৬ষ্ঠ হিজরী সন

হিজরী ৬ষ্ঠ সনের ঘটনাবলী

বায়হাকী (র) বলেন : বলা হয়ে থাকে যে, এ বছর মুহাররম মাসে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামার নেতৃত্বে নজিদ অভিমুখে একটা বাহিনী প্রেরণ করা হয়। এ অভিযানে তাঁরা ছুমামা ইবন উছাল ইয়ামানীকে বন্দী করে আনেন। আমি বলি, কিন্তু ইবন ইসহাক (3) সাঈদ মাকবুরী সূত্রে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনিও এ বাহিনীতে শরীক ছিলেন। অথচ তিনি হিজরত করেন খায়বর বিজয়ের পর (হিজরী ৭ সালে) সুতরাং এটা পরের ঘটনা হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন। এটা এমন এক বছর যে বছরের প্রথম দিকে বনূ লিহইয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটাই বিশুদ্ধ মত। আর বনূ কুরায়যাকে পরাজিত করার ঘটনা ঘটে যিলকাদের শেষ এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম দিকে। আর এ হজ্জ মুশরিকদের তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় অর্থাৎ হিজরী পঞ্চম সালে, ইতিপূর্বেও এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ইবন ইসহাক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যিলহজ্জ মুহাররম, সফর এবং রবিউল আউয়াল এবং রবিউছ ছানী মাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং বনূ কুরায়যার অভিযানের ৬ মাসের মাথায় বনূ লিহয়ান অভিমুখে অভিযানে বের হন। তিনি রাজী এর শহীদ খুবায়র এবং তার সঙ্গীদের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বের হন। বাহ্যিকভাবে তিনি প্রকাশ করেন যে, তিনি শাম দেশের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছেন, যাতে অকস্মাৎ তাদের উপর হামলা চালাতে পারেন, ইবন হিশাম বলেন, তিনি ইবন উম্মে মাকতুমকে মদীনার প্রশাসকের দায়িত্বে নিযুক্ত করে যান। মোট কথা, নবী করীম (সা) তাঁদের আবাসস্থলের দিকে অগ্রসর হলে তারা পালিয়ে পাহাড়ের শীর্ষে গিয়ে নিজেদের সুরক্ষা করে। এরপর রাসূল করীম (সা) উছফানের দিকে গমন করেন। সেখানে একদল মুশরিকের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন এবং সেখানে সালাতুল খাওফ আদায় করেন। চতুর্থ হিজরী সনের ঘটনাবলীতে যুদ্ধ বিষয়ে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আর বায়হাকী (র) ও এ ঘটনা সেখানেই আলোচনা করেছেন। তবে ইবন ইসহাক (র) যা উল্লেখ করেছেন, তা-ই বেশী যুক্তিযুক্ত। আর তা হলো এই যে, এ ঘটনাটি খন্দক যুদ্ধের পরের আর এটা প্রমাণিত যে, নবী করীম (সা) বনূ লিহইয়ানের দিনে সেখানে সালাতুন খাওফ আদায় করেন। তাই সে আলোচনা সেখানে হওয়াই বিধেয়। মাগাযীর ইমাম (মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক)-এর অনুসরণ অনুসরণেই এটা হওয়া উচিৎ। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন :

যে ব্যক্তি মাগাযী তথা যুদ্ধ বিগ্রহ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে চায়, তাকে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। বনূ লিহইয়ান যুদ্ধ সম্পর্কে কা’ব ইবনূ মালিক (রা) বলেন :

বনূ লিহইয়ান যদি অপেক্ষা করতে তাহলে তারা নিজেদের অঞ্চলে সত্যপন্থী। দলের সঙ্গে সংঘাতে প্রবৃত্ত হতো। অনতিবিলম্বে তারা এমন দলের সঙ্গে সংঘাতে প্রবৃত্ত হতো, যাতে অন্তর হতো ভীত। ধ্বংস কর দলের সম্মুখে, যাদের তরঝরি চাকচিক্য নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। কিন্তু তারাতো ছিল যেন জঙ্গলের বিড়াল, মানুষ দেখে যারা গর্তে আশ্রয় নেয় ।

যূকারাদের যুদ্ধ

ইবন ইসহাক (র) বলেন : এরপর রাসূল করীম (সা) মদীনায় পদার্পণ করেন এবং মাত্র কয়েক দিন সেখানে অবস্থান করেন। শেষ পর্যন্ত উয়াইনা ইবন হিসন ফাযারীর নেতৃত্বে একটা বাহিনী ‘গাবা’ নামক স্থানে নবী করীম (সা)-এর দুধেল উষ্ট্রীর উপর হামলা চালায়। তথায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পক্ষ থেকে রাখাল রূপে বনূ গিফারের জনৈক ব্যক্তি সস্ত্রীক বসবাস করতো। হামলাকারীরা পুরুষটিকে হত্যা করে এবং উষ্ট্ৰীগুলোর সঙ্গে তার স্ত্রীকে নিয়ে যায়। ইবন ইসহাক (র) আসিম ইবন উমর— আব্দুল্লাহ্ ইবন কাব ইবন মালিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সালমা ইবন আমর ইবনুল আওয়া’ আসলামী এ হামলা সম্পর্কে সর্ব প্রথম জানতে পান। তীর-ধনুক নিয়ে তিনি গাবার দিকে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিল তালহা ইবন উবায়দুল্লাহর ভৃত্যও একটি ঘোড়া। ঘোড়া তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ছানিয়াতুল ওদা’ পৌঁছলে কাফিরদের কিছু অশ্বের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ে। সানা’ পর্বতের এক কিনারায় পৌঁছে তিনি চিৎকার করে বলেন, — হে সাবধান! তারপর তিনি হামলাকারীদের পেছনে ছুটে যান, তিনি ছিলেন নেকড়ের ন্যায় দ্রুতগামী । তিনি তাদেরকে নাগালে পেয়ে যান। আর তীর দ্বারা তাদেরকে আঘাত করতে করতে আবৃত্তি করেন :

তাদের পাকড়াও কর আর আমি হলাম আকওয়া তনয়, আর আজকের দিনটা হলো নীচ প্রকৃতির লোকদের বিনাসের দিন।

অশ্ববাহিনী তাঁর দিকে ছুটে এলে তিনি পিছিয়ে যেতেন। সুযোগ পেলে তিনি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতেন এবং তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুনরায় পূর্বোক্ত পংক্তি আবৃত্তি করবেন।

ইবন ইসহাক বলেন, তাদের কেউ একজন বলে উঠে; সে কি সারা দিন ধরে আমাদের উপর হামলা চালাবেন? ইবন ইসহাক বলেন : ইবনুল আকওয়া এর আহ্বান শুনে রাসূল করীম (সা) মদীনায় বিপদ সংকেত দেন : বিপদ! বিপদ!! তা শুনে মুসলিম ঘোড়সওয়াবরা তাঁর নিকট চলে আসেন। সর্ব প্রথম রাসূলের কাছে পৌঁছেন মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ । তারপর আব্বাস ইবন বির, সা’দ ইবন যায়দ এবং উসায়দ ইবন যহীর। তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ আছে- আরো পৌঁছেন উক্কাশা ইবন মিহসান, বনূ আসাদের মুহারিয ইব্ন নালা, বনু সালমার আবু কাবাহা হারিছ ইবন রিঈ এবং বনূ সুরাইকের আবু আয়্যাশ উবায়দ ইবন যায়দ ইবন সামিত। তিনি আরো বলেন, রাসূল করীম (সা)-এর সমীপে তাঁরা একত্র হলে সা’দ ইবন যায়দকে তিনি তাদের আমীর নিযুক্ত করে বললেন : দুশমনের খোঁজে বের হও; আমিও সদলবলে তোমাদের সঙ্গে যোগ দেবো।

বনী যুরায়কের একাধিক ব্যক্তি থেকে আমি জানতে পাই যে নবী করীম (সা) আবু আয়্যাশকে বলেছিলেন : হে আবূ আয়্যাশ! তুমি যদি তোমার ঘোড়াটি তোমার চাইতে দক্ষ অশ্বারোহীকে দান করতে। আর সে দুশমনের পেছনে ছুটতো (তাহলে কতইনা ভাল হতো)। আবৃ আয়্যাশ বলেন; তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সবচেয়ে দক্ষ ঘোড়সওয়ার। এরপর আমি ঘোড়া ছুটালাম। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি ৪০ গজও এগুতে পারিনি ঘোড়া আমাকে নিচে ফেলে দেয়। এতে আমি বিস্মিত হই। বনু যুরায়কের কিছু লোক মনে করে যে, রাসূল করীম (সা) আবু আয়্যাশের ঘোড়াটা মুআয ইবন মাইদ অথবা আইস ইবন মাইস ইবন কায়স ইবন খালদাকে দিয়েছিলেন। আর ইনি ছিলেন অষ্টম ঘোড়সওয়ার। আবার কেউ কেউ সালামা ইবন আওয়াকে অষ্টম ঘোড়সওয়ার মনে করেন এবং বলেন যে, অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে যাকে ফেলে দেয়, সে উসায়দ ইবুন যহীর। আসল ব্যাপার কি আর কে অষ্টম ছিলেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। তিনি বলেন, ঐ দিন সালামা ইবনুল আকওয়া ঘোড়ায় সওয়ার ছিলেন না। তিনি পদব্রজে ছুটে গিয়েই দুশমনের সঙ্গে মিলিত হন। ইব্‌ন ইসহাক (র) বলেন, ঘোড়সওয়াররা বের হলেন। এবং ছুটে গিয়ে দুশমনের নাগাল পেলেন। আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা সূত্রে তিনি বলেন যে, সর্ব প্রথম যে ঘোড় সওয়ার ছুটে গিয়ে দুশমনের সঙ্গে মিলিত হন তিনি ছিলেন মুহরিম ইবন নাযলা। আর তাকে আখরাম নামে অভিহিত করা হতো অথবা তাকে কুমায়র বলা হতো। যে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি গমন করেন, তা ছিল মাহমূদ ইবন মালামার। আর এই ঘোড়াকে বলা হতো যুল লুম্মা। মুহূরম দুশমনের কাছে পৌঁছে তাদেরকে বললেন : হে বনূ লুকায়্যার লোকেরা! তোমরা অপেক্ষা কর; পেছন দিক থেকে মুহাজির আনসাররা এসে তোমাদের সাথে মিলিত হোন। ইবন ইসহাক বলেন, একথা শোনার পর দুশমনদের একজন হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে। আর ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায়, তাকে পাকড়াও করা যায়নি। নিহত ব্যক্তির ঘোড়াটি ছুটে যায় এবং বনূ আবদুল আশহালের বাগানে গিয়ে থামে। এটাই ছিল মদীনায় তাদের আস্তাবল । ইবন ইসহাক বলেন, সে দিন মুসলমানদের মধ্যে তিনি ব্যতীত আর কেউ নিহত হননি। অবশ্য ইবন হিশাম বলেন যে, একাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেন যে, সেদিন তার সঙ্গে ওয়াক্কাস ইবন মুজযান মুছলাজীও নিহত হন। ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ্ ইবন কা’ব ইবন মালিক সূত্রে বলেন যে, মুহরিয উক্কাশা ইবন মিহসানের ঘোড়ায় সওয়ার ছিলেন, যাকে বলা হতো ‘জানাহ’। মুহরিয নিহত হন এবং জামাহ নামক ঘোড়াটি ছিনতাই করা হয়। আল্লাহই ভাল জানেন। তিনি আরো বলেন যে, ঘোড় সওয়ার দুশমনের সঙ্গে মিলিত হলে আবু কাতাদা হাবীব ইবন উয়াইনাকে হত্যা করে তাকে চাদর দ্বারা ঢেকে রাখেন এবং এরপর লোকজনের সঙ্গে যোগ দেন। তারপর রাসূল করীম (সা) মুসলমানদের সঙ্গে এসে যোগ দেন। ইবন হিশাম বলেন যে, ঐ সমষ রাসূল করীম (সা) ইবন উম্মে মাকতুমকে মদীনায় প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এ সময় লোকজন হাবীবকে আবু কাতাদার চাদরে আবৃত দেখে ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন। তারা বলেন, আবু কাতাদা নিহত হয়েছেন। তখন রাসূল করীম (সা) বললেন না, সে আবু কাতাদা নয়, বরং সেতো আবু কাতাদার হাতে নিহত ব্যক্তি। আবু কাতাদা তার উপর চাদর স্থাপন করেছে, যাতে জানা যায় যে, সেই তার হত্যাকারী । তিনি আরো বলেন যে, উক্কাশা ইবন মিহছান আওবার এবং তার পুত্র আরকে একই উষ্ট্রের উপর সওয়ার পান এবং উভয়কে তীর নিক্ষেপে বধ করেন। তারা তাদের কিছু উট নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তিনি আরো বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ চলতে চলতে যিকারাদ এর একটা পাহাড়ে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সাহাবীগণও তাঁর সঙ্গে সেখানে গিয়ে মিলিত হন। তিনি সেখানে এক দিন এক রাত অবস্থান করেন। সালামা ইবনুল আকওয়া তাঁকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি আমাকে একশ’জন লোক সাথে দিয়ে পাঠান তবে আমি বাকী উটগুলোও নিয়ে আসতে পারতাম। আর ঘাড়ে ধরে ওদের লোকদেরকেও ধরে আনতাম। আমার কাছে যে বর্ণনা এসেছে সে মতে তখন নবী করীম (সা) বললেন :

এখন তারা গাতফান গোত্রে পৌঁছে গেছে এবং তাদের মেহমানদারী করা হচ্ছে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গী সাথীদের মধ্যে গনীমতের মাল বণ্টন করেন এবং প্রতি একশজন লোকের মধ্যে অনেকগুলো উট বন্টন করেন এবং সেখানে কয়েকদিন অবস্থান শেষে মদীনার উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন।

তিনি আরো বলেন যে, গিফার গোত্রের এক নারী রাসূল করীম (সা)-এর উটনীতে আরোহণ করে মদীনায় আগমন করে। সেই মহিলাটি রাসূল (সা) কে এই খবরটি দেন। মহিলাটি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি মানত করছি যে, আল্লাহ আমাকে নাজাত দিলে মানে নিরাপদে পৌঁছালে আমি উটনীটি যবাই করবো। মহিলার কথা শুনে রাসূলে মাকরূল (সা) হেসে বললেন : তুমি উটনীটিকে কতইনা নিকৃষ্ট প্রতিদান দিলে। কারণ, আল্লাহ্ তোমাকে তার উপর সওয়ার করান এবং তার সাহায্যে তোমাকে নাজাত দিলেন, আর এত সবের পর তুমি তাকে জবাই করার মানত করলে? জেনে রেখো, আল্লাহর নাফরমানীতে কোন মানত নেই। তুমি যে জিনিসের মালিক নও, সে ব্যাপারেও মানত করার অবকাশ নেই। সেটিতো আমার উটনী। আল্লাহর বরকত নিয়ে তুমি স্বজনদের মধ্যে ফিরে যাও! ইবন ইসহাক (র) বলেন : এ ব্যাপারে আবু যুবায়র মাক্কী সূত্রে হাসান বসরীর বরাতে হাদীছ বর্ণিত আছে। ইবন ইসহাক (র) সনদসহ কাহিনীটি এভাবে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী (র) হুদায়বিয়ার পরে এবং খায়বরের আগে যূকাবাদ যুদ্ধের উল্লেখ করেছেন। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় খায়বর যুদ্ধের তিন দিন পূর্বে; যাতে দুশমনরা রাসূল করীম (সা)–এর উটনী লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। ইমাম বুখারী (র) কুতায়বা ইবন সাঈদ (র)— সালামা ইবনুল আকওয়া’ সূত্রে বর্ণনা করেন :

তিনি বলেন, প্রথম আযানের (ফজরের) আগে আমি (ঘর থেকে বের হই। তখন রাসূল করীম (সা)-এর উটনীগুলো ছিল যী কারাদ-এর চারণ ভূমিতে। পথে আবদুর রহমান ইবন আওফের এক ভৃত্যের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি বললেন, রাসূল করীম (সা)-এর উটনীগুলো লুট করে নিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম; কে নিয়ে গেছে? তিনি বললেন, গাতফান গোত্রের লোকেরা। তিনি বলেন । এরপর আমি [ ] বলে তিন দফা চিৎকার করি। আমার চিৎকারের শব্দ মদীনার সকলকে শোনাই। তারপর আমি ছুটে যাই এবং তাদের নাগাল পেয়ে যাই। তারা তখন পানি পান করছিল। আমি তাদেরদিকে তীর নিক্ষেপ করলাম আর আমি ছিলাম দক্ষ তীরন্দায়। এ সময় আমি বলছিলাম :

আমি হলাম আকওয়া তনয়, আর আজকের দিনটি হলো নীচ লোকদের বিনাশের দিন। এ কথাগুলো আমি সুর করে গানের মতো আবৃত্তি করছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের নিকট থেকে উটনীগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হই। এছাড়াও আমি তাদের নিকট থেকে ৩০ খানা চাদরও ছিনিয়ে আনি। তিনি বলেন, তারপর রাসূল করীম (সা) এলেন এবং লোকজনও উপস্থিত হলো। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিতো তাদেরকে পানি পান করতে বাধা দিয়েছি। তারা পিপাসার্ত। তখনই তাদের প্রতি লোক প্রেরণ করান। তখন রাসূল করীম (সা) বললেন :

হে ইবনুল আকওয়া’, যখন তুমি বিজয়ী হয়েছে তখন উদার হও। তারপর আমরা ফিরে আসি এবং রাসূল করীম (সা) আমাকে তার নিজের উটনীতে সহযাত্রী করলেন। অবশেষে আমরা মদীনা পৌঁছলাম। অনুরূপভাবে মুসলিম কুতায়বা সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (র) ও আবু আসিম সুহালী–… আবূ উবায়দার আযাদ করা গোলাম সালামা সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (র) হাশিম ইব্‌ন কাসিম– সালামা ইবনুল আকওয়া সূত্রে বর্ণনা করেন হুদায়বিয়ার যমানায় আমরা রাসূল করীম (সা)-এর সাথে মদীনায় আগমন করি । একদিন আমি এবং রাসূল করীম (সা)-এর ভৃত্য রাবাহ রাসূলের সওয়ারী নিয়ে (মদীনায়) বাইরে গমন করি । এবং আমি তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ ঘোড়া নিয়ে বের হই। উদ্দেশ্য ছিল উটনীর সঙ্গে ঘোড়াকেও পানি পান করানো ও মাঠে চরানো। অন্ধকার থাকতেই আবদুর রহমান ইবন উয়ায়না রাসূল করীম (সা)-এর উটের উপর হামলা চালায়। সে উটের রাখালকে হত্যা করে এবং সে-ও তার সঙ্গে অন্যরা উটগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। আমি তখন বললাম, হে রাবাহ! ঘোড়ার পিঠে চড় এবং তালহার সঙ্গে মিলিত হয়ে রাসূল করীম (সা)-কে খবর দাও যে, তাঁর পশুগুলো লুট হয়ে গেছে। রাবী বলেন, আমি একটা উচ্চস্থানে আরোহণ করে মদীনার দিকে মুখ করে তিনবার ধ্বনি দেই, এরপর শত্রুরা পিছু ছুটে যাই তরবারী আর তীর ধনুকসহ আমি তীর নিক্ষেপ করতে থাকি আর তাদের বাহনকে আহত করতে থাকি। ঐ সময় সেখান পর্যাপ্ত পরিমাণ গাছপালা ছিল। কোন ঘোড় সওয়ার আমার দিকে ছুটে এলে আমি গাছের আড়ালে আত্মগোপন করতাম। তারপর আবার তীর ছুড়তাম। আমার দিকে কোন ঘোড় সওয়ার এগিয়ে এলে আমি তাকে তীর নিক্ষেপে আহত করতাম। এ সময় আমি আবৃত্তি করছিলাম ।

“আমি হলাম ইবনুল আকওয়া, আজকের দিনটি নীচাশয় লোকদের ধ্বংসের দিন।” তিনি বলেন, আমি শক্রর কোন লোকের নিকটবর্তী হলে তাকে তীর নিক্ষেপ করতাম, যা তার বাহন ভেদ করে তার কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছতো। তখন আমি বলতাম–

তাকে পাকড়াও কর, আমি হচ্ছি ইবনুল আকওয়া’,
আজকের দিনটি তো নীচ লোকদের ধ্বংসের দিন।

যখন আমি বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত আগুনে থাকতাম, তীর নিক্ষেপ দ্বারা তাদের দেহ ঝাঁজরা করে ফেলতাম, আবার যখন গিরিপথ সামনে পড়তো তখন আমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করতাম। আমার এবং তাদের দশা এমনই ছিল যে, আমি একাধারে তাদের অনুসরণ করছিলাম আর সুর করে কবিতা আওড়াচ্ছিলাম। এমনকি রাসূল করীম (সা)-এর সবগুলো উটকেই আমি আমার পেছনে নিয়ে আসি এবং তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেই। এরপরও আমি অব্যাহত ধারায় তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে চলোম। এমন কি তারা বোখা হালকা করার মানসে ত্রিশটি বর্শা এবং ত্রিশটি চাদর ফেলে যায়। আর তারা যা কিছু নিক্ষেপ করতো তার উপর আমি প্রস্তর স্থাপন করতাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের আগমন পথে সেসব কিছু একত্র করে রাখতাম।

শেষ পর্যন্ত বেলা উঠলে উয়ায়না ইবন বদর ফাযারী তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। তখন তারা ছিল একটা সংকীর্ণ গিরিপথে। এরপর আমি পাহাড়ে চড়ে তাদের উপরে অবস্থান নেই এ সময় উয়ায়না বললোঃ আমি এটা কি দেখছি? তারা বললোঃ আমরা এমনই এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। ভোর রাত থেকে এখন পর্যন্ত লোকটি আমাদের পিছু ছাড়েনি। আমাদের নিকট যা কিছু ছিল তার সবই সে ছিনিয়ে নিয়ে তার পেছনে রেখে দিয়েছে। তখন উয়ায়না বলে সে যদি এটা না দেখতো যে, তার পশ্চাৎ থেকে সাহায্য আসছে তাহলে সে তোমাদেরকে ত্যাগ করে চলে যেতো। তোমাদের কিছু লোক তাদের সন্মুখে দাঁড়াক। তাদের মধ্য থেকে চারজন সমুখে এগিয়ে আসে এবং পাহাড়ে আরোহণ করে। আমি তাদেরকে নিয়ে শুনিয়ে বললাম, তোমরা কি আমাকে চিনতে পারছ? তারা বললোঃ কে তুমি? বললাম, আমি ইবনুল আফওয়া’। সে সত্তার শপথ, যিনি মুহাম্মাদের চেহারাকে সম্মানিত করেছেন। তোমাদের মধ্যে যে কেউ আমার পশ্চাদ্ধাবন করবে সে আমাকে পাকড়াও করতে পারবেনা। পক্ষান্তরে আমি যার পশ্চাদ্ধাবন করবো সে আমার হাত থেকে পালাতে পারবে না। তাদের এক ব্যক্তি বললো, হবেও তা, তিনি বলেন, আমি আমার অবস্থানে স্থির থাকলাম। এমন সময় রাসূল করীম (সা)-এর অশ্বারোহীদের প্রতি আমার নজর পড়ে। গাছের ফাঁক দিয়ে তারা এগিয়ে আসছিলেন। তাঁদের মধ্যে সকলের অগ্রভাগে ছিলেন আখরাম আল- আসাদী আর তাঁর পশ্চাতে ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ঘোড় সওয়ার আবু কাতাদা। আর তার পেছনে ছিলেন মিকদাদ ইবন আসাদ আল-কিন্দী। তখন মুশরিকরা পেছনের দিকে ছুটে পালায়। আমি পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসি এবং আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরি। বলি : আখরাম! তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে । আমার আশংকা হয়। তারা তোমাকে হত্যা করবে। তুমি রাসূল করীম এবং তার সাহাবীদের আগমন পর্যন্ত একটু অপেক্ষা কর। তিনি বললেন : সালামা! আল্লাহ্ তা’আলা এবং শেষ দিনে তোমার যদি ঈমান থাকে আর তোমার যদি বিশ্বাস হয় যে, জান্নাত-জাহান্নাম সত্য তাহলে আমার আর শাহাদতের মধ্যস্থলে তুমি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়োনা।

ইবন ইসহাক বলেন : তখন আমি তাঁর ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দেই। ফলে তিনি আবদুর রহমান ইবন উয়ায়নার মুখোমুখী হন। আর আবদুর রহমানও তার প্রতি ফিরে দাঁড়ায়। উভয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। আখরাম আবদুর রহমানকে আঘাত করেন এবং আবদুর রহমান তীর নিক্ষেপে তাকে হত্যা করে। এর ফলে আবদুর রহমান আখরামের ঘোড়ায় চড়ে বসে। তারপর আবু কাতাদা আবদুর রহমানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ান, পরস্পরে একে অন্যের উপর আঘাত হানেন! সে আবু কাতাদার ঘোড়াকে আহত করে। আৰু কাতাদা আবদুর রহমানকে হত্যা করেন এবং আখরামের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হন।

এরপর আমি শকবাহিনীর পশ্চাতে ছুটে যাই; এমনকি আমি নবী করীম (সা)-এর সাহাবীদের ঘোড়ার পায়ের ধুলোতেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। সূর্যাস্তের পূর্বে শত্রুরা একটা ঘাটিতে পৌঁছে, যেখানে পানি ছিল। এর নাম ছিল মূ-কারাদ। শত্রুপক্ষ সেখানে পানি পান করতে চেয়েছিল; কিন্তু পেছন দিক থেকে আমাকে ছুটে আসতে দেখে, তারা পেছনে সরে দাঁড়ায় এবং সানিয়া যী বির–এর দিকে মোড় নেয় এবং সেখানেই সূর্য অস্তমিত হয়। এসময় এক ব্যক্তির কাছে গিয়ে আমি তাকে তীর নিক্ষেপ করে বলি ।

তাকে পাকড়াও করো আর আমি হলাম আওয়া” এর পুত্র আর আজকের দিনটি হল নিশ্চয় লোকদের বিনাশ করার দিন! সে বললো, আকওয়া এর মা তার জন্য রোদন করুক। সকালের সেই আওয়া’ আমি বললাম; হাঁ রে নিজের দুশমন! ভোরবেলা আমি তাকে তীর নিক্ষেপ করেছিলাম এবং এরপর আরো একটা তীর ছুড়ি; ফলে তার দেহে দুটি তীর বিদ্ধ হয়। আর তারা রেখে যায় দুটি ঘোড়া । আমি সে ঘোড়া দুটি হাকিয়ে রাসূল করীম (সা)-এর কাছে নিয়ে যাই। পানির যে কূপের কাছ থেকে আমি তাদেরকে উচ্ছেদ করেছিলাম। তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। অর্থাৎ মূ-কারাহ কুয়ার কাছে। তখন নবী করীম (সা) ছিলেন পাঁচশ’ জন সাহাবী পরিবেষ্টিত। আর বিলাল (রা) আমার ফেলে আসা উটের মধ্য থেকে একটা উট যবাই করেন। এবং তিনি রাসূল করীম (সা)-এর জন্য উটের কলিজা ও কুজের গোশত ভুনছিলেন। আমি রাসূল করীম (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলাম; ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি আপনার সাহাবীগণের মধ্যে থেকে একশজনকে বাছাই করে নেবো এবং রাতের অন্ধকারে আমি কাফিরদেরকে পাকড়াও করবো এবং তাদের মধ্যে একজন গুপ্তচরও অবশিষ্ট থাকবে না, আমি তাদের সকলকেই হত্যা করবো। আমার কথা শুনে রাসূল করীম (সা) বললেন : সালামা! তুমি কি তাই করবে? আমি বললাম, জী হাঁ। যে সত্তা আপনাকে সম্মানিত করেছেন তাঁর শপথ করে বছি। এতে রাসূল করীম (সা) হেসে ফেললেন; এমন কি আগুনের আলোতে আমি তাঁর মাড়ির দাঁত দেখতে পেলাম। এরপর তিনি বললেন, গাতফান গোত্রের ভূমিতে এখন তাদের মেহমানদারী চলছে। তখন গাতফান গোত্রের জনৈক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে বললো : তারা অমুক গাতফানীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছে। সে তাদের জন্য উট যবাই করেছে। তারা বসে উটের চামড়া খসাচ্ছিল এমনি সময় গিয়ে তারা ধূলাবালি উড়তে দেখতে পেয়ে ছেড়ে ছুটে পালায়। ভোর হলে রাসূল করীম (সা) বললেন : আমাদের ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে আবু কাতাদা সর্বোত্তম; আর পদাতিকদের মধ্যে সর্বোত্তম হল সালামা। তাই রাসূল করীম (সা) আমাকে ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক উভয়ের অংশ দান করলেন। তারপর মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে তিনি তাঁর নিজের উটনী ‘আযবার পিঠে আমাকে সহযাত্রী করলেন। যখন আমাদের আর মদীনার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব অবশিষ্ট ছিল এবং লোকদের মধ্যে একজন এমনও ছিল, যে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হতো না সে। ডাক দিয়ে বলছিল; কোন প্রতিযোগী আছে কি? মদীনা পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার মতো কেউ আছে কি? কথাটা সে বারবার উচ্চারণ করছিল। আর আমি ছিলাম রাসূল করীম (সা)-এর পেছনের সহযাত্রী। আমি তাঁকে বললাম : তুমি কি কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সম্মান করনা আর কোন শরীফ ব্যক্তিকে ভয় কর না? সে বললোঃ রাসূল করীম (সা) ব্যতীত অন্য কাউকে আমি সম্মানও করি না আর ভয়ও করি না। আমি আরয করলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা কুরবান হোন, আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে। তিনি বললেন : তোমার ইচ্ছা হলে নামতে পার। আমি তাকে বললাম, আমি তোমার দিকে আসছি। সে সওয়ারী থেকে লাফিয়ে পড়লো, আর আমিও উটনীর পিছন থেকে লাফিয়ে পড়লাম। এরপর আমি এক বা দুই টিলা পেছনে রইলাম অর্থাৎ দম রাখার জন্য ধীর গতিতে এগুলাম। তারপর দ্রুত ও দৌড়ে গিয়ে তার সঙ্গে মিলিত হলাম এবং তার দু’ স্কন্ধের মধ্যস্থলে একটা ঘুষি মেরে বললাম, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি, অথবা এরকম কোন কথা বললাম। আমার কথা শুনে সে হেসে বললোঃ আমিও তো তাই মনে করছি। এভাবে আমরা মদীনায় গিয়ে পৌঁছলাম। মুসলিম (4) ইকরিমা ইবন আম্মার থেকে বিভিন্ন সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তাতে উল্লেখ আছে যে, আমি তার আগে মদীনা পৌঁছি এবং তিনদিন অবস্থান করেই আমরা খায়বারের উদ্দেশ্যে বের হই। এ সূত্রে ইমাম আহমদ (র) থেকেও হাদীছ বর্ণিত আছে। বুখারী এবং বায়হাকী হুদায়বিয়ায় পর এবং খায়বরের আগে এ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনার তুলনায় এটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন। সুতরাং সপ্তম হিজরীর ঘটনাবলীর সঙ্গে তার উল্লেখ করাই হবে সমীচীন। কারণ, সপ্তম হিজরীর সফর মাসে খায়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। অবশ্য, সে মহিলাটি নবী করীম (সা)-এর উটনীতে আরোহণ করে রক্ষা পেয়ে তা যবাই করার মানত করেছিল। ইমাম ইবন ইসহাক (র) হাসান বসরী সূত্রে আবুয যুবায়র এর বরাতে বিচ্ছিন্ন সনদে তা বর্ণনা করেছেন। অবশ্য অন্যান্য সূত্রে অবিচ্ছিন্ন সনদে হাদীছটি বর্ণিত আছে।

ইমাম আহমদ (র) আফফান (র)– ইমরান ইব্‌ন হুসাইন সূত্রে বর্ণনা করে বলেন যে, আম্বা উটনীটি ছিল বনূ আকীলের জনৈক ব্যক্তির। এটি হাজীদেরকে নিয়ে দ্রুত গতিতে আগে আগে ছুটে যেত। সে লোকটাসহ আযৰা উটনীকে ধরে আনা হয়। ইমাম আহমদ (র) আরো বলেন যে, লোকটি যখন বাঁধা ছিল তখন ইমাম আহমদ (র) নবী করীম (সা) তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে লোকটি জিজ্ঞাসা করে। হে মুহাম্মাদ! আমাকে এবং যাত্রীদলের অগ্রগামী বাহনটাকে আপনি কেন আটক করলেন। রাসূল করীম (সা) এ সময় তার খচ্চরের উপর সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলেন। আর জবাবে তিনি বললেন, আমরা তোমাকে গ্রেফতার করেছি তোমাদের মিত্র গোত্র ছাকীফ এর অপরাধের কারণে। তিনি বলেন যে, ছাকীফ গোত্র নবী করীম (সা)-এর দু’জন সাহাবীকে বন্দী করে রেখেছিল। সে তার বক্তব্যে বলেছিল, আমি তো একজন মুসলমান। রাসূল করীম (সা) তখন বললেন : তুমি যদি বন্দী হওয়ার আগে স্বাধীন থাকাকালে এ কথা বলতে তাহলে তো তুমি সফলই হতে।

এ কথাটি বলে রাসূল করীম (সা) স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হলে সে বললো : হে মুহাম্মাদ! আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে আহার্য দিন। আমি পিপাসার্ত। আমাকে পানি পান করান। তখন নবী করীম (স) বললেন : এই তোমার প্রয়োজন। এরপর তিনি পূর্বোক্ত দুব্যক্তির ফিদিয়া বা বিনিময় স্বরূপ তাকে মুক্ত করে দিলেন এবং আম্বা উটনীটি নিজের বাহনের জন্য রেখে দিলেন। ইমাম আহমদ (র) আরো বলেন যে, মুশরিকরা যখন মদীনায় রাসূল (সা)-এর পশুপালে হামলা চালায় তখন তারা গুষ্ঠিত পশুপালের সঙ্গে আবা উটনীও নিয়ে যায়। উপরন্তু তারা একজন মুসলিম মহিলাকেও ধরে নিয়ে বন্দী করে রাখে। তিনি আরো বলেন যে, তারা কোন মনযিলে অবস্থান করলে মনযিলের আঙ্গিনায় উটগুলো চারণের জন্য ছেড়ে দিতো। এক রাত্রে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মহিলাটি উঠে উটনীটির কাছে গেলে উটনীটি আওয়ায দিল। মহিলাটি আবা নামক উটনীর কাছেও যায়। এটি ছিল অত্যন্ত অনুগত ও শান্তশিষ্ট। মহিলাটি আবার পিঠে সওয়ার হয়, তাকে মদীনার দিকে ছুটায় এবং মানত করে যে, আগাহ্ তাকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছালে সে এটিকে আল্লাহর নামে যবাই করবে। মদীনায় পৌঁছলে জানা যায় যে, এটি রাসূল করীম (সা)-এর বহুল পরিচিত উটনী। মহিলাকে বলা হয় যে, এটি রাসূল করীম (সা)-এর উটনী । তার মানত সম্পর্কে রাসূল করীম (সা) জানতে পারলেন, অথবা মহিলা নিজেই রাসূল (সা)-কে জানালেন, তখন তিনি বললেন : তুমি সে উটনীটিকে নিকৃষ্ট প্রতিদান দিলে, অথবা তিনি বললেন যে, মহিলাটি তাকে নিকৃষ্ট প্রতিদান দিল। আল্লাহতো সে উক্লীর উপর সওয়ার করিয়ে তাকে মুক্তি দিলেন আর সে মুক্তি পেয়ে তাকে যবাই করতে উদ্যত। তারপর তিনি (সা) বললেন : আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে মানত পূরণ করতে হয় না; আদম সন্তান যে বস্তুর মালিক নয়, সে ক্ষেত্রেও মানত সিদ্ধ হয় না (আর তা পূরণও করতে হয় না) ইমাম মুসলিম (র) আবুর রাবী যাহরানী সূত্রে হাম্মাদ ইবন যায়দের বরাতে হাদীছটি বর্ণনা করেন।

ইবন ইসহাক (র) বলেন : যি-ফারাদ যুদ্ধ সম্পর্কে যে সব কাব্য রচিত হয়েছে, তন্মধ্যে হাসান ইবন সাবিতের নিম্নোক্ত কবিতাও উল্লেখযোগ্য–

মর্মার্থ : ছায়ার দক্ষিণে কাল যদি আমাদের ঘোড়া ব্যস্ত না থাকতো, তাহলে সে আসতো তোমাদের নিকট সশস্ত্র শীর্ষ ব্যক্তিবর্গকে পৃষ্ঠে সওয়ার করে।

আমরা মিকদাদের ঘোড়সওয়ারদের হাতে ন্যস্ত- এতে বংশ পরিচয় হীন লোকেরা আনন্দিত হয়।

আমরা ছিলাম আটজন (অশ্বারোহী) আর তারা ছিল বিশাল বাহিনী, যাদেরকে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে বর্শার আঘাতে।

আমরা এমন সম্প্রদায়ের লোক যারা ছিল তাদের নিকটবর্তী কুলীন অশ্বের লাগাম ধরে তারা সম্মুখে এগিয়ে যায়।

কক্ষনো না, সেসব সওয়ারীদের পালনকতার শপথ, যারা মিনারপথে গমনকালে সুউচ্চ পার্বত্য পথ অতিক্রম করে চলে।

এমনকি উন্নত মানের অশ্ব তোমাদের গৃহের আঙ্গিনায়, আর আমরা প্রত্যাবর্তন করবো বন্দিনী আর সন্তানদেরকে নিয়ে।

ধীরে-সুস্থে চলতে চলতে এক একটি চপল-চঞ্চল অশ্বকে, যা ছুটে যায় প্রতিটি লড়াইয়ের ময়দানে আর প্রতিটি উপত্যকায়।

বিনাশ করেছে সেসব অশ্বের পশ্চাদৃদেশকে আর উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে সেগুলোর পৃষ্ঠদেশ; যে দিন সেগুলো চালিত হবে আর নিক্ষেপ করা হবে তীর।

অনুরূপভাবে আমাদের কুলীন অশ্বগুলো বয়সে তরুণ আর যুদ্ধতে তীব্র হয়ে উঠে ভোরের বাতাসে।

আর আমাদের তরবারিগুলো লোহার উজ্জ্বল্যকে স্পষ্ট করে।

লোহার মরিচা দূর করে আর যুদ্ধংদেহীর শির কর্তন করে।

গ্রহণ করেছেন আল্লাহ্ তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার, হামের মর্যাদা রক্ষায় এবং আল্লাহর সম্ভ্রম রক্ষায় তারা ছিল নিজ দেশে সুখে-শান্তিতে, এরপর বদলে দি যু-কারার যুদ্ধের কারণে অবাধ্যতার চেহারা।

ইবন ইসহাক (র) বলেন যে, (এ কবিতাগুলো শুনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি অগ্রগামী অশ্বারোহী বাহিনীর আমীর হযরত সাদ ইব্‌ন যায়দ (র) ক্রোধান্বিত হলেন হাসান (ইন সাবিত)–এর প্রতি এবং হলফ করে বললেন যে, তিনি কখনো হাসানের সঙ্গে কথা বলবেন না। তিনি বলেন যে, হাসানতো আমার অশ্ব ও অশ্বারোহীদের নিকট গিয়ে সেসবকে মিকদাদের বলে সাব্যস্ত করেছেন। তখন হাসসান তাঁর নিকট ওখাহী করেন যে, তিনি নামই কেবল অন্তমিলের জন্য ব্যবহার করেছেন মিকদাদের। তখন হযরত সা’দ ইব্‌ন যায়দ (র)-এর প্রশংসায় হাসান (রা) নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন :

তোমরা যখন সুদৃঢ় ব্যক্তি বা অমুখাপেক্ষী ব্যক্তির অভিপ্রায় করবে তখন অবশ্যই সা’দ (ইন যায়দ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। কারণ, তাঁকে দমানো যায় না।

ইবন ইসহাক (র) বলেন যে, তার দ্বারা এটা ঘটেনি, অর্থাৎ তিনি এ ওর আপত্তি গ্রহণ করেননি। তখন হাস্সান ফি-কারাদের যুদ্ধ সম্পর্কে নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন —

উয়ায়না কি ধারণা করেছিল যে, মদীনায় আগমন করে সে প্রাসাদ ধূলিসাৎ করে দেবে? যে কথা তুমি সত্য বলে স্বীকার কর, আমি তা মিথ্যা বলি।

তোমরাতো বলেছিলে আমরা বিরাট গনীমত লাভ করবো। তুমি মদীনায় গিয়ে তাকে অনুকূল পেলে না,

তখন তুমি সেখানে অনুভব করলে সিংহের গর্জন। তখন তারা প্রত্যাবর্তন করে উট পাখির দৌঁড়ের মতো।

আর তারাতো উন্মুক্ত করেনি কোন উদ্ভাগারের দ্বারও। মহান আল্লাহর রাসূল আমাদের আমীর, তিনি আমাদের কত প্রিয় আমীর।

তিনি এমন এক রাসূল তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয় তিনি তার সত্যায়ন করেন। আর তিনি তিলাওয়াত করেন উজ্জ্বল আলোকময় কিতাব।

হযরত কা’ব ইবন মালিক (র) যি-কারাদের যুদ্ধের দিন মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর প্রশংসায় নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

কুড়িয়ে পাওয়াদের সন্তানরা কি মনে করে যে, আমরা তাদের মতো অশ্বারোহী নই।

আমরাতো এমন লোক, যারা হত্যাকে কলংক জ্ঞান করে না। কারণ, আমরা তীন্দযদের তীরের জবাবে প্রত্যাঘাত করি।

আর আমরা মেহমানের মেহমানদারী করি উষ্ট্রের পৃষ্ঠের উঁচু অংশ দ্বারা। আর সুন্দর চেহারাধারী ব্যক্তির মন্তকে আঘাত হানি।

আমরা প্রত্যাঘাত হানি চিহ্নিত বীরদেরকে যখন তারা অহংকার করে, এমন আঘাত, যা নস্যাৎ করে হঠকারীর অহমিকা।

এমন যুবক দ্বারা, যে যুবক সত্যের সহায়ক মর্যাদাবান, বনের বাঘের মতো হঠাৎ তুলে নিয়ে যায় সে।

তারা প্রতিরোধ করে নিজেদের এবং দেশের মর্যাদা, এমন তরবারি দ্বারা, যা কর্তন করে তার নিচের মস্তকসমূহ।

বদরের সন্তানদের জিজ্ঞাসা কর যখন তাদের সাক্ষাৎ পাও, ভাইয়েরা যুদ্ধের দিন কেমন আচরণ করেছিল ।

যখন তোমরা বের হবে তখন যার সঙ্গে দেখা হবে সত্য বলবে, আর মজলিসে নিজেদের কথা গোপন করবে না।

আর তোমরা বলবে- আমরা বেরিয়ে এসেছি হতভম্ব ব্যাঘ্রের পাঞ্জা থেকে, আমাদের বক্ষে আছে উষ্ণতা- যাবত যুদ্ধ না করে।

বনু মুস্তালিক যুদ্ধ

ইমাম বুখারী (র) বনু মুস্তালিক যুদ্ধকে গাওয়া মুরাটসী বলেন, আর মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বলেন : ৬ষ্ট হিজরী সনে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পক্ষান্তরে মূসা ইবন উবার মতে চতুর্থ হিজরী সনে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নুমান ইবন রাশিদ (র) যুহরী (রা সূত্রে বর্ণনা করে বলেন যে, গাওয়া মুরাইসীতে ইফক কথা অপবাদের ঘটনা ঘটে। অনুরূপভাবে ইমাম বুখারী (র) মূসা ইবন উকবার মাগাযীর বরাত দিয়ে বলেন যে, এ যুদ্ধ চতুর্থ হিজরী সনে সংঘটিত হয়েছে। তিনি মূসা ইবন উ এবং উরওয়া (র) সূত্রে একথাও উল্লেখ করেন যে, পঞ্চম হিজরী সনের শাবান মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর ওয়াকিদী বলেন, ৫ম হিজরীর ২রা শা’বান সংঘটিত এ যুদ্ধে রাসূল করীম (সা)-এর সঙ্গে সাতশ’ সাহাবী ছিলেন। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন : ঘূ-কারাদ এর ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় জুমাদাল উখরা এবং রজব মাসের কয়েক দিন অবস্থান করেন এবং ৬ষ্ঠ হিজরী সনের শাবান মাসে বনু খুযাআর শাখা গোত্র বনূ মুস্তালিক এর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। এ সময় আৰু যর গিফারী (রা) মতান্তরে নুমায়ন ইবন আবদুল্লাহ্ লায়ছীকে মদীনায় আমির নিযুক্ত করে যান। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা প্রমুখ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানতে পারেন যে, হারিছ ইব্‌ন আবু যিরারের নেতৃত্বে বনূ মুস্তালিক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সমবেত হচ্ছে। এ আকূ যিরার ছিল পরবর্তীকালের উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া এ খবর পেয়ে রাসূল (সা) তাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং মুরাইসী কূয়োর নিকট তাদের মুখোমুখী হন। স্থানটি ছিল কুদায় এর দিক থেকে সমুদ্র উপকূলে । উভয় পক্ষে লড়াই হয়। আল্লাহ তাআলা বনূ মুস্তালিককে পরাজিত করেন তাদের অনেকে নিহত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের বন্দী করে এনে গনীমতরূপে বন্টন করেন। ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) হিজরী ৫ম সালে ২রা শা’বান ৭ শত সাহাবীর একটা বাহিনী নিয়ে বনূ মুস্তালিক অভিমুখে রওয়ানা হন । এরা ছিল বনূ মুদলজের মিত্র । তাদের নিকট পৌঁছে রাসূল (সা) মুহাজিরদের পতাকা হযরত আবু বকর সিদ্দীক মতান্তরে আম্মার ইবন ইয়াসিরের হাতে এবং আনসারদের পতাকা সাদ ইব্‌ন উবাদার হাতে ন্যস্ত করেন। এরপর উমর ইবনুল খাত্তাকে জনগণের মধ্যে এ মর্মে ঘোষণা প্রচার করার নির্দেশ দেন যে, তোমরা সকলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই একথা স্বীকার করে নাও; এতে তোমরা নিজেদের জানমাল সুরক্ষিত হবে। তারা এটা মেনে নিতে অস্বীকার করলে তীর নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। এরপর রাসূল (সা)-এর নির্দেশে সকলে একযোগে হামলা চালালে তাদের এক ব্যক্তিও গা ঢাকা দিতে সক্ষম হয়নি। তাদের দশজন নিহত এবং অবশিষ্ট সকলে বন্দী হয় এবং মুসলমানদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কেউ শহীদ হননি।

বুখারী ও মুসলিমে আবদুল্লাহ্ ইবন আওন বর্ণিত হাদীছে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন : আমি যুদ্ধের পূর্বে ইসলামের দিকে আহ্বানের বিফল সম্পর্কে জানতে চেয়ে নাফিকে পত্র লিখি; তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) যখন বনূ মুস্তালিকে হামলা করেন, তখন তারা পশু পালকে পানি পান করাবার কাজে কূয়ার কাছে ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করেন এবং অন্যদেরকে বন্দী করেন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি সেদিন একথাও বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেদিন জুয়াইরিয়া বিনতুল হারিছকেও বন্দী করেছিলেন, নাফি’ বলেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন উমর আমাকে এরূপ বলেছেন যে, সে বাহিনীতে তিনি নিজেও ছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন : এ যুদ্ধে একজন মুসলমান শহীদ হন; তাঁর নাম ছিল হিশাম ইবন বাবা জনৈক আনসারী শত্রুপক্ষের লোক মনে করে ভুলক্রমে তাঁকে হত্যা করেন।

