৭. লাইব্রেরিতে ফেরা

সেদিন সকালে আরও পরে লাইব্রেরিতে ফেরার পর সামনে নিচু টেবিলের উপর মেলে ধরা স্ক্রোলে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে আবিষ্কার করল ও। তলপেটের কাছে এক ধরনের আভা ও টিউনিকের স্কার্টের নিচের উপস্থিতির ব্যাপারে দারুণভাবে সজাগ।

যেন আরেকজন হাজির হয়েছে আমার সাথে জীবনে ভাগ নিতে, এক বখে যাওয়া মেয়ে সারাক্ষণ মনোযোগ দাবি করছে। ওটার প্রতি এক ধরনের আমুদে অধিকারময় দুর্বলতা বোধ করছে ও। এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হতে চলেছে এটা, ইচ্ছা শক্তির পরীক্ষা, আমাদের ভেতর কে কর্তৃত্বে রয়েছে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর, ভাবল ও। কিন্তু বেদনার সর্বোচ্চ পর্যায় দমন, বা বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহে প্রশিক্ষিত নিখুঁত অবস্থায় উন্নত করা বুদ্ধিমত্তার ওর মন অনেক ছোটখাট বিকৃতির সাথে কুলিয়ে উঠতে সক্ষম। ক্কোলে মনোযোগ ফিরিয়ে আনল ও। অচিরেই এমনভাবে মগ্ন হয়ে গেল, চারপাশের পরিবশে সম্পর্কে আবছাভাবে সচেতন থাকল কেবল।

লাইব্রেরির পরিবেশ নিরিবিলি, পড়ার উপযোগি। লাগোয়া কামরাগুলোয় গ্রাহকরা কাজের টেবিলে বসে থাকলেও এই কামরাটা একাকী ব্যবহারের জন্যে পেয়েছে ও। যেন বাকিদের ওর সাথে সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রাখতে বলে দেওয়া হয়েছে। মাঝেসাঝে লাইব্রেরিয়ানরা এই কামরা হয়ে ঝুড়িতে করে তাকে তুলে রাখতে স্ক্রোল নিয়ে যায়। ওদের দিকে তেমন একটা খেয়াল করছে না তাই। নিষিদ্ধ কামরা খোলার গ্রিল টানার আওয়াজ পেল ও, চোখ তুলে দেখল অনাকর্ষণীয় চেহারার মাঝবয়সী এক মহিলা ভোলা দরজা পথে ভেতরে ঢুকছে। কিছুই না ভেবে আবার পড়ায় মন দিল ও। কিছুক্ষণ বাদে সেই একই মহিলা বের হয়ে দরজায় তালা দিল। কামরা বরাবর নীরবে এগিয়ে যাবার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তাইতার টেবিলের পাশে থামল। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ও। টেবিলের উপর একটা স্ক্রোল নামিয়ে রাখল সে। তোমার মনে হয় ভুল হয়েছে, তাকে বলল তাইতা। এটার কথা তোমাকে বলিনি আমি।

বলা উচিত ছিল, মহিলা এত কোমল কণ্ঠে কথাটা বলল যে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ও। ডান হাতের কানিষ্ঠা আঙুল বাড়িয়ে নিচের ঠোঁট স্পর্শ করল সে।

চমকে উঠল তাইতা। এটা তিনাতের দেখানো শনাক্তকরণ সঙ্কেত। এই মহিলা তার লোক। স্ক্রোলটা টেবিলে রেখে আর কোনও কথা না বলে হাঁটা শুরু করল মহিলা। ওকে ডাকতে চাইল তাইতা, কিন্তু নিজেকে বিরত রাখল। তাকিয়ে রইল ওর গমন পথের দিকে। একা আছে, কেউ লক্ষ করছে না নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজের স্ক্রোলটা পড়ে চলল ও। তারপর ওটা গুটিয়ে এক পাশে ঠেলে তার জায়গায় লাইব্রেরিয়ানের রাখা স্ক্রোল খুলল। শিরোনামহীন, লেখকের নাম দেখা যাচ্ছে না। অস্বাভাবিক ছোট ও শৈল্পিক হিয়েরোগ্লাফিক হরফগুলো কার হাতের চিনতে পারল ও।

ডাক্তার রেই, ফিসফিস করে বলল ও। তারপর দ্রুত পড়তে শুরু করল। ওর পাঠ্য বিষয় বীজ বপন ও রোপন করে মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন। প্যাপিরাসের পাতার উপরে নিচে চোখ বুলিয়ে চলল ও। রেইর লেখা সমস্ত কিছুর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ও। বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার বর্ণনা আকর্ষণীয়ভাবে বিশদ, সাবলীল; তবে স্ক্রোলের মাঝামাঝি যাওয়ার আগে বলতে গেলে নতুন কিছুই পেল না ও। তারপর ব্যাখ্যা করতে শুরু করল যে কীভাবে বীজ বোনার কাজটি সফল করে ক্ষতস্থানে সেটাকে রোপনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। অধ্যায়ের নাম রাখা হয়েছে: বীজ নির্বাচন ও চাষ। চোখ চালানোর সময় মহিলার এত ঠাণ্ডাভাবে এমন বিশাল বিষয় বর্ণনার ব্যাপারটা ওর উপর যেন হিমবাহের মতো নেমে এলো। প্রবল ধাক্কায় মন অসাড় হয়ে গেল ওর। অধ্যায়ের সূচনায় ফিরে আবার পড়ল; এইবার ধীরে ধীরে; যৌক্তিক বিশ্বাসের অতীত অংশগুলো বারবার পড়ল।

.

দাতাকে তরুণ ও স্বাস্থ্যবান হতে হবে। তাকে অবশ্যই পাঁচটি ঋতুকাল পার করতে হবে। তার কিংবা তার পরিবারের কারও মারাত্মক কোনও অসুখের ইতিহাস থাকতে পারবে না। তার চেহারা হতে হবে প্রীতিকর। পরিচালনার সুবিধার জন্যে তাকে অনুগত ও বাধ্য হতে হবে। এই দিক দিয়ে কোনও সমস্যার মুখোমুখি হলে শান্ত করার ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। খুবই যত্নের সাথে তার প্রয়োগ করতে হবে যাতে মুল লক্ষ্য বিচ্যুত না হয়ে পড়ে। এই অভিসন্দর্ভের শেষাংশে নির্ঘণ্ট অংশে সুপারিশকৃত কিছু ওষুধের তালিকা দেওয়া হয়েছে। খাদ্যাভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ। লাল মাংস ও দুধের তৈরি খাবার হতে হবে ন্যূনতম, কারণ তাতে রক্ত তেতে ওঠে।

.

এই ধারায় আরও লেখা রয়েছে। এবার পরের অধ্যায় চলে এলো ও, স্রেফ প্রজনন শিরোনাম দেওয়া।

.

দাতার মতো গ্রহীতাকেও তরুণ ও স্বাস্থ্যবান হতে হবে। কোনও রকম খুঁত বা ত্রুটি থাকতে পারবে না। বর্তমান ব্যবস্থায় তাদের সাধারণভাবে রাষ্ট্রের প্রতি কোনও ধরনের সেবার বিনিময়ে পুরস্কার হিসাবে নির্বাচন করা হয়। অনেক সময় সামরিক ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্যে। দাতার সাথে কোনও রকম আবেগজাত সম্পর্ক স্থাপন এড়াতে বিশেষ যত্নবান থাকতে হবে। সংক্ষিপ্ত বিরতিতে তাদের পরিবর্তন করতে হবে। দাতার অন্তসত্তা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ামাত্র তার সাথে নিষিক্তকারীর পরবর্তী সব যোগোযোগ নিষিদ্ধ করতে হবে।

.

ফাঁকা দৃষ্টিতে ওর ঠিক সামনে রাখা ফলকের তাকগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল ও। ছোট সিদুদুর ভীষণ আতঙ্কের কথা মনে পড়ে গেল। করুণ আবেদনের কথা হুবহু মনে আছে ওর: দয়া করুন, ম্যাগাস! আপনাকে মিনতি করছি! দয়া করুন! আমাকে বাঁচান! বাচ্চাটাকে নষ্ট না করলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওনকার জারজ সন্তানের জন্যে আমি মরতে চাই না!

পলাতক সিদুদু দাতাদের একজন। স্ত্রী বা মা নয়, বরং দাতা। ওনকা ছিল তার একজন নিষিক্তকারী। স্বামী, বন্ধু বা সঙ্গী নয়। নিষিক্তকারী। ক্রমে বেড়ে উঠল তাইতার আতঙ্ক। কিন্তু নিজের উপর জোর খাঁটিয়ে পড়ে চলল ও। পরের অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে ফসল তোলা। কয়েকটা বিষয় যেন পাতা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এলো ওর কাছে।

.

অন্তসত্তাকালীন সময়ের বার থেকে চব্বিশতম সপ্তাহের ভেতর অবশ্যই ফসল তুলতে হবে।

জরায়ু থেকে জ্বণকে অবশ্যই অক্ষত ও পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে আনতে হবে। বীজের মানের জন্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় অবশ্যই স্বাভাবিক জন্ম প্রতিরোধ করতে হবে।

ভ্রূণ অপসারণের পর দাতার বেঁচে থাকার সম্বাবনা যেহেতু ক্ষীণ, তাই তাকে সাথে সাথে মেরে ফেলতে হবে। চিকিৎসককে অবশ্যই নাহক ভোগান্তি এড়াতে হবে। সবচেয়ে পছন্দনীয় পদ্ধতি দাতাকে বেঁধে রাখা। হাত পা বেঁধে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে রাখতে হবে যাতে সে অন্যদের আতঙ্কিত করে তুলতে না পারে। তারপর সামনের দিকে পেট চিরে অতিদ্রুত জ্বণ অপসারণ করতে হবে। কাজটা শেষ হওয়ামাত্র দাতাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে হবে। যতক্ষণ হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ না হচ্ছে ও শরীর শীতল না হচ্ছে ততক্ষণ দড়ি পেঁচিয়ে রাখতে হবে।

.

দ্রুত ভ্রূণ শিরোনামের পরের অধ্যায়ে চলে এলো তাই। এত দ্রুত হৃৎস্পন্দন হচ্ছে যে নিজের কানে অনুরণন শুনতে পাচ্ছে ও।

.

ভ্রূণের লিঙ্গের বিষয়টি গুরুত্বহীন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, যদিও তা গ্রহীতার মতো একই লিঙ্গের হওয়াটাই যৌক্তিক ও কাঙ্ক্ষিত। জ্বণ অবশ্যই স্বাস্থ্যবান ও সুগঠিত হতে হবে, তাতে কোনও লক্ষণীয় খুঁত বা বিকৃতি থাকতে পারবে না। এই মানদণ্ডের সাথে খাপ না খেলে ফেলে দিতে হবে। এইসব কারণে সব সময় একাধিক দাতাকে হাতের কাছে পাওয়ার ব্যবস্থা রাখাই কাক্ষিত। রোপনের এলাকা বিস্তৃত হলে অন্তত পক্ষে তিনজন দাতা প্রস্তুত রাখতে হবে। তবে সবেচেয়ে বেশি কাক্ষিত সংখ্যা পাঁচ।

.

পেছনে হেলান দিল তাইতা। তিনজন দাতা। ওদের প্রথম আগমনের দিন সকালে জলপ্রপাতের কাছে তিনজন মেয়ে দেখার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মেরেনের জন্যে নতুন চোখের ব্যবস্থা করতে ওদের বলীর পাঁঠা হিসাবে নিয়ে আসা হয়েছে। পাঁচ জন দাতা। পথে ওনকার সাথে দেখা হলে তার কাছে পাঁচজন মেয়ে পাহাড়ে আনার কথা শুনেছে, মনে পড়ে গেল। ওদের সবাই কি অনুমোদিত কৌশলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে? রাতে কি তবে ওদেরই কারও কান্নার আওয়াজ শুনেছে। ও? নিজের আর পেটের বাচ্চার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে জেনে ফেলেছিল সে? সেজন্যেই কাঁদছিল? টেবিল থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। ঝড়ের মতো দালান ছেড়ে বনে চলে এলো। গাছপালার আড়ালে এসে উবু হয়ে আপন গ্লানি আর অপরাধ বোধে বমি করে দিল। একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে টিউনিকের নিচের স্ফীত অংশের দিকে তাকিয়ে রইল।

এটার জন্যেই কি নিষ্পাপ মানুষগুলোকে মরতে হয়েছে? কোমরের খাপ থেকে ছোট ছুরিটা বের করে আনল ও। কেটে হান্নাহর গলায় ঠেসে দেব। দম বন্ধ করে মারব তাকে! ক্রোধে ফুঁসে উঠল ও। বিষাক্ত উপহার এটা, আমার জন্যে কেবল অপরাধবোধ আর কষ্ট ডেকে এনেছে।

এত জোরে ওর হাত কাঁপতে শুরু লাগল যে আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে গেল ছুরিটা। দুই হাতে মুখ ঢাকল ও। ওটাকে ঘৃণা করি নিজেকে ঘৃণা করি! ফিসফিস করে বলল ও। ভীষণ সহিংস ও বিভ্রান্তিকর সব ছবি ফুটে উঠছে মনের পর্দায়। সেই একই হ্রদে কুমীরদের উন্মত্ত ভোজ উৎসব দেখার কথা মনে পড়ছে। মেয়েদের বিলাপ, শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনেছে ও। দুঃখ ও হতাশার শব্দ।

অবশেষে বিভ্রান্তি কেটে গেল, আবার মোহন্ত দিমিতারের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। ইয়োস মিথ্যার স্যাঙ্গাৎ। প্রতারণা, ক্ষমতা দখলকারী, ধোঁকাবাজ, চোর ও শিশুখাদকের অন্য নাম।

শিশু খাদক, পুনরাবৃত্তি করল ও। সেই এইসব নৃশংসতার হুকুম দেয়। অবশ্যই তার দিকেই আমার ঘৃণাকে চালিত করতে হবে। কেবল তাকেই সত্যিকার অর্থে ঘৃণা করি আমি। তাকে ধ্বংস করতেই এখানে এসেছি। হয়তো এই জিনিসটা রোপনের ভেতর দিয়ে নিজের অজান্তেই আমার হাতে নিজের ধ্বংসের হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। চোখ থেকে হাত নামাল ও। তাকিয়ে রইল ওগুলোর দিকে। এখন কাঁপছে না।

তোমার সাহস এক করে মনস্থির করো, গালালার তাইতা, ফিসফিস করে বলল ও।খোঁচাখুঁচির পর্ব শেষ। আসল যুদ্ধ শুরু হলো বলে।

ডাক্তার রেই-এর স্ক্রোলটা নিতে বন থেকে বের হয়ে আবার লাইব্রেরিতে ফিরে এলো ও; জানে ওটা পড়ে প্রত্যেকটা বিষয় বিস্তারিত মনে রাখতে হবে। জানতেই হবে কীভাবে ওরা বিষাক্ত বীজ সৃষ্টি করতে ছোট ছোট বাচ্চাদের কাটাছেঁড়া করে। শিশুদের আত্মাহুতি যেন নিষ্ফল না হয়, নিশ্চিত করতে হবে। স্ক্রোলটা যেখানে রেখে গিয়েছিল সেই টেবিলে ফিরে এলো ও, কিন্তু ওটা উধাও হয়ে গেছে।

*

ও যখন স্যানেটোরিয়ামে নিজের কামরায় পৌঁছাল ততক্ষণে সূর্য জ্বালামুখের দেয়ালের ওপাশে বিদায় নিয়েছে। ভৃত্যরা তেলের কুপি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। তামার অগ্নিকুণ্ডে উত্তপ্ত অঙ্গারের উপর গরম হচ্ছে ওর সন্ধ্যার খাবার। কোনওমতে খাওয়া শেষ করে ডাক্তার আসেমের উদ্ভাবিত এক বাটি কফি বানিয়ে খেল। তারপর মাদুরে আসন পেতে বসে ধ্যানের জন্যে তৈরি করে নিল নিজেকে। এটা ওর রাতের নিয়মিত রুটিন। পিপহোলের চোখ রাখা পাহারাদার এতে তাই সন্দেহজনক কিছু পেল না। শেষে তেলের কুপি নিভিয়ে দিল ও। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল কামরাটা। অল্পক্ষণ বাদেই পিপহোলের পেছনের লোকটা রাতের মতো তার অবস্থান থেকে বিদায় নিলে আভা মিলিয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, তারপর সলতে এমনভাবে কমাল যাতে সামান্য আভা অবশিষ্ট থাকে। মাদুলিটা হাতের মুঠোয় ধরে ফেনে পরিণত হওয়া লক্ট্রিসের মানসিক প্রতিমূর্তির কথা ভাবতে লাগল। লকেট খুলে ওর নতুন আর পুরোনো চুলের গোছা বের করল। লস্ত্রিসের প্রতি ভালোবাসাই ওর মূল প্রতিরক্ষা, এর উপরই নির্ভর করছে ইয়োসের বিরুদ্ধে ওর শক্তি। কোঁকড়া চুল মুখের কাছে ধরে নিজের ভালোবাসা নিশ্চিত করল ও।

আমাকে প্রতিরক্ষা দাও, প্রিয়া আমার, প্রার্থনা করল ও। শক্তি দাও। চুলের শক্তি এসে ওর আত্মাকে শক্তিশালী করে তুলছে, টের পেল। ওটা আবার লকেটে ঢুকিয়ে রাখল ও। তারপর মেরেনের চোখ থেকে বের করা লাল পাথরের কণাগুলো বের করে হাতের তালুতে রেখে ওগুলোয় মনোসংযোগ করল।

ঠাণ্ডা, কঠিন, আপনমনে বলল ও। ইয়োসের প্রতি আমার ঘৃণার মতোই।

ভালোবাসাই বর্ম, ঘৃণা হচ্ছে তলোয়ার। দুটোই নিশ্চিত করল ও। তারপর চুলের সাথে পাথর লকেটে রেখে গলায় ঝোলাল। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ও। কিন্তু ঘুম এলো না।

ফেনের বিচ্ছিন্ন সব স্মৃতি তাড়া করে ফিরতে লাগল ওকে। ওকে কাঁদতে ও হাসতে দেখার কথা ভাবল। ওর হাসি-ঠাট্টার কথা মনে পড়ল। ওকে সমাধান করতে দেওয়া কোনও সমস্যা নিয়ে সিরিয়াস অভিব্যক্তির কথা মনে পড়ে গেল। রাতে ওর পাশে উষ্ণ ও কোমল পড়ে থাকা ওর দেহের কথা মনে পড়ল। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদূ আওয়াজ, ওর বুকের সাথে তার বুকের স্পন্দনের শব্দ।

ওকে আবারও দেখতেই হবে। এটা হয়তো শেষবার হবে। মাদুরে উঠে বসল ও। ওকে আহ্বান জানানোর সাহস করা ঠিক হবে না, কিন্তু ওকে দেখে তো আসতে পারি। এদুটো নাক্ষত্রিক মহড়া প্রায় একই রকম হলেও মূলত পার্থক্য আছে। আহ্বান জানানোর মানে ইথারে ওর উদ্দেশে চিৎকার করা, তখন কোনও অপ্রত্যাশিত শ্রোতা ইথারের স্পন্দন টের পেয়ে যেতে পারে। নজর দেওয়ার মানে গোপনে কাউকে দেখে আসা, অনেকটা পিপহোলের নজরদারের মতো। কেবল ইয়োসের মতো একজন মোহন্ত ও গণকই তা টের পেতে পারে। ঠিক যেমন নজরদারকে ধরতে পেরেছে ও। তবে দীর্ঘদিন ধরে যেকোনও ধরনের নাক্ষত্রিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকায় এখন হয়তো ডাইনী তেমন একটা সতর্ক নাও থাকতে পারে।

ফেনকে দেখতেই হবে। ঝুঁকি নিতেই হবে।

ডান হাতে মাদুলিটা ধরল ও। চুলের গোছা ফেনেরই অংশ, ওর কাছে পৌঁছে দেবে ওকে। মাদুলিটা কপালে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ দুলতে শুরু করল। হাতে ধরা লকারটা যেন অদ্ভুতভাবে নিজস্ব জীবন লাভ করেছে। ওর হৃৎস্পন্দনের সাথে তাল মিলিয়ে ওটার ছন্দময় স্পন্দিত হওয়া টের পেল তাই। মন উন্মুক্ত করে অস্তিত্বের প্রবাহকে স্বাধীনভাবে প্রবশে করতে দিল। সবুজ নদীর মতো ওকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। দেহ ছেড়ে সোজা শূন্যে উঠে গেল ওর আত্মা, যেন বিশাল দানবীয় পাখির ডানায় ভর করে উড়ছে। অনেক নিচে বন আর সমভূমির পলায়নপর বিভ্রান্তিকর দৃশ্য দেখতে পেল ও। মনে হলো এক সেনাদল কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছে। কিন্তু নিচে নামতেই দেখতে পেল ওটা শরণার্থীদের মিছিল: শত শত নারী-পুরুষ-শিশু ধূলিধূসরিত পথে কষ্টেসৃষ্টে এগোচ্ছে, কিংবা লক্কড়মার্কা আঁড়ে টানা ঠেলাগাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বসেছে। ওদের সাথে সৈনিক আর ঘোড়সওয়াররা রয়েছে। কিন্তু ওই ভীড়ে ফেন নেই।

আরও আগে বাড়ল ও। ওর আত্মা অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। আরেকটু সামনে মুতাঙ্গির ছোট দালানকোঠার জটলাটা উদয় না হওয়া পর্যন্ত মাদুলিটাকে দিক নির্দেশক হিসাবে ব্যবহার করে খোঁজ করে চলল ও। কাছে যাওয়ার পর ক্রমবর্ধমান সতর্কতার সাথে বুঝতে পারল ধ্বংস হয়ে গেছে গ্রাম, পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। গণহত্যার নাক্ষত্রিক ছবি কুয়াশার মতো গ্রামের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন চিহ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ও। তবে বেড়ে ওঠা স্বস্তির সাথে লক্ষ করল মৃতদের ভেতর ফেন বা ওর দলের কেউ নেই। ধ্বংসের আগ নিশ্চয়ই মুতাঙ্গি থেকে পালিয়েছে ওরা।

গ্রামের অনেক পুবে চাঁদের পাহাড়ের পাদদেশে ওর অস্তিত্বের একটা ক্ষীণ আভাস না পাওয়া পর্যন্ত আত্মাকে উড়ে যেতে দিল ও। আভা অনুসরণ করে আগে বাড়ল ও, অবশেষে পাহাড়ের নিচের দিকের ঢাল আড়াল করে রাখা বনে লুকানো একটা সংকীর্ণ উপত্যকার উপর ভাসতে লাগল।

ওখানেই আছে ও। আরও কাছে অনুসন্ধান চালিয়ে ঘোড়া বেঁধে রাখার অলামত পেল। উইন্ডস্মোক রয়েছে ওদের সাথে, আছে ওয়ার্লউইন্ডও। ঘোড়াগুলোর ঠিক ওপাশে একটা গুহার সংকীর্ণ মুখ থেকে আগুনের আভা বের হচ্ছে। ইম্বালিকে পাশে নিয়ে প্রবেশপথে বসে আছে নাকোঁন্তো। আত্মাকে ভেতরে ভেসে যেতে দিল তাইতা।

ওই তো সে। একটা ছোট আগুনের পাশে মাদুরে শোয়া ফেনের অবয়ব খুঁজে বের করল ও। ওর এক পাশে শুয়ে আছে সিদুদু। সিদুদুর পাশে মেরেন, তারপর হিলতো। ফেনের এত কাছে রয়েছে তাইতা যে ওর নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাচ্ছে। দেখল, হাতের কাছেই অস্ত্র ফেলে রেখেছে ও। দলের অন্য সদস্যরাও পুরোপুরি সশস্ত্র। চিত হয়ে শুয়েছে ফেন। পরনে কেবল একটা নেংটি, কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত। কোমল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল ও। শেষবার দেখার পর ওর শরীর আরও বেশি নারীসুলভ হয়ে উঠেছে। বাচ্চাদের চর্বির অবশেষ পেট থেকে মিলিয়ে গেছে। আগুনের নিচু শিখায় ওর শরীরের বাকও গহ্বরগুলো ছায়াময়, উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বিশ্রামরত অবস্থায় ওর চেহারা সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতির চেয়েও কমণীয়। বিস্ময়ের সাথে তাইতা বুঝতে পারল ওর বয়স এখন ষোল বছরের কম নয়। ওর সাথে বছরগুলো দ্রুত কেটে গেছে।

ওর নিঃশ্বাসের ধরণ পাল্টে গেল, ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল ও। অগ্নিকুণ্ডের আগুনের আলোয় সবুজ দেখাচ্ছে, তবে ওর উপস্থিতি টের পেতেই গাঢ় হয়ে উঠল। কনুইয়ের ভর দিয়ে উঠে বসল ও। তাইতা বুঝতে পারল ওকে আহ্বান জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে সে। মেঘ-বাগিচার অনেক কাছে রয়েছে ওরা। ফের পাহাড়ের বৈরী জিনিসের কাছে উপস্থিতি ফাঁস করে দেওয়ার আগেই ঠেকাতে হবে ওকে। ওর চোখের সামনে নিজের আত্মার প্রতীক ফুটে উঠতে দিল ও। তাই ওকে লক্ষ করছে বুঝতে পারতেই চমকে সোজা হয়ে বসল ও। প্রতাঁকের দিকে তাকিয়ে রইল সে। ওকে চুপ থাকার নির্দেশ দিল তাইতা। হেসে মাথা দোলাল ফেন।

জবাবে নিজের আত্মার প্রতীক তৈরি করল ও। শাপলার জটিল রেখা ওর বাজপাখির প্রতাঁকের সাথে প্রেমিকসুলভ আলিঙ্গনে মূর্ত হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত বেশি সময় ওর সাথে রইল তাইতা। যোগাযোগ পলায়নপর ছিল, কিন্তু আরও বেশি সময় থাকা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ওর মনে একটামাত্র বার্তা গেঁথে দিল ও। শিগগিরই ফিরে আসব। শিগগিরই। খুব তাড়াতাড়ি। তারপর সরে আসতে শুরু করল।

ওর বিদায় টের পেল ফেন, মুখের হাসি ম্লান হয়ে এলো ওর। যেন ওকে আটকে রাখতে চায়, একটা হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। কিন্তু থাকবার সাহস হলো তাইতার।

একটা ঝকির সাথে নিজের শরীরে ফিরে এলো ও। মেঘ-বাগিচায় নিজের ঘুমানোর মাদুরে আসন পাতা বসা অবস্থায় আবিষ্কার করল নিজেকে। সংক্ষিপ্ত যোগাযোগের পর ফেনের সাথে বিচ্ছেদের বেদনা ভারাক্রান্ত করে তুলল ওকে।

*

পরের মাসগুলোতে নিজের নতুন মাংস নিয়ে যুদ্ধ করে চলল ও। বরাবরই ঘোড়সওয়ার থাকায় ওটাকে পোষ না মানা কোল্ট হিসাবে দেখছিল। শক্তি ও তাগিদ দিয়ে ইচ্ছার দাসে পরিণত করতে হচ্ছে। তরুণ বয়স থেকেই শরীরের উপর এখনকার কাজের চেয়ে ঢের কঠিন দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে নিষ্ঠুরভাবে নিজেকে শিক্ষিত ও শৃঙ্খলিত করে তুলল ও। প্রথমে শ্বাসপ্রশ্বাসের অনুশীলন রপ্ত করল। ফলে মনোসংযোগের অসাধারণ ক্ষমতা মিলল। অবশেষে সদ্যজাত অঙ্গের উপর কর্তৃত্ব করতে পারল ও। অল্প সময়ের ভেতরই কোনও রকম মানবিক অনুপ্রেরণা ছাড়াই ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি শক্তিমান থাকতে সক্ষম হয়ে উঠল।

দিমিতার ইয়োস বাগে পাওয়ার পর ওদের নারকীয় সঙ্গমের অভিজ্ঞতা কথা ওকে বলেছিলেন। তাইতা জানে অচিরেই তার জৈবিক আক্রমণের শিকার হতে হবে। বাঁচতে হলে প্রতিরোধ করা শিখতে হবে। যুদ্ধের জন্যে ওর সমস্ত প্রস্তুতি ব্যর্থ মনে হতে লাগল। বহু যুগের সবচেয়ে লোভী ও ক্ষুধার্ত শিকারীর মোকাবিলা করতে চলেছে, অথচ নিজে এখনও কুমার রয়ে গেছে।

নিজেকে সশস্ত্র করতে একজন নারীর সাহায্য লাগবে, স্থির করল ও। বেশ অভিজ্ঞ কেউ হতে হবে।

প্রথম পরিচয়ের পর থেকে ডাক্তার লাসুলুকে লাইব্রেরিতে বেশ কয়েববার দেখেছে ও। মনে হয় ওর মতোই বেশির ভাগ সময়ই লাইব্রেরিতে কাটায়। সংক্ষিপ্ত সৌজন্য বিনিময় করেছে ওরা, কিন্তু মেয়েটা ওদের বন্ধুত্বকে আরও দূরে নিয়ে যেতে আগ্রহী হলেও ও সেটাকে তেমন আমল দেয়নি। এবার তার খোঁজ শুরু করল ও। একদিন সকালে দেখা হয়ে গেল। লাইব্রেরির একটা রূমে ওঅর্কটেবিলে বসেছিল সে।

তোমার উপর দেবীর করুণা বর্ষিত হোক, শান্ত কণ্ঠে শুভেচ্ছা জানাল ও। হান্নাহ ও রেইকে একই কথা বলতে শুনেছে। মুখ তুলে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি দিল লাসুলু। ভয়ানক আঁকাবাঁকা রেখায় ঝলসে উঠল ওর আভা। গায়ের রঙ গাঢ় হয়ে এলো, দুই চোখ জলজল করতে লাগল। উত্তেজিত হলে বেশ সুন্দর লাগে তাকে।

আপনার উপরও শন্তি বর্ষিত হোক, মাই লর্ড, জবাব দিল সে। আপনার দাড়ি ছাঁটার নতুন ধরনে রীতিমতো চমকে গেছি আমি। খুব মানিয়েছে। কয়েক মিনিট কথা বলল ওরা। তারপর বিদায় নিয়ে নিজের টেবিলে চলে এলো তাই। অনেকক্ষণ তার দিকে আর তাকাল না। শেষে যে স্ক্রোলটা পড়ছিল সেটা গুটিয়ে রেখে মহিলার উঠে দাঁড়ানোর শব্দে চোখ তুলে তাকাল। সে কামরা পেরুনোর সময় পাথুরে মেঝেতে হালকা শব্দ তুলল পায়ের স্যান্ডেল। চোখ তুলে তাকাল তাইতা, চোখাচোখি হয়ে গেল ওদের। দরজার দিকে মাথা কাত করে আবার হাসল সে। ওকে অনুসরণ করে বনে চলে এলো তাই। স্যানেটোরিয়ামের পথ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে সে। আরও এক শো গজ যাবার আগেই তাকে ধরে ফেলল তাইতা। আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করল ওরা। শেষে লাসুলু জানতে চাইল, প্রায়ই আপনার উপর ডাক্তার হান্নাহর চালানো অপারেশন থেকে আপনার সেরে ওঠা নিয়ে ভাবি। শুরুর মতো শেষটাও কি ঠিকমতো হয়েছে?

সত্যিই তাইতা, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। মনে আছে, ডাক্তার হান্নাহর সাথে আমার ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছিলে?

উস্কানিমূলক শব্দের প্রয়োগে ওর আভা চড়া হয়ে উঠতে দেখল ও। জবাব দেওয়ার সময় কিঞ্চিত কর্কশ শোনাল তার কণ্ঠস্বর। হ্যাঁ।

বেশ, বিজ্ঞানী ও সার্জন হিসাবে তোমার হয়তো একটা প্রদর্শনীতে পেশাদারী আগ্রহ থাকতে পারে।

মহিলা তাইতার কামরায় না ঢোকা পর্যন্ত সহকর্মীর ভান করে গেল ওরা। কামরার কোণের পিপহোলটা জোব্বা দিয়ে ঢাকতে এক মুহূর্ত সময় নিল ও। তারপর লাসুলু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ফিরে এলো।

আরও একবার তোমার সহযোগিতা লাগবে আমার, টিউনিক খোলার সময় বলল ও।

অবশ্যই, সায় দিল সে, তৈরি হয়ে ওর কাছে এলো। আরেকটু পরে জানতে চাইল, মাই লর্ড, আপনি এর আগে কোনও মহিলাকে চিনতেন কিনা জানতে পারি?

হায়! দুঃখের সাথে মাথা নাড়ল ও। কীভাবে শুরু করতে হয় তাই জানি না।

তাহলে আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।

পোশাক পরা অবস্থা থেকে নগ্ন অনেক বেশি সুন্দরী সে। মাদুরে চিত হয়ে শুয়ে ওকে আমন্ত্রণ জানাল সে। আরেকটু হলেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল প্রায়। অনেক চেষ্টায় নিজেকে ও শরীরকে সামাল দিল ও। এখন অনুশীলন ও আত্মপ্রশিক্ষণ থেকে ফায়দা পাবে ও। নিজের শিহরণ ঠেকিয়ে রেখে নাবিক যেভাবে মহাসাগরের মানচিত্র পড়ে সেভাবে তার আভা পরখ করে চলল। মহিলা নিজে বোঝার আগেই তার প্রয়োজন ও চাহিদা জানার কাজে ব্যবহার করল তাকে। চিৎকার করে উঠল সে, গোটা শরীর খিচুনি উঠতে লাগল। মেরে ফেললে তো! অবশেষে ফুঁপিয়ে উঠল সে। দেবীর পবিত্র নামের দোহাই, আর পারছি না। কিন্তু চালিয়ে গেল তাই।

ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। অশ্রু, ঘামে ভিজে সপসপ করছে মুখ। চোখে ভয়ের গাঢ় ছায়া পড়েছে। তুমি একটা শয়তান, ফিসফিস করে বলল সে। খোদ শয়তান।

হান্নাহ আর তোমার মতো অন্যরা আমাকে শয়তান বানিয়েছে।

অবশেষে তৈরি হলো মহিলা। মুখ দিয়ে চেপে ধরে হাঁ করতে বাধ্য করল তাকে। তারপর পিঠ বাঁকা করে মুক্তো শিকারীর মতো জলের গভীরে ডুব দেওয়ার আগে শেষবারের মতো লম্বা শ্বাস নিয়ে সবকিছু বের করে আনল: ওর জ্ঞান, শক্তি ও বিদ্যা। ওর বিজয় ও পরাজয়, ভীতি ও গভীরে প্রোথিত অপরাধবোধ। তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে মাদুরে শূন্য ফেলে রাখল। এখন দ্রুত ও অগম্ভীর হয়ে পড়েছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস; ত্বক মলিন, স্বচ্ছ মোমের মতো লাগছে। চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে থাকলেও কিছুই দেখছে না। সে রাতের বাকি সময় তার পাশে বসে থাকল ও; ওর স্মৃতি জেনে নিল, শিখে নিল সব বিদ্যা, সব গোপন বিষয়, তাকে সত্যিকার অর্থে চিনে নিল।

যখন ভোরের আলো চুঁইয়ে ঘরে ঢুকল তখন অবশেষে নড়ে উঠে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়তে শুরু করল সে। কে আমি? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল। কোথায় আমি? আমার কী হয়েছে? কিছুই মনে করতে পারছি না।

তুমি লাসুলু নামে একজন মানুষ, কিন্তু তোমার জীবনে মহাশয়তানকে ধারণ করেছ। অপরাধে পীড়িত হয়েছ তুমি। তোমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছি। কিন্তু রাখার মতো কোনও কিছুই ছিল না তোমার। ফিরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে, বিশেষ করে অপরাধবোধ। শেষ পর্যন্ত এটা তোমাকে হত্যা করবে, সেই মৃত্যুই তোমার খুব বেশি পাওনা।

ওকে আবার চিত করে শুইয়ে পাশে হাঁটু গেড়ে বসার পর যুদ্ধ করার প্রয়াস পেল লাসুলু। কিন্তু তার শরীরে আর শক্তি নেই। দ্বিতীয়বারের মতো তাই প্রবিষ্ট হলে আর্তনাদ করে উঠল সে। সেই আর্তনাদ কণ্ঠে বুদ্বুদ তুলল কেবল, ঠোঁট পর্যন্ত আসতে পারল না। সবকিছু আবার ফিরিয়ে দিল তাকে। তারপর নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ম্লান করতে চলে গেল।

আবার শোয়ার ঘরে ফিরে এসে দেখল টিউনিক পরছে সে। প্রবল আতঙ্কে ওর দিকে তাকাল সে। ওর আভা ছিন্নভিন্ন হতে দেখল তাইতা। টলমল পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটানে কবাট খুলে দ্রুত প্যাসেজে বের হয়ে গেল। মিলিয়ে গেল তার ছুটন্ত পায়ের শব্দ।

প্রথমবারের মতো করুণার একটা খোঁচা বোধ করল ও। কিন্তু তার জঘন্য অপরাধগুলোর কথা মনে হতেই উধাও হয়ে গেল তা। তারপর ভাবল: কিন্তু তার মালকিন, মহাডাইনীর সাথে কীভাবে লড়তে হবে তার কায়দা শিখিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত করেছে।

*

দিনের পর দিন সপ্তাহর পর সপ্তাহ ইয়োসের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় রইল ও, জানে তা আসবেই। তারপর একদিন সকালে ফুরফুরে প্রত্যাশার পরিচিত অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠল ও। ডাইনী আমাকে তার আস্তানায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, আপন মনে বলল ও। হ্রদের দিকে খোলা টেরেসে বসে খেজুর ও ডুমুড় দিয়ে হালকা নাশতা সারল। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সুর্যের আলোয় জ্বালামুখের দেয়াল সোনালি আলোয় ভরে উঠতে দেখল। ভৃত্যদের ছাড়া আর কাউকে দেখছে না। হান্নাহ, রেই বা আসেম, কাউকে না। স্বস্তি বোধ করল ও। গোপন কামরার ক্রোলের গুপ্ত বিষয় জানার পরপরই ওদের কারও সাথে মুখোমুখি হতে চাইছিল না। যখন দালান থেকে বের হয়ে উপরের বাগানের তোরণের উদ্দেশে পা বাড়াল, কেউ যেচে কথা বলতে এলো না বা বাধা দিতে গেল না।

ধীর পায়ে হাঁটছে ও, নিজের শক্তি জড়ো ও খতিয়ে দেখার সময় নিচ্ছে। কেবল দিমিতারের দেওয়া বর্ণনাতেই ইয়োসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে। হাঁটার সময় প্রতিটি শব্দ বারবার উল্টেপাল্টে পাল্টে দেখল। ওর স্মৃতিশক্তির প্রখরতার কারণে মনে হলো বুড়ো মানুষটা ওর সামনে বসে কথা বলছে।

হুমকি মনে করলে চেহারা পাল্টে ফেলতে পারে সে, ঠিক গিরগিটির মতো, দিমিতারের কণ্ঠ বাজতে লাগল ওর কানে। গুহায় দেখা বিভিন্ন প্রতিমূর্তির কথা ভবাবল তাইতা: ইম্প, ফারাও, দেবতা ও দেবী এবং ওর নিজের প্রতিমূর্তি।

কিন্তু অহঙ্কার হচ্ছে তার নানা দোষের ভেতর সবচেয়ে খারাপ। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কত সুন্দর রূপ ধরতে পারে সে। এই রূপ যখন ধরে কোনও পুরুষের পক্ষে তাকে ঠেকানো অসম্ভব। তার রূপ যেকোনও আদর্শ পুরুষকেও স্রেফ পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে। স্যানেটোরিয়ামের অপারেশন রুমে ইয়োসকে দেখার কথা মনে করল ও। কালো পর্দার ওপাশে চেহারা দেখতে না পেলেও তার সৌন্দর্য এমন ছিল যে পর্দার আড়ালেও গোটা কামরা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

মোহন্ত হিসাবে প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও নিজের কুপ্রবৃত্তি দমন করতে পারিনি। আবার কথা বলে উঠলেন দিমিতার। মন দিয়ে শুনতে লাগল তাইতা। পরিণাম বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার কাছে সে ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। কামনার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে খেলেছে সে, ঠিক পাহাড়ী হাওয়া ঝরা পাতাকে নিয়ে যেমন করে খেলে। আমার মনে হয়েছিল সে আমাকে সব দিয়েছে, এই জগতের সব আনন্দ। নিজের শরীর তুলে দিয়েছিল সে। কথা বলার সময় তার কণ্ঠে আবার সেই যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পেল তাইতা: প্রতিটি উত্থান পতন, প্রতিটি খাঁজ, সুবাসিত ভাঁজ…ওকে ঠেকানোর চেষ্টাই করিনি, কারণ কোনও স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তাকে ঠেকানো সম্ভব না।

আমি কি তা পারব? ভাবল তাই।

তারপর দিমিতারের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী প্রতিধ্বনি তুলল ওর কানে: তাইতা, আপনি বলেছিলেন আসল ইয়োস এক অতৃপ্ত নিম্ফোম্যানিয়াক। কথাটা ঠিক। কিন্তু অন্য এই ইয়োস ক্ষুধার দিক থেকে তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সে যখন চুমু খায়, প্রেমিকের শরীর থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় রস কেড়ে নেয়। যেভাবে আমরা পাকা আমের রস চুষে খাব। পুরুষকে আলিঙ্গন করে পায়ের মাঝে আটকে রেখে তার সত্তা বের করে নেয়। শিকারের সত্তাই তার জীবনীশক্তি। মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকা এক দানবীয় ভ্যাম্পায়ার। কেবল উন্নত সত্তাকেই শিকার হিসাবে বেছে নেয়। সৎ মনের নারী-পুরুষ, সত্যির সাধক, বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাগাস, প্রতিভাবান ভবিষ্যদ্বক্তা। শিকারের সন্ধান পাওয়ার পর পিছু নেয়, ঠিক নেকড়ে যেভাবে হরিণের পিছু ধাওয়া করে।

আমার বেলায় যেমন করেছে, ভাবল তাই।

সে মহাবুভুক্ষু। এসব দিমিতারের কথা, তার মতো আর কোনও জীবিত মানুষ চেনেনি তাকে। বয়স বা চেহারা কোনও ব্যাপার না, শারীরিক খুঁত বা বিকৃতিও না। মাংস দিয়ে ক্ষুধা মেটায় না সে। বরং আত্মা দিয়ে। তরুণ-প্রবীন, নারী-পুরুষ সবাইকে গ্রাস করে। একবার আয়ত্ত করতে পারলে, রূপালি জালে আটকানোর পর ওদের পুঞ্জীভূত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা শুষে নেয়। অভিশপ্ত চুমু খেয়ে সব কেড়ে নেয় সে। ঘৃণিত আলিঙ্গনের সময় টেনে বের করে নেয়। কেবল শূন্য খোসাটা ফেলে রাখে।

ডাইনীর চ্যালা হান্নাহ, রেই ও আসেম কেবল একটা কারণেই তাইতার পুরুষাঙ্গকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। যাতে ইয়োস ওকে ধ্বংস করতে পারে-দেহ, মনে, আত্মায়। জলোচ্ছ্বসের মতো ফুঁসে উঠে ওকে ধ্বংস করার হুমকী অনেক কষ্টে সহ্য করল ও।

আমি তার জন্যে তৈরি, যতটা সম্ভব। কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট হবে?

বাগানের গেট হাঁ করে খোলা ছিল। কিন্তু ও সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গোটা জ্বালামুখ জুড়ে এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মৃদু হাওয়া পড়ে গেল। একজোড়া বুলবুল পরস্পরের উদ্দেশে দ্বৈত সঙ্গীত গাইছিল, চুপ করে গেল ওরা। গাছের উঁচু ডালপালা স্তব্ধ হয়ে গেল, আকাশের নীল ক্যানভাসের পটভূমিতে অনড় হয়ে রইল। এক মুহূর্ত বেশি সময় নীরবতায় কান পেতে শুনল, তারপর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল ও।

ওর পায়ের নিচে জমি নড়ছে। কাঁপছে। সহানুভূতিতে তিরতির করে দুলছে গাছের পাতা। কাঁপুনিটা প্রবল ঝাঁকুনিতে পরিণত হলো। পায়ের নিচে পাথরের গোঙানি শুনতে পেল ও। জ্বালামুখের একটা অংশ ভেঙে সগর্জনে নিচের বনে লুটিয়ে পড়ল। ঝড়ে আক্রান্ত জাহাজের পাটাতনের মতো দুলছে গোটা পৃথিবী। তাল হারানোর দশা হলো ওর। নিচে ছিটকে পড়া থেকে বাঁচতে গেটের একটা গরাদ ধরতে হাত বাড়িয়ে দিল। আবার বেড়ে উঠল হাওয়া। তবে এবার সেটা এলো শয়তানের গুহার দিকে থেকে। গাছপালার ডালের উপর দিয়ে বয়ে গেল সবেগে, মরা পাতার ঘূর্ণী তুলল চারপাশে। লাশের দেশের মতোই শীতল।

ওকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে ইয়োস। আগ্নেয়গিরি মালকিন সে। ভূমিকম্প ও নরকে প্রবাহিত লাভা নদীর চালক। তার শক্তির কাছে আমি কত নগণ্য সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইছে, ভাবল ও। তারপর জোরে চিৎকার করে উঠল। আমি এখানে, ইয়োস! তোমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।

পৃথিবীর কম্পন থেমে গেল, জ্বালামুখে আবার রহস্যময় নীরবতা নেমে এলো। এখন ওর সামনের পথ পরিষ্কার, আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অবশেষে বড় বড় পাথরের চাইয়ের মাঝখান দিয়ে আগে বেড়ে গুহা থেকে বের হয়ে আসা জলধারার কুলকুল ধ্বনি শুনতে পেল। সবুজের পর্দা ভেদ করে এগিয়ে গেল ও, পুকুরের পাশের খালি জায়গায় পা রাখল। যেমন দেখে গিয়েছিল তেমনই আছে সব। উপড়ে পড়া গাছের কাণ্ডের দিকে পেছন ফিরে ঘাসের উপর পুরোনো জায়গায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল ও।

তার আসার প্রথম যে সঙ্কেত পেল ও, সেটা হচ্ছে বরফ শীতল হাওয়া, ঘাড়ের পেছনের চুলে শিহরণ তুলল। বাহুর পশমগুলো কেঁপে উঠল। গুহার মুখের দিকে খেয়াল রাখল ও, দেখতে পেল সূক্ষ্ম একটা রূপালি কুয়াশা বের হয়ে আসছে ওখান থেকে। তারপর একটা গাঢ় অবয়ব বের হয়ে এলো কুয়াশার ভেতর থেকে, শ্যাওলায় ঢাকা পথ ধরে রাজকীয় ঢঙে এগিয়ে আসছে। হান্নাহর ঘরে দেখা সেই পর্দা পরা মহিলাই, সেই একই বিশাল আধাস্বচ্ছ কালো রেশমী পোশাক পরেছে।

রূপালি কুয়াশার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো ইয়োস। ওর নগ্ন পাজোড়া দেখতে পেল তাইতা। আলখেল্লার নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। কেবল অংশ বিশেষই নজরে আসছে। পায়ের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঝর্নার পানিতে ভিজে চকচক করছে। ছোট, নিখুঁত। যেন ক্রিম রঙা আইভরি থেকে কোনও দক্ষ শিল্পী কুঁদে বের করেছে। ওর পায়ের নখ মুক্তোর মতো উজ্জ্বল। কেবল শরীরের ওই অংশটুকুই দেখতে পেয়েছে এ পর্যন্ত। মারাত্মক উত্তেজক ওগুলো। চোখ সরাতে পারছে না ও। টের পেল উত্তেজিত হয়ে উঠছেও, অনেক চেষ্টায় নিজেকে দমন করল।

কেবল পায়ের আঙুল দেখিয়ে এভাবে প্রভাবিত করতে পারলে শরীরের বাকি অংশ উন্মুক্ত করলে কীকরে তাকে রোধ করার আশা করতে পারি?

অবশেষে চোখ তুলতে পারল ও। পর্দার আড়াল ভেদ করে দেখার প্রয়াস পেল। কিন্তু সেটা দুর্ভেদ্য। এবার তার দৃষ্টির পরশ পেল ও, যেন প্রজাপতি এসে বসেছে ওর গায়ে। কথা বলল সে, দম বন্ধ হয়ে এলো তাইতার। তার কণ্ঠের গানের সাথে তুলনা করার মতো কোনও শব্দ জীবনেও শোনেনি ও। ফটিকের ঘণ্টার মতো রূপালি। ওর আত্মার ভিত্তি টলে উঠল।

যুগের পর যুগ তোমার অপেক্ষায় ছিলাম আমি, বলল ইয়োস, সে মহা মিথ্যার ধারক জানা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাস না করে পারল না ও।

*

Done page 404

কাপ্টেন ওনকা তাইতাকে মেঘ-বাগিচায় নিয়ে যাবার পরেও বেশ কয়েক মাস VIসিদুদুকে লুকিয়ে রাখল ফেন ও মেরেন। গোড়ার দিকে বিপর্যয়ে ভেঙে পড়ে রীতিমতো বিভ্রান্ত ও মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছিল সে। মেরেন ও ফেন ওর সাথে খুবই কোমল আচরণ করায় অচিরেই ওদের উপর যারপরনাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সে। সারাক্ষণই ওদের কাউকে ওর সাথে থাকতে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিল ও, ওর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করল। অবশেষে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে পারল, ভালোবাসার মন্দিরের কাহিনী জানাল ওদের।

ওটা একমাত্র সত্য দেবীর নামে উৎসর্গ করা, ব্যাখ্যা করল ও। নবাগতদের ভেতর থেকে মন্দিরের কুমারীদের বাছাই করা হয়, কখনওই অভিজাত মহল থেকে নয়। নবাগত প্রত্যেকটা পরিবারকে তাদের একটা মেয়েকে ওদের হাতে তুলে দিতেই হবে। যেসব পরিবারের মেয়ে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের পক্ষে বিরাট সম্মান ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী হওয়া যায়। আমাদের গ্রামের সবাই দেবীর আরাধনায় একটা উৎসবের আয়োজন করে। সেখানে সবচেয়ে জাঁকাল পোশাক। পরায় আমাকে, ফুলের মুকুট মাথায় পরিয়ে মন্দিরে নিয়ে যায়। বাবা-মা আমার সাথে গিয়েছিল। খুশিতে হাসছিল ওরা, কাঁদছিল। আমাকে ওরা প্রধান পুরোহিতিনীর হাতে তুলে দিয়ে চলে আসে। ওদের আর কোনওদিন দেখিনি।

তোমাকে দেবীর সেবিকা বাছাই করেছিল কে? জিজ্ঞেস করল ফেন।

কোন এক অলিগার্কের কথা বলেছে ওরা, জবাব দিল সিদুদু।

ভালোবাসার মন্দির সম্পর্কে বলো, বলল মেরেন। ভাবতে গিয়ে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল সে। তারপর মৃদু অথচ দ্রুত কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল। খুবই সুন্দর জায়গা। প্রথম যখন যাই, আরও অনেক মেয়ে ছিল। মহিলা পুরোহিতরা আমাদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছে। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় আর ভালো খাবার দেওয়া হতো আমাদের। ওরা বলত আমরা আমাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিলেই দেবীর পাহাড়ে যেতে পারব, দেবী আমাদের সম্মান দেবেন।

তোমরা সুখে ছিলে? জানতে চাইল ফেন।

প্রথম প্রথম ছিলাম আমি। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ত বটে, কিন্তু রোজ সকালে আমাদের মজাদার শরবত খাওয়াত ওরা, তাতে খুশি আর উদ্যমী হয়ে উঠতাম আমরা, হাসতাম, নাচতাম।

তারপর কী হলো? জিজ্ঞেস করল মেরেন।

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিচু কণ্ঠে কথা বলতে লাগল সে, ঠিকমতো শুনতে কষ্ট হলো মেরেনের। কিছু লোক আমাদের দেখতে এলো। ওদের আমরা আমাদের বন্ধু ভেবেছিলাম। ওদের সাথে নাচলাম আমরা। নীরবে কাঁদতে শুরু করল সিদুদু।

আর বলতে পারব না, লজ্জা পাচ্ছি।

চুপ করে রইল ওরা, সিদুদুর হাত ধরল ফেন। আমরা তোমার সত্যিকারের বন্ধু, সিদুদু, বলল ও। আমাদের সব বলতে পারো। আমাদের সাথে কথা বলতে কোনও সমস্যা নেই।

হৃদয় মোচড়ানো শব্দে কেঁদে উঠল মেয়েটা, ফেনের গলা জড়িয়ে ধরল। প্রধান পুরোহিতিনী আমাদের দেখতে আসা লোকগুলোর সাথে বিছানায় যাওয়ার হুকুম দিলেন।

কারা ছিল ওরা? গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল মেরেন।

প্রথম জন লর্ড আকের। ভয়ঙ্কর লোক। অন্যরাও ছিল, অনেক লোক। ওনকাও ছিল।

আর বলতে হবে না, ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল ফেন।

না! বলতেই হবে! সেই দুঃসহ স্মৃতি আমার মনে আগুনের মতো জ্বলেছ। তোমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারব না। দীর্ঘ, শরীর কাঁপানো শ্বাস নিল সিদুদু। মাসে একবার হান্নাহ নামে এক মহিলা ডাক্তার আমাদের পরীক্ষা করতে আসত। প্রতিবার একজন বা তার বেশি মেয়েকে বাছাই করত সে। পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো ওদের দেবীর হাতে মর্যাদা পাবার জন্যে। ওরা আর মন্দিরে ফিরে আসেনি। আবার থেমে গেল সে। নাক ঝাড়তে ওকে একটা টুকরো লিনেন এগিয়ে দিল ফেন। না ঝেড়ে কাপড়টা সযত্নে ভাঁজ করে আবার কথা বলতে শুরু করল সিদুদু মেয়েদের একজন আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। খুবই ভালো মেয়ে। ওর নাম লিতানি। দেখতেও সুন্দর। কিন্তু মায়ের কথা খুব মনে পড়ত ওর, লোকগুলোর সাথে আমরা যা করতাম তাকে ঘৃণা করত। একদিন রাতে মন্দির থেকে পালাল ও। চলে যাবার কথা আমাকে বলেছিল, ওকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল ও। পরদিন সকালে পুরোহিতিনী ওর লাশ এনে রাখল বেদীর উপর। সতর্ক করার জন্যে আমাদের সবাইকে ওর লাশের পাশ দিয়ে যেতে বাধ্য করে ওরা। ওরা বলে ট্রগরা বনের ভেতর পাকড়াও করেছে ওকে। বেদীতে শুয়ে থাকা লিতানের সৌন্দর্য বলতে কিছু ছিল না।

কিছুক্ষণ ওকে কাঁদতে দিল ওরা। তারপর মেরেন বলল, ওনকার কথা বলো আমাদের।

ওনকা অভিজাত গোষ্ঠীর লোক। লর্ড আকের তার চাচা। আকেরের প্রধান গোয়েন্দা। এইসব কারণে বিশেষ সুবিধা পায় সে। আমাকে বেছে নিয়েছিল সে। তার অবস্থানের কারণে একবারের বেশি আমার কাছে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাকে। তারপর তার বাড়িতে দাসীগিরি করতে আমাকে মন্দির থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল ওকে। রাষ্ট্রের জন্যে তার সেবার পুরস্কার ছিলাম আমি। মাতাল অবস্থায় আমাকে সে মারত। মেরে মজা পেত। ঝিলিক দিয়ে উঠত ওর চোখ। কাজটা করার সময় সে হাসত। একদিন ওনকা দূরে থাকবার সময় গোপনে এক মহিলা এলো। আমাকে জানাল মেঘ-বাগিচায় বিশাল লাইব্রেরিতে কাজ করে সে। তার কাছেই পাহাড় থেকে নিয়ে যাওয়া মেয়েদের ভাগ্যে কী পরিণতি ঘটেছে। জানতে পারি। দেবী তাদের মর্যাদা দেয়নি। জন্মের আগেই ওদের বাচ্চা জরায়ু থেকে কেটে বের করে দেবীর খাবার হিসাবে পরিবেশন করা হয়েছে। সেজন্যেই দেবীকে আড়ালে শিশু খাদক বলা হয়।

বাচ্চাদের পেটে ধরেছিল যারা সেই মেয়েদের কী হয়েছে?

অদৃশ্য হয়ে গেছে, সহজ কণ্ঠে বলল সিদুদু। আবার ফুঁপিয়ে কাঁদল। চলে যাওয়া মেয়েদের কয়েকজনকে পছন্দ করতাম। মন্দিরের অন্য মেয়েরাও ছিল যাদের ভালো লাগত। পেটে বাচ্চা আসার পর ওদেরও পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

শান্ত হও, সিদুদু, ফিসফিস করে বলল ফেন। এসব বলা আসলেই ভীতিকর।

না, ফেন, বেচারাকে কথা বলতে দাও, বাধা দিয়ে বলল মেরেন। ওর কথা আমার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জাররিয়রা দানব। আমার ক্রোধ ওদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে তুলছে আমাকে।

তাহলে আমার বন্ধুদের উদ্ধারে সাহায্য করবে, মেরেন? ডাগর ডাগর চোখে আশার চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে মেরেনের দিকে তাকাল সিদুদু।

তুমি যা বলবে তাই করব, সাথে সাথে জবাব দিল মেরেন। কিন্তু তার আগে ওনকা সম্পর্কে আরও কিছু বলল। সবার আগে সে-ই আমার বদলার রূপ দেখবে।

ভেবেছিলাম আমাকে বাঁচাবে সে। ভেবেছিলাম তার সাথে থাকলে আমাকে আর পাহাড়ে পাঠানো হবে না। কিন্তু তারপর অল্প কিছু দিন আগে একদিন ডাক্তার হান্নাহ আমাকে পরীক্ষা করতে আসে। তাকে আশা না করলেও তার আসার মানে জানতাম। আমাকে পরীক্ষা করার সময় কিছু না বললেও ওনকার দিকে তাকাতে দেখলাম তাকে, ওনকার মাথা দোলানোও দেখলাম। বুঝে গেলাম আমার পেটের বাচ্চা বেড়ে উঠলেই আমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। কয়েক দিন পর আরও একজন দেখতে এলো আমাকে। ওনকা তামাফুপায় কর্নেল তিনাতের সাথে থাকতে গোপনে আমার কাছে এসেছিল সে। আমাকে জররি থেকে পালানোর পরিকল্পনাকারী নবাগতদের সাথে কাজ করার প্রস্তাব দিল। অবশ্যই রাজি হয়ে গেলাম। ওদের কথা মতো একটা আরক খেতে দিলাম, অমনি অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। এরপর আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করে ওনকা। আমার সাথে আরও নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে সে। বুঝে গেলাম অচিরেই আমাকে ফের মন্দিরে ফেরত পাঠাবে। তখনই শুনলাম ম্যাগাস নাকি মুতাঙ্গিতে আছেন। ভাবলাম তিনি ওনকার বাচ্চাকে সরিয়ে দিতে পারবেন হয়তো। তো তার খোঁজ পেতে সবরকম ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পালালাম, কিন্তু ট্রগরা আমার পিছু নিল। তখনই আমাকে উদ্ধার করেছ তোমরা।

ভয়ঙ্কর কহিনী, বলল ফেন। অনেক ভুগেছ।

হ্যাঁ, কিন্তু এখনও মন্দিরের রয়ে যাওয়া মেয়েদের মতো নয়। ওদের মনে করিয়ে দিল সিদুদু।

ওদের উদ্ধার করব আমরা, ঝোঁকের বশে বলে ফেলল মেরেন। জাররি থেকে পালানোর সময় আমাদের সাথে থাকবে ওরা, কসম।

ওহ, মেরেন, তুমি কত সাহসী আর ভালো।

*

এরপর দ্রুত সেরে উঠল সিদুদু। রোজ ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল ফেন আর ও। অন্যরাও ওকে পছন্দ করে ফেলল: হিলতো, নাকোন্তা ও ইম্বালি, কিন্তু বাকি সবার চেয়ে বেশি পছন্দ মেরেনের। হিলতো ও মুতাঙ্গি গ্রামের অন্যদের সাহয়তায় দিনের বেলায় ঘর থেকে পালিয়ে বনে গিয়ে সময় কাটায়। মেরেন ও হিলতো ফেনকে তীর ছোঁড়ার কায়দা শেখানো চালিয়ে যাচ্ছে; অচিরেই সিদুদুকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাল ওরা। ওকে একটা ধনুক বানিয়ে দিল মেরেন, ওর শক্তি ও বাহুর আওতার সাথে খাপ খাইয়ে দিল ওটা ৷ সিদুদু মেয়েটা ছোটখাট, ছিপছিপে গড়নের হলেও বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী, তীর ছোঁড়ায় স্বাভাবিক এক ধরনের ঝোঁক দেখা গেল তার ভেতর। বনের ভেতর একচিলতে ফাঁকা জায়গায় ওদের লক্ষ্য বস্তু ঠিক করে দিল মেরেন, মেয়েরা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে তীর ছুঁড়তে লাগল।

মনে করো নিশানাটা ওনকার মাথা, ওকে বলেছিল ফেন। এরপর আর তেমন একটা ফস্কাল না সিদুদুর তীর। ওর বাহু দ্রুত শক্তিশালী বেড়ে উঠল; ফলে মেরেনকে অপেক্ষাকৃত ভারি টানঅলা আরেকটা ধনুক বানিয়ে দিতে হলো। অনেক আন্তরিক অনুশীলনের পর দুইশো কদম দূরের নিশানা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে সফল হলো ও।

মেরেন, হিলতো ও নাকোন্তো অভ্যাসবশতঃ জুয়াড়ি। মেয়েরা প্রতিযোগিতায় নামলেই বাজি ধরে ওরা। যার যার প্রিয়জনকে তাগিদ দেয়, সিদুদুকে দেওয়া বাড়তি সুবিধা নিয়ে ঝামেলা করে। ফেন সিদুদুর চেয়ে অনেক বেশি তীর ধনুক ব্যবহার করায় ওকে অনেক বেশি দূর থেকে তীর ছুঁড়তে দেয় ওরা। প্রথমে পঞ্চাশ কদম দূরত্ব মেনে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সিদুদুর দক্ষতা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আস্তে আস্তে সেটা কমে এলো।

একদিন ফাঁকা জায়গায় আরেকটা টুর্নামেন্ট করছিল ওরা। ফেন আর হিলতোর বিরুদ্ধে মেরেন ও সিদুদু দল বেঁধেছে। তীব্র প্রতিযোগিতা চলছিল, হল্লা প্রবল হয়ে উঠেছে, এমন সময় গাছপালার ভেতর থেকে একটা অচেনা খোঁড়ায় চেপে হাজির। হলো এক আগন্তুক। ক্ষেতের কৃষকের পোশাক তার পরনে, কিন্তু ঘোড়া হাঁকাচ্ছে যোদ্ধার ঢঙে। মেরেনের কাছ থেকে সঙ্কেত পেয়ে ধনুকে টাটকা তীর এঁটে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল ওরা। আগম্ভক ওদের উদ্দেশ্য টের পেয়ে লাগাম টানল, মুখ ঢেকে রাখা নেকাব সরিয়ে ফেলল।

সেথের গোবর লেপা পাছার দোহাই! বলে উঠল মেরেন। এ যে দেখছি তিনাত। ওকে স্বাগত জানাতে ছুটে গেল সে। কর্নেল, একটা কিছু ভজঘট হয়েছে। কী সেটা? এখুনি বলো।

তোমাদের খোঁজ পেয়ে খুশি হয়েছি, বলল তিনাত। মহাবিপদে আছি। আমরা, সেটা জানাতেই আসা। অলিগার্করা আমাদের সবাইকে ওদের সামনে হাজির হওয়ার সমন জারি করেছে। ওনকা ও তার লোকজন সব জায়গায় আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে মুতাঙ্গির ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে ওরা।

তার মানে? জিজ্ঞেস করল মেরেন।

এর একটাই মানে হতে পারে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল তিনাত। আমরা সন্দেহের আওতায় পড়ে গেছি। মনে ওনকা আমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। জাররিয় বিচারে আমি অবশ্য তাই। তুমি সিদুদুকে উদ্ধার করার সময় নিহত ট্ৰগদের লাশ খুঁজে পেয়েছে সে, ব্যাপারটা তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে, কারণ এখন সে নিশ্চিত যে তুমিই ওকে লুকিয়ে রেখেছ।

কী প্রমাণ আছে তার কাছে?

প্রমাণ লাগে না তার। লর্ড আকেরের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমাদের সবাইকে শাস্তি দিতে তার মুখের কথাই যথেষ্ট। জবাব দিল তিনাত। অলিগার্কদের বিচার কী হবে সেটা নিশ্চিত। অত্যাচার চালিয়ে জেরা করা হবে আমাদের। সেটা থেকে বাঁচতে পারলে, খনি বা কুয়েরিতে পাঠানো হবে আমাদের…কিংবা আরও খারাপ।

তাহলে এখন আমরা সবাই ফেরারী, মেরেনকে তাতে উদ্বিগ্ন মনে হলো না। অন্তত ভণিতার আর প্রয়োজন রইল না।

হ্যাঁ, সায় দিল তিনাত। আমরা ফেরারী। মুতাঙ্গিতে ফিরে যেতে পারবে না তুমি।

অবশ্যই না, বলল মেরেন। ওখানে আমাদের প্রয়োজনীয় কিছুই নেই। সাথে ঘোড়া আর অস্ত্রশস্ত্র আছে। জঙ্গলের পথই বেছে নিতে হবে আমাদের। মেঘ বাগিচা থেকে তাইতার ফেরার অপেক্ষায় থাকার সময় এই অভিশপ্ত জায়গা থেকে প্রিয় মিশরে ফিরে যাবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেব।

এখুনি সরে পড়তে হবে আমাদের, সায় দিয়ে বলল তিনাত। মুতাঙ্গির অনেক কাছে আছি আমরা। দূরের পাহাড়ে লুকোনোর মতো অনেক জায়গা মিলবে। চলার উপর থাকলে ওনকার পক্ষে আমাদের নাগাল পাওয়া কঠিন হবে। ঘোড়ায় চেপে পুব দিকে চলল ওরা। শেষ বিকেলের দিকে বিশ লীগ দূরত্ব অতিক্রম করে এলো। কিতানগালে গ্যাপের নিচে পাহাড়ের পাদদেশের ঢাল বেয়ে ওঠার সময় দীর্ঘ প্যাচানো শিং আর পেল্লায় কানঅলা অ্যান্টিলোপের একটা বিশাল পাল আড়াল থেকে বের হয়ে এসে ওদের সামনে দিয়ে ছুটে গেল। সাথে সাথে তীর ধনুক নামিয়ে ধাওয়া করল ওরা। ওয়ার্লউইভের পিঠে ফেন, সবার আগে ওদের নাগাল পেল সে, ওর তীর একটা মোটাসোটা শিৎবিহীন মাদী অ্যান্টিলোপকে শুইয়ে দিল।

যথেষ্ট! চিৎকার করে উঠল মেরেন। বেশ কয়েক দিন চলার মতো প্রচুর মাংস মিলবে ওটায়। পালের বাকি পশুদের যেতে দিয়ে মরা জানোয়ারটার ছাল খসিয়ে মাংস সংগ্রহ করতে জিন থেকে নামল ওরা। সূর্যাস্তের সময় ওদের পথ দেখিয়ে একটা পরিষ্কার মিঠা পানির ধারার কাছে নিয়ে এলো সিদুদু। ওটার কিনারে তাঁবু খাটাল ওরা, রাতের খাবারের জন্যে আগুনে অ্যান্টিলোপের বড় বড় মাংসের টুকরো ঝলসে নিল।

ওরা হাড় চিবোনোর সময়ে মেরেনকে বিদ্রোহী আদর্শের প্রতি অনুগত রাজকীয় বাহিনীর সাম্প্রতিক অবস্থানের ব্যাপারে খুলে বলল তিনাত। আমার নিজের রেজিমেন্ট হচ্ছে লাল পতাকা, আমি অস্ত্র তুলে নিতে বললেই সব অফিসার ও লোকজন ছুটে আসবে আমাদের কাছে। হলদে পতাকার দুটি ডিভিশনের উপরও নির্ভর করতে পারি আমি, আমার সহকর্মী কর্নেল সানগাত রয়েছে ওটার নেতৃত্বে। আমাদের পক্ষের লোক সে। তারপর আছে খনির স্টোপে কাজ করা কয়েদি ও বন্দিদের পাহারায় থাকা তিনটা ডিভিশন। বন্দিদের উপর চালানো নিষ্ঠুরতা ও অমানুষিকতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে ওদের। আমার নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ওরা। আমরা যুদ্ধ শুরু করামাত্র বন্দিদের ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র দিয়ে জোর করে আমাদের সাথে যোগ দিতে নিয়ে আসবে। সেনা সমাবেশের বিভিন্ন জায়গা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেল ওরা, শেষ পর্যন্ত স্থির হলো যে প্রত্যেকটা ইউনিটকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে কিতানগালে গ্যাপের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, ওখানে মিলিত হবে ওরা।

আমাদের বিরুদ্ধে জাররিয়রা কী ধরনের শক্তি মোতায়েন করতে পারে? জানতে চাইল। মেরেন।

সংখ্যায় আমাদের দশজনে একজনে হারিয়ে দিলেও সৈন্য সমাবেশ করে আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিতে অনেক দিন লাগবে অলিগার্কদের। যতক্ষণ ওদের ভড়কে দিতে পারছি, ওদের আগে আমাদের বাহিনীকে সমবেত করতে পারছি ততক্ষণ আমাদের বাহিনী কিতানগালে নদীর মুখ পর্যন্ত পেছন থেকে আসা আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারবে। ওখানে পৌঁছানোর পর প্রয়োজনীয় নৌকা ছিনতাই করব আমরা। একবার নদীতে নেমে গেলে ভাটি বরাবর বিশাল নালুবালে হ্রদের দিকে চলে যাওয়া অনেক সহজ হবে। থেমে ধূর্ত দৃষ্টিতে মেরেনের দিকে তাকাল সে। দিন দশেকের মধ্যেই তৈরি হতে পারব আমরা।

ম্যাগাস তাইতা ছাড়া যেতে পারব না আমরা, চট করে বলল মেরেন।

তাইতা একজন মানুষ মাত্র, যুক্তি দেখাল তিনাত। আমাদের শত শত লোক বিপদে আছে।

ওকে ছাড়া সফল হতে পারবে না, বলল মেরেন। ওর ক্ষমতা ছাড়া তুমি আর তোমার সব লোক শেষ হয়ে যাবে।

খোঁচা খোঁচা দাড়ি টানতে টানতে চেহারায় পরিহাস তরল চিন্তার ভাব ফুটিয়ে তুলে ভাবল তিনাত। তারপর যেন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, এমন একটা ভাব করল। ওর জন্যে সারা জীবন অপেক্ষা করতে পারব না আমরা। এরই মধ্যে মারা গিয়ে থাকে যদি? এই ঝুঁকি নিতে পারব না আমি।

কর্নেল তিনাত! ফেটে পড়ল ফেন। তুমি কি নবান্নের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত তাইতার জন্যে অপেক্ষা করবে?

ওর দিকে তাকিয়ে রইল তিনাত, তারপর সংক্ষেপে মাথা দোলাল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ম্যাগাস তার আগেই পাহাড় থেকে না নামলে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি আর কোনওদিনই ফিরবেন না।

ধন্যবাদ, কর্নেল। তোমার সাহস আর বুদ্ধি আছে। ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল ফেন। বিব্রত ভঙ্গিতে আগুনের শিখার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করতে লাগল তিনাত। নির্বিকারভাবে কথা বলে চলল ফেন। ভালোবাসার মন্দিরের মেয়েদের কথা জানো, কর্নেল?

অবশ্যই মন্দিরের সেবাদাসীদের থাকার কথা জানি আমি, কিন্তু কি হয়েছে তাতে?

সিদুদুর দিকে ফিরল ফেন। আমাদের যা বলেছ ওকেও বলো।

ক্রমে বেড়ে ওঠা আতঙ্কের সাথে সিদুদুর বিবরণ শুনে গেল তিনাত। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই চেহারা ফাঁকা হয়ে গেল তার। আমাদের অল্প বয়সী মেয়েদের উপর এমন জঘন্য অত্যাচারের কোনও ধারণাই ছিল না। অবশ্যই, এটা জানতাম যে মেয়েদের কাউকে কাউকে মেঘ-বাগিচায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে আমি নিজে নিয়ে গেছি। তবে ওরা স্বেচ্ছায় গিয়েছে। ওদের দেবীর কাছে বিসর্জন দেওয়ার বা পাহাড়ে মানুষখেকো আচারের কথা জানা ছিল না।

কর্নেল, ওদের আমাদের সাথে নিয়ে যেতে হবে। ওদের জাররিয়দের হাতে ফেলে যেতে পারব না, বাধা দিয়ে বলল মেরেন। ওদের মুক্ত করে জাররি থেকে যাবার সময় সাধ্যে যতটুকু কুলোয় তার সবটুকুই করার শপথ আগেই নিয়েছি আমি।

এখন আমিও একই শপথ করছি, গর্জে উঠল তিনাত। সব দেবতার নামে কসম খেয়ে বলছি, ওই মেয়েদের মুক্ত না করা পর্যন্ত এখান থেকে একপাও নড়ব না।

আমাদেরকে নবান্নের চাঁদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হলে তার আগ পর্যন্ত আর কয়জন মেয়েকে পাহাড়ে পাঠানো হতে পারে? জানতে চাইল ফেন।

ওর প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল ওরা।

আমরা বেশি আগে কাজে নামলে ওদের চমকে দেওয়ার সুযোগ হারাব। সাথে সাথে আমাদের বিরুদ্ধে ওদের শক্তি লেলিয়ে দেবে জাররিয়রা। তোমার কি প্রস্তাব, ফেন? তিনাতই কথা বলল।

কেবল পেটে বাচ্চা আছে এমন মেয়েদেরই পাহাড়ে পাঠানো হয়, জানাল ফেন।

আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কথাটা ঠিক, সায় দিল তিনাত। কিন্তু তাতে আমাদের কী উপকার হবে? অসংখ্য লোকের খেলার সামগ্রীর মতো ব্যবহার করা হলে আমরা তো আর ওদের অন্তসত্তা হওয়া ঠেকাতে পারব না।

তা হয়তো পারব না, তবে বাচ্চার বৃদ্ধি তো ঠেকাতে পারি।

কীভাবে? জানতে চাইল মেরেন।

সিদুদুর বেলায় তাই যেভাবে করেছে, গর্ভপাতের একটা আরক আছে। ফেনের কথাগুলো ভাবল ওরা। তারপর আবার কথা বলল মেরেন।

তাইতার ডাক্তারি ব্যাগটা রয়েছে মুতাঙ্গির বাড়িতে। ওটা আনতে ফিরে যেতে পারব না আমরা।

আরকটা বানাতে ও কী গুল্ম ব্যবহার করেছে, জানি আমি। ওকে ওগুলো সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছিলাম।

ওষুধটা মেয়েদের কাছে পৌঁছাবে কীকরে? জানতে চাইল তিনাত। ঐগরা ওদের পাহারা দিয়ে রাখে।

আমি ও সিদুদু মন্দিরে নিয়ে যাব ওষুধটা, ব্যবহারের নিয়ম শিখিয়ে দেব মেয়েদের।

কিন্তু ট্রগ আর পুরোহিতিনীরা-ওদের এড়াবে কেমন করে?

সিদুদুকে যেভাবে ওনকার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম, জবাব দিল ফেন।

আড়াল করার মন্ত্র! বলে উঠল মেরেন।

বুঝতে পারছি না, বলল তিনাত। কীসের কথা বলছ?

ফেন ম্যাগাসের শিষ্যা, বুঝিয়ে বলল মেরেন। ওকে বেশ কিছু গোপন বিদ্যা শিখিয়েছেন তিনি। এইসব কায়দা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে ও। নিজেকে ও অন্যদের অদৃশ্য পর্দায় আড়াল করতে পারে।

এটা সম্ভব, বিশ্বাস করি না, ঘোষণা করল তিনাত।

তাহলে তোমাকে দেখাচ্ছি, বলল ফেন। দয়া করে মেরেন আবার না ডাকা পর্যন্ত আগুনের কাছ থেকে সরে ওই গাছপালার ঝোঁপের আড়ালে অপেক্ষা করো। ভুরু কুঁচকে, বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাঁড়াল তিনাত, অন্ধকারে গটগট করে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফের ওকে ডাকল মেরেন। ফিরে এসে ওকে একা আবিষ্কার করল তিনাত।

বেশ ভালো, কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস। ওরা কোথায়? গজগজ করে জিজ্ঞেস করল তিনাত।

তোমার দশ কদমের ভেতর, বলল মেরেন। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে আগুনের চারপাশে একটা চক্কর দিল তিনাত, ডান বামে তাকাচ্ছে। শেষে যেখানে শুরু করেছিল সেখানেই ফিরে এলো।

কিছু নেই, বলল সে। এবার বলো ওরা কোথায় গাঢাকা দিয়েছে।

ঠিক তোমার সামনে, ইঙ্গিতে দেখাল মেরেন।

সামনে তাকাল তিনাত, তারপর মাথা নাড়ল। কিছুই দেখছি না, শুরু করল সে। তারপর পিছিয়ে গিয়ে বিস্ময়ের একটা ধ্বনি করে উঠল। হায়, অসিরিস আর হোরাস, এযে ডাকিনী বিদ্যা! শেষবার যেখানে দেখেছিল সেখানেই বসে আছে মেয়ে দুটি। হাতে হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

হ্যাঁ, কর্নেল, তবে এটা সামান্য একটা ব্যাপার। তোমার চেয়ে অনেক সহজে ট্রগদের ফাঁকি দেওয়া যাবে, বলল ফেন। কারণ ওরা সীমিত বুদ্ধির বর্বর, যেখানে তুমি প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ও খুবই উন্নত বুদ্ধির। প্রশংসায় শিথিল হলো তিনাত।

মেয়েটা সত্যিই ডাইনী। তিনাত তার সাথে পেরে উঠবে না। মনে মনে হাসল মেরেন। চাইলে ওকে মাথার উপর উল্টো করে দাঁড় করিয়ে ওর পাছায় শিসও বাজাতে পারবে ও।

*

ঘোড়ায় চেপে পাশাপাশি ভালোবাসার মন্দিরের দিকে যেতে পারল না ওরা। ৰোতাইতার মতো ঘোড়া ও মানুষের বিশাল দল আড়াল করার ক্ষমতা ফেনের নেই। ঘোড়াগুলোকে নিবিড় গাছপালার একটা জটলায় মেরেন ও নাকোন্তোর হাওলায় লুকিয়ে রেখে একাকী পায়ে হেঁটে আগে বাড়ল দুজন। চারটে ছোট ছোট গুল্ম ভর্তি লিনেনের ব্যাগ বইছে সিদুদু, ওর স্কার্টের নিচে কোমরে বাঁধা আছে ওগুলো।

বনের ভেতর দিয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল ওরা, অবশেষে একটা উঁচু জমিনের চূড়ায় পৌঁছাল; এখান থেকে নিচের উপত্যকায় নজর চালানো যায়। শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটা। হলদে স্যান্ডস্টোনের বিশাল, আঁকাল দালান, চারপাশে আঙিনা ও পুকুর, সেখানে দানবীয় শাপলার পাতা ভাসছে। ক্ষীণ ফুর্তির আওয়াজ আসছে, সবচেয়ে বড় পুকুরটার ধারে মেয়েদের বেশ বড়সড় জটলা দেখল ওরা। কেউ কেউ গোল হয়ে বসে গান গাইছে, হাত তালি দিচ্ছে; অন্যদিকে বাকিরা বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে।

এই সময় রোজই এমন করতাম আমরা, ফিসফিস করে বলল সিদুদু। ওরা পুরুষদের অপেক্ষা করছে।

কাউকে চিনতে পারছ? জানতে চাইল ফেন।

বুঝতে পারছি না। আমরা অনেক দূরে তো, বলা মুশকিল, হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল সিদুদু। দাঁড়াও! পুকুর ধারের একাকী মেয়েটা দেখতে পাচ্ছ? ওই আমার বন্ধু জিঙগা।

ছিপছিপে গড়নের প্রফুল্ল মেয়েটাকে দেখতে পেল ফেন, পুকুরের কিনারা বরাবর হাঁটাহাঁটি করছে। খাট চিতন পরেছে সে। হাত-পা নগ্ন, চুলে হলদে ফুল। ওকে কতটা বিশ্বাস করা যায়? জানতে চাইল ফেন।

অন্যদের চেয়ে বয়সে একটু বড় ও, ওদের ভেতর সবেচেয়ে বোদ্ধা। ওরা ওর কথা মানে।

ওর সাথে কথা বলতে যাব আমরা, বলল ফেন, কিন্তু ওর হাত চেপে ধরল সিদুদু।

দেখ! বলল ও, গলা কাঁপছে। ওরা যে রিজের চূড়ায় বসে আছে ঠিক তার নিচেই গাছ থেকে নেমে আসছে রোমশ কালো অবয়ব। বেঢপ ভঙ্গিতে শ্লথ পায়ে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে আগে বাড়ছে ওরা, হাত দিয়ে মাটি কামড়ে ধরছে। ট্রগ!

মন্দিরের এলাকার সীমানা ঘিরে চক্কর দিচ্ছে দানবীয় শিম্পাঞ্জিগুলো, তবে প্রাঙ্গণের মেয়েদের চোখের আড়ালে থাকছে। কয়েক কদম পর পর নাক ফুলিয়ে জমিন শুঁকছে, আগন্তুক বা মন্দির থেকে পলাতকদের খোঁজ করছে।

তুমি গন্ধ আড়াল করতে পারবে? জিজ্ঞেস করল সিদুদু। ট্রিগদের ঘ্রাণ শক্তি কিন্তু খুব চড়া।

না, স্বীকার গেল ফেন। মেয়েদের দিকে এগোনোর আগে ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে দিতে হবে। দ্রুত আগে বাড়ছে ট্রগরা। গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেল ওরা।

এগোও! বলল ফেন। জলদি! সিদুদুর হাতের দিকে হাত বাড়াল ও। মনে রেখ, কথা বলা যাবে না, দৌড়াবে না বা আমার হাত ছাড়বে না। সাবধানে, ধীরে ধীরে আগে বাড়বে।

নিজেদের উপর মন্ত্র পড়ল ফেন। তারপর সিদুদুকে নিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। সিদুদুর বন্ধু জিঙগা এখনও একা একটা উইলো গাছের নিচে বসে ধুরা পিঠার টুকরো ছুঁড়ে ফেলছে পানির মাছের ঝাঁকের দিকে। ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ওরা, তারপর আস্তে সিদুদুর ওপর থেকে আড়াল করার মন্ত্র তুলে নিল ফেন। অচেনা চেহারা দেখে জিঙগা যাতে চমকে না ওঠে তাই নিজে আড়ালে রয়ে গেল। কিলবিল করতে থাকা মাছের দিকে গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে ছিল মেয়েটা, মুহূর্তের জন্যে সিদুদুর উপস্থিতি টেরই পেল না ও। সহসা চমকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেল।

হাত ধরে ওকে ঠেকাল সিদুদু। জিঙগা, ভয় পেয়ো না।

ওর দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা, তারপর হাসল। তোমাকে দেখতে পাইনি, সিদুদু। ছিলে কোথায়? তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। আরও সুন্দর হয়ে গেছ তুমি।

তুমিও, জিঙগা, ওকে চুমু খেয়ে বলল সিদুদু। কিন্তু কথা বলার মতো বেশি সময় নেই হাতে। অনেক কথা বলতে হবে। মেয়েটার চেহারা জরিপ করল ও, সভয়ে লক্ষ করল ওর চোখের তারা আরকের কারণে বিস্ফারিত হয়ে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে হবে তোমাকে। ধীরে ধীরে কথা বলছে সিদুদু, যেন একেবারে কচি খুকীর সাথে কথা বলছে।

সিদুদুর কথার ব্যাপকতা বুঝতে পেরে জিঙগার চোখজোড়া আরও পরিষ্কারভাবে স্থির হলো। শেষে ফিসফিস করে বলল, ওরা আমাদের বোনদের খুন করছে। এ হতে পারে না।

কিন্তু তাই ঠিক, জিঙগা, আমার কথা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। তবে ব্যাপারটা ঠেকানোর জন্যে একটা কাজ করতে পারো। চট করে গুল্ম আর সেটা দিয়ে ওষুধ বানানোর কায়দা শিখিয়ে দিল ও। যাদের বাচ্চা আছে শুধু তাদেরই পাহাড়ে নিয়ে যায় ওরা। এই ওষুধ আমার বাচ্চা নষ্ট করে দিয়েছে। বিপদাপন্ন যেকোনও মেয়েকেই এটা দিতে হবে তোমাকে। স্কার্ট উঁচু করে কোমরে বাঁধা গুল্মের ব্যাগ আলগা করল সিদুদু। ভালো করে লুকিয়ে রাখ। পুরোহিতিনীরা যেন দেখতে না পায়। ডাক্তার হান্নাহ কোনও মেয়েকে দেবীর কাছে সম্মানের জন্যে নিয়ে যেতে বাছাই করামাত্র এই আরক খেতে দেবে। কেবল এটাই ওদের বাঁচাতে পারে।

আমাকে এরই মধ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে, ফিসফিস করে বলল জিঙগা। চারদিন আগে এসেছিল ডাক্তার, বলেছে শিগগিরই দেবীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি।

আহা, বেচারা জিঙগা! তাহলে আজ রাতেই এটা খেতে হবে তোমাকে, একা হলেই। বলল সিদুদু। আবার ওর হাত জড়িয়ে ধরল ও। তোমার সাথে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারছি না, তবে শিগগিরই তোমাকে উদ্ধার করতে একদল ভালো মানুষ নিয়ে ফিরে আসব। তোমাকে ও অন্যদের নতুন এক দেশে নিয়ে যাব আমরা, যেখানে নিরাপদে থাকব আমরা। ওদের বিদায় নিতে তৈরি থাকতে বলে দিয়ো। জিঙগার হাত ছেড়ে দিল ও। গুল্ম ভালো করে লুকিয়ে রাখ। এবার যাও। পেছনে তাকিয়ো না।

জিঙগা ওর দিকে পেছন ফেরামাত্র সিদুদুর উপর আড়ালের আলখেল্লাহ ছড়িয়ে দিল ফেন। বিশ কদম যাওয়ার আগেই আবার পেছনে তাকাল জিঙগা। সিদুদু অদৃশ্য হয়ে গেছে দেখে ওর চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। স্পষ্ট প্রয়াসে নিজেকে সামলে নিয়ে আঙিনা পেরিয়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল সে।

বনের ভেতর দিয়ে ফিরতি পথ ধরল ফেন ও সিদুদু। পাহাড়ের অর্ধেকটা দূরত্ব ওঠার পর পথ ছেড়ে অটল দাঁড়িয়ে রইল ফেন। কথা বলার সাহস হলো না ওর, তবে সিদুদুর হাতে চাপ দিয়ে জাদু অটুট রাখার ইশারা করল। দম ফেলতে ভুলে গেছে ওরা, দুটো বিশাল কালো ঐগকে গদাইলস্করি চালে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। গাছপালার চারপাশে ঝোপে তল্লাশি চালানোর সময় এপাশ ওপাশ মাথা দোলাচ্ছে ওরা, ঘন ভুরুর নিচে দ্রুত ঘুরে বেড়াচ্ছে ওদের চোখ। মদ্দাটা জোড়ার ভেতর বড় আকারের। মাদিটা তাকে অনুসরণ করছে, দেখে অনেক বেশি সতর্ক ও আগ্রাসী মনে হচ্ছে। মেয়েদের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল ওগুলো, মুহূর্তের জন্যে মনে হলো পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মাদীটা। বাতাসে নাক ফুলিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগল। মদ্দাটাও অনুসরণ করল ওটাকে, সশব্দে বাতাসে গন্ধ শুঁকতে লাগল। এবার দুটোই বেশ আগ্রহের সাথে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে লাগল। ভীষণ দর্শন দাঁতের পাটি বের করতে মুখ হাঁ করল মদ্দাটা। পরক্ষণে সপাটে বন্ধ করল। ওরা এত কাছে যে নিঃশ্বাসের বদগন্ধ পাচ্ছে ফেন। ওর হাতে ধরা সিদুদুর হাতটা কাঁপছে থরথর করে। ওকে সাহস যোগাতে ফের আঙুলে চাপ দিল ও।

মেয়েরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঐগ দুটো সাবধানে লফিয়ে লাফিয়ে সেদিকে আসতে লাগল। এখনও বাতাসে গন্ধ শুঁকছে। মাথা নিচু করে মেয়েরা পথে এসেছে সেখানকার মাটির গন্ধ শুঁকছে মাদীটা। গন্ধ শুঁকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। ত্রাসে থরথর কাঁপছে সিদুদু। নিজের মাঝে আতঙ্ক ক্রমে বেড়ে ওটা টের পাচ্ছে ফেন, একটা সময় সেটা টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করবে। গভীর মনোযোগের সাথে দীক্ষার কথা ভেবে নিজেকে স্থির করতে মনস্তাত্ত্বিক শক্তির তরঙ্গ পাঠাতে লাগল। কিন্তু এতক্ষণে ঐগের নাকের ডগা সিদুদুর স্যান্ডেলের আঙুলের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে চলে এসেছে। ভয়ে পেশাব করে দিল সিদুদু। পা বেয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল তরল; গন্ধ পেয়ে ঘোঁৎ করে উঠল ঐগটা। লাফ দিবেতৈরি হলো শিম্পাঞ্জিটা, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অ্যান্টিলোপ পালানোর সময় গাছের পাতা কাঁপিয়ে দিল। অমনি ভীষণ জোরে গর্জন করে উঠল মদ্দা ট্রগটা। দৌড়ে গেল ওটার পেছনে। মাদীটাও ছুটল ওটার পেছনে। সিদুদুর খুব কাছে দিয়ে গা ঘেঁষে গেল, ধরতে গেলে আরেকটু হলেই ছোঁয়া লেগে যেত। আগাছার ভেতর দিয়ে শিম্পাঞ্জিগুলো ছুটে যাবার সময় ফেনের উপর হেলে পড়ল সিদুদু। ফেন জড়িয়ে না ধরলে হয়তো পড়েই যেত। শক্ত করে ধরে পাহাড় চূড়ার দিকে টেনে নিয়ে চলল ওকে ফেন, মন্দির থেকে দূরে সরে যাবার আগেই যাতে আড়ালের মন্ত্র নষ্ট না হয়। সেজন্যে সতর্ক। অবশেষে মেরেন ও নাকোন্তো যেখানে ওদের জন্যে ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষায় ছিল সেদিকে ছুটে গেল ওরা।

*

পর পর দুই রাত একই তাঁবুতে ঘুমায়নি ওরা। বনের সমস্ত গলিখুঁজি হাতের তালুর মতো চেনে তিনাত ও সিদুদু, তাই দ্রুত ও গোপনে আগে বাড়তে পারছে ওরা, লোক চলাচলের পথ এড়িয়ে যাচ্ছে, পর পর দুটো শিবিরের মাঝখানে অনেক বেশি দূরত্ব তৈরি করছে। সবাইই নবাগত, বেশির ভাগ গ্রামবাসীই ওদের অনুগত। পলাতকদের জন্যে খাবার ও নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলল ওরা: স্থানীয় সহমতের ম্যাজিস্ট্রেট ও গ্রাম্য সর্দারদের সাথে আলোচনা করছে। জাররিয় টহলদারদের উপর নজর রাখছে, ওদের আসতে দেখলেই সতর্ক করে দিচ্ছে।

প্রত্যেকটা গ্রামে যুদ্ধ-সভার আয়োজন করছে মেরেন ও তিনাত।

আমাদের প্রিয় মিশরে ফিরে যাচ্ছি আমরা! ম্যাজিস্ট্রেট ও সর্দারদের বলে ওরা। নবান্নের চাদে তোমাদের লোকজনকে আমাদের সাথে যেতে তৈরি করে রাখ।

আগুনের আলোয় বৃত্তের লোকদের চেহারার দিকে তাকিয়ে আনন্দ ও উত্তেজনার চিহ্ন দেখতে পায় তিনাত। ওদের সামনে মেলে ধরা মানচিত্র ব্যাখ্যা করে সে। তোমাদের এই পথ ধরেই যেতে হবে। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে পুরুষদের সশস্ত্র করে তোল। পুরুষদের অবশ্যই তাদের পরিবারের জন্যে খাবার, গরম পোশাক ও কম্বল যোগাড় করতে হবে। তবে বহন করা যায় এমন সবকিছুই নিয়ো না। দীর্ঘ, কষ্টকর যাত্রা হবে এটা। তোমাদের প্রথম সমবেত হওয়ার জায়গা এটা। মানচিত্রের উপর একটা জায়গার দিকে ইঙ্গিত করল সে। দ্রুত ওখানে চলে যাবে। তোমাদের অপেক্ষায় স্কাউটরা থাকবে ওখানে। পুরুষদের জন্যে আরও ওয়্যাগন থাকবে ওদের কাছে, পথ দেখিয়ে কিতানগালে গ্যাপে নিয়ে যাবে তোমাদের। এটাই আমাদের সব লোকজনের মিলন স্থল হবে। গোপনীয়তা বজায় রাখবে, পরিণতির কথা মাথায় রাখবে। কেবল যাদের ব্যাপারে বিশ্বাস করা যায় তাদেরই আমাদের পরিকল্পনার কথা জানাবে। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তোমরা জানো অলিগার্কদের গুপ্তচর সব জায়গায় আছে। সময় হওয়ার আগে কোনওমতেই রওয়ানা হবে না। যদি না কর্নেল ক্যাম্বিসেস বা আমার কাছ থেকে সরাসরি নির্দেশ পাও। সূর্য ওঠার আগেই আবার পথে নামে ওরা। আশপাশের এলাকার সেনা ছাউনী ও সামরিক দুর্গের অধিনায়করা বলতে গেলে সন্দেহাতীতভাবে তিনাতের পক্ষের লোক। ওরা তার নির্দেশ শুনল। কিছু পরামর্শ দিল, প্রশ্ন করল আরও কম। আমাদের রওয়ানা দেওয়ার বার্তা পাঠিও। আমরা তৈরি থাকব, ওকে বলল তারা।

তিনটা প্রধান খনি পড়েছে পাহাড়সারির দক্ষিণ-পুব পাদদেশে। সবচেয়ে বড়টার স্টোপে কঠিন পরিশ্রম করছে হাজার হাজার দাস আর বন্দি, মূল্যবান রূপা। তুলে আনছে। প্রহরীদের অধিনায়ক তিনাতের লোক; তিনাত ও মেরেনকে শ্রমিকদের পোশাক পরিয়ে দাসদের ব্যারাকুন ও বন্দি শিবিরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিল সে। নিজেদের গোপন সেলে সংগঠিত করেছে বন্দিরা, নেতা স্থির করে রেখেছে। অনেক আগে থেকেই বেশির ভাগ নেতাকে চেনে তিনাত, গ্রেপ্তার ও বন্দি হওয়ার বেশ আগে থেকেই ওরা ওর বন্ধু, সতীর্থ। খুশি হয়েই ওর নির্দেশ শুনল।

নবান্নের চাঁদের অপেক্ষা করো, ওদের বলল সে। পাহারাদাররা আমাদের সাথে আছে। নির্দিষ্ট সময়ে তোমাদের মুক্ত করে দিতে গেট খুলে দেবে ওরা।

অন্য খনিগুলো ছোট। একটায় তামা ও তামাকে ব্রোঞ্জে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় সঙ্কর ধাতু জিঙ্ক উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে ছোটটাই বেশি সমৃদ্ধ। শ্রমিকরা এখানে পুরু সোনার কোয়ার্ট তুলে আনে, এত সমৃদ্ধ যে খাঁটি সোনার টুকরো শ্রমিকদের বাতির আলোয় চিকচিক করতে থাকে।

স্মেল্টারে পনের ওয়্যাগন ভর্তি খাঁটি সোনা আছে আমাদের, তিনাতকে জানাল প্রধান প্রকৌশলী।

বাদ দাও! কাটা কণ্ঠে নির্দেশ দিল মেরেন।

মাথা দোলাল তিনাত। হ্যাঁ! সোনা ফেলে যাও!

কিন্তু এত বেশি সম্পদ! প্রতিবাদ করল প্রকৌশলী।

স্বাধীনতা আরও বড় সম্পদ, বলল মেরেন। সোনা ফেলে যাও। ওসব আমাদের ধীর করে দেবে। ওয়্যাগনের আরও ভালো ব্যবহার বের করতে পারব আমরা। ওগুলো নারী, শিশু ও যারা খুব দুর্বল বা অসুস্থ বা হাঁটতে পারে না তাদের বহন করবে।

*

নবান্নের চাঁদের বিশ দিন বাকি থাকতেই আক্রমণ হানল অলিগার্করা। পরিকল্পিত যাত্রার কথা অনেকেই জেনে গিয়েছিল, ফলে গোটা জাররিতে উজ্জ্বল একটা আগুন জ্বলছিল। গোয়েন্দারা ধোয়ার গন্ধ পাবে এটাই স্বাভাবিক। অলিগার্করা দুই শো লোকসহ ক্যাপ্টেন ওনকাকে মুতাজিতে পাঠিয়েছে, এখন থেকেই গুজবের ডালপালা গজিয়েছে।

এক রাতে শহর ঘেরাও করে সব বাসিন্দাকে আটক করল ওরা। গ্রাম্য পরিষদের কুঁড়েয় একজন একজন করে ওদের জেরা করল ওনকা। চাবুক ও জ্বলন্ত লোহা ব্যবহার করল সে। জেরার সময় আটজন পুরুষ নিহত ও আরও অনেকে অন্ধ হয়ে গেলেও তেমন কিছু জানতে পারল না। এবার মেয়েদের উপর চড়াও হলো সে। বিলতোর কনিষ্ঠা স্ত্রীর ছিল যমজ সন্তান। চার বছর বয়সী একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। সে ওনকার প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার গেলে তার ছেলেকে দ্বিখণ্ডিত করার সময় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করল তাকে। তারপর ছেলেটার দ্বিখণ্ডিত দেহ ছুঁড়ে দিল তার পায়ের কাছে। তারপর বোনের মাথার কোঁকড়া চুলের ঝুঁটি ধরে তুলে নিল। মায়ের চোখের সামনে তাকে ঝোলাতে লাগল। চিৎকার করছিল মেয়েটা। তুমি জানো তোমার একটা বাচ্চাকে দিয়েই শেষ করব না আমি, মহিলাকে বলল সে। মেয়েটার গলায় ড্যাগারের ডগা দিয়ে খোঁচা মারল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সে। ভেঙে পড়ল বেচারা মা। যা জানা ছিল সবই ওনকাকে বলে দিল। অনেক কিছুই জানা হয়ে গেল ওনকার।

বিলতো, তার স্ত্রী আর বেঁচে যাওয়া মেয়েসহ গ্রামবাসীদের ছাউনী দেওয়া গ্রাম্য পরিষদের কুঁড়েয় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল ওনকা। দরজা জানালা আটকে আগুন ধরিয়ে দিল ছাউনীতে। জ্বলন্ত ভবন থেকে আর্তচিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসার সময় অলিগার্কদের খবর দিতে ঘোড়ায় চেপে আগুনের মতো দুর্গের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল ওনকা।

গ্রামবাসীদের দুজন পাহাড়ে শিকারে গিয়েছিল। ওখান থেকে হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করল ওরা, ওদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার খবর তিনাত ও মেরেনকে দিতে চলল। প্রায় বিশ লীগ দূরে দলটা যেখানে আত্মগোপন করেছিল সেদিকে ছুটে গেল ওরা।

লোক দুজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল তিনাত, দ্বিধা করল না সে। আমাদের পক্ষে আর নবান্নের চাঁদের অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখুনি রওয়ানা দিতে হবে।

তাইতা! চিৎকার করে উঠল ফেন, যন্ত্রণার সাথে। ওর জন্যে অপেক্ষা করবে বলে কথা দিয়েছিলে তুমি।

তুমি জানো, আমি পারব না, জবাব দিল তিনাত। এমনকি কর্নেল ক্যাম্বিসেসকেও একমত হতে হবে যে সেটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

অনীহার সাথে মাথা দোলাল মেরেন। কর্নেল তিনাত ঠিক বলেছে। ওর পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব না। লোকজন নিয়ে সটকে পড়তে হবে ওকে। খোদ তাইতাই এমনটা চাইতেন।

তোমাদের সাথে যাব না আমি, বলে উঠল ফেন। তাইতা না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

আমিও থাকব, বলল মেরেন। কিন্তু বাকি সবাইকে এখুনি চলে যেতে হবে।

ফেনের হাতের দিকে হাত বাড়াল সিদুদু। তুমি আর মেরেন আমার বন্ধু। আমিও যাব না।

তুমি সাহসী মেয়ে, বলল তিনাত। কিন্তু তুমি আবার ভালোবাসার মন্দিরে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে আসতে পারবে?

অবশ্যই! জোরে বলে উঠল ফেন।

তোমার সাথে কয়জন পুরুষ দিতে হবে? তিনাত জিজ্ঞেস করল।

দশজন হলেই চলবে, ওকে বলল মেরেন। মন্দিরের মেয়েদের জন্যে কয়েকটা ঘোড়াও লাগবে আমাদের। ওদের কিতানগালে যাবার পথে প্রথম খেয়া ঘাটে তোমাদের হাতে তুলে দেব। তারপর তাইতার জন্যে অপেক্ষা করতে আবার ফিরে আসব।

*

প্রায় রাতভর চলল ওরা। ফেন ও সিদুদু রয়েছে সামনে, কিন্তু উইন্ডস্পোকের পিঠে মেরেন পেছন থেকে অনুসরণ করছে। ভোরের প্রথম আলোয়, সূর্যোদয়ের আগে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলো ওরা, ভালোবাসার মন্দিরের দিকে তাকাল। নিচের উপত্যকতায় দাঁড়িয়ে আছে ওটা।

মন্দিরের সকালের রুটিন কি? জিজ্ঞেস করল ফেন।

সূর্য ওঠার আগে পুরোহিতিনীরা দেবীর উপাসনা করতে মেয়েদের মন্দিরে নিয়ে যায়। এর পর নাশতার জন্যে খাবার ঘরে যায় ওরা।

তারমানে এখন ওদের মন্দিরে থাকার কথা? জানতে চাইল মেরেন।

তা তো নিশ্চিতই, নিশ্চিত করল সিদুদু।

আর ট্রগরা?।

নিশ্চিত করে বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা ওরা মন্দির এলাকা ও গাছপালার ভেতর টহল দিচ্ছে।

পুরোহিতিনীদের কেউ কি মেয়েদের প্রতি সহানুভূতিশীল? ওদের ভেতর ভালো কেউ আছে?

কেউ না! তিক্ত কণ্ঠে বলল সিদুদু। সবাই নিষ্ঠুর, নির্দয়। আমাদের সাথে খাঁচায় বন্দি জানোয়ারের মতো আচরণ করে। ওখানে আসা লোকগুলোর কাছে নিজেদের তুলে দিতে বাধ্য করে। পুরোহিতিনীদের কেউ কেউ নিজেদের বিকৃত আনন্দ ভোগ করতে ব্যবহার করেছে আমাদের।

মেরেনের দিকে তাকাল ফেন। ওদের নিয়ে কী করা যায়?

কেউ আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেই মেরে ফেলব।

তলোয়ার বের করে নিবিড়ভাবে আগে বাড়ল ওরা, ওদের উপস্থিতি আড়াল করার কোনও চেষ্টাই করছে না। ঐগদের দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ওদের সরাসরি মন্দিরে নিয়ে গেল সিদুদু। মূল ভবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। দ্রুত ওটার দিকে ছুট গেল ওরা, কাঠের দরজার সামনে লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল। লাফ দিয়ে নামল মেরেন, অর্গল খোলার প্রয়াস পেল, কিন্তু ভেতর থেকে আটকানো।

হাত মেলাও! সাথে আসা লোকদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল ও। এক সারিতে দাঁড়াল ওরা। ওর পরের নির্দেশে বর্ম উঁচু করে ধরে দরজার উপর হামলে পড়ল। দড়াম করে খুলে গেল দরজা। মন্দিরের ঠিক মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মেয়েরা। চারজন কালো জোব্বা পরা পুরোহিতিনী পাহারা দিচ্ছে ওদের। একজন বেশ লম্বা, মাঝ বয়সী মহিলা, বসন্তের দাগঅলা কঠিন চেহারা। হাতে ধরা সোনালি তালিসমান মেরেনের দিকে তাক করল সে।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল সিদুদু। ওটা নোনগাই, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জাদুকর। জাদু দিয়ে তোমাকে শেষ করে ফেলতে পারবে।

আগেই ধনুকে তীর পড়িয়েছে ফেন। দ্বিধা করল না ও। একক নড়াচড়ায় তীর ছুঁড়ে দিল। মন্দিরের চক্রের দৈর্ঘ্য বরাবর গুঞ্জন তুলে ছুটে গেল ওটা, ঠিক বুকে গিয়ে বিধল নোনগাইয়ের হাত থেকে তালিসমানটা ছুটে পাথুরে মেঝেতে পড়ল। বাকি তিনজন পুরোহিতিনী কাকের ঝাঁকের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আরও দুটো তীর ছুঁড়ল ফেন। শেষ একজন বাদে বাকি সবাইকে ফেলে দিল। বেদীর পেছনের ছোট দরজার কাছে চলে গেল মহিলা। পেঁচিয়ে দরজা খোলার সময় তার পিঠের মাঝখানে একটা তীর পাঠিয়ে দিল সিদুদু। পাথরের বুকে রক্তের একটা ধারা রেখে পিছলে লুটিয়ে পড়ল মহিলা। আর্তচিৎকার করে চলেছে বেশির ভাগ সেবাদাসী। অন্যরা মাথার উপর চিতন টেনে দিয়েছে, সন্ত্রস্ত দলের মতো জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে।

ওদের সাথে কথা বলো, সিদুদু, নির্দেশ দিল মেরেন। শান্ত করো ওদের।

মেয়েদের কাছে দৌড়ে গেল সিদুদু, কয়েকজনকে টেনে দাঁড় করাল।

আমি সিদুদু। তোমাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। ওরা ভালো মানুষ, তোমাদের উদ্ধার করতে এসেছে। ওদের ভেতর জিঙগাকে দেখতে পেল ও।

আমাকে সাহায্য করো, জিঙগা! ওদের বুদ্ধি ফেরাতে সাহায্য করো!

ঘোড়র কাছে নিয়ে যাও ওদের, জিনে তুলে দাও, ফেনকে বলল মেরেন। যেকোনও মুহূর্তে ঐগদের দিক থেকে হামলা আসতে পারে।

দরজা পথে মেয়েদের টেনে নিয়ে চলল ওরা। কেউ কেউ এখনও কাঁদছে, বিলাপ করে চলেছে, জোর করে ওদের ঘোড়ার জিনে তুলে দিতে হলো। ওদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করল মেরেন, ফেনের উদ্দেশে চিৎকার করে ওঠায় একজনকে চড় কসাল ও। ওঠো, নির্বোধ মেয়েছেলে! নইলে ঐগদের হাতে রেখে যাব তোমাকে।

অবশেষে ঘোড়ার পিঠে উঠল সবাই। চিৎকার করে উঠল মেরেন। দুলকি চালে আগে বাড়ো! উইন্ডস্মোকের পাশে পায়ের গোড়ালির খোঁচা দিল। ওর পেছনে রয়েছে দুটি মেয়ে, ওকে আর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে। ফেনের রেকাবের সাথে ঝুলে আছে নাকোন্তো ও ইম্বালি। ওদের সাথে নিয়ে চলেছে ও। ওদের পেছনে সিদুদু ও জিঙগা, সামনে বসেছে একটা মেয়ে। বাকি ঘোড়াগুলো কমপক্ষে তিনজন করে মেয়ে বইছে। বিশাল ভার নিয়ে খুব কাছাকাছি থেকে মন্দিরের আঙিনা দিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটছে ওগুলো পাহাড় ও কিতানগালেমুখী রাস্তার দিকে।

বনের ভেতরের পথে উঠতেই দেখা গেল ওদের অপেক্ষা করছে ট্রগগুলো। পাঁচটা বিশাল শিম্পাঞ্জি গাছে উঠে পড়েছিল, ঘোড়াগুলো নিচ দিয়ে যাবার সময় ওগুলোর উপর লাফ দিয়ে পড়তে লাগল। একই সময়ে অন্য শিম্পাঞ্জিগুলো আগাছার আড়াল থেকে মুখ খিঁচিয়ে সগর্জনে ছুটে এলো। ঘোড়সওয়ারদের লক্ষ্য করে লাফ দিল, কিংবা শক্তিশালী চোয়ালে কামড়ে ধরল ঘোড়ার পা।

একটা খাট বর্শা ছিল নাকোন্তোর ডান হাতে, দ্রুত হাত চালিয়ে তিনটা জানোয়ারকে মেরে ফেলল সে। বাতাসে সই সই শব্দ তুলল ইম্বালির কুড়োল, আরও দুটোকে নামিয়ে দিল সে। মেরেন ও হিলতো তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে চলল, ঘাই মারল, ওদের পেছনে অনুসরণ করে আসতে থাকা সৈনিকরা ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাতে লাগল যুদ্ধে যোগ দিতে। কিন্তু ট্রগের দল ভীতিহীন, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; ভয়ঙ্কর চেহারা পেল লড়াইটা। এমনকি মারাত্মকভাবে আহত বা মরণোন্মুখ হলেও জোর করে উঠে দাঁড়াচ্ছে শিম্পাঞ্জিগুলো, যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে। উইন্ডম্মেকের ঘাড়ের উপর উঠে ওটার পেছনের পায়ে কামড় বসানোর চেষ্টা করল দুটো ট্রগ। ঝেড়ে দুটো লাথি কষাল ধূসর মেয়ারটা। প্রথম লাথির আঘাতে একটার খুলি ভেঙে গেল, দ্বিতীয় লাথিটা লাগল অন্যটার চোয়ালের নিচে, পরিষ্কার ভেঙে দিল ওটার ঘাড়।

হিলোর স্যাডলের পেছন থেকে মন্দিরের একটা মেয়েকে টেনে নামিয়ে নেওয়া হলো, হিলতো ওটার খুলি বরাবর আঘাত হানার আগেই এক কামড়েই গলা ফাঁক হয়ে গেল তার। নাকোন্তো যখন শেষ ট্রগটাকে শেষ করল ততক্ষণে অনেকগুলো ঘোড়াই কামড় খেয়েছে। একটা এমন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে যে ওটার খুলিতে আঘাত হেনে মারতে বাধ্য হলো ইম্বালি।

আবার জড়ো হলো ওরা, উপত্যকা থেকে বের হয়ে এলো; পথের মোড়ে পৌঁছানোর পর পুবে বাঁক নিয়ে পাহাড় ও কিতানগালে গ্যাপের পথ ধরল। রাতভর এগিয়ে চলল ওরা, পরদিন বেশ সকালে ওদের সামনের সমতলে প্রথম ধোয়ার মেঘ উড়তে দেখল। দুপুরের আগেই শরণার্থীদের একটা বিশাল সারির শেষ মাথায় যোগ দিল ওরা। পেছনে ছিল তিনাত, ওদের দেখেই দুলকি চালে পিছিয়ে এলো। ভালো জায়গাতেই দেখা হলো, কর্নেল ক্যাম্বিসেস! চিৎকার করে বলল সে। দেখতে পাচ্ছি মেয়েদের বাঁচাতে পেরেছ?

যারা বেঁচে ছিল, সায় দিয়ে বলল মেরেন। তবে অনেক ভোগান্তি গেছে ওদের। এখন বন্দি দশার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।

ওদের জন্যে ওয়্যাগনে থাকার ব্যবস্থা করব আমরা, বলল তিনাত। কিন্তু তোমার ও তোমার দলের কী হবে? আমাদের সাথে জাররি থেকে বের হয়ে যাবে, নাকি প্রবীন ম্যাগাসের খোঁজে আবার ফিরে যাচ্ছ?

আমাদের জবাব আগেই জানো তুমি, কর্নেল তিনাত, মেরেন কিছু বলার আগেই জবাব দিল ফেন।

তাহলে তোমাদের বিদায় জানাতে হচ্ছে। তোমাদের সাহসের জন্যে ধন্যবাদ, আর আমাদের জন্যে তোমরা যা করেছ তার জন্যেও ধন্যবাদ। হয়তো আর কোনওদিনই আমাদের দেখা হবে না, তবে তোমাদের বন্ধুত্ব আমার পক্ষে অনেক সম্মানজনক ছিল।

কর্নেল তিনাত, স্যার, তুমি চিরন্তন আশাবাদী লোক, ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ফেন। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, এত সহজে আমাদের হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই। ওয়ার্লউইন্ডকে ঠেলে তার ঘোড়ার পাশে নিয়ে এলো ও। ওর দাড়িভরা গালে চুমু খেল। আবার যখন মিশরে আমাদের দেখা হবে তখন অন্য গালে চুমু খাব, বলল সে। তারপর ওয়ার্লউইন্ডকে ঘুরিয়ে নিল ও পেছনে তিনাতকে আমোদিত বিভ্রান্তি ফেলে এগিয়ে চলল। ওর দিকে চেয়ে রইল তিনাত।

*

এখন ছোট একটা দলে পরিণত হয়েছে ওরা। মাত্র তিনজন মেয়ে আর তিনজন নপুরুষ। একবারের জন্যে ছোটার বদলে ঘোড়া হাঁকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাকোন্তো ও ইম্বালি, দুজনই একটা করে বাড়তি ঘোড় নিয়ে এগোচ্ছে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? পাশাপাশি চলার সময় মেরেনকে জিজ্ঞেস করল ফেন।

পাহাড়ের যতটা কাছে গেলে নিরাপদে থাকা যাবে, জবাব দিল মেরেন। তাইতা ফিরে এলে দ্রুত ওর সাথে যোগ দিতে হবে আমাদের। সিদুদুর দিকে ফিরল ও। ওর অন্য পাশে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে সে। পাহাড়ের কাছে লুকোনোর মতো কোনও জায়গা চেনা আছে তোমার?

মাত্র এক মুহূর্ত ভাবল সে। হ্যাঁ, জবাব দিল তারপর। একটা উপত্যকা আছে যেখানে মৌসুমের সময় বাবার সাথে ব্যাঙের ছাতা কুড়োতে যেতাম। একটা গুহায় শিবির করতাম আমরা, খুব অল্প লোকই ওটার খবর রাখে।

অচিরেই পশ্চিম দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়াল তিনটা আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত চূড়া। মুতাঙ্গি গ্রামের পাশ দিয়ে এলা ওরা, নিচু টিলার উপর থেকে ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাল। এখানে একটা বুনো শুয়োর শিকার করল ওরা। ছাই আর পোড়া লাশের গন্ধ ভেসে আসছে। ঘুরে পশ্চিমে পাহাড়ের পথ ধরার সময় কেউই তেমন একটা কথা বলল না।

ওদের পাহাড়ের পাদদেশে লুকানো একটা উপত্যকায় নিয়ে এসেছে সিদুদু। গাছপালা ও জমির ভাজে এমনভাবে আড়াল করা ওটা যে ঠিকমতো না দেখা পর্যন্ত। চোখেই পড়ে না। ঘোড়ার জন্যে ভালো চারণভুমি রয়েছে এখানে, ঝর্না থেকে প্রয়োজন মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানি মিলবে। গুহাটা শুকনো, উষ্ণ। একজোড়া পুরোনো ট্যাপ খাওয়া রান্নার হাঁড়ি ও অন্যান্য তৈষজপত্র পেছনের একটা ফাটলের ভেতর এক গাদা লাকড়ির সাথে রেখে গেছে সিদুদুর পরিবার। সন্ধ্যার খাবার রান্না করল মেয়েরা। আগুনের পাশে বসে খেল সবাই।

এখানে বেশ আরামেই থাকতে পারব, বলল ফেন, কিন্তু দুর্গ আর মেঘ বাগিচার রাস্তা থেকে কত দূরে আছি আমরা?

উত্তরে ছয় বা সাত লীগ, জবাব দিল সিদুদু।

ভালো! মুখে হরিণের মাংসের স্টু নিয়ে বলল মেরেন। চোখে না পড়ার মতো যথষ্ট দূরে আবার তাইতা ফিরে আসার সময় ওর সাথে যোগ দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট কাছে।

তুমি যদি ফিরে আসে না বলে ফিরে এলে বলায় খুশি হলাম, বলল ফেন।

কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় রইল। কেবল তামার বাটিতে চামচের আওয়াজ শোনা গেল।

ও কখন আসছে কীভাবে জানতে পারব? জিজ্ঞেস করল সিদুদু। রাস্তায় পাহারা দিতে হবে? ফেনের দিকে তাকাল সবাই।

তার দরকার হবে না, জবাব দিল ফেন। ও এলে আমি টের পাব। আমাকে আগেই জানাবে ও।

লাগাতার চলার উপর ছিল ওরা, ঘোড়র পিঠে থেকে লড়াই করে গেছে অনেকগুলো মাস। এর ভেতর রাতের পাহারা দেওয়ার পালায় বিরতি বাদে এটাই ছিল সারারাত ঘুমোনোর প্রথম সুযোগ। মাঝরাতের পাহারার দায়িত্ব নিল ফেন ও সিদুদু; তারপর যখন দক্ষিণ আকাশে তারকামণ্ডলীর বিশাল ক্রস দিগন্তে ডুব দিল, পাহারা দেওয়ার জন্যে সিদুদু ও নাকোন্তোকে ডেকে তুলতে আধা ঘুমে হামাগুড়ি দিয়ে গুহায় ঢুকল। তারপর মাদুরে লুটিয়ে পড়ল ওরা, হারিয়ে গেল অজানায়।

পরদিন ভোরের আগেই ধাক্কা দিয়ে মেরেকে জাগিয়ে তুলল ফেন। বাকিরাও উঠে পড়ল। ফেনের চোখে অশ্রু দেখে তলোয়ারের দিকে হাত বাড়াল মেরেন। কি ব্যাপার, ফেন? কী হয়েছে?

কিছু না! কেঁদে বলল ফেন। এবার ভালো করে ওকে দেখল মেরেন। বুঝতে পারল আনন্দে কাঁদছে ও। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। রাতে আমার কাছে এসেছিল

তুমি ওকে দেখেছ? ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল মেরেন। এখন কোথায় আছেন তিনি? কোথায় গেছেন?

আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় আমাকে দেখতে এসেছিল ও। জেগে ওঠার পর আমাকে ওর আত্মার প্রতীক দেখিয়ে বলেছে, শিগগিরই, খুব শিগগির তোমার কাছে ফিরে আসছি।

মাদুর থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সিদুদু, ফেনকে জড়িয়ে ধরল। তোমার জন্যে অনেক খুশি লাগছে আমার, বাকি সবার জন্যেও।

এবার সব ঠিক হয়ে যাবে, বলল ফেন। তাইতা ফিরে আসছে, আমরা নিরাপদ হয়ে যাব।

*

যুগ যুগ ধরে তোমার আগমনের অপেক্ষায় আছি আমি, বলল ইয়োস। সে মহা মিথ্যাকে মূর্ত করে জানা থাকা সত্ত্বেও ওর কথা বিশ্বাস না করে পারল না তাইতা। ঘুরে গুহার মুখের কাছে ফিরে এলো সে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না তাইতা। জানে একে অনুসরণ করা ছাড়া কিছুই করার নেই ওর। তার মায়ার বিরুদ্ধে ওর সব প্রতিরোধ সত্ত্বেও এই মুহূর্তে ওকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে মন চাইছে না।

প্রবেশ পথের ওপাশে সুড়ঙটা ক্রমে সংকীর্ণ হতে হতে ছত্রাকে ঢাকা পাথর এক সময় ওর কাঁধ স্পর্শ করল। ওর পায়ের উপর দিয়ে বয়ে যাবার সময় টিউনিকের হেম ছুঁয়ে দিচ্ছে বরফের মতো শীতল ঝর্নার পানি। সামনে যেন ভেসে চলেছে ইয়োস। ওর কালো আলখেল্লার নিচে নিতম্বজোড়া ফণা তোলা গোখরা সাপের মতো নিখুঁত ছন্দে দোল খেয়ে চলেছে। ঝর্নার চেয়ে সংকীর্ণ পাথুরে র‍্যাম্প ধরে উঠতে শুরু করল সে। উপরে প্রসারিত হয়ে একটা প্রশস্ত প্যাসেজওয়েতে পরিণত হয়েছে সুড়ঙটা। দেয়ালগুলো বাস্তব ও কাল্পনিক মানুষ ও জম্ভজানোয়ারের আবক্ষ মূর্তি খচিত রুবি পাথরের টালিতে ঢাকা। মেঝেয় বাঘের চোখের নকশা আঁকা, ছাদ গোলাপি কোয়ার্টযে তৈরি। মানুষের মাথার আকৃতির বিরাট আকারের পাথরের স্ফটিক দেয়ালের ব্র্যাকেটে বসানো রয়েছে। ইয়োস কাছে পৌঁছানোমাত্র রহস্যময় কমলা আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আলোকিত করে তুলছে সামনের প্যাসেজ। ওরা এগিয়ে যাবার সাথে সাথে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। ইয়োসের ছোট নগ্ন পা সোনালি টালির উপর পিছলে যাচ্ছে। ওকে বিমুগ্ধ করে তুলছে, চোখ সরানো কষ্টকর হয়ে উঠছে। এগিয়ে যাবার সময় বাতাসে সুবাস রেখে যাচ্ছে সে। প্রবল আনন্দের সাথে উপভোগ করছে ও, ওটা সূর্যশাপলার গন্ধ, চিনতে পারছে ও।

অবশেষে একটা বিশাল আঁকাল দর্শন চেম্বারে হাজির হলো ওরা। এখানকার দেয়ালগুলো সবুজ মালাকাইটের। মাথার উপরের উঁচু ছাদের ফোকরগুলো নিশ্চয়ই পৃথিবীর পিঠের কাছে পৌঁছে গেছে, কারণ ওগুলো দিয়ে সূর্যের আলো আসছে, দেয়ালে পড়ে জ্বলন্ত রুবি পাথরে ঝিলিক খেলছে। কামরার আসবাবপত্র আইভরি কুঁদে বানানো। মাঝখানে রয়েছে দুটো নিচু কাউচ। ওগুলোর একটায় বসল ইয়োস, নিতম্বের নিচে পাজোড়া ভাঁজ করল; এমনভাবে আলখেল্লা ছড়িয়ে দিল যাতে এমনকি ওর পাজোড়াও ঢেকে গেল। সামনের কাউচের দিকে ইঙ্গিত করল সে। দয়া করে আরাম করে বসো। তুমি আমার সম্মানিত ও প্রিয় মেহমান, তাইতা, তেনমাস ভাষায় বলল সে।

কাউচের কাছে গিয়ে ওর উল্টোদিকে বসল ও। রেশমী নকশা করা চাদরে ঢাকা ওটা।

আমি ইয়োস, বলল সে।

আমাকে প্রিয় বললে কেন? এটা আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমাকে তুমি চেনোই না।

আহ, তাইতা। নিজেকে যেমন করে চেনো তুমি ঠিক সেভাবে তোমাকে চিনি আমি, হয়তো তারচেয়ে বেশি।

ইয়োসের হাসির ওর কানে ওর শোনা যেকোনও সঙ্গীতের চেয়েও মিষ্টি শোনাল। মনকে অবরুদ্ধ রাখার চেষ্টা করল ও। তোমার কথা যুক্তিকে অস্বীকার করলেও কেন যেন তাতে সন্দেহ করতে পারছি না। মেনে নিচ্ছি আমাকে তুমি চেনো, কিন্তু নাম ছাড়া তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, জবাব দিল তাইতা।

তাইতা, আমাদের অবশ্যই পরস্পরের কাছে সৎ থাকতে হবে। তোমার কাছে শুধু সত্যি কথাই বলব আমি। তোমাকেও তাই করতে হবে। তোমার শেষের কথাটা মিথ্যা। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো তুমি। তুমি কিছু ধারণাও তৈরি করে নিয়েছ, যেগুলো দুঃখজনকভাবে ভুল। তোমাকে আলোকিত করে সেই ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য।

বলো, কোথায় আমার ভুল হয়েছে।

আমাকে শত্রু ভাবো তুমি।

নীরব রইল তাই।

আমি তোমার বন্ধু, বলে চলল ইয়োস। এত ভালো, মিষ্টি বন্ধু আর কখনও জোটেনি তোমার।

গম্ভীরভাবে মাথা কাত করল তাইতা, কিন্তু এবারও জবাব দিল না। মরিয়া হয়ে ইয়োসকে বিশ্বাস করতে চাইছে বলে আবিষ্কার করল। প্রতিরক্ষা বর্ম উঁচু রাখতে সম্পূর্ণ দৃঢ়তার প্রয়োজন হলো ওর।

খানিক পরে খেই ধরল ইয়োস, ভাবছ, তোমার সাথে আমি মিথ্যা বলব, আমার সাথে তুমি যেমন বলেছ আমিও তেমনি তোমার সাথে মিথ্যা বলেছি, বলল সে।

ইয়োসের পড়ার জন্যে কোনও আভা না ছড়ানোয় স্বস্তি বোধ করল তাইতা; ওর আবেগ লুকানো রয়েছে।

তোমার কাছে সত্যি কথাই বলেছি। গুহায় তোমাকে দেখানো দৃশ্যগুলো সত্যি। ওগুলোয় প্রতারণার কোনও উপাদান নেই, বলল সে।

শক্তিশালী দৃশ্য ছিল ওগুলো, বলল তাইতা, ওর কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক, নিরাসক্ত।

এর সবই সত্যি। যা যা কথা দিয়েছি সেগুলো তোমাকে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে।

দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে আমাকে কেন বেছে নিলে?

এত মানুষ! ভর্ৎসনার সাথে বলে উঠল সে। আমার কাছে দুনিয়ার সব মানুষ উইয়ের ঢিবির একটা উইপোকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওরা প্রবৃত্তির দাস, যুক্তি বা জ্ঞানের ধার ধারে না, কারণ এইসব গুণ আয়ত্ত করার মতো দীর্ঘদিন বাঁচে না ওরা।

শিক্ষিত, সহানুভূতিশীল ও মানবতাবাদী লোকের কথা জানি আমি, ওকে শুধরে দিল তাইতা।

তোমার অল্পদিনের আয়ুর ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ তুমি, বলল ইয়োস।

অনেক দিন বেঁচেছি আমি, বলল ও।

কিন্তু আর বেশি দিন বাঁচবে না, ওকে বলল সে। তোমার দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

তুমি কাঠখোট্টা কথা বললো, ইয়োস।

আহ, এইমাত্র যেমন বলেছি, তোমার কাছে শুধু সত্যি কথাই বলব আমি। মানুষের শরীর একটা গুরুত্বপূর্ণ বাহন, আর জীবন ক্ষণস্থায়ী। সত্যিকারের প্রজ্ঞা ও উপলব্ধি অর্জন করার মতো দীর্ঘ আয়ু নিয়ে আসে না সে। মানুষের হিসাবে তুমি অনেক দীর্ঘজীবী, আমার হিসাবে দেড়শো বছর; কিন্তু আমার চোখে এটা প্রজাপতির বা সন্ধ্যায় ফুটে রাতের দিনের আলো ফোঁটার আগেই মরে যাওয়া ক্যাকটাস ফুলের চেয়ে বেশি নয়। তোমার আত্মা যে দেহখাঁচায় আছে অচিরেই তোমাকে ছেড়ে যাবে সেটা। অকস্মাৎ কালো জোব্বার নিচ থেকে ডান হাত বাড়িয়ে আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে।

ওর পাজোড়া কমনীয় হলে হাতদুটো অসাধারণ সুন্দর। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো তাইতার, মহোনীয় ভঙ্গিমায় হাতের পশম শিউরে উঠল ওর।

অবশ্য তোমাকে একথা না বললেও চলে, মৃদু কণ্ঠে বলল ইয়োস।

আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি তুমি, ইয়োস। আমাকে কেন?

তোমার সংক্ষিপ্ত জীবনে সেই যোগ্যতা অর্জন করেছ তুমি। আমি তোমার জীবন চিরকালের জন্যে প্রসারিত করে দিলে দানবীয় বুদ্ধিমানে পরিণত হবে তুমি।

তাতে সব কিছুর ব্যাখ্যা মেলে না। আমি বুড়ো, কুৎসিত।

তোমার শরীরের একটা অংশ এরই মধ্যে ঠিক করে দিয়েছি আমি, যুক্তি দেখাল সে।

তিক্ত হাসল তাইতা। তাহলে এখন তরুণ, সুন্দর সেই অংশসহ বয়স্ক কদর্য পুরুষ আমি।

ওর সাথে হাসল সেও, সেই রোমহর্ষক শব্দ হলো। খুবই সুন্দর বলেছ। হাতটা আবার জোব্বার আড়ালে নিয়ে গেল সে। কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল তাইতা। আবার কথা শুরু করল ইয়োস, গুহাতে তোমার তরুণ পুরুষ হিসাবে একটা ইমেজ দেখিয়েছিলাম। তুমি সুন্দর ছিলে, আবারও সুন্দর হয়ে উঠতে পারো।

চাইলে তো যেকোনও সুদর্শন তরুণকে পেতে পারো তুমি। আগেও যে তাই করেছ, তাতে আমার সন্দেহ নেই, চ্যালেঞ্জ করল ও।

সাথে সাথে জবাব দিল সে। সুন্দর, সতোর সাথে। দশ হাজার বার, বা তারও বেশি, কিন্তু সৌন্দর্য সত্ত্বেও ওরা ছিল পিঁপড়ার মতো।

আমি কি ভিন্ন হবো?

হ্যাঁ, তাইতা-হ্যাঁ।

কীভাবে?

মনের দিক থেকে, বলল সে। কেবল দৈহিক আবেগ অচিরেই ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধিমত্তা সব সময়ই প্রলুব্ধকর। চিরন্তন তরুণ দেহে মহান মন সময়ের সাথে সাথে শক্তিশালী হয়ে ওঠে: এগুলো দেবতাসুলভ গুণাবলী। তাইতা, তুমিই সেই নিখুঁত সঙ্গী ও সহচর যার জন্যে অযুত যুগ ধরে অপেক্ষা করে আছি।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করে গেল ওরা। ইয়োসের মেধা শীতল ও বৈরী জানা থাকলেও মুগ্ধকর ও বাধ্যকারী। নিজেকে শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে পরিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে ওর। শেষ পর্যন্ত নিজের বিরক্তির সাথে ওর মনে হতে লাগল যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছে ও, কিন্তু সেটা উচ্চারণের আগেই ইয়োস বলল, তোমার জন্যে কোয়ার্টার আলাদা করে রাখা হয়েছে। তোমার ডান দিকের ওই দরজা দিয়ে গিয়ে প্যাসেজ বরাবর শেষ মাথায় চলে যাও।

ইয়োস ওকে যে কামরায় পাঠিয়েছে সেটা বেশ বড়সড়, দেখার মতো, তবে আশপাশ তেমন একটা খেয়াল করল না ও, কারণ ওর মনটা আলোকিত হয়ে আছে। একটুও ক্লান্তি বোধ করছে না। একটা কিউবিকলে চমৎকারভাবে খোদাই করা একটা টুল পেল ও, ওটার নিচে ল্যাট্রিন বাস্কেট রাখা। নিজেকে ভারমুক্ত করল ও। এক কোণে একটা নল থেকে আরেকটা পাথরের স্ফটিক বেসিনে সুবাসিত উষ্ণ পানি ঝরে পড়ছে। ধোয়া শেষ করেই আবার সবুজ চেম্বারে ফিরে এলো ও, মনে আশা ইয়োস হয়তো এখনও আছে ওখানে। এখন আর ছাদের ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে না। রাত নেমেছে, কিন্তু দেয়ালের পাথুরে স্ফটিকগুলো উষ্ণ আলো বিলোচ্ছে। শেষবার যেভাবে দেখে গিয়েছিল সেভাবেই বসে আছে ইয়োস। ওর সামনে গিয়ে বসতেই সে বলল, তোমার জন্যে খাবার আর পানীয় আছে। চমৎকার আঙুলে ওর পাশের আইভরি টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওর অনুপস্থিতির সময় রূপার ডিশ ও একটা পাত্র এনে রাখা হয়েছে ওটার উপর। ক্ষিধে বোধ করছে না ও, কিন্তু ফল শরবত দেখে খাসা মনে হচ্ছে। নিস্পৃহভাবে খেল ও, পান করল। তারপর সাগ্রহে আবার কথোপকথনে ফিরে এলো। অনায়াসে অনন্ত জীবনের কথা বলছ?

ফারাও থেকে শুরু করে চাষী পর্যন্ত সবার স্বপ্ন, বলল ইয়োস। কাল্পনিক স্বর্গে অনন্ত জীবনের আশায় থাকে তারা। এমনকি আমার জন্মের আগে যারা বেঁচে ছিল সেই বয়স্ক লোকেরাও গুহার দেয়ালে সেই স্বপ্নের ছবি এঁকে রেখে গেছে।

তা কি পূরণ করা সম্ভব? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

তোমার সামনেই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসাবে বসে আছি আমি।

তোমার বয়স কত, ইয়োস?

ফারাও চিপস গিযার মহান পিরামিড নির্মাণ করানোর সময়ই অনেক বয়স্কা ছিলাম আমি।

সেটা কি করে সম্ভব?

ফন্টের কথা শুনেছ তুমি? জানতে চাইল সে।

এটা অতীত কাল থেকে চালু একটা মিথ, জবাব দিল তাইতা।

মোটেই মিথ নয়, তাইতা। ফন্টের অস্তিত্ব আছে।

কী সেটা? কোথায়?

জীবনের নীল নদী, আমাদের মহাবিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজনীয় শক্তি।

সত্যিই নদী বা ঝর্না এটা?

নীল নাম কেন? বর্ণনা দিতে পারবে?

এমনকি তেনমাস ভাষায়ও ওটার শক্তি ও সৌন্দর্য বর্ণনার উপযুক্ত শব্দ নেই। আমরা মিলে গেলে তারপর ওখানে নিয়ে যা তোমাকে। নীলে একসাথে ম্লান করব আমরা, তারুণ্যের সমস্ত জাঁকজমক নিয়ে বের হয়ে আসবে তুমি।

কোথায় ওটা? আকাশে নাকি জমিনে?

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায় ওটা। সাগরের স্থান বদল আর পাহাড়ের ওঠা নামার সাথে বদলে যায়।

এখন কোথায় আছে ওটা?

আমাদের বসার এই জায়গা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, বলল ইয়োস। কিন্তু ধৈর্য ধরো। সময় হলেই ওখানে নিয়ে যাব তোমাকে।

অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছে সে। স্বয়ং সে মিথ্যা। এমনকি ফন্টের অস্তিত্ব থাকলেও তাইতা জানে অন্য কাউকে ওখানে নিয়ে যাবে না সে। তারপরেও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কৌতূহলী করে তুলল ওকে।

বুঝতে পারছি, এখনও আমাকে সন্দেহ করছ, মৃদু কণ্ঠে বলল ইয়োস। আমার আন্তরিক বিশ্বাস প্রমাণ করতে তোমার সাথে আরেকজনকেও ফন্টে নেওয়ার অনুমতি দেব তোমাকে, যাতে ওটার আশীর্বাদের ভাগ নিতে পারে। এমন কেউ যাকে অনেক ভালোবাসো তুমি। কেউ আছে এমন?

ফেন! নিমেষে ভাবনাটা আড়াল করে ফেলল ও, ইয়োসও যাতে টের না পায়। ফাঁদ পেতেছে ইয়োস, প্রায় ধরা দিতে যাচ্ছিল ও। না, নেই, জবাব দিল তাইতা।

একবার তোমাকে দেখার সময় বনের একটা পুকুর ধারে ছিলে তুমি। তোমার সাথে একটা বাচ্চাকে দেখেছিলাম, ওর মাথার চুল ফিকে রঙের।

ও হ্যাঁ, সায় দিল ও। এমনকি তার নামও ভুলে গেছি, কারণ তুমি যাদের উইপোকা বলো তাদের একজন ছিল সে। মুহূর্তের সঙ্গী।

ওকে ফন্টে নিতে চাও না?

নেওয়ার কোনও কারণ নেই। চুপ করে রইল ইয়োস, কিন্তু কপালে কোমলতম ছোঁয়া টের পাচ্ছে তাইতা; অনেকটা আঙুলের চাপের মতো। তাই জানে ওর কথা বিশ্বাস করেনি ইয়োস, এখন ওর মাথার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, ওর ভাবনা চুরি করতে চায়। মানসিক প্রয়াসে বাধা দিল ও, সাথে সাথে। সরে গেল ইয়োস।

তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, তাই। কিছুক্ষণ ঘুমানো দরকার।

মোটেও ক্লান্ত নই আমি, জবাব দিল ও, সত্যিই নিজেকে প্রাণবন্ত ও টাটকা মনে হচ্ছে ওর।

আমাদের অনেক কিছু আলোচনার রয়েছে, যেন আমরা এক দীর্ঘ প্রতিযোগিতার দৌড়বিদ। আমাদেরকে অবশ্যই ঠিকমতো পা ফেলতে হবে। হাজার হোক, চিরকালের সাথী হওয়াই আমাদের নিয়তি। তাড়াহুড়োর কোনও প্রয়োজন নেই। সময় আমাদের খেলার সামগ্রী, শত্রু নয়। কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ইয়োস, কোনও কথা না বলে কালো দেয়ালের দরজা গলে পিছলে উধাও হয়ে গেল; এই দরজাটা আগে খেয়াল করেনি তাইতা।

*

কান্তি বোধ না করলেও নিজের চেম্বারে এসে গদিমোড়া রেশমী মাদুরে শোয়ামাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা। জেগে ওঠার পর দেখল ছাদের ফোকর গলে সূর্যের আলোর একটা ধারা নেমে আসছে। নিজেকে ওর অসাধারণ জীবন্ত মনে হলো।

ওর নোংরা পোশাকআশাক উধাও হয়েছে, তার জায়গায় ওর চামড়ার জোব্বার পাশে একজোড়া স্যান্ডেলসহ একটা টাটকা টিউনিক বিছিয়ে রাখা। গোসল করে পোশাক পরে নিল ও। সূক্ষ্ম কাপড়ে তৈরি ইয়োসের দেওয়া টিউনিকটা, ওর গায়ে যেন আদর বোলাচ্ছে, সদ্যজাত ছাগলের চামড়া দিয়ে বানানো হয়েছে স্যান্ডেল জোড়া, সোনালী পাতা খোদাই করা তাতে। নিখুঁতভাবে লেগে গেছে তাইতার পায়ে।

ইয়োসের সবুজ কামরায় এসে দেখল ওটা ফাঁকা। কেবল ওর সৌরভের অবশেষ রয়ে গেছে। গত রাতে ইয়োস যে দরজা গলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেলও। ওটার ওপাশের দীর্ঘ প্যাসেজ রোদের আলোয় নিয়ে এলো ওকে। চোখজোড়া সয়ে আসার পর দেখল আরেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে এসে পড়েছে ও, মেঘ-বাগিচার মতো অত বড় নয়, তবে ওটার চেয়ে ঢের সুন্দর। কিন্তু জ্বালামুখের মুখের মেঝে বিপুলভাবে ঢেকে রাখা সমৃদ্ধ বন ও বাগানের তুলনা করার মতো ভাষা ওর জানা নেই। ঠিক ওর সামনেই বিছিয়ে আছে একটা সবুজ প্রাঙ্গণ, এখানে ঠিক মাঝখানে ছোট মাৰ্বল পাথরের ছামিয়ানা টাঙানো একটা ছোট পুকুর রয়েছে। ঝলমলে পানির একটা ধারা গড়িয়ে পড়ছে তাতে। পানির ধারা পরিষ্কার হলেও পুকুরটা পলিশ করা জেটের মতো কালো, চকচকে।

তাবুর মাৰ্বল বেঞ্চে বসে আছে ইয়োস। তার মাথা উন্মুক্ত, কিন্তু মুখটা অন্যদিকে ফেরানো থাকায় কেবল চুলই দেখতে পাচ্ছে তাই। নীরবে ওর দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অজান্তে তার কাছে যাওয়ার আশা করছে, মুখটা এক নজর দেখতে পাবে। কোমরের কাছে নেমে এসেছে ইয়োসের চুল; পুকুরের জলের মতোই কালো। কিন্তু অনির্বচনীয়ভাবে ঢের বেশি ঝলমলে। কাছাকাছি যাবার পর লক্ষ করল চুলের গোছায় রোদের আলো দামী রুবি পাথরের মতো আভা তুলে ঠিকরে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল ওর, কিন্তু হাত বাড়াতেই মাথার উপর নেকাব ওঠাল ইয়োস, ঢেকে ফেলল নিজেকে। ওকে ক্ষণিকের জন্যেও তার চেহারা দেখার সুযোগ দিল না। তারপর ফিরে তাকাল ওর দিকে। আমার পাশে বোস, কারণ তোমার স্থান ওখানেই।

কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল ওরা। তাই ক্রুদ্ধ, হতাশ। ইয়োসের মুখ দেখতে চাইছে ও। যেন ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেই তাইতার হাতে হাত রাখল সে। ওর স্পর্শ রোমাঞ্চিত করে তুলল তাইতাকে। কিন্তু নিজেকে স্থির রেখে জানতে চাইল, আমরা বাইরের চেহারা নিয়েই বেশি কথা বলেছি, ইয়োস। তোমার কি কোনও খুঁত আছে? সেকারণেই কি পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখো? নিজের চেহারা নিয়ে তুমি লজ্জিত?

ইয়োসের মতোই তাকে উস্কানি দিতে চেয়েছে তাই। কিন্তু জবাব দেওয়ার সময় তার কণ্ঠস্বর মিষ্টি ও শান্ত শোনাল: এই পৃথিবীর জীবন্ত নারী বা পুরুষের ভেতর সবচেয়ে সুন্দর আমি।

সেজন্যেই এই সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখ?

কারণ যারা দেখবে তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাদের মন ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।

তোমার অহঙ্কার এমনিতেই বিশ্বাস করব?

এটা অহঙ্কার নয়, তাইতা। খাঁটি সত্যি।

তোমার সেই সৌন্দর্য আমাকে দেখাবে না কোনওদিন?

তৈরি হলেই আমার সৌন্দর্য দেখতে পাবে, যখন পরিণতি সম্পর্কে জানতে ও মেনে নিতে তৈরি থাকবে। ওর বাহুর উপর পড়ে আছে ইয়োসের হাত। বুঝতে পারছে না, আমার সামান্য স্পর্শও তোমাকে উতলা করে তুলছে? আমার আঙুলের ডগায় তোমার হৃদয়ের স্পন্দন টের পাচ্ছি। তাইতার ইন্দিয়কে উত্তাল অবস্থায় রেখে হাত তুলে নিল সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল ওর। এসো, অন্য বিষয়ে কথা বলা যাক। আমাকে নিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে, সেগুলোর সত্যি জবাব দেওয়ার কথা দিয়েছি আমি, বলল সে। ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সময় তাইতার কণ্ঠস্বর খানিকটা রুদ্ধশ্বাস শোনাল। নীলের উৎসমুখে বাঁধ দিয়েছ তুমি। এমন করার কী কারণ?

দুটি উদ্দেশ্য ছিল আমার। প্রথমত, এটা ছিল তোমার প্রতি আমার কাছে। আসার একটা আমন্ত্রণ। সেটা প্রতিরোধে অক্ষম ছিলে তুমি। এখন আমার পাশে আছ তুমি।

গভীরভাবে কথাটা ভাবল তাইতা। তারপর জানতে চাইল, দ্বিতীয় কারণ?

তোমার জন্যে একটা উপহার তৈরি করছিলাম আমি।

উপহার? বলে উঠল তাইতা।

বিয়ের উপহার। আমরা দেহমনে এক হয়ে যাবার পর তোমাকে মিশরের দুটি রাজ্যই উপহার দেব আমি।

কেবল সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলার পর? এটা কেমন বিকৃত ও বর্বর উপহার?

তুমি যখন দ্বৈত মুকুট পরে আমার পাশে মিশরের সিংহাসনে বসবে, আমি আবার নীল ও তার পানিকে আমাদের মিশরের জন্যে পুনরুজ্জীবিত করব… আমাদের এমন আরও অসংখ্য রাজ্যের প্রথম হবে এটা।

আর এই অবসরে মানুষের সন্তানগুলো ভোগন্তি পোহবে? জানতে চাইল তাইতা।

এরই মধ্যে তুমি নিজেকে সমস্ত সৃষ্টির প্রভুর মতো ভাবতে শুরু করেছ, অচিরেই তাই হবে তুমি। গুহার পাশে মেঘ-বাগিচার ইমেজে সেটা তোমাকে দেখিয়েছি। সকল জাতি, অন্তহীন জীবন, তারুণ্য ও সৌন্দর্যের উপর আধিপত্য ও হাজার বছরের জ্ঞান ও শিক্ষা, যা কিনা হীরার পাহাড়।

সত্যিকেই সবচেয়ে বড় পুরস্কার মনে করি আমি, বলল তাইতা।

সেটা তোমার হবে।

আমি এখনও তোমার প্রস্তাবের ব্যাপারে সন্দিহান, সমান মাপের একটা কিছুর বিনিময় ছাড়া তোমার এমন করার কথা নয়।

ওহ, আমি তো এরই মধ্যে সে কথা বলেছি তোমাকে। আমার প্রস্তাবের বিনিময়ে তোমার চিরন্তন প্রেম আর নিবেদন দাবি করি আমি।

দীর্ঘদিন কোনও সঙ্গী ছাড়াই তো বেঁচে আছো, এখন কী কারণে তার প্রয়োজন?

শত বছরের একঘেয়েমিতে অবসন্ন আমি, আত্মার ক্লান্তি আর এইসব বিস্ময় ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো একজন সঙ্গীর অভাবের একঘেয়েমী।

আমার কাছে কেবল এইটুকুই চাইছ তুমি? তোমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সামান্য আভাস আমি পেয়েছি। তোমার সৌন্দর্য ও বুদ্ধি মিলে গেলে এই দামটা তো একেবারেই তুচ্ছ। তার মিথ্যাগুলো সত্যির আবরণে ঢাকা। তার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল তাইতার। ওরা পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়ানো দুই সেনাদলের অধিনায়কের মতো। এটা হচ্ছে যুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তের মহড়া ও অস্ত্র শানানো। ভয় পাচ্ছে তাইতা, নিজের জন্যে ততটা নয়, যতটা মিশর ও ফেনের জন্যে; ওর কাছে অমূল্য দুটি বিষয়, দুটিই এখন ভয়ঙ্কর বিপদে রয়েছে।

পরের দিনগুলো কৃষ্ণ পুকুর পাড়ে বসে কাটাল ওরা, রাতগুলো ইয়োসের সবুজ কামরায়। ক্রমে আত্মা গোপন রেখে তাইতার কাছে দৈহিক রূপের আরও অনেক কিছুই প্রকাশ করল সে। রোজই আগের চেয়ে ঢের বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠল ওর আলোচনা। মাঝে মাঝে রূপার ট্রেতে রাখা ফলের টুকরো নিতে সামনে ঝুঁকে পড়ে সে, তখন বেমানানভাবে বাহু উন্মুক্ত করতে হাতা খসে পড়ার সুযোগ করে দেয়; কিংবা আইভরি কাউচে নড়েচড়ে বসার সময় কালো জোব্বার স্কার্ট খসে পড়তে দিয়ে হাঁটু উন্মুক্ত করে। ওর পায়ের হোড়ের মাংস সূক্ষ্ম। ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত আকারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা উচিত ছিল ওর, কিন্তু হয়নি। ওর গোটা শরীর উন্মুক্ত হবার সময়ের ভয়ে সময় কাটাচ্ছে ও। তার মোহ প্রতিরোধ করার আপন ক্ষমতায় সন্দিহান।

বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে পার হয়ে যেতে লাগল দিন-রাত। এক সময় অসহনীয় হয়ে উঠল ওদের মাঝখানে গড়ে ওঠা দৈহিক ও নাক্ষত্রিক টেনশন। ওকে স্পর্শ করল সে। কোনও একটা বিষয়ের গুরুত্ব বোঝাতে ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। একবার নিজের বুকে ওর হাত চেপে ধরল ও। ওর বুকের উষ্ণ স্থিতিস্থাপকতা অনুভব করার সময়ে যন্ত্রণার কাছে পরাস্ত না হতে সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ কাজে লাগাতে হলো ওকে।

ওর সৌরভ কখনও বদলায় নাঃ সব সময়ই সূর্য শাপলার সুবাস। অবশ্য, সকাল-সন্ধ্যায় পোশাক পাল্টায় ও। সব সময়ই লম্বা ও বিশাল; সূক্ষ্ম কাপড়ের নিচে ওর শরীরের উত্থানপতন ও বাঁকগুলোর কোনও আভাসই মেলে না প্রায়। অনেক সময় প্রশান্ত ভাঙ্গিতে থাকে সে, অন্যান্য সময় অস্থির; আবার মানুষখেকো বাঘিনীর মতো জাঁকাল ঢঙে তাইতার কাউচের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। একবার ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা চালু রেখেই টিউনিকের নিচে হাত গলিয়ে উরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, তারপর সরিয়ে নিয়েছে। অন্যান্য সময় কালো আলখেল্লায় ফিরে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রাখে, এমনকি ওর গোড়ালি পর্যন্ত দেখতে দেয় না।

একদিন সকালে সবুজ কামরায় বসেছিল ওরা, ইয়োসের পরনে ছিল শাদা সিল্কের সূক্ষ্ম আলখেল্লা। এর আগে আর কখনও শাদা পোশাক পরেনি সে। কথোপকথনের মধ্যেই অপ্রত্যাশিতভাবে উঠে দাঁড়াল ইয়োস, ওর সামনে এসে দাঁড়াল। পরনের শাদা জোব্বা মেঘের মতো ওর শরীর ঘিরে উড়ছিল। ওর শরীরে আলো খেলা করার সময় পোশাকের আড়াল থেকে গোলাপি আর আইভরি ত্বক উঁকি দিচ্ছিল। সিল্কের ভেতর দিয়ে দেখতে ওর ইমেজ বায়বীয় মনে হচ্ছিল। ওর চাঁদের মতো ফিকে পেটটা ছুটন্ত হাউন্ডের মতোই পিচ্ছিল, ওর বুক অসীম ক্রিমের মতো।

তুমি সত্যিই চাও তোমার সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করি আমি, মাই লর্ড? জিজ্ঞেস করল সে।

তাইতা এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে চট করে জবাব দিতে পারল না। অবশেষে বলল, মনে হচ্ছে সারা জীবন এই মুহূর্তটিরই অপেক্ষায় ছিলাম যাতে তাই করো তুমি।

আমি তোমাকে আমার সবটুকু তুলে দিতে চাই। তোমার কাছে কিছুই লুকাব না। বিনিময়ে তোমার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করি না। কেবল তোমার ভালোবাসা। রেশমী হাতা ছুঁড়ে ফেলে দিল ও; দৃঢ়, সরু আঙুলের ডগায় পর্দার হেম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। মুখ থেকে সরাতে শুরু করল। চিবুকের কাছে এসে থামল একবার। দীর্ঘ, মোহনীয় গ্রীবা ওর।

আমরা চেহারা দেখতে চাও কিনা নিশ্চিত হয়ে নাও। পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করেছি আমি। তোমার আগে যারাই আমার সৌন্দর্য দেখেছে, আমার দাসে পরিণত হয়েছে। তুমি তা প্রতিহত করতে পারবে?

এমনকি আমাকে ধ্বংস করে দিলেও কাজটা করতে হবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা। জানে এটা সেই ভীষণ মুহূর্ত যখন ওরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

তবে তাই হোক, বলল ইয়োস, অসীম অসহনীয় ধীরতায় নেকাব ওঠাল সে। ওর চিবুক গোলাকার, টোল পড়া। ঠোঁটজোড়া পুরুষ্ট, বাকা, লাল রক্তের মতো পাকা চেরির রঙ। ঠোঁট চাটল সে। হাই ভোলা বেড়াল বাচ্চার মতো ডগার দিকটা বেঁকে গেল ওটার। ছোট, ঝলমলে দাঁতের আড়ালে হারিয়ে গেল। ওর নাক সরু, সোজা, তবে ডগার কাছটায় একটু ছড়ানো। হনুর হাড় সামান্য উঁচু হয়ে আছে, কপাল প্রশস্ত ও গভীর। ওর বাঁকা ভুরুজোড়া চোখের জন্যে নিখুঁত কাঠামো তৈরি করেছে। তাইতার আত্মার গভীরে নজর দিল ওগুলো। ওর চেহারা প্রতিটি অংশ নিখুঁত। একসাথে মেলালে অতুলনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।

তোমাকে খুশি করতে পেরেছি, মাই লর্ড? জানতে চাইল সে। মাথার উপর থেকে ফেলে দিল নেকাব, সবুজ মালাকাইটের মেঝেয় লুটিয়ে পড়তে দিল ওটাকে। রুবি আলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া কালো ফোয়ারা লুটিয়ে পড়েছে ওর কাঁধে। কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে, লাফাচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে যেন নিজের জীবন আছে।

আমরা প্রশ্নের জবাব দাওনি তুমি, বলল সে। আমি কি তোমাকে খুশি করতে পেরেছি?

আমার মন তোমার সৌন্দর্য উপরব্ধি করতে পারছে না, কম্পিত কণ্ঠে বলল ও। এর সামান্য অংশ বর্ণনা করার মতোও কোনও ভাষার অস্তিত্ব নেই। এই সৌন্দর্যের দিকে তাকানোর পর বুঝতে পারছি লোকে কীভাবে এতে বন্দি হয়ে পড়তে পারে, ঠিক দাউদাউ জ্বলন্ত দাবানলের মতো। আমাকে ভীত করে তুলেছে, কিন্তু আমি একে ঠেকাতে অক্ষম।

ওর দিকে ভেসে এলো ও। সূর্য শাপলার সুবাস আচ্ছন্ন করে ফেলল ওকে। মুখ তুলে ওর দিকে না তাকানো পর্যন্ত ওর সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল, তারপর সরে গেল। কিন্তু তার স্বাদ বিস্ময়কর ফলের রসের মতো ওর মুখ ভরে রাখল।

মালাকাইট টাইলসের উপর দিয়ে সাঁই করে সরে গেল সে। পেছনে হেলে পড়ল, শরীরের চারপাশে উড়ছে শাদা জোব্বার প্রান্ত। চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঝে। পাজোড়া নাচছে ওর, প্রবল গতির কারণে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাল রাখতে পারছে না ও। তারপর থেমে গেল ওগুলো, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াল সে। মূর্তির মতো স্থির। কেবল ওর চুল চারপাশে দোল খাচ্ছে।

আরও আছে, মাই লর্ড, তার কণ্ঠস্বর গভীর, দপদপ করা প্রাবল্য লাভ করল, এর আগে এমন শোনেনি তাই। আরও অনেক কিছু আছে। নাকি যথেষ্ট দেখা হয়ে গেছে তোমার?

তোমার দিকে হাজার বছর তাকিয়ে থাকলেও যথেষ্ট হবে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে কাঁধের উপর থেকে চুল সারাল সে। জ্বলন্ত চোখে তাকাল ওর দিকে। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে এসে দাঁড়িয়েছ তুমি, ওকে সতর্ক করল সে। এমনকি এই শেষ পর্যায়েও নিজেকে সরিয়ে নিতে পারো। একবার ঝাঁপিয়ে পড়লে ফেরার উপায় থাকবে না। তোমার জন্যে বিশ্বজগৎ চিরকালের জন্যে বদলে যাবে। অনেক চড়া মূল্য হবে সেটা তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি। তুমি কি তৈরি?

আমি তৈরি।

এক কাঁধের উপর থেকে আলখেল্লা সরিয়ে ফেলল সে। দীর্ঘ, সূক্ষ্ম কাঁধের সাথে সম্পূর্ণ মানানসই তার বাঁক। জোব্বাটাকে আরও নিচে নামতে দিল সে। কোমর দোলাতেই জোব্বাটা ওর গোড়ালির কাছে ফুলের মালার মতো খসে পড়ল।

ওটার ভেতর থেকে বের হয়ে তাইতার দিকে এগিয়ে এলো ও। আরও একবার সামনে ঝুঁকে একহাতে তাইতার ঘাড় জড়িয়ে ধরল।

এবার আবার পিছিয়ে গিয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে পিঠে দুই হাত বোলাল সে। অনুগতের মতো অনুসরণ করল ওর চোখ। ইয়োসের চোখের গভীরে তাকাল, সেখানে স্পষ্ট আদিম ক্ষুধা দেখতে পেল, এক মুহূর্ত আগেও যা ছিল না। জানে, ওর খোদ আত্মাকে চাইছে সে। এবার দুই হাতই ওর উপর রাখল সে, ওকে তুলে কাউচের দিকে নিয়ে গেল। ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে স্যান্ডেলের ফিতে ঢিলে করে খুলে নিল পা থেকে। মাথা তুলে ওর গায়ে ঘষল। তাই ফের উঠে দাঁড়ালে ওর মাথার উপর দিয়ে টিউনিক খুলে নিয়ে আবার কাউচে শুইয়ে দিল। এক পা বাড়িয়ে ওর উপর চড়াও হলো সে, যেন ঘোড়ায় চাপতে যাচ্ছে, তারপর উবু হয়ে ওকে গোপন অভ্যন্তরে প্রবেশে সাহায্য করল।

পুলক এত প্রবল হয়ে উঠল যে প্রায় বেদনায় পরিণত হলো। ওর শরীরে গভীর অভ্যন্তরের পেশিগুলো দপদপ করছে, চেপে আসছে। শিকার পেঁচিয়ে ধরা পাইথনের মতো অনড়ভাবে পেঁচিয়ে ধরছে। ওকে এমন এক মিলনে বন্দি করে ফেলেছে সে তার থেকেও বের হয়ে আসার উপায় নেই। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে তার চোখ, হত্যা করতে উদ্যত যোদ্ধার মতো বিজয়ীর দৃষ্টি সেখানে। তুমি সম্পূর্ণ আমার। সাপের মতো ফিসফিস করে বলল সে। তোমার সবই আমার। আর ভনিতা নেই, আসল রূপ ধারণ করতে সব মুখোশ ফেলে দিয়েছে।

তার জৈবিক আক্রমণের সূচনা টের পেল তাই। যেন কোনও বর্বর বাহিনী ওর আত্মার দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে, দেয়ালের গায়ে আঘাত হানছে। ওকে ঠেকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করল তাইতা, তাকে প্রবেশাধিকার না দিতে সব দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল। ঠেলে ফেলে দিতে চাইল। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাইতা ওকে ফাঁদে ফেলেছে টের পেয়ে তার চোখে বিপদের ছাপ পড়ল। তারপর খুনে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল চেহারায়। ফের আক্রমণ শানাল সে।

পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলল ওরা; প্রথমে সমানে সমানে লড়ল। একসাথে আবদ্ধ অবস্থায় মালাকাইটের মেঝেয় আছড়ে পড়ল ওরা, কিন্তু ইয়োস নিচে থাকায় ওর শরীরের পুরো চাপটা সহ্য করল। ধাক্কা খেয়ে মাত্র মুহূর্তের জন্যে তার দেহের পেশিগুলো শিথিল হলো। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাল তাইতা। ওর মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। নীরবে পরস্পরের সাথে যুঝছে ওরা। সমস্ত শক্তি এক করার প্রয়াস পাচ্ছে, পরস্পরকে ভঙুর ভারসাম্যে আটকে রেখেছে।

ইয়োস শেষ শক্তি জড়ো করছে টের পেয়ে তাইতাও ওর সমস্ত শক্তি প্রস্তুত রাখল। তারপরই এক মনস্তাত্ত্বিক পাহাড় ধসের মতো ওর উপর চড়াও হলো ইয়োস। ওর প্রতিরক্ষায় জোর করে দুর্বলতা তৈরির চেষ্টা করছে সে। ওর আত্মার গোপন জায়গায় ঢুকে পড়তে চায়। তাই ওর শরীরের পরাস্ত হওয়া টের পেল। আরও একবার বৈরী বিজয়ীর ছাপ পড়ল তার চোখে। হাত নামিয়ে গলায় ঝোলানো লস্ত্রিসের মাদুলিটা চেপে ধরল। মনে মনে শক্তির শব্দ ফুটিয়ে তুলল। মেনসার! বেসুরোভাবে চিৎকার করে উঠল ইয়োস। কিদাশ! নিউবে! আবার চিৎকার করে বলল তাইতা। মাদুলি থেকে মনস্তাত্ত্বিক শক্তির একটা ঝলক দেখা দিল। বিদ্যুঝলকের মতো ইয়োসকে ওর আত্মায় নিক্ষেপ করল। আরও একবার পরস্পরকে ঠেকিয়ে রাখল ওরা। ওদের শক্তি সামান সমান। পরস্পরের গায়ে লেগে থেকে আইভরিতে খোদাই করা মূর্তির মতো অটল রইল ওরা।

কুপির তেল টিমটিম করে জ্বলছে, শিখাটা একবার দপ করে উঠেই নিভে গেল। চেম্বারের অনেক উঁচু ছাদের ফোকর দিয়ে ভেতরে আসছে একমাত্র আলো। সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে অস্ত যাবার সাথে সাথে আলো ফিকে হয়ে এলো। যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে অন্ধকারে ছুঁড়ে দিল ওদের। সারা রাত এমনি ভীষণ সঙ্গমে জড়িয়ে থাকল ওরা।

ছাদের ফোকর দিয়ে ভোরের আলোে চুঁইয়ে ঢুকতে শুরু করার মুহূর্তেও পরস্পরের সাথে সেঁটে ছিল ওরা। আলো স্পষ্ট হয়ে উঠলে ইয়োসের চোখ দেখতে পেল তাইতা। সেগুলোর গভীরে কামনার আতঙ্কে পরিণত হওয়া দেখতে পেল, অনেকটা খাঁচায় বন্দি পাখির গরাদের গায়ে ডানা ঝাপ্টানোর মতো। ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল সে, কিন্তু দৃষ্টি স্থির রাখল ও। অনেক আগেই ক্লান্তির সব সীমা পার হয়ে গেছে ওরা। কারুরই কেবল লেগে থাকার ইচ্ছাটুকু ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। লম্বা পায়ে তাইতার কোমর পেঁচিয়ে রেখেছে সে, দুই হাতে পিঠ জড়িয়ে ধরেছে। ওকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল ও। ওর ডান হাতে তখনও লক্ট্রিসের মাদুলি ধরা; তার পিঠের মাঝখানে মুঠি পাকানো অবস্থায় রাখা। খুব সাবধানে যেন ইয়োস সতর্ক হয়ে না উঠতে পারে, বুড়ো আঙুলের নখের সাহায্যে লকেটের মুখ খুলে ফেলল ও। লাল পাথরের গুড়ো ওর হাতে পড়ল।

ইয়োসের মেরুদণ্ডে পাথরের গুঁড়ো চেপে ধরল ও। ইয়োসের উপর শক্তি চালিত হওয়ামাত্র উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল। আর্তচিৎকার করে উঠল ইয়োস। প্রলম্বিত, মরিয়া আর্তনাদ; তারপর দুর্বলভাবে যুঝল, ওকে বিতাড়িত করার মরিয়া প্রয়াসে আর্তচিৎকার করার মতো কোমর দোলাতে শুরু করল। তার খিচুনীর সাথে ধাক্কাগুলোকে সমন্বিত করল তাইতা।

ওর নিচে লুটিয়ে পড়ল সে। গোঙাচ্ছে, বিড়বিড় করছে। মুখ দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল তাইতা, গলার গভীরে জিভ ঢুকিয়ে, স্তব্ধ করে দিল আর্তচিৎকার। তার সত্তার অন্তস্থঃ জগৎ তছনছ করে দিল ও, ভাণ্ডার বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তার সমস্ত জ্ঞান আর শক্তি। প্রবাহ টেনে নিতে লাগল ও। এ কাজ করার সময় নিজস্ব শক্তি বানের মতো ফিরে এলো। যতখানি সে কেড়ে নিয়েছিল তার শতগুন বেশি হয়ে।

বর্ণনাতীত কমনীয় চেহারা, অসাধারণ চোখের দিকে তাকাল ও, বদলে যেতে দেখল ওগুলো। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। লালার রূপালি ধারা গড়াচ্ছে। চোখজোড়া ম্লান হয়ে আসছে। নুড়ি পাথরের মতো ফ্যকাশে। আগুনের খুব কাছে ধরে রাখা মোমবাতির মতো নাকটা চওড়া কর্কশ হয়ে গেছে। উজ্জ্বল ত্বক এখন ম্লান হলদে রং পেয়েছে, সরীসৃপের আঁশঅলা ত্বকের মতো কর্কশ, শুষ্ক। ঠোঁট আর চোখের কোণে গভীর খাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। চুলের সজীব কোঁকড়া ভাব চলে গিয়ে সোজা হয়ে গেছে, চাঁদিতে শুকনো ত্বক দেখা যাচ্ছে।

ধসে পড়া বাঁধের পানির মতো ইয়োসের কাছ থেকে প্রবাহিত হতে থাকা নাক্ষত্রিক ও মনস্তাত্ত্বিক সার বস্তুর ধারা টেনে নিচ্ছে। এত বিপুল সেই পরিমাণ যে ঘন্টার পর ঘণ্টা অব্যাহত রইল প্লাবন। ছাদের ফোকার দিয়ে ঢুকে পড়া রোদ মালাকাইটের মেঝে পেরিয়ে মধ্য দুপুরের রেখায় পৌঁছালে তাইতা বুঝতে পারল প্রবাহ দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ হলো তা। সবই শুষে নিয়েছে ও। ইয়োস নিঃশেষ, শূন্য হয়ে গেছে।

খোলা মুখে শব্দ করে শ্বাস ফেলছে সে। তার শরীর ফুলে উঠতে শুরু করায় চোখজোড়া চেম্বারের ছাদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে। রোদে ফেলে রাখা লাশের মতো যেন পচা গ্যাসে ভরে উঠছে এমনভাবে কেঁপে উঠতে শুরু করল তার দেহ। সরু হাত-পা ফুলে ঢোল হয়ে গেল। শরীরের মাংস মাখনের ব্লাডারের মতো নরম আকারহীন হয়ে ফুলে উঠেছে। পেস্টের মতো শাদা ভাঁজের আড়ালে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত তার মাংস ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখল তাইতা। কেবল মাথাটাই শরীরের বাকি অংশের তুলনায় ছোট রয়ে গেল।

ধীরে ধীরে চেম্বারের অর্ধেকটা দখল করে নিল তার ফোলা শরীর। কেঁপে ওঠার জায়গা করে দিতে লাফ দিয়ে কাউচ থেকে উঠে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল তাইতা। এখন টিপির কেন্দ্রে শুয়ে থাকা রানি উইপোকার মতো লাগছে। তাকে। এই গুহা থেকে আর কোনও দিন পালাতে পারবে না সে। এমনকি ট্রগরা ওকে উদ্ধার করতে ফিরে এলেও না, ওকে কোনওদিন সংকীর্ণ পাথুরে প্যাসেজ দিয়ে ভোলা বাতাসে বের করতে পারবে না তারা।

একটা ভীতিকর দুর্গন্ধ গুহা ভরে তুলেছে। ইয়োসের ত্বকের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে বের হয়ে শব বেয়ে নামছে পুরু তেলতেলে তরল। ফোঁটাগুলো ফিকে সবুজ, তাতে পচনের আভাস। বমি জাগানো গন্ধ তাইতার শ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার যোগাড় করল, ফুসুফুস জ্বালিয়ে দিল। পচা লাশের গন্ধ। তার খুনে ক্ষিধের শিকার, জঠর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জন্ম-না-নেওয়া শিশু ও ওদের পেটে ধরা অল্প বয়সী মা; বিভিন্ন জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভিক্ষ, খরা ও প্লেগে প্রাণ হারানো লাশ, তার উস্কে দেওয়া ও নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে প্রাণ হারানো যোদ্ধা; ফাঁসিকাঠ বা চিতায় যাদের মেরেছে সে; খনি ও গহ্বরে প্রাণ হারানো দাসদের লাশের গন্ধ। এক বিশাল অশুভের গন্ধে আরও জোরাল হয়ে উঠেছে যা, তার মুখ থেকে বের হয়ে আসা প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে বের হয়েছে। এমনকি ইন্দ্রিয়ের উপর তাইতার নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত এই পরিবেশে টলে উঠল। গুহার সীমিত জায়গায় যতটা সম্ভব তার কাছ থেকে দূরে সরে দেয়াল ঘেঁষে সুড়ঙের মুখের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ও।

এক অশুভ শব্দ থমকে দিল ওকে। যেন দানবীয় সজারু সতর্ক করতে কাঁটা ঝাঁকি দিচ্ছে। ইয়োসের ভৌতিক মাথা ওর দিকে গড়ান খেল, ওর মুখের উপর স্থির হলো তার চোখ। চেহারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ায় সৌন্দর্যের কোনও চিহ্নই আর নেই। চোখজোড়া গভীর, অন্ধকার গহ্বরে পরিণত হয়েছে। ঠোঁটজোড়া সরে গিয়ে খুলির দাঁতের মতো দাঁত বের হয়ে পড়েছে। অনির্বচনীয় কুৎসিত তার চেহারা, জটিল আত্মার আসল রূপ। কর্কশ, ফাসফেঁসে কণ্ঠে কাকের মতো কথা বলে উঠল সে। আমি বেঁচে উঠব, বলল সে।

তার নিঃশ্বাসের কটু গন্ধে চমকে পিছিয়ে এলো ও। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ইয়োসের চোখে চোখে তাকাল। মিথ্যা সব সময়ই টিকে থাকবে, তেমনি সত্যিও। এই যুদ্ধের কখনও শেষ হবে না, জবাব দিল ও।

চোখ বন্ধ করল ইয়োস, আর কথা বলল না। কেবল তার নিঃশ্বাসের শব্দ গলায় ঘরঘর আওয়াজ করে চলল।

*

জোব্বা খুঁজে নিয়ে সবুজ চেম্বার হয়ে বাইরের হাওয়া-বাতাসে খোলা প্যাসজে চলে এলো তাইতা। ইয়োসের গোপন উদ্যানে এলো যখন, তখন সূর্যের আলো ক্লিফের চূড়া স্পর্শ করছে, কিন্তু জ্বালামুখের গভীর ছায়ায় ফেলে রেখেছে। ইয়োসের কোনও ট্রগের ছায়া দেখা যায় কিনা দেখতে সাবধানে ইতিউতি তাকাল ও। ওদের আভা খুঁজছে, কিন্তু নেই। এটা ওর জানা ছিল, ইয়োসের ধ্বংসের সাথে সাথে তারা পথ চলার বুদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন দিশাহারা হয়ে মরার জন্যে পাহাড়ের সুড়ঙ ও প্যাসেজে ঢুকে পড়েছে।

বাতাস পরিষ্কার, ঠাণ্ডা। স্বস্তির সাথে গভীরভাবে শ্বাস টানল ও। কালো পুকুরের পাশে তাঁবুর দিকে এগোনোর সময় ফুসফুস থেকে ইয়োসের বদ গন্ধ ধুয়ে মুছে ফেলল। একটা বেঞ্চিতে বসল ও, এখানেই যখন সে তরুণী ও সুন্দরী ছিল তখন তার সাথে বসত ও। কাঁধের উপর চামড়ার জোব্বা টেনে নিল ও। ভেবেছিল ওই বিপদের মোকাবিলার পর নিজেকে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আবিষ্কার করবে, অথচ উচ্ছ্বাস পরিপূর্ণ করে রেখেছে ওর সত্তা। নিজেকে শক্তিশালী, অপরাজেয় লাগছে।

ডাইনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া শক্তি ও ক্ষমতার কারণে বদলে গেছে বোঝার আগ পর্যন্ত প্রথমে ব্যাপারটা বিস্মিত করল ওকে। এখন ওকে পূর্ণ করে রাখা পাহাড়সম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে বিশাল ও প্রসারিত হয়ে উঠল ওর মন। সেই সময়ের সূচনা পর্যন্ত ইয়োসের অস্তিত্বের সবগুলো সহস্রাব্দের দিকে নজর দিতে পারছে। প্রতিটি বিষয় একদম তরতাজা। তার কামনা ও ইচ্ছার তল খুঁজে পাচ্ছে, যেন এসবই ওর নিজস্ব। ইয়োসের নিষ্ঠুরতা ও নৈতিক স্থলনের গভীরতা দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ মিথ্যা ও অমঙ্গলের আসল রূপ উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এর প্রকৃতি বুঝে উঠতে পারেনি। তার কাছ থেকে এত কিছু শেখার ছিল যে, জানত এর অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ পরীক্ষা করতেই গোটা আয়ু লেগে যেত।

জ্ঞানটা এক ধরনের ভয়ঙ্কর ও ঘৃণিত মায়াজালে আচ্ছন্ন করে রাখার মতো। নিমেষে ও বুঝে গেল এর ঘোর লাগানো মুগ্ধতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এটা তাকে নষ্ট করতে না পারে। এমন অশুভ হাতের নাগালে এসে পড়ায় ওর নিজেরই ইয়োসের মতো দানবে পরিণত হওয়ার সমূহ ঝুঁকি রয়েছে। ডাইনীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জ্ঞান ওর নিজের জ্ঞানের সাথে মিলে ওকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত করেছে, এই ভাবনা বিনয়ী করে তুলল ওকে।

নিজের সব শক্তি এক করে স্মৃতিব গভীর কন্দরে জমে থাকা সমস্ত অশ্লীল বিষয় দূরে ঠেলে দিতে শুরু করল ও। যাতে সেগুলো ওকে তাড়া করে ফিরতে না পারে বা হামলা না করে, কিন্তু প্রয়োজনে এর যেকোনও অংশই আবার ফিরে পায়।

অশুভের পাশপাশি এখন ওর আয়ত্তে রয়েছে সমান বা বেশি পরিমাণ বিদ্যার সামগ্রিক আধার, যা হয়তো মানুষ ও মানবজাতির পক্ষে সীমাহীনভাবে উপকারী হতে পারে। ডাইনীর কাছ থেকে মহাসাগর, পৃথিবী ও স্বর্গের স্বাভাবিক রহেস্যর চাবিকাঠি ছিনিয়ে নিয়েছে ও, পেয়েছে জীবন, মৃত্যু, ধ্বংস ও পুনরুজ্জীবনের রহস্য; এর সবই মনের একেবারে সামনের দিকে জমা রাখল ও, যেখানে খোঁজ করতে পারবে, ঝালিয়ে নিতে পারবে।

সব কিছু মনের ভেতর নতুন করে সাজাতে সাজাতে সূর্য পাটে বসল, রাত পার হলো। তারপরই কেবল নিজের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল ও বেশ কয়েক দিন ধরে মুখে কিছু দেয়নি ও, পান করলেও তৃষ্ণার্তই রয়ে গেছে। এখন ডাইনীর আস্তানার অন্ধিসন্ধি চেনা হয়ে গেছে ওর, যেন এখানে তার মতোই অনেক দিন ধরে ছিল। জ্বালামুখ ছেড়ে পাথুরে বসতিতে ফিরে নির্ভুলভাবে গুদাম ঘর, ভাঁড়ারঘর আর রান্নাঘর খুঁজে বের করল, যেখানে ট্রগরা ইয়োসের সেবা করেছে। সেরা ফল ও পনির খেল ও, এক কাপ মদ গিলল। তারপর তরতাজা হয়ে ফিরে এলো তাঁবুতে; এখন ওর সবচেয়ে বড় কাজ হলো ফেনের সাথে যোগাযোগ করা।

নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে প্রথমবারের মতো ইথারে আহ্বান পাঠাল, পরিষ্কার, উন্মুক্ত কণ্ঠে ডাকল ওকে। অমনি বুঝতে পারল ডাইনীর ক্ষমতাকে খাট করে দেখেছিল ও। ফেনের কাছে পৌঁছানোর ওর প্রয়াস ডাইনীর অবশিষ্ট রয়ে যাওয়া কোনও শক্তির কারণে আবার ওর কাছে ফিরে আসছে। এমনকি তার বেহাল অবস্থায়ও নিজের ও তার চালাদের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা প্রাচীর গড়ে তুলতে পারছে সে। চেষ্টাটা বাদ দিল ও, পাহাড় থেকে পালানোর একটা উপায় খুঁজতে শুরু করল। ইয়োসের স্মৃতি হাতড়ে এমন কিছু আবিষ্কার করল যা ওকে টলিয়ে দিল, বিশ্বাসের সর্বশেষ সীমায় পৌঁছে দিল ওকে।

আবার তাবু ছেড়ে গেল ও, ইয়োসের সবুজ পাথুরে চেম্বারের দিকে চলে যাওয়া পাথুরে সুড়ঙে চলে এলো। নিমেষে পচনের গন্ধ এসে ঘা দিল নাকে। আর কিছু না হোক, আগের চেয়ে আরও প্রবল হয়ে উঠেছে সেটা। আরও বিরক্তিকর। টিউনিকের হেম দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখল। বমির বেগ দমন করল। এখন প্রায় পুরো গুহাটা ভরে ফেলেছে ইয়োসের শরীর। ওটার নিজস্ব পচা গ্যাসে ফুলে উঠেছে। তাইতা লক্ষ করল এখন মানুষ থেকে কীটে পরিণত হওয়ার একটা পর্যায়ে রয়েছে সে। তার শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসা তরল শরীর আবৃত করে এখন চকচকে খোলে পরিণত হতে চলেছে; নিজেকে একটা মুটকীটে ঘিরে ফেলছে সে। কেবল মাথাটাই এখনও দেখা যাচ্ছে। চুলের অবশেষ এখন সবুজ মেঝেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চোখ বন্ধ। তার কর্কশ শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ হাওয়াকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এক গভীর শীত নিদ্রায় নিজেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সে। জীবনের এক স্থগিতাবস্থা, অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত যা চলতে পারে।

যেমন অসহায় পড়ে আছে সেভাবেই তাকে শেষ করে দেওয়ার কোনও উপায়। আছে? ভাবল ও। কাজটা করার উপায়ের খোঁজে সদ্য প্রাপ্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার হাতড়াল। নেই, সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও। অমর নয় সে, কিন্তু আগ্নেয়গিরি অগ্নিশিখায় সৃষ্টি করা হয়েছে তাকে, কেবল ওই আগুনেই সে ধ্বংস হতে পারে। মুখে ও বলল, শুভেচ্ছা ও বিদায়, ইয়োস! দশ হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকো যেন, যাতে দুনিয়াটা অল্প সময়ের জন্যে হলেও তোমার কাছ থেকে রক্ষা পেতে পারে। উবু হয়ে তার এক গাছি চুল তুলে নিল ও। পেঁচিয়ে পুরু একটা বেণীতে পরিণত করে যত্নের সাথে বেল্টের পাউচে ভরে রাখল।

ইয়োস ও চকচকে মালাকাইটের দেয়ালের মাঝখানে ওর পিছলে যাবার মতো সামান্য জায়গা ছিল, চেম্বারের শেষ মাথায় পৌঁছুল ও। এখানে, আগেই যেমন জানা ছিল, একটা গোপন দরজা পেল ও। ওটাকে আয়নার মতো দেয়ালে এমন চতুরতার সাথে খোদাই করা হয়েছে যে প্রতিফলনে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কেবল নিরেট সবুজ পাথরের মতো দেখতে জিনিসটা স্পর্শ করার পরেই পথটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। ওর ঢোকার মতো যথেষ্ট প্রশস্ত ওটা।

ওপাশে একটা সংকীর্ণ প্যাসেজে আবিষ্কার করল নিজেকে। আগে বাড়ার সাথে সাথে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে শুরু করল আলো। সামনে হাত মেলে দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে এগোল ও, অবশেষে প্যাসেজটা যেখানে ডানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছাল। অন্ধকারে উপরে হাত বাড়িয়ে একটা পাথরের তাক পেল। হাতের পিঠে মাটির চুলোর উষ্ণতার ছোঁয়া পেল। পাতিলের দড়ির হাতলের কাছে নিয়ে গেল ওটা। হাঁড়িটা নামিয়ে আনল ও। তলায় ক্ষীণ আভা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফুঁ দিয়ে আবার শিখায় পরিণত করল ওটাকে। তার আলোয় আগাছায় বানানো মশালের একটা তূপ দেখতে পেল। একটা মশাল জ্বালল ও। পাথরের তাকে রাখা ঝুড়িতে দুটো বাড়তি মশাল দিয়ে মাটির হাঁড়িটা বসাল ও। তারপর ফের সংকীর্ণ টানেল ধরে আগে বাড়ল।

খাড়া কোণে নিচে নেমে গেছে সুড়ঙটা। ডান দিকের দেয়াল বরাবর ঝোলানো দড়ি ধরে ভারসাম্য বজায় রাখল ও। অবশেষে একটা ছোট কামরায় শেষ হলো সুড়ঙটা। এত নিচু ছাদ, ওটার নিচে প্রায় উবু হয়ে থাকতে হলো ওকে। মেঝের ঠিক মাঝখানে একটা গাঢ় মুখ দেখতে পেল ও, মনে হচ্ছে কুয়োর মুখ। ওটার উপর মশাল ধরে নিচে উঁকি দিল। অন্ধকার গ্রাস করে নিল দুর্বল আলো।

মেঝে থেকে একটা ভাঙা মাটির পাত্র তুলে গর্তে ফেলে দিল তাইতা। ওটা তলায় পৌঁছানোর অপেক্ষা করার সময় মনে মনে গুনতে লাগল। পঞ্চাশ গোনার পরও ওটার নিচের পাথর স্পর্শ করার কোনও আওয়াজ মিলল না। গহ্বরটা তলাহীন। ঠিক ওর সামনেই একটা মজবুত ব্রোঞ্জের হুক গুহার ছাদে গাঁথা রয়েছে। চামড়ার বেণী পাকানো একটা রশি ওটা থেকে নেমে গেছে গহ্বরে। ওর মাথার উপরের ছাদ ধোয়ায় কালো। এই গুহায় অসংখ্যবার আসা যাওয়া করার সময় মাথার উপর মশাল ধরে রেখেছিল ইয়োস, তারই ধোয়ায় এমন হয়েছে। মশাল দাঁতে চেপে ধরে দড়ি বেয়ে কুয়োয় ওঠানামা করার মতো শক্তি ও নৈপূণ্য ছিল তার।

স্যান্ডেল খুলে ঝুড়িতে রেখে দিল তাইতা। তারপর মশালটা পাশের দেয়ালের একটা ফোকরে গেঁথে দিল যাতে নিচে নামার সময় ওটা থেকে সামান্য হলেও আলো মেলে। ঝুড়ির হাতলটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাত বাড়াল দড়ির দিকে, গহ্বরের উপরে উঠে পড়ল। সবিরতিতে দড়ির উপর গিঁট দেওয়া রয়েছে। হাত ও নগ্ন পায়ের পক্ষে নাজুক এক ধরনের অবলম্বনের কাজ দিল ওগুলো। আগে পা তারপর হাত চালিয়ে দেয়াল বেয়ে নামতে লাগল ও। জানে এই অবতরণ কত দীর্ঘ ও কষ্টসাপেক্ষ হতে পারে। সাবধানে অগ্রসর হচ্ছে, বিশ্রাম নিতে ও গভীরভাবে শ্বাস নিতে নিয়মিত থামছে।

বেশি সময় পেরুনোর আগেই ওর শরীরের পেশি কাঁপতে শুরু করল, দুর্বল হয়ে এলো হাত-পা। নিজেকে আগে বাড়তে বাধ্য করল ও। মাথার উপরের চেম্বারে রেখে আসা মশালের আলো এখন স্রেফ একটা ঝলকে পরিণত হয়েছে। অন্ধকারে ক্রমেই নেমে চলল ও, কিন্তু ইয়োসের স্মৃতি থেকে পথ চেনা আছে ওর। ওর ডান পায়ের থোড়ের মাংসে ঝিঁঝি ধরে গেল, ব্যথা করছে। পঙ্গু করে দিতে চাইছে। কিন্তু মনকে ওটা থেকে সরিয়ে রাখল ও। ওর হাত এখন অসাড় থাবা। বুঝতে পারছে পেরেকে লেগে একটা হাত ছড়ে গেছে, কারণ ওর উপরে কাত করে রাখা মুখে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। জোর করে দড়ির উপর হাত খুলছে, বন্ধ করছে ও।

নামছে তো নামছেই; অবশেষে বুঝতে পারল আর নামতে পারবে না। অন্ধকারে নিথর ঝুলে রইল ও। ঘামে ভিজে একসা, দোলায়মান দড়ির উপর আবার মুঠি বদলাতে অক্ষম। অন্ধকার ওর শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে। রক্তে পিচ্ছিল হয়ে গেছে হাত, আঙুল খুলে যেতে শুরু করায় পিছলে যেতে চাইছে।

মেনসার! শক্তির শব্দ ফুটিয়ে তুলল ও। কিদাশ! নিউবে! অমনি স্থির হয়ে গেল ওর পা, দৃঢ় হলো হাতের মুঠি। কিন্তু তারপরেও পরের গিঁটের দিকে এগিয়ে যেতে নিজের শরীরকে বাধ্য করতে পারল না ও।

তাইতা! প্রিয় তাইতা আমার! জবাব দাও! ফেনের কণ্ঠস্বর এত স্পষ্ট, মিষ্টি মনে হলো অন্ধকারে ওর পাশেই ঝুলছে ও। ওর আত্মার প্রতীক শাপলার জটিল রেখা ফুটে উঠল। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল। আবার ওর পাশে এসে পড়েছে ও। এমন জায়গায় এসে গেছে ও যেখানে দুর্বল ডাইনী শক্তিও ওদের নাক্ষত্রিক যোগাযোগে বাদ সাধতে পারবে না।

ফেন! ইথারে মরিয়া আহ্বান পাঠাল ও।

ওহ, দয়াময় মাতা আইসিসকে ধন্যবাদ। পাল্টা আহ্বান জানাল ফেন। অনেক দেরি হয়ে গেছে ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম কঠিন অবস্থায় পড়েছ তুমি। যেমন শিখিয়েছ, তোমার শক্তির সাথে আমার সমস্ত শক্তি মেলাচ্ছি আমি।

কম্পিত পাজোড়া অটল, কঠিন হয়ে আছে, টের পেল ও। গিঁটের উপর থেকে পা সরিয়ে নিল ও, হাতের উপর ঝুলে থেকে পায়ের আঙুল নিচে নামাল। নিচের শূন্যতা টেনে নিতে চাইল ওকে, দড়ির উপর পাক খেতে লাগল ও।

মনে শক্তি রাখ, তাইতা। আমি তোমার সাথে আছি, ওকে জানাল ফেন।

পরের গিঁটটা খুঁজে পেল ওর পা। পিছলে হাত নামিয়ে আনল ও। আবার আঁকড়ে ধরল। গুনছিল ও, তাই জানে এখনও অন্তত বিশটা গিট পার হওয়া বাকি, তারপর দড়ির শেষ মাথায় পৌঁছতে পারবে।

এগোও, তাইতা! আমাদের দুজনের খাতিরেই এগোতে হবে তোমাকে! তুমি ছাড়া আমি কিছু না। তোমাকে টিকে থাকতেই হবে, তাগিদ দিল ফেন।

উষ্ণ, নাক্ষত্রিক তরঙ্গ তুলে শক্তির প্রত্যাবর্তন টের পেল ও। উনিশ…আঠার… রক্তাক্ত হাত গলে নেমে যাওয়ার সময় বাকি গিটগুলো গুনে চলল ও।

তোমার শক্তি ও ইচ্ছা আছে, ফিসিফিস করে ওর মনের ভেতর বলল ফেন। তোমার পাশে আছি আমি। আমাদের স্বার্থে কাজটা করো। তোমার জন্যে আমার ভালোবাসার স্বার্থে। তুমি আমার বাবা ও বন্ধু। কেবল তোমার জন্যেই আমি ফিরে এসেছি। এখন আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।

নয়…আট…সাত… গুনতে লাগল তাই।

শক্তিশালী হয়ে উঠছ তুমি, মৃদু কণ্ঠে বলল ফেন। আমি বুঝতে পারছি। আমরা একসাথে বের হয়ে আসব।

তিন…দুই…এক…, নিচের দিকে একটা পা লম্বা করে দিল ও। আঙুল দিয়ে দড়ির খোঁজ করছে। এখন ওর পায়ের নিচে শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। দড়ির শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে ও। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে দুই হাত ছেড়ে দিতেই এত জোরে নিচে পড়ল যে দম বেরিয়ে যাবার যোগাড় হলো। দু পা ছড়িয়ে পড়ায় নীড় থেকে পড়ে যাওয়া পাখির ছানার মতো টলে উঠল ও। উপুড় হয়ে পড়ে রইল। ক্লান্তি ও স্বস্তিতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এমনকি উঠে বসার মতো শক্তিও নেই।

তুমি ঠিক আছে, তাইতা? এখনও আছো? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

শুনতে পাচ্ছি, উঠে বসার সময় জবাব দিল ও। আমি ঠিক আছি আপাতত। তুমি না থাকলে অন্য রকম হতো ব্যাপারটা। তোমার শক্তি আমাকে সাহস যুগিয়েছে। এখন আমাকে যেতে হবে। আমার ডাকের অপেক্ষায় থেকো। তোমাকে নিশ্চিতভাবেই আবার প্রয়োজন হবে।

মনে রেখ, তোমাকে আমি ভালোবাসি, বলে উঠল ফেন, তারপর মিলিয়ে গেল ওর উপস্থিতি। আরও একবার অন্ধকারে একা হয়ে গেল ও। ঝুড়ি হাতড়ে আগুনের হাঁড়িটা বের করে আনল। ফুঁ দিয়ে আগুন উস্কে নতুন করে মশাল জ্বালল। মশাল উঁচু করে ধরে ওটার আলোয় আশপাশের এলাকা পরখ করল।

বামে খাড়া দেয়াল বরাবর বানানো একটা সংকীর্ণ কাঠের ক্যাটওঅকে রয়েছে। ও, ব্রোঞ্জের বোল্ট দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকানো। অন্য পাশে মুখ হাঁ করে আছে অন্ধকার শূন্যতা। মশালের দুর্বল আলো তার গভীরতা আঁচ করতে পারছে না। শুড়ি মেরে ক্যাটওঅকের কিনারে এসে নিচের দিকে উঁকি দিল ও। নিচে বিছিয়ে রয়েছে অন্তহীন অন্ধকার। বুঝতে পারল একটা বিশাল গহ্বরের উপর ঝুলে আছে ও, পৃথিবীর পেটের ভেতর চলে গেছে ওটা, ইয়োসের উত্থানের সেই অস্তিত্বহীন জায়গা।

আরেকটু সময় বিশ্রাম নিল ও। পিপাসা চড়ে উঠেছে, কিন্তু গলায় ঢালার মতো কিছুই নেই। মনের শক্তি দিয়ে পিপাসার গলা টিপে মারল ও, হাত পায়ের ক্লান্তি দূর করল। ঝুড়ি থেকে স্যান্ডেল বের করে পায়ে বেঁধে নিল। দড়ির ঘায়ে ক্ষত হয়ে গেছে। অবশেষে উঠে ক্যাটওঅক ধরে কোনওমতে আগে বাড়ল। ওর বাম পাশের গহ্বরের সাথে কোনও রকম বাধা নেই। ওখানকার অন্ধকার সম্মোহনী শক্তিতে টানছে ওকে, ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। ধীরে সাবধানে এগিয়ে চলল ও, বুঝেশুনে একের পর এক পা ফেলছে।

মনের চোখে ইয়োস কীভাবে এই ক্যাটওয়াক ধরে হালকা পায়ে দৌড়ে যেত সেই দৃশ্য দেখল, ঠিক ছোট বাচ্চা যেভাবে উন্মুক্ত মাঠে ছুটে বেড়ায়; কীভাবে শক্তিশালী শাদা দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত মশাল ধরে গিঁট লাগানো দড়ি বেয়ে অনেক উঁচুতে নিজের আবাসে উঠে যেত। তাই জানে, তার বিপরীতে পায়ের নিচের এই মসৃণ মেঝে বরাবর আগে বাড়ার মতো সামান্য শক্তিই রাখে ও।

ওর পায়ের নিচে কাঠের তক্তা কর্কশভাবে ভাঙা পাথরে পরিণত হলো। পাহাড়ের একটা চাতালে এসে পৌঁছেছে ও। পা রাখার মতো সামান্য চওড়া। তীক্ষ্ণভাবে ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে; ভারসাম্য বজায় রাখতে দেয়াল আঁকড়ে থাকতে হলো ওকে।

চাতালটা যেন অন্তহীন, আতঙ্ক দূর করতে ওর সমস্ত মানসিক শক্তি এক করতে হলো। চাতাল ধরে বেশ কয়েক শো কিউবিট নামার পর অবশেষে একটা গভীর ফাটলে পৌঁছাল ও। ওটা দিয়ে আরেকটা সুড়ঙে পা রাখল। এখানে আবার বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলো। পাথরের গায়ে কুঁদা একটা ফোকরে মশালটা আটকে রাখল। অগুনতি মশালের আঁচে মাথার উপরের পাথর কালো হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করল ও। লম্বা করে শ্বাস টেনে হৃপিণ্ডের স্পন্দন ধীর করে আনল। মশালটা নিভে যাবার আগে ধোয়া উগড়ে পটপট শব্দ করছে। নিভন্ত আগুন দিয়ে শেষ মশালটা জ্বালল ও। তারপর আবার সড়ঙ ধরে নামতে শুরু করল। এইমাত্র ছেড়ে আসা উন্মুক্ত চাতালেরও চেয়েও ঢের বেশি ঢালু। শেষে একটা পাথুরে সিঁড়িঘরে পরিণত হলো ওটা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। শত শত বছর ধরে ইয়োসের পায়ের ঘায়ে মসৃণ, অবতল হয়ে গেছে।

তাইতার জানা ছিল পাহাড়ের ভেতরটা প্রাচীন আগ্নেয়গিরি ও ফাটলের একটা মৌচাকের মতো। পাথর এত উত্তপ্ত, স্পর্শ করা যায় না। একেবারে কেন্দ্রের বুদ্বুদ থেকে তৈরি তাপে উত্তপ্ত। বাতাসে সালফারের গন্ধ, কয়লার চুল্লী থেকে আসা ধোয়ার মতো দম বন্ধ করে দিতে চাইছে।

শেষে যেমনটা আশা করছিল, সুড়ঙের একটা বাঁকে পৌঁছাল তাইতা। মূল শূটটা সোজা নিচে নেমে গেছে, ছোট শাখাটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। দ্বিধা করল না তাইতা, সংকীর্ণতর ফোকরে পা রাখল। পা রাখার জায়গাটা রুক্ষ, কিন্তু প্রায় সমতল। বেশ কয়েকটা বাঁক হয়ে সুড়ঙ ধরে এগিয়ে চলল ও, শেষ পর্যন্ত আরেকটা গুহায় হাজির হলো। লালচে চুল্লীর মতো একটা আভায় আলোকিত। এমনকি ওঠানামা করতে থাকা আলো বিশাল জায়গাটার দূরতম প্রান্তে পৌঁছাতে পারছে না। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল আরেকটা গভীর জ্বালামুখের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে ও। ওর অনেক নিচে ভীষণ লাভার হ্রদ উতড়াচ্ছে। উপরের তলটা ফুলে ফেঁপে উঠছে, টগবগ করছে; উপর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে গলন্ত পাথর ও স্ফুলিঙ্গ। তাপের ঝাপ্টা এত প্রবলভাবে এসে ধাক্কা দিল ওর মুখে যে ঠেকাতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে হলো ওকে।

জ্বলন্ত লাভার অনেক উপর থেকে ঝড়ো হাওয়ার মতো বাতাস টেনে নিচ্ছে। হুহু গর্জন করে চলেছে, পোশাকে টান মারছে ওর, ঠেকাতে গিয়ে টলে উঠল ও। ওর সামনে টগবগ ফুটতে থাকা ডেগচির উপর একটা পাথরের টুকরো দেখতে পেল। ঠিক মাঝখানে ঝুলে গেছে, অনেকটা ঝুলন্ত দড়ির সেতুর মতো। এত সরু যে দুজন লোক পাশাপাশি যেতে পারবে না। গুহার ভেতরে গুমড়ে চলা হাওয়া স্থির নয়। এই দমকা হয়ে উঠছে, পরক্ষণেই আবার ফুঁসে উঠছে ভয়ঙ্করভাবে। কখনও কোনও আভাস ছাড়াই দিক বদল করছে। পেছনে টেনে নিচ্ছে ওকে। তারপরই ঠেলে দিচ্ছে সামনে। একাধিকবার ওকে টলিয়ে দিল, কিনারায় টলমল করতে হলো ওকে। ভারসাম্য ফিরে পেতে দুই হাত হাওয়া কলের মতো ঘোরাতে লাগল ও। শেষে জোর করে চার হাতপায়ে ভর দিতে বাধ্য করল ওকে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ও। মাথার উপর শক্তিশালী হাওয়ার তোড় বয়ে যাবার সময় সেতুর সাথে মিশিয়ে দিল নিজেকে, আঁকড়ে থাকল। সারাক্ষণই নিচে টগবগ করে ফুটছে লাভা।

অবশেষে সামনে গুহার দূর প্রান্ত দেখতে পেল ও। আরেকটা খাড়া প্রাচীর। ওটার দিকে হামা দিয়ে এগিয়ে গেল ও, তারপর সভয়ে লক্ষ করল পাথুরে স্পরের শেষ অংশটুক ভেঙে নিচের ভয়ঙ্কর ডেগচিতে পড়ে গেছে। স্পারের শেষ মাথা আর গুহার অপর প্রান্তের দেয়ালের মাঝে বেশ খানেকটা ফারাক। দীর্ঘদেহী কোনও পুরুষের তিন কদম সমান হবে। প্রান্তে এসে ফোকরের উপর দিয়ে তাকাল ও। সামনের দেয়ালে একটা ছোট ফোকর রয়েছে।

ইয়োসের স্মৃতির কল্যাণে তাইতার জানা আছে, অনেক বছর এই পথে যায়নি সে। তার শেষ সফরের সময় চাতালটা অক্ষত ছিল। শেষ অংশটুকু নিশ্চয়ই সাম্প্রতিক কালে ভেঙেছে। এর কথা ইয়োসের জানা না থাকাতেই এই রকম একটা বাধার মুখে পড়তে তৈরি ছিল না ও।

অল্প খানিকটা পিছিয়ে এলো ও। হাঁটু গেড়ে বসে স্যান্ডেল খুলে ঝুড়ির হাতল আলগা করে কাঁধ থেকে কাঁধের উপর থেকে ফেলে দিল। ঝুড়ি আর স্যান্ডেল কিনারার উপর দিয়ে লাভার হ্রদের দিকে ধেয়ে গেল। জানে ওর আর ফিরে যাবার মতো শক্তি নেই, সুতরাং সামনেই যেতে হবে। চোখ বন্ধ করে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত করে নিয়ে, শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু একত্র করে সম্পূর্ণ মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তির সাহায্যে বাড়িয়ে তুলল। তারপর প্রতিযোগিতার সূচনা বিন্দুতে এসে দাঁড়ানো ম্যারাথন দৌড়বিদের মতো উবু হয়ে গেল। চাতালের উপর দিয়ে বয়ে চলা ভীষণ বাতাসের একটা বিরতির অপেক্ষা করল ও, তারপর সংকীর্ণ পথ ধরে সামনে ঝুঁকে পড়ে এক দৌড়ে আগে বেড়ে লাফ দিল। মহাশূন্যে বের হয়ে এলো ও, এবং নিমেষে বুঝে ফেলল দূরত্বটুকু পার হতে পারবে না। নিচে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে ফুটন্ত ডেগচি।

ঠিক তখনই ফের বিলাপ শুরু করল হাওয়া। দিক বদলে দ্বিগুন হয়ে গেছে ওটার হিংস্রতা। ওর ঠিক পেছন থেকে ধেয়ে এলো। টিউনিকের স্কার্টের নিচে ঢুকে ফুলিয়ে তুলল ওটা, সামনে ঠেলে দিল ওকে। তবে যথেষ্ট দূরে নয়। দেয়ালে বাড়ি খেল ওর শরীরের নিচের অংশ। কোনওমতে ফোকরের কিনারা আঁকড়ে ধরতে পারল ও। ওখানেই ঝুলে রইল, গহ্বরের উপর ঝুলছে ওর পা, গোটা দেহের শক্তি ছেড়ে দিয়েছে দুই হাতের উপর। একটা কনুই কিনারার উপরে ওঠাতে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করল ও।, কিন্তু অল্প একটু ওঠার পরেই আবার আগের জায়গায় নেমে আসতে হলো। পাগলের মতো বাতাসে নগ্ন পা ছুঁড়তে লাগল ও, ক্লিফের গায়ে পা রাখার মতো জায়গা খুঁজছে, কিন্তু পাথরের শরীর মসৃণ।

ওর নিচে লাভার হ্রদ থেকে গলন্ত লাভার একটা ফোয়ারা উঠে এলো। আবার নিচে নেমে যাবার আগে গলন্ত ম্যাগমার ছিটে লাগল পায়ের তালুতে। ব্যথা অসহনীয়। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল ও।

তাইতা! ওর ব্যথা টের পেয়েছে ফেন, ইথারে আহ্বান জানাল ওকে।

সাহায্য করো, ফুঁপিয়ে বলে উঠল ও।

আমি তোমার সাথে আছি, জবাব দিল ফেন। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে-এইবার!

ব্যথাটা ছিল খোঁচার মতো। হাতের পেশি ছিঁড়ে যাবার মতো একটা বোধ না হওয়া পর্যন্ত উপরের দিকে উঠতে লাগল ও। আস্তে আস্তে যন্ত্রণাদায়কভাবে চোখজোড়া কিনারার সমান্তরালে না উঠে পর্যন্ত নিজেকে টেনে তুলল ও। কিন্তু এরপর আর উঠতে পারল না। বুঝতে পারল ওর হাতজোড়া আবার খসে পড়তে যাচ্ছে।

ফেন, বাঁচাও! আবার চিৎকার করে উঠল ও।

একসাথে! এইবার! শক্তির বেড়ে ওঠা টের পেল ও। কিনারার উপর একটা হাত তুলে আনতে না পারা পর্যন্ত নিজেকে টেন তুলল। এক মুহূর্ত ঝুলে থেকে আবার ফের ফেনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

আবার একসাথে, তাইতা। এবার!

উপরের দিকে উঠে অন্য হাতটাও তুলে দিল ও। ধরার মতো একটা জায়গা মিলল। দুই হাতের অবলম্বন পাওয়ায় সাহস ফিরে এলো। পোড়া পায়ের যন্ত্রণা ভুলে উপরে উঠে এলো, ওর শরীরের উধ্বাংশ কিনারার উপর এসে থপ করে পড়ল। পা ছুঁড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে টেনে খোলা মুখের কাছে নিয়ে এলো নিজেকে। আবার উঠে বসার শক্তি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত স্রেফ পড়ে রইল। এবার পায়ের দিকে তাকাল, দেখল কোথায় পুড়েছে। পায়ের পাতায় লেগে থাকা লাভার টুকরোগুলো ধরে টানল, ওদের সাথে মাংসও উঠে এলো। পায়ের থোড়ের কাছে ফোস্কা পড়ে গেছে, ভেতরে স্বচ্ছ তরল ফুলে উঠছে। ব্যথায় অচল হয়ে পড়েছে ও, কিন্তু দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল ও। তারপর সুড়ঙ ধরে টলমল পায়ে এগিয়ে চলল। পায়ের পাতা একেবারে কাঁচা, পাথরের উপর রক্তাক্ত পায়ের ছাপ রেখে চলল ও। ওর পেছনের ফুটন্ত কাড়াইয়ের আলো পথ আলোকিত করে রেখেছে।

অল্প কিছুদূর সোজা এগিয়ে গেল সুড়ঙটা, তারপর ঢালু হয়ে গেল; ফলে লালচে আলো মিলিয়ে গেল। তারই শেষ আভায় দেয়ালের ফোকরে ঢোকানো আধপোড়া একটা মশাল দেখতে পেল। অনেক আগে ইয়োসের শেষ সফরের পর থেকেই এখানে আছে। ওটা জ্বালানোর কোনও উপায় নেই, ভাবল ও। তারপরই ডাইনীর কাছ থেকে পাওয়া শক্তির কথা ভাবল; হাত বাড়িয়ে দিল ওটার দিকে। তর্জনী দিয়ে পোড়া অংশটুকুর দিকে নির্দেশ করেছে, মনস্তাত্ত্বিক শক্তি স্থির করেছে ওটার উপর।

নেভা মশালের ডগায় একটা আভা দেখা দিল। ধোঁয়ার ক্ষীণ সর্পিল রেখা ফুটতে শুরু করল সেখানে। তারপর আচমকা দপ করে জ্বলে উঠল আগুন, উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে আগুন লাগল। ফাটল থেকে ওটা নামিয়ে উঁচু করে ধরে পোড়া পায়ে ল্যাঙচাতে ল্যাংচাতে যত দ্রুত সম্ভব আগে বাড়ল। আরেকটা ঢালু শূটের কিনারে এসে পৌঁছাল ও। এখানেও চলাচল হয়েছে, তবে পাথর তেমন ক্ষয়ে যায়নি, মিস্ত্রির বাটালির চিহ্ন এখনও টাটকা। ওটা ধরে নামতে শুরু করল ও, কিন্তু সিঁড়িগুলো অন্ত হীন মনে হচ্ছে; বিশ্রাম নিতে বারবার থামতে হলো ওকে। এমনি এক বিরতির সময় বাতাস ও যে পাথরের উপর বসেছিল তাতে এক ধরনের কাঁপন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল ও। শব্দটা একটানা চলছে না, বরং ওঠানামা করছে; অনেকটা দানবীয় নাড়ীর স্পন্দনের মতো।

তাইতার জানা ছিল আওয়াজটা কীসের।

এবার সাগ্রহে উঠে দাঁড়াল ও। নামতে শুরু করল আবার। সামনে বাড়ার সাথে সাথে চড়া ও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল শব্দটা। ক্রমেই নিচে নেমে চলল তাইতা, শব্দটা ওর উত্তেজনা চাগিয়ে তুলতে লাগল। পায়ের যন্ত্রণাকে ম্লান করে দেওয়ার মতো প্রবল না হয়ে ওঠা পর্যন্ত এগিয়ে চলল ও। বিশাল নাড়ীর স্পন্দনের শব্দ সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছাল। থরথর কাঁপছে পাথরের দেয়াল। নিজেকে টেনে সামনে নিয়ে চলল ও, তারপর থমকে দাঁড়াল। হতবাক। ইয়োসের কাছ থেকে এখানকার স্মৃতি পেয়েছে ও, কিন্তু টানেলটা কানা গলিতে পরিণত হয়েছে। ধীর পায়ে, যন্ত্রণাকাতরভাবে সামনে বেড়ে দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল ও।

দেখে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক কর্কশ পাথর। কোনও ফোকর বা পথ নেই, কিন্তু ঠিক ওটার মাঝখানে ওর চোখ বরাবর তিনটা চিহ্ন খোদাই করা রয়েছে। প্রথমটা লাভা গামলার সালফারাস গ্যাসে ক্ষয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে না; ওটার প্রাচীনত্ব বোঝার অতীত। দ্বিতীয়টা সামান্য টাটকা, বেশ ভালো করে পরখ করার পর ক্ষুদে পিরামিডের আউটলাইন দেখতে পেল, পুরোহিত বা কোনও পবিত্র পুরুষের আত্মার চিহ্ন। তৃতীয়টা সবচেয়ে নতুন, তবে তারপরেও অনেক শতাব্দী প্রাচীন। ওটা ইয়োসের আত্মার চিহ্ন বেড়ালের থাবার আউটলাইন।

খোদাইগুলো ওর আগে এখানে যারা এসেছিল তাদের আত্মার চিহ্ন। সময়ের সূচনা থেকে মাত্র তিনজন এখানে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে। পাথরটা স্পর্শ করতেই ফেলে আসা নারকীয় জ্বালামুখ আর জ্বলন্ত লাভার বিপরীত শীতল ঠেকল।

এটাই সেই ফন্ট যার খোঁজে মানুষ যুগ-যুগ অনুসন্ধান চালিয়ে গেছে, গভীর শ্রদ্ধায় বিড়বিড় করে বলল ও। বেড়ালের থাবার প্রতাঁকের উপর হাত রাখল। ওর স্পর্শে উষ্ণ হয়ে উঠল ওটা। পৃথিবীর নাড়ীর স্পন্দনে একটু বিরতির অপেক্ষায় থাকল ও। তারপর ডাইনীর কাছে থেকে নেওয়া শক্তির তিনটা মন্ত্র উচ্চারণ করল। এটা তার গোপন মন্ত্র, আর কেউ যা জানে না।

তাশকালোন! আ্যাসকররা! সিলোনদেলা!

গুঙিয়ে উঠে ওর হাতে নিচে সরে যেতে শুরু করল পাথরটা। আরও জোরে চাপ দিল ও। পাথরের দেয়ালটা ধীর গতিতে একপাশে সরে যেতে শুরু করায় কর্কশ ঘর্ষণের শব্দ উঠল, যেন ঘানি চলছে। ওটার ওপাশে আরেকটা ছোট সিঁড়িঘর রয়েছে, তারপর সুড়ঙের একটা বাঁক থেকে আহত পশুর আর্তনাদের মতো একটা শব্দ আসছে। ওর চারপাশে আওয়াজ করে চলা পৃথিবীর নাড়ীর স্পন্দন এখন আর দরজার কারণে চাপা পড়েনি। নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার আগেই ওটার শক্তিতে পিছিয়ে যেতে হলো ওকে। সামনের সুড়ঙটা নীল আলোয় আলোকিত, নাড়ীর জোরাল স্পন্দনের সাথে সাথে প্রবল হয়ে উঠছে, তারপর শব্দ কমে এলে ক্ষীণ হচ্ছে।

ফোকর দিয়ে ভেতরে পা রাখল তাই। দুই পাশে দেয়ালের কুলঙ্গিতে একটা করে মশাল রাখা। ওগুলো জ্বালল। সেগুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্যাসেজ বরাবর নেমে চলল ও। এক ধরনের বিস্ময় বোধে অভিভূত ও, যার সাথে এর আগে পরিচয় ঘটেনি, এমনকি মিশরের মহান দেবদেবীদের পবিত্র অন্দরমহলেও না। প্যাসেজের শেষ মাথায় বাঁক ঘুরল ও, আরেকটা ছোট সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াল। শাদা বালির মসৃণ মেঝে দেখতে পেল নিচে।

মনে ভীতি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল ও, ভূগর্ভস্থ নদীর শুকনো তলদেশের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে আবিষ্কার করল। ওর জানা ছিল অচিরেই অন্ধকার সুড়ঙে আওয়াজ ও আলো প্রবল হয়ে উঠবে। জীবন নদীর জলকে ওর নিজের উপর দিয়ে বয়ে যেতে দিলে কী পরিণতি হবে?

অনন্ত কাল বেঁচে থাকা আশীর্বাদের চেয়ে বরং অভিশাপই হওয়ার কথা। সময়ের প্রথম কাল পেরিয়ে যাওয়ার পর পঙ্গু করে দেওয়া একঘেয়েমী ও স্থবিরতা দেখা দিতে পারে, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার সুযোগ মিলবে না। সময়ের প্রবাহে কি নৈতিকতা ও বিবেক ক্ষয়ে যাবে? ইয়োস যাতে জড়িয়ে পড়েছিল সেভাবে কি নীতি ও সৌজন্যতা বিকৃত অশুভ ও দুষ্কর্মে প্রতিস্থাপিত হবে?

ওর স্নায়ু ভেঙে পড়ল। পালাবে বলে ঘুরে দাঁড়াল ও। কিন্তু আর দ্বিধা করল না। তীব্র নীল ভরে ফেলল সুড়ঙটা। চাইলেও এখন আর পালাতে পারবে না ও। সুড়ঙের দিকে মুখ করে দাঁড়াল ও। আগুয়ান বজ্রকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত করে নিল নিজেকে। ভূগর্ভস্থ নদীর মুখ থেকে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য বিস্ফোরিত হলো, যার আপাত কোনও উৎস আছে বলে মনে হলো না। কেবল ওর পায়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময়ই বুঝতে পারল ওটা বায়বীয় বা তরল কিছুই নয়। বাতাসের মতোই হালকা, কিন্তু একই সময়ে ঘন, ভারি। চামড়ার উপর বরফ শীতল অনুভূতি সৃষ্টি করছে, কিন্তু নিচের মাংসকে উষ্ণ করে তুলছে।

এটাই অনন্ত জীবনের আরক!

নিমেষে বানে পরিণত হলো তা, কোমর অবধি উঠে এলো। পানি হলে ওকে পৃথিবীর গভীরে টেনে নিয়ে যেত। কিন্তু এটা কমনীয় আলিঙ্গনে উপরে ঠেলে দিচ্ছে ওকে। বজ্রের ধ্বনি কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে, নীরব স্রোত কাঁধ পর্যন্ত উঠে এলো। নিজেকে ওজনহীন, মুক্ত মনে হলো ওর, যেন উড়ন্ত ফুল। শেষবারের মতো গভীর শ্বাস টানল ও। মাথার উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলল। বন্ধ চোখের পাতার ভেতর দিয়েও নীল আভা দেখতে পাচ্ছে, বজ্রের ধনি কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।

শরীরে নিচের অংশে নীলাভার চুঁইয়ে ঢুকে পড়া টের পাচ্ছে, ওর শরীর পরিপূর্ণ করে তুলছে। চোখ খুলল ও, ওগুলোকে ধুয়ে দিল তা। চেপে রাখা দম ছাড়ল ও, আবার শ্বাস টেনে নিল। বুঝতে পারল নীল আরক ওর নাকের ফুটো দিয়ে ফুসফুেসে চলে যাচ্ছে। এবার হাঁ করে নীল মুখে টেনে নিল। ফুসফুস থেকে রক্তের ধমনীতে নীল ঢুকে পড়ায় প্রবলভাবে স্পন্দিত হতে শুরু করল হৃৎপিণ্ড। শরীরের প্রতিটি অংশে বয়ে যেতে লাগল। হাত পায়ের আঙুলের ডগায় সুরসুরি তুলল। ওর ক্লান্তি ভেসে গেল, নিজেকে এতই শক্তিমান বোধ হলো যেমনটা কখনও বোধ করেছে বলে মনে পড়ে না। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছতায় ঝিলিক দিয়ে উঠছে ওর মন।

নীলাভা ওর ক্লান্ত প্রবীন শরীরকে উষ্ণ করে তুলছে, সুস্থ ও নবায়িত করছে। পায়ের ব্যথা চলে গেছে। পোড়া মাংস সেরে উঠছে, হাড় হয়ে উঠছে মজবুত। মেরুদণ্ড ঋজু হয়ে উঠেছে ওর, মাংস পেশি দৃঢ়; অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলা সেই তারুণ্যের বিস্ময় ও আশাবাদে আবার ভরে উঠেছে মন। কিন্তু সরলতা এখন ওর ভাণ্ডারে সঞ্চিত প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় শক্তিশালী হয়েছে।

তারপর ক্রমশঃ ঔজ্জ্বল্য ফিকে হতে শুরু করল। বজ্রের ধনি কমে গেল। সুড়ঙ বরাবর ছুটে যাবার আওয়াজ পেল। নীরব নদীর তলদেশে একাকী দাঁড়িয়ে রইল ও। নিজের দিকে তাকাল একবার। পা উঁচু করল। পায়ের থোড়ের মাংস ও পায়ের পাতার পোড়া জায়গাগুলো সেরে গেছে। ত্বক মসৃণ, খুঁতহীন। কঠিন, গর্বিত চঙে উঁচু হয়ে উঠেছে পায়ের পেশি। ছুটতে চাইছে ওর পাজোড়া। ঘুরে সিঁড়ি বয়ে গড়ানো পাথরের দরজার উদ্দেশে ছুটল ও। একেকবারে তিন চারটে করে কর্কশ পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল, একবারের জন্যেও পা হড়কে গেল না। চেম্বারের মুখে একপলকের জন্যে থামল ও। ব্র্যাকেট থেকে এক ঝটকায় মশাল তুলে নিয়ে শক্তির মন্ত্র পড়তে ঘুরে দাঁড়াল। ঘরঘর করে বন্ধ হয়ে গেল পাথরের দরজা। এবার অন্য তিনটা প্রতাঁকের পাশে আরেকটা প্রতীক খোদাই হয়ে থাকতে দেখল ও। আহত বাজপাখীর প্রতীক, ওর আত্মার প্রতীক। সরে এলো ও, খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল আবার। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পেছনে ফন্টের চিরন্তন বজ্ৰধনি শুনতে পাচ্ছে; বুকের ভেতর দপদপ করছে পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন।

বিশ্রামের জন্যে থামার কোনও প্রয়োজন বোধ করছে না ও। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ও হালকা, পাথরের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওর নগ্ন পা। উপরে উঠতে লাগল ও, সেই সাথে ফন্টের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল, অবশেষে আর কোনও শব্দ কানে এলো না ওর। নামার চেয়ে ওঠা অনেক বেশি কম কষ্টকর মনে হচ্ছে। প্রত্যাশার আগেই সামনে ফুটন্ত ডেগচির আভা দেখতে পেল। আরও একবার ফুটন্ত লাভার হ্রদের দিকে তাকাল ও। পাথুরে চাতালের ফোকরের দূরত্বটুকু চোখের আন্দাজে বোঝার জন্যে ক্ষণিকের জন্যে থামল। এক সময়ের অমন ভয়ঙ্কর ও ভীতিকর জিনিসটাকে এখন কেমন যেন তুচ্ছ মনে হচ্ছে। ছয় কদম পিছিয়ে গেল ও, তারপর দ্রুত ছুটল সামনে। জ্বলন্ত মশালটা উঁচু করে ধরে মুখ থেকে লাফ দিল। ফোকারের উপর দিয়ে উড়ে চলল। ফাটলের ঠিক তিন কদম দূরে নিখুঁতভাবে নেমে এলো। এমনকি ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটা দমকা হাওয়া ওকে আক্রমণ করলেও ভারসাম্য বজায় রইল, এতটুকু নড়ল না ও।

সংকীর্ণ পাথুরে ক্যাটওঅক ধরে ছুটতে শুরু করল ও। আগে যেখানে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিল এখন সেখানেই হালকা পায়ে দৌড়াচ্ছে। বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইছে ওকে, ওর টিউনিকের হেমে বাড়ি মারছে, কিন্তু গতি কমল না ওর। ক্যাটওয়ের শেষে সুড়ঙের পাথুরে ছাদের কাছে পৌঁছে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল ও, বাক ও মোড়গুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, সুড়ঙের বাঁকে পৌঁছার আগে আর থামল না ও। মূল শাখায় পা রাখল।

এমনকি এখানেও সময় ক্ষেপণের দরকার মনে করল না ও। গভীর শ্বাস নিচ্ছে ও, তবে স্থিতিশীল, সিডার গাছের গুঁড়ির মতোই শক্তিশালী ওর পা। তারপরেও মশালটা দেয়ালের স্বাভাবিক ফোকরে ঠেসে দিল ও, তারপর টিউনিক উঁচু করে একটা পাথুরে ধাপে পড়ল। টিউনিক কোমর পর্যন্ত তুলে পাজোড়া পরখ করল। মসৃণ ত্বকে হাত বোলাল: নিচের পেশি পরিপূর্ণ, স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। স্পর্শ করল ও; কঠিন ও জোরাল ঠেকল। এবার হাত খেয়াল করে দেখল ও। পিঠের চামড়া ঠিক তারুণের হাতের মতো। বয়সের গাঢ় বলীরেখা বিদায় নিয়েছে। বাহুজোড়া ঠিক পায়ের মতোই, কঠিন, সুঠাম। দুই হাত মুখের কাছে তুলে আনল ও। হাতের আঙুল দিয়ে পরখ করল। দাড়ি আগের চেয়ে ঘন লাগল, গলা ও চোখের নিচের ত্বক বুলীরেখাহীন। চুলে হাত চালাল ও। ঘন, আবার কাঁচা হয়ে গেছে।

খুশিতে কীভাবে এই বদল ঘটে গেছে ভেবে জোরে হেসে উঠল ও। ওকে দেওয়া আয়নাটা সাথে আনা উচিত ছিল, ভাবল ও। অন্তত এক শো বছর ন্যায়সঙ্গত গর্বের সন্তোষ বোধ করেনি ও।

আবার তরুণ হয়ে গেছি! চিৎকার করে বলে উঠল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মশালটা হাতে তুলে নিল আবার।

*

আরও দূরে যাবার আগেই একটা সিপে এসে পৌঁছাল ও যেখানে ফাটল থেকে মিষ্টি পানি চুঁইয়ে বের হয়ে এসে টানেলের দেয়াল বেয়ে নেমে একটা স্বাভাবিক পাথুরে বেসিনে জমা হচ্ছে। দৌড়ানোর সময়ও ফেনের চিন্তা চলছিল ওর মনে। ওকে শেষ বার দেখার পর অনেক মাস কেটে গেছে। শেষবার দেখার পর মেয়েটার চেহারা কতটা বদলে গেছে ভাবল ও। এর আগে ওর সাথে সংক্ষিপ্ত যোগাযোগের সময় মেয়েটার মাঝে এক সাগর পরিবর্তন লক্ষ করেছে ও।

অবশ্যই বদলে গেছে ও, তবে আমার মতো অতটা নয়। এরপর দেখা হলে আমরা একে অন্যকে চমকে দেব। এখন তরুণী হয়ে উঠেছে ও। আমাকে কোন চোখে দেখবে? ওদের সাক্ষাতের কথা ভেবে কেমন যেন ঘোের লেগে যাচ্ছে।

সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সব বোধ হারিয়ে ফেলেছে ও। এখন দিন না রাত জানা নেই, কিন্তু এগিয়ে চলল। অবশেষে এমন একটা জায়গায় হাজির হলো। যেখান থেকে আরেকটা খাড়া সিঁড়ি নেমে গেছে। নিচে নেমে সামনে যাবার পথে একটা ভারি চামড়ার পর্দা আটকানো দেখতে পেল, সেটায় বিভিন্ন প্রতীক ও হরফের নকশা। চট করে মশালটা নিচু করে ওটার আরও সামনে চলে এলো। চামড়ার ফাঁক দিয়ে আলোর নরম একটা রেখা দেখা যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে শুনল ও। ফন্টে নামার আগে যেমন ছিল তারচেয়ে ঢের বেশি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এখন ওর শ্রবণ শক্তি। কিছুই শুনতে পেল না। সাবধানে পর্দার ফোকরটা আরেকটু ফাঁক করে উঁকি দিল। ছোট অথচ চমৎকার আসবাবে সাজানো একটা কামরার দিকে তাকিয়ে আছে ও। জনমানুষের চিহ্ন আছে কিনা চট করে দেখে নিল, কিন্তু কোনও আভা পেল না। পর্দা তুলে ভেতরে পা রাখল ও।

এটা ইয়োসের খাস কামরা। দেয়াল ও ছাদ আইভরি টালিতে ঢাকা, প্রত্যেকটায় চমৎকার সব নকশা আঁকা, মনিমুক্তার রঙে রঙ করা। ফলাফল রীতিমতো মহোনীয়, উজ্জ্বল। ব্রোঞ্জের চেইনে চারটা তেলের কুপি ঝোলানো রয়েছে। ওগুলোর বিচ্ছুরিত আলো কোমল। দূর প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে রেশমী কাপড়ে ঢাকা একটা কাউচ ঠেস দেওয়া, ওটার উপর কুশন; নিচু একটা সেগুন কাঠের টেবিল রয়েছে মেঝের মাঝখানে। ওটার উপর রাখা ফল, মধু, পিঠা ও অন্যান্য মিষ্টির গামলা। সাথে একটা ছোট স্ফটিকের মদের জগ। সোনালি ডলফিনের মতো লাগছে। টেবিলের আরেক পাশে প্যাপিরাসের স্ক্রল ও আকাশমণ্ডলীর মহাজাগতিক মডেল রাখা, অনন্য সোনায় বানানো সূর্য, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রের যাত্রাপথ তুলে ধরেছে। মেঝে কয়েক পাল্লা রেশমী কাপড়ে ঢাকা।

সোজা স্ফটিক টেবিলের কাছে এসে বাটি থেকে এক গোছা আঙুর তুলে নিল ও। ডাইনীর আবাস থেকে যাবার পর আর কিছুই খায়নি ও। অথচ এখন কমবয়সী তরুণের মতো ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। গামলার অর্ধেকটা ফল শেষ করে কাউচের পাশে দ্বিতীয় দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এটাও আরেকটা পরিচ্ছন্ন নকশার পর্দায় আড়াল করা। যেটা দিয়ে কামরায় ঢুকেছিল সেটারই অনুলিপি। ওটার পাশে কান পাতল ও, কিছুই শুনতে পেল না। পর্দার আড়াল ভেদ করে এবার অপেক্ষাকৃত। ছোট একটা কামরায় পা রাখল ও। এখানে দূরের দেয়ালের কাছে একটা টুল রাখা, দেয়ালের গায়ে একটা পিপহোল। ওটার কাছে গিয়ে ফোকর দিয়ে উঁকি দিল।

দেখতে পেল অলিগার্কদের সুপ্রিম কাউন্সিল চেম্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা একটা স্পাই হোল, পাহাড় থেকে এখানে কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব ও নির্দেশনার জন্যে এলে এটা দিয়ে গোয়েন্দাগিরি করত সে। এই চেম্বারেই আকের, এক-তাঙ ও কায়থরের সাথে দেখা করেছিল তাইতা। এখন ওটা পরিত্যক্ত, আধোঅন্ধকার। পেছনের উঁচু জানালা রাতের আকাশের একটা চৌকো ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সেরাস নক্ষত্রপুঞ্জের একটা অংশ ধারণ করেছে ওটা। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। প্রাসাদ নীরব। ইয়োসের খাস কামরায় ফিরে বাকি ফলগুলো খেয়ে নিল। তারপর কাউচে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, ঘুমে থাকার সময়ে নিজেকে বাঁচাতে চারপাশে আড়ালের একটা পর্দা তৈরি করে নিল, তারপর চোখ বন্ধ করতেই ঢলে পড়ল ঘুমে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *