৩. শব্দ, বাক্য, বাচন
আমার জন্মদিনে কিছু আত্মীয় ও বন্ধু বরাবর শুভেচ্ছা জানান। গত কয়েক বছর তাঁদের সংখ্যা ছাপিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, অর্থসংস্থা, দোকান, পরিষেবাকেন্দ্র প্রভৃতির বার্তায়। সরকারি নিয়মে বা অন্য ছুতোয় নানা সংস্থা আজকাল আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের কাছ থেকে ছড়িয়ে যায় আরও অনেকগুলিতে, ফলে আমার জন্মতারিখ তাদের নথিভুক্ত।
এমন সরল মানুষ কেউ আছেন কি, যিনি সত্যিই ভাবেন সংস্থাগুলি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর হদিশ রাখে, উদ্যোগ নিয়ে বার্তা রচনা করে পাঠায়? সবাই জানি একটা তৈরি বয়ান কম্পিউটার ডেটাবেস থেকে পাঠানো হয়, একদম যান্ত্রিকভাবে। তবু হয়তো আশ্বস্ত হই যে সংস্থাটি (বা তাদের সফটওয়ার প্রস্তুতকার) এই মেকি আন্তরিকতার প্রয়োজন বোধ করছে, গ্রাহক যে একটা মানুষ তার অন্তত এটুকু স্বীকৃতি দিচ্ছে। এও আমরা জানি, কোনও দরকারে সেই সংস্থার সঙ্গে সত্যিই যোগাযোগ করতে চাইলে নৈর্ব্যক্তিক যান্ত্রিকতার দেয়ালে মাথা ঠুকতে হয়। ফোন ধরেন কল সেন্টারের কর্মী, সংস্থাটির সঙ্গে যাঁর কোনও যোগ নেই; নচেৎ ইমেল পাঠাতে হয় ড্রপ-ডাউন মেনুতে সমস্যার বাঁধা তালিকা ধরে, যার কোনওটাই হয়তো আমাদের ক্ষেত্রে খাটে না। উত্তরটাও প্রায়ই অপর প্রান্তের বাঁধা মেনু উদ্ভূত, পাঠাচ্ছে যন্ত্রমেধাসম্পন্ন কোনও কম্পিউটার।
জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তায় ফিরে যাই। বলা বাহুল্য, আমার আত্মীয়-বন্ধুর শুভেচ্ছা আমি যে দৃষ্টিতে দেখব, ব্যাঙ্ক বা দোকানের যান্ত্রিক বার্তা সেভাবে নয়। দুই বার্তার বয়ান হয়তো হুবহু এক, বা হতে পারে দোকানেরটাই বেশি পল্লবিত; কিন্তু দুটোর মেজাজ আর উদ্দেশ্য আলাদা। প্রথমটার পিছনে ভালবাসা বা হৃদ্যতা আছে, একটা মানবিক সম্পর্ক আছে; দ্বিতীয়টায় তার প্রশ্ন ওঠে না, আশা করাই অন্যায়।
আমরা যখন কথা বলি বা লিখি, শব্দের নির্দিষ্ট অর্থ ছাপিয়ে একটা উদ্দেশ্য ফুটে ওঠে; কথার মারফত আমরা শ্রোতা বা পাঠককে লিপ্ত বা প্রভাবিত করতে চাই— বলা যায়, একটা কাজ হাসিল করতে চাই। প্রথম অধ্যায়ে হ্বিটগেনস্টাইনের একটা মন্তব্যের উল্লেখ করেছিলাম: ভাষা চিন্তার ছদ্মবেশ। তার পরেই তিনি বলছেন, পোশাক থেকে যেমন শরীরের আসল গড়ন বোঝা যায় না, ভাষা থেকেও চিন্তার গঠন নয়। আমরা ভাষার অর্থ উদ্ধার করি অত্যন্ত জটিল ও অব্যক্ত কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে।৩৩
কারও কথা শুনে যখন মনে হয় ‘লোকটা কী বলতে চাইছে?’, সচরাচর আমাদের ধন্দ তার কথার আক্ষরিক অর্থ নিয়ে নয়, মতলব নিয়ে। শুধু গুরুতর বা গোলমেলে কথা নয়, সব কথারই একটা ‘মতলব’ থাকে: একেবারে বিনা কারণে আমরা মুখ খুলি না, কলম ধরি না। কথা বলা তাই কেবল ভাষার উচ্চারণ নয়, লঘু বা গুরু কোনও উদ্দেশ্যসিদ্ধির চেষ্টা। এই ‘স্পীচ অ্যাক্ট’ বা বাচনক্রিয়া তত্ত্বের মূল প্রবক্তা দার্শনিক জন রজার স্যর্ল।৩৪ তত্ত্বটা আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে লেখনক্রিয়া বা ‘স্ক্রিপ্ট অ্যাক্ট’-এর কথা বলেছেন পাঠবিদ পিটার শিলিংসবার্গ।৩৫
ভাষা ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে বাক্যের গঠন থেকে বোঝা যায়। স্যর্ল উদাহরণ দিচ্ছেন এক গুচ্ছ বাক্যের: ‘জন কি চলে যাচ্ছে?’, ‘জন চলে যাবে’, ‘জন, চলে যাও’ ইত্যাদি।৩৬ প্রথম বাক্যটা প্রশ্ন, দ্বিতীয়টা উক্তি বা বিবৃতি (statement), তৃতীয়টা আদেশ। সব বাচনক্রিয়া কিন্তু অত সোজাসুজি নয়। ‘জন, বেরিয়ে যাও’ না বলে আমি ভদ্রভাবে বলতে পারি ‘জন, একটু বাইরে যেতে পার?’ বাক্যটা কিন্তু আদতে প্রশ্ন নয়, আদেশ বা অনুজ্ঞা। যদি বলি ‘ওদের সর্বনাশ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি’, ক্রিয়াপদটা বর্তমান কালের কিন্তু উক্তি ভবিষ্যৎ নিয়ে: ‘ওদের নিঃসন্দেহে সর্বনাশ হবে।’ এবার প্রশ্ন, কথাটা আমি কী উদ্দেশ্যে, কী মনোভাব থেকে বললাম: ওটা কি সতর্কবার্তা, না অভিসম্পাত, না বিলাপ, না নৈর্ব্যক্তিক অনুমান?
বাচনক্রিয়ার পার্থক্য প্রায়ই বাক্যগঠনে নয়, প্রসঙ্গে: উদ্দেশ্যটা কেবল কথার মানে থেকে বোঝা যাবে না, বলার পরিস্থিতি জানতে হবে। এমন অনেক নিদর্শনকে আলংকারিকরা ‘শ্লেষ’ বলেন, তার মধ্যে প্রকারভেদও করেন। সেই সূক্ষ্ম বিচারে আমি যাব না। ‘অশ্বত্থামা হত’ এমন উক্তির ক্লাসিক উদাহরণ, যদিও ঠিক শ্লেষ নয়। চলতি অর্থে শ্লেষ, মানে ব্যঙ্গ বা বক্রোক্তির ক্ষেত্রে অভিপ্রায়টা বোঝা জরুরি (আর যন্ত্রমেধার পক্ষে খুব কঠিন): ‘আহা, কী চমৎকার কথাই না বললেন!’ বক্তা সম্ভবত বলতে চান, কথাটা একদম বোকার মতো; তবে সত্যি সাধুবাদ জানাচ্ছেন তাও হতে পারে— অর্থাৎ একই বাক্য দুই বিপরীত উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে, কোনটা তা প্রসঙ্গ থেকে বুঝতে হবে। শব্দগুলির আক্ষরিক মানে কিন্তু এক থাকছে, পালটাচ্ছে কেবল প্রসঙ্গ।
ফিরে আসি জন্মদিনের শুভেচ্ছায়। সেখানেও বন্ধু আর ব্যবসায়ীর বার্তার ভাষা এক কিন্তু উদ্দেশ্য অর্থাৎ সত্যিকারের ‘বার্তা’ আলাদা। বন্ধু বোঝাতে চাইছেন, ‘আমি তোমার সুহৃদ, আমার ভালবাসা জেনো, ভাল থেকো।’ দোকানদার বলছেন, ‘এই যে স্যর, আমাদের কথা মনে করিয়ে দিলাম। এবার পুরনো টিভিটা বদলাবেন নাকি?’ দুটো বাচনক্রিয়া একদম আলাদা; কিন্তু এটা কোনও বিচারেই শ্লেষ বলা চলে না। শ্লেষে শব্দের অর্থ সম্বন্ধে বক্তা অত্যন্ত সচেতন, অর্থ নিয়ে সজ্ঞানে কৌশল করছেন। দোকানদারের বার্তায় কিন্তু শব্দগুলির আসল অর্থ তার উদ্দেশ্যের পক্ষে অবান্তর। ‘ভিতরের’ মানে উবে গিয়ে শব্দগুলি এখন ফাঁপা আওয়াজ মাত্র— সংকেত নয়, ঠাট বা ঠমক; ইংরেজিতে symbol নয়, cipher। শব্দের অর্থ ডিঙিয়ে বাক্যটা হয়ে গেছে অন্য এক খেলার ঘুঁটি।৩৭
অধৈর্য পাঠক ভাবছেন, তুচ্ছ টেক্সট মেসেজ নিয়ে সাতকাহন কেন? অমন খুচরো প্রচারবার্তা কত আসে, আমরা না পড়ে মুছে দিই, এত তত্ত্বকথার কী আছে? আমি ইচ্ছা করেই একটা হালকা উদাহরণ দিয়ে শুরু করেছি, যাতে অন্য গুরুতর প্রসঙ্গ ঢুকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে না দেয়। ধরা যাক, এ হল বিজ্ঞানীরা যেভাবে পরীক্ষাগারে একটা ছোট নমুনা নির্বাধভাবে খুঁটিয়ে দেখেন; সেই দেখার ভিত্তিতে তারপর বৃহৎ বিশ্বের জটিল দৃষ্টান্তগুলো বুঝতে চেষ্টা করেন।
আমার ছোট্ট নমুনা থেকে আশা করি পাঠক একটা কথা ভাবছেন: শব্দের এই ‘অর্থহীন’ ব্যবহার, যেখানে বাক্যটা তার আপাত অর্থ ত্যাগ করে শর্টকাট রাস্তায় নিজের ধান্দায় মশগুল, মনে করিয়ে দিচ্ছে নব্য অর্থব্যবস্থায় টাকার ব্যবহারের কথা— টাকা যেখানে সংকেত নয়, অন্য পণ্যের কেনাবেচার মাধ্যম নয়, ইচ্ছামতো নিজের একটা দাম ঠিক করে সেটা নিয়েই লেনদেন করছে। টাকা আর ভাষা, উভয় রকম ‘অর্থের’ তাত্ত্বিক মাউরিৎসিও লাৎসারাতো ব্যাপারটা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা আমার বক্তব্যে আলোকপাত করবে। তিনি বলছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেনাপাওনা লেনদেনের পদ্ধতি হচ্ছে এক সোনার পাথরবাটি, ‘অনির্দেশক সংকেতক্রিয়া’ (asignifying semiotics)।৩৮ এই প্রক্রিয়ায় সাংকেতিক উপকরণ ব্যবহার হচ্ছে (যথা টাকা বা হিসাবের সংকেত), কিন্তু তা সংকেতের সাধারণ ধর্ম অনুসারে কোনও কিছু নির্দেশ করতে বাধ্য নয়। অর্থবহতার পুরো প্রক্রিয়া পাশ কাটিয়ে সংকেতটা কিছু ‘বোঝাচ্ছে’ না, সেটা নিয়েই সরাসরি লেনদেন হচ্ছে: প্রক্রিয়াটা বৌদ্ধিক নয়, স্রেফ ব্যবহারিক।৩৯
লাৎসারাতো বলছেন এই প্রক্রিয়াটা সাধারণ ভাষায় বা সামাজিক জীবনে ঘটে না,৪০ দেখা যায় কেবল টাকার দুনিয়ায়, শিল্প-বাণিজ্যে ও শেয়ার বাজারে— এক সর্বগ্রাসী যন্ত্রের রাজত্বে, অন্য বহু কিছুর মতো স্বয়ং মানুষ যার অধীন। কিন্তু ‘অনির্দেশক সংকেতক্রিয়া’ শব্দবন্ধটা শুধু টাকার সাংকেতিক ভূমিকা নয়, ভাষার ‘অর্থহীন’ ব্যবহারের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়: বলা যায়, ভাষাও একই যন্ত্রের কবলে পড়েছে। আর যোগ করা যায় একটা কথা যা লাৎসারাতো বলেননি।
ফেরা যাক অগডেন আর রিচার্ডসের ‘শব্দার্থের ত্রিভুজে’। তার একটা কোণ আসল বস্তু, একটা সেই বস্তুর ভাবগত রূপ, তৃতীয়টা যে শব্দ সেই ভাবগত রূপকে (আসল বস্তুকে নয়) নির্দেশ করছে। এবার সেই ভাবগত রূপটা বাতিল হয়ে গেল, শব্দটা সরাসরি যুক্ত হল বাস্তব বস্তুর সঙ্গে: ত্রিভুজের বদলে পেলাম সরল রেখা। এ অবস্থায় শব্দটা আর সংকেত রইল না। বাইরের সব যোগসূত্র, সব ভাবনা প্রসঙ্গ পটভূমি ত্যাগ করে সেটা হয়ে উঠল ব্যবহারিক দ্রব্য বা সামগ্রী, অন্য যে-কোনও বস্তুর মতো। ভাষার এই নতুন ও সংকুচিত ভূমিকা নতুন নতুন বাচনক্রিয়ায় ব্যবহার হতে পারে, যা শব্দের অর্থকে গুরুত্ব দিলে সম্ভব হত না। এ ভাবেই জন্মদিনের বার্তা হয়ে যাচ্ছে পণ্যবস্তু বা অন্তত পণ্য বিপণনের বস্তু, এক ধরনের প্রচার-উপহার।
অনেক হয়েছে, ওই এসএমএস বার্তা সত্যি আর চটকাব না। পরীক্ষাগার ছেড়ে বাইরে আসা যাক, আরও গুরুতর বিষয়ের খোঁজে। বেশি দূর যেতে হবে না: দৃষ্টান্ত সর্বত্র। প্রতি বছর ১৫ অগাস্টের আগে দেখি তামাম পণ্যের বিজ্ঞাপনে সময়োচিত থিম: ‘আমাদের তৈরি অমুক জিনিসটা কিনে (অর্থাৎ অন্য কোম্পানির তমুকটা না কিনে) তোমার স্বাধীনতার প্রমাণ দাও’ বা ‘অমুক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে মুক্ত বায়ু সেবন করো, দেখো কেমন স্বাধীন-স্বাধীন লাগে’। গোড়াতেই বলেছি বটে বেশি নীতিকথা আওড়াব না, কিন্তু এমন দেখে মনে হওয়া অন্যায় নয়, এত মানুষ যার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তা কি এই স্বাধীনতা— পছন্দমতো ভোগপণ্য কেনা বা অবাধে বেড়াতে যাওয়ার অবকাশ? পয়সা থাকলে সে তো ব্রিটিশ আমলেও করা যেত। রাজনৈতিক বা নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চয় বাজার-অর্থনীতির পণ্যের ‘চয়েস’ নয়।
ইংরেজিতে independence আর freedom কথা দুটো সমার্থক নয়: প্রথমটার ইঙ্গিত সার্বিক স্বাধীনতার, একটা স্থায়ী অবস্থার; দ্বিতীয়টার ঝোঁক বিশেষ ক্ষেত্রে নিজের মতো চলার বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘স্বাধীন’-এর দুটো ব্যাখ্যা: ‘যে আপনাতে আছে; … স্বতন্ত্র, … অপরাধীন’, আর ‘স্বায়ত্ত, স্ববশগত’। প্রথমটা ব্যক্তি সম্বন্ধে প্রযোজ্য (‘স্বাধীন নাগরিক’), দ্বিতীয়টা সেই ব্যক্তির আয়ত্তে কোনও বস্তু বা ক্রিয়া সম্বন্ধে (‘স্বাধীন মত’)। পরাধীন ব্যক্তিরও কিছু নিজস্ব মত বা পছন্দ থাকতে পারে— লালের বদলে নীল জামা, একরকম বিস্কুটের বদলে আর এক রকম। স্বাধীনতা দিবস সেগুলির সম্মানে অনুষ্ঠিত নয়। তার উদ্যাপনে নানা বাচনক্রিয়ার প্রকাশ হতে পারে— মুক্তিসংগ্রাম স্মরণ, দেশের বর্তমান অবস্থার আলোচনা, তার মঙ্গল ও উন্নতিসাধনের চিন্তা; কিন্তু ভোগপণ্যের প্রচার? এমন প্রয়োগে ‘স্বাধীনতা’র অর্থ কেবল পালটে নয়, কার্যত মুছে যাচ্ছে। শব্দটা আর সত্যিকারের সংকেত নেই, যা কতগুলি ভাবগত ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য নির্দেশ করছে। তার বদলে কেবল আক্ষরিক মানেটুকু আঁকড়ে হয়ে গেছে পণ্য বিক্রির যান্ত্রিক বাহন, তাই নির্বোধ বাচনক্রিয়ায় এই উপদেশ দিতে পারে, ‘আপনি স্বাধীন দেশের নাগরিক, কারও পরোয়া না করে এই মিষ্টিটা খান’ বা ‘ওই টিভিটা কিনুন’। জন্মদিনের বার্তার মতো এখানেও ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা হয়ে গেছে পণ্যবস্তু বা পণ্য বিপণনের বস্তু; তার অর্থপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস লোপ পেয়েছে।
স্বাধীনতা দিবস ঘিরে আরও এক রকম সংকেতভ্রষ্টতা ঘটে, যেখানে শব্দটার অর্থপূর্ণ প্রকাশ কেবল উপেক্ষিত নয় প্রতিবর্তিত, উলটোমুখে ঘোরানো।
কেবল ‘স্বাধীনতা’ শব্দটাই সংকেত নয়, স্বাধীনতা দিবস পালন করা একটা সাংকেতিক ক্রিয়া: অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীন সত্তাকে আমরা স্বীকৃতি জানাচ্ছি, স্মরণ করছি তার অর্জন ও বিবর্তনের কাহিনি, আবাহন করছি তার ভবিষৎকে। এটা দেশের সকলের গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের হেতু, তাই তা উদ্যাপনের একটা সাধারণ কাঠামো সারা দেশে স্বীকৃত ও অনুসৃত হয়; স্বাধীনভাবে সকলে তাতে সায় দিই, অংশ নিই, আপন করে নিই রুচি ও বিচার অনুসারে। তার বদলে কর্তৃপক্ষ যদি বিধান দেন, দেশ জুড়ে এক বিশেষ অনড় রীতিতে দিনটি পালন করতে হবে, একই বাঁধা বয়ানে দেশপ্রেম প্রকাশ করতে হবে, মনে হতে পারে স্বাধীনতার আসল ভাব, কথাটার ভরপুর তাৎপর্য অস্বীকার করা হচ্ছে, স্বাধীনতার নামে পরাশ্রয়িতার অধিষ্ঠান হচ্ছে। এই অর্থচ্যুতি অবশ্যই নৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়, কিন্তু তার মূলে আছে বৌদ্ধিক বিভ্রান্তি। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা প্রয়োগ করেই তার আসল তাৎপর্য উৎখাত হচ্ছে, পরিবর্তে সেটা আলগাভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এক সংকীর্ণ, নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রিক জীবনের সূচক হিসাবে।
একই পন্থায় আরও সঙ্গিনভাবে কিছুদিন যাবৎ দুটি নাম আমাদের দেশে উচ্চারিত হচ্ছে: একটি রামচন্দ্রের, অন্যটি ভারতমাতার। এক দেবতা পৌরাণিক, অন্যজন আধুনিক। উভয়ের (বিশেষত প্রথমটির, দীর্ঘতর ইতিহাসের জন্য) নাম ঘিরে আখ্যান সাহিত্য ভাবনা, সামাজিক প্রথা ও ধর্মবিশ্বাসের বিশাল পরিমণ্ডল। এই ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যেই উভয় নামের মাহাত্ম্য, এজন্যই তাদের ভারতব্যাপী (ও রামচন্দ্রের ক্ষেত্রে ব্যাপকতর) অধিষ্ঠান। কবীর ও নামদেব ব্রহ্মবাচক অর্থে রামের বন্দনা করেছেন; উভয়ের দোঁহা শিখ গ্রন্থসাহেব-এর অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ-এর কাহিনি প্রবল জনপ্রিয় লোকনাট্যের আখ্যান। রামনাম নানা আচার কল্পনা বিশ্বাসের উদার মিলনক্ষেত্র: ‘ঈশ্বর আল্লাহ্ তেরা নাম।’ ভাষাতত্ত্বের বয়ানে, এই নামবিশেষ্য সারগর্ভ তাৎপর্য (denotation) ও দ্যোতনার (connotation) সংকেত, আমাদের বৌদ্ধিক ও সামাজিক জীবনে অসংখ্য ভাব ও অনুশীলনের অভিজ্ঞান। রামনাম তাই হতে পারে বহু ক্ষেত্রে বহু বাচনক্রিয়ার ভিত্তি: ধর্মীয়, দার্শনিক, মরমিয়া, কাব্যিক বা নিছক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে, সমাজ ও কৃষ্টির নানা প্রকাশ ও প্রথায়।
জনজীবনে রামনামের সাম্প্রতিক ব্যবহার এই অগাধ বৌদ্ধিক ও মানবিক সম্পদ পরিত্যাগ করে নামটিকে করতে চায় এক বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্যের যান্ত্রিক উচ্চারণ। যান্ত্রিক বলছি এই কারণে, যে উচ্চারণ নিশ্চিত করার জন্য জোর খাটানো রেওয়াজ হয়ে পড়েছে। যেখানে হিংসা-হুমকি বিনা কাজ হবে না— অর্থাৎ উচ্চারণটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এমনকী বক্তার আন্তরিক বিশ্বাসের পরিপন্থী— সেখানেই তা বেশি করে বলবৎ হচ্ছে। তাতে রামনামের পরম সমৃদ্ধ অর্থমণ্ডলের কোনও তাৎপর্যই ফুটে উঠছে এমন দাবি করা দুষ্কর। সত্যিকারের রামভক্ত যখন রামনাম উচ্চারণ করেন, সেই উচ্চারণ ভক্তিতে সঞ্চারিত হয়; অর্থাৎ সেটা তাঁর ভক্তির, এবং ভক্তির আনুষঙ্গিক তত্ত্ব ও আচারের, অর্থবহ সংকেত। জবরদস্ত প্রয়োগে রামনাম আর সংকেত থাকছে না, হয়ে পড়ছে নিছক টোকেন বা পাসওয়ার্ড, গোষ্ঠীভুক্তির প্রবেশপত্র। আমরা জানি, পাসওয়ার্ডের মানে থাকার দরকার নেই, বরং না রাখতেই পরামর্শ দেওয়া হয় (যথা, ফোন নম্বর বা জন্মতারিখ যেন না হয়)। রামনামের মর্মার্থ যত কম চিন্তায় আসে, বিনা মাথাব্যথায় স্রেফ পাসওয়ার্ড হিসাবে তা ব্যবহারে তত সুবিধা।
আবার ঠিক পাসওয়ার্ডও বলা চলে না। পাসওয়ার্ড গোপন থাকে। ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘ভারতমাতা কী জয়’ গোপনে আওড়ানো হয় না, রাজপথে মাঠে-ময়দানে মন্দ্রিত হয়: উচ্চারণকারীরা সকলের কাছে এইভাবে তাঁদের পরিচয় বিজ্ঞপিত করেন। বাচনক্রিয়ার নিরিখে এটা তাঁদের আত্মপ্রকাশের বাণী। এমন বাণী বোঝাতে তাঁরা নিজেরা ও অন্য সবাই আজকের চালু শব্দ ব্যবহার করেন: স্লোগান।
‘স্লোগান’ শব্দটার ব্যাপক প্রয়োগ রাজনীতির ক্ষেত্রে, এখানেও তাই। রামনামের জবরদস্ত প্রচারে যাঁরা নামেন তাঁদের আর যাই পরিচয় থাক, মুখ্য ভূমিকায় তাঁরা এক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য। অন্যান্য দলের সঙ্গে মাঝে-মধ্যেই তাঁদের স্লোগান বিনিময় চলে। শব্দটা নতুন হলেও ব্যাপারটা নয়। সেকালেও সৈন্যেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত অট্টরোল বিনিময় করতে করতে:
“জয় গুরুজির” হাঁকে শিখ বীর
সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
স্লোগানে শব্দগুলির অর্থ অগ্রাহ্য হয় না, বরং বিশেষ গুরুত্ব পায়, হয়ে দাঁড়ায় স্লোগানদার গোষ্ঠীর পরিচিতি ও অবস্থানের নির্যাস। কিন্তু সেই সঙ্গে ঘটে অর্থের চরম সরলীকরণ: যত দ্যোতনা সূক্ষ্মতা জটিলতা, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অবস্থান ঘিরে যত চিন্তা প্রশ্ন তত্ত্ব, সব হটিয়ে গোষ্ঠীর পুরো পরিচয় ন্যস্ত হয় দু’-চারটে শব্দের পরিসরে— তাও এমন শব্দ যা লোকের মনে ধরে, কানেও ভাল শোনায়: এক কথায়, দল বা গোষ্ঠীটি যাতে সকলের নজর কাড়ে, ভালবাসা সমীহ বা অন্তত ভীতির উদ্রেক করে। এরপর থেকে আমি স্লোগানধর্মী বচন বোঝাতে ‘চুম্বক’ শব্দটা ব্যবহার করব। কথাটার দুটো অর্থই এখানে প্রাসঙ্গিক, আকর্ষক বস্তু এবং সংক্ষিপ্তসার। কোনও কোনও প্রসঙ্গে (যেমন এই অধ্যায়েই অনেক ক্ষেত্রে) ‘স্লোগান’ই অবশ্য বেশি উপযুক্ত হবে।
এত শর্ত মেনে যে শব্দবন্ধের উদ্ভব হয়, তাতে তাৎপর্যের বিচারে যদি বা কিছু অর্থ রক্ষা পায়, প্রয়োগে তা অবান্তর হয়ে পড়ে: চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হয় দলের ভিতরের লোকদের সংগঠিত করা ও বাইরের লোকদের আকৃষ্ট করা। তারা যদি না বুঝেও জড় হয়, উদ্বুদ্ধ হয়, ক্ষতি নেই; বরং ব্যাখ্যা চাইলে বা বিতর্ক জুড়লেই আপদ। তেমন ঘটলে স্লোগানের আর এক চেহারা বেরিয়ে আসে: আকর্ষক নয়, ভীতিপ্রদ। যে ভূমিকাতেই হোক, স্লোগানের ক্রিয়া বাস্তব ও ব্যবহারিক, সাংকেতিক নয়: মানে বোঝানো নয়, সোজাসাপ্টা কাজ হাসিল করা।
গোষ্ঠীর ভিতর আর বাইরের লোক, সদস্য আর জনসাধারণের এই সম্পর্ক কিছুটা বিক্রেতা আর ক্রেতার সম্পর্কের মতো। স্লোগানের একটা বড় উদ্দেশ্য দলকে জনপ্রিয় ও গ্রহণীয় করা: ইংরেজি বাগ্ধারায় বলা চলে, to make it sell। অন্য যে ক্ষেত্রে প্রচুর স্লোগান (ওই নামেই) ব্যবহার হয় তা হল পণ্যের বিজ্ঞাপন। রাজনৈতিক স্লোগানের চেয়ে বাণিজ্যিক স্লোগান সচরাচর আরও অসার হয়, কারণ পণ্যের যথার্থ গুণ বা চরিত্র একটা ছোট শব্দবন্ধে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। পরের অধ্যায়ে দেখব, অধিকাংশ বিজ্ঞাপনের এমনিতেই এমন অভিপ্রায় নেই। ফলে স্লোগান হয় নিছক পণ্যটিকে মনে রাখার— বলা যায়, মনে রাখতে বাধ্য করার— একটা আকর্ষণীয় উপায়, বস্তুপণ্য থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন।
খুব সম্প্রতি ভাষার আর এক রকম চুম্বকধর্মী ব্যবহার পৃথিবী ছেয়ে ফেলেছে, তা হল টুইটারের (এবং দেখাদেখি অন্যান্য সমাজমাধ্যমের) হ্যাশট্যাগ। হ্যাশট্যাগ এক বা একাধিক শব্দের হতে পারে, তবে একাধিক শব্দ থাকলে যুক্ত হতে হবে, ফাঁক রাখা চলবে না। (এটাও ভেবে দেখার বিষয়।) ভাষাতত্ত্বের পরিভাষায় হ্যাশট্যাগ একটা lexeme, বিশেষ অর্থবহ এক বা একাধিক শব্দ: বাংলায় ‘বাক্কণিকা’ বলা যেতে পারে। হ্যাশট্যাগ মূলত স্লোগান নয়, টুইটের বিষয়সূচক চিহ্ন, যেন একটা ক্ষুদ্র শিরোনাম। কিন্তু বিষয়টা যদি হয় কোনও নির্দিষ্ট ভাবনা বা আন্দোলন, তার স্লোগান হ্যাশট্যাগ হিসাবে ব্যবহার হতে পারে, যথা #MeToo, #MeraBharatMahan, #OccupyWallStreet, #OpenAmericaNow, #JaiShriRam।
হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের কতগুলি লক্ষণ দেখা যাক। অল্প হ্যাশট্যাগই ভাব বা ক্রিয়াসূচক শব্দবন্ধ; অধিকাংশ স্রেফ বিষয়সূচক একটা শব্দ (#fashion, #dogs, #cricket, #photography), উৎসব, ঘটনা বা অনুষ্ঠানের নাম (#WorldCup, #HappyHoli), কিংবা ব্যক্তিনাম, হয়তো কোনও সংযোজন সমেত (#NaMo অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি, বা #realDonaldTrump— এটি আদিতে হ্যাশট্যাগ নয়, টুইটারে ট্রাম্পের নিজের ব্যবহৃত নাম)। ফলে আরও বিস্তারিত হ্যাশট্যাগগুলির চরিত্র সম্বন্ধে একটা ধন্দ থেকে যায়। প্রথম কথা, সেগুলি ব্যাকরণের কোন পদ, বিশেষত একাধিক শব্দে গঠিত হলে? #OccupyWallStreet হ্যাশট্যাগ কি স্রেফ আন্দোলনের নাম (অর্থাৎ বিশেষ্য) হিসাবে প্রয়োগ হচ্ছে, নাকি নামের ভিতর নিহিত আহ্বান বা অনুজ্ঞা বহন করছে, অর্থাৎ ক্রিয়াপদ? এটা কেবল ব্যাকরণের কচকচি নয়: আন্দোলনটাকে আমরা কীভাবে দেখব, তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে না হোক মানসিকভাবে কতটা যুক্ত হব, তা এই ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করছে। আরও প্রশ্ন: ২০১১-তে আন্দোলন চালু থাকাকালীন না হয় ছিল শামিল হবার ডাক, আজও কি তাই? যদি সেভাবে দেখি, তা হলে হ্যাশট্যাগটা হয়ে দাঁড়ায় এক স্থায়ী রাজনৈতিক উচ্চারণ, নচেৎ অতীত ঘটনার নথি মাত্র।
ব্যাখ্যাগুলি পরস্পরের বিকল্প নয়, একসঙ্গে দুটোই সম্ভব হতে পারে। নারী আন্দোলনের হ্যাশট্যাগ #MeToo কখনওই নারীর আর পুরুষের কাছে এক বার্তা বহন করবে না, কারণ ওই Me হতে পারে কেবল যৌন-হেনস্থায় উৎপীড়িত নারী। নাকি এমন ইঙ্গিত আছে, প্রত্যেক পুরুষ দেখে ভাববে সেও অভিযুক্ত পুরুষদের অপরাধে ভাগীদার? কিংবা ভাববে সে পুরুষ হয়েও ওই নারীদের সহমর্মী, তাদের যন্ত্রণার অংশীদার? একজন নারী নিশ্চয় ভাববে সেও ভুক্তভোগী, বাস্তবে ঠিক একভাবে না হলেও সাধারণ অবস্থানে, কোনও-না-কোনও হেনস্থার সত্যিকারের বা সম্ভাব্য শিকার হিসাবে।
দেখা যাচ্ছে, হ্যাশট্যাগের একটা সজীবতা আছে; একই হ্যাশট্যাগ নানা বাচনক্রিয়ার বাহন হিসাবে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া একই হ্যাশট্যাগের ছত্রছায়ায় ভিন্ন ও বিপরীত মত ব্যক্ত করা যেতে পারে। সমাজমাধ্যমে সবাই অংশ নিতে পারে, তার নিহিত গণতান্ত্রিক বহুত্ব টুইটার বার্তার সমারোহে ফুটে ওঠে আর হ্যাশট্যাগে প্রতিফলিত হয়।
একটা মস্ত ‘কিন্তু’ তাও থেকে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি, কিছু হ্যাশট্যাগ স্রেফ বিষয় বা উপলক্ষসূচক ((#photography, #cricket, #WorldCup, #HappyHoli)। সবচেয়ে প্রচলিতগুলি স্বভাবত মানুষের সাধারণ আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত। দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ #love; পর-পরই আছে #photo, #fashion, #selfie, #fun, #food, #beauty প্রভৃতি বিশেষ্য ও তাদের বিশেষণ রূপ। কোনও গুরুতর ঘটনা, জনপ্রিয় ছায়াছবি ইত্যাদি সাময়িকভাবে ‘টপ ট্রেন্ড’ হতে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ওই সাধারণ বিশেষ্যগুলির প্রবল আধিক্য।
এখানেই প্রশ্ন, ব্যক্তিগত বার্তা ইঙ্গিত করতে এত ব্যাপক সামগ্রিক (generalized) শব্দ কেন? আরও সুনির্দিষ্ট কিছু হলে ভাল হত না? ঘটনা হল, লোকে টুইটার বা অন্য সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে তাদের বার্তা বহুল প্রচার হবে এই আশায়। ওইরকম ব্যাপক অর্থের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করলে আরও অনেকের সঙ্গে মিলে যাবার সুযোগ অজস্র গুণ বেশি, বলা বাহুল্য। ফলে টুইটারকারী সচেষ্ট হন, নিজের বক্তব্য স্বকীয় নজরকাড়া ভাবে পেশ করার বদলে সাদামাটা শিরোনাম দিয়ে আর পাঁচটার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে— কারণ তিনি জানেন, শেষ অবধি চালু হ্যাশট্যাগের সূত্র ধরে এ ভাবেই তা বেশি লোকের চোখে পড়বে। উপরন্তু টুইটার বার্তা খুব ছোট— নিয়ম অনুযায়ী যেটুকু হতে পারে, প্রায় সব ক্ষেত্রে তারও অনেক কম। অক্ষরসীমা (শব্দসীমা নয়) আগে ছিল ১৪০, এখন ২৮০; কিন্তু মাত্র এক শতাংশ বার্তা অত লম্বা হয়— গড় অক্ষরসংখ্যা মাত্র ৩৩! অর্থবহ বক্তব্য পেশ এখানে মূল উদ্দেশ্য নয়; আসল প্রেরণা একটা দল বা সমষ্টির মধ্যে মিশে যাওয়া, যার সদস্যসংখ্যা হাজার-লক্ষের ঘরে। বক্তব্যের কোনও স্বকীয়তা থাকলেও তা হারিয়ে যায় বাকি বার্তার ভিড়ে, কারণ সবগুলি দেখা হয় হ্যাশট্যাগের খেই ধরে সমষ্টিগতভাবে— গুনতিতে, বৈশিষ্ট্যের বিচারে নয়।
ফলে কার্যত হ্যাশট্যাগ হয়ে পড়ে স্লোগানের সমগোত্রীয়। কিছু কিছু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় স্লোগান (বা একাধারে দুটোই) হ্যাশট্যাগ হিসাবে ব্যবহার হয়। কিন্তু বলা চলে, কোনও আন্দোলন বা জনমতের সারমর্ম যাই হোক, বৃহত্তর জগতে যাই ভূমিকা থাক, টুইটারের দুনিয়ায় সবগুলির একটাই পরিচয় ও বাচনক্রিয়া, সেটা স্লোগানের। ভাবাদর্শে যতই তফাত থাক, অভিঘাতের বিচারে #MeraBharatMahan, #JaiShriRam, #OccupyWallStreet বা #OpenAmericaNow সব হ্যাশট্যাগের এক ভূমিকা: হ্যাশট্যাগগুলো তাদের ভাববস্তুর সংকেত নয়, তার সমর্থনে একটা আওয়াজ মাত্র। সমর্থনেও হয়তো নয়: যত লোকে টুইট করছে, সকলে কখনওই সহমত হয় না— অনেক মতভেদ, বিরোধিতা এমনকী কাঁচা খিস্তি ঢুকে পড়ে। সবটাই কিন্তু জড়ো হয় এক হ্যাশট্যাগের আওতায়, অর্থাৎ কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্ব পায় না। সব রকম চুম্বকবার্তা সন্বন্ধে যে কথা খাটে, হ্যাশট্যাগ সম্বন্ধেও তাই বলতে হয়: তার শব্দগুলো মূলত সংকেত নয়, অর্থবহতা তার প্রধান উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হল সরাসরি একটা কেজো দরকার মেটানো, গোষ্ঠীভুক্তির চটজলদি প্রমাণ দাখিল। শব্দের অর্থ নয়, আক্ষরিক শব্দটা নিয়েই কারবার— টাকা দিয়ে টাকার কারবারের মতো, শব্দকে অর্থ প্রচার নয় পণ্য প্রচারে ব্যবহারের মতো।
এবার একটা মস্ত নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে কিন্তু। কেউ যদি কোনও রাজনৈতিক দলের স্লোগান আওড়ায়, ধরে নেওয়া যায় সে ওই দলের সদস্য বা সমর্থক। #JaiShriRam বা #OccupyWallStreet হ্যাশট্যাগ কেউ টুইট করলে সে কিন্তু কেবল সেই আন্দোলনের শামিল হচ্ছে না (বা উপরে যা বললাম, মোটেই না হতে পারে)। আরও ব্যাপক ও মৌলিকভাবে সে যোগ দিচ্ছে আর একটা গোষ্ঠীতে, তা হল টুইটারাটিদের বিশ্বজোড়া সংঘে। এতে যোগদানের জন্য সকলের অবারিত দ্বার: পয়সা লাগে না, কোনও শর্ত পূরণ করতে হয় না, একটা মোবাইল বা কম্পিউটার থাকলেই চলে।
টুইটারের কর্তাদের এত বদান্যতা কেন? উত্তরটা আমরা জানি, যদিও সচরাচর তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। টুইটারে— বা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সব সমাজমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে, এবং গুগল সার্চ এঞ্জিন থেকে শুরু করে আন্তর্জালের সমস্ত সহায়ক ব্যবস্থায়— নিঃশুল্ক ব্যবহারের যে ‘দাম’ দিতে হয়, তা হল তথ্য। আমাদের যত বার্তা ও বৃত্তান্ত ওই প্ল্যাটফর্মে গৃহীত হচ্ছে, যত কেনাবেচা যোগাযোগ তার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের মালিক সংস্থা সবটা জড়ো করে বিক্রি করছে নানা বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থাকে, তাদের প্রচার ও বিপণনের স্বার্থে; মালিকেরা নিজেরাই কাজে লাগাচ্ছে তাদের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে (যেমন, ভাষার ব্যবহার ও অনুবাদের সফটওয়ার বানাতে); এবং হয়তো স্বীকৃত বা অস্বীকৃত অন্য নেপথ্য উদ্দেশ্যেও তথ্যের হাতবদল হচ্ছে।
তাই বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত যে কোনও লেনদেন বা পরিষেবায় আমরা আদতে ক্রেতা বা গ্রাহক নই, আমরাই পণ্য: টাকা নয়, আরও মোক্ষমভাবে আমাদের কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা এমনকী দৈনন্দিন হাঁড়ির খবর নিয়ন্ত্রকদের হাতে তুলে দিচ্ছি তাদের পরিষেবার মাশুল হিসাবে। সেই তথ্য তারা সরবরাহ করছে অন্য পক্ষকে, যারা তাদের সত্যিকারের ক্রেতা; বা নিজেরাই ব্যবহার করছে অন্য ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। আমাদের ব্যক্তিপরিচয় নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই এটাই রক্ষা (অন্তত আমরা তা ভেবে নিশ্চিন্ত থাকি): আমাদের ব্যক্তিজীবনের উপকরণ তথ্যকণিকায় বিভক্ত হয়ে— ‘ইন্ডিভ়িজুয়াল’কে অসংখ্য ‘ডিভ়িজুয়াল’এ পরিণত করে— নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাদের সার্ভার-সাগরে কয়েক বিন্দু জোগাচ্ছে মাত্র। বদলে আমাদের লাভ, বৈদ্যুতিন উপায়ে আমরা বার্তাবিনিময় ও আরও বহু কাজ মসৃণভাবে অভাবনীয় দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করছি। যে বিল মেটাতে বা টিকিট কাটতে এক বেলা লাইন দিতে হত, সেটা পাঁচ মিনিটে ঘরে বসে সেরে ফেলছি, ছবি পাঠাচ্ছি আধ মিনিটে; দুনিয়ার তাবৎ খবর মায় আস্ত গ্রন্থাগার হাতের নাগালে এসে যাচ্ছে; হরেক সুবিধা পাচ্ছি যা আগে কল্পনাতীত ছিল।
ঝ়ীল দেল্যুজ় প্রবর্তিত ‘ডিভ়িজুয়াল’-এর ধারণাটা আমরা গত অধ্যায়ে দেখেছি। দেল্যুজ় সেটা যুক্ত করেছেন টাকার বাজারের সঙ্গে: পুরনো যে স্থিতিশীল বাজারে টাকার দাম সোনার দামে নির্ধারিত হত সেটা নয়, আজকের যে অস্থির বাজারে বিভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা পরস্পরের অনুপাতে নিত্য ওঠে-নামে। এই আলোড়নের মধ্যে আমাদের স্থাবর ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ পরিচয় বাতিল হয়ে যায়। আমরা চিহ্নিত হই নামে নয়, একটা বাঁধা নম্বরে পর্যন্ত নয়, তার বদলে একরাশ কোড বা পাসওয়ার্ড দ্বারা; প্রত্যেকটা দিয়ে আমরা একগুচ্ছ তথ্যের নাগাল পাই (অবশ্যই তা বৈদ্যুতিন তথ্য, information)। একই সঙ্গে তথ্যকর্তারাও আমাদের নাগাল পেয়ে যান, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হয়— নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক, যেখানে আমাদের উপস্থিতি কেবল খণ্ডিত ‘ডিভ়িজুয়াল’ রূপে, ওই বিশেষ তথ্যসূত্রের পক্ষে যতটুকু প্রাসঙ্গিক।
পূর্ণ আমি আর খণ্ড-আমি, দুইয়ের যোগ ও বিচ্ছেদের এই বিশাল লীলাভূমি যুগ্মভাবে বিশ্বায়িত অর্থব্যবসা এবং তথ্যপ্রযুক্তির জগৎ, কয়েক দশক আগেও যা কল্পনার অতীত ছিল। এই জগতের মধ্যে একটা বিরাট মহাদেশ জুড়ে আছে সমাজমাধ্যম। সমাজমাধ্যম মারফত আমরা শুধু চেনা লোকের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ করি তা নয়, বিশ্বজোড়া মানুষের সঙ্গে তাৎক্ষণিক ও প্রায় অনামী সম্পর্ক স্থাপন করি, খুচরো হলেও উপভোগ্য আদানপ্রদান চলে। সবটাই কিন্তু চলে একটা মৌলিক বিভ্রান্তির বশে। আমরা ভাবি, ফেসবুক টুইটার হোয়াট্সঅ্যাপে আমরা রীতিমতো আত্মপ্রকাশ করছি— নিজের কথা বলার, ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার যে সুযোগ পাচ্ছি আর কোথাও পাইনি, পাব না। আসলে কিন্তু ছাড়া ছাড়া বার্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত টুকরো, অজস্র খণ্ডপরিচয়, তথ্যকণিকার এক-একটা ক্ষুদ্র গুচ্ছ হিসাবে।
সমাজমাধ্যমে আমার ‘ইন্ডিভ়িজুয়াল’ ব্যক্তিত্বের প্রক্ষেপ আসলে অসংখ্য ‘ডিভ়িজুয়াল’এর একটা আলগা সংযোগ মাত্র। অর্জুন আপ্পাদুরাই বলছেন, বৈদ্যুতিন জগতের ‘ডিভ়িজুয়াল’ অস্তিত্বে আমাদের দেহ-আত্মা-অভিপ্রায়-অনুভূতি সংবলিত কোনও সুস্থিত সত্তা থাকে না; তার বদলে গড়ে আর ভাঙে সামাজিকতা, আত্মবোধ আর অনুভূতির একের পর এক অস্থায়ী জোড়াতালির পরিচিতি।৪২ যতই আন্তরিকভাবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করি, তা মিলিয়ে যায় এই বিক্ষিপ্ত ক্ষণস্থায়ী স্ফুরণের কাতারে, একটার পর একটা ক্ষুদ্র রচনা বা fictionএ। আর কী আশ্চর্য, সমাজমাধ্যমের সব অংশকারী মোটেই আন্তরিক হতে চান না। সজ্ঞানে বা অজান্তে সমাজমাধ্যমের বার্তায় ঢুকে পড়ে অল্পবিস্তর (প্রায়ই বিস্তর) কল্পনা, আত্মপ্রতারণা বা সরাসরি মিথ্যা। যত বার্তাপ্রেরকের নাম দেখা যায়, তার একটা বড় অংশ ছদ্মনাম বা একেবারে কাল্পনিক ব্যক্তি। আসল-নকল সব কিছুরই কিন্তু তথ্যের রসদ হিসাবে এক দাম, এক পরিচয়। সেই রসদ নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বিশ্বজয়ী মালিক সংস্থারা নিজেদের নিঃশব্দ কারবারে ব্যস্ত, সে সম্বন্ধে আমাদের খেয়ালও নেই, ধারণাও নেই।
ব্যাপারটা রীতিমতো মিলে যায় বিশ্বায়িত নব্য অর্থব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভূমিকার সঙ্গে, প্রথম দুটো অধ্যায়ে যার কথা বলেছি। আমাদের স্বল্প সম্পদ নিয়ে আমরা সেই অর্থব্যবস্থার এক প্রান্তে ছোটখাটো সরল লেনদেন করি, জগৎটার আসল পরিধির ধারণা বিনা। বরং তথ্যপ্রযুক্তির জগতের সঙ্গে আমাদের যোগ আজকের দিনে প্রায়ই ব্যাপক ও নিবিড়, কারণ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে আমরা এই প্রযুক্তি আরও বেশি বেশি ব্যবহার করছি। তথ্যপ্রযুক্তির আসল বৃহৎ কর্মকাণ্ড কিন্তু ঘটে আমাদের অজ্ঞানে, সেখানে আমরা খেলার ঘুঁটি।
আমার আলোচনা এই পুরো জগৎটা নিয়ে নয়, ভাষার ব্যবহারে তার প্রভাব নিয়ে। মানতেই হবে, ভাষার সবচেয়ে নিবিড় ও জটিল প্রয়োগে— যেমন পাঠ বিশ্লেষণ মায় সাহিত্য রচনায়— কম্পিউটার বিজ্ঞান (কেবল সংকীর্ণ ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ নয়) নানা বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটিয়ে চলেছে। আমার বক্তব্য সেই বিশেষ প্রয়োগ নিয়ে ততটা নয়, যতটা তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ববাজারের কল্যাণে সাধারণ মানুষের ভাষার অভ্যাস নিয়ে— এক দিকে অতিকায় বিশ্বায়িত বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে, অন্য দিকে সামাজিক ও মানবিক স্তরে ব্যক্তিসম্পর্কের নতুন বিন্যাসে। এক কথায় বলা যায়, এই দুটি ‘দিক’ বা ক্ষেত্রের এত অভিনব ও নাটকীয় সংযোগ বৈদ্যুতিন যুগের আগে সম্ভব ছিল না। সেই সংযোগের বিস্তার নিয়ে একটু ভাবা যাক; আরও বেশি ভাবা যাক তার অভূতপূর্ব চরিত্র নিয়ে।
প্রথম কথা, বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির ফলে— বিশেষত সমাজমাধ্যমে তার ব্যাপক প্রয়োগের ফলে— বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে লিখিত ভাষার ব্যবহার প্রভূতভাবে বেড়েছে। প্রথম অধ্যায়ে দেখেছি, সর্বজনীন সাক্ষরতার প্রবর্তন শুরু হয়েছে উনিশ শতক থেকে। লিখতে-পড়তে শেখার পরও কিন্তু ভাষা ব্যবহারের আর একটা স্তর আছে, সামাজিক সাক্ষরতা (social literacy) অর্থাৎ সামাজিক আদানপ্রদানে সক্রিয়ভাবে সাক্ষরতার প্রয়োগ। সমাজের একটা ছোট শিক্ষিত অংশ বরাবরই সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল ভাবে ভাষা ব্যবহার করে এসেছে। বরং অনুযোগ শোনা যায় যে সাইবার যুগে এই শ্রেণির মধ্যে, বিশেষত তার তরুণ প্রজন্মে, ভাষার অনুশীলন কমে এসেছে। অনুযোগটা ঠিক নয়। দু’-একটা অভ্যাস, যেমন হাতে চিঠি লেখা, প্রায় লোপ পেয়েছে ঠিকই; কিন্তু একই ধরনের রচনা ইমেলে, বা ফেসবুক ইত্যাদি বিস্তৃত পরিসরের সমাজমাধ্যমে, নতুন অবতার ধারণ করেছে; উদ্ভাবন হয়েছে ব্লগের মতো নতুন সংরূপের। সাহিত্য রচনা, সাংবাদিক প্রতিবেদন, সরকারি ব্যবসায়িক ও আইনি দলিলপত্রের মুসাবিদা— ভাষার এই সব প্রচলিত প্রমিত ব্যবহার মোটামুটি আগের মতো চলছে। কিছু পরিবর্তন সব যুগে ঘটে থাকে, আজ স্বাভাবিকভাবে সেগুলি প্রায়ই বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য কাজে লাগাচ্ছে। বৈদ্যুতিন ফাইলের সংযোগকারী হাইপারলিংকের সদ্ব্যবহার করে নতুন আঙ্গিকের উপন্যাস ‘হাইপারনভেল’ লেখা হচ্ছে, এমনকী সারবন্দি টুইটারবার্তা সাজিয়ে লেখা হচ্ছে আস্ত উপন্যাস। এই উদ্ভাবনের কতগুলি সত্যিই উদ্দীপক, কতগুলি হয়তো নেহাত হুজুগ। তবে মোটের উপর ভাষার নতুন ব্যবহার নিয়ে যা বলতে যাচ্ছি তা এই অভিজাত প্রয়োগের ক্ষেত্রে তত খাটে না। এখানে ভাষার অভ্যাস মৌলিকভাবে বদলায়নি।
যুগান্তর ঘটেছে সমাজমাধ্যমে, আরও অনেক বিশাল এক জনসংখ্যার মধ্যে। অতীতে এই মানুষেরা প্রয়োজনে এক-আধটা চিঠি বা দরখাস্ত ছাড়া পারতপক্ষে কিছু লিখতেন না। আজ তাঁরা বলতে গেলে বিনা প্রয়োজনে দিনভর এন্তার বার্তা রচনা ও বিনিময় করছেন; তাঁদের জীবন বাঁধা পড়ে গেছে তাঁদেরই সৃষ্ট ভাষার আবর্তে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াট্সঅ্যাপের পর্দায় এঁরা বার্তার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, যার বৃহত্তম অংশ আটপৌরে জীবনের খুঁটিনাটি, ছোট ছোট ভাবনাচিন্তার রোজনামচা: বিশ শতকের শেষ অবধি তার অধিকাংশ উপাদান মানবজাতি লেখায় ধরে রাখার সুযোগ পায়নি, হয়তো তাগিদও বোধ করেনি। (ডায়েরি বা ব্যক্তিগত চিঠিতে অল্প লোকে অতি ক্ষুদ্র অংশ তুলে রাখতেন।) এই অভিনব চাহিদা মেটাতে সমাজমাধ্যম হয়ে উঠেছে নতুন নতুন বাচনক্রিয়ার কারখানা, এতদিন (অন্তত লিখিত রূপে) যাদের প্রায় অস্তিত্ব ছিল না।
বিশ্বজনতার যে অংশ সমাজমাধ্যমে নতুন আত্মপ্রকাশ করছেন, তাঁদের প্রথম উদ্দেশ্য রচনা সৃষ্টি নয়, পাঁচটা লোকের সঙ্গে সংযোগস্থাপন। তাঁদের ভাষার বয়ান প্রমিত বা আনুষ্ঠানিক নয়, স্বকীয় স্বচ্ছন্দ সাদামাটা এমনকী বেয়াড়া, সব অর্থে ‘অশিষ্ট’। ভাষার এমন প্রয়োগ প্রচলিত অর্থে বাচনক্রিয়া কিনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, কারণ এর গূঢ় (ও প্রায়ই স্পষ্ট) উদ্দেশ্য অপরকে কিছু জানানো নয়, নিজের কাছে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। বার্তার বিষয় যদি বহির্জগতের কোনও গুরুতর ঘটনাও হয়, বার্তাকারীর দৃষ্টি আত্মমুখী: প্রধান বার্তা ‘দেখ আমি বলছি’, ‘আমি কী বলছি’ সেটা তুলনায় গৌণ। অর্থাৎ পরিমাণ ও পরিসরের দিক দিয়ে সমাজমাধ্যমে ভাষার ব্যবহার যে অভাবিত হারে বাড়ছে, তার অর্থবহতা সে হারে বাড়ছে না। বার্তার ভিড়ে আমরা বেশি করে তাৎপর্য বা সারবত্তা খুঁজছি না, বরং কমই খুঁজছি। তার বদলে উপভোগ করছি একটা নতুন সামাজিক সংযুক্তির আনন্দ— যোগাযোগ তত নয়, যতটা যোগদান। যোগদানের শর্ত হিসাবে ভাষায় বার্তা পাঠাতে হয়, কিন্তু সেই ভাষা সরলীকৃত ও প্রয়োগে সীমিত, বাইরের জগতের প্রতি সাংকেতিক নির্দেশের কাজটা যথাসম্ভব সংক্ষেপে সেরে নিজের আহ্লাদিত অস্তিত্ব প্রকাশ করতেই ব্যস্ত: যত না বাচনক্রিয়া, তার অনেক বেশি মাত্রায় সামাজিক ক্রিয়া।
একই সঙ্গে অ্যাপ মালিকের দৃষ্টিতে বার্তাগুলি ব্যবসার রসদ। বার্তা বিনিময়ের পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি অতিকায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, যাদের বিত্ত ও ব্যাপ্তি আর সব বিশ্বায়িত প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে (হয়তো একমাত্র আমাজন বাদে)। আগেই বলেছি, এদের প্রধান পণ্য হচ্ছে তথ্য, যা আমরাই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। তথ্যটা কী বিষয়ের সেটা তারা শনাক্ত করতে পারে, কিন্তু যাই হোক না কেন, কিছু যায় আসে না। বাস্তব জীবনের সমস্ত উপাদানই তথ্যশিল্পের কাঁচামাল, মানুষের স্বাভাবিক ভাষায় (natural language) ব্যক্ত। অঙ্কের সাংকেতিক ভাষায়, বিমূর্ত বাইনারি কোডে তার ‘অনুবাদ’ হল এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্য। কোড-করা তথ্য কম্পিউটারে প্রেরণযোগ্য ও বিশ্লেষণযোগ্য, দুনিয়ার হরেক কাজে লাগে; চাহিদামতো সাজিয়ে গুছিয়ে খুঁটিয়ে তা ক্রেতাকে জোগান দেওয়া হয়। আবার আমাদের মনে পড়তে পারে, টাকার বাজারে অর্থের বিমূর্ত অঙ্ক নিয়ে লেনদেন: নেপথ্যে যদি বা বাস্তব পণ্যের অস্তিত্ব থাকে, সেটা কী তা অবান্তর। তথ্যের বাজারেও তাই।
এই পুরো অধ্যায়ে ভাষা প্রয়োগের যা আলোচনা করেছি, এখানেই হয়তো সেই বক্তব্য সবচেয়ে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। ভাষা প্রায় কখনওই পুরোপুরি নিরর্থক হতে পারে না। চুম্বকধর্মী বচনেও— রাজনীতি বা বিজ্ঞাপনের স্লোগানে, সমাজমাধ্যমের বার্তা ও তার নির্দেশক হ্যাশট্যাগে— শব্দগুলির একটা মানে থাকতেই হবে; কিন্তু আছে ন্যূনতম মাত্রায়, নেহাত না থাকলে নয় বলে। ভাষা এখানে মুখ্যত প্রণালী নয়, সামগ্রী: খাদ্য বস্ত্র আসবাবের মতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হলেও প্রয়োগে তেমনই সীমিত। তার প্রধান ভূমিকা আর সাংকেতিক উপায়ে অর্থনির্দেশ নয়, বরং শব্দার্থের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কোনও বার্তা বহন করা, একদম অন্য একটা কেজো উদ্দেশ্যে: ‘এই জিনিসটা কেনো’, ‘আমাদের দলে যোগ দাও’, ‘দেখো আমি তোমাদের একজন’।
শব্দের মৌলিক অর্থবহতা এত গৌণ হয়ে পড়লে ভাষার প্রচলিত সংজ্ঞা আর খাটে না, নতুন করে ভাবতে হয়। এই অধ্যায়ের সব দৃষ্টান্তেই আমরা যা দেখলাম, ফ্রাঙ্কো বেরার্দি তার একটা দাঁতভাঙা কিন্তু উপযুক্ত নাম দিয়েছেন dereferentialization, নির্দেশক্রিয়ালোপ। একটা শব্দ স্বভাবত তার বাইরে আর কিছুর প্রতি নির্দেশ বা refer করে; শব্দের এই নির্দেশক ভূমিকাটা এবার কমিয়ে এমনকী সরিয়ে দেওয়া হল, তার স্বধর্ম— অন্তত প্রচলিত ধর্ম— ক্ষুণ্ণ করে। বেরার্দির মূল আলোচ্য বিষয় পুঁজিবাদ। তিনি বলছেন, আজকের ধনতন্ত্র একদিকে পৃথিবীর বাস্তব প্রকৃতিগত অস্তিত্ব, অন্যদিকে মানুষের ইতিহাসলব্ধ সামাজিক অস্তিত্ব, দুটোকেই ধ্বংস করছে। পুঁজি হয়ে পড়েছে মানুষ প্রকৃতি স্থান-কাল-পাত্র সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন একটা বিমূর্ত নিরালম্ব শক্তি। এই প্রসঙ্গে আসছে ভাষার উল্লেখ। বেরার্দি বলছেন, এই ধ্বংসলীলায় ধনতন্ত্রের কর্মকৌশল হল সংকেতের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্পর্ক লুপ্ত করা, অর্থাৎ যেমন টাকার তেমনি ভাষার সাংকেতিক পরিচয় বিনষ্ট করা। তার ফলে বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে কিছু বলা বা বোঝা, অনুভব বা আলোচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে; ধনতন্ত্রের বিচ্ছিন্ন আত্মলিপ্ত কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে হাসিল করা যায়।৪৩
আবার চলে এলাম জ্ঞানতত্ত্ব বা epistemologyর চিন্তায়— যে মানসিক প্রক্রিয়ায় আমরা জগৎটা দেখি, বুঝি ও ব্যক্ত করি। সমাজমাধ্যমে এই প্রক্রিয়া এক অভিনব রূপ নিচ্ছে— কিংবা বলা চলে, যে প্রক্রিয়া আগে বিক্ষিপ্ত ও অস্ফুটভাবে কাজ করত, সমাজমাধ্যমে তার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। সমাজমাধ্যমের গুরুত্ব আজ অপরিসীম, একটা দেশের হাল টুইটের উপর নির্ভর করতে পারে। কিন্তু তাতে ভাষার অর্থবহ সাংকেতিক ভূমিকা ক্ষীয়মাণ— যেন ফাঁপা, হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। সমকালীন রাজনীতির অসারতার এটা এক প্রধান কারণ; বিশ্বস্তরে তার ব্যাপক ও মর্মান্তিক নিদর্শন ডনাল্ড ট্রাম্পের বিধ্বংসী টুইটের তোড়। সমাজমাধ্যমের বিশ্বজোড়া প্রসারে তাই দিশা পাওয়া মুশকিল: বার্তাগুলো যতই কম্পিউটারে নিখুঁত বিন্যাসে সাজানো থাক, হ্যাশট্যাগের সূত্র ধরে যতই একত্র করা যাক, সবটাই বিক্ষিপ্ত, আধাখেঁচড়া, বিভ্রান্ত। ভাষার প্রকাশ যে এমন বন্যার স্রোতে বইতে পারে, কয়েক দশক আগে তা কল্পনার অতীত ছিল; প্রযুক্তির কল্যাণে আজ তা জলভাত। কিন্তু ঘটনা হিসাবে অভ্যস্ত হওয়া আর মানসিকভাবে দখলে আনা দুটো আলাদা ব্যাপার।
দার্শনিক ঝ়াঁ বদ্রিইয়ারের একটা উপলব্ধি এখানে নিবিড়ভাবে প্রাসঙ্গিক। বদ্রিইয়ার বলছেন, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় সব কিছু অত্যধিক ও অসুস্থ হারে বেড়ে চলেছে। অন্য অনেক কিছুর মতো বার্তা ও সংকেতও এত বিপুল বেগে সৃষ্টি ও সম্প্রচার হচ্ছে যে সবটার হদিশ রাখা অসম্ভব, এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ কোনওক্রমে দেখা যায়। ফলে বার্তার এই বৈভব কোনও উপকারে আসছে না— কেবল অবহেলিত সিংহভাগ নয়, যেটুকুর নাগাল পাচ্ছি তারও সদ্ব্যবহার করতে পারছি না: প্রাচুর্যের তোড়ে আমাদের চেতনা অবশ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো।৪৪ যে-যে ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ প্রাচুর্য ঘটছে— ভাষা তার একটা, আর আছে ধন, যুদ্ধাস্ত্র, সব রকম পণ্যসামগ্রী— সেখানে আধিক্যের ভারে উপকারিতা হারিয়ে গেছে, লোপ পেয়েছে প্রয়োগমূল্য (use-value)। যে উদ্দেশ্যে এই সম্পদ সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই সাধিত হচ্ছে না।
একটা বিখ্যাত কল্পকথা এখানে দেখা যেতে পারে। অষ্টম অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করব জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস নাইন্টিন এইটি-ফোর। উপন্যাসের পটভূমি যে একচ্ছত্র রাষ্ট্র, তার এক প্রধান লক্ষ্য মানুষের স্বাভাবিক ভাষা লুপ্ত করে তার বদলে এক ‘নতুন ভাষা’ চালু করা: ‘নিউস্পিক’, যা একাধারে ‘নিউজ়স্পিক’ও বটে, সংবাদের বা প্রচারের ভাষা। এই অভিনব ভাষায় শব্দের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা হবে। অর্থের সূক্ষ্ম পার্থক্যের তোয়াক্কা করা হবে না, অতএব বিপুল সংখ্যক শব্দ এক কোপে বাতিল হয়ে যাবে। অবশিষ্ট শব্দগুলিরও উপমালব্ধ আনুষঙ্গিক অর্থ বাতিল হবে: যথা, ‘মুক্তি’ বলতে বোঝাবে আক্ষরিকভাবে কোনও কিছুর অভাব বা অনুপস্থিতি (‘এই খেতটা আগাছামুক্ত’); মনের বা চিন্তার মুক্তির কথা ভাবাই যাবে না, সুতরাং বলার প্রশ্ন নেই।৪৫ দুটি বিপরীতার্থ শব্দের একটা বাদ দিয়ে অন্যটাতে উপসর্গ বসিয়ে কাজ চালাতে হবে: যথা, ‘খারাপ’ শব্দটা (অর্থাৎ তার চিন্তাটাই) লোপ পাবে, একান্ত বলতে হলে বলব ‘অ-ভাল’ (ungood)।৪৬
ভাষাপ্রক্রিয়ার পরিহাসে বদ্রিইয়ার বর্ণিত বাহুল্য আর অরওয়েল বর্ণিত স্বল্পতা, দুটোর একই পরিণাম: যে অর্থ পরিবেশনের জন্য ভাষার উদ্ভব, সেই অর্থটাই হ্রাস পেতে পেতে হারিয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে কী, দুটো প্রক্রিয়া আসলে এক। বদ্রিইয়ার-বর্ণিত ভাষার যান্ত্রিক তোড়ের মধ্যে আলাদা আলাদা অর্থপূর্ণ শব্দের সংখ্যা কিন্তু অল্প; অরওয়েলের কল্পিত ভাষাতেও আলাদা শব্দের সংখ্যা অল্প এবং তাদের অর্থ সীমিত, কিন্তু সেগুলি ব্যবহার হচ্ছে অবিরত। একই সমস্যার দুই দিক এই দুই লেখক ইঙ্গিত করছেন (অরওয়েল প্রায় পথিকৃতের মতো ১৯৪৯-এ, সমস্যাটা সাধারণভাবে স্বীকৃত হবার আগে): ভাষার সাংকেতিক ভূমিকা খর্ব হচ্ছে, তার অর্থবহতার অভাবে জগৎটাকে আমরা জানতে বুঝতে, তার সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছি না। বদ্রিইয়ার বলছেন, এর ফলে যত তথ্য (ডেটা) জড়ো হচ্ছে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আসল বাজার, আসল অর্থনীতি ছারখার করে কায়েম হয়েছে ভাবাদর্শ সমাজচেতনা ও ইতিহাসের ভারমুক্ত এক শূন্যস্থিত অর্থব্যবস্থা। মোক্ষম যমকের প্রয়োগে বলছেন, এই ব্যবস্থার উপজীব্য pure speculation:৪৭ ব্যবসায়িক অর্থে speculation অর্থাৎ বাজার নিয়ে ফাটকাবাজি, কিন্তু একই সঙ্গে বৌদ্ধিক অর্থেও অর্থাৎ আন্দাজ-অনুমান, চিন্তার বায়বীয় আকাশকুসুম। দুটো মানে পরস্পরযুক্ত: আজকের পৃথিবীতে ক্রিয়া আছে কিন্তু তার হেতু বা উদ্দেশ্য নেই, যান্ত্রিক ও বিছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু কেন করছি জানি না। ব্যবহারিক জগৎ আর মননের জগৎ, টাকার জগৎ আর ভাষার জগৎ যুগ্মভাবে বিপর্যস্ত, দুটোরই সাংকেতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
এই অধ্যায়ের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান বিশ্বের প্রবণতা হল আমাদের অভ্যস্ত মানসিক জগতের তাৎপর্য ও পটভূমিকা, অর্থাৎ তার বৃহত্তর অস্তিত্ব, অগ্রাহ্য করে খণ্ডবিশেষ দিয়ে বিনা বিবেচনায় তাৎক্ষণিক কোনও কাজ হাসিল করা। অর্থব্যবস্থা ও ভাষা, উভয় ক্ষেত্রেই এটা ঘটে চলেছে। দুটোই আদতে সাংকেতিক ব্যবস্থা, যাতে একটা জিনিস দিয়ে আর একটাকে নির্দেশ করা হচ্ছে, সামনে যা দেখছি তার নেপথ্যে আর কিছু আছে। সেই নেপথ্য তাৎপর্য উত্তরোত্তর অগ্রাহ্য করে সংকেতকে দেখা হচ্ছে অসার বস্তু বা সামগ্রী হিসাবে। টাকা আর ভাষা, দুটোরই গূঢ় সত্তা বিমূর্ত, ভাবাশ্রয়ী; কিন্তু সাংকেতিক প্রক্রিয়ায় সেগুলি সারগর্ভ বাস্তব নির্দেশ করে। সেই সারবত্তা অগ্রাহ্য করায় এখন সংকেতগুলির উদ্দেশ্য ব্যর্থ: সেগুলি আর বিমূর্ত নয়, স্রেফ অন্তঃসারহীন।
অর্থাল্পতার ফলে ভাষার আদি অভ্যস্ত কাজ বাধা পায়, অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হয়ে পড়ে। পরের অধ্যায়ে এটা আরও বিশদভাবে দেখব।