৭. জ্ঞান, বিজ্ঞান, অজ্ঞানতা
গত পাঁচ বছরে ভারতের কিছু ক্ষমতাসীন মানুষের কাছ থেকে আমরা কখনও পৌরাণিক, কখনও প্রাকৃতিক জগৎ সম্বন্ধে এই উক্তিগুলি শুনেছি:
• গণেশের দেহে হাতির মাথা প্রতিস্থাপনের কাহিনি প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল।
• রামায়ণে পুষ্পক রথের উল্লেখ প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতে উড়োজাহাজ ছিল।
• মহাভারতে সঞ্জয়ের দূর থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দর্শন প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতে টেলিভিশন ছিল।
• গোরুর নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন নির্গত হয়।
• গোবরের ক্ষমতা আছে তেজস্ক্রিয়তা শুষে নেবার।
• গোরুর শিং বেয়ে মহাজাগতিক শক্তি প্রবাহিত হয়।
• ময়ূর যৌনসঙ্গম করে না, তাদের প্রজনন ঘটে পুরুষ ময়ূরের অশ্রু থেকে।
উক্তিকারদের মধ্যে আছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, এক মুখ্যমন্ত্রী, এক শিক্ষামন্ত্রী এবং উচ্চ ন্যায়ালয়ের এক বিচারপতি। স্বস্তির কথা, কোনও বিজ্ঞানী নেই। তবে নামী বিজ্ঞানকেন্দ্রের কিছু কিছু পাঠক্রম, গবেষণা এবং আলোচনার বিবরণ থেকে অনুমান হয়, ভয়ে বা ভক্তিতে বা অনুদানের আশায় কিছু বিজ্ঞানী এমন উক্তি সমর্থন করতে বিলক্ষণ রাজি হবেন।
শান্তিপ্রিয় লোকে বলবেন, এতে বিচলিত হবার কী আছে? জ্যোতিষশাস্ত্রে কত কী বলে, যারা মানে না তারাও শুনে যায়, এই কথাগুলো নিয়ে এত হইচই কেন? এর একটা উত্তর, জ্যোতিষশাস্ত্রের দাবি সবাই সব সময় চুপচাপ শুনে যান তা নয়, ঠাট্টা করেন বা যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করেন— বেশি মাত্রায় করে প্রাণও দিয়েছেন কেউ কেউ, ভারতে ও প্রতিবেশী দেশে। বৌদ্ধিক স্তরে আর একটা উত্তর আছে: জ্যোতিষশাস্ত্র একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, তার গণ্ডীর ভিতর যে যাই বলুক ভাবুক, বিজ্ঞানীদের তোয়াক্কা করার দরকার নেই। উপরের উক্তিগুলো সরাসরি বিজ্ঞানের জমি দখলের চেষ্টা করছে; এবং তা করছে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে নয়, অর্থাৎ প্রমাণ ও যুক্তি সাজিয়ে নয়, বরং একেবারেই বিনা ব্যাখ্যায় স্রেফ ঘোষণা করে অর্থাৎ বিশ্বাসের স্তরে।
সৎ বিশ্বাস বিশ্বাসবস্তুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, তা উপস্থাপন করে স্থিরবুদ্ধি সংযতভাবে, এবং নিজের মতো করে বোঝাবার চেষ্টা করে। উপরোক্ত দাবিগুলি কিন্তু নিছক দাবি, ‘মানতে হবে’ গোছের আস্ফালন— বৌদ্ধিক উক্তি নয়, ক্ষমতার প্রকাশ। যাঁরা দাবি করছেন তাঁরা যে ক্ষমতাবান লোক তা নেহাত কাকতালীয় নয়। কারও কারও প্রথাগত শিক্ষা, এমনকী বিজ্ঞানশিক্ষা, এত উচ্চমানের যে সন্দেহ হয় তাঁরা নিজেরাও কথাগুলো বিশ্বাস করেন না, পেশিপ্রদর্শনের জন্যই বলছেন। তাঁদের অনুচরদের পেশিপ্রদর্শন আক্ষরিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারে: মোটেই অসম্ভব নয় যে গোরুর শিংয়ের শক্তিপ্রবাহ অস্বীকার করে কারও প্রাণ যাবে। এমন উক্তির সদম্ভ উচ্চারণে শিক্ষিত যুক্তিপন্থী সমাজকে ভেংচি কাটা হয়, কোণঠাসা করা হয়, তাঁদের অসহায়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়। তৃতীয় অধ্যায়ে যে বাচনক্রিয়া তত্ত্বের উল্লেখ করেছি, তার নিরিখে বলা যায় এই উক্তিগুলি জ্ঞানের বার্তা নয়, আধিপত্যের হুঙ্কার।
এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব, কিন্তু আগে বিষয়টার বৌদ্ধিক দিক আর একটু দেখা যাক। এখনই বললাম, জ্যোতিষ বা অন্য প্রচলিত যুক্তিমুক্ত চর্চার চেয়ে এই উক্তিগুলি বেশি আলোচিত হয়, অনেক লোককে বেশি বিচলিত করে, কারণ এগুলি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের এলাকায় হানা দিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করছে: এ হল সরাসরি অপবিজ্ঞান। জ্যোতিষ সম্বন্ধে এ কথা বলা হয় যখন তা আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব ব্যবহার করে, কিন্তু এমন ভাবে যা বিজ্ঞানীরা মানবেন না। অর্থাৎ আপত্তিটা মূলত প্রসঙ্গ আর উদ্দেশ্য নিয়ে। যদি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে পড়ি কেউ বহুদূরের ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছে (অন্তত একটা এমন গল্প আছে, এইচ জি ওয়েলসের লেখা১০০), বা গোবর তেজস্ক্রিয়তা রোধ করছে (প্রোফেসর শঙ্কুর কিছু আবিষ্কার এই গোছের ঘরোয়া উপকরণ নিয়ে), আমরা কখনই আপত্তি করব না, বরং উপভোগ করে পড়ব। অথবা বিজ্ঞানীরা যদি সত্যিই পরীক্ষা করে প্রমাণ পান যে গোবর তেজস্ক্রিয়তা রোধ করে, সেই অসামান্য আবিষ্কারকে আমরা দু হাত তুলে সাধুবাদ জানাব, দুনিয়া জুড়ে শোরগোল পড়ে যাবে। সমস্যা হয় যখন বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে রেখাটা মুছে যায়, কল্পকাহিনির বস্তুকে বিনা ব্যাখ্যা-প্রমাণে বাস্তব বলে চালানোর চেষ্টা হয়। সব সময় বিনা ব্যাখ্যাতেও নয়: কোনও অবাস্তব তত্ত্বের সমর্থনে বৈজ্ঞানিক ঢঙে যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ সাজিয়ে প্রমাণের উপচার খাড়া করা হয়। মুশকিল একটাই, তার ভিত্তি বা সূত্রপাত একটা অপরীক্ষিত আশ্রয়বাক্য; ‘প্রমাণের’ সৌধ গড়া হচ্ছে সেই বালির ভিতের উপর।১০১
এই বুদ্ধিভ্রংশের সর্বকালীন দৃষ্টান্ত উনিশ ও বিশ শতকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিপথগামী উদ্যোগ, মানুষের বিভিন্ন জাতির মধ্যে মেধা, নীতিবোধ, কর্মক্ষমতা ইত্যাদি সদ্গুণের ভিত্তিতে শ্রেণিভেদ করার প্রচেষ্টা— অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ বা আর্যদের শীর্ষে রেখে। এই উদ্দেশ্যে প্রচুর বই লেখা হয়েছে, সারণি সাজিয়ে হিসাব কষা হয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাপ থেকে আচার-আচরণ-কৃষ্টির অশেষ লক্ষণের, বিজ্ঞানের অন্য যে কোনও অনুসন্ধানের মতো। বলা বাহুল্য, নীতি ও মানবিকতার দিক দিয়ে জঘন্য এই প্রয়াস বৈজ্ঞানিক বিচারেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে, কারণ এমন বিচারের কোনও বাস্তব ভিত্তি-প্রমাণ আজ অবধি মেলেনি। বরং দেখা গেছে, যে মাপকাঠিগুলি ওই অপবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন তার লেশমাত্র সারবত্তা নেই, পাশ্চাত্য পূর্বসংস্কারের প্রতিফলন মাত্র। সব চেয়ে বড় কথা, জিনতত্ত্ব নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে মানসিক গুণ কোন ছার, সামান্যতম শারীরিক লক্ষণও এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে অমন সরল রেখায় বাহিত হয় না, ব্যাপারটা রীতিমতো জটিল। এই অসার তত্ত্ব হাতে-নাতে প্রয়োগ হয়েছে ‘সুপ্রজনন’ বা eugenics নামক অপবিজ্ঞানের সর্বনাশা খেলায়, অর্থাৎ প্রজননকৌশল খাটিয়ে ‘উন্নততর’ জাতের মানুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। এভাবে এক ‘প্রভুর জাত’ (Herrenvolk) সৃষ্টি করতে নাৎসিরা অনেক উদ্যোগ নিয়েছিল, সেজন্য মানবদেহ নিয়ে যে পরীক্ষা হয়েছিল তা নৃশংস ও অশ্লীল। নাৎসিদের মারণ অপবিজ্ঞানের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সিদ্ধার্থ মুখার্জি একটা সাধারণ সূত্র নির্দেশ করেছেন: ‘অসার বিজ্ঞান একচ্ছত্র শাসনকে তুলে ধরে রাখে, আর একচ্ছত্র শাসন অসার বিজ্ঞান সৃষ্টি করে।’১০২
নাৎসিরা বিগত, কিন্তু এই চিন্তাধারা আজও নির্মূল হয়নি; আমাদের দেশে শিকড় গেঁথেছে অন্তত একশো বছর আগে। প্রাচীন ভারতে বর্ণাশ্রমের উদ্ভব বোঝাতে সপ্রশংস প্রয়োগ তো আছেই,১০৩ ভবিষ্যতে জাতীয় আদর্শ হিসাবে প্রস্তাব হয়েছে খোলাখুলি নাৎসি জার্মানির ইহুদিনিধনের নজির দেখিয়ে।১০৪ এই চরম পর্যায়ে না গেলেও একই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভিতর ‘গর্ভবিজ্ঞান’ নামক চর্চা ভারতে আজ প্রসারলাভ করছে। তার ঘোষিত পদ্ধতির সঙ্গে অবশ্য পাশ্চাত্য ইউজেনিক্সের সরাসরি সাদৃশ্য নেই: তা দৈহিক প্রজননের সঙ্গে যুক্ত নয়, গর্ভধারণের আগে-পরের অভ্যাসকেন্দ্রিক। আকাঙ্ক্ষিত ‘উত্তম সন্ততি’ যে বিশেষ জাতি-বর্ণের হতে হবে এমন কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিতও নেই। তবে এই পুরো বিষয়টা ঘিরে অন্তত একশো বছর ধরে যে ব্যাখ্যান গড়ে উঠেছে, তাতে পুত্রসন্তান লাভ, তার দীর্ঘ গড়ন ও ফর্সা রং, এবং আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, উত্তর বনাম দক্ষিণ ভারত ইত্যাদি নানা বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ নিয়মিত চলে আসে। এমন প্রয়াস যে বর্তমান ভারতে শুধু চিন্তায় নয়, ব্যবহারিকভাবে যথেষ্ট প্রচলিত, সে সম্বন্ধে সকলে যথেষ্ট অবগত নই।
অপবিজ্ঞান আর অতিকথার সাধারণ আলোচনায় ফিরে আসি। গল্প সম্বন্ধে চতুর্থ অধ্যায়ে যা বলেছি, তা এখানে প্রাসঙ্গিক। সাহিত্যিকের সৃষ্টির কথা বলছি না (সে বিষয়ে উপরের মন্তব্য যথেষ্ট); বলছি কোনও কেজো উদ্দেশ্যে গল্প ব্যবহারের কথা, যেমন পণ্যের বিপণনে। রাজনীতিতে পৌরাণিক অতিকথার ব্যবহার গল্পের আরও বড় মাপের ব্যবহারিক প্রয়োগ। উপরে যে অপবিজ্ঞানের উদাহরণ দিলাম, তা আদতে রাজনৈতিক অতিকথার অঙ্গ: উক্তিগুলো করছেন রাজনীতিক বা উচ্চ ন্যায়াধীশ, ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে। কিছু উক্তির উপকরণ সরাসরি পৌরাণিক, বাকিগুলো একই ঢঙে অতিপ্রাকৃত কল্পনা। থাক আর না থাক, গোরুর শিঙের মহাজাগতিক শক্তি বা ময়ূরের চোখের জলে প্রজনন পুরাণের কাহিনিতে থাকতেই পারত।
গত অধ্যায়ে দেখেছিলাম প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনি ও তত্ত্ব কীভাবে বর্তমান কালে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল উলটোমুখী দুটো কৌশল। প্রথমটায় উড়োজাহাজ টেলিভিশন প্রভৃতি একান্তভাবে আধুনিক আবিষ্কারকে পৌরাণিক যুগে নিয়ে ফেলা হচ্ছে; যে উপায়ে হচ্ছে, ইতিহাসবিদের কাছে তা আদৌ গ্রাহ্য নয়। দ্বিতীয়টায় প্রকৃতির সর্বকালীন ধারাকে অতিকথার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; সেজন্য কাল্পনিক তত্ত্ব ফাঁদা হচ্ছে, বিজ্ঞানের মানদণ্ডে যা স্রেফ আজগুবি। এইভাবে আধুনিক যুক্তিপন্থার পরিবর্তে যুক্তিবিহীন অতিকথার প্রচার চলছে— একটা আস্ত বৌদ্ধিক জগতের জায়গায় আর একটার প্রতিষ্ঠা। যুক্তি-বিজ্ঞানকে অবশ্য একেবারে নির্বাসন দেওয়া হচ্ছে না। বরং তার কাঠামো বজায় রেখে, তার মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রণালী (কেবল তথ্যগত ভুল নয়): অর্থাৎ বিজ্ঞানের মৌলিক রীতিনীতি অস্বীকার করব অথচ তার সার্টিফিকেটও নেব। কৌতুকপ্রদভাবে দেখা যায়, পৌরাণিক অপবিজ্ঞানের প্রবক্তারা আধুনিক (অতএব তাঁদের মতে পাশ্চাত্য) বিজ্ঞানকে যতই তাচ্ছিল্য করুন, দৈবাৎ ইউরোপ-আমেরিকার কোনও মুরুব্বির থেকে সেই অপবিজ্ঞানের সমর্থন জুটলে তা বড় গলায় জাহির করেন।
অপবিজ্ঞানের অবতারণা ঘটছে দেশের সর্বোচ্চ বিজ্ঞানসভায় এবং অগ্রণী বিদ্যায়তন ও গবেষণাকেন্দ্রে। জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে এটা কেবল অনুপ্রবেশ নয়, অন্তর্ঘাত। এবং খেয়াল করা দরকার, অন্তর্ঘাতটা দ্বিমুখী— অর্থাৎ কেবল বিজ্ঞানের নয়, পুরাণেরও অপব্যাখ্যা ও অবমাননা: ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যবিদদের প্রতিবাদের কারণ কিছু কম নেই। বহু বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্যোৎসাহী লোক নিশ্চয় পৌরাণিক ঐতিহ্যকে জানতে বুঝতে আগ্রহী— বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাল্পনিক সূত্র হিসাবে নয়, কাহিনি ইতিহাস দর্শন এমনকী ধর্মীয় বিশ্বাসের আকর হিসাবে; কিন্তু উদ্ভট অপব্যাখ্যার ফলে তাঁদের মনে এই পুরো ঐতিহ্য সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা জন্মাচ্ছে। সমাজের এক বৃহৎ অংশে যেমন পুরাণ আর অতিকথা নিয়ে নতুন উৎসাহ জাগছে, আর একটা অংশের ধারণা হচ্ছে যে বিজ্ঞানের যুগে এসব নেহাত অচল, আক্ষরিক অর্থেই মান্ধাতার আমলের ব্যাপার। এভাবে প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিক জ্ঞানচর্চার মধ্যে সেতুবন্ধনের বদলে অবিশ্বাস আর বিদ্বেষ জেঁকে বসছে। কৃত্রিম ও বৌদ্ধিকভাবে অসৎ (intellectually dishonest) পথে, অর্থাৎ ব্যাখ্যা এড়িয়ে যুক্তিপ্রমাণের তোয়াক্কা না করে, প্রাচীনকে আধুনিক প্রতিপন্ন করতে গেলে এমন হতে বাধ্য। এই বিদ্বেষটা কাজে লাগিয়ে কারবার ফাঁদার ব্যাপারীর অভাব নেই; তাদের বিচরণভূমি শিক্ষা নয়, রাজনীতি— বা ভীতিকরভাবে, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি।
বিদ্যার জগতে থেকে থেকে বিপ্লব ঘটে: কেবল অজানা তথ্য আবিষ্কার করে নয়, আবিষ্কারের প্রণালী ও দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে— শুধু ‘কী জানি’ নয়, ‘কীভাবে জানি’। বিজ্ঞানের জগতে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিখ্যাত বিবরণ দিয়েছেন টমাস কুহ্ন।১০৫ তিনি বলছেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি সচরাচর চলে একটা নির্দিষ্ট পথে, ধাপে ধাপে পা ফেলে। কিন্তু এভাবে এগোতে এগোতে এক সময়ে বিজ্ঞানীরা এমন আবিষ্কারে পৌঁছে যান, যা সূচনা করে বিজ্ঞানচিন্তার এক ‘ধারাপাতিক পরিবর্তন’ (paradigm shift)। গতানুগতিক বিজ্ঞানচর্চা থেকেই এই যুগসন্ধির মুহূর্তগুলো বেরিয়ে আসে। কুহ্ন বলেছিলেন তাঁর বিবরণ কেবল বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেই খাটবে, অন্যত্র নয়; কিন্তু অন্য নানা ক্ষেত্রেও— বলা যেতে পারে, সাধারণভাবে সব জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে— এই মডেলটি সফলভাবে প্রয়োগ হয়ে চলেছে।
বিজ্ঞানে অতিকথার যে অনুপ্রবেশের কথা বলছি, সেটা কি কুহ্নের বর্ণিত জ্ঞানবিপ্লবের উদাহরণ? শুধু বিজ্ঞানীরা কেন, সমস্ত বিদ্বানসমাজ এমন দাবিতে আপত্তি করবেন। তার প্রধান কারণ, কুহ্নের ‘ধারাপাতিক পরিবর্তন’ আসে জ্ঞানের প্রসার থেকে, নতুন কোনও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে নতুন কোনও আবিষ্কার নেই, কোনও যুক্তি বা প্রণালীর উল্লেখমাত্র নেই— না আনকোরা নতুন, না প্রাচীন উপাদানকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। এই শেষ কাজটা সফলভাবে করতে পারলে বিশ্ববিদ্যার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হত; কিন্তু দেখা যাচ্ছে এমন কোনও প্রচেষ্টা নেই, দাবিগুলো করা হচ্ছে ‘যা বলছি মেনে নাও’ এই মানসিকতা থেকে— যা বিজ্ঞান কেন, যে কোনও সৎ জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী। মাঝখান থেকে যুক্তিপন্থার চালু ধারাপাত একটা ধাক্কা খেল, তার চর্চা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। প্রাচীন আর আধুনিক, দুইয়ের কাটাকুটিতে যোগফল শূন্য হবার উপক্রম।
এই পরিবর্তনকে যদি বিপ্লব হিসাবে দেখতে হয়, বলতে হবে এটা পশ্চাদমুখী বা প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব, আমাদের মননের জগৎ সংকুচিত করছে; জানলাও খুলছে না, দরজাও বন্ধ হচ্ছে। দুটো বিপরীত প্রণালীর মধ্যে পড়ে আমাদের আমও যাচ্ছে ছালাও যাচ্ছে: দুটো মেলাবার অবকাশ নেই, হচ্ছে কেবল বিসদৃশের সহাবস্থান। আজকের জগতে অন্তত কেজো দরকারে যুক্তিপন্থার অভ্যাস, বিশেষত ব্যবহারিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, কিছুটা বজায় রাখতেই হয়, নইলে জীবনধারণ করা অসম্ভব; কিন্তু সেটা বাঁচিয়ে রাখতে চাই গভীরতর বৌদ্ধিক চর্চা, বিশেষত মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা (fundamental research)। এই চর্চার পরিধি যুক্তিবিরোধী অতিকথার প্রকোপে কমতে বাধ্য, ফলে মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মনোভাব সাধারণভাবে হ্রাস পায়; প্রশ্ন করার, খতিয়ে দেখার ক্ষমতা ও আগ্রহ হারিয়ে যায়, সমাজটাকে একটা বাঁধা ছকে ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে। (আবার বলছি, বৈজ্ঞানিক মনোভাব আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানে আবদ্ধ নয়, জ্ঞানের মায় জীবনের সব ক্ষেত্রে জরুরি।)
বৌদ্ধিক জীবনের এই সংকোচনে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষতি নেই। মামুলি প্রযুক্তি আমদানির রাস্তা খোলা রাখলেই যথেষ্ট, সদিচ্ছা থাকলে তাতে আম জনতার খানিক মঙ্গলসাধনও করা যাবে। সেই সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সবচেয়ে বড় লাভ হবে যে শিক্ষিত জনগণের (বিশেষত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের) প্রশ্ন করার, তলিয়ে দেখার, স্বাধীন মত প্রকাশের ও স্বাধীন উদ্যোগ নেবার প্রবণতায় লাগাম টানা যাবে: দেশবাসীর মানসিক জীবন অহিংস উপায়ে শাসকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, দমন-পীড়নের অস্বস্তিকর প্রয়োজন কমবে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র রাজ্যগুলি বুদ্ধিজীবীদের ধরপাকড় আর মগজধোলাইয়ের জন্য কুখ্যাতি লাভ করেছিল। ধর্মীয় অতিকথার মার্ক্স-অভিহিত আফিমের প্রয়োগে হয়তো মগজধোলাইটা আরও অহিংস উপায়ে করা যেত, জোরজারের দরকার পড়ত না। ধর্মের শরণ না নিয়ে নির্ভেজাল রাজনৈতিক অতিকথায় আধিদৈবিক মাত্রা ঢোকানো মুশকিল, এবং কমিউনিজমের মতো নিরীশ্বর ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে অসম্ভব। সরাসরি বিশ্বাসভিত্তিক কোনও উপাদানের অভাবে নাগরিকদের স্বেচ্ছা-আনুগত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকা যায় না, যেমন যায় ধর্মীয় বা পৌরাণিক অতিকথার মিশেল থাকলে।
ভারতের কৃষ্টিতে ধর্মীয় অতিকথার প্রচুর উপাদান, অর্থাৎ বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক জীবন বিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার অশেষ সুযোগ। এ বিষয়ে আগের অধ্যায়ে বিস্তারে আলোচনা করেছি। এই যুক্তিমুক্ত মানসিকতার ঐতিহ্য আছে বলেই চিন্তা ও প্রশ্ন, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে রাশ টানা সহজ; সহজ তার বদলে সহমত ও আনুগত্যের অভ্যাস মজ্জাগত, কার্যত বাধ্যতামূলক করে ফেলা— সোচ্চার সক্রিয়ভাবে যদি নাও হয়, অবশ্যই নীরব অনুশীলনে ও সম্মতিদানে। সেই নীরব সম্মতি অধিকাংশ নাগরিক অনায়াসে দিতে পারেন, কারণ অতিকথার অনেক উপচার তাঁদের চিরাচরিত অভ্যাস, ফলে সম্মতির জমি তৈরি হয়েই আছে। তাঁরা মন্দিরে পুজো দেন, আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন, তাঁদের দৈনন্দিন জীবন একটা সংস্কারসিদ্ধ ছন্দে বাঁধা। রাষ্ট্রীয় জীবনের নতুন উপাদানগুলি হয়ে পড়ে সেই জীবনযাত্রার পরিপূরক, নতুন হলেও সনাতন: ভাবতে হয় না, বাজিয়ে দেখার প্রশ্নই ওঠে না, বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করে তৈরি ছকে ফেলা যায়।
যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রেরা যেমন নোট মুখস্থ করে ভাল নম্বর পায়, ব্যাপারটা সেই রকম। (অবধারিতভাবে, দেশের আসল শিক্ষাব্যবস্থায় এই প্রবণতা প্রায় সার্বিক।) মুখস্থবিদ্যা রপ্ত হয়ে পড়লে সেটা স্বাভাবিক এমনকী আকর্ষণীয় মনে হয়, কিছু ছাত্র সত্যিই তার মধ্যে লেখাপড়ার রস খোঁজে। কোনও নাছোড় বুদ্ধিমান ছাত্র বেশি জানতে চেয়ে বেমক্কা প্রশ্ন করলে শিক্ষক বিব্রত হন, চড়চাপড় বসান, হয়তো শেষ অবধি স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেন। বিশ্বের নানা দেশের সংশোধনাগারে রাষ্ট্রীয় পাঠশালার এমন হাজার হাজার বেয়াড়া বিতাড়িত পড়ুয়ার খোঁজ মিলবে; নানা রোমহর্ষক অভিযোগে হীরক রাজার দল তাদের কয়েদে পুরেছে। ভারতেও মিলবে: এখনও সংখ্যাটা কিছু কম, রাষ্ট্রিক অতিকথার রাজত্ব তেমন কায়েম হয়নি বলে, কিন্তু দিন দিন বাড়ছে, সম্প্রতি বড় উদ্বেগজনক গতিতে।
পাঠকের ধৈর্যভিক্ষা করে এই বইয়ের গোড়া থেকে আমার মূল বক্তব্য আর একবার আউড়ে নিই। সেটা হল: সভ্যতার একটার পর একটা বৌদ্ধিক অবলম্বন দুর্বল হয়ে পড়ছে; তাদের বাহক ও ধারক যে জটিল সংকেতপ্রণালী, তার অর্থের পরিসর হ্রাস পাচ্ছে। সংকেতগুলি আর সংকেত থাকছে না, অর্থাৎ অন্য কিছু নির্দেশ করছে না, তাদের নিজেদের পরিধির বাইরে দেখা-জানা-বোঝার কোনও বৃহত্তর জগতের হদিশ দিচ্ছে না। টাকার ধারণাটা পণ্য বা অন্য বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্বেই আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, নিজেকে নিয়েই লেনদেন করছে। ফলে পণ্যের নিজের বিপণনের জন্য অন্য উপায়ের উদ্ভাবন করতে হচ্ছে। আসল বেচাকেনা যদিও টাকার মারফৎ হয়ে চলেছে (টাকার প্রচলিত ভূমিকার এটুকু ত্যাগ করা সম্ভব নয়), নজর কাড়ছে পণ্যের নতুন নিজস্ব একটা সত্তা আর সেটা ঘিরে ইচ্ছা ও কল্পনার ভাবমণ্ডল। ভাষাও সাংকেতিক ভূমিকা ত্যাগ করে তার অর্থবহতা ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনছে (একেবারে বর্জন করা সম্ভব নয়)। শব্দগুলির বিশদ অর্থ গৌণ ও প্রায় অবান্তর হয়ে যাচ্ছে, বাক্য বা আস্ত একটা রচনাই হয়ে পড়ছে সোজাসাপটা ব্যবহারিক বার্তা— কার্যসিদ্ধির উপাদান, কোনও যন্ত্র বা ব্যবহার্য বস্তুর মতো। ধাপে-ধাপে দেখলাম, যে কোনও সংকেতপ্রণালী যে জগৎ সৃষ্টি করছে— মনের ভিতরে বোধের জগৎ, বহির্বাস্তবের ‘আসল’ জগতের সাংকেতিক প্রতিরূপ— সেটাকে যুক্তি-তথ্য দিয়ে বিস্তারের বদলে বিশ্বাসবস্তু ও অতিকথার রূপ দিয়ে অন্যরকম মানসিক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। শেষে এই অধ্যায়ে দেখলাম, জ্ঞানবিজ্ঞানের যে চর্চা বিশেষভাবে যুক্তি-তথ্য-প্রমাণের এক্তিয়ারে থাকা উচিত সেটাও অতিকথার আওতায় চলে আসছে; ফলে তার মানসিক অভিঘাতটা জোরালো হলেও বৌদ্ধিক গুরুত্ব কমছে।
এত সংকোচনের ফলে মানুষের সমাজবোধ ও সমাজচিন্তার পরিধিও হ্রাস পাচ্ছে, তার আদল পালটে যাচ্ছে। গত কয় শতক ধরে যুক্তি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় আদর্শের একটা ব্যাখ্যান গড়ে উঠেছিল, যতই আংশিক ও ত্রুটিপূর্ণভাবে হোক। তার প্রাণশক্তি কতগুলি সামাজিক ভাবাদর্শ, আর প্রামাণ্য প্রকাশ কয়েকটি দেশের সংবিধানে, যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হল ভারতের। সংবিধান একটা ব্যাখ্যান, discourse। এই ব্যাখ্যানে অনেক নীতি ও তত্ত্বের প্রস্তাবনা আছে; আছে সংসদ, আইনব্যবস্থা, ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নির্দেশ। এই পুরো সাংবিধানিক কাঠামোটাকে বলা যেতে পারে একটা বিশাল সাংকেতিক ক্ষেত্র: নীতি ও তত্ত্বগুলি যেন সংকেত বা নির্দেশক, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি তার বাস্তবায়িত রূপ বা অভিজ্ঞান। বলা বাহুল্য, যতক্ষণ সেগুলি নির্দেশের আকারে সংবিধানের পাতায় আবদ্ধ থাকছে, তাদের বাস্তবায়িত বলা চলে না: প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘটে স্থাপিত হলে, সক্রিয় হলে। সাংকেতিক প্রক্রিয়াটা অতএব দ্বিস্তর: নীতি ও তত্ত্বগুলি নির্দেশ করছে প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা; আবার সেই পরিকল্পনা নির্দেশ করছে বাস্তব প্রতিষ্ঠানগুলিকে, শক্ত মাটিতে অবস্থিত আসল দেশটাকে।
কোনও সংবিধান নিখুঁত নয়; মাঝে মাঝে সংশোধন করতে হয়, আশা রাখতে হয় যে সংশোধনীগুলি সত্যিই উপকারী, কোনও তাৎক্ষণিক স্বার্থ বা অভিসন্ধিজনিত নয়। আরও বড় কথা, কোনও সংবিধানে সব কিছু বলা থাকতে পারে না: অনেক কথা উহ্য বা একেবারে অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য। চতুর্থ অধ্যায়ে দেশের ইতিহাস কৃষ্টি প্রচলন আদর্শ সব কিছু মিলিয়ে একটা বিশাল জাতীয় ব্যাখ্যানের কথা বলেছিলাম। ছাপা সংবিধান এই ব্যাখ্যানের পরিপূরক, জাতীয় জীবনের অতীত ও বর্তমান ধারার ভিত্তিতে ব্যাখ্যানটা ভবিষ্যতের দিকে চালিত করছে। বলা যেতে পারে, ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের এই সব উপাদান মিলে, বাস্তব আর স্বপ্নের সমন্বয় করে জাতীয় জীবনের সত্যিকারের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যান।
তর্কের খাতিরে বলা চলে, সংবিধানের সবগুলি ধারা যদি একশো ভাগ রূপায়িত করা যেত, দেশের অবস্থা হত আদর্শ, সর্বাঙ্গসুন্দর। তাতে অন্তর্ভুক্ত হত জাতীয় ব্যাখ্যানের সব সজীব কার্যকর উপাদান, অতীত থেকে উৎসারিত হয়ে আজও যা জাতির চেতনায় জেগে আছে। এমন সম্ভাবনা অবশ্যই অলীক স্বপ্ন, লিখতে হাত কাঁপে; কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে যত বিশাল ব্যবধান থাক, যতই অগাধ অপ্রাপ্তি অনিবার্য হোক, এই ব্যাখ্যান যত বেশি মাথায় রাখা যাবে, ব্যবধান অন্তত কিছু মাত্রায় দূর করা যাবে, কিছু মৌলিক প্রাপ্তি ঘটবে।
কাজটা মূখ্যত যাদের হাতে, সেই শাসকগোষ্ঠী কিন্তু স্বভাবতই চাইবে ব্যাখ্যানটাকে সরল আর সংক্ষেপ করতে, যাতে রূপায়ণের ঝামেলা কমে। হাজারটা কাজ একশো ভাগ সম্পন্ন করা অবাস্তব স্বপ্ন; সদিচ্ছা থাকলে বাস্তবে হয়তো পাঁচশো কাজের পঞ্চাশ ভাগ করা সম্ভব; তার চেয়ে চারশো কাজের চল্লিশ ভাগ করে পার পেলে বালাই কমে, তিনশো কাজের তিরিশ ভাগ হলে আরও আরাম। অন্যদিকে কিন্তু বোঝা বাড়িয়ে কর্তারা অবধারিতভাবে চাইবেন আরও কিছু যোগ করতে যা আদর্শ চিত্রটাতে আদৌ নেই: দুধে শুধু জল নয়, গরল মেশানো হতে পারে।
এমন সংক্ষিপ্ত ও বিকৃত কার্যসূচি একটা স্তরে জারি করা যায় স্রেফ জনগণকে হতাশায় ঠেলে দিয়ে। লোকে যদি মেনে নেয় যে অমুক দল বা সরকারকে দিয়ে কিছু হবে না, চাহিদা পূরণের তাগিদ কমে; কিন্তু অবশ্যই একটা ঝুঁকি থেকে যায়, বিশেষত নির্বাচনী গণতন্ত্রে। তার চেয়ে অনেক পোক্ত ব্যবস্থা, রাষ্ট্র সম্বন্ধে জনগণের ধারণাটা আরও সরল করা আর সেই সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া, যাতে তাঁরা জোর করে কিছু চাইবার বা প্রশ্ন করার প্রত্যয় হারিয়ে ফেলেন। (পরের অধ্যায়ে ‘গ্যাসলাইটিং’ বলে একটা প্রক্রিয়ার কথা বলব, যার উদ্দেশ্য ঠিক এই।) জাতীয় ব্যাখ্যানের হাজার উপকরণের মধ্যে এমনিতেই সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ যোগ হয়তো দু’শোটার সঙ্গে; তারও মাত্র পঞ্চাশটা নাহয় তাঁদের সামনে তুলে ধরা হল, সঙ্গে বাহ্য ও বিকৃত আরও পঞ্চাশটা; যুক্তিপন্থার বিচার এড়িয়ে সেগুলি স্লোগান বা চুম্বকের চটজলদি রূপ দেওয়া হল; আর সবটা পরিবেশিত হল রাষ্ট্রিক অতিকথার মোড়কে।
আমি বলতে চাইছি, যা আমরা সচরাচর দেখি রাষ্ট্রশাসনের ব্যর্থতা হিসাবে, হয়তো দুর্নীতি বা দুরভিসন্ধি হিসাবে, তার পরাকাষ্ঠা ঘটে সমাজের এমন বৌদ্ধিক বিপর্যয়ে যখন লোকে সাদা মনে ভাবে এটাই হওয়া উচিত, ব্যর্থতা আর অনাচারই স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত। তখন আর তা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না, ঘাটতিটা ধরতেই পারে না। অর্থের বাজারে, পণ্যের বাজারে, ধর্মবিশ্বাসে, আরও মৌলিক স্তরে ভাষার আদানপ্রদানে যে পরিবর্তনগুলি আমরা দেখে এসেছি, তার সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা আছে বর্তমানে আলোচ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। এই বৌদ্ধিক বিপর্যয়ের স্বরূপ এবার সবচেয়ে মৌলিক স্তরে দেখা যাক। তার জন্য কিছুক্ষণ আবার তত্ত্বকথায় ফিরে যাই।
আমাদের চিন্তা ও বক্তব্য গঠিত হয় ছোট ছোট উপলব্ধি বা অবগতি গেঁথে গেঁথে। জ্ঞানের এই ক্ষুদ্রতম অংশকে দর্শনের ভাষায় বলে proposition, বাংলায় সচরাচর ‘বচন’। কিন্তু ‘বচন’ শব্দটার সাধারণ অর্থের সঙ্গে গুলিয়ে যাবার ভয়ে দার্শনিকদের ক্ষমা চেয়ে আমি একে বলব ‘জ্ঞানকণিকা’। জ্ঞানকণিকা সত্যিই কণামাত্র, খুব মামুলি উক্তিতেও অনেকগুলো থাকে। যদি বলি ‘দাদার পাঠানো নলেন গুড়ের সন্দেশগুলো কাল রাতে খেয়ে আমার খুব ভাল লেগেছে’, তার মধ্যে জ্ঞানকণিকা আছে অন্তত চারটি: এক, দাদা আমাকে সন্দেশ পাঠিয়েছে; দুই, সেগুলি নলেন গুড়ের তৈরি; তিন, কাল রাতে সেগুলি আমি খেয়েছি; চার, খেয়ে আমার ভাল লেগেছে। একটা ছোট প্রবন্ধ বা আলোচনা অসংখ্য জ্ঞানকণিকায় ঠাসা; একটা বড় বই তারও বহুগুণ; একটা আস্ত বিদ্যাক্ষেত্র বা ব্যাখ্যান যে কতগুণ তা হিসাবের বাইরে। তার অনেক কণিকা দুরূহ বা অপরিচিত হতে বাধ্য; যেগুলি সহজ ও পরিচিত— যা আমরা (উপরে সন্দেশের উদাহরণের মতো) অজান্তে অক্লেশে একসঙ্গে অনেকগুলো হজম করি— সেগুলিও এত সংখ্যায় হদিশ রাখা কঠিন। সবগুলি মিলিয়ে একটা রচনার তাৎপর্য। তাই জটিল রচনা বা ব্যাখ্যান হলে প্রায়ই আমরা শরণ নিই তার সহজ সংক্ষিপ্ত রূপে, বা শুধু একটা দরকারি অংশ দেখে নিই। এমন না করে উপায় থাকে না; তবে এর ফলে পুরোটার তাৎপর্য হারিয়ে যাবার বা বিকৃত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
ভাষা, অর্থব্যবস্থা, ইতিহাস, বিজ্ঞান— একের পর এক ব্যাখ্যানে, মননের একের পর এক ক্ষেত্রে আমরা যে সরলীকরণ দেখলাম, তার মূল কৌশল জ্ঞানকণিকার সংখ্যা কমানো। এই প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি স্লোগান বা টুইটের মতো চুম্বকধর্মী বাচনে। টুইটার প্রভৃতি সমাজমাধ্যমে পাঠকদের চুটকি মন্তব্যে প্রায়ই দেখা যায় সংখ্যাটা একেবারে শূন্যে ঠেকেছে, অর্থাৎ কোনও বক্তব্য নেই, কেবল ‘আমি মানছি না’ গোছের আলগা কথা বা নিছক খিস্তি। অতটা না হলেও, অধিকাংশ টুইট (বা অন্য অনলাইন মন্তব্য) প্রায়ই একটিমাত্র অতিসরল মত প্রকাশ করে— ওই সামান্য পরিধিতে তার বেশি সম্ভব নয়। টুইটারের জনপ্রিয়তা এমন খুচরো বেমক্কা মন্তব্যের দৌলতে; উলটে বলা চলে, টুইটারের অস্তিত্ব এই প্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে। প্রসঙ্গের অভাবে এই খুচরো উক্তির কোনও বৃহত্তর তাৎপর্য থাকে না; দুম করে একটা কথা বলে দেওয়া হল, এই পর্যন্ত, কেউ পড়লে একটা চটজলদি প্রতিক্রিয়া হবে এটুকু ভেবে।
অথচ উত্তরোত্তর দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষেরা টুইটারবার্তা প্রচার করছেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিদেশনীতি সমেত সব সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি এভাবে কেবল প্রকাশ করছেন না, উদ্ভাবন করছেন; তাঁর নিকটতম আমলারা টুইট পড়ে জানছেন দেশ কোন দিকে চলছে, জেনে বিমূঢ় হচ্ছেন। দুনিয়ার প্রায় সব শাসকই এই অভ্যাস অল্পবিস্তর আয়ত্ত করেছেন: কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই তা অকল্পনীয়। অবধারিতভাবে বিপদ ঘটছে: যে গুরুতর বিষয়ে সব দিক আলোচনা করে সুদূরপ্রসারী পন্থা গ্রহণ সবচেয়ে জরুরি, সেখানেই নেওয়া হতে পারে তাৎক্ষণিক, প্রায় ঝোঁকের মাথায় খেয়ালি চটকদার সিদ্ধান্ত। দেশীয় হোক আন্তর্দেশীয় হোক, এই প্রণালীতে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করা অবশ্যই অভিনব কীর্তি, মানবসভ্যতার নতুন সংযোজন।
টুইট ও বিশেষ করে হ্যাশট্যাগ নিয়ে আগের এক অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। সেখানে বিষয় ছিল ভাষার প্রয়োগে অভিনবত্ব, তার সাংকেতিক চরিত্রের রূপান্তর ও প্রায় অবলুপ্তি। এবার দেখব ভাষার এই ক্ষীয়মাণ ব্যবহারে তার বিষয়বস্তু কী ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। কেবল চুম্বকবার্তা নয়, দেখব যে কোনও রচনা, আলোচনা বা ব্যাখ্যানের প্রতিপাদ্য ফিকে হতে থাকলে, তাতে জ্ঞানকণিকার সংখ্যা কমতে থাকলে, শুধু যে আমরা কম জানতে পারি তাই নয়, যেটুকু জানি তাও অন্যভাবে, প্রায়ই ব্যর্থ বা বিকৃতভাবে। জ্ঞানকণিকা জুড়ে জুড়ে আমরা ব্যাখ্যান সৃষ্টি করি। সেই সমষ্টির একটা ন্যূনতম ওজন বা ঘনত্ব (critical mass) না থাকলে— সোজা কথায়, যথেষ্ট সার পদার্থ না থাকলে— সার্থক ব্যাখ্যান সৃষ্টি হতে পারে না, পাঁচ টাকা পকেটে নিয়ে যেমন বিয়ের বাজার করা যায় না। ব্যাখ্যানটা অতিসরল হয়ে পড়ে, তার সংগঠক উপাদান অর্থাৎ জ্ঞানকণিকাগুলির যোগ সহজেই কেটে যায়, সেগুলি বিক্ষিপ্ত ও দিক্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
প্রক্রিয়াটা শেষ পর্যন্ত টুইটের পর্যায়ে চলে যায়; কিন্তু তার অনেক আগেই একটা সংবদ্ধ ব্যাখ্যান পাতলা হতে হতে হয়ে দাঁড়ায় খণ্ড উক্তির আলগা সমাবেশ, যেন অনেকগুলি টুইট পরপর সাজানো। এই ছড়ানো-ছেটানো টুকরোর যে কোনওটা পেড়ে যে কোনও কাজে লাগানো যায়, তার বৃহত্তর যোগ ও প্রসঙ্গ অগ্রাহ্য করে। ভরপুর ব্যাখ্যানে বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য বজায়ের কতগুলি রক্ষাকবচ (checks and balances) থাকে, এই ক্ষয়িষ্ণু বাচনে সেগুলি উবে যায়। ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যানের একটা বিশেষ সূত্র— যেমন গোরক্ষা, বা সামরিক গৌরব, বা নাগরিকত্ব, বা আপৎকালে রাষ্ট্রের বিশেষ ক্ষমতা— আর সব সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে এককভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয়। সেই সঙ্গে বাঁধুনি আলগা হওয়ায় অন্য অবান্তর প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে, তাতেও ব্যাখ্যানের চেহারা পালটে যায়। হয়তো আদি ব্যাখ্যানের কিছু জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় উপাদান বড় করে সামনে রাখা হয়, কিন্তু পুরো সমাহারের ঝোঁক চলে যায় অন্যদিকে। পঞ্চম অধ্যায়ে এই ধরনের প্রক্রিয়ার বিবরণ দিয়েছিলাম।
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী নিয়ে ২০২০ সালের গোড়ায় যখন ভারত জুড়ে তুমুল বিতর্ক চলছিল, আইনটির সমর্থকেরা দাবি করেছিলেন তাঁরা মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশ মান্য করছেন। আসল অবস্থান হল, গান্ধী অবশ্যই পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের আশ্রয়দানের কথা বলেছেন: ‘পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরণার্থী এলে আমরা কি তাদের কুয়োয় ফেলে দেব? তাদের এখানে থাকতে দিয়ে দেখাশোনা করব না?’১০৬ একই সঙ্গে বারবার বলেছেন ভারত কেবল হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারে না, সেখানে মুসলিমদের বসবাসের পূর্ণ অধিকার আছে: ‘এটা হতে পারে না যে ভারতে কেবল হিন্দুরা থাকবে, আর মুসলিমরা থাকতে চাইলে থাকবে ক্রীতদাসের মত।’১০৭ বলেছেন, মুসলিমদের মধ্যেও নানা সম্প্রদায় আছে, পাকিস্তান সরকার তাঁদের সকলের প্রতি কেমন আচরণ করে দেখতে হবে— অর্থাৎ দ্বিধা প্রকাশ করেছেন, সব মুসলিমও পাকিস্তানে নিরাপদ কিনা।১০৮
তাহলে দেখা যাছে, নাগরিকত্ব আইনের প্রেক্ষিতে কিছু লোক তাদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য প্রথমে গান্ধীর জটিল বক্তব্যের মাত্র একটা অংশ তুলে নিয়ে বাকি সব কিছু অগ্রাহ্য করল; দুই, আলোচনায় মুসলিম-বর্জনের অবতারণা করল, যা গান্ধীর লেখায় ঘুণাক্ষরে নেই; তিন, এমন আলটপকা উপায়ে গান্ধীর আজীবন অবস্থান উলটে দিয়ে তাঁকে দুই-রাষ্ট্র নীতি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা করা হল। আগের অনুচ্ছেদে যে কৌশলের বিবরণ দিয়েছি, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কৌশল বললাম, যদিও এমন ক্ষেত্রে কোনটা প্রবক্তাদের সরল বিশ্বাস আর কোনটা দুরভিসন্ধি বোঝা অসম্ভব, হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে দুটোই। তবে সজ্ঞানে হোক বা না হোক, এমন আদ্যোপান্ত ভুল বার্তা— এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপজ্জনক বার্তা— যে এক ধরনের প্রবঞ্চনা তা স্বীকার করতেই হয়। প্রবক্তাদের যদি সত্যিই এমন ধারণা থাকে, বলতে হয় তাঁরা বার্তাটা প্রচারের আগে যথেষ্ট যাচাই করেননি। জ্ঞানচর্চার জগতে এই দায়িত্বহীন (নাকি ইচ্ছাকৃত?) শৈথিল্যের একটাই নাম— বৌদ্ধিক অসততা, intellectual dishonesty।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘সততা’ আর ‘সত্য’ শব্দ দুটি সহোদর না হলেও সম্পর্কিত। তার চেয়ে বড় কথা, বৌদ্ধিক কাজের একটা নৈতিক মাত্রা আছে— পুণ্যকর্ম করে নয়, তথ্য ও যুক্তির ব্যবহারে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে, সম্পূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করে নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি দিয়ে তা ব্যাখ্যা করে। কোনও ক্ষুদ্র স্বার্থে এই বৌদ্ধিক সাক্ষ্য নিয়ে কারচুপি করা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়।
আদালতের সাক্ষ্যের তুলনায় বৃহত্তর বৌদ্ধিক সাক্ষ্য বরং আরও জটিল ব্যাপার। আইনি সাক্ষ্য হয় সত্য নয় মিথ্যা: কোন ক্ষেত্রে কোনটা, কখনও-বা বিচার করা কঠিন হলেও বিচারের মানদণ্ড সহজ ও ঋজু। বৌদ্ধিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে তথ্যগত সত্য-মিথ্যা বিচার করাও অনেক সময় কঠিন, কারণ তা নির্ভর করতে পারে কোনও দুরূহ বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর, কিংবা সুদূর অতীতের অস্পষ্ট ভগ্নচিত্রের উপর। তার চেয়ে অনেক বড় কথা, কোনও বিশেষ জ্ঞানকণিকার ব্যাখ্যা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয় তাকে ঘিরে অন্যান্য কণিকার উপস্থিতিতে, অর্থাৎ প্রসঙ্গের দ্বারা। এই প্রসঙ্গ ও পটভূমিকা এক একজন ব্যাখ্যাতা এক এক ভাবে— হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবে— সাজাতে পারেন। এই মতভেদ শুধু অবধারিত নয়, অপরিহার্য; মতভেদের অবকাশ যে কোনও সুস্থ বৌদ্ধিক পরিবেশের প্রথম শর্ত, সব মত বিচার করেই পাকা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব। তার পরিপূরক শর্ত, প্রত্যেক মত যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণের কঠোর নিয়ম মেনে চলবে।
এই দ্বিতীয় শর্তটা বহু ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় না। যুক্তি-তথ্যের মধ্যে এক ভিন্ন প্রণালীর মিশেল ঘটে, যথা অতিকথা— এই অধ্যায়ের গোড়ায় অপবিজ্ঞানের উক্তিগুলিতে যা ঘটেছে। সত্যাসত্যের বিচার নির্ভর করে উক্তির সঙ্গে বহির্জগতের, নির্দেশকের সঙ্গে নির্দিষ্টের সম্পর্কের উপর অর্থাৎ বাক্যের সাংকেতিক ক্রিয়ার উপর। সংকেত ভুল জিনিস নির্দেশ করলে সত্যহানি হয়। আরও গভীরভাবে হয় দুটো সংকেতপ্রণালী গুলিয়ে ফেললে, যেমন এই অধ্যায়ের অনেক উদাহরণে বিজ্ঞানের সঙ্গে অতিকথার। বাহ্য স্তরে দুটোতে একই গোত্রের সংকেত ব্যবহার হচ্ছে, তা অবশ্যই ভাষা; কিন্তু তার পিছনে কাজ করছে আদ্যন্ত ভিন্ন দুই জ্ঞানপ্রণালী। দুটোর মধ্যে আপস করতে গিয়ে সত্য আবিষ্কারের সততা ক্ষুণ্ণ হয়, আবিষ্কারের ফল হয় ভ্রান্ত বা বিকৃত।
আগের এক অধ্যায়ে বলেছিলাম, একমাত্র মানুষই সংকেত ব্যবহার করে; তার মানে একমাত্র মানুষই অসত্য বলতে পারে। কোনও পশুর মনমেজাজ তার হাবভাব দেখে বোঝা যায়, লুকোবার উপায় তার জানা নেই। জনাথান সুইফটের গালিভার্স ট্র্যাভেলস-এ এক উচ্চমেধার দার্শনিক ঘোড়ার জাতের বিবরণ আছে। এই বুদ্ধিমান ঘোড়ারা শুধু অসত্য বলে না তাই নয়, অসত্য কাকে বলে তাদের ধারণাই নেই; নেহাত বোঝাবার দরকার হলে তারা বলে ‘যা নয় তাই’, ‘the thing which is not’।১০৯ তাদের দৃষ্টিতে, যার অস্তিত্বই নেই তাকে নাহয় অসত্য বলা গেল; যা আছে তা তো সোজাসুজি দেখা বা বোঝা যাছে, তা নিয়ে অন্যরকম বলার প্রশ্ন উঠছে কোথায়?
অথচ আমরা নিত্য তেমন বলে যাচ্ছি। মিথ্যার রীতিমত শ্রেণিভাগ করেছেন ইতালির কবি দান্তে, সাতশো বছর আগে তাঁর দিভিনা কম্মেদিয়া কাব্যে নরকের বর্ণনায়; সেই সঙ্গে মিথ্যাচারের চরিত্র খতিয়ে তুলে ধরেছেন। তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের পরবর্তী আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। সব পাপকে দান্তে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: স্বাভাবিক প্রবৃত্তির আতিশয্য (কাম, লোভ, ক্রোধ ইত্যাদি); সেই প্রবৃত্তির বিকৃতি (আত্মহনন, ঈশ্বরনিন্দা ইত্যাদি); এবং মিথ্যাচার। প্রথম দুই বর্গের পাপ জৈবিক প্রবৃত্তিগত: মানবসত্তার যে হীনতর উপাদান পশুদেরও আছে, তার অশুভ প্রকাশ। মিথ্যাচার কিন্তু একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব, কারণ সেটা বুদ্ধির অপপ্রয়োগ। একমাত্র মানুষেরই বুদ্ধি ও যুক্তিবোধ আছে, সেটা মানুষকে ঈশ্বরের সবিশেষ ও শ্রেষ্ঠ দান। সেই দানের অপব্যবহার তাই সবচেয়ে গর্হিত পাপ, মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অধঃপতন: নরকের নিম্নতম লোকে সবচেয়ে বীভৎস শাস্তি অপেক্ষা করে আছে মিথ্যাচারীদের জন্য।
দান্তের থেকে আমরা দুটো কথা শিখলাম। এক, মিথ্যা শুধু বলার জিনিস নয়, করার জিনিস। মিথ্যাভাষণের দোসর মিথ্যাচার— মিথ্যাভাষণের বাস্তব রূপ, বাস্তব ফল। তবে এটাও ঠিক, মিথ্যাচারের উৎস ও সঞ্চালক মিথ্যাভাষণ: মুখ ফুটে বলি আর না বলি, মিথ্যাটা নিজের কাছে স্পষ্ট করলে তবেই কাজে রূপায়িত করতে পারি। দ্বিতীয় কথাটা এর সঙ্গে যুক্ত: মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয় বুদ্ধি খরচ করে কোনও উদ্দেশ্যে, এবং সেই উদ্দেশ্য দিয়েই মিথ্যার বিচার হয়। আগেই বলেছি, কোনও কথা বানিয়ে গল্পে লিখলে তাকে আমরা মিথ্যা বলি না। বাস্তব জীবনেও কাকে কোন অবস্থায় বলেছি, তা দিয়ে মিথ্যার গুরুত্ব বিচার হয়; কখনও কখনও— যেমন কঠিন রোগীকে সান্ত্বনা দিতে, বা কারও প্রাণ বাঁচাতে— আদৌ অপরাধ বলে গণ্য নয় না।
‘মিথ্যা কথা’ বলতে আমরা সচরাচর বুঝি একটা বাস্তব তথ্য বা ঘটনা অস্বীকার করা, হয়তো উলটো বা অন্যরকম বলা। কারও দেরাজ থেকে টাকা সরিয়ে বললাম, ‘কই, ওই ঘরেই ঢুকিনি!’ কোথাও তিনটের সময়ে দেখা করতে হবে, পৌনে তিনটেয় বেরিয়ে চারটেয় পৌঁছে বললাম, ‘সেই দেড়টায় বেরিয়েছি, রাস্তায় যা ভিড়!’ ষোলো শতকের ফরাসি দার্শনিক মিশেল দ্য মঁতায়েন মিথ্যাভাষণের একটা সহজ মাপকাঠি বলে দিয়েছেন: আমরা যা সঠিক বলে জানি, তার অন্যরকম কিছু বললে সেটা মিথ্যা।১১০ কিন্তু এমন মিথ্যারও একটা বাস্তবতা থাকা চাই, স্রেফ সত্যের বিপরীত হলে চলবে না। ধরে নেওয়া যাক গোবর তেজস্ক্রিয়তা রোধ করে না, এবং ত্রেতা যুগে পুষ্পক রথের মতো কোনও আকাশযান ছিল না। যাঁরা এগুলির সত্যতা দাবি করছেন, তাঁদের ‘ভুল বলছ’ বা ‘আজগুবি কথা বলছ’ বলা চলে, ‘মিথ্যা বলছ’ ঠিক বলা চলে না। তাঁরা আমাদের আটপৌরে অর্থে ঠকাতে চাইছেন না, নতুনভাবে প্রকৃতিকে বা ইতিহাসকে দেখতে বলছেন। এটা তাঁদের বিশ্বাসের, বা আরও বিশদভাবে অতিকথার, উপাদান: বিশ্বাসীদের কাছে সত্য, অন্যদের কাছে নয়।
সত্য-মিথ্যা বিচারের এ এক নতুন মানদণ্ড। আমরা বরাবর জানি, সত্য হল নৈর্ব্যক্তিক ও চিরন্তন। তার বদলে এবার বলছি, সত্যাসত্য নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের অবস্থানের উপর: আমার সত্য তোমার মিথ্যা হতে পারে। পুষ্পক রথ বা তেজস্ক্রিয়রোধক গোবর আমাদের বাস্তব জীবনের অঙ্গ নয়, তা নিয়ে মতভেদ হলেও সহাবস্থান করতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যদি হিংসা-বিদ্বেষ ঘটে, বুঝতে হবে জল অনেক দূর গড়িয়েছে, স্থূল বাস্তব স্তরে সত্য-মিথ্যার ব্যবধান মুছে গেছে; ফলে প্রকৃতপক্ষে যা অনুপস্থিত বা অপ্রামাণ্য, সেটাও ঘোরতর বাস্তব স্বীকৃতি পেয়ে প্রকট বাস্তবের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।
তথ্য যাচাই অনেক পিছনে ফেলে প্রশ্নটা আরও গভীর জ্ঞানপ্রণালীর স্তরে চলে এসেছে, আবার ‘কী জানি’ থেকে ‘কী করে জানি’র পর্যায়ে। সেই জ্ঞানপ্রণালী আর পণ্ডিতি তর্কের বিষয় নেই, মর্মান্তিক জাগতিক মাত্রা লাভ করেছে, বাস্তব জীবনের নির্ধারক হয়ে উঠেছে: মারদাঙ্গা, অপশাসন, সামাজিক বিভেদ মায় যুদ্ধবিগ্রহ, সব কিছুর মূলে একটা বৌদ্ধিক বিকার। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় এমন পরিস্থিতি দেখা যায়, যখন এমন মোক্ষম রক্তক্ষয়ী স্তরে মানুষের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে।