১৮.
একজন একজন করে ওদের বনের কোণায় দেখতে পেলাম, আনুমানিক হিসেবে বেশ কয়েক মিটার দূরে। প্রথম লোকটা সামনের দিকে লাফিয়ে উঠলো কিন্তু পড়ে যাওয়ায় পেছনের জন সামনের লোকটার স্থান দখলের চেষ্টা করলো। লোকটা খানিকটা দীর্ঘদেহী ঘন কালো চুল। তৃতীয়জন মহিলা এই দূর থেকেও তাকে বেশ ভালোভাবে দেখতে পেলাম-মহিলার চুল লালচে ধরনের।
ওরা বেশ ভদ্রভাবে এ্যাডওয়ার্ডের পরিবারের সদস্যদের কাছে এগিয়ে এলো। তাদের মতোই আরেক পরিবারকে দেখতে পেয়ে স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত ভদ্র আচরণ করার চেষ্টা করলো ওরা।
ওরা এগিয়ে আসার পর বুঝতে পারলাম কুলিন পরিবারের সাথে ওদের কতোই না পার্থক্য। ওদের হাঁটার ধরন অনেকটাই বেড়ালের মতো। চলার ভঙ্গিতে এক ধরনের ভীত সন্ত্রস্তভাব। তাছাড়া পোশাকেও যথেষ্ট পার্থক্য-অতি সাধারণ পোশাক; জিনিস এবং বোতাম খোলা ভারী পোশাক। ওয়েদার প্রুফ কাপড় দিয়ে এই জামা তৈরি করা হয়েছে। পোশাকের রঙগুলো অনেক আগেই চটে গেছে, ফলে বুঝার উপায় নেই, এর আসল রঙ কী রকম ছিলো। পোশাকের অবস্থা হয়তো মেনে নেয়া যায় কিন্তু এই তিন সদস্যের প্রত্যেকেরই খালি পা। পুরুষ দু’জনের চুল কোঁকড়ানো। তবে মহিলার চুল দূর্লভ কমলা রঙের। এই কমলা চুলে গাছের পাতা এবং ছাল বাকল জড়িয়ে আছে।
তীক্ষ্ণ চোখের এই তিন সদস্য কোনো রকমের ইতস্তত না করেই এমেট এবং জেসপারের দিকে এগিয়ে গেলেন পরিচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে জেসপারদের সামনে শুধু তারা দাঁড়িয়ে রইলেন, কোনো কথা বললেন না।
সামনের দাঁড়ানো ভদ্রলোক দেখতে নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর-চমৎকার জলপাই রঙের ত্বক, চকচকে কালো চুল। উচ্চতায় মাঝারি আকারের হলেও নিঃসন্দেহে সুগঠিত শরীর।
মহিলা একটু বুনো স্বভাবের ওর তাকানো মানুষগুলোর দিকে মহিলা ক্রমাগত চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। তার রুক্ষ চুলগুলো হালকা বাতাসেও এলোমেলোভাবে উড়ছে। দ্বিতীয় পুরুষটা অনেকটা যেন ওই দুজনের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারপরও নেতৃত্ব দেবার একটা ভঙ্গি লক্ষ করলাম। ওর হালকা বাদামি রঙের চুল এবং দৈহিক গড়ন আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো কিছু নেই-আর দশটা সাধারণ মানুষের সাথেই তাকে তুলনা করা চলে।
আর যাই হোক ওদের প্রত্যেকের চোখের ভেতর এক ধরনের স্বাতন্ত্রীকতা আছে। সোনালিও নয় কালোও নয়, আমি অবশ্য প্রথম দিকে ওরকমই মনে করেছিলাম। তবে গভীরভাবে নীরিক্ষা করলে দেখা যাবে ওদের চোখের রঙ একেবারে আলাদা রঙের। একে বারগেন্ডি রঙের চোখ বলা যেতে পারে-যা দেখলে একদিকে যেমন বিরক্তি লাগে, অন্যদিকে শরীরটা শিরশির করেও ওঠে।
ঘন কালো চুলো ভদ্রলোকের মুখে এখনো হাসি লেগেই আছে। উনি কয়েক পা এগিয়ে কার্লিসলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“আমরা ভেবেছিলাম এখানে বুঝি কোনো খেলা হচ্ছে, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বিষয়টা জানতে চাইলেন কার্লিসলের কাছে। তার কথায় ফরাসি টান আমি বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করলাম। “আমি হচ্ছি লরেন্ট, আর এরা হচ্ছে ভিক্টোরিয়া এবং জেমস।” তার পাশে দাঁড়ানো ভ্যাম্পায়ারদের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক।
“আমি হচ্ছি কার্লিসল আর এরা আমার পরিবারের সদস্য-এমেট এবং জেসপার, রোজালে, এসমে এবং এলিস, এ্যাডওয়ার্ড এবং বেলা।” কার্লিসল ভাগ ভাগ করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে যখন উনি আমার নাম উল্লেখ করলেন, তখন আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম।
“আপনাদের খেলায় আরো কয়েকজন কি অংশ নিতে পারে? লরেন্ট মার্জিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন।
কার্লিসল লরেন্টের মার্জিত কণ্ঠস্বরের সাথে তাল মেলালেন। “সত্যি বলতে এইমাত্র আমরা খেলা শেষ করলাম। তবে সামনে আবার আমরা এ ধরনের একটা ম্যাচ খেলতে খুবই আগ্রহী। আপনারা কি এখানে দীর্ঘদিন থাকার পরিকল্পনা করছেন?”
“আসলে আমরা দিন কয়েকের ভেতর উত্তরে যাত্রা করবো। কিন্তু আপনারা আমাদের প্রতিবেশী,তাই আপনাদের সম্পর্কে খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দীর্ঘদিন আপনাদের মতো কারও সাথে আমাদের পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি।
“না ঠিকই বলেছেন আপনি। আমরা ছাড়া আমাদের মতো কারও সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ নেই আপনাদের। অবশ্য কেউ বেড়াতে এদিকে আসে তাহলেই। এই যেমন আপনারা এসেছেন।
“আপনাদের শিকারের সীমানা কততদূর পর্যন্ত?” লরেন্ট স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলেন।
কার্লিসল সরাসরি লরেন্টের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। এখানকার অলিম্পিক রেঞ্জ-এর উপর পর্যন্ত এবং মাঝে মাঝে কোস্ট রেঞ্জের নিচ পর্যন্তই আমরা ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা করি। তাছাড়া যেহেতু কাছেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছি, সেহেতু শিকারের স্থান নিয়ে তেমনভাবে কখনো আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। এছাড়াও কাছেই ডেনালীতেও আমার একটা বাড়ি আছে।”
লরেন্ট শক্ত পাথরের ওপর হালকাভাবে একবার পা ঠুকলেন।
“স্থায়ী আবাস? আপনি এগুলোর ব্যবস্থা করলেন কিভাবে?” ভদ্রলোকের কণ্ঠে স্বাভাবিক কৌতূহল লক্ষ করলাম আমি।
“তো আমাদের বাড়িতে একদিন আপনারা বেড়াতের আসছেন না কেন? তাহলে কিন্তু বেশ মজা করে গল্প করা যাবে।” কার্লিসল তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। “আমার জীবন-কাহিনী কিন্তু অনেক দীর্ঘ।”
“বাড়ি” শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে জেমস এবং ভিক্টোরিয়া চোখে চোখে ইঙ্গিতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। বিষয়টা লক্ষ করার পরও লরেন্টের অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলাম না-হাসি মুখেই তিনি কথা বলতে লাগলেন।
“আপনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে আমার খুবই ভালো লাগছে। কী বলবো, আমার কাছে এক ধরনের অদ্ভুতও মনে হচ্ছে।” তার হাসি অকৃত্রিমই মনে হলো। “ওল্টারিও’র প্রায় সমস্ত এলাকা জুড়ে আমরা এততক্ষণ শিকারের খোঁজে চষে বেড়িয়েছি, এমন কি নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার সুযোগ পর্যন্ত পাইনি।”
“দয়া করে বিব্রত হবেন না। এই এলাকায় যেভাবে ইচ্ছে শিকার করেন, তাতে আমাদের তো বলার কিছুই নেই, থাকতে পারে না। আমরা একে-অপরকে সহযোগীতা করবো এটাইতো স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই আমার প্রস্তাব আপনার খারাপ লাগার কথা নয়,” কার্লিসল ব্যাখ্যা করে বললেন।
“অবশ্যই।” লরেন্ট মাথা নাড়লেন। “আমরা কোনোভাবেই আপনার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছি না। আমরা মাত্র সিয়েটেলের বাইরে থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এসেছি,” কথাটা বলতে বলতে তিনি হেসে উঠলেন। কিন্তু কেন যেন আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে একটা শীতল রক্তের স্রোত দ্রুত বয়ে গেল।
“তো ঠিক আছে, যদি আপনারা রাস্তাটা চিনে নিতে চান, তাহলে আমাদের সাথে আসতে পারেন-এমেট এবং এলিস তোমরা এ্যাডওয়ার্ড এবং বেলার সাথে যাও। ওদের জীপ পর্যন্ত পৌঁছে দাও।” স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাগুলো বললেন কার্লিসল।
কার্লিসল যখন কথাগুলো বলছেন, তখন পরপর তিনটা ঘটনা ঘটে গেল। হালকা বাতাসে আমার এলোমেলো চুল উড়তে লাগলো, এ্যাডওয়ার্ড শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেল, এবং জেমস নামের দ্বিতীয় ভদ্রলোক হঠাৎ তার মাথা বনবন করে ঘুরাতে লাগলো, সতর্ক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে গন্ধ নেবার চেষ্টা করলো।
জেমস দ্রুত একবার লাফিয়ে উঠলো। এরপর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো, এ্যাডওয়ার্ড দাঁত বের করে আত্নরক্ষার ভঙ্গিতে খানিকটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওর গলার ভেতর থেকে অদ্ভুত এক ধরনের গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরুতে লাগলো।
এ ধরনের শব্দ মোটেও আমার কাছে পরিচিত নয়। সকালে ওর কণ্ঠ থেকে এ ধরনের কোনো শব্দ আমি শুনতে পাইনি। মোট কথা এ ধরনের শব্দের সাথেই আমি পরিচিত নই।
“এটা কি?” লরেন্ট তার বিক্ষিপ্ত ভাবকে মোটেও গোপন করতে পারলেন না। জেমস এবং এ্যাডওয়ার্ড-উভয়ের ভেতর এখন একই রকম আক্রমণাত্বক ভঙ্গি। দুজনের কেউই নিজেদের সংযত করতে পারছে না। জেমস প্রায় অচেতন অবস্থায় একপাশে পড়ে আছে অন্যদিকে এ্যাডওয়ার্ড ওকে প্রতিহত করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে।
“ওই মেয়েটা আমাদের সাথের।” জেমসের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো। লরেন্টের চাইতে জেমসের গন্ধ নেবার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে বেশি, যার কারণে সহজেই আমার গন্ধটা ওর নাকে গিয়ে লেগেছে।
“তুমি কি আমাদের খাবার জন্যে একটা স্ন্যাকস সাথে করে এনেছো?” লরেন্ট কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন।
এ্যাডওয়ার্ড আবার ভালোকের মতো দাঁত বের করে লরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল। লরেন্ট এবার কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।
“আমি বলছি ও আমাদের মেয়ে, দৃঢ় কণ্ঠে কার্লিসল বললেন কথাটা।
“কিন্তু ওতো একজন মানুষ,” লরেন্ট প্রতিবাদ জানানোর ভঙ্গিতে বললো।
“হ্যাঁ।” এমেট বেশ খানিকটা আত্নবিশ্বাস নিয়ে কার্লিসলের পাশে এসে দাঁড়ালো। হীরভাবে ও জেমসের দিকে তাকিয়ে আছে। জেমস হামাগুড়ি দিয়ে ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু আমার ওপর থেকে ও মোটেও তার দৃষ্টি সরালো না। ওর নাকের ফুটোগুলো বেশ বিস্তৃত হয়ে গেছে। আমাকে রক্ষা করার জন্যে এ্যাডওয়ার্ড আমার সামনে সিংহের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
লরেন্ট যখন আবার মুখ খুললো তখন ওর কণ্ঠস্বর অনেক ম্লান কোণালো। এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। “তাহলে দেখছি আমাদের একে অপরকে জানার আরো অনেক কিছু বাকি থেকে গেছে।”
“নিঃসন্দেহে আপনি ঠিকই বলেছেন।” কার্লিসলের কণ্ঠস্বর আগের মতোই শীতল কোণালো।
“কিন্তু আপনার আমন্ত্রণ কিন্তু আমরা সাদরেই গ্রহণ করেছি।” ওর চোখ জোড়া আমার ওপর দিয়ে একবার ঘুরে গিয়ে কার্লিসলের ওপর স্থীর হলো। এবং অবশ্যই আমরা ওই মানুষ মেয়েটার কোনো ক্ষতিই করবো না। আমি যেমন বলেছিলাম, সেভাবে শুধু আপনার এলাকায় আমরা শিকার করবো।”
জেমস অবিশ্বাস এবং একগুয়ে দৃষ্টিতে লরেন্টের দিকে তাকালো।
এরপর জেমস ভিক্টোরিয়ার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। ভিক্টোরিয়াকে একেবারে উদভ্রান্তের মতো মনে হচ্ছে, সকলের ওপরই ওর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিদিষ্টভাবে কারও ওপর দৃষ্টি স্থীর রাখতে পারছে না।
“ঠিক আছে আপনাকে রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। জেসপার, রোজালে এসমে?” কার্লিসল বললেন। কার্লিসলের কণ্ঠ শুনে সবাই একইস্থানে এসে জমায়েত হলো। ওরা এমনভাবে দাঁড়ালো, যেন সবাই আমাকে ঘিরে রাখতে চায়। এলিস ইচ্ছেকৃতভাবে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো। আমার পেছনে দাঁড়ানো জেমসের দিকে এমেট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“বেলা চলো এবার যাওয়া যাক।” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ ম্লান কোণালো।
এই সম্পূর্ণ সময়টাতে আমি একইস্থানে শিকড় গেড়ে যাওয়ার মতো করে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হয় এ সময়টুকুতে আমি একবারো নড়িনি। এ্যাডওয়ার্ড আমার কনুয়ের কাছে শক্তভাবে চেপে ধরে রেখেছে। এলিস এবং এমেট এখনো আমাদের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে-অনেকটা রক্ষাকর্তার মতো। আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারলাম না, আদৌ ওরা চলে গেছে কিনা।
অতি অল্প সময়ে আমরা জীপের কাছে এসে পৌঁছলাম। আমি এ্যাডওয়ার্ড তো বটেই, এলিস এবং এমেটও জীপ পর্যন্ত আমাকে পাহারা দিয়ে এনেছে।
“ওর সিট বেল্টটা ভালোভাবে বেঁধে দাও।” আমার পাশে দাঁড়িয়ে এ্যাডওয়ার্ড এমেটকে নির্দেশ দিলো।
আমি পেছন সিটে বসার কারণে এলিস সামনের সিটে বসেছে। এ্যাডওয়ার্ড ইঞ্জিনটা চালু করলো। জীবন পাওয়ার পর এ্যাডওয়ার্ড গাড়িটাকে খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে রওনা হলো।
এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করে এমন কিছু বললো যা আমি মোটেও বুঝতে পারলাম না। এলোমেলো পথে এভাবে এগিয়ে যাওয়াটা আমার কাছে চরম বিরক্তিকর মনে হলো। তাছাড়া ঘুটঘুঁটে অন্ধকার পথ আমার ভয়কে আরো বাড়িয়ে তুললো। এমেট এবং এলিস উভয়েই গাড়ির জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে আছে।
অবশেষে আমরা প্রধান সড়কে উঠে এলাম। স্বাভাবিকভাবে এতে গাড়ির গতিও অনেক বেড়ে গেল। মনে হলো আগের চাইতে এখন বেশ খানিকটা ভালো লাগছে। ফরকস্ ছাড়িয়ে আমরা দক্ষিণের দিকে এগিয়ে চললাম।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?” প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার প্রশ্নের কোনো জবাব পেলাম না, এমনকি আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকালো না।
“ঘোড়ার ডিম, এ্যাডওয়ার্ড! তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”
“যেভাবেই হোক এখান থেকে তোমাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে চাইছি-অনেক দূরে-আপাতত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও।” এ্যাডওয়ার্ড পেছন ফিরে তাকালো না-সোজা ওর চোখ নিবদ্ধ রাস্তার ওপর। দেখলাম স্পীড মিটারের কাঁটা একশো পাঁচ-এর ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।
“গাড়ি ঘুরাও! আমাকে তোমার কোথাও নিয়ে যেতে হবে না। তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!” আমি চিৎকার করে উঠলাম। সিট বেল্ট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বোকার মতো ওটা ধরে টানাটানি শুরু করলাম।
“এমেট,” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
আর সাথে সাথে এমেট তার লৌহ কঠিন হাত দিয়ে আমার হাত জোড়া চেপে ধরলো।
“না! এ্যাডওয়ার্ড! না! তুমি কোনোভাবেই এ ধরনের কাজ করতে পারো না!”
“বেলা, এখন আমাকে এই কাজটা করতেই হবে। এখন তুমি দয়া করে চুপ থাকো!”
“আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই! তুমি বাড়িতে নিয়ে চলো- আমার দেরি দেখলে কিন্তু চার্লি এফ.বি.আই কে ডাকবে। ওরা তোমার পরিবারকে বেশ ভালোভাবেই চেনে-কার্লিসল এবং এসমে! ওদের প্রত্যেককে এখান থেকে পালাতে হবে, নয়তো সারা জীবনের জন্যে লুকিয়ে থাকতে হবে!”
“বেলা, শান্ত হও।” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ শান্ত কোণাললো। “আমরা যেখানে যাচ্ছি,এর আগেও আমরা সেখানে গিয়েছি।”
“আমাকে নিয়ে কিছু করতে যেও না, তুমি তা মোটেও করতে পারো না! তুমি আমাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারো না!” যতোটা সম্ভব আমি প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
এলিস এই প্রথমবারের মতো মুখ খুললো। এ্যাডওয়ার্ড, জোরে চালাতে থাকো।”
এ্যাডওয়ার্ড একবার জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালো, তারপর গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।
“এ্যাডওয়ার্ড, তুমি আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো।”
“তুমি বুঝতে পারছে না, হতাশ কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড গুঙিয়ে উঠলো। এতো জোরে তাকে কখনো কথা বলতে শুনিনি। প্রীড মিটারের কাঁটা এখন একশো পনেরো। “ও খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছে এলিস, তুমি কি তা দেখতে পারছো না? ও খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে!”
আমার পাশে এমেট একেবারে চুপচাপ বসে আছে। আমার আতংকিত কণ্ঠস্বরেও তার ভেতর কোনো ভাবান্তর লক্ষ করলাম না। এর অর্থ কি তাহলে এই যে ওরা তিনজন আমাকে নিয়ে কিছু একটা করতে চাইছে? ওদের উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করলাম। আমি। কিন্তু জিজ্ঞেস করে যে তাদের কাছ থেকে কিছু জানা সম্ভব নয়, তা বেশ ভালোভাবে বুঝে গেছি।
“এ্যাডওয়ার্ড জোরে চালাতে থাকো।” এলিস এভাবে ওকে আদেশ করতে পারে এই প্রথম লক্ষ করলাম।
স্পীড মিটারের কাটা দেখতে পেলাম এবার একশো বিশ মিটারের ঘর ছুঁয়ে আছে।
“এভাবেই চলতে থাকো এ্যাডওয়ার্ড,” আবার এলিসের নির্দেশ শুনতে পেলাম।
“এলিস আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো। আমি ওর মনের ইচ্ছে ঠিকই বুঝতে পারছি। ওই লোকটা বেলাকে পেতে চাইছে এলিস-বিশেষত ওই লোকটা। ও আজ শিকারেই বের হয়েছে।”
“ও নিশ্চয়ই জানে না আমরা কোথায়-” কথাটা আমি সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।
এ্যাডওয়ার্ডের কথার মাঝপথে থেমে গেলাম আমি। “কততদূর পর্যন্ত ওকে নিয়ে যেতে পারলে ওই লোকটা আর গন্ধ অনুভব করতে পারবে না? লরেন্ট যাই বলুক না কেন, আগেই জেমস তার পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়েছে।”
আমি হাঁপাতে লাগলাম। আমি জানি কোথায় গেলে ওই লোকটা আর আমার গন্ধ খুঁজে পাবে না। “চার্লি। তুমি তাকে একা রেখে যেতে পারো না। ওর ওখানে একা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়।” আমি এ্যাডওয়ার্ডকে বিষয়টা স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্ঠ করলাম।
“বেলা আসলে ঠিক বলেছে, এলিস আমাকে সমর্থন জানালো। গাড়ির গতি খানিকটা কমে এলো।
“মিনিট খানেকের ভেতর আমাদের বিকল্প কোনো পরিকল্পনা সাজাতে হবে,” এলিস উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললো।
গাড়ির গতি আরো কমে এলো। গতি কমে আসার ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করা যায়। পরক্ষণেই গাড়িটা হঠাৎ হাই ওয়েতে থেমে গেল।
“এখন আর বিকল্প কিছু চিন্তা করতে পারছি না,” এ্যাডওয়ার্ড দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
“আমি চার্লিকে একা থাকতে দিবো না!” আমি প্রতিবাদ জানালাম।
এ্যাডওয়ার্ড সম্পূর্ণভাবে আমাকে উপেক্ষা করলো।
“তাকে আমাদের ফিরিয়ে আনা উচিত, শেষ পর্যন্ত এমেট মুখ খুললো।
“না।” এ্যাডওয়ার্ড আগের মতোই অটল হয়ে রইলো।
“ওই লোকটাকে মোটেও আমাদের সাথে মেলানো যাবে না এ্যাডওয়ার্ড। মনে হয় না লোকটা বেলাকে স্পর্শ করার কোনো সাহস পাবে।
“ওই লোকটা অবশ্যই অপেক্ষা করে থাকবে।”
এমেট হাসলো। “আমিও কিন্তু অপেক্ষায় আছি।”
“তুমি কিছু দেখোনি-তুমি কিছু বুঝতে পারোনি। একবার যখন ওই লোকটা প্রতিজ্ঞা করেছে শিকার করবে,তাকে আর প্রতিহত করা যাবে না। আমাদের সামনে এখন একটাই পথ খোলা আছে, ওকে হত্যা করতে হবে।”
এ্যাডওয়ার্ডের এই পরিকল্পনা শুনে এমেটকে মোটেও হতাশ মনে হলো না। “এই পথটা অবশ্য আমাদের খোলা আছ।”
“কিন্তু ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটাও আছে তার সাথে। ওকেই আমাদের হত্যা করতে হবে।”
“এতোকিছু করতে যাওয়াটা আমাদের জন্যে বেশ কষ্টকর হবে।”
“আমাদের বিকল্প আরেকটা পন্থা আছে,” এলিস শান্ত কণ্ঠে বললো।
এ্যাডওয়ার্ড এলিসের দিকে তাকিয়ে তিক্ত কণ্ঠে ছাড়া ছাড়া ভাবে বললো, “এখন আর-বিকল্প-কোনো কিছু চিন্তা-করার-অবকাশ-নেই!”
আহত দৃষ্টিতে এমেট এবং আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালাম। কিন্তু এলিসকে মোটেও বিচলিত মনে হলো না। এ্যাডওয়ার্ড এবং এলিস একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়টুকুকেই আমার কাছে দীর্ঘক্ষণ বলে মনে হলো।
এই দীর্ঘ নীরবতা আমার মোটেও ভালো লাগলো না। প্রথম কথা বলে আমিই নিরবতা ভঙ্গ করলাম। “তোমাদের কেউ কি আমার পরিকল্পনাটা শুনতে চাও?”
“না,” এ্যাডওয়ার্ড গড়গড় করে বলে উঠলো। এলিস একবার ওর দিকে তাকিয়ে, হতাশভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
“শোনো!” আমি ব্যাকুল কণ্ঠে বললাম। “তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।”
আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। “তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। বাবাকে বলবো, আমাকে যেন ফিনিক্স-এ ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আমি সব দ্রুত গুছিয়ে নিতে পারবো। ওর উপর সবাই নজর রাখবো, আর সুযোগ বুঝেই চমপট দিতে পারবো। ওই তিনজন আমাদের যখন অনুসরণ করতে চার্লি বাড়িতে একা থেকে যাবে। ওরা চার্লির পেছনে আর লাগার সুযোগ পাবে না। চার্লি তোমার পরিবারের কথা চিন্তা করে এফ.বি.আই কে কিছু জানাবেনও না। এরপর ইচ্ছে করলে তুমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে।”
একসাথে ওরা আমার দিকে ঘুরে তাকালো।
“এটা মনে হয় না খারাপ বুদ্ধি সত্যিই আমার কাছে দারুণ মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা।” এমেটের এরকম উৎফুল্ল হয়ে ওঠার পেছনে যে এক ধরনের অবজ্ঞার সুর মিশে আছে, তা আর বুঝতে অসুবিধা হলো না।
“এতে কাজ হতে পারে-আর তাছাড়া ওর বাবাকে একেবারে অসহায় অবস্থায় তো আর ফেলে রেখে দেয়া যায় না। এডওয়ার্ড তুমি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছো।” এলিস আমার কথার সমর্থন জানানোর চেষ্ঠা করলো।
প্রত্যেকে এ্যাডওয়ার্ডের মুখের দিকে তাকালো।
“এই কাজটা খুবই বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে-বেলার কাছ থেকে ওই লোকটাকে আমি শমাইলের ভেতরও রাখতে চাইছি না।”
এমেটকে খুব বেশি আত্নবিশ্বাসী মনে হলো। এ্যাডওয়ার্ড ওই লোকটা কোনোভাবেই সম্পূর্ণ রাস্তা আমাদের পেছন পেছন আসতে পারবে না।”
এলিস মিনিট খানিক কী যেন চিন্তা করলো। আমার মনে হয় না লোকটা আক্রমণ করতে এখানে ছুটে আসবে। কততক্ষণে আমরা এলিসকে এখানে একলা রেখে ফিরে যাই, সেই অপেক্ষাতেই থাকবে ওই লোক।”
“এরকম কিছু যে আমরা করবো না, তার সেটা বুঝতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়, এ্যাডওয়ার্ড আমাদের বুঝিয়ে বললো।
“তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও এটাই শুধু আমার অনুরোধ।” শান্ত কণ্ঠে অনুরোধ জানালাম তাকে।
এ্যাডওয়ার্ড আঙ্গুলগুলো মটকিয়ে চোখ বন্ধ করে কী যেন চিন্তা করলো।
“দয়া করে আমার অনুরোধটা তুমি রক্ষা করো।” আমি আবারো তাকে অনুরোধ জানালাম।
আমার অনুরোধ শুনে ও ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। যখন ও কথা বললো, তখন ওর কণ্ঠ শুনে অত্যন্ত ক্লান্ত মনে হলো।
অনুসরণকারী ওই লোক তোমাকে দেখুক কিংবা না দেখুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আজ রাতেই তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তুমি চার্লিকে গিয়ে বলবে তোমার পক্ষে এক মিনিটও ফরকস থাকা সম্ভব নয়। মাথায় যা আসে যাইহোক একটা গল্প বানিয়ে বলবে তাকে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একটা ব্যাগে গুছিয়ে নেবে প্রথমে। তারপর তোমার ট্রাকটা সাথে নেবে। উনি যাই বলুন না কেন, তাতে মোটেও কান দেবে না। তোমার হাতে মাত্র পনেরো মিনিট সময় আছে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছো? বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছানোর পর মাত্র পনেরো মিনিট সময় পাবে তুমি।”
জীপটা আবার যেন জীবন খুঁজে পেল। আমাদের কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড একঝটকায় গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো। স্পীড মিটারের কাঁটাটা ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলো।
“এমেট?” আমার হাতের দিকে তাকিয়ে ওকে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম।
“ওহ্, আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি।” এতোক্ষণ শক্তভাবে চেপে ধরা মুঠো ও আলগা করলো।
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া মিনিট কয়েক কোনো শব্দই কোণা গেল না–অর্থাৎ আমরা কেউই কোনো কথা বললাম না। খানিক বাদে এ্যাডওয়ার্ডই প্রথম মুখ খুললো।
“কীভাবে আমাদের এগুতে হবে বুঝিয়ে বলছি তোমাদের। আমরা যখন বেলাদের বাড়ি পৌঁছবো তখন নিশ্চয়ই ওই লোকটা ওখানে উপস্থিত থাকবে না। দরজা পর্যন্ত আমি বেলাকে পৌঁছে দিবো। তারপর ওর হাতে থাকবে মাত্র পনেরো মিনিট।” রেয়ার ভিউ মিররে ওকে খানিকটা উৎফুল্ল মনে হলো। “এমেট, তুমি বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করবে। এলিসের দায়িত্ব হবে ট্রাকটা বের করে আনা। বেলা যতোক্ষণ বাড়ির ভেতর থাকবে, ততোক্ষণ আমি ওখানেই থাকবো। বেলা সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে আসার পর, তোমরা জীপ নিয়ে বাড়ি যাবে-কার্লিসলকে তোমরা সব খুলে বলবে।”
“তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, এমেট মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠলো। “আমি তোমার সাথেই থাকবো।”
“মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করার চেষ্টা করো এমেট। নিজেও জানি না কতোক্ষণের জন্যে আমাকে এখান থেকে যেতে হচ্ছে।”
“যতোদূর পর্যন্ত তোমাদের যাওয়া সম্ভব, আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।”
এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “ওই লোকটা যদি ওখানেও উপস্থিত হয়, শান্ত কণ্ঠে বললো ও, “আমাদের কিন্তু গাড়ি চালিয়েই যেতে হবে।”
“ওর আগেই আমরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারব আশাকরি।” বেশ আত্নবিশ্বাসের সাথে বললো এলিস।
এ্যাডওয়ার্ড সম্ভবত এ ধরনের কোনো ভরসার বানী শুনতে চাইছিলো, তা এলিসের সাথে তার সম্পর্ক যেমনই হোক।
“তাহলে জীপটার কি ব্যবস্থা হচ্ছে?” এলিস প্রশ্ন করলো।
এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ এবার কঠিন কোণালো। “তুমি ওটা বাড়ি নিয়ে যাবে!”
“না, আমি ওটা নিয়ে যাচ্ছি না,” শান্ত কণ্ঠে বললো এলিস।
বুঝতে পারলাম সামনেই একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
“সত্যি বলতে আমার ট্রাকে কিন্তু জায়গা হবে না, আমি ফিসফিস করে ওদের। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।
এ্যাডওয়ার্ড বোধহয় আমার যুক্তি কোণার প্রয়োজনও অনুভব করলো না।
“আমার মনে হয় এ্যাডওয়ার্ড, আমাকে একাই যেতে দেয়া উচিত, আগের চাইতেও শান্ত কণ্ঠে বললাম আমি কথাটা।
“বেলা দয়া করে আমার মতো কাজ করতে দাও,” কঠোর কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে ধমক দিলো।
“শোনো, চার্লিকে তুমি মূর্খ লোক বলে মনে করো না, প্রতিবাদ জানানোর ভঙ্গিতে আমি তাকে বললাম। “আগামীকাল তোমরা যদি শহরে অনুপস্থিত থাকো তাহলেই তিনি বিস্মিত হয়ে যাবেন।”
“তোমার ওই আশঙ্কা একেবারে অবান্তর। উনি নিরাপদে থাকতে পারছেন, এটাই আমাদের কাছে মূখ্য বিষয়। আমাদের সেটা নিয়েই চিন্তা করতে হবে।
“তাহলে অনুসরণকারীর কি হবে? তুমি কোন পথে এগুচ্ছো, ঠিকই ও জেনে যাবে। ও বুঝে ফেলবে, তুমি আমার সাথেই আছো, তা তুমি যেখানেই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন।”
এমেট আমার দিকে তাকালো। স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে ও অবাক হলো। “এ্যাডওয়ার্ড বেলার কথা শোনো,” ওর কণ্ঠে এক ধরনের মিনতি। “আমার ধারণায় ও একদিকে ঠিক কথাই বলেছে।”
“হ্যাঁ, বেলার কথায় গুরুত্ব আছে,” এলিস এমেটকে সমর্থন জানালো।
“আমার পক্ষে ওর কথা মতো কাজ করা মোটেও সম্ভব নয়।” বরফ শীতল কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“এমেট আমাদের সাথে থাকতে পারে,” পূর্বের সুত্র ধরে আমি বললাম। “নিঃসন্দেহে ওর দেখার দৃষ্টি বেশ প্রখর।”
“কি?” এমেট আমার দিকে তাকালো।
তুমি সাথে থাকলে, ওই শয়তানটাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে পারবো।” এলিস, মন্তব্য করলো।
এ্যাডওয়ার্ড অনিশ্চিতভাবে এলিসের দিকে তাকালো। “তোমার কি মনে হয় ওকে একা একা যেতে দেয়া উচিত?”
“অবশ্যই নয়, এলিস বললো। “জেসপার এবং আমি ওকে নিয়ে যাবো।”
“আমি তা কোনোভাবেই করতে দিতে পারি না,” এ্যাডওয়ার্ড একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো। কিন্তু এবার ওর কণ্ঠে তেমন একটা জোর খুঁজে পেলাম না। এখন ও যুক্তিগুলো পুনঃবিবেচনা করার চেষ্টা করছে হয়তো।
এ্যাডওয়ার্ডকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানোর চেষ্টা করলাম। “এক সপ্তাহের জন্যে এখান থেকে সরে থাকলাম-” এবং আয়নায় ওর অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করলাম “কয়েক দিনের জন্যে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এমন কিছু আমি চার্লিকে বুঝাতে চাইছি না। এবং চার্লি সেরকম ধারণা করে জেমসকে তাড়া করুক এমন কিছুও আমি চাই না। জেমসকে চার্লি মোটেও সন্দেহ করবে না। সন্দেহ করলে চার্লি আমাকেই করার কথা, কিন্তু আমার ওপর চার্লি যখন সন্দেহমুক্ত হতে পারবে, তখন তোমরা আমার সাথে এসে মিলিত হবে। অবশ্যই কোন পথে আমরা এগুলো তার একটা রুট তৈরি করে নিতে হবে আমাদের। এবং এরপর জেসপার এবং এলিস বাড়ি চলে যাবে।”
আমি দেখলাম এ্যাডওয়ার্ড প্রথম থেকে এখন একটু নমনীয় হয়েছে।
“তাহলে তোমার সাথে কোথায় মিলিত হচ্ছি?”
“ফিনিক্স, অবশ্যই।”
“না। ওই লোকটা হয়তো জেনে থাকতে পারে তোমরা কোথায় যাচ্ছো,” অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“নিঃসন্দেহে তোমরা সবাই খুব তাড়াহুড়ো করছে। আমরা কী করছি না করছি, আমরা যে সব জেনে গেছি ওই লোকটা তা ভালোভাবেই জানে। আমি কোথায় যাচ্ছি, মুখে যেভাবে বলছি, সেখানে যে আমি যাবো না, ওই লোকটা তাও ভালোভাবে জানে।”
“বেলা তার যাদু বিদ্যা দিয়ে প্রতিহত করবে,” এমেট টিটকারী দিয়ে বললো।
“আর যদি ওই যাদুবিদ্যা কাজে না আসে?”
“ফিনিক্স-এ লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস, আমি জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।
“ফোন বুক থেকে নামটা খুঁজে বের করা কিন্তু কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।”
“আমি বাড়ি ফিরতেই চাইছিলাম না।”
“ওহ?” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠে রীতমতো এক ধরনের আতঙ্ক লক্ষ করলাম।”
“নিজের থাকার একটা জায়গা খুঁজে বের করার মতো বয়স নিশ্চয়ই আমার হয়েছে।”
“এ্যাডওয়ার্ডসহ আমরা সবাই ওর সাথে থাকছি,” এলিস এ্যাডওয়ার্ডকে স্মরণ করিয়ে দিলো।
“ফনিক্স গিয়ে তোমরা কি করবে?”এলিসকে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।
“বাড়ির ভেতর বসে থকবো।”
“আমারো প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হয়েছে।” এমেট সমর্থন জানালো এলিসকে।
“চুপ করে থাকো এমেট!”
জীপ ধীরে ধীরে শহরের রাস্তায় প্রবেশ করলো। এতোক্ষণ যে আমি একজন সাহসী মেয়ের মতো কথা বলতে পেরেছি, তা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। চিন্তা করলাম চার্লি বাড়িতে সম্পূর্ণ একা।
“বেলা।” এ্যাডওয়ার্ড নরম সুরে বললো। এলিস এবং এমেট আবার গাড়ির জানালা পথে বাইরে দেখতে লাগলো।
“যদি তোমাকে আমি তোমার মতো কিছু করতে দিই-যাই হোক না কেন-আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তার দায়ভার বহন করতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছো?”
“হ্যাঁ,” আমি ঢোক গিলে বললাম।
এ্যাডওয়ার্ড এলিসের দিকে তাকালো।
“জেসপার কি এই সমস্যা সামলাতে পারবে?”
“এ্যাডওয়ার্ড ওকে তোমার কিছু করার সুযোগ দেয়া উচিত। সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে ও অনেক ভালোভাবে সামলাতে পারবে আশা করি।”
“তুমি কি একাই সমস্যাগুলো সামলাতে পারবে?”এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো।
ছোটোখাটো এলিসের ঠোঁটে আমি এক ধরনের রহস্যের হাসি দেখতে পেলাম।
এ্যাডওয়ার্ড ওর দিকে তাকিয়ে পাল্টা হাসলো। “কিন্তু তোমার মতামত ঠিকই তোমার মতো করে আঁকড়ে ধরে রাখলে,” এ্যাডওয়ার্ড হঠাৎ করে বলে উঠলো।
.
১৯.
চার্লি আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। বাড়ির সমস্ত আলোগুলো জ্বালানো। আমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কী কারণ দেখাবো কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। ভাবা যতোটা সহজ মনে হয় না, বলাটা ততোটা সহজ।
এ্যাডওয়ার্ড ধীর গতিতে আমার ট্রাকটা পেছনে সরিয়ে আনলো। ওদের তিনজনই সত্যিকার অর্থে সতর্ক হয়ে আছে। একেবারে নিশ্চুপ সিটের ওপর বসে আছে গাছপালার ভেতর থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন শব্দ,প্রতিটা বস্তুর প্রতিফলিত ছায়া, প্রতিটা বস্তুর গন্ধ-সবকিছুর ওপরই যেন সতর্ক নজরদারী। ইঞ্জিনের শব্দ থেমে গেল এবং আগের মতোই নির্জিবভাবে বসে রইলাম। ওরা এখনো আগের মতোই সতর্ক।
“ও এখানে নেই,” এ্যাডওয়ার্ড তিক্ত কণ্ঠে বললো। “এবার তাহলে যেতে পারি।”
দৈত্যাকৃতির গাড়িটা থেকে নামতে এমেট আমাকে সাহায্য করলো।
“বেলা তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই,” সতর্ক চাপা স্বরে বললো এমেট। “এদিককার সবকিছু আমরা বেশ ভালোভাবে সামরে নিতে পারবো।”
এমেটের আমার প্রতি অনুভূতি দেখে চোখের কোণ ভিজে উঠলো। ওকে আমি খুব কমই জানি। তাছাড়া আদৌ ওর সাথে আবার কবে দেখা হবে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
“এলিস,এমেট।” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠে আদেশের সুর। এরা নিঃশব্দে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এ্যাডওয়ার্ড আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।
“মাত্র পনেরো মিনিট,” নিঃশ্বাস চেপে রেখে এ্যাডওয়ার্ড কোনোভাবে উচ্চারণ করলো কথাটা।
“আমি করতে পারবো।” আমি মাথা নাড়লাম। আমার চোখের পানিই আমাকে এক ধরনের উৎসাহ জুগিয়েছে।
পোর্চের নিচে এসে আমি থেমে গেলাম। ওর গালটা দুহাতে চেপে ধরলাম। আমি ওর চোখে এক ধরনের আতংক লক্ষ করলাম।
“আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি,” শান্ত এবং ম্লান কণ্ঠে বললাম কথাটা। “এখন যাই কিছু ঘটুক না কেন, সারা জীবন আমি তোমাকে ভালোবেসে যাবো।”
“বেলা, দেখে নিও তোমার কিছুই হবে না,” ভীত হলেও সাহস দেবার চেষ্টা করলো এ্যাডওয়ার্ড।
“শুধু আমার পরিকল্পনা মাফিক কাজ করবে, ঠিক আছে? চার্লি আমাকে কোনো সন্দেহ করবে না। তাকে আমার কোনো ভয় নেই। হয়তো এরপর তিনি আমাকে খুব একটা পছন্দ করবেন না। কিন্তু আমার জবাবদিহি করার একটা সুযোগ থাকবে।”
“তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকো বেলা। আমাদের কিন্তু খুবই তাড়া আছে।” উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“আরেকটা বিষয়,” অধৈৰ্য্য হয়ে আমি ফিসফিস করে বললাম। “আজ রাতের আমার চিন্তাগুলো তুমি মোটেও মনে করার চেষ্টা করবে না।” এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো, এবং পায়ের আঙ্গুলগুলোর ওপর ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হলাম।
তারপর একেবারে চমকে দিয়ে ওর ঠোঁটের ওপর চুমু খেলাম- এ্যাডওয়ার্ডের অতি শীতল ঠোঁটের ওপর যতোটা সম্ভব শক্তভাবে আমার ঠোঁট চেপে ধরলাম। এরপর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম।
“এ্যাডওয়ার্ড যাচ্ছি আমি!” এক নজর ওর দিকে তাকিয়েই দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। ওর হতভম্ভ মুখের ওপর সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।
“বেলা?” লিভিং রুম থেকে চার্লির গলা ভেসে এলো। ইতোমধ্যে উনি উঠে দাঁড়িয়েছেন।
“আমাকে একা থাকতে দাও!” অশ্রু ভেজা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। এখন আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত সিঁড়িগুলো টপকে আমার ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা দরাম করে লাগিয়ে লক্ আটকে দিলাম। বিছানার ওপর উঠে আলমিরার উপর থেকে মোটা ব্যাগটা নামিয়ে আনলাম।
চার্লি ইতোমধ্যে আমার দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছেন।
“বেলা, তুমি কি ঠিক আছো? কি হয়েছে তোমার?” ওর কণ্ঠস্বর রীতিমতো ভীত কোণালো।
“আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি,” আমি চিৎকার করে চার্লিকে বললাম। চিৎকার করতে গিয়ে কণ্ঠস্বরটা খানিকটা ভেঙে এলো। অভিনয়টা আমি তাহলে বেশ ভালোই করতে পারছি।
“এ্যাডওয়ার্ড কি তোমার মনে কোনো কষ্ট দিয়েছে?” চার্লির কণ্ঠে খানিকটা ক্রোধ লক্ষ করলাম আমি।
“না!” কণ্ঠস্বরকে আরো খানিকটা চড়ালাম আমি। এরপর ড্রেসারটা দ্রুত খুলে ফেললাম। এ্যাডওয়ার্ড ওখানেই আমাকে সাহায্য করার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একের পর এক প্রয়োজনীয় কাপড়গুলো ও আমার দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো আর ওগুলো আমি ব্যাগে ভরতে লাগলাম।
“কোনো কারণে ও কি তোমার মন ভেঙ্গে দিয়েছে?” চার্লির কণ্ঠ শুনে মনে হলো তিনি আমার আচরণে একেবারে হতভম্ভ হয়ে পড়েছেন।
“না!”আমি চিৎকার করে উঠলাম। এই সামান্য সময়ে ব্যাগে আমি অনেক কিছু ভরে নিতে পারলাম। এ্যাডওয়ার্ড এরপরও অন্য আরেকটা ড্রয়ারের জিনিসগুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিতে লাগলো, আর আমি তা ব্যাগে ভরতে লাগলাম। ব্যাগটা এরই মধ্যে বেশ খানিকটা ফুলে উঠেছে।
“কি হলো বেলা?” দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চার্লি আবারো চিৎকার করে উঠলেন।
“আমি ওর সাথে থেকে শেষ হয়ে গেছি!” আগের মতোই আবারো চিৎকার করে উঠলাম আমি। এক ঝটকায় ব্যাগের চেনটা টেনে বন্ধ করলাম। এ্যাডওয়ার্ড সাবধানে ব্যাগের স্ট্রীপগুলো কাঠের ওপর আটকে দিলো।
“আমি ট্রাকে যাচ্ছি-তুমি দ্রুত বেড়িয়ে পড়ো!” এ্যাডওয়ার্ড ফিসফিস করে আমাকে নির্দেশ দিলো। এরপরই ও জানালা গলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দরজা খুলে অভদ্রের মতো চার্লিকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেলাম। ভারী ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে যদিও আমার বেশ কষ্ট হলো।
“কি হলো তোমার?” চার্লি আবারো চিৎকার করে উঠলেন। উনি এখন ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। “আমার ধারণা ছিলো তুমি এ্যাডওয়ার্ডকে খুবই পছন্দ করো।”
কিচেনের কাছাকাছি এসে আমার কনুইটা চেপে ধরলেন। যেহেতু এখনো তিনি হতভম্ভ হয়ে আছেন, সেহেতু তেমন শক্তভাবে হাতটা চেপে ধরতে পারেননি।
চার্লি ঘুরে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। তার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কোনোভাবেই তিনি আমাকে এখান থেকে যেতে দিতে চান না। কিন্তু অত্যন্ত খারাপ দেখালেও আমাকে তার সাথে বাধ্য হয়েই খারাপ ব্যবহারটা করতে হলো। এরকম করা ছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায়ও নেই।
আমি বাবার দিকে প্রায় তেড়ে গেলাম। এখনো চোখ দিয়ে আমার অঝোর ধারায় অশ্রু বিন্দু ঝরে পড়ছে।
“আমি ওকে পছন্দ করেছিলাম-সেটা আমার সমস্যা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এখানকার সাথে আমার পক্ষে আর কোনো সম্পর্কই রাখা সম্ভব নয়। মার মতো নীরস এই শহরের ফাঁদে আমি আর পড়তে চাই না। মা যেমন ভুল করেছিলো, একই ভুল আর আমি করতে চাইনা। এই শহরটা আমি ঘৃণা করি-এখানে আমি আর এক মিনিটও থাকবো না!”
শক লেগেছে এমন ভঙ্গিতে আপনা থেকেই আমার কনুই চার্লির হাতটা খুলে গেল। একরাশ হতাশা নিয়ে উনি দরজার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
“বেলা তুমি এখন যেতে পারবে না। এখন গভীর রাত,” আমার পেছন থেকে ফিসফিস করে বললেন চার্লি।
আমি মোটেও তার দিকে তাকালাম না। “তেমন ক্লান্তবোধ করলে ট্রাকেই আমি ঘুমিয়ে থাকবো।”
“মাত্র একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করো,” চার্লি মিনতি করলেন। এখনো তাকে আগের মতোই মর্মাহত মনে হলো। “রেনে এরই ভেতর ফিরে আসবে।”
চার্লির কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। “কি?”
চার্লি ক্রমাগত আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করতে লাগলো। “তুমি যখন বাইরে ছিলে, রেনে কল করেছিলো। ফ্লোরিডার কাজে তারা তেমনভাবে সফল হয়নি। আর ফি যদি সপ্তাহ শেষে চুক্তিটা সম্পাদন করতে না পারে, তাহলে ওরা এরিজোনায় ফিরে যাবে। সাইড উইন্ডারস্-এর সহকারি প্রশিক্ষক জানিয়েছে নতুন স্পটের অবশ্যই তাদের এরিজোনায় আরো বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।”
আমি ধীরে মাথা নাড়লাম। এভাবে বোধহয় নতুন চিন্তা গুছিয়ে নিলাম। বুঝতে পারলাম প্রতিটা সেকেন্ড পার করার অর্থই হচ্ছে চার্লির বিপদকে বাড়িয়ে তোেলা।
“আমার কাছে চাবি আছে,” বিড়বিড় করে বলে দরজার লক ঘুরালাম। চার্লি সাথে সাথে আরো এগিয়ে এলেন, একটা হাত বাড়িয়ে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। চোখে-মুখে তার হতবুদ্ধির ভাব। তার সাথে তর্ক বিতর্ক করে আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতে চাইলাম না আমি। চার্লিকে সরিয়ে দিয়ে আবার এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। ২৮৮
“বাবা আমাকে আমার পথে যেতে দাও,” মা’র শেষ বলা কথাগুলোর মতো করেই আমি বললাম। অনেক বছর আগে চার্লিকে এভাবে কথাগুলো বলে মা এই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তবে মা’র চাইতেও অনেক বেশি রাগ দেখিয়ে কথাগুলো বলার চেষ্টা করে দরজাটা খুলে ফেললাম। “তোমার এভাবে বাধা দিয়ে কোনো লাভ হবে না, বুঝতে পারলে? আমি সত্যিই এই শহরটাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি।”
আমার নিষ্ঠুরভাবে বলা কথাগুলো বেশ কাজে দিলো-দরজার কাছে চার্লি একেবারে বরফের মতো জমে গেলেন। অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ার সময় দেখলাম তিনি একেবারে হতবাক হয়ে গেছেন। খালি জায়গাটুকু পার হওয়ার সময় একরাশ আতংক এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি বুনো জন্তুর মতো ট্রাকটার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। ব্যাগটা ট্রাকের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম। ইগনিশনে আমি চাবিটা ঝুলানোই দেখলাম।
“কাল আমি তোমাকে ফোন করবো।” আমি চিৎকার করে উঠলাম। জানি পরে আমি তাকে সবকিছু ঠিকই বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমি ইঞ্জিন চালু করে গাড়িটা বের করে আনলাম।
এ্যাডওয়ার্ড আমাকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালো।
“আমি সাহায্য করছি,” এ্যাডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বললো। দেখলাম চার্লি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখান থেকে বাড়ির ভেতর চলে গেছেন।
“আমি চালাতে পারবো।” শান্ত কণ্ঠে বললাম। এখন আবার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে আমার।
এ্যাডওয়ার্ডের দীর্ঘাকার হাত দিয়ে কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। গ্যাস প্যাডালের ওপর রাখা আমার পায়ের চাপ দিয়ে গতি বাড়াতে সাহায্য করলো। হঠাৎ আমাকে ওর কোলে তুলে নিলো, তারপর পাশের সিটে সরিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে স্টেয়ারিং হুইল নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো।
ট্রাকটা হঠাৎ থেমে গেল-এক ইঞ্চিও নড়লো না।
“বাড়িটা দেখার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই,” এ্যাডওয়ার্ড বুঝানোর চেষ্টা করলো আমাকে।
আমাদের পেছনে হঠাৎ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। চোখ বড় বড়ড়া করে পেছনের জানালা দিয়ে আমি বাইরের দিকে দেখার চেষ্টা করলাম।
“এলিস হতে পারে, এ্যাডওয়ার্ড আমাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করলো। ও আমার হাতটা আবার মুঠোর ভেতর চেপে ধরলো।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চার্লির মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। “অনুসরণকারী লোকটা?”
“তোমার শেষ পরিকল্পনা ও ঠিকই জানতে পেরেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“চার্লির তাহলে কি অবস্থা?” আতঙ্কিত কণ্ঠে আমি প্রশ্ন করলাম।
“অনুসরণকারী লোকটা আমাদের পেছন পেছনই আসছে এখন।”
আমার সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
“ওর চোখকে আমরা ফাঁকি দিতে পারবো?”
“না।” কিন্তু কথাটা বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। ইঞ্জিনটা জোর প্রতিবাদ জানিয়ে ট্রাকের গতি খানিকটা বেড়ে গেল।
আমার পরিকল্পনার তেমন কোনো সাফল্য দেখতে পেলাম না।
পেছন দিকে তাকিয়ে এলিসের হেড লাইটে ট্রাকটা যখন আলোকিত হয়ে থাকতে দেখলাম। তারই ভেতর একটা ছায়ামূর্তিকে লাফিয়ে উঠতে দেখলাম।
এ্যাডওয়ার্ড হাত চাপা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেবার আগে আমার রক্ত হীম করা চিৎকারটা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলো।
“ও হচ্ছে এমেট!”
আমার মুখের ওপর থেকে এ্যাডওয়ার্ড হাত সরিয়ে নিলো। আবার ও আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো।
“সবই ঠিক আছে বেলা,” এ্যাডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করার ভঙ্গিতে বললো।
“তুমি নিরাপদেই থাকবে।” আমরা শান্ত শহর ছাড়িয়ে উত্তরের হাইওয়েতে উঠে এলাম।
আমি অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালাম। পাল্টা এ্যাডওয়ার্ডও আমার দিকে খানিকক্ষণের জন্যে তাকিয়ে রইলো।
“বেলা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” আস্বস্ত করার চেষ্টা করলো এ্যাডওয়ার্ড।
“অবশ্যই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, যখন আমার আর তোমার সাথে থাকা হবে না,” আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম।
“দিন কয়েকের ভেতর আমরা আবার এক সাথে থাকতে পারবো,” কোমরে জড়ানো হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে আমাকে আবার অভয়বাণী কোণালো এ্যাডওয়ার্ড। “ভুলে যাবে না এর সবই কিন্তু তোমার পরিকল্পনা।”
“এটাই সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা-আর স্বীকার করছি এটা আমারই পরিকল্পনা।”
ওর ভরসা দেবার ভঙ্গির হাসিটা ম্লান মনে হলো এবং খানিকক্ষণের ভেতর তা মুছেও গেল।
“এই ঘটনাগুলো কেন ঘটতে গেল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আমার ওপর এই অত্যাচার কেন?”
“এটা আমার ভুল-আমি বোকার মতো তোমাকে ওদের দেখাতে গিয়েছি,” রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“আমি কিন্তু তেমন কিছু বলতে চাইনি,” জোর প্রতিবাদ জানালাম আমি। “আমি ওখানে ছিলাম ঠিকই এবং ভালোই ছিলাম। কিন্তু ওই দু’জন কিছু বললো না, শুধু জেমস কেন আমাকে হত্যার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো? ওখানে চারদিকে অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবাইকে বাদ দিয়ে আমাকে কেন?”
উত্তর দেবার আগে ও খানিকটা ইতস্তত করলো।
“আমি আজ রাতে ওর মনের কথা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি,” শান্ত কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড বলতে শুরু করলো। একবার তোমাকে দেখার পর এই বিষয়টা এড়াতে পারতাম কিনা ঠিক জানি না। এখানে তোমার দোষ অতি সামান্য।” ওর কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি লক্ষ করলাম আমি। “কামুকতাপূর্ণ ওই সুতীব্র গন্ধ যদি তুমি না ছড়াতে তাহলে বোধহয় না জেমস এতোটা উত্তেজিত হয়ে উঠতো। কিন্তু যখন আমি তোমাকে প্রতিহত করতে গেলাম…তখনই বিপত্তির সৃষ্টি। কোনো কিছুতে বাঁধা পেতে ও অভ্যস্ত নয়। নিজেকে একজন শিকারী হিসেবেই মনে করছে। এই কারণেই জেমস তোমাকে অনুসরণ করছে-বিষয়টা ও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না জেমস এখন কতোটা জেদি হয়ে উঠেছে। এটা তার এক ধরনের প্রিয় খেলা এবং আমরাও ওকে প্রতিহত করাকে জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছি।” ওর কণ্ঠ থেকে একরাশ তিক্ততা ঝরে পড়লো।
ও খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো।
“ওই সময় আমি যদি চুপ করে থাকতাম তাহলে ওই লোকটা তোমাকে তখনই হত্যা করতো, হতাশ কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“আমি ভেবেছিলাম…আমার গন্ধ যে অন্যদেরও এভাবে আকর্ষণ করবে আমি ভাবতে পারিনি…যেমন তুমি আমার প্রতি কামার্ত হয়ে ওঠো। তেমনি লরেন্টও হয়ে উঠবে ভাবতে,” ইতস্তত করে আমি ব্যাখ্যা করলাম।
“তুমি হয়তো ভাবোনি। কিন্তু এটার অর্থ কিন্তু এও নয় যে প্রত্যেকেই তোমার গন্ধে মোহিত হয়ে পড়বে। যদি তুমি জেমসের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারো-অথবা ওদের অন্য কারও মনে যেভাবে আবেদনে সৃষ্টি করবে-ওই একইভাবে আমার মনেও তুমি আবেদন সৃষ্টি করে, এটাকে এক ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যাপার বলা যেতে পারে।”
আমি বলার মতো তেমন কিছু খুঁজে পেলাম না।
“ওকে হত্যা করা ছাড়া আমি বিকল্প কিছু আর খুঁজে পাচ্ছি না,” ও বিড়বিড় করে বললো। “কার্লিসল অবশ্য বিষয়টা কখনোই সমর্থন করবেন না। “
“তুমি কিভাবে একটা ভ্যাম্পায়ারকে হত্যা করবে?”
“টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে হবে, তারপর তা আগুনের পুঁড়িয়ে ফেলতে হবে।”
“অন্য দু’জনও তো তাহলে জেমসের সাথে সাথে তোমাকে আক্রমণ করবে?”
“মহিলা করবে নিশ্চয়ই। তবে লরেন্টের ব্যাপারে নিশ্চিত নই। ওদের একে অপরের সাথে বন্ধনটা খুব একটা দৃঢ় নয়-এমনই মনে হয়েছে আমার। লরেন্ট ওদের সাথে আছে সম্ভবত সামাজিক রীতির কারণে। জেমসের আচরণে নিঃসন্দেহে ও বিব্রত বোধ করছে…”
“কিন্তু জেমস এবং ওই মহিলা-ওরা তোমাকে হত্যার চেষ্টা করবে,” ভীত কণ্ঠে আমি বললাম।
“বেলা, আমার কথা চিন্তা করে অযথা তুমি সময় নষ্ট করো না। তুমি নিজেকে কিভাবে নিরাপদে রাখবে সেটাই তোমার চিন্তা হওয়া উচিত-দয়া করে নিজের কথা চিন্তা করো।”
“এখনো কি ও আমাদের পিছু তাড়া করে আসছে?”
“হ্যাঁ, যদিও বাড়ির ভেতর আক্রমণ করবে না। আজ রাতেও করার সম্ভাবনা কম।”
এ্যাডওয়ার্ড অদৃশ্য কোনো চালকের দিকে পেছন ফিরে তাকালো। আমাদের পেছনে এলিসকে অনুসরণ করতে দেখা ছাড়া আমি আর কিছু দেখতে পেলাম না।
আমরা বাড়িতে সময় মতোই পৌঁছতে পারলাম। ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, তবে চারপাশের গাছ-পালার কারণে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলেও মনে হলো আমার কাছে। ট্রাকটা সম্পূর্ণভাবে থামার আগেই এমেট গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো। তারপর সিটের ওপর থেকে আলতোভাবে তুলে নিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।
আমরা হঠাৎ বিশাল একটা সাদা রঙের ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম। এ্যাডওয়ার্ড এবং এলিসও আমার সাথে সাথে প্রবেশ করলো। এখানে প্রত্যেককেই উপস্থিত দেখতে পেলাম। আমাদের প্রবেশ করার শব্দ শুনে সবাই উঠে দাঁড়ালো। লরেন্ট সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। এমেটের কণ্ঠ থেকে হালকাভাবে এক ধরনের গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। ও আমাকে এ্যাডওয়ার্ডের পাশে বসিয়ে দিলো।
“আমাদের পিছু পিছু তাড়া করে আসছে,” লরেন্টের দিকে এক নজর তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড অভিযোগ জানালো।
লরেন্টের মুখ দেখে প্রচণ্ড হতাশ মনে হলো। “আমি ওই কারণে খুবই ভীত।”
এলিস লাফিয়ে জেসপারের পাশে এসে দাঁড়ালো এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বললো; প্রায় নিঃশব্দে কথাটা বলতে গিয়ে তার ঠোঁট জোড়া তুলনামূলকভাবে একটু জোরেই নড়লো। ওরা একসাথে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। রোজালে চোখ বড়ো বড়ো করে ওদের দেখলো এবং তারপরই এমেটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রোজালের চমৎকার চোখ জোড়ায় একরাশ আবেগ ঝরে পড়ছে এবং যখন ওই চোখজোড়া ঘুরে আমার ওপর নিবদ্ধ হলো-দেখতে পেলাম ওই চোখ জোড়ায় আবেগের বদলে হিংস্র হয়ে উঠেছে।
“জেমস তাহলে কি করতে পারে?” শীতল কণ্ঠে কার্লিসল লরেন্টকে প্রশ্ন করলেন।
“আমি দুঃখিত,” লরেন্ট বললো “ওই মেয়েটাকে যখন আপনার ছেলে জেমসের হাত থেকে বাঁচাতে চাইছিলো, তখনই আমি ভয় পেয়ে যাই। মনে হয় এ কারণেই ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।”
“আপনি ওকে থামাতে পারেন না?”
লরেন্ট মাথা নাড়লেন। “জেমস্ যখন কিছু শুরু করে তখন কোনো কিছু দিয়েই ওকে থামানো যাবে না।”
“আমরা ওকে থামাবো,” এমেট প্রতিজ্ঞা করলো। আমি অবশ্য বুঝতে পারলাম না কী মনে করে ও কথাটা বললো।
“ওকে প্রতিহত করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার তিনশ বছর বয়সে তার মতো কাউকে আমি দেখিনি। জেমস নিঃসন্দেহে একজন রক্ত পিপাসু ব্যক্তি। এবং সে কারণেই আমি তার ডাকিনী দলে যোগ দিয়েছি। মেয়েদের মতো কিছু পুরুষ আছে। তারাও ডাকিনী বিদ্যার চর্চা করে।”
“ডাকিনী বিদ্যা চিন্তা করে দেখলাম, অবশ্যই তেমনই হবে।
লরেন্ট আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তারপর কার্লিসলের উদ্দেশ্যে বললেন। “আপনি কি নিশ্চিত যে এতে কোনো কাজ হবে?”
এ্যাডওয়ার্ড এবার মৃদুভাবে একবার গোঁ গোঁ শব্দ করলো; লরেন্ট ভয়ে পিছিয়ে গেল।
কার্লিসল শান্ত দৃষ্টিতে লরেন্টের দিকে তাকালেন। “আপনি সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দেখে আমার ভয় হচ্ছে।”
লরেন্ট সমস্যা বুঝতে পারলেন। চুপ করে থেকে কিছু একটা চিন্তা করার চেষ্টা করলেন।
“আপনি যে এখানে জীবনগুলো সৃষ্টি করেছেন, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিলো। এই ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও আমার নাক গলানোর ইচ্ছে ছিলোও না এখনো ইচ্ছে নেই-আপনাদের কারও সাথে শত্রুতাও নেই, কিন্তু জেমসের বিপক্ষে আমার কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়। ইচ্ছে ছিলো উত্তরে আমরা যাত্রা করবো-ডেনালীর একটা গোত্রের সাথে যোগ দিবো।
লরেন্ট খানিকটা ইতস্তত করলো। জেমসকে কোনভাবেই খাটো করে দেখার চেষ্টা করবেন না। ওর মনের জোর অত্যন্ত বেশি। আগে থেকেই ও সবকিছু ধারণা করে ফেলতে পারে। মনুষ্য জীবনের যা কিছু আছে তার কোনো কিছুই অজানা নেই এবং এখানে সে আপনার মুখোমুখিও হতে আসবে না। আপনার ক্ষমতা যে কতো বেশি তা সে জেনে গেছে।…এখানে যে অযাচিত ঘটনাগুলো ঘটে গেল, তার জন্যে আমি দুঃখিত, সত্যিই আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” লরেন্ট মাথা নিচু করে কার্লিসলকে কুর্নিশ করলেন বটে, কিন্তু তার আগেই একবার রহস্যময় ভঙ্গিতে আমাকে দেখে নিলো।
“শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা আপনাকেই করতে হবে, কার্লিসল স্বাভাবিক উত্তর দিলেন।
লরেন্ট খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এরপরই দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন।
ঘরের ভেতরের নিরবতা ক্ষণিকের জন্যে স্থায়ী হলো যেন।
“কততদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছে?” কার্লিসল এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
এসমে ইতোমধ্যে নড়াচড়া শুরু করেছে, কীপ্যাডের ওপর আঙ্গুল দিয়ে টোকা দেবার মতো করে দেয়ালের ওপর এখন টোকা দিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কারণ নেই, উত্তেজনার কারণেই সে এমন করছে।
“নদী থেকে প্রায় তিন মাইল পেছনে; ওখানে ওই মেয়েটার সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছে তার।” এ্যাডওয়ার্ড জবাব দিলো।
“এখন কি পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে?”
“ওদের আমি মাঝপথেই থামিয়ে দিবো। তারপর এলিস এবং জেসপার ওই মেয়েটাকে দক্ষিণে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।”
“তারপর?”
এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর ম্লান কোণালো। “যতো দ্রুত সম্ভব বেলার জীবন আমরা রক্ষা করবো-আমরা জেমসকে হত্যা করবো।”
“আমার মনে হয় এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায়ও নেই, কার্লিসল এ্যাডওয়ার্ডের কথায় সমর্থন জানালেন। কার্লিসলের মুখ এখন কঠিন হয়ে উঠেছে।
এ্যাডওয়ার্ড রোজালের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
“তুমি ওকে উপরতলায় নিয়ে যাও এবং পোশাকগুলো পাল্টিয়ে ফেলতে বলো,” আদেশের সুরে বললো এ্যাডওয়ার্ড। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে রোজালে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালো।
“আমি কেন?” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো রোজালে।” ভয়ঙ্কর ছাড়া আমি ওকে আর কিছুই মনে করি না-অযথাই একটা বিপদ ডেকে এনেছো তুমি। ওর জন্যে এখন আমাদের প্রত্যেককে কষ্ট পেতে হচ্ছে।”
রোজালের মুখ থেকে এ ধরনের নিষ্ঠুর কথা শুনে, আমি প্রায় আঁতকে পেছনে সরে এলাম।
“রোজ…” এমেটও এ ধরনের কথা শুনে বিচলিত হয়ে উঠেছে। আর এ কারণে কথাটা পর্যন্ত সে শেষ করতে পারলো না। ও রোজালের কাঁধের ওপর শান্তভাবে হাত রাখলো। আমার কারণে রোজালে এতটাই রেগে গেছে!
সতর্ক দৃষ্টিতে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে একবার তাকিয়ে তার মনোভাবটা বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম।
এ্যাডওয়ার্ড অবশ্য আমাকে অবাক করলো। রোজালের ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে-মনে হলো যেন রোজালে কোনো মন্তব্যই করেনি, একবারের জন্যে ও উত্তেজিত হয়নি।
“এসমে?” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
“অবশ্যই, এসমে বিড়বিড় করে এ্যাডওয়ার্ডকে সমর্থন জানালো।
এসমে আমার পাশে এতো কাছে এসে দাঁড়ালো যে, রীতিমতো তার হৃঃস্পন্দনও শুনতে পেলাম। হাতটা বাড়িয়ে আমি ওর কনুয়ের কাছে চেপে ধরলাম। খানিক আগে রোজালের কথায় যে মানসিক আঘাত পেয়েছি, তা মন থেকে দূর করতে গভীরভাবে একবার নিঃশ্বাস ফেললাম।
“আমরা এখন কি করতে যাচ্ছি?” দ্বিতীয়তলার একটা অন্ধকার রুমে বসে এসমে কে প্রশ্ন করলাম আমি।
“তোমার শরীরের গন্ধের ভেতর কিছু ব্যতিক্রম আনতে চাইছি। যদিও এভাবে ওই শয়তানটাকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে বিভ্রান্ত করা যাবে না, কিন্তু কিছু সময়ের জন্যে ওর মন থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে। এসমে শরীর থেকে পোশাক খুলে মেঝের ওপর রাখতে লাগলো। অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেলেও, মেঝের ওপর পোশাক পড়ার শব্দ আমি ঠিকই শুনতে পেলাম।
“আমার মনে হয় ওই পোশাকগুলো আমার শরীরে ঠিক…” আমি খানিকটা ইতস্তত করলাম। কিন্তু প্রতিবাদ না শুনে, দ্রুত হাতে মাথা গলিয়ে আমার জামাটা খুলে নিলো। আমি ও দ্রুত হাতে বোতাম খুলে জিনসটা খুলে ফেললাম। ও আমার হাতে কিছু একটা ধরিয়ে দিলো। হাতে নিয়ে জিনিসটাকে জামা বলেই মনে হলো। ওর জামাটা আমার শরীরের তুলনামূলকভাবে খাটো হওয়ার কারণে ওটা পরতে আমাকে বেশ কসরত করতে হলো। জামা পরে নেবার সাথে সাথে এসমে তার স্ন্যাকা এগিয়ে দিলো। আমি এক নজর ওটার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো ঠিক উল্টো, স্ন্যাকটা আমার শরীরের তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা। তবে ওটাকেই মানিয়ে নিতে হলো। আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম আর ও মাটিতে বসে নিচের অংশটা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মুড়িয়ে দিলো। পোশাক পরা শেষ হওয়ার পর ও আমাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেল। দেখলাম এলিস ওখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে ধরা ছোটো একটা চামড়ার ব্যাগ। এসমে এবং এলিস আমাকে দুদিক থেকে দুই কনুই ধরে প্রায় ঝুলাতে বুলাতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনলো।
সিঁড়ির কাছে এসে মনে হলো এরই মধ্যে সবকিছুই গুছিয়ে ফেলা হয়েছে। এ্যাডওয়ার্ড এবং এমেট যাওয়ার জন্যে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছে। এমেটের পিঠের ওপর বাঁধা বিশালাকৃতির ব্যাগ। কার্লিসল ছোটো কি যেন একটা জিনিস এসমের হাতে ধরিয়ে দিলেন। একই ধরনের জিনিস তিনি এলিসের হাতে ধরিয়ে দিলেন। জিনিসগুলো আর কিছুই নয়, ক্ষুদ্রাকৃতির রুপালি রঙের সেল ফোন।
“বেলা এসমে এবং রোজালে হয়তো তোমার ট্রাকটা ব্যবহার করতে পারে” কার্লিসল আমার দিকে খানিকটা এসে বললেন। রোজালের দিকে তাকিয়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম। ও কার্লিসলের দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্ধভাবে কী যেন বলে উঠলো। অবশ্য আমি তা শুনতে পেলাম না।
“এলিস এবং জেসপার তোমরা মার্সিডিজটা নিয়ে যাবে। তোমরা সবাই সোজা দক্ষিণে চলে যাবে।”
একইভাবে সমর্থনের ভঙ্গিতে ওরাও মাথা নাড়ালো।
“আমরা জীপটা সাথে নিবো।” আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে কার্লিসল এ্যাডওয়ার্ডের সাথে যাওয়ার জন্যে আগ্রহী হয়ে আছেন। ওরা যে ভাবে শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা দেখে হঠাৎ আমি আতংকিত হয়ে উঠলাম।
“এলিস?” কার্লিসল জিজ্ঞেস করলেন “তোমার কি মনে হয়, আমরা ওদেরকে প্রলুব্ধ করতে পারবো?”
প্রত্যেকের দৃষ্টি এলিসের দিকে ঘুরে গেল। ও চোখ বন্ধ করে রেখেছে নিশূপভাবে দাঁড়ানো এলিসের চোখ জোড়া শক্তভাবে বন্ধ করে রাখা।
অবশেষে ও চোখ খুললো। জেমস তোমাকে অনুসরণ করবে। ওই মেয়েটা অনুসরণ করবে ট্রাককে। এরপর অবশ্য আমরা মুক্ত।” সম্পূর্ণ আত্নবিশ্বাস নিয়ে বললো এলিস।
“তাহলে রওনা হওয়া যাক!” কার্লিসল কিচেনের দিকে রওনা হলেন।
অবশ্য এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমার হাত শক্তভাবে চেপে ধরে রেখেছে। ওর দৃঢ় মনোবল দেখে কিছুটা হলেও সাহস খুঁজে পেলাম। পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতে ও মেঝে থেকে আমাকে খানিকটা উঁচু করে তুলে ধরলো। এবং ওর বরফ শীতল ঠোঁট আমার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরলো। মাত্র সেকেন্ড কয়েক। তারপর ঠোঁট সরিয়ে নিলো এ্যাডওয়ার্ড। মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে দুই হাতে আমার গাল চেপে ধরলো, ওর চমৎকার চোখের দৃষ্টি আমাকে দহন করলো খানিকক্ষণ।
এরপর এ্যাডওয়ার্ডের দৃষ্টি নিপ্রভ মনে হলো এবং ও ঘুরে দাঁড়ালো।
এরই মধ্যে অন্যান্য সদস্যরাও রওনা হলো। আমি এবং এ্যাডওয়ার্ড ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখ এবং নাক দিয়ে পানি গড়িয়ে নামার বিবৃতকর দৃশ্যটা অবশ্য কারও নজরে পড়লো না।
নিস্তব্ধতা পার হলো, এবং তারপর পরই এসমের হাতে ধরা ফোনটা কেঁপে উঠলো। কথা বলার জন্যে ফোনটা ও কানের কাছে ধরলো।
“এখন” এসমে বললো। আমার দিকে একবারো না তাকিয়ে রোজালে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু এসমে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার মুখটা একটু স্পর্শ করলো।
“সাবধানে থাকবে।” ফিসফিস করে বললো এসমে। আমার ট্রাকটার চালু হওয়ার গর্জন শুনতে পেলাম। তারপর অল্পক্ষণের ভেতরই শব্দটা মিলিয়ে গেল।
জেসপার এবং এলিস অপেক্ষা করতে লাগলো। এলিসের ফোনটা বেজে ওঠার আগেই ও সেটা কানে ঠেকালো।
“এ্যাডওয়ার্ড বললো মেয়েটা এসমের পেছন পেছন এগুচ্ছে। আমি গাড়িটা নিয়ে এগুচ্ছি।” এ্যাডওয়ার্ডের গমন পথের দিকে এলিস এগিয়ে গেল।
জেসপার এবং আমি একে অপরের দিকে তাকালাম।
“তুমি যে ভুল, তা তুমি ভালোভাবেই জানো,” ও শান্ত কণ্ঠে বললো।
“তুমি কোন ব্যাপারে বলছো?” আমি ঢোক গিলে বললাম।
“তুমি কী ভাবছো, আমি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি তোমার এ ধরনের চিন্তা মোটেও সুফল বয়ে আনবে না।”
“ঠিক তা নয়,” আমি অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করলাম ওদের যদি কিছু একটা ঘটে যায়, এটা সে তুলনায় কিছুই নয়।”
“তুমি আসলেই ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো, জেসপার আবার কথাটার পুনরাবৃত্তি করলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে ও মিষ্টি করে একবার হাসলো।
আমার কানে সত্যিকার অর্থে কিছুই ঢুকলো না বটে, কিন্তু তারপরই এলিস সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
“আমি কি সাহায্য করতে পারি?” ও জিজ্ঞেস করলো।
“তুমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে আমার কাছ থেকে অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করলে।” ওকে সমর্থন দেবার ভঙ্গিতে আমি ম্লানভাবে একটু হাসলাম।
এমেট যেভাবে আমাকে অতি সহজে কোলে তুলে নিয়েছিল, এলিসও একইভাবে আমাকে তুলে নিলো। ও আমাকে এমনভাবে জাপটে ধরে রাখলে যে, কোনো বিপদই যেন আমাকে স্পর্শ করতে না পারে। এরপর আমরা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম পেছনে থেকে গেল শুধু আলোয় আলোকিত বাড়িটা।
.
২০.
যখন আমি জেগে উঠলাম নিজেকে একেবারেই বিভ্রান্ত মনে হলো। আমার চিন্তাগুলো সব এলেমেলো হয়ে গেছে-সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে যা কিছুই ঘটেছে তা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি কোথায় শুয়ে আছি সেটা বুঝতেও আমার অনেকটাই সময় লেগে গেল।
আমার এই শোবার রুমটা যেখানেই হোক অত্যন্ত নিরিবিলি, তবে ধারণা করা যায় এটা হোটেলেরই কোনো রুম হবে। সুন্দর পাল্লা লাগানো বেডসাইড টেবিল এবং ল্যাম্প। দেয়ালের সাথে ঝুলানো দীর্ঘ পর্দাগুলো একই রকমের কাপড়ে তৈরি করা।
এখানে কীভাবে এলাম তা একবার চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রথম দিকে কিছুই মনে করতে পারলাম না।
অবশেষে একে একে সব মনে পড়তে লাগলো চকচকে কালো গাড়ি, গাড়ির জানালার কাঁচগুলো লিমুজিন গাড়ির মতো গাঢ় রঙের। ইঞ্জিনের প্রায় কোনো শব্দই হচ্ছিলো না। কালো রাস্তা ধরে যানমুক্ত সড়ক ধরে আমরা স্বাভাবিকের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
মনে পড়লো এলিস আমার সাথে পেছন দিককার চামড়ার সিটে বসে ছিলো। রাতের দীর্ঘ যাত্রাপথে আমি মাথাটা ওর কাঁধের ওপর রেখে ঝিমুচ্ছিলাম। এতো কাছে বসে থাকার পরও অবশ্য এলিস একটুও বিব্রতবোধ করেনি। এমনকি ওর ত্বক শীতল এবং খানিকটা রুক্ষ হলেও ওর সাথে থাকতে আমার মোটেও খারাপ লাগলো না। এই চলার পথে আমি ক্রমাগত কেঁদেছি। আমার চোখের পানিতে এলিসের সাদা সৃতির জামার সামনের দিকটার গায় সম্পূর্ণ অংশই আমি ভিজিয়ে ফেলেছিলাম।
ঘুম চোখ থেকে সম্পূর্ণ পালিয়ে ছিলো, শেষরাত পর্যন্ত প্রায় একইভাবে আমি চোখ খুলে রেখেছিলাম এবং সূর্য ওঠার পর বুঝতে পারলাম ক্যালিফোর্নিয়ার ছোটো খাটো কোনো পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছেছি। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে ধূসর বর্ণের অদ্ভুত এক আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এই অদ্ভুত আলো চোখের ওপর এসে পড়ায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করলাম, কিন্তু তবুও আমি চোখ বন্ধ করতে পারলাম না। অবশ্য খানিক বাদে যখন বন্ধ করার সুযোগ পেলাম; তখন আমার চোখের সামনে একের পর এক সব দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগলো, অনেকটা যেন চোখের পাতার সামনে দিয়ে একের পর এক স্লাইড সরে যাচ্ছে, আমার এভাবে দৃশ্যগুলো সরে যাওয়া মোটেও ভালো লাগলো না। চার্লির মর্মাহত হওয়ার দৃশ্য, এ্যাডওয়ার্ডের হিংস্রভাবে দাঁত বের করে হিসহিস করে ওঠা, রোজালের আমার প্রতি বিতৃষ্ণা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন জেমসের আমাদের পিছু তাড়া শেষবার এ্যাডওয়ার্ড আমাকে চুমু খাওয়ার পর, হতাশ মুখচ্ছবি… আমি আশপাশ কোথাও ওদের দেখতে পেলাম না। স্বাভাবিকভাবেই আমার উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। এরপর দেখতে পেলাম সূর্যটা আরো উপরে উঠে এসেছে।
পাহাড়ের পাশ দিয়ে এক চিলতে রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এলাম। সূর্য এখন আমাদের পেছন থেকে আলো ছড়াচ্ছে। শক্ত পাথরের পাহাড়ের ওপর সেই সূর্যের আলোর প্রতিফলন ঘটছে। আমি এতোটাই আবেগতাড়িত হয়ে ছিলাম যে, অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা তিনদিনের পথ মাত্র একদিনে পার হয়ে এসেছি। চারদিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম সমান্তরাল বিশাল এক খোলা প্রান্তর। ফিনিক্স। পামগাছ, এলোমেলোভাবে চারদিকে গজিয়ে। উঠেছে ছোটোখাটো লতাগুলোর ঝড়, সবুজ মসৃণ ঘাসে আবৃত গলফ্ কোর্স। আর খানিক দূরে পরিষ্কার টলটলে পানির সুইমিংপুল। পামগাছগুলো ছায়া এসে পড়েছে ফ্রীওয়ের ওপর। কিন্তু এতোকিছুর পরও এগুলোর কিছুই আমার ভালো লাগলো না।
“বেলা, এয়ারপোর্টটা কোন পথে?” জেসপার প্রশ্ন করলো। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। যদিও জেসপার অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করেছে আমাকে। এতোক্ষণ পর এই প্রথমবারের মতো কারও মুখ থেকে কোনো কথা শুনতে পেলাম।
“আই-টেন”-এ থাকা যেতে পারে আপনাআপনি উত্তরটা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।” আমরা খানিক আগে ওটা পেছনে ফেলে এসেছি।”
আমার চিন্তার জটগুলো একটু একটু করে খুলতে শুরু করেছে।
“আমরা কি প্লেনে কোথাও যাচ্ছি?” আমি এলিসকে প্রশ্ন করেছিলাম।
“না, কিন্তু বিষয়টা মাথায় রাখতে চাইছিলাম, যদি তেমন কিছু ঘটে তাহলে প্লেনে চাপতেও হতে পারে।”
আমার মনে পড়লো,” স্কাই হারবার ইন্টারন্যাশনাল চারদিকে আমার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম…কিন্তু ওই ঘুরে বেড়ানো শেষ হয়নি। মনে হয় তখনই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
যদিও এখন ওই সময়কার অনেক কিছুই মনে করতে পারছি। গাড়ি থেকে নামার এক ধরনের জোর তাগিদ অনুভব করছিলাম দিগন্তরেখায় তখন সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। এলিসের কাঁধ আঁকড়ে আমি বসে আছি এবং এলিস আমার বুকের কাছে ওর একহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
এই রুমটা সম্পর্কে আমি কোনো স্মৃতি মনে করতে পারলাম না।
নাইট স্ট্যান্ডের ওপরকার ডিজিটাল ক্লকটার দিকে তাকালাম। লাল জ্বলজ্বলে অক্ষরে তিনটা বাজার সংকেত প্রদর্শন করছে, কিন্তু ঘড়িতে দিন কিংবা রাত, তার কোনো সংকেত নেই। ভারি পর্দা ভেদ করে বাইরে থেকে কোনো আলোও ঘরে ভেতর। প্রবেশ করছে না, তবে ল্যাম্পের আলোয় রুমটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
বিছানা থেকে উঠে আমি দ্রুত জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে ফেললাম।
বাইরের দিকটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে আছে; তাহলে তিনটা বলতে এখন ভোর তিনটা। জানালা থেকে ফ্লীওয়ের ধূ ধূ প্রান্তর চোখে পড়লো। একই সাথে চোখে পড়লো এয়ারপোর্টে দীর্ঘ দিন গাড়ি রাখার গ্যারাজগুলো। নির্দিষ্ট সময় এবং অবস্থান জানার পর আমি একটু স্বস্তিবোধ করতে পারলাম।
এরপর নিজেকে আমি লক্ষ করার চেষ্টা করলাম। এখন পর্যন্ত আমি এসমের পোশাকই পরে আছি এবং মোটেও তা আমার শরীরের সাথে মানানসই মনে হচ্ছে না। আমি রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলালাম, নিচু ড্রেসারের ওপর আমার পেটমোটা ব্যাগটা দেখে বেশ অবাকই হলাম।
যখন আমি পোশাক পাল্টানোর ইচ্ছেয় ড্রেসারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তখনই দরজার ওপর মৃদ টোকা দেবার শব্দ শুনতে পেলাম। এই সামান্য শব্দেও আমি প্রায় আঁতকে উঠলাম।
“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” এলিস প্রশ্ন করলো।
আমি গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম।” অবশ্যই।”
রুমে ঢুকে সতর্কভাবে আমার ওপর একবার দৃষ্টি বুলালো। “মনে হয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছো,” বললো।
আমি শুধু মাথা নাড়লাম।
যে পর্দাগুলো আমি খানিক আগে সরিয়ে দিয়েছিলাম, সেগুলোই ভালোভাবে আবার বন্ধ করে দিলো।
“আমাদের এখন ভেতরে থাকা উচিত, এলিস বললো।
“ঠিক আছে।” মোটেও স্বাভাবিক কণ্ঠে আমি উত্তর দিতে পারলাম না।
“পিপাসা লেগেছে?” ও জিজ্ঞেস করলো আমাকে।
আমি শ্রাগ করলাম। “আমি ঠিকই আছি। তুমি কেমন আছো?”
“খুব একটা খারাপ নই।” এলিস একটু হাসলো। “আমি তোমার জন্যে কিছু খাবারের অর্ডার দিই। সামনের ঘরে বসেই খেতে পারবে। এ্যাডওয়ার্ড আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, আমার ঘন ঘন খাবার গ্রহণের প্রয়োজন। আমাদের অবশ্য এতোটা খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় না।”
ওর নাম শুনে সাথে সাথে আমি উত্তষ্ঠিত হয়ে উঠলাম। “ও ফোন করেছিলো?”
“না” কথাটা বলে, ও সাথে সাথে আমার মুখের দিকে তাকালো। “আমরা ওখান থেকে রওনা হওয়ার আগে শেষ দেখা করেছিলো।”
এলিস আমার হাত আলতোভাবে ধরে হোটেল স্যুইটের লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দেখতে পেলাম টিভি থেকে মৃদু কথার শব্দ ভেসে আসছে। কোণার দিককার একটা ডেস্কের সামনে জেসপার চুপচাপ বসে আছে। টেলিভিশনের খবরের দিকে ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেও মনোযোগ দিয়ে জেমস কিছুই দেখছে না বা শুনছে না।
এলিস সোফার হাতলের ওপর বসে জেসপারের মতোই ভোতা দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলো খানিকক্ষণ।
খেতে খেতে ওদের আমি লক্ষ করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম খানিক পরপরই ওরা একে-অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এই রুমটাতে প্রবেশ করার পর থেকেই ওরা একেবারে চুপচাপ হয়ে আছে। টেলিভিশনের স্ক্রীনের ওপর থেকে ওরা একবারের জন্যেও দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না। যদিও এখন বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে, তবুও ওরা টিভির ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। আমি খাবার ট্রে-টা একপাশে রাখলাম। কেন জানি না, পেটের ভেতর এখন কেমন যেন এক ধরনের মোচড় দিতে শুরু করেছে।
“এলিস কিছু কি ঘটেছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তেমন কিছুই নয়।” ওর চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে উত্তর দিলো। সত্য কথা বলছে বলে মনে হলেও আমি ঠিক ওকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
“ওরা এখন কি করছে?”
“আমরা কার্লিসলের ফোনের অপেক্ষায় আছি।”
“তার পক্ষে কি এখন ফোন করা সম্ভব?” মনে হলো আমি বোধহয় সঠিক কোনো অনুমান করতে পারছি না। এলিস সাথে সাথে তার ব্যাগের ওপর রাখা ফোনটার দিকে তাকালো।
“তোমাদের এই কথার অর্থ কি?” আমার কণ্ঠস্বর খানিকটা কেঁপে উঠলো। অনেক কষ্টে নিজের কণ্ঠস্বরকে আমি সংযত করলাম। তার মানে তিনি এরই মধ্যে ফোন করছেন না?”
“এর অর্থ হচ্ছে তারা এখন পর্যন্ত আমাদের সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারেন নি।” কিন্তু ওর কণ্ঠ বেশ স্বাভাবিকই কোণালো।
জেসপার এলিসের পাশে এসে দাঁড়ালো। বলা যেতে পারে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। সাধারণত ও আমার এতো কাছাকাছি কখনো দাঁড়ায়নি।
“বেলা,” শীতল এবং শান্ত কণ্ঠে বললো জেসপার।” তোমার এই বিষয়গুলো নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই।
তুমি এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদেই থাকবে।”
“আমি তা ভালোভাবেই জানি।”
“তাহলে তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন?” জেসপার জিজ্ঞেস করলো। আমি যে কেন উৎকণ্ঠিত, কাদের জন্যে উৎকণ্ঠিত, তা না জেনেই শুধু আমাকে অভয় দেবার চেষ্টা করলো।
“লরেন্ট কী বলেছিলো, নিশ্চয়ই তোমরা তা শুনেছিলে।” আমি প্রায় ফিসফিস করে বললাম। কথাগুলো ফিসফিস করে বললেও, নিশ্চিত যে ওরা তা ভালোভাবেই শুনতে পারছে।” উনি বলেছিলেন জেমস হচ্ছে রক্তপিপাসু। যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে, তাহলে কি ওরা বিচ্ছিন্ন হতে পারবে? যে কারও ওপরই আক্রমণ আসুক না কেন, কার্লিসল, এমেট …এ্যাডওয়ার্ড…” আমি ঢোক গিলোম। এসমেকে যদিও শিকারি মেয়েটা আক্রমণ করে আমার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। মনে হলো আমি হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। “আমার ভুলের কারণে এই ক্ষতি আমি কি ভাবে মানিয়ে নিবো? তোমরা কেউই আমার কোনো ক্ষতি করেনি, তাহলে আমার জন্যে তোমাদের ক্ষতি কেন আমি মেনে নেবো, আমি কেন
“বেলা বেলা থামো,” ও আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো। ও কথাগুলো এতো দ্রুত বললো যে, আমি প্রায় বুঝতেই পারলাম না।” তুমি অযথাই সব উল্টা পাল্টা বিষয় নিয়ে ভীত হয়ে আছে। বেলা তুমি আমাকে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারো আমাদের কেউই কিন্তু বিপদাপন্ন নয়। তুমি অযথাই এই বিষয়টা নিয়ে মানসিক উত্তেজনায় ভুগছো। আমার কথা শোনো!” অনেকটা আদেশের সুরেই জেমস আমার মানসিক উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করতে চাইলো। আমি স্বাভাবিক ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমাদের পরিবারটা খুবই শক্তিশালী। আমাদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাকে হারাতে হয় কিনা সেটা নিয়েই আমাদের যতো ভয়।”
“কিন্তু তুমি কেন-”
এবার এলিস আমার কথার ভেতর বাঁধ সাধলো। আমার চিবুকের ওপর ওর শীতল আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে বললো, “প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে এ্যাডওয়ার্ড কিন্তু একাই ছিলো। এখন ও তোমাকে প্রথমবারের মতো খুঁজে পেয়েছে। ওর ভেতরকার পরিবর্তনগুলো আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু তুমি মোটেও বুঝতে পারবে না। তোমাকে হারিয়ে আবার তোমার মতো কাউকে খুঁজে পেতে এ্যাডওয়ার্ড আরো শ’ বছর পার করে দিক, এমন কি আমরা কেউ চাইতে পারি?”।
সমস্ত দিনটাকেই আমার কাছে মনে হলো অতি দীর্ঘ।
আমরা রুমের ভেতরই সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দিলাম। এলিস ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আমাদের বর্তমানে কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, সুতরাং কেউ যেন আমাদের অযথা বিরক্ত না করে। জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখা। টেলিভিশনটা অবশ্য আগের মতোই চালু রাখা হয়েছে যদিও টিভিটা কেউই দেখছে না। এতে গতানুগতিক সব অনুষ্ঠানই প্রচারিত হচ্ছে। আগের মতোই এলিসের ব্যাগের ওপর সেলফোনটা পড়ে আছে।
দুপুর বেলায় সবকিছু আমার কাছে অসহ্য মনে হতে লাগলো। আমি বিছানায় ফিরে গেলাম কিছু ভেবে নয়, কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারবো এই ভেবেই। এলিসও অবশ্য আমার সাথে সাথেই এলো। আমি একটা বিষয় ভেবে বের করতে পারলাম না, অতি অল্প সময়ের ভেতর এ্যাডওয়ার্ড আমার ব্যাপারে এলিসকে কোন কোন বিষয়ে নজর দেবার কথা বলে দিয়েছে। আমি বিছানায় বসে পড়লাম, আর এলিস আমার পাশেই পা ভাঁজ করে বসে থাকলো। এলিসের সাথে প্রথম দিকে আমার কথা বলতে ভালো লাগলো না- চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। কেন যেন হঠাৎ আমার বেশ ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু ঘুরে ফিরেই জেসপারের কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। ঘুমানো আর হলো না। উঠে বসে পা ভাঁজ করে এলিসের কাছ থেকে তথ্যগুলো আদায়ের চেষ্টা করলাম।
“এলিস?” আমি ওকে ডাকলাম।
“হ্যাঁ, বলো?”
আমার কণ্ঠকে যতোটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। “তোমার কি মনে হয়, ওরা কি করছে?”
“কার্লিসল, একেবারে উত্তরে ওই শিকারি জেমসের জন্যে অপেক্ষায় আছেন। জেমস এখনো কার্লির্সলের কাছাকাছি হয়নি। কাছাকাছি হলেই তিনি রুখে দাঁড়াবেন এবং জেমসকে আতর্কিত আক্রমণ করে বসবেন। এসমে এবং রোজালে সম্ভবত পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে। যতোক্ষণ পারে ওই মেয়েটাকে ওদের পিছু তাড়া করার সুযোগ দিতে চাইছে– এটাকে তুমি ওই মেয়েটাকে এক ধরনের আটকে রাখার চেষ্টাও বলতে পারো। যদি ও দিক পরিবর্তন করে, তাহলে এসমে এবং রোজালে ফরস-এর দিকে রওনা হবে। তোমার বাবার ওপর নজর রাখার জন্য। সুতরাং আমি চিন্তা করছি সবকিছু ভালোভাবেই এগুচ্ছে। এ কারণেই তারা ফোন করছে না। এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে জেমস কার্লিসলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে হয়তো। এ সময় কার্লিসল কোনো কথা বলতে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে সবকিছু ওই শয়তানটার কানে চলে যাওয়া।”
“আর এসমে?”
“আমার ধারণায় ও ফরকস্-এ ফিরে গেছে। ও ফোন করতে পারছে না, তার কারণ ওই মেয়েটা। কার্লিসলের মতো এসমের কথাও ওই শয়তান মেয়েটার কানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার ধারণা আমাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই অতি সতর্কভাবে এই সমস্যাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে এবং সবাই নিরাপদেই আছে।”
“তুমি কি সত্যই মনে করছো, ওরা সবাই নিরাপদে আছে?”
“বেলা, আমি তোমাকে কতোবার বলবো যে, ওরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যে মোটেও ভয়ংকর নয়।”
“তবুও অন্য কিছু ঘটলে তুমি কি আমাকে সত্য কথাটা বলবে?”
“হ্যাঁ, আমি সবসময়ই তোমাকে সত্য কথা বলবো।” ওর কণ্ঠ সম্পূর্ণ আন্তরিক কোণালো।
আমি খানিকক্ষণ কোনো কথা বললাম না, তবে বুঝে শুনেই যে কথাগুলো বলেছে, এতোটুকু ঠিকই বুঝতে পারলাম।
“তাহলে এখন বলো কিভাবে তুমি একজন ভ্যাম্পায়ার হয়ে উঠলে?”
আমার প্রশ্ন শুনে ও থমকে গেল। ও কিছুই বললো না। আমি চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু তার ভেতর তেমন কোনো বলার আগ্রহ লক্ষ করলাম না।
“এ্যাডওয়ার্ড কখনোই চায় না এই কথাগুলো তোমাকে জানানো হোক,” শান্ত কণ্ঠে বললো এলিস। তবে বুঝতে পারলাম ও-ই আসলে কথাগুলো বলতে চাইছে না।
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমার জানার আগ্রহ তো থাকতেই পারে!”
“আমি জানি।”
ওর দিকে তাকিয়ে কোণার আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এলিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “এ্যাডওয়ার্ড কিন্তু খুব রেগে যাবে।”
“এ বিষয় নিয়ে ওর তো নাক গলানোর কিছু নেই! এই বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে তোমার এবং আমার মধ্যে। এলিস, তোমাকে একজন বন্ধু মনে করেই জানতে চাইছি সবকিছু। যেভাবেই হোক আমরা দুজন এখন বন্ধু- সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরে এই কথাগুলো তোমার জানানো উচিত।”
উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকালো…আমার দিকে তাকিয়ে বক্তব্যগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো হয়তো।
“এর নিয়মগুলো হয়তো তোমাকে বলতে পারবো,” অবশেষে এলিস মুখ খুললো, “কিন্তু আমি কীভাবে ভ্যাম্পায়ার হয়ে উঠলাম তার কিছুই মনে নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাকে কীভাবে ভ্যাম্পায়ার তৈরি করা হলো তার কিছুই এখন বলতে পারবো না। তাছাড়া আমি কখনোই কারও ওপর এর প্রয়োগ ঘটাতে যাইনি, অথবা কীভাবে একজন মৃতকে ভ্যাম্পায়ার তৈরি করে সেটাও দেখিনি। যতোটুকু আমার মনে আছে, তাতে শুধু এর তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারবো।”
বিস্তারিত সব কোণার আশায় আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
“শিকারজীবী হওয়ার কারণে আমাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য মজুদ করে রাখতে পারি, যতোটুকু প্রয়োজন, তার চাইতে অনেক বেশি পরিমাণ। দৈনিক শক্তি, গতি, পঞ্চইন্দ্রীয় ক্ষমতা, কারো সাথে কোনোভাবেই তুলনা করা যাবে না। অন্যদিকে এ্যাডওয়ার্ড, জেসপার এবং আমার ক্ষমতাগুলোও একই রকমের নয়। যেমন এ্যাডওয়ার্ডের ক্ষমতা আমাদের চাইতে অনেক বেশি। তারপর ধরো মাংসভোজী বা কীট-পতঙ্গ ভোজী ফুলের মতো আমরা দৈহিকভাবে আমাদের শিকারকে আকর্ষণ করতে পারি।”
মনে পড়লো, এ্যাডওয়ার্ড ওই খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আমাকে এরকমই কিছু ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিলো।
এলিস আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুভাবে হাসলো। “সত্যি বলতে আমাদের আরেকটা মারাত্নক অস্ত্র আছে। আমরা বিষাক্তও বটে,” ও বললো, ওর দাঁতগুলো ঝিকমিকিয়ে উঠলো। “এই বিষের মাধ্যমে কাউকে হত্যা করা সম্ভব নয়-তবে এর মাধ্যমে কারও কর্মক্ষমতাকে নষ্ট করে ফেলা সম্ভব। এটা খুব ধীরে ধীরে কাজ করে, রক্তের মাধ্যমে সমস্ত শরীরে এই বিষ ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে যদি আমাদের শিকারকে কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারি, তাহলে এক সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে। প্রায় সবকিছুই আমি তোমাকে বলে ফেলেছি। আমরা যদি ইচ্ছে করি তাহলে কোনো শিকারই আমাদের কাছ থেকে পালাতে পারে না। অবশ্যই, কার্লিসল এর ব্যতিক্রম।”
“তো…যদি এই বিষ কারও ওপর প্রয়োগ করা হয়…,” আমি বিড়বিড় করে বললাম।
“সম্পূর্ণভাবে এধরনের বিষ শিকারের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে দিন কয়েক লেগে যেতে পারে। এটা নির্ভর করে কী পরিমাণ বিষ রক্তে মিশেছে তার ওপর, হৃৎপিণ্ডের কতোটা বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে ইত্যাদির ওপর। ওই শিকারের হৃৎস্পন্দন ঠিক আগের মতোই স্পন্দিত হতে থাকবে, আর বিষও সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। এই বিষ সমস্ত শরীর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শরীরে এক ধরনের হিলিং-এর মতো কাজ করতে থাকবে– সমস্ত শরীরে এক ধরনের পরিবর্তন শুরু হবে। স্বাভাবিকভাবেই এক সময় হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে এবং পরিবর্তনগুলোও থেমে যাবে। কিন্তু এমন এক ধরনের অবস্থায় সৃষ্টি হবে যে, শিকার প্রতিটা মিনিটে নিজের মৃত্যু কামনা করতে থাকবে।”
আমি শিউরে উঠলাম।
“তোমাকে দেখে খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে না।”
“এ্যাডওয়ার্ড বলেছিলো, এ ধরনের কিছু করাটা নাকি খুব কঠিন কাজ…আমি তখন ঠিক বিষয়টা বুঝতে পারিনি,” আমি এলিসকে বললাম।
এক দিক থেকে তুমি আমাদের হাঙ্গরের সাথেও তুলনা করতে পারো। একবার যদি রক্তের স্বাদ গ্রহণ করি অথবা রক্তের গন্ধ নাকে এসে লাগে, তাহলে ওই রক্তপান না করে সহজে নিবৃত্ত হতে পারি না। আর নিজেদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও প্রচণ্ড কষ্ঠ হয়, মাঝে মাঝে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তো, কখনো যদি কোনো শিকারকে আমাদের কেউ কামড়িয়েই ফেলে, এবং কোনোভাবে রক্তের স্বাদ পেয়ে যার তাহলে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এটা উভয় দিক থেকেই এক ধরনের সমস্যা এক দিকে রক্তের তৃষ্ণা, অন্যদিকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করার কষ্ট সহ্য করা।”
“তোমার কিছুই মনে নেই, এখন মনে হওয়ার কারণ কি?”
“আমি কিছুই জানি না। সবার অনুভূতিই প্রায় একই রকম। মনুষ্য জীবন সম্পর্কে ওরাও কিছু মনে করতে পারে না। আমিও কখনো আগের জন্ম নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করিনি। এলিসকে প্রচণ্ড হতাশ মনে হলো।
আমরা দু’জন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকলাম। বিছানায় শুয়ে আমরা নিজেদের মতো করে মেডিটেশনে মন সন্নিবেশিত করার চেষ্টা করলাম।
প্রথমে দ্বিতীয় কৌশলের প্রয়োগ ঘটালাম। আমি এলিসের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম।
এরপর এলিস আমাকে কিছু না বলেই বিছানা থেকে নেমে পড়লো। আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে এলিসের দিকে তাকালাম।
“কিছু একটা পরিবর্তন অনুভব করছি।” এলিসকে উত্তেজিত মনে হলো। ও আমার সাথে আর কোনো কথাই বললো না।
ও যখন দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছলো, ঠিক একই সময় জেসপারকেও একই স্থানে দেখতে পেলাম। জেসপার সম্ভবত আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছে এবং এলিসের কাছ থেকে বলার কারণ জানতে এসেছে। ও এলিসের পিঠের ওপর হাত রেখে বিছানার দিকে ঠেলে নিয়ে গেল।
“তুমি কি কিছু দেখতে পেয়েছো?” এলিসের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো। মনে হলো এলিস বহু দূরের কিছু দেখার চেষ্টা করছে। আমি এলিসের পাশে গিয়ে বসলাম। নিচু কণ্ঠে বলা কথাগুলো আমি কোণার চেষ্টা করলাম।
“আমি একটা রুম দেখতে পাচ্ছি। দীর্ঘ একটা রুম। এখানে অসংখ্য আয়না লাগানো। মেঝেটা কাঠের। ওই লোকটা ঘরেই অপেক্ষা করছে। ওখানে সোনার কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছি… একটা সোনালি রেখা আয়নায় প্রতিবিম্বিত হচ্ছে।”
“রুমটা কোথায়?”
“আমি জানি না। কিছু একটা যোগসূত্র ঠিক মেলাতে পারছি না, অন্যদিকে কী ঘটছে এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“কত সময় লোকটা ওখানে থাকবে?”
“বেশিক্ষণ নয়। আয়না লাগানো ঘরে লোকটা সম্ভবত আজ পর্যন্ত থাকতে পারে অথবা আগামীকাল পর্যন্ত। এর সবই অনিশ্চিত। ও কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। এখন আমি ওকে আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি।”
জেসপারের কণ্ঠ শান্ত কোণালো। “ও কি করছে ওখানে?”
“ও টিভি দেখছে…না, ও একটা ভি.সি. আর চালিয়েছে। অন্য জায়গাটা তেমন ভাবে বুঝতে পারছি না।”
“অন্য লোকটা কোথায় তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছো?”
“না, চারদিকে খুবই অন্ধকার কিছুই দেখতে পারছি না।”
“আর ওই আয়না লাগানো ঘরটাতে, ওখানে কি ঘটছে?”
“শুধুই আয়না এবং সোনা। রুমের চারদিকে সোনার পাত লাগানো। ওখানে কালো টেবিলের ওপর একটা বড়ো স্টেরিও সেট রাখা। আর টিভিতে ভি সি আর-এ কিছু একটা দেখছে। কিন্তু মোটেও ওর টিভির দিকে মনোযোগ নেই। দেখে মনে হচ্ছে কিছুর অপেক্ষায় ও বসে আছে।” ইতস্তত তাকিয়ে এলিস জেসপারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
“ওখানে আর কিছুই নেই?”
এলিস অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়লো। নিঃস্পন্দভাবে ওরা একে অপরের দিকে তাকালো।
“এর অর্থ কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সাথে সাথে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে কেউই মুখ খুললো না। এরপর জেসপার আমার মুখের দিকে তাকালো।
“এর অর্থ হচ্ছে জেমস তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছে। নতুন পরিকল্পনা আঁটতে ওই লোক একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে।
“আর আমরা জানি না, রুমটা কোথায় অবস্থিত?”
“না, আমরা তা জানি না।”
“কিন্তু আমরা ধারণা করেছিলাম ওয়াশিংটনের উত্তরের কোনো পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে ওই লোকটা রওনা হয়েছে?” এলিসের কণ্ঠ ম্লান কোণালো।
“আমরা কি ওকে ডাকতে পারি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে বিভ্রান্তভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আর তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।
এলিস ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো।
“কার্লিসল,” এলিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। এলিসকে খুব একটা অবাক মনে হলো না।
“হ্যাঁ,” আমার দিকে তাকিয়ে এলিস বললো। দীর্ঘক্ষণ ও কথাগুলো শুনলো।
“আমি মাত্র তাকে দেখলাম।” এলিস আমাদের কাছে দৃশ্যগুলোর যে রকম বর্ণনা করেছিলো। টেলিফোনে একই বর্ণনা দিলো কার্লিসলকে। “যেভাবেই হোক ওকে নতুন পরিকল্পনা ফাদার সুযোগ দেয়া যাবে না….” এলিস একটু থামলো। “হা” আবার কথা বললো এলিস। এরপর ও আমার নাম উল্লেখ করলো, “বেলা?”
এলিস ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। এলিসের হাত থেকে আমি ফোনটা নিলাম।
“হ্যালো?” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
“বেলা,” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো।
“ওহ্ এ্যাডওয়ার্ড। আমি খবুই ভয়ে আছি।”
“বেলা,” এ্যাডওয়ার্ড হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো,
“তোমাকে আমি বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা না করতে।” ওর কণ্ঠ শুনে এতোটাই ভালো লাগলো যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
“তুমি কোথায় এখন?”
“বেলা, ভ্যানকুভারের বাইরে আমরা। আমি দুঃখিত আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি। মনে হয় ও আমাদের সন্দেহ করছিলো। এ কারণে সতর্ক হয়ে যায়। সতর্ক হয়ে ও আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছে এতোটাই দূরে সরে পড়েছে যে, ওর চিন্তাগুলো আর পড়তে পারছি না। কিন্তু এখন ও অন্যাদিকে খাওয়ার চিন্তা করছে এ কারণে মনে হচ্ছে নতুন কোনো পরিকল্পনা তৈরির চিন্তা করছে। আমরা ধারণা করছি ও ফরকস্ এ ফিরে যাবে, যেখান থেকে ও যাত্রা শুরু করেছিলো।”
“আমি জানি, এলিসের কাছ থেকে আমি ও রকমই ধারণা পেয়েছি।”
“যদিও তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে খুঁজে পাওয়ার মতো এখন তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই নেই। ওকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তুমি ওখানেই অপেক্ষা করো।”
“আমি ভালোই থাকবো। এসমে কি চার্লির ওখানেই আছে?”
“হ্যাঁ-ওই মেয়েটা এখন শহরে। ও একবার তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলো। কিন্তু চার্লি তখন বাড়িতে ছিলো না কাজে গিয়েছিলো। ও চার্লির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি, সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এসমের সাথে চার্লি নিরাপদেই থাকবেন, তাছাড়া রোজালে ওদের ওপর ঠিকই নজর রাখছে।”
“এসমে ওখানে কি করছে?”
“সম্ভবত তাদের গতিপথ সম্পর্কে ধারণা নেবার চেষ্টা করছে। সমস্ত রাত ও শহরেই থাকবে। এয়ারপোর্ট থেকে রোজালে ওর পিছু নিয়েছিলো।
“তুমি তাহলে নিশ্চিত যে চার্লি নিরাপদেই আছেন?”
“হ্যাঁ, এসমে চার্লিকে ওই মেয়ের চোখে পড়তে দেবে না। অন্যদিকে আমরা তিনজনও খুব দ্রুত ওখানে গিয়ে পৌঁছবো। যদি ওই লোকটা ফরকস্ এর কাছে কোথাও থাকে তাহলে ঠিকই ওকে ধরে ফেলতে পারবো।”
“আমি তোমাকে খুব মিস করছি এ্যাডওয়ার্ড,” আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম।
“আমি জানি বেলা। বিশ্বাস করো, আমি তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে আমার অর্ধেকটাই তোমার কাছে থেকে গেছে।”
“তাহলে চলে এসে তার প্রমাণ দাও,” আমি অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বললাম কথাটা।
“যত দ্রুত, সম্ভব আমি সেই চেষ্টাই করছি। তবে, তোমাকে নিরাপদে রাখাই হচ্ছে আমার প্রথম কাজ।” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ বেশ কঠিন কোণালো আমার কাছে।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি এ্যাডওয়ার্ড,” ওকে আমি স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।
“আমি তা খুব ভালোভাবেই জানি বেলা। আমিও তোমাকে খুবই ভালোবাসি। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে ফিরে আসছি।”
“আমি তোমার ফিরে আসার অপেক্ষাতেই আছি,” আমি বললাম।
এরই মধ্যে ফোনটা কেটে গেল, আর সাথে সাথে আমি আবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
ফোনটা ফিরিয়ে দেবার সময় দেখতে পেলাম, এলিস এবং জেসপার টেবিলের ওপর ঝুঁকে একটা কাগজের ওপর কী যেন আকা-ঝোকা করছে। আমি ফিরে কাউচের ওপর বসে পড়লাম।
এলিস একটা রুমের ছবি এঁকেছে– দীর্ঘ, আয়তাকৃতির, তবে তুলনামূলকভাবে বেশ অপ্রশস্ত। পেছন দিকে চৌকো আকৃতির একটা অংশ আছে। মেঝেটা কাঠের তৈরি। দেয়ালে চৌকো আকৃতির সব আয়না লাগানো। উঁচুতে দীর্ঘ ব্যান্ড সাটানো।
এলিস এই ব্যান্ডকেই সোনার ব্যান্ড বলতে চাইছে।
“এটা তো ব্যালে স্টুডিও,” আমি বললাম। আকৃতি দেখে আমি ঠিকই ধারণা করতে পারলাম।
ওরা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।
“তুমি কি এই রুমটা চেনো?” জেসপার শান্ত কিন্তু উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো। মাথা নিচু করে এলিস আগের কাজেই ব্যস্ত হয়ে রইলো। এবার সে ঘরটার একপাশে এমারজেন্সি এক্সিট এবং কোণায় রাখা নিচু টেবিলের ওপরকার স্টেরিও এবং টিভি সেটটা এঁকে ফেলেছে।
“জায়গাটা আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই জায়গাতে আমি নাচ শেখার জন্যে যেতাম তখন আমার বয়স আট অথবা নয়। আকৃতিটা দেখে আমার একই রকম মনে হচ্ছে।” রুমটা এক প্রান্তের চৌকো আকৃতির ছোটো ঘরটার ওপর আমি টোকা দিলাম। “এখানে সম্ভবত একটা বাথরুম থাকার কথা এই দরজা দিয়ে অন্য ডান্স ফ্লোরে যাওয়া যায়। কিন্তু স্টেরিও সেটটা এখানে ছিলো, বাম পাশের এক কোণায় আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করলাম “এটা ছিলো পুরাতন মডেলের এবং এখানে কোনো টিভি সেটও ছিলো না। এখানে ওয়েটিং রুমে একটা জানালা ছিলো- ওয়েটিং রুমটা এদিক থেকে তাকালে দেখতে পাওয়ার কথা।”
এলিস এবং জেসপার অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
“তুমি একেবারে নিশ্চিত যে, এটা সেই জায়গাই?” জেসপার প্রশ্ন করলো। এখানো তার কণ্ঠ শান্তই কোণালো।
“না, একেবারে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না বেশির ভাগ ডান্স স্টুডিও কিন্তু একই রকম দেখতে আয়না, সোনালি পাত বসানো।” এলিসের আঁকানো ছবির আয়নাগুলোর ওপর আঙুলের টোকা দিয়ে বললাম। “আমি শুধু বলতে চাইছি এর আকৃতি আমার পরিচিত।” ছবির দরজাটা স্পর্শ করলাম। যতোটুকু মনে পড়ে দরজাটা একইস্থানে ছিলো।
“কিছু দিনের ভেতর তোমার কি এই জায়গাটাতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয়েছিলো?” আমার ইতস্তত ভাবকে উপক্ষো করে এলিস প্রশ্ন করলো।
“না, আমার প্রায় দশ বছর এখানে যাওয়া হয়নি। আমি ভয়ংকর নৃত্য শিল্পী। ছিলাম আমার অবর্তমানে এ নিয়ে ওরা কম সমালোচনা করেনি।”
“তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, এই নির্দিষ্ট স্থানের সাথেই তোমার কোনো সম্পর্ক ছিলো?” এলিস প্রশ্ন করলো আমাকে।
“না, এটা যে একই ব্যক্তির ডান্স ফ্লোর হতে পারে, তা কোনোভাবেই জোর দিয়ে বলতে পারি না। আমি শুধু বলতে পারি এটা ডান্স ফ্লোর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্য কোথাও যে হতে পারে না, তা তো নয়!”
“তুমি কোন ডান্স ফ্লোরে যেতে?” স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো জেসপার।
“মা’র বাড়ির এক কোণায় ছিলো সেটা। স্কুল ছুটির পর হেঁটেই যেতাম সেখানে…” আমি বললাম। তবে দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় আমার চোখ এড়ালো না।
“এই ফিনিক্স শহরে, তারপর?” জেসপারের কণ্ঠ স্বাভাবিক কোণালো।
“হ্যাঁ,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি বললাম। ফিফটি-এইট স্ট্রীট এ্যান্ড ক্যাকটাস্।
আমরা তিনজনই চুপচাপ বসে থাকলাম। তবে তিনজনের দৃষ্টিই ওই হাতে আকা ছবিটার ওপর নিবদ্ধ।
“এলিস ওই টেলিফোনে কথা বলাটা কি নিরাপদ মনে করো?”
“হ্যাঁ,” এলিস আমাকে নিশ্চিত করলো। “এই নাম্বার শুধু ওয়াশিংটন থেকে খুঁজে বের করা সম্ভব।”
“তাহলে কি এটা থেকে আমার মাকে একটা ফোন করা যেতে পারে?”
“আমার ধারণায় তিনি এখন ফ্লোরিডায়।”
“কিন্তু তার খুব শীঘ্রই বাড়ি ফেরার কথা, কিন্তু এটাও ঠিক এরই মধ্যে তিনি বাড়ি ফেরেননি…” আমার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো। একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এ্যাডওয়ার্ড জানালো যে লাল-চুলো মেয়েটাকে চার্লির বাড়ির কাছে, তারপর আমার স্কুলের কাছে দেখা গেছে। এর অর্থ হতে পারে ওই লাল-চুলো মেয়েটা হয়তো আমার রেকর্ড খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
“তোমার মা’র সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে?”
“উনাদের বাড়ির নাম্বার ছাড়া অন্য কোনো নাম্বার নেই তবে মনে হয় তারা নিয়মিত ম্যাসেজ চেক করেন।”
“জেসপার?” এলিস ডাকলো। বিষয়টা নিয়ে জেসপার একটু চিন্তা করলো। “আমার মনে হয় না, এতে কোনো অসুবিধা আছে। তবে কোথায় আছে, তা কোনোভাবেই উল্লেখ করবে না।”
আমি ফোনটা নিয়ে পরিচিত নাম্বারটাতে ডায়াল করলাম। ফোনটা বারবার বেজে উঠলো। তারপরই রেকর্ডকৃত মা’র কণ্ঠ শুনতে পেলাম। আমার জন্যে উনি একটা ম্যাসেজ রেখে গেছেন।
“মা,” একটা বিপ বাজার সাথে সাথে আমি বললাম। “আমি বলছি, শোনো, আমার জন্যে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। ম্যাসেজ পাওয়ার সাথে সাথে, এই নাম্বারে তুমি আমাকে কল করবে।” এলিস এরই মধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব সাবধানে নাম্বারটা তাকে জানিয়ে দিলাম। আমার সাথে কথা না বলে তুমি দয়া করে কোথাও যাবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা বলা খুবই জরুরি। যতো পরেই তুমি এই ম্যাসেজ পাও না কেন, অবশ্যই আমার সাথে কথা বলবে, বুঝতে পারলে? আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, বিদায়।” আমি চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলাম, আমার পরিকল্পনা যেন সফল হয়।
সোফার ওপর বসে টেবিলে রাখা প্লেটের ওপর থেকে একটা আপেল তুলে নিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে আসলে আমার তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। একবার চিন্তা করলাম চার্লিকেও ফোন করবো কিনা। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না, আদৌ চার্লি বাড়িতে না কি এখন অফিসেই আছেন।
এখন জেসপার কিংবা এলিসেরও কিছু করার নেই। কল্পনায় আকা ছবির ওপর এলিস নতুনভাবে কিছু আকার চেষ্টা করতে লাগলো।
আরেকবার ফোন আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমি সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়লাম। এলিসের শীতল হাতের স্পর্শে আমি জেগে উঠলাম, ও আমাকে বিছানায় যাওয়ার জন্যে ডাকতে এসেছে। বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথেই আমি আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
.
২১.
আবারো বুঝতে পারলাম, খুব তাড়াতাড়ি আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বিছানায় শুয়েই অন্য ঘর থেকে এলিস এবং জেসপার কথা আমার কানে ভেসে এলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র ভোর দু’টো। এলিস এবং জেসপার সোফায় একসাথে বসে আছে। ছবিটা নিয়ে এলিস আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার রুমে প্রবেশ করা ওর কেউই লক্ষ করলো না।
জেসপারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি ছবিটার দিকে তাকালাম।
“এলিস কি নতুন কিছু দেখতে পেয়েছে?” আমি শান্ত কণ্ঠে জেসপারকে প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ, কোনো কারণে ও ঘর থেকে বেরিয়েছে। অবশ্য ও ভি.সি. আর-টা সাথে নিয়েছে। এখনও স্পষ্টভাবে কিছু বুঝতে পারছে না।”
এলিসের নতুন আকা ছবিটা আমি দেখতে লাগলাম। চৌকো আকৃতির একটা ছোটো ঘর। নিচু সিলং বরাবর ঘন রঙের বিম্। দেয়ালগুলো কাঠের। দেয়ালের রং গাঢ় রঙের অনেকটা আগেকার আমলের বাড়ির মতো। মেঝেতে গাঢ় রঙের পুরু কার্পেট পাতা। এটাও দেখে পুরাতন আমলেরই মনে হচ্ছে। দক্ষিণের দেয়ালে বড় একটা জানালা এবং পশ্চিম বরাবর চোখে পড়ছে একটা লিভিং রুম। ছবিতে একটা টিভি এবং ভি সি, আর-ও দেখানো হয়েছে ওগুলো ছোটো ছোটো দুটো কাঠের টেবিলের ওপর রাখা। টিভির সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটা সোফা পাতা।
“ওর কলে আমার টেলিফোনের কথা পৌঁছেছিল।” আমি ফিসফিস করে বললাম।
দুই জোড়া চোখ একই সাথে আমার ওপর নিবদ্ধ হলো।
“ওটা আমার মার বাড়ি।”
এলিস ইতোমধ্যে টেলিফোনে ডায়াল শুরু করেছে। স্বভাববিরুদ্ধভাবে জেসপার একেবারে আমার পাশে এসে বসেছে। ও আমার কাঁধের ওপর মৃদু টোকা দিলো। এলিস বিড়বিড় করে ফোনে কী যেন বলতে শুরু করেছে।
“বেলা,” এলিস বললো।
“বেলা, এ্যাডওয়ার্ড তোমাকে নিতে আসছে। এ্যাডওয়ার্ড, এমেট এবং কার্লিসল তোমাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাবে। কিছু সময়ের জন্যে তোমাকে লুকিয়ে রাখবে।”
“এ্যাডওয়ার্ড আসছে?” উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, ও সিয়াটেল থেকে প্রথম ফ্লাইট ধরার চেষ্টা করছে। ওর সাথে আমাদের এয়ারপোর্টে দেখা হবে। ওর সাথে তুমি এই স্থান ত্যাগ করবে।”
“কিন্তু আমার মা…ও এখানে এসেছে আমার মায়ের জন্যে!” এলিস জেসপারের দিকে তাকিয়ে হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
“জেসপার এবং আমি যততক্ষণ পর্যন্ত আছি, ততক্ষণ উনি নিরাপদেই থাকবেন।
“এলিস আমি জিততে পারিনি। চিরকাল আমাদের সবাইকে তোমরা পাহারা দিয়ে রাখতে পারবে না। তুমি কি দেখছো না ও কী করে বেড়াচ্ছে? ও শুধুমাত্রা আমাকেই অনুসরণ করছে না। ও এমন সব মানুষদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, আমি যাদের ভালোবাসি…এলিস, আমি পারবো না”।
“বেলা, আমরা সবাই মিলে ওকে ধরবোই,” এলিস আমাকে নিশ্চিত করলো।
“আমি এখন মোটেও ঘুমোবো না।” প্রতিবাদের সুরে বললাম আমি।
আমি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমি জানি যে এ সময় এলিস আমাকে বিরক্ত করতে আসবে না। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আমি চিন্তা করতে লাগলাম অন্ধকার ভবিষ্যত ছাড়া কিছুই চিন্তা করতে পারলাম না। আমার মনে একটাই চিন্তা খেলা করতে লাগলো, এর আগে ওদের হাতে আর কতোজনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
আমার মনে শুধু একটাই সন্তুষ্টি, এ্যাডওয়ার্ডের সাথে খুব শীঘ্রই আমার দেখা হতে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ও এর একটা সমাধানের পথ দেখাতে পারবে।
ফোনটা বেজে ওঠার সাথে সাথে আমি ফ্রন্টরুমে এসে হাজির হলাম। রুমে ঢোকার সময় খানিকটা বিব্রত মনে হলো আমাকে। তবে মনে হয় না ওদের আমি খুব একটা বিরক্ত করছি।
যেমনভাবে এলিস এক নাগাড়ে কথা বলে, এখন ও তেমনভাবেই কথা বলছে, কিন্তু প্রথমেই আমার যা নজরে পড়লো, তা হলো, রুমে জেসপার অনুপস্থিত। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল সাড়ে পাঁচটা।
“ওরা কেবল মাত্র প্লেনে উঠতে যাচ্ছে, এলিস আমাকে বললো।
“নয়টা পয়তাল্লিশের ভেতর ওরা এখানে এসে পৌঁছবে।”
“জেসপার কোথায়?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“ও চেক আউট করার জন্য বেরিয়ে পড়েছে।”
“তোমরা তাহলে আর এখানে অপেক্ষা করছো না?”
“না, আমরা তোমার মা’র বাড়ির কাছাকাছি অবস্থান নেবার চেষ্টা করছি।” এলিসের কথা শুনে আমার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
কিন্তু ফোনটা আবার বেজে ওঠায় আমার চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল। এলিসকে দেখে বেশ অবাক মনে হলো। কিন্তু ইতোমধ্যে আমি সামনে এগিয়ে ফোনটা নেবার জন্য হাত বাড়ালাম।
“হ্যালো?” এলিস জিজ্ঞেস করলো। “না, ও এখানে বেশ ভালোই আছে।” ও ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“হ্যালো?”
“বেলা? বেলা?” বুঝতে পারলাম এটা মা’র কণ্ঠ। এই পরিচিত কণ্ঠ আমি হাজার বারেরও বেশি শুনেছি। আতংকিত কণ্ঠে মা কথা বলছেন। মা’র এ ধরনের আতংকিত কণ্ঠস্বর সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি। যখনই আমি সাইডওয়াকের ধারে চলে গেছি অথবা ভিড়ের ভেতর তার হাতছাড়া হয়ে গেছি, তখনই তিনি এ রকম আতংকিত কণ্ঠে আমাকে ডেকে উঠেছেন।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। আমি এমনই আশা করেছিলাম।
“মা, শান্ত হও,” যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত করে আমি বললাম। ধীর পায়ে আমি এলিসের কাছ থেকে সরে এলাম। ওর দৃষ্টির সামনে মিথ্যেগুলো গুছিয়ে বলতে পারবো কিনা, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। সবকিছুই ঠিক আছে, বুঝতে পারলে? শুধু একটা মিনিট সময় দাও, আমি সব ব্যাখ্যা করছি তোমাকে।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। মা এতোক্ষণে একবারও আমার কথার মাঝখানে কথা বলার চেষ্টা করেননি।
“মা?”
“খুব সাবধান, যতক্ষণ না কিছু বলতে বলবো, ততোক্ষণ তুমি কোনো কথাই বলবে না!” যে কণ্ঠটা এখন আমি শুনতে পেলাম তা আমার একেবারে অপরিচিত এবং অপ্রত্যাশিত। এটা একটা পুরুষের চড়া কণ্ঠ, খুবই শান্ত, কিন্তু ভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বর এ ধরনের কণ্ঠস্বর মূল্যবান গাড়ির বিজ্ঞাপনে সাধারণত কোণা যায়।
“এখন আমি আসল প্রসঙ্গে আসি, তোমার মাকে আঘাত করার মোটেও আমার ইচ্ছে নেই। সুতরাং আমি যা যা বলবো, তুমি সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি করবে। আশাকরি এতে তোমার মা ভালোই থাকবেন।” লোকটা মিনিট খানিকের জন্যে চুপ করে থাকলো। এই সামান্য সময়টুকুতেই একটা আতংক মেরুদণ্ড বেয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। “এই তো লক্ষ্মী মেয়ে,” ধন্যবাদ জানানোর স্বরে বললো লোকটা “এখন আমার সাথে সাথে কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করবে। আরেকটা কথা, তোমার কণ্ঠস্বরকে একেবারে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবে।
“না, মা তুমি যেখানে আছে, সেখানেই থাকো।” আমার কণ্ঠ ফিসফিস করে কথা বলার মতো কোণালো।
“আমি দেখছি কাজটা ক্রমশ দূরহ হয়ে পড়ছে।” ওই লোকটার কণ্ঠে এক ধরনের আমুদে এবং বন্ধুত্বের সুর। “তুমি এখনো অন্য রুমে যাচ্ছে না কেন? তোমার মুখের অভিব্যক্তি কি সবকিছু ভেস্তে দেবে না? মাকে তো তোমার কষ্ট দেয়া উচিত নয়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হাঁটতে তুমি বলো, “মা, দয়া করে তুমি আমার কথা শোন। “কথাটা তুমি এখনই বলো।”
“মা, দয়া করে তুমি আমার কথা শোনো” শান্ত কণ্ঠে কথাটা বলতে বলতে আমার বেডরুমের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম, এলিস চিন্তিত হয়ে পড়েছে এবং আমার পেছন পেছন এগিয়ে আসছে। বেডরুমে ঢুকে এলিসের মুখের ওপরই আমি দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। বুঝতে পারলাম, আতংক এবার আমার মস্তিষ্ককে আঁকড়ে ধরেছে।
“এখন কি তুমি একা? শুধু হ্যাঁ, অথবা না বলবে।”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমি নিশ্চিত ওরা তোমার কথা ঠিকই শুনছে।”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে, কাজের কথায় আসা যাক, লোকটা আবার বলতে শুরু করলো, “বলল, “মা, আমাকে বিশ্বাস করো।”
“মা, আমাকে বিশ্বাস করো।”
“আমি যেমনটা আশা করেছিলাম, তার চাইতেও বেশ ভালো বলেছো তুমি। আমি অপেক্ষা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কিন্তু তোমার মা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে এসেছেন। এতে কাজটা আমার বেশ সহজ হয়ে গেছে, তাই নয় কি? তোমাকে উৎকণ্ঠায় থাকতে হলো না, উত্তেজনায় থাকতে হলো না।”
এরপর লোকটা কী বলে তা কোণার আশায় আমি চুপ করে থাকলাম।
“এখন আশা করবো তুমি আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমি চাই তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও; কি মনে হয়, তুমি তা পারবে? হ্যাঁ অথবা না, এককথায় উত্তর দিবে।”
“না।“
“শুনে খুব দুঃখ পেলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি চিন্তাশীল মেয়ে। তুমি কি একবারো চিন্তা করে দেখেছো, তোমার সরে যাওয়ার ওপর তোমার মা’র জীবন নির্ভর করছে? হ্যাঁ অথবা না বলো।”
যেভাবেই হোক এটা একটা সুযোগ বটে। আমার মনে পড়লো, আমাদের এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা। স্কাই হারবার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট; নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হলো আমার…
“হ্যাঁ।”
“খুব ভালো কথা। আমি জানি কাজটা তোমার জন্য সহজ নয়, কিন্তু তুমি কারও সাথে আসছো, সামান্য ধারণাও যদি আমি পাই, ভালো কথা তা কিন্তু তোমার মা’র চরম পরিণতি ডেকে আনবে,” বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠ প্রতিজ্ঞা করলো। “নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, তুমি কারও সাথে আসছো কিনা আমরা তা কতো দ্রুত জেনে যেতে পারি। আর সে রকম যদি তুমি কিছু করতে যাও, তাহলে যে তোমার মা’কে হত্যা করতে আমার মিনিট খানিক সময়ও লাগবে না, তা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো? হ্যাঁ অথবা না বলো।”
“হ্যাঁ।” আমার কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এলো।
“খুব ভালো কথা বেলা। এখন তোমাকে ওই কাজটাই করতে হবে। আমি চাই তুমি তোমার মা’র বাড়িতে যাবে। এরপর যে ফোন করা হবে, তখন একটা নাম্বার দেয়া হবে। তুমি তাতে কল করবে, তখনই বলে দেয়া হবে কোথায় তোমাকে যেতে হবে।” আমি ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছি কোথায় আমাকে যেতে হবে এবং কোথায় এর শেষ হবে। “তুমি কি তা করতে পারবে। হ্যাঁ অথবা না বলো।”
“হ্যাঁ।”
“বেলা, দয়া করে যা কিছু করবে, তা দুপুরের আগেই করবে। সারাদিন আমার পক্ষে অপেক্ষা করে থাকা সম্ভব নয়।”
খুব ভদ্র কণ্ঠে বললো কথাটা।
“কোথায় যেতে হবে?” আমি তিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
“আহ্, এখন থেকে খুব সাবধান হতে হবে বেলা। আমি কথা না বলা পর্যন্ত কোনোকিছুই বলবে না দয়া করে।”
আমি চুপ করে থাকলাম। “বন্ধুদের কাছে ফিরে যাওয়ার পর মোটেও তোমাকে উত্তেজিত হওয়া যাবে না। ওদের বলবে যে, মা তোমার সাথে কোনো জরুরি কথা বলতে চান এবং এ কারণে অবশ্যই খানিকক্ষণের জন্য বাইরে বেরুতে হবে। এখন যা বলছি সেই কথাটার পুনরাবৃত্তি করো, “মা ধন্যবাদ তোমাকে। এখন কথাটা বলো।”
“মা ধন্যবাদ তোমাকে। আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে নামতে লাগলো। যথাসম্ভব আমি চোখের পানি রোধ করার চেষ্টা করলাম।
বলো, “আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, তোমার সাথে আমার খুব শীঘ্ন দেখা হচ্ছে। এখন এই কথাটা বলো।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, তোমার সাথে আমার খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।” অবশ্য এটা আমার মনের কথাও।
“শুভ বিদায় বেলা। আমি বুঝতে পারছি, আবার তোমার সাথে দেখা হতে যাচ্ছে আমার।” ও ফোন বন্ধ করে দিলো।
ফোনটা আমি কানের কাছেই ধরে রাখলাম। আতংকে আমার আঙুলের জোড়াগুলো শক্ত হয়ে গেছে। আর এ কারণে আমি ফোনটা কানের কাছে নামাতে পর্যন্ত পারছি না।
এখন আমার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত। কিন্তু এখন মাথার ভেতরটা মা’র আতংকিত কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ফলে নতুনভাবে কোনো কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা আর নেই।
দুঃখের দেয়ালটা কীভাবে ভেঙে ফেলা যায়, ধীরে ধীরে আমি তা নিয়েই চিন্তা করতে লাগলাম। এখন আমার ওই আয়না লাগানো ঘরটাতে ফিরে যাওয়া এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অবশ্য এমন নিশ্চয়তা নেই যে, এরপরও মাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। কিন্তু চেষ্টা আমাকে ঠিকই করতে হবে। এ ছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায়ও নেই।
আতংকটাকে যতোটা সম্ভব আমি দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছি। আমাকে এখন দ্রুতই চিন্তা করতে হচ্ছে, কারণ এলিস এবং জেসপার আমার অপেক্ষায় আছে। যেভাবেই হোক ওদের সামনে আমাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে- কোনোভাবেই ওদের সন্দেহের উদ্বেগ হতে দেয়া যাবে না।
আমি নিজেকে কিছুটা হলেও ভাগ্যবান মনে করছি। কারণ ও এখানে উপস্থিত নেই। এখানে থাকলে গত পাঁচ মিনিটের সমস্ত ঘটনাগুলো ও চিন্তা করে বের করে ফেলতো। ওদের আমি সন্দেহমুক্ত রাখবো কীভাবে সেটাও এখন চিন্তা বটে।
কীভাবে পালানো যায়, তা নিয়েই এখন আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে।
আমি জানি অন্য ঘরে এলিস আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ফোনে কী আলাপ হলো তা জানার জন্যে নিশ্চয়ই ঔৎসুক্য হয়ে আছে। কিন্তু জেসপার ফিরে আসার আগেই আমি ব্যক্তিগতভাবে সুযোগ নিতে চাই।
এ্যাডওয়ার্ডের সাথে আমার আর দেখা হচ্ছে না, এ বিষয়ে এখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি। এমনকি আয়না লাগানো ওই রুমেও শেষবারের মতো আমি এ্যাডওয়ার্ডের চেহারা দেখতে পাবো না। ওকে প্রচণ্ড মর্মাহত করতে হচ্ছে আমাকে। ওকে আমি শুভ বিদায় জানানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। নির্যাতনের স্রোত আমি সহজভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। এই স্রোত নিজের মতো করে তার গণ্ডিপথ তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু আমি এই স্রোতকে ঠেলে দূরে সরিয়েও দিলাম। বরং এলিসের সাথে সাক্ষাত করাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করলাম বর্তমানে।
আমি এলিসকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিলাম না। আমার শুধু একটা স্ক্রীপ্টই মুখস্ত আছে। আমি এলিসকে সেটাই কোণালাম।
“মা খুব উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন। উনি বাড়ি ফিরে আসতে চাইছেন। কিন্তু অনেক কষ্টে তাকে যেখানে আছেন, ওখানেই আটকে রাখার চেষ্টা করেছি।” আমার কণ্ঠ একেবারেই ম্লান কোণালো।
“আমরা নিশ্চিত জানি যে তিনি ভালোই আছেন। বেলা, তোমার উৎকণ্ঠিত বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম- সত্যিকার অর্থে আমার উল্কণ্ঠিত মুখ তাকে দেখাতে চাইলাম না।
টেবিলের ওপর রাখা এলিসের আঁকা ছবিটার দিকে একবার তাকালাম। ওটা দেখতে দেখতে একটা নতুন পরিকল্পনার চিন্তা করতে লাগলাম। ওই কাগজটার পাশেই একটা খাম পড়ে আছে। ভেবে দেখলাম কাজটা আমি সহজেই করতে পারবো।
“এলিস,” ওর দিকে না ঘুরে শান্ত কণ্ঠে আমি বললাম। আমার কণ্ঠকে যতোটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করলাম।
“যদি মাকে আমি একটা চিঠি লিখি, তুমি কি সেটা তার হাতে দিতে পারবে? আমি বলছিলাম চিঠিটা আমি বাড়িতেই রেখে যাবো।”
“অবশ্যই বেলা।” ওর সতর্ক কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি ওর কাছে আসার পর থেকেই কিছু একটার যোগসূত্র মেলানোর চেষ্টা করছে। বর্তমানে আমার আবেগকে যতোটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করলাম।
আমি আবার বেডরুমে গিয়ে ঢুকলাম এবং স্থির হয়ে বেডসাইড টেবিলে লিখতে বসলাম।
“এ্যাডওয়ার্ড,” আমি লিখলাম। এতোটুকু লিখতে গিয়েই আমার হাত কাঁপতে লাগলো। ফলে লেখাগুলো পড়ার যোগ্য হলো কিনা বুঝতে পারলাম না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ওই লোকটা মার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, এবং আমি তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এতে আদৌ কাজ হবে কিনা, জানি না। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এলিস এবং জেসপারের ওপর মোটেও রাগ করবে না। যদি এদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারি, তাহলে সেটা হবে এক অলৌকিক ঘটনা। আমার পক্ষ থেকে ওদের ধন্যবাদ জানাবো। বিশেষ করে এলিসকে। এবং বিনীত অনুরোধ জানাবে তুমি ওই লোকটার পিছু তাড়া করবে নাদয়া করে অনুরোধ তুমি রক্ষা করবে। তুমি পিছু তাড়া করবে, এমনই ধারণা করছে জেমস। আমার কারণে কারও কোনো ক্ষতি হোক আমি তা মোটেও চাইবো না, বিশেষত তোমার কোনো ক্ষতি হোক, আমি তা কল্পনাও করতে পারি না। এখন শুধু তোমাকে আমার একটা কথাই বলার আছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করো।
—বেলা।