প্রতিদিন দক্ষিণের আরও গভীরে যাচ্ছে ওরা, মেরেন ও তার বাহিনীর প্রতিজ্ঞা একবারের জন্যে টলেনি। এক দিন সন্ধ্যায় যারীবা বানানোর সময় মেরেনকে একপাশে এনে তাইতা জিজ্ঞেস করল, তোমার লোকদের মেজাজ মর্জির কী অর্থ করছ তুমি? মনে হচ্ছে সহ্যের শেষ সীমায় চলে এসেছে ওরা। আসৌন ও ওদের দেশে ফিরতে উত্তরে ঘুরে যাবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। আমাদের হয়তো শিগগিরই একটা বিদ্রোহের মোকবিলা করতে হতে পারে।
ওরা আমার লোক, ওদের ভালো করেই চেনা আছে আমার। মনে হচ্ছে আপনি ওদের চিনতে পারেননি, ম্যাগাস। ওদের মাথায় বেপরোয়া একগাছি চুল বা ফুসফুসে একটা নিঃশ্বাসও নেই। আমার মতোই কাজের জন্যে ক্ষেপে আছে।
আমাকে ক্ষমা করবে, মেরেন। তোমাকে সন্দেহ করতে পারি আমি? বিড়বিড় করে বলল তাইতা, কিন্তু মেরেনের কণ্ঠে ইয়োসের কণ্ঠের প্রতিধনি বের হয়ে আসতে শুনেছে ও। সবার উপরে আমাকে গম্ভীর চেহারা আর তিরীক্ষি মেজাজ মোকাবিলা করতে হচ্ছে না তাতেই আমি খুশি। এইদিক দিয়ে আমার ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছে ইয়োস, আপন মনে বলল তাইতা।
এই সময় শিবির থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এলো ফেন, চিৎকার করছে, ম্যাগাস! তাইতা! জলদি এসো! লি-তো-লিতির বাচ্চাটা পেট ফেটে বের হয়ে আসছে, ওকে আর ভেতরে ঢোকাতে পারছি না!
সেক্ষেত্রে আমি আসছি বেচারাকে তোমার কবল থেকে বাঁচাতে। দুরদার করে উঠে দাঁড়াল তাইতা, ফেনের সাথে দ্রুত শিবিরের দিকে পা বাড়াল। শিলুক মেয়েটার পাশে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার সময় মসৃণভাবে ঘটল প্রসবের ব্যাপারটা। লি-তো-লিতি চিৎকার করে উঠলেই চমকে উঠছে সে। প্রতিটি খিঁচুনির মাঝখানে শুয়ে থাকা মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘামে ভিজে যাচ্ছে, ফেন বলছে, দেখে তো এখন আর অত মজার খেলা মনে হচ্ছে না। আমাদের এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না।
মাঝরাতের আগে একটা বাদামী রঙ ছেলে জন্ম দিল লি-তো-লিতি, মাথায় এক ঝাক কোঁকড়া কালো চুল। তাইতার কাছে এই নতুন শিশুর আগমন অনেকটা এই তিক্ত পথে অন্য তরুণ প্রাণের ক্ষতিপূরণের মতো লাগল। বাবার সাথে উল্লাস করল ওরা।
এটা ভালো লক্ষণ, পরস্পরকে বলতে লাগল লোকেরা। দেবতারা আমাদের দিকে চেয়ে হেসেছেন। এখন থেকে আমাদের অভিযান ভালোর দিকে যাবে।
নাকোন্তোর পরামর্শ চাইল তাইতা। তোমাদের রেওয়াজ কী? আবার রওয়ানা দেওয়ার আগে মেয়েটিকে কয়দিন বিশ্রাম নিতে হবে?
আমরা গরুর পাল নতুন চারণ ভূমিতে নেওয়ার সময় আমার প্রথম বউয়ের বাচ্চা হয়েছিল। পানি ভাঙে যখন তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। রাস্তার পাশে কাজটা শেষ করার জন্যে ওকে মায়ের সাথে রেখে যাই আমি। রাত নামার আগেই আবার আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল ওরা, ভালো হয়েছিল, কারণ আশপাশে সিংহ ঘুরঘুর করছিল।
তোমাদের মেয়েরা বেশ কঠিন, মন্তব্য করল তাইতা।
কিছুটা বিস্মিত দেখাল নাকোন্তোকে।ওরা শিলুক, বলল সে।
তাতেই ব্যাখ্যা মেলে, সায় দিল তাইতা।
পরদিন সকালে বাচ্চাকে কোমরে ঝুলিয়ে নিল লি-তো-লিতি, ফলে ঘোড়া থেকে না নেমেই দুধ খেতে পারবে বাচ্চাটা। কলাম রওয়ানা দেওয়ার সময় স্বামীর ঘোড়ার পেছন উঠে বসল সে।
পর্যাপ্ত জলপুষ্ট ঘেসো এলাকা দিয়ে অব্যাহত রইল ওদের যাত্রা। পশুদের পা ও খুরের নিচে কোমল ঠেকছে বালিময় জমিন। নিজস্ব মলম দিয়ে টুকটাক ক্ষত বা রোগের চিকিৎসা করছে তাইতা। বেশ চমৎকার আছে ওরা। বুনো অ্যান্টিলোপ ও মোষের অন্তহীন পাল রয়েছে চারপাশে। ফলে মাংসের ঘাটতি হচ্ছে না। এমন মসৃণ নিয়মে দিনগুলো পেরিয়ে যেতে লাগল যে ওরা সবাই তাতে মিশে গেল যেন। একের পর লীগ পেছনে পড়ে যাচ্ছে, আর সামনে খুলে যাচ্ছে বিশাল দূরত্ব।
তারপর সামনে কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে একটা পাহাড়ের ঢাল দেখা দিল। পরের কয়েক দিনে চোখের সামনে মাথা খাড়া রইল ওটা, অবশেষে আকাশের অর্ধেকটা যেন ঢেকে ফেলেছে বলে মনে হলো। উঁচু এলাকায় গভীর ফোকর দেখতে পাচ্ছিল ওরা, ওগুলোর ভেতর দিয়ে নীল বয়ে গেছে। সোজা ওটার দিকেই এগিয়ে গেল ওরা, জানে পাহাড়ের ভেতর সহজ পথ হবে ওটাই। আরও কাছে আসার পর নিবিড় গাছে ছাওয়া ঢালের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আর ওগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া হাতির রাস্তা দেখতে পেল ওরা। অবশেষে আর ধৈর্য ধরতে পারল না মেরেন। ব্যাগেজ ট্রেইন থেকে ছোট একটা দল নিয়ে রেকি করতে এগিয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই ওদের সাথে গেল ফেন। তাইতার পাশে চলছে ও। নদীর গোর্জে ঢুকল ওরা, এবড়োখেবড়ো হাতি সড়ক ধরে ঢালের চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করল। কেবল অর্ধেক পথ উঠেছে, এমন সময় দৌড়ে সামনে চলে এলো নাকোন্তো। জমিন পরখ করতে এক পা ভেঙে বসে পড়ল।
কী ব্যাপার? চিৎকার করে জানতে চাইল তাইতা। জবাব না পেয়ে সামনে এগিয়ে গেল ও, শিলুক কী আবিষ্কার করেছে দেখতে উইন্ডস্মোকের পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ল।
ঘোড়ার পায়ের ছাপ, এক চিলতে নরম মাটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল নাকোন্তো। একদম টাটকা। মাত্র এক দিনের পুরোনো।
পাহাড়ী যেব্রা? জানতে চাইল তাইতা।
প্রবল বেগে মাথা নাড়ল নাকোন্তো।
সওয়ারিসহ ঘোড়া, মেরেনের জন্যে তরজমা করে দিল ফেন।
সতর্ক হয়ে উঠল সে। অচেনা ঘোড়সওয়ার। কারা হতে পারে, সভ্য জগৎ থেকে এত দূরে? ওরা বৈরী হতে পারে। ওদের পরিচয় না জানা পর্যন্ত আর উপরে ওঠা ঠিক হবে না। যেপথে এসেছিল পেছন ফিরে সেদিকে তাকাল ওরা। নিচের সমতলে কলামের বাকি অংশের কারণে ওড়া হলদে ধূলির মেঘ দেখতে পাচ্ছে। এখনও তিন বা তারচেয়ে বেশি লীগ দূরে রয়েছে ওরা। অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, তারপর সদলে আগে বাড়া যাবে। তাইতা জবাব দেওয়ার আগেই মাথার উপর থেকে তীক্ষ্ণ উঁচু কণ্ঠের হাঁক শোনা গেল, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলল সেই শব্দ। চমকে দিল সবাইকে।
ধরা পড়ে গেছি! কিন্তু সেথের দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাসের কসম, ওরা যেই হোক, মিশরিয় ভাষায় কথা বলছে, বলে উঠল মেরেন। পাসের দিকে ফিরে দুই হাত এক করে চোঙের মতো বানিয়ে মুখের কাছে ধরে পাল্টা হাঁক ছাড়ল সে। তোমরা কারা?
স্বর্গীয় ফারাও নেফার সেতির সৈনিক!
এগিয়ে এসে পরিচয় দাও, হাঁকল মেরেন।
ওদের সাথে মিলিত হতে খটাখট আওয়াজ তুলে তিনজন অচেনা অশ্বারোহীকে নেমে আসতে দেখে স্বস্তির সাথে হাসল ওরা। এমনকি দূর থেকেও একজনকে মামোসের প্রাসাদের নীল পতাকা বইতে দেখল মেরেন। আরও কাছে আসার পর ওদের পরিষ্কার মিশরিয় বৈশিষ্ট্য দেখতে পেল ওরা। ওদের সাথে মিলিত হতে আগে বাড়ল মেরেন। দুই দল এক সাথে হলে স্যাডল থেকে নেমে খুশির সাথে আলিঙ্গন করল ওরা।
আমি ক্যাপ্টেন রাবাত, পরিচয় দিল নেতা, কর্নেল আহ-আখতোনের বাহিনীর অফিসার, ফারাও নেফার সেতির সেবায় নিয়োজিত।
আমি কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস, একই স্বর্গীয় ফারাওর বিশেষ দায়িত্বে আছি। বুকের উপর একটা হাত মুঠি করে রেখে স্যালুট ঠুকে ওর উচ্চ পদমর্যাদার স্বীকৃতি দিল রাবাত। মেরেন বলে চলল, আর ইনি হচ্ছেন ম্যাগাস গালালার তাইতা। রাবাতের চেহারায় সত্যিকারের সমীহের ছাপ পড়ল, আবার স্যালুট করল সে। ওর আভা থেকে তাইতা লক্ষ করল সীমিত বুদ্ধির লোক রাবাত, তবে কোনও রকম খুঁত ছাড়াই সৎ।
আপনার খ্যাতি আপনাকে ছাড়িয়ে গেছে, ম্যাগাস। দয়া করে আপনাদের আমাদের শিবিরে নিয়ে যাবার অনুমতি দিন, ওখানে আমাদের সম্মানিত অতিথি হবেন আপনারা।
ছোট মেয়ে বলে ফেনকে উপেক্ষা করে গেছে রাবাত, কিন্তু এই উন্নাসিকতার ব্যাপারে সজাগ ছিল ও। রাবাতকে আমার পছন্দ হয়নি, শিলুক ভাষায় তাইতাকে বলল ও।লোকটা বেয়াড়া।
হাসল তাইতা। নিজের বিশেষ অবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। এদিক দিয়ে ওকে লস্ত্রিসের কথা মনে করিয়ে দেয় সে; যখন মিশরের সার্বভৌম রানি ছিল সে। ও আসলে কঠিন সৈনিক ছাড়া আর কিছু না, ওকে সান্ত্বনা দিল ও। তোমার বিবেচনার পাত্র। এতে খুশিতে ওর চেহারা সহজ হয়ে এলো।
আপনার নির্দেশ কী, ম্যাগাস? জানতে চাইল রাবাত।
এক বিরাট রসদের কাফেলা নিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দলের বাকি অংশ, সমতলের ধূলি মেঘের দিকে ইঙ্গিত করল তাইতা। তোমার কোনও লোককে পাঠাও ওদের কাছে। সাথে সাথে একজন লোক পাঠিয়ে দিল রাবাত। তারপর ওদের পথ দেখিয়ে খাড়া, পাথুরে পথ ধরে পাসের চূড়ার দিকে নিয়ে চলল।
তোমার কমান্ডার কর্নেল আহ-আখতোন কোথায়? রাবাতের পাশাপাশি ওঠার সময় জানতে চাইল তাইতা।
নদী ধরে আসার পথে জলভূমির অসুখে মারা গেছেন।
সে তো সাত বছর আগের কথা? জানতে চাইল তাইতা।
নাহ, ম্যাগাস। নয় বছর দুই মাস, ওকে শুধরে দিল রাবাত। আমাদের প্রাণপ্রিয় মিশর থেকে নির্বাসনের কাল।
তাইতা বুঝতে পারল কারনাক ছেড়ে এখানে আসতে প্রয়োজনীয় সময়টুকু হিসাবে ধরতে ভুলে গেছে ও। কর্নেল আহ-আখলতানের জায়গায় এখন কে নেতৃত্ব দিচ্ছে? জানতে চাইল ও।
কর্নেল তিনাত আনকুত।
কে সে?
ফারাওর নির্দেশ মোতাবেক তিনি সেনাবাহিনীকে নদী বরাবর দক্ষিণে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে এখানে মাত্র বিশজন পুরুষ আর কয়েক জন মেয়ের সাথে রেখে গেছেন তিনি, এদের একেবারে ছোট বাচ্চা রয়েছে যারা অভিযানের সময় জন্ম। নিয়েছে বা যাদের এখন সামনে বাড়ার শক্তি নেই, এত দুর্বল।
কর্নেল তিনাত তোমাকে এখানে রেখে গেল কেন?
আমাকে শস্য রোপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ওর জন্যে ঘোড়া তৈরি রাখতে বলা হয়েছে, আর পেছনের এই ঘাঁটি পাহারা দিতে বলা হয়েছে যাতে দক্ষিণের বুনো এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হলে এখানে আশ্রয় নিতে পারেন। তিনি।
সে চলে যাবার পর তার আর কোনও খবর পেয়েছ?
কয়েক মাস পরে বেঁচে যাওয়া সবগুলো ঘোড়াসহ তিনজন লোককে ফেরত পাঠিয়েছিলেন তিনি। মনে হচ্ছে দক্ষিণের এমন কোথাও গেছেন যেখানে মাছির খুব অত্যাচার, ঘোড়ার পক্ষে ওদের কামড় মারাত্মক। প্রায় সব ঘোড়াই হারিয়েছেন। তিনি। ওরা তিন জন পৌঁছানোর পর আর কোনও খবর পাইনি। বুনো দেশের পেটে হারিয়ে গেছেন ওরা। অনেক বছর আগের কথা এটা। এতগুলো বছরে কেবল আপনারাই একমাত্র সভ্য জগতের মানুষ যাদের সাথে আমাদের দেখা হলো। বিষণ্ণ শোনাল তার কণ্ঠস্বর।
এই জায়গা ছেড়ে লোকজন নিয়ে মিশরে ফেরার কথা ভাবোনি? লোকটার সাহস মাপতে জিজ্ঞেস করল তাইতা।
কথাটা ভেবেছি, সায় দিল রাবাত। কিন্তু এই জায়গাটা ধরে রাখার নির্দেশ ছিল আমার উপর, একটু দ্বিধা করে আবার খেই ধরল, তাছাড়া, মানুষখেকো চিমা ও বিশাল জলাভূমি আমাদের আর মিশরের মাঝে বাধা হয়ে আছে। সম্ভবত এটাই তোমার এই অবস্থান আঁকড়ে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ, ভাবল তাইতা। কথা বলতে বলতে পাসের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, সামনে বিছিয়ে আছে বিস্তৃত মালভূমি। নিচের সমতলের চেয়ে ঢের প্রীতিকর এটা।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে চরে বেড়াচ্ছ গরুর পাল, ওদের ওপাশে দেখার মতো সামরিক দুর্গের মাটির দেয়াল দেখে অবাক হলো তাইতা। এই প্রত্যন্ত বুনো এলাকায় কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল ওটাকে। দুবছরেরও বেশি আগে কেবুইয়ের দুর্গ ছেড়ে আসার পর এই প্রথম সভ্যতার কোনও চিহ্ন চোখে পড়ল। সাম্রাজ্যের নিখোঁজ চৌকি এটা, যার কথা মিশরের কারও জানা নেই।
এই জায়গার নাম কী? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
কর্নেল তিনাত একে আদারি দুর্গ বলতেন।
চরে বেড়ানো গরুগুলোর ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা: লম্বা, ছিপছিপে পশু, বিরাট কুঁজঅলা কাঁধ আর ভারি শিংয়ের বিরাট বিস্তার। প্রতিটি পশুর চামড়ার ভিন্ন ভিন্ন রঙ ও নকশা রয়েছে: দুটো পশু এক রকম নয়। লাল বা শাদা, কালো বা হলুদ, বিপরীত রঙের ফুটকি ও দাগ।
ওই গরুর পাল পেলে কোথায়? ওগুলোর মতো আর চোখে পড়েনি।
স্থানীয় উপজাতীদের সাথে বদলাবদলি করেছি। ওরা এদের যেৰু ডাকে। ওই পাল থেকে মাংস আর দুধ পাই আমরা। ওগুলো না থাকলে আরও বেশি কষ্ট পোহাতে হতো আমাদের।
ভুরু কোঁচকাল মেরেন, রাবাতের প্রাণশক্তি ঘাটতির জন্যে ওকে ভর্ৎসনা করতে মুখ খুলল, কিন্তু ওর ইচ্ছার কথা বুঝে চট করে মাথা নেড়ে নিষেধ করল তাইতা। এই লোকের গুরুত্ব সম্পর্কে মেরেন ও ফেনের সাথে মোটামুটি একমত হলেও ওকে খামোকা অপমান করা ওদের পক্ষে কাজে আসবে না। বলতে গেলে নিশ্চিতভাবেই পরে এর সাহায্য লাগবে ওদের। দুর্গের চারপাশের জমিনে ধুরা, তরমুজ ও তাইতার অচেনা সজির চাষ করা হয়েছে। ওকে ওগুলোর বিচিত্র স্থানীয় নাম জানাল রাবাত, একটা বড় চকচকে কালো ফল ছিঁড়তে স্যাডল থেকে নেমে পড়ল। তাইতার হাতে দিল ওটা। স্টুর মতো রান্না করলে বেশ স্বাদু আর পুষ্টিকর হয়।
দুর্গে পৌঁছার পর ঘাঁটির নারী ও শিশুরা ওদের স্বাগত জানাতে দরজা গলে বের হয়ে এলো। ওদের হাতে ছানা কাটা দুধ ও ধুরা পিঠাভর্তি থালা। সবমিলিয়ে তিরিশিজনেরও কম। দেখতে কাহিল, বিষণ্ণ চেহারা ওদের, যদিও যথেষ্ট বন্ধুসুলভ। দুর্গের ভেতরে থাকার ব্যবস্থা সীমিত। তাইতা ও ফেনকে একটা জানালা বিহীন কুঠরী দিল মহিলারা। মেঝেটা মাটি-লেপা, কর্কশ দেয়ালের উপর দিয়ে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করে চলছে পিঁপড়ের সরি, দেয়ালের ফোকরে ফোকরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে চকচকে কালো তেলাপোকার দল। নোংরা অপরিচ্ছন্ন দেহ ও আগের বাসিন্দাদের মলত্যাগের পাত্রের গন্ধ মিশে আছে চারদিকে। ক্ষমা চাওয়ার সুরে ব্যাখ্যা করল রাবাত, মেরেন ও অন্যান্য অফিসারসহ বাকিদের কমান্ড ফাড়ির সৈনিকদের সাথে থাকতে হবে। কৃতজ্ঞতা ও বিষাদের অভিব্যক্তি নিয়ে এই আতিথেয়তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল তাইতা।
দুর্গের আধা লীগ পেছনে একটা প্রবহমান জলধারার পাশে ছায়াময় গাছপালার মাঝে আরামদায়ক জায়গা বাছাই করল মেরেন ও তাই। ওদের দুর্গে রাখতে হচ্ছে না বলে স্পষ্ট স্বস্তি লাভকারী রাবাত মেরেনের বাজপাখির সীলমোহরের প্রতি সম্মান দেখিয়ে টাটকা দুধ, ধুরা আর নিয়মিত বিরতিতে একটা করে জবাই করা আঁড় যোগান দিল।
আশা করি এখানে বেশি দিন থাকতে হবে না আমাদের, দ্বিতীয় দিন তাইতার উদ্দেশে মন্তব্য করল হিলতো। এই লোকগুলো এত মনমরা যে আমাদের লোকজনের মনোবল ভেঙে পড়বে। ওদের মনোবল এখন চাঙা, ওভাবেই থাকুক, চাইছি আমি। তাছাড়া, এখানকার বেশির ভাগ মেয়েই বিবাহিতা, কিন্তু আমাদের ছেলেরা অনেক দিন হয় নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত। অচিরেই ওদের সাথে মজা করতে চাইবে ওরা। তাতে ঝামেলা বেধে যাবে।
তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সৎ হিলতো, ব্যবস্থা করা মাত্রই রওয়ানা হবো আমরা। পরের কটা দিন বিষণ্ণ রাবাতের সাথে নিবিড় আলোচনায় সময় কাটাল তাইতা ও মেরেন।
কর্নেল তিনাতের সথে দক্ষিণে কয়জন গেছে? জানতে চাইল তাইতা।
অসংখ্য অশিক্ষিত মানুষের মতোই আস্থা রাখার মতো স্মৃতিশক্তি রাবাতের, নির্দ্বিধায় জবাব দিল সে: ছয় শো তেইশ জন, সাথে এক শো পঁয়তাল্লিশ জন মেয়ে।
করুণাময় আইসিস, কারনাক থেকে রওয়ানা দেওয়া এক হাজারের ভেতর মাত্র এই কয়জনই বেঁচেছিল?
জলাভূমি ছিল গভীর, দিকচিহ্নহীন, ব্যাখ্যা করল রাবাত। জলাভূমির জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমরা। আমাদের গাইডরা বিশ্বস্ত ছিল না, স্থানীয় উপজাতীয়দের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের লোকজন আর পশুর ক্ষতি ছিল ভয়াবহ। নিশ্চিতভাবেই আপনাদেরও একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, কারণ আপনারা নিশ্চয়ই আদারিতে আসতে গিয়ে একই এলাকা পার হয়েছেন।
হ্যাঁ, ঠিক। তবে পানি অনেক নিচু ছিল, আমাদের গাইডরা ছিল নির্ভুল।
তাহলে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান আপনারা।
তুমি বললে কর্নেল তিনাত ঘোড়া আর মানুষ ফিরিয়ে দিয়েছিল এখানে। কতজন ছিল তারা? আরও জুৎসই প্রসঙ্গে ফিরে গেল তাইতা।
ছাপ্পান্নটি ফিরিয়ে এনেছিল ওরা, সবকটা মাছিতে আক্রান্ত। বেশির ভাগই এখানে পৌঁছানোর পরপরই মারা যায়। মাত্র আঠারটি বেঁচে যায়। কর্নেল তিনাতের লোকজন ঘোড়া পৌঁছে দিয়ে ওর সাথে যোগ দিতে ফের দক্ষিণে ফিরে যায়। ওদের জন্যে ঠিক করা কুলিদের সাথে নিয়ে গেছে ওরা।
তারমানে তিনাতের কেউই এখন তোমদের সাথে নেই?
ওদের ভেতর একজন এত অসুস্থ ছিল যে ওকে রেখে দিয়েছিলাম, এখনও সে বেঁচে আছে সে।
ওকে প্রশ্ন করতে চাই, বলল তাইতা।
এখুনি লোক পাঠাচ্ছি তাকে ডাকতে।
একমাত্র জীবিত লোকটা লম্বা, তবে শারীরিকভাবে কৃশ। তাইতা সাথে সাথে লক্ষ করল লোকটার শীর্ণকায় কাঠামো শাদা হয়ে যাওয়া মাথার চুল রোগেরই ফল; বয়সের কারণে নয়। তারপরেও স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে সে। রাবাতের অধীনের বাকিদের চেয়ে অনেক বেশি প্রফুল্ল মেজাজের, স্বতঃস্ফুর্ত।
তোমার বিপদের কথা শুনলাম, বলল তাইতা। তোমার সাহস আর উৎসাহের তারিফ করি আমি।
কেবল আপনিই তা করলেন, ম্যাগাস। সেজন্যে আপনাকে জানাই ধন্যবাদ।
তোমার নাম কী?
তোলাস।
তোমার পদবী?
আমি হর্স সার্জেন আর ফার্স্ট ওয়াটারের সার্জেন্ট।
বেঁচে থাকা ঘোড়াসহ তোমাদের কর্নেল ফেরত পাঠানোর আগে কতদূর যেতে পেরেছিলে তোমরা?
মোটামুটি বিশ দিনের পথ, ম্যাগাস, সম্ভবত দুইশো লীগ। কর্নেল তিনাত দ্রুত আগে বাড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন-অনেক দ্রুত। আমার ধারণা, তাতেই বেশি ঘোড়া হারাতে হয়েছে আমাদের।
এত তাড়াহুড়ো করছিল কেন সে? জানতে চাইল তাইতা।
কৃশ হাসল তোলাস। আমাকে বলেননি তিনি, ম্যাগাস, আমার কাছে কোনও পরামর্শও চাননি।
একটু ভাবল তাইতা। এমন হতে পারে, তিনাতও ডাইনীর প্রভাবের অধীনে চলে গিয়েছিল, তাকে জাদু করে দক্ষিণে টেনে নিয়ে গেছে সে। তাহলে, সৎ তোলাস, ঘোড়াকে আক্রান্ত করা অসুখ সম্পর্কে বলো আমাকে। ক্যাপ্টেন রাবাত এ কথা বলেছে, তবে বিস্তারিত বলো তুমি। কী কারণে তোমার ধারণা জন্মাল যে মাছির কামড়েই দেখা দিয়েছিল অসুখটা?
পোকাগুলোর সাথে আমাদের মোকাবিলার দশদিনের মাথায় দেখা দেয় অসুখটা। দরদর করে ঘামছিল ঘোড়াগুলো, চোখ ভরে উঠেছিল রক্তে, ফলে আধা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওগুলো। প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার দশ কি পনের দিনের মধ্যেই মারা গেছে বেশির ভাগ।
তুমি একজন হর্স সার্জন। কোনও চিকিৎসা জানা আছে তোমার?
দ্বিধা করল তোলাস। কিন্তু জবাব দিল না। তার বদলে মন্তব্য করল, আপনার ধূসর মেয়ারটা দেখেছি। জীবনে হাজার হাজার ঘোড়া দেখেছি, কিন্তু আমার ধারণা ওই মেয়ারটা সবার সেরাটার মতোই ভালো। আপনি হয়তো আর কোনওদিনই ওটার মতো আর একটা ঘোড়ার দেখা পাবেন না।
বোঝা যাচ্ছে, ঘোড়ার ভালো সমঝদার তুমি, তোলাস, কিন্তু আমাকে একথা বলছ কেন?
কারণ মাছিদের কাছে এমন দারুণ একটা ঘোড়া খোয়ানো লজ্জার ব্যাপার হবে। যেমন ভাবছি, আপনি সামনে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকলে, ফিরে না আসা পর্যন্ত ঘোড়া আর ওটার বাচ্চাটাকে আমার হেফাযতে রেখে যান। ওদের নিজের সন্তানের মতো দেখেশুনে রাখব।
কথাটা ভেবে দেখব, ওকে বলল তাইতা। কিন্তু, আমার প্রশ্নে ফিরে আসা যাক, মাছির রোগের কোনও প্রতিষেধক জানা আছে তোমার?
এখানকার স্থানীয় উপজাতীগুলো বুনো বেরি থেকে বের করা একটা আরক ব্যবহার করে। ওদের গরুর পালের চিকিৎসা করে এটা দিয়ে।
কর্নেল তিনাত আদারি দুর্গ ছাড়ার আগেই ওকে ওরা রোগ সম্পর্কে সতর্ক করেনি কেন?
তখন গোত্রগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমি মাছিতে আক্রান্ত ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসার পরেই ওষুধ বিক্রি করতে হাজির হয়েছিল ওরা।
কাজের?
অব্যর্থ, বলল তোলাস। আমার মনে হয় আক্রান্ত দশটা ঘোড়ার মধ্যে ছয়টিকেই সারিয়ে তুলবে ওটা। তবে আমি যে ঘোড়াগুলোর ওপর প্রয়োগ করেছিলাম সেগুলো সম্ভবত অনেক বেশি দিন অসুস্থ ছিল।
ওটা ব্যবহার না করলে কেমন ক্ষতি হতো তোমার?
নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
আন্দাজ করো।
আমার ধারণা কোনও কোনও জানোয়ারের হুলের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ শক্তি রয়েছে। সেটা খুবই কম, ধরুন, এক শোর ভেতর পাঁচটা কোনও প্রভাব দেখাবে না। অন্যরা, সম্ভবত একশোতে তিরিশ বা চল্লিশটা, অসুস্থ হলেও সেরে উঠবে। বাকিগুলো মারা পড়বে। কোনও পশু আক্রান্ত হয়ে আবার সেরে উঠলে সেটা আর এর পরে আক্রান্ত হয় না।
এসব কীভাবে জানলে?
স্থানীয়রা এসব ভালো করেই জানে।
তোমার হেফাযতে থাকা কয়টা ঘোড়া আক্রান্ত হয়েও আবার সেরে উঠেছে?
বেশিরভাগই ওষুধ দেওয়ার অবস্থা থেকে অনেক বেশি অসুস্থ ছিল। অবশ্য, আঠারটা সেরা। দ্রুত জবাব দিল তোলাস, তারপর শুধরে নিল। ওগুলো মুক্ত।
তাহলে, তোলাস, ওই দেশী আরকের ভালো একটা যোগান চাই আমার। আমার জন্যে যোগাড় করতে পারবে?
তারচেয়ে ভালো কিছুই করতে পারব। প্রায় নয় বছর ব্যাপারটা পরখ করার সুযোগ পেয়েছি আমি। উপজাতীয়রা গোপনীয়তা বজায় রাখতে ও উপকরণ জানাতে রাজি না থাকলেও ওদের ব্যবহার করা গাছপালা চিনে নিয়েছি। মেয়েরা ওসব সংগ্রহ করার সময় ওদের ওপর নজর রেখেছিলাম।
আমাকে দেখাবে?
অবশ্যই, ম্যাগাস, সাথে সাথে বলল তোলাস। কিন্তু আবারও বলছি, চিকিৎসা করা হলেও কিন্তু অনেক ঘোড়াই মারা যায়। আপনার ধূসর মেয়ারটাকে এমন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে অনেক বেশি ভালো ঘোড়া ওটা।
মৃদু হাসল তাইতা। এটা পরিষ্কার, উইন্ডস্মোকের প্রেমে পড়েছে তোলাস, ওটাকে নিজের কাছে রাখার একটা ছুঁতো খুঁজছে। তোমার সব কথাই ভালো করে ভেবে দেখব। কিন্তু এখন প্রতিষেধক সম্পর্কে জানাটাই আমার আসল লক্ষ্য।
ক্যাপ্টেন রাবাতের অনুমতি পেলেই আপনাকে আগামীকাল বেরি সংগ্রহ করতে বনে নিয়ে যাব। ওগুলোর ক্ষেত এখান থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টার পথ।
চমৎকার, খুশি হলো তাইতা। এবার কর্নেল তিনাতের সাথে দক্ষিণে যাবার সময় যে পথে গিয়েছিলে সেই পথের বর্ণনা দাও। যতটুকু মনে ছিল সবই বলল তোলাস, মাটির ফলকে তার তথ্য টুকে রাখল ফেন। সে শেষ করলে তাই বলল, আমাকে যা বললে, তোলাস, খুবই মূল্যবান, কিন্তু আমরা কীভাবে মাছির এলাকা চিনতে পারব তার বর্ণনা দিতে হবে তোমাকে।
মাটির ফলকে ফেনের আঁকা স্কেচ ম্যাপের উপর আঙুল ছোঁয়াল তোলাস। দক্ষিণে যাত্রা পথের আনুমানিক বারতম দিনে আপনি কুমারীর বুকের মতো এক জোড়া পাহাড়ের কাছে পৌঁছবেন আপনারা। বেশ কয়েক লীগ দূর থেকেই দেখা যাবে ওগুলো। ওই পাহাড়গুলোই সীমানা চিহ্নিত করে। ধূসর ঘোড়াটাকে আর সামনে না দিতে পরামর্শ দিচ্ছি আপনাকে। ওধারের বিষণ্ণ এলাকায় ওটাকে খোয়াবেন আপনি।
*
পরদিন সকালে ওরা বেরির খোঁজে নামলে ক্যাপ্টেন রাবাতও তাইতার পাশাপাশি ওদের সাথে চলল। সহজ পথ, কথা বলার বেশ সুযোগ পেল ওরা।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে গোর্জের গভীরে নদীর তীরে জন্মানো বিশাল চওড়া ডুমুড় গাছের এক বনে নিয়ে এলো ওদের তোলাস। বেশির ভাগ ডালই সর্পিল লতার ভারে নুয়ে পড়েছে। ওগুলোর উপর ছোট ছোট পিঙ্গল বেরি ধরেছে। ফেন, তোলাস আর তাইতা দুর্গ থেকে ওর সাথে আনা অন্য লোকেরা গাছে উঠে পড়ল। প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে চামড়ার ফসল তোলার ঝুড়ি ঝুলছে, ফল পেড়ে ওতে রাখতে লাগল। ওরা গাছ থেকে নামার পর দেখা গেল ওদের হাত পিঙ্গল হয়ে গেছে, অসুস্থ, পচা গন্ধ বের হচ্ছে বেরি থেকে। মুঠি ভরে ওয়ার্লউইন্ডদের দিকে বাড়িয়ে দিল ফেন, কিন্তু কোল্টটা প্রত্যাখ্যান করল। উইন্ডস্মোকও সমান অনীহ।
এটা ওদের স্বাভাবিক রুচির খাবার নয়, মেনে নিচ্ছি, তবে বেরিকে ধুরা শস্যের সাথে মিশিয়ে পিঠা বানিয়ে খেতে দিলে ভালোমতোই খাবে। বলল তোলাস। আগুন জ্বেলে তাতে নদীর চ্যাপ্টা পাথর বসাল তোলাস। ওটা গরম হয়ে ওঠামাত্র ফলগুলোকে কীভাবে মণ্ডের মতো বানিয়ে তারপর ধুরা খাবারের সাথে মেশাতে হয় সেটা বাতলে দিল তোলাস। অনুপাতটা গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচভাগ খাবারের সাথে একভাগ ফল। বেরির পরিমাণ বেশি হলেই ঘোড়া প্রত্যাখ্যান করবে। আর খেলেও বমি করে উগড়ে দেবে, ব্যাখ্যা করল সে। পাথরগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে মুঠো ভর্তি মিশ্রণটা তাতে রাখল ও, তারপর ওটাকে পিণ্ডে পরিণত হতে দিল। ঠাণ্ডা হতে ওগুলো একপাশে নামিয়ে রেখে আরেক দফা পিঠা বানাতে শুরু করল। পিঠাগুলো অনেক মাস নষ্ট হবে না। এমনকি সবচেয়ে বাজে অবস্থাতেও টিকে থাকবে। এমনকি সবুজ ছত্রাকে ঢেকে গেলেও।
একটা পিঠা হাতে নিতে গিয়ে আঙুলে ছ্যাকা খেল ফেন। এক হাত থেকে আরেক হাতে চালান করে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করল ওটা, তারপর উইন্ডস্মোকের কাছে নিয়ে গেল। নাক ফুলিয়ে পরখ করল ঘোড়াটা। তারপর দুই ঠোঁটের মাঝখানে তুলে নিয়ে চোখ গোল গোল করে তাইতার দিকে তাকাল।
চালিয়ে যা, দুষ্টু কোথাকার, তীর্যক কণ্ঠে ওটাকে বলল ও। খা, তোর শরীরের জন্যে ভালো হবে।
পিঠায় কামড় দিল উইন্ডস্মোক। মুখের কোণ দিয়ে কয়েকটা টুকরো পড়ে গেল। কিন্তু বাকিটুকু গিলে ফেলল সে। এবার ঘাসের উপর পড়ে যাওয়া টুকরোগুলোও তুলে নিতে মাথা নোয়াল ওটা। কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল ওয়ার্লউইন্ড। ফেন ওর কাছে একটা পিঠা নিয়ে যেতেই মেয়ারের নজীর অনুসরণ করে ঝটপট গিলে ফেলল। তারপর নাক দিয়ে ফেনকে ধাক্কা দিতে লাগল। আরও চায়।
ওদের কি পরিমাণ ওষুধ দিয়েছ? তোলাসকে জিজ্ঞেস করল তাইতা।
ওটা ছিল পরীক্ষার ব্যাপার, জবাব দিল তোলাস। ওদের শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ামাত্রই রোজ চার থেকে পাঁচটা করে পিঠা খেতে দেব যতক্ষণ না লক্ষণ মিলিয়ে যাচ্ছে, তারপর সম্পূর্ণ সেরে না ওঠা পর্যন্ত ওষুধ অব্যাহত রাখব।
ফলের নাম কী? জানতে চাইল ফেন।
কাঁধ ঝাঁকাল তোলাস। উতাসারা অদ্ভুত নামে ডাকে একে, তবে আমি কখনও কোনও মিশরিয় নাম রাখার কথা ভাবিনি।
তাহলে আমি এটার নাম রাখলাম তোলাস ফল, ঘোষণা দিল ফেন। খুশি হয়ে হাসল তোলাস।
পরের দিন তাইতা ও ফেন শোফার, চার সৈনিক আর প্রচুর পরিমাণ তোলাস পিঠা বানোনার জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে বনে ফিরে এলো। বনের মাঝে নীলের শুকনো তলদেশের মুখে একটা ফাঁকা জায়গায় শিবির খাটাল ওরা। দশদিন ওখানে থেকে পিঠা দিয়ে বিশটা বড় আকারের চামড়ার বস্তা বোঝাই করল। পিঙ্গল দাগে ভরা হাত ও দশটা মালবোঝাই খচ্চর নিয়ে যখন ফিরে এলো, মেরেন ও তার লোকজন তখন রওয়ানা দিতে উদগ্রীব হয়েছিল।
*
ওরা রাবাতকে বিদায় জানানোর সময় তাইতাকে বেদনার্ত কণ্ঠে সে বলল, এই জীবনে আমাদের হয়তো আর কোনওদিন দেখা হবে না, ম্যাগাস, তবে কিছুটা সেবা করার সুযোগ পাওয়াটা আমার জীবনের এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার ছিল।
তোমার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সেবা ও চমৎকার সঙ্গের জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। স্বয়ং ফারাও এই সংবাদ পাবেন, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।
তোলাসকে গাইড হিসাবে নিয়ে ফের দক্ষিণে কুমারীর বুকের মতো দেখতে পাহাড় আর মাছির দেশের পথ ধরল ওরা। আদারি দুর্গে কাটানো সময়টুকু মানুষ ও পশুর দলকে তরতাজা করে তুলেছে, ভালোই অগ্রগতি হয়েছে ওদের। শিকারীরা শিকার করা পশুর লেজ রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল তাইতা। ছাল খসানোর কায়দা শিখিয়েছে, মাংস কুঁদে লবণ মেখে শুকোনোর জন্যে খোলা বাতাসে রেখে দিতে হবে। এই সময়ে কাঠ কেটে হাতল বানিয়েছে ওরা, তারপর শুকনো চামড়ার হাড়ের ফুটোয় জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে হাড় বের করে নেওয়া হয়েছে। শেষে, একটা ফ্লাই সুইচ নেড়েচেড়ে দেখিয়ে তাইতা ওদের বলেছে, শিগগিরই এর জন্যে শোকর করবে তোমরা। সম্ভবত মাছিদের পিছু হঠানোর এটাই একমাত্র অস্ত্র।
আদারি দুর্গ ছেড়ে আসার পর বিশতম দিন সকালে যথারীতি ভোর হতেই দ্রুত যাত্রা শুরু করল ওরা। দুপুর পেরুনোর অল্প খানিক পরে তোলাসের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক কুমারীর বুকের মতো পাহাড়ের জোড়া চূড়া দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়াল।
আর নয়। থামার নির্দেশ দাও, মেরেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল তাইতা। আদারি দুর্গ ছেড়ে আসার আগেই স্থির করে রেখেছিল ও, তোলাসের কথা অন্ধের মতো অনুসরণ করবে না। এরই মধ্যে উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডকে পিঠা খাওয়াতে শুরু করে দিয়েছে, আশা করছে, প্রথম বারের মতো হুলের ঘাঁই খাওয়ার আগেই ওষুধটা ওদের রক্তে জমাট বাঁধবে। মাছিদের এলাকায় প্রবেশ করার আগের সেই সন্ধ্যায় ফেনকে নিয়ে ঘোড়ার আস্তাবলে চলে এলো ও। ওদের আসতে দেখে হ্রেষাধ্বনি করে উঠল উইন্ডস্মোক। ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিল তাইতা, কানের পেছনে চুলকে দিল; তারপর তোলাস পিঠা খেতে দিল ওকে। ওয়ার্লউইন্ডের বেলায়ও একই কাজ করল ফেন। এতদিনে দুটোরই পিঠার জন্যে রুচি গড়ে উঠেছে, ক্ষুধার্তের মতো খেল ওরা। ছায়া থেকে দেখছিল তোলাস। এবার সামনে এসে অবিশ্বাসের সাথে সম্ভাষণ জানাল। তাহলে ধূসর মেয়ার আর ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছেন? জানতে চাইল সে।
ওদের ফেলে যেতে পারব না আমি, জবাব দিল তাইতা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোলাস। বুঝতে পারছি, ম্যাগাস। সম্ভবত আমিও এমন কিছুই করতাম, কারণ এরই মধ্যে আমিও ভালোবেসে ফেলেছি ওদের। হোরাস আর আইসিসের কাছে প্রার্থনা করি, ওর যেন বেঁচে থাকে।
ধন্যবাদ, তোলাস। আমরা আবার একসাথে ফিরে আসব, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
পরদিন সকালে আলাদা হয়ে গেল ওরা। তোলাসের পক্ষে এরচেয়ে বেশি দূরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, আদারি দুর্গে ফিরে যাচ্ছে সে। নাকোন্তো রয়েছে সবার সামনে, ট্রেইল বের করছে; মেরেন ও তিনটা স্কোয়াড জোর কদমে এগিয়ে চলেছে তার পেছনে। ঠিক তারপরেই উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে রয়েছে তাইতা ও ফেন। আঠারটা স্বাস্থ্যবান ঘোড়া শিথিল পালে অনুসরণ করছে। চার নম্বর স্কোয়াডের সাথে বাকি সবাইকে নিয়ে আসছে শাবাকো।
সেদিন সন্ধ্যায় পাহাড়ের নিচে তাঁবু খাটাল ওরা। আগুনের পাশে বসে রাতের খাবার খাওয়ার সময় পাহাড়ের ওধারের সমভূমিতে শিকারী সিংহদের একটা দল গর্জন ছাড়তে শুরু করল, ভীতিকর শব্দ। বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোর দড়ির বাঁধন পরখ করতে গেল তাইতা ও মেরেন। কিন্তু সিংহগুলো কাছে এলো না, আস্তে আস্তে কমে এলো ওদের গর্জন, তারপর রাতের নীরবতা নামল।
পরদিন সকালে কলাম তৈরি হবার সময় ঘোড়াগুলোকে তোলাস পিঠা খাওয়াল তাইতা ও ফেন। তারপর স্যাডলে চেপে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে আগে বাড়ল। চলার ছন্দে কেবল নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে তাইতা, এমন সময় সহসা সোজা হয়ে বসল ও, উইন্ডস্মোকের ঘাড়ের দিকে তাকাল। একটা বিরাট গাঢ় পোকা ওর কেশরের বেশ কাছে চকচকে চামড়ার উপর এসে পড়েছে। ডান হাত কাপের মতো করে পোকাটার তীক্ষ্ণ কালো হুল বের করে মেয়রের চামড়ার নিচে রক্তবাহী শিরায় ঢোকানোর অপেক্ষা করতে লাগল ও। ফোঁটানো হুল এঁটে বসল, তাতে করে খাবলা মেরে ওটাকে হাতের মুঠোয় পুরতে পারল ও। পালানোর প্রয়াসে তীক্ষ্ণ শব্দে গুনগুন করতে লাগল ওটা। কিন্তু মুঠি শক্ত করে এঁটে ওটার শরীর মাথা থেঁতলে দিল ও। তারপর দু আঙুলের ডগায় তুলে ফেনকে দেখাল। এটাই সেই মাছি উপজাতীয়রা যাকে তসেতসি বলে। এটার মতো আরও আসবে, ভবিষ্যদ্বাণী করল ও। ওর কথা শেষ হতে না হতে আরেকটা মাছি এসে বসল ওর কাঁধে, কানের পেছনে নরম মাংসে হুল ফোঁটাল। চোখ কুঁচকে থাপ্পড় কষাল ও। জোর আঘাত লাগাতে পারলেও বলতে গেলে অক্ষত অবস্থায় সটকে পড়ল ওটা।
তোমাদের ফ্লাই সুইচগুলো বের করো, হুকুম দিল মেরেন। অচিরেই হুল ফোঁটানো মাছিদের তাড়াতে গিয়ে ধর্মীয় আত্মনিপীড়নকারীদের মতো ঘোড়া আর নিজেদের গায়ে ক্রমাগত আঘাত হেনে চলল ওরা। পরের দিনগুলো রীতিমতো একটা অত্যাচারের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, অবিরাম আক্রমণ হেনে চলেছে মাছির দল। দিনের উত্তপ্ততম সময়টায় সবচেয়ে খারাপ হয়ে ওঠে ওদের অবস্থা, কিন্তু চাঁদ ও তারার আলোতেও আক্রমণ চালিয়ে যায়, মানুষ আর ঘোড়াকে সমানভাবে পাগল বানিয়ে ছাড়ে।
অবিরাম শরীর আর পেছনে আঘাত হানছে ঘোড়াগুলোর লেজ। হামা দিয়ে চোখ আর কানে ঢুকে পড়া মাছি তাড়াতে বারবার মাথা নাড়ছে, চামড়ায় ঝাঁকি দিচ্ছে।
লোকদের চেহারা অদ্ভুতুড়ে কোনও লাল ফলের মতো ফুলে গেছে চোখগুলো বেল থলতলে মাংসের ফাঁকে রেখায় পরিণত হয়েছে। ওদের কাঁধের পেছন দিকটা কুঁজের মতো হয়ে গেছে, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে চুলকানী। আঙুলের ডগা দিয়ে কানের পেছনে চুলকাতে চুলকাতে কাঁচা মাংস বের করে ফেলেছে ওরা। রাতে হাতির শুকনো গোবর দিয়ে ধোঁয়াটে আগুন জ্বালছে ওরা, তারপর তার উৎকট ধোয়ার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে কাশছে, বিষম খাচ্ছে, নিস্তার পাওয়ার উপায় খুঁজছে। কিন্তু যখনই টাটকা বাতাসের সন্ধানে সরে আসছে, মাছির ঝাঁক হামলা চালাচ্ছে ওদের উপর, নেমে আসার সাথে সাথে গভীরে বিধিয়ে দিচ্ছে তীক্ষ্ণ হুল। ওদের শরীর এত শক্ত যে, হাতের তালু দিয়ে সজোরে থাপ্পড় মেরেও তেমন কিছু করা যায় না। এমনকি ওদের বসা অবস্থা থেকে ফেলে দিলেও আবার একইভাবে ফিরে আসে, শরীরের অন্য কোনও খোলা জায়গায় হুল ফোঁটায়। কেবল ফ্রাইসুইচগুলোই একমাত্র কাজের অস্ত্র। ওগুলোকে মারতে পারে না, তবে লম্বা পেছনের লম্বা চুল ঝুলে থাকা পা আর ডানা প্যাঁচ লেগে যায়, তখন আঙুলে চেপে ধরে মারা যায়।
এই দানোগুলোর আওতার নিশ্চয়ই একটা সীমা আছে, লোকদের উৎসাহিত করে তাইতা। নাকোন্তো ওদের স্বভাব ভালো জানে। ও বলছে, যেমন হুট করে ওদের মাঝে এসে পড়েছে, ঠিক তেমনি মুক্তি মিলবে।
জোর গতি স্থির করে ফোর্সড মার্চের নির্দেশ দিয়ে কলামের সামনে চলে এলো মেরেন। ঘুম থেকে বঞ্চিত ও রক্তের ধারায় মাছিগুলোর বিষ ঢেলে দেওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ায় স্যাডলের উপর দোল খাচ্ছে লোকেরা। কোনও সৈনিক ঢলে পড়লেই সতীর্থ আবার ঘোড়ার পিঠে তুলে দিচ্ছে তাকে, তারপর আবার সামনে বাড়ছে।
নাকোন্তোই কেবল পোকামাকড়ের হাত থেকে মুক্ত রয়েছে। মসৃণ ও চকচকে রয়ে গেছে ওর ত্বক। হুলের কোনও চিহ্ন নেই। পোকাগুলোকে ওর রক্ত পুরোপুরি শুষে নিতে দেয় ও, ফলে ওগুলো আর নড়াচড়া করতে না পারে। তখন ডানা ছিঁড়ে নেওয়ার সময় টিটকারী মারে ওদের সাথে মানুষ আমাকে ঘাই মেরেছে, চিতা কামড়েছে, সিংহ থাবা বসিয়েছে। তুমি কে এসেছ বিরক্ত করতে? এবার সোজা নরকে চলে যেতে পারো।
পাহাড় ছেড়ে আসার দশম দিনে মাছিদের এলাকা থেকে বের হয়ে এলো ওরা। ব্যাপারটা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ওরা। এই পাক খাওয়া পোকাগুলোকে অভিশাপ দিয়ে আঘাত হেনে চলছিল ওরা, তারপর আরও পঞ্চাশ কদম সামনে বাড়ার পর দেখা গেল বনের নীরবতা ভীষণ গুঞ্জনে আর ভঙ্গ হচ্ছে না। এমনি স্বেচ্ছাচারের কবল থেকে বেঁচে লীগখানেক দূরে আসার পরেই একটা বিচ্ছিন্ন নদীর পুকুরে হাজির হলো ওরা। দলের প্রতি করুণা দেখাল মেরেন। ছড়িয়ে পড়ো! নির্দেশ দিল সে। সবার শেষে যে জলে নামবে সে একটা নির্বোধ কুমারী।
নগ্ন শরীরের হুটোপুটি লেগে গেল, স্বস্তি আর আনন্দের সাড়া পড়ে গেল গোটা বনে। ওরা যখন পুকুর থেকে উঠে এলো, সবার হুল ফোঁটা জায়গায় ম্যাগাসের একটা মলম মেখে পরিচর্যা করল তাইতা ও ফেন। সেরাতে ক্যাম্পফায়ার ঘিরে ওদের হাসি আর ঠাট্টা তামাশা ছিল নির্মল।
মাঝরাতে তাইতার উপর ঝুঁকে পড়ে ঝাঁকি দিয়ে ঘুম থেকে জাগাল ওকে ফেন। জলদি এসো, তাইতা! মারাত্মক কিছু ঘটছে। ওর হাত জাপ্টে ধরে টেনে হিঁচড়ে ঘোড়ার আস্তাবলে নিয়ে এলো। ওরা দুজনই, বেদনায় ভেঙে যাচ্ছে ফেনের কণ্ঠ। উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ড, একসাথে।
ওরা যখন আস্তাবলে পৌঁছুল, কোল্টটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, শ্বাস প্রশ্বাসের প্রবল চাপে ওঠানামা করছে বুকটা। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক, জিহ্বার দীর্ঘ ছোঁয়ায় চেটে দিচ্ছে ওর শরীর। ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টায় দুর্বলভাবে টলছে। গায়ের পশম খাড়া হয়ে গেছে, ঘামে সপসপ করছে সারা শরীর। পেট থেকে ঝরে পড়ছে, গড়িয়ে নামছে পা দিয়ে।
শোফার আর ওর দলবলকে ডাকো। জলদি আসতে বলল ওদের। তারপর দৌড়ে গিয়ে ওদের সবচেয়ে বড় তিনটা পাত্রে পানি গরম করে আমার কাছে নিয়ে আসতে বলো। তাইতার মুল লক্ষ্য ওয়ার্লউইন্ডকে আবার খাড়া করা ও উইন্ডস্মোককে দাঁড় করিয়ে রাখা। ঘোড়া একবার লুটিয়ে পড়লে সেটা যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে, রোগের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শোফার আর তার লোকজন ওয়ার্লউইন্ডকে দাঁড় করিয়ে দিল, তারপর উষ্ণ পানিতে ওটার গা মুছে দিল তাইতা। সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে নাকে ফুঁ দিতে লাগল ফেন। ফিসফিস করে সাহস উৎসাহ আর আদর দেওয়ার ফাঁকে একটা তোলাস পিঠা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
কোল্টকে গোসল করানোর পরপরই এবার উইন্ডস্মোকের দিকে ফিরল তাইতা। সাহস রাখ, প্রিয়া আমার, ভেজা এক টুকরো লিনেন দিয়ে গা মুছে দেওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল ও। টাটকা কাপড়ে ভালো করে মোছার সময় মেরেন সাহায্য করল, তারপর তাইতার বাঘের ছাল পরিয়ে দিল ওরা। আমরা একসাথে এটাকে ঠেকাব, মেয়ারের সাথে কথা বলে চলল ও। নাম ধরে ডাকার সময় বারবার কণ্ঠের শক্তি কাজে লাগাল। কান খাড়া করে ওর কথা শুনতে লাগল ও। পা ছড়িয়ে ভারসাম্য ধরে রাখল। বাক-হার। উইন্ডস্মোক। হাল ছাড়িস না।
নিজের হাতে মধুতে ডোবানো ভোলাস পিঠা খাওয়াল ওকে। এমনকি এমনি বিপর্যয়ের মুহূর্তেও এই মজাদার খাবারটা ঠেকাতে পারল না সে। এবার ঘোড়াটাকে এক বাটি ওর তৈরি ঘোড়ার সর্দি কাশির বিশেষ প্রতিষেধক খেতে বাধ্য করল। ফেন আর ও হাতে হাত মিলিয়ে ঘোড়ারূপ দেবতা হোরাসের প্রতিরক্ষার জন্যে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। মেরেন আর ওর লোকজন প্রার্থনায় যোগ দিল, রাতের বাকি অংশ অব্যাহত থাকল তা। সকাল নাগাদ উইন্ডস্মোক ও তার কোল্টটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিন্তু ওদের মাথা ঝুলে পড়েছে, পিঠা খেতে চাইছে না। তবে ভয়ানক পিপাসার্ত হয়ে পড়েছে ওরা, তাইতা ও ফেনের ধরে রাখা পাত্র থেকে আগ্রহের সাথে পানি খাচ্ছে। দুপুরের ঠিক আগে আগে মাথা ওঠাল উইন্ডস্মোক, কোল্টের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল। তারপর টলমল পায়ে এগিয়ে গেল ওটার দিকে। কাঁধে ধাক্কা দিল। মায়ের দিকে তাকাতে মাথা ওঠাল সে।
মাথা উঠিয়েছে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল একজন।
আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে মেয়ারটা, বলল আরেকজন। নিজের আর বাচ্চাটার জন্যে লড়ছে।
ঘামছে না আর। জ্বর নেমে যাচ্ছে।
সেদিন বিকেলে মধু মাখানো আরও পাঁচটা তোলাস পিঠা খেল উইন্ডস্মোক। পরের দিন সকালে তাইতার পিছু পিছু নদীর কাছে গিয়ে শাদা বালিতে গড়াগড়ি খেল। সব সময় নীলের তীরে জন্মানো রসাল গোলাপি শিষঅলা একটা বিশেষ ধরনের ঘাসের প্রতি দুর্বল সে, তাই তাইতা ও ফেন বেশ কয়েক বান্ডিল কেটে পছন্দসই ডগা বেছে দিল। চতুর্থ দিন সকালে উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ড পেট ভরে খেল ওই জিনিস।
বিপদ কেটে গেছে ওদের, ঘোষণা দিল তাইতা। ওয়ার্লউইন্ডকে আলিঙ্গন করল ফেন। তারপর এমনভাবে কাদল যেন ওর মন ভেঙে গেছে, আর কোনওদিন ভালো হবে না।
তোলাস পিঠা সত্ত্বেও অন্য ঘোড়াগুলোর রোগের একই রকম লক্ষণ দেখা গেল। বারটা মারা গেল, কিন্তু বেঁচে যাওয়া ঘোড়াদের ছোট পাল থেকে তাদের শূন্য স্থান পূরণ করল মেরেন। কয়েকজন লোকও মাছির বিষাক্ত প্রভাবে ভুগছিল। দুঃসহ মাথা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠেছে তারা, ওদের শরীরের প্রতিটি সন্ধি এমন আড়ষ্ট হয়ে গেছে যে বলতে গেলে হাঁটতে পারছে না। আবার যাত্রা শুরু করার মতো সুস্থ হয়ে উঠতে মানুষ ও পশুর আরও অনেক কটা দিন লেগে গেল। তারপরও তাইতা ও ফেন ওদের জন্যে উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডকে ভারাক্রান্ত করতে গেল না। বরং হল্টার রোপ দিয়ে টেনে বাড়তি ঘোড়ার পিঠে এগোল। দৈনন্দিন যাত্রার বেগ ও পাল্লা কমিয়ে নিল মেরেন যাতে ওরা পুরোপুরি সেরে উঠতে পারে। তারপর দিন পেরিয়ে যাবার সাথে সাথে গতি বাড়াতে লাগল ও, আরও একবার বেশ দ্রুত আগে বাড়তে লাগল।
মাছিদের রাজত্বের পর দুই শশা লীগ এলাকাজুড়ে জনমনিষ্যির কোনও চিহ্ন ছিল না কোথাও। তারপর যাযাবর জেলেদের একটা ছোট গ্রামের দেখা মিলল। ঘোড়সওয়ারদের দলের আগমনের সাথে সাথে পালিয়ে গেল ওখানকার বাসিন্দারা। ফ্যাকাশে ত্বকের অদ্ভুত ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্র আর অদ্ভুত শিঙহীন পশুর পিঠে আসীন লোকগুলোর সাথে দেখা হওয়াটা ওদের পক্ষে ভয়ানক ছিল। ওদের মাছ ঝলসানোর তাক পরখ করল তাইতা, দেখা গেল ওগুলো প্রায় খালি। নীলও এখন গ্রামের জন্যে পর্যাপ্ত উপহার বিলোচ্ছে না। স্পষ্টতই জেলেরা উপোস মরছিল।
নদী তীরের প্লাবন রেখা বরবার একটা বিরাট বাঁকা তলোয়ারের মতো শিঙ আর চোখের চারপাশে শাদা ছোপঅলা স্বাস্থ্যবান অ্যান্টিলোপের পাল চরে বেড়াচ্ছিল। মদ্দাগুলো কালো রংয়ের, মাদীগুলোর গায়ের রঙ গাঢ় লাল। পাঁচ জন। অশ্বারোহী তীরন্দাজকে পাঠিয়ে দিল মেরেন। ঘোড়াগুলোর প্রতি অ্যান্টিলোপগুলোকে কৌতূহলী মনে হলো। ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো। তীরের প্রথম হামলায় লুটিয়ে পড়ল চারটা অ্যান্টিলোপ, পরের হামলায় প্রায় সমান সংখ্যক। শান্তির প্রতীক হিসাবে মৃতদেহগুলোকে গ্রামের সীমানায় ফেলে রাখল ওরা। অপেক্ষা করতে লাগল তারপর। বেশি সময় বিরত থাকতে পারল না ক্ষুধার্ত গ্রামবাসী। সাবধানে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আগন্তকদের তরফ থেকে আক্রমণের যেকোনও লক্ষণ চোখে পড়ামাত্রই সটকে পড়তে তৈরি। ওরা পশুগুলোর ছাল খসিয়ে মাংস গোটা বার আগুনে পোড়াতে দেওয়ার পর শুভেচ্ছা জানাতে এগিয়ে গেল নাকোন্তো। ওদের মুখপাত্র ধূসর দাড়িঅলা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তীক্ষ্ণ ভাঙা ভাঙা কথায় সাড়া দিল সে।
তাইতাকে রিপোর্ট করতে ফিরে এলো নাকোন্তো। এই লোকগুলো ঊতাসাদের সাথে সম্পর্কিত। খুবই পরিচিত ওদের ভাষা, পরিষ্কার বুঝতে পারি আমরা।
ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাহসী হয়ে উঠেছে গ্রামবাসীরা, ওদের এবং ওদের অস্ত্র আর ঘোড়া পরখ করতে সামনে এগিয়ে এসেছে। অবিবাহিতা মেয়েরা স্রেফ কোমরে একটা পুঁতির মালা জড়িয়ে রেখেছে, শিলুক শিবির অনুসারী নেই এমন সৈনিকদের সাথে বলতে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল ওরা।
বিবাহিতা মেয়েরা তাইতা, মেরেন, ও তার ক্যাপ্টেনদের জন্যে কালাবাশ ভর্তি টক বিয়র নিয়ে এলো। ওদিকে সেই প্রবীন লোকটা, তার নাম পোলতা, গর্বিত ভঙ্গিতে তার পাশে বসে রইল। নাকোন্তোর প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল ঝটপট।
দক্ষিণের এলাকা ভালো করেই চিনি আমি, গর্বের সাথে বলল সে। আমার বাবা আর তার বাবা মহা হ্রদের পাশে ছিল, মাছে ভরা ছিল সেগুলো, কোনওটা এত বিশাল যে চার জনে মিলে একটা মাছকে তুলতে হতো। ওদের পেট ছিল এত বড়… শীর্ণ বাহু দিয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করল সে।…আর এত লম্বা… লাফ দিয়ে উঠে বিশাল পায়ের আঙুলে মাটির উপর একটা রেখা আঁকল, তারপর চার কদম সামনে বেড়ে আঁকল দ্বিতীয় রেখাটা।…এখান থেকে ওই পর্যন্ত।
সারা দুনিয়ার জেলেরা একই রকম, মন্তব্য করল তাইতা, তবে বিস্ময়ের জুৎসই আওয়াজ করল মুখে। পোতোকে ওর গোত্রের লোকেরা অবহেলা করে বলে মনে হলো, একবারের জন্যে হলেও পূর্ণ মনোযোগ পেয়েছে সে। নতুন বন্ধুদের সঙ্গ তার ভালো লাগছে।
তোমাদের গোত্র অমন একটা চমৎকার জায়গা ছেড়ে চলে এলো কেন? জানতে চাইল তাইতা।
পুব থকে আরেকটা শক্তিশালী ও অনেক বড় একটা দল আসায় ওদের ঠেকাতে পারিনি। নদী বরাবার আমাদের উত্তরে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা। মুহূর্তের জন্যে বিমর্ষ দেখাল তাকে, তারপর ফের খেই ধরল। আমার খত্ন আর দীক্ষার পর বাবা আমাকে আমাদের এই নদীর জন্মস্থান সেই বিরাট জলপ্রপাতের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। নীলের দিকে ইঙ্গিত করল সে, ওটার তীরেই বসেছিল ওরা। জলপ্রপাতের নাম তালা মাদযি, বজ্রের ধনি তোলা জল।
এমন অস্বাভাবিক নাম কেন?
পড়ন্ত পানির গর্জন আর সাথে করে নিয়ে আসা পাথরের ভেঙে পড়ার আওয়াজ দুই দিনের দূরের পথ থেকেও শোনা যায়। আকাশের বুকে রূপালি মেঘের মতো প্রপাতের মাথার উপরে উঠে আসে পানির ফোয়ারা।
এমন অসাধারণ দৃশ্য চোখে দেখেছে কে? জিজ্ঞেস করে প্রবীন লোকটার উপর অন্তর্চক্ষু স্থির করল তাইতাতো।
খোদ এই চোখ দিয়েই, বলে উঠল পোতো। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় নিভে যাওয়ার আগে জ্বলজ্বল করতে থাকা তেলের শিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর আভা। সত্যি কথা বলছে লোকটা।
তোমার বিশ্বাস এটাই নদীর জন্মস্থান? উত্তেজনায় দ্রুত হয়ে উঠেছে তাইতার হৃৎস্পন্দন।
বাবার আত্মার কসম খেয়ে বলতে পারি, জলপ্রপাতের ওখানেই শুরু হয়েছে নদীর।
ওদের উপরে ওপাশে আর কী আছে?
পানি, বিরস কণ্ঠে বলল পোত। পানি ছাড়া আর কিছু নেই। জগতের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত খালি পানি আর পানি।
জলপ্রপাতের ওপাশে আর কোনও জমিন দেখনি?
পানি ছাড়া আর কিছু না।
আকাশে ধোঁয়া উগড়ে দেওয়া জ্বলন্ত পাহাড় চোখে পড়েনি?
কিছু না, বলল পোতো। পানি ছাড়া আর কিছু না।
আমাদের জলপ্রপাতের কাছে নিয়ে যাবে? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
নাকোন্তো প্রশ্নটার তর্জমা করে দিতেই সতর্ক হয়ে উঠতে দেখা গেল তাকে। আমি আর কোনওদিন ফিরতে পারব না। ওখানকার লোকজন আমাদের শত্রু। আমাকে মেরে খেয়ে ফেলবে। নদী বরাবর যেতে পারব না, কারণ দেখতেই পাচ্ছেন, নদী অভিশপ্ত, মরতে চলেছে।
আমাদের সাথে এলে কাঁচের পুঁতি ভরা ব্যাগ দেব তোমাকে, প্রতিশ্রুতি দিল তাইতা। গোত্রের সবচেয়ে ধনী লোক হয়ে যাবে।
দ্বিধা করল না পোতো। ছাইয়ের মতো শাদা হয়ে গেছে তার চেহারা। ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে এখন। না! কোনওদিন না! একশো ব্যাগ পুঁতি দিলেও না। ওরা আমাকে খেয়ে নিলে আমার আত্মা আর কোনওদিন আগুনের ভেতর দিয়ে যেতে পারবে না। হায়েনা হয়ে সারা জীবন রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে, পচা লাশ আর ফেলে দেওয়া টুকরাটাকরা খাবে। মনে হলো যেন লাফ দিয়ে উঠে পালাবে সে। কিন্তু আস্তে ওকে স্পর্শ করে বিরত রাখল তাইতা। নিজের প্রভাব প্রয়োগ করে শান্ত, আশ্বস্ত করল ওকে। ওর সাথে আবার কথা বলার আগে বড় বড় দুই ঢোক বিয়ার খেতে দিল ওকে।
আমাদের পথ দেখানোর মতো আর কেউ আছে?
মাথা নাড়ল পোতো। ওরা সবাই ভীতু, এমনকি আমার চেয়েও।
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল ওরা। তারপর নড়াচড়া শুরু করল পোতো। কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছুনোর জন্যে ওকে সময় দিল তাইতা। শেষ পর্যন্ত কেশে উঠল সে, ধূলির উপর বিরাট এক দলা হলদে কফ ফেলল। মনে হয়ে একজন আছে, নিজে থেকেই বলল সে। কিন্তু না, নিশ্চয় সে মরে গেছে। শেষ বার যখন দেখি তখনই অনেক বয়স হয়েছিল তার। অনেক দিন আগের কথা সেটা। এমনকি তখনও সে আপনার চেয়ে বয়স্ক ছিল, সম্মানিত পুরুষ। তাইতার উদ্দেশে শ্ৰদ্ধার ইঙ্গিত করে মাথা দোলাল সে। সে হচ্ছে আমাদের গোত্র অস্তিত্ব পাওয়ার পর থেকে বেঁচে থাকাদের একজন।
কে সে? ওকে কোথায় পাওয়া যাবে? জানতে চাইল তাইতা।
তার নাম কালুলু। কোথায় পাওয়া যাবে তার পথ বাৎলে দেব আমি। আবার বালির উপর পায়ের আঙুল দিয়ে আঁকতে শুরু করল পোতো। আপনারা মহান নদী ধরে এগিয়ে গেলে, যেটা মরতে চলেছে, এমন একটা জায়গায় হাজির হবেন যেখানে এটা অনেক হ্রদের একটার সাথে মিলেছে। বিশাল পানির বিস্তার এটা। আমরা একে বলি সেমলিকি নিয়নযু। চ্যাপ্টা ভাঙা বৃত্তের মতো করে আঁকল সে।
এখানেই তাহলে নদীর জন্মস্থানের সেই জলপ্রপাতের দেখা পাব? জানতে চাইল তাইতা।
না। মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসা বর্শার ফলার মতো হ্রদ থেকে বের হয়ে এসেছে নদীটা। বৃত্তের ভেতর দিয়ে ফুটো তৈরি করল সে। আমাদের নদীটা বাইরের অংশ, ভেতরের অংশ পড়েছে হ্রদের দক্ষিণ তীরে।
কেমন করে সেটা পাব?
পাবেন না, যদি না কালুলুর মতো কেউ আপনাদের সেখানে নিয়ে যায়। একটা ভাসমান দ্বীপে জলায় থাকে সে, হ্রদের আগাছার একটা দ্বীপ। নদীর বাইরের অংশের কাছে।
ওকে কীকরে পাব?
খোঁজ করে, তন্নতন্ন করে, আর ভাগ্য ভালো হলে। কাঁধ ঝাঁকাল পোতো। কিংবা হয়তো সেই আপনাদের খুঁজে নেবে। তারপর অনেকটা যেন দ্বিতীয় ভাবনার ঢঙে সে বলল, কালুলু বিরাট অলৌকিক শক্তিঅলা একজন শামান, কিন্তু তার পা নেই।
ওরা গ্রাম ছাড়ার সময় পোতোকে দুই মুঠো কাঁচের পুঁতি দিল তাইতা। কেঁদে ফেলল বুড়ো। আমাকে আপনি ধনী করে দিয়েছেন, বুড়ো বয়সে সুখী হয়েছি। এখন আমার দেখা শোনা করতে দুটি অল্প বয়সী বউ কিনতে পারব।
*
তীর বরাবর দক্ষিণে এগোনোর সময় দেখা গেল নীল নদের গতি কিছুটা জোরাল হয়েছে, তবে জলরেখার উচ্চতা থেকে ওরা বুঝতে পারছিল আগের বছরগুলোর তুলনায় পানির স্তর অনেক অনেক নিচে।
বিশগুন শুকিয়ে গেছে, হিসাব করে বলল মেরেন। সায় দিল তাইতা। যদিও মুখে তেমন কিছু বলল না। অনেক সময় মেরেনকে মনে করিয়ে দিতে হয়, সে মোহান্ত নয়, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো এসব যারা বোঝে তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
পশ্চিম তীর ধরে এগোনোর সময় দিন পেরুনোর সাথে সাথে মানুষ ও পশু ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে লাগল। হ্রদের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সবাই মাছির আক্রমণের প্রভাব থেকে পুরোপুরি সেরে উঠল। পোতোর বর্ণনার মতোই আবিষ্কার করল ওরা হ্রদটা। বিশাল।
সামান্য হ্রদ নয়, এটা নির্ঘাৎ সাগর, ঘোষণা দিল মেরেন। নদী থেকে এক কলসি পানি আনতে পাঠাল ওকে তাই।
এবার খেয়ে দেখ, সৎ মেরেন, নির্দেশ দিল ও। ইতস্তত করে এক চুমুক পানি নিয়ে মুখের ভেতর ঘোরাল সে। তারপর কলসীর বাকি পানিটুকুও খেলো।
লোনা সাগর? করুণার হাসি দিল তাইতা।
না, ম্যাগাস, মধুর মতো মিষ্টি। আমার ভুল হয়েছে, আপনার কথাই ঠিক।
হ্রদটা এত বিশাল, মনে হচ্ছে নিজেই বায়ুমণ্ডল তৈরি করে নিয়েছে। ভোরের হাওয়া ঠাণ্ডা, নিথর। তলদেশে থেকে শুন্যে উঠে আসা ধোঁয়ার মতো লাগছে।
আগ্নেয়গিরির কারণে পানি গরম হয়ে উঠছে, বলল একজন।
না, বলল আরেক জন। কুয়াশার মতো উবে যাচ্ছে পানি। বৃষ্টি হয়ে অন্য কোথাও ঝরে পড়বে।
উঁহু, এটা পানিতে বাস করা সাগর দানোর ভয়াল নিঃশ্বাস, কর্তৃত্বের সাথে বলল মেরেন।
শেষে সত্যি কথা জানবার জন্যে তাইতার দিকে তাকাল ওরা।
মাকড়শা, বলল তাইতা, ফলে আরেকটা প্রবল বিতর্কে লিপ্ত হলো ওরা।
মাকড়শা উড়তে পারে না। ফড়িংয়ের কথা বুঝিয়েছেন উনি-গঙ্গা ফড়িং।
আমাদের বিশ্বাস নিয়ে ঠাট্টা করছেন তিনি, বলল মেরেন। ওকে ভালো করেই চিনি। ছোটখাট মজা করতে ভালোবাসেন।
দুদিন বাদে বাতাস পড়ে গেল, একটা মেঘের মতো জটলা ভেসে এলো শিবিরের উপর। জমিনের কাছে আসার পর নামতে শুরু করল ওটা। লাফিয়ে শূন্যে উঠে কি যেন লুফে নিল ফেন।
মাকড়শা! চিৎকার করে উঠল ও। তাইতার কখনও ভুল হয় না। অগুনতি সদ্য জন্মানো মাকড়শা মিলে তৈরি করেছে মেঘটা, এত ছোট যে স্বচ্ছই মনে হয়। ভোরের হাওয়া ধরার জন্যে এক ধরনের জালের পাল তৈরি করে নিয়েছে ওরা, যাতে হ্রদের কোনও নতুন এলাকায় নিরাপদে নামতে পারে।
সূর্য রশ্মি পানি স্পর্শ করার সাথে সাথে বাতাস চড়ে উঠল। দুপুরের দিকে বাতাসকে আঘাত করে ঘূর্ণী তৈরি করতে লাগল। বিকেলের দিকে কমে আসতে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অব্যাহত রইল। চারদিকে নেমে এলো সুনসান নীরবতা। তরঙ্গায়িত গোলাপি ডানায় ভর করে দিগন্তে উড়ে চলল ফ্লামিঙ্গোর ঝক। জলহস্তীর দল গ্রানিট বোল্ডারের মতো জলে গড়াগড়ি যাচ্ছে, বিশাল গুহার মতো গোলাপি চোয়াল হাঁ করে দীর্ঘ শ্বদন্ত বের করে ভয় দেখাচ্ছে প্রতিপক্ষকে। বালির উপর শুয়ে আছে দানবীয় কুমীরের দল, রোদ পোহাচ্ছে; মুখ হাঁ করে রেখেছে যাতে পানির পাখিরা হলদে দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া মাংসের টুকরো খুঁড়ে বের করে আনতে পারে। রাতগুলো নিথর, মখমলের মতো চকচকে জলে ঠিকরে যায় তারার আলো।
হ্রদের পশ্চিম দিকটা এত বিশাল যে ওখানটায় জমিনের কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে না, স্রেফ কয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপ বাতাসের আঘাতে বিক্ষিপ্ত জলের উপর ডিঙি নৌকার মতো ভেসে চলে বলে মনে হয়। আর দক্ষিণে হ্রদের কেবল অপর প্রান্ত কোনওমতে চোখে পড়ে। উঁচু পাহাড়চূড়া বা আগ্নেয়গিরি বলে কিছু নেই, কেবল নিচু টিলার নীল বিস্তার।
স্থানীয় গোত্রগুলোর হিংস্রতা সম্পর্কে ওদের সাবধান করে দিয়েছিল পোতো। তাই সুরক্ষিত হ্রদের কিনারায় জন্মানো বাবলা গাছের কাঁটা ডালের শিবির গড়ে তুলল ওরা। দিনের বেলায় ঘোড়া আর খচ্চরগুলো উপকূলে জন্মানো ঘেসো জমিনে চরে বেড়ায় বা জল ভেঙে নেমে যায় শাপলা আর অগভীর জলে জন্মানো অন্যান্য জলজ গাছের ফুলের ভোজ উৎসবে মেতে উঠতে।
আমরা শামান কালুলুর খোঁজে নামছি কখন? জানতে চাইল ফেন।
আজই সন্ধ্যার খাবার শেষ করে।
প্রতিশ্রুতি মতো ওকে সৈকতে নিয়ে গেল তাইতা, ভেসে আসা কাঠ দিয়ে একটা আগুন জ্বালল এখানে। ওটার পাশে বসে ফেনের হাত তুলে নিল তাইতা, তারপর প্রতিরক্ষার একটা বৃত্ত তৈরি করে নিল। কালুলু মোহন্ত হলে, পোতো যেমন বলেছে, ইথারে তাকে আহবান জানাতে পারব আমরা, বলল তাইতা।
সেটা পারবে তুমি, তাইতা? জিজ্ঞেস করল ফেন।
পোতোর কথামতো এখানে থেকে খুব কাছে জলাভূমিতে থাকে সে, হয়তো আমরা এখন যেখানে আছি সেখান থেকে মাত্র কয়েক লীগ দূরে। সহজে ডাক পাঠানোর মতো দূরত্ব।
দূরত্ব কি গুরুত্বপূর্ণ?
মাথা দোলাল তাইতা। আমরা তার নাম জানি। শারীরিক গড়ন সম্পর্কে জানি। কেটে ফেলা পায়ের কথা জানি। ওর আত্মার নাম জানা থাকলে অবশ্যই আরও সহজ হতো কাজটা। কিংবা আমাদের কাছে যদি তার ব্যক্তিগত কোনও কিছু থাকত-এক গাছি চুল, নখের টুকরো, ঘাম, পেশাব বা মল। তবে, হাতে যা আছে তা দিয়েই কোনও কিছু খোঁজার কায়দা তোমাকে শেখাব আমি। থলে থেকে এক চিমটি ভেষজ বের করে আগুনে ছুঁড়ে দিল তাইতা। গন্ধময় ধোয়া তুলে ঝলসে উঠল সেটা। আশেপাশে ভেসে বোড়ানো যে কোনও অশুভ প্রভাব দূর করে দেবে এটা, ব্যাখ্যা করল ও। আগুনের দিকে তাকাও। কালুলু এলে ওখানে দেখতে পাবে তাকে।
হাত ধরে রেখেই তাইতার বুকের গভীর থেকে বের আনা এক ধরনের গুঞ্জন ধ্বনির সাথে তাল রেখে দুলতে শুরু করল ওরা। ওর শিক্ষা মতো ফের ওর মন পরিষ্কার করার পর শক্তির তিনটা প্রতীক তৈরি করল ওরা; নীরবে সেগুলোকে সংযুক্ত করল।
মেনসার!
কিদাশ!
নিউবে!
ওদের চারপাশের ইথারে গুঞ্জন উঠল। তাতে হাঁক ছাড়ল তাইতা।
কালুলু, হে, পা বিহীন পুরুষ, শোনো! তোমার কান উন্মুক্ত করো! সবিরতিতে আহ্বান পুনরাবৃত্তি করে চলল ও। এদিকে চাঁদ উঠে সর্বোচ্চ বিন্দুর দিকে অর্ধেকটা পথে এগিয়ে গেল।
সহসা আঘাতটা টের পেল ওরা। উত্তেজনায় ঢোক গিলল ফেন, ওর আঙুলের ডগা দিয়ে বের হয়ে গেল একটা বিচ্ছুরণ। আগুনের দিকে তাকাল ও। একটা চেহারার রেখা দেখতে পেল। চেহারাটা ওর কাছে প্রাচীন কিন্তু চিরন্তন জ্ঞানী হনুমানের মতো লাগল।
কে ডাকে? তেনমাস ভাষায় প্রশ্নটাকে আকার দিল আগুনের চেহারা। কে ডাকে কালুলুকে?
আমি গালালার তাইতা।
আপনি সত্যি হলে আমাকে আপনার আত্মার নাম দেখান। মাথার উপর ভাঙা ডানার বাজপাখীর প্রতীক হিসাবে ওটাকে আবির্ভূত হতে দিল তাইতা। বৈরী সত্তার হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে এমন একটা জায়গায় ইথারে ব্যাখ্যা করা ভীষণ বিপজ্জনক হতে পারে।
আমি আপনাকে চিনেছি, সত্যির ভাই, বলল কালুলু।
তোমার আত্মার নাম প্রকাশ করো, চ্যালেঞ্জ করল তাইতা। ধীরে ধীরে আগুনের উপর একটা ওত পাতা আফ্রিকান খরগোশের রেখা ফুটে উঠল। পৌরাণিক বিজ্ঞ ব্যক্তির চেহারা। কালুলু, খরগোশ, যার মাথা আর দীর্ঘ কান পূর্ণিমার পূর্ণ গোলকে আঁকা থাকে।
তোমাকে চিনতে পেরেছি, ডানদিকের পথের ভাই। তোমার সাহায্যের জন্যে তোমাকে আহবান করেছি, বলল তাইতা।
আপনি কোথায় জানি আমি, আমিও কাছেই আছি। তিনদিনের মধ্যে আপনার কাছে আসছি আমি, জবাব দিল কালুলু।
*
ইথারে কাউকে আহবান জানানোর এই কৌশলে বিমোহিত হলো ফেন। ওহ, হতাইতা, স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবিনি এমনটা সম্ভব হতে পারে। দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দাও।
সবার আগে নিজের আত্মার নাম শিখতে হবে তোমাকে।
মনে হয় আমি জানি, জবাব দিল ও। একবার ওই নামে আমাকে ডেকেছিলে তুমি, তাই না? নাকি সেটা স্বপ্ন ছিল, তাইতা?
অনেক সময়ই স্বপ্ন আর বাস্তব মিলে মিশে যায়, ফেন। কোন নামটা মনে করতে পার তুমি?
জলের সন্তান, পরিষ্কার কণ্ঠে জবাব দিল সে। লস্ত্রিস।
সবিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। অজান্তেই নিজের মনস্তাত্ত্বিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে ও, আগের মতোই কদাচিত। অন্য জীবনে ফিরে যেতে পেরেছে ও। উত্তেজনা ও খুশি ওর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর করে তুলল। তোমার আত্মার নামের প্রতীক কী জানো, ফেন?
না। কখনও দেখিনি, ফিসফিস করে বলল ফেন। নাকি দেখেছি, তাইতা?
ভেবে দেখ, বলল তাইতা। তোমার মনের সামনের কাতারে নিয়ে এসো তাকে। চোখ বন্ধ করে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল ও। আছে নামটা তোমার মনের ভেতর? আস্তে করে জানতে চাইল তাইতা।
আছে, ফিসফিস করে বলল ফেন। অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল ওর আভা, আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে ওকে, মাথার উপর ঝুলছে সেই একই স্বর্গীয় আগুনে খোদাই করা ওর আত্মার প্রতীক।
জলজ ফুল, শাপলা আকৃতি, ভাবল তাইতা। পূর্ণাঙ্গ। পূর্ণ বয়স্ক হয়ে উঠেছে–ও। ওর আত্মার প্রতাঁকের মতোই। এমনকি ছোটবেলাতেই প্রথম জলের পণ্ডিত হয়ে উঠেছিল ও। মুখে ফেনকে ও বলল, ফেন, তোমার মন ও আত্মা সম্পূর্ণ তৈরি। সব কিছু শেখার জন্যে তুমি প্রস্তুত। তোমাকে শিক্ষা দিতে পারব আমি, হয়তো তার চেয়ে বেশি কিছু।
তাহলে ইথারে আহ্বান পাঠানো শেখাও আমাকে। অনেক দূরে থাকলেও যাতে তোমার কাছে পৌঁছুতে পারি তার কৌশল শেখাও।
এখুনি শুরু করছি আমরা, বলল তাইতা। তোমার একটা কিছু এরই মধ্যে পেয়ে গেছি।
কী সেটা? কোথায়? আগ্রহের সাথে জানতে চাইল ফেন। জবাবে গলায় ঝোলানো মাদুলিটা স্পর্শ করল তাইতা। আমাকে দেখাও, বলে উঠল ফেন। লকেট খুলে ভেতরের চুলের গোছা দেখাল তাই।
চুল, বলল ফেন। কিন্তু, আমার না। তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করল সে। বয়স্কা মহিলার চুল এটা। দেখতে পাচ্ছ? সোনালির চুলের সাথে ধূসর চুল মিশে আছে।
তোমার মাথা থেকে কেটে নেওয়ার সময় বয়স হয়েছিল তোমার, মেনে নিল তাইতা। ততক্ষণে মরে গিয়েছিলে তুমি। মলমের টেবিলে নিথর শীতল পড়েছিলে।
আমোদিত ভয়ে কেঁপে উঠল ফেন। সেটা কি ভিন্ন জীবনে? জানতে চাইল ও। আমাকে বললো সে কথা। কে ছিলাম আমি?
সবকিছু বলতে গেলে সারা জীবন লেগে যাবে আমার, বলল তাইতা, তবে এই বলে শুরু করতে দাও যে, তুমিই ছিলে আমার ভালোবাসার সেই নারী, ঠিক এখন যেভাবে তোমাকে ভালোবাসি। ওর হাতের দিকে হাত বাড়াল ফেন, চোখের অশ্রু ওকে অন্ধ করে দিচ্ছে।
আমার একটা কিছু তোমার কাছে আছে, ফিসফিস করে বলল ফেন। এবার তোমার একটা কিছু প্রয়োজন আমার। ওর দাড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে আঙুলে পেঁচিয়ে নিল পুরু কগাছি দাড়ি। আমাদের দেখা হওয়ার সেই প্রথম দিন আমাকে ধাওয়া করার সময়ই তোমার দাড়ি চোখে লেগেছিল। খাঁটি রূপার মতো ঝলমলে। কোমরে ঝোলানো খাপ থেকে ছোট তীক্ষ্ণ ড্যাগার বের করল সে। চামড়ার বেশ কাছ থেকে কেটে নিল দাড়ির গোছাটা। নাকের কাছে তুলে গন্ধ শুকল, যেন সুবাসিত কোনও ফুল। এটা তোমার গন্ধ, তাইতা, তোমার নিজস্ব সত্তা।
ওটা রাখতে তোমাকে এবটা লকার বানিয়ে দেব।
খুশিতে হেসে উঠল ফেন। হ্যাঁ, খুবই ভালো হবে তাহলে। কিন্তু ওই মৃত বৃদ্ধার চুলের সাথে একটা জীবন্ত বাচ্চার চুলও রাখতে হবে তোমাকে। হাত তুলে নিজের মাথার কগাছি চুল কেটে ওকে বাড়িয়ে দিল। যত্নের সাথে ওগুলো পেঁচিয়ে মাদুলির ভেতরের খোপে সত্তর বছরের বেশি আগে রেখে দেওয়া চুলের গোছার উপর রাখল।
আমি কি সব সময়ই তোমাকে ডাক পাঠাতে পারব? জিজ্ঞেস করল ফেন।
হ্যাঁ। আমিও তোমাকে ডাকতে পারব, সায় দিল তাইতা। তবে তার আগে তোমাকে তার কায়দা শেখাতে হবে।
পরের দিনগুলোতে কায়দাটা রপ্ত করল ওরা। পরস্পরের কাছাকাছি কিন্তু শ্রবণসীমার বাইরে বসে শুরু করল। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ওর মনে স্থাপন করা ইমেজ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে উঠল ফেন, তারপর নিজের ইমেজ দিয়ে সাড়া দিল। পুরোপুরি আয়ত্ত করার পর পরস্পরের দিকে পেছন ফিরে বসল ওরা, যাতে চোখাচোখি না হয়। সবশেষে ফেনকে শিবিরে এনে মেরেনকে সাথে নিয়ে হ্রদের কিনারা বরাবর বেশ কয়েক লীগ দুরে চলে এলো তাই। এখান থেকে প্রথম চেষ্টাতেই ফেনের কাছে পৌঁছতে পারল ও।
যখনই আহ্বান করছে, আগের চেয়ে অনেক দ্রুত সাড়া দিচ্ছে ফেন, ওর কাছে পাঠানো ইমেজগুলো আগে চেয়ে অনেক বেশি তরতাজা, আরও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠতে লাগল। ওর সুবিধার জন্যে কপালে প্রতীক রেখেছে ফেন, অনেকগুলো প্রয়াসের পর ইচ্ছামতো শাপলার রঙ বদলাতে সক্ষম হয়ে উঠল ফেন, গোলাপি থেকে লাইলাক তারপর রক্তিম।
রাতে প্রতিরক্ষার জন্যে নিজের মাদুরে ওর কাছাকাছি ঘেঁষে গুলো ফেন। ঘুমে ঢলে পড়ার আগে ফিসফিস করে ওকে বলল, এবার আর বিচ্ছিন্ন হবো না আমরা, তুমি যেখানেই যাও আমি তোমাকে খুঁজে বের করতে পারব।
*
ভোরে হাওয়া খেলতে শুরু করার আগেই হ্রদে ম্লান করতে গেল ওরা। জলে নামার আগে কুমীর ও গভীর জলে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে এমন যেকোনও দানো দূরে ঠেলে রাখতে প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরি করার জন্যে মন্ত্র পড়ল তাইতা। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। ভোদরের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে ফেন। পিছলে গভীরে চলে যাওয়ার সময় পলিশ করা আইভরির মতো বলসে উঠছে ওর নগ্ন দেহ। ফেনের পানির নিচে থাকা সময় নিয়ে একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি ও, তাই জলের উপর শুয়ে নিচের সবুজ জগতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তলে তলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ও। তারপর যেন অনন্ত কাল পরে মেয়েটি ওর দিকে উঠে আসার সময় ওর দেহের মলিন ঝলক দেখতে পেল। ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিল। তারপর ছলাৎ করে ওর পাশে মাথা জাগাল ও। হাসছে, চুল থেকে পানি ঝরাচ্ছে। অন্য সময় ওর ফিরে আসা টের পায় না ও। গোড়ালী ধরে ওকে নিচে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করার সময় প্রথম বুঝতে পারে।
এভাবে সাঁতার কাটা শিখলে কোথায়? জানতে চায় তাই।
আমি জলের সন্তান, ওর দিকে চেয়ে হাসে ফেন। মনে নেই তোমার? আমার জন্মই হয়েছে সাঁতার কাটার জন্যে।হ্রদ ছেড়ে উঠে আসার পর সকালের সূর্যের আলোয় দেহ শুকোনার মতো একটা জায়গা খুঁজে পেল ওরা। ফেনের পেছনে বসে ওর চুলে বেণী বেঁধে দিল তাইতা। চুলের গোছর ভেতর শাপলা ফুল বানায়। এই সময় মিশরের রানি হিসাবে কাটানো ওর সেই জীবনের গল্প বলল। অন্য যারা ওকে ভালোবেসেছিল তাদের কথা, ওর বাচ্চাদের কথা বলল। প্রায়ই চিৎকার করে ওঠে ও। ও, হ্যাঁ! এখন মনে পড়ছে। একটা ছেলে থাকার কথা মনে আছে, কিন্তু ওর চেহারা দেখতে পাই না।
তোমার মন উন্মুক্ত করো, আমার স্মৃতি থেকে ওর ছবি তোমার মনে স্থাপন করব।
চোখ বুজল ফেন। হাতজোড়া কাপের মতো করে ওর মাথার দুপাশে কানসহ ঢেকে ফেলল। চেপে ধরল ও। কিছুক্ষণ চুপ রইল ওরা। অবশেষে ফিসফিস করে ফেন বলল, বাহ, কী সুন্দর বাচ্চা। ওর মাথার চুল সোনালি। ওর মাথার উপর কার্তুশে দেখতে পাচ্ছি। ওর নাম মেমনন।
এটা ওর ছোটবেলার নাম, বিড়বিড় করল তাইতা। সিংহাসনে বসে মিশরের দুই রাজ্যের শাসন ভার কাঁধে তুলে নেওয়ার পর তার নাম হয়েছে ফারাও তামোস, এই নামের প্রথম ফারাও। এই যে! সমস্ত ক্ষমতা ও আভিজাত্যসহ তাকে দেখ। ওর মনে ছবিটা স্থাপন করল তাইতা।
অনেকক্ষণ চুপ থাকল ফেন। তারপর বলল, কী সুদর্শন ও অভিজাত। ওহ, তাইতা, ছেলেটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
দেখতে পাবে, ফেন। ওকে বুকের দুধ খাইয়েছ তুমি, নিজের হাতে ওর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিয়েছ।
আবার নীরব হয়ে গেল ফেন। তারপর ফের বলল, অন্য জীবনে আমার সাথে তোমার পরিচয়ের দিনের চেহারা দেখাও আমাকে। সেটা পারবে, তাইতা? আমার জন্যে তোমার নিজের ছবি তৈরি করতে পারবে?
তেমন চেষ্টা করার সাহসই দেখাতে যাব না, চট করে জবাব দিল তাইতা।
কেন নয়? জানতে চাইল ফেন।
বিপজ্জনক হবে সেটা, জবাব দিল তাইতা। আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে তোমাকে। সেটা কোনওভাবেই বেশি বিপজ্জনক হবে না।
তাইতা জানে ফেনকে ওর সে সময়ের রূপ দেখালে সেটা ওকে সময়ে সময়ে অসম্ভব স্বপ্নে তাড়া করে ফিরবে। ওর অসন্তোষের বীজ বপন করে বসবে ও। কারণ ওর অন্য জীবনে ওদের প্রথম পরিচয়ের সময় তাইতা ছিল দাস, মিশরের সবচেয়ে সুদর্শন যুবক। এটাই ছিল ওর পতনের কারণ। ওর মনিব লর্ড ইনতেফ ছিলেন কারনাকের নোমার্ক ও উচ্চ মিশরের বিশটা নোমের গভর্নর। তাছাড়া কিশোর-প্রেমী ও দাস ছেলেটির প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত ছিলেন তিনি। মনিবের বাড়ির আলীদা নামের এক দাসীর প্রেমে পড়েছিল তাইতা। খবরটা লর্ড ইনতেফের কানে তোলার পর তিনি জল্লাদ রাসফারকে আলীদার খুলি ধীরে ধীরে থেঁতলে দেওয়ার হুকুম দেন। তাইতাকে তার মৃত্যু দেখতে বাধ্য করা হয়। এমনকি ব্যাপারটা শেষ করার পরেও সন্তষ্ট হতে পারেননি লর্ড ইনতেফ। কুমার তাইতাকে নির্বীজ করে দিতে বলেন তিনি রাসফারকে।
এই ভীষণ ঘটনার ভিন্ন দিকও রয়েছে। লর্ড ইনতেফই ছিলেন ছোট মেয়ে লখ্রিসের বাবা, অনেক বছর পরে যে মিশরের রানি হয়েছিল। তাঁর মেয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল না ওর, তাই নপুংসক তাইতাকে তার শিক্ষক ও পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই বাচ্চাটি ফেন হয়ে ফিরে এসেছে এখন।
ব্যাপারটা এত জটিল যে তাইতার পক্ষে ফেনের কাছে ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। শিবিরের দিক থেকে ভেসে আসা জোরাল চিৎকারের কারণে আপাতত সেই বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেল ও। তীরের দিকে নৌকা আসছে! অস্ত্র তুলে নাও! মেরেনের কণ্ঠস্বর, এতদূর থেকেও পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে ভেজা শরীরে টিউনিক পরে নিল ওরা। তারপর দ্রুত পায়ে শিবিরের দিকে ছুটে গেল।
ওই যে! সবুজ জলের উপর দিয়ে হাতের ইশারা করল ফেন। ক্রমে বেড়ে ওঠা বাতাসের ভেতর ঠেলে আনা শাদা ঘোড়ার পালের পটভূমিতে গাঢ় ফুটকিগুলো বুঝতে খানিকটা সময় লাগল তাইতার।
স্থানীয় যুদ্ধ নৌকা! ফেন, মাঝির সংখ্যা গুনতে পারবে?
চোখের উপর হাত দিয়ে আড়াল করল ফেন। তারপর বলল, সামনের ক্যানুর দুপাশে রয়েছে রয়েছে বার জন করে। অন্যগুলোও সমান বড় মনে হচ্ছে। দাঁড়াও! দ্বিতীয় নৌকাটা বেশি বড়। এপাশে বিশ জন মাঝি রয়েছে।
প্রাচীরের তোরণে নিজের লোকদের দুই সারিতে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে মেরেন। যে কোনও আকস্মিক জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ওরা। ওদের নিচে ক্যানুগুলোকে তীরে ভিড়তে দেখল ওরা। মাঝি এল্লোরা নেমে বড় নৌকাটাকে ঘিরে দাঁড়াল। বাদকদের একটা দল লাফিয়ে তীরে নেমে বাজনা বাজাতে শুরু করল। এক ধরনের বুনো ছন্দ তৈরি করল ঢুলীরা। অন্যদিকে নাকাড়াঅলারা বুনো অ্যান্টিলোপের দীর্ঘ প্যাচানো শিং দিয়ে বানানো শিংগায় ফুঁ দিতে লাগল।
তোমার আভা আড়াল করো, ফেনের উদ্দেশে ফিসফিস করে বলল তাইতা। এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। আভা মিলিয়ে যেতে দেখল ও। বেশ ভালো। কালুলু মোহন্ত হয়ে থাকলে ওর আভা সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেললে বরং আরও গভীর সন্দেহের সৃষ্টি করবে।
আটজন বাহক নৌকা থেকে একটা খাটিয়া নামিয়ে সৈকতে নিয়ে এলো। সুঠাম স্বাস্থ্যের মেয়ে ওরা; পেশীবহুল হাত পা। পরনে নেংটি, তাতে কাঁচের পুঁতির দরাজ নকশা। ওদের বুকে বিশেষ ধরনের চর্বি মাখানো, রোদ লেগে চকচক করছে। তাই যেখানে দাঁড়িয়েছিল সরাসরি সেখানে চলে এলো ওরা, তারপর খাটিয়া নামিয়ে রাখল ওর সামনে। এবার ওটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। গভীর শ্রদ্ধার ভঙ্গি।
খাটিয়ার মাঝখানে বসে আছে এক বামন। আগুনের সেই ইমেজ থেকে তাকে চিনতে পারল ফেন। বড় বড় কান আর চকচকে টাকঅলা প্রাচীন শিম্পাঞ্জীর চেহারা। আমি কালুলু, তেনমাস ভাষায় বলল সে। আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, গালালার তাইতা।
তোমাকে স্বাগত জানাই, সাড়া দিল তাইতা। নিমেষে বুঝে গেছে ও কালুলু মোহন্ত নয়। তবে শক্তিশালী নিবিড় আভা ছুঁড়ে দিচ্ছে সে। ওটা থেকেই বুঝতে পারছে তাইতা, লোকটা সত্যির অনুসারী ও জ্ঞানী। চলো একান্তে আরামে কথা বলা যাবে এমন কোথাও যাওয়া যাক।
হাতের উপর ভর দিয়ে খাড়া হলো কালুলু, কাটা পাদুটো আকাশের দিকে খাড়া হয়ে গেল। খাটিয়া থেকে নেমে এমনভাবে হাতের উপর ভর দিয়ে হাঁটতে লাগল যেন ওগুলোই পা। এক পাশে মাথা বাঁকা করে রেখেছে যাতে তাইতার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর সাথে কথা বলতে পারে। আপনাকে আশা করছিলাম আমি, ম্যাগাস। ইথারে আপনার আগমন নিদারুণ গোলমাল সৃষ্টি করেছিল। নদী বরাবর এগিয়ে আসার সাথে সাথে আপনার উপস্থিতি প্রবলভাবে টের পাচ্ছিলাম। ওর পেছন পেছন এগিয়ে আসতে লাগল মেয়েরা, খালি খাটিয়া বইছে।
এই দিকে, কালুলু, আমন্ত্রণ জানাল তাই। ওরা ওর আবাসে আসার পর খাটিয়াটা নামিয়ে রাখল মেয়েরা, তারপর শ্রবণ সীমার বাইরে সরে গেল। লাফ দিয়ে আবার ওটায় উঠে বসল কালুলু, আবার তার স্বাভাবিক মাথা উঁচু করে রাখা অবস্থান গ্রহণ করল। কাটা পায়ের উপর ভর দিয়েছে। শিবিরের চারপাশে উজ্জ্বল চোখে নজর চালাল সে। কিন্তু ফেন যখন ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এক বাটি মধুর সুরা বাড়িয়ে দিল, ওর দিকেই পূর্ণ মনোযোগ দিল।
কে তুমি, খুকী? আগুনের আলোয় তোমাকে দেখেছিলাম, তেনমাস ভাষায় বলল সে। না বোঝার ভান করে তাইতার দিকে তাকাল ফেন।
তুমি জবাব দিতে পারো, ওকে বলল তাইতা।ও সত্যের পক্ষের লোক।
আমি ফেন, ম্যাগাসের শিষ্যা।
তাইতার দিকে তাকাল কালুলু। আপনি ওর পক্ষে সাক্ষী দিচ্ছেন?
হ্যাঁ, জবাব দিল তাইতা, মাথা দোলাল বামন।
আমার পাশে বসো, ফেন, কারণ তুমি দেখতে খুবই সুন্দর। আস্থার সাথে খাটিয়ায় বসল ফেন। তীক্ষ্ণ কালো চোখে তাইতার দিকে তাকাল কালুলু। আমাকে কেন ডেকেছেন, ম্যাগাস? আমার কাছে কী সেবা আশা করছেন?
আমি চাই তুমি আমাকে নীলের জন্মস্থানে নিয়ে যাবে।
বিস্ময়ের কোনও ছাপ দেখা গেল না কালুলুর মাঝে। স্বপ্নে আমি আপনাকেই দেখেছি। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করে আছি আমি। আপনাকে লাল জোড়া পাথরের কাছে নিয়ে যাব আমি। আজ রাতে হাওয়া পড়ে গেলে রওয়ানা হবো আমরা। আপনার দলে কতজন লোক আছে?
আটত্রিশ, ফেন আর আমিসহ, তবে আমাদের মালপত্র অনেক বেশি।
আরও পাঁচটা বড় ক্যানু আমাকে অনুসরণ করবে। রাত নামার আগেই এসে যাবে ওগুলো।
আমার সাথে অনেক ঘোড়া আছে, যোগ করল তাইতা।
হ্যাঁ। মাথা দোলাল ছোট বামন। ক্যানুর পেছন পেছন সাঁতরে আসবে ওগুলো। ওদের ভাসিয়ে রাখতে পশুর ব্লাডার নিয়ে এসেছি আমি।
সংক্ষিপ্ত আফ্রিকা গোধূলীতে বাতাসের ঝাপ্টা থেমে যেতেই সৈনিকদের কয়েকজন ঘোড়াগুলোকে তীর বরাবর নিচে এনে অগভীর পানিতে নামিয়ে দিল, তারপর জিনের পেটি দিয়ে দুপাশে ফোলানো ব্লাডার বেঁধে দিল। কাজটা চলার সময় অন্যরা ওদের সাজসরঞ্জাম ক্যানুতে বোঝাই করল। কালুলুর নারী দেহরক্ষীরা খাটিয়ায় করে সবচেয়ে বড় ক্যানুতে নিয়ে তুলে দিল ওকে। হ্রদের জল চকচকে স্থির হয়ে এলে তীর থেকে বের হয়ে এলো ওরা, অন্ধকারে দক্ষিণে আকাশের বুকে ঝুলে থাকা বিশাল তারার ক্রসের দিকে এগিয়ে চলল। প্রত্যেকটা ক্যানুর পেছনে দশটা করে ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে। পেছনে বসেছে ফেন, এখান থেকে পেছনে সাঁতরে আসা উইডম্মোক ও ওয়ার্লউইভকে সাহস যোগাতে পারছে ও। বৈঠা বেয়ে চলেছে মাঝিরা, গাঢ় ছুরির মতো পানি কেটে এগোচ্ছে দীর্ঘ সংকীর্ণ খোলসগুলো।
কালুলুর খাটিয়ার পাশে বসেছে তাইতা। কিছুক্ষণ নিচু কণ্ঠে কথা বলল ওরা। এই হ্রদের নাম কী?
সেমলিকি নিয়নযু। আরও অনেক নামের একটা এটা।
এর জল আসে কোত্থেকে?
আগে দুটো বিরাট নদী এসে মিশেছিল এটায়, একটা পশ্চিমে, ওটার নাম সেমলিকি; অন্যটা নীল। দুটোই এসেছে দক্ষিণ থেকে, সেমলিকি পাহাড় থেকে, আর নীল বিশাল জলাধার থেকে। সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
সেটা কি আরেকটা হ্রদ?
কেউ জানে না ওটা হ্রদ নাকি মহাশূন্যের সূচনা।
ওখানেই আমাদের মা নীলের জন্ম,?
এমনকি তাইতা, সায় দিল কালুলু।
এই বিশাল জলাধারকে কী নামে ডাক তোমরা?
আমরা একে ডাকি নালুবালে।
পথটা আমাদের বুঝিয়ে দাও, কালুলু।
সেমলিকির সৈকতে পৌঁছানোর পর নীলের দক্ষিণের শাখার দেখা পাব আমরা।
আমার মনে যে ছবি আছে তাতে নীলের দক্ষিণ শাখা এসে পড়েছে সেমিলিকি নিয়ানযুতে। উত্তরের শাখা হ্রদ থেকে বের হয়ে উত্তরে মহা জলাভূমির দিকে চলে গেছে। নীলের এই শাখাই আমাদের এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
হ্যাঁ, তাই। এটাই ঠিক ছবি। অবশ্যই অন্যান্য ছোটখাট নদী, খাড়ি আর হ্রদ আছে, কারণ এটা অনেক জলধারার উৎস। কিন্তু ওগুলো সবই নীলে এসে পড়েছে, তারপর উত্তরে গেছে।
কিন্তু নীল এখন মরতে বসেছে, মৃদু কণ্ঠে বলল তাইতা।
কিছুক্ষণ চুপ রইল কালুলু, তারপর যখন মাথা দোলাল সে, বিশীর্ণ গালের উপর দিয়ে পড়িয়ে পড়ল একবিন্দু অশ্রু। হ্যাঁ, সায় দিয়ে বলল সে। তাকে জল বিলোত যেসব নদী, সেগুলো থেমে গেছে। আমাদের মা মরতে বসেছে।
কালুলু, ব্যাপারটা কেমন করে ঘটল খুলে বলো।
একে ব্যাখ্যা করার মতো কোনও কথা নেই। আমরা লাল পাথরের কাছে পৌঁছানোর পরে নিজের চোখে দেখতে পাবেন। আমি এসব বিষয় আপনার কাছে বর্ণনা করতে পারব না। সামান্য কথায় এই ধরনের কাজ করা যায় না।
আমি আমার ধৈর্য ধরে রাখছি।
অধৈর্য তরুণের খারাপ গুন, হাসল বামন। আধো আঁধারে চকচক করে উঠল তার দাঁত। আর বয়স্ক লোকের সান্ত্বনা হচ্ছে ঘুম। ক্যানুর নিচে পানির ছলাৎ শব্দ থামিয়ে দিল ওদের। খানিক পর ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
সামনের ক্যানু থেকে মৃদু চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাইতার। উঠে কিনারার উপর দিয়ে ঝুঁকে মুখে আঁজলা ভরে দুবার পানি ছিটাল। তারপর চোখ পিটপিট করে পানি ঝেড়ে ফেলল, তাকাল সামনের দিকে। সামনে জমিনের গাঢ় অবয়ব দেখতে পেল।
অবশেষে জমিনের কাছে এসে পৌঁছানোয় খোলের নিচে জমিনের টান অনুভব করল ওরা। মাঝিরা বৈঠা বাওয়া থামিয়ে লাফ দিয়ে তীরে নেমে ক্যানুগুলোকে আরও উঁচুতে তুলতে শুরু করল। পা রাখার মতো মাটি পেয়ে লাফ দিয়ে পানি কেটে তীরে উঠে এলো ঘোড়াগুলো। খাটিয়ায় তুলে কালুলুকে সৈকতে নিয়ে এলো মেয়েরা।
আপনার লোকজন এখন নিশ্চয়ই নাশতা করবে, তাইতাকে বলল কালুলু, যাতে প্রথম আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে আবার আমরা রওয়ানা হতে পারি। পাথরের কাছে যেতে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে আমাদের।
মাঝিদের আবার ক্যানুতে চেপে হ্রদে চলে যেতে দেখল ওরা। অন্ধকারে মিশে গেল দ্রুতযানগুলোর অবয়ব, এক সময় বৈঠার শাদা ঝলক ছাড়া আর চিহ্ন দেখা গেল না। অচিরেই অদৃশ্য হয়ে গেল তাও।
*
আগুনের আলোয় হ্রদের ঝলসানো মাছ আর ধুরা পিঠা খেল ওরা; তারপর সাভোরে হ্রদের তীর বরাবর আগে বাড়ল। আধা লীগ যাওয়ার পরেই একটা শাদা শুকনো নদীর তলদেশে এসে পৌঁছুল। এটা কোন নদী? কালুলুকে জিজ্ঞেস করল তাইতা, যদিও জবাবটা কী হবে জানত ও।
আগেও নীল ছিল এখনও নীলই আছে, সহজ কণ্ঠে জবাব দিল কালুলু।
শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে! নদীর তলদেশের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে বলে উঠল তাইতা। এক তীর থেকে আরেক তীরের দূরত্ব চারশো কদম, কিন্তু মাঝখানে এক বিন্দু পানিও বইছে না। ছোটখাট বাঁশের মতো হাতির ঘাস কোনও দীর্ঘদেহী মানুষের চেয়েও উঁচু হয়ে জন্মেছে, ভরে ফেলেছে পুরো জায়গাটা। নদী অনুসরণ করে মিশর থেকে দুই হাজার লীগ দূরে এখানে এসেছি আমরা। সারা পথে একটু পানি হলেও পেয়েছি, স্থবির পুকুর, নিদেন পক্ষে পানির ধারা, বা নালা। কিন্তু এটা একেবারে খটখটে শুকনো, মরুভূমির মতো।
আরও উত্তরে অপনারা যে পানি দেখতে পাচ্ছেন, সেমলিকি নিয়ানযুর উপচে পড়া জল ওটা এটার শাখা থেকে বয়ে গেছে, ব্যাখ্যা করল কালুলু। এটাই ছিল নীল, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নদী। এখন কিছুই না।
এটার কী হয়েছে? জানতে চাইল তাইতা। এমন বিশাল প্রবাহ রুদ্ধ করে দিতে পারে কোনও সে নারকীয় শক্তি?
এটা আপনার মতো সবার সব কল্পনা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো একটা ব্যাপার, ম্যাগাস। আমরা লাল পাথরের কাছে পৌঁছানোর পর নিজের চোখেই সব দেখতে পাবেন।
মেরেনের সুবিধার জন্যে কী বলা হচ্ছে তার তরজমা করে দিচ্ছিল ফেন, এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না সে। আমাদের একটা শুকনো নদী অণুসরণ করতে হলে, জানতে চাইল সে, আমার লোকজন আর ঘোড়ার পানি পাব কোথায়?
ঠিক হাতির মতোই খুঁজে বের করব আমরা, মাটি খুঁড়ে, ওকে বলল তাইতা।
এই যাত্রা কত সময় নেবে? জিজ্ঞেস করল মেরেন।
কথাটা অনুবাদ করা হলে ওর দিকে তাকিয়ে শয়তানী সুলভ হাসি দিল কালুলু। তারপর জবাব দিল, তোমার ঘোড়ার স্ট্যামিনা আর তোমার দুপায়ের শক্তির উপর উপর অনেকখানি নির্ভর করছে।
দ্রুত আগে বাড়ল ওরা, এককালের দুকুল উপচানো ল্যাগুন আর এখন স্থবির পুকুর আর শুকনো পাথুরে গহ্বরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল। জলপ্রপাত সগর্জনে লুটিয়ে পড়ত এখানে। মোল দিন পরে নিচু একটা রিজের ধারে হাজির হলো ওরা, নীলের চলার পথের সমান্তরালে চলে গেছে ওটা। এটাই অনেক অনেক লীগের একঘেয়ে জঙ্গলের হাত থেকে প্রথম রেহাই দিল।
ওই উঁচু এলাকায় আছে তামাফুপা শহর, আমার জাতির আবাস, ওদের বলল কালুলু। উঁচু থেকে আপনারা নালুবালের বিশাল জলে বিস্তার দেখতে পাবেন।
চলো ওখানেই যাওয়া যাক, বলল তাইতা। শুকনো নদীর উপরের ঢাল ঢেকে রাখা উজ্জ্বল হলদে কাণ্ডঅলা ফেভার গাছের একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে উপরে উঠতে লাগল ওরা। পানির অভাবে মরে গেছে গাছগুলো, ওগুলোর শাখা পাতাহীন, বাতজ্বরের আক্রান্ত হাত-পায়ের মতো বেঁকেচুরে গেছে। নিজের মাথায় উঠে এলো ওরা, নাক ঝেড়ে মাথা দোলাল উইন্ডস্মোক। ওয়ার্লউইন্ডও সমান উত্তেজিত, বেশ কয়েকবার লাফঝাঁপ দিল সে।
দুষ্টু ঘোড়া! হাতের প্যাপিরাসের সুইচ দিয়ে ওটার কাঁধে হালকাভাবে আঘাত করল ফেন। ঠিক থাক! তারপর তাইতাকে ডাকল সে। ওদের উত্তেজনার কারণ কী, ম্যাগাস?
নিজেই গন্ধ শুঁকে দেখ, বলল ও। সৌরভের মতোই মিষ্টি আর ঠাণ্ডা, ওটার নিচে রয়েছে ইথারাল নীলের একটা বাঁক, দিগন্তের গোটা বিস্তার জুড়ে বিছিয়ে আছে।
অবশেষে নালুবালে!
রিজের চূড়া দখল করে রেখেছে হার্ডউড খুঁটির একটা শক্তপোক্ত সীমানা। দরজাগুলো খোলা। ওটা গলে পরিত্যক্ত তামাফুপা গ্রামে প্রবেশ করল ওরা। বোঝাই যায় এককালে সমৃদ্ধ, গতিশীল সম্প্রদায় ছিল এটা-পরিত্যক্ত কুঁড়েগুলো প্রাসাদোপম, আঁকালভাবে ছাউনী দেওয়া-কিন্তু ওগুলোর উপর চেপে বসা বিষাদময় নৈঃশব্দ্য অপার্থিব। আবার গেটের দিকে ফিরল ওরা, দলের বাকি অংশকে ডাকল।
ওদের হাঁকে সাড়া দিয়ে ঘর্মাক্ত, হাঁপাতে থাকা দেহরক্ষীদের হাতে খাটিয়ায় করে ওদের সামনে নিয়ে আসা হলো কালুলুকে। তামাফুপার তোরণের কাছে সমবেত হওয়ার সময় ওদের প্রত্যেককে গম্ভীর, চিন্তামগ্ন মনে হলো, দূরের নীল জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
নীরবতা ভাঙল তাই। আমাদের নীল মাতার উৎস।
দুনিয়ার শেষ বলল কালুলু। এই পানির ওধারে শূন্যতা আর মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নেই।
তামাফুপার প্রতিরক্ষার দিকে তাকাল তাইতা। বৈরী গোত্রদের ঘেরাওয়ের ভেতর বিপজ্জনক এলাকায় আছি আমরা। আবার আগে বাড়ার আগ পর্যন্ত এটাকেই ঘাঁটি হিসাবে কাজে লাগাব আমরা, মেরেনকে বলল ও। হিলতো আর শাবাকোকে লোকজনকে দিয়ে যেকোনও হামলার বিরুদ্ধে দেয়ালগুলোকে আরও মজবুত করার কাজে লাগিয়ে দেব। ওরা কাজটা করার সময় আমাদের রহস্যময় লাল পাথরের ওখানে নিয়ে যাবে কালুলু।
সকালে রওয়ানা হয়ে গেল ওরা: প্রায় দুবছরেরও বেশি লেগে যাওয়া যাত্রার শেষ সংক্ষিপ্ত পর্যায়। নদীর তলদেশ অনুসরণ করে প্রশস্ত শুকনো ধারার মাঝখান দিয়ে এগোল ওরা। আরেকটা সহজ বাকের কাছে হাজির হলো। ওদের সামনে পানির ঘায়ে বিক্ষত ঢালু রোদেপোড়া পাথরের ধস নেমে গেছে। ওটার চারপাশে মহান শহরের সুরক্ষা প্রাচীরে মতো নিরেট লাল গ্রানিটের দেয়াল উঠে গেছে।
পুত্র হোরাস আর স্বর্গীয় পিতা অসিরিসের পবিত্র নামে, বলে উঠল মেরেন, এটা আবার কোন দুর্গ? কোনও আফ্রিকান সম্রাটের দুর্গ নাকি?
তোমরা যা দেখতে পাচ্ছ সেটাই লাল পাথর, শান্ত কণ্ঠে বলল কালুলু।
কে এখানে বসিয়েছে ওটা? জিজ্ঞেস করল তাইতা তার সঙ্গীদের মতোই বিভ্রান্ত সে।
কোনও মানুষ নয়, জবাব দিল কালুলু। মানুষের হাতের কাজ নয় এটা।
কার তবে?
আসুন। আগে আপনাকে জিনিসটা দেখাই। তারপর কথা বলা যাবে।
সাবধানে লাল পাথরের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। অবশেষে নীলকে এক তীর থেকে আরেক তীর পর্যন্ত রুদ্ধ করে রাখা বিশাল পাথুরে প্রাচীরের নিচে এসে দাঁড়ালে ঘোড়া থেকে নেমে ওটার ভিত্তি বরাবর এগিয়ে গেল তাই। ফেন ও মেরেন অনুসরণ করল ওকে। পরখ করতে খানিক পর পর থামছে। প্রবহমান ধারার মতো, মোমবাতির মোমের মতো।
পাথর একবার গলানো হয়েছিল, মন্তব্য করল তাইতা। জমে এই রকম অবিশ্বাস্য চেহারা নিয়েছে।
ঠিক বলেছেন, সায় দিল কালুলু। ঠিক এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে এটার।
অন্তত একটা ফাটল রয়েছে এতে, ম্যাগাস, সামনের দিকে দেখাল ফেন। প্রাচীরে ঠিক মাঝখানে গোড়া থেকে চূড়া অবধি চলে যাওয়া একটা সংকীর্ণ ফাটল ধরা পড়েছে ওর তীক্ষ্ণ চোখ। ওটার কাছে পৌঁছানোর পর ড্যাগার বের করে ফাটলের ভেতর ফলা ঢোকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বড় বেশি সংকীর্ণ। কেবল আঙুলের প্রথম গিটের মতো দূরত্বে ঢুকল ফলাটা।
এই কারণেই আমাদের লোকজন খালি লাল পাথর না ডেকে এটাকে লাল পাথর বলে, ওদের বলল কালুলু, কারণ এটা দুটি ভাগে বিভক্ত।
প্রাচীরের ভিত্তি পরখ করতে হাঁটু গেড়ে বসল তাইতা। পুরোনো নদীর তলদেশের উপর নির্মাণ করা হয়নি এটা। ওটা থেকেই বের হয়ে এসেছে, যেন দানবীয় ব্যাঙের ছাতার মতো পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বেড়ে উঠেছে। এই দেয়ালের পাথর চারপাশের অন্য সব পাথর থেকে ভিন্ন।
আবার ঠিক ধরেছেন, ওকে বলল কালুলু। এটাকে চারপাশের পাথরের মতো খোঁড়াখুড়ি করা যাবে না। ভালো করে দেখলে এটার নামের কারণ লাল স্ফটিক দেখতে পাবেন।
সামনে চোখ বাড়িয়ে দিল তাইতা, অবশেষে দেয়ালটাকে গঠনকারী সূক্ষ্ম স্কটিকগুলো বোদ লেগে রুবি পাথরের মতো ঝিলিক মেরে উঠল। এখানে অশ্লীল বা অস্বাভাবিক কিছু নেই, মৃদু কণ্ঠে বলল ও। খাটিয়ায় বসে থাকা কালুলুর কাছে ফিরে এলো ও। জিনিসটা এখানে এলো কেমন করে?
নিশ্চিত করে বলতে পারব না, ম্যাগাস, যদিও ঘটনা ঘটার সময় এখানেই ছিলাম আমি।
নিজের চোখে দেখে থাকলে কী করে ঘটল জানবে না কেন?
পরে বুঝিয়ে বলব আপনাকে, বলল কালুলু। তবে এখন এইটুকু বলাটাই যথেষ্ট যে আমার মতো আরও অনেকে এটা দেখেছে, কিন্তু ব্যাখ্যা যোগানোর পঞ্চাশটা ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী রয়েছে তাদের।
পুরো দেয়ালটাই অলৌকিক, যুক্তি দেখাল তাইতা। সম্ভবত কিংবদন্তী ও কল্পকাহিনীর ভেতরই লুকিয়ে আছে সত্যির বীজ।
হতে পারে, সায় দিয়ে মাথা কাত করল কালুলু। কিন্তু আসুন আগে দেয়ালের মাথায় উঠি। ওখানে আরও দেখার বাকি আছে। দেয়াল বাইবার মতো একটা জায়গার খোঁজ করতে ফের নদীর তলদেশ ধরে উল্টোপথে ফিরে আসতে হলো ওদের।
আপনার জন্যে এখানে অপেক্ষা করব আমি, বলল কালুলু। ওপরের পথ অনেক কঠিন। কাঁচের মতো চকচকে প্রায় খাড়া দেয়ালের গায়ের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওকে রেখে সাবধানে ওপারে উঠতে শুরু করল ওরা। কোথাও কোথাও হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাল জোড়া পাথরের গোলাকার চূড়ায় উঠে দাঁড়াল। এখান থেকে হ্রদের দিকে চোখ ফেরাল ওরা। হাত দিয়ে আড়াল করে পানির উপরি তলে রোদের ঝলক থেকে চোখ বাঁচাল তাই। বেশ কাছেই গোটা কতক ছোটখাট খাড়ি রয়েছে, কিন্তু ওগুলোর মাঝখানে জমিনের কোনও চিহ্নই চোখে পড়ল না। এবার ফেলে আসা পথের দিকে তাকাল ও। অনেক নিচে ছোট হয়ে যাওয়া বামনের কাঠামো দেখা যাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে কালুলু।
কেউ কখনও হ্রদের শেষপ্রান্তে যাবার চেষ্টা করেছে? চিৎকার করে নিচের কালুলুকে জিজ্ঞেস করল তাইতা।
শেষ প্রান্ত বলে কিছু নেই, পাল্টা চিৎকার করে বলল কালুলু। আছে কেবল শূন্যতা।
ওদের পা থেকে মাত্র চার কি পাঁচ কিউবিট নিচে ছলাৎছলাৎ করে চলেছে হ্রদের তলের পানি। নদীর তলদেশের দিকে ফিরল তাইতা, মনে মনে দেয়ালের দুপাশের গভীরতার বৈষম্যের একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কিউবিট উচ্চতার পানি আটকে রেখেছে এটা, হাতের ইশারায় হ্রদটাকে দেখিয়ে বলল ও। ওটার সীমাহীন বিস্তারকে আওতায় নিয়ে এলো ওর ভঙ্গি। এই দেয়াল থাকলে এই সমস্ত পানিই নীলের ওই শাখায় পড়ত, চলে যেত মিশরে। আমাদের দেশের ওই হাল হওয়াটা তেমন বিচিত্র কিছু না।
আশপাশের এলাকায় হামলা করে বড়সড় একদল দাস বন্দি করে এনে কাজে লাগিয়ে দিতে পারি, পরামর্শ দিল মেরেন।
কী করবে তারা? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
এই বাঁধটাকে গুঁড়িয়ে দেব আমরা, তখন নীল ফের আমাদেরই মিশরের দিকে বয়ে যাবে।
হেসে স্যান্ডেল পরা একটা পা দিয়ে দেয়ালের গায়ে আঘাত করল তাইতা। কালুলু বলেছে, এই পাথরের দেয়ালটা কত শক্ত আর অনড়। এটার আকারটা একবার দেখ, মেরেন। গিযার মহান তিনটা পিরামিড একটার উপর একটা বসালে যত বড় হবে এটা তারচেয়েও ঢের বড়। আফ্রিকার সমস্ত লোক ধরে এনে ওদের আগামী একশো বছর ধরে একাজে কাজ করালেও ওরা সামান্য অংশও নড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।
এটা কত শক্ত সেই ব্যাপারে ওই অচেনা লোকটার কথা হুবহু বিশ্বাস করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আমার লোকদের দিয়ে আগুন আর ব্রোঞ্জ দিয়ে পাথরটা পরখ করাতে যাচ্ছি আমি। একটা কথা মনে রাখবেন, ম্যাগাস, পিরামিডগুলো বানাতে যে স্থাপত্য বিদ্যা কাজে লাগানো হয়েছে সেটাকেই আবার ওগুলোকে ধ্বংস করার কাজে লাগানো সম্ভব। এখানেও সেই একই কৌশল কাজে লাগাতে না পারার কোনও কারণ দেখছি না, আমরাও মিশরিয়, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রাণী।
তোমার কথায় কিছুটা যুক্তি আছে দেখতে পাচ্ছি, মেরেন, সায় দিল তাইতা। তারপর দেয়ালের শেষ প্রান্তের ওধারে একটা কিছু ওর নজর কেড়ে নিল। ভুরু কোঁচকাল ও। আমাদের সামনের ব্লাফের উপর ওটা কি দালান নাকি? প্রশ্নটা কালুলুকে করছি।
পিচ্ছিল পাথুরে শরীর বেয়ে দেহরক্ষীদের ঘেরাওয়ের ভেতর নিজের খাটিয়ায় বসে থাকা বামনের কাছে নেমে এলো ওরা। তাইতা ধ্বংসাবশেষের দিকে ইঙ্গিত করতেই উজ্জ্বল চেহারায় মাথা দোলাল সে। ঠিক বলেছেন, ম্যাগাস। ওটা মানুষের তৈরি মন্দির।
তোমার গোত্র তো পাথর দিয়ে নির্মাণ করে না, তাই না?
না, ওটা অচেনা লোকদের বানানো।
এই অচেনা লোকরা কারা, কবে বানিয়েছে ওটা? জানতে চাইল তাইতা।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম পাথর বসিয়েছিল ওরা।
কেমন লোক ছিল ওরা? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
জবাব দেওয়ার আগে ইতস্তত করল কালুলু। দক্ষিণের লোক নয় ওরা। ওদের চেহারা আপনার আর আপনার লোকদের মতো। একই রকম পোশাক ছিল ওদের পরনে, অস্ত্রশস্ত্রও একই রকম।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। বিস্ময়ে নীরব হয়ে গেছে। অবশেষে বলল, বলতে চাইছ ওরা মিশরিয় ছিল। সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না। ওরা মিশর থেকে এসেছিল, তুমি নিশ্চিত?
আপনারা কোন দেশ থেকে এসেছেন তার কোনও ধারণা নেই আমার। আমি এমনকি নীল নদ বরাবর মহা জলাভূমি অবধিও যাইনি কোনওদিন। নিশ্চিত করে বলতে পারব না, তবে আমার কাছে ওদের আপনার জাতের লোকই মনে হয়েছে।
ওদের সাথে কথা বলেছিলে?
না, আবেগের সথে বলল কালুলু। ঢাকঢাক গুরগুর একটা ভাব ছিল ওদের ভেতর, কারও সাথে কথা বলত না ওরা।
কত জন ছিল ওরা, এখন কোথায় গেছে? সাগ্রহে জানতে চাইল তাইতা। মনে হচ্ছে নিবিড়ভাবে বামন লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ও। কিন্তু ফেন জানে ওর আভা পরখ করছে ও।
তিরিশজনেরও বেশি, অন্তত পঞ্চাশ জন। যেভাবে এসেছিল তেমনি রহস্যজনকভাবেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে।
লাল পাথর দিয়ে নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের পরপরই অদৃশ্য হয়ে গেছে?
ঠিক তাইতা, ম্যাগাস।
খুবই অদ্ভুত, বলল তাইতা। এখন ওই মন্দিরে কে থাকে?
এখন পরিত্যক্ত, ম্যাগাস, জবাব দিল কালুলু, ওটার চারপাশের এক শো লীগ এলাকার মতোই পরিত্যক্ত। আমার গোত্র ও বাকি সবাই এইসব ও অন্যান্য অদ্ভুত ঘটনার পর এখান থেকে পালিয়ে গেছে। এমনকি আমিও জলাভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। এই প্রথম ফিরে এলাম। স্বীকার করছি, আপনার প্রতিরক্ষা ছাড়া কোনওদিনই সেটা পারতাম না।
মন্দিরে যেতে হবে আমাদের, বলল তাইতা। তুমি আমাদের পথ দেখাবে?
আমি কখনও ওই দালানের ভেতরে যাইনি, মৃদু কণ্ঠে বলল কালুলু। কোনও দিন যাবও না। আমাকে সাথে যেতে বলবেন না।
কেন নয়, কালুলু?
ওটা চরম অশুভের জায়গা। আমাদের উপর গজব নামানো শক্তি।
তোমার সতর্কতাকে সম্মান করি। এসব খুবই গভীর ব্যাপার, কিছুতেই হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। মেরেনের সাথে ফিরে যাও, আমি একাই যাব মন্দিরে। মেরেনের দিকে ফিরল ও। শিবির নিরাপদ করার কোনও চেষ্টাই বাদ দেবে না। ভালোভাবে সুরক্ষিত করবে, কড়া পাহারা বসাবে। তুমি কাজ শেষ করার পর লাল পাথরের কাঠিন্য পরখ করতে ফিরে আসব আমরা।
অন্ধকার মেলানোর আগেই আপনাকে শিবিরে ফেরার অনুরোধ করছি, ম্যাগাস, উদ্বেগে পাণ্ডুর দেখাল মেরেনকে। সূর্যাস্তের সময় আপনি না ফিরলে আপনার খোঁজে বেরুব আমি।
দেহরক্ষীরা খাটিয়া তুলে নিয়ে মেরেনকে অনুসরণ করতে শুরু করল। ফেনের দিকে তাকাল তাইতা। মেরেনের সাথে যাও। ওর নাগাল পেতে জলদি পা বাড়াও।
সোজা হয়ে দাঁড়াল ফেন। হাত পেছনে রাখা, মুখ অটলভাবে স্থির। ওর এই অভিব্যক্তি খুব ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে ওর। আমাকে যেতে বাধ্য করার মতো কোনও জাদু বানাতে পারব না তুমি, ঘোষণা দিল সে।
ভুরু কোঁচকালে তোমাকে আর সুন্দর লাগে না, ওকে মৃদু কণ্ঠে সতর্ক করল তাইতা।
আমি যে কতটা কুৎসিত হতে পারি, ধারণাও করতে পারবে না, বলল ফেন। আমাকে দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখ, তখন টের পাবে।
তোমার হুমকী আমাকে কাবু করে ফেলে। হাসি ঠেকাতে কষ্ট হলো ওর। তাহলে আমার কাছেই থেক। আমরা কোনও বৈরী উৎসারণের মুখোমুখি হওয়ামাত্রই উল্টো ঘুরতে তৈরি থাকবে।
রাফের দিকে উঠে যাওয়া পথ খুঁজে পেল ওরা। মন্দিরে পৌঁছে দেখল ওটার পাথরের নকশা দারুণ সুন্দরভাবে শেষ করা হয়েছে। খোদাই করা কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো হয়েছে গোটা দালানটার ছাদ, উপরে নদীর আগাছার ছাউনি দেওয়া হয়েছে, এখানে ওখানে খসে পড়তে শুরু করেছে এখন। দেয়াল ঘিরে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল ওরা। আনুমানিক পঞ্চাশ কদম বিস্তারের একটা বৃত্তাকার ভিত্তির উপর স্থাপন করা হয়েছে মন্দিরটা। পাঁচটা সমান দূরত্বের বিন্দুতে নিরেট গ্রানিট স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের পেন্টাগ্রামের পাঁচটা বিন্দু,মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে ফিরে এলো ওরা। দরজার চৌকাঠগুলোয় নিগূঢ় প্রতাঁকের বাস রিলিফ খোদাই করা।
ওগুলো পড়তে পারবে? জিজ্ঞেস করল ফেন।
না, স্বীকার গেল তাইতা। অচেনা। এবার ভয়ের কোনও চিহ্ন আছে কিনা দেখতে ওর চোখের দিকে তাকাল ও। আমার সাথে ভেতরে যাবে?
জবাবে তাইতার হাত তুলে নিল ফেন। এসো, চক্র গড়ে তুলি আমরা, পরামর্শ দিল।
একসাথে দরজাপথে বৃত্তাকার বাইরের বারান্দায় ঢুকে পড়ল ওরা। ধূসর পাথর বিছানো এখানে, ছাদের ফোকর দিয়ে আলোর রশ্মি ঢুকে পড়ছে ভেতরে। ভেতরের দেয়ালে কোনও দরজা নেই। খোদাই করা দহলিজ ধরে পাশাপাশি আগে বাড়ল ওরা। প্রতিটি স্তম্ভের সাথে একই সমতলে আসার পর দেখতে পেল ওদের পায়ের নিচে শাদা মাৰ্বল পাথরে বিছানো হয়েছে পেন্টাগ্রামের বিন্দুগুলো। প্রতিটি বিন্দুর ভেতরে আরেকটা রহস্যময় প্রতীক ঢোকানো : সরীসৃপ, ক্রাক্স আনসাতা, উড়ন্ত শকুন, নীড়ে আরেকটা এবং সবশেষে একটা শেয়াল। শিথিল ছাউনির একটা স্তূপের উপর এসে দাঁড়াল ওরা, কর্কশ হিসহিস শব্দ কানে এলো। তারপর পায়ের নিচে ভীষণ সরসর আওয়াজ। এক হাতে ফেনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে শূন্যে তুলে নিল তাইতা। ওদের পেছনে মিশরিয় কালো কোবরার ঢাকা মাথা অগোছাল আগাছার ভেতর থেকে মাথা তুলল। ক্ষুদে মার্বলের মতো কালো চোখ দিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ওটা। লম্বা জিভ লকলক করছে, ওদের গন্ধের খোঁজে বাতাস পরখ করছে। ফেনকে নামিয়ে রেখে ছড়িটা তুলে নিয়ে সাপের মাথা নিশানা করল তাইতা। ভয় পেয়ো না, বলল ও। এটা প্রেতাত্মা নয়। স্বাভাবিক প্রাণী। ছড়ির ডগাটা এপাশ থেকে ওপাশে ছন্দোময় ভঙ্গিতে নাচাতে লাগল ও। কোবরাও দুলুনির সাথে দুলতে লাগল। আস্তে আস্তে শান্ত হলো ওটা। আবার ছাউনির খড়ে মাথা দাবাল। ফেনকে নিয়ে গ্যালারি থেকে বের হয়ে এলো তাই। অলঙ্কৃত দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
উল্টোদিকের দরজা, বলল তাইতা। এটা বাইরের দরজার ঠিক উল্টোদিকে। এটা ভেতরের পবিত্রস্থানকে বাইরের প্রভাব থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
অনেকটা পাপড়িঅলা ফুলের মতো ওদের সামনের দরজার আকার। চৌকাঠগুলোয় পলিশ করা আইভরি, মালাকাইট আর বাঘের চোখের নকশা করা। বদ্ধ দরজা কুমীরের নকশা করা চামড়ায় ঢাকা। দরজার উপর শরীরের সম্পূর্ণ চাপ দিতে ছড়ির উপর ঝুঁকে পড়ল তাইতা। হাঁ করে খুলে গেল ওটা। কাঁচকোচ করে উঠল ব্রোঞ্জের কজা। ছাদের গম্বুজের একটা মাত্র ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে ভেতরে। রঙের বিস্ফোরণে ভেতরের পবিত্র মেঝে ভরিয়ে দিচ্ছে।
মেঝে দরাজভাবে নকশা করা পেন্টাগ্রামে সাজানো। টাইলস আর আধা মূল্যবান পাথরের উপর নকশা আঁকা হয়েছে। রোজ কোয়ার্টস্ ও পাথরের স্ফটিক বেরেলিয়াম ও রুবেলাইট চিনতে পারল তাইতা। নিপূণ কারুকাজ। নকশার কেন্দ্রে পলিশ করা মাৰ্বল পাথরের একটা বৃত্ত এমন চমৎকারভাবে পরস্পরের সাথে মিলে গেছে যে জোড়াগুলো দেখাই যায় না। দেখে মনে হবে অখণ্ড আইভরির একটা বর্ম।
চলো ভেতরে যাই, ম্যাগাস, গোলাকার দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনি তুলল ফেনের ছেলেমানুষি উচ্চারণ।
দাঁড়াও! বলল তাইতা। ভেতরে একটা কিছু আছে, এখানকার আত্মা। আমার মনে হয় এটা বিপজ্জনক। এই কারণেই ভয় পেয়েছিল কালুলু। মন্দিরের মেঝেয় এসে পড়া রোদের দিকে ইঙ্গিত করল ও। পেন্টাগ্রামের ঠিক মধ্যখানে এসে পড়তে যাচ্ছে আলোটা। সেটা হবে ভীষণ এক মুহূর্ত।
মেঝের উপর দিয়ে রোদের রশ্মিটার পিছলে আসা দেখতে লাগল ওরা। আইভরি চক্রের কিনারা স্পর্শ করল ওটা। চারপাশের দেয়ালে প্রতিফলিত হলো, বহুগুণ বেড়ে উঠল ঝলক। এবার যেন আরও দ্রুত আগে বাড়তে শুরু করল ওটা। তারপর এক সময় হঠাৎ করেই আইভরি চাকতিটাকে ভরে ফেলল। সাথে সাথে সিস্ট্রাময়ের গুঞ্জন আর ঝনঝন আওয়াজ কানে এলো। ওদের চারপাশের বাতাসে বাদুর ও শকুনের ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ উঠল। শাদা আলো এমন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে পবিত্র এলাকা ভরে ফেলল যে হাত তুলে চোখ ঢাকতে বাধ্য হলো ওর। ঝলকের ভেতর দিয়ে ইয়োসের আত্মার চিহ্নটাকে চাকতির কেন্দ্রে হাজির হতে দেখতে লাগল ওরা: আগুনে ফুটে উঠল বেড়ালের থাবা।
বুনো পশুর গন্ধের মতো ওদের নাক ভরে তুলল ডাইনীর গন্ধ। দরজার কাছ থেকে পিছিয়ে এলো ওরা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আইভরি চাকতির উপর দিয়ে চলে গেল রোদের আলো, আগুনে হরফগুলো উবে গেল। মিলিয়ে গেল ডাইনীর দুর্গন্ধ। কেবল রেখে গেল ভেজা ছাউনি আর বাদুরের মলের আবছা গন্ধ। রোদের আলো ফিকে হয়ে গেল। আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠল পবিত্র এলাকা। নিঃশব্দে গ্যালারি বেয়ে বাইরে রোদে বের হয়ে এলো ওরা।
ওখানে ছিল সে, ফিসফিস করে বলল ফেন। হ্রদের শীতল ঠাণ্ডা হাওয়ায় লম্বা করে দম নিল, যেন ফুসফুস পরিষ্কার করছে।
তার প্রভাবের অবশেষ, ছড়ি দিয়ে কুঁজের মতো লাল পাথরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল তাইতা। এখনও নিজের নিষ্ঠুর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা ওর মন্দির ধ্বংস করে দিতে পারি না? দালানের দিকে পেছন ফিরে তাকাল ফেন। এভাবে তাকে শেষ করে দেব?
না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল তাইতা। নিজের ঘাঁটির ভেতরে তার প্রভাব অনেক জোরাল। ওকে ওখানে চ্যালেঞ্জ করা খুবই বিপজ্জনক হবে। তাকে হামলা করার ভিন্ন সময় ও জায়গা আমরা পাব। ফেনের হাত ধরল ও। তারপর ওকে নিয়ে আগে বাড়ল। আগামীকাল দুর্বলতার খোঁজে দেয়াল পরখ করতে আর কালুলুর কাছে গোর্জের উপর কীভাবে লাল পাথর বসানো হলো জানতে আসব আমরা।
*
জোড়া লাল পাথরকে দুই ভাগ করা মাঝখানের ফাটলটা দেখাল মেরেন। এটাই দেয়ালের দৈর্ঘ্য বরাবর দুর্বলতম জায়গা কোনও সন্দেহ নেই তাতে। এটা একটা খাড়া রেখা হতে পারে।
পরীক্ষা শুরু করার জন্যে নিশ্চিতভাবেই এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা, সায় দিল তাইতা। লাকড়ির কোনও অভাব নেই। পানির উপর বাঁধ সৃষ্টি হওয়ার পর গোর্জের ঢাল ঢেকে রাখা বেশির ভাগ গাছই মরে গেছে। লোকদের শুরু করতে বলল।
বনের ভেতর ওদের ছড়িয়ে পড়তে দেখল ওরা। অচিরেই গোর্জের দিক থেকে ওদের কুড়োলের আওয়াজ ভেসে এলো, ক্লিফের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। গাছ লুটিয়ে পড়ামাত্র ঘোড়ায় টেনে দেয়ালের নিচে আনছে ওরা। দৈর্ঘ্য বরাবর কেটে পাথরের দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখছে, যাতে একটা চোঙা তৈরি করে আগুনের ভেতর বাতাস টেনে নিতে পারে। দানবীয় দাহ্য পটাকে জায়গামতো বসাতে বেশ কয়েক দিন লেগে গেল। এই সময় দেয়ালের উপর পানি তুলে পাথর তেতে লাল হয়ে ওঠার পর পানি ঢেলে ভেজাতে চারটে ভিন্ন ভিন্ন শাদুফ হুইল বানানোর কাজ তদারকি করল তাইতা।
সবকিছু তৈরি হলে কাঠের তূপে আগুন ধরিয়ে দিল মেরেন। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা, ধেয়ে গেল আকাশের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা কাঠের স্তূপটা সগর্জনে জ্বলতে শুরু করল। মাংসের উপর থেকে চামড়া কুঁচকে আসার ঝুঁকি না নিয়ে ওটার এক শো গজের মধ্যে থাকতে পারল না কেউই।
*
আগুন দমে আসার অপেক্ষায় থাকার অবসরে গোর্জের চূড়ায় ব্লাফে কালুলুর সাথে ওপাশে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা আর ফেন। ওখানে দাঁড়ানো একটা ছোট ধসে পড়া তাবুর ছায়ায় বসে নিজেদের রক্ষা করছে। ওটার ছাদ মেরামত করে নিয়েছে দেহরক্ষীরা।
নদীটা যখন ঠিক ছিল, আমার গোত্র এখানে থাকার সময়, বছরের উত্তপ্ত মৌসুমে এখানে আসার অভ্যাস ছিল আমার, গোটা দুনিয়া যখন রোদের অত্যাচারে গোঙাত। ব্যাখ্যা করল কালুলু। হ্রদ থেকে ভেসে আসা বাতাস অনুভব করতে পারতাম। তাছাড়া, নদীর ওপাশে আগম্ভকদের কাজকর্মে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে ছিলাম আমি। এটাকে একটা লুকআউটের মতো ব্যবহার করতাম, ওদের উপর নজর রাখতাম এখান থেকে। উল্টোদিকের ব্লাফের উপর দাঁড়ানো মন্দিরের দিকে ইঙ্গিত করল সে। তখনকার সেই দৃশ্য আপনাকে মনে মনে কল্পনা করে নিতে হবে। এখন যেখানে লাল পাথরের দেয়ালটা দাঁড়িয়ে আছে, বেশ কয়েকটা জলপ্রপাতসহ একটা গভীর গোর্জ ছিল ওখানে; এত পানি নিচে গড়িয়ে নামত যে পতনের শব্দে সব ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে যেত। মাথার উপর উঠে আসত ফোয়ারার একটা লম্বা মেঘ। হাত উপরে ওঠাল সে। বেশ বাঅয় ভঙ্গিতে উচ্চতার ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করল। বাতাসে পরিবর্তন ঘটলে ফোয়ারা এখান পর্যন্ত পৌঁছে যেত, বৃষ্টির মতেই ঠাণ্ডা আর আরামদায়ক। কথাটা ভেবে হাসল সে। এভাবে এখান থেকে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের শকুনের চোখে দেখা ছবি দেখতাম।
মন্দিরটা বানানো দেখেছ তুমি? জানতে চাইল ফেন। তুমি জানো, ওখানে অনেক আইভরি আর আধা মূল্যবান পাথর আছে?
সত্যি জানি, আমার মিষ্টি মেয়ে। আগন্তকদের ওগুলো আনতে দেখেছি। শত শত দাসকে মালবাহী পশুর মতো কাজে লাগিয়েছে ওরা।
কোন দিক থেকে এসেছিল ওরা? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
এসেছিল পশ্চিম থেকে, আবছা নীল দূরত্বের দিকে ইঙ্গিত করল কালুলু।
ওদিকে কোন দেশ? জানতে চাইল তাইতা।
সাথে সাথে জবাব দিল না বামন। একটু ভাবল সে, তারপর দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জবাব দিল। আমার বয়স যখন কম ছিল, পাজোড়াও সম্পূর্ণ ও শক্তিশালী ছিল, এক ভবঘুরে মোহন্তের কথা শুনে জ্ঞান আর বিদ্যার সন্ধানে গিয়েছিলাম আমি। পশ্চিমের ওই দেশে থাকতেন তিনি।
কী আবিষ্কার করেছিলে তুমি?
বছরের বেশির ভাগ সময় ঘন মেঘে ঢেকে থাকা পাহাড় দেখেছি, বিশাল সব পাহাড়। মেঘ সরে গেলে চূড়াগুলো বের হয়ে পড়ে, আকাশের দিকে উঠে গেছে। ওগুলো, চূড়াগুলোর মাথা চকচকে শাদা।
চূড়ায় উঠেছিলে?
না। অনেক দূর থেকে দেখেছিলাম কেবল।
পাহাড়গুলোর নাম আছে?
ওগুলোর আশপাশে যারা থাকে তারা বলত চাঁদের পাহাড়, কারণ চূড়াটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল ছিল।
বিজ্ঞ ও সম্মানিত বন্ধু আমার, আমাকে বলো ওই সফরে আর কোনও অবাক কাণ্ড দেখেছ তুমি?
অবাক কাণ্ডের কোনও সীমাপরিসীমা নেই, জবাব দিল কালুলু। মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসা নদী দেখেছি আমি, উত্তপ্ত কড়াইয়ের পানির মতো টগবগ করে ফুটছিল তার পানি। পাহাড়ের গোঙানি শুনেছি, পায়ের নিচে তার কম্পন টের পেয়েছি, যেন গভীর গুহায় নড়াচড়া করছে কোনও দানব। স্মৃতি উজ্জ্বল করে তুলল তার গাঢ় চোখজোড়াকে। এই পাহাড়সারিতে এমন শক্তি আছে যে একটা চূড়ায় দানবীয় ফার্নেসের মতো আগুন জ্বলছিল, ধোয়া উগড়ে দিচ্ছিল।
জ্বলন্ত পাহাড়! বলে উঠল তাইতা। আগুন আর ধোঁয়া ওগড়ানো পাহাড় দেখেছ তুমি! একটা আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করেছ?
এমনি অলৌকিক কাণ্ডকে যদি তাই বলেন, সায় দিল ক্ষুদে মানুষটা। আশপাশের গোত্রগুলো ওটাকে ডাকত আলোর মিনার। দৃশ্যটা আমাকে ভয়ে ভরে দিয়েছিল।
যার খোঁজে বের হয়েছিলে, সেই বিখ্যাত মোহন্তের দেখা পেয়েছিলে?
না।
ওই মন্দির নির্মাতারা চাঁদের পাহাড় থেকে এসেছিল? এটাই তোমার বিশ্বাস? ওকে আবার আসল প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনল তাইতা।
কে জানে? আমি না। তবে ওই দিক থেকেই এসেছিল ওরা। প্রথমে দাসদের সাহায্যে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসে। তারপর দেয়াল বানিয়ে কাঠ ও ছাউনি দিয়ে ঢেকে দেয়। আমার গোত্র ওদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিল, বিনিময়ে পুঁতি, কাপড় আর ধাতব সরঞ্জাম পেয়েছে। ওটা বানানোর উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি আমরা, তবে নিষ্পাপ মনে হয়েছে, আমাদের পক্ষে হুমকি মনে হয়নি। নিজেদের অনাড়ীপনার স্মৃতি মনে পড়তেই মাথা নাড়ল কালুলু। কাজে আগ্রহী ছিলাম আমি। ওই নির্মাতাদের সাথে খাতির করার চেষ্টা করেছি। ওরা কী করছে সে সম্পর্কে আরও জানতে চেয়েছি, কিন্তু আমাকে নিদারুণ বৈরীভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে ওরা। শিবিরের চারপাশে প্রহরা বসিয়েছে, আমি আর কাছে ভিড়তে পারিনি। এখান থেকেই ওদের কাজ দেখতে বাধ্য হয়েছি। নীরবতায় ডুবে গেল কালুলু।
আরেকটা প্রশ্ন করে তাকে উৎসাহিত করল তাইতা। মন্দির শেষ হওয়ার পর কী হলো?
নির্মাতা আর দাসরা চলে যায়। মন্দিরের দেখভাল করতে নয়জন পুরোহিত রেখে যেদিক থেকে সেই পশ্চিমেই আবার কুচকাওয়াজ করে চলে গেছে ওরা।
মাত্র নয়জন? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
হ্যাঁ। ওদের সবার চেহারা পরিচিত হয়ে উঠেছিল আমার, এখান থেকেই।
কী কারণে তোমার ওদের পুরোহিত মনে হয়েছে?
লাল ধর্মীয় জোব্বা পরত ওরা। নিবেদনের আচার পালন করত। উৎসর্গ করে বলী আগুনে পোড়াত।
ওদের আচারের বর্ণনা দাও, গভীর মনোযোগের সাথে শুনছে তাই।
খুঁটিনাটি প্রত্যেকটা বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক দুপুরে পুরোহিতদের তিনজন মিছিল করে নদীর শাখার মাথায় নেমে আসত। সোরাইতে পানি ভরে মন্দিরে নিয়ে যেত। অদ্ভুত ভাষায় নাচত, উল্লাস করত।
তেনমাস ভাষায় না? জানতে চাইল তাইতা।
না, ম্যাগাস। ওই ভাষা চিনতে পারিনি।
ব্যস, এই? নাকি আর কিছু মনে আছে তোমার? বিসর্জনের কথা বলছিলে।
আমাদের কাছ থেকে কালো ছাগল আর কালো মুরগী কিনত ওরা। রঙের ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে ছিল। নিখাদ কালোই হতে হবে। ওগুলো মন্দিরে নিয়ে যেত ওরা। গান শুনেছি আমি, পরে ধোয়া আর পোড়া মাংসের গন্ধ পেয়েছি।
এছাড়া আর কী? লেগে রইল তাইতা।
এক মুহূর্ত ভাবল কালুলু। একজন পুরোহিত মারা গিয়েছিল। কারণটা আমার জানা নেই। বাকি আটজন তার মৃতদেহ হ্রদের তীরে নিয়ে আসে। বালির উপর তাকে নগ্ন ফেলে রেখে ব্লাফের ঢাল বেয়ে আবার উপরে উঠে গেছে। ওখান থেকে হ্রদের কুমীর ওটাকে টেনে পানির নিচে নিয়ে যাওয়া দেখেছে। চরম একটা ভঙ্গি করল বামন। কয়েক সপ্তাহর মধ্যে আরেকজন পুরোহিত এসে হাজির হয়েছিল মন্দিরে।
সেই আবার পশ্চিম থেকে? বলে উঠল তাইতা।
জানি না, কারণ তাকে আসতে দেখিনি। একদিন সন্ধ্যায় আটজন ছিল, পরদিন সকালে দেখি ফের নয়জন হয়ে গেছে।
তার মানে পুরোহিতের সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীবনের সঙ্কেত। একটু ভাবল তাইতা, তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, এরপর কী হলো?
দুবছরের বেশি সময় ধরে পুরোহিতদের অনুশীলন চালু থাকে। তারপর টের পেলাম যে মারাত্মক একটা কিছু ঘটতে চলেছে। মন্দিরের চারপাশে পাঁচটা অগ্নিসঙ্কেত জ্বালল ওরা। অনেক মাস দিনরাত সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রেখেছিল ওগুলো।
পাঁচটা আগুন, বলল তাইতা। আগুনগুলো কোথায় কোথায় জ্বালিয়েছিল ওরা?
বাইরের দেয়ালে পাঁচটা স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল। আপনি সেগুলো দেখেছেন? জানতে চাইল কালুলু।
হ্যাঁ। একটা বিরাট পেন্টাগ্রামের বিন্দু গঠন করেছে ওগুলো। উচ্চমার্গীয় এই নকশার উপরই মন্দিরটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কোনওদিন মন্দিরের ভেতরে যাইনি। কোনও পেন্টাগ্রামের কথা জানি। শুধু জানি বাইরের দেয়াল ঘিরে পাঁচটা জায়গায় আগুন ধরানো হয়েছিল, বলল কালুলু।
অস্বাভাবিক ঘটানা কি কেবল এটাই?
তারপর আরেকজন এসে যোগ দিয়েছিল ওদের সাথে।
আরেকজন পুরোহিত?
মনে হয় না। লাল নয়, তার পরনে কালো পোশাক ছিল। একটা ঢিলেঢালা কালো বোরখা সব বৈশিষ্ট্য আড়াল করে রেখেছিল। তবে ওটা পুরুষ ছিল নাকি মহিলা, নিশ্চিত করে বলতে পারব না। অবশ্য পোশাকের নিচের অবয়বের আকার থেকে মনে হয়েছে মহিলা হতে পারে। রোজ সূর্যোদয়ের সময় মন্দির থেকে বের হয়ে আসত সে। পাঁচটা আগুনের প্রত্যেকটার সামনে বসে প্রার্থনা করে আবার মন্দিরের সীমানায় ফিরে যেত।
তার চেহারা দেখেছ?
সব সময়ই বোরখা পরে থাকত সে। এক ধরনের অলৌকিক আচ্ছন্ন করা জাকের সাথে চলাফেরা করত। অন্য পুরোহিতরা সীমাহীন শ্রদ্ধায় তার সাথে আচরণ করত, তার সামনে নতজানু হতো। নিশ্চয়ই ওদের গোষ্ঠীর প্রধান নারী পুরোহিত ছিল সে।
সে মন্দিরে থাকার সময় আকাশে বা প্রকৃতিতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ খেয়াল করেছ?
সত্যিই, ম্যাগাস, অনেক স্বর্গীয় চিহ্ন ছিল। তাকে প্রথমবারের মতো মন্দিরের আগুনের সামনে প্রার্থনা করতে দেখার দিনই সন্ধ্যা তারা কক্ষপথ পাল্টে আকাশের বুকে ভেসে গেছে। এর অল্প পরেই আরেকটা তাৎপর্যহীন, নামহীন তারা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে আগুনে পুড়ে যায়। তার মন্দিরে থাকার পুরো সময়টায় নানা রঙের অদ্ভুত সব আলো উত্তর আকাশে নেচে বেড়িয়েছে। এইসব লক্ষণ দেখা দিয়েছে প্রকৃতিতে।
তোমার ধারণা, পর্দা ঢাকা সেই মহিলারই কাজ এসব?
আমি শুধু বলব, সে আসার পরেই এসব ঘটেছে। স্রেফ কাকতালীয় হয়ে থাকতে পারে। আমি জানি না।
ব্যস, এই? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল কালুলু। আরও আছে। প্রকৃতি যেন উত্তাল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। আপনাদের ক্ষেতের ফসল হলদে হয়ে মরে গেছে। গরুছাগলের পেট থেকে বাচ্চা বের হয়ে গেছে। আমাদের গোত্রের স্থায়ী সর্দার সাপের কামড় খেয়ে বলতে গেলে সাথে সাথে মারা গেছে। তার বড় বউ দুই মাথাঅলা একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে।
ভীষণ খারাপ লক্ষণ, গম্ভীর দেখাল তাইতাকে।
আরও খারাপ ব্যাপারও আছে। আবহাওয়া ওলটপালট হয়ে গেছে। পাহাড়ের বুকে আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে প্রবল হাওয়া সব ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে গেছে গোত্রীয় টোটেম; আমাদের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন রেলিক আর জুজু গিলে নিয়েছে। স্থায়ী সর্দারের কবর খুঁড়ে হাড়গোড় খেয়ে ফেলেছে হায়েনার দল।
তোমাদের জনগণ, পূর্বপুরুষ আর ধর্মের উপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ ছিল এটা, বলল তাইতা।
তারপর আমাদের পায়ের নিচে জ্যান্ত পশুর মতো নড়তে শুরু করে পৃথিবী। হ্রদের পানি লাফিয়ে শূন্যে উঠে আসে, উত্তপ্ত শাদা, ভয়ানক। মাছের ঝাঁক অদৃশ্য হয়ে যায়। হ্রদের পাখিগুলো পশ্চিমে উড়ে চলে যায়। সৈকতে বাধা আমাদের ক্যানুগুলোকে ভাসিয়ে নেয় ঢেউ। মাছধরার জালগুলো ছিঁড়েখুড়ে ফেলে। লোকজন আমাদের গোত্রের ক্রুদ্ধ দেবতাদের সাথে মধ্যস্ততা করার জন্যে আমার কাছে অনেক আবেদন নিবেদন করেছে।
এমনি একটা অবস্থায় কী করতে পারতে তুমি? জানতে চাইল তাইতা। কঠিন একটা কাজ করতে বলেছিল ওরা তোমাকে।
এখন আমরা যেখানে বসে আছি, সেখানে আসি আমি। আমার সাধ্যমতো সবচেয়ে কার্যকর জাদু সৃষ্টি করি। হ্রদের দেবতাদের শান্ত করতে আমাদের পূর্বপুরুষদের ছায়াকে আহ্বান জানাই। কিন্তু আমার আবেদনে কানে তুলো দিয়ে রেখেছে ওরা। আমার গোত্রের ভোগান্তির প্রতি ক্ষেপই করেনি। মদ্দা হাতি যেভাবে নৃগং বাদাম গাছ আঁকায় ঠিক সেভাবে এই পাহাড়টাকে ঝাঁকিয়েছে তারা। এমনভাবে নাচছিল দুনিয়াটা যে মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। ক্ষুধার্ত সিংহের হায়ের মতো গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, পিঠে বাচ্চা ঝোলানো নারী পুরুষকে গিলে নিয়েছে। চিবুক বেয়ে নগ্ন বুকের উপর অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। একজন দেহরক্ষী একটা লিনেনের কাপড় দিয়ে মুছে দিল।
হ্রদের পানি সৈকতের উপর দিয়ে গর্জন তুলে ভয়ানক হিংস্রতায় গড়িয়ে আসতে দেখেছি আমি। আমাদের নিচের ক্লিফের আধাআধি দূরত্ব পর্যন্ত উঠে আসছিল। প্রবল বৃষ্টির মতো আমার উপর এসে পড়ছিল ফোয়ারার পানি। রীতিমতো অন্ধ আর বধির হয়ে গিয়েছিলাম। মন্দিরে দিকে তাকিয়েছিলাম। মেঘ আর ফোয়ারার ভেতর দিয়ে গেটের সামনে কালো বোরখা পরা ছায়ামূর্তিকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। যুদ্ধ ফেরত স্বামীকে আহ্বান জানানো নারীর মতো উত্তাল হ্রদের দিকে দুই হাত মেলে রেখেছিল সে। শ্বাস নেওয়ার জন্যে হাঁপাচ্ছে কালুলু, শরীর নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুঝছে। তার হাত আর বাহু ঝাঁকি খাচ্ছে, নাচছে; পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগির মতো দুলছে মাথা। মুখে এমন খিচুনী হচ্ছে যেন মূৰ্ছা যাবে।
শান্তি! ওর মাথার উপর একটা হাত রাখল তাইতা। আস্তে আস্তে শান্ত, স্থির হয়ে এলো বামন। কিন্তু এখনও চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসছে। বেশি খারাপ লাগলে আর বলার দরকার নেই।
আপনার কাছে বলতেই হবে। কেবল আপনিই বুঝবেন। মুখ হাঁ করে বাতাস টেনে নিল সে, তারপর আবার খেই ধরল, পানি দুর্ফাঁক হয়ে ঢেউয়ের ভেতর থেকে গাঢ় বস্তু ঠেলে বের হয়ে এলো। প্রথমে ভেবেছিলাম গভীর থেকে উঠে আসা জ্যান্ত দানো বুঝি। সবচেয়ে কাছের দ্বীপের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওখানে কোনও দ্বীপ ছিল না। হ্রদের পানি ছিল উন্মুক্ত, শূন্য। তারপর ওই পাথরটা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এখন যে দ্বীপটাকে দেখতে পাচ্ছেন সেটা হ্রদের জঠর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসা নবজাতকের মতো জন্ম নিয়েছে। দ্বীপের দিকে ইঙ্গিত করার সময় ভীষণভাবে কাঁপতে লাগল তার হাত। কিন্তু ওটাই শেষ নয়। আরও একবার জল দুভাগ হয়ে যায়।হ্রদের তলা থেকে আরেকটা পাথরের একটা চাঙর উঠে আসে। ওটাই সেই লাল জোড়া পাথর! হাপরের আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছিল। হিসহিস শব্দে বাষ্প হয়ে দুপাশে সরে যাচ্ছিল পানি। পাথর ছিল আধা গলা, গভীর থেকে শূন্যে উঠে আসামাত্রই জমাট বেঁধে যাচ্ছিল। ওগুলোর সৃষ্ট বাষ্পের মেঘ এত ঘন ছিল যে প্রায় সবকিছু অস্পষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু ফাঁক হয়ে যাবার পর দেখলাম মন্দির অক্ষত আছে। দেয়ালের প্রত্যেকটা পাথর রয়েছে জায়গামতো। ছাদটা মজবুত। কিন্তু কালো জোব্বা পরা অবয়ব অদৃশ্য হয়ে গেছে। অদৃশ্য হয়ে গেছে পুরোহিতরা। ওদের আর দেখিনি। দানবীয় অন্তসত্তা উদরের মতো ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছিল জোড়া লাল পাথর, এক সময় শেষে ওই আকার আর কাঠামো পেয়েছে। নীলের মুখ আটকে দিয়েছে। নদী শুকিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আর পানির নিচ থেকে বের হয়ে এসেছে পাথর ও বালুময় তীর।
দেহরক্ষীদের ইশারা করল কালুলু। এক জন ছুটে এসে ওর মাথা আগলে ধরল, আরেকজন ঠোঁটের কাছে একটা লাউ ধরে রাখল। শব্দ করে গিলল সে। তরলটায় এক ধরনের তীব্র গন্ধ, মনে হলো নিমিষে তাকে শান্ত করে ফেলেছে। লাউটা ঠেলে সরিয়ে আবার তাইতার সাথে কথা বলতে শুরু করল সে।
এই প্রলয়ঙ্করী ঘটনাগুলো দেখে এমন তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম যে, দৌড়ে এই কুঁড়ে থেকে ব্লাফের ঢাল বেয়ে নেমে গেছি। ইঙ্গিতে যাবার পথটা দেখাল সে। ওই গাছপালার সারির সাথে এক স্তরে আসার পর জমিন দুভাগ হয়ে যায়, সামনে খুলে যাওয়া গভীর খাদে পড়ে যাই আমি। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও আমার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। উপরে চলে এসেছিলাম প্রায়, এমন সময় মানুষখেকো দানোর চোয়ালের মতো যেমন দ্রুত ফাঁক হয়েছিল তেমনি দ্রুত আবার বুজে গেল জামিনের ফোকরটা। আমার দুটো পাই আটকে গেল, হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। দুদিন ওখানে পড়ে ছিলাম আমি, তারপর তামাফুপা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা এসে আমাকে উদ্ধার করে। আমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল ওরা, কিন্তু পাথরের দুটো খণ্ডের মাঝখানে আটকা পড়েছিল আমার পা। আমাকে একটা ছুরি আর কুড়োল এনে দিতে বললাম ওদের। ওরা আমাকে ধরে রাখার সময় নিজের পা কেটে ফেললো। বাকলের কাপড়ে কাটা পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধলাম। আমার গোত্রের লোকজন অভিশপ্ত এলাকা ছেড়ে কিয়োগার জলাভূমিতে পালিয়ে যাবার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যায়।
সেইসব দিনের ভীষণ ঘটনাগুলো আবার তোমার মনে পড়ে গেছে, বলল তাইতা। তোমার শক্তির উপর ধকল গেছে তাতে। তোমার সমস্ত কথা শুনে আমি দারুণ অভিভূত। তোমার মেয়েদের ডেকে বলো আবার নিরাপদে তোমাকে তামাফুপায় নিয়ে যেতে, ওখানে তোমাকে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে।
আপনি কী করবেন, ম্যাগাস?
কর্নেল মেরেন ওটা ফেটে পড়ে কিনা দেখার জন্যে তপ্ত পাথরের প্রাচীর ঠাণ্ডা করতে তৈরি হয়ে আছে। ওকে সাহায্য করব।
*
দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা কাঠের পাহাড় পুড়ে গনগনে ছাইয়ের গাদায় পরিণত হয়েছে। লাল জোড়া-পাথর এত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে ওটার চারপাশের হাওয়া মরুভূমির মরীচিৎকার মতো কাঁপছে, তরঙ্গায়িত হচ্ছে। চারটে দল লাল জোড়া-পাথরের চূড়ায় শাদুফে হুইলের চারপাশে অবস্থান নিয়েছে। কারওই পাথর ভাঙার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। অবশ্য, তাইতা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছে ওদের।
আপনি তৈরি, ম্যাগাস? গোর্জ থেকে প্রতিধ্বনিত হলো মেরেনের কণ্ঠস্বর।
তৈরি! পাল্টা চিৎকার করল তাইতা।
পাম্প শুরু করো! চিৎকার করে উঠল মেরেন।
শাদুফের হাতল আঁকড়ে ধরল লোকেরা, নিজেদের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিল তার উপর। তাল মিলিয়ে ওঠানামা করতে লাগল ওদের মাথা। হাবারি স্থানীয় ঢোলের গায়ে বাজনা বাজাচ্ছে। খালি বালতির সারি জলের তলে নেমে গেল। ভর্তি হলো, তারপর উঠে গেল দেয়ালের মাথায়। এখানে কাঠের ট্রাফে ঢালা হলো সেই পানি, দেয়ালের কুঁজের উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে উল্টোদিকের তপ্ত পাথরের দেয়ালের উপর ঢেলে দিতে লাগল। সাথে সাথে হিসহিস শব্দে বাষ্পের ঘন শাদা মেঘে ভরে গেল চারদিকের বাতাস, দেয়াল আর ওটার উপরের মানুষজন ঢেকে ফেলল। হাতলে যারা ছিল এক মুহূর্তের জন্যেও হতোদ্যম হলো না তারা, কিনারার উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। বাষ্প হিসহিস করে উঠল। গোঙানি ও গর্জনের আওয়াজ উঠল চুপসে আসা পাথরে।
ভাঙছে? চিৎকার জানতে চাইল তাইতা।
দেয়ালের পায়ের কাছে ঘন বাস্পের আড়ালে হারিয়ে গেছে মেরেন। পানির গড়িয়ে পড়া আর বাস্পের হিসহিস শব্দের নিচে প্রায় চাপা পড়ে গেল মেরেনের কণ্ঠস্বর। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ওদের পাম্প করে যেতে বলুন, ম্যাগাস!
শাদুফের লোকজন ক্লান্ত হয়ে আসছে। ওদের জায়গায় নতুন দল বসাল তাইতা। দেয়ালের গা বরাবর পানি ঢালা অব্যাহত রাখল ওরা। আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করল হিসহিস করা বাস্পের মেঘ।
পাম্প করে চলল! গর্জে উঠল মেরেন। আবার দল পাল্টাল তাইতা। তারপর ধীর পায়ে কিনারার কাছে এসে নিচে উঁকি দিল। কিন্তু ক্লিফের বাঁক দেয়ালের নিচের দিকটা আড়াল করে রেখেছে। আমি নিচে যাচ্ছি, পাম্পের লোকদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল ও। আমি নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত থামাবে না। গোর্জের দিকে নেমে যাওয়া পথের দিকে দ্রুত পা বাড়াল ও। সাধ্যমতো দ্রুত নিচে নামতে লাগল। নিচে মেরেন ও ফেনের অবয়ব বোঝার মতো যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে এসেছে বাষ্প। দেয়ালের অনেক কাছে চলে গেছে ওরা। পরীক্ষার ফল নিয়ে আলোচনা করছে।
পাথরের দেয়ালের বেশি কাছে যেয়ো না, বলল তাইতা, কিন্তু ওরা শুনেছে বলে মনে হলে না। এখনও পানি ঝরছে। ছাই ধুয়ে নদীর তলদেশের দিকে নিয়ে গেছে।
হো, মেরেন! কী অবস্থা? রাস্তা ধরে দ্রুত নেমে যাওয়ার সময় জোরে ডাকল ও। ওর দিকে মাথা তুলে তাকাল মেরেন। ওর চেহারা এমন হাস্যকরভাবে করুণ দেখাচ্ছে যে হেসে ফেলল তাইতা। এত গম্ভীর কেন?
কিচ্ছু না! বিলাপ করল মেরেন। সব চেষ্টাই জলে গেল। বাষ্পের অবশেষের দিকে এগিয়ে গিয়ে পাথরের দিকে হাত বাড়াল সে।
সাবধান! চিৎকার করে বলল তাইতা। এখনও গরম ওটা। চট করে হাত সরিয়ে নিল মেরেন। তারপর তলোয়ার বের করল। ব্রোঞ্জের ফলা দিয়ে স্পর্শ করল।
ওর একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ফেন। পাথর এখনও অটল, চিৎকার করে বলল ফেন। ওদের পেছনে এসে দাঁড়াল তাইতা। ফেন ও মেরেন বাষ্প ওঠা পাথরের দেয়াল থেকে মাত্র হাত খানেক দূরে। ফেনের কথাই ঠিক, বুঝতে পারল ওঃ আগুনের আঁচে কালো হয়ে গেলেও অক্ষত রয়ে গেছে লাল জোড়া-পাথরের দেয়াল।
তলোয়ারের ডগা দিয়ে ওটার গায়ে টোকা দিল মেরেন। নিরেট আওয়াজ উঠল। রাগের সাথে আরও জোরে আঘাত হানতে মাথার উপর তলোয়ার তুলল ও। হতাশা দূর করতে চায়। ওদের ঢেকে রাখা বাস্পের মেঘ ভেজা-ভেজা, উষ্ণ। সহসা প্রবল বৈপরীত্য অনুভব করল তাইতা: হাত ও মুখে বরফের শীতলতা। সাথে সাথে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। মেরেন যেখানে আঘাত হেনেছে সেখানে ছাইয়ে কালো হয়ে যাওয়া পাথরে সূক্ষ্ম ফুটো দেখতে পেল। লাল আভা বিলোচ্ছে ওটা। তারপর বেড়ালের থাবার আকার নিল ওটা-ভোরের ইয়োসের প্রতীক।
পিছিয়ে যাও! হুকুম দিল তাইতা। নির্দেশ জোরাল করতে শক্তির কণ্ঠস্বর ব্যবহার করল। একই সাথে সামনে লাফ দিয়ে ফেনের হাত জাপ্টে ধরেই সাঁৎ করে সরিয়ে নিয়ে এলো ওকে। কিন্তু মেরেনকে সতর্ক করতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছে। মেরেন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও উজ্জ্বল জায়গাটায় আঘাত করল ওর তলোয়ারের ডগা। কাঁচ ভাঙার মতো আওয়াজ করে বাইরের দিকে বিস্ফারিত হলো ইয়োসের প্রতাঁকের ঠিক নিচে পাথরের ছোট একটা অংশ, বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোর একটা ঝটকা এসে লাগল ওর চোখে মুখে। বেশির ভাগই ছোট ছোট টুকরো হলেও সূচের মতো তীক্ষ্ণ। পেছনে ধাক্কা খেল ওর মাথা। তলোয়ার ফেলে দুই হাতে মুখ ঢাকল ও। হাতের ফাঁক গলে রক্ত বুকের উপর ঝরতে লাগল।
ওর দিকে ছুটে গেল তাইতা, হাত ধরে স্থির করল ওকে। জমিনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে ফেনকে। কিন্তু হাঁছড়েপাছড়ে উঠেই ছুটে এলো সাহায্য করতে। দুজনে মিলে ধোয়া-ওঠা পাথরের কাছ থেকে মেরেনকে সরিয়ে আনল, এক চিলতে ছায়া খুঁজে বসাল ওকে।
সরে যাও! বাকি লোকদের নির্দেশ দিল তাইতা। ওদের অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছিল ওরা, চেপে আসছিল। আমাদের কাজ করার মতো জায়গা দাও। ফেনের উদ্দেশে বলল, পানি নিয়ে এসো।
দৌড়ে গিয়ে একটা লাউ নিয়ে এলো ও। মেরেনের মুখ থেকে ওর হাত সারাল তাইতা। ভয়ে আঁতকে উঠল ফেন। ভুরু কুঁচকে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করল তাইতা।
এখনও সুন্দর আছে আমার চেহারা? হাসার চেষ্টা করল মেরেন। কিন্তু চোখজোড়া শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে। চোখের পাতা ভারি, রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।
ভালোই উন্নতি হয়েছে, ওকে আশ্বস্ত করে বলল তাইতা। রক্ত ধুতে শুরু করল ও। কয়েকটা ক্ষত কেবল উপরের, তবে তিনটা বেশ গভীর। একটা ওর নাকের পাটার উপর দিয়ে গেছে, দ্বিতীয়টা গেছে ওপরের ঠোঁটের ওপর দিয়ে, আর তিন নম্বরটা সবচেয়ে খারাপ, ডান পাশের চোখের পাতা ভেদ করে গেছে। চোখের কোটরে পাথরের একটা টুকরো আটকে থাকতে দেখল তাইতা।
আমার ওষুধের ব্যাগটা নিয়ে এসো, ফেনকে বলল ও। ওদের সরঞ্জাম রাখার জায়গার দিকে দৌড়ে গেল ফেন, চামড়ার থলেটা নিয়ে ফিরে এলো।
অস্ত্রপচারের বান্ডিলটা খুলল তাইতা। প্রোবসহ একটা আইভরি ফোরসেপ বেছে নিল।চোখ খুলতে পারবে? আস্তে করে জিজ্ঞেস করল ও।
চেষ্টা করল মেরেন, বাম চোখটা সামান্য খুলল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত চোখের পাতা কাপলেও ডান চোখটা বন্ধই রইল।
নাহ, ম্যাগাস, চাপা কণ্ঠে বলল মেরেন।
অনেক ব্যথা? দরদের সাথে জানতে চাইল ফেন। বেচারা মেরেন। ওর হাত ধরল সে।
ব্যথা? মোটেই না। তোমার ছোঁয়ায় অনেক ভালো লাগছে।
মেরেনের দাঁতের ফাঁকে এক টুকরো চামড়া গুঁজে দিল তাইতা। কামড়ে থাকো। পাথরের টুকরোর উপর ফোরসেপের দুই মাথা চেপে ধরল। একটা মাত্র দৃঢ় প্রয়াসে বের করে আনল ওটা। গুঙিয়ে উঠল মেরেন। বিকৃত হয়ে গেল ওর চেহারা। ফোরসেপটা একপাশে নামিয়ে রেখে আঙুল দিয়ে আস্তে করে খুলল দুই চোখের পাতা পেছনে ফেনের আঁতকে ওঠার আওয়াজ পেল।
বেশি খারাপ? জানতে চাইল মেরেন।
চুপ থাকল তাইতা। অক্ষিগোলক ফেটে গেছে, গাল বেয়ে নেমে আসছে রক্তাক্ত জেলি। নিমেষে তাইতা বুঝে গেল এই চোখে আর কোনওদিনই দেখতে পাবে না মেরেন। আস্তে করে অন্য চোখের পাতা খুলল ও। তাকাল ওটার ভেতরে। চোখের মণি বড় হয়ে ঠিকমতো স্থির হচ্ছে, লক্ষ করল ও। অন্য হাতটা উঁচু করল ও। কয়টা আঙুল? জিজ্ঞেস করল ও।
তিনটা, জবাব দিল মেরেন।
তাহলে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওনি, বলল তাইতা। কঠিন যোদ্ধা মেরেন। ওকে সত্য থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন বা উচিত নয়।
অর্ধেকটা পথ চলে গেছি? তীর্যক হেসে জিজ্ঞেস করল মেরেন।
সেজন্যেই দেবতারা তোমাকে দুটি চোখ দিয়েছেন, বলল তাইতা। শাদা লিনেনের টুকরোয় নষ্ট চোখটা বাঁধতে শুরু করল ও।
ডাইনীটাকে আমি ঘৃণা করি। এটা তার কাজ, বলল ফেন। মৃদু স্বরে কাঁদতে লাগল ও। ওকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা করি।
কর্নেলের জন্যে একটা খাটিয়া বানাও, লোকদের নির্দেশ দিল তাইতা, কাছেই অপেক্ষায় ছিল ওরা।
লাগবে না, প্রতিবাদ করল মেরেন। আমি হাঁটতে পারব।
অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম আইন হচ্ছে, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা, চড়তে পারলে কোনও সময়ই হাঁটবে না।
খাটিয়া তৈরি হলে মেরেনকে ওটায় উঠতে সাহায্য করল ওরা। তারপর তামাফুপার উদ্দেশে রওয়ানা দিল। অল্প কিছু সময় চলার পর তাইতাকে ডাকল ফেন। ওদিকে অচেনা লোকজন আমাদের দিকে নজর রাখছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীপথের দিকে ইঙ্গিত করে বলল ও। দিগন্ত রেখায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট দল। গুনল ফেন। পাঁচজন।
নেংটি পরে থাকলেও শরীর নগ্ন। সবার কাছেই বর্শা আর মুগুর। দুজনের কাছে তীর-ধনুক দেখা যাচ্ছে। ওদের ভেতর সবচেয়ে লম্বা জন রয়েছে সামনে। লাল ফ্লেমিঙ্গো পালকের শিরস্ত্রাণ পরেছে। ওদের হাবভাব উদ্ধত, বৈরী। সর্দারের পেছনে দুজনকে আহত বা চোট পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সতীর্থরা সাহায্য কর ওদের।
ম্যাগাস, যুদ্ধে ছিল ওরা, বলল খাটিয়াবাহকদের একজন শোফার।
ওদের উদ্দেশে হক দাও! নির্দেশ দিল তাইতা। চিৎকার করে হাত নাড়ল শোফার। যোদ্ধাদের কেউই এতটুকু প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ফের চিৎকার করল শোফার। ফ্লামিঙ্গো পালকের শিরস্ত্রাণ পরা সর্দার নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বর্শা উঁচু করল। সাথে সাথে দিগন্ত থেকে উধাও হয়ে গেল তার লোকজন। খাখা করতে লাগল পাহাড়ের শরীর। ওরা অদৃশ্য হওয়ার পরপরই দূরাগত একটা আর্তচিৎকার ভেসে এসে নীরবতা ভেঙে দিল।
শহর থেকে আসছে শব্দটা, চট করে সেদিকে চোখ ফেরাল ফেন। ওখানে ঝামেলা হচ্ছে।
*
লাল জোড়া-পাথরের কাছে তাইতাকে রেখে আসার পর দেহরক্ষীরা নদীর উপত্যকা দিয়ে বয়ে তামাফুপার দিকে বয়ে নিয়ে গেছে কালুলুকে। মানুষটা দারুণ বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকায় ধীরে, সাবধানে পথ চলেছে ওরা। ওকে ওষুধের লাউ থেকে খেতে দিতে আর মুখ ভেজাতে ও ভেজা কাপড়ে মোছার জন্যে কয়েক শো গজ পরপরই থামতে হয়েছে ওদের। সূর্যের বাঁকা পথের হিসাবে উপত্যকা থেকে বের হয়ে ঢাল বেয়ে তামাফুপার তোরণের উদ্দেশে বাইতে শুরু করতে গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল।
নিবিড় কিতার কাঁটা ঝোঁপের ভেতর পৌঁছতেই এক দীর্ঘদেহী আগন্তুক ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। কালুলু আর মেয়েরা চিনতে পারল তাকে। কেবল ফ্লামিঙ্গো পালকের শিরস্ত্রাণের কারণে নয়। খাটিয়া নামিয়ে রেখে প্রণত হলো মেয়েরা।
আমরা আপনাকে দেখেছি, মহান সর্দার, সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল ওরা। কোনওমতে একটা কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল কালুলু। সভয়ে তাকাল আগন্তুকের দিকে। বাসমা হচ্ছে তামাফুপা আর কিওগাদের দেশের মাঝখানে বাসিন্দা বাসমারা গোত্রের অবিসম্বাদিত সর্দার। মন্দির নির্মাণকারী ও হ্রদের গভীর থেকে লাল পাথর তুলে আনা আগন্তুকদের আগমনের আগে শক্তিমান শাসক ছিল সে। এখন তার গোত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, শাসন বিক্ষিপ্ত।
হে, শক্তিমান বাসমা, সম্মানের সাথে বলল কালুলু। আমি আপনার কুকুর।
বাসমা ছিল ওর চির শত্রু, প্রতিপক্ষ। এতদিন খ্যাতি আর মর্যাদার কারণে সুরক্ষিত ছিল কালুলু। এমনকি বাসমারাদের সর্দারও ওর মতো ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী শামানের ক্ষতি করার সাহস করে ওঠেনি। অবশ্য কালুলু জনত, নীলের বুকে বাধ ওঠার পর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বাসমা।
তোমার উপর নজর রাখছিলাম আমি, জাদুকর, শীতল কণ্ঠে বলল বাসমা।
আপনার মতো এমন শক্তিশালী একজন সর্দার আমার মতো এক নগণ্য প্রাণীর কথা ভেবেছেন জেনে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বিড়বিড় করে বলল কালুলু। ঝোঁপ থেকে বের হয়ে এলো দশজন বাসমারা যোদ্ধা। সর্দারের পেছনে অবস্থান নিল।
গোত্রের শত্রুদের পথ দেখিয়ে তামাফুপায় নিয়ে এসেছ তুমি। আমার শহর দখল করে নিয়েছে ওরা।
ওরা শত্রু নয়, জবাব দিল কালুলু। আমাদের বন্ধু, মিত্র। ওদের নেতা একজন মহান শামান, আমার চেয়েও অনেক বেশি জ্ঞানী ও শক্তিশালী। লাল জোড়া পাথর ধ্বংস করে নীল নদকে আবার প্রবাহিত করার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে।
কী কাঁচা মিথ্যা এসব, ব্যাটা পাহীন বিশ্রী বস্তা? এরাও নদীর মুখে মন্দির নির্মাতাদের মতোই জাদুকর, অন্ধকারের আত্মার অভিশাপ বয়ে এনেছে অন্যদের মতোই, যারা হ্রদের জলকে টগবগিয়ে ফুটিয়েছে, পৃথিবীর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ওরাই গভীর থেকে পাথরটাকে তুলে এনেছে, আমাদের বাবা-মা মহান নদী রুদ্ধ করেছে।
ব্যাপারটা তা নয়, খাটিয়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল কালুলু, বাসমার মুখোমুখি হতে কাটা পায়ের উপর ভর দিয়ে সামনে এগোল। ওরা আমাদের বন্ধু।
আস্তে করে বর্শা তুলে বামনের বুক তাক করল বাসমা। এটা শাস্তির একটা ভঙ্গি। নিজের দেহরক্ষীদের দিকে তাকাল কালুলু। ওরা বাসমার অধীন কোনও গোত্রের সদস্য নয়, ওদের বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ ছিল। অনেক উত্তরের এক যোদ্ধা গোত্র থেকে এসেছে ওরা। অবশ্য, বাসমা ও ওর মাঝে যেকোনও একজনকে বেছে নিতে হলে ওরা কার পক্ষে যাবে নিশ্চিত করে বলতে পারবে না ও। যেন ওর অনুক্ত প্রশ্নের জবাবেই ওকে ঘিরে অবস্থান দৃঢ় করল আটজন মেয়ে। ইম্বালি-ফুল-ওদের নেতা। হয়তো বা আত্মাসাইট কুঁদে বের করা হয়ে থাকতে পারে ওর শরীর। ওর কালো ত্বকে তেল মাখানো বলে রোদ লেগে চিকচিক করছে। সূক্ষ্ম, চ্যাপ্টা পেশিতে কিলবিল করছে হাত পা। উঁচু, দৃঢ় বুক ওর, আচরিক ক্ষতের নকশা করা। দীর্ঘ গ্রীবা, গর্বিত। চোখজোড়া হিংস্র। কোমরের কাছে ফুটোয় ঝোলানো যুদ্ধ-কুড়োলটা আলগা করে নিল সে। বাকিরা ওর নজীর অনুসরণ করল।
এখন আর তোমার বেশ্যারা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না, কালুলু, বিতৃষ্ণার সাথে নাক সিঁটকাল বাসমা। জাদুকরকে মেরে ফেল, নিজের যোদ্ধাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল সে। কালুলুর দিকে বর্শা ছুঁড়ে দিল।
আগেই আঁচ করেছিল ইম্বালি। সামনে ঝাঁপ দিল সে। ডান হাতে পাঁই করে ঘোরাল যুদ্ধ-কুড়োল, মাঝপথেই আঘাত করল বর্শাটাকে। সোজা শূন্যে পাঠিয়ে দিল ওটা, নিচে নেমে আসতেই বাম হাতে নিপূণভাবে ধরে ফেলল। ফলাটা এগিয়ে দিল আগুয়ান যোদ্ধাদের মোকাবিলায়। প্রথম লোকটা সোজা ওটার দিকেই তেড়ে এসে ঠিক স্টার্নামের নিচে শূলবিদ্ধ হলো। পিছিয়ে গিয়ে পেছনে ছুটে আসা লোকটার উপর পড়ল। ভারসাম্য হারাল সে। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে পেটে বেঁধা ফলা নিয়েই হাত পা ছুঁড়তে লাগল। তার লাশের উপর দিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে লাফ। দিল ইম্বালি, সামলে ওঠার আগেই পেছনের লোকটাকে কায়দা করল। মাথার ওপর তুলে আনল কুড়োলটা, পরক্ষণে কনুই থেকে আলগা করে নিল লোকটার বর্শা ধরা হাত। সাথে সাথে পাই করে ঘুরে ভরবেগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় লোকটার ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করল। সামনে ছুটে আসছিল সে। বসার ভঙ্গিতে লুটিয়ে পড়ল মুণ্ডহীন লাশটা, কাটা ধমনী থেকে ফিনকি দিয়ে উজ্জ্বল লাল রক্ত বের হয়ে আসতে লাগল। এবার জমিনে লুটিয়ে পড়ল সে, রক্তে ভিজে যেতে লাগল জমিন।
কালুলুকে ঘিরে ধরে চট করে পিছিয়ে এলো ইম্বালি আর অন্য মেয়েরা, খাটিয়ার র-হাইড স্ট্র্যাপ ধরে তুলে নিল ওটা। তারপর ধাক্কা মারার অস্ত্রের মতো ওটা নিয়ে ধেয়ে গেল বাসমারাদের দিকে। কুড়োলের ফলা শূন্যে পাক খেয়ে শিষ তোলার সময় বিকট স্বরে উলু ধ্বনি করতে লাগল। এ্যাচ এ্যাচ করে মাংস আর হাড়ে বিধতে লাগল সেগুলো।
দ্রুত একাট্টা হলো বাসমার লোকজন। পরস্পরের সাথে লাগানো বর্ম নিয়ে ওদের মুখোমুখি হলো। ওদের মাথা লক্ষ্য করে দীর্ঘ বর্শা ছুঁড়ে দিল। একজন লুটিয়ে পড়ল, গলায় পাথরের ফলা ঢুকে পড়ায় নিমেষে প্রাণ হারাল সে। অন্যরা খাটিয়া উঁচু করে বর্মের সারির উপর আঘাত হানল। দুপক্ষই একে অন্যের উপর চাপ দিতে লাগল। বাসমারাদের একজন হাঁটু ভেঙে বসে খাটিয়ার তলা দিয়ে সারির মাঝখানের মেয়েটার পেটে আঘাত হানল। খাটিয়া ছেড়ে পেছনে পাক খেল সে। সরে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু ঝটকা দিয়ে বর্শা আলগা করে নিল হানাদার, ফের ওর কিডনি লক্ষ্য করে আঘাত করল। গভীরে গেঁথে গেল আঘাতটা, বর্শাটা মেরুদণ্ডের পাশ ঘেঁষে যাবার সময় এক লহমায় জীবনের জন্যে পঙ্গু করে দিল ওকে, আর্তচিৎকার করে উঠল বেচারা।
কয়েক কদম পিছিয়ে গেল কালুলুর দেহরক্ষীরা, আহত মেয়ের শূন্যস্থান পূরণ করে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল খাটিয়াটা। বৰ্ম উঁচু করে ধরল বাসামারারা, তারপর আরও একবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তেড়ে এলো। খাটিয়ার দিকে ছুটে আসার সময় বর্মের নিচের প্রান্ত দিয়ে আঘাত হানল ওরা, কুঁচকি ও পেট ওদের নিশানা। বর্মের রেখা সামনে পেছনে আসা যাওয়া করছে। আরও দুটো মেয়ে লুটিয়ে পড়ল। একজনের উরুর উপরে লেগেছে আঘাত, ফলে ফেমারের ধমনী ছিন্ন হয়েছে। পিছিয়ে গেল সে, ক্ষতস্থানের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে ধমনীর রক্তক্ষরণ থামানোর প্রয়াসে চিমটি দিয়ে ধরে রাখল। উবু হয়ে থাকায় পিঠ অরক্ষিত হয়ে পড়ল তার, এক বাসমারা মেরুদণ্ডে আঘাত হানল। দুই কশেরুকার মাঝখানে আশ্রয় নিল বর্শার ফলা। আড়ষ্ট পা হাল ছেড়ে দিল তার। ফের তাকে আঘাত করল লোকটা, কিন্তু মেয়েটাকে হত্যায় ব্যস্ত থাকায় খাটিয়ার নিচে দিয়ে বাউলি কেটে এগিয়ে এসে তার মাথায় কুড়োল বসিয়ে দিল ইম্বালি।
খাটিয়ার উপর অসমান চাপ ওটার ঘূণী কমিয়ে দিয়েছে। একপাশে অরক্ষিত পড়ে আছে কালুলু। এই মুহূর্তটাকেই বেছে নিল সর্দার বাসমা: বর্মের প্রাচীর ছেড়ে স্যাৎ করে বের হয়ে এসেই খাটিয়ার একপাশ দিয়ে ঝুপ করে বসে দৌড়ে এলো ওর দিকে। ওকে আসতে দেখল কালুলু, চট করে হাতের উপর অবস্থান নিল সে। বিস্ময়কর ক্ষিপ্রতার সাথে কিতার কাটার গাছের ঝোঁপের দিকে ধেয়ে গেল। প্রায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় তাকে ধরে ফেলল বাসমা, দুবার আঘত করল।
বেঈমান! চিৎকার করে উঠল সর্দার। পিঠের ঠিক মাঝখানে অঘাত করল তার বর্শার ডগা। অনেক চেষ্টায় হাতের উপর খাড়া হয়ে থাকল কালুলু। লাফ দিয়ে আগে বাড়তে লাগল, কিন্তু আবার ওর নাগাল পেল বাসমা। ডাইনীর চ্যালা! আর্তনাদ করে উঠল সে। ফের আঘাত করল, এবার ক্ষুদে মানুষটার চুপসানো ঢোকানো কুঁকচি হয়ে পেটে। আর্তনাদ করতে করতে হাঁচড়ে-পাছড়ে বনের দিকে ছুটতে লাগল কালুলু। ওর ট্র্যাক অনুসরণের প্রয়াস পেল বাসমা। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে মাথার উপর কুড়োল তুলে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখল ইম্বালিকে। চট করে বসে পড়ল সে, ইষালির কুড়োল তার কানের পাশ দিয়ে শিস তুলে চলে যাওয়ামাত্র ওর পাল্টা আঘাত থেকে সরে গেল, ছুট লাগাল। ওকে পালাতে দেখে অনুসরণ করল তার লোকেরা, ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে দূরে।
জাদুকর মরেছে! চিৎকার করে বলল বাসমা।
গলা মেলাল তার যোদ্ধারা। কালুলু মরেছে! শয়তার আর দানোদের লোককে মারা হয়েছে!
ওদের জন্ম দেওয়া কুত্তীদের কাছে ফিরে যেতে দাও, পিছু ধাওয়া থেকে নিজের মেয়েদের ঠেকাল ইম্বালি। আমাদের মনিবকে বাঁচাতে হবে।
ওকে ঘন ঝোপে যখন আবিষ্কার করল, কালুলু গোল বলের মতো ব্যথায় কাঁদছে। যত্নের সাথে ওকে কাটা ঝোঁপ থেকে উদ্ধার করে আনল ওরা, তারপর আবার খাটিয়ায় তুলে দিল। ওই মুহূর্তে আরও নিচের ঢাল থেকে ভেসে আসা একটা চিৎকার ওদের বাধা দিল।
সেই প্রবীন লোকের কণ্ঠস্বর, তাইতার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেছে ইম্বালি। ওদের পথ দেখাতে উলু ধ্বনি করল সে।
অচিরেই দৃষ্টিসীমায় এলো তাইতা ও ফেন। খুব কাছে থেকে ওদের অনুসরণ করছে মেরেনকে খাটিয়ায় বয়ে আনা দলটা।
কালুলু, তুমি মারাত্মক আহত হয়েছ, আস্তে করে বলল তাইতা।
উঁহু, ম্যাগাস, আহত নই, যন্ত্রণাদায়কভাবে মাথা নাড়ল কালুলু। মনে হচ্ছে মরে গেছি।
জলদি শিবিরে নিয়ে চলো ওকে! ইদালি ও তার তিন জীবিত সঙ্গীকে বলল তাইতা। আর তোমরা পুরুষরা! মেরেনের খাটিয়া অনুসরণকারী চারজনকে বেছে নিল ও। এখানে তোমাদের সাহায্য লাগবে!
দাঁড়ান! তাইতার হাত জাপ্টে ধরে ওকে ঠেকাতে চাইল কালুলু। বাসমার কাজ এটা, বাসমারাদের প্রধান সর্দার।
সে তোমাকে হামলা করতে গেল কেন? নিশ্চয়ই ওর শিষ্য ছিলে তুমি?
বাসমার ধারণা আপনারা মন্দির নির্মাণকারী গোত্রের লোক, এখানে এসেছেন আরও বিপর্যয় আর দুর্যোগ ঘটাতে। তার ধারণা আমি আপনাদের সাথে যোগ দিয়েছি দেশ, নদী, হ্রদ ধ্বংস আর বাসমারাদের শেষ করার জন্যে।
এখন চলে গেছে সে। তোমার মেয়েরা ওকে হটিয়ে দিয়েছে, ওকে শান্ত ও আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেল তাই।
কিছুই মানতে চাইল না কালুলু। সে ফিরে আসবে, হাত বাড়িয়ে তাইতার কব্জি আঁকড়ে ধরল ও। খাটিয়ার উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। শহরে গিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে আপনাকে। বাহিনী নিয়ে ফিরে আসবে বাসমা।
তামাফুপা ছেড়ে যাবার সময় তোমাকে নিয়ে যাব আমি, কালুলু। তোমার সাহায্য ছাড়া আমাদের ডাইনীর অনুসন্ধান শেষ হবে না।
আমার পেটের গভীরে রক্ত ক্ষরণ টের পাচ্ছি। আপনার সাথে যাওয়া হবে না আমার।
সূর্যাস্তের আগেই মারা গেল কালুলু। তামাফুপার সীমানার ঠিক বাইরে একটা বিরাট পরিত্যক্ত পিপড়ার ঢিবির একপাশে একটা কবর খুঁড়ল ওর চার দেহরক্ষী। এক টুকরো অপরিষ্কার লিননের কাপড়ে লাশে কাফন পরাল তাইতা, তারপর সঁতসেঁতে কাদার সুড়ঙে নামিয়ে দিল ওটা। বড় বড় পাথরে টুকরো দিয়ে ঢেকে দিল যাতে হায়েনার দল খুঁড়ে লাশ বের করে আনতে না পারে।
তোমার পূর্ব পূরুষের দেবতারা তোমাকে স্বাগত জানাবেন, শামান কালুলু, তুমি ছিলে সত্যের পক্ষে, বিদায় জানাল তাইতা।
কবর থেকে সরে আসার পর চার দেহরক্ষী ওর সামনে এসে দাঁড়াল। শিলুক ভাষায় সবার হয়ে কথা বলল ইম্বালি। আমাদের মনিব চলে গেছেন। দেশ থেকে অনেক দূরে একা পড়ে গেছি আমরা। আপনি একজন শক্তিমান শামান, কালুলুর চেয়েও মহান। আমরা আপনাকে অনুসরণ করব।
নাকোন্তোর দিকে তাকাল তাইতা। এই মেয়েদের সম্পর্কে কী ধারণা তোমার? ওদের সাথে নিলে তোমার অধীনে গ্রহণ করবে? জিজ্ঞেস করল ও।
গম্ভীরভাবে প্রশ্নটা উল্টেপাল্টে দেখল নাকোন্তো। ওদের লড়তে দেখেছি। ওদের সাথে পেলে খুশিই হবো।
মাথাটাকে আঁকাল ভঙ্গিতে কাত করে ওর উপস্থিতি ও কথাগুলো মেনে নিল ইম্বালি। যতদিন আমাদের মনে চাইবে ততদিন আমরা এই তোতলা শিলুক মরদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাব, কিন্তু পেছনে কখনও নয়, তাইতাকে বলল সে।
নাকোন্তার সাথে প্রায় চোখে চোখ রেখে তাকাল ইম্বালি। স্পষ্ট ভসনার দৃষ্টিতে পারস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল অসাধারণ জুটিটা। অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা, ওদের আভায় পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রতিফলিত হতে দেখে মৃদু হাসল। ঠিকাছে, নাকোন্তো? জিজ্ঞেস করল ও।
ঠিকাছে, আবার সম্মতিসূচক বেপরোয়া একটা ভঙ্গি করল নাকোন্তো। আপাতত।
*
ফেন ও শিলুক শিবির-অনুসারীরা মেরেনের জন্যে বড়সড় একটা কুঁড়ে ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর উক্ত আগুনে তাইতার কিছু বিশেষ ভেষজ লতা পোড়াল ফেন। সুবাসিত ধোয়ায় কুঁড়েটাকে আবাস করে নেওয়া পোকামাকড় আর মাকড়শা তাড়াল। টাটকা ঘাসের একটা তক্তপোষ বানাল ওরা, তারপর মেরেনের মাদুর বিছিয়ে দিল ওটার উপর। ব্যথায় এমন কাতড়াচ্ছে সে, ফেনের বাড়িয়ে ধরা বাটি থেকে খাবার জন্যে মাথা পর্যন্ত তুলতে পারছে না। মেরেন ফের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার মতো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চার ডিভিশনের দায়িত্ব নিতে হিলতো-বার-হিলতোকে পদোন্নতি দিল তাইতা।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যাচাই করতে গোটা শহর জরিপ করল তাইতা ও হিলতো। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই ছিল ওদের প্রথম চিন্তা। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটা গভীর কূপ রয়েছে। কূপের সাথে একটা সংকীর্ণ মাটির সিঁড়ি নেমে গেছে পানির দিকে। পানি বেশ ভালো। শোফারের অধীনে একটা দলকে বাসমারাদের আক্রমণের প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সমস্ত লাউ আর চামড়ার পানির পাত্র ভর্তি রাখার নির্দেশ দিল তাইতা। লড়াইয়ের প্রচণ্ডতার ভেতর তৃষ্ণার্ত মানুষ কুপ থেকে পানি তোলার সুযোগই পাবে না।
তাইতার পরের ভাবনার বিষয় ছিল বাইরের দেয়ালের অবস্থা। ওটাকে এখনও মেরামতযোগ্য একটা পর্যায়ে অবিষ্কার করেছে ওরা-ঘুনে খুঁটি খেয়ে নেওয়া বিশেষ কয়েকটা জায়গা ছাড়া। এটা অবশ্য অবিলম্বে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এত বিশাল এলাকা পাহারা দিয়ে রাখতে পারবে না ওরা। তামাফুপা বিরাট শহর, এক সময় বিরাট একটা গোত্রের আবাস ছিল। দেয়ালটা পরিধির দিক থেকে প্রায় আধা লীগের মতো। এটা ছোট করে আনতে হবে আমাদের, হিলতোকে বলেছে তাইতা। তারপর শহরটা পুড়িয়ে প্রবেশপথগুলো পরিষ্কার করে তীরন্দাজদের পুরো এলাকা আয়ত্তে আনতে সাহায্য করতে হবে।
আমাদের কঠিন দায়িত্ব দিয়েছেন, ম্যাগাস, মন্তব্য করল হিলতো। জলদি কাজে নেমে পড়া দরকার।
তাইতা নতুন সীমানা ঠিক করার পর নারী-পুরুষ কাজে লেগে গেল। এখনও সবচেয়ে মজবুত খুঁটিগুলো তুলে তাইতার জরিপ করা নতুন সীমানা রেখা বরাবর পুঁতল। স্থায়ী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার মতো সময় নেই বলে ফোকরগুলো কিতার কাঁটা ঝোঁপ দিয়ে ভরে ফেলল ওরা। নতুন সীমানার চার কোণে চারটা উঁচু প্রহরাবানাল ওরা, উপত্যকার উপর দিয়ে চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ভালোভাবে দেখা যাবে এখান থেকে।
সীমানা বরাবর বনফায়ারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিল তাইতা। জ্বালানোর পর রাতের বেলায় বেলায় সীমানা প্রাচীর আলোকিত রাখবে ওগুলো। কাজটা শেষ হলে দেয়াল ঘিরে একটা অন্তস্থ প্রাচীর গড়ে তুলল ও, বাসমারারা শহরে ঢুকে পড়লে এটাই হবে ওদের শেষ প্রতিরক্ষা। এই অন্তস্থ ঘাঁটির ভেতর ধুরার অবশিষ্ট ব্যাগ, বাড়তি অস্ত্র-শস্ত্র আর অন্যান্য মূল্যবান রসদ তুলে রাখল ও। অবশিষ্ট ঘোড়াগুলোর জন্যে একটা আস্তাবল বানাল ওরা। উইন্ডস্মোক ও ওটার বাচ্চা এখনও ভালো অবস্থায় আছে, কিন্তু বাকিগুলো অনেকেই দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার ধকল সইতে গিয়ে হয় অসুস্থ বা মরতে বসেছে।
রোজ সন্ধ্যায় মেরেনকে খাইয়ে, ওর ডান চোখের শূন্য কোটরে ব্যান্ডেজ বাঁধতে তাইতাকে সাহায্য করার পর ওয়ার্লউইন্ডের কাছে চলে আসে ফেন, ওর পছন্দের ধুরা পিঠা খাওয়ায়।
নতুন সীমানার প্রাচীরের বাইরে পড়ে যাওয়া পুরোনো শহরের বাকি অংশে আগুন ধরাতে অনুকূল বাতাসের অপেক্ষা করছে তাই। ছাউনি এবং কাঠের দেয়ালে শুকিয়ে খটখটে হয়েছিল, দ্রুত পুড়তে লাগল সেগুলো, বাতাসের ধাক্কায় নতুন দেয়ালের দিক থেকে দূরে ভেসে গেল অগ্নিশিখা। সেদিন রাত নেমে আসতে আসতে পুরোনো শহর জ্বলন্ত ছাইয়ের মাঠে পরিণত হলো।
এবার ভোলা মাঠের উপর দিয়ে আক্রমণ করতে আসুক বাসমারার দল, সন্তোষের সাথে বলল হিলতো, ব্যটাদের হকচকিয়ে দেব।
এবার সীমনার সামনে মার্কার বসাতে পারো, ওকে বলল তাইতা। বিশ, পঞ্চাশ ও এক শো কদম দূরে দুরে নদীর শাদা পাথর এনে স্তূপ করল ওরা, যাতে তীরন্দাজরা প্রতিপক্ষ হানাদারদের ঠিকমতো নিশানা করতে পারে।
তীর বানাতে নদীর তলদেশ থেকে শুকনো আগাছা কেটে আনতে ইদালি ও তার সঙ্গীদের পাঠাল তাইতা। কেবুই দুগের অস্ত্রাগার থেকে অতিরিক্ত তীরের ফলা নিয়ে এসেছে ও। সেগুলো কাজে লাগানোর সময় দেয়ালের নিচে পাহাড়ের ধারে একটা পাথরের উঁচু হয়ে থাকা অংশ দেখতে পেল। পাথরের টুকরো কেটে বর্শার ফলায় রূপান্তরিত করার কায়দা মেয়েদের শিখিয়ে দিয়েছে ও। দ্রুত শিখে নিয়েছে। ওরা। বাকলের রশি দিয়ে আগাছার দণ্ডে বেঁধে নিয়েছে ফলাগুলো। কঠিন ও শক্ত করে তুলতে পানিতে ভিজিয়ে নিয়েছে। দেয়ালের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ঠেস দিয়ে রেখে দিয়েছে বাড়তি তীরগুলো।
দশ দিনের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ হলো। পুরুষ ও ইম্বালির মেয়েরা অস্ত্রশস্ত্র শানিয়ে নিল; সম্ভবত শেষ বারের মতো সাজসরঞ্জাম পরখ করে নিল।
একদিন বিকেলে লোকেরা যখন রাতের খাবার খেতে আগুনের পাশে জড়ো হয়েছে, হঠাৎ করে একটা বেমানান জোড়া আগুনের আলোয় এসে হাজির হতেই আকিস্মিক আলোড়ন আর হুল্লোড় লেগে গেল। টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে আছে মেরেন, কিন্তু ফেনের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সামলে তাইতা ক্যাপ্টেনদের নিয়ে যেখানে বসেছিল সেখানে এলো। সবাই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ওকে ঘিরে হাসি ঠাট্টা, আলিঙ্গন করতে লাগল। দ্রুত সেরে ওঠায় অভিনন্দন জানাল। ওর শূন্য কোটর ঢেকে রেখেছে একটা লিনেনের ব্যান্ডেজ। আগের চেয়ে মলিন ও শীর্ণ দেখাচ্ছে ওকে। তবে পুরোনো দৃঢ়তার সাথে হাটার প্রয়াস পাচ্ছে ও। সমান শক্তিতে অফিসারদের আক্রমণ ঠেকাচ্ছে। অবশেষে তাইতার সামনে এসে দাঁড়াল ও। ওকে স্যালুট করল।
হো, মেরেন, বিছানায় শুয়ে শিবিরের সব মেয়ের সেবা পেতে পেতে ক্লান্ত? হাসি মুখে কথা বলেছে তাইতা, কিন্তু ফেনের কমনীয় কাঁধে কঠিন যোদ্ধার হাত দেখে অনুভূত ঈর্ষার খোঁচাটা আড়াল করতে কষ্ট হলো ওর। ওর জানা আছে শরীর আর সৌন্দর্য আরও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার সাথে সাথে এই ঈর্ষা আরও বেড়ে উঠবে। ওর অন্য জীবনেও এমনি ক্ষতিকর আবেগের মোকাবিলা করেছে ও।
*
পরদিন সকালে তীরন্দাজদের সাথে অনুশীলনের টিলায় ছিল মেরেন। প্রথম প্রথম একটা মাত্র চোখ দিয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, কিন্ত ভয়ানক মনোসংযোগের সাহায্যে অবাধ্য ইন্দ্রিয়কে বাগে এনে নতুন করে সেগুলোকে দীক্ষা দিল ও। এরপরে সমস্যা হলো লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব আন্দাজ করা ও নিশানার উপর স্থির থাকা। ওর তীর হয় লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছানোর আগেই মাটিতে লুটাচ্ছে বা অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। গম্ভীর চেহারায় কাজ চালিয়ে গেল ও। রানি লস্ত্রিসের সেনাবাহিনীতে সকল সেনাদলের ভেতর সেরা তীরন্দাজ ছিল তাইতা, ওকে সবক দিতে লাগল সে, প্রথম তীরটাকে একটা মার্কার হিসাবে ছুঁড়ে ওটাকে দ্বিতীয় তীরের লক্ষ্য স্থির করার কাজে ব্যবহার করতে শেখাল। ঠিক পরপরই সেটা ছুঁড়ে দিল সে। অচিরেই প্রথমটা শূন্যে থাকতেই দ্বিতীয় তীর ছুঁড়তে সক্ষম হয়ে উঠল মেরেন। বিশ্রী কোটরটা ঢাকতে চামড়ার একটা পট্টি বানিয়ে দিল ফেন ও ওর শিলুক স্ত্রী। ওর ত্বক স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান রঙ ফিরে পেল, অবশিষ্ট চোখ তার পুরোনো ঝিলিক।
রোজ সাকলে অশ্বারোহী টহল দল পাঠায় তাইতা, কিন্তু রোজই বাসমারা বাহিনীর কোনও আলামত না দেখার খবর নিয়েই ফিরে আসে ওরা। ইম্বালি আর ওর অন্য মেয়েদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে পরামর্শ করল তাইতা।
সর্দার বাসমাকে ভালো করে চিনি আমরা। প্রতিশোধ পরায়ণ, নিষ্ঠুর মানুষ, বলল ইম্বালি। আমাদের কথা ভোলেনি সে। বিশাল রীফের উপত্যকায় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে ওর বাহিনী-নদীর গোর্জ আর হ্রদের জলাভূমিতে। ওদের জড়ো করতে সময় লাগবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আসবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারি আমরা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাইতার হাতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। কাদামাটির পিণ্ড আর ঘাস দিয়ে লম্বা খুঁটির মাথায় মানুষের নকল মাথা বানানোর কায়দা শিখিয়ে দিয়েছে মেয়েদের। দূর থেকে দেখে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়া পর্যন্ত এসবে প্রাকৃতিক রঙ লাগিয়েছে ওরা। তীর বানানোর চেয়ে একাজটা বেশি ভালো লাগল ওদের। অবশ্য, অপেক্ষার ফলে ওদের স্নায়ুর উপর ভালো চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
এখান থেকে কিয়োগার দূরত্বের কথা ভাবলেও এতদিনে ওদের আবার ফিরে আসার কথা, মেরেনকে বলল তাইতা, ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিল ওরা। কাল আমি আর তুমি এলাকা রেকি করতে বেরুব একবার।
আমিও যাব তোমাদের সাথে, বলে উঠল ফেন।
সেটা সময় হলে দেখা যাবে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল তাইতা।
ধন্যবাদ, প্রিয় তাইতা, বলল ফেন, মিষ্টি, উজ্জ্বল চেহারায় হাসল।
আমি তা বোঝাইনি, জবাব দিল তাইতা, কিন্তু ওরা দুজনই জানে তাই বুঝিয়েছে।
বাচ্চাটা সীমাহীন আকর্ষণীয়। ওর উপস্থিতিতে খুশি হয়ে ওঠে তাই। মেয়েটা ওর আপন সত্তার একটা বর্ধিত অংশ হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
টহল পার্টি যখন রওয়ানা হলো, তাইতা ও মেরেনের মাঝখানে রইল ফেন। নাকোন্তো ও ইদালি চিহ্ন পড়ার জন্যে ট্র্যাকার হিসাবে ওদের সামনে রইল। দীর্ঘ পায়ের কল্যাণে ইদালি অনেক লম্বা পথে নাকোন্তোর সাথে পাল্লা দিতে পারে। হাবারি আর দুই সৈনিক রয়েছে পেছনে। একবারের জন্যে খাপে ওর কোমরে ঝোলানো খাপে ভরা তলোয়ার বহন করছে তাইতা, তবে ছড়িটা রয়েছে ওর হাতে।
পাহাড়ের চূড়া বরাবর আগে বাড়ল ওরা। এখান থেকে উপত্যকার পূর্ণ বিস্তারের দিকে নজর চালাতে পারছে। বামে তরঙ্গ তুলে চলে গেছে এলাকাটা, ঘন বনে ছাওয়া। রিজের নিচে হাতির বিরাট পাল চরে বেড়াতে দেখল ওরা। ওদের বিশাল ধূসর শরীর সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে। ওদের অসীম শক্তির ফলে খানিক পর পরই বড় আকারের ফল ধরা গাছ উপড়ে পড়ার শব্দ হচ্ছে। কোনও গাছ একটা জানোয়ারের পক্ষে বেশি মজবুত হলে অন্য মদ্দাগুলো এগিয়ে আসছে তাকে সাহায্য করতে। ওদের সম্মিলিত শক্তির সামনে টিকে থাকতে পারছে না কোনও গাছই।
গোত্রের লোকজন এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় হাতির দল আর অত্যাচারের মুখে পড়েনি, মানুষের অনেক কাছাকাছি এসে পড়া সত্ত্বেও সতর্ক হলো না ওরা। ওদের প্রথম আবির্ভাবে পালিয়ে যাওয়ার বদলে বরং ঘোড়সওয়াররা পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় অটল দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে হয়তো একটা বদমেজাজি মাদী হাতি ভীতিকর প্রদর্শনীতে মেতে উঠছে, কিন্তু কোনওটাই আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো না। বাচ্চা হাতির কাজ কারবার দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ফেন। শক্তিশালী পশু ও সেগুলোর স্বভাব-অভ্যাস নিয়ে নানা প্রশ্নে পাগল করে তুলল ওকে।
বুনো জানোয়ার হিসাবে কেবল হাতিরই দেখা পেল না ওরা। অ্যান্টিলোপের পাল, খোলা প্রান্তরে জটলা বাধা বা অপেক্ষাকৃত লম্বা গাছের মগডালে উঠে বসে থাকা হলদে বেবুনও রয়েছে। একটা দল আতঙ্কে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। মা বেবুনগুলো সটকে পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে খপ করে তুলে পেটের নিচে ঝুলিয়ে নিল। পেছনে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুলল বিশাল মদ্দাগুলো। কেশর দোলাচ্ছে, মুখে হিংস্র গর্জন ছাড়ছে।
কী হয়েছে ওদের? জানতে চাইল ফেন।
চিতা বা অন্য কোনও শিকারী পশু হবে। তাই কথা বলার সময়ই ঠিক সামনে এক চিলতে ঘেসো জমি থেকে একটা অসম্ভব সুন্দর হলদে-কালো বুটিদার বেড়াল বের হয়ে এলো। লেপার্ডের চিহ্নগুলো পটভূমির সাথে নিখুঁতভাবে মিশে গেছে।
আবার ঠিক বলেছ তুমি, তাইতা। দুনিয়ায় জানার মতো সবই তোমার জানা। সমীহের সাথে বলল ফেন।
ঢাল বেয়ে কোণাকুণিভাবে পরের পাহাড়সারির দিকে উঠতে শুরু করল ওরা, কিন্তু চূড়ায় পৌঁছার আগেই দিগন্তের কাছে যেব্রার একটা বিরাট পাল ধেয়ে গেল। ওদের খুরের ঘায়ে শুকনো মাটি আলগা হয়ে গেল, শূন্য আকাশের বুকে অনেক উপরে উঠে গেল ধুলোর মেঘ। ঘোড়াগুলোর দিকে তেমন একটা নজরই দিল না ওরা। মনে হয় ওদের কয়েক কদম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের জাতিভাই ধরে নিয়েছে।
নিশ্চয়ই কোনও কারণে ভয় পেয়েছে ওরা, বলল মেরেন।
আগুন নয়তো মানুষ, সায় দিয়ে বলল তাইতা। অন্য কোনও কারণে এমন স্ট্যাম্পিড সৃষ্টি হতে পারে না।
দাবানলের কোনও ধোয়া চোখে পড়ছে না, বলল মেরেন। মানুষই হবে। এবার সিরিয়াসভাবে আগে বাড়ল ওরা। হেঁটে দিগন্তে রেখার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আবার চিৎকার করে উঠল ফেন, বাম দিকে ইশারা করল। একটা বাচ্চা! একটা কালো বাচ্চা!
তিন চার বছরের একটা নগ্ন বাচ্চা। বাঁকা পায়ে ঢাল বেয়ে আনাড়ী পায়ে উঠে যাচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে দোল খাচ্ছে ওর ছোট্ট পেছনটা।
ওকে তুলে আনতে যাচ্ছি, বলে উঠল ফেন। ছোেটার জন্যে তাগিদ দিল ওয়ার্লউইন্ডকে। কিন্তু ওর লাগাম টেনে ধরল তাই।
ফেন, পাকা টোপ মনে হচ্ছে।
ওকে আমরা চলে যেতে দিতে পারি না, প্রতিবাদ করল ফেন। বাচ্চাটা দিগন্ত রেখার ওপারে উধাও হয়ে গেল। ও হারিয়ে গেছে। একা পড়ে গেছে।
আমরা ওকে অনুসরণ করব, সায় দিল তাইতা। তবে সাবধানে। ওয়ার্লউইভের লাগাম ছাড়ল না ও, এগিয়ে চলল ওরা। রিজের এক শো কদম নিচে এলো ও।
চলো, মেরেন! নির্দেশ দিল ও। জিন থেকে নেমে এলো ওরা, ফেনের হাতে লাগাম তুলে দিল।
এখানে থাকো, ঘোড়াগুলোকে সামলে রাখো, তবে জোরসে ছোটার জন্যে তৈরি থেকো, ওকে বলল তাইতা। পায়ে হেঁটে আগে বাড়ল মেরেন আর ও। পাহাড়ের দূরের ঢালের উপর দিয়ে তাকানোর সময় মাথা উঁচু করতে একটা ছোট ঝোঁপ কাজে লাগাল ওরা। ঠিক ওদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, গোলাকার চেহারায় আমোদিত হাসি নিয়ে ওদের মুখোমুখি। দুই হাতে ছোট্ট শিশ্ন ধরে রেখেছে, রোদে পোড়া বালির উপর হলদে ধারায় পেশাব করছে। চমৎকার একটা দৃশ্য, মুহূর্তের জন্যে মুগ্ধ করে রাখল সবাইকে। সহানুভূতির সাথে হাসতে যাচ্ছিল মেরেন, কিন্তু ওর বাহু আঁকড়ে ধরল তাইতা।পেছনে দেখ!
আরও এক মুহূর্ত বেশি সময় তাকিয়ে রইল ওরা, তারপর প্রতিক্রিয়া দেখাল মেরেন। বাসমারা শয়তান বলে উঠল ও। পিচ্চিটা একটা টোপ ছিল।
ছেলেটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বড় জোর পঞ্চাশ কদম দূরে নিবিড় ঢঙে বসে আছে ওদের সারিগুলো। কাঠের মুগুর, লম্বা বর্শা আর তীক্ষ্ণ পাথরের ডগা লাগানো ছোট ঘাই মারার আসেগেইতে সশস্ত্র। পিঠের ওপর ঝোলানো র-হাইড বর্ম, যুদ্ধের মুখোশের মতো একটা ভাব তৈরি করতে ওদের চেহারা রঙিন কাদায় লেপা। মাথায় পশম আর পালকের শিরস্ত্রান, হাতির দাঁতের পিন নাক আর কানের লতি ফুটো করেছে। হাতির দাঁত আর উটপাখির খোলের
অন্যদিকে ব্রেসলেট আর অ্যাঙ্কলেট হাত পা অলঙ্কৃত করেছে।
তাইতা ও মেরেন ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ই বিরক্ত করা মৌচাকের গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এলো নিবিড়ভাবে বসে থাকা দলটার ভেতর থেকে। একক সমন্বিত ঢঙে যুদ্ধের বর্ম আলগা করল ওরা, বর্শা দিয়ে তাল ঠুকতে লাগল ওগুলোর ওপর। তারপর যুদ্ধ সঙ্গীতে ফেটে পড়ল ওরা। গভীর সুরেলা কণ্ঠস্বর ক্রমে চড়তে লাগল, ঢাকের আওয়াজের সাথে বাড়ছে। অ্যান্টিলোপের শিঙ্গার আওয়াজে ছিন্ন হলো সেই আওয়াজ। এটা ছিল সৈন্যদের প্রতি উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত। একসাথে দল বেধে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা।
ঘোড়ার কাছে ফিরে চলো, বলল তাইতা।
ওদের আসতে দেখল ফেন, উইন্ডস্মোক আর মেরেনের ঘোড়াসহ দ্রুত ছুটে এলো ওদের সাথে যোগ দিতে। ঝটপট জিনে উঠে বসল ওরা, বাসমারা যোদ্ধারা ওদের পেছনে চূড়া পেরিয়ে ধেয়ে আসতে শুরু করতেই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল। হানারি আর টহলদারদের সদস্যরা যেখানে অপেক্ষা করছিলে ছুটে চলল সেদিকে।
ওরা আগেই আমাদের ঠেকাতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে, বলে উঠল ফেন, কাবের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বনের দিকে ইঙ্গিত করল ও। এবার গাছপালার ন, বিভিন্ন অবয়ব আলাদা করতে পারল ওরা, ওদের ঘেরাও করতে তেড়ে আসছে।
আমার রেকাবের রশি ধরো! নাকোন্তোর উদ্দেশে চিৎকার করে বলল তাইতা। লুপ থেকে ঝাঁকি মেরে বাম পা বের করে নিতেই নাকোন্তো আঁকড়ে ধরল সেটা।
মেরেন, তোমার অন্ধ দিক কাভার করতে ইম্বালিকে তুলে নাও। বাঁক নিল মেরেন, ডান পাশের লুপটা কেড়ে নিল ইম্বালি। ঘোড়া টেনে নিয়ে চলল ওকে আর নাকোন্তোকে। মাটিতে পিছলে যাচ্ছে ওদের পা।
জোরসে চলো! চিৎকার করে বলল তাইতা। ওরা ঘিরে ফেলার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। বাসমারাদের ভেতর ক্ষিপ্র সওয়ারিরা অন্য সঙ্গীদের চেয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। ফেন, মেরেন আর আমার মাঝখানে থাকো। আমাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ো না।
ছুটন্ত বাসমারাদের চারজন ওদের একেবারে সামনে এসে পড়ল, তাইতা যে ফোকরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটাকেই রুদ্ধ করে দিতে যাচ্ছে। আগুয়ান সওয়ারিদের মুখোমুখি হতে ঘুরে দাঁড়াল ওরা। লম্বা বর্শা পিঠে ঝোলানো থাকায় অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে হাত মুক্ত। ওদের ক্ষুদে বাঁকানো ক্যাভালরি তীর পাশ কাটিয়ে গেল তাইতা আর মেরেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে ছোঁড়ার জন্যে নকশা করা হয়েছে ওগুলোর। কাছে আসামাত্রই কাঁধের উপর থেকে ছুঁড়েছে। লাগাম বাহনের কাঁধের উপর ফেলে পা আর হাঁটুর চাপে ঘোড়াকে আগে বাড়িয়ে সোজা বর্শাধারীদের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। একজন অশ্বারোহী বর্শা ছুঁড়ে মারল। মেরেনকে লক্ষ্য করেছিল সে, কিন্তু অনেক লম্বা পাল্লা থাকায় প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো সময় পেল মেরেন। পায়ের আঙুলের স্পর্শে বে-টাকে ঘুরিয়ে নিল ও, ওর বাম কাঁধের উপর দিয়ে উড়ে গেল বর্শাটা। নিজের ধনুক তুলে নিয়ে পরপর দ্রুত তীর ছুঁড়ল ও। একটা লোকটার মাথার প্রায় এক হাত উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল-আরও পঞ্চাশ কদম সামনে-এমনি অল্প দূরত্বে তীরটা দরুণ শক্তিশালী। কিন্তু দ্বিতীয় তীরটা ঠিক বুকের মাঝখানে গিয়ে আঘাত করল বাসমারার, শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেল। রক্তের ফোয়ারা তুলে দুই কাঁধের হাড়ের মাঝখান দিয়ে বের হয়ে এলো ওটা। জমিন স্পর্শ করার আগেই অক্কা পেল সে।
ওদিকে বর্শা ছোঁড়ার জন্যে হাত পেছনে নিয়ে গেছে ডান দিকের দ্বিতীয় অশ্বারোহী। এই লোকও মেরেনের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করছিল। মেরেনের অন্ধ এলাকায় রয়েছে সে। ওকে দেখতে না পাওয়ায় আত্মরক্ষার প্রয়াসই পেল না মেরেন। রেকাবের রশিতে ভর দিয়ে বাইরে ঝুঁকে পড়ল ইম্বালি, ছুঁড়ে মারল ওর কুড়োল, বাতাসে পাক খেয়ে উড়ে গেল ওটা। পেছনের পায়ের উপর ছিল বাসমারার শরীরে ভর-বর্শা ছুঁড়ে মারার মুহূর্তে ছিল সে, পাশ কাটানো বা বাউলি কাটার উপায় ছিল না-কপালের ঠিক মাঝখানে লাগল কুড়োলটা, খুলির গভীরে বসে গেল। পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যওয়ার সময় ওটা উদ্ধার করতে ঝুঁকে পড়ল ইম্বালি। তৃতীয় বর্শাধারীকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল তাইতা। ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিল সে হাতের অস্ত্র, ফেলে দিল সেটা, পেট থেকে তীর বের করে আনার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গভীরে বসে গেছে ফলাটা।
চতুর্থ ও শেষ যোদ্ধা অটল রইল। বর্শা ছুঁড়ে মারার জন্যে তৈরি সে। ডান কাঁধের উপর রাখা তার বর্শার হাতল। যুদ্ধের উন্মত্ততায় লাল হয়ে আছে তার চোখজোড়া। তাইতা লক্ষ করল ফেনের দিকে দৃষ্টি তার। ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে বসা ফেন চমৎকার লক্ষ্যবস্তু। ভারি বর্শাটা ওর দিকে ছুঁড়ে মারার কসরত করতে গিয়ে মুখ বাকাল বাসমারা।
তুন থেকে আরেকটা তীর বের করে আনল তাইতা। মাথা নিচু করো, ফেন, হুকুম দিল ও কণ্ঠের শক্তি দিয়ে। মিশে যাও! সামনে ঝুঁকে পড়ে ওয়ার্লউইন্ডের পিঠের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিল ফেন। ধনুকটা উঁচু করল তাইতা, ছিলাটা ওর নাক আর কান স্পর্শ না করা পর্যন্ত টানটান করে ধরে রাখল, তারপর ছেড়ে দিল তীরটা। ইতিমধ্যে তীর ছোঁড়ার ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে পেড়েছে বর্শাধারী, কিন্তু তাইতার পাথরের তীরের ফলা তার গলার গোড়ার ফোকরে গিয়ে বিধল, নিমেষে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিল তার। অবশ্য, বর্শাটা আগেই তার মুঠো থেকে বেরিয়ে এসেছে। অসহায়ের মতো চেয়ে রইল তাইতা। ফেনের দিকে ধেয়ে আসছে ওটা। মুখ নিচে করে রাখায় দেখতে পায়নি ও। কিন্তু ওয়ার্লউইন্ড দেখতে পেয়েছে। ওটা তার নাকের উপর দিয়ে পিছলে যাবার সময় ভয়ানকভাবে একপাশে সরে গেল। মাথা উঁচু করে ফেলায় মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়ালে চলে গেল বর্শাটা। মনে মনে ভাবল ওটা ফেনকে লাগেনি, স্বস্তির একটা ধাক্কা বোধ করল। কিন্তু তারপরই যন্ত্রণা আর বিস্ময়ের কান্নার শব্দ কানে এলো। কোল্টের পিঠে কুঁকড়ে যেতে দেখল ওকে।
ব্যথা পেয়েছ? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল তাইতা। কিন্তু ফেন জবাব দিল না। তারপর ওয়ার্লউইন্ডের শরীরের পাশে বর্শাটা ঝুলে থাকতে দেখল ও। ওর পেছনে মাটিতে ঘেঁষটাতে ঘেঁষটাতে আসছে।
কোল্টের পেছনে উইন্ডস্মোককে ঘুরিয়ে নিল তাইতা, সাথে সাথে দেখল বর্শার মাথা ফেনের নগ্ন উরুতে গেঁথে আছে। লাগাম ছেড়ে দুই হাতে কোল্টের ঘাড় ধরে রেখেছে ও। ওর দিকে ফিরল সে। তাই দেখল মেয়েটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ওর দিকে তাকানোর সময় মনে হচ্ছে ওর চোখজোড়া চেহারার অর্ধেকটা ভরে রেখেছে। জমিনের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাবার সময় বর্শার বাটটা ধাক্কা দিচ্ছে, ঠেলা মারছে। ফলাটার তীক্ষ্ণ ধার ওর মাংসের ভেতর নিষ্ঠুরভাবে কাজ করে চলেছে, বুঝতে পারল তাইতা, ক্ষতস্থানটাকে আরও বড় ও বিপজ্জনক করে তুলছে। ফেমেরাল আর্টারির খুব কাছেই বিঁধেছে ওটা। সবুজ রক্তবাহী ধমনী ছিঁড়ে ফেললে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যাবে ও।
শক্ত করে এঁটে থাকো, প্রিয়া আমার, ডেকে বলল ও। কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকাল একবার। একদল বাসমারাকে ওদের পিছে ধেয়ে আসতে দেখল। বনের ভেতর দিয়ে সবেগে ধেয়ে আসার সময় হাঁক ছাড়ছে। থামা চলবে না। থামলে নিমেষে আমাদের উপর চড়াও হবে ওরা। তোমাকে নিতে আসছি আমি।
তলোয়ার বের করে কোল্টের পাশে চলে এলো তাই। হিসাব করে আঘাত হানল। মনে হচ্ছে মেয়েটার এমনি যন্ত্রণাকতর চেহারা দেখার পর অনেক আগে হারিয়ে গেছে বলে ভেবেছিল যে শক্তি তা ফের ফিরে এসেছে। দোল খাওয়া বর্শার দিকে সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ বরল ও। ভারি ব্রোঞ্জের ফলাটা ঘোরানোর সময় শক্তির একটা মন্ত্র উচ্চারণ করল ও। কিদাশ!
ওর হাতের মুঠোয় অস্ত্রটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে মনে হলো। নিখুঁত ভারসাম্যের ফলার উপর একটা বিন্দু থাকে, যেখানে আঘাতের সম্পূর্ণ ভর ও শক্তি কেন্দ্রিভূত। ফলার শ্যাংকটাকে চামড়ার বাঁধনের ঠিক এক আঙুল উপরে শক্ত কাঠের বাটটাকে ধরেছে সেখান দিয়ে ছিন্ন করল যেন ওটা একটা সবুজ ডাল। বাটটা পড়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে ফেনের মুখে স্বস্তির ছাপ দেখতে পেল ও।
তোমাকে নিতে আসছি আমি, ওকে বলল তাইতা, আবার খাপে ভরল ফলাটা। তৈরি থেকো। উইন্ডস্মোককে ওর কোল্টের পাশে নিয়ে এলো ও। আস্থার সাথে ওর দিকে হাত মেলে দিল ফেন। হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল তাইতা, ফাঁকা জায়গার উপর দিয়ে তুলে নিয়ে এলো। ওকে উহন্ডস্মোকের পিঠে একপাশে করে জিনের উপর বসিয়ে দিতেই গলা জড়িয়ে ধরল ফেন।
কী যে ভয় পেয়েছিলাম, তাইতা, ফিসফিস করে বলল ও, তুমি আসার আগ পর্যন্ত। এখন জানি আর কোনও সমস্যা নেই।
শক্ত করে ধরে রাখো, বলল তাইতা। নইলে সব কেঁচে যাবে। দাঁত দিয়ে ফেনের টিউনিকের হেম থেকে এক টুকরো লিনেন ছিঁড়ে নিল ও, ওর বর্শার ভাঙা অংশ ক্ষতস্থানে চেপে ধরে লিনেন দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। এখন অনেক সুন্দর আর পরিষ্কার হয়েছে, বলল ও। তবে আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মেয়ে তুমি। আমরা তামাফুপায় যা নওয়া পর্যন্ত ওটা শক্ত করে আঁকড়ে থাকবে।
পিছু ধাওয়ারত বাসমারা পিছিয়ে গেল। গাছপালার ভেতরে অচিরেই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল ওরা। লাগাম টেনে ঘোড়াগুলোকে দুলকি চালে হাঁকাতে পারল ওরা। তারপরেও দিগন্তের ওপাশে সূর্য ডুব দেওয়ার আগই তামাফুপার তোরণ পার হয়ে এলো।
ফাঁড়ি সশস্ত্র অবস্থায় রাখো মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। এক ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ফের চড়াও হবে শয়তানগুলো। উইন্ডম্মেকের পিঠ থেকে ফেনকে নামাল ও। ওদের কুঁড়েয় নিয়ে এলো। আস্তে করে শুইয়ে দিল মাদুরে।