উটচালকরা চলার গতি বাড়ালেও এখনও অধৈর্য হয়ে রয়েছে তাইতা। পরের রাতে আবার কাফেলা ছেড়ে সামনে চলে গেল ও, আশা করছে ডেল্টার ঢালে পৌঁছে বহু বছরের অনুপস্থিতির পর আবার প্রাণপ্রিয় মিশরের দিকে এক নজর তাকাবে। ওর আগ্রহ যেন সংক্রামক, কারণ দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে উইন্ডস্মোকও, ওটার ছুটন্ত খুর এক সময় শেষ দূরত্বটুকুও পার হয়ে এলো। ঢালের কিনারায় এসে লাগাম টানল তাইতা। নিচে চাঁদের আলো রূপালি অলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে কৃষি জমিন, স্পষ্ট করে তুলেছে নীলের সীমানায় দাঁড়ানো পামগাছগুলো। রূপালি জলের ক্ষীণতম ঝিলিকের খোঁজে চোখ চালাল ও। কিন্তু এই দূরত্বে নদীর তলদেশ অন্ধকার, গম্ভীর।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মেয়ারের নাকের কাছে এসে দাঁড়াল তাইতা, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ চোখে শহর, চাঁদের মতো শাদা মন্দির প্রাচীর, কারনাকের প্রাসাদগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওপারে মেমননের প্রাসাদের আকাশছোঁয়া দেয়াল খুঁজে বের করলেও ঢাল বেয়ে নেমে পলিমাটির সমতল পার হয়ে থেবসের শত শত তোরণের যেকোনও একটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন ঠেকাল।
দিমিতারের খুব কাছে থাকা ওর দায়িত্ব, ওকে ফেলে সামনে ছুটে যাওয়া নয়। মেয়ারের মাথার কাছে গোড়ালির উপর বসল ও। তারপর ঘরে ফেরা ও প্রাণের প্রিয় সবার সাথে পুনর্মিলনের দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল।
ফারাও ও রানি মিনতাকা ওকে খুবই সমাদর করেন, সাধারণত রাজ পরিবারের উধ্বর্তন সদস্যদের জন্যেই এমনি সমাদর তোলা থাকে। বিনিময়ে ওদের দুজনের জন্যেই অনুগত ভালোবাসা লালন করে ও। ছেলেবেলা থেকেই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা। নেফারের বাবা ফারাও তামোজ নেফার খুব ছোট থাকতে খুন হন, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার পক্ষে খুবই ছোট ছিলেন তিনি; তাই একজন রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তামোজের শিক্ষক ছিল তাইতা, সুতরাং তার সন্তানকে সাবালকত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত ওর হাতে তুলে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ওর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটি দেখেছে তাইতা, ওকে ঘোরসওয়ার আর যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারপর যুদ্ধ পরিচালনা ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার কৌশল শিখিয়েছে। রাজকীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও কূটনীতি শিখিয়েছে। পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে। অনেক বছরের পরিক্রমায় ওদের দুজনের মাঝে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, অবিচ্ছেদ্য রয়ে গেছে সেটা।
ঢাল বেয়ে হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ধেয়ে এলো। ওর শরীর শিউরে তোলার মতো যথেষ্ট শীতল। এই উত্তপ্ত মৌসুমে অস্বাভাবিক। নিমেষে সতর্ক হয়ে গেল ও। অনেক সময় তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস অতিলৌকিক প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে কাজ করে। দিমিতারের সতর্কবাণী এখনও ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলছে।
অটল বসে থেকে ইথারে অনুসন্ধান চালাল ও। খারাপ কিছুর আলামত পেল না। এবার উইন্ডস্মোকের দিকে মনোযোগ দিল ও। প্রাণীটা ওর মতোই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে দারুণ স্পর্শকাতর। কিন্তু ওটাকে যেন শান্ত ও স্থির দেখাল। সম্ভষ্ট হয়ে ফের উঠে দাঁড়াল ও, মেয়ারের পিঠে উঠতে লাগাম হাতে তুলে নিল। কাফেলার কাছে ফিরে যাবে। এতক্ষণে মেরেন হয়তো রাতের মতো যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিয়েছে; তাঁবু খাটাচ্ছে। ঘুম ওকে দখল করে নেওয়ার আগেই দিমিতারের সাথে আরও খানিকক্ষণ আলাপ করতে চায়। এখনও বুড়ো মানুষটার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ আদায় করতে পারেনি।
ঠিক এই সময় মৃদু স্বরে ডেকে উঠল উইন্ডস্মোক, কানজোড়া খাড়া করে ফেলল; তবে তেমন সিরিয়াসভাবে সতর্ক মনে হলো না। ওটাকে ঢাল বরাবর নিচের দিকে তাকাতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। প্রথমে কিছুই দেখতে না পেলেও মেয়ারের উপর আস্থা থাকায় রাতের নীরবতায় কান পেতে রইল। অবশেষে ঢালের পাদদেশে একটা ছায়াটে নড়াচড়া ধরা পড়ল। নিমেষে উধাও হয়ে গেল সেটা। তাইতা ভাবল কোথাও ভুল হয়েছে ওর, কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দিল না। অপেক্ষা করল, তাকিয়ে আছে সতর্ক চোখে। এবার আবার নড়াচড়াটা চোখে পড়ল। আরও অনেক কাছে, অনেক স্পষ্ট।
অন্ধকারে ফুটে উঠল আরেক অশ্বারোহীর আবছা ছায়া। ঢাল অনুসরণ করে ওর অবস্থানের দিকে উঠে আসছে। অচেনা ঘোড়াটা ধূসর হলেও উইন্ডস্মোকের তুলনায় ফ্যাকাশে। তরঙ্গ উঠল ওর স্মৃতিতে, ভালো ঘোড়ার কথা কখনও ভোলে না ও। ওটাকে কবে, কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি অনেক দূরবর্তী হওয়ায় ধরে নিল নিশ্চয়ই অনেক আগের ব্যাপার হবে। অথচ ধূসর ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে মাত্র বছর চারেক হবে ওটার বয়স। চট করে ওটার পিঠে আসীন সওয়ারির দিকে মনোযোগ দিল ও-আবছা একটা অবয়ব, পুরুষ নয়, বরং কিশোরই হবে হয়তো। সে যেই হোক, ঘোড়ার পিঠে সহজ সজীব ভঙ্গিতে বসেছে। ছেলেটার হাবভাবে পরিচিত একটা ভাব আছে, তবে ওর বাহনের মতোই তারও বয়সও তাইতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পক্ষে বেশ কম। এমন কি হতে পারে এই ছেলেটি ওর পরিচিত কারও সন্তান? মিশরের কোনও রাজকুমার? বিভ্রান্ত্র বোধ করল ও।
রানি মিনতাকা ফারাও নেফার সেতিকে অনেক কটি অসাধারণ ছেলে উপহার দিয়েছেন। সবার সাথেই বাবা বা মায়ের চেহারার ভালো মিল রয়েছে। এই ছেলেটার মাঝে মামুলি কোনও ব্যাপার নেই। ওর শরীরে রাজকীয় রক্ত বয়ে যাবার ব্যাপারে তাইতার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। আরও কাছে এলো ঘোড়া ও সওয়ারি। এবার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তাইতার। লক্ষ করল, সওয়ারি একটা খাট চিতন পরে আছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তার পাজোড়া। সরু, সন্দেহাতীতভাবে নারীসুলভ পা। ওটা একটা মেয়ে। ওর মাথা আড়াল করা। কিন্তু মেয়েটা কাছে আসার পর শালের নিচে ওর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারল।
ওকে আমি চিনি। ভালো করে চিনি! আপনমনে ফিসফিস করে বলল ও। কানের কাছে নাড়ীর গতি দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত উঁচু করল মেয়েটা, তারপর সামনে কোমর বাড়িয়ে আগে বাড়ার তাগিদ দিল ঘোড়াকে। দুলকি চালে এগোতে শুরু করল ওটা। কিন্তু পাথুরে পথে এতটুকু আওয়াজ করছে না ওটার খুর। অলৌকিক নীরবতায় ঢাল বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওটা।
দেরি হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে তাইতা, পরিচিত চেহারায় ওকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দ্রুত চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খোলার প্রয়াস পেল ও।
কোনও আভা বিলোচ্ছে না! ঢোক গিলল ও। মেয়ারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ধূসর ঘোড়া বা ওটার সওয়ারির কেউই স্বাভাবিক প্রাণী নয়। ভিন্ন মাত্রা থেকে এসেছে ওরা। দিমিতারের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফের অসতর্ক অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে ও। চট করে গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল। মুখের সামনে তুলে ধরল ওটা। লাগাম টানল সওয়ারি, মুখ ঢেকে রাখা শালের ছায়া থেকে জরিপ করতে লাগল ওকে। মেয়েটা এখন এত কাছে যে তার চোখের ঝিলিক, তরুণ গালের কোমল বাঁক দেখতে পাচ্ছে ও। স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মনে।
ধূসর ঘোড়াটার কথা এত পরিষ্কার মনে থাকাটা তেমন বিস্ময়ের কিছু নয়। ও ই উপহার দিয়েছিল। সযত্নে, দরদের সাথে বাছাই করা। ওটার বিনিময়ে পঞ্চাশটি রূপার তালেন্ত দিয়েছিল ও, তখন ভেবেছিল দরাদরিতে জিতেছে। ওটার নাম দিয়েছিল গাল, সব সময়ই ওর প্রিয় পশু ছিল ওটা। জাকের সাথে কায়দা করে ওটার পিঠে সওয়ার হতো ও। অনেক দশক আগের কথাগুলো মনে আছে তাইতার। এত প্রবল ছিল ওর ধাক্কাটা যে স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছিল না ও। স্রেফ গ্রানিট পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঢালের মতো ধরে রেখেছে মাদুলিটা।
ধীরে ফর্শা একটা হাত উঁচু করল ঘোড়সওয়ার, শালের কিনারা সরাল। ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকানোর সময় তাইতার মনে হলো ওর আত্মাটাকে বুঝি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে আছে।
সে নয়। নিজেকে স্থির রাখার প্রয়াস পেল তাইতা। বিরাট সাপটার মতো শূন্য থেকে আসা আরেকটা প্রেতাত্মা, সম্ভবত সমান ভয়ঙ্কর।
স্বপ্নে দেখা সোনালি ডলফিনের পিঠের সেই মেয়েটা সম্পর্কে দিমিতারের সাথে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ ছিল না তার। আপনার স্বপ্ন ডাইনীটার চাতুরী ছাড়া আর কিছুই না, ওকে সতর্ক করে বলেছিলেন তিনি। আপনার আকাক্ষা ও আশাকে জাগিয়ে তোলা কোনও ইমেজকে বিশ্বাস করতে যাবেন না। যখনই পুরোনো ভালোবাসার মতো কোনও সূখকর স্মৃতিকে আপনার মনে জাগতে দিচ্ছেন, ইয়োসের জন্যে রাস্তা খুলে দিচ্ছে সেটা। আপনার কাছে। পৌঁছাতে এর ভেতর দিয়ে পথ বের নেবে সে।
মাথা নেড়েছিল তাইতা। না, দিমিতা, এমনকি ইয়োসই বা কেমন করে অতদিন আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত জিনিস ফুটিয়ে তুলবে? লস্ত্রিসের কণ্ঠস্বর, ওর চোখের গড়ন, হাসার সময় ওর ঠোঁটের কম্পন। কেমন করে ইয়োস তার অনুকরণ করবে? সত্তর বছর ধরে সমাধিতে আছে লস্ত্রিস। ইয়োস নকল করার মতো এমন কোনও সজীব চিহ্ন নেই ওর।
ইয়োস আপনার স্ক্রিসের স্মৃতি চুরি করেছে। তারপর ওগুলোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আকর্ষণীয় রূপে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এমনকি আমিও তো বেশির ভাগ খুঁটিনাটি জিনিস ভুলে গেছি।
আপনি নিজেই তো বলেছেন, আমরা কিছুই ভুলে যাই না। সবই রয়ে যায়। আপনার মন থেকে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনতে কেবল অতিলৌকিক দক্ষতার প্রয়োজন, ইয়োসের তা আছে। যেমন করে আপনি আমার মনের ভেতর থেকে ইয়োসের স্মৃতি, ওর কণ্ঠস্বর বের করে এনেছেন, যখন সে অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিল।
ওটা লস্ত্রিস ছিল না, আমি মেনে নিতে পারব না, মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠেছিল তাইতা।
তার কারণ আপনি মানতে চান না। ইয়োস আপনার যুক্তিবোধ অন্ধ করে দিতে চাইছে। একটু ভেবে দেখুন, ডলফিনের পিঠে মেয়েটার ইমেজ কীভাবে তার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হয়েছিল। সে যখন আপনাকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কুহকী দৃশ্য দেখিয়ে বিক্ষিপ্ত ও প্রলুব্ধ করছিল ঠিক তখন আমাকে শেষ করে দিতে সাপটাকে পাঠিয়েছিল। আপনার স্বপ্নকে বিক্ষিপ্ত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।
এখন ডেল্টার ঢালে ফের সেই একই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে তাইতা: লস্ত্রিসের ইমেজ, মিশরের এককালের রানি, যার স্মৃতি আজও ওর হৃদয় দখল করে আছে। এইবার ওকে আরও বেশি নিখুঁত মনে হচ্ছে। টের পেল ওর স্থিরতা ও যুক্তিবোধ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেল। কিন্তু লক্ট্রিসের চোখের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ওখানে আমোদিত আলো ঝলমল করছে। ওগুলোর গভীরতায় সারা জীবনের সকল আনন্দ বেদনার অশ্রু।
তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি! যতটা সম্ভব শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বলল তাইতা। তুমি লস্ত্রিস নও। আমার ভালোবাসার নারীটি তুমি নও। তুমি আসলে মহামিথ্যা। যেই অন্ধকার থেকে এসেছ সেই অন্ধকারে আবার ফিরে যাও।
ওর কথায় লস্ত্রিসের চোখের কমনীয় ঝিলিক বদলে গিয়ে সেখানে অসীম বিষাদ এসে ভর করল। প্রিয় তাইতা, মৃদু কণ্ঠে ওকে ডাকল সে। আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে তোমাকে ছাড়াই বন্ধ্যা ও নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। এখন তোমার এমন এক লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিপদের মুহূর্তে আবার তোমার সাথে এক হতে ফিরে এসেছি। আমরা একসাথে তোমার উপর নেমে আসা অশুভকে ঠেকাতে পারব।
তুমি ধর্মের অপমান করছ, বলল তাইতা। তুমি ইয়োস, মিথ্যা। তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। সত্য আমাকে রক্ষা করছে। আমার কাছে আসতে পারবে না তুমি। আমার ক্ষতি করতে পারবে না।
ওহ, তাইতা, ফিসফিস করে বলে উঠল লস্ত্রিস। আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে তুমি। আমি নিজেও বিপদে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময়ের সূচনা থেকে মানুষের সকল বিষাদ এসে ভর করেছে ওর উপর। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাদের দুজনের স্বার্থেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তোমার ভালোবাসার সেই লস্ত্রিস ছাড়া অন্য কেউ নই-তোমাকে যে ভালোবেসেছিল। ইথারের ভেতর দিয়ে আমাকে আহ্বান করেছ তুমি। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছি আমি।
পায়ের নিচে পৃথিবীর ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠা টের পেল তাইতা। কিন্তু নিজেকে স্থির করল ও। দূর হও, অভিশপ্ত ডাইনী! চিৎকার করে উঠল ও। ভাগো, মিথ্যার দুষ্ট দাস। তোমাকে ও তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।
না, তাইতা! এমন করতে পারো না তুমি, আবেদন জানাল লস্ত্রিস। আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না তুমি।
তুমি অশুভ, কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিভীষিকা। নিজের জঘন্য আস্তানায় ফিরে যাও।
গুঙিয়ে উঠল লস্ত্রিস, মিলিয়ে যেতে শুরু করল ওর ইমেজ। দিনের আলোয় যেভাবে প্রায়ই ওর তারাটি মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবে মিলিয়ে গেল লস্ত্রিসের ছায়া। রাতের আঁধার থেকে ওর শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: একবার মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছি আমি, এবার আমাকে পুরোটা হজম করতে হবে। বিদায়, তাইতা। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে যদি।
পরক্ষণেই হারিয়ে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাইতা, মাথার উপর দিয়ে ভেঙে পড়া অনুতাপ আর বিষাদের ঢেউ বয়ে যেতে দিল। আবার যখন মাথা তোলার মতো শক্তি ফিরে পেল, তখন সূর্য উঠেছে। এরই মধ্যে দিগন্তের হাত খানেক উপরে উঠে এসেছে ওটা। শান্তভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক। ঝিমোচ্ছে। কিন্তু খোঁচা দিতেই মাথা ওঠাল ওটা, ফিরে তাকাল ওর দিকে। এত খাট হয়ে গেছে ও যে ওটার পিঠে উঠতে একটা পাথরের সাহায্য নিতে হলো। পিঠে বসে দুলতে লাগল ও। ঢালের পথের দিকে এগোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।
মাথা ভরে রাখা আবেগের জগাখিচুরির জঙ্গল গোছানোর প্রয়াস পেল তাইতা। ওর বিভ্রান্তি থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে এলো: ভূতুড়ে লস্ত্রিসের সাথে ওর সাক্ষতের সময় উইন্ডস্মোকের শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, এতটুকু অস্থির হয়নি ওটা। অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বোঝার বেশ আগেই অশুভের প্রকাশের ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠেছে। চাঁদ গ্রস্ত হওয়ার সময় ছুটে গিয়েছিল, অথচ লস্ত্রিসের ছায়ামূর্তি ও ওর ভূতুড়ে সত্তার প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে।
ওসবের ভেতর অশুভ থাকতে পারে না, নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল ও। লস্ত্রিস সত্যি কথা বলেছিল? আমাকে রক্ষা করতেই কি বন্ধু ও মিত্র হিসাবে এসেছিল ও? আমি কি আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করে দিলাম? এক অসহনীয় ব্যথা এটা। উইন্ডস্মোকের মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্ণ গতিতে ডেল্টার দিকে ছোটাল। কেবল ঢালের কিনারা থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরেই সামলাল নিজেকে। লস্ত্রিস যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক সেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।
লস্ত্রিস! আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকল ও। আমাকে ক্ষমা করো! ভুল করেছি! এখন জানি তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি সত্যিই লস্ত্রিস। ফিরে এসো, প্রিয়া আমার! ফিরে এসো! কিন্তু লস্ত্রিস চলে গেছে। প্রতিধ্বনি যেন ওকে ভেঙচি কাটছে: ফিরে এসো…এসো..এসো…
*
ওরা পবিত্র থেবস নগরীর অনেক কাছে এসে পড়ায় সূর্য ওঠার পরেও রাতের যাত্রা চালিয়ে যেতে মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। ভোরের তীর্যক আলোক রশ্মিতে আলোকিত ক্ষুদে কাফেলা ঢাল থেকে নেমে সমতল পলিমাটির জমিনের উপর দিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে এগোল। কালো মাটি শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে, রোদের কড়া আঁচে ফেটে চৌচির। কৃষকরা আক্রান্ত জমিন ছেড়ে চলে গেছে, বেহাল দশা হয়েছে ওদের কুঁড়েগুলোর। কড়িকাঠ থেকে থোকায় থোকায় খসে পড়ছে তালপাতার ছাউনী। জমিনের এখানে ওখানে শাদা ডেইজি ফুলের মতো পড়ে আছে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো কাইনের হাড়গোড়। ঘূর্ণী হওয়ার একটা ঝাপ্টা বয়ে যাবার পথে বিরান জমিনের উপর নাচতে নাচতে ধূলি ও শুকনো ধুরা পাতার একটা স্তম্ভ ছুঁড়ে দিল মেঘহীন আকাশের দিকে। বন্ধ্যা জমিনের উপর যুদ্ধ কুঠারের আঘাতের মতো আঘাত হেনে চলেছে সূর্য।
বিরূপ ল্যান্ডস্কেপে কাফেলার মানুষ আর পশুগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার মতোই গুরুত্বহীন। নদীর কাছে পৌঁছে নিজেদের অজান্তেই তীরে থমকে দাঁড়াল ওরা। ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হলো। এমনকি দিমিতারও নেমে পড়েছেন পালকি থেকে। তাইতা ও মেরেনের সাথে যোগ দিতে কোনওমতে আগে বাড়লেন তিনি। নদীটা এখানে মাত্র চারশো গজ চওড়া। স্বাভাবিক ভাটার মৌসুমেও মহানদী নীলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধূসর পলিমাটি ভরা পানিতে ভরপুর থাকে, এত গভীর ও শক্তিশালী যে জলের উপরিতল ঝলমলে ফেনায় ভরে থাকে, অসংখ্য ঘূর্ণীর গহ্বর চোখে পড়ে। বানের মৌসুমে নীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তীর উপচে উঠে এসে জমিন ভাসিয়ে দেয়। এর জলের সাথে ভেসে আসা সমৃদ্ধ কাদা ও পলিমাটি এক মৌসুমেই তিনটা ফসল ধরে রাখতে পারে।
কিন্তু আজ সাত বছর ধরে বানের দেখা নেই। এখন নদীটা অতীত শক্তিশালী সত্তার একটা ভূতুড়ে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণ পুঁতিগন্ধময় নালায় পর্যবসিত হয়েছে ওটা, তলদেশ বরাবর ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে। কেবল মৃত্যুমুখী মাছ ও অল্প কয়েকটা জীবিত কুমীরের কষ্টকর নড়াচড়ার কারণে সেই জলে কিঞ্চিত তরঙ্গ উঠছে। জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল ফেনাময় আবর্জনা ঢেকে রেখেছে জলের উপরিভাগ।
নদীর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কেন? জানতে চাইল মেরেন। এটা একটা অভিশাপ!
আমার মনে হয় বিষাক্ত শ্যাওলার জন্যেই এমন হয়েছে, বলল তাইতা, সায় দিলেন দিমিতার।
শ্যাওলাই বটে, তবে এটা যে অস্বাভাবিক তাতে আমার একটুকু সন্দেহ নেই, জলের ধারা থমকে দেওয়া একই অশুভ প্রভাবের কারণেই আবির্ভূত।
কলো কাদার চরে রক্ত-রঙ পুকুরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। নগরের বজ্য ও আটকে পড়া আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলো। আছে শেকড়বাকড়, ভেসে আসা কাঠ, পরিত্যক্ত ফেরি নৌকার ধ্বংসাবশেষ, পাখি ও পশুর ফুলে ওঠা মৃতদেহ। উন্মুক্ত বালিচরে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র জীবিত প্রাণীগুলো হচ্ছে অদ্ভুত দর্শন বেঁটে কিছু জানোয়ার, মরদেহের দখল পেতে ভৌতিক জোড়া লাগানো পায়ে আনাড়ী ভঙ্গিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। টেনে পচা মাংসের চাক ছিঁড়ছে, তারপর গিলে নিচ্ছে। গভীর বিতৃষ্ণায় বিড়বিড় করে উঠল মেরেন, কাফেলার সর্দার যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম: দানবীয় কুনো ব্যাঙ! তারপরই কেবল ওগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল তাইতা। গলা খাকারি দিয়ে গলায় জমে ওঠা শ্লেষা ঝাড়ল ও। মিশরের উপর নেমে আসা অশুভ প্রভাবের কি শেষ নেই?
তাইতা বুঝতে পারল উভচরগুলোর আকারই ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। বিশাল আকারের। পিঠের হিসাবে বুনো শুয়োরের মতোই মোটা, পেছন পায়ে ভর দিয়ে সম্পূর্ণ খাড়া হলে রীতিমতো শেয়ালের সমান লম্বা মনে হচ্ছে।
কাদার ভেতর মানুষের লাশ পড়ে আছে, বলে উঠল মেরেন। ওদের ঠিক নিচেই পড়ে থাকা একটা ছোট্ট দেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও। মৃত শিশুও আছে।
মনে হচ্ছে থেবসের নাগরিকরা এতটাই নির্বিকার হয়ে গেছে যে এখন লাশ কবর না দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, বিষাদের সাথে ঘাড় নেড়ে বললেন দিমিতার।
ওরা তাকিয়ে থাকার সময়ই একটা ব্যাঙ বাচ্চাটার হাত কামড়ে ধরে দশ বার বার ঝাঁকি দিয়ে কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ছোট্ট বাহুটা। নেমে আসতেই মুখ হাঁ করে গিলে নিল টুপ করে।
দৃশ্যটা দেখে সবাই অসুস্থ বোধ করল। ফের ঘোড়ায় চেপে তীর বরাবর এগিয়ে নগরের বহিপ্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বাইরের এলাকা ভূমিহীন কৃষক, বিধবা ও এতিম, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও বিপর্যয়ের অন্য সব শিকারের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরা। পাতার তৈরি খোলা চালার নিচে জড়োসড়ো অবস্থায় রয়েছে ওরা। সবাই বিশীর্ণ ও করুণ চেহারার। এক তরুণী মাকে দেখল তাইতা, কোলের বাচ্চাটার মুখে শূন্য বুক ছুঁইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাচ্চাটা এতই দুর্বল, চুষতে পারছে না। ওর চোখেমুখে মাছি ঢুকে পড়ছে। ওদের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে মা।
ওর বাচ্চার জন্যে ওকে খাবার দিয়ে আসি, বলে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামতে গেল মেরেন। কিন্তু ওকে বাধা দিলেন দিমিতার।
এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে এখন খাবার দেখালেই রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যাবে।
আবার আগে বাড়ার সময় বিষণ্ণ, অপরাধী চেহারায় পেছনে তাকাতে লাগল মেরেন।
দিমিতার ঠিকই বলেছেন, মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। এত অসংখ্য ক্ষুধার্তের অল্প কয়েকজনকে বাঁচাতে পারব না আমরা। বাঁচাতে হবে মিশরকে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক নয়।
হতভাগাদের কাছ থেকে বেশ দূরে শিবির ফেলার জায়গা বেছে নিল তাইতা ও মেরেন। দিমিতারের ফোরম্যানকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমার গুরু যেন আরামে থাকে সেটা খেয়াল করো, ওকে ভালো করে পাহারা দেবে। তারপর চোর-ডাকাত ঠেকাতে শুকনো কাঁটাঝোঁপের বেড়া বানাবে। পশুগুলোর জল আর খাবারের যোগাড় করো। আরও জুৎসই থাকার ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।
মেরেনের দিকে ফিরল ও। শহরে ফারাওয়ের প্রসাদে যাচ্ছি আমি। দিমিতারের সাথে থাক। জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেয়ারের পেটে লাথি মারল ও। মূল তোরণের দিকে রওয়ানা দিল। ও এগিয়ে যাওয়ার সময় টাওয়ার থেকে তাকিয়ে রইল প্রহরীরা, তবে চ্যালেঞ্জ করল না। পথঘাট বলতে গেলে বিরান। অল্প যে কজনকে চোখে পড়ছে তারাও দেয়ালের ওপাশের ভিখিরিদের মতোই ফ্যাকাশে, ক্ষুধার্ত। ওকে আসতে দেখেই সটকে পড়ছে। শহরের মাথার উপর যেন অসুস্থ একটা গন্ধ ঝুলে আছে, মৃত্যু ও কষ্টের গন্ধ।
প্রাসাদ প্রহরীদের সর্দার চিনতে পারল ওকে। তোরণ খুলে দিতে ছুটে এলো সে। ও ভেতের ঢুকতেই সমীহের সাথে সালাম ঠুকল।
আমার লোক ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে যাবে, ম্যাগাস। রাজকীয় সহিসরা ওটার দেখভাল করবে।
ফারাও বাড়িতে আছেন? ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় জানতে চাইল তাইতা।
জ্বি, আছেন।
ওর কাছে নিয়ে চলো আমাকে, নির্দেশ দিল তাইতা। দ্রুত হুকুম তামিল করল প্রহরী। প্যাসেজ ও হলওয়ের গোলকধাঁধা ধরে এগিয়ে চলল ওকে নিয়ে। উঠোনের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা, এককালে আঙ্গিনা, ফুলের কেয়ারি আর নির্মল জলের ফোয়ারার সমাহারে অসাধারণ ছিল জায়গাটা। তারপর হল ও ক্লয়েস্টারের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল, এক সময় অভিজাত নারীদের হাসিঠাট্টা, গান, ট্রাম্বলার, এবোলদার আর দাসীনর্তকীদের গানে মুখরিত থাকত। কামরাগুলো খাখা করছে এখন। বাগান বাদামী হয়ে মরে গেছে। ফোয়ারা শুকিয়ে কাঠ। চেপে বসা নীরবতা কেবল পাথুরে পথের উপর ওদের পায়ের আওয়াজে ছিন্ন হচ্ছে।
অবশেষে রাজকীয় দরবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে পৌঁছাল ওরা। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা বন্ধ দরজা। বর্শার গোড়া দিয়ে ওটায় টোকা দিল প্রহরী। প্রায় নিমেষে একজন দাস খুলে ধরল ওটা। ওর পেছনে তাকাল তাইতা। গোলাপি মাৰ্বল পাথরের মেঝেয় একটা ছোট ডেস্কের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে স্থূলদেহী এক খোঁজা। টেবিলে স্কুল আর পাথরের ফলকের স্তূপ। এক মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল তাইতা। ফারাওর প্রবীন চেম্বারলেইন, তাইতার সুপারিশেই এমন উচ্চ পদে নিয়োগ পেয়েছিল সে।
রামরাম, পুরোনো বন্ধু আমার, ওকে শুভেচ্ছা জানাল তাইতা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রামরাম, এমন বিশালদেহী লোকের পক্ষে বিস্ময়কর ক্ষিপ্র তার চলাফেরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলো। ফারাওর সেবায় নিয়োজিত খোঁজারা এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
তাইতা, অনেক দিন থেবসের বাইরে ছিলে তুমি, তাইতাকে ব্যক্তিগত এটা ব্যুরোতে নিয়ে এলো সে। সেনাপতিদের সাথে সভায় বসেছেন ফারাও, তাই ওকে এখন বিরক্ত করতে পারছি না। তিনি অবসর পাওয়ামাত্রই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তিনি তাই চাইবেন। এতে অবশ্য কথা বলার একটা সুযোগ মিলে গেছে। কতদিন হলো দূরে আছো তুমি? অনেক বছর নিশ্চয়ই।
সাত বছর। শেষবার আমাদের দেখা হওয়ার পর বহু অজানা দেশ ঘুরেছি আমি।
তাহলে তো তোমার অবর্তমানে আমাদের উপর নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে তোমাকে জানানো দরকার। দুঃখের কথা, ভালো সংবাদ তেমন একটা নেই।
একটা কুশনে মুখোমুখি বসল ওরা। চেম্বারলেইনের ইশারায় এক দাস মাটির কলসীতে ঠাণ্ডা করা শরবত পরিবেশন করল ওদের।
আগে বলো, মহামান্য আছেন কেমন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তাইতা।
আমার ভয় হচ্ছে, ওকে দেখে খারাপ লাগবে তোমার। নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি। বেশিরভাগ দিন মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আর নোম গভর্নরের সাথে সভা করে কাটাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাচ্ছেন। নদীর লাল আবর্জনা দূর করতে নতুন করে কুয়ো খননের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামরাম, শরবতের বাটিতে লম্বা একটা চুমুক দিল সে।
মেদিয় ও সুমেরিয়রা, সাগরবাসী, লিবিয় ও অন্য শক্ররা আমাদের দুর্দশার কথা জানে, খেই ধরল সে। ওদের বিশ্বাস আমাদের সুসময় ফুরোতে চলেছে। তাই নিজেদের সেনাদলকে তৈরি করছে ওরা। তুমি তো জানো, আমাদের করদ রাজ্য ও আশ্রিত দেশগুলো বরাবরই ফারাওকে মেটাতে বাধ্য হওয়া দক্ষিণার ব্যাপারে বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। অনেকেই আমাদের এই দুর্ভাগ্যকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ মনে করছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্যে মৈত্রী গড়ে তুলছে তারা। আমাদের সীমান্তে বহু শত্রু সমাবেশ ঘটিয়েছে। আমাদের সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ফারাওকে অবশ্যই নিজ বাহিনী শক্তিশালী করে তুলতে রসদ আর মানুষ যোগাড় করতে হবে। নিজেকে যারপরনাই কষ্ট দিচ্ছেন তিনি, তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।
ছোটখাট অন্য কোনও রাজা হলে এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন না, বলল তাইতা।
নেফার সেতি মহান রাজা। কিন্তু আমাদের সবার মতো তিনিও অন্তর থেকে জানেন দেবতারা এখন আর মিশরের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। যতক্ষণ ঐশী আশীর্বাদ ফিরে না পাচ্ছেন ততক্ষণ তার কোনও প্রয়াসই সাফল্যের মুখ দেখবে না। দেশের সমস্ত মন্দিরের পুরোহিত সমাজকে অবিরাম প্রার্থনা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিজে দিনে তিন বার বলী দিচ্ছেন। নিজের শক্তিকে শেষ সীমায় টেনে নিয়ে গেলেও রোজ অর্ধেক রাত জেগে থাকছেন। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সতীর্থ দেবতাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রার্থনা করার পেছনে সেই সময় পার করছেন।
জলে ভরে উঠল চেম্বারলেইনের চোখ। লিনেনের কোণ দিয়ে মুছল সে। আমাদের উপর নেমে আসা নদী মাতার পতন আর নানা প্লেগে আক্রান্ত গত সাত বছর এভাবেই কাটছে তার জীবন। সাধারণ কোনও রাজা হলে ধ্বংস হয়ে যেতেন। নেফার সেতি একজন দেবতা, কিন্তু তার হৃদয় ও আবেগ মানুষের মতো। ফলে তিনি বদলে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন।
এ খবর শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বলো তো, রানি ও তাঁর সন্তানরা কেমন আছেন?
এখানেও খবর তেমন সুবিধার নয়। প্লেগ ওদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। রানি মিনতাকা অসুস্থ হয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ প্রায় মরণোন্মুখ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এখন সেরে উঠেছেন অবশ্য। তবে অনেক দুর্বল। রাজকীয় সন্তানদের সবার এমন সৌভাগ্য হয়নি। রাজকুমার খাবা ও তাঁর ছোট বোন উনাস রাজকীয় স্মৃতিসৌধে এখন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। প্লেগ ওদের কেড়ে নিয়েছে। অন্য সন্তানরা বেঁচে গেলেও-
একজন দাস নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঢুকতেই থেমে গেল রামরাম। চেম্বারলেইনের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল সে। মাথা দোলাল রামরাম, ইশারায় বিদায় করে দিল তাকে। তারপর ফের তাইতার দিকে ফিরল। গোপন সভা শেষ হয়েছে। ফারাওর কাছে তোমার আগমনসংবাদ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর পা টেনে টেনে কামরার পেছন দিকে চলে গেল। ওখানে একটা প্যানেলে খোদাই করা একটা অবয়ব স্পর্শ করল সে। ওর আঙুলের স্পর্শে ঘুরে গেল ওটা। দেয়ালের একটা অংশ সম্পূর্ণ সরে গেল। খোলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল রামরাম। তার অল্পক্ষণ পরেই গোপন দরজার ওপাশের করিডর থেকে বিস্ময় ও খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল দ্রুত পায়ের আওয়াজ। এরপর চিৎকার: তাতা, কোথায় তুমি? ওকে দেওয়া ফারাওর ডাক নাম এটা।
জাঁহাপনা, আমি এখানে।
অনেক দিন আমাকে উপেক্ষা করেছ তুমি, দরজা গলে বের হয়ে আসার সময় ওকে অভিযুক্ত করলেন ফারাও, তাইতার দিকে তাকাতে থমকে দাঁড়ালেন। সত্যিই তো তুমি। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আগের সমনের মতো এবারও অগ্রাহ্য করে যাবে।
হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের একটা লিনেনের স্কার্টের সাথে স্রেফ একজোড়া উন্মুক্ত স্যান্ডেল পরেছেন নেফার সেতি। উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। চওড়া পুরু বুকের ছাতি, পেটটা স্থূলকায়, পেশি খেলা করছে। তীর আর তলোয়ারে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দুটি হাত খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো। নিখুঁত করে তোলা যোদ্ধার তাঁর গোটা ধড়।
ফারাও, আপনাকে অভিবাদন। আমি আপনার একজন তুচ্ছ দাস, সব সময়ই যা ছিলাম।
সামনে এসে ওকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন নেফার সেতি। গুরু শিষ্য যখন একসাথে হয় তখন এসব দাস-দাসত্বের কথা চলবে না, ঘোষণা দিলেন তিনি। তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। ওকে মুখের সামনে ধরলেন তিনি। চেহারা জরিপ করলেন। হোরাসের করুণায় তোমার একদিনও বয়স বাড়েনি।
আপনারও না, জাঁহাপনা। আন্তরিক স্বরে বলল তাইতা। হেসে উঠলেন নেফার সেতি।
কথাটা মিথ্যা হলেও পুরোনো বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া হিসাবে এই তোষামোদ মেনে নিচ্ছি। নেফার সেতি আনুষ্ঠানিক ঘোড়ার পশমের পরচুলা খুলে রেখেছেন, গায়ে রঙের প্রলেপ না থাকায় তাঁর বৈশিষ্ট জরিপ করতে পারছে তাইতা। নেফারের ছোট করে ছাটা চুল খাড়া হয়ে আছে, মাথার চাঁদি ন্যাড়া। সময়ের আঁচড় পড়েছে চোখেমুখে। মুখের কোণে গাঢ় রেখা দেখা দিয়েছে। গাঢ় চোখের চারপাশে বলী রেখার জাল। গায়ের ত্বকে অস্বাস্থ্যকর আভা। চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল ফারাওর আভা জোরালভাবে জ্বলছে, সাহসী হৃদয় ও অদম্য প্রাণশক্তিরই প্রতীক।
কত বয়স হলো তাঁর? মনে করার চেষ্টা করল তাইতা। বাবা নিহত হওয়ার সময় ওর বয়স ছিল বার, সুতরাং এখন তার বয়স অন্তত পক্ষে উনপঞ্চাশ। উপলব্ধিটুকু টলিয়ে দিল ওকে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই সাধারণ একজন মানুষকে বৃদ্ধ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মারা যায়। রামরাম সত্যি কথাই বলেছে। ফারাও অনেক বদলে গেছেন।
রামরাম তোমার থাকবার ব্যবস্থা করেছে? জানতে চাইলেন ফারাও, তাইতার কাঁধের উপর দিয়ে চেম্বারলেইনের দিকে তাকলেন।
ওকে বিদেশী দূতদের জন্যে তুলে রাখা একটা স্যুট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম আমি, প্রস্তাব রাখল রামরাম।
তাইতাকে কোনওভাবেই বিদেশী বলা যাবে না, ধমকে উঠলেন নেফার। তাইতা বুঝতে পারল তার আগের ভালো মেজাজ এখন তেতে উঠেছে, বেশ সহজেই ক্ষেপে উঠছেন তিনি। আমার খাস কামরার দরজার কাছে প্রহরীদের কামরাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের যেকোনও সময় পরামর্শ ও আলোচনার জন্যে ওকে কাছে পেতে চাই। ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বাবিলনের দূতের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে বিক্রি করা শস্যের দাম তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রামরাম রাষ্ট্রীয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবে তোমাকে। আশা করছি মাঝরাত নাগাদ অবসর পাব। তখন ডেকে পাঠাব তোমাকে। আমার সাথেই রাতের খাবার খেতে হবে তোমাকে, যদিও আমার ধারণা, তোমার সেটা ভালো লাগবে না। আমার নির্দেশে দেশের বাকি লোকজনের মতো দরবারও একই খাবার উপভোগ করছে। গোপন দরজা পথে ফিরে গেলেন নেফার সেতি।
জাঁহাপনা, তাইতার কণ্ঠে তাগিদের সুর। চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালেন নেফার সেতি। হড়বড় করে কথা বলে গেল তাইতা। আমার সাথে একজন মহান জ্ঞানী ম্যাগাস আছেন।
তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নয় নিশ্চয়ই, প্রশ্রয়ের সাথে হাসলেন নেফার সেতি।
ঠিক তাইতা, তার পাশে আমি শিশুর মতো। তিনি আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে সাহায্য ও রক্ষা করতে এসেছেন।
এখন সে কোথায়?
নগর প্রাচীরের বাইরে আছেন এখন। বিপুল বিদ্যা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল। আমার তার কাছাকাছি থাকা দরকার।
রামরাম, প্রাসাদের এই অংশে বিদেশী ম্যাগাসের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করো।
মেরেন ক্যাম্বিসেস এখনও আমার সঙ্গী হিসাবে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিচ্ছে। ওকে হাতের কাছে পেলে অনেক খুশি হবো।
হায় হোরাস, মনে হচ্ছে তোমার সাথে গোটা দুনিয়া ভাগাভাগি করতে হবে আমাকে, হেসে উঠলেন নেফার সেতি। অবশ্য মেরেন সুস্থ আছে শুনে খুশি হলাম, ওকে সঙ্গী হিসাবে পেতে যাচ্ছি। রামরাম ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এবার তবে যেতে হচ্ছে।
ফারাও, আপনার অসীম ধৈর্যের আরেকটা প্রত্যক্ষ নজীর, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগেই বলে উঠল তাইতা।
এখানে এসেছ বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ এর ভেতর আমার কাছ থেকে পঞ্চাশটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছ। তোমার লেগে থাকার ক্ষমতা অসীম। আর কী চাই তোমার?
নদী অতিক্রম করে রানি মিনতাকাকে অভিনন্দন জানানোর অনুমতি।
আমি প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে বৈরী অবস্থানে স্থাপন করব। আমার রানি মেজাজ হারাননি। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে হাসলেন তিনি। ওর কাছে অবশ্যই যাবে তুমি, তবে মাঝরাতের আগেই ফিরে এসো।
*
রাজপ্রাসাদে দিমিতারের থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পরপরই রাজকীয় চিকিৎসকদের দুজনকে ওর চিকিৎসার জন্যে তলব করল তাইতা। তারপর মেরেনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, রাত নামার আগেই ফিরে আসার আশা করছি, ওকে ঠিক মতো পাহারা দিয়ে।
আপনার সাথে যাওয়া উচিত আমার, ম্যাগাস। অভাব ও দুর্ভিক্ষের এমন একটা সময়ে সৎ মানুষও নিজের পরিবারের খাবারের যোগাড় করতে হতাশা থেকে রাহাজানির পথ বেছে নেয়।
রামরাম এক দল পাহারাদার দিয়েছে আমার সাথে।
নীল নদের মতো একটা নদী পেরুনোর জন্যে নৌকায় না উঠে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসাটা অদ্ভুত ঠেকল। উইন্ডস্মোকের পিঠে থেকে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল তাইতা, লক্ষ করল ঘঘালাটে পুকুরের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে। এমনি একটা পথে আগে বাড়ল ওরা। তাইতার মেয়ারের সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হলো একটা রাক্ষুসে কুনো ব্যাঙ।
মেরে ফেল! ধমকে উঠল প্রহরী দলের সর্দার। এক সৈনিক বর্শা বাগিয়ে ধরে রাস্তা ধরে ধেয়ে গেল। কোণঠাসা বুনো শূকরের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ওটা। সৈনিক সামনে ঝুঁকে কম্পিত লাল গলায় বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল। মরণ চিল্কারে বর্শার ফলার উপর চোয়াল চেপে ধরল বিশ্রী জানোয়ারটা, ফলে জানোয়ারটা ওটা না ছাড়া পর্যন্ত ঘোড়ার পিছন পিছন যেতে বাধ্য হলো সৈনিক। অবশেষে অস্ত্র মুক্ত করে নিতে পারল সে। তাইতার পাশে এসে বর্শাটা দেখাল। শক্ত কাঠের উপর ব্যাঙের দাঁতের ছাপ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।
নেকড়ের মতোই বুনো, প্রহরীদের সার্জেন্ট ছিপছিপে প্রবীন যোদ্ধা হাবারি বলল। প্রথম যখন ওদের আবির্ভাব ঘটে, নদী পরিষ্কার করে ওদের ধ্বংস করতে দুই রেজিমেন্ট সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও। তখন শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে ওদের খতম করেছি আমরা। জানালার উপর ওদের লাশ টাল দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মনে হয়েছে বুঝি একটা মারলে তার জায়গায় আরও দুটো বেড়ে উঠছে। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা অর্থহীন কাজে আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি, এখন তিনি হুকুম দিয়েছেন ওদের অবশ্যই নদীর তলদেশেই আটকে রাখতে হবে। অনেক সময় সাঁতার কেটে উঠে আসে ওরা, আমরা ফের আক্রমণ করি। বলে চলল হাবারি। ওদের নিজেস্ব বিশ্রী কায়দায় কিছুটা উপকারে আসে ওরা। নদীতে ছুঁড়ে দেওয়া সব আবর্জনা আর লাশ খেয়ে নেয়। প্লেগের শিকারের জন্যে এখন আর ভালো কবর খোঁড়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না লোকে, তো কুনো ব্যাঙের দলই মুদাফরাসের দায়িত্ব নিয়েছে।
ঘোড়াগুলো অগভীর কর্দমাক্ত পুকুরগুলোর একটায় পড়ল, পশ্চিম তীরের দিকে এগিয়ে চলল তারপর। ওরা প্রাসাদের দৃষ্টিসীমায় আসার সাথে সাথে হাঁ করে তোরণ খুলে গেল, ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো দ্বার রক্ষক।
হে মহান ম্যাগাস, স্বাগতম! তাইতাকে অভিবাদন করল সে। মহারানি থেবসে আপনার আগমনের অপেক্ষা করছেন, আপনাকে আনন্দময় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনাকে বরণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। প্রাসাদ তোরণের দিকে ইঙ্গিত করল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেয়ালের উপর ক্ষুদে ক্ষুদে অবয়ব দেখতে পেল তাইতা। নারী ও শিশু ওরা, ওর উদ্দেশে হাত নাড়ার আগে ওদের ভেতর রানি কোনজন নিশ্চিত হতে পারল না। মেয়ার আগে বাড়াল ও। সামনে লাফ দিল ওটা। খোলা তোরণ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। উঠোনে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে কিশোরীর চঞ্চলা নিয়ে নেমে এলেন মিনতাকা। আগাগোড়াই অ্যাথলিট ছিলেন তিনি, দক্ষ রথ চালক, এবং নিপূণ শিকারী। তাকে এখনও তেমনি সাবলীল দেখতে পেয়ে খুশি হলো তাই। তবে ওকে আলিঙ্গন করতে কাছে আসার পর বুঝতে পারল তিনি কতটা শীর্ণকায় হয়ে গেছেন। বাহুগুলো যেন সরু কাঠির মতো, চেহারা মলিন, ফ্যাকাশে। তিনি হাসলেও গভীর চোখজোড়ায় বিষাদের ছায়া খেলা করছে।
ওহ, তাইতা। তোমাকে ছাড়া যে কীভাবে চলেছে বোঝাতে পারব না, বললেন তিনি। ওর দাড়িতে মুখ লুকোলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাইতা। ওর স্পর্শে তার হাসিখুশি ভাবটুকু মিলিয়ে গেল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা শরীর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনও দিন ফিরবে না, নেফার আর আমি খাবা ও ছোট্ট উনাসের মতো তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।
আপনার দুঃখের কথা শুনেছি। আপনার সাথে আমিও শোকাহত, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।
সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমার মতো আরও অনেক মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে আমার কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই তিক্ত। একটু পেছনে হটে দাঁড়িয়ে হাসার প্রয়াস পেলেন তিনি। কিন্তু জলে ভরে আছে তার চোখজোড়া, ঠোঁট কাঁপছে। এসো। তোমার সাথে অন্য বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ওদের বেশির ভাগকেই চেন তুমি। শুধু সবচেয়ে ছোট দুটি তোমাকে কখনও দেখেনি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।
দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। ছেলেরা সামনের কাতারে, ওদের পেছনে মেয়েরা। বিস্ময় ও সমীহে আড়ষ্ট সবাই। ভাইবোনদের কাছে মহান ম্যাগাসের গল্প শুনে সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি এতটাই নার্ভাস ছিল যে তাইতা ওর দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড়ের উপর ওর মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলল তাইতা। সাথে সাথে সহজ হয়ে গেল সে। কান্না রেখে দুই হাতে তাইতার গলা জড়িয়ে ধরল।
বাচ্চা ও পশু ভোলানোয় তোমার নৈপূণ্যের কথা জানা না থাকলে বিশ্বাস করতাম না, ওর দিকে চেয়ে হাসলেন মিনতাকা। তারপর অন্যদের এক এক এগিয়ে আসতে বললেন।
এত সুন্দর বাচ্চা জীবনে দেখিনি আমি, রানিকে বলল তাইতা। কিন্তু আমি তাতে অবাক হইনি। মা হিসাবে আপনাকে পেয়েছে ওরা।
অবশেষে বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে তাইতার হাত ধরলেন মিনতাকা। খাস কামরায় নিয়ে এলেন ওকে। এখানে একটা ভোলা জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমের পাহাড়সারির দিকে চোখ ফেরালেন। ওকে শরবত ঢেলে দেওয়ার সময় বললেন, আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি, কিন্তু এখন আর পারি না। ওই দৃশ্য আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে শিগগিরই জল ফিরে আসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে।
কে করেছে? অলস কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা। কিন্তু উত্তরে রানি সবজান্তা, হেঁয়ালিমাখা হাসায় কৌতূহল চাগিয়ে উঠল ওর। তারপর কথোপকথন সুখের সময়ের দিকে বাঁক নিল। যখন রানি ছিলেন অল্পবয়সী, সুন্দরী কুমারী বধূ, এই দেশ ছিল সবুজ, সুন্দর। রানির মেজাজ হালকা হয়ে এলো, প্রাণবন্তভাবে কথা বলতে লাগলেন। ওকে শেষ করার সুযোগ দিল তাইতা, জানে, রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীর প্রসঙ্গে ফিরে আসতে দেরি করবেন না তিনি।
সহসা স্মৃতিচারণ থামালেন রানি। তাইতা, আমাদের দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জানো তুমি? অচিরেই এক নতুন দেবী ওদের জায়গা দখল করবেন। তাঁর হাতেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। আবার নীল নদের প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন তিনি, পুরোনো, বিধ্বস্ত দেবতারা যা পারেননি তিনি সেই প্লেগ দূর করবেন।
সমীহের সাথে শুনছে তাই। না, মহামান্যা, এটা আমার জানা ছিল না।
আরে, হ্যাঁ, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। রানির ফ্যাকাশে চেহারা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বয়স কমে এলো যেন। ফের তরুণী হয়ে উঠেছেন তিনি, আশা ও আনন্দে ভরপুর। কিন্তু, তাইতা, কথা আরও আছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ঢঙে থামলেন তিনি, তারপর ফের খেই ধরলেন। দ্রুত কথা বলছেন এখন। আমাদের যা কিছু হারিয়েছে বা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই দেবীর, কিন্তু আমরা তাঁকে পুরোপুরি মেনে নিলেই সেটা সম্ভব হবে। আমাদের মন-প্রাণ তাঁকে সঁপে দিলে, তিনি আমাদের তারুণ্য ফিরিয়ে দেবেন। যারা কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, তাদের আবার সুখী করে তুলতে পারবেন। কিন্তু, ভেবে দেখ, তাইতা-এমনকি মৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আবার তার চোখ জলে ভরে উঠল। উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হওয়ায় কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করেছে, যেন এইমাত্র লম্বা পথ দৌড়ে এসেছেন। আমাকে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন! খাবা আর উনাসের উষ্ণ, জীবন্ত শরীর ফের কোলে নিতে পারব, ওদের ছোট্ট মুখে চুমু খেতে পারব।
এই নতুন আশায় সান্ত্বনার সন্ধান থেকে রানিকে বাঞ্চিত করতে চাইল না তাইতা। এসব ব্যাপার আমাদের বোঝার মতো নয়, এতই বিস্ময়কর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।
হ্যাঁ, ঠিক! পয়গম্বরকে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা। কেবল তখনই উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ থাকতে পারবে না।
কে এই পয়গম্বর?
তাঁর নাম সোয়ে।
কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, মিনতাকা? জানতে চাইল তাইতা।
উত্তেজনায় হাতে তালি দিলেন রানি। ওহ, তাইতা, এটাই আসল কথা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আমার প্রাসাদেই আছেন! প্রাচীন দেবতা অসিরিস, হোরাস ও আইসিসের পুরোহিতদের হাত থেকে তাকে আশ্রয় দিয়েছি আমি। সত্য কথা বলার কারণে ওরা তাঁকে ঘৃণা করে। তাঁকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। রোজ আমাকে ও তার পছন্দসই লোকজনকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন তিনি। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তাইতা, এমনকি তুমিও দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না, তবে তা গোপনে শিখতে হবে। মিশর এখনও অর্থহীন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন। নতুন ধর্ম বিকাশের আগে ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাধারণ লোকজন এখনও এই নতুন দেবীকে মেনে নিতে তৈরি নয়।
চিন্তিতভাবে মাথা দোলাল তাইতা। রানির জন্যে গভীর করুণা বোধ করছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার পর লোকের বাঁচার জন্যে অর্থহীনভাবে হাওয়ায় আঁচড় কাটার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ও বোঝে। নতুন চমৎকার এই দেবীর নাম কী?
অবিশ্বাসীদের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতে পারবে না, এতই পবিত্র তিনি। কেবল যারা তাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে তারাই তার নাম মুখে নিতে পারবে। এমনকি তার নাম বলার আগে আমাকেও সোয়ের কাছে দীক্ষা নিতে হয়েছে।
সোয়ে কখন আপনাকে দীক্ষা দিতে আসবে? তার মুখে এই বিস্ময়কর তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনতে চাই।
না, তাইতা, বলে উঠলেন রানি। তোমাকে বুঝতে হবে, এগুলো তত্ত্ব নয়। সত্যের প্রকাশ। রোজ সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছে আসেন সোয়ে। ওর মতো এমন জ্ঞানী ও পবিত্র পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। রানির উজ্জ্বল অভিব্যাক্তি সত্ত্বেও ফের তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। কথা দাও, তুমি তার কথা শুনতে আসবে।
আমার উপর আস্থা স্থাপন করায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, প্রিয় রানিমাতা। কখন সেটা?
আজ সন্ধ্যায়। সাপারের পর, জানালেন তিনি।
এক মুহূর্ত ভাবল তাই। আপনি বললেন কেবল মনোনীতদেরই দীক্ষা দেয় সে। যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে? তাহলে রাগ হবে আমার।
কখনওই তোমার মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত লোককে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি, মহান ম্যাগাস।
আমি সে ঝুঁকি নিতে যাব না, প্রাণপ্রিয় মিনতাকা। আমার পরিচয় প্রকাশ না করে তার কথা শোনার ব্যবস্থা করা যায় না?
সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। তাঁকে ঠকাতে চাই না, অবশেষে বললেন তিনি।
কোনও রকম ঠকবাজির কথা ভাবছি না আমি। তার সাথে কোথায় দেখা হবে আপনার?
এই মহলেই, তুমি যেখানে বসে আছে, তিনিও ওখানেই বসবেন। ওই কুশনেই।
কেবল আপনারা দুজনই থাকবেন?
না, আমাদের সাথে আরও তিনজন প্রিয় মহিলা থাকবে। আমার মতোই দেবীর ভক্ত ওরা।
সতর্কতার সাথে কামরাও নকশা জরিপ করছিল তাইতা। কিন্তু রানির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ও। এই দেবী কি নিজেকে কখনও মিশরের জনগণের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন? নাকি স্রেফ তার মনোনীত অল্প কয়েকজনের কাছেই তার ধর্ম প্রকাশিত হবে?
নেফার আর আমি মনে প্রাণে তাঁকে বরণ করার পর মিথ্যা দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের মন্দির ধ্বংস করে পুরোহিত সমাজকে ছত্রভঙ্গ করে দেব, তখনই দেবী বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেন। প্লেগের অবসান ঘটাবেন তিনি, তার পরিণতি ভোগান্তি দূর করবেন। নীল নদকে আবার প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেবেন… একটু দ্বিধা করলেন তিনি, তারপর ফের দ্রুত কথা বলতে লাগলেন। …আমার বাচ্চাদের আবার ফিরিয়ে দেবেন।
প্রাণপ্রিয় রানি। সত্যি যদি তাই হতো। যাক, একটা কথা বলুন, নেফার কি এই পরিস্থিতির কথা জানেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নেফার জ্ঞানী, অসাধারণ শাসক। মহান যোদ্ধা। ভালোবাসায় ভরা স্বামী ও পিতা। কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ নন তিনি। কেবল উপযুক্ত সময়েই ওর কাছে সব কথা খুলে বলবেন বলে আমার সাথে একমত হয়েছেন সোয়ে। সেই সময় এখনও হয়নি।
গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল তাইতা। নিজের স্ত্রীর কাছে দাদা-দাদী, বাবা-মা আর বলা বাহুল্য ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের পাইকারী প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে ভালো ধাক্কাই খাবেন নেফার সেতি। এমনকি তাঁকেও ঐশী পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হবে। বেঁচে থাকতে তিনি এমনটি ঘটতে দেবেন না, এটুকু বোঝার মতো তাঁকে চিনি বলেই মনে হয়।
চিন্তাটা এক ভীতিকর সম্ভাবনার স্রোত বইয়ে দিল তাইতার মনে। নেফার সেতি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগি আর পরামর্শকগণ পয়গম্বরকে ঠেকাতে জীবিত না থাকলে এমন এক রানিকে খেলাতে পারবে যিনি বিনা প্রশ্নে, কোনও প্রতিশোধ ছাড়াই সোয়ের সব নির্দেশ পালন করবেন। তিনি কি রাজা, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের বাবার হত্যাকাণ্ডে সায় দেবেন? আপন মনে প্রশ্ন করল তাইতা। উত্তরটা পরিষ্কার: হ্যাঁ, দেবেন। যদি নতুন নামহীন দেবীর হাতে মৃত বাচ্চাদের সাথে তাঁরও আবার বেঁচে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। মরিয়া মানুষ বেপরোয়া পরীক্ষায় মেতে ওঠে। চড়া গলায় ও জানতে চাইল: সোয়েই কি এই মহান দেবীর একমাত্র পয়গম্বর?
সোয়ে ওদের নেতা। তবে তাঁর অনেক নিচের কাতারের শিষ্যরা দুই রাজ্যের সাধারণ জনগণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগমনের পথ সুগম করে তুলছে।
আপনার কথা আমার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার অবস্থানের কথা প্রকাশ না করে তার বয়ান শুনতে দিলে সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সাথে আরেকজন ম্যাগাস থাকবেন। এত জ্ঞানী ও বয়স্ক, আমার পক্ষে যেমনটি কোনওদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আঙুল তুলে প্রতিবাদ না করে রানিকে নীরব থাকার ইঙ্গিত করল ও। কথাটা ঠিক, মিনতাকা। তাঁর নাম দিমিতার। ওই যেনানা জানালার পেছনে আমার সাথে বসে থাকবেন তিনি। একটা জটিল বুনটের পর্দার দিকে ইশারা করল ও, আগের দিনে ওটার পেছন থেকে রানি ও উপপত্নীরা চেহারা না দেখিয়েই বিদেশী গণ্যমান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।
তবু ইতস্তত করতে লাগলেন মিনতাকা, কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল তাইতা। দুজন প্রভাবশালী ম্যাগাইকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন আপনি। সোয়ে ও নতুন দেবীকে একসাথে খুশী করতে পারবেন। আপনার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবেন তিনি। তখন তাঁর কাছে আপনার সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ যেকোনও বর চাইতে পারবেন।
ঠিক আছে, তাতা, তোমার কথামতোই করব। তবে তার বিনিময়ে আমার আজকের কথাগুলো নেফারকে বলবে না, যতক্ষণ না দেবীকে মেনে নেওয়া আর প্রাচীন দেবতাদের প্রত্যাখ্যানের সময় হচ্ছে তাঁর…
আপনার হুকুম মতোই করব, রানি আমার।
তুমি আর তোমার সহকর্মী দিমিতারকে অবশ্যই কাল খুব সকালে ফিরে আসতে হবে। মূল দরজার বদলে পেছন দরজা দিয়ে আসবে। আমার এক পরিচারিকা তোমাদের এই কামরায় নিয়ে আসবে, তখন তোমরা ওই পর্দার পেছনে আশ্রয় নিতে পারবে।
সূর্য উদয়ের এক ঘণ্টার মধ্যেই আসব আমরা, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।
*
মেমননের প্রাসাদের তোরণ হয়ে বেরিয়ে আসার সময় বিকেলের সূর্যের উচ্চতা যাচাই করল তাইতা। এখনও দিনের আলোর বেশ কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। হঠাৎ কী ভেবে রক্ষীদের সার্জেন্টকে থেবসে যাবার সোজা পথ বেছে নিতে নিষেধ করল ও। তার বদলে কবরস্থানের পথে ঘুর পথে পশ্চিমের পাহাড় ও বিশাল রাজকীয় নেক্রোপলিসের দিকে এগোল। একটা পাথুরে উপত্যকার আড়ালে রয়েছে ওটা। প্রাণপ্রিয় লখ্রিসের জাগতিক দেহে মলম মাখানোর বিষয়টি যেখানে তত্ত্বাবধান করেছিল ও, সত্তর বছর আগের ঘটনা এটা। কিন্তু সময় সেই ভীষণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। মাদুলিটা স্পর্শ করল ও, লস্ত্রিসের একগাছি চুল রাখা আছে ওতে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে উঠতে লাগল ওরা। হাথরের মন্দির পাশ কাটাল: পাথুরে টেরেসের পিরামিডের চূড়ায় বসানো দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। নিচের টেরেসে পায়চারীরত পুরোহিতিনীকে চিনতে পারল তাইতা, আরও দুজন নবীশ রয়েছে তার সথে। তার সাথে কথা বলতে একপাশে সরে এলো।
ঐশী হাথর আপনাকে রক্ষা করুন, মা, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাল ও। হাথর হচ্ছেন মহিলাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তাই প্রধান পুরোহিতও একজন নারী।
শুনেছি আপনি সফর শেষে ফিরে এসেছেন, ম্যাগাস, ওকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আমরা সবাই আশা করছিলাম, আপনি এখানে আসবেন, আমাদের আপনার অভিযানের গল্প শোনাবেন।
সত্যি, অনেক কথা বলার আছে আমার, আপনাদের ভালো লাগবে আশা করি। মেসোপটেমিয়া, একবাতানা ও বাবিলনের ওধারে যার উপর দিয়ে খোরাশান মহাসড়ক চলে গেছে সেই পাহাড়ি ভূমির প্যাপিরাস মানচিত্র নিয়ে এসেছি আমি।
আমাদের জন্যে অনেক কিছুই নতুন হবে, সাগ্রহে হাসলেন প্রধান পুরোহিতীনি। সাথে এনেছেন ওগুলো?
আরে, না! অন্য কাজে বেরিয়েছি আজ, এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। থেবসে স্ক্রোল রেখে এসেছি। তবে পয়লা সুযোগেই নিয়ে আসব ওগুলো।
সেটা খুব শিগগির হবার নয়, ওকে আশ্বস্ত করলেন প্রধান পুরোহিতীনি। এখানে সবসময়ই আপনি স্বাগত। আপনার ইতিমধ্যে দেওয়া তথ্যের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আপনার কাছে যা আছে সেটাও মনোমুগ্ধকর হবে বলেই আমি নিশ্চিত।
তাহলে আপনার মহত্বের সুযোগটুকু নেব আমি। আপনার কাছে একটা উপকার চাইতে পারি?
আমার কাছে পাওয়ার মতো কোনও উপকার থাকলে সেটা পেয়ে গেছেন আপনি। মুখ ফুটে বলুন শুধু।
অগ্নিগিরি নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।
কোনটা? হাজারে হাজারে আছে, অনেক দেশে ছড়িয়ে আছে।
পাহাড়ের কাছাকাছি বা কোনও দ্বীপে, বা কোনও হ্রদ কিংবা বিশাল নদীর কিনারের গুলো। একটা তালিকা দরকার আমার, মা।
বেশ কঠিন অনুরোধ, ওকে নিশ্চিত করলেন তিনি। ভাই নুবাঙ্ক, আমাদের একজন প্রবীন মানচিত্র শিল্পী সব সময়ই আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণতার অন্যান্য ডুবো উত্স নিয়ে দারুণ কৌতূহলী, যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ ও গেইসার। খুশি মনেই আপনার তালিকা তৈরি করে দেবেন তিনি। তবে ধরে নিন অনেক বিস্তারিত ও ক্লান্তিকর হবে সেটা। নুবাঙ্ক এত বেশি খুঁতখুঁতে যে এটাই তার দোষ। এখুনি কাজ শুরু করতে বলছি তাকে।
কত সময় লাগতে পারে?
আপনি কি আগামী দশদিনের ভেতর এদিকে আসবেন, সম্মানিত ম্যাগাস? জানতে চাইলেন তিনি।
বিদায় নিল তাইতা, তারপর নেক্রোপলিসের ভিন্ন একটা তোরণের দিকে এগোল।
*
এক বিশেষ সামরিক দুর্গ রাজকীয় সমাধির আশ্রয় নেক্রোপলিস পাহারা দিচ্ছে। প্রতিটিতে ডুবন্ত চেম্বারের কমপ্লেক্স রয়েছে, নিরেট পাথর কুঁদে নির্মাণ করা হয়েছে এসব। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে সমাধি চেম্বার, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ রাজকীয় পাথুরে শাবাধার, ফারাওর মামিকৃত মরদেহ রয়েছে তাতে। এই চেম্বারের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টোররুম আর গুদামঘর, অপরিমেয় রত্নভাণ্ডারে ঠাসা সেগুলো। কেউ জানে না এর কথা। দুটি রাজ্য ও এর সীমান্তের বাইরের অন্য দেশের সমস্ত চোর আর ডাকাতের লোভের কারণ হয়েছে এটা। পবিত্র এনক্লোজারে ঢুকতে সব সময়ই সুচতুর প্রয়াস পেয়ে আসছে তারা। ওদের ঠেকাতে ছোটখাট একটা সেনাদলের স্থায়ী প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে।
ঘোড়ার দলকে দানাপানি খাইয়ে তরতাজা করে তুলতে সঙ্গীদের দুর্গের মূল প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে সামাধিক্ষেত্রের দিকে পা বাড়াল ও। রানি লখ্রিসের সমাধিতে যাবার পথ যতটা ভালো করে জানার কথা জানে ও। নিজেই লেআউটের নকশা করেছে ও, খনন কাজ তত্ত্বাবধান করেছে। লস্ত্রিসই মিশরের একমাত্র রানি যাকে গোরস্থানের এই অংশে কবরস্থ করা হয়েছে, সাধারণত ক্ষমতাসীন ফারাওর জন্যে সংরক্ষিত থাকে এটা। লস্ত্রিসের বড় ছেলে সিংহাসনে বসার পর তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এর বরাদ্দ নিয়েছিল তাইতা।
ইহ জগত থেকে বিদায় নিয়ে পরজগতে পদার্পণের কথা ভেবে ফারাও নেফার সেতির সমাধি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সে জায়গাটা পার হয়ে এলো ও। রাজমিস্ত্রিতে গিজগিজ করছে জায়গাটা, পাথর কুঁদে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করছে ওরা। মাথার উপর নিপূণভাবে ঝুড়ি ফেলে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধ শ্রমিকরা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মসৃণ ধূলোর পুরু আস্তরণ ওদের শরীরে। স্থপতি ও দাসদের সর্দারদের একটা ছোট দল ওদের মাথার উপর থেকে নিচের কাজের গতি জরিপ করছে। উপত্যকা জুড়ে বাটালি, বাইস আর পাথরের উপর গাইতি চালানোর আওয়াজ।
কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই শবযাত্রার পথ ধরে এগোল তাইতা, এক সময় উপত্যকা সরু হয়ে দুটি ভিন্ন পথে ভাগ হয়ে গেল। বাম দিকের পথ বেছে নিল ও। পঞ্চাশ কদম এগোনোর পরই একটা বাঁক ঘুরে লক্ট্রিসের সমাধির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। ঠিক সামনেই রয়েছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে বসানো। প্রবেশ পথ দৃষ্টিনন্দন গ্ৰানিটের স্তম্ভ ঘিরে রেখেছে, পাথরের ব্লকের দেয়ালে ঘেরাও করা, প্রলেপ লাগানোর পর অসাধারণভাবে রঙ করা মুরালে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। রানির জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সাজানো হয়েছে তার কার্তুশের চারপাশে: স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সুখে লস্ত্রিস, রথ হাঁকাচ্ছে, নীলের জলে মাছ ধরছে, গেযেল ও পাখি শিকার করছে, হিকস্স হানাদারদের সেনাদলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে, নৌবহরে জনগণসহ নীলের বিভিন্ন জলপ্রপাত পাড়ি দিচ্ছে, এবং হিকস্সের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে তাদের। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিজের হাতে এইসব দৃশ্য এঁকেছিল তাইতা, কিন্তু এখনও টাটকা রয়ে গেছে রঙ।
সমাধির প্রবেশ পথে আরেকজন শোককারী ছিল, দেবী আইসিসের সন্ন্যাসীনিদের আলখেল্লার মতো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। মুরালের দিকে ফিরে প্রবল ভক্তির ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। সময় নিতে ইচ্ছে করে গতি কমাল তাইতা। ক্লিফের পায়ের কাছে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে একপাশে সরে গেল ও। ছবির লক্ট্রিসের চেহারা সুখ-স্মৃতির একটা চলমান ছবি চালু করে দিল। উপত্যকার এই দিকটা বেশ নিরিবিলি, আরও নিচের শ্রমিকদের কাজ-কর্মের হাঁকডাক পাথুরে দেওয়ালের কারণে চাপা পড়ে গেছে। খানিকক্ষণ সমাধির যাজিকার উপস্থিতির কথা ভুলে গেল ও, পরক্ষণেই উঠে আবার তার দিকে মনোযোগ ফেরাল।
মহিলা জোব্বার হাতার ভেতরে হাত চালিয়ে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র-হয়তো বাটালি বা ছুরি-বের করে আনার সময়ও ওর দিকে পেছন ফিরে ছিল সে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তাইতাকে ভীত বিহ্বল করে যন্ত্রের ডগা দিয়ে ইচ্ছে করেই মুরালের উপর আঘাত হানল সে। আরে, পাগল মেয়েমানুষ, করছ কী? চিৎকার করে উঠল ও। রাজকীয় সমাধির ক্ষতি করছ তুমি! এখুনি বন্ধ করো!
যেন ও কোনও কথাই বলেনি, ওকে উপেক্ষা করে গেল মহিলা, ঘনঘন আঘাত হেনে চলল লস্ত্রিসের মুখে। গভীর ক্ষতের ভেতর থেকে নিচের আস্তরণ বের হয়ে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা। চিৎকার করে চলেছে, থাম! শুনতে পাচ্ছ না! তোমার শ্রদ্ধেয়া মা এ খবর জানতে পারবেন। এই অপবিত্রতার জন্যে তোমার উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করব আমি। নিজের উপর দেবতাদের সাজা ডেকে আনছ তুমি…
তারপরেও ওর দিকে না তাকিয়ে প্রবেশ পথ ছেড়ে ইচ্ছাকৃত শিথিল পায়ে ওকে ছেড়ে উপত্যকার অন্য দিকে চলে গেল সন্ন্যাসীনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছু নিল তাইতা। এখন আর চিৎকার করছে না, তবে ডান হাতে ভারি ছড়িটা ধরে আছে। মহিলা যাতে অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায়। সহিংসতা ওর মন ভারি করে দিয়েছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মহিলার মাথায় ঠকাস করে বাড়ি মেরে খুলি ফাটিয়ে দিত ও।
উপত্যকার তীক্ষ্ণ বাঁকে পৌঁছাল মহিলা। থেমে কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল সে। তার মুখ আর চুল বলতে গেলে লাল শালে সম্পূর্ণ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা। যাচ্ছিল।
ক্রোধ ও হাতাশা মিলিয়ে গেল তাইতার, বিস্ময় ও বিহ্বলতা সে জায়গা দখল করে নিল। মহিলার দৃষ্টি স্থির, প্রশান্ত, চোখজোড়া প্রবেশপথের রানির ছবির মতোই। এক মুহূর্ত নড়তে বা কথা বলতে পারল না ও। যখন ভাষা খুঁজে পেল, খরখরে শোনাল ওর কণ্ঠ: এ যে দেখছি তুমি!
এক ধরনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার চোখজোড়া, ফলে উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর হৃদয়। মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও বুঝতে পারল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে। ওর বিস্ময় সূচক কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা দোলাল সে। তারপর আবার ঘুরে ধীরস্থিরভাবে পাথর প্রাচীরের বাঁক ঘুরে চলে গেল।
না! হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তাইতা। আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারো না তুমি! দাঁড়াও! অপেক্ষা করো! পিছনে ছুটল ও, মহিলা উধাও হয়ে যাবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাদে বাকে পৌঁছাল। এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পরক্ষণে থমকে দাঁড়াল ও, ওর চোখের সামনে উপত্যকার উঁচু প্রান্ত খুলে যেতেই দুহাত আবার স্কুলে পড়ল দুপাশে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কানা গলিতে পরিণত হয়েছে রাস্তাটা; ধূসর পাথরের দেয়ালে পথ রুদ্ধ, এত খাড়া যে পাহাড়ী ছাগলের পক্ষেও ওটা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। উধাও হয়ে গেছে। মহিলা।
লস্ত্রিস, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া আমার। ওর ওপর চেপে বসল পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও, অর্থহীন আবেদনের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেয়ালের গায়ে ফাটলের খোঁজ করতে লাগল, যেখানে মেয়েটা গাঢাকা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাবার মতো গোপন দরজা। কিছুই পেল না। যে পথে এসেছিল সেদিকে তাকাল ও। দেখতে পেল উপত্যকার মেঝে পাহাড়ের শরীর থেকে খসে পড়া শাদা বালির হালকা আস্তরণে ঢাকা। ওর নিজের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কোনও পায়ের ছাপ নেই। কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি সে। ক্লান্তভাবে লস্ত্রিসের সমাধির দিকে ফিরল ও। প্রবশে পথের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তরণে খোদাই করা হিয়েরেটিক হরফে লেখাটা পড়ল। ছয় আঙুল পথ দেখাবে, জোরে জোরে পড়ল। কোনও মানে বুঝল না। পথ? কোনও রাস্তা, নাকি কোনও কায়দা বা কৌশল?
ছয় আঙুল? বিভিন্ন দিক দেখাচ্ছে ওগুলো, নাকি একটা? অনুসরণের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সাইনপোস্ট? হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। জোরে খোদাইম্বালিপিটা ফের পড়ল: ছয় আঙুল পথ দেখাবে। ও পড়ার সময়ই মহিলার লেখা হরফগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল এক সময়। লস্ত্রিসের পোর্ট্রেট অক্ষত। সবগুলো বিকৃতি আবার নিখুঁতভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিস্ময়ের সাথে হাত বাড়িয়ে ছবি স্পর্শ করল ও। উপরিতল মসৃণ, নির্মল।
পিছিয়ে এসে আবার পরখ করল। হাসিটা কি যেভাবে এঁকেছিল এখনও তেমনই আছে, নাকি বদলে গেছে? কোমল দেখাচ্ছে এখন, নাকি পরিহাস করছে? আন্তরিক, নাকি হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছে? ওটা কি দয়ার্দ্র, নাকি বৈরী? নিশ্চিত হতে পারল না।
তুমি কি লস্ত্রিস, নাকি আমাকে কষ্ট দিতে পাঠানো দুষ্ট কোনও অভিশাপ? জিজ্ঞেস করল ও। লস্ত্রিস কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? তুমি সাহায্য আর নির্দেশনা দিতে চাইছ-নাকি আমার পথে ফাঁদ আর গহ্বর খুঁড়ে যাচ্ছ?
অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল ও, তারপর সঙ্গীরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দুর্গের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঘোড়ায় চেপে থেবসের উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরল ওরা।
*
ফারাও নেফার সেতির প্রাসাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবার আগে রামরামের কাছে এলো তাইতা।
ফারাও এখনও গোপন সভায় আছেন। পরিকল্পনা মতো আজ রাতে তোমার সাথে দেখা করতে পারবেন না তিনি। তার তলবের অপেক্ষা করতে হবে। তোমাকে নিজের মাদুরে শুয়ে পড়ার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।
রামরামকে ছেড়ে দ্রুত দিমিতারের ঘরের দিকে এগোল ও। বাও বের্ডের সামনে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখল বুড়ো আর মেরেনকে। তাইতাকে দেখেই স্বস্তি প্রকাশের নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল মেরেন। খেলাটার জটিলতা অনেক সময় ওর বোধের বাইরে ঠেকে। স্বাগত, ম্যাগাস। ঠিক সময় মতো এসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচালেন।
দিমিতারের পাশে বসল তাইতা, ঝটপট স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খবর দিল।
সফরের ক্লান্তি সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে তো?
আপনার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ। আসলেই ভালো আছি আমি, বললেন দিমিতার।
শুনে খুশি হলাম, কারণ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে আমাদের। আপনাকে মেমনরের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নতুন ধর্মের প্রচারকদের একজনের বাণী শুনব। এক নতুন দেবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে সে, যিনি পৃথিবীর সকল জাতির উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন।
হাসলেন দিমিতার। সত্যি বলতে প্রলয় পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো দেবতার অভাব আছে আমাদের?
আহা, বন্ধু আমার, আমাদের চোখে এমনটা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু পয়গম্বরের মতে পুরোনো দেবতাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, তাদের মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে, ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে তাদের যাজকদের।
ভাবছি এক এবং অদ্বিতীয় আহুরা মাদার কথা বলছে কিনা সে? তাহলে এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়।
আহুরা মাযদা নয়, নতুন কেউ। তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী, ভীতিকর। মানুষের রূপে নেমে আসবেন এই দেবী, আমাদের মাঝে বাস করবেন। সাধারণ লোকজন তার রাজকীয় করুণা সরাসরি ভোগ করবে। মৃতকে জীবিত করা ও যোগ্যদের অমরত্ব ও চিরস্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
এমন স্পষ্ট অর্থহীনতার সাথে কেন নিজেদের জড়াতে যাচ্ছি আমরা, তাইতা? বিরক্তির সাথে জানতে চাইলেন দিমিতার। মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক জরুরি সমস্যা আছে।
এই পয়গম্বর সাধারণ লোকের মাঝে গাঢাকা দিয়ে একই ধরনের কথাবার্তা প্রচার করে বেড়ানো আরও অনেকের একজন। মনে হচ্ছে, মিশরের রানি এবং ফারাও নেফার সেতির স্ত্রী মিনতাকাসহ অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ফেলছে ওরা।
সামনে ঝুঁকে এলেন দিমিতার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি। এমন আজগুবী ব্যাপার বিশ্বাস না করার মতো ভালো বুদ্ধি তো রানি মিনতাকার থাকার কথা?
নতুন দেবীর আগমন ঘটার পর তাঁর প্রথম কাজ হবে মিশরের প্লেগ দূর করা, এই রোগের কারণে আবির্ভুত সমস্ত ভোগান্তির অবসান ঘটানো। তার মাঝে মিনতাকা প্লেগে মৃত দুই সন্তানকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখতে পেয়েছেন।
আচ্ছা, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন দিমিতার। যেকোনও মায়ের কাছেই অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হওয়ার কথা এটা। কিন্তু আর কোন কারণের কথা বলছেন। আপনি?
পয়গম্বরের নাম সোয়ে। বিহ্বল দেখাল দিমিতারকে। নামটার অক্ষরগুলোকে উল্টে দিন। তেনমাস হরফ ব্যবহার করুন, পরামর্শ দিল তাইতা। দিমিতারের বিভ্রান্তি কেটে গেল।
ইয়োস, ফিসফিস করে বললেন তিনি। আপনার কুকুরের দল ডাইনীর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে, তাইতা।
আমাদের অবশ্যই এবার গন্ধ শুঁকে ঝটপট তার আস্তানায় ছুটে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল তাই। ভালো করে ঘুমিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিন। সূর্যোদয়ের সময় মেরেনকে পাঠাব আপনাকে নিতে।
*
পুব আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ আভা মাত্র, দিমিতারের উট আর ঘোড়াসহ প্রাঙ্গণে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হাবারি। পালকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন দিমিতার। ঘোড়ার পিঠে তার পাশে থেকে এগোতে লাগল তাইতা ও মেরেন। ওদের নদী পারাপারের জায়গায় নিয়ে এলো এসকর্ট। এখানে স্রেফ একটা রাক্ষুসে ব্যাঙ দেখতে পেল ওরা। ওদের এড়িয়ে গেল ওটা, বিনা ঝামেলায় নদী পেরুল ওরা। মেমননের প্রাসাদ পাশ কাটিয়ে পেছনের তোরণে চলে এলো, এখানে মেরেন ও হাবারির হেফাযতে বাহন রেখে এগোলো তাইতা ও দিমিতার। মিনতাকার প্রতিশ্রুতি মতো একজন পরিচারিকা ওদের স্বাগত জানাতে তোরণের ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছিল। প্যাসেজ আর টানেলের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল সে, অবশেষে দরাজহাতে সাজানো একটা কামরায় পৌঁছুল ওরা। এখানে ধূপ আর সৌরভ ভুরভুর করছে। মেঝে রেশমী কাপড়ের গালিচা আর কুশনে ঢাকা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত পদা। দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা পর্দা টানানো যেনানা জানালা ঢেকে রাখা হ্যাংগিং সরিয়ে ফেলল পরিচারিকা। দ্রুত সেটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অলঙ্কৃত নকশার ভেতর দিয়ে আম দরবারের দিকে তাকাল। আগের দিন মিনতাকার সাথে এখানেই দেখা করেছিল ও। এখন খা-খা করছে। সন্তুষ্ট হয়ে দিমিতারের কাছে ফিরে এসে হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে। কুশনে বসল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পর্দার ওপাশ থেকে অচেনা এক লোক পা রাখল কামরায়।
মাঝ বয়সী, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়নের লোকটা। কাঁধের উপর নেমে আসা ঘন চুলে ছোট সঁচাল দাড়ির মতোই পাক ধরেছে। পরনে যাজকীয় কালো লম্বা জোব্বা, স্কার্টে আধ্যাত্মিক প্রতাঁকের নকশা, গলায় ঝুলছে তাবিজ। কামরায় চক্কর দিতে শুরু করল সে। পর্দা সরিয়ে ভেতর পরখ করছে। যেনানা জানালার সামনে। এসে দাঁড়াল সে, পর্দার খুব কাছে নিয়ে এলো মুখটা। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো জিসিনটা হচ্ছে তার চোখ: ধর্মান্ধদের চোখের মতো, অন্ধবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে সেখানে।
এটাই সোয়ে, ভাবল তাইতা। ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিজেদের আড়াল করার শক্তি একত্রিত করে বাড়ানোর জন্যে দিমিতারের হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কারণ ওই লোকটার কী ধরনের অকাল্ট বিদ্যা আছে জানা নেই। পর্দার ভেতর দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে আড়ালের পর্দা টিকিয়ে রাখতে পুরো শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ঘুরে দাঁড়াল সোয়ে। দূরে জানালার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরের প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের কমলা আলোয় কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে ওটা।
লোকটাকে বিভ্রান্ত করার পর এবার অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। সোয়ে সাধুপুরুষ নয় মোটেই, কারণ নিমেষে তার চারপাশে একটা আভা ফুটে উঠল। এমন আভা এর আগে আর দেখেনি ও অস্থির, এই প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে, তারপরই আবার ক্ষীণ আভায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওটার রঙ, তারপরই আবার মলিন, চাপা রূপ নিচ্ছে। নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তার কারণে দূষিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্তিত্ব টের পেল তাই।
সোয়ের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, পরস্পরবিরোধী, তবে তার উল্লেখযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
হাসতে হাসতে একদল নারী কামরায় ঢুকতেই চট করে জানালার কাছ থেকে সরে এলো সোয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিনতাকা, উত্তেজিতভাবে ছুটে গিয়ে প্রবল মমতায় সোয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল তাইতা। রানির পক্ষে দারুণ ব্যতিক্রমী আচরণ। কেবল একা থাকলেই তাইতাকে আলিঙ্গন করেন তিনি। পরিচারিকাদের সামনে নয়। সোয়ের কাছে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তিনি বুঝতে পারেনি ও। রানি সোয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পরিচারিকরা এসে হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে।
পবিত্র পিতা, আমাদের আশীর্বাদ করুন, মিনতি করল ওরা। এক ও অদ্বিতীয় দেবীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন।
ওদের মাথর উপর আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে। পরমানন্দে হেসে উঠল ওরা।
সোয়েকে কুশনের একটা ঢিবির কাছে নিয়ে গেলেন মিনতাকা, রানির মাথা থেকে বেশ উঁচু করে তুলল সেগুলো সোয়ের মাথা। তারপর অল্পবয়সী মেয়েদের মতো নিতম্বের নিচে পা ভাঁজ করে বসলেন তিনি। যেনানা জানালার দিকে ফিরে সুন্দর হাসি দিলেন, জানেন তাইতা ওখানে বসে ওদের দেখছে। নিজের সাম্প্রতিক সংগ্রহের প্রতি ওর অনুমোদন কামনা করছেন। যেন সোয়ে দূর দেশ থেকে আনা কোনও বিচিত্র পাখি, কিংবা কোনও বিদেশী অতিথির দেওয়া মূল্যবান রত্ন। রানির এমনি অসতর্কতায় সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কিন্তু পরিচারিকাদের সাথে আলাপে মগ্ন সোয়ে। ওদের দৃষ্টি চালাচালি লক্ষ করেনি। এবার মিনতাকার দিকে তাকাল
মহারানি, গতবার আমাদের দেখা হওয়ার পর আপনার উদ্বেগের বিষয়ে অনেক ভেবেছি, দেবীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছি আমি, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে সাড়া দিয়েছেন।
ফের অবাক হলো তাইতা। এ লোক বিদেশী কেউ নয়, ভাবল ও। মিশরিয়। আমাদের ভাষা নির্ভুল ব্যবহার করছে। উচ্চ রাজ্যের অধিবাসী আসৌনদের মতো টান আছে তার কথায়।
বলে চলল সোয়ে। এসব ব্যাপার এত জরুরি ও কঠিন যে এই মুহূর্তে সেগুলো কেবল আপনার নিজের কাছে গোপন রাখতে হবে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিন। হাত তালি দিলেন মিনতাকা। লাফ দিয়ে উঠে ভীত ইঁদুরের মতো কামরা থেকে ছুটে বের হয়ে গেল ওরা।
সবার আগে আপনার স্বামী, নেফার সেতির প্রসঙ্গ, একাকী হওয়ার পর আবার বলল সোয়ে। তিনি আপনার কাছে এই খবব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু থেমে মিনতাকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তারপর এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করল যেটা ওর নিজস্ব ভাষা নয়, বৈরী নারী কণ্ঠ। আমার আগমনের সময় নেফার সেতিকে নিজের প্রেমময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করব আমি, সানন্দে আমার কাছে আসবে সে।
চমকে উঠল তাইতা, কিন্তু ওর পাশে দিমিতার বুনো চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে শান্ত করতে হাত বাড়াল তাইতা। যদিও নিজেই প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন দিমিতার। তাইতার হাত ধরে টানলেন তিনি। ওর দিকে ফিরল তাইতা। নিঃশব্দে একটা বার্তা উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, পরিষ্কার বুঝতে পারল তাইতা, যেন চিৎকার করে বলা হয়েছে। ডাইনী! এটা ইয়োসের কণ্ঠস্বর! দিমিতার ঘোরে থাকার সময় তার মনের গহীন থেকে এই কণ্ঠস্বরই বের করে এনেছিল তাইতা।
তবে এসবেরই প্রভু হচ্ছে আগুন, পুনরাবৃত্তি করে পূর্ণ সম্মতিতে হাতের তালু উপরের দিকে মেলে ধরল।
সোয়ে কথা বলে চলেছে, শোনার জন্যে পেছন ফিরে তাকাল ওরা: আমার অলৌকিক রাজ্যের অধিপতি করার জন্যে পুনরুত্থান ঘটাব তার। পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের রাজারা তার অধীনে চলে আসবে। আমার নামে চিরকাল আপন মহিমায় শাসন করবে সে। আপনি, প্রিয় মিনতাকা, থাকবেন তার পাশে।
স্বস্তি আর আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিনতাকা। পিতৃসুলভ কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সোয়ে। তাঁর সামলে ওঠার অপেক্ষা করল। অবশেষে চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের কী হবে?
আগেই ওদের কথা বলেছি আমরা, কোমল কণ্ঠে তাঁকে মনে করিয়ে দিল সোয়ে।
হা! কিন্তু বেশিবার শুনিনি। দয়া করে, পবিত্র পয়গম্বর, আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি…
দেবী আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওদের, ওরা পূর্ণ আয়ু পার করবে।
আর কী নির্দেশ দিয়েছেন তিনি? দয়া করে আবার বলুন।
ওরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারলে আপনার সকল সন্তানকে চির তারুণ্য দান করবেন তিনি। কোনও দিন আপনাকে ফেলে যাবে না ওরা।
আমি সন্তুষ্ট, সর্বশক্তিমতী দেবীর মহান পয়গম্বর, ফিসফিস করে বললেন মিনতাকা। আমি আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছার কাছে সঁপে দিচ্ছি। হাঁটু ভেঙে সোয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। চুলের ডগায় অশ্রু মুছলেন তিনি।
এরচেয়ে বিতৃষ্ণ দৃশ্য আর হতে পারে না। এমনটা আর তাইতা দেখেনি। পর্দার এপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল ও। লোকটা মিথ্যার চ্যালা! নিজেকে ওর হাতে নোংরা হতে দেবেন না।
পরিচারিকাদের তলব করলেন মিনতাকা। সকালের বাকি সময়টা সোয়ের সাথে কাটাল ওরা। কথোপকথন অর্থহীন বাক্যালাপে পর্যবসিত হলো, কারণ পরিচারিকাদের কারওই সোয়ের শিক্ষা অনুসরণ করার মতো বুদ্ধি নেই। সরল ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হলো সে। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, হাসিঠাট্টায় তাকে ত্যক্ত করতে লাগল।
দেবী আমার জন্যে ভালো একজন স্বামী খুঁজে দেবেন?
আমাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেবেন?
লক্ষ্যণীয় ধৈর্য ধরে ওদের সামাল দিল সোয়ে।
তাইতা বুঝতে পারল ওরা অনেক কিছু জানতে পারলেও যেনানা পর্দার আড়ালে নীরবে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চলে যাবার চেষ্টা করলে নড়াচড়ায় পয়গম্বরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। দুপুরের খানিক আগে দেবীর উদ্দেশে লম্বা প্রার্থনা শেষে সভার সমাপ্তি টানল সোয়ে। তারপর ফের মেয়েদের চুমু খেয়ে মিনতাকার দিকে ফিরল। মহারানি, আপনি কি চান পরে আবার আসি আমি?
দেবীর এইসব ইচ্ছা নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কাল সকালে আবার আসুন, তখন এসব নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। মাথা নুইয়ে সরে গেলেন তিনি।
সোয়ে বিদায় নেওয়ার পরপরই পরিচারিকাদের বিদায় দিলেন মিনতাকা।
তাইতা, এখনও আছো তোমরা?
জ্বি, মহারানি।
একটানে পর্দা সরিয়ে মিনতাকা জানতে চাইলেন, লোকটা কত জ্ঞানী আর শিক্ষিত, কত চমৎকার সব সংবাদ নিয়ে আসেন বলেছি তোমাকে?
অসাধারণ খবর, সত্যি, জবাব দিল তাইতা।
দেখতেও সুন্দর, না? মনেপ্রাণে তাকে বিশ্বাস করি আমি। অন্তর থেকে জানি তার ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী সত্যি; দেবী নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করবেন, আমাদের কষ্ট দূর করবেন তিনি। ওহ, তাইতা, তার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তুমি? নিশ্চয়ই করেছ!
ধর্মীয় ঘোরে রয়েছেন মিনতাকা। তাইতার জানা আছে, এখন কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে হিতে বিপরীত হবে। দিমিতারকে এখন এমন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে বসে এতক্ষণ যা কিছু জেনেছে সেসব নিয়ে আলাপ করতে পারবে। অগ্রসর হওয়ার কায়দা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তার আগে মিনতাকার মুখে সোয়ের তারিফ শুনতে হবে। এক সময় সব প্রশংসার শব্দ ফুরিয়ে গেলে আস্তে করে তাইতা বলল, আমি আর দিমিতার উত্তেজনায় ক্লান্ত। ফারাও তাঁর জরুরি দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ামাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, তো এখন হাতের কাছে থাকার জন্যে থেবসে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। আরও আলোচনা করা যাবে তখন, রানি আমার।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বিদায় দিলেন তিনি।
*
ওরা ফের বাহনে চেপে নদীর দিকে পথে নামার পরপরই পালকির দুই পাশে যথারীতি অবস্থান নিল তাইতা ও মেরেন। মিশরিয় ভাষা ছেড়ে তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করল এবার তাইতা ও দিমিতার, যাতে এসকর্টের লোকজন ওদের আলোচনা না বোঝে।
সোয়ের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে পেরেছি আমরা, শুরু করল তাইতা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকটা ডাইনীকে দেখেছে, বলে উঠলেন দিমিতার। ডাইনীর কথা শুনেছে সে। নির্ভুলভাবে তার কণ্ঠে কথা বলেছে।
তার কথাবার্তার ধরন আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি, অপানার কথার সত্যতায় আমার সন্দেহ নেই, সায় দিল তাইতা। তবে আমার মতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। সোয়ে মিশরিয়। তার বলার ভঙ্গি উচ্চ রাজ্যের।
এটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনাদের ভাষায় আমার দক্ষতা এসব ব্যাপার ধরতে পারার মতো নয়। এটা ডাইনীর সত্যিকারের অবস্থানের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। থেবসে আসতে সোয়েকে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়নি ধরে নিলে দুটি রাজ্যের সীমানার ভেতরই আমাদের তদন্ত শুরু করতে পারি, কিংবা অন্ততপক্ষে, এগুলোর আশপাশের জায়গাগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে।
এইসব এলাকায় কি কি আগ্নেয়গিরি আছে?
ঠিক মিশরে কোনও বড় আগ্নেয়গিরি বা হ্রদ নেই। মধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে নীলনদ। উত্তরে এটাই সবচেয়ে কাছের জলের উৎস। এতনা দশদিনেরও বেশি দূরের পথ। ইয়োস ওখানে নেই, এ ব্যাপারে আপনি এখনও নিশ্চিত?
হ্যাঁ, মাথা দোলালেন দিমিতার।
বেশ। এই দিকে আরেক বড় আগ্নেয়গিরি, এতনার ওপাশে প্রণালীর উল্টোদিকের মূলভূখণ্ডের ভিসুভিয়াস সম্পর্কে কী বলবেন? জানতে চাইল তাইতা।
সন্দিহান মনে নিচের ঠোঁট কামড়ালেন দিমিতার। ওই কুকুরও শিকার করবে, জোরের সাথে বললেন তিনি। ওর খপ্পর থেকে পালোনোর পর ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে তিরিশ লীগেরও কম দূরের মন্দিরের যাজকদের সাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। ধারে কাছে থাকলে নির্ঘাৎ টের পেতাম, কিংবা সেও আমার উপস্থিতি বুঝে যেত। উঁহু, তাইতা, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে আমাদের।
আপাতত আপনার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই চলা যাক, বলল তাইতা। লোহিত সাগরের পুব প্রান্তে। ওই সাগরের তীরে আরব বা অন্য কোনও দেশের বুনো এলাকা চিনি না আমি। আপনি চেনেন?
না। ওসব জায়গায় গেলেও কোনও আগ্নেয়গিরির কথা শুনিনি বা দেখিনি।
যাগরেব পাহাড়ের ওধারের এলাকায় দুটি আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি, তবে বিশাল প্রান্তর ওগুলোকে ঘিরে রেখেছে। আমরা যেটা খুঁজছি তার সাথে ওগুলোর বর্ণনা মেলে না।
মিশরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা পড়ে আছে, বললেন দিমিতার। তবে আসুন, আরেকবার সম্ভাবনার কথা বিচার করা যাক। আফ্রিকার অভ্যন্তরে বিশাল নদী ও হ্রদ আর সেগুলোর কোনওটার আশপাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে না?
তেমন কিছু শুনিনি আমি-অবশ্য, এটাও ঠিক যে, ইথিওপিয়ার চেয়ে দক্ষিণে কেউ এপর্যন্ত যায়নি।
শুনেছি, তাইতা, মিশর থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লস্ত্রিসকে সেই উত্তরে হাওয়ার দেশ কেবুই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি, যেখানে নীল দুটো বিশাল জলধারায় ভাগ হয়ে গেছে।
ঠিক। কবুই থেকে আমরা নদীর বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পাহাড়সারিতে গিয়েছিলাম। ডান দিকের শাখা অন্তহীন জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে, ওদিকে বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কোনওদিন ওটার দক্ষিণের প্রান্তে যায়নি। কেউ গেলেও সে-কাহিনী বলতে ফিরে আসেনি। কেউ কেউ বলে জলাভূমি নাকি অন্তহীন, বিশাল, নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শেষমাথা পর্যন্ত চলে গেছে ওটা।
তাহলে আরও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তার রসদের জন্যে হাথরের মন্দিরের যাজিকার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। কবে ওরা তথ্য জানাবে?
দশ দিন পর আবার যেতে বলেছিলেন যাজিকা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
পালকির পর্দা একপাশে সরিয়ে তারপর পেছনের পাহাড়সারির দিকে তাকালেন দিমিতার। এখন মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছি আমরা। ওখানে গিয়ে যাজিকার আতিথ্য ও রাতের জন্যে ঘুমোনোর চাদর চাওয়া দরকার। সকালে ওর মানচিত্র শিল্পী ও ভূগোল বিশারদদের সাথে কথা বলা যাবে।
ফারাও মেমনন আমাকে তলব করলে, ওর ভৃত্যরা আমাকে খুঁজে পাবে না, বলল ইতা। আমরা আবার প্রাসাদ থেকে বেরুনোর আগেই ওর সাথে দেখা করতে দিন।
এখানে থামো, হাবারিকে নির্দেশ দিলেন দিমিতার। এখুনি থামাও, বলছি। তারপর তাইতার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই, কিন্তু এখন আমি জানি, আপনার সাথে আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বপ্ন ও অশুভ ভাবনা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। মেরেন আর আপনার দেওয়া প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ডাইনীটা অচিরেই আমাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে সফল হবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। সেদিন সকালে সোয়ের ভীতিকর আভা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার পর থেকেই এই একই অশুভ ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাকে। পালকির কাছে এসে বুড়োর জীর্ণ চেহারা ভালো করে পরখ করল ও। বিষাদের সাথে লক্ষ করল, দিমিতার ঠিকই বলেছেন: মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার। প্রায় বিবর্ণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া, তবে ওগুলোর গভীরে খাওয়ায় ব্যস্ত হাঙড়ের মতো চলমান ছায়া দেখতে পেল।
আপনিও দেখতে পেয়েছেন, নিরস, ফাঁকা কণ্ঠে বললেন দিমিতার।
জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ঘুরে দাঁড়াল তাইতা, হাবারিকে নির্দেশ দিল। দলটাকে ঘোরাও। হাথরের মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। এক লীগের চেয়ে সামান্য দূরে সেটা।
কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা। তারপর ফের কথা বললেন দিমিতার। আমার প্রাচীন, দুর্বল দেহের বাধা না থাকলে আরও দ্রুত এগোতে পারবেন আপনারা।
নিজের প্রতি বড় অবিচার করছেন আপনি, ওকে ভৎর্সনা করল তাইতা। আপনার সাহায্য ছাড়া কোনদিনই এতদূর আসতে পারতাম না।
শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে ডাইনীটাকে হত্যার সময় উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা হবার নয়। একটু সময় চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আবার খেই ধরলেন। সোয়ের সাথে কীভাবে সামাল দেবেন? আপনার সামনে একটা পথই খোলা। ফারাওকে সোয়ের মিনতাকাকে জাদু করার খবর আর তার মনে গেথে দেওয়া বিশ্বাসঘাতকার চিন্তার খবর দিলে তাকে আটক করার জন্যে তিনি প্রহরী পাঠাবেন। তখন আপনি নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের সুযোগ পাবেন। শুনেছি থেবসের কারারক্ষীরা নাকি তাদের কাজে বেশ দক্ষ। নির্যাতনের কথায় কুকুড়ে যান না তো?
স্রেফ শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সোয়ের মচকানোর সামান্যতম সম্ভাবনা আছে থাকলে তাতে দ্বিধা করব না। কিন্তু তাকে আপনি দেখেছেন। ডাইনীকে রক্ষা করতে চাইবে সে। ডাইনীর সাথে তার এমনই বোঝাঁপড়া যে তার কষ্ট ও তার কারণ বুঝে যাবে সে। সে বুঝতে পারবে ফারাও ও রানি মিনতাকা তার বোনা জালের কথা টের পেয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে রাজপরিবারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে তা।
তা ঠিক, সায় দিলেন দিমিতার।
তাছাড়া, সোয়েকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন মিনতাকা, তখন নেফার সেতি বুঝবেন তিনি আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী। তাতে ওদের ভালোবাসা ও আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওদের এই ক্ষতি করতে পারব না।
তাহলে মন্দিরেই উত্তর পাওয়ার আশা করতে হবে।
দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলেন যাজিকারা। স্বাগত জানাতে দুজন নবীশকে পাঠালেন তারা। ওদের পথ দেখিয়ে মূল প্রবেশ পথের র্যাম্পের কাছে নিয়ে এলো ওরা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রধান যাজিকা। :
আপনাকে দেখে খুবই খুশি হলাম, ম্যাগাস। এমনিতেও ব্রাদার নুবাঙ্ক আপনার অনুরোধ নিয়ে অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করেছেন জানাতে আপনার খোঁজে থেবসে বার্তাবাহক পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তিনি আপনাকে তাঁর পাওয়া তথ্য তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে আপনি আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। তাইতার দিকে মায়ের চোখে তাকালেন তিনি। আপনি এখানে হাজারবার স্বাগত। পুরুষদের মহলে পরিচারিকরা আপনার চেম্বারের ব্যবস্থা করছে। যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পরেন। আপনার বিজ্ঞ আলোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।
আপনার অসীম দয়া ও ঔদার্য, মা। আমার সাথে আরেকজন মহাজ্ঞানী ও বিখ্যাত ম্যাগাস রয়েছেন।
তিনিও এখানে স্বাগত। আপনার সঙ্গীদের পুরুষদের মহলে আশ্রয় ও খাবার দেওয়া হবে।
যার যার বাহন থেকে নেমে পড়ল ওরা। দিমিতারকে নামতে সাহায্য করল মেরেন। তারপর মন্দিরে প্রবেশ করল। প্রধান দরবারের আনন্দ, মাতৃত্ব ও ভালোবাসার দেবী হাথরের প্রতিকৃতির সামনে থামল ওরা। শাদা-কালো ফুটকিঅলা গাভী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে, শিঙজোড়া সোনালি চাঁদ দিয়ে সাজানো। প্রার্থনা করলেন যাজিকা। তারপর তাইতা ও দিমিতারকে একটা মাঠের উপর দিয়ে মন্দিরের যাজকদের এলাকায় নিয়ে যেতে এক নবীশকে ডাকলেন। ওদের একটা ছোট পাথুরে দেয়ালের সেলে নিয়ে এলো সে, এখানে দূর প্রান্তের দেয়ালের গায়ে চাদর ঠেস দিয়ে রাখা। জলভর্তি গামলাও আছে যাতে তরতাজা হয়ে নিতে পারে ওরা।
রাতের খাবারের সময় আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে আবার আসব আমি, ব্রাদার নুবাঙ্ক ওখানে আপনাদের সাথে দেখা করবেন।
*
ওরা যখন খাবার ঘরে পা রাখল তখন আগে থেকেই মোটামুটি জনাপঞ্চাশ যাজক খাচ্ছিল, কিন্তু একজন এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ওদের সাথে মিলিত হতে দৌড়ে এলো। আমি নুবাঙ্ক। আপনাদের স্বাগত জানাই। মানুষটা লম্বা, ছিপছিপে, মড়ার মতো চেহারা। এই দুঃসময়ে মিশরে খুব কমই মোটাসোটা লোক আছে। খাবার একেবারেই সামন্য: এক বাটি ঝোল আর ছোট এক জগ বিয়র। মোটামুটি নীরবেই খাওয়া সারল সবাই। কেবল নুবাঙ্ক বাদে। এক মুহূর্তের জন্যেও কথা থামাল না সে। কণ্ঠস্বর খরখরে, আচরণে তোষামুদে ভাব।
কাল কেমন করে বাঁচব জানি না, দিমিতারকে বলল তাইতা, নিজেদের সেলে ফিরে এসেছে ওরা, ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রিয় ব্রাদার নুবাঙ্কের বকবকানি শুনতে গেলে দিনটা লম্বা হয়ে যাবে।
তবে ভূগোল সম্পর্কে তার বিদ্যা পূর্ণাঙ্গ, যুক্তি দেখালেন দিমিতার।
ঠিক বিশেষণটাই বেছে নিয়েছেন আপনি, ম্যাগাস, বলে পাশ ফিরে শুলো তাইতা।
*
এক নবীশ ওদের নাশতার জন্যে তলব করতে এলো যখন, তখনও সূর্য ওঠেনি। দিমিতারকে আরও দুর্বল ঠেকল। তাই মেরেন ও তাইতা মাদুর থেকে উঠতে সাহায্য করল ওকে।
মাফ করবেন, তাই। ভালো ঘুম হয়নি আমার।
আবার স্বপ্ন? তেনমাস ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ। ডাইনীটা কাছে এসে পড়ছে। ওকে ঠেকানোর মতো শক্তি পাচ্ছি না।
তাইতাও স্বপ্নে আক্রান্ত হয়েছে। ওর স্বপ্নে ফিরে এসেছে পাইথনটা। এখনও নাক ও গলার পেছনে লেগে আছে ওটার বুনো গন্ধ। কিন্তু নিজের ভীতি গোপন করে দিমিতারের সামনে আত্মবিশ্বাসী ভাব করল ও। আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের।
নাশতায় ছিল ছোট কঠিন ধুরা পাতা আর আরেক জগ পাতলা বিয়র। গতরাতে যেখানে বাধা পড়েছিল সেখান থেকে ফের একক সংলাপ শুরু করল ব্রাদার নুবাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে অচিরেই নাশতার পালা চুকে গেল। কিছুটা স্বস্তির সাথে নুবাঙ্কের পিছু পিছু গুহার মতো দরবার আর উঠোন হয়ে মন্দিরের লাইব্রেরির দিকে এগোল ওরা। বিশাল, শীতল একটা কামরা, উঁচু উঁচু পাথুরে দেয়ালে মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঢেকে রাখা তাক ছাড়া অলঙ্করণ বা আসবাবেব কোনও বালাই নেই। প্যাপিরাসের স্কোলে ঠাসা তাকগুলো, হাজার হাজার।
নুবাঙ্কের জন্যে অপেক্ষা করছিল তিনজন নবীশ ও দুই জন পুরোনো শিষ্য। এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, হাত সামনে বেঁধে রেখেছে। দাসসুলভ আচরণ। ওরা নুবাঙ্কের সহকারী। ওদের ভক্তির পেছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। ওদের সাথে রূঢ় আচরণ করে নুবাঙ্ক। সবচেয়ে কর্কশ অপমানকর ভাষায় নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না সে।
তাইতা ও দিমিতার প্যাপিরাস স্কুলে ভর্তি দীর্ঘ নিচু সেন্টার টেবিলে বসার পর লেকচার শুরু করল নুবাঙ্ক। পরিচিত বিশ্বের প্রতিটি আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণ জিনিসের বিবরণ দিতে লাগল, সেটা বিশাল জলাধারের আশপাশে হোক বা না হোক। একেকটা জায়গার নাম বলছে আর অমনি ভীত সন্ত্রস্ত একজন সহাকারীকে তাক থেকে সঠিক স্ক্রোলটা আনতে বলছে। অনেক সময়ই নড়বড়ে মই বেয়ে ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। এদিকে লাগাতার মুখখিস্তি করে দৌড়ের উপর রাখছে ওদের নুবাঙ্ক। তাই একবার ওর মূল অনুরোধের কথা উল্লেখ করে এই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চেষ্টা করলেও দায়সারাভাবে মাথা দুলিয়ে ফের নিজের কায়দায় কাজ চালিয়ে গেল নুবাঙ্ক।
অভাগা এক নবীশ ছিল নুবাঙ্কের পছন্দের শিকার। বেখাপ্পা চেহারা তার: শরীরের কোনও অংশই খুঁত হীন বা বিকৃতির উর্ধ্বে মনে হয়নি। ওর মুড়ানো মাথা লম্বাটে, মাথায় খুস্কি ভরা, পরিষ্কার ঘা সেখানে। কুঁতকুঁতে কাছাকাছি বসানো ট্যারা চোখের উপর বসানো তার ভুরুজোড়া। হেয়ারলিপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে বড় বড় দাঁত। কথা বলার সময় লালা গড়াচ্ছে। যদিও মুখে খুব একটা কথা সরে না তার। চিবুক এমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে যে আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। বাম গালের উপর বড় মালবেরি আকারের জন্মদাগ, বুকটা ভেতরে ঢোকানো, পাহাড়ের মতো কুঁজঅলা পিঠ। কাঠির মতো সরু পাজোড়া বাকানো; হাঁটার সময় একপাশে হেলে হাঁটে।
দিনের মাঝামাঝি সময় একজন নবীশ দুপুরের খাবারের জন্যে ওদের খাবার ঘরে যেতে তলব করতে এলো। সবাই আধা উপোস থাকায় নুবাঙ্ক ও তার সহকর্মীরা দ্রুত সাড়া দিল। খাবারের সময় কুঁজো নবীশকে আড়ালে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে দেখল তাইতা। তাইতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বোঝমাত্র উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল সে। ওখানে একবার পেছনে তাকিয়েই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে; বোঝাতে চাইছে, তাইতা ওকে অনুসরণ করুক।
ছোটখাট মানুষটাকে টেরেসে ওর অপেক্ষায় থাকতে দেখল তাইতা। ফের ইশারা করল সে। তারপর একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুসরণ করল তাইতা। অচিরেই প্রাঙ্গণের একটা ছোট মন্দিরে আবিষ্কার করল নিজেকে। দেয়ালগুলো হাথরের আবক্ষমূর্তিতে ঢাকা। ফারাও মামাসের একটা মূর্তিও রয়েছে। ওটার পিছনে গা ঢাকা দিয়েছে লোকটা।
মহান ম্যাগাস! আপনাকে একটা কিছু বলার আছে আমার, আপনার হয়তো কৌতূহল হতে পারে। তাই কাছে এগিয়ে যেতেই প্রণত হলো সে।
উঠে দাঁড়াও, সহজ কণ্ঠে বলল তাইতা। আমি রাজা নই। তোমার নাম কী? ব্রাদার নুবাঙ্ক এই নবীশটিকে কেবল এই মিয়া সম্বোধন করেছে।
এভাবে হাঁটি বলে আমাকে সবাই টিপটিপ ডাকে। আমার দাদা মিশর থেকে ইথিওপিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লক্ট্রিসের দরবারের একজন নিম্নপদস্থ চিকিৎসক ছিলেন। তখন প্রায়ই আপনার কথা বলতেন তিনি। আপনার হয়তো তার কথা মনে থাকতে পারে, ম্যাগাস। তার নাম সিতন।
সিতন? এক মুহূর্ত ভাবল তাইতা। হ্যাঁ! ভালো ছেলে ছিল সে। চামচ দিয়ে কাঁটাঅলা তীর তোলায় বেশ দক্ষ ছিল। অনেক সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রাণখোলা হাসি দিল টিপটিপ। কাটা ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তোমার দাদার কী হয়েছে?
বুড়ো বয়সে শান্তিতেই মারা গেছেন, তবে যাবার আগে দক্ষিণের দেশে আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী বলেছেন তিনি। ওখানকার লোকজন আর বুনো জম্ভজানোয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতের কথা বলেছেন, দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া এক বিশাল জলাভূমির কথাও বলেছেন।
সে ছিল দারুণ উত্তেজনার সময়, টিপটিপ, মাথা দুলিয়ে ওকে অনুপ্রাণিত করল তাইতা। বলে যাও।
কেমন করে আমাদের জাতির মূল অংশ নীলের বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পর্বতমালার দিকে গিয়েছিল সে কাহিনী বলেছেন তিনি। শেষ সীমানা আবিষ্কার করার জন্যে ডান দিকের শাখায় একটা দল পাঠিয়েছিলেন রানি লস্ত্রিস। সেনাপতি লর্ড আকেরের নেতৃত্বে বিশাল জলার দিকে রওয়ানা হয়েছিল তারা, সেই বাহিনীর একজন ছাড়া আর কাউকে আর দেখা যায়নি। কথাটা কি ঠিক, ম্যাগাস?
হ্যাঁ, টিপটিপ। রানির বাহিনী পাঠানোর কথা মনে আছে আমার। স্বয়ং তাইতাই সেই অভিশপ্ত অভিযানে আকেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। লোকটা ঝামেলাবাজ ছিল, লোকজনের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সেটা আর এখন বলতে গেল না ও। এও ঠিক যে, কেবল একজনই ফিরে এসেছিল। কিন্তু মানুষটা রোগে আর যাত্রায় এতই ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত ছিল যে আমাদের কাছে ফিরে আসার অল্প কদিন বাদেই জ্বরের কাছে হার স্বীকার করে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! উত্তেজনায় তাইতার বাহু খামচে ধরল টিপটিপ। আমার দাদাই সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘোরের ভেতর সেই সৈনিক পাহাড় আর বিশাল সব হ্রদে ঘেরা এক দেশের কথা বলেছিল। হ্রদগুলো এত বিশাল যে খালি চোখে এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না।
তাইতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। হ্রদ! আগে তো এ-কথা শুনিনি। বেঁচে যাওয়া সেই লোকের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। ইথিওপিও পাহাড়ে ছিলাম আমি। সে যখন মৃত্যুর স্থান কেবুইয়ে পৌঁছায় তখন আমি সেখান থেকে শত শত লীগ দূরে। আমার কাছে যে খবর আসে তাতে বলা হয়েছিল যে, রোগীর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারেনি। টিপটিপের দিকে তাকিয়ে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। ওর আভা থেকে বুঝতে পারল আন্তরিক মানুষ সে, যেমন মনে আছে সেভাবেই সত্যি কথা বলছে। তোমার আরও কিছু বলার আছে, টিপটিপ? আমার কিন্তু তাই ধারণা।
জ্বি, ম্যাগাস। একটা আগ্নেয়গিরি আছে, হড়বড় করে বলে উঠল টিপটিপ। সেকারণেই আপনার কাছে আসা। মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক একটা জ্বলন্ত পাহাড়ের কথা বলেছিল, এর আগে কেউ অমন দেখেনি। ওরা বিশাল জলাভূমি পেরুনোর পর অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল ওটা। সে বলেছে ওটার সুড়ঙ থেকে বেরুনো ধোয়া আকাশের বুকে চিরস্থায়ী মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। বাহিনীর কেউ কেউ একে কালো আফ্রিকান দেবতাদের আর না এগোনোর সতর্কবাণী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড আকের ওটাকে স্বাগত সঙ্কেত ঘোষণা করেন। ওখানে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি; অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অবশ্য, এই পর্যায়ে সৈনিকটি আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিসীমায় জ্বরে পড়লে সে মরে গেছে ভেবে তাকে ফেলে সঙ্গীরা দক্ষিণে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনওমতে দানবীয় কালো মানুষদের একটা গ্রামে পৌঁছায় সে, হ্রদের পাশেই ওদের বসতি ছিল। ওকে তুলে নিয়ে যায় ওরা; ওদের এক শামান ওষুধ দিয়ে সেরে ওঠা পর্যন্ত সেবাযত্ন করে তার। ঠিকমতো সেরে ওঠার পর ফিরতি পথ ধরে সে। উত্তেজনার বশে তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল টিপটিপ। ব্রাদার নুবাঙ্ক বাধা দেওয়ার আগেই কথাটা আপনাকে বলতে চেয়েছি। সত্তর বছর আগের গুজবে আপনাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন আমরা ভূগোলবিশারদরা কেবল সত্যি বিষয় নিয়ে কাজ করি। ব্রাদার নুবাঙ্ককে আবার আমার অবাধ্য হওয়ার কথা বলে দেবেন না তো? তিনি ভালো, পবিত্র পুরুষ, তবে অনেক কঠোর হতে পারেন।
ঠিক কাজই করেছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। আস্তে করে ওকে খামচে ধরে রাখা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করল। তারপর হঠাৎ আরও নিবিড়ভাবে পরখ করতে টিপটিপের হাত তুলে নিল। তোমার ছয় আঙুল! বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।
স্পষ্টই হতবাক হয়ে গেছে টিপটিপ। হাত মুঠি বানিয়ে বিকৃতি আড়াল করার চেষ্টা করল সে। দেবতারা আমার গোটা শরীরটাই উল্টাপাল্টা করে বানিয়েছেন। আমার মাথা, চোখ, পিঠ, হাত-পা-আমার সমস্ত কিছুই বাঁকাচোরা, কিস্তুত। অশ্রুতে ভরে উঠল তার চোখ।
কিন্তু তোমার মনটা ভালো, ওকে সান্ত্বনা দিল তাইতা। আস্তে করে ওর হাত খুলল ও। স্বাভাবিক কনে আঙুলের পাশে হাতের তালু থেকে একটা বাড়তি ছোট্ট আঙুল গজিয়েছে।
ছয় আঙুল পথ দেখাবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা।
আমি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইনি, ম্যাগাস। আমি কোনওদিনই ইচ্ছাকৃতভাবে ওভাবে আপনাকে অসম্মান করতে যাব না। গুঙিয়ে উঠল টিপটিপ।
না, টিপটিপ, আমার দারুণ উপকার করেছ তুমি। আমার কৃতজ্ঞতা আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।
ব্রাদার নুবাঙ্ককে বলে দেবেন না তো?
না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।
আপনার উপর হাথরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ম্যাগাস। এবার যাই, ব্রাদার নুবাঙ্ক এলে দেখে ফেলবেন আমাকে। কাঁকড়ার মতো পাশ কেটে চলে গেল টিপটিপ। তাকে কিছুটা এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিল তাইতা, তারপর লাইব্রেরির ফিরতি পথ ধরল। মেরেন ও দিমিতার ওর আগেই এসে পড়েছে। টিপটিপকে গালমন্দ করছে নুবাঙ্ক: ছিলে কোথায়?
ল্যাট্রিনে গিয়েছিলাম, ব্রাদার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন কিছু খেয়েছি, পেটে গোলমাল বেধে গেছে।
আমার পেটেও গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছ তুমি, ব্যাটা দুর্গন্ধঅলা মলের টুকরো। ওখানেই নিজেকে রেখে আসা উচিত ছিল তোমার। টিপটিপের জন্মদাগের উপর আঘাত করল সে। যাও, এবার পুব সাগরের দ্বীপের বর্ণনাঅলা স্ক্রলগুলো নিয়ে এসো।
দিমিতারের পাশে বসে তেনমাস ভাষায় তাই বলল, বেচারার ডান হাতের দিকে একবার তাকান।
ওর ছয়টা আঙুল, বলে উঠলেন দিমিতার। ছয় আঙুল পথ দেখাবে! ওর কাছে কিছু জানতে পেরেছেন, নাকি পারেননি?
নীল মাতার ডান দিকের শাখা ধরেই উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের। ওখানেই এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির দেখা পাব। আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়ে আছে ইয়োস।
*
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই হাথরের মন্দির ত্যাগ করল ওরা। অনীহার সাথে ওদের বিদায় জানাল নুবাঙ্ক-এখনও পঞ্চাশটা আগ্নেয়গিরির বর্ণনা দেওয়া বাকি রয়ে গেছে তার। থেবসের নীচে নীলের ঘাটে যখন পৌঁছাল ওরা, তখনও অন্ধকার কাটেনি। পথ দেখিয়ে ওদের নদীর জলে নিয়ে এলো হাবারি ও মেরেন। তাইতা ও দিমিতার অনুসরণ করল। কিন্তু দুটি দলের মাঝে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হলো। নেতারা দুর্গন্ধময় লাল পুকুরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথে আধাআধি আগে বাড়ার পর কাদা ভেঙে এগোতে শুরু করল দিমিতারের উট। ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের উপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা একটা বৈরী প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা টের পেল। কানের পাশে শিরাটা দপদপ করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ারের নিত্যস্বর উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ও।
এইমাত্র ছেড়ে আসা তীরে এক নিঃসঙ্গ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের সাথে তার কালো জোব্বা মিশে গেলেও নিমেষে তাকে চিনে ফেলল তাইতা।
অন্তর্চক্ষু খুলতেই সোয়ের ভিন্ন ধরনের আভা দেখা দিল, মানুষটাকে যেন ঢেকে ফেলছে, অনেকটা বনফায়ারের শিখার মতো: রঙটা হিংস্র লাল, এখানে ওখানে পিঙ্গল ও সবুজ ছোপ। এমন ভয়ঙ্কর আভা এর আগে কখনও দেখেনি তাই।
সোয়ে এখানে! পালকিতে শোয়া দিমিতারের উদ্দেশে তাগিদ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে উটের পার হওয়ার পথের পুকুরের তলের দিকে ইঙ্গিত করল সোয়ে। যেন তার নির্দেশে সাড়া দিচ্ছে, এমনভাবে পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠল একটা বিশাল কুনো ব্যাঙ, কামড়ে উটের বাম পায়ের উরুর উপরের অংশ থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিল। ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জানোয়ারটা, পুকুর থেকে লাফ দিল। ওপারে যাবার বদলে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরই নদীর তলদেশের উপর দিয়ে ছুটল সবেগে। প্রবলবেগে এপাশ ওপাশ দোল খেতে লাগল দিমিতারের পালকি।
মেরেন! হাবারি! মেয়ারের পেটে লাথি হাঁকিয়ে ছুটন্ত উটের পিছু ধাওয়া শুরু করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা। বাহন ঘুরিয়ে নিল মেরেন ও হাবারি, পিছু ধাওয়ায় ওদের সামিল করতে তাগিদ দিতে লাগল।
শক্ত করে ধরে রাখুন, দিমিতার! চিৎকার করল তাইতা। আমরা আসছি! ওর পাছার নিচে যেন উড়াল দিচ্ছে উইন্ডস্মোক। কিন্তু দিমিতারের নাগাল পাওয়ার আগেই আরেক পুকুরে পৌঁছে গেল উটটা, জলের ধারা ছিটিয়ে ছুটতে লাগল সেটার ভেতর দিয়ে। তখুনি ওটার সামনেই ফাঁক হয়ে গেল পুকুরের জল, আরেকটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত উটের মাথায় চড়াও হয়ে বুলডগের মতো মরণ কামড় বসাল। নিশ্চয়ই কোনও স্নায়ুতে আঘাত করে থাকবে, উটের সামনের পাজোড়া ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ে ব্যাঙের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়তে লাগল ওটা। উটের নিচে চাপা পড়ে গেছে পালকিটা, ভারে নাজুক বাঁশের কাঠামো মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
দিমিতার! ওকে বাঁচাতেই হবে! চিৎকার করে মেরেনের উদ্দেশে বলল তাইতা। আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল মেয়ারকে। কিন্তু ওটা পুকুরের কিনারে পৌঁছার আগেই জলের নিচ থেকে উঠে এলো দিমিতারের মাথা। কোনওভাবে পালকি থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু কাদায় অর্ধেকটা ডুবে গেছেন। মাথায় আস্তরণ পড়ে গেছে, ক্রমাগত কাশছেন বেচারা, বমি করছেন, নড়াচড়া নাজুক, ভ্রান্তিময়।
আমি আসছি! চিৎকার করে বলল তাইতা। হাল ছাড়বেন না! তারপরই সহসা কুনো ব্যাঙে টগবগ করে ফুটতে শুরু করল গোটা পুকুর। তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দিমিতারের উপর, যেন এক পাল বুনো কুকুর কোনও গেযেল হরিণকে আক্রমণ করেছে। আর্তনাদ করার প্রয়াসে মুখ হাঁ হয়ে ছিল বুড়ো মানুষটার। কিন্তু কাদা বাধা দিচ্ছে। ব্যাঙের দল টেনে পানির নিচে নিয়ে গেল ওকে, ফের যখন সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে উঠে এলেন তিনি, ওর লড়াই প্রায় শেষের দিকে। জলের নিচের ব্যাঙগুলোই ওর নড়াচড়ার কারণ, খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে ওরা।
আমি এখানে, দিমিতার! মরিয়া হয়ে চিৎকার করল তাইতা। মেয়ার নিয়ে উন্মত্ত ব্যাঙগুলোর ভেতর যেতে পারছে না, জানে ঘোড়াটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওরা। লাগাম টেনে ছড়ি হাতে পিছলে নেমে এলো ও। পুকুরের জলের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল। কিন্তু জলের নিচে একটা ব্যাঙ পায়ে দাঁত বসাতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। ছড়ির আঘাত হানল ব্যাঙটাকে। আঘাতটাকে জোরাল করতে শারীরিক-মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ এক করে নিল। ছড়ির ডগা জায়গামতো আঘাত করতেই ধাক্কা অনুভব করল ও। ওকে ছেড়ে দিল জানোয়ারটা। চিত হয়ে জলের উপর উঠে এলো, হতচকিত, খিঁচুনির ঢঙে পা ছুঁড়ছে।
দিমিতার! ওকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত ব্যাঙের দল থেকে থেকে আলাদা করে চেনা দায়। চকচকে কালো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে মানুষ আর পশু।
হঠাৎ গিজগিজে ব্যাঙের ঝাঁকটাকে ফাঁক করে দুটি শীর্ণ বাহু উঠে এলো জলের উপর। দিমিতারের কণ্ঠস্বর কনে এলো ওর। আমি শেষ। আপনাকে একাই যেতে হবে, তাইতা। ওর কণ্ঠস্বর বলে চেনা মুশকিল, কাদা আর বিষাক্ত লাল পানিতে দম বন্ধ হয়ে এসেছে তার। এবং পরক্ষণেই অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বড় আকারের একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ওর মাথার এক পাশে কামড়ে ধরে শেষবারের মতো পানির নিচে নিয়ে যেতেই থেমে গেল সেটা।
আবার সামনে এগোল তাইতা। কিন্তু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেরেন। শক্তিশালী হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কাদা থেকে তুলে নিল ওকে, তারপর ফিরিয়ে আনল তীরে।
নামাও আমাকে, নিজেকে মুক্ত করতে লড়াই করছে তাইতা। ওকে বিশ্রী জানোয়ারগুলোর হাতে ফেলে রেখে যেতে পারব না। কিন্তু ছাড়ল না মেরেন।
ম্যাগাস, আপনি আহত। নিজের পায়ের দিকে একবার তাকান। ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন। লাল কাদার সাথে মিশে যাচ্ছে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত। দিমিতার শেষ হয়ে গেছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মেরেন। তাইতাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। ধূসর মেয়ারটাকে ধরতে ফিরে গেল ও, ওর কাছে পৌঁছে দিল ওটাকে। তাইতাকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করার সময় মৃদু কণ্ঠে বলল, আমাদের যেতেই হবে, ম্যাগাস। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনার ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যাঙের দাঁত বিষাক্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর কাদাও এমন জঘন্য যে আপনার মাংসে সংক্রমণ ঘটবে।
কিন্তু আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, বন্ধুর শেষ একটা চিহ্নের খোঁজ করছে। তার শেষ যোগাযোগের সন্ধান করছে। কিন্তু কোনওটাই দেখা গেল না। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে মেয়ারের লাগাম তুলে নিয়ে সামনে বাড়ল মেরেন, আর প্রতিবাদ করল না তাইতা। পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছে ও। প্রবীন সাধু চলে গেছেন, এখন বুঝতে পারছে ওর ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ও। এখন একাই ডাইনীর মোকবিলা করতে হবে। ওকে, সম্ভাবনাটা দারুণ হতাশায় ভাবিয়ে তুলল ওকে।
*
নিরাপদে থেবসের প্রাসাদের নিজেদের মহলে পৌঁছানোর পর তাইতাকে গোসল করিয়ে কাদা ধুয়ে ফেলতে বড় গামলা ভর্তি গরম পানি আর বোতল ভর্তি সুগন্ধি মলম পাঠাল রামরাম। ওকে খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর দুজন রাজচিকিৎসক এলেন। তাদের পেছনে একদল সহকারী, ওদের হাতে ওষুধ ও জাদুকরী তাবিজ ভরা বাক্স। তাইতার নির্দেশে ওদের দরজায় থেকেই বিদায় করে দিল মেরেন। মিশরের সবচেয়ে দক্ষ ও জ্ঞানী শল্যচিকিৎসক ম্যাগাস নিজেই তাঁর ক্ষতের পরিচর্যা করছেন। আপনাদের উদ্বেগের জন্যে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
পাতলা মদে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলল তাইতা। তারপর স্বয়ং-প্রভাবিত ঘোরে বাম পা অবশ করে নিল। তেলের কুপির আগুনে তপ্ত ব্রোঞ্জের একটা চামচ দিয়ে গভীর করে পাটা চিড়ল মেরেন। ওকে শেখানো তাইতার অন্যতম ডাক্তারী বিদ্যা এটা। ওর কাজ শেষে হলে উঠে দাঁড়াল তাইতা, উইন্ডস্মোকের এক গোছা লেজ সুতো হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষতস্থানের দুপ্রান্ত সেলাই করল। নিজের বানানো মলম লাগিয়ে লিনেনে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ করতে গিয়ে ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেল ও, দিমিতারকে হারানোর শোকে পূর্ণ। মাদুরে শুয়ে চোখ বুজল ও।
দরজার কাছে শোরাগোলের শব্দে চোখ মেলে তাকাল ও। পরিচিত কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, তাইতা, কোথায় তুমি? তোমাকে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না, এমন একটা বিপদ বাধালে যে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখন আর কচি খোকাটি নও! এই কথা বলে রোগীর ঘরে পা রাখলেন জগতের বুকে ঐশী ঈশ্বর ফারাও নেফার সেতি। লর্ড ও পরিচারকের দল অনুসরণ করল তাঁকে।
মনে হচ্ছে, তাইতার প্রাণশক্তি বেড়ে গেছে। ওর দৈহিক শক্তিও ফিরে এসেছে। যেন। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কোনওমতে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
তাইতা, লজ্জা নেই তোমার? ভেবেছিলাম মরতে চলেছ তুমি, অথচ এখন দেখছি বোকার মতো মুখে হাসি নিয়ে আরামে শুয়ে আছো?
জাঁহাপনা, এটা স্বাগত জানানোর হাসি, আপনাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি।
ওকে ঠেলে আবার বালিশে শুইয়ে দিলেন নেফার সেতি। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকলেন। মাই লর্ডস, আমাকে ম্যাগাসের কাছে রেখে যেতে পারো, ও আমার পুরোনো বন্ধু-শিক্ষক। প্রয়োজনে তোমাদের তলব করব। চেম্বার থেকে পিছু হটে বের হয়ে গেল ওরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে সামনে ঝুঁকলেন ফারাও। আইসিসের বুকের মিষ্টি দুধের দোহাই, তুমি নিরাপদে আছে দেখে খুশি হয়েছি, যদিও শুনেছি তোমার সঙ্গী ম্যাগাস গত হয়েছে। সব কিছু শুনতে চাই আমি, তবে তার আগে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে স্বাগত জানানোর সুযোগ দাও। মেরেনের দিকে তাকালেন তিনি। দরজায় পাহারায় রয়েছে সে। তাঁর সামনে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়াল মেরেন। কিন্তু ওকে টেনে দাঁড় করালেন ফারাও। আমার সামনে নিজেকে খাট করো না, লাল পথের সাথী। আন্তরিক আলিঙ্গনে ওকে বুকে টেনে নিলেন নেফার সেতি। তরুণ বয়সে এক সাথে যোদ্ধা হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ওরা; রথ চালানো, তলোয়ার চালনা ও তীর নিক্ষেপে দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষিত ও সুপরিচিত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দল বেঁধে লড়াই করেছেন ওরা, পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে বাধা দিতে হত্যাসহ যেকোনও অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। একসাথে বিজয় লাভ করেছিলেন ওরা। লাল পথের সাথীরা যোদ্ধার রক্তের সম্পর্কে ভাই, জীবনের জন্যে এক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেরেন নেফার সেতির বোন রাজকুমারী মেরিকারার সাথে বাগদত্ত। ফারাও আর ও বলতে গেলে বোন জামাই আর সম্মন্ধী। এতে ওদের বাধন আরও জোরাল হয়েছে। মেরেন হয়তো থেবসে উঁচু পদ ধারণ করতে পারত, কিন্তু তার বদলে তাইতার নবীশ হিসাবে নাম লিখিয়েছে।
তাইতা সব রহস্য শিখিয়েছে তোমাকে? তুমি শক্তিমান যোদ্ধার মতো ম্যাগাসও হতে পেরেছ? জানতে চাইলেন ফারাও।
না, জাঁহাপনা। তাইতার সীমাহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই মেধা নেই। এখনও একেবারে মামুলি কৌশলও আয়ত্ত করতে পারিনি। কয়েকটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ একটা ভাব করল মেরেন।
যেকোনও সময়ই একজন দক্ষ যোদ্ধা আনাড়ী জাদুকরের চেয়ে অনেক ভালো, পুরোনো বন্ধু। এসো, আমাদের সাথে সভায় বসো, অনেক আগে যেমনটা আমাদের রীতি ছিল, যখন আমরা স্বৈরাচারের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্যে লড়াই করছিলাম।
ওরা তাইতার মাদুরের দুপাশে বসার পর পরই সিরিয়াস হয়ে গেলেন নেফার সেতি। এবার কুনো ব্যাঙের সাথে তোমাদের মোকবিলার কথা বলো আমাকে।
পালা করে দিমিতারের মৃত্যুর বর্ণনা দিল তাইতা ও মেরেন। ওদের কথা শেষ হলে নীরব রইলেন নেফার সেতি। তারপর গর্জে উঠলেন। প্রতিদিন আগের চেয়ে বেপরোয়া আর হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারগুলো। আমি নিশ্চিত ওদের কারণেই নদীর জলাধারের অবশিষ্ট জল দূষিত ও নষ্ট হচ্ছে। ওগুলোর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভাবলেও দেখা গেছে একটাকে মারলে তার জায়গায় আরও দুটো এসে হাজির হচ্ছে।
জাঁহাপনা, বলে এক মুহূর্ত থামল তাইতা, তারপর ফের খেই ধরল, আপনাকে আগে ওদের যে সৃষ্টি করেছে সেই ডাইনীর খোঁজ পেতে হবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে। আপনার ও আপনার রাজ্যে তার পাঠানো কুনো ব্যাঙ আর অন্যান্য রোগ তার সাথেই মিলিয়ে যাবে, কারণ সেই এসবের মালিক। তারপর নীল নদ আবার বইবে, মিশরে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।
সতর্ক চোখে ওর দিকে তাকালেন নেফার সেতি। তবে কি ধরে নেব প্লেগগুলো প্রাকৃতিক নয়? জানতে চাইলেন তিনি। এক নারীর জাদুমন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছে এগুলো?
সেটাই আমার বিশ্বাস, তাঁকে নিশ্চিত করল তাইতা।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নেফার সেতি, পায়চারি শুরু করলেন। আপন ভাবনায় ডুবে গেছেন। অবশেষে থেমে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকালেন। কে এই ডাইনী? কোথায় সে? তাকে ধ্বংস করা যাবে, নাকি সে অমর?
আমার বিশ্বাস সে মানুষ, ফারাও, তবে তার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। নিজেকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করতে পারে সে।
কী নাম তার?
ইয়োস।
ভোরের দেবী? দেবদেবীদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে পুরোহিতরা ভালোমতোই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। কারণ তিনি স্বয়ং একজন দেবতা। এই না বললে সে মানুষ?
মানুষই, নিজের পরিচয় গোপন করতে দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে।
তাই যদি হয়, তার নিশ্চয়ই একটা জাগতিক আবাস রয়েছে। সেটা কোথায়, তাইতা?
দিমিতার আর আমি তারই খোঁজ করছিলাম, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে ফেলেছে সে। ওকে আক্রমণ করাতে প্রথমে একটা বিশাল পাইথন পাঠিয়েছিল, কিন্তু মেরেন আর আমি মিলে ওকে বাঁচাই, যদিও প্রায় মরার দশা হয়েছিল তার। পাইথন ব্যর্থ হলেও এবার কুনো ব্যাঙ দিয়ে সফল হয়েছে সে।
তার মানে ডাইনীকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা নেই তোমার? লেগে রইলেন নেফার সেতি।
নিশ্চিত করে না জানলেও অলৌকিক ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, একটা আগ্নেয়গিরিতে থাকে সে।
আগ্নেয়গিরি? কোনও ডাইনীর পক্ষেও কি সম্ভব? বলে হেসে উঠলেন তিনি। অনেক আগেই তোমাকে সন্দেহ না করতে শিখেছি আমি, তাইতা। কিন্তু বলো দেখি, কোন আগ্নেয়গিরি? অনেক আছে অমন।
আমার বিশ্বাস সেটার সন্ধান পেতে হলে নীলের উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের, কেবুইয়ের উজানে নদীর পথ আটকে দেওয়া সেই বিশাল জলা ভূমির ওধারে। এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির ভেতর তার আস্তানা। জগতের একেবারে শেষ সীমার কোথাও।
আমি ছোট থাকতে তুমি বলেছিলে আমার দাদী রানি লস্ত্রিস নদীর উৎস খুঁজে বের করতে লর্ড আকেরের নেতৃত্বে দক্ষিণে একদল সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। কেবুইয়ের ওই ভয়ঙ্কর জলাভূমির ওধারে হারিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর ফিরে আসেনি। ওই অভিযানের সাথে ইয়োসের সম্পর্ক থাকতে পারে?
আছে, আঁহাপনা, সায় দিল তাইতা। সেই বাহিনীর একজন মাত্র জীবিত সদস্য আবার কেবুইতে ফিরে এসেছিল, সেকথা আপনাকে বলেছি না?
গল্পের এই অংশের কথা আমার মনে নেই।
সেই সময় ব্যাপারটাকে তাৎপর্যহীন ঠেকেছে, তবে একজন ফিরে এসেছিল। লোকটা প্রলাপ বকছিল, দিশাহারা ছিল সে। চিকিত্সকরা মনে করেছিল যাত্রার ভোগান্তির কারণেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার। আমি ওর সাথে কথা বলার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু ইদানীং জানতে পেরেছি, মারা যাবার আগে অদ্ভুত কথা বলে গেছে সে যা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আমাকে সেসব বলেনি ওরা। দুনিয়ার শেষ মাথায় বিশাল হ্রদ ও পাহাড়ের কথা বলেছিল সে…আর সবচেয়ে বড় হ্রদের পাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি। এই কিংবদন্তী থেকেই দিমিতার আর আমি ডাইনীর অবস্থান জানতে পেরেছি। কুজো টিপটিপের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানাল ও।
মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলেন নেফার সেতি। তাইতার কথা শেষ হলে ভাবলেন খানিকক্ষণ; তারপর জানতে চাইলেন, আগ্নেয়গিরির এত গুরুত্ব কেন?
জবাবে ইয়োসের আস্তানায় দিমিতারের বন্দিত্ব ও পলায়নের কাহিনী বলল তাইতা।
ডুবো আগুনকে হাপর হিসাবে ব্যবহার করে জাদু সাজায় সে। প্রবল তাপ থেকে আসা শক্তি ও সালফারের গ্যাস তার ক্ষমতাকে দেবতার কাছাকছি পর্যায়ে নিয়ে যায়। ব্যাখ্যা করল তাইতা।
এত শত শত আগ্নেয়গিরি থাকতে এটাকেই সবার আগে পরখ করার জন্যে বেছে নিলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি।
কারণ মিশরের অনেক কাছে এটা, নীল নদের ঠিক উৎসের মুখে।
বুঝতে পারছি তোমার যুক্তি অকাট্য। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, বললেন নেফার সেতি। সাত বছর আগে নীল নদ মরে যাবার সময় দাদীর অভিযান সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলেছিল সব মনে পড়ে যায় আমার, তাই আরেকটা বাহিনী একই মিশনে উৎসে গিয়ে নদীর মরে যাবার কারণ অনুসন্ধানে পাঠিয়েছিলাম। নেতৃত্বে দিয়েছিলাম কর্নেল আহ-আখতনকে।
এই খবর আমার জানা ছিল না, বলল তাইতা।
তার কারণ আলোচনার করার জন্যে ছিলে না তুমি। মেরেন আর তুমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। নেফার সেতির কণ্ঠে ভৎর্সনা। আমার সাথে থাকা উচিত ছিল তোমার।
অনুশোচনার একটা ভাব ধরল তাই। আমাকে যে আপনার প্রয়োজন সেকথা আমার জানা ছিল না, আঁহাপনা।
তোমাকে সব সময়ই আমার প্রয়োজন হবে, ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয় এই অভিযানের খবর কী? চট করে সুযোগটা লুফে নিল তাইতা। ফিরে এসেছে?
না, ফেরেনি। কুচকাওয়াজ করে যাওয়া আটশো লোকের একজনও ফেরেনি। দাদীর সেই দলের চেয়ে আরও ভালোভাবে উধাও হয়ে গেছে। ডাইনী কি ওদেরও শেষ করেছে?
সেটা খুবই সম্ভব, জাঁহাপনা, নেফার সেতি এরই মধ্যে ডাইনীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, বুঝতে পারল তাইতা। তাকে ধাওয়া করার জন্যে নতুন করে বিশ্বাস করানো বা উৎসাহিত করার দরকার হলো না।
আমাকে কখনও নিরাশ করোনি তুমি, তাইতা, কেবল যখন একমাত্র দেবতারাই জানেন কোথায় বেড়াতে চলে যাও তখন ছাড়া। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন নেফার সেতি। এখন আমি আমার শত্রুর পরিচয় জানি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার জনগণের উপর থেকে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো দূর করতে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কেবল কুয়ো খনন, শত্রুর কাছে খাবার ভিক্ষা আর ব্যাঙ মারায় পর্যবসিত হয়েছিল আমার সব কাজ। এখন আমার সমস্যার সমাধানের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। ডাইনীটাকেই খতম করতে হবে!
লাফ দিয়ে উঠে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। কাজের লোক তিনি, তলোয়ার হাতে নিতে সব সময় প্রস্তুত। যুদ্ধের ভাবনা তাঁর চেতনাকে তরতাজা করে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা ও মেরেন, একের পর এক নানা বুদ্ধির জোয়ার খেলে যাচ্ছে তার মাথায়। খানিক পরপরই পাশের তলোয়ারের খাপে চাপড় মারছেন, চিৎকার করে বলে উঠছেন, হ্যাঁ, হোরাস ও অসিরিসের দোহাই, তাই করব! অবশেষে তাইতার দিকে ফিরলেন তিনি। ইয়োসের বিরুদ্ধে আরেকটা বাহিনীর নেতৃত্ব দেব আমি।
ফারাও, এরই মধ্যে দু-দুটি মিশরিয় বাহিনী গ্রাস করে নিয়েছে সে, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
একটু স্থির হলেন নেফার সেতি। ফের পায়চারি শুরু করলেন। থামলেন আবার। ঠিক আছে। এতনায় দিমিতার যেমন করেছে তুমিও ঠিক তেমনি ওই ডাইনীর বিরুদ্ধে এমন এক জাদু শক্তি কাজে লাগাবে যাতে পাহাড় থেকে টসটসে পাকা ফলের মতো মাটিতে পড়ে ফেটে যাবে সে। তোমার কী মত, তাতা?
জাঁহাপনা, ইয়োসকে ভুল বুঝবেন না। দিমিতার আমার চেয়ে ঢের বড় মাপের ম্যাগাস ছিলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাইনীর মোকবিলা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে ধ্বংস করে দিয়েছে সে। বলতে গেলে কোনও রকম কষ্ট ছাড়াই। ঠিক যেভাবে আপনি দুহাতের আঙুলে কাঠি ভেঙে ফেলেন। দুঃখের সাথে মাথা নাড়ল তাইতা। আমার জাদু জেভলিনের মতো। দূরে ছুঁড়ে দিলে দুর্বল হয়ে যাবে, তখন তার বর্মে ঠিকরে গিয়ে সহজেই ব্যর্থ হবে। তার কাছাকাছি গিয়ে ঠিক মতো অবস্থান বের করতে পারলে আমার নিশানা অনেক ভালো হবে। তাকে চোখের সামনে পেলে হয়তো আমার তীর তার বর্ম ভেদ করতে পারবে। এত দূর থেকে ওকে স্পর্শ করতে পারব না।
সে দিমিতারকে খতম করার মতো ক্ষমতাধর হয়ে থাকলে তোমারও একই দণা করল না কেন? চট করে নিজের প্রশ্নে জবাব দিলেন তিনি। কারণ তোমাকে নিজের চেয়ে শক্তিশালী মনে করে সে।
ব্যাপারটা এত সহজ হলেই ভালো ছিল। না, ফারাও, তার কারণ এখনও সম্পূর্ণ ক্ষমতায় আমাকে আক্রমণ করেনি সে।
বিভ্রান্ত দেখাল নেফার সেতিকে। কিন্তু দিমিতারকে হত্যা করেছে সে, আমার সাম্রাজ্যকে বৈরিতার ঘানিতে দুমড়ে দিয়েছে। তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে কেন?
দিমিতারকে তার আর দরকার ছিল না। আপনাকে তো বলেছি ওর হাতে বন্দি থাকার সময় কীভাবে বিশাল রক্তচোষার মতো তাঁর সব বিদ্যা আর দক্ষতা শুষে নিয়েছিল সে। ও পালিয়ে যাবার পর তেমন মরিয়া হয়ে ওর খোঁজ করেনি। ওর জন্যে হুমকি ছিলেন না তিনি। ওর কাছে কিছু পাওয়ারও ছিল না। মানে, ওর সাথে আমার ঐকবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তখন আবার তার আগ্রহ দেখা দেয়। আমরা একসাথে এমন তাৎপর্যময় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম যে আমার উপস্থিতি বুঝতে পারছিল সে। দিমিতারের মতো আমাকেও শুষে শেষ না করে ধ্বংস করতে চাইবে না সে, তবে আমাকে নিঃসঙ্গ না করা পর্যন্ত ফাঁদে ফেলতে পারবে না। তাই আমার মিত্রকে শেষ করেছে।
তোমাকে তার অশুভ উদ্দেশ্যে বন্দি করতে চাইলে তোমার সাথে আমার সেনাবাহিনীকেও নিয়ে যাব আমি। তুমি হবে আমার শিকারের ঘোড়া। তোমাকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে আসার টোপ হিসাবে ব্যবহার করব, তুমি ওর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার পর দুজনে মিলে আক্রমণ করব ওকে। প্রস্তাব রাখলেন নেফার সেতি।
মরিয়া ব্যবস্থা, ফারাও। আপনাকে যেখানে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারবে সেখানে কেন আপনাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে সে, যেমনটা দিমিতারের বেলায় করেছে?
তোমার কথায় মনে হচ্ছে, মিশরের অধিকার চায় সে। বেশ, ভালো কথা, ওকে বলব আত্মসমর্পণ করতে ও আমার দেশ ওর হাতে তুলে দিতে এসেছি। নিবেদনের অংশ হিসাবে ওর পায়ে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাইব।
গম্ভীর চোহার ধরে রাখল তাইতা। যদিও এমনি আনাড়ী পরামর্শ শুনে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছিল। জাঁহাপনা, ডাইনীটা কিন্তু মোহন্ত।
সে আবার কী? জানতে চাইলেন নেফার সেতি।
অন্তর্চক্ষু দিয়ে আপনি যেভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখেন ঠিক সেভাবে মানুষের আত্মা দেখতে পারে সে। আপনার আভায় অমন ক্রোধের বিচ্ছুরণ নিয়ে কোনওদিনই তার ধারে কাছে যেতে পারবেন না।
তাহলে তার রহস্যময় চোখে ধরা না পড়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে যাওয়া যাবে বলে মনে করো?
ওর মতো আমিও একজন মোহন্ত। সে টের পাবে এমন কোনও আভা ছড়াই আমি।
রেগে উঠছেন নেফার সেতি। দীর্ঘদিন ধরেই দেবতা আছেন বলে কোনও বাধা বা বিঘ্ন সহ্য করতে পারেন না। চড়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর: তোমার ভাবের কথায় ভোলার মতো এখন আর ছোট খোকাটি নেই আমি। আমার পরিকল্পনায় ঝটপট খুঁত বের করছ তুমি, বললেন তিনি। বিজ্ঞ ম্যাগাস, দয়া করে এমন একটা বিকল্প প্রস্তাব রাখ যাতে আমারগুলোর বেলায় যেমন করেছ আমিও তেমন করতে পারি।
আপনি ফারাও, আপনিই মিশর। কোনওভাবেই আপনি তার পেতে রাখা ফাঁদে গিয়ে পড়তে পারেন না। এখানে জনগণ, মিনতাকা ও সন্তানদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। আমি ব্যর্থ হলে যেন ওদের বাঁচাতে পারেন।
তুমি শয়তানীতে নিপূন একটা বদমাশ, তাতা। কোন দিকে এগোচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমাকে এখানে ব্যাঙ মারার কাজে রেখে তুমি আর মেরেন আরেকটা অভিযানে নামবে। আমাকে নিজের হেরেমে মেয়েমানুষের মতো কুকড়ে থাকতে হবে? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
উঁহু, আঁহাপনা, সিংহাসনে আসীন গর্বিত ফারাওর মতো জীবন দিয়ে দুটি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে তৈরি থাকবেন আপনি।
মুঠি পাকানো হাতজোড়া কোমরের কাছে রাখলেন নেফার সেতি। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তোমার মধুর সঙ্গীত শোনা ঠিক হচ্ছে না আমার। যেকোনও ডাইনীর মতোই শক্তিশালী ফাঁদ পাততে পারো তুমি। তারপর হালছাড়ার ঢঙে হাত মেলে দিলেন। গেয়ে যাও, তাতা, বাধ্য হয়েই শুনব আমি।
মেরেনকে ছোটখাট একটা বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন, বেশি না, বাছাই করা শখানেক সৈনিক হলেই চলবে। দ্রুত আগে বাড়বে ওরা, বিরাট রসদের কাফেলা ছাড়াই জমির বিভিন্ন জিনিসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারবে। কেবল সংখ্যা ডাইনীর পক্ষে কোনও হুমকী নয়। এই আকারের একটা বাহিনী নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে না সে। মেরেনের তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোর মতো কোনও মানসিক আভা না থাকায় ওকে সে ধোকা, সাধারণ সৈনিক হিসাবে পরখ করবে। ওর সাথে যাব আমি। অনেক দূর থেকে আমাকে চিনতে পরবে সে, কিন্তু কাছে গিয়ে আসলে তার খেলার সামগ্রীতেই পরিণত হতে যাচ্ছি। আমার কাছ থেকে কাক্ষিত জ্ঞান ও ক্ষমতা কেড়ে নিতে আমাকে কাছে যেতে দিতেই হবে তাকে।
সবেগে পায়চারি করতে করতে চাপা কণ্ঠে গজগজ করতে লাগলেন নেফার সেতি। অবশেষে ফের তাইতার মুখোমুখি হলেন: অভিযানের নেতৃত্বে থাকতে না পারাটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তোমার প্যাঁচানো যুক্তি আমার বুদ্ধি ঘোলা করে দিয়েছে। খানিকটা স্বাভাবিক হলো তার রাগত চেহারা। মিশরের সব পুরুষের ভেতর মেরেন ক্যাম্বিসেস আর তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি আমি। মেরেনের দিকে ফিরলেন তিনি। কর্নেলের পদ পাবে তুমি। পছন্দমতো একশোজনকে বেছে নাও, তোমাকে আমার রাজকীয় বাজপাখীর সিলমোহর দেব যাতে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে ওদের সজ্জিত করতে পারো ও আমার রাজ্যর যেকোনও জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে পারো। বাজপাখীর সীলমোহর ফারাও-এর ক্ষমতা বাহকের হাতে হস্তান্তর করে। আমি চাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব লোক লস্কর নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হও তুমি। সব ব্যাপারে তাইতার পরামর্শ মোতাবেক চলবে। ডাইনীর মুণ্ড নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো।
*
মেরেনের অভিজাত অশ্বারোহীদের নিয়ে একটাঝটিকা বাহিনী গড়ার কথা রাষ্ট্র Cমহয়ে যাওয়ামাত্র স্বেচ্ছাসেবীর দল ঘিরে ফেলল ওকে। তিন জন পোড়খাওয়া সৈনিককে ক্যাপ্টেন হিসাবে বেছে নিল ওঃ হিলতো-বার হিলতো, শাবাকো ও তুনকা। গৃহযুদ্ধের সময় এদের কেউই ওর সাথে লড়াইতে অংশ নেয়নি-তখন অনেক কম বয়সী ছিল ওরা-তবে ওদের বাবা ও দাদারা লাল পথের সঙ্গী ছিল।
যোদ্ধার রক্ত সত্যিকারের বীরের জন্ম দেয়, তাইতার কাছে ব্যাখ্যা করল মেরেন। ওর চতুর্থ বাছাই ছিল হাবারি, ওকে পছন্দ ও বিশ্বাস করে ফেলেছে ও। ওকে চারটি প্লাটুনের একটার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিল সে।
চার ক্যাপ্টেনেরই পরীক্ষা নিয়ে ওদের নির্বাচন নিশ্চিত করল; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করল: তোমার স্ত্রী বা মেয়েমানুষ আছে? আমরা যতদূর সম্ভব কম রসদ নেব সাথে। ক্যাম্পফলোয়ারদের জন্যে কোনও জায়গা নেই আমাদের এখানে। মিশরিয় সেনারা ঐতিহ্যগতভাবে যার যার মেয়েমনুষ নিয়ে পথ চলে।
আমার স্ত্রী আছে, জানাল হাবারি। কিন্তু পাঁচ বছর ওর মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে পারলেই বরং খুশি আমি, দশ কি আরও বেশি হলেও ক্ষতি নেই। যদি আপনার দরকার হয়, কর্নেল। এই যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হলো বাকি তিনজন।
কর্নেল, আমাদের জমিনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হলে যেখানে মিলবে সেখানেই মেয়েমানুষ বেছে নিতে পরব, বলল হিলতে-বার-হিলতো, বুড়ো হিলতোর ছেলে, অনেক আগেই মারা গেছে সে। দশ-হাজারের-ভেতর-সেরা ছিল সে, প্রশংসার স্বর্ণ জয় লাভ করেছিল; ইসমালার যুদ্ধে নকল ফারাওকে উচ্ছেদ করার পর খোদ ফারাও পরিয়ে দিয়েছিলেন ওর গলায়।
সত্যিকারের সৈনিকের মতো কথা, হেসে বলল মেরেন। যার যার প্লাটুন বাছাই করার ক্ষমতা নির্বাচিত চারজনের হাতে তুলে দিল ও। দশ দিনেরও কম সময়ের ভেতর গোটা মিশরিয় সেনাবাহিনী থেকে নিখুঁত এক শো জন যোদ্ধা বাছাই করে ফেলল ওরা। প্রত্যেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, দুটো চার্জার ও একটা প্যাক মিউল বেছে নিতে আস্তাবলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওদের। ফারাওর নির্দেশ মোতাবেক থেবস থেকে নতুন চাঁদ ওঠার দিন যাত্রা শুরু করতে তৈরি হলো ওরা।
বিদায়ের দুই দিন আগে নদী পেরুল তাইতা, রানি মিনতাকার কাছ থেকে বিদায় নিতে মেমননের প্রাসাদে গেল। আগের চেয়ে বেশ কৃশ হয়ে গেছেন তিনি, চেহারা মলিন। ওদের সাক্ষাতের প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরই ওর কাছে কারণ ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
ওহ, তাতা, প্রিয় তাতা। ভীষণ একটা ঘটনা ঘটেছে। সোয়ে উধাও হয়ে গেছেন। আমার কাছে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। তুমি ওকে আমার আম দরবারে দেখার তিনদিন পরেই উধাও হয়ে যান তিনি।
অবাক হলো না তাইতা। সেদিনই ছিল দিমিতারের ভীতিকর মৃত্যুর ক্ষণ।
ওর খোঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছি। তাইতা, জানি, আমার মতোই বিচলিত বোধ করবে তুমি। ওকে চিনতে, সমীহ করতে। ওর মাঝে মিশরের মুক্তি দেখেছিলাম আমরা। তোমার বিশেষ জাদুকরী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ওকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবে না? তিনি চলে যাওয়ায় আমি আর কোনওদিনই আমার বাচ্চাদের মুখ দেখতে পাব না। মিশর ও নেফার চিরন্তন যন্ত্রণায় ভুগবে। নীলও আর কখনওই বইবে না।
ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাইতা। বুঝতে পারছে রানির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, হতাশার চাপে ওর গর্বিত চেতনা ভেঙে পড়ার উপান্তে পৌঁছে গেছে। মিনতাকাকে আশা দেওয়ার সময় মনে মনে ইয়োস ও তার অপকর্মের শাপশাপান্ত করল ও। মেরেন আর আমি দক্ষিণ সীমান্তের ওধারে অভিযানে যাচ্ছি। যাবার পথে প্রতিটি কোণে সোয়ের খোঁজ করাটাকে আমার প্রথম দায়িত্বে পরিণত করব। আমার ধারণা সে বেঁচে আছে, কোনও ক্ষতি হয়নি। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও ঘটানপ্রবাহ হুট করে আপনাকে না জানিয়েই বিদায় নিতে বাধ্য করেছে তাকে, মহারানি। তবে নতুন নামহীন দেবীর নামে মিশন চালু রাখতে প্রথম সুযোগেই ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে তার। সবই আসলে যুক্তিসঙ্গত অনুমান, নিজেকে বলল তাইতা। এবার আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আপনার কথা সব সময় আমার মনে আর অনুগত ভালোবাসায় থাকবে।
এখন নীল নদে জাহাজ চালানোর উপায় নেই, তাই মৃতপ্রায় নদীর তীর বরাবর ওয়্যাগন রোড বেছে নিল ওরা। প্রথম এক মাইল তাইতার পাশাপাশি এগোলেন ফারাও, নির্দেশ ও পরামর্শে ভারাক্রান্ত করে তুললেন ওকে। তিনি ফিরতি পথ ধরার আগে বাহিনীর উদ্দেশে আন্তরিক উদাত্ত আহবান জানিয়ে ভাষণ দিলেন: আশা করছি সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করবে, শেষ করলেন তিনি, তারপর ওদের সামনে তাইতাকে আলিঙ্গন করলেন। উল্লাস করে তাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে দিল ওরা।
এমনভাবে যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছে তাইতা যাতে রোজ সন্ধ্যায় নীলের তীর বরাবর অবস্থিত উচ্চ রাজ্যের অসংখ্য মন্দিরের কোনও একটার কাছে পৌঁছাতে পারে। প্রতিটি মন্দিরেই দেখা গেল ওর আগেই ওর খ্যাতি পৌঁছে গেছে। প্রধান পুরুত ওকে স্বাগত জানাতে আর লোকজনকে আশ্রয় দিতে বেরিয়ে এলেন। ওদের আপ্যায়ন ছিল আন্তরিক, কারণ মেরেনের কাছে রাজার বাজপাখির সীলমোহর রয়েছে, প্রতিটি শহরের পাহারায় নিয়োজিত সামরিক দুর্গের কোয়ার্টার মাস্টারদের কাছ থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহে সাহায্য করছে সেটা। পুরোহিতদের আশা এর ফলে ওদের সামান্য খাদ্য মওজুত আরও বেড়ে উঠবে।
রোজ সন্ধ্যায় খাবার ঘরে সামান্য খাবারের পর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে অবস্থান নিচ্ছে তাইতা। শত শত বা এমনকি হাজার বছর ধরে এইসব জায়গায় উপাসনার যোগাড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পূজকদের উৎসাহ আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে, এমনকি ইয়োসের পক্ষেও যা ভেদ করা কঠিন হবে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ডাইনীর নজরদারী থেকে দূরে থাকতে পারবে ও। ওকে বেপথু করতে ডাইনীর পাঠানো অশুভ অভিশাপের ভয় না করেই আপন দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে পারবে। প্রতিটি মন্দিরের নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশে ডাইনীর বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াইয়ের জন্যে শক্তি ও নির্দেশনা পেতে প্রার্থনা করল ও। এমনি পরিবেশের নির্জনতা ও প্রশান্তির ভেতর শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে নিজেকে বলীয়ান করে তুলতে সক্ষম হলো।
মন্দিরগুলো প্রতিটি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু ও শিক্ষার ভাণ্ডার। পুরোহিতদের অনেকেই মোটামাথার লোক হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু শিক্ষিত ও আলোকিত, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সজাগ তারা, দলের মনোভাব সম্পর্কে অবগত। তথ্য ও গোপন বিষয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস ওরা। ওদের সঙ্গে আলোচনার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিল তাইতা। নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল ওদের। সবাইকেই একই প্রশ্ন করল: তোমাদের লোকদের ভেতর কারও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা শুনেছ, এক নতুন ধর্মের প্রচার করছে?
প্রত্যেকেই জানালেন, হ্যাঁ শুনেছেন। পুরোনো দেবতারা ব্যর্থ হতে চলেছেন বলে প্রচার করছে ওরা, তাঁরা আর মিশরকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। নতুন এক দেবীর কথা বলছে যিনি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হবেন, তারপর নদী ও দেশের উপর থেকে অভিশাপ তুলে নেবেন। তিনি এসে প্লেগকে বিদায় জানাবেন, তখন নীল মাতার বুকে ফের বান ডাকবে, মিশরকে আবার সৌন্দর্য ফিরিয়ে দেবে। লোকজনকে ওরা বলছে যে ফারাও ও তার পরিবার এই নতুন দেবীর গোপন অনুসারী। অচিরেই নেফার সেতি পুরোনো দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে নতুন দেবীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবেন। তারপর উদ্বিগ্ন জানতে চাইলেন, মহান ম্যাগাস, আমাদের বলুন, এটা সত্যি? ফারাও সত্যিই এই বিদেশী দেবীর কাছে মাথা নোয়াবেন?
এমন কিছু ঘটার আগে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো সব তারা খসে পড়বে। ফারাও হোরাসের ভক্ত, কায়মনোবাক্যে, ওদের আশ্বস্ত করেছে ও। তবে একটা কথা বলো, লোকজন এই ভণ্ডদের কথায় বিশ্বাস করছে?
ওরা তো মানুষ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিরাট গাড্ডায় পড়েছে এখন, যেই ওদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তির কথা বলবে তাকেই মানবে।
এই যাজকদের কারও সাথে তোমাদের দেখা হয়েছে?
কারওই না। ওরা গোপনে গা বাঁচিয়ে চলছে, বললেন একজন। ওদের বিশ্বাস ব্যাখ্যা করে বোঝানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তাবাহক পাঠালেও কেউই আসেনি।
কারও নাম জানতে পেরেছ?
মনে হচ্ছে সবাই একই নাম ব্যবহার করছে।
সেটা কি সোয়ে? জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ, ম্যাগাস, এ নামটাই ব্যবহার করছে ওরা। সম্ভবত এটা নামের চেয়ে বরং কোনও পদবীই হবে।
ওরা মিশরিয় নাকি বিদেশী? মাতৃভাষার মতোই আমাদের ভাষায় কথা বলে?
শুনেছি তাই বলে, আমাদের মতো একই রক্তের দাবী করছে ওরা।
এই যাত্রা যার সাথে কথা বলছিল ও, তাঁর নাম সেনাপি, উচ্চ মিশরের তৃতীয় নোমর খুম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তাঁর বক্তব্য শোনার পর তাই এবার আরও মামুলি প্রসঙ্গে ফিরে এলো: প্রাকৃতিক জ্ঞানের একজন বিশারদ হিসাবে আপনি কি এমন কোনও পথ বের করার চেষ্টা করেছেন যাতে নীলের লাল পানি আবার মানুষের ব্যবহারের উপযোগি করে তোলা যায়?
একথা শুনে ভীত হয়ে উঠলেন মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষটা। ওটা অভিশপ্ত নদী। ওখানে কেউ ম্লান করতে যায় না, কেউ ওই পানি মুখে নেয় না। যারা খায়, অল্পদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তারা, অক্কা পায়। নদীটা এখন রাক্ষুসে লাশখেকো কুনো ব্যাঙের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মিশর বা অন্য কোনও দেশে এমন ঘটনা কোনও দিন দেখা যায়নি। হিংস্রভাবে পচা পুকুরগুলো পাহারা দিচ্ছে ওরা। কেউ আগে বাড়লেই হামলা করছে। ওই বিষ মুখে তোলার চেয়ে বরং মরতে রাজি আছি। জবাব দিলেন সেনাপি, তার অভিব্যক্তি বিতৃষ্ণার ভঙ্গিতে বেঁকে গেল। এমনকি মন্দিরের নবীশরাও বিশ্বাস করে যে কোনও ক্ষুব্ধ দেবতা নদীকে অভিশপ্ত করে দিয়েছেন।
তো তাইতা নিজেই লাল স্রোতের আসল প্রকৃতি জানা ও নীলের জলকে বিশুদ্ধ করে তোলার একটা উপায় বের করতে বেশ কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে হাত দিল। সেনাদলকে কষ্টকর গতিতে দক্ষিণে ঠেলে নিয়ে চলছিল মেরেন। জলের সামান্য সরবরাহে কোনও রকম সংযোজন করতে না পারলে অচিরেই ঘোড়াগুলো পিপাসায় প্রাণ হারাবে, এটা জানে সে। ফারাওর সদ্য খোঁড়া কূপগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, কঠোরভাবে আগে বাড়ানো প্রায় তিনশো ঘোড়ার প্রয়োজনের তুলনায় ওগুলোর সরবরাহ অপ্রতুলই বলা চলে। এটা ছিল যাত্রার সহজতম পর্যায়। প্রথম শাখা ধারার শাদা পানির উপরে ওঠার পর নদীটা কঠিন ভীতিকর মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার লীগ চলে গেছে, ওখানে কোনও কুয়োর দেখা মিলবে না। শত বছরে একবার বৃষ্টি হয় ওখানে, কাঁকড়া বিছা আর ওরিক্সের মতো বুনো প্রাণীর আখড়া, এরা নিষ্ঠুর সূর্যের রাজত্বে ভূপৃষ্ঠের পানি ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে। পানির নির্ভরযোগ্য একটা উৎসের খোঁজ করতে না পারলে অমন প্রচণ্ড গা পোড়ানো বন্ধ্যাভূমিতে শেষ হয়ে যাবে এই অভিযান, কোনওদিনই নীলের উৎসে পৌঁছাতে পারবে না, সফল হওয়া তো পরের কথা।
প্রতিটি নিশি-শিবিরে পরীক্ষার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে তাই। মেরেনের চারজন তরুণ ট্রুপার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছে। মহান ম্যাগাসের সাথে কাজ করতে পেরে গর্বিত ওরা: এই গল্প নাতীপুতিদের বলে বেড়াবে। তাই নির্দেশ দেওয়ার সময় দৈত্য-দানোর ভয় করছে না ওরা। কারণ ওদের রক্ষা করার বেলায় তাইতার ক্ষমতায় ওদের অগাধ বিশ্বাস। রাতের পর রাত খেটে চলেছে ওরা, কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু এমনকি ম্যাগাসের মেধাও পচা পানিকে সুপেয় করে তোলার মতো কোনও উপায় বের করতে পারল না।
কারনাক থেকে রওয়ানা দেওয়ার সতের দিন পর কোম ওম্বোয় নদীর তীরে হাথরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির এলাকায় পৌঁছাল ওরা। যথারীতি বিখ্যাত ম্যাগাসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন প্রধান পুরোহিতীনি। নীলের পানি সেদ্ধ করতে সাহায্যকারীদের তামার পাত্র চুলোর উপর বাসাতে দেখে ব্যাপারটা ওদের উপর ছেড়ে দিল তাইতা, তারপর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাস মহলে চলে গেল।
ভেতরে পা রাখতে যা দেরি, পরক্ষণেই এক ধরনের করুণাময় প্রভাবের উপস্থিতি টের পেল ও। গরু দেবীর প্রতিমার সামনে চলে এলো ও। ওটার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। দিমিতার ওকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করতে ওর দেখা ডাইনীর গড়ে তোলা লস্ত্রিসের ছবি প্রায় বিশ্বাসের অতীত মন্তব্য করার পর আর রানিকে আহ্বান করার সাহস করে ওঠেনি। তবে এখানে দেবনিচয়ের অন্যতম শক্তিশালী দেবী হাথরের প্রতিরক্ষা রয়েছে ওর। পৃষ্ঠপোষকরা সবাই মেয়ে হওয়ায় তিনি নিশ্চিতভাবেই লস্ত্রিসকে নিজের খাসমহলে আশ্রয় দেবেন।
উপাস্যের মুখোমুখি হতে তিনবার প্রয়োজনীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে অন্তর্চক্ষু খুলে নীরবতার ছায়ায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ও। ক্রমশঃ কানের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনে নীরবতা ভঙ্গ হতে লাগল। ওর দিকে এগিয়ে আসা আধ্যাত্মিক সত্তার আভাস জোরাল হয়ে উঠল, ঠাণ্ডা অনুভূতি আচ্ছন্ন করার অপেক্ষায় রইল ও। বাতাসে শীতলতার প্রথম স্পর্শেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রস্তুত। শান্ত ও আমোদিতভাবে উষ্ণ রইল খাসমহল। বেড়ে উঠল ওর নিরাপত্তা ও শান্তির বোধ। ঘুমে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। চোখ বুজতেই স্বচ্ছ জলের একটা ছবি দেখতে পেল, তারপরই ছেলেমানুষি কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনল: তাইতা, তোমার কাছে আসছি আমি! জলের গভীরে কী যেন ছলকে উঠতে দেখল ও। ভাবল রূপালি মাছ বুঝি ভেসে উঠছে। তারপরই বুঝতে পারল ভুল হয়েছে ওর: ওটা ছিপছিপে ফর্শা একটা বাচ্চা, সাঁতরে ওর দিকে আসছে। পানির উপরে উঠে এলো একটা মাথা, বছর বার বয়সের একটা মেয়ের মাথা ওটা, বুঝতে পারল তাইতা। লম্বা ভেজা চুলের গোছা সোনালি পর্দার মতো মুখ আর বুকে নেমে এসেছে।
তোমার ডাক শুনেছি, প্রফুল্ল শোনাল হাসির আওয়াজ। সহানুভূতির সাথে হাসল তাইতা। সঁতরে ওর দিকে এগিয়ে এলো বাচ্চাটা। পানির ঠিক নিচে শাদা বালির কিনারে পৌঁছে উঠে দাঁড়াল। একটা মেয়ে, এখনও ওর কোমর ঠিক নারীসুলভ বাঁক নেয়নি, আর কেবল ওর পাঁজরের রেখাই উর্ধ্বাংশকে অলঙ্কৃত করেছে।
কে তুমি? জানতে চাইল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাল মেয়েটা, উন্মুক্ত হয়ে পড়ল চেহারা। তাইতার বুক ফুলে উঠতে লাগল, এক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হলো ওর। লস্ত্রিস।
ধিক তোমাকে, আমাকে চিনতে পারোনি, আমি ফেন, বলল সে। নামটার মানে চাঁদ মাছ।
আগাগোড়া তোমাকে আমি চিনি, মেয়েটাকে বলল তাইতা। প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার চোখদুটো কখনও ভুলবার নয়। ওগুলো তখন যেমন ছিল এখনও তেমনি মিশরের সবচেয়ে সবুজ ও সুন্দর চোখই আছে।
মিথ্যে বলছ, তাই। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি। চোখা গোলাপি জিভ বের করল সে।
তোমাকে অমন না করতে শিখিয়েছিলাম।
তাহলে ঠিকমতো শেখাতে পারোনি।
ফেন তোমার ছোটবেলার নাম ছিল, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা। তোমার প্রথম লাল চাঁদ দেখা দেওয়ার পর পুরোহিতরা তোমার নাম নারীসুলভ করে দিয়েছিলেন।
জলকন্যা, ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল মেয়েটা। এ নামটা কোনওদিনই ভালো লাগেনি আমার। লস্ত্রিস শুনলে কেমন হাস্যকর, আড়ষ্ট ঠেকে।
তারচেয়ে ফেনই আমার পছন্দ।
তাহলেই ফেনই সই, বলল তাইতা।
তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি, কথা দিল মেয়েটা। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ওরা আমাকে ডাকছে। কমনীয় ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিল সে, তলিয়ে গেল পানির নিচে, শরীরের দুপাশে হাত রেখে সরু পাজোড়া নাড়তে নাড়তে ক্রমে গভীরে চলে যাচ্ছে। পেছনে সোনালি পতাকার মতো আভা বিলোচ্ছে ওর চুল।
ফিরে এসো, পিছু ডাকল তাইতা। কোথায় অপেক্ষা করবে বলে যেতে হবে। কিন্তু চলে গেল সে। কেবল ওর হাসির ক্ষীণ একটা প্রতিধ্বনি ফিরে এলো ওর কাছে।
জেগে ওঠার পর তাইতা বুঝতে পারল, রাত হয়ে গেছে, কারণ মন্দিরের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। একাধারে ক্লান্ত ও তরতাজা মনে হলো নিজেকে। ডান হাতে একটা কিছু ধরে আছে, সজাগ হয়ে উঠল ও। সাবধানে হাতের মুঠি খুলল। মুঠির ভেতর শাদা পাউডার দেখতে পেল। এটাই ফেনের উপহার কিনা ভাবল। হাতটা নাকের কাছে তুলে এনে সাবধানে গন্ধ শুকল।
চুন! চেঁচিয়ে উঠল ও। নদীর কিনারা বরাবর প্রতিটি গ্রামে একটা করে আদিম ভাটা রয়েছে, এখানে গ্রামবাসীরা চুনাপাথরের চাই পুড়িয়ে এই পাউডার বানায়। এ জিনিস দিয়ে ঘরবাড়ি ও গোলাঘর রঙ করে ওরা। শাদা আস্তরণ সূর্যের রশ্মি ঠিকরে দেয় বলে ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকে। পাউডারটুকু ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, পরক্ষণে বিরত রাখল নিজেকে। দেবীর দেওয়া উপহার সম্মানের সাথে রাখতে হবে। নিজের বিপদে নিজেই হেসে উঠল ও। মুঠোর চুনা পাউডারটুকু টিউনিকের এক কোণে গেরো দিয়ে বেঁধে বাইরে এলো ও।
খাস কামরার দরজায় ওর অপেক্ষায় ছিল মেরেন। আপনার লোকজন নদীর পানি তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। পথ চলায় ক্লান্ত থাকায় ঘুমের প্রয়োজন ছিল ওদের। মেরেনের কণ্ঠে আবছা ভর্ৎসনার সুর। নিজের লোকদের যত্ন নিজেই নিয়ে থাকে সে। আশা করছি পচা পানির ভাণ্ড নিয়ে সারা রাত জেগে থাকার পরিকল্পনা করেননি। মাঝরাতের আগেই আপনাকে নিতে আসব, কারণ তেমনটি হতে দেব না আমি।
হুমকি অগ্রাহ্য করে তাইতা জানতে চাইল, পানিতে ঢালার জন্যে আমার বানানো আরক জলে মিশিয়েছিল শোফার?
হেসে উঠল মেরেন। যেমন বললাম, লাল পানির চেয়ে আরও বেশি দুর্গন্ধ ওটায়। চারটে ভাণ্ড যেখানে উতরাচ্ছিল তাইতাকে ওখানে নিয়ে গেল সে। ধোয়া উঠছে ওগুলো থেকে। আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল সাহায্যকারীরা, ওকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল; তারপর পাত্রের ডালার ভেতর লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে আগুনের উপর থেকে নামাল ওগুলো। পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা, তারপর পাত্রগুলোর পাশ দিয়ে আরক ঢালতে ঢালতে সামনে বাড়ল। একটা কাঠের খুনতি দিয়ে প্রত্যেকটায় ঘুটা দিল শোফার। সে যখন শেষ পাত্রটা নাড়তে যাবে, থামল তাইতা।ফেনের উপহার, বিড়বিড় করে বলল ও, টিউনিকের কোণার গিঁট খুলল। শেষ পাত্রে চুনা পাথরের পাউডার ঢেলে দিল। ভালো ফল পেতে লখ্রিসের সোনালি মাদুলিটা পাত্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্তির শব্দ নিউবে! উচ্চারণ করল।
বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল চার সহকারী।
পাত্রগুলো সকাল পর্যন্ত এভাবেই থাকতে দাও, নির্দেশ দিল তাইতা, বিশ্রামে যাও তোমরা। ভালো কাজ দেখিয়েছ, ধন্যবাদ।
মাদুরে গা এলিয়ে দিতেই মরার মতো ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা, স্বপ্ন হানা দিল না, এমনকি মেরেনের নাকের গর্জনও বিরক্ত করতে পারল না ওকে। ভোরে যখন জেগে উঠল, দোরগোড়ায় দরাজ হাসি মুখে নিয়ে শোফারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জলদি আসুন, মহান ম্যাগাস। আপনার স্বস্তি পাওয়ার মতো একটা কিছু দেখাবার রয়েছে আমাদের।
গত রাতের আগুনের শীতল হয়ে আসা কয়লার পাশে রাখা পাত্রগুলোর কাছে। ছুটে এলো ওরা। যার যার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাবারি ও অন্য ক্যাপ্টেনরা। সবাইকে নতুন নির্দেশ দেওয়ার জন্যে হাজির করা হয়েছে। বর্মের সাথে তলোয়ারের খাপ বইছে ওরা, এমনভাবে উল্লাস করছে যেন তাইতা কোনও বিজয়ী জেনারেল, যুদ্ধ ক্ষেত্রের দখল বুঝে নিচ্ছে। চুপ করো! গর্জে উঠল তাইতা। আমার মাথা ভেঙে ফেলবে তোমরা! কিন্তু আরও জোরে উল্লাস করল ওরা।
প্রথম তিনটা পাত্র বমি জাগিয়ে তোেলা কালো তরলে ভর্তি হয়ে আছে, কিন্তু চতুর্থ পাত্রের পানি একেবারে টলটলে পরিষ্কার। সামনে ঝুঁকে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে দ্বিধার সাথে মুখে দিল ও। মিষ্টি নয়, কিন্তু মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা, ছেলেবেলা থেকে ওদের বাঁচিয়ে রাখা নীলের কাদার পরিচিত সুবাস।
এর পর থেকে প্রতিদিন রাতের বিশ্রামের সময় নদীর জলে চুনের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে লাগল; পরদিন সকালে পানি রাখার চামড়ার পাত্রগুলো ভরে নিল। অচিরেই পিপাসায় দুর্বল ঘোড়াগুলো আবার শক্তি ফিরে পেতেই বেড়ে উঠল যাত্রার গতি। নয় দিন পর আসৌনে পৌঁছাল ওরা। সামনেই ছয়টি বিশাল জলপ্রপাতের প্রথমটি। নৌকার পক্ষে ভীতিকর বাধা ওগুলো, কিন্তু ঘোড়ার দল উপরের ক্যারাভান রোডে নিয়ে যেতে পারবে ওদের।
আসৌন শহরে ঘোড়া আর লোকজনকে টানা তিনদিন বিশ্রাম দিল মেরেন। রাজকীয় গোলাঘর থেকে শস্যের বস্তা ভরে নিল। জলের ধারের প্রমোদগুহাগুলোতে যাবার অনুমতি দিয়ে লোকজনকে যাত্রার পরবর্তী দীর্ঘ পর্যায়ের জন্যে বলীয়ান হয়ে নেওয়ার সুযোগ দিল। নিজের পদমর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে মেকি নির্বিকার চেহারায় বানিয়ে স্থানীয় সুন্দরীদের বেপরোয়া দৃষ্টির আমন্ত্রণ ও তোষামোদ এড়িয়ে গেল।
প্রথম জলপ্রপাতের নিচের জলাশয়টা শুকিয়ে তুচ্ছ পুকুর হয়ে গেছে। তো তাইতাকে ছোট দ্বীপে পৌঁছে দিতে কোনও মাঝির দরকার হলো না, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আইসিসের সবুজ মন্দির। ওটার দেয়ালে খোদাই করা দেবী, তাঁর স্বামী অসিরিস ও ছেলে হোরাসের দানবীয় প্রতিমা আঁকা।
ওকে সরাসরি ওখানে নিয়ে গেল উইন্ডস্মোক। নদীর পাথুরে তলদেশে খটাখট শব্দ তুলল ওটার খুর। ওকে স্বাগত জানাতে সমবেত হলেন সব পুরোহিত, পরের তিনটি দিন ওদের সাথেই কাটাল ও।
দক্ষিণের নুবিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ওকে জানানোর মতো তেমন কোনও তথ্য ছিল না ওদের কাছে। সুসময়ে নীলের বান যখন নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী ও সত্যি ছিল তখন একটা বাণিজ্য জাহাজের বিরাট বহর নদীর উজানে দুই নীলের সঙ্গমস্থল সেই কেবুই অবধি যাতায়াত করত। হাতির দাঁত, শুকনো মাংস এবং বুনো পশুর চামড়া, গাছের গুঁড়ি, তামার দণ্ড আর নীলের প্রধান শাখা আতবারা নদীর তীরের খনি থেকে সোনা নিয়ে ফিরে আসত ওরা। এখন বান না ডাকায় চলার পথের পুকুরগুলোর অবশিষ্ট জল রক্তে পরিণত হয়েছে, হাতে গোণা পর্যটকই কেবল পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে এই মরুপথে যাতায়াত করার সাহস দেখায়। পুরোহিতরা সতর্ক করে বললেন যে, দক্ষিণের রাস্তা ও এর বরাবর চলে যাওয়া পাহাড় পর্বত অপরাধী ও অস্পৃশ্যদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
আরও একবার পুরোহিতদের কাছে মেকি দেবীর কথা জানতে চাইল ও। ওরা বললেন, গুজব রটেছে যে সোয়ে পয়গম্বররা আবর্জনা থেকে হাজির হয়ে উত্তরে কারনাক ও ডেল্টার দিকে গেছে, কিন্তু কেউই ওদের সাথে যোগাযোগ করেনি।
রাত নামার পর দেবী মাতা আইসিসের মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে চলে এলো তাইতা, তার প্রতিরক্ষায় ধ্যান ও প্রার্থনা করতে স্বস্তি বোধ করল। নিজের পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে আহ্বান জানালেও ধ্যানের প্রথম দুই রাত তার কাছ থেকে কোনও সাড়া পেল না। তারপরেও কেবুই ও তার ওধারে অচেনা দেশ ও জলাভূমিতে যাবার পথে অপেক্ষমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যে নিজেকে বেশ শক্তিশালী ও তৈরি মনে হতে লাগল ওর। ইয়োসের সাথে অনিবার্য মোকাবিলা এখন অনেক কম ভীতিকর ঠেকছে। ওর শক্তিশালী দেহ ও স্থৈর্য তরুণ সেনা ও অফিসারদের সাথে চলার ও থেবস ছাড়ার পর থেকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ফল হয়ে থাকতে পারে। তবে দেবী লস্ত্রিস, বা এখন নিজেকে যেমন ফেন নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে সে, কাছাকাছি আছে জানা থাকায় নিজেকে যুদ্ধের জন্যে আরও বেশি তৈরি করেছে ভাবতে ভালো লাগছে ওর।
শেষ সকালে সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি ফুটে ওঠামাত্র জেগে উঠল ও। ফের আইসিস ও কাছাকাছি থাকতে পারেন এমন যেকোনও দেবতার আশীর্বাদ ও প্রতিরক্ষার জন্যে প্রার্থনা জানাল। খাস কামরা থেকে বের হবে, এমন সময় আইসিসের মূর্তির দিকে একবার তাকাল ও। লাল গ্রানিট পাথর কুঁদে বের করা হয়েছে ওটা। ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মূর্তিটা, ছায়ায় হারিয়ে গেছে ওটার মাথা, পাথরের চোখজোড়া অটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। বেনী করা প্যাপিরাসের মাদুরের পাশে রাখা ছড়ি তুলে নিতে উবু হলো ও, রাতে ওটার উপরই ঘুমিয়েছে। সোজা হওয়ার আগেই কানের কাছে শিরা দপদপ করে লাফাতে শুরু করল, কিন্তু নগ্ন উর্ধ্বাংশে কোনও রকম শীতল স্পর্শ বোধ করল না। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মূর্তিটা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখজোড়া, সেখানে যেমন করে কেউ ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকায় ঠিক তেমনি কোমল দৃষ্টি ফুটে উঠেছে।
ফেন, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা। লস্ত্রিস, তুমি এসেছ? ওর মাথার অনেক উপরে পাথরের ছাদ থেকে হাসির প্রতিধ্বনি কানে এলো, কিন্তু নীড়ে ফিরে যাওয়া বাঁদুরের কালো ডানার ঝাপ্টা ছাড়া আর কিছু দেখল না ও।
আবার মূর্তির দিকে ফিরে এলো ওর চোখ। পাথুরে মাথাটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এখন, ফেনের মুখ ওটা। মনে আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি, ফিসফিস করে বলল সে।
কোথায় পাব তোমাকে? কোথায় খুঁজতে হবে বলে দাও, অনুনয় করল তাইতা।
আর কোথায় চাঁদ মাছের খোঁজ করবে? পরিহাস করল ফেন। অন্য মাছের ভেতর লুকোনো অবস্থায় পাবে আমাকে।
কিন্তু কোথায় সেই মাছগুলো? মিনতি করল ও। ইতিমধ্যে পাথরে পরিণত হতে চলেছে ওর জীবন্ত চেহারা। ফের ম্লান হয়ে আসছে উজ্জ্বল চোখজোড়া।
কোথায়? চিৎকার করে উঠল তাইতা। কখন?
অন্ধকারের দূত থেকে সাবধান। ওর কাছে ছুরি আছে। সেও তোমার অপেক্ষা করছে। বিষণ্ণ সুরে ফিসফিস করে বলল ফেন। এবার আমাকে যেতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ আমাকে থাকতে দেবে না সে।
কে থাকতে দেবে না? আইসিস, না অন্য কেউ? এই পবিত্র স্থানে ডাইনীর নাম মুখে আনা অপবিত্রতার সামিল হবে। কিন্তু মূর্তির ঠোঁট জমে গেছে।
বাহুর উপরের অংশে কারও হাতের খোঁচা লাগল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। ভেবেছিল আরও একটা প্রেতাত্মার আবির্ভাব হচ্ছে বুঝি; কিন্তু স্রেফ প্রধান পুরুতের মুখই দেখতে পেল ও। তিনি বললেন, ম্যাগাস, কী হয়েছে আপনার? চিৎকার করছিলেন কেন?
স্বপ্ন দেখছিলাম। বাজে স্বপ্ন।
স্বপ্ন কখনও বাজে হয় না। অন্তত আপনার সেটা জানার কথা। স্বপ্ন হচ্ছে দেবতাদের কাছ থেকে আসা সতর্কবাণী ও বার্তা।
পবিত্র পুরুষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তাবলে চলে এলো ও। ওর কাছে ছুটে এলো উইন্ডস্মোক। খুশিতে মাটিতে পা ঠুকছে। মুখের কোণে ঝুলছে এক গোছা খড়।
ওরা তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, বুড়ি ছিনাল কোথাকার। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ ঘোড়ার বাচ্চার মতো গিলছ, ইয়া বড় পেট হয়েছে। আদুরে গলায় বকল ওকে তাই। কারনাক সফরের সময় একজন অসতর্ক সহিস ফারাওর প্রিয় স্ট্যালিয়নগুলোর একটাকে ওটার কাছে আসতে দিয়েছিল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে পিঠে চাপার সুযোগ করে দিল ঘোড়াটা। তারপর মেরেনের সেনাদল যেখানে শিবির গোটাচ্ছে সেখানে নিয়ে এলো। কলাম তৈরি হওয়ার পর যার যার ঘোড়ার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে লোকেরা, বাড়তি ঘোড়া ও প্যাক অ্যানিমেলের লাগাম ধরে আছে। হাতে। অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরখ করতে করতে সারির ভেতর দিয়ে এগোল মেরেন। সবাই যার যার তামার পানির পাত্র ও চুনের ব্যাগ খচ্চরের পিঠে নিয়েছে, নিশ্চিত হয়ে নিল।
উঠে পড়ো! কলামের পেছন থেকে চিৎকার করে নির্দেশ দিল। এগোও! হট! ছোট! কাঁদতে কাঁদতে একদল মহিলা পাহাড়ের পাদদেশ অবধি অনুসরণ করল ওদের। মেরেনের চলার গতির সাথে আর তাল রাখতে না পেরে তারপর পিছিয়ে গেল।
তেতো বিদায়, তবে স্মৃতি অনেক মধূর, হিলতো-বার-হিলতো মন্তব্য করল, হেসে উঠল তার বাহিনী।
উঁহু, হিলতো, নিজের কলামের মাথা থেকে বলে উঠল মেরেন, শরীর মিষ্টি, কিন্তু তারচেয়ে মিষ্টি তার স্মৃতি।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ওরা, খাপ দিয়ে ঢালের উপর তাল ঠুকতে লাগল।
এখন হাসছে, শুকনো কণ্ঠে বলল তাইতা, কিন্তু মরুভূমির চুল্লীতে পৌঁছানোর পরেও হাসতে পারছে কিনা দেখা যাবে।
জলপ্রপাতের গহ্বরের দিকে তাকাল ওরা। ক্রুদ্ধ জলের কোনও গর্জন নেই। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলো এমনিতে নৌচলাচলের পথে বিরাট বিপদ হয়ে থাকে, কিন্তু এখন শুকনো নাঙা হয়ে আছে। বুড়ো মোষের পালের পিঠের মতোই শুকনো, কালো। উপরের প্রান্তে গহ্বরের ঠিক নিচে একটা ব্লাফে একটা লম্বা গ্রানিটের অবিলিস্ক দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন ওদের ঘোড়া আর খচ্চরকে পানি খাওয়ানোর সময় ক্লিফ বেয়ে সৌধের কাছে এলো তাইতা ও মেরেন, ওটার পায়ের কাছে দাঁড়াল ওরা। জোরে জোরে খোদাই লিপি পড়ল তাইতা:
আমি, মিশরের রিজেন্ট ও ফারাও, এ ধারায় অষ্টম মেমোজের বিধবা পত্নী, রানি লস্ত্রিস, আমার পরে মিশরের দুই রাজ্যের হবু অধিপতি যুবরাজ মেমননের মা, এই সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছি।
এটা মিশরের জনগণের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন ও প্রমাণ, বর্বরদের হটিয়ে বনবাস থেকে ওদের কাছে আবার ফিরে আসব আমি।
আমার শাসনকালের প্রথম বছরে স্থাপন করা হয়েছে এই পাথরখণ্ড-ফারাও চিপসের মহান পিরামিড নির্মাণের পর নয় শত নম্বর।
আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন এই পাথর অটল থাকে।
.
স্মৃতিরা ভিড় করে আসার সাথে সাথে অশ্রুতে ভরে উঠল তাইতার চোখ। অবিলিস্ক স্থাপনের দিন লখ্রিসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর: তখন ওর বয়স ছিল বিশ বছর, রাজকীয় ও নারীসুলভ মহিমায় ছিল গর্বিত।
ঠিক এখানেই আমার কাঁধে প্রশংসার স্বর্ণ তুলে দিয়েছিল রানি লস্ত্রিস, মেরেনকে বলল ও। অনেক ভারি ছিল, কিন্তু ওর অনুকম্পার তুলনায় অনেক সস্তা। ঘোড়ার কাছে এসে পিঠে চেপে বসল ওরা।
বিশাল কোনও অগ্নিকুণ্ডের শিখার মতো ওদের ঢেকে ফেলল মরুপ্রান্তর। দিনের বেলায় চলতে পারছিল না ওরা, তো নদীর পানি সেদ্ধ করে তাতে চুনাপাথর ছিটাচ্ছে, তারপর ক্ষিপ্র বেগে ছোটা পশুর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে খুঁজে পাওয়া কোনও ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করার পর রাত ভর এগিয়ে চলছে ওরা। জায়গায় জায়গায় মোটা ক্লিফটা নদীর উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়েছে। যে সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একটা সারিতে এগোতে পারছে ওরা। লুটিয়ে পড়া কুঁড়ে ঘর পাশ কাটাল ওরা, এক কালে ওদের আগে এপাথে যাওয়া পর্যটকদের আশ্রয় ছিল ওগুলো। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত। আসৌন ছেড়ে পথে নামার পর দশ দিনের আগে নতুন কোনও মানুষের চিহ্ন পেল না। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপরার সারিতে এসে পৌঁছুল, এখানে এক কালে একটা গভীর পুকুর ছিল। সম্প্রতি কারও দখলে ছিল এটা: অগ্নিকুণ্ডের ছাই এখনও টাটকা, মচমচে। কুঁড়েয় ঢোকার সাথে সাথে ডাইনীর ক্ষীণ অথচ সন্দেহাতীত আভাস পেল ও। ছায়ায় চোখজোড়া সয়ে এলে দেয়ালের গায়ে কয়লার টুকরো দিয়ে লেখা হিয়েটিক হরফের লিপি দেখতে পেল।
ইয়োস মহান। ইয়োস আবির্ভূত হন। অল্প দিন আগেই ডাইনীর কোনও ভক্ত গেছে এ পথে। দেয়ালের পায়ের কাছে যেখানে দাঁড়িয়ে আবেদনের কথা লিখেছে সে, সেখানে ধূলির বুকে পায়ের ছাপ পড়েছে। সর্যোদয়ের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। দিনের উত্তাপ দ্রুত ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। শিবির খাটানোর জন্যে সেনাদলকে নির্দেশ দিল মেরেন। এমনকি ধসে পড়া কুঁড়েগুলোও নিষ্ঠুর সূর্যের কবল থেকে কিছুটা ছায়া বিলোতে পারে। এসব যখন ঘটছে, উত্তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই, ইয়োসের উপাসকদের খোঁজ করল তাইতা। দক্ষিণে চলে যাওয়া নুড়িপাথরের পথে পায়ের ছাপ দেখতে পেল। সেগুলোর অবস্থান দেখে বুঝতে পারল ঘোড়াটা নিশ্চিতভাবেই দশাসই একজন লোককে বয়ে নিয়ে গেছে। দক্ষিণে, কেবুইয়ের দিকে গেছে খুরের ছাপ। মেরেনকে ডাকল তাইতা, জিজ্ঞেস করল, এই ছাপ কতদিন আগের? দক্ষ স্কাউট ট্র্যাকার মেরেন।
নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, ম্যাগাস। তিন দিনের বেশি তবে দশদিনের কম।
তাহলে আমাদের ফেলে অনেক দূর চলে গেছে ইয়োসের পুজক।
*
ওরা কুঁড়ের আশ্রয়ে ফিরে আসার সময় শিবিরের মাথার উপর থেকে একজোড়া কালো চোখ ওদের প্রতিটি নড়াচড়া নিরীখ করে চলল। ওই কালো, গম্ভীর চোখজোড়া ইয়োসের পয়গম্বর সোয়ের, রানি মিনতাকাকে যে জাদু করেছে। কুঁড়ের দেয়ালের লেখাগুলো তারই কাজ। এখন নিজের অস্তিত্ব এভাবে ফাঁস করে দেওয়ায় অনুতাপ হলো তার।
মাথার উপরের পাহাড় চূড়ার ছড়ানো এক চিলতে ছায়ায় শুয়ে আছে সে। তিনদিন আগে পথের একটা ফোকরে হোঁচট খেয়ে সামনের পা ভেঙে ফেলেছে তার ঘোড়া। এক ঘণ্টার মধ্যেই নেকড়ের পাল এসে হাজির হয়েছে পঙ্গু জানোয়ারটাকে ছিঁড়ে খেতে। ওটা পা ছুঁড়ে চিৎকার করার সময়ই শরীর থেকে মাংস খুবলে গিলেছে। আগের রাতে অবশিষ্ট পানিটুকই শেষ করেছে সোয়ে। এই ভীতিকর জায়গায় আটকা পড়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, তাকে আর বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে, ওকে নিদারুণ পুলকিত করে উপত্যকা বরাবর ঘোড়ার খুরের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। নবাগতদের স্বাগত জানিয়ে সাথে করে ওকে নেওয়ার আবেদন জানানোর বদলে এখানে গা ঢাকা দিয়ে ওদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। দলটা দৃষ্টিসীমায় আসামাত্র ওটাকে রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ডিটাচমেন্ট হিসাবে শনাক্ত করল সে। প্রত্যেকে ভালোভাবেই সজ্জিত, দারুণ সব ঘোড়ায় চেপেছে। ওরা যে বিশেষ অভিযানে নেমেছে এটা পরিষ্কার, সম্ভবত স্বয়ং ফারাওর নির্দেশেই। এমনও হতে পারে যে ওকে পাকড়াও করে ফের কারনাকে ফিরিয়ে নিতেই পাঠানো হয়েছে ওদের। থেবসের ভাটিতে নদীর কিনারে ম্যাগাস তাইতা ওকে দেখেছিল, এব্যাপারে সে নিশ্চিত, এও জানে, ম্যাগাস রানি মিনতাকার আস্থাভাজন। রানি সম্ভবত তাইতাকে সব বলে দিয়েছেন এবং রানির সাথে সোয়ের সম্পর্কের কথা সে জানে, এটা বুঝতে খুব বেশি কল্পনা শক্তি লাগে না। সোয়ে নিশ্চিতভাবে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অপরাধী, ফারাওর আদালতে রেহাই পাওয়ার কোনওই আশা নেই। এইসব কারণেই কারনাক থেকে সটকে পড়েছে সে। এখন যেখানে সে শুয়ে আছে ঠিক তার নিচেই সেনাদলের মাঝে তাইতাকে শনাক্ত করতে পেরেছে।
নদীর পাড়ে বিভিন্ন কুঁড়ের ফাঁকে ফাঁকে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোকে জরিপ করল সোয়ে। বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোনটা বেশি দরকার স্পষ্ট নয় ওর কাছে: একটা ঘোড়া নকি প্যাক মিউলের পিঠ থেকে সৈনিকের নামানো ফোলা পানির চামড়ার ব্যাগ। অবশেষে যখন ঘোড়াই বেছে নিল সে, কুঁড়ের বাইরে তাইতার বেঁধে রাখা মেয়ারটাকেই সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও চমৎকার ঠেকল তার। ওটার সাথে বাচ্চা থাকলেও সোয়ের প্রথম পছন্দ হবে ওটাই, যদি কাছে ঘেঁষতে পারে।
শিবিরে দারুণ কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে দলাইমলাই করা হচ্ছে। নদীর পুকুর থেকে তামার গামলা বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেরা ব্যস্ত হাতে খাবার রান্না করছে যেসব চুলোয় সেগুলোয় পাচ্ছে। খাবার তৈরি হওয়ার পর চারটি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দলীয় পাত্র ঘিরে আলাদা বৃত্ত তৈরি করে বসে পড়ল সেনাদল। থিতু হওয়ার মতো সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নিতে নিতে সূর্যটা মাথার বেশ উপরে উঠে এলো। গোটা শিবির জুড়ে এক ধরনের গাম্ভীর্যপূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। সতর্কতার সাথে শান্ত্রীদের অবস্থান জরিপ করল সোয়ে। সীমানা বরাবর নিয়মিত বিরতিতে চারজন প্রহরী রয়েছে। বুঝতে পারছে, শুকনো নদীর তলদেশই তার এগিয়ে যাবার সেরা উপায়, তাই ওদিকের প্রহরীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। লোকটা বেশ অনেকটা সময় নড়াচড়া করছে না দেখে সোয়ে ধরে নিল ঝিমোচ্ছে সে। চৌহদ্দীর আরও সতর্ক প্রহরীদের চোখের আড়ালে থেকে পাহাড়ের কিনারা থেকে পিছলে নেমে এসে শিবিরের আধা লীগ নিচ দিয়ে নদীর শুকনো তলদেশ ধরে আগে বাড়ল, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল উজানের দিকে। শিবিরের ঠিক উল্টোদিকে আসার পর আস্তে করে নদীর কিনারার উপরে মাথা ওঠাল।
মাত্র বিশ কদম দূরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে এক শান্ত্রী। চিবুকটা বুকের কাছে ঝুলছে, চোখবন্ধ। ফের কিনারার নিচে গা ঢাকা দিল সোয়ে। গা থেকে জোব্বা খুলে বগলদাবা করল। খাপে ভরা ড্যাগারটা খুঁজে নিল নেংটির নিচে। তারপর তীরের উপরে উঠে এলো। দৃঢ় পায়ে মেয়ারটা যে কুঁড়ের পিছনে বাঁধা ছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেল। সামান্য নেংটি আর স্যান্ডেল পায়ে নিজেকে সৈন্যদেরই একজন হিসাবে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে স্থানীয় মিশরিয় ভাষায় জবাব দিতে পারবে; বলবে, ব্যক্তিগত কাজে নদীর ধারে গিয়েছিল। অবশ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করতে গেল না ওকে। কুঁড়ের কোণে পৌঁছে ওটার পেছনে গা ঢাকা দিল।
খোলা দরজার ঠিক ওধারেই বাধা রয়েছে মেয়ারটা। দেয়ালের ছায়ায় একটা পানি ভর্তি চামড়ার ভাণ্ড রাখা। মেয়ারের পিঠে চেপে বসতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। সব সময়ই বিনা জিনে ঘোড়া হাঁকায় সে, তাই জিন, লাগাম বা রেকাবের দরকার হয় না। পা টিপে টিপে মেয়ারের কাছে চলে এলো সে, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাতের গন্ধ শুকল ঘোড়াটা। অস্থিরভাবে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মৃদু কণ্ঠে সোয়ে ওর সাথে কথা বলতেই ফের শান্ত হলো, ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল সোয়ে। এবার চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে। ভারি ওটা, তুলে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ওটাকে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে নিল। পিঠে উঠতে যাবে, এমন সময় খোলা দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর থামাল ওকে। মিথ্যা পয়গম্বর থেকে সাবধান। তোমার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করা হয়েছে, সোয়ে।
চমকে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল সে। দরজা পথে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাগাস। নগ্ন। আরও তরুণ কারও মতো পেশীবহুল ছিপছিপে দেহ তার; কিন্তু কুঁচকির কাছে খোঁজা করার পুরোনো দাগ রূপালি লাগছে। মাথার চুল ও দাড়ি অবিন্যস্ত। কিন্তু চোখজোড়া আরও উজ্জ্বল। সতর্ক করার সুরে কণ্ঠস্বর আরও চড়াল ওঃ আমার কাছে এসো! প্রহরী! হিলতো, হাবারি! মেরেন! এখানে, শাবাকো! নিমেষে ডাকে সাড়া মিলল। সারা শিবিরে প্রতিধ্বনি উঠল তার।
আর দ্বিধা করল না সোয়ে। উইন্ডস্মোকের পিঠে চেপে বসেই আগে বাড়ার তাগিদ দিল ওটাকে। ওটার পথে ছুটে এলো তাইতা, হাতে তুলে নিল দড়িটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মেয়ার, ফলে ছিটকে ওটার ঘাড়ে সরে এলো সোয়ে। বুড়ো গাধা, পথ ছাড়ো! রাগের সাথে চিৎকার করে উঠল সে।
ওর কাছে ছুরি আছে। ফেনের সাবধানবাণী প্রতিধ্বনি তুলল তাইতার মাথার ভেতর। সোয়ের ডান হাতে ড্যাগারের ঝিলিক দেখতে পেল, ঘাই মারার জন্যে উইন্ডস্মোকের পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ল সে। আগেই ওকে সতর্ক করা না হলে ঠিক গলায় লাগত আঘাতটা। কিন্তু বাউলি কেটে একপাশে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল ও। ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল ড্যাগারের ডগা। পেছনে হোঁচট খেল ও। ঘাড়ের একপাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পেছনে সরে এলো ও। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে মেয়ারটাকে তাগিদ দিল সোয়ে। ক্ষতস্থান চেপে ধরে তীক্ষ্ণ শিস বাজাল তাইতা। ফের থমকে দাঁড়াল উইন্ডস্মোক। তারপর হিংস্রভাবে লাফ দিয়ে উঠল, বাস্পের হিসিহিস তোলা মেঘে পানির পাত্রটাকে উল্টে দিল। হামাগুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত কয়লা থেকে সরে এলো সোয়ে। কিন্তু সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই দুজন দশাসই সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। বালির উপর চেপে ধরল তাকে।
মেয়ারকে শেখানো সামান্য কায়দা এটা, শান্ত কণ্ঠে সোয়েকে বলল তাইতা। ড্যাগারটা যেখানে পড়েছিল সেখান থেকে তুলে নিল ও। সোয়ের কানের ঠিক সামনে চোয়ালের নরম ত্বকে ওটার ডগা ছোঁয়াল। ফের মিথ্যা বলো, পাকা ডালিমের মতো মাথাটা দুমড়ে দেব।
কুঁড়ে থেকে দিগম্বর অবস্থায় ছুটে বের হয়ে এলো মেরেন। হাতে তলোয়ার। নিমেষে অবস্থান নিল। সোয়ের ঘাড়ের পেছনে ব্রোঞ্জের ডগা ছোঁয়াল। তাইতার দিকে তাকাল তারপর। শুয়োরটা আপনাকে আঘাত করেছে। ওকে মেরে ফেলব, ম্যাগাস?
না! বলল তাইতা। এটাই সোয়ে, মিথ্যা দেবী ইয়োসের মিথ্যা পয়গম্বর।
সেথের মিষ্টি অণ্ডকোষের দোহাই, এবার চিনতে পেরেছি ব্যাটাকে। এ লোকই নদীর ধারে দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল।
এক ও অদ্বিতীয়, সায় দিল তাইতা। ঠিক মতো বেঁধে ফেল। কাজটা শেষ হয়েছে দেখার পরেই ওর সাথে খানিকটা বাতচিত করব আমি।
খানিক বাদে তাইতা আবার কুঁড়ে থেকে বের হয়ে এলে দেখা গেল সোয়েকে বাজারে বিক্রির শুয়োরের মতো বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই নিশ্চিত হতে ওকে পুরো ন্যাংটো করে ফেলেছে ওরা। সূর্যের কড়া আঁচে এরই ভেতর লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে তার ত্বক। উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিলতো ও শাবাকো। কুঁড়ের দেয়ালের ছায়ায় চামড়ার ফিতের গদি দেওয়া একটা টুল পেতে দিয়েছে মেরেন। সহজ ভঙ্গিতে ওটায় বসল তাইতা। অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টিতে সময় নিয়ে সোয়েকে পরখ করল। শেষ বার যেমন দেখেছিল তারপর আর লোকটার আভায় কেনও পরিবর্তন ঘটেনি; ক্রুদ্ধ ও বিভ্রান্ত।
অবশেষে কিছু মামুলি প্রশ্ন করতে শুরু করল তাইতা, যেগুলোর জবাব আগে থেকেই জানা, যাতে সত্যি বা মিথ্যা বলার সময় সোয়ের আভার পরিবর্তন বুঝতে পারে।
তুমি সোয়ে নামে পরিচিত?
নীরব অবজ্ঞায় চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকাল সোয়ে। খোঁচা লাগাও, শাবাকোকে নির্দেশ দিল তাইতা। পায়ে, তবে বেশি ভেতরে না। সূক্ষ্ম হিসাব করে একটা ঘা দিল শাবাকো। লাফিয়ে উঠল সোয়ে, আর্তনাদ ছাড়ল, বাঁধা অবস্থায় পাক খেল একবার। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা দেখা দিল উরুতে।
আবার শুরু করছি, বলল তাইতা। তুমি সোয়ে?
হ্যাঁ, দাঁত কিড়মিড় করে বলল সে। অবিরাম জ্বলছে তার আভা।
সত্যি, নীরবে নিশ্চিত করল তাইতা।
তুমি মিশরিয়?
মুখ বন্ধ রাখল সোয়ে, রাগী চেহারায় তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
শাবাকোকে হুকুম দিল তাইতা। অন্য পায়ে।
হ্যাঁ, চট করে বলল সোয়ে। অপবির্তিত রইল আভা। সত্যি।
রানি মিনতাকাকে দীক্ষা দিয়েছ তুমি?
হ্যাঁ। ফের সত্যি।
তুমি তাকে মৃত বাচ্চাদের জীবিত করে তোলার কথা দিয়েছ?
না, সহসা সোয়ের আভার ভেতর একটা সবজে আলো ঠিকরে উঠল।
মিথ্যার আলামত, ভাবল তাইতা। সোয়ের এর পরের জবাব বিচার করার মানদণ্ড পেয়ে গেছে।
আমার আতিথেয়তার ঘাটতি ক্ষমা করবে। তুমি তৃষ্ণার্ত, সোয়ে?
শুকনো, ফাটা ঠোঁটজোড়া জিভে ভেজাল সোয়ে। হা! বলে উঠল ফিসফিস করে। স্পষ্টতই সত্যি।
তোমাদের কি ভদ্রতা জ্ঞান নেই, মেরেন? আমাদের সম্মানিত মেহমানের জন্যে একটু পানি নিয়ে এসো।
দাঁত বের করে হেসে চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। কাঠের পানপাত্র ভরে নিল। ফিরে এসে সোয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ফাটা ঠোঁটের কাছে উপচে পড়া পাত্রটা ধরল। মুখ ভর্তি করে খেল সোয়ে। আগ্রহের আতিশয্যে কাশতে কাশতে কোনওমতে সবটুকু পানি শেষ করল। দম ফিরে পেতে তাকে খানিকটা সময় দিল তাইতা।
তো, নিজের মালকিনের কাছে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি?
না, বিড়বিড় করে বলল সে। ওর আভার সবুজ প্রলেপ মিথ্যা ফাস করে দিল।
ওর নাম ইয়োস?
হ্যাঁ। সত্যি।
তুমি তাকে দেবী মানো?
তিনিই একমাত্র দেবী। পরম প্রভু। আবার সত্যি। বড় বেশি সত্যি।
তার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে তোমার?
না! মিথ্যা।
সে কি তোমাকে এপর্যন্ত ওর সাথে জিজিমা করতে দিয়েছে? ইচ্ছে করেই লোকটাকে উস্কে দিতে কর্কশ সেনাসুলভ বুলি ব্যবহার করল তাইতা। কথাটার আদি মানে দৌড়ানো, বিজয়ী সৈন্যদল পরাস্ত সেনাবাহিনীর নারীদের ধরার সময় যা করে।
না! হিংস্রতার সাথে ঝিকিয়ে উঠল কথাটা। সত্যি।
তবে কি তার সমস্ত হুকুম তামিল করার পর মিশর তার হাতে তুলে দেওয়ার পর জিজিমার কথা দিয়েছে সে?
না। মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কথাটা। মিথ্যা। আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওকে ইয়োস।
তার আস্তানা কোথায় জানো?
না। মিথ্যা।
কোনও আগ্নেয়গিরি কাছে?
না। মিথ্যা।
জলাভূমির ওধারে দক্ষিণে কোনও বিশাল হ্রদের ধারে?
না। মিথ্যা।
সে মানুষ খেকো?
জানি না। মিথ্যা।
ছোট্ট বাচ্চাদের খায়? আবার মিথ্যা।
সে কি জ্ঞানী ও শক্তিমান লোকজনকে প্রলুব্ধ করে নিজের আস্তানায় ডেকে নিয়ে তারপর তাদের ধ্বংস করার আগে সমস্ত জ্ঞান আর ক্ষমতা কেড়ে নেয়?
এসব কিছুই জানি না আমি। বিরাট ও নিরেট মিথ্যা।
বিশ্ববেশ্যা এ পর্যন্ত মোট কয়জন পুরুষের সাথে শুয়েছে? এক হাজার? দশ হাজার?
তোমার প্রশ্ন ধর্মদ্রোহমূলক। এজন্যে তোমার সাজা হবে।
ম্যাগাস ও মোহন্ত দিমিতারকে যেভাবে সাজা দিয়েছে? তার হয়ে তুমিই ওর উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিলে?
হ্যা! ধর্মদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ছিল সে। এই বিচারই পাওনা ছিল তার। তোমার নোংরা কথায় আর কান দিচ্ছি না। চাইলে মেরে ফেল আমাকে, কিন্তু আমি আর মুখ খুলছি না। ওকে বেঁধে রাখা দাড়ির বাঁধন আলগা করার প্রয়াস পেল সোয়ে। কর্কশ হয়ে উঠেছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস, চোখে বুনো দৃষ্টি। ধর্মান্ধের চোখ।
মেরেন, আমাদের অতিথি উত্তেজনায় ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে দাও তাকে। সকালে সূর্য উষ্ণ করে তুলবে এমন একটা জায়গায় বেঁধে রাখবে ওকে। শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে, কিন্তু বেশি দূরে নয়, যাতে সে ফের আলাপে রাজি হলে কথা বলার সময় বা ওকে হায়েনার দল খুঁজে পাওয়ার সময় টের পাই।
সোয়ের ঘাড়ে ভালো করে দাড়ি পেঁচিয়ে টেনে দূরে নিয়ে যেতে শুরু করল মেরেন। থেমে তাইতার দিকে তাকাল একবার। ওকে দিয়ে আর কাজ নেই, আপনি নিশ্চিত, ম্যাগাস? আমাদের কিছুই বলেনি কিন্তু।
সবই বলেছে, বলল তাইতা। আত্মা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ওর পা ধরো, শাবাকো ও তোনকাকে বলল মেরেন। ধরাধরি করে সোয়েকে দূরে নিয়ে গেল ওরা। পেরেক দিয়ে তপ্ত মাটিতে বেঁধে রাখার আওয়াজ পেল তাইতা। বিকেলের মাঝামাঝি আবার তার সাথে কথা বলতে গেল মেরেন। রোদে পেট আর কুঁচকিতে ফোঁসকা পড়েছে; গালের রঙ লাল, ফুলে উঠেছে।
মহান ম্যাগাস আলাপ চালু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তোমাকে, বলল মেরেন। ওকে থুতু মারার চেষ্টা করল সোয়ে, কিন্তু মুখে লালা এলো না। পিঙ্গল জিভ মুখটাকে ভরে রেখেছে। সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে ডগাটা।
সূর্যাস্তের খানিক আগে হায়েনার দল দেখা পেল তার। ওগুলোর বিকৃত গর্জন ও হাসির শব্দে এমনকি পোড়খাওয়া পুরোনো বীর মেরেন পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
ওকে ভেতরে নিয়ে আসব, ম্যাগাস? জানতে চাইল সে।
মাথা নাড়ল তাইতা। থাক। কোথায় ডাইনীর খোঁজ করতে হবে বলে দিয়েছে সে।
হায়েনার দল মরণটাকে নিষ্ঠুর করে তুলবে, ম্যাগাস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইতা। শান্ত কণ্ঠে বলল, কুনো ব্যাঙগুলো দিমিতারের মরণকেও একই রকম নিষ্ঠুর করে দিয়েছিল। ডাইনীর চ্যালা সে। সাম্রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মারা যাওয়াই উচিত। তবে এভাবে নয়। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেকের দংশনে জর্জরিত করবে। আমাদেরও অমানুষের কাতারে নামিয়ে দেবে। যাও, ওর গলাটা দুফাঁক করে দাও।
উঠে দাঁড়াল মেরেন। তলোয়ার বের করে একুট থেমে কান খাড়া করল। একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। চুপ মেরে গেছে হায়েনার দল।
জলদি, মেরেন। যাও, দেখ কী হচ্ছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা।
ঘনায়মান অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল মেরেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে পাহাড় থেকে ওর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল; বুনো চিৎকার ছাড়ছে। লাফিয়ে উঠল তাইতা, দৌড়ে গেল ওর কাছে। মেরেন, কোথায় তুমি?
এখানে, ম্যাগাস।
সোয়েকে যেখানে গেঁথে রেখেছিল ওরা, সেখানেই মেরেনকে পেল তাইতা, কিন্তু গায়েব হয়ে গেছে লোকটা। কী হয়েছে, মেরেন? কী দেখছ?
ডাকিনীবিদ্যা! তোতলাতে তোতলাতে বলল মেরেন। দেখলাম- থেমে গেল ও, কী দেখেছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
ব্যাপারটা কী? তাগিদ দিল তাইতা। জলদি বলো।
ঘোড়ার মতো বিশাল এক হায়েনা, ওটার পিঠে বসে আছে সোয়ে। নিশ্চয়ই তার পরিচিত হবে। ছুটে পহাড়ে চলে গেছে ওটা, সাথে করে নিয়ে গেছে ওকে। ওদের পিছু ধাওয়া করব? ধরতে পারবে না, বলল তাইতা। বরং মারাত্মক বিপদে ফেলে দেবে নিজেকে। যতটা ভেবেছিলাম, সোয়েকে উদ্ধার করতে ইয়োস তারচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে। এযাত্রা যেতে দাও ওকে। অন্য কোনও সময়, ভিন্ন কোথাও ওর সাথে ফয়সালা করব আমরা।
উটচালকরা চলার গতি বাড়ালেও এখনও অধৈর্য হয়ে রয়েছে তাইতা। পরের রাতে আবার কাফেলা ছেড়ে সামনে চলে গেল ও, আশা করছে ডেল্টার ঢালে পৌঁছে বহু বছরের অনুপস্থিতির পর আবার প্রাণপ্রিয় মিশরের দিকে এক নজর তাকাবে। ওর আগ্রহ যেন সংক্রামক, কারণ দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে উইন্ডস্মোকও, ওটার ছুটন্ত খুর এক সময় শেষ দূরত্বটুকুও পার হয়ে এলো। ঢালের কিনারায় এসে লাগাম টানল তাইতা। নিচে চাঁদের আলো রূপালি অলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে কৃষি জমিন, স্পষ্ট করে তুলেছে নীলের সীমানায় দাঁড়ানো পামগাছগুলো। রূপালি জলের ক্ষীণতম ঝিলিকের খোঁজে চোখ চালাল ও। কিন্তু এই দূরত্বে নদীর তলদেশ অন্ধকার, গম্ভীর।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মেয়ারের নাকের কাছে এসে দাঁড়াল তাইতা, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ চোখে শহর, চাঁদের মতো শাদা মন্দির প্রাচীর, কারনাকের প্রাসাদগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওপারে মেমননের প্রাসাদের আকাশছোঁয়া দেয়াল খুঁজে বের করলেও ঢাল বেয়ে নেমে পলিমাটির সমতল পার হয়ে থেবসের শত শত তোরণের যেকোনও একটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন ঠেকাল।
দিমিতারের খুব কাছে থাকা ওর দায়িত্ব, ওকে ফেলে সামনে ছুটে যাওয়া নয়। মেয়ারের মাথার কাছে গোড়ালির উপর বসল ও। তারপর ঘরে ফেরা ও প্রাণের প্রিয় সবার সাথে পুনর্মিলনের দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল।
ফারাও ও রানি মিনতাকা ওকে খুবই সমাদর করেন, সাধারণত রাজ পরিবারের উধ্বর্তন সদস্যদের জন্যেই এমনি সমাদর তোলা থাকে। বিনিময়ে ওদের দুজনের জন্যেই অনুগত ভালোবাসা লালন করে ও। ছেলেবেলা থেকেই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা। নেফারের বাবা ফারাও তামোজ নেফার খুব ছোট থাকতে খুন হন, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার পক্ষে খুবই ছোট ছিলেন তিনি; তাই একজন রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তামোজের শিক্ষক ছিল তাইতা, সুতরাং তার সন্তানকে সাবালকত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত ওর হাতে তুলে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ওর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটি দেখেছে তাইতা, ওকে ঘোরসওয়ার আর যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারপর যুদ্ধ পরিচালনা ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার কৌশল শিখিয়েছে। রাজকীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও কূটনীতি শিখিয়েছে। পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে। অনেক বছরের পরিক্রমায় ওদের দুজনের মাঝে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, অবিচ্ছেদ্য রয়ে গেছে সেটা।
ঢাল বেয়ে হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ধেয়ে এলো। ওর শরীর শিউরে তোলার মতো যথেষ্ট শীতল। এই উত্তপ্ত মৌসুমে অস্বাভাবিক। নিমেষে সতর্ক হয়ে গেল ও। অনেক সময় তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস অতিলৌকিক প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে কাজ করে। দিমিতারের সতর্কবাণী এখনও ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলছে।
অটল বসে থেকে ইথারে অনুসন্ধান চালাল ও। খারাপ কিছুর আলামত পেল না। এবার উইন্ডস্মোকের দিকে মনোযোগ দিল ও। প্রাণীটা ওর মতোই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে দারুণ স্পর্শকাতর। কিন্তু ওটাকে যেন শান্ত ও স্থির দেখাল। সম্ভষ্ট হয়ে ফের উঠে দাঁড়াল ও, মেয়ারের পিঠে উঠতে লাগাম হাতে তুলে নিল। কাফেলার কাছে ফিরে যাবে। এতক্ষণে মেরেন হয়তো রাতের মতো যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিয়েছে; তাঁবু খাটাচ্ছে। ঘুম ওকে দখল করে নেওয়ার আগেই দিমিতারের সাথে আরও খানিকক্ষণ আলাপ করতে চায়। এখনও বুড়ো মানুষটার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ আদায় করতে পারেনি।
ঠিক এই সময় মৃদু স্বরে ডেকে উঠল উইন্ডস্মোক, কানজোড়া খাড়া করে ফেলল; তবে তেমন সিরিয়াসভাবে সতর্ক মনে হলো না। ওটাকে ঢাল বরাবর নিচের দিকে তাকাতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। প্রথমে কিছুই দেখতে না পেলেও মেয়ারের উপর আস্থা থাকায় রাতের নীরবতায় কান পেতে রইল। অবশেষে ঢালের পাদদেশে একটা ছায়াটে নড়াচড়া ধরা পড়ল। নিমেষে উধাও হয়ে গেল সেটা। তাইতা ভাবল কোথাও ভুল হয়েছে ওর, কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দিল না। অপেক্ষা করল, তাকিয়ে আছে সতর্ক চোখে। এবার আবার নড়াচড়াটা চোখে পড়ল। আরও অনেক কাছে, অনেক স্পষ্ট।
অন্ধকারে ফুটে উঠল আরেক অশ্বারোহীর আবছা ছায়া। ঢাল অনুসরণ করে ওর অবস্থানের দিকে উঠে আসছে। অচেনা ঘোড়াটা ধূসর হলেও উইন্ডস্মোকের তুলনায় ফ্যাকাশে। তরঙ্গ উঠল ওর স্মৃতিতে, ভালো ঘোড়ার কথা কখনও ভোলে না ও। ওটাকে কবে, কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি অনেক দূরবর্তী হওয়ায় ধরে নিল নিশ্চয়ই অনেক আগের ব্যাপার হবে। অথচ ধূসর ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে মাত্র বছর চারেক হবে ওটার বয়স। চট করে ওটার পিঠে আসীন সওয়ারির দিকে মনোযোগ দিল ও-আবছা একটা অবয়ব, পুরুষ নয়, বরং কিশোরই হবে হয়তো। সে যেই হোক, ঘোড়ার পিঠে সহজ সজীব ভঙ্গিতে বসেছে। ছেলেটার হাবভাবে পরিচিত একটা ভাব আছে, তবে ওর বাহনের মতোই তারও বয়সও তাইতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পক্ষে বেশ কম। এমন কি হতে পারে এই ছেলেটি ওর পরিচিত কারও সন্তান? মিশরের কোনও রাজকুমার? বিভ্রান্ত্র বোধ করল ও।
রানি মিনতাকা ফারাও নেফার সেতিকে অনেক কটি অসাধারণ ছেলে উপহার দিয়েছেন। সবার সাথেই বাবা বা মায়ের চেহারার ভালো মিল রয়েছে। এই ছেলেটার মাঝে মামুলি কোনও ব্যাপার নেই। ওর শরীরে রাজকীয় রক্ত বয়ে যাবার ব্যাপারে তাইতার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। আরও কাছে এলো ঘোড়া ও সওয়ারি। এবার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তাইতার। লক্ষ করল, সওয়ারি একটা খাট চিতন পরে আছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তার পাজোড়া। সরু, সন্দেহাতীতভাবে নারীসুলভ পা। ওটা একটা মেয়ে। ওর মাথা আড়াল করা। কিন্তু মেয়েটা কাছে আসার পর শালের নিচে ওর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারল।
ওকে আমি চিনি। ভালো করে চিনি! আপনমনে ফিসফিস করে বলল ও। কানের কাছে নাড়ীর গতি দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত উঁচু করল মেয়েটা, তারপর সামনে কোমর বাড়িয়ে আগে বাড়ার তাগিদ দিল ঘোড়াকে। দুলকি চালে এগোতে শুরু করল ওটা। কিন্তু পাথুরে পথে এতটুকু আওয়াজ করছে না ওটার খুর। অলৌকিক নীরবতায় ঢাল বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওটা।
দেরি হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে তাইতা, পরিচিত চেহারায় ওকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দ্রুত চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খোলার প্রয়াস পেল ও।
কোনও আভা বিলোচ্ছে না! ঢোক গিলল ও। মেয়ারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ধূসর ঘোড়া বা ওটার সওয়ারির কেউই স্বাভাবিক প্রাণী নয়। ভিন্ন মাত্রা থেকে এসেছে ওরা। দিমিতারের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফের অসতর্ক অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে ও। চট করে গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল। মুখের সামনে তুলে ধরল ওটা। লাগাম টানল সওয়ারি, মুখ ঢেকে রাখা শালের ছায়া থেকে জরিপ করতে লাগল ওকে। মেয়েটা এখন এত কাছে যে তার চোখের ঝিলিক, তরুণ গালের কোমল বাঁক দেখতে পাচ্ছে ও। স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মনে।
ধূসর ঘোড়াটার কথা এত পরিষ্কার মনে থাকাটা তেমন বিস্ময়ের কিছু নয়। ও ই উপহার দিয়েছিল। সযত্নে, দরদের সাথে বাছাই করা। ওটার বিনিময়ে পঞ্চাশটি রূপার তালেন্ত দিয়েছিল ও, তখন ভেবেছিল দরাদরিতে জিতেছে। ওটার নাম দিয়েছিল গাল, সব সময়ই ওর প্রিয় পশু ছিল ওটা। জাকের সাথে কায়দা করে ওটার পিঠে সওয়ার হতো ও। অনেক দশক আগের কথাগুলো মনে আছে তাইতার। এত প্রবল ছিল ওর ধাক্কাটা যে স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছিল না ও। স্রেফ গ্রানিট পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঢালের মতো ধরে রেখেছে মাদুলিটা।
ধীরে ফর্শা একটা হাত উঁচু করল ঘোড়সওয়ার, শালের কিনারা সরাল। ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকানোর সময় তাইতার মনে হলো ওর আত্মাটাকে বুঝি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে আছে।
সে নয়। নিজেকে স্থির রাখার প্রয়াস পেল তাইতা। বিরাট সাপটার মতো শূন্য থেকে আসা আরেকটা প্রেতাত্মা, সম্ভবত সমান ভয়ঙ্কর।
স্বপ্নে দেখা সোনালি ডলফিনের পিঠের সেই মেয়েটা সম্পর্কে দিমিতারের সাথে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ ছিল না তার। আপনার স্বপ্ন ডাইনীটার চাতুরী ছাড়া আর কিছুই না, ওকে সতর্ক করে বলেছিলেন তিনি। আপনার আকাক্ষা ও আশাকে জাগিয়ে তোলা কোনও ইমেজকে বিশ্বাস করতে যাবেন না। যখনই পুরোনো ভালোবাসার মতো কোনও সূখকর স্মৃতিকে আপনার মনে জাগতে দিচ্ছেন, ইয়োসের জন্যে রাস্তা খুলে দিচ্ছে সেটা। আপনার কাছে। পৌঁছাতে এর ভেতর দিয়ে পথ বের নেবে সে।
মাথা নেড়েছিল তাইতা। না, দিমিতা, এমনকি ইয়োসই বা কেমন করে অতদিন আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত জিনিস ফুটিয়ে তুলবে? লস্ত্রিসের কণ্ঠস্বর, ওর চোখের গড়ন, হাসার সময় ওর ঠোঁটের কম্পন। কেমন করে ইয়োস তার অনুকরণ করবে? সত্তর বছর ধরে সমাধিতে আছে লস্ত্রিস। ইয়োস নকল করার মতো এমন কোনও সজীব চিহ্ন নেই ওর।
ইয়োস আপনার স্ক্রিসের স্মৃতি চুরি করেছে। তারপর ওগুলোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আকর্ষণীয় রূপে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এমনকি আমিও তো বেশির ভাগ খুঁটিনাটি জিনিস ভুলে গেছি।
আপনি নিজেই তো বলেছেন, আমরা কিছুই ভুলে যাই না। সবই রয়ে যায়। আপনার মন থেকে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনতে কেবল অতিলৌকিক দক্ষতার প্রয়োজন, ইয়োসের তা আছে। যেমন করে আপনি আমার মনের ভেতর থেকে ইয়োসের স্মৃতি, ওর কণ্ঠস্বর বের করে এনেছেন, যখন সে অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিল।
ওটা লস্ত্রিস ছিল না, আমি মেনে নিতে পারব না, মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠেছিল তাইতা।
তার কারণ আপনি মানতে চান না। ইয়োস আপনার যুক্তিবোধ অন্ধ করে দিতে চাইছে। একটু ভেবে দেখুন, ডলফিনের পিঠে মেয়েটার ইমেজ কীভাবে তার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হয়েছিল। সে যখন আপনাকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কুহকী দৃশ্য দেখিয়ে বিক্ষিপ্ত ও প্রলুব্ধ করছিল ঠিক তখন আমাকে শেষ করে দিতে সাপটাকে পাঠিয়েছিল। আপনার স্বপ্নকে বিক্ষিপ্ত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।
এখন ডেল্টার ঢালে ফের সেই একই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে তাইতা: লস্ত্রিসের ইমেজ, মিশরের এককালের রানি, যার স্মৃতি আজও ওর হৃদয় দখল করে আছে। এইবার ওকে আরও বেশি নিখুঁত মনে হচ্ছে। টের পেল ওর স্থিরতা ও যুক্তিবোধ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেল। কিন্তু লক্ট্রিসের চোখের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ওখানে আমোদিত আলো ঝলমল করছে। ওগুলোর গভীরতায় সারা জীবনের সকল আনন্দ বেদনার অশ্রু।
তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি! যতটা সম্ভব শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বলল তাইতা। তুমি লস্ত্রিস নও। আমার ভালোবাসার নারীটি তুমি নও। তুমি আসলে মহামিথ্যা। যেই অন্ধকার থেকে এসেছ সেই অন্ধকারে আবার ফিরে যাও।
ওর কথায় লস্ত্রিসের চোখের কমনীয় ঝিলিক বদলে গিয়ে সেখানে অসীম বিষাদ এসে ভর করল। প্রিয় তাইতা, মৃদু কণ্ঠে ওকে ডাকল সে। আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে তোমাকে ছাড়াই বন্ধ্যা ও নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। এখন তোমার এমন এক লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিপদের মুহূর্তে আবার তোমার সাথে এক হতে ফিরে এসেছি। আমরা একসাথে তোমার উপর নেমে আসা অশুভকে ঠেকাতে পারব।
তুমি ধর্মের অপমান করছ, বলল তাইতা। তুমি ইয়োস, মিথ্যা। তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। সত্য আমাকে রক্ষা করছে। আমার কাছে আসতে পারবে না তুমি। আমার ক্ষতি করতে পারবে না।
ওহ, তাইতা, ফিসফিস করে বলে উঠল লস্ত্রিস। আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে তুমি। আমি নিজেও বিপদে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময়ের সূচনা থেকে মানুষের সকল বিষাদ এসে ভর করেছে ওর উপর। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাদের দুজনের স্বার্থেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তোমার ভালোবাসার সেই লস্ত্রিস ছাড়া অন্য কেউ নই-তোমাকে যে ভালোবেসেছিল। ইথারের ভেতর দিয়ে আমাকে আহ্বান করেছ তুমি। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছি আমি।
পায়ের নিচে পৃথিবীর ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠা টের পেল তাইতা। কিন্তু নিজেকে স্থির করল ও। দূর হও, অভিশপ্ত ডাইনী! চিৎকার করে উঠল ও। ভাগো, মিথ্যার দুষ্ট দাস। তোমাকে ও তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।
না, তাইতা! এমন করতে পারো না তুমি, আবেদন জানাল লস্ত্রিস। আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না তুমি।
তুমি অশুভ, কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিভীষিকা। নিজের জঘন্য আস্তানায় ফিরে যাও।
গুঙিয়ে উঠল লস্ত্রিস, মিলিয়ে যেতে শুরু করল ওর ইমেজ। দিনের আলোয় যেভাবে প্রায়ই ওর তারাটি মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবে মিলিয়ে গেল লস্ত্রিসের ছায়া। রাতের আঁধার থেকে ওর শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: একবার মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছি আমি, এবার আমাকে পুরোটা হজম করতে হবে। বিদায়, তাইতা। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে যদি।
পরক্ষণেই হারিয়ে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাইতা, মাথার উপর দিয়ে ভেঙে পড়া অনুতাপ আর বিষাদের ঢেউ বয়ে যেতে দিল। আবার যখন মাথা তোলার মতো শক্তি ফিরে পেল, তখন সূর্য উঠেছে। এরই মধ্যে দিগন্তের হাত খানেক উপরে উঠে এসেছে ওটা। শান্তভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক। ঝিমোচ্ছে। কিন্তু খোঁচা দিতেই মাথা ওঠাল ওটা, ফিরে তাকাল ওর দিকে। এত খাট হয়ে গেছে ও যে ওটার পিঠে উঠতে একটা পাথরের সাহায্য নিতে হলো। পিঠে বসে দুলতে লাগল ও। ঢালের পথের দিকে এগোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।
মাথা ভরে রাখা আবেগের জগাখিচুরির জঙ্গল গোছানোর প্রয়াস পেল তাইতা। ওর বিভ্রান্তি থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে এলো: ভূতুড়ে লস্ত্রিসের সাথে ওর সাক্ষতের সময় উইন্ডস্মোকের শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, এতটুকু অস্থির হয়নি ওটা। অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বোঝার বেশ আগেই অশুভের প্রকাশের ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠেছে। চাঁদ গ্রস্ত হওয়ার সময় ছুটে গিয়েছিল, অথচ লস্ত্রিসের ছায়ামূর্তি ও ওর ভূতুড়ে সত্তার প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে।
ওসবের ভেতর অশুভ থাকতে পারে না, নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল ও। লস্ত্রিস সত্যি কথা বলেছিল? আমাকে রক্ষা করতেই কি বন্ধু ও মিত্র হিসাবে এসেছিল ও? আমি কি আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করে দিলাম? এক অসহনীয় ব্যথা এটা। উইন্ডস্মোকের মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্ণ গতিতে ডেল্টার দিকে ছোটাল। কেবল ঢালের কিনারা থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরেই সামলাল নিজেকে। লস্ত্রিস যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক সেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।
লস্ত্রিস! আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকল ও। আমাকে ক্ষমা করো! ভুল করেছি! এখন জানি তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি সত্যিই লস্ত্রিস। ফিরে এসো, প্রিয়া আমার! ফিরে এসো! কিন্তু লস্ত্রিস চলে গেছে। প্রতিধ্বনি যেন ওকে ভেঙচি কাটছে: ফিরে এসো…এসো..এসো…
*
ওরা পবিত্র থেবস নগরীর অনেক কাছে এসে পড়ায় সূর্য ওঠার পরেও রাতের যাত্রা চালিয়ে যেতে মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। ভোরের তীর্যক আলোক রশ্মিতে আলোকিত ক্ষুদে কাফেলা ঢাল থেকে নেমে সমতল পলিমাটির জমিনের উপর দিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে এগোল। কালো মাটি শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে, রোদের কড়া আঁচে ফেটে চৌচির। কৃষকরা আক্রান্ত জমিন ছেড়ে চলে গেছে, বেহাল দশা হয়েছে ওদের কুঁড়েগুলোর। কড়িকাঠ থেকে থোকায় থোকায় খসে পড়ছে তালপাতার ছাউনী। জমিনের এখানে ওখানে শাদা ডেইজি ফুলের মতো পড়ে আছে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো কাইনের হাড়গোড়। ঘূর্ণী হওয়ার একটা ঝাপ্টা বয়ে যাবার পথে বিরান জমিনের উপর নাচতে নাচতে ধূলি ও শুকনো ধুরা পাতার একটা স্তম্ভ ছুঁড়ে দিল মেঘহীন আকাশের দিকে। বন্ধ্যা জমিনের উপর যুদ্ধ কুঠারের আঘাতের মতো আঘাত হেনে চলেছে সূর্য।
বিরূপ ল্যান্ডস্কেপে কাফেলার মানুষ আর পশুগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার মতোই গুরুত্বহীন। নদীর কাছে পৌঁছে নিজেদের অজান্তেই তীরে থমকে দাঁড়াল ওরা। ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হলো। এমনকি দিমিতারও নেমে পড়েছেন পালকি থেকে। তাইতা ও মেরেনের সাথে যোগ দিতে কোনওমতে আগে বাড়লেন তিনি। নদীটা এখানে মাত্র চারশো গজ চওড়া। স্বাভাবিক ভাটার মৌসুমেও মহানদী নীলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধূসর পলিমাটি ভরা পানিতে ভরপুর থাকে, এত গভীর ও শক্তিশালী যে জলের উপরিতল ঝলমলে ফেনায় ভরে থাকে, অসংখ্য ঘূর্ণীর গহ্বর চোখে পড়ে। বানের মৌসুমে নীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তীর উপচে উঠে এসে জমিন ভাসিয়ে দেয়। এর জলের সাথে ভেসে আসা সমৃদ্ধ কাদা ও পলিমাটি এক মৌসুমেই তিনটা ফসল ধরে রাখতে পারে।
কিন্তু আজ সাত বছর ধরে বানের দেখা নেই। এখন নদীটা অতীত শক্তিশালী সত্তার একটা ভূতুড়ে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণ পুঁতিগন্ধময় নালায় পর্যবসিত হয়েছে ওটা, তলদেশ বরাবর ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে। কেবল মৃত্যুমুখী মাছ ও অল্প কয়েকটা জীবিত কুমীরের কষ্টকর নড়াচড়ার কারণে সেই জলে কিঞ্চিত তরঙ্গ উঠছে। জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল ফেনাময় আবর্জনা ঢেকে রেখেছে জলের উপরিভাগ।
নদীর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কেন? জানতে চাইল মেরেন। এটা একটা অভিশাপ!
আমার মনে হয় বিষাক্ত শ্যাওলার জন্যেই এমন হয়েছে, বলল তাইতা, সায় দিলেন দিমিতার।
শ্যাওলাই বটে, তবে এটা যে অস্বাভাবিক তাতে আমার একটুকু সন্দেহ নেই, জলের ধারা থমকে দেওয়া একই অশুভ প্রভাবের কারণেই আবির্ভূত।
কলো কাদার চরে রক্ত-রঙ পুকুরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। নগরের বজ্য ও আটকে পড়া আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলো। আছে শেকড়বাকড়, ভেসে আসা কাঠ, পরিত্যক্ত ফেরি নৌকার ধ্বংসাবশেষ, পাখি ও পশুর ফুলে ওঠা মৃতদেহ। উন্মুক্ত বালিচরে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র জীবিত প্রাণীগুলো হচ্ছে অদ্ভুত দর্শন বেঁটে কিছু জানোয়ার, মরদেহের দখল পেতে ভৌতিক জোড়া লাগানো পায়ে আনাড়ী ভঙ্গিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। টেনে পচা মাংসের চাক ছিঁড়ছে, তারপর গিলে নিচ্ছে। গভীর বিতৃষ্ণায় বিড়বিড় করে উঠল মেরেন, কাফেলার সর্দার যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম: দানবীয় কুনো ব্যাঙ! তারপরই কেবল ওগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল তাইতা। গলা খাকারি দিয়ে গলায় জমে ওঠা শ্লেষা ঝাড়ল ও। মিশরের উপর নেমে আসা অশুভ প্রভাবের কি শেষ নেই?
তাইতা বুঝতে পারল উভচরগুলোর আকারই ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। বিশাল আকারের। পিঠের হিসাবে বুনো শুয়োরের মতোই মোটা, পেছন পায়ে ভর দিয়ে সম্পূর্ণ খাড়া হলে রীতিমতো শেয়ালের সমান লম্বা মনে হচ্ছে।
কাদার ভেতর মানুষের লাশ পড়ে আছে, বলে উঠল মেরেন। ওদের ঠিক নিচেই পড়ে থাকা একটা ছোট্ট দেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও। মৃত শিশুও আছে।
মনে হচ্ছে থেবসের নাগরিকরা এতটাই নির্বিকার হয়ে গেছে যে এখন লাশ কবর না দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, বিষাদের সাথে ঘাড় নেড়ে বললেন দিমিতার।
ওরা তাকিয়ে থাকার সময়ই একটা ব্যাঙ বাচ্চাটার হাত কামড়ে ধরে দশ বার বার ঝাঁকি দিয়ে কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ছোট্ট বাহুটা। নেমে আসতেই মুখ হাঁ করে গিলে নিল টুপ করে।
দৃশ্যটা দেখে সবাই অসুস্থ বোধ করল। ফের ঘোড়ায় চেপে তীর বরাবর এগিয়ে নগরের বহিপ্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বাইরের এলাকা ভূমিহীন কৃষক, বিধবা ও এতিম, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও বিপর্যয়ের অন্য সব শিকারের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরা। পাতার তৈরি খোলা চালার নিচে জড়োসড়ো অবস্থায় রয়েছে ওরা। সবাই বিশীর্ণ ও করুণ চেহারার। এক তরুণী মাকে দেখল তাইতা, কোলের বাচ্চাটার মুখে শূন্য বুক ছুঁইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাচ্চাটা এতই দুর্বল, চুষতে পারছে না। ওর চোখেমুখে মাছি ঢুকে পড়ছে। ওদের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে মা।
ওর বাচ্চার জন্যে ওকে খাবার দিয়ে আসি, বলে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামতে গেল মেরেন। কিন্তু ওকে বাধা দিলেন দিমিতার।
এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে এখন খাবার দেখালেই রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যাবে।
আবার আগে বাড়ার সময় বিষণ্ণ, অপরাধী চেহারায় পেছনে তাকাতে লাগল মেরেন।
দিমিতার ঠিকই বলেছেন, মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। এত অসংখ্য ক্ষুধার্তের অল্প কয়েকজনকে বাঁচাতে পারব না আমরা। বাঁচাতে হবে মিশরকে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক নয়।
হতভাগাদের কাছ থেকে বেশ দূরে শিবির ফেলার জায়গা বেছে নিল তাইতা ও মেরেন। দিমিতারের ফোরম্যানকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমার গুরু যেন আরামে থাকে সেটা খেয়াল করো, ওকে ভালো করে পাহারা দেবে। তারপর চোর-ডাকাত ঠেকাতে শুকনো কাঁটাঝোঁপের বেড়া বানাবে। পশুগুলোর জল আর খাবারের যোগাড় করো। আরও জুৎসই থাকার ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।
মেরেনের দিকে ফিরল ও। শহরে ফারাওয়ের প্রসাদে যাচ্ছি আমি। দিমিতারের সাথে থাক। জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেয়ারের পেটে লাথি মারল ও। মূল তোরণের দিকে রওয়ানা দিল। ও এগিয়ে যাওয়ার সময় টাওয়ার থেকে তাকিয়ে রইল প্রহরীরা, তবে চ্যালেঞ্জ করল না। পথঘাট বলতে গেলে বিরান। অল্প যে কজনকে চোখে পড়ছে তারাও দেয়ালের ওপাশের ভিখিরিদের মতোই ফ্যাকাশে, ক্ষুধার্ত। ওকে আসতে দেখেই সটকে পড়ছে। শহরের মাথার উপর যেন অসুস্থ একটা গন্ধ ঝুলে আছে, মৃত্যু ও কষ্টের গন্ধ।
প্রাসাদ প্রহরীদের সর্দার চিনতে পারল ওকে। তোরণ খুলে দিতে ছুটে এলো সে। ও ভেতের ঢুকতেই সমীহের সাথে সালাম ঠুকল।
আমার লোক ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে যাবে, ম্যাগাস। রাজকীয় সহিসরা ওটার দেখভাল করবে।
ফারাও বাড়িতে আছেন? ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় জানতে চাইল তাইতা।
জ্বি, আছেন।
ওর কাছে নিয়ে চলো আমাকে, নির্দেশ দিল তাইতা। দ্রুত হুকুম তামিল করল প্রহরী। প্যাসেজ ও হলওয়ের গোলকধাঁধা ধরে এগিয়ে চলল ওকে নিয়ে। উঠোনের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা, এককালে আঙ্গিনা, ফুলের কেয়ারি আর নির্মল জলের ফোয়ারার সমাহারে অসাধারণ ছিল জায়গাটা। তারপর হল ও ক্লয়েস্টারের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল, এক সময় অভিজাত নারীদের হাসিঠাট্টা, গান, ট্রাম্বলার, এবোলদার আর দাসীনর্তকীদের গানে মুখরিত থাকত। কামরাগুলো খাখা করছে এখন। বাগান বাদামী হয়ে মরে গেছে। ফোয়ারা শুকিয়ে কাঠ। চেপে বসা নীরবতা কেবল পাথুরে পথের উপর ওদের পায়ের আওয়াজে ছিন্ন হচ্ছে।
অবশেষে রাজকীয় দরবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে পৌঁছাল ওরা। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা বন্ধ দরজা। বর্শার গোড়া দিয়ে ওটায় টোকা দিল প্রহরী। প্রায় নিমেষে একজন দাস খুলে ধরল ওটা। ওর পেছনে তাকাল তাইতা। গোলাপি মাৰ্বল পাথরের মেঝেয় একটা ছোট ডেস্কের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে স্থূলদেহী এক খোঁজা। টেবিলে স্কুল আর পাথরের ফলকের স্তূপ। এক মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল তাইতা। ফারাওর প্রবীন চেম্বারলেইন, তাইতার সুপারিশেই এমন উচ্চ পদে নিয়োগ পেয়েছিল সে।
রামরাম, পুরোনো বন্ধু আমার, ওকে শুভেচ্ছা জানাল তাইতা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রামরাম, এমন বিশালদেহী লোকের পক্ষে বিস্ময়কর ক্ষিপ্র তার চলাফেরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলো। ফারাওর সেবায় নিয়োজিত খোঁজারা এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
তাইতা, অনেক দিন থেবসের বাইরে ছিলে তুমি, তাইতাকে ব্যক্তিগত এটা ব্যুরোতে নিয়ে এলো সে। সেনাপতিদের সাথে সভায় বসেছেন ফারাও, তাই ওকে এখন বিরক্ত করতে পারছি না। তিনি অবসর পাওয়ামাত্রই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তিনি তাই চাইবেন। এতে অবশ্য কথা বলার একটা সুযোগ মিলে গেছে। কতদিন হলো দূরে আছো তুমি? অনেক বছর নিশ্চয়ই।
সাত বছর। শেষবার আমাদের দেখা হওয়ার পর বহু অজানা দেশ ঘুরেছি আমি।
তাহলে তো তোমার অবর্তমানে আমাদের উপর নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে তোমাকে জানানো দরকার। দুঃখের কথা, ভালো সংবাদ তেমন একটা নেই।
একটা কুশনে মুখোমুখি বসল ওরা। চেম্বারলেইনের ইশারায় এক দাস মাটির কলসীতে ঠাণ্ডা করা শরবত পরিবেশন করল ওদের।
আগে বলো, মহামান্য আছেন কেমন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তাইতা।
আমার ভয় হচ্ছে, ওকে দেখে খারাপ লাগবে তোমার। নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি। বেশিরভাগ দিন মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আর নোম গভর্নরের সাথে সভা করে কাটাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাচ্ছেন। নদীর লাল আবর্জনা দূর করতে নতুন করে কুয়ো খননের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামরাম, শরবতের বাটিতে লম্বা একটা চুমুক দিল সে।
মেদিয় ও সুমেরিয়রা, সাগরবাসী, লিবিয় ও অন্য শক্ররা আমাদের দুর্দশার কথা জানে, খেই ধরল সে। ওদের বিশ্বাস আমাদের সুসময় ফুরোতে চলেছে। তাই নিজেদের সেনাদলকে তৈরি করছে ওরা। তুমি তো জানো, আমাদের করদ রাজ্য ও আশ্রিত দেশগুলো বরাবরই ফারাওকে মেটাতে বাধ্য হওয়া দক্ষিণার ব্যাপারে বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। অনেকেই আমাদের এই দুর্ভাগ্যকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ মনে করছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্যে মৈত্রী গড়ে তুলছে তারা। আমাদের সীমান্তে বহু শত্রু সমাবেশ ঘটিয়েছে। আমাদের সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ফারাওকে অবশ্যই নিজ বাহিনী শক্তিশালী করে তুলতে রসদ আর মানুষ যোগাড় করতে হবে। নিজেকে যারপরনাই কষ্ট দিচ্ছেন তিনি, তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।
ছোটখাট অন্য কোনও রাজা হলে এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন না, বলল তাইতা।
নেফার সেতি মহান রাজা। কিন্তু আমাদের সবার মতো তিনিও অন্তর থেকে জানেন দেবতারা এখন আর মিশরের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। যতক্ষণ ঐশী আশীর্বাদ ফিরে না পাচ্ছেন ততক্ষণ তার কোনও প্রয়াসই সাফল্যের মুখ দেখবে না। দেশের সমস্ত মন্দিরের পুরোহিত সমাজকে অবিরাম প্রার্থনা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিজে দিনে তিন বার বলী দিচ্ছেন। নিজের শক্তিকে শেষ সীমায় টেনে নিয়ে গেলেও রোজ অর্ধেক রাত জেগে থাকছেন। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সতীর্থ দেবতাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রার্থনা করার পেছনে সেই সময় পার করছেন।
জলে ভরে উঠল চেম্বারলেইনের চোখ। লিনেনের কোণ দিয়ে মুছল সে। আমাদের উপর নেমে আসা নদী মাতার পতন আর নানা প্লেগে আক্রান্ত গত সাত বছর এভাবেই কাটছে তার জীবন। সাধারণ কোনও রাজা হলে ধ্বংস হয়ে যেতেন। নেফার সেতি একজন দেবতা, কিন্তু তার হৃদয় ও আবেগ মানুষের মতো। ফলে তিনি বদলে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন।
এ খবর শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বলো তো, রানি ও তাঁর সন্তানরা কেমন আছেন?
এখানেও খবর তেমন সুবিধার নয়। প্লেগ ওদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। রানি মিনতাকা অসুস্থ হয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ প্রায় মরণোন্মুখ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এখন সেরে উঠেছেন অবশ্য। তবে অনেক দুর্বল। রাজকীয় সন্তানদের সবার এমন সৌভাগ্য হয়নি। রাজকুমার খাবা ও তাঁর ছোট বোন উনাস রাজকীয় স্মৃতিসৌধে এখন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। প্লেগ ওদের কেড়ে নিয়েছে। অন্য সন্তানরা বেঁচে গেলেও-
একজন দাস নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঢুকতেই থেমে গেল রামরাম। চেম্বারলেইনের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল সে। মাথা দোলাল রামরাম, ইশারায় বিদায় করে দিল তাকে। তারপর ফের তাইতার দিকে ফিরল। গোপন সভা শেষ হয়েছে। ফারাওর কাছে তোমার আগমনসংবাদ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর পা টেনে টেনে কামরার পেছন দিকে চলে গেল। ওখানে একটা প্যানেলে খোদাই করা একটা অবয়ব স্পর্শ করল সে। ওর আঙুলের স্পর্শে ঘুরে গেল ওটা। দেয়ালের একটা অংশ সম্পূর্ণ সরে গেল। খোলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল রামরাম। তার অল্পক্ষণ পরেই গোপন দরজার ওপাশের করিডর থেকে বিস্ময় ও খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল দ্রুত পায়ের আওয়াজ। এরপর চিৎকার: তাতা, কোথায় তুমি? ওকে দেওয়া ফারাওর ডাক নাম এটা।
জাঁহাপনা, আমি এখানে।
অনেক দিন আমাকে উপেক্ষা করেছ তুমি, দরজা গলে বের হয়ে আসার সময় ওকে অভিযুক্ত করলেন ফারাও, তাইতার দিকে তাকাতে থমকে দাঁড়ালেন। সত্যিই তো তুমি। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আগের সমনের মতো এবারও অগ্রাহ্য করে যাবে।
হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের একটা লিনেনের স্কার্টের সাথে স্রেফ একজোড়া উন্মুক্ত স্যান্ডেল পরেছেন নেফার সেতি। উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। চওড়া পুরু বুকের ছাতি, পেটটা স্থূলকায়, পেশি খেলা করছে। তীর আর তলোয়ারে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দুটি হাত খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো। নিখুঁত করে তোলা যোদ্ধার তাঁর গোটা ধড়।
ফারাও, আপনাকে অভিবাদন। আমি আপনার একজন তুচ্ছ দাস, সব সময়ই যা ছিলাম।
সামনে এসে ওকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন নেফার সেতি। গুরু শিষ্য যখন একসাথে হয় তখন এসব দাস-দাসত্বের কথা চলবে না, ঘোষণা দিলেন তিনি। তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। ওকে মুখের সামনে ধরলেন তিনি। চেহারা জরিপ করলেন। হোরাসের করুণায় তোমার একদিনও বয়স বাড়েনি।
আপনারও না, জাঁহাপনা। আন্তরিক স্বরে বলল তাইতা। হেসে উঠলেন নেফার সেতি।
কথাটা মিথ্যা হলেও পুরোনো বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া হিসাবে এই তোষামোদ মেনে নিচ্ছি। নেফার সেতি আনুষ্ঠানিক ঘোড়ার পশমের পরচুলা খুলে রেখেছেন, গায়ে রঙের প্রলেপ না থাকায় তাঁর বৈশিষ্ট জরিপ করতে পারছে তাইতা। নেফারের ছোট করে ছাটা চুল খাড়া হয়ে আছে, মাথার চাঁদি ন্যাড়া। সময়ের আঁচড় পড়েছে চোখেমুখে। মুখের কোণে গাঢ় রেখা দেখা দিয়েছে। গাঢ় চোখের চারপাশে বলী রেখার জাল। গায়ের ত্বকে অস্বাস্থ্যকর আভা। চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল ফারাওর আভা জোরালভাবে জ্বলছে, সাহসী হৃদয় ও অদম্য প্রাণশক্তিরই প্রতীক।
কত বয়স হলো তাঁর? মনে করার চেষ্টা করল তাইতা। বাবা নিহত হওয়ার সময় ওর বয়স ছিল বার, সুতরাং এখন তার বয়স অন্তত পক্ষে উনপঞ্চাশ। উপলব্ধিটুকু টলিয়ে দিল ওকে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই সাধারণ একজন মানুষকে বৃদ্ধ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মারা যায়। রামরাম সত্যি কথাই বলেছে। ফারাও অনেক বদলে গেছেন।
রামরাম তোমার থাকবার ব্যবস্থা করেছে? জানতে চাইলেন ফারাও, তাইতার কাঁধের উপর দিয়ে চেম্বারলেইনের দিকে তাকলেন।
ওকে বিদেশী দূতদের জন্যে তুলে রাখা একটা স্যুট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম আমি, প্রস্তাব রাখল রামরাম।
তাইতাকে কোনওভাবেই বিদেশী বলা যাবে না, ধমকে উঠলেন নেফার। তাইতা বুঝতে পারল তার আগের ভালো মেজাজ এখন তেতে উঠেছে, বেশ সহজেই ক্ষেপে উঠছেন তিনি। আমার খাস কামরার দরজার কাছে প্রহরীদের কামরাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের যেকোনও সময় পরামর্শ ও আলোচনার জন্যে ওকে কাছে পেতে চাই। ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বাবিলনের দূতের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে বিক্রি করা শস্যের দাম তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রামরাম রাষ্ট্রীয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবে তোমাকে। আশা করছি মাঝরাত নাগাদ অবসর পাব। তখন ডেকে পাঠাব তোমাকে। আমার সাথেই রাতের খাবার খেতে হবে তোমাকে, যদিও আমার ধারণা, তোমার সেটা ভালো লাগবে না। আমার নির্দেশে দেশের বাকি লোকজনের মতো দরবারও একই খাবার উপভোগ করছে। গোপন দরজা পথে ফিরে গেলেন নেফার সেতি।
জাঁহাপনা, তাইতার কণ্ঠে তাগিদের সুর। চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালেন নেফার সেতি। হড়বড় করে কথা বলে গেল তাইতা। আমার সাথে একজন মহান জ্ঞানী ম্যাগাস আছেন।
তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নয় নিশ্চয়ই, প্রশ্রয়ের সাথে হাসলেন নেফার সেতি।
ঠিক তাইতা, তার পাশে আমি শিশুর মতো। তিনি আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে সাহায্য ও রক্ষা করতে এসেছেন।
এখন সে কোথায়?
নগর প্রাচীরের বাইরে আছেন এখন। বিপুল বিদ্যা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল। আমার তার কাছাকাছি থাকা দরকার।
রামরাম, প্রাসাদের এই অংশে বিদেশী ম্যাগাসের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করো।
মেরেন ক্যাম্বিসেস এখনও আমার সঙ্গী হিসাবে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিচ্ছে। ওকে হাতের কাছে পেলে অনেক খুশি হবো।
হায় হোরাস, মনে হচ্ছে তোমার সাথে গোটা দুনিয়া ভাগাভাগি করতে হবে আমাকে, হেসে উঠলেন নেফার সেতি। অবশ্য মেরেন সুস্থ আছে শুনে খুশি হলাম, ওকে সঙ্গী হিসাবে পেতে যাচ্ছি। রামরাম ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এবার তবে যেতে হচ্ছে।
ফারাও, আপনার অসীম ধৈর্যের আরেকটা প্রত্যক্ষ নজীর, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগেই বলে উঠল তাইতা।
এখানে এসেছ বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ এর ভেতর আমার কাছ থেকে পঞ্চাশটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছ। তোমার লেগে থাকার ক্ষমতা অসীম। আর কী চাই তোমার?
নদী অতিক্রম করে রানি মিনতাকাকে অভিনন্দন জানানোর অনুমতি।
আমি প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে বৈরী অবস্থানে স্থাপন করব। আমার রানি মেজাজ হারাননি। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে হাসলেন তিনি। ওর কাছে অবশ্যই যাবে তুমি, তবে মাঝরাতের আগেই ফিরে এসো।
*
রাজপ্রাসাদে দিমিতারের থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পরপরই রাজকীয় চিকিৎসকদের দুজনকে ওর চিকিৎসার জন্যে তলব করল তাইতা। তারপর মেরেনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, রাত নামার আগেই ফিরে আসার আশা করছি, ওকে ঠিক মতো পাহারা দিয়ে।
আপনার সাথে যাওয়া উচিত আমার, ম্যাগাস। অভাব ও দুর্ভিক্ষের এমন একটা সময়ে সৎ মানুষও নিজের পরিবারের খাবারের যোগাড় করতে হতাশা থেকে রাহাজানির পথ বেছে নেয়।
রামরাম এক দল পাহারাদার দিয়েছে আমার সাথে।
নীল নদের মতো একটা নদী পেরুনোর জন্যে নৌকায় না উঠে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসাটা অদ্ভুত ঠেকল। উইন্ডস্মোকের পিঠে থেকে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল তাইতা, লক্ষ করল ঘঘালাটে পুকুরের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে। এমনি একটা পথে আগে বাড়ল ওরা। তাইতার মেয়ারের সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হলো একটা রাক্ষুসে কুনো ব্যাঙ।
মেরে ফেল! ধমকে উঠল প্রহরী দলের সর্দার। এক সৈনিক বর্শা বাগিয়ে ধরে রাস্তা ধরে ধেয়ে গেল। কোণঠাসা বুনো শূকরের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ওটা। সৈনিক সামনে ঝুঁকে কম্পিত লাল গলায় বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল। মরণ চিল্কারে বর্শার ফলার উপর চোয়াল চেপে ধরল বিশ্রী জানোয়ারটা, ফলে জানোয়ারটা ওটা না ছাড়া পর্যন্ত ঘোড়ার পিছন পিছন যেতে বাধ্য হলো সৈনিক। অবশেষে অস্ত্র মুক্ত করে নিতে পারল সে। তাইতার পাশে এসে বর্শাটা দেখাল। শক্ত কাঠের উপর ব্যাঙের দাঁতের ছাপ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।
নেকড়ের মতোই বুনো, প্রহরীদের সার্জেন্ট ছিপছিপে প্রবীন যোদ্ধা হাবারি বলল। প্রথম যখন ওদের আবির্ভাব ঘটে, নদী পরিষ্কার করে ওদের ধ্বংস করতে দুই রেজিমেন্ট সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও। তখন শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে ওদের খতম করেছি আমরা। জানালার উপর ওদের লাশ টাল দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মনে হয়েছে বুঝি একটা মারলে তার জায়গায় আরও দুটো বেড়ে উঠছে। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা অর্থহীন কাজে আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি, এখন তিনি হুকুম দিয়েছেন ওদের অবশ্যই নদীর তলদেশেই আটকে রাখতে হবে। অনেক সময় সাঁতার কেটে উঠে আসে ওরা, আমরা ফের আক্রমণ করি। বলে চলল হাবারি। ওদের নিজেস্ব বিশ্রী কায়দায় কিছুটা উপকারে আসে ওরা। নদীতে ছুঁড়ে দেওয়া সব আবর্জনা আর লাশ খেয়ে নেয়। প্লেগের শিকারের জন্যে এখন আর ভালো কবর খোঁড়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না লোকে, তো কুনো ব্যাঙের দলই মুদাফরাসের দায়িত্ব নিয়েছে।
ঘোড়াগুলো অগভীর কর্দমাক্ত পুকুরগুলোর একটায় পড়ল, পশ্চিম তীরের দিকে এগিয়ে চলল তারপর। ওরা প্রাসাদের দৃষ্টিসীমায় আসার সাথে সাথে হাঁ করে তোরণ খুলে গেল, ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো দ্বার রক্ষক।
হে মহান ম্যাগাস, স্বাগতম! তাইতাকে অভিবাদন করল সে। মহারানি থেবসে আপনার আগমনের অপেক্ষা করছেন, আপনাকে আনন্দময় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনাকে বরণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। প্রাসাদ তোরণের দিকে ইঙ্গিত করল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেয়ালের উপর ক্ষুদে ক্ষুদে অবয়ব দেখতে পেল তাইতা। নারী ও শিশু ওরা, ওর উদ্দেশে হাত নাড়ার আগে ওদের ভেতর রানি কোনজন নিশ্চিত হতে পারল না। মেয়ার আগে বাড়াল ও। সামনে লাফ দিল ওটা। খোলা তোরণ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। উঠোনে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে কিশোরীর চঞ্চলা নিয়ে নেমে এলেন মিনতাকা। আগাগোড়াই অ্যাথলিট ছিলেন তিনি, দক্ষ রথ চালক, এবং নিপূণ শিকারী। তাকে এখনও তেমনি সাবলীল দেখতে পেয়ে খুশি হলো তাই। তবে ওকে আলিঙ্গন করতে কাছে আসার পর বুঝতে পারল তিনি কতটা শীর্ণকায় হয়ে গেছেন। বাহুগুলো যেন সরু কাঠির মতো, চেহারা মলিন, ফ্যাকাশে। তিনি হাসলেও গভীর চোখজোড়ায় বিষাদের ছায়া খেলা করছে।
ওহ, তাইতা। তোমাকে ছাড়া যে কীভাবে চলেছে বোঝাতে পারব না, বললেন তিনি। ওর দাড়িতে মুখ লুকোলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাইতা। ওর স্পর্শে তার হাসিখুশি ভাবটুকু মিলিয়ে গেল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা শরীর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনও দিন ফিরবে না, নেফার আর আমি খাবা ও ছোট্ট উনাসের মতো তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।
আপনার দুঃখের কথা শুনেছি। আপনার সাথে আমিও শোকাহত, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।
সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমার মতো আরও অনেক মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে আমার কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই তিক্ত। একটু পেছনে হটে দাঁড়িয়ে হাসার প্রয়াস পেলেন তিনি। কিন্তু জলে ভরে আছে তার চোখজোড়া, ঠোঁট কাঁপছে। এসো। তোমার সাথে অন্য বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ওদের বেশির ভাগকেই চেন তুমি। শুধু সবচেয়ে ছোট দুটি তোমাকে কখনও দেখেনি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।
দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। ছেলেরা সামনের কাতারে, ওদের পেছনে মেয়েরা। বিস্ময় ও সমীহে আড়ষ্ট সবাই। ভাইবোনদের কাছে মহান ম্যাগাসের গল্প শুনে সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি এতটাই নার্ভাস ছিল যে তাইতা ওর দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড়ের উপর ওর মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলল তাইতা। সাথে সাথে সহজ হয়ে গেল সে। কান্না রেখে দুই হাতে তাইতার গলা জড়িয়ে ধরল।
বাচ্চা ও পশু ভোলানোয় তোমার নৈপূণ্যের কথা জানা না থাকলে বিশ্বাস করতাম না, ওর দিকে চেয়ে হাসলেন মিনতাকা। তারপর অন্যদের এক এক এগিয়ে আসতে বললেন।
এত সুন্দর বাচ্চা জীবনে দেখিনি আমি, রানিকে বলল তাইতা। কিন্তু আমি তাতে অবাক হইনি। মা হিসাবে আপনাকে পেয়েছে ওরা।
অবশেষে বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে তাইতার হাত ধরলেন মিনতাকা। খাস কামরায় নিয়ে এলেন ওকে। এখানে একটা ভোলা জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমের পাহাড়সারির দিকে চোখ ফেরালেন। ওকে শরবত ঢেলে দেওয়ার সময় বললেন, আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি, কিন্তু এখন আর পারি না। ওই দৃশ্য আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে শিগগিরই জল ফিরে আসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে।
কে করেছে? অলস কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা। কিন্তু উত্তরে রানি সবজান্তা, হেঁয়ালিমাখা হাসায় কৌতূহল চাগিয়ে উঠল ওর। তারপর কথোপকথন সুখের সময়ের দিকে বাঁক নিল। যখন রানি ছিলেন অল্পবয়সী, সুন্দরী কুমারী বধূ, এই দেশ ছিল সবুজ, সুন্দর। রানির মেজাজ হালকা হয়ে এলো, প্রাণবন্তভাবে কথা বলতে লাগলেন। ওকে শেষ করার সুযোগ দিল তাইতা, জানে, রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীর প্রসঙ্গে ফিরে আসতে দেরি করবেন না তিনি।
সহসা স্মৃতিচারণ থামালেন রানি। তাইতা, আমাদের দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জানো তুমি? অচিরেই এক নতুন দেবী ওদের জায়গা দখল করবেন। তাঁর হাতেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। আবার নীল নদের প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন তিনি, পুরোনো, বিধ্বস্ত দেবতারা যা পারেননি তিনি সেই প্লেগ দূর করবেন।
সমীহের সাথে শুনছে তাই। না, মহামান্যা, এটা আমার জানা ছিল না।
আরে, হ্যাঁ, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। রানির ফ্যাকাশে চেহারা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বয়স কমে এলো যেন। ফের তরুণী হয়ে উঠেছেন তিনি, আশা ও আনন্দে ভরপুর। কিন্তু, তাইতা, কথা আরও আছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ঢঙে থামলেন তিনি, তারপর ফের খেই ধরলেন। দ্রুত কথা বলছেন এখন। আমাদের যা কিছু হারিয়েছে বা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই দেবীর, কিন্তু আমরা তাঁকে পুরোপুরি মেনে নিলেই সেটা সম্ভব হবে। আমাদের মন-প্রাণ তাঁকে সঁপে দিলে, তিনি আমাদের তারুণ্য ফিরিয়ে দেবেন। যারা কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, তাদের আবার সুখী করে তুলতে পারবেন। কিন্তু, ভেবে দেখ, তাইতা-এমনকি মৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আবার তার চোখ জলে ভরে উঠল। উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হওয়ায় কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করেছে, যেন এইমাত্র লম্বা পথ দৌড়ে এসেছেন। আমাকে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন! খাবা আর উনাসের উষ্ণ, জীবন্ত শরীর ফের কোলে নিতে পারব, ওদের ছোট্ট মুখে চুমু খেতে পারব।
এই নতুন আশায় সান্ত্বনার সন্ধান থেকে রানিকে বাঞ্চিত করতে চাইল না তাইতা। এসব ব্যাপার আমাদের বোঝার মতো নয়, এতই বিস্ময়কর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।
হ্যাঁ, ঠিক! পয়গম্বরকে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা। কেবল তখনই উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ থাকতে পারবে না।
কে এই পয়গম্বর?
তাঁর নাম সোয়ে।
কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, মিনতাকা? জানতে চাইল তাইতা।
উত্তেজনায় হাতে তালি দিলেন রানি। ওহ, তাইতা, এটাই আসল কথা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আমার প্রাসাদেই আছেন! প্রাচীন দেবতা অসিরিস, হোরাস ও আইসিসের পুরোহিতদের হাত থেকে তাকে আশ্রয় দিয়েছি আমি। সত্য কথা বলার কারণে ওরা তাঁকে ঘৃণা করে। তাঁকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। রোজ আমাকে ও তার পছন্দসই লোকজনকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন তিনি। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তাইতা, এমনকি তুমিও দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না, তবে তা গোপনে শিখতে হবে। মিশর এখনও অর্থহীন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন। নতুন ধর্ম বিকাশের আগে ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাধারণ লোকজন এখনও এই নতুন দেবীকে মেনে নিতে তৈরি নয়।
চিন্তিতভাবে মাথা দোলাল তাইতা। রানির জন্যে গভীর করুণা বোধ করছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার পর লোকের বাঁচার জন্যে অর্থহীনভাবে হাওয়ায় আঁচড় কাটার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ও বোঝে। নতুন চমৎকার এই দেবীর নাম কী?
অবিশ্বাসীদের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতে পারবে না, এতই পবিত্র তিনি। কেবল যারা তাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে তারাই তার নাম মুখে নিতে পারবে। এমনকি তার নাম বলার আগে আমাকেও সোয়ের কাছে দীক্ষা নিতে হয়েছে।
সোয়ে কখন আপনাকে দীক্ষা দিতে আসবে? তার মুখে এই বিস্ময়কর তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনতে চাই।
না, তাইতা, বলে উঠলেন রানি। তোমাকে বুঝতে হবে, এগুলো তত্ত্ব নয়। সত্যের প্রকাশ। রোজ সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছে আসেন সোয়ে। ওর মতো এমন জ্ঞানী ও পবিত্র পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। রানির উজ্জ্বল অভিব্যাক্তি সত্ত্বেও ফের তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। কথা দাও, তুমি তার কথা শুনতে আসবে।
আমার উপর আস্থা স্থাপন করায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, প্রিয় রানিমাতা। কখন সেটা?
আজ সন্ধ্যায়। সাপারের পর, জানালেন তিনি।
এক মুহূর্ত ভাবল তাই। আপনি বললেন কেবল মনোনীতদেরই দীক্ষা দেয় সে। যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে? তাহলে রাগ হবে আমার।
কখনওই তোমার মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত লোককে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি, মহান ম্যাগাস।
আমি সে ঝুঁকি নিতে যাব না, প্রাণপ্রিয় মিনতাকা। আমার পরিচয় প্রকাশ না করে তার কথা শোনার ব্যবস্থা করা যায় না?
সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। তাঁকে ঠকাতে চাই না, অবশেষে বললেন তিনি।
কোনও রকম ঠকবাজির কথা ভাবছি না আমি। তার সাথে কোথায় দেখা হবে আপনার?
এই মহলেই, তুমি যেখানে বসে আছে, তিনিও ওখানেই বসবেন। ওই কুশনেই।
কেবল আপনারা দুজনই থাকবেন?
না, আমাদের সাথে আরও তিনজন প্রিয় মহিলা থাকবে। আমার মতোই দেবীর ভক্ত ওরা।
সতর্কতার সাথে কামরাও নকশা জরিপ করছিল তাইতা। কিন্তু রানির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ও। এই দেবী কি নিজেকে কখনও মিশরের জনগণের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন? নাকি স্রেফ তার মনোনীত অল্প কয়েকজনের কাছেই তার ধর্ম প্রকাশিত হবে?
নেফার আর আমি মনে প্রাণে তাঁকে বরণ করার পর মিথ্যা দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের মন্দির ধ্বংস করে পুরোহিত সমাজকে ছত্রভঙ্গ করে দেব, তখনই দেবী বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেন। প্লেগের অবসান ঘটাবেন তিনি, তার পরিণতি ভোগান্তি দূর করবেন। নীল নদকে আবার প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেবেন… একটু দ্বিধা করলেন তিনি, তারপর ফের দ্রুত কথা বলতে লাগলেন। …আমার বাচ্চাদের আবার ফিরিয়ে দেবেন।
প্রাণপ্রিয় রানি। সত্যি যদি তাই হতো। যাক, একটা কথা বলুন, নেফার কি এই পরিস্থিতির কথা জানেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নেফার জ্ঞানী, অসাধারণ শাসক। মহান যোদ্ধা। ভালোবাসায় ভরা স্বামী ও পিতা। কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ নন তিনি। কেবল উপযুক্ত সময়েই ওর কাছে সব কথা খুলে বলবেন বলে আমার সাথে একমত হয়েছেন সোয়ে। সেই সময় এখনও হয়নি।
গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল তাইতা। নিজের স্ত্রীর কাছে দাদা-দাদী, বাবা-মা আর বলা বাহুল্য ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের পাইকারী প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে ভালো ধাক্কাই খাবেন নেফার সেতি। এমনকি তাঁকেও ঐশী পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হবে। বেঁচে থাকতে তিনি এমনটি ঘটতে দেবেন না, এটুকু বোঝার মতো তাঁকে চিনি বলেই মনে হয়।
চিন্তাটা এক ভীতিকর সম্ভাবনার স্রোত বইয়ে দিল তাইতার মনে। নেফার সেতি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগি আর পরামর্শকগণ পয়গম্বরকে ঠেকাতে জীবিত না থাকলে এমন এক রানিকে খেলাতে পারবে যিনি বিনা প্রশ্নে, কোনও প্রতিশোধ ছাড়াই সোয়ের সব নির্দেশ পালন করবেন। তিনি কি রাজা, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের বাবার হত্যাকাণ্ডে সায় দেবেন? আপন মনে প্রশ্ন করল তাইতা। উত্তরটা পরিষ্কার: হ্যাঁ, দেবেন। যদি নতুন নামহীন দেবীর হাতে মৃত বাচ্চাদের সাথে তাঁরও আবার বেঁচে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। মরিয়া মানুষ বেপরোয়া পরীক্ষায় মেতে ওঠে। চড়া গলায় ও জানতে চাইল: সোয়েই কি এই মহান দেবীর একমাত্র পয়গম্বর?
সোয়ে ওদের নেতা। তবে তাঁর অনেক নিচের কাতারের শিষ্যরা দুই রাজ্যের সাধারণ জনগণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগমনের পথ সুগম করে তুলছে।
আপনার কথা আমার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার অবস্থানের কথা প্রকাশ না করে তার বয়ান শুনতে দিলে সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সাথে আরেকজন ম্যাগাস থাকবেন। এত জ্ঞানী ও বয়স্ক, আমার পক্ষে যেমনটি কোনওদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আঙুল তুলে প্রতিবাদ না করে রানিকে নীরব থাকার ইঙ্গিত করল ও। কথাটা ঠিক, মিনতাকা। তাঁর নাম দিমিতার। ওই যেনানা জানালার পেছনে আমার সাথে বসে থাকবেন তিনি। একটা জটিল বুনটের পর্দার দিকে ইশারা করল ও, আগের দিনে ওটার পেছন থেকে রানি ও উপপত্নীরা চেহারা না দেখিয়েই বিদেশী গণ্যমান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।
তবু ইতস্তত করতে লাগলেন মিনতাকা, কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল তাইতা। দুজন প্রভাবশালী ম্যাগাইকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন আপনি। সোয়ে ও নতুন দেবীকে একসাথে খুশী করতে পারবেন। আপনার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবেন তিনি। তখন তাঁর কাছে আপনার সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ যেকোনও বর চাইতে পারবেন।
ঠিক আছে, তাতা, তোমার কথামতোই করব। তবে তার বিনিময়ে আমার আজকের কথাগুলো নেফারকে বলবে না, যতক্ষণ না দেবীকে মেনে নেওয়া আর প্রাচীন দেবতাদের প্রত্যাখ্যানের সময় হচ্ছে তাঁর…
আপনার হুকুম মতোই করব, রানি আমার।
তুমি আর তোমার সহকর্মী দিমিতারকে অবশ্যই কাল খুব সকালে ফিরে আসতে হবে। মূল দরজার বদলে পেছন দরজা দিয়ে আসবে। আমার এক পরিচারিকা তোমাদের এই কামরায় নিয়ে আসবে, তখন তোমরা ওই পর্দার পেছনে আশ্রয় নিতে পারবে।
সূর্য উদয়ের এক ঘণ্টার মধ্যেই আসব আমরা, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।
*
মেমননের প্রাসাদের তোরণ হয়ে বেরিয়ে আসার সময় বিকেলের সূর্যের উচ্চতা যাচাই করল তাইতা। এখনও দিনের আলোর বেশ কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। হঠাৎ কী ভেবে রক্ষীদের সার্জেন্টকে থেবসে যাবার সোজা পথ বেছে নিতে নিষেধ করল ও। তার বদলে কবরস্থানের পথে ঘুর পথে পশ্চিমের পাহাড় ও বিশাল রাজকীয় নেক্রোপলিসের দিকে এগোল। একটা পাথুরে উপত্যকার আড়ালে রয়েছে ওটা। প্রাণপ্রিয় লখ্রিসের জাগতিক দেহে মলম মাখানোর বিষয়টি যেখানে তত্ত্বাবধান করেছিল ও, সত্তর বছর আগের ঘটনা এটা। কিন্তু সময় সেই ভীষণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। মাদুলিটা স্পর্শ করল ও, লস্ত্রিসের একগাছি চুল রাখা আছে ওতে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে উঠতে লাগল ওরা। হাথরের মন্দির পাশ কাটাল: পাথুরে টেরেসের পিরামিডের চূড়ায় বসানো দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। নিচের টেরেসে পায়চারীরত পুরোহিতিনীকে চিনতে পারল তাইতা, আরও দুজন নবীশ রয়েছে তার সথে। তার সাথে কথা বলতে একপাশে সরে এলো।
ঐশী হাথর আপনাকে রক্ষা করুন, মা, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাল ও। হাথর হচ্ছেন মহিলাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তাই প্রধান পুরোহিতও একজন নারী।
শুনেছি আপনি সফর শেষে ফিরে এসেছেন, ম্যাগাস, ওকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আমরা সবাই আশা করছিলাম, আপনি এখানে আসবেন, আমাদের আপনার অভিযানের গল্প শোনাবেন।
সত্যি, অনেক কথা বলার আছে আমার, আপনাদের ভালো লাগবে আশা করি। মেসোপটেমিয়া, একবাতানা ও বাবিলনের ওধারে যার উপর দিয়ে খোরাশান মহাসড়ক চলে গেছে সেই পাহাড়ি ভূমির প্যাপিরাস মানচিত্র নিয়ে এসেছি আমি।
আমাদের জন্যে অনেক কিছুই নতুন হবে, সাগ্রহে হাসলেন প্রধান পুরোহিতীনি। সাথে এনেছেন ওগুলো?
আরে, না! অন্য কাজে বেরিয়েছি আজ, এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। থেবসে স্ক্রোল রেখে এসেছি। তবে পয়লা সুযোগেই নিয়ে আসব ওগুলো।
সেটা খুব শিগগির হবার নয়, ওকে আশ্বস্ত করলেন প্রধান পুরোহিতীনি। এখানে সবসময়ই আপনি স্বাগত। আপনার ইতিমধ্যে দেওয়া তথ্যের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আপনার কাছে যা আছে সেটাও মনোমুগ্ধকর হবে বলেই আমি নিশ্চিত।
তাহলে আপনার মহত্বের সুযোগটুকু নেব আমি। আপনার কাছে একটা উপকার চাইতে পারি?
আমার কাছে পাওয়ার মতো কোনও উপকার থাকলে সেটা পেয়ে গেছেন আপনি। মুখ ফুটে বলুন শুধু।
অগ্নিগিরি নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।
কোনটা? হাজারে হাজারে আছে, অনেক দেশে ছড়িয়ে আছে।
পাহাড়ের কাছাকাছি বা কোনও দ্বীপে, বা কোনও হ্রদ কিংবা বিশাল নদীর কিনারের গুলো। একটা তালিকা দরকার আমার, মা।
বেশ কঠিন অনুরোধ, ওকে নিশ্চিত করলেন তিনি। ভাই নুবাঙ্ক, আমাদের একজন প্রবীন মানচিত্র শিল্পী সব সময়ই আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণতার অন্যান্য ডুবো উত্স নিয়ে দারুণ কৌতূহলী, যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ ও গেইসার। খুশি মনেই আপনার তালিকা তৈরি করে দেবেন তিনি। তবে ধরে নিন অনেক বিস্তারিত ও ক্লান্তিকর হবে সেটা। নুবাঙ্ক এত বেশি খুঁতখুঁতে যে এটাই তার দোষ। এখুনি কাজ শুরু করতে বলছি তাকে।
কত সময় লাগতে পারে?
আপনি কি আগামী দশদিনের ভেতর এদিকে আসবেন, সম্মানিত ম্যাগাস? জানতে চাইলেন তিনি।
বিদায় নিল তাইতা, তারপর নেক্রোপলিসের ভিন্ন একটা তোরণের দিকে এগোল।
*
এক বিশেষ সামরিক দুর্গ রাজকীয় সমাধির আশ্রয় নেক্রোপলিস পাহারা দিচ্ছে। প্রতিটিতে ডুবন্ত চেম্বারের কমপ্লেক্স রয়েছে, নিরেট পাথর কুঁদে নির্মাণ করা হয়েছে এসব। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে সমাধি চেম্বার, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ রাজকীয় পাথুরে শাবাধার, ফারাওর মামিকৃত মরদেহ রয়েছে তাতে। এই চেম্বারের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টোররুম আর গুদামঘর, অপরিমেয় রত্নভাণ্ডারে ঠাসা সেগুলো। কেউ জানে না এর কথা। দুটি রাজ্য ও এর সীমান্তের বাইরের অন্য দেশের সমস্ত চোর আর ডাকাতের লোভের কারণ হয়েছে এটা। পবিত্র এনক্লোজারে ঢুকতে সব সময়ই সুচতুর প্রয়াস পেয়ে আসছে তারা। ওদের ঠেকাতে ছোটখাট একটা সেনাদলের স্থায়ী প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে।
ঘোড়ার দলকে দানাপানি খাইয়ে তরতাজা করে তুলতে সঙ্গীদের দুর্গের মূল প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে সামাধিক্ষেত্রের দিকে পা বাড়াল ও। রানি লখ্রিসের সমাধিতে যাবার পথ যতটা ভালো করে জানার কথা জানে ও। নিজেই লেআউটের নকশা করেছে ও, খনন কাজ তত্ত্বাবধান করেছে। লস্ত্রিসই মিশরের একমাত্র রানি যাকে গোরস্থানের এই অংশে কবরস্থ করা হয়েছে, সাধারণত ক্ষমতাসীন ফারাওর জন্যে সংরক্ষিত থাকে এটা। লস্ত্রিসের বড় ছেলে সিংহাসনে বসার পর তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এর বরাদ্দ নিয়েছিল তাইতা।
ইহ জগত থেকে বিদায় নিয়ে পরজগতে পদার্পণের কথা ভেবে ফারাও নেফার সেতির সমাধি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সে জায়গাটা পার হয়ে এলো ও। রাজমিস্ত্রিতে গিজগিজ করছে জায়গাটা, পাথর কুঁদে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করছে ওরা। মাথার উপর নিপূণভাবে ঝুড়ি ফেলে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধ শ্রমিকরা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মসৃণ ধূলোর পুরু আস্তরণ ওদের শরীরে। স্থপতি ও দাসদের সর্দারদের একটা ছোট দল ওদের মাথার উপর থেকে নিচের কাজের গতি জরিপ করছে। উপত্যকা জুড়ে বাটালি, বাইস আর পাথরের উপর গাইতি চালানোর আওয়াজ।
কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই শবযাত্রার পথ ধরে এগোল তাইতা, এক সময় উপত্যকা সরু হয়ে দুটি ভিন্ন পথে ভাগ হয়ে গেল। বাম দিকের পথ বেছে নিল ও। পঞ্চাশ কদম এগোনোর পরই একটা বাঁক ঘুরে লক্ট্রিসের সমাধির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। ঠিক সামনেই রয়েছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে বসানো। প্রবেশ পথ দৃষ্টিনন্দন গ্ৰানিটের স্তম্ভ ঘিরে রেখেছে, পাথরের ব্লকের দেয়ালে ঘেরাও করা, প্রলেপ লাগানোর পর অসাধারণভাবে রঙ করা মুরালে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। রানির জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সাজানো হয়েছে তার কার্তুশের চারপাশে: স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সুখে লস্ত্রিস, রথ হাঁকাচ্ছে, নীলের জলে মাছ ধরছে, গেযেল ও পাখি শিকার করছে, হিকস্স হানাদারদের সেনাদলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে, নৌবহরে জনগণসহ নীলের বিভিন্ন জলপ্রপাত পাড়ি দিচ্ছে, এবং হিকস্সের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে তাদের। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিজের হাতে এইসব দৃশ্য এঁকেছিল তাইতা, কিন্তু এখনও টাটকা রয়ে গেছে রঙ।
সমাধির প্রবেশ পথে আরেকজন শোককারী ছিল, দেবী আইসিসের সন্ন্যাসীনিদের আলখেল্লার মতো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। মুরালের দিকে ফিরে প্রবল ভক্তির ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। সময় নিতে ইচ্ছে করে গতি কমাল তাইতা। ক্লিফের পায়ের কাছে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে একপাশে সরে গেল ও। ছবির লক্ট্রিসের চেহারা সুখ-স্মৃতির একটা চলমান ছবি চালু করে দিল। উপত্যকার এই দিকটা বেশ নিরিবিলি, আরও নিচের শ্রমিকদের কাজ-কর্মের হাঁকডাক পাথুরে দেওয়ালের কারণে চাপা পড়ে গেছে। খানিকক্ষণ সমাধির যাজিকার উপস্থিতির কথা ভুলে গেল ও, পরক্ষণেই উঠে আবার তার দিকে মনোযোগ ফেরাল।
মহিলা জোব্বার হাতার ভেতরে হাত চালিয়ে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র-হয়তো বাটালি বা ছুরি-বের করে আনার সময়ও ওর দিকে পেছন ফিরে ছিল সে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তাইতাকে ভীত বিহ্বল করে যন্ত্রের ডগা দিয়ে ইচ্ছে করেই মুরালের উপর আঘাত হানল সে। আরে, পাগল মেয়েমানুষ, করছ কী? চিৎকার করে উঠল ও। রাজকীয় সমাধির ক্ষতি করছ তুমি! এখুনি বন্ধ করো!
যেন ও কোনও কথাই বলেনি, ওকে উপেক্ষা করে গেল মহিলা, ঘনঘন আঘাত হেনে চলল লস্ত্রিসের মুখে। গভীর ক্ষতের ভেতর থেকে নিচের আস্তরণ বের হয়ে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা। চিৎকার করে চলেছে, থাম! শুনতে পাচ্ছ না! তোমার শ্রদ্ধেয়া মা এ খবর জানতে পারবেন। এই অপবিত্রতার জন্যে তোমার উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করব আমি। নিজের উপর দেবতাদের সাজা ডেকে আনছ তুমি…
তারপরেও ওর দিকে না তাকিয়ে প্রবেশ পথ ছেড়ে ইচ্ছাকৃত শিথিল পায়ে ওকে ছেড়ে উপত্যকার অন্য দিকে চলে গেল সন্ন্যাসীনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছু নিল তাইতা। এখন আর চিৎকার করছে না, তবে ডান হাতে ভারি ছড়িটা ধরে আছে। মহিলা যাতে অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায়। সহিংসতা ওর মন ভারি করে দিয়েছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মহিলার মাথায় ঠকাস করে বাড়ি মেরে খুলি ফাটিয়ে দিত ও।
উপত্যকার তীক্ষ্ণ বাঁকে পৌঁছাল মহিলা। থেমে কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল সে। তার মুখ আর চুল বলতে গেলে লাল শালে সম্পূর্ণ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা। যাচ্ছিল।
ক্রোধ ও হাতাশা মিলিয়ে গেল তাইতার, বিস্ময় ও বিহ্বলতা সে জায়গা দখল করে নিল। মহিলার দৃষ্টি স্থির, প্রশান্ত, চোখজোড়া প্রবেশপথের রানির ছবির মতোই। এক মুহূর্ত নড়তে বা কথা বলতে পারল না ও। যখন ভাষা খুঁজে পেল, খরখরে শোনাল ওর কণ্ঠ: এ যে দেখছি তুমি!
এক ধরনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার চোখজোড়া, ফলে উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর হৃদয়। মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও বুঝতে পারল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে। ওর বিস্ময় সূচক কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা দোলাল সে। তারপর আবার ঘুরে ধীরস্থিরভাবে পাথর প্রাচীরের বাঁক ঘুরে চলে গেল।
না! হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তাইতা। আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারো না তুমি! দাঁড়াও! অপেক্ষা করো! পিছনে ছুটল ও, মহিলা উধাও হয়ে যাবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাদে বাকে পৌঁছাল। এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পরক্ষণে থমকে দাঁড়াল ও, ওর চোখের সামনে উপত্যকার উঁচু প্রান্ত খুলে যেতেই দুহাত আবার স্কুলে পড়ল দুপাশে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কানা গলিতে পরিণত হয়েছে রাস্তাটা; ধূসর পাথরের দেয়ালে পথ রুদ্ধ, এত খাড়া যে পাহাড়ী ছাগলের পক্ষেও ওটা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। উধাও হয়ে গেছে। মহিলা।
লস্ত্রিস, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া আমার। ওর ওপর চেপে বসল পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও, অর্থহীন আবেদনের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেয়ালের গায়ে ফাটলের খোঁজ করতে লাগল, যেখানে মেয়েটা গাঢাকা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাবার মতো গোপন দরজা। কিছুই পেল না। যে পথে এসেছিল সেদিকে তাকাল ও। দেখতে পেল উপত্যকার মেঝে পাহাড়ের শরীর থেকে খসে পড়া শাদা বালির হালকা আস্তরণে ঢাকা। ওর নিজের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কোনও পায়ের ছাপ নেই। কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি সে। ক্লান্তভাবে লস্ত্রিসের সমাধির দিকে ফিরল ও। প্রবশে পথের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তরণে খোদাই করা হিয়েরেটিক হরফে লেখাটা পড়ল। ছয় আঙুল পথ দেখাবে, জোরে জোরে পড়ল। কোনও মানে বুঝল না। পথ? কোনও রাস্তা, নাকি কোনও কায়দা বা কৌশল?
ছয় আঙুল? বিভিন্ন দিক দেখাচ্ছে ওগুলো, নাকি একটা? অনুসরণের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সাইনপোস্ট? হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। জোরে খোদাইম্বালিপিটা ফের পড়ল: ছয় আঙুল পথ দেখাবে। ও পড়ার সময়ই মহিলার লেখা হরফগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল এক সময়। লস্ত্রিসের পোর্ট্রেট অক্ষত। সবগুলো বিকৃতি আবার নিখুঁতভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিস্ময়ের সাথে হাত বাড়িয়ে ছবি স্পর্শ করল ও। উপরিতল মসৃণ, নির্মল।
পিছিয়ে এসে আবার পরখ করল। হাসিটা কি যেভাবে এঁকেছিল এখনও তেমনই আছে, নাকি বদলে গেছে? কোমল দেখাচ্ছে এখন, নাকি পরিহাস করছে? আন্তরিক, নাকি হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছে? ওটা কি দয়ার্দ্র, নাকি বৈরী? নিশ্চিত হতে পারল না।
তুমি কি লস্ত্রিস, নাকি আমাকে কষ্ট দিতে পাঠানো দুষ্ট কোনও অভিশাপ? জিজ্ঞেস করল ও। লস্ত্রিস কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? তুমি সাহায্য আর নির্দেশনা দিতে চাইছ-নাকি আমার পথে ফাঁদ আর গহ্বর খুঁড়ে যাচ্ছ?
অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল ও, তারপর সঙ্গীরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দুর্গের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঘোড়ায় চেপে থেবসের উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরল ওরা।
*
ফারাও নেফার সেতির প্রাসাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবার আগে রামরামের কাছে এলো তাইতা।
ফারাও এখনও গোপন সভায় আছেন। পরিকল্পনা মতো আজ রাতে তোমার সাথে দেখা করতে পারবেন না তিনি। তার তলবের অপেক্ষা করতে হবে। তোমাকে নিজের মাদুরে শুয়ে পড়ার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।
রামরামকে ছেড়ে দ্রুত দিমিতারের ঘরের দিকে এগোল ও। বাও বের্ডের সামনে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখল বুড়ো আর মেরেনকে। তাইতাকে দেখেই স্বস্তি প্রকাশের নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল মেরেন। খেলাটার জটিলতা অনেক সময় ওর বোধের বাইরে ঠেকে। স্বাগত, ম্যাগাস। ঠিক সময় মতো এসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচালেন।
দিমিতারের পাশে বসল তাইতা, ঝটপট স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খবর দিল।
সফরের ক্লান্তি সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে তো?
আপনার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ। আসলেই ভালো আছি আমি, বললেন দিমিতার।
শুনে খুশি হলাম, কারণ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে আমাদের। আপনাকে মেমনরের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নতুন ধর্মের প্রচারকদের একজনের বাণী শুনব। এক নতুন দেবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে সে, যিনি পৃথিবীর সকল জাতির উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন।
হাসলেন দিমিতার। সত্যি বলতে প্রলয় পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো দেবতার অভাব আছে আমাদের?
আহা, বন্ধু আমার, আমাদের চোখে এমনটা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু পয়গম্বরের মতে পুরোনো দেবতাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, তাদের মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে, ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে তাদের যাজকদের।
ভাবছি এক এবং অদ্বিতীয় আহুরা মাদার কথা বলছে কিনা সে? তাহলে এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়।
আহুরা মাযদা নয়, নতুন কেউ। তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী, ভীতিকর। মানুষের রূপে নেমে আসবেন এই দেবী, আমাদের মাঝে বাস করবেন। সাধারণ লোকজন তার রাজকীয় করুণা সরাসরি ভোগ করবে। মৃতকে জীবিত করা ও যোগ্যদের অমরত্ব ও চিরস্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
এমন স্পষ্ট অর্থহীনতার সাথে কেন নিজেদের জড়াতে যাচ্ছি আমরা, তাইতা? বিরক্তির সাথে জানতে চাইলেন দিমিতার। মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক জরুরি সমস্যা আছে।
এই পয়গম্বর সাধারণ লোকের মাঝে গাঢাকা দিয়ে একই ধরনের কথাবার্তা প্রচার করে বেড়ানো আরও অনেকের একজন। মনে হচ্ছে, মিশরের রানি এবং ফারাও নেফার সেতির স্ত্রী মিনতাকাসহ অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ফেলছে ওরা।
সামনে ঝুঁকে এলেন দিমিতার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি। এমন আজগুবী ব্যাপার বিশ্বাস না করার মতো ভালো বুদ্ধি তো রানি মিনতাকার থাকার কথা?
নতুন দেবীর আগমন ঘটার পর তাঁর প্রথম কাজ হবে মিশরের প্লেগ দূর করা, এই রোগের কারণে আবির্ভুত সমস্ত ভোগান্তির অবসান ঘটানো। তার মাঝে মিনতাকা প্লেগে মৃত দুই সন্তানকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখতে পেয়েছেন।
আচ্ছা, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন দিমিতার। যেকোনও মায়ের কাছেই অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হওয়ার কথা এটা। কিন্তু আর কোন কারণের কথা বলছেন। আপনি?
পয়গম্বরের নাম সোয়ে। বিহ্বল দেখাল দিমিতারকে। নামটার অক্ষরগুলোকে উল্টে দিন। তেনমাস হরফ ব্যবহার করুন, পরামর্শ দিল তাইতা। দিমিতারের বিভ্রান্তি কেটে গেল।
ইয়োস, ফিসফিস করে বললেন তিনি। আপনার কুকুরের দল ডাইনীর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে, তাইতা।
আমাদের অবশ্যই এবার গন্ধ শুঁকে ঝটপট তার আস্তানায় ছুটে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল তাই। ভালো করে ঘুমিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিন। সূর্যোদয়ের সময় মেরেনকে পাঠাব আপনাকে নিতে।
*
পুব আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ আভা মাত্র, দিমিতারের উট আর ঘোড়াসহ প্রাঙ্গণে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হাবারি। পালকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন দিমিতার। ঘোড়ার পিঠে তার পাশে থেকে এগোতে লাগল তাইতা ও মেরেন। ওদের নদী পারাপারের জায়গায় নিয়ে এলো এসকর্ট। এখানে স্রেফ একটা রাক্ষুসে ব্যাঙ দেখতে পেল ওরা। ওদের এড়িয়ে গেল ওটা, বিনা ঝামেলায় নদী পেরুল ওরা। মেমননের প্রাসাদ পাশ কাটিয়ে পেছনের তোরণে চলে এলো, এখানে মেরেন ও হাবারির হেফাযতে বাহন রেখে এগোলো তাইতা ও দিমিতার। মিনতাকার প্রতিশ্রুতি মতো একজন পরিচারিকা ওদের স্বাগত জানাতে তোরণের ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছিল। প্যাসেজ আর টানেলের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল সে, অবশেষে দরাজহাতে সাজানো একটা কামরায় পৌঁছুল ওরা। এখানে ধূপ আর সৌরভ ভুরভুর করছে। মেঝে রেশমী কাপড়ের গালিচা আর কুশনে ঢাকা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত পদা। দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা পর্দা টানানো যেনানা জানালা ঢেকে রাখা হ্যাংগিং সরিয়ে ফেলল পরিচারিকা। দ্রুত সেটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অলঙ্কৃত নকশার ভেতর দিয়ে আম দরবারের দিকে তাকাল। আগের দিন মিনতাকার সাথে এখানেই দেখা করেছিল ও। এখন খা-খা করছে। সন্তুষ্ট হয়ে দিমিতারের কাছে ফিরে এসে হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে। কুশনে বসল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পর্দার ওপাশ থেকে অচেনা এক লোক পা রাখল কামরায়।
মাঝ বয়সী, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়নের লোকটা। কাঁধের উপর নেমে আসা ঘন চুলে ছোট সঁচাল দাড়ির মতোই পাক ধরেছে। পরনে যাজকীয় কালো লম্বা জোব্বা, স্কার্টে আধ্যাত্মিক প্রতাঁকের নকশা, গলায় ঝুলছে তাবিজ। কামরায় চক্কর দিতে শুরু করল সে। পর্দা সরিয়ে ভেতর পরখ করছে। যেনানা জানালার সামনে। এসে দাঁড়াল সে, পর্দার খুব কাছে নিয়ে এলো মুখটা। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো জিসিনটা হচ্ছে তার চোখ: ধর্মান্ধদের চোখের মতো, অন্ধবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে সেখানে।
এটাই সোয়ে, ভাবল তাইতা। ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিজেদের আড়াল করার শক্তি একত্রিত করে বাড়ানোর জন্যে দিমিতারের হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কারণ ওই লোকটার কী ধরনের অকাল্ট বিদ্যা আছে জানা নেই। পর্দার ভেতর দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে আড়ালের পর্দা টিকিয়ে রাখতে পুরো শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ঘুরে দাঁড়াল সোয়ে। দূরে জানালার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরের প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের কমলা আলোয় কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে ওটা।
লোকটাকে বিভ্রান্ত করার পর এবার অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। সোয়ে সাধুপুরুষ নয় মোটেই, কারণ নিমেষে তার চারপাশে একটা আভা ফুটে উঠল। এমন আভা এর আগে আর দেখেনি ও অস্থির, এই প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে, তারপরই আবার ক্ষীণ আভায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওটার রঙ, তারপরই আবার মলিন, চাপা রূপ নিচ্ছে। নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তার কারণে দূষিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্তিত্ব টের পেল তাই।
সোয়ের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, পরস্পরবিরোধী, তবে তার উল্লেখযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
হাসতে হাসতে একদল নারী কামরায় ঢুকতেই চট করে জানালার কাছ থেকে সরে এলো সোয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিনতাকা, উত্তেজিতভাবে ছুটে গিয়ে প্রবল মমতায় সোয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল তাইতা। রানির পক্ষে দারুণ ব্যতিক্রমী আচরণ। কেবল একা থাকলেই তাইতাকে আলিঙ্গন করেন তিনি। পরিচারিকাদের সামনে নয়। সোয়ের কাছে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তিনি বুঝতে পারেনি ও। রানি সোয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পরিচারিকরা এসে হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে।
পবিত্র পিতা, আমাদের আশীর্বাদ করুন, মিনতি করল ওরা। এক ও অদ্বিতীয় দেবীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন।
ওদের মাথর উপর আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে। পরমানন্দে হেসে উঠল ওরা।
সোয়েকে কুশনের একটা ঢিবির কাছে নিয়ে গেলেন মিনতাকা, রানির মাথা থেকে বেশ উঁচু করে তুলল সেগুলো সোয়ের মাথা। তারপর অল্পবয়সী মেয়েদের মতো নিতম্বের নিচে পা ভাঁজ করে বসলেন তিনি। যেনানা জানালার দিকে ফিরে সুন্দর হাসি দিলেন, জানেন তাইতা ওখানে বসে ওদের দেখছে। নিজের সাম্প্রতিক সংগ্রহের প্রতি ওর অনুমোদন কামনা করছেন। যেন সোয়ে দূর দেশ থেকে আনা কোনও বিচিত্র পাখি, কিংবা কোনও বিদেশী অতিথির দেওয়া মূল্যবান রত্ন। রানির এমনি অসতর্কতায় সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কিন্তু পরিচারিকাদের সাথে আলাপে মগ্ন সোয়ে। ওদের দৃষ্টি চালাচালি লক্ষ করেনি। এবার মিনতাকার দিকে তাকাল
মহারানি, গতবার আমাদের দেখা হওয়ার পর আপনার উদ্বেগের বিষয়ে অনেক ভেবেছি, দেবীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছি আমি, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে সাড়া দিয়েছেন।
ফের অবাক হলো তাইতা। এ লোক বিদেশী কেউ নয়, ভাবল ও। মিশরিয়। আমাদের ভাষা নির্ভুল ব্যবহার করছে। উচ্চ রাজ্যের অধিবাসী আসৌনদের মতো টান আছে তার কথায়।
বলে চলল সোয়ে। এসব ব্যাপার এত জরুরি ও কঠিন যে এই মুহূর্তে সেগুলো কেবল আপনার নিজের কাছে গোপন রাখতে হবে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিন। হাত তালি দিলেন মিনতাকা। লাফ দিয়ে উঠে ভীত ইঁদুরের মতো কামরা থেকে ছুটে বের হয়ে গেল ওরা।
সবার আগে আপনার স্বামী, নেফার সেতির প্রসঙ্গ, একাকী হওয়ার পর আবার বলল সোয়ে। তিনি আপনার কাছে এই খবব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু থেমে মিনতাকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তারপর এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করল যেটা ওর নিজস্ব ভাষা নয়, বৈরী নারী কণ্ঠ। আমার আগমনের সময় নেফার সেতিকে নিজের প্রেমময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করব আমি, সানন্দে আমার কাছে আসবে সে।
চমকে উঠল তাইতা, কিন্তু ওর পাশে দিমিতার বুনো চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে শান্ত করতে হাত বাড়াল তাইতা। যদিও নিজেই প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন দিমিতার। তাইতার হাত ধরে টানলেন তিনি। ওর দিকে ফিরল তাইতা। নিঃশব্দে একটা বার্তা উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, পরিষ্কার বুঝতে পারল তাইতা, যেন চিৎকার করে বলা হয়েছে। ডাইনী! এটা ইয়োসের কণ্ঠস্বর! দিমিতার ঘোরে থাকার সময় তার মনের গহীন থেকে এই কণ্ঠস্বরই বের করে এনেছিল তাইতা।
তবে এসবেরই প্রভু হচ্ছে আগুন, পুনরাবৃত্তি করে পূর্ণ সম্মতিতে হাতের তালু উপরের দিকে মেলে ধরল।
সোয়ে কথা বলে চলেছে, শোনার জন্যে পেছন ফিরে তাকাল ওরা: আমার অলৌকিক রাজ্যের অধিপতি করার জন্যে পুনরুত্থান ঘটাব তার। পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের রাজারা তার অধীনে চলে আসবে। আমার নামে চিরকাল আপন মহিমায় শাসন করবে সে। আপনি, প্রিয় মিনতাকা, থাকবেন তার পাশে।
স্বস্তি আর আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিনতাকা। পিতৃসুলভ কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সোয়ে। তাঁর সামলে ওঠার অপেক্ষা করল। অবশেষে চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের কী হবে?
আগেই ওদের কথা বলেছি আমরা, কোমল কণ্ঠে তাঁকে মনে করিয়ে দিল সোয়ে।
হা! কিন্তু বেশিবার শুনিনি। দয়া করে, পবিত্র পয়গম্বর, আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি…
দেবী আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওদের, ওরা পূর্ণ আয়ু পার করবে।
আর কী নির্দেশ দিয়েছেন তিনি? দয়া করে আবার বলুন।
ওরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারলে আপনার সকল সন্তানকে চির তারুণ্য দান করবেন তিনি। কোনও দিন আপনাকে ফেলে যাবে না ওরা।
আমি সন্তুষ্ট, সর্বশক্তিমতী দেবীর মহান পয়গম্বর, ফিসফিস করে বললেন মিনতাকা। আমি আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছার কাছে সঁপে দিচ্ছি। হাঁটু ভেঙে সোয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। চুলের ডগায় অশ্রু মুছলেন তিনি।
এরচেয়ে বিতৃষ্ণ দৃশ্য আর হতে পারে না। এমনটা আর তাইতা দেখেনি। পর্দার এপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল ও। লোকটা মিথ্যার চ্যালা! নিজেকে ওর হাতে নোংরা হতে দেবেন না।
পরিচারিকাদের তলব করলেন মিনতাকা। সকালের বাকি সময়টা সোয়ের সাথে কাটাল ওরা। কথোপকথন অর্থহীন বাক্যালাপে পর্যবসিত হলো, কারণ পরিচারিকাদের কারওই সোয়ের শিক্ষা অনুসরণ করার মতো বুদ্ধি নেই। সরল ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হলো সে। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, হাসিঠাট্টায় তাকে ত্যক্ত করতে লাগল।
দেবী আমার জন্যে ভালো একজন স্বামী খুঁজে দেবেন?
আমাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেবেন?
লক্ষ্যণীয় ধৈর্য ধরে ওদের সামাল দিল সোয়ে।
তাইতা বুঝতে পারল ওরা অনেক কিছু জানতে পারলেও যেনানা পর্দার আড়ালে নীরবে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চলে যাবার চেষ্টা করলে নড়াচড়ায় পয়গম্বরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। দুপুরের খানিক আগে দেবীর উদ্দেশে লম্বা প্রার্থনা শেষে সভার সমাপ্তি টানল সোয়ে। তারপর ফের মেয়েদের চুমু খেয়ে মিনতাকার দিকে ফিরল। মহারানি, আপনি কি চান পরে আবার আসি আমি?
দেবীর এইসব ইচ্ছা নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কাল সকালে আবার আসুন, তখন এসব নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। মাথা নুইয়ে সরে গেলেন তিনি।
সোয়ে বিদায় নেওয়ার পরপরই পরিচারিকাদের বিদায় দিলেন মিনতাকা।
তাইতা, এখনও আছো তোমরা?
জ্বি, মহারানি।
একটানে পর্দা সরিয়ে মিনতাকা জানতে চাইলেন, লোকটা কত জ্ঞানী আর শিক্ষিত, কত চমৎকার সব সংবাদ নিয়ে আসেন বলেছি তোমাকে?
অসাধারণ খবর, সত্যি, জবাব দিল তাইতা।
দেখতেও সুন্দর, না? মনেপ্রাণে তাকে বিশ্বাস করি আমি। অন্তর থেকে জানি তার ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী সত্যি; দেবী নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করবেন, আমাদের কষ্ট দূর করবেন তিনি। ওহ, তাইতা, তার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তুমি? নিশ্চয়ই করেছ!
ধর্মীয় ঘোরে রয়েছেন মিনতাকা। তাইতার জানা আছে, এখন কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে হিতে বিপরীত হবে। দিমিতারকে এখন এমন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে বসে এতক্ষণ যা কিছু জেনেছে সেসব নিয়ে আলাপ করতে পারবে। অগ্রসর হওয়ার কায়দা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তার আগে মিনতাকার মুখে সোয়ের তারিফ শুনতে হবে। এক সময় সব প্রশংসার শব্দ ফুরিয়ে গেলে আস্তে করে তাইতা বলল, আমি আর দিমিতার উত্তেজনায় ক্লান্ত। ফারাও তাঁর জরুরি দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ামাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, তো এখন হাতের কাছে থাকার জন্যে থেবসে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। আরও আলোচনা করা যাবে তখন, রানি আমার।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বিদায় দিলেন তিনি।
*
ওরা ফের বাহনে চেপে নদীর দিকে পথে নামার পরপরই পালকির দুই পাশে যথারীতি অবস্থান নিল তাইতা ও মেরেন। মিশরিয় ভাষা ছেড়ে তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করল এবার তাইতা ও দিমিতার, যাতে এসকর্টের লোকজন ওদের আলোচনা না বোঝে।
সোয়ের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে পেরেছি আমরা, শুরু করল তাইতা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকটা ডাইনীকে দেখেছে, বলে উঠলেন দিমিতার। ডাইনীর কথা শুনেছে সে। নির্ভুলভাবে তার কণ্ঠে কথা বলেছে।
তার কথাবার্তার ধরন আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি, অপানার কথার সত্যতায় আমার সন্দেহ নেই, সায় দিল তাইতা। তবে আমার মতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। সোয়ে মিশরিয়। তার বলার ভঙ্গি উচ্চ রাজ্যের।
এটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনাদের ভাষায় আমার দক্ষতা এসব ব্যাপার ধরতে পারার মতো নয়। এটা ডাইনীর সত্যিকারের অবস্থানের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। থেবসে আসতে সোয়েকে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়নি ধরে নিলে দুটি রাজ্যের সীমানার ভেতরই আমাদের তদন্ত শুরু করতে পারি, কিংবা অন্ততপক্ষে, এগুলোর আশপাশের জায়গাগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে।
এইসব এলাকায় কি কি আগ্নেয়গিরি আছে?
ঠিক মিশরে কোনও বড় আগ্নেয়গিরি বা হ্রদ নেই। মধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে নীলনদ। উত্তরে এটাই সবচেয়ে কাছের জলের উৎস। এতনা দশদিনেরও বেশি দূরের পথ। ইয়োস ওখানে নেই, এ ব্যাপারে আপনি এখনও নিশ্চিত?
হ্যাঁ, মাথা দোলালেন দিমিতার।
বেশ। এই দিকে আরেক বড় আগ্নেয়গিরি, এতনার ওপাশে প্রণালীর উল্টোদিকের মূলভূখণ্ডের ভিসুভিয়াস সম্পর্কে কী বলবেন? জানতে চাইল তাইতা।
সন্দিহান মনে নিচের ঠোঁট কামড়ালেন দিমিতার। ওই কুকুরও শিকার করবে, জোরের সাথে বললেন তিনি। ওর খপ্পর থেকে পালোনোর পর ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে তিরিশ লীগেরও কম দূরের মন্দিরের যাজকদের সাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। ধারে কাছে থাকলে নির্ঘাৎ টের পেতাম, কিংবা সেও আমার উপস্থিতি বুঝে যেত। উঁহু, তাইতা, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে আমাদের।
আপাতত আপনার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই চলা যাক, বলল তাইতা। লোহিত সাগরের পুব প্রান্তে। ওই সাগরের তীরে আরব বা অন্য কোনও দেশের বুনো এলাকা চিনি না আমি। আপনি চেনেন?
না। ওসব জায়গায় গেলেও কোনও আগ্নেয়গিরির কথা শুনিনি বা দেখিনি।
যাগরেব পাহাড়ের ওধারের এলাকায় দুটি আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি, তবে বিশাল প্রান্তর ওগুলোকে ঘিরে রেখেছে। আমরা যেটা খুঁজছি তার সাথে ওগুলোর বর্ণনা মেলে না।
মিশরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা পড়ে আছে, বললেন দিমিতার। তবে আসুন, আরেকবার সম্ভাবনার কথা বিচার করা যাক। আফ্রিকার অভ্যন্তরে বিশাল নদী ও হ্রদ আর সেগুলোর কোনওটার আশপাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে না?
তেমন কিছু শুনিনি আমি-অবশ্য, এটাও ঠিক যে, ইথিওপিয়ার চেয়ে দক্ষিণে কেউ এপর্যন্ত যায়নি।
শুনেছি, তাইতা, মিশর থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লস্ত্রিসকে সেই উত্তরে হাওয়ার দেশ কেবুই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি, যেখানে নীল দুটো বিশাল জলধারায় ভাগ হয়ে গেছে।
ঠিক। কবুই থেকে আমরা নদীর বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পাহাড়সারিতে গিয়েছিলাম। ডান দিকের শাখা অন্তহীন জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে, ওদিকে বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কোনওদিন ওটার দক্ষিণের প্রান্তে যায়নি। কেউ গেলেও সে-কাহিনী বলতে ফিরে আসেনি। কেউ কেউ বলে জলাভূমি নাকি অন্তহীন, বিশাল, নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শেষমাথা পর্যন্ত চলে গেছে ওটা।
তাহলে আরও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তার রসদের জন্যে হাথরের মন্দিরের যাজিকার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। কবে ওরা তথ্য জানাবে?
দশ দিন পর আবার যেতে বলেছিলেন যাজিকা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
পালকির পর্দা একপাশে সরিয়ে তারপর পেছনের পাহাড়সারির দিকে তাকালেন দিমিতার। এখন মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছি আমরা। ওখানে গিয়ে যাজিকার আতিথ্য ও রাতের জন্যে ঘুমোনোর চাদর চাওয়া দরকার। সকালে ওর মানচিত্র শিল্পী ও ভূগোল বিশারদদের সাথে কথা বলা যাবে।
ফারাও মেমনন আমাকে তলব করলে, ওর ভৃত্যরা আমাকে খুঁজে পাবে না, বলল ইতা। আমরা আবার প্রাসাদ থেকে বেরুনোর আগেই ওর সাথে দেখা করতে দিন।
এখানে থামো, হাবারিকে নির্দেশ দিলেন দিমিতার। এখুনি থামাও, বলছি। তারপর তাইতার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই, কিন্তু এখন আমি জানি, আপনার সাথে আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বপ্ন ও অশুভ ভাবনা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। মেরেন আর আপনার দেওয়া প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ডাইনীটা অচিরেই আমাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে সফল হবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। সেদিন সকালে সোয়ের ভীতিকর আভা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার পর থেকেই এই একই অশুভ ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাকে। পালকির কাছে এসে বুড়োর জীর্ণ চেহারা ভালো করে পরখ করল ও। বিষাদের সাথে লক্ষ করল, দিমিতার ঠিকই বলেছেন: মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার। প্রায় বিবর্ণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া, তবে ওগুলোর গভীরে খাওয়ায় ব্যস্ত হাঙড়ের মতো চলমান ছায়া দেখতে পেল।
আপনিও দেখতে পেয়েছেন, নিরস, ফাঁকা কণ্ঠে বললেন দিমিতার।
জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ঘুরে দাঁড়াল তাইতা, হাবারিকে নির্দেশ দিল। দলটাকে ঘোরাও। হাথরের মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। এক লীগের চেয়ে সামান্য দূরে সেটা।
কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা। তারপর ফের কথা বললেন দিমিতার। আমার প্রাচীন, দুর্বল দেহের বাধা না থাকলে আরও দ্রুত এগোতে পারবেন আপনারা।
নিজের প্রতি বড় অবিচার করছেন আপনি, ওকে ভৎর্সনা করল তাইতা। আপনার সাহায্য ছাড়া কোনদিনই এতদূর আসতে পারতাম না।
শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে ডাইনীটাকে হত্যার সময় উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা হবার নয়। একটু সময় চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আবার খেই ধরলেন। সোয়ের সাথে কীভাবে সামাল দেবেন? আপনার সামনে একটা পথই খোলা। ফারাওকে সোয়ের মিনতাকাকে জাদু করার খবর আর তার মনে গেথে দেওয়া বিশ্বাসঘাতকার চিন্তার খবর দিলে তাকে আটক করার জন্যে তিনি প্রহরী পাঠাবেন। তখন আপনি নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের সুযোগ পাবেন। শুনেছি থেবসের কারারক্ষীরা নাকি তাদের কাজে বেশ দক্ষ। নির্যাতনের কথায় কুকুড়ে যান না তো?
স্রেফ শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সোয়ের মচকানোর সামান্যতম সম্ভাবনা আছে থাকলে তাতে দ্বিধা করব না। কিন্তু তাকে আপনি দেখেছেন। ডাইনীকে রক্ষা করতে চাইবে সে। ডাইনীর সাথে তার এমনই বোঝাঁপড়া যে তার কষ্ট ও তার কারণ বুঝে যাবে সে। সে বুঝতে পারবে ফারাও ও রানি মিনতাকা তার বোনা জালের কথা টের পেয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে রাজপরিবারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে তা।
তা ঠিক, সায় দিলেন দিমিতার।
তাছাড়া, সোয়েকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন মিনতাকা, তখন নেফার সেতি বুঝবেন তিনি আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী। তাতে ওদের ভালোবাসা ও আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওদের এই ক্ষতি করতে পারব না।
তাহলে মন্দিরেই উত্তর পাওয়ার আশা করতে হবে।
দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলেন যাজিকারা। স্বাগত জানাতে দুজন নবীশকে পাঠালেন তারা। ওদের পথ দেখিয়ে মূল প্রবেশ পথের র্যাম্পের কাছে নিয়ে এলো ওরা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রধান যাজিকা। :
আপনাকে দেখে খুবই খুশি হলাম, ম্যাগাস। এমনিতেও ব্রাদার নুবাঙ্ক আপনার অনুরোধ নিয়ে অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করেছেন জানাতে আপনার খোঁজে থেবসে বার্তাবাহক পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তিনি আপনাকে তাঁর পাওয়া তথ্য তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে আপনি আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। তাইতার দিকে মায়ের চোখে তাকালেন তিনি। আপনি এখানে হাজারবার স্বাগত। পুরুষদের মহলে পরিচারিকরা আপনার চেম্বারের ব্যবস্থা করছে। যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পরেন। আপনার বিজ্ঞ আলোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।
আপনার অসীম দয়া ও ঔদার্য, মা। আমার সাথে আরেকজন মহাজ্ঞানী ও বিখ্যাত ম্যাগাস রয়েছেন।
তিনিও এখানে স্বাগত। আপনার সঙ্গীদের পুরুষদের মহলে আশ্রয় ও খাবার দেওয়া হবে।
যার যার বাহন থেকে নেমে পড়ল ওরা। দিমিতারকে নামতে সাহায্য করল মেরেন। তারপর মন্দিরে প্রবেশ করল। প্রধান দরবারের আনন্দ, মাতৃত্ব ও ভালোবাসার দেবী হাথরের প্রতিকৃতির সামনে থামল ওরা। শাদা-কালো ফুটকিঅলা গাভী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে, শিঙজোড়া সোনালি চাঁদ দিয়ে সাজানো। প্রার্থনা করলেন যাজিকা। তারপর তাইতা ও দিমিতারকে একটা মাঠের উপর দিয়ে মন্দিরের যাজকদের এলাকায় নিয়ে যেতে এক নবীশকে ডাকলেন। ওদের একটা ছোট পাথুরে দেয়ালের সেলে নিয়ে এলো সে, এখানে দূর প্রান্তের দেয়ালের গায়ে চাদর ঠেস দিয়ে রাখা। জলভর্তি গামলাও আছে যাতে তরতাজা হয়ে নিতে পারে ওরা।
রাতের খাবারের সময় আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে আবার আসব আমি, ব্রাদার নুবাঙ্ক ওখানে আপনাদের সাথে দেখা করবেন।
*
ওরা যখন খাবার ঘরে পা রাখল তখন আগে থেকেই মোটামুটি জনাপঞ্চাশ যাজক খাচ্ছিল, কিন্তু একজন এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ওদের সাথে মিলিত হতে দৌড়ে এলো। আমি নুবাঙ্ক। আপনাদের স্বাগত জানাই। মানুষটা লম্বা, ছিপছিপে, মড়ার মতো চেহারা। এই দুঃসময়ে মিশরে খুব কমই মোটাসোটা লোক আছে। খাবার একেবারেই সামন্য: এক বাটি ঝোল আর ছোট এক জগ বিয়র। মোটামুটি নীরবেই খাওয়া সারল সবাই। কেবল নুবাঙ্ক বাদে। এক মুহূর্তের জন্যেও কথা থামাল না সে। কণ্ঠস্বর খরখরে, আচরণে তোষামুদে ভাব।
কাল কেমন করে বাঁচব জানি না, দিমিতারকে বলল তাইতা, নিজেদের সেলে ফিরে এসেছে ওরা, ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রিয় ব্রাদার নুবাঙ্কের বকবকানি শুনতে গেলে দিনটা লম্বা হয়ে যাবে।
তবে ভূগোল সম্পর্কে তার বিদ্যা পূর্ণাঙ্গ, যুক্তি দেখালেন দিমিতার।
ঠিক বিশেষণটাই বেছে নিয়েছেন আপনি, ম্যাগাস, বলে পাশ ফিরে শুলো তাইতা।
*
এক নবীশ ওদের নাশতার জন্যে তলব করতে এলো যখন, তখনও সূর্য ওঠেনি। দিমিতারকে আরও দুর্বল ঠেকল। তাই মেরেন ও তাইতা মাদুর থেকে উঠতে সাহায্য করল ওকে।
মাফ করবেন, তাই। ভালো ঘুম হয়নি আমার।
আবার স্বপ্ন? তেনমাস ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ। ডাইনীটা কাছে এসে পড়ছে। ওকে ঠেকানোর মতো শক্তি পাচ্ছি না।
তাইতাও স্বপ্নে আক্রান্ত হয়েছে। ওর স্বপ্নে ফিরে এসেছে পাইথনটা। এখনও নাক ও গলার পেছনে লেগে আছে ওটার বুনো গন্ধ। কিন্তু নিজের ভীতি গোপন করে দিমিতারের সামনে আত্মবিশ্বাসী ভাব করল ও। আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের।
নাশতায় ছিল ছোট কঠিন ধুরা পাতা আর আরেক জগ পাতলা বিয়র। গতরাতে যেখানে বাধা পড়েছিল সেখান থেকে ফের একক সংলাপ শুরু করল ব্রাদার নুবাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে অচিরেই নাশতার পালা চুকে গেল। কিছুটা স্বস্তির সাথে নুবাঙ্কের পিছু পিছু গুহার মতো দরবার আর উঠোন হয়ে মন্দিরের লাইব্রেরির দিকে এগোল ওরা। বিশাল, শীতল একটা কামরা, উঁচু উঁচু পাথুরে দেয়ালে মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঢেকে রাখা তাক ছাড়া অলঙ্করণ বা আসবাবেব কোনও বালাই নেই। প্যাপিরাসের স্কোলে ঠাসা তাকগুলো, হাজার হাজার।
নুবাঙ্কের জন্যে অপেক্ষা করছিল তিনজন নবীশ ও দুই জন পুরোনো শিষ্য। এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, হাত সামনে বেঁধে রেখেছে। দাসসুলভ আচরণ। ওরা নুবাঙ্কের সহকারী। ওদের ভক্তির পেছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। ওদের সাথে রূঢ় আচরণ করে নুবাঙ্ক। সবচেয়ে কর্কশ অপমানকর ভাষায় নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না সে।
তাইতা ও দিমিতার প্যাপিরাস স্কুলে ভর্তি দীর্ঘ নিচু সেন্টার টেবিলে বসার পর লেকচার শুরু করল নুবাঙ্ক। পরিচিত বিশ্বের প্রতিটি আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণ জিনিসের বিবরণ দিতে লাগল, সেটা বিশাল জলাধারের আশপাশে হোক বা না হোক। একেকটা জায়গার নাম বলছে আর অমনি ভীত সন্ত্রস্ত একজন সহাকারীকে তাক থেকে সঠিক স্ক্রোলটা আনতে বলছে। অনেক সময়ই নড়বড়ে মই বেয়ে ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। এদিকে লাগাতার মুখখিস্তি করে দৌড়ের উপর রাখছে ওদের নুবাঙ্ক। তাই একবার ওর মূল অনুরোধের কথা উল্লেখ করে এই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চেষ্টা করলেও দায়সারাভাবে মাথা দুলিয়ে ফের নিজের কায়দায় কাজ চালিয়ে গেল নুবাঙ্ক।
অভাগা এক নবীশ ছিল নুবাঙ্কের পছন্দের শিকার। বেখাপ্পা চেহারা তার: শরীরের কোনও অংশই খুঁত হীন বা বিকৃতির উর্ধ্বে মনে হয়নি। ওর মুড়ানো মাথা লম্বাটে, মাথায় খুস্কি ভরা, পরিষ্কার ঘা সেখানে। কুঁতকুঁতে কাছাকাছি বসানো ট্যারা চোখের উপর বসানো তার ভুরুজোড়া। হেয়ারলিপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে বড় বড় দাঁত। কথা বলার সময় লালা গড়াচ্ছে। যদিও মুখে খুব একটা কথা সরে না তার। চিবুক এমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে যে আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। বাম গালের উপর বড় মালবেরি আকারের জন্মদাগ, বুকটা ভেতরে ঢোকানো, পাহাড়ের মতো কুঁজঅলা পিঠ। কাঠির মতো সরু পাজোড়া বাকানো; হাঁটার সময় একপাশে হেলে হাঁটে।
দিনের মাঝামাঝি সময় একজন নবীশ দুপুরের খাবারের জন্যে ওদের খাবার ঘরে যেতে তলব করতে এলো। সবাই আধা উপোস থাকায় নুবাঙ্ক ও তার সহকর্মীরা দ্রুত সাড়া দিল। খাবারের সময় কুঁজো নবীশকে আড়ালে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে দেখল তাইতা। তাইতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বোঝমাত্র উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল সে। ওখানে একবার পেছনে তাকিয়েই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে; বোঝাতে চাইছে, তাইতা ওকে অনুসরণ করুক।
ছোটখাট মানুষটাকে টেরেসে ওর অপেক্ষায় থাকতে দেখল তাইতা। ফের ইশারা করল সে। তারপর একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুসরণ করল তাইতা। অচিরেই প্রাঙ্গণের একটা ছোট মন্দিরে আবিষ্কার করল নিজেকে। দেয়ালগুলো হাথরের আবক্ষমূর্তিতে ঢাকা। ফারাও মামাসের একটা মূর্তিও রয়েছে। ওটার পিছনে গা ঢাকা দিয়েছে লোকটা।
মহান ম্যাগাস! আপনাকে একটা কিছু বলার আছে আমার, আপনার হয়তো কৌতূহল হতে পারে। তাই কাছে এগিয়ে যেতেই প্রণত হলো সে।
উঠে দাঁড়াও, সহজ কণ্ঠে বলল তাইতা। আমি রাজা নই। তোমার নাম কী? ব্রাদার নুবাঙ্ক এই নবীশটিকে কেবল এই মিয়া সম্বোধন করেছে।
এভাবে হাঁটি বলে আমাকে সবাই টিপটিপ ডাকে। আমার দাদা মিশর থেকে ইথিওপিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লক্ট্রিসের দরবারের একজন নিম্নপদস্থ চিকিৎসক ছিলেন। তখন প্রায়ই আপনার কথা বলতেন তিনি। আপনার হয়তো তার কথা মনে থাকতে পারে, ম্যাগাস। তার নাম সিতন।
সিতন? এক মুহূর্ত ভাবল তাইতা। হ্যাঁ! ভালো ছেলে ছিল সে। চামচ দিয়ে কাঁটাঅলা তীর তোলায় বেশ দক্ষ ছিল। অনেক সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রাণখোলা হাসি দিল টিপটিপ। কাটা ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তোমার দাদার কী হয়েছে?
বুড়ো বয়সে শান্তিতেই মারা গেছেন, তবে যাবার আগে দক্ষিণের দেশে আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী বলেছেন তিনি। ওখানকার লোকজন আর বুনো জম্ভজানোয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতের কথা বলেছেন, দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া এক বিশাল জলাভূমির কথাও বলেছেন।
সে ছিল দারুণ উত্তেজনার সময়, টিপটিপ, মাথা দুলিয়ে ওকে অনুপ্রাণিত করল তাইতা। বলে যাও।
কেমন করে আমাদের জাতির মূল অংশ নীলের বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পর্বতমালার দিকে গিয়েছিল সে কাহিনী বলেছেন তিনি। শেষ সীমানা আবিষ্কার করার জন্যে ডান দিকের শাখায় একটা দল পাঠিয়েছিলেন রানি লস্ত্রিস। সেনাপতি লর্ড আকেরের নেতৃত্বে বিশাল জলার দিকে রওয়ানা হয়েছিল তারা, সেই বাহিনীর একজন ছাড়া আর কাউকে আর দেখা যায়নি। কথাটা কি ঠিক, ম্যাগাস?
হ্যাঁ, টিপটিপ। রানির বাহিনী পাঠানোর কথা মনে আছে আমার। স্বয়ং তাইতাই সেই অভিশপ্ত অভিযানে আকেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। লোকটা ঝামেলাবাজ ছিল, লোকজনের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সেটা আর এখন বলতে গেল না ও। এও ঠিক যে, কেবল একজনই ফিরে এসেছিল। কিন্তু মানুষটা রোগে আর যাত্রায় এতই ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত ছিল যে আমাদের কাছে ফিরে আসার অল্প কদিন বাদেই জ্বরের কাছে হার স্বীকার করে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! উত্তেজনায় তাইতার বাহু খামচে ধরল টিপটিপ। আমার দাদাই সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘোরের ভেতর সেই সৈনিক পাহাড় আর বিশাল সব হ্রদে ঘেরা এক দেশের কথা বলেছিল। হ্রদগুলো এত বিশাল যে খালি চোখে এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না।
তাইতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। হ্রদ! আগে তো এ-কথা শুনিনি। বেঁচে যাওয়া সেই লোকের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। ইথিওপিও পাহাড়ে ছিলাম আমি। সে যখন মৃত্যুর স্থান কেবুইয়ে পৌঁছায় তখন আমি সেখান থেকে শত শত লীগ দূরে। আমার কাছে যে খবর আসে তাতে বলা হয়েছিল যে, রোগীর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারেনি। টিপটিপের দিকে তাকিয়ে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। ওর আভা থেকে বুঝতে পারল আন্তরিক মানুষ সে, যেমন মনে আছে সেভাবেই সত্যি কথা বলছে। তোমার আরও কিছু বলার আছে, টিপটিপ? আমার কিন্তু তাই ধারণা।
জ্বি, ম্যাগাস। একটা আগ্নেয়গিরি আছে, হড়বড় করে বলে উঠল টিপটিপ। সেকারণেই আপনার কাছে আসা। মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক একটা জ্বলন্ত পাহাড়ের কথা বলেছিল, এর আগে কেউ অমন দেখেনি। ওরা বিশাল জলাভূমি পেরুনোর পর অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল ওটা। সে বলেছে ওটার সুড়ঙ থেকে বেরুনো ধোয়া আকাশের বুকে চিরস্থায়ী মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। বাহিনীর কেউ কেউ একে কালো আফ্রিকান দেবতাদের আর না এগোনোর সতর্কবাণী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড আকের ওটাকে স্বাগত সঙ্কেত ঘোষণা করেন। ওখানে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি; অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অবশ্য, এই পর্যায়ে সৈনিকটি আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিসীমায় জ্বরে পড়লে সে মরে গেছে ভেবে তাকে ফেলে সঙ্গীরা দক্ষিণে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনওমতে দানবীয় কালো মানুষদের একটা গ্রামে পৌঁছায় সে, হ্রদের পাশেই ওদের বসতি ছিল। ওকে তুলে নিয়ে যায় ওরা; ওদের এক শামান ওষুধ দিয়ে সেরে ওঠা পর্যন্ত সেবাযত্ন করে তার। ঠিকমতো সেরে ওঠার পর ফিরতি পথ ধরে সে। উত্তেজনার বশে তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল টিপটিপ। ব্রাদার নুবাঙ্ক বাধা দেওয়ার আগেই কথাটা আপনাকে বলতে চেয়েছি। সত্তর বছর আগের গুজবে আপনাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন আমরা ভূগোলবিশারদরা কেবল সত্যি বিষয় নিয়ে কাজ করি। ব্রাদার নুবাঙ্ককে আবার আমার অবাধ্য হওয়ার কথা বলে দেবেন না তো? তিনি ভালো, পবিত্র পুরুষ, তবে অনেক কঠোর হতে পারেন।
ঠিক কাজই করেছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। আস্তে করে ওকে খামচে ধরে রাখা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করল। তারপর হঠাৎ আরও নিবিড়ভাবে পরখ করতে টিপটিপের হাত তুলে নিল। তোমার ছয় আঙুল! বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।
স্পষ্টই হতবাক হয়ে গেছে টিপটিপ। হাত মুঠি বানিয়ে বিকৃতি আড়াল করার চেষ্টা করল সে। দেবতারা আমার গোটা শরীরটাই উল্টাপাল্টা করে বানিয়েছেন। আমার মাথা, চোখ, পিঠ, হাত-পা-আমার সমস্ত কিছুই বাঁকাচোরা, কিস্তুত। অশ্রুতে ভরে উঠল তার চোখ।
কিন্তু তোমার মনটা ভালো, ওকে সান্ত্বনা দিল তাইতা। আস্তে করে ওর হাত খুলল ও। স্বাভাবিক কনে আঙুলের পাশে হাতের তালু থেকে একটা বাড়তি ছোট্ট আঙুল গজিয়েছে।
ছয় আঙুল পথ দেখাবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা।
আমি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইনি, ম্যাগাস। আমি কোনওদিনই ইচ্ছাকৃতভাবে ওভাবে আপনাকে অসম্মান করতে যাব না। গুঙিয়ে উঠল টিপটিপ।
না, টিপটিপ, আমার দারুণ উপকার করেছ তুমি। আমার কৃতজ্ঞতা আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।
ব্রাদার নুবাঙ্ককে বলে দেবেন না তো?
না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।
আপনার উপর হাথরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ম্যাগাস। এবার যাই, ব্রাদার নুবাঙ্ক এলে দেখে ফেলবেন আমাকে। কাঁকড়ার মতো পাশ কেটে চলে গেল টিপটিপ। তাকে কিছুটা এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিল তাইতা, তারপর লাইব্রেরির ফিরতি পথ ধরল। মেরেন ও দিমিতার ওর আগেই এসে পড়েছে। টিপটিপকে গালমন্দ করছে নুবাঙ্ক: ছিলে কোথায়?
ল্যাট্রিনে গিয়েছিলাম, ব্রাদার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন কিছু খেয়েছি, পেটে গোলমাল বেধে গেছে।
আমার পেটেও গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছ তুমি, ব্যাটা দুর্গন্ধঅলা মলের টুকরো। ওখানেই নিজেকে রেখে আসা উচিত ছিল তোমার। টিপটিপের জন্মদাগের উপর আঘাত করল সে। যাও, এবার পুব সাগরের দ্বীপের বর্ণনাঅলা স্ক্রলগুলো নিয়ে এসো।
দিমিতারের পাশে বসে তেনমাস ভাষায় তাই বলল, বেচারার ডান হাতের দিকে একবার তাকান।
ওর ছয়টা আঙুল, বলে উঠলেন দিমিতার। ছয় আঙুল পথ দেখাবে! ওর কাছে কিছু জানতে পেরেছেন, নাকি পারেননি?
নীল মাতার ডান দিকের শাখা ধরেই উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের। ওখানেই এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির দেখা পাব। আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়ে আছে ইয়োস।
*
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই হাথরের মন্দির ত্যাগ করল ওরা। অনীহার সাথে ওদের বিদায় জানাল নুবাঙ্ক-এখনও পঞ্চাশটা আগ্নেয়গিরির বর্ণনা দেওয়া বাকি রয়ে গেছে তার। থেবসের নীচে নীলের ঘাটে যখন পৌঁছাল ওরা, তখনও অন্ধকার কাটেনি। পথ দেখিয়ে ওদের নদীর জলে নিয়ে এলো হাবারি ও মেরেন। তাইতা ও দিমিতার অনুসরণ করল। কিন্তু দুটি দলের মাঝে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হলো। নেতারা দুর্গন্ধময় লাল পুকুরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথে আধাআধি আগে বাড়ার পর কাদা ভেঙে এগোতে শুরু করল দিমিতারের উট। ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের উপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা একটা বৈরী প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা টের পেল। কানের পাশে শিরাটা দপদপ করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ারের নিত্যস্বর উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ও।
এইমাত্র ছেড়ে আসা তীরে এক নিঃসঙ্গ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের সাথে তার কালো জোব্বা মিশে গেলেও নিমেষে তাকে চিনে ফেলল তাইতা।
অন্তর্চক্ষু খুলতেই সোয়ের ভিন্ন ধরনের আভা দেখা দিল, মানুষটাকে যেন ঢেকে ফেলছে, অনেকটা বনফায়ারের শিখার মতো: রঙটা হিংস্র লাল, এখানে ওখানে পিঙ্গল ও সবুজ ছোপ। এমন ভয়ঙ্কর আভা এর আগে কখনও দেখেনি তাই।
সোয়ে এখানে! পালকিতে শোয়া দিমিতারের উদ্দেশে তাগিদ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে উটের পার হওয়ার পথের পুকুরের তলের দিকে ইঙ্গিত করল সোয়ে। যেন তার নির্দেশে সাড়া দিচ্ছে, এমনভাবে পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠল একটা বিশাল কুনো ব্যাঙ, কামড়ে উটের বাম পায়ের উরুর উপরের অংশ থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিল। ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জানোয়ারটা, পুকুর থেকে লাফ দিল। ওপারে যাবার বদলে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরই নদীর তলদেশের উপর দিয়ে ছুটল সবেগে। প্রবলবেগে এপাশ ওপাশ দোল খেতে লাগল দিমিতারের পালকি।
মেরেন! হাবারি! মেয়ারের পেটে লাথি হাঁকিয়ে ছুটন্ত উটের পিছু ধাওয়া শুরু করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা। বাহন ঘুরিয়ে নিল মেরেন ও হাবারি, পিছু ধাওয়ায় ওদের সামিল করতে তাগিদ দিতে লাগল।
শক্ত করে ধরে রাখুন, দিমিতার! চিৎকার করল তাইতা। আমরা আসছি! ওর পাছার নিচে যেন উড়াল দিচ্ছে উইন্ডস্মোক। কিন্তু দিমিতারের নাগাল পাওয়ার আগেই আরেক পুকুরে পৌঁছে গেল উটটা, জলের ধারা ছিটিয়ে ছুটতে লাগল সেটার ভেতর দিয়ে। তখুনি ওটার সামনেই ফাঁক হয়ে গেল পুকুরের জল, আরেকটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত উটের মাথায় চড়াও হয়ে বুলডগের মতো মরণ কামড় বসাল। নিশ্চয়ই কোনও স্নায়ুতে আঘাত করে থাকবে, উটের সামনের পাজোড়া ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ে ব্যাঙের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়তে লাগল ওটা। উটের নিচে চাপা পড়ে গেছে পালকিটা, ভারে নাজুক বাঁশের কাঠামো মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
দিমিতার! ওকে বাঁচাতেই হবে! চিৎকার করে মেরেনের উদ্দেশে বলল তাইতা। আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল মেয়ারকে। কিন্তু ওটা পুকুরের কিনারে পৌঁছার আগেই জলের নিচ থেকে উঠে এলো দিমিতারের মাথা। কোনওভাবে পালকি থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু কাদায় অর্ধেকটা ডুবে গেছেন। মাথায় আস্তরণ পড়ে গেছে, ক্রমাগত কাশছেন বেচারা, বমি করছেন, নড়াচড়া নাজুক, ভ্রান্তিময়।
আমি আসছি! চিৎকার করে বলল তাইতা। হাল ছাড়বেন না! তারপরই সহসা কুনো ব্যাঙে টগবগ করে ফুটতে শুরু করল গোটা পুকুর। তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দিমিতারের উপর, যেন এক পাল বুনো কুকুর কোনও গেযেল হরিণকে আক্রমণ করেছে। আর্তনাদ করার প্রয়াসে মুখ হাঁ হয়ে ছিল বুড়ো মানুষটার। কিন্তু কাদা বাধা দিচ্ছে। ব্যাঙের দল টেনে পানির নিচে নিয়ে গেল ওকে, ফের যখন সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে উঠে এলেন তিনি, ওর লড়াই প্রায় শেষের দিকে। জলের নিচের ব্যাঙগুলোই ওর নড়াচড়ার কারণ, খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে ওরা।
আমি এখানে, দিমিতার! মরিয়া হয়ে চিৎকার করল তাইতা। মেয়ার নিয়ে উন্মত্ত ব্যাঙগুলোর ভেতর যেতে পারছে না, জানে ঘোড়াটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওরা। লাগাম টেনে ছড়ি হাতে পিছলে নেমে এলো ও। পুকুরের জলের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল। কিন্তু জলের নিচে একটা ব্যাঙ পায়ে দাঁত বসাতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। ছড়ির আঘাত হানল ব্যাঙটাকে। আঘাতটাকে জোরাল করতে শারীরিক-মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ এক করে নিল। ছড়ির ডগা জায়গামতো আঘাত করতেই ধাক্কা অনুভব করল ও। ওকে ছেড়ে দিল জানোয়ারটা। চিত হয়ে জলের উপর উঠে এলো, হতচকিত, খিঁচুনির ঢঙে পা ছুঁড়ছে।
দিমিতার! ওকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত ব্যাঙের দল থেকে থেকে আলাদা করে চেনা দায়। চকচকে কালো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে মানুষ আর পশু।
হঠাৎ গিজগিজে ব্যাঙের ঝাঁকটাকে ফাঁক করে দুটি শীর্ণ বাহু উঠে এলো জলের উপর। দিমিতারের কণ্ঠস্বর কনে এলো ওর। আমি শেষ। আপনাকে একাই যেতে হবে, তাইতা। ওর কণ্ঠস্বর বলে চেনা মুশকিল, কাদা আর বিষাক্ত লাল পানিতে দম বন্ধ হয়ে এসেছে তার। এবং পরক্ষণেই অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বড় আকারের একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ওর মাথার এক পাশে কামড়ে ধরে শেষবারের মতো পানির নিচে নিয়ে যেতেই থেমে গেল সেটা।
আবার সামনে এগোল তাইতা। কিন্তু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেরেন। শক্তিশালী হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কাদা থেকে তুলে নিল ওকে, তারপর ফিরিয়ে আনল তীরে।
নামাও আমাকে, নিজেকে মুক্ত করতে লড়াই করছে তাইতা। ওকে বিশ্রী জানোয়ারগুলোর হাতে ফেলে রেখে যেতে পারব না। কিন্তু ছাড়ল না মেরেন।
ম্যাগাস, আপনি আহত। নিজের পায়ের দিকে একবার তাকান। ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন। লাল কাদার সাথে মিশে যাচ্ছে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত। দিমিতার শেষ হয়ে গেছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মেরেন। তাইতাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। ধূসর মেয়ারটাকে ধরতে ফিরে গেল ও, ওর কাছে পৌঁছে দিল ওটাকে। তাইতাকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করার সময় মৃদু কণ্ঠে বলল, আমাদের যেতেই হবে, ম্যাগাস। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনার ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যাঙের দাঁত বিষাক্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর কাদাও এমন জঘন্য যে আপনার মাংসে সংক্রমণ ঘটবে।
কিন্তু আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, বন্ধুর শেষ একটা চিহ্নের খোঁজ করছে। তার শেষ যোগাযোগের সন্ধান করছে। কিন্তু কোনওটাই দেখা গেল না। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে মেয়ারের লাগাম তুলে নিয়ে সামনে বাড়ল মেরেন, আর প্রতিবাদ করল না তাইতা। পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছে ও। প্রবীন সাধু চলে গেছেন, এখন বুঝতে পারছে ওর ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ও। এখন একাই ডাইনীর মোকবিলা করতে হবে। ওকে, সম্ভাবনাটা দারুণ হতাশায় ভাবিয়ে তুলল ওকে।
*
নিরাপদে থেবসের প্রাসাদের নিজেদের মহলে পৌঁছানোর পর তাইতাকে গোসল করিয়ে কাদা ধুয়ে ফেলতে বড় গামলা ভর্তি গরম পানি আর বোতল ভর্তি সুগন্ধি মলম পাঠাল রামরাম। ওকে খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর দুজন রাজচিকিৎসক এলেন। তাদের পেছনে একদল সহকারী, ওদের হাতে ওষুধ ও জাদুকরী তাবিজ ভরা বাক্স। তাইতার নির্দেশে ওদের দরজায় থেকেই বিদায় করে দিল মেরেন। মিশরের সবচেয়ে দক্ষ ও জ্ঞানী শল্যচিকিৎসক ম্যাগাস নিজেই তাঁর ক্ষতের পরিচর্যা করছেন। আপনাদের উদ্বেগের জন্যে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
পাতলা মদে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলল তাইতা। তারপর স্বয়ং-প্রভাবিত ঘোরে বাম পা অবশ করে নিল। তেলের কুপির আগুনে তপ্ত ব্রোঞ্জের একটা চামচ দিয়ে গভীর করে পাটা চিড়ল মেরেন। ওকে শেখানো তাইতার অন্যতম ডাক্তারী বিদ্যা এটা। ওর কাজ শেষে হলে উঠে দাঁড়াল তাইতা, উইন্ডস্মোকের এক গোছা লেজ সুতো হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষতস্থানের দুপ্রান্ত সেলাই করল। নিজের বানানো মলম লাগিয়ে লিনেনে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ করতে গিয়ে ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেল ও, দিমিতারকে হারানোর শোকে পূর্ণ। মাদুরে শুয়ে চোখ বুজল ও।
দরজার কাছে শোরাগোলের শব্দে চোখ মেলে তাকাল ও। পরিচিত কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, তাইতা, কোথায় তুমি? তোমাকে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না, এমন একটা বিপদ বাধালে যে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখন আর কচি খোকাটি নও! এই কথা বলে রোগীর ঘরে পা রাখলেন জগতের বুকে ঐশী ঈশ্বর ফারাও নেফার সেতি। লর্ড ও পরিচারকের দল অনুসরণ করল তাঁকে।
মনে হচ্ছে, তাইতার প্রাণশক্তি বেড়ে গেছে। ওর দৈহিক শক্তিও ফিরে এসেছে। যেন। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কোনওমতে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
তাইতা, লজ্জা নেই তোমার? ভেবেছিলাম মরতে চলেছ তুমি, অথচ এখন দেখছি বোকার মতো মুখে হাসি নিয়ে আরামে শুয়ে আছো?
জাঁহাপনা, এটা স্বাগত জানানোর হাসি, আপনাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি।
ওকে ঠেলে আবার বালিশে শুইয়ে দিলেন নেফার সেতি। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকলেন। মাই লর্ডস, আমাকে ম্যাগাসের কাছে রেখে যেতে পারো, ও আমার পুরোনো বন্ধু-শিক্ষক। প্রয়োজনে তোমাদের তলব করব। চেম্বার থেকে পিছু হটে বের হয়ে গেল ওরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে সামনে ঝুঁকলেন ফারাও। আইসিসের বুকের মিষ্টি দুধের দোহাই, তুমি নিরাপদে আছে দেখে খুশি হয়েছি, যদিও শুনেছি তোমার সঙ্গী ম্যাগাস গত হয়েছে। সব কিছু শুনতে চাই আমি, তবে তার আগে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে স্বাগত জানানোর সুযোগ দাও। মেরেনের দিকে তাকালেন তিনি। দরজায় পাহারায় রয়েছে সে। তাঁর সামনে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়াল মেরেন। কিন্তু ওকে টেনে দাঁড় করালেন ফারাও। আমার সামনে নিজেকে খাট করো না, লাল পথের সাথী। আন্তরিক আলিঙ্গনে ওকে বুকে টেনে নিলেন নেফার সেতি। তরুণ বয়সে এক সাথে যোদ্ধা হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ওরা; রথ চালানো, তলোয়ার চালনা ও তীর নিক্ষেপে দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষিত ও সুপরিচিত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দল বেঁধে লড়াই করেছেন ওরা, পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে বাধা দিতে হত্যাসহ যেকোনও অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। একসাথে বিজয় লাভ করেছিলেন ওরা। লাল পথের সাথীরা যোদ্ধার রক্তের সম্পর্কে ভাই, জীবনের জন্যে এক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেরেন নেফার সেতির বোন রাজকুমারী মেরিকারার সাথে বাগদত্ত। ফারাও আর ও বলতে গেলে বোন জামাই আর সম্মন্ধী। এতে ওদের বাধন আরও জোরাল হয়েছে। মেরেন হয়তো থেবসে উঁচু পদ ধারণ করতে পারত, কিন্তু তার বদলে তাইতার নবীশ হিসাবে নাম লিখিয়েছে।
তাইতা সব রহস্য শিখিয়েছে তোমাকে? তুমি শক্তিমান যোদ্ধার মতো ম্যাগাসও হতে পেরেছ? জানতে চাইলেন ফারাও।
না, জাঁহাপনা। তাইতার সীমাহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই মেধা নেই। এখনও একেবারে মামুলি কৌশলও আয়ত্ত করতে পারিনি। কয়েকটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ একটা ভাব করল মেরেন।
যেকোনও সময়ই একজন দক্ষ যোদ্ধা আনাড়ী জাদুকরের চেয়ে অনেক ভালো, পুরোনো বন্ধু। এসো, আমাদের সাথে সভায় বসো, অনেক আগে যেমনটা আমাদের রীতি ছিল, যখন আমরা স্বৈরাচারের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্যে লড়াই করছিলাম।
ওরা তাইতার মাদুরের দুপাশে বসার পর পরই সিরিয়াস হয়ে গেলেন নেফার সেতি। এবার কুনো ব্যাঙের সাথে তোমাদের মোকবিলার কথা বলো আমাকে।
পালা করে দিমিতারের মৃত্যুর বর্ণনা দিল তাইতা ও মেরেন। ওদের কথা শেষ হলে নীরব রইলেন নেফার সেতি। তারপর গর্জে উঠলেন। প্রতিদিন আগের চেয়ে বেপরোয়া আর হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারগুলো। আমি নিশ্চিত ওদের কারণেই নদীর জলাধারের অবশিষ্ট জল দূষিত ও নষ্ট হচ্ছে। ওগুলোর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভাবলেও দেখা গেছে একটাকে মারলে তার জায়গায় আরও দুটো এসে হাজির হচ্ছে।
জাঁহাপনা, বলে এক মুহূর্ত থামল তাইতা, তারপর ফের খেই ধরল, আপনাকে আগে ওদের যে সৃষ্টি করেছে সেই ডাইনীর খোঁজ পেতে হবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে। আপনার ও আপনার রাজ্যে তার পাঠানো কুনো ব্যাঙ আর অন্যান্য রোগ তার সাথেই মিলিয়ে যাবে, কারণ সেই এসবের মালিক। তারপর নীল নদ আবার বইবে, মিশরে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।
সতর্ক চোখে ওর দিকে তাকালেন নেফার সেতি। তবে কি ধরে নেব প্লেগগুলো প্রাকৃতিক নয়? জানতে চাইলেন তিনি। এক নারীর জাদুমন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছে এগুলো?
সেটাই আমার বিশ্বাস, তাঁকে নিশ্চিত করল তাইতা।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নেফার সেতি, পায়চারি শুরু করলেন। আপন ভাবনায় ডুবে গেছেন। অবশেষে থেমে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকালেন। কে এই ডাইনী? কোথায় সে? তাকে ধ্বংস করা যাবে, নাকি সে অমর?
আমার বিশ্বাস সে মানুষ, ফারাও, তবে তার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। নিজেকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করতে পারে সে।
কী নাম তার?
ইয়োস।
ভোরের দেবী? দেবদেবীদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে পুরোহিতরা ভালোমতোই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। কারণ তিনি স্বয়ং একজন দেবতা। এই না বললে সে মানুষ?
মানুষই, নিজের পরিচয় গোপন করতে দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে।
তাই যদি হয়, তার নিশ্চয়ই একটা জাগতিক আবাস রয়েছে। সেটা কোথায়, তাইতা?
দিমিতার আর আমি তারই খোঁজ করছিলাম, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে ফেলেছে সে। ওকে আক্রমণ করাতে প্রথমে একটা বিশাল পাইথন পাঠিয়েছিল, কিন্তু মেরেন আর আমি মিলে ওকে বাঁচাই, যদিও প্রায় মরার দশা হয়েছিল তার। পাইথন ব্যর্থ হলেও এবার কুনো ব্যাঙ দিয়ে সফল হয়েছে সে।
তার মানে ডাইনীকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা নেই তোমার? লেগে রইলেন নেফার সেতি।
নিশ্চিত করে না জানলেও অলৌকিক ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, একটা আগ্নেয়গিরিতে থাকে সে।
আগ্নেয়গিরি? কোনও ডাইনীর পক্ষেও কি সম্ভব? বলে হেসে উঠলেন তিনি। অনেক আগেই তোমাকে সন্দেহ না করতে শিখেছি আমি, তাইতা। কিন্তু বলো দেখি, কোন আগ্নেয়গিরি? অনেক আছে অমন।
আমার বিশ্বাস সেটার সন্ধান পেতে হলে নীলের উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের, কেবুইয়ের উজানে নদীর পথ আটকে দেওয়া সেই বিশাল জলা ভূমির ওধারে। এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির ভেতর তার আস্তানা। জগতের একেবারে শেষ সীমার কোথাও।
আমি ছোট থাকতে তুমি বলেছিলে আমার দাদী রানি লস্ত্রিস নদীর উৎস খুঁজে বের করতে লর্ড আকেরের নেতৃত্বে দক্ষিণে একদল সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। কেবুইয়ের ওই ভয়ঙ্কর জলাভূমির ওধারে হারিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর ফিরে আসেনি। ওই অভিযানের সাথে ইয়োসের সম্পর্ক থাকতে পারে?
আছে, আঁহাপনা, সায় দিল তাইতা। সেই বাহিনীর একজন মাত্র জীবিত সদস্য আবার কেবুইতে ফিরে এসেছিল, সেকথা আপনাকে বলেছি না?
গল্পের এই অংশের কথা আমার মনে নেই।
সেই সময় ব্যাপারটাকে তাৎপর্যহীন ঠেকেছে, তবে একজন ফিরে এসেছিল। লোকটা প্রলাপ বকছিল, দিশাহারা ছিল সে। চিকিত্সকরা মনে করেছিল যাত্রার ভোগান্তির কারণেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার। আমি ওর সাথে কথা বলার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু ইদানীং জানতে পেরেছি, মারা যাবার আগে অদ্ভুত কথা বলে গেছে সে যা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আমাকে সেসব বলেনি ওরা। দুনিয়ার শেষ মাথায় বিশাল হ্রদ ও পাহাড়ের কথা বলেছিল সে…আর সবচেয়ে বড় হ্রদের পাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি। এই কিংবদন্তী থেকেই দিমিতার আর আমি ডাইনীর অবস্থান জানতে পেরেছি। কুজো টিপটিপের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানাল ও।
মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলেন নেফার সেতি। তাইতার কথা শেষ হলে ভাবলেন খানিকক্ষণ; তারপর জানতে চাইলেন, আগ্নেয়গিরির এত গুরুত্ব কেন?
জবাবে ইয়োসের আস্তানায় দিমিতারের বন্দিত্ব ও পলায়নের কাহিনী বলল তাইতা।
ডুবো আগুনকে হাপর হিসাবে ব্যবহার করে জাদু সাজায় সে। প্রবল তাপ থেকে আসা শক্তি ও সালফারের গ্যাস তার ক্ষমতাকে দেবতার কাছাকছি পর্যায়ে নিয়ে যায়। ব্যাখ্যা করল তাইতা।
এত শত শত আগ্নেয়গিরি থাকতে এটাকেই সবার আগে পরখ করার জন্যে বেছে নিলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি।
কারণ মিশরের অনেক কাছে এটা, নীল নদের ঠিক উৎসের মুখে।
বুঝতে পারছি তোমার যুক্তি অকাট্য। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, বললেন নেফার সেতি। সাত বছর আগে নীল নদ মরে যাবার সময় দাদীর অভিযান সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলেছিল সব মনে পড়ে যায় আমার, তাই আরেকটা বাহিনী একই মিশনে উৎসে গিয়ে নদীর মরে যাবার কারণ অনুসন্ধানে পাঠিয়েছিলাম। নেতৃত্বে দিয়েছিলাম কর্নেল আহ-আখতনকে।
এই খবর আমার জানা ছিল না, বলল তাইতা।
তার কারণ আলোচনার করার জন্যে ছিলে না তুমি। মেরেন আর তুমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। নেফার সেতির কণ্ঠে ভৎর্সনা। আমার সাথে থাকা উচিত ছিল তোমার।
অনুশোচনার একটা ভাব ধরল তাই। আমাকে যে আপনার প্রয়োজন সেকথা আমার জানা ছিল না, আঁহাপনা।
তোমাকে সব সময়ই আমার প্রয়োজন হবে, ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয় এই অভিযানের খবর কী? চট করে সুযোগটা লুফে নিল তাইতা। ফিরে এসেছে?
না, ফেরেনি। কুচকাওয়াজ করে যাওয়া আটশো লোকের একজনও ফেরেনি। দাদীর সেই দলের চেয়ে আরও ভালোভাবে উধাও হয়ে গেছে। ডাইনী কি ওদেরও শেষ করেছে?
সেটা খুবই সম্ভব, জাঁহাপনা, নেফার সেতি এরই মধ্যে ডাইনীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, বুঝতে পারল তাইতা। তাকে ধাওয়া করার জন্যে নতুন করে বিশ্বাস করানো বা উৎসাহিত করার দরকার হলো না।
আমাকে কখনও নিরাশ করোনি তুমি, তাইতা, কেবল যখন একমাত্র দেবতারাই জানেন কোথায় বেড়াতে চলে যাও তখন ছাড়া। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন নেফার সেতি। এখন আমি আমার শত্রুর পরিচয় জানি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার জনগণের উপর থেকে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো দূর করতে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কেবল কুয়ো খনন, শত্রুর কাছে খাবার ভিক্ষা আর ব্যাঙ মারায় পর্যবসিত হয়েছিল আমার সব কাজ। এখন আমার সমস্যার সমাধানের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। ডাইনীটাকেই খতম করতে হবে!
লাফ দিয়ে উঠে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। কাজের লোক তিনি, তলোয়ার হাতে নিতে সব সময় প্রস্তুত। যুদ্ধের ভাবনা তাঁর চেতনাকে তরতাজা করে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা ও মেরেন, একের পর এক নানা বুদ্ধির জোয়ার খেলে যাচ্ছে তার মাথায়। খানিক পরপরই পাশের তলোয়ারের খাপে চাপড় মারছেন, চিৎকার করে বলে উঠছেন, হ্যাঁ, হোরাস ও অসিরিসের দোহাই, তাই করব! অবশেষে তাইতার দিকে ফিরলেন তিনি। ইয়োসের বিরুদ্ধে আরেকটা বাহিনীর নেতৃত্ব দেব আমি।
ফারাও, এরই মধ্যে দু-দুটি মিশরিয় বাহিনী গ্রাস করে নিয়েছে সে, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
একটু স্থির হলেন নেফার সেতি। ফের পায়চারি শুরু করলেন। থামলেন আবার। ঠিক আছে। এতনায় দিমিতার যেমন করেছে তুমিও ঠিক তেমনি ওই ডাইনীর বিরুদ্ধে এমন এক জাদু শক্তি কাজে লাগাবে যাতে পাহাড় থেকে টসটসে পাকা ফলের মতো মাটিতে পড়ে ফেটে যাবে সে। তোমার কী মত, তাতা?
জাঁহাপনা, ইয়োসকে ভুল বুঝবেন না। দিমিতার আমার চেয়ে ঢের বড় মাপের ম্যাগাস ছিলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাইনীর মোকবিলা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে ধ্বংস করে দিয়েছে সে। বলতে গেলে কোনও রকম কষ্ট ছাড়াই। ঠিক যেভাবে আপনি দুহাতের আঙুলে কাঠি ভেঙে ফেলেন। দুঃখের সাথে মাথা নাড়ল তাইতা। আমার জাদু জেভলিনের মতো। দূরে ছুঁড়ে দিলে দুর্বল হয়ে যাবে, তখন তার বর্মে ঠিকরে গিয়ে সহজেই ব্যর্থ হবে। তার কাছাকাছি গিয়ে ঠিক মতো অবস্থান বের করতে পারলে আমার নিশানা অনেক ভালো হবে। তাকে চোখের সামনে পেলে হয়তো আমার তীর তার বর্ম ভেদ করতে পারবে। এত দূর থেকে ওকে স্পর্শ করতে পারব না।
সে দিমিতারকে খতম করার মতো ক্ষমতাধর হয়ে থাকলে তোমারও একই দণা করল না কেন? চট করে নিজের প্রশ্নে জবাব দিলেন তিনি। কারণ তোমাকে নিজের চেয়ে শক্তিশালী মনে করে সে।
ব্যাপারটা এত সহজ হলেই ভালো ছিল। না, ফারাও, তার কারণ এখনও সম্পূর্ণ ক্ষমতায় আমাকে আক্রমণ করেনি সে।
বিভ্রান্ত দেখাল নেফার সেতিকে। কিন্তু দিমিতারকে হত্যা করেছে সে, আমার সাম্রাজ্যকে বৈরিতার ঘানিতে দুমড়ে দিয়েছে। তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে কেন?
দিমিতারকে তার আর দরকার ছিল না। আপনাকে তো বলেছি ওর হাতে বন্দি থাকার সময় কীভাবে বিশাল রক্তচোষার মতো তাঁর সব বিদ্যা আর দক্ষতা শুষে নিয়েছিল সে। ও পালিয়ে যাবার পর তেমন মরিয়া হয়ে ওর খোঁজ করেনি। ওর জন্যে হুমকি ছিলেন না তিনি। ওর কাছে কিছু পাওয়ারও ছিল না। মানে, ওর সাথে আমার ঐকবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তখন আবার তার আগ্রহ দেখা দেয়। আমরা একসাথে এমন তাৎপর্যময় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম যে আমার উপস্থিতি বুঝতে পারছিল সে। দিমিতারের মতো আমাকেও শুষে শেষ না করে ধ্বংস করতে চাইবে না সে, তবে আমাকে নিঃসঙ্গ না করা পর্যন্ত ফাঁদে ফেলতে পারবে না। তাই আমার মিত্রকে শেষ করেছে।
তোমাকে তার অশুভ উদ্দেশ্যে বন্দি করতে চাইলে তোমার সাথে আমার সেনাবাহিনীকেও নিয়ে যাব আমি। তুমি হবে আমার শিকারের ঘোড়া। তোমাকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে আসার টোপ হিসাবে ব্যবহার করব, তুমি ওর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার পর দুজনে মিলে আক্রমণ করব ওকে। প্রস্তাব রাখলেন নেফার সেতি।
মরিয়া ব্যবস্থা, ফারাও। আপনাকে যেখানে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারবে সেখানে কেন আপনাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে সে, যেমনটা দিমিতারের বেলায় করেছে?
তোমার কথায় মনে হচ্ছে, মিশরের অধিকার চায় সে। বেশ, ভালো কথা, ওকে বলব আত্মসমর্পণ করতে ও আমার দেশ ওর হাতে তুলে দিতে এসেছি। নিবেদনের অংশ হিসাবে ওর পায়ে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাইব।
গম্ভীর চোহার ধরে রাখল তাইতা। যদিও এমনি আনাড়ী পরামর্শ শুনে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছিল। জাঁহাপনা, ডাইনীটা কিন্তু মোহন্ত।
সে আবার কী? জানতে চাইলেন নেফার সেতি।
অন্তর্চক্ষু দিয়ে আপনি যেভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখেন ঠিক সেভাবে মানুষের আত্মা দেখতে পারে সে। আপনার আভায় অমন ক্রোধের বিচ্ছুরণ নিয়ে কোনওদিনই তার ধারে কাছে যেতে পারবেন না।
তাহলে তার রহস্যময় চোখে ধরা না পড়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে যাওয়া যাবে বলে মনে করো?
ওর মতো আমিও একজন মোহন্ত। সে টের পাবে এমন কোনও আভা ছড়াই আমি।
রেগে উঠছেন নেফার সেতি। দীর্ঘদিন ধরেই দেবতা আছেন বলে কোনও বাধা বা বিঘ্ন সহ্য করতে পারেন না। চড়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর: তোমার ভাবের কথায় ভোলার মতো এখন আর ছোট খোকাটি নেই আমি। আমার পরিকল্পনায় ঝটপট খুঁত বের করছ তুমি, বললেন তিনি। বিজ্ঞ ম্যাগাস, দয়া করে এমন একটা বিকল্প প্রস্তাব রাখ যাতে আমারগুলোর বেলায় যেমন করেছ আমিও তেমন করতে পারি।
আপনি ফারাও, আপনিই মিশর। কোনওভাবেই আপনি তার পেতে রাখা ফাঁদে গিয়ে পড়তে পারেন না। এখানে জনগণ, মিনতাকা ও সন্তানদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। আমি ব্যর্থ হলে যেন ওদের বাঁচাতে পারেন।
তুমি শয়তানীতে নিপূন একটা বদমাশ, তাতা। কোন দিকে এগোচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমাকে এখানে ব্যাঙ মারার কাজে রেখে তুমি আর মেরেন আরেকটা অভিযানে নামবে। আমাকে নিজের হেরেমে মেয়েমানুষের মতো কুকড়ে থাকতে হবে? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
উঁহু, আঁহাপনা, সিংহাসনে আসীন গর্বিত ফারাওর মতো জীবন দিয়ে দুটি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে তৈরি থাকবেন আপনি।
মুঠি পাকানো হাতজোড়া কোমরের কাছে রাখলেন নেফার সেতি। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তোমার মধুর সঙ্গীত শোনা ঠিক হচ্ছে না আমার। যেকোনও ডাইনীর মতোই শক্তিশালী ফাঁদ পাততে পারো তুমি। তারপর হালছাড়ার ঢঙে হাত মেলে দিলেন। গেয়ে যাও, তাতা, বাধ্য হয়েই শুনব আমি।
মেরেনকে ছোটখাট একটা বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন, বেশি না, বাছাই করা শখানেক সৈনিক হলেই চলবে। দ্রুত আগে বাড়বে ওরা, বিরাট রসদের কাফেলা ছাড়াই জমির বিভিন্ন জিনিসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারবে। কেবল সংখ্যা ডাইনীর পক্ষে কোনও হুমকী নয়। এই আকারের একটা বাহিনী নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে না সে। মেরেনের তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোর মতো কোনও মানসিক আভা না থাকায় ওকে সে ধোকা, সাধারণ সৈনিক হিসাবে পরখ করবে। ওর সাথে যাব আমি। অনেক দূর থেকে আমাকে চিনতে পরবে সে, কিন্তু কাছে গিয়ে আসলে তার খেলার সামগ্রীতেই পরিণত হতে যাচ্ছি। আমার কাছ থেকে কাক্ষিত জ্ঞান ও ক্ষমতা কেড়ে নিতে আমাকে কাছে যেতে দিতেই হবে তাকে।
সবেগে পায়চারি করতে করতে চাপা কণ্ঠে গজগজ করতে লাগলেন নেফার সেতি। অবশেষে ফের তাইতার মুখোমুখি হলেন: অভিযানের নেতৃত্বে থাকতে না পারাটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তোমার প্যাঁচানো যুক্তি আমার বুদ্ধি ঘোলা করে দিয়েছে। খানিকটা স্বাভাবিক হলো তার রাগত চেহারা। মিশরের সব পুরুষের ভেতর মেরেন ক্যাম্বিসেস আর তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি আমি। মেরেনের দিকে ফিরলেন তিনি। কর্নেলের পদ পাবে তুমি। পছন্দমতো একশোজনকে বেছে নাও, তোমাকে আমার রাজকীয় বাজপাখীর সিলমোহর দেব যাতে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে ওদের সজ্জিত করতে পারো ও আমার রাজ্যর যেকোনও জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে পারো। বাজপাখীর সীলমোহর ফারাও-এর ক্ষমতা বাহকের হাতে হস্তান্তর করে। আমি চাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব লোক লস্কর নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হও তুমি। সব ব্যাপারে তাইতার পরামর্শ মোতাবেক চলবে। ডাইনীর মুণ্ড নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো।
*
মেরেনের অভিজাত অশ্বারোহীদের নিয়ে একটাঝটিকা বাহিনী গড়ার কথা রাষ্ট্র Cমহয়ে যাওয়ামাত্র স্বেচ্ছাসেবীর দল ঘিরে ফেলল ওকে। তিন জন পোড়খাওয়া সৈনিককে ক্যাপ্টেন হিসাবে বেছে নিল ওঃ হিলতো-বার হিলতো, শাবাকো ও তুনকা। গৃহযুদ্ধের সময় এদের কেউই ওর সাথে লড়াইতে অংশ নেয়নি-তখন অনেক কম বয়সী ছিল ওরা-তবে ওদের বাবা ও দাদারা লাল পথের সঙ্গী ছিল।
যোদ্ধার রক্ত সত্যিকারের বীরের জন্ম দেয়, তাইতার কাছে ব্যাখ্যা করল মেরেন। ওর চতুর্থ বাছাই ছিল হাবারি, ওকে পছন্দ ও বিশ্বাস করে ফেলেছে ও। ওকে চারটি প্লাটুনের একটার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিল সে।
চার ক্যাপ্টেনেরই পরীক্ষা নিয়ে ওদের নির্বাচন নিশ্চিত করল; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করল: তোমার স্ত্রী বা মেয়েমানুষ আছে? আমরা যতদূর সম্ভব কম রসদ নেব সাথে। ক্যাম্পফলোয়ারদের জন্যে কোনও জায়গা নেই আমাদের এখানে। মিশরিয় সেনারা ঐতিহ্যগতভাবে যার যার মেয়েমনুষ নিয়ে পথ চলে।
আমার স্ত্রী আছে, জানাল হাবারি। কিন্তু পাঁচ বছর ওর মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে পারলেই বরং খুশি আমি, দশ কি আরও বেশি হলেও ক্ষতি নেই। যদি আপনার দরকার হয়, কর্নেল। এই যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হলো বাকি তিনজন।
কর্নেল, আমাদের জমিনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হলে যেখানে মিলবে সেখানেই মেয়েমানুষ বেছে নিতে পরব, বলল হিলতে-বার-হিলতো, বুড়ো হিলতোর ছেলে, অনেক আগেই মারা গেছে সে। দশ-হাজারের-ভেতর-সেরা ছিল সে, প্রশংসার স্বর্ণ জয় লাভ করেছিল; ইসমালার যুদ্ধে নকল ফারাওকে উচ্ছেদ করার পর খোদ ফারাও পরিয়ে দিয়েছিলেন ওর গলায়।
সত্যিকারের সৈনিকের মতো কথা, হেসে বলল মেরেন। যার যার প্লাটুন বাছাই করার ক্ষমতা নির্বাচিত চারজনের হাতে তুলে দিল ও। দশ দিনেরও কম সময়ের ভেতর গোটা মিশরিয় সেনাবাহিনী থেকে নিখুঁত এক শো জন যোদ্ধা বাছাই করে ফেলল ওরা। প্রত্যেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, দুটো চার্জার ও একটা প্যাক মিউল বেছে নিতে আস্তাবলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওদের। ফারাওর নির্দেশ মোতাবেক থেবস থেকে নতুন চাঁদ ওঠার দিন যাত্রা শুরু করতে তৈরি হলো ওরা।
বিদায়ের দুই দিন আগে নদী পেরুল তাইতা, রানি মিনতাকার কাছ থেকে বিদায় নিতে মেমননের প্রাসাদে গেল। আগের চেয়ে বেশ কৃশ হয়ে গেছেন তিনি, চেহারা মলিন। ওদের সাক্ষাতের প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরই ওর কাছে কারণ ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
ওহ, তাতা, প্রিয় তাতা। ভীষণ একটা ঘটনা ঘটেছে। সোয়ে উধাও হয়ে গেছেন। আমার কাছে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। তুমি ওকে আমার আম দরবারে দেখার তিনদিন পরেই উধাও হয়ে যান তিনি।
অবাক হলো না তাইতা। সেদিনই ছিল দিমিতারের ভীতিকর মৃত্যুর ক্ষণ।
ওর খোঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছি। তাইতা, জানি, আমার মতোই বিচলিত বোধ করবে তুমি। ওকে চিনতে, সমীহ করতে। ওর মাঝে মিশরের মুক্তি দেখেছিলাম আমরা। তোমার বিশেষ জাদুকরী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ওকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবে না? তিনি চলে যাওয়ায় আমি আর কোনওদিনই আমার বাচ্চাদের মুখ দেখতে পাব না। মিশর ও নেফার চিরন্তন যন্ত্রণায় ভুগবে। নীলও আর কখনওই বইবে না।
ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাইতা। বুঝতে পারছে রানির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, হতাশার চাপে ওর গর্বিত চেতনা ভেঙে পড়ার উপান্তে পৌঁছে গেছে। মিনতাকাকে আশা দেওয়ার সময় মনে মনে ইয়োস ও তার অপকর্মের শাপশাপান্ত করল ও। মেরেন আর আমি দক্ষিণ সীমান্তের ওধারে অভিযানে যাচ্ছি। যাবার পথে প্রতিটি কোণে সোয়ের খোঁজ করাটাকে আমার প্রথম দায়িত্বে পরিণত করব। আমার ধারণা সে বেঁচে আছে, কোনও ক্ষতি হয়নি। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও ঘটানপ্রবাহ হুট করে আপনাকে না জানিয়েই বিদায় নিতে বাধ্য করেছে তাকে, মহারানি। তবে নতুন নামহীন দেবীর নামে মিশন চালু রাখতে প্রথম সুযোগেই ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে তার। সবই আসলে যুক্তিসঙ্গত অনুমান, নিজেকে বলল তাইতা। এবার আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আপনার কথা সব সময় আমার মনে আর অনুগত ভালোবাসায় থাকবে।
এখন নীল নদে জাহাজ চালানোর উপায় নেই, তাই মৃতপ্রায় নদীর তীর বরাবর ওয়্যাগন রোড বেছে নিল ওরা। প্রথম এক মাইল তাইতার পাশাপাশি এগোলেন ফারাও, নির্দেশ ও পরামর্শে ভারাক্রান্ত করে তুললেন ওকে। তিনি ফিরতি পথ ধরার আগে বাহিনীর উদ্দেশে আন্তরিক উদাত্ত আহবান জানিয়ে ভাষণ দিলেন: আশা করছি সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করবে, শেষ করলেন তিনি, তারপর ওদের সামনে তাইতাকে আলিঙ্গন করলেন। উল্লাস করে তাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে দিল ওরা।
এমনভাবে যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছে তাইতা যাতে রোজ সন্ধ্যায় নীলের তীর বরাবর অবস্থিত উচ্চ রাজ্যের অসংখ্য মন্দিরের কোনও একটার কাছে পৌঁছাতে পারে। প্রতিটি মন্দিরেই দেখা গেল ওর আগেই ওর খ্যাতি পৌঁছে গেছে। প্রধান পুরুত ওকে স্বাগত জানাতে আর লোকজনকে আশ্রয় দিতে বেরিয়ে এলেন। ওদের আপ্যায়ন ছিল আন্তরিক, কারণ মেরেনের কাছে রাজার বাজপাখির সীলমোহর রয়েছে, প্রতিটি শহরের পাহারায় নিয়োজিত সামরিক দুর্গের কোয়ার্টার মাস্টারদের কাছ থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহে সাহায্য করছে সেটা। পুরোহিতদের আশা এর ফলে ওদের সামান্য খাদ্য মওজুত আরও বেড়ে উঠবে।
রোজ সন্ধ্যায় খাবার ঘরে সামান্য খাবারের পর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে অবস্থান নিচ্ছে তাইতা। শত শত বা এমনকি হাজার বছর ধরে এইসব জায়গায় উপাসনার যোগাড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পূজকদের উৎসাহ আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে, এমনকি ইয়োসের পক্ষেও যা ভেদ করা কঠিন হবে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ডাইনীর নজরদারী থেকে দূরে থাকতে পারবে ও। ওকে বেপথু করতে ডাইনীর পাঠানো অশুভ অভিশাপের ভয় না করেই আপন দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে পারবে। প্রতিটি মন্দিরের নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশে ডাইনীর বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াইয়ের জন্যে শক্তি ও নির্দেশনা পেতে প্রার্থনা করল ও। এমনি পরিবেশের নির্জনতা ও প্রশান্তির ভেতর শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে নিজেকে বলীয়ান করে তুলতে সক্ষম হলো।
মন্দিরগুলো প্রতিটি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু ও শিক্ষার ভাণ্ডার। পুরোহিতদের অনেকেই মোটামাথার লোক হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু শিক্ষিত ও আলোকিত, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সজাগ তারা, দলের মনোভাব সম্পর্কে অবগত। তথ্য ও গোপন বিষয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস ওরা। ওদের সঙ্গে আলোচনার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিল তাইতা। নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল ওদের। সবাইকেই একই প্রশ্ন করল: তোমাদের লোকদের ভেতর কারও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা শুনেছ, এক নতুন ধর্মের প্রচার করছে?
প্রত্যেকেই জানালেন, হ্যাঁ শুনেছেন। পুরোনো দেবতারা ব্যর্থ হতে চলেছেন বলে প্রচার করছে ওরা, তাঁরা আর মিশরকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। নতুন এক দেবীর কথা বলছে যিনি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হবেন, তারপর নদী ও দেশের উপর থেকে অভিশাপ তুলে নেবেন। তিনি এসে প্লেগকে বিদায় জানাবেন, তখন নীল মাতার বুকে ফের বান ডাকবে, মিশরকে আবার সৌন্দর্য ফিরিয়ে দেবে। লোকজনকে ওরা বলছে যে ফারাও ও তার পরিবার এই নতুন দেবীর গোপন অনুসারী। অচিরেই নেফার সেতি পুরোনো দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে নতুন দেবীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবেন। তারপর উদ্বিগ্ন জানতে চাইলেন, মহান ম্যাগাস, আমাদের বলুন, এটা সত্যি? ফারাও সত্যিই এই বিদেশী দেবীর কাছে মাথা নোয়াবেন?
এমন কিছু ঘটার আগে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো সব তারা খসে পড়বে। ফারাও হোরাসের ভক্ত, কায়মনোবাক্যে, ওদের আশ্বস্ত করেছে ও। তবে একটা কথা বলো, লোকজন এই ভণ্ডদের কথায় বিশ্বাস করছে?
ওরা তো মানুষ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিরাট গাড্ডায় পড়েছে এখন, যেই ওদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তির কথা বলবে তাকেই মানবে।
এই যাজকদের কারও সাথে তোমাদের দেখা হয়েছে?
কারওই না। ওরা গোপনে গা বাঁচিয়ে চলছে, বললেন একজন। ওদের বিশ্বাস ব্যাখ্যা করে বোঝানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তাবাহক পাঠালেও কেউই আসেনি।
কারও নাম জানতে পেরেছ?
মনে হচ্ছে সবাই একই নাম ব্যবহার করছে।
সেটা কি সোয়ে? জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ, ম্যাগাস, এ নামটাই ব্যবহার করছে ওরা। সম্ভবত এটা নামের চেয়ে বরং কোনও পদবীই হবে।
ওরা মিশরিয় নাকি বিদেশী? মাতৃভাষার মতোই আমাদের ভাষায় কথা বলে?
শুনেছি তাই বলে, আমাদের মতো একই রক্তের দাবী করছে ওরা।
এই যাত্রা যার সাথে কথা বলছিল ও, তাঁর নাম সেনাপি, উচ্চ মিশরের তৃতীয় নোমর খুম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তাঁর বক্তব্য শোনার পর তাই এবার আরও মামুলি প্রসঙ্গে ফিরে এলো: প্রাকৃতিক জ্ঞানের একজন বিশারদ হিসাবে আপনি কি এমন কোনও পথ বের করার চেষ্টা করেছেন যাতে নীলের লাল পানি আবার মানুষের ব্যবহারের উপযোগি করে তোলা যায়?
একথা শুনে ভীত হয়ে উঠলেন মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষটা। ওটা অভিশপ্ত নদী। ওখানে কেউ ম্লান করতে যায় না, কেউ ওই পানি মুখে নেয় না। যারা খায়, অল্পদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তারা, অক্কা পায়। নদীটা এখন রাক্ষুসে লাশখেকো কুনো ব্যাঙের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মিশর বা অন্য কোনও দেশে এমন ঘটনা কোনও দিন দেখা যায়নি। হিংস্রভাবে পচা পুকুরগুলো পাহারা দিচ্ছে ওরা। কেউ আগে বাড়লেই হামলা করছে। ওই বিষ মুখে তোলার চেয়ে বরং মরতে রাজি আছি। জবাব দিলেন সেনাপি, তার অভিব্যক্তি বিতৃষ্ণার ভঙ্গিতে বেঁকে গেল। এমনকি মন্দিরের নবীশরাও বিশ্বাস করে যে কোনও ক্ষুব্ধ দেবতা নদীকে অভিশপ্ত করে দিয়েছেন।
তো তাইতা নিজেই লাল স্রোতের আসল প্রকৃতি জানা ও নীলের জলকে বিশুদ্ধ করে তোলার একটা উপায় বের করতে বেশ কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে হাত দিল। সেনাদলকে কষ্টকর গতিতে দক্ষিণে ঠেলে নিয়ে চলছিল মেরেন। জলের সামান্য সরবরাহে কোনও রকম সংযোজন করতে না পারলে অচিরেই ঘোড়াগুলো পিপাসায় প্রাণ হারাবে, এটা জানে সে। ফারাওর সদ্য খোঁড়া কূপগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, কঠোরভাবে আগে বাড়ানো প্রায় তিনশো ঘোড়ার প্রয়োজনের তুলনায় ওগুলোর সরবরাহ অপ্রতুলই বলা চলে। এটা ছিল যাত্রার সহজতম পর্যায়। প্রথম শাখা ধারার শাদা পানির উপরে ওঠার পর নদীটা কঠিন ভীতিকর মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার লীগ চলে গেছে, ওখানে কোনও কুয়োর দেখা মিলবে না। শত বছরে একবার বৃষ্টি হয় ওখানে, কাঁকড়া বিছা আর ওরিক্সের মতো বুনো প্রাণীর আখড়া, এরা নিষ্ঠুর সূর্যের রাজত্বে ভূপৃষ্ঠের পানি ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে। পানির নির্ভরযোগ্য একটা উৎসের খোঁজ করতে না পারলে অমন প্রচণ্ড গা পোড়ানো বন্ধ্যাভূমিতে শেষ হয়ে যাবে এই অভিযান, কোনওদিনই নীলের উৎসে পৌঁছাতে পারবে না, সফল হওয়া তো পরের কথা।
প্রতিটি নিশি-শিবিরে পরীক্ষার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে তাই। মেরেনের চারজন তরুণ ট্রুপার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছে। মহান ম্যাগাসের সাথে কাজ করতে পেরে গর্বিত ওরা: এই গল্প নাতীপুতিদের বলে বেড়াবে। তাই নির্দেশ দেওয়ার সময় দৈত্য-দানোর ভয় করছে না ওরা। কারণ ওদের রক্ষা করার বেলায় তাইতার ক্ষমতায় ওদের অগাধ বিশ্বাস। রাতের পর রাত খেটে চলেছে ওরা, কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু এমনকি ম্যাগাসের মেধাও পচা পানিকে সুপেয় করে তোলার মতো কোনও উপায় বের করতে পারল না।
কারনাক থেকে রওয়ানা দেওয়ার সতের দিন পর কোম ওম্বোয় নদীর তীরে হাথরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির এলাকায় পৌঁছাল ওরা। যথারীতি বিখ্যাত ম্যাগাসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন প্রধান পুরোহিতীনি। নীলের পানি সেদ্ধ করতে সাহায্যকারীদের তামার পাত্র চুলোর উপর বাসাতে দেখে ব্যাপারটা ওদের উপর ছেড়ে দিল তাইতা, তারপর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাস মহলে চলে গেল।
ভেতরে পা রাখতে যা দেরি, পরক্ষণেই এক ধরনের করুণাময় প্রভাবের উপস্থিতি টের পেল ও। গরু দেবীর প্রতিমার সামনে চলে এলো ও। ওটার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। দিমিতার ওকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করতে ওর দেখা ডাইনীর গড়ে তোলা লস্ত্রিসের ছবি প্রায় বিশ্বাসের অতীত মন্তব্য করার পর আর রানিকে আহ্বান করার সাহস করে ওঠেনি। তবে এখানে দেবনিচয়ের অন্যতম শক্তিশালী দেবী হাথরের প্রতিরক্ষা রয়েছে ওর। পৃষ্ঠপোষকরা সবাই মেয়ে হওয়ায় তিনি নিশ্চিতভাবেই লস্ত্রিসকে নিজের খাসমহলে আশ্রয় দেবেন।
উপাস্যের মুখোমুখি হতে তিনবার প্রয়োজনীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে অন্তর্চক্ষু খুলে নীরবতার ছায়ায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ও। ক্রমশঃ কানের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনে নীরবতা ভঙ্গ হতে লাগল। ওর দিকে এগিয়ে আসা আধ্যাত্মিক সত্তার আভাস জোরাল হয়ে উঠল, ঠাণ্ডা অনুভূতি আচ্ছন্ন করার অপেক্ষায় রইল ও। বাতাসে শীতলতার প্রথম স্পর্শেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রস্তুত। শান্ত ও আমোদিতভাবে উষ্ণ রইল খাসমহল। বেড়ে উঠল ওর নিরাপত্তা ও শান্তির বোধ। ঘুমে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। চোখ বুজতেই স্বচ্ছ জলের একটা ছবি দেখতে পেল, তারপরই ছেলেমানুষি কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনল: তাইতা, তোমার কাছে আসছি আমি! জলের গভীরে কী যেন ছলকে উঠতে দেখল ও। ভাবল রূপালি মাছ বুঝি ভেসে উঠছে। তারপরই বুঝতে পারল ভুল হয়েছে ওর: ওটা ছিপছিপে ফর্শা একটা বাচ্চা, সাঁতরে ওর দিকে আসছে। পানির উপরে উঠে এলো একটা মাথা, বছর বার বয়সের একটা মেয়ের মাথা ওটা, বুঝতে পারল তাইতা। লম্বা ভেজা চুলের গোছা সোনালি পর্দার মতো মুখ আর বুকে নেমে এসেছে।
তোমার ডাক শুনেছি, প্রফুল্ল শোনাল হাসির আওয়াজ। সহানুভূতির সাথে হাসল তাইতা। সঁতরে ওর দিকে এগিয়ে এলো বাচ্চাটা। পানির ঠিক নিচে শাদা বালির কিনারে পৌঁছে উঠে দাঁড়াল। একটা মেয়ে, এখনও ওর কোমর ঠিক নারীসুলভ বাঁক নেয়নি, আর কেবল ওর পাঁজরের রেখাই উর্ধ্বাংশকে অলঙ্কৃত করেছে।
কে তুমি? জানতে চাইল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাল মেয়েটা, উন্মুক্ত হয়ে পড়ল চেহারা। তাইতার বুক ফুলে উঠতে লাগল, এক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হলো ওর। লস্ত্রিস।
ধিক তোমাকে, আমাকে চিনতে পারোনি, আমি ফেন, বলল সে। নামটার মানে চাঁদ মাছ।
আগাগোড়া তোমাকে আমি চিনি, মেয়েটাকে বলল তাইতা। প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার চোখদুটো কখনও ভুলবার নয়। ওগুলো তখন যেমন ছিল এখনও তেমনি মিশরের সবচেয়ে সবুজ ও সুন্দর চোখই আছে।
মিথ্যে বলছ, তাই। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি। চোখা গোলাপি জিভ বের করল সে।
তোমাকে অমন না করতে শিখিয়েছিলাম।
তাহলে ঠিকমতো শেখাতে পারোনি।
ফেন তোমার ছোটবেলার নাম ছিল, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা। তোমার প্রথম লাল চাঁদ দেখা দেওয়ার পর পুরোহিতরা তোমার নাম নারীসুলভ করে দিয়েছিলেন।
জলকন্যা, ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল মেয়েটা। এ নামটা কোনওদিনই ভালো লাগেনি আমার। লস্ত্রিস শুনলে কেমন হাস্যকর, আড়ষ্ট ঠেকে।
তারচেয়ে ফেনই আমার পছন্দ।
তাহলেই ফেনই সই, বলল তাইতা।
তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি, কথা দিল মেয়েটা। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ওরা আমাকে ডাকছে। কমনীয় ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিল সে, তলিয়ে গেল পানির নিচে, শরীরের দুপাশে হাত রেখে সরু পাজোড়া নাড়তে নাড়তে ক্রমে গভীরে চলে যাচ্ছে। পেছনে সোনালি পতাকার মতো আভা বিলোচ্ছে ওর চুল।
ফিরে এসো, পিছু ডাকল তাইতা। কোথায় অপেক্ষা করবে বলে যেতে হবে। কিন্তু চলে গেল সে। কেবল ওর হাসির ক্ষীণ একটা প্রতিধ্বনি ফিরে এলো ওর কাছে।
জেগে ওঠার পর তাইতা বুঝতে পারল, রাত হয়ে গেছে, কারণ মন্দিরের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। একাধারে ক্লান্ত ও তরতাজা মনে হলো নিজেকে। ডান হাতে একটা কিছু ধরে আছে, সজাগ হয়ে উঠল ও। সাবধানে হাতের মুঠি খুলল। মুঠির ভেতর শাদা পাউডার দেখতে পেল। এটাই ফেনের উপহার কিনা ভাবল। হাতটা নাকের কাছে তুলে এনে সাবধানে গন্ধ শুকল।
চুন! চেঁচিয়ে উঠল ও। নদীর কিনারা বরাবর প্রতিটি গ্রামে একটা করে আদিম ভাটা রয়েছে, এখানে গ্রামবাসীরা চুনাপাথরের চাই পুড়িয়ে এই পাউডার বানায়। এ জিনিস দিয়ে ঘরবাড়ি ও গোলাঘর রঙ করে ওরা। শাদা আস্তরণ সূর্যের রশ্মি ঠিকরে দেয় বলে ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকে। পাউডারটুকু ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, পরক্ষণে বিরত রাখল নিজেকে। দেবীর দেওয়া উপহার সম্মানের সাথে রাখতে হবে। নিজের বিপদে নিজেই হেসে উঠল ও। মুঠোর চুনা পাউডারটুকু টিউনিকের এক কোণে গেরো দিয়ে বেঁধে বাইরে এলো ও।
খাস কামরার দরজায় ওর অপেক্ষায় ছিল মেরেন। আপনার লোকজন নদীর পানি তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। পথ চলায় ক্লান্ত থাকায় ঘুমের প্রয়োজন ছিল ওদের। মেরেনের কণ্ঠে আবছা ভর্ৎসনার সুর। নিজের লোকদের যত্ন নিজেই নিয়ে থাকে সে। আশা করছি পচা পানির ভাণ্ড নিয়ে সারা রাত জেগে থাকার পরিকল্পনা করেননি। মাঝরাতের আগেই আপনাকে নিতে আসব, কারণ তেমনটি হতে দেব না আমি।
হুমকি অগ্রাহ্য করে তাইতা জানতে চাইল, পানিতে ঢালার জন্যে আমার বানানো আরক জলে মিশিয়েছিল শোফার?
হেসে উঠল মেরেন। যেমন বললাম, লাল পানির চেয়ে আরও বেশি দুর্গন্ধ ওটায়। চারটে ভাণ্ড যেখানে উতরাচ্ছিল তাইতাকে ওখানে নিয়ে গেল সে। ধোয়া উঠছে ওগুলো থেকে। আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল সাহায্যকারীরা, ওকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল; তারপর পাত্রের ডালার ভেতর লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে আগুনের উপর থেকে নামাল ওগুলো। পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা, তারপর পাত্রগুলোর পাশ দিয়ে আরক ঢালতে ঢালতে সামনে বাড়ল। একটা কাঠের খুনতি দিয়ে প্রত্যেকটায় ঘুটা দিল শোফার। সে যখন শেষ পাত্রটা নাড়তে যাবে, থামল তাইতা।ফেনের উপহার, বিড়বিড় করে বলল ও, টিউনিকের কোণার গিঁট খুলল। শেষ পাত্রে চুনা পাথরের পাউডার ঢেলে দিল। ভালো ফল পেতে লখ্রিসের সোনালি মাদুলিটা পাত্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্তির শব্দ নিউবে! উচ্চারণ করল।
বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল চার সহকারী।
পাত্রগুলো সকাল পর্যন্ত এভাবেই থাকতে দাও, নির্দেশ দিল তাইতা, বিশ্রামে যাও তোমরা। ভালো কাজ দেখিয়েছ, ধন্যবাদ।
মাদুরে গা এলিয়ে দিতেই মরার মতো ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা, স্বপ্ন হানা দিল না, এমনকি মেরেনের নাকের গর্জনও বিরক্ত করতে পারল না ওকে। ভোরে যখন জেগে উঠল, দোরগোড়ায় দরাজ হাসি মুখে নিয়ে শোফারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জলদি আসুন, মহান ম্যাগাস। আপনার স্বস্তি পাওয়ার মতো একটা কিছু দেখাবার রয়েছে আমাদের।
গত রাতের আগুনের শীতল হয়ে আসা কয়লার পাশে রাখা পাত্রগুলোর কাছে। ছুটে এলো ওরা। যার যার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাবারি ও অন্য ক্যাপ্টেনরা। সবাইকে নতুন নির্দেশ দেওয়ার জন্যে হাজির করা হয়েছে। বর্মের সাথে তলোয়ারের খাপ বইছে ওরা, এমনভাবে উল্লাস করছে যেন তাইতা কোনও বিজয়ী জেনারেল, যুদ্ধ ক্ষেত্রের দখল বুঝে নিচ্ছে। চুপ করো! গর্জে উঠল তাইতা। আমার মাথা ভেঙে ফেলবে তোমরা! কিন্তু আরও জোরে উল্লাস করল ওরা।
প্রথম তিনটা পাত্র বমি জাগিয়ে তোেলা কালো তরলে ভর্তি হয়ে আছে, কিন্তু চতুর্থ পাত্রের পানি একেবারে টলটলে পরিষ্কার। সামনে ঝুঁকে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে দ্বিধার সাথে মুখে দিল ও। মিষ্টি নয়, কিন্তু মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা, ছেলেবেলা থেকে ওদের বাঁচিয়ে রাখা নীলের কাদার পরিচিত সুবাস।
এর পর থেকে প্রতিদিন রাতের বিশ্রামের সময় নদীর জলে চুনের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে লাগল; পরদিন সকালে পানি রাখার চামড়ার পাত্রগুলো ভরে নিল। অচিরেই পিপাসায় দুর্বল ঘোড়াগুলো আবার শক্তি ফিরে পেতেই বেড়ে উঠল যাত্রার গতি। নয় দিন পর আসৌনে পৌঁছাল ওরা। সামনেই ছয়টি বিশাল জলপ্রপাতের প্রথমটি। নৌকার পক্ষে ভীতিকর বাধা ওগুলো, কিন্তু ঘোড়ার দল উপরের ক্যারাভান রোডে নিয়ে যেতে পারবে ওদের।
আসৌন শহরে ঘোড়া আর লোকজনকে টানা তিনদিন বিশ্রাম দিল মেরেন। রাজকীয় গোলাঘর থেকে শস্যের বস্তা ভরে নিল। জলের ধারের প্রমোদগুহাগুলোতে যাবার অনুমতি দিয়ে লোকজনকে যাত্রার পরবর্তী দীর্ঘ পর্যায়ের জন্যে বলীয়ান হয়ে নেওয়ার সুযোগ দিল। নিজের পদমর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে মেকি নির্বিকার চেহারায় বানিয়ে স্থানীয় সুন্দরীদের বেপরোয়া দৃষ্টির আমন্ত্রণ ও তোষামোদ এড়িয়ে গেল।
প্রথম জলপ্রপাতের নিচের জলাশয়টা শুকিয়ে তুচ্ছ পুকুর হয়ে গেছে। তো তাইতাকে ছোট দ্বীপে পৌঁছে দিতে কোনও মাঝির দরকার হলো না, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আইসিসের সবুজ মন্দির। ওটার দেয়ালে খোদাই করা দেবী, তাঁর স্বামী অসিরিস ও ছেলে হোরাসের দানবীয় প্রতিমা আঁকা।
ওকে সরাসরি ওখানে নিয়ে গেল উইন্ডস্মোক। নদীর পাথুরে তলদেশে খটাখট শব্দ তুলল ওটার খুর। ওকে স্বাগত জানাতে সমবেত হলেন সব পুরোহিত, পরের তিনটি দিন ওদের সাথেই কাটাল ও।
দক্ষিণের নুবিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ওকে জানানোর মতো তেমন কোনও তথ্য ছিল না ওদের কাছে। সুসময়ে নীলের বান যখন নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী ও সত্যি ছিল তখন একটা বাণিজ্য জাহাজের বিরাট বহর নদীর উজানে দুই নীলের সঙ্গমস্থল সেই কেবুই অবধি যাতায়াত করত। হাতির দাঁত, শুকনো মাংস এবং বুনো পশুর চামড়া, গাছের গুঁড়ি, তামার দণ্ড আর নীলের প্রধান শাখা আতবারা নদীর তীরের খনি থেকে সোনা নিয়ে ফিরে আসত ওরা। এখন বান না ডাকায় চলার পথের পুকুরগুলোর অবশিষ্ট জল রক্তে পরিণত হয়েছে, হাতে গোণা পর্যটকই কেবল পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে এই মরুপথে যাতায়াত করার সাহস দেখায়। পুরোহিতরা সতর্ক করে বললেন যে, দক্ষিণের রাস্তা ও এর বরাবর চলে যাওয়া পাহাড় পর্বত অপরাধী ও অস্পৃশ্যদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
আরও একবার পুরোহিতদের কাছে মেকি দেবীর কথা জানতে চাইল ও। ওরা বললেন, গুজব রটেছে যে সোয়ে পয়গম্বররা আবর্জনা থেকে হাজির হয়ে উত্তরে কারনাক ও ডেল্টার দিকে গেছে, কিন্তু কেউই ওদের সাথে যোগাযোগ করেনি।
রাত নামার পর দেবী মাতা আইসিসের মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে চলে এলো তাইতা, তার প্রতিরক্ষায় ধ্যান ও প্রার্থনা করতে স্বস্তি বোধ করল। নিজের পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে আহ্বান জানালেও ধ্যানের প্রথম দুই রাত তার কাছ থেকে কোনও সাড়া পেল না। তারপরেও কেবুই ও তার ওধারে অচেনা দেশ ও জলাভূমিতে যাবার পথে অপেক্ষমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যে নিজেকে বেশ শক্তিশালী ও তৈরি মনে হতে লাগল ওর। ইয়োসের সাথে অনিবার্য মোকাবিলা এখন অনেক কম ভীতিকর ঠেকছে। ওর শক্তিশালী দেহ ও স্থৈর্য তরুণ সেনা ও অফিসারদের সাথে চলার ও থেবস ছাড়ার পর থেকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ফল হয়ে থাকতে পারে। তবে দেবী লস্ত্রিস, বা এখন নিজেকে যেমন ফেন নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে সে, কাছাকাছি আছে জানা থাকায় নিজেকে যুদ্ধের জন্যে আরও বেশি তৈরি করেছে ভাবতে ভালো লাগছে ওর।
শেষ সকালে সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি ফুটে ওঠামাত্র জেগে উঠল ও। ফের আইসিস ও কাছাকাছি থাকতে পারেন এমন যেকোনও দেবতার আশীর্বাদ ও প্রতিরক্ষার জন্যে প্রার্থনা জানাল। খাস কামরা থেকে বের হবে, এমন সময় আইসিসের মূর্তির দিকে একবার তাকাল ও। লাল গ্রানিট পাথর কুঁদে বের করা হয়েছে ওটা। ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মূর্তিটা, ছায়ায় হারিয়ে গেছে ওটার মাথা, পাথরের চোখজোড়া অটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। বেনী করা প্যাপিরাসের মাদুরের পাশে রাখা ছড়ি তুলে নিতে উবু হলো ও, রাতে ওটার উপরই ঘুমিয়েছে। সোজা হওয়ার আগেই কানের কাছে শিরা দপদপ করে লাফাতে শুরু করল, কিন্তু নগ্ন উর্ধ্বাংশে কোনও রকম শীতল স্পর্শ বোধ করল না। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মূর্তিটা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখজোড়া, সেখানে যেমন করে কেউ ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকায় ঠিক তেমনি কোমল দৃষ্টি ফুটে উঠেছে।
ফেন, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা। লস্ত্রিস, তুমি এসেছ? ওর মাথার অনেক উপরে পাথরের ছাদ থেকে হাসির প্রতিধ্বনি কানে এলো, কিন্তু নীড়ে ফিরে যাওয়া বাঁদুরের কালো ডানার ঝাপ্টা ছাড়া আর কিছু দেখল না ও।
আবার মূর্তির দিকে ফিরে এলো ওর চোখ। পাথুরে মাথাটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এখন, ফেনের মুখ ওটা। মনে আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি, ফিসফিস করে বলল সে।
কোথায় পাব তোমাকে? কোথায় খুঁজতে হবে বলে দাও, অনুনয় করল তাইতা।
আর কোথায় চাঁদ মাছের খোঁজ করবে? পরিহাস করল ফেন। অন্য মাছের ভেতর লুকোনো অবস্থায় পাবে আমাকে।
কিন্তু কোথায় সেই মাছগুলো? মিনতি করল ও। ইতিমধ্যে পাথরে পরিণত হতে চলেছে ওর জীবন্ত চেহারা। ফের ম্লান হয়ে আসছে উজ্জ্বল চোখজোড়া।
কোথায়? চিৎকার করে উঠল তাইতা। কখন?
অন্ধকারের দূত থেকে সাবধান। ওর কাছে ছুরি আছে। সেও তোমার অপেক্ষা করছে। বিষণ্ণ সুরে ফিসফিস করে বলল ফেন। এবার আমাকে যেতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ আমাকে থাকতে দেবে না সে।
কে থাকতে দেবে না? আইসিস, না অন্য কেউ? এই পবিত্র স্থানে ডাইনীর নাম মুখে আনা অপবিত্রতার সামিল হবে। কিন্তু মূর্তির ঠোঁট জমে গেছে।
বাহুর উপরের অংশে কারও হাতের খোঁচা লাগল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। ভেবেছিল আরও একটা প্রেতাত্মার আবির্ভাব হচ্ছে বুঝি; কিন্তু স্রেফ প্রধান পুরুতের মুখই দেখতে পেল ও। তিনি বললেন, ম্যাগাস, কী হয়েছে আপনার? চিৎকার করছিলেন কেন?
স্বপ্ন দেখছিলাম। বাজে স্বপ্ন।
স্বপ্ন কখনও বাজে হয় না। অন্তত আপনার সেটা জানার কথা। স্বপ্ন হচ্ছে দেবতাদের কাছ থেকে আসা সতর্কবাণী ও বার্তা।
পবিত্র পুরুষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তাবলে চলে এলো ও। ওর কাছে ছুটে এলো উইন্ডস্মোক। খুশিতে মাটিতে পা ঠুকছে। মুখের কোণে ঝুলছে এক গোছা খড়।
ওরা তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, বুড়ি ছিনাল কোথাকার। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ ঘোড়ার বাচ্চার মতো গিলছ, ইয়া বড় পেট হয়েছে। আদুরে গলায় বকল ওকে তাই। কারনাক সফরের সময় একজন অসতর্ক সহিস ফারাওর প্রিয় স্ট্যালিয়নগুলোর একটাকে ওটার কাছে আসতে দিয়েছিল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে পিঠে চাপার সুযোগ করে দিল ঘোড়াটা। তারপর মেরেনের সেনাদল যেখানে শিবির গোটাচ্ছে সেখানে নিয়ে এলো। কলাম তৈরি হওয়ার পর যার যার ঘোড়ার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে লোকেরা, বাড়তি ঘোড়া ও প্যাক অ্যানিমেলের লাগাম ধরে আছে। হাতে। অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরখ করতে করতে সারির ভেতর দিয়ে এগোল মেরেন। সবাই যার যার তামার পানির পাত্র ও চুনের ব্যাগ খচ্চরের পিঠে নিয়েছে, নিশ্চিত হয়ে নিল।
উঠে পড়ো! কলামের পেছন থেকে চিৎকার করে নির্দেশ দিল। এগোও! হট! ছোট! কাঁদতে কাঁদতে একদল মহিলা পাহাড়ের পাদদেশ অবধি অনুসরণ করল ওদের। মেরেনের চলার গতির সাথে আর তাল রাখতে না পেরে তারপর পিছিয়ে গেল।
তেতো বিদায়, তবে স্মৃতি অনেক মধূর, হিলতো-বার-হিলতো মন্তব্য করল, হেসে উঠল তার বাহিনী।
উঁহু, হিলতো, নিজের কলামের মাথা থেকে বলে উঠল মেরেন, শরীর মিষ্টি, কিন্তু তারচেয়ে মিষ্টি তার স্মৃতি।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ওরা, খাপ দিয়ে ঢালের উপর তাল ঠুকতে লাগল।
এখন হাসছে, শুকনো কণ্ঠে বলল তাইতা, কিন্তু মরুভূমির চুল্লীতে পৌঁছানোর পরেও হাসতে পারছে কিনা দেখা যাবে।
জলপ্রপাতের গহ্বরের দিকে তাকাল ওরা। ক্রুদ্ধ জলের কোনও গর্জন নেই। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলো এমনিতে নৌচলাচলের পথে বিরাট বিপদ হয়ে থাকে, কিন্তু এখন শুকনো নাঙা হয়ে আছে। বুড়ো মোষের পালের পিঠের মতোই শুকনো, কালো। উপরের প্রান্তে গহ্বরের ঠিক নিচে একটা ব্লাফে একটা লম্বা গ্রানিটের অবিলিস্ক দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন ওদের ঘোড়া আর খচ্চরকে পানি খাওয়ানোর সময় ক্লিফ বেয়ে সৌধের কাছে এলো তাইতা ও মেরেন, ওটার পায়ের কাছে দাঁড়াল ওরা। জোরে জোরে খোদাই লিপি পড়ল তাইতা:
আমি, মিশরের রিজেন্ট ও ফারাও, এ ধারায় অষ্টম মেমোজের বিধবা পত্নী, রানি লস্ত্রিস, আমার পরে মিশরের দুই রাজ্যের হবু অধিপতি যুবরাজ মেমননের মা, এই সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছি।
এটা মিশরের জনগণের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন ও প্রমাণ, বর্বরদের হটিয়ে বনবাস থেকে ওদের কাছে আবার ফিরে আসব আমি।
আমার শাসনকালের প্রথম বছরে স্থাপন করা হয়েছে এই পাথরখণ্ড-ফারাও চিপসের মহান পিরামিড নির্মাণের পর নয় শত নম্বর।
আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন এই পাথর অটল থাকে।
.
স্মৃতিরা ভিড় করে আসার সাথে সাথে অশ্রুতে ভরে উঠল তাইতার চোখ। অবিলিস্ক স্থাপনের দিন লখ্রিসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর: তখন ওর বয়স ছিল বিশ বছর, রাজকীয় ও নারীসুলভ মহিমায় ছিল গর্বিত।
ঠিক এখানেই আমার কাঁধে প্রশংসার স্বর্ণ তুলে দিয়েছিল রানি লস্ত্রিস, মেরেনকে বলল ও। অনেক ভারি ছিল, কিন্তু ওর অনুকম্পার তুলনায় অনেক সস্তা। ঘোড়ার কাছে এসে পিঠে চেপে বসল ওরা।
বিশাল কোনও অগ্নিকুণ্ডের শিখার মতো ওদের ঢেকে ফেলল মরুপ্রান্তর। দিনের বেলায় চলতে পারছিল না ওরা, তো নদীর পানি সেদ্ধ করে তাতে চুনাপাথর ছিটাচ্ছে, তারপর ক্ষিপ্র বেগে ছোটা পশুর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে খুঁজে পাওয়া কোনও ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করার পর রাত ভর এগিয়ে চলছে ওরা। জায়গায় জায়গায় মোটা ক্লিফটা নদীর উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়েছে। যে সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একটা সারিতে এগোতে পারছে ওরা। লুটিয়ে পড়া কুঁড়ে ঘর পাশ কাটাল ওরা, এক কালে ওদের আগে এপাথে যাওয়া পর্যটকদের আশ্রয় ছিল ওগুলো। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত। আসৌন ছেড়ে পথে নামার পর দশ দিনের আগে নতুন কোনও মানুষের চিহ্ন পেল না। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপরার সারিতে এসে পৌঁছুল, এখানে এক কালে একটা গভীর পুকুর ছিল। সম্প্রতি কারও দখলে ছিল এটা: অগ্নিকুণ্ডের ছাই এখনও টাটকা, মচমচে। কুঁড়েয় ঢোকার সাথে সাথে ডাইনীর ক্ষীণ অথচ সন্দেহাতীত আভাস পেল ও। ছায়ায় চোখজোড়া সয়ে এলে দেয়ালের গায়ে কয়লার টুকরো দিয়ে লেখা হিয়েটিক হরফের লিপি দেখতে পেল।
ইয়োস মহান। ইয়োস আবির্ভূত হন। অল্প দিন আগেই ডাইনীর কোনও ভক্ত গেছে এ পথে। দেয়ালের পায়ের কাছে যেখানে দাঁড়িয়ে আবেদনের কথা লিখেছে সে, সেখানে ধূলির বুকে পায়ের ছাপ পড়েছে। সর্যোদয়ের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। দিনের উত্তাপ দ্রুত ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। শিবির খাটানোর জন্যে সেনাদলকে নির্দেশ দিল মেরেন। এমনকি ধসে পড়া কুঁড়েগুলোও নিষ্ঠুর সূর্যের কবল থেকে কিছুটা ছায়া বিলোতে পারে। এসব যখন ঘটছে, উত্তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই, ইয়োসের উপাসকদের খোঁজ করল তাইতা। দক্ষিণে চলে যাওয়া নুড়িপাথরের পথে পায়ের ছাপ দেখতে পেল। সেগুলোর অবস্থান দেখে বুঝতে পারল ঘোড়াটা নিশ্চিতভাবেই দশাসই একজন লোককে বয়ে নিয়ে গেছে। দক্ষিণে, কেবুইয়ের দিকে গেছে খুরের ছাপ। মেরেনকে ডাকল তাইতা, জিজ্ঞেস করল, এই ছাপ কতদিন আগের? দক্ষ স্কাউট ট্র্যাকার মেরেন।
নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, ম্যাগাস। তিন দিনের বেশি তবে দশদিনের কম।
তাহলে আমাদের ফেলে অনেক দূর চলে গেছে ইয়োসের পুজক।
*
ওরা কুঁড়ের আশ্রয়ে ফিরে আসার সময় শিবিরের মাথার উপর থেকে একজোড়া কালো চোখ ওদের প্রতিটি নড়াচড়া নিরীখ করে চলল। ওই কালো, গম্ভীর চোখজোড়া ইয়োসের পয়গম্বর সোয়ের, রানি মিনতাকাকে যে জাদু করেছে। কুঁড়ের দেয়ালের লেখাগুলো তারই কাজ। এখন নিজের অস্তিত্ব এভাবে ফাঁস করে দেওয়ায় অনুতাপ হলো তার।
মাথার উপরের পাহাড় চূড়ার ছড়ানো এক চিলতে ছায়ায় শুয়ে আছে সে। তিনদিন আগে পথের একটা ফোকরে হোঁচট খেয়ে সামনের পা ভেঙে ফেলেছে তার ঘোড়া। এক ঘণ্টার মধ্যেই নেকড়ের পাল এসে হাজির হয়েছে পঙ্গু জানোয়ারটাকে ছিঁড়ে খেতে। ওটা পা ছুঁড়ে চিৎকার করার সময়ই শরীর থেকে মাংস খুবলে গিলেছে। আগের রাতে অবশিষ্ট পানিটুকই শেষ করেছে সোয়ে। এই ভীতিকর জায়গায় আটকা পড়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, তাকে আর বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে, ওকে নিদারুণ পুলকিত করে উপত্যকা বরাবর ঘোড়ার খুরের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। নবাগতদের স্বাগত জানিয়ে সাথে করে ওকে নেওয়ার আবেদন জানানোর বদলে এখানে গা ঢাকা দিয়ে ওদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। দলটা দৃষ্টিসীমায় আসামাত্র ওটাকে রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ডিটাচমেন্ট হিসাবে শনাক্ত করল সে। প্রত্যেকে ভালোভাবেই সজ্জিত, দারুণ সব ঘোড়ায় চেপেছে। ওরা যে বিশেষ অভিযানে নেমেছে এটা পরিষ্কার, সম্ভবত স্বয়ং ফারাওর নির্দেশেই। এমনও হতে পারে যে ওকে পাকড়াও করে ফের কারনাকে ফিরিয়ে নিতেই পাঠানো হয়েছে ওদের। থেবসের ভাটিতে নদীর কিনারে ম্যাগাস তাইতা ওকে দেখেছিল, এব্যাপারে সে নিশ্চিত, এও জানে, ম্যাগাস রানি মিনতাকার আস্থাভাজন। রানি সম্ভবত তাইতাকে সব বলে দিয়েছেন এবং রানির সাথে সোয়ের সম্পর্কের কথা সে জানে, এটা বুঝতে খুব বেশি কল্পনা শক্তি লাগে না। সোয়ে নিশ্চিতভাবে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অপরাধী, ফারাওর আদালতে রেহাই পাওয়ার কোনওই আশা নেই। এইসব কারণেই কারনাক থেকে সটকে পড়েছে সে। এখন যেখানে সে শুয়ে আছে ঠিক তার নিচেই সেনাদলের মাঝে তাইতাকে শনাক্ত করতে পেরেছে।
নদীর পাড়ে বিভিন্ন কুঁড়ের ফাঁকে ফাঁকে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোকে জরিপ করল সোয়ে। বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোনটা বেশি দরকার স্পষ্ট নয় ওর কাছে: একটা ঘোড়া নকি প্যাক মিউলের পিঠ থেকে সৈনিকের নামানো ফোলা পানির চামড়ার ব্যাগ। অবশেষে যখন ঘোড়াই বেছে নিল সে, কুঁড়ের বাইরে তাইতার বেঁধে রাখা মেয়ারটাকেই সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও চমৎকার ঠেকল তার। ওটার সাথে বাচ্চা থাকলেও সোয়ের প্রথম পছন্দ হবে ওটাই, যদি কাছে ঘেঁষতে পারে।
শিবিরে দারুণ কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে দলাইমলাই করা হচ্ছে। নদীর পুকুর থেকে তামার গামলা বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেরা ব্যস্ত হাতে খাবার রান্না করছে যেসব চুলোয় সেগুলোয় পাচ্ছে। খাবার তৈরি হওয়ার পর চারটি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দলীয় পাত্র ঘিরে আলাদা বৃত্ত তৈরি করে বসে পড়ল সেনাদল। থিতু হওয়ার মতো সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নিতে নিতে সূর্যটা মাথার বেশ উপরে উঠে এলো। গোটা শিবির জুড়ে এক ধরনের গাম্ভীর্যপূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। সতর্কতার সাথে শান্ত্রীদের অবস্থান জরিপ করল সোয়ে। সীমানা বরাবর নিয়মিত বিরতিতে চারজন প্রহরী রয়েছে। বুঝতে পারছে, শুকনো নদীর তলদেশই তার এগিয়ে যাবার সেরা উপায়, তাই ওদিকের প্রহরীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। লোকটা বেশ অনেকটা সময় নড়াচড়া করছে না দেখে সোয়ে ধরে নিল ঝিমোচ্ছে সে। চৌহদ্দীর আরও সতর্ক প্রহরীদের চোখের আড়ালে থেকে পাহাড়ের কিনারা থেকে পিছলে নেমে এসে শিবিরের আধা লীগ নিচ দিয়ে নদীর শুকনো তলদেশ ধরে আগে বাড়ল, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল উজানের দিকে। শিবিরের ঠিক উল্টোদিকে আসার পর আস্তে করে নদীর কিনারার উপরে মাথা ওঠাল।
মাত্র বিশ কদম দূরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে এক শান্ত্রী। চিবুকটা বুকের কাছে ঝুলছে, চোখবন্ধ। ফের কিনারার নিচে গা ঢাকা দিল সোয়ে। গা থেকে জোব্বা খুলে বগলদাবা করল। খাপে ভরা ড্যাগারটা খুঁজে নিল নেংটির নিচে। তারপর তীরের উপরে উঠে এলো। দৃঢ় পায়ে মেয়ারটা যে কুঁড়ের পিছনে বাঁধা ছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেল। সামান্য নেংটি আর স্যান্ডেল পায়ে নিজেকে সৈন্যদেরই একজন হিসাবে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে স্থানীয় মিশরিয় ভাষায় জবাব দিতে পারবে; বলবে, ব্যক্তিগত কাজে নদীর ধারে গিয়েছিল। অবশ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করতে গেল না ওকে। কুঁড়ের কোণে পৌঁছে ওটার পেছনে গা ঢাকা দিল।
খোলা দরজার ঠিক ওধারেই বাধা রয়েছে মেয়ারটা। দেয়ালের ছায়ায় একটা পানি ভর্তি চামড়ার ভাণ্ড রাখা। মেয়ারের পিঠে চেপে বসতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। সব সময়ই বিনা জিনে ঘোড়া হাঁকায় সে, তাই জিন, লাগাম বা রেকাবের দরকার হয় না। পা টিপে টিপে মেয়ারের কাছে চলে এলো সে, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাতের গন্ধ শুকল ঘোড়াটা। অস্থিরভাবে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মৃদু কণ্ঠে সোয়ে ওর সাথে কথা বলতেই ফের শান্ত হলো, ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল সোয়ে। এবার চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে। ভারি ওটা, তুলে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ওটাকে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে নিল। পিঠে উঠতে যাবে, এমন সময় খোলা দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর থামাল ওকে। মিথ্যা পয়গম্বর থেকে সাবধান। তোমার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করা হয়েছে, সোয়ে।
চমকে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল সে। দরজা পথে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাগাস। নগ্ন। আরও তরুণ কারও মতো পেশীবহুল ছিপছিপে দেহ তার; কিন্তু কুঁচকির কাছে খোঁজা করার পুরোনো দাগ রূপালি লাগছে। মাথার চুল ও দাড়ি অবিন্যস্ত। কিন্তু চোখজোড়া আরও উজ্জ্বল। সতর্ক করার সুরে কণ্ঠস্বর আরও চড়াল ওঃ আমার কাছে এসো! প্রহরী! হিলতো, হাবারি! মেরেন! এখানে, শাবাকো! নিমেষে ডাকে সাড়া মিলল। সারা শিবিরে প্রতিধ্বনি উঠল তার।
আর দ্বিধা করল না সোয়ে। উইন্ডস্মোকের পিঠে চেপে বসেই আগে বাড়ার তাগিদ দিল ওটাকে। ওটার পথে ছুটে এলো তাইতা, হাতে তুলে নিল দড়িটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মেয়ার, ফলে ছিটকে ওটার ঘাড়ে সরে এলো সোয়ে। বুড়ো গাধা, পথ ছাড়ো! রাগের সাথে চিৎকার করে উঠল সে।
ওর কাছে ছুরি আছে। ফেনের সাবধানবাণী প্রতিধ্বনি তুলল তাইতার মাথার ভেতর। সোয়ের ডান হাতে ড্যাগারের ঝিলিক দেখতে পেল, ঘাই মারার জন্যে উইন্ডস্মোকের পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ল সে। আগেই ওকে সতর্ক করা না হলে ঠিক গলায় লাগত আঘাতটা। কিন্তু বাউলি কেটে একপাশে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল ও। ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল ড্যাগারের ডগা। পেছনে হোঁচট খেল ও। ঘাড়ের একপাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পেছনে সরে এলো ও। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে মেয়ারটাকে তাগিদ দিল সোয়ে। ক্ষতস্থান চেপে ধরে তীক্ষ্ণ শিস বাজাল তাইতা। ফের থমকে দাঁড়াল উইন্ডস্মোক। তারপর হিংস্রভাবে লাফ দিয়ে উঠল, বাস্পের হিসিহিস তোলা মেঘে পানির পাত্রটাকে উল্টে দিল। হামাগুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত কয়লা থেকে সরে এলো সোয়ে। কিন্তু সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই দুজন দশাসই সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। বালির উপর চেপে ধরল তাকে।
মেয়ারকে শেখানো সামান্য কায়দা এটা, শান্ত কণ্ঠে সোয়েকে বলল তাইতা। ড্যাগারটা যেখানে পড়েছিল সেখান থেকে তুলে নিল ও। সোয়ের কানের ঠিক সামনে চোয়ালের নরম ত্বকে ওটার ডগা ছোঁয়াল। ফের মিথ্যা বলো, পাকা ডালিমের মতো মাথাটা দুমড়ে দেব।
কুঁড়ে থেকে দিগম্বর অবস্থায় ছুটে বের হয়ে এলো মেরেন। হাতে তলোয়ার। নিমেষে অবস্থান নিল। সোয়ের ঘাড়ের পেছনে ব্রোঞ্জের ডগা ছোঁয়াল। তাইতার দিকে তাকাল তারপর। শুয়োরটা আপনাকে আঘাত করেছে। ওকে মেরে ফেলব, ম্যাগাস?
না! বলল তাইতা। এটাই সোয়ে, মিথ্যা দেবী ইয়োসের মিথ্যা পয়গম্বর।
সেথের মিষ্টি অণ্ডকোষের দোহাই, এবার চিনতে পেরেছি ব্যাটাকে। এ লোকই নদীর ধারে দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল।
এক ও অদ্বিতীয়, সায় দিল তাইতা। ঠিক মতো বেঁধে ফেল। কাজটা শেষ হয়েছে দেখার পরেই ওর সাথে খানিকটা বাতচিত করব আমি।
খানিক বাদে তাইতা আবার কুঁড়ে থেকে বের হয়ে এলে দেখা গেল সোয়েকে বাজারে বিক্রির শুয়োরের মতো বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই নিশ্চিত হতে ওকে পুরো ন্যাংটো করে ফেলেছে ওরা। সূর্যের কড়া আঁচে এরই ভেতর লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে তার ত্বক। উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিলতো ও শাবাকো। কুঁড়ের দেয়ালের ছায়ায় চামড়ার ফিতের গদি দেওয়া একটা টুল পেতে দিয়েছে মেরেন। সহজ ভঙ্গিতে ওটায় বসল তাইতা। অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টিতে সময় নিয়ে সোয়েকে পরখ করল। শেষ বার যেমন দেখেছিল তারপর আর লোকটার আভায় কেনও পরিবর্তন ঘটেনি; ক্রুদ্ধ ও বিভ্রান্ত।
অবশেষে কিছু মামুলি প্রশ্ন করতে শুরু করল তাইতা, যেগুলোর জবাব আগে থেকেই জানা, যাতে সত্যি বা মিথ্যা বলার সময় সোয়ের আভার পরিবর্তন বুঝতে পারে।
তুমি সোয়ে নামে পরিচিত?
নীরব অবজ্ঞায় চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকাল সোয়ে। খোঁচা লাগাও, শাবাকোকে নির্দেশ দিল তাইতা। পায়ে, তবে বেশি ভেতরে না। সূক্ষ্ম হিসাব করে একটা ঘা দিল শাবাকো। লাফিয়ে উঠল সোয়ে, আর্তনাদ ছাড়ল, বাঁধা অবস্থায় পাক খেল একবার। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা দেখা দিল উরুতে।
আবার শুরু করছি, বলল তাইতা। তুমি সোয়ে?
হ্যাঁ, দাঁত কিড়মিড় করে বলল সে। অবিরাম জ্বলছে তার আভা।
সত্যি, নীরবে নিশ্চিত করল তাইতা।
তুমি মিশরিয়?
মুখ বন্ধ রাখল সোয়ে, রাগী চেহারায় তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
শাবাকোকে হুকুম দিল তাইতা। অন্য পায়ে।
হ্যাঁ, চট করে বলল সোয়ে। অপবির্তিত রইল আভা। সত্যি।
রানি মিনতাকাকে দীক্ষা দিয়েছ তুমি?
হ্যাঁ। ফের সত্যি।
তুমি তাকে মৃত বাচ্চাদের জীবিত করে তোলার কথা দিয়েছ?
না, সহসা সোয়ের আভার ভেতর একটা সবজে আলো ঠিকরে উঠল।
মিথ্যার আলামত, ভাবল তাইতা। সোয়ের এর পরের জবাব বিচার করার মানদণ্ড পেয়ে গেছে।
আমার আতিথেয়তার ঘাটতি ক্ষমা করবে। তুমি তৃষ্ণার্ত, সোয়ে?
শুকনো, ফাটা ঠোঁটজোড়া জিভে ভেজাল সোয়ে। হা! বলে উঠল ফিসফিস করে। স্পষ্টতই সত্যি।
তোমাদের কি ভদ্রতা জ্ঞান নেই, মেরেন? আমাদের সম্মানিত মেহমানের জন্যে একটু পানি নিয়ে এসো।
দাঁত বের করে হেসে চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। কাঠের পানপাত্র ভরে নিল। ফিরে এসে সোয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ফাটা ঠোঁটের কাছে উপচে পড়া পাত্রটা ধরল। মুখ ভর্তি করে খেল সোয়ে। আগ্রহের আতিশয্যে কাশতে কাশতে কোনওমতে সবটুকু পানি শেষ করল। দম ফিরে পেতে তাকে খানিকটা সময় দিল তাইতা।
তো, নিজের মালকিনের কাছে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি?
না, বিড়বিড় করে বলল সে। ওর আভার সবুজ প্রলেপ মিথ্যা ফাস করে দিল।
ওর নাম ইয়োস?
হ্যাঁ। সত্যি।
তুমি তাকে দেবী মানো?
তিনিই একমাত্র দেবী। পরম প্রভু। আবার সত্যি। বড় বেশি সত্যি।
তার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে তোমার?
না! মিথ্যা।
সে কি তোমাকে এপর্যন্ত ওর সাথে জিজিমা করতে দিয়েছে? ইচ্ছে করেই লোকটাকে উস্কে দিতে কর্কশ সেনাসুলভ বুলি ব্যবহার করল তাইতা। কথাটার আদি মানে দৌড়ানো, বিজয়ী সৈন্যদল পরাস্ত সেনাবাহিনীর নারীদের ধরার সময় যা করে।
না! হিংস্রতার সাথে ঝিকিয়ে উঠল কথাটা। সত্যি।
তবে কি তার সমস্ত হুকুম তামিল করার পর মিশর তার হাতে তুলে দেওয়ার পর জিজিমার কথা দিয়েছে সে?
না। মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কথাটা। মিথ্যা। আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওকে ইয়োস।
তার আস্তানা কোথায় জানো?
না। মিথ্যা।
কোনও আগ্নেয়গিরি কাছে?
না। মিথ্যা।
জলাভূমির ওধারে দক্ষিণে কোনও বিশাল হ্রদের ধারে?
না। মিথ্যা।
সে মানুষ খেকো?
জানি না। মিথ্যা।
ছোট্ট বাচ্চাদের খায়? আবার মিথ্যা।
সে কি জ্ঞানী ও শক্তিমান লোকজনকে প্রলুব্ধ করে নিজের আস্তানায় ডেকে নিয়ে তারপর তাদের ধ্বংস করার আগে সমস্ত জ্ঞান আর ক্ষমতা কেড়ে নেয়?
এসব কিছুই জানি না আমি। বিরাট ও নিরেট মিথ্যা।
বিশ্ববেশ্যা এ পর্যন্ত মোট কয়জন পুরুষের সাথে শুয়েছে? এক হাজার? দশ হাজার?
তোমার প্রশ্ন ধর্মদ্রোহমূলক। এজন্যে তোমার সাজা হবে।
ম্যাগাস ও মোহন্ত দিমিতারকে যেভাবে সাজা দিয়েছে? তার হয়ে তুমিই ওর উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিলে?
হ্যা! ধর্মদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ছিল সে। এই বিচারই পাওনা ছিল তার। তোমার নোংরা কথায় আর কান দিচ্ছি না। চাইলে মেরে ফেল আমাকে, কিন্তু আমি আর মুখ খুলছি না। ওকে বেঁধে রাখা দাড়ির বাঁধন আলগা করার প্রয়াস পেল সোয়ে। কর্কশ হয়ে উঠেছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস, চোখে বুনো দৃষ্টি। ধর্মান্ধের চোখ।
মেরেন, আমাদের অতিথি উত্তেজনায় ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে দাও তাকে। সকালে সূর্য উষ্ণ করে তুলবে এমন একটা জায়গায় বেঁধে রাখবে ওকে। শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে, কিন্তু বেশি দূরে নয়, যাতে সে ফের আলাপে রাজি হলে কথা বলার সময় বা ওকে হায়েনার দল খুঁজে পাওয়ার সময় টের পাই।
সোয়ের ঘাড়ে ভালো করে দাড়ি পেঁচিয়ে টেনে দূরে নিয়ে যেতে শুরু করল মেরেন। থেমে তাইতার দিকে তাকাল একবার। ওকে দিয়ে আর কাজ নেই, আপনি নিশ্চিত, ম্যাগাস? আমাদের কিছুই বলেনি কিন্তু।
সবই বলেছে, বলল তাইতা। আত্মা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ওর পা ধরো, শাবাকো ও তোনকাকে বলল মেরেন। ধরাধরি করে সোয়েকে দূরে নিয়ে গেল ওরা। পেরেক দিয়ে তপ্ত মাটিতে বেঁধে রাখার আওয়াজ পেল তাইতা। বিকেলের মাঝামাঝি আবার তার সাথে কথা বলতে গেল মেরেন। রোদে পেট আর কুঁচকিতে ফোঁসকা পড়েছে; গালের রঙ লাল, ফুলে উঠেছে।
মহান ম্যাগাস আলাপ চালু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তোমাকে, বলল মেরেন। ওকে থুতু মারার চেষ্টা করল সোয়ে, কিন্তু মুখে লালা এলো না। পিঙ্গল জিভ মুখটাকে ভরে রেখেছে। সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে ডগাটা।
সূর্যাস্তের খানিক আগে হায়েনার দল দেখা পেল তার। ওগুলোর বিকৃত গর্জন ও হাসির শব্দে এমনকি পোড়খাওয়া পুরোনো বীর মেরেন পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
ওকে ভেতরে নিয়ে আসব, ম্যাগাস? জানতে চাইল সে।
মাথা নাড়ল তাইতা। থাক। কোথায় ডাইনীর খোঁজ করতে হবে বলে দিয়েছে সে।
হায়েনার দল মরণটাকে নিষ্ঠুর করে তুলবে, ম্যাগাস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইতা। শান্ত কণ্ঠে বলল, কুনো ব্যাঙগুলো দিমিতারের মরণকেও একই রকম নিষ্ঠুর করে দিয়েছিল। ডাইনীর চ্যালা সে। সাম্রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মারা যাওয়াই উচিত। তবে এভাবে নয়। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেকের দংশনে জর্জরিত করবে। আমাদেরও অমানুষের কাতারে নামিয়ে দেবে। যাও, ওর গলাটা দুফাঁক করে দাও।
উঠে দাঁড়াল মেরেন। তলোয়ার বের করে একুট থেমে কান খাড়া করল। একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। চুপ মেরে গেছে হায়েনার দল।
জলদি, মেরেন। যাও, দেখ কী হচ্ছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা।
ঘনায়মান অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল মেরেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে পাহাড় থেকে ওর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল; বুনো চিৎকার ছাড়ছে। লাফিয়ে উঠল তাইতা, দৌড়ে গেল ওর কাছে। মেরেন, কোথায় তুমি?
এখানে, ম্যাগাস।
সোয়েকে যেখানে গেঁথে রেখেছিল ওরা, সেখানেই মেরেনকে পেল তাইতা, কিন্তু গায়েব হয়ে গেছে লোকটা। কী হয়েছে, মেরেন? কী দেখছ?
ডাকিনীবিদ্যা! তোতলাতে তোতলাতে বলল মেরেন। দেখলাম- থেমে গেল ও, কী দেখেছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
ব্যাপারটা কী? তাগিদ দিল তাইতা। জলদি বলো।
ঘোড়ার মতো বিশাল এক হায়েনা, ওটার পিঠে বসে আছে সোয়ে। নিশ্চয়ই তার পরিচিত হবে। ছুটে পহাড়ে চলে গেছে ওটা, সাথে করে নিয়ে গেছে ওকে। ওদের পিছু ধাওয়া করব? ধরতে পারবে না, বলল তাইতা। বরং মারাত্মক বিপদে ফেলে দেবে নিজেকে। যতটা ভেবেছিলাম, সোয়েকে উদ্ধার করতে ইয়োস তারচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে। এযাত্রা যেতে দাও ওকে। অন্য কোনও সময়, ভিন্ন কোথাও ওর সাথে ফয়সালা করব আমরা।
উটচালকরা চলার গতি বাড়ালেও এখনও অধৈর্য হয়ে রয়েছে তাইতা। পরের রাতে আবার কাফেলা ছেড়ে সামনে চলে গেল ও, আশা করছে ডেল্টার ঢালে পৌঁছে বহু বছরের অনুপস্থিতির পর আবার প্রাণপ্রিয় মিশরের দিকে এক নজর তাকাবে। ওর আগ্রহ যেন সংক্রামক, কারণ দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে উইন্ডস্মোকও, ওটার ছুটন্ত খুর এক সময় শেষ দূরত্বটুকুও পার হয়ে এলো। ঢালের কিনারায় এসে লাগাম টানল তাইতা। নিচে চাঁদের আলো রূপালি অলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে কৃষি জমিন, স্পষ্ট করে তুলেছে নীলের সীমানায় দাঁড়ানো পামগাছগুলো। রূপালি জলের ক্ষীণতম ঝিলিকের খোঁজে চোখ চালাল ও। কিন্তু এই দূরত্বে নদীর তলদেশ অন্ধকার, গম্ভীর।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মেয়ারের নাকের কাছে এসে দাঁড়াল তাইতা, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ চোখে শহর, চাঁদের মতো শাদা মন্দির প্রাচীর, কারনাকের প্রাসাদগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওপারে মেমননের প্রাসাদের আকাশছোঁয়া দেয়াল খুঁজে বের করলেও ঢাল বেয়ে নেমে পলিমাটির সমতল পার হয়ে থেবসের শত শত তোরণের যেকোনও একটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন ঠেকাল।
দিমিতারের খুব কাছে থাকা ওর দায়িত্ব, ওকে ফেলে সামনে ছুটে যাওয়া নয়। মেয়ারের মাথার কাছে গোড়ালির উপর বসল ও। তারপর ঘরে ফেরা ও প্রাণের প্রিয় সবার সাথে পুনর্মিলনের দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল।
ফারাও ও রানি মিনতাকা ওকে খুবই সমাদর করেন, সাধারণত রাজ পরিবারের উধ্বর্তন সদস্যদের জন্যেই এমনি সমাদর তোলা থাকে। বিনিময়ে ওদের দুজনের জন্যেই অনুগত ভালোবাসা লালন করে ও। ছেলেবেলা থেকেই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা। নেফারের বাবা ফারাও তামোজ নেফার খুব ছোট থাকতে খুন হন, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার পক্ষে খুবই ছোট ছিলেন তিনি; তাই একজন রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তামোজের শিক্ষক ছিল তাইতা, সুতরাং তার সন্তানকে সাবালকত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত ওর হাতে তুলে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ওর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটি দেখেছে তাইতা, ওকে ঘোরসওয়ার আর যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারপর যুদ্ধ পরিচালনা ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার কৌশল শিখিয়েছে। রাজকীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও কূটনীতি শিখিয়েছে। পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে। অনেক বছরের পরিক্রমায় ওদের দুজনের মাঝে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, অবিচ্ছেদ্য রয়ে গেছে সেটা।
ঢাল বেয়ে হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ধেয়ে এলো। ওর শরীর শিউরে তোলার মতো যথেষ্ট শীতল। এই উত্তপ্ত মৌসুমে অস্বাভাবিক। নিমেষে সতর্ক হয়ে গেল ও। অনেক সময় তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস অতিলৌকিক প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে কাজ করে। দিমিতারের সতর্কবাণী এখনও ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলছে।
অটল বসে থেকে ইথারে অনুসন্ধান চালাল ও। খারাপ কিছুর আলামত পেল না। এবার উইন্ডস্মোকের দিকে মনোযোগ দিল ও। প্রাণীটা ওর মতোই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে দারুণ স্পর্শকাতর। কিন্তু ওটাকে যেন শান্ত ও স্থির দেখাল। সম্ভষ্ট হয়ে ফের উঠে দাঁড়াল ও, মেয়ারের পিঠে উঠতে লাগাম হাতে তুলে নিল। কাফেলার কাছে ফিরে যাবে। এতক্ষণে মেরেন হয়তো রাতের মতো যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিয়েছে; তাঁবু খাটাচ্ছে। ঘুম ওকে দখল করে নেওয়ার আগেই দিমিতারের সাথে আরও খানিকক্ষণ আলাপ করতে চায়। এখনও বুড়ো মানুষটার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ আদায় করতে পারেনি।
ঠিক এই সময় মৃদু স্বরে ডেকে উঠল উইন্ডস্মোক, কানজোড়া খাড়া করে ফেলল; তবে তেমন সিরিয়াসভাবে সতর্ক মনে হলো না। ওটাকে ঢাল বরাবর নিচের দিকে তাকাতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। প্রথমে কিছুই দেখতে না পেলেও মেয়ারের উপর আস্থা থাকায় রাতের নীরবতায় কান পেতে রইল। অবশেষে ঢালের পাদদেশে একটা ছায়াটে নড়াচড়া ধরা পড়ল। নিমেষে উধাও হয়ে গেল সেটা। তাইতা ভাবল কোথাও ভুল হয়েছে ওর, কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দিল না। অপেক্ষা করল, তাকিয়ে আছে সতর্ক চোখে। এবার আবার নড়াচড়াটা চোখে পড়ল। আরও অনেক কাছে, অনেক স্পষ্ট।
অন্ধকারে ফুটে উঠল আরেক অশ্বারোহীর আবছা ছায়া। ঢাল অনুসরণ করে ওর অবস্থানের দিকে উঠে আসছে। অচেনা ঘোড়াটা ধূসর হলেও উইন্ডস্মোকের তুলনায় ফ্যাকাশে। তরঙ্গ উঠল ওর স্মৃতিতে, ভালো ঘোড়ার কথা কখনও ভোলে না ও। ওটাকে কবে, কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি অনেক দূরবর্তী হওয়ায় ধরে নিল নিশ্চয়ই অনেক আগের ব্যাপার হবে। অথচ ধূসর ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে মাত্র বছর চারেক হবে ওটার বয়স। চট করে ওটার পিঠে আসীন সওয়ারির দিকে মনোযোগ দিল ও-আবছা একটা অবয়ব, পুরুষ নয়, বরং কিশোরই হবে হয়তো। সে যেই হোক, ঘোড়ার পিঠে সহজ সজীব ভঙ্গিতে বসেছে। ছেলেটার হাবভাবে পরিচিত একটা ভাব আছে, তবে ওর বাহনের মতোই তারও বয়সও তাইতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পক্ষে বেশ কম। এমন কি হতে পারে এই ছেলেটি ওর পরিচিত কারও সন্তান? মিশরের কোনও রাজকুমার? বিভ্রান্ত্র বোধ করল ও।
রানি মিনতাকা ফারাও নেফার সেতিকে অনেক কটি অসাধারণ ছেলে উপহার দিয়েছেন। সবার সাথেই বাবা বা মায়ের চেহারার ভালো মিল রয়েছে। এই ছেলেটার মাঝে মামুলি কোনও ব্যাপার নেই। ওর শরীরে রাজকীয় রক্ত বয়ে যাবার ব্যাপারে তাইতার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। আরও কাছে এলো ঘোড়া ও সওয়ারি। এবার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তাইতার। লক্ষ করল, সওয়ারি একটা খাট চিতন পরে আছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তার পাজোড়া। সরু, সন্দেহাতীতভাবে নারীসুলভ পা। ওটা একটা মেয়ে। ওর মাথা আড়াল করা। কিন্তু মেয়েটা কাছে আসার পর শালের নিচে ওর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারল।
ওকে আমি চিনি। ভালো করে চিনি! আপনমনে ফিসফিস করে বলল ও। কানের কাছে নাড়ীর গতি দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত উঁচু করল মেয়েটা, তারপর সামনে কোমর বাড়িয়ে আগে বাড়ার তাগিদ দিল ঘোড়াকে। দুলকি চালে এগোতে শুরু করল ওটা। কিন্তু পাথুরে পথে এতটুকু আওয়াজ করছে না ওটার খুর। অলৌকিক নীরবতায় ঢাল বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওটা।
দেরি হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে তাইতা, পরিচিত চেহারায় ওকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দ্রুত চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খোলার প্রয়াস পেল ও।
কোনও আভা বিলোচ্ছে না! ঢোক গিলল ও। মেয়ারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ধূসর ঘোড়া বা ওটার সওয়ারির কেউই স্বাভাবিক প্রাণী নয়। ভিন্ন মাত্রা থেকে এসেছে ওরা। দিমিতারের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফের অসতর্ক অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে ও। চট করে গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল। মুখের সামনে তুলে ধরল ওটা। লাগাম টানল সওয়ারি, মুখ ঢেকে রাখা শালের ছায়া থেকে জরিপ করতে লাগল ওকে। মেয়েটা এখন এত কাছে যে তার চোখের ঝিলিক, তরুণ গালের কোমল বাঁক দেখতে পাচ্ছে ও। স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মনে।
ধূসর ঘোড়াটার কথা এত পরিষ্কার মনে থাকাটা তেমন বিস্ময়ের কিছু নয়। ও ই উপহার দিয়েছিল। সযত্নে, দরদের সাথে বাছাই করা। ওটার বিনিময়ে পঞ্চাশটি রূপার তালেন্ত দিয়েছিল ও, তখন ভেবেছিল দরাদরিতে জিতেছে। ওটার নাম দিয়েছিল গাল, সব সময়ই ওর প্রিয় পশু ছিল ওটা। জাকের সাথে কায়দা করে ওটার পিঠে সওয়ার হতো ও। অনেক দশক আগের কথাগুলো মনে আছে তাইতার। এত প্রবল ছিল ওর ধাক্কাটা যে স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছিল না ও। স্রেফ গ্রানিট পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঢালের মতো ধরে রেখেছে মাদুলিটা।
ধীরে ফর্শা একটা হাত উঁচু করল ঘোড়সওয়ার, শালের কিনারা সরাল। ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকানোর সময় তাইতার মনে হলো ওর আত্মাটাকে বুঝি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে আছে।
সে নয়। নিজেকে স্থির রাখার প্রয়াস পেল তাইতা। বিরাট সাপটার মতো শূন্য থেকে আসা আরেকটা প্রেতাত্মা, সম্ভবত সমান ভয়ঙ্কর।
স্বপ্নে দেখা সোনালি ডলফিনের পিঠের সেই মেয়েটা সম্পর্কে দিমিতারের সাথে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ ছিল না তার। আপনার স্বপ্ন ডাইনীটার চাতুরী ছাড়া আর কিছুই না, ওকে সতর্ক করে বলেছিলেন তিনি। আপনার আকাক্ষা ও আশাকে জাগিয়ে তোলা কোনও ইমেজকে বিশ্বাস করতে যাবেন না। যখনই পুরোনো ভালোবাসার মতো কোনও সূখকর স্মৃতিকে আপনার মনে জাগতে দিচ্ছেন, ইয়োসের জন্যে রাস্তা খুলে দিচ্ছে সেটা। আপনার কাছে। পৌঁছাতে এর ভেতর দিয়ে পথ বের নেবে সে।
মাথা নেড়েছিল তাইতা। না, দিমিতা, এমনকি ইয়োসই বা কেমন করে অতদিন আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত জিনিস ফুটিয়ে তুলবে? লস্ত্রিসের কণ্ঠস্বর, ওর চোখের গড়ন, হাসার সময় ওর ঠোঁটের কম্পন। কেমন করে ইয়োস তার অনুকরণ করবে? সত্তর বছর ধরে সমাধিতে আছে লস্ত্রিস। ইয়োস নকল করার মতো এমন কোনও সজীব চিহ্ন নেই ওর।
ইয়োস আপনার স্ক্রিসের স্মৃতি চুরি করেছে। তারপর ওগুলোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আকর্ষণীয় রূপে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এমনকি আমিও তো বেশির ভাগ খুঁটিনাটি জিনিস ভুলে গেছি।
আপনি নিজেই তো বলেছেন, আমরা কিছুই ভুলে যাই না। সবই রয়ে যায়। আপনার মন থেকে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনতে কেবল অতিলৌকিক দক্ষতার প্রয়োজন, ইয়োসের তা আছে। যেমন করে আপনি আমার মনের ভেতর থেকে ইয়োসের স্মৃতি, ওর কণ্ঠস্বর বের করে এনেছেন, যখন সে অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিল।
ওটা লস্ত্রিস ছিল না, আমি মেনে নিতে পারব না, মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠেছিল তাইতা।
তার কারণ আপনি মানতে চান না। ইয়োস আপনার যুক্তিবোধ অন্ধ করে দিতে চাইছে। একটু ভেবে দেখুন, ডলফিনের পিঠে মেয়েটার ইমেজ কীভাবে তার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হয়েছিল। সে যখন আপনাকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কুহকী দৃশ্য দেখিয়ে বিক্ষিপ্ত ও প্রলুব্ধ করছিল ঠিক তখন আমাকে শেষ করে দিতে সাপটাকে পাঠিয়েছিল। আপনার স্বপ্নকে বিক্ষিপ্ত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।
এখন ডেল্টার ঢালে ফের সেই একই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে তাইতা: লস্ত্রিসের ইমেজ, মিশরের এককালের রানি, যার স্মৃতি আজও ওর হৃদয় দখল করে আছে। এইবার ওকে আরও বেশি নিখুঁত মনে হচ্ছে। টের পেল ওর স্থিরতা ও যুক্তিবোধ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেল। কিন্তু লক্ট্রিসের চোখের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ওখানে আমোদিত আলো ঝলমল করছে। ওগুলোর গভীরতায় সারা জীবনের সকল আনন্দ বেদনার অশ্রু।
তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি! যতটা সম্ভব শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বলল তাইতা। তুমি লস্ত্রিস নও। আমার ভালোবাসার নারীটি তুমি নও। তুমি আসলে মহামিথ্যা। যেই অন্ধকার থেকে এসেছ সেই অন্ধকারে আবার ফিরে যাও।
ওর কথায় লস্ত্রিসের চোখের কমনীয় ঝিলিক বদলে গিয়ে সেখানে অসীম বিষাদ এসে ভর করল। প্রিয় তাইতা, মৃদু কণ্ঠে ওকে ডাকল সে। আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে তোমাকে ছাড়াই বন্ধ্যা ও নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। এখন তোমার এমন এক লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিপদের মুহূর্তে আবার তোমার সাথে এক হতে ফিরে এসেছি। আমরা একসাথে তোমার উপর নেমে আসা অশুভকে ঠেকাতে পারব।
তুমি ধর্মের অপমান করছ, বলল তাইতা। তুমি ইয়োস, মিথ্যা। তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। সত্য আমাকে রক্ষা করছে। আমার কাছে আসতে পারবে না তুমি। আমার ক্ষতি করতে পারবে না।
ওহ, তাইতা, ফিসফিস করে বলে উঠল লস্ত্রিস। আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে তুমি। আমি নিজেও বিপদে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময়ের সূচনা থেকে মানুষের সকল বিষাদ এসে ভর করেছে ওর উপর। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাদের দুজনের স্বার্থেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তোমার ভালোবাসার সেই লস্ত্রিস ছাড়া অন্য কেউ নই-তোমাকে যে ভালোবেসেছিল। ইথারের ভেতর দিয়ে আমাকে আহ্বান করেছ তুমি। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছি আমি।
পায়ের নিচে পৃথিবীর ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠা টের পেল তাইতা। কিন্তু নিজেকে স্থির করল ও। দূর হও, অভিশপ্ত ডাইনী! চিৎকার করে উঠল ও। ভাগো, মিথ্যার দুষ্ট দাস। তোমাকে ও তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।
না, তাইতা! এমন করতে পারো না তুমি, আবেদন জানাল লস্ত্রিস। আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না তুমি।
তুমি অশুভ, কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিভীষিকা। নিজের জঘন্য আস্তানায় ফিরে যাও।
গুঙিয়ে উঠল লস্ত্রিস, মিলিয়ে যেতে শুরু করল ওর ইমেজ। দিনের আলোয় যেভাবে প্রায়ই ওর তারাটি মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবে মিলিয়ে গেল লস্ত্রিসের ছায়া। রাতের আঁধার থেকে ওর শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: একবার মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছি আমি, এবার আমাকে পুরোটা হজম করতে হবে। বিদায়, তাইতা। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে যদি।
পরক্ষণেই হারিয়ে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাইতা, মাথার উপর দিয়ে ভেঙে পড়া অনুতাপ আর বিষাদের ঢেউ বয়ে যেতে দিল। আবার যখন মাথা তোলার মতো শক্তি ফিরে পেল, তখন সূর্য উঠেছে। এরই মধ্যে দিগন্তের হাত খানেক উপরে উঠে এসেছে ওটা। শান্তভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক। ঝিমোচ্ছে। কিন্তু খোঁচা দিতেই মাথা ওঠাল ওটা, ফিরে তাকাল ওর দিকে। এত খাট হয়ে গেছে ও যে ওটার পিঠে উঠতে একটা পাথরের সাহায্য নিতে হলো। পিঠে বসে দুলতে লাগল ও। ঢালের পথের দিকে এগোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।
মাথা ভরে রাখা আবেগের জগাখিচুরির জঙ্গল গোছানোর প্রয়াস পেল তাইতা। ওর বিভ্রান্তি থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে এলো: ভূতুড়ে লস্ত্রিসের সাথে ওর সাক্ষতের সময় উইন্ডস্মোকের শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, এতটুকু অস্থির হয়নি ওটা। অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বোঝার বেশ আগেই অশুভের প্রকাশের ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠেছে। চাঁদ গ্রস্ত হওয়ার সময় ছুটে গিয়েছিল, অথচ লস্ত্রিসের ছায়ামূর্তি ও ওর ভূতুড়ে সত্তার প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে।
ওসবের ভেতর অশুভ থাকতে পারে না, নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল ও। লস্ত্রিস সত্যি কথা বলেছিল? আমাকে রক্ষা করতেই কি বন্ধু ও মিত্র হিসাবে এসেছিল ও? আমি কি আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করে দিলাম? এক অসহনীয় ব্যথা এটা। উইন্ডস্মোকের মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্ণ গতিতে ডেল্টার দিকে ছোটাল। কেবল ঢালের কিনারা থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরেই সামলাল নিজেকে। লস্ত্রিস যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক সেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।
লস্ত্রিস! আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকল ও। আমাকে ক্ষমা করো! ভুল করেছি! এখন জানি তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি সত্যিই লস্ত্রিস। ফিরে এসো, প্রিয়া আমার! ফিরে এসো! কিন্তু লস্ত্রিস চলে গেছে। প্রতিধ্বনি যেন ওকে ভেঙচি কাটছে: ফিরে এসো…এসো..এসো…
*
ওরা পবিত্র থেবস নগরীর অনেক কাছে এসে পড়ায় সূর্য ওঠার পরেও রাতের যাত্রা চালিয়ে যেতে মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। ভোরের তীর্যক আলোক রশ্মিতে আলোকিত ক্ষুদে কাফেলা ঢাল থেকে নেমে সমতল পলিমাটির জমিনের উপর দিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে এগোল। কালো মাটি শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে, রোদের কড়া আঁচে ফেটে চৌচির। কৃষকরা আক্রান্ত জমিন ছেড়ে চলে গেছে, বেহাল দশা হয়েছে ওদের কুঁড়েগুলোর। কড়িকাঠ থেকে থোকায় থোকায় খসে পড়ছে তালপাতার ছাউনী। জমিনের এখানে ওখানে শাদা ডেইজি ফুলের মতো পড়ে আছে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো কাইনের হাড়গোড়। ঘূর্ণী হওয়ার একটা ঝাপ্টা বয়ে যাবার পথে বিরান জমিনের উপর নাচতে নাচতে ধূলি ও শুকনো ধুরা পাতার একটা স্তম্ভ ছুঁড়ে দিল মেঘহীন আকাশের দিকে। বন্ধ্যা জমিনের উপর যুদ্ধ কুঠারের আঘাতের মতো আঘাত হেনে চলেছে সূর্য।
বিরূপ ল্যান্ডস্কেপে কাফেলার মানুষ আর পশুগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার মতোই গুরুত্বহীন। নদীর কাছে পৌঁছে নিজেদের অজান্তেই তীরে থমকে দাঁড়াল ওরা। ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হলো। এমনকি দিমিতারও নেমে পড়েছেন পালকি থেকে। তাইতা ও মেরেনের সাথে যোগ দিতে কোনওমতে আগে বাড়লেন তিনি। নদীটা এখানে মাত্র চারশো গজ চওড়া। স্বাভাবিক ভাটার মৌসুমেও মহানদী নীলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধূসর পলিমাটি ভরা পানিতে ভরপুর থাকে, এত গভীর ও শক্তিশালী যে জলের উপরিতল ঝলমলে ফেনায় ভরে থাকে, অসংখ্য ঘূর্ণীর গহ্বর চোখে পড়ে। বানের মৌসুমে নীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তীর উপচে উঠে এসে জমিন ভাসিয়ে দেয়। এর জলের সাথে ভেসে আসা সমৃদ্ধ কাদা ও পলিমাটি এক মৌসুমেই তিনটা ফসল ধরে রাখতে পারে।
কিন্তু আজ সাত বছর ধরে বানের দেখা নেই। এখন নদীটা অতীত শক্তিশালী সত্তার একটা ভূতুড়ে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণ পুঁতিগন্ধময় নালায় পর্যবসিত হয়েছে ওটা, তলদেশ বরাবর ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে। কেবল মৃত্যুমুখী মাছ ও অল্প কয়েকটা জীবিত কুমীরের কষ্টকর নড়াচড়ার কারণে সেই জলে কিঞ্চিত তরঙ্গ উঠছে। জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল ফেনাময় আবর্জনা ঢেকে রেখেছে জলের উপরিভাগ।
নদীর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কেন? জানতে চাইল মেরেন। এটা একটা অভিশাপ!
আমার মনে হয় বিষাক্ত শ্যাওলার জন্যেই এমন হয়েছে, বলল তাইতা, সায় দিলেন দিমিতার।
শ্যাওলাই বটে, তবে এটা যে অস্বাভাবিক তাতে আমার একটুকু সন্দেহ নেই, জলের ধারা থমকে দেওয়া একই অশুভ প্রভাবের কারণেই আবির্ভূত।
কলো কাদার চরে রক্ত-রঙ পুকুরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। নগরের বজ্য ও আটকে পড়া আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলো। আছে শেকড়বাকড়, ভেসে আসা কাঠ, পরিত্যক্ত ফেরি নৌকার ধ্বংসাবশেষ, পাখি ও পশুর ফুলে ওঠা মৃতদেহ। উন্মুক্ত বালিচরে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র জীবিত প্রাণীগুলো হচ্ছে অদ্ভুত দর্শন বেঁটে কিছু জানোয়ার, মরদেহের দখল পেতে ভৌতিক জোড়া লাগানো পায়ে আনাড়ী ভঙ্গিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। টেনে পচা মাংসের চাক ছিঁড়ছে, তারপর গিলে নিচ্ছে। গভীর বিতৃষ্ণায় বিড়বিড় করে উঠল মেরেন, কাফেলার সর্দার যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম: দানবীয় কুনো ব্যাঙ! তারপরই কেবল ওগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল তাইতা। গলা খাকারি দিয়ে গলায় জমে ওঠা শ্লেষা ঝাড়ল ও। মিশরের উপর নেমে আসা অশুভ প্রভাবের কি শেষ নেই?
তাইতা বুঝতে পারল উভচরগুলোর আকারই ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। বিশাল আকারের। পিঠের হিসাবে বুনো শুয়োরের মতোই মোটা, পেছন পায়ে ভর দিয়ে সম্পূর্ণ খাড়া হলে রীতিমতো শেয়ালের সমান লম্বা মনে হচ্ছে।
কাদার ভেতর মানুষের লাশ পড়ে আছে, বলে উঠল মেরেন। ওদের ঠিক নিচেই পড়ে থাকা একটা ছোট্ট দেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও। মৃত শিশুও আছে।
মনে হচ্ছে থেবসের নাগরিকরা এতটাই নির্বিকার হয়ে গেছে যে এখন লাশ কবর না দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, বিষাদের সাথে ঘাড় নেড়ে বললেন দিমিতার।
ওরা তাকিয়ে থাকার সময়ই একটা ব্যাঙ বাচ্চাটার হাত কামড়ে ধরে দশ বার বার ঝাঁকি দিয়ে কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ছোট্ট বাহুটা। নেমে আসতেই মুখ হাঁ করে গিলে নিল টুপ করে।
দৃশ্যটা দেখে সবাই অসুস্থ বোধ করল। ফের ঘোড়ায় চেপে তীর বরাবর এগিয়ে নগরের বহিপ্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বাইরের এলাকা ভূমিহীন কৃষক, বিধবা ও এতিম, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও বিপর্যয়ের অন্য সব শিকারের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরা। পাতার তৈরি খোলা চালার নিচে জড়োসড়ো অবস্থায় রয়েছে ওরা। সবাই বিশীর্ণ ও করুণ চেহারার। এক তরুণী মাকে দেখল তাইতা, কোলের বাচ্চাটার মুখে শূন্য বুক ছুঁইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাচ্চাটা এতই দুর্বল, চুষতে পারছে না। ওর চোখেমুখে মাছি ঢুকে পড়ছে। ওদের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে মা।
ওর বাচ্চার জন্যে ওকে খাবার দিয়ে আসি, বলে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামতে গেল মেরেন। কিন্তু ওকে বাধা দিলেন দিমিতার।
এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে এখন খাবার দেখালেই রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যাবে।
আবার আগে বাড়ার সময় বিষণ্ণ, অপরাধী চেহারায় পেছনে তাকাতে লাগল মেরেন।
দিমিতার ঠিকই বলেছেন, মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। এত অসংখ্য ক্ষুধার্তের অল্প কয়েকজনকে বাঁচাতে পারব না আমরা। বাঁচাতে হবে মিশরকে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক নয়।
হতভাগাদের কাছ থেকে বেশ দূরে শিবির ফেলার জায়গা বেছে নিল তাইতা ও মেরেন। দিমিতারের ফোরম্যানকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমার গুরু যেন আরামে থাকে সেটা খেয়াল করো, ওকে ভালো করে পাহারা দেবে। তারপর চোর-ডাকাত ঠেকাতে শুকনো কাঁটাঝোঁপের বেড়া বানাবে। পশুগুলোর জল আর খাবারের যোগাড় করো। আরও জুৎসই থাকার ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।
মেরেনের দিকে ফিরল ও। শহরে ফারাওয়ের প্রসাদে যাচ্ছি আমি। দিমিতারের সাথে থাক। জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেয়ারের পেটে লাথি মারল ও। মূল তোরণের দিকে রওয়ানা দিল। ও এগিয়ে যাওয়ার সময় টাওয়ার থেকে তাকিয়ে রইল প্রহরীরা, তবে চ্যালেঞ্জ করল না। পথঘাট বলতে গেলে বিরান। অল্প যে কজনকে চোখে পড়ছে তারাও দেয়ালের ওপাশের ভিখিরিদের মতোই ফ্যাকাশে, ক্ষুধার্ত। ওকে আসতে দেখেই সটকে পড়ছে। শহরের মাথার উপর যেন অসুস্থ একটা গন্ধ ঝুলে আছে, মৃত্যু ও কষ্টের গন্ধ।
প্রাসাদ প্রহরীদের সর্দার চিনতে পারল ওকে। তোরণ খুলে দিতে ছুটে এলো সে। ও ভেতের ঢুকতেই সমীহের সাথে সালাম ঠুকল।
আমার লোক ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে যাবে, ম্যাগাস। রাজকীয় সহিসরা ওটার দেখভাল করবে।
ফারাও বাড়িতে আছেন? ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় জানতে চাইল তাইতা।
জ্বি, আছেন।
ওর কাছে নিয়ে চলো আমাকে, নির্দেশ দিল তাইতা। দ্রুত হুকুম তামিল করল প্রহরী। প্যাসেজ ও হলওয়ের গোলকধাঁধা ধরে এগিয়ে চলল ওকে নিয়ে। উঠোনের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা, এককালে আঙ্গিনা, ফুলের কেয়ারি আর নির্মল জলের ফোয়ারার সমাহারে অসাধারণ ছিল জায়গাটা। তারপর হল ও ক্লয়েস্টারের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল, এক সময় অভিজাত নারীদের হাসিঠাট্টা, গান, ট্রাম্বলার, এবোলদার আর দাসীনর্তকীদের গানে মুখরিত থাকত। কামরাগুলো খাখা করছে এখন। বাগান বাদামী হয়ে মরে গেছে। ফোয়ারা শুকিয়ে কাঠ। চেপে বসা নীরবতা কেবল পাথুরে পথের উপর ওদের পায়ের আওয়াজে ছিন্ন হচ্ছে।
অবশেষে রাজকীয় দরবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে পৌঁছাল ওরা। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা বন্ধ দরজা। বর্শার গোড়া দিয়ে ওটায় টোকা দিল প্রহরী। প্রায় নিমেষে একজন দাস খুলে ধরল ওটা। ওর পেছনে তাকাল তাইতা। গোলাপি মাৰ্বল পাথরের মেঝেয় একটা ছোট ডেস্কের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে স্থূলদেহী এক খোঁজা। টেবিলে স্কুল আর পাথরের ফলকের স্তূপ। এক মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল তাইতা। ফারাওর প্রবীন চেম্বারলেইন, তাইতার সুপারিশেই এমন উচ্চ পদে নিয়োগ পেয়েছিল সে।
রামরাম, পুরোনো বন্ধু আমার, ওকে শুভেচ্ছা জানাল তাইতা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রামরাম, এমন বিশালদেহী লোকের পক্ষে বিস্ময়কর ক্ষিপ্র তার চলাফেরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলো। ফারাওর সেবায় নিয়োজিত খোঁজারা এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
তাইতা, অনেক দিন থেবসের বাইরে ছিলে তুমি, তাইতাকে ব্যক্তিগত এটা ব্যুরোতে নিয়ে এলো সে। সেনাপতিদের সাথে সভায় বসেছেন ফারাও, তাই ওকে এখন বিরক্ত করতে পারছি না। তিনি অবসর পাওয়ামাত্রই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তিনি তাই চাইবেন। এতে অবশ্য কথা বলার একটা সুযোগ মিলে গেছে। কতদিন হলো দূরে আছো তুমি? অনেক বছর নিশ্চয়ই।
সাত বছর। শেষবার আমাদের দেখা হওয়ার পর বহু অজানা দেশ ঘুরেছি আমি।
তাহলে তো তোমার অবর্তমানে আমাদের উপর নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে তোমাকে জানানো দরকার। দুঃখের কথা, ভালো সংবাদ তেমন একটা নেই।
একটা কুশনে মুখোমুখি বসল ওরা। চেম্বারলেইনের ইশারায় এক দাস মাটির কলসীতে ঠাণ্ডা করা শরবত পরিবেশন করল ওদের।
আগে বলো, মহামান্য আছেন কেমন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তাইতা।
আমার ভয় হচ্ছে, ওকে দেখে খারাপ লাগবে তোমার। নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি। বেশিরভাগ দিন মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আর নোম গভর্নরের সাথে সভা করে কাটাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাচ্ছেন। নদীর লাল আবর্জনা দূর করতে নতুন করে কুয়ো খননের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামরাম, শরবতের বাটিতে লম্বা একটা চুমুক দিল সে।
মেদিয় ও সুমেরিয়রা, সাগরবাসী, লিবিয় ও অন্য শক্ররা আমাদের দুর্দশার কথা জানে, খেই ধরল সে। ওদের বিশ্বাস আমাদের সুসময় ফুরোতে চলেছে। তাই নিজেদের সেনাদলকে তৈরি করছে ওরা। তুমি তো জানো, আমাদের করদ রাজ্য ও আশ্রিত দেশগুলো বরাবরই ফারাওকে মেটাতে বাধ্য হওয়া দক্ষিণার ব্যাপারে বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। অনেকেই আমাদের এই দুর্ভাগ্যকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ মনে করছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্যে মৈত্রী গড়ে তুলছে তারা। আমাদের সীমান্তে বহু শত্রু সমাবেশ ঘটিয়েছে। আমাদের সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ফারাওকে অবশ্যই নিজ বাহিনী শক্তিশালী করে তুলতে রসদ আর মানুষ যোগাড় করতে হবে। নিজেকে যারপরনাই কষ্ট দিচ্ছেন তিনি, তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।
ছোটখাট অন্য কোনও রাজা হলে এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন না, বলল তাইতা।
নেফার সেতি মহান রাজা। কিন্তু আমাদের সবার মতো তিনিও অন্তর থেকে জানেন দেবতারা এখন আর মিশরের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। যতক্ষণ ঐশী আশীর্বাদ ফিরে না পাচ্ছেন ততক্ষণ তার কোনও প্রয়াসই সাফল্যের মুখ দেখবে না। দেশের সমস্ত মন্দিরের পুরোহিত সমাজকে অবিরাম প্রার্থনা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিজে দিনে তিন বার বলী দিচ্ছেন। নিজের শক্তিকে শেষ সীমায় টেনে নিয়ে গেলেও রোজ অর্ধেক রাত জেগে থাকছেন। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সতীর্থ দেবতাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রার্থনা করার পেছনে সেই সময় পার করছেন।
জলে ভরে উঠল চেম্বারলেইনের চোখ। লিনেনের কোণ দিয়ে মুছল সে। আমাদের উপর নেমে আসা নদী মাতার পতন আর নানা প্লেগে আক্রান্ত গত সাত বছর এভাবেই কাটছে তার জীবন। সাধারণ কোনও রাজা হলে ধ্বংস হয়ে যেতেন। নেফার সেতি একজন দেবতা, কিন্তু তার হৃদয় ও আবেগ মানুষের মতো। ফলে তিনি বদলে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন।
এ খবর শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বলো তো, রানি ও তাঁর সন্তানরা কেমন আছেন?
এখানেও খবর তেমন সুবিধার নয়। প্লেগ ওদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। রানি মিনতাকা অসুস্থ হয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ প্রায় মরণোন্মুখ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এখন সেরে উঠেছেন অবশ্য। তবে অনেক দুর্বল। রাজকীয় সন্তানদের সবার এমন সৌভাগ্য হয়নি। রাজকুমার খাবা ও তাঁর ছোট বোন উনাস রাজকীয় স্মৃতিসৌধে এখন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। প্লেগ ওদের কেড়ে নিয়েছে। অন্য সন্তানরা বেঁচে গেলেও-
একজন দাস নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঢুকতেই থেমে গেল রামরাম। চেম্বারলেইনের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল সে। মাথা দোলাল রামরাম, ইশারায় বিদায় করে দিল তাকে। তারপর ফের তাইতার দিকে ফিরল। গোপন সভা শেষ হয়েছে। ফারাওর কাছে তোমার আগমনসংবাদ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর পা টেনে টেনে কামরার পেছন দিকে চলে গেল। ওখানে একটা প্যানেলে খোদাই করা একটা অবয়ব স্পর্শ করল সে। ওর আঙুলের স্পর্শে ঘুরে গেল ওটা। দেয়ালের একটা অংশ সম্পূর্ণ সরে গেল। খোলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল রামরাম। তার অল্পক্ষণ পরেই গোপন দরজার ওপাশের করিডর থেকে বিস্ময় ও খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল দ্রুত পায়ের আওয়াজ। এরপর চিৎকার: তাতা, কোথায় তুমি? ওকে দেওয়া ফারাওর ডাক নাম এটা।
জাঁহাপনা, আমি এখানে।
অনেক দিন আমাকে উপেক্ষা করেছ তুমি, দরজা গলে বের হয়ে আসার সময় ওকে অভিযুক্ত করলেন ফারাও, তাইতার দিকে তাকাতে থমকে দাঁড়ালেন। সত্যিই তো তুমি। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আগের সমনের মতো এবারও অগ্রাহ্য করে যাবে।
হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের একটা লিনেনের স্কার্টের সাথে স্রেফ একজোড়া উন্মুক্ত স্যান্ডেল পরেছেন নেফার সেতি। উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। চওড়া পুরু বুকের ছাতি, পেটটা স্থূলকায়, পেশি খেলা করছে। তীর আর তলোয়ারে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দুটি হাত খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো। নিখুঁত করে তোলা যোদ্ধার তাঁর গোটা ধড়।
ফারাও, আপনাকে অভিবাদন। আমি আপনার একজন তুচ্ছ দাস, সব সময়ই যা ছিলাম।
সামনে এসে ওকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন নেফার সেতি। গুরু শিষ্য যখন একসাথে হয় তখন এসব দাস-দাসত্বের কথা চলবে না, ঘোষণা দিলেন তিনি। তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। ওকে মুখের সামনে ধরলেন তিনি। চেহারা জরিপ করলেন। হোরাসের করুণায় তোমার একদিনও বয়স বাড়েনি।
আপনারও না, জাঁহাপনা। আন্তরিক স্বরে বলল তাইতা। হেসে উঠলেন নেফার সেতি।
কথাটা মিথ্যা হলেও পুরোনো বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া হিসাবে এই তোষামোদ মেনে নিচ্ছি। নেফার সেতি আনুষ্ঠানিক ঘোড়ার পশমের পরচুলা খুলে রেখেছেন, গায়ে রঙের প্রলেপ না থাকায় তাঁর বৈশিষ্ট জরিপ করতে পারছে তাইতা। নেফারের ছোট করে ছাটা চুল খাড়া হয়ে আছে, মাথার চাঁদি ন্যাড়া। সময়ের আঁচড় পড়েছে চোখেমুখে। মুখের কোণে গাঢ় রেখা দেখা দিয়েছে। গাঢ় চোখের চারপাশে বলী রেখার জাল। গায়ের ত্বকে অস্বাস্থ্যকর আভা। চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল ফারাওর আভা জোরালভাবে জ্বলছে, সাহসী হৃদয় ও অদম্য প্রাণশক্তিরই প্রতীক।
কত বয়স হলো তাঁর? মনে করার চেষ্টা করল তাইতা। বাবা নিহত হওয়ার সময় ওর বয়স ছিল বার, সুতরাং এখন তার বয়স অন্তত পক্ষে উনপঞ্চাশ। উপলব্ধিটুকু টলিয়ে দিল ওকে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই সাধারণ একজন মানুষকে বৃদ্ধ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মারা যায়। রামরাম সত্যি কথাই বলেছে। ফারাও অনেক বদলে গেছেন।
রামরাম তোমার থাকবার ব্যবস্থা করেছে? জানতে চাইলেন ফারাও, তাইতার কাঁধের উপর দিয়ে চেম্বারলেইনের দিকে তাকলেন।
ওকে বিদেশী দূতদের জন্যে তুলে রাখা একটা স্যুট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম আমি, প্রস্তাব রাখল রামরাম।
তাইতাকে কোনওভাবেই বিদেশী বলা যাবে না, ধমকে উঠলেন নেফার। তাইতা বুঝতে পারল তার আগের ভালো মেজাজ এখন তেতে উঠেছে, বেশ সহজেই ক্ষেপে উঠছেন তিনি। আমার খাস কামরার দরজার কাছে প্রহরীদের কামরাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের যেকোনও সময় পরামর্শ ও আলোচনার জন্যে ওকে কাছে পেতে চাই। ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বাবিলনের দূতের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে বিক্রি করা শস্যের দাম তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রামরাম রাষ্ট্রীয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবে তোমাকে। আশা করছি মাঝরাত নাগাদ অবসর পাব। তখন ডেকে পাঠাব তোমাকে। আমার সাথেই রাতের খাবার খেতে হবে তোমাকে, যদিও আমার ধারণা, তোমার সেটা ভালো লাগবে না। আমার নির্দেশে দেশের বাকি লোকজনের মতো দরবারও একই খাবার উপভোগ করছে। গোপন দরজা পথে ফিরে গেলেন নেফার সেতি।
জাঁহাপনা, তাইতার কণ্ঠে তাগিদের সুর। চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালেন নেফার সেতি। হড়বড় করে কথা বলে গেল তাইতা। আমার সাথে একজন মহান জ্ঞানী ম্যাগাস আছেন।
তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নয় নিশ্চয়ই, প্রশ্রয়ের সাথে হাসলেন নেফার সেতি।
ঠিক তাইতা, তার পাশে আমি শিশুর মতো। তিনি আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে সাহায্য ও রক্ষা করতে এসেছেন।
এখন সে কোথায়?
নগর প্রাচীরের বাইরে আছেন এখন। বিপুল বিদ্যা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল। আমার তার কাছাকাছি থাকা দরকার।
রামরাম, প্রাসাদের এই অংশে বিদেশী ম্যাগাসের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করো।
মেরেন ক্যাম্বিসেস এখনও আমার সঙ্গী হিসাবে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিচ্ছে। ওকে হাতের কাছে পেলে অনেক খুশি হবো।
হায় হোরাস, মনে হচ্ছে তোমার সাথে গোটা দুনিয়া ভাগাভাগি করতে হবে আমাকে, হেসে উঠলেন নেফার সেতি। অবশ্য মেরেন সুস্থ আছে শুনে খুশি হলাম, ওকে সঙ্গী হিসাবে পেতে যাচ্ছি। রামরাম ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এবার তবে যেতে হচ্ছে।
ফারাও, আপনার অসীম ধৈর্যের আরেকটা প্রত্যক্ষ নজীর, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগেই বলে উঠল তাইতা।
এখানে এসেছ বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ এর ভেতর আমার কাছ থেকে পঞ্চাশটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছ। তোমার লেগে থাকার ক্ষমতা অসীম। আর কী চাই তোমার?
নদী অতিক্রম করে রানি মিনতাকাকে অভিনন্দন জানানোর অনুমতি।
আমি প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে বৈরী অবস্থানে স্থাপন করব। আমার রানি মেজাজ হারাননি। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে হাসলেন তিনি। ওর কাছে অবশ্যই যাবে তুমি, তবে মাঝরাতের আগেই ফিরে এসো।
*
রাজপ্রাসাদে দিমিতারের থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পরপরই রাজকীয় চিকিৎসকদের দুজনকে ওর চিকিৎসার জন্যে তলব করল তাইতা। তারপর মেরেনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, রাত নামার আগেই ফিরে আসার আশা করছি, ওকে ঠিক মতো পাহারা দিয়ে।
আপনার সাথে যাওয়া উচিত আমার, ম্যাগাস। অভাব ও দুর্ভিক্ষের এমন একটা সময়ে সৎ মানুষও নিজের পরিবারের খাবারের যোগাড় করতে হতাশা থেকে রাহাজানির পথ বেছে নেয়।
রামরাম এক দল পাহারাদার দিয়েছে আমার সাথে।
নীল নদের মতো একটা নদী পেরুনোর জন্যে নৌকায় না উঠে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসাটা অদ্ভুত ঠেকল। উইন্ডস্মোকের পিঠে থেকে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল তাইতা, লক্ষ করল ঘঘালাটে পুকুরের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে। এমনি একটা পথে আগে বাড়ল ওরা। তাইতার মেয়ারের সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হলো একটা রাক্ষুসে কুনো ব্যাঙ।
মেরে ফেল! ধমকে উঠল প্রহরী দলের সর্দার। এক সৈনিক বর্শা বাগিয়ে ধরে রাস্তা ধরে ধেয়ে গেল। কোণঠাসা বুনো শূকরের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ওটা। সৈনিক সামনে ঝুঁকে কম্পিত লাল গলায় বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল। মরণ চিল্কারে বর্শার ফলার উপর চোয়াল চেপে ধরল বিশ্রী জানোয়ারটা, ফলে জানোয়ারটা ওটা না ছাড়া পর্যন্ত ঘোড়ার পিছন পিছন যেতে বাধ্য হলো সৈনিক। অবশেষে অস্ত্র মুক্ত করে নিতে পারল সে। তাইতার পাশে এসে বর্শাটা দেখাল। শক্ত কাঠের উপর ব্যাঙের দাঁতের ছাপ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।
নেকড়ের মতোই বুনো, প্রহরীদের সার্জেন্ট ছিপছিপে প্রবীন যোদ্ধা হাবারি বলল। প্রথম যখন ওদের আবির্ভাব ঘটে, নদী পরিষ্কার করে ওদের ধ্বংস করতে দুই রেজিমেন্ট সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও। তখন শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে ওদের খতম করেছি আমরা। জানালার উপর ওদের লাশ টাল দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মনে হয়েছে বুঝি একটা মারলে তার জায়গায় আরও দুটো বেড়ে উঠছে। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা অর্থহীন কাজে আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি, এখন তিনি হুকুম দিয়েছেন ওদের অবশ্যই নদীর তলদেশেই আটকে রাখতে হবে। অনেক সময় সাঁতার কেটে উঠে আসে ওরা, আমরা ফের আক্রমণ করি। বলে চলল হাবারি। ওদের নিজেস্ব বিশ্রী কায়দায় কিছুটা উপকারে আসে ওরা। নদীতে ছুঁড়ে দেওয়া সব আবর্জনা আর লাশ খেয়ে নেয়। প্লেগের শিকারের জন্যে এখন আর ভালো কবর খোঁড়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না লোকে, তো কুনো ব্যাঙের দলই মুদাফরাসের দায়িত্ব নিয়েছে।
ঘোড়াগুলো অগভীর কর্দমাক্ত পুকুরগুলোর একটায় পড়ল, পশ্চিম তীরের দিকে এগিয়ে চলল তারপর। ওরা প্রাসাদের দৃষ্টিসীমায় আসার সাথে সাথে হাঁ করে তোরণ খুলে গেল, ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো দ্বার রক্ষক।
হে মহান ম্যাগাস, স্বাগতম! তাইতাকে অভিবাদন করল সে। মহারানি থেবসে আপনার আগমনের অপেক্ষা করছেন, আপনাকে আনন্দময় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনাকে বরণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। প্রাসাদ তোরণের দিকে ইঙ্গিত করল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেয়ালের উপর ক্ষুদে ক্ষুদে অবয়ব দেখতে পেল তাইতা। নারী ও শিশু ওরা, ওর উদ্দেশে হাত নাড়ার আগে ওদের ভেতর রানি কোনজন নিশ্চিত হতে পারল না। মেয়ার আগে বাড়াল ও। সামনে লাফ দিল ওটা। খোলা তোরণ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। উঠোনে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে কিশোরীর চঞ্চলা নিয়ে নেমে এলেন মিনতাকা। আগাগোড়াই অ্যাথলিট ছিলেন তিনি, দক্ষ রথ চালক, এবং নিপূণ শিকারী। তাকে এখনও তেমনি সাবলীল দেখতে পেয়ে খুশি হলো তাই। তবে ওকে আলিঙ্গন করতে কাছে আসার পর বুঝতে পারল তিনি কতটা শীর্ণকায় হয়ে গেছেন। বাহুগুলো যেন সরু কাঠির মতো, চেহারা মলিন, ফ্যাকাশে। তিনি হাসলেও গভীর চোখজোড়ায় বিষাদের ছায়া খেলা করছে।
ওহ, তাইতা। তোমাকে ছাড়া যে কীভাবে চলেছে বোঝাতে পারব না, বললেন তিনি। ওর দাড়িতে মুখ লুকোলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাইতা। ওর স্পর্শে তার হাসিখুশি ভাবটুকু মিলিয়ে গেল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা শরীর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনও দিন ফিরবে না, নেফার আর আমি খাবা ও ছোট্ট উনাসের মতো তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।
আপনার দুঃখের কথা শুনেছি। আপনার সাথে আমিও শোকাহত, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।
সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমার মতো আরও অনেক মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে আমার কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই তিক্ত। একটু পেছনে হটে দাঁড়িয়ে হাসার প্রয়াস পেলেন তিনি। কিন্তু জলে ভরে আছে তার চোখজোড়া, ঠোঁট কাঁপছে। এসো। তোমার সাথে অন্য বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ওদের বেশির ভাগকেই চেন তুমি। শুধু সবচেয়ে ছোট দুটি তোমাকে কখনও দেখেনি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।
দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। ছেলেরা সামনের কাতারে, ওদের পেছনে মেয়েরা। বিস্ময় ও সমীহে আড়ষ্ট সবাই। ভাইবোনদের কাছে মহান ম্যাগাসের গল্প শুনে সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি এতটাই নার্ভাস ছিল যে তাইতা ওর দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড়ের উপর ওর মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলল তাইতা। সাথে সাথে সহজ হয়ে গেল সে। কান্না রেখে দুই হাতে তাইতার গলা জড়িয়ে ধরল।
বাচ্চা ও পশু ভোলানোয় তোমার নৈপূণ্যের কথা জানা না থাকলে বিশ্বাস করতাম না, ওর দিকে চেয়ে হাসলেন মিনতাকা। তারপর অন্যদের এক এক এগিয়ে আসতে বললেন।
এত সুন্দর বাচ্চা জীবনে দেখিনি আমি, রানিকে বলল তাইতা। কিন্তু আমি তাতে অবাক হইনি। মা হিসাবে আপনাকে পেয়েছে ওরা।
অবশেষে বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে তাইতার হাত ধরলেন মিনতাকা। খাস কামরায় নিয়ে এলেন ওকে। এখানে একটা ভোলা জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমের পাহাড়সারির দিকে চোখ ফেরালেন। ওকে শরবত ঢেলে দেওয়ার সময় বললেন, আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি, কিন্তু এখন আর পারি না। ওই দৃশ্য আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে শিগগিরই জল ফিরে আসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে।
কে করেছে? অলস কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা। কিন্তু উত্তরে রানি সবজান্তা, হেঁয়ালিমাখা হাসায় কৌতূহল চাগিয়ে উঠল ওর। তারপর কথোপকথন সুখের সময়ের দিকে বাঁক নিল। যখন রানি ছিলেন অল্পবয়সী, সুন্দরী কুমারী বধূ, এই দেশ ছিল সবুজ, সুন্দর। রানির মেজাজ হালকা হয়ে এলো, প্রাণবন্তভাবে কথা বলতে লাগলেন। ওকে শেষ করার সুযোগ দিল তাইতা, জানে, রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীর প্রসঙ্গে ফিরে আসতে দেরি করবেন না তিনি।
সহসা স্মৃতিচারণ থামালেন রানি। তাইতা, আমাদের দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জানো তুমি? অচিরেই এক নতুন দেবী ওদের জায়গা দখল করবেন। তাঁর হাতেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। আবার নীল নদের প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন তিনি, পুরোনো, বিধ্বস্ত দেবতারা যা পারেননি তিনি সেই প্লেগ দূর করবেন।
সমীহের সাথে শুনছে তাই। না, মহামান্যা, এটা আমার জানা ছিল না।
আরে, হ্যাঁ, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। রানির ফ্যাকাশে চেহারা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বয়স কমে এলো যেন। ফের তরুণী হয়ে উঠেছেন তিনি, আশা ও আনন্দে ভরপুর। কিন্তু, তাইতা, কথা আরও আছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ঢঙে থামলেন তিনি, তারপর ফের খেই ধরলেন। দ্রুত কথা বলছেন এখন। আমাদের যা কিছু হারিয়েছে বা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই দেবীর, কিন্তু আমরা তাঁকে পুরোপুরি মেনে নিলেই সেটা সম্ভব হবে। আমাদের মন-প্রাণ তাঁকে সঁপে দিলে, তিনি আমাদের তারুণ্য ফিরিয়ে দেবেন। যারা কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, তাদের আবার সুখী করে তুলতে পারবেন। কিন্তু, ভেবে দেখ, তাইতা-এমনকি মৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আবার তার চোখ জলে ভরে উঠল। উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হওয়ায় কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করেছে, যেন এইমাত্র লম্বা পথ দৌড়ে এসেছেন। আমাকে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন! খাবা আর উনাসের উষ্ণ, জীবন্ত শরীর ফের কোলে নিতে পারব, ওদের ছোট্ট মুখে চুমু খেতে পারব।
এই নতুন আশায় সান্ত্বনার সন্ধান থেকে রানিকে বাঞ্চিত করতে চাইল না তাইতা। এসব ব্যাপার আমাদের বোঝার মতো নয়, এতই বিস্ময়কর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।
হ্যাঁ, ঠিক! পয়গম্বরকে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা। কেবল তখনই উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ থাকতে পারবে না।
কে এই পয়গম্বর?
তাঁর নাম সোয়ে।
কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, মিনতাকা? জানতে চাইল তাইতা।
উত্তেজনায় হাতে তালি দিলেন রানি। ওহ, তাইতা, এটাই আসল কথা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আমার প্রাসাদেই আছেন! প্রাচীন দেবতা অসিরিস, হোরাস ও আইসিসের পুরোহিতদের হাত থেকে তাকে আশ্রয় দিয়েছি আমি। সত্য কথা বলার কারণে ওরা তাঁকে ঘৃণা করে। তাঁকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। রোজ আমাকে ও তার পছন্দসই লোকজনকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন তিনি। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তাইতা, এমনকি তুমিও দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না, তবে তা গোপনে শিখতে হবে। মিশর এখনও অর্থহীন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন। নতুন ধর্ম বিকাশের আগে ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাধারণ লোকজন এখনও এই নতুন দেবীকে মেনে নিতে তৈরি নয়।
চিন্তিতভাবে মাথা দোলাল তাইতা। রানির জন্যে গভীর করুণা বোধ করছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার পর লোকের বাঁচার জন্যে অর্থহীনভাবে হাওয়ায় আঁচড় কাটার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ও বোঝে। নতুন চমৎকার এই দেবীর নাম কী?
অবিশ্বাসীদের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতে পারবে না, এতই পবিত্র তিনি। কেবল যারা তাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে তারাই তার নাম মুখে নিতে পারবে। এমনকি তার নাম বলার আগে আমাকেও সোয়ের কাছে দীক্ষা নিতে হয়েছে।
সোয়ে কখন আপনাকে দীক্ষা দিতে আসবে? তার মুখে এই বিস্ময়কর তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনতে চাই।
না, তাইতা, বলে উঠলেন রানি। তোমাকে বুঝতে হবে, এগুলো তত্ত্ব নয়। সত্যের প্রকাশ। রোজ সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছে আসেন সোয়ে। ওর মতো এমন জ্ঞানী ও পবিত্র পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। রানির উজ্জ্বল অভিব্যাক্তি সত্ত্বেও ফের তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। কথা দাও, তুমি তার কথা শুনতে আসবে।
আমার উপর আস্থা স্থাপন করায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, প্রিয় রানিমাতা। কখন সেটা?
আজ সন্ধ্যায়। সাপারের পর, জানালেন তিনি।
এক মুহূর্ত ভাবল তাই। আপনি বললেন কেবল মনোনীতদেরই দীক্ষা দেয় সে। যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে? তাহলে রাগ হবে আমার।
কখনওই তোমার মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত লোককে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি, মহান ম্যাগাস।
আমি সে ঝুঁকি নিতে যাব না, প্রাণপ্রিয় মিনতাকা। আমার পরিচয় প্রকাশ না করে তার কথা শোনার ব্যবস্থা করা যায় না?
সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। তাঁকে ঠকাতে চাই না, অবশেষে বললেন তিনি।
কোনও রকম ঠকবাজির কথা ভাবছি না আমি। তার সাথে কোথায় দেখা হবে আপনার?
এই মহলেই, তুমি যেখানে বসে আছে, তিনিও ওখানেই বসবেন। ওই কুশনেই।
কেবল আপনারা দুজনই থাকবেন?
না, আমাদের সাথে আরও তিনজন প্রিয় মহিলা থাকবে। আমার মতোই দেবীর ভক্ত ওরা।
সতর্কতার সাথে কামরাও নকশা জরিপ করছিল তাইতা। কিন্তু রানির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ও। এই দেবী কি নিজেকে কখনও মিশরের জনগণের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন? নাকি স্রেফ তার মনোনীত অল্প কয়েকজনের কাছেই তার ধর্ম প্রকাশিত হবে?
নেফার আর আমি মনে প্রাণে তাঁকে বরণ করার পর মিথ্যা দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের মন্দির ধ্বংস করে পুরোহিত সমাজকে ছত্রভঙ্গ করে দেব, তখনই দেবী বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেন। প্লেগের অবসান ঘটাবেন তিনি, তার পরিণতি ভোগান্তি দূর করবেন। নীল নদকে আবার প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেবেন… একটু দ্বিধা করলেন তিনি, তারপর ফের দ্রুত কথা বলতে লাগলেন। …আমার বাচ্চাদের আবার ফিরিয়ে দেবেন।
প্রাণপ্রিয় রানি। সত্যি যদি তাই হতো। যাক, একটা কথা বলুন, নেফার কি এই পরিস্থিতির কথা জানেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নেফার জ্ঞানী, অসাধারণ শাসক। মহান যোদ্ধা। ভালোবাসায় ভরা স্বামী ও পিতা। কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ নন তিনি। কেবল উপযুক্ত সময়েই ওর কাছে সব কথা খুলে বলবেন বলে আমার সাথে একমত হয়েছেন সোয়ে। সেই সময় এখনও হয়নি।
গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল তাইতা। নিজের স্ত্রীর কাছে দাদা-দাদী, বাবা-মা আর বলা বাহুল্য ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের পাইকারী প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে ভালো ধাক্কাই খাবেন নেফার সেতি। এমনকি তাঁকেও ঐশী পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হবে। বেঁচে থাকতে তিনি এমনটি ঘটতে দেবেন না, এটুকু বোঝার মতো তাঁকে চিনি বলেই মনে হয়।
চিন্তাটা এক ভীতিকর সম্ভাবনার স্রোত বইয়ে দিল তাইতার মনে। নেফার সেতি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগি আর পরামর্শকগণ পয়গম্বরকে ঠেকাতে জীবিত না থাকলে এমন এক রানিকে খেলাতে পারবে যিনি বিনা প্রশ্নে, কোনও প্রতিশোধ ছাড়াই সোয়ের সব নির্দেশ পালন করবেন। তিনি কি রাজা, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের বাবার হত্যাকাণ্ডে সায় দেবেন? আপন মনে প্রশ্ন করল তাইতা। উত্তরটা পরিষ্কার: হ্যাঁ, দেবেন। যদি নতুন নামহীন দেবীর হাতে মৃত বাচ্চাদের সাথে তাঁরও আবার বেঁচে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। মরিয়া মানুষ বেপরোয়া পরীক্ষায় মেতে ওঠে। চড়া গলায় ও জানতে চাইল: সোয়েই কি এই মহান দেবীর একমাত্র পয়গম্বর?
সোয়ে ওদের নেতা। তবে তাঁর অনেক নিচের কাতারের শিষ্যরা দুই রাজ্যের সাধারণ জনগণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগমনের পথ সুগম করে তুলছে।
আপনার কথা আমার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার অবস্থানের কথা প্রকাশ না করে তার বয়ান শুনতে দিলে সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সাথে আরেকজন ম্যাগাস থাকবেন। এত জ্ঞানী ও বয়স্ক, আমার পক্ষে যেমনটি কোনওদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আঙুল তুলে প্রতিবাদ না করে রানিকে নীরব থাকার ইঙ্গিত করল ও। কথাটা ঠিক, মিনতাকা। তাঁর নাম দিমিতার। ওই যেনানা জানালার পেছনে আমার সাথে বসে থাকবেন তিনি। একটা জটিল বুনটের পর্দার দিকে ইশারা করল ও, আগের দিনে ওটার পেছন থেকে রানি ও উপপত্নীরা চেহারা না দেখিয়েই বিদেশী গণ্যমান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।
তবু ইতস্তত করতে লাগলেন মিনতাকা, কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল তাইতা। দুজন প্রভাবশালী ম্যাগাইকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন আপনি। সোয়ে ও নতুন দেবীকে একসাথে খুশী করতে পারবেন। আপনার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবেন তিনি। তখন তাঁর কাছে আপনার সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ যেকোনও বর চাইতে পারবেন।
ঠিক আছে, তাতা, তোমার কথামতোই করব। তবে তার বিনিময়ে আমার আজকের কথাগুলো নেফারকে বলবে না, যতক্ষণ না দেবীকে মেনে নেওয়া আর প্রাচীন দেবতাদের প্রত্যাখ্যানের সময় হচ্ছে তাঁর…
আপনার হুকুম মতোই করব, রানি আমার।
তুমি আর তোমার সহকর্মী দিমিতারকে অবশ্যই কাল খুব সকালে ফিরে আসতে হবে। মূল দরজার বদলে পেছন দরজা দিয়ে আসবে। আমার এক পরিচারিকা তোমাদের এই কামরায় নিয়ে আসবে, তখন তোমরা ওই পর্দার পেছনে আশ্রয় নিতে পারবে।
সূর্য উদয়ের এক ঘণ্টার মধ্যেই আসব আমরা, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।
*
মেমননের প্রাসাদের তোরণ হয়ে বেরিয়ে আসার সময় বিকেলের সূর্যের উচ্চতা যাচাই করল তাইতা। এখনও দিনের আলোর বেশ কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। হঠাৎ কী ভেবে রক্ষীদের সার্জেন্টকে থেবসে যাবার সোজা পথ বেছে নিতে নিষেধ করল ও। তার বদলে কবরস্থানের পথে ঘুর পথে পশ্চিমের পাহাড় ও বিশাল রাজকীয় নেক্রোপলিসের দিকে এগোল। একটা পাথুরে উপত্যকার আড়ালে রয়েছে ওটা। প্রাণপ্রিয় লখ্রিসের জাগতিক দেহে মলম মাখানোর বিষয়টি যেখানে তত্ত্বাবধান করেছিল ও, সত্তর বছর আগের ঘটনা এটা। কিন্তু সময় সেই ভীষণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। মাদুলিটা স্পর্শ করল ও, লস্ত্রিসের একগাছি চুল রাখা আছে ওতে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে উঠতে লাগল ওরা। হাথরের মন্দির পাশ কাটাল: পাথুরে টেরেসের পিরামিডের চূড়ায় বসানো দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। নিচের টেরেসে পায়চারীরত পুরোহিতিনীকে চিনতে পারল তাইতা, আরও দুজন নবীশ রয়েছে তার সথে। তার সাথে কথা বলতে একপাশে সরে এলো।
ঐশী হাথর আপনাকে রক্ষা করুন, মা, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাল ও। হাথর হচ্ছেন মহিলাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তাই প্রধান পুরোহিতও একজন নারী।
শুনেছি আপনি সফর শেষে ফিরে এসেছেন, ম্যাগাস, ওকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আমরা সবাই আশা করছিলাম, আপনি এখানে আসবেন, আমাদের আপনার অভিযানের গল্প শোনাবেন।
সত্যি, অনেক কথা বলার আছে আমার, আপনাদের ভালো লাগবে আশা করি। মেসোপটেমিয়া, একবাতানা ও বাবিলনের ওধারে যার উপর দিয়ে খোরাশান মহাসড়ক চলে গেছে সেই পাহাড়ি ভূমির প্যাপিরাস মানচিত্র নিয়ে এসেছি আমি।
আমাদের জন্যে অনেক কিছুই নতুন হবে, সাগ্রহে হাসলেন প্রধান পুরোহিতীনি। সাথে এনেছেন ওগুলো?
আরে, না! অন্য কাজে বেরিয়েছি আজ, এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। থেবসে স্ক্রোল রেখে এসেছি। তবে পয়লা সুযোগেই নিয়ে আসব ওগুলো।
সেটা খুব শিগগির হবার নয়, ওকে আশ্বস্ত করলেন প্রধান পুরোহিতীনি। এখানে সবসময়ই আপনি স্বাগত। আপনার ইতিমধ্যে দেওয়া তথ্যের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আপনার কাছে যা আছে সেটাও মনোমুগ্ধকর হবে বলেই আমি নিশ্চিত।
তাহলে আপনার মহত্বের সুযোগটুকু নেব আমি। আপনার কাছে একটা উপকার চাইতে পারি?
আমার কাছে পাওয়ার মতো কোনও উপকার থাকলে সেটা পেয়ে গেছেন আপনি। মুখ ফুটে বলুন শুধু।
অগ্নিগিরি নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।
কোনটা? হাজারে হাজারে আছে, অনেক দেশে ছড়িয়ে আছে।
পাহাড়ের কাছাকাছি বা কোনও দ্বীপে, বা কোনও হ্রদ কিংবা বিশাল নদীর কিনারের গুলো। একটা তালিকা দরকার আমার, মা।
বেশ কঠিন অনুরোধ, ওকে নিশ্চিত করলেন তিনি। ভাই নুবাঙ্ক, আমাদের একজন প্রবীন মানচিত্র শিল্পী সব সময়ই আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণতার অন্যান্য ডুবো উত্স নিয়ে দারুণ কৌতূহলী, যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ ও গেইসার। খুশি মনেই আপনার তালিকা তৈরি করে দেবেন তিনি। তবে ধরে নিন অনেক বিস্তারিত ও ক্লান্তিকর হবে সেটা। নুবাঙ্ক এত বেশি খুঁতখুঁতে যে এটাই তার দোষ। এখুনি কাজ শুরু করতে বলছি তাকে।
কত সময় লাগতে পারে?
আপনি কি আগামী দশদিনের ভেতর এদিকে আসবেন, সম্মানিত ম্যাগাস? জানতে চাইলেন তিনি।
বিদায় নিল তাইতা, তারপর নেক্রোপলিসের ভিন্ন একটা তোরণের দিকে এগোল।
*
এক বিশেষ সামরিক দুর্গ রাজকীয় সমাধির আশ্রয় নেক্রোপলিস পাহারা দিচ্ছে। প্রতিটিতে ডুবন্ত চেম্বারের কমপ্লেক্স রয়েছে, নিরেট পাথর কুঁদে নির্মাণ করা হয়েছে এসব। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে সমাধি চেম্বার, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ রাজকীয় পাথুরে শাবাধার, ফারাওর মামিকৃত মরদেহ রয়েছে তাতে। এই চেম্বারের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টোররুম আর গুদামঘর, অপরিমেয় রত্নভাণ্ডারে ঠাসা সেগুলো। কেউ জানে না এর কথা। দুটি রাজ্য ও এর সীমান্তের বাইরের অন্য দেশের সমস্ত চোর আর ডাকাতের লোভের কারণ হয়েছে এটা। পবিত্র এনক্লোজারে ঢুকতে সব সময়ই সুচতুর প্রয়াস পেয়ে আসছে তারা। ওদের ঠেকাতে ছোটখাট একটা সেনাদলের স্থায়ী প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে।
ঘোড়ার দলকে দানাপানি খাইয়ে তরতাজা করে তুলতে সঙ্গীদের দুর্গের মূল প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে সামাধিক্ষেত্রের দিকে পা বাড়াল ও। রানি লখ্রিসের সমাধিতে যাবার পথ যতটা ভালো করে জানার কথা জানে ও। নিজেই লেআউটের নকশা করেছে ও, খনন কাজ তত্ত্বাবধান করেছে। লস্ত্রিসই মিশরের একমাত্র রানি যাকে গোরস্থানের এই অংশে কবরস্থ করা হয়েছে, সাধারণত ক্ষমতাসীন ফারাওর জন্যে সংরক্ষিত থাকে এটা। লস্ত্রিসের বড় ছেলে সিংহাসনে বসার পর তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এর বরাদ্দ নিয়েছিল তাইতা।
ইহ জগত থেকে বিদায় নিয়ে পরজগতে পদার্পণের কথা ভেবে ফারাও নেফার সেতির সমাধি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সে জায়গাটা পার হয়ে এলো ও। রাজমিস্ত্রিতে গিজগিজ করছে জায়গাটা, পাথর কুঁদে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করছে ওরা। মাথার উপর নিপূণভাবে ঝুড়ি ফেলে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধ শ্রমিকরা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মসৃণ ধূলোর পুরু আস্তরণ ওদের শরীরে। স্থপতি ও দাসদের সর্দারদের একটা ছোট দল ওদের মাথার উপর থেকে নিচের কাজের গতি জরিপ করছে। উপত্যকা জুড়ে বাটালি, বাইস আর পাথরের উপর গাইতি চালানোর আওয়াজ।
কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই শবযাত্রার পথ ধরে এগোল তাইতা, এক সময় উপত্যকা সরু হয়ে দুটি ভিন্ন পথে ভাগ হয়ে গেল। বাম দিকের পথ বেছে নিল ও। পঞ্চাশ কদম এগোনোর পরই একটা বাঁক ঘুরে লক্ট্রিসের সমাধির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। ঠিক সামনেই রয়েছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে বসানো। প্রবেশ পথ দৃষ্টিনন্দন গ্ৰানিটের স্তম্ভ ঘিরে রেখেছে, পাথরের ব্লকের দেয়ালে ঘেরাও করা, প্রলেপ লাগানোর পর অসাধারণভাবে রঙ করা মুরালে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। রানির জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সাজানো হয়েছে তার কার্তুশের চারপাশে: স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সুখে লস্ত্রিস, রথ হাঁকাচ্ছে, নীলের জলে মাছ ধরছে, গেযেল ও পাখি শিকার করছে, হিকস্স হানাদারদের সেনাদলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে, নৌবহরে জনগণসহ নীলের বিভিন্ন জলপ্রপাত পাড়ি দিচ্ছে, এবং হিকস্সের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে তাদের। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিজের হাতে এইসব দৃশ্য এঁকেছিল তাইতা, কিন্তু এখনও টাটকা রয়ে গেছে রঙ।
সমাধির প্রবেশ পথে আরেকজন শোককারী ছিল, দেবী আইসিসের সন্ন্যাসীনিদের আলখেল্লার মতো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। মুরালের দিকে ফিরে প্রবল ভক্তির ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। সময় নিতে ইচ্ছে করে গতি কমাল তাইতা। ক্লিফের পায়ের কাছে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে একপাশে সরে গেল ও। ছবির লক্ট্রিসের চেহারা সুখ-স্মৃতির একটা চলমান ছবি চালু করে দিল। উপত্যকার এই দিকটা বেশ নিরিবিলি, আরও নিচের শ্রমিকদের কাজ-কর্মের হাঁকডাক পাথুরে দেওয়ালের কারণে চাপা পড়ে গেছে। খানিকক্ষণ সমাধির যাজিকার উপস্থিতির কথা ভুলে গেল ও, পরক্ষণেই উঠে আবার তার দিকে মনোযোগ ফেরাল।
মহিলা জোব্বার হাতার ভেতরে হাত চালিয়ে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র-হয়তো বাটালি বা ছুরি-বের করে আনার সময়ও ওর দিকে পেছন ফিরে ছিল সে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তাইতাকে ভীত বিহ্বল করে যন্ত্রের ডগা দিয়ে ইচ্ছে করেই মুরালের উপর আঘাত হানল সে। আরে, পাগল মেয়েমানুষ, করছ কী? চিৎকার করে উঠল ও। রাজকীয় সমাধির ক্ষতি করছ তুমি! এখুনি বন্ধ করো!
যেন ও কোনও কথাই বলেনি, ওকে উপেক্ষা করে গেল মহিলা, ঘনঘন আঘাত হেনে চলল লস্ত্রিসের মুখে। গভীর ক্ষতের ভেতর থেকে নিচের আস্তরণ বের হয়ে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা। চিৎকার করে চলেছে, থাম! শুনতে পাচ্ছ না! তোমার শ্রদ্ধেয়া মা এ খবর জানতে পারবেন। এই অপবিত্রতার জন্যে তোমার উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করব আমি। নিজের উপর দেবতাদের সাজা ডেকে আনছ তুমি…
তারপরেও ওর দিকে না তাকিয়ে প্রবেশ পথ ছেড়ে ইচ্ছাকৃত শিথিল পায়ে ওকে ছেড়ে উপত্যকার অন্য দিকে চলে গেল সন্ন্যাসীনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছু নিল তাইতা। এখন আর চিৎকার করছে না, তবে ডান হাতে ভারি ছড়িটা ধরে আছে। মহিলা যাতে অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায়। সহিংসতা ওর মন ভারি করে দিয়েছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মহিলার মাথায় ঠকাস করে বাড়ি মেরে খুলি ফাটিয়ে দিত ও।
উপত্যকার তীক্ষ্ণ বাঁকে পৌঁছাল মহিলা। থেমে কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল সে। তার মুখ আর চুল বলতে গেলে লাল শালে সম্পূর্ণ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা। যাচ্ছিল।
ক্রোধ ও হাতাশা মিলিয়ে গেল তাইতার, বিস্ময় ও বিহ্বলতা সে জায়গা দখল করে নিল। মহিলার দৃষ্টি স্থির, প্রশান্ত, চোখজোড়া প্রবেশপথের রানির ছবির মতোই। এক মুহূর্ত নড়তে বা কথা বলতে পারল না ও। যখন ভাষা খুঁজে পেল, খরখরে শোনাল ওর কণ্ঠ: এ যে দেখছি তুমি!
এক ধরনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার চোখজোড়া, ফলে উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর হৃদয়। মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও বুঝতে পারল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে। ওর বিস্ময় সূচক কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা দোলাল সে। তারপর আবার ঘুরে ধীরস্থিরভাবে পাথর প্রাচীরের বাঁক ঘুরে চলে গেল।
না! হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তাইতা। আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারো না তুমি! দাঁড়াও! অপেক্ষা করো! পিছনে ছুটল ও, মহিলা উধাও হয়ে যাবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাদে বাকে পৌঁছাল। এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পরক্ষণে থমকে দাঁড়াল ও, ওর চোখের সামনে উপত্যকার উঁচু প্রান্ত খুলে যেতেই দুহাত আবার স্কুলে পড়ল দুপাশে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কানা গলিতে পরিণত হয়েছে রাস্তাটা; ধূসর পাথরের দেয়ালে পথ রুদ্ধ, এত খাড়া যে পাহাড়ী ছাগলের পক্ষেও ওটা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। উধাও হয়ে গেছে। মহিলা।
লস্ত্রিস, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া আমার। ওর ওপর চেপে বসল পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও, অর্থহীন আবেদনের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেয়ালের গায়ে ফাটলের খোঁজ করতে লাগল, যেখানে মেয়েটা গাঢাকা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাবার মতো গোপন দরজা। কিছুই পেল না। যে পথে এসেছিল সেদিকে তাকাল ও। দেখতে পেল উপত্যকার মেঝে পাহাড়ের শরীর থেকে খসে পড়া শাদা বালির হালকা আস্তরণে ঢাকা। ওর নিজের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কোনও পায়ের ছাপ নেই। কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি সে। ক্লান্তভাবে লস্ত্রিসের সমাধির দিকে ফিরল ও। প্রবশে পথের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তরণে খোদাই করা হিয়েরেটিক হরফে লেখাটা পড়ল। ছয় আঙুল পথ দেখাবে, জোরে জোরে পড়ল। কোনও মানে বুঝল না। পথ? কোনও রাস্তা, নাকি কোনও কায়দা বা কৌশল?
ছয় আঙুল? বিভিন্ন দিক দেখাচ্ছে ওগুলো, নাকি একটা? অনুসরণের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সাইনপোস্ট? হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। জোরে খোদাইম্বালিপিটা ফের পড়ল: ছয় আঙুল পথ দেখাবে। ও পড়ার সময়ই মহিলার লেখা হরফগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল এক সময়। লস্ত্রিসের পোর্ট্রেট অক্ষত। সবগুলো বিকৃতি আবার নিখুঁতভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিস্ময়ের সাথে হাত বাড়িয়ে ছবি স্পর্শ করল ও। উপরিতল মসৃণ, নির্মল।
পিছিয়ে এসে আবার পরখ করল। হাসিটা কি যেভাবে এঁকেছিল এখনও তেমনই আছে, নাকি বদলে গেছে? কোমল দেখাচ্ছে এখন, নাকি পরিহাস করছে? আন্তরিক, নাকি হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছে? ওটা কি দয়ার্দ্র, নাকি বৈরী? নিশ্চিত হতে পারল না।
তুমি কি লস্ত্রিস, নাকি আমাকে কষ্ট দিতে পাঠানো দুষ্ট কোনও অভিশাপ? জিজ্ঞেস করল ও। লস্ত্রিস কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? তুমি সাহায্য আর নির্দেশনা দিতে চাইছ-নাকি আমার পথে ফাঁদ আর গহ্বর খুঁড়ে যাচ্ছ?
অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল ও, তারপর সঙ্গীরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দুর্গের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঘোড়ায় চেপে থেবসের উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরল ওরা।
*
ফারাও নেফার সেতির প্রাসাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবার আগে রামরামের কাছে এলো তাইতা।
ফারাও এখনও গোপন সভায় আছেন। পরিকল্পনা মতো আজ রাতে তোমার সাথে দেখা করতে পারবেন না তিনি। তার তলবের অপেক্ষা করতে হবে। তোমাকে নিজের মাদুরে শুয়ে পড়ার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।
রামরামকে ছেড়ে দ্রুত দিমিতারের ঘরের দিকে এগোল ও। বাও বের্ডের সামনে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখল বুড়ো আর মেরেনকে। তাইতাকে দেখেই স্বস্তি প্রকাশের নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল মেরেন। খেলাটার জটিলতা অনেক সময় ওর বোধের বাইরে ঠেকে। স্বাগত, ম্যাগাস। ঠিক সময় মতো এসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচালেন।
দিমিতারের পাশে বসল তাইতা, ঝটপট স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খবর দিল।
সফরের ক্লান্তি সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে তো?
আপনার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ। আসলেই ভালো আছি আমি, বললেন দিমিতার।
শুনে খুশি হলাম, কারণ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে আমাদের। আপনাকে মেমনরের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নতুন ধর্মের প্রচারকদের একজনের বাণী শুনব। এক নতুন দেবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে সে, যিনি পৃথিবীর সকল জাতির উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন।
হাসলেন দিমিতার। সত্যি বলতে প্রলয় পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো দেবতার অভাব আছে আমাদের?
আহা, বন্ধু আমার, আমাদের চোখে এমনটা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু পয়গম্বরের মতে পুরোনো দেবতাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, তাদের মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে, ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে তাদের যাজকদের।
ভাবছি এক এবং অদ্বিতীয় আহুরা মাদার কথা বলছে কিনা সে? তাহলে এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়।
আহুরা মাযদা নয়, নতুন কেউ। তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী, ভীতিকর। মানুষের রূপে নেমে আসবেন এই দেবী, আমাদের মাঝে বাস করবেন। সাধারণ লোকজন তার রাজকীয় করুণা সরাসরি ভোগ করবে। মৃতকে জীবিত করা ও যোগ্যদের অমরত্ব ও চিরস্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
এমন স্পষ্ট অর্থহীনতার সাথে কেন নিজেদের জড়াতে যাচ্ছি আমরা, তাইতা? বিরক্তির সাথে জানতে চাইলেন দিমিতার। মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক জরুরি সমস্যা আছে।
এই পয়গম্বর সাধারণ লোকের মাঝে গাঢাকা দিয়ে একই ধরনের কথাবার্তা প্রচার করে বেড়ানো আরও অনেকের একজন। মনে হচ্ছে, মিশরের রানি এবং ফারাও নেফার সেতির স্ত্রী মিনতাকাসহ অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ফেলছে ওরা।
সামনে ঝুঁকে এলেন দিমিতার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি। এমন আজগুবী ব্যাপার বিশ্বাস না করার মতো ভালো বুদ্ধি তো রানি মিনতাকার থাকার কথা?
নতুন দেবীর আগমন ঘটার পর তাঁর প্রথম কাজ হবে মিশরের প্লেগ দূর করা, এই রোগের কারণে আবির্ভুত সমস্ত ভোগান্তির অবসান ঘটানো। তার মাঝে মিনতাকা প্লেগে মৃত দুই সন্তানকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখতে পেয়েছেন।
আচ্ছা, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন দিমিতার। যেকোনও মায়ের কাছেই অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হওয়ার কথা এটা। কিন্তু আর কোন কারণের কথা বলছেন। আপনি?
পয়গম্বরের নাম সোয়ে। বিহ্বল দেখাল দিমিতারকে। নামটার অক্ষরগুলোকে উল্টে দিন। তেনমাস হরফ ব্যবহার করুন, পরামর্শ দিল তাইতা। দিমিতারের বিভ্রান্তি কেটে গেল।
ইয়োস, ফিসফিস করে বললেন তিনি। আপনার কুকুরের দল ডাইনীর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে, তাইতা।
আমাদের অবশ্যই এবার গন্ধ শুঁকে ঝটপট তার আস্তানায় ছুটে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল তাই। ভালো করে ঘুমিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিন। সূর্যোদয়ের সময় মেরেনকে পাঠাব আপনাকে নিতে।
*
পুব আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ আভা মাত্র, দিমিতারের উট আর ঘোড়াসহ প্রাঙ্গণে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হাবারি। পালকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন দিমিতার। ঘোড়ার পিঠে তার পাশে থেকে এগোতে লাগল তাইতা ও মেরেন। ওদের নদী পারাপারের জায়গায় নিয়ে এলো এসকর্ট। এখানে স্রেফ একটা রাক্ষুসে ব্যাঙ দেখতে পেল ওরা। ওদের এড়িয়ে গেল ওটা, বিনা ঝামেলায় নদী পেরুল ওরা। মেমননের প্রাসাদ পাশ কাটিয়ে পেছনের তোরণে চলে এলো, এখানে মেরেন ও হাবারির হেফাযতে বাহন রেখে এগোলো তাইতা ও দিমিতার। মিনতাকার প্রতিশ্রুতি মতো একজন পরিচারিকা ওদের স্বাগত জানাতে তোরণের ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছিল। প্যাসেজ আর টানেলের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল সে, অবশেষে দরাজহাতে সাজানো একটা কামরায় পৌঁছুল ওরা। এখানে ধূপ আর সৌরভ ভুরভুর করছে। মেঝে রেশমী কাপড়ের গালিচা আর কুশনে ঢাকা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত পদা। দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা পর্দা টানানো যেনানা জানালা ঢেকে রাখা হ্যাংগিং সরিয়ে ফেলল পরিচারিকা। দ্রুত সেটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অলঙ্কৃত নকশার ভেতর দিয়ে আম দরবারের দিকে তাকাল। আগের দিন মিনতাকার সাথে এখানেই দেখা করেছিল ও। এখন খা-খা করছে। সন্তুষ্ট হয়ে দিমিতারের কাছে ফিরে এসে হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে। কুশনে বসল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পর্দার ওপাশ থেকে অচেনা এক লোক পা রাখল কামরায়।
মাঝ বয়সী, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়নের লোকটা। কাঁধের উপর নেমে আসা ঘন চুলে ছোট সঁচাল দাড়ির মতোই পাক ধরেছে। পরনে যাজকীয় কালো লম্বা জোব্বা, স্কার্টে আধ্যাত্মিক প্রতাঁকের নকশা, গলায় ঝুলছে তাবিজ। কামরায় চক্কর দিতে শুরু করল সে। পর্দা সরিয়ে ভেতর পরখ করছে। যেনানা জানালার সামনে। এসে দাঁড়াল সে, পর্দার খুব কাছে নিয়ে এলো মুখটা। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো জিসিনটা হচ্ছে তার চোখ: ধর্মান্ধদের চোখের মতো, অন্ধবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে সেখানে।
এটাই সোয়ে, ভাবল তাইতা। ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিজেদের আড়াল করার শক্তি একত্রিত করে বাড়ানোর জন্যে দিমিতারের হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কারণ ওই লোকটার কী ধরনের অকাল্ট বিদ্যা আছে জানা নেই। পর্দার ভেতর দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে আড়ালের পর্দা টিকিয়ে রাখতে পুরো শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ঘুরে দাঁড়াল সোয়ে। দূরে জানালার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরের প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের কমলা আলোয় কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে ওটা।
লোকটাকে বিভ্রান্ত করার পর এবার অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। সোয়ে সাধুপুরুষ নয় মোটেই, কারণ নিমেষে তার চারপাশে একটা আভা ফুটে উঠল। এমন আভা এর আগে আর দেখেনি ও অস্থির, এই প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে, তারপরই আবার ক্ষীণ আভায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওটার রঙ, তারপরই আবার মলিন, চাপা রূপ নিচ্ছে। নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তার কারণে দূষিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্তিত্ব টের পেল তাই।
সোয়ের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, পরস্পরবিরোধী, তবে তার উল্লেখযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
হাসতে হাসতে একদল নারী কামরায় ঢুকতেই চট করে জানালার কাছ থেকে সরে এলো সোয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিনতাকা, উত্তেজিতভাবে ছুটে গিয়ে প্রবল মমতায় সোয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল তাইতা। রানির পক্ষে দারুণ ব্যতিক্রমী আচরণ। কেবল একা থাকলেই তাইতাকে আলিঙ্গন করেন তিনি। পরিচারিকাদের সামনে নয়। সোয়ের কাছে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তিনি বুঝতে পারেনি ও। রানি সোয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পরিচারিকরা এসে হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে।
পবিত্র পিতা, আমাদের আশীর্বাদ করুন, মিনতি করল ওরা। এক ও অদ্বিতীয় দেবীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন।
ওদের মাথর উপর আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে। পরমানন্দে হেসে উঠল ওরা।
সোয়েকে কুশনের একটা ঢিবির কাছে নিয়ে গেলেন মিনতাকা, রানির মাথা থেকে বেশ উঁচু করে তুলল সেগুলো সোয়ের মাথা। তারপর অল্পবয়সী মেয়েদের মতো নিতম্বের নিচে পা ভাঁজ করে বসলেন তিনি। যেনানা জানালার দিকে ফিরে সুন্দর হাসি দিলেন, জানেন তাইতা ওখানে বসে ওদের দেখছে। নিজের সাম্প্রতিক সংগ্রহের প্রতি ওর অনুমোদন কামনা করছেন। যেন সোয়ে দূর দেশ থেকে আনা কোনও বিচিত্র পাখি, কিংবা কোনও বিদেশী অতিথির দেওয়া মূল্যবান রত্ন। রানির এমনি অসতর্কতায় সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কিন্তু পরিচারিকাদের সাথে আলাপে মগ্ন সোয়ে। ওদের দৃষ্টি চালাচালি লক্ষ করেনি। এবার মিনতাকার দিকে তাকাল
মহারানি, গতবার আমাদের দেখা হওয়ার পর আপনার উদ্বেগের বিষয়ে অনেক ভেবেছি, দেবীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছি আমি, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে সাড়া দিয়েছেন।
ফের অবাক হলো তাইতা। এ লোক বিদেশী কেউ নয়, ভাবল ও। মিশরিয়। আমাদের ভাষা নির্ভুল ব্যবহার করছে। উচ্চ রাজ্যের অধিবাসী আসৌনদের মতো টান আছে তার কথায়।
বলে চলল সোয়ে। এসব ব্যাপার এত জরুরি ও কঠিন যে এই মুহূর্তে সেগুলো কেবল আপনার নিজের কাছে গোপন রাখতে হবে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিন। হাত তালি দিলেন মিনতাকা। লাফ দিয়ে উঠে ভীত ইঁদুরের মতো কামরা থেকে ছুটে বের হয়ে গেল ওরা।
সবার আগে আপনার স্বামী, নেফার সেতির প্রসঙ্গ, একাকী হওয়ার পর আবার বলল সোয়ে। তিনি আপনার কাছে এই খবব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু থেমে মিনতাকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তারপর এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করল যেটা ওর নিজস্ব ভাষা নয়, বৈরী নারী কণ্ঠ। আমার আগমনের সময় নেফার সেতিকে নিজের প্রেমময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করব আমি, সানন্দে আমার কাছে আসবে সে।
চমকে উঠল তাইতা, কিন্তু ওর পাশে দিমিতার বুনো চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে শান্ত করতে হাত বাড়াল তাইতা। যদিও নিজেই প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন দিমিতার। তাইতার হাত ধরে টানলেন তিনি। ওর দিকে ফিরল তাইতা। নিঃশব্দে একটা বার্তা উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, পরিষ্কার বুঝতে পারল তাইতা, যেন চিৎকার করে বলা হয়েছে। ডাইনী! এটা ইয়োসের কণ্ঠস্বর! দিমিতার ঘোরে থাকার সময় তার মনের গহীন থেকে এই কণ্ঠস্বরই বের করে এনেছিল তাইতা।
তবে এসবেরই প্রভু হচ্ছে আগুন, পুনরাবৃত্তি করে পূর্ণ সম্মতিতে হাতের তালু উপরের দিকে মেলে ধরল।
সোয়ে কথা বলে চলেছে, শোনার জন্যে পেছন ফিরে তাকাল ওরা: আমার অলৌকিক রাজ্যের অধিপতি করার জন্যে পুনরুত্থান ঘটাব তার। পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের রাজারা তার অধীনে চলে আসবে। আমার নামে চিরকাল আপন মহিমায় শাসন করবে সে। আপনি, প্রিয় মিনতাকা, থাকবেন তার পাশে।
স্বস্তি আর আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিনতাকা। পিতৃসুলভ কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সোয়ে। তাঁর সামলে ওঠার অপেক্ষা করল। অবশেষে চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের কী হবে?
আগেই ওদের কথা বলেছি আমরা, কোমল কণ্ঠে তাঁকে মনে করিয়ে দিল সোয়ে।
হা! কিন্তু বেশিবার শুনিনি। দয়া করে, পবিত্র পয়গম্বর, আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি…
দেবী আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওদের, ওরা পূর্ণ আয়ু পার করবে।
আর কী নির্দেশ দিয়েছেন তিনি? দয়া করে আবার বলুন।
ওরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারলে আপনার সকল সন্তানকে চির তারুণ্য দান করবেন তিনি। কোনও দিন আপনাকে ফেলে যাবে না ওরা।
আমি সন্তুষ্ট, সর্বশক্তিমতী দেবীর মহান পয়গম্বর, ফিসফিস করে বললেন মিনতাকা। আমি আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছার কাছে সঁপে দিচ্ছি। হাঁটু ভেঙে সোয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। চুলের ডগায় অশ্রু মুছলেন তিনি।
এরচেয়ে বিতৃষ্ণ দৃশ্য আর হতে পারে না। এমনটা আর তাইতা দেখেনি। পর্দার এপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল ও। লোকটা মিথ্যার চ্যালা! নিজেকে ওর হাতে নোংরা হতে দেবেন না।
পরিচারিকাদের তলব করলেন মিনতাকা। সকালের বাকি সময়টা সোয়ের সাথে কাটাল ওরা। কথোপকথন অর্থহীন বাক্যালাপে পর্যবসিত হলো, কারণ পরিচারিকাদের কারওই সোয়ের শিক্ষা অনুসরণ করার মতো বুদ্ধি নেই। সরল ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হলো সে। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, হাসিঠাট্টায় তাকে ত্যক্ত করতে লাগল।
দেবী আমার জন্যে ভালো একজন স্বামী খুঁজে দেবেন?
আমাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেবেন?
লক্ষ্যণীয় ধৈর্য ধরে ওদের সামাল দিল সোয়ে।
তাইতা বুঝতে পারল ওরা অনেক কিছু জানতে পারলেও যেনানা পর্দার আড়ালে নীরবে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চলে যাবার চেষ্টা করলে নড়াচড়ায় পয়গম্বরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। দুপুরের খানিক আগে দেবীর উদ্দেশে লম্বা প্রার্থনা শেষে সভার সমাপ্তি টানল সোয়ে। তারপর ফের মেয়েদের চুমু খেয়ে মিনতাকার দিকে ফিরল। মহারানি, আপনি কি চান পরে আবার আসি আমি?
দেবীর এইসব ইচ্ছা নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কাল সকালে আবার আসুন, তখন এসব নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। মাথা নুইয়ে সরে গেলেন তিনি।
সোয়ে বিদায় নেওয়ার পরপরই পরিচারিকাদের বিদায় দিলেন মিনতাকা।
তাইতা, এখনও আছো তোমরা?
জ্বি, মহারানি।
একটানে পর্দা সরিয়ে মিনতাকা জানতে চাইলেন, লোকটা কত জ্ঞানী আর শিক্ষিত, কত চমৎকার সব সংবাদ নিয়ে আসেন বলেছি তোমাকে?
অসাধারণ খবর, সত্যি, জবাব দিল তাইতা।
দেখতেও সুন্দর, না? মনেপ্রাণে তাকে বিশ্বাস করি আমি। অন্তর থেকে জানি তার ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী সত্যি; দেবী নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করবেন, আমাদের কষ্ট দূর করবেন তিনি। ওহ, তাইতা, তার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তুমি? নিশ্চয়ই করেছ!
ধর্মীয় ঘোরে রয়েছেন মিনতাকা। তাইতার জানা আছে, এখন কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে হিতে বিপরীত হবে। দিমিতারকে এখন এমন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে বসে এতক্ষণ যা কিছু জেনেছে সেসব নিয়ে আলাপ করতে পারবে। অগ্রসর হওয়ার কায়দা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তার আগে মিনতাকার মুখে সোয়ের তারিফ শুনতে হবে। এক সময় সব প্রশংসার শব্দ ফুরিয়ে গেলে আস্তে করে তাইতা বলল, আমি আর দিমিতার উত্তেজনায় ক্লান্ত। ফারাও তাঁর জরুরি দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ামাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, তো এখন হাতের কাছে থাকার জন্যে থেবসে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। আরও আলোচনা করা যাবে তখন, রানি আমার।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বিদায় দিলেন তিনি।
*
ওরা ফের বাহনে চেপে নদীর দিকে পথে নামার পরপরই পালকির দুই পাশে যথারীতি অবস্থান নিল তাইতা ও মেরেন। মিশরিয় ভাষা ছেড়ে তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করল এবার তাইতা ও দিমিতার, যাতে এসকর্টের লোকজন ওদের আলোচনা না বোঝে।
সোয়ের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে পেরেছি আমরা, শুরু করল তাইতা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকটা ডাইনীকে দেখেছে, বলে উঠলেন দিমিতার। ডাইনীর কথা শুনেছে সে। নির্ভুলভাবে তার কণ্ঠে কথা বলেছে।
তার কথাবার্তার ধরন আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি, অপানার কথার সত্যতায় আমার সন্দেহ নেই, সায় দিল তাইতা। তবে আমার মতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। সোয়ে মিশরিয়। তার বলার ভঙ্গি উচ্চ রাজ্যের।
এটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনাদের ভাষায় আমার দক্ষতা এসব ব্যাপার ধরতে পারার মতো নয়। এটা ডাইনীর সত্যিকারের অবস্থানের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। থেবসে আসতে সোয়েকে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়নি ধরে নিলে দুটি রাজ্যের সীমানার ভেতরই আমাদের তদন্ত শুরু করতে পারি, কিংবা অন্ততপক্ষে, এগুলোর আশপাশের জায়গাগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে।
এইসব এলাকায় কি কি আগ্নেয়গিরি আছে?
ঠিক মিশরে কোনও বড় আগ্নেয়গিরি বা হ্রদ নেই। মধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে নীলনদ। উত্তরে এটাই সবচেয়ে কাছের জলের উৎস। এতনা দশদিনেরও বেশি দূরের পথ। ইয়োস ওখানে নেই, এ ব্যাপারে আপনি এখনও নিশ্চিত?
হ্যাঁ, মাথা দোলালেন দিমিতার।
বেশ। এই দিকে আরেক বড় আগ্নেয়গিরি, এতনার ওপাশে প্রণালীর উল্টোদিকের মূলভূখণ্ডের ভিসুভিয়াস সম্পর্কে কী বলবেন? জানতে চাইল তাইতা।
সন্দিহান মনে নিচের ঠোঁট কামড়ালেন দিমিতার। ওই কুকুরও শিকার করবে, জোরের সাথে বললেন তিনি। ওর খপ্পর থেকে পালোনোর পর ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে তিরিশ লীগেরও কম দূরের মন্দিরের যাজকদের সাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। ধারে কাছে থাকলে নির্ঘাৎ টের পেতাম, কিংবা সেও আমার উপস্থিতি বুঝে যেত। উঁহু, তাইতা, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে আমাদের।
আপাতত আপনার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই চলা যাক, বলল তাইতা। লোহিত সাগরের পুব প্রান্তে। ওই সাগরের তীরে আরব বা অন্য কোনও দেশের বুনো এলাকা চিনি না আমি। আপনি চেনেন?
না। ওসব জায়গায় গেলেও কোনও আগ্নেয়গিরির কথা শুনিনি বা দেখিনি।
যাগরেব পাহাড়ের ওধারের এলাকায় দুটি আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি, তবে বিশাল প্রান্তর ওগুলোকে ঘিরে রেখেছে। আমরা যেটা খুঁজছি তার সাথে ওগুলোর বর্ণনা মেলে না।
মিশরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা পড়ে আছে, বললেন দিমিতার। তবে আসুন, আরেকবার সম্ভাবনার কথা বিচার করা যাক। আফ্রিকার অভ্যন্তরে বিশাল নদী ও হ্রদ আর সেগুলোর কোনওটার আশপাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে না?
তেমন কিছু শুনিনি আমি-অবশ্য, এটাও ঠিক যে, ইথিওপিয়ার চেয়ে দক্ষিণে কেউ এপর্যন্ত যায়নি।
শুনেছি, তাইতা, মিশর থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লস্ত্রিসকে সেই উত্তরে হাওয়ার দেশ কেবুই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি, যেখানে নীল দুটো বিশাল জলধারায় ভাগ হয়ে গেছে।
ঠিক। কবুই থেকে আমরা নদীর বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পাহাড়সারিতে গিয়েছিলাম। ডান দিকের শাখা অন্তহীন জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে, ওদিকে বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কোনওদিন ওটার দক্ষিণের প্রান্তে যায়নি। কেউ গেলেও সে-কাহিনী বলতে ফিরে আসেনি। কেউ কেউ বলে জলাভূমি নাকি অন্তহীন, বিশাল, নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শেষমাথা পর্যন্ত চলে গেছে ওটা।
তাহলে আরও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তার রসদের জন্যে হাথরের মন্দিরের যাজিকার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। কবে ওরা তথ্য জানাবে?
দশ দিন পর আবার যেতে বলেছিলেন যাজিকা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
পালকির পর্দা একপাশে সরিয়ে তারপর পেছনের পাহাড়সারির দিকে তাকালেন দিমিতার। এখন মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছি আমরা। ওখানে গিয়ে যাজিকার আতিথ্য ও রাতের জন্যে ঘুমোনোর চাদর চাওয়া দরকার। সকালে ওর মানচিত্র শিল্পী ও ভূগোল বিশারদদের সাথে কথা বলা যাবে।
ফারাও মেমনন আমাকে তলব করলে, ওর ভৃত্যরা আমাকে খুঁজে পাবে না, বলল ইতা। আমরা আবার প্রাসাদ থেকে বেরুনোর আগেই ওর সাথে দেখা করতে দিন।
এখানে থামো, হাবারিকে নির্দেশ দিলেন দিমিতার। এখুনি থামাও, বলছি। তারপর তাইতার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই, কিন্তু এখন আমি জানি, আপনার সাথে আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বপ্ন ও অশুভ ভাবনা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। মেরেন আর আপনার দেওয়া প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ডাইনীটা অচিরেই আমাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে সফল হবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। সেদিন সকালে সোয়ের ভীতিকর আভা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার পর থেকেই এই একই অশুভ ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাকে। পালকির কাছে এসে বুড়োর জীর্ণ চেহারা ভালো করে পরখ করল ও। বিষাদের সাথে লক্ষ করল, দিমিতার ঠিকই বলেছেন: মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার। প্রায় বিবর্ণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া, তবে ওগুলোর গভীরে খাওয়ায় ব্যস্ত হাঙড়ের মতো চলমান ছায়া দেখতে পেল।
আপনিও দেখতে পেয়েছেন, নিরস, ফাঁকা কণ্ঠে বললেন দিমিতার।
জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ঘুরে দাঁড়াল তাইতা, হাবারিকে নির্দেশ দিল। দলটাকে ঘোরাও। হাথরের মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। এক লীগের চেয়ে সামান্য দূরে সেটা।
কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা। তারপর ফের কথা বললেন দিমিতার। আমার প্রাচীন, দুর্বল দেহের বাধা না থাকলে আরও দ্রুত এগোতে পারবেন আপনারা।
নিজের প্রতি বড় অবিচার করছেন আপনি, ওকে ভৎর্সনা করল তাইতা। আপনার সাহায্য ছাড়া কোনদিনই এতদূর আসতে পারতাম না।
শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে ডাইনীটাকে হত্যার সময় উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা হবার নয়। একটু সময় চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আবার খেই ধরলেন। সোয়ের সাথে কীভাবে সামাল দেবেন? আপনার সামনে একটা পথই খোলা। ফারাওকে সোয়ের মিনতাকাকে জাদু করার খবর আর তার মনে গেথে দেওয়া বিশ্বাসঘাতকার চিন্তার খবর দিলে তাকে আটক করার জন্যে তিনি প্রহরী পাঠাবেন। তখন আপনি নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের সুযোগ পাবেন। শুনেছি থেবসের কারারক্ষীরা নাকি তাদের কাজে বেশ দক্ষ। নির্যাতনের কথায় কুকুড়ে যান না তো?
স্রেফ শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সোয়ের মচকানোর সামান্যতম সম্ভাবনা আছে থাকলে তাতে দ্বিধা করব না। কিন্তু তাকে আপনি দেখেছেন। ডাইনীকে রক্ষা করতে চাইবে সে। ডাইনীর সাথে তার এমনই বোঝাঁপড়া যে তার কষ্ট ও তার কারণ বুঝে যাবে সে। সে বুঝতে পারবে ফারাও ও রানি মিনতাকা তার বোনা জালের কথা টের পেয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে রাজপরিবারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে তা।
তা ঠিক, সায় দিলেন দিমিতার।
তাছাড়া, সোয়েকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন মিনতাকা, তখন নেফার সেতি বুঝবেন তিনি আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী। তাতে ওদের ভালোবাসা ও আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওদের এই ক্ষতি করতে পারব না।
তাহলে মন্দিরেই উত্তর পাওয়ার আশা করতে হবে।
দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলেন যাজিকারা। স্বাগত জানাতে দুজন নবীশকে পাঠালেন তারা। ওদের পথ দেখিয়ে মূল প্রবেশ পথের র্যাম্পের কাছে নিয়ে এলো ওরা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রধান যাজিকা। :
আপনাকে দেখে খুবই খুশি হলাম, ম্যাগাস। এমনিতেও ব্রাদার নুবাঙ্ক আপনার অনুরোধ নিয়ে অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করেছেন জানাতে আপনার খোঁজে থেবসে বার্তাবাহক পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তিনি আপনাকে তাঁর পাওয়া তথ্য তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে আপনি আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। তাইতার দিকে মায়ের চোখে তাকালেন তিনি। আপনি এখানে হাজারবার স্বাগত। পুরুষদের মহলে পরিচারিকরা আপনার চেম্বারের ব্যবস্থা করছে। যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পরেন। আপনার বিজ্ঞ আলোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।
আপনার অসীম দয়া ও ঔদার্য, মা। আমার সাথে আরেকজন মহাজ্ঞানী ও বিখ্যাত ম্যাগাস রয়েছেন।
তিনিও এখানে স্বাগত। আপনার সঙ্গীদের পুরুষদের মহলে আশ্রয় ও খাবার দেওয়া হবে।
যার যার বাহন থেকে নেমে পড়ল ওরা। দিমিতারকে নামতে সাহায্য করল মেরেন। তারপর মন্দিরে প্রবেশ করল। প্রধান দরবারের আনন্দ, মাতৃত্ব ও ভালোবাসার দেবী হাথরের প্রতিকৃতির সামনে থামল ওরা। শাদা-কালো ফুটকিঅলা গাভী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে, শিঙজোড়া সোনালি চাঁদ দিয়ে সাজানো। প্রার্থনা করলেন যাজিকা। তারপর তাইতা ও দিমিতারকে একটা মাঠের উপর দিয়ে মন্দিরের যাজকদের এলাকায় নিয়ে যেতে এক নবীশকে ডাকলেন। ওদের একটা ছোট পাথুরে দেয়ালের সেলে নিয়ে এলো সে, এখানে দূর প্রান্তের দেয়ালের গায়ে চাদর ঠেস দিয়ে রাখা। জলভর্তি গামলাও আছে যাতে তরতাজা হয়ে নিতে পারে ওরা।
রাতের খাবারের সময় আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে আবার আসব আমি, ব্রাদার নুবাঙ্ক ওখানে আপনাদের সাথে দেখা করবেন।
*
ওরা যখন খাবার ঘরে পা রাখল তখন আগে থেকেই মোটামুটি জনাপঞ্চাশ যাজক খাচ্ছিল, কিন্তু একজন এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ওদের সাথে মিলিত হতে দৌড়ে এলো। আমি নুবাঙ্ক। আপনাদের স্বাগত জানাই। মানুষটা লম্বা, ছিপছিপে, মড়ার মতো চেহারা। এই দুঃসময়ে মিশরে খুব কমই মোটাসোটা লোক আছে। খাবার একেবারেই সামন্য: এক বাটি ঝোল আর ছোট এক জগ বিয়র। মোটামুটি নীরবেই খাওয়া সারল সবাই। কেবল নুবাঙ্ক বাদে। এক মুহূর্তের জন্যেও কথা থামাল না সে। কণ্ঠস্বর খরখরে, আচরণে তোষামুদে ভাব।
কাল কেমন করে বাঁচব জানি না, দিমিতারকে বলল তাইতা, নিজেদের সেলে ফিরে এসেছে ওরা, ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রিয় ব্রাদার নুবাঙ্কের বকবকানি শুনতে গেলে দিনটা লম্বা হয়ে যাবে।
তবে ভূগোল সম্পর্কে তার বিদ্যা পূর্ণাঙ্গ, যুক্তি দেখালেন দিমিতার।
ঠিক বিশেষণটাই বেছে নিয়েছেন আপনি, ম্যাগাস, বলে পাশ ফিরে শুলো তাইতা।
*
এক নবীশ ওদের নাশতার জন্যে তলব করতে এলো যখন, তখনও সূর্য ওঠেনি। দিমিতারকে আরও দুর্বল ঠেকল। তাই মেরেন ও তাইতা মাদুর থেকে উঠতে সাহায্য করল ওকে।
মাফ করবেন, তাই। ভালো ঘুম হয়নি আমার।
আবার স্বপ্ন? তেনমাস ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ। ডাইনীটা কাছে এসে পড়ছে। ওকে ঠেকানোর মতো শক্তি পাচ্ছি না।
তাইতাও স্বপ্নে আক্রান্ত হয়েছে। ওর স্বপ্নে ফিরে এসেছে পাইথনটা। এখনও নাক ও গলার পেছনে লেগে আছে ওটার বুনো গন্ধ। কিন্তু নিজের ভীতি গোপন করে দিমিতারের সামনে আত্মবিশ্বাসী ভাব করল ও। আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের।
নাশতায় ছিল ছোট কঠিন ধুরা পাতা আর আরেক জগ পাতলা বিয়র। গতরাতে যেখানে বাধা পড়েছিল সেখান থেকে ফের একক সংলাপ শুরু করল ব্রাদার নুবাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে অচিরেই নাশতার পালা চুকে গেল। কিছুটা স্বস্তির সাথে নুবাঙ্কের পিছু পিছু গুহার মতো দরবার আর উঠোন হয়ে মন্দিরের লাইব্রেরির দিকে এগোল ওরা। বিশাল, শীতল একটা কামরা, উঁচু উঁচু পাথুরে দেয়ালে মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঢেকে রাখা তাক ছাড়া অলঙ্করণ বা আসবাবেব কোনও বালাই নেই। প্যাপিরাসের স্কোলে ঠাসা তাকগুলো, হাজার হাজার।
নুবাঙ্কের জন্যে অপেক্ষা করছিল তিনজন নবীশ ও দুই জন পুরোনো শিষ্য। এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, হাত সামনে বেঁধে রেখেছে। দাসসুলভ আচরণ। ওরা নুবাঙ্কের সহকারী। ওদের ভক্তির পেছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। ওদের সাথে রূঢ় আচরণ করে নুবাঙ্ক। সবচেয়ে কর্কশ অপমানকর ভাষায় নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না সে।
তাইতা ও দিমিতার প্যাপিরাস স্কুলে ভর্তি দীর্ঘ নিচু সেন্টার টেবিলে বসার পর লেকচার শুরু করল নুবাঙ্ক। পরিচিত বিশ্বের প্রতিটি আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণ জিনিসের বিবরণ দিতে লাগল, সেটা বিশাল জলাধারের আশপাশে হোক বা না হোক। একেকটা জায়গার নাম বলছে আর অমনি ভীত সন্ত্রস্ত একজন সহাকারীকে তাক থেকে সঠিক স্ক্রোলটা আনতে বলছে। অনেক সময়ই নড়বড়ে মই বেয়ে ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। এদিকে লাগাতার মুখখিস্তি করে দৌড়ের উপর রাখছে ওদের নুবাঙ্ক। তাই একবার ওর মূল অনুরোধের কথা উল্লেখ করে এই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চেষ্টা করলেও দায়সারাভাবে মাথা দুলিয়ে ফের নিজের কায়দায় কাজ চালিয়ে গেল নুবাঙ্ক।
অভাগা এক নবীশ ছিল নুবাঙ্কের পছন্দের শিকার। বেখাপ্পা চেহারা তার: শরীরের কোনও অংশই খুঁত হীন বা বিকৃতির উর্ধ্বে মনে হয়নি। ওর মুড়ানো মাথা লম্বাটে, মাথায় খুস্কি ভরা, পরিষ্কার ঘা সেখানে। কুঁতকুঁতে কাছাকাছি বসানো ট্যারা চোখের উপর বসানো তার ভুরুজোড়া। হেয়ারলিপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে বড় বড় দাঁত। কথা বলার সময় লালা গড়াচ্ছে। যদিও মুখে খুব একটা কথা সরে না তার। চিবুক এমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে যে আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। বাম গালের উপর বড় মালবেরি আকারের জন্মদাগ, বুকটা ভেতরে ঢোকানো, পাহাড়ের মতো কুঁজঅলা পিঠ। কাঠির মতো সরু পাজোড়া বাকানো; হাঁটার সময় একপাশে হেলে হাঁটে।
দিনের মাঝামাঝি সময় একজন নবীশ দুপুরের খাবারের জন্যে ওদের খাবার ঘরে যেতে তলব করতে এলো। সবাই আধা উপোস থাকায় নুবাঙ্ক ও তার সহকর্মীরা দ্রুত সাড়া দিল। খাবারের সময় কুঁজো নবীশকে আড়ালে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে দেখল তাইতা। তাইতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বোঝমাত্র উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল সে। ওখানে একবার পেছনে তাকিয়েই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে; বোঝাতে চাইছে, তাইতা ওকে অনুসরণ করুক।
ছোটখাট মানুষটাকে টেরেসে ওর অপেক্ষায় থাকতে দেখল তাইতা। ফের ইশারা করল সে। তারপর একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুসরণ করল তাইতা। অচিরেই প্রাঙ্গণের একটা ছোট মন্দিরে আবিষ্কার করল নিজেকে। দেয়ালগুলো হাথরের আবক্ষমূর্তিতে ঢাকা। ফারাও মামাসের একটা মূর্তিও রয়েছে। ওটার পিছনে গা ঢাকা দিয়েছে লোকটা।
মহান ম্যাগাস! আপনাকে একটা কিছু বলার আছে আমার, আপনার হয়তো কৌতূহল হতে পারে। তাই কাছে এগিয়ে যেতেই প্রণত হলো সে।
উঠে দাঁড়াও, সহজ কণ্ঠে বলল তাইতা। আমি রাজা নই। তোমার নাম কী? ব্রাদার নুবাঙ্ক এই নবীশটিকে কেবল এই মিয়া সম্বোধন করেছে।
এভাবে হাঁটি বলে আমাকে সবাই টিপটিপ ডাকে। আমার দাদা মিশর থেকে ইথিওপিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লক্ট্রিসের দরবারের একজন নিম্নপদস্থ চিকিৎসক ছিলেন। তখন প্রায়ই আপনার কথা বলতেন তিনি। আপনার হয়তো তার কথা মনে থাকতে পারে, ম্যাগাস। তার নাম সিতন।
সিতন? এক মুহূর্ত ভাবল তাইতা। হ্যাঁ! ভালো ছেলে ছিল সে। চামচ দিয়ে কাঁটাঅলা তীর তোলায় বেশ দক্ষ ছিল। অনেক সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রাণখোলা হাসি দিল টিপটিপ। কাটা ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তোমার দাদার কী হয়েছে?
বুড়ো বয়সে শান্তিতেই মারা গেছেন, তবে যাবার আগে দক্ষিণের দেশে আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী বলেছেন তিনি। ওখানকার লোকজন আর বুনো জম্ভজানোয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতের কথা বলেছেন, দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া এক বিশাল জলাভূমির কথাও বলেছেন।
সে ছিল দারুণ উত্তেজনার সময়, টিপটিপ, মাথা দুলিয়ে ওকে অনুপ্রাণিত করল তাইতা। বলে যাও।
কেমন করে আমাদের জাতির মূল অংশ নীলের বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পর্বতমালার দিকে গিয়েছিল সে কাহিনী বলেছেন তিনি। শেষ সীমানা আবিষ্কার করার জন্যে ডান দিকের শাখায় একটা দল পাঠিয়েছিলেন রানি লস্ত্রিস। সেনাপতি লর্ড আকেরের নেতৃত্বে বিশাল জলার দিকে রওয়ানা হয়েছিল তারা, সেই বাহিনীর একজন ছাড়া আর কাউকে আর দেখা যায়নি। কথাটা কি ঠিক, ম্যাগাস?
হ্যাঁ, টিপটিপ। রানির বাহিনী পাঠানোর কথা মনে আছে আমার। স্বয়ং তাইতাই সেই অভিশপ্ত অভিযানে আকেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। লোকটা ঝামেলাবাজ ছিল, লোকজনের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সেটা আর এখন বলতে গেল না ও। এও ঠিক যে, কেবল একজনই ফিরে এসেছিল। কিন্তু মানুষটা রোগে আর যাত্রায় এতই ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত ছিল যে আমাদের কাছে ফিরে আসার অল্প কদিন বাদেই জ্বরের কাছে হার স্বীকার করে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! উত্তেজনায় তাইতার বাহু খামচে ধরল টিপটিপ। আমার দাদাই সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘোরের ভেতর সেই সৈনিক পাহাড় আর বিশাল সব হ্রদে ঘেরা এক দেশের কথা বলেছিল। হ্রদগুলো এত বিশাল যে খালি চোখে এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না।
তাইতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। হ্রদ! আগে তো এ-কথা শুনিনি। বেঁচে যাওয়া সেই লোকের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। ইথিওপিও পাহাড়ে ছিলাম আমি। সে যখন মৃত্যুর স্থান কেবুইয়ে পৌঁছায় তখন আমি সেখান থেকে শত শত লীগ দূরে। আমার কাছে যে খবর আসে তাতে বলা হয়েছিল যে, রোগীর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারেনি। টিপটিপের দিকে তাকিয়ে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। ওর আভা থেকে বুঝতে পারল আন্তরিক মানুষ সে, যেমন মনে আছে সেভাবেই সত্যি কথা বলছে। তোমার আরও কিছু বলার আছে, টিপটিপ? আমার কিন্তু তাই ধারণা।
জ্বি, ম্যাগাস। একটা আগ্নেয়গিরি আছে, হড়বড় করে বলে উঠল টিপটিপ। সেকারণেই আপনার কাছে আসা। মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক একটা জ্বলন্ত পাহাড়ের কথা বলেছিল, এর আগে কেউ অমন দেখেনি। ওরা বিশাল জলাভূমি পেরুনোর পর অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল ওটা। সে বলেছে ওটার সুড়ঙ থেকে বেরুনো ধোয়া আকাশের বুকে চিরস্থায়ী মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। বাহিনীর কেউ কেউ একে কালো আফ্রিকান দেবতাদের আর না এগোনোর সতর্কবাণী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড আকের ওটাকে স্বাগত সঙ্কেত ঘোষণা করেন। ওখানে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি; অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অবশ্য, এই পর্যায়ে সৈনিকটি আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিসীমায় জ্বরে পড়লে সে মরে গেছে ভেবে তাকে ফেলে সঙ্গীরা দক্ষিণে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনওমতে দানবীয় কালো মানুষদের একটা গ্রামে পৌঁছায় সে, হ্রদের পাশেই ওদের বসতি ছিল। ওকে তুলে নিয়ে যায় ওরা; ওদের এক শামান ওষুধ দিয়ে সেরে ওঠা পর্যন্ত সেবাযত্ন করে তার। ঠিকমতো সেরে ওঠার পর ফিরতি পথ ধরে সে। উত্তেজনার বশে তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল টিপটিপ। ব্রাদার নুবাঙ্ক বাধা দেওয়ার আগেই কথাটা আপনাকে বলতে চেয়েছি। সত্তর বছর আগের গুজবে আপনাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন আমরা ভূগোলবিশারদরা কেবল সত্যি বিষয় নিয়ে কাজ করি। ব্রাদার নুবাঙ্ককে আবার আমার অবাধ্য হওয়ার কথা বলে দেবেন না তো? তিনি ভালো, পবিত্র পুরুষ, তবে অনেক কঠোর হতে পারেন।
ঠিক কাজই করেছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। আস্তে করে ওকে খামচে ধরে রাখা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করল। তারপর হঠাৎ আরও নিবিড়ভাবে পরখ করতে টিপটিপের হাত তুলে নিল। তোমার ছয় আঙুল! বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।
স্পষ্টই হতবাক হয়ে গেছে টিপটিপ। হাত মুঠি বানিয়ে বিকৃতি আড়াল করার চেষ্টা করল সে। দেবতারা আমার গোটা শরীরটাই উল্টাপাল্টা করে বানিয়েছেন। আমার মাথা, চোখ, পিঠ, হাত-পা-আমার সমস্ত কিছুই বাঁকাচোরা, কিস্তুত। অশ্রুতে ভরে উঠল তার চোখ।
কিন্তু তোমার মনটা ভালো, ওকে সান্ত্বনা দিল তাইতা। আস্তে করে ওর হাত খুলল ও। স্বাভাবিক কনে আঙুলের পাশে হাতের তালু থেকে একটা বাড়তি ছোট্ট আঙুল গজিয়েছে।
ছয় আঙুল পথ দেখাবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা।
আমি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইনি, ম্যাগাস। আমি কোনওদিনই ইচ্ছাকৃতভাবে ওভাবে আপনাকে অসম্মান করতে যাব না। গুঙিয়ে উঠল টিপটিপ।
না, টিপটিপ, আমার দারুণ উপকার করেছ তুমি। আমার কৃতজ্ঞতা আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।
ব্রাদার নুবাঙ্ককে বলে দেবেন না তো?
না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।
আপনার উপর হাথরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ম্যাগাস। এবার যাই, ব্রাদার নুবাঙ্ক এলে দেখে ফেলবেন আমাকে। কাঁকড়ার মতো পাশ কেটে চলে গেল টিপটিপ। তাকে কিছুটা এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিল তাইতা, তারপর লাইব্রেরির ফিরতি পথ ধরল। মেরেন ও দিমিতার ওর আগেই এসে পড়েছে। টিপটিপকে গালমন্দ করছে নুবাঙ্ক: ছিলে কোথায়?
ল্যাট্রিনে গিয়েছিলাম, ব্রাদার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন কিছু খেয়েছি, পেটে গোলমাল বেধে গেছে।
আমার পেটেও গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছ তুমি, ব্যাটা দুর্গন্ধঅলা মলের টুকরো। ওখানেই নিজেকে রেখে আসা উচিত ছিল তোমার। টিপটিপের জন্মদাগের উপর আঘাত করল সে। যাও, এবার পুব সাগরের দ্বীপের বর্ণনাঅলা স্ক্রলগুলো নিয়ে এসো।
দিমিতারের পাশে বসে তেনমাস ভাষায় তাই বলল, বেচারার ডান হাতের দিকে একবার তাকান।
ওর ছয়টা আঙুল, বলে উঠলেন দিমিতার। ছয় আঙুল পথ দেখাবে! ওর কাছে কিছু জানতে পেরেছেন, নাকি পারেননি?
নীল মাতার ডান দিকের শাখা ধরেই উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের। ওখানেই এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির দেখা পাব। আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়ে আছে ইয়োস।
*
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই হাথরের মন্দির ত্যাগ করল ওরা। অনীহার সাথে ওদের বিদায় জানাল নুবাঙ্ক-এখনও পঞ্চাশটা আগ্নেয়গিরির বর্ণনা দেওয়া বাকি রয়ে গেছে তার। থেবসের নীচে নীলের ঘাটে যখন পৌঁছাল ওরা, তখনও অন্ধকার কাটেনি। পথ দেখিয়ে ওদের নদীর জলে নিয়ে এলো হাবারি ও মেরেন। তাইতা ও দিমিতার অনুসরণ করল। কিন্তু দুটি দলের মাঝে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হলো। নেতারা দুর্গন্ধময় লাল পুকুরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথে আধাআধি আগে বাড়ার পর কাদা ভেঙে এগোতে শুরু করল দিমিতারের উট। ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের উপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা একটা বৈরী প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা টের পেল। কানের পাশে শিরাটা দপদপ করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ারের নিত্যস্বর উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ও।
এইমাত্র ছেড়ে আসা তীরে এক নিঃসঙ্গ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের সাথে তার কালো জোব্বা মিশে গেলেও নিমেষে তাকে চিনে ফেলল তাইতা।
অন্তর্চক্ষু খুলতেই সোয়ের ভিন্ন ধরনের আভা দেখা দিল, মানুষটাকে যেন ঢেকে ফেলছে, অনেকটা বনফায়ারের শিখার মতো: রঙটা হিংস্র লাল, এখানে ওখানে পিঙ্গল ও সবুজ ছোপ। এমন ভয়ঙ্কর আভা এর আগে কখনও দেখেনি তাই।
সোয়ে এখানে! পালকিতে শোয়া দিমিতারের উদ্দেশে তাগিদ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে উটের পার হওয়ার পথের পুকুরের তলের দিকে ইঙ্গিত করল সোয়ে। যেন তার নির্দেশে সাড়া দিচ্ছে, এমনভাবে পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠল একটা বিশাল কুনো ব্যাঙ, কামড়ে উটের বাম পায়ের উরুর উপরের অংশ থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিল। ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জানোয়ারটা, পুকুর থেকে লাফ দিল। ওপারে যাবার বদলে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরই নদীর তলদেশের উপর দিয়ে ছুটল সবেগে। প্রবলবেগে এপাশ ওপাশ দোল খেতে লাগল দিমিতারের পালকি।
মেরেন! হাবারি! মেয়ারের পেটে লাথি হাঁকিয়ে ছুটন্ত উটের পিছু ধাওয়া শুরু করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা। বাহন ঘুরিয়ে নিল মেরেন ও হাবারি, পিছু ধাওয়ায় ওদের সামিল করতে তাগিদ দিতে লাগল।
শক্ত করে ধরে রাখুন, দিমিতার! চিৎকার করল তাইতা। আমরা আসছি! ওর পাছার নিচে যেন উড়াল দিচ্ছে উইন্ডস্মোক। কিন্তু দিমিতারের নাগাল পাওয়ার আগেই আরেক পুকুরে পৌঁছে গেল উটটা, জলের ধারা ছিটিয়ে ছুটতে লাগল সেটার ভেতর দিয়ে। তখুনি ওটার সামনেই ফাঁক হয়ে গেল পুকুরের জল, আরেকটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত উটের মাথায় চড়াও হয়ে বুলডগের মতো মরণ কামড় বসাল। নিশ্চয়ই কোনও স্নায়ুতে আঘাত করে থাকবে, উটের সামনের পাজোড়া ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ে ব্যাঙের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়তে লাগল ওটা। উটের নিচে চাপা পড়ে গেছে পালকিটা, ভারে নাজুক বাঁশের কাঠামো মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
দিমিতার! ওকে বাঁচাতেই হবে! চিৎকার করে মেরেনের উদ্দেশে বলল তাইতা। আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল মেয়ারকে। কিন্তু ওটা পুকুরের কিনারে পৌঁছার আগেই জলের নিচ থেকে উঠে এলো দিমিতারের মাথা। কোনওভাবে পালকি থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু কাদায় অর্ধেকটা ডুবে গেছেন। মাথায় আস্তরণ পড়ে গেছে, ক্রমাগত কাশছেন বেচারা, বমি করছেন, নড়াচড়া নাজুক, ভ্রান্তিময়।
আমি আসছি! চিৎকার করে বলল তাইতা। হাল ছাড়বেন না! তারপরই সহসা কুনো ব্যাঙে টগবগ করে ফুটতে শুরু করল গোটা পুকুর। তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দিমিতারের উপর, যেন এক পাল বুনো কুকুর কোনও গেযেল হরিণকে আক্রমণ করেছে। আর্তনাদ করার প্রয়াসে মুখ হাঁ হয়ে ছিল বুড়ো মানুষটার। কিন্তু কাদা বাধা দিচ্ছে। ব্যাঙের দল টেনে পানির নিচে নিয়ে গেল ওকে, ফের যখন সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে উঠে এলেন তিনি, ওর লড়াই প্রায় শেষের দিকে। জলের নিচের ব্যাঙগুলোই ওর নড়াচড়ার কারণ, খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে ওরা।
আমি এখানে, দিমিতার! মরিয়া হয়ে চিৎকার করল তাইতা। মেয়ার নিয়ে উন্মত্ত ব্যাঙগুলোর ভেতর যেতে পারছে না, জানে ঘোড়াটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওরা। লাগাম টেনে ছড়ি হাতে পিছলে নেমে এলো ও। পুকুরের জলের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল। কিন্তু জলের নিচে একটা ব্যাঙ পায়ে দাঁত বসাতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। ছড়ির আঘাত হানল ব্যাঙটাকে। আঘাতটাকে জোরাল করতে শারীরিক-মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ এক করে নিল। ছড়ির ডগা জায়গামতো আঘাত করতেই ধাক্কা অনুভব করল ও। ওকে ছেড়ে দিল জানোয়ারটা। চিত হয়ে জলের উপর উঠে এলো, হতচকিত, খিঁচুনির ঢঙে পা ছুঁড়ছে।
দিমিতার! ওকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত ব্যাঙের দল থেকে থেকে আলাদা করে চেনা দায়। চকচকে কালো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে মানুষ আর পশু।
হঠাৎ গিজগিজে ব্যাঙের ঝাঁকটাকে ফাঁক করে দুটি শীর্ণ বাহু উঠে এলো জলের উপর। দিমিতারের কণ্ঠস্বর কনে এলো ওর। আমি শেষ। আপনাকে একাই যেতে হবে, তাইতা। ওর কণ্ঠস্বর বলে চেনা মুশকিল, কাদা আর বিষাক্ত লাল পানিতে দম বন্ধ হয়ে এসেছে তার। এবং পরক্ষণেই অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বড় আকারের একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ওর মাথার এক পাশে কামড়ে ধরে শেষবারের মতো পানির নিচে নিয়ে যেতেই থেমে গেল সেটা।
আবার সামনে এগোল তাইতা। কিন্তু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেরেন। শক্তিশালী হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কাদা থেকে তুলে নিল ওকে, তারপর ফিরিয়ে আনল তীরে।
নামাও আমাকে, নিজেকে মুক্ত করতে লড়াই করছে তাইতা। ওকে বিশ্রী জানোয়ারগুলোর হাতে ফেলে রেখে যেতে পারব না। কিন্তু ছাড়ল না মেরেন।
ম্যাগাস, আপনি আহত। নিজের পায়ের দিকে একবার তাকান। ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন। লাল কাদার সাথে মিশে যাচ্ছে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত। দিমিতার শেষ হয়ে গেছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মেরেন। তাইতাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। ধূসর মেয়ারটাকে ধরতে ফিরে গেল ও, ওর কাছে পৌঁছে দিল ওটাকে। তাইতাকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করার সময় মৃদু কণ্ঠে বলল, আমাদের যেতেই হবে, ম্যাগাস। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনার ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যাঙের দাঁত বিষাক্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর কাদাও এমন জঘন্য যে আপনার মাংসে সংক্রমণ ঘটবে।
কিন্তু আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, বন্ধুর শেষ একটা চিহ্নের খোঁজ করছে। তার শেষ যোগাযোগের সন্ধান করছে। কিন্তু কোনওটাই দেখা গেল না। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে মেয়ারের লাগাম তুলে নিয়ে সামনে বাড়ল মেরেন, আর প্রতিবাদ করল না তাইতা। পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছে ও। প্রবীন সাধু চলে গেছেন, এখন বুঝতে পারছে ওর ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ও। এখন একাই ডাইনীর মোকবিলা করতে হবে। ওকে, সম্ভাবনাটা দারুণ হতাশায় ভাবিয়ে তুলল ওকে।
*
নিরাপদে থেবসের প্রাসাদের নিজেদের মহলে পৌঁছানোর পর তাইতাকে গোসল করিয়ে কাদা ধুয়ে ফেলতে বড় গামলা ভর্তি গরম পানি আর বোতল ভর্তি সুগন্ধি মলম পাঠাল রামরাম। ওকে খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর দুজন রাজচিকিৎসক এলেন। তাদের পেছনে একদল সহকারী, ওদের হাতে ওষুধ ও জাদুকরী তাবিজ ভরা বাক্স। তাইতার নির্দেশে ওদের দরজায় থেকেই বিদায় করে দিল মেরেন। মিশরের সবচেয়ে দক্ষ ও জ্ঞানী শল্যচিকিৎসক ম্যাগাস নিজেই তাঁর ক্ষতের পরিচর্যা করছেন। আপনাদের উদ্বেগের জন্যে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
পাতলা মদে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলল তাইতা। তারপর স্বয়ং-প্রভাবিত ঘোরে বাম পা অবশ করে নিল। তেলের কুপির আগুনে তপ্ত ব্রোঞ্জের একটা চামচ দিয়ে গভীর করে পাটা চিড়ল মেরেন। ওকে শেখানো তাইতার অন্যতম ডাক্তারী বিদ্যা এটা। ওর কাজ শেষে হলে উঠে দাঁড়াল তাইতা, উইন্ডস্মোকের এক গোছা লেজ সুতো হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষতস্থানের দুপ্রান্ত সেলাই করল। নিজের বানানো মলম লাগিয়ে লিনেনে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ করতে গিয়ে ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেল ও, দিমিতারকে হারানোর শোকে পূর্ণ। মাদুরে শুয়ে চোখ বুজল ও।
দরজার কাছে শোরাগোলের শব্দে চোখ মেলে তাকাল ও। পরিচিত কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, তাইতা, কোথায় তুমি? তোমাকে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না, এমন একটা বিপদ বাধালে যে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখন আর কচি খোকাটি নও! এই কথা বলে রোগীর ঘরে পা রাখলেন জগতের বুকে ঐশী ঈশ্বর ফারাও নেফার সেতি। লর্ড ও পরিচারকের দল অনুসরণ করল তাঁকে।
মনে হচ্ছে, তাইতার প্রাণশক্তি বেড়ে গেছে। ওর দৈহিক শক্তিও ফিরে এসেছে। যেন। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কোনওমতে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
তাইতা, লজ্জা নেই তোমার? ভেবেছিলাম মরতে চলেছ তুমি, অথচ এখন দেখছি বোকার মতো মুখে হাসি নিয়ে আরামে শুয়ে আছো?
জাঁহাপনা, এটা স্বাগত জানানোর হাসি, আপনাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি।
ওকে ঠেলে আবার বালিশে শুইয়ে দিলেন নেফার সেতি। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকলেন। মাই লর্ডস, আমাকে ম্যাগাসের কাছে রেখে যেতে পারো, ও আমার পুরোনো বন্ধু-শিক্ষক। প্রয়োজনে তোমাদের তলব করব। চেম্বার থেকে পিছু হটে বের হয়ে গেল ওরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে সামনে ঝুঁকলেন ফারাও। আইসিসের বুকের মিষ্টি দুধের দোহাই, তুমি নিরাপদে আছে দেখে খুশি হয়েছি, যদিও শুনেছি তোমার সঙ্গী ম্যাগাস গত হয়েছে। সব কিছু শুনতে চাই আমি, তবে তার আগে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে স্বাগত জানানোর সুযোগ দাও। মেরেনের দিকে তাকালেন তিনি। দরজায় পাহারায় রয়েছে সে। তাঁর সামনে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়াল মেরেন। কিন্তু ওকে টেনে দাঁড় করালেন ফারাও। আমার সামনে নিজেকে খাট করো না, লাল পথের সাথী। আন্তরিক আলিঙ্গনে ওকে বুকে টেনে নিলেন নেফার সেতি। তরুণ বয়সে এক সাথে যোদ্ধা হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ওরা; রথ চালানো, তলোয়ার চালনা ও তীর নিক্ষেপে দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষিত ও সুপরিচিত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দল বেঁধে লড়াই করেছেন ওরা, পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে বাধা দিতে হত্যাসহ যেকোনও অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। একসাথে বিজয় লাভ করেছিলেন ওরা। লাল পথের সাথীরা যোদ্ধার রক্তের সম্পর্কে ভাই, জীবনের জন্যে এক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেরেন নেফার সেতির বোন রাজকুমারী মেরিকারার সাথে বাগদত্ত। ফারাও আর ও বলতে গেলে বোন জামাই আর সম্মন্ধী। এতে ওদের বাধন আরও জোরাল হয়েছে। মেরেন হয়তো থেবসে উঁচু পদ ধারণ করতে পারত, কিন্তু তার বদলে তাইতার নবীশ হিসাবে নাম লিখিয়েছে।
তাইতা সব রহস্য শিখিয়েছে তোমাকে? তুমি শক্তিমান যোদ্ধার মতো ম্যাগাসও হতে পেরেছ? জানতে চাইলেন ফারাও।
না, জাঁহাপনা। তাইতার সীমাহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই মেধা নেই। এখনও একেবারে মামুলি কৌশলও আয়ত্ত করতে পারিনি। কয়েকটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ একটা ভাব করল মেরেন।
যেকোনও সময়ই একজন দক্ষ যোদ্ধা আনাড়ী জাদুকরের চেয়ে অনেক ভালো, পুরোনো বন্ধু। এসো, আমাদের সাথে সভায় বসো, অনেক আগে যেমনটা আমাদের রীতি ছিল, যখন আমরা স্বৈরাচারের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্যে লড়াই করছিলাম।
ওরা তাইতার মাদুরের দুপাশে বসার পর পরই সিরিয়াস হয়ে গেলেন নেফার সেতি। এবার কুনো ব্যাঙের সাথে তোমাদের মোকবিলার কথা বলো আমাকে।
পালা করে দিমিতারের মৃত্যুর বর্ণনা দিল তাইতা ও মেরেন। ওদের কথা শেষ হলে নীরব রইলেন নেফার সেতি। তারপর গর্জে উঠলেন। প্রতিদিন আগের চেয়ে বেপরোয়া আর হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারগুলো। আমি নিশ্চিত ওদের কারণেই নদীর জলাধারের অবশিষ্ট জল দূষিত ও নষ্ট হচ্ছে। ওগুলোর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভাবলেও দেখা গেছে একটাকে মারলে তার জায়গায় আরও দুটো এসে হাজির হচ্ছে।
জাঁহাপনা, বলে এক মুহূর্ত থামল তাইতা, তারপর ফের খেই ধরল, আপনাকে আগে ওদের যে সৃষ্টি করেছে সেই ডাইনীর খোঁজ পেতে হবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে। আপনার ও আপনার রাজ্যে তার পাঠানো কুনো ব্যাঙ আর অন্যান্য রোগ তার সাথেই মিলিয়ে যাবে, কারণ সেই এসবের মালিক। তারপর নীল নদ আবার বইবে, মিশরে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।
সতর্ক চোখে ওর দিকে তাকালেন নেফার সেতি। তবে কি ধরে নেব প্লেগগুলো প্রাকৃতিক নয়? জানতে চাইলেন তিনি। এক নারীর জাদুমন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছে এগুলো?
সেটাই আমার বিশ্বাস, তাঁকে নিশ্চিত করল তাইতা।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নেফার সেতি, পায়চারি শুরু করলেন। আপন ভাবনায় ডুবে গেছেন। অবশেষে থেমে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকালেন। কে এই ডাইনী? কোথায় সে? তাকে ধ্বংস করা যাবে, নাকি সে অমর?
আমার বিশ্বাস সে মানুষ, ফারাও, তবে তার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। নিজেকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করতে পারে সে।
কী নাম তার?
ইয়োস।
ভোরের দেবী? দেবদেবীদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে পুরোহিতরা ভালোমতোই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। কারণ তিনি স্বয়ং একজন দেবতা। এই না বললে সে মানুষ?
মানুষই, নিজের পরিচয় গোপন করতে দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে।
তাই যদি হয়, তার নিশ্চয়ই একটা জাগতিক আবাস রয়েছে। সেটা কোথায়, তাইতা?
দিমিতার আর আমি তারই খোঁজ করছিলাম, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে ফেলেছে সে। ওকে আক্রমণ করাতে প্রথমে একটা বিশাল পাইথন পাঠিয়েছিল, কিন্তু মেরেন আর আমি মিলে ওকে বাঁচাই, যদিও প্রায় মরার দশা হয়েছিল তার। পাইথন ব্যর্থ হলেও এবার কুনো ব্যাঙ দিয়ে সফল হয়েছে সে।
তার মানে ডাইনীকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা নেই তোমার? লেগে রইলেন নেফার সেতি।
নিশ্চিত করে না জানলেও অলৌকিক ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, একটা আগ্নেয়গিরিতে থাকে সে।
আগ্নেয়গিরি? কোনও ডাইনীর পক্ষেও কি সম্ভব? বলে হেসে উঠলেন তিনি। অনেক আগেই তোমাকে সন্দেহ না করতে শিখেছি আমি, তাইতা। কিন্তু বলো দেখি, কোন আগ্নেয়গিরি? অনেক আছে অমন।
আমার বিশ্বাস সেটার সন্ধান পেতে হলে নীলের উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের, কেবুইয়ের উজানে নদীর পথ আটকে দেওয়া সেই বিশাল জলা ভূমির ওধারে। এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির ভেতর তার আস্তানা। জগতের একেবারে শেষ সীমার কোথাও।
আমি ছোট থাকতে তুমি বলেছিলে আমার দাদী রানি লস্ত্রিস নদীর উৎস খুঁজে বের করতে লর্ড আকেরের নেতৃত্বে দক্ষিণে একদল সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। কেবুইয়ের ওই ভয়ঙ্কর জলাভূমির ওধারে হারিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর ফিরে আসেনি। ওই অভিযানের সাথে ইয়োসের সম্পর্ক থাকতে পারে?
আছে, আঁহাপনা, সায় দিল তাইতা। সেই বাহিনীর একজন মাত্র জীবিত সদস্য আবার কেবুইতে ফিরে এসেছিল, সেকথা আপনাকে বলেছি না?
গল্পের এই অংশের কথা আমার মনে নেই।
সেই সময় ব্যাপারটাকে তাৎপর্যহীন ঠেকেছে, তবে একজন ফিরে এসেছিল। লোকটা প্রলাপ বকছিল, দিশাহারা ছিল সে। চিকিত্সকরা মনে করেছিল যাত্রার ভোগান্তির কারণেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার। আমি ওর সাথে কথা বলার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু ইদানীং জানতে পেরেছি, মারা যাবার আগে অদ্ভুত কথা বলে গেছে সে যা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আমাকে সেসব বলেনি ওরা। দুনিয়ার শেষ মাথায় বিশাল হ্রদ ও পাহাড়ের কথা বলেছিল সে…আর সবচেয়ে বড় হ্রদের পাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি। এই কিংবদন্তী থেকেই দিমিতার আর আমি ডাইনীর অবস্থান জানতে পেরেছি। কুজো টিপটিপের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানাল ও।
মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলেন নেফার সেতি। তাইতার কথা শেষ হলে ভাবলেন খানিকক্ষণ; তারপর জানতে চাইলেন, আগ্নেয়গিরির এত গুরুত্ব কেন?
জবাবে ইয়োসের আস্তানায় দিমিতারের বন্দিত্ব ও পলায়নের কাহিনী বলল তাইতা।
ডুবো আগুনকে হাপর হিসাবে ব্যবহার করে জাদু সাজায় সে। প্রবল তাপ থেকে আসা শক্তি ও সালফারের গ্যাস তার ক্ষমতাকে দেবতার কাছাকছি পর্যায়ে নিয়ে যায়। ব্যাখ্যা করল তাইতা।
এত শত শত আগ্নেয়গিরি থাকতে এটাকেই সবার আগে পরখ করার জন্যে বেছে নিলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি।
কারণ মিশরের অনেক কাছে এটা, নীল নদের ঠিক উৎসের মুখে।
বুঝতে পারছি তোমার যুক্তি অকাট্য। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, বললেন নেফার সেতি। সাত বছর আগে নীল নদ মরে যাবার সময় দাদীর অভিযান সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলেছিল সব মনে পড়ে যায় আমার, তাই আরেকটা বাহিনী একই মিশনে উৎসে গিয়ে নদীর মরে যাবার কারণ অনুসন্ধানে পাঠিয়েছিলাম। নেতৃত্বে দিয়েছিলাম কর্নেল আহ-আখতনকে।
এই খবর আমার জানা ছিল না, বলল তাইতা।
তার কারণ আলোচনার করার জন্যে ছিলে না তুমি। মেরেন আর তুমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। নেফার সেতির কণ্ঠে ভৎর্সনা। আমার সাথে থাকা উচিত ছিল তোমার।
অনুশোচনার একটা ভাব ধরল তাই। আমাকে যে আপনার প্রয়োজন সেকথা আমার জানা ছিল না, আঁহাপনা।
তোমাকে সব সময়ই আমার প্রয়োজন হবে, ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয় এই অভিযানের খবর কী? চট করে সুযোগটা লুফে নিল তাইতা। ফিরে এসেছে?
না, ফেরেনি। কুচকাওয়াজ করে যাওয়া আটশো লোকের একজনও ফেরেনি। দাদীর সেই দলের চেয়ে আরও ভালোভাবে উধাও হয়ে গেছে। ডাইনী কি ওদেরও শেষ করেছে?
সেটা খুবই সম্ভব, জাঁহাপনা, নেফার সেতি এরই মধ্যে ডাইনীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, বুঝতে পারল তাইতা। তাকে ধাওয়া করার জন্যে নতুন করে বিশ্বাস করানো বা উৎসাহিত করার দরকার হলো না।
আমাকে কখনও নিরাশ করোনি তুমি, তাইতা, কেবল যখন একমাত্র দেবতারাই জানেন কোথায় বেড়াতে চলে যাও তখন ছাড়া। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন নেফার সেতি। এখন আমি আমার শত্রুর পরিচয় জানি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার জনগণের উপর থেকে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো দূর করতে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কেবল কুয়ো খনন, শত্রুর কাছে খাবার ভিক্ষা আর ব্যাঙ মারায় পর্যবসিত হয়েছিল আমার সব কাজ। এখন আমার সমস্যার সমাধানের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। ডাইনীটাকেই খতম করতে হবে!
লাফ দিয়ে উঠে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। কাজের লোক তিনি, তলোয়ার হাতে নিতে সব সময় প্রস্তুত। যুদ্ধের ভাবনা তাঁর চেতনাকে তরতাজা করে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা ও মেরেন, একের পর এক নানা বুদ্ধির জোয়ার খেলে যাচ্ছে তার মাথায়। খানিক পরপরই পাশের তলোয়ারের খাপে চাপড় মারছেন, চিৎকার করে বলে উঠছেন, হ্যাঁ, হোরাস ও অসিরিসের দোহাই, তাই করব! অবশেষে তাইতার দিকে ফিরলেন তিনি। ইয়োসের বিরুদ্ধে আরেকটা বাহিনীর নেতৃত্ব দেব আমি।
ফারাও, এরই মধ্যে দু-দুটি মিশরিয় বাহিনী গ্রাস করে নিয়েছে সে, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।
একটু স্থির হলেন নেফার সেতি। ফের পায়চারি শুরু করলেন। থামলেন আবার। ঠিক আছে। এতনায় দিমিতার যেমন করেছে তুমিও ঠিক তেমনি ওই ডাইনীর বিরুদ্ধে এমন এক জাদু শক্তি কাজে লাগাবে যাতে পাহাড় থেকে টসটসে পাকা ফলের মতো মাটিতে পড়ে ফেটে যাবে সে। তোমার কী মত, তাতা?
জাঁহাপনা, ইয়োসকে ভুল বুঝবেন না। দিমিতার আমার চেয়ে ঢের বড় মাপের ম্যাগাস ছিলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাইনীর মোকবিলা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে ধ্বংস করে দিয়েছে সে। বলতে গেলে কোনও রকম কষ্ট ছাড়াই। ঠিক যেভাবে আপনি দুহাতের আঙুলে কাঠি ভেঙে ফেলেন। দুঃখের সাথে মাথা নাড়ল তাইতা। আমার জাদু জেভলিনের মতো। দূরে ছুঁড়ে দিলে দুর্বল হয়ে যাবে, তখন তার বর্মে ঠিকরে গিয়ে সহজেই ব্যর্থ হবে। তার কাছাকাছি গিয়ে ঠিক মতো অবস্থান বের করতে পারলে আমার নিশানা অনেক ভালো হবে। তাকে চোখের সামনে পেলে হয়তো আমার তীর তার বর্ম ভেদ করতে পারবে। এত দূর থেকে ওকে স্পর্শ করতে পারব না।
সে দিমিতারকে খতম করার মতো ক্ষমতাধর হয়ে থাকলে তোমারও একই দণা করল না কেন? চট করে নিজের প্রশ্নে জবাব দিলেন তিনি। কারণ তোমাকে নিজের চেয়ে শক্তিশালী মনে করে সে।
ব্যাপারটা এত সহজ হলেই ভালো ছিল। না, ফারাও, তার কারণ এখনও সম্পূর্ণ ক্ষমতায় আমাকে আক্রমণ করেনি সে।
বিভ্রান্ত দেখাল নেফার সেতিকে। কিন্তু দিমিতারকে হত্যা করেছে সে, আমার সাম্রাজ্যকে বৈরিতার ঘানিতে দুমড়ে দিয়েছে। তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে কেন?
দিমিতারকে তার আর দরকার ছিল না। আপনাকে তো বলেছি ওর হাতে বন্দি থাকার সময় কীভাবে বিশাল রক্তচোষার মতো তাঁর সব বিদ্যা আর দক্ষতা শুষে নিয়েছিল সে। ও পালিয়ে যাবার পর তেমন মরিয়া হয়ে ওর খোঁজ করেনি। ওর জন্যে হুমকি ছিলেন না তিনি। ওর কাছে কিছু পাওয়ারও ছিল না। মানে, ওর সাথে আমার ঐকবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তখন আবার তার আগ্রহ দেখা দেয়। আমরা একসাথে এমন তাৎপর্যময় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম যে আমার উপস্থিতি বুঝতে পারছিল সে। দিমিতারের মতো আমাকেও শুষে শেষ না করে ধ্বংস করতে চাইবে না সে, তবে আমাকে নিঃসঙ্গ না করা পর্যন্ত ফাঁদে ফেলতে পারবে না। তাই আমার মিত্রকে শেষ করেছে।
তোমাকে তার অশুভ উদ্দেশ্যে বন্দি করতে চাইলে তোমার সাথে আমার সেনাবাহিনীকেও নিয়ে যাব আমি। তুমি হবে আমার শিকারের ঘোড়া। তোমাকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে আসার টোপ হিসাবে ব্যবহার করব, তুমি ওর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার পর দুজনে মিলে আক্রমণ করব ওকে। প্রস্তাব রাখলেন নেফার সেতি।
মরিয়া ব্যবস্থা, ফারাও। আপনাকে যেখানে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারবে সেখানে কেন আপনাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে সে, যেমনটা দিমিতারের বেলায় করেছে?
তোমার কথায় মনে হচ্ছে, মিশরের অধিকার চায় সে। বেশ, ভালো কথা, ওকে বলব আত্মসমর্পণ করতে ও আমার দেশ ওর হাতে তুলে দিতে এসেছি। নিবেদনের অংশ হিসাবে ওর পায়ে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাইব।
গম্ভীর চোহার ধরে রাখল তাইতা। যদিও এমনি আনাড়ী পরামর্শ শুনে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছিল। জাঁহাপনা, ডাইনীটা কিন্তু মোহন্ত।
সে আবার কী? জানতে চাইলেন নেফার সেতি।
অন্তর্চক্ষু দিয়ে আপনি যেভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখেন ঠিক সেভাবে মানুষের আত্মা দেখতে পারে সে। আপনার আভায় অমন ক্রোধের বিচ্ছুরণ নিয়ে কোনওদিনই তার ধারে কাছে যেতে পারবেন না।
তাহলে তার রহস্যময় চোখে ধরা না পড়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে যাওয়া যাবে বলে মনে করো?
ওর মতো আমিও একজন মোহন্ত। সে টের পাবে এমন কোনও আভা ছড়াই আমি।
রেগে উঠছেন নেফার সেতি। দীর্ঘদিন ধরেই দেবতা আছেন বলে কোনও বাধা বা বিঘ্ন সহ্য করতে পারেন না। চড়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর: তোমার ভাবের কথায় ভোলার মতো এখন আর ছোট খোকাটি নেই আমি। আমার পরিকল্পনায় ঝটপট খুঁত বের করছ তুমি, বললেন তিনি। বিজ্ঞ ম্যাগাস, দয়া করে এমন একটা বিকল্প প্রস্তাব রাখ যাতে আমারগুলোর বেলায় যেমন করেছ আমিও তেমন করতে পারি।
আপনি ফারাও, আপনিই মিশর। কোনওভাবেই আপনি তার পেতে রাখা ফাঁদে গিয়ে পড়তে পারেন না। এখানে জনগণ, মিনতাকা ও সন্তানদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। আমি ব্যর্থ হলে যেন ওদের বাঁচাতে পারেন।
তুমি শয়তানীতে নিপূন একটা বদমাশ, তাতা। কোন দিকে এগোচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমাকে এখানে ব্যাঙ মারার কাজে রেখে তুমি আর মেরেন আরেকটা অভিযানে নামবে। আমাকে নিজের হেরেমে মেয়েমানুষের মতো কুকড়ে থাকতে হবে? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
উঁহু, আঁহাপনা, সিংহাসনে আসীন গর্বিত ফারাওর মতো জীবন দিয়ে দুটি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে তৈরি থাকবেন আপনি।
মুঠি পাকানো হাতজোড়া কোমরের কাছে রাখলেন নেফার সেতি। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তোমার মধুর সঙ্গীত শোনা ঠিক হচ্ছে না আমার। যেকোনও ডাইনীর মতোই শক্তিশালী ফাঁদ পাততে পারো তুমি। তারপর হালছাড়ার ঢঙে হাত মেলে দিলেন। গেয়ে যাও, তাতা, বাধ্য হয়েই শুনব আমি।
মেরেনকে ছোটখাট একটা বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন, বেশি না, বাছাই করা শখানেক সৈনিক হলেই চলবে। দ্রুত আগে বাড়বে ওরা, বিরাট রসদের কাফেলা ছাড়াই জমির বিভিন্ন জিনিসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারবে। কেবল সংখ্যা ডাইনীর পক্ষে কোনও হুমকী নয়। এই আকারের একটা বাহিনী নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে না সে। মেরেনের তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোর মতো কোনও মানসিক আভা না থাকায় ওকে সে ধোকা, সাধারণ সৈনিক হিসাবে পরখ করবে। ওর সাথে যাব আমি। অনেক দূর থেকে আমাকে চিনতে পরবে সে, কিন্তু কাছে গিয়ে আসলে তার খেলার সামগ্রীতেই পরিণত হতে যাচ্ছি। আমার কাছ থেকে কাক্ষিত জ্ঞান ও ক্ষমতা কেড়ে নিতে আমাকে কাছে যেতে দিতেই হবে তাকে।
সবেগে পায়চারি করতে করতে চাপা কণ্ঠে গজগজ করতে লাগলেন নেফার সেতি। অবশেষে ফের তাইতার মুখোমুখি হলেন: অভিযানের নেতৃত্বে থাকতে না পারাটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তোমার প্যাঁচানো যুক্তি আমার বুদ্ধি ঘোলা করে দিয়েছে। খানিকটা স্বাভাবিক হলো তার রাগত চেহারা। মিশরের সব পুরুষের ভেতর মেরেন ক্যাম্বিসেস আর তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি আমি। মেরেনের দিকে ফিরলেন তিনি। কর্নেলের পদ পাবে তুমি। পছন্দমতো একশোজনকে বেছে নাও, তোমাকে আমার রাজকীয় বাজপাখীর সিলমোহর দেব যাতে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে ওদের সজ্জিত করতে পারো ও আমার রাজ্যর যেকোনও জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে পারো। বাজপাখীর সীলমোহর ফারাও-এর ক্ষমতা বাহকের হাতে হস্তান্তর করে। আমি চাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব লোক লস্কর নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হও তুমি। সব ব্যাপারে তাইতার পরামর্শ মোতাবেক চলবে। ডাইনীর মুণ্ড নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো।
*
মেরেনের অভিজাত অশ্বারোহীদের নিয়ে একটাঝটিকা বাহিনী গড়ার কথা রাষ্ট্র Cমহয়ে যাওয়ামাত্র স্বেচ্ছাসেবীর দল ঘিরে ফেলল ওকে। তিন জন পোড়খাওয়া সৈনিককে ক্যাপ্টেন হিসাবে বেছে নিল ওঃ হিলতো-বার হিলতো, শাবাকো ও তুনকা। গৃহযুদ্ধের সময় এদের কেউই ওর সাথে লড়াইতে অংশ নেয়নি-তখন অনেক কম বয়সী ছিল ওরা-তবে ওদের বাবা ও দাদারা লাল পথের সঙ্গী ছিল।
যোদ্ধার রক্ত সত্যিকারের বীরের জন্ম দেয়, তাইতার কাছে ব্যাখ্যা করল মেরেন। ওর চতুর্থ বাছাই ছিল হাবারি, ওকে পছন্দ ও বিশ্বাস করে ফেলেছে ও। ওকে চারটি প্লাটুনের একটার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিল সে।
চার ক্যাপ্টেনেরই পরীক্ষা নিয়ে ওদের নির্বাচন নিশ্চিত করল; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করল: তোমার স্ত্রী বা মেয়েমানুষ আছে? আমরা যতদূর সম্ভব কম রসদ নেব সাথে। ক্যাম্পফলোয়ারদের জন্যে কোনও জায়গা নেই আমাদের এখানে। মিশরিয় সেনারা ঐতিহ্যগতভাবে যার যার মেয়েমনুষ নিয়ে পথ চলে।
আমার স্ত্রী আছে, জানাল হাবারি। কিন্তু পাঁচ বছর ওর মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে পারলেই বরং খুশি আমি, দশ কি আরও বেশি হলেও ক্ষতি নেই। যদি আপনার দরকার হয়, কর্নেল। এই যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হলো বাকি তিনজন।
কর্নেল, আমাদের জমিনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হলে যেখানে মিলবে সেখানেই মেয়েমানুষ বেছে নিতে পরব, বলল হিলতে-বার-হিলতো, বুড়ো হিলতোর ছেলে, অনেক আগেই মারা গেছে সে। দশ-হাজারের-ভেতর-সেরা ছিল সে, প্রশংসার স্বর্ণ জয় লাভ করেছিল; ইসমালার যুদ্ধে নকল ফারাওকে উচ্ছেদ করার পর খোদ ফারাও পরিয়ে দিয়েছিলেন ওর গলায়।
সত্যিকারের সৈনিকের মতো কথা, হেসে বলল মেরেন। যার যার প্লাটুন বাছাই করার ক্ষমতা নির্বাচিত চারজনের হাতে তুলে দিল ও। দশ দিনেরও কম সময়ের ভেতর গোটা মিশরিয় সেনাবাহিনী থেকে নিখুঁত এক শো জন যোদ্ধা বাছাই করে ফেলল ওরা। প্রত্যেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, দুটো চার্জার ও একটা প্যাক মিউল বেছে নিতে আস্তাবলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওদের। ফারাওর নির্দেশ মোতাবেক থেবস থেকে নতুন চাঁদ ওঠার দিন যাত্রা শুরু করতে তৈরি হলো ওরা।
বিদায়ের দুই দিন আগে নদী পেরুল তাইতা, রানি মিনতাকার কাছ থেকে বিদায় নিতে মেমননের প্রাসাদে গেল। আগের চেয়ে বেশ কৃশ হয়ে গেছেন তিনি, চেহারা মলিন। ওদের সাক্ষাতের প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরই ওর কাছে কারণ ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
ওহ, তাতা, প্রিয় তাতা। ভীষণ একটা ঘটনা ঘটেছে। সোয়ে উধাও হয়ে গেছেন। আমার কাছে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। তুমি ওকে আমার আম দরবারে দেখার তিনদিন পরেই উধাও হয়ে যান তিনি।
অবাক হলো না তাইতা। সেদিনই ছিল দিমিতারের ভীতিকর মৃত্যুর ক্ষণ।
ওর খোঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছি। তাইতা, জানি, আমার মতোই বিচলিত বোধ করবে তুমি। ওকে চিনতে, সমীহ করতে। ওর মাঝে মিশরের মুক্তি দেখেছিলাম আমরা। তোমার বিশেষ জাদুকরী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ওকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবে না? তিনি চলে যাওয়ায় আমি আর কোনওদিনই আমার বাচ্চাদের মুখ দেখতে পাব না। মিশর ও নেফার চিরন্তন যন্ত্রণায় ভুগবে। নীলও আর কখনওই বইবে না।
ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাইতা। বুঝতে পারছে রানির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, হতাশার চাপে ওর গর্বিত চেতনা ভেঙে পড়ার উপান্তে পৌঁছে গেছে। মিনতাকাকে আশা দেওয়ার সময় মনে মনে ইয়োস ও তার অপকর্মের শাপশাপান্ত করল ও। মেরেন আর আমি দক্ষিণ সীমান্তের ওধারে অভিযানে যাচ্ছি। যাবার পথে প্রতিটি কোণে সোয়ের খোঁজ করাটাকে আমার প্রথম দায়িত্বে পরিণত করব। আমার ধারণা সে বেঁচে আছে, কোনও ক্ষতি হয়নি। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও ঘটানপ্রবাহ হুট করে আপনাকে না জানিয়েই বিদায় নিতে বাধ্য করেছে তাকে, মহারানি। তবে নতুন নামহীন দেবীর নামে মিশন চালু রাখতে প্রথম সুযোগেই ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে তার। সবই আসলে যুক্তিসঙ্গত অনুমান, নিজেকে বলল তাইতা। এবার আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আপনার কথা সব সময় আমার মনে আর অনুগত ভালোবাসায় থাকবে।
এখন নীল নদে জাহাজ চালানোর উপায় নেই, তাই মৃতপ্রায় নদীর তীর বরাবর ওয়্যাগন রোড বেছে নিল ওরা। প্রথম এক মাইল তাইতার পাশাপাশি এগোলেন ফারাও, নির্দেশ ও পরামর্শে ভারাক্রান্ত করে তুললেন ওকে। তিনি ফিরতি পথ ধরার আগে বাহিনীর উদ্দেশে আন্তরিক উদাত্ত আহবান জানিয়ে ভাষণ দিলেন: আশা করছি সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করবে, শেষ করলেন তিনি, তারপর ওদের সামনে তাইতাকে আলিঙ্গন করলেন। উল্লাস করে তাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে দিল ওরা।
এমনভাবে যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছে তাইতা যাতে রোজ সন্ধ্যায় নীলের তীর বরাবর অবস্থিত উচ্চ রাজ্যের অসংখ্য মন্দিরের কোনও একটার কাছে পৌঁছাতে পারে। প্রতিটি মন্দিরেই দেখা গেল ওর আগেই ওর খ্যাতি পৌঁছে গেছে। প্রধান পুরুত ওকে স্বাগত জানাতে আর লোকজনকে আশ্রয় দিতে বেরিয়ে এলেন। ওদের আপ্যায়ন ছিল আন্তরিক, কারণ মেরেনের কাছে রাজার বাজপাখির সীলমোহর রয়েছে, প্রতিটি শহরের পাহারায় নিয়োজিত সামরিক দুর্গের কোয়ার্টার মাস্টারদের কাছ থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহে সাহায্য করছে সেটা। পুরোহিতদের আশা এর ফলে ওদের সামান্য খাদ্য মওজুত আরও বেড়ে উঠবে।
রোজ সন্ধ্যায় খাবার ঘরে সামান্য খাবারের পর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে অবস্থান নিচ্ছে তাইতা। শত শত বা এমনকি হাজার বছর ধরে এইসব জায়গায় উপাসনার যোগাড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পূজকদের উৎসাহ আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে, এমনকি ইয়োসের পক্ষেও যা ভেদ করা কঠিন হবে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ডাইনীর নজরদারী থেকে দূরে থাকতে পারবে ও। ওকে বেপথু করতে ডাইনীর পাঠানো অশুভ অভিশাপের ভয় না করেই আপন দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে পারবে। প্রতিটি মন্দিরের নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশে ডাইনীর বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াইয়ের জন্যে শক্তি ও নির্দেশনা পেতে প্রার্থনা করল ও। এমনি পরিবেশের নির্জনতা ও প্রশান্তির ভেতর শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে নিজেকে বলীয়ান করে তুলতে সক্ষম হলো।
মন্দিরগুলো প্রতিটি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু ও শিক্ষার ভাণ্ডার। পুরোহিতদের অনেকেই মোটামাথার লোক হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু শিক্ষিত ও আলোকিত, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সজাগ তারা, দলের মনোভাব সম্পর্কে অবগত। তথ্য ও গোপন বিষয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস ওরা। ওদের সঙ্গে আলোচনার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিল তাইতা। নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল ওদের। সবাইকেই একই প্রশ্ন করল: তোমাদের লোকদের ভেতর কারও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা শুনেছ, এক নতুন ধর্মের প্রচার করছে?
প্রত্যেকেই জানালেন, হ্যাঁ শুনেছেন। পুরোনো দেবতারা ব্যর্থ হতে চলেছেন বলে প্রচার করছে ওরা, তাঁরা আর মিশরকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। নতুন এক দেবীর কথা বলছে যিনি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হবেন, তারপর নদী ও দেশের উপর থেকে অভিশাপ তুলে নেবেন। তিনি এসে প্লেগকে বিদায় জানাবেন, তখন নীল মাতার বুকে ফের বান ডাকবে, মিশরকে আবার সৌন্দর্য ফিরিয়ে দেবে। লোকজনকে ওরা বলছে যে ফারাও ও তার পরিবার এই নতুন দেবীর গোপন অনুসারী। অচিরেই নেফার সেতি পুরোনো দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে নতুন দেবীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবেন। তারপর উদ্বিগ্ন জানতে চাইলেন, মহান ম্যাগাস, আমাদের বলুন, এটা সত্যি? ফারাও সত্যিই এই বিদেশী দেবীর কাছে মাথা নোয়াবেন?
এমন কিছু ঘটার আগে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো সব তারা খসে পড়বে। ফারাও হোরাসের ভক্ত, কায়মনোবাক্যে, ওদের আশ্বস্ত করেছে ও। তবে একটা কথা বলো, লোকজন এই ভণ্ডদের কথায় বিশ্বাস করছে?
ওরা তো মানুষ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিরাট গাড্ডায় পড়েছে এখন, যেই ওদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তির কথা বলবে তাকেই মানবে।
এই যাজকদের কারও সাথে তোমাদের দেখা হয়েছে?
কারওই না। ওরা গোপনে গা বাঁচিয়ে চলছে, বললেন একজন। ওদের বিশ্বাস ব্যাখ্যা করে বোঝানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তাবাহক পাঠালেও কেউই আসেনি।
কারও নাম জানতে পেরেছ?
মনে হচ্ছে সবাই একই নাম ব্যবহার করছে।
সেটা কি সোয়ে? জানতে চাইল তাইতা।
হ্যাঁ, ম্যাগাস, এ নামটাই ব্যবহার করছে ওরা। সম্ভবত এটা নামের চেয়ে বরং কোনও পদবীই হবে।
ওরা মিশরিয় নাকি বিদেশী? মাতৃভাষার মতোই আমাদের ভাষায় কথা বলে?
শুনেছি তাই বলে, আমাদের মতো একই রক্তের দাবী করছে ওরা।
এই যাত্রা যার সাথে কথা বলছিল ও, তাঁর নাম সেনাপি, উচ্চ মিশরের তৃতীয় নোমর খুম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তাঁর বক্তব্য শোনার পর তাই এবার আরও মামুলি প্রসঙ্গে ফিরে এলো: প্রাকৃতিক জ্ঞানের একজন বিশারদ হিসাবে আপনি কি এমন কোনও পথ বের করার চেষ্টা করেছেন যাতে নীলের লাল পানি আবার মানুষের ব্যবহারের উপযোগি করে তোলা যায়?
একথা শুনে ভীত হয়ে উঠলেন মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষটা। ওটা অভিশপ্ত নদী। ওখানে কেউ ম্লান করতে যায় না, কেউ ওই পানি মুখে নেয় না। যারা খায়, অল্পদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তারা, অক্কা পায়। নদীটা এখন রাক্ষুসে লাশখেকো কুনো ব্যাঙের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মিশর বা অন্য কোনও দেশে এমন ঘটনা কোনও দিন দেখা যায়নি। হিংস্রভাবে পচা পুকুরগুলো পাহারা দিচ্ছে ওরা। কেউ আগে বাড়লেই হামলা করছে। ওই বিষ মুখে তোলার চেয়ে বরং মরতে রাজি আছি। জবাব দিলেন সেনাপি, তার অভিব্যক্তি বিতৃষ্ণার ভঙ্গিতে বেঁকে গেল। এমনকি মন্দিরের নবীশরাও বিশ্বাস করে যে কোনও ক্ষুব্ধ দেবতা নদীকে অভিশপ্ত করে দিয়েছেন।
তো তাইতা নিজেই লাল স্রোতের আসল প্রকৃতি জানা ও নীলের জলকে বিশুদ্ধ করে তোলার একটা উপায় বের করতে বেশ কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে হাত দিল। সেনাদলকে কষ্টকর গতিতে দক্ষিণে ঠেলে নিয়ে চলছিল মেরেন। জলের সামান্য সরবরাহে কোনও রকম সংযোজন করতে না পারলে অচিরেই ঘোড়াগুলো পিপাসায় প্রাণ হারাবে, এটা জানে সে। ফারাওর সদ্য খোঁড়া কূপগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, কঠোরভাবে আগে বাড়ানো প্রায় তিনশো ঘোড়ার প্রয়োজনের তুলনায় ওগুলোর সরবরাহ অপ্রতুলই বলা চলে। এটা ছিল যাত্রার সহজতম পর্যায়। প্রথম শাখা ধারার শাদা পানির উপরে ওঠার পর নদীটা কঠিন ভীতিকর মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার লীগ চলে গেছে, ওখানে কোনও কুয়োর দেখা মিলবে না। শত বছরে একবার বৃষ্টি হয় ওখানে, কাঁকড়া বিছা আর ওরিক্সের মতো বুনো প্রাণীর আখড়া, এরা নিষ্ঠুর সূর্যের রাজত্বে ভূপৃষ্ঠের পানি ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে। পানির নির্ভরযোগ্য একটা উৎসের খোঁজ করতে না পারলে অমন প্রচণ্ড গা পোড়ানো বন্ধ্যাভূমিতে শেষ হয়ে যাবে এই অভিযান, কোনওদিনই নীলের উৎসে পৌঁছাতে পারবে না, সফল হওয়া তো পরের কথা।
প্রতিটি নিশি-শিবিরে পরীক্ষার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে তাই। মেরেনের চারজন তরুণ ট্রুপার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছে। মহান ম্যাগাসের সাথে কাজ করতে পেরে গর্বিত ওরা: এই গল্প নাতীপুতিদের বলে বেড়াবে। তাই নির্দেশ দেওয়ার সময় দৈত্য-দানোর ভয় করছে না ওরা। কারণ ওদের রক্ষা করার বেলায় তাইতার ক্ষমতায় ওদের অগাধ বিশ্বাস। রাতের পর রাত খেটে চলেছে ওরা, কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু এমনকি ম্যাগাসের মেধাও পচা পানিকে সুপেয় করে তোলার মতো কোনও উপায় বের করতে পারল না।
কারনাক থেকে রওয়ানা দেওয়ার সতের দিন পর কোম ওম্বোয় নদীর তীরে হাথরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির এলাকায় পৌঁছাল ওরা। যথারীতি বিখ্যাত ম্যাগাসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন প্রধান পুরোহিতীনি। নীলের পানি সেদ্ধ করতে সাহায্যকারীদের তামার পাত্র চুলোর উপর বাসাতে দেখে ব্যাপারটা ওদের উপর ছেড়ে দিল তাইতা, তারপর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাস মহলে চলে গেল।
ভেতরে পা রাখতে যা দেরি, পরক্ষণেই এক ধরনের করুণাময় প্রভাবের উপস্থিতি টের পেল ও। গরু দেবীর প্রতিমার সামনে চলে এলো ও। ওটার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। দিমিতার ওকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করতে ওর দেখা ডাইনীর গড়ে তোলা লস্ত্রিসের ছবি প্রায় বিশ্বাসের অতীত মন্তব্য করার পর আর রানিকে আহ্বান করার সাহস করে ওঠেনি। তবে এখানে দেবনিচয়ের অন্যতম শক্তিশালী দেবী হাথরের প্রতিরক্ষা রয়েছে ওর। পৃষ্ঠপোষকরা সবাই মেয়ে হওয়ায় তিনি নিশ্চিতভাবেই লস্ত্রিসকে নিজের খাসমহলে আশ্রয় দেবেন।
উপাস্যের মুখোমুখি হতে তিনবার প্রয়োজনীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে অন্তর্চক্ষু খুলে নীরবতার ছায়ায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ও। ক্রমশঃ কানের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনে নীরবতা ভঙ্গ হতে লাগল। ওর দিকে এগিয়ে আসা আধ্যাত্মিক সত্তার আভাস জোরাল হয়ে উঠল, ঠাণ্ডা অনুভূতি আচ্ছন্ন করার অপেক্ষায় রইল ও। বাতাসে শীতলতার প্রথম স্পর্শেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রস্তুত। শান্ত ও আমোদিতভাবে উষ্ণ রইল খাসমহল। বেড়ে উঠল ওর নিরাপত্তা ও শান্তির বোধ। ঘুমে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। চোখ বুজতেই স্বচ্ছ জলের একটা ছবি দেখতে পেল, তারপরই ছেলেমানুষি কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনল: তাইতা, তোমার কাছে আসছি আমি! জলের গভীরে কী যেন ছলকে উঠতে দেখল ও। ভাবল রূপালি মাছ বুঝি ভেসে উঠছে। তারপরই বুঝতে পারল ভুল হয়েছে ওর: ওটা ছিপছিপে ফর্শা একটা বাচ্চা, সাঁতরে ওর দিকে আসছে। পানির উপরে উঠে এলো একটা মাথা, বছর বার বয়সের একটা মেয়ের মাথা ওটা, বুঝতে পারল তাইতা। লম্বা ভেজা চুলের গোছা সোনালি পর্দার মতো মুখ আর বুকে নেমে এসেছে।
তোমার ডাক শুনেছি, প্রফুল্ল শোনাল হাসির আওয়াজ। সহানুভূতির সাথে হাসল তাইতা। সঁতরে ওর দিকে এগিয়ে এলো বাচ্চাটা। পানির ঠিক নিচে শাদা বালির কিনারে পৌঁছে উঠে দাঁড়াল। একটা মেয়ে, এখনও ওর কোমর ঠিক নারীসুলভ বাঁক নেয়নি, আর কেবল ওর পাঁজরের রেখাই উর্ধ্বাংশকে অলঙ্কৃত করেছে।
কে তুমি? জানতে চাইল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাল মেয়েটা, উন্মুক্ত হয়ে পড়ল চেহারা। তাইতার বুক ফুলে উঠতে লাগল, এক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হলো ওর। লস্ত্রিস।
ধিক তোমাকে, আমাকে চিনতে পারোনি, আমি ফেন, বলল সে। নামটার মানে চাঁদ মাছ।
আগাগোড়া তোমাকে আমি চিনি, মেয়েটাকে বলল তাইতা। প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার চোখদুটো কখনও ভুলবার নয়। ওগুলো তখন যেমন ছিল এখনও তেমনি মিশরের সবচেয়ে সবুজ ও সুন্দর চোখই আছে।
মিথ্যে বলছ, তাই। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি। চোখা গোলাপি জিভ বের করল সে।
তোমাকে অমন না করতে শিখিয়েছিলাম।
তাহলে ঠিকমতো শেখাতে পারোনি।
ফেন তোমার ছোটবেলার নাম ছিল, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা। তোমার প্রথম লাল চাঁদ দেখা দেওয়ার পর পুরোহিতরা তোমার নাম নারীসুলভ করে দিয়েছিলেন।
জলকন্যা, ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল মেয়েটা। এ নামটা কোনওদিনই ভালো লাগেনি আমার। লস্ত্রিস শুনলে কেমন হাস্যকর, আড়ষ্ট ঠেকে।
তারচেয়ে ফেনই আমার পছন্দ।
তাহলেই ফেনই সই, বলল তাইতা।
তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি, কথা দিল মেয়েটা। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ওরা আমাকে ডাকছে। কমনীয় ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিল সে, তলিয়ে গেল পানির নিচে, শরীরের দুপাশে হাত রেখে সরু পাজোড়া নাড়তে নাড়তে ক্রমে গভীরে চলে যাচ্ছে। পেছনে সোনালি পতাকার মতো আভা বিলোচ্ছে ওর চুল।
ফিরে এসো, পিছু ডাকল তাইতা। কোথায় অপেক্ষা করবে বলে যেতে হবে। কিন্তু চলে গেল সে। কেবল ওর হাসির ক্ষীণ একটা প্রতিধ্বনি ফিরে এলো ওর কাছে।
জেগে ওঠার পর তাইতা বুঝতে পারল, রাত হয়ে গেছে, কারণ মন্দিরের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। একাধারে ক্লান্ত ও তরতাজা মনে হলো নিজেকে। ডান হাতে একটা কিছু ধরে আছে, সজাগ হয়ে উঠল ও। সাবধানে হাতের মুঠি খুলল। মুঠির ভেতর শাদা পাউডার দেখতে পেল। এটাই ফেনের উপহার কিনা ভাবল। হাতটা নাকের কাছে তুলে এনে সাবধানে গন্ধ শুকল।
চুন! চেঁচিয়ে উঠল ও। নদীর কিনারা বরাবর প্রতিটি গ্রামে একটা করে আদিম ভাটা রয়েছে, এখানে গ্রামবাসীরা চুনাপাথরের চাই পুড়িয়ে এই পাউডার বানায়। এ জিনিস দিয়ে ঘরবাড়ি ও গোলাঘর রঙ করে ওরা। শাদা আস্তরণ সূর্যের রশ্মি ঠিকরে দেয় বলে ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকে। পাউডারটুকু ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, পরক্ষণে বিরত রাখল নিজেকে। দেবীর দেওয়া উপহার সম্মানের সাথে রাখতে হবে। নিজের বিপদে নিজেই হেসে উঠল ও। মুঠোর চুনা পাউডারটুকু টিউনিকের এক কোণে গেরো দিয়ে বেঁধে বাইরে এলো ও।
খাস কামরার দরজায় ওর অপেক্ষায় ছিল মেরেন। আপনার লোকজন নদীর পানি তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। পথ চলায় ক্লান্ত থাকায় ঘুমের প্রয়োজন ছিল ওদের। মেরেনের কণ্ঠে আবছা ভর্ৎসনার সুর। নিজের লোকদের যত্ন নিজেই নিয়ে থাকে সে। আশা করছি পচা পানির ভাণ্ড নিয়ে সারা রাত জেগে থাকার পরিকল্পনা করেননি। মাঝরাতের আগেই আপনাকে নিতে আসব, কারণ তেমনটি হতে দেব না আমি।
হুমকি অগ্রাহ্য করে তাইতা জানতে চাইল, পানিতে ঢালার জন্যে আমার বানানো আরক জলে মিশিয়েছিল শোফার?
হেসে উঠল মেরেন। যেমন বললাম, লাল পানির চেয়ে আরও বেশি দুর্গন্ধ ওটায়। চারটে ভাণ্ড যেখানে উতরাচ্ছিল তাইতাকে ওখানে নিয়ে গেল সে। ধোয়া উঠছে ওগুলো থেকে। আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল সাহায্যকারীরা, ওকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল; তারপর পাত্রের ডালার ভেতর লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে আগুনের উপর থেকে নামাল ওগুলো। পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা, তারপর পাত্রগুলোর পাশ দিয়ে আরক ঢালতে ঢালতে সামনে বাড়ল। একটা কাঠের খুনতি দিয়ে প্রত্যেকটায় ঘুটা দিল শোফার। সে যখন শেষ পাত্রটা নাড়তে যাবে, থামল তাইতা।ফেনের উপহার, বিড়বিড় করে বলল ও, টিউনিকের কোণার গিঁট খুলল। শেষ পাত্রে চুনা পাথরের পাউডার ঢেলে দিল। ভালো ফল পেতে লখ্রিসের সোনালি মাদুলিটা পাত্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্তির শব্দ নিউবে! উচ্চারণ করল।
বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল চার সহকারী।
পাত্রগুলো সকাল পর্যন্ত এভাবেই থাকতে দাও, নির্দেশ দিল তাইতা, বিশ্রামে যাও তোমরা। ভালো কাজ দেখিয়েছ, ধন্যবাদ।
মাদুরে গা এলিয়ে দিতেই মরার মতো ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা, স্বপ্ন হানা দিল না, এমনকি মেরেনের নাকের গর্জনও বিরক্ত করতে পারল না ওকে। ভোরে যখন জেগে উঠল, দোরগোড়ায় দরাজ হাসি মুখে নিয়ে শোফারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জলদি আসুন, মহান ম্যাগাস। আপনার স্বস্তি পাওয়ার মতো একটা কিছু দেখাবার রয়েছে আমাদের।
গত রাতের আগুনের শীতল হয়ে আসা কয়লার পাশে রাখা পাত্রগুলোর কাছে। ছুটে এলো ওরা। যার যার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাবারি ও অন্য ক্যাপ্টেনরা। সবাইকে নতুন নির্দেশ দেওয়ার জন্যে হাজির করা হয়েছে। বর্মের সাথে তলোয়ারের খাপ বইছে ওরা, এমনভাবে উল্লাস করছে যেন তাইতা কোনও বিজয়ী জেনারেল, যুদ্ধ ক্ষেত্রের দখল বুঝে নিচ্ছে। চুপ করো! গর্জে উঠল তাইতা। আমার মাথা ভেঙে ফেলবে তোমরা! কিন্তু আরও জোরে উল্লাস করল ওরা।
প্রথম তিনটা পাত্র বমি জাগিয়ে তোেলা কালো তরলে ভর্তি হয়ে আছে, কিন্তু চতুর্থ পাত্রের পানি একেবারে টলটলে পরিষ্কার। সামনে ঝুঁকে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে দ্বিধার সাথে মুখে দিল ও। মিষ্টি নয়, কিন্তু মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা, ছেলেবেলা থেকে ওদের বাঁচিয়ে রাখা নীলের কাদার পরিচিত সুবাস।
এর পর থেকে প্রতিদিন রাতের বিশ্রামের সময় নদীর জলে চুনের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে লাগল; পরদিন সকালে পানি রাখার চামড়ার পাত্রগুলো ভরে নিল। অচিরেই পিপাসায় দুর্বল ঘোড়াগুলো আবার শক্তি ফিরে পেতেই বেড়ে উঠল যাত্রার গতি। নয় দিন পর আসৌনে পৌঁছাল ওরা। সামনেই ছয়টি বিশাল জলপ্রপাতের প্রথমটি। নৌকার পক্ষে ভীতিকর বাধা ওগুলো, কিন্তু ঘোড়ার দল উপরের ক্যারাভান রোডে নিয়ে যেতে পারবে ওদের।
আসৌন শহরে ঘোড়া আর লোকজনকে টানা তিনদিন বিশ্রাম দিল মেরেন। রাজকীয় গোলাঘর থেকে শস্যের বস্তা ভরে নিল। জলের ধারের প্রমোদগুহাগুলোতে যাবার অনুমতি দিয়ে লোকজনকে যাত্রার পরবর্তী দীর্ঘ পর্যায়ের জন্যে বলীয়ান হয়ে নেওয়ার সুযোগ দিল। নিজের পদমর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে মেকি নির্বিকার চেহারায় বানিয়ে স্থানীয় সুন্দরীদের বেপরোয়া দৃষ্টির আমন্ত্রণ ও তোষামোদ এড়িয়ে গেল।
প্রথম জলপ্রপাতের নিচের জলাশয়টা শুকিয়ে তুচ্ছ পুকুর হয়ে গেছে। তো তাইতাকে ছোট দ্বীপে পৌঁছে দিতে কোনও মাঝির দরকার হলো না, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আইসিসের সবুজ মন্দির। ওটার দেয়ালে খোদাই করা দেবী, তাঁর স্বামী অসিরিস ও ছেলে হোরাসের দানবীয় প্রতিমা আঁকা।
ওকে সরাসরি ওখানে নিয়ে গেল উইন্ডস্মোক। নদীর পাথুরে তলদেশে খটাখট শব্দ তুলল ওটার খুর। ওকে স্বাগত জানাতে সমবেত হলেন সব পুরোহিত, পরের তিনটি দিন ওদের সাথেই কাটাল ও।
দক্ষিণের নুবিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ওকে জানানোর মতো তেমন কোনও তথ্য ছিল না ওদের কাছে। সুসময়ে নীলের বান যখন নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী ও সত্যি ছিল তখন একটা বাণিজ্য জাহাজের বিরাট বহর নদীর উজানে দুই নীলের সঙ্গমস্থল সেই কেবুই অবধি যাতায়াত করত। হাতির দাঁত, শুকনো মাংস এবং বুনো পশুর চামড়া, গাছের গুঁড়ি, তামার দণ্ড আর নীলের প্রধান শাখা আতবারা নদীর তীরের খনি থেকে সোনা নিয়ে ফিরে আসত ওরা। এখন বান না ডাকায় চলার পথের পুকুরগুলোর অবশিষ্ট জল রক্তে পরিণত হয়েছে, হাতে গোণা পর্যটকই কেবল পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে এই মরুপথে যাতায়াত করার সাহস দেখায়। পুরোহিতরা সতর্ক করে বললেন যে, দক্ষিণের রাস্তা ও এর বরাবর চলে যাওয়া পাহাড় পর্বত অপরাধী ও অস্পৃশ্যদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
আরও একবার পুরোহিতদের কাছে মেকি দেবীর কথা জানতে চাইল ও। ওরা বললেন, গুজব রটেছে যে সোয়ে পয়গম্বররা আবর্জনা থেকে হাজির হয়ে উত্তরে কারনাক ও ডেল্টার দিকে গেছে, কিন্তু কেউই ওদের সাথে যোগাযোগ করেনি।
রাত নামার পর দেবী মাতা আইসিসের মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে চলে এলো তাইতা, তার প্রতিরক্ষায় ধ্যান ও প্রার্থনা করতে স্বস্তি বোধ করল। নিজের পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে আহ্বান জানালেও ধ্যানের প্রথম দুই রাত তার কাছ থেকে কোনও সাড়া পেল না। তারপরেও কেবুই ও তার ওধারে অচেনা দেশ ও জলাভূমিতে যাবার পথে অপেক্ষমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যে নিজেকে বেশ শক্তিশালী ও তৈরি মনে হতে লাগল ওর। ইয়োসের সাথে অনিবার্য মোকাবিলা এখন অনেক কম ভীতিকর ঠেকছে। ওর শক্তিশালী দেহ ও স্থৈর্য তরুণ সেনা ও অফিসারদের সাথে চলার ও থেবস ছাড়ার পর থেকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ফল হয়ে থাকতে পারে। তবে দেবী লস্ত্রিস, বা এখন নিজেকে যেমন ফেন নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে সে, কাছাকাছি আছে জানা থাকায় নিজেকে যুদ্ধের জন্যে আরও বেশি তৈরি করেছে ভাবতে ভালো লাগছে ওর।
শেষ সকালে সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি ফুটে ওঠামাত্র জেগে উঠল ও। ফের আইসিস ও কাছাকাছি থাকতে পারেন এমন যেকোনও দেবতার আশীর্বাদ ও প্রতিরক্ষার জন্যে প্রার্থনা জানাল। খাস কামরা থেকে বের হবে, এমন সময় আইসিসের মূর্তির দিকে একবার তাকাল ও। লাল গ্রানিট পাথর কুঁদে বের করা হয়েছে ওটা। ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মূর্তিটা, ছায়ায় হারিয়ে গেছে ওটার মাথা, পাথরের চোখজোড়া অটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। বেনী করা প্যাপিরাসের মাদুরের পাশে রাখা ছড়ি তুলে নিতে উবু হলো ও, রাতে ওটার উপরই ঘুমিয়েছে। সোজা হওয়ার আগেই কানের কাছে শিরা দপদপ করে লাফাতে শুরু করল, কিন্তু নগ্ন উর্ধ্বাংশে কোনও রকম শীতল স্পর্শ বোধ করল না। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মূর্তিটা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখজোড়া, সেখানে যেমন করে কেউ ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকায় ঠিক তেমনি কোমল দৃষ্টি ফুটে উঠেছে।
ফেন, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা। লস্ত্রিস, তুমি এসেছ? ওর মাথার অনেক উপরে পাথরের ছাদ থেকে হাসির প্রতিধ্বনি কানে এলো, কিন্তু নীড়ে ফিরে যাওয়া বাঁদুরের কালো ডানার ঝাপ্টা ছাড়া আর কিছু দেখল না ও।
আবার মূর্তির দিকে ফিরে এলো ওর চোখ। পাথুরে মাথাটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এখন, ফেনের মুখ ওটা। মনে আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি, ফিসফিস করে বলল সে।
কোথায় পাব তোমাকে? কোথায় খুঁজতে হবে বলে দাও, অনুনয় করল তাইতা।
আর কোথায় চাঁদ মাছের খোঁজ করবে? পরিহাস করল ফেন। অন্য মাছের ভেতর লুকোনো অবস্থায় পাবে আমাকে।
কিন্তু কোথায় সেই মাছগুলো? মিনতি করল ও। ইতিমধ্যে পাথরে পরিণত হতে চলেছে ওর জীবন্ত চেহারা। ফের ম্লান হয়ে আসছে উজ্জ্বল চোখজোড়া।
কোথায়? চিৎকার করে উঠল তাইতা। কখন?
অন্ধকারের দূত থেকে সাবধান। ওর কাছে ছুরি আছে। সেও তোমার অপেক্ষা করছে। বিষণ্ণ সুরে ফিসফিস করে বলল ফেন। এবার আমাকে যেতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ আমাকে থাকতে দেবে না সে।
কে থাকতে দেবে না? আইসিস, না অন্য কেউ? এই পবিত্র স্থানে ডাইনীর নাম মুখে আনা অপবিত্রতার সামিল হবে। কিন্তু মূর্তির ঠোঁট জমে গেছে।
বাহুর উপরের অংশে কারও হাতের খোঁচা লাগল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। ভেবেছিল আরও একটা প্রেতাত্মার আবির্ভাব হচ্ছে বুঝি; কিন্তু স্রেফ প্রধান পুরুতের মুখই দেখতে পেল ও। তিনি বললেন, ম্যাগাস, কী হয়েছে আপনার? চিৎকার করছিলেন কেন?
স্বপ্ন দেখছিলাম। বাজে স্বপ্ন।
স্বপ্ন কখনও বাজে হয় না। অন্তত আপনার সেটা জানার কথা। স্বপ্ন হচ্ছে দেবতাদের কাছ থেকে আসা সতর্কবাণী ও বার্তা।
পবিত্র পুরুষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তাবলে চলে এলো ও। ওর কাছে ছুটে এলো উইন্ডস্মোক। খুশিতে মাটিতে পা ঠুকছে। মুখের কোণে ঝুলছে এক গোছা খড়।
ওরা তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, বুড়ি ছিনাল কোথাকার। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ ঘোড়ার বাচ্চার মতো গিলছ, ইয়া বড় পেট হয়েছে। আদুরে গলায় বকল ওকে তাই। কারনাক সফরের সময় একজন অসতর্ক সহিস ফারাওর প্রিয় স্ট্যালিয়নগুলোর একটাকে ওটার কাছে আসতে দিয়েছিল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে পিঠে চাপার সুযোগ করে দিল ঘোড়াটা। তারপর মেরেনের সেনাদল যেখানে শিবির গোটাচ্ছে সেখানে নিয়ে এলো। কলাম তৈরি হওয়ার পর যার যার ঘোড়ার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে লোকেরা, বাড়তি ঘোড়া ও প্যাক অ্যানিমেলের লাগাম ধরে আছে। হাতে। অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরখ করতে করতে সারির ভেতর দিয়ে এগোল মেরেন। সবাই যার যার তামার পানির পাত্র ও চুনের ব্যাগ খচ্চরের পিঠে নিয়েছে, নিশ্চিত হয়ে নিল।
উঠে পড়ো! কলামের পেছন থেকে চিৎকার করে নির্দেশ দিল। এগোও! হট! ছোট! কাঁদতে কাঁদতে একদল মহিলা পাহাড়ের পাদদেশ অবধি অনুসরণ করল ওদের। মেরেনের চলার গতির সাথে আর তাল রাখতে না পেরে তারপর পিছিয়ে গেল।
তেতো বিদায়, তবে স্মৃতি অনেক মধূর, হিলতো-বার-হিলতো মন্তব্য করল, হেসে উঠল তার বাহিনী।
উঁহু, হিলতো, নিজের কলামের মাথা থেকে বলে উঠল মেরেন, শরীর মিষ্টি, কিন্তু তারচেয়ে মিষ্টি তার স্মৃতি।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ওরা, খাপ দিয়ে ঢালের উপর তাল ঠুকতে লাগল।
এখন হাসছে, শুকনো কণ্ঠে বলল তাইতা, কিন্তু মরুভূমির চুল্লীতে পৌঁছানোর পরেও হাসতে পারছে কিনা দেখা যাবে।
জলপ্রপাতের গহ্বরের দিকে তাকাল ওরা। ক্রুদ্ধ জলের কোনও গর্জন নেই। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলো এমনিতে নৌচলাচলের পথে বিরাট বিপদ হয়ে থাকে, কিন্তু এখন শুকনো নাঙা হয়ে আছে। বুড়ো মোষের পালের পিঠের মতোই শুকনো, কালো। উপরের প্রান্তে গহ্বরের ঠিক নিচে একটা ব্লাফে একটা লম্বা গ্রানিটের অবিলিস্ক দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন ওদের ঘোড়া আর খচ্চরকে পানি খাওয়ানোর সময় ক্লিফ বেয়ে সৌধের কাছে এলো তাইতা ও মেরেন, ওটার পায়ের কাছে দাঁড়াল ওরা। জোরে জোরে খোদাই লিপি পড়ল তাইতা:
আমি, মিশরের রিজেন্ট ও ফারাও, এ ধারায় অষ্টম মেমোজের বিধবা পত্নী, রানি লস্ত্রিস, আমার পরে মিশরের দুই রাজ্যের হবু অধিপতি যুবরাজ মেমননের মা, এই সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছি।
এটা মিশরের জনগণের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন ও প্রমাণ, বর্বরদের হটিয়ে বনবাস থেকে ওদের কাছে আবার ফিরে আসব আমি।
আমার শাসনকালের প্রথম বছরে স্থাপন করা হয়েছে এই পাথরখণ্ড-ফারাও চিপসের মহান পিরামিড নির্মাণের পর নয় শত নম্বর।
আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন এই পাথর অটল থাকে।
.
স্মৃতিরা ভিড় করে আসার সাথে সাথে অশ্রুতে ভরে উঠল তাইতার চোখ। অবিলিস্ক স্থাপনের দিন লখ্রিসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর: তখন ওর বয়স ছিল বিশ বছর, রাজকীয় ও নারীসুলভ মহিমায় ছিল গর্বিত।
ঠিক এখানেই আমার কাঁধে প্রশংসার স্বর্ণ তুলে দিয়েছিল রানি লস্ত্রিস, মেরেনকে বলল ও। অনেক ভারি ছিল, কিন্তু ওর অনুকম্পার তুলনায় অনেক সস্তা। ঘোড়ার কাছে এসে পিঠে চেপে বসল ওরা।
বিশাল কোনও অগ্নিকুণ্ডের শিখার মতো ওদের ঢেকে ফেলল মরুপ্রান্তর। দিনের বেলায় চলতে পারছিল না ওরা, তো নদীর পানি সেদ্ধ করে তাতে চুনাপাথর ছিটাচ্ছে, তারপর ক্ষিপ্র বেগে ছোটা পশুর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে খুঁজে পাওয়া কোনও ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করার পর রাত ভর এগিয়ে চলছে ওরা। জায়গায় জায়গায় মোটা ক্লিফটা নদীর উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়েছে। যে সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একটা সারিতে এগোতে পারছে ওরা। লুটিয়ে পড়া কুঁড়ে ঘর পাশ কাটাল ওরা, এক কালে ওদের আগে এপাথে যাওয়া পর্যটকদের আশ্রয় ছিল ওগুলো। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত। আসৌন ছেড়ে পথে নামার পর দশ দিনের আগে নতুন কোনও মানুষের চিহ্ন পেল না। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপরার সারিতে এসে পৌঁছুল, এখানে এক কালে একটা গভীর পুকুর ছিল। সম্প্রতি কারও দখলে ছিল এটা: অগ্নিকুণ্ডের ছাই এখনও টাটকা, মচমচে। কুঁড়েয় ঢোকার সাথে সাথে ডাইনীর ক্ষীণ অথচ সন্দেহাতীত আভাস পেল ও। ছায়ায় চোখজোড়া সয়ে এলে দেয়ালের গায়ে কয়লার টুকরো দিয়ে লেখা হিয়েটিক হরফের লিপি দেখতে পেল।
ইয়োস মহান। ইয়োস আবির্ভূত হন। অল্প দিন আগেই ডাইনীর কোনও ভক্ত গেছে এ পথে। দেয়ালের পায়ের কাছে যেখানে দাঁড়িয়ে আবেদনের কথা লিখেছে সে, সেখানে ধূলির বুকে পায়ের ছাপ পড়েছে। সর্যোদয়ের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। দিনের উত্তাপ দ্রুত ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। শিবির খাটানোর জন্যে সেনাদলকে নির্দেশ দিল মেরেন। এমনকি ধসে পড়া কুঁড়েগুলোও নিষ্ঠুর সূর্যের কবল থেকে কিছুটা ছায়া বিলোতে পারে। এসব যখন ঘটছে, উত্তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই, ইয়োসের উপাসকদের খোঁজ করল তাইতা। দক্ষিণে চলে যাওয়া নুড়িপাথরের পথে পায়ের ছাপ দেখতে পেল। সেগুলোর অবস্থান দেখে বুঝতে পারল ঘোড়াটা নিশ্চিতভাবেই দশাসই একজন লোককে বয়ে নিয়ে গেছে। দক্ষিণে, কেবুইয়ের দিকে গেছে খুরের ছাপ। মেরেনকে ডাকল তাইতা, জিজ্ঞেস করল, এই ছাপ কতদিন আগের? দক্ষ স্কাউট ট্র্যাকার মেরেন।
নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, ম্যাগাস। তিন দিনের বেশি তবে দশদিনের কম।
তাহলে আমাদের ফেলে অনেক দূর চলে গেছে ইয়োসের পুজক।
*
ওরা কুঁড়ের আশ্রয়ে ফিরে আসার সময় শিবিরের মাথার উপর থেকে একজোড়া কালো চোখ ওদের প্রতিটি নড়াচড়া নিরীখ করে চলল। ওই কালো, গম্ভীর চোখজোড়া ইয়োসের পয়গম্বর সোয়ের, রানি মিনতাকাকে যে জাদু করেছে। কুঁড়ের দেয়ালের লেখাগুলো তারই কাজ। এখন নিজের অস্তিত্ব এভাবে ফাঁস করে দেওয়ায় অনুতাপ হলো তার।
মাথার উপরের পাহাড় চূড়ার ছড়ানো এক চিলতে ছায়ায় শুয়ে আছে সে। তিনদিন আগে পথের একটা ফোকরে হোঁচট খেয়ে সামনের পা ভেঙে ফেলেছে তার ঘোড়া। এক ঘণ্টার মধ্যেই নেকড়ের পাল এসে হাজির হয়েছে পঙ্গু জানোয়ারটাকে ছিঁড়ে খেতে। ওটা পা ছুঁড়ে চিৎকার করার সময়ই শরীর থেকে মাংস খুবলে গিলেছে। আগের রাতে অবশিষ্ট পানিটুকই শেষ করেছে সোয়ে। এই ভীতিকর জায়গায় আটকা পড়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, তাকে আর বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে, ওকে নিদারুণ পুলকিত করে উপত্যকা বরাবর ঘোড়ার খুরের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। নবাগতদের স্বাগত জানিয়ে সাথে করে ওকে নেওয়ার আবেদন জানানোর বদলে এখানে গা ঢাকা দিয়ে ওদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। দলটা দৃষ্টিসীমায় আসামাত্র ওটাকে রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ডিটাচমেন্ট হিসাবে শনাক্ত করল সে। প্রত্যেকে ভালোভাবেই সজ্জিত, দারুণ সব ঘোড়ায় চেপেছে। ওরা যে বিশেষ অভিযানে নেমেছে এটা পরিষ্কার, সম্ভবত স্বয়ং ফারাওর নির্দেশেই। এমনও হতে পারে যে ওকে পাকড়াও করে ফের কারনাকে ফিরিয়ে নিতেই পাঠানো হয়েছে ওদের। থেবসের ভাটিতে নদীর কিনারে ম্যাগাস তাইতা ওকে দেখেছিল, এব্যাপারে সে নিশ্চিত, এও জানে, ম্যাগাস রানি মিনতাকার আস্থাভাজন। রানি সম্ভবত তাইতাকে সব বলে দিয়েছেন এবং রানির সাথে সোয়ের সম্পর্কের কথা সে জানে, এটা বুঝতে খুব বেশি কল্পনা শক্তি লাগে না। সোয়ে নিশ্চিতভাবে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অপরাধী, ফারাওর আদালতে রেহাই পাওয়ার কোনওই আশা নেই। এইসব কারণেই কারনাক থেকে সটকে পড়েছে সে। এখন যেখানে সে শুয়ে আছে ঠিক তার নিচেই সেনাদলের মাঝে তাইতাকে শনাক্ত করতে পেরেছে।
নদীর পাড়ে বিভিন্ন কুঁড়ের ফাঁকে ফাঁকে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোকে জরিপ করল সোয়ে। বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোনটা বেশি দরকার স্পষ্ট নয় ওর কাছে: একটা ঘোড়া নকি প্যাক মিউলের পিঠ থেকে সৈনিকের নামানো ফোলা পানির চামড়ার ব্যাগ। অবশেষে যখন ঘোড়াই বেছে নিল সে, কুঁড়ের বাইরে তাইতার বেঁধে রাখা মেয়ারটাকেই সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও চমৎকার ঠেকল তার। ওটার সাথে বাচ্চা থাকলেও সোয়ের প্রথম পছন্দ হবে ওটাই, যদি কাছে ঘেঁষতে পারে।
শিবিরে দারুণ কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে দলাইমলাই করা হচ্ছে। নদীর পুকুর থেকে তামার গামলা বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেরা ব্যস্ত হাতে খাবার রান্না করছে যেসব চুলোয় সেগুলোয় পাচ্ছে। খাবার তৈরি হওয়ার পর চারটি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দলীয় পাত্র ঘিরে আলাদা বৃত্ত তৈরি করে বসে পড়ল সেনাদল। থিতু হওয়ার মতো সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নিতে নিতে সূর্যটা মাথার বেশ উপরে উঠে এলো। গোটা শিবির জুড়ে এক ধরনের গাম্ভীর্যপূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। সতর্কতার সাথে শান্ত্রীদের অবস্থান জরিপ করল সোয়ে। সীমানা বরাবর নিয়মিত বিরতিতে চারজন প্রহরী রয়েছে। বুঝতে পারছে, শুকনো নদীর তলদেশই তার এগিয়ে যাবার সেরা উপায়, তাই ওদিকের প্রহরীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। লোকটা বেশ অনেকটা সময় নড়াচড়া করছে না দেখে সোয়ে ধরে নিল ঝিমোচ্ছে সে। চৌহদ্দীর আরও সতর্ক প্রহরীদের চোখের আড়ালে থেকে পাহাড়ের কিনারা থেকে পিছলে নেমে এসে শিবিরের আধা লীগ নিচ দিয়ে নদীর শুকনো তলদেশ ধরে আগে বাড়ল, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল উজানের দিকে। শিবিরের ঠিক উল্টোদিকে আসার পর আস্তে করে নদীর কিনারার উপরে মাথা ওঠাল।
মাত্র বিশ কদম দূরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে এক শান্ত্রী। চিবুকটা বুকের কাছে ঝুলছে, চোখবন্ধ। ফের কিনারার নিচে গা ঢাকা দিল সোয়ে। গা থেকে জোব্বা খুলে বগলদাবা করল। খাপে ভরা ড্যাগারটা খুঁজে নিল নেংটির নিচে। তারপর তীরের উপরে উঠে এলো। দৃঢ় পায়ে মেয়ারটা যে কুঁড়ের পিছনে বাঁধা ছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেল। সামান্য নেংটি আর স্যান্ডেল পায়ে নিজেকে সৈন্যদেরই একজন হিসাবে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে স্থানীয় মিশরিয় ভাষায় জবাব দিতে পারবে; বলবে, ব্যক্তিগত কাজে নদীর ধারে গিয়েছিল। অবশ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করতে গেল না ওকে। কুঁড়ের কোণে পৌঁছে ওটার পেছনে গা ঢাকা দিল।
খোলা দরজার ঠিক ওধারেই বাধা রয়েছে মেয়ারটা। দেয়ালের ছায়ায় একটা পানি ভর্তি চামড়ার ভাণ্ড রাখা। মেয়ারের পিঠে চেপে বসতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। সব সময়ই বিনা জিনে ঘোড়া হাঁকায় সে, তাই জিন, লাগাম বা রেকাবের দরকার হয় না। পা টিপে টিপে মেয়ারের কাছে চলে এলো সে, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাতের গন্ধ শুকল ঘোড়াটা। অস্থিরভাবে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মৃদু কণ্ঠে সোয়ে ওর সাথে কথা বলতেই ফের শান্ত হলো, ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল সোয়ে। এবার চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে। ভারি ওটা, তুলে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ওটাকে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে নিল। পিঠে উঠতে যাবে, এমন সময় খোলা দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর থামাল ওকে। মিথ্যা পয়গম্বর থেকে সাবধান। তোমার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করা হয়েছে, সোয়ে।
চমকে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল সে। দরজা পথে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাগাস। নগ্ন। আরও তরুণ কারও মতো পেশীবহুল ছিপছিপে দেহ তার; কিন্তু কুঁচকির কাছে খোঁজা করার পুরোনো দাগ রূপালি লাগছে। মাথার চুল ও দাড়ি অবিন্যস্ত। কিন্তু চোখজোড়া আরও উজ্জ্বল। সতর্ক করার সুরে কণ্ঠস্বর আরও চড়াল ওঃ আমার কাছে এসো! প্রহরী! হিলতো, হাবারি! মেরেন! এখানে, শাবাকো! নিমেষে ডাকে সাড়া মিলল। সারা শিবিরে প্রতিধ্বনি উঠল তার।
আর দ্বিধা করল না সোয়ে। উইন্ডস্মোকের পিঠে চেপে বসেই আগে বাড়ার তাগিদ দিল ওটাকে। ওটার পথে ছুটে এলো তাইতা, হাতে তুলে নিল দড়িটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মেয়ার, ফলে ছিটকে ওটার ঘাড়ে সরে এলো সোয়ে। বুড়ো গাধা, পথ ছাড়ো! রাগের সাথে চিৎকার করে উঠল সে।
ওর কাছে ছুরি আছে। ফেনের সাবধানবাণী প্রতিধ্বনি তুলল তাইতার মাথার ভেতর। সোয়ের ডান হাতে ড্যাগারের ঝিলিক দেখতে পেল, ঘাই মারার জন্যে উইন্ডস্মোকের পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ল সে। আগেই ওকে সতর্ক করা না হলে ঠিক গলায় লাগত আঘাতটা। কিন্তু বাউলি কেটে একপাশে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল ও। ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল ড্যাগারের ডগা। পেছনে হোঁচট খেল ও। ঘাড়ের একপাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পেছনে সরে এলো ও। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে মেয়ারটাকে তাগিদ দিল সোয়ে। ক্ষতস্থান চেপে ধরে তীক্ষ্ণ শিস বাজাল তাইতা। ফের থমকে দাঁড়াল উইন্ডস্মোক। তারপর হিংস্রভাবে লাফ দিয়ে উঠল, বাস্পের হিসিহিস তোলা মেঘে পানির পাত্রটাকে উল্টে দিল। হামাগুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত কয়লা থেকে সরে এলো সোয়ে। কিন্তু সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই দুজন দশাসই সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। বালির উপর চেপে ধরল তাকে।
মেয়ারকে শেখানো সামান্য কায়দা এটা, শান্ত কণ্ঠে সোয়েকে বলল তাইতা। ড্যাগারটা যেখানে পড়েছিল সেখান থেকে তুলে নিল ও। সোয়ের কানের ঠিক সামনে চোয়ালের নরম ত্বকে ওটার ডগা ছোঁয়াল। ফের মিথ্যা বলো, পাকা ডালিমের মতো মাথাটা দুমড়ে দেব।
কুঁড়ে থেকে দিগম্বর অবস্থায় ছুটে বের হয়ে এলো মেরেন। হাতে তলোয়ার। নিমেষে অবস্থান নিল। সোয়ের ঘাড়ের পেছনে ব্রোঞ্জের ডগা ছোঁয়াল। তাইতার দিকে তাকাল তারপর। শুয়োরটা আপনাকে আঘাত করেছে। ওকে মেরে ফেলব, ম্যাগাস?
না! বলল তাইতা। এটাই সোয়ে, মিথ্যা দেবী ইয়োসের মিথ্যা পয়গম্বর।
সেথের মিষ্টি অণ্ডকোষের দোহাই, এবার চিনতে পেরেছি ব্যাটাকে। এ লোকই নদীর ধারে দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল।
এক ও অদ্বিতীয়, সায় দিল তাইতা। ঠিক মতো বেঁধে ফেল। কাজটা শেষ হয়েছে দেখার পরেই ওর সাথে খানিকটা বাতচিত করব আমি।
খানিক বাদে তাইতা আবার কুঁড়ে থেকে বের হয়ে এলে দেখা গেল সোয়েকে বাজারে বিক্রির শুয়োরের মতো বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই নিশ্চিত হতে ওকে পুরো ন্যাংটো করে ফেলেছে ওরা। সূর্যের কড়া আঁচে এরই ভেতর লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে তার ত্বক। উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিলতো ও শাবাকো। কুঁড়ের দেয়ালের ছায়ায় চামড়ার ফিতের গদি দেওয়া একটা টুল পেতে দিয়েছে মেরেন। সহজ ভঙ্গিতে ওটায় বসল তাইতা। অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টিতে সময় নিয়ে সোয়েকে পরখ করল। শেষ বার যেমন দেখেছিল তারপর আর লোকটার আভায় কেনও পরিবর্তন ঘটেনি; ক্রুদ্ধ ও বিভ্রান্ত।
অবশেষে কিছু মামুলি প্রশ্ন করতে শুরু করল তাইতা, যেগুলোর জবাব আগে থেকেই জানা, যাতে সত্যি বা মিথ্যা বলার সময় সোয়ের আভার পরিবর্তন বুঝতে পারে।
তুমি সোয়ে নামে পরিচিত?
নীরব অবজ্ঞায় চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকাল সোয়ে। খোঁচা লাগাও, শাবাকোকে নির্দেশ দিল তাইতা। পায়ে, তবে বেশি ভেতরে না। সূক্ষ্ম হিসাব করে একটা ঘা দিল শাবাকো। লাফিয়ে উঠল সোয়ে, আর্তনাদ ছাড়ল, বাঁধা অবস্থায় পাক খেল একবার। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা দেখা দিল উরুতে।
আবার শুরু করছি, বলল তাইতা। তুমি সোয়ে?
হ্যাঁ, দাঁত কিড়মিড় করে বলল সে। অবিরাম জ্বলছে তার আভা।
সত্যি, নীরবে নিশ্চিত করল তাইতা।
তুমি মিশরিয়?
মুখ বন্ধ রাখল সোয়ে, রাগী চেহারায় তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
শাবাকোকে হুকুম দিল তাইতা। অন্য পায়ে।
হ্যাঁ, চট করে বলল সোয়ে। অপবির্তিত রইল আভা। সত্যি।
রানি মিনতাকাকে দীক্ষা দিয়েছ তুমি?
হ্যাঁ। ফের সত্যি।
তুমি তাকে মৃত বাচ্চাদের জীবিত করে তোলার কথা দিয়েছ?
না, সহসা সোয়ের আভার ভেতর একটা সবজে আলো ঠিকরে উঠল।
মিথ্যার আলামত, ভাবল তাইতা। সোয়ের এর পরের জবাব বিচার করার মানদণ্ড পেয়ে গেছে।
আমার আতিথেয়তার ঘাটতি ক্ষমা করবে। তুমি তৃষ্ণার্ত, সোয়ে?
শুকনো, ফাটা ঠোঁটজোড়া জিভে ভেজাল সোয়ে। হা! বলে উঠল ফিসফিস করে। স্পষ্টতই সত্যি।
তোমাদের কি ভদ্রতা জ্ঞান নেই, মেরেন? আমাদের সম্মানিত মেহমানের জন্যে একটু পানি নিয়ে এসো।
দাঁত বের করে হেসে চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। কাঠের পানপাত্র ভরে নিল। ফিরে এসে সোয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ফাটা ঠোঁটের কাছে উপচে পড়া পাত্রটা ধরল। মুখ ভর্তি করে খেল সোয়ে। আগ্রহের আতিশয্যে কাশতে কাশতে কোনওমতে সবটুকু পানি শেষ করল। দম ফিরে পেতে তাকে খানিকটা সময় দিল তাইতা।
তো, নিজের মালকিনের কাছে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি?
না, বিড়বিড় করে বলল সে। ওর আভার সবুজ প্রলেপ মিথ্যা ফাস করে দিল।
ওর নাম ইয়োস?
হ্যাঁ। সত্যি।
তুমি তাকে দেবী মানো?
তিনিই একমাত্র দেবী। পরম প্রভু। আবার সত্যি। বড় বেশি সত্যি।
তার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে তোমার?
না! মিথ্যা।
সে কি তোমাকে এপর্যন্ত ওর সাথে জিজিমা করতে দিয়েছে? ইচ্ছে করেই লোকটাকে উস্কে দিতে কর্কশ সেনাসুলভ বুলি ব্যবহার করল তাইতা। কথাটার আদি মানে দৌড়ানো, বিজয়ী সৈন্যদল পরাস্ত সেনাবাহিনীর নারীদের ধরার সময় যা করে।
না! হিংস্রতার সাথে ঝিকিয়ে উঠল কথাটা। সত্যি।
তবে কি তার সমস্ত হুকুম তামিল করার পর মিশর তার হাতে তুলে দেওয়ার পর জিজিমার কথা দিয়েছে সে?
না। মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কথাটা। মিথ্যা। আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওকে ইয়োস।
তার আস্তানা কোথায় জানো?
না। মিথ্যা।
কোনও আগ্নেয়গিরি কাছে?
না। মিথ্যা।
জলাভূমির ওধারে দক্ষিণে কোনও বিশাল হ্রদের ধারে?
না। মিথ্যা।
সে মানুষ খেকো?
জানি না। মিথ্যা।
ছোট্ট বাচ্চাদের খায়? আবার মিথ্যা।
সে কি জ্ঞানী ও শক্তিমান লোকজনকে প্রলুব্ধ করে নিজের আস্তানায় ডেকে নিয়ে তারপর তাদের ধ্বংস করার আগে সমস্ত জ্ঞান আর ক্ষমতা কেড়ে নেয়?
এসব কিছুই জানি না আমি। বিরাট ও নিরেট মিথ্যা।
বিশ্ববেশ্যা এ পর্যন্ত মোট কয়জন পুরুষের সাথে শুয়েছে? এক হাজার? দশ হাজার?
তোমার প্রশ্ন ধর্মদ্রোহমূলক। এজন্যে তোমার সাজা হবে।
ম্যাগাস ও মোহন্ত দিমিতারকে যেভাবে সাজা দিয়েছে? তার হয়ে তুমিই ওর উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিলে?
হ্যা! ধর্মদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ছিল সে। এই বিচারই পাওনা ছিল তার। তোমার নোংরা কথায় আর কান দিচ্ছি না। চাইলে মেরে ফেল আমাকে, কিন্তু আমি আর মুখ খুলছি না। ওকে বেঁধে রাখা দাড়ির বাঁধন আলগা করার প্রয়াস পেল সোয়ে। কর্কশ হয়ে উঠেছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস, চোখে বুনো দৃষ্টি। ধর্মান্ধের চোখ।
মেরেন, আমাদের অতিথি উত্তেজনায় ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে দাও তাকে। সকালে সূর্য উষ্ণ করে তুলবে এমন একটা জায়গায় বেঁধে রাখবে ওকে। শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে, কিন্তু বেশি দূরে নয়, যাতে সে ফের আলাপে রাজি হলে কথা বলার সময় বা ওকে হায়েনার দল খুঁজে পাওয়ার সময় টের পাই।
সোয়ের ঘাড়ে ভালো করে দাড়ি পেঁচিয়ে টেনে দূরে নিয়ে যেতে শুরু করল মেরেন। থেমে তাইতার দিকে তাকাল একবার। ওকে দিয়ে আর কাজ নেই, আপনি নিশ্চিত, ম্যাগাস? আমাদের কিছুই বলেনি কিন্তু।
সবই বলেছে, বলল তাইতা। আত্মা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ওর পা ধরো, শাবাকো ও তোনকাকে বলল মেরেন। ধরাধরি করে সোয়েকে দূরে নিয়ে গেল ওরা। পেরেক দিয়ে তপ্ত মাটিতে বেঁধে রাখার আওয়াজ পেল তাইতা। বিকেলের মাঝামাঝি আবার তার সাথে কথা বলতে গেল মেরেন। রোদে পেট আর কুঁচকিতে ফোঁসকা পড়েছে; গালের রঙ লাল, ফুলে উঠেছে।
মহান ম্যাগাস আলাপ চালু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তোমাকে, বলল মেরেন। ওকে থুতু মারার চেষ্টা করল সোয়ে, কিন্তু মুখে লালা এলো না। পিঙ্গল জিভ মুখটাকে ভরে রেখেছে। সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে ডগাটা।
সূর্যাস্তের খানিক আগে হায়েনার দল দেখা পেল তার। ওগুলোর বিকৃত গর্জন ও হাসির শব্দে এমনকি পোড়খাওয়া পুরোনো বীর মেরেন পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
ওকে ভেতরে নিয়ে আসব, ম্যাগাস? জানতে চাইল সে।
মাথা নাড়ল তাইতা। থাক। কোথায় ডাইনীর খোঁজ করতে হবে বলে দিয়েছে সে।
হায়েনার দল মরণটাকে নিষ্ঠুর করে তুলবে, ম্যাগাস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইতা। শান্ত কণ্ঠে বলল, কুনো ব্যাঙগুলো দিমিতারের মরণকেও একই রকম নিষ্ঠুর করে দিয়েছিল। ডাইনীর চ্যালা সে। সাম্রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মারা যাওয়াই উচিত। তবে এভাবে নয়। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেকের দংশনে জর্জরিত করবে। আমাদেরও অমানুষের কাতারে নামিয়ে দেবে। যাও, ওর গলাটা দুফাঁক করে দাও।
উঠে দাঁড়াল মেরেন। তলোয়ার বের করে একুট থেমে কান খাড়া করল। একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। চুপ মেরে গেছে হায়েনার দল।
জলদি, মেরেন। যাও, দেখ কী হচ্ছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা।
ঘনায়মান অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল মেরেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে পাহাড় থেকে ওর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল; বুনো চিৎকার ছাড়ছে। লাফিয়ে উঠল তাইতা, দৌড়ে গেল ওর কাছে। মেরেন, কোথায় তুমি?
এখানে, ম্যাগাস।
সোয়েকে যেখানে গেঁথে রেখেছিল ওরা, সেখানেই মেরেনকে পেল তাইতা, কিন্তু গায়েব হয়ে গেছে লোকটা। কী হয়েছে, মেরেন? কী দেখছ?
ডাকিনীবিদ্যা! তোতলাতে তোতলাতে বলল মেরেন। দেখলাম- থেমে গেল ও, কী দেখেছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
ব্যাপারটা কী? তাগিদ দিল তাইতা। জলদি বলো।
ঘোড়ার মতো বিশাল এক হায়েনা, ওটার পিঠে বসে আছে সোয়ে। নিশ্চয়ই তার পরিচিত হবে। ছুটে পহাড়ে চলে গেছে ওটা, সাথে করে নিয়ে গেছে ওকে। ওদের পিছু ধাওয়া করব? ধরতে পারবে না, বলল তাইতা। বরং মারাত্মক বিপদে ফেলে দেবে নিজেকে। যতটা ভেবেছিলাম, সোয়েকে উদ্ধার করতে ইয়োস তারচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে। এযাত্রা যেতে দাও ওকে। অন্য কোনও সময়, ভিন্ন কোথাও ওর সাথে ফয়সালা করব আমরা।