ইন ইসহাক উল্লেখ করেন যে, তার ভাই মিকয়াস ইবন সাবাবা ইসলাম প্রকাশ করে মক্কা থেকে আগমন করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তার ভাইয়ের দিয়াত তথা রক্তপণ দাবী করেন। কারণ, ভুলবশতঃ তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে দিয়াত দান করেন। এরপর স্বল্পকাল মদীনায় অবস্থান করে তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে হত্যা করে মুরতাদ হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে। এ সম্পর্কে সে নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করে–

মর্মার্থ : মনের তৃপ্তি এই যে, সে নিচু ভূমিতে রাত্রিকালে আসন গ্রহণ করেছে যে, তার ঘাড়ের রক্ত সিক্ত করছিল তার বস্তুকে।

তার মৃত্যুর পূর্বে মনের চিন্তা আমাকে তিরস্কার করছিল আর বারণ করছিল নরম শয্যায় শয়ন করতে।

আমি তাকে অতিক্রম করেছি আর তুমিতো দেখতে পাচ্ছ; আর আমি পেয়েছি আমার প্রতিশোধ আর আমি ছিলাম মূর্তির দিকে সর্বাগ্রে প্রত্যাবর্তনকারী।

আমি তার নিকট থেকে বদলা নিয়েছি ফিহরের আর বনূ নাজ্জারের দুর্গ ফারি’ এর মালিকের নিকট থেকে অর্জন করেছি তার রক্তপণও।

আমি বলি যে, এ মিয়াস ছিল সে চার ব্যক্তির অন্যতম, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) যাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যদি কাবার গিলাফ ধরে ঝুলে থাকে তবু।

ইবন ইসহাক (র) বলেন : লোকেরা তখনো সে কূপের নিকট অবস্থান করছিল। এ সময় কিছু লোকের আগমন ঘটে (পানি নেয়ার জন্য) উমর ইবনুল খাত্তাবের সঙ্গে তাঁর মজুর জাহ্জাহ্ও ছিল। জাহজাহ ইবন মাসঊদ ঘোড়ার রশি টেনে চলেছিল। এসময় জাহজাহ গিফারী এবং সিনান ইবন ওবর জুহানীর সংঘর্ষ বাঁধে। সিনান ইবন ওবর জুহানী ছিলেন বনূ আওফ ইবনুল খারাজের মিত্র। উভয়ের মধ্যে সংঘাত শুরু হলে জুহানী চিৎকার দিয়ে বলে : হে আনসার দল! আর জাহজাহ চিৎকার দিয়ে বলে হে মুহাজির দল! এতে আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই ইবন সাল্ল কুদ্ধ রুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়। তার সঙ্গে ছিল তার দলের কিছু লোক। এদের মধ্যে যায়দ ইবন আরকাম নামে জনৈক তরুণও ছিলেন। ইবনে উবাই বলে ওঠে! এরা এমন কাণ্ড করছে। এরা আমাদের মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক করছে আর আমাদের শহরে আমাদের উপর সংখ্যাধিক্য বলে যাহির করছে। আল্লাহর কসম! আমাদের এবং কুরাইশী বিদেশীদের দৃষ্টান্ত এমন, যেমন আরবী ভাষায় বলা হয়–

কুকুরকে খাইয়ে-দাইয়ে পুষ্ট কর তারপর সে তোমাকে সাবাড় করবে। সে আরো বলে–

আল্লাহর কসম! আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথাকার সম্মানিতরা হীন তুচ্ছদেরকে অবশ্যই বহিষ্কার করবে।

অতঃপর সে তার দলের উপস্থিত লোকদের প্রতি লক্ষ্য করে বলে?

“এ কান্ততা তোমরা নিজেরা সৃষ্টি করেছ। তোমরা নিজেদের শহরে তাদেরকে স্থান দান করেছ, নিজেদের ধন-সম্পদ তাদেরকে বণ্টন করে দিয়েছে। আল্লাহর কসম, তোমাদের হাতে যা আছে তোমরা তা সংরক্ষণ করে নিলে তারা তোমাদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবে। যায়দ ইবন আরকাম এ কথাগুলো শুনে রাসূল (সা)-কে তা অবহিত করেন। এসময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর নিকট হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবও উপস্থিত ছিলেন। তখন হযরত উমর (রা) বললেন : আব্বাদ ইবন বিশুরকে আদেশ করুন সে যেন তাকে হত্যা করে। তখন রাসূল (সা) বললেন :

“হে উমর! এটা কেমন করে হতে পার? লোকে বলাবলি করবে- মুহাম্মাদ তার সঙ্গি সাথীদেরকে হত্যা করা শুরু করছে। এটা ঠিক নয়। তবে এখন আমি প্রস্থানের নির্দেশ দিচ্ছি, এটা ছিল এমন সময় সাধারণত রাসূলুল্লাহ (সা) সে সময় সফর করতেন না। তাই লোকেরা প্রস্থান করে। আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই ইবন সালুল জানতে পারে যে, যায়দ ইব্‌ন আরকাম যা কিছু শুনেছিলেন বা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে অবহিত করেছেন। তখন সে শপথ করে বলেন যে, সে আপনাকে যে কথা বলেছেন তেমন কথা আমি বলিনি। সে ছিল স্বজাতির মধ্যে সম্ভ্রান্ত এবং নেতৃস্থানীয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আনসারদের মধ্যেকার যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বললেন ও ইয়া রাসূলাল্লাহ! হতে পারে বালকটি বলতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে। লোকটি যা বলেছে তা হয়ত স্মৃতিতে ধরতে পারেনি। একথাগুলো তারা বলেছিলেন দয়াপরবশ হয়ে এবং তার মুখ রক্ষার উদ্দেশ্যে! রাসূলুল্লাহ্ (সা) সুস্থির হয়ে যখন রওয়ানা হলেন তখন রাস্তায় উসায়দ ইবন হুযাইর এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সালাম দিয়ে তিনি আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি অসময় রওয়ানা করেছেন, এমন অসময়তো সাধারণত আপনি রওয়ানা করেন না। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন : তোমরা কি জানা নেই যে, তোমাদের সঙ্গীটি কী বলেছে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন সঙ্গী? বললেন, আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই। তিনি জানতে চাইলেন, কী বলেছে সে? বললেন : তার ধারণা সে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে সম্মানিতরা তথা থেকে হীনদেরকে বের করে দেবে। তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ইচ্ছা করলে তাকে বের করে দিতে পারেন। আল্লাহর শপথ! আপনি হলেন সম্মানিত আর সে হলো হীন । অতঃপর তিনি আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার সঙ্গে কোমল আচরণ করুন। আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে এমন সময় আমাদের নিকট উপস্থিত করেছেন যখন তার জাতি তাকে মুকুট পরাবার আয়োজন করেছিল। তার ধারণা, আপনি তার বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) লোকজন নিয়ে চলতে থাকেন সকাল থেকে সন্ধ্যা, আবার সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত পূরো দিবা-রাত্র এবং পরদিন দুপুরে সূর্য তাপ তীব্র না হওয়া পর্যন্ত। তারপর তিনি লোকজনকে নিয়ে অবতরণ করেন এবং মাটির স্পর্শ লাভ মাত্র তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। অবশ্য তিনি এটা করেন এজন্য যাতে লোকেরা আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই-এর গতকালকের ঘটনা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত না হয়ে পড়েন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হিজাযের পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকেন এবং নাকী’ এর কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত বুকআ’ কুপের নিকট অবস্থান গ্রহণ করেন। রাসূল (সা) যখন সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন তখন প্রচন্ড বায়ু প্রবাহিত হয়। এতে লোকজনের কষ্ট হয় এবং তাঁরা ভীত হয়ে পড়লে তিনি (সা) বললেন :

“তোমরা এতে ভীত হবে না; কাফিরদের একজন বড় নেতার মৃত্যুতে এ ঝঞ্ঝা বায়ু প্রবাহিত হয়েছে। মদীনা উপনীত হয়ে তারা জানতে পারেন যে, বনূ কায়নুকা এর অন্যতম নেতা রিফা’আ ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন তাবৃত এ দিন মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। সে ছিল অন্যতম প্রধান ইহুদী নেতা এবং মুনাফিকদের আশ্রয় দাতা। মূসা ইবন উকবা এবং ওয়াকিদী (র) এরূপই বর্ণনা করেছেন । আর ইমাম মুসলিম (র) ও আমাশ সুত্রে জাবির থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি মৃত্যু বরণকারী মুনাফিকের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি এতটুকু উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম (সা)-এর কোন এক সফর কালে তীরে বায়ু প্রবাহিত হলে তিনি বলেছিলেন : জনৈক মুনাফিকের মৃত্যুতে এ বায়ু প্রবাহিত হয়েছে। আমরা মদীনায় উপনীত হয়ে অন্যতম প্রধান মুনাফিকের মৃত্যু সম্পর্কে অবগত হই। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই এবং অনুরূপ মুনাফিক প্রসঙ্গে সূরা মুনাফিকুন নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ (সা) যায়দ ইবন আরকামের কানে ধরে বলেন যে এ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর খাজির যা কর্ণে শ্রবণ করেছে তা-ই বর্ণনা করেছে। আমি বলি, এ বিষয়ে আমাদের তাফসীর গ্রন্থে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে তার পুনঃউল্লেখ নিষ্প্রয়োজন এবং যায়দ ইবন আরকামের মাধ্যমে বর্ণিত এ হাদীছের সূত্র সম্পর্কেও আমরা সেখানে আলোচনা করেছি। সমস্ত প্রশংসা ও স্তব-স্তুতি আল্লাহর জন্য। আগ্রহী পাঠক সেখানে দেখে নিতে পারেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই ইবন সালের পূত্র আবদুল্লাহ্ (রা) রাসূল (সা)-এর দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন :

ইয়া রাসূলাল্লাহ্! (আমার পিতা) আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই আপনাকে যে কষ্ট দিয়েছে। আমি জানতে পারলাম যে, সে জন্য আপনি তাকে হত্যা করতে মনস্থ করেছেন। যদি তাই হয় তবে আপনি আমাকে নির্দেশ দিন, আমি আপনার সম্মুখে তার মস্তক হাযির করবো । আল্লাহ্ কসম! খাযরাজ গোত্র (ভাল করেই জানে যে, তাদের মধ্যে পিতার প্রতি আমার চেয়ে বেশী শ্রদ্ধাশীল কোন ব্যক্তি নেই। আমার আশংকা হচ্ছে আপনি আমি ছাড়া অপর কোন ব্যক্তিকে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলে আর সে ব্যক্তি তাকে হত্যা করবে। আমার পিতার হত্যাকারীকে আমি যমীনের বুকে চলাফেরা করতে দেখে তাকে হত্যা করবো। আর এভাবে একজন কাফির এর বদলায় একজন মু’মিনকে হত্যা করে আমি জাহান্নামী হবো- অন্তত আমার এমন অবস্থা হতে আপনি দেবেন না।

তার এ নিবেদনের জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন —

না বরং আমরা তার সঙ্গে কোমল আচরণ করবো এবং সে যতদিন আমাদের সঙ্গে অবস্থান করে আমরা তার সঙ্গে সদাচার করবে। এরপর যখনই কোন ঘটনা ঘটাতো, তার জাতির লোকেরাই তাকে শাসাতো, হুমকি দিত এবং উষ্ম প্রকাশ করতো। তাদের এ অবস্থা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবকে বললেন :

হে উমর! কী মনে হয় : আল্লাহর কসম, সে দিন তুমি বলেছিলে, সেদিন আমি যদি তাকে হত্যা করতাম তবে অনেকেই নাক সিটকাতো, আজ যদি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেই তবে

অবশ্যই তাকে হত্যা করবে। তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বললেন :

আল্লাহর কসম, আমি জানতাম যে, আমার কথার চেয়ে রাসূল (সা)-এর কথা অনেক বরকতময় । ইকরামা ও ইবন যায়দ প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, তদীয় পুত্র আবদুল্লাহ্ (রা) মদীনায় একটি সংকীর্ণ গলিতে পিতা আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সাল এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেন। দাঁড়ান! রাসূলুল্লাহ্ ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আপনি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবেন না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) অনুমতি দান করলে তবে তিনি তাকে পথ ছেড়ে দেন এবং সে মদীনায় প্রবেশ করে।

ইন ইসহাক (র) বলেন : এ যুদ্ধে বনূ মুস্তালিকের বেশ কিছু লোক আহত ও বন্দী হয় । আলী ইবন আবু তালিব (রা) তাদের দুব্যক্তি মালিক এবং তার পুত্রকে হত্যা করেন। ইবন হিশাম (র) বলেন : এ যুদ্ধে মুসলমানদের সংকেত ধ্বনি ছিল–

ইবন ইসহাক আরো বলেন যে, এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের অনেককে বন্দী করে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন।

বুখারী (র) কুতায়বা ইবন সাঈদ— ইবন মুহাইরীয় সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি মসজিদে প্রবেশ করে আবু সাঈদ খুদরীকে দেখতে পেয়ে তার পাশে বসলাম। আল সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে আবু সাঈদ (রা) বললেন : বনূ মুস্তালিক যুদ্ধে আমরা রাসূল (সা)-এর সঙ্গে বের হলাম। আমরা আরবদের অনেককে বন্দী করলাম । নারীর প্রতি আমাদের আসক্তি জাগে এবং নারী বিহীন জীবন যাপন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আযল করাই আমরা পসন্দ করলাম। আমরা বললাম, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো আমাদের সম্মুখেই আছেন; তাঁকে জিজ্ঞেস করেই আমরা আযল করবো? তাই এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন :

তোমরা আল না করলেও কিছু যায় আসে না। কিয়ামত পর্যন্ত এ প্রাণী আসবার আছে সে অবশ্যই আসবে। কেউ তার আগমন ঠেকাতে পারবে না। তিনি অনুরূপই বর্ণনা করেছেন।

ইবন ইসহাক (র) বলেন : সেদিন যাদেরকে বন্দী করা হয় তাদের মধ্যে জুয়াইরিয়া বিত হারিছ ইবন আবু যিরার)ও ছিলেন। মুহাম্মাদ ইবন জা’ফর—আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন :

রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব মুস্তালিকের বন্দীদেরকে বণ্টন করলে জুয়াইরিয়া বিনতুল হারিছ সাবিত ইবন কায়স ইবন শাম্মাস অথবা তার চাচাত ভাইয়ের ভাগে পড়েন জুয়াইরিয়া নিজের জন্য মুক্তিপণ নির্ধারণ করিয়ে নেয়। আর ইনি ছিলেন এক লাবণ্যময়ী মহিলা। যে কেউ তাকে দেখলে মনে দাগ কাটতো। তিনি রাসূলুলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমন করে মুক্তিপণ পরিশোধে তার সাহায্য কামনা করেন। আইশা (রা) বলেন : আল্লাহ্ কসম! আমার হুজরার দ্বারে তাকে দেখে আমি পসন্দ করতে পারিনি। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি তার (সৌন্দর্যের) যা দেখতে পাচ্ছি রাসূল (সা) ও তা অচিরেই দেখতে পাবেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আর করলেন :

ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জুয়াইরিয়া বিন্ত হারিছ ইবন আবু যিরার। আমার পিতা সম্প্রদায়ের নেতা। আমি এমন বিপদে পতিত হয়েছি, যা আপনার কাছে গোপন নেই। আমি ছাবিত ইবন কায়স ইবন শাম্মাস অথবা তার চাচাত ভাইয়ের হিস্যায় পড়ি এবং নিজেকে মুক্ত করার জন্য তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। চুক্তির দায় শোধ করার জন্য আপনার নিকট সাহায্য চাইতে এসেছি। জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : তোমার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু করা হলে? তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : আমি তোমার মুক্তিপণ পরিশোধ করে তোমাকে বিবাহ করবো। তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবুল করলাম। রাবী হযরত আইশা (রা) বলেন : লোকজনের নিকট খবর পৌঁছে গেল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা), জুয়াইরিয়া বিত হারিছকে বিবাহ করেছেন। তখন লোকেরা বলে? এরা হল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শ্বশুর গোষ্ঠী তখন তারা আনন্দিত হয়ে ঐ বংশের দাসদেরকে মুক্ত করে দেন। রাবী হযরত আইশা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) কর্তৃক জুয়াইরিয়াকে বিয়ে করার ফলে তাদের মধ্যে বনূ মুস্তালিকের একশ পরিবার আযাদ হয়ে যায়। জানামতে জুয়াইরিয়ার চাইতে নিজের সম্প্রদায়ের জন্য বেশী বরকতময় আর কোন নারী আছে বলে আমার জানা নেই।

অতঃপর ইবন ইসহাক (র) ব মুস্তালিক যুদ্ধ প্রসঙ্গে ই তথা অপবাদ আরোপের বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে ইমাম বুখারী (র) প্রমুখ মনীষীও ইফকের ঘটনা বর্ণনা করেন। তাফসীর গ্রন্থে সূরা নূর-এর তাক্সীর প্রসঙ্গে এ বর্ণনার সকল সনদের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা যেতে পারে।

ওয়াকিদী হারাম সূত্রে– উরওয়া থেকে বর্ণনা করেছেন । হযরত জুয়াইরিয়া বলেন যে, নবী করীম (সা)-এর আগমনের তিন দিন পূর্বে আমি স্বপ্নে দেখি যে, যেন চন্দ্র ইয়াছরিব থেকে এসে আমার কোলে পতিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোন মানুষকে অবহিত করা আমি পসন্দ করিনি।

অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আগমন করলেন। আমরা যখন বন্দী হলাম তখন স্বপ্নের ব্যাখ্যার আকাঙ্খ জাগ্রত হয়। হযরত জুয়াইরিয়া বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে মুক্ত করে বিবাহ করেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুয়াহ্ (সা)-এর সঙ্গে আমার সম্প্রদায় সম্পর্কে আমি কোন কথা বলিনি। মুসলমানরা নিজেরাই তাদেরকে আযাদ করেছেন। আমার চাচাতো বোনের এক দাসীর মাধ্যমে আমি এ বিষয়ে জানতে পেরেছি। সে আমাকে এ খবর দিলে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি । ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা) জুয়াইরিয়ার মহর হিসাবে ব মুস্তালিকের ৪০ জন কে মুক্ত করেন। মূসা ইবন উকবা বনূ মুস্তালিক সূত্রে উল্লেখ করেন যে, তাঁর পিতা তাঁর খোঁজ নেন এবং মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে তাঁর পিতা তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেন।

হযরত আইশা (রা)-এর প্রতি অপবাদ আরোপের ঘটনা

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) অপবাদের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ইবন ইসহাক যুহরী সূত্রে আলকামা— উবায়দুল্লাহ ইবন উতবা এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, এরা সকলেই আমাকে এ ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছেন তবে তাদের মধ্যকার কিছু লোক ঘটনা বেশী স্মরণ রেখেছেন। আর লোকেরা আমাকে যা জানিয়েছেন তার সমস্ত আমি একত্র করেছি। ইবন ইসহাক ইয়াহইয়া ইবন আব্বাদ— সূত্রে আইশা (রা) থেকে এর আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর উমরা বিন্‌ত আবদুর রহমান আইশা সূত্রে এবং তিনি নিজের সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, অপবাদ রটনাকারীরা এ ব্যাপারে যা বলার বলেছে। এ ঘটনা বর্ণনায় সকলেই অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের কেউ কেউ এমন বর্ণনা দিয়েছেন যা অন্যরা বর্ণনা করেননি। আর এরা সকলেই নির্ভরযোগ্য এবং সকলেই হযরত আইশা থেকে যা কিছু শুনেছেন তা-ই বর্ণনা করেছেন। হযরত আইশা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)সফরে গমনের অভিপ্রায় করলে (স্বভাবতই) তিনি স্ত্রীগণের মধ্যে লটারী করতেন । এতে যার নাম আসতো, তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সফরে বের হতেন। বনূ মুস্তালিক যুদ্ধে বের হওয়ার সময় ও তিনি সেই ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এতে আমার নাম উঠে। ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে সঙ্গে নিয়ে বের হন। হযরত আইশা (রা) বলেন : তখনকার দিনে নারীরা স্বল্প আহার করতেন। ফলে মেদভুড়ি বৃদ্ধি দ্বারা নারীরা মোটা সোটা না হয়ে বরং হাল্কা হতেন। আমার বাহন প্রস্তুত হলে আমি হাওদায় বসে পড়ি। এরপর আমার উটের চালকরা আগমন করলে তারা আমার হাওদা নীচ দিয়ে ধরে উটের পিঠে রাখে এবং হাওদাকে উটের পিঠে সওয়ার করায় হাওদা রশি দিয়ে কষে বাঁধার পর তারা রওয়ানা করতো। হযরত আইশা (রা) বলেন : এ সফর শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার দিকে রওয়ানা করেন। মদীনার কাছে এসে একটা মনযিলে সকলে অবস্থান করেন এবং রাত্রের কিছু অংশ সেখানে কাটান। তারপর ঘোষক লোকদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলে সকলেই রওয়ানা হন। আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন বাইরে গিয়েছিলাম। আমার গলায় ছিল ঝিনুকের হার। আমি যখন প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে অবসর হই তখন আমার অজান্তে হারটি আমার গলা থেকে পড়ে যায়। আমি টেরই পাইনি। আমি অবতরণস্থলে ফিরে এসে গলায় হাত দিয়ে দেখি হার নেই। এসময় লোকেরা বাহন যোগে রওয়ানা হতে উদ্যত হয়। যে স্থানে আমি হার ফেলে এসেছিলাম। আমি সেখানে ফিরে যাই এবং হারটি খুঁজে পাই।

ইতোমধ্যে আমার বাহনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ এসে পড়েন এবং বাহন প্রস্তত করে তারা অবসর হয়ে যথারীতি আমি তাতে আছি মনে করে তারা হাওদা তুলে নেন। উঠের পিঠে হাওদায় আমি নেই এমন সন্দেহও তাঁরা করেননি; তাই তাঁরা সওয়ারীর লাগাম ধরে রওয়ানা হয়ে পড়েন। অবতরণ স্থলে আমি ফিরে আসি; তখন সেখানে আহ্বানকারী আর সাড়াদানকারী কেউই নেই। সকলেই রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমি সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে স্ব-স্থানে শুয়ে পড়ি এবং ধারণা করি যে, তারা আমাকে খুঁজে না পেয়ে অবশ্যই আমার দিকে ফিরে আসবেন। তিনি আরো বলেন; আমি শুয়ে আছি এমন সময় সাফওয়ান ইবন মুয়াত্তাল সুলামী আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। নিজের কোন প্রয়োজনে তিনি কাফেলার পেছনে ছিলেন। তিনি লোকজনের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেননি এবং আমার অস্পষ্ট অবয়ব দেখে এগিয়ে আসেন এবং আমাকে দেখে চিনতে পারেন। কারণ, আমাদের উপর পর্দার বিধান আসার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে দেখে তিনি ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করে বলেন– এ যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সহধর্মিণী! আমি কাপড় মুড়ি দিয়ে ছিলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন, কী করে আপনি পেছনে রয়ে গেলেন? আইশা বলেন। আমি তার সঙ্গে কোন কথা বলিনি। এরপর উট আমার কাছে এনে আরোহণ করতে বলে তিনি দূরে সরে দাঁড়ান। তিনি বলেন, আমি উঠে চড়লে তিনি উঠে লাগাম ধারণ করতঃ রওয়ানা করেন। আল্লাহর কসম! ভোর পর্যন্ত আমরা কাফেলাকে ধরতে পারিনি এবং আমাকে কেউ তালাশও করেনি। তারা অবতরণ স্থলে নির্বিকার অবস্থান করছিলেন এমন সময় আমাকে নিয়ে লোকটি সেখানে পৌঁছেন তখন অপবাদ রটনাকারীরা যা বলার তা বলে এবং বাহিনীতে হৈচৈ পড়ে গেল । আল্লাহর কসম, এসবের কিছুই আমি জানি না। আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি এবং এসেই আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং এতসবের কিছুই আমার কানে পৌঁছেনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং আমার পিতামাতার কানে এসব কথা পৌঁছলেও তাঁরা অল্প বিস্তর কিছুই আমাকে জানাননি। অবশ্য আমার সঙ্গে রাসূল (সা) হাসি তামাশা আর কৌতুকে আমি কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি। আমি অসুস্থ হলে তিনি দয়া আর কোমলতা প্রদর্শন করতেন। কিন্তু আমার এবারের অসুস্থতায় তিনি তেমন কোমলতা প্রদর্শন করেননি। এবার তাঁর পক্ষ থেকে আমি ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলাম। তিনি আমার কাছে আসেন আর আম্মাজান [টীকা : সীরাতে ইবন হিশামে আছে? তিনি উম্মে রোমান, তাঁর নাম যয়নব বিনত আব্দ দাহমান, বনূ কিবাস ইবন গনম ইবন মালিক ইবন কিনানার অন্যতম সদস্য।] আমার সেবায় রত; তিনি কেবল বলতেন– বাড়ীর লোক কেমন আছেন? এর বেশী কিছু বলতেন না। তিনি বলেন : এতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হলাম এবং তাঁর এরূপ আচরণ দেখে আমি আরয করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আপনি অনুমতি দান করলে আমি আমার মায়ের নিকট চলে যাই। তিনি আমার সেবা-যত্ন করবেন। তিনি বললেন, অসুবিধা নেই। হযরত আইশা (রা) আরো বলেন । এরপর আমি মায়ের নিকট চলে যাই । যা ঘটেছে সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। এক মাসের অসুখে আমি নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ি। আমরা আরবের লোকেরা আজমী লোকদের মতো গৃহে শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখতাম না। বরং এ ব্যবস্থাকে আমরা ঘৃণা করতাম। এজন্য আমরা মদীনার উপযুক্ত প্রান্তরে গমন করতাম আর নারীরা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে রাতের বেলা বাইরে গমন করতেন। একদা রাত্রিকালে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আমি গৃহের বাইরে গমন করি, আমার সঙ্গে ছিলেন আবু রহম ইবন মুত্তালিবের কন্যা উম্মু মিস্তাহ। হযরত আইশা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! উম্মু মিস্তাহ আমার সঙ্গে হাঁটছিলেন। এমন সময় চাদরের সঙ্গে জড়িয়ে তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যান এবং বলে উঠেন, মিস্তাহর সর্বনাশ হোক! (মিস্তাহ ছিল তার উপনাম, তার নাম ছিল আওফ)। তিনি বলেন, তখন আমি বললাম, একজন মুহাজিরকে বদ দোয়া দিয়ে তুমি অন্যায় করলে । তিনিতো বদর যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেছেন। তখন উম্মু মিসতাহ বললেন। হে আবূ বকর তনয়া! তুমি কি কিছুই খবর রাখনা। আমি বললাম, কী খবর? তখন অপবাদ রটনাকারীদের কথাবার্তা সম্পর্কে তিনি আমাকে অবহিত করলেন। আমি বললাম, এমন ঘটনাই কি ঘটেছে? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তাই ঘটেছে। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, এসব কথা শুনে আমি আর প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে পারিনি, বরং সেখান থেকে ফিরে আসি। আল্লাহর কসম, আমি অঝোরে কাঁদতে থাকি। এমন কি আমার আশংকা হয় যে, কাঁদতে কাঁদতে আমার কলিজা ফেটে যাবে। তিনি বলেন, আমি আমার মাকে বললাম, আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমা করুন, লোকেরা নানা কথাবার্তা বলছে, আপনিতো তার কিছুই আমাকে জানাননি।

তিনি বললেন : স্নেহের তনয়া আমার। ব্যাপারটাকে হাল্কাভাবে নাও। কোন পুরুষের সুন্দরী রমণী থাকবে। পুরুষ তাকে ভালবাসবে, তার সতীনও থাকবে তাহলে তার সম্পর্কে নারীরা অনেক কিছু বলবে, অনেক কিছু অন্যান্য লোকেরাও বলবে, এমন না ঘটলে তা হবে বিরল ঘটনা। হযরত আইশা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ সময় দাঁড়িয়ে লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করেন। এটাও আমি জানতাম না, ভাষণে তিনি বললেন :

লোকসকল! লোকদের কী হয়েছে : তারা আমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তারা অসত্য কথা বলছে তাদের বিরুদ্ধে। আল্লাহর কসম! তাদের বিরুদ্ধে মঙ্গল ও কল্যাণ বৈ কিছুই আমি জানিনা। আর তারা এটা এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলছে যার সম্পর্কে ভাল ছাড়া কিছুই আমার জানা নেই। সে যখন আমার গৃহে প্রবেশ করে তখন সে আমার সঙ্গেই থাকে।

হযরত আইশা (রা) বলেন : মিসতাহ্ এবং হামনা বিন্ত জাহাশ বলেছে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই ইব্‌ন সালুল খাযরাজীদের মধ্যে এ অপবাদ রটনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর এটা এ কারণে যে, তাঁর বোন যয়নাব বিন্ত জাহাশ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর স্ত্রী ছিলেন । মান্দায় তিনি ছাড়া নবীজীর অপর কোন স্ত্রী আমার সমকক্ষ ছিল না। দীনদারীর কারণে যয়নাবকে আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন। তাই তিনি ভাল ছাড়া কিছুই বলেননি। আর হামনাতো একথা খুব প্রচার করেছেন এবং বোনের কারণে তিনি আমাকে কষ্ট দেন। এর ফলে তিনি হতভাগিনী হয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এ ভাষণের পর উসায়দ ইবন হুদায়র আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এ অপবাদ রটনাকারীরা যদি আওস গোত্রের হয়ে থাকে তা হলে আমরাই তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি তারা তোমাদের ভাই খারাজ গোত্রের হয়ে থাকে তবে আপনি নির্দেশ দিন, আল্লাহর কসম । তারা গদান উড়িয়ে দেয়ার যোগ্য। আইশা (রা) বলেন : (একথা শ্রবণ করে) সা’দ ইবন উবাদা দাঁড়ালেন, ইতিপূর্বে তাঁকে নেককার বলে ধারণা করা হতো। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি মিথ্যা বলছ। তাদের গদান উড়িয়ে দেয়া যাবে না। আল্লাহর কসম, একথা তুমি এজন্যই বলছ যে, তুমি জান যে, তারা খারাজ বংশের লোক। তুমি যদি জানতে যে, তারা তোমার গোত্রের লোক তাহলে তুমি এমন কথা বলতে না। তখন উসায়দ ইবন হুযায়র বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি মুনাফিক, মুনাফিকদের পক্ষে কথা বলছ। হযরত আইশা (রা) বললেন : এপর লোকেরা বিবাদে প্রবৃত্ত হলো, এমন কি পরস্পরে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হল। আওস আর খাযরাজ এ দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় আর কি? রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বর থেকে নেমে আমার কাছে এলেন। তিনি আলী ইবন আবী তালিব এবং উসামা ইবন যায়দকে ডাকলেন। তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন । উসামা (আমার সম্পর্কে) ভালই বললেন, প্রশংসা করলেন, তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার পরিবার সম্পর্কে তো আমরা ভাল ছাড়া কিছুই জানি না। আর এসব কথা মিথ্যা ও অসার। অবশ্য আলী (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! নারীর তো অভাব নেই) আর আপনি তো স্ত্রী বদলও করতে পারেন। আপনি এর দাসীকে জিজ্ঞেস করুন, সে আপনাকে সত্য তথ্য দিবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করার জন্য বারীরাকে ডাকলেন। আইশা (রা) বলেন, আলী (রা) তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বেদম পেটাতে পেটাতে বললেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে তুই সত্য কথা বলবি। হযরত আইশা (রা) বলেন যে, সে বললো আল্লাহর কসম! তার সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া কিছুই জানিনা। আইশা (রা)-এর মধ্যে আমিতো দোষের কিছুই দেখিনাঃ কেবল এটুকু যে, আমি আটা খামীর করে তাকে খেয়াল রাখার জন্য বলে যাই আর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এ সময় বকরী এসে আটা খেয়ে ফেলে।

হযরত আইশা সিদ্দীকা (রা) বলেন : এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার নিকট আগমন করলেন। এসময় আমার নিকট পিতা-মাতা ছাড়াও একজন আনসারী নারী ছিলেন। আমি রোদন করছিলাম, সে আনসারী মহিলাও রোদন করছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) এসে বসলেন, আল্লাহর হাদ ও ছানা বর্ণনা করে বললেন :

হে আইশা! লোকেরা কিসব বলাবলি করছে তা তো তোমার জানা হয়েছে। তুমি আল্লাহকে ভয় করো। আর লোকেরা যেসব কথা বলাবলি করছে। তাতে তুমি লিপ্ত থেকে থাকলে আল্প হুর নিকট তাওবা কর। আল্লাহতা বান্দার তাওবা কবূল করে থাকেন।

হযরত আইশা (রা) বলেন, আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে লক্ষ্য করে একথাগুলো বলা মাত্র আমার অশ্রু সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়, আমি এক বিন্দু অশ্রু আছে বলেও অনুভব করলাম না। আমি অপেক্ষা করলাম যে, আমার পক্ষ থেকে পিতামাতা জবাব দেবেন। কিন্তু তারা কিছুই বললেন na। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, আমার নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল আর আমার ব্যাপারে আল্লাহ্ কুরআন নাযিল করে আমাকে সান্ত্বনা দিবেন- আমার এমন অবস্থাও আছে বলে মনে হতো না। তবে আমি আশা পোষণ করতাম যে, নবী (সা) কিছু স্বপ্নে দেখবেন দ্বারা আল্লাহ আমার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদের স্বরূপ প্রকাশ করবেন এবং আমি যে নির্দোষ, তা তিনি জানতে পারবেন। এতে তিনি আরো কিছু বিষয়ও জানতে পারবেন, অবশ্য আমার সম্পর্কে কুরআন নাযিল হবে আমার নিজেকে নিজের কাছে তার চাইতে তুচ্ছ মনে হয়েছে। তিনি আরো বলেন : আমার পিতামাতাকে আমার পক্ষ থেকে জবাব না দিতে দেখে আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা কি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কথার জবাব দেবেন না। তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা কী জবাব দিবো তা-ই তো বুঝতে পারছি না। আইশা (রা) আরো বলেন, এদিনগুলোতে আবু বকরের পরিবারের উপর যেসব বিপদ আপতিত হয়েছে। তেমন বিপদ অন্য কোন পরিবারের উপর আপতিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই, এমন কথা আমি হলফ করে বলতে পারি । তিনি আরো বললেন : আমার ব্যাপারে তারা একেবারে নির্বাক থাকার পর আমি ‘অশ্রুপাত করলাম, রোদন করলাম আর বললাম, আমার সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি কখনো আল্লাহর নিকট তাওবা করব না আল্লাহর কসম, আমি ভাল করেই জানি যে, লোকেরা সেসব কথা বলাবলি করছে। আমি যদি তা স্বীকারও করি আর আল্লাহ জানেন যে, আমি এ ব্যাপারে নিদোষ তবে যা ঘটেনি তা স্বীকার করে নেয়া হবে। পক্ষান্তরে লোকেরা যা বলাবলি করছে আমি তা অস্বীকার করলেও তারা তা সত্য বলে মেনে নেবে না। তিনি বলেন, অবশেষে আমি হযরত ইয়াকুব (আ)-এর নাম স্মরণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তা আমার মনে পড়লো না। তখন আমি বললাম, হযরত ইউসুফ (আ)-এর পিতা যা বলেছিলেন তেমন কথাই আমি উচ্চারণ করবো–

অতএব, সুন্দর সবরই (উত্তম)। আর তোমরা যা বলছ, সে ব্যাপারে আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করছি (ইউসুফ ১২ : ১৮)।

হযরত আইশা (রা) বলেন : আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ (সা) মজলিসে থাকতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে নেয়, যে ভাব আছন্ন করতে ওহী নযিল কালে। তাই তিনি বস্ত্র দিয়ে নিজেকে আবৃত করে নেন এবং মাথার নীচে স্থাপন করলেন চামড়ার বালিশ। আর এ সময় তার যে অবস্থা আমি দেখতে পেলাম। আল্লাহর কসম, তাতে আমি মোটেই বিচলিত হইনি। কোন পররাওয়াও করিনি। কারণ, আমি তো জানি যে, আমি নির্দোষ আর আল্লাহ তো আমার প্রতি যালিম নন। আর আল্লাহর কসম করে বলছি। আইশার জীবন-প্রাণ যে পবিত্র সত্তার হাতে আছে, আমার পিতামাতার তো করুণ দশা, আমার মনে আশংকা জাগলো, লোকেরা যা বলাবলি করছে, ওহীর মাধ্যমে যদি তার সত্যতা প্রতিপন্ন হয়। তিনি বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহর ভাবান্তর হলো, তিনি উঠে বসলেন, প্রচণ্ড শীতের মওসুমেও তার চেহারা মুবারক থেকে মুক্তার মতো ঘাম ঝড়ে পড়ছিল। তিনি চেহারা থেকে ঘাম মুছতে মুছতে বলছিলেন :

হে আইশা! সুসংবাদ গ্রহণ কর, আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রমাণ করে আয়াত নাযিল করেছেন। তিনি বলেন, আমি আলহামদু লিল্লাহ বললাম। এপর তিনি লোকদের উদেশ্যে বের হয়ে পড়লেন। তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং এ উপলক্ষে আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদের যে আয়াত নাযিল করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তা তিলাওয়াত করলেন। অতঃপর অশ্লীল কথা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মিসতাহ ইবন উছাছা, হাসান ইবন ছাবিত এবং হামনা বিন্ত জাহাশকে তলব করে এনে অপবাদ আরোপের দণ্ড তথা (হদ) জারী করেন। এ হাদীছটি

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে যুহরীর বরাতে বর্ণিত হয়েছে। আর এ বর্ণনায় প্রভূত শিক্ষণীয় বিষয় নিহিত রয়েছে। হাস্সান ইবন ছাবিত এবং তাঁর সঙ্গীদের ক্ষেত্রে অপবাদের জন্যে দণ্ড কার্যকরার কথা আবু ইউসুফ (র) তার সুনান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ইবন ইসহাক (র) বলেন : হাস্সান ইব্‌ন ছাবিত এবং তাঁর সঙ্গীদের উপর দণ্ড প্রয়োগ বিষয়ে কোন মুসলিম কবি নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন —

মর্মার্থ : হাস্সান উপযুক্ত শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছেন। হামনা আর মিস্তাহও, যখন তারা আবোল-তাবোল বকেছে। নবীর স্ত্রীকে তারা অপবাদ দিয়েছে আন্দাজ অনুমান করে। আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করে তারা হয়েছে বিষ। তারা তাতে কষ্ট দিয়েছে আল্লাহর রাসূলকে, আরোপিত হয়েছে তাদের উপর অপমান, যা আচ্ছন্ন করে নিয়েছে তাদেরকে এবং হয়েছে তারা লাঞ্ছিত । বর্ষিত হয়েছে তাদের উপর চাবুক, যেন তা বৃষ্টির ছিটা, যা বর্ষিত হচ্ছে ঊর্বের মেঘমালা থেকে?

ইবন ইসহাক (র) উল্লেখ করেন যে, হাসসান ইবন ছাবিত তাঁর কবিতায় মারওরান ইবন মুয়াত্তাল এবং তার কুরায়শী সঙ্গীদের কুৎসা রচনা করেন মুরায়সীর যুদ্ধের দিনে বাদশাহ ও তাঁরা সঙ্গীদের সঙ্গে যে ঝগড়া হয়েছিল তাকে কেন্দ্র করে। কবিতাগুলো এই :

মর্মার্থ : মুরায়শীরা বিজয়ী হয়েছে আর সংখ্যায় তারা তো অনেক, আর ফারীয়ার [টীকা : ফারিয়া বলতে হাসানের মাকে বুঝানো হয়েছে] ছেলে হয়ে পড়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী! তুমি যার সাথী, তার মাতা তাকে হারায়, অথবা সে আসুক সিংহের পাঞ্জার তলে। আমি যাকে হত্যা করি দৌড়ে গিয়ে তাকে পাকড়াও করি । তার জন্যে কোন রক্তপণ দিতে হয় না বা শাস্তি ভোগ করতে হয় না … অবশ্য কুরায়শের ব্যাপার স্বতন্ত্র, আমি আপোষ করবোনা তাদের সঙ্গে, যতক্ষণ তারা ভ্রান্তি থেকে হিদায়াতের পথে ফিরে না আসে। আর লাত-উজ্জাকে বর্জন করে। সকলেই সিজদা না করে একক আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আর সাক্ষ্য না দেবে যে, রাসূল তাদেরকে যা বলেন, তা-ই সত্য, সুতরাং তারা পূরা করুক আল্লাহর হক আর অঙ্গীকার । ইবন ইসহাক (র) বলেন, সাফওয়ান ইবন মুয়াত্তাল হাসানের প্রতিবন্ধক হলে তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করে বলেন :

আমার পক্ষ থেকে তলোয়ারের ধার গ্রহণ কর, কারণ আমিতো নওজোয়ান (হামলাকারী) যখন আমার নিন্দা করা হয়,

আমিতো কোন কবি নই। কথিত আছে যে, সাফওয়ান হাসানকে তরবারি দ্বারা আঘাত হানলে ছাবিত ইব্‌ন কায়স ইবন শাম্মাস তাকে পাকড়াও করে শক্তভাবে বেঁধে ফেলেন। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন ।

ব্যাপার কি? তিনি বললেন : সে হাস্সানকে তরবারি দ্বারা আঘাত করেছে। তখন আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি এ সম্পর্কে জানেন? তিনি বললেন, না। তখন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাকে বন্ধনমুক্ত করেন। এরপর তারা সকলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে হাযির হলে ইব্‌ন মুয়াত্তাল বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার নিন্দা করেছে, আমার ভীষণ রাগ হয়েছে, তাই আমি তরবারি দ্বারা আঘাত করেছি। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

আমার সম্প্রদায়কে আল্লাহ হিদায়াত দান করেছেন বলে তুমি কি তাদের নিন্দাবাদ করেছ? তারপর তিনি বললেন : হে হাস্সান! তুমি যে আঘাত পেয়েছ তা ক্ষমা করে দাও; তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্যে তা ক্ষমা করে দিলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিনিময়ে হযরত হাসসানকে বায়রূহা কূয়া দান করেন, যা আবূ তালহা তাঁকে দান করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি তাঁকে সিরীণ নামী দাসীটি দান করেন। এর গর্ভ থেকে তারপুত্র আবদুর রহমানের জন্ম হয়। ইবন ইসহাক (র) বলেন : হযরত আইশা (রা) বলতেন- ইবন মুয়াত্তাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে জানা যায় যে, তিনি এমন এক পুরুষ, যার মধ্যে নারীর প্রতি কোন আসক্তি নেই। পরবর্তীকালে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। ইবন ইসহাক বলেন, হযরত আইশা (রা) সম্পর্কে যা রটনা করেছিলেন, সে জন্য হযরত হাসান দুঃখ প্রকাশ করে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

মর্মার্থ : তিনি যে পূত-পবিত্র ও সতী-সাধ্বী, তাতে সন্দেহ করা যায় না।

যায় না তাঁকে অপবাদে ক্লিষ্ট করা, আর গাফিল নারীদের নিন্দাবাদ দ্বারা তিনি দিবসের সূচনা করেন না।

তিনি লুয়াই ইবন গালিবের গোত্রের সুকীর্তির ধারক-বাহক, তার কর্ম সুন্দর। তিনি এমন এক বংশের সন্তান, যাদের মান-মর্যাদা বিলীন হওয়ার নয়।

তার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা কিছুতেই প্রামাণ্য নয়, কোন কালেও নয় । বরং আমার ক্ষেত্রে তা এক নিন্দুকের উক্তি যদি সে কথা আমি বলেই থাকি, যা তোমরা অনুমান কর। তাহলে আমার হাতের আঙ্গুল আমার পানে কোড়া উত্তোলন করবে না।

তা কেমনে হতে পারে, অথচ আমার ভালবাসা আর সাহায্য তো রাসূলের (সা) পরিবার পরিজনের জন্য উৎসর্গীকৃত। তিনিই তো আসরের দীপ্তি!

তাদের জন্য রয়েছে সম্মান আর মর্যাদা, এর বাইরে লোকদেরকে তুমি দেখতে পাবে খর্বকায় আর তাদের মর্যাদা তো সকলের ঊর্ধ্বে। এখানে সূরা নূর-এর নিম্নোক্ত আয়াত উদ্ধৃত করা যায়–

যারা এ অপবাদ আনয়ন করেছে তারাতো তোমাদেরই একটা দল। এটাকে তোমরা নিজেদের জন্য অনিষ্টকর মনে করবে না; বরং এটাতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে নিজেদের কৃত পাপ কর্মের ফল। আর ওদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। তারা যখন এটা শ্রবণ করল তখন মু’মিন পুরুষ এবং মুমিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে কেন ভাল ধারণা করেনি এবং কেন তারা বলেনি এটাতো সুস্পষ্ট অপবাদ! তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি। যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু আল্লাহর নিকট তারা মিথ্যাবাদী, দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফযল ও রহমত না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে, তজ্জন্য মহাশাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করতো। তোমরা যখন মুখেমুখে এটা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে সে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিলনা এবং তোমরা এটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করছিলে, যদিও আল্লাহর নিকট এটা ছিল গুরুতর বিষয়। আর তোমরা যখন এটা শ্রবণ করছিলে তখন কেন কললে না- এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র মহান। এতো এক গুরুতর অপবাদ! আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন- তোমরা মু’মিন হয়ে থাকলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবেনা, আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফযল ও রহমত না থাকলে তোমাদের কেউ রেহাই পেতেনা)। আর আল্লাহ অতি দয়ার্ল ও পরম দয়ালু। হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করবে না। কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরণ করলে শয়তানতো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়। তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফযল ও রহমত না থাকলে তোমাদের কেউ কখনো পবিত্র হতে পারতো না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ না করে যে, আত্মীয়-স্বজন এবং অভাবগ্রস্ত ও আল্লাহর রাস্তায় হিজরত কারীদেরকে কিছুই দেবে না। তারা যেন ক্ষমা আর উপেক্ষা করে। তোমরা কামনা কর না যে, আল্লাহ্ আমাদেরকে ক্ষমা করেন, আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল অতি দয়ালু। যারা সাধ্বী, সরলমনা ও ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে দুনিয়া ও আখিরাতে তারা অভিশপ্ত আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। সেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহ্বা তাদের হস্ত ও তাদের চরণ, তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সেদিন আল্লাহ্ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহ্ই সত্য এবং স্পষ্ট প্রকাশক। ভ্ৰষ্টা নারী ভ্রষ্ট পুরুষের জন্য, ভ্রষ্ট পুরুষ ভ্ৰষ্টা নারীর জন্য। পবিত্র নারী পবিত্র পুরুষের জন্য আর পবিত্র পুরুষ পবিত্র নারীর জন্য। লোকেরা যা বলে তা থেকে এরা মুক্ত। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা আর সম্মানজনক জীবিকা। (২৪ সূরা নূর ও ১১-২৬)

এ আয়াতগুলোর তাফসীর প্রসঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট হাদীছ ও আছারসমূহ এবং অতীত মনীষীদের উক্তিসমূহ সংশ্লিষ্ট হাদীছের সূত্র উল্লেখ করেছি।

হুদায়বিয়ার অভিযান

হিজরী ষষ্ঠ সনের যিলকদ মাসে হুদায়বিয়ার অভিযান সংঘটিত হয়। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। ইমাম যুহরী, ইবন উমর (রা)-এর আযাদ কৃত গোলাম নাফি’ কাতাদা, মূসা ইব্‌ন উকবা এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক প্রমুখ এ মত পোষণ করেন। ইবন লাহিয়া আবুল আসওয়াদ সূত্রে উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, হিজরী ষষ্ঠ সালের যিলকদ মাসে হুদায়বিয়ার ঘটনা ঘটে। ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান– ওরওয়া সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান মাসে হুদায়বিয়ার উদ্দেশ্যে বের হন আর হুদায়বিয়ার সন্ধি হয় শাওয়াল মাসে। উরওয়া সূত্রের এ বর্ণনা নিতান্তই গরীব তথা বিরল পর্যায়ের। ইমাম বুখারী (র) ও ইমাম মুসলিম (র) উভয়ে হুদবা–..– আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যিলকদ মাসে ৪ বার উমরা করেন। অবশ্য হজ্জের সঙ্গে তিনি যে উমরা করেন তা এর ব্যতিক্রম। তিনি হুদায়বিয়ার উমরা করেন যিলকদ মাসে, পরবর্তী বছরের উমরা করেন যিলকদ মাসে এবং জি ইরান থেকে উমরা করেন যিলকদ মাসে। এখানে তিনি হুনায়নের গনীমতের মাল বণ্টন করেন। আর এক উমরা করেন হজ্জের সঙ্গে। এটা বুখারী শরীফের ভাষ্য। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) রমযান এবং শাওয়াল এই দু মাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং যিলকদ মাসে উমরার উদ্দেশ্যে বের হন। এ সময় যুদ্ধের অভিপ্রায় ছিলনা, ইবন হিশাম বলেন, এ সময় তিনি মদীনায় নুসায়লা ইবন আবদুল্লাহ্ লায়ছীকে আমীর নিযুক্ত করেন।

ইন ইসহাক (র) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বেদুঈন এবং তাদের আশপাশের গ্রামের লোকদের প্রতি বের হওয়ার আহ্বান জানান। কুরায়শের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আশংকা ছিল যে, তারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে বা বায়তুল্লাহর যিয়ারত করতে তাকে বাধা দেবে; কিন্তু গ্রামের অনেকেই বের হতে বিলম্ব করে। ফলে মুহাজির এবং আনসারদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে ছিলেন তাদেরকে নিয়ে তিনি বের হলেন। গ্রামের কিছু লোকও তীর সঙ্গে যোগ দেয়। তিনি সঙ্গে কুরবানীর পশুও (হাদী) নিলেন এবং উমরার এহরামও বাঁধলেন যাতে যুদ্ধের ব্যাপারে লোকেরা নিরাপদ হয়ে যায় এবং তারা একথাও জানতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কেবল বায়তুল্লাহর যিয়ারতের উদ্দেশ্যেই বের হয়েছেন যুদ্ধের জন্য নয়। বায়তুল্লাহর মর্যাদা প্রকাশ করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

ইন ইসহাক (র) মারওয়ান ইবনুল হাকাম সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুদায়বিয়ার বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল্লাহ্ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে বের হন; যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নয়, হাদী বা কুরবানীর জন্য তিনি ৭০টি পশুও সঙ্গে নেন। তাঁর সঙ্গে ছিল ৭শ লোক প্রতি দশ জনের জন্য ছিল কুরবানীর এক একটা পশু । অবশ্য জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ (রা) বলতেন যে, হুদায়বিয়ায় আমরা সঙ্গীরা ছিলাম চৌদ্দ শত।

ইমাম যুহরী (র) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বের হয়ে চলতে চলতে উছফান নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছলে বিশর ইবন সুফিয়ান কাবী (ইবন হিশাম-এর মতে বু- ১) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আপনার বের হওয়ার বিষয় কুরায়শরা জানতে পেরেছে; তাই তারা কম বয়সের উষ্ট্র সঙ্গে নিয়ে বাঘের চামড়া পরিধান করে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যীতুয়া উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করছে। তারা আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করছে যে, তারা কিছুতেই আপনাকে প্রবেশ করতে দেবেনা। আর তাদের অশ্বারোহী বাহিনীতেখালিদ ইবন ওয়ালীদ কুরাউল গামীম পর্যন্ত এসে পৌঁছে গেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হায় কুরায়শ, যুদ্ধ তাদের সর্বনাশ করেছে। কী হতো যদি তারা আমার এবং আরবের সকল লোকের মধ্যে পথ উন্মুক্ত করে দিতো। তারা আমাদেরকে বিনাশ করতে সক্ষম হলে এটাইতো হবে তাদের কাম্য; পক্ষান্তরে আল্লাহ্ যদি আমাকে তাদের উপর বিজয় দান করেন তবে তারা বিপুল সংখ্যায় ইসলামে প্রবেশ করতে পারতো। আর ইসলামে প্রবেশ না করলে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতো। কুরায়শরা কি মনে করে? আল্লাহর কসম, যে দীন সহকারে আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন তার জন্য আমি অব্যাহত ধারায় নিরলসভাবে জিহাদ চালিয়ে যাবো- যাবত না আস্নাহ্ আমাকে বিজয় দান করেন অথবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে আমার গদান ঘাড় থেকে। আমি আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করে দেবো। এরপর তিনি বললেন, সে পথে শত্রু সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছে সে পথ হাড়া ভিন্ন পথে আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে- এমন কোন পুরুষ কি আছে? আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকর সূত্রে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আসলাম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি পারবো। ফলে তিনি পাবর্ত্য অঞ্চলের দুর্গম কংকরময় পথ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে চললেন। এ দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করা ছিল মুসলমানদের জন্য এক কঠিন কাজ। সে পথ থেকে বের হয়ে সমতল ভূমিতে আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : তোমরা সকলেই বলো–

আমরা আল্লাহর নিকট পানাহ চাই এবং তাঁর কাছে তাওবা করি- তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। তাঁরা সকলে তা বললে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : এ হল সে হিত্তা (ক্ষমা) যা বনী ইস্রাঈলের উপর পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বলেনি। ইবন শিহাব যুহরী (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোকজনকে নির্দেশ দান করেন মক্কার নিম্নভূমি থেকে হুদায়বিয়ায় আরোহণের পথে সায়াতুল মিরার’ হয়ে ডান দিকের আল-হিস্ এর পথ ধরে চলার জন্য। তিনি বলেন, মুসলিম বাহিনী এভাবেই অগ্রসর হয়। কুরায়শ বাহিনী (মুসলিম) বাহিনীর (পথ পরিক্রমের) ধুলো বালি দেখতে পেয়ে পথ পরিবর্তন করে দ্রুত কুরায়শের নিকট প্রত্যাবর্তন করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে পথে বের হয়ে সানিয়াতুল মিরার’ উপনীত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উট বসে পড়ে। তখন লোকেরা বলে উষ্ট্র অবাধ্য হয়ে থেমে পড়েছে। তিনি বললেন, না নয়, বরং হস্তিবাহিনীকে যিনি রোধ করেছিলেন মক্কায় পৌঁছতে তিনি এ উষ্ট্রকেও রোধ করেছেন। কুরায়শরা আজকের দিনে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি আমাকে আহ্বান জানালে আমি তাদেরকে সে সুযোগ দেবো। এরপর তিনি লোকজনকে বললেন, তোমরা অবতরণ করো। কেউ বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! এখানেতো পানি নেই। তখন তিনি ‘তীরদান থেকে একটা তীর বের করে জনৈক ব্যক্তিকে দান করে কূয়ার নীচে পুঁতে দেয়ার জন্য বললে তিনি পুঁতে দেন। ফলে তা থেকে অবিরাম ধারায় পানি উথলে উঠতে থাকে। যা থেকে লোকেরা তাদের উটকেও পানি পান করায়। ইবন ইসহাক (র) আসলাম গোত্রের জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তির বরাতে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর তীর নিয়ে কূয়োয় অবতরণকারী ব্যক্তি ছিলেন রাসূলের উষ্ট্র চালক নাজিয়া ইবন জুব। পক্ষান্তরে ইবন ইসহাক বলেন, কোন কোন বিজ্ঞজন মনে করেন যে, হযরত বারা ইবন আযিব বলতেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তীর নিয়ে কূপে অবতরণকারী ব্যক্তি ছিলাম আমি! কোটা সঠিক আল্লাহই তা ভাল জানেন। ইবন ইসহাক প্রথম মতের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করে বলেন যে, আনসারদের এক দাসী কূয়ার নিকট আসে। তখন নাজিয়া কূয়ার নীচ থেকে পানি তুলছিল দেখে দাসী বলে।

হে পানি উত্তোলনকারী! আমার বালতি ভরে দাও। আমি লোকদের দেখেছি তোমার প্রশংসা করতে । তারা তোমার সম্পর্কে ভাল বলে এবং তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে। দাসীর কবিতার জবাবে নাজিয়া বলেন :

ইয়ামানী নারী জানে যে, আমি পানি উত্তোলন করছি আর আমার নাম নাজিয়া বিদঘুঁটে পানির ফোঁটাধারী অনেক ভ€সনাকারিণী আছে আমি যার নিন্দা করেছি খারাপ স্বভাব প্রকাশ কালে।

ইমাম যুহরী (র) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) সুস্থির হলে বুদায়ল ইবন ওয়ারাকা খুযায়ী তার সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সমীপে উপস্থিত হন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে কথা বলে আগমনের হেতু জানতে চাইলে তিনি জানালেন যে, যুদ্ধ করার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি আগমন করেননি; বরং তিনি এসেছেন বায়তুল্লাহ্ শরীফ যিয়ারত করতে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। এরপর তিনি বিশর ইব্‌ন সুফিয়ানকে যা বলেছিলেন তাদেরকেও তাই বললেন। তারা কুরায়শের নিকট ফিরে গিয়ে বলে?

হে কুরায়শের লোকেরা! মুহাম্মাদের ব্যাপারে তোমরা তাড়াহুড়া করছো । মুহাম্মাদতো যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আসেননি। তিনি এসেছেন বায়তুল্লাহ শরীফ যিয়ারতের অভিপ্রায় নিয়ে। একথা শুনে তারা তাঁকে দোষারোপ করে এবং তাঁর প্রতি কটুক্তি করে। তারা বলে? সে যদি যুদ্ধ করার জন্য না-ও আসে তবু ও আমরা তাকে জোরপূর্বক প্রবেশ করতে দেবো না এবং আরবদের মধ্যে তার কথা প্রচার করতেও দেব না। যুহরী বলেন, কাফির-মুশরিক নির্বিশেষে খুযাআ গোত্রের সমস্ত লোক ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শুভার্থী। তারা তাঁর কাছে মক্কার কোন কথা গোপন রাখতো না। তিনি আরো বলেন যে, এরপর তারা বনূ আমির ইবন লুয়াই-এর মুফরিয ইব্‌ন হাক্স আখয়াফকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট প্রেরণ করেন। তাকে আসতে দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এ তো দেখছি একটি বিশ্বাসঘাতক। সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে তাঁর সঙ্গে কথা বললে তিনি তাকে সে কথাই বলেন যা বলেছিলেন বুদাইল এবং তার সঙ্গীদেরকে। সে কুরাইশের নিকট ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কথা তাদেরকে জানালে তারা হুলায়স ইবন আলকামা অথবা ইবন সবানকে প্রেরণ করে। এ হুলায়স ছিল আছাবশী তথা কুরায়শ বহির্ভূত গোত্রগুলির দলপতি। সে ছিল বনুল হারিস ইবন আব্‌দ মানাত ইব্‌ন কিনানার অন্যতম সদস্য। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

এ ব্যক্তি এমন এক গোষ্ঠির সদস্য যারা এক আল্লাহকে স্বীকার করে (অর্থাৎ তাওহীদে বিশ্বাসী)। তোমরা কুরবানীর পশু তার সম্মুখে নিয়ে এসো যাতে সে তা দেখতে পায়। তার সম্মুখে কুরবানীর জন্য উপস্থিত করা হলো। সে দেখতে পেলো যে, ওগুলো উপত্যকার ধার ঘেঁষে তার সম্মুখে উপস্থিত হচ্ছে। ওগুলোর গলায় রয়েছে মালা। অবস্থান স্কুল থেকে দূরে দীর্ঘ সময় আটক থাকার কারণে সে গুলো শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থা দেখে সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে না গিয়ে কুরায়শের নিকট ফিরে আসে এবং যা দেখতে পেয়েছে তাদের কাছে তা বলে । তখন কুরায়শের লোকেরা তাকে বলে? বসে পড়ো, তুমিতো নিছক এক বেদুইন। কোন জ্ঞান- ধ্যান নেই। আবদুল্লাহ্ ইবন আবু বকরের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবন ইসহাক (র) বলেন; তবে হুলায়স ক্রুদ্ধ হয়ে বলে–

হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আল্লাহর শপথ, এ কথায় আমরা তোমাদের সঙ্গে চুক্তি করিনি এবং একথায় আমরা তোমাদের মিত্র হইনি যে, কোন ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারত এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আগমন করলে তাকে বাধা দেয়া হবে। হুলায়সের জীবন যার হাতে নিহিত তার শপথ করে বলছি, মুহাম্মাদ এবং তাঁর অভীষ্ঠ বিষয়ের মধ্যে তোমরা অন্তরায় হয়ো না। অন্যথায় আমি সকল আহাবীশকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে চলে যাবো। একথা শুনে তারা বলে ও একটু অপেক্ষা কর, আমরা তাদের নিকট থেকে এমন অঙ্গীকার গ্রহণ করি, যাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি।

যুহরী (র) আরো বলেন এরপর কুরায়শের লোকেরা উরওয়া ইবন মাসউদ সাকাফীকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট প্রেরণ করেন। তিনি রওয়ানা হওয়ার আগে কুরায়শকে উদ্দেশ্য করে বলেন :

হে কুরায়শের লোকেরা! আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তোমরা যাকে মুহাম্মাদের নিকট প্রেরণ কর, সে ফিরে এলে তোমরা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার কর এবং উন্মা প্রকাশ কর। তোমরা জান যে, তোমরা পিতৃস্থানীয় আর আমি সন্তান তুল্য। আর উরওয়া ছিলেন সুবায়’আ বিমৃত আব্দ শামসের সন্তান । তোমাদের বিবাদ সম্পর্কে আমি শুনতে পেয়েছি। আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা আমাকে মান্য করে তাদেরকে একত্র করেছি এবং তোমাদের কাছে তাদেরকে নিয়ে এসেছি (তোমাদের সাহায্যের জন্য) এমনকি আমি নিজে তোমাদের সমবেদনায় এগিয়ে এসেছি। উরওয়ার এসব কথা শুনে তারা বললো, তুমি যথার্থই বলেছ। তোমার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। এরপর তিনি বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে তাঁর সম্মুখে আসন গ্রহণ করে বললেন :

মুহাম্মাদ! তুমি কিছু বখাটে লোক একত্র করে তাদেরকে নিয়ে নিজ গোত্রের সর্বনাশের আয়োজন করেছ। কুরায়শের লোকজন তাদের সন্তানাদি নিয়ে ময়দানে সমবেত হয়েছে। তারা বাঘের চামড়া পরিধান করেছে। তারা আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে, তুমি শক্তি প্রয়োগ করে কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। আল্লাহর শপথ, আজ যারা তোমার চতুর্দিকে জড়ো হয়েছে কাল তারা সকলেই উধাও হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহর (সা) পিছনে ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)। উরওয়ার বক্তব্য শুনে তিনি বললেন :

লাত দেবীর অঙ্গ বিশেষ চুষতো। আমরা কি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গ ত্যাগ করে চলে। যাবো? উরওয়া জানতে চায়, হে মুহাম্মাদ! ইনি কে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানালেন- এ হলো আৰু কুহাফার পুত্র। উরওয়া বললো : আল্লাহর কসম, আমার প্রতি আপনার অনুগ্রহ না থাকলে আমি অবশ্যই আপনার কথার জবাব দিতাম। কিন্তু অনুগ্রহের কারণে জবাব দিলাম না। যুহরী (র) বলেন : এরপর উরওয়া কথা বলতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দাড়ি মুবারক স্পর্শ করেন। মুগীরা ইবন শুবা তখন অস্ত্র হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যুহরী (র) বলেন : উরওয়া রাসূল (সা)-এর দাড়ি মুবারকে হাত রেখে কথা বলার সময় হাত নাড়লে হযরত মুগীরা (রা) তার হাতে ঠোকর দিয়ে বলতেনঃ তোমার হাত সরাও নতুবা তা আর তোমার দিকে ফিরে আসবে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুখের উপর এভাবে হাত নাড়াবে না। তখন উরওয়া বলে ও দুঃখ হয় তোমার জন্য, তুমি কতটা হঠকারী আর বদমেজায! এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) মৃদু হাসলে উরওয়া জিজ্ঞেস করেন, মুহাম্মাদ! এ কে? তিনি বললেন, এ তোমার ভাতিজা মুগীরা ইবন শু বা । উরওয়া বললেন, হে দাগাবাজ! আমিতো গতকালই তোমার দাগাবাজীর হাত ধুয়ে দিয়েছিলাম। যুহরী (র) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন, যেমনভাবে তিনি বলেছেন তার পূর্বেকার সঙ্গীদেরকে। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে একথাও জানিয়ে দেন যে, তিনি যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আগমন করেননি। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখ থেকে সরে আসার জন্য উঠে দাঁড়ান। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবীগণ তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করেন এ সময় তিনি দূরে দাঁড়িয়ে তা পর্যবেক্ষণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উযু করলে তাঁরা ছুটে এসে তাঁর উযূর পানি নিয়ে নিতেন (মাটিতে পড়তে দিতেন না), তিনি থুথু ফেললো, সাহাবীগণ ছুটে এসে তাও তুলে নিতেন এবং তাঁর চুল-দাড়ির কোন পশম খসে পড়লে তাও তারা ছুটে এসে লুফে নিতেন।

তিনি কুরায়শের নিকট প্রত্যাবর্তন করে বললেন :

হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আমি কিরা, কায়সর এবং নাজাশীর মতো সম্রাটদের দরবার ঘুরে এসেছি। আল্লাহর শপথ! আমি কখনো কোন সম্রাটকে তার লোকজনের এমন মর্যাদার আসনে দেখতে পাইনি, যেমনটি দেখতে পেয়েছি মুহাম্মাদকে তার সঙ্গীদের মধ্যে। তারা কোন অবস্থায়ই তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাবে না, তোমরা এখন নিজেরাই মত স্থির কর, কী করবে। কোন কোন ওয়াকিফহাল মহলের উদ্ধৃতি দিয়ে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বলেন :

রাসূলুল্লাহ্ (সা) খারাশ ইবন উমাইয়া খুযায়ীকে ডেকে তাঁর উট সা’লাব এর পিঠে সওয়ার করিয়ে কুরায়শের নিকট রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমনের মূল পয়গাম পৌঁছাবার জন্য প্রেরণ করেন। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উটনীকে বধ করে এবং খারাশকেও হত্যা করতে উদ্যত হলে আহাবীশরা তাকে রক্ষা করে। তখন তারা তাকে ছেড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ফিরে আসতে সক্ষম হন। নির্ভরযোগ্য রাবী থেকে ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে ইবন ইসহাক (র) বর্ণনা করেন যে, কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাহিনীকে নিরীক্ষণ করার জন্য ৪০/৫০ জনের একটা দলকে প্রেরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কোন সাহাবীকে আক্রমণ করা। তাদেরকে পাকড়াও করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে হাযির করা হলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে তাদেরকে মুক্ত করে দেন। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাহিনীর প্রতি প্রস্তর এবং তীরে নিক্ষেপ করেছিল। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)–কে ডেকে কুরায়শের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিকট রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিতে বললে তিনি আরয করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমার জীবনের ব্যাপারে কুরায়শকে আমি হুমকি মনে করি। আর মক্কায় বনূ আদীর মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমাকে রক্ষা করতে পারে। আর কুরায়শরা আমার প্রতি কতটা ক্ষুদ্ধ আর রুষ্ট তাতো আপনি জানেনই। তবে আমি এমন এক ব্যক্তির কথা আপনাকে বলবো যিনি আমার চেয়েও বেশী মর্যাদাশীল। তিনি হচ্ছেন উছমান ইবন আফফান (রা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে ডেকে আবু সুফিয়ান প্রমুখ কুরায়শী নেতৃবৃন্দের নিকট প্রেরণ করেন তাদেরকে একথা জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুদ্ধ করার জন্য আগমন করেননি, বরং তিনি আগমন করেছেন বায়তুল্লাহর যিয়ারত এবং প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। হযরত উছমান (রা) মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যান। মক্কায় প্রবেশকালে অথবা তার কিছু আগে আবান ইবন সাঈদ ইবনুল আস এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। তিনি তাঁর বাহনের সম্মুখে তাঁকে। বসান এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পয়গাম পৌঁছানোর পর্যন্ত তাকে নিরাপত্তা দান করেন। এরপর হযরত উছমান (রা) আবু সুফিয়ান প্রমুখ কুরায়শ নেতৃবৃন্দের নিকট গমন করেন এবং তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পয়গাম পৌঁছান। তারা তাঁর বক্তব্য শুনে বললো– তুমি যাই ইচ্ছা কর তা হলে আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করতে পার। তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাওয়াফ না করা পর্যন্ত আমিতো তাওয়াফ করতে পারিনা। এ সময় কুরায়শরা হযরত উছমান (রা)-কে আটক করলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং মুসলমানদের নিকট খবর পৌঁছে যে, হযরত উছমান (রা)-কে হত্যা করা হয়েছে। ইবন ইসহাক (র) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আবূ বকর (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, হযরত উছমান (রা) নিহত হয়েছেন- একথা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন ও তাদের থেকে বদলা না নিয়ে আমরা ফিরে যাবো না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সকলকে বায়আত করার জন্য আহ্বান জানান। একটা গাছের তলায় অনুষ্ঠিত এই বায়আতকে বায়আতে রিদওয়ান’ বলা হয়। লোকেরা বলাবলি করতো রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের কাছ থেকে আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার বায়আত গ্রহণ করেন। আর জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) বলতেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নিকট থেকে আমৃত্যু লড়বার বায়আত গ্রহণ করেননি। বরং তিনি বায়আত গ্রহণ করেছিলেন যে, আমরা যেন পলায়ন করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নিকট থেকে এ মর্মে বায়আত গ্রহণ করেন। বনূ সালিমার জা ইবন কায়স ছাড়া মজলিসে উপস্থিত কেউই এ বায়আত গ্রহণ থেকে পিছিয়ে থাকেননি। এ সম্পর্কে হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) বলেন, আল্লাহর কসম, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি জাদ তার উস্ত্রীর আড়ালে লোকজন থেকে লুকাচ্ছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট খবর আসে যে, উছমান (রা)-এর ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা গুজব মাত্র। ইবন হিশাম ওয়াকী সূত্রে– শা’বীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, বায়আতুর রিদওয়ানে সর্বপ্রথম যিনি বায়আত গ্রহণ করেন তিনি ছিলেন আবু সিনান আল-আসাদী। নির্ভরযোগ্য রাবীর বরাতে ইবন উমর সূত্রে ইবন হিশাম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে হযরত উছমান (রা) এর পক্ষ থেকে বায়আত গ্রহণ করেন এবং তার নিজের এক হাতের উপর অপর হাত স্থাপন করেন, যে সনদে ইবন হিশাম এ হাদীছটি বর্ণনা করেন তা দুর্বল; তবে হাদীছটি দুর্বল হলেও বুখারী এবং মুসলিমের রিওয়ায়াতে ব্যাপারটি সমর্থিত। যুহরী (র)-এর বরাতে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন যে; এরপর কুরায়শ বনূ আমির ইব্‌ন লুয়াই-এর অন্যতম সদস্য সুহায়ল ইবন আম্রকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খিদমতে প্রেরণ করে এবং তাকে বলে দেয় যে, মুহাম্মাদ এর নিকট গমন করে তাঁর সঙ্গে সন্ধি কর । সন্ধিতে একথা অন্তর্ভুক্ত থাকবে যে, এ বহর (ওমরা না করেই) তাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আল্লাহর কসম, আরবে এ কথা যেন বলাবলি না হয় যে, মুহাম্মাদ জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেছেন। সুহায়ল ইবন আরকে আগমন করতে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, সন্ধির উদ্দেশ্যে তারা এ ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছে, সুহায়ল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তারা সন্ধির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন। কথাবার্তা কেবল পাকাপাকি হয়ে যায় সন্ধিপত্র লেখা বাকী ছিল এমন সময় উমর (রা) আবু বকর (রা)-এর নিকট ছুটে যান এবং বলেন : আবু বকর! তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন? আবু বকর বললেন, অবশ্যই। উমর বললেন, আমরা কি মুসলিম নই? আবু বকর বললেন, নিঃসন্দেহে। উমর (রা) আবার বললেন, তারা কি মুশরিক নয়। তিনি বললেন, এতে কোনই সন্দেহ নেই; উমর বললেন, তাহলে দীনের ব্যাপারে আমরা কেন হীনতা স্বীকার করে নেব? তখন আবু বকর (রা) বললেন, হে উমর! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আনুগত্য শক্তভাবে অবলম্বন কর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল! উমর (রা) বললেন, আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট হাযির হয়ে আরয করলেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আপনি কি আল্লাহর রাসূল নন? তিনি বললেন, অবশ্যই। উমর বললেন, আমরা কি মুসলিম নই! জবাবে তিনি বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন, তারা কি মুশরিক নয়? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, অবশ্যই; এবার উমর (রা) বললেন, তবে কেন আমরা দীনের ব্যাপারে এ দীনতা হীনতা মেনে নেবো? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, আমি আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারি না এবং আল্লাহ্, কিছুতেই আমার বিনাশ সাধন করবেন না, উমর (রা) বলতেন, সেদিন আমি যেসব কড়া কথা বলেছি সে ভয়ে আমি অব্যাহতভাবে নামায পড়ি, রোযা রাখি, সদকা করি, দাস মুক্ত করতে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমি কল্যাণ লাভের আশা করি।

ইবন ইসহাক (র) বলেন : এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) আলী ইব্‌ন আবু তালিবকে ডেকে এনে বললেন, লেখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম; সুহায়ল বললেন, এটা কি, আমি জানি না, তবে বিসমিকা আল্লাহুম্মা (4LJf Law)- “হে আল্লাহ! তোমার নামে লিখ, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, লেখ বিসমিকা আল্লাহুম্মা। আলী (রা) তাই লিখলেন, এরপর বললেন, লেখ–

এ হচ্ছে সে চুক্তিপত্র যাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং সুহায়ল ইবন আমর একমত হয়েছেন। সুহায়ল বললেন, আমি যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলেই স্বীকার করতাম, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতাম না, বরং আপনার এবং আপনার পিতার নাম লিখুন! তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, লেখ!

এ হলো সেসব শর্ত, যাতে মুহাম্মাদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ এবং সুহায়ল ইবন আমর চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, (১) উভয় পক্ষের মধ্যে দশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এসময় লোকেরা নিরাপদে নিরুপদ্রবে জীবন-যাপন করবে, একে অন্যের উপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে, (২) কুরায়শের কোন লোক তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুহাম্মাদ এর নিকট আগমন করলে তিনি তাকে ফেরত পাঠাবেন, কিন্তু মুহাম্মাদের সঙ্গী-সাথীদের মধ্য থেকে কেউ কুরায়শের নিকট চলে আসলে তারা তাকে ফেরত দিবে না। (৩) আমরা আমাদের কোন পক্ষ অপর পক্ষকে যুদ্ধের জন্য প্রকাশ্যে বা গোপনে যুদ্ধের উস্কানী দেবে না। (৪) যার ইচ্ছা মুহাম্মাদ এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে আর যার ইচ্ছা কুরায়শদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে। সে মতে বনূ খুযাআ মুহাম্মাদ (সা)-এর সঙ্গে এবং বকর কুরায়শের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।

(৫) এ বছর মুসলমানগণ মক্কায় প্রবেশ না করেই ফিরে যাবেন, (৬) আগামী বছর কুরায়শরা মুসলমানদের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দেবে, মুহাম্মাদ সঙ্গি-সাথী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন এবং (৭) সেখানে তিন দিন অবস্থান করতে পারবেন । (৮) তখন পথিক সুলভ কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সাথে থাকবে না ।

যুহরী (র) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং সুহায়ল ইব্‌ন আমর এর চুক্তিপত্র লিখা হচ্ছে এমন সময় সুহায়ল ইবন আমর এর পুত্র আবু জল লোহার বেড়ি পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)–এর সম্মুখে উপস্থিত হন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে বিজয় সম্পর্কে সাহাবীগণের মনে কোন সন্দেহ সংশয় ছিল না, তাই তারা যখন সন্ধি স্থাপন ও ফিরে যাওয়ার শর্ত মেনে নেয়া এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ধৈর্য-স্থৈর্য প্রত্যক্ষ করলেন, তখন তারা এমন মর্মাহত হন যে, তাদের জীবন নাশের উপক্রম হয়। সুহায়ল আবূ জলকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যান, তাঁকে চপেটাঘাত করেন এবং জামার প্রান্ত ধরে বলেন : হে মুহাম্মাদ! এর আগমনের পূর্বেই আপনার ও আমার মধ্যে সন্ধিশর্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। রাসূলল্লাহ (সা) বললেন : যথার্থ। সুহায়ল আৰু জন্দলকে টেনে হেঁচড়ে কুরায়শদের কাছে নিয়ে যেতে শুরু করে। এ সময় আবূ জল উচ্চস্বরে ফরিয়াদ করে বলছিলো?

হে মুসলিম সমাজ! আমাকে কি মুশরিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে? তারা আমাকে ধর্মচ্যুত করতে প্রয়াস পাবে। এ অবস্থা দেখে সাহাবীগণের মর্মযাতনা আরো বৃদ্ধি পেলো। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে দেখে বললেন : হে আবু জল! ধৈর্য ধারণ কর আর ছাওয়াবের আশা পোষণ কর। কারণ আল্লাহ্ তোমার জন্য তোমার অন্যান্য দুর্বল সঙ্গীদের মুক্তি ব্যবস্থা করবেন। আমরা এইমাত্র কুরায়শ সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি বদ্ধ হয়েছি আর তারাও আমাদের সঙ্গে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারিনা।

রাবী বলেন যে, উমর ইবনুল খাত্তাব তখন ছুটে নিয়ে আবু জলের পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন। এ সময় তিনি বলছিলেন :

হে আৰূ জল! ধৈর্য ধারণ কর, তারাতো মুশরিক, তাদের রক্ততে কুকুরের রক্ত তুল্য। হযরত উমর (রা) এর সঙ্গে তলোয়ারও ছিল। তিনি বলেন, আমি আশা করছিলাম আবূ জল তরবারি খানা নিয়ে তার পিতার গর্দানে মারবেন। আবূ জল পিতার প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং চুক্তিটি কার্যকর হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) চুক্তিপত্র লিপিবদ্ধ করা সম্পন্ন করে মুসলমান এবং মুশরিকদের মধ্যে কয়েকজনকে সাক্ষী রাখেন। মুসলমানদের মধ্যে সাক্ষী ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা), উমর ইবনুল খাত্তাব (রা), আবদুর রহমান ইবন আওফ, আবদুল্লাহ ইবন সুহায়ল ইবন আমর, সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস। আর মুশরিকদের মধ্যে মাহমূদ ইবন মাসলামা ও মুকরি ইবন হাফস তখনো তিনি মুশরিক ছিলেন। আর হযরত আলী ইবন আবু তালিব চুক্তিপত্রটি লিপিবদ্ধ করেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে সময় হেরেম এলাকার বাইরে তাঁবু খাটান এবং হেরেমে নামায আদায় করতেন, চুক্তিপত্র সম্পাদন শেষে তিনি কুরবানীর পশু গুলির দিকে এগিয়ে যান এবং পশু জবাই করেন। তারপর বসে মস্তক মুণ্ডন করেন। আর এ দিন তাঁর মস্তক মুণ্ডনের কার্য সম্পাদন করেন খারাশ ইবন উমাইয়া ইবন ফযল খুযায়ী। লোকেরা যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুরবানী করে মস্তক মুণ্ডন করেছেন তখন তারা সকলেও উঠে যান এবং কুরবানী ও মস্তক মুণ্ডন করেন। ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ ইবন আবু নাজীহ– ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুদায়বিয়ার দিন কিছু লোক ‘হলফ করেন অর্থাৎ মাথা মুণ্ডন করেন আর কিছু লোক কসর করেন অর্থাৎ চুল ছোট করে হাঁটেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) দু’আ করলেন :–

তারা মস্তক মুণ্ডন করেছে তাদের প্রতি আল্লাহ্ রহম করুন, সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! মাথা ছাঁটাইকারীদের কী হবে? তখন তিনি বললেন, আল্লাহ মস্তক মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন। আল্লাহ মস্তক মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন!! আল্লাহ মস্তক মুণ্ডনকারীদের প্রতি রহম করুন!!! চতুর্থবার বললো, চুল ছাঁটাইকারীদের প্রতিও আল্লাহ্ রহম করুন। তখন সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আপনি কেন মস্তক মুণ্ডনকারীদের জন্য রহমতের দু’আ পরপর করলেন, চুল কর্তনকারীদেরকে বাদ দিয়ে? রাসূল (সা) বললেন : যারা মস্তক মুণ্ডন করেছে, ইহরাম খোলার ব্যাপারে তাদের মনে কোন রকম সন্দেহ সংশয় ছিল না। আবদুল্লাহ ইবন আবু নাজীহ মুজাহিদ সূত্রে হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুদায়বিয়ার বছর কুরবানীর পশুর মধ্যে আবূ জাহলের উটও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মাথায় ছিল রৌপ্যের কুণ্ডলী, তিনি এ কাজ করেন, যাতে কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি হয়।

হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে এ হল মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র)-এর বর্ণনা, বুখারী (র)-এর বর্ণনায় কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে, যা আমরা পরে দেখতে পাবো ইনশাআল্লাহ! ইমাম বুখারীর পূর্ণ বর্ণনা আমরা উল্লেখ করবো এবং তাতে সহীহ্ এবং হাসান হাদীছও অন্তর্ভুক্ত করবো। ইন্শাআল্লাহ্।

ইমাম বুখারী (র) খালিদ ইবন মাখলাদ– যায়দ ইবন খালিদ সূত্রে বর্ণনা করে বলেন :

হুদায়বিয়ার বছরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে বের হলাম। সে রাত্রে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফজরের সালাত আদায় করে আমাদের দিকে মুখ করে বললেন : তোমরা কি জান, তোমাদের পালনকতা কী বলেছেন। আমরা বললাম আল্লাহ্ এবং তার রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ্ বলেছেন : আমার বান্দাদের মধ্যে কিছু লোক সকালে আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আর কিছু হয়েছে আমার প্রতি কাফির বেঈমান।তাদের মধ্যে যারা বলেছে যে, আল্লাহর রহমত বরকত আর ফসলে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, তারা আমার প্রতি ঈমানদার আর নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যারা বলে যে, অমুক নক্ষত্রের দ্বারা আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। সে নক্ষত্রে বিশ্বাসী কিন্তু আমাতে অবিশ্বাসী । ইমাম বুখারী (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থের একাধিক স্থানে হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম মুসলিমও ইমাম যুহরী থেকে বিভিন্ন সূত্র হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরী (র) থেকে উবায়দুল্লাহ্ ইবন আবদুল্লাহর মারফত হযরত আবু হুরায়রাও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (র) উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন মূসা–… বারা’ সূত্রে বর্ণনা করে বলেন! তোমরাতো মক্কা বিজয়কেই আসল বিজয় মনে করে থাক আর ফতেহ মক্কা’ অবশ্যই বিজয় ছিল। তবে আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন বায়আতুর রিদওয়ানকে বিজয় মনে করি। নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে আমরা ১৪০০ সঙ্গী ছিলাম আর হুদায়বিয়ায় ছিল একটা কুয়া। আমরা কৃয়া থেকে পানি উত্তোলন করি এবং এমন কি তাতে এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট ছিল না। নবী করীম (সা) এ সম্পর্কে জানতে পেয়ে সেখানে আগমন করেন এবং কূয়ার কিনারায় বসে পানির একটা পাত্র আনতে বলেন এবং সে পানি দিয়ে উযূ করেন কুলি করেন তার দু’আ করেন ও সে পানি কূয়া ফেলে দেন। এরপর কিছুক্ষণ আমরা অপেক্ষা করলাম। তারপর কূয়া আমাদের এবং আমাদের সওয়ারীর জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করলো। ইমাম বুখারী এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করে।

আর ইবন ইসহাক আল্লাহ্ তা’আলার বাণী সম্পর্কে বলেন যে, এখানে তথা নিকট বিজয় অর্থ হুদায়বিয়ার সন্ধি। আর যুহরী (র) বলেন, ইসলামে ইতিপূর্বে এর চেয়ে বড় বিজয় সাধিত হয়নি। যেখানে দুদল মুখোমুখী হতো সেখানেই যুদ্ধ হতে সন্ধি স্থাপিত হলে অস্ত্র সংরক্ষিত হলো লোকেরা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করলো। একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। মেলামেশা করে। পরস্পরে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে যাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল তারা ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা শুনে ইসলাম গ্রহণ করতো। ইতিপূর্বে যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের সম পরিমাণ বা ততোধিক ব্যক্তি এ দুবছরে ইসলাম গ্রহণ করে। যুহরী (র) যা বলেছেন তার প্রমাণ এই যে, হযরত জাবির (রা)-এর উক্তি মতে রাসূলুল্লাহ (সা) ১৪শ সাহাবীর সঙ্গে হুদায়বিয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। পক্ষান্তরে দু’বছর পর মক্কা বিজয় কালে তিনি ১০ হাজার সঙ্গী নিয়ে বের হন।

ইমাম বুখারী ইউসুফ ইবন ঈসা– জাবির সূত্রে বর্ণনা করেন : হুদায়বিয়ার দিন লোকেরা পিপাসায় কাতর হন। একটা পাত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে কিছু পানি ছিল। তিনি তা থেকে উযূ করলেন। এরপর লোকেরা তাঁর দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? তোমাদের কী হয়েছে : তাঁরা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমাদের কাছে উযূ করার মতো পানি নেই। পান করার মতো কোন পানিও নেই আমাদের কাছে। আপনার পাত্রে যা আছে কেবল এতটুকু ছাড়া। তখন নবী করীম (সা) পানির পাত্রে হাত রাখলেন। এতে তা থেকে ফোয়ারার মতো পানি উথলে উঠতে থাকে। রাবী বলেন, আমরা পান করলাম। উফু করলাম। জাবিরকে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। সেদিন আপনারা কত লোক ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা ১৫শ লোক ছিলাম, তবে আমরা যদি সংখ্যায় এক লাখ হতাম তাহলেও তা আমাদের সকলের জন্য যথেষ্ট হতো। বুখারী (র) এবং মুসলিম ভিন্ন সূত্রেও জাবির থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। বুখারী (র) সাত ইবন মুহাম্মাদ–… জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তাঁরা ছিলেন চৌদ্দশ জন। সাঈদ বলেন, জাবির আমাকে বলেন যে, যারা হুদায়বিয়ার দিন বায়আত করেছেন তাঁরা ছিলেন পনের শ”। ইমাম আবু দাউদ এর সমর্থক হাদীছ বর্ণনা করেন। হাদীছটি বুখারীর (র) একক বর্ণনা। বুখারী আলী ইবন আবদুল্লাহ্– জাবির সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুদায়বিয়ার দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে বলেন : তোমরা পৃথিবীর সেরা মানব গোষ্ঠি। আমরা ছিলাম চৌদ্দশ জন। আজ যদি আমার দৃষ্টিশক্তি থাকতো তবে বৃক্ষের স্থানটি তোমাদেরকে দেখাতাম। বুখারী (র) ও মুসলিম (র) সুফিয়ান ইবন উয়াইনা সূত্রেও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে যায়দ ইবন সা’দ– জাবির সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন : হাতিবের এক গোলাম রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট অভিযোগ করে বলে : ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! হাতিব নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : তুমি মিথ্যা বলছ, বদর আর হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিল এমন লোক জাহান্নামে যাবে না। মুসলিম (র) হাদীছটি বর্ণনা করেন। মুসলিম (র) ভিন্ন সূত্রে জাবির থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, উম্মে মুবাশশার আমাকে জানান যে, তিনি রাসূল করীম (সা)-কে হাফসাকে (রা) লক্ষ্য করে বলতে শুনেছেন–

বৃক্ষের সাথী যারা বৃক্ষের নীচে বায়আত গ্রহণ করেছেন ইনশাআল্লাহ্ তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। তখন হাফসা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঠিক? তখন রাসূলুল্লাহ (সা) হাফসাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। হাফসা বললেন : তোমাদের প্রত্যেককেই তা অতিক্রম করতে হবে। (১৯ মারয়াম : ৭১) তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : আল্লাহ তাআলা

বলেছেন :  পরে আমি মুত্তাকীদেরকে নাজাত দেবো আর যালিমদেরকে সেখানে নিক্ষেপ করবো নতজানু অবস্থায় (১৯ মারয়াম : ৭২) বুখারী (র) উবায়দুল্লাহ ইবন মু’আয–. আবদুল্লাহ্ ইবন আবু আওফা সূত্রে বলেন যে, বৃক্ষের তলায় বায়আত গ্রহণকারী ছিলেন ১৩শ আর আসলাম গোত্র ছিল মুহাজিরদের এক অষ্টমাংশ। মুহাম্মাদ ইবন বাশশার সূত্রে ইমাম আবু দাউদ (র) তাঁর সমর্থনে হাদীছ বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে বুখারী (র) আবদুল্লাহ্ সূত্রে সনদবিহীনভালে হাদীছটি বর্ণনা করেন। মুসলিম (র)ও একাধিক সূত্রে শুবা থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেন। এরপর বুখারী (র) আলী ইবন আবদুল্লাহ– সাফওয়ান ও মিস্ওয়ার ইবন মাখরামা সূত্রে বর্ণনা করেন :

হুদায়বিয়ার বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তেরশ-এর বেশী সঙ্গী নিয়ে বের হন। যুল হুলায়ফায় পৌঁছে ‘হাদী’কে কালাদা পরান, চিহ্নিত করেন এবং সেখান থেকে ইহরাম বাঁধেন; বুখারী (র) এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেন । পূর্ণ বর্ণনা পরে আসছে।

মোদ্দা কথা এই যে, এইসব বর্ণনা ইবন ইসহাকের সেই মতের বিপরীত যাতে তিনি বলেছিলেন যে, হুদায়বিয়ার সঙ্গীদের সংখ্যা সাতশ আল্লাহই ভাল জানেন। হতে পারে যে, তিনি নিজের বিবেচনা অনুসারে একথা বলে থাকবেন। কারণ, সেদিন কুরবানী উষ্ট্র ছিল ৭০টি। দশ জনের পক্ষ থেকে ১টি করে উষ্ট্র কুরবানী করা হলে ৭০x১০=৭শ হয়। এটাও নয় যে, তাদের প্রত্যেকেই এক একটি হাদী কুরবানী করবেন এবং প্রত্যেকেই ইহরাম বাঁধবেন। কারণ, প্রমাণ আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুদায়বিয়ার সাথীদের একটা দলকে প্রেরণ করেন, সে দলে আবু কাতাদাও ছিলেন। আবু কাতাদা ইহরাম বাঁধেননি। এমনকি একটা বন্য গাধা বধ করে তিনি আর তার সঙ্গীরা আহার করেন এবং পথে গাধার গোস্তের কিছু অংশ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যও নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করেন : তোমাদের কেউ কি তাকে শিকার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে বা শিকারের প্রতি ইঙ্গিত করেছে? সকলেই বললেন না। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : গাধার যা অবশিষ্ট রয়েছে তোমরা আহার করতে পার। বুখারী (র) শুবা ইবন রবী’— আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবু কাতাদা সূত্রে তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, হুদায়বিয়ার বছর আমরা নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে রওয়ানা হই। আমার সঙ্গীরা ইহরাম বাঁধেন কিন্তু আমি ইহরাম বাঁধিনি। বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইবন রাফি– সাঈদ ইবন মুসায়্যাব সূত্রে তিনি তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি সে বৃক্ষটি দেখেছি; কিন্তু পরবর্তীকালে এসে তা আর চিনতে পারিনি। মূসা মুসায়্যাব সূত্রে বলেন : বৃক্ষের নীচে যারা বায়আত করেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। পরবর্তী বছর সেখানে গিয়ে আর সেটি ঠিক চেনা যায়নি। ইমাম বুখারী (র) মাহমুদ– তারিক ইবন আবদুর রহমান সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, আমি হজ্জের পথে এক দল লোকের নিকট দিয়ে গমন করি। তারা তখন নামায আদায় করছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। এটা কোন মসজিদ? জবাবে তারা বললো : এটা সে বৃক্ষ, যেখানে নবী করীম (সা) বায়আতুর রিযওয়ানের বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাবের নিকট গমন করে এ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলে তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে বলেছেন যে, বৃক্ষের তলায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যারা বায়আত করেছেন। তিনিও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । তিনি বলেন, কিন্তু পরবর্তী বছর আমরা সে বৃক্ষটি আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে যায় আমরা আর তা চিনতে সক্ষম হইনি। সাঈদ আরো বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গীরা বৃক্ষটি চিনতে পারতেন না। আর তোমরা তা চিনতে পারলে। তবে কি তোমরা বেশী জান? বুখারী ও মুসলিম (র) হাদীছটি ছাওরী–… তারিক সূত্রেও বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (র) সাঈদ– আব্বাদ ইবন তামীম সূত্রে বর্ণনা করেন : হাররার দিন লোকেরা আবদুল্লাহ্ ইবন হানযালার হাতে বায়আত গ্রহণ করছিল, তখন ইব্‌ন যায়দ বলেন : ইবন হানযালা কিসের উপর লোকদের নিকট থেকে বায়আত নিচ্ছেন। কেউ বললো : মৃত্যুর উপর। তখন তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর এ বিষয়ে আমি কারো নিকট থেকে বায়আত গ্রহণ করবে না। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে হুদায়বিয়ায় হাযির ছিলেন। বুখারী (র) ও মুসলিম (র) আর ইবন ইয়াহইয়া সূত্রেও হাদীছটি বর্ণনা করেন। বুখারী (র) কুতায়বা ইবন সাঈদ– আবু উবায়দ সূত্র উদ্ধৃত করে বলেন যে, আমি সালামা ইবনুল আওয়াকে জিজ্ঞেস করলামঃ হুদায়বিয়ার দিন আপনারা কিসের উপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বায়আত করেছিলেন। তিনি বললেন, মৃত্যুর উপর। মুসলিম (র) ও য়াযীদ ইবন আবু উবায়দ সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন। সহীহ মুসলিমে সালামা থেকে বর্ণিত যে, তিনি তিনবার বায়আত করেন, শুরুতে মধ্যখানে এবং শেষে সহীহ গ্রন্থে মা’কিল ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চেহারা থেকে বৃক্ষের ডালসমূহ সরাচ্ছিলেন যখন তিনি লোকজন থেকে বায়আত গ্রহণ করছিলেন। আর এ দিন সর্ব প্রথম যিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন। তিনি হলেন আবু সিনান। আর এ আবু সিনান হলেন উক্কাশা ইবন মিহসান এর ভাই ওয়াহাব ইবন মিহসান। ভিন্ন মতে সিনান ইকন আবু সিনান।

বুখারী (র) সুজা ইবনুল ওলীদ–নাফি’ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, লোকেরা বলাবলি করে যে, ইবন উমর উমর (রা)-এর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আসলে ব্যাপার কিন্তু তা নয়। তবে হুদায়বিয়ার দিন উমর (রা) তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে জনৈক আনসারীর নিকট থেকে তার একটা ঘোড়া আনার জন্য প্রেরণ করেন, যাতে করে তাতে সওয়ার হয়ে তিনি যুদ্ধ করতে পারেন। আর এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) গাছের নিকট বায়আত গ্রহণ করছিলেন। আর উমর (রা) এ সম্পর্কে জানতেন না। তাই আবদুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহর হাতে বায়আত করেন। এরপর তিনি হযরত উমরকে সঙ্গে নিয়ে এলে তিনি রাসূল (সা)-এর নিকট বায়আত করেন। এর ফলে লোকেরা বলাবলি করে যে, ইবন উমর হযরত উমর (রা)-এর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। হিশাম ইবন আম্মার ওলীদ ইবন মুসলিম– ইবন উমর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হুদায়বিয়ার দিন লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে বৃক্ষের নীচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। হঠাৎ দেখে মনে হয় যে, লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বেষ্টন করে রেখেছেন। তখন হযরত উমর (রা) বললেন, হে আবদুল্লাহ্! দেখ তো কী অবস্থা, লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বেষ্টন করে আছে। তিনি দেখতে পেলেন লোকেরা বায়য়াত করছে, তখন তিনিও বায়আত করেন। এরপর তিনি উমর (রা)-এর নিকট ফিরে গেলে তিনিও বেরিয়ে এসে বায়আত করলেন, এ সূত্রছয় থেকে বুখারী (র) এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেন।

উমরাতুল হুদায়বিয়া : বুখারীর বর্ণনা

বুখারী (র) কিতাবুল মাগাযীতে আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ– মিস্ওয়ার ইব্‌ন মামী ও মারওয়ান ইবন হাকাম সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তাঁরা উভয়ে বলেন যে, হুদাবিয়ার বছর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তের শতাধিক সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে বের হন, যুল হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে তিনি ‘হাদী’ তথা কুরবানীর পশুকে কালাদা পরান, চিহ্নিত করেন এবং সেখান থেকে উমরার ইহরাম বাঁধেন এবং খুযাআ গোত্র থেকে একজন গুপ্তচর প্রেরণ করেন। নবী করীম (সা) চলতে থাকেন তিনি গাদীর আল-আশতাত’ নামক স্থানে পৌঁছলে গুপ্তচর তার কাছে এসে বলে?

কুরায়শরা আপনার বিরুদ্ধে লোকবল সমবেত করেছে তারা অাপনার বিরুদ্ধে আহাৰীশ’ দেরকেও একত্র করেছে, তারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এবং বায়তুল্লাহয় গমন করতে আপনাকে বাধা দেবে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, লোক সকল! তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। তোমরা কি মনে কর, যারা আমাদেরকে বায়তুল্লাহর যিয়ারত করতে বাধা দেয় আমি তাদের পরিবার ও সন্তানদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হামলা চালাবো? তারা আমাদের নিকট এলে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের একটা দলকে ধ্বংস করে দেবেন, অন্যথায় আমরা তাদেরকে যুদ্ধে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছেড়ে আসবো, তখন আবূ বকর (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আপনিতো বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, আমরা কাউকে হত্যা করতে চাই না। কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আপনি সে লক্ষ্যেই মনোনিবেশ করুন, তবে কেউ আমাদেরকে বাধা দিলে আমরা তার সঙ্গে লড়াই করবো। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাহলে আল্লাহর নাম নিয়ে তোমরা সম্মুখে অগ্রসর হও! বুখারী এখানে এ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন, এরচেয়ে বেশী কিছু উল্লেখ করেননি। বুখারী (র) কিতাবুশ শুরুত তথা জিহাদের শর্ত অধ্যায়ে আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুহাম্মাদ– মিসওয়ার ইবন মারামা ও মারওয়ান ইবনুল হাকাম সূত্রে বর্ণনা করেন :

হুদায়বিয়ার দিনগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সা) বহির্গত হলেন। তিনি তখনো পথে । এমন সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : খালিদ ইবন ওয়াণদি কুরায়শ দলের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে অগ্রগামী দলরূপে ‘গামীম’ নামক স্থানে আছে। সুতরাং তোমরা ডান দিকের পথ ধরে অগ্রসর হও। রাবীদ্বয় বলেন, আল্লাহর কসম, খালিদ তাদের সম্পর্কে জানতে পারেনি। যতক্ষণ না তারা সৈন্যদের চলা ধূলা তারা দেখতে পায়। তখন খালিদ কুরায়শকে সতর্ক করার জন্য ছুটে যায়। নবী করীম (সা) পথ চলা অব্যাহত রাখেন। তিনি যখন ‘ছানিয়া নামক স্থানে পৌঁছেন, যেখান থেকে নিচে নামতে হয়, সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উটনী ৰসে পড়ে। তখন লোকেরা ওঠ ওঠ বলে তাকে তুলবার চেষ্টা চালান, কিন্তু উটনীটি বসেই থাকে, লোকজন বলাবলি করতে থাকেন যে, কালওয়া অবাধ্য হয়ে বসে পড়েছে। তখন রাসূল (সা) বললেন : কাসওয়া বসে পড়েনি, আর এটা তার স্বভাবও নয়; বরং যিনি হাতিকে রোধ করেছিলেন, তিনি কাসওয়াকেও রোধ করেছেন । তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, কুরায়শরা যদি আমার নিকট এমন কিছু দাবী করে, যাতে তারা আল্লাহর নিদর্শনাজির সম্মান রক্ষা করবে তবে আমি তাদেরকে তা দেবো। এরপর তিনি উটনীকে হাঁকালে সে উঠলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেখান থেকে সরে গিয়ে দূরবর্তী হুদায়বিয়ায় এমন একটা হাযের নিকট অবস্থান গ্রহণ করেন। যেখানে সামান্য পানি আছে। সেখানে যে সামান্য পানি ছিল লোকজন তা তুলে নেন। সেখানে যেটুকু পানি ছিল তা নিঃশেষিত হল তাঁরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পিপাসার অভিযোগ করেন। তখন তিনি তৃণীর থেকে একটা তীর বের করে তা সেখানে রাখতে বলেন। আল্লাহর কসম, সেখান থেকে পানি উথলে উঠে, যাতে তাঁরা তা থেকে তৃপ্ত হতে পারেন।

তাঁরা সেখানে অবস্থান কালে বুদায়ল ইবন ওয়ারাকা খুযায়ী তাঁর স্বগোত্রীয় কয়েকজন লোকসহ সেখান উপস্থিত হন। তিহামার এ গোত্রটি ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কল্যাণকামী। বুদায়ল বলেন : আমি কাব ইবন লুয়াই এবং আমির ইব্‌ন লুয়াইকে হুদায়বিয়ার কূপের নিকট দেখে এসেছি। তাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের লোকজনও রয়েছে। তারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করে বায়তুল্লাহর যিয়ারত থেকে আপনাকে বাধা দিতে উদ্যত। তখন রসূলুল্লাহ (সা) বললেন : আমরাতো কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আসিনি, আমরা এসেছি উমরা করার উদ্দেশ্যে। আর যুদ্ধতো কুরায়শদেরকে পেয়ে বসেছে। তারা চাইলে আমি তাদেরকে সময় দিতে পারি, যাতে তারা আমার এবং অন্যান্য লোকদের মধ্যে অন্তরায় না হয়। আমি যদি বিজয়ী হই, তারা ইচ্ছা করলে ঐ দীনে প্রবেশ করবে, যাতে অন্যান্য লোকেরা প্রবেশ করেছে আর তা যদি না হয় তবে তো তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেল । আর যদি তারা একান্তই অন্তরায় সৃষ্টি করে তা হলে যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার শপথ করে বলছি। এ বিষয়ে আমি তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাবো, যতক্ষণ আমার গান বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় এবং আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়ে যায়। তখন বুদায়ল বলে : আপনি যা বললেন, আমি তাদের কাছে তা পৌঁছিয়ে দেবো। তিনি রওয়ানা হয়ে কুরায়শের নিকট গমন করে বলেছেন। আমরা সে লোকের নিকট থেকে আসছি এবং তিনি যা বলেছেন আমরা তা শুনেছি। তোমরা শুনতে চাইলে আমরা তোমাদেরকে শুনাতে পারি। তখন তাদের মধ্যকার বোকা লোকেরা বললো : তুমি আমাদেরকে সে লোকের কথা শুনাবে আমাদের তাতে কোন কাজ নেই। কিন্তু তাদের মধ্যেকার প্রাজ্ঞ লোকের বললো : বল সে কি বলেছে। বুদায়ল বললো : আমি তাকে এরূপ এরূপ বলতে শুনেছি। একথা বলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা বলেছেন তিনি তাদেরকে তা শুনালেন। তাঁর কথা শুনে উরওয়া ইবন মাসউদ সাকাফী দাঁড়িয়ে বলে : হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আমি কি পিতৃস্থানীয় নই? তারা বললো : হাঁ। আবার তিনি বললেন : তোমরা কি সন্তান তুল্য নও? তারা বললো : হাঁ। তিনি বললেন :তবে তোমরা কি আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ কর? তারা বললো, না, তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তিনি বললেন : তোমরা কি জানো যে, আমি উকাবাসীদের সাহায্যের জন্য ডেকেছি তারা এগিয়ে আসতে অস্বীকার করলে আমি আমার লোকজন এবং অনুগতদেরকে। ডাকি, তারা বললো, আপনি ঠিক বলেছেন। তখন তিনি বললেন : এ লোকটি তোমাদের নিকট হিদায়াত ও কল্যাণের পথ উপস্থাপন করেছে। তোমরা তা মেনে নাও। তোমরা বললে আমি তাঁর নিকট যেতে পারি। তারা সকলে বললো, হাঁ তার কাছে যাও। রাসূলুল্লাহ্ নিকট গিয়ে উরওয়া তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। নবী করীম (সা) বুদায়লকে যা বলেছিলেন, উরওয়াকেও অনুরূপ কথা বললেন। এ সময় উরওয়া বলেন :

হে মুহাম্মাদ! তোমার কি মনে হয় : তুমি কি তোমার নিজের সম্প্রদায়ের সর্বনাশ সাধন করতে চাও? তুমি কি ইতিপূর্বে কোন আরব সম্পর্কে শুনেছ, যে নিজের লোকজনের বিনাশ সাধনের জন্য উদ্যত হয়েছে। অন্যথায় আমি এমন মুখ দেখতে পাচ্ছি, তোমার পেছনে আমি এমনসব লোক জড়ো হতে দেখছি। যারা তোমাকে ত্যাগ করে চলে যাবে। তখন হযরত আবু বকর (রা) তাকে বললেন : তুমি লাত দেবীর অঙ্গ বিশেষ চুষগে (তুমি কি মনে কর) তাঁকে ত্যাগ করে আমরা পলায়ন করবো। তাঁর কথা শ্রবণ করে উরওয়া জানতে চায় লোকটি কে? লোকেরা জানায়, ইনি আবু বকর। উরওয়া বলেন, আমার প্রতি যদি তোমার অনুগ্রহ না থাকতো, যার প্রতিদান এখনো আমি দিতে পারিনি। তাহলে আমি তোমার কথার জবাব দিতাম। রাবী বলেন, উরওয়া নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় তিনি রাসূল (সা)-এর দাড়ি মুবারকে হাত রাখেন তখর মুগীরা ইবন শুবা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পিছনে দন্ডায়মান। তাঁর হাতে ছিল তলোয়ার, মাথায় শিরস্ত্রাণ। উরওয়া রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দাড়ির দিকে হাত বাড়ালে মুগীরা তার বাট দ্বারা আঘাত করে বললেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দাড়ি মুবারক থেকে হাত সরাও। তখন উরওয়া মাথা তুলে বলেন, এ লোকটি কে? লোকেরা বলে মুগীরা ইবন শুবা। উরওয়া বলেন : হে বিশ্বাসঘাতক তোর বিশ্বাসঘাতকতার মাশুল কি আমি দিয়ে যাচ্ছি না? জাহিলী যুগে একদা মুগীরা ইব্‌ন শুবা কিছু লোকের সঙ্গে চলছিল। তিনি তাদেরকে হত্যা করে তাদের সম্পদ নিয়ে পালিয়ে আসেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললোঃ আমি তোমার ইসলাম গ্রহণ মেনে নিচ্ছি, কিন্তু তোমার সম্পদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

এরপর উরওয়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীদেরকে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন। তিনি দেখতে পান যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর থুথু কোন সাহাবীর হাতে পড়লে তিনি তা মুখে আর গায়ে মেখে নেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে কোন নির্দেশ দান করলে তারা তা পালন করার জন্য ছুটে যান। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উযূ করলে তাঁর উযূর পানি নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লেগে যান এবং তিনি কথা বললে তাঁরা নিজেদের আওয়ায নিচু করে তা শুনেন এবং তাঁর সম্মানার্থে তাঁরা তাঁর দিকে সরাসরি তাকান না। উরওয়া তাঁর সম্মানার্থে তাঁরা তাঁর দিকে সরাসরি তাকাল না। উরওয়া তার কুরায়শদের নিকট ফিরে গিয়ে বললেন : আল্লাহর কসম, আমি রাজা বাদশাহদের দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছি। কায়সার কিসরা এবং নাজাশীর দরবারেও আমি উপস্থিত হয়েছি। আমি কোন রাজা-বাদশাহকে তার সঙ্গী-সাথীদের এত তাযীম করতে দেখিনি যত সম্মান করতে দেখেছি মুহাম্মাদকে তার সাথীদের। এরপর তিনি পূর্বোক্ত কথাগুলো উল্লেখ করেন। অবশেষে তিনি বলেন যে, তিনি তোমাদের সম্মুখে আলোকমালা উপস্থাপন করেছেন, তোমরা তা মেনে নাও।

তারপর বনূ কিনানার জনৈক ব্যক্তি বলে। তোমরা আমাকে যেতে দাও, আমি তার কাছে যাই। সকলে বলে? যাও! লোকটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এবং তাঁর সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে দেখে বললেন : এতো অমুক ব্যক্তি, এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে তার সম্পর্ক, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে। তার সম্মুখে কুরবানীর পশু হাযির কর। কুরবানীর পশু হাযির করা হলে লোকেরা লাব্বায়িক লাব্বায়িক উচ্চারণ করে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। এ অবস্থা দেখে লোকটি বলে উঠে, সুবহানাল্লাহ! এমন লোকদেরকে বায়তুল্লাহ থেকে বাধা দেওয়া সমীচীন নয়। সঙ্গীদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে লোকটি বলে, আমি কুরবানীর পশু দেখেছি সেগুলোকে মালা পরানো হয়েছে এবং চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার মনে হয়, বায়তুল্লাহ্ যিয়ারতে তাদেরকে বাধা দেয়া উচিত হবে না ।

এরপর তাদের এক ব্যক্তি যাকে বলা হয় মুকরিয ইবন হফিস দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে তার নিকট যেতে দাও। সকলেই বললো, ঠিক আছে, যাও। সে উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এতো মুকরি। একজন পাপাচারী লোক! লোকটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় সুহায়ল ইবন আমর উপস্থিত হন। মামার ইকরামা সূত্রে বলেন যে, সুহায়ল ইবন আর উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : তোমাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ করা হয়েছে। মামার বলেন, যুহরী বলেন, সুহায়ল এসে বলেন, চলুন আমরা আমাদের এবং আপনাদের মধ্যে চুক্তি লিপিবদ্ধ করি। তখন নবী (সা) লেখক ডাকালেন এবং তাঁকে বললেন :লেখ বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সুহায়ল বলে উঠলেন? আল্লাহর কসম, রহমান কি আমরা

তো জানি না। বরং তুমি লেখ বিসমিকা আল্লাহুম্মা । তখন মুসলমানরা বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ছাড়া অন্য কিছু লিখবো না। তখন নবী করীম (সা) বললেন : বিসমিকা আল্লাহুম্মাই লিখ । এরপর বললেন : এ হল সে চুক্তি যাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এতে সুহায়ল আপত্তি জানিয়ে বলেন : আল্লাহর কসম, আমরা আপনাকে যদি রাসূল বলে স্বীকার করতাম তাহলে তো আপনাকে বায়তুল্লাহ্ যিয়ারত করতে বাধা দিতামনা, আপনার সঙ্গে আমরা যুদ্ধও করতাম না, বরং আপনি মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ্ লিখুন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

আল্লাহর কসম! তোমরা আমাকে অস্বীকার করলেও আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, (হে আলী!) তুমি লেখ- মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ্।

এরপর যুহরী আবু জলের পায়ে শিকলসহ আগমন, তাকে ফেরত দান এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- যার বর্ণনা ইতিপূর্বেও দেয়া হয়েছে।

তারপর যুহূরী (র) বলেন, হযরুত উমর (রা) বলেন, এ ( সব কড়াকড়া) কথার জন্য পরবর্তীকালে আমি অনেক আমল করেছি (যাতে আল্লাহ তা’আলা আমার সেসব গুনাহ মাফ করেন)। যুহুরী (র) আরো বর্ণনা করেন যে, চুক্তিপত্র লিপিবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে বললেন : তোমরা ওঠ! কুরবানী কর, তারপর মাথা মুণ্ডন কর, তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূল (সা) একথা তিনবার না বলা পর্যন্ত সাহাবীদের কেউই উঠে দাঁড়াননি। এরপর রাসূল (সা) হযরত উম্মে সালামা (রা)-এর নিকট গিয়ে তার কাছে লোকদের এ আচরণের কথা উল্লেখ করেন। তখন উম্মে সালামা বলেন : হে আল্লাহর নবী! আপনি কি এটা পসন্দ করেন : আপনি নিজে বের হোন, কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে নিজের পশু যবাই করুন এবং ক্ষৌরকারকে ডেকে নিজের মাথা মুণ্ডন করুন। তিনি বের হলে কারো সঙ্গে কথা না বলেই এটা করলেন । নিজের পও যবাহ করলেন এবং ক্ষৌরকারকে ডেকে মাথা মুণ্ডন করান, সাহাবীগণ এটা দেখে উঠে দাঁড়ালেন এবং সকল কুরবানী করলেন । সাহাবীগণ একজন অন্যজনের মাথা মুণ্ডন করেন। এ সময় ক্ষোভে-দুঃখে সাহাবীগণের এমন অবস্থা হয়েছিল, যেন একজন অপরজনকে হত্যা করবেন, এরপর মুমিন নারীগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমন করলে আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন :

হে মু’মিনগণ! তোমাদের নিকট মু’মিন নারীরা হিজরত করে আগমন করলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করবে, আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন তবে তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠাবে না। মু’মিন নারীগণ কাফিরদের জন্যে বৈধ নয় এবং কাফির পুরুষগণ মু’মিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফির পুরুষরা যা ব্যয় করেছে তাদেরকে তা ফেরত দেবে। এরপর তোমরা তাদেরকে বিবাহ করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবেনা। যদি তোমরা তাদেরকে মহর দাও। তোমরা কাফির নারীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে না………। (৬০ মুমতাহানা : ১০)

এ আয়াত নাযিল হলে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) জাহিলী যুগের তাঁর দুজন স্ত্রীকে তালাক দেন। তাঁর তালাক দেয়া দুজন স্ত্রীর একজনকে বিবাহ করেন মু’আবিয়া ইব্ন আবু সুফিয়ান আর অপরজনকে বিবাহ করেন সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা। এরপর নবী করীম (সা) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে কুরায়শের একজন পুরুষ আবু বসীর যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমন করলে কুরায়শরা তাকে ফেরত নেয়ার জন্য দুজন লোক প্রেরণ করে। তারা সম্পাদিত চুক্তির কথা স্মরণ করালে রাসূলুল্লাহ (সা) কুরায়শী মুসলিম ব্যক্তি তথা আৰূ বাসীরকে তাদের হাতে তুলে দেন। তাঁকে নিয়ে তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ‘যুল হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে তারা খেজুর খেতে বসে। তাদের একজনকে আবু বাসীর বললেন আল্লাহর কসম! আমি দেখছি, তোমার তলোয়ার খানা খুব চমৎকার, তার কথা শুনে লোকটি খাপ থেকে তরবারি বের করে বলে? হাঁ, আল্লাহর কসম, আসলেই তরবারিটা চমৎকার । আমি বারবার তা পরীক্ষা করে দেখেছি। তখন আবু বাসীর বলেন : দেখি, তলোয়ারটা আমাকে দেখাও তো! সে তা দেখতে দিলে তিনি তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করেন। অপরজন পলায়ন করে দৌড়ে মসজিদে নববীতে উপস্থিত হয়। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : নিশ্চয়ই সে ভীতিপ্রদ কিছু দেখতে পেয়েছে। সে নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলে? আমার সঙ্গী নিহত হয়েছে, আল্লাহর কসম, আমিও হত্যার শিকার হবো, ইতোমধ্যে আবু বাসীরও রাসূল (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করে?

হে আল্লাহর নবী! আল্লাহর কসম, আপনি আপনার চুক্তির শর্ত পালনের দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন। আপনি আমাকে কুরায়শ মুশরিকদের নিকট ফেরত দিয়েছিলেন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের কবল থেকে আমাকে নাজাত দিয়েছেন। তখন নবী করীম (সা) বলেন : সর্বনাশ, সেতো যুদ্ধের আগুন উস্কে দিচ্ছে, যদি তার সঙ্গে অন্য কেউ থাকতো। এ কথা শ্রবণ করে আবূ বাসীর বুঝতে পারেন যে, রাসূল (সা) তাকে আবারও কুরায়শদের নিকট ফেরত পাঠাবেন। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে সীফুল বাহ্র তথা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে গমন করেন। যুহরী (র) বলেন : এরপর আবূ জুল ইবন সুহায়ল ইব্‌ন আমরও সেখান থেকে ছুটে এসে আৰু বাসীর এর সঙ্গে যোগ দিয়ে দেন। কুরায়শদের নিকট থেকে কোন মুসলমান পালিয়ে আসলে তিনিও আবু বাসীর এর জোটে যোগ দিতেন। এভাবে তাদের একটা দল গড়ে উঠে।

কুরায়শের কোন বাণিজ্য কাফেলা শাম দেশের উদ্দেশ্যে গমন করছে, শুনতে পেলে তারা পথরোধ করে তাদেরকে হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করতেন। এ অবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে কুরায়শরা নবী করীম (সা)-এর প্রতি আল্লাহ এবং আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আবেদন জানায় কুরায়শদের মধ্য থেকে যে আপনার কাছে আগমন করে সে নিরাপদ। সে মতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকট পয়গাম পাঠালে আল্লাহ্ তা’আলা আয়াত নাযিল করেন :

তিনি মক্কা উপত্যকায় ওদের হস্ত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হস্ত ওদের থেকে নিবারণ করেছেন ওদের উপর তোমাদেরকে বিজয়ী করার পর । তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা দেখেন। ওরাইতো কুফরী করেছিল এবং তোমাদেরকে মাসজিদুল হারাম থেকে নিবৃত্ত করেছিল এবং বাধা দিয়েছিল কুরবানীর জন্য আবদ্ধ পশুগুলোকে যথাস্থানে পৌঁছতে। যদি এমন কতক মুমিন নারী পুরুষ না থাকতো যাদেরকে তোমরা জানো (তবে তোমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হতো) তোমরা তাদেরকে পদদলিত করতে অজ্ঞাতসারে। ফলে তাদের কারণে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে। (যুদ্ধের নির্দেশ হয় নাই এজন্য যে, তিনি যাকে ইচ্ছা নিজ অনুগ্রহ দান করবেন। যদি তারা পৃথক হতো আমি তাদের মধ্যে কাফিরদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিতাম। যখন কাফিররা তাদের অন্তরে পোষণ করতে গোত্রীয় অহমিকা অজ্ঞতা যুগের অহমিকা– (৪৮ ফাত্হ : ২৪-২৬) আর তাদের গোত্রীয় অহমিকা ছিল এই যে, তারা রাসূল করীম (সা)-কে আল্লাহর নবী। বলে স্বীকার করেনি। বিসমিল্লাহ্ শিখাও মেনে নিতে পারেনি এবং বায়তুল্লাহ্ যিয়ারতের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল । এ বর্ণনায় এমনসব অতিরিক্ত বিষয় এবং চমঙ্কার শিক্ষণীয় জিনিষ আছে যা ইবন ইসহাকের বর্ণনায় নেই।

বুখারী (র) কিতাবুল শুরুত এর শুরুতে ইয়াইয়া ইবন বুকায়র— মিসওয়ার ইবন মাখরামা সূত্রে রাসূল (সা)-এর কতিপয় সাহাবী থেকে গোটা কাহিনী বর্ণনা করেছেন। আর এটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কারণ, হুদায়বিয়ার দিন মারওয়ান ও মিসওয়ার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন। আর এটা স্পষ্ট যে তারা হাদীছটি সাহাবীদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন ।

বুখারী (র) হাসান ইবন ইসহাক– আবু ওয়াইল সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সুহায়ল ইবন হুনায়ফ সিফফীন যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে (যুদ্ধের) খবরাখবর নেয়ার জন্য আমরা তার কাছে গেলে তিনি বলেন : তোমরা নিজের মতামতের যথার্থ জ্ঞান করবে না। হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে আবু জ্বলের ঘটনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য থাকলে আমি অবশ্যই তা করতাম। কিন্তু আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-ই তো সবচেয়ে ভাল জানেন। ইতিপূর্বে কোন ভয়ংকর ইস্যুতে যখনই আমরা কাঁধে তরবারি তুলে নিয়েছি এবং জিহাদে প্রবৃত্ত হয়েছি। তখনই আমরা সুফল লাভ করেছি। কিন্তু এ ঘটনায় অবস্থা অন্য রকম। বিপর্যয়ের এক দিক বন্ধ করলে অন্য দিক উন্মুক্ত হয়। কিভাবে উদ্ধার পেতে হবে কিছুই আমাদের বুঝে আসছিল না। [টীকা : একদল লোক সুহায়ল ইব্‌ন হুনায়ফকে এ মর্মে অভিযুক্ত করে যে, সিফফীন এর দিন তিনি লড়াই করতে ত্রুটি করেছেন। এ অভিযোগের জবাবে তিনি সে দিন বলেছিলেন তোমরা আমাকে নয়, বরং তোমাদের নিজেদের মতামতকে অভিযুক্ত কর। কারণ, প্রয়োজনের সময় আমি কোন ত্রুটি করিনা। নবী করীম (সা)-এর যামানায় কোন কঠিন ব্যাপারে অস্ত্র পরিধান করলে আমাদের অস্ত্র সহজে জায়গা মতো আমাদেরকে পৌঁছাতো। অবশ্য সিফফীনের ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। আমরা এর কোন একটা দিক বন্ধ করলে অন্য একটা দিক বেরিয়ে আসতো। ফলে তা সংশোধন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। ]

বুখারী (র) আবদুল্লাহ্ ইবন ইউসুফ– যায়দ ইবন আসলাম। তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা) কোন এক সফরে গমন করেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তখন ছিল রাত্রি বেলা । উমর ইবনুল খাত্তাব রাসূল করীম (সা)-কে কোন একটা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন জবাব দেননি। এভাবে তিনবার তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন জবাব দিলেন না। তখন উমর (রা) নিজেকে বললেন, উমর! তোমার মা তোমাকে হারাক। তুমি তিন দফা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর শরণাপন্ন হলে কিন্তু তিনি একবারও তোমাকে জবাব দিলেন না। উমর (রা) বলেন। এরপর আমি বাহন ছুটালাম এবং বাহিনীর আগে চলে গেলাম। এসময় আমার আশংকা হলো, যেন আমার ব্যাপারে কুরআন মজীদের আয়াত নাযিল হবে। একটু পরই কেউ চিৎকার দিয়ে আমাকে বলছিল- উমর (রা) বলেন, আমার আশংকা হলো, হয়তো আমার ব্যাপারেই কুরআন নাযিল হয়েছে। সুতরাং আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গমন করে তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি (সা) বললেন :

আজ রাত্রে আমার উপর একটা সূরা নাযিল হয়েছে যা আমার নিকট সে সকল বস্তু থেকে প্রিয়, যার উপর সূর্য উদিত হয় অর্থাৎ সে সূরাটি আমার নিকট পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু থেকে প্রিয়তর। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন :

নিশ্চয় আমি তোমাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি। আমার রচিত তাসীর গ্রন্থের সূরা ফাতৃহে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সমস্ত প্রশংসা আর স্তুতি-স্তব আল্লাহর জন্য। কেউ বিশদ জানতে চাইলে সেখানে দেখে নিতে পারেন। আবদুল্লাহ্ আবদুল্লাহ্

ষষ্ঠ হিজরীতে পরিচালিত যুদ্ধাভিযানসমূহ

 হাফিয বায়হাকী (র) ওয়াকিদী (র) সূত্রে এ সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন তার সার সংক্ষেপ এই

এ বছরের রবিউল আউয়াল বা রবিউল আখির মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উক্কাশা ইবন মিহসান (রা)-এর নেতৃত্বে ৪০ জনের একটা বাহিনী গামর অভিমুখে প্রেরণ করেন। তাতে ছাবিত ইবন আকর ও সিবা ইবন ওহবও ছিলেন। এলাকার লোকজন পলায়ন করলে ঐ বাহিনীটি তাদের পানির কূপের নিকট শিবির স্থাপন করে তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য চতুর্দিকে লোক প্রেরণ। করে। তাঁরা দশ উট নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। ঐ বছরই আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ্-এর নেতত্বে ৪০ জনের একটা পদাতিক বাহিনী দল ‘যুল কিসমা অভিমুখে প্রেরণ করা হয়। তাঁরা ভোর রাত্রে উক্ত অঞ্চলে হাযির হলে লোকজন পলায়ন করে পাহাড়ের শীর্ষ দেশে আরোহণ করলে তাদের একজনকে পাকড়াও করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে হাযির করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) মুহাম্মাদ ইব্‌ন মাসলামার নেতৃত্বে দশজন সাহাবীর একটা দলকে উক্ত অঞ্চলে প্রেরণ করলে ঘুমন্ত অবস্থায় মুহাম্মাদ ইবন মাসলামার সঙ্গীদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের সকলকে হত্যা কৰা হয় । মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা আহত হয়ে কোন রকমে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। একই বছর রাসূলুল্লাহ (সা) যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে ‘হামুম’ অভিমুখে প্রেরণ করলে তিনি মুযায়না গোত্রের হালীমা নামী এক মহিলাকে প্রেফতার করে আনেন। সে বনূ সুলায়মের একটা মহল্লার কথা বলে দিলে তারা সেখানে প্রচুর উট বক্রী হস্তগত করেন এবং তাদের অনেককে বন্দী কবেন। বন্দ’ ব্যক্তিদের মধ্যে এ হালীমার স্বামীও ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐ মহিলাকে তার স্বামীকে হেবা কারেন এবং তাদের উভয়কেই মুক্ত করে দেন। একই বছরের জুমাদাল উলা মাসে বনূ ছালাবা গোত্রের প্রতি যায়দ ইবন হারিছর নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটা বাহিনী প্রেরণ করেন। গোত্রের লোকজন পলায়ন করলে যায়দ ইবন হারিছা (রা) তাদের পশুপাল থেকে ২০টি উট নিয়ে চার দিন পর প্রত্যাবর্তন করেন। একই বছরের জুমাদাল উলা মাসে হযরত যায়দ ইবন হারিছা (রা) ঈস’ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। হাফিয বায়হাকী (র) আরো বলেন যে, এ বছর আবুল আস ইবনু রবীব-এর মালপত্র বাজেয়াপ্ত করা হলে তিনি তাঁর স্ত্রী যয়নব বিত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তিনি তাঁর স্বামীকে আশ্রয় দান করেন।

পক্ষান্তরে ইবন ইসহাক (র) এ বাহিনী তখনকার বলে উল্লেখ করেন । যখন আবুল আস ইবন রবী’ এর দল লুষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গীরা নিহত হয় এবং তিনি তাদের মধ্য থেকে পলায়ন করে মদীনায় উপস্থিত হন। আর তাঁর স্ত্রী যয়নব বিন্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা), বদর যুদ্ধের পর হিজরত করেন। তাঁর স্বামী মদীনায় আগমন করে আশ্রয় প্রার্থনা করলে ফজর নামাযান্তে স্ত্রী যয়নব স্বামীকে আশ্রয় দান করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাকে আশ্রয় দান করেন এবং তার দলের নিকট থেকে যা কিছু গ্রহণ করা হয়েছিল তা ফেরত দানের জন্য নির্দেশ দান করেন। সে মতে তাঁর সমুদয় বস্তু ফেরত দেওয়া হয়, কোন কিছুই বাদ পড়েনি। আবুল আস মক্কায় আগমন করে সকলকে তাদের মালামাল ফেরৎ দান করেন এবং সকলের আমানত প্রত্যর্পন করে মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর বিবাহ বহাল রাখেন এবং নতুন বিবাহ ব্যতিরেকেই তার স্ত্রীকে তাঁর নিকট প্রত্যর্পন করেন। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) নতুন আকদের ব্যবস্থা করেননি যেমনটি পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। আবুল আস এর ইসলাম গ্রহণ এবং যয়নবের হিজরতের মধ্যস্থলে ৬ বছর মতান্তরে ২ বছরের ফারাক ছিল। আমরা আলোচনা করেছি যে, উভয় বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ, মুমিন নারীদেরকে কাফিরদের জন্য হারাম করার দুই বছর পরে আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন। আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের বছরে । তিনি ষষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে ওয়াকিদী (র) যে উক্তি করেছেন তা ঠিক নয়, মহান আল্লাহ্ সবচেয়ে ভাল জানেন। হিজরী ষষ্ঠ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে ওয়াকিদী (র) দিহইয়া ইব্ন খালীফা আল-কালবীর প্রত্যাবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন । রোম সম্রাট কায়জারের নিকট থেকে তিনি প্রচুর বিত্ত-বিভব আর মহামূল্য খিলাত নিয়ে ফিরে আসেন। ফেরার পথে তিনি হিমা নামক স্থানে পৌঁছলে জুযাম’ গোত্রের কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় । তারা তাঁর নিকট থেকে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এদের বিরুদ্ধেও হযরত যায়দ ইবন হারিছা (রা)-কে প্রেরণ করেন। ওয়াকিদী (র) আবদুল্লাহ্ ইবন জাফর– ইয়াকূব ইবন উতবা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী (রা) একশ জন লোকের একটা দল নিয়ে বের হয়ে বনূ অসাদ ইবন বর-এর নিকট একটি শাখা গোত্রের নিকট গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। খায়বরের ইহুদীদেরকে সহায়তা দানের লক্ষ্যে সেখানে এক দল লোক সমবেত হচ্ছে একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে প্রেরণ করেছিলেন। এ দলটি রাত্রিবেলা সফর করতে আর দিনের বেলা আত্মগোপন করে থাকতো। শত্রুপক্ষের এক গুপ্তচরকে পাকড়াও করা হলে সে স্বীকার করে যে, তাকে খায়বরে প্রেরণ করা হয়েছে। খায়বরের খেজুরের বিনিময়ে সে ইহুদীদেরকে সাহায্য করার প্রস্তাব করবে। ওয়াকিদী আরো উল্লেখ করেন যে, ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে আবদুর রহমান ইবন আউফ (রা)-এর নেতৃত্বে দুমাতুল জান্দাল অভিমুখে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ দলকে বলেছেন যে, তারা বশ্যতা স্বীকার করলে তাদের বাদশাহের কন্যাকে বিবাহ করবে। তারা ইসলাম কবূল করলে হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফ তাদের বাদশাহের কন্যা তামাযুর বিনতুল আসবা আল-কালবিয়্যাকে বিবাহ করেন আর ইনি ছিলেন আবূ সালামা ইবন আবদুর রহমান ইবন আউফের মা। ওয়াকিদী (র) বলেন যে, ষষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে কুরয ইবন জাবির আল-ফিহীকে উরানিয়্যীনদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয় । যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রাখালকে হত্যা করে উটগুলি নিয়ে পলায়ন করেছিল। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুরম্ ইবন জাবির-এর নেতৃত্বে ২০ জন অশ্বারোহীর একটা দল প্রেরণ করেন। এ বাহিনী তাদেরকে পাকড়াও করে আনে।

বুখারী (র) ও মুসলিম (র) সাঈদ ইব্‌ন আবূ আরূবা– আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, উকল এবং উরায়না গোত্রের বর্ণনান্তরে উকল অথবা উরায়নার কিছু লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করে, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমরা এমন লোক যাদেরকে জীবন যাপন করতে হয় পশুর দুধপান করে। আমাদের ওখানে কোন শস্যশ্যামল ভূমি নেই। মদীনার আবহাওয়া আমাদের অনুকূল হয়নি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে কিছু উট আর রাখালসহ চারণভূমিতে গমন করে সেগুলোর দুধ আর পেশাব পান করার জন্য বলেন। সে মতে তাঁরা সেখানে যায়। হারবার প্রান্তে পৌঁছে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর রাখালকে হত্যা করে উষ্ট্রগুলো নিয়ে পলায়ন করে এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে যায়। নবী করীম (সা) তাদেরকে ধরে আনার জন্য কুরয ইবন জাবির আল-ফিহরীকে প্রেরণ করেন এবং তাদের হাত পা কাটার এবং তাদের চোখে লৌহ শলাকা বিদ্ধ করার জন্য তাকে নির্দেশ দান করেন। এ অবস্থায় তাদেরকে রৌদ্রে উত্তপ্ত কঙ্করময় স্থানে ফেলে রাখা হলে সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। রাবী কাতাদা (রা) বলেন, আমরা জানতে পেরেছি যে, এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (সা) খুতবা দান করার জন্য দাঁড়ালে দান-সদকা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্তন করতে নিষেধ করতেন। একদল রাবী কাতাদা সূত্রে অপর দল আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। মুসলিম (র)-এর বর্ণনায় হযরত মুআবিয়া ইবন কুররা আনাস সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উরায়নার এক দল লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং বায়আত গ্রহণ করে। মদীনায় তখন জন্ডিস জাতীয় ব্যধির প্রকোপ ছিল। লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আবেদন জানাল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এ ব্যধি দেখা দিয়েছে আপনি অনুমতি দান করলে আমরা (আপনার চারণভূমির দিকে ফিরে যেতে পারি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্মতি দিলে তারা সেখানে গিয়ে বসবাস শুরু করে। পরে তারা সেখান থেকে বের হয়ে রাখালদেরকে হত্যা করে উটগুলো নিয়ে পলায়ন করে। রাবীর মতে, এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট প্রায় ২০ জন আনসারী সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওদের পাকড়াও করতে আনসারীদেরকে প্রেরণ করেন এবং তাদের সাথে একজন পদচিহ্ন বিশারদকেও প্রেরণ করেন। এ ব্যক্তি তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। তখন তাদের হাত পা কেটে গরম শলাকা দ্বারা চক্ষু বিদ্ধ করে দেয়া হয়। আর সহীহ্ বুখারী শরীফে আইয়ুব আবু কিলাবা আনাস (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আনাস (রা) বলেন : উকাল গোত্রের একদল লোক আগমন করে ইসলাম গ্রহণ করে (কিন্তু মদীনায় অবস্থান করা তারা পসন্দ করেনি) তখন তারা রাসূল করীম (সা)-এর দরবারে হাযির হয়ে বিষয়টি তাঁকে অবহিত করলে তিনি বললেন : তোমরা উটের সঙ্গে বাস করো এবং সেগুলোর পেশাব আর দুধ পান কর। তারা সেখানে চলে যায় এবং যতদিন আল্লাহর ইচ্ছা হয় অবস্থান করে। পরবর্তীকালে তারা রাখালদেরকে হত্যা করে উটগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। একজন ফরিয়াদকারী ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ছুটে আসে (এবং বিষয়টি তাঁকে অবহিত করলে) বেলা উঠার পূর্বেই তাদের ধরে আনা হয়।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) শলাকা আনার নির্দেশ দিল (তা আনা হয় এবং গরম করে তা দ্বারা তাদেরকে দাগানো হয়। তাদের হাত পা কেটে ফেলা হয় এবং তাদেরকে কঙ্করময় উত্তপ্ত ভূমিতে ফেলে রাখা হয়। তারা পানি পানি বলে চিৎকার করলেও তাদেরকে পানি পান করতে দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। কেউ তাদের সাহায্য করেনি। আনাস (রা)-এর এক বর্ণনায় আছে যে, তিনি বলেন, আমি তাদের একজনকে পিপাসায় কাতর হয়ে মুখ দ্বারা মাটি চাটতে দেখেছি। আকূ কিলাবা (রা) বলেন : এ সব লোকেরা হত্যা, চুরি, ঈমান আনার পর কুফ্রী অবলম্বন করা এবং আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার অপরাধে অপরাধী ছিল।

বায়হাকী (র) উছমান ইবন আবূ শায়বা— জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন :

রাসূল করীম (সা) তাদের পদাংক অনুসরণে লোক প্রেরণ করে এ দু’আ করেন :

হে আল্লাহ্! তুমি তাদের জন্য পথ সন্দিগ্ধ করে দাও এবং তাদের চলার পথকে সংকীর্ণ করে দাও। রাবী বলেন, ফলে আল্লাহ্ তাদের জন্য তাদের পথ অদৃশ্য করে দেন। তাদেরকে পাকড়াও করে আনা হয় এবং তাদের হাত-পা কেটে চোখ ফুটা করে দেওয়া হয়।

সহীহ্ মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে যে, তাদের চোখ এজন্য ফুটা করা হয় যে, তারা রাখালদের চোখ ফুটা করেছিল।

হিজরী ষষ্ঠ সালে সংঘটিত অন্য ঘটনাবলী

এ বছর হুদায়বিয়ার দিনগুলোতে হজ্জ ফরয হওয়া সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়। ইমাম শাফিঈ (র) এটা সপ্রমাণ করেন। আল্লাহ্ বলেন ।

“তোমরা আল্লাহর জন্য হজ্জ ও উমরা পরিপূর্ণ কর। (২: ১৯৬)। এ কারণে ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে হজ্জ তাৎক্ষণিকভাবে ফরয নয়, বরং বিলম্বে আদায় করলেও চলবে। কারণ, নবী করীম (সা) হিজরী ১০ সনে ছাড়া আর কোন হজ্জ করেননি। পক্ষান্তরে অন্যান্য তিন ইমাম ইমাম মালিক (র) ইমাম আবু হানীফা (র) এবং ইমাম আহমদ (র)–এর মতে সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর তাৎক্ষণিকভাবে হজ্জ ফরয হয়ে যায়। তাদের মতে উপরোক্ত আয়াত দ্বারা তাৎক্ষণিকভাবে হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণ হয় না। তাদের মতে উপরোক্ত আয়াত দ্বারা হজ্জ শুরু করার পর তা সমাপ্ত করাই কেবল প্রমাণিত হয়। ইমামত্রয়ের যুক্তি-প্রমাণের অনেকাংশ আমরা আমাদের রচিত তাফসীর গ্রন্থে সবিস্তারে আলোচনা করেছি।

একই বছর মুসলিম নারীদের মুশরিক পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে। বিশেষ করে হুদায়বিয়ার বছরে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তোমার কাছে আসবে সে তোমার ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকলেও তুমি অবশ্যই তাকে আমাদের নিকট ফেরত দেবে। এ চুক্তি সম্পাদনের পর আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন :

-হে মু’মিনগণ! মু’মিন নারীরা তোমাদের নিকট হিজরত করে আসলে তাদেরকে তোমরা পরীক্ষা করবে। তাদের ঈমান সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন। যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মু’মিন তবে তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠাবে না। মু’মিন নারীগণ কাফিরদের জন্য হালাল নয়, আর কাফির পুরুষগণও মু’মিন নারীদের জন্য হালাল নয়। কাফিররা যা কিছু ব্যয় করেছে তাদেরকে তা ফেরত দেবে । তারপর তোমরা তাদেরকে বিবাহ করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না- যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মহর দাও। তোমরা কাফির নারীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে না। তোমরা যা কিছু ব্যয় করেছ তা ফেরত চাইবে এবং কাফিররা যা ব্যয় করেছে তারা তা ফেরত চাইবে। এটাই আল্লাহর হুকুম; তিনি তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময় । তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাত ছাড়া হয়ে কাফিরদের নিকট থেকে যায় আর তোমাদের যদি সুযোগ আসে তখন যাদের স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদেরকে তারা যা ব্যয় করেছে তার সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। আল্লাহকে ভয় কর, যার প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো। (৬০ মুমতাহানা –১০)

একই বছরে মুরাইসী অভিযান পরিচালিত হয় [টীকা ও ইতিহাসে এটা বনী মুস্তালিক যুদ্ধ নামেও পরিচিত।–সম্পাদক] যাতে অপবাদ আরোপের ঘটনা ঘটে। এপ্রসঙ্গে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আইশা সিদ্দীকা (রা)-এর নির্দোষিতা প্রমাণ করে আয়াত নাযিল হয়। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ বছর উমরাতুল হুদায়বিয়া সংঘটিত হয়, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে উমরা পালন করতে বাধা দেয় এবং দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকারসহ সন্ধি স্থাপিত হয়। ফলে লোকেরা পরস্পরে নিরাপত্তা লাভ করে। এ সময় কেউ কারো উপর তরবারি উত্তোলন করবে না এবং কেউ কারো সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গও করবে না। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ বছর ও মুশরিকরা হজ্জের তত্ত্বাবধান করে।

ওয়াকিদী বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ বছর যিলহজ্জ মাসে ৬ জন দূতকে পত্রসহ বিভিন্ন রাজ দরবারে প্রেরণ করেন, এরা হলেন- ১. হাতিব ইবন আবূ বালতাআকে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা মুকাওকিসের প্রতি ২. বদর সমরে অংশ গ্রহণকারী শুজা ইবন ওহব ইবন আসাদ ইবন জুযাইমাকে হারীস ইবন আবু শামির আল-গাসসানীর প্রতি। অর্থাৎ ইনি ছিলেন আরবের খৃস্টানদের বাদশাহ। ৩. দিহইয়া ইবন খলীফা আল-কালবীকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। ৪. আবদুল্লাহ্ ইবন হুযায়ফা সাহমীকে পারস্য সম্রাট কিস্র প্রতি, ৫. হাওযা ইব্‌ন আলী আল হানাফীর প্রতি সালীত ইব্‌ন আম্র আল-আমিরীকে এবং ৬, আবিসিনিয়ার ইথিওপিয়া খৃস্টান শাসক নাজাশীর প্রতি আমর ইবন উমাইয়া আদৃদিমারীকে। ঐ নাজাশীর আসল নাম ছিল আসহামা ইবন হুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *