৫. সূর্যের আলোয়

১৩.

সূর্যের আলোয় এ্যাডওয়ার্ডের প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তার এই কষ্টের সাথে আমি মোটেও পরিচিত নই। যদিও বিকেল পর্যন্ত তাকে একই রকম দেখেছি। গতকাল শিকারে যাওয়ার সময় তার চামড়ার রঙ সাদা দেখেছিলাম। কিন্তু সেই চামড়া এখন চকচক করছে। দেখে মনে হতে পারে হাজার খানেক অতি ক্ষুদ্রাকার হীরক কুচি তার চামড়ার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখনো ও চমৎকারভাবে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে, জামার বুকের কাছকার বোতামগুলো খোলা, তাপদগ্ধ হওয়ার কারণে বুকের খোলা অংশটুকুও জ্বলজ্বল করছে। ঘাসের ওপর শুয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে ও ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু ও মোটেও ঘুমায়নি। ওকে দেখে মনে হচ্ছে একটা নিখুঁত মূর্তি, কোনো অজানা পাথর দিয়ে গড়া, মার্বেল পাথরের মতো মসৃণ এবং ক্রীস্টালের মতো চকচকে।

মাঝে মাঝে ও ঠোঁট নাড়ছে, এতোটাই দ্রুত যে, মনে হচ্ছে ওগুলো কাঁপছে। কিন্তু যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, জবাব দিলো, ও নাকি আপনমনে গান গাইছে; তবে এতো আস্তে যে কিছুই শুনতে পেলাম না।

আমি সূর্যের আলো উপভোগ করতে লাগলাম, যদিও যেমন শুষ্ক বাতাস আমি পছন্দ করি তেমন বাতাস অনেকক্ষণ থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। ও যেভাবে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে আমারও ইচ্ছে করলো ওর পাশে সেভাবে শুয়ে পড়ি এবং মুখে সূর্যের আলো এসে পড়ক। কিন্তু আমি হাঁটু জোড়া ভাঁজ করে চুপচাপ বসে থাকলাম এবং থুতনিটা হাঁটুর ওপর নামিয়ে আনলাম। ইচ্ছে না থাকলেও প্রতিবারই আমার দৃষ্টি ওর দিকে ঘুরে যাচ্ছে। চারদিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে; বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ে এসে মুখের ওপর পড়ছে।

আমার ভেতর সবসময় এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে, এক ধরনের ভয়, এমনকি এখনো তাকে মরীচিৎকার মতো মনে হচ্ছে, বাস্তবের চাইতে অতি সুন্দর একজন মানুষ। একবার ইচ্ছে হলো ওকে একটু স্পর্শ করে দেখি-স্পর্শও করলাম-একটা নিখুঁত আবয়ব। আবার যখন ওর দিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম ওর চোখ জোড়া খোলা, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি।

“তোমাকে আমি ভড়কে দিতে পারিনি?” কৌতুকচ্ছলে প্রশ্নটা করলেও ওর নরম স্বরে এক ধরনের ঔৎসুক্য।

“যেমনটা চেয়েছিলে, তেমনটা বোধহয় নয়।”

ও দাঁত বের করে হাসলো, সূর্যের আলোয় ওই দাঁতগুলো চকমক করে উঠলো।

ওর কাছে ইঞ্চি খানেক এগিয়ে গেলাম।

“তুমি কি কিছু মনে করেছো?” আবার ও চোখ বন্ধ করার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না,” চোখ না খুলেই ও উত্তর দিলো। “ওই অনুভূতি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো।

এ্যাডওয়ার্ডের পেশীবহুল বাহুর ওপর আলতোভাবে একটা হাত রাখলাম। দেখতে পেলাম কনুইয়ের কাছে নীলচে রঙের শিরাগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ১৯২

“দুঃখিত,” এ্যাডওয়ার্ড অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করলো। যখন তার দিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম ওর সোনালি চোখ জোড়া আবার বন্ধ করে ফেলেছে। “তোমার সাথে আসলে আমার সহজ আচরণ করা উচিত ছিলো।”

ওর একটা হাত সামান্য উঁচু করে ধরলাম। দেখতে পেলাম ওর তালুর ওপর সুর্যের আলো জ্বল জ্বল করছে। তালুটা তুলে আমার গালের ওপর ছোঁয়ালাম-ওর হাতের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম।

“তুমি কী চিন্তা করছো, আমাকে বলতে পারো, ফিসফিস করে বললো। আমি দেখলাম, আমার দিকে ও অপলক তাকিয়ে আছে। “এখনো কিছু বুঝতে পারছে না, সেটা ভেবেই আমার অবাক লাগছে।”

“তুমি জানো, বাকিটা সময় আমাদের বোধহয় এভাবেই কেটে যাবে।”

“এই জীবনাটা আসলেই কঠিন।” ও কি দোষ স্বীকার করে নিলো? “কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলেনি।”

“তুমি কি চিন্তা করছে, আশা করেছিলাম আমি তা জানতে পারবো…” আমি ইতস্তত করে বললাম।

 “এবং?”

“তুমি যা কিছু বলবে, সেটাই বিশ্বাস করবো তেমনই আশা করেছিলাম। তাছাড়া আমি ভয় পাবো না সে রকমও আশা করেছিলাম।”

“আমি তোমাকে কিন্তু ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি।” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড। ভয় পাইয়ে দিতে চায়নি, এমন বলাটা বোধহয় ওর ঠিক হয়নি। কারণ, এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই।

“ভালো কথা, আমি ভয় বলতে তেমন কিছু বুঝাতে চাইনি, যদি তেমন কিছু ভেবে থাকো, তাহলে ভুল করেছে।”

কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও উঠে বসলো, ডান হাতটা ভাঁজ করলো, ওর বাম হাত এখনো আমার হাতে ধরাই আছে। ওর দেবদূতের মতো চেহারা আমার কাছ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। আমি নিঃসন্দেহে-ওর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারি, কিন্তু মোটেও আমি নড়তে পারলাম না। ওর সোনালি চোখ আমাকে সম্পূর্ণভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছে।

“তো তুমি কিসে ভয় পেলে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। যেমন খানিকক্ষণ আগে ওর সুগন্ধিত শীতল নিঃশ্বাস আমার গালে অনুভব করছিলাম, সেভাবেই ওই নিঃশ্বাস অনুভব করতে লাগলাম। মিষ্টি, চমৎকার সুগন্ধে আমার মুখ পানিতে ভরে উঠলো। এর সাথে অন্য কিছুর তুলনা করা সম্ভব নয়।

আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শুধু এক মুহূর্ত তাকানোর অপেক্ষা মাত্র, ওকে প্রায় বিশ ফুট দূরে দেখতে পেলাম, ছোটো একটা ঝোঁপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ওর মাথার ওপর বিশাল এক দেবদারু গাছ-দেবদারু গাছের ছায়ায় হয়তো ওর কিছুটা ভালো লাগছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, গাছের ছায়ার মতোই ওর চোখ জোড়া এখন ঘন কালো মনে হলো, আমি এ্যাডওয়ার্ডের অভিব্যক্তি মোটেও বুঝতে পারলাম না।

আমার চেহারায় হতাশা এবং ব্যথা একই সাথে ফুটে উঠলো। আমার হাতে কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার মতো যন্ত্রণা অনুভব করলাম।

“আমি …দুঃখিত…এ্যাডওয়ার্ড,” ফিসফিস করে বললাম। আমি জানি আমার এই ফিসফিস করে বলা কথা ও ঠিকই শুনতে পাবে।

 “আমাকে একটুক্ষণ সময় দাও,” চিৎকার করে বললো কথাটা। আমার স্পর্শকাতর কানে ওর কথাটা খুবই জোড়ালো কোণালো। আমি একেবারে নিশ্চুপ বসে। থাকলাম।

খুব জোর মিনিট খানিক হবে, ওকে আমার দিকে হেঁটে আসতে দেখলাম। ওর হাঁটার গতি অত্যন্ত মন্থর। আমার থেকে কয়েক ফুট দূরে এসে ও থেমে গেল এবং পা। মেলে মাটির ওপর বসে পড়লো। এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে একবারো তাকালো না। গভীরভাবে দু’বার নিঃশ্বাস নিয়ে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে হাসলো।

 “আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” ও ইতস্তত করলো। “আমাকে দেখে তোমার মানুষ বলে মনে হচ্ছে তো?”

আমি শুধু একবার মাথা নাড়লাম। ওর মজার কথা শুনে তেমনভাবে হাসতেও পারলাম না। তলপেটে দ্রুত রক্ত চলাচল করতে শুরু করায় বুঝতে পারলাম ধীরে ধীরে কোনো বিপদের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। যেখানে বসে আছে সেখান থেকেই ও গন্ধ পাচ্ছে। ওর হাসি দেখে মনে হলো ভেংচি কাটছে।

আমি নিশ্চুপ বসে থাকলাম, এর আগে যেমন দেখেছি, তার চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর মনে হলো তাকে। তার এই পরিবর্তন একেবারেই আকস্মিক-অনাকাঙ্খিত। এরকম চেহারা দেখার দুর্ভাগ্য ইতোপূর্বে আমার মোটেও হয়নি। তাকে দানব বলে মনে হয়নি বটে-অতি সুন্দর বলেও মনে হলো না। ওর মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে,চোখগুলো বড়ো বড়ো, নিজেকে আমার মনে হলো একটা পাখির মতো-সাপের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি।

ওর চমৎকার চোখজোড়া উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পার হলো ওগুলোই আবার নিভে গেল, বরং মনে হলো ওখানে বসানো আছে একজোড়া ঘোলাটে চোখ। ওর অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো।

“ভয় পাওয়ার কিছুই নেই,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করে বললো, ওর মখমলের মতো নরম কণ্ঠস্বরের ভেতর অনাকাঙ্খিত হলেও সম্মোহিত করার সুর লক্ষ করলাম। “আমি প্রতিজ্ঞা করছি…” ও ইতস্তত করলো। “আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি মোটেও তোমাকে আমার আঘাত করার ইচ্ছে ছিলো না। মনে হলো আমাকে নয় বরং নিজেকেই ও প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছে।

“একেবারেই ভয় পাবে না,” আবার ও ফিস ফিস করে কথাটা বলে এক পা ‘সামনে এগিয়ে এলো।ও আবার আমার মুখোমুখি এসে বসলো।

দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও। নিজেকে আমি নিয়ন্ত্রণ করে নিতে পেরেছি। তুমি আমাকে অন্যরকম দেখেছিলে। কিন্তু এখন আমি নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি-এখন মোটেও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না।”

এ্যাডওয়ার্ড অপেক্ষা করে থাকলেও কোনো কথা বলতে পারলো না।

“আজ আমি মোটেও তৃষ্ণার্ত নই। চোখ মিটমিট করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

ওর এ ধরনের কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম, যদিও দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেবার কারণে আমার হাসির শব্দ স্পষ্টভাবে কোণা গেল না।

“তুমি কি সুস্থ আছো?” মার্বেল পাথরের মতো মসৃণ একটা হাত আমার পিঠের ওপর রেখে ও প্রশ্ন করলো।

আমি ওর মসৃণ ঠাণ্ডা হাতের দিকে তাকালাম, এরপর তাকালাম ওর চোখের দিকে। শান্ত একজোড়া চোখ। একটু হেসে ওর মসৃণ হাতের ওপর দিয়ে আঙ্গুল বুলাতে লাগলাম।

মুখে কিছু না বলে শুধু হাসি দিয়ে উত্তর দেবার ভঙ্গিটা আমার কাছে খুবই রহস্যময় মনে হলো।

“ইতোপূর্বে কখনো কি তোমার সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করেছি?” সেই আগেকার দিনের ভদ্রলোকদের মতো অতি শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

 “সত্যি বলতে,আমি তা স্মরণে আনতে পারি না।”

ও হাসলো বটে কিন্তু হাসিটা খুবই শুষ্ক মনে হলো।

“আমি কতো সহজে হতাশ হয়ে পড়ি,” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, এখন আমার কাছে ওর সবকিছুই দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছে।

 “আমি ভয় পেয়েছিলাম…কারণ, তার সুনির্দিষ্ট কারণ ছিলো, আমি তোমার সাথে থাকতে চাইছিলাম না। এবং আমি ভয় পাচ্ছিলাম এ কারণে যে, তোমার সাথে খুব বেশি আমার থাকতে ইচ্ছে করছিলো।” ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আমি কথাগুলো বললাম। জোড় গলায় এই কথাগুলো আমার পক্ষে বলা বেশ কষ্টকর ছিলো।

“হ্যাঁ,” মৃদু কণ্ঠে ও সমর্থন জানালো। “ভয় পাওয়ার মতো অবশ্য কারণও ছিলো। তুমি আমার সাথে থাকতে চেয়েছিলে। মনে হয় না আমার সাথে থাকার তোমার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো।”

আমি ভ্রু কুঁচকালাম।

“তোমাকে আমার অনেক আগেই ছেড়ে দেয়া উচিত ছিলো,” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “এখন আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইছি। কিন্তু আদৌ জানি না, তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবো কিনা।

“তুমি আমাকে ছেড়ে যাও, মোটেও আমি তা চাই না,” দুঃখিত কণ্ঠে বলে আবার মাথা নিচু করলাম।

 “আমিও সে কথাই বলতে চাইছিলাম। কিন্তু ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সত্যিকার অর্থে আমি খুবই স্বার্থপর মানুষ। তোমার সান্নিধ্য বাদ দিয়ে আমিও কোথাও যেতে চাইছি না।”

“আমি খুশি হলাম।”

“খুশি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই!” আমার হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিলো। ওর কণ্ঠস্বর অন্যান্য সময়ের তুলনায় রুক্ষ কোণালো। রুক্ষ কোণালেও অন্য যে কোনো মানুষের কণ্ঠস্বরের তুলনায় আমার কাছে তা মধুরই মনে হলো। এ ধরনের কণ্ঠস্বরকে অনুধাবন করা আসলেই কঠিন।

“তুমি আমাকে সঙ্গ দাও এমন কামনা করা আমার উচিত নয়, এই কথাটা কখনোই ভুলে যাবে না। এই কথাটা ভুলে যাবে না যে কারো চাইতে আমি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারি।” ও একটু থামলো, খানিকক্ষণ গাছপালার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখলো।

আমি একটুক্ষণ চিন্তা করলাম।

“তুমি আসলে কী বলতে চাইছে মনে হয় আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না-বিশেষত তোমার কথার শেষের অংশটুকু।” আমি বললাম।

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে ঘুরে মিষ্টি করে হাসলো। বুঝতে পারলাম ও আগের সেই মুডে ফিরে গেছে।

“আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো?” ও চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। “আমি যে তোমাকে আবার ভয় পাইয়ে দিবো না, তা নিশ্চিত করে বলি কীভাবে…হমম্‌!” ও আবার ওর হাতটা আমার হাতের ওপর রাখলো। আর আমি ওর হাতটা মুঠো পাকিয়ে ধরলাম। মুঠো পাকিয়ে ধরা আমাদের হাতের দিকে ও একবার তাকালো।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে এ্যাডওয়ার্ড তার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিলো।

“তুমি কি জানো বিভিন্ন মানুষ কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভার পছন্দ করে?” ও আবার বলতে শুরু করলো। কেউ কেউ চকোলেট আইসক্রীম পছন্দ করে, আবার অনেকে স্ট্রবেরী ফ্লেভার?” আমি মাথা নাড়লাম।

“খাবার দিয়ে বিষয়টা তুলনা করার জন্যে দুঃখিত-এ ছাড়া তুলনা করার মতো আর কিছু পেলাম না।”

আমি একটু হাসলাম। আমার হাসিটা ও পাল্টা ফিরিয়ে দিলো।

“তুমি দেখবে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন গন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাদের কিছু প্রিয় সুগন্ধি থাকে। অতিরিক্ত মদপানে অভ্যস্ত একজনকে বাসী বিয়ারের সামনে বসিয়ে দিলেও দেখতে পাবে দিব্যি ওই বোতল শেষ করে ফেলেছে। ওই বিয়ারের গন্ধেই নিজেকে ও সংযত করতে পারেনি। অথচ হয়তো লোকটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলো আর সে কখনো মদ স্পর্শ করবে না। এখন তুমি ওর ঘরে একগ্লাস একশো বছরের পুরাতন ব্যান্ডি রাখো, দুলর্ভ, সবচেয়ে সেরা মানের কগনেগ’-এবং সমস্ত ঘর এর সুগন্ধে ভরে আছে-তুমি কিভাবে চিন্তা করো, এর পরও ওই লোকটা নির্লোভ থাকবে?”

আমরা চুপচাপ বসে থাকলাম, একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম-সত্যিকার অর্থে একে অপরের চিন্তা পড়ার চেষ্টা করলাম।

ওই-ই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করলো।

মনে হয় না ওটা সঠিক তুলনা দেয়া হলো। ব্র্যান্ডির সাথে তুলনা দেয়াটা খুবই সহজ। পারতপক্ষে আমি এ্যালকোহলের বদলে নায়িকার প্রতিই বেশি অনুরক্ত হবো।”

“তো তুমি বলতে চাইছো যে আমি তোমার প্রিয় নায়িকা?” ওর মুড হালকা করার জন্যে টিটকারী দিয়ে বললাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড দ্রুত একটু হাসলো, মনে হলো আমার সন্তুষ্টির জন্যে আমাকে সমর্থন জানাচ্ছে, “হ্যাঁ, তুমি হচ্ছো আমার প্রিয়তম নায়িকা।”

“আমাকে কি তোমার মাঝে মাঝে নায়িকা বলে মনে হয়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

গাছপালার উপর দিকে ও খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, মনে হলো কী জবাব দিবে মনে মনে চিন্তা করে নিলো।

 “আমার ভাইকে বিষয়টা জানিয়েছি,” এখনো ও ওই দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। “ও সম্প্রতি আমাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে এসেছে। ওর সবকিছুকেই আমাদের মতো মনে করতে পারো। ও অবশ্য বিভিন্ন রকমের গন্ধের পার্থক্য করতে পারে না।” ও দ্রুত আমার দিকে তাকালো। কথাগুলো ও বললো অনেকটা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে।

“দুঃখিত।” ও বললো।

“আমি কিছুই মনে করিনি। আমাকে বিব্রত করার জন্যে, ভয় দেখাবার জন্যে অথবা যাইহোক অন্য যা-ই করার ইচ্ছে হোক না কেন, তাতে তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এগুলোতে আসলে আমি মোটেও ভয় পাই না। তুমি যেভাবেই চিন্তা করার চেষ্টা করো না কেন আমি বুঝতে পারবে, অথবা অন্ততপক্ষে বুঝার চেষ্টা করবো। শুধু তুমি আমাকে সবকিছু বিশদভাবে জানাও।”

ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো।

“তো জেসপার এখানো বুঝতে পারেনি কে কী রকম”-ও একটু ইতস্তত করে সঠিক বক্তব্য গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো-”তুমি যেভাবে আমাকে নিয়ে চিন্তা করেছে, আমি কিন্তু মোটেও তেমনভাবে কিছু চিন্তা করিনি। এমেট খুব সহজে সবকিছু বুঝতে পারে, সুতরাং ও তার ব্যাপারে আমাকে দু’বার প্রস্তাব দিয়েছে।”

“আর তুমি?”

 “কখনোই নয়।”

মনে হলো উষ্ণ বাতাসে কথাটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঝুলে থাকলো যেন।

 “এমেট তাহলে কি করলো?” নীরবতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলাম আমি।

আসলে তাকে আমার এ ধরনের প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। ওর মুখ ক্রমশই কালো হয়ে উঠতে লাগলো। ওর মুঠোর ভেতর আঁকড়ে ধরা হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরলো। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কিন্তু কোনো জবাব দেবার ইচ্ছে লক্ষ করলাম না।

“আমার ধারণা আমি বুঝতে পেরেছি,” শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই উত্তর দিলাম।

ও আমার দিকে তাকালো, ওর চোখে জানার কৌতূহল।

“আমাদের ভেতর যে সবচেয়ে শক্ত মনের, সে পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি, তাই নয় কি?”

“তো তুমি এখন আমাকে কি বলতে চাইছো? তুমি কি আমার অনুমতি চাইছো?” যতোটা তীক্ষ্ণ হওয়ার প্রয়োজন তারও চাইতে তীক্ষ্ণ স্বরে আমি তাকে প্রশ্নটা করলাম। তবে কণ্ঠস্বরকে মুহূর্তেই কোমল করার চেষ্টা করলাম-ধারণা করতে লাগলাম ওর সতোর মূল্য ওকে কীভাবে দিতে হবে। আমি বলতে চাইছিলাম, যদি এ বিষয়ে কোনো আশাই না থাকে, তাহলে?” আমার মৃত্যু নিয়ে কতো সহজেই না আলোচনা করতে পারলাম!

“না, না! ও মনের থেকেই জোর প্রতিবাদ জানালো।”অবশ্যই আশা আছে। আমি বলতে চাইলাম অবশ্যই আমি চাই না…” ওর কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিলো। ওর চোখ দিয়ে আমাকে যেন পুঁড়িয়ে মারতে চাইলো। “এটা আমাদের জন্যে একেবারেই ভিন্ন এক ধরনের ব্যাপার। এমেট… আমাদের কাছে একজন বহিরাগত। ওর এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার কোনো অধিকার নেই। তাছাড়া কথাটা ও অনেক আগে বলেছিলো।”

আবার ও চুপ করে থাকলো।

“তো যদি আমরা মিলিত হই…ওহ, অন্ধকার কোনো গলির ভেতর অথবা ওরকমই কোথাও…আমি ঠিকই তোমার পেছনে পেছনে ওই স্থানে গিয়ে হাজির হয়েছি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ক্লাসের মাঝখানে সকলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তোমাকে পছন্দ করার বিষয়টা সবাইকে জানিয়ে দিবো এবং–” অন্যদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই ও থেমে গেল। “যখন তুমি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাও, তখন মনে হয়, চারপাশের সবকিছু ভেঙ্গে গুঁরিয়ে ফেলি। আমার আকাঙ্খকে যদি ত্যাগ করতে না পারি, তাহলে নিজেকেও সংযত করতে পারবো না।” ও একটু থেমে, গাছের উঁচু ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

শান্ত চোখে ও আমার দিকে তাকালো, উভয়েই আমরা বোধহয় পূর্বের ঘটনাগুলো স্মরণে আনার চেষ্টা করলাম। “তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে, তোমার জন্যে আমি উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছি।”

“কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কেন। তুমি একবার আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করো, দ্রুত আবার…”

“আমার দিক থেকে বিষয়টাকে এক ধরনের শয়তানি বলতে পারো। আমার নিজের তৈরি করা নরক যন্ত্রণায় নিজেই দগ্ধ হচ্ছি। প্রথম দিন তোমার শরীর থেকে যে সুগন্ধ বেরুচ্ছিলো…আমার মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি পাগল হয়ে যাবো। ওই একটা মাত্র ঘন্টা, তুমি যখন আমার সাথে একা ছিলে, শুধু আমাকে প্রলোভনই দেখিয়ে গেছে। কিন্তু ওই প্রলোভনকে শুধু আমি দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি-চিন্তা করেছি, পরিবারের জন্যে আমি কতোটুকুই বা করতে পেরেছি! সে কারণেই কিছু বলার আগেই আমি পালাতে চেয়েছি…”

এ্যাডওয়ার্ড আমার হতভম্ভ মুখের দিকে তাকালো।

“তুমি অবশ্যই আমার সবকিছু জানতে পারবে,” ওর সম্পর্কে সবকিছু জানাবে বলে এ্যাডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করলো।

 “আমি অবশ্যই তোমার সবকিছু কোণার ব্যাপারে আগ্রহী,” আমি শান্ত কণ্ঠে জবাব দেবার চেষ্টা করলাম।

ও ভ্রু কুঁচকে আমার হাতের দিকে তাকালো। “এবং এরপর আমি তোমাকে বাদ দিয়ে আমার সবকিছু নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু আবার তোমাকে ওই ছোটো ঘরটাতে পেয়ে গেলাম পেয়ে গেলাম একান্ত নিভৃতে। তোমার দেহের সুগন্ধ আমাকে পাগল করে তুললো। তোমার সান্নিধ্য লাভের লোভ আমি সামলাতে পারলাম না। ওখানে তুমি ছাড়াও আরেকজন অসৎ চরিত্রের মেয়ে ছিলো। ওই মেয়েকে নিয়ে কিছু করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। সুতরাং তোমার সাথে সহজেই আমার মনের আবেগ বন্টন করে নিতে বাধ্য হলাম।”

উষ্ণ সূর্যালোকেও আমি শিউরে উঠলাম। আমার স্মৃতিগুলো নতুন করে ওর চোখে খুঁজতে পেলাম যেন। মনে হলো আমি বড়ো একটা বিপদ আঁকড়ে ধরে বসে আছি। হায়রে! আমি আবার শিউরে উঠলাম, কতো সহজেই না নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছি!

“কিন্তু এরপরও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। কীভাবে তা বলতে পারবো না। আমার মন প্রবলভাবে নিষেধ করতে লাগলো, স্কুলে তোমার জন্যে অপেক্ষা না করার জন্যে স্কুল থেকে তোমাকে অনুসরণ করার ব্যাপারেও আমার মন প্রতিবাদ জানাতে লাগলো। বুঝতে পারলাম, তোমার কাছ থেকে যত দূরে সরে থাকতে পারবো, ততোই লাভ। তোমার গন্ধ আমাকে মোহিত না করলে আমি সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারবো, আর সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও আমার জন্যে সহজ হবে। নিজের বাড়িতে থাকার সাহস পেলাম না। সুতরাং আশ্রয় নিতে হলো কাছের আরেকজনের বাড়িতে আমি খুব দুর্বল কোনোভাবে তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। ও কোনোভাবে জানতে পেরেছিলো আমার কিছু সমস্যা আছে-ওর সাথে সোজা কার্লিসলের একটা হাসপাতালে চলে গেলাম।”

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।

“ওর সাথে গাড়ি বদল করলাম-ওর গাড়িতে গ্যাস ভর্তি করাই ছিলো, তাছাড়া মোটেও আমার কোথাও থামার ইচ্ছে হলো না, বাড়িও ফিরতে চাইলাম না আমি সত্যিকার অর্থে এসমের মুখোমুখি হতে চাইলাম না। নাটক ছাড়া কোনো কাজ ও সহজ ভাবে করতে পারে না। এ সবকিছুর যে প্রয়োজন নেই, ও যেভাবেই হোক যুক্তি প্রমাণ দিয়ে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকবে…

“পরদিন সকালে আমি আলাস্কায় গিয়ে পৌঁছলাম।” ও লজ্জিত কণ্ঠে বললো। মনে হলো যেন ও একজন খুব বড়ো কাপুরুষ। “আমারই সমমনা কিছু বয়স্ক মানুষের সাথে ওখানে দু’দিন কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু কোনো স্থানে আমার বেশি দিন ভালো লাগে না–একঘেয়েমিতে ভুগতে থাকি। এসমেকে মর্মাহত করেছি ভেবে দুঃখ পেলাম এবং একই সাথে আমি অন্যদেরও মর্মাহত করেছি। আমাকে যে পরিবার পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাদের মনেও আমি দুঃখ দিয়েছি। নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এভাবে পালিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ থাকতে পারে না-এটা শুধু আমার ধ্বংসই ডেকে আনবে। ইতোপূর্বে আমার যে সব সমস্যা এসেছে, তার সবই আমি পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করেই সমাধান করেছি। এটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়, বিষয়টাকে আমার ছোটো করে দেখারও অবকাশ নেই। তাছাড়া এগুলো লুকিয়ে রাখাও বিষয় নয়। তবে এটাও ঠিক সবসময় নিজের মনোবলকে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করে এসেছি। তুমি তো কোনো ছাড়”-হঠাৎ ভেঙচি কেটে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি কিছুই বলতে পারলাম না।

“নিজের নিরাপত্তার জন্যে যা কিছু প্রযোজন, সেভাবেই ব্যবস্থা নিতে লাগলাম। তুমি যে রকম আগে দেখেছিলে তার চাইতে শিকার এবং খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে শক্তি অর্জন করতে হবে-তুমি এবং তোমার মতো যে কোনো মানুষকে যেন মোকাবেলা করতে পারি, সেই ধরনের শক্তি।

“বলার অপেক্ষা রাখে না আমার একটা বড়ো ধরনের সমস্যা ছিলো। আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা তা আমি বুঝতে পারতাম না। সরাসরি তোমার মন পড়ার ক্ষমতা আমি তখনো অর্জন করতে পারিনি। তোমার কথাগুলো আমি জেসিকার মনের ভেতর পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম… ওর মনকে মোটেও সাধারণ বলা যাবে না। অন্যদিকে তার মনকে পড়ার বিষয়টাকে যে উপেক্ষা করবো সেটাও আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। এরপর থেকে আমি বুঝতে পারলাম না তুমি যেগুলো বলছে, আদৌ সেগুলো তোমার মনের কথা কিনা। তোমার সবগুলো কথাই গা জ্বালানো।” ভ্রু কুঁচকে এ্যাডওয়ার্ড অতীতকে স্মরণ করার চেষ্টা করলো যেন।

প্রথম দিন থেকেই আমার অসামঞ্জস্যগুলো যতোটা সম্ভব তুমি ভুলে যেতে পারো সেই চেষ্টাই করতে লাগলাম। সুতরাং আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই তোমার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তোমার চিন্তাগুলো পড়ার জন্যে আমি উল্কণ্ঠিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু তুমি হচ্ছো এক অদ্ভুত চরিত্রের মেয়ে। আমাকে তুমি যে বুঝতে চেষ্টা করছো, তোমার অভিব্যক্তি দেখেই তা বুঝতে পারলাম…মাঝে মাঝেই বাতাসে তোমার চুল ওড়ানো, হাত নাড়ানো…সবই আমি মুগ্ধ চোখে শুধু দেখতেই লাগলাম…এবং তোমার দেহের সুগন্ধে মাঝে মাঝেই থমকে যেতে লাগলাম…

“এর দিনকয়েক পরে দেখতে পেলাম একটা গাড়ি তোমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবার জন্যে ছুটে আসছে। পরবর্তীতে চিন্তা করে দেখেছি কেন সেদিন ওরকম ছুটে গিয়ে গাড়িটা থামিয়ে ছিলাম…। সেদিন যদি ওভাবে গাড়ি না থামাতাম তাহলে গাড়ির আঘাতে তোমার দেহ থেকে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসতো। আর যদি সেদিন তোমার দেহ থেকে সামান্য রক্তও বেরিয়ে আসতো, তাহলে নিজেকে আমি কোনোভাবেই সামলে রাখতে পারতাম না। রক্ত দেখে আমরা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠতাম। তবে এ ধরনের চিন্তা অবশ্যই আমি অনেক পরে করেছি। সত্যিকার অর্থে ওই দিন তোমাকে বাঁচানোটাই ছিলো আমার মূখ্য উদ্দেশ্য।”

ও চোখ বন্ধ করলো। মনে হলো যেন মনের যন্ত্রণাগুলো বুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি তার দুঃখটা বুঝতে পারলাম।

অনেকক্ষণ বাদে আমি কথা বলতে পারলাম। যদিও আমার কণ্ঠেস্বর খুবই ক্ষীণ কোণালো। “তাহলে হাসপাতালের ঘটনা?”

এ্যাডওয়ার্ডের চোখ জোড়া ঝলছে উঠলো। আমি তখন অসহায় ছিলাম-আমার কিছুই করার ছিলো না। আমি কোনোভাবে চিন্তাও করতে পারছিলাম যে তুমি কোন বিপদে জড়িয়ে পড়ো। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে ওই সময় হয়তো আমাকে হত্যা করতে হতো।” মুখ ফসকে এ ধরনের একটা কথা বেরিয়ে আসায় আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম। “কিন্তু ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটলো। তোমাকে রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম,” এ্যাডওয়ার্ড দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। “আমাকে রোজালে, এমেট এবং জেসপারের সাথে রীতিমতো লড়াই করতে হলো।

ওরা আমাকে বললো যে সময় নাকি এসে গেছে…আমাদের জঘন্যতম কাজটা করতে হবে। কিন্তু কার্লিসল এবং এলিস আমার পক্ষেই থাকলো।” এলিস নামটা উল্লেখ করতে গিয়ে কেন জানি না ও মুখ টিপে একটু হাসলো। “এসমে অন্য ধরনের। ওকে যেমন বলবো, আমার নির্দেশের নড়চড় করবে না।” অনিশ্চিতভাবে ও মাথা নাড়লো।

“পরের সমস্ত দিনই ওরা আমার মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করলো। আমি তোমার মনের কথা তেমনভাবে পড়তে না পারলেও ওরা ঠিকই তোমার মনের অনেক কথা পড়তে পারলো। তবে এতোটুকু বুঝতে পারলাম তোমার সাথে নিজেকে মোটেও তেমনভাবে জড়ানো ঠিক হবে না। তোমার কাছ থেকে নিজেকে যতোটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারবো, তাতে উভয়েরই মঙ্গল। কিন্তু প্রতিদিন যেভাবে তোমার শরীরের সুগন্ধ, চুলের গন্ধ পেতে লাগলাম…প্রথম দিনের মতোই আমাকে আমোদিত করতে লাগলো।”

এ্যাডওয়ার্ড আবার আমার চোখের দিকে তাকালো।

 “এবং ওই সব কারণে,” ও আবার বলতে লাগলো, “সুতরাং প্রথম বারের মতো আমরা যদি নিজেদের প্রকাশ করতে পারি-এইখানে এই নিভৃত স্থানে, তাহলে আমি অনেকটাই সুস্থ অনুভব করবো। এই নিভৃত স্থানে নিজেদের যদি প্রকাশ করি তাহলে কোনো স্বাক্ষী থাকবে না এবং কেউ আমাদের বাধা দিতেও আসবে না-আমি তোমাকে যন্ত্রণা দিতে চাই।”

যেহেতু আমি একজন মানুষ, প্রশ্ন জাগাটা একান্ত স্বাভাবিক। তাই প্রশ্ন করলাম, “কেন?”

“ইসাবেলা।” ও আমার চুলের ভেতর বিলি কাটতে কাটতে পুরো নাম ধরেই সম্বোধন করলো। ওর স্বাভাবিক স্পর্শেই আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। “বেলা, তোমাকে যন্ত্রণা না দিয়ে নিজেকে আমি ধরে রাখতে পারছি না। আমাকে কতোটা কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। লজ্জায় ও মাথা নিচু করলো। “তোমার চিন্তাগুলো এখনো আমার কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য, শীতল- তোমার রক্তে রাঙা মুখ আমি আর দেখতে চাই না, আমার কথাগুলোকে অবিশ্বাস্য মনে করে তোমার বক্র চাহনীও আর… বিষয়টা একেবারেই সহ্য করতে পারছি না।” বড়ো বড়ো চোখ মেলে ও আমার দিকে তাকালো। “তুমি এখন আমার কাছে দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে-চিরকালের সর্বসেরা এক বস্তু।”

এ্যাডওয়ার্ডের এলোমেলো কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। আমার মুখ থেকে ও কিছু শুনতে চাইলো। ওর ধরে রাখা আমার হাতটা একবার দেখে নিলাম।

 “আমার অবস্থাটাও তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, অবশেষে আমি মুখ খুললাম। “আমি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি…কীভাবে তা আর নতুনভাবে বলে দিতে হবে না। সহজভাবে বলতে হলে বলতে হয়, তোমাকে ছাড়া আমি আর বাঁচবো না।” আমি ভু কুঁচকালাম। “আমি আসলে খুবই বোকা একটা মেয়ে।”

“তুমি আসলেই একটা বোকা মেয়ে,” এ্যাডওয়ার্ড হাসতে হাসতে আমাকে সমর্থন জানালো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও হাসলাম।

“হ্যাঁ, আমার অবস্থা হয়েছে সিংহের মতো। সিংহ যেমন ভেড়ার ছানার প্রতি লালায়িত হয়ে ওঠে… ও বিড়বিড় করলো। আমার উত্তেজনা লুকানোর জন্যে অন্য দিকে তাকালাম।

“সত্যিই অসহায় এক ভেড়ার ছানা আমি!” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

“একজন অসুস্থ মর্ষকামী অসহায় সিংহ। এমন অসুস্থ মানসিকতা যে, প্রণয়িনীর মাধ্যমে নিপীড়িত না হলে আনন্দ লাভ করতে পারে না!” গাছের ওপর দিয়ে ও খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, ওরা লাগামহীন চিন্তা কোনো দিকে ছুটে চলেছে।

“কেন…?” কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও পারলাম না, মাঝপথেই আমাকে থেমে যেতে হলো। কীভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো; ওর মুখ আর দাঁতের ওপর সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করতে লাগলো।

“হুঁ, কি বলছিলে যেন?”

 “আমাকে বলল যে, প্রথমে তুমি আমার কাছ থেকে কেন পালাতে চেয়েছিলে।”

 ওর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। তার কারণ তুমি ভালোভাবেই জানো।”

“না, আমি বুঝাতে চাইছিলাম, কোথায় ভুল করলাম? তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। সুতরাং, কোন কাজগুলো কার উচিত নয়, তা শেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। এভাবেই বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে পারি”-ওর হাতের পেছনে আমি টোকা দিলাম

“মনে হয় বিষয়টা তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে পারলাম।”

ও আবার হাসলো।” বেলা তুমি আসলে কোনো ভুল করোনি-ভুল আমারই বলতে হবে।”

“কিন্তু আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো, কিংবা বুঝতে পারতাম তাহলে অবশ্যই সাহায্য করতাম। তোমার জন্যে বিষয়টাকে নিশ্চয়ই এ রকম কঠিন করে তুলতাম না।”

“ভালো কথা…” ও গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করলো। “বিষয়টা কঠিন হতো না যদি তুমি আমার একান্ত সান্নিধ্যে আসতে পারতে। সহজাত কারণেই বেশিরভাগ মানুষ আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছে। ভীনগ্রহের জীব হিসেবেই সবাই আমাদের ধরে নিয়েছে…সুতরাং তুমি আমার একান্ত সান্নিধ্যে আসবে এমন আশাও আমি করিনি। এমন কি তোমার সুগন্ধ নেবার চেষ্টাও করিনি… “ আমার মন খারাপ হলো কিনা তা দেখে নিয়ে মাঝপথেই এ্যাডওয়ার্ড কথা থামিয়ে দিলো।

“ঠিক আছে, তারপর?” চটপট আমি প্রশ্ন করলাম। আমি চিবুকের ওপর টোকা দিলাম। “গলা বাড়ানোর চেষ্টা করবে না।”

এটা কাজে দিলো; ও হেসে উঠলো।

“না, সত্যিকার অর্থে যে কোনো বিষয়ের চাইতে এটাকে চমকপ্রদ বলে মনে হচ্ছে।”

ওর হাতটা আলতোভাবে তুলে ধরে গলার পাশে স্থাপন করে নিপভাবে বসে থাকলাম। ওর শীতল স্পর্শ এক ধরনের প্রাকৃতিক সতর্ক সংকেতের মতো মনে হলো–আমাকে আতঙ্কিত করে তোলার মতো এক ধরনের সতর্ক সংকেত। কিন্তু যতোটা ভয় পাওয়া উচিত ছিলো, তেমনটা ভয় পেলাম না। তার বদলে অন্য এক ধরনের অনুভূতি হতে লাগল আমার…

“দেখ,” ও বললো, “তোমার প্রস্তাব আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হচ্ছে।”

আমার রক্ত দ্রুত প্রবাহিত হতে লাগলো। আমি আশা করলাম এই রক্ত প্রবাহ মন্থর হয়ে উঠুক। মনে হলো এই রক্ত প্রবাহের শব্দও বুঝি ওর কানে পৌঁছে যাবে।

“তোমার ওই রাঙা গাল দেখে কিন্তু আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি,” ও বিড়বিড় করলো।

“একেবারে নড়বে না, একেবারে চুপচাপ বসে থাকো,” ফিসফিস করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

খুব ধীরে, আমার ওপর থেকে ওর চোখ একটুও নড়লো না, হাঁটু গেড়ে ও আমার দিকে এগিয়ে এলো। এরপরই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, তবে অবশ্যই ভদ্রোচিত আচরণে ওর অতি শীতল চিকুকটা আমার গলার খাজটার কাছে স্থাপন করলো। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি একেবারেই নড়াচড়া করতে পারলাম না। ওর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ আমার কানে এসে বাজতে লাগলো। ওর ব্রোঞ্জ রঙের ঢেউ খেলানো চুলগুলো শান্ত বাতাস এলোমেলো করে দিয়ে যেতে লাগলো, এ্যাডওয়ার্ডের শরীরের প্রত্যেকটা অংশকে মেলানোর মতো আমার দেখা কোনো মানুষকে খুঁজে বের করতে পারলাম না।

দ্রচিতভাবে, অতি ধীরে ও একটা হাত আমার গলার পাশে স্থাপন করলো। তবে হাত একই স্থানে স্থীর থাকলো না, বরং কাঁধের ওপর ওর আঙ্গুলগুলো নড়াচড়া করতে লাগলো এবং একটা স্থানে এসে থেমে গেল।

এ্যাডওয়ার্ড খানিকক্ষণের ভেতর মুখটাও নামিয়ে এনে প্রথমে গলার পাশে, তারপর কণ্ঠনালীর নিচকার খাজের ভেতর স্থাপন করলো। ওর মুখটা আবার স্থান পরিবর্তন করে আমার বুকের মাঝখানে এসে থেমে গেল। সম্ভবত এ্যাডওয়ার্ড আমার। হৃৎস্পন্দন কোণার চেষ্টা করলো।

“আহ!” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

আমরা আর কতোক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হলো ঘণ্টা খানিক হতে পারে। আমার নাড়ির স্পন্দন ঠিক আগের মতোই চলতে লাগলেও, আমাকে আবার জড়িয়ে ধরার পর এ্যাডওয়ার্ড মোটেও কোনো কথা বলেনি কিংবা নড়াচড়া করেনি। কিন্তু আমি জানি, যে কোনো মুহূর্তে ওর ভেতর পরিবর্তন আসতে পারে, আর সেরকম যদি কোনো পরিবর্তন আসেই তাহলে তা। আসবে অতিরিক্ত মাত্রায়। আর তখন আমার জীবনের যে সমাপ্তি ঘটবে না নিশ্চিতভাবে তার কিছুই বলা যাবে না। হয়তো তখন আমার পক্ষে নিজেকে সামলে নেবার কিংবা জানার সময়টুকুও পাবো না। তবে নিজেকে আমি মোটেও ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। তাছাড়া ও আমাকে ধরে রেখেছে, এর বাইরে কিছুই চিন্তাও করতে চাইলাম না।

এবং তারপর, খুবই দ্রুত ও আমাকে মুক্তি দিলো।

ওর দু’চোখে একরাশ প্রশান্তি।

“বোধহয় না বিষয়টা তোমার কাছে খুব কষ্টদায়ক মনে হয়েছে?” ও প্রশ্ন করলো আমাকে।

“তোমার জন্যে বিষয়টা কি কষ্টদায়ক মনে হয়েছে?”

“যতোটা কঠিন হবে বলে ভেবেছিলাম, ততোটা মোটেও নয়। তোমার ক্ষেত্রে?”

“না তেমন খারাপ নয়…”

আমার আহত মুখের দিকে তাকিয়ে ও একটু হাসলো। “নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছো, আমি কী বুঝাতে চাইছি।”

আমি একটু হাসলাম।

“এখানে।” ও আমার একটা হাত তুলে নিয়ে ওর গালে ঠেকালো। “আমার এই গাল কতোটা যে উষ্ণ, তুমি কি তা অনুভব করতে পারছো?”

স্পর্শ করে আমার কাছে ওর গালটা উষ্ণ বলেই মনে হলো। এর আগে যখনই ওর দেহ স্পর্শ করেছি, শীতলতা ছাড়া আর অন্য কিছু অনুভব করতে পারিনি।

“একটুও নড়বে না, আমি ফিস ফিস করে বললাম।

এ্যাডওয়ার্ডের মতো এতোটা স্থীর কোনো মানুষ দেখিনি। ও চোখ বন্ধ করলো এবং পাথরের মতোই স্থীর হয়ে রইলো। আমার হাতের নিচে ওর দেহের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো আমি অনুভব করতে পারলাম।

ওর চাইতেও অনেক ধীরে আমি একটু নড়লাম, অনেকটা কাউকে বুঝতে না দেবার মতো করে। গালের ওপর দিয়ে আলতোভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে নিয়ে, অবশেষে তা এসে থেমে গেল ওর চোখের পাতার ওপর–আমি আলতোভাবে টোকা দিলাম। চোখের নিচকার খাজের ভেতর এক ধরনের লালচে বেগুনী রঙের আভা দেখতে পেলাম আমি। ওর নাকে স্পর্শ করে অতি চমৎকার অবয়ব বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম এবং তারপর একেবারে স্থীর ঠোঁট জোড়া। আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে ওর ঠোঁট জোড়া একটু ফাঁক হয়ে গেল। খুব ইচ্ছে হলো হাঁটু গেঁড়ে ওর দিকে সামান্য একটু এগিয়ে যাই ওর দেহের সুগন্ধ সম্পূর্ণভাবে শুষে নিই। সুতরাং আমার একটা হাত আলতোভাবে ছেড়ে দিয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম–তবে সামান্য পেছনে সরে যাক, তেমনটাও চাইলাম না।

এ্যাডওয়ার্ড চোখ খুললো। মনে হলো ওই চোখ জোড়া ক্ষুধার্ত হয়ে আছে যেন। এতে অবশ্য মোটেও ভয় পেলাম না বটে, তবে পেটের মাংসপেশিতে এক ধরনের চাপ ধরা অনুভূতি হতে লাগলো। এবং ধমনীর ভেতর দিয়ে আবার সেই আগের মতোই দ্রুতবেগে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো।

“আমার ইচ্ছে,” ও ফিসফিস করলো, “আমার ইচ্ছে তুমি বিষয়টা সঠিকভাবে অনুভব করবে…এর বিভিন্ন জটিলতা…বিভ্রান্তিগুলো…আমি সবই অনুভব করলাম। তোমার বুঝতে বোধহয় না কষ্ট হবে।

এ্যাডওয়ার্ড আমার মাথার ওপর হাত রাখলো, তারপর বিলি কেটে চুলগুলো সামনে এনে কপাল ঢেকে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো।

“যা বলার আছে, বলে ফেললো,” আমি গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললাম।

“আমার মনে হয় না, তোমাকে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে, অন্য দিকে ক্ষুধা তৃষ্ণা-সবকিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া অদ্ভুত এক সৃষ্টি, এরপরও তোমাকে আমার ভালো লাগে। আশাকরি তুমি এতোদিনে তা বুঝতে পেরেছে। যদিও বিষয়টা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়েছে।” ও সম্পূর্ণভাবে হাসতে পারলো না, “নিষিদ্ধ কোনো বিষয়ের প্রতি যেহেতু তুমি অনুরক্ত নও, সেহেতু মনে হয় না বিষয়টাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে।

“কিন্তু…” ও হালকাভাবে ঠোঁটের ওপর আঙুল স্পর্শ করলো। আমি আবার শিউরে উঠলাম। “এখানে অন্য এক ধরনের ক্ষুধা আছে, এ ধরনের ক্ষুধা ঠিক আমিও বুঝতে পারি না, ওটা আমর কাছে বিদেশী ভাষার মতোই দুর্বোধ্য বলে মনে হয়।”

“তোমার চিন্তাগুলোকে আমি ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করতে চাই।”

“নিজেকে আমার আর সব মানুষের মতো মনে হয় না। এটা কি এভাবেই চলতে থাকবে?”

 “আমার মতামত জানতে চাও?” আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। না, কখনোই নয়, আগে যেমন ঘটেছে, তেমন আর ঘটবে না।”

ওর দু’ হাতের মুঠোর ভেতর আমার একটা হাত চেপে ধরে রাখলাম।

“কীভাবে তোমার সান্নিধ্য লাভ করবো আমি তা জানি না,” আমার কথার সাথে সুর মিলিয়ে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “আমি পারবো কিনা সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।”

আমার চোখের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও অতি ধীরে একটু সামনের দিকে এগিয়ে এলো। ওর পাথরের মতো মসৃণ বুকের ওপর আমি চিবুকটা স্থাপন করলাম। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অবশ্য আমি আর কিছুই শুনতে পেলাম না।

“যথেষ্ট হয়েছে,” চোখ বন্ধ করে বললাম।

প্রায় আর সব পুরুষের মতোই ও আমার গলা জড়িয়ে ধরলো এবং ওর মুখটা আমার চুলের ভেতর নামিয়ে আনলো।

“তোমার যোগ্যতাগুলোকে প্রকাশ করার সময় এসেছে,”আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম।

নিশ্চুপভাবে আবার আমরা বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম আমার মতোই ও ইচ্ছে করে চুপচাপ বসে আছে কিনা। কিন্তু দেখতে পেলাম দিনের আলো ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ঘন গাছপালার ছায়া এসে পড়ছে আমাদের দেহের ওপর। আমি এরই ভেতর একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

“তোমার বোধহয় এখন রওনা হওয়া প্রয়োজন।”

“মনে হচ্ছে, আমার মনের চিন্তাগুলো তুমি মোটেও পড়তে পারছে না।”

“ক্রমশই বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসছে।” ওর কণ্ঠ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম আমি।

ও আমার কাঁধের ওপর হাত রাখলো এবং আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম।

“আমি কি তোমাকে কিছু একটা দেখাতে পারি?” ও জিজ্ঞেস করলো। হঠাৎই ওর চোখে এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করলাম।

“তুমি আমাকে কি দেখাবে?”

“তোমাকে দেখাবো কীভাবে আমি বনের ভেতর বেড়াই।” এ্যাডওয়ার্ড আমার অভিব্যক্তি বুঝে নেবার চেষ্টা করলো। “ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, তুমি নিরাপদেই থাকবে এবং তোমার ওই ট্রাকের চাইতে দ্রুতই ঘুরে বেড়াতে পারবে।” ওর মুখে দুষ্টু কিন্তু মিষ্টি হাসি দেখে আবারও আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে চাইলো।

 “তুমি কি তাহলে বাদুরে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছো?” সতর্কভাবে আমি প্রশ্ন করলাম।

ও হেসে উঠলো সাধারণত যে রকম হাসে, তার চাইতে একটু উচ্চ স্বরেই। “তোমাকে কিন্তু এভাবে কখনোই হাসতে দেখিনি।”

“ঠিক, এরকম হাসি তুমি আশা করি সবসময় শুনতে পাবে।”

“ভীতুর ডিম, এদিকে এসে আমার পিঠে চেপে বসো।”

আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম, আদৌ ও আমার সাথে কোনো ছেলেমানুষী করছে কিনা। আমার ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পরেছে, এমনভাবে একটু হেসে ও আমার দিকে হাত বাড়ালো। আমি আঁতকে উঠলাম, যদিও আমার চিন্তাগুলো ও পড়তে পারলো না। তবে প্রতিবারই মনে হতে লাগলো আমার নাড়ির স্পন্দন বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর আমার দেহটা আলতোভাবে ওর পিঠের ওপর তুলে নিলো। পিঠের ওপর খানিকটা তুলে নেবার পর হাত এবং পা দিয়ে ওর দেহ আঁকড়ে ধরলাম। ও যেভাবে আমার দেহটা তুলে নিলো, তাতে মনে হলো ওর কাছে আমি শিশু ছাড়া আর কিছুই নই।

“তোমার সাধারণ ব্যাকপ্যাকের চাইতে আমার ওজন কিন্তু সামান্য বেশিই হবে” ওকে সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে বললাম আমি।

“হাহ!” নাক দিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করলো এ্যাডওয়ার্ড। আমার কাছে মনে হলো, ওর চোখের পাতা নড়ানোর শব্দও যেন শুনতে পাবো।

“সহজ থাকার চেষ্টা করবে,” ও বিড়বিড় করলো। এবং তারপরই ও দৌড়াতে শুরু করলো।

এ্যাডওয়ার্ড অন্ধকারের দিকে তাকালো। বনের ঘন গাছপালার নিচে নিচ্ছিদ্র শুধু অন্ধকারই মনে হতে পারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেশ কিছু ভুত দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনো শব্দই শুনতে পেলাম না, এমনকি এ্যাডওয়ার্ডের পা-জোড়া যে মাটি স্পর্শ করে আছে তারও কোনো প্রমাণ খুঁজে পেলাম না। ও আগের মতোই স্বাভাবিক নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে লাগলো-ওর সামান্যতমও কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হলো না। কিন্তু গাছ পালাগুলো অতিদ্রুত গতিতে আমাদের শরীরের নিচ দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম-এতোই দ্রুত যে, মাঝে ভুল হতে লাগলো আদৌ ওগুলো গাছপালা নাকি অন্য কিছু।

প্রচণ্ড ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে রাখলাম। যদিও বনের অত্যন্ত শীতল বাতাস চোখে মুখে এসে ঝাঁপটা দিতে লাগলো। এই শীতল বাতাসের স্পর্শে মুখে রীতিমতো যন্ত্রণা শুরু হলো। মনে হলো বোকার মতো প্লেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছি। অন্যদিকে গতি জড়তার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে কী ধরনের অনুভূতি হতে পারে, জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমি তা অনুভব করতে পারলাম।

অবশেষে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানো শেষ হলো। খুব সকালে আমরা তৃণভূমিতে বেড়াতে এসেছিলাম এবং এখন মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার- মিনিট কয়েকের ভেতর আমাদের সমস্ত আনন্দ শেষ হতে চলেছে। আমরা ট্রাকে ফিরে গেলাম।.

“মন চাঙ্গা করা ঔষুধের মতো তাই নয় কি?” ওর কণ্ঠের ভেতর প্রচণ্ড উত্তেজনা।

এ্যাডওয়ার্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। ওর পিঠ থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। কেন যেন মাংসপেশিগুলো সাড়া দিলো না। আমার হাত এবং পা আগের মতোই ওর শরীর আঁকড়ে থাকলো এবং বনবন করে মাথা ঘুরতে লাগলো।

“বেলা?” উৎকণ্ঠিত হয়ে ও আমাকে ডাকলো।

“আমার মনে হচ্ছে মাটির ওপর শুয়ে পড়ি,” হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম আমি।

“ওহ, আমি আন্তরিক দুঃখিত, ও আমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো বটে কিন্তু মোটেও নড়াচড়া করতে পারলাম না।

“আমার মনে হচ্ছে, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।”

এ্যাডওয়ার্ড শান্তভাবে একটু হাসলো।

এরপর ওর গলায় জড়ানো ধরা আমার হাতের শক্ত বাঁধনি হালকা করে নিলো। ওর হাতকে এখন মোটেও লোহার মতো শক্ত বলে মনে হলো না। পিঠ থেকে নামিয়ে সামনের দিকে টেনে ওর মুখোমুখি দাঁড় করালো। ছোটো শিশুকে দোল দেবার ভঙ্গিতে যেভাবে দু হাতের ওপর তুলে নেয়া হয়, এ্যাডওয়ার্ড একই ভঙ্গিতে আমাকে তুলে নিলো। ও খানিকক্ষণ আমাকে একই ভঙ্গিতে ধরে রাখলো তারপর প্রীং এর মতো ফাণ গাছের ওপর আলতোভাবে শুইয়ে দিলো।

“এখন তোমার কেমন লাগছে?” ও জিজ্ঞেস করলো।

বনবন করে মাথা ঘুরতে থাকায় ভালো না মন্দ আমি খানিকক্ষণ কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।”

“আমার হাঁটুর মাঝখানে তোমার মাথা নামিয়ে আনে।”

ওর কথামতোই আমি তেমনই করার চেষ্টা করলাম, মনে হলো এতে কিছুটা উপকার হলো যেন। আমি ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। একই সাথে ওর হাঁটুর ওপর মাথাটা শক্তভাবে চেপে ধরে রাখলাম। মনে হলো ও আমার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকুক। কিন্তু মুহূর্তেগুলো দ্রুত পার হয়ে যেতে লাগলো এবং স্বাভাবিকভাবেই এক সময় মনে হলো এখন বুঝি মাথা তুলে উঠে বসতে পারবো। মাথার এই এলোমেলো অবস্থার ভেতরও মৌমাছির গুঞ্জণের মতো এক ধরনের শব্দ আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো।

“তোমার এই বুদ্ধিটা আমার কাছে মোটেও যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না,” ও মুখ টিপে হাসলো।

আমি, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কণ্ঠস্বর খুবই দূর্বল কোণালো। “না, সবকিছুই আমার কাছে খুব মজার বলে মনে হচ্ছে।”

“হাহ! বললেই হলো, তোমাকে একেবারে ভূতের মতো সাদা দেখাচ্ছে না, মনে হয় ভুল বললাম, তুমি একেবারে আমার মতো সাদা হয়ে গেছে।”

“আমার মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি।”

“কথাটা পরেও যেন স্মরণে থাকে।”

 “পরেও স্মরণে রাখবো!” আমি কোনোভাবে জবাব দিলাম।

ও হাসলো, ওর মন এখানো চাঙ্গা হয়ে আছে।

“দেখিয়ে দাও,” আমি বিড়বিড় করলাম।

 “বেলা, তোমার চোখ খুলো,” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

ওর দিক থেকে আমার মনে হয় ও ঠিকই আছে। ও মুখটা আমার কাছে এগিয়ে আনলো। ওর সৌন্দর্য্যে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

“যখন আমি দৌড়াচ্ছিলাম, তখন আমার মনে হচ্ছিলো…” কথাটা শেষ না করেই ও থেমে গেল।

“আমি চিন্তা করছিলাম, কখোন না জানি গাছগুলোর সাথে ধাক্কা লাগে।”

“আরে দূর বেলা,” ও মুখ টিপে হাসলো।” দৌড়ানোর ব্যাপারটা অর্থাৎ তোমার কাছে যেটা উড়ে বেড়ানো মনে হতে পারে, ওটা আমার স্বভাবের দ্বিতীয় ব্যাপার। ওটা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তা করি না।”

“আমি দেখতে চাই, আমি আবার বিড়বিড় করলাম।

ও হাসলো।

“না,” ও আগের মতোই বলতে লাগলো “আমার মনে হয় আমি খুব সামান্য কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করেছি।” এ্যাডওয়ার্ড দু’হাতে আমার মুখটা চেপে ধরলো।

আমি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম।

ও একটু ইতস্তত করলো-সাধারণ নিয়মে নয় অন্তত আর দশটা মানুষের মতো নয়। একটা মেয়েকে চুমু খাওয়ার আগে একজন পুরুষ যেভাবে ইতস্তত করে, ওর আচরণ দেখে মোটেও তেমন মনে হলো না। মনে হলো দীর্ঘসময় নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ যদি জোর করে চুমু খেয়েও ফেলে, পরিস্থিতি যতোখানি তিক্ত মনে হয়, এ ধরনের চুপ করে থাকায় আরো বেশি তিক্ত মনে হতে পারে পরিস্থিতিটাকে।

এ্যাডওয়ার্ড তার প্রয়োজনগুলোকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলো কিনা সেটা ভেবেই ইতস্তত করতে লাগলো।

এবং তারপরই মার্বেল পাথরের মতো শীতল ঠোঁট জোড়া আমার ঠোঁটের ওপর নামিয়ে আনলো।

আমার চামড়ার নিচে রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। একই সাথে ঠোঁট জোড়ায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। নিঃশ্বাস খুব ধীর গতিতে প্রবাহিত হতে লাগলো। ওর চুলের ভেতর এক হাতে আমি বিলি কেটে দিতে লাগলাম, অন্য হাতে যতোটা সম্ভব জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। ওর অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধ টেনে নেবার জন্যেই বোধহয় ঠোঁট জোড়া একটু ফাঁক করলাম।

“ওপস,” আমি গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললাম।

 “এটা একটা উপলব্ধি করার বিষয়।”

ওর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করতে লাগলো। ও আমার মুখটা আঁকড়ে ধরে সামান্য একটু ওর দিকে টেনে নিলো।

 “আমি কি…?” আমি ওর কাছ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাইলাম। ফলে দু’জনের ভেতর খানিকটা দুরত্বের সৃষ্টি হলো। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড আমাকে যেভাবে ধরে রেখেছে, তাতে ইঞ্চি দু’য়েকের বেশি নড়তে পারলাম না।

“না, আমি জানি বিষয়টা তোমার কাছে অসহ্যকর মনে হচ্ছে না। দয়া করে আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করো।” ওর কণ্ঠস্বর সংযত এবং অত্যন্ত ভদ্রোচিত।

এরপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে ও হেসে উঠলো।

 “ওখানে,” ও বললো। ওকে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট মনে হলো।

 “সহ্য করার মতো?” অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম।

ও জোরে হেসে উঠলো। “যতোটা ভেবেছিলাম, তার চাইতে দেখছি আমি অনেক বেশি শক্তিশালী। বিষয়টা জেনে আমার বেশ ভালো লাগছে।”

“আমিও একই কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমি দুঃখিত।”

“হাজার হলেও তুমি একজন মানুষ।”

“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,” আমি বললাম।

ও নমনীয়ভাবে উঠে দাঁড়ালো। ওর উঠে দাঁড়ানো আমার চোখেই পড়লো না। যেন। আমার দিকে ও একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি এ্যাডওয়ার্ডের বরফ শীতল হাতটা চেপে ধরলাম। যতোটা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি জোর দিতে হলো ওর হাতের ওপর। এখনো ঠিক মতো আমি ভরসাম্য রক্ষা করতে পারছি না।

 “উড়ে বেড়ানোর কারণে তুমি কি এখনো ভীত? নাকি আমার চুমু খাওয়ার দক্ষতা দেখে ভয় পেয়ে গেছ?” পরিবেশটাকে ও হালকা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ওকে এখন। আমর কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হচ্ছে। একেবারে অচেনা এক এ্যাডওয়ার্ড।

“আমি নিশ্চিত কিছুই বলতে পারছি না, এখনো আগের মতোই হতবিহ্বল অবস্থার ভেতর আছি,” কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিলাম আমি।

“সম্ভবত তুমি আমাকে গাড়ি চালানোর সুযোগ দিচ্ছো।”

“তুমি কি পাগল হলে?” আমি প্রতিবাদ জানালাম।

“তোমার যে কোনো দিনের চাইতে আমি অনেক ভালোভাবে গাড়ি চালাতে পারবো” টিটকারী দেবার ভঙ্গিতে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “গতি জড়তার কারণে তুমি মোটেও ভালোভাবে গাড়ি চালাতে পারবে না।”

“তোমার কথাটা যে সত্য, আমি তা মানছি। কিন্তু আমার মনের জোর সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই এবং যে ট্রাকটা সাথে করে এনেছি সেটা সম্পর্কেও তোমার কোনো ধারণা নেই।”

“বেলা, তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো।”

পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে গাড়ির চাবিটা মুঠোর ভেতর শক্তভাবে চেপে ধরে রাখলাম। ঠোঁট কামড়ে ধরে আমি মাথা নাড়লাম।

“নাহ! কোনো সুযোগই নেই।” অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে ও ভ্রু কুঁচকালো।

ওর চারদিকে ঘুরে আমি ড্রাইভিং সিটের দিকে এগিয়ে গেলাম। অকম্পিতভাবে হাঁটতে দেখে আমাকে হেঁটে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধ করলো না। তবে মনে হলো কাজটা সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করছে। ও একটা হাত দিয়ে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরলো।

“বেলা, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এততক্ষণ পর্যন্ত সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। যখন তুমি ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না, তখন মোটেও আমি স্টেয়ারিং হুইলের সামনে বসতে দিতে পারি না। এর পাশাপাশি বলতে হয়, এক বন্ধু আরেক মাতাল বন্ধুকে কখনোই গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয় না।” আড়চোখে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড কথাগুলো বললো। ওর বুকের কাছ থেকে ভেসে আসা মোহিত করা সুগন্ধ মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

“মাতাল?” আমি জোর প্রতিবাদ জানালাম।

“চোখের সামনে আমি তোমাকে মাতাল হতে দেখেছি,” ওর সেই রহস্যময় হাসি আবার হাসলো।

“এ বিষয় নিয়ে মোটেও আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাইছি না,” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ওকে চাবি ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া নতুন কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। মেলে ধরা হাতের তালুর ওপর চাবিটা খানিক ওপর থেকে ছেড়ে দিলাম। স্বল্পালোকেও চাবিটা চকচক করে উঠলো। “খুব ভালোভাবে চালাবে আমার ট্রাকটা কিন্তু নিঃসন্দেহে এক বয়স্ক নাগরিক।”

“এবং খুবই স্পর্শকাতর,” ও সমর্থন জানালো।

“আশাকরি আমার সামনেই ওটার প্রতি তুমি অনুরক্ত হয়ে পড়বে না, আমি ওকে খোঁচা দেবার ভঙ্গিতে বললাম।

আবার আগের সেই এ্যাডওয়ার্ডকে খুঁজে পেলাম যেন-শান্ত আমুদে স্বভাবের এ্যাডওয়ার্ড। ও প্রথম দিকে আমার কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে চাইলো না। মুখটা এগিয়ে এনে আমার চোয়ালের ওপর ওর ঠোঁট জোড়া ঘষতে লাগলো এরপর কান থেকে চিবুক পর্যন্ত ওর ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলাম। এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ওর ঠোঁট জোড়া একইভাবে আমার মুখের ওপর দিয়ে ঘুরতে লাগলো। আমি নড়াচড়া করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেললাম।

“একেবারেই অনুভূতিহীন,” অবশেষে ও বিড়বিড় করলো, “আমি কিন্তু সুখ ভালোভাবেই আস্বাদন করতে পেরেছি।”

.

১৪.

আমি মানতে বাধ্য হলাম যে, ও চমৎকার গাড়ি চালায়। রাস্তার দিকে ও খুব কমই তাকাচ্ছে, তবুও লেন থেকে গাড়ির চাকা মনে হলো না এক ইঞ্চিও নড়ে গেছে। এ্যাডওয়ার্ড এক হাতে গাড়ি চালাচ্ছে এবং অন্য হাতে সিটের ওপর রাখা আমার একটা হাত চেপে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে অস্তমিত সূর্যটাকে দেখে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার একবার করে আমাকেও দেখে নিচ্ছে। আমার মুখ গাড়ির বাইরে চুলগুলো এলোমেলোভাবে বাতাসে উড়ছে ও ধীরে ধীরে আমার হাতের ওপর চাপ দিতে লাগলো।

রেডিওর নব ঘুরিয়ে এ্যাডওয়ার্ড পুরাতন গানের একটা স্টেশন ধরলো। রেডিও থেকে ভেসে আসা একটা গানের সাথে ও কণ্ঠ মেলালো। অবশ্য এই গানটা আমি ইতোপূর্বে কখনো শুনিনি। এই গানের প্রতিটা লাইনই ওর মুখস্ত।

“পঞ্চাশ দশকের গানও তোমার পছন্দের?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“পঞ্চাশ দশকের গান খুবই চমৎকার। ষাট অথবা সত্তরের দশকের তুলনায় অবশ্যই ভালো লাগার মতো, বুঝলে কিছু?” অজানা কোনো কারণে ও কেঁপে উঠলো। “আশির দশকের গান তাও সহ্য করা যায়।”

“তুমি কি বলবে, তোমার বয়স কতো?” সাধারণভাবেই আমি প্রশ্নটা করলাম। ওর গান কোণার আনন্দকে মাটি করে দেবার ইচ্ছে আমার মোটেও নেই।

“পুরাতন গান কোণার অর্থই কি আমার অনেক বয়স?” ওর হাসি দেখে খানিকটা ভরসা পেলাম। অন্তত আমার এ ধরনের প্রশ্নে ওর মন খারাপ হয়নি।

 “না, কিন্তু এখনো আমি অবাক হচ্ছি…” আমি মুখ টিপে হাসলাম। “তোমার এই আজকের রহস্য সারা রাতেও সমাধান করতে পারবো না।”

“তোমাকে বিষয়টা যদি হতাশ করে থাকে তাহলে আমি কিন্তু খুব অবাক হবো” আপনমনেই বিড়বিড় করে ও মন্তব্য করলো। এরই মধ্যে ও একবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিয়েছে; এভাবেই মিনিট খানিক পার হয়ে গেল।

“আমাকে বুঝার চেষ্টা করো” আবশেষে আমি মুখ খুললাম।

ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার চোখের দিকে তাকালো। মনে হলো খানিকক্ষণের জন্যে ও রাস্তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। এবং সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। অবশেষে এ্যাডওয়ার্ড আবার মুখ খুললো।

“আমার জন্ম শিকাগো শহরে ১৯০১ সালে। ও একটু থেমে আড়চোখে আমাকে দেখে নিলো। আমার বিস্ময়াভাবকে যতোটা সম্ভব প্রকাশ না করার চেষ্টা করলাম। ও হালকাভাবে একটু হাসলো। কথা বলার সময়টুকুতে ওই হালকা হাসি ঝুলেই থাকলো। “১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে একটা হাসপাতালে কার্লিসল আমাকে খুঁজে পান। আমার বয়স তখন সতেরো। আমার স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু ঘটেছিলো।”

মনে হলো এ্যাডওয়ার্ড আমার নিঃশ্বাসের শব্দ কোণার চেষ্টা করছে। যদিও এই নিঃশ্বাসের শব্দ নিজের কাছেই ক্ষীণ কোণালো।

“ঘটনাটা তেমন ভালোভাবে মনে নেই। এটা অনেক আগের ঘটনা,তাছাড়া সাধারণ মানুষের এই স্মৃতিগুলো মন থেকে মুছে যাওয়ারই কথা।”

এরই ভেতর ও চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললো। “কার্লিসল আমাকে রক্ষা করার সময়কার অনুভূতি বেশ মনে আছে। এটা সহজে ভুলে যাবার মতো সাধারণ কোনো ঘটনা নয়।”

“তোমার বাবা-মা?”

“ওই রোগে উনারা আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমি একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলাম। এ কারণেই কার্লিসল আমাকে গ্রহণ করেছিলেন। মহামারীর মতো এক ধরনের বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিলো সে সময়ে। আমি যে চলে গেছি কেউই তা লক্ষ করেনি।”

“উনি তোমাকে…উনি তোমাকে কিভাবে রক্ষা করলেন?”

ও জবাব দিতে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। মনে হলো যথার্থ উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

“এটা বলা বেশ কঠিন ব্যাপার। বিষয়টার সাথে নিজের মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আমাদের ভেতর অনেকেরই থাকে না। কিন্তু কার্লির্সল প্রথম থেকেই অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। আমাদের প্রত্যেকের প্রতিই তিনি দয়া দেখিয়ে এসেছেন… ইতিহাসে তার মতো কাউকে খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। ও একটু থামলো। “আমার জন্যে এটা খুবই দুঃখজনক এক স্মৃতি হয়ে আছে।”

একবার তাকে বলতে ইচ্ছে করলো এ বিষয় নিয়ে আর মোটেও আলোচনা নয়। কিন্তু আমার জানার আগ্রহকেও চেপে রাখতে পারলাম না। ওর বিষয়ে সত্যিকার অর্থে অনেক কিছু জানার আছে আমার।

ওর নরম কণ্ঠস্বর আমার চিন্তার জালকে ছিন্ন করে দিলো। “উনি প্রথম থেকে নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। আমি কার্লিসল পরিবারের প্রথম সদস্য হলেও এরপরই তিনি এসমেকে গ্রহণ করেন। ও পাহাড়ের পাশ থেকে পড়ে গিয়েছিলো। ওরা এসমেকে ভুল করে সরাসরি মর্গে এনে হাজির করেছিলো। মারাত্নক আহত হলেও ওর তখন হৃৎস্পন্দন ঠিকই চালু ছিলো।”

“তাহলে অবশ্যই তোমাদের মৃত্যু ঘটবে, তারপর ইচ্ছে করলেই পরিণত হবে। একটা…” শব্দটা চিন্তা করা যতো সহজ আমি ততো সহজে শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলাম না।

“না, সেটা শুধুমাত্র কার্লিসলের জন্যে যুক্তিযুক্ত। কারও যদি অন্য পছন্দ থাকে তাহলে কখনোই তিনি এমন কাজ করেন না।” পিতার প্রসঙ্গ উঠতেই তার প্রতি এ্যাডওয়ার্ডের অন্য এক ধরনের শ্রদ্ধা লক্ষ করলাম। যদিও ও কথাটা বেশ সহজভাবেই বললো, পূর্বের কথার সুত্র ধরে ও বলতে লাগলো,”বিষয়টা রক্তের অবস্থার ওপরও নির্ভর করে। যদিও রক্তের ঘনত্ব কমে আসে…” খানিকক্ষণ অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ও কথাগুলো বললো এবং বুঝতে পারলাম আলোচনার যবনিকা পাত হয়তো এখানেই করা উচিত। কিন্তু তবুও জানার আগ্রহ ধরে রাখতে পারলাম না। ওর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম না।

“এমেট এবং রোজালে?”

“কার্লিসল এরপর আমাদের পরিবারের সদস্য করে আনলেন রোজালেকে। এসমেকে তিনি আমার সঙ্গিনী করার চিন্তা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার মনের ইচ্ছে যেমনই হয়ে থাকুক না কেন, আমি তাকে বোন ছাড়া আর অন্য কোনো ধরনের সম্পর্কের কথা চিন্তাও করিনি।” এ্যাডওয়ার্ড ভ্রু কুঁচকালো। “এর দু’ বছর বাদে এসমে খুঁজে পেলো এমেটকে। এসমে তখন শিকারে গিয়েছিলো ওই সময় আমরা থাকতাম এ্যাপালাচিয়াতে। আমরা দেখলাম একটা ভালোকের আক্রমণে এমেটের প্রায় শেষ অবস্থা। এসমে এমেটকে কার্লিসলের বাড়িতে নিয়ে এলো। প্রায় শমাইল দূর থেকে বয়ে আনা হয়েছিলো এ্যাপালাচিয়াতে। এসমের ভয় ছিলো, আদৌ হয়তো এতো দূর থেকে তাকে বয়ে আনা সম্ভব হবে না। আমি শুধু বুঝতে পারি তার জন্যে কাজটা কতোটা কঠিন ছিলো।” এ্যাডওয়ার্ড আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মুঠো পাকিয়ে ধরে রাখা হাতটা উপর দিকে তুলে ধরে আবার ছেড়ে দিলো। ওর হাতের উল্টো আমার গালের ওপর বুলিয়ে নিলো।

“কিন্তু ওর পক্ষে কাজটা করা সম্ভব হয়েছিলো,” আমি উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললাম। আড়চোখে একবার ওর চোখের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে নিলাম।

“হ্যাঁ,” ও বিড়বিড় করলো। এসমে এমেটের ভেতর অন্য ধরনের কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলো, যার কারণে ওকে কারসিলের কাছে নিয়ে আসার সাহসও পেয়েছিলো। এরপর থেকে ওরা এক সাথে আছে। মাঝে মাঝে ওরা আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আলাদা থাকতে বোধহয় ওরা পছন্দ করে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে ওরা বুঝি প্রেমিক জুটি নয়, বরং বিবাহিত জুটি। ছেলেবেলা থেকেই আলাদাভাবে পছন্দের কোনো স্থান ছিলো না, ফলে ফরককেই প্রথম থেকে বেছে নিয়েছিলাম। আর এখানেই আমাদের মন বসে গেছে। সুতরাং সবাই আমরা একই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম।” ও হাসলো। “আমার ধারণা অতি শীঘ্রই ওদের বিয়েতে আমরা হয়তো যোগ দিতে পারবো।”

“এলিস এবং জেসপার?”

“এলিস এবং জেসপার, দুজনেই প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। একই সাথে তাদের আমি দুর্লভও বলবো। ওদের ক্ষেত্রে বলতে হয়, দুজনেই ওরা আত্মনির্ভরশীলভাবে বেড়ে উঠেছে। বাইরের কারও কাছে থেকেই কোনো সাহায্য সহযোগিতা নেবার মোটেও প্রয়োজন হয়নি। জেসপারকে প্রথম থেকেই আমার অন্য রকমের মনে হয়েছে…অন্য এক ধরনের গোত্রভুক্ত একেবারেই ভিন্ন এক ধরনের গোত্রের সদস্য। ও ভিন্ন এক ধরনের হতাশায় ভুগছিলো, নিজের ওপর কেমন যেন সন্দিহান হয়ে উঠেছিলো। এলিস ওকে দেখতে পেলো। এলিস অনেকটাই আমার মতোই বলতে গেলে, তবে ওর ক্ষমতা আমার চাইতে অনেক বেশি। অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের কারও ক্ষমতার সাথে তার ক্ষমতাকে মেলানো যাবে না।”

“আসলেই?” মুগ্ধ হয়ে আমি ওর কথা শুনছিলাম বটে কিন্তু এর মাঝে বাঁধা দিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। “কিন্তু বলেছিলে, তুমিই ওই পরিবারের একমাত্র সদস্য, যে অন্যদের চিন্তাগুলোকে পড়তে পারো।

“সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছিলাম। এলিস অন্যান্য বিষয়গুলো ভালো বুঝতে পারে। ও বিভিন্ন ঘটনা দেখতে পারে। এমন সব ঘটনা, যা ভবিষ্যতে ঘটবে বা ঘটতে পারে। কিন্তু এগুলোর সবই বিষয় ভিত্তিক ঘটনা। তবে মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যত কখনোই পাথরের মতো নিশ্চল থাকে না।

কথাগুলো বলার সময় ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো এবং ক্ষণিকের জন্যে আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আদৌ ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিনা।

“কোন ধরনের ঘটনা সে আগে থেকেই দেখতে পারে?

“এলিস আগে থেকেই জেসপারকে দেখতে পেয়েছিলো। অথচ জেসপারকে তখন একেবারেই জানতো না। ও কার্লিসল এবং আমাদের পরিবারের সদস্যদের আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলো। দয়ালু মানুষের প্রতি এলিস খুবই স্পর্শকাতর। ও সবসময়ই ভবিষ্যত দেখতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আমাদের মতোই যখন অন্য দলের সদস্যরা কাছে আসে তখন তাদের ভবিষ্যত এলিস আগে থেকেই বলে দিতে পারে। আসন্ন কোনো বিপদের আভাস পেলে এলিস তাদের সাবধান করে দেয়।”

“তোমার মতো কি…তোমার মতো কি অনেকেই আছে?” আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেছি। ওদের মতো কতোজন আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

“না খুব বেশি জন নেই। তবে সবাই যে একই স্থানে থাকবে এমন কথাও নেই। আমাদের মতো আবার অনেকে আছে যারা তোমার মতো মানুষ শিকার করতে পছন্দ করে”-লাজুক ভঙ্গিতে ও আমার দিকে একবার তাকালো- “যতোদিন ইচ্ছে তারা স্বাভাবিকভাবে মানুষের সাথে মিশে থাকতে পারে। আমাদের মতো শুধু মাত্র একটা পরিবার আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি। এই পরিবারকে দেখেছিলাম আলাস্কার একটা ছোট্ট শহরে। ওই পরিবারের সাথে আমরা বেশ কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা যে আমাদের মতোই তা বুঝতে অনেকে সময় লেগে গিয়েছিলো।”

 “আর অন্যান্যরা?”

“ওদের বেশিরভাগ ছিলো যাযাবর শ্রেণীর। ওদের সাথে আমরা তখন একইভাবে কাটিয়েছিলাম। যে কোনো কিছুর চাইতে বিষয়টা বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝে এই অন্যান্যদের পেছনে ঘুরে বেড়ানো ভালো লাগে না, আমাদের বেশির ভাগই তখন উত্তরে জমা হতে শুরু করেছে।

 “এমন হওয়ার কারণ কি?”

এতোক্ষণে গাড়িটা আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও সাবধানে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো। চারদিকে একেবারে নির্জনতা এবং অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্নও খুঁজে পেলাম না। পোর্চের লাইট নেভানো দেখে বুঝতে পারলাম বাবা এখনো বাড়ি ফেরেননি।

“সন্ধার সময় তোমার চোখ জোড়া কি ভোলা ছিলো?” টিটকারী দেবার ভঙ্গিতে বললো এ্যাডওয়ার্ড “ দুর্ঘটনা এরিয়ে আমি সূর্যালোকের ভেতর দিয়ে এতো সহজে কীভাবে গাড়ি চালাতে পারলাম, তোমার একবারো মনে এলো না? অলিম্পিক পেনেলসুলাকে বেছে নেবার পেছনে আমার একটা কারণ ছিলো। এটা পৃথিবীর এমন একস্থান যেখানে কোনো সূর্যের আলো নেই। সূর্যের আলো না থাকার কারণে দিনের আলোতে বেরুতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, বিশ্রি আশি বছরের একজন মানুষের রাতটা কতো কষ্টের ভেতর কাটে!”

“এগুলো অনেকটা গল্প গাথার মতো চলে গেছে নয় কি?”

“সম্ভবত।”

 “তাহলে এলিস জেসপারের মতোই অন্য পরিবার থেকে এসেছিলো?”

“না, এটা এক ধরনের রহস্য। এলিস তার মানব জীবনের কথা স্মরণে আনতে পারে না। এমন কি তাকে কে বাঁচিয়ে তুলেছিলো, তাও বলতে পারে না। ও নিজে থেকেই বেঁচে উঠেছিলো। ওকে কে নিয়ে এসেছিলো এবং কেন এনেছিল, তার কিছুই আমাদের জানা নেই। ওর ভেতর প্রথম দিকে ব্যতিক্রমী তেমন কিছু ছিলো না। যদি ও জেসপার এবং কার্লিসল কিংবা আমাদের কারও সাথে পরিচিত হতে না পারতো, তাহলে হয়তো এলিস সেই আদিম অবস্থাতেই থেকে যেতো।”

আমার মাথার ভেতর অসংখ্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, সুতরাং আমার জিজ্ঞাসারও শেষ নেই। এখনো তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার থেকে গেছে। কিন্তু এখন আমি বেশ অস্বস্তির ভেতর আছি। পেটের ভেতর খিদেয় মোচড় দিতে শুরু করেছে।

আমার যে এতোটা খিদে পেয়েছে এতোক্ষণ তা খেয়ালেই আসেনি। তারপরও এখন আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।

“আমি দুঃখিত, তোমার ডিনারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো আমার।”

 “সত্যিই আমি বেশ আছি।”

“যারা স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ করে, তাদের সাথে আমি বেশি সময় কাটাই না। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।”

“তোমার সাথে থাকতেই আমার ভালো লাগছে।” অন্ধকারের ভেতর কথাটা বলা আমার পক্ষে বেশ সহজই মনে হলো। যদিও আমি জানি আমার কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে আমার সাথে প্রতারণা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার প্রতি যেভাবে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, সহজে তাকে ছাড়তেও পারছি না।

“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” ও অনুমতি চাইলো।

“তোমার কি তাতে ভালো লাগবে?” আমি মনের পর্দায় দৃশ্যটাকে ঠিক মতো সাজাতে পারলাম না। কিচেনের সামনে বাবার আরাম কেদারায় ও বসে আছে, এমন দৃশ্য কল্পনা বোধহয় সহজে মাথায় আনা সম্ভব নয়।

“হ্যাঁ, এটা বোধহয় ভালোই হবে।” আমি হালকাভাবে দরজাটা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম, যুগপৎ ও আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজে থেকেই এ্যাডওয়ার্ড আমার জন্যে দরজাটা খুলে ধরলো।

“অসংখ্য ধন্যবাদ, তোমার অনেক দয়া,” আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে কার্পন্য করলাম না।

“এটা কিন্তু আমার সম্পূর্ণ বাহ্যিক রূপ।”

ঘন অন্ধকারের ভেতর নিঃশব্দে এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ঘন অন্ধকারের ভেতরও তার অবয়ব খুব সহজেই আমার নজরে এলো। এই অন্ধকারে এ্যাডওয়ার্ডকে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হলো-এখনো সেই শান্ত ধীর। ওর চেহারায় স্বপ্নীল সৌন্দর্য ফুটে বেরুচ্ছে।

এ্যাডওয়ার্ড দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে চৌকাঠ ধরে দাঁড়ালো। ও আমাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।

“দরজা কি খোলা আছে?”

“না, দরজার চাবি আমি দরজার চৌকাঠের ওপর একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখি।”

আমি ভেতরে প্রবেশ করে পোর্চের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। ও আমার দিকে তাকাতেই পাল্টা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আমি নিশ্চিত যে কখনোই আমি চাবিটা লুকানো জায়গা থেকে বের করবো না।

“তোমার কাজগুলো দেখে বেশ মজা পাচ্ছি।”

“তুমি কি আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করার চেষ্টা করছো?” যতোটা সম্ভব কণ্ঠস্বরকে স্বাভাবিক রেখে তাকে প্রশ্ন করলাম।

আমি ওর মুখের ভাব দেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। “রাতে আর তোমার কি কি করার আছে?”

আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারপর হলরুম পার হয়ে কিচেনে ঢুকলাম। এ বাড়িতে এ্যাডওয়ার্ড আজই প্রথম হলেও, ওকে ঠিকই রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ওকে এখানে আনতে কাউকে পথ দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। দেখলাম ও একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। এ্যাডওয়ার্ড ও ভাবে বসে থাকায় আমার কাছে মনে হলো সমস্ত রান্নাঘরটা উজ্জ্বল আভায় ভরে উঠেছে। তবে দৃশ্যটা ক্ষণিকের জন্যে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।

ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ডিনার তৈরিতে মনোযোগ দিলাম। গত রাতের লাসাঙ্গা ফ্রীজ থেকে বের করে চৌকোভাবে প্লেটের ওপর সাজিয়ে নিয়ে মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলাম। মাইক্রোওভেন থেকে খাবার বের করে আনতেই টমেটো এবং মসলার গন্ধে সমস্ত রান্নাঘরটা মৌ মৌ করতে লাগলো। ওর সাথে কথা বলার সময় প্লেটের ওপর থেকে মোটেও নজর ফেরাতে পারলাম না।

 “তুমি কি এখানে মাঝে মাঝেই আসো?” স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলাম আমি।

এখন পর্যন্ত আমি অন্যদিকে তাকানোর সুযোগ পাইনি। “কখন তুমি এখানে আসো?”

“আমি এখানে প্রায় প্রতিরাতেই আসি।”

বিস্মিত হয়ে আমার প্রায় বাক্য রুদ্ধ হয়ে এলো। “কেন?”

“তুমি যখন ঘুমোও, দেখে আমার খুব মজা লাগে।” সত্য কথাটা সে নিঃসংকোচে স্বীকার করলো।” তুমি ঘুমের ভেতরও কথা বলো।”

 “নাহ?” আমি মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। একটা গরম আভা মুখ থেকে চুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। ভারসাম্য রক্ষা করতে কিচেনের একটা ব্ল্যাক আমি আঁকড়ে ধরলাম। ঘুমের ভেতর যে আমি কথা বলি এটা মোটেও মিথ্যে নয়। বিষয়টা নিয়ে মা আমাকে অনেকবারই টিটকারী মেরেছেন। যদিও এটাতে ভীত হওয়ার কিছু আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি।

ওর অভিব্যক্তি খানিকক্ষণের ভেতর আমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। “তুমি কি আমার ওপর খুব ক্ষেপে আছো?”

“এ নিয়ে খানিকটা চিন্তা করতে হবে। এটা নির্ভর করছে…।” কথাটা বলতে গিয়ে মনে হলো আমার নিঃশ্বাসটা ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে।

এ্যাডওয়ার্ড আমার কথা কোণার অপেক্ষায় থাকলো।

 “তারপর?” ও জানার জন্যে তাগাদা দিলো

। “তুমি কী শুনেছা!” আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে, নিঃশব্দে ও আমার পাশে এসে দাঁড়ালো এবং আমার একটা হাত ওর মুঠোর ভেতর চেপে ধরলো।

“তোমার হতাশ হওয়ার তো কিছু দেখছি না!” ও আমাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করলো। হঠাৎ-ই ওর মুখটা আমার চোখ বরাবর নামিয়ে আনলো। বেশ খানিকক্ষণ একইভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর এভাবে তাকিয়ে থাকায় আমি বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমাকে অন্যদিকে তাকাতে হলো।

“তোমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তাই না?” এ্যাডওয়ার্ড ফিসফিস করে বললো। “তুমি তাকে নিয়ে খুব চিন্তা করো। এবং বৃষ্টির দিন তোমার মনকে অশান্ত করে তুলে। বাড়ির কথা বলতে খুব ভালোবাসো, কিন্তু এখন তুমি একেবারে চুপ করে আছো। একবার বলেছিলে, তোমার শহরটা খুবই সবুজ!” ও হালকাভাবে একটু হাসলো। আমার মনটা ভালো হয়ে উঠুক আমার মনে হয়, এমনই আশা করলো এ্যাডওয়ার্ড।

“আর কিছু কি বলার আছে?” খানিকটা রাগ মিশিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম।

আমার মনের অবস্থা এখন কেমন, তা সে বুঝতে পারছে। “আমার নামটা তুমি চাইতে পারো।” ঠাট্টারছলে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

হালকাভাবে একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম, আমি। “যথেষ্ট কি হয়নি?”

 “যথেষ্ট হয়েছে বলতে আসলে তুমি কি বুঝাতে চাইছো?”

 “হায় ঈশ্বর!” আমার মাথা ঝুলে পড়লো।

ও আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলো, আলতোভাবে এবং অবশ্যই প্রকৃতির নিয়মে।

“এতোটা আত্নবিশ্বাসী হয়ে ওঠা ভালো নয়, কানের কাছে ফিসফিস করে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “যদি আমি কোনো স্বপ্ন দেখে থাকি, তা শুধুমাত্র তোমাকে নিয়ে। কিন্তু তাতে আমি মোটেও লজ্জা পাই না।”

এরপরই ইটের ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার শব্দ শুনতে পেলাম। সামনের জানালায় হেড লাইটের আলো এসে পড়লো। ওর বুকের ভেতর আমি একেবারে শক্ত হয়ে গেলাম।

“আমি যে এখানে, তোমার বাবার কি ধারণা আছে?” ও জিজ্ঞেস করলো।

 “আমি ঠিক বলতে পারছি না…” দ্রুত চিন্তা করে জবাব দিতে হলো আমাকে।

 “তাহলে অন্য কোন সময়…”

এবং অবশ্যই যখন আমি একা থাকবো।

 “এ্যাডওয়ার্ড!” আমি হিসহিস করে ওর নাম উচ্চারণ করলাম।

ভূতের মতো অদ্ভুত এক ধরনের হাসি ছাড়া আর তার মুখে কিছুই দেখতে পেলাম না।

দরজায় যে বাবা চাবি ঘুরাচ্ছেন আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম।

“বেলা?” উনি আমার নাম ধরে ডাকলেন। আর খানিকক্ষণ আগে তার ডাক শুনে নিঃসন্দেহে আমাকে চমকে উঠতে হতো। বাবা হলরুমের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন।

“এই যে, আমি এদিকে।” আশা করলাম, তিনি যেন আমার আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর বুঝতে না পারেন। মাইক্রোওভেনের ভেতর থেকে প্লেটটা বের করে আনতে ওটা বেশ শক্তভাবে চেপে ধরতে হলো আমাকে। বাবাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি তা আলাদাভাবে তার চেয়ারের সামনে নামিয়ে রাখলাম। এ্যাডওয়ার্ডের সাথে সারাদিন কাটানোর পর বাবার পায়ের শব্দ আমার কানে একটু জোরেই বাজতে লাগলো।

“ওগুলোর কিছু কি আমার ভাগ্যে জুটবে? খাবারের সন্ধানে এতোক্ষণ আমি অযথাই ঘুরে মরেছি।” বুট জুতায় শব্দ তুলে উনি একটা চেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

আমার সাথে সাথে বাবার জন্যেও আমি খাবার পরিবেশন করলাম। খাবারটা কতোটুকু গরম মোটেও খেয়াল না করে মুখে তুললাম। আমার জিভ প্রায় পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। লাসাঙ্গা যখন গরম করছিলাম, তখন দু’গ্লাস দুধ ঢেলেছিলাম। তার থেকেই একটা গ্লাস তুলে নিয়ে গলায় ঢালোম। মনে হলো মুখের আগুন সামান্য হলেও নিভেছে। বুঝতে পারলাম আমার হাত রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। চার্লি তার চেয়ার দখল করে বসলেন।

 “ধন্যবাদ, খাবার পরিবেশন করার পর বাবা আমাকে ধন্যবাদ জানালেন।

“আজ সারাটা দিন কেমন কাটলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কথাটা হঠাৎ করেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। সত্যিকার অর্থে আমি আমার রুমে যাওয়ার তাড়া অনুভব করছি।

“ভালোই। অনেকবারই মাছ আমার টোপ গেলার চেষ্টা করেছে…সেটাই বা মন্দ কি, তুমিই বলো? তুমি যেমন আশা করো, সবসময়ই কি তেমনভাবে কাজ হয়?”

 “না, তা অবশ্য ঠিক-তবে আমার মনে হয় এমন অবস্থায় বাইরে কষ্ট না করে বাড়িতে বসে থাকাতেই বেশি আনন্দ।” লাসাঙ্গায় বড়ো এক কামড় বসিয়ে মন্তব্য করলাম।

“আজকের দিনটা কিন্তু চমৎকার ছিলো,” চার্লি আমাকে সমর্থন জানালেন।

লাসাঙ্গার শেষ অংশটুকু শেষ করে আরেক গ্লাস দুধে চুমুক দিলাম।

“তোমার কি তাড়া আছে?” আমাকে বিমর্ষ দেখে চার্লি আমাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলেন।

“হ্যাঁ, আমি খুবই ক্লান্ত,আজ একটু তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে চাইছি।”

“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তালা চাবি লাগিয়ে তোমার সমস্ত আনন্দকে কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে।” উনি মাথা নাড়লেন।

“আমাকে দেখে তেমনই কি মনে হচ্ছে?” সীঙ্কে দ্রুত আমি ডিসগুলো পরিষ্কার করে নিলাম। এরপর ভালোভাবে সেগুলো মুছে নিয়ে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলাম।

“আজ শনিবার”, চার্লি মুখ টিপে হাসলেন।

আমি কোনো জবাব দিলাম না।

 “আজ রাতে তোমার কোনো পরিকল্পনাই নেই?” হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করে বসলেন।

“না,বাবা, আমি শুধু একটু ঘুমোতে চাই।”

“তোমার মনের মতো কোনো ছেলেই কি এই শহরে নেই, উহ্?” তিনি নিঃসন্দেহে অবাক হয়েছেন, তবে কণ্ঠটাকে যতোটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন।

 “না, এখন পর্যন্ত এই শহরে তেমন কোন ছেলেকে খুঁজে পাইনি।” “ছেলে” শব্দটার ওপর খুব বেশি জোর না দিয়ে, কথাটা সহজভাবে বলার চেষ্টা করলাম। চার্লির কাছে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যেই কথাটা সহজভাবে বলার চেষ্টা করলাম।

“আমার মনে হয় মাইক নিউটন…একবার বলেছিলে, ও খুব আন্তরিক এবং আমুদে স্বভাবের ছেলে।

“বাবা ও শুধুই আমার বন্ধু মাত্র।”

“ভালো কথা, ইচ্ছে করলেই তুমি অনেককেই বন্ধু হিসেবে পেতে পারো। এরা শুধু তোমার বন্ধু হয়েই থাকবে। তেমন কাউকে খুঁজে পেতে চাইলে তোমাকে কলেজে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রতি পিতাই আশা করে হরমনের প্রভাবে তার কন্যা এক সময় ঠিকই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়বে।

 “তোমার বুদ্ধিটা মন্দ নয়,” আমি চার্লিকে সমর্থন জানিয়ে মাথা নাড়লাম। এরপর সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।

“শুভরাত্রি, আমার মিষ্টি সোনা,” পেছন থেকে শুভেচ্ছা জানাতে বাবা ভুললেন না।

“বাবা, সকালে আবার তোমার সাথে দেখা হচ্ছে। মনে মনে একবার ভাবলাম, আদৌ আমি ঘরে আছি কিনা তা অবশ্য তুমি মাঝরাতে এসে দেখে যেতে পারো।

ক্লান্তিতে আমার কণ্ঠস্বর ম্লান হয়ে গেছে। ক্লান্তভাবে কোনো মতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমার রুমে প্রবেশ করলাম। বাবার কানে পৌঁছানোর কারণেই বেশ শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম এবং তার পরই জানালার কাছে ছুটে গেলাম। দ্রুত জানালা খুলে অন্ধকারের ভেতর দিয়েই বাইরে তাকালাম। ওই অন্ধকারে ভেতর দিয়েই আমার চোখ জোড়া ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। খুব আবছাভাবে গাছের নিচে একটা ছায়া দেখতে পেলাম।

 “এ্যাডওয়ার্ড,” ফিসফিস করে ওকে আমি ডাকলাম। নিজেকে আমার বোকার মতো মনে হলো।

কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। বরং পেছন থেকে হাসির সাথে সাথে একটা উত্তর ভেসে এলো, “হ্যাঁ বলো?”

প্রচণ্ড বিষ্ময়ে একটা হাত আমার গালের ওপর উঠে এলো।

ও আমার বিছানায় শুয়ে হাসছে। বালিশের মতো মাথার নিচে ওর হাতজোড়া ঢুকিয়ে রেখেছে। অজানা কোনো আনন্দে ও বেশ করে পা নাচাচ্ছে।

“ওহ্!” আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। একই সাথে মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম।

“আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” ও ঠোঁট কামড়ে ধরলো। সম্ভবত এ্যাডওয়ার্ড তার উচ্ছ্বাসকে চাপা দেবার চেষ্টা করলো।

“হৃৎপিন্ড সচল হওয়ার জন্যে দয়া করে আমাকে একটু সময় দাও।”

ও ধীরে ধীরে বিছানার ওপর উঠে বসলো, তবে মোটেও আমার দিকে তাকালো না। এরপর সামনের দিকে একটু এগিয়ে এসে দীর্ঘ হাত বাড়িয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে কাছে টেনে নিয়ে তার পাশে বসালো।

“আমার পাশে বসতে তোমার আপত্তি কোথায়?” ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা একটা হাত রেখে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে প্রশ্ন করলো। “এখন তোমার হৃৎপিন্ডের অবস্থা কি রকম?”

আমরা চুপচাপ বিছানার ওপর খানিকক্ষণ বসে থাকলাম, উভয়েই আমরা হৃৎপিণ্ডের অতি ধীর স্পন্দন শুনতে লাগলাম। আমার শুধুমাত্র একটাই চিন্তা, বাবা বাড়িতে উপস্থিত থাকতেই এ্যাডওয়ার্ড আমার বেড রুমে বসে আছে।

“মানুষ হওয়ার জন্যে আমাকে কি খানিকটা সময় দেবে?” এ্যাডওয়ার্ডকে আমি প্রশ্ন করলাম।

“এ বিষয়ে আমার না বলার কোনো অবকাশই নেই।” এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে ও আমার পিঠে আলতোভাবে একটু চাপড় দিলো।

“এখান থেকে কোথাও নড়বে না, অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি বললাম।

“অবশ্যই ম্যাডাম।” কথাটা বলে বিছানার কোণায় ও একেবারে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকলো।

আমি লাফিয়ে উঠলাম, মেঝেতে পড়ে থাকা পায়জামা তুলে নিলাম, ডেস্কের ওপর থেকে নিলাম আমার কসমেটিক ব্যাগ। লাইট অফ করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

সিঁড়ি পার হয়ে এতো উপরেও টেলিভিশনের শব্দ আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো। ইচ্ছাকৃতভাবে বাথরুমের দরজাটা খুব জোরে লাগালাম। তাকে বুঝাতে চাইলাম, আমার বিছানায় যাওয়ার খুব তাড়া আছে, সুতরাং তিনি এসে অযথা আমাকে যেন বিরক্ত না করেন।

আসলেই আমার বেশ তাড়া আছে। দ্রুত হাতে দাঁত মাজার সময় আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো-মনে হলো খানিক আগে খাওয়া লাসাঙ্গা এবং অন্যান্য খাদ্য উপকরণগুলো পেটের ভেতর মোচড় খেয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু গরম পানিতে শরীর ভিজিয়ে নেবার পর তেমন আর কোনো বিপত্তি ঘটলো না। শরীরের পেছন দিককার মাংসপেশি সজীব হয়ে উঠলো, সাথে স্নায়ুর উত্তেজনা কমে আসতে লাগলো। পরিচিত শ্যাম্পুর গন্ধে আমার মনে হলো আমি আসলে অচেনা কোনো মানুষ নই আমি সেই আমার মতোই আছি- সেই সকালে যেমন ছিলাম। ঠিক এই মুহূর্তে এ্যাডওয়ার্ডের কথা আমি চিন্তা করতে চাইলাম না। ও আমার ঘরে বসে আছে, বসে থাকুক, শান্ত মন নিয়ে আমি মোটেও ওর সাথে এগোতে পারবো না। তবে এটাও ঠিক, খুব দেরি করার ইচ্ছেও আমার নেই। শাওয়ার বন্ধ করে তোয়ালে দিয়ে গা মোছার সময় আবার সেই ভয় এসে আমাকে নাড়া দিতে লাগলো। গা মুছে একটা টি-শার্ট এবং ধূসর রঙের সোয়েট প্যান্ট পরে নিলাম। ভ্যারোনিকা সিল্ক পাজামা পরার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার। কিন্তু সেটা এখন আমার নাগালের বাইরে। ট্যাগ লাগানো অবস্থাতেই বাড়ির কোনো ওয়্যারড্রোবের ভেতর হয়তো পড়ে আছে। দুই জন্মদিন আগে মা আমাকে ওই পাজামা উপহার দিয়েছিলেন।

তোয়ালে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবার মাথাটা ভালোভাবে মুছে নিলাম। এবং তারপরই বেশ যত্ন নিয়ে চুল আঁচড়ে নিলাম। হ্যাঁঙ্গারের দিকে তোয়ালেটা ছুঁড়ে দিয়ে টুথব্রাশ এবং পেস্ট আমার কসমেটিত ব্যাগের ভেতর প্রায় ছুঁড়েই মারলাম। পাজামা পরে নিয়েছি এবং মাথার চুল ভিজে আছে-চার্লিকে এগুলো দেখানোর উদ্দেশ্যে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ২২০

“শুভ রাত্রি বাবা,” রাতটা তুমি ভালোভাবে পার করো।

“শুভ বিদায় বেলা।” আমার আকস্মিক উপস্থিতি হওয়ায় তিনি বেশ অবাক হয়েছেন। এ কারণে তার আমাকে খুঁজতে উপরতলায় যাওয়াটাও হয়তো বিচিত্র কিছু ছিলো না।

একেকবার দুই ধাপ সিঁড়ি পার করে উপরে উঠে এলাম। এবং প্রায় উড়ে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলাম।

এ্যাডওয়ার্ড এতোক্ষণে তার স্থান থেকে এক চুল পরিমাণ পর্যন্ত নড়েনি। ওকে। দেখে আমি একটু হাসলাম, এবং ওর ঠোঁট খানিকটা নড়ে উঠলো-মূর্তিতে প্রাণের স্পন্দন ফিরে এসেছে।

ও আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগলো। ভেজা চুল নিয়ে খানিকক্ষণ খেলা করলো, একই সাথে দুমড়ানো-মুচড়ানো জামার দিকে তাকালো। এ্যাডওয়ার্ড একটা ভ্রু কুঁচকালো। “চমৎকার!”

আমি মুখ টিপে হাসলাম।

“আসলেই সত্যি বলছি,তোমাকে কিন্তু দেখতে চমৎকার লাগছে।”

“ধন্যবাদ,” আমি ফিসফিস করে বললাম। খাটের একপাশ দিয়ে ঘুরে আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তবে ওর দিকে না তাকিয়ে মেঝের কাঠগুলোর জোড়া দেখতে লাগলাম।

“চার্লির ধারণা, আমি চুপিসারে বাইরে বেরিয়ে পড়বো।”

“ও,” কথাটাকে ও বেশ সহজভাবেই গ্রহণ করলো। “কেন?”

 এ্যাডওয়ার্ড চার্লির মন পড়তে পারে না।

 “স্বাভাবিক ব্যাপার। আজ একটু বেশি উত্তেজিত আচরণ করে ফেলেছি।”

এ্যাডওয়ার্ড আমার চিবুক ধরে একটু উঁচু করে মুখটা ভালোভাবে দেখে নিলো।

ওর মাথা বেশ খানিক আমার দিকে এগিয়ে আনলো, ওর ঠাণ্ডা চিবুকের স্পর্শ আমার চামড়ায় বেশ অনুভব করতে পারলাম।

“মমম্…” ও ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।

ও যখন আমাকে স্পর্শ করে, তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করার মতো আলাদা কোনো প্রশ্নও খুঁজে পাই না। নতুনভাবে বলার মতো কিছু খুঁজে বের করতে আমার বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল।

“এখন মনে হচ্ছে আমার সাথে মিলিত হওয়ার…অনেক সহজ একটা সুযোগ পেয়ে গেলে।”

 “এটাকে তোমার সহজ মিলন বলে মনে হচ্ছে?” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। ও একটু নাক কুঁচকালো। আমি এ্যাডওয়ার্ডের একটা হাত মুঠোর ভেতর চেপে ধরলাম। ওর হাত এতটাই হালকা, যেন প্রজাপতির পাখা। আমার ভেজা চুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে নিয়ে এ্যাডওয়ার্ড আমার কানের ওপর তার মুখটা স্থাপন করলো।

“সহজ, অন্য সময়ের চাইতে এখন আমার কাছে অনেক সহজ মনে হচ্ছে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি তাকে বললাম।

“হু…”

“অবশ্য আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে…” পূর্ব কথার সুত্র ধরে আমি বলতে চাইলাম। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড হালকাভাবে আমার কলারবোনের ওপর স্পর্শ করলো। ওর স্পর্শে ভুলেই গেলাম, ওকে আসলে কী বলতে চেয়েছিলাম।

“হ্যাঁ,” এ্যাডওয়ার্ড গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো।

“কিন্তু তোমার ভয়ের কারণ কি?” কথাটা বলতে গিয়ে বেশ বিব্রতবোধ করলাম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমার গলাটা কেঁপে উঠলো, “তোমার কি এটা নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে?”

আমার গলার কাছে এ্যাডওয়ার্ডের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। আমার কাছে বস্তুর চাইতে মনটাই বড়ো।”

এ্যাডওয়ার্ডকে ঠেলে খানিকটা পিছিয়ে এলাম আমি। এভাবে সরে যাওয়ায় ও একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল-অবশ্য এরপর আর ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম না।

স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমরা খানিকক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, এবং অল্পক্ষণের ভেতর ওর কঠিন মুখ স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখলাম। তবে আমার পক্ষে ওর মুখের ভাষা ঠিক বুঝে ওঠা সম্ভব হলো না।

 “আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?”

“না-ঠিক এর উল্টো। তুমি ক্রমশই আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছো,” এ্যাডওয়ার্ডকে ব্যাখ্যা করে বললাম।

মনে হলো আমার অবস্থা ও বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর আমার কাছে বেশ মার্জিত মনে হলো। “সত্যি বলছো তো?” ওর ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা দেখতে পেলাম।

“এভাবে প্রশংসামূলক আলোচনা করেই কি আমাদের সারারাত পার হয়ে যাবে?” অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড দাঁতে দাঁত চাপলো।

“আমি সত্যি খুব অবাক হয়েছি,” এ্যাডওয়ার্ড ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। “গত একশ বছর অথবা তার চাইতে বেশিও হতে পারে, এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠে বিদ্রূপ, “এ রকম কিছুর কথা চিন্তাতেও আনতে পারিনি। কারও সাথে আমি…এ ধরনের চিন্তা কখনোই আমার মাথায় আনিনি। এই কথা আমার অন্যান্য ভাই এবং বোনদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আরো যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, তাহলে বলবো এর সবকিছুই আমার কাছে এক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। তাছাড়া বলতে গেলে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই… এই মুহূর্তে তোমার সাথে…”

“তুমি সব বিষয়েই অতুলনীয়,” আমি মন্তব্য করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড শ্রাগ করলো। অবশ্য আমার কথাটা ও মেনে নিলো। কারও কানে যেন পৌঁছুতে না পারে, তেমনিভাবে আমরা উভয়েই মৃদু শব্দে হেসে উঠলাম।

“কিন্তু বিষয়টা এখন এতো সহজ হয়ে উঠলো কিভাবে?” আমি ওর মুখ থেকে কথাটা আদায় করে নেবার চেষ্টা করলাম। “আজ বিকেলের ঘটনাগুলো…”।

“ঘটনাগুলো মোটেও সহজ হয়নি,”এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “কিন্তু আজ বিকেলে যে ঘটনা ঘটেছে…এখন পর্যন্ত তার কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। ওই ঘটনার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মনে হয়েছে এ কারণে তুমি আমাকে মোটেও ক্ষমা করবে না।”

“অবশ্যই তুমি ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছো” আমি ইচ্ছেকৃত এ্যাডওয়ার্ডকে হতাশ করার চেষ্টা করলাম।

“ধন্যবাদ তোমাকে।” এ্যাডওয়ার্ড একটু হাসলো

“তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছো,” মাথা নিচু করে ও বলতে লাগলো, “সত্যি বলতে কতটা শক্তিশালী সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই…” আমার একটা হাত তুলে নিয়ে এ্যাডওয়ার্ড ওর গালের ওপর রেখে আলতোভাবে চাপ দিতে লাগলো।” এ বিষয়ে আমার সামান্যও যদি ধারণা থাকতো… তাহলে অবশ্যই আমি সফল হতে পারতাম” এ্যাডওয়ার্ড আমার বুকের সুগন্ধ শুষে নেবার চেষ্টা করলো-”আমি…আমি আবেগের বশে অনেক কিছু করে ফেলি। যতোক্ষণ পর্যন্ত না নিজের মনকে সংযত করতে না পারছি, ততোক্ষণ পর্যন্ত আমি মনকে শক্ত করতে পারি না, আর মনকে শক্ত করা সম্ভব না হলে আমার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়…”

কথাগুলো বলতে এ্যাডওয়ার্ডের বেশ কষ্ট হলো। এর আগে তার কথা বলতে এতো কষ্ট হতে দেখিনি।

“তাহলে কি এখন কোনো সম্ভাবনাই নেই?”

“আমি আগেই বলেছি, বস্তুর চাইতে আমার মনটাই বড়ো,” এ্যাডওয়ার্ড আগের সেই কথাটার পুনরাবৃত্তি করলো। কথাগুলো বলার সময় হালকাভাবে হেসে ওঠায় এই অন্ধকারের ভেতরও ওর সাদা দাঁতগুলো চকচক করে উঠলো।

“ওয়াও! কথাটা বলা কিন্তু খুব সহজ,” মন্তব্য করলাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড তার মাথা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো-অনুচ্চ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলার শব্দের মতো করে।

“হয়তো সেটা তোমার জন্যে সহজ!” আমার নাকের ওপর একটা টোকা দিয়ে মন্তব্য করলো এ্যাডওয়ার্ড।

পরক্ষণেই ওর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

“আমি চেষ্টা করছি,” এ্যাডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বললো “তবে একটা বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাই…একটা বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাই যে, এই বিষয় নিয়ে যদি খুব বেশি আলোচনা চলতে থাকে, তাহলে এখান থেকে চলে যেতে আমি বাধ্য হবো।”

আমি ভ্রুকুটি করলাম। ও চলে যাবার মতো এমন কোনো বিষয়ই আমি এই মুহূর্তে আলোচনা করতে চাই না।

“তবে আগামীকাল হলে সেটা ভালো হয়,” এ্যাডওয়ার্ড পূর্ব কথার সূত্র ধরে বলতে লাগলো। “তোমার দেহের সুগন্ধ সমস্ত দিন আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে, এবং তা যেন হারিয়ে না যায়, সে কারণে নিজেকে সংবেদনশীল করে রাখার চেষ্টা করতে থাকি। তোমার কাছ থেকে আমি যতোদূরেই থাকি না কেন, যতো সময়ের জন্যেই থাকি না কেন, তোমাকে দেখার জন্যে ঠিকই উতলা হয়ে উঠি।”

“বেশি দূরে না গেলেই হয়,” খুব বেশি উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করে বললাম আমি।

“যতোদূরেই যাই না কেন, তোমার কাছে আমাকে আত্নসমর্পন করতেই হয়, মিষ্টি হেসে এ্যাডওয়ার্ড মন্তব্য করলো। “এক কথায় বলতে গেলে আমি তোমার বন্দি হয়ে আছি।”

“আজ তোমাকে দার্শনিকের মতো মনে হচ্ছে,” এ্যাডওয়ার্ডকে নিরীক্ষণ করে মন্তব্য করলাম আমি। “এর আগে তোমাকে এরকম আশাবাদী হতে দেখিনি।”

“বিষয়টা কি এরকমই হওয়া উচিৎ নয়?” এ্যাডওয়ার্ড একটু হাসলো। প্রথম ভালোবাসা একটু ভিন্নভাবেই প্রকাশ পায়। একটা নতুন বইপড়া কিংবা নতুন ছবি দেখার চাইতে ভালোবাসার বিষয়টা কি একেবারে আলাদা নয়?”

“একেবারেই আলাদা,” আমি সমর্থন জানালাম। “একটা প্রকৃত ভালোবাসা যে কতোটা শক্তিশালী হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারি না।”

 “উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক”-এ্যাডওয়ার্ড এখন দ্রুত কথা বলছে। আমি তার প্রতিটা কথাই মনোযোগ দিয়ে কোণার চেষ্টা করলাম-” মানুষের হিংসে-বিদ্বেষ দেখে খুবই মর্মাহত হই। অনেকের মন পড়ে দেখেছি, হাজার হাজার মানুষ তাদের মনের ভেতর এ ধরনের হিংসে পুষিয়ে রেখেছে। তাছাড়া দেখবে হাজার হাজার নাটক সিনেমায় এই হিংসে নামক বিষয়টা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। মানব চরিত্রের এই খারাপ দিকটা খুব সহজেই অনুভব করতে পারি। আর তখনই এক ধরনের মর্ম যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি…” এ্যাডওয়ার্ড মুখ টিপে হাসলো। “তোমার কি ওই দিনটার কথা মনে আছে, যেদিন মাইক তোমাকে নাচের আসরে যোগ দেবার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো?”

আমি মাথা নাড়লাম। যদিও ওই দিনের কথা আমার ভিন্ন এক কারণে মনে আছে। “ওই দিন তুমি আবার আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলে।”

“কেন যেন আমার বিরক্তি ক্রমশই বেড়ে চলেছে। একে প্রচণ্ড ক্রোধও বলা যেতে পারে, এগুলো বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছি-সত্যিকার অর্থে এ ধরনের অনুভূতিকে কী বলা যেতে পারে, প্রথম অবস্থায় মোটেও বুঝতে পারলাম না। উত্তেজনার কারণে তুমি কী চিন্তা করছে, সেগুলো পর্যন্ত আমি পড়তে পারিনি-আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কেন তাকে অস্বীকার করেছিলেন। এটা কি শুধুমাত্র বন্ধুর কারণে? নাকি এর বাইরেও অন্য কেউ আছে? যদিও এগুলো নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কথা নয়। এগুলো নিয়ে আমি মাথা ঘামাতেও চাই না…

 “মাথা ঘামাতে না চাইলেও বিষয়গুলো তখন থেকেই আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করে,” এ্যাডওয়ার্ড মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বরং অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

“আমি অপেক্ষা করলাম। ওদের তুমি কী বলছে তা কোণার জন্যে অযথাই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলাম-তোমার অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করলাম। তোমার মুখে চরম উৎকণ্ঠা দেখে আমি মোটেও স্বস্তি অনুভব করলাম না। তবে আদৌ তুমি উৎকণ্ঠিত কিনা সেটাও ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“ওই প্রথম রাতেই আমি এখানে এলাম। নিশ্চুপ বসে তোমার ঘুমন্ত চেহারা দেখতে লাগলাম। বসে বসে বৈপরিত্যগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। নৈতিকতা, সততা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যুক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম আমি কতোটা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছি। বুঝতে পারলাম তোমাকে যেভাবে ক্রমাগত উপেক্ষা করে যাচ্ছি, অথবা বছর খানেকের জন্যে তোমাকে ছেড়ে যদি চলেও যাই সেটা কোনো বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না। জীবন থেকে তোমাকে আমার হাড়াতে হবে। একদিন ঠিকই তুমি মাইককে গিয়ে হ্যাঁ বলবে, অথবা মাইকের মতোই অন্য কাউকে। নিঃসন্দেহে বিষয়টা আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলতো।

“এবং তারপর,” এ্যাডওয়ার্ড ফিসফিস করে বললো, “তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে, ঘুমের ঘোরে তুমি আমার নাম ধরে ডাকছিলে। খুব স্পষ্টভাবেই নামটা উচ্চারণ করছিলে, প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি বুঝি জেগেই আছে। কিন্তু তোমার চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে আছে, চোখের কোনো পলকই পড়ছে না। এরই মধ্যে তুমি আবার আমার নামটা উচ্চারণ করলে এবং তারপরই একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললে। আমার মনের দৃঢ়তা স্বাভাবিক ভেঙ্গে পড়লো। বুঝতে পারলাম কোনোভাবেই তোমাকে আমার পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।” এ্যাডওয়ার্ড বেশ খানিক্ষণ একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকলো। সম্ভবত ও আমার হৃৎস্পন্দন কোণার চেষ্ঠা করতে চাইলো।

“কিন্তু হিংসা…বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত। যেভাবে চিন্তা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। হিংসা মানুষকে ধীরে ধীরে উত্তেজিত করতে থাকে। এই খানিক আগে চার্লি যখন তোমাকে মাইক নিউটন সম্পর্কে জানতে চাইলেন…” এক ধরনের রাগ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে এ্যাডওয়ার্ড মাথা নাড়লো।

“তুমি তাহলে আমাদের আলোচনা শুনেছো?” আমি এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্ন করলাম।

“অবশ্যই।”

“সত্যিকার অর্থে এই বিষয়টাও তোমার মনে হিংসের উদ্রেগ করেছে?”

“এই বিষয়গুলোর সাথে আমি একেবারে নতুন পরিচিত হয়েছি। তুমি আমার মানব সত্ত্বাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করেছে। বিষয়গুলোর ভেতর কোনো দূরাভিসন্ধি নেই বলে, আমি আলাদা এক ধরনের শক্তি অর্জনে সমর্থ হই।

“কিন্তু সত্যি বলতে,” আমি এ্যাডওয়ার্ডকে খোঁচা দেবার ভঙ্গিতে বললাম, “রোজালের ব্যাপারে কোণার পর তোমাকে কিন্তু আমি বিব্রত হতে দেখেছিলাম-রোজালে রক্ত মাংসে গড়া অত্যন্ত সুন্দরী এক মেয়ে, রোজালে-তোমার ক্ষেত্রেই কথাটা বলছি। এমেট অথবা অন্য কেউ নয়, কিভাবে তার সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করবো?”

“এখানে কোনো প্রতিদ্বন্ধিতার প্রশ্নই উঠতে পারে না।” এ্যাডওয়ার্ড দাঁত বের করে হাসলো। আলতোভাবে পড়ে থাকা আমার একটা হাত নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলো। আমি যেরকম নিশ্চুপ ছিলাম, সেরকমই নিশ্চুপ বসে থাকলাম। আমি নিঃশ্বাসও সাবধানে নিতে লাগলাম।

“আমি জানি, এর ভেতর কোনো প্রতিযোগীতা নেই, আমি এ্যাডওয়ার্ডের মার্বেলের মতো মসৃণ চামড়ার ওপর দিয়ে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বললাম। “ওটাই হচ্ছে আসলে সমস্যা।”

“রোজালের দিক থেকে অবশ্যই সে অত্যন্ত সুন্দরী, কিন্তু ও যদি আমার বোনের মতো না হতো, এমনকি এমেট যদি রোজালের সাথে জুটি বাঁধার চিন্তা নাও করতো, তাহলেও আর দশজনের মতো ও কখনোই আমাকে মুগ্ধ করার সুযোগ পেতো না। শত শত অতি সুন্দরী মেয়েকে বাদ দিয়ে তুমি আমার চোখে ধরা পড়েছে। এ্যাডওয়ার্ডের চিন্তিত মুখ দেখে মনে হলো, ও যা বলছে, নিঃসন্দেহে সত্যই বলছে। প্রায় নব্বই বছর হতে চললো, সম্পূর্ণ আমি নিজের মতো বলার চেষ্টা করেছি। এবং তোমরা সবসময় মনে করেছো…তোমরা মনে করেছে আমি সম্পূর্ণ একজন মানুষ। আমার অসুস্থতা যে কী তা কখনো, কেউই ভেবে দেখার চেষ্টা করোনি। তাছাড়া তোমরা আমার কোনো সমস্যাই বুঝতে চাওনি।”

“সেভাবে চিন্তা করলে তুমি কোনো ভুল বলোনি,” আমি ফিসফিস করে বললাম। এখনো আমার গাল এ্যাডওয়ার্ডের বুকে ঠেকিয়ে রেখিছি। ওর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কোণার চেষ্টা করছি। “যতোটা অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিলো, আমি তা করিনি। কিন্তু এতো সহজে আমি তোমার মন জয় করলাম কিভাবে?”

“তুমি ঠিকই বলেছো,” আমুদে কণ্ঠে আমাকে সমর্থন জানালো এ্যাডওয়ার্ড। “নিঃসন্দেহে আমি তোমার কাছে বিষয়টাকে কঠিন করে তুলেছিলাম।বুকের ওপর থেকে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে, এ্যাডওয়ার্ড তার হাতের মুঠোর ভেতর তা চেপে ধরলো। ও আমার ভেজা চুলের ওপর মৃদু টোকা দিতে লাগলো। এরপর সিঁথির কাছ থেকে আমার বুক পর্যন্ত কয়েকবার আঙ্গুল বুলিয়ে নিলো। “আমার সাথে তুমি যতোক্ষণ ছিলে, তার প্রতিটা সেকেন্ডই ছিলো বিপদজনক। কিন্তু সেটাও বোধহয় যথেষ্ট নয়। তুমি প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে নিয়েছো, একজন সত্যিকারের মানুষের মতোই আচরণ করেছো…এর ভেতর খারাপ কি থাকতে পারে?”

“খুবই সামান্য খুবই সামান্য হলেও কোনো কিছু থেকেই বঞ্চিত হইনি,”

“গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করলো এ্যাডওয়ার্ড।

চেহারা ভালোভাবে দেখার জন্যে ওকে সামান্য একটু পেছনে সরিয়ে দিলাম। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড আমাকে শক্তভাবে চেপে ধরে রাখায়, একটুও নড়তে পারলাম না।

 “কি” এ্যাডওয়ার্ড সামান্য একটু নড়ে ওঠায় নতুনভাবে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাইলাম। আমি একেবারে জমে গেলাম, কিন্তু হঠাৎ-ই ও আমার হাতটা ছেড়ে দিলো, আর পরক্ষণেই আমার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

“শুয়ে পড়ো!” এ্যাডওয়ার্ড হিসহিস করে বললো। অন্ধকারের কোথা থেকে ও কথা বলছে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

বিছানার একপাশে ভাঁজ করে রাখা কম্বলটা টেনে নিয়ে শরীরের উপর চাপিয়ে দিলাম-যেমনটা ঘুমের সময় করে থাকি। আমি দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। ঘরে উপস্থিত আছি কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে চার্লি উপরে উঠে এসেছেন। আমি স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। অযথাই একটু নড়াচড়া করলাম।

বেশ কয়েক মিনিটা একইভাবে কেটে গেল। আমি কান পেতে থাকলাম, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না চার্লি আদৌ দরজাটা বন্ধ করলেন কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই এ্যাডওয়ার্ড তার ঠাণ্ডা হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কম্বলের নিচে ও আমার কানের ওপর ঠোঁট ছোঁয়ালো। ২২৬

“তুমি নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিনেত্রী-এই প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে জীবনের উন্নতি কেউ ধরে রাখতে পারবে না।”

“ঘোড়ার ডিম,” আমি বিড়বিড় করে বললাম। বুকের পাজড় ভেদ করে আমার হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসতে চাইলো।

এ্যাডওয়ার্ড গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাঁজতে লাগলো। কিন্তু গানটা আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত বলে মনে হলো-অনেকটা ঘুমপাড়ানি গানের মতো।

এ্যাডওয়ার্ড একটু থামলো। “গান গেয়ে আমি কি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবো?”

 “ভালোই বলেছে,” আমি হেসে উঠলাম। “তোমার সাথে এখানে আমি ঘুমাবো!”

“এতোদিন তো ঘুমিয়ে এসেছে, তখন?” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো।

“কিন্তু তুমি যে এখানে উপস্থিত থাকতে,আমার মোটেও তা জানা ছিলো না,” আমি শীতল কণ্ঠে পাল্টা জবাব দিলাম।

 “তো তুমি যদি ঘুমাতে না চাও…” আমার অভিমানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ও বললো। আমার নিঃশ্বাস প্রায় আটকে এলো।

“যদি আমি ঘুমাতে না চাই…?”

 এ্যাডওয়ার্ড চুকচুক করে শব্দ করলো। “তাহলে তুমি কি করতে চাইছো?”

 “আমি ঠিক জানি না,” শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম।

“তা কখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে ফেলো।”

গলার ওপর এ্যাডওয়ার্ডের ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস অনুভব করতে লাগলাম। আমার চিবুকের ওপর ও নাক ঘষতে লাগলো।

“আমি ভেবেছিলাম তুমি খুবই অসংবেদনশীল।”

“তোমার শরীরে অসম্ভব সুন্দর এক ধরনের গন্ধ আছে-ফুলের গন্ধ। অনেকটা ল্যাভেন্ডার…অথবা ফ্রিশিয়া ফুলের মতো গন্ধ,” এ্যাডওয়ার্ড মাথা নাড়লো। “এ ধরনের গন্ধে জিভেতে পানি চলে আসে।”

“হ্যাঁ, বিষয়টা জানলাম বটে, কিন্তু কীভাবে আমি গন্ধ ছড়াই তা জানতে পারলাম না।”

এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

“আমি আসলে কী চাই তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি,” আমি তাকে বললাম। “আমি তোমার সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চাই।”

“তুমি আমাকে যা ইচ্ছে জিজ্ঞেস করতে পারো।

আমি অবান্তর প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে আসল প্রসঙ্গে ফিরে এলাম। “তুমি এই কাজগুলো কেন করো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি এখন পর্যন্ত একটা বিষয় বুঝতে পারি না, তুমি হঠাৎ করে এতো শক্তি কোথা থেকে পাও…আশাকরি তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না। তোমার এ ধরনের ক্ষমতা দেখে আমার অবশ্যই খুব ভালো লাগে।”

জবাব দেবার আগে ও খানিকটা ইতস্তত করলো। “তুমি বেশ ভালোই প্রশ্ন করেছে। তাছাড়া এ ধরনের প্রশ্ন তোমার আগে অনেকেই করেছে আমাকে। আমাদের মতো আর যারা আছে-এদের ভেতর প্রায় সবাইকে আমার দলে ফেলা যেতে পারে-আমাদের মতো ওদেরও বেঁচে থাকাটাই বিষ্ময়কর। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই বেঁচে আছি এটাই বড়ো কথা…সবাই কম বেশি মানুষের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি, এর অর্থ এই নয় যে, আমরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে চাই-সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে সবকিছুকে জয় করতে চাই। এমনটা কেউই আসলে চাই না। আমাদের কাছে সবচেয়ে যা জরুরি, তা হলো মানবগুন সম্পন্ন সত্বাগুলোকে বিকশিত করে সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করা।”

আমি একটুও নড়াচড়া না করে একেবারে নিশ্চুপ শুয়ে থাকলাম।

“তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে?” একটানা কয়েক মিনিট কথা বলার পর ও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো।

“না।”

 “আমার বলা এই কথাগুলোয় তোমার কৌতূহল কি মিটেছে?”

আমি চোখ পাকালাম। “খুব একটা বেশি নয়।”

“তোমার আর কি জানার আছে?”

“তুমি কিভাবে অন্য মানুষের মনের কথা পড়তে পারো-শুধুমাত্র তুমিই কেন? এবং এলিস ভবিষ্যত দেখতে পারে…এগুলো কিভাবে ঘটে?”

অন্ধকারের ভেতরও এ্যাডওয়ার্ডকে আমি শ্রাগ করতে দেখলাম। “সত্যি বলতে এর সঠিক উত্তর আমাদের জানা নেই। কার্লিসলের অবশ্য একটা এ বিষয় নিয়ে তত্ত্ব আছে…ও বিশ্বাস করে যে আমরা প্রত্যেকেই এই পরজন্মে বিশেষ কিছু মানব বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছি-এগুলোই ধীরে ধীরে তীব্রতা লাভ করেছে। এগুলোর ভেতর আমাদের মন এবং জ্ঞান বিশেষভাবে কাজ করে। কার্লিসল মনে করে আশপাশের সকলের চিন্তাগুলো পড়ার যে ক্ষমতা আমি লাভ করেছি, তার মতো আর কেউই নেই। অন্যদিকে এলিসের মতো ভবিষ্যৎ বলে দেবার ক্ষমতা আর কারো ভেতর নেই।”

“কার্লিসল তাহলে পরজন্মে কোন ধরনের ক্ষমতা নিয়ে এসেছেন? তাছাড়া অন্যান্যদের ক্ষমতাগুলো কোন ধরনের?”

“কার্সিলের মায়া মমতাকে অন্য কারও সাথে তুলনা করা যাবে না। এসমের ভেতর আছে অকৃত্রিম ভালোবাসার ক্ষমতা। এমে যে বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে, দৈহিক শক্তি। রোজালের ভেতর আছে মানসিক মনোবল…অথবা এটাকে তুমি শুকরের মতো একগুঁয়ে স্বভাবও বলতে পারো!” এ্যাডওয়ার্ড আফসোস করার ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করলো “জেসপার অদ্ভুত চরিত্রের। প্রথম জীবনে ও খুব করিঙ্কৰ্মা ছেলে ছিলো। ওর আশপাশের সকলের ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারতো। বর্তমানে জেসপার আশপাশের সকলের আবেগ খুব ভালো বুঝতে পারে-এমনকি তাদের ওপর প্রভাব বিস্তারও করতে পারে-উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ঘরের ভেতরকার একগাদা রাগান্বিত মানুষকে খুব সহজে শান্ত করে ফেলতে পারে, অথবা এক দল মানুষকে আকস্মিক উত্তেজিত করে তুলতে পারে। নিঃসন্দেহে এটা তার খুব বড়ো এক গুণ।”

এ্যাডওয়াডের বর্ণনা করা অদ্ভুত বিষয়গুলো নিয়ে আমি খানিকক্ষণ চিন্তা করলাম। আমার চিন্তা করার সময়টুকুতে ও একেবারে নিশ্চুপ হয়ে রইলো।

“তো এগুলো কখন থেকে শুরু হলো? আমি বুঝাতে চাইছি, কার্লিসল হয়তো তোমার ভেতর এই পরিবর্তনগুলো এনেছে, কিন্তু কার্লিসলের ভেতরও হয়তো কেউ তার পরিবর্তনগুলো এনেছে এবং এভাবে…”।

“ভালো কথা তুমি কোথা থেকে এসেছো বলতে পারবে? রূপান্তরিত হয়ে?” নাকি তোমাকে কেউ সৃষ্টি করেছে? অন্যান্য প্রাণীরা যেভাবে রূপান্তর লাভ করেছে, আমরা সেভাবে রূপান্তরিত হইনি। শিকার জীবী অথবা অন্য জীবের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকি এমনো কি বলা যাবে? তুমি হয়তো অনেক কিছুই জানো না। এই পৃথিবীর সবকিছু চলছে তার নিজস্ব গতিতে, যার অনেক কিছুই আমাদের পক্ষে যেমন মেনে নেয়া সম্ভব নয়, তেমনি বিশ্বাস করাও সম্ভব নয়-এই পৃথিবীতে যেমন এঞ্জেল ফিস সৃষ্টি হয়েছে এর পাশাপাশি হাঙ্গরও সৃষ্টি হয়েছে। শিশু সীল যেমন আছে এর পাশাপাশি আছে খুনি তিমি মাছ-ভালো মন্দ উভয়েই এই পৃথিবীতে নিজ নিজ অবস্থানে সক্রিয় হয়ে আছে।”

 “আমার কাছে তোমার ব্যাখ্যা অনেক সহজ হয়ে গেছে-আমি তাহলে হচ্ছি সীল শাবক?”

“ঠিকই বুঝতে পেরেছো।” ও হাসতে লাগলো। ওর শরীরের কোনো একটা অংশ আমার মাথার চুল স্পর্শ করলো-কি হতে পারে, ওর ঠোঁট?

আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে ঘুরে দেখতে চাইলাম আদৌ ওর ঠোঁট আমার চুল স্পর্শ করেছে কিনা।

“তোমার কি ঘুম পেয়েছে?”

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ও আমাকে প্রশ্ন করলো। “অথবা তোমার কি আরো কোনো প্রশ্ন আছে?”

“এক অথবা দুই লক্ষও হতে পারে।”

“তুমি প্রশ্ন করার কিন্তু অনেক সময় পাবে। আমাদের হাতে আগামীকাল আছে,এবং এর পরদিন আছে, এবং তারপর দিনও তুমি হাতে সময় পাবে…” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসতে আমি মনে মনে হেসে উঠলাম।

“কাল সকালে তুমি উধাও হয়ে যাচ্ছে না, সে বিষয়ে কি নিশ্চিত হতে পারি?” আকস্মিকভাবে আমি এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্নটা করে বসলাম। হাজার হলেও তুমি পৌরাণিক কাহিনীর মতো এক চরিত্র।”

“তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।” এ্যাডওয়ার্ড বেশ জোর দিয়েই অঙ্গিকার করলো আমার কাছে।

“আজ রাতে শুধু একবারই…” লজ্জায় সাথে সাথে আমি রাঙা হয়ে উঠলাম। অন্ধকার আমার কোনো সাহায্যে এলো না-এ্যাডওয়ার্ড হঠাৎ-ই আমার চামড়ার নিচকার উষ্ণতা খোঁজার চেষ্টা করলো।

“এটা কি হচ্ছে?”

“না, কিছু না। এসব ভুলে যাও আমার মন পাল্টে গেছে।”

 “বেলা, তুমি আমাকে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারো।”

আমি কোনো জবাব দিলাম না।

“আমি খানিকটা হতাশায় আছি,” এ্যাডওয়ার্ড বললো, “আজ কিন্তু তেমনভাবে আমি তোমার মনের কথাগুলো পড়তে পারছি না। আজ আমার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগছে।”

 “আর চিন্তাগুলো তুমি পড়তে পারছে না বলে, আমার প্রচণ্ড ভালো লাগছে। আমি ঘুমের ভেতর কি চিন্তা করবো, তা তুমি জেনে ফেলবে এটা মোটেও ভালো কথা নয়।”

“তুমি বলেছিলে রোজালে এবং এমেট অতি শীঘ্রই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে…এটা কি…সাধারণ মানুষ যেভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সে রকমই কিছু?” কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড হেসে উঠলো। “এই মুহূর্তে তুমি তাহলে আমার সাথে কি করছো? এগুলো কি মানুষের মতো ভালোবাসার বহিপ্রকাশ নয়?”

ওর কথা শুনে আমি প্রায় জমে গেলাম। তাৎক্ষণিকভাবে ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।

“হ্যাঁ, আমার ধারণায় এই বৈবাহিক সম্পর্ক মানুষের মতোই,” ও বললো, “আমি তোমাকে বলতে পারি, আমাদের মতো যারা আছে তাদের প্রত্যেকেরই মানুষের মতোই জৈবিক চাহিদা আছে। শুধু এই জৈবিক চাহিদা অথবা আকাঙ্খ যাই বলো না কেন, আমরা যথা সম্ভব দমন করে রাখতে চেষ্টা করি এটাই যা পার্থক্য।”

“ওহ্,” আমি শুধুমাত্র এতোটুকুই বলতে পারলাম।

এ্যাডওয়ার্ড হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হলো ও পাথরের মূর্তিতে রূপ। নিয়েছে। ওকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে আমিও নিশুপ হয়ে গেলাম।

“আমি বিষয়টা ভাবতেও পারছি না-ওটা-ওটা যে আমাদের পক্ষে সম্ভব তা চিন্তা করাও কঠিন।”

“কারণ আমি তোমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করেছি, সে কারণে তুমি আমাকে তোমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছো?”

“সেটা অবশ্য একটা সমস্যা বটে। কিন্তু তা নিয়ে আমি ভাবছি না। বিষয়টা হচ্ছে তুমি খুবই কোমল হৃদয়ের। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতাই নেই তোমার। সুতরাং তোমার সাথে চলতে গেলে অহরহই যে কষ্ট দিবো না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমি মোটেও তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তোমাকে আমি খুব সহজে হত্যা করতে পারি বেলা-একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েই তা আমি করতে পারি।” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক আমার কানে কঠিন কোণালো। ওর শীতল হাতটা আমার গালের ওপর রাখলো। “আমি যদি খুবই খারাপ প্রকৃতির হতাম তাহলে তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতাম, অযথা তোমার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠতাম না। অথবা তোমাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া ছিলো আমার এক সেকেন্ডের কাজ-আমি তোমার মুখ স্পর্শ করতাম আর সাথে সাথে তোমার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। কীভাবে কী হলো,কিছুই বুঝে উঠতে পারতে না। সবার কাছে মনে হতো এটা একটা দুঘর্টনা। আমি যখন তোমার সাথে থাকি কখনোই-কখনোই নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারানোর চেষ্টা করি না।”

এ্যাডওয়ার্ড আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর আশা করছিলো, কিন্তু তা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।” তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?” ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

উত্তরটা গুছিয়ে নেবার জন্যে আমি মিনিট খানিক অপেক্ষা করলাম। ফলে সত্য উত্তরটাই বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। “না,আমি তোমাকে মোটেও ভয় করছি না।”

এ্যাডওয়ার্ডকে খানিকটা ইতস্তত করতে দেখলাম আমি। “এখন অবশ্য একটা বিষয়ে জানতে আমি খুবই আগ্রহী, অনেকটা শান্ত কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে জিজ্ঞেস করলো। “তুমি কি কখনো কারো সাথে…?” এ্যাডওয়ার্ডের এই জিজ্ঞাসা আমার কানে অনেকটাই উপদেশ দেবার মতো কোণালো।

“অবশ্যই নয়।” আমি লজ্জায় রাঙা হয়ে জবাব দিলাম। “তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, এর আগে কাউকে নিয়েই আমার এ ধরনের অনুভূতি হয়নি, এতোটা কাছাকাছিও আসি নি কারো।”

“আমি জানি। আমি জানি এগুলো অন্যান্যদের চিন্তা। এটাও জানি ভালোবাসা এবং কাম-লালসা সবসময় একই অর্থ বহন করে না।”

“ওরা আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে চিন্তা করতে পারে, কামনাও করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমার কাছে কোনো মূল্যই নেই।” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।

“তুমি ভালো বলেছো। অন্ততপক্ষে আমাদের দুজনের এক দিক দিয়ে মিল আছে।” এ্যাডওয়ার্ড সন্তষ্ট হয়ে জবাব দিলো।

“তোমার মানবিক প্রবৃত্তিগুলো…” পূর্বকথার রেশ ধরে আমি বলার চেষ্টা করলাম। আমি কী বলতে চাইছি, তা কোণার জন্যে এ্যাডওয়ার্ড অপেক্ষা করে রইলো। “ভালো কথা, তোমার কাছে আমাকে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে এইটুকুই?”

ও হেসে উঠে প্রায় শুকিয়ে আসা চুলের উপর হাত বুলিয়ে দিলো।

“আমি মানুষ হয়ে উঠতে চাই না, তবুও আমি একজন মানুষ,” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করলো।

“তোমার প্রশ্নের জবাব আমি দিয়ে ফেলেছি, এখন তুমি ঘুমোতে পারো।”

 “আমার আদৌ ঘুম আসবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

 “আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাই এটাই কি তুমি চাও?”

 “না!” আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

এ্যাডওয়ার্ড হেসে উঠলো। আগের মতোই ও গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজতে লাগলো-অপরিচিত ঘুমপাড়ানি গানের মতো। ওর কণ্ঠস্বর আমার কানে দেবদূতের মতোই কোমল কোণালো।

বুঝতে পারলাম সত্যিকার অর্থে আমি খুবই ক্লান্ত। সমস্ত দিনের মানসিক চাঞ্চল্যর কারণে শরীরের ওপর এতোটাই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে যে ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এতোটা ক্লান্তি এর আগে আমি কখনোই বোধ করিনি। স্বাভাবিক, এ্যাডওয়ার্ডের শীতল বাহুর ওপর মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *