২. রসূলুল্লাহ-এর নামায পড়ার পদ্ধতি

২. রসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর নামায পড়ার পদ্ধতি

তাকবীরে তাহরীমা

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযের জন্যে দাঁড়ায়েই ‘আল্লাহু আকবার‘ উচ্চারণ করতেন। (এটাকে ‘তাকবীরে তাহরীমা বলা হয়)। তিনি এই তাকবীর উচ্চারণের পূর্বে অন্য কোনো কিছুই পড়তেন না, বলতেন না, এমনকি নিয়্যতও উচ্চারণ করতেন না। (নিয়্যত তো হলো মনস্থির করা যা ইচ্ছা [এরাদা] করার নাম)। এ ধরনের কিছুও তিনি বলতেন না যে, কিবলামুখী হয়ে অমুক ওয়াক্তের এতো রাকাত ফরয নামায ইমাম হিসেবে বা এই ইমামের পেছনে মোক্তাদি হিসেবে পড়ছি। কিংবা আদায় পড়ছি, বা কাযা পড়ছি। এ ধরনের কথা তিনি ফরয নামাযেও বলতেন না, (সুন্নত এবং নফল নামাযেও বলতেন না।)

তাকবীরে তাহরীমার পূর্বে এসব কিছু বলা বিদ‘আত। কারণ এগুলোর পক্ষে রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদিস নেই। এমনকি সাহাবায়ে কিরামের কোনো বক্তব্যও নেই। তাবেয়ীগণের কোনো কথাও নেই। এমনকি চার ইমামের কেউই এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। কেউই এমন কিছু বলা পছন্দ করেননি।

তবে পরবর্তী কালের কিছু আলিম ইমাম শাফেয়ীর একটি কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। ইমাম শাফেয়ীর সে কথাটি হলো “নামাযের অবস্থা রোযার মতো নয়, উল্লেখ না করে কেউ নামাযে প্রবেশ করতে পারেনা।”

-এ আলেমরা তাঁর উল্লেখ অর্থ বুঝেছেন, নামাযের নিয়্যত উল্লেখ বা উচ্চারণ করা। অথচ, প্রকৃতপক্ষে ইমাম শাফেয়ী নিজে একথা দ্বারা বুঝিয়েছেন নামাযের জন্যে ‘তাকবীর তাহরীমা‘ উচ্চারণ করা।

ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য সম্পর্কে উপরোক্ত আলিমদের ধারণা ভুল। কারণ, স্বয়ং রসূল (ﷺ) তাঁর সাহাবায়ে কিরাম এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণ যে কাজটির উল্লেখ পর্যন্ত করেননি, ইমাম শাফেয়ী সেটাকে অবশ্যকীয় বলতে পারেন কী করে? আমরা এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কিরাম থেকে যদি একটি শব্দও পাই, তবে অবশ্যি তা মেনে নেবো। কারণ রসূলুল্লাহর সন্নাত আর সাহাবায়ে কিরামের পন্থা অনুসরণই আমাদের কর্মনীতি। তাদের দেখানো সর্বোত্তম পথই আমাদের পথ। আমরা বিনীতভাবে কেবল তাঁদের থেকে প্রমাণিত কর্মনীতিই অনুসরণ করবো।

তাকবীরে তাহরীমার সময় ‘রফে ইয়াদাইন‘ করা

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায শুরু করার জন্যে ‘আল্লাহু আকবার‘ ছাড়া আর কিছু বলতেন না এবং আল্লাহু আকবার উচ্চারণের সময় রফে ইয়াদাইন‘ করতেন (দু‘হাত উঠাতেন)। এজন্যে তিনি হস্তদ্বয়কে কিবলামুখী করে কাঁধ কিংবা কান পর্যন্ত উঠাতেন। এ সময় তাঁর হাতের আংগুলগুলো ছড়িয়ে থাকতো। তিনি হাত কতোটুকু উঠাতেন সে ব্যাপারে কায়েক রকম বর্ণনা আছে। আবু হুমাইদ আস সা‘আদী রা. ও তাঁর সাথিরা কাঁধ বরাবর উঠানোর কথা বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর বক্তব্যও তাই। ওয়ায়েল ইবনে আযেব রা. বলেছেন, হাত কানের কাছাকাছি নিতেন। কেউ কেউ বলেছেন, শেষোক্ত মতটিই উত্তম তবে উপরে বর্ণিত যে কোনো পরিমাণ উঠাবার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কারো কারো মতে, কানের লতির উপর উঠাবার সুযোগ নেই। তবে কাঁধ পর্যন্ত উঠালেও চলবে। এ বিষয়ের এটাই মীমাংসা।

তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বলার সময় তিনি আরো যেসব স্থানে রফে ইয়াদাইন করতেন, সেগুলো সথাস্থানে উল্লেখ করা হবে।

তাকবীরে তাহরীমার পর কি পড়তেন?

তাকবীরে তাহরীমা উচ্চারণের সময় হাত উঠাবার পর হাত নামিয়ে ডান হাত বাম হাতের পিঠের উপর স্থাপন করতেন। তারপর নামায (সূরা ফাতিহা) শুরু করার পূর্বে বিভিন্ন রকম দু‘আ করতেন। কখনো এই দু‘আ করতেন:

(আরবী**************)

অর্থ: আমার আল্লাহ! আমার সমস্ত ভুলত্রুটি আমার থেকে দূরে সরিয়ে দাও, যেমন তুমি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছো পূর্ব আর পশ্চিমের মঝে। আয় আল্লাহ! তুমি পানি, বরফ আর শীতল জিনিস দ্বারা আমাকে আমার ভুলত্রুটি থেকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দাও। ওগো আল্লাহ! আমাকে আমার গুনাহ খাতা থেকে ঠিক সেরকম ঝকঝকে ত্বকত্বকে পরিচ্ছন্ন করে দাও যেমন ময়লা ও দাগ থেকে সাদা কাপড় ধবধবে সাদা হয়ে উঠে।”

কখনো এই দু‘আটি পড়তেন:

(আরবী************)

অর্থ: আমি একনিষ্ঠভাবে মহাবিশ্ব ও এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার দিকে আমার মুখ ফিরালাম। তাঁর সাথে যারা শিরক করে, আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। অবশ্যি আমার নামায আমার কুরবানি আমার জীবন ও আমার মৃত্যু মহান আল্লাহর জন্যে, যিনি সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রভু-প্রতিপালক। কেউই তাঁর অংশীদার নয়।–এই কথাগুলো মেনে নেয়ার নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমিই সাবার আগে মেনে নিয়েছি।”

কখনো এই দু‘আ করতেন:

(আরবী****************)

অর্থ: ওগো আল্লাহ! তুমিই মহাবিশ্বের একমাত্র সম্রাট। তুমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। তুমি আমার প্রভু আর আমি তোমার দাস। আমি নিজের উপর যুলুম করেছি এবং আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দাও। তুমি ছাড়া তো অপরাধ ক্ষমা করার কেউ নেই। আমাকে সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্র অর্জনের পথ দেখাও, তুমি ছাড়া তো এ পথ দেখাবার আর কেউ নেই। আমার চরিত্র ও আচরণে যা কিছু দোষত্রুটি আছে, তুমি তা দূর করে দাও, তুমি ছাড়া তো তা দূর করার আর কেউ নেই। প্রভু! তোমার দরবারে আমি হাযির হয়েছি, বড় মেহেরবান তুমি, আর সমস্ত কল্যাণও তোমারই হাতে। অকল্যাণের দায়দায়িত্ব তোমার নেই। আমি তোমারই ইচ্ছামতো চলবো, তোমারই কাছে আমি ফিরে যাবো। বড়ই প্রাচুর্যময় তুমি, বড়ই আলীশান তুমি প্রভু! তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাই আর তোমারই দিকে আমি মুখ ফিরালাম।”

সাধারণত রাত্রের নামাযে (তাহাজ্জুদে) রসূলুল্লাহ (ﷺ) এই দু‘আ করতেন। আবার কখনো এসময় তিনি এই দু‘আ পড়তেন:

(আরবী***************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! তুমিই জিবরিল ও ইসরাফীলের প্রভু, আসমান যমীনের স্রষ্টা এবং দুশ্য অদৃশ্যের জ্ঞানী। তোমার বান্দাদের মধ্যকার বিরোধের তুমিই মীমাংসা দিয়ে থাকো। তোমার নির্দেশ আমি মহাসত্য নিয়ে যে বিরোধের সম্মখীন হয়েছি, সে ব্যাপারে তুমি আমাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দান করো। তুমি তো যাকে ইচ্ছা করো সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়ে থাকো।”

কখনো আবার নিম্নোক্ত দু‘আটি পড়তেন: (আরবী******************)

অর্থ: আমার আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসার মালিক তুমি। মহাবিশ্ব, এই পৃথিবী আর এগুলোর মাঝে যা কিছু আছে, সেগুলোর তুমিই আলোকবর্তীকা।”

-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকবীরে তাহরীমা উচ্চারণ করার পর উপরোক্ত দু‘আটি পড়তেন।

আবার কখনো তিনি তিনবার الله اكبر كبيرا তিনবার الحمد لله كثيرا তিনবার سبحان الله بكرة واصيلا এবং সেই সাথে اللهم اني اعوذبك من الشيطان الرجيم من همزه ونفخه ونفثه বলতেন।

কখনো الله اكبر দশবার, سبحان الله দশবার, الحمد لله দশবার, لااله الا الله দশবার, استغفر الله দশবার এবং اللهم اغفرلى واهدنى وارزقنى দশবার, অতপর اللهم اني اعوذبك من ضيق المقام يوم القيامة দশবার বলতেন। রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকবীরে তাহরীমা উচ্চারণ করার পর এই দু’আগুলোর কোনো না কোনোটি পড়তেন বলে সহীহ সূত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়।

বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নিম্নেক্ত সানা পড়ে নামায শুরু করতেন:

(আরবী**************)

অর্থ: হে আল্লাহ! সমস্ত দোষত্রুটি, অক্ষমতা ও দর্বলতা থেকে পবিত্র তুমি। আমি তোমারই প্রশ্রংসা করি। মোবারক তোমার নাম। সর্বোচ্চ তোমার শান। আর তুমি ছাড়া নেই কোনো ইলাহ।”

-এ সানাটির (আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্যের) কথা বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন সুনান গ্রন্থে আলী ইবনে আলী রিফায়ী থেকে। তিনি আবীল মুতাওয়াককাল এবং তিনি আবি সায়ীদ রা. থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। আয়েশা রা. থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। উমর রা. ইমামতি করার সময় এটি শব্দ করে উচ্চারণ করতেন এবং সবাইকে শিক্ষাদান করতেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, আমি উমর রা. কে অনুসরণ করে এ দু’আটি পড়া পছন্দ করি। তবে উপরে বর্নিত যে কোনো একটি দু’আ পড়ে যদি কেউ নামায শুরু করে, তবে তা সহীহ।

ইমাম আহমদ যুক্তি প্রদর্শন করে বলেছেন, এ দুআটি শ্রেষ্ঠ, পূর্ণাংগ ও উত্তম। উমর রা. ইমামতির সময় যে এটি সবাইকে শুনিয়ে পড়েছেন, তার অর্থ হলো, সবাই যেনো নামাযের শুরুতে এটি পড়ে। বিশেষ করে সবাই যেনো ফরয নামাযে এটি পড়ে।

সূরা ফাতিহা পাঠ

উপরে বর্ণিত সানা/দু‘আ পড়ার পর রসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম‘ পড়তেন। অতপর বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সহ সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন।

সূরা ফাতিহা তিনি কখনো শব্দ করে পড়তেন, আবার কখনো নি:শব্দে পড়তেন। তবে বেশির ভাগ সময় শব্দ করে পড়তেন। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেই তিনি শব্দ করে পড়তেন না। আবাসেও নয়, প্রবাসেও নয়। যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেই তিনি শব্দ করে পড়ে থাকতেন, তবে খুলাফায়ে রাশেদীন, অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম এবং বিশেষ করে মদীনাবাসীর কাছে তা কী করে অজ্ঞাত থাকতে পারতো? তাই একথা নিশ্চিত যে, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেই সূরা ফাতিহা শব্দ করে পড়তেন না।

তিনি যখন সূরা ফাতিহা শব্দ করে পড়তেন, তখন শুরুতে বিসমিল্লাহও শব্দ করে পড়তেন।

আমীন উচ্চারণ

সূরা ফাতিহা শেষ করে তিনি ‘আমীন‘ বলতেন। সূরা ফাতিহা শব্দ করে পড়লে ‘আমীন‘ও সশব্দে উচ্চারণ করতেন এবং তাঁর সাথে মুক্তাদিরাও সশব্দে ‘আমীন‘ উচ্চারণ করতেন।

ক্ষণিক চুপ থাকা

তিনি নামাযে কিছুক্ষণের জন্যে দু‘বার নিরব থাকতেন। একবার তাকবীরে তাহরীমা এবং কিরাত (সূরা ফাতিহা) পাঠের মধ্যবর্তী সময়। এই নিরব থাকাটি সম্পর্কে আবু হুরাইরা রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়েছেন।

দ্বিতীয়বার কখন নিরব থাকতেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন সূরা ফাতিহা পাঠের পর, আবার কেউ বলেছেন কুরআন পাঠ শেষ করে রুকূতে যাবার পূর্বে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, প্রথমটি ছাড়াই তিনি দু‘বার নিরব থাকতেন। এ মতটি মেনে নিলে তিনবার নিরব থাকা হয়ে যায়। অথচ একথা সুস্পষ্ট যে, তিনি মাত্র দু‘বার নিরব থেকেছেন।

তৃতীয় যে নিরব থাকাটির কথা বলা হয় অর্থাৎ রুকূতে যাবার আগে, সেটা মূলত তাঁর নিরব থাকা ছিলনা। সেটা ছিলো নি:শ্বাস ফেলে মনের প্রশান্তি অর্জনের জন্যে নেয়া খানিকটা সময়। কারণ তিনি কিরাত এবং রুকূকে একই নি:শ্বাসে মিলিয়ে ফেলতেন না।

তাকবীরে তাহরীমা এবং সূরা ফাতিহা শুরু করার মধ্যবর্তী সময়ের নিরব থাকাটা যুক্তিসংগত ছিলো। কারণ, সেটা ছিলো সূরা ফাতিহা আরম্ভ করার প্রস্তুতিমূলক নীরব থাকা।

দ্বিতীয় যে নিরব থাকাটা অর্থাৎ সুরা ফাতিহা শেষ করার পর, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেটা ছিলো মুক্তাদিদের সূরা ফাতিহা শেষ করার অবকাশ দেয়ার জন্যে।

আর তৃতীয় নিরব থাকাটা অর্থাৎ কিরাত শেষ করার পর এবং রুকূতে যাবার পূর্বে, সেটা ছিলো দম নিয়ে সুস্থির হবার জন্যে ক্ষণকালের সামান্য বিরতি মাত্র।

যারা তৃতীয়টির কথা উল্লেখ করেননি, তারা তা করেননি সেটি খুব সংক্ষিপ্ত হাবার কারনে। আর যারা সংক্ষিপ্ত হলেও সেটিকে গণ্য করেছেন, তাদের দৃষ্টিতে রসূল (ﷺ) তিন সময় নিরকব থেকেছেন। সুতারাং দুটি বর্ণনার মধ্যে মূলত কোনো বিরোধ নেই। এ সংক্রান্ত হাদিসের এটাই মীমাংসা।

দু‘টি নিরব থাকা সংক্রান্ত হাদিস সামুরা বিন জুনদুব রা. উব্বাই ইবনে কা‘ব রা. এবং ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে সহীহ সূতে বর্নিত হয়েছে। আবু হাতীম তাঁর সহীহ হাদিস সংকলনে এসব হাদিস উল্লেখ করেছেন।

যারা দু‘বার নিরব থাকার হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের একজন সামুরা বিন জুনদুব। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাযে থেকে আমি তাঁর দু‘বার নিরব থাকার বিষয়টি মুখস্ত করে রেখেছি। তিনি একবার নিরব থকতেন তাকবীরে তাহরীমা পর, আর দ্বিতীয়বার ‘গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দালীন‘-পড়ার পর।

কোনো কোনো সূত্রের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) কিরাতের পর কিছুক্ষন নিরব থাকাতেন।” কিন্তু এটা একেবারে এজমালি কথা। প্রথমোক্ত হাদিসের অর্থাৎ হযরত সামুরার হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তাতে পরিস্কারবাবে সুরা ফাতিহা পাঠের পর নিরব থাকার কথা বলা হয়েছে।….. সুতরাং সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসই এক্ষেত্রে দলিল।

তাঁর কিরাত (নামাযে কুরআন পাঠ) পদ্ধতি

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কিরাত (নামাযে কুরআন পাঠ) ছিলো টানা টানা। প্রতিটি আয়াত পাঠ করে থামতেন। আয়াত শেষ করার সময় একটু টানা আওয়াযে শেষ করতেন।

সূরা ফাতিহা শেষ করার পর তিনি অন্য সূরায় যেতেন। অন্য সূরায় গিয়ে কিরাত কখনো দীর্ঘ করতেন, আবার কখনো সফর বা অন্য কোনো কারণে সংক্ষিপ্ত করতেন। তাবে তাঁর কিরাত সাধারণত হ্রস্ব বা দীর্ঘ না হয়ে মধ্যম রকম হতো।

বিভিন্ন নামাযে তাঁর কিরাত

ফজর নামাযে সাধারণত ষাট থেকে একশত আয়াত পড়তেন। ফজর নামাযে প্রায়ই তিনি সূরা ক্বাফ, সূরা আর রূম, সূরা তাকবীর, কখনো উভয় রাকাতে সূরা যিলযাল এবং কখনো ফালাক ও নাস পড়তেন। তাবে সফরের সময়ই ফালাক ও নাস দিয়ে পড়তেন। কখনো সূরা মু‘মিনূন দিয়ে উভয় রাকাত পড়তেন। এই সূরার যেখানে মূসা ও হারূনের কথা উল্লেখ হয়েছে সেখানে পর্যন্ত পায়লা রাকাতে আর বাকি অংশ দ্বিতীয় রাকাতে পড়তেন।

জুমার দিন ফজরে সূরা আস সাজাদা এবং সূরা আদ দাহার পূরো পড়তেন। এই সূরার এক অংশ ঐ সূরার একাংশ- এমনটি পাঠ করতেন না। তাছাড়া সূরা আসসাজদাকে ভেংগে উভয় রাকাতে পাড়তেন না, পূরোটা এক রাকাতে পড়তেন। এমনটি তাঁর নিয়মের খেলাফ। যারা জুমার দিন ফজর নামায শুধুমাত্র সূরা আসসাজদা দিয়ে পড়াকে উত্তম মনে করে, তারা রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞ। লোকদের এই অজ্ঞতাপূর্ণ ধারণার কোনো কোনো ইমাম জুমার দিন ফজরে সূরা আসসাজদা পড়া অপছন্দ করতেন।

মূলত রসূলুল্লাহ (ﷺ) উপরোক্ত দুটো সূরা দিয়েই জুমার দিন ফজর নামায পড়াতেন। কারণ এদুটো সূরাতে মানব সৃষ্টির সূচনা, মানুষের শেষ পরিণতি, আদমের সৃষ্টি, জন্নাত ও জাহান্নামে যাবার কারণ বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ মানব জীবনে যা ঘটেছিল এবং যা সংঘটিত হবে, এগুলোতে তাই বর্ণিত হয়েছে বলে জুমার দিন সকালে তিনি সবাইকে এ সূরাগুলো শুনাতেন। এই একই কারণে তিনি জুমা এবং ঈদের নামাযে সূরা ক্বাফ, সূরা আল ক্বামার, সূরা আল আ‘লা এবং সূরা আল গাশিয়া পাঠ করতেন।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) যুহর নামাযে প্রায়ই কিরাত দীর্ঘ করতেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু সায়ীদ খুদরি রা. বর্ণনা করেছেন, যুহর-এর ইকামত হবার পর কোনো ব্যক্তি যদি তার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার জন্যে জান্নাতুল বাকিয়ীতে যেতো এবং সেখানে থেকে কাজ সম্পন্ন করে, নিজের বাসা থেকে অযু করে ফিরে আসতো, তবে নবী (ﷺ) কে প্রথম রাকাতেই ধরতে পারতো। যুহর নামাযে তিনি কখনো কখনো এ ধরনেরই লম্বা কিরাত নিতেন। যুহরে কখনো তিনি সূরা আসসাজদার সমপরিমাণ কিরাত পড়তেন। কখনো পড়তেন সূরা আল আ‘লা এবং আল লাইল, কখনো বা সূরা বুরূজ এবং আত তারিক।

আসর নামাযে তিনি যুহরের অর্ধেক পরিমাণ কিরাত পড়তেন। কখনো এর চাইতে একটু দীর্ঘ, আবার কখনো একটু হ্রাস্ব।

মাগরিবের কিরাত-এর ক্ষেত্রে তাঁর নিয়ম ছিলো বর্তমান কালের লোকেরা যা করছে, তার চাইতে ভিন্নতর। তিনি কখনো সূরা আ‘রাফ, কখনো সূরা আত তূর এবং কখনো সূরা আল মুরসালাম দিয়ে মাগরিবের নামায পড়তেন। এর একটি সূরাকে দুই রাকাতে ভাগ করে পড়তেন।

আবু উমর ইবনে আবদুল বার এক্ষেত্রে নবী করীম (ﷺ) এর আমল সম্পর্কে বর্ণনা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি মাগরিবের নামায কখনো সূরা আরাফ, কখনো সূরা আসসাফফাত, কখনো সূরা দুখান, কখনো সূরা আল আ‘লা, কখনো সুরা তিন, কখনো মুয়াব্বেযাতাইন (নাস ও ফালাক) এবং কখনো সূরা আল মুরসালাত দিয়ে পড়েছেন। এছাড়া তিনি মাগরিবের নামায ছোট ছোট সূরা দিয়েও পড়তেন। এসবগুলো বর্ণনাই সহীহ সূত্রে খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে সবসময় ছোট দিয়ে মাগরিবের নামায পড়াটা ছিলো মারওয়ান [মারওয়ান ইবনে হাকাম চতুর্থ উমাইয়া খলিফা অর্থাৎ মুয়াবিয়া রা. > ইয়াযীদ > মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযীদ > মারওয়ান ইবনে হাকাম। তার রাজত্বকাল ছিলো ৬৪-৬৫ হিজরি। এই মারওয়ানের কারণেই হযরত উসমানের শাহাদাতের ঘটনা সংঘটিত হয়।] ইবনে হাকামের কাজ। এ কারণে হযরত যায়েদ বিন সাবিত তার সমালোচনা করেছেন। হযরত মালিক বলেছেন তোমরা কেবল ছোট ছোট সূরা দিয়ে মাগরিবের নামায পড়ছো, অথচ আমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) –কে দুটি দীর্ঘ সূরার একটি অর্থাৎ সূরা আ‘রাফ পড়তে দেখেছি।” এটি সহীহ হাদিস। সুনান সংকলকগণ এটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম নাসায়ী আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) মাগরিবের নামাযে সূরা আ‘রাফ পড়েছেন। সূরাটিকে দুইভাগ করে দুই রাকাতে পড়েছেন। তাই সব সময় শুধুমাত্র ছোট ছোট আয়াত এবং ছোট ছোট সূরা দিয়ে মাগরিবের নামায পড়াটা সুন্নতের খেলাফ। এটা হলো মারওয়ান ইবনে হাকামের কাজ।

পাঁচ ওয়াক্তের শেষ ওয়াক্ত হলো ইশার নামায। এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, তিনি ইশার নামাযে সূরা আততীন‘ পড়েছেন। আরেকটি বর্ণনা অনুযায়ী তিনি মুয়ায বিন জাবালকে ইশার নামাযে সূরা আশ শামস‘, সূরা আল-আ‘লা এবং সূরা আল-লাইল‘ জাতীয় সূরা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া তিনি মুয়াযকে অধিক রাতে আমর বিন আউফ গোত্রে গিয়ে ইশার নামায পড়াবার সময় সূরা বাকারা দিয়ে পড়াতে নিষেধ করেছেন।

ঘটনাটা হলো, মুয়ায রা. রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর সাথে ইশার নামায পড়তেন। তারপর আমর বিন আউফ গোত্রে গিয়ে সেখানকার অপেক্ষমান লোকদের ইশার নামায পড়াতেন। তিনি নবীর মসজিদ থেকে ইশা পড়ে ঐ গোত্রে যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যেতো। তিনি নবীর পেছনে মুক্তাদি হিসেবে নামায পড়ে গিয়ে পুনরায় ইমাম হিসেবে এই লোকদের ইশার নামায পড়াতেন। কিন্তু এতো অধিক রাতেও তিনি সূরা বাকারা দিয়ে নামায পড়াতেন। এতে দিনের শ্রমজীবি লোকদের খুব কষ্ট হতো। বিষয়টি রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর গোচরীভূত হলে তিনি মুয়ায রা. কে উপরোক্ত নির্দেশ দেন এবং বেশি রাতে লম্বা কিরাত পড়ে মানুষকে সমস্যার ফেলতে নিষেধ করেন।

জুমার নামাযে তিনি সূরা আল জুমা এবং আল মুনাফিকুন পড়তেন। আবার কখনো সূরা আল-আ‘লা এবং আল-গাশিয়াও পড়তেন। কিন্তু প্রথমোক্ত সূরা দুটির কেবল শেষাংশ [সূরা জুমা এবং সূরা মুনাফিকুন এই দুটি সূরারই শেষাংশ ইয়া আইউহাল্লাযীনা আ-মানু দিয়ে শুরু] দিয়ে তিনি কখনো নামায পড়াতেন না। এটা তাঁর নিয়মেরও খেলাফ।

ঈদের নামাযে তিনি সূরা ক্বাফ এবং সূরা ক্বামার পুরো পড়তেন। কখনো বা সূরা আল আ‘লা এবং সূরা আলা গাশিয়া পড়তেন। উভয় ঈদেই তিনি এমনটি করতেন।

মৃত্যু পর্যন্ত তিনি কোন নামাযে কি ধরনের কিরাত পড়েছেন, এই হলো তার সঠিক নির্দেশিকা। খুলাফাযে রাশেদীন তাঁর এই নির্দেশিকার অনুসারী ছিলেন।

আবু বকর রা. ফজর নামাযে সূরা বাকারা শেষ করতেন। ফলে সালাম ফেরাতে সূর্যোদয়ের কাছাকাছি সময় হয়ে যেতো। একদিন লোকেরা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেলো: ওহে আল্লাহর রসূলের খলিফা! সূর্যোদয়ের তো সময় হয়ে গেছে? তিনি জবাব দিন : সূর্যোদয়ের ব্যাপারে তোমরা আমাকে অসতর্ক মনে করো না। উমর রা. ফজর নামাযে সূরা ইউসূফ, সুরা আন নহল, সূরা হুদ, সূরা বনি ইসরাইল এবং অনুরূপ অন্যান্য সূরা পড়তেন।

ফজর নামাযে রসূলুল্লাহ (ﷺ) যে লম্বা কিরাত পড়তেন তা যদি রহিতই হতো, তবে সেটা খুলাফায়ে রাশেদীন এবং লম্বা কিরাতের সমালোচনাকারীদের কাছে গোপন থাকতোনা। সহীহ মুসলিমে জাবির বিন সামুরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে: রসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজর নামাযে সূরা ক্বাফ পড়তেন এবং এরপর তাঁর নামায সংক্ষেপ হতো।” এখানে এরপর মানে ফজরের পরে। অর্থাৎ তাঁর ফজরের কিরাত লম্বা হতো এবং ফজরের নামাযগুলোতে কিরাত সংক্ষেপ হতো। একথার প্রমাণ হযরত আব্বাস এর স্ত্রী উম্মুল ফদলের বক্তব্য। তিনি (তার স্বামীর পুত্র) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে আরাফাতে সূরা আল-মুরসালাত‘ পড়তে শুনে জিজ্ঞাসা করলেন: বাবা! তুমি না আমাকে বলেছিলে, তুমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জীবনের শেষ মাগরিব নামাযে এ সূরাটি পড়তে শুনেছিলে?‘

আর জাবির ও সামুরার হাদিসে ‘এরপর‘ শব্দটিতে এর সর্বনাম রয়েছে। এর সর্বনামটির অন্তরালে এখানে নির্দেশিত নামটি উহ্য বা গোপন রয়েছে।

একথা সকলেরই জানা, সর্বনাম সবসময় পূর্বোল্লেখিত নামের পরিবর্তেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই এখানে এরপর বলতে ফজরের পরে বুঝতে হবে, এছাড়া অন্য কিছু বুঝার অবকাশ নেই।

সুতরাং উক্ত হাদিসের এরপর অর্থ হলো, রসূল (ﷺ) ফজরের পরের নামাযগুলোর কিরাত সংক্ষেপে করতেন। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি সেদিনের পর থেকে সব নামাযের কিরাত সংক্ষেপ করেছেন। এই অর্ত হয়ে থাকলে সেটা খুলাফায়ে রাশেদীনের কাছে গোপন থাকতোনা। তারা রসূল রা. এর রহিতকারী আমলের কথা জেনেও রহিত আমলের অনুসরণ করে সন্তুষ্টি থাকতেন না।

কিরাত সংক্ষেপ করা সংক্রান্ত রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর বক্তব্য তোমাদের কেউ ইমামতি করলে সে যেনো কিরাত সংক্ষেপ করে।” আর হযরত আনাসের বর্ণনা : রসূলুল্লাহ (ﷺ) সব নামাযের ক্ষেত্রেই কিরাত সংক্ষেপ করার নীতি অবলম্বন করতেন। এ দুটো বক্তব্যেরই মানদণ্ড হবে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর আমল। অর্থাৎ এ দুটো হাদিসে যে সংক্ষেপনের কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তব রূপ ছিলো কিরাত পড়ার ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বাস্তব আমল যা এতোক্ষন আমরা উল্লেখ করে এসেছি।

এ দুটো বক্তব্য থেকে রসূল (ﷺ) এর বাস্তব আমল এর বিপরীত কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করার অবকাশ নেই। কারণ তিনি এক রকম করবেন আর অন্যরকম বলবেন- তা কিছুতেই হতে পারে না। নি:সন্দেহে তিনি সেরকম সংক্ষেপ করার কথাই বলেছেন, যেরকমটি তিনি নিজে পড়তেন। একথাও সকলেরই জানা যে, তাঁর পেছনে বৃদ্ধ, দুর্বল এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যস্ত লোকেরাও নামায পড়তো।

এই লম্বা ও সংক্ষেপ কিরাত সংক্রান্ত ইখতিলাফের মীমাংসা এটা হতে পারে যে, তিনি প্রথম প্রথম খুব দীর্ঘ কিরাত পড়তেন এবং পরবর্তীকালে তা কিছুটা সংক্ষেপ করে কম লম্বা কিরাত পড়তেন। এই সমাধানটির পক্ষে দলিলও আছে। ইমাম নাসায়ী এবং অন্যান্য হাদিসের ইমামগণ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে কিরাত সংক্ষেপ করার কথা বলতেন এবং তিনি আমাদের ইমামতি করতেন সূরা আস সাফফাত দিয়ে।” সুতরাং সংক্ষেপের উদাহারণ হলো সুরা আস সাফফাত। (আল্লাহই অধিক জানেন)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনো নামাযের জন্যে কোনো সুরা নির্দিষ্ট করে সে নামাযে কেবল সে সূরাই পড়তেন এমনটি করতেন না। তবে জুমা এবং দুই ঈদের নামায এর ব্যতিক্রম। আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দাদা বলেছেন: ছোট বা বড় এমন কোনো সূরা নেই, যেটি রসূল (ﷺ) ফরয নামাযে ইমামতি করার সময় পড়েন নাই। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে আবু দাউদে।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এক নামাযে একটি পূর্ণ সূরা পড়তেন। কখনো এক রাকাতে একটি পূর্ণ সূরা পড়তেন, আবার কখনো একটি সূরাকে ভেংগে দু‘রাকাতে পড়তেন। কখনো কখনো সূরার প্রথম অংশ পড়তেন। কিন্তু কোনো সূরার মাঝের বা শেষের অংশ পড়েছেন বলে প্রমাণ নেই।

তিনি নফল নামাযে একই রাকাতে দু‘টি সূরা পড়েছেন। কিন্তু ফরয নামাযে এক রাকাতে দুটি সূরা পড়েছেন বলে প্রমাণ নেই।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি রাকাতে দুটি করে সূরা পড়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন, সেটা একটা এজমালি কথা। এমনটি তিনি ফরয নামাযে করেছেন, নাকি নফল নামাযে, সেকথা এখানে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই।

আবু দাউদে জুহাইনা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি যে বর্ণনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে ঐ ব্যক্তি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে ফজরের উভয় রাকাতে সূরা যিলযাল পড়তে শুনেছি।” কিন্তু ঐ ব্যক্তিই একথা বলার পর বলেন: ‘তবে তিনি উভয় রাকাতে সূরা যিলযাল কি ভুলবশত পড়েছেন, নাকি ইচ্ছাকৃত, সেটা আমি জানিনা।”

রসূলুল্লাহ (ﷺ) দ্বিতীয় রাকাতের তুলনায় প্রথম রাকাতের কিরাত লম্বা করতেন। ফজরসহ প্রত্যেক নামাযেই এমনটি করতেন। কখনো কখনো প্রথম রাকাত ততোক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করতেন, যতোক্ষণে মুসল্লিদের (মসজিদে আসার) পদক্ষেপের শব্দ বন্ধ হতো। অর্থাৎ সব মুসল্লি এসে প্রথম রাকাত ধরা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করতেন।

তিনি অন্যান্য নামাযের তুলনায় ফজর নামাযের কিরাত দীর্ঘ করতেন। ফজর নামায দীর্ঘ করার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে:

ক. যেহেতু ফজরের কুরআন পাঠে ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন। এসময় রাত ও দিনের ফেরেশতাদের সমাগম ঘটে। কারণ এটা তাদের ডিউটি বদলের সময়।

খ. যেহেতু ফজর নামাযে রাকাত সংখ্যা কম।

গ. যেহেতু মুসালমানদেরকে ঘুম ও বিশ্রাম থেকে উঠে এসে ফজর নামায ধরতে হয়।

ঘ. যেহেতু এ নামাযের পরেই মুসলমানরা একটা দীর্ঘ সময়ের জন্যে উপার্জনের কাজে বেরিয়ে পড়ে। তাই দীর্ঘ সময় ধরে যেনো তাদের মধ্যে কুরআনের প্রভাব বিরাজ করে।

ঙ. যেহেতু এসময় মানুষের মন প্রশান্ত থাকে এবং মনোযোগের সাথে কুরআন শুনার, বুঝার ও চিন্তা করার সুযোগ থাকে।

চ. যেহেতু এটাই দিনের প্রথম আমল, তাই এর প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতেন এবং এর মাধ্যমে দিনের সূচনাতেই বেশি বেশি নেকি ও কল্যাণ অর্জন করে নেয়ার আকাংখা পোষণ করতেন।

জ্ঞানী লোকদের পক্ষে শরীয়তের এই হিকমত, তাত্পর্য ও নিগূঢ় তত্ত্বসমূহ বুঝে নিতে কোনোই অসুবিধা হয়না।

তাঁর রুকু করার পদ্ধতি

রসূলুল্লাহ (ﷺ) কিরাত শেষ করে নি:শ্বাস নিয়ে প্রশান্তি অর্জনের জন্যে খানিকটা সময় নিরব থাকতেন। তারপর তাকবীরে তাহরীমার সময়কার মতো ‘রফে ইয়াদাইন‘ করতেন এবং আল্লাহু আকবার‘ বলে রুকূতে চলে যেতেন।

রুকুতে গিয়ে জড়িয়ে ধারার মতো দু‘হাত হাঁটুতে স্থাপন করতেন। দু‘বাহু পাঁজর থেকে আলাদা করে ফাঁকা করে রাখতেন। পিঠ সোজাসুজি লম্বা করে বিছিয়ে রাখতেন। মাথা পিঠের বরাবর রাখতেন, উঁচু বা নিচু করে রাখতেন না।

তিনি রুকুতে গিয়ে এই ভাষায় তাসবীহ করতেন: (আরবী***************)

কখনো বা এর সাথে নিম্নেক্ত তাসবীহও যোগ করে উচ্চারণ করতেন: (আরবী******************)

অর্থ (উভয় বাক্যের) আমার প্রভু সকল ত্রুটি ও দর্বলতা থেকে মুক্ত পবিত্র মহীয়ান। সমস্ত ক্রটি ও দুর্বলতা থেকে পবিত্র তুমি হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা তোমার হে আমাদের প্রভু। ওগো আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

তিনি রুকূতে গিয়ে এতোটা সময় থাকতেন যে, উপরোক্ত তাসবীহ প্রায় দশবার পড়া যেতো। সাজতাতেও তিনি এতোটা সময়ই থাকতেন। এ ক্ষেত্রে বারা ইবনে আযের রা. এর বক্তব্য কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে। তিনি বর্ণনা করেছেন : রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মৃত্যু পর্যন্ত আমি তাঁর পেছনে নামায পড়েছি। তাঁর কিয়াম এবং রুকূর সময় (দৈর্ঘ) সমান হতো। সাজদা এবং দুই সাজদার মাঝের বৈঠকও প্রায় সমপরিমাণ সময় নিয়ে হতো।”

এ বক্তব্য থেকে একদল লোক বুঝে নিয়েছেন যে, রসূল (ﷺ) এর কিয়াম ও রুকু সমপরিমাণ লম্বা হতো এবং সাজদাও সে পরিমাণ লম্বা হতো। আসলে এ ধরনের বুঝ গ্রহনের কোনো অবকাশ নেই। কারণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কিরাতের দৈর্ঘ তো সুপ্রমাণিত। ফজর নামাযে তিনি একশ আয়াত বা তার কিছু কমবেশি পরিমাণ পড়তেন। তাঁর মাগরিবের কিরাত সংক্রান্ত হাদিসও আগেই উল্লেখ করে এসেছি যে, তিনি মাগরিব নামাযে সূরা আ‘রাফ সূরা তুর এবং সূরা মুরসালতও পড়তেন। কিন্তু একথা তো সবারই জানা যে, তিনি রুকু ও সাজদাতে গিয়ে এতোটা দীর্ঘ সময় থাকতেন না।

একথার প্রমাণ সুনান সমূহে [সিহাহ সিত্তার ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী ও মুসলিম ছাড়া বাকি চারটিকে সুনান বা সুনানে আরবা‘আ বলা হয়] বর্ণিত আনাসের হাদিস। এতে আনাস রা. বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পরে আমি তাঁর অনুরূপ নামায আর করো পিছে পড়িনি এই যুবকটি (অর্থাৎ উমর ইবনে আবদুল আযীয) ছাড়া।” বর্ণনাকারী বলেন : আমি উমর ইবনে আবদুল আযীযের রুকূ ও সাজদায় দশবার করে তাসবীহ পড়েছি।”

এছাড়া আনাস রা. থেকে বর্ণিত ঐ হাদিসটিও এর প্রমাণ, যাতে তিনি বলেছেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের ইমামতি করার সময় সূরা আস সাফফাত পড়তেন।”

এখন বারা ইবনে আযের রা. এর বক্তব্যের অর্থ যে কী তা আল্লাহই ভালো জানেন।[আমাদের মতে “তাঁর কিয়াম ও রুকুর সময় (দৈর্ঘ) সমান হতো“- হযরত বারা ইবনে আযেবের এই বক্তব্যে কিয়াম অর্থ রুকুর পরবর্তী এবং সাজদায় যাবার পূর্ববর্তী কিয়াম]

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাযের বিভিন্ন অংশের মধ্যে স্বাভাবিকতা ও সামঞ্জস্য বজায় থাকতো। তিনি যখন কিয়াম (কিরাত) লম্বা করতেন তখন স্বাভাবিকভাবে রুকু সাজদাও লম্বা করতেন। আবার যখন কিয়াম সংক্ষিপ্ত করতেন, তখন রুকু সাজদাও সংক্ষিপ্ত করতেন।

তিনি রাতের নামাযে (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ ও নফল নামাযে) কখনো কখনো রুকু-সাজদা কিয়ামের সমান লম্বা করেছেন। সূর্যগ্রহণের নামাযেও প্রায় এমনটিই করতেন।

নামাযের বিভিন্ন অংগ ও অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর থেকে প্রাপ্ত নির্দেশিকা তাই, যা উপরে বর্ণনা করা হলো।

রাতের (তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নফল) নামাযে তিনি রুকূতে গিয়ে নিম্নেক্ত দু‘আ এবং তাসবীহগুলোও পড়তেন : (আরবী****)

অর্থ : সকল দুর্বলতা, ত্রুটি ও অক্ষমতামুক্ত অতিশয় পাক-পবিত্র তুমি সকল ফেরেশতা ও জিবরিলের প্রভু।”

(আরবী******************)

অর্থ: আমার প্রভু। আমি তোমার জন্যে মাথা নতো করেছি, তোমার প্রতি ঈমান এনেছি, তোমারই উদ্দেশ্য আত্মসমর্পন করে দিয়েছি এবং তোমারই উপর ভরসা করেছি। তুমিই আমার মনিব। আমার কান, চোখ, মগয, হাড়, শিরা-উপশিরা সবই তোমার প্রতি বিনয়াবনত হয়েছে। আমার পা যতোবার উপরে উঠে তার যতোবার নিচে নামে, তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্যেই উঠে নামে।”

রুকূ থেকে দাঁড়ানো

অতপর তিনি রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন। রুকূ থেকে মাথা উঠাবার সময় তিনি:

১. রফে ইয়াদাইন করতেন (দুই হাত উঠাতেন)।

২. এবং নিম্নেক্ত তাসহীব পড়তেন : (আরবী*******)

অর্থ: আল্লাহ শুনেছেন তাঁর বান্দা কার প্রশংসা করেছে?

এ সময় এবং উপরে বর্ণিত দু‘বারসহ তিনি মোট তিন সময় রফে ইয়াদাইন করতেন। [অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমার সময়, রুকুতে যাবার সময় এবং রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময়। অবশ্য সামনে আরেকটি রফে ইয়াদাইনের কথা আসবে]

এই তিন সময় তিনি যে রফে ইয়াদাইন‘ করতেন, সে সম্পর্কে প্রায় ত্রিশজন সাহাবি বর্ণনা করেছেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এর বিপরীত কোনো প্রামাণ পাওয়া যায় না। মৃত্যু পর্যন্ত সারাজীবন তিনি এ নিয়মেই নামায পড়তেন।

বারা ইবনে আযেব থেকে বর্ণিত এ সংক্রান্ত হাদিসটি সহীহ নয়। মূলত রসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো এ নিয়ম পরিত্যাগ করেননি এবং এ থেকে প্রত্যাবর্তনও করেননি।

ইবনে মাসউদ রা. এর রফে ইয়াদাইন ত্যাগ করাটা এজন্যে ছিলনা যে, তিনি তা রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে জানতে পেরেছেন। তিনি আসলে রফে ইয়াদাইনের সাথে বিরোধও করেননি এবং তার পরিপন্থী কাজও করেননি। ব্যাপারটা হলো, সেকালে আমীর-উমরারা দেরি করে নামাযে আসতেন। ফলে তিনি আযান-ইকামত ছাড়া ঘরেই নামায পড়তেন। এসময় তাঁর দুপাশে দুজন মুক্তাদি দাঁড়াতো। তিনি ইমাম হিসেবে সামনে না দাঁড়িয়ে তাদের সমান্তরালে তাদের মাঝখানে দাঁড়াতেন। এতে করে রফে ইয়াদাইন করতে অসুবিধা হতো বলে তিনি তা করতেন না।

অথচ তাঁর এই নিয়মের বিপরীতে রয়েছে বিপুল সংখ্যক সহীহ হাদিস। রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে রফে ইয়াদাইন সম্পর্কে এতোগুলো সহীহ, অকাট্য ও সুপ্রমাণিত আমলী হাদিস বর্তমান থাকা সত্ত্বেও কী করে তা বর্জন করা যেতে পারে? এমনটি অকল্পনীয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কর্মনীতি অনসরণ করার ওতফীক দান করুন- আমীন। তিনি রুকু থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেন। তিনি বলেছেন : (আরবী********************)

অর্থ: ঐ নামাযের কোনো জাযা নেই, যাতে (নামযী) ব্যক্তি রুকু ও সাজদা থেকে মেরুদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ায়না এবং বসেনা।” (সহীহ ইবনে খোযায়মা)

রুকু থেকে দাঁড়িয়ে কী বলতেন?

তিনি যখন রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন, তখন বলতেন:

ربنا ولك الحمد কখনো বলতেন ربنا لك الحمد আবার কখনো বলতেন اللهم ربنا لك الحمد

অর্থ: হে আল্লাহ/ আমাদের প্রভু! সমস্ত প্রশংসা তোমারই।”

এই তিনটি বাক্যই রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তবে এ রকম বলাটা সহীহ নয়: اللهم ربنا ولك الحمد কারণ, তিনি একই বাক্য আল্লাহুম্মা এর সাথে ওয়াও যুক্ত করতেন না। রসূলুল্লাহ (ﷺ) রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে যে কিয়াম করতেন, তা সময়ের দিক থেকে তাঁর রুকু ও সাজদার সমান দীর্ঘ হতো। সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) রুকু থেকে দাঁড়িয়ে কখনো এই দু’আ পড়তেন:

(আরবী*****************)

অর্থ: আল্লাহ ঐ ব্যক্তির কথা শুনেন (কবুল করেন), যে তাঁর প্রশংসা করে। আমাদের প্রভু। সমস্ত প্রশংসা তোমারই। মহাবিশ্ব পূর্ণ করা প্রশাংসা তোমার। এই পৃথিবী পূর্ণ করা প্রশংসা তোমার। এ ছাড়াও তুমি যা চাও, তা পূর্ণ করা প্রশংসা তোমার। তোমার বান্দা যতো গুণ, প্রশংসা ও মর্যাদার কথা বলে, তা পাওয়ার সর্বাধিক যোগ্য ও অধিকরী তুমিই। আমরা সবাই তোমারই দাসানুদাস। আমার আল্লাহ! তুমি যা দিতে চাও, তা ঠেকাবার কেউ নেই। আর তুমি যা না দিতে চাও, তা দেয়ার সাধ্য করো নেই। কোনো ক্ষমতাশালীর ক্ষমতা ও বিত্তশালী ব্যক্তির বিত্ত তোমার দরবারে তার কোনো উপকারে আসেনা।”

সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রুকুর পরের কিয়ামে তিনি এই দু‘আও করতেন:

(আরবী*****************)

অর্থ: ওগো আল্লাহ! আমার ভুলত্রুটি থেকে আমাকে পানি, বরফ এবং ঠান্ডা বন্তু দিয়ে ধুইয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে দাও। গুনাহখাতা থেকে আমাকে সেরকম মুক্ত করো, যেমনিভাবে সাদা কাপড় থেকে ময়লা পরিস্কার করে ধবধবে করা হয়। উদয়াচল এবং অস্তাচলের মাঝে তুমি যেরকম দূরত্ব সৃষ্টি করেছো, আমার ও আমার গুনাহ খাতার মাঝে তুমি সেরকম দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও।”

তাছাড়া রুকুর পরের কিয়ামে তিনি নিম্নের কথাগুলোও অনেকবার উচ্চারণ করতেন: (আরবী*****************)

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আমার রবের, সমস্ত প্রশংসা আমার প্রভুর…..।

এভাবে তাঁর এই কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকুর সমপরিমাণ দীর্ঘ হয়ে যেতো। তিনি রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে এতোটা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন (কিয়াম করতেন) যে, লোকেরা বলাবলি করতো: হয়তো তিনি ভুলে গেছেন।

মহীহ মুসলিমে আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন “সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ“ বলে রুকু থেকে দাঁড়াতেন, তখন এতোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, আমরা বলতাম হয়তো তিনি সন্দেহে পড়েছেন। অতপর সাজদায় যেতেন। তারপর দুই সাজদার মাঝখানে এতোটা দীর্ঘসময় বসে থাকতেন যে, আমরা বলতাম হয়তো তিনি ভূলে গেছেন।”

সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি (ﷺ) সূর্যগ্রহণের নামাযে রুকুর পরের এই কিয়ামটি এতোই দীর্ঘ করতেন যে, তা প্রায় রুকুর সমান দীর্ঘ হতো। আর তাঁর সে রুকু হতো রুকুর পূর্বেকার কিয়ামের সমান দীর্ঘ।

রুকু এবং রুকুর পরবর্তী কিয়াম (দাঁড়ানো) সম্পর্কে এগুলোই হচ্ছে রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সুপ্রমাণিত কথা। এগুলোর সাথে কোনো বিরোধ নেই এবং এগুলোর বিপরীত কোনো কথা নেই। কোনো সূত্রেই কোনো কথা নেই।

বাকি থাকলো বারা ইবনে আযের রা. বর্ণিত হাদিসটি। সহীহ বুখারিতে বারা ইবনে আযের রা. থেকে এ সম্পর্কে যে হাদিস উল্লেখ হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর রুকু ও সাজদা, এবং জলসা ও কিয়ামের (বসা ও দাঁড়ানোর) সময় প্রায় সমপরিমাণ হতো।”

তবে কিরাত পড়ার কিয়াম এবং তাশাহুদ পড়ার জলসা এগুলোর থেকে ব্যতিক্রম। কারণ নামাযে দুই ধরনের কিয়াম (দাঁড়ানো) এবং দুই ধরনের জলসা (বসা) হয়ে থাকে। বারা রা. রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর রুকু, সাজদা এবং কিয়াম ও জলসা সমান হতো বলে রুকুর পরবর্তী কিয়াম এবং দুই সাজদার মধ্যবর্তী জলসাই বুঝিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের এ অর্থ গ্রহণ করলেই অন্যসবগুলো সহীহ হাদিসের সাথে এ বক্তব্যের কোনো বিরোধ থাকেনা। কারণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কিয়াম এবং তাশাহহুদের জলসা যে নামাযের অন্যান্য আরকান থেকে দীর্ঘ হতো, সে কথাতো সুস্পষ্ট এবং সুপ্রমাণিত।

আমাদের উস্তাদ (ইমাম ইবনে তাইমিয়া) বলেছেন, বনি উমাইয়ার শাসকরা নামাযের এই দুটি রুকন সংক্ষেপ করে ফেলেছে। এভাবে তারা নামাযের আরো বিভিন্ন অংগে হস্তক্ষেপ করে বিভিন্ন রকম বিদআত সৃষ্টি করেছে। যেমন তকবীর পূর্ণ না করা, অনেক দেরি করে নামায পড়া ইত্যাদি। এমনকি তাদের সৃষ্টি করা এসব বিদআতকে তারা সুন্নাত মনে করতো।

তাঁর সাজদায় যাবার পদ্ধতি

এভাবে প্রসান্তির সাথে (রুকু পরবর্তী) কিয়াম শেষ করে রসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আল্লাহু আকবার‘ বলে সাজদায় লুটিয়ে পড়তেন। এসময় তিনি রফে ইয়াদাইন করতেন না।

তবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি এ সময়ও রফে ইয়াদাইন‘ করতেন। ইবনে হাযম রহ. প্রমুখ এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন। আসলে একটা অনুমানভিত্তিক বক্তব্য। মূলত রসূলুল্লাহ (ﷺ) সাজদায় যাবার সময় রফে ইয়াদাইন করতেন না। রাবির (হাদিস বর্ণনাকারীর) ভুলের কারণে তিনি এসময় রফে ইয়াদাইন করতেন বলে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন।

সাজদায় যাবার সময় রসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতের পূর্বে হাঁটু যমীনে স্থাপন করতেন। তারপর দুই হাত, অতপর কপাল এবং সবশেষে নাক স্থাপন করতেন।

হাত আগে না হাঁটু আগে?

তিনি যে হাতের আগেই হাঁটু স্থাপন করতেন, একথা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন শরীক > আসেম ইবনে কুলাইব থেকে > তিনি তাঁর পিতা থেকে > তিনি ওয়ালে ইবনে হিজর রা. থেকে। ওয়ালে রা.বলেন : “আমি দেখেছি, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সাজদা করতেন, তিনি দুই হাতের পূর্বে দুই হাঁটু স্থাপন করতেন। যখন সাজদা থেকে উঠতেন, তখন দুই হাঁটুর পূর্বে দুই হাত উঠাতেন।” [দেখুন তিরমিযি, নামায অধ্যায়]

-এর বিপরীত করতে তাঁকে দেখা যায়নি।

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি মরফু হাদিস এক্ষেত্রে বিরোধ সৃষ্টি করেছে। হাদিসটি হলো: “তোমাদের কেউ যখন সাজদায় যাবে, সে যেনো উটের নিয়মে না বসে, বরং সে যেনো দুই হাঁটুর আগে দুই হাত রাখে।” [দেখুন, আবু দাউদ]

এ হাদিসটির বিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন। তবে সম্ভবত, হাদিসটির মধ্যে কোনো না কোনো রাবি থেকে কিছু কল্পনা প্রসূত কথা ঢুকে পড়েছে। তাছাড়া এর প্রথমাংশ দ্বিতীয়াশের সাথে অসংগতিপূর্ণ। হাঁটুর আগে যদি হাত রাখা হয়, তবে সেটা উটের মতোই বসা হয়। কারণ উট তার দুই হাতই আগে রাখে, হাঁটু নয়।

হাঁটুর আগে হাত রাখার পক্ষের লোকেরা যখন জানতে পারলেন, উট হাঁটুর আগে হাত, বিছিয়ে দেয়, তখন তাঁরা ব্যাখ্যা দিলেন, উটের হাঁটু তার হাতেই মধ্যেই থাকে, পায়ে নয়। আসলে এই ব্যক্তিগণের কথা কয়েক কারণে গ্রহণযোগ্য নয়:

এক: উট বসার সময় প্রথমে তার হাত দুটিই বিছিয়ে দেয়, তখন তার দুই পা দাঁড়ানো থাকে। আবার যখন বসা থেকে দাঁড়ায় তখন তার পা দুটি আগে উঠে এবং হাত দুটি তখনো মাটিতেই থাকে।

হাদিসে এ পদ্ধতিটি অনসরণ করতেই তো রসূল (ﷺ) নিষেধ করেছেন এবং তিনি এর বিপরীত করেছেন।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) যমীনে প্রথমে সে অংগেই স্থাপন করতেন, যেটি যমীনের বেশি কাছাকাছি, যেটি স্বাভাবিকভাবে আগে মাটিতে স্থাপিত হতো। আবার উঠার সময় একটির পর একটি করে সেসব অংগই আগে উঠাতেন, যেগুলো প্রথমে দুই হাঁটু রাখতেন, তারপর দুই হাত, তারপর কপাল। আবার সাজদা থেকে উঠার সময় প্রথম মাথা উঠাতেন তারপর দুই হাত অতপর দুই হাঁটু।

এটাই উটের পদ্ধতির বিপরীত। এভাবে রসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্তু-জানোয়ারদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করেছেন, হিংস্র পশুদের মতো যমীনে হাত বিছিয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন, কুকুরের মতো হাত ছড়িয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন এবং কাকের মতো ঠোকর মারতে নিষেধ করেছেন। তাছাড়া তিনি সালামের সময় ঘোড়ার লেজের মতো হাত উঠাতেও নিষেধ করেছেন।

দুই তারা যে বলেছেন, “উঠের হাঁটু উটের হাতে থাকে“ এ এক বিস্ময়কর কথা। কোনো ভাষাবিদের পক্ষে এর অর্থ বুঝা এবং একথা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ হাটু হাতে নয়, পায়ে থাকে, এটাই সর্বজনবিদিত।

তিনি সত্যিই যদি রসূলুল্লাহ (ﷺ) হাঁটুর আগে হাত রাখার কথা বলে থাকেন, তাহলে তিনি বলতেন তোমরা উটের মতো বসবে এবং হাটুর আগে হাত রাখবে।” তাহলেই বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো।

আমার ধারণা, আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত এ হাদিসটির বক্তব্য প্রথমত সঠিকই ছিলো। প্রথমে হাদিসটি সম্ভবত “সে যেনো দুই হাতের আগে দুই হাটু রাখে ‘ছিলো। পরবর্তীতে বর্ণনাকারীদের দ্বারা বক্তব্যের মধ্যে গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে। যেমনটি হয়েছে আরো বিভিন্ন হাদিসের ক্ষেত্রে। যেমন সেহরি খাওয়া সংক্রান্ত ইবনে উমর রা. এর হাদিস। এতে তিনি রসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন: বিলাল অধিক রাতে রাযান দেয়। সুতরাং তার আযানের পরও তোমরা পানাহার করতে থাকো যতোক্ষণ না ইবনে উম্মেম মাকতুম আযান দেয়।” এখানে পরবর্তী কোনো কোনো রাবি বিলালের জায়গায় ইবনে উম্মে মাকতুম এবং ইবনে উম্মে মাকতুমের জায়াগায় বিলালের নাম উল্লেখ করেছেন। অন্য একটি হাদিসে পরবর্তী কোনো রাবি জান্নাতের স্থলে জাহান্নাম এবং জাহান্নামের স্থলে জান্নাত উল্লেখ করে গোলমাল করে ফেলেছেন।

-এভাবে এই হাদিসটিতে পরবর্তী কোনো রাবি হাতের স্থলে হাটু এবং হাঁটুর স্থলে হাত বলে ফেলেছেন বলে মনে হয়। আর সমস্যার সমাধান রয়েছে উটের বিশ্রাম গ্রহনের পদ্ধতির মধ্যে। এক্ষেত্রে ওয়ায়েল বিন হিজরের হাদিসটি সঠিক।

আগে হাঁটু স্থাপনের পক্ষে আবু হুরাইরা রা. থেকেই আরো বর্ণনা রয়েছে। আবু বকর ইবনে আবি শাইবা> মুহাম্মদ ইবনে ফযাইল থেকে > তিনি আবদুল্লাহ ইবনে সায়ীদ থেকে > তিনি তাঁর দাদা থেকে > তিনি আবু হুরাইরা রা. থেকে > তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের কেউ যখণ সাজদায় যাবে সে যেনো হাতের আগেই হাঁটু রাখে। সে যেনো উটের মতো না বসে।”

আছরম তাঁর সুনান গ্রন্থে সহীহ সূত্রে আবু হুরাইরা রা. থেকে এই হাদিস বর্ণনা করেছেন।

এ হাদিসটি ওয়ায়েল বিন হিজর বর্ণিত হাদিসটির সাথে হুবহু মিলে যায়। আরেকটি অনরূপ হাদিস দেখুন:

ইবনে খুযাইমা তাঁর সহীহ হাদিস সংকলনের মুসআব ইবনে সা‘আদ থেকে হাদিস উল্লেখ করেছেন। মুসআব তাঁর পিতা সা‘আদ রা. থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন: আমরা হাঁটুর আগে হাত রাখতাম। এমনটি দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে হাতের আগে হাঁটু রাখার নির্দেশ দেন।”

এমতবস্থায় আবু হুরাইরা রা. এর প্রথম হাদিসটির বর্ণনার মধ্যে যদি গোলমাল নাও সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবু সেটি মনসুখ (রহিত) হয়ে যায়। আল মুগনী প্রণেতা ইমাম ইবনে কুদামা সহ অন্যান্য হাদিস বিশারদগণের এটাই অভিমত।

এছাড়াও হাদিসটি অগ্রহণযোগ্য হবার আরো দুটি কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো:

এক. হাদিসটি সনদে (বর্ণনাসূত্রে) একজন রাবি (বর্ণনাকারী) রয়েছেন ইয়াহইয়া বিন সালামা বিন কুহাইল। ইনি নির্ভরযোগ্য নন। ইমাম নাসায়ী বলেছেন, এই ব্যক্তি রাবি হিসেবে পরিত্যাজ্য (মাতরূক)। ইবনে হিব্বান বলেছেন, এ ব্যক্তি রাবি হিসেবে খুবই দুর্বল-অযোগ্য (মুনকার), তাকে কিছুতেই নির্ভযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। ইবনে মুয়ীন তো তাকে রাবি হবার বিষয়টি উড়িয়েই দিয়েছেন।

দুই. মুসআব ইবনে সা‘আদ তার পিতা সা‘আদ থেকে যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, সেটিকে এ বিষয়ের সমন্বয়কারী হাদিস হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। হাদিসটি নির্ভরযোগ্যও বটে। এ হাদিস সা‘আদ রা. বলেন, আমরা ওরকম করতাম, অতপর রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে হাঁটুতে হাত রাখতে নির্দেশ দেন।” আর মুগনী প্রণেতা (ইমাম ইবনে কুদামা) হাদিসটি হাঁটুর আগে হাত রাখতাম। এমনটি দেখে রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে হাতের আহে হাঁটু রাখার নির্দেশ দেন।”

এ বর্ণনাটিতেও কোনো বর্ণনাকারী সা‘আদ এবং আবু সায়ীদ এই দুই নামের মধ্যে গোলমাল বাধিয়ে ফেলেছেন। এ হাদিসটির সনদে সাহাবির নামের ক্ষেত্রে গোলমাল থাকলেও হাদিসটির মূল বক্তব্য (মতন) ঠিকই আছে। তাই এ হাদিসটিকে হাত আগে না হাঁটু আগে এই সমস্যার সমন্বয়কারী হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ

-সাহাবিগণ প্রথমদিকে হাতই আগে রাখতেন।

-পরে রসূল (ﷺ) হাঁটু আগে রাখার নির্দেশ দেন।

তাছাড়া আবু হুরাইরার প্রথম হাদিসটি সনদকে ইমাম বুখারী, ইমাম তিরমিযি, দারু কুতনি এবং আবু হাতিমও বিশুদ্ধ বলেননি।

এবার দেখা যাক, এ বিষয়ে সাহাবায়ে কিরামের আছার (আচরণ) কী ছিলো? প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবদুর রাজ্জাক এবং ইবনুল মুনযির তাঁদের হাদিস সংকলনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, উমর রা. সব সময় হাতের আগে হাঁটু যমীনে রাখতেন।

ইমাম তাহাবি ফাহাদ থেকে >তিনি উমর ইবনে হাফস থেকে > তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ছাত্র আলকামা ও আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা দুজনই বলেছেন: আমরা আমাদের ইলমের মধ্যে একথা খোদাই করে রেখেছি যে, উমর ইবনুল খাত্তাব রা. রুকূর পরে উটের মতো তা হাঁটুর উপর ভর করে নুইয়ে পড়তেন এবং হাতের আগেই হাঁটু স্থাপন করতেন।

ইমাম তাহাবি হাজ্জাজ বিন আরতাতের সূত্রে ইব্রাহিম নখয়ীর এ বক্তব্যও উল্লেখ করেছেন: আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখন সাজদায় যেতেন, তখন হাতের পূর্বেই হাঁটু যমীনে স্থাপন করতেন। ইমাম তাহাবি আরেকটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন আবু মারযুক থেকে> তিনি ওহাব থেকে> তিনি শো‘বা থেকে> তিনি মুগীরা থেকে। মুগীরা বলেন, আমি ইব্রাহীম নখয়ীকে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, যে সাজদায় যাবারকালে হাঁটুর আগে যমীনে হাত রাখে। জবাবে তিনি বললেন: আহমক কিংবা পাগল ছাড়া কেউ কি এমনটি করে?

ইবনুল মুনযির বলেছেন, হাত আগে না হাঁটু আগে এ বিষয়টি নিয়ে জ্ঞনীদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। যাদের মত হলো, হাতের আগে হাটু রাখতে হবে, তাদের মধ্যে রয়েছেন- উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ইব্রাহীম নখয়ী, মুসলিম ইবনে ইয়াসার, সুফিয়ান সওরী, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহউইয়া, আবু হানীফা এবং তাঁর শিষ্যগণ ও কুফাবাসী।

পক্ষান্তরে যাদের মতে হাঁটুর আগে হাত রাখতে হবে, তাদের মধ্যে রয়েছেন, মালিক ও আওয়ায়ী। তাঁরা বলেছেন, আমরা দেখতে পেয়েছি লোকেরা হাঁটুর আগে হাত রাখেন। আহলে হাদিসের মতও এটাই।

বায়হাকীতে আবু হুরাইরা রা. এর হাদিসটি কিছুটা ভিন্ন ভাষায় উদ্বৃত হয়েছে। সেখানে হাদিসটি এভাবে বর্নিত হয়েছে : তোমাদের কেউ যখন সাজদা করে, তখণ সে যেনো উটের মতো লুটিয়ে না পড়ে। বরং সে যেনো হাঁটুর উপর হাত রাখে।”

বায়হাকী বলেছেন, হাদিসটি যদি সুরক্ষিত ও অবিকৃত (মাহফয) থেকে থাকে, তবে এটি সাজদায় যাবারকালে হাঁটুর আগে হাত রাখার পক্ষে একটি দলিল। তবে কয়েকটি কারণে ওয়ায়েল বিন হিজর বর্ণিত হাদিসটি (অর্থাৎ হাতের আগে হাঁটু রাখার হাদিসটি) গ্রহণ করা উত্তম। কারণগুলো হলো:

১. আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত (অন্যান্য) হাদিস থেকে হাতের আগে হাঁটু রাখার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। একথা বলেছেন খাত্তাবি প্রমুখ হাদিস বিশারদগণ।

২. আবু হুরাইরা রা. কর্তৃক বর্ণিত এ হাদিসের মূল বক্তব্য (মতন) অনকেটা গোলমালে। বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনায় বক্তব্যের গোলমাল লক্ষ্য করা যায়। কখনো বলা হয়েছে : হাঁটুর আগে যেনো হাত রাখে।” কখনো বলা হয়েছে : হাতের আগে যেনো হাঁটু রাখে। কখনো বা মূল বক্তব্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে বলা হয়েছে।

৩. ইমাম বুখারি ও দারু কতনি প্রমুখ বড় বড় হাদিস বিশারদগণ আবু হুরাইরা রা. এর হাঁটুর আগে হাত রাখার, হাদিসটি সনদকে ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

৪. একদল আহলে ইলম হাঁটুর আগে হাত রাখার বর্ণনাকে মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে বলে মনে করেন। ইবনুল মুনযির বলেছেন, অনেকেই এ বর্ণনাটি বাতিল হয়ে গেছে বলে মনে করেন।

৫. রসূলুল্লাহ (ﷺ) যেহেতু উটের মতো সাজদায় লুটিয়ে পড়তে নিষেধ করেছেন, তাই উটের পদ্ধতি পরিহার করার জন্যেও ওয়ায়েল বিন হিজরের বর্ণনাটি উত্তম।

৬. বড় বড় সাহাবিগণের আছার (আমল) সম্পর্কে যে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাও হাতের আগে হাঁটু রাখার পক্ষে। উমর, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম হাতের আগে হাঁটু রাখতেন। তাঁদের কেউই আবু হুরাইরা রা. এর বর্ণনার অনুরূপ আমল করেছেন বলে প্রমাণ নেই। কেবলমাত্র উমর রা. কখনো এমনটি করেছেন বলে ভিন্নমত পাওয়া যায়।

৭. ওয়ায়েল বিন হিজর রা. বর্ণিত হাদিসের সমর্থনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এবং আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসও রয়েছে। কিন্তু আবু হুরাইরা রা. এর সমর্থনে অন্য কোনো সাহাবি বর্ণিত হাদিস নেই।

৮. অধিকাংশ লোকই ওয়ায়েল বিন হিজর রা. বর্ণিত হাদিসের অনুসারী। আর আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত এ হাদিসটির অনুসরণ করেছেন কেবল ইমাম আওয়ামী এবং ইমাম মলিক। আবু দাউদ যে বলেছেন, আহলে হাদিস আবু হুরাইরার হাদিসটি অনুসরণ করে, এর অর্থ- আহলে হাদিসের কিছু লোক। কারণ, ইমাম আহমদ ইবনে আম্বল, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম ইসহাক এ হাদিসের অনুসরণ করেননি।

৯. আবু হুরাইরা রা. এর হাদিসটি কওলী (বাণীগত) হাদিস। অন্যদিকে ওয়ায়েল বিন হিজর রা. এর হাদিসটি ফি‘লী (রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কর্মের বর্ণনাগত) হাদিস। ফি‘লী হাদিস কওলী হাদিসের তুলনায় অধিক মাহফুয (সংরক্ষিত ও অবিকৃত) থাকে। তাই এদিক থেকেও ওয়ায়েল বিন হিজর রা. এর বর্ণনাটি উত্তম।

১০. ওয়ায়েল বিন হিজর রা. রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাজদায় যাবার যে বাস্তব (ফি‘লী) বর্ণনা দিয়েছেন, তা অন্যান্য সহীহ বর্ণনা থেকেও প্রমাণিত হয়। রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাযের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিগত (ফি‘লী) সমস্ত বর্ণনাই প্রমাণিত ও সহীহ। আর এটিও সেরকমই একটি বর্ণনা সুতরাং এ বর্ণনাটি এ সংক্রান্ত বিধান হিসেবে গ্রহণীয়। এর বিপরীত বর্ণনাটিকে এর চাইতে অগ্রাধিকার দেবার মতো মজবুত যুক্তি নেই। -এর হলো আমাদের বুঝ-জ্ঞানের কথা। তবে প্রকৃত জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছে।

তিনি কিসের উপর সাজদা করতেন?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) বেশিরভাগ সময়ই যমীনের উপর সাজদা করতেন। কখনো কখনো পানি, কাদামাটি খেজুর পাতার মাদুর, খেজুর আঁশের গদি এবং শুকনো চামড়ায় সাজদা করেছেন।

তিনি কিভাবে সাজদা করতেন?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) কপাল ও নাক যমীনে করে সাজদা করতেন। তিনি পাগড়িতে ঢাকা কাপালে নয়, খালি কপালে সাজদা করতেন। পাগড়িতে ঢাকা কপালে সাজদা করতেন বলে কোনো সহীহ হাদিসে প্রমাণ নেই। এমনকি কোনো হাসান হাদিসেও এর প্রমান নেই।

তবে আবদুর রাজ্জাক তাঁর আল মুসান্নাফ গ্রন্থে আবু হুরাইরা রা. এর একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) পাগড়ির প্যাঁচের উপর সাজদা করতেন।”

এ হাদিসটি যাদের মুখে বর্ণিত হয়ে এসেছে, তাদের একজন হলো আবদুল্লাহ ইবনে মুহাররায। এ ব্যক্তি হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য নয়, পরিত্যাজ্য (মাতরূক)।

আবু আহমদও জাবির রা. এর সূত্রে অনুরূপ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসটির বর্ণনাসূত্রে আমর ইবনে শোহর এবং জাবির আল জা‘ফী নামাক দু‘ব্যক্তি রয়েছেন। এরা দুজনই অবিশ্বস্ত এ পরিত্যাজ্য (মাতরূক)। একজন পরিত্যাজ্য ব্যক্তি থেকে আরেকজন পরিত্যাজ্য ব্যক্তি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।

মারাসীলে আবু দাউদে বর্ণিত একটি হাদিসের বক্তব্য এরূপ একদিন রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মসজিদে এক এক ব্যক্তিকে নামায পড়তে দেখেন। কপাল জুড়ে পাগরি বাঁধা অবস্থায় লোকটি সাজদা করছিল। তখণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) তার কপাল থেকে পাগড়ি সরিয়ে দেন। ‘

তিনি যখন সাজদা করতেন, কপাল ও নাক যমীনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেন। দুই বাহু দুরে সরিয়ে রেখে বগল ফাঁকা করে রাখতেন। বগল এতোটা ফাঁকা করতেন যে, বগলের শুভ্রতা দেখা যেতো। ইচ্ছা করলে দুই বাহুর এই ফাঁকা দিয়ে ছোট ছাগল ছানা দৌড়ে যেতে পারতো। (বুখারী ও মুসলিম)

তিনি সাজদায় দুই হাতের তালু কখনো ঘাড় কখনো কান বরাবর রাখতেন।

সহীহ মুসলিমে বারা রা. থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন তুমি যখন সাজদা করবে, হাতের তালু দুটি যমীনে স্থাপন করবে এবং দুই কুনই উপরে উঠিয়ে রাখবে।”

তিনি সাজদায় গিয়ে পিঠ সোজা রাখতেন। দুই পায়ের আংগুলের মাথাগুলো (বাঁকিয়ে) কিবলামুখী করে রাখতেন। হাতের তালু ও আংগুল বিছিয়ে রাখতেন, তবে একেবারে মিলিয়ে রাখতেন না, আবার বেশি ফাঁকাও রাখতেন না।

ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ হাদিস সংকলনে বর্ণনা করেছেন : রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন রুকু করতেন, তখন হাতের আংগুলগুলো ফাঁকা ফাঁকা রাখতেন, আর যখন সাজদা করতেন, তখন মিলিয়ে রাখতেন।”

এভাবে তিনি হাঁটু, হাতের তালু, পায়ের পাতার সম্মুখভাগ, এবং কপাল ও নাক এতমীনানের (প্রশান্তির) সাথে যমীনে স্থাপন করে পিঠ সোজা করে সাজদায় অবস্থান করতেন।

তিনি সাজদায় কী বলতেন?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) সাজদায় গিয়ে বিভিন্ন তাসবীহ উচ্চারণ করতেন এবং দু‘আও করতেন। সহীহ সূত্রে জানা যায়, তিনি বিভিন্নরূপ তাসবীহ ও দু‘আ করতেন। তিনি কখনো এই তাসবীহ পাঠ করতেন:

سبحان ربي الاعلى

অর্থ: আমার মহান প্রভূ পবিত্র ক্রটিমুক্ত।

-এই তাসবীহ তিনি নিজেও পড়তেন এবং সাহাবিগণকে পড়তে নির্দেশ দিতেন। কখনো নিম্নোক্ত তাসবীহ পাঠ করতেন:

(আরবী***************) অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের প্রভু! তোমার প্রশংসাসহ তুমি পবিত্র ত্রুটিমুক্ত। হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দাও।”

কখনো এই তাসবীহ করতেন : (আরবী***********)

অর্থ: অতিশয় পবিত্র ত্রুটিমুক্ত তুমি জিবরিল ও সমস্ত ফেরেশতার প্রভু।”

কখনো উচ্চারণ করতেন এই তাসবীহ : (আরবী******************)

কখনো পড়তেন : (আরবী************************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টি পেয়ে তোমার অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচতে চাই। তোমর ক্ষমার উসিলায় তোমার শাস্তি থেকে বাঁচতে চাই। তোমার সত্তার উসিলায় আমি তোমার কাছে পানাহ চাই। আমি তোমার ততোটা প্রশংসা করতে অক্ষম, তুমি নিজেই তোমার যতোটা প্রশংসা করেছো হে প্রভু!”

কখনো এই দুআ করতেন: (আরবী*********************)

অর্থ: আমার আল্লাহ! তোমারই উদ্দেশ্যে আমি সাজদা করেছি। তোমারই প্রতি আমি ইমান এনেছি। আর তোমারই প্রতি আমি আত্মসমর্পণ করেছি। তুমিই আমার মালিক ও মনিব। আমার মুখমণ্ডল তাঁরই প্রতি সাজদায় অবনত, যিনি এ মুখমন্ডলকে সৃষ্টি করেছেন, সর্বোত্তম আকৃতি দান করেছেন এবং তাতে চোখ কান দিয়ে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টি দান করেছেন। সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা তুমি হে আল্লাহ, বড় বরকতময় তোমার নাম।” (সহীহ মুসলিম)

কখনো সাজদায় গিয়ে এই বলে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন: (আরবী************)

অর্থ হে আল্লাহ! ক্ষমা করে দাও আমার সমস্ত গুনাহ, সামনের ও পেছনের, প্রথমের ও শেষের, প্রকাশ্যের ও গোপনের।” (মুসলিম)

কখনো এই দুআ করতেন: (আরবী*******************)

অর্থ: হে আল্লাহ! ক্ষমা করে দাও আমার সব ভ্রান্তি, অজ্ঞতা, বাড়াবাড়ি- যা তুমি আমার চাইতে অধিক জানো। আমার আল্লাহ ! মাফ করে দাও আমার সব সীমলংঘন, অক্ষমতা, অনিচ্ছকৃত ভুল, ইচ্ছাকৃত ভুল এবং এরকম আরো যা কিছু আমার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। আয় আল্লাহ! মাফ করে দাও আমার আগে পরের এবং গোপন ও প্রকাশ্যের সব গুনাহ। তুমিইতো আমার ত্রানকর্তা। তুমি ছাড়া তো আর কোনো ত্রাণকর্তা নেই।”

সাজদায় তিনি কখনো বা এই দুআ করতেন: (আরবী****************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমার অন্তরে নূর (আলো) সৃষ্টি করে দাও। আমার যবানে নূর দাও। আমার শ্রবণশক্তিতে নূর দাও। আমার দৃষ্টিশস্তিতে নূর দাও। আমার ডানে নূর দাও। আমার বামে নূর দাও। আমার সামনে নূর দাও।আমার পেছনে নূর দাও। আমার উপরে নূর দাও। আমার নিচে নূর দাও। আমার মধ্যে নূর সৃষ্টি করে দাও আর আমার নূরকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করে দাও।”

রসূলুল্লহ (ﷺ) সাজদার দু’আর ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন: সাজদায় বান্দ আল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী হয়। তোমরা সাজদায় বেশি বেশি দু’আ করো। সাজদা দু’আ কবুলের উপযুক্ত সময়। এখানে তিনটি কথা সুম্পষ্ট:

এক : সাজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়।

দুই : আল্লাহ সাজদার দু‘আ বেশি বেশি কবুল করেন।

তিন : তাই সাজদায় গিয়ে বেশি বেশি দু‘আ করো।

সাজদায় রসূলুল্লহ (ﷺ) দুই ধরনের দু‘আ বেশি বেশি করতেন। সেগুলো হলো :

এক : আল্লাহর প্রশংসামূলক দু‘আ।

দুই : প্রার্থনামূলক দু‘আ।

সাজদার বিরাট মর্যাদা

আল্লাহর বনী (আল কুরআনের) তিলাওয়াত এবং দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহর সামনে অনুগত ও বিনীত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে নামাযের ‘কিয়াম‘ যেমন মর্যাদাবান, ঠিক তেমনি সাজদাও আল্লাহর কাছে বিরাট মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহর সাজদা করার মর্যাদা অনেক অনেক বেশি। কারণ-

১. রসূলুল্লহ (ﷺ) বলেছেন : যে বান্দা তার মা‘বুদের সবচেয়ে নিকটতর হয়, সে হলো সাজদাকারী।

২. মা‘দান বিন আবু তালহা বলেন, আমি রসূলুল্লহ (ﷺ) এর মুক্ত দাস সাওবান রা. কে বলেছিলাম আমাকে এমন একটি কথা শিখিয়ে দিন, যাতে আমি উপকৃত হতে থাকবো। জবাবে তিনি বললেন, বেশি বেশি সাজদা করো। কারণ, আমি রসূলুল্লহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যখনই কোনো বান্দা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি সাজদা করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা এক ধাপ বাড়িয়ে দেন এবং তার গুনাহসমূহ থেকে একটি গুণাহ মুছে দেন।”

মা‘দান বলেন, অতপর আমি গিয়ে আবুদ দারদা রা. এর সাথে সাক্ষাত করি এবং একই বিষয়ে জানতে চাই। তিনিই আমাকে সওয়াবানের মতো একই হাদিস শুনান।

৩. রবীয়া ইবনে কা‘ব আল আসলামি রসূলুল্লহ (ﷺ) এর নিকট জান্নাতে তাঁর সাথি হবার তামান্না প্রকাশ করলে তিনি তাকে বলেন: তবে তুমি বেশি বেশি সাজদা করে আমাকে সাহায্য করো।”

৪. সূরা আল্লাকের শেষ আয়াত আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

واسجد واقترب

“সাজদা করো আর (আমার) নৈকট্য অর্জন করো।”

৫. ছোট বড় সমস্ত মাখলুকাত আল্লাহর প্রতি সাজদায় অবনত হয়।

৬. সাজদার মধ্যমেই বান্দা তার প্রভুর প্রতি সর্বাধিক অবনত হবার সুযোগ পায় এবং সর্বাধিক ভক্তি ও বিনয় প্রকাশ করে। তাই এটাই প্রভুর কাছে দাসের সর্বোত্তম সম্মানজনক অবস্থা।

৭. সাজদাই তো হলো ইবাদত ও দাসত্বের চূড়ান্ত প্রকাশ। কারণ, বিনয়, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও দাসোচিত আনুগত্য প্রকাশের জন্যে সাজদাই মনিবের কাছে সর্বাদিক প্রিয় হয়ে থাকে।

তিনি সাজদায় কতোক্ষণ থাকতেন?

রসূলুল্লহ (ﷺ) নামাযের সকল অংগের (আরকানের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখতেন। তিনি যখন দীর্ঘ কিয়াম (কিরাত পাঠ) করতেন, যখন সেই অনুপাতে রুকু এবং সাজদাও দীর্ঘ করতেন। যেমন সূর্যগ্রহণের নামায এবং রাতের (তাহাজ্জুদ) নামাযে তিনি কিয়ামও সুদীর্ঘ করতেন এবং রুকু সাজাদাও।

আবার যখন কিয়াম (কিরাত পাঠ) তুলনামূলক সংক্ষেপ করতেন, তখন রুকু-সাজদাও সেই অনুপাতে ছোট করতেন। সাধারণত তিনি ফযর নামাযেই এমনটি করতেন।

এই ভারসাম্য রক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায় বারা ইবনে আযেব রা. এর হাদিস থেকে। তিনি বলেছেন : রসূলুল্লহ (ﷺ) এর কিয়াম, রুকু ও সাজদা ছিলো ভারসাম্যপূর্ণ। এগুলোর দৈর্ঘ প্রায় কাছাকাছি ছিলো।”

এখানকার আলোচনা থেকে আমরা তিনটি কথা পেলাম:

১. রসূলুল্লহ (ﷺ) নামাযের অংগগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতেন। কিরাত দীর্ঘ করলে রুকু সিজদাও দীর্ঘ করতেন। কিরাত ছোট করলে রুকু-সাজদাও ছোট করতেন।

২. সূর্য গ্রহণ ও রাতের নামাযে কিয়াম ও রুকু সাজদা খুব বেশি দীর্ঘ করতেন।

৩. তুলনামূলকভাবে ফরয নামায়ে কিয়াম ও রুকু সাজদা ছোট করতেন।

তাঁর সাজদা থেকে উঠে বসা

অতপর তিনি আল্লাহু আকবার’ বলে সাজদা থেকে মাথা উঠাবেন। এসময় রফে ইয়াদাইন, করতেন না। সাজদা থেকে উঠার সময় তিনি হাতের আগে মাথা উঠাতেন।

তারপর বাম পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর প্রশান্তির সাথে বসতেন। ডান পায়ের পাতা দাঁড় করিয়ে রাখতেন। ইমাম নাসায়ী এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে সহীহ সূত্রে হাদিস উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন ‘সুন্নত হলো, বাম পা পেতে দিয়ে তার উপর বসতে হবে এবং ডান পায়ের পাতা দাঁড় করিয়ে আংগুলগুলো কিবলামূখী করে রাখতে হবে।”

এ সময়কার বসার ধরণ সম্পর্কে রসূলুল্লহ (ﷺ) থেকে এছাড়া আর কোনো প্রকার পদ্ধতির কথা জান যায় না।

এ সময় তিনি দুই হাত দুই উরুর উপর রাখতেন। হাতের কনুই উরুর উপর এবং হাতের মাথা হাঁটুর উপর রাখতেন। বাম হাতের তালু বাম হাতের হাঁটুর উপর বিছিয়ে দিতেন। ডান হাতের ডান পাশের আংগুল দুটি মুষ্টিবদ্ধ রাখতেন আর বৃদ্ধাংগুলি মধ্যকার উপর রেখে একটা গোলাকার বৃত্তের মতো বানাতেন এবং শাহাদাত আংগুল (তর্জনি) উপরের দিকে উঠিয়ে দুআ পড়তে থাকতেন এবং সেটিকে নাড়াতেন। এ হাদিস বর্ণনা করেছেন ওয়ায়েল ইবনে হিজর রা.।

আবু দাউদে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. থেকে এ সম্পর্কে যে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে, তাতে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. বলেন : রসূলুল্লহ (ﷺ) দু’আ পড়ার সময় শাহাদাত আংগুল দিয়ে ইশারা করতে থাকতেন, নাড়াতেন না।”

এই নাড়াতেন না’ একথাটি পরবর্তীতে কেউ (কোনো রাবি) বাড়িয়ে বলেছেন বলে মনে হয়। কারণ, একথাটুকুর বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ মুসলিমেও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. এর সূত্রে হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি এই বর্ধিতাংশ অর্থাৎ নাড়াতেন না, একথাটি উল্লেখ করেননি। বরং তাতে তিনি এভাবে বলেছেন : রসূলুল্লহ (ﷺ) যখন নামাযে বসতেন, তখন বাম পায়ের পাতা দুই উরু ও জঙ্ঘার মাঝখানে রাখতেন এবং ডান পায়ের উপর বসতেন। বাম হাতের তালু বাম হাটুর উপর রাখতেন। ডান হাতের তালু ডান উরুর উপর রাখতেন এবং তর্জনি দিয়ে ইশারা করতেন।”

আবু দাউদের হাদিসে যে নাড়াতেন না’ কথাটি আছে, সেটা এখানে নেই। তাছাড়া আবু দাউদের হাদিসের এই নাড়াতেন না’ কথাটি যে নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে কথা বলা হয়নি।

এক্ষেত্রে ওয়ায়েল ইবনে হিজর রা. এর হাদিস মজবুত ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তাছাড়া আবু হাতিম তাঁর সহীহ সংকলনে বলেছেন, এটি সহীহ হাদিস।

দুই সাজদার মধ্যবর্তী বৈঠকে যে দু’আ পড়তেন

রসূলুল্লহ (ﷺ) পয়লা সাজদা থেকে মাথা উঠিয়ে প্রশান্তির সাথে বসতেন। দুই সাজদার মধ্যেবর্তী এ বৈঠকে তিনি নিম্নরূপ দু’আ পড়তেন: (আরবী******************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করেদাও, আমার প্রতি দয়া করো, আমাকে বলবান করো, আমার মান-মর্যাদা বড়িয়ে দাও, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করো, আমাকে সুস্থ রাখো এবং জীবিকা দান করো।”[তিরমিযি, আবু দাউদ,ইবনে মাজাহ। হাকিম থেকে ইবনে আব্বাস রা. প্রমুখের সূত্রেও এ দুআর কথা জানা যায়]

হুযাইফা রা. বলেছেন, রসূলুল্লহ (ﷺ) দুই সাজদার মধ্যবর্তী বৈঠকে নিম্নরূপ দুআ পড়তেন: (আরবী**************)

অর্থ: প্রভু! আমাকে মাফ করে দাও। প্রভু! আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

দুই সাজদার মধ্যবর্তী বৈঠক লম্বা করা

রসূলুল্লহ (ﷺ) দুই সাজদার মধ্যবর্তী বৈঠক সাজদার সমান লম্বা করতেন।

তামাম হাদিসেই এর প্রমাণ রয়েছে। সহীহ সংকলন সমূহে আনাস রা. থেকে হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, রসূলুল্লহ (ﷺ) দুই সাজদার মাঝখানে এতোটা দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন যে, আমরা বলতাম হয়তো তিনি ভুলে গেছেন কিংবা সংশয়ে পগেছেন।

এটাই সুন্নত। সাহাবিদের যুগের পরে অধিকাংশ লোকই এ সুন্নত ত্যাগ করেছে।

দ্বিতীয় সাজদা থেকে উঠে দাঁড়ানো

প্রথম সাজদা থেকে উঠে প্রশান্তির সাথে বসা ও দুআ করার পর তিনি আল্লাহু আকবার বলে দ্বিতীয় সাজদায় যেতেন। দ্বিতীয় সাজদায়ও পয়লা সাজদার অনুরূপ করতেন।

রসূলুল্লহ (ﷺ) দ্বিতীয় সাজদা শেষ করে আল্লাহু আকবার’ বলে উঠে দাঁড়াতেন।

দাঁড়াবার সময় তিনি দুই হাতে দুই পা ও হাঁটু ধরে উরুর উপর ভর করে দাঁড়াতেন। তাঁর এ আমল বর্ণিত হয়েছে ওয়ায়েল ইবনে হিজর এবং আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে।

তিনি হাত যমীনে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন না।

বিশ্রামের বৈঠক ও এ ব্যাপারে মতভেদ

মলিক ইবনে হুয়াইরিস বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লহ (ﷺ) দ্বিতীয় সাজদা থেকে উঠে দাঁড়াবার আগে কিছুক্ষণ সোজা হয়ে না বসে দাঁড়াতেন না। এই জলসা (বসা) কে বিশ্রামের জলসা বলা হয়।

তবে এই বিশ্রামের বসা নিয়ে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে- এই বসাটা কি সুন্নত? প্রত্যেকের জন্যেই কি তা অনুকরণীয়? নাকি তিনি কোনো অসুবিধার কারনে এমনটি করেছিলেন? এ বিষয়ে দুরকম বর্ণনাই পাওয়া যায়।

খুল্লাল বলেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে আম্বল মালিক ইবনে হুয়াইরিসের বর্ণনা মেনে নিয়ে বিশ্রামের বৈঠকের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউসুফ ইবনে মুসা আমাকে খবর দিয়েছেন, আবু উমামাকে সাজদা থেকে দাঁড়াবার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন সাজদা থেকে দাঁড়াতে হবে দুপায়ের উপর ভর দিয়ে।” –একথার দলিল রিফা’আ বর্ণিত হাদিস। কিন্তু ইবনে আজলানের হাদিস থেকে একথার প্রমাণ পাওয়া যায়না যে, রসূল (ﷺ) দুপায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতেন।

অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক সাহাবি (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) রসূলুল্লহ (ﷺ) এর নামাযের বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁরা কেউই এর বিশ্রামের বৈঠকের কথা উল্লেখ করেননি।

এই বৈঠকটি সম্পর্কে শুধুমাত্র আবু হুমায়েদ এবং মালিক ইবনে হুয়াইরিস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে।

রসূলুল্লহ (ﷺ) যদি নিয়মিত ও স্থায়ীভাবে এই আমলটি করতেন, তবে তাঁর নামাযের বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতি বর্ণনাকারী বিপুল সংখ্যক সাহাবি অবশ্যি তা উল্লেখ করতেন। একবার তিনি একাজটি করেছেন বলেই সেটা নামাযের সুন্নত বলে প্রমাণিত হয়না। তবে তিনি এমনটি সুন্নত হিসেবে করেছেন বলে যদি প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রেই তা অনুকরণীয়। আর যদি ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধার কারনে একবার তিনি তা করে থাকেন তবে তা নামাযের একটি সুন্নত বলে পরিগণিত হবেনা। -এটাই এই মতভেদের সমাধান।

দ্বিতীয় রাকাত কিভাবে পড়তেন?

রসূলুল্লহ (ﷺ) পয়লা রাকাতের সাজদা থেকে উঠে দাঁড়িয়েই সুরা ফাতিহা পাঠ করা শুরু করতেন। দাঁড়ানোর পর পয়লা রাকাতের মতো একটু থামতেন না, বা কিছুক্ষণ নিরব থাকতেন না।

তবে দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পূর্বে আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম পড়তেন কি না সে বিষয়ে ফকীহগনের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য, তারা সকলেই এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এটা নামাযের শুরু নয়, মধ্যবর্তী একটি জায়গা।

এখানে তায়াউয’ পড়া না পড়ার ব্যাপারে দুটি মত সৃষ্টি হয়েছে ইমাম আহমদের দুটি কথা থেকে। তাঁর একদল ছাত্র তাঁর একটি মতের ভিত্তিতে বলেছেন, নামাযের গোটা কিরাতকে যদি একটি কিরাতের সমষ্টি ধরা হয়, তবে একবার তায়াউয পড়াই যথেষ্ট। আর যদি প্রত্যেক রাকাতরে কিরাতকে স্বতন্ত্র কিরাত ধরা হয়, তবে প্রত্যেক ফাতিহাতেই তায়াউয পড়তে হবে।

আসলে এক তাকবীরে তাহরীমার অধীনস্থ নামায সমষ্টির সূচনা তো একটিই। তাই একথা পরিস্কার, সূচনাতে একবার তায়াউয পড়াই যথেষ্ট। সহীহ হাদিস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন রসূল (ﷺ) যখন দ্বিতীয় রাকাতে দাঁড়াতেন, তখন না থেমেই কিরাত আরম্ভ করতেন।”

আসলে রাকাত সমূহের সূচনা প্রথম রাকাতেই হয়। [কুরআন পাঠ শুরু করার সময় ‘তায়াউয‘ পড়া জরুরি বলে এই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এক তাকবীরে তাহরীমার অধীনস্থ রাকাতগুলোর সুচনা একটি, নাকি প্রত্যেক রাকাত এর সূচনা আলাদা আলাদা?] দুই রাকাতের মাঝখানে যে বিঘ্ন ঘটে, তা বিরতির কারনে ঘটেনা, ঘটে যিকর এর কারণে। আর যিকর কিরাতের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়না। কারণ তাতে তো হামদ, তাসবীহ, তাহলীল, সালাত আলান্নাবী এবং অনুরূপ অন্যান্য কথাই উচ্চারণ করা হয়।

রসূলুল্লহ (ﷺ) চারটি বিষয় ছাড়া দ্বিতীয় রাকাত পয়লা রাকাতের মতোই পড়তেন। সে চারটি বিষয় হলো:

১. তাকবীরে তাহরীমা।

২. তাকবীরে তাহরীমার পরে কিছুক্ষন নিরব থাকা।

৩. ঐ নিরব থাকার সময় প্রারম্ভিক হামদ ও দুআ পাঠ।

৪. এবং দ্বিতীয় রাকাতের তুলনায় কিছুটা দীর্ঘ করা।

রসূলুল্লহ (ﷺ) দ্বিতীয় রাকাতে তাকবীরে তাহরীমা উচ্চারণ করতেন না, কিছুক্ষন নিরব থাকতেন না, নিরব থাকার সময় প্রারম্ভিক যিকর ও দুআ পাঠ করতেন না। তাছাড়া পয়লা রাকাতের তুলনায় কিছুটা সংক্ষেপ করতেন। তাঁর প্রত্যেক নামাযেই দ্বিতীয় রাকাতের তুলনায় পয়লা রাকাত দীর্ঘ হতো।

প্রথম তাশাহহুদের বৈঠক ও প্রাসঙ্গিক কর্মপদ্ধতি

দ্বিতীয় রাকাতের উভয় সাজদা শেষ করে রসূলুল্লহ (ﷺ) যখন তাশাহুদের জন্যে বসতেন, তখন বাম উরুর উপর বাম হাত এবং ডান উরুর উপর ডান হাত রাখতেন। ডান হাতের শাহাদাত আংগুল দ্বারা কিবলার দিকে ইংগিত করতে থাকতেন। এসময় আংগুটির পুরোপুরি দাঁড় করাতেন না, আবার নিচু করেও রাখতেন না, বরং উপরের দিকে ঈষৎ উঠিয়ে রাখতেন এবং নাড়াতে থাকতেন। বুড়ো আংগুল মধ্যমার উপর রেখে একটা বৃত্তের মতো বানাতোন আর শাহাদাত আংগুল (তর্জনি) উঁচিয়ে তাশাহুদ পড়তে থাকতেন এবং সেটির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে রাখতেন। এসময় বাম উরুর উপর বাম হাত বিছিয়ে রাখতেন।

দুই সাজদার মাঝখানে তিনি যেভাবে বসতেন, তাশাহুদের বৈঠকেও (পয়লা বৈঠকে) সেভাবে বসতেন। বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে তার উপর বসতেন। ডান পায়ের পাতা খাড়া করে রাখতেন এবং আংগুলগুলো কিবলামুখী করে দিতেন। এ বৈঠকে এর ব্যতিক্রম বসতে কেউ তাঁকে দেখেনি।

সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. এর যে বর্ণনাটি উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নামাযে বসতেন, তখন তাঁর বাম পায়ের পাতা তাঁর উরু ও জঙ্ঘার মাঝে রাখতেন এবং ডান পায়ের পাতা বিছিয়ে দিতেন।”

-আসলে এ বর্ণনাটি শেষ বৈঠক সংক্রান্ত। এ সম্পর্কে সম্মুখে আলোচনা আসছে। তাঁর দুইটি বৈঠকের একটির বৈশিষ্ট্য হলো এ রকম।

সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিমে আবু হুমায়েদ রা. থেকে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাযের যে পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে: রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন (চার রাকাতের) নামাযে দ্বিতীয় রাকাতের পর প্রথম তাশাহুদের জন্যে বসতেন, তখন তিনি বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন এবং অপর পায়ের (ডান পায়ের) পাতা খাড়া করে রাখতেন। আর যখন শেষ বৈঠকে বসতেন, তখন বাম পায়ের পাতা একটু সামনে এগিয়ে নিয়ে ডান পায়ের জঙ্ঘার (নলার) নিচে রাখতেন। ডান পায়ের পাতা খাড়া করে রাখতেন এবং পাছা যমীনে স্থাপন করে পাছার উপর বসতেন।

এখানে আবু হুমায়েদ এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এই দুইজন থেকে ডান পা সম্পর্কে দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। আবু হুমায়েদ বলেছেন, ডান পা খাড়া করে রাখতেন আর ইবনে যুবায়ের বলেছেন, বিছিয়ে দিতেন।

কোনো বর্ণনাকারীই একথা বলেননি যে, তিনি প্রথম তাশাহুদের বৈঠকে এরকম করতেন। এরকম কেউ বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

তবে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বসা সম্পর্কে বর্ণনার তারতম্যের কারণে লোকদের মধ্যে কয়েক প্রকার মতামত সৃষ্টি হয়েছে। যেমন : কেউ কেউ উভয় তাশাহুদেউ পাছার উপর বসার কথা বলেছেন। এ হচ্ছে মালিক রহ. এর মাযহাব।

-কেউ কেউ উভয় বৈঠকেই বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসা এবং ডান পা খাড়া করে রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ হচ্ছে হানীফা রহ. এর মত।

-কেউ কেউ বলেছেন, সালাম ওয়ালা তাশাহুদের বৈঠক পাছার উপর বসবে, অন্য তাশাহুদে বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসবে। এ হচ্ছে শাফেয়ি রহ. এর মত।

-কেউ কেউ বলেছেন, দুই তাশাহুদ ওয়ালা নামাযের শেষ তাশাহুদের বৈঠকে পাছার উপর বসতে হবে- উভয় বৈঠকের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার জন্যে। এ হচ্ছে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর মত।

আর আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. যে বলেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) ডানে পা বিছিয়ে দিতেন, তার অর্থ হলো, তিনি শেষ বৈঠকে তাঁর পাছা যমীনে স্থাপন করে পাছার উপর ভর দিয়ে বসতেন। ফলে ডান পা বিছিয়ে দিতেন। বাম পা দুই উরু ও জঙ্ঘার মাঝখানে রাখতেন আর পাছা রাখতেন যমীনে।

এ ক্ষেত্রে মতভেদ করা হয়েছে এই নিয়ে যে, এ সময় ডান পায়ের পাতা কোথায় কিভাবে রাখতেন? তাকি বিছিয়ে দিতেন, নাকি খাড়া করে রাখতেন?

প্রকৃত ব্যাপারটি আল্লাহই ভালো জানেন। তবে, আমাদের মতে এখানে পার্থক্যের কিছু দেখা যায় না। কারণ তিনি কখনো ডান পায়ে বসতেন না। বরং তা ডানদিকে বিছিয়ে দিতেন। ফলে তা না খাড়া থাকতো, আর না পুরোপুরি বিছানো থাকতো। এমতবস্থায় বিছিয়ে দেয়ার অর্থ ডান পায়ের পাতার উল্টা পিঠ বিছিয়ে দিতেন, ফলে তা পরোপুরি দাঁড়ানো থাকতোনা। দাঁড় করানোর অর্থ পায়ের পাতার নিচের দিক দাঁড় করানো, কারণ এমতাবস্থায় তা বিছানো থাকতো না এবং তিনি তাতে বসতেননা।

তাই আবু হুমায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) উভয়ের বক্তব্যই সঠিক।

অথবা বলা যেতে পারে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো এরকম করতেন, আবার কখনো ওরকম করতেন। প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন।

প্রথম তাশাহুদে কী পড়তেন?

চার বা তিন রাকাতের নামাযে রসূলুল্লাহ (ﷺ) দুই রাকাত পড়ে বসতেন। এটাকেই আমরা প্রথম তাশাহুদের বৈঠক বলেছি। এ বৈঠকে তিনি সবসময় তাশাহুদ পড়তেন।

নাসায়ীতে আবুয যুবায়েরের সূত্রে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি জাবির রা. থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। জাবির রা. বলেন : রসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনের মতোই আমাদের তাশাহুদ শিক্ষা দিতেন। [তিনি এসময় তাশাহুদ পড়তেন ভুলে গেলে শেষ বৈঠকে সাহু সাজদা করতেন। (বুখারী)। তাশাহুদ নি:শব্দে পড়া সুন্নত। (আবু দাউদ)]

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিম্নরূপ তাশাহুদ শিক্ষা দিয়েছেন : (আরবী**************************)

অর্থ : সকল মর্যাদাব্যঞ্জক ও সম্মানজনক সম্বোধন আল্লাহর জন্যে। সমস্ত শান্তি, কল্যাণ ও প্রাচুর্যর মালিক আল্লাহ। সর্বপ্রকার পরিত্রতার মালিকও তিনি। হে নবী! আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, আল্লাহর অনুগ্রহ ও বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর সকল নেক বান্দার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আমি আরো সাক্ষ্যৗ দিচ্ছি মুহাম্মদ তাঁর দাস ও রসূল।

নাসায়ীতে জাবির রা.- এর হাদিস নিম্নরূপ তাশাহহুদের কথা বর্ণিত হয়েছে:

(আরবী**********************)

অর্থ: বিসমিল্লাহি ওয়া বিল্লাহি, সকল সম্মানজনক সম্বোধন আল্লাহর জন্যে। আল্লাহই সমস্ত শান্তি, কল্যাণ, প্রাচুর্য ও সর্বপ্রকার পবিত্রতার মালিক। হে নবী। আপনার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরতক নাযিল হোক। আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর সব নেক বান্দাহর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর দাস ও রসূল। আমি আল্লাহর কাঝেঁ জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।”

এই হাদিসটি ছাড়া আর কোনো হাদিসে তাশাহহুদের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’-র উল্লেখ হয়নি। অবশ্য এ হাদিসটি সনদে (বর্ণিত সূত্রে) কিছুটা ত্রুটি আছে। রসূলুল্লাহ (ﷺ) এই তাশাহহুদটি (প্রথম তাশাহহুদ) খুবই সংক্ষেপে করতেন।

তিনি এই তাশঅহ্হুদে কবর আযাব, জাহান্নামের আযাব, জীবদ্দশা ও মৃত্যুকালীন ফিতনা এবং মসীহে দাজ্জালের ফিতনা থেকেও আশ্রয় চাইতেন না। অবশ্য রসূলুল্লাহ (ﷺ) সাধারণভাবে সব সময় এই চারটি জিনিস থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলার কারণে কেউ কেউ প্রথম তাশাহ্হুদেও এগুলো থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পসন্দ করেন। তবে এই আাশ্রয় প্রার্থনা শেষ তাশঅহ্হুদের সাথেই অধিকতর সহীহ।

প্রথম তাশাহহুদের বৈঠক থেকে দাঁড়ানো

তাশাহহুদ শেষ করে রসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাঁড়াতেন। তিনি পাযের পাতার বুক হাঁটু যমীনে ঠেকিয়ে দুই উরুতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।

সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) এসময় ‘রাফে ইয়াদাইন’ করতেন।

বুখারিতেও কোনো কোনো সূত্রে একথাটি বর্ণিত হযেছে। তবে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. –এর সব সূত্রের বর্ণনায় সর্বসম্মতভঅবে এখানে রফে ইয়াদাইনের কথা উল্লেখ নেই।

অবশ্য আবু হুমায়েদ আস সায়েদীর বর্ণনা থেকে অকাট্যভাবে এখানে রফে ইয়াদাইনের কথা প্রমাণিত হয়। তিনি রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর নামাযের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:

“রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নামাযের জন্যে দাঁড়াতেন, আল্লাহু আকবর (অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমা) বলতেন এবং রফে ইয়াদাইন করতেন। এ সময় দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। তিনি নামাযে এমনভাবে দাঁড়াতেন যে শরীরের প্রতিটি অংগ স্ব স্ব স্থানে প্রশান্তির সাথে প্রতিষ্ঠিত হতো। তারপর কিরাত পাঠ করতেন। কিরাত শেষে দুই হাত কাঁধ বরাবর উঠিয়ে ‘রফে ইয়াদাইন’ করতেন। তারপর রুকূ করতেন। হাতের আংগুলগুলো হাঁটুতে রাখতেন স্বাভাবিকভাবে। মাথা পিঠ বরাবর রাখতেন। মাথা বরাবরের চাইতে ঝুঁকিয়েও রাখতেন না, উঠিয়েও রাখতেন না। অতপর ‘সামিয়াল্লাহুলিমান হামিদা’ বলে মাথা উঠাতেন। রুকু থেকে মাথা উঠিয়ে প্রশান্তির সাঁথে দাঁড়াতেন, এমনকি শরীরের প্রতিটি অংগ স্ব স্ব স্থানে বহাল হতো। এরপর সাজদার জন্যে যমীনের দিকে ঝুঁকে পড়তেন। সাজদার সময় দুই বাহু পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন। পায়ের আংগুলগুলো কিবলার দিকে মুড়িয়ে (কিবলামুখী) রাখতেন। তারপর দুই পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন। [হযরত আবু হুমায়েদ রা.-এর অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় বাম পা বিঝিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন।] অতপর দ্বিতীয় সাজদায় যেতেন। অতপর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে বাম পা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বসতেন। প্রশান্তির সাথে বসতেন, এমনকি শরীরের প্রতিটি অংগ স্ব স্ব স্থানে বহাল হতো। তারপর (দ্বিতীয় রাকাতের জন্যে) দাঁড়াতেন। দ্বিতীয় রাকাতের আরকানগুলোও প্রথম রাকাতের মতোই করতেন। অতপর দ্বিতীয় রাকাতের তাশাহহুদ শেষ করে যখন দাঁড়াতেন, দাঁড়াবার সময় ‘রফে ইয়াদা্ন’ বরতন। রফে ইয়াদাইনের হাতগুলো কাঁধ পর্য়ন্ত উঠাতেন, যেমনটি করতেন নামাযের শুরুতে। অতপর বাকি নামায এই একই পদ্ধতে পড়তেন। অতপর শেষ সাজদায়, যে সাজদার পর সালাম ফিরাতে হয়, দুই পা (ডান দিকে) বের করে দিতেন এবং বাম পাছা যমীনে ঠেকিযে তার উপর ভর করে বসতেন।”

-এ বর্ণনাটি গ্রহণ করা হয়েছে সহীহ আবু হাতিম থেকে।

-সহীহ মুসলিমেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। তিমমিযিওেত সহীহ সূত্রে আলী ইবনে আবু তালিব রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) এসব স্থঅনে রফে ইয়াদাইন করতেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে কী পড়তেন?

প্রথম তাশাহহুদ থেকে দাঁড়িযে তিনি শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়তেন। তিন তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছু পড়েছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই।

অবশ্য ইমাম শাফেয়ী শেষ দু’রাকাতেও সূরা ফাতিহার সাথে কিরাত মিলানোকে মুস্তাহাব মনে করেন। এজন্য তিনি আবু সায়ীদ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ মুসলিমে। তাতে আবু সায়ীদ রা. বলেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর যুহরের কিয়াম থেকে আমরা অনুমান করতাম তিনি প্রথম দুই রাকাতে সূরা ‘আসসাদজার সমপরিমাণ কিরাত পড়তেন আর সেই দুই রাকাতে প্রথম দুই রাকাতের অর্ধেক পরিমাণ পড়তেন। [উল্লেখ্য সূরা আস সাজদার আয়াত সংখ্যা ৩০ (ত্রিশটি)। সুতরাং এই হাদিসের বক্তব্য হলো, প্যথম দুই রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ এবং শেষ দুই রাকাতে পনের আয়াত পারিমাণ পড়তেন।] তাছাড়া আমরা তাঁর আসরের নামাযের কিয়াম থেকে অনুমান করতাম, তিনি আসরের প্রথম দুই রাকাতে তার অর্ধেক পরিমাণ পড়তেন। (সহীহ মুসলিম)

অন্যদিকে একটি সুস্পষ্ট ও সর্বজন স্বীকৃত হাদিস হচ্ছে আবু কাতাদা রা. বর্ণিত হাদিস। এ হাদিসে পরিষ্কারভাবে তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) শেষ দু’রাকাতে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়তেন, সাথে অন্য কিরাত মিলাতেন না। আবু কাতাদাহ রা. বলেন:

“রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে নামায পড়তেন। তিনি যুহর এবং আসরের প্রথম দুই রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে আরো দু’টি সূরা মিলিয়ে পড়তেন। কখনো কখনো আমাদের শুনিয়ে পড়তেন।”

-বুখারি ও মুসলিম উভয়ের বর্ণনায়ই একথাগুলো আছে। মুসলিমে এই আবু কাতাদাহর হাদিসে অতিরিক্ত একথাগুলোও আছে।”এবং শেষ দু রাকাতে তিন শুধামাত্র সূরা ফাতিহা পড়তেন।”

বুখার ও মুসলিমে আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত এই হাদিস দু’টি থেকে এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে স্পষ্ট ও অকাট্য নির্দেশ পাওয়া যায়। অপরদিকে এক্ষেত্রে আবু সায়ীদ রা. –এর বক্তব্য অনুমানভিত্তিক।

এক্ষেত্রে আমরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারি যে, রসূল (ﷺ) –এর সাধারণ রীতি ছিলো তিনি শেষ দুই রাকাতে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পড়তেন, সেই সাথে আর কোনো সূরা কিরাত মিলাতেন না। -এর দলিল আবু কাতাদার হাদিস।

তবে কখনা কখনো শেষ দুই রাকাতেও সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা-কিরাত মিলাতেন। -এর দলিল আবু সায়ীদ রা.-এর হাদিস। তবে এমনটি করা তাঁর নিয়ম ছিলনা। এটা ছিলো তাঁর সাধারণ রীতির ব্যত্রিক্রম কাজ।

নামাযে তাঁর রীতি ও রীতির ব্যত্রিক্রম

বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কখনো কখনো সাধারণ রীতির ব্যতিক্রমও করতেন। যেমন ফজর নামাযে দীর্ঘ কিরাত পড়া ছিলো তাঁর সাধারণ রীতি। কিন্তু কখনো কখনো হালকা কিরাতও পড়তেন। মাগরিব নামাযে তাঁর রীতি ছিলো ছোট কিরাত পড়া, কিন্তু কখনো কখনো দীর্ঘ কিরাতও পড়তেন। তাঁর সাধারণ রীতি ছিলো ফজর নামাযে দু’আ কুনূত না পড়া, কিন্তু কখনো কখকনো পড়তেন। তাঁর সাধারণ রীতি ছিলো যুহর ও আসরের নামাযে নিঃশব্দে কিরাত পড়া, কিন্তু কখনো কখনো সাহাবায়ে কিরাম তাঁর কিরাত শুনতেন। সাধারণত তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ নিঃশব্দে পড়তেন কিন্তু কখনো কখনো শব্দ করে পড়তেন।

মোটকথা, রসূল (ﷺ) তাঁর নামাযের কোনো কোনো পদ্ধতিতে মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম করতেন। সেটা হতো তাঁর সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এবং সাময়িক। উদ্দেশ্য ছিলো মাঝে মধ্যে তার ব্যতিক্রম করার অবকাশ রাখা। কিন্তু এই অবকাশটা তঁঅর রীতি ছিলনা।

যেমন, একবার তিনি এক ব্যক্তিকে ঘোড়ায় করে একটি বিশেষ সংবাদ সংগ্রহ করে আনতে পাঠান। তাকে পাঠাবার পর তিনি নামাযে দাঁড়ান। নামাযের মধ্যে তিনি বারবার সে ব্যক্তির পথ পানে তাকাচ্ছিলেন।

অথচ সহীহ বুখারিতে আয়েশা রা. থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছৈ। তিনি বলেন, আমি রসূল (ﷺ)-কে নামাযের মধ্যে এদিক সেদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি বলেন: এটা শয়তানের প্রতারণা। সে এভাবে প্রতারণা করে বান্দাকে নামায থেকে অমনোযোগী করতে চায়।…..

কুরআন হাদিস সম্পর্কে ভঅলো জ্ঞান রাখেন, এমন ব্যক্তির পক্ষে এ দুটি হাদিসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা মোটেও কঠিন ব্যাপার নয়। তিনি নামাযের ব্যাপারে আল্লাহর ব্যাপারে কখনো অমনোযোগী হতেন না। ঘোড় সওয়ার সংবাদ বাহকের হাদিসটি যুদ্ধাবস্থার সাথে জড়িত। রণাঙ্গনে প্রায়ই তিনি ‘সালাতুল খাউফ’ পড়তেন। মুসলমানদের কল্যাণের জন্যেই তিন ঐ নামাযে প্রতীক্ষিত সংবাদ বাহকের আগমন পথে তাকাচ্ছিলেন। এটা তার সাধারণ রীতি ছিলনা।

প্রথম দুই রাকা এবং পয়লা রাকাত লম্বা করতেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর রীতি ছিলো, তিনি চার রাকাতের নামাযে শেষ দুই রাকাতের চাইতে প্রথম দুই রাকাত লম্বা করতেন। আবার প্রথম দুই রাকাতে দ্বিতীয় রাকাতের চাইতে পয়লা রাকাত লম্বা করতেন। -এ কারণেই সাআদ রা. উমর রা.-কে বলেছিলেন: আমি পয়লা দুই রাকাত লম্বা করবো এবং শেষের দুই রাকাত ্রস্ব করবো। রসূল (ﷺ)-এর সাথে এভাবেই নামায পড়েছি।

রসূল (ﷺ) –এর রীতি ছিলো, তিনি অন্যসব নামাযের চাইতে ফজর নামায দীর্ঘ করতেন। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশরা রা. বর্ণনা করেছেন প্রথমত আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক নামাযই দুই দুই রাকাত করে ফরয করেছিলেন। অতপর রসূলূল্লাহ (ﷺ) যখন হিজরত করলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা মুকীম অবস্থায় ফজর ছাড়া অন্যান্য নামায (দুই রাকাত) বৃদ্ধি করে দিলেন। দীর্ঘ কিরাতের কারণে ফজর নামাযকে পূর্বাবস্থায় (অর্থাৎ দুই রাকাত) রাখলেন। আর মাগরিবকে দিনের ‘বিতর’ হিসেবে তিন রাকাত রাখলেন।”

-এ হাদীস বর্ণনা করেছেন আবু হাতিম এবং ইবনে হিব্বান তাঁদের সহীহ সংকলনে। হাদীসটির মূল বক্তব্য সহীহ বুখারিতেও বর্ণিত হয়েছে।

সকল নামাযেই রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রীতি ছিলো যে, তিন শেষ অংশের তুলনায় প্রথমাংশ দীর্ঘ করতেন।

-সূর্য গ্রহণের নামাযও তিনি এভাবেই পড়তেন।

-রাতের নামাযও তিনি এভাবেই পড়তেন। তবে রাতের নামায যেহেতু তিনি দুই রাকাত দুই রাকাত করে পড়তেন, সে জন্যে প্রথম দুই রাকাত অধিক লম্বা করতেন। পরের দুই রাকাত তার তুলনায় কম লম্বা করতেন।

এভাবেই সামনের দিকে পড়তেন এবং শেষ করতেন। আর তিন যে রাতের প্রথম দুই রাকাত খাটো করে পড়তে বলেছেন, সেটা তাঁর এ রীতির খেলাফ নয়। কারণ সে দু’রাকাত রাতের নামায সমূহের উব্দোধনী নামায। উদ্ভোদনী দুই রাকাত তিনি ছোটই করতেন, যেমন ফজরের সুন্নত দুই রাকাত ফরয দুই রাকাতের তুলনায় ছোট করতেন। কারণ এ দুই রাকাত ছিলো ফজরের উদ্বোধনী নামায।

তাই এই ছোট দুই রাকাতের ফলে রাতের নাময দীর্ঘ করার রীতির ব্যত্রয় ঘটেনা। যেমন, তিন (ﷺ) বলছেন: ‘বিতরকে রাতের শেষ নামায বানাও।” অথচ তিন প্রায়িই বিতরের পরপর বসে বা দাঁড়িযে দুই রাকাত নফল নামায পড়তেন। এতে বিতর রাতের শেষ নামায হবার ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনা। আবার দেখুন, তিনি (ﷺ) মাগরিবকে দিনের বিরত বলেছেন, কিন্তু মাগরিবের পর পর শাফঅয়াত লাভের উদ্দেশ্যে দুই রাকাত সুন্নাত নামায পড়তে বলেছেন। এর ফলে মাগরিব দিনের বিতর হবার ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনা।

আসলে তিনি (ﷺ) মাগরিবের ফরযের পর দুই রাকাত পড়তেন। ফরযকে হিফাযত করার জন্যে। রাতের শেষ নামায বিতরের পরে দুই রাকাত পড়তেন ঐ বিতরকে হিফাত করার জন্যে। এটা সাধারণ কথা যে সাহায্যকারী বা হিফাযতকারী নামায মূল নামাযের বৈশি্যের ব্যত্যয় ঘটায়না। একথা সকল ব্যাপারেই প্রযোজ্য।

শেষ তাশাহহুদের বৈঠক

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন শেষ তাশাহহুদের জন্যে বসতেন, তখন (বাম) পাছা যমীনে রেখে পাছার উপর ভর দিয়ে বসতেন এবং দুই পা একদিকে (ডান দিকে) বের করে দিতেন।

-পাছার উপর ভর করে বসার ক্ষেত্রে যে তিন প্রকার পদ্ধতি তার (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এটা তন্মধ্যে একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিটি বর্ণিত হয়েছে সুনানে আবু দাুদে এবং আবু হাতিম-এর সহীহ সংকলনে আবু হুমায়েদ আস সায়েদী রা. থেকে।

-দ্বিতীয় পদ্ধতিটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারিতে সেই আবু হুমায়েদ আস সায়েদী রা. থেকেই। তিনি বলেন: রসূল (ﷺ) যখন শেষ রাকাতে বসতেন, তখ বাম পা একটু সামনে এগিয়ে নিতেন, ডান পা খাড়া করে রাখতেন এবং পাছার উপর বসতেন।

-এ পদ্ধতিটি প্রায় পয়লা পদ্ধতির মতোই। উভয় ক্ষেত্রেই পাছার উপর বসার কথা বলেছেন। তবে এ দুটোর মধ্যে পার্থখ্য শুধু পা রাখার ক্ষেত্রে।

-তৃতীয় পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে সহহি মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের হাদিসে। ইবনে যুবায়ের রা. বলেন: এসময় রসূল (ﷺ) তাঁর বাম পা উরু ও ডান জঙ্ঘার মাঝখঅনে রাখতেন এবং ডান পায়ের পাতা বিছিয়ে দিতেন।”-

আবুল কাসেম হারবি তাঁর গ্রন্থে এ পদ্ধতিকে সমর্থন করেছেন। পা রাখঅর ক্ষেত্রে প্রথম দুই পদ্ধতি থেকে এ পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। হয়তো বা রসূল (ﷺ) কখনো এ রকম করতেন। আবার কখনো ওরকম করতেন। স্পষ্টত এটাই মনে হয়। অথবা বর্ণনাগত কারণেও এ তারতম্য সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে।

-রসূল (ﷺ) প্রথম তাশহ্হুদের বৈঠক এবং শেষ তাশাহহুদের বৈঠকের মধ্যে পার্থখ্য করতেন। শেষ বৈঠকে তিনি পাছার উপর বসতেন। প্রথম বৈঠকে বাম পায়ের পাতার উপর বসতেন।

-ইমাম আহমদ বলেছেন, প্রথম বৈঠক এবং শেষ বৈঠকের মধ্যে পার্থক্য করার জন্যেই তিনি এমনটি করতেন। প্রথম বৈঠকের পর আবার উঠে দাঁড়াতে হবে বলে তিনি পায়ের পাতার উপর বসে দাঁড়াবার জন্যে প্রস্তুত থাকতেন। আর শেষ বৈঠকের পর দাঁড়াবার প্রস্তুতি থঅকেনা বলে, সে বৈঠকে এতমীনান ও প্রশান্তির সাথে বসতেন। শেষ তাশাহহুদের মাধ্যমে নামায শেষ হচ্ছে বলেই প্রশান্তির সাথে পাছার উপর গোটা দেহ ভর করে বসেনত।

-আবু হুমায়েদ রা. রসূল (ﷺ) –এর প্রথম বৈঠক এবং শেষ বৈঠকের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিনি রসূল (ﷺ) –এর শেষ বৈঠক বুঝঝাবার জন্যে বিভিন্ন বর্ণনায় এভাবে শব্দ প্রয়োগ করেছেন:

-“যখন তিনি শেষ রাকাতে বসতন।”

-যখন তিনি চতুর্থ রাকাতে বসতেন।”

-“যখন তিন সালামের বৈঠকে বসতেন, তখন দুই পা বের করে দিতেন এবং পাছার উপর ভরে করে বসতেন।”

এই শেষ বাক্যটি থেকে ইমাম শাফেয়ী প্রমুখ এই দলিলও গ্রহণ করেছেন যে, সালামের বৈঠক হলেই দুই পা বের করে পাছা মাটিতে রেখে পাছার উপর ভর করে বসেত হবে, চাই সেটা চার রাকাতী নামায হোক, কিংবা দুই রাকাতী, অথবা তিন রাকাতী।

-অবশ্য হাদিসের প্রকাশ্য ভাষা থেকে এমনটি বুঝা যায়না, তবে হাদিসের বক্তব্য থেকে এভাবে প্রকাশ পায়।

-হাদিসের বাহ্য বক্তব্য তো প্রথম বৈঠকের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা করার পর এটাকে দ্বিতীয় বৈঠক বা সালামের বৈঠক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং হাদিসের বাহ্য বক্তব্য থেকে এটা তিন রাকাতী বা চার রাকাতী নামাযের শেষ বা দ্বিতীয় বৈঠকের বৈশিষ্ট্য বলেই প্রমাণিত হয়।

এতো গেলো এ বৈঠকের একদিক। অপরদিকে তিন যখন তাশাহহুদের জন্যে বসতেন, তখন ডান হাত ডান ঊরুর উপর রাখতেন এবং তিন আংগুল মিলিয়ে রেখে শাহাদাত আংগুল খাড়া করতেন। অপর বর্ণনায় এসেছে, তখন তিন আংগুল মুষ্টিবদ্ধ করে শাহাদাত আংগুল খাড়া করতেন। আর বাম হাত বাম উরুর উপর রাখতেন। (সহীহ মুসলিম: ইবনে উমর রা.)

এদিকে ওয়ায়েল ইবনে হিজর রা. বর্ণনা করেছেন: আমি দেখেছি রসূল (ﷺ) তাশাহহুদের বৈঠকে বসে বাম হাত বাম উরুর উপর বিঝিয়ে রেখেছেন। ডান হাতের কনুই ডান উরুর উপর বিছিয়ে রেখেছেন এবং দুটি আংগুলের একটি নিয়ে আরেকটিকে চেপে ধরে একটি কুন্ডলীর মতো পাকান আর শাহাদাত আংগুল খাড়া করে সেটি নাড়াতে থাকেন ও দু’আ করতে থাকেন। (আবু দাউদ, নাসায়ী, দারামি: ওয়ায়েল ইবনে হিজর রা. )

সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর বর্ণনায় আছে: “তিনি বাম হাত বাম হাঁটুর উপর রাখতেন এবং ডান হাঁটুর উপর রাখতেন। এ সময় তিনি তিপ্পান্ন বুঝানোর জন্যে আংগুল যেভাবে জুড়ে নেয়া হয়, সেভাবে জুড়ে নিতেন এবং শাহাদাত আংগুল দ্বারা ইশারা করতেন।”

– আসলে এই সবগুলোই বর্ণনাই এক। যেমন-

ক. যে বর্ণনায় বলা হয়েছে: তিন আংগুল মুষ্টিবদ্ধ রাখতেন; তাতে বুঝঅনো হয়েছে, মধ্যমাও মিলানো থাকতো, তর্জনির (শাহাদাত আংগুলের মতো সেটি উন্মুক্ত থাকতোনা।

খ. যে বর্ণনায় বলা হয়েছে, দুই আংগুলের একটি দিয়ে আরেকটি চেপে ধরতেন, তাতে বুঝানো হয়েছে, পাশের দুই আংগুল যেভাবে মিলানো থাকতো, মধ্যমা সেভাবে বা সেগুলোর বরাবরে মিলানো থাকতোনা।

গ. আর যে বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিপ্পান্ন বুঝানোর মতো আংগুল জুড়ে নিতেন, সেখানে মধ্যমা জুড়ে নেয়াপর কথাই বলা হয়েছে। তবে তা পাশের দুই আংগুলের সাথে নয়, বরং বৃদ্ধাংগুলের সাথ।

তিনি দুই হাত দুই উরুর উপর বিছিয়ে রাখতেন। উরু এবং হাতের মাঝে ফাঁক রাখতেন না। হাতের কনুই উরুর শেষ প্রান্তের সাথে মিলে থাকতো।

-বাম হাতের আংগুলগুলো বাম ঊরুর উপর বিঝিয়ে রাখতেন।

আংগুল কিবলামুখী রাখতেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাশাহহুদের সময় হাতের আংগুল কিবলামুখী করে রাখতেন। এছাড়াও রফে ইয়াদাইন এবং রুকূ ও সাজদার সময় তিনি আংগুল কিবলামুখী রাখতেন। তিনি সাজদার সময় দুই পায়ের আংগুলও কিবলামুখী করে রাখতেন।

প্রত্যেক বৈঠকে তাশাহহুদ পড়তেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম বৈঠকের মতো শেষ বৈঠকেও তাশাহহুদ পড়তেন। তিনি দুই রাকাত পরপর তাশাহহুদ পড়তেন। তিনি সাহাবায়ে কিরামকে কুরআনের সূরার মতো তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন। তিনি প্রথম বৈঠকে যেরকম তাশাহহুদ পড়তেন, শেষ বৈঠকেও একই রকম তাশাহহুদ পড়তেন। তাঁর তাশাহহুদের বর্ণনা আমরা আগেই উল্লেখ করে এসেছি।

রসূলুল্লাহর প্রতি সালাত (দরুদ)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন নামায পড়ে, সে যেনো আল্লাহর হামদ ও ছানা (আল্লাহর প্রশংসা ও মহত্ব) বর্ণনা করে এবং তাঁর নবীর উপর সালাত (দরূদ) পাঠ করে। অতপর যেনো সে ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো দু’আ করে।”

হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ফুযালা ইবনে উবায়েদ। ইমাম তিরমিযি এটিাকে সহীহ হাদিস বলেছেন। [অনুরূপ হাদীস মুসনাদে আহমদ, নাসায়ী এবং আবু দাউদেও বর্ণিত হয়েছে। রসূল (ﷺ) তাঁর প্রতি সালাম শেষে দরূদ পড়ার নির্দেশ দিযেছেন। হাদিস থেকে উভয় তাশাহহুদের পরেই দরুদ পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কেউ কেউ প্রথম তাশাহ্হুদে পরে দরূদ পড়াকে মাকরূহ বলেছেন। কিন্তু তাদের মতের পক্ষে হাদিসের প্রমাণ নাই।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও নিজের উপর সালাত (দরূদ) পাঠ করতেন। সাহাবাগণকেও শিখিয়ে গেছেন তাঁরা কোন্ ভাষায় তাঁর প্রতি সালাত[ইমাম ইবনুল কায়্যিম তাঁর ‘জমাউল ইফহাম’ গ্রন্থে ‘সালাত’ –এর অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমাদের দেশে রসূল (ﷺ)-এর প্রতি সালাত পাঠ করাকে ‘দরূদ’ বলা হয়। এটা ফার্সি শব্দ। রসূল (ﷺ) উপর সালাত পাঠানোর জন্যে দু’আ করা মনে- তার জন্যে রহমতের দু’আ করা। আবুল আলিয়্যা (র) বলেছেন, রসূল (ﷺ) এর উপর সালাত পাঠানোর জন্যে দু’আ করা মানে তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও প্রশংসা বাড়িয়ে দেবার জন্যে দু’আ করা।] পাঠ করতেব। [রসূল (ﷺ) এর প্রতি কোন ভাষার সালাত (দরূদ) পাঠ করতে হবে, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এখানে তা উল্লেখ করেননি। তাই আমরা হাদিস গ্রন্থাবলী থেকে কতিপয় সালাত (দরূদ) এখানে উল্লেখ করছি:

** বুখারি, মুসলিম, তাহাবি, হুমায়দি, বায়হাকি ও নাসায়ীদে বর্ণিত দরূদ (সালাত):

(আরবী****************)

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও প্রশংসা বৃদ্ধি করো। তাঁর অনুসারী বংশধরদের প্রতিও অনুরূপ করো, যেমনটি করেছিলে তুমি ইব্রাহীত ও তাঁর অনুসারী বংশধরদের প্রতি। নিশ্চয়ই তুমি সপ্রশংসিত ও মহান সম্মানিত। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারী বংশধরদের বরকত (কল্যাণ) দান করো, যেমন বরকত দান করেছিলে ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারী বংশধরদের। নিশ্চয়ই তুমি সুপশংসিত মহা সম্মানিত।****

মুসনাদে আহমদ ও নাসায়ীদে এই দরূদের উল্লেখ হয়েছে:

(আরবী******************)

সহীহ মুসলিমে এই দরূদের উল্লেখ রয়েছে:-

(আরবী*****************)

মুসনাদে আহমদ ও তাহাবিতে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের জন্যে এই দরূদ পড়ে দু’আ করতেন:

(আরবী****************)

বুখারি নাসায়ী তাহাবি এবং মুসনাদে আহমদে এই দরূদের কথাও বর্ণিত হয়েছে:

(আরবী******************)

বুখারি মুসলিমে এই দরূদটিও উল্লেখ হয়েছে:

(আরবী***************)

নবীর জন্যে ‘সালাত পাঠ করা মানে নবীর জন্যে রহমত, সম্মান, মর্যাদা প্রশংসা ও কল্যাণের দু’আ করা।

তিনি নামাযের ভিতর সাত জায়গায় দু’আ করতেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযের মধ্যে সাত জায়গায় দু’আ করতেন। সে সাতটি স্থান নিম্নরূপ:

১। তাকবীরে তাহরীমার পর, নামায শুরুর প্রাক্কালে।

২। কিরাত শেষে রুকূতে যাবার পূর্বে বিতর নামাযে এবং সাময়িভাবে ফজর নামাযে দু’আ কুনূত পড়া। অবশ্য এ স্থানে দু’আ করার বিষয়ে যে হাদিস আছে, তা সহীহ কিনা- সে সম্পর্কে প্রশ্ন আছে।

৩। রুকূ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা রা. বলেছেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন রুকূ থেকে মাথা উঠাতেন তখন বলতেন:

(আরবী*********************)

অর্থ: আল্লাহ তার কথা শুনেন (কবুল করেন), যে তাঁর প্রশংসা করে। আমাদের প্রভু। সমস্ত প্রশংসা তোমার! আসমান ভরা প্রশংসাতোমার যমীন ভরা প্রশংসা তোমার! এ ছাড়াও তুমি যা চাও, তা পূর্ণ করা প্রশংসা তোমার। হে আল্লাহ! আমাকে বরফ, ঠান্ডা পানিয়ে দিয়ে ধুইয়ে পবিত্র ও পরিষ্কার করে দাও! হে আল্লাহ! আমার গুনাহ খাতা থেকে আমাকে পবিত্র করে দাও, যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে ধবধবে পরিষ্কার করা হয়।”

৪। তিনি রুকূর মধ্যেও দু’আ করতেন। বলতেন:

(আরবী******************)

অর্থ: পবিত্র তোমার সত্তা হে আল্লাহ, আমাদের প্রভু! প্রশংসা তোমারই যেহ প্রভু, আমাকে মাফ করে দাও।”

৫। সাজদায়। সাজদায়ই তিনি বেশি দু’আ করতেন।

৬। দুই সাজদার মধ্যবর্তী বৈঠকে।

৭। তাশাহহুদের পরে এবং সালামের পূর্বে।

তিনি নিজে এসব স্থানে দু’আ করেছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও দু’আ করতে বলেছেন।

[তাশাহহুদের পরে এবং সালামের পূর্বে যে সব দু’আ, তন্মধ্যে রসূল (ﷺ) উপর সালাত (দরূদ) ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে< কাণ সালাত (দরূদ)ও এক প্রকার দু’আ।

সালাম ফিরানোর পূর্বে রসূলুল্লাহর বিভিন্ন দু’আ

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, রসূল (ﷺ) নামাযের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে দু’আ করতেন। কোন্ স্থানে কি কি দু’আ করতেন তাও কিচু উল্লেখ করা হয়েছে। তাশাহহুদের পরে রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে বিভিনন দু’আ করেছেন এবং সাহাবাগণকেও বিভিন্ন দু’আ শিখিয়েছেন। এখঅনে তাঁর কতিপয় দু’আ উল্লেখ করা হলো, যেগলো বিশেষভাবে তাশাহহুদের পরে এবং সালামের পূর্বে পড়তেন:

(আরবী*****************)

অর্থ: আয় আল্লাহ। আমি তোমার কাঝে কবর আযাব থেকে পানাহ চাই, মসীহে দাজ্জালের ফিতনা থেকে পানাহ চাই এবং জীবন কালের ও মৃত্যুর পরের ফিতনা থেকে পানাহ চাই। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে পানাহ চাই পাপ কাজে এবং ঋণগ্রস্ত হওয়া থেকে।” (সহীহ বুখারি ও মুসলম)

-রসূলুল্লাহ (ﷺ) সব সময় এ কয়টি জিনিস থেকে পানাহ চাইতেন বলে বর্ণিত হয়েছে।

[সহীহ মুসলিম এবং নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছৈ, রসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাগণকে তাশাহহুদের পরে নিম্নোক্ত ভাষায় চারটি জিনিস থেকে পানাহ চাইতে আদেশ করেচেন:

(আরবী*************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাঝে পানাহ (আশ্রয়) চাই জাহান্নামের আযাব থেকে, কবর আযাব থেকে, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং মসীহে দাজ্জালের ক্ষতি থেকে।”

নাসায়ীদে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযে এভাবেও আল্লাহর কাছে পানাহ (আশ্রয়) চাইতেন:

(আরবী**************)

অর্থ: হে আল্লাহ আমি তোমার কাঝে পানাহ চাই আমার কৃতকর্মের ক্ষতি থেকে এবং ভবিষ্যতে যেসব কাজ করতে পারবোনা, সেগুলোর ক্ষতি থেকে।”]

-রসূলুলআহ (ﷺ) কখনো এই দু’আ করতেন:

(আরবী*****************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করে দাও। আমার ঘর আমার জন্যে প্রশস্ত করে দাও, আর তুমি আমাকে যে জীবিকাই দান করবে, তাতে কল্যাণ ও প্রাচুর্য দাও।

কখনো এই দু’আ করতেন:

(আরবী******************)

অর্থ: হে আল্লাহ! তোমার হুকুম পালনে আমি তোমার কাছে অটলতা ও অগ্রগামীতা প্রার্থনা করছি। সত্য-সঠিক পথে চলার জন্যে মনের দৃঢ়তা প্রার্থনা করছি। তোমার কাছে আমার প্রার্থনা- আমি যেনো তোমার নি’আমতের শোকর আদায় করি এবং সর্বোত্তম পন্থায় তোমার ইবাবদ করি। আমি তোমার কাছে চাই একটি প্রশান্ত হৃদয় আর একটি প্রকৃতভাষী যবান। আমি তোমার কাছে চাই- তুমি যা কিছু আমার জন্যে ভালো মনে করো। আমি সেইসব থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যা কিছু তুমি আমার জন্যে ক্ষতিকর মনে করো। আমার যতো দোষত্রুটি তোমার জন্যে আছে, আমি সেগুলো থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাই।”

[হাদিসে তাশাহহুদের পরে আরো বিভিন্ন দু’আ উল্লেখ আছে। তিনি নিজেও বিভিন্ন রকম দু’আ করেছেন সাহাবাগণকেও শিখিয়েছেন, আবার কোনো সাহাবীর নিজস্ব দু’আও সমর্থন করেছেন। ইমাম ইবনুল করিীয়্যম তাঁর গ্রন্থে সব দু’আ উল্লেখ করেননি। তাই আমার টীকার আরো কতিপয় দু’আ উল্লেখ করছি:
 

*** নাসায়ী এবং মুসতাদরকে হাকিমে রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযে এই দু’আ পড়তেন বলে উল্লেখ হয়েছে:

(আরবী******************)

অর্থ: হে আল্লাহ! তোমার গায়েব সম্পর্কি জ্ঞান এবং সৃষ্টির উপর তোমার যে শক্বিত তা দ্বারা আমাকে ততোদিন জীবিত রেখো যতোদিন আমার জন্য হায়াতকে তুমি উত্তম মনে করবে। আর যখন আমার মৃত্যুকে উত্তম মনে করবে, তখন আমাকে মৃত্যু দিও। হে আল্লাহ! আমি গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহভীতি কামনা করি, রাগ ও সন্তুষ্টির মুহূর্তে আমি সত্য কথা বলা ও সুবিচার করার তাওফীক প্রার্থনা করি। অভাব ও প্রাচুর্যের মধ্যে মিতব্যয়িতা চাই। তোমার কাছে অফুরন্ত নিয়ামত চাই। চোখের অবিচ্ছিন্ন শীলতা চাই। মৃত্যুর পর তোমার সন্তুষ্টি প্রার্থনা করি। পর জীবনে শান্তি, শীতলতা চাই। তোমার চেহারার প্রতি দৃষ্টি লাভের আনন্দ প্রার্থনা করি। তোমার সাক্ষাতের জন্য আগ্রহ কামনা করি কোনো ক্ষতিকর বিষয় এবং পথভ্রষ্টকারী ফিতনা ছাড়া। হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঈমানের সৌন্দর্যে সৌন্দর‌্যমন্ডিত করো এবং আমাদেরকে হিদায়াতকারী ও হিদায়াতপ্রাপ্ত বানিয়ে দাও।”

রসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে নামাযে এই দু’আ করতে শিখিয়েছেন।:

(আরবী****************)

অর্থ: হে আল্লাহ্ আমার হিসাব নিও সহজ করে। (মুসনাদে আহমদ, হাকিম)

**বুখারি ও মুসলিমে উল্লেখ হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু বকর রা. কে নামাযে নিম্নোক্ত দু’আ করতে বলেছেন:

(আরবী*****************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আমার নিজের উপর অনেক যুলুম করেছি, তুমি ছাড়া আর কেউ তা মাফ করতে পারে না। তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে ক্ষশা করো এবং আমাকে রহম করো। নিশ্চয়ই তুমি অত্যধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।”

মুসনাতে ইমাম আহমদ, আদাবুল মুফরাদ লিল বুখারি, তায়ালিসি এবং ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, নামাযে পড়ার জন্যে রসূলুল্লাহ (ﷺ) মা আয়েশাকে এই দু’আটি শিক্ষা দিযেছেন:

(আরবী********************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আমার জানা-নাজানা দ্রুত প্রাপ্য এবং বিলম্বিত সকল কল্যাণ প্রার্থনা করি। আমি তোমার কাছে দ্রুত ও বিলম্বিত সকল মন্দ থেকে যা আমি জানি এবং যা জানিনা- পানাহ চাই। আমি তোমার কাছে জানতে চাই এবং তা লাভ করার সহায়ক কথা ও কাজ কামনা করি এবং তোমার কাছে তোমার বন্দা ও রসূল মুহাম্মদ (ﷺ) যে কল্যাণ কামনা করেছেন সে সকল কল্যাণ কামনা করি। তোমার কাছে যে মন্দ ও অকল্যাণ থেকে তোমার বান্দা ও রসূল মুহাম্মদ (ﷺ) আশ্রয় চেয়েছেন আমি সে সকল মন্দও ও অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাই। আমি তোমার কাছে আমার ভাগ্যে নির্ধারিত বিষয় সমূহের ভালো পরিণাম কামনা করি।”

**রসূলুল্লাহ (ﷺ) এক ব্যক্তিকে তাশাহ্হুদে নিম্নোক্ত দু’আ পড়তে শুনে বলে উঠেন: একে মাফ করে দেয়া হয়েছে, একে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে:

(আরবী******************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! তুমি এক ও একক। কারুর মুখাপেক্ষী তুমি নও, তুমি সেই সত্তা, যিনি কোনো সন্তান জন্ম দেননি এবং নিজেও জন্ম নেননি, যার কোনো সমকক্ষ নেই, আমার গুনাফ মাফ করো, তুমি নিশ্চয়ই অতীব ক্ষমাশীলও মেহেরবান।” (আবু দাউদ, নাসায়ী)

** আবু দাউদ, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ, আদাবুল মুফরাদ, তারানি প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত হযেছে:

(আরবী******************)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এক ব্যক্তিকে তাশাহ্হুদে এই দু’আটি পড়তে শুনে সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞাপসা করন: তোমরা কি জানো, সে কি দিয়ে দু’আ করেছে? তাঁরা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর সলূ সর্বাধিক জানেন। তিনি বলেন, আমার প্রাণ যার হাতে, তাঁর শপথ করে বলছি: সে আল্লাহর মহান নাম সহকারে দু’আ করেছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে আল্লাহর ‘ইসমে আযম’ সহকরে দু’আ করেছে। ঐ নামে তাঁকে ডাকা হলে তিনি জবাব দেন এবং কোনো কিছু চাওয়া হলে তিনি তা প্রদান করেন।

এই দু’আটির অর্থ হলো:

“হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। সকল প্রশংসা তোমার, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তুমি এক ও একক, তোমার কোনো শরিক নেই। হে মহাপোকারী আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, হে মহান ও সম্মানিত, হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী! আমি তোমার কাছে জান্নাত চাই এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাই।”

** মুসলিম এবং আবু আওয়ানা বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাশাহহুদের পরে এবং সালামের পূর্বে সর্বশেষ এই বাষায় প্রার্থনা করতেন:

(আরবী**********************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমার আগের ও পরের সব গুনাহ, গোপন ও প্রাকশ্য সব গুনাহ, আমার সব সীমালঙ্ঘন এবং যা সম্পর্কে তুমি আমার চাইতে অধিক জানো, আমার সে সব গুনাহ মাফ করে দাও। তুমিই এগিয়ে দাও এবং তুমিই পিছিয়ে দাও। তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।”

নামাযের সাত স্থানে রসূলুল্লাহ (ﷺ) যেসব দু’আ, যিকর ও তাসবীহ করতেন, যথাস্থানে আমরা সহীহ হাদিসের আলোকে সেসব দু’আ যিকর ও তাসবীহ উল্লেখ করেছি। রসূলুল্লাহ (ﷺ) সাজদায় যেসব দু’আ করতেন, সেগুলো যদিও আমরা আগেই উল্লেখ করে এসেছি, তবু সাজদায় পঠিত তাঁর আরেকটি দু’আ এখানে উল্লেখ করে দিচ্ছি:

(আরবী***************)

অর্থ: আমার প্রবু! আমাকে আমার নফসের তাকওয়া দান করো এবং আমার নফস্কে পরিশুদ্ধ করো, তুমিই নফসের সর্বোত্তম পবিত্রতাদানকারী আর তুমিই তো তার অভিভাবক।”

ইমাম এক বচনে নাকি বহু বচনে দু’আ করবে?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযে যতো দু’আ করছেন বলে হাদিসে উল্লেখ ও সংরক্ষিত হয়েছে, তা সবই একবচনে, অর্থাৎ তিনি নিজের জন্যে দু’আ করেছেন। এমনকি সাহাবাগণকে নামাযে যেসব দু’আ করতে শিখিয়েছেন, সেগুলোও এক বচনে। যেমন, তিনি নামাযে এভাবে (নিজের জন্যে এক বচরে) দু’আ করতেন: (আরবী*****************)

অর্থ: আমার প্রবু! আমাকে ক্ষমা করো দাও, আমার প্রতি রহম করো এবং আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করো।”

সব দু’আই তিন এভাবে একবচনে করতেন। নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার পর প্রথম দু’আ করতেন। তাও এক বচনেই এভাবে করতেন:

(আরবী************)

অর্থ: হে আল্লাহ! বরফ, ঠাণ্ডাবস্তু এবং ঠাণ্ডা পানি দিয়ে আমার গুনাহ-খাতা ধুইযে মুছে আমাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে দাও। হে আল্লাহ! আমার আর আমার গুনাহ-খাতার মাঝে সেরকম দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও, যেমন তুমি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছো উদয়াচল আর অন্তাচলের মাঝে।…

(পুরো হাদিসটিই এভাবে একবচন)।

এখন এ বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে একটি হাদিস। হাদিসটি মুসনাদে আহমদ এবং সুনান গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত হয়েছে সাওবান রা. থেকে। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন:

“কোনো ব্যীক্ত যদি কোনো কওমের ইমাম (নেতা) হয়, আর দু’আ করার সয় যদি কেবল নিজের জন্যেই দু’আ করে, তবে সে খিয়াদনত করে।”

ইবনে খুযাইমা তাঁর সহীহ হাদিস সংকলনে এই হাদিসটিকে মওজু হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সহীহ সূত্রে বর্ণিত.

(আরবী*************)

-হাদিসটিকে একবচনে নিজের জন্যে দু’আ করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করে সাওবান রা. থেকে বর্ণিত হাদিসকে রদ (খন্ডন) করে দেন।

আমি খাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে বলতে শুনেছি, সাওবান রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটির ভাষ্য কেবল দু’আ কুনূত ধরনের সাময়িক দু’আর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নামাযে তো কেবল সেইসব দু’আই করতে হবে, যেগুলো রসূলুললাহ (ﷺ) নিজে করেছেন, করতে শিখিয়েছেন এবং অনুমান করেছেন। [আমাদের মতে সাওবান রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটি সহীহ না হলেও হাদিসটির বক্তব সঠিক। আর সে বক্তব্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় তথা সামষ্টিক ইমামতের (নেতৃত্বের) ক্ষেত্রে প্রযোজ।]

রসূলুল্লাহর সালাম ফিরানো পদ্ধতি

দু’আ শেষ করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-

(আরবী*****************)

অর্থ: আপনাদের প্রতি সালাম (শান্তি) ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক’ বলে প্রথমে ডান দিকে ফিরতেন এবং একই বাক্য উচ্চারণ করতে করতে বলে প্রথমে ডান দিকে ফিরতেন এবং একই বাক্য উচ্চারণ করতে করতে পরে বাম দিকে ঘাড় ফিরাতেন।

তিনি এভাবে সালাম বলে দু’দিকে ঘাড় ফিরাতেন বলে পনরজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। তাঁরা হলেন:

১। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আহু।

২. সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আহু।

৩. সহল বিন সা’আদ আস সায়েদী রাদিয়াল্লাহু আহু।

৪. ওয়ায়েল বিন হিজর রাদিয়াল্লাহু আহু।

৫. আবু মূসা আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু।

৬. হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আহু।

৭. আম্মার ইবনে ইয়াসের রাদিয়াল্লাহু আহু।

৮. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আহু।

৯. জাবির বিন সামুরা রাদিয়াল্লাহু আহু।

১০. বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আহু।

১১. আবু মালিক আল আশ‘য়ারী রাদিয়াল্লাহু আহু।

১২. তলক ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আহু।

১৩. আউস ইবনে আউস রাদিয়াল্লাহু আহু।

১৪. আবু রমছা রাদিয়াল্লাহু আহু।

১৫. আদী ইবনে উমায়রা রাদিয়াল্লাহু আহু।

রসূল (ﷺ) সামনের দিকে ফিরে থাকা অবস্থায়েই কেবল একটি সালাম বলে নামায শেষ করতেন বলেও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এ বক্তব্যে কোনো সহীহ সূত্র থেকে প্রমাণিত নয়। এ ক্ষেত্রে কেবল আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটিই বিচেবনায় আনা যেতে পারে। সুনান [‘সুনান গ্রন্থাবলী’ বলতৈ বুঝায তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহকে। এই চারটি গ্রন্থকে একত্রে ‘সুনানে আরবায়া’ (সুনান চতুষ্টয়)ও বল হয়।] গ্রন্থাবলীতে তাঁর হাদিসটি সংকলিত হয়েছে। তাঁর বর্ণনাটি হলো;

“নামায শেষে রসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আস্সালামু আলাইকুম উচচারণ করে কেবল একটি সালামই বলতেন এবং সেটি তিনি এতোটা শব্দ করে উচ্চারণ করতেন যে, আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠতাম।”

কতিপয় সংগত কারণে এই হাদিসটি ত্রুটিপূর্ণ এবং সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণগুলো হলো:

১. আয়েশা রা.-এর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, তিনি রসূল (ﷺ)-এর রাত্রের (নফল বা তাহাজ্জাদ) নামায সম্পর্কে একথা বলেছেন।

২. এছাড়া আয়েশরা রা. ঘুমে থাকার কারণে প্রথম সালামটি না শুনে হয়তো দ্বিতীয় সালামটি শুনে থাকবেন।

৩. যারা দুই সালামের কথা বর্ণনা করেছেন, তাঁরা জাগ্রত অবস্থায় এবং রসূল (ﷺ) এর সাথে নামায পড়া অবস্থায় তাঁকে দুই সালাম করতে দেখেছেন।

৪. দুই সালাম সংক্রান্ত হাদিসগুলো অধিকাংশই সহীহ, বাকীগুলো হাসান আর সংখ্যায়ও অনেক।

৫. আয়েশা রা. এখানে এক সালমের কথা উল্লেখ করলেও দুই সালামের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করেছেন।

-এসব কারণে দুইদিকে দুই সালামের মাধ্যমে নামায শেষ করার বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীতে উমাইয়া শাসকরা মদিনাসহ বিভিন্ন শহরে এক সালামের প্রচলন করে। ফলে সেই সময়কার প্রজন্মের কিছু লোকের ধারণা হয়, এক সালামের মাধ্যমেই বুঝি নামায শেষ করতে হয়। মসজিদে এসে এক সালাম দেখে তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্মে। কিন্তু রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে নামাযের যে রীতি প্রচলন করেছেন এবং খুলাফায়ে রাশেদীন যে রীতির অনুসরণ করেছেন আর সহীহ হাদিসের মাধ্যমে যেগুলো সুপ্রাণিত হয়েছে, তার বিপরীত কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।

এক সালাম সংক্রান্ত আরো যে দুয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলো সবই দুর্বল, ত্রুটিপূর্ণ ও বাতিল।

সালামের পরে মুক্তাদিরের নিয়ে মুনাজকাত (দু’আ) করা প্রসংগ

সালাম ফিরানোর পর কিবলার দিকে ফিরে, কিংবা মুক্তাদিরের দিকে ফিরে হাত উঠিয়ে দুআ বা মুনাজাত করার যে প্রথা চালু হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ রসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে পাওয়া যায়ণা। সহীহ বা হাসান কোনো সূত্রই পাওয়া যায়ণা। আবার অনেকেই খাস করে ফজর এবং আসর নামাযযের পর মুক্তাদিদের দিকে ফিরে এরূপ মুনাজাত করার রীতি চালু করছেন। কিন্তু এটাও রসূলুল্লাহা (ﷺ) কিংবা খুলাফায়ে রাশেদীনের কোনো একজন থেকেও প্রাণিত নয়। এমনটি করার কোনো নির্দেশ বা ইংগিতও তিনি উম্মতকে প্রদান করেননি।

যারা সালামের পর কিবলার দিকে ফিরে কিংবা ফজর ও আসরের পরে মুক্তাদিদের দিকে ফিরে মুনাজাত করার প্রথা চালু করেছেন, এটা তারা সুন্নতের বিকল্প হিসেবে চালু করেছেন। এটাকে তারা ভালো কাজ মনে করেন। সুন্নতের পরিবর্তে এমনটি করা ভালো কাজ কিনা তা আল্লাহই ভালো জানেন।

হাদিসে নামায সংক্রান্ত যদো দু’আর কথা উল্লেখ হয়েছে, সবই রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযের ভিতরে করেছেন এবং নামাযের ভিতরে করার জন্যে নির্দেশ দিযেছেন।

বান্দাহ যতোক্ষণ নামাযে থাকে ততক্ণ তো প্রকৃতপক্ষে তার প্রভুর সাথে তার মুনাজাত (গোপন কথাবার্তা) হয়। সেজন্যে রসূ (ﷺ) নামাযের ভিতরেই দু’আ করেছেন এবং করার নির্দেশ দিযেছেন। তখনইতো বান্দা তার প্রভুর একান্ত নিকটে থাকে, সেটাই তো চাওয়ার (দু’আর) প্রকৃতি সময়।

কিন্তু যখন সে নামাযের সালাম ফিরায়, তখনতো মুনাজাত (গোপন কথাবার্তা)-এর ধারা ছিন্ন হযে যায়। তাই মোক্ষম সময়ই প্রভুর কাছে চাওয়া উচিত, অর্থাৎ নামাযের ভিতর। এটাই সুন্নত। এটাই উত্তম পন্থা। সুন্নাতের বিপরীত নিজেদের কোনো রীতি বানিয়ে নেয়া উত্তম নয়।

তবে হ্যাঁ যে কোনো সময় যে কেউ আল্লাহর কাছে চাইতে পারে, দুআ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার উচিত, প্রথমে তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ, তাকবীর প্রভৃতি রসূল (ﷺ) এর শিখানো পদ্ধতিতে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি সালাত (দরূদ) পাঠ করা। অতপর যা ইচ্ছা দুআ করা, চাওয়া।

এমনটি করা হলে এটা আলাদা একটা ইবাদতের পরে দুয়া করা হলো। নামাযের সাথে আর এর সম্পর্ক থাকলোনা। এভাবে নামাযের সাথে যুক্ত করে সালামের পরে হাত উঠিয়ে দু’য়া বা মুনাজাত করার বানানো প্রথা চালু করা থেকে বাঁচা যায়। [বাংলাদেশে ও আশেপাশের অঞ্চলের লোকেরা নামাযের সাথে একাজকে একাকার করে ফেলেছে। অজ্ঞ লোকেরা নামাযের পর হাত উঠিয়ে মুনাজাত করাকে নামাযের অংগ বা নামাযের সাথে যুক্ত মনে করে। অথচ রাসূল (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কিরাম এমনটি করেননি। নামাযের ইমামগণ এমনটি করাকে বাধ্যতামূলক করে নিয়েছেন। অনেক ইমাম এমনটি করেন মুক্তাদিদের মন রক্ষার্থে, না করলে ইমামতি কক্ষা করা যাবে না বলে। আসলে যে কাজটি আদৌ সুন্নত নয়, এমন একটি কাজকে সুন্নত বানিয়ে নেয়া, এমনকি ফরযের মতো অনিবর্য করে নেয়াটা কি যুক্তিসংগত হতে পারে?]

এভাবে যেকোনো সময় দু’আ করা যায়। এভাবে আল্লাহর স্মরণ এবং রসূল (ﷺ) এর প্রতি সালাম (দরূদ) পাঠের পর দু’আ করলে সে দু’আও কবুল হয়। ফযালা ইবনে ওবায়েদ বর্ণিত হাদিস থেকে এটা বুঝা যায়। কিন্তু নামাযের বাইরের দু’আকে নামাযের সাথে যুক্ত করা ঠিক নয়।

জুতা পরে এবং এক কাপড়ে নামায পড়া

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো কখনো খালি পায়ে নামায পড়তেন, আবার কখনো কখনো জুতা পরে নামায পড়তেন। (আবু দাউদ)

ইহুদীদের বিপরীত করার জন্যে তিনি জুতা পরে নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: তোমরা ইহুদীদের বিপরীত করো, তারা জুতা ও চামড়ার মোজা পরে নামায পড়েনা। (আবু দাউদ)

তিনি বলেছেন তোমাদের কেউ যখন নামায পড়বে, সে যেনো জুতা পড়ে থাকে। তবে খুলতে চাইলে খুলে যেনো তা দুই পায়ের মাঝখানে রাখে। [আবু দাউদ, ইবনে খুযাইমা এবং হাকিম সহীহ সূত্রে আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে নামায পড়ছিলেন। নামাযের মধ্যেই তিনি নিজের জুতা খুলে বাম পাশে রাখেন। এটা দেখে মুক্তাদিরাও সবাই নিজ নিজ জুতা খুলে ফেলে। নামায শেষ করে তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন : তোমরা কোন জুতা খুললে? আমরা বললাম: আপনাকে খুলতে দেখে আমরাও জুতা খুলে রেখেছি। তখন তিনি বললেন, জিবরিল এসে খবর দিয়েছেন: আমার জুতায় অপবিত্রতা আছে। সে জন্যে আমি জুতা খুলে রেখেছি। তোমরা মসজিদে এলে নিজ নিজ জুতা দেখে নিয়ো- তাতে কোনো অপবিত্রতা আছে কিনা? যদি ময়লা কিছু থাকে, তা মুছে ফেলবে এবং জুতা পরেই নামায পড়বে।”] যেখানে সেখানে জুতা রেখে কাউকে কষ্ট না দেয়।” (আবু দাউদ)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো কখনো এক কাপড়ে নামায পড়তেন। আবার কখনো কখনো দুটি কাপড় পড়ে নামায পড়তেন। তবে দুই কাপড়ে করেই বেশিরভাগ পড়তেন। [মুসানাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, কাপড়ের অভাব থাকার কারণেই রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কখনো কখনো এক কাপড়ে নামায পড়া হতো। সচ্ছলতার সময় দুই কাপড়ে নামায পড়াই উত্তম।]

নামাযে তাঁর আনন্দ, প্রশান্তি, বিনয় ও কান্না

-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন, মাথা কিছুটা ঝুঁকিয়ে আনত করে রাখতেন।

-নামায রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর চোখ জুড়াতো। নামাযের মাধ্যেমেই তিনি আনন্দ ও প্রশান্তি অনুভব করতেন। তিনি বলতেন: (আরবী *********) অর্থ: নামাযে আমার চোখ জুড়ায়। নামাযের মধ্যে আমি আনন্দ ও প্রশান্তি লাভ করি।”

তিনি বিলালকে উদ্দেশ্য করে বলতেন: (আরবী*********)

অর্থ: বিলাল। নামাযে ডেকে আমার হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে দাও।”

-তিনি বলছেন, নামাযে একটা মনোযোগ, ধ্যান, মগ্নতা ও তন্ময়তা আমাকে ঘিরে রাখে।” (বুখারী, মুসলিম)

– রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রায়ই নামাযে কাঁদতেন। কান্নায় তাঁর বুকের ভেতর গুমগুম আওয়ায হতো। সাহাবীগণ নামাযে তাঁর কান্না শুনতেন। (আহমদ, নাসায়ী, আবু দাউদ)

-গোটা নামাযের বিভিন্ন স্থানে বার বার তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। গুনাহের জন্যে মাফি চাইতেন। দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় অকল্যাণ থেকে ত্রাণ প্রার্থনা করতেন। দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় মংগল কামনা করতেন। এভাবে পুরো নামাযে আল্লাহর সাথে মুনাজাত (একান্ত আবেদন নিবেদন) করতে থাকেতেন।

-নিশি রাতে গোটা দুনিয়া যখন ঘুমাতো, তখন তিনি প্রভুর সান্নিধ্যে হাযির হতেন নামাযের মাধ্যমে।

-প্রভুর শোকর আদায়ের জন্যে তিনি নামায পড়তেন।

-বিপদের সময় তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।

-যুদ্ধের ময়দানে তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।

-প্রভুর সাহায্য প্রার্থনার জন্যে তিনি সাজদায় লুটিয়ে পড়তেন।

নামাযে তাঁর সতর্কতা

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযে নিজের হৃদয় –মনকে পুরোপুরিভাবে আল্লাহ তা’আলার প্রতি নিবিষ্ট করতেন, নিজেকে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে উপস্থিত করতেন এবং আল্লাহ তা’আলার প্রতি পূর্ণংগ মনোসংযোগ স্থাপন করতেন। কিন্তু এতদসত্বেও তিনি নামাযের মধ্যে পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করতেন। মুসল্লিদের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখতেন। এখানে সহীহ সূত্রে বর্ণিত এ ধরনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো:

১. তিনি নামাযকে দীর্ঘ করতেন। কিরাত দীর্ঘ করতেন। সে অনুযায়ী রুকু সাজদাও দীর্ঘ করতেন। কিন্তু যখনই নামাযের মধ্যে কোনো শিশুর কন্না শুনতেন, তখন তাঁর সাথে নামাযরত শিশুর মায়ের মনের অবস্থা বিবেচনা করে নামায সংক্ষেপ করে দ্রুত শেষ করে দিতেন।

২. কোনো এক যুদ্ধে তিনি একজন অশ্বারোহীকে একটি তথ্য সংগ্রহ করে আনার জন্যে পাঠান। তাকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি নামাযে দাঁড়ান। নামাযরত অবস্থায় তিনি তাঁর প্রেরিত সেই অশ্বারোহীর আগমণ পথে তাকাচ্ছিলেন। নামাযরত অবস্থায়ও তিনি তাঁর প্রেরিত অশ্বারোহীর ব্যাপারে অসতর্ক হননি।

৩. একবার তিনি নাতনী উমামা বিনতে আবিল আস (তার কোনো একজন কন্যার মেয়ে) কে ঘাড়ে নিয়ে ফরয নামায পড়ান। রুকু ও সাজদায় গেলে ওকে নামিয়ে পাশে বসিয়ে রাখতেন। সাজদা থেকে দাড়াবার সময় আবার ঘাড়ে উঠিয়ে নিতেন। (বুখারী ও মুসলিম)

৪. কখনো কখনো তিনি সাজদায় গেলে তাঁর নাতি হাসান বা হুসাইন এসে তাঁর পিঠে বসতো। ওর পড়ে যাবার আশংকায় তখন তিনি সাজদা দীর্ঘ করতেন।

৫. কখনো এমন হতো যে, তিনি নামায পড়ছেন, ঘরের দরজা বন্ধ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এসে দরজায় কড়া নাড়ছেন। তিনি নামাযরত অবস্থায় গিয়ে আয়েশাকে দরজা খুলে দিন এবং ফিরে এসে নামাযের বাকি অংশ শেষ করেন। (আহমদ, তিনমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী)

৬. তাঁর নামায পড়া অবস্থায় যদি কেউ তাঁকে সালাম দিতো, তিনি হাতে ইশারা করে তার সালামের জবাব দিতেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, জাবির রা. বলেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে কোনো একটি কাজে পাঠান। আমি ফিরে এসে দেখি তিনি নামায পড়ছেন। নামাযরত অবস্থায়ই আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি ইশারা করে আমার সালামের জবাব দিলেন।

আনাস রা. বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযরত অবস্থায় ইশারা-ইংগিত করতেন। (মুসনাদে আহমদ)

সুনান গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে, সুহাইব রা. বলেন, একবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায পড়ছিলেন। এসময় আমি তাঁর নিকট দিয়ে যাবার সময় তাঁকে সালাম করলাম। তিনি ইশারায় আমার সালামের জবাব দেন।

একবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) কুবায় এলেন। তিনি কুবায় মসজিদে নামায পড়ছিলেন এমন সময় একদল আনসার সাহাবী এলেন। তারা নামাযরত অবস্থায়ই তাকে সালাম দিলেন। তিনি ইশারা করে তাদের সালামের জবাব দেন।

ইমাম তিরমিযি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর সূত্রে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন এটি সহীহ হাদিস।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেছেন, আমি হাবশা থেকে প্রত্যাবর্তন করে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এরসাথে সাক্ষাত করতে এলাম। এসে দেখি তিনি নামায পড়ছেন। এ অবস্থায় আমি তাঁকে সালাম দিই। তিনি মাথায় ইশারা করে আমার সালামের জবাব দেন। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন বায়হাকি।

নামাযে ইশারা করার ক্ষেত্রে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস বিরোধ সৃষ্টি করে। হাদিসটি আবু গাতফান আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে ব্যক্তি নামাযে বোধগম্য ইশারা করবে, সে যেনো পূণরায় নামায পড়ে নেয়।”

ইমাম দারু কুতনি বলেছেন, এটি বাতিল হাদিস-এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ইমাম আবু দাউদ আমাকে বলেছেন: এই হাদিসের বর্ণনাকারী আবু গাতফান একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি। তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করা যায়না। অপরদিকে এ হাদিসটি এ সংক্রান্ত সহীহ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক। হযরত আনাস এবং হযরত জাবির প্রমুখ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযরত অবস্থায় ইশারা ইংগিত করতেন।

৭. রসূলুল্লাহ (ﷺ) (রাত্রে) যখন ঘরে নামায পড়তেন, আয়েশা রা. তাঁর সাজদার জায়গায় আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে থাকতেন। তিনি যখন সাজদায় যেতেন, আয়েশাকে সরে যাবার জন্যে তার গায়ে টিপ দিতেন, বা চিতটি কাটতেন। তখন আয়েশা রা. পূণরায় পা বিছিয়ে দিতেন। (বুখারী)

৮. একবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায পড়ছিলেন। এমন সময় শয়তান আসে তাঁর নামাযে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্যে। তিনি শয়তানের গলা চেপে ধরেন, এমনকি এতে শয়তানের লালা বা জিহ্বা বেরিয়ে তাঁর হাতে লাগে। (মুসনাদে আহমদ, দারু কুতনি)

৯. তিনি কখনো কখনো মিম্বারে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন। সেখানেই রুকু করতেন। সাজদার সময় মিম্ব থেকে নেমে পেছনে সরে এসে যমীনের উপর সাজদা করতেন। সাজদা শেষ হলে আবার মিম্বরে গিয়ে দাঁড়াতেন। (বুখারী, মুসলিম)

১০. তিনি একবার একটি দেয়ালকে সামনে রেখে নামায পড়ছিলেন। এসময় একটি চতুষ্পদ জানোয়ার (কুকুর) তাঁর সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে উদ্যত হয়। তিনি সামনে এগিয়ে জানোয়ারটির পেট দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে দেন। ফলে জানোয়ারটি তাঁর পিছে দিয়ে পথ অতিক্রম করতে বাধ্য হয়। (তাবরানি, হাকিম, ইবনু খুযাইমা)

১১. একবার তিনি নামায পড়ছিলেন। এসময় বনি আবদুল মুত্তালিবের দুটি বালিকা হাতাহাতি করতে করতে তাঁর সামনে এসে পড়ে। তিনি নামাযরত অবস্থায়ই ওদের ধরেন এবং একজনকে আরেকজন থেকে ছাড়িয়ে দেন। ইমাম আহমদের বর্ণনায় একথাও আছে যে, মেয়ে দুটি নবী করীম (ﷺ) এর হাঁটু আকড়ে ধরলো। অতপর তিনি তাদের ছাড়িয়ে দেন, কিংবা থামিয়ে দেন। কিন্তু নামায অব্যাহত রাখেন।

১২. একবার তিনি নামাযে দাঁড়ালে একটি বালক তাঁর সামনে দিয়ে যেতে উদ্যত হয়। তিনি তাকে হাতে ইশারা করে ফিরে যেতে বললে সে ফিরে যায়। (মুসনাদে আহমদ)

১৩. আরেকবার তিনি নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একটি বালিকা তাঁর সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিল। তিনি তাকে হাতে ইশারা করলে সে ফিরে যায়। (সুনান গ্রন্থাবলী)

১৪. তিনি কখনো কখনো নামাযরত অবস্থায় সাজদায় জায়গায় ফুঁক দিতেন। অবশ্য ফুঁক দেয়ার হাদিসটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। যদিও হাদিসটি মুসনাদে আহমদ ও সুনান গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ হয়েছে। এটি মূলত রসূল (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়ে আসেনি।

১৫. তিনি নামাযে কাঁদতেন।

১৬. তিনি নামাযে গলা ঝেড়ে নিতেন। গলা ঝেড়ে ইশারাও করতেন। আলী রা. বলেন আমি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় দুবার রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে যেতাম। আমি দিয়ে ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইতাম। আমার আগমনের সময় কখনো তিনি নামাযরত থাকতেন। এ সময় তিনি গলা ঝেড়ে আমাকে প্রবেশের অনুমতি দিতেন। (সুনানে নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ)

ইমাম আহমদও নামাযে গলা ঝাড়তেন এবং এটাকে তিনি নামায বিনষ্টকারী মনে করতেন না।

এভাবে নামাযে গভীর তন্ময়তা ও আল্লাহমুখীতা সত্ত্বেও তিনি অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করতেন এবং এগুলোকে নামায বিনষ্টকারী মনে করতেন না।

ফরয নামাযে দু’আ কুনূত (বা কুনূতে নাযেলা)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) একমাস অনবরত যুহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ফজর নামাযে দু’আ কুনূত পড়েছেন। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)

কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, তিনি ফজর নামাযে একমাস দু’আ কুনূত পড়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে তিনি মাগরিব নামাযে দু’আ কুনূত পড়েছেন। মূলত উপরের হাদীসটিই সঠিক। আসলে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেই দু’আ কুনূত পড়েছেন।

-তিনি সব সময় দু’আ কুনূত পড়েননি।

-তিনি বিপদকালে দু’আ কুনূত পড়েছেন।

-দু’আ কুনুত তিনি কারো জন্যে দু’আ এবং কারো জন্যে বদ দু’আ করতেন।

তিনি যে নামাযে দুআ কুনুত পড়তেন, সে নামাযের শেষ রাকাতে সামিয়াল্লাহু লিমান আমিদাহ” বলে ‍রুকু থেকে দাড়িয়ে দুআ কুনূত পড়তেন। দু’আ কুনূত পড়ার পর সরাসরি সাজদায় চলে যেতেন। তিনি দু’আ কুনূত এবং সাজদার মাঝখানে অন্যকিছু করতেন না।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন দু’আ কুনূত পড়তেন, তখন মুক্তাদিগণ আমীন বলতেন।

সহীহ বুখারি সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: রসূলুল্লাহু (ﷺ) যখন কারো জন্যে দু’আ কিংবা কারো জন্যে বদ দুআ করতে চাইতেন, তখণ রুকূর পরে দুআ কুনূত পড়তেন। রুকূর পরে সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ রাব্বানা লাকাল হামদ” বলার পর কিছুদিন তিনি এই দুয়া করেছেন: (আরবী********************)

অর্থ: হে আল্লাহ! অলীদ, সালামা বিন হিশাম এবং আইরাশ বিন আবি রবিআ’কে রক্ষা কারো। হে আল্লাহ! তুমি মুদার সম্প্রদায়কে শক্ত করে পাকড়াও করো এবং তাদের উপর ইউসূফ (আঃ) এর কওমের মতো বছরের পর বছর দুর্ভীক্ষ দাও।”

আবু দাউদ এবং মুসনাদে আহমেদ ইবনে আব্বাস রা. থেকে যে বর্ণনা উল্লেখ হয়েছে, তিনি কখনো কখনো দু’আ কুনূত এই বলে বদ দু’আ করতেন: (আরবী*******************)

অর্থ: হে আল্লাহ! লিহইয়ান, রা’ল, যাকওয়ান এবং আ’সিয়্যা সম্প্রদায়ের উপর অভিশাপ নাযিল করো। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানি করেছে।”

আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন, রসূল (ﷺ) এর সাধারণ রীতি ছিলো, যখন বিপদাপদ দেখা দিতো, তখনই দু’আ কুনূত (কুনূতে নাযেলা) পড়তেন। বিপদাপদ দূর হয়ে গেলে পড়া ছেড়ে দিতেন। তিনি শুধু ফজর নামাযেই দু’আ কুনূত পড়াটা নির্দিষ্ট করেননি, অন্যান্য নামাযেও পড়তেন। তবে ফজর নামাযেই বেশি পড়তেন।

মহাদ্দিসগণ বিপদে আপদে দু’আ কুনূত পড়া মুস্তাহাব মনে করেন। অবশ্য হাদিস সম্পর্কে তাঁরাই বেশি ওয়াকিফহাল। তাঁদের মতে কুনূত পড়া এবং ছেড়ে দেয়া দুটোই সুন্নত। তারা মনে করেন, পড়াটাও ভালো, না পড়াটাও ভালো। কারণ রসূল (ﷺ) পড়েছেন বলেও হাদিসে আছে, আবার ত্যাগ করেছেন বলেও হাদিসে আছে।

ইমাম যদি মুক্তাদিদের জানিয়ে বা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে দু’আ কুনূত শব্দ করে পড়ে, তবে তাতে দোষ নেই। উমর রা. মুক্তাদিদের স্মরণ কারিয়ে দেবার জন্যে শুরুটা শব্দ করে পড়তেন। ইবনে আব্বাস রা. জানাযায় সূরা ফাতিহা শব্দ করে পড়তেন, যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, জানাযায় সূরা ফাতিহা পড়া সুন্নত।

ইমামের সশব্দে আমীন বলাটাও এরকমই একটি ব্যাপার। আসলে এগুলো সেইসব মতভেদ (ইখতিলাফ), যেগুলোর উভয়টা করাই মুবাহ (বৈধ), কিংবা করা বা না করা উভয়টাই মুবাহ। যেমন নামাযে রফে ইয়াদাইন করা এবং ত্যাগ করা উভয়টাই বৈধ। যেমন, বিভিন্ন প্রকারের তাশাহুদের যে কোনোটি পড়াই বৈধ। যেমন বিভিন্ন আযান ও ইকামতের যে কোনোটি অবলম্বন করাই বৈধ।

কিন্তু, এখানে বৈধ অবৈধ আলোচনা করাটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য তো কেবল রসূল (ﷺ) কী করতেন, কিভাবে করতেন তা উল্লেখ করা। কারণ তিনি আমাদের নমুনা মাপকাঠি। এ গ্রন্থে আমরা কেবল তাঁর রীতি ও নীতিই অনুসন্ধান করে প্রকাশ করতে চাই। তিনিই তো পূর্ণাংগ পথ প্রদর্শক। তিনিই আমাদের অনুকরণীয়, অনুসরণীয়।

ফরয নামাযে দু‘আ কুনূত পড়ার ব্যাপারে যেসব হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে, সেগুলোর সারকথা প্রকাশ হয়েছে ইসলামের একজন বিজ্ঞ আলিমের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে সঠিক কথা হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুনূত নাযেলা (দু‘আ কুনূত) কেবল কোনো কওম বা ব্যক্তির জন্যে দু‘আ করা কিংবা বদ দুআ করার জন্যেই পড়েছেন। তারপর যখন তাঁর দুআর ফল দেখা গেছে, তখন তিনি তা ত্যাগ করেন। তাছাড়া তিনি দুআ কুনূত শব্দ করেও পড়েছেন, আবার নি:শব্দেও পড়েছেন। তিনি দুআ কুনূত পড়েছেন আবার তা পড়া ত্যাগও করেছেন। শব্দ করে পড়ার চাইতে বেশিদিন পড়েননি। কুনূতের ব্যাপারে এই ছিলো তাঁর রীতি। তাছাড়া ফরয নামাযে তিনি রুকু থেকে দাঁড়িয়েই দুআ কুনূত পড়তেন। এটাই প্রমাণিত।

সাহু সাজদা (ভুলের সাজদা)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তোমাদের যেমন ভূল হয়, আমারও ভূল হয়। আমি কোনো কিছু ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।” (বুখারী)

নামাযে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ভুল হওয়াটা তাঁর উম্মতের জন্যে আল্লাহর নি‘আমতের পূর্ণতা। এভাবেই আল্লাহ পাক তাদের জন্যে তাদের দীনকে পূর্ণ করেছেন। কারণ এ প্রক্রিয়াতেই তারা জানতে পেরেছে- নামাযে ভুল হলে তাদের করণীয় কী?

মুআত্তায়ে মালিকে একটি সূত্রবিচ্ছিন্ন হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এই বাণীটি উল্লেখ হয়েছে: আমি ভুলে যাই কিংবা আমাকে ভুলানো হয়, যাতে করে আমি সে বিষয়ে (লোকদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে এবং ব্যাখ্যা দিয়ে) তাদেরকে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিতে পারি“

আসলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মাঝে মধ্যে ভুলে যাবার কারনেই শরীয়তে ভুলের বিধান তৈরি হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে বুহাইনা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন তাঁদের সাথে নিয়ে যুহর নামায পড়েন। এ সময় তিনি প্রথম দুই রাকাতের পর না বসেই দাঁড়িয়ে যান। মুক্তাদিরাও তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে যায়। এভাবে নামায শেষ প্রান্তে এসে পৌছলো, লোকেরা সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করছিল। ঠিক এমনি সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (শেষ তাশাহহুদের এই বসা অবস্থাতেই) সালাম ফিরানোর পূর্বে ‘আল্লাহ আকবার‘ বলে দুটি সাজদা করেন। অতপর সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করেন। (বুখারী-মুসলিম)

এ থেকে এই নিয়ম জানা গেলো যে, কেউ যদি নামাযের আরকান (ফরয) ছাড়া অন্য কোনো অংশ ভুলবশত ছেড়ে দেয়, তবে তাকে সালামের পূর্বে ভুলের সাজদা করতে হবে।

এভাবে ভুলবশত নামাযের কোনো অংগ ছাড়া পড়লে তিনি আবার সেটা সম্পন্ন করার জন্যে প্রত্যাবর্তন করতেন না। যেমন একবার তিনি ভুলবশত প্রথম তাশাহুদের বৈঠক ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। লোকেরা পেছন থেকে সুবহানাল্লাহ‘ বলা সত্ত্বেও তিনি না বসে দাঁড়ায়ে যেতে ইংগিত করেন।

ইয়াযীদ ইবনে হারূণ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একবার মুগীরা ইবনে শু‘বা রা. আমাদের নামায পড়ান। দু‘রাকাত পড়ার পর তিনি না বসে দাড়িয়ে গেলেন। মুক্তাদিরা সুবহানাল্লাহ বললো। কিন্তু তিনি তাদের ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। অতপর নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন। তারপর দুটি সাজদা করলেন। অতপর আবার সালাম ফিরালেন। শেষে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমনটিই করতেন। হাদিসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে। তিরমিযি বলেছেন এটি সহীহ হাদিস।

ভুলের সাজদা সালাম ফিরানোর আগে না পরে এ বিষয়ে হাদিসের মধ্যে কিছুটা বিরোধ দেখা যায়। আবদুল্লাহ ইবনে বুহাইনার হাদিসে থেকে জানা যায় সালাম ফিরানোর পূর্বে। মুগীরার হাদিস থেকে জানা যায় সালাম ফিরানোর পরে। আসলে বিভিন্ন যক্তিসংগত করণে আবদুল্লাহ ইবনে বুহাইনা বর্ণিত হাদিসটিই অধিকতর সঠিক। তবে উভয় পদ্ধতিই সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাই যে কোনো একটি পদ্ধতিই অবলম্বন করা যেতে পারে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে নামাযে কয়েক ধরনের ভুল সম্পর্কে জানা যায়। যেমন-

১. একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইশা, যুহর, কিংবা আসর নামায দুই রাকাত পড়েই সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। সালাম ফিরাবার পূর্ণ করেন। তারপর সালাম ও কলামের পর দুটি সাজদা করেন। প্রতিটি সাজদায় যাওয়া ও উঠার সময় আল্লাহু আকবার বলেন।

২. আবু দাউদ ও তিরমিযিতে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) লোকদের নামায পড়ালেন, নামাযে ভুল করলেন, তারপর দুটি সাহু সাজদা করলেন। অতপর তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরান। ইমাম তিরমিযি বলেছেন এই হাদিসটি হাসান ও গরীব।

৩. একদিন তিনি চার রাকাতের তিন রাকাত নামায পড়িয়ে মুক্তাদিদের দিকে ফিরলেন। তখন তালহা বিন উবায়দুল্লাহ রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বলেন, আপনি নামায তিন রাকাত পড়েছেন, এক রাকাত পড়তে ভুলে গেছেন। তখন তিনি বিলালকে ইকামত দিতে নির্দেশ দেন। বিলাল ইকামত দেন। তিনি লোকদের আবার নামায পড়ান। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ।

৪. একদিন তিনি যুহরের নামায পাঁচ রাকাত পড়ালেন। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো- যুহরের নামায কি এক রাকাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে? তিনি বললেন, সেটা আবার কি? তখন তারা বললেন, আপনি আজ পাঁচ রাকাত পড়েছেন। একথা শুনে তিনি (সালাম ফিরাবার পর দুটি সাজদা করেন। (বুখারী ও মুসলিম)

৫. একদিন তিনি আসর নামায তিন রাকাত পড়িয়ে ঘরে চলে গেলেন। তখন খিরবাক নামক যুল ইয়াদাইন (লম্বা হাতওয়ালা) একজন লোক তাঁর পিছে পিছে গিয়ে তাঁকে বিষয়টি খুলে বললো। তার কথা শুনে তিনি রাগান্বিত হয়ে চাদর টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন এর কথা কি ঠিক? তারা বললেন, জী-হ্যা। তখন তিনি বাকি এক রাকাত পড়িয়ে সালাম ফিরালেন। তারপর দুটি (সাহু) সাজদা করলেন এবং পুনরায় সালাম ফিরালেন। (সহীহ মুসলিম)

নামাযে ভুল এবং ভুলের সাজদা সম্পর্কে রসূল (ﷺ) থেকে সর্বমোট এই পাঁচ প্রকার পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

তিনি ভুলের সাজদা সালামের আগেও করেছেন, পরেও করেছেন। এ ব্যাপারে ইমামগণের মতামত নিম্নরূপ:

১. ইমাম শাফেয়ী (র) এর মতে সব ধরনের ভুলের সাজদা সালামের পূর্বে করতে হবে।

২. ইমাম আবু হানীফা (র) এর মতে সব ধরনের ভুলের সাজদা সালামের পরে করতে হবে।

৩. ইমাম মালিক (র) বলেছেন, ভুলবশত নামাযে কোনো কিছু কম করার ক্ষেত্রে সাহু সাজদা সালাম ফিরাবার আগে করতে হবে। ভুলবশত নামাযে কোনো কিছু বেশি পড়লে ভুলের সাজদা সালাম ফিরানোর পরে করতে হবে। আর একই নামাযে যদি উভয় প্রকার ভুল হয়ে যায়, তবে সাহু সাজদা সালাম ফিরানোর আগে করতে হবে। আবু উমর বলেছেন, এটাই ইমাম মালিকের মযহাব। তবে কেউ যদি তাঁর মতের ব্যতিক্রম করতো, তবে তাতেও তিনি নিষেধ করতেননা। কারণ, তাঁর মতে এ বিষয়ে মতভেদ করার অবকাশ রয়েছে।

৪. এ বিষয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মত কি? সে সম্পর্কে আছরম বলেন আমি শুনেছি ইমাম আহমদ (র) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ভুলের সাজদা সালাম ফিরানোর আগে, নাকি পরে? জবাবে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সালামের পূর্বে, আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সালামের পরে। রসূলুল্লাহ (ﷺ) এমনই করেছেন।

৫. ইমাম দাউদ (যাহেরি) বলেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যে পাঁচটি ক্ষেত্রে সাহু সাজদা করেছেন, কেউ যেনো সে পাঁচটি ক্ষেত্রে অন্য কারণে সাহু সাজদা না করে।

সন্দেহের সাজদা

নামাযের ভিতরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হলে রসূল (ﷺ) ফিরে নামায পড়েননি। তিনি বলেছেন, সন্দেহের ক্ষেত্রে বিশ্বাস যেদিকে প্রবল হবে, সে অনুসারে নামায শেষ করে সালাম ফিরানোর আগে সাজদা করে নেবে এবং সন্দেহ ত্যাগ করবে।

আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন : তোমাদের কেউ যখন নামাযের মধ্যে সংশয়ে পড়ে যায় এবং কয় রাকাত পড়েছে, তিন রাকাত না চার রাকাত, তা স্থির করতে না পারে, তখন সে যেনো সন্দেহ পরিত্যাগ করে এবং বিশ্বাস যেদিকে পবল হয়, সেটাকেই যেনো ভিত্তি বানায় (গ্রহণ করে)। অতপর সে সালাম ফিরাবার পূর্বে দুটি সাজদা করে নেবে। (সহীহ মুসলিম)

ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে: তোমাদের কেউ যখন নামাযের মধ্যে সংশয়ে পড়ে যাবে তখন সে যেনো কোনো একটিকে সঠিক ধরে নিয়ে নামায পড়ে নেয় এবং সালাম ফিরানোর পূর্বে দুটি সাজদা করে নেয়। (বুখারী, মুসলিম)। একটি বর্ণনায় একথাও উল্লেখ আছে অতপর সে যেনো সালাম ফিরায় এবং তারপর দুটি সাজদা করে নেয়।

ইমাম আহমদ (র) বলেছেন : সন্দেহ দুই প্রকার। একটি হলো তাহাররী (প্রবল ধারণা), আর অপরটি হলো একীন (নিশ্চিত বিশ্বাসের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ)। ইমাম আহমদের মতে তাহাররীর ক্ষেত্রে মুসল্লি সালামের পরে সাজদা করবে, আর একীনের ক্ষেত্রে সালামের পূর্বে সাজদা করবে।

ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম মালিক (র) বলেছেন কেউ যদি নামাযের মধ্যে সন্দেহে পড়ে, তবে সে যেনো সন্দেহে ডুবে না থাকে, বরং যেনো একটি ধারণার উপর একীন স্থাপন করে। ইমাম আহমদেরও একটি মত এটাই।

ইমাম আবু হানীফা (র) বলেছেন : কেউ যদি নামাযের মধ্যে সংশয়ে পড়ে, আর এই সংশয় যদি প্রথমবারের মতো হয়, তবে সে যেনো দ্বিতীয়বার নামায পড়ে নেয়। কিন্তু সে যদি প্রায়ই সন্দেহে পড়ে, তবে সে যেনো ‘প্রবল ধারণা‘ অথবা একীনের ভিত্তিতে নামায অব্যাহত রাখে।

নামাযে চোখ বন্ধ করা

চোখ বন্ধ করে নামায পড়া রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নীতি ছিলনা। সহীহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, তাশাহুদের দুআ পড়ার সময় রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাতের শাহাদাত আংগুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সে দৃষ্টি আংগুলের বাইরে যেতোনা।

-সহীহ বুখারিতে আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা রা. এর একটি বিশেষ ধরণের পর্দা ছিলো। তিনি সেটিকে ঘরের এক দিকে টানিয়ে রেখেছিলেন। রসূল (ﷺ) আয়েশাকে সেটা সরিয়ে ফেলতে বলেন। আরো বলেন: পর্দাটিতে অংকিত ছবি নামায থেকে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

-তিনি যদি নামাযে চোখ বন্ধ করে রাখতেন, তবে পর্দার চিত্রিত ছবি কেমন করে তাঁর চোখে বাধতো?

-অবশ্য এ হাদিস দ্বারা নামাযে চোখ বন্ধ করা না জায়েয বলে প্রমাণিত হয় না।

ফকীহগণ নামাযে চোখ বন্ধ করার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। ইমাম আহমদ প্রমুখ নামাযে চোখ বন্ধ করাকে মাকরূহ বলেছেন। তাঁদের মতে এটা ইহুদীদের কাজ।

কিন্তু অন্যরা নামাযে চোখ বন্ধ করাকে বৈধ মনে করেন। তাঁদের মতে চোখ বন্ধ করার মধ্যেমে নামাযে খুশূ-খুযূ অর্জন এবং আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করাটা সহজ হয়। আর এটাই হলো নামাযের প্রাণ এবং উদ্দেশ্য।

এ ব্যাপারে সঠিক কথা হলো, নামাযে চোখ খোলা রেখে যদি খুশূ-খুযূ এবং মনোনংযোগ ঠিক রাখা যায়, তবে খোলা রাখাই উত্তম। আর যদি খোলা রাখলে বিভিন্ন দৃশ্যের কারণে মনস্থির ও খুশূ-খুযূ সৃষ্টি না হয়, তবে চোখ বন্ধ করাটা অবশ্যি দোষনীয় নয়। বরং শরীয়তের মূল নীতি অনুযায়ী এ ধরনের অবস্থায় চোখ বন্ধ রাখাটাই উত্তম ও পছন্দনীয়।

সুতরা (আড়াল)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন কোনো কিছুর সামনে দাঁড়াতেন, অথবা সামনে কিছু দাঁড় করিয়ে দিতেন, কিংবা অন্তত সামনে একটা রেখা এঁকে দিতেন। তিনি নামাযের সামনে আড়াল সৃষ্টিকারী (সুতরা) কিছু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি কখনো দেয়াল সামনে রেখে নামায পড়েছেন। তখন তাঁর সাজদা ও দেয়ালের মাঝখান দিয়ে একটি বকরী বা ভেড়া পার হবার জায়গায় থাকতো মাত্র। তাঁর ও সুতরার মাঝে এর চাইতে বেশি দূরত্ব থাকতোনা। বরং তিনি সুতরার নিকটবর্তী দাঁড়াবার নির্দেশ দিয়েছেন।

কখনো তিনি খাট, কাঠ, গাছ, কিংবা মসজিদের খুঁটিকে সামনে রেখে নামায পড়েছেন।

যখন যুদ্ধের সফরে থাকতেন, কিংবা কোনো খোলা মাঠে নামায পড়তেন, তখন সামনে হাতিয়ার গেড়ে সেটাকে সুতরা বানিয়ে নামায পড়তেন এবং লোকেরা তাঁর পেছনে নামায পড়তো।

কখনো বাহন রেখে নামায পড়েছেন, বাহনকেই সুতরা বানিয়েছেন। কখনো কখনো সোয়ারীর আসনকে সুতরা বানিয়েছেন।

তিনি মুসল্লিদের নির্দেশ দিয়েছেন, কোনো আড়াল পাওয়া না গেলে অন্তত তীর বা লাঠি সামনে পুতে নিয়ে সেটাকে সুতরা বানিয়ে যেনো তারা নামায পড়ে। তীর বা লাঠিও পাওয়া না গেলে অন্তত সামনে মাটিতে যেনো একটি রেখা এঁকে নেয়। [বুখারী, মুসলিম ও সহীহ ইবনে খুযাইমা গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, কেউ সামনে সুতরা (আড়াল) রেখে নামায পড়া সত্বেও যদি কোনো লোক তার নামাযের সামনে দিয়ে অর্থাৎ আড়ালের ভিতর দিক দিয়ে অতিক্রম করতে উদ্যত হয়, তবে নামাযী যেনো বুক দিয়ে তকে প্রতিরোধ করে।” কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে : তাকে যেনো সাধ্যমতো প্রতিহত করে।” অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে : তাকে যেনো (ইশারায়) দুইবার নিষেধ করে। এতেও যদি সে না মানে, তবে তার সাথে লড়তে হবে‘ কারণ সে শয়তান।

বুখারি, মুসলিম ও সহীহ খুযাইমা গ্রন্থে আরো উল্লেখ হয়েছে : নামাযীর সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী যদি জানতো এর পরিণতি কতো ভায়াবহ তবে সে নামাযীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করার চাইতে চল্লিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করাকেও উত্তম মনে করতো।

এখানে চল্লিশ পর্যন্ত মানে চল্লিশ দিন, বা চল্লিশ বছর অথবা চল্লিশ ওয়াক্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা।]

আবু দাউদ বলেন, আমি আহমদ ইবনে হাম্বলকে বলতে শুনেছি, মাটিতে রেখা আঁকলে সেটা নতুন চাঁদের মতো আড়াআড়ি আকবে। আবদুল্লাহ বলেছেন, লম্বালম্বি আঁকবে। আর লাঠি গাড়লে সেটা খাড়া করে গাড়বে।

সুতরা না থাকলে কি নামায ভংগ হবে?

যদি নামাযীর সামনে সুতরা না থাকে, তাবে এমনতবন্থায় নামাযের সমানে দিয়ে বালেগা নারী, গাধা ও কালো কুকুর অতিক্রম করলে নামায ভংগ হবে বলে সহীহ সূত্রে জানা যায়। এ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন আবু যর, আবু হুরাইরা, ইবনে আব্বাস এবং আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

অবশ্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা উপরোক্ত মতের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেছেন, তিনি রসূল (ﷺ) এর সাজদার জায়গায় আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে থাকতেন। রসূল (ﷺ) সাজদা করার সময় তার পায়ে চিমটি কাটতেন, তখন তিনি পা গুটিয়ে নিতেন। তিনি সাজদা থেকে উঠে দাঁড়ালে আয়েশা রা. আবার পা ছড়িয়ে দিতেন।

এই উভয় ধরনের বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য হলো, অতিক্রম করা আর অবস্থান করার। প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন।

সালাম ফিরিয়ে রসূল (ﷺ) কী করতেন? কী পড়তেন?

(ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পর রসূলুল্লাহ (ﷺ) কী করতেন, কীভাবে বসতেন? কী পাঠ করতেন এবং কী কী যিকর-আযকার করতেন এ পর্যায়ে সেসব কথাই আলোচনা করা হবে।

সহীহ মুসলিমে আয়েশা ও সাওবান রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতেন, তখন তিনবার استغفر الله (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষামা চাই) বলতেন। [সহীহ বুখারি ও মুসলিমে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত : আমরা রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামাযের সমাপ্তি বুঝতে পারতাম তাঁর তাকবীর উচ্চারণ করা থেকে।

অর্থাৎ রসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাম ফিরানোর পর উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবার বলতেন।

সুতরাং হাদিস অনুযায়ী প্রথমে একবার আল্লাহু আকবার উচ্চরণ করে তারপর তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়গা সঠিক বলে মনে হয়। এ পরই আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম…… পড়া উচিত।] তারপর বলতেন : (আরবী***********)

অর্থ হে আল্লাহ! শান্তির উত্স তুমি, তোমার থেকেই আসে শান্তি। হে প্রতাপশালী মহা মর্যাদার অধিকারী। তুমি বড়ই বরকতময়-প্রাচুর্যশালী।”

সালাম ফিরানোর পর এই কথাগুলো বলতে যতোটুকু সময় ব্যয় হতো, কেবল ততোটুকু সময়ই তিনি কিবলামুখী থাকতেন। এ ব্যক্যটি পাঠ করার পর তিনি উঠে যেতেন, অথবা মুক্তাদিদের দিকে ফিরে বসতেন। কখনো ডানদিকে থেকে, কখনো কখনো বামদিক থেকে মুক্তাদিদের দিকে ঘুরে বসতেন। বুখারি ও মুসলিম ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: আমি দেখেছি রসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিকাংশ সময়ই বামদিক থেকে ঘুরে বসতেন।”

সহীহ মুসলিমে আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন আমি দেখেছি রসূলুল্লাহ (ﷺ) অধিকাংশ সময়ই ডানদিকে ঘুরে বসতেন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি দেখেছি রসূলুল্লাহ (ﷺ) ডানদিক থেকেও এবং বামদিক থেকেও ঘুরে বসেছেন। তিনি সোজাসুজি মুক্তাদিদের দিকে ফিরে বসতেন। একদিক বাদ দিয়ে বিশেষ করে আরেকদিকে ঘুরে বসতেন না। সোজাসুজি বসে সকলের দিকে দৃষ্টি দিতেন। ফজর নামায পড়ার পর সূর্য উঠা পর্যন্ত তিনি নামাযের স্থানে বসে থাকতেন।

নামায শেষে যেসব যিকর ও দুআ পাঠ করতেন

সহীহ বুখারি ও মুসলিমে মুগীরা ইবনে শু‘বা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক ফরয নামাযের পর এই কথাগুলো বলতেন: (আরবী***********************)

অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (হুকুমকর্তা) নেই। তিনি এ একক। তাঁর কোনো শরীক (অংশীদার) নেই। মহাবিশ্বের কর্তৃত্ব কেবল তাঁর। সমস্ত প্রশংসা তাঁর। সর্বশক্তিমান তিনি। হে আল্লাহ! তুমি কিছু দিতে চাইলে তা রোধ করার সাধ্য কারো নেই। আর তুমি কিছু না দিতে চাইলে তা দেবার সাধ্য করো নেই। কোনো সম্পদশালীর সম্পদ, কোনো মর্যাদাবানের মর্যাদা তোমার মোকাবেলায় সম্পূর্ণ নিষ্ফল, একেবারেই অকার্যকর।”

আবু হাতিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নবী করীম (ﷺ) নামায শেষ করার পর বলতেন:

(আরবী**********************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমার দীনকে পরিশুদ্ধ করে দাও, যা আমার সমস্ত কাজের রক্ষক। তুমি আমার দুনিয়াকে ঠিক করে দাও, যেখানে দিয়েছো আমার জীবিকা। হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তোষ দ্বারা তোমার অসন্তোষ থেকে পানাহ চাই। তোমার ক্ষমা দ্বারা তোমার প্রতিশোধ থেকে পানাহ চাই। আর আমি তোমার (শাস্তি) থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। তুমি দিতে চাইলে ফিরাবার সাধ্য করো নাই, আর না দিতে চাইলে দিবার সাধ্যও কারো নেই। তোমার সম্মুখে কোনো সম্পদশালীর সম্পদ আর কোনো মর্যাদাবানের মর্যাদাই কাজে আসেনা।” (সহীহ আবু হাতিম)

হাকিম তাঁর মুসতাদরকে আবু আইউব আনসারী রা. থেকে হাদিস উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি যখনই তোমাদের প্রিয় নবীর পেছনে নামায পড়েছি, তখন অবশ্যি নামায শেষে তাঁকে একথাগুলো বলতে শুনেছি:

(আরবী****************)

অর্থ: ওগো আল্লাহ! আমার সব ভুলত্রুটি এবং গুনাহ খাতা মাফ করে দাও। হে আল্লাহ! আমাকে উত্থিত করো, আমাকে জীবন দাও, জীবিকা দাও আর জীবন যাপনের তৌফিক দাও শুদ্ধ আমল ও চরিত্রের ভিত্তিতে। কারণ তুমি তৌফিক না দিলে কেউ সেভাবে জীবন যাপন করতে পারেনা। তুমি ছাড়া কেউ মানুষকে মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে রাখতে পারেনা।”

সহীহ মুসলিমে ইবনে যুবায়ের রা. থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নামাযের সালাম ফিরাতেন, তখন উঁচুস্বরে এই কথাগুলো উচ্চারণ করতেন: (আরবী*********************)

অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। মহাবিশ্বের গোটা রাজত্ব তাঁর। সমস্ত প্রশংসা তাঁরই। সর্বশক্তিমান তিনি। আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই, তিনি ছাড়া কোনো ভারসাস্থলও নেই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমকর্তা নেই। আমরা কেবল তাঁর ছাড়া কোনো গোলমী করি না। সমস্ত নি‘আমত তাঁর, দানও তাঁরই। তাই সমস্ত উত্তম প্রশংসাও তাঁরই। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমরা একনিষ্ঠভাবে কেবল তাঁরই আনুগত্য করি-যদিও কাফিররা তা পছন্দ করেনা।”

নামায শেষে ক্ষমা ও আশ্রয় চাওয়া

আবু দাউদে আলী রা. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ হয়েছে। তাতে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সালাম ফিরাতেন, তখন বলতেন : (আরবী*********************)

অর্থ: আয় আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও আমার আগে-পরের এবং গোপন ও প্রকাশ্য গুনাহ। মাফ করে দাও আমার সব সীমালংঘন। মাফ করে দাও আমার সেইসব গুনাহ যা সম্পর্কে তুমি আমার চাইতে ভালো জানো। এগিয়ে দাও, তুমিই পিছিয়ে দাও। তুমি ছাড়া কোনো ত্রানকর্তা নেই।”

এ দু‘আটি সম্পর্কে ইমাম মুসলিম দুটি মত ব্যক্ত করেছেন।

১. রসূলুল্লাহ (ﷺ) এটি তাশাহুদ ও সালামের মাঝখানে পড়তেন। মূলত এ মতটিই সঠিক।

২. তাঁর দ্বিতীয় মত হলো রসূল (ﷺ) এটি সালামের পরে পড়তেন।

-সম্ভবত রসূলুল্লাহ (ﷺ) সালামের আগে এবং পরে উভয় ক্ষেত্রেই এই দুআটি পড়তেন। প্রকৃত ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।

সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. তাঁর সন্তানদের এই কথাগুলো শিখাতেন এবং বলতেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযের পরে এভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন : (আরবী*****************)

অর্থ: আয় আল্লহ! আমি তোমার কাছে ভীরুতা ও কাপুরুষতা থেকে পানাহ চাই। কৃপণ হওয়া থেকে পানাহ চাই। আমি তোমার কাছে পানাহ চাই বৃদ্ধ বয়সের অক্ষমতা থেকে। তোমার কাছে পানাহ চাই দুনিয়ার ফিতনা [ফিতনা মানে- কঠিন বিপদে ফেলে ইমানের পরিক্ষা নেয়া।] আর কবরের আযাব থেকে।” (সহীহ বুখারী)

নামায শেষে সাক্ষ্য (শাহাদাত) প্রদান

মুসনাদে আহমেদ যায়েদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক নামাযের পরে, একথাগুলো বলতেন: (আরবী***********************)

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু এবং প্রতিটি জিনিসের প্রভু ও মালিক। আমি সাক্ষী, তুমিই একমাত্র প্রভু, তুমি একক, তোমার কোনো শরীক নাই। আয় আল্লাহ আমাদের ও প্রতিটি জিনিসের প্রভু! আমি সাক্ষী আছি, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ তোমার দাস ও রসূল। ওগো আল্লাহ, আমাদের এবং প্রত্যেকটি জিনিসের প্রভু! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি বান্দাহরা সবাই ভাই ভাই। হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু এবং প্রতিটি জিনিসের প্রভু। দুনিয়া ও আখিরাতের প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে ও আমার পরিবারকে তোমার জন্যে একমুখী ও একনিষ্ঠ বানিয়ে দাও। হে মহামর্যাদাবান মহাসম্মানিত। তুমি আমার আবেদন শুনো এবং কবুল করো। আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহই মহাবিশ্ব (Universe) আর এই পৃথিবীর আলো। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠতম তিনি। আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। সর্বোত্তম ভরসাস্থল তিনি। আল্লাহ আকবার, আল্লাহ আকবার।”

-হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ এবং ইমাম আবু দাউদ।

নামায শেষে তাসবীহ, তাহমীদ ও তাকবীর বলা

রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মতের জন্যে এ রীতিটা পছন্দ করে গেছেন যে, নামায শেষ করার পর তারা-

سبحان الله তেত্রিশবার পড়বে, الحمد لله তেত্রিশবার পড়বে, الله اكبر তেত্রিশবার পড়বে এবং তারপর (আরবী********) একবার পড়ে মোট একশত বার পূর্ণ করবে।

সহীহ মুসলিমের আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের শেষে তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ, তেত্রিশবার আল্লাহু আকবার, সর্বমোট নিরানব্বই বার এই কথাগুলো উচ্চরণ করেছে, অতপর লাইলাহ ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু………. আলা কুল্লে শাইয়ীন কাদীর, উচ্চারণ করে একশত পূর্ণ করেছে, তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দেওয়া হবে, এমনটি তা যদি সমদ্রের বুদ্বুদের মতো ব্যাপকও হয়ে থাকে।

অবশ্য সহীহ মুসলিমে কা’আব ইবনে উজরা রা. থেকে এ সম্পর্কে যে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ঐ ব্যক্তি কখনো নিরাশ হবে না যে প্রত্যেক নামায শেষে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। (সহীহ মুসলিম)

নামাযের পরে পড়ার জন্যে সাহাবাগণকে যা শিখিয়েছেন

আবু যর, আবু আইউব আনসারী এবং আবদুর রহমান বিন গনম রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন যে ব্যক্তি ফজর এবং মাগরিবের সালাম ফিরাবার সাথে সাথে নিম্নোক্ত এথাগুলো দশবার উচ্চারণ করবে, সেজন্যে তার দশটি নেকি প্রাপ্য হবে, দশটি গুনাহ মুছে দেয়া হবে এবং তার মর্যাদার দশটি ধাপ বৃদ্ধি করা হবে। তাছাড়া এই কথাগুলো তার জন্যে চারটি ক্রীতদাস মুক্তি করে দেয়ার সমতুল্য হবে এবং এই কথাগুলো তার জন্য শয়তান থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। এগুলো পড়তে থাকলে শিরক ছাড়া অন্যান্য পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারবেনা। আর এই কথাগুলো তার আমলকে সুন্দর করবে। কথাগুলো হলো: (আরবী*********************)

অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোনো অংশীদার নাই। সমস্ত সাম্রাজ্য ও কর্তৃত্ব শুধু তাঁর। সকল প্রশংসাও তারই। তিনি সর্বব্যাপী ক্ষমতাবান।” (ইবনে হিব্বন, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি)

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এই ব্যক্যগুলো সম্পর্কে একথাও বলেছেন কোনো ব্যক্তি যদি ফজরের সময় এ বাক্যগুলো উচ্চারণ করে, তবে মাগরিব পর্যন্ত সে শয়তানের খপ্পর থেকে রক্ষা পাবে। আর সে যদি মাগরিবেও একথাগুলো পাঠ করে, তবে ফজর পর্যন্ত সে শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাবে।

-ইমাম তিরমিযি বলেছেন, এই হাদিসটি হাসান, সহীহ ও গরীব।

ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ সংকলনে হারিস ইবনে মুসলিম তাইমীর বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) আমাকে বলেছেন তুমি যখন ফজর নামায শেষ করবে, তখন অন্য কোনো কথা বলার আগে এই কথাটি সাতবার বলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চেয়ো। মাগরিবের (ফরয) নামাযের পরেও এই কথাগুলো সাতবার বলবে। ফরে, তুমি যদি ঐদিন বা ঐ রাত্রে মারা যাও, তবে আল্লাহ তোমার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি লিখে দেবেন। সাতবার চাওয়ার সেই বাক্যটির হলো: (আরবী**********)

অর্থ: ওগো আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও।”

ইমাম নাসায়ী তাঁর আল-কবীর গ্রন্থে আবি উমর রা. থেকে এবং ইমাম বায়হাকি তাঁর শুয়াবুল ইমানে‘ আলী বা থেকে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে [আয়াতুল কুরসি আল্লাহ পাকের অসীম ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত কুরআনের একটি বিখ্যাত আয়াত। এটি সূরা আল বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াত। প্রত্যেক মুমিনেরই আয়াতটি মুখস্ত করা এবং এর অর্থ জানা উচিত।], মৃত্যু ছাড়া তার জান্নাতে প্রবেশের পথে আর কোনো বাধা থাকবেনা।

হাদিসটি এছাড়াও আরো বিভিন্ন সূত্রে বর্নিত হয়েছে। তবে হাদিসটি সহীহ ও জয়ীফ হবার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন হাদিসটি সূত্রের দিক থেকে দুর্বল এবং গ্রহণযোগ্য নয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সূত্রের (সনদের) দিক থেকে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও যেহেতু হাদিসটি অনেকগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাই এর মধ্যে সত্যতার নির্যাস থাকতে পারে।

মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, বায়হাকী, আবু হাতিম, ইবনে হিব্বান, হাকিম প্রভৃতি গ্রন্থে উকবা ইবনে আমির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে প্রত্যেক নামাযের পরে সূলা ফালাক ও সূরা নাস (কুরআনের শেষ দুইটি সূরা) পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন।

তাবারানি তাঁর মু’জামে আবু ইয়ালী তাঁর মুসনাদে উমর ইবনে নাবহানের সূত্রে জাবির রা. থেকে মারুফ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে: এমন তিনটি কাজ আছে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সে কাজগুলো করবে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে, আর জুড়ি হিসেবে লাভ করতে পারবে আয়ত নয়ন হুরদের। সে তিনটি কাজ হলো:

১. নিজের হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেয়া,

২. গোপন ঋণ পরিশোধ করে দেয়া এবং

৩. প্রত্যেক ফরয নামাযের পর দশবার ‘কুলহওয়াল্লাহু আহাদ……..সূরা (সূরা ইখলাস) পাঠ করা।

-আবু বকর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই তিনটির একটি কাজ করলেও কি তা পাওয়া যাবে? তিনি বললেন হ্যাঁ, একটি কাজ করলেও।

রসূলুল্লাহ (স). মুয়ায (রা)-কে প্রত্যেক নামাযের পিছে আল্লাহর কাছে এভাবে সাহায্য চাইতে অসীয়ত করে গেছেন:

(আরবী******************)

অর্থ আয় আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করো সবসময় তোমাকে স্মরণ করতে, তোমার শোকর আদায় করতে আর সর্বোত্তম ও সর্বসুন্দরভাবে তোমার ইবাদত করতে।”

এখানে ‘নামাযের পিছে’ বলতে সালাম ফিরাবার আগেও হতে পারে, পরেও হতে পারে। আমাদের উস্তাদ (ইমাম ইবনে তাইমিয়া) বলেছেন, নামাযের পিছে মানে- শেষ প্রান্তে। অর্থাৎ সালামের পূর্বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *