগুলোও তেমন রাতে গর্ত থেকে বের হত না।
ওই হিমশীতল রাতে আমি দীন-দুঃখী ও দুঃস্থ মানুষদের জন্যে লেলিহান শিখাময় আগুন জ্বালিয়েছি। ওই আগুন বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল। আমি ওই আগুনের উত্তাপ বৃদ্ধি করি।
দানশীলতার এই উদারতা আমাকে উত্তরাধিকার রূপে প্রদান করেছে আমর এবং তার পূর্বে তাঁর পিতা। মুশতা অঞ্চলে অবস্থানকালে তারা এরূপ করতেন।
তারা নক্ষত্ররাজির অবস্থান লক্ষ্য করে রাতে ভ্রমণ করতেন; কিন্তু তাদের এই সাধনা কখনো কঠিন বাধার নিকটবর্তী হয়নি।
ইবন ইসহাক বলেন, এরপর হাসসান ইবন ছাবিত (রা) উপরোক্ত পংক্তিমালার জবাব দেন । (কিন্তু ইবন হিশাম এটিকে কাব ইবন মালিক প্রমুখের বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আমার মতে ইবন ইসহাকের বক্তব্য প্রসিদ্ধ।
তোমাদের বোকামি ও অজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে তোমরা কিনানা গোত্রের লোকজনকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছ। জেনে রেখ যে, আল্লাহর সৈন্যগণ ওই শত্রুপক্ষকে লাঞ্ছিত করবেনই।
তোমরা তো ওদেরকে মৃত্যুকূপে ঠেলে দিয়েছ সকাল বেলায়। ওদের প্রতিশ্রুত স্থান জাহান্নাম আর হত্যা ওদেরকে পাকড়াও করবেই।
হে কাফির নেতৃবৃন্দ! তোমরা তো ওদেরকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছ, তোমাদের সত্যদ্রোহিতা তোমাদেরকে প্রতারিত করেছে।
বদর যুদ্ধে আল্লাহর সৈনিকগণ তোমাদের পক্ষের যাদেরকে হত্যা করেছে এবং তারপর আবর্জনাপূর্ণ কূপে নিক্ষেপ করেছে আল্লাহর ওই সৈনিকদের থেকে কেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করনি?
তোমাদের বহু বন্দী লোককে আমরা মুক্তিপণ ছাড়া এবং চুল কেটে দেয়া ছাড়া মুক্ত করে দিয়েছি। আমরা ওদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণই করেছি।
ইবন ইসহাক বলেছেন যে, হুবায়রা ইবন আবু ওয়াহব মাখযুমীর কবিতার জবাব কাব ইবন মালিক এভাবে দিয়েছেন:
আমাদের পক্ষ থেকে কি গাসসান গোত্রের নিকট কোন আক্রমণ এসেছে? ওদের পেছনে তো রয়েছে উঁচু-নীচু বন্ধুর ভূমি যেখানে ভ্রমণ করা কষ্টকর বটে।
ওদের পেছনে রয়েছে ধুধু ময়দান ও পার্বত্য ভূমি। দূর থেকে ওখানকার বালিগুলোকে মনে হয় জলাশয়।
জংলী বকরীগুলো ওই শুষ্ক মরুভূমিতে বসবাস করে ক্ষীণকায় দুর্বল শরীরে। এরপর বৃষ্টি বর্ষণে সদ্য গজিয়ে উঠা ঘাস-পাতা খেয়ে সেগুলো মোটা তাজা হয়ে যায়।
বৃষ্টিতে সেখানে জন্মে মওসুমী ঘাস। ওই কচি ও সজীব ঘাসগুলো চকচক করে, যেমন চকচক করে, ব্যবসারী পণ্য কাতান।
সেখানে রয়েছে নীলগাভী ও বন্য হরিণ, সেগুলো একটার পেছনে একটা নির্ভয়ে বিচরণ করে। সেখানে আছে উটপাখির ডিম যেগুলোর খোসা ভাঙ্গা ফাটা অবস্থায় রয়েছে।
আমাদের ধর্মের পক্ষে প্রত্যুত্তর দেয়া স্পষ্টভাষী, বাগী ব্যক্তিগণ, তাদের মাথায় থাকে শিরস্ত্রাণ যা ঝলমল করে।
এবং প্রতিধ্বনি করে কঠিন কঠোর পাথ শুলো, ওগুলোতে পানি মিশ্রিত হলে সেগুলো ভিজে পানি টেনে সিক্ত হয়ে উঠে।
তবে বদর যুদ্ধের ঘটনায় ওরা বলাবলি করছিল যে, কাদের সাথে তোমরা মুকাবিলা করছিলে। গায়বী সংবাদ তো অবশ্যই কল্যাণ সাধন করে।
কোন দেশের অধিবাসিগণ যদি আমরা মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ হয় তবে সেটি আমাদের জন্যে ভয়ের স্থান বটে। কিন্তু মূলত আমাদের ভয়ে ওরা রাত কাটায়।
আমাদের ঘোড়া সওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এসে বলেছিল আপনারা প্রস্তুত হোন, আবু সুফিয়ান ইবন হারব মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে তার মুকাবিলার জন্যে।
যখন যে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। আমরা ওই ষড়যন্ত্র দমনে সবচেয়ে সিদ্ধহস্ত।
আমাদের বিরুদ্ধে সবাই মিলেও যদি কোন চক্রান্ত তৈরী করে তবু এটা ঠিক যে, তারা আত্মসমর্পণ করবেই এবং ক্ষতি স্বীকার করবে।
আমরা পূর্ণ শক্তিতে মুকাবিলা করে যাব । অবশেষে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যে, প্রত্যেক গোত্র আমাদের ভয়ে তটস্থ ও অস্থির হয়ে থাকবে।
ওরা যখন আমাদের যত নষ্ট করার চেষ্টা করেছে, তখন আমাদের নেতৃবর্গ বলেছেন যে, যদি যতই রক্ষা করতে না পারি, তবে আমাদের সাধ্য সাধনায় কী লাভ?
মনে রেখ, আমাদের মধ্যে আছেন আল্লাহর রাসূল (সা)- আমরা তাঁর নির্দেশ পালন করি। তিনি যখন আমাদের মধ্যে কোন কথা বলেন, তখন আমরা তা থেকে এক চুলও বিচ্যুত হই না।
তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাঁর নিকট রহ অর্থাৎ হযরত জিবরাঈল অবতীর্ণ হন । জিরাঈল আকাশ থেকে অবতীর্ণ হন এবং আবার আকাশে উঠে যান।
আমরা আমাদের সকল কর্মে তার সাথে পরামর্শ করি, তিনি কোন কাজের আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরা তা বাস্তবায়নে তাঁর নির্দেশ শুনি ও পালন করি।
প্রথম পর্যায়েই রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, তোমরা মৃত্যুর ভয় ত্যাগ করবে; বরং তা (শহীদী মৃত্যু কামনা করবে।
তোমরা বরং হয়ে যাবে এমন, যে ব্যক্তি তার জীবন বিক্রি করে মহান আল্লাহর নৈকট্যের উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর নিকট জীবন পাবে এবং সেখানে ইচ্ছামত আসা-যাওয়া করবে।
তোমরা বরং মযবুতভাবে তরবারি ধর । আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। নিশ্চয় সকল কর্ম আল্লাহর অধীন।
এরপর আমরা সকাল বেলা প্রকাশ্যে শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমাদের মাথার উপর চিকচিক করছিল তীক্ষ্ণ তরবারি, আমাদের মনে কোন ভয়ভীতি ছিল না।
সাথে ছিল লৌহ নির্মিত অস্ত্র ও বর্শা। কারো পায়ে আঘাত করলে তার আর রক্ষা নেই।
আমরা এসে পৌঁছলাম এক জনসমুদ্রে। ওখানে গিজগিজ করছিল শত্রুসৈন্য। ওদের কেউ শিরস্ত্রাণ পরিহিত কেউ খালি মাথায়।
ওরা ছিল তিন হাজার আর আমরা মাত্র তিনশ’ আর খুব বেশী হলে আমাদের সংখ্যা চারশ’–এর মত হবে।
আমরা ওদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিলাম। আমাদের মাঝে মৃত্যু ও শাহাদাঁতের ঘটনা চলছিল। আমরা ওদেরকে মৃত্যুকূপে ঠেলে দিচ্ছিলাম। আমরাও মৃত্যুকূপে পতিত হচ্ছিলাম।
তীর-ধনুক সমান তালে ব্যবহৃত হচ্ছিল আমাদের মধ্যে এবং এদের মধ্যে। ওই তীর ছিল প্রচণ্ড ধারালো তীক্ষ্ণ ইয়াছরীবের তৈরী।
আরও তীর ছিল মক্কার তৈরী প্রশস্ত মাথা সায়েদীয়ার তৈরী। ওগুলো তৈরীর সময় তাতে বিষ মিশ্রিত করে দেয়া হয়েছিল।
ওই তীর ও বর্শা কখনো কারো শরীরে গিয়ে আঘাত করছিল আবার কারো কারো চোখে গিয়ে পতিত হচ্ছিল।
সেখানে ছিল বহু অশ্ব। উন্মুক্ত প্রান্তরে ওগুলোকে মনে হচ্ছিল পঙ্গপাল। সমতল ভূমিতে সেগুলো চার পা স্থির রেখে নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।
আমরা মুখোমুখি হলাম। যুদ্ধের চাকা আমাদেরকে নিয়ে ঘুরতে শুরু করল । আল্লাহ্ তা’আলা যাকে রক্ষা করেন তাকে হটানোর শক্তি কারো নেই।
আমরা ওদেরকে আক্রমণ করেছি– মেরেছি। অবশেষে তাদের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে বদর প্রান্তরে ফেলে রেখে এসেছি। তারা ওই ময়দানে পড়ে রয়েছে মূলোৎপাটিত গাছের গুঁড়ির ন্যায়।
আমরা ভোরবেলা থেকে আক্রমণ শুরু করেছি। সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে আমরা ঝামেলামুক্ত হয়েছি। তখন সূর্যকে মনে হচ্ছিল ঝলমলে চকচকে অগ্নিকুণ্ড।
রসন্ধ্যা বেলায় ওরাও দ্রুত ফিরে গিয়েছে ক্ষত-বিক্ষত দেহ ও বেদনাতুর মন নিয়ে, ওরা যেন শূন্য মেঘ, প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহ যার সব পানি ঝরিয়ে দিয়েছে।
আমরাও সন্ধ্যা বেলায় ফিরে গিয়েছি আমাদের শেষ লোকটিসহ। আমরা গিয়েছি ধীরে-সুস্থে হেলে-দুলে । আমরা যেন বীশাহ অঞ্চলের গোশত খাওয়া পরিতৃপ্ত সিংহকুল।
আমরা ওদের বিরুদ্ধে সফলতা পেয়েছি। ওরাও আমাদের কিছু ক্ষতি করেছে। মাঝে মাঝে আমরা এরূপ করে থাকি তবে মহান আল্লাহর নিকট যে পুরস্কার রয়েছে তা প্রশস্ততর ।
আমাদের যুদ্ধের চাকা ঘুরেছে। ওরা ওদের যুদ্ধের চাকা ঘুরিয়েছে। ওরা অকল্যাণ পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে।
আমরা এমন মানুষ যে, খুন ও নিহত হওয়াকে আমরা মানহানি মনে করি না। যারা দায়িত্বশীল অন্যের সুখ-দুঃখের যিম্মাদার তাদের উপর তো আঘাত আসবেই ।
সকল বিপদাপদে আমরা ধৈর্যশীল অবিচল। কেউ মারা গেলে তার জন্যে চোখের পানি ফেলতে দেখি না কাউকে।
আমরা যুদ্ধের সন্তান-যোদ্ধা, আমরা যা বলি তা করেই ছাড়ি। আর যুদ্ধ আমাদের জন্যে যে পরিস্থিতি তাই নিয়ে আসুক তাতে আমরা অস্থির হই না।
আমরা যুদ্ধের সন্তান- যোদ্ধা, আমরা বিজয়ী হলে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হই না। আর বিজিত হলেও দুঃখিত হই না ।
আমরা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যার তাপ থেকে শত্রুপক্ষ দূরে সরে যায় এবং যারা সেটির কাছে ঘেঁষে তা তাদেরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কালো করে দেয়।
হে ইব্ন যাব’আরী! তুমি আমার বিরুদ্ধে দর্প প্রকাশ করেছো অথচ তোমাদেরকে পাকড়াও করার জন্যে ধাওয়াকারীরা শেষ রাতে যাত্রা করেছে।
সুতরাং তুমি নিজেকে জিজ্ঞেস কর, সা’দের উচ্চভূমি প্রভৃতি স্থানে যে মানবকুলের সর্বাধিক লাঞ্ছিত ও অভিশপ্ত কে?
এবং কে এমন ব্যক্তি যুদ্ধ যার দর্পচূর্ণ করেনি এবং যুদ্ধের দিন কার চেহারা বিবর্ণ হয়নি।
আমরা তোমাদের উপর আক্রমণ করেছি প্রচন্ড আক্রমণ আল্লাহর শক্তি ও সাহায্য নিয়ে। আমাদের বশীর ফলাগুলো তোমাদের দিকে তাক করেই হামলা করেছি ।
আমাদের তীরগুলো বারবার তোমাদের উপর গিয়ে পড়ছে, তীরের ফলাগুলো যেন শীতকালের হরিণ পাল। খুব দ্রুত পথ অতিক্রম করছে।
আমরা অগ্রসর হয়েছি তোমাদের পতাকাবাহী সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এবং পতাকার কথা উল্লেখ করে যারা কবিতা আওড়াচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্যে। তবে কবিতা নয় পতাকা হাতে আল্লাহর প্রশংসাই অধিকতর সংগত।
আমাদের মুজাহিদগণ ওদের নিকট গিয়ে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ওরা আমাদের সৈনিকদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে এবং তারা লাঞ্ছিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর নির্দেশ কার্যকর করেছেন। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম-বিধায়ক।
ইবন ইসহাক বলেন যে, আবদুল্লাহ ইব্ন যাব’আরী উহুদ দিবসে নিম্নের পংক্তিমালা উচ্চারণ করেছে। তখনো সে মুশরিক।
ওহে কাক! তুমি কি শুনেছ? তাহলে কিছু বল। তুমি তো শুধু তাই বল যা হয়ে গিয়েছে।
নিশ্চয়ই কল্যাণ ও অকল্যাণ দুটোর জন্যে নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে এবং দুটোর পক্ষেই গ্রহণযোগ্য যুক্তি রয়েছে।
ওদের মাঝে দান-দক্ষিণার ব্যাপারটি গৌণ ও তুচ্ছ। মূলত ধনী ও দরিদ্র উভয়ের কবর সমান সমান।
সকল আরাম-আয়েশ ও সুখ শান্তি একদিন শেষ হবেই। যুগের মেয়েরা তথা কালচক্র সবাইকে নিয়ে খেলা করে।
হাসানকে আমার পক্ষ থেকে একটি সংবাদ জানিয়ে দাও, যে কবিতা রচনা ও কাব্য প্রতিযোগিতা বিদ্বেষী মনে স্বস্তি প্রদান করে।
তুমি তো দেখেছ বহু মাথার খুলি এবং হাত-পা ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে।
হাসানের পাজামা খুলে গিয়েছে। ওরা সকলে তাদের অবতরণ ক্ষেত্রে নিহত হয়েছে।
আমরা হত্যা করেছি তোমাদের অভিজাত ও মর্যাদাবান বড় বড় কত নেতাকে। যারা পিতৃপক্ষ- মাতৃপক্ষ উভয় দিক থেকে মর্যাদাবান। অগ্রণী ও বীরযোদ্ধা।
তারা প্রকৃতই অভিজাত । যুবক এবং দানশীল, তীর নিক্ষেপের সময় অলসতাকারী নয় ।
সুতরাং সাহসী লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যাও। তারা যেন মাথায় শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধের ময়দানে না থাকে।
হায়, বদর যুদ্ধে আমার যে সকল নেতৃবর্গ মারা গিয়েছেন ওরা যদি এখন উপস্থিত থাকতেন আর বশী নিক্ষেপের শিকার হয়ে খাযরাজ গোত্রের লোকেরা কেমন অস্থির হয়ে পড়েছে তা দেখতে পেতেন!
কুবা পর্যন্ত পৌঁছে ওরা উট বসিয়ে দেয়। আবদ আশহাল গোত্রে হত্যাকাণ্ড তীব্র রূপ ধারণ করেছে।
এরপর সেটিকে নাচাতে শুরু করল, উটপাখির বাচ্চার নাচনের ন্যায়। যখন সেটি নেচে নেচে পর্বতের উপরের দিক উঠে।
এরপর আমরা আমাদের নিহতের দ্বিগুণ সংখ্যক ওদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করলাম, আমরা বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ নিলাম। উভয় যুদ্ধের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনলাম। এরপর সমান সমান হয়ে গেল,
আমি নিজেকে দোষারোপ করি না তবে কথা হল আমরা যদি প্রকৃত ও প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করি, তাহলে ঘটনার মত ঘটনা ঘটাতে পারি।
আমরা ঘটনা ঘটাই ভারতীয় তরবারি দ্বারা। সেগুলো শত্রুপক্ষের মাথার উপর চক্কর দিতে থাকে। প্রথমবারের পানীয় গ্রহণের পর দ্বিতীয় বারের পান করানোর ন্যায়।
ইবন ইসহাক বলেন, হাসসান ইবন ছাবিত (রা) ইবন যাব আরীর উপরোক্ত কবিতার জবাবে নিম্নের কবিতা উচ্চারণ করেন :
হে ইবন যাব’আরী এটি সত্য যে, একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে, তবে যথার্থ বিচারে তাতে শ্রেষ্ঠত্ব ও জয় আমাদেরই।
তাতে তোমরা আমাদের ক্ষতি করেছ আমরাও তোমাদের ক্ষতি সাধন করেছি। মূলত যুদ্ধ সে রকমই বালতির ন্যায়। কখনো এই পক্ষের হাতে কখনো ওই পক্ষের হাতে।
আমরা তোমাদের ঘাড়ের উপর তরবারি রাখি। যে স্থানে আঘাত করতে চাই করি। তোমাদেরকে প্রথম বারের পর পুনরায় পান করাই, বারবার আঘাত করি।
তোমাদের পশ্চাদদেশ থেকে আমরা তোমাদের মায়ের দুধ বের করে আনব। যেমন লোহার অস্ত্র ঘাসকে নির্মূল করে দেয়।
যখন তোমরা পায়ের গোড়ালিতে ভর করে পেছনের দিক যাচ্ছিলে পলায়ন করে। পাহাড়ী পথে পথে বন্য প্রাণীর পলায়নের ন্যায়, ।
আমরা যখন তোমাদের উপর আক্রমণ করেছিলাম প্রচণ্ডভাবে? আমরা তোমাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম পাহাড়ের পাদদেশে। বাধ্য করেছিলাম পার্ক গুহায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ।
আমরা তোমাদেরকে তাড়া করেছিলাম বিরাট বিরাট কিরিচ ও চাপাতি নিয়ে সাঁড়াশির ন্যায়। যে কেউ এ গুলোর আওতায় পড়বে সে কাটা পড়বেই।
আমাদের উপস্থিতিতে পাহাড়ী পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছিল। আমরা সেখানকার ছোট-বড় সকল পথ পূর্ণ করে দিয়েছিলাম উপস্থিতি দ্বারা।
ওই পথ ভরতি হয়ে গিয়েছিল এমন সব লোক দ্বারা (ফেরেশতাদ্বারা) যে তোমরা ওদের সমান নও। জিব্রাঈল (আ)-এর মাধ্যমে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছেন। জিবরাঈল (আ) নিজে সেদিন ওখানে অবতরণ করেছিলেন।
আমরা বদর দিবসে বিজয়ী হয়েছি তাকওয়া ও খোদাভীতির মাধ্যমে। আল্লাহর আনুগত্যে এবং রাসূলগণের সত্যায়নের মাধ্যমে।
ওদের সকল নেতাকে আমরা হত্যা করেছি এবং ওদের সকল অহংকারী দাম্ভিক ব্যক্তিকে আমরা খুন করেছি।
বদর দিবসে আমরা কুরায়শ বংশে পুরুষ রাখিনি শুধু মহিলাদেরকে অবশিষ্ট রেখেছি। আর সে দিন আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি।
রাসূল মুহাম্মাদ (সা) সত্য নবী। বদর দিবসে তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলসহ সক মূর্তির প্রতি তীর নিক্ষেপকারী।
তিনি বদর যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁর প্রতিপক্ষে ছিল কুরায়শ সম্প্রদায়। তারা সমাবেশ ঘটিয়েছিল তার বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ। যেমন একত্রিত হয় উর্বর জমিতে রাখালহীন উট।
আমরা তো তোমাদের মত ভীতু কাপুরুষ নই। বরং যে কোন বিপদ ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমরা হাযির হই। যদি বিপদ ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ইবন ইসহাক বলেছেন যে, উহুদের যুদ্ধে শহীদান হযরত হামযা (রা) ও অন্যান্যদের প্রতি শোক প্রকাশ কবে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে কা’ব (রা) বলেন :
হে হামযা (রা)! আপনিতো অনেকের জন্যে কেঁদেছেন এখন আপনার জন্যে ক্রন্দনকারী কেউ আছে কি? আপনি তো এমন ব্যক্তিত্ব যখনই আপনার সম্পর্কে আলোচনা হত আপনি সমুদ্রের সাথে তুলনীয় হতেন।
এমন এক সম্প্রদায়ের কথা আমার স্মরণে আসে যাদের বক্রযুগের (জাহেলী যুগের) আলোচনা আমার নিকট এসেছে।
সুতরাং ওদের কথা স্মরণ হলে ওদের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আপনার অন্তর স্পন্দিত ও শিহরিত হয় আনন্দে গৌরবে এবং গভীর দুঃখে।
ওই সম্প্রদায়ের (মুসলিম সম্প্রদায়ের) শহীদগণের অবস্থান নি’আমতে ভরপুর জান্নাতে । যেখানে প্রবেশ স্থান ও বাহির হবার স্থান সমুন্নত।
এই মর্যাদা তারা অর্জন করেছে এই জন্যে যে, তারা ধৈর্যের সাথে অবস্থান করেছিল পতাকার নীচে। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পতাকার নীচে উপত্যকার কিনারায় ।
ওরা ধৈর্যের সাথে অবিচল থেকেছিলেন সেই ভোরে যখন আওস ও খাযরাজ গোত্রীয় লোকজন তরবারি উঁচিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ডাকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
ওরা আহমাদ মুস্তাফা (সা)-এর সহযোগী। তারা সত্য ও আলোকময় জীবন বিধানে তাঁর অনুসারী।
যখন ভোর হল তখন তারা শত্রু পক্ষের মাথায় ও শিরস্ত্রাণে আঘাত করতে শুরু করল এবং মরু ধুলায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল।
এভাবে বিরামহীনভাবে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন এক পর্যায়ে মহান মালিক আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে ডাক দিলেন সুপ্রশস্ত-বিশাল বিস্তৃত জান্নাতের দিকে।
ওদের সকলেই মৃত্যুবরণ করেছে বিপদের মুখে অলাহর মনোনীত মিতের উপর অবিচল থেকে সুতরাং তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
যেমন হযরত হামযা (রা)। তিনি পূর্ণ শক্তিতে একান্ত নিষ্ঠার সাথে যুদ্ধ করছিলেন একটি সুতীক্ষ্ণ আতিকর ধারালো তরবারি নিয়ে।
অনন্তর বনু নাওফাল গোত্রের এক ক্রীতদাস তার মুখোমুখি হ। সে উন্মাদ উটের ন্যায় গোঁ গোঁ শব্দ করছিল ।
সে হামযা (রা)-এর দেহে একটি ধারালো বশা ডুকিয়ে দিল। যে বশটি ছিল অগ্নি স্ফুলিঙ্গের নায় চকচকে ও ঝলমলে ।
এবং নুমান, তিনি তার অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন এবং কল্যাণময় হানসালী। তিনি বিচ্যু হননি।
তিনি বিচ্যুত হননি সত্য থেকে। এমতাবস্থায় তার রূহ পৌঁছে গেল গৌরবজনক স্থানে। মহামূল্য দ্রব্য সামগ্রীতে সজ্জিত জান্নাতে।
তারা ওই দলের লোক নয় যে দলে ভোমরা রয়েছ। তোমাদের লোকগুলোর ঠিকানা তো চিরস্থায়ী আগুনে ও জাহান্নামের অতল তলে ।
ইন ইসহাক বলেন, হযরত হামযা (রা) সহ উহুদ যুদ্ধের অন্যান্য শহীদদের প্রতি শোক প্রকাশ করতে গিয়ে হাস্সান ইব্ন ছাবিত (রা) নিম্নের কবিতা আবৃতি করেছেন। এটি মূলত? বদর দিবসে নিহত মুশরিকদের সম্পর্কে উমাইয়া ইবন আৰু সালতের কবিতার ছন্দে। ইবন হিশাম বলেছেন যে, কতক জ্ঞানী ব্যক্তি এই কবিতা হযরত হাসানের (রা) নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
হে আমার মা! উঠ উঠ, সাহরীর সময়ে জনম দুঃখিনীদের কনে সাড়া দাও, সান্ত্বনা দাও। ক্রন করছে তারা যাদের সাথে দুঃখের বোঝা। বেদনায় যাদের হৃদয় ভরাক্রস্তি।
ওরা আহাজারী করছে ওরা অভিজাত দ্র মহিলা, ক্ষোভে মুখমণ্ডলে খামচি দিচ্ছে। ওদের অশ্রু প্রবাহ যেন মূর্তির দেহে ঝরতে থাকা বলির পশুর রক্ত।
ওরা ওদের চাদর ফেলে দিয়ে চুল ছিঁড়ছে। তাদের এলোমেলো চুল যেন প্রাতঃকালীন ঘোড়ার লেজ।
তারা ক্রন্দন করছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ এবং জবাই হয়ে যাওয়া সৈনিকদের জন্যে। চরম দুঃখ তাদেরকে অস্থির করে তুলেছে।
তাদের হৃদয়ে ক্ষত ও ফোস্কা পড়েছে। তাতে ভীষণ ব্যথা, তাদের এই ব্যথা নওজোয়ানদের মৃত্যুর কারণে। ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ গ্রিহে আমরা যাদের উপর ভরসা করতাম।
ওই ক্রন্দন উহুদের শহীদদের জন্যে। তারা যুগ যুগান্তরের বেদনা রেখে গিয়েছেন। অস্ত্রধারী সৈন্য প্রেরণের সময় ওরা ছিলেন আমাদের অশ্বারোহী ওরা ছিলেন আমাদের নিরাপত্তা রক্ষাকারী ।
হে হামযা (রা)! আমি আপনাকে ভুলব না, ইয়াতীম মান এবং বিধবাদের দুধ পানের জন্যে যতদিন দুধেল উস্ত্রীর দুধ দোহন করা হবে ততদিন আমি আপনার কথা বিস্মৃত হব না।
যুগ যুগ ধরে, যুদ্ধের পর যখন যুদ্ধ সংঘটিত হবে। হে অশ্বারোহী, হে নেতা! হে হামযা! আপনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে স্মরণীয় হবেন।
আপনি তো আমাদের বিপদে ঠেকাতেন। আর পরবর্তীতে আমরা যখনই বিপদগ্রস্ত হব। হে রাসূলের (সা) সিংহ! আমি আপনাকে স্মরণ করব। আপনি আমাদের মোচন ত্রাণকতা নেতা।
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত। জন সমাগমের মধ্যেও তাঁর মাথা যাবত সবার উপরে। তিনি মহান দানশীল ও সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন ।
তিনি কোন ভয়ে ভীত নন, কম্পমান নন, আর কোন ঝেঝা বহনে অক্ষম নন। তিনি সমুদ্রের ন্যায় উদার, তাঁর প্রতিবেশী তাঁর ছোট এবং বড় আকারের দানশীলতা থেকে বঞ্চিত হয় না।
এই যুবকগণ নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত থেকেছে এবং তারা অভাবীদেরকে আহার্য দান কত।
তারা দান করেছে মোটা তাজা উটের গোশত এবং তার উপর চর্বির প্রলেপ, নিজেদের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে শত্রু ও হিংসুকের যে অসৎ পরিকল্পনা নিয়েছিল তা প্রতিরোধ করার জন্যে।
আমার দুঃখ ওই যুবকদের জন্যে। আমরা ওদের জন্যে শোক প্রকাশ করি। ওরা ছিল প্রদীপের ন্যায় ওরা ছিল নেতা, সেনাপতি অগ্রগামী ও দনিশীল ।
ওরা ধন-সম্পদের বিনিময়ে হলেও প্রশংসা অর্জন করতো। নিশ্চয় প্রশংসা একটি লাভজনক ও কল্যাণময় ব্যাপার। যখনই কোন চীৎকারকারী চাকরি করে, দুঃস্থ ব্যক্তি আহাজারী করে তারা তার ওই চীৎকার বন্ধের ব্যবস্থা কর ।
যারা প্রতিকূল সময়ে লক্ষ্য বস্তুতে তীর নিক্ষেপ করে যে, তাদের সওয়ারী মরুভূমির মরুধুলিতে পদ চিহ্ন একে যেত ।
ওরা যুদ্ধ করছিল, সে ছিল এমন একদল সওয়ারীর মধ্যে যাদের বক্ষ ছিল ঘর্মাক্ত । শেষ পর্যন্ত সে সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। এটি সহজলভ্য সাফল্য নয়।
হে হামযা! আপনি আমাকে একাকী রেখে গেছেন সেই বৃক্ষভালের ন্যায় শক্ৰণ যার পতাকাগুলো ঝরিয়ে ফেলেছে। আমি আপনার নিকট মনের দুঃখ প্রকাশ করছি। অথচ আপনার উপর রয়েছে বৃত্তাকার মাটির স্তূপ।
একটি বিরাট পাথর আপনার উপর রেখেছে কবর খননকারী লোকেরা যখন কবর খনন করেছে সুপ্রশস্ত মাঠে মাটি দিয়ে তারা ওই কবর ভরাট করেছে।
আমাদের শোক হল আমরা বলছি যে, কালের আবর্তনে সংঘটিত ঘটনায় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হৃয়েছেন।
সুতরাং সবাই আসুক, আমাদের শহীদানের জন্যে ক্রন্দন করুক । আমাদের সেসব শহীদান যারা কথায় ও কাজের প্রশংসাযোগ্য ও দানশীল।
যারা যুগ যুগ ধরে দুহাতে অঞ্জলি ভরে দান করে গিয়েছেন। ইবন হিশাম বলেন যে, উপরোক্ত পংক্তিমালা হযরত হাসসান (রা)-এর এটা অধিকাংশ নীজন স্বীকার করে না।
ইন ইসহাক বলেন যে, হযরত হামযা (রা) এবং অন্যান্য শহীদদের প্রতি শোক প্রকাশে হযরত কা’ব ইব্ন মালিক নিম্নের কবিতা বলেছেন :
তুমিতো চরম দুঃখে পতিত হয়েছ। ফলে তুমি নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছ। তুমি তো অস্থির হয়ে পড়েছ এজন্যে যে, তরতাজা নওজোয়ানগণ নিহত হয়েছেন ।
এখন তোমার অন্তর উদাসীন। তোমার উদাসীনতা অন্ধকারময়। তোমার সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং বেপরোয়াভাবে গোমরাহীর অনুসরণ ত্যাগ কর। তুমিতো বোকার মত গোমরাহীর অনুসরণে মত্ত ছিলে।
এখন সময় এসেছে তোমার আনুগত্যে উৎকর্ষ অর্জনের, অথবা পথ-প্রদর্শক মুরশিদ যখন তোমাকে মন্দ কাজ থেকে বারণ করছেন তখন সচেতন হবার। গাফলতী ঘুম ভাঙ্গার ।
হামযা (রা)-কে হারিয়ে তুমি চরমভাবে ধাক্কা খেয়েছ শংকিত হয়েছ। তোমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে।
তাঁর তিরোধানে হেরা পর্বত যদি কম্পমান হত, প্রকাশ্যে বেদনা দেখাতে পারত, তবে তুমি দেখতে পেতে যে, পর্বতের পাথরের মাথাগুলো সব ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে।
তিনি জননেতা, তিনি সম্ভ্রান্ত। তিনি বনূ হাশিম গোত্রে উচ্চাসনে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বনূ হাশিম গোত্র তো নবুওয়াত, দানশীলতা ও নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থল।
তিনি নেতা, গোত্রপতি, শক্তিমান, ভোরের বায়ু যখন পানিতে জমাট বাঁধা তখনও।
শক্তিমান অস্ত্রধারী শত্রুকে তিনি পরাজিত করে ছাড়েন, অবলীলাক্রমে যুদ্ধের দিনে। তাঁর তীর ও বর্শা শত্রু খুঁজে বেড়ায়।
তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ যে, লৌহ-বর্ম পরিধান করে তিনি বীরত্বের সাথে পায়চারি করছেন। সিংহের ফুলানো কে যেন ভর ঘাড়ে শোভা পাচ্ছে। তাঁর হাত যেন বাজ পির নখর। প্রচন্ড ক্রোধে তাঁর চোখ-মুখ রক্তিম।
তিনি নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর চাচা এবং তাঁর খাঁটি বন্ধু। তিনি মৃত্যু ঘটে উপস্থিত! ওই ঘাট কতই না উত্তম!
তিনি মৃত্যু ঘাটে উপস্থিত হয়েছেন এমন কতক লোকের দলে শামিল হয়ে যারা নবী (সা)-কে সাহায্য করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন শাহাদতের সৌভাগ্য লাভে ধন্য ব্যক্তিবর্গ।
এটি দ্বারা তিনি হিনদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি তার গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছিলেন। যার ব্যথা প্রশমিত হচ্ছিল না।
সেদিন সকালে আমরা তার সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম এক দূরবর্তী ময়দানে। সেদিন ওই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
সেদিন কাফির পক্ষের লোকদের চেহারা ওলট পালট করে দেয়া হয়েছিল বদরের কূপে। সেদিন আমাদের পতাকার নীচে জিবরাঈল (আ) ছিলেন আর ছিলেন মুহাম্মাদ (সা)
আমি তো সেদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুকাবিলায় ওদের নেতৃবৃন্দকে দেখেছি যে, ওরা দু’প্রকার হয়ে গিয়েছে। আমার যাকে ইচ্ছা হত্যা করছি আর যাকে ইচ্ছা তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম।
এরপর ওদের সত্তর জনের স্থান হয়েছে বদরের নোংরা গর্তে। তাদের মধ্যে রয়েছে উতবা ও আসওয়াজ।
এবং ওই নোংরা গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইবনুল মুগীরা। আমরা তাকে মেরেছি তার ঘাড়ের উপর প্রচন্ড মার।
এবং উমাইয়া জুমাহী, তার বাঁকা ঘাড় সোজা করে দিয়েছে একটি তরবারির আঘাত। তরবারিটি ছিল মুসলমানদের হাতে, ভারতীয় তরবারি।
এরপর পরাজিত মুশরিক সৈনিকরা আপনার নিকট এসেছে। তারা এবং তাদের অশ্বারোহীরা যেন পলায়নপর উটপাখি।
যারা চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে বসবাস করবেন তাদের চেয়ে দূরে বহু দূরে থাকবে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে বসবাসকারিরা।
ইবন ইসহাক বলেছেন, হযরত হামযা (রা) ও উহুদ যুদ্ধের অন্যান্য শহীদের শাহাদত বরণে শোক প্রকাশ করে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা) নিম্নের কবিতা আবৃতি করেন। ইবন হিশামের মতে এ পংক্তিগুলো আবু যায়দ কা’ব ইবন মালিকের। আল্লাহই ভাল জানেন।
আমার দুচোখ কেঁদেছে। কান্না করা তার জন্যে সংগত বটে। মূলত ক্রন্দন ও আহাজারিতে এখনতো আর কোন লাভ হচ্ছে না।
আমি কেঁদেছি আল্লাহর সিংহ হামযার (রা) জন্যে। যেদিন সকালে বলা হল এই কি হামযা! তোমাদের নিহত ব্যক্তি।
সেদিন সেখানে সকল মুসলমানই বিপদগ্রস্ত ও আহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজেও।
হে আবূ ইয়ালা! আপনার জন্যে বায়তুল্লাহ শরীফের স্তম্ভগুলো কেঁদেছে। আপনি মর্যাদাবান, পুণ্যময় ও আত্মীয়বৎসল ।
আপনার জন্যে জান্নাতে আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে সালাম ও অভিনন্দন। সাথে রয়েছে জান্নাতের অবিনশ্বর নিআমতসমূহ।
শুনে নিন হে ভাল মানুষদের ভাল মানুষ! ধৈর্য সহকারে শুনুন! আপনাদের সকল কাজ সুন্দর ও মহান।
রাসূলুল্লাহ (সা) ধৈর্যের অনুপম আদর্শ পরম দানশীল। তিনি যখন কথা বলেন, তা আল্লাহর বলে থাকেন।
কেউ আছ কি আমার পক্ষ থেকে লুওয়াই গোত্রকে জানিয়ে দেবে যে, আজ থেকে পরবর্তী সময়ের জন্যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই।
আজ দিনের পূর্বে ওরা আমাদের সম্পর্কে যা জেনেছে এবং যা ভোগ করেছে তাতে রুগ্ন-হৃদয় ব্যক্তির জন্যে প্রতিষেধক ছিল।
বদর কূপে তোমাদের উপর আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণ ও আঘাতের কথা তোমরা ভুলে গিয়েছ। সেই ভোর বেলার কথা যখন দ্রুত মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করেছিল।
সেই গোত্রের কথা ভুলে গিয়েছ যখন আবু জাহল হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছিল বদর প্রান্তরে । পাখী (কাক- চিল ও শকুন)-গুলো তার উপর চক্কর দিচ্ছিল।
উতবা এবং তার পুত্র দুজনে লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। আর শায়বা তীক্ষ্ণ ধার তরবারি তাকে কেটে খণ্ড খণ্ড করেছিল ।
তোমরা ভুলে গিয়েছ সেই কথা যে, উমাইয়াকে আমরা ভুলুণ্ঠিত করে ফেলে এসেছিলাম। অথচ তখনও তার বুকে বিদ্ধ ছিল তীর ও বর্শা।
বনূ রাবী’আ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে ওরা জিজ্ঞেস করে। বস্তুত আমাদের তরবারিতে রয়েছে ওদেরকে কর্তন করার চিহ্ন। কাটার ফলে তরবারি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
শুনে নাও, হে হিনদ! তুমি কেঁদেই যাও, তুমি দুঃখিনী তুমি অশ্রু বর্ষণকারিণী এবং তুমি উন্মাদ।
শুনে নাও, হে হিন্দ! হযরত হামযাকে (রা) হত্যা করে তুমি খুশি হয়ো না, আনন্দ প্রকাশ করো না। কারণ, তোমাদের জয় হল মূলতঃ পরাজয়ই। তোমাদের ইজ্জত হল বেইজ্জতি ও লাঞ্ছনার নামান্তর।
ইবন ইসহাক (রা) বলেছেন, হযরত হামযা (র)-এর শাহাদতের পর তাঁর বোন সাফিয়্যা (রা) বিনত আবদুল মুত্তালিব নিম্নের শোক গাঁথা আবৃত্তি করেন। সাফিয়্যা (রা) হলেন হযরত যুবায়র (রা)-এর মা এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ফুফু।
আমার বাবার মেয়েরা কি ভয়ে ভয়ে উহুদ যুদ্ধের শহীদানদের কথা জিজ্ঞেস করছে ও জ্ঞাত-অজ্ঞাত সবাইকে।
তখন যে ব্যক্তি ওয়াকিফহাল সে বলল যে, হামযা (রা) তো রাসূলাল্লাহ (সা)-এর উযীর রূপে নিয়োগ পেয়েছেন।
সত্য নাযিলকারী মা’বুদ আরশের মালিক মাবুদ তাকে ডেকেছেন জান্নাতের দিকে। তিনি সেখানে জীবিত থাকবেন এবং আনন্দে মগ্ন থাকবেন।
আমরা হযরত হামযা (রা)-এর জন্যে এটাই কামনা করেছিলাম যে, হাশর দিবসে তিনি সর্বোত্তম বাসস্থানের অধিকারী হবেন।
আল্লাহর কসম! পূবাল হাওয়া যত দিন প্রবাহিত হবে ততদিন আমি তোমাকে ভুলব না। আমার নিজ দেশে এবং সফর অবস্থায় সর্বাবস্থায় আমি তোমার জন্যে কাঁদবো ও শোক প্রকাশ করবো।
আমি কাদব এমন ব্যক্তির শোকে যিনি আল্লাহর সিংহ। যিনি নেতা। ইসলামের উপর আগত সকল কাফিরী আক্রমণ তিনি প্রতিহত করতেন।
হায় আমার দেহ ও হাঁড় যদি ওই ব্যক্তির নিকট থাকত যিনি প্রচণ্ড আক্রমণকারী ও বাজপাখী।
আমার প্রতিবেশীগণ তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করছে আর আমি বলছি যে, আমার ওই ভাই ও সাহায্যকারীকে মহান আল্লাহ্ উত্তম পুরস্কার ও বিনিময় দান করুন।
ইবন ইসহাক বলেন, শাম্মাস ইবন উছমানের স্ত্রী নুআম তার স্বামী নিহত হবার প্রেক্ষিতে নিম্নের শোকগাঁথা আবৃত্তি করেছেন। আল্লাহ্ ভাল জানেন সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে।
হে আমার চক্ষু অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ কর। অশ্রুপাত বন্ধ করো না। কেঁদে যাও এমন এক সম্ভ্রান্ত যুবকের জন্যে যে ছিল সৌখিন পোশাক পরিধানকারী।
তিনি অত্যন্ত মিষ্টভাষী, বিচক্ষণ এবং তার চরিত্র ও স্বভাব বরকতময় প্রশংসাৰ্হ। তিনি পতাকাবাহী অশ্বারোহী সৈনিক।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদদাতা যখন মৃত্যু সংবাদ জানাল তখন আমি অস্থি হয়ে বললাম, তাহলে একজন দানশীল ব্যক্তির মৃত্যু হল। একজন আহার্যদানকারী বস্ত্র প্রদানকারীর তিরোধান ঘটল।
তাঁর সাথে আমার উঠা বসা ও যখন শেষ হয়ে গেল তখন আমি বললাম, মহান আল্লাহ্ যেন শাম্মসের সাথে আমাদের দূরত্ব ও ব্যবধান সৃষ্টি না করেন।
ইবন ইসহাক বলেছেন, এই মর্সিয়া ও শোক গাঁথা শুনে তাঁর ভাই আবদুল হাকাম ইবন সাঈদ তাঁর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
সে তো তোমার ইজ্জত সম্মান বজায় রেখেছে সংবাদ রক্ষণ করেছে পদা ও আবরণের মাধ্যমে। কারণ সে নিজে ছিল অন্যতম লজ্জাশীল মানুষ ।
সে যখন আল্লাহর আনুগত্যে যুদ্ধ দিবসে জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছে তখন তুমি তার শোকে বিরহে নিজেকে ধ্বংস করনি।
হযরত হামযা ছিলেন আল্লাহর সিংহ। সেদিন তিনি ও শাম্মামের পেয়ালা থেকে পানীয় পান করেছেন- তিনিও শহীদ হয়েছেন। সুতরাং তুমি ধৈর্যধারণ কর ।
মুশরিকরা উহুদ যুদ্ধ থেকে ফিরে যাবার পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিনদ বিত উবা নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছিল?
আমি উহুদ ময়দান থেকে ফিরে এসেছি বটে; কিন্তু এখনো আমার বহু দুঃখ ও আক্ষেপ, কারণ, আমার যা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল তার সবটুকু পূর্ণ হয়নি।
বদর যুদ্ধে কুরায়শ বংশের বনূ হাশিম গোত্র ও ইয়াছবি অধিবাসীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছিল ওই সংঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতির প্রতিশোধ তো নিতে পারেনি ।
তবে কিছু প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। আমার এখানে আগমনের যতটুকু আশা করেছিলাম তার পুরোটা অর্জিত হয়নি।
এ প্রসংগে ইবন ইসহাক আরো বহু কবিতা উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘ হয়ে যাওয়া এবং বিরক্তি সৃষ্টি হওয়ার আশংকায় আমরা সেগুলো বাদ দিলাম। যা আমরা উল্লেখ করেছি তা-ই যথেষ্ট হবে। ইবন ইসহাক তাঁর গ্রন্থে যতগুলো কবিতা উল্লেখ করেছেন উমাভী তাঁর মাগাযী গ্রন্থে তার চেয়ে অধিক কবিতা উল্লেখ করেছেন। তাঁর নিয়ম এটাই ছিল! তাঁর উল্লিখিত কবিতাগুলো থেকে হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত (রা)-এর একটি কবিতা আমরা নিম্নে উল্লেখ করছি। উহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে হযরত হাসান (রা) বলেছেন :
ওরা তো শয়তানের আনুগত্য করেছে। শয়তান তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেছে। ফলে লাঞ্ছনা ও সাহসহীনতা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ওরা আবূ সুফিয়ানের সাথে সমস্বরে যখন চীৎকার করেছিল তখন তারা বলেছিল, হুবল প্রতিমার জয় হোক।
তখন আমরা সকলে সমস্বরে ওদের জবাব দিয়ে বলেছি “আমাদের দয়াময় প্রতিপালক সর্বোচ্চ সুমহান।
দাঁড়াও, তোমরা অতি সত্বর মৃত্যু কূপ থেকে তিক্ত পানি পান করবে। মৃত্যু তো প্রথম বার পান করাই।
জেনে রাখ যে, মৃত্যু ঘোড়ায় পাতিল ভর্তি করে, যখন তা ফুটানো হয় তখন ওই পাতিল টগবগ করে ফুটতে থাকে।
আবদুল্লাহ্ ইবন যাব’আরীর কবিতার উত্তরে হযরত হাসসান ইবন ছাবিত (রা) যে কবিতা বলেছিলেন উপরোক্ত পংক্তিগুলো ওই কবিতার অংশ বিশেষ।
অধ্যায়ঃ উহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে শেষ কথা
তৃতীয় হিজরীতে সংঘটিত ঘটনাবলী ও যুদ্ধ বিগ্রহ সম্পর্কে আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। ওই সব ঘটনার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ঘটনা হল উহুদ-যুদ্ধের ঘটনা, এটি সংঘটিত হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের মধ্য ভাগে। এর বিস্তারিত বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহর।
ঐ যুদ্ধে আবূ ইয়ালা (রা) ও শহীদ হন। তাকে আবূ উমারাও বলা হতো। ওই যুদ্ধে আল্লাহর সিংহ এবং রাসূলের সিংহ উপাধিপ্রাপ্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চাচা হামযা (রা) শহীদ হন। হযরত হামযা (রা) এবং আৰূ সালামা ইবন আবদুল আসাদ দু’জনই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুধ ভাই ছিলেন। আবূ লাহাবের দাসী ছুওয়ায় তাঁদের তিনজনকে স্তন্যদান করেছিলেন। বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ দ্বারা তা প্রমাণিত। এই তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, হযরত হামযা (রা) যে দিন শহীদ হন সে দিন তাঁর বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছিল। তিনি ছিলেন সাহসী বীর এবং প্রথম কাতারের সিদ্দীক। সেদিন তিনি সহ ৭০ জন সাহাবী (রা) শহীদ হন। ওই বছরই রাসূলের কন্যা হযরত উছমানের স্ত্রী রুকাইয়া (রা) ইনতিকাল করেন এবং তাঁর ইনতিকালের পর হযরত উছমান (রা) রাসূল-কন্যা উম্মু কুলছুম (রা)-কে বিবাহ করেন। এই আর্দ সম্পন্ন হয় তৃতীয় হিজরী সনের রবীউল আওয়াল মাসে। তাদের বাসর সম্পন্ন হয় ওই বছর জুমাদাল উখরা মাসে। বিষয়টি ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
ইবন জারীর বলেছেন, তৃতীয় হিজরীতে আলী ও ফাতিমা (রা)-এর পুত্র হাসানের জন্ম হয়। ওই বছরই ফাতিমা (রা) হুসায়নকে গর্ভে ধারণ করেন।