৪. বাউড়িয়া ছাড়িয়ে

২৬.

প্রায় জাহাজের বেগে বাউড়িয়া ছাড়িয়ে এসেছে নৌকা। লাল মালা পালের কানদড়ি কষে টান দিল আরও। নৌকা কাত হয়ে পড়ল। ছলাৎ করে জলে ভেসে গেল সামনের পাটাতন। গলুইয়ের মুখ ঘুরল পুব-দক্ষিণ কোণে। মার খাওয়া বুনো শুয়োরের মতো নৌকা বেগে ছুটল। ডাইনে রইল চেঙ্গাইল। ওপারে বজবজ। মাঝ দরিয়ায় পৌঁছুতেই, পশ্চিমে উলুবেড়ের নৌকার ভিড় দেখা গেল অস্পষ্ট।

ক্রমে প্রশস্ত হয়ে উঠেছে গঙ্গার কোল। জলেরও মাতন বাড়ছে। ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠছে ক্রমে। পশ্চিম উত্তর কোণের শীতার্ত ধাবিত হাওয়া এখানে আচমকা এলোমলো হয়ে উঠছে। একদিন পরেই মকর সংক্রান্তি, আর এক মাস বাদেই এই হাওয়া বিপরীত মুখে উদ্দাম হয়ে উঠবে।

ক্রমে দূরে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে হাওড়ার তটভূমি। দামোদরের সঙ্গমস্থল পর্যন্ত নজরে এড়ায় না। এদিকে নৌকা পুব ঘেঁষে বজবজ ছাড়িয়েও ফলতার সীমানায় এসেছে। কিন্তু রূপনারায়ণের মোহনা আর দৃষ্টিগোচর হয় না। গঙ্গা যেন দুটি দ্বীপকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, দু হাত বাড়িয়ে নিরন্তর টানে ছুটে চলেছে সমুদ্রের বুকে। পশ্চিমে বাঁক নিয়ে মেদিনীপুরের তটরেখা উধাও হয়ে যাচ্ছে। রূপনারায়ণের মোহনা সমুদ্রের মতো বিশাল হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ পশ্চিমে জল আর আকাশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।

এই ভাটার টানই শেষ টান। সাগরে না পৌঁছতে পারলেও কাকদ্বীপের সীমানায় পৌঁছুনো চাই। টেনে চলল। হাওড়া থেকে চব্বিশ পরগনার কূলে এসে, সাগরযাত্রী নৌকার ভিড় পাওয়া গেল। কাছে কাছে দূরে দূরে আরও অনেক যাত্রীবাহী চলেছে। থেকে থেকে যাত্রী ও যাত্রিণীদের জয়ধ্বনি উঠছে মহামহিমময়ী গঙ্গার নামে। মাঝি সামলে! সামনে সেই অপার মহাবিস্ময়ের ও ভয়ংকরের স্তিমিত গর্জনধ্বনি ভেসে আসছে কি? না, এখনও দূরে। জীবন মৃত্যুর সংগ্রামে মাঝির সর্বাঙ্গের পেশি এখনও সাপের মতো নাচতে শুরু করেনি। তবু, যাত্রীদের বুকের মধ্যে গুরুগুরু ধ্বনি ওঠে। অনিশ্চিত জীবন, বাঁচা মরার সংশয়! সামনে যে রহস্যঘন লীলাময়ের এক বিচিত্র রূপ।

দেখতে দেখতে সূর্য গেল অস্তাচলে। অন্ধকার নেমে এল।

 এত যাত্রীবাহী নৌকা। ফরাসডাঙার কেতু মাঝির নৌকা নেই? চাঁদ উঠেছে আকাশে। পুবের কোলে চাঁদ, পশ্চিমের জলের ঢেউয়ে অস্পষ্ট হাসির ইশারা। কোথায় কেতুর নৌকা, কতদূর গেছে অধরা রাক্ষুসি মোহকে নিয়ে। মোহ! কোন নৌকার অন্ধকার ছইয়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে আছে সে। একটু কি তার সাড়া পাওয়া যায় না। একটু কান্নার রেশ, কিংবা তার মোহিনী হাসির লহর! আঃ, হাসি মুখের কাঙাল মধু, কিন্তু মোহ কেমন করে হাসবে। বুকে তার কান্না। কাঁদছে সে লুকিয়ে নিঃশব্দে।

মধু তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে প্রতিটি নৌকা। মাঝির মুখ চেনা যায় না। আর এত নৌকা। নৌকার বহর চলেছে। মধু শুনতে পাচ্ছে লাল মালা ও মামুদকে সাবধান করছে মনোহর বেদে। খবরদার এ রাত্রে কিছু করা হবে না। আগামীকালও নয়। সংক্রান্তি মিটুক। স্নানযাত্রার শেষ হোক। কারবারি ব্যাপারিরা মেলা ছেড়ে ঘরমুখো হোক। তখন সুন্দরবনের কোলে, ঝপাঝপ কাজ মিটিয়ে, মাতলার ভিতর দিয়ে ঘুরে একেবারে এক ধাক্কায় খুলনা যশোর চক্র দিয়ে আসতে হবে। তার আগে মধুকে নিরাপদ এলাকায় অথবা নৌকায় পৌঁছে দিতে হবে।

সামনে ডায়মন্ডহারবার। মুক্তা পোতাশ্রয়। দূর থেকেই হারবারের আলো চোখে পড়ে। ডায়মন্ডহারবার নয়, গ্রামের নাম হাজিপুর। পুরনো লোকেরা এখনও তাই বলে। নতুন লোকেরা বুঝতে পারে না। তাই নতুনদের দাবিতে, হাজিপুর নাম চির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। কাছাকাছি হতে টের পাওয়া গেল, সমুদ্রগামী জাহাজ নোঙর করে রয়েছে। ছোট স্টিমার লঞ্চও রয়েছে কয়েকখানি কলকাতা বন্দরে ঢোকবার আর সমুদ্রে যাবার আগে মুক্তা পোতাশ্রয়ে আশ্রয় নিতে হয় সবাইকে। মেরামতি কারখানা, গুদাম ঘর আর সাহেব কুঠি নিয়ে ডায়মন্ডহারবার। শুধু কি কুঠি! বাগান, জুড়িগাড়ি, নারী, সুরা আর শেষ শয়ান কবরখানা, সব মিলিয়ে জমজমাট মুক্তা পোতাশ্রয়।

কিন্তু সাগরযাত্রীরা কেউ থামে না। এই ভাটার টানের একটি মুহূর্তও নষ্ট করা চলবে না। ডায়মন্ডহারবার দেখবার সাধ যাদের, তারা ফেরার পথে দেখবে। মধু ভাবল, এখানে একবার হাঁকলে কি কেতু মাঝির সাড়া পাওয়া যাবে। কেতুও বড় কম মাঝি নয়। সে কি এখানে আছে? কিন্তু লাল মালার কাছে কিছুই নয়। তারা তো দ্বিগুণ পথ এসেছে।

সে হঠাৎ চিৎকার করে হাঁক দিয়ে উঠল, হোই ফরেসডাঙার কেতু মাঝি হে-এ-এ?

উত্তরিয়া বাতাসে বহু দূর দূরান্তে ভেসে গেল সে ডাক। লাল মালা বলল, ডাকলে কি সাড়া পাবে? আরও পালাবে।

কথাটা ঠিক। মধু নিরস্ত হল। কিন্তু অদূরে একটা নৌকার মাঝি বলে উঠল, ফরেসডাঙার কেতু মাঝিকে ডাকছ?

হ্যাঁ।

আগে আছে।

 কত আগে?

 বেশি লয়। যে তালে যাচ্ছ, সে তালে এগুলে আধ ক্রোশের মধ্যেই পাবে।

আধ ক্রোশ! লাল মালা আরও চাপ দিল। তারপর সহসা তার নৌকা অন্য নৌকার কোল থেকে বোঁ করে পাক খেয়ে আর এক নৌকার পাশে, বারেবারে এঁকেবেঁকে চলল। বারবার এরকম এক নৌকার কোল থেকে আর এক নৌকার কোলে যেতে দেখে অন্যান্য মাঝিরা শঙ্কিত হয়ে হেঁকে উঠল, এ কেমন আনাড়ি মাঝি, লাও ইদিক উদিক করছে। ধাক্কা লাগবে যে!

ধাক্কা লাগবে লাল মালার সঙ্গে? আসলে লাল মালা ইচ্ছে করেই এর ওর কাছ ঘেঁষে কেটে বেরিয়ে চলেছে। মধুর লক্ষ করার সুবিধা হচ্ছে সব নৌকাগুলি। সব নৌকাতেই প্রায় অল্প ও বেশি মেয়েদের ভিড়। পুরুষেরা বেশির ভাগই বৃদ্ধ, ঘাটে পা বাড়ানোর দল। মেয়েদের মধ্যে বেশির ভাগই বিধবা। যুবতী প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা, সব রকমই আছে। শিশু, বালকের কচি গলাও শোনা যাচ্ছে। নারায়ণ খুড়োদের নৌকাও নিশ্চয়ই পিছনে পড়ে গেছে। কিন্তু কেতু? কেতু কত দূর?

হঠাৎ তার নজরে পড়ল কাছেই একটা নৌকার সামনের পাটাতনের উপর হারিকেন নিয়ে বিষ্টু বসে রয়েছে। বিষ্টু, দুলেপাড়ার বেষ্টা। বেষ্টা-ই তো! হাল মাঝির দিকে চোখ পড়তেই চকিত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মধুর নজর। কেতু না! হ্যাঁ, কেতুই তো! আরও দুজন বসে আছে বাইরে। একজন মেয়েমানুষ, অপরটি পুরুষ। মেয়েমানুষটি কে? অধরা নয়। তবে? আর পুরুষটি বাবু ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। তাই তো, এ কাদের নৌকা? অধরা আর মোহ কোথায়? মেয়েমানুষটি মুখ ফেরাল। মধু চমকে উঠল। ঠোঁট দুটি বিদ্রুপে বেঁকে উঠল তার। নিঃশব্দে হেসে উঠল। ফরাসডাঙার মাতঙ্গিনী বৃদ্ধা বেশ্যা তপস্বিনী। অধরার ফটিকজল। অর্থাৎ সই। আর বাবুটি? আরও হাসি পেল মধুর। তিক্ত নিষ্ঠুর হাসি। জগু, তেসুতি কলের জগা মিস্তিরি। শয়তান বাবু সেজেছে। বোধহয় ফরাসডাঙা থেকে ভাড়া করেই বাবুদের মতো চায়না কোট পরেছে। গায়ে, গলায় উড়নি চাপিয়েছে। ইঞ্চি চওড়া পাড়ের দেশি ধুতি। হারিকেনের সামনেই কোচা লুটিয়ে পড়েছে। চাঁদের আলোতেও বোঝা গেল মাথায় জবজবে করে তেল মেখেছে ভর সন্ধেয়। ফুলল তেল নাকি? হুঁ, অনেকদিন থেকে নজর ছিল মোহর ওপর। এতদিন সুবিধে করতে পারেনি। এবার অধরার টোপ গিলেছে। মোহর মৌতাত লেগেছে মনে, তাই সন্ধ্যাবেলা নৌকা বিলাসের সাজ পরা হয়েছে। সাগর যাত্রার নামে ধর্মকর্ম সবই হবে। মনে পড়ল, জগু কারখানায় তাকে হিংসা করে, পাগলা সায়েবের খাতির দেখে। সেই মধু যম তার কাছে রয়েছে, তা ওর ঠাহর হচ্ছে না। কিন্তু মোহ কোথায়? আর অধরা? সায়েব বাবুদের মতে, বিবি আর কুটনির নৌকা আলাদা করেছে। নাকি জগা। নাকি, ছইয়ের মধ্যেই আছে?

মধু ইশারা করল লাল মালাকে। গতি মন্থর হল নৌকার। তারপর মধু ভিতরে গিয়ে বলল মনোহর বেদকে, খুড়ো, তোমার পায়ের ধুলো দেও, কেতুর লৌকো পেয়েচি। সঙ্গে জগুও আছে, আর আছে ফরেসডাঙ্গার মাতঙ্গিনী।

মামুদ জিজ্ঞেস করল, জগার অবস্থা কেমন?

অবস্থা ভাল। কারখানার কাঁচা পয়সা। ওর বাপকে লোক বলত ফকড়ে কড়ি। কিন্তু জগু অনেক জমি জিরেত করেছে।

তা হলে অনেক মাল নে বেইরেচে বলো?

কে, জগা? শালা পিঁপড়ের পোঁদ টিপে খায়। হয়তো খাবার-দব্যি ছাড়া কিছুই আনেনি।

মেয়েমানুষ ফোঁসলাতে বেরিয়েছে। তা কি আর খালি হাতে হয়?

এক সেই মরণ ধরায় যদি ব্যাটা টাকা এনে থাকে।

মধু বিদায় চাইল! তারা তিনজনেই মধুকে বিদায় দিল। মনোহর বলে দিল, কাকপক্ষীকে বোলো না আমাদের কথা। তোমার বন্ধু গোলামকেও নয়, মোহকেও নয়। তারপর হঠাৎ মধুর হাতটি ধরে বলল, তোর লখাই খুড়োকে বলিস, আমি বলিছি এ জীবনে কবে দেখা হবে, জানিনে। তার কথা আমার প্রাণে প্রাণে থাকে। সে বড় সজ্জন, অনেক বড় মানুষ। তাকে কেউ চিনল না।

মধু বুঝল, লখাই খুডোর সঙ্গেও মনোহরের জানাজানি আছে। যাবার আগে লাল পিঠ চাপড়াল। মামুদ বুকে ধরে জাপটাজাপটি করল। তারপর নৌকার পিছন দিক গিয়ে মধু ডাকল, কেতুদাদা, লাও কাছে আনন।

পাঁচ-ছ হাত দূরেই কেতু। বজ্রাঘাতের মতো চমকে উঠে বলল, কে, মধু?

হ্যাঁ, নেবে না তোমার লৌকায়। তোমার লৌকার জন্যই এইচি।

এক মুহূর্ত চুপচাপ। কেতু মধুকে চেনে, তাকে ফিরেও যেতে হবে। এপার ওপার, মধুর সঙ্গে প্রায় দু বেলা দেখা। আর মধু তো তার ক্ষতি করেনি। বলল, লোব। লোব না কেন? এলে কী করে?

সে অনেক কথা। আর কে আছে?

 মাতঙ্গিনী, ভুতো, বিষ্টু।

তা জানে মধু। তবু বলল, তবে দেখচি সবই চেনাশোনা কাছের মানুষ গো।

কেতু নৌকা ভেড়াল লাল মালার নৌকার গায়ে। চেনবার চেষ্টা করল মাঝিদের। পারল না। মধু কেতুর নৌকায় উঠতেই, মুহূর্তে লাল মালার নৌকা এবার বোম্বেটে চালে পানসির মতো তীব্রগতিতে বেরিয়ে গেল।

জগু দাঁতে হেসে হেঁ হেঁ করে উঠল। মদু এইচিস, ভাল করেছিস। পাগলা সায়েব যে পাগল হয়েছে বাবা তোর জন্যে।

মধু সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে বিষ্টুকে বলল, যেন চিনতে পারছিসনে? বিষ্টু অবাক হল। সে মধুর একজন শাগরেদ। বলল, সত্যি, তুই?

মাতঙ্গিনী বলল, বোস বাবা, বোস।

কিন্তু বিষ্টুর হঠাৎ খুশি ছাড়া সমস্ত নৌকাটা যেন ডাকাতের হাতে পড়ে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বলল, তোমার ফটিকজল কোথায় মাসি?

অই যে, ভেতরে। বউ নিয়ে, শুয়ে আছে। যা শীত, কেউটের ছোবল। ঢেউয়ের ভয়ে বাইরে বসে আছি।

মধু ছইয়ের সামনের আগলটা খুলে ফেলল। ভিতরে লম্ফর ঊর্ধ্বমুখী সটান শিখা হঠাৎ হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেল। মোহ মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সে বোধহয় কিছুই শুনতে পায়নি। হাতের সামনে শাড়ি আলতা চিরুনি নিয়ে বসে আছে অধরা। স্তিমিত চোখে ভোলা আঙুলের দিকে চেয়ে উৎকর্ণ হয়ে বসেছিল।

মধু ডাকল, কী গ অধরা মাসি, কী করছ?

অধরার হাত কেঁপে গিয়ে উলটে গেল খোলা আলতার শিশি। সে কান পেতেই ছিল। নৌকা থামা, লোক ওঠা টের পেয়েছে। যেটুকু তার দেখার বাকি ছিল, সেটুকু দেখেই ভয়ে যন্ত্রণায় তার গলা দিয়ে গোঙানি উঠে গেল। কাঁপতে লাগল সারা শরীর থরথর করে।

আর বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শয্যা থেকে অর্ধেক উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল মোহ। তার এলো চুল। কান্নায় ফোলা লাল চোখ। গালে চোখের জলের দাগ। সারা মুখে উদ্বেগ, ভয়, রক্তশূন্যতা, তবু ঠোঁটের কোণে ফুরিত ঘৃণা। মধুকে দেখে অসহ্য বিস্ময়ে সে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। পরমুহূর্তেই মুখ চেপে কেঁদে উঠল হু হু করে। প্রাণ ভরে, জীবনের সব কান্না একদিনে কাঁদবার জন্য যেন মুখ চেপে ফুলে ফুলে উঠল সে।

অধরা তখনও গোঙাচ্ছে। তার সামনে ফণা তোলা কালসাপ এসে দাঁড়িয়েছে যেন।

কালসাপ তখন ওখান থেকেই মুখ টিপে হেসে বলল, কেতুদাদা, তামাক খাব।

 কেতু বলল, এসো ভাই।

বিষ্টু বলে উঠল, দাঁড়াও আমি সাজি।

সামনের দাঁড়ি চারজন। একজন বলল, সেই ভাল।

 জগা, মাতঙ্গিনী ভীত বিস্ময়ে বিমূঢ়। কুয়াশাচ্ছন্ন চাঁদের আলোর মতো, ওই দুর দক্ষিণের অজানা ভয়ংকর বিস্ময়ের বিচিত্র সংশয়ের মতোই এ ব্যাপারটাও তাদের আচ্ছন্ন করে রাখল।

.

মধু অধরার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল মাসি, রাগ করলে?

অধরা চকিতে মুখ তুলে যেমন ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, না বাবা, রাগ করব কেন? তুই এইচিস, কত ভাগ্যি। আয় বাবা, বোস, এখানে বোস।

নিজে ছই মুখঘাটের কাছে সরে গিয়ে মধুর জায়গা করে দিল। কিন্তু তার সারা গা তখনও কাঁপছে। মধুর ঠোঁট হাসিতে একবার বিস্ফারিত হল। পরমুহূর্তেই মুখখানি শক্ত হয়ে, থমথমিয়ে উঠল। তারও শরীরের মধ্যে কাঁপছে একটি উৎকণ্ঠিত ক্রোধে। যদি সে এসে না পৌঁছুতে পারত, তা হলে মোহর ক্ষমা ছিল না। বিদ্রোহ করলে হয়তো সত্যি সত্যি মোহকে বিসর্জন দিয়ে যেত অধরা। মধু বলল, তোমার বাড়াভাতে ছাই দিলুম।

অধরা গোঙাতে গোঙাতে বলল, তা কেন? তুই কেন আমার বাড়াভাতে ছাই দিবি। আমার আবার বাড়াভাত! বুড়ি রাড়ি, তিনকাল গিয়ে এক কাল ঠেকেছে..।

তীব্র রাগে ও ঘৃণায় এবার সত্যি হাসি চাপতে পারল না মধু। মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, শুনছ জগাদা, মাসি কী বলছে?

জগা মিস্তিরির কোনও জবাব পাওয়া গেল না। মধু আবার ডাকল, কই মিস্তিরি দাদা, জবাব নেই যে?

জগার স্খলিত গলা শোনা গেল, এই যে ভাই।

বিষ্টু হুঁকো নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। কলকেয় ফুঁ দিচ্ছে সে। মুখে হাসি হাসি ভাব। মধুর সঙ্গে চোখাচোখি করল। মধু তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করল বিষ্টুকে। অনুমান করল, মোহকে নিয়ে আসার যোগসাজসের মধ্যে, যে ভাবেই হোক বিষ্টু আছে। হয়তো, জগুর পয়সায় সাগরযাত্রা, ভ্রমণ, খাওয়াদাওয়া, পড়ে পাওয়া কিছু কিঞ্চিৎ ফুর্তির আশা। পরিবর্তে, বিদেশ বিভুয়ে, তেসুতি কলের বড় মিস্তিরির পাশে পাশে থেকে সাহস জোগানো।

কিন্তু মানুষ শক্তের ভক্ত। এখন আর কিছু বলে লাভ নেই। এক মুহূর্তেই সামলে নিয়েছে বিষ্টু। হুঁকোটা বাড়িয়ে দিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, ছেড়ে দে মধু। এমনিতেই ভয়ে মরছে। বেশি বললে, দম আটকে একেবারে পটল তুলবে।

মধু আর একবার বিষ্টুর চোখের দিকে তাকাল। বিষ্টু চোখ নামিয়ে নিল। মধু হুঁকোটা হাতে নিয়ে, মুখঘাটের কাছে দাঁড়িয়েই বার কয়েক ভুড়ুক ভুড়ুক টান দিল।

মাতঙ্গিনী ডাক দিয়ে উঠল, ওগো, অ ফটিকজল, বাইরে এসে মুড়ি ঝুড়ি দিয়ে বসোনা। ছেলেটাকে এটটু ভেতরে বসতে দাও।

মাতঙ্গিনী টান বুঝে দাঁড় টানে। অধরা হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠে, হামা দিয়ে দিয়ে মাতঙ্গিনীর পাশে চলে গেল।

এই তোষামোদ এবং ইঙ্গিতে মধুর লজ্জা করল। কিন্তু মোহর সঙ্গে একবার কথা বলার ইচ্ছা বুকের মধ্যে দাপাদাপি করছে। আরও বার কয়েক হুঁকো টেনে, বিষ্টুর হাতে দিয়ে, নিচু হয়ে ঢুকল সে। বেশ বড় নৌকা। পাশাপাশি শুলে, আট-দশজন শুতে পারে। জিনিসপত্রও কম নেই। মধু বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল। মুখছাট বন্ধ করতে তার সংকোচ হল। আলতার শিশিটা একেবারে শূন্য হয়েছে। এক ফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। মোহর শাড়ি ভিজিয়ে, একপাশে, ধারায় গড়িয়ে গিয়েছে। মধু শিশিটা তুলে রাখল। মোহ একপাশে, তেমনি মুখ গুঁজে পড়ে আছে। কিন্তু নিশ্চল, চুপচাপ। এখন আর সে ফুলে ফুলে উঠছে না। তার অবস্থান বাইরে থেকে কিছুটা আড়ালে পড়ে।

মধু কাছে এগিয়ে গেল। ডাকল, মউ!

মোহ নিঃশব্দ, অনড়। তার পিঠের উপর রুক্ষু চুল এলিয়ে পড়েছে। ডুরে শাড়িতে পিঠ ঢাকা। মধু গায়ে হাত রেখে ডাকল, ওই, মউ!

দেখল মোহ শক্ত। চৈতন্য হারাল নাকি? দাঁতকপাটি লাগেনি তো। মধু দুহাতে জোর করে তুলল মোহকে। না চৈতন্য হারায়নি। এবং রক্তহীন মুখে রং ফিরে এসেছে। চোখের জলের দাগে এখন ভয় ও শোকের ছায়া নেই, মানিনীর মানের ছটা লেগেছে। নত চোখ, নিচু মুখ।

মধু চিবুকে হাত দিয়ে, মোহর মুখ তুলতে চেষ্টা করে ডাকল, ওই।

মোহ চোখ তুলল। নাসারন্ধ্র স্ফীত হল। নিশ্বাস দ্রুত হল। তারপর ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল মধুর বুকে। দিয়ে, মধুরই হাঁটুর উপর আর একবার মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে উঠল সে। যেন, তিন দিনের সকল উদ্বেগের, লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিল মধুর বুকে আঘাত করে। মধু হা হা করে হেসে উঠল।

নদীর বুক থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল, বান। বান আসছে।

ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। ডায়মন্ডহারবার ছাড়িয়ে এসেছে। কিন্তু পোতাশ্রয় থেকে ঘণ্টা বাজিয়ে সাবধান করা হচ্ছে। কোম্পানির লঞ্চও বেরিয়ে পড়েছে একটানা ঘন্টা বাজিয়ে। দূর দূরান্তের যাত্রীদের হুঁশিয়ার করার জন্যে।

কেতুর চিৎকার শোনা গেল, ভেতরে যেয়ে বসো সবাই। জলে ভিজে যাবে।

মধু মোহর মুখটা তুলে ধরে আর একবার দেখল। বলল, ভেতরে থাক। বাইরে যাচ্ছি।

সে বাইরে গিয়ে বিষ্টুকে বলল, যা, ওর কাছে গিয়ে বোস।

 পাটাতন খালি করে সবাই ভিতরে চলে গেল। মধু জিজ্ঞেস করল, কোথায় এলুম কেতুদা?

করঞ্জলি।

 নৌকার গতি তীরের দিকে। আশেপাশে যত নৌকা ছিল, সকলেই ছুটেছে সেদিকে। সকলেই মোটামুটি সচেতন ছিল, তীর থেকে কেউই বেশি দূরে ছিল না। অনেকে ভয়ে ভয়ে, আগেই নোঙর করেছে। আন্দাজ ছিল, কখন জোয়ার আসতে পারে।

দূরের একটা স্তিমিত গর্জনধ্বনি যেন ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। আর মুহুর্মুহু সমবেত গলায় চিৎকার উঠছে, জয় গঙ্গা মায়ের জয়।..

পৌষমাস, টানের সময়। তবু সমুদ্রের কাছাকাছি, বান এখানে প্রবল হয়ে দেখা দেবে। এক ধাক্কায় নৌকা উলটে দিতে পারে। ডাঙায় নিয়ে আছড়ে ফেলতে পারে। বাইরের জলে থাকলে, সুউচ্চ ফণার মতো ঢেউয়ের মুখে দূর দূরান্তে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

পাল খুলে নাও।

নৌকায় নৌকায় সাড়া পড়ে গেল। শাঁখ বেজে উঠল দিকে দিকে। বিশ্বাস, শঙ্খনাদে বান বিমূঢ় আড়ষ্ট হয়ে যাবে। শান্ত হয়ে পড়বে।

কোনও এক নৌকায় যেন বৃদ্ধার কম্পিত চিৎকার শোনা গেল, বউমা, আসনটা জলে ফেলে দাও। ওঁকে বসতে দাও।

মানুষ যেমন ক্রুদ্ধকে শান্ত করে, বসায়, তেমনি। আসন পেতে দিচ্ছি, হে ভয়ংকর, তুমি বোস। আমরা তোমার স্তব করি।

ঘন্টা তখনও বেজে চলেছে।

নৌকা তীরে ঠেকল। কেতু লাফ দিয়ে পলি পাঁকে নেমে গেল। আরও তিনজন মাঝি জলে নামল। মধুও নামল।

কেতু বলল, থাক না মধু, এই কজনেই হবে।

মধু বলল, একটু ধরি।

কেতু নোঙরের দড়ি ধরে টান দিল। বাকি চারজন নৌকা ঠেলে দিতে লাগল উপরে। কিন্তু আর সময় পাওয়া গেল না। সেই স্তিমিত ধ্বনি মুহূর্তে প্রবল গর্জন হয়ে উঠল। মানুষের কলকোলাহল চিৎকার ছাপিয়ে, ভয়ংকর বেগে এসে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সেই বেগে নৌকা ঠেলে দিল সবাই তীরের দিকে।

কেতু হাঁক দিল, হুঁশিয়ার।

 মধুর গলা অবধি ডুবে গেল। মুখে জল ঢুকল। তিক্ত লবণাক্ত জল।

জয় হে ভগীরথ। জয় মা বিপদনাশিনী।…

জোয়ারের মুখে বানের ধাক্কা একটাই। কিন্তু তার বিস্তৃতি এত বিশাল, মনে হয় এক আঘাতেই পৃথিবী প্লাবিত করবে। নৌকা যে কতদূর উঠে গেল, তার হিসাব করা গেল না। দীর্ঘ সময় ধরে, একভাবে ঠেলে রাখতে হল চারজনকে। কেতু নোঙর ধরে রাখল। জল ক্রমাগত কেঁপে ফুলে উচ্ছ্বসিত হল। নৌকা আরও উপরে উঠল। এবং জোয়ার তার প্রথম মুখপাতের সীমায় এসে পৌঁছুল। কেতু নোঙর নিয়ে উঠে গেল আরও উপরে। চিৎকার করে বললে, আর ভয় নেই। মধু, উঠে পড়ো।

অনেকগুলি নৌকা একত্রিত হল কাছাকাছি। মাঝিদের সঙ্গে মধু উঠে এল। বিষ্টু দিল তাকে শুকনো কাপড় আর চাদর। কেতু ঠাট্টা করে বলল, কার মায়ায় বুক দিয়ে লৌকো ঠেকালে গো?

মধু জবাব দিল না। কলকে সাজতে বসল গিয়ে।

কেতু সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, কই গো, তোমরা রান্নাবান্নার জোগাড় দেখো। এ ধাক্কা কিছু নয়, আসল ধাক্কা পাবে কাল সাগর পাড়ির মুখে। তার আগে, ভোররাতের মধ্যে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে লাও। কাল একেবারে তীখে গিয়ে আবার হাঁড়ি চাপবে, মনে রেখো।

বিষ্টু বলল, লৌকো এখানেই থাকবে এখন?

মাথা খারাপ। লগি মেরে যদি লক্ষ্মীপুর কি শিবকালীনগর তক না যেতে পারি ভাটার আগে, তবে ভোগান্তি আছে। তা ধরগে, রাত তিন পহর লাগাত আবার ভাটা পড়বে। তার আগেই সব সারতে হবে।

কেতু গাঁজা সাজতে বসল। ওদিকে শুরু হল রান্নার আয়োজন। বিষ্টু মাতঙ্গিনী আর মোহ, তিনজনেই রান্নার তদারকে ব্যস্ত হল। সাড়া নেই কেবল অধরা আর জগা মিস্তিরির।

কেতু অন্যান্য মাঝিদের লগি ঠেলার নির্দেশ দিল। তারপর বকবক করতে লাগল, এখন কত লোক তীখে যায়। আগে কত ভয় ছিল। এক তো জলের ভয়। ডাঙায় বাঘ ডাকাত বোম্বেটে। মরণ মাথায় নিয়ে বেরুনো। আর এখন দেখ, বানের ঘণ্টা বাজে। বাড়িঘর হয়েছে কত! রাস্তা হয়েছে ডাঙায়। জলের ওজনকাটি পুতেছে। নতুন লতুন থানা করেছে। টেলিগাপের তার গেছে ফেজরগঞ্জো (ফ্রেজারগঞ্জ) তক। ইষ্টিমার ইস্তক যাচ্ছে। লাও কত যাবে চলো।

একটু চুপ করল কেতু। আবার বলল, তবে সাগর বলে কথা। আজ পর্যন্ত দেখলুম না, সে তার উশুল না নিয়ে মানুষকে পুণ্যি দিলে। আর দেখলুম না, ডাকাত বম্বেটেরা কোনও বছর খালি হাতে ফিরেছে। তাই বুঝিন বলে, সব তীখ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।…

শেষের কথাগুলি সত্য আর নিষ্ঠুর। সকল হাঁকডাক কাজ আয়োজনের মাঝে, সকল যাত্রীর শেষ মুহূর্ত, আসন্ন প্রসবের ব্যথা ও ভয়ের মতো, অনিশ্চিত, অচেনা, অলৌকিক।

কেন, ভয় নেই বুঝি শুধু মোহ আর মধুর? খোঁটার সঙ্গে কাপড় বেঁধে, বাতাস আড়াল করে, কাঠের তোলা চুলোয় রান্না বসেছে। উত্তরিয়া বাতাসে আখার আগুন বাগ মানে। মোহর ডুরে শাড়ির ঘোমটা কিন্তু বশ মানে না। মাতঙ্গিনী চোখ বুজে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বিষ্টু বাটনা বেটে, হাত পা গুটিয়ে অন্যমনস্ক চোখে, দূরে তাকিয়ে রয়েছে। লগি পড়ার শব্দ বাজে, ঝুপ ঝুপ। কেবল মোহর চোখের তারা ছিটকে ছিটকে মধুর চোখে পড়ে। মধুর মনে হয়, মোহ ওর বুকের পাত্র থেকে কী আরক যেন ছিটিয়ে ছিটিয়ে দেয় চোখ দিয়ে। নেশা নেশা লাগে। বসে থাকা দায় হয়। মোহ-র কাছে গিয়ে বসতে ইচ্ছা করে।

মোহ যেন টের পায় মধুর মনের কথা। ভুরু কোঁচকায়, ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসি চাপে। হাঁড়ি থেকে ভাত তুলে টিপে দ্যাখে। আবার এলো চুলের পাশ থেকে, মধুকে চোখের মণি বিধিয়ে, হাতা তুলে মার দেখায়। মধু হাসে, বলে, বড় খিদে পাচ্ছে।

মোহ ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ পাকায়। এমন নির্লজ্জ! তোমার খিদের বাক্যি কি কেউ বুঝতে পারে না? কিন্তু সত্যি কেউ শোনে না। এদের ভয় নেই। আর সকলের অনিশ্চয়তার ভয়। কেতু হাল ঠেলছে। আর মাঝে মাঝে একটা একটা কথা বলে উঠছে, এই সাগরে দানোয় দেবতায় লড়ে।

কেতুর কথাতেই যেন মধু মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। দূরের দিগন্ত বিস্তারের কুহেলি আলো কুয়াশার দিকে দেখছিল। তার জীবন আর প্রেম, সে কি অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর অভিসারে যায়? তাই কি ভয়ের চেতনা তার নেই?

একবার জিজ্ঞেস করল, কেতুদাদা, হুই দূরে কালো মতন কী দেখায়?

 কেতু জবাব দিল, ঘোড়ামারার দ্বীপ।

আলো দেখছি যেন এক-আধটা?

 জেলে মালারা আছে। রোদে চড়ায় মাছ শুকোয়।

 কিন্তু আবার চোখের টানে ফিরে তাকাল মধু। আর উঠে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, তেসুতিকলের শপনর-এর এই কামিন বউটাকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধব। কাজ নেব কলে। সে একেবারে মোহর কাছে এসে বসল। মোহ ত্রস্ত লজ্জায় ঘোমটা টানল।

মধু বলল, নে, লজ্জা রাখ, আয় দুজনে রাঁধি।

.

২৭.

খাওয়াদাওয়ার পাট চোকবার আগেই, তিন প্রহর কাটল। ডাইনে জল বাঁয়ে জঙ্গল। এতক্ষণ সবই সরব চঞ্চল ছিল। সহসা সকল প্রকৃতি যেন স্থির হয়ে গেল। কীসের সংকেতে থমকে গেল।

এক নৌকায় মাঝি হাঁক দিল, এই টান লেগেছে, সাগরে টানছে।

কেতু গলা তুলে ঘোষণা করল, ভাঁটা পড়ছে।

কোথায় আসা গেল?

শিবকালীনগর। কাকদ্বীপ সামনে।

কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয় পাওয়া চাঁদ পশ্চিমের কপালে ঠেকছে। ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে গেল তার কুহকী ছটা। চারদিকে সাদা কুয়াশার পাতলা আবরণ ফুটে উঠল। কিন্তু আবার বাতাস উঠল সহসা। অরণ্যে উঠল সাঁ সাঁ আওয়াজ। দূরে শোনা গেল প্রমত্তের গর্জন। মাঝি সামাল। এবার পাড়ি। সুদূর ডাইনে একটি রেখার ইশারা। সম্মুখে দিগন্তহীন, অশেষ। কাঁপা কাঁপা গলা শোনা গেল, দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে…।

কেতু গলার শির ফুলিয়ে হেঁকে উঠল, মনের পাপ পুণ্যি সব ওঁয়ারে দিয়ে দাও গো। কিছু রেখো না।

চারদিকে গঙ্গার জয়গান, স্তব, বন্দনা। জীবনের সকল কৃত পাপ যেন এই মুহূর্তেই সহসা উদিত হচ্ছে। শত শত প্রাণে, পাপ অপরাধ আর অন্যায়ের ছায়া ভেসে উঠছে। আশ্চর্য! প্রাণের সকল খতিয়ানের হিসাবে আজ বেজায় গরমিল। অসংশয়ে দেখছে সবাই, পাপের বোঝা ভারী। যাত্রার সময় বুকে ছিল প্রকাশ করবার সাহস। প্রকাশ করে মুক্তি যাজ্ঞা। কিন্তু শঙ্কায় কাঁপন ধরল বুকে। প্রাণের ভয়। বড় প্রিয় সংসারের সকল কাম্য বস্তুর থেকে প্রিয়তর, এই প্রিয়তম প্রাণ, রক্ষা করো হে নাথ। তোমার শুদ্ধ স্পর্শে পুণ্য করে। প্রাণ নিও না।

ক্রমে নৌকার নাচ শুরু হয়। এই শেষ রক্ষার সময়। ঢেউ তার বিশাল থাবায় আঘাত করছে। জল চলকে উঠছে পাটাতনের উপর। কেতু যেন শত্রুকে শেষ আঘাতের আক্রমণে দুহাত আর বুক দিয়ে হাল চেপে ধরেছে। সর্বাঙ্গে পেশির ঢেউ। দাঁতে দাঁত চেপে সে কেবলি বলে চলেছে, খবরদার পালের কানদড়ি কষে রাখ।

কান্না আর চিৎকার উঠল নৌকায় নৌকায়। জয়ধ্বনি উঠল ভয়েরই ছদ্মবেশে।

 কেতু চিৎকার করল, সব ডাইনে চাপো, ডাইনে চেপে বসো।

নৌকা বাঁয়ে কাত হয়ে পড়েছে। পাল ফুলে উঠেছে যেন গোঁয়ারের মতো। তবু, সবাই সামনে যাও। নৌকায় সমুখভাগ দাবিয়ে রাখো। জল উঠুক, যত খুশি উঠুক, এই গতি আর সামলাবার নয়। আবার শঙ্খধ্বনি উঠছে চারদিকে। ফুল বেলপাতা আসন আর কাঠের পিড়ি পড়ছে জলে।

কেতু আর একজন মাঝিকে ডেকে, তার সঙ্গে হাল ধরতে বলল। সে নিজে,হাল বুকে চেপে ডাইনে বেঁকে পড়ল ধনুকের মতো।

জয়, কপিলমুনির জয়।

বিষ্টু ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ডাকল, কেতুদাদা!

 চুপ। চুপ কর।

 মাতঙ্গিনী বমি করছে। অধরা কাঁদছে চিৎকার করে। জগুও বমি করছে। কাঁপছে থরথর করে। কাচির ধুতি কোমর থেকে প্রায় স্থলিত। বমির সঙ্গেই বোধহয় ফোঁপাচ্ছে। সামনের ছইয়ের মুখছাটের কাছে, মধুর কোলে আঁকড়ে পড়ে আছে মোহ।

সহসা কেতু আবার হাঁক দিল, হুশিয়ার! পরমুহূর্তেই মনে হল, পাহাড় ভেঙে পড়ল, উলটে গেল নৌকা। কয়েকবার পর পর শত শত নাগ যেন ছোবল দিল নৌকার গায়ে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ভিতরের জিনিসপত্র।

আবার যেন একটু শান্ত হল। যদিও গতি কমেনি। দিগদিগন্তে একটি রক্তাভা দেখা দিল।

ভয় ছাড়ো, সামনে দেখো। সার্থক করো মানবজন্ম। হে রুদ্র, ভয়ংকর, হে অনন্ত, হে ভয়ভঞ্জন, হে জীবনদাতা! একী তোমার বিচিত্র রূপ! ভয় নেই…ভয় নেই তো সেই মহাদ্বার অতিক্রমণে! ওই তো সেই অনন্তশয্যার মহাসমুদ্র! নারায়ণের নাভিউদ্ভূত পদ্ম থেকে উঠেছেন ব্রহ্মা। মাথার উপরে উচ্ছিত শেষনাগের সপ্ত ফণার গর্জন। নররূপী নারায়ণ আবেশবিহ্বল, লক্ষ্মীর মুখে বরাভয়ের হাসি। এই তো উৎপত্তি সৃষ্টিকর্তার।

ভয় নেই, ভয় নেই। মানুষ, তুমি মানশ্চক্ষে দেখো, সৃষ্টি স্থিতি লয়ের দেবতা তোমার সমুখে। ইনি অভয়দাতা, ইনি দর্পহারী।

কেতু চিৎকার করে উঠল, জয় হে নারায়ণ, মধু-কৈটভ নাশক, জগৎ তোমার ছিষ্টি হে! তুমি হে পালক!

কেতুর উন্মত্তের মতো চিৎকার শুনলে মনে হয়, সে যেন সগর্জনে কাউকে শাসাচ্ছে। আসলে মাঝির সাহস সঞ্চয়ের এই ভাষা, ধ্যানের এই ভঙ্গি। যে কারণে শঙ্খনাদ, সেই কারণেই প্রবল চিৎকার। সমুদ্র, শান্ত হও! অনন্তশয্যায় শায়িত হে পরমাত্মা, হে পুরুষ, হে ঈশ্বর, হে অব্যয়, হে অনাময়, হে বিশ্বব্যাপী! মানুষ তোমার অঙ্কে, তার প্রাণভয় রোল তোমার ইন্দ্রিয়গত হোক।

কেতু আবার চিৎকার করল, তোমার বুকে কস্তমণি, (কৌস্তভমণি), ছিবৎস চিহ্ন (শ্রীবৎস চিহ্ন)…। সহসা দিগদিগন্তে একটি আলোর আভাস ফুটে উঠল। কুয়াশা ছিন্ন করে উদ্ভাসিত হল রক্তিম ছটা। দক্ষিণায়নের অয়নবিন্দুতে যিনি পৌঁছেছেন উত্তরায়ণের নবীনযাত্রায় তিনি সহাস।

কেতু ধ্যান করে চলেছে, তুমি তিপাদ (ত্রিপাদ)! তুমি দশাবতার হে!…অভয়দাতার মতোই যেন পূর্ব-দক্ষিণে দেখা দিলেন সূর্য। উত্তাল ঢেউয়ের বুকে ভয়াল ভয়ংকরের যে রুদ্র বেশ ছিল, সে যেন ফেনিলোচ্ছল হাসিতে, নাচের ছন্দে খেলা করে উঠল।

মোহ শক্ত হয়ে আঁকড়ে পড়ে আছে মধুর কোলের উপর। অবিন্যস্ত বেশবাস উড়ছে, এলো চুল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চোখে তার জল। সে কাঁদছে।

মধু বুকের কাছে তার মুখ তুলে ধরে বলল, কাঁদছিস মউ?

হ্যাঁ, মোহ কাঁদছে। দুঃখে নয়, ভয়ে নয়, মধুর সঙ্গে সে চলেছে, মধু বেঁচে আছে, সকলে বেঁচে আছে। তাই এ যে মোহরই ভাগ্য। এ কল্যাণ যেন মোহকেই দান করেছেন ঈশ্বর।

চোয়ালে চোয়াল বসা মধুর শক্ত মুখ। কালো চকচকে মুখে দৃঢ়তার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। জগদ্দল সেনপাড়ার কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে মা বাবা লখাই খুড়ো, হীরালালকে। জল আসছে তারও চোখে। বুকের কাছে তার মোহ।

সামলে! সামলে! জগা অর্ধমৃতবৎ পড়ে আছে। অধরার ঘন ঘন সংজ্ঞা লোপ পাচ্ছে। মাতঙ্গিনী কাঁপছে থরথর করে। বিষ্টু অসুস্থ মুখ ফিরিয়ে আছে পেছন দিকে। ভাবছে, কেন এল সে। তার জীবন যৌবন, তার অফুরন্ত সাধ। তার ছোট্ট টুকটুকে বালিকা দুলেনি রয়েছে ঘরে। তেসুতি কলে পড়ে রয়েছে। এক হপ্তার মাইনে।

সকল নৌকায় ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠছে। সাগরদ্বীপ নিকটবর্তী। কেতুর মুখের কষে ফেনা জমেছে। তার সর্বাঙ্গে স্ফীত পেশিগুলি সাপের মতো কিলবিল করছে। চোখ রক্তবর্ণ। সে আবার চিৎকার করে উঠল, জয় হে কপিল মুনি। জয় হে সাগর রাজা!…

দিকে দিগন্তে বিচ্ছুরিত রৌদ্রচ্ছটায় সাগর নতুন রূপ ধারণ করল। প্রতিটি তরঙ্গ যেন সগররাজের অভিশপ্ত মৃত ষাট হাজার ছেলের ফিরে পাওয়া প্রাণের তরঙ্গ। এই জলের নীচেই কি সেই পাতাল স্থান, যেখানে একাগ্র সাধনার জন্যে কপিল আশ্রম করেছিলেন। সগররাজের অশ্বমেধের ঘোড়া যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। আর সেই অশ্ব খুঁজতে, সগররাজের ষাট হাজার ছেলে যেখানে এসেছিল। দেখেছিল মুনির আশ্রমে সেই অশ্ব। দেখে অশ্ব অপহরণের দায়ে মুনিকে আক্রমণ করেছিল। এবং মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের ভস্ম করে দিয়েছিলেন।

তারপর সগররাজের পৌত্র অংশুমান তপস্যায় মুনিকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। কপিলমুনি বর দিয়েছিলেন, জাহ্নবীর জল স্পর্শে সগর বংশ জীবন ফিরে পাবে। ভগীরথ সেই অংশুমানের পৌত্র। গঙ্গাকে তিনিই আনয়ন করেছিলেন। উদ্ধার করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষদের।

কুয়াশা সম্পূর্ণ অপসারিত। ক্রমে উত্তরিয়া বাতাসের বেগ বেড়ে উঠল। কিন্তু এই লবণাক্ত নীলাম্বুধির সীমায় উত্তরিয়া হিম দংশনের হিংস্রতা যেন ম্লান হয়ে গেল। নৌকা দ্বীপে এসে লাগল। চারিদিকে খোল করতাল সহকারে গান চলেছে। নৌকায় ঠাসাঠাসি। অজস্র মাস্তুলে বিদ্ধ আকাশ। মধু দেখল, বালু বেলায় নেমে মোহ সত্যি মোহময়ী হয়ে উঠল। সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মুখের ছায়া সম্পূর্ণ তিরোহিত। হাসিতে ঘরছাড়া উদ্দাম প্রাণের মুক্তির সংকেত। কিন্তু মধুর হাত সে ছাড়েনি। বলল, এ ডাঙার চারিদিকে জল?

মধু বলল, হ্যাঁ।

–মানুষ থাকে না বারোমাস?

 –না।

মোহর চোখে যেন স্বপ্ন নেমে এল। নিচু স্বরে বলল, তবে এস, এখানে থাকি। কেউ এসে বিবাদ ঝামেলা করতে পারবে না।

খাবি কী?

 চাষ আবাদ করব।

–তবে কলে কাজ করবে কে?

মোহ ভ্রুকুটি করে, চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। বলল, ক’লো ভূত।

মধু হাসল। তা বলুক মোহ। মধু হবে মিস্তিরি। তার পাকা ঘরের পাকা মেঝেয়, মোহ আলতা পায়ে ঘুরে বেড়াবে। তাই দেখতে চায় সে। তৃষ্ণার্ত চোখে দেখল সে মোহকে। মোহ তাকাল। ক্রু কুঁচকে ইশারায় শাসন করল। আর মজা পেল, এত লোকের সামনে, অসহায় অসুরের মতো পুরুষটাকে দেখে।

কেতু হাতের চেটোয় গাঁজা ডলতে ডলতে হাঁক দিল, যাও যাও গোলপাতার ছাউনির ব্যবস্থা দেখ, রাত কাটাবার একটা ডাঙার আস্তানা করতে হবে তো।

বিষ্টু নৌকা থেকে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে মধুর পাশেই। জগা, অধরা আর মাতঙ্গিনী এখনও যেন সাগরের উথালি পাথালি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গোছগাছ করে উঠতে সময় লাগছে তাদের। গঙ্গাসাগর যেন তাদের কাছে নরক সাগর হয়ে উঠেছে। সকল ব্যর্থ আশায়, এ দক্ষিণদুয়ার তাদের কাছে সত্যি যমের দুয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে।

দ্বীপে যদিও আবহাওয়া সরগরম। চারিদিকে মানুষেরা নানান হাসি কোলাহলে মত্ত। সংসার, টাকাপয়সা, পাড়া এবং গাঁয়ের কথা, পরনিন্দা পরচর্চা, সব কিছু আছে। আর এখানেও সামাল সামাল! হাঁড়ি কড়া খুন্তি, জামাকাপড়, মানুষ, সব সামলে। নয়তো বেহাত হয়ে যাবে। নজর রাখো চারদিকে।

কিছুটি কেউ ছাড়বে না। ডাঙা পেয়েছে তো জনপদের দৈনন্দিন জীবন আপনি তার দুয়ার খুলে দিয়েছে। কে বলবে, এই মানুষেরা সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে, প্রাণভয়ে থরহরি কাঁপছিল। কাঁদছিল চিৎকার করে।

অবাঙালি সাধুরা ভিড় করেছে অনেক। ছাই মাখা কপনি আঁটা ত্রিশূলধারী নিপাট উলঙ্গ নাগা। রক্তাম্বরী, ত্রিশূলধারিণী ভৈরব। বৈষ্ণব বৈষ্ণবী। চাল, ডাল, মশলাপাতির দোকান তো আছেই। ময়রার দোকানই বা কত। সবাই সাগর পাড়ি দিয়েছে।

সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।

পড়ন্ত বেলায় মধুর আশা পূরণ হল। বিমলা আর নারায়ণ খুডোর দেখা পাওয়া গেল। সব কথা শুনে বিমলি তো হেসেই বাঁচে না। নারায়ণ লাল লাল চোখ দুটি ঘুরিয়ে বলল, কার ভাইপো দেখতে হবে তো।

বিমলি বলল, তা বটে। তবে পুরুষমানুষ কার টানে জগৎ ভোলে, জান তো? দেখো? চাঁদ মুখখানি একবারটি দেখো।

বলে মোহর ঘোমটা সরিয়ে মুখ দেখিয়েছে। লজ্জা পেয়ে, মোহ আবার তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে দিল।

নারায়ণ বলল, আমি তোমার খুড়া শ্বশুর গো।

 বলে হা হা করে হাসল।

বিমলা বলল মধুকে, কিন্তু আর তো আমার ভাশুরপো ভাশুরপো-বউকে ছাড়ব না। এখন আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে।

মধুরও সেই ইচ্ছা। সঙ্গে বিষ্টু ছিল। তাকে বলে দিল অধরাদের খবর দিয়ে দিতে। বিষ্টুর রক্তেও একটা দোলা লাগল। ইচ্ছে হল এদের সঙ্গ ছাড়বে না। কিন্তু এদের মতিগতির সঙ্গে তাল রাখতে ভয় পেল সে। ফিরেই গেল।

বিমলিদের সঙ্গে তাদের পাতায় ঘরে ফিরে মধু বলল, ফিরছ কবে?

বিমলি বলল, কোথায়?

–বাড়িতে, গারুলিয়ায়?

বিমলি নারায়ণের সঙ্গে চোখাচোখি করে হেসে বলল, তার কি এখন ঠিকঠিকানা আছে?

মধু বলল, সে কী! অলিক সায়েব যে খেপে আছে।

বিমলার হাসি আর ধরে না। বলল, ও উটকপালের মেজাজ অমনি। তা সারা বছরের গতর খাটুনি সারাই। এখন দেড়-দুমাসের ধান্দা নিশ্চিন্দি।

মধু অবাক হয়ে বলল, থাকবে কোথায়?

বিমলা চোখ ঢুলুঢুলু করে বলল, যেখানে খুশি। নৌকোয় নৌকায় ঘুরব। এখান থেকে বেরিয়ে হাড়োয়ার মাঘের মেলায় যাব। সেখান থেকে, কলকাতা দেখতে যাব, কালীঘাট দেখব, লাটসাহেবের বাড়ি দেখব। শেষ করব ঘোষপাড়ার মেলায়। সেখান থেকে গালে।

মধুর প্রাণের মধ্যে নেচে উঠলেও, মনটা বিমর্ষ হয়ে উঠল। বলল, আমি কী করব খুড়ি?

-কী আবার। ছেলে আর ছেলের বউ আমাদের সঙ্গে থাকবে। তাদের তো কোনও পেছু টান নেই।

–তা নেই। মধু বলল, কিন্তু অলটার সায়েব বড় রাগ করবে যে।

করুক। আবার দেখা পেলেই, রাগ পড়ে যাবে। আমার বউমা কী বলে?

বিমলা মোহর দিকে অপাঙ্গে তাকাল। মোহ পাতার ঘরে, বিচুলি বিছানো মেঝেয় বসেছিল। লজ্জাবতী নতুন বউটির মতো, ঘোমটা তার টানাই ছিল। জবাব সে বিমলাকে দিল না। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মধুর দিকে একবার কটাক্ষ করল। সে চোখের চাউনি দেখে মধু হেসে উঠল। বলল, ও বাবা, তুই যে মেতে গেছিস দেখছি।

বিমলা খ্যালখ্যাল করে হেসে বলল, তা মাতবে না। লতা যে অশ্বথের নাগাল পেয়েছে গো। জীবনে এমন দিন কি আর আসবে।

সত্যি, এমন দিন কি আর আসবে। মোহকে নিয়ে এমন অবাধ স্বাধীন জীবন, এই ভো প্রথম পাওয়া গিয়েছে। রক্তে দোলা ছিলই। দ্বিধা যেটুকু ছিল, মোহর সম্মতিতে তাও দূর হল। রক্তধারা সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো প্রাণের তটে আছড়ে পড়তে লাগল। মোহকে সঙ্গে নিয়ে, পৃথিবীর যেখানে বলো, স্বর্গে মর্তে পাতালে, সবখানে যাব।

.

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এরা যেন বেদে। কিন্তু এর মধ্যে একটি দুর্ভাগ্যের প্রহার আছে, প্রহারের তাড়ায় একটা উদ্ধৃঙ্খল বেদিয়া বেগ রয়েছে এই মানুষগুলির জীবনে। সমাজে যাদের কর্তৃত্ব নেই, এরা সেই নিচু জাতের মানুষ। গ্রামীণ হিন্দু সংস্কারবদ্ধ, জীবিকায় কৃষকদেরই বংশধর এরা। ক্রমশ ভূমিহীনতা, অভাব, দারিদ্র্য এদের শ্রীহীন করেছে। অন্তরে অন্তরে এই মানুষেরা বিক্ষুব্ধ ছিল, অবিনীত হয়েছিল। কিন্তু গ্রামীণ শাসনে এক ধরনের অসহায় দাসত্বে বন্দি ছিল। সে অবস্থা থেকে প্রায় মুক্তিদাতার বেশেই নতুন কলকারখানা এসে দাঁড়িয়েছে এদের সামনে। যে মুক্তি ওরা চায়নি, যে মুক্তিকেই গ্রহণ করতে হয়েছে। এ ঘটনার ঐতিহাসিক মূল্যমান বিচারের অবকাশ জ্ঞান বুদ্ধি এদের নেই। পুরনো জীবনের প্রতি তবু একটা নৈতিক বিশ্বাস ছিল। কিন্তু প্রহারের আঘাতে, সে জীবনটাকে ওরা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলে এসেছে। এখন সেই মুক্তিকে উপভোগ করছে একটা অন্ধ উচ্চুঙ্খল বেগে। জীবন আপনা থেকে কিছুই দেয় না। রস নিংড়ে বার করতে হয়। বর্ণ হিন্দু, জমিদার, মহাজন, সকলের প্রতি এ যেন একটা প্রতিশোধের মতো।

কিন্তু মানুষ যা-ই করুক, তার সব কাজের, ব্যবহারের, জীবনধারণের রীতির দায় তার নিজেরই মূল্য তার, ভাল মন্দ, সবই নিজেদেরই দিতে হবে।

.

২৮.

লখাই ফিরে এল রাইটারের দপ্তর থেকে। নিবারণ ঘোষ তাতে শাসিয়েছে। বলেছে, কোম্পানির বিরুদ্ধে সে যদি কোনও কথা বলে, তা হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। মনে রাখতে হবে, চটকল কোম্পানির সাহেবরা মহারানির জাতভাই। যদি জমি বিক্রি করতে আপত্তি করে কেউ, দায়ী হবে লখাই। মনে রাখা দরকার, সেদিন নেই।

তা ছাড়াও লখাই জানত, নিবারণ ঘোষ তার অনেক ক্ষতি করতে পারে। অহেতুক অপবাদ দিয়ে চালান করে দিতে পারে জেলে। এমন সে অনেক করেছে। আজ একে মামুদের চর, কাল ওকে লাল মালার শাগরেদ, পরশু অমুকের ঘরে সিঁদ কাটার দায়ে জেলে পাঠিয়েছে। চারিদিকে সবাই তটস্থ হয়ে আছে নিবারণ কায়েতের দৌরাত্ম্যে। অবশ্য এ দৌরাত্ম্যের মূলে সবটুকুই মিথ্যে নয়। চারিদিকে চুরি রাহাজানির হিড়িক পড়েছে। রাত পোহালে এমন দিন নেই, যেদিন একটা সিঁদ কাটা কিংবা ঘুপচুক চুরির কথা শোনা না যায়। নিবারণ কায়েতের মতো আর দশজনেও জানে যে, ডোমপাড়ার কয়েকজনের কীর্তিই বেশি। এই সারা অঞ্চলের মধ্যে ডোমপাড়ার সকলের কুল্যে দশ বিঘা জমিও নেই। জাত ব্যবসার মধ্যে চামড়ার কাজ আর বিশেষ হয় না। ঠেকেছে এখন শুধু বাঁশের দড়মা চুপড়ি তৈরি করা। তবে ভাল করতে পারলে কদর আছে তার এখনও। নানান রকম ফুলের সাজি, ডালি, বহু রকমের সুন্দর নকশা করা কাজের জিনিস। কিন্তু সেই অনুপাতে দাম পাওয়া যায় না। আর বাঁশের অনেক দাম হয়েছে। পড়তা পড়ে না।

অভাবে স্বভাব নষ্ট। সে শুধু আজ ডোমপাড়ায় কেন। সব পাড়াতেই সমান তবে ডোমপাড়ায় মেয়েপুরুষ একত্র। মেয়েপুরুষ উভয়ে চুরিবিদ্যা রপ্ত করেছে। নিবারণ ডোমপাড়ার যম। সবদিকেই। কেননা, শাস্তিদাতা সে নিজে। মেয়েদের সে পিঠেও মারে, আবার লুকিয়ে চুরিয়ে তাদের সঙ্গতও করে। অর্থাৎ একদিকে শাসন অন্য হাতে বরাভয়।

কিন্তু ডোমপাড়া ছাড়াও নিবারণের কোপে পড়লে রক্ষা নেই। সেই কথাই ভাবছিল লখাই। আর ভাবছিল, সেদিন নেই। সত্যি, এক সময়ে তাকে সেনকর্তা শাসন করেছেন। সেই তুলনায় নিবারণ ঘেঁকি কুকুর। কিন্তু মহারানির চাকর। এ খেকি কুকুরের বিষদাঁত ভাঙার ক্ষমতা নেই আজ লখাইয়ের।

আঁতপুর পেরিয়ে সেনপাড়ায় ঢুকে মনে পড়ল সেজোবাবুর কথা। মজুমদারদের সেজোবাবু। তিনি বহুদিন থেকে কলকাতায় আছেন। মাঝে মাঝে আসেন সেনপাড়ায়। তখন কলকাতা থেকে বন্ধুরাও আসেন ওঁর সঙ্গে। সবাই ব্রাহ্ম বন্ধু। উনি বাড়ি এলে, ভাটপাড়া থেকে বনমালী ঠাকুর আসেন, নৈহাটি আর শ্যামনগর থেকেও কেউ কেউ আসেন। সবাই মিলে সভা করেন, তর্ক করেন, দেশ কাল আচার নিয়ে আলোচনা করেন। তারপর সেজো আর মেজোকর্তা তাঁদের গিন্নিসহ, বন্ধুদের নিয়ে নৌকায় বেড়াতে যান। পাড়ার সেন বোস ঘোষ-জায়ারা, চোখ পাকিয়ে গালে হাত দিয়ে দেখেন। পিচ করে থুথু ফেলেন, আর নিন্দে করেন।

একবার শোনা গেল, তিনি নাকি বিলাতে যাবেন। লখাই বিশ্বাস করেনি। করতে পারেনি। কেননা আগেও বাবুর যাওয়ার কথা হয়েছিল, তিনি যাননি। চোখের বাইরে থাকলে মানুষ কত কী রটায়। মনে পড়ল তাঁর কথা, লখাই, আমরা নিধিরামের জাত হয়েছি। কী কথাই বলেছিলেন। জীবনে মরণে সে কথাটি কোনও দিন ভুলবে না সে। কিন্তু কেমন করে নিধিরামের ভাঁড়ামি ও কাপুরুষতা থেকে আমরা মুক্তি পাব, সে কথা বলেননি কোনওদিন। তবে কি এ জাতের মুক্তি নেই!

সেজোবাবু নেই, তাই মজুমদার বাড়িতে সে যায় না এখন। যেতে মন চাইলেও যায় না। কেননা, সেখানে গিয়েও কারুর বড় একটা দেখা পাওয়া যায় না। গেলেও এক সেজোগিন্নি ছাড়া সকলেই তার কাছে বড় দুর্বোধ্য। সেজোকর্তাও খুব সুবোধ্য নন, তবু সেজোকর্তার কথার মধ্যে, লখাই নিজের মনের কথা খুঁজে পায়। উনি যে বলেন, আমরা পরাধীন, লখাই, এ জাতের সেটাই দুর্ভাগ্য।

সেনবাড়িতেও কারুর কাছে যাবার নেই। যারা আছে তাদের কাছে দুদণ্ড বসতেও লজ্জাকরে লখাইয়ের। সেই পুরী আজ মৃত। হাঁক ডাক নেই, আশা ভরসার কথা বলবার লোক নেই। কেবল বৃদ্ধা সেনগিন্নি একটু খাতির যত্ন করেন। ভাল মন্দ জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু লখাই জানে, দেওয়ানগিন্নি বড় অসহায়। সুদিনের স্মৃতি, দুর্দিনের ভারে ন্যুজ। আর লখাইয়ের জীবনে কোনও আশ্রয় নেই, কোথাও তার ঠাঁই নেই।

.

বাড়ি এল লখাই। বাড়িতে এসে দেখল সারদা এসেছে। বসে আছে হীরালালকে বুকে নিয়ে। কালী গঙ্গাজলের ছিটা দিচ্ছে বোয়াকে উঠোনে। শীতের বেলা আসতে না আসতে যায়। সন্ধ্যা ঘনায়মান।

লখাইকে দেখে সারদা আর কালী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কালী জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছিল রাইটারবাবু?

লখাই বলল তাদের সবিস্তারে। বলে তারপর জানাল, গাঁয়ের লোক তো আমার গোলাম নয়। বাস্তু যদি কেউ বেচে দেয় দিক, আমি আমার আগুরিপাড়ার দান পাওয়া জমি বেচব না। আর শ্যাম দাদাও পারবে না ভিটে বেচতে। দেখি একবার কোম্পানি আমার কী করে।

.

কয়েকটা দিন ধরে বাড়িতে শান্তি ছিল না। মধুর কোনও সংবাদ আজও বাড়িতে পৌঁছায়নি। কালী গোলামকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছে। সে দ্ব্যর্থবোধকভাবে বলেছে, ভাবনা করো না কো। তাতে যা ভাবতে হয় ভাব। খেতে শুতে শান্তি নেই। কালী রাত্রে হীরাকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে। জেগে থাকে সারা রাত। যদি একবার আগল খোলার শব্দ শোনা যায়।

শ্যাম কদিন থেকে রাত্রে উঠে বেরিয়ে পড়ে খালি। মধুরূপী নিশিতে পেয়েছে তাকে। দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। বলে, মধু এলি বাবা? ওই দেখ, আমিন মশাই এসেছিলেন। বললেন, আবারো নাকি খাজনা বাকি পড়েছে। মা লক্ষ্মী খাজনাউলি হয়েছেন, মানুষগুলোনকে হাতি ভেবে ঘাড়ে চেপ্লে আছেন। পারবিনে বাপ, ও সব জমি জিরেতে আর যাসনি। ঘরের যে ধানগুলান আছে, গঞ্জে গিয়ে বেচে দিগে, লইলে, আমিনমশাইকে ওই দে।

ও গো, কাকে বলছ, কোথা যাচ্ছ! আর কোথা যাচ্ছে। মানুষের বাইরে চলে গেছে শ্যাম। তাই রাত্রে কালী নিজের আঁচলের সঙ্গে বেঁধে রাখে কোঁচা কাছার খুঁট। বলা তো যায় না। মেয়েমানুষের কপাল! কখন ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকবে। জেগে দেখবে সে নেই। কিন্তু এ গিঠ তো আর কেউ খুলতে পারবে না।

একদিন বোদাই থেকে এমনি গাঁটছড়া বেঁধে সে এসেছিল। কতযুগ আগের কথা, তবুও ভোলেনি। মিনসে তখন এইটুকু, সে নিজে যে কতটুকু, আজ আর ঠাওর হয় না। শুধু মনে আছে, নাকে নতুন মোলক পরায় বড় ব্যথা ছিল। তা মিনসে এতটুকু হলে কী হবে। মানুষটি তো কম নয়। পথে আসতে হটর হটর গোরু গাড়ি থেকে নামে আর হুঁকো টানে গাড়োয়ানের সঙ্গে। গায়ে ছিল বিলিতি কাপড়ের জামা আর গলায় উড়নিটা ছিল কালীর আঁচলের সঙ্গে বাঁধা। যত ছোটই হোক, আর যতই নামুক শ্যাম তামাক খেতে, কালী আঁচলে বাঁধা উড়নিটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল আর ঠোঁট টিপে হাসছিল। ভাবছিল, মিনসেটা তার কোলের কাছেই রয়েছে।

নিদ্রাহীন রাত্রে চোখের জলে ভাসে কালী। চৌকিদার হেঁকে যায়, প্রহরে প্রহরে ডাকে শেয়াল, অবিশ্রান্ত ডেকে চলে কালপ্যাঁচা। বয়স হয়েছে তো। ঘন ঘন বাইরে আসে। স্থির থাকতে পারে না। কিন্তু কই, মধু তো আসে না।

দুর্ভাবনা লখাইয়ের বেশি। সে পরাজয় মেনেছে হীরার কাছে। অথচ তারই কোপে পড়ে মধু ঘর ছেড়ে গেল। মধুকে ঘর ছাড়া করল সে! এক হীরা ছাড়া সে ঘটনার সাক্ষী কেউ নেই। সে হয়তো এত দিনে বলেছে কালী বউঠানকে। ছি ছি, বউঠান ভাবছে তার ছেলেকে দেশান্তরী করেছে লখাই।

শান্তি নেই। ঘরে না, বাইরে না। সারদার কাছে নয়। পাড়া ঘুরে ঘুরে বু সে জমি ভিটের কথাটি যাচাই করে সকলের সঙ্গে। কার কী ইচ্ছা। ইচ্ছা নেই, কিন্তু জোর জুলুম হলে?

লখাই একদিন গোলামকে জিজ্ঞেস করেছিল মধুর কথা। গোলাম বলেছে, সে জানে না। বলে পেছনে থেকে ভেংচেছে লখাইকে। শালা, হাত ভেঙে দিয়ে এখন সোহাগ দেখাতে এসেছে।

তারপর ফিরে এসেছে অধরার দল। আসেনি মোহ আর মধু। সেই কথাই সাতকাণ্ড রামায়ণের মতো খেউড় করে শুনিয়েছে সে কালীকে হেঁচতলায় দাঁড়িয়ে। তাই নিয়ে পাড়ায় ঘরেও আলোচনার অন্ত রইল না। বিষ্টু দুলে তেসুতি কলের সকলের কাছে গল্প করে বেড়াল মধুর কথা। পাগলা সাহেব শুনে বিষ্টুকেই দুই রা কষিয়েছে ঘাড়ে। জগা মিস্তিরি নালিশ করতে গিয়েছিল পাগলা সাহেবের কাছে। মিছিমিছি লাগাতে গিয়েছিল মধুর নাম করে। মধু নাকি গাল দিয়েছে সাহেবকে। পাগলা সাহেব উলটে তাকে বলেছে, এরকম কথা বললে তাকে সে তাড়িয়ে দেবে কারখানা থেকে।

খবর রটেছে, গারুলিয়ার কলে কচি ছেলের হাতকাটা পড়েছে। সবাই ছেলে সামলাচ্ছে। যাদের ছেলেরা কারখানায় যায়, তাদের ঘরে আটকাচ্ছে। গারুলিয়ার সেই ছেলেকে কলকাতায় সাহেবদের হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। একটা হাত তার বাদ দিতে হয়েছে। কোম্পানি বলেছে, আজীবন ওই ছেলের ভরণপোষণ করবে তারা। ছুটকো ছাটকা কাজ করলেই হবে। ভরণপোষণ যদি না চায়, তবে কোম্পানি দুশো টাকা দিয়ে দিয়ে দেবে। কথায় বলে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। ছেলে কতদিন বাঁচবে, ততদিন যদি কোম্পানি আর না দিতে চায়। তার থেকে হাতের দুশো-ই ভাল। দুশো টাকা! কম তো নয়। ছেলের বাপ মা তাই নিয়েছে।

কথাটা প্রথম শুনে হীরার মনে বড় দুশ্চিন্তা হয়েছিল। কিন্তু সে ক্ষণিকের। গোলাম তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, ওটা অসাবধানতার ফল। আগুনে কেউ হাত দিলে, হাত তত পুড়বেই। হাত দিতে জানা চাই। যে জানে, তার পোড়ে না। সে আছে দিনরাত তেসুতি কলের আনাচে-কানাচে।

বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতে করতে, বারে বারেই মধুদাদার কথা মনে পড়ে যায়। মধুদাদার কথা মনে হলে হীরার বড় রাগ হয়। মধুদাদা মর্মাহকে নিয়ে চলে গেল। পালিয়ে গাঁ-ছাড়া হল। তবে হীরার দিন যাবে কেমন করে। সে কার কাছে থাকবে। সে লুকিয়ে কাঁদে। নিশি পাওয়া ভূতুড়ে বাই নিয়ে ছুটে ছুটে যায় গঙ্গার ধারে। ঘোরে তেসুতি কলের কলঘরের যন্ত্রের আনাচে-কানাচে আর চোখ মোছে কনুই দিয়ে।

গোলামও রাগ করে। সত্যি, মধু পালিয়ে গেল মোহকে নিয়ে। কার ভয়ে, কীসের অভাবে?

পাগলা সাহেবের নজর এড়ায় না। তার নজর পড়ে হীরালালের উপর। ধর্মান্ধ সেই লোকটার ছেলে এই হীরালাল। তবু হীরাকে নিয়ে পড়ল সে। ওকে এখন থেকেই পাকা-পোক্ত করে তুলতে হবে। নেটিভদের এই ফরসা ছেলেটার অদ্ভুত চোখ দুটোর নিরন্তন অনুসন্ধিৎসা, যন্ত্রের সম্পর্কে অদম্য কৌতূহল, নিয়ত কলঘরে ঘুরে বেড়ানো, পাগলা সাহেবের মনে বিস্ময় ও উত্তেজনার সৃষ্টি করল। টমাসডাফের মি. ওয়ালিক নিজের হাতে নেটিভদের কাজ শেখায়। দিনে দিনে ওরা কর্মঠ কারিগরের দল তৈরি করছে। সেও তাই করবে। কিন্তু কী আছে এ সব নেটিভদের চরিত্রের মধ্যে। ওরা হঠাৎ পালিয়ে যায়, গ্রাম্য উৎসবে মেতে গিয়ে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়। তাই মি. ওয়াল্টার বলে, এক হাতে শেখাও, আরও এক হাতে চাবুক রাখো।

কিন্তু হীরালালের জন্য চাবুকের প্রয়োজন ছিল না। পাগলা সাহেব হীরালালকে নিয়ে পড়ল।

.

ফাল্গুন মাস শেষ হয়ে এল। দোল পূর্ণিমা গেছে কয়েকদিন আগে। কিন্তু এখনও তার রেশ কাটেনি।

দক্ষিণ হাওয়ার ঝড় বইছে। থেকে থেকে সেই হাওয়া চৈতালি ঘূর্ণির গোঁ গোঁ শব্দে মাঠ ঘাট ভেঙে ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে মটর, মুগ, কলাইয়ের পাকা রং ধরা খেতের উপর দিয়ে। লাটিমের মতো পাক খেয়ে উড়ে চলেছে শুকনো পাতার ডাঁই, হারিয়ে যাচ্ছে গঙ্গার ঢেউয়ে ঢেউয়ে।

আম গাছে বোল ফুটে কষুটে আম ধরেছে। কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল। যেন পাঁশুটে খরার কচি কচি বাচ্চা। কচি কিশলয়ে ভরে উঠেছে বট অশ্বথের ডাল। পাকা নাজনা, কাঁচা শজনে ডাঁটা গাছে গাছে।

আকাল এসেছে। সময় বড় খারাপ। মা শীতলার পুজো চলেছে, গাঁয়ের বাইরে। মাকে ওখান থেকেই ফিরে যাওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে। সব ঠাকুরের দয়া চাই। চাইনে মা শীতলার, ওলাই চণ্ডীর। এই মায়েরা দয়া করলে রক্ষা নাই।

দাম বাড়ছে চালের। তিন আনা থেকে চার আনা পাল্লা দাঁড়িয়েছে। পাল্লা অর্থাৎ পাঁচ সের। পাঁচ আনা, ছ আনাও ছোঁবে বলে মনে হচ্ছে। পুরবী বালাম ছ আনায় ইতিমধ্যেই উঠেছে, সাত আনা সাড়ে সাত আনায় উঠতে পারে। তিন টাকা থেকে সোয়া তিন টাকা, সাড়ে তিন টাকায় মন দাঁড়াবে। কে জানে ডালের দর কী রকম উঠবে। সময় বুঝে চালের দাম চড়ল। ডালের দামও উঠবে। উঠলে ক্ষতি নেই, কিন্তু গোলাজাত হয়ে পড়ে থাকলে কী লাভ। বাজার চাষির হাতে নয়, মহাজনদের হাতে। যা করে মহাজন।

.

ফিরে আসছে ঘোষপাড়ার মেলার লোকেরা। আউলচাঁদ বাবাজির লীলাক্ষেত্র। তাঁর প্রধান শিষ্য সদগোপ কুলবধূ সতীমায়ের থান ঘোষপাড়া। সেখানে নাকি অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায় হিমসায়র পুকুরে স্নান করলে। বোবা কথা বলে, কালা কানে শুনতে পায়, বিকলাঙ্গ সর্বাঙ্গ সুস্থ হয়। আউল ধর্মে গুরুই সব। গুরুকে বলে কর্তা। শিষ্যকে বলে বরাতী। এদের বলে কর্তাভজা।

আউলচাঁদ নাকি চৈতন্যের পুনর্জন্ম রূপ। ঘোষপাড়ার ডালিম গাছের তলায় পালেদের কূলবধূকে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেখানেই স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। আবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন সতীমায়ের গর্ভেই। এই জন্মোৎসবই ঘোষপাড়ার দোল মেলা।

নরনারী আসে। ডালিম গাছে মানত করে ঢিল লটকে দেয়। তাতে নাকি মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসে, বেঁধে বেড়ে খায়। সবাই ফিরে চলেছে। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাসী, তীর্থযাত্রীর সংখ্যা নগণ্য। যারা ফিরে চলেছে, তারা অধিকাংশই আমোদবাজ। ঘোষপাড়ার দোল মেলা যেন ফুর্তির জায়গা। এদের দেখলেই বোঝা যায়। চুঁড়ি, বুড়ি, রাড়ি রাঁড়, বেশ্যা ঘুসকি আর আমুদে বুড়ো জোয়ানেরা। হেঁটে, গোরুর গাড়িতে, কেউ কেউ ঘোষপাড়া থেকে কাচরাপাড়া রেল স্টেশনে রেলে করে ফিরে চলেছে। সব রং-এ ফাগে মাখামাখি। নেশা ও ঘুমকাতর চোখের কোলে কালি। কি মিনসে কি মেয়ে। কদিন তাড়ি-মদের শ্রাদ্ধ হয়েছে। মাঠের ঝোপে দোললীলা করেছে সবাই। মেয়েমানুষকে মাঠের মধ্যে উলঙ্গ করে দিয়ে পূর্ণিমার রাত্রে ফুর্তি করেছে বন্ধুরা। হাততালি দিয়েছে, ফাগ ছুঁড়ে দিয়েছে, তাড়া দিয়েছে। আর উলঙ্গ মেয়েমানুষ ছুটে ছুটে পালিয়েছে, তাড়া দিয়েছে সকলে। এ সব করেছে কলকাতা ফরাসডাঙার লোকেরাই বেশি। বাদ বাকি মানা আমোদ লুটেছে।

আঁতপুর, সেনপাড়া থেকে যারা গিয়েছিল ঘোষপাড়ায়, তাদের মুখে শোনা গিয়েছে, মধু আর মোহকে তারা দেখেছে সেখানে। সঙ্গে দেখা গিয়েছে নারায়ণ আর বিমলিকে।

কালী বিশ্বাস করেনি, অবিশ্বাসও করেনি। লোকে যে কত কথাই বলছে। গারুলিয়ায় দেখেছে, ফরাসডাঙায় দেখেছে, চুঁচুড়ায় দেখেছে। সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের কোনও উপায় নেই।

কিন্তু আর কতদিন। এ সব কথায় যে কালী আর সান্ত্বনা পায় না।

.

তেলিনিপাড়ার বাবুদের বাড়িতে গিয়েছিল টমাস ডাফের ওয়ালিক, তাদের বেগ ডানলপ কোম্পানির অতিথি লিটুলজন। ফোর্ট গ্লাস্টারের ওয়াল্টারও গিয়েছিল। একী আশ্চর্য ব্যাপার! সাত দিন ধরে সেখানে যাত্রা গান, কবি গান, বাঈজি নাচ চলেছে। লোকজন কারখানায় যাবে কী, বাড়িতেই ফেরে না অনেকে। সাহেবরা অনুরোধ করল এ গানবাজনা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। বাবুরা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি তাঁরা করতে চাইলেন না। বন্ধ করে দিলেন গানবাজনা।

.

তারপর এল গেরিমাটিতে কাপড় ছোপানোর পালা। সামনে চৈত্র মাস। সকলে সন্ন্যাস নেবে। সন্ন্যাসের শেষ হবে চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক পূজায়। এখন শোনা যাবে ঘাটে মাঠে, জয় তারকেশ্বরো শিবো জয়বাবা তারকনাথ। যেখানে যেমন। কোথাও ভদ্দেশ্বরো শিববা, কোথাও তারকেশ্বর, কোথাও বুড়োশিবের জয় জয়কার।

এখানে তারকেশ্বর। চড়কের দিন সবাই যাবে তারকেশ্বরের মাথায় জল ঢালতে। গাড়ি পালকিতে নয়, বাঁকে ঘড়া গঙ্গাজল নিয়ে যাবে সবাই। কারখানায় দেখা গেল, অনেক মেয়েপুরুষের গায়েই গেরুয়া। কোম্পানির সাহেবরা জানে, আবার দুদিন কারখানা বন্ধের দিন সমাগত।

হাওয়ার বুকে ঝড়ের ইশারা।

মধু এখনও আসেনি। লখাই একলাই মাঠে যায়। ঘরে ধান চাল বাড়ন্ত। তাড়াতাড়ি কোনওরকমে মটর কলাই তুলতে পারলে হয়। শ্যাম তো অথর্ব। কাছে থাকলে হীরাকে দিয়ে কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু হীরা পালাবার জন্য সদাই সচকিত। লখাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কখনও আটকায় না। মাঝে মাঝে উদভ্রান্ত হয়ে ওঠে। কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায়, চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে, হীরা! হীরা কোথায় গেলি?

মাঠের সবাই তার দিকে ফিরে তাকায়। এদিক ওদিক দ্যাখে। কোথায় হীরা।

লখাই ডেকেই বুঝতে পারে। লজ্জা হয়, বুকটা টাটিয়ে ওঠে। না না, হীরাকে সে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কোথায় থাকে ছেলেটা! বাপের কাছে কি এক দণ্ড থাকতে নেই। মধুও নেই। থাকলে চোখে চোখে রাখত। কোনওদিন হয়তো যন্ত্রের মধ্যে পেষাই হয়ে পড়ে থাকবে।

সারদা চলে গিয়েছিল। আবার নিয়ে এসেছে লখাই। কালী একলা পারে না।

একসঙ্গে ঘর সংসার, তার মধ্যে ফসলের কাজ। জাঁতা পেষাই, ঝাড়া বাছা রোদ খাওয়ানো, এ সব কি একলা হাতের কাজ।

লখাইকে অন্য লোকে মাঠে সাহায্য করে। বলে, ছোঁড়াকে নিয়ে এলে তো পারতে।

 লখাই বলে, না, একলাই পারব।

.

২৯.

দক্ষিণের ঝড়ো হাওয়ায় গঙ্গার জলে যেন ডাক ছেড়েছে। সদ্য জোয়ার পড়েছে। এমন সময় সেনপাড়ার ঘাটে এসে নৌকা লাগল। গোঁসাইদের নায়েব এসেছেন। সঙ্গে শ্যামনগরের রাজা প্রসন্ন ঠাকুরদের একজন কর্মচারী।

সবে সকাল হয়েছে। এর মধ্যেই চৈত্র মাসের রোদ চড়ে উঠেছে। গঙ্গার ধারের মাঠে কাজ করছে চাষিরা। আরও উত্তরে তেসুতি কলের বাঁধানো পোস্তার গায়ে নোঙর করেছে স্টিম লঞ্চ। পাট এসেছে। পাট তুলছে কলের মুটেরা। নোয়াখালি চাটগাঁ অঞ্চলের খালাসিরা কৌতূহল ভরে দেখছে এই নতুন দেশ। সকলেই বাঙালি। কিন্তু এর কথা সে বোঝে না।

গোঁসাইদের নায়েবকে দেখে মাঠের সকলে সচকিত হয়ে উঠল। কী ব্যাপার! এমন অসময়ে? একা আমিনেই রক্ষে নেই, তার উপরে নায়েব মশাই। সঙ্গে আবার উটি কে?

হরি দুলে মাটিতে কপাল ঠুকে গড় করল। কাছাকাছি সকলেই দণ্ডবৎ হল।

 নায়েব বললেন, কেমন আছ হরি? খবর সব ভাল তো?

হরি বলল, এঁজ্ঞে, সবই ভাল। হুজুরেরা যেমন রাখবেন, তেমনই থাকব। তা আপনি এলেন যে লায়েব মোশাই?

কেন হে, আসতে নেই নাকি?

রাম রাম কত্তা, আপনাদের রাজ্যি, আপনারা আসবেন না তো কে আসবে। আসেন না তো।

নায়েব মশাই নিরুত্তরে মাঠের উত্তর দক্ষিণে নজর করলেন। দুলেপাড়া আর আগুরিপাড়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, হ্যাঁ, আসতে হল। জমি বিলি বন্দেজ করতে হবে।

জমি বিলি বন্দেজ! জমি কোথায় যে নায়েবকে আসতে হল বিলি বন্দেজের জন্য? কথাটা শুনে খটকা লাগল সকলের। মুখ চাওয়াচায়ি করল সবাই।

হরি সংশয় শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, এঁজ্ঞে জমি কোতায় আর লায়েববাবু যে বিলি করবেন?

নায়েব কয়েক পা এগিয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে বললেন, কেন, এই তো এত জমি রয়েছে, সবই নতুন বন্দোবস্ত হবে। জমিদারের ট্যাক্সসা বেড়েছে, জমিদারকে সেটা উশুল করতে হবে তো! প্রজারা সে হারে খাজনা দিতে না পারলে, পাবার মতো লোককেই বন্দোবস্ত দেওয়া হবে।

মাঠের সব মানুষগুলি ভ্রু কুঁচকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল নায়েব মশাইয়ের দিকে। কথাটা ঠিক ঠাওর হল না যেন। নায়েব মশাই হঠাৎ হেসে বললেন, কাছারিতে এসো সব বুঝিয়ে বলব, বুঝেছ? ভয়ের কিছু নেই। বলো সবাইকে, যেন দলিল দস্তাবেজ নিয়ে সবাই আসে। আইনের সঙ্গে পা দিয়ে চলতে হবে তো। নিত্যি নতুন হেরফের, সব বুঝে নেওয়া দরকার।

বলে নায়েব মশাই সঙ্গের লোকটিকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেলেন।

চৈত্র সকালের নীল আকাশে যেন আচমকা কালবৈশাখীর মেঘ ছেয়ে এল। রং মাতাল বাতাস হল ঝড়ের গোঙানি। কিছুই নয়, অথচ কোথা দিয়ে যেন কী হয়ে গেল। কাছাকাছি যে কয়জনা ছিল, সকলেই কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে রইল।

কিছুদিন থেকে সকলেই মনে মনে সম্ভাব্য অসম্ভাব্য নানান চিন্তায় শঙ্কিত ছিল। শঙ্কা ও চিন্তাটা জমির-ই। সেই যেদিন উটকপালে অলিক সায়েবের সঙ্গে আর একটা সাহেব এসেছিল, সেইদিন থেকে দুশ্চিন্তা ঘুম কেড়েছে সেনপাড়ার। সাহেব দেখে ভয় হয়নি। ভয় হয়েছিল লখাইয়ের কথা শুনে। লখাই সেদিন নির্মম সত্য কথাটা তাদের শুনিয়েছিল। ভয় প্রথম ধরেছিল, কয়েক বছর আগে। যেদিন গোঁসাইদের আমিন মশাই ঢোল সহরত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, গঙ্গার ধারে আর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে না। উপরন্তু, কোম্পানি চাইলে সকলে জমি বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে।

কিন্তু সে কথা ভুলে গিয়েছিল সবাই। আবার সে উৎপাত এসে হাজির হয়েছে। সেই উৎপাতে সকলের মন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু নায়েব মশাই বিলি বন্দোবস্তের কথা বললেন। গত দশ-বিশ বছর থেকে শুধু একই কথা শোনা যাচ্ছে, খাজনা আর টেকসসা, টেকসসা আর খাজনা। দু-এক কথা বললে, কর্তারা বারাসতের কোর্ট দেখিয়ে দেন। আজ কোম্পানির কথা নয়, কথা আরও খাজনা বৃদ্ধি। তেমন উপযুক্ত রায়ত না থাকলে রায়তি স্বত্ব বেদখল হবে। উপযুক্ত রায়ত তারাই, যারা জমিদারের মর্জিমতো বাড়তি খাজনা দিতে পারবে। জমিদারের মর্জির কূল পাথার নেই। প্রজার তো ডাইনে রাখতে বাঁয়ে কুলায় না, বাঁয়ে রাখতে ডাইনে নেই। মর্জির পাথারে সে ভাসবে না, ডুবে যাবে।

ফের খাজনা বৃদ্ধি, নইলে নতুন বন্দোবস্ত। হরি দুলের ভয়ার্ত হৃৎপিণ্ডের পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল বিষধর। সে তার শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। আর মাত্র একটি কোপের অপেক্ষা। তাকে লুটিয়ে পড়তে হবে ধুলোয়।

বোবা উদভ্রান্তের মতো হরি ফিরে তাকাল মাঠের দিকে। তার মূক অস্থিরতা, ভয় ও অসহায় চোখ নিয়ে খুঁজল সবাইকে। লখাই আসেনি। লখাইয়ের কাজ ও কথাকে তার বড় ভয়। তবু তার আশা ভরসা ও আশ্রয় তো একমাত্র লখাই। এমনকী তার বোবা আড়ষ্ট জিভের ভাষাও লখাইয়ের মুখেই। সে কথা যত ভয়াবহ হোক, কানে শুনলে প্রাণে আশা জাগে। সে আশাও বড় ভয়ের। নইলে রাইটারবাবু পর্যন্ত শাসিয়ে দেয় লখাইকে।

এ তো শুধু জমিদারের কথা। তারপরে আছে মহাজন। হরি দুলে আজও মহাজনের কাছে হাত পাতেনি। অন্যান্য অনেকেই পেতেছে। জমি নিয়ে একটু এদিক ওদিক হলে, আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে মহাজন।

মাঠের কাজে আর তেমন মন দিতে পারল না কেউ। এখনও অনেক কাজ। রোস বোসের সময় নেই। এই ফসলটা গেলে আগামী কয়েক মাসের ভবিষ্যতের চেহারাটা দেখা যাবে। অর্থাৎ বোঝা যাবে অবস্থার গতিক।

গোকুল দিগর একটু দূরে ছিল। কাস্তে হাতে হাত দুটো তখনও হাতজোড়ের ভঙ্গিতে হাতে হাতে ঠেকানো। গলা চড়িয়ে হরিকে জিজ্ঞেস করল, কথাটা কী রকম হল হরি দাদা?

জবাব দিল অখিল দুলে। অখিল নমস্কার করেনি নায়েবকে। কানে শুনেছে, আড়চোখে চেয়ে দেখেছে, তবু মুখ তুলে তাকায়নি নায়েবমশায়ের দিকে। সে আপন মনে কাজ করছিল। এখনও কাজ করতে করতেই গোকুলের কথার জবাব দিল, বুইতে পারলেনি কথাটা? আমিন নিয়ে কারবার কর, তা এবার লায়েব মোশাই এয়েছেন। মোশাইয়ের লজরানা দিতে হবে না। নজরানা দিতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

গোকুল বলল, কেন, নতুন কানুন হয়েছে নাকি? জমিদারে এলে তানার নামে লজরানা দেয়। লায়েবের আবার…

অখিল তিক্ত গলায় হেসে বলল, দিতে হবে গো দিতে হবে। লায়েব মোশাইয়ের নামে না দেও, সদর আমলাদের লৌকো ভাড়াটা দেবে তো? এই ফান্ধুন যাচ্ছে, সামনে চোত মাস। পোষের কিস্তি দিতে যাবে তো? লায়েবের লজরানা না দিলে দেখবে শাবনের কিস্তিশোধ নেকা হয়নি। মটর বেচার টাকা সব ওই কিস্তির সুদেই শোধ যাবে। মাটি চষে খাও আর এটা বোঝ না?

অখিল আবার হেসে উঠল। মাঠের সংশয়শঙ্কিত পরিবেশে তার হাসিটা আতঙ্কের চাপা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিল।

সে আবার বলল, আরও বলব? শোন

অখলে চুপ দে, চুপ দে বাবা। বাতাসেরও কান আছে।

 প্রায় ডুকরে উঠল হরি। তার বড় ভয়। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে অখিলের কথা শুনলে। ছোঁড়া আর এক তরো। লখাইয়ের বাড়া। হরির না বলে উপায় কী। অখিল যে তার মজুর কিষাণ। তার ঘরের মানুষ বলা চলে। অন্যান্য সকলেই অখিলের দিকে তাকায়। সকলের চোখেই ভয়। অখিল এক মূর্তিমান কুগ্রহ। অখিলের বাতাসও খারাপ। অতি ভয়ংকর অখিলের মুখের কথা। সে সব কথা যেন দেবতারও অসহ্য। অখিল এক ভয়াবহ কাহিনীর নায়ক। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদের প্রবাদকে সত্যে পরিণত করেছিল সে। সে অঞ্চলে সেই প্রথম।

বছর তিনেক আগের ঘটনা। আমিন মশায়ের কোপে পড়েছিল অখিল। সামান্য ঘটনা। আমিন মশায়ের তলবানা কম দিয়েছিল সে। দেখা গেল, তার আগের বছরের বাকি কিস্তি পাঁচ টাকা কুড়ি হয়ে বসে আছে। সে স্বীকার পাবে কি, কেঁদে ভাসাল। আমিন মশায় শুনলেন না। অখিলের দেবার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু পরের বছর ফসল ভাল হয়েছিল তার। আমিন মশাই কোর্টে দরখাস্ত করে দিলেন। বাকি খাজনা উশুলের জন্য বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট পেয়াদা মোকরার করে দিলেন অখিলের সব ফসল কেটে কাছারির গোলাজাত করার জন্য। সেনপাড়ার তাবৎ মানুষ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে দৃশ্য দেখেছিল। দুশ্চিন্তায় ও ভয়ে সেনপাড়ার অনেক চাষির ঘরে সেদিন উনুন জ্বলেনি।

অখিল গেল রাম ঠাকুরের কাছে। রামদাস বাভুজ্জে মশাই। বড় ভয়ানক লোক। ছিলেন বাংলাদেশের বাইরে, কোম্পানির কাজে। কিন্তু বনল না কোম্পানির সঙ্গে। দিল্লি লখনউ করে ফিরে এলেন। এসে এক আজব কাজ করলেন। ঠাকুর কাগজ ছাপালেন। ফরাসডাঙায় ছাপাখানা খুললেন। সে আবার কোথায়। ফরাসডাঙায় বড় সাহেবের কুঠির গায়ে। সাহেব নিজেই নাকি ঠাঁই দিয়েছিলেন। মহারানির রাজত্বের উপর ফরাসডাঙার সাহেবের বড় রাগ ছিল। আর রাজরাজড়া লোক। রাজার ঘরের খবর তারাই জানেন। কোন সাহেবের ঘরে কার পেট পাতলা রোগ রয়েছে, মায় কোন মেমসাহেবের মাথা উকুন নিকিতে ভরে গেছে সে খবরও জানেন। ঠাকুরকে তিনিই তালিম দেন, এটা লেখো, সেটা লেখো। ঠাকুরেরও বুকের পাটা কম নয়। নিজেও সরস্বতীর ডাকসাইটে ছেলে। তিনি হপ্তায় হপ্তায় ছাপতে লাগলেন বঙ্গসিন্ধু। সে এক হইহই। রইরই কাণ্ড। বঙ্গসিন্ধু তো নয়, হপ্তায় হপ্তায় যেন মুষলের ঘা পড়তে লাগল এ সব অঞ্চলে। কলকেতার এক কাগজে লিখল, কে এই বঙ্গবীর নাম যার রামদাস বন্দ্যোপাধ্যায়? আর এক কাগজ লিখল, কলিকাতার উপকণ্ঠে সিংহ নিনাদ না যাইতেছে। মাত্র বছর দু-তিন আগের কথা। তখন বাংলাদেশের কাগজের উপরও সরকারি কোপকটাক্ষ পড়েছে। লর্ড লিটন সায়েব বীজ পুঁতেছিলেন। সে বীজে জল ঢেলেছিলেন লেফটেনেন্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল। সেই বীজ দেশীয় কাগজের মাথায় মহীরুহের ছায়ার আশায় নয়। নেটিভ পত্রিকার উচ্ছেদের, উৎখাতের, তার স্বাধীন লেখনীকে মুছে দিতে, তার দাবিকে কণ্ঠরোধ করতে। সেই বীজ গাছ হয়ে প্রথমে লেফটেনেন্ট গভর্নর স্যার এডেন সায়েবের থাবা এগিয়ে এল। এল সোমপ্রকাশের উপর।

সানাইয়ের পোঁ সাহেবদের কাগজ আবার শান দিলে এডেনের থাবা। বললে, আর একটু ঠেলে দাও। তেমন খয়ের খাঁ দেশি কাগজও ছিল, ইংরেজের কাগজের প্রতিধ্বনি করল।

তখন মহামহিম লেফটেনেন্ট গভর্নর বাহাদুর শ্রীল শ্রীযুক্ত স্যার অ্যাসলি এডেন মহাশয়ের মুসুল এই শিরোনামা দিয়ে বঙ্গসিন্ধু ঘোষণা করল, এক অবৈধ আইন সৃষ্টি করিয়া, তাঁহারই লালিত সভ্য প্রজার প্রাথমিক ও বৈধ অধিকারে তিনি হস্তক্ষেপ করিলেন। কোনও কাগজ লিখে নাই, ইংরাজ দেশ ছাড়িয়া যাউক। শাসনতন্ত্রের অক্ষমতার দিকগুলি মর্মানুগ্রাহী প্রজামাত্রেই অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া থাকেন। ইহাতে সরকারের কোপ হইলে প্রজা সাধারণের মনে স্বভাবতই সন্দেহের উদয় হয় যে, সরকার প্রজাকে বিশ্বাস করে না, তাঁহার রাজকীয় ক্ষমতা অন্তরে অন্তরে নিয়ত আতঙ্কগ্রস্ত ও ভীত। অতএব, দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি, দৃষ্টব কালানলসন্নিনি। দিশো ন জানে ন লভে চ শৰ্ম প্ৰসীদ বেদনা জগন্নিবাস ॥

চারিদিকে দ্যাখ দ্যাখ করে সবাই ছুটে এল। হুগলি, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, কলকাতা, দু দিনে সব জায়গায়, রামদাস বাড়ুজ্জের নাম সকলে শুনতে পেল। এপারে বিশেষ আলোড়ন হয়নি। কে করবে, লোক কোথায়। আলোড়ন সামান্য হয়েছে হালদার বাড়ি, মজুমদার বাড়ি। চক্রবর্তীরা ও সব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। সেনবাড়িতে তো সন্ধ্যায় বাতি দেখা যায় না বাইরে থেকে।

অথচ রামঠাকুর এপারের মানুষ। সেনপাড়া আঁতপুরের সীমান্তে তাঁর বাড়ি। কিন্তু অধিকাংশ সময় থাকেন ফরাসডাঙায়, নিজের ছাপাখানায়। বঙ্গসিন্ধু তাঁর ধ্যান তাঁর জ্ঞান।

কী মনে করে অখিল গিয়েছিল তাঁর কাছে। গোঁসাই আমিনের এই বেআইনি ক্রোকের বিরুদ্ধে, অখিলকে তিনি মামলা করতে বললেন বারাসতের কোর্টে। তদবির করলেন নিজে। অখিল ঠাকুরের কথায় ঘটি বাটি সব বেচল। কিন্তু রামঠাকুর ভাল বুঝতেন, মন্দ বুঝতেন না। ন্যায় যুদ্ধ জানতেন, অন্যায় সমর জানতেন না। যা না জানলে, বুকে হাঁটা অন্ধকারের সরীসৃপদের সঙ্গে লড়াই চলে না। যে ক্রোক করে ধান কেটে নিয়ে গেল, সেই উলটে নালিশ করল, অখিল ক্রোক অদুল করেছে। মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেটের পিয়াদা মোকরার হওয়ার সংবাদ পেয়ে পূর্বাহ্নেই সে ফসল কেটে ঘরে তুলেছে। পিয়াদার পকেটস্থ হল জমিদারের টাকা।

ফলে, আইনের ফল ফলল উলটো। সর্বস্বান্ত অখিলের হল ছ মাস সশ্রম কারাদণ্ড। সারা সেনপাড়া ভয়ে স্তম্ভিত! তাদের কাছে রাম ঠাকুর হয়ে উঠলেন এক ভয়াবহ জীব। সর্বনাশ! ঠাকুরের ছায়া মাড়াসনি। কেননা অখিলকে পরামর্শ দিয়ে সর্বস্বান্ত তো তিনিই করেছেন। তাঁকে দেখলে সবাই লুকোত। পথে পড়লে তারা অন্য পথ ধরত। ঠাকুর কাগজে বিদ্যে ফলাক, এখানে আর নয়।

রামদাস তা জানতেন। সন্তানেরা তখন ছোট। মাঝে মাঝে হালদারবাড়ি অথবা মজুমদারদের বৈঠকখানায় যান। নানান আলোচনা হয়। বেশির ভাগই ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দুধর্ম বিষয়। কিন্তু অখিলের জন্য বেদনা তিনি কোথাও প্রকাশ করতে পারেননি। কেবল আহ্নিকে বসে তাঁর দু চোখ জলে ভেসে যেত। সান্ত্বনা পেয়েছিলেন স্ত্রীর কাছে। আর চোখের জল রোধ করতে পারেননি জেল হাজতে অখিলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। অখিল বলেছিল পায়ে হাত দিয়ে, ঠাকুর, আমার মনস্তাপ নেইকো। কাণ্ডটা তো আমি সব বুয়েছি। আপনি আর চোখের জল ফেলে আমার অকল্যাণ করবেন না। আপনি একটু কাগজে লিখবেন, লিখবেন রায়ত কি মানুষ নয়?

লিখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, লর্ড কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামক বিষবৃক্ষটি রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার ফল খাইয়া বাঙ্গালার রায়তবৃন্দ মহামারী আক্রান্ত কুকুটকুলের ন্যায় মরিতেছে। এই মৃত্যু হাহাকারের মধ্যে দেশীয় জমিদারগণ শ্মশানবাসী নিশাচরের মতো নৃত্য করিতেছেন। লর্ড ক্যানিং-এর সংশোধিত দশ আইনঔষধ এই মহামারী রোধ করিতে পারিল না। পাঠক, ইহা মস্যাধারের মসী লিখিত নহে, বাঙ্গালার কৃষকপ্রজার নয়ন বারিতে লিখিত হইল।

এ ব্যাপার নিয়েও কম আলোড়নটা হয়নি। আশেপাশের লম্বা বেঁটে রোগা মোটা, সব রকমারি জমিদারেরাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন রামদাস বাঁড়ুজ্জের উপর। কত কুকথা রটনা হয়েছে তাঁর নামে। তাঁর জাতি, সংসার, চরিত্র, পরিবার কিছুই বাদ যায়নি সেই রটনাকারীদের কাছ থেকে। কটুক্তির অন্ত রইল না তাঁর বিদ্যা বুদ্ধি সম্পর্কে।

কিন্তু ঠাকুর অবিচল। হেসেছেন। হেসেছেন আর লিখেছেন, তবু ঠাকুরকে একটু সামাল দিতে হয়েছে।

ফরাসডাঙায় বড়সাহেব ঠাকুরকে একটু রাশ টানতে বলেছেন। লেঃ গভর্নর এডেনের কাল! আঠারো শো আটাত্তরের নএর ধারা হাঁ করে আছে আক্রমণের জন্য। তা ছাড়া সরকারি দিকটা দেখতে হবে। ফরাসডাঙার রাজ্যের মতো এই সামান্য জমিদারি নিয়ে বাংলার গভর্নর বাহাদুরের সঙ্গে টক্কর দেওয়া ফরাসি সাহেবের ক্ষমতা নেই।

ঠাকুর রাশ টানলেন কিন্তু স্থানীয় পণ্ডিতসমাজের উপর তাঁর বঙ্গসিন্ধুর তীব্র কুটি বিদ্যুৎ কষায় হানল। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের উপর খঙ্গহস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। সে জন্য তাঁকে কী নিদারুণ মাশুল দিতে হয়েছিল, সে কথা পরে আসবে। কিন্তু অখিলের ব্যাপারের পর জগদ্দল-সেনপাড়ার ছোট জাতের মানুষগুলিকে পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কটুক্তি করতে দেখে তিনি যেমন ব্যথিত হয়েছিলেন, তেমনি বিরক্তও হয়েছিলেন বিলক্ষণ। আর এই অখিলের ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই লখাইও ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তাঁর ইংরেজ বিরোধিতায় একটা যেন সূত্র খুঁজে পেয়েছিল লখাই। কিন্তু একই গোষ্ঠীর সাদা চামড়াওয়ালা ফরাসি সাহেব ভাল হল কেমন করে এটা সে জানত না। তবু এই ঠাকুরকে ভক্তি না করে উপায় ছিল না।

কিন্তু রামদাস নিজেই সরে থাকেন। লখাই এলেও উৎসাহিত হন না। এমনকী পথ চলতে সত্যি যদি কেউ মাটিতে কপালও ঠেকায়, তিনি নিরুত্তরে, দৃকপাত না করে চলে যান।

জেলে থাকতে অখিল ভেবেছিল, সবই যখন গেছে, তখন ছাড়া পেয়ে কোম্পানির চটকলে যাওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। কিন্তু ভেবে উঠতে পারেনি ছেলেবউয়ের কথা। তাদের কোনও সংবাদও পায়নি জেলে থাকতে। ওই এক ভাবনা পাগল করেছে তাকে। তারপর আঁতপুরের ডোমপাড়ার ভুলো এল জেলে। ভুলো সিঁদেল চোর। তার মুখে সংবাদ পেল, হরি দুলের ঘরে আশ্রয় পেয়েছে তার ব্যাটা বউ।

সে সংবাদ পেয়ে উকুন ছারপোকা আর সারাদিনের ঘানি ঘোরানো, কিছুই তাকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। তারপর যখন ছাড়া পেয়ে গাঁয়ে এল, তখন এসে শুনল, তার বউ কাঁকনাড়ায় থাকে। জার্ডিনদের কলের দালান উঠছে, সেখানে জোগানদারনির কাজ নিয়েছে রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে।

বাপের মতো হরি দুলে। তার মুখ থেকে এ কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত সে স্থির হয়ে বসে ছিল। তারপর বিচুলি কাটার কাটারিটা চোখে পড়তেই ধক করে জ্বলে উঠেছিল চোখ দুটি। সেটাকে হাতে নিতেই হরি দুহাত সাপটে ধরেছিল তাকে। বলেছিল, বাবা অখিল, কথা মা। বউ গেলে বউ হয়, প্রাণ গেলে প্রাণ হয় না। যে গেছে, সে যাক। একটা কাণ্ড করে তুই কেন ফের জেলে যাবি। লোকে হাসবে, আমিন মশাই বলবে, ওই শয়তানটাকে আমি আগেই চিনতুম। ও সব লয়। একবার বলে দেখ, যদি বেটি আসে। না আসে, না এল। তুই থাকবি আমার ঘরে। আমারও তো লোকজন চাই।একটা বছরও পুরো হয়নি। এই বিরাট পরিবর্তন অখিলকে অসহায় বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিল। হরির কথা শুনে কাটারিটা ফেলে দিল সে। তিনদিন তিনরাত্রি না খেয়ে শুধু বিচুলি ঘরে ঘুমিয়ে কাটাল। তারপরে গেল কাঁকনাড়ায় বউয়ের কাছে।

জীবনে এমন দিন অখিলের আসেনি। গিয়ে দেখল বউ রাজমিস্তিরি গোপাল আলির ঘরনি। গোপাল আলি মুসলমান। খিরপাড়ায় তার ঘর। অখিলের প্রাণের মধ্যে কী হয়েছিল জানি না। গোপাল আলির সামনেই সে শান্তভাবে বউকে জিজ্ঞেস করল, কী দুঃখে চলে এলি তুই?

বউ বলল, পরের ভাতে দুঃখ আছেই। তাই খেটে খেতে এয়েছি।

আর এটা?

এটা অর্থে, গোপাল আলির ঘর করা! তার কোনও জবাব দেয়নি তার বউ। নীরবে হুঁকোটা বাড়িয়ে দিয়েছিল অখিলের দিকে। অখিল হুঁকো নেয়নি। গোপাল আলির উঠোনে খেলছিল তার ছেলেটা। একবার ফিরেও তাকাল না। আপন মনে খেলা করতে করতে, আধো স্বরে গোপাল আলিকে ডেকে উঠছিল, বাব্বা! অই বাব্বা।…

কান্না তো মানুষের বুক ফেটে আসে। অখিলের মাথার শির ছিঁড়ে যেন গলার কাছে কিছু ঠেলে এসেছিল। যদিও সেটা কান্না কিনা সে জানে না। কিন্তু ভয়ানক একটা কাণ্ড সে কিছুই করেনি। চলি বলে উঠে এসেছে। তার বউ বলেছিল, আবার এসো।

এই সেই অখিল। লোকে বলেছে, কী বুকের পাটা হরি দুলের। ঠাঁই দিল ওই সর্বনেশেকে। আমিন মশাই কি ওকে ছেড়ে কথা কইবে।

ভয় যে হরির না ছিল তা নয়। কিন্তু তার একটা সীমা আছে। ধর্মের কাছে তো ভয় নেই। ভয় থাকলেও, অখিলকে আশ্রয় না দেওয়া অধর্ম। তাই ঘরে নিয়েছে।

তার বড় ভাই মতি। সে মরে গিয়েছে। মতির ছেলে বহুদিন পূর্বে ঘর ছেড়ে গিয়েছে কোম্পানির রেলে কাজ করতে। সে আর ফিরে আসেনি। ছেলেটার বিয়ে হয়েছিল। সে বউ আজ সধবা হয়েও রাঁড়ি। এক চিমটি বউ এখন বয়সে বাড়ন্ত, মস্ত বড় হয়েছে। কালো দুলেনির নাতবউ। পাপ বউ। তা হলেও ঘর ছাড়েনি মেয়েটা। সঙ্গ করেনি কারুর। রং ঢং বাঁচালতার অপবাদ নেই। হরির নিজের ছেলেপিলে হয়নি। লোক দরকার। অখিলের মতো লোকেরই দরকার তার। খাঁটি মানুষ, খাঁটিয়ে জোয়ান।

তবু অখিলের কথা সহ্য হয় না। এই সেই অখিল। সে কারুর শত্রু নয়, তবু এক ভয়াবহ পরিণতির দর্পণ সে সকলের চোখের সামনে। সহ্য অসহ্য নয়, তাকে দেখলে, তার তিক্ত উত্তেজিত কথাগুলি শুনলে শঙ্কা হয়।

অখিল চুপ করল। তবু কেউ-ই আর কাজে মনোযোগ দিতে পারল না। হরি ফিরে তাকাল সেনবাড়ির দিকে। তাদের আশা, তাদের গৌরব আজ ভগ্ন মৌন হতাশার দ্রুকুটি হেনে জীর্ণ বেশে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার তাদের বিদেশি। কিন্তু সেনবাড়ি তাদের পালক ছিল। তাদের শাসক। দেওয়ানদের দুর্দিনে সব অপরের হাতে চলে গেল। তবু তারা যেন এখনও সেনবাড়িরই প্রজা। তার বাপ কালো দুলের ঘরের বাড়বাড়ন্ত তো ওই সেনকর্তাদের দৌলতেই। হরির মায়ের নাম আজও কালো দুলেনি, সেদিন নাম ছিল মতির মা। সেই মতির মায়ের গলায় সেনগিন্নির সোনার হার উঠেছিল, কে না জানে সে কথা।

কিন্তু আজ! নিঃশব্দ জনহীন সেনবাড়ি। চৈত্র হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস বহে। বাগান বন লতাগুল্মের অবাধ আক্রমণে অন্ধকার। কবিরাজ কমল চক্রবর্তীর গুপ্ত ঔষধি লতার বনজ ঐশ্বর্যভাণ্ডার। আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় হরির বুকের মধ্যে চাপা কান্না দমিত হতে চায় না। অদৃশ্যে জল ঝরে যায় চোখের। আবার বাড়তি খাজনা, আবার বন্দোবস্ত।

.

ঢাক বাজছে শ্যামনগর কালীবাড়িতে। জোয়ারের জলে মান লেগেছে চৈত্র হাওয়ায়। ঢেউ উঠছে। ছপছপ শব্দে দিগন্ত মুখরিত। পাল তোলা ভাউলে প্রায় যেন উড়ে চলেছে উত্তরে। শুশুক পাছা দেখাচ্ছে সূর্যকে। তেসুতি কলের ঘাটে নোঙর করা কলের জাহাজে হইচই। বাংলার দূর পূর্বের মুসলমান খালাসি মাঝিদের হাসির হররা।

নিরবধি এত যে বয়ে চলা, তবু ছোট হয়ে আসছে গঙ্গা। সেনপাড়ার মানুষ ভাবে, ছোট হয়ে আসছে সব। মানুষ, সংসার, খাওয়া, পরা, তার প্রাণ, তার মন। টেমটেমি বাজে মিয়াজি পীরের থানে। জোয়ারের ছলছল শব্দে চাপা পড়ে গেছে হস্তিনীদ্বয় পবনেপেয়ারিদের ঘণ্টাধ্বনি। রম্ভার গলার ঘণ্টাধ্বনিও তো শোনা যায় না। আতপুরের ভিতরে তরফদারদের যুবতী হস্তিনী রম্ভা। সরোবরের ধারে কদমতলায় বাঁধা থাকে সে। কিছু না থাক, তার যৌবন আছে। তরফদারদেরও যৌবন আছে। জাতে গোয়ালা। বিলাসিতা জানে ভাল। সরস্বতী বর্জিত মদোন্মত্ত তরফদার বংশ। জানে মদ মাংস মেয়েমানুষ। ভদ্রলোকদের সঙ্গে পানাহার নেই। কর্তা ফরেসডাঙা থেকে মেয়েমানুষ এনে বাড়িতে ফুর্তি করেন। যৌবন আছে, অন্তস্তলে পঙ্কিল স্রোতে তা আবর্তিত। যৌবনের চন্দন কাঠ পুড়িয়ে তরফদারি চলছে।

নিঝুম হালিশহর পরগনা। হতাশা ও নিরাবেগ। কেবল জার্ডিনদের জমিতে তেসুতির কলে, টমাস ডাফের গারুলিয়ার কারখানায় যন্ত্র ও মানুষের কলরব। সে কলরব বাড়ছে, বাড়ছে, বাড়ছে। ডান্ডি থেকে এসেছে সে ঝড়ের বেগে, স্টিমের পাখায় সমুদ্রের জল কেটে, ডাঙায় লৌহ অজগরের বুক বেয়ে। নতুন নতুন ইমারতের ভিত কাটা হচ্ছে গোটা নদীর এ কূল ও কূল জুড়ে।

.

৩০.

সংবাদ রটে গেল, নায়েব এসেছেন। বার কর দলিল দস্তাবেজ। আইন বোঝ, নিজেরটা বুঝে নাও। নানান রকম রটল। সেটেলমেন্টের লোক আসবে। জমি মাপ জরিপ হবে নতুন করে। গোঁসাইরা পত্তনি দেবে। পত্তনিদার হবে নাকি তরফদারেরা। নগিন মহাজনও হতে পারে। বিশ বছর আগে একবার জমি নিয়ে এলোপাতাড়ি কাণ্ড ঘটেছিল। জমি হেঁটে বেড়িয়েছে এর দোর থেকে তার দোরে। নয়তো হেঁটে চলে গেছে জমিদারের খাস সীমানায়। অর্থাৎ জমি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছিল। এবারও সেরকম হবে।

কিন্তু দুদিন না যেতেই আসল কথা, আগের সম্ভাব্য কথাটাই সকলে শুনল। কোম্পানি জমি নেবে। ইতিমধ্যেই সাহেব এসেছে। সেই নতুন সাহেবটা। অর্থাৎ বেগডানলপের লিজন। নায়েবের সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখেছে জমি। কাছারির পাইকেরা সারা দুলেপাড়া জুড়েই প্রায় খুঁটি পুঁতেছে। পুঁততে পুঁততে আগুরিপাড়া বাগদিপাড়ার সীমানায় চলে গেছে। সঙ্গে আছে সাহেব, নায়েব, শ্যামনগরের ঠাকুরদের সেই কর্মচারী, আর আমিন মশাই। পেছনে পেছনে চোরের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে চলেছে নগিন মহাজন। সে দেখছে কার কার গেল। তার হাতের পাঁচ কেউ কি না। অবশ্য সেদিকে নজরটা আমিন মশাইয়েরও ছিল। তিনি খোদ একজন মহাজন। প্রথমদিন খুটি পোঁতার পর দ্বিতীয়দিন নায়েব এলেন শুধু কয়েকজন পাইক নিয়ে। কিছু লোক ছিল তখন মাঠে। লখাইও ছিল। সকলেই ভবিষ্যতের ব্যাপারে কৌতূহলে ও ভীত চিন্তায় নানান কথা আলোচনা করেছিল। এমন সময় নায়েবকে দেখে সকলেই থমকে চুপ করে গেল।

নায়েব মশাই দক্ষিণ দিকে এগিয়ে লখাইয়ের জমির অর্ধেকটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে খুঁটি পুঁততে বললেন। নায়েব মশাইকে জমির মধ্যে ঢুকতে দেখেই লখাই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুকনো হলদে মঠ। মটরশুটি আর কলাই সবই কাটা হয়ে গেছে। নায়েব মশাইয়ের ইশারা মাত্র পাইকের হাতে শাবল উদ্যত হল।

লখাই এক মুহূর্ত নীরব রইল। কোঁচকানো জ্বর তলায় তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল ধক করে। একবার ঠোঁট নেড়ে আপন মনেই বলে উঠল, কী চায় ওরা।

সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল হরি। লখাইয়ের মুখ দেখে ভয়ে বিবর্ণ হল সকলের মুখ। লখাই ক্ষিপ্ত হল না। সে এগুতে এগুতে একজন পাইককে বলল, কী করছিস বলরাম?

বলরাম পাইক। লখাইকে বিলক্ষণ চেনে শুধু নয়, ভক্তি আছে। পাইকেরা সকলেই খাইয়ের প্রতি কম বেশি অনুরক্ত। বলরাম তাকাল নায়েব মশাইয়ের দিকে। নায়েব বললেন, ও, তুমিই লখীন্দর। এ জমি দান পেয়েছ সেনবাবুদের কাছ থেকে?

লখাই গড় করে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

নায়েব মশাই পূর্বাহেই কিছু শুনেছিলেন সম্ভবত। স্মিত হেসে বললেন, জমি আমরা কোম্পানিকে বিক্রি করব। জমিদার তোমাদের দাম দেবেন, খেসারত দেবেন। তোমার দানপত্রখানি নিয়ে কাছারিতে এসো, আমি সব বুঝিয়ে দেব।

লখাই হাত জোড় করে বললে, বোঝাবুঝির কি কিছু আছে লায়েব মশাই? আপনার উশুল ঠিক থাকলে জমি বেচা পেজার ইচ্ছে। আপনি যদি ভোবা খ্যানার জমি দেন, সে আমি লোব কেন। জমি আমি বেচব না।

নায়েব মশাইয়ের চোখে রক্ত উঠে এসেছে। তবুশান্তভাবেই বললেন, জমিদারের দরকারেও দেবে না?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে লখাই তার সারা জমির উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কিন্তু শক্ত হয়ে উঠেছে তার মুখ। তবুন তীব্র গলায় বলে উঠল, বাবু, জমিদারের পেয়োজন হলে, আমার যা আছে সব মাথায় করে গিয়ে দিয়ে আসব। জমিদার আমার, আপনি আমার। সাহেব কোম্পানির জন্যে কুটো গাছটি আমি জ্যান্ত থাকতে দিতে পারব না। মাপ করেন, খুঁটি পুঁততে বারণ করেন আপনি।

আরও দশজন যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা প্রাণহীন পুতুলের মতো পাংশু মুখে পঁড়িয়ে ছিল। থরথর করে কাঁপছিল তাদের বুকের মধ্যে। বজ্রাঘাতের পূর্বমুহূর্তেই পল গুনছে যেন সবাই।

নিজের কথার বিশ্বাসে ও দৃঢ়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে লখাইয়ের মুখের কুঞ্চিত শিথিল চামড়া। তবু একটা ছায়া পড়ছিল তার মুখে। ছায়াটা হীরার। সেদিনের মাঠের হীরা।

নায়েব মশাই কয়েক মুহূর্ত কিছুটা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ মুখে তাকিয়ে রইলেন। তাকিয়ে দেখলেন সকলের মুখের দিকে একবার। ভাবটা বুঝে নিতে চাইলেন। সত্যি, এই লখাই লোকটার সম্পর্কে তিনি অনেক কথা শুনেছেন। কিন্তু এমন অদ্ভুত, বিচিত্র ও দুঃসাহসী কথা কোনও লোকের মুখে কোনওদিন শোনেননি। তবুনায়েব মশাই চমৎকৃত হলেন না। ভাবিত হলেন। মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আশ্চর্য! এই মানুষগুলি কি সকলেই লখাইয়ের মতোই বাধা দেবে নাকি?

মুখ ফিরিয়ে কী যেন ভাবলেন কয়েক পল। একটা চাপা হাসির ঝিলিক খেলে গেল তাঁর মুখে। হঠাৎ বলে উঠলেন, হয়তো ঠিক বলেছ তুমি। তবে রাখতে পারবে কি? অবশ্যি সেনেরা তোমার সহায়, ওদের গোমস্তারা বলছিলেন, তোমাকে বাঁচিয়ে দেবেন ওঁরা। ভাল কথা। বলরাম চলে চল।

বাদ বাকি সকলের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা কালকেই কাছারিতে যেয়ো। পাইক পাঠাবার হাঙ্গামা যেন না করতে হয়।

বলে তিনি চলে গেলেন।

লখাই একটু অবাক হল। সেনবাড়ি সহায়। কী রকম কথা! কে আছে সেখানে, কে তার সহায়! কে তাকে রক্ষা করবে? কই তেমন কোনও কথা তো সে শোনেনি। তবু মনটা তার আনন্দে ভরে উঠল।

গোমস্তা মশাইরা তার সহায় থাকবেন। তাকে বাঁচিয়ে দেবেন।

তবু একবার সে রামদাস বাঁড়ুজ্জের কথা না ভেবে পারল না। সেই ঠাকুরের কাছে একবার যেতে হবে। তৈরি হতে হবে। বলা যায় না। যদি কোনও বিপদ আপদ হয়।

হরি ভীত ব্যাকুল গলায় বলে উঠল, লখাই ভাই, একী করলে? নায়েব মশাইকে তুমি কি চেন না।

লখাই বলল, চিনি। যা পারব না, সে কথা কেমন করে বলব ভাই। আমার পরনে ন্যাকড়া না থাক, আমার পেটে ভাত না থাক, আমারটা নিয়ে আমি থাকব। কোম্পানির মোড়লি মানতে যাব কেন? পারব না, পারব না, পারব না। লায়েব মোশাই আমাকে বাঁশ ডলা দিয়ে খুন করলেও আমি পারব না।

রাগ নয়, বলতে বলতে গভীর সংশয়ে, যাতনাবিদ্ধ অন্ধকার হয়ে উঠল লখাইয়ের মুখ। হে ঈশ্বর। শতাব্দীর এই পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে, আপন মুখে উচ্চারিত প্রতিজ্ঞা পালনের ক্ষমতা কি আর আছে তার।

সকলে তেমনি ভীত মুখে চুপ করে রইল। তারা কেউ-ই কিছু বলতে পারবে না। তারা একটু চোখের ইশারা দিয়েও সাহায্য বা সমর্থন করতে পারবে না।

হরি বলল, কিন্তু আমরা কী করব লখাই, আমরা বাঁচব কেমন করে?

লখাই যেন আপন মনে বলল, বাঁচতে বোধহয় আমিও পারব না, হরি ভাই। তবু আমার যে মন মানে না, আমি কী করব? বাঁচা বোধহয় যাবে না।

হতাশায় ভয়ে নিশ্ৰুপ সকলে। কী করে বলবে, কেমন করে বলবে তারা। এর মধ্যে ফোঁস করে উঠল অখিল। বলল, জমিদারই বা আমার কোন আপন জনটা এল যে, সে যা চাইবে তা-ই দিতে লাগবে। কী গো লখাই খুড়ো, তুমি যে বললে, জমিদারের পেয়োজন হলে সব মাথায় করে নিয়ে দিয়ে আসবে।

লখাই বলল, হ্যাঁ, দিয়ে আসব। তুই চাইলে তোকে দেব। মুর্শিদাবাদের নবাব চাইলে তাকে দেব। কিন্তু সায়েবকে দেব না। সায়েব সায়েব, আমার কে? সায়েবের কল, আমার কল লয়। সায়েব তার দেশে গিয়ে কল ফলাক গে, আমি দেখতে যাব না।

কিন্তু অখিল বুঝল না। বুঝতে পারল না। তার জীবনের ঘোর অন্ধকারে সে যত খোঁজে, বারেবারে দেখতে পায়, সশস্ত্র নিষ্ঠুর শত্ৰু মাত্র একজন। তার নাম জমিদার। সে বারবার মাথা নেড়ে বলল, তুমি সব ভেবে দেখো খুড়ো। শত্রুর আমার জমিদার। সে আমার সব নিয়েছে, আকোচে নিয়েছে। তাদের আমি সব দিয়ে আসব?

লখাই অসহিষ্ণু হয়ে আবার বলে উঠল, দিয়ে আসব। হাজারবার। তার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়া পরে হবে। মাথা নেই তার মাথা ব্যথা। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া করি, সোম্সারের মধ্যে করি। সে আমাদের সোর। সায়েব আমার কে?

বলতে বলতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল লখাই। ভিতরের এক অসহ্য ক্রোধ তার শিথিল মাংসপেশির ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠল। পা দিয়ে আঘাত করল মাটিতে। বলল, সব নুটে পুটে ডাকাত ফলাবে রাজাগিরি রানিগিরি, আমি তার সেবা করব? ওই রাজার জাতের সোখের লাও না ডুবলে আমার কিছু নেই।

সকলে আরও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। যেন আশেপাশে ওত পেতে রয়েছে শত্রু। এমনিভাবে সকলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। লখাইকে চুপ করতে বলার সাহস হয় না। কিন্তু শুনতে পারে না আর। কী এক সর্বনাশ না জানি হবে লখাইয়ের কথায়।

কেবল অখিল তখনও নিশি পাওয়া আচ্ছন্নের মতো ঘাড় নাড়ছে। ফুলে উঠেছে তার বুকটা। মুখে বোবা যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। চোখ রক্তাভ। সে ফিসফিস করে তখনও বলছে, না, না, না!

কিন্তু লখাইয়ের তাতে মায়া হল না। সে আরও রূঢ় চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, তবে কি কোম্পানি তোর মিতে, তোর ঘরের মানুষ?

অখিল বলল, কোম্পানি মিতে লয়, কিন্তুক জমিদার আমার জমো শব্দুর। যার মুখ দেখতে নেই, তার পাছাও আমি দেখব না। খুড়ো, তুমি মা মোর পুত, তোমার কথা বুঝি না। কিন্তুক

গলা বন্ধ হয়ে গেল অখিলের। করুণ অথচ ভীত চোখে দেখল সবাই, অখিলের চোখে জল এসে পড়েছে। হরি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, থাক, থাক, তুই কিছু বলিসনে অখিল, শুদুমুদু জল ফেলছিস চোখের।

কিন্তু লখাইয়ের প্রাণ মানে না। তারও এমনি করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে অনেক কথা।

এমন সময় সবাই দেখল, সারদা ছুটে আসছে মাঠে। আলুথালু বেশ, এলোমলো চুল। নামে সারদা বোষ্টমী। আসছে যেন ব্যাকুল বৈরাগিণী। কাছে আসতে দেখা গেল, ভয় তরাস চোখে জলের ধারা। বলতে গিয়ে কথা ফুটছে না গলায়।

লখাই ক্রোধ ও অশান্তির মধ্যে তাকে দেখে বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল?

সারদা কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাকে ও সবাইকে এক মুহূর্ত দেখে বলল, কী আবার। তুমি একদণ্ড শান্তি দেবে না। আখড়া ঠাকুর সব ছেড়ে তোমার পায়ে মাথা কুটতে এনু। তা, তুমি তোমার মোন্তরে বেভোর। আমার মরণ নেই, তাই।

কান্না বাকরোধ করল সারদার। অভিমান করেছে, রাগও করেছে। রাগ করলে শেষ আঁচের ইশারা দেখা যায় সারদার চোখে।

এতগুলি লোকের সামনে একটু যে লজ্জা করছিল না তা নয়। একে মেয়েমানুষ হুতাশে এসেছে। তাতে আবার সে লখাইয়ের প্রেমিকা, এই জানাজানিটুকু চাপা অথচ স্পষ্ট আঁকা রয়েছে সকলের চোখে। সে-ই বা ভোলে কেমন করে। প্রেমের তো বয়স নেই।

লখাই বলল, কী হয়েছে বলবে তো?

উদগত নিশ্বাসে বুক ফুলে উঠল সারদার। ঠোঁট টিপেও কান্না রোধ করতে পারল না। বলল, কত হয়েছে, কত বলেছি, বলা তুমি মানো নাকি যে বলব? যে বলার বাইরে, তাকে বলে লাভ। সারা গাঁয়ে টিটি পড়ে গেছে, নায়েব মোশাইয়ের সঙ্গে তুমি বিবাদ বাধিয়েছ।..

লখাই কিছু একটা বলবার উদ্যোগ করতেই সারদা আবার বলে উঠল, ওই এক ঘরে বুড়ো বুড়ি ভাই ভাজ, ছেলেটা গেছে কোন চুলোয়। হীরাটা থাকে কোথায়। আর তুমি পড়ে রইলে আন চিন্তে নিয়ে। আমি না গেনু মন্দিরে, তুমিও রইলে না ঘরে। তবে আমি যাই কোথায়। মরণ ছাড়া আমার গতি নেই।

বলে সে যেমনভাবে এসেছিল, তেমনি দ্রুত পায়ে ফিরে গেল। মুগ মুসুরির রিক্ত মাঠের আল পথের উপরে, তার দ্রুত পদক্ষেপে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে অভিমান ও কান্না। সামনের পথ তার চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেছে। ফালনের হাওয়া দোলা দুপুরের মতো তার মন উতলা। এ উতল দোলা হঠাৎ ভয়ের। তবু বিচিত্র এই মনে মনে সে নিজের কাছে পাপিষ্ঠা। মন্দিরের ঠাকুরে যে তার প্রাণ ভরে না! লখাই আর হীরা তার ঠাকুর, ধন প্রাণ, সব। তা ছাড়াও তার সারা বুক জুড়ে এক অসহ্য বেদনা কখনও কান্নায়, কখনও বিচিত্র জ্বালায়, কখনও বা আনন্দে দুর্বোধ্য খেলায় মেতে ওঠে। সে খেলায় সে কখনও অপরূপ, কখনও কুরূপা। তবু তার হৃদয় বড় শান্ত। সে তার হৃদয় যমুনায় কখনও আলোড়ন তোলে না, নিরন্তর কেটে কেটে তাকে আরও গভীর করে তুলেছে। তুলেছে। সেখানে পরম বিশ্বাসে সে ডুব দিয়েছে। কিন্তু লখাই বা হীরা, যাদের নিয়ে তার যমুনার তলে মৃত্তিকা হনন, তারা কেউ-ই ধরা দেয় না। না, সেনপাড়া থেকে তাকে ফিরে যেতেই হবে আখড়ায়।

লখাই কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ় মুখে নিশ্ৰুপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সারদার দিকে এগিয়ে গেল। খানিকটা এগিয়ে ডাকল, সই, সই শোনো।

শুনল না সারদা। মিছে কেন ডাকাডাকি। যে কারণে সে সেনপাড়ায় এসে রইল, সেই বিপদই বাধিয়ে বসল লখাই। তোমার প্রাণের জ্বালা। কেন, সেই প্রাণের জ্বালা কি তুমি সারদার কাছে রাখতে পার না।

যেখানে সরু নয়ানজুলি আর মরকুটে খেজুর ও কুলের ঝাড়ে খানিকটা ঝোপের সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে এসে লখাই ধরে ফেলল সারদাকে। বলল, দাঁড়াও সই।

সারদা দাঁড়াল। লখাই কাছে এসে বলল, লায়েব মোশাইকে আমি অল্যাজ্য কিছু বলিনি, জিজ্ঞেস করোগে। তবে কী জানো, মরণ তোমার লয়কো, আমারই মরণ ছাড়া কোনও গতিক নেই। আর বেঁচে থাকতে মন চায় না সত্যি।

সারদা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরে দাঁড়াল। হাত দিয়ে চেপে ধরল লখাইয়ের মুখ। ডুকরে উঠল, ছি ছি, মুখের কি একটুস রাখ ঢাক নেই।

–না নেই। আর পারিনে এ মুখের রাখ ঢাক করতে। জম্মে কাটল রাখ ঢাক করে। মরণের কথায় আর ঢাকতে পারিনে।

লখাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সারদা বলল, আমারই ঘাট হয়েছে। আমি যে বুঝি না কিছু। সত্যি কিছু বুঝি না। মাঠ থেকে লোক বাড়ি বয়ে খবর দিয়ে এল, নায়েব আর পাইকদের সঙ্গে তোমার দাঙ্গা হবে। তাই ছুটে এসেছি। কী করব বলে। কালীদি যে হুতোশে মরছে। তুমি গিয়ে বলল, বিপদ আপদ কিছু হয়নি। আমার কথা ধরো না।

লখাই বলল, সবার কথা ধরব, আমার কথা ধরব না। সকলে ভয় পায়, মোর গোঁ শোনে। সই, ভগমান কি শুধু আমার বুকের আগুন জ্বেলে দিয়েছে।

না, আগুন সকলের প্রাণেই জ্বলেছে। কম আর বেশি। বেশি হলে প্রকাশ পায়। কম হলে ভিতরে ভিতরেই ছাই হয়ে যায়। সকলেরই জ্বলছিল। মাঠের সকলেই তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। তবু জীবনের এই বিপদ সন্ধিক্ষণে, বৃথা আক্রোশে, ক্ষোভে ও ভয়ে তাদের প্রাণও মরিয়া হয়ে উঠতে চাইছে। তাদের যুগ যুগান্তরে নত মাথা ঘাড়ের শিরা ছিঁড়ে উঠে পড়তে চাইছে। কিন্তু তার বোবা অন্ধ ভীত হৃদয় তাকে টেনে রাখে। কোম্পানি আর জমিদারের শক্তি বুঝি ভগবানের চেয়ে অসীম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *