২. মধু আগে পিছনে না দেখে

১১.

মধু আগে পিছনে না দেখে একেবারে ফোর্ট গ্লাসটারের তেসুতি কলের সীমানায় এসে দাঁড়াল।

কলের বাঁশি বেজে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।

কলের মানুষেরা তখনও বেশির ভাগ ভিড় করে রয়েছে সামনের মাঠে ও বাগানে। শুকনো মাঠে রোদে পিঠ দিয়ে এলিয়ে পড়ে আছে কেউ কেউ। গোটাকয়েক হুঁকো ঘুরছে হাতে হাতে। কোয় মজলিশ বসেছে নব সুরের মুদির দোকানে। কোঁচড় ভরে মুড়ি আর পাটালি গুড় খাচ্ছে অনেকে নব খুডোর দোকান থেকে। অদূরেই আমবাগানের কোল ঘেঁষে বসেছে মেয়েরা। বলছে নানান গালগল্প। কান পাতলে শোনা যায়, কাঁকিনাড়ার জন্ম বাউণ্ডেলে ভেলো বৈরাগি গান ধরেছে,

কলেতে নিলুম কাজ
ছেড়ে গেল বউ ভাজ
এবার ঠাঁই দে গো পাটেশ্বরী মা,
গেছে নাঙল জোয়াল বলদ
মা গো, ঘর ভাঙা করলিনি রদ
গড় করি গো পাটেশ্বরী, তোকে ছেড়ে যাব না।

 মজলিশ ও আড্ডার এই খানিকটা সময়। সেই ভোর পাঁচটায় রাত্রি থাকতে কাজ আরম্ভ হয়েছিল। যখন লোকজন গ্রামবাসীরা কাঁথার তলায় ওম করছে, হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে, পশ্চিম আকাশে অন্ধকার নাবিতে দপদপ করছে শুকতারা, তখন শুরু হয়েছিল কাজ। তারপর দু ঘণ্টার ছুটি। তারপর আবার চলবে রাত্রি আটটা নটা পর্যন্ত। মাঝে বিকালে আবার ঘণ্টাখানেকের ছুটি। এখানে ঘড়ি নেই, আর ঘড়ি দেখতেও জানে না কেউ। সুতরাং রাত্রি আট প্রহর কি নপ্রহরে ছুটি পাওয়া যায়, সে কথা জানে না কলের মানুষেরা। ফিরে যাওয়ার সময় সমস্ত গ্রামগুলি নিঝুম হয়ে যায়। ঘরে ঘরে শোনা যায় ঘুমন্ত মানুষের নিশ্বাস ঝিঁঝি ডেকে চলে একটানা। মনে হয়, রাত্রির মধ্য প্রহর পেরিয়ে গিয়েছে।

যারা দূর থেকে আসে, তারা বাড়ি যায় না। একেবারে কাজের শেষে বাড়ি ফিরে যায়। যারা আসে কাছাকাছি গ্রামগুলি থেকে, সেনপাড়া জগদ্দল আতপুর থেকে, তারা বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসে।

মাঠের সংলগ্ন উত্তরে আলকাতরা পালিশ করা বিরাট টিনের দোচালা মাথা উঁচিয়ে উঠেছে। মাথা থেকে ত্রিকোণাকার ভঙ্গিতে নেবে এসেছে দু পাশের চালার টিন, যেন অতিকায় আকাশচারী পাখিটা পাখা মেলে দিয়ে বসেছে মাটিতে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি টিনের বেড়া। বেড়ার গায়ে খড়খড়িহীন চৌকো জানালা কাটা। ঝাঁপের মতো ছিটে বেড়ার ঢাকনা বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেকা দেওয়া রয়েছে। কয়েক হাত অন্তর অন্তর মস্ত বড় বড় টিনের দরজা। এ দরজার পাল্লা নেই, মাটিতে পাতা রেলিঙের উপর চার ইঞ্চি চাকার সঙ্গে যুক্ত করা রয়েছে দরজা। দরকার হলে দরজা সরিয়ে দেওয়া, আবার ঠেলে বন্ধ করা যায়। এই দোতলা বিরাট টিনের ঘরটার নাম কলঘর। সাহেবা ইংরাজিতে বলে মেশিন শপ। সারাদিনে খোলা দরজা-জানালাগুলিই আলোর কাজ করে। রাত্রে জ্বলে গ্যাসবাতি। যে গ্যাসবাতি পালাপার্বণে, নাচগানের আসরে জ্বলে আতপুরের রাজার বাড়িতে, তেলিনিপাড়ার বাঁড়ুজ্জে বাবুদের বাড়িতে, ফরাসডাঙার সাহেবের কুঠিতে। স্ফটিকের মতো সেই আলো কলঘরকে যেন দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল ও পরিষ্কার করে তোলে।

চালার উত্তরের শেষাংশের গা ছুঁড়ে উঠেছে চিমনির চোঙা। চালার পিছনে ঢাকা পড়ে গিয়েছে বয়লার ও স্টিম ঘর। সেখানে এখন একটানা শোঁ-শোঁ শব্দের মধ্যে, কাঠের বুকে সুদীর্ঘ করাতটানার মতো ঘসঘস শব্দ হচ্ছে ধীরে ধীরে, বিলম্বিত লয়ে। স্টিমের নলে কোঁতল মারা হয়েছে। কোঁতল হল কন্ট্রোল। স্টিম কন্ট্রোল করে তার এনার্জিকে অত্যন্ত সাবধানে অন্যপথে সামান্য সামান্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ওই ঘসঘস শব্দটা তারই। পশ্চিম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ইটের গাঁথনি দেওয়া, মাথায় গোলপাতার ছাউনি ছাওয়া তিনকামরা বাড়ি। সামনে খাটো খাটো থামওয়ালা বারান্দা। ওটা অফিসবাড়ি, কলের দপ্তর। দপ্তর জীবনকেষ্ট ঠাকুরের। অর্থাৎ, বাবু আছেন কুল্যে তিন-চার জন, তার মধ্যে বড়বাবু হলেন ভাটপাড়ার জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। সাহেবের মন্ত্রী হলেন তিনি। নানান কাজে ও সমস্যায় তিনি মন্ত্রণা দেন।

আরও পশ্চিমে, গঙ্গার কোল ঘেঁষে সাহেবের একতলা কুঠি। কারখানার দিকের দালানে অষ্টপ্রহরই চিকের আড়াল দেওয়া থাকে। কুঠির মাথার উপরে ত্রিকোণ মুকুটের মতো ইটের গাঁথনি দিয়ে চূড়া করা হয়েছে। সেই চূড়ার মাথায় গাঁথা রয়েছে বিদ্যুৎ আকর্ষক লোহা।

আশেপাশে শুধু নব সুরের দোকান নয়, দুরে অদূরে ছড়িয়ে রয়েছে আরও কয়েকটা ছোটখাটো দোকান। দক্ষিণে পেছিয়ে রয়েছে বাজারের কয়েকটা ছোট ছোট চালা ঘর। ওটা জগদ্দল বাজার। তার পিছনেই বিনু মুচিনির তাড়ির দোকান। দোকানের মালিক বিনু মুচিনি নয়, বিনুর স্বামী ইন্দির, অর্থাৎ ইন্দ্ৰ মুচি। কিন্তু লোকে বলে ওটা বিনু মুচিনির রসের কারখানা। ইন্দিরকে পাওয়া যায় কালে ভদ্রে। নগদ কারবার চলে বিনুর সঙ্গেই। ওখানে রসে রসে পাক খেয়ে হয় রসায়ন। তাড়ি এক রস, বিনুও আর এক রস। কেউ তার পর নয়। মুখে হাসি ছাড়া কথা নেই, বিলোল ও চুলটুলু কটাক্ষ বিনা তার চাউনি নেই। নগদ কারবারে ফাউ দিতে কার্পণ্য নেই বিনুর। ফাউ বিনু নয়, এক কটরা রস। যাকে বলে মাটির গেলাস। তা ছাড়া বিনু যদি সঙ্গে বসে, ফাউয়ের কোনও হিসাব থাকে না তখন। বিনু যখন মাতাল হয়, বিস্রস্ত বেশে আলুথালু কেশে রঙ্গভরে নাচে, বাদবাকি সবাই তখন এমনি মাতাল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গেই মাতাল হয় বিনুর কালো কালো বাচ্চা দুটি। উলঙ্গ শুয়োরছানার মতো তারাও নাচে তা-থই তা-থই করে।

এখন সেখানেও ভিড় করেছে কেউ কেউ। দুপুরের অবসরে জগদ্দল ও আগুড়িপাড়ার মধ্যস্থলে এ স্থানটিকে মনে হয় মেলার মতো। যেন মেলা বসেছে মানুষের। এখানে সকলেই মধুর পরিচিত। জোয়ান-বুড়ো সকলে তার দোসর। কিন্তু কারুর দিকে সে ফিরে তাকাল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল একটা গাছের তলায়। তখনও তার চোখ জ্বলছে। তার স্থির দৃষ্টি শূন্যে নিবদ্ধ। কী যেন সে চিন্তা করছে, কিছু একটা স্থির করছে মনে মনে। এমন সময় অলটার সাহেব, অর্থাৎ ওয়াল্টার মাথায় ঘাসের বোনা টুপি দিয়ে অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সঙ্গে তার হাজিরাবাবু ভূত কায়েত। ভূতনাথ বোসকে সবাই ভূতো কায়েত বলে ডাকে।

ওয়াল্টার ভূতনাথকে গেটের কাছে যাওয়ার হুকুম দিয়ে মাঠে নেমে চিৎকার করে উঠল, হেই ভালা আদমি, স্যাটানের দল, কাম পাকড়ো, কাম পাকড়ো

এবার আড়মোড়া ভাঙল সবাই, চারদিকে গুনগুনানি উঠল, ওই গো, অল্টারের ডাক পড়েছে।

ওয়াল্টার মাথা থেকে টুপি খুলে সপাসপ নিজের উরুতে আঘাত করতে করতে হেঁকে বলল, হারি আপ, জোয়ান। হেই মাগি, হেই মাগিলোক, টুমার এট কী কটা হয়, আঁই, কী কটা? টুমার বাঁশি শুনলে কিনা।আগে পিছনে সবাই কলঘরে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু মন্থর গতিতে। রোজই এমনি হয়। ঠিক সময়ে কারখানার বাঁশি বেজে যায়। কিন্তু যন্ত্রের শাসন এখনও ততখানি শিকড় গাড়তে পারেনি। সাহেবকে এসে রোজই ডাকতে হয়, এদিক ওদিক ঘুরে তাড়া দিয়ে দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু ছুটোছুটি করে না কেউ। গ্রাম্য জীবনের সেই মন্থরতা এখানেও বিরাজিত।

মেয়েরা হাসতে হাসতে চলেছে দল বেঁধে। তাদের মাঝে মধ্যমণিটির মতো দুলতে দুলতে, খিলখিল হাসির লহর তুলে চলেছে লক্ষ্মী বাগদিনি। জগদ্দলের লক্ষ্মী। কালো কুচকুচে রং, মাথায় তার বাসি খোঁপা আধখোলা হয়ে ঝুলে পড়েছে ঘাড়ের কাছে। বছর তিরিশের কোঠায় এসেও সেই আঠারোর আঁটুনি তার শিথিল হয়নি একটুও। লক্ষ্মীরই গলা শোনা গেল, বাঁশি বাজলে কী হবে, সে যে আসেনি।

ভেলো হেঁকে জিজ্ঞেস করল, কার কথা বলছ গো লক্ষ্মীদিদি?

লক্ষ্মীর চেয়ে বয়সে বড় ভেলো বৈরাগি। কিন্তু লক্ষ্মীর কাছে নিজেকে ছোট করে হাজির করতেই তার আনন্দ। লক্ষ্মী বলল, কে আবার? সে যে আমার মরণ!

লক্ষ্মীর পাশেই অধরা, অধরার পাশে তার ছেলের বউ। বউয়ের মাথায় ঘোমটা, চেহারা তার নজরে পড়ে না। অধরার কড়া শাসনের এই পদ্ধতি। নাম তার মোহ। সবাই ডাকে মউ বলে।

সে কথা শুনতে পাচ্ছিল মধু। সেও তাকিয়েছিল ওদিকেই। কাউকে দেখছিল না, দেখছিল একজনকেই। চোখের দৃষ্টি গিয়ে শান্ত হয়ে এল তার। সে শুধু দেখছে এত লোকের মধ্যে একজনকে। কিছুক্ষণ আগের সমস্ত বিবাদ বিসম্বাদ ভুলে বুকের স্তব্ধ রক্তে একটা মৃদু মত্ততার ক্ষীণ কলরোল ক্রমাগত উত্তাল ঢেউয়ের গতিতে ছুটে আসতে লাগল। হৃৎপিণ্ডের তালে তালে ধকধক করে বাজতে লাগল শুধু একটি কথা, একটি নাম, মোহ।

মউ! মউ!

সেই মুহূর্তেই স্টিমঘর থেকে বারকয়েক ঘটঘট শব্দ করে আচমকা টিনের শেডের মধ্যে যেন একসঙ্গে সহস্র ঘোড়া জোর কদমে ঝনঝন শব্দে ছুটতে আরম্ভ করল। চকিত চমকে ভীত পাখির দল কিচির-মিচির করে আকাশে উড়ে গেল। কয়েকটা বাঁধা গোরু ছুটে গেল এদিকে ওদিকে। এক মুহূর্ত পরেই শব্দটা একটানা গোমরানিতে পরিণত হয়। গ্রাম্য নিঝুমতার মধ্যে দুর থেকে মনে হয় একটানা ঝিঁঝির ডাকের মতো। এখনও জগদ্দল-সেনপাড়ার গ্রাম্য শান্ত নিঝুমতাকে ভেঙে দিতে পারেনি ফোট গ্লাস্টারের তেসুতি কল।

.

১২.

মধু সোজা চলে গেল বয়লার ঘরে। বয়লার ঘরটা দিনের বেলাও আধো অন্ধকার। মন্দিরের গম্বুজের মতো বিরাট পাথরের ঘেরাওয়ের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের উপর জলের ট্যাঙ্ক। তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে অগ্নিকুণ্ডের ধোঁয়া নিষ্কাশনের চিমনি। জলের ট্যাঙ্কের মোটা পাইপ চলে গিয়েছে গঙ্গার বুকে। জল এসে টগবগ করে ফুটছে ট্যাঙ্কের মধ্যে। লোকে বলে ট্যাঙ্কি। সে ট্যাঙ্কও আর দশটা ট্যাঙ্কের মত নয়। নিচ্ছিদ্র লোহার বিরাটকায় জলাধারের উপর সিমেন্টের পলেস্তারা। মাত্র একটি লোহার পাইপের ভিতর দিয়ে ফুটন্ত জলের বাষ্প চলেছে শোঁ-শোঁ করে। পাইপ নয়, সাহেব বলে স্টিম চেস্ট।

মধুর চোখের সামনে যন্ত্রটার লৌহঅন্ধ সুড়ঙের সমস্ত রহস্য একে একে ভেসে উঠতে থাকে। নাম মনে থাকে না, কিন্তু এই যন্ত্রের প্রতিটি অন্ধিসন্ধি সে চিনে নিয়েছে। চিনে নিয়েছে তার নিজের মনের মতো করে। সাহেব বলে স্টিম, সে বলে দম। দম-ই তো। মানুষের দেহের প্রতিটি কোষ ও রক্তপ্রবাহের অগণিত বিচিত্র শিরা উপশিরার মতো এক এক করে তাকে দেখিয়েছে পাগলা সাহেব। তার কাছে এই সমস্ত যন্ত্রের সবটা মিলিয়ে একটা মানুষ হয়ে উঠেছে। যার অন্ধিসন্ধি নাড়িনক্ষত্র সবই জানা যায়। প্রাণের সেই সবটুকু খুলে দেওয়া পরিচয়েই তো একজনকে ভাল লাগে। যার প্রাণের গোপন সংবাদ ধরা পড়ে, সেই তো হয় বন্ধু। তেমনি এ বিরাটকায় যন্ত্র ধীরে ধীরে মধুর বন্ধুত্বের পর্যায়ে এসেছে। এই যন্ত্রের জাদুকে সে ভালবেসেছে।

তাই স্টিম চেস্টকে সে বলে শ্বাসনালি। পাগল সাহেব হোহো করে হেসেছে। বলেছে, কেয়া বোলা? শ্বাসনালি?

তারপর পিঠে চাপড় মেরে বলেছে, ঠিকই, স্টিম চেসট থেকে শোঁ-শোঁ শব্দে বাষ্প চলেছে সিলিন্ডার স্লাইড ভালবের লোহাসুর দানবটার হৃৎপিণ্ডে। সেই বাষ্পের ধাক্কায় পিস্টনরড একদিক থেকে উপরে। ধাক্কা মারছে, আর নীচে থেকে ক্র্যাঙ্ক শ্যাফটের শক্ত মুঠি চক্রাকারে পাক দিয়ে চলেছে ফ্লাই হুইল। ক্র্যাঙ্ক শ্যাফটকে মধু বলে, কানশাফটু। ফ্লাই হুইল হল লাহুল। এ শুধুমাত্র মধুর কথা নয়, ইংরেজের কলে দেশি মিস্তিরিদের সকলের একই উচ্চারণ।

গোলাম বয়লারের চুল্লি থেকে খানিকটা দূরেই গামছা পেতে শুয়েছিল। পৌষের শীতে শুধু এই ঘরটাই আরামদায়ক নয়, মেঝেটাও গরম হয়ে রয়েছে। চারদিকে কয়লার গুঁড়ো ছড়ানো। গোলাম সদ্য কয়লা দিয়েছে বয়লারে। তাই এখনও পরনে তার গামছা। কয়লা দেওয়ার সময় সে গামছা পরে, মাথায় গামছা বাঁধে। তার শক্ত বেঁটে শরীর কয়লার গুঁড়ো ও আগুনের হলকায় হয়েছে কালীবর্ণ। মাথার কাছে দেওয়ালে খাড়া রয়েছে বেলচা।

মধু ভাবল গোলাম ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ঘুমোয়নি। পায়ের শব্দে চোখ মেলে মধুকে দেখেই গোলাম উঠে বসল। বিস্মিত হয়ে বলল, বাড়ি যাসনি? মধু জবাব না দিয়ে গোলামের কাছে এসে পড়ল। গোলাম তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, দুলেপাড়ার ঘটনা নিয়ে নিশ্চয়ই বাড়িতে গণ্ডগোল হয়েছে। ঝগড়া হয়েছে হয়তো মায়ের সঙ্গে। কিছু বলেছে হয়তো ওর লখাই খুড়ো। জিজ্ঞেস করল, মদো, খেয়েছিস?

মধু শুনতে পেল না যেন। না, মায়ের কথা মনে নেই তার। কষ্ট হচ্ছে না খিদের জন্য। সে ভাবছিল তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা। স্বপ্ন দেখছিল, সেও ওপারের কেদার মিস্তিরির মতো বড় মিস্তিরি হয়েছে। এপারে ওপারে দেশজোড়া তার খ্যাতি। নিজের চোখে দেখে এসেছে, কেদারের কাঁচা ভিটেয় উঠেছে পাকা বাড়ি। ইটের ভিত, ইটের ছাত। মধুও সেই সুখের স্বপ্ন দেখছে, তার পাকা ঘরের শানে রুপোর বাঁকমলপরা পা ছড়িয়ে বসেছে মোহ। মউ!

গোলাম তাকে একটা ঠ্যালা দিয়ে বলল, হল কী তোর? মারামারি করেছিস নাকি কোথাও!

মধু গোলামের দিকে তাকাল। দিনের মধ্যে হাজারবার সে ওই স্বপ্ন দেখে। শুতে বসতে খেতে ওই তার ধ্যানজ্ঞান। আবার তার কিছুক্ষণ আগের ভাবনাই ফিরে এল। বলল, মারামারি করব কার সঙ্গে। তবে, ভাবছি, আর নয়, এবার কলের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলব।

মধুর মুখে এ কথা আরও অনেকদিন শুনেছে গোলাম। শুনেছে, কিন্তু মধু বারবারই পেছিয়ে গিয়েছে। কলের খাতায় আজও তার নাম ওঠেনি। পাগলা সাহেব বলেছে, তোমার হাতে আমি পুরো কারখানা ছেড়ে দেব। তুমি সব চালাবে, সকলের কাছ থেকে কাজ আদায় করবে। কিন্তু মধু তা পারেনি। তার ইচ্ছা অন্যরকম। এ তেসুতিকলের ছোট আবেষ্টনীতে বেঁধে রাখতে চায় না সে নিজেকে। সে ভাবে গারুলিয়ার কলের কথা, ভাবে তেলিনিপাড়া, চাঁপদানি, গৌরীপুরের বড় বড় কারখানার কথা। এখানে সে হাত পাকাতে চেয়েছিল। হাত পাকানো আজও শেষ হয়নি। গোলাম বলল, তালে বাড়িতে ঝগড়া করে এয়েছিস বুঝিন?

মধু বলল, বাড়িতে যাব না আর।

গোলাম তার আগুনে-পোড়া মুখে এতক্ষণে হাসল। হেসে বলল, সেই ভাল। তুই বোস আমি আসছি।

মধু গোলামের হাত চেপে ধরে বলল, কোথা যাচ্ছিস?

 ছাড় না, আসছি।

বলে দুজনে চোখাচোখি করে হেসে উঠল। এতক্ষণে মধুর মনের সমস্ত অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো ফুটল মুখে।

গোলাম বলল, ওরে শালা, তুই যা ভাবছিস তা লয়। ছাড়, চাড্ডি মুড়ি আর গুড় নিয়ে আসি, আগে খেয়ে নে। পাগলা সায়েব এল বলে। ছেড়ে দে, ঘুরে আসি।

বলে নিজেকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আবার বলল, দেখিস, সাত তাড়াতাড়ি আবার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকিসনে যেন।

মধু হেসে বলল, আমার বয়ে গেছে।

গোলাম বেরিয়ে গেল হাসতে হাসতে। মধুও আপন মনে হাসতে লাগল আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে। তাকে দেখে মনে হয়, একটা আদিম বাংলার মানুষ আপনার মনে একলা কথা বলছে। তার কালো রং, টানা টানা কালো চোখ, একটু বা চ্যাপটা ছোট নাক আর ঘন কুঞ্চিত চুল।

গোলামের কথা শুনে প্রাণটা তার আবার ভরে উঠেছে। সে ভেবেছিল গোলাম বুঝি কলঘরের দিকে চলেছে। তাই চেপে ধরেছিল। কলঘরে যাওয়া মানেই, মোহকে সংবাদ দেওয়া। গোলাম নিজে বলে না মোহকে, কানে কানে সংবাদ দেয় লক্ষ্মী বাগদিনিকে। লক্ষ্মী বলে মোহকে। মোহ আসে লক্ষ্মীর সঙ্গে, অধরার কুটিল চোখের সন্ধানী সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে।

এমনি কতদিন হয়েছে। আর মধুকে খাওয়ানো, সেও গোলামের নতুন নয়।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে মধু আর থাকতে পারলে না। তার সারা দেহের উচ্ছলিত যৌবনের মতোই তার প্রাণের বেগ।

সামনেই রয়েছে পাকার কয়লার পাহাড়। বয়লারের অগ্নিকুণ্ডের একটা মুখ খুলে দিল। সেদিকটার কাঁচা কয়লার লেলিহান শিখা, ঝাঁপিতে পোরা অজগরের মতো বাইরের দিকে ফোঁসফোঁস করে ছোবলাচ্ছে। সেটা বন্ধ করে আর একটা দিক খুলে দিল। এদিকে আগুন ঝিমিয়ে এসেছে। বেলচা দিয়ে কয়লা ঠেলে ঠেলে দিতে লাগল মধু। একাজে তার হাত পোক্ত হয়ে গিয়েছে। বেলচা যেন তার হাতের খেলনা। আনাড়ি লোকের বেলচা তুলে কয়লা দিতে একবেলা যায়। মধুর হাত চলেছে পিস্টন রডের মতো দ্রুত। বয়লারের অগ্নিগহ্বর থেকে পিঙ্গল ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান জিহ্বা বেরিয়ে আসছে। মধু ঘেমে উঠেছে। তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে একটা ছায়া ঘনিয়ে এসেছে মুখে।…মনে পড়ছে একটা কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি বাড়ি আর দুটি মুখ। বাড়ি ভাঙা। মাথার গোলপাতার ছাউনি পড়েছে ভেঙে। ভেঙে গিয়েছে মাটির দেওয়াল, কাঁচা মেঝে ও দাওয়ার চারিদিকে ইঁদুরের গর্ত। উঠোনে গজিয়েছে ঘাস, সেখানে চরে গোরু আর ছাগল। চারিদিকে কালকাসুন্দের বন, আলোকলতার অন্ধকার বেষ্টনী। আর মনে পড়ে কানুতাঁতির কাটুনি বউ ও তার মেয়ে। সে মেয়ে মরে গিয়েছে। মধু তখন নবকিশোর। কিন্তু কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়েছিল সেই ছেলে। তাদের সমাজ প্রেম জানে না, জানে না ভালবাসা। হেসে বলে রং, কেঁদে বলে পিরিত। পিরিতের রীতি বুঝত না, তবু কিশোরের পাগল বুকে সে মেয়েই ছিল তার প্রেমিকা। পুঁই-মেটুলির রাঙা রসে সে মেয়ে রাঙাত ঠোঁট, হাতের চেটো, কপালে দিত টিপ। কানে পরত ছাগলবটি লতার কানফুল, আকন্দ ফুলের পরাগের নাকছাবি পরত নাকে। নবীনা কিশোরী সাজত বনসুন্দরীর সাজে।

সে মেয়ে মরে গেল। মধুর কিশোর বুকে বাজল প্রথম বেদনা। বিরহের গুমরানির মাঝে এল যৌবন। তারপর কবে একদিন মোহ-র ঘোমটা-চাপা মুখ পড়ে গেল নজরে। প্রাণে বাজল আবার রঙের বাঁশি। তবে বড় শক্ত ঠাঁই। সে শক্ত ঠাঁই অধরা। কিন্তু সে শক্ত ঠাঁইয়ের বুকে মধুও ধারালো কুড়োল। সে ধার দিনে দিনে তীক্ষ্ণ ও শাণিত হয়ে উঠেছে মোহরই খর চোখের চাউনিতে। এমনি নয়, তাতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

মোহ ঘোমটা-ঢাকা থাকে বটে, কিন্তু সে দর্পিতা। তাকে যেদিন প্রথমে অধরা নিয়ে এল বাড়িতে, সেদিন সারা সেনপাড়া-জগদ্দলে শুধু একই জল্পনা কল্পনা। কার মেয়ে, কোথাকার মেয়ে, সে হদিসের জন্য সবাই ব্যস্ত। লোকে ধরল মদনকে। মদনও জানত না, সে কোথাকার মেয়ে। মায়ের হুকুমে একদিন তাকে ফরাসডাঙায় যেতে হল। সেখানেই অধরার সইয়ের বাড়িতে মোহর সঙ্গে বিয়ে হল। মদনের। মদন চেয়েও দেখেনি, বিন্দুমাত্র কৌতূহলও প্রকাশ করেনি। তার সারা বুক জুড়ে ছিল কাতু। মদনের বোধসোধ কম, মনের মধ্যে কোনও কিছু গোছগাছ করে বিচার করা তার দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু নারাণের সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া বিদ্রোহিণী কাতুর মুখখানা যতবার সে স্মরণ করেছে, ততবারই দেখেছে তার সেই নির্ভীক হাসির তলে তলে কাতু এক অশ্রুমতী দিশেহারা বালিকা। মদনের শাসন ও ভালবাসার বাইরে বটে, কিন্তু মদন নিজেকে চিরদিন কামনা করেছে কাতুর শাসন ও ভালবাসার অধীন হওয়ার। তাই যেদিন সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে, নিঃশব্দে মায়ের সঙ্গে মোহকে নিয়ে ঢুকল সে বাড়িতে, সেইদিনই মদন প্রতিজ্ঞা করে বসল, ঢের হয়েছে আর নয়। চিরকাল কাতুর পায়ে পড়ে থাকব, তবু এখানে আর নয়!

কয়েকদিন পরেই ঘর ছেড়ে চলে গেল সে। গেল কাতুর কাছে। কাতুও তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তারপরে মোহ-অধরা কাহিনী। কাতু যতদিন ছিল, ততদিন অধরার বাড়ি ছিল নিঃশব্দ। এবার আর তা হল না। মোহকে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করাতে গিয়ে অধরা রাগে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে দেখল, ফরাসডাঙা থেকে যাকে সে এনেছে, সে বিষবতী এক কালসাপিনী। মাথার কাছে যে সাপের ঝাঁপি নিয়ে সে শুয়ে আছে, তার বিষদাঁত ওপড়ানো হয়নি। অধরার মতো অমন কুটিল সাপ-খেলানো বর্ষীয়সীকেও চকিতে ফণা তুলে ছোবল মারতে আসে।

অধরা মরিয়া হয়ে সে বিষদাঁত ভাঙবার আয়োজন করল। কিন্তু সমস্ত আয়োজন পণ্ড করে মোহ দাঁড়াল বেঁকে। দিশেহারা অধরা দেখল, সর্বনাশ! একে নিয়ে সে কী করবে? কাকে খেলা দেখাবে আর কে দেখবে! খেলা যে আজকে আর শুধু অধরার পুরনো পিরিতের মানুষ ধরে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তার ভরণপোষণেরও ব্যাপার ঘটে। পেট যে সবার বড় শত্রু। সে শত্ৰু ঠাণ্ডা না করলে জগৎ অন্ধকার। মোহ সোনা-রুপা রংবাহার শাড়িতে ভোলে না। ভোলে না কোম্পানির ছাপ মারা চাঁদির জেল্লায়, ফরেসডাঙার বিলিতি আলতা আর ফুলল তেলে।

অধরা ছাড়ল সেই পুরনো গতানুগতিক পথ। সমূহ উপোসের হাত থেকে বাঁচার জন্য মোহকে প্রথমে সে রাজি করাল কারখানায় কাজে যাওয়ার। কুটনি অধরার কারসাজি চলল অন্তঃস্রোতে। ইংরেজের কারখানায় শুধু লোহার যন্ত্র নেই, সে কারখানায় আরও অনেক মজার কল আছে। সেখানে অনেক মানুষ। অনেক তার জাত। ব্রাহ্মণ কায়স্থ-শুদ্র। নানান জাত আর নানা প্রকার চরিত্র। অধরার কার্যসিদ্ধির ক্ষেত্র এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল সেনপাড়া-জগদ্দলের গ্রামের মধ্যে। এবার সে ক্ষেত্র প্রসারিত, বিস্তৃত। মোহকে কেন্দ্র করে তার হাতের মুঠোয় এল বিচিত্র রকমের বহু লোক। তারা সব রকমারি পতঙ্গ, নিজেদের পাখা পোড়ানোই তাদের নেশা। সেই নেশার ঝোঁকে না পুড়েও তারা পোড়ার আশায় মুঠি ভরে দিল অধরার।

কিন্তু মোহ শুধু মোহ বিস্তার করে, নিজে কখনও মুগ্ধ হয় না। এ অবস্থায় মধু এসে দাঁড়াল মোহর সামনে। দর্পিনী মোহ অহঙ্কারে ফিরিয়ে নিল মুখ। ঠোঁটের কোণে তীব্র শ্লেষের হাসি নিয়ে মধুকে সে অবজ্ঞা করে নিজের মোহের গরিমায় এঁকে বেঁকে পাশ কাটিয়ে গেল সাপের মতো। কিন্তু কোমরে একটা ব্যথা লেগেছিল। কোমরে নয়, বুকে। চলতে গিয়ে ব্যথা লাগল। ফিক ব্যথা। বিষ ছিল মধুর চোখে, ওই কালো কুচকুচে পোড়া লোহার কাটারিটার মতো মানুষটার সর্বাঙ্গে, তার ঠোঁটের হাসিতে। সে বিষে বুক ভরে গেল, চোখের কোণে বিদ্বেষের শাণিত কটাক্ষে ঢেউ লাগল মাতাল রক্তের। হাসতে গিয়ে হাসি গেল আটকে। কিশোরী বয়সে অধরার হাতে পড়ে যৌবনের চেতনা তার ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছিল। মেঘচাপা ছিল হৃদয়ের রং। মধু এসে সামনে দাঁড়াতে মড়মড়িয়ে উঠল সেই রঙের দরজা। তাই ব্যথা লাগল। শাশুড়ি আর তার হাত ধরা পুরুষেরা যখন এই সামান্য ছোটখাটো মেয়েটিকে জয় করার জন্য গুপ্ত ষড়যন্ত্রে মাতোয়ারা, তখন এ কী এক বিচিত্র ব্যথার ঝংকারে নিজের কাছেও রহস্যময়ী হয়ে উঠল সে।

এ ব্যথার নাম নেই। এর টোটকা নেই, ওঝা নেই, নেই ওষুধ। চলতে ফিরতে, ঝোপ-জঙ্গলে, পথে-বিপথে ওই এক ভাবনা চেপে বসল মনে। কিন্তু সর্বত্রই যে মধু। ওই সর্বনেশে মিনসে ছেলেটার ঝিকিয়ে ওঠা কালো চোখ, মরণের ডাকের ইশারাভরা হাসি মুখ, সে যে ঘাটে-অঘাটে, বনে বাদাড়ে, তেসুতি কলের কলঘরে, শপর মেশিনের লাইনে, নলি স্প্যান্ডেলের ধারে ধারে।

তবু কথায় বলে, ভাঙে তো মচকায় না। দর্প এক বিচিত্র বস্তু। একটা শক্ত লৌহপিণ্ডের মতো। সে প্রথমে তাতে, তারপর গলে। তেমনি করে মোহ গলে গেল। দিকে দিকে শুধু মধু। গ্রামে, কারখানায়, ঝগড়ায়, বীরত্বে, খাতিরে, মধু অনন্য। মোহর প্রাণ আপনি গলল। গলে গলে সে কাঁচামিঠে স্বাদের সুধায় ভরে উঠল আকণ্ঠ।

কিন্তু জল এত ঘোলা হয়েছিল যে, মধুর দিকে চেয়ে কথা বলা দায়। তার খর চোখের কালো তারায় দপ দপ করে জ্বলে হাসি। হাসিও লুকোনো। শাশুড়ি অধরা আছে, আছে গাঁয়ে কারখানায় লোকজন। কিন্তু সে আর কতদিন চাপা থাকে!

যে হাসি অনেকের হৃদয় কেটে দুখানা করছে, তারা সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করল তীব্র বিদ্বেষে। কলঙ্ক দিল মোহর নামে। সে কলঙ্কের স্বাদও যে মধুর। তবু একলা অগ্রসর হতে বাধল মোহর। এদিকে মন মানে না। প্রাণবেগ দুর্বার। তারপর সে প্রাণের কথা ফাঁস করে দিল লক্ষ্মী বাগদিনির কাছে। লক্ষ্মী হল তার সই। লক্ষ্মীকে সামনে রেখে এগুল সে।

গোলাম এসেই তাড়াতাড়ি বয়লারের খোলা মুখটা বন্ধ করে দিল। বলল, এই মেরেছে, ভাবছিস কীরে? আগুন যে একেবারে ঢসকে গেল। মধু বিভোর হয়েছিল ভাবনায়। প্রাণের বন্ধু গোলাম। ওর কাছে কিছু গোপন নেই। তবু বলল হেসে, কী আবার ভাবব? আগুন ঢসকেছে কোথায়?

গোলাম হা হা করে হেসে উঠল। বলল, দ্যাখো কাণ্ড, যেন নেশা করেছে। অতক্ষণ ধরে দরজা খুলে রেখেছিস, আগুন তো হাওয়া পেয়ে ছাই হয়ে গেছে। নে, ধর মুড়ি কটা চিবিয়ে নে, আমি ততক্ষণ কয়লা মারি।

না, আমিই মারি। বলে মধু বেলচা তুলতেই দুজনে ধস্তাধস্তি আরম্ভ করল। বেলচা কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে দুজনেই লুটোপুটি হল হেসে। তারপর জয় হল গোলামেরই।

মধুর মুড়ি খাওয়া শেষ না হতেই এল পাগলা সাহেব। ডেকে নিয়ে গেল মধুকে কলঘরে। ডেকে নিয়ে যাওয়ার ধরনও আলাদা। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ছেলেমানুষেরা ফাটিয়ে কু দিয়ে ছোটে, পাগলা সাহেবও তেমনি সরু গলায় কু দিতে দিতে, মধুর হাতে ধরে ছুটল।

গোলপাতার ছাউনি দেওয়া অফিস ঘরে বাবুরা হাসেন। হাসে কলঘরের মানুষেরা। মেয়ে পুরুষেরা। কিন্তু ঝিমিয়ে এসেছে হাসি। মেশিনের সঙ্গে সারাদিন পাল্লা দিতে গিয়ে মানুষগুলি বেঁকে দুমড়ে পড়েছে। এ সময়ে একটু কড়া নজরের দরকার। এখান ওখান দিয়ে সরে পড়ে কেউ কেউ সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে। কেউ কেউ দম নেওয়ার জন্য ভেঙ্গে পড়ে বিনু মুচিনির তাড়ির আড্ডায়। মেশিনের তলায় বসে থাকে, শুয়ে থাকে, আগুন পোহাতে যায় গোলামের বয়লার ঘরে। মুড়ি চিবুতে যায় মুদিখানায়।

সেদিক থেকে ওয়াল্টার সাহেবের নজর কড়া। সে তার তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁজে খুঁজে বার করে সবাইকে। ছুটে যায় মুদির দোকানে। আদর করে পিঠ চাপড়ে বলে, কাম অন মাই বয়, কাম পুরা করো, কোম্পানি ইনাম ডিবে।

মেয়েদের ধরে এনে বলে, টুমি আমার বেটি! গো অন, কাম চালু করো।

যারা ইতিমধ্যেই কারখানার চৌহদ্দি পেরিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে তাদের আর পাত্তা পাওয়া যায় না। যারা একেবারেই না আসে তোক দিয়ে তাদের আবার ডেকে পাঠানো হয়। এখানে সেখানে আলপটকা লোক ধরে নিয়ে আসে মাঠ ঘাট থেকে, ধরে নিয়ে আসে রাস্তা থেকে খেলায় মাতা ছেলেদের। এনে স্পিনিং মেশিনের কাছে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, নলি খোল। পয়সা মিলবে।

.

১৩.

মধুকে মেশিনে বসিয়ে, ওয়াল্টার ছুটেছে বিনু মুচিনির আড্ডায়। বাতিদার গ্যাসলাইট জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে চলেছে কলঘরের মাথায় শেডের হুকের সঙ্গে।

মেশিন চলেছে একটানা। তার প্রাণের দ্রুততালে কোথাও ছন্দপতন নেই। কোথাও ঘটঘট, কোথাও ঝমঝম। শস্নরের পাড়নে ফেলা পাটের গোছা পিডুলে ধরছে ঘরঘর শব্দে, সেখান থেকে সিলিন্ডার স্টপার ওয়ার্কার ডবারের দুমদুম, ভটভট…তারপর ড্রামরুল থেকে ডেলিভারির টিনের ছাত পেটানোর মতো তীব্র ঝমঝম। সেখান থেকে পাট বেরিয়ে আসে, বোয়া মোছা তেল-লাগানো বুড়ির মাথার আজানুলম্বিত পাকা চুলের মতো। স্পিনিং-এর কানফাটানো তীব্র ঝটপট ঝনঝনাৎকার। সবে মিলে এক বিচিত্র ঐকতান। সমস্ত যন্ত্রের কল কোলাহলে মুখরিত। স্টিমঘরের সংলগ্ন সিলিন্ডার স্লাইড ভালবের অন্তস্তলের ধাক্কায় পিস্টন চোখের পলকে উপরের ক্র্যাঙ্ক শ্যাফট একসেস্ট্রিজে ও নীচে আর্ম বিয়ারিং-এ ওঠানামার খেলায় মেতে উঠেছে। তারই ওঠানামায় উঠছে নামছে সারা কলঘরের মেশিন। সেখান থেকে সারা কলঘরের সঙ্গে যুক্ত ঘুরন্ত রডের গায়ে লোহার চাকা। সেই চাকার গায়ে লেদ জুড়ে দিয়ে বিযুক্তকে যুক্ত করেছে নিজের এনার্জিতে।

লালু অয়েলার ঘুরছে মেশিনের ফাঁকে। তাকে সবাই বলে, লালু তেলওলা। সে মেশিনে তেল দেয়। বলে গাঁটে গাঁটে তেল দিয়ে মেশিনের জাম ছাড়াই। গায়ে বড় ব্যথা কিনা!

এখানে কথা শোনা যায় না। এখানে কেউ কথা বলে না। কথা হয় চোখে, ইশারায়, হাসে, ঝগড়া করে, কাঁদেও। পাশাপাশি মানুষ চেঁচিয়ে কথা বলে।

তবুও কান পাতলে শোনা যায় শশ্নরের মেয়েরা কয়েকজন পাটের গোছা ফেলতে ফেলতে গুনগুনিয়ে গান ধরেছে। লক্ষ্মীর গলাই তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যায়।

তাদের পিছনেই অনেকটা ভোলা জায়গায় পুরুষেরা পাটের গাঁট কাটছে। সবাই এদের ঠাট্টা করে বলে গাঁটকাটা। শুধু ঠাট্টা নয়, গাঁটকাটা এদের নাম। এরা গাঁট থেকে পাট বের করে, ঝাড়ে, দলে মুছড়ে আছড়ে ময়লা পরিষ্কার করে। কারখানার মানুষেরা বলে যাচাই করা। তারা যাচাই করে পাট তুলে দেয় মেয়েদের হাতে।

ভেলো বৈরাগি গাঁট কাটে। কিন্তু সন্ধ্যার এই আলো-আঁধারির ঝোঁকে তার কাজে মন নেই। সে শুনছে গান। তাল ঠুকছে পাটের গাঁটে। মেয়েরা গাইছে,

সাঁজের বেলা ভাত নামে।
দোরে বসে থাকি গো,
মিনসে কখন আসবে ভেবে,
চোখের মাথা খাই গো!

গাইছে আর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে টিপে টিপে হাসছে। কারুর মাথায় ঘোমটা নেই, গাছকোমর করে বাঁধা শাড়ি। আঁট করে বাঁধা চুল। গায়ে মাথায় সকলের পাটের ফেঁসোয় ছেয়ে গিয়েছে। চেহারা চেনা যায় না।

ভেলো দেখছে লক্ষ্মীকে। গানের কথা শুনে ভাবে, কার জন্যে দু চোখ ভরে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের মাথা খাচ্ছে লক্ষ্মী। কে সে মিনসে। ভাবতে গিয়ে চোখ তুলে তাকায় কলঘরের বুকে। অসংখ্য মানুষ। কাঁকড়া জগদ্দল আতপুরের মানুষ। এই এতগুলি মানুষের মধ্যে কার জন্য সে দোরে বসে থাকে।

চোখ পড়ে মধুর দিকে। স্পিনিং-এর লাইনের একটা ব্লকে তাকে নিয়ে পড়েছে পাগলা সাহেব। জগু মিস্তিরি খানিকটা বোকাটে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মধুর দিকে। জগু লাইন মিস্তিরি। তার একটু নামও আছে। দরকার হলে সে আজ অন্য কোথাও চলতে পারে। ফোর্ট গ্লাস্টারের নামকরা মিস্তিরি আজ অনায়াসে টমাসডফের কোম্পানিতে চলে যেতে পারে। কয়েকবার তাকে টমাসডফের দালাল ফুসলে নিতেও এসেছে। সে যায়নি। কিন্তু এখানে মধু তার প্রতিদ্বন্দ্বী, পাগলা সাহেবের আদরের লোক। যে কাজটা তার নিজের হাতে ঠেকে যায়, সেটাই সাহেব মধুকে দিয়ে করিয়ে নেয়। না পারলে মধুর কান ধরে চুলের মুঠি ধরে টানে, কোমরে চাটি মারে। ঠিক যেন পাঠশালার পণ্ডিতের মতো। মধুও ছাত্র হিসাবে বাধ্য। মারটা গায়ে মাখে না, ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেশিনের বুকে। কোথায় গলদ, বের করে খুঁজে খুঁজে।

আজও তাই ঘটেছে। পুরো একটা ব্লকেই স্পিনিং-এর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা ব্লক মানে, ছোট ছোট ফাইলে আটটা স্প্যান্ডেল। আট আটে চৌষট্টি স্প্যান্ডেলে একটি ব্লক। যারা সেখানে এসে ভিড় করেছে, তাদের ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে পাগলা সাহেব। যারা কাজ বন্ধ করে তাকিয়ে দেখছে, তাদের চিৎকার করে, হাতের ইশারায় কাজে লাগতে বলছে।

ওই মধুর বড় ভারী বন্ধুনী হল লক্ষ্মী। কিন্তু মনের মানুষ নয়। সে হল মোহ। অধরার ছেলের বউ। তবে? ভেলো ভাবে, তবে লক্ষ্মীর ওই ঝাঁঝ ধরানো হাসিভরা বুকে কে ঠাঁই পেয়েছে?

কলঘরের বড় বড় জানালা দিয়ে দেখা যায় চাঁদের আলোভরা আকাশ, গাছগাছালির মাথা। সেই চাঁদের আলো একটা বিচিত্র রঙের রেখায় এসে পড়েছে কলঘরে। গ্যাসবাতির জেল্লায় মেশিনের চকমকানি ও চিৎকার যেন বিদ্রূপ করছে ফ্যাকাশে নীল জ্যোৎস্নার আলোকে।

মনটা বাইরে ছুটতে চায় ভেলোর। এই কলঘরকে সে ভালবাসে না, এই যন্ত্রের ধ্বনি তার সয় না! কী হবে কাঁচা পয়সায়? সপ্তাহে এক টাকা তার মাইনে। তারা বলে হপ্তা। এক টাকা কম নয়, তার একার পক্ষে অনেক। সব গাঁটকাটারাই তাই পায়। সবচেয়ে বেশি মাইনে পায় জগু মিস্তিরি। হপ্তায় তার তিন টাকা মাইনে। তবু মন বলে, এর চেয়ে যেদিন একতারা নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেদিনও আমার ঝুলি খালি থাকেনি। কিন্তু কী ক্ষণে নজরে পড়ল লক্ষ্মী বাগদিনি। জগদ্দলে ভিক্ষা করতে এসে লক্ষ্মীর হাসি শুনে সে আর ফিরে যেতে পারল না। কাজ ধরল কলে। ঝুলি আর একতারা পড়ে রয়েছে ঘরের খুঁটির গায়ে ঝোলানো। কিন্তু লক্ষ্মী কোনওদিন ফিরেও তাকায়নি। সে প্রতিদিন অন্ধকার অথবা জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে গঙ্গার ধার দিয়ে ফিরে গিয়েছে কাঁকনাড়ায়। কাঠকুটো পাতা জ্বেলে ভাত রান্না করেছে, খেয়েছে, আবার রাত্রিটা কোনওরকমে কাটিয়ে ভোর রাত্রেই ছুটে এসেছে কলে।

এই সন্ধ্যায় ভোলার মন বাইরে যেতে চাইলেও প্রাণ চায় না। লক্ষ্মী যে এখানে।

ওদিকে মধুর কাজ শেষ হতে তার নজর এসে পড়ল শরে। লক্ষ্মীর পাশেই মোহ। এখানে অধরা নেই, নেই তার সন্ধানী দৃষ্টি। সে আছে চরকাখানায় সেখানে নলি থেকে সুতোর বড় বড় গুছি তৈরি হয়। মোহ-র সঙ্গে চোখাচোখি হয় মধুর, সেই সঙ্গে লক্ষ্মীরও। দূর থেকে তিন চোখে শুধু হাসাহাসি। তারপর মধু বেরিয়ে গেল।

.

১৪.

কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্মীর খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গার ধারে। সাহেববাড়ির মাঠের নীচেই কোল আঁধারে ঘন জঙ্গল। উত্তরদিকে বাঁশের ঝাড়। বাঁশঝাঁড়ের ঝুপসি অন্ধকারে রাত্রিচর জন্তুর পায়ের শব্দ শোনা যায়। চাঁদের আলো ও ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে এক বিচিত্র গা-ছমছম পরিবেশ। কারখানার শব্দ এখানে অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এসেছে। সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঝিঁঝির ডাক।

গঙ্গায় আবার ভাটা পড়েছে। চাঁদের আলোয় গৈরিক গঙ্গা যেন এক চুমকিঝরা নীলকাপড় জড়ানো সুন্দরী। ওপারে স্বপ্নের দেশের মতো নিস্তব্ধ ফরাসডাঙা। একটিমাত্র ফরাসি ভাউলের দাঁড় মাঝগঙ্গার বুকে ঘুমঘোরে যেন ককিয়ে উঠছে। নিঃশব্দ শীতের রাত্রে সে শব্দ উদাস হয়ে উঠছে না, থেকে থেকে যন্ত্রণার গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু ঘুম নেই। মাঝির চোখে ঘুম থাকলেও, ঘুম নেই যাত্রী-পুলিশের চোখে। তার চোখে সন্ধানী সতর্ক দৃষ্টি। যত ছোট জমিদার হয় তার দাপট তত বেশি হয়! ফরাসি সরকারেরও তাই। রাজ্য ছোট, কিন্তু সতর্কতার সীমা নেই! এক ইঞ্চি রেশম, কিংবা এক ফোঁটা ফরাসি মদও যেন কোনওরকমে ফরাসি এলাকা পেরিয়ে যেতে না পারে। এই দুটি জিনিসের উপর সবচেয়ে কড়া নজর। এই সাম্রাজ্যের একমাত্র লোভনীয় সম্পদ।

লক্ষ্মীর হাসিতে শিউরে উঠল ভাটা-পড়া গঙ্গার জল আর বাঁশঝাড়। পিছনে তার মোহ। পাটের ফেঁসো ঝেড়ে মোহ পরিষ্কার হয়েছে। মোহ নয়, মোহিনী। গায়ের রং তার মাজা মাজা। মুখের আকৃতি সামান্য দীর্ঘ। সব পানপাতা যেমন গোল নয় তেমনি, অথচ যেন পানপাতাটির মতো মুখের ছাঁদ। সে মুখে চাঁদের আলো পড়েছে। আলোছায়ার সেই বিচিত্র মুখে রহস্যের হাসি। টিকোলো নাকে রুপার নাকছাবি উদ্বেলিত হৃদয়ের দ্রুত নিশ্বাসে ঝিকিমিকি করছে। চোখ তার টানা টানা। সেই টানা চোখের চাউনি গোপন প্রেমের লুকোচুরির মতো কেবলি বেঁকে ওঠে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট লক্ষ করা যায় তার চোখের তারার চকমকানি। উশকো-খুশকো চুলে ছদ্মবেশিনী প্রেমিকা এসেছে অভিসারে। শরীরের গড়ন তার একহারা কিন্তু শক্ত। গাছকোমর করে বাঁধা আঁটসাঁট কাপড়ের রেখায় নূতন যৌবন পেরিয়ে এসেছে ইশারার সীমা। ঢেউ বঙ্কিম রেখায় সে আজ তার ওই গোপন হাসির মতোই চাপা অথচ তীব্রভাবে স্ফুরিত। হাতে পায়ে গলায় তার অলঙ্কার নেই। এই মোহাচ্ছন্ন রাত্রির মোহ যেন নিজেই।

কিন্তু মানুষ কোথায়। লক্ষ্মী বলল, ওমা, এ যে মাঝরাত্তিরের বন খাঁখাঁ করছে, মানুষ কোথা?

বলে দুজনে চোখাচোখি করে দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠল। মোহ বলল, কী বা দরকার, চল পাইলে যাই।

লক্ষ্মী বলল, পরে তখন দোষ দিসনে যেন।

মোহ ঠোঁট উলটে বলল, বয়ে গেছে। কে এখানে এসে মরতে চায়? লক্ষ্মী বলল আর একটু গলা চড়িয়ে, তাই তো! মরতে হলে এই বনবাদাড়ের চেয়ে কত ভাল ভাল জায়গা আছে এ সোমসারে। মুখের কথা খসালেই হয়।

মোহও তেমনি গলা আর একটু চড়িয়ে বলল, সে কথাটাই শুনিয়ে দাও। দিয়ে চল, চলে যাই।

মোহ বলে। কিন্তু বলে সে হাসে। চোখের কোণে একটু বা সংশয়ের ছায়া, তবু এদিকে ওদিকে চায়। যেতে চায়, তবু নড়ে না।

তখন লক্ষ্মী যেন গঙ্গাকেই মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল, চললুম তবে, থাকো তুমি তোমার ঢং নিয়ে। চল লো ছুঁড়ি চল। তোর যেমন চোখ। জগতে আর কাউকে নজরে লাগল না।

কিন্তু মোহ যে সত্যিই বালিকা। চোখে মুখে যার অত হাসির তীব্রতা, বুকে তার এক কাঁচা মেয়ের চোখ এবার সত্যি সজল হয়ে উঠল। তবে কি সে আসেনি? অভিমানে ফুলে উঠল তার ঠোঁট। বলল, তবে বলে দাও, আর কোনওদিন আসব না।

লক্ষ্মী বলল মুচকে হেসে, গঙ্গার কাছে দাঁইড়ে এমন কিরে কাটবি?

মোহর অসহায় মন বলল, না না না। না এসে তো পারব না। সত্যি একদিন মুখ ফিরে চাইনি, আর আজ মানুষটা খালি আমাকে কাঁদিয়ে মারতে চায়।

মোহ বলল, কার কাছে আসব?

তাদের এই বিচিত্র কথোপকথনে রাত্রিও যেন রহস্যের লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠল।

এমন সময় গঙ্গার ধারের কোল আঁধার থেকে মধু হাসতে হাসতে উঠে এল, বলল, কাকে খুঁজছ গো লক্ষ্মীদিদি?

অমনি মোহর ছায়া-মুখে আবার আলো ফুটল। অভিমানে বঙ্কিম ভুরুলতার নীচে চকচক করে উঠল চোখ। জোর করে টিপে রাখল ঠোঁটের হাসি। কপট অভিমানে ভরে রাখল মুখ।

লক্ষ্মী ঝেঁজে বলল, কাকে আবার, এই মউ পেতনির মরণকে।

বলে সে মোহ-র হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল উলটো দিকে। বলল, চল লো চল, কেন অত পোড়ানি কেন এমন ভাল মানুষের বাচ্চা ঘুড়িটাকে?

মধু হা হা করে, হেসে সামনে এসে পথরোধ করল। বলল, আহা হা, কী হয়েছে বল না ছাই, দেখি এট্টা ব্যওস্থা ট্যাওস্থা করা যায় কিনা।

ছাই ব্যাওস্থা। ছোঁড়া যেন হাড়জ্বালানে যম।

বলে লক্ষ্মী আড়চোখে মোহর মুখ দেখে বলল, ওসব শুকনো কথায় চিড়ে ভেজে না, বুঝলি? কী দিবি আগে বল।

কী চাও?

 লক্ষ্মী বলল, চাই রুপোর চেন হার, বিলেতি পলকাটা চুড়ি, পায়ের বাঁকমল, সোনার নাকচাবি, কোমরে গোট। তা পরে শাড়ি চাই, আতর চাই।

মধু বলল, মাত্তর? এ আর কি চাইলে গো? তা তোমার নিজের কী চাই? বলে তারা তিনজনে পরস্পর চোখাচোখি করে হেসে উঠল। কিন্তু লক্ষ্মীর হাসিটা এত বিলম্বিত যে, আর থামতে চায় না। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে উঠে বলল, পোড়াবার কাঠ চাই। দিবি তো?

মধু ততক্ষণে মোহ-র হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে গঙ্গার ধারে। দূর থেকে বলল কাঠ কেন, ভেলো বোরেগি তো আছে।

লক্ষ্মী কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। যেন হাসির রেশটা সামলে উঠতে পারেনি। তারপরে আচমকা একটা নিশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে ফিরে গেল সে। ভেলো দূর থেকে লুকিয়ে সবই দেখছিল। লক্ষ্মীকে আসতে দেখে সে তাড়াতাড়ি অন্ধকারে লুকোল।

গঙ্গার ধারের নিঃশব্দ জ্যোৎস্নালোকে মোহর মিঠে গলার চাপা হাসি বেজে উঠল যেন গুপ্তঘরে মোহর গোনার রিনিঠিনিতে। অরণ্য-সংকুল গঙ্গার ধারের মোহাচ্ছন্ন রাত অভাবিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল এই দুটি ছেলেমেয়ের দিকে। ভাটাপড়া গঙ্গার কুলুকুলু ধ্বনিতে হাসির শব্দ ভেসে গেল দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে।

যারা জানে না মধু ও মোহ-র এ রাত্রির অভিসারের কথা, তারা ভীত বুকের দুরু দুরু তালে কান পেতে শোনে গঙ্গার অন্ধকার বনে দুটি মেয়ে-পুরুষের কলকাকলি। নদীর বুকে পুব-পাড়-ঘেঁষা মাঝির হালধরা হাত শিথিল হয়ে আসে। শিউরে ওঠে বুক। অশরীরী অস্তিত্বে আকাশগঙ্গা অন্ধকার হয়ে ওঠে। জোড়া জোড়া প্রেতনীর চোখ জ্বলতে থাকে আগে পিছনে। ভাবে তেসুতিকলের কলঘরের অন্ধকার থেকে বিচরণ করতে বেরিয়েছে বুঝি কোনও অশরীরী আত্মা। কিন্তু যারা হাসে তাদের ভয় নেই। তাদের শীত নেই গ্রীষ্ম নেই, আঁধার নেই আলো নেই। রাত্রিচর শ্বাপদ কিংবা প্রেতিনীর ভয় নেই। যদি রাত্রির বুকে কোনও সর্বনাশ থেকে থাকে, তবে তার নায়ক ও নায়িকা তারা দুজনেই।

ওই অদূরেই আগুরিপাড়া ঘাটের তেঁতুলতলা। ওই তেঁতুলগাছে পবন প্রাণঘাতী হয়েছিল। গলায় দড়ি দিয়েছিল। মধু সে সব কথা গল্প করে মোহ-র কাছে। মোহ মধুর বুকের কাছে গুটিয়ে বসে সে সব কথা শোনে আর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তেঁতুল গাছের দিকে। ভয়ের চেয়েও বিস্ময় বেশি হয় মধুর কথা শুনে। কান্নায় উথলে ওঠে বুক। সত্যি, জন্মপিরিতের বউ যার বানের জলে ভেসে গেল, তাও গেল কিনা প্রাণের ভুলে!

মোহ বলল, আজ দুকুর বেলা আবার বুঝিন মায়ের সঙ্গে লেগেছিল?মধু বলল, রাগিনিকো। মা-ই রাগ করতে লাগল, শুধু শুধু গালাগাল পাড়তে লাগল। মউ! তোকে নিয়ে আমি চলে যাব। চলে যাব অন্য কোনও কলকারখানায় মিস্তিরির কাজ নিয়ে।

মোহ বলল, আর তোমার ঘর?

নতুন ঘর করব। কী আছে? মাকে বোঝাতে পারিনে, ওরা বোঝে না। বছরে ছমাসের খোরাক জুটবে না দুদিন বাদে, ওদের সে ধেয়ান নেই।

কিন্তু তোমার মায়ের যত রাগ, সে তো এ মুখপুড়ি মউয়ের জন্যে।

 তোকে বুঝি কানে কানে বলে গেছে?

কানে কানে কেন, গাঁ মাথায় করেই তো বলে।

বলতে বলতে চোখ ছলছলিয়ে উঠল মোহ-র। বলল, শাশুড়ি দিন রাত তক্কে তক্কে থাকে, কখন গলায় কাটারি বসিয়ে খুন করবে।

দুরন্ত ক্রোধে অমনি মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল মধু। বলল, বলিসনে মউ, কোনদিন বুড়িকে আমি জ্যান্তই গঙ্গার ধারে পুঁতে ফেলব।

মোহ তাকিয়ে দেখল মধুর দিকে। চাঁদের আলোয় যেন খ্যাপা ফণাতোলা কালো কুচকুচে একটা মহানাগ। এইটুকুই মোহর সান্ত্বনা! তার প্রাণের আশঙ্কা, অপমান ও কলঙ্ক, সবই সে জলাঞ্জলি দিয়েছে এই মানুষটির জন্য। এখানে সব দিতে পারে, নিতেও পারে সব। এমনকী নিজের প্রাণটুকুও।

তারপর তারা মেতে উঠল তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের কল্পনায়। প্রেমের খুনসুটি খেলায় ও হাসির ধারে তারা হয়ে ওঠে পৃথিবীর আদিম দম্পতি।

.

অদুরেই কলঘরের ঝমঝম শব্দ। এখনও থামেনি। এসময়ে কোনও কোনওদিন মধু ও তার জোয়ান সাকরেদরা লুকিয়ে এসে মাঠে কপাটি খেলে। গোলামও তাই ভাবছিল। ভাবছিল আজ দোস্তর কাছে মউ জুটেছে। তারও চোখের সামনে ভেসে ওঠে আতপুরে শিরিষ সরকারের রক্ষিতা মুক্তা গয়লানির মুখ। মুক্তা তার চেয়ে হয়তো বয়সে কিছু বড়। তবু মুক্তাকে সে ভুলতে পারে না। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে পড়ে মৃত শরাফতের ছয় বিবির সবচেয়ে ছোট বিবির কথা। ছোট বিবি এ বাংলাদেশের মেয়ে নয়, শরাফত তাকে আনিয়েছিল দিল্লি থেকে। অবশ্যই শোনা কথা। সে বাংলা বুলি জানে না। তার বুলি বুঝত খালি শরাফত। বড় মানুষের খানদানি মেয়ে। কিন্তু শরাফতের মৃত্যুর পর কেউ সারা বাড়ি খুঁড়েও একটি সোনার মোহর পায়নি। বর্তমানে ওদের বড় অভাব। তবু ছোট বিবির করুণ মুখখানি কেন যেন তার চিত্তপটে থেকে থেকে ভেসে ওঠে। ওই ভেসে ওঠা বড় ভয়ানক। এখনও শরাফতের ভাই নেয়ামত জীবিত। ছোট বিবি আজ তার আয়ত্তে। তেসুতির কলে কয়লা-মারা গোলামের এ চিত্তপট যদি কোনওদিন মুসলমানপাড়ায় প্রকাশ হয়ে পড়ে, তবে তা জীবন-মরণের প্রশ্নের মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু ভয় যে গোলামেরও নেই!

.

১৫.

পরদিন সকালবেলা। একটু বেলা হয়েছে তখন।

 হীরাকে কালী কানে কানে বলে দিয়েছে যেন সে দাপাদাপি না করে। বাপ তার রাগ করেছে। রাগ পড়ে গেলে আবার নিয়ে আসবে।

কিন্তু হীরা তা মানবে না। মধুদাদা, গোলামকে ছেড়ে সে কিছুতেই বাবার সঙ্গে যেতে পারবে না।

লখাই যখন তাকে এক টানে ঘাড়ের উপর তুলল, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে, কামড়ে খামচে লখাইয়ের ঘাড় থেকে নেমে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।

লখাই নীরবে এ দাপাদাপি সহ্য করল। একটি কথাও না বলে একটা নিতান্ত বাঁদর বাচ্চার মতো হীরাকে কাঁধে করে বেরিয়ে গেল।

পেছন থেকে কালী কী বলল শোনা গেল না। কেবল তার ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠে একটা অস্ফুট গোঙানি শোনা গেল।

বাড়ি থেকে বেরিয়েই গোয়ালের পিছনে মধুর সঙ্গে চোখাচোখি হল লখাইয়ের। এই ব্যাপারটা মধুর কাছে নিতান্ত অবিচার ও নিষ্ঠুরতা বলেই মনে হয়েছে। তাই লখাই খুড়োর উপর বিদ্বেষে ও রাগে তার সারা অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। এখানে শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু অসহায় রাগে তার চোখজোড়া জ্বলছে ধকধক করে। এবং তার সে চোখের দৃষ্টি আজ অসম সাহসে লখাইয়ের চোখের দিকেই নিবদ্ধ।

লখাই দাঁড়াল। মধুর চোখের দিকে তাকিয়ে তারও বুকের মধ্যে রুদ্ধ আক্রোশ ফুঁসে উঠল। মধুর কাছ থেকে এ দৃষ্টি সে আশা করেনি। তার মনে পড়ে গেল বহুদিন পূর্বের সেই পদ্মপুকুরের পাড়ে ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ নারায়ণের ছবি। সেদিন ক্রোধের জবাব দেওয়ার মধ্যে তার একটু সংকোচ ছিল। আজ তার সে সংকোচ ছিল না। তবু মধুর এই বিদ্বেষভাবাপন্ন নীরব প্রতিবাদের মধ্যে হীরাকে নিয়ে যেতে তার পৌরুষে বাধল। হীরা তার ছেলে হতে পারে, কিন্তু বীরপুরুষ কখনও প্রতিবাদ মেনে নিতে পারে না। বহুদিন পরে আজ তার ক্রোধের মাত্রা ভয়াবহ রকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মধুর সাহেব ও কারখানা প্রীতির প্রতি ঘৃণা ও অন্তঃস্রোতে পাকিয়ে ওঠা বিদ্বেষ যেন এই মুহূর্তে লখাইয়ের সমস্ত বাঁধ ভেঙে দিল। সেও মধুর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, কী চাস? হীরাকে?

মধু এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, কী করে চাইব, তোমার তো ছেলে।

লখাইয়ের প্রৌঢ় শরীরের মাংসপেশি শক্ত হয়ে উঠল। বলল, তুই তো মস্ত বীর, ক্ষ্যামতা থাকে তো ছিনিয়ে নে। না পারিস, দামড়া বাছুরের মতো গাইয়ের বাট চাটগে যা।

চকিত ক্রোধে ফণার মতো খাড়া ও শক্ত হয়ে উঠল মধুর ঘাড়। চোখে রক্ত উঠে এল। এত বড় কথা মধুকে এই গাঁয়ে দাঁড়িয়ে কেউ বলতে সাহস করে না। লখাই খুড়ো বলেই কী? নীরব ও তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার সর্বাঙ্গে।

লখাই চকিতে হীরাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে, বাঁ হাতে তাকে ধরে, ডানহাত বাড়িয়ে দিল মধুর দিকে। বলল, আয়, হাত্তা লড়বি। হারলে ছেলে দিয়ে দেব, নিজে নাম লিখে দিয়ে আসব কারখানার গোলামের খাতায়।

এক মুহূর্তের নীরবতা। পৌষের উজ্জ্বল সকাল কালো হয়ে উঠেছে এক কুটিল ছায়ায়। আশেপাশে লোক নেই। শুধু দুটি পুরুষ পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষে ও জ্বলন্ত ঘৃণায় আক্রমণোদ্যত হয়ে, রুদ্ধশ্বাসে চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য! হীরা ভীত নয়, তার শিশু হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছে এই দ্বৈত সংগ্রামের ফলাফল দেখবার জন্য। সেই ফলাফলের উপরেই প্রতীক্ষা করে আছে তার মুক্তি।

এক মুহূর্ত পরেই মধু ভীষণ উত্তেজনায় তার কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো শক্ত হাত বাড়িয়ে দিল। কষে ধরল দুজনে দুজনের হাত। তারপর প্রচণ্ড পেষণে শক্ত হয়ে উঠল দুজনেরই চোয়াল, ঠিকরে বেরিয়ে এল চোখ। দমবন্ধ অবস্থায় স্ফীত হয়ে উঠল দুজনের বুক।

স্তব্ধ সর্বচরাচর। রুদ্ধশ্বাস পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে জয়পরাজয়ের জন্য।

কিন্তু কেউ-ই কম নয়। মধুর হাত কাঁকড়ার দাঁড়া বটে, কিন্তু লখাইয়ের আঙুলগুলি যেন শক্ত লোহার সাঁড়াশি। দুই হাত যেন একটি সরল রেখা হয়ে গিয়েছে। এদিকে ওদিকে কোনওদিকেই হেলে না। মধু তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। লখাই তাকিয়ে আছে মধুর চোখের দিকে। পলে পলে সময় বইছে যেন দীর্ঘ একটা দিনের মতো। এদিকে পেশিতে পেশিতে আরও রক্ত ও শক্তি সঞ্চারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় দুজনে কবজি শক্ত করে তুলছে। নিশ্বাস বেরিয়ে এলেও চকিতে আটকে রাখছে বুকের মধ্যে।

হটাৎ চোখের পলকে কী ঘটল, একটা অস্ফুট আর্তনাদে দুমড়ে গেল মধুর হাত। বেঁকে গেল কবজি। লখাইয়ের শেষ-শক্তি নিয়োজিত হাত কাঁপছে থরথর করে।

কিন্তু মধুর চোখেমুখে কোথাও ব্যথার অভিব্যক্তি নেই। অসহায় পরাজিত হৃদয়ের জ্বালা আগুনের মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছে তার চোখে।

লখাই তার হাত ছেড়ে দিয়ে আবার হীরাকে তুলে নিল ঘাড়ের উপর। তারপর চিবিয়ে বলল, তোর ওই কারখানার পাগলা সায়েবকে বলিস কবজিতে এটুস সরষের তেল মেখে দিতে, বুঝলি?

বল হনহন করে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল সে। হীরা তার মুক্তির শেষ চেষ্টায় তখনও দাপাদাপি করছে।

মধু ঝুলে-পড়া হাতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইল সেদিকে চেয়ে।

অসহ্য ক্রোধে ও যন্ত্রণায় পদক্ষেপ অসমান হয়ে উঠেছে লখাইয়ের। চলতে চলতে সে মাঠের মাঝে এসে পড়ল। পিছনে পড়ে রইল রেললাইনের উঁচু জমি। মাঠের জমি কোথাও রিক্ত, পাঁশুটে ও মাটির রং কালো। কোথাও কাঁচা পাকা সবুজ ও হরিতের ওড়না ছড়ানো। জল নিষ্কাশনের নালাগুলি শুকনো। নয়ানজুলিতে বর্ষার জল শুকিয়ে গজিয়েছে দূর্বাঘাস। এতখানি বেলাতেও পৌষের শিশিরের ঝিকিমিকি। ওই দূরে পুব-উত্তর কোল ঘেঁষে দেখা যায় মুক্তাপুরের খাল। খাল নয়, যেন পরিত্যক্ত একটা শুকনো নালা। বর্ষাকালে কিছু জল আসে, তার সঙ্গেই কচুরিপানা। এখন নীরস শুকনো গর্তে হেজে পচে রয়েছে সেই কচুরিপানা। অথচ এই খাল দিয়ে একদিন যাত্রীবাহী নৌকা আনাগোনা করেছে। দূর-দূরান্তের মানুষ গঙ্গার বুক থেকে খাল দিয়ে চলে গিয়েছে বরুতী, মালতী, বোদাই। সেখান থেকে নতুন খাল দিয়ে বারাসত, বসিরহাট দিয়ে গিয়েছে ইচ্ছামতীর বুকে। গিয়েছে যশোর, খুলনা, বরিশাল, গিয়েছে সুন্দরবনের বাদায়, বঙ্গোপসাগরের ধার দিয়ে মগ-আরাকানিদের দেশে। এখন নৈহাটি-কাঁটালপাড়ার কাছে মুক্তাপুরের খালের পথ রুদ্ধ করেছে রেললাইন। খালকে বইয়ে দিয়েছে একটা সরু সুড়ঙের নালিপথে।

মধুর সঙ্গে হাত্তা লড়ে জিতেও লখাইয়ের ক্রোধ প্রশমিত হল না। তা উত্তরোত্তর কেবলি বেড়ে চলল। পূর্ব স্মৃতির সমস্ত জ্বালা যেন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল বুকের মধ্যে। পুড়তে লাগল বুকের মধ্যে তার অতীতের আত্মা। একটা বিচিত্র ব্যতিক্রমের মতো সমাজের বুকে সে প্রেতের মতো ঘুরে ফিরছে। ফিরবে সে চিরদিন, যতদিন বেঁচে থাকবে। তবু হার মানতে পারবে না, পরাজয় স্বীকার করতে পারবে না বিদেশি শক্তির কাছে।

হীরা তখনও বৃথাই লাফিয়ে পড়ার আশায় দাপাদাপি করছে কাঁধের উপর। মধুর পরাজয়ে শিশুর প্রাণেও আগুন জ্বলেছে। নিজের প্রতি শাসনের তার কোনও জবাবদিহি ছিল না, কিন্তু মধুদাদাকে কেন বাবা হারিয়ে দিল। সেই রাগে ও অভিমানেই জেদি কান্নায় ফুঁসছে সে।

লখাই আর সহ্য করতে পারল না। হঠাৎ ওই মাঠের মাঝে হীরাকে নামিয়ে তার শক্ত হাতে একটা ভারী চড় কষিয়ে দিল গালে। বলল, হারামজাদা শলুই, কীসের তোর অত ফোঁসানি, অ্যাঁ?

হীরা অত বড় হাতটার ভারে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বেরিয়ে এল কয বেয়ে। কটা মুখ লাল হয়ে উঠল আগুনের মতো। আশ্চর্য! কোথায় তার ভয় ও কান্না। সেই অবস্থাতেই সে সত্যি যেন একটা সুধগোখরোরশলুইয়ের মতো তীব্র বিদ্বেষে ফিরে তাকাল লখাইয়ের দিকে।

লখাই আবার বলল, যন্তর ঘাঁটতে যাবি ফলে, গোলাম কমনেকার? হীরা কান্নায় ফুসতে ফুসতে বলল, যাব, হ্যাঁ যাব তো।

বলেই আচমকা লাফ দিয়ে উঠে উলঙ্গ অবস্থায় সে ছুটতে আরম্ভ করল মাঠের উপর দিয়ে। যেন একটা খাপখোলা গুপ্তি ছুটছে মাঠের উপর দিয়ে। মাথার উপরে তার রেললাইন, নীচের থেকে পথ এঁকেবেঁকে উঠে গিয়েছে সেইদিকে।

লখাই একমুহূর্ত হতবাক বিহ্বল হয়ে রইল। পরুমুহূর্তেই ছুটতে ছুটতে ডাকল, হীরা, শোন, শুনে যা।

হীরা–রা!

হীরা ছুটছে পাগলের মতো। মাঠের বুকে ধনুকছোঁড়া তীরের মতো ছোট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সে। লখাইও ছুটল দুরন্ত বেগে। ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল রেললাইনের ঢালুতে। দু হাতে সে জাপটে ধরল হীরাকে। তার সমস্ত ক্রোধ মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল হীরার মুখ দেখে। হীরা একেবারে খেপে গিয়েছে। কাঁদছে আর কাঁপছে থরথর করে কান্নার শব্দ নেই, কেবল হেঁচকি উঠছে। তবুও ফিসফিস করে বলছে, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

লখাইয়ের মনে হল হীরা অজ্ঞান হয়ে যাবে। অসহায় ক্রোধের যন্ত্রণায় তার শিশুপ্রাণ বেরিয়ে যাবে এখুনি। সে হাঁটু ভেঙে বসে টেনে নিল তাকে বুকে। তার একমাত্র বুকের ধন, তার শেষ আশা। তার কাঞ্চী বউয়ের গর্ভের ছেলে, কাঞ্চনের নাড়িছেঁড়া ছেলে, সে দুহাতে হীরার কোমল ক্ষিপ্ত মুখ তার মুখের কাছে তুলে ধরল। এ যে অভিমানাহত ক্রুদ্ধা কাঞ্চনেরই মুখ। হঠাৎ কী একটা বস্তু যেন লখাইয়ের বুক ঠেলে হুহু করে ছুটে এল গলার কাছে। পরাজয়ের বেদনায় চোখ ফেটে আসছে তার। বৃথা সে মধুর কবজি ভেঙে দিয়েছে! বৃথাই তার ক্রোধ আকাশের গায়ে মাথা ঠুকেছে। আঃ তার এতবড় পরাজয় যে এই সামান্য শিশুর মাঝে লুকিয়ে ছিল, তা তো সে জানত না।

সে ভাঙা কোমল স্বরে ডাকল, হীরা, হীরালাল আমার, বাবা আমার, চল, একবারটি ঘুরে আসি তোর ছোট মায়ের আখড়া থেকে। তোকে না দেখলে যে তার প্রাণখানি পাগল পাগল হয় বাপ।

বিচিত্র শিশুর মন। হীরা জলে ভেজা বড় বড় চোখে অনুসন্ধিৎসু হয়ে তাকাল লখাইয়ের দিকে। তারপর অপূর্ব হেসে লজ্জায় ও সোহাগে বাপের বুকে মুখ লুকাল সে বলল, তুমি কেন মধুদাদাকে মারলে? মধুদাদা তোমাকে কত ভালবাসে।

অন্ধ হয়ে এল লখাইয়ের চোখ। সে কেমন করে এই শিশুকে বোঝাবে মধুকে সে মারেনি! মধুর সঙ্গে সে তার প্রাণের ধনকে নিয়ে শক্তি পরীক্ষায় মেতেছিল। কিন্তু সে পরীক্ষা যে হাতের কবজিতে নেই। মধুকে মেরে ফেলার মধ্যেও নেই। সেই জয়পরাজয়ের ক্ষেত্র আলাদা। নইলে, তোর মতো শিশুর কাছে আজ বিদ্রোহী সিপাহির বুক ভেঙে পড়বে কেন!

সে আবার ডাকল, হীরা।

 হীরা বলল, উ!

লখাই তাকিয়ে দেখল তন্দ্রা ঘিরে ধরেছে, ঘুমে ভার হয়ে এসেছে হীরার চোখের পাতা। তার শিশু হৃদয় অনেকক্ষণ পর, অনেক যন্ত্রণার পর শান্ত হয়ে এসেছে, তাই ঘুম পেয়েছে তার।

ঘুমোক, প্রাণভরে ঘুমোক। পাষাণভার নয়, এ রত্নভার নিয়ে চিরকাল লখাই পথ চলবে। হীরাকে কোলে করে সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু চোখ ছাপিয়ে একটা নোনা স্বাদ তার জিভে গিয়ে ঠেকল। মনে পড়ল কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা। সেদিনও এমনি করে তার অসহায় বুকের রুদ্ধ বেগ চোখ ছাপিয়ে এসেছিল। সেদিন ওয়ালিক সাহেবের চলে যাওয়া গাড়ির চাকার দাগ সে নিজের হাতে মাটি দিয়ে বুজিয়ে দিয়েছিল। সেদিন হীরা তাকিয়ে ছিল অবাক চোখে।

সামনে পথ হারিয়ে গিয়েছে দিগদিগন্তে। নির্জন মাঠ, নিঃশব্দ। দিনের বেলা ঝিঁঝি ডাকছে। পুবের দূর আকাশে মিশে আছে গ্রামের রেখা। কেউটে, উচ্ছেগড় বরুতীর বিল। সেখানে আছে সারদা। ঘুমন্ত হীরাকে নিয়ে সেদিকে চলল লখাই।

.

১৬.

সারদার আখড়া। লোকে বলে সারদামণির আখড়া, কেউ বলে সারদা বোষ্টমির আখড়া।

পুরদুয়ারি মন্দির। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া মন্দিরের ঘর। পশ্চিমমুখ করা ঠাকুর। ঠাকুর সেই মুরলীদাসেরই যুগলকিশোর। বড় দুর্দিনে, অসময়ে সারদা সে যুগলকিশোরকে প্রতিষ্ঠা করেছে এই দূর গ্রামে। মুরলীদাস মারা গিয়েছে, মারা গিয়েছে সরযু। কনকের প্রাণে কিছু বিদ্বেষ ছিল সারদার উপর। তাই সে এখানকার সব সংস্রব ছেড়ে চলে গিয়েছে হুগলির এক বাবাজির সঙ্গে।

কিন্তু সারদাও গুছিয়ে তুলেছে। মন্দিরের পাশেই দক্ষিণ-দুয়ারি বাস ঘর, তার পিছনে ধানের গোলা। রান্নাঘর সংলগ্ন ভেঁকিশাল। গোয়ালে আছে দুগ্ধবতী গাই। বাড়ির চৌহদ্দির নীচেই দিগন্তবিস্তৃত জমি, প্রায় তিন মাইল পুবদিকে সে জমি বিস্তারিত। ওপারে ধুধু করে বরুতী গ্রাম। এই মাঠ হল সোনা। বর্ষাকালে বিল ফেঁপে ফুলে এই সমস্ত জমি ভাসিয়ে দেয়। শুকনো দিনের ফুটিফাটা মাঠকে প্লাবিত করে গঙ্গার পলিমাটির মতো নরম মাখন করে দিয়ে যায়। চাষির লাঙলের ফলা অনায়াসে অল্প সময়েই এ জমিকে আয়ত্তে এনে ফেলে। তাই এ জমিটুকু সকলের বড় লোভের।

এই বিস্তৃত ভূখণ্ডের মধ্যে আট বিঘা জমি যুগলকিশোরের সম্পত্তি। সম্পত্তির তদারক করে সারদা। তার হাতের গুণে সবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এক জায়গায় ভাঙে, আর এক জায়গায় গড়ে, এই তো বিশ্বের নিয়ম। আবার ফুলে ফলে আখড়া সাজিয়ে তুলেছে সারদা। তাও তো আজকের কথা নয়। অনেক কটা বছরের অধ্যবসায়ে গড়ে উঠেছে এই আখড়া।

ঠাকুরের দ্বিপ্রহরিক ভোগ নিবেদনের পর, ঠাকুরকে দিবানিদ্রা পাড়িয়ে সারদা বেরিয়ে এসেই থমকে দাঁড়াল। উঠোনের মাঝখানে লখাইকে দেখে সে দাঁড়াল।

দিগভ্রান্ত যৌবন মধ্যবয়স উত্তীর্ণা সারদাকে আজও ঘিরে আছে। তীব্র স্রোতস্বিনীর কলকল নাদ আজ ভরা গাঙের নৈঃশব্দ্যে ঢলঢল। চোখের দৃষ্টিতেও তার সেই অতল গভীরতা। ওই দুই বাহুর মাঝখানে, অতল বুকে আজ ডুব দেওয়া যায়। আজ আর বাঁকা কিশোর তার প্রেমিক নয়, শিশুনীলমণি তার দেবতা। আজ রং নেই, রঙে রঙে আজ সব একাকার। তার চমক নেই, খরতা নেই।

সে লখাইকে দেখে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নেমে এল তরতর গতিতে। আগেই ঘুমন্ত হীরাকে দুহাত বাড়িয়ে বুকে নিল। হীরার গালে চোখের জলের দাগ। দেখে বিস্মিত অভিমানে তাকাল লখাইয়ের মুখের দিকে। বুঝল, শিশুর উপর পীড়ন হয়েছে। গালে এখনও লখাইয়ের চড়ের দাগ।

সারদা বলল, মেরেছ বুঝি?

লখাই কিছু একটা বলতে গিয়েও জবাব দিতে না পেরে মুখটা ফিরিয়ে নিল। বলল, ভোগ হয়ে গেছে?

সারদা গম্ভীর হয়ে বলল, হয়েছে। এসো, ঘরে বসবে।

বলে সে হীরাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। লখাই দাওয়ায় উঠে, কোকাকে পেড়ে তামাক সাজতে বসল। সারদা হীরাকে শুইয়ে এসে তাড়াতাড়ি কলকেটা লখাইয়ের হাত থেকে নিয়ে নিল। নিজের হাতে তামাক সাজতে সাজতে বলল, এতদিন পরে মনে পড়ল বুঝি।

লখাই বলল, না, মনে রোজই পড়ে। কিন্তু মনটার হদিস পাইনে।

বলে সে মধু ও হীরার সমস্ত কথাই একটা একটা করে বলল। তার এ অন্ধ ক্রোধ ও বিদ্বেষের কথা আরও অনেকদিন শুনেছে সারদা। শুনে উৎকণ্ঠিত হয়েছে, বিস্মিত হয়েছে, আজ শুনে রাগও করল। বলল, এ তোমার ভারী অন্যায় কাজ হয়েছে কান্ত। কার পরে তোমার রাগ, আর কার পরে তুমি শোধ তুলতে গেছ! তোমাকে বাপু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে। কেউ-ই পারে না। তবে কি বিশ্বসমাজের মাঝে লখাই একা? তার ধ্যান-জ্ঞান, সে কি সবই ভুল। যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আগুরিপাড়ার তেঁতুলের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণঘাতী হওয়া ছাড়া কি উপায় আছে। আজকে সে সবই বলবে সারদা সইয়ের কাছে। তার পূর্বজীবনের বৃত্তান্ত। বলে জিজ্ঞেস করবে, তবে বলল এ কোন দেশে কার ভঁয়ে তুমি ঘর বেঁধেছ। দেশ যখন শত্রুর করায়ত্ত, পরাজয়ের জ্বালা সেখানে অহরহ দাউদাউ করে জ্বলছে, সেই আগুনে কিছু গড়ার স্বপ্ন যে আমি দেখিনে।

হীরাকে উঠিয়ে খাওয়াতে বেলা একটু বেশিই হল। লখাই ও হীরাকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে সারদা এসে বসল লখাইয়ের কাছে। লখাই আত্মচিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল। সারদা ডাকতে তার চমক ভাঙল। সে শুনতে পাচ্ছিল, আখড়ার চাষিকে হীরা বলছে, একটা পেয়ারা কাঠের হাতুড়ি বানিয়ে দিতে পারবে কিনা। চাষিটি বিস্ময় প্রকাশ করতে, হীরা তাকে রাজ্যের কলকারখানার কথা বোঝতে আরম্ভ করেছে। গল্প করছে পাগলা সাহেবের। তাই শুনতে শুনতে লখাই নিজের ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল। সে ফিরে তাকাল সারদার দিকে।

এতখানি বয়সেও সারদার চুল পাকেনি, দাঁত পড়েনি। শরীরের বাঁধুনিতে কিছুটা ভাঙন ধরেছে। সে ভাঙন যেন বিহ্বলতার আবেশ। কিন্তু আজ তাদের উভয়ের কারুরই চোখে আর কামনার সে উদ্বেলতা নেই। আজ তারা পাশাপাশি কাছে বসে শুধু কথা বলে। কিন্তু বেশিদিন কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। সারদার চোখে কামনা নেই কিন্তু তার চোখের স্নেহ ও প্রেমের অতল গভীর এক মহাপ্রশান্তিতে ডুব দেওয়ার ডাক যেন রয়েছে। প্রাণের জ্বালা প্রশমিত হয় তার কাছে এলে। মন উদাস হয়ে ওঠে, তন্দ্রাবেশে ভারী হয়ে ওঠে চোখের পাতা।

লখাই তার প্রাণের আগুন নিয়ে ভাবে, কী দিয়ে তার সইয়ের প্রাণ এমন ভরে থাকে। দিবানিশি তার চোখেমুখে হৃদয়ের কোনখান থেকে এসে ছেয়ে থাকে এই আনন্দের রেশ।

সারদা বলল, কী দেখছ অমন করে?

লখাই বলল, দেখি তোমাকে। ভাবি, কীসের নেশা করেছ। তোমার কি দুঃখু নেই?

সারদা কোপকটাক্ষে হেসে বলল, আমার দুঃখু থাকলে বুঝি তোমার সুখ হত? তোমার খালি পাগল পাগল কথা। তুমি দুঃখু না দিলে আমার আর দুঃখু কোথায়?

বলে হেসে উঠে আবার গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, কান্ত, সোমসার যেন দুঃখের সমুদুর। নেশা করেছি সেই সমুদুরের জল খেয়ে। একদিন ভেবেছিলুম, সুখের শেষ নেইকো। তাতে বড় দাগা পেয়েছি। সুখের নেশা করতে চেয়েছিলুম যে। পরে ভাবলুম, ও পোড়া সুখ-দুখ নিয়ে অত ভেবে কেন মরি। ভাবলে জ্বালা বাড়ে। তাই ভাবি, যা আছি, আমার যেটুকুন আছে, সব ঝেড়েপুঁছে দিয়ে যাই। ওমা! দিতে গিয়ে দেখি, দিয়ে দিয়ে আর শেষ পাইনে। নেবে কে?

লখাই অবাক হয়ে বলল, নেবে কে? কেউ কি নেবার নেই সই?

সারদার চোখের দৃষ্টি কোথায় হারিয়ে গেল। দূর দক্ষিণের বিলের বাঁক যেখানে আকাশে ও বারাকপুরের খালের সঙ্গে ঝাপসা হয়ে মিশে গিয়েছে, সেখানে গিয়ে ঠেকল যেন তার শূন্য দৃষ্টি। বলল, কান্ত আমি পাপিষ্টিনি। যুগলকিশোর ঠাকুর যে আমার কাছে শুধু পাথরের মূর্তি ধরে দাঁইড়ে আছে, সে আমার কাছে কিছু চায় না। ওই চাষি মুনিষটাকে দিনরাত দেখি, ঠাউরে উঠতে পারিনে ওর প্রাণটা কী চায়। তা ওকে খাইয়ে পরিয়ে বকে ঝকে ওর মুখ খোলাতে পারিনে। রোজই লোকজন ডেকে নিয়ে এসে মোচ্ছবে মাতি, সবাইকে প্রাণতোষ করে ভোগ দিই। রোজ রাঁধতে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি রাঁধি কিন্তু মিছে রান্না। খাবে কে? রাজ্যের গাই ধরে এনে, নিজের হাতে বিচুলি কেটে খাওয়াই, এর তার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি, বালভোজন করাই। কিন্তু সবই, এই আসে, এই যায়। কান্ত, তুমিও তো নাও না।

অকস্মাৎ যেন অভিমানে বেঁকে উঠল সারদার ঠোঁট। ছলছলিয়ে উঠল চোখ। লখাই বলল, কী নেব, কী সে বস্তু?

সারদার ছলছল চোখে বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল। ফিসফিস করে বলল, সে বস্তু যদি মানুষ দেখতেই পাবে, তবে আর ধরে রাখবে কেন? কান্ত, হীরাকে এনে তুমি বড় ভাল করেছ। আর আমি ফিরে যেতে দেব না। বলো, নিয়ে যাবে না ওকে?

লখাই যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠল সারদার কথায়। বলল, তোমাকে তো বলেছি সই সব কথা। তুমি যদি রাখতে পার আমি বেঁচে যাই। থাকুক।

কিন্তু লখাইয়ের প্রাণের মধ্যে কী যেন আটকে রইল। সে তার বিদ্রোহী জ্বলন্ত বুকটার মধ্যে আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল সারদার সব বিলিয়ে দেওয়ার সেই বস্তু। কিন্তু কোথায়? সেখানেও সমস্ত যন্ত্রণার ধারে ধারে অশ্রুর বাষ্প জমে আছে। কিন্তু কী বিলোবে সে, কাকে বিলোবে। তার তো দেবার কিছু নেই। তার দেওয়ার কাছে, মনে শুধুই জ্বালা, শুধুই ঘৃণা।

লখাই কয়েকদিন যেন ঝিমিয়ে রইল সারদার আখড়ায়। সারদা মেতে রইল হীরাকে নিয়ে। যুগলকিশোর আর হীরা। হীরাকে নাওয়াবে, খাওয়াবে। কোঁচা দিয়ে রাঙা কাপড় পরাবে, গলায় দেবে পৈতে আর উড়নি। দেবে সন্ধ্যামালতীর মালা। বুকে কপালে এঁকে দেবে রসকলি। মালা জড়িয়ে দেবে মাথায়। কানে গুঁজে দেবে ফুল। চোখে কাজল। তারপর নিজের হাতে খঞ্জনি বাজিয়ে গাইবে,

প্রাণ ভরে নাচ নিমাই, দিব ছানা চিনি।

 কখনও বাসন্তী কাপড় পরিয়ে মাথার মালায় দেবে গুঁজে ময়ূরের পাখা। গাইবে,

শিখি বাঁকা ময়ূর পাখা বাঁকা বন্ধুবিহারী।

হীরা নাচে। তার বিদ্রোহী শিশুমন হরণ করেছে সারদা। তার বুকের অতল গভীরে ডুব দিয়েছে হীরা। যেন সে ভুলে গিয়েছে বাড়ির কথা, কারখানা ও মধুদাদার কথা। সারদা ডেকে ডেকে নিয়ে আসে পাড়ার আরও ছেলেদের। সকলেই তার সঙ্গে নাচে। নাচে সারদার হাতের আড়ালে লুকোনো দিব্যির জন্য। দিব্যি অর্থাৎ খাবার।

খাবার, সেও এক ব্যাপার। হেন খাবার নেই, যা নাকি সারদা করে না হীরার জন্য। যেন এক যজ্ঞিবাড়ির কাজ নিয়ে পড়েছে সে।

লখাই দেখে। দেখতে দেখতে মন তার অশান্ত হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই ভাবে, আজকে সে বলে ফেলবে তার অতীত জীবনের কাহিনী। কিন্তু সারদাকে কখনওই সে তেমন করে পায় না। সময় বয়ে যায়, তবু সারদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে তার দ্বিধা হয়।

একদিন বলল, সই, তুমি জাত মান?

 সারদা বলল, জাত? কান্ত, ঠাকুরের কাছে মানুষের কি জাত আছে? বলে গুনগুন করে গাইল,

জাত বেজাতের পায়ের ধুলো আমার মাথায় দিয়ে রে!
জাতের মান কুলের মান ভাসা প্রেমের সাগরে।

লখাইয়ের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। তিক্ত চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, সই, ফিরিঙ্গি জাতের পায়ের ধুলোও কি মাথায় নিতে হবে?

সারদা লখাইয়ের কথা শুনে চমকে উঠল। উৎকণ্ঠিত হল তার মুখ দেখে। এত সব ভেবে তো সে বলেনি এ কথা। তার মনে পড়ল সেই ঘটনা। লখাইয়ের সেই গারুলিয়ার আখড়ায় সাহেব দেখে খেপে যাওয়ার কাহিনী। নিজের মনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সে দেখতে পেল নিজেকে। এই সমাজে তার কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে নিপীড়িত জীবনকে দেখতে পেল সে। দেখতে পেল সামনে তার প্রাণকান্ত লখাইকে। কই, লখাইকে যেদিন প্রথমে দেখেছিল, একবারও তো জাতের কথা মনে হয়নি। কিছুই না জেনে না বুঝে সঁপে দিয়েছিল প্রাণ। জাত নিয়ে কোনওদিনই কোনও বিষয়ে তার হৃদয়ের দ্বার ভেজানোর কথা মনে হয়নি। নিজেকে চোখ ঠারতে পারল না সে। সে সহজভাবেই বলল, কান্ত, মানুষের জাতটা-ই কি বড়? ফিরিঙ্গি জাত মানুষ হলে তারও…

থাক। আর বোলো না। চাপা তীব্র গলায় যেন ধমকে উঠল লখাই। বুকের চাপা আগুন হঠাৎ লেলিহান শিখায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। বলল, ফিরিঙ্গি জাত শত্রুরের জাত। পায়ের ধুলো কেন, তার ছোঁয়াও পাপ, অধম্মো।

বলে সে সামনে থেকে সরে চলে গেল ঘরের মধ্যে। সারদা ব্যথিত আড়ষ্ট মনে দাঁড়িয়ে রইল।

বিকাল হয়ে এসেছে। বরুতীবিলের তেপান্তরের মাথায়, আকাশের বুকে বসন্তের রং ফুটেছে। মৃদু মৃদু হাওয়া আসছে দক্ষিণ থেকে। হীরা খেলা করছে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে মন্দিরের পিছনে। সারদা দেখল, চাদর গায়ে দিয়ে লখাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। সে দ্রুত পায়ে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়াল। বিস্মিত করুণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছ কোথায়?

বাড়ি।

বাড়ি? আচমকা জলের ঘটি চলকে যাওয়ার মতো সারদার চোখে জল এসে পড়ল। সে তো লখাইয়ের প্রাণে কষ্ট দেওয়ার জন্য কোনও কথা বলেনি। বলল, কী করেছি?

সারদার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কোনও কঠিন কথা বলতে পারল না লখাই। বলল, তুমি কিছু করনি, আমার আর কিছু সইছে না সারদা। বলতে পারিনে, কিন্তু আমার বুক যে জ্বলে যাচ্ছে।

সারদার কান্নার উপরে উৎকণ্ঠা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। লখাইয়ের হাত ধরে বলল, কী হয়েছে তোমার? আমি তোমাকে দুঃখু দিতে চাইনি। তুমি যেয়ো না।

না, আমি যাব। আমাকে আজ আটকে না ভাই। লখাই দিশেহারার মতো বলল।

 কথা ফোটে না সারদার গলায়। তবু বলল, হীরাকে নিয়ে যেয়ো না, ও থাক আমার কাছে।

লখাই এক মুহূর্ত ভেবে বলল, থাক। তোমার কাছে তো আমিই ওকে রাখব বলে এসেছিলুম। থাক।

বলে সে বেরিয়ে গেল। গেল যেন তাড়া-খাওয়া একটা বিরাটকায় আহত মানুষের মতো, ঝুঁকে, দ্রুতপায়ে। চোখের জলে অন্ধ হয়ে গেল সারদার চোখ।

.

১৭.

সাতদিন না যেতে একদিন দিনের বেলা সারদা ঘুম থেকে জেগে উঠে বসল। ঘুম নয়, আলস্য ভাঙতে গিয়ে দুপুরবেলা একটু শুয়েছিল। তন্দ্র এসেছিল একটু। পাশে হীরাকে নিয়ে শুয়েছিল। দেখল হীরা নেই। বোধ হয় গায়ে হীরার স্পর্শ পাচ্ছিল না বলেই সহসা তন্দ্রা ভেঙে গেল। সে ডাকল হীরা! হীরু কোথায় গেলি?

কোনও সাড়া পেল না। সারদার মনটা চমকে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে এল সে। চাষি মুনিষটা ঘুমুচ্ছে উঠোনের রোদে পিঠ দিয়ে। উঠোনটা ফাঁকা। মন্দিরের দরজা বন্ধ। বাড়ির আশেপাশে দেখল। গোয়ালে, চেঁকিঘরে। কই, কোথাও তো নেই। রুদ্ধশ্বাস বুকে কান্না চেপে এল তার। কোথায় গেল ছেলেটা। সামনে বরুতীর মাঠ। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল তার সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে। মাঠ নয়, মহাসমুদ্র। ধানকাটা রিক্ত মাঠ ধুধু করছে। পৌষের রোদ দিঘির জলের মতো চিকচিক করছে। হলই বা শীতকাল, তৃষ্ণা পেলে ওমাঠে এক ফোঁটা জলও যে পাওয়া যাবে না! ওই মহাসমুদ্র দিগন্তে মানুষ তৃষ্ণায় মরে, কিন্তু মাঠের তৃষ্ণা মানুষের। অনেক মানুষ গৃহপালিত গরু ছাগল ওই মাঠের পিপাসা মিটিয়েছে। খেয়ালি ছেলে কি এই পথে গিয়েছে। সর্বনাশ! জোয়ান পুরুষ যে এ মাঠ শীতের দিনেও সচরাচর পাড়ি দেয় না। গরমকাল নয়, রোদে তেমন তাত নেই। তবু, হীরার পক্ষে এই তো যথেষ্ট।

উৎকণ্ঠিত চোখে জল নিয়ে সারা দিশেহারা হয়ে আবার এদিক ওদিক দেখল। চাষা মুনিষটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করল। সে কিছুই বলতে পারল না। খুঁজতে পাঠাল তাকে মাঠে। নিজে গেল পাড়ায়।

তাই তো, এখন মনে পড়ছে, ছেলের চোখেমুখে যেন কীসের অস্থিরতা ছিল কদিন ধরে। আনমনা ছেলে, দিশেহারার মতো কেবল এপাশ ওপাশ করেছে কদিন। কেন? নিজের প্রাণ যাক, কী বলবে সে লখাইকে, পাড়ায় কোথাও নেই। সঙ্গীরা অবাক হয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, তারা দেখেনি। দেখেনি, তবে কোথায় সে! কোথায় গেল!

আরও কয়েকজনকে বরুতীর মাঠের দিকে পাঠিয়ে, পাগলিনির মতো সারদা সেনপাড়ায় ছুটে এল। এসে বাড়ির ঢোকবার মুখেই দেখল, বেড়ার আগল ধরে কালী দাঁড়িয়ে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। সারদা কোনওরকমে অবিকৃত গলায় জিজ্ঞেস করল, দিদি হীরে, হীরে এসেছে?

কালী চমকে উঠল। বলল, কে, আমাদের হীরা? হ্যাঁ, এসেছে। এই তো এল। এসেই বললে, মা চলে এলুম। মধুদা কোথায়? আমি বললুম, জানিনে। অমনি ছুটল কোথায়–

আর শোনবার অবসর হল না সারদার। সেখানেই বসে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। এ কান্না শুধু ব্যথার নয়, হারানিধি ফিরে পাওয়ার কান্না। রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণা ও উৎকণ্ঠা ভেসে যাওয়ার কান্না।

কালী উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?

কাঁদব না? না বলে ছেলে চলে এসেছে। নাইয়ে খাইয়ে কোলের কাছে ছেলে নিয়ে ঘুমিয়েছি, হাতড়ে দেখি ছেলে নেই। গাঁ মাথায় করে মাঠ ঘাট ঘুরে ছেলে পাইনে। হুতোশ আমার প্রায় যায় গো।

বলে কেঁদে কেঁদে, নিশ্বাস ফেলে বুকটা খালি করল। তারপর বলল, সে কোথায় দিদি? সে সব্বোনেশের মুখ একবারটি না দেখে যে আমি যেতে পারব না?

সারদার উপর কালীর মন আগে বিরূপ ছিল। কারণ এই সারদার সঙ্গে লখাইয়ের ভাবের বাড়াবাড়ি দেখেই, কাঞ্চনের জগৎ-সংসার অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। মনের সেই অবস্থায়, পূর্ণ গর্ভবতী কাঞ্চন ভর সন্ধ্যায় গঙ্গায় গা ধুতে গিয়ে সহসা মানসিক অস্থিরতায়, কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আর তার জ্ঞান ফেরেনি। ছেলের জন্ম দিয়ে সে মারা গিয়েছিল। তাই সারদার উপর কখনও প্রসন্ন ছিল না কালী। কিন্তু আস্তে আস্তে কালী দেখেছিল, সারদা লখাইকে গ্রাস করতে চায়নি। লখাইকে আখড়ার বাবাজি করে, সংসার ছাড়িয়ে নিয়ে যায়নি। সেবাদাসীর ছদ্মবেশে, অনাচারের সংসার গড়ে তোলেনি। সে যেমন ছিল, তেমনি আছে তার যুগলকিশোরকে নিয়ে। কিন্তু নারীর প্রাণ, কালী নিজেও নারী, অন্তর্যামী জানেন, মনের মতো একটি পুরুষের দেখা পেলে, নিজেকে সে সম্পূর্ণ গোপন করতে পারে না। মেয়েমানুষের ভালবাসাটা তার স্বধর্ম। কিন্তু সে ভালবাসা দিয়ে কোনও অনাসৃষ্টি করেনি সারদা। তাই ধীরে ধীরে কালীর বুকে একটি স্নেহ ও বিশ্বাসের স্থান করে নিয়েছে সে।

কালী বলল, ওই যে বললুম, সে তার মধুদাদাকে খুঁজতে গেছে। কিন্তুন কোথায় পাবে। বলতে বলতে কালীর চোখে জল এসে পড়ল। এতক্ষণে সারদা লক্ষ করল, কালীর মুখে দুশ্চিন্তার কালিমা। খেয়াল হল, আগল ধরে আনমনে কালী দাঁড়িয়ে ছিল পথের দিকে তাকিয়ে।

সারদা বলল, কেন, মধু কোথায়?

কালী বলল, জানিনে। সেই যেদিন লখাই গেল তোমার ঠাঁই, সেদিনের থেকে কোথায় গেছে, কেউ জানে না। সবাইকে ডাক করে শুধিয়েছি, পাত্তা পাইনি। কাকপক্ষীর মুখেও কোনও খপর নেই।

সারদার মনে পড়ে গেল লখাইয়ের কথা। সে তাকে মধুর সঙ্গে ঘটিত সমস্ত ঘটনাই বলেছিল। মনের মধ্যে তার আর এক নতুন দুশ্চিন্তার ছায়া ঘনিয়ে এল। বলল, আর তোমার দেওর কোথায়?

কালী জলভরা চোখেই ভীরু হতাশায় ঘাড় নাড়ল। ভীত গলায় বলল, সে যে আর এক বেপদ। শুনছি কোম্পানি সারা গাঁঘর নাকি কিনে নেবে। কারখানা কল বসাবে। তা সে মিনসে সব্বাইকে বলে বেড়াচ্ছে জমি বিক্রি কোরো না। মা মনসার গোঁ, এই গোঁ নিয়ে আমার চেরকাল ভাবনা। শুনছি কোম্পানি গোঁসাইদের বলেছে জমি হাত করে দিতে। কিন্তুন বাস্তু বিক্রি কে সাধ করে করতে চায়। কোম্পানি আর জমিদারে একজোটে পেছুনাগলে, মাষে এঁটে উঠবে কেন? তা সে মিনসে শুনবে না। ঘরে ঘরে গিয়ে বলছে বিক্রি কোরো না।

বলতে বলতে কালীর গলা একেবারে ধরে এল। কান্নাভরা গলায় ফিসফিস করে বলল, সব যেন কেমন হয়ে গেল। দিন গিয়ে রাত এল, আর একে একে আমার সবই গেল। ওই এক দ্যাখো, মধুর বাপ, হাঁটতে চলতে পারে, তবু যেন অথব্বো। মধু পেটের শত্রুর কোথায় গেছে। আর লখাই, শুনছি নাকি আজ ওকে পুলুশের সেই আতপুরের নেবারন ঘোষ আয়টার না কোন ঘাটের মড়া, মহারানির নাম নিয়ে ডাক করেছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক, প্রাণটা আমার গলায় এসে ঠেকেছে।

সারদার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। লখাইকে যতদিন থেকে সে দেখেছে, ততদিন অকল্পিত সংকটের মধ্যে মানুষটাকে সে মাথা গলাতে দেখেছে। মহারানির পুলিশ, সে তো চোর ডাকাত বাটপাড় ধরে বেড়ায়। কিন্তু তার কান্ত এ কোন সর্বনাশের আগুন জ্বালতে চলেছে যে, পুলিশ ডাক করিয়েছে। তাকে!

ফিরে যাওয়া তার হল না। শুধু হীরা নয়, হীরার বাপের সঙ্গেও না দেখা করে সে যেতে পারবে না। আখড়া খালি পড়ে আছে, কিন্তু মুনিষটা তো রয়েছে। সে সব দেখেশুনে রাখবে। আর যুগলকিশোর। আজ তাঁর ভোগের ও আরতির ব্যতিক্রম ঘটবে, দেরি হবে। তবু পাপিষ্ঠিনি সারদাকে কি ঠাকুর ক্ষমা করবেন না! তিনি রুদ্র নন, কুদ্ধ নন। তিনিই তো দুঃখ এবং সহ্যের প্রতীক। তিনি অন্তর্যামী। মনের কথা তিনি সবই বুঝতে পারেন।

কালী বেড়ার আগল খুলে, বাইরের দিকে মুখ করে মাটিতে বসল। সারদাকে ডেকে বলল, এসো, বসো

সারদা এসে পাশে বসল। কেউ আর কোনও কথা বলল না। নীরবে পথের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

.

১৮.

মধু যেদিন লখাইয়ের কাছে হাত্তা লড়াইয়ে পরাজিত হল, সেদিনটা তার জীবনে এক অসহ্য যন্ত্রণায় কালো হয়ে উঠল। না, হাতের কবজি তার ভেঙে যায়নি। হাতের তালুর চামড়া একটু ফেটে গিয়েছিল। সামান্য রক্ত বেরিয়েছিল। ব্যথা একটু হয়েছিল, সে ব্যথা মধুর কাছে ধর্তব্যের মধ্যে নয়। পরাজয়ের জ্বালা ও বৃথা রোষে জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ছুটে গেল কারখানায়। নিজের অক্ষম শক্তির প্রতি সে বারবার ধিক্কার দিয়েছে। গোলাম যখন অনেক কাকুতি মিনতি করে তার কাছ থেকে সমস্ত কথা জানল, তখন সেও বন্ধুপীড়নে ক্রোধে জ্বলে উঠল। বলল, মদো বল শালাকে একদিন মাথায় এক ঘা মেরে একেবারে জন্মের শোধ দিই।

কিন্তু কী বিচিত্র? এ কটুক্তি শুনে হঠাৎ মধু তার সেই ব্যথাধরা হাত তুলেই গোলামের গাল বেড়ে কষাল এক থাপ্পড়, তুই শালা বলছিস কাকে? অ্যা, কাকে? ব্যাপারটা এতই অভাবিত যে, প্রথমে গোলামের মুখে একটি কথা ফুটল না। সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না, তার সামনে আজন্ম পিরিতের বন্ধু মধুই দাঁড়িয়ে আছে। পরমুহূর্তেই দুর্জয় রাগে রক্ত ফুটে উঠল তার চোখে। যার জন্য করি, সেই বলে চোর। কিন্তু মধুকে আক্রমণ করতে গিয়ে গোলামের হাত আড়ষ্ট হয়ে গেল। সেও জোয়ান মানুষ। দেহে তার শক্তিও কম নয়। তবু তার বুকের মধ্যে খচ করে বাজল। অত বড় থাপ্পড়টা খেয়েও উলটে মধুর জন্যই মায়া হল তার। কিন্তু ক্রোধের বশে সে কথা স্বীকার করতে পারল না।

গোলামকে মেরে মধুও কিছুক্ষণ মনে মনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল বয়লার ঘর থেকে। কলঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার থমকে দাঁড়াল। মোহর কথা মনে পড়ছে। কিন্তু দেখা করল না। সোজা গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়াল। একবার ভাবল, দক্ষিণের পথ ধরে ছুটে যাবে। কিন্তু ঠিক সে সময়েই কে যেন তাকে ডাক দিল, কে, মধু ভাইপো নাকি?

মধু তাকিয়ে দেখল, গারুলিয়া কলের নরসিং মিস্তিরি কোম্পানির নৌকায় করে দক্ষিণ দিকেই চলেছে। নৌকাও তার বেশি দূরে নয়। বিশ হাত দূরের জলে হবে বা।

নরসিং জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

মধু বলল, গারলে।

অর্থাৎ গারুলিয়ায়। নরসিং উৎসাহিত হল। তার চোখে একটি চকিত চোরা ঝিলিক খেলে গেল। বলল, তা হেঁটে যাবে কেন? আমিও তো যাচ্ছি গারলে, আমার নৌকোয় চলে এসো।

মধু আপত্তির কারণ খুঁজে পেল না। ভাববার অবকাশও তার কম ছিল। সে কোথাও যেতে চায়। এই মুহূর্তে, এই গ্রাম ছেড়ে, কোথাও যেতে চায়। স্বভাবতই, একটা আস্তানার দরকার, তাই সাক্ষাৎ খুড়া নারাণের কথা তার মনে পড়েছে। নারাণ খুড়ো গারুলিয়ায় আছে। তার আস্তানাই আজ মধুর প্রয়োজন।

নরসিং-এর নির্দেশে মাঝি নৌকা তীরে নিয়ে এল। নরসিং আর একবার ডেকে তুলল মধুকে, এসো, ভাইপো এসো।

মধু নৌকায় উঠে যে-যাত্রীদের দেখল, তারা অনেকেই মুখ চেনা। নরসিং নিজের কাছেই বসাল তাকে। মধুর মুখের ভাবভঙ্গি দেখে, জলের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা করল সে। জিজ্ঞেস করল, তা গারলেয় কী মনে করে খুড়ো?

এ ক্ষেত্রে খুড়ো সম্বোধন স্নেহার্থে। মধু ডান হাতটা বাঁ হাতে আড়াল করে, একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করল, কী মনে করে? ঠোঁটে ঠোঁট টিপে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, খুড়োর কাছে যাচ্ছি।

নরসিং হেসে বলল, খুড়োকে দেখবার মন করেছে বুঝি? তা খুড়ো তোমার বেশ ভালই আছে। টমাসডমের মিস্তিরি, তার কি কিছুর অভাব আছে?

মধু দুরের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমারও কাজ কামের ফিকির আছে, তাই যাচ্ছি।

অ।

নরসিং উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, তা ভাল, খুব ভাল বাবা। তোমার মতন গুণধর ছেলের কি কাজ কামের অভাব হয়?

নরসিং-এর এতখানি উচ্ছ্বাস ও উৎসাহের কারণ ছিল। সে শুধু মিস্তিরি নয়। কোম্পানির আড়কাটির কাজও কিছু কিছু করে। কাঁকিনাড়ায় জার্ডিনদের কারখানায় শীঘ্রই মেশিন বসবে। কাঁকিনাড়া থেকে যারা গারুলিয়ায় কাজে আসত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যেই কারখানায় আসা বন্ধ করে দিয়েছে। দু-একজন বাবুও জার্ডিন কোম্পানির সাহেবের ফোঁসলানিতেই আসা বন্ধ করেছে। এমনকী কাজ শুরু না হতেই বাবুকে সঙ্গে করে সাহেব হাতে হাতে হপ্তার পয়সা তুলে দিয়ে আসছে লোকের বাড়িতে গিয়ে। বাবা বাছা করে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে।

নরসিং গিয়েছিল তাদেরই ডাকতে। কয়েকজনকে মাত্র পেয়েছে সে, বাদবাকি কেউ আসেনি। যারা এসেছে তারা জার্ডিনদের পয়সাও নিয়েছে, কিন্তু কাঁচা পয়সার উগ্র লোভ না ছড়াতে পেরে টমাসডমের কারখানায় চলেছে। তা ছাড়া সময়টাও খারাপ পড়েছে। সামনেই পৌষ সংক্রান্তি। গঙ্গাসাগর মেলার দিন এসেছে ঘনিয়ে। এখন যন্ত্রের বাঁধন বড় শিথিল। না বলে কয়ে কারখানার মেয়ে-পুরুষ পালাচ্ছে। দলে দলে সকলের যাত্রা এখন গঙ্গাসাগরের দিকে। সবাই গিয়ে হয়তো পৌঁছায় না। ধর্ম ছাড়াও, কয়েকদিন জলে জলে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা করে অনেকের। এই একটি সময়, যখন কারখানার লোক কম পড়ে যায়।

অবশ্য সে সংকট শুধু মাত্র টমাসডমের নয়, কুল্যে যে চার-পাঁচটি কারখানা এপারে ওপারে আছে, সেই সব কারখানাতেই মজুর মিস্তিরির সংখ্যা কম হয়ে পড়ছে। এ আর এমনকী বেশি কথা। গঙ্গাসাগর যাত্রা একটা চূড়ান্ত ব্যাপার বটে। কিন্তু শরৎকাল থেকে বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত রীতিমতো লোকের টান পড়ে। কারখানার চৌহদ্দিতে লোকজন আসতে চায় না। মাঠে ঘাটে ঘরে তারা আসর জমিয়ে বসে থাকে। এ সময়ে চাষ-আবাদ থেকে শুরু করে, বাংলার নানান জায়গায় বছরের শ্রেষ্ঠ মেলাগুলি বসতে আরম্ভ করে। নেই নেই করেও, প্রাচুর্য ও উৎসবের সাড়া পড়ে যায় দিকে দিকে। বর্ষার পরে, এখানে সেখানে, গঞ্জে হাটে মাঠে দেশ-বিদেশ থেকে আসে যাত্রার দল। রাঢ়ের খেমটা ও সারা বাংলার কবিয়ালেরা এসে জড়ো হয় চন্দননগর চুঁচুড়ার মতো জায়গায়। বড় বড় বাবুদের বাড়িতে নাচগানের আসর বসে। কিছু না হোক, একবেলা অনেকের খাওয়াও জুটে যায়।

এসময়ে ভেঙে যায় যন্ত্রের নিয়ম। বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যন্ত্র তার শেষ চেষ্টা করে অবাক বিস্ময় ও বিরক্তিতে এই বিচিত্র দেশের বিচিত্র মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে।

নরসিং মধুর কথা জানত। জানত যে, মধু ইতিমধ্যেই ওস্তাদ কারিগর হয়ে উঠেছে। কোনও কলে কাজ না করেও তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে ও অঞ্চলের সর্বত্র। তার ডাকসাইটেগিরির কথাও সেসঙ্গে সবাই জানে। নরসিংহের বুকের মধ্যে খুশির ঢেউ বইল। নৌকায় যখন তুলতে পেরেছি তখন সাহেবের কাছে এ কৃতিত্ব তারই।

.

মধু এল গারুলিয়ায়।

মধু আরও কয়েকবার এসেছে গারুলিয়াতে। তবু মনের তার সাধ মেটে না। দিনে দিনে গারুলিয়া এক বিচিত্র জায়গা হয়ে উঠেছে। সে শুনেছে কলকাতায় অনেক লোক, অনেক বাড়ি গাড়ি ঘোড়া, দিনরাত হাট বসে রয়েছে। সেই হাটের মাঝে দিনের বেলা রংমহালের রসের বান ডাকে।

গারুলিয়া যেন দিনে দিনে একটা প্রত্যহের হাট হয়ে উঠেছে। কারখানার চারপাশ জুড়ে দোকান বসেছে। ছোট ছোট কাঁচা বাড়ি উঠেছে অনেক। ঘাটে ছোট বড় নৌকার ভিড় সবসময়। আর কত না লোক ঘোরাফেরা করছে। সবাই কাজের লোক নয়, অকাজের লোকও আছে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আসে নানান লোক কলকারখানা দেখতে। গোরুর গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কারখানার বাইরে। কারখানার মানুষেরা অনেকে গোরুর গাড়িতে করে বাড়ি ফেরে। কেরানিবাবুদের অনেকেও তাই ফেরেন। তা ছাড়া, গোরুর গাড়ি ভাড়াও খাটে। এ এক অভিনব ব্যাপার যে, মুনিষজন হেঁকে বেড়ায় গোরুর গাড়ির ভাড়ার জন্য। শোনা যায়, চাপদানি রিষড়ার কলের কাছে নাকি এমনি সব ব্যাপার ঘটে।

মধু দেখেছে কারখানা। আরও কয়েকবার দেখেছে। দেখে দেখেও বিস্ময় ও কৌতূহল মেটে না। কারখানা তো নয়, এক বিরাট রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। তাই বা কেন! গোটা একটা গ্রাম জুড়ে কারখানার চৌহদ্দি। তেসুতি কলের মতো টিনের দোচালা নয়, রীতিমতো পেটানো ছাদওয়ালা, চিনে লোহার বিম দেওয়া পাকা কলঘর। সেও কি একটুখানি! এক নজরে দেখলে তার চার ভাগের এক ভাগও নজরে পড়ে না। এপাশ ওপাশ ফিরে দেখতে হয়। বোধহয় টিনের ঘর নয় বলেই এখানে কলঘরের শব্দ ঝমঝম করে বাজে না। মনে হয় পাতাল গর্ভের কোনও বিশালকায় জানোয়ারের তীক্ষ্ণ চিৎকার ও দাপাদাপিতে পায়ের তলায় মাটিসুদ্ধ কাঁপছে।

এ কারখানার উত্তর-পুর্ব ঘেঁষেই উঠছে ডানবার সুতাকলের ইমারত। ডানবারের জমির সীমানা পেরিয়ে শস্যের খেত। ডানবারের জমিতে গাছ কাটছে শ্রীনাথ কাঠুরে। জঙ্গলপীর দহের ধারে কাঠুরে পাড়ার শ্রীনাথ, যার দুই নিঃসন্তান বউ পালিয়েছিল তেলিনিপাড়ার চটকলে। দুটি বউই কুরুসেন সাহেবের অর্থাৎ ক্রুকসনের দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিল। ঘুচিয়েছিল তাদের আঁটকুড়ি নাম। কিন্তু এ কথা সবাই জানে, ক্রুকসন সেই গর্ভবতী বউ দুটোকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত একটা বউকে মেরেও ফেলেছিল। কিন্তু আর একটা বউ তার আগেই পালিয়ে বেঁচেছিল। বেঁচেছে কি মরেছে সে সংবাদ অবশ্য আর কেউ জানে না। আর কোনওদিন সে ফিরে আসেনি। কোনও কলেকারখানায়ও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সকলের বড় কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল। কালো কাঠুরে বউয়ের পেটে গোরার ছেলে কেমন দেখতে হয়।

যাই হোক, সেই থেকে শ্রীনাথ একরকমের পাগল হয়েছে। তার ধারণা যন্ত্র যদি তার দুই বউয়ের অভিশপ্ত পেটে সন্তান জন্ম দিতে পারল, তবে তাকেই বা আঁটকুড়ো নাম ঘোচাবার সুযোগ দেবে না কেন? সে তার দুই বউকে খুঁজেছিল। কিন্তু পায়নি। লোকে বলেছে, পালিয়েছে। সে বিশ্বাস করেনি। কতদিন তেলিনিপাড়ায় কারখানার এলাকায় গিয়ে পড়েছিল, মেয়ে শ্রমিকদের দঙ্গলের মধ্যে ঢুকে একে তাকে হাত ধরে টেনে দেখত, ওই সেই বউ কি না। গর্ভবতী মেয়েমানুষ দেখলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করত। এখনও সে গারুলিয়ার কারখানার মেয়েদের তাকিয়ে দেখে, সন্ধান করে তার বউদের। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা লুকিয়ে রয়েছে এখানেই কোথাও। শ্রীনাথের মারের ভয়ে আসতে চায় না। কিন্তু শ্রীনাথ আর কোনওদিন তাদের মারবে না। সে দেখতে চায় ছেলে। সে যাচাই করতে চায়। আর তার এই বৃদ্ধ প্রাণের আশা ও আকাঙ্ক্ষা, বড় সাধ যে, ওই ছেলেরা তাকে বাবা বলে ডাকবে। হাজার হোক তারই বউয়ের পেটে তারা জন্মেছে। বাপ তারা আর কাকে বলবে। শ্রীনাথই তাদের বাবা। শ্রীনাথ সেই ছেলেদের নিয়ে কাঠ কাটতে বেরুবে। লোকে দেখে বলবে, ছিনাথ তার ব্যাটাদের নিয়ে কাঠ কাটতে বেরিয়েছে। আর শ্রীনাথ ছেলেদের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলবে, হারামজাদারা শুনছিস কী? তাড়াতাড়ি চ। কিন্তু বছরের পরে চলে গিয়েছে বছর। তারা আসেনি।

শ্রীনাথের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মধু হাসল। আস্তে আস্তে কলঘরের দিকে অগ্রসর হতেই নরসিং-এর সঙ্গে ওয়ালিক সাহেব এসে দাঁড়াল তার সামনে। হেসে জিজ্ঞেস করল, টুমি মডু আছে? ভেরি ফাইন। হামি বহুট খুশি আছে। টুমাকে বড় মিসটিরি করবে হামি, সব সে বড়। টুমার সাডি ডিবে, ঘর ডিবে হামি, ইয়েস মাই বয় মডু।

বলে ওয়ালিক সন্ধানী চোখে মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। হেসে উঠে মধুর ঝাঁকড়া কালো কুঞ্চিত চুলে চকিতে হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক হ্যায়?

মধু কথা দিতে দ্বিধা বোধ করল। অবশ্য সকালবেলার সমস্ত ঘটনাটা তার চাপা ক্রোধকে বারবার উসকে দিচ্ছে। সেই ক্রোধই যেন এখনও কবজিতে একটা ব্যথার কনকনানিতে বইছে রক্তের শিরায়। তবু কথা দিতে তার বাধল। তেসুতি কলের পাগলা সাহেবকে তো ভোলা যায় না। সে বলল, সায়েব, আমি খুড়োর সঙ্গে দেখা করব। পরে কথা দেব।

খুড়ো? ইউ মিন, আঙ্কল। কে টুমার খুড়া আছে?

নরসিং তাড়াতাড়ি বলল, আমাদের লারান মিস্তিরি।

নারাণ! ওয়ালিক আরও আশান্বিত হয়ে হা হা করে হেসে উঠল। বলল, টুমি নারাণের ভাইকা লেড়কা আছে? টুমি মডু আছে। গুড গুড ভেট কর। নারাণ কেদার মিসটিরির সাকরেড আছে, টুমি নারাণ কা সাকরেড বনবে হ্যাঁ? হা হা, আবার টুমার সাকরেড সবকো নিয়ে আসবে হামার কারখানায়।

হাসতে হাসতে মধুর পিঠে চাপড় মেরে বলল, টুমি আমার মেশিন শপ নাই ডেখেছ? নরসিন, ইসকো কলঘর ডেখাও।

মধুর তখন আর একজনের দিকে নজর পড়েছে। সে দেখল শ্রীরামপুরের গোঁসাইবাবুদের নায়েবমশাই এদিকে আসছেন। এই লোকটিকে মধু জীবনে আর একবার সেনপাড়ায় দেখেছে। চক্রবর্তীদের বাড়ির কাছেই গোঁসাইদের কাছারিবাড়ি। সেইখানে শুধুই কাছারি দপ্তর। একজন চাকর নিয়ে সেখানে থাকেন একজন আমিন ব্রজবল্লভ চাটুজ্যে মশাই। সামান্য তদারকি ছাড়া তাঁর বিশেষ কিছু করার নেই। তবে পাড়া-ঘরে নানারকমের জুলুমে চাটুজ্যে মশাই সুবিখ্যাত।

নায়েবকে দেখেই ওয়ালিক চিৎকার করে উঠল, হেলো গোসাই নাইব, মি. লিটলজন ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। ইট ইজ টু-উ লেট।

নায়েব মশাই গলার উড়নিসহ হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। বাংলাতেই বললেন, নৌকো ভাঁটার মুখে পড়ে গেল কিনা, তাই আসতে একটু দেরি হল। তা ছাড়া আমি যে তেলেনিপাড়ায় গিয়েছিলাম সাহেব, ভেবেছিলাম আপনাদের সেই সাহেব ওখানেই আছেন।

সেই সাহেব বলতে নায়েব মশাই লিটলজনের কথা বলছেন। নামটা মনে থাকে না, তা ছাড়া কিঞ্চিৎ উচ্চারণের দোষও বেরিয়ে পড়তে পারে।

ওয়ালিক বলল, অল রাইট। মি. লিটলজনের কাম এপারে আছে, ওপারে হামার কুছ কাম নেই অখুন।

নরসিং নায়েব মশাইকে গড় করল। মধু বোধ করি নমস্কারের প্রয়োজনটা বোধ করল না।

নায়েব মশাই তাকে চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোনও কথা না বলে সাহেবের সঙ্গে চলে গেলেন।

 নরসিং বলল মধুকে, কিছু আন্দাজ করতে পারলে?

মধু পারেনি, তাই নরসিং-এর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। নরসিং বলল, সেনপাড়ায় কল খুলবে। জমি বিক্রির জন্য ডাক পড়েছে গোঁসাইদের। তাই নায়েব মশাই এসেছেন।

মধুর চোখের সামনে সেইদিনের দুলেপাড়ার ছবি ভেসে উঠল। মনে মনে সে উচ্চারণ করল, নতুন কারখানা।

.

১৯.

 লিটলজন প্রতীক্ষা করছিল নায়েব মশায়ের। সে এখন টমাসডম কোম্পানির অতিথি। এক নতুন কোম্পানিকে টমাসডম ভ্রাতৃত্ববোধে সাহায্য করছে। যদিও মজুরদের নিয়ে প্রত্যেক কোম্পানির সঙ্গেই প্রত্যেকের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে, তবু বিশ্বের বাজারে চটের চাহিদার অনুপাতে নতুন কোম্পানি পত্তন না করলে একটা সুষ্ঠু ও ক্রমপরিণতির মুখে বাজার নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও অন্য পর্যায়ের এবং সেটা সম্পূর্ণ আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

গঙ্গার ধারে সাহেবদের কুঠি। কুঠি রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল। তবে কুঠির চেহারা ভিন্নরকম। এ চকমিলানো, মহলের পর মহল রাজপ্রাসাদ নয়। এ হল বিলাতি কুঠি। এরকম কুঠি তেলিনিপাড়ায় ইতিপূর্বেই হয়েছে। কুঠির চারপাশে অপর্যাপ্ত খোলা জায়গায় বিলাতি ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে সুরকি ঢালা রাস্তা। নতুন দশ ইঞ্চি ইট দিয়ে রাস্তার ধার বাঁধানো। আর আজকাল শুধু কুঠি নয়, দেশীয় লোকের বাড়িও বড় বড় দশ ইঞ্চি ইটের গাঁথনিতে তৈরি হয়। এই সব কুঠির অতিরিক্ত দরজা দেখলে মনে হয়, বিলাতি আবাসের অন্দরমহলের কোনও চিহ্ন নেই। দরজায় ও জানালায় রঙিন কাপড়ের পরদা দিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

ওয়ালিকের সঙ্গে যে ঘরে নায়েব এলেন, সেই ঘরটিতে কার্পেট পাতা মেঝের উপর গদি আঁটা বিলাতি কৌচ ও একটি মস্ত গোল টেবিল। লিটলজন নিবিষ্ট মনে কাজে ব্যস্ত ছিল।

ওয়ালিক জুতো পায়ে দিয়ে ঢুকল। নায়েব মশাই স্বাভাবিক সংস্কারবশত চটি জোড়াটি বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলেন। ওয়ালিক পরিচয় করিয়ে দিল, শ্রীরামপুরের গোঁসাই স্টেটের ম্যানেজার। অল ইনফরমেশনস উইল বি সারভড বাই হিম।

লিটলজন নায়েবকে বসতে বলেও একটা কাগজ বিশেষ মনোযোগ সহকারে পড়ছিল। নায়েব দেখছিলেন গৃহসজ্জা। অবশ্য তাঁর মনিব গোঁসাইদের বাড়িতেও বিলাতি সভ্যতার আঁচ লেগেছে অনেকখানি। সেই আঁচ তাদের পারিবারিক জীবনেও অনেক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। যাই হোক, সে আলোচনা এখন বিষয়বস্তু নয়। নায়েব দেখছিলেন দেয়ালের ছবি। সবই সাহেবদের ছবি। তার মধ্যে যে ছবিটি পরিচিত, সেটি মহারানি ভিক্টোরিয়ার। বাদবাকি ছবিগুলির তলায় ইংরাজিতে অনেক কথা লেখা রয়েছে।

ছবি রয়েছে হারগ্রিভসের। ওয়াট, আর্করাইট ও কার্টরাইটারের ছবি। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লবী এঁরা। হারগ্রিভসের তাঁত, ওয়াটের স্টিম এঞ্জিন; আর্করাইটের কর্ডিং, ড্রয়িং, স্পিনিং; কার্টরাইটের পাওয়ার লুম আর ব্লাস্ট ফারনেসের যন্ত্রের মডেলগুলি রয়েছে তাদের চিত্রের পাশে পাশে, ছোট আকারে। এরা ক্লাইভের মতো পলাশীর বুকে কামান দাগেনি, দেশের বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মাতেনি, ক্ষমতার লড়াইয়ে বিশাল ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত খোলা তলোয়ার হাতে অশ্বসওয়ার নিয়ে ছোটেনি। কিন্তু এরাই প্রকৃত ভারত-বিজেতা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। এই সব যুগান্তর মহারথীদের আবিষ্কৃত যন্ত্র নিয়েই পুরনো ভারত ভাঙার ও নতুন ভারত গঠনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। উন্মুক্ত করে দিয়েছিল অবাধ ঐশ্বর্য আহরণের পথ। এ সব ইতিহাসের কথা, এরা ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এদের শিল্প বিজ্ঞান সেদিন যেমন ইউরোপে নতুন শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিল, তারই একটা সূচনা আজ চব্বিশ পরগনা ও হুগলি, গঙ্গার এই দুই উপকূল জুড়ে দেখা দিয়েছে।

কিন্তু মহারথীদের আবিষ্কৃত যন্ত্র সেদিন ইংলন্ডের টেমস নদীর জলে ডুবিয়ে দিতে হত যদি না সেদিন বাংলার রুপা ও সোনা পাউন্ডের ওজন ও সংখ্যা বাড়িয়ে দিত। অর্থাৎ যাকে বলে মূলধন।

তাই আজ এ ছবিগুলি গারুলিয়ার চটকল কুঠিতে শুধু মানানসই নয়, তাৎপর্যপূর্ণও বটে। আবিষ্কার ও ঐশ্বর্য গরিমায় তারা যেন সুখ ও বিস্ময়ের হাসিতে, চেয়ে দেখছে লিটলজন, ওয়ালিকের মতো বিপ্লবী কর্মীদের, পাইওনিয়ারদের, দেখছে গঙ্গার দুই উপকূলে গড়ে ওঠা কলকারখানা। একে বলে সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্য কনস্ট্রাকশন। সে কনস্ট্রাকশন আজ মধ্য গগনের সূর্যের ছটায় প্রতিভাত। প্রতিভাত স্টিম ইঞ্জিনে, পাওয়ার লুমে, স্পিনিং-এ, আর ব্লাস্ট ফারনেসের অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখায়। লন্ডনের তুষারকণার উপর সূর্যের ছটার মতো তা উজ্জ্বল, লমবার্ট স্ট্রিটের আদি ব্যাঙ্ক অব ইংলন্ডের লৌহ পেটিকার তাল তাল সোনার চকমকানি।

নায়েব মশাই তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওয়ালিক দেখছিল লিটলজন কৃত দুলেপাড়া সেনপাড়ার নকশা। লিটলজন চোরা চোখে একবার নায়েবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর বসবার অনুরোধ করল না। ওয়ালিককে দোভাষী হিসাবে রেখে সে সরাসরি কথা আরম্ভ করল, ইয়েস ম্যানেজার, আপনার প্রভু জানেন কি না যে আমরা জমি কিনতে চাই?

নায়েব মশাই প্রাচীন চালেই অভ্যস্ত। বললেন, নইলে এ শর্মাকে আর এখানে কেন দেখতে পাবেন?

নায়েবের এরকম কথার ভঙ্গি লিটলজন সাহেবের ভাল লাগল না। সে দেখেছে, প্রত্যেকটি লোকই প্রায় এরকম মোসাহেবের মতো বিগলিতভাবে কথা বলে। শুধু মোসাহেব হলে আপত্তি ছিল না, এই হাসির মধ্যে একটা নোংরামির আভাস পাওয়া যায়। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, জমি বিক্রি করতে জমিদার রাজি আছেন তো?

নায়েব বললেন মোলায়েম গলায়, জমি প্রজারা বিক্রি করলেই হবে।

আর না করলে?

জমিদার তাদের অনুরোধ করবে।

তাতেও না ছাড়লে?

আইনের কাগজ দেখতে হবে।

লিটলজন উত্তপ্ত গলায় বলে উঠল, হাউ ইট ইজ পসিবল? কোনও আইনই নেই, উচ্ছেদ করবার। আইন দিয়ে কিছুতেই উচ্ছেদ করা যাবে না, টেক অ্যাসিওরেন্স ফ্রম মি।

এতক্ষণে ওয়ালিক হা হা করে হেসে উঠল। টেবিলের উপর চাপড় মেরে সে বলে উঠল নায়েবমশাইকে, আই অ্যাম ভেরি সরি মি. গোঁসাই নাইব! মি. লিটলজন কুড নট ফলো ইউ। কোম্পানি টুমাকে খুশি করবে, ইনাম ডিবে, টুমার কাম টুমি করে যাবে। বাট উই নিড ল্যান্ড, এনি হাউ। ইউ টেক অল চার্জেস, ইনফরম ইট টু ইওর লর্ড অ্যান্ড কোম্পানি উইল স্যাটিসফাই ইউ।

নায়েব মশায়ের ইনফরম করার কিছুই ছিল না। কেন না, কর্তারা সরাসরি হুকুম দিয়েছেন এবং প্রজাদেরও বহুপূর্বেই তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, জমি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু ওয়ালিক যে কথাটি বলল, ওই কথাটির জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। জানতেন যে, তাঁর সাহায্য ব্যতীত কোম্পানির পক্ষে জমি কেনা সম্ভব নয়। একেবারেই যে অসম্ভব, তা নয়। মা কালীর ব্রহ্মাস্ত্র এখন মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। তারই সাঙ্গোপাঙ্গ এই সব কোম্পানি এবং সাহেবরা। সুতরাং নতুন আইন তৈরি করতে সময় লাগবে না। উচ্ছেদ এবং জোর দখল কোম্পানির ক্ষমতাতে অসম্ভব হবে না। কিন্তু তাতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। সময় লাগবে। কে জানে, এর জন্য হয়তো বিলাতের পার্লামেন্টের নতুন বৈঠকের প্রয়োজন হতে পারে। তার চেয়ে যদি নায়েব মশাইয়ের সামান্য মুঠিটুকু ভরে দেওয়া যায়, তবে কোনওদিক থেকেই গণ্ডগোলের আশঙ্কা নেই। এই নায়েব মশায়েরা ইংরাজি বুলি জানেন না, কিন্তু বোঝেন ভাল। সাহেবদের মেজাজও জানেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। আর বর্তমান জমিদারি প্রথায় কোথায় আইনের ফাঁক ও ফাঁকি রয়েছে, সকল অন্ধকারের অন্ধিসন্ধিও তাদের রাত্রিচর পাখির মতো সর্বদাই নজরে নজরে থাকে। দূরের অপরিচিত লাট ও মৌজায় পা দিলে বুঝতে পারেন রায়তপ্রজার মনোভাব। এই নায়েব গোমস্তারাই জমিদারের খুঁটি, প্রাণস্বরূপ। জমিদারেরা জীবন কাটাতে ব্যস্ত। গাঁয়ের জমিদারেরা কেউ কলকাতায় যান ফুর্তি করতে। কলকাতার বাঁশবনে বাড়ি ফেঁদে, চার ডবল দামে ঘেয়ো নির্জীব ঘোড়াওয়ালা ফিটন কেনেন, গায়ে ডবল ইংরাজি কুর্তা চাপান। উলটো মোজা পরেন, ডাইনেরটা বাঁয়ে, আর বাঁয়েরটা ডাইনে ইংরাজি বুটজুতো পরে চলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তার সঙ্গে আছে বিলাতি আরক। মোসাহেবরা চিৎপুর থেকে পণ্যাঙ্গনা এনে বলে, কর্তা, অনেক পাপ করেছি, কালীঘাটে কম করে চার জোড়া পাঁঠা বলি দিতে হবে, নগদ দিতে হবে শত মুদ্রা। ইনি যে সে নন, কলকাতার নামকরা এক কুলবধূ।

কর্তার সে সব খেয়াল থাকলে তো। তিনি দিন রাত্রিই মত্ত। কুলবধূ শুনেই তিনি খুশি। আর কিছু চান না। বেশ্যা-সুন্দরী দিব্যি অভিনয় করে। তবু হলে কী হবে, জমিদার মশায়ের যৌবন গত হয়েছে যৌবন আসার আগেই। এখন নাম করা হেকিম কবিরাজের মদনানন্দ ভরসা। যৌবনের অপচয় হয় বললেও একটা কথার মতো কথা বলা হত। রায়তপ্রজার রক্তের ধন বেশির ভাগটাই যায় আবগারি বিভাগ ও বেশ্যাদের হাত দিয়ে সরকারেরই লাইসেন্স ট্যাক্স মেটাতে। কিছুটা যায় মোসাহেবদের ভাঙা ঘরের পাঁচিল তুলতে। বাকিটা ধর্মমন্দিরের পুরোহিতের স্ফীতোদরে।

গাঁয়ের জমিদারেরা গাঁয়ে থেকেও এ সব করতে পারেন, তবে সত্যি কুলবধূদেরই সর্বনাশ ঘটে। আর শহরের কেতাদুরস্ত জমিদারেরা এদের দেখে হাসেন। কথায় বলে বড়মানুষের বড় ব্যাপার, তাদের কেলেঙ্কারিও বড় বড়। তারা মেশেন সাহেবসুবোর সঙ্গে, ব্রেকফাস্ট করেন, লাঞ্চ করেন, ডিনার করেন, খান না। পরিবারে গণ্ডগোল। তা ছাড়া, এরা শহর ছেড়ে দূরের নিরালায় যান বাগানবাড়িতে, চিৎপুরের খাঁদা পঞ্চির চেয়ে কুলছাড়া সুন্দরী বিধ্যাধরীদের নিয়ে এঁরা ফুর্তি করেন, দরকার হলে তাদের সঙ্গেই ব্রাহ্ম ও হিন্দুধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি আলোচনা করে থাকেন। এঁদের মোসাহেবরাও রীতিমতো শিক্ষিত। গেঁয়ো জমিদারের মতো এঁরা বিলাতি আরক ভুলে ধান্য সুন্দরীকেই আকণ্ঠ গেলেন না। তা ছাড়াও এঁদের মুখে অনেক বড় বড় বুলিও শোনা যায়। ধর্মে এঁরা হিন্দু নন, ব্রাহ্ম নন, মুসলমান বা ক্রিশ্চানও নন, জাতে এঁরা জমিদার। নজর করলে, কলকাতার সংবাদপত্রে এঁদের নামও দেখা যায়, শ্রীযুক্ত অমুক মহাশয়, অমুক জিলার, অমুক পরগনার জমিদার, অমুক ফণ্ডে দুইশত টাকা দান করিয়া দেশবাসীর অতিশয় কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। এ যদি শুধু মাত্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার ব্যাপায় হত, তা হলে একটা কথা ছিল। আসলে এ সব শহুরে জমিদারদের সঙ্গে গ্রাম্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর একজনের রক্ষিতা ও মোসাহেবের মন ভাঙানোর জন্যই এই খয়রাতি।

হিসাব করলে কেতাদুরস্ত শহুরে জমিদার আর পাড়াগাঁয়ের আকাট মূর্খ জমিদারের রায়প্রজা নিংড়ানো টাকা দুই বিভিন্ন নদীপথে সেই একই সমুদ্রের মোহনায় গিয়ে পড়ে। আর এদেরই খুঁটি, জমিদারি জিইয়ে রাখার প্রধানমন্ত্রী, এইসব নায়েব মশাইরা। এ হল সারা দেশের সাধারণ চিত্র। গোঁসাইবাবুদের সম্পর্কে কিন্তু তেমন কোনও জনরব এ দেশে নেই। নায়েব মশাইয়ের বুদ্ধির তারিফ করবার জন্য এ সব কথার উল্লেখ করতে হল।

লিটলজনের বাদামি চোখে ক্রোধ ও ঘৃণাবিদ্ধ প্রতিবাদ জ্বলে উঠল। এ সব ব্যাপার অবশ্য বুঝতে তার খুব কষ্ট হয় না। প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকলেও, ওয়ালিকের সম্মানের জন্য সেটা সে করতে পারল না। নায়েব মশাই কিন্তু হাসিতে বিগলিত হয়ে ওয়ালিককে জবাব দিলেন, না না, সে কী বলছেন। আমরা মনিবের চাকর, মনিব খুশি হলেই আমরা খুশি। ইনি চটে যাচ্ছেন আমার উপর। কিন্তু প্রজাদের উচ্ছেদ করা কতখানি কষ্টকর, সে তো আপনি জানেন।

ওয়ালিক তেমনি হেসে বলল, সব জানে হামি, বিলকুল জানে। ইয়েস ইট ইজ ভেরি হার্ড জব। র‍্যাদার এ টাফ ফাইট। বাট, গোঁসাই নাইব, টুমি সব পারে। ল্যান্ড হামার চাই, কোম্পানি টুমার হেলপ চায়। কোম্পানি টুমাকে ইনাম ডিবে, খুশি করবে, আন্ডারস্ট্যান্ড? টুমি কাম শুরু করে।

নায়েব চোরা চোখে দেখছিলেন লিটলজনের মুখ। লিটলজনের রাগের চেয়ে তখন কৌতূহলের মাত্রাটাই বেশি হয়েছে। সে আগ্রহভরে দেখছিল নায়েবের মুখ।

নায়েব বললেন, আপনাদের নকশাটা একটু দেখি।

লিটলজন নিজেই নকশাটা বাড়িয়ে দিল। নায়েব ভ্রু কুঁচকে ঝুঁকে পড়লেন নকশাটার উপর। নকশাটার লেখা সবই ইংরাজি। ভাল করে পড়তে পারেন না, কিন্তু নকশা দেখেই তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেনপাড়া-জগদ্দলের সমগ্র ছবিটা। সেই সঙ্গে সেইখানকার অধিবাসীদের। আর একটা অদ্ভুত হাসির রেখা খুব ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে কুঞ্চিত ছোট ছোট চোখের কোণে গিয়ে ঠেকল। অজস্র টাকার ঝলক যেন তাঁর চোখ দুটিকে আলোকিত করে তুলল।

.

২০.

মধুকে নিয়ে নরসিং এল তাঁতঘরে। নারায়ণ বিশেষ কোনও ঘরের মিস্তিরি নয়। সে এখানকার মধ্যে সকলের বড়। কিন্তু প্রায় সর্বক্ষণ থাকে সে তাঁতঘরে।

তাঁতঘরে একজনের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল নারায়ণ। মধুকে দেখেই চমকে উঠল সে। কাছে এসে মেশিনের শব্দ ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, মধু না কি রে?

জবাব দিল নরসিং। বলল, ভাইপো তোমার হেঁটে পাড়ি দিচ্ছিল। তা দেখে আমি নৌকায় করে নিয়ে এলুম। কলে কাজ ধরবে তোমার ভাইপো।

বিরক্ত হল নারায়ণ নরসিং-এর কথায়। যার কথা, সে নীরব। বক্তব্য বলছে আর একজন। নরসিং-এর দালালের স্বভাব। কোনওমতেই নিজের কথা ভুলতে পারে না। কিন্তু নারায়ণের চোখের দিকে তাকিয়েই চুপ হয়ে গেল সে।

সত্যি এখনও নারায়ণের চোখের মধ্যে বাঘা বাগদির হিংস্রতা যেন ধকধক করে জ্বলে। বয়স হয়েছে নারায়ণের। লখাইয়ের চেয়েও বয়সে সে বড়। শ্যামের থেকে খুব ছোট নয়। কিন্তু এ বয়সেও শরীরটা খাটো বলেই বোধহয় মনে হয়, তার গুলিভাটার মতো শক্ত পেশি এখনও শিথিল হয়ে পড়েনি। গায়ে তার ধূসর লোমের ছড়াছড়ি। মাথার চুলগুলিও পেকে ধূসর বর্ণ হয়েছে। তা ছাড়া সর্বাঙ্গে পাটের ফেঁসো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলে নারায়ণকে হঠাৎ মনে হয় বন্য নিষ্ঠুর। তার ভাবে ভঙ্গিতে কোথায় যেন একটা পাশবিকতা লুকিয়ে রয়েছে।

কিন্তু আজকাল সে অদ্ভুত শান্ত হয়ে গিয়েছে। একদিন কাঞ্চীর জন্য লখাইয়ের উপর প্রতিশোধ তুলতে গিয়ে পরাজিত হয়েছিল সে। সেই পরাজয়ের পর থেকে নারায়ণ চিরকালই যেন কেমন শান্ত অথচ দিকভ্রান্ত হয়ে গিয়েছে। কাতুকে নিয়ে সে ঘুরেছে কলে কারখানায়। রিষড়ায় গিয়েছে। রিষড়া থেকে বরানগর। বরানগর থেকে বাউড়িয়া। চটকলের পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে এই গারুলিয়ার কারখানায় এখন মোটামুটি স্থিতি। কিন্তু এমনি ঘুরতে ঘুরতেই একদিন কাতুকেও ছেড়ে দিয়েছে। তারপর জীবনে তার অনেক মেয়েমানুষ এসেছে। কাউকে সে বেঁধে রাখেনি, নিজেও বাঁধা পড়েনি কারুর কাছে। পয়সা কোনওদিন জমায়নি। আর দশজনের মতো একটা আধলা ধরে রাখেনি কাটা বাঁশের ছিদ্রে। সে কেদার মিস্তিরির শাকরেদ। একদিন তার জীবনে একটি নতুন বান ডেকেছিল। প্রতিষ্ঠা লাভের, ঘর-সংসার গড়বার একটি উন্মাদনা প্রাণের মধ্যে নিঃশব্দে জেগে উঠেছিল।

কিন্তু আশ্চর্য! এ স্বাভাবিক চিন্তাধারা তার অচিরেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার জন্য অবশ্য কাতু খানিকটা দায়ী। কেন না, কাতু তখন স্বাধীন। নির্জীব পুরুষ ও নিষ্ঠুর শাশুড়ির পীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে, সে ঘর ছেড়েছিল বটে নারায়ণের সঙ্গে। কিন্তু স্বাধীনতা ভোগ করেছিল সমান পরিমাণে। যে স্বাধীনতা বদ্ধ প্রাণের সহসা মুক্তিতে আবর্জনার স্থূপে ভরে উঠেছে। বিচার বিবেকহীন হয়ে উঠেছে। কিন্তু নারায়ণ আপত্তি করতে পারেনি। নিতান্ত পুরুষের শক্তিতে সে কাতুকে বাধা দিতে পারত। সে প্রবৃত্তি আর হয়নি। বিবাহিতা স্ত্রী কাঞ্চনকেই যখন বেঁধে রাখতে পারেনি, তখন পরের গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে বেঁধে রেখে লাভ কী! তা ছাড়া, নারায়ণ কারখানায় কাজ করে জীবনধারণ করে। কাতুও করে। তাই কাতুকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখেনি সে। বরং এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল, এ যুগে, তাদের মতো মানুষদের আর সংসার পাতা সম্ভব নয়।

তারপরে আর একবার কাকু এসেছিল। মুক্তির ব্যভিচারে বুঝি তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু নারায়ণের চোখে ঘরের স্বপ্নের ইশারাটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

এখন সে একজনের কাছে আত্মসমর্পণ করে আছে। তাকে সংসার বলা যায় না। ভাসতে ভাসতে চড়ায় আটকে যাওয়া বলা চলে। আবার যদি স্রোত আসে, চর ডুবে যায়, হয়তো ভেসে যাবে।

নারায়ণ মধুর কথা অনেক শুনেছে। কয়েকবার গারুলিয়ায় নয়তো তেলিনীপাড়ায় দেখাও হয়েছে। মধুর জন্য তার প্রাণের মধ্যে বিশেষ একটি গর্ব ছিল। সেই সঙ্গে ছিল খানিকটা ব্যর্থতার বেদনা। কেন না, যে মধুর অত নামডাক, কি লাঠি খেলায় আর কি কলকারখানার কাজে, সেই মধু তার ভাইপো হয়েও পর। নারায়ণ তার আসল খুড়ো হয়েও পর। খুড়ো তার লখাই।

আজ সেই মধু যখন এল, তখন সে প্রথমে ভাবল, হয়তো মধুর বাপ মায়ের কোনও বিপদআপদ হয়েছে। দাদা বউঠান হয়তো কোনও প্রয়োজনে পাঠিয়েছে। সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মধু?

মধুর বরাবর ধারণা তার নারায়ণ খুড়ো ভয়ানক রগচটা লোক। কোনওদিনই সে তাদের সংসারের প্রতি তুষ্ট নয়। সেজন্য তার খানিকটা সংকোচ ছিল। তা ছাড়া তার খুড়ি কাঞ্চন ও লখাইয়ের ব্যাপারটাও সে জানে। আর সেই লখাই তাকে আজ হাত ভেঙে দিয়েছে, এ কথাটা সে কিছুতেই বলতে পারল না। বলল, চলে এলুম তোমার কাছে। তোমার কাছে থাকব।

নারায়ণ বিস্মিত হলেও না হেসে পারল না। নিষ্ঠুর নির্বিকার নারায়ণকে সহসা বোঝা দায়। কিন্তু প্রাণে তার খুব আনন্দ হয়েছে। মধু তার কাছে থাকতে এসেছে এ তার কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার। সে কত যুগ ধরে ঘর ছাড়া। আজ সেই ঘরের ছেলে এসে এতদিনে তবু তাকে আপন জন বলে ডেকেছে, তার কাছে থাকতে চেয়েছে। তাও যে সে নয়, মধুর মতো ভাইপো।

বলল, কেন রে, বউঠানের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস বুঝি?

না।

তবে?

তবে? তবের কথা মরে গেলেও বলতে পারবে না মধু! বলল, এমনি। সেখানে থাকতে মন চায় না।

নারায়ণ হা হা করে হেসে উঠল। যন্ত্রের তাণ্ডব চিৎকারের মধ্যেও সে হাসি পরিষ্কার শোনা গেল। বলল, সত্যি থাকবি মধু?

মধু নারায়ণের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, তুমি যদি রাখ।

 রাখব। যদ্দিন খুশি, সারা জীবন চাস তো তাই থাক, আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে, তোর মনটা কেন ভাঙল, সেটা আমাকে বল। শুনছিলুম…।

নারায়ণের চোখেমুখে একটা কৌতুকের চাপা হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে হাসি দেখে মধু হঠাৎ কিছু আন্দাজ করতে পারল না। পরমুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝে, কল দেখার ভান করে সে অন্যদিকে তাকাল।

নারায়ণ বলল, শুনেছি অধরার এখনকার ব্যাটার বউ নাকি ভারী রূপসি। তা ভাল কথা, সুখের কথা। তা তাকে নিয়ে এলেই হত।

মধুর মতো ছেলেরও লজ্জা আছে। তবে অন্যরকম। ভাবছিল, তা হলে নারায়ণ খুড়োও সে খবর জানে।

জানবে না কেন। কে না জানে! মধুর তেসুতি কলের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল,শপুরে লক্ষ্মীর পাশে মোহকে। ব্যস্ত কামিন বারবার ব্যাকুল চোখে দেখছে এদিক ওদিক। আর গোলাম। গোলাম কী করছে এতক্ষণ! হয়তো বলে দিয়েছে সবাইকে, লখাই কেমন করে তাকে হাত ভেঙে দিয়েছে। ভাঙা হাত নিয়ে পালিয়েছে মধু…।

না না, এত সহজে গ্রাম ছাড়তে সে পারবে না। বলল, নিয়ে আসব, তবে এখন নয়। মানে, একটু যুগ্যিটুগ্যি না হলে পর…।

নারায়ণ বললে, কীসের যুগ্যি। শুনেছি সে মেয়ে তো বেশ ডাগর-ডোগরটি হয়েছে।

মেয়ে নয়, আমি। খেতে পরতে হবে তো!

নারায়ণ হা হা করে হেসে উঠে বলল, খুড়োর কাছে এসেছিস, সে কি পর। বাপ না হই, বাপের মতন তো, না কী রে? ছেলে বউ থাকবে আমার ঘরে।…

বলতে বলতে নারায়ণ আবার হেসে উঠল। সে হাসির সুর নেই, ভাব নেই, ভঙ্গি নেই। হাসিটা যেন আর কিছু। হৃদয়ের একটা অনিরুদ্ধ হাসিকান্নার লহর একসঙ্গে শুধু হাসির ছদ্মবেশে বেরিয়ে আসছে। ঘর আর ছেলে আর ছেলের বউ! কী বিচিত্র কথা নারায়ণের মুখে। তার নিজের কানেই কথাটা বোধহয় অদ্ভুত ঠেকেছে।

মধ্যবয়স্ক নারায়ণ জানে না। তার ঘর ছাড়া যাযাবর প্রাণে একটি সংসার প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ক্ষুধা লুকিয়ে রয়েছে। যে ক্ষুধা বংশানুক্রমিকভাবে তার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত। সে হবে স্বামী পিতা শ্বশুর পিতামহ…।

মধু একটু অবাক হয়ে তাকাল তার নারায়ণ খুড়োর দিকে। নারায়ণ হাসতে হাসতেই এক দিকে চোখ তুলে তাকাল। হাতের ইশারা করে মধুকে বলল, আয়, আমার সঙ্গে আয় মধু।

নারায়ণের পিছনে পিছনে মধু, সারি সারি তাঁত বিভাগের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেশিন চলেছে সগর্জনে। একদিকে চট আর একদিকে সুতোর প্রকাণ্ড বিম মন্থর গতিতে ঘুরছে। চোখে ঠাহর হয় না, এত মন্থর। মাকু দৌডুচ্ছে এদিকে ওদিকে। যার কাছে নিয়ে দাঁড় করাল, মধু প্রথমে তাকে পুরুষ মনে করেছিল। কিন্তু এক মুহূর্ত লক্ষ করতেই বুঝল, তাঁত চালাচ্ছে মেয়েমানুষ। একসঙ্গে চারটে তাঁত চালাচ্ছে। এর কথা শুনেছে মধু। নাম বিমলি, অর্থাৎ বিমলা। লোকে বলে ডাকাতে বিমলি। ডাকাত-ই বটে। কালো আর বেঁটে চেহারা বিমলির। যেন নারীর বেশে নারয়ণ খুড়োই। পুরুষের মতো তার শরীরের গঠন। চলাফেরায় শক্ত পেশি ফুলে ফুলে উঠছে। মুখখানি যেন কালো পাথরের একটা এবড়ো-খেবড়ো বড় টুকরো। চেহারায় রুক্ষতার জন্যেই বয়স অনুমান করা কঠিন। চুলের গুচ্ছি ঘাড়ের থেকে অনেকখানি তুলে চুড়োর মতো শক্ত করে বাঁধা। কিন্তু একটিও পাকেনি। তার স্ফীত বিশাল বুকের উপর দিয়ে এক বেড় শাড়ি আঁট করে ঘুরিয়ে নিয়ে কষে কোমরের সঙ্গে বাঁধা। গায়ে সামান্য অলঙ্কারের বাহুল্য নেই, এমনকী একটি টিপ নেই কপালে।

হাতে একখানি এক ফুট সমান ধারালো ছুরি। তাঁতির হাতে ছুরি সবসময়েই থাকে। বোনা চটের গায়ে সুতো দলা পাকিয়ে যায়। বাড়তি সুতো পড়ে যায় মসৃণ বুননটের মধ্যে। পদে পদে ছুরি দিয়ে তা কেটে দিতে হয়। ওই ধারালো ছুরির মতোই বিমলার শাণিত চোখের অপলক দৃষ্টি। তার শরীর ও রক্তাভ চোখের দৃষ্টি তাকে নিষ্ঠুর ও ভীষণ দর্শনা করে তুলেছে। মেয়েমানুষেরা দূরের কথা, পুরুষেরা তাকে ভয় করে চলে। তাকে ভয় করে সাহেবরা। তা ছাড়া একসঙ্গে চারটে তাঁত চালানো কটা পুরুষের পক্ষেই বা সম্ভব। শোনা যায়, গৌরীপুর ও রিষড়েতেও কয়েকজন মেয়েমানুষ তাঁত চালায়। কিন্তু তারা কেউ ডাকাতে বিমলির মতো চারটে তাঁত একসঙ্গে চালাতে পারে না। তাই একজন পুরুষের থেকেও বিমলির মান বেশি।

সে কোথাকার মেয়ে, কার মেয়ে বা ঘরনি, সে কথা বোধহয় কেউই জানে না। একদিন হঠাৎ উদয় হয়েছিল সে তেলিনিপাড়ায়। সেখান থেকে নারায়ণের সঙ্গে এসেছে গারুলিয়ায়। তারা একসঙ্গে থাকে। অনেকে বলে, নারায়ণের বউ হল বিমলি। বউ নয়, বলে নারায়ণের মেয়েমানুষ।

বিমলি মধুকে দেখে হেসে বলল, এ যে কালো সাপ দেখছি। শুনেছি বাবা তোমার কথা, তুমি ওস্তাদ ছেলে! তা কী মনে করে?

নারায়ণ বলল, থাকবে আমার কাছে।

বিমলি হাসলে ভয়ংকরের মধ্যে একটা অদ্ভুত সরল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। মনে হয়, বোঁচা নাক একটি অত্যন্ত হাসকুটে মেয়েমানুষ। বলল, তোমার কাছে, না আমার?

মধুকে আদর করে জিজ্ঞেস করলে, কী গো ছেলে, কার কাছে থাকবে?

আদর আপ্যায়নটা ভালই লাগছিল মধুর। সকালবেলার ব্যাপারের পর মনটা তার খুশি হয়ে উঠল অনেকখানি। বলল, থাকব তোমাদের দুজনকার কাছেই।

বিমলি মোটা গলায় খলখল করে হেসে উঠল। বলল, কলঘাঁটা ছেলে, কথা জানে।

আর একজন হাসছিল খিলখিল করে। সেও তাঁত চালাচ্ছে। মেয়েমানুষ। অল্পবয়সি তাঁতি মেয়ে। বাঁ হাতে তাঁতের রেলিং ধরে ডান হাতে ছুরির উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসছে। মধু তাকিয়ে দেখল,নজরটা তার দিকেই। বাঁকা চোখে নিষ্পলক নির্লজ্জ চাউনি, যেন কতকালের চেনা। কে গো কে গো করে কাজ ছেড়ে আরও কয়েকজন এসে ভিড় করল। দূরের লোকেরা হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে। মেশিনের শব্দে কোনও কথা শোনা যায় না।

মধু সেই মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখল, বিমলি তাঁত মেশিনের নীচে থেকে একটা বোতল তুলে ঢকঢক করে গলায় ঢালছে কী একটা বস্তু। গন্ধে টের পেল, মদ খেয়ে মধুর দিকে তাকিয়ে হাসল। হু হু করে রক্ত ছুটে এল তার চোখে। বলল, নইলে পারা যায় না। যা কাজ বাপু!

বলে বোতলটা নারায়ণের দিকে এগিয়ে দিল।

এ সব শুনেছে মধু কিন্তু কোনওদিন চোখে দেখেনি। আজ চোখে দেখে তারও মনটা হঠাৎ চলকে উঠল। এই বয়সের একটা স্বভাব ধর্ম বোধহয়। অনাস্বাদিত রক্তসন্ধানী বাঘের মতো, বিচার বিবেকহীন উদ্দামতা বুকের মধ্যে দাপাদাপি করে ওঠে। এ কলঘরের দামামা বেজে উঠল তার বুকে। এত আনন্দ, এত কোলাহলময় জীবন আর এত অনায়াস বাধা বন্ধনহীন!

এমন সময় ওয়ালিক ছুটে এল সেখানে। এসে বলল, কেয়া হোতা? মেলা যাবে সব? নো নো, হামি কাউকে যেতে ডিবে না।

বিমলি বলল, যার মনে যা, লাফিয়ে ওঠে তা। সায়েব মিনসে আর কথা পেল না।

 ভিড় ভেঙে গেল। কিন্তু কথাটা যে মিথ্যে নয়, সেটা মধু পরে বুঝেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *