৬. জুমার নামায
জুমার নামায কিভাবে শুরু হলো?
ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক সূত্র উল্লেখ করে আবদুর রহমান ইবনে কা’ব ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন। আবদুর রহমান বলেন, আমার আব্বা কা’ব ইবনে মালিক বৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছুলে যখন তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পেলো, তকন আমি তাঁকে হাতে ধরে পথ দেখিয়ে এদিক সেদিক নিতাম। আমি যখন তাঁকে জুযমার নামায পড়তে নিয়ে চললাম, তখন পথিমধ্যে তিনি জুমার আযান শুনতে পেলেন। আযান শুনেই তিনি আবু উমামা আস’আদ ইবনে যিরারার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে আমার কৌতূহল হলো। কিন্তু তাঁর প্রতি অধিক শ্রদ্ধাবোধের কারণে সেদিন আর আমি কিছুই জিজ্ঞাসা করলাম না।
এরপর থেকে প্রত্যেক জুমাবারই আমি তাঁকে জুমার নামাযে নিয়ে যেতাম। জুমার আযান শুনলেই তিনি আবু উমামা আস’আদ ইবনে যিরারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। কৌতুহলের আধিক্যে একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেই বসলাম: আব্বা! আপনি জুমার আযান শুনলেই আস’আদ ইবনে যিরারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কনে কেন?
জবাবে আব্বা বললেন: বৎস! রসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় আসার পূর্বেই তিনি আমাদের নিয়ে বাকিয়ীর বিরাণ ভূ-খণ্ডে জুমার নামায পড়ার সূচনা করেছিলেন। এ জায়গাকে বলা হতো ‘বাকিউল খাদুরাত’।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম: তখন আপনারা কতজন জুমার নামায পড়তেন?
তিনি বললেন: চল্লিশ জন।
এ হাদিসটি একটি উত্তম ও বিশুদ্ধ সূত্রের হাদিস। এর বর্ণনাকারীগণ সকলেই বিশ্বস্ত।
-আমার মতে এটাই জুমার নামাযের সূচনা।
অতপর রসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় এলেন। প্রথমে তিনি মদীনার উপকণ্ঠে বনি আমর ইবনে আউফর কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। ইবনে ইসহাকের মতে, তিনি এখানে সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবারে কুবাপর মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। অতপর শুক্রবারে এখান থেকে সম্মুখে যাত্রা শুরু করেন। তিনি যখন সারিম ইবনে আউফ গোত্রে পৌঁছেন, তখন জুমার নামাযের সময় হয়। তিনি সেই প্রান্তরে অবস্থিত মসজিদে জুমার নামায পড়েন।
মদীনায় হিজরত করে আসার পর এটাই রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর প্রথম জুমার নামায। এখানেই তিনি জুমার প্রথম খুতবা প্রদান করেন। ইবনে ইসহাক বলেছেন, আমি আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান থেকে তাঁর প্রথম খুতবাটি শুনতে পেয়েছি। রসূলুল্লাহরনামে কোনো ভুল কথা বলা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
তিনি তাঁর এই প্রথম খুতবায় প্রথমে আল্লাহ তা’আলার যথোপযুক্ত হাম্দ ও সানা পাঠ করেন। অতপর বলেন:
(আরবী*********************)
অর্থ হে মানুষ! নিজের জন্যে পূণ্য আগেই পাঠাও। মনে রাখবে, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, হঠাৎ যখন তোমাদের মৃত্যু হবে, তখন তোমাদের বকরীগুলো রাখাল শূন্য হয়ে পড়বে। মৃত ব্যক্তি আল্লাহর কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার কাছে কি আমার রসূল যায়নি? তোমাকে কি সে আমার বাণী পৌঁছায়নি? আমি তোমাকে কি ধন সম্পদ দিইনি? তোমাকে কি বিভিন্ন মর্যাদায় ভূষিত করিনি? তা হলে তুমি তোমার জন্য আগাম কি পাঠিয়েছো? তখন সে ডানে ও বামে তাকাতে থাকবে? কিন্তু সে কিছুই দেখতে পাবেনা। তাপর সম্মুখে তাকাবে এবং নিজের সামনে জাহান্নাম দেখবে। সুতরাং এটা খেজুর দান করে হলেও যতটুকু পারো, সেই ভীষণ আগুন থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। তাও যে পারবেনা, সে যেনো সুন্দর কথা বলে বিদায় দেয়, কারণ তা পূণ্য কাজের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। তার পূণ্য দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত হবে। তোমাদের প্রতি শান্তি, রহমত ও বরকত নেমে আসুক।”
ইবনে ইসহাক বলেন: অতপর তিনি এখানে আরেকটি নিম্নরূপ খুতবা দিয়েছিলেন:
(আরবী**************************)
অর্থ: সব প্রশংকা আল্লাহর জন্যে। তাঁরই প্রশংসকা করছি এবং তাঁরই সাহায্য কামনা করছি। আমরা নিজের আত্মার ক্ষতি সাধন ও পাপ কার্য থেকে আল্লাহ কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে পথ দেখান কেউ তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না এবঙ তিনি যাকে বিভ্রান্ত করে দেন, কেউ তাকে পথ দেখাতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই। তিনি একক ও অংশীদারহীন। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কালাম। আল্লাহ যার অন্তরকে তা দিয়ে অলংকৃত করেছেন এবং কুফরি থেকে যাকে ইসলাম এনেছেন, সে অবশ্যি সফল হয়েছে। অন্যান্য কথা থেকে কালামকে বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে। কারণ এ হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ট আলংকরিক বাক্য। আল্লাহ যাকে ভালবাসেন, তোমরাও তাকে ভালবাসবে। নিজ অন্তরের সব ভালবাসা আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করো। আল্লাহ কালাম পাঠ ও তাঁর স্মরণ থেকে বিরত হয়ো না। তোমাদের অন্তর যেনো পাক কালামের ব্যাপারে কঠিন হয়ে না যায়। কারণ আল্লাহ তা’আলা সেটাকে উত্তম কাজ ও সর্বোত্তম বাণী আখ্যা দিয়েছেন। তাতে মানুষের জন্য যা কিছু হালাল বা হারাম করা হয়েছে, তা মওজুদ আছে। তাই আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর সাথে কিছুমাত্র শরীক করোনা। তাঁকে ভয় করার মতো ভয় করো। আল্লাহর দয়ায় পরস্পরকে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদা ভংগকারীর প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তোমাদের প্রতি আল্লাহর তরফ থেকে শান্তি, বরকত ও রহমত নাযিল হোক।”
খুতবার অধ্যায়ে এ সম্পর্কি আরো তথ্য আলোচিত হবে।
জুমার দিনের মর্যাদা
বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: দুনিয়াতে আমরা শেষ উম্মত, কিন্তু আখিরাতে আমরাই সবার আগে থাকবো। পার্থক্য কেবল এতোটুকু যে, এই পৃথিবীতে তারা আমাদের আগে কিতাব লাভ করেছে, আর আমরা লাভ করেছি তাদের পরে। জুমার দিনটি তাদেরিই দিন ছিলো। কিন্তু তারা এ দিনটি নিয়ে মতভেদ করলো। ফলে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এই দিনটির সন্ধান দিলেন। অন্যরা এ বিষয়ে আমাদের পিছে পড়লো। ইহুদরিা শনিবারকে বেছে নিলো আর খৃস্টানরা বেছে নিলো রোববারকে।”
সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) বলেছেন: সূর্যোদয়ের মাধ্যমে যেসব দিনের সূচনা হয়, তন্মধ্যে (অর্থাৎ সকল দিনের মধ্যে) জুমার দিন সর্বোত্তম। কারণ এই দিনই-
-আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
-এ দিনই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে।
-এ দিনই তাঁকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।
-আর জুমার দিনই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।”
ইবনে মাজাহর একটি বর্ণনায় এসেছে-
-‘এ দিনই আদমের মৃত্যু হয়েছে।”
দু’আ কবুলের এক পরম মুহূর্ত
বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে: রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জুমার দিনে এমন একটি বিশেষ সময় রয়েছে, কোনো মুসলিম বান্দা যদি সে সময়টি পায় এবং আল্লাহর কাছে কোনো কল্যাণ প্রার্থনা করে, তবে আল্লাত তা’আ’লা অবশ্যি তাকে তা দান করেন।”
-এ বিশেষ সময়টির ব্যাপারে বিশুদ্ধ সূত্রে আরো অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু সেই বিশেষ সময়টি কোন্ সময়? তা সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা কঠিন। কারণ বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন সময়ের কথা উল্লেখ হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই বিশেষ সময়টি নির্দিষ্ট নয়, বরং আবর্তিত হয়। একেক সপ্তাহে একেক সময়ে সেই বিশেষ মুহূর্তটি আসে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের কথা বর্ণনা করেছেন, তাদের বর্ণনা নিম্নরূপ:
১. ইবনে মানজার আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন: সেই বিশেষ সময়টি হলো ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়া থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
২. ইবনে মানজার হাসান বসরি এবং আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেছেন: সে সময়টি সূর্য হেলার সময়।
৩. ইবনে মানজার আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন: সে সময়টি হলো, মুয়াযযিন কর্তৃক জুমার আযান দেয়ার সময়।
৪. ইবনে মানজার হাসান বসরি থেকে বর্ণনা করেছেন, সে সময়টি হলো, ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্যে মিম্বরে বসে, তখন থেকে খুতবা শেষ করা পর্যন্ত।
৫. আবু বুরদা বলেছেন সে সময়টি হলো জুমার নামাযের সময়।
৬. আবুস সাওয়ার আদভি বলেছেন, পূর্ববর্তী লোকেরা মনে করতেন, সে সময়টি হলো সূর্য হেলার পর থেকে নামাযের সময় পর্যন্ত।
৭. আবু যর বলেছেন, সময়টি হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্য গজ খানেক উপরে উঠা পর্যন্ত।
৮. আবু হুরাইরা. আতা আবদুল্লাহ ইবনে সালাম এবং তাউস, বলেছেন, সে সময়টি হলো, আসর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
৯. অধিকাংশ সাহাবি, তাবেয়ী এবং আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে, সে সময়টি হলো, আসরের পরে দিনের শেষ সময়টি।
১০. ইমাম নববী প্রমুখ বলেছেন, সে সময়টি হলো, ইমাম মসজিদের উদ্দেশ্যে বাহির হওয়া থেকে নিয়ে নামায শেষ করা পর্যন্ত।
১১. আল মুগণী প্রণেতা বলেছেন, সময়টি হলো, দিনের তৃতীয় ভাগ।
এই এগারটি মতের মধ্যে কেবল দুটি মতই প্রাধান্য পেতে পারে। ঐ দুটি মতের পক্ষেই আমরা সহীহ ও প্রমাণিত হাদিস পাই। সে দুটি মত হলো:
এক. ইমামের মিম্বরে বসার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত। এই মতের দলিল হলো সহীহ মুসলিমে বর্নিত আবু বুরদার হাদিস। হযরত আবু মূসার পুত্র বুরদা রা. বলেন, আমি আমার পিতার নিকট থেকে শুনেছি, তিনি জুমার দিনের দু’আ কবুলের সেই বিশেষ সময়টি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন সেই সময়টি হলো ইমাম মিম্বরে বসা থেকে নিয়ে নামায শেষ করা পর্যন্ত।
এ প্রসংগে আরেকটি সহীহ হাদিস হলো ইবনে মাজাহ এবং তিরমিযি বর্ণিত আমর ইবনে আউপ আল মুযনির হাদিস। তিনি রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ অবশ্যি তাকে তা দান করেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো: ইয়া রাসূলুল্লাহ! সেই মুহূর্তটি কখন? তিনি বললেন: নামায (জুমার নমায) কায়েম হবার সূচনা থেকে নিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত।
দুই. দ্বিতীয় বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী সে সময়টি হলো, আসরের নামায পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এই মতের পক্ষেও বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। মুসনাদে আহমদে আবু সায়ীদ খুদরি রা. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: দু’আ কবুলের সেই বিশেষ সময়টি হলো, আসরের পরে।
আবু দাউদ এবং নাসায়ী জাবির রা. থেকে অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
“আসরের পরে দিনের শেষ প্রান্তে সে সময়টিকে তালাশ করো।”
ইবনে মাজাহতে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
জুমার দিনের উত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহ
জুমার দিনের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদা সুস্পষ্ট। শুদুমাত্র আলিমদের মদ্যে এ বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে আরাফঅ ও জুমার দিনের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ? আমরা এখানে জুমার দিনের উত্তম বৈশিষ্টসমূহ তুলে ধরছি, যাতে করে জুমার দিনের মর্যাদা সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
এক. রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমা দিন ফজরের নামাযে সূরা আস সাজদা এবং সূরা আদদাহার (সূরা নং ৩২ ও ৭৬) পাঠ করতেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন, রসূল (ﷺ) জুমার দিন ফজরের নামাযে এ সূরা দুটি পড়ার কারণ হলো এ দুটো সূরাতে সেইসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যা জুমার দিন সেংঘটিত হয়েছে, বা হবে। মেয আদম সৃষ্টি, পুণরুত্থান, হাশর, কিয়ামত ইত্যাদি। জুমাবারে এসব বিষয়ে লোকদের স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যেই রসূল (ﷺ) সেদিন সকালে এ সূরা দুটি পড়তেন।
দুই. এদিন রসূল (ﷺ) –এর উপর অধিক অধিক সালাত (দরুদ) পাঠ করা মুস্তাহাব। তিনি বলেছেন তোমরা জুমার দিন আমার প্রতি বেশি বেশি সালাত পাঠ কর।
তিন. ইসলামের যৌথভাবে পালনীয় ফরয সমূহের মধ্যে জুমার নামায সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফরয। ইসলামের ফরয সমাবেশ সমূহের মধ্যে আরাফার সমাবেশ ছাড়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ জুমার নামাযের সমাবেশ।
চার. জুমার দিন গোসল করা ওয়াজিব। শুধুমাত্র হাম্বলী মাযহাবের অভ্যন্তরে এদিন গোসল ওয়াজিব হবার ব্যাপারে কিচুটা মতভেদ আছে।
পাঁচ. এই দিন সুগন্ধি ব্যবহার করতে বলা হয়েছে এবং তা সপ্তাহের অন্যান্য দিনের সুগন্ধির তুলনায় উত্তম হওয়া চাই।
ছয়. এদিন মিসওয়াক করতে হবে এবং তা অন্যান্য দিনের তুলনায় অধিকতর উত্তম করতে হবে।
সাত. খুতবায়ে আযানের পর নামাযের জন্যে আরেকটি আযান দেয়া এই দিনের বৈশিষ্ট্য।
আট. ইমামের মসজিদে আসা পর্যন্ত নামায, যিকর আযকার এবং কুরআন পাঠে মশগুল থাকা এদিনের বৈশিষ্ট্য।
নয়. নিরবে চুপ থেকে ইমামের খুতবা (ভাষণ) শুনা ওয়াজিব। কেউ চুপ না থাকলে তার জুমা ব্যর্ত হতে পারে।
দশ. সায়দি ইবনে মনসুর আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে শুনেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমার দিন সূরা কাহাফ পড়তে বলেছেন। তিন বলেছেন: যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ পাঠ করবে, তার পা থেকে আকাশ পর্যন্ত নূর বিছিয়ে দেয়া হবে। কিয়ামতের দিন তা থেকে সে আলো পাবে এর বদৌলতে তার এক জুমা থেকে আরেক জুমা পর্যন্ত গুনাহ সময়হ মাফ করে দেয়া হবে।
এগার. ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম তাইমিয়ার মতে জুমার দিন সূর্য মাথার উপর এসে হেলার সময় নামায পড়া মাকরূহ নয়। তাঁরা হাদিসের ভিত্তিতে এমত গ্রহণ করেছেন।
বার. রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমার নামায সূরা জুমা ও সূরা মুনাফিকুন দিয়ে পড়তেন। কিংবা সাব্বাহ দিয়ে শুরু করা সূরা এবং সূরা গাশিয়া দিয়ে পড়তেন। অথবা সূরা জুমা ও সূরা গাশিয়া দিয়ে পড়তেন। তিনি পূর্ণ সূরা পাঠ করতেন আংশিক নয়।
তের. জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদ। সুনানে ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন জুমার দিন সকল দিনের সর্দার এবং আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম দিন। এ দিনটি আল্লাহর কাছে ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতর থেকেও উত্তম।
চৌদ্দ. রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) জুমার দিন সাধ্যানুযায়ী উত্তম কাপড় চোপড় পরিধান করতে বলেছেন। মুসনাদে আহমদ সুনানে আবু দাউদ এবং ইবনে মাজাহতে একথা বর্ণিত হয়েছে।
পনের. জুমার দিন মসজিদে ধূপ-দুনা জ্বালানো মুস্তাহাব। সায়ীদ ইবনে মনসুর নয়ীম ইবনে আবদুল্লাহ আর মেজমার থেকে বর্ণনা করেছেন: খফিলা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. প্রত্যেক জুমার দিন দুপুর হলে মসজিদে ধূপ-ধুনা জ্বালাবার নির্দেশ দিতেন।
ষোল. যে ব্যক্তির উপর জুমার নামায ফরয, তার জন্যে জুমার ওয়াক্ত আরম্ভ হলে সফরে রওয়ানা করা জায়েয নয়।
তবে কেউ কেউ বলেছেন, জিহাদ বা অন্য কোনো ইবাদতের কাজে হলে জায়েয।
সতের. যে ব্যক্তি জুমার নামাযের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের নফল রোযা এবং এক বছরের নফল নামাযের সওয়াব লাভ করে। ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে এ সম্পর্কে রসূল (ﷺ) –এর হাদিস উল্লেখ করেছেন।
আঠর. জুমার দিন হলো পাপ মোচনের দিন। মুসনাদে আহমদে সালমান ফারেসি রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জুমার দিন যে ব্যক্তি ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে, তারপর মসজিদে এসে নিরবতা অবলম্বন করবে এবং ইমামের খুতবা ও নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সে নিরবে তা অনুসরণ করবে, তার একাজ পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার গুনাহের কাফফারা বলে গণ্য হবে।
ঊনিশ. জুমার দিন ছাড়া বাকি সব দিনেই জাহান্নামের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। রসূল (ﷺ) বলেছেন, যেহেতু জুমার দিন সর্বোত্তম, সেজন্যে এদিন জাহান্নাম উত্তপ্ত করা হয়না।
বিশ. জুমার দিন দু‘আ কবুল হবার একটি বিশেষ মুহূর্ত আছে, সে সময়টিতে আল্লাহ তা’আলা বান্দাহর দু’আ কবুল করে থাকেন। এ সময়টি সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে।
একুশ. এই দিন জুমার নামায পড়া হয়। মুসলিমদের বিরাট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ নামাযে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করা হয়।
বাইশ. এই দিন জুমার নামাযের পূর্বে ইমাম (নেতা) মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ (খুতবা) প্রদান করে। এই ভাষণে আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মদ (ﷺ)-এর রিসালতের স্বীকৃতি ঘোষণা প্রদান করা হয়। মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় এবং তাদেরকে উপদেশ প্রদান করা হয়।
তেইশ. জুমার দিন ইবাদতের জন্যে অবসর (ছুটি) গ্রহণ মুসলমানদের জন্যে মুস্তাহাব।
চব্বিশ. বার্ষিক দুই ঈদের মতোই জুমার দিন মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন।
পঁচিশ. জুমার দিন দান খয়রাত করা অন্যান্য দিনের চাইতে অধিক সওয়াবের কাজ। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমযানের দানে যেমন অধিক সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমার দিনের দানে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।
ছাব্বিশ. জুমার দিন আল্লাহ তা’আলা তাঁর মুমিন বান্দাহদেরকে তাঁর নূরের দ্যুতি দেখাবেন। যারা ইমামের কাছাকাছি বসবে এবং জুমার নামাযের জন্যে তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিয়ে বের হবে, তারা আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভ করবে এবং সবার আগে আল্লাহকে দেখতে পাবে। একথাগুলো বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
সাতাশ. বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, কিয়ামতের দিন হলো- ‘ইয়াওমুল মাওউদ’। আরাফার দিন হলো- ‘ইয়াওমুল মাশহুদ’। আর জুমার দিন হলো- ইয়ামুশ শাহিদ’।
আচাশ. জুমার দিন হলো, মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক সভার দিন। এটা আল্লাহ তা’আলাই উম্মতের জন্যে ফরয করে দিয়েছেন।
ঊনত্রিশ. কা’ব রা. বর্ণনা করেছেন, জুমার দিন মানুষ আর শয়তান ছাড়া আসমান, যমীন, পাহাড়, সাগর এমনকি আল্লাহর সকল সৃষ্টিই ভয়ে কাঁপে।
ত্রিশ. জুমার দিনটি আল্লাহর মনোনীত দিন।
একত্রিশ. জুমার দিন মানুষের আত্মাগুলো কবরের কাছে আসে বলে বর্ণিত হয়েছে।
বত্রিশ. ইমাম আহমদ বলেছেন, শুধুমাত্র জুমার দিন রোযা রাখা মাকরূহ। অর্থাৎ বেছে বেছে শুধুমাত্র জুমার দিন রোযা রাখাটা মাকরূহ। অবশ্য অন্যান্য ইমাম জুমার দিন রোযা রাখাকে মুবাহ বলেছেন।
রসূলুল্লাহর জুমার নামায
রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমার নামায দুই রাকাত পড়েছেন এবং তাতে সশব্দে কিরাত পড়েছেন। জুমার নামায ফরয সমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফরয। রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
এই কয় ধরনের লোক ছাড়া বাকি সকল মুসলমানের জন্যে জুমার নামায ফরয। সেই কয় ধরণের লোক হলো: ১. কৃতদাস, ২. নারী. ৩. শিশু. ৪. রোগী, ৫. মুসাফির (ভ্রমণরত ব্যক্তি) ও ৬. পাগল।”
-হাদিসটি দারু কুতনি বর্ণনা করেছেন জাবির রা. –এর সূত্রে এবং আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন তারিক ইবনে শিহাব-এর সূ্ত্রে।
-রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) জুমার নামাযে প্রায়ই সূরা আস সাজদা, সূরা দাহার, সূরা জুমা, সূরা গাশিয়া ও সূরা মুনাফিকূন পড়তেন।
-তিনি সূর্য হেলার পরে জুমার নামায পড়তেন। (বুখারি)
-তিনি প্রচণ্ড শীতের সময় জুমার নামায আগেভাগে পড়তেন আর প্রচণ্ড গরমের সময় বিলম্বে পড়তেন। (বুখারি)
-তিন আগে খুতবা প্রদান করতেন তারপর নামায পড়তেন। (বুখারিী
-তিনি নামায দীর্ঘ এবং খুতবা সংক্ষেপ করতে বলেছেন। (মুসলিম)
তাঁর খুতবা এবং নামায দুটোই মধ্যম রকম ছিলো-না দীর্ঘ ছিলো, না হ্রস্ব। (সহীহ মুসলিম)
-তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকাত পেলো, সে পুরো নামায পেলে। (বুখারি মুসলিম)
রসূলুল্লাহর জুমা খুতবার (ভাষণের) অনুষ্ঠান
-রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামাযের আগেই খুতবা প্রদান করতেন।
-তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন।
-তিনি দুটি খুতবা প্রদান করতেন এবং প্রথম খুতবার পর কিছুক্ষণ নিরবে বসতেন, তারপর উঠে দ্বিতীয় খুতবা দিতেন।
তিনি মিম্বরে উঠে বসার পর মুয়াযযিন আযান দিতো। মুসয়াযযিনের আযান শেষ হবার পর তিনি দাঁড়াতেন এবং খুতবা দিতে শুরু করতেন।
-মিম্বর তৈরি হবার আগে তিনি খেজুরের ডালে ভর করে দাঁড়াতেন।
-তারপর মিম্বর তৈরি হলো। তখন থেকে তিনি মিম্বরে দাঁড়াতেন। মিম্বরটি মসজিদের মাঝখানে নয়, বরং দেয়াল ঘেষে বসানো ছিলো। মিম্বর ও দেয়ালের মাঝখানে একটি বকরী যাতায়াতের ফঅঁক ছিলো।
-মিম্বর তৈরি হবার পর তিনি কখনো তীর, তলোয়ার বা খেজুর ডালে ভর দিয়ে দাড়াননি। তলোয়ারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন বলেও প্রমাণ নেই।
-তিনি যখন মিম্বরে উঠতেন, তখন সাহাবায়ে কিরামের দিকে মুখ করে বসতেন। তাদের মুখোমুখি বসতেন এবং দাঁড়াতেন।
-কোনো কাজের নির্দেশ দেবার জন্যে বা কোনো কাজ নিষেধ করবার প্রয়োজন হলে তিনি খুতবার ভিতরেই তা করতেন। একবার খুতবা প্রদানরত অবস্থাতেই একজন সাহাবিকে বললেন: দু’রাকাত নামায পড়ে নাও।
-একবার এক সাহাবি গর্দান উঁচু করলে তিনি খুতবার মধ্যেই তাকে বসে পড়তে বলেন।
-কখনো কখনো কুতবার মাঝখানেই সাহাবিদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। তারপর খুতবার বাকি অংশ শেষ করতেন।
-কখনো খুতবার প্রদান কালে তিনি মিম্বর থেকে নেমে আসতেন। তারপর প্রয়োজন সেরে আবার মিম্বরে গিয়ে অসমাপ্ত খুতবা সম্পন্ন করতেন। এবং খুতবার চলাকালে হাসান হুসাইন মসজিদে আসে। তিনি মিম্বর থেকে নেমে গিয়ে তাদের কোলে নেন। তারপর মিম্বরে এসে তাদের কোলে রেখেই খুতবার বাকি অংশ শেষ করেন।
-কখনো খুতবা চলাকালে কাউকেও বলতেন হে অমুক! বসে পড়ো। কাুকেও রোদের থেকে ছায়ায় আসতে বলতেন।
-সবলোক এলে তিনি খুতাব প্রদান করতেন।
-খুতবার পূর্বক্ষণে তিনি একাই অনাড়ম্বরভাবে নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেন। তাঁর আগে পিছে কোনো ঘোষক থাকতো না।
-মসজিদে ঢুকে নিজেই আগে সাহাবিদের সালাম দিতেন।
-মিম্বরে বসার সময় সবার দিকে দৃষ্টি ফিরাতেন, সালাম দিতেন।
-তিনি বসা মাত্র বিলাল আযান দিতেন। আযান শেষ হওূা মাত্র তিনি খুতবা শুরু করতেন।
-তিনি জুমার দিন মসজিদে এসে লোকদের নিরব থাকতে বলতৈন। তিনি বলেছেন: জুমায় তিন ধরনের লোক উপস্থিত হয়:
এক. বাজে কথার লোক। সে বাজে ও বেহুদা কথা বলে।
দুই. আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার লোক। তার প্রার্থনা আল্লাহ তা’আলা কবুল করতেও পারেন, নাও করতে পারেন।
তিন: এমন ব্যক্তি, যে নিরব থাকে, কাউকেও ডিংগায় না, কাউকেও বিরক্ত করে না, কষ্ট দেয় না এবং কায়মন্য বাক্যে ইবাদতে মশগুল থাকে। তার এসব আমল পরবর্তী জুমা পর্যন্ত পাপের কাফফারা হয়ে যায়। তাছাড়া সে অতিরিক্ত দিনের সওয়াবও পায়।”
-কখনো খুতবার দেয়ার সময় তাঁর দুচোখ লাল হয়ে যেতো। আওয়াজ উঁচু হয়ে পড়তো। মনে হতো তিনি যেনো কোনো আক্রমণকারী শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজ বাহিনীকে সতর্ক করছেন।
-তাঁর কুতবার ছিলো সংক্ষিপ্ত, নামায ছিলো লম্বা।
তিনি খুতবায় কি বলতেন?
রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জুমাপর ভাষণে (খুতবায়) ঈমানের মূলনীতি বর্ণনা করতেন। তাওহীদ, রিসালাতের তাৎপর্য বর্ণনা করতেন। জান্নাত-জাহান্নামসহ পরকালের বিস্তারিত অবস্থা তুলে ধরতেন। আল্লাহর কিতাব অনুসরণের কথা বলতেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বন্ধু ও অনুগতদের জন্যে যেসব নি’আমত তৈরি করে রেখেছেন, সেগুলোর চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিতেন। আল্লাহর দুশমন ও নাফরমানদের জন্যে তিনি যেসব শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সেগুলোকে ভয়ানক চিত্র তুলে ধরতেন।
ফলে তাঁর বক্তব্য শুনে শ্রোতাদের হৃদয় প্রভাবিত ও বিগলিত হতো। তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেতো। আল্লাহর সান্নিধ্য ও পুরষ্কার লাভের জন্যে সকলের মন ব্যাকুল হয়ে উঠতো। এতে তারা আল্লাহর আনুগত্যের জীবন যাপন করতো। আল্লাহর প্রতি মহব্বতকে সর্বোর্ধ্বে স্থান দিতো।
তিনি তাঁর খুতবায বেশি বেশি কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন। আখিরাতের চিত্র সম্বলিত সূরা কাফ’ খুব বেশি পাঠ করতেন। উম্মে হিশাম বিনতে হারিস বিন নুমান বলেছেন: রসূলূল্লা (ﷺ) –এর খুতবা শুনে শুনে আমি ‘সূরা কাফ’ মুখস্ত করেছি।
শুতবার শুরুতে তিনি আল্লাহ তা’আলার যথোপযুক্ত হামদ-ছানা পাঠ করতেন। কখনো তাওহীদ রিসালাতের ঘোষণাও দিতেন। তারপর বলতেন ‘আম্মা বা’দ (অতপর শুনো)’।
তারপর কথা বলতেন:
(আরবী*********************)
অর্থ সর্বোত্তম কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। সর্বোত্তম রীতিনীতি হচ্ছে মুহাম্মদের রীতিনীতি। সব কাজের মধ্যে নিকৃষ্ট কাজ হলো বিদআত (দীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাসিত জিনিস)।
-এই ধারায় তিনি আরো কিছু কথা বলতেন।
অপর বর্ণনায় আছে, হামদ ও সানার পর তিনি বলতেন:
(আরবী********************)
অর্থ, আল্লাহ যাকে সঠিক পথ দেখান তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারেনা। আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে কেউ সঠিক পথে আনতে পারেনা। সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (সহীহ মুসলিম)। প্রত্যেকটি বিদআতই বিপথগামিতা। আর প্রত্যেক বিপথগামীতাই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (নাসায়ী)
আবু দাউদে তাঁর একটি খুতবা নিম্নরূপ বর্ণিহ হয়েছে:
(আরবী*************************)
অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমি তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি এবং তাঁর কাছে ক্ষশাত প্রার্থনা করছি। আমাদের প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে সঠিক পথ দেখান, কেউ তাকে বিপথগামী করতে পারেনা। আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, কেউ তাকে হিদায়াত করতে পারেনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি-কোনো ইলাহ নেই আল্লাহ ছাড়া। তিনি এক ও একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি- মুহাম্মদ তাঁর দাস ও রসূল। আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত তাকে মহাসত্য দিয়ে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুগত্য করলো, সে সঠিক পথ পেলো। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হলো, সে নিজের ছাড়া আর কারো ক্ষতি করেনা। আল্লঅহর কোনো ক্ষতি সে করতে পারেনা।” (আবু দাউদ)
তাঁর আরেকটি খুতবা নিম্নরূপ বর্ণি হয়েছে:
(আরবী************************)
অর্থ: মৃত্যুর পূর্বেই তোমরা মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসো। ভালো ও পূণ্যের কাজে দৌড়ে চলো। বেশি বেশি আল্লাহর যিকর এবং গোপন ও প্রকাশ্য দানের মাধ্যমে তোমাদের ও তোমাদের প্রভুর মধ্যে সম্পর্ক জুড়ে নাও। এমনটি করলে তোমরা পুরস্কৃক হবে, প্রশংসিত হবে এবং জীবিকাপ্রাপ্ত হবে। জেনে রাখো, মহান আল্লাহ তোমাদের জন্যে জুমা ফরয করে দিয়েছেন। এ স্থানে, এ শহরে এবং এ বছর জুমা ফরয হলেও তা কিয়ামত পর্যন্ত ফরয থাকবে এমন সব ব্যক্তির জন্যে যারা মসজিদে পৌঁছতে পারবে। কোনো ব্রীক্ত যদি তার ন্যায়পরায়ণ কিংবা যালিম নেতা থাকা সত্ত্বেও আামর জীবদ্দশায়, কিংবা আমার মৃত্যুর পর হালকা ভেবে জুমা ত্যাগ করে, কিংবা অস্বীকার করে, তার জীবন আল্লাহ তা’আলা ব্যর্থ করে দেবেন। তার কাজে বরকত হবেনা। তার নামায হবেনা, তার অযু হবেনা, তার রোযা হবেনা, তার যাকাত হবেনা, তার হজ্জ হবেনা, তার কোনো কিছুতেই বরকত হবেনা- যতোক্ষণ না সে তওবা করে। সে যদি তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।”
এটি বর্ণনা করেছেন আলী বিন যায়েদ বিন জুদআন। বর্ণনাটিতে দুর্বলতা আছে। রসূলূল্লাহ (ﷺ)-এর খুতবা ছিলো প্রাণবন্ত। তাঁর খুতবা লোকেরা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসয় উদ্বেলিত হতো। ত্যাঁর মর্মস্পর্শী ভাষণ মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের প্রেরণায় ব্যাকুল করে তুলতো। তাতে তাদের তরবিয়ত লাভ হতো তাদের আখলাক উন্নত হতো এবং দীন ও শরীয়তের জ্ঞান অর্জিত হতো।
আজকাল লোকেরা যেসব খুতবা প্রদান করে, তাতে খুতবার সেই প্রাণ নেই। আজকালকার লোকদের খুতবা প্রাণহীন বাহ্যিক চাকচিক্য ভরা।
জুমার সুন্নাত নামায
রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর সময় জুমার নামাযে একটি আযান ও একটি ইকামত হতো। অবশ্য এ দুটিকে প্রথম আযান ও দ্বিতীয আযান বলা হতো।
রসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি মিম্বরে বসতেন। তাঁর মিম্বরে বসার সাথে সাথে বিলাল জুমার আযান দিতেন। বিলালের আযান শেষ হবার সাথে সাথে রসূলুল্লাহ (ﷺ) খুতবা শুরু করতেন। সুতরাং জুমার নামাযের পূর্বে কোনো সুন্নত নামায থাকার প্রমাণ হয়না।
জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত নামায খাতা না থাকার ব্যাপারে আলিমগণের দুটি মত পাওয়া যায়। এ দুটি মতের মধ্যে উপরোক্ত মতটিই হলো বিশুদ্ধ এবং সুন্নরত রসূল থেকে প্রমাণিত। অর্থাৎ জুমার নামাযের পূর্বে কোনো সুন্নত নামায নেই।
একদল লোক মনে করেন, বিলালের আযান শেষ হলে সবাই উঠে দুই রাকাত নামায পড়তো। আসলে এ ধারণাটি সুন্নতে রসূললে সম্পর্ক অজ্ঞতারই বহিপ্রকাশ।
একথা সুস্পষ্ট যে, জুমার নামাযের আগে কোনো সুন্নত নামায নেই। ইমাম মালিকের এটাই মত। ইমাম আহমদেরও মশহুর কওল এটাই। ইমাম শাফেয়ীর শাগরেদগণের একদলের মত এটাই।
যারা মনে করেন জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত নামায আছে, তারা জুমার নামাযকে যুহর নামাযের সংক্ষিপ্ত রূপ মনে করেন। তাই তারা জুমার জন্যে যুহরের নিয়ম প্রয়োজ্য বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁদের এই যুক্তি একান্তই দুর্বল। এর কোনো ভিত্তি নেই।
মূলত জুমার নামায সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি নামায। যুহর নামায থেকে এর স্বাতন্ত্র পরিষ্কার। এ নামায সশব্দে পড়া হয়, এ নামায দুই রাকাত, এ নামাযে খুতবা আছে এবং কতিপয় শর্ত আছে। এসবই যুহর নামাযে অনুপস্থিত। সুতরাং এ নামাযকে যুহর নামাযের সংক্ষিপ্তরূপ ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই।
তাই যারা যুহর নামাযের উপর কিয়াস করে জুমার পূর্বেও সুন্নত আছে বলে ধরে নেন, তাদের কিয়াস বাতিল। কারণ সুন্নত তো প্রমাণিত হতে হবে রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর কথা, কাজ ও সমর্থন থেকে, কিংবা খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে। কিন্তু এখান সেরকম কোনো প্রমাণ নেই।
বরং জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত নামায না পড়ার সুন্নতই রসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত। যেমনস, ঈদের নামাযের আগে পরে আর কোনো নামায না পড়াই তাঁর থেকে প্রমাণিত। সুতরাং জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত নামায না পড়াটাই সুন্নত।
যারা জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত আছে বলে ধারণা করেন, তাঁরা বুখারির ‘জুমার আগে-পর নামায’ অনুচ্ছেদে একটি হাদিসকে দলিল হিসেবে পেশ করেন। এই অনুচ্ছেদে ইমাম বুখারি সনদসহ ইবনে উমর রা. থেকে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। তাতে তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ)-
যুহরের পূর্বে দুই রাকাত নামায পড়তেন,
যুহরের পরে দুই রাকাত নামায পড়তেন,
মাগরিবের পরে তাঁর ঘরে দুই রাকাত নামায পড়তেন,
ইশার পরে দুই রাকাত নামায পড়তেন এবং
জুমার পরে ঘরে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন।”
-এই হাদিসটি জুমার নামাযের পূর্বে সুন্নত নামায থাকার প্রমাণ করেনা। হাদিসটি থেকে পরিষ্কার বঝা যায়, ইমাম বুখারি হাদিসটির শিরোনাম ‘জুমার আগে পরের নামায’ দেয়ার অর্থই হলো, যারা মনে করে জুমার আগে নামায আছে, তাদের ধারণা সঠিক নয়।
-বুখারির এই হাদিসটি থেকে একথাও সুপ্রমাণিত হয় যে, জুমার নামায যুহরে সংক্ষিপ্ত নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নামায। হাদিসে জুমার নামাযকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নামায হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
-আবু দাউদে নাফে রা. থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: ইবনে উমর রা. জুমার আগে নামায পড়তেন এবং জুমার পরে ঘরে গিয়ে দুই রাকাত নামায পড়তেন।
-এই হাদিস জুমার আগে সুন্নত থাকা প্রমাণ করেনা। ইবনে উমর রা. জুমার আগে যে লম্বা নামায পড়েছেন, তা ছিলে সাধারণ নামায। আযান দেয়া বা ইমাম আসার আগে যে ব্যক্তিই মসজিদে হাযির হবে, তার নফল নামায পড়তে থাকা উত্তম।
-এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো, রসূল (ﷺ) এর আমল সম্পর্কে ইবনে উমরের বর্ণনা এবং ইবনে উমরের আমল সম্পর্কে তাঁর নাফের বর্ণনার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ইবনে উমর রসূল (ﷺ) –এর সুন্নত বর্ণনা করেছেন, তিনি জুমার পর দুই রাকাত নামায ঘরে গিয়ে পড়তেন। আর নাফে ইবনে উমরের সাধারণ নফলের কথা বর্ণনা করেছেন। যা তিনি আগে ভাগে মসজিদে এসে পড়তেন।
-একথাও বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত, রসূল (ﷺ) –এর খুতবা প্রদানকালে একজন সাহাবি মসজিদে এসে বসে পড়লে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, মসজিদে প্রবেশ করে তুমি কি দু’রাকাত নামায পড়েছো? সাহাবি বললেন, জ্বী-না। তখন রসূ (ﷺ) বললেন: উঠে দুই রাকাত নামায পড়া।” তিনি বলেছেন: তোমাদের কেউ খুতবা প্রদানকালেও মসিজে প্রবেশ করলে সে যেনো দুই রাকাত নামায পড়তে নয়।”
-এই দুই রাকাত নামায যে জুমার সুন্নত নয়, বরং যে মসজিদে প্রবেশের (তাহিয়্যাতুল মসিজের) নামায, তা হাদিসের ভাষা বক্তব্য থেকে পরিষ্কার।
জুমার দিন আগে ভাগে মসজিদে এসে নফল নামায পড়ার জন্যে রসূল (ﷺ) উৎসাহিত করেছেন। এর ফযীলতও তিনি বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই আগে ভাগে মসজিদে এসে নফল নামায পড়তেন। ইবনে মানজার বলেন, আমার কাছে বর্ণনা পৌঁছেঠছে, জুমার আগে ইবনে উমর রা. বার রাকাত নামায পড়তেন এবং ইবনে মাসউদ রা. আট রাকাত নামায পড়তেন।
-ইবনে মাজাহতে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেছেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমার আগে এক সালামে চার রাকাত নামায পড়তেন।” এ হাদিসটির সনদ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
-রসূলুল্লাহ (ﷺ) জুমার নামায পড়ে ঘরে গিয়ে দুই রাকাত নামায পড়তেন। মূলত এ দু’ রাকাতই জুমার সুন্নত।
অবশ্য রসূল (ﷺ) জুমার পরে চার রাকাত নামায পড়ার কথা বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম)
-ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, জুমার পরে কেউ যদি সুন্নত নামায মসজিদে পড়ে, তবে চার রাকাত পড়বে। আর যে সুন্নত নামায ঘরে গিয়ে পড়ে, সে দুই রাকাত পড়বে। মূলত হাদিস থেকে একথারই প্রমাণ মেলে আবু দাউদে ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে: তিনি ঘরে পড়লে দুই রাকাত পড়তেন আর মজিদে পড়লে চার রাকাত পড়তেন।