০৭.
আমি চার্লিকে বললাম যে আমার প্রচুর হোমওয়ার্ক করার আছে, সুতরাং রাতে খাওয়ার মতো হাতে মোটেও সময় নেই। টেলিভিশনে বাস্কেটবল খেলা দেখা নিয়ে তিনি ভীষণ উত্তেজিত। সুতরাং কী বললাম কিংবা আমার মুখে কী ধরনের অনুভূতি প্রকাশ পেলো, কিছুই তার লক্ষ করার কথা নয়। যদিও আমি ঠিক বুঝতে পারি না, এই খেলার ভেতর এমন কী উত্তেজনার আছে।
বেডরুমে ঢুকে, দরজার লক ভালোভাবে আটকে দিলাম। ডেস্ক হাতড়ে আমি পুরাতন হেডফোনটা খুঁজে বের করে সিডি পেয়ারের সাথে সংযুক্ত করলাম। বড়োদিনে ফিলের উপহার দেয়া একটা ডিস্ক আমি প্লেয়ারে চাপিয়ে দিলাম। এটা তার প্রিয় এক সঙ্গীত দলের এ্যালবাম, কিন্তু গানগুলো আমার তেমন একটা ভালো লাগলো না। হেডফোন কানে লাগানো অবস্থাতেই আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কানে পীড়া দেয়, এমনভাবে সিডি প্লেয়ারের ভলিউম বাড়িয়ে দিলাম। আমি চোখ বন্ধ করে রাখলাম, কিন্তু আলো চোখে লাগায় তেমন সুবিধা করতে পারলাম না। পাশ থেকে বালিশ টেনে নিয়ে চোখের ওপর চাপা দিলাম।
গানটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। ড্রামের তালেতালে গাওয়া গানের কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ড্রামের অতিরিক্ত শব্দের কারণে কথাগুলো বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর। তৃতীয়বারের মতো সিডিটা চালানোর পর অন্তত এতোটুকু বুঝতে পারলাম, গানটা গাওয়া হচ্ছে সমবেত কণ্ঠে। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত ব্যান্ডের গানগুলো আমার বেশ ভালোই লাগতে শুরু করেছ। নতুনভাবে আমি আবার ফিলকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।
সিডিটা আমি এক নাগালে শুনতে লাগলাম, যতোক্ষণ না গানগুলো নিজে থেকে গাইতে পারলাম, ততোক্ষণ সিডিটা শুনেই গেলাম। অবশ্য বেশিক্ষণ আর কোণা হলো না, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগলো।
.
চোখ খুলে আমি পরিচিত একটা জায়গা দেখতে পেলাম অবচেতন মনে যদিও বেশ ভালোভাবেই জানি যে আমি স্বপ্ন দেখছি, তবুও আমার কাছে সবকিছু মনে হচ্ছে একেবারে বাস্তব জঙ্গলের সেই সবুজ আলো আবার আমি দেখতে পেলাম। কাছেই কোথাও পাথরের তীরের ওপর ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেলাম। এবং মনে হলো একটু চেষ্টা করলে সাগরটাও দেখতে পাবো, চেষ্টা করলে সূর্যটাও দেখা যাবে। আমার কানে একটা শব্দ ভেসে এলো, কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে আসছে তা বুঝে ওঠার আগেই জ্যাকব ব্ল্যাককে দেখতে পেলাম। আমার একটা হাত ওর মুঠোয় শক্তভাবে ধরে জঙ্গলের অন্ধকার অংশের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
“জ্যাকব? এটা কি হচ্ছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। ওর চোখেমুখে রীতিমতো আতঙ্ক লক্ষ করলাম। কোনো কারণে ও এতোটাই ভয় পেয়েছে যে, সজোরে আমার হাত চেপে ধরে অন্ধকারের দিকে এগুতে লাগলো। কিন্তু অন্ধকারে মোটেও আমি যেতে চাইলাম না।
“পালাও! বেলা পালাও! তোমাকে পালাতে হবে!” আতঙ্কে ও ফিসফিস করে বললো।
“এদিক দিয়ে তুমি পালাও!” মাইকের গলা আমি চিনতে পারলাম। গাছপালার অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশ থেকে মাইক চিৎকার করে আমাকে সাবধান করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওকে মোটেও দেখতে পেলাম না।
“কেন?” আমি জানতে চাইলাম। জ্যাকব এখনো সেই আগের মতোই আমাকে জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু সূর্য দেখার জন্যে আমি উল্কণ্ঠিত হয়ে উঠলাম।
কিন্তু জ্যাকব আগের মতোই হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করতে লাগলো। হঠাৎই ও কাঁপতে লাগলো। প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এমনভাবে গড়াগড়ি খেতে লাগলো যে, আমি তা দেখে ভয়ে শিউরে উঠলাম।
“জ্যাকব।” আমি চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু ও আমার সামনে থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। বরং সেখানে দেখতে পেলাম লালচে বাদামি রঙ আর কালো চোখের একটা বিশালাকৃতির নেকড়ে। নেকড়েটা আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে সাগর সৈকতের দিকে তাকালো। ঘন পশমে আবৃত ঘাড় নাড়িয়ে শ্বদন্তের গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠলো।
“বেলা দৌড়াও!” আমার পেছন থেকে মাইক আবার চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু আমি নড়তে পারলাম না। দেখতে পেলাম সাগরের দিক থেকে অদ্ভুত ধরনের একটা আলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
এরপরই দেখতে পেলাম এ্যাডওয়ার্ডকে ও গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। ওর শরীরের চামড়া চকচক করছে, আর কালো চোখ জোড়া ভয়ঙ্করভাবে জ্বলজ্বল করছে। ও আমার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নেবার চেষ্টা করলো। নেকড়াটা আমার প্রায় কাছেই দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো।
আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে এক পা পিছিয়ে এলাম। ও হেসে উঠলো। তখন লক্ষ করলাম ওর দাঁতগুলো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং ধারালো।
“আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।” মধু মাখানো কণ্ঠে আমাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করলো এ্যাডওয়ার্ড।
আমি আরেক পা সরে দাঁড়ালাম।
নেকড়েটা আমার এবং ভ্যাম্পায়ারের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ালো। স্বদন্তগুলোর আকার এখন আরো বেড়ে গেছে।
“না!” আমি চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলাম- এতোটাই জোরে লাফিয়ে উঠলাম যে ঘুম ভেঙে নিজেকে আমি বিছানার নিচে আবিস্কার করলাম।
.
বিছানার থেকে আমার এই পড়ে যাওয়ায় হেডফোনে টান লেগে সিডি প্লেয়ারটা টেবিলের পাশের কাঠের মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে গেল।
ঘরের লাইটটা এখনো আমার অন করাই আছে। রাতে বাইরের পোশাক জুতা পরা অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছিলাম। ড্রেসারের ওপর রাখা টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। ঘড়িটা সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় নির্দেশ করছে।
যন্ত্রণায় আমি গুঙিয়ে উঠলাম। গড়িয়ে মুখ ঢেকে উবু হয়ে শুয়ে পড়লাম। এরপর লাথি মেরে পা থেকে জুতাজোড়া খুলে ফেললাম। যেখানেই হোক তন্দ্রাচ্ছন্নতা আমি সহ্য করতে পারি না। আবার গড়িয়ে জীনসের বোতাম খুলে ওটা সরাসরি সামনের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম খোঁপাটা এখনো বাঁধাই আছে, ফলে মাথার পেছনে ব্যথা করছে আমার। মাথা ঘুরিয়ে রাবার ব্যান্ড খুলে চুলগুলোর ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে যতোদূর সম্ভব চুলগুলো সোজা করে নেবার চেষ্টা করলাম। আগের মতোই বালিশটা চোখের ওপর চাপিয়ে আলোর যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করলাম।
অবশ্যই এগুলোর কোনো অর্থ নেই। যে দৃশ্যকল্পগুলো এতোক্ষণ আমাকে পীড়া দিয়ে এসেছে, অবচেতন মন অবশ্যই সেগুলো মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
আমি উঠে বসলাম। উপর থেকে নিচের দিকে দ্রুত রক্ত প্রবাহের কারণে। খানিকক্ষণ মাথা ঘুরতে লাগলো। আগের কাজ আগে করতে হবে মনে মনে ভাবলাম। যতোটা সম্ভব এই দুঃচিন্তাগুলো মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবো, তাতেই মঙ্গল। বাথরুম ব্যাগটা আমি টেনে নিলাম।
যেমনভাবে মনে করেছিলাম বাথরুমে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ শরীর ভেজাবো, তেমন অবশ্য করলাম না। এমনকি ড্রায়ার দিয়ে চুলও ভালোভাবে শুকানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করলাম। চার্লি এখনো ঘুমাচ্ছেন নাকি কাজে বেড়িয়ে পড়েছেন, কিছুই বলতে পারছি না। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম পার্কিং লটে ক্রুজারটা নেই।
ধীরে সুস্থে পোশাক পাল্টিয়ে বিছানা গুছিয়ে নিলাম। যদিও ভালোভাবে গুছাতে পারলাম না। কিছু বিষয় আছে যেগুলো মোটেও আমি ভালোভাবে করতে পারি না। সুতরাং বিছানা গুছানোর কাজে নিজেকে বেশিক্ষণ ব্যস্ত রাখতে পারলাম না। ডেস্কের কাছে গিয়ে আমার পুরাতন কম্পিউটারটা অন করলাম।
এটাতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে মোটেও ভালো লাগে না। কম্পিউটারের মোডেমটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ পুরাতন মডেলের। ফ্রি সাবস্ক্রাইবের কাছে ডায়াল করার পর ইন্টারনেটের সংযোগ পেতে হয়।
আমি খুব ধীরে ধীরে খেতে লাগলাম। প্রতি খাদ্যের টুকরো মনে হলো যেন যত্ন করে চিবুচ্ছি। খাবার শেষ করে থালা-বাসনগুলো ধুয়ে-মুছে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলাম। ক্লান্তিতে ওপরতলার সিঁড়ি ভাঙতেও আমার বেশ কষ্ট হতে লাগলো। প্রথমেই সিডি প্লেয়ারটার কাছে গিয়ে সেটা যথাস্থানে তুলে রাখলাম। প্লেয়ার থেকে হেডফোন খুলে ডেস্কের ড্রয়ারের ভেতর রেখে দিলাম। এরপর আবার সিডিটা চালালাম। কয়েকটা গান পার হয়ে নির্দিষ্ট গান সিলেক্ট করলাম। এই গানের ব্যাক গ্রাউন্ডে বিশেষ কিছু শব্দ যুক্ত করা হয়েছে।
আরেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আমি কম্পিউটার অন করলাম। স্বাভাবিক স্ক্রীনে পপ-আপ এ্যাডভারটাইজমেন্ট ভেসে উঠলো। ফোল্ডিং চেয়ারে বসে প্রথমেই ছোটো ছোটো উইন্ডোজগুলো বন্ধ করে দিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি প্রিয় সার্চ ইঞ্জিনে প্রবেশ করলাম। এরপর নতুনভাবে কিছু প-আপ বেছে নিলাম এবং এরপর একটা শব্দ টাইপ করলাম।
“ভ্যাম্পায়ার।”
শব্দের তথ্যগুলো সুবিন্যস্তভাবে আসতে খানিকক্ষণ সময় লাগলো। একই শব্দের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সংশিষ্টতা লক্ষ করলাম- এর বেশিরভাগই মুভি এবং টিভি-শো সংক্রান্ত, কিছু কম্পিউটার গেম, এমনকি কসমেটিক কোম্পানি সংক্রান্ত তথ্যও।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাঙ্খিত সাইটটা আমি খুঁজে পেলাম- ভ্যাম্পায়ার এ টু জেড। অধৈয্য হয়ে আমি এটা লোড হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। দ্রুত কাজ করার সুবিধার্থে স্ক্রীনের অনেক অংশ দখল করে রাখা বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধ করে দিলাম। অবশেষে স্ক্রীনটা সম্পূর্ণভাবে দেখতে পেলাম- সাধারণ সাদা ব্ল্যাকগ্রাউন্ডের ওপর কালো অক্ষরে লেখা –অনেকটা যেমন শিক্ষামূলক কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হয়। হোম পেজের দুটো কোটেশন আমার বেশ নজর কাড়লো।
এই বিশাল পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অশরীরী, প্রেতাত্মা, ভূত কিংবা শয়তান। এদের যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এদের প্রত্যেককেই কিন্তু চেহারার দিক থেকে ভয়ঙ্কর, আতঙ্কজনক কিংবা বিতৃষ্ণা উদ্রেককারী বলা যাবে না। অন্যদিকে মনোয়োম সাজপোশাক পরা সব ভ্যাম্পায়ারই কিন্তু আমাদের এক কথায় মুগ্ধ করে। কোনোভাবেই তাদের ভূত প্রেত কিংবা শয়তান বলা যাবে না। কিন্তু এরপরও তারা ডার্ক নেচার-এর চর্চা করে, অলৌকিক সব কর্মকান্ড সম্পাদন করতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে।
– রেভারেন্ড মন্টেগু সামারস্
যদি কোনো কারণে পৃথিবীর কোনো কিছুকে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি প্রদান করতে হয়, তাহলে প্রথমে ভ্যাম্পায়ারের কথাই উল্লেখ করতে হয়। এর ভেতর কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়: অফিসের কোনো রিপোর্ট প্রদান, খ্যাতিমান ব্যক্তির মুচলেখা, সার্জনের সার্টিফিকেট, যাজক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্ট বিধানতান্ত্রিকভাবে সম্পূর্ণ বৈধ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। তাহলে ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু থাকতে পারে তা কে বিশ্বাস করবে?
– রুশো
এর পরবর্তী অংশে, ভ্যাম্পায়ার সংক্রান্ত যতো ধরনের মিথ পৃথিবীতে প্রচলিত আছে, সেগুলো আক্ষরিকভাবে সাজানো হয়েছে। প্রথমবার যেটাতে আমি ক্লিক করলাম, সেটা ভ্যানাগ। ভ্যানাগ হচ্ছে ফিলিপাইনের ভ্যাম্পায়ার। এই ভ্যাম্পায়ারই ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে ট্যারৌ নামক গাছগুলো (গ্রীষ্মপ্রধান দেশ-বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে জন্মানো এক ধরনের উদ্ভিদ, যার মূল খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়) প্রথম রোপন করেছিলেন। এটা অনেক দিন আগেকার ঘটনা। মিথ-এ উল্লেখ পাওয়া যায়। ভ্যানাগ মানুষের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে প্রচুর সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন। কিন্তু মানুষের সাথে এর সম্পর্ক নষ্ট হলো একটা ঘটনার পর থেকে। একদিনের ঘটনা এক মহিলার হঠাৎ হাত কেটে গেল। মহিলার কাটা হাত থেকে যখন রক্ত ঝরতে লাগলো, তখন একটা ভ্যানগ ছুটে এসে সেই রক্ত চেটে চেটে খেতে লাগলো। সে এতোটাই তৃপ্তি নিয়ে রক্তপান করলো যে, তার সমস্ত শরীরে সেই রক্ত ছড়িয়ে পড়লো।
বর্ণনাটা আমি খুব ভালোভাবে পড়তে লাগলাম। খুব ভালোভাবে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, বিষয় সংশিষ্ট আর কিছু খুঁজে বের করা সম্ভব কি না। বেশির ভাগ মিথ এ উল্লেখ করা হয়েছে মহিলারাই হচ্ছে শয়তান এবং শিশুরা তাদের শিকার; এমনকি অতিরিক্ত শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবেও এদেরই দায়ী করা হয়। অনেকগুলো কাহিনীতে অশরীরী আত্নার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কবর দেবার ক্ষেত্রে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। গুটি কয়েকবাদে এ ধরনের খুব একটা ছবি দেখার সুযোগ হয়নি আমার। এর ভেতর হিব্রু ছবি এসট্রি এবং পোলিশ ছবি উপিয়ার অন্যতম। এই দুই ছবির সম্পূর্ণ অংশ জুড়েই রক্তপানের বিষয় উঠে এসেছে।
অনেক খুঁজে, মাত্র তিনটা বর্ণনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো: রোমানিয়ান এক ভ্যাম্পায়ারের নাম হচ্ছে- ভ্যারাকোলাসি। অলৌকিক সব ঘটনা ঘটতে পারতো সে। চমৎকার চেহারা, মসৃণ চামড়ার সুদর্শন পুরুষ হিসেবে তিনি জনসমুক্ষে উপস্থিত হতেন। এদের দ্বিতীয় জন হচ্ছে স্লোভাকের নিলাপসি। অতিশয় ক্ষমতার অধিকারী অদ্ভুত এক জীব। মধ্যরাত্রীর পর মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভেতর এই জীব একটা গ্রাম সম্পূর্ণভাবে তছনছ করে ফেলে। আর এই তিনজনের ভেতরকার আরেকজন হচ্ছে স্টেরিগোনি বেনেফিশি।
শেষের এই তিনজনের ব্যাপারে খুব সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। স্টেরিগোনি বেনেফিশি একজন ইতালীয় ভ্যাম্পায়ার। এর পাশাপাশি ধার্মিকতার কারণেও বেশ সুনাম ছিলো। তিনি ছিলেন সমস্ত শয়তান ভ্যাম্পায়ারের প্রাণঘাতী শত্রু।
একটা বিষয়ে স্বস্তিবোধ করলাম এই ভেবে যে প্রায় শ’খানেক মিথ-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভ্যাম্পায়াররা প্রকৃত পক্ষে সৎ চরিত্রেরই হয়ে থাকে। আমার নিজস্ব অভিমত তো বটেই, জ্যাকব যে গল্পগুলো বলেছিলো, তাতেও একই রকম ইঙ্গিত পেয়েছি আমি। মনে মনে আমি একটা ক্যাটালগের মতো তৈরি করলাম। এরপর একের সাথে আরেক ভ্যাম্পায়ারের তুলনা করে দেখার চেষ্টা করলাম। সাফল্য, শক্তি, সৌন্দৰ্য্য, মসৃণ চামড়া, চোখের রঙের পরিবর্তন ইত্যাদি; এবং এরপর বলা যেতে পারে জ্যাকবের বলা বৈশিষ্ট্যগুলো: রক্তপিপাসু, ওয়্যারউলফের প্রধান শত্রু, শীতল ত্বক এবং অবিনশ্বর। আমার সাজানো বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে জ্যাকবের বলা বৈশিষ্ট্যগুলোকে কোনোভাবেই মেলানো সম্ভব নয়।
এরপরও আরেকটা সমস্যা থেকেই যায়, আমি যে কয়েকটা ভূতের ছবি দেখেছি, সেগুলোর আজকের পড়া বিষয়গুলোর সাথে মেলানোর চেষ্টা করলাম। একটা পার্থক্য লক্ষ করলাম যে, দিনের আলোয় ভ্যাম্পায়ার কখনো জনসমুক্ষে আসে না। ওরা সূর্যের আলোয় পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দিনের বেলা ভ্যাম্পায়াররা কফিনের ভেতর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় আর রাত্রিবেলা কফিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
বিরক্ত হয়ে আমি সরাসরি কম্পিউটারের পাওয়ার সুইচটাই বন্ধ করে দিলাম, সাইটটা বন্ধ হওয়ার সুযোগও দিলাম না। এগুলোর সবকিছুই এখন আমার বিরক্তিকর মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে সবকিছুই বোকার প্রলাপ। আমার শোবার ঘরে বসে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে আবার নতুনভাবে চিন্তা শুরু করলাম। আমার সমস্যা কোথায়? মনে হলো প্রায় প্রতিটা বাড়িতে গিয়ে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি।
আমার বাইরে বেরুতে খুব ইচ্ছে করলো, কিন্তু কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না কোথায় যাওয়া যেতে পারে। যাইহোক, জুতাজোড়া ঠিকই পরে নিয়ে নিচে এলাম। বাইরে বৃষ্টি কিংবা ঝড় হচ্ছে কিনা সেটা না দেখেই, শ্রাগ করে আমি রেইন কোটটা টেনে নিলাম।
আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। কিন্তু মনে হয় না সহসাই বৃষ্টি নামবে। আমি প্রাক নেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না, বরং পায়ে হেঁটে পূর্ব দিকে রওনা হলাম। চার্লির বাড়ির সীমানা থেকে কোণাকোনি সহজে প্রবেশ করা যায় এমন একটা জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। পায়ের নিচে কাদার শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না।
জঙ্গলের এই অংশ এক চিলতে ফিতের মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে। অবশ্য এখানে এসে আনন্দে অতিশষ্য হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না, বরং চারদিকে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। যতোই এগুচ্ছি ততোই জঙ্গলটা গভীর থেকে গভীরতর মনে হচ্ছে, যতোই পূর্বে এগুবে জঙ্গল যে আরও গম্ভীর হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চারদিকে সব বিচিত্র গাছের সারি সাপের মতো মসৃণ সিটকা, হেমলক, বিভিন্ন জাতের চির সবুজ বৃক্ষ এবং ম্যাপলস। আশপাশের গাছগুলো সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সীমাবদ্ধ। তবে আমার মনে আছে গত দিন চার্লি ক্রুজারের জানালা দিয়ে বেশ কিছু গাছের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর অনেকগুলোই আমি ইতোমধ্যে ভুলে গেছি। এরই ভেতর আরো কিছু গাছ আছে যেগুলোকে ঠিক চিনতে পারলাম না, কারণ গাছগুলোকে পেঁচিয়ে এতোটাই পরগাছা জন্মেছে যে প্রকৃত গাছকে চেনার কোনো উপায় নেই।
মনের ভেতর দানা বেঁধে ওঠা রাগটা কোনোভাবে প্রশমিত করতে পারলাম না বলেই একগুয়ে স্বভাবের মেয়ের মতো আমি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাগটা কিছু প্রশমিত হলে আমার হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। পাতার শামিয়ানার ওপর থেকে কয়েক ফোঁটা পানি আমার শরীরে ঝরে পড়লো, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না আদৌ এগুলো বৃষ্টির পানি কিনা। তবে এমনও হতে পারে গতদিনের জমে থাকা বৃষ্টির পানিই হয়তো আমার শরীরে ঝরে পড়েছে। সদ্য পড়ে যাওয়া একটা গাছের ওপর আমি বসলাম- আমি জানি গাছটা সম্প্রতি পড়ে গেছে। গাছে জন্মানো সদ্য ছত্রাকগুলো দেখলে সহজেই তা অনুমান করা যায়। ফার্ণ গাছগুলো এড়িয়ে পড়ে থাকা গাছটার ওপর গিয়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম, জ্যাকেটটা নিয়ে ভেজা অংশের ওপরই বসে পড়েছি। জ্যাকেটের সাথে সাথে আমার কাপড়ও ভিজে উঠছে। মৃত গাছের গুঁড়ির ওপর বসে জ্যাকেটের হুডটা নামিয়ে নিয়ে চারদিকের জীবন্ত গাছগুলো দেখতে লাগলাম।
আমি সম্পূর্ণ ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। গতরাতে দেখা স্বপ্নের মতোই গাছপালাগুলো ঘন সবুজ, এতো সবুজের ভেতর এলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। অনেকক্ষণ থেকেই আমার ভেজা পায়ের শব্দ শুনতে হচ্ছে না, তবে অতিরিক্ত নীরবতাও স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলছে। এমনকি পাখিরাও এখন নীরব হয়ে আছে। পানির ফোঁটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, সুতরাং জমে থাকা বৃষ্টির পানি নয়, সত্যিকার অর্থে বৃষ্টিই শুরু হয়েছে। ফার্ণগুলো আমার মাথা ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। বসে থাকার কারণে আমি সম্পূর্ণভাবে ফার্ণগুলোর আড়াল হয়ে গেছি। আমি জানি কেউ একজন রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে, খুব জোর ফুট তিনেক দূরে হবে, তবে নিশ্চিত ও আমাকে দেখতে পায়নি।
আমি দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করলাম, তবে অনেকটা মনের বিরুদ্ধেই বলা যেতে পারে।
প্রথমত, কুলিনদের সম্পর্কে জ্যাকব যেমন বলেছে তার সবই হয়তো সত্যি।
সাথে সাথেই আমি বিষয়টা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলাম। বিষয়টাকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাহলে কি হতে পারে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। এই মুহূর্তে আমি কীভাবে বেঁচে আছি তার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ বের করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মাথার ভেতর যে তথ্যগুলো ধারণ করেছিলাম, সেগুলো নতুনভাবে ঝালাই করে নিতে লাগলাম: অতিরিক্ত গতি এবং শক্তি, চোখের রঙের দ্রুত পরিবর্তন- কালো থেকে সোনালি এবং পুনরায় কালো, আমানবীয় সৌন্দৰ্য্য, পান্ডুর, বরফ শীতল ত্বক। এবং আরো কিছু বলতে গেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক বিষয়ই এগুলোর সাথে সাথে চলে আসতে পারি- ওরা খাদ্য গ্রহণ ছাড়া কি বেঁচে থাকতে পারে? ও মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে কথা বলে। ওর কথার ভেতর এক ধরনের ছন্দ আছে। ও যে ধরনের বাক্য ব্যবহার করে তা সাধারণ কোনো সাহিত্যে বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না- খুঁজলে দেখা যাবে তা একবিংশ শতাব্দীর কোনো গল্প-উপন্যাসেই পাওয়া যাচ্ছে। ব্লাড়-টাইপিং-এর দিন ও ক্লাস পালিয়েছিলো। যতোক্ষণ পর্যন্ত না জানানো হলো আমরা বীচ-এ যাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত ও আমাকে কিছুই বলেনি। ওকে ঘিরে সবাই কী আলোচনা করছে, তার সবই বোধহয় ও জানে, এর ব্যতিক্রম শুধু আমি। কুলিন আমাকে বলেছিলো যে ও নাকি পাজি প্রকৃতির, ভয়ঙ্কর।
কুলিন কি ভ্যাম্পায়ার হতে পারে?
ভালো কথা, ওরা হয়তো অন্য রকম। আমার দিব্য দৃষ্টিতে সবকিছু যেমন দেখি তার বাইরে অন্য রকমের কোনো কিছু। জ্যাকবের বলা গল্পানুসারে ও “ভয়ঙ্কর”ও হতে পারে, অথবা আমার কল্পনার “সুপারহিরো” তত্ত্ব। এ্যাডওয়ার্ড কুলিন হয়তো সাধারণ মানুষ নয়…। ও হয়তো সাধারণের চাইতেও বেশি কিছু।
তো এরপর? এরপর আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্য আমি সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টাই বা করছি কেন?
যদি এ্যাডওয়ার্ড একজন ভ্যাম্পায়ার হয়েই থাকে, অবশ্য কথাটা চিন্তা করতে আমার কষ্টই হচ্ছে- তাহলে আমার কি করার আছে? এ বিষয়ে কারও কাছে সাহায্য চাইবো, তা চিন্তা করাই সম্ভব নয়। আমি নিজেই যেখানে বিশ্বাস করতে পারছি না, আর কাউকে কি বিষয়টা বিশ্বাস করানো সম্ভব? তাছাড়া জ্যাকবের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, বিষয়টা নিয়ে কারও সাথে আমি আলোচনা করবো না।
আমার মাথায় দুইটা পরিকল্পনা খেলা করছে, সম্ভবত এগুলোকে আমি কাৰ্য্যকারী করতে পারবো। প্রথমত হচ্ছে তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা: বুদ্ধিমানের মতো তাকে যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। ওর সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মাথা থেকে তাড়িয়ে যতোটুকু এড়িয়ে চলা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। মনে হলো আমরা এমন এক স্থানে অবস্থান করছি, যেখানে দুর্ভেদ্য এক কাঁচের দেয়াল দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে দু’জনকে। ওকে বলতেই হবে আমাকে বিরক্ত না করার জন্যে, এবং সেটা বলার সময় এখনই।
আকস্মিক এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। মন থেকে যন্ত্রণাটুকু মুছে ফেলে পরবর্তী করণীয় কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম।
আমি ব্যতিক্রম কোনো আচরণ করছি না। যাই হোক, সে যদি তেমন কিছু হয়েই থাকে অশুভ কোনো কিছু, আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, ও আমার বড়ো কোনো ক্ষতি করতে পারে। সত্যি বলতে এ্যাডওয়ার্ড যদি সেদিন রক্ষা না করতো, তাহলে টাইলারের গাড়ির ধাক্কায় আজ হয়তো স্বর্গে বসবাস করতে হতো আমাকে। খুব দ্রুত, নিজের সাথে যুক্তিতে অবতীর্ণ হলাম, আমি আসলে যা কিছু করছি, তা সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করতে হচ্ছে। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করেনি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কি কখনো কারও জীবন রক্ষা করে? আর কেউ যদি কারও জীবন রক্ষা করেই থাকে, তাহলে তাকে ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি এর সমুচিত জবাব খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তেমন কোনো উত্তরই খুঁজে বের করতে পারলাম না।
চেষ্টা করলে যদি সব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে একটা বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। জ্যাকব ভয়ের কথাগুলো বলেছিলো বলেই গতরাতের স্বপ্নে আবছা আবছা এ্যাডওয়ার্ডকে দেখে আমার ভয় লেগেছিলো, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড নিজে আমাকে কোনো ভয় দেখায়নি।
আমি উত্তরটা খুঁজে বের করতে পরলাম। সত্যিকার অর্থে এর কোনো বিকল্পও নেই। ইতোমধ্যে আমি আসলে ওর সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েছি। এখন আমি বুঝতে পারছি-বুঝতে পারছি, ভয় পেলেও আসলে আমার কিছু করার নেই। কারণ যখন আমি তাকে নিয়ে চিন্তা করি, তার কণ্ঠস্বর, অন্যকে আকর্ষিত করা তার চোখ, তার যাদুমন্ত্রের মতো মুগ্ধ করা ব্যক্তিত্ব- এগুলোর বাইরে তাকে নিয়ে অন্য কোনো চিন্তা করাই সম্ভব নয়। এমনকি যদি … কিন্তু তা আমি চিন্তা করতে চাই না। একাকী ঘন এই জঙ্গলের ভেতর কোনোভাবেই এমন কিছু চিন্তা করতে চাই না। বৃষ্টির চাঁদোয়ার নিচে চাঁদের আলো যেভাবে ম্লান হয়ে আসে সেভাবে নয়, এবং ওই চাঁদোয়ার নিচ দিয়ে ধূসর মাটির ওপর দিয়ে ছোটো ছোটো পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। যেভাবেই হোক এক্ষেত্রে পথ হারানোর সম্ভাবনা থেকেই যায়।
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না, সবকিছু নিরাপদই মনে হলো আমার কাছে। সবুজ গাছপালার ভেতর দিয়ে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমি দ্রুত চলার তাগিদ অনুভব করলাম। তাছাড়া বাতাসের ঝাপ্টা থেকে মুখটা রক্ষা জ্যাকেটের হুড দিয়ে মাথা ঢেকে নিলাম। এক সময় বিস্মিত হয়ে দেখলাম মনের অজান্তেই গাছপালার ভেতর দিয়ে আমি প্রায় দৌড়াতে শুরু করলাম। আমি ভাবতেও পারলাম না এতো স্বল্প সময়ে এতোটা পথ কীভাবে চলে এলাম। আরেকটা বিষয়ে আমি অবাক হলাম, একেবারে না চিনলেও এতোটা পথ আমি ঠিকই চলে আসতে পেরেছি। মারাত্বক ভয়ে আক্রান্ত হওয়ার আগে কোনো খোলা স্থান খুঁজতে লাগলাম, অবশ্য সামান্য গাছে ঘেরা একটা ভোলা স্থান পেয়েও গেলাম। এর পরপরই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার শব্দ শুনতে পেলাম এবং নিজেকে এখন আমার একেবারে মুক্ত বলে মনে হলো। চার্লির লনটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বাড়ি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে- ভেজা কাপড় এবং মোজা শুকিয়ে উষ্ণ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
বাড়িতে প্রবেশের সময় আকাশে পূর্ণ চাঁদের ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেলাম। ওপর তলায় উঠে আমি দিনের পোশাক পরে নিলাম- জিনস এবং টি-শার্ট, যদিও এখন আমার বাইরে কোথাও যাওয়ার কথা নয়। আজকের হোমওয়ার্ক এর প্রতি তেমন মনোযোগ দিতে হবে না- ম্যাকবেথের ওপর একটা পেপার-ওয়ার্ক করতে হবে, তাও সেটা জমা দিতে হবে আগামী বুধবার। শুধু অ্যাসাইনমেন্টটার একটা আউট লাইন তৈরি করে নিলাম প্রথমে। আগের চাইতে এখন আমি অনেকটাই শান্ত… ভালো, গত বৃহস্পতিবার থেকে কাজের প্রতি অনেকখানি একাগ্র হয়ে উঠেছি। অবশ্য আমার স্বভাবই এরকম। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়, এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকি। কিন্তু একবার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলতে পারলে আর কোনো চিন্তার কারণ থাকে না, খুব সহজেই আমি সেই মতো চলতে থাকি। অবশ্য তেমন কোনো ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার কারণে আমি স্বস্তিই অনুভব করি। মাঝে মাঝে অবশ্য ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে স্বস্তি নয় বরং বিষয়টা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এই ফরস্-এ আসার সিদ্ধান্তের কথাই ধরা যাক। তবে অন্য কিছুর সাথে রেসলিং-এ অবতীর্ণ হওয়ার চাইতে বরং এটাকে অনেক ভালো বলেই মনে করি।
দিনটাকে আমার কাছে বেশ ভালো বলেই মনে হলো, পরপর বেশকিছু কাজ সেরে নিতে পারলাম। আটটা বাজার আগেই আমার লেখার কাজ শেষ হয়ে গেল। বড়ো একটা মাছ নিয়ে চার্লি বাড়ি ফিরলেন- মাছটা তিনি নিজেই ধরেছেন। বই থেকে একটা মাছের রেসিপি মনে করতে করতে আগামী সপ্তাহের সিয়েটেল ভ্রমণের ব্যাপারে চিন্তা করতে লাগলাম। গরম তেলে মরিচগুলো ছেড়ে দিতেই খানিকটা গরম তেল ছিটকে উঠলো। জ্যাকবের সাথে হাঁটতে হাঁটতে সিয়েটেল ভ্রমণ নিয়ে আমার ভেতর যে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো, এখন তা সম্পূর্ণ কেটে গেছে। আমি ভেবে দেখলাম, ওরা বোধহয় খানিকটা অন্য ধরনের হতে পারে। আমি অবশ্যই ভয় পেয়েছি- জানি যে ভয় পেয়েছি, কিন্তু মনে হলো না আমার ওই ভয় যথার্থ ছিলো।
দিনের শুরু থেকেই পরিশ্রমের কারণে বেশ আগেই বিছানায় গেলাম এবং সম্পূর্ণ স্বপ্নবিহীন একটা রাত কাটালাম। ফরস্-এ আসার পর দ্বিতীয়বারের মতো রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন দেখতে পেলাম। আমি জানালার কাছে ছুটে গেলাম। পর্দা সরিয়ে দেখলাম আকাশে একটুও মেঘ জমে নেই। মাঝে মাঝে শুধু পেঁজা তুলোর মতো সামান্য কিছু মেঘ জমে আছে। অবশ্য ওই মেঘ থেকে কোনোভাবেই বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না আমি। আমি জানালাটা খুললাম- অবাক হয়ে দেখলাম, একেবারে নিঃশব্দে পাল্লাটা খুলে গেল, আমি ঠিক জানি না, কতো বছর এ জানালা মোটেও ভোলা হয়নি। শুষ্ক বাতাসের সাথে পাল্লাগুলো ধাক্কা খেল। উষ্ণ প্রায়, বেশ জোর একটা বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগলো আমার শরীরে। শিরা-উপশিরার ভেতর দিয়ে দ্রুত রক্ত প্রবাহিত হওয়ার কারণে মনে হলো আমি তড়িতাহত হয়েছি।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পর দেখলাম, চার্লি মাত্র তার ব্রেকফাস্ট শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন। চমৎকার আবহাওয়া দেখে আমি যে আনন্দিত, তিনি তা সহজেই বুঝতে পারলেন।
“বাইরে কিন্তু চমৎকার আবহাওয়া”, মন্তব্য করলেন চার্লি।
“হ্যাঁ, তেমনই দেখলাম” মিষ্টি হেসে তার কথার সমর্থন জানালাম আমি।
চার্লি পাল্টা হাসলেন। ওর বাদামি চোখে চারদিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলেন।
চার্লি যখন মিষ্টি করে হাসেন, তখন ঠিকই বুঝতে পারি, মা এতো কম বয়সে কেন তাকে বিয়ে করার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছিলেন। যতোদিন থেকে চার্লিকে জানি, আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম, একসময় যে কমবয়সী তরুণীরা চার্লিকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছেন, তাদের কাউকেই তিনি আজ স্মরণে রাখেননি। তার আগের চেহারা আমার বেশ মনে আছে, ঢেউ খেলানো বাদামি চুল- শরীরের রঙও একই রকমের, আমার চাইতেও সুন্দর বললে ভুল বলা হবে না- ক্রমে ক্রমে তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন তার কপালের চামড়া চকচকে হয়ে এসেছে।
আমি উৎফুল্ল মনে ব্রেকফাস্ট করতে লাগলাম, দেখতে পেলাম পেছন জানালায় উজ্জ্বল রোদের আলো এসে পড়েছে। চার্লি শুভেচ্ছা জানিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, এর পরপরই শুনতে পেলাম বাড়ির সামনে থেকে ক্রুজারটা চলে যাওয়ার শব্দ। খানিকটা ইতস্তত করে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাইরে বেরুলাম। ইতস্তত করার কারণ জ্যাকেট পরে আসলে আজ বাইরে বেরুবার দিন নয়। তবুও যেহেতু একবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিই, এটা ভাঁজ করে হাতে ঝুলিয়ে নিলাম। এরপর মাসের সবচেয়ে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের রাস্তায় পা বাড়ালাম।
সূর্যের প্রখর আলোয় চোখে রীতিমতো যন্ত্রণা হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমি ট্রাকের উভয় দিকের কাঁচ নামিয়ে দিলাম। স্কুলে পৌঁছে দেখতে পেলাম এখন পর্যন্ত সেখানে কেউই উপস্থিত হয়নি। তাড়াহুড়ার কারণে আমি সময় দেখার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করিনি। গাড়িটা পার্ক করে ক্যাফেটেরিয়ার দক্ষিণ দিককার পিকনিক বেঞ্চগুলোর দিকে রওনা হলাম। বেঞ্চগুলো এখনো খানিকটা ভিজে আছে। সুতরাং জ্যাকেটটাকেই এবার কাজে লাগালাম। বেঞ্চের ওপর পেতে তাতে বসে পড়লাম আমি। বাড়ির যে কাজগুলো দেয়া হয়েছিলো, সেগুলো গতরাতেই শেষ করে নিয়েছি। আমার অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় ছিলো- “স্থবির সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী” এতে এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছি, আদৌ আমি জানি না এগুলো কতোটা যুক্তিযুক্ত। বিষয়গুলো মেলানোর জন্যে ব্যাগ থেকে বইটা বের করলাম। কিন্তু প্রথম সমস্যা নিয়ে বইয়ের মাঝামাঝি অংশে এসে খেই হারিয়ে ফেললাম- আমি দিবাস্বপ্ন দেখতে লাগলাম- বই থেকে চোখ তুলে, লাল পাতায় ছাওয়া গাছগুলোর ওপর কীভাবে রোদের আলো খেলা করছে তা দেখতে লাগলাম। আনমনে হোম-ওয়ার্ক-এর মার্জিনের ওপর আঁকিবুকি করতে লাগলাম। খানিকবাদে দেখতে পেলাম, মনের অজান্তে পাঁচজোড়া কালো চোখ এঁকে ফেলেছি ওগুলো কাগজের পাতা থেকে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরেজার দিয়ে ওগুলো দ্রুত মুছে ফেলতে লাগলাম।
“বেলা!” কাউকে আমি ডাকতে শুনলাম। কণ্ঠ শুনে মনে হলো মাইক-ই বোধহয় আমাকে ডাকছে।
.
আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম বেঞ্চে বসে থাকার সময়টুকুর ভেতর স্কুলে অনেকে এসে হাজির হয়েছে। প্রত্যেকেরই পরনে টি-শার্ট। এমনকি অনেকে শর্টও পরে এসেছে। তাপমাত্রা ষাটের বেশি হওয়ার কারণেই সবার এই পোশাকের পরিবর্তন। মার্ককে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ওর পরনে খাকি শর্ট এবং রাগবী টি-শার্ট। ১১০
“এই যে মাইক,” খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ওকে শুভেচ্ছা জানালাম। সত্যি বলতে এতো সুন্দর একটা দিনে কারও মনে দুঃখ দিতে চাই না।
ও আমার পাশে এসে বসলো। ওর খাড়া খাড়া চুল সূর্যের আলোয় সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে। বুঝতে পারলাম আমাকে দেখতে পেয়ে ও বেশ খুশি হয়েছে। আমি তাকে সাহায্য করতে পারলাম না বটে, কিন্তু ওকে খুশি হতে দেখে এক ধরনের সন্তুষ্টি অনুভব করলাম।
“আগে কিন্তু কখনো লক্ষ করিনি, তোমার চুল লালচে ধরনের,” ও মন্তব্য করলো। ওর আঙ্গুলের ভঁজে রেশমের সুতো দিয়ে বুনানো একটা দড়ি। সূর্যের আলোয় ওটা চকচক করে উঠলো।
“হয়তো সূর্যের আলোর কারণেই ও রকম মনে হচ্ছে।”
কানের কাছে মুখ এনে মার্ক অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করায় আমি খানিক অস্বস্তি বোধ করলাম।
“খুব সুন্দর দিন, তাই না?”
“আমার ভালো লাগা একটা দিন” ওকে সমর্থন জানালাম আমি।
“গতকাল কি করলে তুমি?” ওর কণ্ঠে জবাবদিহি চাইবার ভঙ্গি লক্ষ করলাম আমি।
“বেশিরভাগ সময় অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমি বললাম না যে কাজটা শেষ করতে পেরেছি- এ ধরনের কিছু বলে আলাদাভাবে স্বস্তি অনুভব করার চেষ্টা করলাম না।
ও কপালে চাপড় দিলো। “আরে হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম- ওটা তো বৃহস্পতিবার জমা দিতে হবে তাই না?”
“উমম… আমি তো জানি বুধবার।”
“বুধবার?” ও ভ্রু-কুটি করলো।
“এটা তো মোটেও ভালো কথা নয়… তো এ বিষয়ে তুমি কি লিখলে?”
“শেক্সপিয়ার মহিলা চরিত্রগুলোকে বিবাহ বিদ্বেষী হিসেবে দেখিয়েছেন সেই বিষয়টাই বিশেষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”
ও আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি জঘন্য ল্যাটিন ভাষায় কথা বলছি।
‘মনে হয় আজরাতে কাজটা শুরু করতে পারবো।” নিজেকে প্রবোধ দেবার মতো করে বললো মাইক। “আমি এসেছিলাম তুমি বাইরে যাবে কিনা তা জিজ্ঞেস করতে।”
“ওহ্।” নিজেকে সমর্থন করার চেষ্টা করলাম আমি। এগুলো বাদে মাইকের সাথে অন্য আলোচনার সুযোগ পেলে তা ছেড়ে দিবো কেন?
“ভালো কথা, আমরা ডিনার কিংবা ইচ্ছে করলে অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে পারি… এবং ইচ্ছে করলে এর ওপর কাজ আমি পরেও করতে পারবো।” বেশ আশা নিয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
“মাইক…” দ্রুত ওই স্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। “তোমার এই বুদ্ধিটা আমার কাছে খুব একটা যুক্তি সম্মত মনে হচ্ছে না।”
ওকে প্রচণ্ড হতাশ মনে হলো। “কেন?” চোখ পাকিয়ে ও প্রশ্ন করলো। আমার মাথায় যেখানে এ্যাডওয়ার্ডের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, সেখানে তাকে নিয়ে চিন্তা করার কি আছে।
“আমি ভাবছিলাম… আসলে তুমি যদি বলো, তোমার সাথে মরতে যেতেও রাজি আছি,” আমি ওকে ভয় দেখালাম। “কিন্তু আমার মনে হয় জেসিকা এতে খুব দুঃখ পাবে।”
ওকে বেশ খানিকটা বিভ্রান্ত মনে হলো। স্বাভাবিকভাবেই ও এভাবে বিষয়টা চিন্তা করেনি। “জেসিকা?”
“আসলেই মাইক, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না?”
“ওহ,” ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো- বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ওর একেবারে হতবুদ্ধি অবস্থা। অন্যদিকে এতে আমি পালানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।
“এখন ক্লাসের সময়, সুতরাং মোটেও এখানে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার।” বই-খাতাগুলো গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগলাম আমি।
তিন নম্বর বিল্ডিং-এ হেঁটে আসা পর্যন্ত আমরা একটা কথাও বললাম না। বুঝতে পারলাম ওর মাথায় বিক্ষিপ্ত সব চিন্তা খেলা করছে। আমার কাছে মনে হলো ওকে বোধহয় একটা সঠিক পথের খেই ধরিয়ে দিতে পেরেছি।
ত্রিকোণমিতি ক্লাসে জেসিকাকে বেশ কৌতূহলী মনে হলো। ও, এঞ্জেলা এবং লরেন আজ পোর্ট এনজেলস যাচ্ছে ডান্স পার্টির পোশাক কেনার উদ্দেশ্যে। আমার পোশাক কেনার প্রয়োজন আছে কিনা, সেটা না ভেবেই ও আশা করেছিলো, ড্রেস কিনতে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে। আমি এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। কিছু মেয়ে বন্ধুর সাথে শহরের বাইরে যেতে পারলে মন্দ হতো না অবশ্য, কিন্তু লরেনও ওদের সাথে থাকছে। তাছাড়া কে জানে আজরাতে আমার জন্যে কী অপেক্ষা করছে… কিন্তু সেটাও যে আমার সঠিক সিদ্ধান্ত তেমন মোটেও বলা যাবে না। অবশ্যই আজকের এই রৌদ্রজ্জ্বল দিন নিয়ে আমি আনন্দিত। তবে ওর সাথে যেতে পারলে আমার এই আনন্দ বাড়বেও না কমবেও না বৈকি।
সুতরাং তার সাথে যাওয়ার ব্যাপারে আমি রাজি হলেও হতে পারি। অবশ্য সবচেয়ে আগে চার্লির অনুমতি নিতে হবে আমাকে।
নাচের ব্যাপারে জেসিকা আমাকে কোনো রকমের ধারণাই দেয়নি। কোনো রকম বিপত্তি ছাড়াই মিনিট পাঁচ দেরি করে স্প্যানিশ ক্লাস শেষ হলো, এবং সবাই আমরা লাঞ্চের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অবশ্য ও আমাকে বিস্তারিত কিছু বলেনি তাতে কিছু যায় আসে না- ও আমাকে যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটাই যথেষ্ট।
ক্যাফেটেরিয়ার এসে এ্যাডওয়ার্ড বাদে কুলিন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখে খানিকটা মর্মাহত হলাম- মনের ভেতর যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে, তার সাথে ওদের আমি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ক্যাফেটেরিয়ার দরজা পেরুনোর সময় তীব্র একটা আতঙ্ক এসে গ্রাস করলো আমাকে। আতঙ্কের একটা অদ্ভুত অনুভূতি সমস্ত মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে পেটের কাছে এসে খামচে ধরলো। ওদের দেখে এভাবে আতঙ্কিত হওয়া এটাই আমার প্রথম। আমি চিন্তা করছি ওদের পক্ষে কি তা জানা সম্ভব? এরপরই আরেকটা চিন্তা এসে মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো- এ্যাডওয়ার্ড কি আবার কখনো আমার পাশে এসে বসবে?
নিয়মিত অভ্যেসে প্রথমেই আমি কুলিন পরিবারের সদস্যদের বসে থাকা টেবিলটার দিকে আড়চোখে আরেকবার তাকালাম। কিন্তু এবারো আতঙ্কে পেটের কাছে মোচড় দিয়ে উঠলো। কুলিন ব্রাদার্সরা যেখানে মুহূর্তখানিক আগেও বসে ছিলো, সেটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। ক্যাফেটেরিয়ার চারদিকে আমি নজর বুলিয়ে নিলাম- মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো কোথাও এ্যাডওয়ার্ড আমার জন্যে একাকী বসে আছে। ক্যাফেটেরিয়া এখন প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে স্প্যানিশ ক্লাস আমাদের দেরি করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড কিংবা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
জেসিকার সাথে পা মিলিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম। ওর কোনো কথাই আমার কানে ঢুকলো না।
আমরা এতোটাই দেরি করে ফেলেছি যে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের টেবিলে এসে ভিড় জমিয়েছে। মাইকের পাশে জেসিকাকে বসার সুযোগ করে দিয়ে এঞ্জেলার পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, মাইক খুব দ্রভাবে তার পাশের চেয়ারে জেসিকাকে বসার জন্যে অনুরোধ জানালো।
ম্যাকবেথ পেপার নিয়ে এলো আমাকে বেশকিছু প্রশ্ন করলো। চরম দুর্দশার মধ্যেও আমাকে একে একে তার প্রশ্নের জবাব দিতে হলো। এঞ্জেলাও আজ রাতে ওদের সাথে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানালো। ওর প্রস্তাবে এখন রাজি হয়ে গেলাম। আসলে আমি যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে চাই, সেগুলোকেই আমার আঁকড়ে ধরতে হয়।
যতোটুকু আশা ছিলো, বায়োলজি ক্লাসে ঢুকে ততোটুকুও মন থেকে মুছে গেল, আমি ওর চেয়ারটা খালি দেখতে পেলাম এবং নতুনভাবে আমাকে হতাশা ঘিরে ধরলো।
দিনের বাকিটা সময় আমার ধীর এবং হতাশায় কেটে গেল। জিম্-এ ব্যাডমিন্টনের ওপর আমাদের একটা লেকচার কোণানো হলো। এটাও আমার কাছে আরেক ধরনের অত্যাচার বলে মনে হলো। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে লেকচার কোণা অত্যাচার ছাড়া আর কি হতে পারে! এর চাইতে চুপচাপ বসে থাকা অথবা লেকচার কোণা বাদ দিয়ে কোর্টের চারদিকে ঘুরে বেড়ানো অনেক আনন্দের। ব্যাডমিন্ট খেলার আসল কলা-কৌশল সম্পর্কেই আজ আর কিছু বললেন না কোচ। সুতরাং আগামীকালও জিম এ হয়তো আমার একইভাবে কাটাতে হবে। তবে এই লেকচারের চাইতে সমস্ত ক্লাসে যদি আমার হাতে র্যাকেট ধরিয়ে দেয়, তাহলে সেটাতে আমি বেশি খুশি হবো।
ক্যাম্পাস ছাড়তে পেরে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগলো। আজরাতে জেসিকা এবং তার বন্ধুদের সাথে দোকানে যাচ্ছি পোশাক কেনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু চার্লির বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে জেসিকা ফোঁস করে জানিয়ে দিলো যে, তাদের পোশাক কিনতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছে। মাইক আমাকে ডিনারে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো ভেবে নতুনভাবে ভালো লাগলো- একই সাথে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত ও আসল সত্য অনুধাবন করতে পেরেছে কিন্তু নিজেকে মুক্ত রাখার জন্যে জেসিকাকে নিয়ে যে মিথ্যে বলেছি, তা এখনো আমার কানে বাজছে। জেসিকা অবশ্য তাদের পোশাক কিনতে যাওয়ার পরিকল্পনা একদিন মাত্র পিছিয়ে দিয়েছে।
বিষয়টা আমাকে খানিকটা হতাশই করলো। এরই মধ্যে ডিনারের জন্যে আমি মেনিরেট তৈরি করতে শুরু করলাম। আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম ডিনারে রুটি এবং সালাদ ছাড়া আর তেমন কিছুই করবো না, সুতরাং এতে পরিশ্রমের তেমন কিছুই নেই। ডিনারের প্রস্তুতি সেরে আধ ঘণ্টা হোমওয়ার্ক এর প্রতি মনোযোগ দিলাম। ই মেইল চেক করে, মার লেখা আগের চিঠিগুলো পড়তে লাগলাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি দ্রুত জবাব দিতে বসলাম।
মা,
দুঃখিত। আমি বাইরে ছিলাম। কয়েকজন বন্ধুর সাথে আমি বীচ-এ বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাছাড়া আমাকে একটা লেখার কাজও শেষ করতে হয়েছে। আমার জবাবদিহি অবশ্য হয়তো তোমার কিছুটা দুঃখ লাঘব করবে।
আমার ধারণায় এখানে আসার পর সবচেয়ে সুন্দর একটা দিন এরই ভেতর অতিবাহিত করলাম। তবুও আমি খুবই মর্মাহত। সুতরাং আমাকে বেরুতে হচ্ছে। কেন? যতোটা সম্ভব শরীরটাকে ভিটামিন-ডি-এর ভেতর চুবিয়ে নেবার জন্যে। আমি তোমাকে ভালোবাসি মা।
—বেলা।
ঠিক করলাম, ঘণ্টাখানিক আমি গল্প-উপন্যাস কিছু একটা পড়ে কাটিয়ে দিবো। ফরস্-এ আসার সময় ওগুলো আমার সাথে এসেছে। এর ভেতর জে অস্টিন-এর রচনা সমগ্র অন্যতম। সমগ্রের ভেতর থেকে একটা খণ্ড বেছে নিয়ে পেছন দিকে রওনা হলাম।
বাড়ির বাইরে চার্লির ছোটো একটা আঙ্গিনা। গাছের ছায়ায় মাদুর পেতে নিলাম। ঘন ঘাসে আবৃত লন সবসমই আমার কাছে খানিকটা আদ্র মনে হয়। তা যতোই সূর্যের আলো থাকুক না কেন। পেটের ওপর উবু হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম, আর একই সাথে পা-জোড়া দোলাতে লাগলাম। এই খণ্ডে অনেকগুলো উপন্যাস। কোনটা আগে শুরু করবো, তা নিয়ে খানিকক্ষণ আমাকে ভাবতে হলো। জেন অস্টিনের আমার প্রিয় দুই উপন্যাস হচ্ছে “প্রাইড এ্যান্ড প্রেজুডিস” এবং “সেনস্ এ্যান্ড সেনসিবিলিটি”। প্রথমটা আমি অতি সম্প্রতি শেষ করেছি, সুতরাং দ্বিতীয়টাই পড়তে শুরু করলাম। তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্যন্ত পড়ার পর বুঝতে পারলাম এখানে কাহিনীর কেন্দ্রিয় চরিত্রের নাম হচ্ছে এ্যাডওয়ার্ড। উত্তেজিত এবং খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ে “সেনস এ্যান্ড সেনসিবিলিটি” পড়া বাদ দিয়ে শুরু করলাম “ম্যানফিল্ড পার্ক” কিন্তু এই কাহিনীর কেন্দ্রিয় চরিত্র হচ্ছে এ্যাডমুন্ড, এবং তা নিঃসন্দেহে এ্যাডওয়ার্ড-এর কাছাকাছি একটা নাম। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এ ধরনের নাম ছাড়া আর কি কোনো নাম ছিলো না? ধুপ করে বইটা বন্ধ করে এক পাশে রেখে উঠে বসলাম। জামার হাতা যতোটা সম্ভব গুটিয়ে নিয়ে আমি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে আমি মাথায় কোনো চিন্তা না আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু চামড়ায় উষ্ণতা অনুভব করায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। এখনো মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, কিন্তু ওই হালকা বাতাসেই বারবার চুল উড়ে এসে পড়ছে আমার মুখের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই বেশ বিরক্ত লাগছে এতে। চুলগুলো জড়ো করে মাথার পেছন দিকে নিয়ে গেলাম। ওগুলো মাথার ওপর পাখার মতো উড়তে লাগলো। চোখের পাতা, চিবুক, নাক, ঠোঁট, কুনুই, গলা, হালকা স্বচ্ছ জামার ওপর বাতাসে আবার উড়ে এসে চুলগুলো হালকা পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো…
এরপরই শুনতে পেলাম ইটের রাস্তার ওপর দিয়ে চার্লির ক্রুজার এগিয়ে আসার শব্দ। আমি অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সূর্যের আলো পেছনের গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম আমি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হতবুদ্ধের মতো চারদিকে একবার নজর বুলালাম, অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হলো আমার ভেতর। আমি এখন মোটেও একা নই।
“চার্লি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু আমি সামনের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি লাফিয়ে উঠলাম, অযথাই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, সঁাতাতে মাদুর এবং বইগুলো গুছিয়ে নিলাম। দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভের ওপর কিছু তেল গরম করার জন্যে চাপিয়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম ডিনার তৈরি হতে অনেক সময় লেগে যাবে। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম চার্লি গান বেল্ট হুকে ঝুলিয়ে রেখে জুতা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
“বাবা দুঃখিত, এখনো কিন্তু ডিনার তৈরি করা হয়নি বাইরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” আড়চোখে তাকিয়ে আমি তাকে বললাম।
“ওটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না,” চার্লি বললেন। “আমি খেলার ফলাফল জানার চেষ্টা করছি আপাতত।”
ডিনারের পর চার্লির সাথে বসে টিভি দেখতে বসলাম। আসলে কিছু একটা করা দরকার। আমার অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠান দেখার নেই, কিন্তু তিনি ভালোভাবে জানেন বেসবল আমার পছন্দের নয়। সুতরাং খেলা পাল্টিয়ে তিনি অন্য সব অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আমাদের আনন্দ দিতে পারলো না। তবে তাকে খানিকটা আনন্দিত মনে হলো এই ভেবে যে, আমরা অন্তত একসাথে বসে কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি। এভাবে হয়তো আমার মন খানিকক্ষণের জন্যেও ভালো লাগবে।
“বাবা” একটা কমার্শিয়াল ব্রেকের মাঝখানে আমি কথাটা বলার সুযোগ পেলাম। “আমার বান্ধবীরা কালকের রাতের ডান্স পার্টির জন্যে পোর্ট-এঞ্জেলেস থেকে কিছু পোশাক কিনতে চাইছে। কিছু পোশাক নির্বাচন করে দেবার জন্যে ওরা আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চায়… আমি যদি ওদের সাথে যাই, তাহলে কি তুমি কিছু মনে করবে?”
“জেসিকা স্টেলি?” তিনি প্রশ্ন করলেন।
“এবং এঞ্জেলা ওয়েবার।” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিস্তারিত জানালাম।
তাকে খানিকটা বিভ্রান্ত মনে হলো। “কিন্তু তুমি তো ডান্স পার্টিতে যেতে চাইছো না, ঠিক কিনা?”
“না না বাবা, যেতে চাইছ না বটে, কিন্তু ওদের আমি ড্রেস পছন্দ করতে সাহায্য করবো- তুমি তো জানোই ওদের সমালোচনা করার একটা সুযোগ পেয়েছি, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত।”
“ভালো কথা, তুমি যেতে পারো।” তাকে দেখে মনে হলো এসব মেয়েলি ব্যাপার এড়াতে পারলেই যেন তিনি বেঁচে যান। “স্কুল শেষে রাতেই যাচ্ছো নিশ্চয়ই?”
“আমরা স্কুল শেষ হওয়ার সাথে সাথে রওনা হবো। তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরেও আসতে পারবো। তুমি কষ্ট করে ডিনারের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে আশাকরি?”।
“বেলা, তুমি এখানে আসার সতেরো বছর আগে থেকেই আমার নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারি, চার্লি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।
“আমি ঠিক জানি না তুমি কীভাবে বাঁচবে!” আমি বিড়বিড় করলাম। এরপর স্পষ্টভাবে বললাম, “আমি ফ্রিজে কিছু স্যান্ডুইচ তৈরি করে রেখেছি। ফ্রিজের ওপর তাকে আছে, ওগুলো ঠাণ্ডা। গরম করে নিতে হবে, বুঝেতে পারলে?”
.
পরদিনও রৌদ্রজ্জ্বল একটা সকাল পেলাম আমি। স্কুলে ফিরে হতাশ হতে হবে না এমন আশা নিয়ে আমার ঘুম ভাঙলো। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে আমি আজ পোশাক হিসেবে নির্বাচন করেছি একটা গাঢ় নীল রঙের ভী-কাট ব্লাউজ। ফিনিক্সে থাকতে শীতের শেষে এ ধরনের পোশাক পরতাম।
ক্লাসের যেন দেরি না হয় সেই চিন্তা করে একটু আগেই স্কুলে এসে উপস্থিত হলাম। ভগ্ন হৃদয়ে, স্কুলের খোলা জায়গাটার চারদিকে নজর বুলিয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম। পার্কিং লট-এ রুপালি রঙের ভলভোটাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাঙ্খিত ব্যক্তি কিংবা গাড়ি কোনো কিছুই নজরে এলো না আমার। শেষ সারিতে আমি গাড়িটা পার্ক করে ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে প্রবেশ করলাম। শেষ ঘণ্টা বাজা পর্যন্ত প্রায় নিঃশ্বাস চেপে বসে থাকলাম।
আজকের দিনটাও গতকালের মতোই কেটে গেল। আমার মনে সামান্য একটু আশার আলোও জাগাতে পারলাম না। লাঞ্চরুম থেকে ফিরে আমার খালি বায়োলজি টেবিলে এসে বসলাম।
আজরাতে পোর্ট এঞ্জেলসে যাওয়ার চিন্তাটা আবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সবই ঠিক আছে, শুধু লরেনকে নিয়ে আমার যা চিন্তা। শহর থেকে বেরুবার জন্যে আমিও উল্কণ্ঠিত হয়ে আছি। সুতরাং চারদিকে তাকিয়ে আগের মতোই তাকে খুঁজতে লাগলাম। যথা সম্ভব মনটা চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করলাম যেন এঞ্জেলা অথবা জেসিকার পোশাক কিনতে যাওয়ার সময় যেন মন খারাপ না হয়। সম্ভবত আমিও তাদের সাথে কয়েকটা নতুন পোশাক কিনতে পারি। এই উইকেন্ডে একাএকা সিয়েটেল থেকে পোশাক কেনা যেতে পারে, এমন চিন্তা মন থেকে ঝেরে ফেললাম। আগে যেমন চিন্তা করেছিলাম, এখন আর তা চিন্তা করছি না। অবশ্য মনে ক্ষীণ আশা থেকেই গেছে যে, আমাকে কিছু না বলে হয়তো সে পরিকল্পনাটা বাদ দেবে না।
স্কুল ছুটির পর ও আমার পেছন পেছন ওর মার্কারি নিয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এলো। বইপত্র এবং গাড়িটা রাখার জন্যে। বাড়িতে ঢুকে দ্রুত চুল আঁচড়ে নিলাম ফর থেকে বেরুতে পেরে মনের ভেতর আবার খানিক উত্তেজনা কাজ করছে। চার্লির জন্যে টেবিলের ওপর একটা নোট রেখে দিলাম, নোটে আবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম কোথায়, কীভাবে আমি ডিনারের ব্যবস্থা করে রেখেছি। এরপর দ্রুত ব্যাগের ভেতর থেকে টাকা ভর্তি পার্সটা বের করে নিলাম। এটা আমার খুব কমই ব্যবহার করা হয়। জেসিকাকে নিয়ে এরপর আমাকে এঞ্জেলার ওখানে যেতে হবে, ও আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। ফর সীমানা থেকে বেরুতে পেরে আমার ভেতর আলাদা এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো।
.
০৮.
জেস চিফের চাইতেও অনেক দ্রুত গাড়ি চালায়, সুতরাং আমরা বারোটার ভেতরেই পোর্ট এঞ্জেলে পৌঁছে যেতে পারলাম। বড়ো হওয়ার পর এবারই বোধহয় প্রথম আমি রাতের অনেকটা সময় বাইরে কাটাবো। ইস্ট্রোজেনের কারণে নিজের ভেতর যে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে, ইতোপূর্বে কখনো তা হয়নি। জটলা পাকানো কতোগুলো ছেলের পাশ দিয়ে জেসিকা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবার সময় রক-মিউজিক শুনতে পেলাম। মাইকের সাথে জেসিকা ডিনার পর্ব বেশ ভালোভাবেই কাটিয়েছে এবং আশা রাখে, আসছে শনিবার রাতে তাদের সম্পর্কটা প্রথম চুমু পর্যন্ত গড়াতে পারে। আমি সন্তষ্ট হয়ে মনে মনে হাসলাম। নাচের আসরে যেতে পেরে এঞ্জেলাকে নিঃসন্দেহে খুশিই মনে হচ্ছে, তবে এরিকের ব্যাপারে তার ভেতর তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ করলাম না। জেসের যেমন স্বভাব, তেমনভাবেই বকবক করতে লাগলো। আমি অবশ্য পোশাকের প্রসঙ্গ টেনে এনে ওর আলোচনার মোড় ঘুরানোর চেষ্টা করলাম। এঞ্জেলা আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো।
পোর্ট এঞ্জেলেসকে পর্যটক ধরার ফাঁদ বলা যেতে পারে। তাছাড়া ফর থেকে এই শহর অনেক বেশি সুবিন্যস্ত এবং পরিচ্ছন্ন। কিন্তু জেসিকা এবং এঞ্জেলা এই শহরে নতুন নয়। সুতরাং রাস্তার পাশের বিজ্ঞাপন বোর্ডগুলো দেখে ওদের সময় নষ্ট করার প্রয়োজন হলো না। শহরের অন্যতম বড়ো একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে সরাসরি গিয়ে গাড়ি দাঁড় করলো জেস্।
ওরা যাতে অংশ নিতে যাচ্ছে, তা একটা উপ-আনুষ্ঠানিক নাচের আসর। আমরা অবশ্য এর সঠিক অর্থ জানি না। ফিনিক্স-এ কখনো আমি কোনো নাচের আসরে অংশ নেইনি শুনে জেসিকা এবং এঞ্জেলা উভয়েই বেশ অবাক হলো।
“তুমি কি কখনোই কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে কোথাও বেড়াতে যাওনি কিংবা তেমন কোনো কিছুই করোনি?” স্টোরের সামনের দরজার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় জেস আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“সত্যিই,” আমি বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করলাম। আমার যে নাচতে ভালো লাগে সেটা বলে আর তাকে বিভ্রান্ত করতে চাইলাম না। “আমার কখনোই কোনো ছেলে বন্ধু কিংবা তেমন কিছু ছিলো না। বাড়ির বাইরেও আমি খুব একটা বেড়াতে বের হই নি।”
“কেন?” জেসিকা জানতে চাইলো।
“কেউ আমাকে যাবার জন্যে বলেনি,” যা সত্যি সেটাই বললাম তাকে।
জেসিকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। “এখানকার লোক তোমাকে বাইরে বেরুবার প্রস্তাব জানাবে,” ও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলো, “এবং তুমি এককথায় তাদের প্রস্তাব অস্বীকার করবে।” জেসিকা উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে বললো। আমরা এখন স্টোরের জুনিয়র সেকশনে অবস্থান করছি।
“শুধুমাত্র ব্যতিক্রম টাইলার, এঞ্জেলা শান্ত কণ্ঠে মন্তব্য জানালো।
“ক্ষমা করবে?” আমি গভীরভাবে নিঃশ্বাস টানলাম। “তুমি কি যেন বললে?”
“টাইলার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, যে কোনো সময় তোমাকে নিয়ে ও বেড়াতে বেরুতে পারে।” সন্দেহজনক চোখে জেসিকা তথ্যটা জানালো।
“কি বলেছে টাইলার?” ভয়ে আমি প্রায় কথাই বলতে পারলাম না।
“আমি এমনি এমনি বললাম। তোমাকে মিথ্যে বলেছি আমি।” জেসিকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো এঞ্জেলা।
আমি একেবারে চুপ মেরে গেলাম। আকস্মিক একটা মানসিক ধাক্কার পর সেটাই মানসিক যন্ত্রণা হয়ে মনের ভেতর খচখচ করছে। কিন্তু এরপরও আমরা র্যাকের পোশাকগুলো দেখতে লাগলাম। অবশ্য এখন সেটাই আমাদের মূখ্য কাজ।
“এ কারণেই লরেন তোমাকে পছন্দ করে না, জেসিকা চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা প্রশমিত করার চেষ্টা করলাম। “তোমার কি মনে হয় টাইলারের ওপর আমার ট্রাকটা যদি চাপিয়ে দিতে পারি, তাহলে ওর বিব্রতবোধ খানিকটা কমবে?”
“সম্ভবত” জে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। “সেটার অপেক্ষাতেই ও আছে বোধহয়।”
পোশাক নির্বচন করতে তেমন একটা সময় লাগলো না, তবে ওরা অন্যান্য কিছু জিনিসও দেখতে লাগলো। ড্রেসিং রুমের পাশে রাখা একটা চেয়ারে আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। স্থানটার তিনদিকে আয়নায় ঘেরা। আমি ওই চেয়ারে বসে মনের ভেতর চেপে বসা উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করতে লাগলাম শুধু।
জেসের দুইটা পোশাক পছন্দ হয়েছে। কোনটা নেবে, সেটা নিয়েই এখন দোটানায় আছে। একটা দীর্ঘ ঘের ওয়ালা ফিতা ছাড়া গাঢ় কালো রঙের পোশাক, অন্যটা উজ্জ্বল সমুদ্র নীল রঙের ঘাগড়া। তবে পোশাকটা একটু খাটো হাঁটুর ওপর পর্যন্ত। আমি তাকে নীলটাই পছন্দ করতে বললাম। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো পোশাক হলে আপত্তি কোথায়? এঞ্জেলা পছন্দ করেছে হালকা গোলাপি রঙের একটা পোশাক। ঘন মধুর মতো সোনালি চুল আর দীর্ঘ দেহের সাথে আমার ধারণায় পোশাকটা ওকে চমৎকার মানাবে। মন থেকেই আমি ওদের পোশাকের ব্যাপারে মন্তব্য করলাম, তাছাড়া অপছন্দের কাপড়গুলো র্যাকে ফিরিয়ে রাখতেও তাদের সাহায্য করলাম। রেনি’র সাথে বাড়িতে থাকতে যতোটা সহজে এবং কম সময়ে কেনাকাটা করতাম, তেমনই কম সময়ে আমরা কেনাকাটা শেষ করতে পারলাম। আমার ধারণায় ছোটোখাটো পছন্দের ক্ষেত্রে তেমন কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন হয় না।
এরপর আমরা জুতা এবং অন্যান্য উপকরণগুলো কেনার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ওদের পছন্দগুলোর দিকে সামান্যই তাকালাম, তেমন কোনো মন্তব্যও করলাম না। আজ আর নিজের জন্যে কোনো কিছুই কেনার ইচ্ছে নেই, যদিও আমার নতুন একটা জুতার প্রয়োজন ছিলো।
“এঞ্জেলা,” যখন ও গোলাপি হাই-হীল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পছন্দের চেষ্টা করছে, আমি ইতস্তত করে কথাগুলো বলার চেষ্টা করলাম- ডেট-এর সময় তাকে অতিরিক্ত লম্বা দেখাবে এ কারণে সম্ভবত সে বেশ খানিকটা উৎফুল হয়ে আছে। জেসিকা বর্তমানে জুয়েলারি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে শুধু আমরা দু’জনই দাঁড়িয়ে আছি।
“হ্যাঁ বলো?” ও তার পা জোড়া সোজা করে বাড়িয়ে ধরে, পা মুচড়িয়ে তার গোড়ালি আমাকে দেখানোর চেষ্টা করলো। আসলে জুতাজোড়া দেখতে কেমন লাগছে, সেটাই তার দেখানোর উদ্দেশ্য।
আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। “ওগুলো আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“আমার মনে হয় ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবো- যদিও ওগুলোকে সব ধরনের পোশাকের সাথে মেলানো খুব কঠিন, কিন্তু একটাই তো পোশাক,” গভীরভাবে চিন্তা করে ও কথাগুলো বললো।
“আরে চিন্তার কিছু নেই, সামনে চলো- ওগুলো ‘সেল’-এ বিক্রি হচ্ছে, আমি তাকে উৎসাহ দিলাম। ও হাসলো, জুতাজোড়া আগের বাক্সে ফিরিয়ে রাখলো। ওতে অনেকগুলো সাদা জুতা।
আমি আবার চেষ্টা করলাম। “উম্… এঞ্জেলা…” ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
“কুলিনের ব্যাপারে বলছিলাম… এটা কি স্বাভাবিক?” জুতোগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম- “ও কি খুব বেশি স্কুলের বাইরে কাটায়?” অনেক চেষ্টা করেও আমার কণ্ঠের কৌতূহল চাপতে পারলাম না।
“হ্যাঁ, যখন আবহাওয়া ভালো থাকে, ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে সমস্ত সময় ওরা বাইরে বেরিয়ে পড়ে- এমনকি ডাক্তার সাহেবও। ওদের প্রত্যেকেই আসলে ভবঘুরে ধরনের, ওর জুতো পছন্দ করতে করতে শান্ত কণ্ঠে ও আমাকে তথ্যটা জানালো। জেসিকা যেমন সমস্ত গোপন তথ্য বের করার আশায় হাজারটা প্রশ্ন করে, তেমনভাবে ও আমাকে কোনো প্রশ্নই করলো না। এঞ্জেলাকে ধীরে ধীরে আমি পছন্দ করতে শুরু করলাম।
“ওহ্!” পাথরের জুয়েলারি দেখে জেসিকাকে ফিরে আসতে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম।
আমরা ঠিক করেছিলাম কোনো ছোটো ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে নেবো, কিন্তু কেনাকাটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। জেস এবং এঞ্জেলা তাদের নতুন কেনা পোশাক গাড়িতে রেখে এলো। এরপর ওরা উপসাগরের দিকে হাঁটতে লাগলো। আমি ওদের জানালাম যে, ঘণ্টাখানেক পর রেস্টুরেন্টে ওদের সাথে আমার দেখা হচ্ছে- আমি বইয়ের দোকানগুলো একটু ঘুরে দেখতে চাই। ওরা অবশ্য আমার সাথে আসতে চাইছিলো, কিন্তু আমি তাদের মতো করে মজা করার জন্যে উৎসাহ জানালাম- বইয়ের রাজ্যে একবার ঢুকে পড়লে, ওগুলো কীভাবে আমাকে মোহিত করে ফেলে, তা ওরা মোটেও জানে না; বই পছন্দের কাজ আমি একা একাই করতে চাই। আনন্দে বকবক করতে করতে ওরা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, এবং জেসিকার দেখিয়ে দেয়া পথে বইয়ের দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বইয়ের দোকান খুঁজে বের করতে আমাকে তেমন বেগ পেতে হলো না, অবশ্য যেমন খুঁজছিলাম এটা তেমন নয়। দোকানের সমস্ত জানালা ক্রিস্টালে ঢাকা। হালকাভাবে দেখতে পেলাম আধ্যাত্মিক বিষয়ের ওপর বেশকিছু বই সাজানো। এই অবস্থায় আমার ভেতরে ঢুকতে পর্যন্ত ইচ্ছে করলো না। যদিও ঝাপসা কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখতে পেলাম পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব এক ভদ্র মহিলা পেছন ফিরে বসে আছেন। মহিলার ধূসর দীর্ঘ চুল পিঠের ওপর সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে আছে। মহিলার পরনে যে পোশাক নিঃসন্দেহে তা ষাট দশকের। আমাকে দেখতে পেয়ে কাউন্টার থেকে তিনি আমন্ত্রণ সূচকভাবে একটু হাসলেন। আমার মনে হলো তার সাথে কথা না বললেও বোধহয় না তেমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে। এই শহরে সাধারণ কোনো বইয়ের দোকান নিশ্চয়ই আছে।
আমি রাস্তার দিকে তাকালাম, কর্ম দিবসের কারণে রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে। মনে মনে ঠিক করলাম ডাউন টাইনের দিকে কোনো বইয়ের দোকানের খোঁজ করবো। অবশ্য আমি কোন্ দিকে যাচ্ছি, সে দিকে আমার কোনো মনোযোগই নেই; আমি বোধহয় অদৃশ্য হওয়ার চেষ্টা করছি। ওর সম্পর্কে আমার মোটেও চিন্তা করার ইচ্ছে নেই, তবে এঞ্জেলা যেমন বললো… এবং শনিবার নিয়ে আমার যতোটুকু আশা ছিলো, তা আরো স্তমিত হয়ে এসেছে। পরক্ষণেই আমি ভয়ে প্রায় শিউরে উঠলাম। রাস্তার পাশে কেউ একজন রুপালি রঙের একটা ভলভো এনে দাঁড় করালো। শুধুমাত্র একটা বিষয়ই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, অবিশ্বাসী ভ্যাম্পায়ারটা নয়তো?
দ্রুত আমি দক্ষিণে রওনা হলাম। কাঁচ ঘেরা কয়েকটা দোকান দেখে আমার ভালো লাগলো- আশা করলাম, সেখান হয়তো ভালো লাগা কিছু পেয়ে যেতে পারি। কিন্তু কাছে গিয়ে একেবারে হতাশ হতে হলো- বুঝতে পারলাম, ওগুলো মেরামতের দোকান, তার ভেতর আবার কিছু খালি পড়ে আছে।
জেস এবং এঞ্জেলাকে খুঁজতে যাওয়ার এখনো সময় হয়নি, কিন্তু খুব দ্রুত ওদের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। চুলের ভেতর খানিকক্ষণ চিরুনীর মতো আঙ্গুলগুলো চালিয়ে নিলাম এবং কোণার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার গভীরভাবে নিঃশ্বাস টেনে নিলাম।
বুঝতে পারলাম আমি ভুল রাস্তা পার হয়ে এসেছি, ফলে ভুল দিকে এগুচ্ছি। উত্তর দিকে কিছু মানুষ হেঁটে চলেছে। চারদিকে তাকিয়ে মনে হলো এগুলোর বেশিরভাগই হয়তো ওয়্যার হাউস। পরবর্তী কোণায় এসে আমি পূর্বদিকে মোড় নিলাম এবং কয়েক ব্লক পার হয়ে, ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন একটা পথ ধরলাম।
কোণার দিকে এগুনোয় দেখতে পেলাম, চারজন ছেলে জটলা পাকিয়ে আছে, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সাধারণ পোশাক সব, কিন্তু ওদের টুরিস্ট বলে মনে হলো না আমার কাছে। কাছাকাছি এগিয়ে আসার পর বুঝতে পারলাম, আমার চাইতে ওদের বয়স খুব একটা বেশি হবে না- খুব জোর বছর চারেকের বড়ো। নিজেদের ভেতর ওরা হাসি-তামাশা করছে এবং একজন আরেক জনের হাত ধরে টানাটানি করছে। যতোটা সম্ভব সাইড ওয়াকে আমি চেপে দাঁড়ালাম যেন ওরা আমার পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। ওদের আমি কোণার দিকে চলে যেতে দেখলাম।
“এই যে ওখানে যাবে?” পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো। ও যখন এ ধরনের প্রস্তাব জানালো, দেখলাম আশপাশে কেউই নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমি তার দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম। ওদের দু’জন ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর দু’জনের হাঁটার গতি কমিয়ে এনেছে। কাছের ছেলেটার মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। পরনে একটা ময়লা টি-শার্টের ওপর ফ্লেনালের জামা, ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট এবং স্যান্ডেল। ও খানিকটা আমার দিকে এগিয়ে এলো।
“হ্যালো,” আমি বিড়বিড় করে বলতে বাধ্য হলাম, যদিও হাঁটুর কাছে আমার খানিকটা কাঁপতে লাগলো। এরপর চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে দ্রুত কোণার দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার পেছনে উচ্চ স্বরে ওদের হাসতে শুনলাম।
“এ্যাই, দাঁড়াও!” ওদের একজন আবার আমাকে ডাকলো, কিন্তু আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে কোণার দিকে হাঁটতে লাগলাম। খানিকক্ষণের জন্যে আমি স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার পেছনে এখনো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেই যাচ্ছে।
আমি দেখতে পেলাম সাইড-ওয়াকের যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার পেছনে অনেকগুলো বিভিন্ন রঙের ওয়্যার হাউস। ট্রাকের জিনিস নামানোর জন্যে প্রত্যেকটাতেই বিশাল সব জালের দরজা-রাতের নিরাপত্তার জন্যে দরজার সাথে প্যাডলক আটকানো। দক্ষিণের রাস্তায় কোনো সাইড ওয়াক নেই, শুধুমাত্র চেইন দিয়ে ঘেরা খোলা একটা অংশে বেশকিছু যন্ত্রপাতি রাখা। বুঝতে পারলাম চারদিক ঘিরে আবার অন্ধকার নেমে আসছে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো মেঘগুলো পুঞ্জিভূত হতে শুরু হয়েছে। পশ্চিমে মেঘগুলো পুঞ্জিভূত হয়ে সূর্যাস্তকে ত্বরান্বিত করে আনছে। পূর্বের আকাশ অবশ্য এখনো পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছি তবে খানিকটা ধুসর বর্ণের, তার মাঝে মাঝে গোলাপি এবং কমলার রেখা। জ্যাকেটটা আমি গাড়িতে রেখে এসেছি। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস শুরু হওয়ায় হাতজোড়া আমি বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে চেপে ধরলাম। অনেকক্ষণ বাদে মাত্র একটা ভ্যান আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল এবং এরপরই রাস্ত টিা আবার ফাঁকা হয়ে গেল।
অল্পক্ষণের ভেতর আকাশ আরো ঘন কালো হয়ে এলো। ঘাড় উঁচু করে আকাশের প্রকৃত অবস্থা বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম। আমি আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলাম, ওদের দু’জন ফুট বিশেক দূরত্ব বজায় রেখে আমার পেছন পেছন হেঁটে আসছে।
কোণার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় যাদের আমি দেখেছিলাম, এ দু’জন ওদের দলেরই সদস্য। যদিও অন্ধকারের কারণে বুঝতে পারলাম না কোন জন আমার সাথে কথা বলেছিলো। আমি সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, নিজেকে যতোটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডা দমকা বাতাসে আমি আবার শিউরে উঠলাম। আমার টাকা ভর্তি পার্সটা বুকের সাথে ফিতা দিয়ে ভালোভাবে আটকানো আছে। ফলে সহজে কেউ ওটা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমার মরিচের গুড়ো মেশানো পিচকারী কোথায় আছে, এখন মনে পড়ছে– ওটা একটা ব্যাগের ভেতর বিছানার নিচে রাখা আছে, ওটা এখন পর্যন্ত ভোলাই হয়নি। সাথে আমার খুব বেশি টাকাও নেই, খুব জোর বিশ কিংবা তার চাইতে সামান্য কিছু বেশি হবে। একবার মনে করলাম ইচ্ছেকৃতভাবে টাকার ব্যাগটা ফেলে হাঁটতে থাকবো। কিন্তু মনের অজান্তে কে যেন আমাকে সাবধান করে দিল, ওদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ছিনতাই নয়, ওদের মনে হয়তো খারাপ কোনো উদ্দেশ্য আছে।
আমার পেছনে ওদের ধীর পদশব্দ শুনতে পেলাম। আগের সেই হৈ-হুঁলার তুলনায় এই শব্দ তুলনামূলকভাবে অনেক শান্ত, তাছাড়া ওরা তাদের গতি বাড়ানোর চেষ্টাও করছে না, অথবা আমার একেবারে কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টাও করছে না। অযথাই হয়তো ভয় পাচ্ছি, মনে মনে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করলাম। আসলেই আমি জানি না, আদৌ ওরা আমাকে অনুসরণ করছে কিনা। দৌড়ের গতিতে নয়, তবে যতোটা সম্ভব দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। যতোটা দূরত্ব মেপে আমার পেছন পেছন আসছিলো, তেমন ভাবেই আসছে বটে, তবে ওদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। দক্ষিণের রাস্তা থেকে একটা গাড়ি দ্রুত ছুটে এসে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একবার ভাবলাম ওই গাড়ির ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমাকে খানিকটা ইতস্তত করতে হলো, কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় এতেই আমার বিপদ কেটে যাবে, তাছাড়া অনেক দেরি হয়ে গেছে এতোক্ষণে।
অবশেষে কোণার দিকের একটা স্থানে এসে পৌঁছলাম, কিন্তু দ্রুত চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নেবার পর বুঝতে পারলাম কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে গলির পথ এখানেই শেষ হয়ে গেছে। খানিক ঘুরে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করলাম; যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। এখন সোজা গাড়ি চলার সরু পথটার দিকে ছুটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তারপর সেখান থেকে আবার সাইড ওয়াক্-এ উঠতে হবে। ওই রাস্তা আবার পরের কোণায় গিয়ে শেষ হয়েছে। দেখতে পেলাম ওখানে একটা “স্টপ” সাইনবোর্ড লাগানো। পেছনে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দের দিকে আবার মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম, চিন্তা করলাম, যেমন এগুচ্ছি তেমনভাবেই এগুতে থাকবো, নাকি সোজা দৌড় দিবো। আবার তারা আগের মতোই উচ্চ কণ্ঠে চিৎকার জুড়েছে। আমি বুঝে ফেলেছি ওরা সহজে আমার পিছু ছাড়বে না। মনে মনে ভাবলাম পাখির মতো যদি উড়ে যেতে পারতাম! উড়তে পারলাম না বটে, তবে ছুটতে শুরু করলাম। মনে হলো পেছনের পায়ের শব্দ দূরে ফেলে আসতে পেরেছি। ঘাড় উঁচু করে চারদিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে নিলাম, এখন প্রায় ওদের কাছ থেকে চলিশ ফুট দূরে সরে আসতে পেরেছি, খানিকটা হলেও স্বস্তিবোধ করছি এখন। কিন্তু এখনো ওরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
মনে হলো সারাজীবন বুঝি আমাকে এই কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমার হাঁটার গতি কমিয়ে আনলাম। এখন ওদের পায়ের প্রতিটা পদক্ষেপের শব্দ কানে ভেসে আসছে। সম্ভবত বুঝতে পেরেছে, ওরা আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে। আমি দেখতে পেলাম দুটো গাড়ি উত্তরের ইন্টারসেকশনের দিকে চলে গেল, আমি ওগুলোর দিকে তাকালাম। খানিকটা হলেও স্বস্তি অনুভব করলাম। একটু চেষ্টা করলেই হয়তো আশপাশে কিছু মানুষ পেয়ে যেতে পারি। মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ রাস্তার ভেতর কাউকে খুঁজে পাবো না এমন তো হওয়ার কথা নয়! দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আমি আবার কোণার দিকে এগিয়ে গেলাম।
এরপর আবার থেমে গেলাম।
রাস্তার উভয়দিকই ফাঁকা, দরজাবিহীন, জানালাবিহীন দেয়ালের সারি। দুরে, ইন্টারসেকশনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম স্ট্রীটল্যাম্পস, গাড়ি এবং বেশ কিছু স্তম্ভ, কিন্তু এর সবই আমার কাছে বেশ দূরে বলে মনে হলো। কারণ পশ্চিম দিকের মাথা উঁচু করে থাকা বাড়িগুলো এক ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছে। রাস্তার মাঝামাঝি এসে, অন্য দু’জনও তাদের সাথে যোগ দিলো। আমি সাইডওয়াকে দাঁড়িয়ে আছি। আর ওরা আমার দিকে তাকিয়ে উচ্চ কণ্ঠে হাসছে। আর আমাকে ভয় তাড়া করে ফিরছে।
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে দাঁড়ালাম, কিন্তু মনে হলো অনেকক্ষণ বুঝি দাঁড়িয়ে আছি। এরপর ঘুরে রাস্তার অন্যদিকে রওনা হলাম। যদিও মনে হলো এই চেষ্টা করে আসলে কোনো লাভই হবে না। পেছনের পায়ের শব্দ এখন বেশ জোরে শুনতে পাচ্ছি আমি।
“এই যে শোনো!” গাট্টাগোট্টা শরীরের কালো চুলের ছেলেটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো। ধীরে ধীরে ও আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সাথে সাথে আমি লাফিয়ে উঠলাম। জমে থাকা অন্ধকারের ভেতরও মনে হলো ইতোপূর্বে হয়তো ও আমাকে দেখেছে।
“হ্যাঁ,” পেছন থেকে কে যেন আমাকে ডাকলো। আতঙ্কে আবার প্রায় লাফিয়ে উঠলাম, দ্রুত রাস্তার দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। “আমরা সামান্য একটু দেহের বাঁক দেখতে চাইছিলাম।”
আমার গতি এখন অনেক কমে গেছে, ফলে অলসভাবে এগিয়ে দু’জনের সাথে আমার দূরত্বও ক্রমশই হ্রাস পেতে শুরু করেছে। আমি খুব জোরে চিৎকার করতে পারি, গভীরভাবে নিঃশ্বাস টেনে একবার খুব জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার গলা এতোটাই শুকিয়ে গেছে যে, ঠিক বুঝতে পারলাম না আদৌ কতোটা জোরে চিৎকার করতে পারবো। খুব দ্রুত মাথার ওপর দিয়ে পার্সটা বের করে এনে ফিতাটা শক্তভাবে চেপে ধরলাম। প্রস্তুতি নিলাম, হয় জিনিসটা ওদের হাতে তুলে দিবো, নয়তো জিনিসটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো।
আমি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যাওয়ায়, হোল্কা শরীরের ছেলেটা দেয়ালে হেলান দিয়ে শ্রাগ করলো। আমি খানিকটা সরে রাস্তায় নেমে এলাম।
“আমার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করো!” নির্ভীক ভরাট কণ্ঠে আমি সাবধান করে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম, আমার ধমক তেমন জোরালো হলো না। গলা শুকিয়ে আসায় আমার গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চাইলো না।
“মিষ্টি মেয়ে, এমন করতে হয় না,” অশালীল মন্তব্য করলো আমার প্রতি, আর সাথে সাথে পেছনে হাসির হুড়ে শুনতে পেলাম আমি।
আমি পা দুটো ফাঁক করে থমকে দাঁড়ালাম। মনে মনে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম আত্নরক্ষার কোন কোন কৌশল আমার জানা আছে। সোজা আপার-কাট হাত চালিয়ে নাক ভেঙে ফেলা সম্ভব, অথবা মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা যেতে পারে তেমনভাবে আঘাত করতে পারলে মাথার ভেতরকার মগজ এলোমেলো হয়ে যায়। আঙ্গুল সোজা রেখে চোখের ভেতর বিধিয়ে দেয়া অথবা সজোরে চোখের ওপর খামচি মারা। এ ধরনের আঘাতে চোখের মণি ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া অবশ্যই হাঁটুর ওপর মোক্ষম আঘাত। যে মস্তিষ্ক আত্নরক্ষার কৌশলগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে আমাকে সাহায্য করেছিলো, সেই মস্তিষ্কই আবার আমাকে সাবধান করে দিলো। এইসব আত্নরক্ষার কৌশল একজনের ওপর খুব সহজেই হয়তো প্রয়োগ করা যায়, কিন্তু একারপক্ষে চারজনের ওপর কখনোই নয়। চুপ করো! নতুনভাবে আতঙ্ক এসে আমাকে ঘিরে ধরার আগেই নিজেকে নিজেই শাসন করার চেষ্টা করলাম। আমার সাথে আর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিবো না। আমি জোরালো যে চিঙ্কারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তা গিলে ফেললাম যেন।
হঠাৎ কোণার দিকে হেডলাইটের আলোয় চারদিক উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠলো, হঠাৎ ছুটে এসে গাড়িটা গাট্টাগোট্টা একজনকে সজোরে ধাক্কা মারলো। আকস্তিক ওই ভোটুকু সাইডওয়াকের ওপর ছিটকে পড়লো। আমি রাস্তার ওপর গড়িয়ে পড়লাম হয় গাড়িটা থেমে যাবে, নয়তো আমাকে আঘাত করবে। কিন্তু রূপালি রঙের গাড়িটা কয়েকবার পাক খেয়ে থেমে গেল এবং সাথে সাথে প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে গেল।
“ভেতরে এসো,” কঠিন কণ্ঠে কে যেন আমাকে নির্দেশ দিলো।
এটা একেবারে অদ্ভুত ব্যাপার নিমেষেই আমার ভেতরকার ভয়টা দূর হয়ে গেল, এক ধরনের নিরাপত্তার বেষ্টনিতে আমি আবদ্ধ হলাম- এমনকি বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্বেও আমি তার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, লাফিয়ে গাড়ির সিটে চেপে বসে পাশের দরজা লাগিয়ে দিলাম।
গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আছে। এমনকি দরজা খোলার সময়ও কোনো আলো ভেতরে দেখতে পেলাম না। ড্যাসবোর্ডের কাছের জ্বলজ্বলে সামান্য আলোতে তার মুখ আবছাভাবে দেখতে পেলাম। চাকার তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে গাড়িটা ঘুরে গেল। তারপর সোজা রওনা হলো উত্তর দিকে। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম পোতাশ্রয়ের দিকে রওনা হয়েছি।
“তোমার সিট বেল্ট বেঁধে নাও।” ওর নির্দেশ কোণার পর বুঝতে পারলাম, এততক্ষণ আমি সিট দু’হাতে আকঁড়ে ধরে আছি। ওর নির্দেশমাফিকই কাজ করলাম; অন্ধকারের ভেতরও ঠিকই সিট বেল্ট আটকে নিতে পারলাম আমি। বামদিকে দ্রুত মোড় নিয়ে সোজা এগুতে লাগলো, অনেকগুলো লাল আলো দেখার পরও কোথাও সে একটুও দাঁড়ালো না কিংবা গাড়ির গতি কমানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
কিন্তু এখন পর্যন্ত নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে, যদিও আমি একেবারেই জানি না, কোথায় যাচ্ছি। একটু স্বস্তি পাওয়ার আশায় ওর চেহারা দেখার চেষ্টা করলাম।
“তুমি কি ঠিক আছো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। নিজেও বুঝতে পারলাম না আমার কণ্ঠ এতোটা রুক্ষ কোণালো কেন?
“না,” শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো ও। ওর কণ্ঠ বেশ ম্লান কোণালো।
আমি নিশ্চুপ বসে থাকলাম। সোজা সামনে দিকে তাকিয়ে থাকা ওর মুখের দিকে তাকালাম, যতোক্ষণ পর্যন্ত না গাড়িটা দাঁড়ালো, আমি ততোক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে থাকলাম। আমি চারদিকে একবার নজর বুলালাম, কিন্তু বাইরে এতোটাই অন্ধকার যে, রাস্তার পাশের ঝাপসা কিছু গাছ ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। তবু এতটুকু বুঝতে পারলাম যে, আমরা শহরের বাইরে চলে এসেছি।
“বেলা?” ও জিজ্ঞেস করলো। ওর কণ্ঠ এখনো রূঢ় কোণালো বটে, তবে অনেকটাই সংযত।
“হ্যাঁ?” আমার কণ্ঠ এখনো রুক্ষই কোণালো। সংযতভাবে গলাটা আমি পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করলাম।
“তুমি কি ভালো আছো?” এখন পর্যন্ত ও আমার দিকে তাকায়নি, তবে ওর কণ্ঠের কৌতূহল এড়াতে পারলো না।
“হ্যাঁ,” ভাঙা কণ্ঠে কোনোভাবে জবাব দিলাম।
“দয়া করে তুমি আমার পিছু ছাড়ো।” ও আদেশের সুরে বললো।
“দুঃখিত, তুমি কি বললে আমি ঠিক বুজতে পারলাম না!”
ও ঘন ঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললো।
“আমাকে শান্ত করার জন্যে অযথাই আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছে তখন থেকে,” চোখ বন্ধ করে ও আমাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। একই সাথে ও নাকের ওপর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগলাম।
“উম,” আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। “গতকাল স্কুল শুরু হওয়ার আগে আমি কি টাইলার ক্রোলির ওপর গাড়ি চাপিয়ে দিবো?”
এখন পর্যন্ত ও চোখ বন্ধ করেই রেখেছে, কিন্তু মুখের একপাশে আগের মতোই। কাঁপতে লাগলো।
“কেন?”
“টাইলার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে, ও নাকি ইচ্ছে করলেই নাচের আসরে। আমাকে নিয়ে যেতে পারে- হয় সে কাণ্ডজ্ঞানহীন, নয়তো এভাবে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে… ভালো, তোমার তো সবই মনে আছে, মনে হয় এভাবে ও আমার ওপর মাতাব্বরী করার চেষ্টা করছে। অথবা ভাবছে, আমি যদি তার বড়ো কোনো ক্ষতি করতে পারি তাহলে সমানে-সমান হয়ে যাবে। আমার সাথে কারো শত্রুতা হোক, আমি তা চাই না। টাইলার যদি আমার পিছু ছাড়ে, তাহলে লরেন হয়তো খানিকটা ভরসা পায়…” বকবক করে আমি সবকিছু খুলে বলার চেষ্টা করলাম।
“আমি সবই শুনেছি।” চাপা কণ্ঠে ও জবাব দিলো।
“তুমি সব জানো?” একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করলাম ওকে। আমার আগের দুশ্চিন্তাগুলো আবার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। “প্যারালাইজড় হয়ে ওর যদি ঘাড় বাঁকা হয়ে যায়, তাহলে আর কাউকে নাচের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে খোঁচাতে আসবে না,” পরিকল্পনাটা মনে মনে সাজিয়ে নিয়ে আমি বিড়বিড় করলাম।
এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অবশেষে চোখ খুললো।
“খুব কি ভালো হবে?”
“বোধহয় না খুব একটা ভালো হবে।”
আমি ওর মন্তব্য শুনতে চাইলাম, কিন্তু নতুনভাবে ও কিছুই বললো না। সিটের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে ও গাড়ির সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু। আগের মতো আবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠছে।
“কি হলো?” ফোপানোর মতো আমার কণ্ঠ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এলো।
“বেলা, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত রাগের কারণে মাথা ঠিক রাখতে পারি না। আমার মতো করেই ও কথাগুলো বললো। “কিন্তু এতে কোনো উপকার হয়নি আমার এবং ওদের খুঁজে বের করে যে…” ও তার কথাটা শেষ করলো না। অনেক কষ্টে তার রাগটা সংযত করার চেষ্টা করলো। “অন্তত পক্ষে” আবার সে বলতে লাগলো, “এভাবে নিজেকে আমি প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছি।”
“ওহ্” যদিও জানি এ ধরনের উত্তর অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তবুও এ ছাড়া এই মুহূর্তে আর বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলাম না।
আবার আমরা চুপচাপ বসে থাকলাম। ড্যাসবোর্ডের ঘড়ির দিকে আড়চোখে একবার দেখে নিলাম। ওখানে সাড়ে ছ’টা নির্দেশ করছে।
“জেসিকা এবং এঞ্জেলা হয়তো দুশ্চিন্তা করছে,” আমি বিড়বিড় করলাম। “ওদের সাথে আমার দ্রুত দেখা করা প্রয়োজন।”
একটা কথাও না বলে ও ইঞ্জিন চালু করলো, খুব ধীরে মোড় ঘুরিয়ে পেছনের শহরের দিকে রওনা হলো। স্ট্রীট্রক্লাইটগুলো জ্বলে ওঠায় আমাদের দেরি করার অবকাশ নেই, সুতরাং ও খুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ও আড়াআড়িভাবে এমন একস্থানে গাড়িটা পার্ক করলো, আমার ধারণায় ভলভো পার্ক করার ক্ষেত্রে স্থানটা একেবারেই বোধহয় অপ্রতুল। তবে একবারের চেষ্টাতেই সহজভাবে গাড়িটা পার্ক করতে পারলো না ও। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ল্যা বেলা ইতালিয়ার আলো দেখতে পেলাম। তারপরই দেখতে পেলাম জেস এবং এঞ্জেলা ওখান থেকে মাত্র বেরিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।
“তুমি কীভাবে জানলে কোথায়…?” আমি শুরু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিছুই বলতে না পেরে শুধু একটু মাথা নাড়লাম। আমি দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম এবং দেখলাম ও গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে।
“তুমি কি করতে চাইছো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি তোমাকে ডিনারে নিয়ে যেতে চাই,” ও একটু মুচকি হাসলো, কিন্তু চোখ জোড়া এখনো আগের মতোই কঠিন হয়ে আছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। দরজাটা বন্ধ আগের মতো নিয়ে যেতে করলাম।
আমি কিছু বলার আগেই ও মুখ খুললো।” জেসিকা এবং এঞ্জেলাকে তুমি দাঁড় করাও। আমি যদি ওদের ডাকতে যাই তাহলে বোধহয় না ভালো দেখাবে।”
ওর কথায় আবার এক ধরনের আদেশের সুর লক্ষ করলাম আমি।
“জেস! এঞ্জেলা!” ওদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে ডাকতে লাগলাম। ওরা দ্রুত আমার দিকে ফিরে তাকালো। ওদের চোখে-মুখে রীতিমতো বিস্ময় লক্ষ করলাম।
“কোথায় ছিলে তুমি?” বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো জেসিকা।
“আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম,” জবাবদিহি করার মতো করে বললাম। এরপর এ্যাডওয়ার্ডের খপ্পরে পড়েছিলাম।” ওর দিকে তাকিয়ে বললাম।
“তোমাদের সাথে আমি যোগ দেয়াতে দোষের কিছু করিনি তো?” মোলায়েম কণ্ঠে ও প্রশ্ন করলো।
“এ্যাড… অবশ্যই” জেসিকা গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো।
“উম, সত্যি বলতে বেলা, তোমার জন্যে অনেক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে শেষ পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছি। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” এঞ্জেলাকে বিব্রত মনে হলো।
“ভালোই করেছে। আমার কিন্তু মোটেও খিদে পায়নি।” আমি শ্রাগ করলাম।
“আমার মনে হয় তোমার কিছু খাওয়া উচিত।” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড, কিন্তু কণ্ঠের কৃতত্ব ভাবটা এড়াতে পারলো না। ও জেসিকার দিকে তাকিয়ে খানিকটা গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করলো। “যদি রাতে আমি বেলাকে বাড়ি পৌঁছে দিই, তাহলে তোমরা কি কিছু মনে করবে? তাহলে ওর খাবার সময়টুকুতে তোমাদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না।”
“উহ, কোনো সমস্যাই নেই, আমার ধারণা…” ও ঠোঁট কামড়ে আমার দিকে তাকালো। আমি আসলে কী চাইছি, সেটাই বুঝে নেবার চেষ্টা করলো জেসিকা। আড়চোখে জেসিকার দিকে একবার তাকালাম। আমার আকস্মিক ত্রাণকর্তার সাথে বেশিক্ষণ আর কাটাতে চাইছি না। এতোক্ষণ একসাথে থাকার পরও, এখন পর্যন্ত এ্যাডওয়ার্ডকে একটা প্রশ্নও করতে পারিনি।
“ঠিক আছে।” জেসিকা কিছু বলার আগেই এঞ্জেলা সমর্থন জানালো। “আগামীকাল আবার আমাদের দেখা হচ্ছে বেলা… এ্যাডওয়ার্ড।” ও জেসিকার হাত আঁকড়ে ধরে খানিক দূরে পার্ক করা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। ওরা গাড়িতে ওঠার সময় জেস মুখ ঘুরিয়ে একবার আমাদের দেখে নিয়ে হাত নাড়লো। ওর চোখে-মুখে একই সাথে রাগ এবং কৌতূহল খেলা করছে। আমিও পাল্টা হাত নাড়লাম, ওদের গাড়ি আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
“সত্যি বলছি, আমার মোটেও খিদে পায়নি,” এ্যাডওয়ার্ডের মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে, অতি উৎসাহ নিয়ে তাকে বললাম। আমি ওর মনের অভিব্যক্তি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“তুমি আমার সাথে তামাশা করছে।”
রেস্টুনেন্টের কাছে পৌঁছে, এ্যাডওয়ার্ড ভাবলেশহীনভাবে দরজাটা আমার জন্যে খুলে ধরলো। অবশ্য, এরপর আর ওর সাথে কোনো তর্ক-বিতর্ক করা সম্ভব নয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওর পাশ কাটিয়ে আমি রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
রেস্টুরেন্টে মোটেও ভিড় নেই- পোর্ট এঞ্জেলস্-এর জন্যে বলা চলে এখন অফ সিজন। পরিবেশনের দায়িত্বে যে আছে, সে একজন তরুণী। লক্ষ করলাম, বারবার ওর চোখ এ্যাডওয়ার্ডের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। যতোটা প্রয়োজন, তার চাইতে একটু বেশিই যেন আতিথ্য দেখানোর চেষ্টা করলো তরুণী। একবার ভাবলাম, আমাকে আর কতোটা বিব্রত হতে হবে! তরুণী আমার চাইতেও দীর্ঘদেহী, তাছাড়া স্বর্ণকেশী- এতো সুন্দর সোনালি চুল আমি খুব কমই দেখেছি।
“দু’জন বসার মতো কোনো টেবিল পাওয়া যাবে?” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠে এক ধরনের প্রলোভনের সুর। ওর বলার ভঙ্গি এমন যে, দু’জন বসার মতো খালি টেবিল পেয়ে গেলে ভালো, কিন্তু না পেলেও কোনো ক্ষতি নেই। ওই তরুণী আড়চোখে একবার আমাদের দেখে নিলো। আমার সাধারণ বেশভুষা দেখে হয়তো ধারণা করলো এ্যাডওয়ার্ডের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ডাইনিং ফ্লোরের মাঝখানে বারোজনের বসার মতো একটা টেবিল আমাদের জন্যে বরাদ্দ করে দিলো তরুণী। দেখতে পেলাম, তুলনামূলকভাবে কাস্টমাররা এখানেই সবচেয়ে ভিড় করে আছে।
আমি বসলাম বটে, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো।
“এর চাইতে নিরিবিলি কোনো জায়গা ছিলো না?” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো তরুণীকে। যদিও আমি নিশ্চিত নই, তবুও মনে হলো যেন ও তার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো বকসিস হিসেবে। বয়স্ক একজনকে টেবিল ছেড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো টেবিলই আমি খালি হতে দেখলাম না।
“অবশ্যই।” তরুণী আমার মতোই অবাক হলো। আমাদের ও পর্দা টাঙ্গানো ছোটো একটা বুথ দেখিয়ে দিলো। একই রকম দেখতে পাশাপাশি অনেকগুলো বুথ এর সবগুলোই দেখতে পেলাম খালি। “এটা কেমন?” প্রশ্ন করলো ও।
“একেবারে মনের মতো।” হাসি মুখে এ্যাডওয়ার্ড সমর্থন জানালো।
“উম্” চোখ পিটপিট করে তরুণী মাথা নাড়লো– “তোমাদের খাবার খানিকক্ষণের ভেতর পরিবেশন করছি” কথাগুলো বলে, দৃঢ় পদক্ষেপে ও বুথ থেকে বেরিয়ে গেল।
“মানুষের সাথে তোমার এমন আচরণ করা উচিত নয়,” আমি মন্তব্য করলাম এটা একেবারে অনুচিত।”
“কোন প্রসঙ্গে বলছো তুমি?”
“ওদেরকে ওভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো- ওই মেয়েটা সম্ভবত কিচেনে গিয়ে হাইপারটেনশনে ভুগতে শুরু করেছে।”
এ্যাডওয়ার্ডকে খানিকটা বিভ্রান্ত মনে হলো।
“আরে বাদ দাও তো,” সন্দেহজনকভাবে বললাম। “তোমার আচরণে কার কেমন মনোভাব হওয়ার কথা তুমি তা ভালোভাবেই জানো।”
ও মাথা একপাশে এলিয়ে দিলো। একই সাথে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো, “আমি মানুষকে চমকায়ে দিই?”
“তুমি আগে বুঝতে পারোনি? তুমি কি মনে করো সবার জীবনই খুব সহজ সরল?”
ও আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। “আমি কি কখনো তোমাকে চমক দেখানোর চেষ্টা করেছি?”
“একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছো।” আমি প্রতিবাদ জানালাম।
এরপর পরই আমাদের খাবার চলে এলো। খাবার পনিবেশনের সময় তরুণী অযথাই হাসলো।
“হ্যাল্লো, আমার নাম হচ্ছে আমবার এবং আজ রাতে তোমাকে পরিবেশনের দায়িত্ব আমার ওপরই ন্যস্ত হয়েছে। তোমার জন্যে কি ধরনের ড্রিঙ্ক পরিবেশন করবো?” বুঝতে অসুবিধে হলো না, ও শুধুমাত্র এ্যাডওয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলছে।
এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকালো।
“আমি শুধুই একটা কোক নেবো।”
“দুটো কোক,” এ্যাডওয়ার্ড বললো।
“আমিও তেমনই ধারণা করেছিলাম,” নিশ্চিন্ত হওয়ার ভঙ্গিতে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আমবার একবার হাসলো। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড তা লক্ষ করলো না। ও শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
“কি?” তরুণী চলে যাওয়ার পর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।
ওর চোখ আমার মুখের ওপর স্থির হলো। “তোমার কেমন লাগছে?”
“আমি ভালোই আছি,” জবাব দিলাম তাকে। তার উৎসাহ দেখে আমি বেশ অবাক হলাম।
“মাথা ঝিমঝিম, অসুস্থ বোধ কিংবা ঠাণ্ডা লাগছে…?”
“আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?”
খানিকবাদে তরুণী আবার ফিরে এলো।
“তুমি কি এখন অর্ডার দেবে?” তরুণী এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্ন করলো।
“বেলা?” ও জিজ্ঞেস করলো। অনিচ্ছুকভাবে তরুণী আমার দিকে তাকালো।
মেনুতে প্রথম যা নজরে এলো সেটাই আমি বললাম। “উম্ আমি নিবো মাসরুম রিভোলি।”
“আর তুমি?” এ্যাডওয়ার্ডের দিকে ফিরে তরুণী হেসে জিজ্ঞেস করলো।
“আমি কিছুই নেবো না,” ও বললো। অবশ্যই নয়।
“আমার মনে হয় তুমি তোমার মত পাল্টাবে।” তরুণীর ঠোঁটে এখনো হাসি ঝুলে আছে, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড ওর দিকে মোটেও তাকালো না। ও অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।
“ড্রিঙ্ক,” তরুণী ফিরে যাওয়ার আগে এ্যাডওয়ার্ড অর্ডার দিলো।
বাধ্য মেয়ের মতো সোডার গ্লাসে চুমুক দিলাম। এরপর পানীয়টুকুতে বড়ো করে চুমুক দিলাম। বুঝতে পারলাম এততক্ষণ আমি কতোই না তৃষ্ণার্ত ছিলাম। গ্লাসটা ও আমার দিকে এগিয়ে দেবার সাথে সাথেই আমি তা শেষ করে ফেলেছি।
“ধন্যবাদ,” বিড়বিড় করে বললাম। যদিও আমি এখন পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি। শীতল সোডা আমার বুকের ভেতর দিয়ে নেমে গেল যেন, এবং আমি একবার কেঁপে উঠলাম।
“তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে?”
“কোক পান করার কারণে,” ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডায় আবার আমি কেঁপে উঠলাম।
“সাথে কোনো জ্যাকেট আনো নি?” ওর কণ্ঠে এক ধরনের অসন্তুষ্টি।
“হ্যাঁ, ছিলো,” সামনের একটা খালি টেবিলের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম। “ওহ্ ওটা ভুলে জেসিকার গাড়িতেই থেকে গেছে।”
এ্যাডওয়ার্ড দ্রুত তার জ্যাকেটটা খুলে ফেললো। এতোক্ষণে খেয়াল হলো, ও কি পোশাক পরেছে, আমি তা লক্ষই করিনি- শুধুমাত্র আজ রাতেই নয়, কখনোই আমার লক্ষ করা হয় না।
চিন্তার জাল ছিন্ন করে, জ্যাকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।
ধন্যবাদ,” কথাটা আবার তাকে বললাম। আমি ওর দেয়া জ্যাকেটটা পরে নিলাম। জ্যাকেটা ঠাণ্ডা হয়ে আছে। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় আমারটাও এরকম ঠাণ্ডা হয়েছিলো। আরেকবার ঠাণ্ডায় আমি কেঁপে উঠলাম। জিনিসটা থেকে অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ বেরুচ্ছে। অবশ্যই কোনো পারফিউমের গন্ধ- গন্ধটা আমি চেনার চেষ্টা করলাম। অবশ্য এটা যে কোলনের গন্ধ নয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত।
“ওই নীল রঙ তোমার শরীরের রঙের সাথে চমৎকার মিশে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে ও বললো। আমি বিস্মিত হয়ে মাথা নিচু করলাম। লজ্জায় অবশ্যই রক্তিম হয়ে উঠলাম আমি।
ব্রেডের বাস্কেটটা ও আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
“সত্যিই, আমি আর চমক পেতে চাই না,” প্রতিবাদের সুরে তাকে বললাম।
“সবকিছুই তোমার কাছে চমক মনে হতে পারে- একজন সাধারণ মানুষের কাছে সবকিছুই চমক বলে মনে হতে পারে। ও আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি দেখলাম ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে। এতে জ্বলজ্বলে চোখ ইতিপূর্বে আর দেখিনি।
“তোমার সাথে আমি বেশ নিরাপদ বোধ করছি,” এক ধরনের মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে সত্য কথাটা আবার স্বীকার করে নিলাম।
সম্ভবত আমার কথাটা তার পছন্দ হলো না। প্র কুচকে ও মাথা নাড়লো।
“আমি যেমন পরিকল্পনা করেছিলাম, তার চাইতেও দেখছি বিষয়টা বেশি জটিল,” আপনমনে ও বিড়বিড় করলো।
একটা ব্রেডস্টিক তুলে নিয়ে ওটার ওপর আঙ্গুল বুলাতে লাগলাম। আসলে ও কী চিন্তা করছে, তা বুঝার চেষ্টা করলাম।
“তোমার চোখে যখন আলো থাকে, তখন বোধহয় তুমি বেশ ভালো মুডে থাকো।”
এ্যাডওয়ার্ড বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালো। “কি?”
“তোমার চোখ যখন কালো থাকে, তখন তোমাকে বুনো স্বভাবের মনে হয় আমি পরবর্তীতে এমনই আশা করবো,” আমি বলে যেতে লাগলাম। “এ বিষয়ে আমার একটা তত্ত্ব আছে।”
ওর চোখ কুঁচকে গেল। “আরো তত্ত্ব?”
“মম্… ম…” ব্রেডের একটা টুকরো মুখে পুরে কোনোভাবে কথাটার সমর্থন জানানোর চেষ্টা করলাম।
“আমার মনে হয় ইদানিং তোমার বেশ বুদ্ধি খুলেছে… অথবা এগুলো কি তুমি কমিক্স বই থেকে পেয়েছো?” আমার দিকে তাকিয়ে ও বিদ্রূপ করলো।
“ভালো, না আমি এগুলো কমিক্স বই থেকে পাইনি, তবে নিজের ইচ্ছেতেও করছি না।”
“এবং?” সাথে সাথে ও জিজ্ঞেস করলো।
কিন্তু এরপরই ওয়েট্রেস আমার খাবার নিয়ে এলো। আমি বুঝতে পারলাম, মনের অজান্তেই টেবিলের ওপর দিয়ে দু’জনের একান্ত সান্নিধ্যে চলে এসেছি। আমরা সাথে সাথে সোজা হয়ে বসলাম। ওয়েট্রেস আমার সামনে খাবার নামিয়ে রাখলো- খাবারটা দেখে আমার বেশ ভালোই মনে হলো। ওয়েট্রেস সাথে সাথে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে ফিরে তাকালো।
“তুমি কি মত পাল্টেছো?” তরুণী জিজ্ঞেস করলো। “তোমার জন্যে উৎসর্গ করার মতো কিছুই কি এখানে নেই?” তরুণীর প্রশ্ন শুনে মনে হলো এর দু’ধরনের অর্থ হতে পারে।
“না, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তবে আরো কিছু সোডা হলে বেশ ভালো হয়।”
“অবশ্যই।” খালি গ্লাসগুলো নিয়ে ও চলে গেল।
“হ্যাঁ, তুমি কি যেন বলছিলে?” ও জিজ্ঞেস করলো।
“আমি কথাটা গাড়িতে বলতে চেয়েছিলাম। যদি। আমি কথাটা সম্পূর্ণ করলাম না।
“এতে কোনো শর্ত আছে নাকি?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।
“অবশ্যই আমার কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে!”
“অবশ্যই।”
আরো দুইগ্লাস কোক নিয়ে ওয়েট্রেস ফিরে এলো। টেবিলে গ্লাস দুটো নামিয়ে রেখে এবার আর কোনো কথা না বলে বুথ থেকে বেরিয়ে গেল।
গ্লাসে আবার চুমুক দিলাম।
“হ্যাঁ, যা বলছিলে, চালিয়ে যাও,” এ্যাডওয়ার্ড আগের মতোই কঠিন কণ্ঠে বললো।
বলার যদিও ইচ্ছে ছিলো না, তবুও আমি বলতে বাধ্য হলাম।
“তুমি পোর্ট এঞ্জেলেসে কি করছো?”
ও নিচের দিকে মুখ করে হাতের বিশাল থাবা টেবিলের ওপর বিছিয়ে কী যেন দেখতে লাগলো। এরপর আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
“তারপর।”
“আসল প্রশ্নই তুমি এড়িয়ে গেলে,” আমি প্রতিবাদ জানালাম।
“তারপর।” একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো ও।
আমি হতাশ হয়ে মাথা নিচু করলাম। সীলভারওয়্যার খুলে কাঁটা চামচ তুলে নিলাম এবং খুব সাবধানে একটা রেভোলিতে গেঁথে মুখে পুরলাম। এখনো আমি মাথা নিচু করেই রেখেছি। খাবারটুকু চিবুতে চিবুতে চিন্তা করতে লাগলাম। মাশরুমগুলো মন্দ নয়। চিবানো খাবারটুকু গিলে ফেলে কোকের গ্লাসে আবার চুমুক দিলাম। এরপর আমি মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম।
“ঠিক আছে, তারপর।” আমি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম। “অবশ্যই বিচার বিশ্লেষণ করেই বলতে হবে, সেটা কেউ একজন। অন্য মানুষ কী ভাবছে বলে দিতে পারে, মনের কথা পড়তে পারে, তুমি ভালোভাবেই জানো আমার কাছে এগুলো সবই অদ্ভুত মনে হয়েছে।”
“শুধু একটু অন্যরকম,” ও কথাটা সংশোধন করে দিলো, “বিচার বিশ্লেষণ করে মতামত পেশ করা।”
“ঠিক আছে, এরপরও কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে হয়তো।” ও একা একাই আমাকে নিয়ে খেলা করার চেষ্টা করছে, তবুও আমি এক ধরনের পুলক অনুভব করলাম। এরপর ও নিজেকে যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। “ওই কাজটা কীভাবে করা সম্ভব? সীমাবদ্ধতা কতোটুকু? কীভাবে সম্ভব একজন কাউকে একেবারে সঠিক সময়ে কীভাবে খুঁজে পেতে পারে? কীভাবে একজন জানতে পারে তার বান্ধবী বিপদে পড়েছে?” পর পর প্রশ্ন করার সাথে সাথে আমার চিন্তার জট কীভাবে খুলে গেল, আমি তা নিজেও জানি না।
“প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে সত্য বলে বিবেচনা করা?” ও জিজ্ঞেস করলো।
“অবশ্যই।”
“ভালো, যদি … যদি কোনো ব্যক্তি
“জো’কে ডাকা উচিত,” আমি উপদেশ দিলাম।
ও ম্লানভাবে হাসলো। “জো, তারপর। যদি জো কোনোভাবে মনোযোগ দেয়-ও, ওর সাথে ঠিক সময় মেলানো সম্ভব হবে না,” চোখ পাকিয়ে ও মাথা নাড়লো। “এ রকম শহরে তুমি ছোটোখাটো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে। তুমি নিশ্চয়ই জানো, এখানকার অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
“আমরা প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে সত্য বলার বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।” এ্যাডওয়ার্ডকে আমি স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।
ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ওর চোখ এখন অনেকটাই স্থির-শান্ত।
“হ্যাঁ, আমরা তেমনই আলোচনা করছিলাম, আমাকে সমর্থন জানালো ও “আমরা কি তোমাকে ‘জে’ নামে ডাকতে পারি?”
“তুমি কিভাবে জানলে?” মনের কৌতূহল যতোটা সম্ভব চেপে রেখে প্রশ্ন করলাম তাকে। বুঝতে পারলাম, টেবিলের ওপর দিয়ে আবার আমি তার কাছাকাছি হয়ে পড়েছি।
“ভালোভাবেই জানো, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো,” আমি বিড়বিড় করলাম। টেবিলের ওপর রাখা হাত স্পর্শ না করেই আমি পিছিয়ে গেলাম। সাথে সাথে আমার হাত গুটিয়ে নিলাম।
“আমি জানি না এছাড়া আমার আর কোনো পছন্দ আছে কিনা,” ওর কণ্ঠ রীতিমত হিসহিস্ করে উঠলো। “আমিই আসলে ভুল- আমি যতোটা নই তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষমতাবান বলে মনে করছে তোমরা।”
“আমার ধারণা তুমি সবসময় ঠিকই বলো।”
“আমি ঠিক বলার চেষ্টা করি,” ও আবার নড়েচড়ে বসলো। “কোন কোনো ব্যাপারে আমি তোমাকে বুঝতেও পারি না। তুমি নিশ্চয়ই চৌম্বক শক্তির বলে দুর্ঘটনা ঘটাও নি- এর কোনো বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। তুমি মারাত্নক দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলে। মাত্র দশ মিলিমিটারের এদিক ওদিক হলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। তোমাকে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।”
“কিন্তু তুমি আমাকে অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছিলে নয় কি?” আমি ধারণা করলাম।
ও চেহারা অভিব্যক্তিহীন বলে মনে হলো।
আবার আমি টেবিলের ওপর হাত বিছিয়ে রাখলাম- এ্যাডওয়ার্ড সামান্য একটু পিছিয়ে গেল, কিন্তু সেটা লক্ষ করার চেষ্টা করলাম না- আলতোভাবে ওর আঙ্গুলের আগায় স্পর্শ করলাম। ওর আঙ্গুলগুলো পাথরের মতো শক্ত এবং অতিরিক্ত শীতল বলে মনে হলো।
“ধন্যবাদ তোমাকে,” আমার কণ্ঠে উষ্ণ আন্তরিকতা প্রকাশ পেলো। “এখন পর্যন্ত দু’বার হলো।”
ওর চেহারা ম্লান মনে হলো “ঘটনা আর তিন-এ উত্তীর্ণ করো না।”
আমি মুখে কিছু বললাম না বটে, তবে মাথা নাড়লাম। আমার হাতের নিচ থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে টেবিলের নিচে নামিয়ে রাখলো। কিন্তু ও আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে এলো।
“পোর্ট এঞ্জেলেস্ তোমাকে আমি অনুসরণ করে এসেছিলাম,” ও স্বীকার করলো। “ইতিপূর্বে কারও ত্রানকর্তা হয়ে আমি আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমার বিশ্বাস এতে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সম্ভবত তোমার জন্যেই আমি এরকম ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়েছি। সাধারণ মানুষ হলে, বিষয়টা নিয়ে সারাদিন মুখরোচক গল্প ছড়িয়ে বেড়াতে।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ও থামলো। আমি ভেবে অবাক হলাম, ও আমাকে অনুসরণ করে এখন পর্যন্ত এসেছে বলে এক ধরনের বিব্রতবোধ করছি আমি। অথচ এরকম পরিস্থিতিতে আমার সন্তুষ্ট হওয়াই উচিত ছিলো। আমার ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখে ও একটু অবাক হলো। “তোমার কি কখনো ধারণা হয়েছে, ওই গাড়ি দুর্ঘটনার পর আবারো আমার কোনো বিপত্তি ঘটবে?”
“ওটাই প্রথম নয়,” ও জবাব দিলো, আমার কানে ওর কণ্ঠস্বর কঠিন কোণালো। ওর মন ভালো করার জন্যেই আমি কথাটা বলেছিলোম, কিন্তু ওকে বরং বিরক্তই মনে হলো। “তোমার সাথে প্রথম পরিচয়ের সময়ই জানতাম একের পর এক তুমি বিপত্তি ঘটাবে।”
ওর কণ্ঠ শুনে খানিকটা আমার ভয় লাগলো আবার বলা যায় এক ধরনের সন্তুষ্টিও বোধ করলাম।
“তোমার মনে আছে?” ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ,” শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম।
“এবং তুমি এখন পর্যন্ত এখানে বসে থাকার সুযোগ পেয়েছে …,” ওর কণ্ঠে এক ধরনের সন্দেহের সুর লক্ষ করলাম। এক চোখ কুঁচকে ও আমার দিকে তাকলো।
“হ্যাঁ, আমি এখানে বসে আছি। এর কারণ অবশ্যই তুমি।” আমি একটু থামলাম। “কারণ তুমি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলে আজ আমাকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে, তাই নয় কি?” সাথে সাথে জবাব দেবার চেষ্টা করলাম।
ও খানিকক্ষণ ঠোঁট কামড়ে থাকলো। চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করলো। মনে হলো নতুনভাবে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার খাবার ভর্তি প্লেটের ওপর একবার নজর বুলালো।
“তুমি খাবার শেষ করো, আমি কথা বলি।”
আমি দ্রুত আরেক টুকরো টাভিলি মুখে পুরলাম।
“যতোটা সহজ মনে হয়েছে, কাজটা তার চাইতে বেশ কঠিন- তোমার পিছু লেগে থাকা। সাধারণত কিছু মানুষ আছে, যাদের পেতে চাইলে, খুব সহজে খুঁজে বের করতে পারি। এ ধরনের মানুষ হচ্ছে তারাই যাদের মন আমি ইতোপূর্বে পড়তে পেরেছি।” এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে কঠিন চোখে তাকালো, ওর চাহনীতে আমি প্রায় জমে গেলাম। ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করে আরেক টুকরো রেভোলি মুখে পুরলাম।
“আমি শুধু জেসিকার ওপর নজর রাখছিলাম- আমি বলতে চাইছি, আমার মনে হয়েছে শুধুমাত্র তুমিই পোর্ট এঞ্জেলেস্-এ এসে সমস্যায় পড়বে- ওদের সাথে থাকার সময় তোমার প্রতি আমার নজর দেবার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি ওদের সাথে নেই, তখনই মনে হলো তোমার ওপর নজর রাখা একান্ত প্রয়োজন। তোমাকে বুক স্টোরের সামনে দেখতে পেলাম, ওই মহিলাকেও দেখতে পেলাম। স্টোরের ভেতর ঢুকতে আমি নিষেধ করতে পারতাম অবশ্য তুমি নিজে থেকেই ওখানে ঢুকলে না বরং দক্ষিণে চলে গেলে আমি মনে করেছিলাম খুব দ্রুত তুমি ফিরে আসবে। সুতরাং কততক্ষণে ফিরো সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম রাস্তার ভিড়ে তোমাকে খুঁজতে লাগলাম- জেসিকাদের ভেতর থেকে যে কেউ তোমাকে খুঁজে বের করতে পারলে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না কিন্তু আমার বেশ চিন্তা হতে লাগলো… “ মনে হলো এরই মধ্যে ও চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেছে। আমার চারপাশে কি যেন খুঁজতে লাগলো, কিন্তু কি খুঁজছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“আমি গোলচক্করে গিয়ে পৌঁছলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম কোণার চেষ্টা করলাম। তখন সূর্য ডুবতে বসেছে, এবং গাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে তোমাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। এবং তারপর-” ও থামলো, কথাগুলো বলে, ও বোধহয় খানিকটা স্বস্তিবোধ করলো।
“তারপর?” আমি ফিসফিস করে বললাম।
এ্যাডওয়ার্ড আমার মাথার ওপর দিয়ে অন্য দিকে তাকালো।
“ওরা কি চিন্তা করছে, আমি শুনতে পেলাম,” ও রাগ সামলাতে পারলো না। ওপরের ঠোঁট একটুক্ষণ কামড়ে ধরলো। “ওর মনে আমি তোমার চেহারা দেখতে পেলাম।” ও হঠাৎ পেছন দিকে হেলান দিয়ে একচোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। ওর অভিব্যক্তিগুলো এতো দ্রুত পরিবর্তন হলো যে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“এটা খুবই কঠিন তুমি চিন্তাও করতে পারবে না কতোটা কঠিন- তোমাকে সরিয়ে নেয়া খুবই সহজ ব্যাপার ছিলো এবং ওদের ছেড়েও দিতে পারতাম… জীবন্ত।” ও কথা বলার সাথে সাথে হাত নাড়লো। “জেসিকা এবং এঞ্জেলার সাথে আমি তোমাকে যেতে বলতে পারতাম। কিন্তু আমাকে একা রেখে তুমি চলে যাবে, ভেবে আমার খুব ভয় হচ্ছিলো, এ কারণে ওদের আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো এ্যাডওয়ার্ড।
আমি শান্তভাবে বসে থাকলাম, বিভ্রান্ত, আমার চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। কোলের ওপর হাতজোড়া আমি ভাঁজ করে সিটের ওপর ঘাড় এলিয়ে দিলাম। এখন পর্যন্ত হাতের ভেতর ও মুখ গুঁজে রেখেছে।
শেষ পর্যন্ত ও মুখ তুলে চাইলো, যেন আমার মনের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে।
“তুমি কি এখনই বাড়ি ফিরতে চাও?” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো।
“আমি এখনই যেতে প্রস্তুত, সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে ওর সান্নিধ্যে আরো ঘণ্টাখানেক থাকতে পারবো, তাতেই আমি মনে মনে উৎফুল্ল।
ডাকার সাথে সাথে ওয়েট্রেস এসে হাজির হলো। অথবা হয়তো ও আগে থেকেই আমাদের ওপর নজর রাখছিলো।
“তোমাদের জন্য কি করতে পারি?”
তরুণী এ্যাডওয়ার্ডকে জিজ্ঞেস করলো।
“ধন্যবাদ, আমরা এখন উঠতে চাচ্ছি,” ওর কণ্ঠ খানিকটা শীতল বলে মনে হলো।
“অব-অবশ্যই,” তরুণী খানিকটা তোতলালো। “তোমার ইচ্ছে করলেই যেতে পারো।” তরুণী সামনের পকেট থেকে একটা চামড়ার ফোল্ডার বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো।
ফোল্ডারে রাখা বিল এ্যাডওয়ার্ড হাতে তুলে নিলো। ফোল্ডারের ভেতর টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে তরুণীর হাতে ফিরিয়ে দিলো।
“চেঞ্জের প্রয়োজন নেই।” এ্যাডওয়ার্ড ম্লানভাবে হাসলো। এরপরই ও উঠে দরজার দিকে রওনা হলো, আমিও তার সাথে পা মেলালাম।
এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে তরুণী আরেকবার অনিশ্চিতভাবে হাসলো। “তোমার একটা ভালো সন্ধ্যা কাটলো।”
এ্যাডওয়ার্ড আর তার দিকে ফিরে তাকালো না। আমিই বরং তার হাসিটা ফিরিয়ে দিলাম।
আমার গা ঘেঁষে এ্যাডওয়ার্ড দরজার দিকে এগুতে লাগলো, তবে ও মোটেও আমাকে স্পর্শ করলো না। মাইকের সাথে জেসিকার কোন ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমি তা জানি; ওরা কীভাবে প্রথম অবস্থাতেই চুমু খাওয়ার পর্যায়ে চলে যেতে পারে ভেবে অবাক হলাম। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এ্যাডওয়ার্ড নিশ্চয়ই এই দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুনতে পেলো এবং অবাক দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টি আড়াল করতে সাইড ওয়াকের দিকে তাকালাম। আমি কী চিন্তা করছি মনে হয় না ও বুঝতে পেরেছে।
ভেতরে ঢোকার অপেক্ষায় প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে এ্যাডওয়ার্ড দাঁড়িয়ে রইলো। আমি গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে ওটা বন্ধ হয়ে গেল, এরপর এক প্রকার ছুটে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। ও যে কভোটা চটপটে তা ভেবে আরেকবার অবাক হলাম। ওর আচরণের সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিলো এতোদিনে- কিন্তু মোটেও পরিচিত হয়ে উঠতে পারিনি। আমার মনে হলো, এ্যাডওয়ার্ড এমন একজন যাকে সহজে বুঝে ওঠা বোধহয় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
ড্রাইভিং সিটে বসে ও ইঞ্জিন চালু করলো, তারপর হিটারটা বাড়িয়ে দিলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই আমার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছিলো, বুঝতে পারলাম ভালো আবহাওয়ার দিন শেষ হয়েছে। যদিও ওর জ্যাকেট আমাকে উষ্ণ করে রেখেছিলো। তাছাড়া ওর দৃষ্টি এড়িয়ে জ্যাকেটের চমৎকার গন্ধটা কয়েকবার কেও নিলাম।
এ্যাডওয়ার্ড ট্রাফিকের জট এড়িয়ে ফ্রি-ওয়ের দিকে রওনা হলো।
“এখন,” ও বেশ সন্তুষ্ট চিত্তে বললো, “এবার তোমার পালা।”
.
০৯.
“আমি কি তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করতে পারি এ্যাডওয়ার্ডকে অনুনয়ের সুরে প্রশ্ন করে শান্ত রাস্তায় নেমে এলাম। মনে হলো না রাস্তার দিকে ওর কোনো মনোযোগ আছে।
ও একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
“একটা?” ও রাজি হয়ে গেল। ও ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
“ভালো বলছিলে যে তুমি নাকি জানতে আমি বুক স্টোরে ঢুকবো না, বরং দক্ষিণের দিকে যাবো। আমি শুধু অবাক হচ্ছি, তুমি তা জানলে কীভাবে?”
এ্যাডওয়ার্ড অন্যদিকে তাকালো, দেখে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হলো।
“আমার ধারণা এগুলোর সবই আমরা কৌশলে এড়ানোর চেষ্টা করেছি,” আমি অসন্তষ্ট হয়ে বিড়বিড় করলাম।
ওকে শুধু হাসতে দেখলাম আমি।
“এরপরও তুমি আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিলে না…” আমি নীরস কণ্ঠে বললাম।
ও আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো। “কোন প্রশ্ন?”
“এটা কীভাবে ঘটলো- মাইন্ড রিডিং-এর ব্যাপারটা বলছিলাম? তুমি কি যে কোনো স্থানে যে কারও মন পড়তে পারো? তুমি এটা কীভাবে করো? পরিবারের অন্যান্যরাও কি?” হালকা ধরনের প্রশ্ন হলেও আমি তাকে এগুলো করতে এক প্রকার বাধ্য হলাম।
“এগুলো কিন্তু একের চাইতে বেশিই বলে মনে হচ্ছে, আমাকে ও স্মরণ করিয়ে দিলো। আমি পাল্টা কোনো জবাব দিলাম না, শুধু ওর দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল মটকাতে লাগলাম।
“না, এ ধরনের ক্ষমতা শুধু আমার ভেতরই আছে। তাছাড়া সবখানে সবার কথা আমি শুনতেও পাই না। খুব পরিচিত যদি কেউ হয়… পরিচিত কণ্ঠস্বর, তাহলেই কেবল আমার পক্ষে কোণা সম্ভব হয়। তবে এটাও ঠিক, কয়েক মাইল দূর থেকেই কেবল সম্ভব।” চিন্তিত মুখে ও খানিকক্ষণের জন্যে থামলো। “এটা অনেকটা বিশাল একটা হল-রুমের মতো, যেখানে একসাথে প্রচুর লোক কথা বলছে। বিষয়টা অনেকটা গুণগুণ করে গান গাওয়ার মতো পেছন দিকে অনেকগুলো মানুষের গুঞ্জনের মতো। এর ভেতর থেকে শুধুমাত্র একজনের প্রতি যদি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করি তাহলে তার চিন্তা আমি পরিষ্কারভাবে পড়তে পারি।
“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই চিন্তাগুলোকে অনেকটা টিউন করে নেবার মতো করে নিতে হয়। প্রথম দিকে এলোমেলো মনে হতে থাকে। একটু চেষ্টার পর বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে আসে,”- কথাগুলো বলার সময় ও নাক দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো-”এ সময় আমি তার কথার চাইতে চিন্তাকেই বেশি বুঝতে পারি।”
“আমার কথা তুমি বুঝতে পারবে না, এমন চিন্তা তোমার মাথায় এলো কেন?” একরাশ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম তাকে।
ও আমার দিকে তাকলো। ওর চোখে এক ধরনের বিভ্রান্তি লক্ষ করলাম।
“আমি ঠিক বলতে পারবো না,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। “আমার ধারণা, তুমি যখন কোনো কাজ করো অথবা কথা বলো, তখন তোমার চিন্তাগুলো ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। ধরা যেতে পারে তোমার চিন্তাগুলো প্রবহিত এ.এম. ফ্রিকুয়েন্সিতে, আর আমি শুধুমাত্র এফ.এম. ফ্রিকুয়েন্সির বিষয়গুলোই পেয়ে থাকি।” ও আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো, হঠাৎ ওকে বেশ আমুদে মনে হলো।
“আমার মন ঠিকমতো কাজ করে না? আমি খেয়ালি?” কথাগুলো যদিও খুব একটা খারাপ নয়, কিন্তু আমি খুবই বিব্রতবোধ করলাম- সম্ভবত ও আমার দুর্বলতম স্থানে আঘাত করেছে। আমি সবসময় খুব বেশি দুশ্চিন্তা করি এবং এ কারণে ঠিকমতো কোনো কাজ গুছিয়ে করতে পারি না।
“আমি এখন তোমার চিন্তাগুলো পড়তে পারছি- অতিরিক্ত খেয়ালি ভেবে নিজেকে দুষছো তুমি,” ও হেসে উঠলো। “চিন্তার কোনো কারণ নেই, এটা শুধুই একটা তত্ত্ব মাত্র “ ওর চেহারায় কাঠিন্য লক্ষ করলাম। এর মাধ্যমেই আমরা আবার একে অপরের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।”
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। কীভাবে শুরু করা যায়?
“এখন নিশ্চয়ই সবকিছু কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছি না?” ও শান্ত কণ্ঠে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো।
প্রথমবারের মতো ওর ওপর থেকে আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম, উত্তর দেবার মতো মনে মনে কথা খুঁজতে থাকলাম। স্পীড মিটারের ওপর হঠাৎ আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।
“হায় ঈশ্বর!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “ধীরে চালাও!”
“আমি আবার কি ভুল করলাম?” ও বেশ অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু গাড়ির গতি মোটেও কমলো না।
“তুমি ঘণ্টায় একশ মাইলে গাড়ি চালাচ্ছো।” আমি আগের মতোই চেঁচিয়ে উঠলাম। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে আমি বাইরে তাকালাম, কিন্তু অতিরিক্ত অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধুমাত্র গাড়ির হেডলাইটে বিস্তৃত রাস্ত টিা নীলচে দেখাচ্ছে। রাস্তার উভয় পাশের ঝোঁপ-ঝাড় এবং গাছপালাগুলোকে মনে হছে কালো দেয়াল- এই গতিতে ওই দেয়ালের সাথে যদি সংঘর্ষ ঘটে, তাহলে স্টীলের দেয়ালের সাথে সংঘর্ষ ঘটার মতোই ফলাফল ঘটবে।
“বেলা নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকো,” চোখ পাকিয়ে বললো, এখনো ওর গাড়ির গতি একটুও কমেনি।
“তুমি কি আমাদের মেরে ফেলতে চাইছো?” আমি জানতে চাইলাম।
“আমরা নিশ্বয়ই কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হতে যাচ্ছি না।”
যথা সম্ভব কণ্ঠটা ম্লান করার চেষ্টা করলাম। “তুমি এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”
“আমি সবসময় এভাবেই গাড়ি চালাই।” ষড়যন্ত্রকারীর মতো আমার দিকে তাকিয়ে ও হাসলো।
“রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাও!”
“বেলা, আজ পর্যন্ত আমি কোনো দুর্ঘটনা ঘটাইনি- এমনকি পুলিশ কখনো আমাকে টিকেট দেবারও সুযোগ পায়নি।” ও একটু কপাল ঘষে নিয়ে, ওখানটাতে চেপে ধরলো। বলতে পারো আমার এখানে একটা বিল্ট ইন ডিটেক্টর লাগানো আছে।”
“খুব মজার ব্যাপার।” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম। “চার্লি কিন্তু একজন পুলিশ, একথাটা মনে আছে? আমি সবসময় ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া এখন যদি গাছের গুঁড়ির সাথে এই গাড়ির একবার ধাক্কা লাগে, তাহলে আমাদের হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”
“সম্ভবত,” খুব জোরে হেসে ও এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু তুমি তা পারবে না।” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। স্ত্রী মিটারের কাঁটা আশিতে নামিয়ে আনলো সাথে সাথে। “এখন হলো তো?”
“সম্পূর্ণ নয়, খানিকটা।”
“ধীরে গাড়ি চালাতে আমার খুব খারাপ লাগে,” ও বিড়বিড় করে বললো।
“এটাকে তুমি ধীরে বলছো?”
“আমার গাড়ি চালানো নিয়ে অনেক ধারা বিবরণী শুনেছি,” ও হাত নাড়লো। “আমি এখনো তোমার পরবর্তী তত্ত্ব কোণার আশায় আছি।”
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। ও আমার দিকে তাকালো। ওর মধু রঙের চোখ জোড়া অতিরিক্ত শান্ত।
“তুমি বলতে পারো, আমি মোটেও হাসবো না।”
“তুমি আমার ওপর রেগে যাচ্ছে দেখে খুব ভয় হচ্ছে।”
“এটা কি অন্যায়?”
“আমার মনে হয় তোমার এই রাগ খানিকটা বেশিই।”
আমি কী বলি তা কোণার জন্যে অপেক্ষা করে রইলো। আমি মাথা নিচু করে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুতরাং ওর অভিব্যক্তি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“চালিয়ে যাও।” ওর কণ্ঠ অতিরিক্ত শান্ত কোণালো।
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কীভাবে শুরু করবো।”
“প্রথম থেকে কেন তুমি শুরু করছো না তুমি বলছিলে যে নিজের ইচ্ছেয় এখানে আসে নি।”
“না।”
“তোমাকে তাহলে এখানে কিসে টেনে আনলো বই? সিনেমা?” আসল সত্য ও খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো।
“না- এটা শনিবারের ঘটনা, বীচ্-এ ঘটেছিলো।” খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে আমি ওর দিকে তাকালাম। ওকে দেখে খানিকটা বিক্ষিপ্ত বলে মনে হলো।
“আমি একজন পারিবারিক বন্ধুর পেছন পেছন ওখানে গিয়েছিলাম জ্যাকব ব্ল্যাক্,” আমি বলতে লাগলাম। “ওর বাবা এবং চার্লির ভেতর আমার সেই ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুত্ব।”
এখনো তাকে আগের মতোই বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
“তার বাবা কুইলেটদের ভেতর অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি।” আমি খুব সাবধানে ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখে-মুখে একইভাবে বিভ্রান্তি লটকে আছে। “আমরা হাঁটতে গিয়েছিলাম-” আমার গল্পটা যথা সম্ভব গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। “- এরপর ও আমাকে কিছু প্রাচীন উপগাথা কোণালো- আমার মনে হয় ভয় পাইয়ে দেবার চেষ্টা করছিলো আমাকে। ও আমাকে একটা কাহিনী কোণালো “ কথাটা বলতে আমি খানিক ইতস্তত করলাম।
“চালিয়ে যাও,” এ্যাডওয়ার্ড বললো।
“ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কে বলছিলো।” বুঝতে পারলাম কথাটা বলতে গিয়ে আমি প্রায় ফুঁপিয়ে উঠেছি। এখন ওর মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। কিন্তু স্টেয়ারিং হুইলের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো।
“এবং সাথে সাথে তুমি আমাকে চিন্তা করে বসলে?” এখনো ওকে আগের মতোই শান্ত মনে হলো।
“না। ও আসলে ও আসলে তোমার পরিবারের কথা বলছিলো।”
ও একেবারে চুপ মেরে গেল। সোজা রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো।
হঠাৎ আমার ভয় হলো। ভয় হলো জ্যাকবকে নিয়ে। ওকে আমার রক্ষা করা উচিত।
“ওর ধারণা এগুলো মানুষের একেবারে হালকা ধরনের কিছু অন্ধ বিশ্বাস,” আমি খুব দ্রুত বললাম। “এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে ও আমাকে নিষেধ করেছিলো।” মনে হলো না এতে যথেষ্ট বলা হয়েছে; ওকে যতোটা সম্ভব সম্ভষ্ট করার চেষ্টা করলাম। “এটা আসলে আমারই ভুল, আমিই তাকে এগুলো বলার জন্যে জোর করছিলাম।”
“কেন?”
“লরেন তোমার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছিলো আমাকে সম্ভবত ও আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিলো। তাছাড়া ওদের দলের বড়ো একটা ছেলেও এর জন্যে দায়ি। ও বলছিলো যে, তোমাদের পরিবারের কোনো সদস্যই নাকি কোনো পার্টিতে অংশ নেবে না। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওই ছেলেটা ভিন্ন কোনো অর্থে হয়তো কথাগুলো বলছে। সুতরাং জ্যাকবকে ধরে বসলাম। কৌশলে ওই ছেলের বলা কথাগুলোর অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম,” সমর্থন জানানোর ভঙ্গিতে বললাম আমি।
ও হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকালো।
“ওকে কিভাবে প্রতারণা করলে?” ও জিজ্ঞেস করলো।
“আমি ওর সাথে একটু মিথ্যে প্রেমের অভিনয় করে দেখানোর চেষ্টা করলাম আমি যতোটা ভেবেছিলাম, তার চাইতে অনেক ভালো ফল দিলো।” কণ্ঠস্বরে এক ধরনের অবিশ্বাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম।
“আমি দেখতে পেলে বেশ মজা পেতাম।” হালকাভাবে মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করলো ও। “মানুষকে প্রতারণা করার অভিযোগে আমি কিন্তু তোমাকে অভিযুক্ত করতে পারি- হায়রে বেচারা জ্যাকব ব্ল্যাক্।”
জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে আমি রাতের অন্ধকার দেখতে লাগলাম।
“এরপর তুমি কি করলে?” মিনিট খানিকের ভেতরই ও প্রশ্ন করলো।
“ইন্টারনেট খুলে এ বিষয়ে কিছু জানার চেষ্টা করলাম।”
“আর তাতেই তুমি উৎসুক হয়ে পড়লে?”
ওর কণ্ঠে এক ধরনের উৎসাহ লক্ষ করলাম। কিন্তু ওকে স্টেয়ারিং হুইলটা দু’হাতে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে দেখলাম।
“না। কিছুই আমি মেলাতে পারলাম না। সবই যুক্তিহীন সব তথ্যের সমাহার। এবং তারপর “ আমি থেমে গেলাম।
“কি?”
“মনে হলো এইসব তথ্যের আসলে কোনো মূল্যই থাকতে পারে না,” আমি ফিসফিস্ করে বললাম।
“এগুলোর কোনো মূল্যই খুঁজে পেলে না?” ওর কণ্ঠস্বর তার দিকে তাকাতে বাধ্য করলো- আমি অতি সাবধানে তার ক্রোধের মুখোশটা ভাঙার চেষ্টা করলাম। ওর চেহারায় একই সাথে ক্রোধ এবং ভয় মিশে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভয় পেলাম আমি।
“না,” শান্ত কণ্ঠে বললাম আমি। “তুমি কি সেটা আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়।”
ওর কণ্ঠে অবশ্য আমি উপহাস লক্ষ করলাম। “আমি যদি দানব হয়ে থাকি, তাহলে তোমার কিছু যায় আসে না? আমি যদি মানুষ না হয়ে থাকি, তাতেও কিছু যায় আসে না?
“না।”
ও চুপ করে থাকলো। এখন আবার তার সোজা সামনের দিকে দৃষ্টি। ওর চেহারা থমথম করছে।
“তুমি ক্ষেপে আছো,আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “আমার আর আসলে কিছুই বলা উচিত নয়।”
“না,” ও বললো, কিন্তু ওর কণ্ঠ তার মুখের মতোই কঠিন বলে মনে হলো। “বরং তুমি কি চিন্তা করছে তা নিয়ে আমার ভাবনা হচ্ছে- এমনকি মনের অজান্তে তোমার চিন্তাগুলোও।”
“সুতরাং আমি আবার ভুল করেছি?” চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্ন করলাম তাকে।
“আমি নিশ্চয়ই তোমাকে এমন কিছু বলিনি। এটা কোনো ব্যাপারই নয়।” পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করে ও দাঁতে দাঁত চাপলো।
“আমি ঠিক বলেছি?” আমি হা করে নিঃশ্বাস নিলাম।
“এটা কি কোনো বিষয়?”
আমি গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলাম।
“সত্যিকার অর্থে তেমন নয়।” কথাটা বলতে গিয়ে আমি খানিক বিরতি দিলাম। “কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আমার খানিক কৌতূহল আছে।” আমার কণ্ঠ যতোটা সম্ভব সংযত করার চেষ্টা করলাম।
আকস্মিক ও আগের মূর্তিতে আবির্ভূত হলো। “তুমি এই বিষয়গুলো নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলে কেন?”
“তোমার বয়স কতো হলো?”
“সতেরো,” দ্রুত ও জবাব দিলো।
“তারপর, তুমি আর কত দিন সতেরো বছরে ঝুলে থাকবে?”
এ্যাডওয়ার্ডের ঠোঁটজোড়া একবার কেঁপে উঠলো, আবার ও সরাসরি রাস্তার দিকে তাকালো। “খানিকক্ষণ” অবশেষে ও সমর্থন জানালো।
“ঠিক আছে, আমি একটু হাসলাম। সন্তুষ্ট হলাম এই ভেবে যে, ও এখন পর্যন্ত আমার প্রতি বিশ্বাসী। ও পাল্টা একটু হাসলো।
“হাসবে না- কিন্তু তুমি দিনের বেলায় বাইরে বের হও কীভাবে?”
ও আগের মতোই হাসতে লাগলো। “মিথ।”
“সূর্যের আলোয় যন্ত্রণা হয়?”
“মিথ।”
“কফিনের ভেতর ঘুমাও?”
“মিথ।” একটু ইতস্তত করলো এবং ওর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ করলাম। “আমি ঘুমোতে পারি না।”
ওর কথাটা হজম করতে আমার খানিকক্ষণ সময় লাগলো। “একেবারে নয়?”
“কখনোই নয়।” ও বললো। ওর কণ্ঠস্বর আমার কাছে অচেনা বলে মনে হলো। ও চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকালো। ওর সোনালি চোখ আমাকে আকৃষ্ট করে ফেললো। সাথে সাথে আমি চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললাম। এ্যাডওয়ার্ড অন্যদিকে তাকানোর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“এখন পর্যন্ত তুমি আমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটাই করোনি।” ওর কণ্ঠস্বর এখন কঠিন কোণালো এবং যখন ও আবার আমার দিকে ফিরে তাকালো- দেখলাম এক শীতল দৃষ্টি।
ওর কথা শুনে আমি চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেলাম।
“কোন প্রশ্নটা?”
“আমার খাবার সম্পর্কে তোমার কোনো ধরণা আছে?” ওর প্রশ্নের ভেতর একরাশ বিদ্রূপ ঝরে পড়লো।
“ওহ্,” আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ওই প্রশ্ন?”
“হ্যাঁ, ওই প্রশ্ন।” নীরস কণ্ঠে বললো। “আমি রক্তপান করি কি না তা জানতে চাও না?”
আমি ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে গেলাম। “ভালো, জ্যাকব এ ধরনের কিছু একটা বলছিলো।
“জ্যাকব কি বলছিলো?” ও সরাসরি প্রশ্ন করলো আমাকে।
“ও বলছিলো, তুমি কখনোই- তুমি কখনোই মানুষের ক্ষতি করো না। ও বলছিলো, তোমার পরিবার মনে হয় না ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। কারণ পরিবারের একমাত্র তুমিই হচ্ছে শিকারি প্রকৃতির।”
“ও বললো যে, আমরা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির নই?” ওর কণ্ঠে এক ধরনের সন্দেহ।
“তেমনও ঠিক নয়। ও বলছিলো মনে হয় না তোমার পরিবারের কেউ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারো। তবে কু্যইলেটরা এখনো তাদের ভূমিতে থাকতে দিতে রাজি নয়।”
ও সামনের দিকে তাকালো, কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারবো না, আদৌ সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, নাকি নেই।
“সুতরাং ও-কি ঠিক বলেনি? মানুষ শিকারের প্রসঙ্গে বলছিলোম?” যতোটা সম্ভব আমার কণ্ঠকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
“কুইলেটদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে,” ফিসফিস্ করে বললো।
আমি বিষয়টাকে এক ধরনের সত্য বলে ধরে নেবার চেষ্টা করলাম।
“যদিও এতে তোমার আত্নতৃপ্তি লাভের তেমন কোনো সুযোগ নেই,” ও আমাকে সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে বললো। “ওরা আমাদের কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে ভালোই করেছে। আমরা এখনো ভয়ঙ্কর।”
“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“আমরা চেষ্টা করছি,” শান্ত কণ্ঠে ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করলো। “আমরা সাধারণত খুবই শান্ত প্রকৃতির, সবাই যেমন আমাদের দেখে থাকে। মাঝে মাঝে আমরা ভুলও করি। উদাহরণ হিসেবে আমার কথাই ধরা যাক, তোমার সাথে আমাকে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে।”
“এটা কি কোনো ভুল?” একরাশ দুঃখ ঝরে পড়লো আমার কণ্ঠ থেকে। তবে আমি জানতাম না, ও এতো ভালো।
“একজন ভয়ঙ্কর মানুষের সাথে অবস্থান করা কি ভুল নয়?” ও বিড়বিড় করলো।
এরপর উভয়েই আমরা চুপ মেরে গেলাম। আমি দেখতে পেলাম হেড-লাইটের রাস্তায় বাঁধা পেয়ে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আলোর এই ভিন্নতা খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে অনেকটা যেন ভিডিও গেমের মতো। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে দেখে আমার ভয় হলো ভয় হলো এ কারণে যে, ওর সাথে একান্ত সান্নিধ্যে থাকার এ রকম সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না- এতোটা খোলামেলা, এখন আর আমাদের মাঝে কোনো দেয়াল নেই। ওর শেষের দিককার কথাগুলো মনে পড়লো, এবং সাথে সাথে নতুন পরিকল্পনা সাজাতে লাগলাম। আমি এক মিনিটও নষ্ট করতে চাইলাম না।
“আমাকে আরো কিছু বলো,” হতাশ কণ্ঠে বললাম। ও কী বলছিলো তা আমার কোণার ইচ্ছে নেই, শুধু আরেকবার আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই।
ও এক ঝটকায় আমার দিকে ফিরে তাকালো। “আর কি কি জানতে চাও তুমি?”
“বলো যে, মানুষের বদলে কেন তুমি জীব-জন্তু শিকার করে বেড়াও?” উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে আমি তাকে বললাম। বুঝতে পারলাম আমার চোখ ভিজে উঠেছে।
“আমি কোনো দানব হতে চাই না।” ওর কণ্ঠ শান্ত কোণালো।
“কিন্তু জীব-জন্তুও তো খুব একটা বেশি নেই?” ও একটু থামলো। “অবশ্যই এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। কিন্তু তুলনামূলকভাবে টফু এবং সয়া সিঙ্কের ওপর নির্ভর করা আমাদের জন্যে অনেক সহজ- ঠাট্টা করে নিজেদের আমরা ভেজিটেরিয়ান বলে থাকি। সবসময় আমাদের ক্ষুধাও অনুভব হয় না- খুব একটা তৃষ্ণাও পায় না। কিন্তু যতোটা শক্তি প্রয়োজন, তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী আমরা শুধুমাত্র এগুলোর ওপর নির্ভর করেই। সবসময়ই আমাদের ভেতর এক ধরনের একটা শক্তি থাকে। ওর কথাগুলো আমার কাছে অদ্ভুত মনে হলো। “মাঝে মাঝে অন্যান্যদের কাছে এগুলোকে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে।”
“তুমি কি এখনো অদ্ভুত নও?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি এখন ক্ষুধার্ত নও,” বেশ আত্নবিশ্বাসের সাথে বললাম সরাসরি, কোনো প্রশ্ন নয়।
“তোমার এরকম ভাবার কারণ?”
“তোমার চোখ। আমি তোমাকে বলতে পারি, আমার একটা তত্ত্ব আছে। আমি ওই মানুষগুলোকে চিনতে পারি- নির্দিষ্ট কিছু মানুষ যখন ওরা ক্ষুধায় কাতর হয়ে ওঠে।”
ও মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলো। “তুমি তো শুধুমাত্র একজন পর্যবেক্ষক, তাই নয় কি?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না; শুধু তার হাসির শব্দ উপভোগ করার চেষ্টা করলাম।
“এ্যামারট- এর সাথে উইকেন্ডে তোমরা শিকারে বেরুচ্ছো?” ওকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ, অল্পক্ষণ ও চুপ করে থাকলো। ইতস্তত করলো, আমার প্রশ্নের জবাব দেবে, কি দেবে না। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু এটা জরুরি।
“তুমি যেতে চাইছো না কেন?”
“এটা আমাকে আমার খুব খারাপ লাগছে আসলে তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।” ওকে শান্ত মনে হলেও চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। মনে হলো ওই চোখের দৃষ্টিতে আমার হাড়গুলোও নরম হয়ে যাবে। “যখন তোমাকে সাগরে লাফ দিতে নিষেধ করেছিলাম অথবা গত বৃহস্পতিবার যখন তোমার ওপর গাড়ি উঠে পড়েছিলো, আমি কিন্তু মোটেও তোমার সাথে তামাশা করিনি। আমি একটা বিষয় বেশ ভালো বুঝতে পেরেছি, প্রতিটা উইকেন্ডে তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তায় থাকতে হয়। তাছাড়া আজ রাতের ঘটনা, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, সমস্ত উইকেন্ডে এই ক্ষতি কথা তোমাকে তাড়া করে ফিরবে।” এ্যাডওয়ার্ড মাথা নাড়লো। “যদিও সম্পূর্ণ ক্ষতিগুগ্রস্ত হও নি।”
“কি?”
“তোমার হাত,” ও আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল। আমি তালুর দিকে তাকালাম। তালুর উঁচু অংশটুকুর ওপরকার আঁচড়ের দাগ প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ওর আসলে কিছুই নজর এড়ায় না।
“আমি পড়ে গিয়েছিলাম,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।
“তেমনই চিন্তা করেছিলাম।” ঠোঁট বাঁকা করে বললো ও। “আমার ধারণায়, এর চাইতেও মারাত্নক কিছু একটা ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিলো না। আর যদি ওই সময় আমি দূরে সরে থাকতাম, তাহলে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আমার কাছে ওই তিনটা নিঃসন্দেহে দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে ও হাসলো।
“তিনদিন? তুমি আজই ফিরে আসছো না?”
“না, আমরা রবিবার ফিরে আসছি।”
“তাহলে তোমাদের স্কুলে দেখা যাচ্ছে না কেন?” হতাশ কণ্ঠে বললাম আমি। ওর অনুপস্থিতে আমি যে কতোটা হতাশ, সেটা আর ঢাকা দিতে পারলাম না।
“ভালো কথা, তুমি জানতে চেয়েছিলে, সূর্য আমাদের যন্ত্রণার সৃষ্টি করে কিনা, কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হয় না আমাদের। কিন্তু আমি সূর্যের আলোতে বেরুতে পারি না, অন্তত সবাই সূর্যের আলোতে সবকিছু যেমন দেখতে পারে।
“কেন?”
“মাঝে মাঝে অবশ্য আমি তোমাকে দেখতে পাই,” ও প্রতিজ্ঞা করলো।
ওর কথাগুলো নিয়ে আমি খানিকক্ষণ ভাবলাম।
“তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ডাকতে পারতে,” আমি মন্তব্য করলাম।
ওকে বিভ্রান্ত মনে হলো। কিন্তু আমি জানি যে তুমি নিরাপদেই আছো।”
“কিন্তু তুমি কোথায় আছে, সেটাই তো জানতাম না। আমি-” খানিকটা ইতস্তত করে চোখ নামিয়ে নিলাম।
“কি?” ওর মোলায়েম কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম।
“আমি এটা পছন্দ করি না। তোমাকে দেখতে না পেলে আমার ভালো লাগে না। এতে আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠি।” আমি চাইছিলাম চিৎকার করে কথাগুলো তাকে জানিয়ে দিই। ১৪৪
“আহ্,” ও খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করলো।” এটা কিন্তু তোমার অন্যায়।”
ওর জবাব ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি কি বলেছিলাম?”
“বেলা, তুমি কি বুঝতে পারো না? আমাকে মূল্যায়নের জন্যে একটা বিষয়ই যথেষ্ট কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে তা একেবারে ভিন্ন। যেমন হওয়ার কথা, আসলে তুমি তেমনই।” ও রাস্তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ওর কথা আমি খুব সহজে অনুধাবন করতে পারলাম। আমি জানতাম না, কথাগুলো কোণার পর তোমার এ ধরনের অনুভূতি হবে।” কথাগুলো শান্ত কণ্ঠে বললো বটে, তবে এর ভেতর আলাদা এক ধরনের তাড়া অনুভব করলাম। ওর কথাগুলো শুনে আমি মর্মাহত হলাম। “এটা ভুল। এটা একেবারেই নিরাপদ নয়। বেলা, আমি খুবই ভয়ঙ্কর; দয়া করে তুমি বিষয়টা স্মরণে রাখার চেষ্টা করবে।”
“না।” জেদি বাচ্চার মতো সাথে সাথে আমি প্রতিবাদ জানালাম।
আমি কিন্তু বুঝে শুনেই কথাটা বলেছি।
“আমিও তোমাকে সেই কথাটাই বুঝিয়ে দিতে চাই, সেটা আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়, সবকিছুতে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে।
ওর কণ্ঠস্বর চাবুকের মতো আমাকে আঘাত করলো। “কখনোই তুমি এভাবে বলবে না।”
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। কিন্তু ওর কথায় আমি যে কতোটা মর্মাহত হয়েছি, ও মোটেও তা বুঝতে পারলো না। জানালা দিয়ে আবার আমি রাস্তার দিকে তাকালাম। এখন আমরা ইচ্ছে করলেই একে-অপরের একান্ত সান্নিধ্যে আসতে পারি। এ্যাডওয়ার্ড আবার সেই দ্রুত বেগেই গাড়ি চালাতে শুরু করেছে।
“তুমি কি কাঁদছো?” সরাসরি প্রশ্ন করলো আমাকে। আমি বুঝতে পারিনি, ওই দানব আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সবকিছুই লক্ষ করছে। আমি দ্রুত গাল মুছলাম, ভেজা হাত দেখে বুঝলাম, মনের অজান্তেই কখন যেন চোখের পানিতে আমার গাল ভিজে উঠেছে- নিজের সাথে নিজের মনই আমার প্রতারণা করেছে।
“না,” কথাটা আমি ভালোভাবে বলতে পারলাম না। তার আগেই গলাটা ভেঙে এলো।
দেখতে পেলাম, খানিকটা ইতস্তত করে ওর ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। তবে ক্ষণিকের জন্যে আবার সেটা ফিরিয়ে নিয়ে স্টেয়ারিং হুইলের ওপর স্থাপন করলো।
“আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” ওর দুঃখ প্রকাশ আমার যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে তুললো। যদিও জানি, মর্মাহত হওয়ায়, নিছক সান্ত্বনা দেবার কারণে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেনি।
দেখতে পেলাম, অন্ধকার নিঃশব্দে শুধুমাত্র পিছিয়েই যেতে দেখলাম।
“আমাকে কিছু একটা বলল,” মিনিট খানিক চুপ করে থাকার পর ও আমাকে বললো। এবং এটাও বুঝতে পারলাম, সহজভাবে কথা বলার জন্যে ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
“হ্যাঁ, বলবো?”
“ও কোণায় আসার আগে, আজ রাতে তুমি কি চিন্তা করছিলে? তোমার অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বুঝতে পারিনি- তুমি ওই ক্ষত দেখতে পাওনি। অন্য কিছু তোমার মনোযোগ গভীরভাবে আকর্ষণ করে রেখেছিলো।”
“আক্রমণকারীকে কীভাবে পরাস্ত করা যায়, সেটাই স্মরণ করার চেষ্টা করছিলাম তুমি জানো নিশ্চয়ই, আত্নরক্ষার কৌশল খুঁজছিলাম। আমি ওর নাকটা থেঁতলে দিতে চেয়েছিলাম।” ওই কালো চুলের লোকটার কথা আমার মনে পড়লো।
“তুমি কি ওদের সাথে লড়তে চাইছিলে?” ওকে দেখে হতাশ মনে হলো। “তুমি কি একবারো পালানোর কথা চিন্তা করোনি?”
“আমি দৌড়াতে গিয়ে অনেকবারই পড়ে যাই,” স্বীকার করতে বাধ্য হলাম।
“সাহায্যের জন্যে চিৎকার করলে না কেন?”
“খানিকটা চেষ্টাও করেছিলোম।”
ও মাথা নাড়লো। “তুমি ঠিকই বলেছো- আমি নিঃসন্দেহে ওদের সাথে মারামারি করে তোমাকে অক্ষত ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম।”
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে এলো। ফরকস্-এর সীমানা ঘেঁষে এগুতে লাগলাম। শহরে পৌঁছতে আর মাত্র বিশ মিনিটেরও কম সময় লাগবে।
“আগামীকাল কি তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে?” আমি জানতে চাইলাম।
“হ্যাঁ- আমার কিছু কাগজ জমা দেবার আছে।” ও হাসলো। লাঞ্চের সময় আমি তোমাকে সময় দিতে পারবো।”
আজ রাতে যা কিছু ঘটেছে, সবই আমার কাছে হালকা বলে মনে হচ্ছে, সেখানে হালকা একটা অঙ্গিকার কতোটুকুই বা মূল্যবান হতে পারে।
আমরা চার্লির বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়ির আলো এখনো জ্বলছে, ট্রাকটা আগের জায়গাতেই আছে, সবকিছুই একেবারে স্বাভাবিক। মনে হতে পারে হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে যাবার মতো। এ্যাডওয়ার্ড গাড়ি দাঁড় করালো, কিন্তু আমি নড়লাম না।
“তুমি প্রতিজ্ঞা করেছে, আগামীকাল ওখানে থাকবে?”
“আমি প্রতিজ্ঞা করছি।”
আমি একটুক্ষণ চিন্তা করে মাথা নাড়লাম- জ্যাকেটটা খুলে শেষবারের মতো ওটা থেকে গন্ধ শুষে নিলাম।
“তুমি ওটা রেখে দাও- কালকে পরার মতো কোনো জ্যাকেট আবার খুঁজে পাবে না,” ও আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো।
“কিন্তু আমি ওটা এ্যাডওয়ার্ডের হাতে ফিরিয়ে দিলাম। “চার্লির কাছে আমি কোনো জবাবদিহি করতে চাইছি না।”
“ওহ্, তুমি ঠিকই বলেছো।” ও সমর্থন জানালো।
আমি ইতস্তত করলাম, গাড়ির হ্যাঁন্ডেলের ওপর হাত রাখলাম, চেষ্টা করলাম যতোটা কালক্ষেপণ করা সম্ভব।
“বেলা?” ও ভিন্ন এক কণ্ঠে আমাকে ডাকলো- গম্ভীর, কিন্তু একটুক্ষণ ইতস্তত করলো।
“হ্যাঁ বলো?” বেশ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।
“তুমি কি আমার কাছে কোনো প্রতিজ্ঞা করেছো?”
“হ্যাঁ,” আমি বললাম, এবং সাথে সাথে ওর সাথে শর্তহীন যে চুক্তি হয়েছিলো, তা মনে পড়ে গেল। ওর কাছ থেকে আমাকে দূরে থাকতে বলেছিলো? আমি ওই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে চলেছি।
“বনের ভেতর একা যাবে না।”
দুর্বোধ্য অনুভূতি নিয়ে আমি তার দিকে তাকালাম। “কেন?”
ও ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।
“আমি সবসময় ভয়ঙ্কর কাজগুলো ওখানে করি না। এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।”
ওর নীরস কণ্ঠ শুনে আমি একবার কেঁপে উঠলাম, কিন্তু এক ধরনের স্বস্তিবোধ করলাম। অন্ততপক্ষে, প্রতিজ্ঞার প্রতি সম্মান জানিয়েছে। “তুমি যে রকম বলো।”
“আমার সাথে কাল আমার দেখা হচ্ছে,” ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো। বুঝতে পারলাম ও এখন আমাকে যেতে বলছে।
“আগামীকাল তাহলে।” অনিচ্ছুকভাবে আমি দরজা খুললাম।
“বেলা?”
আমি সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম। ও আমার দিকে ঝুঁকে এলো, ওর শান্ত-সুন্দর আমার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। আমার হৃৎস্পন্দন প্রায় থেমে যাবে বলে মনে হলো।
“ভালোভাবে ঘুমাবে,” ও বললো। ওর নিঃশ্বাস আমার মুখে এসে লাগলো, আমাকে প্রায় হতভম্ব করে দিলো। একই ধরনের গন্ধ আমি ওর জ্যাকেটে পেয়েছিলাম, কিন্তু বেশ তীব্র গন্ধ। আমি চোখ পিটপিট করে আড়চোখে ওর দিকে তাকালাম। আবার ও স্ব-অবস্থানে ফিরে গেল।
মাথার চিন্তার জটগুলোকে যতোক্ষণ না ছাড়াতে পারলাম, আমি গাড়ি থেকে নামতেও পারলাম না। এরপর গাড়ির বাইরে পা রাখলাম, ভারসাম্য রক্ষা করতে একবার গাড়ির দরজা আঁকড়ে ধরলাম। ভেবেছিলাম, ও হয়তো এতে সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিন্তু ক্ষণিকের ভেতর আমি আর কোনো শব্দই শুনতে পেলাম না।
এ্যাডওয়ার্ড সামনের দরজাটা লাগানোর জন্যে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করলো। এরপরই ইঞ্জিনের শব্দ তুলে সোনালি রঙের গাড়িটা কোণার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এততক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমার অসম্ভব ঠাণ্ডা লাগছে।
ব্যাগ থেকে অনেকটা যন্ত্রের মতো চাবি বের করে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলাম।
লিভিং রুম থেকে চার্লির ডাক শুনতে পেলাম। “বেলা?”
“হ্যাঁ, বাবা আমি।” ভেতরে ঢুকে আমি তাকে দেখতে পেলাম। উনি টেলিভিশনে বেস বল খেলা দেখছেন।
“খুব যে তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?”
“তাই নাকি?” আমি অবাক হয়ে বললাম।
“এখনো তো আর্টটাই বাজেনি,” উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। “ওই মেয়েদের সাথে মজা পেলে?”
“হ্যাঁ,- খুবই মজা পেয়েছি।” আজ বিকেলের পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। “ওরা পোশাক কিনতে পেরেছে।”
তুমি কি ভালো আছো?”
“আমি শুধু একটু ক্লান্ত। আজ আমাকে অনেক হাঁটতে হয়েছে।”
“তোমার তাহলে এখন শুয়ে পড়া উচিত।” ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন। আমার চেহারায় এমন কি ক্লান্তির ছাপ পড়েছে, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
“জেসিকাকে প্রথমে আমার একটু ফোন করতে হবে।”
“তুমি কি ওর সাথে ছিলে না?” অবাক হয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন।
“হ্যাঁ-কিন্তু ওর গাড়িতে আমার জ্যাকেটটা থেকে গেছে। কাল ওটা নিয়ে আসতে যেন ভুল না করে, আমি তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।”
“ভালো কথা, কিন্তু তাকে বাড়ি ফেরার সময় তো দেবে।”
“অবশ্যই,” আমি তাকে সমর্থন জানালাম।
কিচেনে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। এখন আমার প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছে।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠায় আমি আঁতকে উঠলাম। হুক থেকে রিসিভার হাতে তুলে নিলাম।
“হ্যালো?” নিঃশ্বাস চেপে আমি প্রশ্ন করলাম।
“বেলা?”
“আরে জেস, আমি এখনই তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”
“তুমি বাড়ি পৌঁছেছো?” ওর কণ্ঠে স্বস্তি লক্ষ করলাম একই সাথে ও খানিকটা বোধহয় অবাকও হয়েছে।
“হ্যাঁ, ভুল করে আমার জ্যাকেটটা তোমার গাড়িতে থেকে গেছে- কষ্ট করে কি আগামীকাল ওটা আনতে পারবে?”
“অবশ্যই। কিন্তু এখন তুমি বলো, কী ঘটেছিলো” ওর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
“উম, সবই বলবো, তবে কালকে- ত্রিকোণমিতি ক্লাসে, ঠিক আছে?”
ও বিষয়টা বোধহয় দ্রুত বুঝতে পারলো। “ওহ্, ওখানে বুঝি তোমার বাবা আছেন?”
“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছে।”
“ঠিক আছে, তোমার সাথে কালকেই না হয় কথা হবে। শুভরাত্রি।” ওর কণ্ঠের হতাশ হওয়ার সুর ঠিকই লক্ষ করলাম।
“শুভরাত্রি জেস।
আমি সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলাম, আমার মনের ভেতর বিক্ষিপ্ত সব চিন্তা খেলা করছে। আমি এলোমেলো পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যি বলতে নিজেও জানি না কী করতে যাচ্ছি- কী করছি সেটাও বুঝতে পারছি না। এমনকি এখন পর্যন্ত আমার গোসল পর্যন্ত সারা হয়নি- পানি দেখলাম অত্যাধিক গরম, কিছু না বুঝে সরাসরি শাওয়ার খুলে ফেলায় শরীরে যন্ত্রণা অনুভব করলাম- অবশ্য বুঝতে পরলাম এতোক্ষণ ঠাণ্ডায় জমে ছিলাম। কিন্তু ওই গরম পানিকে ভয় পেলাম না। প্রে দিয়ে সমস্ত শরীরে পানি ছিটাতে লাগলাম-উত্তেজনায় টানটান হয়ে থাকা মাংসপেশীগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো।
শাওয়ারের নিচ থেকে আমি সরে এলাম, তোয়ালে দিয়ে শরীরকে খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলাম। সত্যিকার অর্থে এতোক্ষণ গরম হয়ে ওঠা শরীর থেকে আমি একটুও গরম বেরিয়ে দিতে চাই না। দ্রুত শোবার পোশাক পরে নিয়ে আমি কম্বলের নিচে ঢুকে বলের মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলাম। আমি উষ্ণতার জন্যে মারিয়া হয়ে উঠেছি।
আমার মাথা এখনো এলোমেলো মনে হচ্ছে, কোনো দৃশ্যই সম্পূর্ণভাবে দেখতে পারছি না, আবার কিছু কিছু দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
তিনটা বিষয়ে আমি একেবারে নিশ্চিত। প্রথমত এ্যাডওয়ার্ড সত্যিই একজন ভ্যাম্পায়ার। দ্বিতীয়ত ওর পৃথক একটা সত্ত্বা আছে এবং আমি ঠিক জানি না ওর সেই পৃথক সত্ত্বা কতোটা ক্ষমতাশালী হতে পারে- ওই সত্ত্বা হয়তো আমার রক্তের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। এবং তৃতীয়ত, আমি কোনো শর্তে যেতে রাজি নই, যেভাবেই হোক ওকে আমি ভালোবেসে যাবো।