৭. কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ নামায)
তাহাজ্জুদ কি রসূল (ﷺ) –এর জন্যে ফরয ছিলো?
রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্যে তাহাজ্জুদ নামায ফরয চিলো কিনা?- এ বিষয়ে পূর্ববর্তী উলামা ও মুজতাহিদগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাঁদের কারো মতে রসূল (ﷺ)-এর জন্যে তাহাজ্জুদ ফরয ছিলো। কারো মতে ছিলো নফল। উভয় পক্ষেই এ আয়াতটিকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন।
(আরবী******************)
অর্থ: রাতের কিচু অংশ জেগে (তাহাজ্জুদ) নামায এটা তোমার জন্যে নফল (অতিরিক্ত)।” (সূরা ১৭ ইস্রা: আয়াত ৭৯)
এক পক্ষ মনে করেন, রাত জেগে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়া যে ফরয নয়, বরং নফল- এ আয়াত তার অকাট্য প্রমাণ।
অপর পক্ষ মনে করেন, এ আয়াত তাঁকে রাত জেগে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়ার নির্দেশ প্রদান করা হযেছে, তাই এটা তাঁর জন্যে ফরয। সূরা মুযযাম্মিলের প্রথশ দুই আয়াতেও তাঁকে একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
(আরবী******************)
অর্থ : হে আচ্ছাদিত! কিছু অংশ বাদে বাকি রাত কিয়ামুল লাইল করো।” এই দুই জায়গায় তাঁকে রাত জেগে নামায পড়তে বলা হয়েছে এবং এই হুকুম তাঁর জন্যে রহিত করা হয়নি। তা তাঁর জন্যে তাহাজ্জুদ ফরয ছিল।
প্রথম আয়াতে যে বলা হয়েছে, ‘এটা তোমার জন্যে নফল (অতিরিক্ত) এখানে নফল মানে ‘নফল নামায’ নয়, বরং এখানে নফল শব্দটি অতিরিক্ত অর্থে এসেছে। অর্থাৎ রাত জেগে নামায পড়ার এই নির্দেশটা তোমার জন্যে অতিরিক্ত। এই নামায রসূলুল্লঅহ (ﷺ)- এর মর্যাদা ও পুরষ্কারের জন্যে একটি অতিরিক্ত নামায।
অন্যদের জন্যে রাত জেগে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়াটা মুবাহ (বৈধ) এবং তাদের গুনাহের কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) স্বরূপ।
রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগে পরের সব গুনাহই আল্লাহ তা’আলা মাফ করে দিয়েছেন। তাই তাঁকে এ নাময পড়তে বলা হয়েছে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্যে। আর তাঁর উম্মতের জন্যে এ নামায গুনাহ থেকে মুক্তির উপায়।
আমাদের মতে, এখানে নফল (অতিরিক্ত) শব্দ দ্বারা এমন বুঝানো হয়নি- যা জায়েয, যা পড়লেও চলে, না পড়লেও চলে।
রসূলুল্লাহ (ﷺ) আবাসে কিংবা প্রবাসে কখনো তাহাজ্জুদ ত্যাগ করতেন না। যদি কখনো নিদ্রা অথবা অসুস্থতার কারণে রাত্রে বাদ পড়তো, দিনের বেলা পড়ে নিতেন।
তিনি তাহাজ্জুদ কতো রাকাত পড়তেন?
রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রে কতো রাকাত নামায পড়তেন, তা বুঝাবার জন্যে প্রথমে একথঞা মনে রাকতে হবে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রের শেষার্ধে তিন প্রকার নামায পড়তেন। অর্থাৎ-
-তাহাজ্জুদ নামায।
-বিতির নামায।
-ফজরের সুন্নত দুই রাকাত।
এই তিনটি নাময তিনি কখনো একই সময় আবার কখনো কিচুটা পৃথক সময়ে পড়তেন বলে তাহাজ্জুদ এবং বিতির রাকাত সংখ্যা নির্ণয়ে কিছুটা মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যিনি যে কয় রাকাত পড়তে দেখেছেন, তিনি সে কয় রাকাতের কথাই বর্ণনা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আয়েশা রা. এবং ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনাই বিশুদ্ধ।
বুখারি ও মুসলিমে আয়েশা রা. থেকে বর্নিহ হয়েছে: রসূলুল্লহ (ﷺ) ইশার নামায থেকে ফারেগ হবার পর ফযর পর্যন্ত এগার রাকাত নামায পড়তেন। দুই রাকাত পর পর সালাম ফিরাতেন এবং এক রাকাত দ্বারা বিতির করতেন। এই নামাযে তাঁর একেকটি সাজদা হতো তোমাদের পঞ্চাশ আয়াত কুরআন পড়ার সমান দীর্ঘ। অতপর মুয়াজ্জিন ফজরের আযান শেষ করলে দুই রাকাত হালকা নামায পড়ে ডান পাশে কাত হয়ে ফজরে ইকামত পর্যন্ত বিশ্রাম নিতেন।”
সহীহ মুসলিমে আয়েশরা রা. থেকে আরেকটি হাদিস উল্লেখ হয়েছে, তাতে আয়েশা রা. বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রে তের রাকাত নামায পড়তেন। এর মধ্যে বিতিরও থাকতো এবং ফজরে দুই রাকাতও থাকতো।;
বুখারি ও মুসলিমে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এক রাত্রে তাঁর খালা উম্মুল মু’মিনীন মাইমুনা রা. –এর ঘরে রাত্রি যাপন করেন। রাত্রে রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে নামায পড়তে দেখে তিনিও উঠে তাঁর সাথে নামায পড়ে বিশ্রাম নেন। অতপর বেলাল ইকামত দিলে উঠে গিয়ে ফজরের নামায পড়েন।
বুখারি ও মুসিলমে আয়েশরা রা. থেকে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাতে আয়েশা রা. বলেন: রমযান কিংবা গাযরে রমযান, কখনো রাসূলূল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায এগার রাকাতের বেশি পড়েননি।”
আয়েশার এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ। তবে উপরে তের রাকাতের যে বর্ণনা উল্লেখ হয়েছে, তা ফজরের দুই রাকাত সহ।
কোনো কোনো বর্ণনায় তের রাকাতের পর দুই রাকাত পড়েছেন বলে উল্লেখ হয়েছে। এ বর্ণনাটি এসেছে বুখারিতে। তবে মুসলিমের বর্ণনায় ফজরের দুই রাকাতসহ তের রাকাত পড়তেন বলে উল্লেখ হয়েছে।
বুখারি ও মুসলিমে কাসিম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি আয়েশা রা. –কে বলতে শুনেছি: রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) ছিলো মূলত দশ রাকাত। সেই সাথে এক সাজদায় বিতির পড়তেন, অতপর ফজরের দুই রাকাত পড়তেন। সর্বমোট পড়তেন তের রাকাত।”
-এই বর্ণনাটি সুস্পষ্ট।
ইমাম শা’বী বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে্যিছ। তাঁরা দু’জনই আমাকে বলেছেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর রাতের নামায ছিল তের রাকাত। এর মধ্যে আট রাকাত তাহাজ্জুদ, তিনি রাকাত বিতির আর দুই রাকাত ফজরের সুন্নত।”
বর্ণনাগত কিছু তারতম্য থাকলেও এ সংক্রান্ত সবগুলো হাদিস ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, মূলত রসূলুল্লাহ (ﷺ) (ফজরের সুন্নত দুই রাকাত বাদে) রাতের নামায (বিতিরসহ) এগার রাকাত পড়তেন। [এযাবতকার আলোচনা থেকে বিতির নামায এক রাকাত না তিন রাকাত সে বিষয়ে কিছুটা সংশয় দেখা দিতে পারে। তবে বিতির সহ তাহাজ্জুদের রাকাত সংক্রান্ত আরেকটি হাদিস এখানে উল্লেখ করছি:
মাসরুর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. –কে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর রাতের নামায (এর রাকাত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি আমাকে বলেছেন: ফজরের দুই রাকাত ছাড়া রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায ছিল সাত, নয় এবং এগার রাকাত। (সহীহ বুখারি)]
রসূল (ﷺ) রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) কখন পড়তেন?
বিভিনন বর্ণনা থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায পড়ার জন্যে-
-কখনো অর্ধরাত্রে উঠতেন।
-কখনো অর্ধরাতের কিছু আগে উঠতেন।
-কখনো অর্ধ রাতের কিছু পরে উঠতেন।
-কখনো মোরগের পয়লা ডাক শুনে উঠতেন। অর্থাৎ রাতের দুই তৃতীয়ংশের মাথায়।
রাতের নামায তিনি কখনো ধরাবাহিকভাবে পড়ে শেষ করতেন। আবার কখনো বিচ্ছিন্নভাবে পড়তেন। বিচ্ছিন্নভাবে মানে দুই রাকাত পড়ে ঘুমাতেন, আবার উঠে অযু মিসওয়াক করে দুই রাকাত পড়তেন। আবার ঘুমাতের, আবার উঠতেনস- এভাবে শেষ করতেন।
তিনি রাতের নামাযের জন্যে উঠলে প্রথম হালকা দুই রাকাত পড়তেন। সাহাবিগণকেও এই হালকা দুই রাকাত পড়তে বলতেন। [এই দুই রাকাতের পরিচয় স্পষ্ট নয়। তবে প্রথমে হালকা দুই রাকাতের কথা বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। এই দুই রাকাত তাহাজ্জুদের পয়লা দুই রাকাতও হতে পারে, অথবা তাহিয়্যাতুল অযুও হতে পারে।] তারপরের রাকাতগুলো দীর্ঘ করতেন।
আয়েশা এবং ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) ইশার নামায পড়িয়ে ঘরে এসে কিচু (দুই চার রাকাত) নামায পড়তেন। কিছু নামায পড়েই তিনি ঘুমাতেন।
তিনি রাতের নামাযের জন্যে ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক করতেন, অযু করতেন, আল্লাহকে স্মরণ করতেন, কিছু দু’আ কালাম পড়তেন, তারপর নামায পড়তেন।
তাহাজ্জুদের সময় এবং তাহাজ্জুদ নামাযে কী পড়তেন?
বুখারি ও মুসলিম একাধিক সূত্রে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায (তাহাজ্জুদ) পড়তেন উঠে অযু করার আগেই আকাশ পানে তাকিয়ে সূরা আলে ইমরানের শেষ (রুকুর) আয়াতগুলো পাঠ করতেন। আয়াতগুলো হলো:
(আরবী***********************)
অর্থ: পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে সেইসব বুদ্ধি-বিবেকওয়ালা লোকদের জন্যে রয়েছে অনেক অনেক নিদর্শন, যারা উঠতে, বসতে, শয়নে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। (তারা স্বতঃস্ফূর্তেই বলে উঠে) হে আমাদের প্রভু! এসব কিচু তুমি অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করোনি। অবশ্যি তুমি নিরর্থক কাজ করার ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত-পবিত্র। তাই হে প্রবু! জাহান্নামের আযা () থেকে আমাদের রক্ষা করো। প্রভু, তুমি যাকে জাহান্নামে ফেলবে, তরকে অবশ্যি চরম অপদস্থ করে ছাড়বে, আর এসব যালিমদের তো কোনো সাহায্যকারী হবেনা। আমাদের মনিব! আমরা একজন আহ্বানকারীকে ‘তোমাদের প্রভুর প্রতি ঈমান আনো’ বলে আহ্বানা করতে শুনেছি। আমরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছি। তাই হে প্রবু। আমাদের পাপসমূহ মাফ করে দাও, আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে দাও আর আমাদের ওফাত দান করে উত্তম লোকদের সাথে। আমাদের মালিক! তোমার রসূলদের মাধ্যমে তুমি আমাদের সাথে যেসব ওয়াদা করেছো, সেগুলো আমাদের প্রদান করো এবং কিয়ামতের দিন আমাদের অপদস্থ করোনা। নিশ্চয়ই তুমি কখনো ভঙ্গ করোনা অংগীকার।” (প্রার্থনা কবুল করে) তাদের প্রভু বলেন: আমি বিনষ্ট করবোনা তোমাদের আমলকারীর আমল, চাই সে নর হোক কিংবা নারী, তোমাদের একজন তো আরেকজন থেকে, তাই যারাই হিজরত করেছে, যাদেরকে নিজেদের ঘরবারি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে আর আমার পথে কাজ করার কারণে কষ্ দেয়া হয়েছে, তারপরও তারা লড়াই করেছে এবং নিহত হয়েছে- আমি অবশ্য অবশ্যি তাদের ত্রুটি বিচ্যুতিসমূহ মুছে দেবো আর তাদের মালিক বানিয়ে দেবো বহমান ঝরণাওয়ালা জান্নাতসমূহের। আল্লাহর পক্ষ থেকে এগুলো তাদের জন্রে পুরষ্কার। আর সর্বোত্তম পুরষ্কার তো আল্লাহর কাছেই রয়েছে। হে নবী! বিভিন্ন দেশ ও নগরের শান শওকতের চলাফেরা যেনো তোমায় প্রতারিত না করে। এ –তো সামান্য ক’দিনের উপভোগ মাত্র। তারপর এদের আবাস হবে জাহান্নাম, যা নিদারুণ নিকৃষ্ট জায়গা। তবে যারা তাদের প্রবুকে ভয় করে চলবে, তাদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে চিরস্থায়ী উপঢৌকন হিসেবে রয়েছে বহমান ঝরণা আর জান্নাতসমূহ। আর যা কিছু আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া যাবে, ভালো লোকদের জন্যে তাই কল্যাণকর। আহলে কিতাবের মধ্যেও এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, তোমাদের কাছে পাঠানো কিতাব আর তাদের কাছে পাঠানো কিতাবের প্রতিও ঈমা রাখে; আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকে এবং আল্লাহর আয়াতকে অল্পদামে বেচেনা। এদের জন্যে এদের প্রভুর কাছে রয়েছে প্রতিদান, আর আল্লাহ তো (পাওনাদারদের) হিসাব জলদি জলদি চুকিয়ে ফেলেন। হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা সবর অবলম্বন করো, অটল-অবিচল হয়ে থাকো, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক মজুবতভাবে জুড়ে রাখো, আর আল্লাহকে ভয় করো। এভাবেই অর্জন কজরবে তোমরা সাফল্য।” ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় একথাও আছে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায শেষে এই দু’আ করেছেন:
(আরবী********************)
অর্থ: আমার আল্লাহ! আমার অন্তরে নূর দাও (জ্যোতির্ময় করে দাও), আমায যবানে নূর দাও, আমার দৃষ্টিতে নূর দাও, আমার শ্রবণশক্তিতে নূর দাও, আমার ডানে নূর দাও, আমার বামে নূর দাও, আমার উপরে নূর দাও, আমার নিচে নূর দাও, আমার সামনে নূর দাও, আমার পিছে নূর দাও। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করো আর আমার নূরকে ব্যাপক-বিশাল করে দাও।”
বুখারি ও মুসলিমে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন উঠলে এই কথাগুলো পাঠ করতেন: (আরবী*****************)
অর্থ: আমার আল্লা! সমস্ত প্রশংসা তোমার। এই মহাবিশ্ব, এই পৃথিবী এবং এসবের মাঝে যা কিছু আছে, সবকিছুর তুমিই তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচালক। সমস্ত প্রশংসা তোমারই, এই মহাবিশ্ব, এই পৃথিবী আর এসবের মধ্যে যা কিছু আছে, সবকিছুর তুমি নূর (জ্যোতি)। তোমারই সমস্ত প্রশংসা, এই মাহাবিশ্ব, এই পৃথিবী আর এসবের মাঝে যা কিছু আছে, তুমিই সবকিছুর সার্বভৌম সম্রাট। সমস্ত প্রশংসা তোমার। তুমি মহাসত্য। তোমার অংগীকার মহাসত্য। তোমার সাক্ষাত সত্য। তোমার বাণী সত্য। জান্নাত সত্য। জাহান্নাম সত্য। নবীগণ সত্য। মুহাম্মদ সত্য (নবী)। কিয়ামত সত্য। আয় আলালাহ, তোমার কাছে আমি আত্মসমর্পণ করেছি। তোমার প্রতি ঈমান এনেছি। তোমার উপর ভরসা করেছি। তোমারই প্রত্যাবর্তন করেছি। তোমারই জন্যে সবার সাথে বিবাদ বাধিয়েছি। তোমারই কাছে বিচার দিয়েছি। তাই হে প্রবু, তুমি আমার আগের পরের আর গোপন-প্রকাশ সব ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। আর সেইসব ত্রুটিও ক্ষমা করে দাও, যেগুলো সম্পর্কে তুমি আমার চাইতেও অধিক জানো। তুমিই তো সবাইকে এবং সবকিছুকে আগে বাড়িয়ে দাও এবং পিছে ঠেলে দাও। তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তুমি ব্যতিরেকে কোনো ত্রাণকর্তা নেই।”
সহীহ মুসিলমে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রে উঠে যখন নামায শুরু করতেন, তখন বলতেন
(আরবী***************)
অর্থ: ওগো আল্লাহ! জিব্রাইল, মিকাইল ও ইসরাফীলের প্রবু! মহাবিশ্ব ও এই পৃথিবীর স্রষ্টা! অদৃশ্য ও দৃশ্যের সর্বজ্ঞানী। তোমার বান্দাদের মতবিরোধসমূহের ফয়সাল তুমিই করবে। আমাকে অনুগ্রহ করে সেই সত্য দেখাও যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে। কারণ, তুমি তো যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখিয়ে থাকো।”
আবু দাউদে আয়েশা রা.থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন রাত্রে ঘুম থেকে জাগতেন, তখন বলতেন:
(আরবী***********************)
অর্থ: তুমি ছাড়া কোনো হুকুমকর্তা ও মুক্তিদাতা প্রভু নেই। সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি দুর্বলতা থেকে মুক্ত-পবিত্র তুমি। আমি তোমারই প্রশংসা করি হে আল্লাহ! আমার অপরাদের জন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমি তোমার অনুগ্রহ চাই। আয় আল্লাহ, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। সঠিক পথ দেখাবার পর আমার অন্তরকে আর বিপথগামী করোনা। তোমার অনুগ্রহ আমাকে দান করো। অবশ্য অবশ্যি তুমি অতিশয় মহান দাতা।”
আবু দাউদে (তাবেয়ী) শরীক হাওয়ানি থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রে নামায পড়তে উঠলে প্রথম কী পড়তেন? জবাবে তিনি বলেন, এমন একটি বিষয়ে তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছো, যা তোমার পূর্বে আমাকে আর কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন রাত্রে ঘুম থেকে উঠতেন, তখন: দশবার (***) (আল্লাহ মহান) উচ্চারণ করতেন, দশবার (***) বলতেন (*********) (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর) বলতেন, দশবার (******) দশবার (*****) বলতেন, দশবার (*******) (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই) বলতেন, দশবার (*****) বলতেন এবং দশবার (******************) (হে আল্লাহ! দুনিয়া এবং কিয়ামতের দিনের সংকীর্ণতা থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই) বলতেন। [এই কথাগুলোকে ‘মুআশশরাতের সাব’আ বলা হয়। এর অর্থ এমন সাতটি বাক্য যার প্রতিটি দশবার করে উচ্চারণ করতে বলা হয়েছে।] অতপর নামায আরম্ভ করতেন।”
সহীহ বুখারিতে উবাদা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে উঠে এই কথাগুলো পাঠ করে দু’আ করবে, তার দু’আ কবুল করা হবে। অতপর অযু করে নামায পড়লে তার নামায কবুল করা হবে। সেউ কথাগুলো হলো: (আরবী******************)
আবু দাউদ ও নাসায়ীদে হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি দেখছেন, রসূলূল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায শুরু করার আগে এই কথাগুলো পাঠ করতন:
(আরবী*****************)
অর্থ আল্লাহগ মহান, আল্লাহ সবার উপরে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, ক্ষমতা ও প্রতাপের অধিকারী তিনি শ্রেষ্ঠ ও মহান তিনি।”
একই বর্ণনায় হুযাইফা রা. বলেন, রাতের নামাযে রসূল (ﷺ) দুই সাজদার মাঝখানে এই দুআ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে:
(আরবী*****************)
অর্থ: আমার প্রভু, আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমার মালিক, আমাকে মাফ করে দাও।………………
নাসায়ী এবং ইবনে মাজাহ আবু যর রা. থেকে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, তাতে আবু যর রা. বলেন: একবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামায পড়তে দাঁড়ান, ফজরের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত গোটা নামাযে৩ তিনি কেবল একটি আয়াতই বার বার পড়েছেন। আয়াতটি হলো: (আরবী******************)
অর্থ: প্রবু, তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও, তবে দিতে পারো, কারণ তারা তোমারই দাস। আর য৩দি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও, তবে তুমি তা অবশ্যি করতে পারো, কারণ তুমিই তো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান প্রজ্ঞাবান। (সূরা মায়িদা: ১১৮)
রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামাযের কোনো কোনো দিন সূরা বাকারা. আলে ইমরান, নিসা, মায়েদা কিংবা আন’আম পড়তেন।
কখনো মুফাসসাল সূরা (হুজরাত থেকে শেষ পর্যন্ত) সমূহের প্রথম দিকের গুলো দুটো দুটো করে মিলিয়ে পড়তেন।
তিনি সাহাবিগণকে রাতের নামাযে তাদের সামর্থ অনুযায়ী দশটি, একশটি এবং হাজারটি করে আয়াত পড়তে উৎসাহিত করতেন।
রাতের ইবাদতের মহাকল্যাণ[‘রাতের ইবাদতের মহাকল্যাণ, শিরোনামের এই অনুচ্ছেদটি সম্পাদক কর্তৃক সংযোজিত।]
বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: প্রত্যেক রাত্রের যকন শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আল্লাহ পাক পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন (পৃথিবীর নিকটবর্তী হন) এবং আহবান করতে থাকেন ‘শুনো, এখন যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। এখন যে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করবো। এখন যে আমার কাচে তার অপরাদের জন্যে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো।” এভাবে ভোর হওয়া পর্যন্ত তিনি আহবান করতে থাকেন।
তিরমিযিতে আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের উচিত রাত্রে উঠে নামায পড়া। কারণ এটা:
-তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহ লোকদের রীতি,
-তোমাদের প্রভুর সান্নিধ্য লাভের উপায়,
-গুনাহসমূহ মুছে ফেলার হাতিয়ার এবং
-পাপের প্রতিবন্ধক।
মুসনাদে আহমদে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলূল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হলো রাতের নামায।
আবু দাউদ ও নাসায়ীতে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ ঐ ব্যক্তির প্রতি রহম করেন, যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে উঠলো, নামায পড়লো, স্ত্রীকেও উঠালো এবং সেও নামায পড়লো, আর স্ত্রী উঠতে না চাইলে তার চোখে পানি ছিটিয়ে দিলো। আল্লাহ পাক ঐ নারীর প্রতিও রহম করেন, যে রাত্রে জেগে উঠলো, নামায পড়লো, স্বামীকেও উঠালো এবং সেও নামায পড়লো, আর স্বামী উঠতে না চাইলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দিলো।
সহীহ বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন ঘুমায়, শয়তান তার মাথার পেছন দিকে তিনটি গিরা দেয়। প্রত্যেক গিরায় ‘এখনো অনেক রাত আছে ঘুমাও’- একথার মোহর মারে। কিন্তু সে যদি জেগে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন কেটি গিরা খুলে যায়। যদি অযুও করে, তখন আরেকটি গিরা খুলে যায়। তারপর যদি নামায পড়ে, তবে শেষ গিরাটিও খুলে যায়। এমতাবস্থায় তার সকাল হয় সুন্দর, পবিত্র ও প্রফুল্ল মনে। অন্যথায় তার সকাল হয় নোংরা অলস মনে।
বুখারি ও মুসলিমে মুগীরা ইবনে শু’বা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন একবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) রাত্রির নামাযে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাঁর পায়ের পাতা ফুলে যায়। তখন তাঁকে বলা হলো, আপনি এতো কষ্ট করেন কেন? আপনার তো আগে-পরের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে।” জবাবে তিনি বলেন তাই বলে কি আমি আল্লাহর শোকরগুজার বান্দাহ হবোনা?
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি গোটা রাত্রের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, কোনো মুসলিম যদি তা লাভ করে এবং সে সময়টিতে আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের যে কোনো কল্যাণ প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যি আল্লাহ তাকে তা দান করেন। আর সেই বিশেষ সময়টি প্রতি রাত্রেই আসে। (সহীহ মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্রাহ (ﷺ) বলেছেন: (আরবী*****************)
আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম লোক হলো কুরআনের বাহক ও (নামায আদায়ে) রাত জাগরণকারী লোকেরা।” (বায়হাকি: ইবনে আব্বাস রা.)