৭. আহার পর্ব শেষ

৪১.

এদিকে আহার পর্ব শেষ। টেবিল পরিষ্কার হয়ে গেছে। ধূমপান পর্ব শুরু হয়েছে। বেয়ারা বাবুর্চি খানসামাদের খাবার ছুটি মিলেছে। এর পরে কফি আসবে। এখনও সবাই ডাইনিং ঘরেই, আলাদা আরামকেদারায় ছড়িয়ে বসেছে। ফার্ডিনান্ডও খেতে গেছে। মাস্টার হরিচরণের বাজনার এখন বিরতি পড়েছে। খানিকটা বিশ্রামের পর আবার আরম্ভ হবে।

ডাইনিং রুমে সকলেরই রক্তাভ চোখে ঈষৎ ঘুম ঘুম ভাব। পানীয় এবং আহারের ক্রিয়া শৈথিল্য এনে দিয়েছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কেউই এমনি চুপচাপ এলিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। একমাত্র লিটলজনই, আরামকেদারায় কাত হয়ে, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওয়ালেস পাইপে নতুন করে তামাক চুসতে চুসতে, জানালা দিয়ে ওপারের দিকে তাকালেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে, দাড়ির ভাঁজে একটু হাসি ফুটে উঠল। ওয়ালিকের অনুরোধ তিনি ভোলেননি। তাই তার মনের মধ্যে নানান কথা আবর্তিত হয়ে উঠছিল। ভারতবর্ষে সিপাহি মিউটিনির সেই রক্তাক্ত দিনগুলির ঠিক এক বছর পরেই তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। জর্জ হেন্ডারসন, সিনিয়র তার কিছুদিন আগেই কলকাতায় ঘুরে গেছেন। সিনিয়র হেন্ডারসন, মেসার্স জর্জ হেন্ডারসন অ্যান্ড কোম্পানির যিনি কর্তা। উদ্দেশ্য, হিন্দুস্থানে ব্যবসায়ের নতুন কোনও দিগন্ত উন্মোচন। ওয়ালেস জাভা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, বোর্নিও কোম্পানির অফিসে। তাঁদের একটা দপ্তর ছিল কলকাতায়। আর সত্যি বলতে কী, বাংলায় বোর্নিও কোম্পানির হাতে তখন কয়েক লক্ষ টাকা আলস্যে ঝিম মেরে পড়েছিল। হেন্ডারসন প্রথমে ভেবেছিলেন, বাংলার প্রথম চটকল, রিষড়া ইয়ার্ন মিলের কর্তা মি. অ্যাকলেন্ডের সঙ্গে কারবার করবেন। কিন্তু তাঁর ভারতীয় এজেন্ট বোর্নিও কোম্পানির হাতে ঘুমন্ত টাকা দেখে, তাকে জাগানোই স্থির করেছিলেন। কাজ আরম্ভ হতে দেরি হয়নি। বোর্নিও কোম্পানির ঘুমন্ত টাকার জেগে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। লাভের গন্ধ পেয়েই, অচিরাৎ কুণ্ডলী খোলা সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়েছিল। যেন শিকার পাওয়ার উত্তেজনায় ও বিক্রমে ফুঁসে গর্জে উঠেছিল। সেই প্রথম কোম্পানি, বোর্নিও কোম্পানি, যারা হোম রেজিস্টার্ড জুটমিল খুলে ছিল, পাওয়ার লুমসহ। বরানগরে ফ্যাক্টরিতে কাজ আরম্ভ হয়েছিল আঠারোশো ঊনষাটে। তখন ওয়ালেসের বয়স তিরিশ। তারপরে দুই যুগ কেটে গেছে, চব্বিশটি বছর। উনি অনেক দেখেছেন। ওয়ালিকের অনুরোধে, সেই স্মৃতিই আবর্তিত হয়ে উঠছে।

ওয়ালেসের বড় ইচ্ছে ছিল, রিষড়ায় অ্যাকলেন্ডের সঙ্গে একবার দেখা করেন। দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। সেই দেখা করবার ইচ্ছেই পূরণ হয়েছিল ডান্ডিতে, যে বছর মি. অ্যাকলেন্ড তাঁর সব হিসাবপত্র মেটাতে গেছলেন। যে বছর বরানগর থেকে কোম্পানি ওয়ালেসকে বিশেষ কাজের জন্যে ডান্ডিতে পাঠিয়েছিল।

ওয়ালেস পাইপে তামাক টিপতে টিপতে, জানালা দিয়ে বাইরে, দূর গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা ঠিক, জুট ইন্ডাস্ট্রি, এখানে এখন ফ্লো টাইডে ছুটে চলেছে। আমরা নির্ভয়, নিশ্চিন্ত অনেকখানি। তবু আপনাদের একটা সংবাদ আমি দিতে পারি, যেটা হয়তো আপনাদের কাছে একেবারে নতুন মনে হতে পারে।

সকলেই নড়েচড়ে উঠল। ওয়ালিক বলল, বলুন, বলুন স্যার।

ওয়ালেস ওয়ালিকের দিকেই ফিরে বললেন, আমরা জানি, ইংরেজ ভদ্রলোক মি. জর্জ অ্যাকলেন্ড প্রথম এখানে এসে জুট ইয়ার্ন মিলের পত্তন করেছিলেন, তাই না?

ওয়ালিক বলল, ইন্ডিয়া জুট ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে তাই তো পেয়েছি।

–কিন্তু তা নয় মি. ওয়ালিক। বাংলাদেশে, প্রথম জুট মিলের ক্রেডিট আসলে একজন হিন্দু বাঙালিরই কিন্তু প্রাপ্য হওয়া উচিত।

-ইজ ইট সো?

সকলেই যেন চমকে উঠলেন। ম্যাকলিস্টার তার বিস্ময়ের মধ্যেই বলে উঠল, অবিশ্যি বেচারাম মুখার্জিকে আমি যে রকম দেখেছি, তাতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। বাট হু, হু ইজ দ্যাট হিদেন বেঙালি, হোয়াট ইজ হিজ নেম?

ওয়ালেস বললেন, হিজ নেম বিসোয়াম্বর সেন।

 অর্থাৎ বিশ্বম্ভর সেন। ওয়াল্টার বলল, কার কাছে শুনলেন আপনি?

–মি. জর্জ অ্যাকলেন্ডের কাছ থেকেই, আমরা যাঁকে জানি, ফাউন্ডার অব দি জুট ইন্ডাস্ট্রি ইন হুগলি। তিনিই বলেছিলেন, বিশ্বম্ভর সেন, সেই নেটিভ জেন্টু লোকটা না থাকলে, আমার পক্ষে রিষড়া মিল খোলা সম্ভব ছিল না। ওর টাকা, আর ওর ইচ্ছে না থাকলে হত না।

ম্যাকলিস্টার বলল, নেটিভ জেন্টুর টাকায় রিষড়া ইয়ার্ন মিল হয়েছিল?

–ইয়েস স্যার, নেটিভ জেন্টুর টাকাতেই। মি. অ্যাকলেন্ড তো আসলে হুগলিতে এসেছিলেন। অন্য মতলব নিয়ে। এইটিন ফিফটিথ্রিতে উনি এসেছিলেন আসলে কাগজ তৈরির আশায়। সস্তা আঁশওয়ালা কোনও ভাল ঘাস বিশেষ করে যদি চাষ করা যায়, সেটাই ছিল ওঁর মতলব। শ্রীরামপুর আর বালির মাঝখানে বেশ খানিকটা জমি নিয়ে ডেয়া ঘাসের চাষ শুরু করেছিলেন। সেই ডেয়া ঘাসের কিছু শক্ত ছোবড়া নিয়ে, ফিফটিফোরে একবার ইংল্যান্ড গেলেন, যদি সাপ্লাইয়ের বরাতটা লেগে যায়। ঠিক সেই সময়েই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মি. জন কের-এর। ডগলাস ফাউন্ড্রির একজন কর্তাব্যক্তি। সেই জন কের অ্যাকলেন্ডের মাথায় ঢুকিয়ে দিল জুট। অ্যাকলেন্ড ভাবলেন জুট? হোয়াট উইল জুট ডু? ব্যাপারটার আগা মাথা ভেবে না পেয়ে, ঠিক উৎসাহিত হতে পারলেন না। অবিশ্য ওই ডেয়া ঘাসের কারবারটা বিশ্বম্ভর সেনের যোগাযোগেই চলছিল। কিন্তু সে ঘাস হোমে কেউ চিবুতে চাইলে না। উনি ইংল্যান্ড থেকে যোগাযোগ করলেন বিশ্বম্বরের সঙ্গে। রাজি থাক তো বলো, টাকা দাও, মেশিনপত্তর নিয়ে কাজের লোকজন সুদ্ধ গিয়ে হাজির হই একেবারে। নেটিভ জেন্টু রাজি হয়ে গেল, টাকাও ছিল। তারপরই তো শুরু।…

মি. জর্জ অ্যাকলেন্ড সম্পর্কে এত সংবাদ কারুরই জানা ছিল না। সবাই যেন খানিকটা বিস্মিত উত্তেজনাতেই এই সব কথা শুনছিল।

ম্যাকলিস্টার বলল, মি. অ্যাকলেন্ড একজন ইংলিশম্যান, নেটিভ জেন্টুর কথা এক্ষেত্রে আমি আনছি না, ওঁকেই ফার্স্ট পাইয়োনিয়রের সম্মান আমি দিচ্ছি। কিন্তু একটা ভারী আশ্চর্য, একজন ইংলিশম্যান জুট শুরু করেছিলেন, আলটিমেটলি আমরা স্কচরাই এখন জুট-এর সর্বত্র ছড়িয়ে গেছি।

ওয়ালিক তাড়াতাড়ি একবার লিটলজনের দিতে তাকিয়ে দেখে নিল। সে না আবার ফোঁস করে ওঠে। কিন্তু লিটলজন তখন সত্যি গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তার মুখখানি ঝুলে পড়েছে। আসলে ওয়ালিকের মন পড়ে আছে অ্যাকলেন্ডের কাহিনীর দিকেই। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে সে অনুরোধ করল, মি. অ্যাকলেন্ডের কথা বলুন, হিজ এক্সপিরিয়েন্সেস। আপনি কোন সময়ে ওঁকে দেখেছিলেন?

ওয়ালেস বললেন, এইটিন সিকসটিএইটের মাঝামাঝি ডান্ডিতে, টে নদীর ধারে এক অপরাহে মি. অ্যাকলেন্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। একজন হতাশ, প্রায় বৃদ্ধ ব্যক্তি, কয়েকদিনের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ডান্ডিতে এসেছিলেন, রিষড়ার হিসেবপত্র মেটাতে। সে সময়েই দেখা হয়েছিল। নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতে, উনি আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। আমার মুখের রং, আর গায়ের হরিণের চামড়ার কোটটা দেখেই নাকি উনি সন্দেহ করেছিলেন, আমি ইন্ডিয়া ফেরত। যেচেই আলাপ করেছিলেন। বলেছিলেন, আপনি বোধহয় ভারতফেরতা? তারপরে বোর্নিও কোম্পানি ক্যালকাটার কর্মী শুনে আর ছাড়লেন না। টে নদীর ধারে, সেই ধূসর বিকেলের কথা আমি ভুলতে পারি না। উত্তর সমুদ্রের হাওয়া বইছিল। তবু শীত ছিল খুবই। খেয়া পারাপার করছিল মাঝিরা। টে নদীতে তখন প্রায়ই স্টিম লঞ্চের ফটফট শোনা যায়। আর ডান্ডির টে নদীর ফার্থ পেরিয়ে এসেই তো তিমি শিকারের সেই সব বড় বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকত। অনেক ভিনদেশি লোকেরও ভিড়। দূরে সমুদ্রে হারপুন নিয়ে যারা অধিকাংশ সময়ে পাগলের মতো কাটিয়ে আসে। যখন কূলে আসে, তখন তারা গাঁয়ের পথ চেয়ে থাকে। ডান্ডির মেয়েরা ঘর সংসার ছেড়ে আসত তিমি শিকারিদের অভ্যর্থনায়। আর

কথা শেষ না করেই ওয়ালেস হেসে উঠলেন।

সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ওয়ালেসের কথা। এ সব কথা যদিও সকলেরই প্রায় কিছু কিছু জানা, তবু ওয়ালেসের মুখ থেকে শুনতে তাদের ভাল লাগছিল। ওয়ালেসের একটি বিশেষ সুর ছিল। বলার একটি বিশেষ ভঙ্গি, ভাষার মধ্যে একটি ওয়ালেসীয় বৈশিষ্ট্য ছিল।

-হাসছেন যে? ওয়ালিক জিজ্ঞেস করল।

 ওয়ালেস বললেন, হাসি পেল একটি কথা মনে করে। আমরা এখানে নেটিভদের গঙ্গার ধারে প্রাকৃত কর্ম দেখে বিরক্ত হই, গালাগালি দিই, ঘৃণা করি। ডান্ডির আরও একটু পেছিয়ে পুরনো দিনের কথা মনে করুন। আমরা সকলেই প্যান্টলুন খুলে টে নদীর ধারে বসে যেতাম সারি সারি। মেয়েরাও বাদ যেত না। সেদিক থেকে আমি বলব, নেটিভ মেয়েরা অনেক বেশি সভ্য। আমাদের ব্লন্ড মেয়েরা সোনালি চুলে মুখ ঢেকে বসে থাকত, পুরুষ দেখলেও উঠত না। তার জন্য দুর্ঘটনা তো প্রায়ই ঘটত।

বলতে বলতে ওয়ালেস হেসে উঠলেন। অন্য সকলেও হেসে উঠল। ইতিমধ্যে কখন লিটলজনের নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, দুর্ঘটনা কীসের?

লিটলজনের প্রশ্ন শুনে সকলের মিলিত গলার হাসি আর একবার দুর্বার হয়ে উঠল। লিটলজনের ঘুম ভাঙা মাতাল মুখটা বোকা বোকা দেখাতে লাগল।

ওয়ালিক বলল, বুঝতে পারলেন না? দুর্ঘটনা, মানে দুর্ঘটনা।

ওয়ালিকের বোঝাবার কায়দা দেখে সকলের হাসি আবার ফেটে পড়ল। সে আর বেশি ব্যাখ্যা করতে পারল না।

লিটলজন গম্ভীর হয়ে উঠল। এতক্ষণে ব্যাপারটা সে আন্দাজ করতে পেরেছে। মনে মনে বলল, এরা কি এ ছাড়া আর কথা বলতে জানে না? এই স্কচদের সঙ্গে কী করে সে কাজ করবে।

ওয়ালিক আবার আরম্ভ করলেন, মিস্টার অ্যাকলেন্ডের কথাই বলি। ওই নদীর ধারে বসেছিলাম দুজনে। অ্যাকলেন্ড বললেন, মি. ওয়ালেস, বেঙ্গলে কাজ করছ কর, তোমাদের বোর্নিও কোম্পানির উন্নতি কামনা করি। কিন্তু খুব সাবধান। লোভ সামলে থাকবে। কষ্টসহিষ্ণু হবার চেষ্টা করো। তা নইলে হার মেনে চলে আসতে হবে। যত সহজে বাজি মাত করা যাবে ভেবেছিলাম, তত সহজ নয় ব্যাপারটা। মনে রাখতে হবে, ক্লাইভের মুর্শিদাবাদ জয়ের চেয়ে এটা কিছু কম কঠিন নয়। এখানে তোমাকে ঘোড়া ছুটিয়ে, সোর্ড নিয়ে দৌডুতে হবে না বটে। কিন্তু তার চেয়েও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি চাই। ভবিষ্যৎকে দেখতে পাওয়া চাই। একটু ভুল করেছ তো তোমাদেরও আমার মতো সওয়ারহীন আহত যুদ্ধের ঘোড়ার মতো বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকতে হবে। সেই ঘোড়াটা নিজেকে তখন যতই মুক্ত মনে করুক, আসলে তার জীবনের দাম ফুরিয়ে যায়। বিজেতা চাষাদের মাল বইবার কাজ ছাড়া তার আর কিছুই করবার থাকে না। প্রতিদানে আধপেটা খাওয়া আর গোরে যাওয়ার দিনটির জন্য অপেক্ষা করা।

বলতে বলতে ওয়ালিকের গলার স্বর করুণ হয়ে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম অ্যাকলেন্ডকে, এ কথা বলছেন? আপনার কি সে ব্যবস্থা হয়েছে?

মি. অ্যাকলেন্ড বললেন, না দু-মুঠো খেতে আমি পাব। যতদিন বেঁচে থাকব আমি আর আমার বুড়ির জীবনটা মোটামুটি চালিয়ে নিয়ে যাব ঠিকই। দেখ, সিকসটি সেভেনের রিফর্ম বিল, কিংবা আসন্ন এডুকেশন বিল, এ সব নিয়েও আমার আর মাথা ঘামাবার কিছু নেই এখন আর। ডিজরেলি আর গ্ল্যাডস্টোনের বিতর্কও আমাকে আর উত্তেজিত করবে না। এমনকী কুইন ভিক্টোরিয়া আর ডিজরেলি হুইসপারিং আমাকে এখন আর উৎসাহিত করে না। লন্ডনের মফস্বলে আমার দিনগুলো, একরকমের প্রাকৃতিক নিয়মে কেটে যাবে, তবু পুরনো দিনগুলোর কথা তো ভোলা যায় না। আমার যা অবস্থা ছিল তাতে হোমে এসে আমি রেগুলার একটা এস্টেট কিনে বসতে পারতাম। আমার কফি প্ল্যান্ট প্রচুর লাভের ব্যবসা ছিল সিলোনে। প্যালেসিয়াল বাড়ি করেছিলাম আমি। আমাদের দু-তিনটি মানুষের জন্য খাটত প্রায় একশোটা দাসদাসী। কফির মতো গায়ের রং, কালো চুল, কালো চোখ যুবতীরা সেবা করত। আমাকে সম্মান করার জন্য তারা বুকে কাপড় দিত না। তারা আমাকে ডাকত আমাজান বলে। সকলেই ছিল আমার আশ্রিত সন্তান। আমি তাদের শাসন করতাম। সেই দ্বীপের আমি ছিলাম ননঅফিসিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মেম্বার। সেটা বড় কথা নয়, গোটা সিলোনদ্বীপের উপরেই ছিল আমার আধিপত্য। আমি বুড়ো হয়েছি, অনেক হারিয়েছি, তাই আমার অতীতের কথা বলতে ভাল লাগছে ওয়ালেস। সেদিন মি. অ্যাকলেন্ডকে থামানো গেল না। থামাতে আমি চাইনিও। তিনি একটানা বাতাসের গোঙানির মতো আবেগ ভরা গলায় বলেই চললেন, আমি হাতিতে চড়ে বেড়াতাম। শত শত লোক নিয়ে শিকারে যেতাম। আমার দুই ছেলে, চালর্স আর ফ্রেডও হাওদায় চেপে শিকারে যেত আমার সঙ্গে। ওদের মাও যে মাঝে মাঝে না যেতেন, তা নয়। ফ্রেডের মা আমার খুব ডানপিটে বউ ছিলেন। তাঁর মৃগয়ায় বেরোনো মানেই প্রেম। উনি সঙ্গে গেলে শিকার-টিকার বিশেষ হত না। ছেলেদের তিনি অন্য হাওদায় চাপিয়ে দিয়ে আমার কাছে থাকতেন। হাওদার চারদিকে পরদা টেনে দিয়ে, দিব্যি গদির উপর শুয়ে পড়তেন। আমাকেও টেনে নিতেন। প্রেম ছাড়া আমার সেই প্রবাস-সঙ্গিনী বউটি কিছুই জানতেন না। হাওদায় চেপে তিনি প্রেম করবেন। বলতেন হাতি এমনি দুলে দুলে চিরদিন চলতে থাকবে, আর আমি চিরদিন এমনি করে তোমার কাছে থাকব জর্জ। ওঁর উত্তাল প্রেমের সমুদ্রে আমি চিরনবীন দ্বীপের মতোই ভেসে থাকতাম। ইংল্যান্ড ছেড়ে প্রথম তো এসেছিলাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেরিন সার্ভিসে। সেটা ছেড়ে, প্রথম ব্যবসা মাথায় ঢুকেছিল বলেই সিলোনে গিয়েছিলাম। কিন্তু অন্য নতুন ব্যবসার চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছিল, সেই নতুন ব্যবসা হল পেপার ওয়ার্কস। আঠারোশো তিপান্নতে তাই কলকাতায় গিয়েছিলাম। স্ত্রী ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম হোমে। কলকাতায় গিয়ে ডেনিশ কলোনি সিরামপোর আর বালীর মাঝখানে কিছু জমি নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম, কাগজের জন্যে ভাল, শক্ত এবং ফাইবার আছে, এরকম কোনও ঘাস তৈরি করা যায় কিনা। বিসোয়ম্বর সেনের সঙ্গে তখন থেকেই আমার আলাপ। ডেয়া ঘাসের চাষও করেছিলাম, আর সেই ঘাসের গোছা নিয়ে হোমের মার্চেন্টদের দেখিয়ে একটা ব্যবস্থা করবার জন্যে ইংল্যান্ডে এসেছিলাম। সেই সময়ে ডগলাস ফাউন্ড্রির মি. কের-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, উনি মাথায় ঢোকালেন জুট। জুট ইন্ডাস্ট্রি! বললেন, মি. অ্যাকলেন্ড, ইট উড বি মোর প্র্যাকটিকাল টু টেক জুট মেশিনারি টু বেঙ্গল হোয়্যার দি জুট কমস ফ্রম অ্যান্ড স্পিন ইট দেয়ার। তারপরেই বিসোয়াম্বর সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে, মি. কেক-এর সঙ্গে এসেছিলাম ডান্ডিতে, সেটা এইটিন ফিফটিফোরের শুরু। ডগলাস ফাউন্ড্রি রাজি হয়ে গেল, ওরা আমাদের দিল প্রিপেয়ারিং আর স্পিনিং মেশিনারিজ। কিন্তু এ সব মেশিন অপারেট করবে কে? রেললাইন পাতবার উদ্যোগ তখন চলেছে বটে ক্যালকাটায়, কিন্তু, এ সব মেশিন চালাবার লোক কথায় পাব। মেশিনকে ওখানে বসানোই তো একটা সমস্যা। বেঙ্গলের প্রিমিটিভ হোম ইন্ডাস্ট্রির জুট কারিগরেরাও নিশ্চয় পারবে না। অতএব, দুই ছেলেকে নিলাম, চার্লস অ্যান্ড ফ্রেড, আর কয়েকজন ডান্ডি মেকানিকস এবং ওভারশিয়ার, মি. ফিনলে তার মধ্যে প্রধান। উনিও ওঁর দুই ছেলেকে সঙ্গে নিলেন। ছেলেদের মধ্যে একজনকে বোধহয় তোমরাও চেন, জন ফিনলে, সে এখনও হুগলির মাটি কামড়ে পড়ে আছে। আমার বিশ্বাস, সে রাইজ করবে। যাই হোক, জাহাজ ভরতি মেশিনারিজ নিয়ে হুগলিতে গিয়ে রিচ করলাম। ঘাসের এক্সপেরিমেন্টের জন্যে, জমি তো আমার আগেই অ্যাকোয়ার করা ছিল। বিসোয়াম্বর সেনের টাকার অভাব ছিল না। যাবতীয় খরচা সে জোগাতে লাগল। গ্রামটার যর্থার্থ নাম ছিল রিষড়া, শ্রীরামপুরের কাছেই, যেখানে কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বাগানবাড়ি ছিল। যে বাগানবাড়িতে, হেস্টিংস তার প্রিয়তমা ম্যরিয়নকে নিয়ে ভোগ করে গেছেন। এ বিউটিফুল, সপ্লেন্ডিড গার্ডেন হাউস। আমাদের দখল করা জমির মধ্যেই সেই বাগানবাড়িটা যেহেতু ছিল, ওটা আমি তাই নষ্ট হতে বা ভাঙতে দিইনি। ওটা আমি প্রিজার্ভ করেছিলাম।…আচ্ছা ওয়ালেস, তুমি আমাকে বলতে পার, এখন সেই বাগানবাড়িটার কী অবস্থা? শুনেছি Muir Co. এখন কারখানার দখলিস্বত্ব পেয়েছে, নাম দিয়েছে ক্যালকাটা জুট মিলস্ কোং লি.।আমি বললাম, শুনেছি মিল অ্যাসিস্টান্টসরা বাড়িটা ভোগ করছে, ওটা তাদের মেস কোয়ার্টার হয়েছে। অ্যাকলেন্ড চুপ করে মাথা নাড়তে লাগলেন। টে নদীর ফার্থের (বিশাল মোহানা) আকাশে তখন মৃত মানুষের মুখের মতো রং লেগেছে। আসন্ন রাত্রিরই আভাস সেটা, কিছুক্ষণ হাওয়া লাগলেই আস্তে আস্তে যেমন বিশ্রী কালো হয়ে ওঠে। একটু পরে বললেন, হয়তো সেটাই ঠিক। ব্যবহার করলেই, বাগানবাড়িটা হয়তো ঠিক মতো প্রিজার্ভ করা হবে।..যাই হোক, মি. ফিনলে, নেটিভ বিসোয়ম্বর আর আমি, তিনজনে কোম্পানির নাম স্থির করলাম, রিষড়া টুইন অ্যান্ড ইয়ার্ন মিলস কোম্পানি লিমিটেড। আমি নিজের মনের মতো করে বাংলোর প্ল্যান তৈরি করলাম। নিজে সুপারভাইজ করে, কারিগরদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছি। এখনও সেই বাড়িটাই আছে। অবিশ্যি, কারখানাটা আমাকে তখন টিপিকাল নেটিভদের পাতা ছাওয়া চালার ঘরের মতো করে নিতে হয়েছিল। আর্থিক যোগ্যতা ঠিক ততটা ছিল না যে, পাকা কারখানাবাড়ি করে নিতে পারি।…আচ্ছা, বলতে পার হে বরানগর পাইয়োনিয়র, এখন কত টনের কাজ হচ্ছে বেঙ্গল ফ্যাকটরিগুলোতে? হাজার টন হবে কি? আমি বললাম, না, দুশো আড়াই শো টন হতে পারে। অ্যাকলেন্ড বললেন, আমরা প্রথমে রোজ আট টন জুট ইয়ার্নের কাজ করেছি। ফ্রম দিস মডেস্ট বিগিনিং এখনও দুশো-আড়াই শো টনে উঠেছে। যে পরিমাণ কারখানা রেজেস্ট্রি হচ্ছে, এটা হাজার হাজার টনে গিয়ে দাঁড়াবে।

এ পর্যন্ত বলে ওয়ালেস থামলেন। নিভে যাওয়া পাইপে কয়েকবার টান দিলেন। শুধু কষটা চেটে নিয়ে আবার বললেন, মি. অ্যাকলেন্ড ঠিকই বলেছিলেন তখন। আমরা প্রায় দেড় হাজার টনে পৌঁছুচ্ছি। মনে হয়, বিংশ শতাব্দী শুরু না হতেই, আমরা ডেইলি দু হাজার টন ছাড়িয়ে যাব।

মি. ওয়ালেসের গলায় এমন একটা দৃঢ়তা আর আশ্বাস ফুটে উঠল, সকলেই যেন সেই সুদিনের স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ম্যাকলিস্টার শুধু উচ্চারণ করলে, মোর দ্যান টু থাউজ্যান্ড টনস!

ওয়ালেস বললেন, ইয়েস স্যার, মোর দ্যান টু থাউজ্যান্ড টনস!

ওয়ালিক ব্যগ্র স্বরে বলল, কিন্তু আপনি সেই ফিরে যাওয়া, ব্যর্থ মানুষটির কথাই বলুন মি. ওয়ালেস, সেই প্রথম মানুষটির কাহিনী বলুন, হু স্টার্টেড উইথ ডেইলি এইট টনস ওনলি!

মিনে করা পিতলের বড় বাটিতে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে ওয়ালেস বললেন, তারপরের কথা তো সামান্যই। কাজের মধ্যে, ফিফটি সেভেনে কিছু হ্যান্ডলুম ফ্রেম বসিয়েছিলেন, বছর দুয়েক পরে, হ্যান্ডলুম সরিয়ে সেটা পাওয়ার লুম করেছিলেন। কাজের মধ্যে, এ পর্যন্তই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। আসল গোলমালটা হয়েছিল অন্য জায়গায়। মি. অ্যাকলেন্ডের ভাষায়, ও জুট, গোল্ডেন জুট! ইট ইজ আওয়ার ক্রাইম। ক্রাইম অব ফাদার অ্যান্ড সনস। সোনালি রং-এর পাট আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি আমরাই, লোভীর মতো তার গা থেকে চেটে চেটে সব সোনা তুলে ফেলেছিলাম। প্রথম থেকেই ব্যবসা এমন লাগামছেঁড়া ঘোড়ার মতো দৌড়তে আরম্ভ করল যে, ছোটার নেশায় আমাদেরও পেয়ে বসল। ভুলে গেলাম, তেজি ঘোড়াটা দানাপানি ঠিকমতো না পেলে, ও একদিন হাঁপিয়ে পড়তে পারে। দৌড় শেষ হয়ে আসতে পারে। আসলে কী জান ওয়ালেস, ইন্ডিয়ার চারিদিকে দেখেশুনে, নবাবি করবার একটা মেজাজ এসে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ার সয়েলেরই গুণ কিনা ওটা, কে জানে। তার ওপরে ছিল আমার কফি প্লান্টারের জীবনের নানান দোষ। নবাবিয়ানাটা সেখানেই পাকাঁপোক্তভাবে রপ্ত করেছিলাম। সে জীবনটা তো আমি একেবারে ফেলে আসিনি। আর, জুটে নগদ টাকার কারবারটা আরও বেশি ছিল। বাপ ব্যাটা, কেউই আমরা ঠিক সামলে চলতে পারিনি।

আমার তো মনে ছিল না, আমি নতুন ধরনের ইন্ডাস্ট্রিজে হাত দিচ্ছি। আর প্লান্টেশন এবং যন্ত্র, এ যে সম্পূর্ণ আলাদা চোখে দেখলেও তার চরিত্র বুঝে চলতে ভুল হয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি যুগ বদলাচ্ছে। যন্ত্র দিয়ে, একটা নতুন যুগ তৈরি হতে চলেছে। তার গতিবিধি সম্পূর্ণ ভিন্ন। না বুঝে মনের আনন্দে আমি ল্যাভিশলি চালিয়ে যাচ্ছিলাম।…অথচ আমি ভয় করেছিলাম সিপাহি বিদ্রোহকে। বছরখানেক বাদেই তো সিপাহি রেবেল ব্রেক করল। গঙ্গার ওপারে বারাকপুরের ব্যারাকে তখন জেনারেল হিয়ারসে ছিলেন। ভয়ে কারখানা কাঁটা তার দিয়ে ঘিরে ফেললাম। বিসোয়াম্বর সেন কি লোক নিয়ে এসেছিল গাদা বন্দুকধারী। আমি তাদের বিশ্বাস করতে পারিনি। চার্লসকে পাঠালাম বারাকপুরে জেনারেল হিয়ারসের কাছে। জেনারেল বলে পাঠালে, তোমার বাবাকে গিয়ে বলল, হিয়ারসের কাঁধে যতক্ষণ মাথা আছে, ততক্ষণ যেন নিশ্চিন্ত থাকে সে। কিন্তু হিয়ারসের কাঁধে মাথা অ্যাট অল থাকবে কি না কে জানে। আমি তাড়াতাড়ি ক্যালকাটা সেইলারস হোম থেকে কিছু সিম্যানদের নিয়ে এসে মুজল লোডিং শট গান দিয়ে বসিয়ে দিলাম পাহারায়। প্রায় আহার নিদ্রা বন্ধ আমাদের। চারিদিকে নানানরকম গুজব। রাত্রে কুকুর ডেকে উঠলেই বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করত। এই বুঝি দিলে আগুন লাগিয়ে। কিন্তু হিয়ারসেরই জয়। রেবেল বন্ধ হল কঠিন হাতে। বারাকপুরেই প্রথম শুরু হয়েছিল বটে। অল্প দিনের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও, ইন্ডিয়ার নর্দান এরিয়াতেই সবথেকে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটেছিল।…তবে রিষড়া ইয়ার্ন কোম্পানির সেটা কোনও দুর্ভাগ্য নয়। নতুন ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে গিয়ে প্রচুর লাভের ব্যাপার দেখে আমরা সবাই বেহিসাবি জীবন কাটাচ্ছিলাম। এ যে আরও কঠিন। ধৈর্য আর সংযমের দরকার ছিল, সেটাই বুঝতে পারিনি। সেমি ফিউডাল প্ল্যান্টারের জীবনের রোমান্স তো আমি ভুলতে পারিনি। ওয়ালেস, মাথার ওপরে ভগবান আছেন। তিনি কখনও পাপীকে ক্ষমা করেন না। যে ইন্ডাস্ট্রিকে আমার চার্চের মতো ভক্তি আর অধ্যবসায় নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলার কথা, সেই ইন্ডাস্ট্রি করতে গিয়ে আমি, আমরা সবাই, আমার ছেলেরাও, সকলে, ফুর্তিতে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। খরচের মাপ ছিল না। একদিকে অনভিজ্ঞতা, আর একদিকে কলকাতার মেয়ে মদ বিলাসব্যসন, ইয়ার্ন কোম্পানিকে টুটি টিপে ধরলে! এইটিন সিক্সটি সেভেনে আর টিকে থাকা গেল না। এই গত বছরের কথা বলছি। কারখানা বন্ধ করে দিতে হল। আমি দেশের পথে পাড়ি দিলাম। চার্লসের মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, দেশে আমি ফিরব না। এই বাজে ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে থাকব না আমি।…আমাকে যা তা বললে। সিলোনের কফি প্ল্যান্টেশনটা হাতছাড়া করেছি বলে, তার সঙ্গে আমার মতবিরোধ আগের থেকেই ছিল। আমার এই বড়ছেলে চার্লসের রক্তের মধ্যেই ছিল খাঁটি প্লান্টারের ঐতিহ্য। ঢিলেঢালা চলন, শাসনের বাসনা, বুক খোলা যুবতী মেয়েদের হাতে স্নান করা, পোশাক পরা আর তারই সঙ্গে প্ল্যান্টেশনের অন্ধিসন্ধির অভিজ্ঞতা। সে আমার সঙ্গে দেশে ফিরল না। চলে গেল কুমায়ুনে, কফি প্ল্যান্টের উদ্দেশ্যে। চার্লস ঠিকই করেছে। এখন সে কুমায়ুনের একজন টি প্ল্যান্টার। কয়েকদিন আগেই সে মস্ত বড় একটা কুমায়ুনের বাঘের মাথা পাঠিয়েছে আমাদের। আর ছোটছেলে ফ্রেড চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। সে এখনও নানান কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারেনি। ও বেচারিরই সবথেকে বেশি গোলমাল হয়ে গেছে। ছোট থেকে সবকিছুই তৈরি পেয়েছে, হাতেকলমে বিশেষ কিছু করতে হয়নি। এখন খুবই হতাশ। আমি এখন ডান্ডির হিসাব মেটাচ্ছি। আর কয়েকটা দিন গেলেই কাজ মিটে যাবে, তারপরে ফিরে যাব ইংল্যান্ডে।…একটা নিশ্বাস ফেলে মি. অ্যাকলেন্ড চুপ করলেন। তখন নিবিড় ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। আমার আর দেরি করা চলছিল না, উঠতে চাইছিলাম। কিন্তু মি. অ্যাকলেন্ড অনুমতি না করলে উঠতে পারছিলাম না। মনটাও আমার সত্যি খারাপ হয়েছিল ওঁর জন্যে। যদিও, ভয় আমি একটুও পাইনি। কারণ সবথেকে খারাপ দিনগুলো আমরা পার হয়ে এসেছিলাম।…একটু পরেই মি. অ্যাকলেন্ড হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, চলো, যাওয়া যাক।চলতে চলতে বললেন, সত্যি তোমরা বোর্নিও কোম্পানির লোকেরাই খাঁটি ইন্ডিয়ান জুট ম্যানুফ্যাকচারার। তোমাদের দেখে আমার শেখা উচিত ছিল। আমি যে বছর মিল এক্সটেন্ড করলাম, তোমরা সে বছর শুরু করলে। অথচ আজ আমি কোথায়, আর তোমরা কোথায়! জানি, আমি জানি হে ওয়ালেস, প্রথম বছরগুলোতে তোমরা কী ভীষণ কষ্ট করেছ। লোকের কাছে শুনেছি, বোর্নিও কোম্পানির স্কচ কর্মচারীরা ইন্ডিয়ান কুলিদের মতো খাটতে পারে। তারা টডি (তাড়ি) ড্রিঙ্ক করে। বাংলোতে শুধু রাত্রে শুতে যায়। তাই আজ তোমরা নিরাপদ সীমানায় পৌঁছেছ। এখন হয়তো কিছু বেশি খরচ করলেও তোমাদের কিছু যাবে আসবে না। এখন তোমাদের দুটো মিল। ডক্টর বেরির গৌরীপুর, ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জির ইন্ডিয়া মিল, সকলেই বেশ ভাল আয় করছে। মাঝে মাঝে তাই একটু অবাক হয়ে ভাবি, বুঝলে ওয়ালেস, মনে কিছু করো না, ভাবি কী যে, জুট ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ইংলিশম্যানের বোধহয় কোনও অভিশাপ জড়িয়ে আছে। এখন যে কটা কোম্পানি কাজ করছে, তারা সবাই স্কচ, তাদের কর্মচারীরাও তাই। আর সব কোম্পানিই বেশ দ্রুত উন্নতি করছে। দেখে মনে হয়, জুট ইজাফর স্কচ ওনলি। আমি বললাম, হয়তো তাই। আপনিই তো বলেছিলেন, বোর্নিও কোম্পানির কর্মচারীদের কষ্টের কথা আপনি সবই জানতেন। অ্যাকলেন্ড বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই বলব, তোমরা অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু, কর্মঠ। তোমরা পারবে, তোমরা পারবে। আমি তো চোখ বুজলেই ভবিষ্যৎ দেখতে পাই, তোমরা চটকলে ছেয়ে ফেলেছ বাংলাদেশ। হয়তো আমি হেরে গেছি, কিন্তু আমরই স্বপ্ন আমি সার্থক হতে দেখছি এখনও। এগিয়ে চলল, এগিয়ে চলো ওয়ালেস, আমি ডান্ডি বুলেটিন পড়ে পড়ে সব জানতে পারব তোমাদের সফল অভিযানের কথা। তোমাকে আমি বলে দিচ্ছি, বেঙ্গল উইল বি এ কান্ট্রি অব জুট মিলস। গুডনাইট মাই বোর্নিও কোম্পানি পাইয়োনিয়র।এই বলে উনি চলে গেলেন।…

ওয়ালেস চুপ করলেন।

ম্যাকলিস্টার খালি ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, এ কান্ট্রি অব জুট মিলস।আর সকলেই চুপ করে রইল। ধূমপানও তখন সকলের মিটে গেছে। মাস্টার হরিচরণের একক বেহালা বাজছে তখন পাশের ঘরে। কখনও চাপা তীব্র কান্নার মতো, কখনও হাসি ও কান্নায় ভেঙে পড়া তরঙ্গের মতো মাস্টার হরিচরণের জাদুকরি বেহালার সুর সমস্ত পরিবেশটাকে মোহময় করে তুলেছে। চুক্তি অনুযায়ী এটাই শেষ বাজনা। ভান্ডা গুণীর কদর বোঝে। হরিচরণকে বেহালার বুক থেকে মুখ সরাতে হয়নি। ভান্ডা তার মুখে অতি সন্তর্পণে মদ ঢেলে দিয়েছে। হরিচরণের চোখ আরও লাল হয়েছে কোকিলের মতো। কিন্তু ছড়ের টানে এক চুল এদিক ওদিক নেই। একটু শৈথিল্য নেই তার। তার সঙ্গী গোরারাও হাঁ করে তাকিয়ে ছিল।

হরিচরণ জানে না, সে বিটোফেনের সিমফনি বাজাচ্ছে। সে তার কলকাতার গোরা মাস্টারের কাছে শেখা মুখস্থ করা গত বাজিয়ে চলেছে। এই সুরের সঙ্গে একাত্ম নতুন জুট ম্যানুফ্যাকচারাররা। চটকলের কাহিনীর আসরে বসে তারা যেন এই সুরের সঙ্গেই বাংলার প্রথম চটকলের স্মৃতির পিঞ্জরে বাঁধা পড়ে গেছে।

ম্যাকলিস্টার ফিসফিস করে বলল, এই আমাদের প্রথম ইন্ডিয়ান চটকলের ইতিহাস। আশ্চর্য! সেদিনে আর এদিনে কত তফাত। অ্যাকলেন্ডের যুগ আর কোনওদিন ফিরে আসবে না।

ওয়ালেস বললেন, আমি আপনাকে এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম মি. ম্যাকলিস্টার। ইট ইজ টু ফার ফ্রম অ্যাকলেন্ডিয়ান এজ। কেবল একটু ভারসাম্য রক্ষা করে চলা, একটু ব্যালান্সড ওয়েতে চললে, আমাদের আর ঠেকাবার কেউ নেই। আগামী দিনে আমি আপনাদের তেরোটি নতুন মিলের কথা ঘোষণা করেছি। আমি নতুন করে ঘোষণা করছি, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে প্রবেশ করেই, আমরা ভারতবর্ষে হান্ড্রেড কভার করে ফেলব। একশোটা মিল হয়ে যাবে।

ওয়াল্টার বলে উঠল, কিন্তু স্যার, আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে।

বাড়ুক। বাড়বেই তো, প্রতিযোগিতার যুগই তো আসছে। কিন্তু যা করবার তা আপনারাই করবেন এই ইন্ডিয়াতে বসে। আপনাদের আর কোনও বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। পাঁচটা মহাদেশকে আপনারা ইন্ডিয়ান ম্যানুফ্যাকচারাররা ভাগাভাগি করবেন, কে কোথায় কত মাল পাঠাতে পারেন। তবু পাঁচটা মহাদেশ আপনাদের হাতে। কে কত কারবার করবেন, করুন না, যত খুশি প্রতিযোগিতা করুন। সারা পৃথিবীতে তো আপনারাই একমাত্র আছেন, যারা জুটকে নিয়ন্ত্রিত করবেন। পাট তো আর কোনও দেশের অধিকারে নেই। মি. ম্যাকলিস্টার ডান্ডির কথাই শুধু বলছিলেন। আপনি যদি তাদের প্রতিযোগী হিসেবে ধরেন, তা হলে শুধু ডান্ডি কেন স্যার, ফ্রান্সও তো আপনার কমপিটিটর। ইউরোপ আর আমেরিকায় অনেকের সঙ্গেই তা হলে আপনাকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। কারণ, আঠারোশো তেতাল্লিশে ফ্রান্স চটকল খুলেছে। ইউ. এস. খুলেছে আটচল্লিশে। জার্মান একষট্টিতে, অস্ট্রিয়া উনসত্তরে, বেলজিয়াম একাত্তরে। আর এশিয়ার মধ্যে জাপান তো এ বছরেই খুলেছে। খুব শীগগিরই আরও যারা খুলবে, তারা হল, ইটালি, হল্যান্ড, স্পেন, চেকোশ্লোভাকিয়া।

ম্যাকলিস্টার বলল, তবু আপনি বলছেন, ইন্ডিয়ার বাইরে আমাদের কমপিটিটরের ভয় নেই?

ওয়ালেস দৃঢ় স্বরে বললেন, না নেই। আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে আমাদের কাউকে ভয় পাবার কিছু নেই। ইট ইজ বেঙ্গল স্যার, বেঙ্গল, দি কান্ট্রি অব জুট!

ওয়ালিক বলে উঠল, শুধু তাই নয়। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, জুট ইন্ডাস্ট্রির এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর নেই। এটা জুটের দেশ তো বটেই, তারপরে এই হুগলি নদী, কাছেই বন্দর। রেললাইনও ইফ মাইল অ্যাওয়ে। কোল মাইনস এরিয়া, রানীগঞ্জও দূরে নয়। এবং সবথেকে লক্ষণীয় বিষয় হল, এখানকার নেটি ভরা, স্পেশালি দি মেকানিকাল ওয়ার্কস অব জুট। যেন মনে হয়, এক শ্রেণীর মানুষের জন্মই হয়েছে শু জুট ইন্ডাস্ট্রির কাজের জন্যে। এত সহজে এরা কাজটাকে রপ্ত করছে, যেটা আর কোথাও সম্ভব হত বলে আমার মনে হয় না। ওনলি ডিফিকাল্টি, এদের ট্যাকল করা।

ওয়ালেস বললেন, ঠিক বলেছেন মি. ওয়ালিক, এই ঠিক হাতেকলমে কাজ করা মানুষেরই কথা। ম্যাকলিটার বনল, এই যুক্তিগুলো অবশ্যি আমিও মানি, এবং জানি। কিন্তু, এই যে বিভিন্ন দেশে জুটমিল তৈরি করছে, এরা মেশিনারিজ পাচ্ছে কোত্থেকে?

ওয়ালেস হেসে উঠে বললেন, যেখান থেকে আপনারা পাচ্ছেন, সেই ডান্ডি থেকেই!

ম্যাকলিস্টার উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, এর মানে কী? ডান্ডি যে সারা দেশে দেশে মেশিনারিজ ছাড়ছে, এতে কি আমাদের বাজার নষ্ট করা হচ্ছে না? এতে কি আমাদের সঙ্গেই শত্রুতা করা হচ্ছে না? ওরা ইউরোপে আর ইউ. এস. এ-তে বসে, আমাদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করতে চাইছে না?

ওয়ালেস নিরুত্তেজিত, নিরুদ্বেগ গলায় বললেন, হয়তো চাইছে। স্বাধীন ব্যবসায়ের শর্তকে যখন মেনে নেওয়া হয়েছে, এবং মেশিনারিজের সবটাই যখন ওদের হাতে। কিন্তু তাতেই বা ভাববার কী আছে মি. ম্যাকলিস্টার। আপনাকেও তো সে মেশিনারিজ দিচ্ছে। আপনি এটা বোঝেন না, আমরা যদি একটু ভেবেচিন্তে চলি, ওয়ার্ল্ড মার্কেট কখনওই আমাদের হাতছাড়া হতে পারে না। ডান্ডির গলাবাজির কারণ তো তাই, তারা ভয় পাচ্ছে আমাদের। তারাও জানে, আমরা যেখানে বসে আছি, জুটের চাবিকাঠি সেখানেই। আমরা ঠিকমতো চললে, ও সব ফ্রান্স বেলজিয়ামের কারখানা দুদিনে লাটে উঠে যাবে। এই বলে দিলাম। আর কিছুকাল অপেক্ষা করুন। ইউরোপের জুট ইন্ডাস্ট্রির উৎসাহ আপনি নিজের চোখেই নিভে যেতে দেখবেন। আমাদের থামাবার আর কোনও রাস্তা ওদের নেই।

ম্যাকলিস্টার শুনল। বাকিরা মাথা নেড়ে খুশিতে হেসে উঠল। ম্যাকলিস্টার চোখ ছোট করে বলল, তবু একটা জিনিস ওদের হাতে থেকে যাচ্ছে। সেটা পার্লামেন্ট। ওখানে ওরা আমাদের নামে নানান অভিযোগ তুলে ঘায়েল করতে চাইবে।

ওয়ালেস আশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, আপনাকে তো আগেই বলেছি, তাও ওরা পারবে না। দেখুন, পার্লামেন্ট ঘাস খায় না। তারা জানে, আমরা এম্পায়ারের সম্পদই বাড়াচ্ছি।

ওয়ালিক বলে উঠল, ঠিক তাই। আমাদের নিশান উঁচুতে।

বলে সে হাত তুলল শূন্যে। ওয়াল্টার যেন তার ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার সাফল্যকে দেখতে পেল। সে চিৎকার করে বলল, হুররা। আসুন, এবার একটু কফি পান করি।

সবাই একবাক্যে সায় দিল। ওয়াল্টার চিৎকার করে হাঁক দিল, বাবোর্চি কফি লাও।

 রসুল প্রস্তুতই ছিল। সে দৌড়ে দরজার সামনে এসে বলল, লে আতা হুজুর। মনে মনে বলল, সাবউন বিয়াগগুন ফাঅল অই গিয়েগোই।

অর্থাৎ সায়েবগুলো পাগল হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সকলের চোখেমুখেই নতুন স্বপ্নের রক্তাভা। এ রক্তাভা সোনালি পাট, ভারতবর্ষে নতুন যুগকে ডেকে নিয়ে আসছে। চটের যুগ। বাংলা যদিও তার আদি স্থান, কিন্তু নতুন রূপ নিয়ে সে পৌঁছেছিল, গঙ্গার কূল থেকে, বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে, উত্তর সাগরের টে নদীর কলে, ডান্ডিতে। টেনদীর স্রোত আবার সাত সমুদ্র তেরো দরিয়া পেরিয়ে এসেছে গঙ্গার বুকে। এসেছে। বজবজ থেকে গৌরীপুরে। তার মাঝখানে জগদ্দলকে সৃষ্টি করছে, জগদ্দল।

ভাগীরথী কূলের এই ডাইনিংরুমে হয়তো জুট ইন্ডাস্ট্রির নতুন যুগের উন্মাদনা আরও উদ্দাম হয়ে উঠত। ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল ভয়ংকর মূর্তি জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে।

হরিচরণের বেহালা ককিয়ে উঠে স্তব্ধ হল। ভান্ডা ধরে রাখতে পারল না ক্ষিপ্ত জীবনকৃষ্ণকে। জীবনকৃষ্ণ এসে দাঁড়ালেন ঘরের দরজায়।

ভেজা গরদের থান জীবনকৃষ্ণের মাটিতে লুটাচ্ছে কোমর থেকে। তাঁর শিখা খোলা, বাতাসে উড়ছে। ভেজা সাদা উপবীত লেপটে পেঁচিয়ে আছে তাঁর বুকে। এক হাতে তাঁর গঙ্গাজলের ঘটি, অন্য হাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে মুচড়ে ধরা হীরালালের হাত। জীবনকৃষ্ণের রক্তবর্ণ চোখ জ্বলছে ধকধকিয়ে।

ওয়াল্টার চিৎকার করে সামনে এসে দাঁড়াল। অভাবিত ব্যাপার। জীবনকৃষ্ণ তো কখনও এ কুঠি স্পর্শও করেন না! জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ দি ম্যাটার পান্ডিট?

রুদ্ধ গলায় প্রায় গর্জে উঠলেন জীবনকৃষ্ণ, বিচার করো সাহেব। তুমি ধর্ম মানো, তুমি বিচার করো।

বলে হীরালালকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ওয়াল্টারের পায়ের কাছে। হীরা আঘাত পেয়ে কেঁদে ককিয়ে উঠল। তবু যেন যে মুক্তি পেল। আতঙ্কে, ভয়ে, কান্নায় তখনও ও কাঁপছে। ওয়াল্টার দু হাতে হীরাকে তুলে নিল কাছে। সে ভাবছিল, হীরা নিশ্চয় চুরি করেছে। বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যায়া হুয়া বোলো, জলদি বোলো।

জীবনকৃষ্ণের চোখে আগুনের শিখা যেন ক্রমেই লেলিহান হয়ে উঠছে। রুদ্ধ উত্তেজিত স্বরে বললেন, সাহেব, তুমি জান, প্রতিদিন গঙ্গাস্নান সেরে, শুদ্ধ হয়ে সারাদিনে একবার আহার করি। আর এই সময়ে একটু জল খাই। কখনও আমি তোমারও ছায়া মাড়াইনে সাহেব। তুমি আমাকে স্নেহ কর, ভালবাস। কখনও আমাকে বিরক্ত কর না। আর এই অস্পৃশ্য, বাগদি আমাকে স্নানের শেষে ছুঁয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাহেব, তাতে ওর দুঃখ নেই প্রাণে। ও যে ভুল করেছে, তাও মানে না। আমি ধমকে উঠলাম, আমাকে বললে, বেশ করেছি, আরও ছোঁব।

বলতে বলতে জীবনকৃষ্ণ নিজেই যেন মহা আক্রোশে দু পা অগ্রসর হলেন হীরার দিকে। হীরা আরও জোর করে আঁকড়ে ধরল ওয়াল্টারকে।

সবাই অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। ওয়াল্টার কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু হীরাকে সে একটি অসহায় পলাতক বলির পশুর মতো, আড়াল করে নিল। ওয়ালিক উঠে এল সামনে। তার জ্বজোড়া কুঁচকে উঠেছে। জীবনকৃষ্ণ ওয়াল্টারকে চিৎকার করে বললেন, আমি জানি সাহেব তুমি ধার্মিক। কারখানায় তুমি যেখানে আমার ধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছ, সেখানে একটা বাগদি ছোঁড়া আমার ধর্ম নষ্ট করবে? বিচার করো, শাস্তি দাও।

ওয়াল্টার জিজ্ঞেস করল, মগর পান্ডিট, এ লেড়কা তুমকো আপনা খুশি সে টাচ কিয়া?

জীবনকৃষ্ণ উন্মাদের মতো হেঁকে উঠলেন, তা জানি না, তুমি ওর বিচার করো সাহেব বিচার করো। ও কিছুই মানতে চায় না।

হীরা কান্নারুদ্ধ গলায় বলে উঠল, আমি ছুটে যাচ্ছিলুম, ঠাকুরকে দেখতে পাইনি।

ওয়ালিক চিৎকার করে উঠল, অ্যাবসার্ড! এ বাচ্চার কোনওই অপরাধ হয়নি।

ওয়াল্টারেরও তাই মনে হল। তার মনে হল জীবনকৃষ্ণ অকারণ বাড়াবাড়ি করছেন। এ ছেলেটার কী দোষ। ছুঁয়ে দিলেই মানুষকে শান্তি পেতে হবে! নতুন দেশ থেকে, নতুন অভিযানের শরিক হয়ে সে প্রায় দস্যুর মতোই এসেছে এ দেশে। এ সব তার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। তা ছাড়া ব্যবসার বাইরে, তার জীবনে এক্ষেত্রে হীরার প্রতিই সব সমবেদনা। জীবনকৃষ্ণের রীতিনীতি ধ্যানধারণার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। মনের টানও যদি কিছুমাত্র থাকে, সেটা হীরাদের দিকেই। ওয়ান্টার বলল, এর আবার বিচার কী হবে। ইউ আর ম্যাড় পাণ্ডিট। তুমি একটা পাগল। এ সব পাগলামির বিচার করা যাবে না। ইনস্যানিটি, সিম্পলি ইনস্যানিটি!

জীবনকৃষ্ণ অকস্মাৎ রুদ্র হয়ে উপবীত টেনে ধরলেন। একটা রক্তাক্ত ক্ষতের মতো দগদগে হয়ে উঠল তাঁর মুখ। রুদ্ধ তিক্তস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, কী বললে সাহেব। আমি পাগল। আমি পাগল!

বলতে বলতে জীবনকৃষ্ণ সহসা নিষ্ঠুরের মতো হাতের জল ভরা ঘটি দিয়ে নিজেরই মুখে মাথায় আঘাত করতে লাগলেন। আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হলেন। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল,হোন্ড হিম, হোন্ড হিম। অত্মহত্যা করতে চায় এই ইনসেন ব্রাহ্মিণ।

ওয়াল্টার সহসা জীবনকৃষ্ণের সম্মান ভুলে গেল। রেগে চিৎকার করে উঠল, গেট আউট ইউ ড্যামন রাসকেল।

অফিসের চক্রবর্তী বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। উনি ছুটে এসে জীবনকৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। বার বার বলতে লাগলেন, শুনুন শুনুন ভটচায মশায়, এ কী করছেন আপনি! বিচার চাইতে গেছেন, আর কোন দুঃখে আপনি এমন করছেন। ধর্মের ওরা কী বোঝে? শুনুন শুনুন।

জীবনকৃষ্ণকে ধরে গঙ্গার ধারে নিয়ে এলেন চক্রবর্তী। হাত ছাড়িয়ে জীবনকৃষ্ণ জলে পড়তে চাইলেন, পারলেন না। পলিমাটির কাদায় মুখ গুঁজে ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।-বাঁচতে চাই নে, হে ভগবান, মৃত্যু দাও, মৃত্যু দাও!

গঙ্গা থামে না। মহাকালেরই কণ্ঠলগ্না ভাগীরথী। যাওয়া তার নিরন্তর। আসা তার নিরবধি। জীবনকৃষ্ণ বুঝি কাঁদতে দেরি করেছেন। মৃত্যুর পর মরতে চাইছেন। তাই যেন প্রেতের মৃত্যু কামনায় গঙ্গার ঢল খাওয়া স্রোতের সুদীর্ঘ বাঁক হাসির মতো ঝিকমিক করছে।

অনেক অশ্রু গঙ্গা তার বুকে নিয়েছে, যখন দিতে গিয়েছে সমুদ্রে, তখন আবার ফিরে আসবার সময় হয়েছে।

আরও অনেক অশ্রু ঝরবে। তবু গঙ্গাকে আরও অনেক নতুন বার্তা আনতে হবে। সে যাবে নিরবধি, আসবে নিরন্তর। সে মহাকাল প্রেয়সী। কিংবা ক্রীতদাসী নাকি, কে জানে!

চক্রবর্তী ডাকলেন, ভটচাৰ্য মশাই উঠুন, বাড়ি ফিরে চলুন।

ভেজা পলির কাদায় লুটিয়ে পড়া জীবনকৃষ্ণ সাড়া দিলেন না। ক্রোধ ও অপমানের দারুণ অগ্নিদাহ যেন তাঁর ঠাণ্ডা পলি পাঁকে জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি যেন আরও গভীরে, পাতালের চির অন্ধকার ঠাণ্ডায় নিজেকে প্রোথিত করতে চাইছিলেন। কাদা ও চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদ তাঁর মুখ ভরে তুলছে।

পাঙ্খাওয়ালার সেই ছোট্ট খুপরির মধ্যে বসে, ঘর্মাক্ত কলেবর ক্লান্ত পাঁচু থরথর করে কাঁপছিল। তার বড় বড় চোখ দুটিতে আতঙ্ক। ফরাসডাঙার দক্ষিণে মীয়াজিপীরের দহ দেখা যায়। সেই দিকে চোখ রেখে সে মনে মনে ডাকছিল, হেই বাবা পীর! বেরাহ্মণের কোপ থেকে রক্ষে করো, রক্ষে করো!

সে মনে মনে বলছিল, আর আরও জোরে জোরে পাখার দড়ি টানছিল। সমস্ত ঘটনাটাই সে নিজের চোখে দেখেছে। সে দেখেছে, হীরা জলে নোঙর করা সাহেবদের ওই ভডভডিয়া নৌকো (লঞ্চ) দেখবার জন্যে ছুটছিল। আ! ছেলেটা কি কানা গো! ভাটপাড়ার ঠাকুর যে নেয়ে ধুয়ে জল নিয়ে আসছিলেন, তা কি ছোঁড়াটা দেখতে পেল না? দুম করে গিয়ে একেবারে ঠাকুরের গায়ে। আর কী সাহস ছোঁড়ার! মুখের ওপর বললে কিনা, ইচ্ছে করে কি ছুঁয়েছি? কোথায় খুঁয়ে লুটিয়ে ক্ষমা চাইবি, তা নয়, ঘাড় বাঁকানো? উঃ, সে কী চেহারা ঠাকুরের। আগুনের অমন রক্ত তেজ দেখেনি পাঁচু। যেমন করে থাবা বাড়িয়ে ধরলেন হীরাকে, মনে হল, কাঁচা খেকো দেবতাই বুঝি ভর করেছে। তুলে মারবেই আছাড়। তারপরে টেনে নিয়ে গেলেন সাহেবের দরবারে। এই জানালার নীচে খুপরিতে বসে বসেই দেখেছে শুনেছে পাঁচু। এখন দেখছে, ঠাকুর গঙ্গার কোলে লুটিয়ে পড়েছেন।

দেখছে, আর তার বুকের মধ্যে কাঁপছে। সে যেন একটা প্রলয়ের স্পন্দন অনুভব করছে। জীবনে এমন ভয়ংকর ঘটনা সে আর কখনও দেখেনি। একটা মহাপ্রলয় যেন সে এই সেনপাড়া-জগদ্দলের ওপর নেমে আসতে দেখছে। এতবড় মহাপাপ! বাগদির ছেলে ঠাকুরের পায়ে পড়তে শেখেনি। ভাটপাড়ার ঠাকুর, হেই বাবা ধর্ম, সে যে খাঁটি জাত সাপ! রক্ষে করো, রক্ষে করো!

.

মাস্টার হরিচরণের বাজনা আর জমেনি। আসরটা মাটি হয়ে গেছে। ভাণ্ডা তাকে খাবার খাওয়াতে চেয়েছে, পারেনি। সে শুধু আরও পান করেছে। ওয়াল্টার লোক দিয়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল হীরাকে তার বাড়িতে। হীরা জানিয়েছে, সে একাই যেতে পারবে।

ওয়াল্টার আশ্রয় দিলেও হীরা মনে মনে বিশ্বাস করেছিল, কত বড় পাপ করেছে সে। তার চোখের সামনে বারবার জীবনকৃষ্ণের চোখ দুটি ভেসে উঠছিল। সে চোখ মানুষের নয়। ভগবান যখন খেপে যায়, কেবল তখনই ওরকম চোখ হয়।

ওয়াল্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, তাই সে প্রথমে ছুটে গেল গঙ্গার ধারের বাঁশঝাড়ের দিকে। সেখান থেকে দেখতে পেল, জীবনকৃষ্ণ আর চক্রবর্তীকে। কাছেপিঠের লোকেরা জড়ো হয়ে, কী আলোচনা করছে, শুনতে পেল না সে। তার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল থরথর করে। দু চোখে তার বিভীষিকা। ভয়ে তার চোখে জল এসে পড়েছে। সে মনে মনে বলছে, হে ভগবান, আমাকে মাপ করে দাও। আমি আর কোনওদিন এমন করব না। দিব্যি গেলে বলছি, আর কোনওদিন বামুনকে ছোঁব না। হেই মা কালী গো, আমার যেন ব্যামো না হয়। আমার যেন ওলাওঠা না হয়।

তবু অভিশাপের ভয় হীরার গেল না। মরণেরা সব ভয়ংকর রূপ ধরে অলৌকিক বীভৎসতায় ঘিরে রইল তাকে। বাঁশঝাড়ের বাতাসের সড়সড় শব্দে ভয় পেয়ে, জঙ্গলের আড়াল দিয়ে পালাল বাড়ির দিকে।

হীরা জীবনকৃষ্ণকে ঘৃণা করে। কারণ জীবনকৃষ্ণ তাকে ঘৃণা করেন। কিন্তু ধর্মের ভয়, অভিশাপের ভয় ওর রক্তে। যৌবনের সাহস দিয়ে সংস্কারের টুটি টিপতে পারে না এখনও। বাড়ি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কালীর কোলে। কালী চমকে উঠে উৎকণ্ঠিত বিস্ময়ে দেখল ছেলের বুকে নখের আঁচড়ের দাগ। সর্বাঙ্গ লাল, গা পুড়ে যাচ্ছে, প্রবল জ্বরের লক্ষণ। কালী জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে হীরা?

হীরা তখন অচৈতন্য।

.

৪২.

কফি পানের পর ওয়ালেসই প্রস্তাব করলেন, চলুন, সবাই মিলে একটু স্টিম লঞ্চে এই এরিয়াটা বেড়ানো যাক।

ম্যাকলিস্টার বলল, আর সেই জার্নিটা নর্থ সাইডেই থোক। একবার জার্ডিন-স্কিনারদের খানখানাড়া কারখানাটা দেখা হবে।

সকলেই সম্মতি দিল, লিটলজন ছাড়া। সে মার্জনা চেয়ে বলল, আমি গারুলিয়ায় ফিরে যেতে চাই, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে।

লিটলজন এমনিতেই কাবু হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া মিশ্রিত মদের নেশা, তার রক্তকেও ক্ষুধার্ত করে তুলেছিল। দক্ষিণী নেটিভ মেয়ে, আয়া চম্পার শ্যাম নগ্ন দেহ তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। এদের প্রতি তার মনের কোনও টান নেই। মনের টান চম্পার প্রতিও নেই। কিন্তু রক্তের ও মাংসের টান আছে। কোনও রোমাঞ্চ নেই, একটা পাশবিক নিষ্ঠুর সুখ আছে। ক্ষুধার্ত পশুর ঝাঁপিয়ে দাবড়িয়ে ছিন্নভিন্ন আহারের তৃপ্তির মতো। ঘরের মধ্যে পোশাক কেড়ে নেওয়া নগ্ন চম্পা যখন লজ্জায় ভয়ে বলির অসহায় পশুর মতো কাঁপে লিটলজনের সামনে, লিটলজনের রক্তের উল্লাস তখনই সবথেকে বেশি উদ্দাম হয়ে ওঠে। নেটিভ মেয়েটার ভয় সংকুচিত লজ্জা, সেই ভঙ্গিটাই লিটলজনের নেশা। মেয়েটা যদি মদির চোখে তাকাত, তা হলে লিটলজন কোনও উত্তেজনাই বোধ করত না। তার চোখের সামনে চম্পার সেই মূর্তিটাই ভাসছিল, আর মনে মনে বলছিল, এই বাস্টার্ড স্কচগুলোর সঙ্গ আর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।

ওয়াল্টার বলল, আপনি যদি অসুস্থ বোধ করেন, তবে আমার এখানেই বিশ্রাম করতে পারেন।

লিটলজন জবাব দিল, আমি আমার ঘরেই ফিরে যেতে চাই। আমার লং স্লিপের দরকার।

ওয়ালিক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, লেট হিম গো। ওঁকে যেতেই দিন, উনি একটু ঘুমোন গে।

ওয়ালিকের পক্ষে হাসি চেপে রাখা দায় হচ্ছিল। কারণ ম্যাকলিস্টার তার দিকে তীক্ষ্ণ অর্থপূর্ণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ছিল। লিটলজনও একটু সন্দিগ্ধ চোখেই ওয়ালিকের মুখের দিকে দেখছিল।

ওয়ালিক তার মনের কথা টের পাচ্ছে কিনা, কে জানে।

ওয়ালিক আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ইউ বেটার গো উইথ মাই বগি। ঘোড়াটাকে জুড়ে দেবার কথা বলছি আমি। পরে মি. ওয়ালেসের ফেরার পথে, আমি লঞ্চে করেই গারুলিয়ার জেটিতে নেবে যাব, কী বলেন মি. ওয়ালেস?

ওয়ালেস বললেন, নিশ্চয়, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে।

ওয়াল্টার চিৎকার করে বলে উঠল, ফার্ডিনান্ড, তুমি তাড়াতাড়ি মি. ওয়ালিকের বগি গাড়িতে মি. লিটলজনের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।

ফার্ডিনান্ড ছুটে এসেছিল। ইয়েস স্যার বলে আবার ছুটে বেরিয়ে গেল। লিটলজনও বিদায় নিল। বলল, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। গুড বাই টু ইউ অল।

লিটলজন বেরিয়ে যাবার এক মুহূর্ত পরেই ম্যাকলিস্টার ওয়ালিকের কাঁধে ধাক্কা মেরে বলল, ইয়েস জনি, ব্যাপারটা কী বলো তো? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, ওই ব্রাহ্মিণের ড্রামাটিক অ্যাকশনে লিটলজন-এর ভাবান্তর হয়েছে। ইট ইজ সামথিং এলস্। ইজ দেয়ার এনি ব্লাডি জুট সফনিং বিজনেস উইথ ইমালসন?

বলে একটা চোখ টিপল। একটা বিশেষ ইঙ্গিত ফুটে উঠল। দেখে এবং শুনে, সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ওয়ালেস বললেন, বেশ বলেছেন, জুট সফনিং বিজনেস উইথ ইমালসন।

ওয়ালিক আর ওয়াল্টার পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। কারণ, মি. ডাডনির আয়া নিয়ে, লিটলজন ঘটিত ব্যাপারটা ওয়াল্টারেরও জানা ছিল। তাদের দুজনকে মুখোমুখি তাকিয়ে হাসতে দেখে ম্যাকলিস্টারের সন্দেহ ঘনীভূত হল। বলল, হুম! তা হলে নিশ্চয়ই বেগ-ডানলপের ইংলিশম্যানটির কোনও ব্যাপার আছে। বলো দিকিনি সত্যি করে।

ওয়াল্টার বলে ফেলল, ইয়েস স্যার, ইট ইজ রিয়েলি এ সফনিং বিজনেস উইথ এ বিগ হেভি মেশিন, হুইচ ইজ কলড বাই নেটিভস হাতিল, আই মিন, এলিফ্যান্ট মেশিন।

এদের সকলেরই জানা আছে, কাঁচা পাটকে পিষে নরম করার জন্যে যে বিশাল দেহ সফনার মেশিন আছে, নেটিভ শ্রমিকরা তাকে হাতিকল বলে। মেশিনের প্রকাণ্ড আকৃতি এবং তারই শ্রমিকদের চোখে ও কল্পনায় হাতি সদৃশ করে তুলেছে। এরা হাতি দেখেছে, মেশিন দেখেনি। তাই প্রকাণ্ড কিছুর সঙ্গে এই তুলনাটাই দেয়। শুধু হাতিক নয়, সমস্ত জুট মেশিনারিরই অদ্ভুত আর বিচিত্র সব নেটিভ নাম আছে। আর সব নামেরই বিশেষ একটা অর্থ আছে। অথবা একটা ধ্বনিগত মিল থাকে। যেমন ব্রেকার মেশিনকে ওরা বলে ঘড়িক। মেশিনটার সঙ্গে যেহেতু একটি ঘড়ির মতো যন্ত্র থাকে এবং মেশিন চলতে চলতে, ঘড়িটার কাঁটাও ঠিক একপাক ঘুরে, মেশিনের মধ্যে পাট চুকিয়ে, বের করে আনার সময় নির্দেশ করে, সেই হেতু তাদের কাছে ওটা ঘড়িক। কিংবা শূল উইন্ডিংকে ওরা বলে মাগিকল। কারণ, একমাত্র মেয়েরাই এই বিভাগে কাজ করে। যেমন কোপ উইন্ডার হল ফুকানলি রোভিং রবিন ড্রইং গিরান।

ম্যাকলিস্টার বলল, আচ্ছা? সফনার মেশিন হল আমাদের বেগ-ডানলপ রিপ্রেজেন্টেটিভ। কিন্তু ফাইভরটি কে, কোন দেশি?

ওয়াল্টার যেন কথা লুফে নিয়ে বলল, জুট স্যার। ইন্ডিয়ান জুট, এ ফাইন জুট, আমি শুনেছি। মেয়েটি আমাদের টমাস ডাফের মি. ডাডনির আয়া, এ হেলদি ব্ল্যাক ভার্জিন।

ম্যাকলিস্টার ভ্রূ কপালে তুলে বলল, ভার্জিন?

ওয়ালিক বলল, সত্যি ভার্জিন। মাদ্রাজি নেটিভ ক্রিশ্চান মেয়েটি, নাম চম্পা। বুঝতেই পারছেন, অবিবাহিত ইংলিশম্যান লিটলজন, মি. ডাডনি ব্যাপারটাকে খুব দোষাবহ মনে করেননি। কিন্তু কিন্তু…

ওয়ালিকের মরক্ত মুখ, কথা বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে উঠল। তার গলার স্বরেও একটু ক্ষুব্ধ উত্তেজনা ফুটে উঠল। সে না থেমেই বলে চলল, কিন্তু নেটিভরাও হিউম্যান, চম্পারও আত্মা বলে একটা পদার্থ আছে, এ কথা মানতেই হবে। মি. লিটলজনের ইচ্ছাকেও আমি তেমন দোষারোপ করছি, কিন্তু অ্যাপ্রোচের একটা ভঙ্গি থাকবে নিশ্চয়। একটা রুচি নিশ্চয় আশা করা যেতে পারে। আমরা সাহিব, আমাদের তারা এত মানে, সম্মান দেখায়, আমাদের ঘৃণা করবার একটা সীমা থাকা উচিত। লিটলজন যে কী ভাবে মেয়েটাকে পীড়ন করে, সকলের সামনেই অপমান করে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ওঃ লোকটা একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ব্যবহার করে। এখন গিয়েও তাই করবে। অথচ চম্পা, সাহিবের একটা অঙ্গুলি সংকেতেই হয়তো ভেঙে পড়ে, প্রতিবাদ তো অনেক দূরের কথা। এ সব আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। এই ঘটনা যদি টমাস ডাফের কুঠির বাইরে ঘটে আর নেটিভরা দেখতে পায়, একটা গোলমাল লেগে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

সকলেই গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। ওয়ালেস ওয়ালিকের কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চাপড়ালেন। বললেন, ঠিক কথাই বলেছেন, কিন্তু এ নিয়ে বেশি ইমোশনাল হবেন না। এটা নেটিভদের ভাগ্য বলেই মেনে নিন মি. ওয়ালিক।

ওয়ালিক বলল, মেনে নিয়েছি মি. ওয়ালেস। ওদের কথা আমি আর কতটুকু ভাবছি, আর ভেবেই বা আমার কী লাভ। তবু চোখের সামনে এতটা, ঠিক সহ্য করা যায় না। আমরা সবসময় নেটিভদের সঙ্গে মিশি। আমাদেরও একটা সম্মান আছে। কোয়ার্টারে আমাদের মহিলাদেরও তো একটা সম্মান আছে।

নিজেদের সম্মানের প্রশ্নটাই সকলের মুখে গভীর ছায়া বিস্তার করল। চম্পার জন্যে সত্যি তেমন একটা অনুভূতি কারুর ছিল না। নিজেদের সম্মান আর বিপদের আশঙ্কাটাই আরও গম্ভীর করে তুলল সবাইকে।

ম্যাকলিস্টার বলল, ব্লাডি ফুল লিটলজনটাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন না?

-লিটলজন এ সব বুঝতে চায় না।

 ওয়ালেস বললেন, যেতে দিন, মি. লিটলজন নিজেই এক সময়ে সংবিৎ ফিরে পাবেন। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গোলমাল কিছুই হবে না। নেটিভরা যখন জানে, চম্পা খ্রিস্টান, সাহিবের ঘরে সে কাজ করে, তখন তার জন্যে ওদের কোনও সিমপ্যাথিই নেই। বিশেষ বাঙালি নেটিভরা তো কিছুই বলবে না, কারণ, মেয়েটা মাদ্রাজি নেটিভ। আমি ওদের চরিত্র খুব ভাল করেই জানি। সম্ভবত সাহায্য চাইলেও, চম্পাকে ওরা সাহায্য করবে না, বিকজ শি ইজ ক্রিশ্চান। একটু আগেই আপনারা দেখলেন, একটা ছোট ছেলে, লোকটাকে শুধু ছুঁয়ে দিয়েছে, তাতেই কী বিশ্রী কাণ্ডটা ঘটে গেল। মি. ওয়াল্টার যদি নেটিভ বাচ্চাটাকে ফায়ার করে মেরে ফেলতেন, তা হলেই বোধহয় সেই ব্রাহ্মিণ খুশি হত। ইয়েট, মি. ওয়ালিক, লিটলজনকে আমিও সমর্থন করতে পারছি না, এটা সত্যি।..এবার চলুন আমরা বেরিয়ে পড়ি, আর দেরি করা ঠিক হবে না।

ওয়াল্টার তাড়াতাড়ি বলল, কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই, আমাদের সঙ্গে কিছু পানীয় যাবে কি না!

ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, সিওর, সিওর, যা পার, কিছু নিয়ে নাও।

ওয়াল্টার রসুলকে ডেকে হুকুম করল মদের বোতল ইত্যাদি লঞ্চে তুলে দিয়ে আসতে এমন সময়ে ঘোড়ার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। বোঝা গেল, লিটলজন ছুটেছে গারুলিয়ার দিকে। ফার্ডিনান্ডও এগিয়ে এল। সে নিজে রসুলকে নির্দেশ দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। ওয়াল্টার বেরিয়ে পড়ল তার অতিথিদের নিয়ে।

ঘরের মধ্যে পাখাটা তেমনিভাবেই দুলতে লাগল। পাঁচু এখনও টের পায়নি, ঘরে সাহেবরা নেই। টের পেলেও সে থামতে পারে না, যতক্ষণ হুকুম না আসে। অন্তত পাগলা সাহেবকে বাইরে না দেখলে সে থামতে পারে না।

.

সূর্য ইতিমধ্যে ফরাসডাঙার আকাশের সীমায় ঢলেছে প্রায়। সারা দুপুর পুড়ে পুড়ে আকাশটার রং হয়েছে ছাই ছাই। চৈত্রের বাতাসে এখনও উত্তাপ। পশ্চিমের তটে, জলে চলকানো রৌদ্রচ্ছটায় এখনও চোখ রাখা যায় না। দৃষ্টি ধাঁধিয়ে যায়। তেসুতি কলের দরোয়ান হিম্মত সিং তিন ঘণ্টা বাজিয়েছে অনেকক্ষণ। চার ঘড়ির সময় হয়ে এল।

কারখানায় আজ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, এক বেলা কাজের পরেই। তবু কলঘরের বাবুরা (বিভাগীয় কেরানিবৃন্দ) বিপিন চক্রবর্তীকে ঘিরে তখনও, অফিস ঘরের বারান্দায় বসে ছিল। তাদের আলোচ্য পাত্র জীবনকৃষ্ণ, বিষয় কিছুক্ষণ আগের দুর্ঘটনা।

কুঠি থেকে সাহেবদের একসঙ্গে বেরুতে দেখে, সকলেই কথাবার্তা থামিয়ে তাকিয়ে রইল। সোজাসুজি নয়, একটু আড়ে আড়ে, আড়াল দিয়ে। স্পিনিং ডিপার্টমেন্টের হাজিরাবাবু ভূতো বোসই একমাত্র দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহূর্তে জীবনকৃষ্ণের উপর বক্তৃতা দিচ্ছিল সে-ই। ধুতিটি কাছা কোচাসহ প্রায় হাঁটুর কাছে ভোলা। গায়ের কামিজটি যদিও সাদা বিলাতি কাপড়ের উপরে জালি কাটা নকশার, কলঘরের তেলে ফেঁসোয় এখন তার রং চেনাই দায়। সে বলছিল, কথাটা তা হচ্ছে না চক্কোতিমশাই, কথাটা হল, ইউ সি দেন, দ্যাট বাগদি কা বাচ্ছা অন দি বেরেস্ট অব পাগলা সাহেব, অ্যান্ড পাগলা সাহেব ইনসাল্ট ভটচায্যি মশাই।

মূল বক্তব্যটি এইরকম, তখন আপনি দেখলেন বাগদির ছেলেটা পাগলা সায়েবের বুকে, পাগলা সায়েব ভটচায্যি মশাইকে অপমান করছে। বিপিন চক্রবর্তী তা বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এত সহজে ভূতো বোসের কাছে তিনি ধরা দেবার পাত্র নন। কারণ এর পরে ভূতো কী ভাবে কথাটা ওয়াল্টারের কানে তুলবে, তা বলা যায় না। উনি বলছিলেন, সায়েব ভটচায মশাইকে অপমান করেছে কি না আমি জানি না। আমি খালি দেখলাম, বাগদি ছোঁড়াটাকে সায়েব মেজে থেকে হাত ধরে তুলে নিল, আর কী যেন বলল। অমনি ভটচায মশাই ঘটি দিয়ে নিজের মাথায় মারতে লাগলেন।

ভূতো বোস তখন দাবি করছিল, অলরাইট, পাগলা সায়েব ইজ নট গিল্টি, গিল্টি ইজ দ্যাট বাগদি ছোঁড়া। এর একটা ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।

সেই সময়েই সাহেবদের আবির্ভাব কুঠির সামনে। এবং ওয়াল্টারকে দেখা গেল সে অফিস বারান্দার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাকিরা গঙ্গার ধারের দিকে এগিয়ে গেল।

ভূতো বোসই বলে উঠল, এই মেরেছে, পাগল সায়েব যে এদিকেই এগিয়ে আসছে।

ব্যাচিং সেকশনের ছোকরা হাজিরাবাবু দীনু বাঁড়ুজ্জে বলল, তুমি এবার পাগলা সায়েবকে সব কথা জিজ্ঞেস করে জেনে নাও না ভূতোদা, তা হলেই তো মিটে যায়।

ভূতো দাঁতে দাঁত চেপে, জ্বলন্ত চোখে তাকাল দীনুর দিকে। চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ, পাগলাকে আমি চিনি নে, না? শালা আমাকে ধরে প্যাঁদাতে আরম্ভ করুক আর কী!

ওয়াল্টারকে এগিয়ে আসতে দেখেই সবাই শানের বারান্দায় মৃত্তিকাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ওয়াল্টার কাছে এসে বলল, কোই ফিকির মত করো, সিট ডাউন অল অব ইউ।

বিপিনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল সে, পণ্ডিত কোথায়?

বিপিন গম্ভীর মুখে জানাল, তাকে একটা গোরুর গাড়িতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি স্যার।

ওয়াল্টার বুঝতে পেরেছিল, পণ্ডিতের বিষয় নিয়েই বাবুদের ঘোঁট হচ্ছে। বুঝেছিল বলেই সে এগিয়ে এসেছে। সকলে যাতে বুঝতে পারে, সেজন্যে সে হিন্দিতে বলল, দেখে, ইসমে হামারা কুছ হুকুম নাই চলে গা। পাণ্ডিট বহুত বড়া আদমি হ্যায়, লেড়কাঠো বহুত ছোটা হ্যায়, তুম লোগ আপনা আপনা ইকা নতিজা দেখো। হামারা গেস্ট লোগকো সামনে পাণ্ডিট বহুত চিল্লিয়া, উস্ লেড়কাকো মারনে বোলা, এ হাম নাই সত্য।

ভূতো বোস বলে উঠল, আই টেল স্যার, আই এগ্রি।

আমিও তাই বলছিলাম, আপনি ঠিক বলেছেন ভূতোর এই বক্তব্য। ওয়াল্টার সে কথায় কান না দিয়ে আবার বলল, ব্রাহ্মিণকা আদত হাম নাই জানতা, তুমকো নেটিভ অ্যাক্ট মে কুছ হ্যায় তো, কোর্ট মে পিটিশন ভেজ দো। ঔর চক্করটি, তুম পাণ্ডিটকো কাল আনে বোলো, হাঁ?

বিপিন বললেন, ইয়েস স্যার।

ওয়াল্টার ফিরে গেল। ভূতো বোস সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, বলেছিলুম কিনা, এতে সায়েবের কোনও দোষ নেই। এখন ওই ছোঁড়াটারই একটা বিহিত করতে হবে আমাদের। আই সি দ্যাট অল লোয়ার কাস্ট পিপল ক্লাইম্ব অন দি হেড। সায়েব তো বলেই গেল, আইনের হাত থাকলে ঠুকে দাও। আমাদের সেনপাড়ার হারু মোক্তারের কাছে চলো, সব জিজ্ঞেসাবাদ করি।

বিপিন বললেন, উকিল মোক্তার ভাটপাড়ায়ও আছে হে ভূতো। কথাটা তা নয়, কথাটা আমাদের ভটচায মশাইয়ের শরীর মন নিয়ে। মিছিমিছি গেজিয়ে আর কোনও লাভ নেই। সায়েবদের তো এ্যাদ্দিন ধরে দেখছি, তারা জাত মানে না, ছোটজাতের সঙ্গে তাদেরই মেলামেশা বেশি। ওই বাগদি ছোঁড়াটাকে তো পাগলা সায়েবই লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। দেখলেই পিঠ চাপড়ায়, কলঘরে নিয়ে গিয়ে যন্ত্র বোঝায়। সায়েব কি ছোঁড়াটাকে আর কারখানার চৌহদ্দির মধ্যে ঢোকা বারণ করতে পারত না?

ভূতো আর দীনুবাবু ছাড়া বাকি যে কয়জন ছিল, সকলেই চুপচাপ। গগন বোস থাকলে এ ক্ষেত্রে কী হত বলা যায় না। সে অনেক আগেই চলে গেছে। কিন্তু ভূতোকে এবারে চুপ করে থাকতে দেখে বিপিন চক্রবর্তী একটু অসহায় বোধ করলেন। আবার বললেন, দেখো, আবার কথাটা সায়েবকে গিয়ে লাগিয়ো না, আমার যা মনে হল, তাই বললুম। তা হলে ভটচাষ মশাইয়ের মনে হত, যাক তবু সায়েব আমার মান রেখেছে।

ভূতো তার কালো মুখখানি ছুঁচোলো করে নিঃশব্দে হাসল। বলল, কী যে বলেন চক্কোত্তি মশাই, আপনার নামে আমি সায়েবকে লাগাতে যাব? আপনি বলুন না, আমিই কাল সায়েবকে বলব, যেন ছোঁড়াকে আর তেসুতিকলের ত্রিসীমানায় না ঢুকতে দেওয়া হয়।

বিপিন চক্রবর্তী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সেটা যদি পার, খুব ভাল। ভটচায মশাইকে তবু বলা যাবে। আমি চলি।

ইতিমধ্যে ভূতো বোসের নতুন চিন্তা মাথায় এসেছে। বলল, ওই যা, সায়েব কোথায় চলেছে, তা তো জিজ্ঞেস করা হল না।

ছোকরাবাবু দীনু বলল, যাও না, ভূতদা, জিজ্ঞেস করে এসো, এখনও লঞ্চ ছাড়েনি।

দীনুর ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ভূতো কাপড় ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, থাক, কাল জিজ্ঞেস করলেই হবে। বরঞ্চ বেলাবেলি যখন ছুটি হয়েই গেল, আজ একটু ফড্ডাঙা মেরে আসি। যাবি না কি রে দীনে।

ফড্ডাঙা হল ফরাসডাঙা-চন্দননগর। খুশিতে উপছে পড়ে, সোহাগ করে উচ্চারণ করলে ফরাসডাঙার নামটা ওই রকমই শোনায়। দীনুর বয়স উনিশ, শ্যামনগরের ছেলে। বিয়ে হয়েছে বটে, মাস কয়েক হল একটি ছেলেও হয়েছে। তবু সকলের সামনে ভূতো বোসের সঙ্গে ফরাসডাঙা যাবার কথাটা বলতে একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। বয়স্কদের সামনে, মুখে একটু রং-এর ছোপ লেগে যায়। কান গরম হয়ে ওঠে। একে ফরাসডাঙা, তায় ভূতোর সঙ্গে। সবাই জানে, এ যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, মদ আর মেয়েমানুষের যোগাযোগ। দীনুর বেতন কুল্যে দশ টাকা। কিন্তু ভূতোর সহযোগিতায়, এবং বিপিন চক্রবর্তীর সাহায্যে, ফার্ডিনান্ডের সাহসে, দীনুর এখন সপ্তাহে সপ্তাহে আয় মন্দ নয়। পাট বাছাইয়ের (ব্যাচিং) ঘরে অন্তত দুটো লোকের বাড়তি হাজিরা থাকে তার খাতায়। তার মানে সপ্তাহে চার টাকা উপুরি আয়। তার মধ্যে এক টাকা ভান্ডা, এক টাকা বিপিন চক্রবর্তী, দু টাকা তার নিজের। সেটাও কম নয়। এক টাকার মদ, এক টাকায় মেয়েমানুষ। ভূতদা যে কী নেশাটাই ধরালে। ঘরের বউটাকে আর চোখে ধরতে চায় না। এখন আর কলাকালোয়তি না হলে শরীরটা যেন চাঙা হতে চায় না।

দীনু বলল, বলছ? কিছু কেনাকাটা অবিশ্যি ছিল।

বলে সে সকলের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল। ভূতো বলল, আরে সওদা করার কথাই তো বলছি।

বলে একটু সুর মিশিয়ে বলল,

ঘুরব ফিরব দেখব
পরাণ ভরে সওদা করব।
আর হাঁকিয়ে যাব পানসী-ঈ-ঈ…।

বিপিন চক্রবর্তী এ ক্ষেত্রে একেবারে নীরব থাকবার পাত্র নন। তবে জীবনকৃষ্ণের ব্যাপারে তার মনটা দমে ছিল। তিনি শুধু বললেন, দুর্গা দুর্গা।

বারান্দা থেকে নেমে একবার অফিসঘরের দরজায় তালাটা লক্ষ করলেন। তারপরে চলে গেলেন।

.

ওয়াল্টার তার অতিথিদের নিয়ে বেরিয়ে যাবার পরেই ফার্ডিনান্ড মাস্টার হরিচরণের হিসাব মিটিয়ে দিল। হিসাবের উপরে, খাঁটি সাহেবের মতোই ইনাম দিল। আবার শীঘ্রই ফরাসডাঙার দাইয়া মেমসাহেবের নাচঘরে দেখা হবে, সেই কথা জানিয়ে বিদায় দিল। তারপরে চিৎকার করে ডাকল,হেই পাথু পাংখাবালা, ইধর আও।

তার এ সময়ে কথাবার্তা ভাবভঙ্গি, সবকিছুর মধ্যেই ওয়াল্টারকে অনুকরণের আপ্রাণ চেষ্টা। পাঁচুর জবাব এল কুঠির বাইরে থেকে, যাই গো সায়েব।

এই ডাকটির জন্যেই পাঁচু অপেক্ষা করছিল। ভডভডিয়া নৌকায় করে পাগলা সাহেবের দলবলকে আগেই বেরিয়ে যেতে দেখেছে সে। এখন কুঠির সর্বময় কর্তা ভান্ডা।

ফার্ডিনান্ড আবার হাঁক দিল, রসুল, হামারা ছোট দারু কা বোতল লাও।

রসুল চাটগাঁয়ের বাঙালি মুসলমান হলেও, গোঁফ দাড়ি আর চালচলনে উত্তর ভারতের ভাবভঙ্গি বজায় রেখেছে। তার দাড়ির ভাঁজে, গোঁফের ফাঁকে, অবহেলা আর বিদ্রুপের হাসিটা ঢাকা পড়ে থাকে। বোতল এগিয়ে দেয় সে।

বোতলটা হাতে নিয়ে, নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে সে আর একবার হাঁক দেয়, হেই ঝাড়ুদারনি মাগি লোগ, হামরা কামরা সাফা কর।

পাঁচুর গলা কাছ থেকেই আর একবার শোনা গেল, খাঁদন আর পাঁচুরালা তোমার ঘর সাফ করছে গো সায়েব, মোদ্দা বোতলটি ভরতি করে এনো। লইলে কুলোবে না।

রসুলের বিক্ষুব্ধ বিদ্রূপ আর চাপা থাকে না। মনে মনে বলে, ঘর সাফা? এখন যে কেমন ঘর সাফা হবে, এ কথা জানে তাবত সংসারের লোক। মুখ ফুটে সে বলেই ফেলল, হালার পুত হলো মাইয়াগোঁয়ার লাই যার।

শালার পো শালার মেয়েছেলের কাছে যায়। খাঁদন ও পাঁচুবালার ঘর পরিষ্কারের এখন একটাই কারণ, ভান্ডার সেবা, ভান্ডার সঙ্গে পান ও বিহার। এতে রসুলের আপত্তি বা ঝগড়ার কিছু নেই। জানে, ভান্ডার সঙ্গে বিবাদ করে এই কুঠির চাকরি রাখা যাবে না। বরং সে নিজে একটু মুসলমান পাড়ায় বেরুবার ফাঁক চাইছে মনে মনে।

.

ইতিমধ্যে সেনপাড়া-জগদ্দলের সর্বত্র জীবনকৃষ্ণ আর হীরার ব্যাপারটা নানান পত্রপল্লবে ছড়িয়েছে। পাড়ায়, নব সুরের দোকানে, ইন্দিরের তাড়ির আড্ডায়, সবখানেই এ সংবাদ রটেছে যে, ঠাকুরের আহ্নিকের মাঝখানে গিয়ে হীরা বাগড়া দিয়েছিল, ছুঁয়ে দিয়ে হাসি মশকরা করতে গিয়েছিল, তাই ঠাকুর তাকে বাণ মেরেছে। হীরার মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত উঠছে, এতক্ষণে বোধহয় কেঁসে গেল। বড় তেল হয়েছিল। জাত সাপের ছোবল জানে না!

এ কথা ঠিক, হীরার ফরসা রং এখন রক্তিম হয়ে উঠেছে। গায়ে জ্বর এসেছে, কিন্তু কাঁথার ঢাকনা রাখতে পারছে না। একেবারে উলঙ্গ হয়ে সে শুয়ে আছে আর নিঝুম অবস্থায় মাঝে মাঝে ছটফটিয়ে উঠছে। রাঙা চোখ মেলে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে আর বিড়বিড় করছে, আর করব না ঠাকুর, আর করব না।

মাটির মেঝেয়। তার মাদুরের দুপাশে কালী আর লখাই। বাণ মারা বিষয়ে কালীর অন্তরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস। লখাইয়ের মনে সংশয়। কিন্তু একটা ভয়ংকর কিছু যে ঘটেছে, সে বিষয়ে তার সন্দেহ নেই। সত্যি কি ভটচায ঠাকুরের শাপ লাগল? ক্ষমা বলে কি কোনও বস্তু নেই সংসারে? আচমকা সুস্থ ছেলের এমন জ্বর আসেই বা কোত্থেকে, এমন ছটফটায় বা কেন? এ যেন সত্যি কেমন খারাপ আত্মায় পাওয়া মানুষের মতো দেখায় হীরাকে। এই অবলম্বনটিও ছেড়ে যাবে নাকি সবাইকে। কাঞ্চী বউয়ের একমাত্র স্মৃতি। কিন্তু ভটচায তো সাহেবের চাকর। তার শাপের কি এত তেজ হবে।

সে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ডাকছে, হীরা! হীরালাল।

কালীর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। সে হীরার শরীরের প্রতিটি অঙ্গের লক্ষণ, মুখের প্রতিটি ভঙ্গি উৎকণ্ঠিত অভিনিবেশে লক্ষ করছে। যদি নীল হয়ে ওঠে। যদি নীলবর্ণ হয়ে যায় ছেলে। তার দেহ মনের এক ভাগ, ঘরের এক পাশের অসুস্থ শ্যামের দিকে। আর এক ভাগ হীরার দিকে। সে ডাকছে, বাবা হীরু, বাবা আমার। কী হয়েছে। কী কষ্ট।

.

৪৩.

বাইরের উঠোনে তখন মেয়েপুরুষের জটলা। কে যেন বলছে, মায়ের থানে একবার কেউ হত্যে দিলে পারত, এ্যাট্টা বিধেন পাওয়া যেত।

কালী ভাবল, তাই কি যাব? হেই দেৰ্তা, তাই কি যাব?

লঞ্চের ইঞ্জিনচালক একজন বাঙালি মুসলমান। সারেঙ স্বয়ং মি. ওয়ালেস। ওয়াল্টার, ম্যাকলিস্টার আর ওয়ালিককে নিয়ে তিনি উপরে বসেছেন হুইল ধরে। ছোট্ট লঞ্চটিতে নীচে বসবারও জায়গা রয়েছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দে সেখানে কথাবার্তা একেবারেই শোনা যাবে না। একজন ছোকরা বেয়ারা উপরে উঠবার সিঁড়ির কাছে বসে ছিল, প্রয়োজনে ডাকলেই যাতে সে আসতে পারে। তাকে নিয়ে এসেছেন ওয়ালেস।

লঞ্চ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ালেস ওয়াল্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয়, ওই ইনসেন ব্রাহ্মিণের ব্যাপারে কোনও রিয়্যাকশন হবে এখানে?

ওয়াল্টার বলল, মনে হয় না কোনও রিয়্যাকশন হবে। তবে লোকটা চুরি জোচ্চোরি একেবারেই করে না। হয়তো আর কাজে আসবে না, সেটাই আমি ভাবছি।

ওয়ালেস বললেন, আপনার বাবুরা কী বলছিল?

আমি ওদের আলোচনা ঠিক শুনিনি। তবে আপনি যে রকম গোলমালের কথা ভাবছেন, সে রকম কিছু ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। হলে ওদের সোসাইটির মধ্যেই হবে, আমাকে বা ফ্যাক্টরিতে অ্যাফেক্ট করবে না।

ওয়ালিক বলল, আমারও তাই বিশ্বাস।

ওয়ালেস সামনে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আমি প্রায় চব্বিশ বছর ধরে এদের দেখছি, ইন্ডিয়ানদের। তার আগে কয়েক বছর জাভায় জাভানিজদের। আমি এদের আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এদের চরিত্রের মধ্যে কী একটা অস্পষ্ট রহস্যময়তা আছে, সামথিং মিস্টিসিজিম। তার সঙ্গে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আর কুটিল ষড়যন্ত্রের চেষ্টা, কখন যে কী করবে, কিছুই ঠিক বোঝা যায় না। এমনিতে এরা বেশ ভাল মানুষ। ভাল থাকতে থাকতেই যে কখন হঠাৎ চেঞ্জ করে যাবে, আপনি কিছুই জানেন না।

ওয়ালিক বলল, তা আছে, একসেনট্রিক টাইপ, মাঝে মাঝে তাদেরই হাওয়া লেগে যায়। আর সে সব অধিকাংশই ধর্মীয় গোঁড়ামি। যদিও বাংলাদেশে আমি সেটা খুব কমই দেখেছি।

ম্যাকলিস্টার বলল, শুধু ধর্মীয় গোঁড়ামি? সিপাই মিউটিনিটা কী?

 ওয়ালিক বলল, পরে সেটা রিবেলেই পরিণত হয়েছিল আমার বিশ্বাস।

ওয়ালেস বলল, শুধু এটা নয়। আমার একটা কী রকম সন্দেহ হয়, এরা যে কোনও মুহূর্তেই একজোট হয়ে যেতে পারে। নবাব বাদশাদের কথা আমি জানি না, ওরা কী টাইপের লোক, তা শুধু আমি বইয়েতেই পড়েছি। আর কয়েকজন যাদের দেখেছি, সেগুলো সব চরিত্রহীন অশিক্ষিত ধনীলোক। কিন্তু আমি সাধারণ লোকদের কথা বলছি। স্পেশালি মুসলিম। আমাদের বরানগর ফ্যাক্টরিকে হঠাৎ ওরা একবার ঘিরে ফেলেছিল। কে ওদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, আমাদের ফ্যাক্টরির মেশিনারির মধ্যে শুয়োরের চর্বি কাজে লাগানো হচ্ছে। তখন মি. লিকফোল্ড গিয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ওদের লিডারদের ডেকে নিয়ে তিনি কারখানার মধ্যে চলে গেলেন, বললেন, এক ফোঁটা শুয়োরের চর্বিও যদি তোমরা কারখানার মধ্যে বের করতে পার, গোটা কারখানাটা আমি এখুনি উপড়ে গঙ্গায় ফেলে দেবার হুকুম দেব। ওরা ফিরে গিয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল কি না জানি না। কিন্তু আমরা সারা রাত্রি ঘুমোতে পারিনি। কে জানে, কারখানাটায় আগুন লাগিয়ে দেয় যদি! তা ছাড়া সন্ধের মধ্যেই খবর এসেছিল, হিন্দুদের নাকি বলা হচ্ছে, গোরুর চর্বি নিশ্চয়ই আছে। যাই হোক, কোনও আক্রমণ হয়নি।…তা ছাড়া, ইট ইজ এ ফরচুন অব বোর্নিও কোম্পানি, আঠারো শো সত্তরে একবার আমাদের ফ্যাক্টরিতে, লর্ড মেয়ো অ্যান্ড এ পার্টি ফ্রম গভর্নমেন্ট হাউস, ইনকুডিং দ্য ডিউক অব এডিনবার্গ পদার্পণ করেছিলেন। তারপর আঠারোশো বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে, বেলা দশটা নাগাদ, হঠাৎ একদিন দেখি, শ্রমিকরা সবাই কাজ ফেলে জটলা করছে, আমাদের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। আমি একজন ইয়ং মিস্তিরিকে ডাকলাম, জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী বলাবলি করছ?ও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, লাটসাহিবকে খুন করা হয়েছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, হাউ ডু ইউ ডেয়ার টু সে সো? লোকটা বললে, যা শুনেছি তাই বললাম সাহেব। স্ট্রেঞ্জ, অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা বাদে, সাগর অঞ্চল থেকে ঢাকা নামে একটা স্টিমার সিগন্যাল করে জানাল, পোর্ট ব্লেয়ারে সত্যি সত্যি সেই হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। লর্ড মেয়ে খুন হয়েছেন। একদিন আগে কী করে এই খবর নেটিভদের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছল, ভাবতেও অবাক লাগে! এবং কাগজে দিয়েছিল, ঘটনা ঘটবার আগেই নাকি মাদ্রাজে একটা কানাঘুষা চলছিল! একে আপনারা ফ্যানাটিসিজমই বলুন, আর যাই বলুন, কোনও সন্দেহ নেই, এর পেছনে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল। অথচ কিছুই টের পাওয়া যায়নি। আমার তো এমনভাবে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছল, আমি সমস্ত নেটিভদের অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলাম। মনে হয়েছিল, সবাই এক-একজন কনসপিরেটর। নইলে চব্বিশঘণ্টা আগে এরা সংবাদ পায় কী করে? মনে হয়েছিল, এরা সবাই ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়িত, এরা সবাই মিলে, একজন খুনি।

মি. ওয়ালেসের কথা শুনতে শুনতে, পুরনো খবরটাই যেন সকলের মনে নতুন বিভীষিকার সঞ্চার করছিল। সকলেই দূর গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপ করেছিল।

ওয়াল্টারই প্রথমে বলে উঠল, সি মি. ম্যাকলিস্টার, দেয়ার ইজ দি জার্ডিন-স্কিনারস খানখানাড়া মিলস।

সকলেই যেন একটা আচ্ছন্নতা থেকে, ডাইনে ফিরে তাকাল। ওয়ালেস ঘণ্টা টিপে সিগন্যাল করতেই, ড্রাইভার ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে দিল।

ওয়ালিক বলল, অবিশ্যি এ কথা ঠিক, এদের মনোভাব সবসময় বোঝা যায় না। তবে আমার মনে হয়, আজকের ঘটনায়, সেরকম ভয়ের কিছু নেই।

ওয়ালেস হুইল ঘুরিয়ে, ডান দিকে সরে, তীরের কাছাকাছি হতে হতে বললেন, আমারও তাই বিশ্বাস।

কিন্তু ম্যাকলিস্টারের নজর তখন কাঁকিনাড়ার মিলের দিকে পড়েছে। তার মাথায় তখন আর মেয়ো হত্যা বা নেটিভ চরিত্রের রহস্য-চিন্তায় আবদ্ধ ছিল না। ওয়াল্টারেরও না। এখনও অসম্পূর্ণ, চারদিকে হাজার হাজার বাঁশের ভারা বাঁধা, কাঁকিনাড়া মিলের চেহারার মধ্যে সে তাই ভবিষ্যতের স্বপ্নকেই দেখতে পাচ্ছিল। জীবনের সকল শ্রম, স্বেদ, অর্থ, প্রবাস, সবকিছু দিয়ে তৈরি একটি স্বপ্ন তো একদা ভবিষ্যতে এমনি করেই রূপ নেবে।

ম্যাকলিস্টারের মনের মধ্যে নতুন কোনও মিল তৈরির স্বপ্ন হয়তো ছিল না। কিন্তু এটা একটা নতুন মিল, যার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। জার্ডিন-স্কিনারের মূলধন কী পরিমাণ কে জানে। ইতিমধ্যেই, কামারহাটিতে ওদের মিল চালু হয়ে গিয়েছে। সেটা হয়েছে আঠারোশো সাতাত্তরে। সেখানকার তাঁত সংখ্যা আটশো সাতাশ। এখানে নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় তাঁত বসছে। কারণ, এর ইমারতের চেহারা, আর সীমা চৌহদ্দি, অনেক, অনেক বড়।

ম্যাকলিস্টারের সকল ব্যর্থতা যেন আবার নতুন করে জেগে উঠতে চাইছে। সে ভাবছে, কামারহাটির সেই ছোট মিলটার থেকে নিশ্চয়ই জার্ডিনদের লাভের পরিমাণ, এই নতুন অভিযানের সাহস জুগিয়েছে। নিশ্চয়ই ওদের শেয়ারের মূল্য অনেক বেড়েছে। আর পেরিয়ে যাওয়া বছরগুলিতেও নিশ্চয়ই, শেয়ার হোল্ডাররা একেবারে চুপচাপ বসে ছিল না। ভাল ডিভিডেন্ডই পেয়েছে। আর আমি! ম্যাকলিস্টার জার্ডিন-স্কিনারদের বিরাট জায়গা নিয়ে, বিশাল কারখানার দিকে চেয়ে, মনে মনে বলছে, আর আমি কী করেছি এতকাল ধরে! এই বোর্নিও কোম্পানির ওয়ালেস শুধু বিনয়ী নয়, ধূর্তও বটে, নইলে আমার আরও একটি কীর্তির কথা জেনেও, চুপ করেই ছিল লাঞ্চ টেবিলে। আমি তো ফোর্ট গ্লাস্টার কোম্পানি ছেড়ে,নতুন মিল খোলবার আশায় পালিয়েছিলাম। নতুন করে যখন বাউরিয়া ফ্যাক্টরি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন শুরু হয়েছিল, সেই ফাঁকে আমি তো সোজাসুজি শিয়ালদায় গিয়ে ওরিয়েন্টাল মিল খুলে বসেছিলাম। ক্যানিং বন্দরকে বড় করে তোলা হবে, সেই আশায় যে বিরাট বিরাট গোডাউন তৈরি হয়েছিল, সেই গুদাম ঘরেই তো ওরিয়েন্টাল শুরু করে দিয়েছিলাম। জুডিও আমার সঙ্গে সেখানেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু, আঃ। কী দুর্ভাগ্য, বাউরিয়ার কনস্ট্রাকশন শেষ হতে হতেই, আমার ওরিয়েন্টালের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। ডাণ্ডিওয়ালারা বিরক্ত হয়েছিল, বিদ্রূপ করেছিল। করবেই। তারা আমাকে বিশ্বাস করে, কারখানার জন্যে সবই দিয়েছিল।…এ কি সত্যি আমার ইয়াংকি প্রবৃত্তির ব্যাধি? একি শুধুই আমার অর্থহীন অ্যাডভেঞ্চারিজম? নইলে, বারে বারে এমন করে হেরে যাচ্ছি কেন?…হে ঈশ্বর? কোন অপদেবতা আমার পিছনে পিছনে ফিরছে? মি. ফোর্ট গ্লাস্টারের লম্বা মুখখানি আমার মনে পড়ছে। সেই তীক্ষ্ণ চোখ, গালে ভাঁজ পড়া লোকটির মুখে যে বৈরাগ্য মেশানো বিদ্রুপের হাসিটা আমি দেখেছি, সে হাসি কি আমার প্রতিই নয়?…অথচ কত আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি দুবার শুরু করলাম। কিন্তু এই পাট, এই সোনালি পাট যেন আমাকে চাবুক হেনে তাড়িয়ে দিতে চাইছে! কেন? ফিলাডেলফিয়ার মাটিতে আমি জন্মেছিলাম বলে? স্কটল্যান্ডের শক্ত রুক্ষ ধূসর মাটিতে জন্মাইনি বলে! তাই তো দেখছি, একজন স্কটল্যান্ডজাত লোক জুটে হাত দিলেই তা সার্থক হয়ে ওঠে। তবু এমন কথা তো কেউ বলতে পারবে না, আমি ইন্ডিয়ায় বসে নবাবি করতে চেয়েছি। জর্জ অ্যাকলেন্ডের মতো আমি তো বিলাসিতায় গা এলিয়ে দিইনি। সে সুযোগই বা আমি পেয়েছিলাম কোথায়? ওরিয়েন্টালের দিগন্তে তো কোনও সূর্যোদয়ের আলোই দেখা দেয়নি। যে অন্ধকারের মধ্যে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই অন্ধকারেই গুটিয়ে গিয়েছিল।

ম্যাকলিস্টারের চোখের সামনে, জার্ডিন-স্কিনারদের ফ্যাক্টরির উপরে ভেসে উঠল শিয়ালদহের খাল, পড়ন্ত সূর্যের রক্তাভ নিস্তরঙ্গ জলে যেখানে ওরিয়েন্টালের ছায়াছবির মতো ভাসছে। ওরিয়েন্টাল! ওরিয়েন্টাল!–অনেক সাধ করে নাম দিয়েছিলাম, ওরিয়েন্টাল! অনেক প্রশংসাও পেয়েছিলাম নামটার জন্যে। তবু হেরে গেলাম। একটা, মাত্র একটা গোঁয়ার্তুমিই আমি করেছিলাম, এই মেশিনারি নিয়ে, এ দেশে সকলের আগে, আমি ফ্রিস্কো হেসিয়ান হুইট ব্যাগ আর অস্ট্রেলিয়ান কর্নস্যাক তৈরি করবার জেদ ধরেছিলাম। আর তার রসদ জোগাতেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। আমি যদি অর্ডিনারি গানি ব্যাগস আর কাপড় তৈরি করতাম, এই ওয়াল্টারের মতো যদি শুধু সুতোই তৈরি করতাম, তা হলেও বোধহয় এতদিনে অনেক দূর এগিয়ে যেতাম। কিন্তু আমার অ্যাম্বিশন! আমার গাভীন ঘোড়া আর তার বাচ্চা, দুই-ই মারা গেল ভুল অপারেশনে। আমি ময়দার ফ্রিস্কো হেসিয়ান ব্যাগ আর অস্ট্রেলিয়ান কর্নস্যাক প্রডিউস করব শুনে, সমস্ত ইন্ডিয়ান জুট ফ্যাক্টরিওয়ালাদের কী দারুণ হিংসা আর বিদ্বেষ জ্বলে উঠেছিল।…এই ওয়ালেস, এই ওয়ালিক, হয়তো ওয়াল্টারও সবাই শ্বাসরুদ্ধ করে নিশ্চয় সেই সময় ওরিয়েন্টালের দিকে তাকিয়েছিল। জুট বুলেটিন বেরুলেই সবাই আগে দেখত ওরিয়েন্টাল সত্যি সত্যি সেই মাল তৈরি করেছে কি না!..পারিনি, হেরে গিয়েছি, একেবারে হেরে গিয়েছি, আবার ফিরে গিয়েছি।…কিন্তু গত বছর থেকে সেই ওরিয়েন্টালই তো আবার বাজারে দাঁড়িয়েছে! বার্ড কোম্পানি তার দায়িত্ব নিয়ে, কারখানার নামটা বদলে দিয়েছে। ওরিয়েন্টাল এখন ইউনিয়ন হয়েছে। ইউনিয়ন উইথ ক্লাইভ জুটমিল। কয়েক বছর আগেই বার্ড কোম্পানি ক্লাইভ মিল চালু করেছিল। ওরিয়েন্টালকে ইউনিয়ন নাম দিয়ে, সেই তাদের দ্বিতীয় মিল।…এখন সেই ইউনিয়ন রোরিং বিজনেস করছে। ম্যাকলিস্টার, সবাই রোরিং বিজনেস করবে, এই কাঁকিনাড়া মিলও নিশ্চয়ই করবে, কিন্তু তুমি কোথায়? এই সুদূর বাংলায়, হুগলি নদীর তীরে, তুমি কোথায়?

ওয়াল্টারের নিচু ঈর্ষা-মুগ্ধ গলা শোনা গেল, হোয়াট এ বিগ মিল দে আর মেকিং!

সকলের মনের মধ্যে সম্ভবত একটি কথাই বাজছিল, হোয়াট এ বিগ মিল! বরানগর মিল-এর থেকে ছোট নয় নিশ্চয়। তবু ওয়ালেসের প্রাণের ভিতরেও কোথায় যেন দপদপ করছিল। ওয়ালিকেরও। তাদের টমাস ডাফের শ্যামনগর কারখানাও ছোট নয়। নর্থ ও সাউথ, দুটো মিল এখন পাঁচিলের এপাশে ওপাশে চালাচ্ছে তারা। তবু, তবু, জার্ডিন-স্কিনারদের এই কারখানা দেখে, তার মনটাও যেন ঈর্ষা ও উত্তেজনায় চিনচিন করে উঠছে।

ঘাটের কাছে, এ দেশীয় বড় বড় নৌকা ভিড় করে রয়েছে। একটি-দুটি নয়, অনেক, সারি সারি কোথাও এলোমেলো নোঙর করেছে। তাদের মাস্তুলের ভিড়ে, আকাশটা হিজিবিজি কাটা। যেন একটা বন্দর। এই সব বড় বড় খুটনী নৌকায় বিরাট গহুর ভরতি চুন, বালি, ইট, সুরকি, বড় বড় লোহার বিম, শিক, রাশি রাশি টিনের পাত। শত-শত শ্রমিকেরা, চিৎকারে আর কলরবে মালপত্র নামাচ্ছে। কোথাও দল বেঁধে গলা খুলে গান ধরেছে, আর কাজ করছে। কোথাও একসঙ্গে গলা মিলিয়ে, প্রচণ্ড জিনিস নামাতে নামাতে সুর করে বলছে, হেই তাগরদারি!–মার লাথি। হেই শালার গতর বড়!–মার লাথি।…হেই হেই হেই হেই…দ্যুম! বিরাট লোহার বিম পড়ছে শব্দ করে। যাদের এই মাত্র কাজকর্ম মিটেছে, তারা অনেকে জলে নেমে পড়েছে। জলে হুড়ছে, সাঁতার কাটছে, আর গঙ্গার বুকে স্টিম লঞ্চ দেখে, লঞ্চের ছাদে সাহেবদের দেখে, নিজেদের মধ্যে চিৎকার করে বলাবলি করছে। মেয়েরাও রয়েছে। তার মধ্যে। বাঙালি কামিন মেয়ে। দু-একজন ওয়ালিক আর ওয়াল্টারকে চিনতে পারছিল। চিৎকার করে বলছিল, অলিক গো, অলিক। আর জগদ্দলের পাগলা সায়েবও আছে, অল্টার অল্টার!…

ওয়ালিক হাত না নেড়ে পারল না। ওয়াল্টার হাসছে। যদিও এই হাসি ক্ষণিকের ছুঁয়ে যাওয়া মাত্র। তারা দেখছে কারখানা। তীরের উপরে অনেক গোরুর গাড়ি কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেও মাল খালাস হচ্ছে। ভারার উপরে মিস্তিরি মজুরেরা কাজ করছে। জোগানদারেরা মাল নিয়ে, ভারার উপরে পিলপিলিয়ে ওঠানামা করছে। কারখানা ইমারতের মধ্যে ইতিমধ্যেই মেশিন বসতে আরম্ভ করেছে। কোনও কোনওটায় বসানো হয়ে গিয়েছে। বয়লারের চিমনিতে এখনও ভারা বাঁধা, তবু তার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। ইট গেঁথে গেঁথে তোলা, বিরাট আকাশস্পর্শী চিমনি। চিমনির ধোঁয়া দেখেই বোঝা যায়, রোজই বয়লার গরম করবার এক্সপেরিমেন্ট চলছে। স্টিম তৈরি করে রোজই একটু একটু পরখ করা হচ্ছে। কাজ চালানো হচ্ছে। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, জার্ডিন-স্কিনারের মেকানিক ওভারশিয়ারের দল ভিতরে কাজ করছে, তারা ব্যস্ত, ত্রস্ত, উত্তেজিত। অবিলম্বে কারখানার উৎপাদন শুরু করার জন্যে তারা সমস্ত বিভাগকে দ্রুত দাঁড় করাবার চেষ্টা করছে। মিস্তিরি মজুর সংগ্রহে লেগেছে তারা অনেকদিন ধরে। সমগ্র এলাকার লোকে জানে, গলায় দড়ের কল পরিপূর্ণরূপে চালু হয়ে গিয়েছে। মজুর আর মিস্তিরি জোগাড়ের দালাল আড়কাঠিরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এ কথা ঠিকই, স্পিনিং ইতিমধ্যেই চলতে আরম্ভ করেছে, কিছু কিছু সুতো তৈরি হতে আরম্ভ করেছে।

যে দু-তিনজন শ্বেতাঙ্গ বাইরে দাঁড়িয়ে ইমারত তৈরি পরিচালনা করছিল, তারাও বরানগর ফ্যাক্টরির স্টিম লঞ্চের দিকে কৌতূহলিত হয়ে তাকাল। একজন দূরবীন দিয়ে দেখতে লাগল, আর সঙ্গীদের ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কিছু বলতে লাগল।

কিন্তু ওয়ালেস লঞ্চ তীরের কাছে নিয়ে গেলেন না। এভাবে ঘাটে লঞ্চ ভিড়িয়ে, অচেনা লোকদের সঙ্গে আলাপ করার প্রবৃত্তি নেই তাঁর। অতএব মুখোমুখি, চোখে চোখে তাকানো ছাড়া, আর কিছুই হল না।

ওয়ালেস বললেন, সত্যি, জার্ডিন-স্কিনার অ্যান্ড কোম্পানি বেশ বড় কারখানাই করছে।

ওয়ালিক বলল, আমার মনে হয়, হাজার দেড়েক লুম ওরা বসাবে, কী বলেন?

ওয়ালেস বললেন, তাই তো আমার মনে হচ্ছে। পুরোপুরি না হলেও, হাজারের ওপর তো নিঃসন্দেহেই বসবে। আমি যেন একবার শুনেছিলাম, প্রায় তেরো চৌদ্দশো তাঁত ওরা বসাবে।

তেরো চৌদ্দশো! উচ্চারণ করতে ওয়ালেসের বুকটা টাটিয়ে উঠল। তাদের বরানগরের দুটো ফ্যাক্টরিতে এগারোশোর মতো লুম আছে। টমাস ডাফের শ্যামনগর ফ্যাক্টরিতে হাজারের কিছু কম। ম্যাকলিস্টার আর ওয়াল্টার শ্বাসরুদ্ধ করে খালি শুনেই যাচ্ছিল। ওয়াল্টার আজ অবধি লুম-এর স্বপ্নই শুধু দেখে আসছে। আর ম্যাকলিস্টার মনে মনে বলছে, পাঁচশো পঁচিশটা তাঁত আমি বসিয়েছিলাম আমার ওরিয়েন্টালে। যদি দাঁড়াতে পারতাম, হয়তো আমিও দেড়হাজার লুম বসাতে পারতাম।

ওয়ালেস বাঁ দিকে হুইল ঘুরিয়ে, লঞ্চ সরিয়ে নিতে নিতে, একটা নিশ্বাস ফেললেন। নতুন বাতাস টেনে নিয়ে যেন, ভিতরের অন্ধকার মুছে দিতে চাইলেন। বললেন, জার্ডিন- স্কিনারের প্রথম কারখানা কামারহাটিতে হয়েছিল, সেটা যেন অনেকটা, পরের সন্তানকে মানুষ করতে করতে যখন তা হাতছাড়া হয়ে গেল, তখন নিজেরও বুক জুড়ে একটি সন্তানের দরকার হয়ে পড়ল। ডক্টর বেরির গৌরীপুর জুট মিলের ওরাই ছিল এজেন্ট। আঠারোশো ছিয়াত্তরে ডক্টর বেরি এলেন বাংলাদেশে। জার্ডিন-স্কিনারের কাছ থেকে এজেন্সি তুলে নিয়ে, সবটাই নিজের ফার্মে নিয়ে নিলেন। জার্ডিনরা দেখল, এভাবে বসে থাকা অসম্ভব। ওরা ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল, দিস ইজ হাই টাইম ফর জুট ইন্ডাষ্ট্রি ইন বেঙ্গল। সাতাত্তর সালের মধ্যেই ওরা কারখানা তুলে ফেলল। তারপরে এই খানখানাড়া। বেরি কোম্পানির লুমের সংখ্যা কত? গৌরীপুরের দুটো কারখানায়, ম্যাকসিমাম বারোশো তেরোশো। আর এদের শুধু কামারহাটিতেই প্রায় সাড়ে আটশো, এখানেও প্রায় চৌদ্দশো বসবে। অথচ এর জন্ম তো সেদিন। বেরির গৌরীপুর ফ্যাক্টরি হয়েছিল আমাদের বরানগরের পরেই, আঠারোশো বাষট্টিতে।…

ওয়ালেস ঘণ্টা বাজিয়ে ড্রাইভারকে ইঞ্জিন চালু করবার ইঙ্গিত করলেন। করা মাত্রই নীচে ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ওয়ালিকের মনে পড়ছিল, শ্যামনগর মিলের প্রতিষ্ঠাতা, মি. টমাস ডাফ স্বয়ং কারখানা চালাবার আগে, নেটিভ ভগবতীর পুজো দিয়েছিলেন। গারুলিয়া মিলের, অফিসের পারচেজিং ক্লার্ক এই বুদ্ধিটি তাঁকে দিয়েছিল, এবং তিনি বিশ্বাস করে সেই পুজোও দিয়েছিলেন। নেকেড ব্ল্যাকগডেস, হরিবল্ লুকিং, মাদার কালী-এঁর কাছে পুজো দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিজে সঙ্গে যাননি। যেতে হয়েছিল ওয়ালিককে। অনেক দূরের গ্রামে, বগি হাঁকাবার রাস্তা নেই, সেই রকম এক গণ্ডগ্রামে, ডাকাতদের পূজ্যা, এক ভাঙা মন্দিরের কালীদেবীর কাছে ওয়ালিককে যেতে হয়েছিল পুজো দেবার জন্যে। মি. টমাস ডাফ ক্লার্ককে দিয়েছিলেন প্রায় পাঁচশো টাকা। অনেকে বলে, পারচেজিং ক্লার্ক, তার থেকে টাকা সরিয়েছিল। সে বিষয়ে ওয়ালিক সঠিক কিছুই জানে না। কিন্তু পুজোটা যে খুব ধুমধামের মধ্যে হয়েছিল, তা মনে আছে। ওয়ালিক পাঁঠা বলি দেখেছিল, প্রচুর টডি পান করেছিল। নেটিভ পুরোহিত গিয়ে, মি. টমাস ডাফের কপালে ভারমিলিয়ানের ফোঁটা লাগিয়ে দিয়েছিল। মি. টমাস ডাফ তাতে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। শুধু সেই বলি দেওয়া পশুর মাংস গ্রহণ করতে পারেননি। ওয়ালিকের তাতেও কোনও বাধা ছিল না। প্রায় পুরো একটি নধর কচি পাঁঠা। ছাল ছাড়িয়ে তাকে দিয়েছিল।

কিন্তু এ সব কথা মনে পড়ছে কেন ওয়ালিকের? মনে পড়ছে, তার কারণ সে ভাবছে, জার্ডিন-স্কিনাররাও সেরকম কোনও নেটিভ দেবদেবীদের পুজোপাট দিয়ে শুরু করেছে কি না। আসলে ওয়ালিকের খাঁটি স্কচ মনের গভীরে, সেই ভয়ংকর দর্শন ভগবতী কালীর একটি ছায়া গাঢ় দাগ কেটে বসে আছে। আশ্চর্য! এই বিজাতীয় ঈশ্বরীর কথাটা প্রায়ই তার থেকে থেকে মনে হয়, এবং কোথায় যেন একটা ক্ষীণ বিশ্বাসের ছায়াও তার মনে রয়েছে। এ কথাটা নিজের দেশের লোকদের কখনও বলতে পারে না সে। তাই ভাগ্যবান জার্ডিন-স্কিনারের কারখানা দেখে, এই কথাটাই তার আগে মনে পড়ছে।

মি. ওয়ালেস হঠাৎ পুবদিকে, জার্ডিনদের উত্তর দিকের খোলা জমিটার দিকে উৎসুক চোখে তাকালেন। রীতিমতো আগ্রহের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন, কেউ বলতে পারেন, এ জমিটা কার, কী অবস্থায় আছে?

ওয়াল্টার আর ওয়ালিক অবাক হয়ে তাকাল ওয়ালেসের দিকে। ম্যাকলিস্টার যেন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।

ওয়াল্টার বলল, কেন বলুন তো স্যার?

–জমিটা খুবই সুন্দর, একটা মিলের পক্ষে বেশ উপযোগী। তার মানে এই নয় যে, বোর্নিও কোম্পানি এখনই নতুন কোনও কারখানা করবে। তবু জানতে ইচ্ছে করছে।

ওয়াল্টার বলল, সত্যি স্যার, আপনার দৃষ্টি অদ্ভুত সজাগ এ ব্যাপারে। জায়গাটা সেজন্যে আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। কোনও অস্ট্রো-জার্মান ফার্ম এই জমিটা কিনে রেখেছে।

–আই সি।

ওয়ালেস ঘাড় নেড়ে, এঞ্জিনে, পূর্ণ গতি দেবার ইঙ্গিত করলেন ড্রাইভারকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বোতল গেলাসের শব্দ পেয়ে, ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ম্যাকলিস্টার গেলাসে ঢকঢক করে মদ ঢালছেন।

ওয়ালিক বলে উঠল, এই মধ্যেই আবার তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠলেন?

ম্যাকলিস্টার জবাব দেবার আগে, গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিল। তারপর যেন নিশ্বাস আটকে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল, হ্যাঁ তৃষ্ণার্ত, খুবই তৃষ্ণার্ত হে ওয়ালিক। বোধহয় আমার এ তৃষ্ণা কোনওদিনই মিটবে না।

ওয়ালেস বুঝতে পেরেছিলেন, ম্যাকলিস্টারের কোথায় লেগেছে। জার্ডিনদের কারখানাটা দেখে, সকলের যেখানে লেগেছে, ম্যাকলিস্টারেরও সেখানেই। তবু, ম্যাকলিস্টারের যাতনাই বেশি। তার মতো ব্যর্থতার মুখোমুখি কাউকেই দাঁড়াতে হয়নি। ওয়ালেস বাঁ হাত দিয়ে, ম্যাকলিস্টারের কাঁধে আস্তে আস্তে চাপড় মারলেন। বললেন, মিটবে তৃষ্ণা, মিটবে মি. ম্যাকলিস্টার। জার্ডিন-স্কিনারদের ফ্যাক্টরি দেখে, আমাদের আসলে উৎসাহ পাবারই কথা। আমরা এখানে সকলেই রোজগার করতে এসেছি, ব্যক্তিগতভাবে আমরা সকলেই উন্নতি করতে চাই, এবং হয়তো আমাদের নিজেদের মধ্যে কিছু ঈর্ষা হিংসা রেষারেষিও থাকবে। থাকুক না, ক্ষতি কী! এই নতুন কারখানাটা দেখে, হয়তো আমারও একটি ডিপ্রেশন এসেছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কী মি. ম্যাকলিস্টার, আমি যেন নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

ওয়ালেসের কথার ফাঁকে ফাঁকে ম্যাকলিস্টার গেলাসে চুমুক দেওয়া বন্ধ রাখেনি। সে বলল, মি. ওয়ালেস, আপনি আমাকে সারাদিন ধরে অনেকবার আশার কথা শুনিয়েছেন।

ওয়ালেস বললেন, কিন্তু মিথ্যে আশার কথা শোনাইনি মি. ম্যাকলিস্টার।

ম্যাকলিস্টার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি তা জানি মি. ওয়ালেস। আমি জানি, আপনি আমাকে মিথ্যে আশার কথা শোনাননি, সে জন্যে আপনাকে আবার অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি আমার মনের অবস্থা ঠিক বুঝতে পারেন, তাই প্রত্যেকবার আমার হতাশাকে আপনি ধুয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি যতই অপরের কৃতকার্যতা দেখি, ততই নিজের অকৃতকার্যতা যেন আমার টুটি চেপে ধরছে, আমি অসহায় হয়ে পড়ছি।

ওয়ালেস বললেন, কিন্তু আপনি নতুন উদ্যমে শুরু করুন। এই সব নতুন নতুন কারখানা দেখে, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন, আমি এই কথাই বলছি। আপনারা সবাই জানেন, আজ এ দেশের চারপাশে এত কারখানা হবার আর একটা কারণ, চা এবং কয়লার থেকেও জুট অনেক বেশি প্রফিট দিয়েছে। কেউ কখনও এতটা আশা করতে পেরেছিল? কল্পনা করতে পেরেছিল, চা আর কয়লার থেকেও জুট বেশি প্রফিট দেবে? সেটা দিয়েছিল বলেই, এইটিন সেভেনটিটু-সেভেনটিথ্রি-তে, জুটমিলের স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে। মি. ম্যাকলিস্টার এই স্রোতের মধ্যে কোথাও কোথাও, হয়তো প্রাকৃতিক নিয়মেই বালুচর রয়ে গেছে, যেখানে দু-একজন ঠেকে গেছে। আপনি তারই একজন, আপাতত চড়ায় ঠেকেছে, কিন্তু কতদিন! জুটের স্রোত আপনা থেকেই, আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

ম্যাকলিস্টার তাড়াতাড়ি নতুন একটা গেলাসে মদ ঢেলে ওয়ালেসের হাতে তুলে দিল। বলল, আপনার কথা যেন সার্থক হয়।

বলে, আরও দুটি গেলাসে নিজের হাতে পানীয় ঢেলে দিল ম্যাকলিস্টার। ওয়ালিক আর ওয়াল্টার ধন্যবাদ দিয়ে গেলাস তুলে নিল।

ওয়ালেস বললেন, কিন্তু আমি জেনে নিতে চাই, উত্তর দিকে আমরা আর কতটা প্রসিড করব?

ওয়ালিক বলল, আপনাদের আপত্তি না থাকলে, আমার প্রস্তাব হল গাউরিপোর পর্যন্ত। ডক্টর বেরির ফ্যাক্টরিটাও তা হলে দূর থেকে দেখে আসা যায়।

ওয়ালেস বললেন, উত্তম প্রস্তাব। বেরিয়েই যখন পড়েছি, তখন এটুকু ঘুরে আসাই যাক। কেবল একটু লক্ষ রাখবেন, লঞ্চটা কোনও চড়ায় না আটকায়। আমি এদিককার গঙ্গা সম্পর্কে আনাড়ি।

ওয়ালিক বলল, আপনি ইস্ট সাইড ঘেঁষেই চলুন, কোনও ভয় নেই।

ইতিমধ্যে লঞ্চ ভাটপাড়া পেরিয়ে যাবার উপক্রম করেছে প্রায়। সূর্য ইতিমধ্যে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আরও একটু ঢলেছে পশ্চিমে। গ্রাম ভাটপাড়ার ঘাটগুলিতে পড়ন্ত রোদ। কোনও কোনও ঘাটে অশ্বত্থা-বকুলের ছায়া নিবিড়তা। সেই ছায়ায় আদুড় গা পুরুষেরা বসে কথা বলছে। দু-চারজন মেয়েপুরুষ মানও করছে। তারা সবাই স্টিম লঞ্চ দেখছে। কাছাকাছি অধিবাসী অনেকে লঞ্চের ভটভট শব্দ পেয়ে ছুটে আসছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে, চোখ বড় বড় করে লঞ্চ দেখছে। লঞ্চের ছাদে, গোরাদের দেখছে।

পশ্চিম তীরে ফরাসি এলাকা পেরিয়ে, ইংরেজদের এলাকা পড়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ষণ্ডেশ্বরতলা ছাড়িয়ে, চুঁচুড়ার নিবিড় বনস্পতিছায়া মাঠ, সরকারি ভবন, ঘণ্টা ঘর, কোর্ট হাউস দেখা যাচ্ছে। তীর ছাড়িয়ে, আরও দূরে, চুঁচুড়ার অনেক বড় বড় অট্টালিকা চোখে পড়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে। বর্ধিষ্ণু, শতাধিক বৎসরের পুরনো শহর, ওলন্দাজ পর্তুগিজদের আমল থেকে তার বাড়বাড়ন্ত। ডাচদের আমল থেকেই চুঁচুড়া প্রাসাদময়ী। ইংরেজরা পরে দখল করেছিল, আর ডাচদের দুর্গের ভিতসুদ্ধ উপড়ে ফেলেছিল। তারই মালমশলা দিয়ে, যে ব্যারাক তৈরি হয়েছিল, তা এখন জেলা কোর্ট ভবন।

পূর্বতীরে, মুক্তাপুর খালের সীমানায় নৈহাটি। কিন্তু তুলনায় চুঁচুড়া, ইমারত আর নিবিড় গাছপালায় অনেক সুন্দর। চুঁচুড়াতে সরকারি অফিস, ব্যবসায় কেন্দ্র, কলেজ, সব মিলিয়ে জমজমাট। সেই তুলনায় নৈহাটি সম্পন্ন গ্রাম। ভাটপাড়ার পর খালের ওপারেই গ্রাম কাঁঠালপাড়া, পূর্ব দিগন্তে বিস্তৃত। কোম্পানির রেললাইন তার বুকের উপর দিয়ে গিয়েছে। ভাটপাড়ার মতোই সম্পন্ন গ্রাম কাঁঠালপাড়ার বর্ণশ্রেষ্ঠদের পাড়া পেরিয়ে, গঙ্গাযাত্রীদের মূমুর্ষ ঘর ও ঘাট। লঞ্চের শব্দে কাঁঠালপাড়ার মানুষেরাও ছুটে এল। তারপরে কেওরাদের পাড়া। খানিকটা পেরিয়ে গঙ্গার ধারেই নৈহাটি বাজার। দূরে দেখা যায় জুবিলি ব্রিজ। শুধু রেলগাড়ি যাবার সেতু। সেতুর আগেই, গৌরীপুর মিলের চিমনি দেখা গেল। চিমনি দিয়ে অনর্গল ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

ওয়ালেস বলে উঠলেন, দিস ইজ অলসো এ বিগ মিল।

ওয়ালিক বলল, হ্যাঁ, দুটো মিল একসঙ্গে আছে। তা ছাড়া একটা তেলকলও এর সঙ্গে চলে।

ওয়ালেস বললেন, শুনেছি সে-তেলকলের কোনও আলাদা রেভিনিউ দেখানো হয় না?

ওয়ালিক বলল, আমিও তাই শুনেছি। যদিও তেলকলও যথেষ্ট লাভের ব্যবসা।

ওয়ালেস লঞ্চের গতি মন্থর করবার নির্দেশ দিলেন। সকলেই গৌরীপুর মিলের দৈর্ঘ্য দৃষ্টি দিয়ে যেন মাপতে লাগল। মিলের জেটির কাছে অনেকগুলি বড় বড় দেশীয় নৌকা। সবগুলিই পাট বোঝাই। নারায়ণগঞ্জের ডেভিড কোম্পানির মস্ত বড় একটা গাধাবোটও রয়েছে। স্টিমার টেনে নিয়ে এসে, মাল বোঝাই গাধাবোট ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে।

ওয়ালেস বললেন, সত্যি, ডক্টর বেরি খুব বুদ্ধিমানের মতোই জার্ডিন-স্কিনারদের হাত থেকে এজেন্সি নিজের হাতে নিয়ে এসেছিলেন। ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছিলেন, এজেন্টদের ডিসকাউন্ট দেবার আর কোনও দরকার নেই। এই কারখানা বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়, কোম্পানি বেশ বেগে দৌড়চ্ছে, তাই নয়?

ওয়ালিক জানাল, নিশ্চয়ই। এক হাজার দুশো পঞ্চান্নটা লুম যাদের চলে, তাদের নিশ্চয়ই অনেক ম্পিড।

সৌভাগ্যবান ডক্টর।

ওয়াল্টার নিবিষ্ট হয়ে কারখানা দেখছিল, আর মনে মনে বলছিল, সৌভাগ্যবান, সৌভাগ্যবান। ওয়াল্টার, তুমি কবে সৌভাগ্যবান হবে?

লঞ্চ বাঁ দিকে বাঁকিয়ে, দক্ষিণ মুখে ঘুরিয়ে নিতে লাগলেন ওয়ালেস। ম্যাকলিস্টারের উদ্দেশে বললেন, এ সবই আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ডক্টর বেরির এই ফ্যাক্টরি, আর এই মজবুত বিরাট রেলওয়ে ব্রিজ, একবার তাকিয়ে দেখুন তো সমস্ত ছবিটা! আমি তো যেন চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছি, হুগলি নদীর এই ধারে ধারে, এই সব ফাঁকা জায়গা এক ইঞ্চিও পড়ে থাকবে না। সমস্তটা কলকারখানায় ছেয়ে যাবে। শুধু একটু ব্যালান্স হয়ে চালিয়ে যাওয়া।

ম্যাকলিস্টারের চোখ দূর শূন্যে নিবদ্ধ। এখন তার মুখে নৈরাশ্যের ছায়া নেই। চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠেছে। শপথ গ্রহণের মতো সে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ব্যালান্স, ব্যালান্স!

ওয়াল্টার মনে মনে বলল, আমি কখনও আনব্যালান্সড হব না। প্রত্যেকটি ইট আমি গুনে গুনে গাঁথব, গভীর ভিতে আমি ইমারত গড়ব।

সূর্য প্রায় অস্তমিত। পশ্চিমের গাছের আড়ালে প্রায় ডুবে যাচ্ছে। অনেক বড় আর রক্তের সুগোল ঘুরন্ত ড্যালার মতো সুর্য, গাছের আড়ালে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ছায়া ঘনিয়ে আসছে। পাখিরা এপার ওপার করছে। ঘাটে অঘাটে মেয়েপুরুষের স্নানের ভিড়। এখনও লক্ষ করলে দেখা যায়, আনার্থীরা অধিকাংশই গেরুয়াধারী। চৈত্রের সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনী। সারাদিনের ভিক্ষা সংগ্রহের পর সবাই স্নান করতে এসেছে। সমস্ত আকাশটাই তাতানো লোহার মতো রক্তাভ হয়ে উঠছে। একটু পরেই জুড়িয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা লোহার মতো কালো হয়ে আসবে। সন্ধ্যা আসন্ন। চৈত্রের গঙ্গায় যারা খয়রা চুনো ধরছে, সেই সব মাঝিরা তাড়াতাড়ি লঞ্চের কাছ থেকে নৌকো সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও অবাক কৌতূহলে গোরাদের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।

ওয়ালেস বললেন, মি. ম্যাকলিস্টার। আপনি তো তবু একটা কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, আপনার ওপর অনেকেরই আস্থা আছে। আপনি একটা কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইলে, এখনও আপনার পিছনে টাকা ঢালবার লোকের অভাব হবে না। আপনি এখনও নতুন উদ্যমে লাগতে পারেন। কিন্তু আমি এমন মানুষও দেখেছি, একেবারে কপর্দকহীন অসহায় হয়ে, জামার আস্তিন দিয়ে শুধু চোখের জল মুছেছে। এবং এই জুট, এই জুটই হচ্ছে তার মূলে। এই সোনালি সুতোর হাতছানিই তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক অজানা অন্ধকারের দিকে। অবশ্যি ভদ্রলোক কপর্দকশূন্যই এসেছিলেন। কিন্তু জুট যেন ওঁকে নিয়ে একটা মজার খেলাই শুধু খেলেছিল।

ওয়ালিক বলে উঠল, কে সে মি. ওয়ালেস?

ম্যাকলিস্টার বলল, এমন লোকের কথা কখনও শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না, একমাত্র মি. জর্জ অ্যাকলেন্ড ছাড়া?

ওয়ালেসের চোখ দূর গঙ্গার স্রোতে রক্তিম ছটার উপর। বললেন, তাঁকে আপনাদের জানবার কথা নয়। তিনি একজন আর্মেনিয়ান, ওঁর পুরো নামটা আমার মনে নেই। মি. ওয়েসকিন বলেই জানতাম। আমাদের জুট ইন্ডাস্ট্রির কম লোকই তাঁকে দেখেছে। আর্মেনিয়ান শুনে ভাববেন না, উনি ফিরিঙ্গি ছিলেন। ভদ্রলোক আমেরিকায় গেছলেন ভাগ্যান্বেষণে, সেখান থেকে এক আমেরিকান ফার্মের কাজে এসেছিলেন কলকাতায়। থাকতেন বরানগরে, আমাদের মিল থেকে একটু দূরে, মল্লিকদের বাগানের কাছেই। অনেকখানি জমি নিয়ে, একটা ছোট বাড়িতে ভদ্রলোক একাই থাকতেন। আর ছিল চাকরবাকর। বেশ বিলাসী আর ফুর্তিবাজ লোক ছিলেন। ভদ্রলোকের ছিল ঈর্ষা করবার মতো একটা আরবি ঘোড়া। সেই ঘোড়ায় চেপেই উনি রোজ কলকাতায় যেতেন। ফিরতেন অনেক রাত্রে। কোনওদিন একলা, কোনওদিন কাউকে জড়িয়ে ধরে। অর্থাৎ কোনও মেয়েকে। ও ব্যাপারেও উনি ইন্টারেস্টেড ছিলেন। অধিকাংশ দিন সকালে দেখলেই বোঝা যেত সারারাত কেটেছে নানান মকারান্ত উপদ্রবের মধ্যে দিয়ে। বেচারির আর করবারই বা কী ছিল। এই সময়ে ফেরার পথে, কাঁকিনাড়ার জার্ডিনদের কারখানাটা আবার একবার তাকিয়ে দেখলেন ওয়ালেস। কিন্তু সবাই ওঁর ওয়েসকিন কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার বললেন, হঠাৎ একদিন সকালবেলা দেখি, মি. ওয়েসকিন আমাদের ফ্যাক্টরির অফিসের দিকে আসছেন। আমি ডিপার্টমেন্টে যাবার পথে থমকে দাঁড়ালাম। ঘোড়াটা হয়তো দারোয়ানের জিম্মায় রেখে, উনি হেঁটেই আসছিলেন। আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ম্যানেজারের সঙ্গে একবার দেখা করবার অনুমতি পাব কি? আমি বললাম, কেন নয়, আসুন। ম্যানেজার ওঁর অফিসেই আছেন, আমি খবর দিচ্ছি। ওয়েসকিন পাকা ভদ্রলোক। বললেন, না না, আপনি কেন কষ্ট করে যাবেন, কোনও বেয়ারাই যাক না। আমি বললাম, খবর দিতে আমি কিছুই মনে করব না। আপনার কী প্রয়োজন, অসুবিধে না থাকলে, আমাকে সেটা বলতে পারেন। আমি ইচ্ছে করেই কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। কারণটা জানবার জন্যে আমার বেশ কৌতূহল হচ্ছিল। ওয়েসকিন হঠাৎ একবার ঠোঁটে ঠোঁট টিপে, এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন, বললেন, প্রয়োজন মানে, নিতান্তই একটি প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছি, অনুগ্রহ করে উনি যদি সে প্রার্থনা পূরণ করেন। আমি আর সময় দিলাম না। ভদ্রলোকের মুখখানিও যেন প্রার্থনায় প্রায় করুণ দেখাচ্ছিল। বললাম, আপনি আসুন।ওঁকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, আমি তাড়াতাড়ি মি. লিকফোন্ডকে সংবাদ দিলাম। মি. লিকফোন্ডও একটু অবাক হলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, লোকটির কী প্রার্থনা থাকতে পারে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ভদ্রলোককে ডাকা হল। স্বভাবতই আমার চলে যাওয়া উচিত। মি. লিকফোন্ড ওয়েসকিনকে বসতে বলে, তাড়াতাড়ি আমাকে ডেকে বললেন, ওয়ালেস তুমি আমাকে দয়া করে ডান্ডির সিক্সটি ফোরের ফাইলটা একটু বের করে দাও। বোধহয় ওই ডানদিকের আলমারিতে আছে। বুঝলাম, লিকফোল্ড আমাকে ইচ্ছে করেই আটকে রাখলেন। তখন মি. ওয়েসকিন বললেন, মি. লিকফোল্ড, আমার কথা কিছু গোপনীয় নয়। আমি একটা আর্জি নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনারা আপনাদের যে জুট কাটিং পুড়িয়ে ছাই করে নদীর ধারে ফেলে দেন, দয়া করে সেই কাটিং আপনি আমাকে দিন। আমার মনে হয়, আপনাদের ওই কাটিংগুলো ছাই করে ফেলে দেওয়ার বদলে, আমি একটা কোনও কাজে লাগাতে পারি। ওঃ ভদ্রলোক এমনভাবে বলছিলেন যেন কী এক অমূল্য সম্পদ সম্পর্কেই না বলছেন। আর তখনকার দিনের জুটকাটিং মেশিন সত্যি ভাল ছিল না। এখন যেমন আমাদের কাটিং মেশিন হয়েছে, প্রায় কিছুই নষ্ট হয় না, তখন তা ছিল না। ওয়েসকিনের কথা শুনে মি. লিকফোল্ড একবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপরে বললেন, এতে আমার আপত্তির কী থাকতে পারে। আপনার যদি সত্যি কোনও কাজে লাগে, আপনি নিয়ে যাবেন। আমি বরং তা হলে পোড়াবার দায়িত্ব থেকে বেঁচে যাই। আমি অর্ডার করে দিচ্ছি, যেন এ বারের লট না পুড়িয়ে রেখে দেয়, আপনি এসে নিয়ে যাবেন। ওয়েসকিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে। বারবার বলতে লাগল, অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে, অশেষ ধন্যবাদ। আমি আগামীকালই গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে কাটিং আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। লিকফোল্ড রাজি হলেন। ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা স্টাফেরা এই নিয়ে একটু জল্পনাকল্পনা করলাম, এই কাটিং দিয়ে কী ব্যবসাই বা হতে পারে? অবিশ্যি মেশিনে ফেলে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। ভাল করে পিজে সুতো করা যেতে পারে, উলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। চিন্তা করলে, কিছু হয়তো মাথা থেকে বেরুতে পারত। যাই হোক, গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে ওয়েকিন তো কাটিং নিয়ে গেলেন। তারপর মাসখানেক পরে জানা গেল, বরানগর থেকে কোনও একজন মি. ওয়েসকিন তিনশো পাউন্ড, জুটকাটিং-এর হ্যান্ড স্কুড় বেল আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। আমরা সকলেই খুব অবাক হলাম। কারণ কিছুদিন বাদে স্বয়ং ওয়েসকিন এসে জানালেন, কাটিং পাঠিয়ে উনি কিছু কিঞ্চিৎ লাভ করেছেন। আরও পেতে পারেন কি না। সেটাই তখন ওঁর আর্জি। ইতিমধ্যে আমাদের কাটিং জমেছিল অনেক। ওঁকে বলা হল, ওঁর জন্যই আমরা সব জমিয়ে রেখেছি, উনি যেন নিয়ে যান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।..সত্যি, পাট যে কী আশ্চর্য জিনিস, সারা বিশ্বের চোখ তার ওপরে পড়ে আছে। তার কাটিং পাবার জন্যেও পৃথিবী হাত পেতে থাকে। তারপরে, বৎসরখানেকের মধ্যেই ওয়েসকিন প্রচুর কাটিং আমেরিকায় পাঠালেন, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্ষতি তো দুরের কথা, বেশ ভাল রকমের লাভ করতে লাগলেন। তখন আর ওঁর পক্ষে সেই আমেরিকান ফার্মের চাকরিতে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হল না। এদিকে যত লাভ করতে লাগলেন, ওদিকে তত স্পেকুলেশনের দিকে ঝোঁক যেতে লাগল। ভদ্রলোকের ওদিকেও মগজ খেলত ভাল, কিন্তু ওটা ওঁর নেশায়ও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে জগদ্দলের তেসুতিকলের ঘাট এসে পড়ল। কিন্তু ওয়াল্টারের সেদিকে মোটেই খেয়াল নেই। সে ওয়েসকিনের কাহিনীতে একেবারে ডুবে গিয়েছে। ওয়ালেসকেই স্মরণ করাতে হল, মি. ওয়াল্টার, আপনার কারখানা এসে গেছে।

ওয়াল্টার চমকে ফিরে তাকাল। সন্ধ্যার ছায়া নেমে পড়েছে। তবু বেয়ারা বাবুর্চিরা লঞ্চের শব্দে ঘাটে এসে পড়েছে, এবং তীরের শস্যের মাঠেও গ্রামবাসীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ওয়াল্টার বলল, গারুলিয়া থেকে আমি হেঁটে চলে আসব। কিন্তু ওয়েসকিনের ঘটনাটা আপনি বলুন। তারপরে কী করল লোকটা?

ওয়ালেস হাসলেন। লঞ্চ চলতে লাগল। চিমনিতে ঢাকা মোমবাতি দিয়ে গেল বেয়ারা।

ওয়ালেস বললেন, আমি যখন ডান্ডি থেকে ফিরে এলাম, তখনও ভদ্রলোক ওইভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপরেই শোনা গেল, ওয়েসকিন নিজেই একটি জুটমিল করবেন।

ওয়াল্টার প্রায় উত্তেজিত রুদ্ধ গলায় বলে উঠল, সত্যি? আমি এটাই আশা করছিলাম, জুটকাটিং থেকে জুটমিল।

চিমনি ঢাকা মোমবাতির আলোয় ওয়ালিক আর ম্যাকলিস্টারের মুখ দুটিও জ্বলজ্বল করছিল। ওয়ালেসের চোখের কোণে একটু হাসি দেখা গেল। ওঁর দৃষ্টি দুরের সন্ধ্যা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া গঙ্গার বুকে নিবদ্ধ। বললেন, হ্যাঁ জুটকাটিং থেকে জুটমিল, অ্যান্ড এ ফুলফ্লেজেড জুটমিল। আর আপনার অবগতির জন্যেই জানাই মি. ওয়াল্টার, সেই সময়েই মি. ওয়েকিনের সঙ্গে একটি আমেরিকার পরিবারকেও প্রায়ই দেখা যেত যাদের মধ্যে সবথেকে লক্ষণীয়া ছিলেন একজন শ্রীময়ী কুমারী! আমরা শুনেছিলাম, কুমারীটির সঙ্গেই মি. ওয়েসকিনের এনগেজমেন্ট পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে। দে আর এনগেজড। কিন্তু বিয়েটা একটু দেরি আছে, এখুনি নয়। কারণ মি. ওয়েসকিনের কারখানা বিল্ডিং উঠতে শুরু হয়ে গিয়েছে। ওঁর বাড়ির সীমানাটা অনেকখানি ছিল। অবিশ্যি সেটাকে বাগান না বলে ওঁর উঠোনই বলা যেত। উঠোনের উপরেই বিল্ডিং শুরু হয়েছিল, আর সেটা গঙ্গার ধারেই। ওয়ালেস হঠাৎ থামলেন, আর খুব জোরে জোরে মুখে নল তুলে ভেঁপু ফুঁকতে লাগলেন। নীচে থেকে বেয়ারার চিৎকার শোনা গেল। ওয়ালেস গতি মন্থরের নির্দেশ দিলেন ইঞ্জিন চালককে। নীচে অনেকগুলি গলার স্বর শোনা গেল।

ওয়ালেস উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, নেটিভ মাঝিগুলো লঞ্চের শব্দটাও শুনতে পায় না? একেবারে সামনে এসে পড়েছে নৌকা নিয়ে। খুব জোর কলিশনটা বাঁচানো গেছে।

বলেই চিৎকার করে ডাকলেন, বেয়ারা!

–জি হোজোর!

চিৎকার করে জবাব দিয়েই বেয়ারা ছুটে এসে জানাল, বাঁচ গয়া হোজের, নৌকা বাঁচ গয়া, মাঝি ভাগ গয়া।

ওয়ালেস আবার ইঞ্জিন চালককে গতি বাড়াবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এদিকে এই সমূহ দৈব বিপদের সম্ভাবনার কথা বাকি তিনজনের মাথায় নেই। প্রথমেই ওয়াল্টার বলে উঠল, অ্যান্ড দেন মি. ওয়ালেস, সেই কারখানার কী হল?

ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, আশ্চর্য, এই আর্মেনিয়ান জুটমিলের কোনও খবরই তো আজ পর্যন্ত পাইনি? এখনও কি সেখানেই আছে মিলটা?

মি. ওয়ালেসের মস্তিষ্কে তখনও সমূহ বিপদের সম্ভাবনাটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি একবার উচ্চারণ করলেন, অ্যাঁ?

তারপর বাইরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে আর একবার লক্ষ করে, সহসা যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক সেখানেই আছে। কিন্তু মিলটা পুরোপুরি তৈরি হতে পারেনি। বিম লেভেল পর্যন্ত বিল্ডিংটা উঠেছিল, তারপরেই থেমে যায়।

–থেমে যায়?

 ওয়াল্টারের যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। বাকিদেরও প্রায় তাই। বিশেষ করে ম্যাকলিস্টারের। সে যেন তারই জীবনের ভিন্নতর এক ব্যর্থতার কথা শুনছে।

ওয়ালেস বললেন, হ্যাঁ, থেমে যায়। বরানগরে মল্লিকদের যেখানে বাগানবাড়ি হচ্ছে, তার পাশে এখনও সেই ইনকমপ্লিট বিল্ডিং, আপনারা গেলেই দেখতে পাবেন। ঠিক তেমনিভাবেই, বিম লেভেল পর্যন্ত অসমাপ্ত কারখানা ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে মি. ওয়েসকিনের বাড়িটা। সেখানে আর কেউ থাকে না। বাড়িটা এখনও খালি পড়ে আছে। বাড়িটা এখন ভূতুড়ে বাড়ির মতো দেখায়। দরজা জানালার পাল্লাগুলো খোলা। বাতাসে সবসময়ে ধুমধাম শব্দে ঝাপটা খাচ্ছে। রংচং আর করা হয় না, শ্যাওলা পড়ে বিশ্রী দেখতে হয়ে গেছে। অসমাপ্ত কারখানা বাড়িটার ইটের রংও এই বাংলাদেশের আবহাওয়ায় শ্যাওলায় কালো হয়ে গেছে।…

ওয়ালেস থামলেন। কেউ সহসা কোনও প্রশ্ন করল না, কথা বলল না। ওয়ালেস লঞ্চের গতি বিশেষ বাড়তে দেননি। আলোর ব্যবস্থা ভাল ছিল না। তা ছাড়া চব্বিশ পরগনার এই উত্তরাঞ্চলের গঙ্গার গভীরতা ও অগভীরতার সীমাও ওঁর অজানা। তাই চারদিকের নৈঃশব্দ্যের মধ্যে, মন্থরগতি লঞ্চের গুড়গুড় গুড়গুড় শব্দটা যেন গভীর উৎকণ্ঠিত ও বিষণ্ণ সুরে বাজছিল। গঙ্গার জলেরও কোনও শব্দ নেই। ইঞ্জিনের কম্পনে সমস্ত লঞ্চটাই কাঁপছে। এখানে ছাদের উপর, মোমের আলোয় দেখা যাচ্ছে, সকলের মুখের চামড়াগুলিও কাঁপছে। আকাশ কালো হয়ে এসেছে, নক্ষত্রেরা ফুটে উঠছে একটি-দুটি করে। দূর থেকে সম্ভবত কোনও নেটিভ বোটম্যানেরই গানের সুর ভেসে আসছে।

ওয়ালেস একটা নিশ্বাস ফেললেন, একটু যেন হাসবারও চেষ্টা করলেন। বললেন, মি. ওয়েসকিনের শেষদিকের চেহারাটা এখনও চোখের সামনে ভাসে। সেই লম্বা জুলফি আর সুন্দর গোঁফজোড়া, না কামানোর জন্যে, আবাদি জমি যেমন জলা ঘাসের সঙ্গে মিশে যায়, তেমনি হয়ে গিয়েছিল। পোশাকের কোনও পারিপাট্যই আর ছিল না। এখনকার খোলা দরজা জানালার মতোই ওঁর বুকের আর হাতের বোতামগুলো খোলা থাকত। অনেকদিন দেখেছি, ধোঁয়াবিহীন পাইপটা কামড়ে ধরে মি. ওয়েসকিন তাঁর সেই অসমাপ্ত জুটমিলের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক-এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছেন। যেন বিভিং-এর কাজ চলছে, উনি ঘুরে ঘুরে দেখাশোনা করছেন।…অবসর সময়ে সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে গেলে দেখতে পেতাম। কিন্তু সহসা দেখা দিতাম না। শুধু যে একটা সংকোচ বোধ করতাম, তা নয়। মি. ওয়েসকিনের সঙ্গে কী কথা বলব, সেটা ভেবে পেতাম না। অ্যান্ড দো…উই দি বোর্নিও কোম্পানি পাইওনিয়ার্স, তবু বুকের ভিতরটা কী রকম করে উঠত ওঁকে দেখলে। বিশেষ করে সেই অসমাপ্ত বাড়িটার সামনে। যদি বা কখনও চোখোচোখি হয়ে যেত, তাড়াতাড়ি না দেখতে পাওয়ার ভান করে সরে পড়বার চেষ্টা করতাম। কিন্তু রেহাই পাওয়া যেত না। মি. ওয়েকিন টুপিটা তুলে মাথা নোয়াতেন, অস্পষ্ট কথায় অভিবাদন জানাতেন। হয়তো তাড়াতাড়ি কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে বলতাম, আপনার শরীরটা কেমন আছে? ওয়েসকিন বলতেন, খুবই ভাল। এদেশের আবহাওয়া এখন আর আমাকে একেবারেই কাবু করতে পারে না। তবু কী জানেন, শরীরটা মনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী, আর মনের মধ্যে অত্যন্ত উদ্বেগ। হঠাৎ কারখানাটা মাঝপথে থেমে গেল, এটাকে সম্পূর্ণ করার জন্যেই এখন নানানভাবে ব্যস্ত আছি। যদিও জানতাম, অর্থহীন ব্যস্ততা, মি. ওয়েকিনের আর কিছুই করবার ছিল না। তাই তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলবার জন্যে, নেটিভ আবহাওয়া, কলকাতা এবং হোমের কোনও বিষয় তুলতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু

ওয়াল্টারের পক্ষে আর ধৈর্যধারণ সম্ভব হল না। সে আগের মতোই রুদ্ধশ্বাস গলাতে জিজ্ঞেস করে উঠল, কিন্তু কেন, মি. ওয়ালেস, কেন মি. ওয়েকিন সফল হলেন না?

স্পেকুলেশন স্যার, স্পেকুলেশন! ওয়ালেস বললেন। এবং ওঁর গলাতেও উত্তেজনার সুর লেগেছে। উত্তেজনা ও অসাফল্যের কষ্ট। বললেন, স্পেকুলেশনটা ভদ্রলোক ভালই বুঝতেন, কিন্তু ওটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল খানিকটা। নেশা হলেই কিছু টালমাটাল হওয়া স্বাভাবিক। আর এ ক্ষেত্রে একটু টাল খাওয়া মানেই অন্ধকার গহ্বরে ডুবে যাওয়া। মি. ওয়েসকিন তাঁর ক্যাপিটালই হারিয়ে বসেছিলেন।

ওয়াল্টারের বুকের ভিতরটা যেন অকল্পিত ভয়ে কেঁপে উঠল। ক্যাপিটাল লস মানে সবকিছুই হারানো। ম্যাকলিস্টারের বুকে তীরের মতো বিধল ক্যাপিটাল হারানোর কথা। সে অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ক্যাপিটাল, ক্যাপিটাল!

ওয়ালিক জিজ্ঞেস করল, তারপর?

ওয়ালেস বললেন, তারপর আর কী, কিছুদিন পরে মি. ওয়েকিন আবার আমেরিকায় ফিরে গিয়েছিলেন। শেষদিকে বেচারির অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, নেটিভদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা হত। খুবই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওঁর সেই সুন্দর ঘোড়াটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক জেন্টুকে। জেন্টু প্রায়ই আসত সেই ঘোড়ায় চেপে ওয়েসকিন ঘোড়াটাকে পিঠ চাপড়ে আদর করতেন। জেন্টু বলত, সাহিব আপ ঘোড়া পর চড়িয়ে। মি. ওয়েসকিন বলতেন, না, আমার আর ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছা করে না।…শুনেছি শেষ পর্যন্ত ওঁর যাবার ব্যবস্থা সেই আমেরিকান ফার্মই করে দিয়েছিল। শেষদিকে একটি কপর্দকও ওঁর হাতে ছিল না।

ওয়াল্টার বলল, আর, আর সেই আমেরিকান ফ্যামিলি? আমেরিকান ফ্যামিলির সেই শ্রীময়ী কুমারীটি, যার সঙ্গে মি. ওয়েকিনের এনগেজমেন্ট হয়েছিল? ওদের বিয়ের কী হয়েছিল?

ওয়ালেস বললেন, নিশ্চয়ই নাকচ হয়ে গিয়েছিল। কারণ শেষদিকে যখন মি. ওয়েসকিনকে ওঁর বাড়িতে একলা একলা কাটাতে দেখেছি, তখন তাদের কাউকে আসতে দেখিনি। সেটা কোন পক্ষের ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়, তা ঠিক বলতে পারি না। তবে আমাদের বরানগর মিলের যে মহিলারা ছিলেন, তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে একটু বেশি কৌতূহলিত ছিলেন। তাঁরা নাকি খোঁজখবর করে জেনেছিলেন, মি. ওয়েসকিনই এনগেজমেন্ট ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি নাকি একটা চিঠি দিয়ে জানিয়ে ছিলেন, বিয়ে করার কথা তিনি আর চিন্তা করতে পারছেন না, জীবনের সকল সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন তিনি নিজেকে মৃত মনে করছেন। অতএব তাঁকে যেন ক্ষমা করা হয়।

ওয়ালেস চুপ করলেন। কয়েক মুহূর্ত ধরে লঞ্চের গুড়গুড় শব্দ বাজতে লাগল। লঞ্চ ইতিমধ্যে শ্যামনগর কালী মন্দির অতিক্রম করে গিয়েছে। দক্ষিণের অন্ধকারে, কয়েকটি এলোমেলো আলো দেখা যাচ্ছে। টমাস ডাফের ঘাটের আলোে। গাছপালা বেষ্টিত ভূমিখণ্ডের একটি কালো ইশারা যেন গঙ্গার বুকে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। নদী বাঁক নিয়েছে। ওয়ালেস হুইল ঘুরিয়ে লঞ্চের মুখ ডাইনে বাঁকালেন।

ওয়ালিক বলল, তীরের কাছাকাছি এগিয়ে নিন, আমরা এসে পড়েছি।

ম্যাকলিস্টার বলে উঠল, এখনও সেই আনফিনিশড, ফ্যাক্টরি বিল্ডিংটা আছে, না।

–আছে, বরানগরের মল্লিকদের বাগানবাড়ির সীমানার মধ্যে, এখনও ঠিক তেমনই আছে। মল্লিকদের বাগানবাড়ি বলতে, এখন দেখা যাচ্ছে, মি. ওয়েসকিনের সেই বাড়িটাই ওরা রংচং করে, একটু-আধটু রিমডেলিং করে নেবার তালে আছে। পাশেই রাসমণির মন্দির। সত্যি, অদ্ভুত লাগে সেই ইনকমপ্লিট বাড়িটা দেখতে।

ম্যাকলিস্টার যেন উৎকণ্ঠিত উত্তেজনায় বসে উঠল, অদ্ভুত বলছেন কি মি. ওয়ালেস। চোখে না দেখেও আমার যেন মনে হচ্ছে, ওটা একটা দুঃস্বপ্নের স্মৃতিসৌধের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যিস আসবার সময় আমি ওটা দেখিনি, বা আপনি দেখাননি।

ওয়ালেস বললেন, আমার খেয়াল ছিল না। কিন্তু দুঃস্বপ্নের স্মৃতিসৌধ বলছেন কেন মি. ম্যাকলিস্টার?

ম্যাকলিস্টার বলল, তবে কি ব্যর্থতার বলব? ওয়ালেসের দাড়ির ভাঁজে একটু হাসি দেখা দিল। বললেন, তার চেয়ে সতর্কতার স্মৃতিসৌধ বলুন না। ভবিষ্যতের জুট ম্যানুফাকচারারদের যে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক করে দিতে পারে, স্মরণ করিয়ে দিতে পারে, অসতর্কতার শিকার এখানে রয়েছে, মনে রেখো।

ওয়াল্টার বলে উঠল, ঠিক, ঠিক তাই!

ওয়ালেস বললেন, সত্যি, আমরা, বোর্নিও কোম্পানির লোকেরা, যাদের আপনারা পাইওনিয়র বলেন, ওয়েকিনের সেই ইনকমপ্লিট বিল্ডিং-এর দিকে তাকিয়ে বারে বারে নিজেদের কথাই চিন্তা করেছি। সাফল্য আর অসাফল্য, এ দুয়ের থেকেই মানুষকে শিক্ষা নিতে হয়। ওয়েসকিন আসলে আমাদের সামনে একটানজির খাড়া করে গেছেন।

ওয়াল্টার তখনও যেন আত্মমগ্ন স্বরেই, অফুটে বারে বারে উচ্চারণ করছিল, ঠিক, ঠিক তাই!

.

৪৪.

কয়েকটা উজ্জ্বল গ্যাসের আলোয়, গারুলিয়ার জেটি দেখা গেল। মোটা পাকা বাঁশের ফ্রেম করে, কপিকল দিয়ে আলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাতিদারদের সারা রাত্রিই জেগে থাকতে হয় আলোয় দম দেবার জন্যে। এখানকার ঘাটেও অনেকগুলি বড় বড় দেশীয় নৌকা বাঁধা রয়েছে। পাড়ের কাছে অল্প জলে, স্বল্পালোকে কাউকে কাউকে স্নান করতে দেখা যাচ্ছে।

ওয়ালেস বললেন, কী ভাবে, কোথায় লঞ্চ ভেড়ানো যায় মি. ওয়ালিক?

 ওয়ালিক বলল, জেটির কাছেই যে বড় নৌকাটা রয়েছে, ওটা আমাদেরই কোম্পানির। প্রায় গাধাবোটের মতোই প্রকাণ্ড, ওটার গায়েই ঠেকিয়ে দিন, তারপরে আমি দেখছি।

ওয়ালেস গতি মন্থর করে, আস্তে আস্তে ভাটার স্রোত কাটিয়ে বড় নৌকাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। জেটির উপরে নীচে কয়েকটি গলার শব্দ পাওয়া গেল। কেউ ছুটে গেল কারখানার দিকে।

ওয়ালিক লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, হেই আদমি লোক, সব ইধর আও।

নৌকায় নৌকায়, জেটিতে অনেক লোক একসঙ্গে দেখা দিল। ওয়ালিককে চিনতে পারল সবাই। সকলেরই হুকুমের প্রত্যাশা।

ওয়ালেস বললেন, মি. ওয়ালিক, আপনি নৌকায় নেমে যান। আমার বেয়ারা আপনাকে কাছি ছুঁড়ে দেবে, সেটা আপনি কোথাও আটকে দিন।

ওয়ালিক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, নিশ্চয়ই! কিন্তু আমাকে আর ওয়াল্টারকে নামিয়ে দিয়ে, এখুনি আপনার বরানগরে যাওয়া চলবে না। কয়েক মিনিটের জন্যেও আপনাদের একবার নামতেই হবে। নইলে আমাদের ম্যানেজার মি. উইলসন আমার ওপরে অসন্তুষ্ট হতে পারেন।

ওয়ালেস বললেন, উইলসন ইজ নট আনোন টু মি। কিন্তু আমি ভাবছি, অনেক দেরি হয়ে যাবে বরানগরে পৌঁছুতে।

বলে তিনি পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখে নিলেন একবার। বললেন, নাউ টেন মিনিটস টু এইট।

ওয়ালিক বলল, সত্যি বলতে কী, এ রাত্রে আপনাদের ছেড়ে দিতেই আমার আপত্তি। সবচেয়ে সুখী হই যদি আপনারা এই প্রবাসী ব্যাচেলরের অতিথি হন।

ওয়ালিক ম্যাকলিস্টারের দিকে চোখ তুলে তাকাল একবার। ম্যাকলিস্টারের চোখে যেন এখনও সেই আর্মেনিয়ানের দুঃস্বপ্নের ঘোর। সে বলল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটা ডিসাইড করা যাবে।

ওয়ালিক নীচে নেমে গেল। কোম্পানির নৌকার মাঝিরা সকলেই প্রস্তুত ছিল। কয়েকজন পর পর চিৎকার করে উঠল, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার।

লঞ্চ ধীরে ধীরে নৌকার গায়ে ভিড়ছে। ধাক্কার টাল সামলানোর জন্যেই হুঁশিয়ার চিৎকার। ওয়ালিক পাকা খালাসির মতোই নৌকায় ফাঁস পরিয়ে দিল। ঠিক সে সময়েই, পাড়ের উপর থেকে উইলসনের চেনা গলা শোনা গেল, হেলো, ওয়ালিক?

ওয়ালিক তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ইয়েস স্যার, আই অ্যাম। বরানগর ফ্যাক্টরির মি. ওয়ালেস, আর বাউরিয়ার মি. ম্যাকলিস্টার লঞ্চে আছেন। জগদ্দলের ওয়াল্টারও রয়েছে।

নৌকার সঙ্গে উঁচু পাড়ের মধ্যে কাঠের তক্তা দিয়ে সিঁড়ি করা হয়েছে। সিঁড়িতে পা দিয়ে উইলসন বলল, মি. লিটলজনের কাছে মোটামুটি একটা খবর আমি পেয়েছি। যদিও ভদ্রলোকের অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। যাই হোক, আমি ওঁদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, মি. ওয়ালেস এবং মি. ম্যাকলিস্টারের জন্যে।

মাথা ঢাকা দেওয়া সারেঙের ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়ালেস বললেন, হিয়ার আই অ্যাম মি. উইলসন, আফটার এ লং লং ডেজ, হাউ ডু ইউ?

উইলসন লঞ্চের ছাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, হাউ ডু ইউ ডু! আমি খুব ভাল আছি। এখন দয়া করে নেমে আসুন, মি. ম্যাকলিস্টারকে নিয়ে আসুন। ওয়াল্টার, তুমিও নেমে এসো।

সকলেই নৌকার উপর দিয়ে, তক্তার সাঁকো বেয়ে পাড়ে এল। ঘাটে দাঁড়িয়েই হাতে হাত মেলানো হল। উইলসন জানাল, তার ড্রইং রুমে টমাস ডাফের ফ্যাক্টরির সমস্ত ইউরোপিয়ান স্টাফ অপেক্ষা করছে। যাই হোক, বরানগর ফ্যাক্টরির সঙ্গে টমাস ডাফ কোম্পানির একটা পুরনো যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্র ধরেই উইলসন একযোগে একটু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এক সময়ে উইলসন নিজেও বরানগর ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছে। মি. টমাস ডাফ স্বয়ং তখন বরানগরে ছিলেন। তারপর টমাস ডাফ যখন শ্যামনগরে কারখানা করলেন, উইলসন চলে এসেছিল। ওয়ালেসের সঙ্গে তার পুরনো পরিচয়। জলপথে বা স্থলপথে ইতিমধ্যে অনেকবার কলকাতায় গেলেও বরানগর স্টাফের সঙ্গে দেখা হওয়া সম্ভব হয়নি। আজ এইভাবে দেখা হওয়ায় সে বেশ খুশি হয়ে উঠেছে। সাড়ে সাতটায় কারখানা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। যেখানে রাত্রি সাড়ে আটটানটা পর্যন্ত কাজ চলে।

দেশীয় মাঝিমাল্লা শ্রমিকেরা নতুন সাহেবদের দেখতে লাগল। সাহেবরা কলকাতা থেকে আসছে! কোম্পানির আলুগুদামের সাহেব!…এই রকম তাদের ধারণা, নতুন সাহেবেরা কলকাতার কোম্পানির হেডঅফিস থেকে আসছে। আর হেডঅফিসকে তারা ওই নামেই ডাকে, আলুগুদাম। পর্তুগিজদের অ্যাগোডাম শব্দ থেকেই আলুগুদামের উৎপত্তি, যার অর্থ প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র বা প্রধান অফিস।

উইলসন সবাইকে নিয়ে তার নিজের কুঠির দিকে অগ্রসর হল। ওয়ালেস আর ম্যাকলিস্টারকেও বেশ খুশি মনে হল। ওয়ালিক উইলসনকে চুপিচুপি বলল, স্যার আজ রাত্রে দু জনকে না যেতে দেওয়াই বোধহয় ভাল।

উইলসন বলল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। আমার অ্যারেঞ্জমেন্টও সেইরকমই। কিন্তু মনে রেখো, তোমার খাবার ব্যবস্থাও আজ আমার ওখানেই।

ওয়ালিক খুশি হয়ে বলল, অশেষ ধন্যবাদ স্যার

উইলসন বাধা দিয়ে বলে উঠল, কিন্তু আরও সংবাদ আছে, পরে বলব তোমাকে। লিটলজন আজ জঘন্য কাণ্ড ঘটিয়েছে।

-কী ব্যাপার? সেই আয়া মেয়েটিকে?

-না, সে এখানে নেই আজ। মিসেস ডাডনি দুপুরে কলকাতায় গেছেন, চম্পাকেও নিয়ে গেছেন। চম্পা থাকলে হয়তো ওরকম ঘটনা ঘটতই না।

-কী ঘটনা স্যার?

–পরে পরে, এখন নয়। আজ রাত্রের মতো অতিথিসকার হোক, তারপরে ও সব কথা হবে। ওয়ালিক চিন্তিত হয়ে উঠল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু কী ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটতে পারে, সঠিক কিছু অনুমান করতে পারল না। তবে এ চিন্তা কয়েক মুহূর্তের জন্যেই। ওয়ালিকের মুখে সহসা ব্যাকুলতা ফুটে উঠল। তার দু চোখ যেন আবেগ ও উত্তেজনায় ঝলকে উঠল। সে স্টাফ কোয়ার্টারের প্রাসাদমালার দিকে চোখ তুলে তাকাল। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে যেন রক্ত চলকে উঠল। কিন্তু কণ্ঠস্বর যথেষ্ট নিরাবেগ রেখে সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সকলেই কি আপনার ড্রইং রুমে জমায়েত হয়েছেন?

-সকলেই, একসেপ্ট মিসেস ডাডনি অ্যান্ড মিসেস মার্স। মি. মার্স বলছিল, ওর স্ত্রীর নাকি অত্যধিক গরমে ভীষণ মাথা ধরেছে। বলা যায় না জ্বর যদি আসে আবার। ম্যালেরিয়া হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

প্রায় যেন ভদ্রতা রক্ষার্থের সুরে ওয়ালিক বলল, তা বটে। যাই হোক সবাই এসে গেছে, আমাকে একটু সময়ের জন্যে ক্ষমা করবেন, আমি একটু আমার কোয়ার্টার থেকে ঘুরে আসতে চাই।

উইলসন সম্মতি দিয়ে বলল, তুমি ঘুরে এসো।

.

ওয়ালিক, ওয়ালেস আর ম্যাকলিস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, প্রাসাদসারির শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল। কুটির চত্বর এবং ইটের উপর সুরকি পেটানো রাস্তা। আলোয় তেমন উজ্জ্বল না হলেও, গ্যাসপোস্টের আলোয় মোটামুটি সবই দেখা যায়। একমাত্র ম্যানেজারের কোয়ার্টারই বিচ্ছিন্ন, আলাদা এবং বিশেষভাবে তৈরি। বাকিগুলি বড় বড় এক-একটি প্রাসাদ, এক-একটি ব্লকের মতো। প্রত্যেক ব্লকেই দু পাশে, ইউরোপীয় স্টাফের বাস।

তিনটি ব্লকের প্রাসাদসারির সব ঘরই প্রায় নিঝুম। কোনও কোনও দরজা জানালার আলো দেখা গেলেও, অধিকাংশই দরজা বন্ধ, অন্ধকার। কোয়ার্টারের পিছন দিকের কোনও কোনও ঘরে আলো এবং কাচের জানালায় মানুষের ছায়া নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে। ওরা সবাই বেয়ারা বাবুর্চির দল। একতলা এবং দোতলায়, পিছন দিকেও আলাদা সিঁড়ি আছে বেয়ারা বাবুর্চি ঝাড়ুদার মেথরদের চলাফেরার জন্যে। সদরে তাদের আবির্ভাব যেন সহজে না ঘটে, কর্তৃপক্ষের সেটাই কাম্য।

একটা ব্লক পেরিয়ে ওয়ালিক হঠাৎ থামল। তার বুকের মধ্যে স্পন্দন বেড়ে উঠল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে, দ্রুত পায়ে কোয়ার্টারের পিছন দিকে চলে গেল। পিছন দিকে সামনের রাস্তার মতো আলো নেই, পথও প্রশস্ত নয়। কয়েকটি বড় বড় কৃষ্ণচূড়া এবং বকুল গাছের ছায়া, অন্ধকারকে নিবিড় করেছে। পিছন দিকে, অন্ধকারের মধ্যে মিশে গিয়ে, ওয়ালিক এক মুহূর্ত চারপাশে দেখল। তার হৃৎপিণ্ডের তাল আরও দ্রুত হল। চৈত্রের বাতাসে, গাছের পাতায় পাতায় ঝরঝর শব্দ না থাকলে হয়তো তার বুকের ধকধকানি শোনা যেত। জিভ শুকিয়ে উঠছিল, সর্বাঙ্গ যেন তাতানো লোহার মতো কষ্টকর গরম বোধ হচ্ছিল। তবু মনের ভিতরটা উদ্বেল, থরথরিয়ে কাঁপছিল। রক্ত দপদপিয়ে উঠছিল, একটা ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা তাকে অস্থির করে তুলছিল।

ওয়ালিক পা টিপেটিপে, তৃতীয় ব্লকের সীমানায় পৌঁছে, আর একবার দাঁড়াল। সবথেকে বিপজ্জনক সীমানা এটা। কারণ তার ঘর দু নম্বর ব্লকে। সেটা পার হয়ে এসেছে সে। এখন কেউ তাকে এখানে দেখলে, কোনও কৈফিয়ত দেবার থাকবে না। তিন নম্বর ব্লকের, দু নম্বর ঘরের পিছন দিকটা যেন বিশেষভাবে স্তব্ধ এবং অন্ধকার। ওখানে কি একটি ব্যাকুল প্রাণ প্রতীক্ষায়, মনে মনে কষ্টকর অধৈর্য প্রতীক্ষায় নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে আছে? নিষ্পলক দুটি চোখের দৃষ্টি কি ওই অন্ধকারে কাউকে খুঁজে মরছে? ওখানে কি কারুর কোমল বুক, শ্বাসরুদ্ধ প্রতীক্ষায় পাথর হয়ে গেল? সে কি জানে, জর্জ ওয়ালিক ফিরেছে।

ওয়ালিক মনে মনে উচ্চারণ করল, হিলডা, হিলডা, প্রিয়তমা?

নিঃশব্দ পায়ে, তৃতীয় ব্লকের দু নম্বর ঘরের, বাথরুম আর কিচেনের তিন ধাপ ছোট সিঁড়ির উপরে উঠে দাঁড়াল ওয়ালিক। দু হাতে, দুই দরজাতেই আস্তে আস্তে টোকা দিল সে।

কোনও সাড়া এল না।

 আবার টোকা দিল ওয়ালিক, আর দরজায় প্রায় ঠোঁট ঠেকিয়ে সে ডাকল, ইউসোপ, ইউসোপ!

ওয়ালিকের ডাক দ্বিতীয়বার শেষ হবার আগেই, বাথরুমের দরজা খুলে গেল। এত গভীর, গাঢ় অন্ধকার যে, ভিতরে কিছুই দেখা যায় না। কেবল একটি চাপা গলার স্বর শোনা গেল, সালাম সাব, আইয়ে!

ওয়ালিক চকিতে ভিতরে ঢুকে, আগেই দরজা বন্ধ করে দিল। এক হাত বাড়িয়ে ইউসুফের একটি হাত ধরল সে। চুপিচুপি বলল, তুমকো সাব বাহার হ্যায় তো?

-জি হাঁ, ম্যানেজার সাবকো কোঠি মে।

–মেমসাব?

–আপকে ইন্তেজারমে ইয়ে সামনে কামরে মে মেমসাব বৈঠরহী। আপ আইয়ে।

 ঠিক সেই মুহূর্তেই, ঘর আর বাথরুমের মাঝখানের দরজা খুলে গেল। পাশের ঘরের একটি ক্ষীণ বিচ্ছুরিত আলোয়, দরজার উপরে একটি মেয়ে-মূর্তি ভেসে উঠল, তার সঙ্গে একটি সুগন্ধ। হিলডার গন্ধ, হিলডার! ওই তো হিলডারই মূর্তি!

কিন্তু হিলডা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইউসুফ এখনও কাছে রয়েছে। যদিও ইউসুফ খানসামা ছাড়া এই গোপন যোগাযোগ কিছুতেই সম্ভব নয়, তবু লজ্জা ও সম্মানের বাধা। ইউসুফও সে বিষয়ে সচেতন। মেমসাহেবকে দেখেই সে গোসলখানার বাইরের দরজার দিকে চলে গেল। বাইরের থেকে দরজা টেনে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালিক এগিয়ে গিয়ে, দু হাত বাড়িয়ে, অধৈর্য আবেগে জড়িয়ে ধরল হিলডাকে। রুদ্ধ স্খলিত গলায় ডাকল, ডার্লিং ডার্লিং!

হিলডা ডাকতে গেল, জর্জ! কিন্তু তার আগেই ওয়ালিকের ব্যাকুল চুম্বনের গ্রাস ঝাঁপিয়ে পড়ল হিলডার বিদোষ্ঠে। হিলডাও দু হাত দিয়ে ওয়ালিককে গভীর আবেগের ঘন আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সঁপে দিল। প্রেমিকের প্রতিটি প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে লাগল রুদ্ধশ্বাস গাঢ় চুম্বনে। কোনও কথা নয়, কেবল অশেষ, অশেষ, গাঢ় গভীর সম্পূর্ণ চুম্বনে চুম্বনে প্রাণের মদ্য পান। আর কোনও শব্দ নয়, কেবল অনিয়মিত সঘন নিশ্বাসের সঙ্গে ক্ষীণ অস্ফুট কুহর। একজন আর একজনের সারাদিনের অঢেল বিশ্রামের মধ্যে তার তিল তিল প্রসাধনকে দলে মুচড়ে মথিত করতে লাগল। আর নিজে তার সারাদিনের ঘাম, মদের আরক্ত প্রচণ্ডতা, ঠোঁটের কষে কফিপানের শেষ স্বাদ যেন ধুয়ে ফেলতে লাগল কোমল যৌবনোচ্ছলিত দেহের নানান সীমায়, মান ধৌত পরিচ্ছন্নতায়, প্রসাধনের মধুর গন্ধে।

এখন ওয়ালিকের মনে পড়তে লাগল ম্যাকলিস্টারের কথা, দেশ থেকে তো বিয়ে করে আসনি, আর এসেছিলে তিরিশ বছর বয়সে। ম্যানেজ করছ কী করে?

ওয়ালিক হেসে উঠেছিল, কোনও জবাব দিতে পারেনি। কিন্তু তার চোখে তখন কীসের স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। যেন একটা গোপন শঙ্কিত আনন্দের ঝিলিক খেলে গিয়েছিল তার চোখে। সে শুধু মনে মনে বলেছিল, কী করে আমার দিন কাটে, কেমন করে হে ওয়ালিক?…

আরও গভীর আবেগে ও উত্তেজনায় হিলডাকে আকর্ষণ করল ওয়ালিক। হয়তো এতক্ষণে তাদের মুখ মদের মধ্যে ঠোঁট ফেটে রক্ত চুঁইয়ে আসতে আরম্ভ করেছে। তবু এই মুহূর্ত জীবনের সকল মূল্য দিয়ে কেনা। কিছুতেই যেন ছাড়া যায় না! এই তো ওয়ালিকের সেই শঙ্কিত আনন্দের ঝিলিক! এ কথা মুখ ফুটে কেমন করে বলবে সে ম্যাকলিস্টারকে, সে পরদার-প্রেমিক।

হয়তো ম্যাকলিস্টারের কথায় একটু শ্লীলতার অভাব ছিল। ভেবেছিল হয়তো, ওয়ালিককে সব অবিবাহিতের মতোই নগরের দরজায় দরজায় ফিরতে হয়। যদি তাই হত! হে ঈশ্বর, যদি তাই হত, সে-যন্ত্রণার স্বাদ কেমন হত ওয়ালিক জানে না। কিন্তু হিলডার প্রতি এই অপ্রতিরোধ্য ভালবাসা, অথচ প্রতি মুহূর্তের গোপনীয়তা, প্রতি মুহূর্তের শঙ্কা ভয়, পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় না পাবার যন্ত্রণা, নেটিভ চাকরের কাছে মাথা নিচু করে থাকার দুঃসহ অপমান, তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো সবসময়ে বাজে।

হিলডা পরস্ত্রী, ওভারসিয়ার যোসেফ মার্স-এর স্ত্রী। সে কারণে উইলসনকে ইচ্ছে করেই একটু আগে সে জিজ্ঞেস করেছিল, সবাই ম্যানেজারের ড্রইংরুমে সমবেত হয়েছে কিনা। ওইটুকুই সে শুনতে চেয়েছিল, মিসেস মার্স আসেনি। কারণ, ওয়ালিক অনুমান করেছিল, মি. মার্স-এর এই অনুপস্থিতির সুযোগটুকু হিলডা সযত্নে গ্রহণ করবে।

অথচ এমন চিন্তা তো ওয়ালিক কখনও করেনি। ছ বছর আগে, যেদিন প্রথম মার্স দম্পতি এল এই গারুলিয়ার, মি. উইলসন যখন সকলের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল, একবারও তো তখন এমনি একটি দুরন্ত বাসনার কথা মনে হয়নি। চোখ তুলে কেবল সাধারণ মুগ্ধতাবশত একজন যুবতী মহিলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। মাঝারি লম্বা যার গঠন, স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য যার দেহে, ঢেউ খেলানো চুল যার প্রায় রক্তিম গালের কাছে এসে পড়েছিল। চোখ দুটি যেন বিকালের ভারতীয় আকাশের মতো নীলাভ মনে হয়েছিল, যে চোখে একটি নিরন্তর বিস্ময় কৌতূহল এবং হাসি ছিল। হয়তো নিজের অজান্তেই ওয়ালিকের বুকে একটি দীর্ঘনিশ্বাস উঠে থাকবে। সেও এক ক্ষণিক বিহ্বলতা বলা যেতে পারে। আর কিছুই তো মনে হয়নি। ওয়ালিক কর্মী মানুষ। কাজ সে ভালবাসে। তার সবথেকে বড় প্রমাণ, নেটিভ যুবকদের সে নিজে যন্ত্রের পটু কারিগর করে গড়ে তুলছে। তাতে কোম্পানির স্বার্থ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ওয়ালিকের ব্যবহার, হৃদ্যতা, ধৈর্য, নেটিভ ছেলেদের বাড়ি বাড়ি ছুটে যাওয়া, সব মিলিয়ে বোঝা যায়, শুধু স্বার্থ নয়, একটা ইচ্ছের বিষয়ও আছে। কর্মী তৈরি করতে সে ভালবাসে।

কাজের মধ্যেই, চলাফেরায় কাছাকাছি হয়তো মিসেস মার্স-এর সঙ্গে কখনও দেখা হয়ে গিয়েছে। একটু হাসি, একটু মাথা নাড়ানো, একটু অস্ফুট জিজ্ঞাসা, ভাল তো? নিতান্ত ভদ্রতা, সামাজিকতা। স্টাফের আর সব মহিলাদের সঙ্গেই যেমন হয়ে থাকে।

কিন্তু সমাজ সংসারের ঊর্ধ্বে বসে, কিউপিড কবে এক নিষিদ্ধ শর নিক্ষেপ করে বসেছিল, ওয়ালিক সঠিক খবর রাখেনি। তবু মিসেস মার্স যে লুকিয়ে তাকায়, আর চোখাচোখি হলেই, আরক্ত মুখে চোখ নামিয়ে নেয়, সেটা চোখে পড়তে আরম্ভ করেছিল বছরখানেকের মধ্যেই। এবং আস্তে আস্তে প্রবাসী ব্যাচেলরের উপর স্বয়ং মি. মার্সও যেন প্রীতিভাবাপন্ন হয়ে পড়ল একটু। চায়ের আসরে মাঝে মধ্যে ডাকাডাকি। চব্বিশ বছরের মিসেস মার্স, পাকা গিন্নির মতো বলে উঠত, সত্যি, এই দূর বিদেশে আপনি দেখছি একেবারে একলা।

আর হিলডার সেই আয়ত ধূসর বর্ণ চোখের গভীরে তাকিয়ে, ওয়ালিক শব্দহীন আনন্দে ও শঙ্কায় মনে মনে বলে উঠল, এ কী সত্যি! ওই চোখে আমি যা দেখছি, এ কি সত্যি! আমি তো এমন আশা কখনও করিনি। জীবনের এই একটা দিক তো চির তুষারের মতোই স্তব্ধ ও অজানা ছিল। হিলডা তার মধ্যে কোন চেতনার সৃষ্টি করছিল! স্কটল্যান্ডের এক গাছপালা-শস্যহীন পাথর রুক্ষ অঞ্চলের দরিদ্র ছেলে আমি, জীবনের তাগিদে ছুটে এসেছিলাম হিন্দুস্তানে। আমার বুকে হিলডার মতো মেয়ে তার মুখ ডুবিয়ে দেবে, এ কথা চিন্তা করবার অবসর কখনও পাইনি।…কিন্তু হিলডার চোখে যে আমি সেই আবেদন দেখছি, একটি উদ্বেল বাসনার ছটায় যেন এক মধুর বেদনা ঝরে পড়ছে। এ কী সত্যি!

সত্যি, সত্যি। হিলডার আর ওয়ালিকের অস্তিত্বের মতোই সত্যি। চার বছর আগে খ্রিস্টমাস-এর দিন, সকলের মিলিত ভোজ ও নাচের আসরে, হিলডা আর কোনও সংশয় রাখেনি। ওয়ালিক হিলডাকেই প্রথম আমন্ত্রণ করেছিল নাচের জন্যে। আর হিলডা, দুঃসাহসিকা হিলডা, হাতে হাত দিয়ে, নাচতে শুরু করার মুহূর্তেই, ওর রক্তিম ঠোঁট চোখের পলকে ছুঁইয়ে দিয়েছিল ওয়ালিকের বুকে। চকিতে ওয়ালিকের বুকের রক্ত ঘূর্ণিতে পাক দিয়ে উঠেছিল। মুহূর্তে তার চোখের সামনে বল-এর আসর হারিয়ে গিয়েছিল, পায়ের ছন্দ আড়ষ্ট হয়ে প্রায় থমকে গিয়েছিল। তার বুকের কাছেই তখন হিলডা এক অধরা মধুর স্বপ্নের মতো দুলছিল। হিলডার আঙুলের স্পর্শের ইশারা না পেলে, ওয়ালিকের দুঃসহ বাসনা হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ত হিলডার বিষোষ্ঠে। দেখেছিল, হিলডার চোখে সাবধানী সংকেত।

সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল ওয়ালিক, কিন্তু রক্তের প্লাবন তার ভিতরে ভিতরে দুর্জয় তরঙ্গে আবর্তিত হয়ে উঠছিল। হিলডার চোখের দিকে তাকিয়েছিল সে। হিলড়াও তাকিয়েছিল, আর অস্ফুটে বলে উঠেছিল, তুমি সবসময়েই অন্ধ।

এমনভাবে হেসে সহজ করে বলেছিল যেন, মিসেস মার্স কোনও সাধারণ কথা বলছে ওয়ালিককে। আর ওয়ালিক ভাবছিল, ঠিক বলেছে হিলডা। আমি এতদিন ধরে অন্ধ ছিলাম, আজ এই নাচের আসরেও অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। অন্ধ, অন্ধ, আমি চিরঅন্ধ!

ওয়ালিক অফুটে না বলে পারেনি, তুমি কি স্বপ্ন?

 ঠিক সেই সময়েই মিসেস উইলসন, ইঞ্জিনিয়ার মি. ওয়াইন্ডেভ-এর সঙ্গে নাচতে নাচতে হিলডাদের সামনে পাক খেয়ে যাচ্ছিল। মিসেস উইলসন হেসে বলে উঠেছিল, কী বলে আমাদের মি. ওয়ালিক?

হিলডা সহজ লাস্যে হেসে, মুহূর্তে জবাব দিয়েছিল, উনি নাকি নাচের অনভ্যাসে আড়ষ্ট বোধ করছেন।

মিসেস উইলসন বলেছিল, বেচারি!

বলে হেসে উঠেছিল। হিলডাও হেসেছিল। ওয়াইভে বলে উঠেছিল, ওর সব জং ধরে গেছে, ভাল করে নাচান মিসেস মার্স।

কাছাকাছি সকলেই সেই সব ঠাট্টা উপভোগ করেছিল। আর হিলডা ও ওয়ালিকের কথাবার্তা বলার পরিবেশ সহজতর হয়ে উঠেছিল। হিলডা তাকিয়েছিল ওয়ালিকের চোখের দিকে। ওর নাসারন্ধ্র স্ফীত, ঠোঁটের কোণে স্বপ্নিল হাসি, অনুরাগের আবেগে জ্বলজ্বল করছিল ওরিয়েন্টের অপরাহু-আকাশী চোখ। বলেছিল, আমি স্বপ্ন নই জর্জ, তাকিয়ে দেখো, অতি বাস্তব।

আমি কেন তবে বুঝতে পারছি না?

সময় হলেই পারবে।

 সে সময় কখন আসবে ডার্লিং?

যখন দুজনে নিরালা পাব।

 নিরালা পেয়েছিল। যতই রাত বাড়ছিল, ততই সবাই অত্যধিক মদ্যপানে এলিয়ে পড়ছিল। কি মেয়ে, কি পুরুষ, সকলেই অবিশ্রান্ত পান করে চলেছিল। হিলডা আগেই বলে রেখেছিল ওয়ালিককে, মাতাল হয়ে যেও না, বেশি ড্রিঙ্ক করো না। নিজেকে সামলে রেখেছিল ওয়ালিক। প্রথম পতন ঘটেছিল উইলসনের। একটা টেবিলের উপর সে এলিয়ে পড়েছিল। যোসেফ মার্স, ছালছাড়ানো আস্ত মোরগের মতো, উপুড় হয়ে পড়েছিল একটা সোফায়। মদমত্ততা যতই বাড়ছিল, আসর ততই ভেঙে যাচ্ছিল। মাতালরা মাতালদের দেখেই হাততালি দিয়ে হাসাহাসি করছিল। মিসেস ওয়াইন্ডেভ রীতিমতো ওয়াইন্ড হয়ে উঠেছিল। অন্তত দুজন বেয়ারার দাড়ি ধরে টেনেছে, আধ ডজন গ্লাস ভেঙেছে।

রাত্রি প্রায় তিনটের সময়, ইউসুফকে ডেকে, হিলডা সকলের সামনেই ওয়ালিককে অনুরোধ করেছিল, মি, মার্সকে ঘরে নিয়ে যেতে আপনি একটু সাহায্য করুন।

সম্পূর্ণ অচৈতন্য যোসেফকে, ইউসুফের সাহায্যে ওয়ালিক ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। এবং সেই শেষ রাত্রের নিরালা মুহূর্তেই, হিলডা স্বপ্নের আবরণ ছেড়ে, ওয়ালিকের আলিঙ্গনে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মার্স-এর কোয়ার্টারে তার অবস্থানের সাক্ষী একমাত্র ইউসুফ।

.

সেই থেকে শুরু। আর শুরু থেকে, চার বছর ধরে, প্রতি মুহূর্তে গোপনীয়তা। যত গোপনীয়তা, ততই যেন আকর্ষণ প্রবলতর হয়ে উঠছে। চার বছর ধরে, সকল বাধা যত কঠিন মনে হয়েছে, দুজনের বাসনা ততই উদ্বেল হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে, দুজনের কাছেই এই গোপনীয়তার বন্ধন অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু একজন যখন স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, আর একজন তখন সান্ত্বনা দিয়েছে। প্রকাশ করে ফেললেই মুহূর্তে যে আলোড়নের সৃষ্টি হবে, সে আলোড়নকে দুজনেই সহসা জাগিয়ে তুলতে চায় না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তের এই লুকোচুরি, প্রতি মুহূর্তের গোপনীয়তা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হিলডা কাঁদে, ওয়ালিক বন্দি বন্য অশ্বের মতো কারখানা ও কুঠির ঘেরাওয়ে ছুটে বেড়ায়।

চার বছর ধরে, কোয়ার্টারের এই চৌহদ্দির মধ্যে, সামান্য সংখ্যক ইওরোপীয়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়াও ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। কখনও কখনও, হঠাৎ যে কারুর ভুরু কুঁচকে ওঠেনি, এমন নয়। কিন্তু সন্দেহ বেশিক্ষণ বজার রাখবার মতো কোনও ঘটনা দুজনে ঘটতে দেয়নি। একমাত্র যোসেফ অনুভব করছে, হিলডা আর সে রকম নেই। আস্তে আস্তে সে বদলে যাচ্ছে। ক্রমে সে নিশুপ গম্ভীর আর ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। তার কাছে অসহজ হয়ে উঠছে হিলডা। ব্যবহারে আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। অথচ, অথচ কী একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য যেন হিলডার ভিতর থেকে বিচিত্র আলোয় বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে। তাই যোসেফও যেন নতুন এক আকর্ষণ বোধ করছে স্ত্রীর প্রতি। মাঝে মাঝে একটা ক্ষীণ সন্দেহের বৃশ্চিক তাকে হুল ফুটিয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছুই পায় না। যদিও তার সেই ক্ষীণ সন্দেহের মধ্যে ওয়ালিকের মূর্তিই বারবার ভেসে ওঠে। কারণ, ওই একটি লোকের সামনেই হিলডাকে সে চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখে। শত চেষ্টা করেও, হিলডা ওর ভিতরের চঞ্চলতার নানান চিহ্নগুলি লুকোতে পারে না।

কিন্তু কখনও যে কিছুই চোখে পড়ে না। আর সপ্তাহে কদিনই বা ওদের দেখা হয়। ওয়ালিক নিজেও কাজের মানুষ, সকলেরই প্রিয়। শুধু ম্যানেজার উইলসনের নয়। মি. টমাসডফেরও সে বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র। আশ্চর্য নয়। উইলসনের পর ওয়ালিকই হয়তো এই টমাসডফ কোম্পানির গারুলিয়া মিলের ম্যানেজার হবে। তা ছাড়া, যোসেফের সঙ্গে ব্যবহারেও, ওয়ালিকের কিছু তারতম্য দেখা যায়নি।

তবু হিলডাকে ঘিরে যে সন্দেহ ও নতুন আকর্ষণ জেগে উঠেছে, তার কেন্দ্রে ওয়ালিকের অস্পষ্ট ছায়া কেন দেখতে পায় যোসেফ!

.

দুজনের নিমেষহারা চুম্বনের মাঝখানে শুধু চিন্তার স্রোত পাক খেয়ে যায়, কথা বলার অবসর পাওয়া যায় না। কথা বলার সময়টুকু যেন অকারণ ফাঁকি হয়ে যাবে। মিলনের এই দুঃসাহসিক চুরি করে পাওয়া পরম মুহূর্ত কয়টি বৃথা চলে যাবে। কথা থাক। সে তো ইউসুফের হাতে লুকিয়ে পাঠানো চিঠিতেই পাওয়া যাবে।

তবু আশ্লেষ চুম্বনের গাঢ় আকর্ষণ ছিন্ন করতেই হয়। ওয়ালিকের জিভে হিলডার চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদ লাগে। কান্নায় হিলডার ঠোঁট শিথিল হয়ে পড়ে। ওদিকেও সময় নেই। হয়তো ইতিমধ্যেই ওয়ালিকের খোঁজ পড়ে গিয়েছে।

ওয়ালিক চুপিচুপি স্বরে ডাকল, হিলডা, ডার্লিং!

কান্নায় তখন হিলডার সর্বাঙ্গই কাঁপছে। আরও গাঢ় আলিঙ্গনে ওয়ালিককে সে জড়িয়ে ধরেছে। কান্নারুদ্ধ গলায় বলল, আর কতদিন জর্জ, আর কতদিন!

ওয়ালিক বলল, আমি বুঝতে পারি না হিলডা। এ ব্যাপারে তুমি যা বলবে, আমি তাই করব।

 দুজনেই এক কথা দুজনকে বলে। ওয়ালিক যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কোনও উপায়ের কথা জিজ্ঞেস করে, তখন হিলডাও এমনি করেই বলে, তুমি যা বলবে জর্জ, আমি তাই করব।

কিন্তু দুজনেই জানে, হয় এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে, নয় তো একটা সংঘর্ষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তার কী পরিণাম হতে পারে, দুজনের কেউ-ই জানে না। এখনও যে সংশয় দুজনের মধ্যে রয়েছে, সেই অজানা পরিণামের জন্যেই। এ দেশে ইউরোপীয় সমাজে যে এমন ঘটনা ঘটে না, তা নয়। একমাত্র সেই অভিজ্ঞতাটুকু আছে। দুজনেই অস্থির, দুজনেই বেপথুমান। হৃদয়ের টানে ছুটেছে, বুদ্ধি করে কোনও পন্থা এখনও স্থির করে উঠতে পারছে না। আসলে, দুজনেই দৈবের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে বসে আছে।

একটু স্থির হল হিলডা। বলল, সকালবেলা তোমাকে দেখলাম, লিটলজনের সঙ্গে তুমি বগি নিয়ে চলে যাচ্ছ।

হ্যাঁ, তোমাকে বলেছিলাম, ফোর্ট গ্লাস্টারের ওয়াল্টারের ওখানে আজ নেমন্তন্ন ছিল। বাউরিয়া থেকে রিচার্ড ম্যাকলিস্টার, জর্জ হেন্ডারসনের বরানগর মিলের মি. ওয়ালেসও ছিলেন। সারাদিন ওদের সঙ্গে কেটেছে। কিন্তু ডার্লিং কখন এসে পৌঁছুব, বারবার সে কথা ভাবছিলাম।

আর একবার ওয়ালিক হিলডার ঠোঁটের উপর লুটিয়ে পড়ল। তারপরে বলল, কী ভাবে এসেছি তুমি জান না, দেরি হলেই উইলসন লোক পাঠাবে কোয়ার্টারে।

–তুমি কাজের মানুষ জর্জ।

হিলডার ফিসফিস স্বরের মধ্যেও অভিমান ফুটে ওঠে। ওয়ালিক নিচু হয়ে হিলডার বুকের মাঝখানে মুখ রেখে বলল, রাগ কোরো না ডার্লিং। অন্য সময় যখন বেশিক্ষণ থাকতে চাই, তুমি কি আমাকে থাকতে দিতে পারো। কাজ আমি ভালবাসি, কিন্তু তোমাকে বাদ দিয়ে আর কোনও কাজই আমার কাজ নয়। আমি তো উইলসনের মুখে জানলাম, মিসেস মার্স-এর মাথা ধরেছে, তাই সে আসতে পারেনি। সেই মুহূর্তেই কয়েক মিনিটের বিদায় নিয়ে ছুটে চলে এসেছি।

হিলডা নিজের বুকের কাছে নুয়ে পড়ে, তার প্রেমিকের চুলে কপালে গালে চুম্বন করল। তার অন্যায় অভিমানের জন্যে এটা ক্ষমা চাওয়া। আঙুল দিয়ে ওয়ালিকের ঠেটি স্পর্শ করে বলল, প্রচুর মদ খেয়েছ সারাদিন।

ওয়ালিক মুখ তুলে এনে বলল, তা খেয়েছি, কিন্তু এখানকার মতো মাতাল হতে পারিনি একবারও।

হিলডা ওয়ালিককে আকর্ষণ করে বলল, শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, একটু বসবে না।

ওয়ালিক অনুনয় করে বলল, এখন বসতে বোলো না ডার্লিং। ম্যানেজারের ওখানে যেতেই হবে।

আবার পরস্পরের ঠোঁট ঘন সান্নিধ্যে এল। হিলডা হঠাৎ ঠোঁট ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ, জান, তোমাদের লিটলজন লোকটা আজ কী করেছে?

-উইলসনের কথায় জানলাম, কিছু একটা সে করেছে, এখনও শোনা হয়নি।

–মিসেস ডাডনির আয়াকে না পেয়ে, লোকটি নেটিভ ওয়ার্কারদের বস্তিতে ঢুকে পড়েছিল। একটা মেয়েকে চেজ করে, তার ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।

–তারপর?

–আমরা ভেবেছিলাম, ওকে হয়তো মেরেই ফেলবে নেটিভরা। তারা নাকি সেই ঘরটা ঘিরেও ফেলেছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, শুনলাম রহমান বলে কে একজন সর্দার আছে, সে-ই বাঁচিয়ে দিয়েছে।

–হ্যাঁ হ্যাঁ, রহমান, লেবার কন্ট্রাক্টর এবং ডিপার্টমেন্ট সর্দার। কী ভাবে সে বাঁচাল?

–শুনলাম লোকটা নাকি ওপন সোর্ড নিয়ে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, সবাইকে ভাগিয়ে দিয়েছে, আর লিটলজন যতক্ষণ সেই ঘরে ছিল, তাকে পাহারা দিয়েছে। ওকে নাকি সবাই যমের মতো ভয় পায়!

ওয়ালিক বলল, তা পায়। হয়তো যে মেয়েটিকে লিটলজন ধরেছে, সে রহমানেরই লোক! রহমান যাদের বাংলাদেশের বাইরে থেকে এখানে কাজের জন্যে নিয়ে এসেছে তারা সকলেই ওর কাছে ঋণী। গাড়ি ভাড়া, খেতে দেওয়া, সবকিছুর বিচারকর্তাও রহমান। ওরা, মোর দ্যান স্লেভস টু হিম। আর টাকার জন্যে রহমানেরা সব পারে জানি, কিন্তু এতটা পারে বলে বুঝতে পারিনি। লিটলজন তারপরে কী করল?

-নাথিং। রহমান নিজে তাকে কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে গেছে। কিন্তু জর্জ, রহমানের লোকেরা ছাড়া, আরও নেটিভরা তো ছিল। তারা কিছু বলল না কেন?

ওয়ালিক বলল, নেটিভদের এই চরিত্রটা আমি বুঝতে পারি না হিলডা। কিন্তু ডার্লিং, এ প্রসঙ্গ এখন থাক। আমাকে বিদায় দাও।

হিলডা সহসা নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, ভুলে যাই, ভুলে যাই জর্জ, তুমি আর আমি ভিন্ন ঘরের বাসিন্দা, লুকিয়ে আমরা দেখা করি।

আবার আলিঙ্গন ও চুম্বনের মধ্যে দুজনে ডুবে যায়। কয়েক মুহূর্ত পরে বিদায় নেবার সময় হিলডা বলল, যোসেফের সন্দেহ আরও বেড়েছে জর্জ। ও আজকাল তোমার সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন করে, ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকায়।

–অনুমান করতে পারছি হিলডা।

হিলডা ওয়ালিকের কাঁধে হাত রেখে, কানের কাছে মুখ এনে বলল, ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আমার আজকাল কী রকম অস্বস্তি হয় জর্জ।

–কেন?

–ওকে যেন আর প্রাণ ধরে বিশ্বাস করতে পারছি না।

কোন দিক থেকে?

–দাড়িওয়ালা আধবুড়ো নেটিভটাকে আবার কোন দিক থেকে সন্দেহ হবে? টাকার জন্যে হয়তো লোকটা যোসেফকেও বলে দিতে পারে।

–আমি তো ওকে অনেক টাকা দিই ডার্লিং।

–সে তো আমি জানি। কিন্তু আজকাল ওর ভাবভঙ্গি আমার খুব সুবিধের মনে হচ্ছে না।

অন্ধকারের মধ্যে ওয়ালিকের চোখ তীক্ষ্ণ ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চাপা চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার। এই মিলের অফিসের হেডক্লার্ক যা মাইনে পায়, তার থেকেও বেশি টাকা মাসে মাসে ইউসুফকে দেয় সে। এবং জানে, সেই টাকায় ইতিমধ্যেই ইউসুফ কিছু জমি কিনেছে। পুবের গ্রামাঞ্চলে কিছু ধান জমি, আর কাছেপিঠেই কোথাও খানিকটা বসতজমি। বিহার প্রদেশ থেকে আগত সে। খবর পেয়েছে ওয়ালিক, এখানে একটি বাঙালি মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করার কথাবার্তা চলছে। ইউসুফ ইতিমধ্যেই খানদানি বড়েমিঞা বলে খ্যাতি অর্জন করেছে। ছুটির দিনে, পায়জামা পাঞ্জাবি আর দাড়ির আতরেই তো প্রমাণ করে। করুক, তাতে কোনও আপত্তি নেই ওয়ালিকের। কিন্তু যদি লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করবার চেষ্টা করে, তা হলে ওয়ালিক তাকে নিষ্কৃতি দেবে না। ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেবে সে!

ওয়ালিক জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কোনওরকম অসম্মান করে না তো?

–সেটা এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না।

–ওকে ভাল করে লক্ষ করো। ও যদি গোলমাল করে তবে তার শাস্তি ওকে পেতে হবে। এবার আমি যাই ডার্লিং।

হিলডার ব্যাকুল আকাঙিক্ষত ঠোঁটে শেষ চুম্বন এঁকে দিয়ে বিদায় নিল ওয়ালিক।

.

উইলসনের ঘরে যখন ওয়ালিক উপস্থিত হল, তখন তার একমাত্র পরিবর্তন লক্ষ করা গেল, মাথার চুল আঁচড়ানো, মুখটি একটু পরিষ্কার। হিলডার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কোনওরকমে ওইটুকুই সারতে পেরেছে সে। ইতিমধ্যে সকলের হাতে হাতেই গেলাস উঠেছে। উইলসন দরাজ হাতেই স্কচ হুইস্কির বোতল খুলে দিয়েছে। সকলেই দুই গুচ্ছতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একদিকে ম্যাকলিস্টার, আর একদিকে ওয়ালেস। মহিলাদের ভিড় ম্যাকলিস্টারের দিকেই বেশি। কারণ সেখানে নানাধরনের, নানান জগতের বিচিত্র গল্প চলেছে। ওয়ালেস জুট ইন্ডাস্ট্রির বিষয় আলোচনা করছে।

সকলের দিকে তাড়াতাড়ি চোখ বুলিয়ে, মুখ ফেরাতে যেতেই ওয়ালিকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল যোসেফ মার্স-এর। ওয়ালিক বুঝতে পারল, সে ঘরে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই যোসেফ তার দিকে তীক্ষ্ণ নিবিষ্ট চোখে লক্ষ্য করছে। চোখাচোখি হওয়ার পরেও সহসা যোসেফ চোখ সরাল না। স্বভাবতই ওয়ালিক যোসেফেরই কাছ ঘেঁষে এল, ঘাড় নেড়ে বলল, হেলো মি. মার্স!

যোসেফের যেন হঠাৎ সংবিৎ ফিরল, বলল, হেলো! সবাইয়ের মধ্যে আপনাকে এতক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম না।

ওয়ালিক বলল, আর বলবেন না, সারাদিন গরমে বেশ কষ্ট গেছে। তাই আমি একটু জল ছোঁয়াতে গেছলাম।

যোসেফের মুখে একটু হাসি। কিন্তু চোখের অনুসন্ধিৎসা তীব্র। বলল, ও, আচ্ছা।

বলেই যোসেফ তাড়াতাড়ি হাত তুলে একজন বেয়ারাকে ইঙ্গিত করে ওয়ালিককে দেখিয়ে দিল, উচ্চারণ করল, সাহাবকো হুইস্কি পানি লাও।

ওয়ালিক একটু হেসে বলল, মেনি, মেনি থ্যাংকস।

নো মেনশন্ প্লিজ!

যোসেফ ওয়ালেসের কথার দিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করল। ওয়ালিক বেয়ারার ট্রে থেকে হাত বাড়িয়ে পানীয়ের গেলাস তুলে নিল। সেও ওয়ালেসের দিকেই ফিরে তাকাল।

ওয়ালেস তখন উইলসনকে বলছেন, ও শিওর। মি. টমাসডফের সঙ্গে আমাদের বরানগর মিলের ফটোগ্রাফ পর্যন্ত আছে। এইটিন সিক্সটি টু-তে সেই ফটো তোলা হয়েছিল, আমার মনে আছে। তবে আপনাদের মতো শুধু গোঁফওয়ালা আমরা কেউ ছিলাম না স্যার, এখন আমার যে দাড়ি দেখছেন, তখনও আমাদের সকলের এমনি দাড়িই ছিল।

মি. ওয়ালেসকে যারা ঘিরেছিল, মেয়ে পুরুষ সবাই হেসে উঠল। মহিলাদের হাসির মধ্যে একটু দাড়ি-অপছন্দের কুঞ্চন দেখা গেল।

ওয়ালেস বললেন, তবে মি. টমাসডফ একটু শৌখিন ছিলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন, ওঁর দাড়ি নেলসনীয় স্টাইলের।

আর এক প্রস্থ হাসি শোনা গেল। ওয়ালেস বলেই চললেন, কিন্তু যা বলছিলাম, আপনাদের শ্যামনগর মিল তো ভাগ্যবান। আমার মনে আছে, বোর্নিও কোম্পানি ছেড়ে দেবার পর মি. টমাসডফ, লন্ডনের কাছে বার্কিং মিলস করেছিলেন। তবে ওতে যে কিছু হবে না, মি. টমাসডফ স্মেল্ট ইট লাইক দি ওল্ড ওয়ার হর্স। তখনই তাড়াতাড়ি সব পাকা মাথা, প্র্যাকটিক্যাল ভদ্রলোক, নিকল ব্রাদার্স আর ডান্ডির মি. জে. জে. বেরির সঙ্গে যুক্তি করে আপনাদের এই শ্যামনগর মিল খোলা হল। খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন মি. টমাসডফ কলকাতার সখোয়েন কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানির অফিসটা কাজের জন্য বেছে নিয়ে। ওদের অর্গানাইজেশন আর অভিজ্ঞতা দুই-ই ছিল, সবদিকেই বেশ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে গিয়েছে।…আপনাদের তো আমি আরও বিশেষভাবে প্রশংসা করব, হেসিয়ান ক্লথ ম্যানুফাঁকচারের ব্যাপারে। যদিও ইম্পর্টেন্ট কনট্রাক্ট গিয়েছিল অন্য কোম্পানির কাছে। কিন্তু প্রথম সিরিয়াস অ্যাটেম্পট আপনারাই করেছিলেন।

প্রৌঢ় উইলসন একটু আরক্তই হয়ে উঠল ওয়ালেসের কথায় এবং সে মুখ তুলে যেন কাউকে খুঁজতে লাগল তার চারপাশে। ওয়ালিককে খুঁজছিল সে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই একটু অর্থপূর্ণ হাসল সে।

আর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে, ওয়ালেসও তাকালেন ওয়ালিকের দিকে। বললেন, জানি মি. ওয়ালিক, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টস চূড়ামণি, উনি না থাকলে আপনি অনেকখানি হেল্পলেস হয়ে পড়তেন।

ওয়ালেসকে যারা ঘিরেছিল, তারা সবাই একবার ওয়ালিকের দিকে। বললেন, জানি মি. ওয়ালিক, আপনার অ্যাসিস্টান্টস চুড়ামণি, উনি না থাকলে আপনি অনেকখানি হেল্পলেস হয়ে পড়তেন।

উইলসন বলল, আচ্ছা, স্যার হোয়াট ডু ইউ থিংক অব দি ফিউচার অব দি জুট ইন্ডাস্ট্রি।

ওয়ালিকের দিকে তাকিয়ে আর একবার হাসলেন ওয়ালেস। গলা তুলে অন্য এক টেবিলের দিকে ম্যাকলিস্টারকে গলা তুলে দেখতে চেষ্টা করলেন। বললেন, আজ আমি সারাদিন ধরেই এই একটি বিষয় বলেছি। মি. উইলসন, আপনি তো অনেক বোঝেন, জুট ইন্ডাস্ট্রি কি এখন আর কোনও জিজ্ঞাসার অপেক্ষা রাখে? খুব বেশি লুব্ধ হয়ে না উঠলে, পঁচিশটা লুম নিয়ে বসলেও আজ একজন দাঁড়িয়ে যেতে পারে। হয়তো বাহাত্তর-তিয়াত্তরের সেই দু হাতে টাকা লোটবার অবস্থাটা নেই আর সেটা একটু অস্বাভাবিক লাভের ব্যাপারই ছিল। যে কারণে ধরুন আমাদের বোর্নিও কোম্পানিকেও কিছুটা সাফার করতে হয়েছে। ধরুন আপনারা সেভেনটি থ্রি-তে ডিভিডেন্ড দিয়েছিলেন টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট। সেভেন্টিফোর-এ দিয়েছেন টুয়েন্টি পারসেন্ট সেভেন্টিফাইভেই নেমে দাঁড়িয়েছিল টেন পারসেন্ট। আমরা তো বেশ বিপন্নই বোধ করেছি, অথচ ঠিক এভাবে ড্রপ করার কথা ছিল না। একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে পারা উচিত ছিল। অথচ দেখুন, সেই আমরাই, বুনটন প্রেসিং কোম্পানির শিয়ালদার কাছে বেঙ্গল প্রেসিং অ্যান্ড ম্যানুফাঁকচারিং ফ্যাক্টরির দেউলিয়া অবস্থায় সেটাকে নিয়ে, বেলেঘাটা মিল নাম দিয়ে দিব্যি থার্ড মিল চালিয়ে যাচ্ছি। অদূর ভবিষ্যতে যদি আমরা আরও একটা মিল চালু করে দিই, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই।

উইলসন বলে উঠল, তাই নাকি স্যার, তাই নাকি? আরও নতুন মিলের পরিকল্পনা আমাদের আছে?

ওয়ালেস গেলাসে একটি ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, ধীরে বন্ধু ধীরে। আপনাদের মতো তাড়াতাড়ি হয়তো আমরা পারব না। জানি আপনাদের টিটাগড় মিল খুব শিগগিরই তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

উইলসন যেন গৌরবের লজ্জাতেই আরও আরক্ত হয়ে উঠল। বলল, ইয়েস স্যার, টিটাগড়ে আমাদের জমিসংক্রান্ত বিষয়টা প্রায় শেষ হয়ে এল। এবং এ ব্যাপারেও আমাদের জর্জই…।

কথাটা শেষ না করে সে ওয়ালিকের দিকে তাকিয়ে হাসল।

ওয়ালেস বললেন, আই নো, আই নো স্যার। আমি আজই তো মি. ওয়ালিককে আপনাদের নতুন মিলের পরিকল্পনার কথা বলছিলাম। মি. টমাসডফ পুরনো বন্ধুত্বটা ভুলতে পারেননি বলে, এখনও কিছু কিছু কথা আমাদের চিঠিতে লিখে জানান। সে যাই হোক, আপনাদের বা আমাদের, যাদের কথাই বলি, এই গত কয়েক বছরে আমরা জুট মার্কেট বুঝতে একটু ভুলই করেছিলাম। আর সেটা হয়েছিল কারণ, মুনাফার বাড়াবাড়িতে আমরা মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। ডান্ডিও অবিশ্যি পিছনে লেগেছে। কিন্তু আবার আমরা, বেঙ্গল ম্যানুফাকচারাররা সামলে উঠেছি। নতুন নতুন কারখানা খোলবার সাহস পাচ্ছি। আপনাদের শ্যামনগর ফার্ম অবিশ্যি অনেক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, আপনারা শেয়ার হোল্ডারদের কুড়ি-পঁচিশ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দেননি কখনও, কিন্তু টেন পার্সেন্ট একেবারে স্টেডি, আর কোনও উত্থান পতন হয়নি। এই স্টেডিনেসের, একটা মূল্য আছে। তেমনি আবার আপনারা হিউজ রিজার্ভ ফান্ড করে ফেলেছেন। অতএব বুঝতেই পারছেন, বেঙ্গল জুট ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে সংশয়ের আর কিছু নেই।

একজন বলে উঠল, কিন্তু মি. ওয়ালেস, আমাদের সেই জর্জ অ্যাকলেন্ডের সঙ্গে এসেছিলেন মি. চার্লস স্মিথ, ওঁকে কিন্তু ট্র্যাজেডিই ফেস করতে হয়েছিল।

ওয়ালেস ঘাড় নেড়ে বললেন, সেটা আমি মানতে পারি না স্যার। মি. স্মিথের বাধা হয়ে উঠেছিল ওঁর বার্ধক্য। আমার মনে আছে, রিষড়া ইয়ার্ন কোম্পানি উঠে যাওয়ায় উনি আবার ডাণ্ডিতে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও সুবিধে করতে পারেননি, বরং বেশ কষ্টেই পড়েছিলেন। আসলে কী জানেন? ভদ্রলোকের মন পড়েছিল এই বাংলাদেশে। বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু যদি করতে হয়, আবার সেই সুদুর জুটল্যান্ডেই ফিরে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত ডান্ডিকে রাজিও করালেন যন্ত্রপাতি দেবার জন্যে। খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তো। সাপ্লিমেন্টেড বাই এ স্পিংকলিং অব নিউ মেশিনারি, হিউজ সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিনের স্টক নিয়ে ভদ্রলোক জাহাজ ভাসিয়েছিলেন। কলকাতার নারকোলডাঙ্গাতে গিয়ে এসিয়াটিক নাম দিয়ে কারখানা শুরুও করে দিয়েছিলেন। বাট মি. চার্লস স্মিথ, বিং অ্যান ওল্ড ম্যান, ডিড নট ওয়েট টু সি দি মিল স্টার্ট। এক ইহুদির কাছে প্রফিটের টাকা তুলে নিয়ে হোমে ফিরে গিয়েছিলেন। এবং খবর নিয়ে দেখতে পারেন, মি. স্মিথ এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর মাখন ও মাংসের ভাগে কিছুমাত্র কম পড়েনি। সোফার ওপরে হরিণের চামড়ার গরমে বসে, সুস্বাদু ভারতীয় চা-ই পান করেন হোমে। এটাকে কী করে ট্র্যাজিডি বলতে পারি বলুন।

উইলসন বলে উঠল, হি ইজ ফরচুনেট এনাফ, আই মাস্ট সে। সেই এসিয়াটিক মিলই তো এখন সূরা নামে চলেছে, আর বেশ ভালভাবেই চলেছে।

ওয়ালেস বললেন, হ্যাঁ, উইথ নেটিভ ম্যানেজমেন্ট, সাম বোম্বে জেন্টু চন্দর রামজি যার দায়িত্ব নিয়েছে, আর ব্যবসাও বেশ ভালই করছে।

স্মিথের কথা যে তুলেছিল, তার দিকে তাকিয়ে ওয়ালেস বললেন, অতএব মি. স্মিথের ট্র্যাজেডির কথাটা সত্য নয় স্যার। হয়তো নিজের কারখানায় ম্যানেজার হয়ে, সবকিছু নিজে চালাবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, হয়তো কিছু বেশি লাভ নিজের হাত দিয়ে আসতে পারত। যদিও তার কোনও স্থিরতা ছিল না। প্রফিটের টাকা তুলে না নিয়েই যে ওকে চলে যেতে হয়নি, সেটাই যথেষ্ট। অবিশ্যি এটা ঠিক যদি আপনারা কিছু মনে না করেন, আমি মুখ ফুটে বলতে সাহস করি, অনেক চোরা অন্ধকার আয়ের পথও আজ জুট ইন্ডাষ্ট্রি তার কর্মচারীদের জন্যে খুলে দিয়েছে। ফ্রম এ ম্যানেজার টু গেটকিপার।…না না মি. উইলসন, আপনি যেন দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না কথাটা। আমি সাধারণভাবেই বলছি, নইলে আমার নিজেকেও তো চোর বলতে হয়। আমি নিতান্তই কথার কথা বলছি, কোনও কোনও কোম্পানিতে এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে।

উইলসন বলল, জানি বইকী, দেখছিও। আমি কিছুই মনে করছি না মি. ওয়ালেস।

ওয়ালেস বললেন, মি. স্মিথের আর যেটুকু বাকি ছিল, সেটা হয়তো হোম কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে কিছু বেশি রোজগার করে নেওয়া।

যে প্রৌঢ় ওভারসিয়ারটি স্মিথের কথা তুলেছিল, সে বলল, আমার অবিশ্যি এত কথা জানা ছিল না স্যার। মি. স্মিথ যে তার প্রফিট তুলে নিয়ে গেছলেন, সেটা ঠিক জানতাম না। তা হলে, এখন দেখছি, একমাত্র জর্জ অ্যাকলেন্ড ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউই নিঃশেষে মার খায়নি।

খেয়েছে।

 ওয়ালেস চোখ তুলে অদূরে ম্যাকলিস্টারকে দেখিয়ে বললেন, ওই লোকটি তারই প্রতিমূর্তি। কিন্তু ভদ্রলোকের দোষও অনেক। বাউরিয়ার পরে ওরিয়েন্ট-এর ট্র্যাজেডি মোটামুটি সবাই জানে। হি ইজ টু-উ মাচ অ্যাম্বিশাস, তার সঙ্গে ওঁর মেকানিকাল জিনিয়াস অদ্ভুত সব এক্সপেরিমেন্টের পথে এঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। সেগুলো এক ধরনের কুপ্রবৃত্তি, তাতে সন্দেহ নেই। আপনারা হয়তো জানেন না, ফোর্ট গ্লাস্টারেই প্রথম যখন টেন অ্যান্ড থ্রিফোর্থ পাউন্ডের উলপ্যাক তৈরি করলেন ম্যাকলিস্টার, ওজন নিয়ে দেখলেন, ওঁর হিসেবে সেগুলো হালকা হয়ে গিয়েছে। সেই বিরাট লট ফিনিশড় মালকে তো ফেলে দিতে পারেন না। রাতারাতি ভদ্রলোক একটা পন্থা বের করে ফেললেন। মিল-ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে একটা যান্ত্রিক কৌশল আবিষ্কার করলেন, যাতে বালি দিয়ে উল প্যাকগুলো ওজনে ভারী করে তোলা যায়।

উইলসন যেন কৌতূহলে ও উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, হাউ, হাউ?।

ওয়ালেস হেসে ফেললেন উইলসনের কৌতূহল দেখে। বললেন, কেন, আপনিও এক্সপেরিমেন্ট করবেন নাকি মি. উইলসন?

উইলসন একটু থমকে বিব্রত হয়ে উঠল। বলল, না না, এক্সপেরিমেন্ট করব কেন? কিন্তু কী করে সেটা সম্ভব হয়েছিল, তাই জানতে চাই।

ওয়ালিকও কৌতূহলিত হয়ে উঠেছিল। ওয়ালেস বললেন, একটা ছোট অরিফিস-এর মধ্য দিয়ে, খুব ফাইন বালি, যাকে বলে জেট অব স্টিমের মারফত সমস্ত উলপ্যাকের গায়ে এমনভাবে ইনসার্ট করে দেওয়া হয়েছিল, একটুও বোঝাবার উপায় ছিল না। শুধু বোঝবার উপায় ছিল না নয়, ওজনের মাত্রা তো কিছু বেশিই ছাড়িয়ে গিয়েছিল, প্যাকগুলোও দেখতে বেশ চকচকে হয়েছিল।

উইলসন বিমূঢ় বিস্ময়ে হেসেই ফেলল। বলল, সিম্পলি স্যান্ডউইচড স্যার।

বাকিরাও সবাই হেসে উঠল তার কথা শুনে। ওয়ালেস বললেন, যা বলেছেন, সিম্পলি স্যান্ডউইচড।

উইলসন বলল, কিন্তু এতে কার না লোভ হয় স্যার? এক হাজার পাউন্ড এক্সপোর্টেড মালকে যদি শুধু বালি দিয়ে বারোশো পাউন্ড করতে পারি।

ওয়ালেস বলে উঠলেন, তা হলে দুশো পাউন্ডের দামটা স্রেফ কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে পকেটে পোরা যায়।

সবাই আবার হেসে উঠল। ওয়ালেস বললেন, ফোর্ট গ্লাস্টারের এ ব্যাপারটার যদিও কোনও রেকর্ড রাখা হয়নি, আর এ বেআইনি বিষয়ের রেকর্ড রাখাও খুব বিপজ্জনক, তবু খবর যারা জানে, তাদের প্রাণে এটা গাঁথা হয়ে গিয়েছে। অবিশ্যি আমি জানি না, বেঙ্গলে কোনও মিল এটা আর প্রাকটিস করছে কি না, তবে জুট ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই মি. ম্যাকলিস্টারকে প্রায় গুরুদেব বলেই মনে করছে। অনেকে অবিশ্যি বলে এটা ম্যাকলিস্টারের ইয়াংকি ইনস্টিংক্ট, তবু ম্যাকলিস্টারকে কোনও কোম্পানি পেলে দেখবেন লুফে নেবে। ম্যাকলিস্টার আরও নতুন নতুন ফার্মে যোগ দেবে। তারাই ওঁকে ডেকে নিয়ে যাবে। অথচ মজা এই, তবু ভদ্রলোকের পায়ের তলার মাটি কখনও শক্ত হচ্ছে না, বার বার হড়কে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, উনি যদি একটু স্টেডি হয়ে একটু ধীর স্থির হয়ে কাজ চালান, তা হলে অনেক উঁচুতে উঠতে পারেন।

উইলসন বলল, কিন্তু স্যার, যারা ধীর স্থির হয়ে কাজ চালাচ্ছে, তারা কি কেউ মি. ম্যাকলিস্টারের মতো নানান কলাকৌশলের চেষ্টা করছে না?

ওয়ালেস বললেন, নইলে আর ম্যাকলিস্টারকে নিয়ে কোম্পানিগুলোর মাথাব্যথা কীসের? কেউ কেউ নিশ্চয় নানা ধরনের বেআইনি কলাকৌশল আবিষ্কারের চেষ্টায় আছে। আমার মতে, তাতে ওয়ার্ল্ড মার্কেট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। আমাদের বরানগর মিল তো কয়েকবার ঠিক এই একটা ব্যাপারেই লস দিয়েছে। এক্সপোর্টেড মাল ওজনে কমে গিয়েছে, কোম্পানিকে তার জন্য ক্ষতিপূরণও করতে হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণ করেও, শেষপর্যন্ত আমরা একেবারে বেপাত্তা হয়ে যাইনি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, কোয়ালিটি অনুযায়ী মালের দাম নেব। আমি যদি খারাপ মাল তৈরি করি, খারাপ মাল হিসেবেই তা বিক্রি করব। পড়ে থাকবার কোনও ভয়ই তো আমার নেই। যাই হোক, ভেজাল চালিয়ে যদি আপনি পার পেয়ে যান, আর বরাবর চালিয়ে যেতে পারেন, আমার কিছু বলার নেই। তবে সেটা বোধহয় বারবার সম্ভব নয়।

উইলসন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, ভেজাল চালাবার আমার কোনও ইচ্ছা বা প্রয়োজন নেই।

 ওয়ালেস বললেন, সেটা আমি বিশ্বাস করছি। এনি হাউ, বেঙ্গল জুট ইন্ডাষ্ট্রি তার সংশয়ের দিন পার হয়ে এসেছে, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এই দেশে থেকেও যদি সেটা অনুমান না করতে পারেন, ডান্ডিতে যান। আপনাকে আমি নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারি, সেখানে আগামী দিনের আরও অনেক ফ্যাক্টরির কল্পনা ইতিমধ্যেই দানা বেঁধে উঠতে আরম্ভ করেছে। আটাশটা মিল তো বেশ ভালভাবেই এখন চলছে। আমরা হিসেব মতো খুব শিগগিরই আরও আঠারো কুড়িটা মিল বছর দশেকের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। উনিশশো শতাব্দীর মধ্যে পঞ্চাশটা মিল চালু হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।

ওয়ালেসকে যারা ঘিরেছিল, তাদের চোখে খানিকটা বিস্মিত সংশয়। উইলসন বলল, এত? এত কোম্পানি কোথায়?

গজাবে স্যার, নতুন নতুন কোম্পানি গজাবে, যেমন এখন গজাচ্ছে। বর্তমানের এই সব কোম্পানিগুলোর হদিস কোথায় ছিল স্যার? সবই তো রাতারাতি গজাচ্ছে। বরং ভয়ের যেটা, সেটা হল, আমাদের নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন। মাল রপ্তানি করার জন্যে, বিশ্বের বাজারে, আমরা এত বেশি হুড়োহুড়ি করছি যে সকলেই সকলের ঘাড়ে পা দিয়ে ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টায় আছি। সেটা ভাল নয়। আমাদের সব কোম্পানিগুলো মিলিয়ে, একটা কোনও অ্যাসোসিয়েশনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, চেষ্টা একটু-আধটু যে না হয়েছে, তা নয়, কিন্তু আমরা সাকসেসফুল হতে পারিনি। একই মালের আপনি এক দর দিলেন, আমি আর এক রকম দর দিলাম। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। এটা এখন আর জেনারেল ক্লাইভ বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগ নয়। আমরা নিতান্তই ছুটোছুটি করে কেনাবেচা শেষে পালাবার তালে নেই। একটা সাম্রাজ্যের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে আমরা কারবার করছি, আমাদের সবকিছুতেই তাই একটা সুসংহত রূপ দিতে হবে। শান্ত হয়ে, বেশ ভেবেচিন্তে স্থির হয়ে, আমাদের কারবার চালাতে হবে। কেউ তো কেড়ে নিতে আসছে না। সবই তো আমাদের। নিজেদের মধ্যে খালি একটু আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ব্যাস। জুট যে কী বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, আমরা নিজেদের একটা নিয়মে বাঁধতে পারলেই তা বুঝতে পারব। আমি আজ একবার বলেছি, আবার বলছি, জুট বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছে। আমরা বিশ্বজয় করব! তার মধ্যেই সুখ আর ভোগ!

ওয়ালেসের গলার উত্তেজনা উইলসনের রক্তে গিয়ে লাগল। ইতিমধ্যে মদের ক্রিয়াও হানা দিয়েছে মস্তিষ্কে। সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, ইয়েস স্যার, উই উইল কঙ্কার দি ওয়ার্ল্ড। হেইল জুট! জুট!…

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা হাসির প্লাবন ফেনিলোচ্ছল হয়ে ফেটে পড়ল ম্যাকলিস্টারের চারপাশে। উইলসন মনে করল, তার চিৎকার শুনেই হেসে উঠেছে সবাই। কিন্তু ম্যাকলিস্টার তখন গলা তুলে বলছে, আপনারা নিশ্চয় বিশ্বাস করছেন না আমাকে। ভাবছেন, আমি মনগড়া গল্প বলছি আপনাদের। আচ্ছা, একটা কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বজবজ মিল সেভেনটি ফোর-এ স্টার্ট করেছিল, এবং সেই বিখ্যাত সুন্দর ভিলা হনিমুন হল সহই মি. এন্ডু উল জমিটা কিনেছিলেন। চিফ জাস্টিস স্যার বারনেস পিকক-এর ওটা উইক এন্ড বা হলিডে কাটাবার প্রিয় জায়গা ছিল। আশা করি, এ সব ঐতিহাসিক সত্যকে আপনারা অস্বীকার করবেন না।

কে একজন জবাব দিল,, এ সব কোনওটাই আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আপনার সেই লেডি ঘোস্ট অ্যান্ড মিস্টার ঘোস্ট-এর ব্যাপারটা সত্যি বুঝতে পারছি না।

দেন, ইউ ক্যান আস্ক এনিবডি অব দ্যাট লোয়ার রিচেজ। তারা সবাই দেখেছে, ওপারের বাউরিয়া ম্যানসনের ছাদ থেকে, শূন্যের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, ছড়ি ঠকঠকিয়ে, দিব্যি এক সাহাব গঙ্গা পার হয়ে চলে যাচ্ছে হনিমুন হলের দিকে। আর ওদিকে হনিমুন হলের ছাদে এক মেমসাহাব তার জন্যে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিসেস ওয়াইন্ডেভ বলল, নেটিভরা নয়, আপনি নিজেও দেখেছেন বলছিলেন।

ম্যাকলিস্টারের মুখের ভাঁজে ভাঁজে চোরাহাসি। বলল, হ্যাঁ, বলেছি।

মিসেস ওয়াইভে আবার বলল, আর আপনি বলেছিলেন, সেই লেডি অ্যান্ড জেন্টলম্যান ঘোস্ট বজবজের আকাশে চুমো খেত, তার শব্দে বাউরিয়ায় শুয়ে আপনার ঘুম ভেঙে যেত রাত্রে।

-হ্যাঁ, তাও বলেছি।

 –এটা কী করে সম্ভব? ভূতের চুমো বলে কি, নদীর ওপার থেকে এপারে শব্দ শোনা যায়? মিসেস ওয়াইভে যে রীতিমতো সিরিয়াস তা বোঝা যাচ্ছে। বাকি অনেকেরই সংশয়, যদিও হাসি সামলানো দায় হয়ে উঠছিল।

ম্যাকলিস্টার যথেষ্ট গাম্ভীর্য বজায় রেখে ঘাড় নেড়ে বলল, যায়।

–কী করে?

 –দুটি কারণে।

–কী কী?

–এক নম্বর, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে।

 আবার একটা হাসির রোল পড়ল। সেই হাসির মধ্যেই, কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল, আর দুনম্বর?

ম্যাকলিস্টার বলল, আর দু নম্বর হল, স্বপ্নের মধ্যে আমি যে ফাঁকা চুমো খেতাম, আসলে শব্দটা তারই। আমি মনে করতাম, শব্দটা ওপার থেকে আমার কানে আসছে।

ঘরের চার দেওয়াল প্রকম্পিত করে হাসি ফেটে পড়ল। সেই প্রবল হাসি কলরবের মধ্যে ম্যাকলিস্টারের চিৎকার আবার শোনা গেল, বাট ফ্রেন্ডস, মনে রাখবেন, এ সবই কিন্তু এইটিন সেভেনট্টিফোর-এর আগে।

কে একজন বলে উঠল, পরে হলে ক্ষতি কী?

ম্যাকলিস্টার ভয়ার্ত স্বরে বলল, ওরে বাবা, বজবজ মিলের প্রতিষ্ঠাতা মি. এন্ড্রু উল তা হলে আমার নামে মামলা ঠুকে দেবেন।

-কেন?

–বা, তাঁর হনিমুন হলকে আমি ভূতুড়ে বাড়ি বলছি, সেটা কি ঠিক? তারপরে মি. উল যদি ভেবে বসেন, আমি ওঁকেই মি. ঘোস্ট বলতে চাইছি?

তরঙ্গের পর তরঙ্গে হাসি ফেটে পড়তে লাগল।

ওয়ালেস উইলসন ওয়ালিক, সকলেই তখন হাসছে। ওয়ালেস বললেন, সত্যি এই হাসিখুশি জোভাইল লোকটিকে দেখলে বোঝা যায় না, ও একজন সিরিয়স কাজের লোক। আর এটাও সত্যি, লোয়ার রিচেজ-এর নেটিভ অধিবাসীরা বড় বেশি ভূত দেখতে পায়। শুনলে মনে হয়, গোটা অঞ্চলটা ভূতে গিজগিজ করছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পেরেছেন কি?

উইলসন বলল, কী বলুন তো?

–আসল ব্যাপারটা হল, বাউরিয়ার ফোর্ট গ্লাস্টারের সঙ্গে, বজবজের এন্ডু উল অ্যান্ড কোম্পানির বরাবরই ঝগড়া ছিল, এখনও আছে।

–কেন?

–খুবই স্বাভাবিক। এপারে ওপারে দুটো ফ্যাক্টরি, শ্রমিক নিয়ে দুজনেরই টানাটানি। শ্রমিকের সমস্যা তো জুট ইন্ডাস্ট্রি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যান্য প্রদেশ থেকে এখন কিছু লোক আনানো হচ্ছে বটে! তবু এখনও লোকাল লোকেরাই তো ভরসা। স্বভাবতই দুই কোম্পানি লোক নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করে। যদিও কর্তৃপক্ষের মধ্যে কখনও ঝগড়া হয়নি, তবু একবার তো বাউরিয়ার এক ওভারসিয়ারের বিরুদ্ধে বজবজের এক ইঞ্জিনিয়ার মানহানির মামলা করে দিয়েছিল। পেছনে কর্তৃপক্ষের হাত ছিল কি না অবিশ্যি জানি না।

এই সময় হঠাৎ ওয়ালিক চমকিত বিস্ময়ে দেখল, হিলডা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায়। আর কোনও কথা তার কানে গেল না। আর সবাই তার চোখের সামনে হারিয়ে গেল। সে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেল, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে যোসেফ মার্স।

কিন্তু হিলডা যেন ওয়ালিককে দেখেও চিনতে পারল না, এমনিভাবে তার দিকে একবার তাকিয়ে, যোসেফের দিকে চেয়ে হাসল। তাতেই সংবিৎ ফিরে পেল ওয়ালিক, তার পাশে যোসেফ রয়েছে। সে যোসেফের দিকে চোখ ফেরাল। দেখল যোসেফ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ওয়ালিক যেন একটু অস্বস্তিবোধ করল। বলল, মিসেস মার্স এসেছেন।

যোসেফ বলল, হ্যাঁ দেখছি, শেষ পর্যন্ত এসে পড়ল।

ওয়ালিক আবার বলল, মি. উইলসন বলছিলেন, ওঁর মাথা ধরেছে।

যোসেফ বলল, হ্যাঁ। এখন বোধহয় সেরে গেছে।

বলে ঠোঁট কুঁচকে একটু অদ্ভুতভাবে হাসল যোসেফ। এগিয়ে গেল হিলডার দিকে। কাছে গিয়ে, কী যেন বলল। হিলডা হেসে জবাব দিল। পিছনে ফিরে অঙ্গুলি সংকেতে দরজার দিকে দেখাল। সেখানে ইউসুফ দাঁড়িয়েছিল। বোধহয় বলল, সে ইউসুফের সঙ্গে এসেছে।

এই কিছুক্ষণ আগেই, অন্ধকারে যার ওষ্ঠ-পুষ্পে লুব্ধ ভ্রমরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওয়ালিক, যার দুই মৃণাল ভুজের বন্ধনে, বুকের শীর্ষ কলিতে রৌদ্রদগ্ধ ঘর্মাক্ত কপোল লুটিয়ে দিয়েছিল, শোণিতে শোণিতে গুঞ্জন করেছিল, সে এসে দাঁড়িয়েছে উজ্জ্বল আলোর মাঝখানে। দেখেই টের পাচ্ছে ওয়ালিক, তাড়াতাড়ি জামা বদলেছে হিলডা। কাঁধ কাটা, বুকের পরিধি বিস্তৃত, শুনান্তরের সীমায় এসে থমকানন, অকুল নদীর বাঁধের মতো, রক্ত গোলাপ ছাপা সাদা রং-এর জামা পরে এসেছে। হয়তো ওয়ালিক চলে আসার পরমুহূর্তের শূন্যতা বোধেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আসার। তাড়াতাড়ি চুল ব্রাশ করেছে, মুখে পাউডার বুলিয়েছে, ঠোঁটে রং মেখেছে। কোথাও স্থূলতা নেই, বরং একটু কৃশতার দিকেই যেন ওর দেহগড়নের ঝোঁক। তবু দীর্ঘ গ্রীবা মরালীর মতো কী অপূর্ব কটিতলের বঙ্কিম উচ্ছ্রিত ভঙ্গি। সত্যি, যত দিন যাচ্ছে, হিলডা যেন ততই সুন্দরী হচ্ছে। ভালবাসা কি মানুষকে সুন্দর করে সত্যি? গোপন ভালবাসাও?

এই তো একটু আগেই ওয়ালিক বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল ওকে। তবু রক্তধারা এমন উত্তাল হয়ে ওঠে কেন? ব্যাকুলতায় বুক ফেটে যেতে চায় কেন? হিলডা! হিলডা।…

–হিলডা।

মিসেস উইলসন দেখতে পেয়ে, ডাক দিয়ে উঠল। হিলডা এগিয়ে এল। মিসেস উইলসন ওয়ালেসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল হিলডার। বলল, জুটের সব অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনছি আমরা। তোমার মাথাধরা কেমন আছে?

হিল বলল, সেরে গেছে। তাই তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। আমিও শুনতে এলাম।

হিলডা জানত, তার পিছনে রয়েছে যোসেফ। তাই চকিতে সে একবার ওয়ালিকের চোখের দিকে তাকাল। আর ওয়ালিক যদিও জানে, তার দিকে যোসেফ তাকিয়ে রয়েছে, তবু সে স্বাভাবিকভাবেই হিলডার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে যেন হিলডার চোখের দিকে তাকিয়ে শুনতে পেল, প্রিয়তম, তোমার জন্যেই ছুটে এসেছি। আর ওয়ালিক মনে মনে বলল, আমি চিরকৃতজ্ঞ, আমি তোমারই চিরকাঙাল হিলডা!

ওয়ালিক তার গেলাস হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে সরে গেল জানালার দিকে, যেখান থেকে গঙ্গা দেখা যায়। আকাশে চাঁদ নেই। দিগন্তব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে তবু, গঙ্গার স্রোত যেন চিকচিক করে উঠছে। নক্ষত্রের প্রতিবিম্বরাই হয়তো নিরন্তর স্রোতে নিমেষে নিমেষে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে নদী তেমন চওড়া নয়। ওপারের গাছপালার স্পষ্ট কালো ছবি দেখা যাচ্ছে। চৈত্রের দক্ষিণা বাতাসে যেন নারকেল গাছের মাথায় ঝাঁকড়া চুল উড়ছে।

বুকের রক্তধারা নেচে ওঠার পরমুহূর্তেই এই বিষণ্ণতার যেন কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল এই কথা মনে হতে থাকে জর্জের, জীবনটা নিয়তির শিকলে বাঁধা, সে কোথাও প্রাণের ইচ্ছাকে স্বাধীন রাস্তা করে দেয়নি। নিজেকে বড় অভিশপ্ত মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে, সকলের মতো স্বাধীন ভালবাসার পথ কেন আমার জন্যেও খোলা হল না। সংসারের মাঝে যেটা বিপথ বলে পরিচিত, নিষিদ্ধ চিহ্নের দ্বারা যেপথ রুদ্ধ, সেই পথের মুখেই এসে কেন দাঁড়াতে হল। যোসেফ মার্স আমার সহকর্মী। তার সঙ্গে আমার কোনও বিরোধেরই সম্ভাবনা ছিল না। তাকে আমি ঠকাব, তার স্ত্রীর সঙ্গে গোপনে প্রেম করব, এর কোনও কিছুই তো আমার জীবনে পূর্বনির্দিষ্ট ছিল না। যোসেফ আমার সহকর্মী, কিন্তু সে সব দিক দিয়েই আমার জুনিয়ার। তার সঙ্গে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাও বিন্দুমাত্র নেই। আমারই নির্দেশে সে কাজ করে, এবং তাতে তার কোনও ত্রুটি নেই। সহকর্মী বন্ধু হিসাবেও সে লোক খারাপ নয়। এবং হিলডা নিজের মুখেই স্বীকার করেছে, স্বামী হিসাবেও যোসেফ আর দশ জনের মতোই স্বাভাবিক, ত্রুটিহীন। তবু হৃদয়ের পথ এত সর্পিল কেন। সে কোনও যুক্তি তর্ক মানতে চায় না কেন, নিরস্ত হতে চায় না কেন। এখন যেন ক্রমাগতই যোসেফকে বাধাস্বরূপ মনে হচ্ছে। চাইলেই তো হিলডাকে সে দান করবে না। বরং তার সন্দেহ যত নিবিড় হচ্ছে, তার ব্যবহার তত বদলাচ্ছে। এক অপ্রতিরোধ্য শত্রুতার সৃষ্টি হচ্ছে। যে শত্রুতার আগুন ক্রমেই যোসেফের চোখে প্রজ্বলিত হয়ে উঠছে। এর পরিণতি কী? এখন আমি মরতে পারি, কিন্তু হিলডাকে তো আর ছাড়তে পারি না। এখন হিলড়াই জীবন, প্রাণস্বরূপিণী।

সহসা এই মুহূর্তে, দেশের কথা মনে পড়ে গেল ওয়ালিকের। বৃদ্ধ বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। প্রতি ছ মাস অন্তর সে দেশে টাকা পাঠায়। অনিয়মিত সৈনিকবৃত্তি ও পশুপালনের হাত থেকে, বাবা এখন বিশ্রাম নিয়েছে। জর্জের পাঠানো টাকাতেই এখন দুজনের চলে যায়। এবং আশা পোষণ করে, হিন্দুস্তান থেকে অনেক টাকা নিয়ে আসবে জর্জ, স্কটল্যান্ডের কোনও উর্বরাঞ্চলে, একটি ছোট এস্টেট কিনে, সেখানে বসবাস করবে। বুড়ো বুড়ি যদি তখনও বেঁচে থাকে, তবে নাতি নাতনিদের নিয়ে পরমানন্দে কাটবে। কিন্তু জর্জ বিয়ে করবে কবে? চল্লিশ তো হল। আর কবে? একবার কয়েক মাসের ছুটি নিয়ে সে হোমে আসুক না। বিয়ে করে যাক। কয়েকদিন আগেই বাবার চিঠি এসেছে। বড় বড় আঁকাবাঁকা কাঁচা হাতের লেখা, প্রচুর বানান ভুল। কিন্তু ওয়ালিকের তাতে কোনও অসুবিধেই হয় না। বাবার প্রত্যেকটি কথাই সে পড়তে পারে, বুঝতে পারে।

আমেলিয়া (মা) ভাল আছে। তোমার মামা আরবুথনটদের এগারোটি ভেড়া মারা গেছে। আমার হাতের ঘা শুকায় নাই। তোমার মা তোমার বিবাহের কথা প্রায়ই বলে। হিন্দুস্তানেও তো আমাদের দেশের মেয়ে এখন অনেক পাওয়া যায়, একটি সচ্চরিত্রা মেয়েকে সেখানেও তুমি বিবাহ করতে পারো। আশা করি তাতে তোমার খরচের টানাটানি হবে না। আমেলিয়া তোমাকে দেখবার জন্যে বড় ব্যাকুল হয়েছে। পাঁচবছর আগে তুমি একবার আসবার ইচ্ছা জানিয়েছিলে। সেই আসা তোমার আজও হল না। চিঠিপত্র কমিয়েছ। তোমার অনেক কাজ, কোম্পানির তুমি বিশ্বস্ত কর্মচারী, আমি জানি, তবু মন মানে না। তোমার মা বলে, জর্জ আমাদের ভুলে যাবে না তো। আমি বলি, না, জর্জ কাজে ব্যস্ত আছে। তোমার বোনের আর একটি ছেলে হয়েছে, খবর এসেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।…।

বাবা মা দুজনের সেই পুরনো চেহারা মনে পড়ছে। আজ যদি তারা জানতে পারত, জর্জের জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছে, তা হলে নিশ্চয় দুঃখিত হত। বাবা বলত, পরস্ত্রীর দিকে চোখ দেওয়া এ একটা পাপ।আর মা হিলডার সম্পর্কে বলত, ও মাগি নিশ্চয় ডাকিনী, তুমি ওর ছায়াও মাড়াবে না।এ কথা তাদের কোনওদিনই জানানো চলবে না। তবু এমনি একটা সময়ে সেই জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীকে বড় বেশি মনে পড়ছে। এখানে তার আর কে-ই বা আছে, যে তার জন্যে ব্যথিত হবে। হিলডার কথা আলাদা। বাকি সমস্তটাই কাজের সম্পর্ক। একমাত্র নেটিভ মিস্তিরিরা আছে, যারা তাকে সত্যি ভালবাসে। যাদের সে নিজের হাতে তৈরি করেছে। যাদের বাড়িতে সে যায়। যাদের মেয়েরা পর্যন্ত তাকে আর ভয় পায় না, বেড়ার ফাঁক দিয়ে দ্যাখে আর হাসে। গাছ থেকে কলার কাঁদি কেটে দেয়। জিজ্ঞেস করে, সাহেব আপকো বাবা মা হ্যায়? আপকো কেতনা ভাই বহিন হ্যায়? সাহেব, আপকো মেমসাহেব কব হোগা? অর্থাৎ স্ত্রী। কত কথাই যে তারা বলে। তারা তাকে অলিক বলে, সংসারের সুখ দুঃখের কথা বলে। এমনকী পারিবারিক বিবাদের বিচার পর্যন্ত চায়। একটা লোক, যে মুখে গান তৈরি করে গেয়ে বেড়ায়, নেটিভ সিঙ্গার, সে অলিককে নিয়ে গানও বেঁধেছে।

তবু ওয়ালিক তাদের কাছে বিদেশি। শেষ পর্যন্ত কোথায় একটা সীমা আছে, যেখানে গিয়ে সে আটকে যায়, ওরাও থমকে থাকে। ওদের মধ্যেও বন্ধুত্ব বলে বস্তু আছে, বুড়োবুড়িদের প্রাণে অগাধ স্নেহ আছে। তবু সেই পাথররুক্ষ দেশটি, সেই গ্রামটি, সেই ছেলেবেলা থেকে দেখা মানুষেরা, বন্ধুরা নিজের বাবা মা, সে সবই যেন আর কিছু। তার মধ্যে এক ভিন্নতর স্বাদ, ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। তেমনটি কোথাও নেই।

এই মুহূর্তে, যখন একটা আবেগের স্রোত টেনে নিয়ে চলেছে, অথচ প্রতি মুহূর্তের সংশয় যাতনার ধাক্কা লেগে একটি স্তব্ধ বিষণ্ণতায় ভরে তুলছে, তখন হিলডা ছাড়া একমাত্র সেখানকার কথাই বেশি করে মনে আসে। সত্যি, বছর পাঁচেক আগে একবার যাবার মনস্থ করে ফেলেছিল ওয়ালিক। কিন্তু তখন থেকেই হিলডা তার কপাটে কড়া নেড়েছে। দরজা খুলে শুধু হিলডাকেই বরণ করতে পেরেছে, আর দেশে যাওয়া হয়নি। এখন, কে জানে, ভবিষ্যৎ কোথায় টেনে নিয়ে চলেছে, কবে যাওয়া হবে।

একটা স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যেই সে শুনতে পেল উইলসনের উচ্চ গলা, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, এবার চলুন আমরা খাবার টেবিলে যাই।

মিসেস উইলসনই তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, কী হল মি. ওয়ালিক, মাত্রা কি একটু বেশি হয়েছে নাকি?

ওয়ালিক একটু হেসে বলল, সারাদিনই চলেছে তো।

মিসেস উইলসন বলল, সে তত মি. ম্যাকলিস্টারের কাণ্ডকারখানা দেখেই বুঝতে পারছি। ওঃ, লোকটা যে কতরকমই জানে। এখন আসুন, খাবেন চলুন।

–চলুন।

 ওয়ালিক এগিয়ে গেল। ম্যানেজার বাংলোর ডাইনিং হলটিও রাজকীয়। বিরাট লম্বা ঘর, সকলেরই বসবার জায়গা হয়েছে। পরিবেশিত হয়েছে প্রচুর ভোজ্যবস্তু। ওয়ালিককে দেখে, ওয়ালেস হাত তুললেন। কাছে যেতে ইশারা করলেন। কাছে যাবার পর, পাশের চেয়ারে বসতে অনুরোধ করলেন। বসতে গিয়ে ওয়ালিকের ভিতরে ভিতরে যেন একটি দৃষ্টির অনুভূতি স্পর্শ করছিল। নিশ্চয় হিলডা কোথাও থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ওয়ালেসকে ধন্যবাদ দিয়ে, চোখ তুলে খুঁজল হিলডাকে। কোথায় হিলডা! দূর থেকে দৃষ্টি কাছে সরিয়ে আনতেই, তার সঙ্গে চোখাচোখি হল যোসেফের। যোসেফ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ঠোঁটের কোণে সেই শ্লেষ মাখানো অদ্ভুত হাসি। এই হাসির মধ্যে যেন কোথায় একটা ভিতরের যন্ত্রণাকে ক্রোধে পরিণত করে তোলবার উৎস রয়েছে। চকিতে একবার ওয়ালিকের বুকে ক্রোধ জ্বলে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু মুহূর্তে সে নিজেকে শান্ত করল। নিতান্ত শুষ্ক হাসিতে একবার ঠোঁট কোঁচকাল। আর হিলডাকে দেখবার জন্য অন্যদিকে চোখ ফেরাল। এবং শেষ পর্যন্ত, মিসেস ওয়াইন্ডেভের বিশাল শরীরের ছায়ান্ধকার পাশে, হিলডার চোখ দুটি দেখতে পেল সে। ওর দুই আবেগমথিত চোখে একটি ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। হয়তো জানতে চায়, জর্জের মুখে এমন বিষণ্ণ অন্যমনস্কতা কেন।

উইলসন বলে উঠল, আমরা শেষ মুহূর্তে, আমাদের দুই অতিথির কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই। মি. ওয়ালেস, প্লিজ!

ওয়ালেসকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখন পানক্লান্ত, কিছু বলবার মতো অবস্থা নয়। তবু হাসতে হাসতে উঠে বললেন, আমার শেষ কথা হল, জুট ইজ লাভলি, জুট ইজ হ্যাপিনেস, লং লিভ জুট, জুট!…

বলে ওয়ালেস বসে পড়লেন। সবাই হাততালি দিল। উইলসন বলল, নাউ মি. ম্যাকলিস্টার, প্লিজ!

ম্যাকলিস্টার উঠে দাঁড়াল। একবার কাশল, তাতেই অনেকের রুদ্ধ হাসি ফেটে পড়বার উপক্রম করল। কারণ ইতিমধ্যেই সে এখানে নিজেকে সেইভাবেই প্রতিষ্ঠা করেছে।

ম্যাকলিস্টার বলল, আমি সবই মানি, জুট এক আশ্চর্য ভবিষ্যৎ নিয়ে এসেছে, এবং প্রাণ খুলে এখন আমরা কারখানাও খুলে যাব। কিন্তু বন্ধুগণ, তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক জটিলতাও বাড়ছে। কতকগুলি নোংরা ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করেছে। ডান্ডি পেছনে লেগেও যে ক্ষতি ইন্ডিয়ান ম্যানুফাকচারারদের করতে পারবে না, তার চেয়েও বড় বিপদের মেঘ আমি দেখতে পাচ্ছি। অবিশ্যি পৃথিবীতে সব বিপদই কাটানো যায়, আমরাও নিশ্চয় কাটাব, কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকার কোনও মানে হয় না। যদিও জুট ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা এখনও তার করাল ছায়া দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে মাপ করবেন, আপনাদের খাবার সময় এই কথা বলার জন্যে।

ম্যাকলিস্টার চুপ করল। সকলের মুখেই সংশয়। কী বলতে চায় লোকটা। নিশ্চয় নতুন লাফিং গ্যাস ফাটাবে।

উইলসন জিজ্ঞেস করল, কোন মেঘের কথা বলছেন আপনি স্যার?

ম্যাকলিস্টার বলল, এইটিন সেভেনটি সেভেন, কুইন ভিক্টোরিয়া যে বছর ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন, সেই বছরেই দুর্যোগের প্রথম লক্ষণ আমি দেখতে পেয়েছি, এবং এ দেশে, অর্থাৎ ইন্ডিয়াতে এ ধরনের দুর্যোগ সেই প্রথম, যার নাম স্ট্রাইক। নেটিভরা বলে হরতাল। নাগপুরের প্রথম ওয়ার্কার্স স্ট্রাইকের কথা আপনারা নিশ্চয়ই কাগজে পড়েছেন। এবং এই বছরেই, এইটিন এইট্টিথ্রি-তে, ইতিমধ্যেই বম্বে আর মাদ্রাজ মিলিয়ে বার সাত আটেক শ্রমিকদের স্ট্রাইক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা র‍্যাপিডলি বাড়ছে।…আর এই যে একটা নেটিভ, কী নাম যেন–এস. এন ব্যানার্জি, এই লোকটা যে ভাবে অল ইন্ডিয়া ঘুরে ঘুরে অ্যাজিটেট করছে, অ্যান্ড আই ডোন্ট নো হু ইজ দ্যাট ব্লাডি ভোলানাথ চন্দর। মুখার্জিস ম্যাগাজিনের লেখক, যে বলছে, ইন্ডিয়ানরা সমস্ত ব্রিটিশমাল বয়কট করুক–এই সমস্ত ব্যাপারগুলো দেখে, আমার মনে হচ্ছে, সোনালি পাটের ভাঁজে ভাঁজে কোনও সময় এই সব বিষাক্ত পোকারা জড়িয়ে পড়তে পারে। স্পেশালি ওয়ার্কার্স স্ট্রাইক ইন নাগপুর বম্বে অ্যান্ড মাদ্রাজ, খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় বলে আমার মনে হয়। সেইজন্যে আমি বলব, আমরা নতুন কারখানা নিশ্চয় খুলব, এবং দীর্ঘদিন চালিয়ে যাবার জন্যে এ সব ব্যাপারে আমাদের অবহিত থাকতে হবে। অ্যান্ড দেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, লং লিভ আওয়ার জুট!…

ম্যাকলিস্টার বসে পড়ল। কেউই ঠিক হাসল না। বেখাপ্পাভাবে একটু-আধটু হাততালিও পড়ল। অধিকাংশ স্কচরাই ব্যাপারটার গুরুত্ব তেমন বুঝেছে বলে মনে হল না। এ সব খবর ঠিক কেউ বোধহয় রাখে না। একমাত্র ওয়ালেসের দু চোখে বিস্মিত প্রশংসা। তিনি ফিসফিস করে ওয়ালিককে বললেন, দিস ইজ রিচার্ড ম্যাকলিস্টার! আশ্চর্য, লোকটার চোখ সবদিকে আছে। রিয়ালি এ জিনিয়াস! লোকটি ঠিক জায়গায় আঙুল দেখিয়েছে। অথচ বেচারা নিজে কিছুতেই সুবিধে করতে পারছে না।

ওয়ালিককে যেন ম্যাকলিস্টার উৎসাহিত করতে পারেনি। সে তার আচ্ছন্নতার বাইরে আসতে পারেনি এখনও। মিসেস ওয়াইল্ডেভের পাশে আবার চোখ তুলে তাকাল সে।

.

ওয়াল্টারকে জগদ্দলে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিল ওয়ালিক। এটা একটু বেশি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে সে। রাত্রি অনেক হয়েছে। কোথাও বিন্দুমাত্র আলো নেই। গারুলিয়া থেকে আসবার সময়েই কেউ কেউ আপত্তি করেছিল। দু-একজন সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। নিদেন কোনও চেনা নেটিভ কোচোয়ান। এমনকী ওয়াল্টার গারুলিয়াতে থাকতেও রাজি হয়েছিল। যদিও তার দুশ্চিন্তা ছিল, ঠিক ভোরবেলা ফার্ডিনান্ড কারখানা চালাতে পারবে কি না। কিন্তু ওয়ালিক দমেনি। সে শুধু বাংলো থেকে তার পিস্তলটা নিয়ে এসেছিল। ওয়াল্টারকে তুলে বগি চালিয়ে দিয়েছিল।

ওয়াল্টারকে পৌঁছে দিয়ে, গাড়ি থেকে নামেনি ওয়ালিক। বিদায় নিয়ে, লাগাম টেনে আবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে চলেছে। বগির ডান দিকে একটি মাত্র টিমটিমে আলো আছে। সেই আলোয় কয়েক হাত দূরের জিনিসও কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু সর্বচরাচরের এই গভীর অন্ধকারের মধ্যেও, অস্পষ্টভাবে যেন সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। চারপাশে এত বড় বড় গাছের ভিড় না থাকলে, রাস্তাটা হয়তো পরিষ্কারই দেখা যেত। ঘোড়াটার বিপথে যাবার সম্ভাবনা কম। কারণ মোটামুটি এ রাস্তা ওর চেনা। অনেকবারই যাতায়াত করেছে। ওয়ালিকের বিশ্বাস, গারুলিয়া থেকে জগদ্দল পর্যন্ত সব নেটিভদেরই সে চেনে। যদিও নাম জানে না। একটু বেশি মেলামেশার দরুনই, এত রাত্রে একলা যেতে তার কোনও ভয় হয়নি। ভেবেছে, ভয়ের আছেই বা কী। একমাত্র ডাকাতেরাই লুণ্ঠন করতে আসতে পারে। কিন্তু কী লুণ্ঠন করবে ওয়ালিকের? কী আছে তার সঙ্গে?… তা ছাড়া, ওয়ালিকের আজ ঘরে ফিরে যেতে মন নেই। সারাদিন সে অনেক ঘুরেছে, প্রচুর মদ্যপান করেছে, সবই ঠিক। তবু তার সমস্ত স্নায়ু যেন উদ্যত ছুরির ফলার মতো শাণিত হয়ে রয়েছে। দেহে একটা ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছে, কিন্তু ভিতরটা যেন জ্বলছে, থরথর করছে। চোখ বোজবার কোনও লক্ষণ নেই। নিদ্রার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই চোখের পাতায়।

এই মধ্য রাত্রি অতিক্রান্ত অন্ধকারের নিদ্রিত নিরালায়, সমুদ্রের হাওয়া মাতাল হয়ে উঠেছে। গাছে গাছে শন শন্ শব্দ, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে লুটোপুটি করছে। জোনাকিগুলি হাওয়ার ঝাপটা সহ্য করতে পারছে না। এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ছে। আর অদ্ভুত একটা গন্ধ বাতাসে। মিষ্টি মদির গন্ধ কখনও তীব্র, কখনও হালকা মনে হচ্ছে। ওয়ালিক জানে, একরকম ফুলের গন্ধ। মার্চ এপ্রিল মে জুন, সমস্ত মাসগুলি ধরেই, এ দেশে সারারাত্রি ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। আগে বুঝতে পারত না, এখন সে বুঝতে পারে, এবং সে ভালও বাসে। এখানে সবকিছুতেই গন্ধ, ফুল ফলে লতায় পাতায়। এদেশে ফুলের বাহার নেই, গন্ধই আছে। যে ফুলে গন্ধ নেই, সে ফুলকে এদেশের লোকেরা ফুল বলে মানতে চায় না। এরা দর্শনেই তৃপ্ত নয়, ভিতরের অনুভূতি চায়। নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে, গভীরে।

কিন্তু জ্বালালে কুকুরগুলি। প্রায় দল বেঁধে, চিৎকার করতে করতে, সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। আসবার সময়েও সারাটা পথ কান ঝালাপালা করেছে। এখনও করছে। মাঝে মাঝে, একটু বিরতি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অন্ধকারের ভিতর থেকে ছুটে আসছে। বোঝা যাচ্ছে, গৃহস্থদের বাড়ির কাছাকাছিই ওদের হামলাটা বেশি হচ্ছে। নিজের সীমানাটা পেরিয়ে গেলেই চুপ করে যাচ্ছে। কিন্তু ঘোড়াটা স্বস্তি পাচ্ছে না। অন্ধকারে এমনিতেই ওর গতি মন্থর। তার উপরে ক্ষিপ্ত কুকুরের পাল দেখে মাঝে মাঝে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছে। যদিও কুকুরগুলির কামড়াবার মতলব নেই মোটেই। রাত্রি বলেই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে।

সহসা একটা ঝোপের কাছ থেকে, একটি টিমটিমে আলো বেরিয়ে এল রাস্তার ধারে। ময়লা চিমনি ঢাকা আলোটা, বাতাসের ঘায়ে মুহূর্তে মুহূর্তে যে মূৰ্ছা যাচ্ছে। সেই আলোয় অন্ধকার কিছুমাত্র দূর হয়নি। বরং একটা অস্পষ্ট অলৌকিকতাই যেন সৃষ্টি করেছে। সেই কুহকী আলোয় একটি অস্পষ্ট কালো মূর্তিও ভেসে উঠল। বিশাল চেহারার পুরুষমূর্তি, খালি গা। প্রায় কাছাকাছি এসে ওয়ালিক হাঁক দিল, কৌন হ্যায়?

জবাব পাওয়া গেল না।

আবার জিজ্ঞেস করল ওয়ালিক, তুম কৌন হ্যায়?

এবার জবাব এল, আদমি।

লাগামে টান দিয়ে বগি দাঁড় করাল ওয়ালিক। বলল, আদমি তো সবকোই হ্যায়। তুম এতনা রাত মে, বাহার মে ক্যায়া করতা?

পালটা প্রশ্ন এল, তুম ক্যায়া করতা সাব?

ওয়ালিকের ভ্রু কুঁচকে উঠল। সে তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। না, লোকটার আক্রমণের কোনও উদ্যোগ নেই। কিন্তু কে? একটু যেন চেনা চেনা লাগছে। সে বলল, হম ঘর যাতা, শ্যামনগর। হম অলিক।

জবাব এল, হম এ গাঁওকে আদমি, আপনা কাম মে যাতা।

সেই মুহূর্তেই ওয়ালিক লখাইকে চিনতে পারল। এই সেই অদ্ভুত চরিত্রের বদরাগি লোকটা। সেই বারো বছর আগে, যাকে প্রথম দেখেছিল সে একটা হিন্দু মন্দির গৃহের চত্বরে। জুতো পায়ে দিয়ে সেখানে ঢুকেছিল বলে, লোকটা বুনো শুয়োরের মতো ওয়ালিককে তেড়ে এসেছিল। লোকটার নাম লখাই, সে জানে। আরও অনেকবার একে দেখেছে সে। এ লোকটা এক ধরনের ইনসেন। নেটিভদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে জেনেছে, এ এক রকমের কিংবদন্তির মানুষ। লোকটির নাকি মৃত্যু হয়েছিল, দেবীর দয়ায় আবার বেঁচে উঠেছে, নেটিভদের এই রকম বিশ্বাস। স্বভাবতই একে ঘিরে নানান সংস্কারের সৃষ্টি হয়েছে, সবাই একে ভিন্ন চোখে দেখে। তবে সচরাচর এরকম দীর্ঘ বলশালী দেহ এ অঞ্চলে বিশেষ চোখে পড়ে না। লোকটাকে কারখানার কাজে লাগানো যেত। কিন্তু রাজি নয়।

ওয়ালিক অনুভব করে, লখাই তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সে ডান দিকের লাগামে ঈষৎ টান দিয়ে, একটু সরে গিয়ে, এগিয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখল, সেই মুহূর্তেও লোকটা দাঁড়িয়ে দেখছিল। এবার উত্তর দিকে ফিরে চলতে আরম্ভ করল।

ওয়ালিক মনে মনে বলল, পাগল।

পরমুহূর্তেই শ্লেষ বিষঃ হেসে মনে মনে বলল, পাগল। পাগল কে নয় হে জর্জ ওয়ালিক! আমি নই? কার মনের কোথায় কী গোলযোগ আছে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি। আমরা নিজেদের সম্পর্কে বা কতটুকু অবহিত আছি। আজ সারাটাদিন যেভাবে কেটেছে, সেটাও তো এখন পাগলামি বলেই মনে হচ্ছে। যাদের সঙ্গে কেটেছে, সকলের মধ্যেই এক এক ধরনের পাগলামি ছিল। সম্ভবত এই সব পাগলামির বেগেই মানুষ চলেছে।…কিন্তু কোথায়, কোথায় চলেছে সব!

শনশন শব্দে গাছপালাগুলি মাতালের মত টলছে। বাতাসে ঝড়ের বেগ। দীর্ঘদিন বৃষ্টির অভাবে ধুলো জমেছে। ধুলো উড়ছে, চোখে এসে ছিটকে লাগছে। শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে চাকার তলায়। ডান দিকে আতপুরের রাজবাড়ির ইমারত। দু-একটি স্তিমিত আলো দেখা যায় মাত্র। অনিয়মিত তালে, মাঝে মাঝে সরু শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠছে। রাজাদের হাতির গলায় ঘন্টা বাজছে, জানে ওয়ালিক। হয়তো বাতাসেই দুলছে ঘণ্টা, কিংবা দেহের নানান অঙ্গে পোকামাকড় তাড়াবার জন্যে শুড় দোলাচ্ছে, তাই ঘণ্টা বেজে উঠছে।

কিন্তু ওয়ালিকের ভিতর থেকে সহসা একটি দীর্ঘশ্বাস উঠল। সে অস্ফুটে ডেকে উঠল, হিলডা, হিল, এই ঘোর একাকিত্ব আর সহ্য করতে পারি না।

ওয়ালিক লাগাম হাতে নিয়ে, আসনের উপর এলিয়ে পড়ল। দূর থেকে চৌকিদারের চিৎকার ভেসে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *